৩০. অবন্তীর মন খারাপ

৩০

অবন্তীর মন খারাপ। তার নামে চিঠি এসেছে। চিঠিতে ঝকঝকে মুক্তোর মতো হাতের অক্ষরে লেখা, শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে…।

এই একটিমাত্র লাইন। আর কিছু লেখা নেই। এমন চিঠি পেয়ে যেকোনো মেয়েরই মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবন্তীর হয় নি। বরং মন খারাপ হয়েছে। এই মন। খারাপের কারণ চিঠিটা বেনামি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই নিয়মিত আসছে। অনেক চেষ্টা করেও সে প্রেরকের নাম আবিষ্কার করতে পারে নি। ফলে প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে, পরিচিত কেউ দুষ্টুমি করছে। হয়তো তার ক্লাসেরই কেউ। যদি তা-ই হয়, তবে বিষয়টা খুবই খারাপ হবে।

সেদিন সন্ধ্যায় হলের গেটে মঈনকে দেখে যে অস্বস্তিটা তার হয়েছিল, তা এখনো কাটে নি। মঈন কার জন্য ওখানে অপক্ষো করছিল? আর তাকে দেখে ওভাবে সরেই বা গেল কেন? অনেক ভেবেও এর উত্তর পায় নি অবন্তী। রিয়ার পাশে শুয়ে ঘুমের ভান করে রাতটা কাটিয়ে দিলেও আসলে একটুও ঘুমাতে পারে নি সে। বারবারই কেবল মনে হয়েছে, মঈন কি তবে অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করছিল? কে সে? সে কি তবে আর কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে?

যদি যায়ও, তাতে তার কী? সে তো মঈনের কাছ থেকে দূরেই সরে এসেছে। মঈন তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে তাকে ধরে রাখার। কিন্তু অবন্তী সেই সুযোগটাই আর দেয় নি। এখন সে যদি অন্য কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাতে তো তাকে দোষ দেওয়া যায় না। নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার আছে।

সমস্যা হচ্ছে, এত সব বুঝেও নিজের ভেতর খোঁচাতে থাকা প্রবল অস্বস্তির কাঁটাটাকে সে উপড়ে ফেলতে পারে না। সে কি তবে মঈনকে এখনো ভালোবাসে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অথই জলে হাবুডুবু খেতে থাকে অবন্তী। মঈনকে ভালো না বাসার কারণ কি আদৌ তার আছে? আর যদি থেকেও থাকে, তবে সেই কারণটা তার মঈনকে অবশ্যই বলা উচিত। অসংখ্যবার বলবে বলেও ভেবেছে সে। কিন্তু অতিসংবেদনশীল, সদা অন্তর্মুখী অবন্তী তা পারে নি।

সে জানে, প্রতিটি মানুষের জীবনেই এমন অসংখ্য দুঃখ থাকে, গোপন অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে, যার কথা সে কখনো কাউকে বলতে পারে না। মানুষ ভাবে, সে বুঝি সব সময় যৌক্তিক, ন্যায্য আচরণটাই করে। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। চাইলেও সব সময় সে তা পারে না। জীবন কখনো কখনো এমন গভীর অন্ধকারের ঘূর্ণিপাকে মানুষকে নিমজ্জিত করে ফেলে যে সেখান থেকে উত্তরণের পথ আর তার জানা থাকে না।

মঈনকে নিয়ে অবন্তীর দ্বন্দ্বটাও সেখানেই। যে অন্তর্ঘাতে সে প্রতিমুহূর্তে পুড়ে যাচ্ছে, তার কথা এই পৃথিবীতে কখনো কাউকে বলতে পারবে না সে। মঈনকে তো নয়ই। কিন্তু মঈন ওখানে কী করছিল সেদিন সন্ধ্যায়?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অবন্তী আবিষ্কার করল, মঈন প্রায়ই ওখানে আসে। কিন্তু কেন আসে, সেই রহস্য সে ভেদ করতে পারল না। আর তারপর হঠাত্র একদিন এই বেনামি চিঠি আসা শুরু করল তার নামে। তত দিনে হলে সিট পেয়ে গেছে অবন্তী। নিজের আলাদা ঘুমানোর জায়গা হয়েছে। নতুন বিছানা-বালিশ কিনে এনে যত্ন করে সব সাজিয়েছে। এত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছন্নছাড়া হলজীবনটাকে তার আপন নিবাস বলে মনে হতে শুরু করল।

কিন্তু কে তাকে এভাবে চিঠি লেখে? মঈন নয়তো? প্রশ্নটা চকিতে একবার মাথায় ঘুরে গেলেও নিশ্চিত হতে পারল না অবন্তী। মঈনকে সে যতটুকু চেনে, তাতে এমন কাজ তার করার কথা নয়। সে মোটেই এতটা সংবেদনশীল, রোমান্টিক মানুষ নয়। অবন্তীর এখনো স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম দিন মঈন যখন তার সঙ্গে কথা বলেছিল, সেই কথা বলার ভঙ্গিটা ছিল ভয়ানক রূঢ়, অশোভন।

অবন্তী সেদিন খানিক আগে আগেই পড়তে গিয়েছিল। শীতের দুপুর তখন চট করে বিকেল হওয়ার অপেক্ষায়। মঈনদের উঠানের পেয়ারাগাছটার পাতার ফাঁক গলে তেরছা সোনালি এক ফালি আলো এসে পড়েছে ঘরের দাওয়ায়। সেখানে বসে বাসি পত্রিকা পড়ছিল মঈন। অবন্তী কী করবে বুঝতে পারছিল না। মঈন সরে গিয়ে তাকে জায়গা না করে দিলে সে ঘরেও ঢুকতে পারছিল না।

অবন্তী খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বলল, মজিবর চাচা আছেন?

যেন ঠিকভাবে শুনতে পায় নি, এমন ভঙ্গিতে তাকাল মঈন। তবে কথা বলল না। বরং আবারও পত্রিকার পাতায় মনোযোগ দিল সে। অবন্তী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, চাচা। বাড়িতে আছেন?

কোন চাচা? পত্রিকা থেকে মুখ না তুলেই বলল মঈন।

মজিবর চাচা।

তার কাছে কী দরকার?

আমি তার কাছে পড়ি।

কারও কাছে পড়লে তাকে স্যার বলতে হয়, চাচা নয়। এইটুকু আদবকায়দা না জানলে পড়ে কী হবে?

অবন্তীর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। তাকে এমন রূঢ় ভাষায় কেউ কখনো কিছু বলে। নি। সে কী বলবে ভেবে পেল না। মঈন বলল, বলল, মজিবর স্যার বাসায় আছেন?

অবন্তী বলতে পারল না। তার হাত-পা কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল। রাগে, দুঃখে, অপমানে দিশেহারা লাগছিল। একবার মনে হচ্ছিল না পড়েই বাড়ি ফিরে আসবে। সে। আর কখনোই ও বাড়িতে যাবে না। কিন্তু সেই শক্তিটুকুও যেন আর নেই।

মঈন অবশ্য তাকে চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার সামনে থেকে চেয়ারটা সরাতে সরাতে বলল, এত অল্পতেই এমন নার্ভাস হলে চলবে? এখন উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের যুগ। মেয়েদের আরও চটপটে, স্মার্ট হতে হবে। উইমেন। এমপাওয়ারমেন্ট মানে কী, জানো?

অবন্তী কথা বলল না। শীতের বিকেলেও তার কানের পাশ দিয়ে সরু ঘামের। প্রস্রবণ উঁকি দিতে শুরু করেছে। এরপর মঈনের সঙ্গে আর কথা হয় নি তার। তবে যতক্ষণ সে ও বাড়িতে থাকত, ততক্ষণই আড়চোখে মঈনকে খুঁজত। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মঈনের আর দেখা মিলল না। যতটা ভয়, ঠিক ততটাই কৌতূহল নিয়ে অদ্ভুত এক অপেক্ষায় সময় কেটে যেতে লাগল তার। মঈনের দেখা মিলল এরও বেশ কিছুদিন পর। তখন তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল। আরও রুক্ষ, কঠিন ভাব। মানুষটাকে দেখে এবার ভয়ের সঙ্গে একটা বিরক্তিও তৈরি হলো অবন্তীর। সেই বিরক্তি আরও বাড়ল যখন সে কারণে-অকারণে কথা বলার চেষ্টা করল। অথচ সেই। কথায় কোনো কোমলতা নেই, সৌজন্যবোধ নেই। ঠোঁটকাটা, চাঁছাছোলা কথা। একদিন হুট করেই তার পড়ার টেবিলের সামনে এসে বলল, আব্বা, এই মেয়ে তো মনে হয় না পাসটাস কিছু করতে পারবে?

মজিবর চাচা চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন, কেন?

আমি গতকাল তার ইংরেজি বই দেখলাম। পুরো বইতে কোথাও একটা দাগ পর্যন্ত নেই। যেন আজই দোকান থেকে কিনে এনেছে। একে এত যত্ন করে পড়িয়ে তো লাভ নেই। পাস তো করবেই না, উল্টো দোষ হবে আপনার।

অবন্তী সেদিন কেঁদেই ফেলেছিল। তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন মজিবর চাচা। ছেলেকে ভর্ৎসনা করে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, ওকে। নিয়ে তোর অত মাস্টারি করতে হবে না। ও খুবই ভালো ছাত্রী। অবশ্যই সে ভালো রেজাল্ট করবে।

জবাবে শ্লেষাত্মক হাসি হেসেছিল মঈন। তারপর আবার হুট করে উধাও। দীর্ঘদিন কোনো খবর নেই। সমস্যা হচ্ছে, অবন্তী হঠাৎ আবিষ্কার করল, ও বাড়িতে গেলে সে অবচেতনেই মঈনকে খোঁজে। এই খোঁজা কোনোভাবেই তার প্রতি কোনো অনুরাগ থেকে নয়, তেমন কারণও নেই। প্রথম প্রথম সেটি একধরনের ভয় কিংবা বিরক্তি থেকেই। এই বুঝি কোথাও থেকে হঠাৎ ভূতের মতো এসে উদয় হলো! তারপর আলটপকা কিছু কথা বলে তার মন খারাপ করে দিল।

ওই ভয়টাই সারাক্ষণ আতঙ্কিত করে রাখত তাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরও যখন সে এল না, তখন কেমন একটা অব্যাখ্যেয় শূন্যতার অনুভূতি ক্রমশ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতে লাগল। রোজই মনে হতো, আজ বুঝি মঈনের সঙ্গে দেখা হবে। এই বুঝি পেছন থেকে এসে কঠিন কিছু বলবে সে! কিন্তু তার এই আশঙ্কা যখন রোজই ভুল প্রমাণিত হতে লাগল, তখন নিজের অজান্তেই ওই আতঙ্ক একসময় অপেক্ষায় পরিণত হতে লাগল কিংবা প্রত্যাশায়ও। তবে এই উপলব্ধির ব্যাখ্যা অবন্তীর কাছে নেই।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে হঠাই তার সামনে এসে দাঁড়াল মঈন। তার ঠোঁটে সিগারেট। মুখভর্তি ধোঁয়া গলগল করে ছাড়তে ছাড়তে সে বলল, তুমি কি আমার ওপর বিরক্ত?

অবন্তী কথা বলল না। মঈন বলল, একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝি না, আমার আশপাশে সবাই কেন আমার ওপর বিরক্ত হয়? আব্বা আমাকে কী বলেছে, জানো?

অবন্তী কথা না বললেও তাকাল।

আব্বা বলেছে তোমাকে পড়ানোর সময় আমি যেন বাড়িতে না থাকি। তুমি নাকি আমাকে ভয় পাও। এটা কি সত্যি?

অবন্তী এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। মঈন বলল, অন্যরা আমার ওপর বিরক্ত হলে, ভয় পেলে আমার কিছু এসে-যায় না। ওসব আমি গ্রাহ্যই করি না। কিন্তু আব্বা যখন কথাটা বলল, তখন থেকে আমার কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। এমন তো এর আগে কখনো হয় নি! এমন কেন হচ্ছে, বলো তো?

কী বলবে অবন্তী, এই প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছে নেই। মঈন হাসল। ফ্যাকাশে, বিব্রত হাসি। তার সঙ্গে এমন হাসি যায় না। তাকে খানিক নার্ভাসও মনে হচ্ছিল। সম্ভবত তার ওই সলজ্জ, বিব্রত হাসিটুকুই অবন্তীর মনে গেঁথে রইল। মনে হলো, কঠিন, রূঢ় ওই মানুষটার ভেতরও তার জন্য বিশেষ একটা অনুভব হয়তো আছে। কিন্তু কেন? মঈন বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর কখনো আমি তোমার সামনে যাব না। তুমি আমার ওপর বিরক্ত হলে, ভয় পেলে আমার খারাপ লাগে।

সেদিনের কথা ওইটুকুই। এরপর আর মঈন তার সামনে আসে নি। কিন্তু অবন্তীর বুকের ভেতর এক অনির্ণেয় অনুভূতি ক্রমশ বাসা বাঁধতে লাগল। তার রোজ মনে হতো, কেন সে আসে না? কেন সে আর আগের মতো হুটহাট এটা-সেটা বলে তাকে চমকে দেয় না?

সেই শুরু। তবে শুরুর ওই গল্পটা কখনোই এর থেকে আলাদা কিছু হয় নি। কখনো কখনো সে নিজে থেকেই খানিক উপযাচকের ভূমিকা পালন করত। মঈন তখন কিছুটা এগিয়ে আসত। আবার পরক্ষণেই দূরে সরিয়ে দিত অবন্তী। মঈনও তখন বিনা প্রতিবাদে, অভিযোগহীন দূরে সরে যেত। অবন্তীর ভেতর শুরু হতে থাকত প্রবল শূন্যতা। দ্বিধাদ্বন্দ্বের খেলা। সেই খেলায় রোজ হেরে যেত সে। আবার কাছে ডাকত। মঈনও চুপচাপ পাশে এসে যেত। তাদের সম্পর্কটা এমনই। মঈন তার জন্য কখনো এমন কিছু করে নি যে তাতে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তারপরও তারা জানত, একটা বিশেষ অনুভব পরস্পরের জন্য বয়ে বেড়ায় তারা।

সেই মঈন তাকে বেনামে চিঠি লিখবে। সেই চিঠিতে লেখা থাকবে–

শোনো, কাজল চোখের মেয়ে,
আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে…।

কিংবা

তোর জন্য ফুল কুড়িয়ে নিলে,
সাথে খানিক ভুল কুড়িয়ে নিলে,
ভুল করেই বললে ভালোবাসি,
তুই কি তবু হাসবি অমন হাসি?

কিংবা

এই যে মেয়ে কাজল চোখ,
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক।

এ রীতিমতো অসম্ভব। অবন্তীর চেয়ে ভালো এ কথা আর কেউ জানে না। তাহলে কে তাকে এই চিঠি পাঠাচ্ছে? বিষয়টা নিয়ে কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছে না সে। এর কারণও আছে। চট করে যে কারও সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায় না সে। হয়তো দেখা যাবে এটা নিয়ে অন্যরা তখন হাসাহাসি করছে। তা ছাড়া রিয়া আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। কী যে হয় মাঝে মাঝে মেয়েটার! কবে যে আবার তার দেখা পাবে কে জানে!

অনেক ভেবে মঈনের সঙ্গেই কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল অবন্তী। সে তাকে ফোন করে বলল, আপনি কি আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবেন?

মঈন বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। যেন এমন অভাবিত ব্যাপার ঘটতে পারে, এটা সে চিন্তাও করে নি। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল সে। কিন্তু বিষয়টা অবন্তীকে বুঝতে দিতে চাইল না। তা ছাড়া কিছুদিন আগেই রিয়ার সঙ্গে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও তার ঘটে গিয়েছিল। নিজেকে সেদিন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি সে। ফলে মঈন ভেবেছিল, কথাটা হয়তো কোনোভাবে অবন্তীর কান অবধিও পৌঁছে গেছে। যদিও রিয়ার তাকে চেনার কথা নয় যে সে বিষয়টা আলাদা করে অবন্তীর কাছে বলবে বা তার কথা উল্লেখ করবে। তারপরও ভেতরে ভেতরে বেশ গুটিয়েই গিয়েছিল সে।

এসব নানা ঘটনা মিলিয়ে যতটা সম্ভব সংযত হয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেছিল মঈন। কিন্তু নিজেকে যতটা দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, যতটা আড়ালে লুকাতে চায়, ততটাই যেন ক্লান্ত, অসহায়, দমবন্ধ লাগে তার। মনে হয়, যদি একমুহূর্তের জন্যও কথা বলতে পারত অবন্তীর সঙ্গে দেখা করতে পারত!

এ এক বিভীষণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে এখন অবধি সংশপ্তক সে। ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও বাইরে তা প্রকাশ করে নি। কিন্তু অবন্তী কি তা বুঝতে পারে? সে কি তার এই ইচ্ছাবিরুদ্ধ জোর করে দূরে থাকা টের পায়? হয়তো পায় না কিংবা পায়। না হলে এই এত দিন বাদে হঠাই কেন সে দেখা করতে চাইবে? নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে তার অনুপস্থিতি অনুভব করছে সে।

মঈন শান্ত গলায় বলল, কেন?

একটু দরকার ছিল।

ফোনেই বলো।

নাহ্। সামনাসামনি বলব।

মঈন ভেবেছিল সে আরও কঠোর হবে। দেখা করতে চাইবে না। কথাও বলবে না বেশিক্ষণ। হঠাৎ ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দেবে। কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারল না সে। বরং রণে ভঙ্গ দিয়ে বলল, আচ্ছা।

তারা দেখা করল পরদিন। রিয়ার বিষয়টা নিয়েও খানিক সন্ত্রস্ত হয়ে ছিল মঈন। তবে অবন্তী সেসব কিছুই বলল না। সে সরাসরিই চিঠির প্রসঙ্গটা তুলল। বলল, আপনি কি আমাকে চিঠি লেখেন?

চিঠি! হতভম্ব চোখে তাকাল মঈন।

হুম, চিঠি। হাতে লেখা চিঠি।

আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

সত্যিই বুঝতে পারছেন না, নাকি না বোঝার ভান করছেন?

আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আর তোমাকে আমি চিঠি কেন লিখব?

প্রশ্নটা অবন্তী নিজেকেও করেছে। মঈনের তাকে চিঠি লেখার আসলেও কোনো কারণ নেই। আর তাও আবার দু-তিন লাইনের কবিতা লেখা চিঠি। তাতে স্পষ্ট কোনো কথা নেই। ঘটনা কিংবা বক্তব্য নেই। মঈন যদি তাকে লিখতও, তবে তাতে তাদের সম্পর্কের কথা থাকত, বিচ্ছিন্নতার কথা থাকত। থাকত তাকে বোঝানোর চেষ্টাও। আর

সে ক্ষেত্রে সে অবশ্য নিজের নামেই চিঠি লিখত। তা ছাড়া মঈনের হাতের লেখা সে। চেনে। ওই হাতের লেখা তার নয়। অন্য কাউকে দিয়ে এমন চিঠি লেখানোর কোনো কারণও তার নেই।

অবন্তী বলল, জানি না। কিন্তু কেউ একজন আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখছে।

কে?

জানি না। বেনামে।

কী লিখছে?

তেমন কিছু না।

কেমন কিছু?

হাবিজাবি কবিতার লাইন।

ওহ্! তোমার পরিচিত কেউই হয়তো। হয়তো তোমাকে পছন্দ করে।

আপনিও তো আমার পরিচিতই। কথাটা বলেও হঠাৎ থমকে গেল অবন্তী। এভাবে বলা বোধ করি ঠিক হয় নি তার।

হ্যাঁ। আমিও তো তোমার পরিচিত কেউই। বলে হাসল মঈন। ফ্যাকাশে, মলিন হাসি। সম্ভবত এই হাসিটাই সেই প্রথম যেদিন রাস্তায় মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল তারা, সেদিন হেসেছিল। কিন্তু আমি যে চিঠি লেখার মতো মানুষ নই, তা বোধ করি তুমি জানো। আর যদি লিখিও, তবে বেনামে কেন লিখব? তাতে আমার লাভ কী?

এই প্রশ্নে চুপ করে রইল অবন্তী। মঈনের কথা যুক্তিসংগত। সে নিজেও জানে, কাজটা মঈন নয়, হয়তো অন্য কেউই করছে। কিন্তু সেই অন্য কেউটা কে?

কিন্তু আপনি যে প্রায়ই আমার হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, আমাকে দেখলেই আড়ালে চলে যান, তা কেন?

মঈন এবার যেন থতমত খেয়ে গেল। বলল, সব প্রশ্নের উত্তর সবার কাছে থাকে? আর থাকলেও সেটা সবার ভালো না-ও লাগতে পারে।

আমার ভালো লাগবে না?

না।

কেন?

কারণ, এই তুমি সেই তুমি নও, যাকে আমি চিনতাম।

আপনি আমাকে চেনেন না?

নাহ্।

কেন?

সেটা তুমি জানো। আর এটা খুব কষ্টেরও। তার চেয়েও বেশি কষ্টের যখন তুমি বুঝবে যে তুমি যাকে একটুও চেনো না, বুঝতে পারো না, অথচ সেই মানুষটা তোমাকে হাতের তালুর মতো চেনে।

আমি আপনাকে হাতের তালুর মতো চিনি?

হুঁ। আর সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানো?

কী?

আমার মনে হয়, আমি যদি তোমাকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে পারতাম, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারতাম।

তাহলে কী হতো?

তাহলে যদি দেখা যেত ঠিক কী কারণে তুমি এমন হয়ে গেলে!

আপনিই তো বললেন সব কারণ জানতে নেই। সব উত্তরও না। শুনতে ভালো লাগবে না। চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ চোখের সামনে এলোমেলো হয়ে যাবে।

মঈন আর কথা বলল না। তার জীবন যে পুরোপুরি শুদ্ধ, তা নয়। বরং সেখানে। আলোর চেয়ে অন্ধকারই হয়তো বেশি। বেপরোয়া, উদ্দাম, অসংযত এক জীবন সে কাটিয়েছে। সেই জীবনের কত কত গলিঘুজির কথা সে নিজেই ভুলে গেছে। পত্রিকায় তাকে নিয়ে খবর বেরোনোর পর তার অনেক কিছুই নতুন করে সামনে এসেছে। সেই সব খবরে নানান রং লাগিয়ে রসালোভাবে প্রকাশও করা হয়েছে। অবন্তী হয়তো তেমন। কিছুর কথাই জানে। কিন্তু সেই কথাটা সে কেন বলছে না? অন্তত বলে দিলেও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারত সে।

মানুষ যা জানে, তার সব কি সব সময় সত্য হয়, অবন্তী? এমনকি যা দেখে, তা ও?

না। হয় না। কিন্তু তাই বলে পৃথিবীতে কি সত্য নেই?

তা আছে। কিন্তু সত্যের উল্টো পিঠে হয়তো আরও অনেক সত্য থাকে। আমরা কি সেই সত্যটা কখনো জানতে চাই?

সব আলাদা করে জানতে হয় না। কিছু সত্য চোখের মতো, তা চোখে না দেখা গেলেও আমরা জানি যে ওটা আছেই।

কথাটা ভাবাল মঈনকে। মাত্র কদিনেই সেই ভীরু, লাজুক, ছোট্ট অবন্তী কেমন বড়, সপ্রতিভ হয়ে গেছ। অবন্তী কি জানে সে তাকে কত ভালোবাসে? নাকি এই ভালোবাসার পুরোটাই কেবল তার উপেক্ষার কারণে সৃষ্টি? না হলে এমন তো এর আগে কখনো কারও জন্য হয় নি তার?

.

সেদিন আর কথা এগোয় না। দুজনই দুজনের কাছে অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন রেখে বিদায় হয়। কিন্তু রাতে রুমে ফিরে আরও একবার তালাবন্ধ ট্রাংক থেকে চিঠিগুলো বের করে অবন্তী। সে এখন নিশ্চিত যে এগুলো মঈন লেখে নি। কে লিখেছে তাহলে? লোকটার প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে সে। কৌতূহলও। কী সুন্দর গোটা গোটা হাতের অক্ষরে লেখা

তুমি তার কাছে যেয়ো রোদ, যে জানে আলো কত দামি,
তুমি তার কাছে যেয়ো মন, যার কাছে শুধু দামি আমি!

কিংবা

অমন কাজল চোখে তুমি চেয়ে রোজ
ওই চোখে জীবনের হিসেব সহজ।

সেই রাতে অবন্তী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর যেন নিজের অজান্তেই চোখে কাজল পরার চেষ্টা করে। তার চোখ কি আসলেই অত সুন্দর? কে সে, যে এমন করে রোজ তার চোখ দেখে কবিতা লেখে? মুগ্ধ হয়?

গত তিন সপ্তাহে সে সাতটি চিঠি পেয়েছে। প্রতিবারই ভেবেছে এই চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে চারতলা থেকে নিচে ফেলে দেবে। ফেলে দেওয়ার সময় বাতাসে ভেসে টুকরো কাগজগুলো কী করে উড়ে উড়ে নিচে পড়ে, তা দেখবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, একবারও তা করা হয় নি। প্রতিবারই রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চিঠি ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারে নি।

কবিতার কথাগুলো কেমন যেন! প্রথম প্রথম যে তেমন ভালো লাগে, তা নয়। কিন্তু তারপর সময় যত গড়াতে থাকে, ততই মাথায় ঘুরতে থাকে। বিধতে থাকে আলপিনের মতো। একটা প্রবল অস্বস্তির অনুভূতি দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো একটা শব্দ হয়তো ভুলে গেছে। সেই শব্দ মনে করার জন্য মাঝরাতে লুকিয়ে একা সে তার ট্রাংক খুলে চিঠিগুলো বের করে। তারপর ভুলে যাওয়া শব্দের লাইনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। এই একটা শব্দ পড়তে গিয়ে আবারও তার সবগুলো চিঠি পড়া হয়ে যায়। আর তারপর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে, কী আশ্চর্য! আমার না কাল পরীক্ষা? এগুলো আমি কী করছি?

এই অবধি ঘটনা সরলই ছিল। খানিক বিরক্তিকর রহস্য, অস্বস্তিকর ভালো লাগা, আর একটু দ্বিধান্বিত রোমান্টিসিজম। কিন্তু ঘটনা গুরুতর আকার ধারণ করল পরের সপ্তাহে।

.

এখন সাধারণত ছুটির দিনটাতে হৃদিদের বাড়িতে যায় অবন্তী। ওই বাড়িটা তার ভীষণ পছন্দের। ঢাকা শহরে যে এখনো এমন বাড়ি আছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। বাড়ির সামনে অতটা খোলা জায়গা। সেখানে পাতাবাহার, দোলনচাঁপা, বাগানবিলাসের ঝোঁপ। ছাদে চেয়ার পেতে বসলে হাত বাড়িয়ে বিশাল আমগাছের ডাল-পাতা ছুঁয়ে দেওয়া যায়। আমের মৌসুমে টুপটাপ আমও পেড়ে ফেলা যায়। চারপাশজুড়ে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। একটা শান্তি শান্তি ভাব। মন খারাপ হলে এই বাড়ির উঠোনে হাঁটলে মন ভালো হয়ে যায়। শেওলা ধরা সবুজাভ উঠানে বর্ষার সময় খুব সাবধানে পা ফেলে ফুল কুড়াতে হয়।

অবন্তী মফস্বলে বড় হলেও কখনো চালতা ফুল দেখে নি। অথচ ঢাকা শহরের এই বাড়িতে একটা বড় চালতাগাছও আছে। সেই গাছের ফুল যে এত সুন্দর হতে পারে, তা তার জানা ছিল না। সে উঠোনে ছড়িয়ে থাকা চালতা ফুল কুড়ায়। কখনো-সখনো। কানের কাছে চুলের ভেতর খুঁজে দেয়। তখন তার নিজেকে পুষ্পকুমারী মনে হয়। আচ্ছা, এই পুষ্পকুমারী শব্দটা সে কোথায় শুনেছে? অবন্তী ঠিক মনে করতে পারে না। কোনো বইয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু পুষ্পকুমারী দেখতে কেমন? কে সে? অবন্তী তা ও জানে না। তবে কল্পনায় একটা ছবি এঁকে নেয়। নিজেকে তখন তার সেই কল্পিত পুষ্পকুমারী মনে হয়।

এখন এ বাড়িতে সবচেয়ে বড় সুবিধা যেটি, সেটি হলো হৃদির ঘরটা ফাঁকা। বিয়ের পর সে নেহালের সঙ্গে দেশের বাইরে গেছে। ফলে অবন্তী এখানে এলে তার ঘরেই থাকে। রুমটা বড়। অ্যাটাচড বাথ। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, এসি–সবই আছে। তবে তার আগ্রহ ড্রেসিং টেবিলের ওপর থাকা বড় ঝকঝকে আয়নাটায়। সে ইচ্ছে হলেই ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিতে পারে। চোখ জ্বালা করলে কিংবা চোখে পানি চলে এলে আরাম করে মুছে ফেলতে পারে। কেউ দেখে ফেলবে বলে তটস্থ হয়ে থাকতে হয় না।

রিয়ার মতো কেউ পেছন থেকে হঠাৎ ফিক করে হেসে দিয়ে বলে না, কী রে নিশিকন্যা, রাতের অভিসারে যাচ্ছিস নাকি? তা রেট কত তোর?

কী বিচ্ছিরি কথা! এমন জঘন্য কথা কেউ কাউকে বলতে পারে? কিন্তু রিয়া পারে। সে এমনই। তার মুখে কিছু আটকায় না। সে ছেলেদের সামনেও অকপটে জগতের সবচেয়ে অশ্লীল কথাটা বলে দিতে পারে। হাঁটু ভাজ করে আচমকা বেজায়গায় লাথি কষাতে পারে। এসবে তার আড় নেই। ফলে আর সবার মতো এসব বিষয়ে রিয়ার সামনে সে-ও জড়সড় হয়ে থাকে। আজ অবশ্য সেসবের বালাই নেই। এই ঘরের একচ্ছত্র অধিপতি আজ সে নিজে। কোনো দ্বিধা, ভয়, সংকোচ ছাড়াই এখন গুনগুন করে গান গাইতে পারবে।

আর কাজল আঁকতে পারবে চোখে।

.

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজটা সে কেন করছে? এমন তো নয় যে সে পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরী কোনো মেয়ে! ওই সামান্য কয়েকটি লাইন পড়েই তার মন এমন উচাটন হওয়ারও কথা নয়। তারপরও এই অতি বিরক্তিকর, হাস্যকর কাজটা সে। করছে। আজ দুপুর থেকে বেশ কয়েকবার ওই চিঠি খুলে পড়েছে অবন্তী। সে জানে না। কেন লাইনগুলো সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে। অজস্র বিরক্তি, রহস্য, দ্বিধার প্রাচীর পেরিয়েও কীভাবে কীভাবে যেন একটা অবচেতন ভালো লাগা আলগোছে। ছুঁয়ে যেতে থাকে তাকে। এই অনুভবটাকে কিছুতেই এড়াতে পারে না সে। বরং তার ভাবতে ভালো লাগে যে কেউ একজন তাকে আড়াল থেকে দেখে। ভালোবাসে। আর কে না জানে, প্রকাশ্যের চেয়ে গোপন প্রেমই বেশি সম্মোহনী।

কিন্তু মানুষটা কে? পরিচিত কেউ নয় তো?

জানালার কাঁচে শব্দটা হলো ঠিক তখুনি। আনমনা অবন্তী শব্দটা প্রথমে শুনতে পায় নি। তবে দ্বিতীয়বার শুনল। কিন্তু যতক্ষণে শুনেছে, ততক্ষণে তার বাঁ দিকের জানালাটা খুলে গেছে। একটা বিঘুঁটে মুখ কিংবা মুখোশ ঝুঁকে আছে জানালায়। সম্ভবত দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছ বেয়ে উঠেছে সে। তার এক হাত জানালার গ্রিলে। কিন্তু অন্য হাতে ওটা কী? বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগল অবন্তীর। লোকটার অন্য হাতে কুচকুচে কালো একটা পিস্তল। লোকটা কি তাকে গুলি করবে? কিন্তু কেন? চুরি করতে এলে তো গুলি করার কথা নয়। বড়জোর ভয় দেখানোর কথা। তা সে ভয় পেয়েছেও।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে সে। তীব্র আতঙ্কে তার গলা থেকে কোনো চিৎকারও বের হলো না। তবে লোকটা তাকে ভুল প্রমাণ করে প্রথম গুলিটা করল তার বুক বরাবর। অবন্তী লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। দ্বিতীয় গুলিটা ছিটকে এসে পড়ল তার ঠিক পাশে। অবন্তীর অবশ্য ততক্ষণে আর কিছু মনে নেই। সে নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।

৩১

পুলিশ অফিসারের নাম আবছার আহমেদ। বয়স চল্লিশের কোটায়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুলের কারণে তাকে আরও বয়স্ক লাগে। রোখসানা বেগম বসে আছেন তার সামনে। আবছার আহমেদ বললেন, আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

এক ছেলে, দুই মেয়ে।

আপনার বড় মেয়ের নাম হৃদি?

জি।

ছেলে?

রাতুল। দেশের বাইরে থাকে।

আরেক মেয়ে?

তিথি।

হুম। বলে খানিক চুপ করে রইলেন আবছার। তারপর বললেন, কিছু মনে করবেন না, একটা প্রশ্ন করি?

জি।

আপনার বড় মেয়ে হৃদির রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছে?

হ্যাঁ।

ছেলের নাম নেহাল? জার্মানি থাকেন? কিছুদিন হলো দেশে এসেছেন?

জি।

কত দিন থাকবেন?

এখনো সেভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে কী একটা প্রজেক্টে এসেছে। প্রজেক্ট শেষ হলে পুরোপুরি চলে যাবে। তার আগে হয়তো যাওয়া-আসার মধ্যেই থাকবে। এখন হানিমুনে বার্লিন গিয়েছে।

আচ্ছা। আপনার মেয়ে হৃদির কি এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল? না, মানে গোপন বিয়ে?

এই প্রশ্নে যেন খানিক থতমত খেয়ে গেলেন রোখসানা বেগম। বললেন, ওই রাতের ঘটনার সঙ্গে সেটির সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক যে আছেই, তা বলছি না। আবার একেবারেই যে নেই, তা-ও না।

মানে?

মানে…। বলে কী ভাবলেন পুলিশ অফিসার। তারপর বললেন, আচ্ছা, আমি বুঝিয়ে বলছি। তার আগে আপনি কি আমাকে হৃদির বিয়ের ঘটনাটা বলবেন?

এই প্রশ্নে যেন তেতে উঠলেন রোখসানা বেগম। বললেন, ওটাকে কি বিয়ে বলা যায়? আপনারা তো আইনের লোক। আপনিই বলুন, একটা অল্প বয়সের মেয়েকে কেউ ফুসলিয়ে কাজি অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেই কি তাকে বিয়ে বলা যায়?

আবছার আহমেদ এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, আপনার কী মনে হয়, হৃদির আগের হাজব্যান্ড প্রতিহিংসাবশত এমন কিছু করতে পারে?

অনিক? কী বলছেন আপনি? অনিক করবে এই কাজ? বলে সামান্য থামলেন তিনি। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে গজগজ করতে লাগলেন, এতই যদি তার। সাহস থাকত তো সে তা ডিভোর্সের আগেই করত।

কিন্তু ধরুন…অনেক সময় এমন হয় না যে কিছু করতে না পারার কারণেই আমরা ভেতরে ভেতরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি? বেশির ভাগ সময় কিন্তু অক্ষমতা থেকেই আক্রোশ তৈরি হয়। তাই না?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তবে পুলিশ অফিসারের কথা শুনে এখন তারও কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে। না হলে অনিকের অমন শান্ত থাকা মোটেই স্বাভাবিক কিছু নয়।

এই যে বিয়ের এত দিন পর হৃদিকে দিয়ে আপনারা ডিভোর্স দেওয়ালেন, তারপর আবার বিয়েও দিয়ে দিলেন–এতে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে না?

পারে। কিন্তু তাই বলে সে খুন করতে চাইবে? মানে…আপনি বলতে চাইছেন। যে হৃদি ভেবেই সে ওই রাতে অবন্তীকে গুলি করেছে?

আমি সম্ভাবনার কথা বলছি। হৃদিকে তো সে ভালোই বাসত, তাই না? ভালোবাসার কাউকে অন্য কারও সঙ্গে দেখতে আমাদের কারোরই ভালো লাগার কথা। নয়। আর সে যদি হয় দীর্ঘদিনের বিয়ে করা বউ, তাহলে কেমন লাগার কথা?

রোখসানা বেগম এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে অনিকের মতো গোবেচারা, সাত চড়ে রা নেই, এমন কেউ এতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে!

এখন বলুন, ওভাবে ভাবার সুযোগ আছে কি না? রোখসানা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে বললেন আবছার আহমেদ। নাকি আপনি অন্য কিছু ভাবছেন?

আসলে…। ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন রোখসানা। ঘটনা যদি সত্যি সত্যিই ওদিকে যায়, মানে কাজটা যদি অনিকই করে থাকে…তাহলে আমাদের সিরিয়াস কিছু ঝামেলায় পড়তে হবে।

কী ঝামেলা?

অনিক আর হৃদির ওই গোপন বিয়ের ব্যাপারটা আমরা এই মুহূর্তে সামনে আনতে চাইছি না।

কেন?

কারণ, ওর হাজব্যান্ড ছাড়া এই ব্যাপারটা আর কেউ জানে না। এমনকি তার বাবা-মাও না। আর সে-ও চায় না বিষয়টা এখুনি তার পরিবারের কেউ জানুক। ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বললেন রোখসানা বেগম। নেহালকেও বিয়ের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয় নি। এখন এই ঘটনায় যদি অনিক আর হৃদির বিষয়টা সামনে চলে আসে, তাহলে কী হবে বুঝতে পারছেন?

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার। বললেন, কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন বিষয়টা কতটা ভয়ংকর?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না।

আপনাদের মতো নির্বিরোধ, নিরীহ কারও বাড়ির দেয়াল টপকে, দোতলার কার্নিশ বেয়ে উঠে কেন কেউ কাউকে খুন করতে চাইবে? তাও গুলি করে?

বিষয়টা রোখসানা বেগমেরও মাথায় ঢুকছে না। ঘটনার ভয়াবহতা তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু হৃদি তার ভুল জীবনকে পেছনে ফেলে সত্যিকারের জীবন খুঁজে পেয়েছে। এই জীবনে তিনি আর তার অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না।

আবছার আহমেদ বললেন, আপনাদের তো আর কোনো শত্রু নেই?

শত্রু সবারই থাকে। তবে রাতের আঁধারে গুলি করে খুন করতে পারে, এমন কেউ নেই।

হুম। বলে থম মেরে রইলেন পুলিশ অফিসার। তারপর বললেন, আমি আপনাদের সমস্যাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ধরুন, যদি সত্যি সত্যিই এই ঘটনা অনিক ঘটিয়ে থাকে, তাহলে?

রোখসানা বেগম কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। বাইরে যতই শান্ত, স্থির থাকার চেষ্টা করুন না কেন, ভেতরে ভেতরে তীব্র এক আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে তাকে। ঘটনার পর প্রায় দুটো দিন কেটে গেছে, কিন্তু এর মধ্যেও একমুহূর্তের জন্য স্থির হতে পারেন নি তিনি। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, কেউ একজন উদ্যত পিস্তল হাতে তাকে অনুসরণ করছে। যেকোনো সময় ছুটে আসবে প্রাণঘাতী বুলেট।

আবছার আহমেদ অবশ্য রোখসানা বেগমকে আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি চোখের ইশারায় কনস্টেবলকে কিছু নির্দেশ করলেন। কিছুক্ষণ বাদেই ঘরে ঢুকল অবন্তী। তাকে দেখে ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে।

আবছার আহমেদ বললেন, আমরা খুবই দুঃখিত যে এমন ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতে হয়েছে।

অবন্তী কথা বলল না। তবে ধীরে তার সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসল। আবছার আহমেদ বললেন, আসলে বিষয়টা যে খুব সিরিয়াস, সেটি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

জি। ম্লান গলায় বলল অবন্তী।

আপনি কি ঘটনাটা একটু বিস্তারিতভাবে বলতে পারবেন?

জি। পারব।

একদম যা যা ঘটেছে, ঠিক তা-ই বলবেন। কমও না, বেশিও না।

আচ্ছা। বলে খানিক সময় নিল অবন্তী। তারপর যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত বলার চেষ্টা করল। সেদিন রাতে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল সে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। কিন্তু প্রবল আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়েছিল সে।

আপনার কী মনে হয়, ইউনিভার্সিটিতে বা বাইরে আপনার এমন কোনো শত্রু আছে, যে আপনাকে খুন করতে চাইতে পারে?

উঁহু। মাথা নাড়ল অবন্তী।

কেন?

আমি কখনো কারও এমন কোনো ক্ষতি করি নি যে সে আমাকে গুলি করে খুন করতে চাইবে।

আপনাকে কি কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

জি।

আপনার কি কোনো সম্পর্ক আছে? মানে প্রেমট্রেম টাইপ কিছু…?

নাহ্।

আগে ছিল?

এই প্রশ্নে থমকে গেল অবন্তী। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে অবশেষে মাথা নাড়ল সে, উঁহু। ও রকম কিছু না।

একদম কিছু না?

না।

কিন্তু আপনি দেখতে ভালো। আপনাকে পছন্দ করার মানুষের তো অভাব থাকার কথা নয়?

ও রকম যে ছিল না, তা না। মানে…স্কুল-কলেজে যা হয় আরকি!

ক্লাসমেট? কাজিন বা পাশের বাড়ির কেউ…এ রকম?

জি। সিরিয়াস কিছু না।

আচ্ছা। বলে চুপ করে রইলেন আবছার আহমেদ। এই ঘটনায় অনিককে ছাড়া আর কাউকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগই তার নেই। কথাটা তিনি রোখসানা বেগমকেও বললেন, কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, আপনি না চাইলেও অনিককেই আমাদের চার্জ করতে হবে। এত বড় একটা ঘটনাকে তো আর আমরা আপনার পারিবারিক ইস্যুর কথা বিবেচনা করে চেপে যেতে পারি না। তাই না?

জি। বলে মাথা নাড়লেন রোখসানা বেগম।

আপনার হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এর চেয়েও অবিশ্বাস্য ঘটনা আমরা অহরহই দেখি। আপনি ভাবতেও পারবেন না মানুষের মনে কী ভয়ংকর সব চিন্তাভাবনা ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ হয়তো সাহসী বলে বাস্তবে প্রয়োগ করে ফেলে। বাকিরা দুর্বল বলে পারে না। কিন্তু দুর্বল বা ভিতুরাও কখনো কখনো নির্দিষ্ট কোনো ঘটনায় হঠাৎ খুব ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এ রকম বহু এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে।

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। আবছার আহমেদ বললেন, আজ তাহলে আপনারা আসুন। প্রয়োজন হলে আমি আবার ডাকব বা নিজেই বাসায় চলে আসতে পারি। এর মধ্যে অবন্তীও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন। ওনার মানসিক ধকলটা কাটিয়ে ওঠাটা জরুরি। আমি খুবই দুঃখিত অবন্তী যে এই অবস্থায়ও আপনাকে বিরক্ত করলাম।

অবন্তী কথা বলল না। সে-ও উঠে দাঁড়াল। রোখসানা বেগম ততক্ষণে দরজার কাছে পৌঁছে গেছেন। অবন্তীও। কিন্তু খানিকটা গিয়েই অবন্তী আচমকা থমকে দাঁড়াল। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, একটা কথা।

জি? কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন আবছার আহমেদ।

অবন্তী দুই পা ঘুরে আবার আবছার আহমেদের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, না, তেমন কিছু না। এই চেয়ারটাতে বসতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। সম্ভবত ফোমের ভেতর থেকে একটা পেরেক বের হয়ে আছে। চেয়ারটা বদলে নেবেন।

৩২

অনিক ঢাকায় এসেছে মাসখানেক হলো। সে ভেবেছিল তার টিউশনটা বুঝি আর নেই। কিন্তু সুমি তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, তুমি চাইলে আরও কিছুদিন গ্যাপ দিতে পারো, অনিক। এই সময়ে চট করে আগের জীবনে ঢুকে যাওয়া সহজ নয়।

কিন্তু জিতুর তো খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

সেটা তোমার ক্ষতির চেয়ে বড় কিছু নয়। তুমি যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে, তার সঙ্গে কি এর তুলনা চলে?

তা চলে না। কিন্তু…।

তুমি ওটা নিয়ে ভেবো না। ওর তো আর তোমার সঙ্গে পড়াশোনার বিষয় তেমন ছিল না। আমরা আসলে ওর একটা ভালো কম্প্যানিয়ন নিশ্চিত করতে চাইছিলাম। যেহেতু আমরা দুজনই খুব ব্যস্ত।

তারপরও।

সুমি হাসল। বলল, ঠিক আছে। তুমি আবার আসতে শুরু করো।

অনিকের আসলে কিছু টাকার দরকার ছিল। কিন্তু কথাটা সে মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। আয়েশাকে আবারও মামার বাসায় রেখে এসেছে সে। তার জন্য টাকা পাঠাতে হবে। গত কয়েক মাসে তার নিজের অবস্থাও ভালো না। বাসাভাড়া বাকি পড়ে গেছে। হাতখরচের অবস্থাও যাচ্ছেতাই।

আজ ঘরে ঢুকতেই মাহমুদ বললেন, কী খবর অনিক, এখন কেমন আছেন আপনি?

অনিক মাথা নাড়ল, জি স্যার, ভালো।

এই পরিস্থিতিতে কেউ ভালো থাকতে পারে না। আপনিও ভালো নেই। সেটা আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অনিক, জীবন তো এমনই, না? আমাদের সবারই তো একদিন না একদিন চলে যেতে হবে। তাই না?

জি।

আপনার চাকরিবাকরির কিছু হলো?

হয়ে যাবে।

আচ্ছা। মাহমুদ আর কথা বাড়ালেন না। তিনি কফির মগ হাতে বারান্দায় চলে গেলেন। অনিক জিতুকে পড়াতে বসল। সমস্যা হচ্ছে, পড়ানোতে মন বসাতে পারছে না। সে। তার সকল মনোযোগ সুমির ওপর। সুমিকে আজ টাকার কথা কী করে বলবে সে?

সুমি তাকে বিকেলের নাশতা দিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, তোমার কি আজ তাড়া আছে, অনিক?

না তো।

পড়ানো শেষে কী করবে?

এখনো জানি না। বিশেষ কোনো কাজ নেই।

আচ্ছা। বলে ভেতরে চলে গেল সুমি।

কিন্তু বাকিটা সময় আর স্থির হতে পারল না অনিক। তার কেবলই মনে হতে লাগল, সুমি কি তাকে কিছু বলবে? এ রকম অনেকবারই হয়েছে যে সুমি তাকে এটা-সেটা কিনতে পাঠিয়েছে। তারপর বাকি টাকাগুলো আর ফেরত নেয় নি। এমন নয় যে অনিক চুপচাপ সেই টাকা পকেটস্থ করেছে। বরং সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে সেগুলো ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সুমি নেয় নি। অনিকের কেন যেন মনে হয়, এই কাজটা সে ইচ্ছে করেই করত। বিশেষ করে মাসের শেষের দিকে। যখন অনিকের পকেটের অবস্থা বিশেষ ভালো থাকত না এবং তার মা অসুস্থ ছিল, তখন। আজও কি তেমন কিছু হবে?

অনিক প্রবল অস্থিরতা নিয়ে জিতুকে পড়ানো শেষ করল। সে চাইলে এখন চলে যেতে পারে। সুমি তাকে থাকতেও বলে নি। তারপরও সে গেল না। চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে রইলে। সুমি এল দীর্ঘ সময় পর। তার পরনে কলাপাতা রঙের শাড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ। চোখে কাজল। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। অনিক সুমিকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। সুমি বলল, তুমি এখনো যাও নি? আমি তো ভেবেছিলাম চলে গেছ।

অনিক বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, আপনি কিছু বলবেন ভেবে যাই নি।

আমি? যেন মনে করার চেষ্টা করল সুমি। আমি কি কিছু বলার কথা বলেছিলাম?

না…। তা বলেন নি। তবে পড়ানো শেষে আমার কোনো কাজ আছে কি না। জিজ্ঞেস করেছিলেন।

ওহ! ওটা এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলে কাজের বুয়াকে ডাকল সুমি, আমি একটু বেরোচ্ছি। তুমি দেখো তোমার স্যারের কিছু লাগে কি না। আর জিতুর দিকে খেয়াল রেখো। ওকে একদম কম্পিউটার ধরতে দেবে না।

মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় জানাল। অনিক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল, আমি কি তাহলে চলে যাব?

যাবেই তো। বলে হাসল সুমি। এখানে কি পড়ানোর মতো আর কেউ আছে?

এবার চুপসে গেল অনিক। সে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, না না। আচ্ছা, আমি যাই। বলেই ঘুরে হাঁটতে শুরু করল সে। সুমি মৃদু কণ্ঠে বলল, তুমি নিচে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি।

অনিক সুমির আচরণে খুবই অবাক হয়েছে। সে বুঝতে পারছে, সুমি ইচ্ছে করেই তার সঙ্গে খানিক হেঁয়ালি করেছে। কিন্তু কেন করছে, সেটি সে বুঝতে পারছে না।

সুমি এল মিনিট পাঁচেক পর। বলল, তুমি তো মোহাম্মদপুরের দিকে থাকো?

জি।

এখান থেকে ধানমন্ডি হয়েই তো যেতে হয়?

জি।

আচ্ছা। একসঙ্গে যাই তাহলে। আমাকেও একটু ওদিকে যেতে হবে।

অনিক মাথা নেড়ে সায় জানাল। তার টাকাটা ভীষণ দরকার। কিন্তু কীভাবে চাইবে বুঝতে পারছে না। তা ছাড়া সুমিকে ভীষণ অন্য রকম লাগছে আজ। এই সময়ে হুট করে টাকার কথা বলা ঠিক হবে না। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে সুমি কিছু কিনতে। বের হয়েছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে সে নিজেই তো তা কিনে এনে দিতে পারে! সে ক্ষেত্রে না চেয়েও কিছু টাকা পেয়ে যেতে পারত সে। চট করে কথাটা জিজ্ঞেসও করে ফেলল অনিক। সুমি অবশ্য উত্তর দিল না। গ্যারেজ পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল সে। তারপর বলল, আজ ড্রাইভার নেই। তুমি কি একটা রিকশা ডাকতে পারবে?

অনিক রিকশা ডাকল। রিকশায় যতটা সম্ভব আড়ষ্ট হয়েই বসল সে। সুমি বলল, তুমি কি সবার সঙ্গেই এভাবে বসো? নাকি শুধু আমার সঙ্গে?

জি? না মানে…। খানিক থতমত খাওয়া গলায় বলল অনিক।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি অশুচি, অদ্ভুত কিছু। আমার ছোঁয়া লাগলেই তোমার জাত চলে যাবে। বলে খিলখিল করে হাসল সুমি।

অনিক কথা বলল না। তবে ভেতরে ভেতরে আরও গুটিয়ে গেল সে। সুমি এর আগে কখনো তার সঙ্গে এমন আচরণ করে নি। আজ হঠাৎ কী হয়েছে তার? অনেক। ভেবে অবশেষে প্রশ্নটা করল সে, আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ?

উমম? যেন শুনতে পায় নি এমন প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকাল সুমি।

অনিক দ্বিরুক্তি করল, আপনার কি মন খারাপ?

মন খারাপ কেন হবে?

না মানে…। বলে থমকে গেল অনিক। যেন মনস্থির করতে পারছে না সে। সুমি বলল, বলো?

না, কিছু না।

সুমি অবশ্য আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গেল সে। তারপর মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টুকরো মেঘ। সে সেই মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, মেঘের যদি কখনো আকাশ ভালো না লাগে, তাহলে মেঘ কী করবে?

অনিক সুমির কথার কিছুই বুঝল না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুমিই বলল, মেঘের তো ওই এক আকাশ ছাড়া যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই, না? ওই তো একটাই আকাশ। ওই আকাশ ছেড়ে সে আর কোথায় যাবে? বলে সামান্য থামল সে। তারপর গাঢ় গলায় বলল–

দূরে যাও, উড়ে যাও, পুড়ে যাও মেঘ
তবু এ আকাশ ছেড়ে যেতে পারো নাকো–
খুঁজে নিয়ে আকাশ আরেক!

অনিক কথা বলল না। সুমি বলল, মেঘেদের আসলে যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না, বুঝলে? তা যতই তার বুকে যন্ত্রণা থাকুক। তাদের ওই এক আকাশেই এখান থেকে সেখানে ভেসে বেড়াতে হয়। তাই না?

বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেলেই তো মুক্তি। বলল অনিক।

সব মেঘে কি বৃষ্টি হয়?

তা হয় না।

বেমানুষও অমন। সব মেঘে যেমন বৃষ্টি হয় না, তেমনি সব মানুষও কাঁদতে পারে না। কেবল যন্ত্রণা জমা করে রাখে বুকে।

অনিক কথা বলল না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সুমির কোনো কারণে মন খারাপ। এমন অবস্থায় কারও কাছে টাকা ধার চাওয়া যায় না। সুমি বলল, আমি সামনের দোকানটায় নামব। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?

অনিক মাথা নাড়াল। সে যাবে। যেন যেকোনো মূল্যে সুমির সঙ্গে আরও খানিকটা সময় কাটাতে চায় সে। যদি এর মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টায়, টাকা চাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়, কিংবা সুমি নিজ থেকেই কিছু বলে! সুমি অবশ্য তেমন কিছু বলল না। সে বরং তিনটা পাঞ্জাবি কিনল। সঙ্গে দুটো শার্ট আর প্যান্টও। অনিক অবাক হয়ে লক্ষ করল, কাপড়গুলো ঠিক তার মাপেই কিনেছে সুমি। কিন্তু মাহমুদ তো তার চেয়েও লম্বা! তাহলে? সম্ভবত অন্য কারও জন্য কিনেছে সে।

অনিক অবশ্য অবাক হলো বিদায় নিতে গিয়ে। সুমি কাপড়ের প্যাকেটগুলো তার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, কাল থেকে আর এই এক পাঞ্জাবি পরে রোজ পড়াতে আসবে না।

মানে?

মানে এখন থেকে এগুলো পরে পড়াতে আসবে।

অনিকের যতটা অবাক হওয়ার কথা ছিল, ততটা অবাক সে হলো না। বরং অদ্ভুত এক কাজ করল সে। সুমি চলে যেতেই দৌড়ে এসে আবার দোকানটাতে ঢুকল। তারপর ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়ানো ছেলেটাকে বলল, আমি এইমাত্রই কাপড়গুলো কিনেছিলাম। কিন্তু এখন হঠাৎ অন্য একটা কাজে টাকাটা খুব দরকার হয়ে পড়েছে আমার, আপনি যদি কাপড়গুলো ফেরত নিতেন, তাহলে খুব উপকার হতো।

ছেলেটা বিরক্ত ভঙ্গিতে হাসল। বলল, স্যার, আপনি চাইলে এগুলো বদলে অন্য কিছু নিতে পারেন। কিন্তু ক্যাশ রিটার্ন হয় না।

আমি অর্ধেক দামে দিয়ে দিচ্ছি। প্রায় কাতর কণ্ঠে বলল অনিক।

সরি স্যার। আমাদের সিস্টেমে স্পষ্ট বলা আছে, এটা সম্ভব না।

অনিক হয়তো আরও কিছু বলত। কিন্তু তার আগেই তিথির গলা শুনে চমকে গেল সে।

বদলাতে হবে না। এদিকে এসো তুমি।

অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তিথি তার একদম পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। অনিক বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, তুই?

হুম। আসো, এদিকে আসো।

অনিক কাউন্টার থেকে সরে এল। তিথি বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। জরুরি কথা।

জরুরি কী কথা?

আগে বাইরে চলো, বলছি।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিথির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল অনিক। তিথি বলল, তোমাকে আমি কতবার ফোন করেছি, তুমি ফোন ধরছ না কেন?

অনিক এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তিথি বলল, তুমি কি ভেবেছ, আমি হৃদি আপুকে নিয়ে কিছু বলব? এই জন্য ফোন ধরো নি?

হুম। বলল অনিক।

তুমি হৃদি আপুর বিষয়ে কোনো কথা শুনতে চাও না?

ঠিক তা না। আসলে…।

তোমার হৃদি আপুর জন্য খুব কষ্ট হয়, তাই না?

অনিক হাসল, এটাই তোর জরুরি কথা?

না।

তাহলে?

চলো, আগে রিকশা নিই। নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে কোথাও বসি।

তারা চলে এল ধানমন্ডি লেকের দিকটায়। তারপর চুপচাপ নির্জন একটা জায়গা দেখে বসল। তিথি সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল, তুমি একটা ভয়াবহ বিপদে পড়ে গেছ।

বিপদে? আবার কী বিপদ? অনিকের কণ্ঠে যেন খানিক শ্লেষ।

তোমাকে পুলিশ খুঁজছে।

পুলিশ? আমি আবার পুলিশকে কী করলাম? ভ্রু কুঁচকে তাকাল অনিক। যেন তিথির কথা বুঝতে পারছে না সে। ফান করিস না, তিথি। আজকাল আর ফান করার মুড নেই আমার।

আমারও নেই। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল তিথি।

পুলিশ আমাকে খুঁজবে কেন?

হৃদি আপুকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার।

মানে কী!

অনিক এবার সত্যি সত্যিই বিভ্রান্ত বোধ করছে। সে ফ্যালফ্যালে চোখে তিথির দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি বলল, সপ্তাহখানেক আগে এক রাতে অবন্তী আপুকে কেউ

জানালা দিয়ে গুলি করেছিল। পরপর দুবার।

কী?

হুম। অবন্তী আপু ছিল হৃদি আপুর ঘরে। ভাগ্য ভালো যে তার খারাপ কিছু হয় নি। লোকটাকেও ঠিকঠাক দেখতে পায় নি ও। সম্ভবত মাস্ক পরা ছিল। কিন্তু পুলিশের ধারণা, এটা তোমার কাজ।

অনিকের মনে হলো, বহু বছর পর কোনো ঘটনায় সে সত্যি সত্যিই বাদ্ধ হয়ে গেছে। এতটা অবাক সে এর আগে কখনো হয় নি। এমনকি তিথির কথাও কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। বরং মনে হচ্ছে আষাঢ়ে কোনো গল্প শুনছে সে।

তিথি বলল, মা প্রথমে বিষয়টা বিশ্বাস করতে চায় নি। কিন্তু তোমার আর হৃদি আপুর বিষয়টা এখন অনেকটাই জানাজানি হয়ে গেছে। মানে অন্তত আমরা যারা কাছের, তারা জানি। পুলিশও জানে বিষয়টা। ফলে তাদের ধারণা ঘটনাটা তুমিই ঘটিয়েছ। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কাজটা করেছ তুমি।

অনিক দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর চোখ তুলে তাকাল তিথির চোখে। বলল, তোর কী মনে হয়?

তিথি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। সে একদৃষ্টে অনিকের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে অদ্ভুত এক কান্না বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে। যেন ঢেউহীন জলের নিষ্কম্প পুকুর। সেই পুকুরে থমথমে মেঘের ছায়া পড়েছে। কিন্তু সেই মেঘ কিছুতেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে না।

সে আচমকা হাত বাড়িয়ে অনিকের গাল ছুঁয়ে দিল। তারপর চোখ ছুঁয়ে দিল আঙুলের ডগায়। একটা জলের ফোঁটা আচমকা টুপ করে তার সেই আঙুলের গা বেয়ে নেমে আসতে লাগল। তিথি প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে চিনি। আমি তোমার সবটুকু চিনি।

অনিক যেমন বসে ছিল, তেমন বসেই রইল। তিথি খানিক সরে এল তার কাছে। তারপর দুহাতে অনিকের গাল চেপে ধরে বলল, তুমি এমন কেন? আজকাল এমন কেউ হয়? এত ভালো?

অনিক কথা বলল না। তবে হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছল সে। যেন উপচে ওঠা জলের ঢেউটাকে চোখের তীর ভাসাতে দিতে চায় না।

তিথি বলল, তুমি একটু অন্য রকম হতে পারো না?

অন্য রকম হলে কী হতো?

তাহলে হৃদি আপু তোমাকে ছেড়ে যেতে পারত না। আর…।

আর কী?

তিথি এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। তবে সে চোখ সরায় না অনিকের চোখ থেকে। অনিক বলে, আর কী?

তোমার জন্য এত কষ্ট হতো না আমার। এমন কেন তুমি?

কেমন?

এমন অসহ্য রকম ভালো!

অনিক হাসে। তবে তার সেই হাসি কান্নার চেয়েও করুণ। তিথি বলে, তুমি কি জানো, তোমার জন্য আমার কেমন কষ্ট হয়?

অনিক জবাব দেয় না। তিথি আবার বলে, জানো তুমি? বুঝতে পেরেছ কখনো?

সবকিছু বুঝতে নেই, তিথি।

কেন?

সব বুঝলে জীবন আরও জটিল হয়ে যায়। যন্ত্রণা বাড়ে।

তোমার জীবন কি সহজ? যন্ত্রণাহীন?

যন্ত্রণাহীন কি না জানি না। তবে সহজই হয়তো।

এই কথায় তিথি চুপ করে থাকে। বেশ খানিকটা সময়। তারপর বলে, তাও ঠিক। হলে এত এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তুমি এমন শান্ত থাকো কী করে! এমন চুপচাপ, স্থির, নির্বিকার? তোমার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে না কখনো? সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে হয় না?

অনিক আবারও হাসার চেষ্টা করে। মলিন, ফ্যাকাশে, বিবর্ণ এক হাসি। তারপর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, যার যন্ত্রণা যত গভীর, তার কান্নার শব্দ তত কম।

৩৩

ঘটনা শুনে চুপ করে রইল সুমি। এখন রাত প্রায় দশটা। তার সামনে বসে আছে অনিক। বিকেলের দিকেই তার সঙ্গে একসাথে ধানমন্ডি পর্যন্ত গিয়েছিল সে। এইটুকু সময়ের মধ্যে যে কারও জীবন এমন ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, এটা তার দূরতম কল্পনায়ও ছিল না। খানিক আগে অনিক তার বাসায় এসেছে। তাকে দেখে চমকে গেছে সুমি। অনিকের চোখমুখ শুকনো। তবে আচরণ ধীরস্থির। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সোফায় বসে রইল সে। তারপর বলল, আমাকে একটু পানি দেবেন?

সুমি নিজে তাকে পানি এনে দিল। অনিক ধাতস্থ হতে খানিক সময় নিল। এই শহরে তেমন কেউ নেই তার, যার কাছে সে এই বিপদে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারে। তিথির কাছে ঘটনা শোনার পর বিষয়টা বুঝতে সময় লেগেছে তার। কিন্তু এখন সে কী করবে? অনেক ভেবে অবশেষে এখানে এসেছে সে। যদিও জানে না এরা কেউ তাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে কি না।

সুমি বলল, এসব কী বলছ তুমি?

জি।

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এ তো ভয়াবহ অবস্থা।

অনিক কথা বলল না। সুমি বলল, আমার মাথায় তো কিছু আসছে না। তুমি কি পুলিশের কাছে ধরা দেবে?

জানি না।

কিন্তু জানতে তো হবে।

আপনার কী মনে হয়, পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করবে?

সুমি এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তার উচিত বিষয়টা নিয়ে মাহমুদের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো মাহমুদের সঙ্গে কথা বলে না সে বা বললেও তা শীতল, নিস্পন্দ।

অনিক বলল, আপনি কি একটু স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠল সুমি। মাহমুদ তার ঘরে কাজ করছিলেন। সুমিকে দেখে ভ্র কুঁচকে তাকালেন তিনি। সুমি বলল, একটু এদিকে আসবে?

মাহমুদ এলেন। ঘটনা শুনে তিনিও হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন, এ তো ভয়াবহ ব্যাপার!

অনিক কথা বলল না। সুমি বলল, এটা যে ভয়াবহ ব্যাপার, সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কিন্তু এই ভয়াবহ ব্যাপার থেকে মুক্তির উপায় কী, সেটা বললে ভালো হয়।

মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গেই কথা বললেন না। চুপচাপ অনিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমরা কি আপনাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারি?

অনিক মুখ তুলে তাকাল। এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না সে। মাহমুদ বললেন, না, মানে রাগের মাথায় কিন্তু আমরা এমন অনেক কিছুই করে ফেলি

যে সেটার কনসিকুয়েন্স নিয়ে ভাবি না। এমন হয় না?

জি।

এমন কিছু তো হয় নি? মানে আপনি সত্যি সত্যিই তো কিছু করেন নি?

নাহ্। মাথা নাড়ল অনিক।

মাহমুদ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। সুমি বলল, তোমার তো অনেক পরিচিত লোকজন আছে। পুলিশেও আছে। তুমি কি একটু তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখবে কিছু করা যায় কি না?

কথা বলে কিছু হবে না। তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছ না। এটা সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। তখন বরং এর জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তা ছাড়া…। বলে একটু থামলেন মাহমুদ। তারপর বললেন, এটাও তো সত্য যে অনিককে আমরা সেই অর্থে চিনি না। তাই না? সে এখানে জিতুকে পড়ায়। এর বাইরে তার সম্পর্কে আমরা কী জানি? কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য। তাই না?

সুমি কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে রইল। মাহমুদের কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু সে এটাও জানে যে অনিক এমন কিছু করতেই পারে না। মাহমুদ বললেন, অনিক?

জি স্যার?

পুলিশ কি এখনো আপনার খোঁজ করছে?

না। ঘটনা ঘটেছে চার-পাঁচ দিন। আমি আজই জানলাম। তিথির কাছে।

হুম। বলে আবার চুপ করে রইলেন মাহমুদ। তার মানে ওনারাও হয়তো একটু কনফিউজড। ফলে আরেকটু নিশ্চিত হয়েই এগোতে চাইছে তারা। এ ক্ষেত্রে আপনি দুটো কাজ করতে পারেন। এক, পুলিশ আপনার কাছে আসা অবধি অপেক্ষা করতে পারেন। তারপর ধরা দিয়ে কোর্টে কেস লড়তে পারেন। কিন্তু সেটা আপনার জন্য কঠিন। মানে বাংলাদেশের আইনি প্রক্রিয়ায় যা হয় আরকি! আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তাতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।

অনিক কথা বলল না। সুমি বলল, আরেকটা কী?

আরেকটা…। বলে সময় নিলেন মাহমুদ। তারপর বললেন, আরেকটা হচ্ছে আপনি কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে পারেন। এতে অবশ্য আপনার ওপর সন্দেহটা আরও গাঢ় হবে। তবে কাজটি যেহেতু আপনি করেন নি আর পুলিশও এখনো তেমন কোনো অ্যাটেম্পট নেয় নি, তার মানে তারা হয়তো অন্য কিছুও ভাবছে। মানে অন্য কোনো সন্দেহভাজন বা আর কারও ইনভলভমেন্ট। আর এর মধ্যে যদি সেটি প্রমাণিতও হয়ে যায়, তাহলে তো আর আপনার কোনো সমস্যা নেই। আপনি তখন নির্বিঘ্নেই ফিরে আসতে পারবেন। আর তখন প্রয়োজনে পুলিশের কাছে গিয়ে বলবেন যে আপনি ভয় পেয়ে পালিয়েছিলেন।

মাহমুদ থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। তিনি যে দুটি উপায়ের কথা

বলেছেন, তার একটিও কারও মনঃপূত হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই কঠিন। এর বাইরে আপাতত আর কোনো উপায়ও নেই। এই নিয়ে দীর্ঘ সময় কথাবার্তা হলো। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল না।

সুমি বলল, ও তাহলে কী করবে এখন?

সেই সিদ্ধান্ত তো অন্য কেউ দিতে পারবে না। ইটস আ সিরিয়াস ইস্যু। সেন্সিটিভ অ্যাজ ওয়েল। ফলে সিদ্ধান্তটা ওনাকেই নিতে হবে।

কিছু ভেবেছ অনিক? বলল সুমি।

ভাবছি পুলিশের কাছে গিয়ে ধরা দিয়ে দেব। এই চোর-পুলিশের জীবন আর ভালো লাগছে না আমার। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল অনিক।

কিন্তু…সেটা কি ঠিক হবে? এরপর যদি ওরা আর তোমাকে না ছাড়ে?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না অনিক। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়ার অভিজ্ঞতা তার নেই। এমনিতে সব সময় স্থির, শান্ত থাকার চেষ্টা করে সে। এখনো করছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। একটা অবর্ণনীয় অস্থিরতা ভেতরটা ভেঙেচুরে দিচ্ছে তার।

সুমি বলল, আমার মনে হয় কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দাও তুমি। তারপর পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ো। প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে চলে আসতে পারবে। যদি সিচুয়েশন তোমার ফেভারেও না আসে, তারপরও এটা তো অন্তত বলা যাবে যে তুমি ঘটনার কিছুই জানতে না। এমনকি এই ঘটনায় পুলিশ যে তোমাকে খুঁজছে, তাও না। হয়তো অন্য কোনো কাজে তুমি ঢাকার বাইরে ছিলে। কোনো গ্রামে বা কোথাও। মানে যেখান থেকে সহজে তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু তেমন কোথায় যাব আমি?

তোমার গ্রামে?

সেটা কি ঠিক হবে? পুলিশ আমাকে ঢাকায় না পেলে সবার আগে ওখানেই খুঁজবে।

তা-ও তো কথা। বলে মাহমুদের দিকে তাকাল সুমি। তুমি কিছু বলছ না কেন? তোমার তো পরিচিত জায়গার অভাব নেই। মানুষও আছে অনেক। তুমি তো একটা ব্যবস্থা করতে পারো?

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন মাহমুদ। তারপর বললেন, তুমি আসলে বিষয়টাকে যত সহজ ভাবছ, তত সহজ নয়, সুমি। যদি কোনোভাবে অনিকের এই আত্মগোপনের সঙ্গে পুলিশ আমাদের ইনভলভমেন্ট খুঁজে পায়, তখন কী হবে, ভেবেছ?

কী হবে? অনিক তো আর সত্যি সত্যিই কোনো দোষ করে নি!

সেটা তুমি-আমি জানি। কিন্তু পুলিশ তো আর জানে না। তারা বরং তাকেই সন্দেহ করছে।

সুমি কথা বলল না। মাহমুদ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি একটা কাজ করতে পারেন, অনিক।

জি স্যার?

আমার এক বন্ধু আছে। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। এখন দেশে ফিরে এখানেই কিছু করার চেষ্টা করছে। বহুদিন আগে একবার আমার কাছে এসেছিলও। সম্ভবত গাজীপুর বা মানিকগঞ্জের দিকে মাছের খামার বা এ-জাতীয় কিছু একটা করতে চাইছিল সে। সঙ্গে আরও কী সব প্ল্যান…।

করেছে? কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল সুমি।

শুনেছি মাছের খামারটা নাকি শুরু করেছে। আমার কাছে একবার একটা ছেলেও চেয়েছিল। শিক্ষিত কিন্তু গ্রামে গিয়ে কাজ করতে পারবে, এমন…।

তুমি কি অনিককে ওখানে পাঠানোর কথা ভাবছ?

শিওর না এখনো। আগে ওর সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে এখনো ওর লোক দরকার আছে কি না। অনেক দিন তো কোনো যোগাযোগ নেই। আজ অনিকের কারণেই হঠাৎ মনে পড়ল। আসলে বিদেশে থাকা লোকজন তো এমন কত কিছু করার কথাই বলে। দুয়েকজন চেষ্টাও করে। কিন্তু সেসব শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। এ কারণে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিই নি আমি। বলে সামান্য থামলেন মাহমুদ। তারপর বললেন, অনিক রাজি থাকলে আমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি।

সুমি উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল, এটাই সবচেয়ে ভালো হয়। তুমি একটু কথা বলে দেখো।

মাহমুদ কথা বললেন সেই রাতেই। স্বস্তির বিষয় হলো সেদিনই অনিকের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল সেখানে। সে যাবে পরদিন রাতে। তাকে গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। তার আগে টুকটাক কিছু কাজ সারতে হলো তাকে। সুমি কিছু টাকা দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে বাসাভাড়া মেটাল সে। আয়েশাকে কিছু পাঠাল। নিজের জন্য খুব প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করল। মাহমুদ তাকে তার ফোন আর সিমকার্ড ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো হয় ফেলে দিলে। কাজটা করতে কেন যেন খারাপ লাগছিল অনিকের।

.

ভরদুপুরে বছিলা ব্রিজের ওপর গিয়ে দাঁড়াল সে। তার মাথার ওপর খাঁ খাঁ রোদ। পায়ের তলায় কংক্রিটের পাটাতন। তার নিচে কালো জল। সেই জলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে হঠাৎ ভীষণ অর্থহীন মনে হতে লাগল অনিকের। আচ্ছা, তার এই আদ্যোপান্ত ব্যর্থ জীবনটার কি আসলেই কোনো মানে আছে? অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না সে।

বছরখানেক আগে, যেদিন তারা ধলেশ্বরীর তীরে ঘুরতে গিয়েছিল, সেদিন ঠিক এখানে এসে একবার হৃদির সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল সে। হৃদি বলেছিল, তোমার কী মনে হয়, মানুষ জীবনের কাছে কী চায়?

মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই।

এটা সত্যি নয়, অনিক। বলেছিল হৃদি।

কেন?

আমি তো জীবনের কাছে আর কিছু চাই না।

সত্যি চাও না?

উঁহু।

কেন?

কারণ, আমি সব পেয়ে গেছি।

কীভাবে সব পেলে? আর মানুষ সব পেলেও ভাবে তার কিছুই পাওয়া হয় নি। তাই সে জীবনভর আরও আরও চায়। চাইতেই থাকে। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত।

আমি চাই না। এই যে আমি তোমাকে পেলাম, মাকে পেলাম, এখন আর কিছু চাই না আমার। সব পাওয়া হয়ে গেছে।

অনিক কথা বলে নি। তবে হৃদির ওই কথাটুকু কেন যেন খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। হয়তো করেও ছিল। না হলে আজ এই অবেলায়, ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই ওই কথাগুলোর প্রতিটা শব্দ কেন মনে পড়বে তার?

অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও লুকায়। জীবন যে পথে তাকে নামিয়েছে, সেই পথের বিপরীতে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। ফলে সে ভেসে যাচ্ছে স্রোতের অনুকূলে। কচুরিপানার মতো। কিন্তু এই স্রোতের গন্তব্য কোথায়? সে কি কখনো স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে?

অকারণেই বাবার কথা খুব মনে পড়ে তার। বাবা কি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন? তার ফলাফলই কি মৃত্যু? যদি ওভাবে ভাগ্য কিংবা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে চাইতেন, তাহলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারতেন আরও কিছুদিন। কিন্তু মানুষ যেভাবে অপ্রাপ্তি, দারিদ্রকে মহান করে তুলতে চায়, জীবন কি আসলেই তেমন? যদি তা-ই হতো, তাহলে তার জীবনটা এমন কেন? সে তো কখনোই কিছু চায় নি। এমনকি জোর করে নি। দাঁড়াতে চায় নি স্রোতের বিপরীতে। বরং ভেসে গেছে যে যেদিকে নিয়ে গেছে, ঠিক সেদিকেই। কিন্তু কই, তাতেও তো তার বেঁচে থাকাটা এমন মহান কিছু হয়ে ওঠে নি। এমনকি উপলব্ধির দিক থেকেও না। বরং দিন শেষে সে পালিয়ে যাচ্ছে বীভৎস এক অতীত পেছনে ফেলে। সেই অতীতে তার আর সব অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, দুঃখ আড়াল হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে নতুন এক পরিচয়। সেই পরিচয়ের নাম কী? খুনি? হৃদিকে খুন করতে চেয়েছিল সে?

অনিক আর ভাবতে চায় না। তারপরও মায়ের কথা মনে পড়ে তার। মনে পড়ে আরও কত কত স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা। সেসব কেন বারবার ফিরে আসে?

ফোনটা হাতে নেয় সে। এখুনি সেটা ছুঁড়ে ফেলবে বুড়িগঙ্গার অতল কালো জলে। কিন্তু তার আগে শেষবারের মতো ফোনের নম্বরগুলো দেখে নেয় সে। ছবি, মেসেজ, আরও কত কী! আচ্ছা, হৃদির কোনো কিছুই কেন এত দিনেও মুছে ফেলে নি সে? এই প্রশ্নের উত্তর জানে না অনিক। নিজেকে এর আগে কখনো জিজ্ঞেসও করে নি। ফলে নতুন করে আর সেসব ভাবতেও চায় না। আর মুহূর্তকাল পরই এই সবকিছু আক্ষরিক অর্থেই বিস্মৃত হয়ে যাবে। কোথাও আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না।

সমস্যা হচ্ছে, ফোনে জমে থাকা স্মৃতি, ছবি, কথা ইচ্ছে হলেই মুছে ফেলা যায়। কিন্তু বুকে জমে থাকা স্মৃতি চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। তিথির ফোনটা এল তখুনি। কী মনে করে ধরল অনিক।

তিথি হড়বড় করে বলল, তুমি কোথায়?

কেন?

জরুরি কথা আছে তোমার সঙ্গে।

কী কথা?

দেখা করে বলব।

অনিক ঠিক জানে না তার ভাবনায় তখন কী কাজ করছিল। কিন্তু সে বিড়বিড় করে তার ঠিকানাটা বলল। তিথি এল ঘণ্টাখানেক পর। এই পুরোটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল অনিক। শূন্য, একা, নিস্তব্ধ। তিথি বলল, এখানে কী করছ তুমি?

অনিক জবাব দিল না। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল সে। খাঁ খাঁ রোদের দুপুর শেষে মেঘলা বিকেল নেমেছে। একটা চিল ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে। তিথি বলল, হৃদিপু আজ ফোন করেছিল।

অনিক তাকিয়ে আছে ব্রিজের তলায় জলের দিকে। সেখানে একদল কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে। তার ওপরে একটা বক। বকটা ইতিউতি কী খুঁজছে। তিথি বলল, আপু তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। রাত থেকে অনেক চেষ্টা করেও নাকি তোমাকে ফোনে। পাচ্ছে না?

অনিক কথা বলল না। তাকালও না তিথির দিকে। তবে সে তার হাতের ফোনটা হঠাৎ ছেড়ে দিল। তারপর গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রইল নিচে। ফোনটা টুপ করে জলের গভীরে গিয়ে পড়ল। তারপর ডুবে যেতে লাগল দ্রুত। তিথি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল।

অনিক বলল, তোর জরুরি কী কথা?

হৃদিপু হঠাৎ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, এটা জরুরি কথা না?

অনিক জবাব দিল না। তিথি বলল, কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন লাগছে কেন?

অনিক হাসল, কেমন লাগছে?

তা জানি না। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার ভয় হচ্ছে।

ভয় হচ্ছে কেন?

তুমি কেমন করে যেন তাকাচ্ছ! এমন কখনো দেখি নি তোমাকে।

অনিক হঠাৎ হাসল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যেতে লাগল দূরে।

৩৪

অবন্তী বলল, তুই আমার ফোন ধরছিস না কেন, রিয়া?

না ধরলে এখন কথা বলছিস কী করে?

তোকে আমি গত এক-দেড় মাসে কম করে হলেও এক শ বার ফোন করেছি।

ওহ্। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল রিয়া।

ওহ্ কী?

খেয়াল করি নি।

খেয়াল করিস নি? এই এত দিনে একবারও খেয়াল করিস নি যে আমি তোকে ফোন করেছি?

বুঝতে পারছি না।

কী হয়েছে তোর?

তাও বুঝতি পারছি না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি মনে হয়। সারাক্ষণ কেমন ঝিমঝিম লাগে।

এখন কী করছিলি?

ঘুমাচ্ছিলাম।

ঘুমাচ্ছিলি? অবাক গলায় বলল অবন্তী। এখন কটা বাজে, জানিস?

না। কটা?

ছটা।

তো ছটা তো ঘুমেরই সময়।

ভোর ছটা না, সন্ধ্যা ছটা।

ওহ। বলে হাই তোলে রিয়া। সন্ধ্যা আর ভোর এখন আমার কাছে একই লাগে।

মানে কী?

মানে বুঝতে পারছি না। সারাক্ষণ খালি ঘুম পায়। আমার মনে হয় কিছু একটা হয়েছে, অবন্তী।

কী হবে?

তা তো জানি না। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

কী কথা?

রিয়া হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে, সিক্রেট। যে কথা যায় না বলা।

না বলা গেলে আমাকে বলবি কেন?

ওল্ড ম্যানকে নিয়ে কথা। তার কথা তুই ছাড়া আর কাকে বলা যায়?

তোর কথা তুই শোন। আমার খবর কিছু রাখিস তুই?

আমার এখন কারও খবরই রাখার সময় নেই গো অবন্তী দেবী। আমি এখন ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো…। বলে হাসে রিয়া। অবন্তী কথা বলে না। চুপ করে থাকে। তবে রিয়াকে তার কেমন অসংলগ্ন মনে হয়ে। রিয়া বলে, তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস? নাকি ওল্ড ম্যানের ওপর? তুই কি এখন আমাদের দুজনের ওপরই বিরক্ত?

আমি বিরক্ত হব কেন?

তোর না কত কত নীতি-গীতি আছে। আমি তো আবার সেই সব নীতি-গীতির ধার ধারি না। তবে ওল্ডম্যান কিন্তু ভালো মানুষ। আর তোকে ভীষণ পছন্দও করেন। বলেন, মেয়েটা এত চুপচাপ, শান্ত। আমাকেও বলেন তোর মতো হতে। হা হা হা। চিন্তা কর, একটা সমুদ্রকে যদি কেউ চুপচাপ গ্লাসে ঢুকে যেতে বলে, তা কি সম্ভব?

অবন্তী কথা বলে না। তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এত দিন ধরে রিয়া তার একটা খোঁজ অবধি নেয় নি। ফোন ধরে নি। আর এখনো কিনা সে তার নিজের এলোমেলো, অসংলগ্ন কথাই বলে যাচ্ছে!

সে কি জানে গত একটা সপ্তাহে কী ঘটে গেছে তার জীবনে? এমন বিভীষিকাময় ঘটনা যে তার জীবনে ঘটতে পারে, এ কথা সে দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবে নি। আতঙ্কে এখনো দুচোখের পাতা পর্যন্ত বন্ধ করতে পারে না অবন্তী।

রিয়া বলল, কী হলো? এমন থম মেরে গেলি কেন?

তুই কি একটু আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবি?

আমি?

হুম।

কোথায়, কবে?

আজই। খালার বাসায়। অবন্তীর গলা থমথমে। ভারী। রিয়া হঠাৎ বলল, এই, কী হয়েছে তোর?

তুই আয়। বলছি।

.

রিয়া এল সন্ধ্যাবেলায়। বাড়ির সামনে পুলিশের গার্ড দেখে অবাক হলো সে। কী হয়েছে এ বাড়িতে? অবন্তীর কিছু হয় নি তো?

অবন্তী অবশ্য রিয়াকে দেখে চমকে গেল। এমন ফ্যাকাশে বিবর্ণ রিয়াকে সে এর আগে কখনো দেখে নি। বলল, এ কী অবস্থা তোর?

কেন?

তোর চেহারার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে শুকনো কাঠ।

রিয়া চোখ টিপে হাসল, জীবন, যৌবন, মৌবন সব তো একজনকে নিঃশেষ করে দিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।

মানে কী?

মানে পরে বলছি। আগে বল তোর কী হয়েছে?

অবন্তী ঘটনা খুলে বলল। শুনে থ হয়ে রইল রিয়া। মুখ থেকে খানিক আগের দুষ্টু-ি মর চিহ্ন দূর হয়ে গেল। বলল, এসব কী বলছিস তুই?

হুম।

এখন? পুলিশ কি তাহলে অনিক নামের ওই লোকটাকে ধরেছে?

এখনো ধরতে পারে নি। তবে খুঁজছে।

ধরতে পারে নি কেন?

সে কোথাও নেই। হঠাত্র যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে সে।

হুম। বলে ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল রিয়া। তোর কী মনে হয়, কাজটা উনিই করেছেন?

জানি না। তবে আমার মনে হয় না উনি এমন কিছু করার মতো মানুষ। আমার বরং মনে হচ্ছে, এখানে অন্য কোনো ঘটনা আছে। তিথির সঙ্গে কথা বলেছি আমি, ওরও ধারণা এই কাজ ওনার না। উনি মানুষ হিসেবে এমন না।

তাহলে?

অবন্তী এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইল সে। রিয়া বলল, উনি যদি না-ই করবেন, তাহলে পালাবেন কেন?

সেটাও একটা প্রশ্ন। হতে পারে পুলিশের ভয়ে।

কিন্তু এটা বোকামি হয়ে গেল না? এখন তো তার ওপর সন্দেহ আরও বাড়বে।

হুম। বলে চুপ করে রইল অবন্তী।

রিয়া বলল, এখন কী করবি?

বুঝতে পারছি না।

পুলিশ কিছুই করতে পারছে না?

ওই তো, বাসার সামনে গার্ড বসিয়েছে। হয়তো দুয়েক দিনের মধ্যে উঠিয়ে নেবে। আর অনিক ভাইকে ধরার চেষ্টা করছে।

আশপাশে সিসি ক্যামেরা ছিল না?

এ বাড়িতে তো নেই। সম্ভবত আশপাশটা ফাঁকা বলে বাইরেও কিছু ছিল না। তারপরও তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো তেমন কিছু ট্রেস করতে পারে নি। তা ছাড়া লোকটার মুখে মাস্কও ছিল।

ওহ্। হতাশ ভঙ্গিতে বলল রিয়া।

তোকে একটা কথা বলা হয় নি।

কী?

গত মাসখানেক ধরে কেউ একজন আমাকে চিঠি লিখছে। বেনামি চিঠি।

কী বলছিস?

হুম।

কী লেখা চিঠিতে?

তেমন কিছু না। এই হাবিজাবি কবিতার লাইন।

অন্য সময় হলে হয়তো এই নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠত রিয়া। কিন্তু আজ তেমন কিছুই করল না। বরং বলল, শুধুই কবিতার লাইন?

হুম।

কী ধরনের কবিতা?

বেশির ভাগই আমার চোখ নিয়ে।

ওহ্। ওই যে একটা ছেলের কথা একবার বলেছিলি, তোদের এলাকার, নামও ভুলে গেছি–ওই ছেলেটা নয় তো?

নাহ্।

তাহলে?

বুঝতে পারছি না। ভাবছি বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত কি না।

অবশ্যই জানানো উচিত। তুই এখনো জানাস নি কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি।

অবন্তী চুপ করে রইল। রিয়া বলল, তা ছাড়া অনিক ছেলেটা যদি আসলেই নির্দোষ হয়ে থাকে, তাহলে সে কেন বিনা কারণে অপরাধী হবে?

অবন্তী এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে বুঝতে পারছে বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত। কিন্তু এই নিয়ে সূক্ষ্ম অথচ তীব্র একটা শঙ্কাও কাজ করছে তার মধ্যে। সে জানে, ঘটনা সেদিকে গেলে এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না।

৩৫

আপনি কি জানেন যে অনিক ঢাকাতে নেই? বললেন আবছার আহমেদ।

তাহলে? কোথায় গিয়েছে সে? বললেন রোখসানা বেগম।

সেটা এখনো জানা যায় নি। আমরা তার ফোন ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারা যায় নি। সে সম্ভবত ফোন বন্ধ করে বা কোথাও ফেলেটেলে দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।

কী বলছেন? তার মানে…। বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন রোখসানা বেগম। আগবাড়িয়ে কিছু বলতে চান না তিনি।

হুম। আমরা যা সন্দেহ করেছিলাম, সম্ভবত তা-ই। না হলে সে আগেভাগেই পালাবে কেন?

রোখসানা বেগম এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আবছার আহমেদ বললেন, আমি আপনার বাসায় এসেছি বিশেষ একটা কারণে।

কী কারণ?

অবন্তী ফোন করেছিলেন।

অবন্তী? কপাল কুঁচকে তাকালেন রোখসানা বেগম। অবন্তী আপনাকে ফোন করেছিল?

হুম।

কেন?

উনি কিছু একটা বলতে চান।

কী?

এখনো জানি না। তবে তার কথা শুনে মনে হলো জরুরি কিছু।

রোখসানা বেগম ঘটনার কিছুই বুঝলেন না। হৃদি গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তেমন কথা হয় নি। কথা হয়েছে তিথির সঙ্গে। তিথিও তাকে পরিষ্কার করে কিছু বলে নি। বিষয়টা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। পরে তিনি হৃদিকে ফোনও করেছিলেন। কিন্তু ধরে নি সে।

আবছার আহমেদ বললেন, আপনি একটু অবন্তীকে ডাকুন, প্লিজ।

অবন্তী এল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। আবছার আহমেদ বললেন, আপনি কি আমার সঙ্গে একা কথা বলতে চান?

না না, সমস্যা নেই। বলল অবন্তী।

আচ্ছা। বলুন।

আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে কথাটা আপনাদের জন্য আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কি না। একবার মনে হচ্ছে হয়তো আপনাদের কাজে লাগবে। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে শুধু শুধু আপনাদের বিরক্ত করছি।

আপনি বলুন।

আমি বেশ কিছুদিন থেকেই বেনামি চিঠি পাচ্ছি।

বেনামি চিঠি? দ্রু কুঁচকে গেল আবছার আহমেদের।

জি।

কী ধরনের চিঠি?

খুব সাধারণ। চিঠিতে তেমন কিছু লেখা নেই। কেবল কবিতার লাইন লেখা থাকে।

কবিতার লাইন!

হুম।

সব চিঠিতেই?

জি।

ইন্টারেস্টিং। বলে পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করলেন আবছার আহমেদ। বললেন, কবিতার লাইনগুলো আপনার মনে আছে?

অবন্তীর এই মুহূর্তে কবিতার লাইনগুলো আর বলতে ইচ্ছে করছে না। তার ধারণা, ওই কবিতার লাইনগুলো সে আর কখনোই মনে করতে পারবে না। বরং ভাবলেই শরীর-মনজুড়ে প্রবল এক আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে। সে ম্লান গলায় বলল, উঁহু। এখন মনে পড়ছে না।

একদম কিছু না?

না।

কিন্তু ওগুলো আমার দরকার।

আমার কাছে এখন নেই।

কোথায় আছে?

ইউনিভার্সিটির হলে। আমার রুমে।

আচ্ছা। আপনি কত দিন ধরে চিঠি পাচ্ছেন?

মাসখানেক হবে। মানে শেষ যেটা পেয়েছিলাম, তখন ও রকমই ছিল। তারপর তো এ বাড়ি থেকে আর হলে যাওয়া হয় নি।

তার মানে এরপর আর এসেছে কি না, আপনি জানেন না?

নাহ।

যেগুলো পেয়েছেন, তার সব কি একই হাতের লেখা?

হুম।

প্রেরকের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছু নেই?

না।

আপনার ইউনিভার্সিটির হলের ঠিকানায় আসে চিঠিগুলো?

জি।

কবিতাগুলোর টপিক কী? মানে স্পেসিফিক কিছু? নাকি র‍্যানডম?

স্পেসিফিক।

কী?

চোখ।

চোখ? আবারও প্রু কোঁচকালেন আবছার আহমেদ। চোখ নিয়ে কবিতা? সবগুলোই?

জি। মানে বেশির ভাগই। তবে দু-একটা অন্য রকমও আছে।

আবছার আহমেদ কথা বললেন না। তিনি স্থির চোখে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। কেউ যদি ওই চোখ দেখে কবিতা লিখে ফেলে, তবে তাকে তো দোষ দেওয়া যায় না।

.

অবন্তীর হলে পরদিন খোঁজ নেওয়া হলো। এ কদিনে আরও তিনটি চিঠি এসেছে। সে চিঠিগুলো খুলল না। বিকেলে আবছার আহমেদ এলেন বাসায়। বললেন, সবগুলো এনেছেন?

জি।

নতুনগুলো এখনো খোলেন নি?

না।

খুলুন, প্লিজ।

অবন্তী খুলল। প্রথম চিঠিতে গোটা গোটা সুন্দর হাতের অক্ষরে লেখা

তোমার চোখ চেয়েছি বলে এমন ডুবল আমার চোখ,
অমন অথই জলে রোজ আমার ডুবসাঁতারটা হোক।
শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমি তোমার হব ঠিক,
তুমি ভীষণ অকূল পাথার, আমি একরোখা নাবিক।

আবছার আহমেদ চিঠিটা হাতে নিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে বোঝার চেষ্টা করলেন এই কবিতা বা হাতের অক্ষরের আড়ালে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে কি না? কিন্তু তেমন কিছুই খুঁজে পেলেন না।

পরের চিঠিটা খুলল অবন্তী। সেখানে লেখা–

শোনো জল ছলছল কাজল চোখের কন্যা সর্বনাশী
আমি তোমায় ভালোবাসি!

পরের চিঠিতেও এমন দুই লাইনের একটা কবিতাই। আবছার আহমেদ একে একে বাকি চিঠিগুলোও দেখলেন। তারপর বললেন, আপনি এত দিন এই চিঠির কথা আমাদের জানান নি কেন?

আমি ভাবি নি এটা তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু হতে পারে।

এখন কেন মনে হলো যে এটা ইম্পর্ট্যান্ট?

বিশেষ কোনো কারণ নেই।

তার মানে আপনি ইচ্ছে করে চিঠির বিষয়টা আমাদের কাছে লুকান নি?

না না। একদমই না। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল অবন্তী।

আবছার আহমেদ কথা বললেন না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চিঠিগুলো আরও একবার খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, কিন্তু অন্য একটা কথা আপনি আমাদের কাছে ইচ্ছে করেই লুকিয়েছিলেন।

আমি! অবাক গলায় বলল অবন্তী।

হুম।

কী?

আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনার সঙ্গে কারও কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে কি না, আপনি বিষয়টা অস্বীকার করেছিলেন।

জি।

কিন্তু কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ।

তাহলে মঈন কে?

এই প্রশ্নে রীতিমতো কেঁপে উঠল অবন্তী। কথা বলল না সে। আবছার আহমেদ বলল, মঈনের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

তেমন কিছু না।

তাহলে সে কেন প্রায় রোজই এসে আপনার হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত? অবন্তী চুপ।

আবছার আহমেদ বললেন, শুধু তা-ই না, আপনি কখন হল থেকে বের হন, কখন আসেন–এই সব খবরও সে হলের দারোয়ানের কাছ থেকে নিয়মিত সংগ্রহ করত। কেন?

এবার সত্যি সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে গেল অবন্তী। আসলেই মঈন এসব নিয়মিত করত? করলে কেন করত? এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও নেই। আবছার আহমেদ বললেন, আমরা আপনার সম্পর্কে অল্পবিস্তর খোঁজখবর নিয়েছি। সেই খোঁজ নিতে গিয়েই জেনেছি যে মঈন ছেলেটার সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক ছিল। আপনারা অনেক আগে থেকেই পূর্বপরিচিত। এমনকি আপনাদের বাড়িও একই জায়গায়। তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার, মঈনের একটা রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এবং সেটি ভালো কিছু নয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি মঈনের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের বিষয়টি কেন লুকালেন?

আসলে আমাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

কেন?

ওনার পলিটিক্যাল নানা ইস্যুর কারণেই। বেশ কিছুদিন আগে একটা বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়। আর এসব কারণে আমার বাড়িতেও তাকে নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছিল।

হুম। বলে চুপ করে রইলেন আবছার আহমেদ। তারপর বললেন, তার মানে সম্পর্কটা আপনার দিক থেকে ক্লোজড হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মঈনের দিক থেকে নয়?

জি।

সে চাইছিল কন্টিনিউ করতে?

হ্যাঁ।

এই নিয়ে আপনাকে উত্ত্যক্ত বা জোর করত? ভয়ভীতি দেখাত কোনোভাবে?

না।

তাহলে সে আপনার হলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত কেন?

আগেরবার এই একই প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে থাকলেও এবার কথা বলল অবন্তী। বলল, কারণ, উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, এটা আমি চাইতাম না।

আপনার সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করেছে সে?

না। তবে আমি করেছি।

আপনি?

হুম। উনি কখনো কিছু করেন নি। বরং চুপচাপ সব শুনতেন। শেষের দিকে আমি ওনার ফোনও ধরতাম না। দেখা হলে কথাও বলতাম না। হয়তো এসব কারণেই।

এসব কারণে কী?

হয়তো এসব কারণেই অন্যদের মাধ্যমে আমার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন।

আপনি জানতেন যে সে আড়াল থেকে আপনার খোঁজখবর নেয়?

সেভাবে জানতাম না। তবে একদিন দেখেছিলাম।

আপনি কারণ জিজ্ঞেস করেন নি?

করেছি। কিন্তু উনি কোনো উত্তর দেন নি।

আবছার আহমেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু অবন্তী, যে যুক্তিতে বা সন্দেহে আমরা এই ঘটনায় অনিককে অভিযুক্ত ভাবছি, ঠিক একই যুক্তিতে কিন্তু মঈনকেও অভিযুক্ত করা যায়। যায় না?

অবন্তী কথা বলল না। তার হঠাই মনে হলো সে যা আশঙ্কা করছিল, পরিস্থিতি এখন সেদিকেই যাচ্ছে।

আবছার আহমেদ বললেন, অনিকের বিরুদ্ধে এর আগে কিন্তু কারও কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু মঈন সম্পর্কে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নানান অভিযোগের তথ্য আমাদের কাছে আছে। ফলে বিষয়টা হালকা করে দেখার সুযোগ আসলে নেই।

বলে খানিক চুপ করে রইলেন আবছার আহমেদ, যেন পরের কথাটা বলার জন্য সময় নিচ্ছেন তিনি। আর অবন্তীর মনোভাব বোঝার চেষ্টার করছেন। অবন্তী অবশ্য কথা বলল না। তবে তার চোখেমুখে একটা স্পষ্ট ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।

আবছার আহমেদ বললেন, আপনি কি জানতেন যে আপনার বান্ধবী রিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল মঈনের?

কী! হতভম্ব চোখে তাকাল অবন্তী। এটা তার কাছে পুরোপুরি অভাবিত এক ব্যাপার।

হুম। শুধু যোগাযোগই নয়, সে নিয়মিত তার ওপরও নজর রাখত। বিষয়টা তার ডিপার্টমেন্টেরও অনেকেই জানে।

অবন্তী রীতিমতো দিশেহারা বোধ করতে লাগল। এসব কথা তো রিয়াও তাকে কখনো বলে নি! সেদিন বাসায় আসার পরও না। অবশ্য রিয়ার বলার কথাও না। সে মঈনকে চেনে না। তা ছাড়া গত মাসখানেকের বেশি সময় ধরে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও হয় নি রিয়ার। কিন্তু মঈন কেন রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিল? বিষয়টা ভারি গোলমেলে ঠেকতে লাগল অবন্তীর। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই পুরো বিষয়টা হঠাৎ করেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে এবং সে নিজেও একটি অজানা আশঙ্কার অনিবার্য অংশ হয়ে উঠছে। অথচ এর কিছুই জানে না সে। মঈন কি জানে?

প্রশ্নটা নিজেকেই নিজে করল অবন্তী। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর মিলল না।

৩৬

রাশু পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। লাল চান বেডিং স্টোরের এক পাশে তোশক বানানোর কাজ চলছে। ফটফট শব্দে তুলো ছাড়ানো হচ্ছে। সেই তুলো ছড়িয়ে পড়ছে।

ঘরজুড়ে। রাশু তার পায়ের আঙুলের ডগায় মেঝেতে পড়ে থাকা তুলোর টুকরোগুলো জড়ো করছে। লাল চান ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, তুই আমার বাপ লাগস। আপনা বাপ। এই আমি তোর পায় ধরতেছি, তুই তাও আমারে সত্য কথা বল। কোরান শরিফ ধইরা বল। জিনিস তোর কাছে আছে। তোর কাছেই আছে, তাই না বাপ?

রাশু কথা বলল না। লাল চান বলল, ওই জিনিসের যদি কিছু হয়, তাইলে আমি শ্যাষ। তুই জামশেদরে চেনস না, সে আমারে জায়গায় খুন করে ফেলবে।

রাশু তাও কথা বলে না। তার দৃষ্টি মেঝেতে। সেখানে ফ্যানের বাতাসে হুটোপুটি খাচ্ছে অজস্র তুলোর টুকরো। লাল চান তার জায়গা ছেড়ে উঠে এল। তারপর হাঁটু ভাঁজ করে বসল রাশুর পায়ের কাছে। বলল, তুই আমার দিকে দেখ। এই যে চাইয়া দেখ, আমার কইলজা দেখা যাইতেছে না? দেখছস, কইলজায় কোনো পানি আছে? নাই। ভয়ে আমার কইলজা শুকাই গেছে। ওই মাল যদি হারায়, আমার কী হইব তুই জানস?

রাশু বসে আছে একটা লালরঙা প্লাস্টিকের টুলের ওপর। তার দুই উরুতে হাত রেখে অসহায় ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছে লাল চান। তার চোখ ফ্যাকাশে। গলার স্বর অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে। চোখেমুখে তীব্র অবিশ্বাস। ভয়। সে প্রায় ফিসফিস করে। বলল, ওই খানকির পোলা, ওই মাদারচোদ্দ… শুয়োরের বাচ্চা, জিনিস তাইলে কই? কই জিনিস?

লাল চানকে হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো মনে হতে লাগল। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আচমকা লাথি বসাল রাশুর কোমরে। রাশু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। লাল চান উঠে গিয়ে তার চোখেমুখে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি বসাতে লাগল। রাশু অবশ্য কিছু বলল না। সে যেমন ছিল তেমনই শুয়ে রইল। মেঝের ঠান্ডা কনকনে শীতল স্পর্শে তার চোখ বুজে আসতে লাগল। সে অবশ্য চোখ বন্ধ করল না। বরং স্থির তাকিয়ে রইল লাল চানের মুখের দিকে। তারপর অকস্মাৎ উঠে বসল।

বলল, জিনিস আমার কাছে নাই।

জিনিস তোর কাছে নাই! যেন আর্তনাদ করে উঠল লাল চান। তোর কাছে থাকব না কেন? আমি নিজে তোর কাছে জিনিস দিয়া গেছি। চারখান ছোট্ট কাঁচের জার। এই মধ্যম আঙুলের সাইজ লম্বা একেকটা। তোর মনে নাই?

রাশু কথা বলল না। লাল চান প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, পুলিশ আমারে তাড়া করল। রাইতের বেলা। জামশেদ স্যার খামার থেকে আমার কাছে দিয়া পাঠাইল। কথা। ছিল আমি চানখারপুলে এক লোকের কাছে দিয়াসবো। কিন্তু পারলাম না। পুলিশ পিছ নিল। তখন তোর কাছে দিয়া বললাম কিছুদিন তোর কাছে রাখ। খবরদার, কেউ যেন। কিছু না জানে। তুই রাখলি। আমি গা ঢাকা দিলাম। আইজ দুই মাস পর আইসা শুনি জিনিস তোর কাছে নাই?

ছিল। কিন্তু এখন নাই।

না থাকলে কই গেছে? তুই নিজে বেইচা দিছস? তোর এত সাহস? কইলজায় ডর নাই তোর?

রাশু আবারও চুপ। লাল চান তার বাহু ধরে ঝাঁকাতে লাগল, তোর এত লোভ? এত লোভ থাকলে আমারে বলতি। আমি যা টাকাপয়সা পাইতাম, তাও তোরে দিয়া দিতাম। কিন্তু এইটা তুই কী করলি? আমার জীবনের উপরে দিয়া খেলাটা খেললি তুই? একবারও আমার কথা ভাবলি না?

আমি জিনিস বেচি নাই।

তাইলে? তাইলে কী করছস তুই?

হারাই ফেলছি।

এবার রীতিমতো চিৎকার করে উঠল লাল চান, তুই আমার লগে দোতারি খেলস? দোতারি খেলস আমার লগে? ওই জিনিস হারায় কেমনে? মিথ্যা কথার আর জায়গা পাস না? বল যে তুই চুরি করছস। নিজে বেচছস। বল?

আমি বেচি নাই।

না বেচলে গেছে কই?

এই প্রশ্নে আবারও চুপ করে রইল রাশু। লাল চান হঠাৎ পাগলের মতো গালির তুবড়ি ছোটাল মুখে। বলল, ওই খানকির পুত। ওই বেশ্যা মাগির পুত। তোর মা বেশ্যা, বেশ্যাখানায় জন্ম তোর। তুই ভালো হবি কেমনে? যার জন্মের ঠিক নাই, তার কথার ঠিক থাকব কেমনে? খানকি মা…।

লাল চান হয়তো আরও কিছু বলত। কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না সে। তার আগেই রাশুর হাতের বিরাশি সিক্কা ওজনের এক চড়ে উল্টে গেল সে। রাশু অবশ্য আর কিছু বলল না। সে শীতল কণ্ঠে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াল মেঝে থেকে। লাল চান হতভম্ব চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেকে সে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে তুলে এনেছিল? এইটুকু এক ছেলেকে? সে আজ তাকে এই প্রতিদান দিল?

রাশু অবশ্য ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও পারল না। ফিরে এসে লাল চানের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর ভারী গলায় বলল, আমি জিনিসের খোঁজে আছি। চেষ্টা করতেছি পাওয়ার।

লাল চান কথা বলল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। রাশুর চোখ লাল। মুখ থমথমে। চোয়াল শক্ত। খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য সে দুঃখিত কি না, বোঝা গেল না।

রাশু শান্ত গলায় বলল, আর…আপনের কিছু হবে না। আমি থাকতে আপনের কেউ কিছু করতে পারব না। শেষ পর্যন্ত যদি মাল না-ই পাই, তাইলে আমি নিজে গিয়া জামশেদ স্যারের কাছে ধরা দিব। বলব, মাল আমি সরাইছি।

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। লাল চান হতভম্ব ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

রাশু অবশ্য তার কথা রাখতে পারল না। লাল চান খুন হয়ে গেল পরদিন মাঝরাতে। তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন জামশেদ। সঙ্গে রাশুকেও। তারা বৈদ্যবেলঘরিয়ার উদ্দেশে রওনা করল রাত দশটার দিকে। তবে ঢাকা থেকে তাদের সঙ্গে আরও একটি ছেলে। গাড়িতে উঠল। ছেলেটির নাম অনিক। সে এখনো জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। মানিকগঞ্জে এক মাছের খামারে তার কাজ করার কথা। তবে তার আসল উদ্দেশ্য কিছুদিনের জন্য সেখানে আত্মগোপনে থাকা।

গাড়িতে লাল চান আর রাশু থম মেরে বসে রইল। তাদের পেছনে বসেছে অনিক। গাড়িতে উঠে দুজনকেই সালাম দিয়েছে সে। কিন্তু তারা কেউ তার সালামের উত্তর দিল না। বরং জামশেদের সামনে গিয়ে কী বলবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে রইল। যদিও জামশেদ এখনো জিনিস হারানোর কথা জানেন না। তিনি জানেন, লাল চানকে পুলিশ সন্দেহ করেছিল। ফলে পিছু নিয়েছিল তার। বাধ্য হয়েই গা ঢাকা দিতে হয়েছিল তাকে। তবে যাওয়ার আগে জিনিসগুলো নিরাপদ স্থানেই রেখে গেছে সে। প্রায় দুই মাস পর ফিরে এসেছে লাল চান। এখন তার সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অনিক জায়গাটা দেখে হকচকিয়ে গেছে। এমন গহিন গোপন জায়গায় কেউ মাছের খামার করতে পারে, এটা তার ধারণা ছিল না। তারা আখখেত পেরিয়ে বড় পুকুরের পাড়ে এসে পৌঁছাল। এখানে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। তবে তাতে আঁধার না কেটে বরং একটা গা-ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে। পুকুরের ওপরই বাঁশ দিয়ে তৈরি একখানা টংঘর। এ ছাড়া আশপাশে কিছু চোখে পড়ল না অনিকের। এখানে সে থাকবে কোথায় তাহলে? ওই টংঘরে?

হঠাই পুরো বিষয়টা তার কাছে ভয়ংকর মনে হতে লাগল। সেই ভয় আরও বাড়ল যখন তারা বড় পুকুরটা পার হয়ে জঙ্গলের কাছে এসে দাঁড়াল। ভেতর থেকে সামান্য। আলোর আভাস এলেও ভয়ে অনিকের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।

জামশেদ অবশ্য অনিককে খেয়াল করলেন না। হয়তো তার কথা মনেও নেই তার। মাহমুদ হাসান তার দীর্ঘদিনের বন্ধু। গত রাতে তিনি হঠাত্র ফোন করে ছেলেটার কথা বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল জামশেদের। ছেলেটাকে যেহেতু পুলিশ খুঁজছে, সেহেতু চট করে আর এখান থেকে কোথাও চলে যেতে পারবে না সে। এমনকি অবাধ্যও হতে পারবে না। ফলে তাকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগানো যাবে। তা ছাড়া দুয়েকজন বাধ্যগত, বিশ্বস্ত লোক তার দরকার। এই ছেলেটা হয়তো দারুণ কাজে লেগে যাবে।

কিন্তু বিষের জারগুলোর চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকা জামশেদ যেন অনিকের কথা বেমালুম ভুলেই গেলেন। এমনকি লাল চান আর রাশুর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়ানো অনিককে খেয়ালও করলেন না তিনি।

লাল চান বলল, কেমন আছেন, স্যার?

আমি তোমার ওপর খুবই বিরক্ত, লাল চান।

জি স্যার।

জি স্যার বললে হবে না। তুমি এত দিন ধরে কাজ করো কিন্তু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারো না? পুলিশ কীভাবে তোমাকে সন্দেহ করে?

ওই সময়েই স্যার ঢাকায় কাদের জানি দুইটা চালান ধরা পড়ছে। একটাতে নাকি পঁচাত্তর কোটি টাকার সাপের বিষ ছিল। এই জন্য পুলিশ খুব সতর্ক হয়ে গেছে।

হুম। বলে চুপ করে রইলেন জামশেদ। তারপর বললেন, কই? জিনিস কই? আনছ? তোমারে দিয়ে আর এই চালান পাঠাব না। এবার কাজ করবে রাশু।

লাল চান এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।

জামশেদ বললেন, কই? জিনিস বের করো? দেখি কী অবস্থায় আছে। কাঁচের জার। যদিও পোক্ত আছে। বিদেশ থেকে আনা। তারপরও খুব সাবধান। জায়গা বেজায়গায় রাখলে কিন্তু ভেঙে যেতে পারে। আর এক ফোঁটা বিষের দাম জানো?

লাল চান এবারও কথা বলল না। জামশেদের হঠাৎ কী হলো, তিনি তার হাতের টর্চ দিয়ে লাল চানের মুখে আলো ফেললেন। তারপর বললেন, কই? জিনিস বের করছ না কেন? তোমার সঙ্গে তো কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছি না? রাশুর কাছেও না। ঘটনা কী?

স্যার। কাঁপা গলায় বলল লাল চান। একটু সমস্যা হয়ে গেছে।

সমস্যা? কী সমস্যা?

লাল চান কী বলবে ভেবে পেল না। সে জানে না কথাটা বলার পর কী হবে। রাশু অবশ্য তাকে বলতেও দিল না। সে হেঁটে লাল চানের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, স্যার, একটা ভুল হয়ে গেছে।

কী ভুল?

ভুলটা লাল চান চাচার না, আমার। জিনিসগুলা আমি হারাই…।

জামশেদ আচমকা স্থির হয়ে গেলেন। তিনি রাশুর কথা শেষ করতে দিলেন না। ঠান্ডা গলায় বললেন, তুই আমার সামনে থেকে সর, রাশু।

রাশু সরল না। জামশেদ বললেন, রাশু…যা বলার লাল চানকে বলতে দে। আমি তারে জিনিস দিছি। তোকে না।

রাশু তাও সরল না। চোখের পলকে জামশেদের হাতে পিস্তল উঠে এল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কপালের শিরা দপদপ করে কাঁপছে। তিনি হিসহিসে গলায় বললেন, লোভ খুব খারাপ জিনিস, রাশু। মিথ্যা কথাও। সর আমার সামনে থেকে, সর।

রাশু তাও সরল না। জামশেদ আচমকা রাশুর মুখে আঘাত করলেন। চকিতে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল রাশু। কিন্তু পারল না। শেষ মুহূর্তে তার কপালের বাঁ দিকে আঘাতটা লাগল। দরদর করে রক্ত ছুটতে লাগল ক্ষতস্থান থেকে। লাল চান হঠাৎ ছুটে গিয়ে জামশেদের পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। জামশেদ অবশ্য কিছু বললেন না। স্থির, নিষ্কম্প চোখে কেবল তাকিয়ে রইলেন।

জামশেদ কান্নাজড়ানো গলায় কী কী সব বলার চেষ্টা করলেন। সেসবের বেশির ভাগই অবশ্য শোনা গেল না। তবে রাতের ওই নিস্তব্ধতায় গুলির শব্দটা বড় কানে বাজল। লাল চান কাত হয়ে পড়ে গেল ডোবার দিকটায়। তার কপালে তৈরি হওয়া ছোট্ট গর্তটা বেয়ে রক্তের একটা স্রোত বেরিয়ে এল। তবে জামশেদ সেদিকে খেয়াল করলেন না। তিনি পা দিয়ে ঠেলে তার নিথর শরীরটা ডোবার ভেতর ফেলে দিলেন। রাশুর বিমূঢ় অবস্থা তখনো কাটে নি। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আসলেই সত্যি! সে পৃথিবীর সকল অবিশ্বাস নিয়ে অন্ধকারে ডোবাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ডোবার ভেতরে ততক্ষণে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে রাক্ষুসে জীব যেন রক্তমাংসের গন্ধে উন্মাদ হয়ে গেছে। লাল চানের মৃত শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। রাশু চুপচাপ তাদের সেই উন্মত্ততার শব্দ শুনতে লাগল। অন্ধকারে তার চোখ জোড়া শূন্য, নিষ্প্রাণ, জলহীন।

তার পেছনে তখন আরও একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। বিবশ, বিমূঢ়, নির্বাক। মানুষটার নাম অনিক। সে জানে না এতক্ষণ ধরে সে তার চোখের সামনে যা দেখেছে, তা সত্যি কি না। সে হঠাৎ হড়বড় করে বমি করে দিল। তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

বিস্মিত জামশেদ আলো ফেললেন সেখানে। প্রথমে খানিক দ্বিধান্বিত হলেও মুহূর্তেই সামলে নিলেন নিজেকে। অনিকের কথা হঠাৎ মনে পড়েছে তার। ভালোই হয়েছে। আজকের এই মুহূর্তের কথা এই জীবনে আর কখনো ভুলতে পারবে না সে। বেরও হতে পারবে না এই ভয়াবহ আতঙ্ক থেকে।

জামশেদের হঠাৎ মনে হলো, এই ছেলেকে তিনি আগে থেকেই চেনেন। দেখেছেন কোথাও। কিন্তু কোথায় দেখেছেন, সেটি এই মুহূর্তে চট করে মনে করতে পারছেন না।

৩৭

সুমির খুব ইচ্ছে ছিল বাসাটা নতুন করে সাজাবে। নিজের মনের মতো করে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করাবে। বাথরুমগুলো ভেঙে বড় করতে হবে। দুটো রুমের দেয়াল সরিয়ে এদিক-সেদিক করতে হবে। রান্নাঘরটা পুরোপুরি ভেঙে সাজাতে হবে। এমন নানা বিষয়। মাহমুদের অবশ্য এ নিয়ে আগ্রহ নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই সব পরিকল্পনা করেছিল সুমি নিজে। অ্যাডভান্স টাকাও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইন্টেরিয়রের লোকদের। কাজের ডেটও ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল বেশ আগে।

কিন্তু কাজ শুরুর মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই সুমি সিদ্ধান্ত নিল যে সে আর এই বাসায় থাকবে না। নির্দিষ্ট করে বললে মাহমুদ হাসানের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না সে। এর আগেও অল্পবিস্তর নানান ঘটনা ঘটেছে। তবে সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল সে। কিন্তু এবারকার ঘটনা গুরুতর।

মাহমুদ বহুমুখী মানুষ। সৃষ্টিশীল, মেধাবী। এই বয়সেও দেখতে যথেষ্ট আকর্ষণীয় তিনি। ফলে তার আশপাশে মেয়েদের আনাগোনা সব সময়ই ছিল। কিন্তু তাতে সুমির প্রতি ভালোবাসার অভাব কখনো দেখা যায় নি। বরং দীর্ঘ এই বিবাহিত জীবনে তারা সুখী, ঝামেলাহীন দাম্পত্যই কাটিয়েছেন। সেখানে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অনাকাক্ষিত ঢেউ যে আসে নি, তা নয়। কিন্তু তাতে মাহমুদের চেয়েও অন্য প্রান্তের নারীটির ভূমিকাই যেন ছিল বেশি।

ফলে, সেসব নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্যও করে নি সুমি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে একই ঘটনা বারবার ঘটেছে। বিষয়টা প্রথম প্রথম গুরুত্ব না দিলেও একটা সময় গিয়ে সচকিত হয়ে উঠল সে। প্রথম দিন বাসায় ফিরে বাথরুমের আয়নায় একটা টিপ দেখতে পেয়ে থমকে গিয়েছিল। সাধারণত টিপ পরে না সে। তাহলে? এই টিপটা এখানে এল কী করে? প্রশ্নটা মাথায় খচখচ করতে থাকলেও মাহমুদকে কিছু বলল না। বলল না ঘরের বিছানা-বালিশে একটা অপরিচিত প্রসাধনী, সুগন্ধির অস্তিত্ব টের পাওয়ার পরও। হতে পারে এটা তার মনের ভুল!

নাকি আসলেই অন্য কিছু?

বিষয়টা নিয়ে একটা অস্বস্তিকর দ্বিধাদ্বন্দ্বেই সময় কেটে যেতে লাগল সুমির। কিন্তু ঘটনা ঘটতে থাকল নিয়মিতই। দিনের বেলায় বাসাটা সাধারণত ফাঁকাই থাকে। স্থায়ী কোনো কাজের বুয়া নেই তাদের। খুব ভোরে আর সন্ধ্যার দিকে এসে কিছু কাজ করে দিয়ে চলে যায় ছুটা বুয়া। জিতুও দিনের বেলাটা তার ক্লাস, কোচিং, স্পোর্টস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফলে এই সময়টা মোটামুটি নিরাপদই।

সেদিন বাইরে থেকে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থমকে গেল সুমি। এক জোড়া অপরিচিত জুতো সেখানে। ঘরে ঢুকে কথাটা মাহমুদকে বললও সে। মাহমুদ অবশ্য গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, পাশের ফ্ল্যাটের কারও হবে হয়তো। কিংবা কেউ হয়তো তোমার জুতা বদলে ওটা রেখে গেছে।

ঘটনা দেখা গেল আসলেই তাই। সুমির এক জোড়া জুতো নেই। বিষয়টা সুমি এবং মাহমুদ দুজনকেই অস্বস্তিতে ফেললেও তারা কেউ আর সেটি নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলল না।

তবে মাহমুদ পরদিন রিয়াকে ঘটনাটা বললেন। রিয়া স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসল। বলল, সুমি সেদিন দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে বলে তুমি হঠাৎ আমাকে যেভাবে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে, তাতে যে আমি তোমার বাসায় আমার আন্ডারগার্মেন্টস ফেলে রেখে আসি নি, তা-ই ঢের।

কিন্তু আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত, রিয়া।

তোমারও হওয়া উচিত। মাহমুদকে আজকাল তুমি করেই বলে রিয়া।

আমি আবার কী করলাম?

কী জানি কী করেছ? তোমার বাসায় গেলেই আমার কেমন ঝিমঝিম লাগে। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। মনে হয় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। বাসায় আসা যাওয়ার পরও ওই ঘোর কাটে না। দেখা গেল কোনো দিন এমন হবে যে তোমার বিছানায় এমনভাবে ঘুমিয়ে গেছি যে সুমি এসে ডেকেও আমাকে ওঠাতে পারছে না।

এটা একদমই হাসিঠাট্টার বিষয় নয়, রিয়া।

সরি। বলে যেন খানিক সিরিয়াস হলো রিয়া। বলল, এর পর থেকে সতর্ক থাকব।

কিন্তু যত সতর্কই তারা থাক, বিষয়টা যেন ক্রমশ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে লাগল। মাহমুদের কোনো অনুরোধ কিংবা বিধিনিষেধকেই আর গ্রাহ্য করতে চায় না রিয়া। তার সারাক্ষণই কেবল মনে হয়, ওই মানুষটার সঙ্গে আরও খানিকটা সময় যদি সে থাকতে পারত, আরও খানিকটা স্পর্শ, অনুভব তার দরকার। ব্যাপারটা যেন নেশার মতো হয়ে গেছে তার কাছে।

মাহমুদ নিজেও যে পুরোপুরি কঠোর হতে পারেন, তা নয়। বরং রিয়ার এই প্রগল্‌ভতা, বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস, বেপরোয়া সর্বগ্রাসী ভালোবাসা তাকে এই বয়সেও যেন নতুন করে জীবনের আস্বাদ দিতে থাকে। ফলে যতবার তিনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে এবারই শেষ, এরপর আর কখনোই রিয়াকে বাসায় আসতে বলবেন না, যোগাযোগ কমিয়ে দেবেন কিংবা সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে ফেলবেন, ততবারই তার বুকের ভেতরটা অদ্ভুত, অব্যাখ্যেয় এক শূন্যতায় ভরে ওঠে। তীব্র এক হাহাকার তাকে এলোমেলো করে দিতে থাকে। ওই হাহাকার থেকে আর মুক্তি মেলে না তার।

সুমি অবশ্য একদিন সরাসরিই জিজ্ঞেস করল, বাসায় কি কেউ এসেছিল, মাহমুদ?

কে আসবে?

তোমার কাছে আসার লোকের অভাব আছে?

ওহ্। তা কতজনই তো আসে। শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুরা।

ছাত্রীরা আসে না?

এটা কেন জিজ্ঞেস করছ? ছাত্রছাত্রী কি আলাদা কিছু?

আলাদা না?

না।

আচ্ছা। বলে মাহমুদের সামনে গোলাপি রঙের একটা চুল বাঁধার রাবার ব্যান্ড ছুঁড়ে দিল সুমি। বলল, ছাত্ররা তো আর বাসায় এসে তাদের চুলের ব্যান্ড, আন্ডারগার্মেন্টস রেখে যেতে পারে না। ছাত্রীরা পারে।

সুমির কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন মাহমুদ। বললেন, এটা কেমন কথা?

সুমি অবশ্য তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ঠান্ডা গলায় বলল, কেন? খারাপ কী বলেছি? চুড়ি, টিপ, রাবার ব্যান্ডের মতোই ওগুলোও তো পোশাকই। এগুলো রেখে যেতে পারলে ওগুলো কেন পারবে না? একদিন হয়তো ওগুলোও রেখে যাবে।

মাহমুদ যেন এই কথায় একটু মিইয়ে গেলেন। তিনি রাবার ব্যান্ডটা হাতে নিয়ে বললেন, এটা কার?

আমার যে নয়, তা তো আমি জানি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল সুমি।

কাজের মেয়েটার হতে পারে।

ওটা কাজের মেয়ে না। মহিলা। তার মাথায় এসব জিনিস কখনো দেখেছ?

মাহমুদ থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি এটা অবশ্য খেয়াল করেন নি। সুমি বলল, তোমার ছাত্ররা বোধ করি টিপ পরে না। এই যে এটা আমাদের বাথরুমের আয়নায় পেলাম। আর এই যে একগাছি চুড়িও আছে। আর কাঁচের ভাঙা কয়েকটা টুকরো খাটের তলায় পড়ে ছিল। দেয়ালের দিক দিয়ে।

মাহমুদ কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তবে তাদের সম্পর্কের শীতলতা সেই শুরু। মাহমুদ নানাভাবে চেষ্টা করেছেন বিষয়টা স্বাভাবিক করতে। কিন্তু সুমি যেন ভেতরে ভেতরে ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকল। কিছু না বললেও তার আচরণে সেটি স্পষ্টই প্রতিভাত হচ্ছিল। যদিও তখনো সিরিয়াস কোনো সিদ্ধান্ত সে নেয় নি। সেই সিদ্ধান্তটা এল আরও বেশ কিছু মাস পরে।

সেদিন সুমির কলেজে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছিল। দুই শিফটের পরীক্ষা নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তার। ড্রাইভারকেও সেভাবেই বলে দেওয়া আছে। বিকেলের দিকে কলেজে গিয়ে ম্যাডামকে নিয়ে আসবে সে। সুযোগটা হারাতে চাইলেন না মাহমুদ। সুমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় চলে এল রিয়া। পুরো একটা দিনের জন্য তারা নিশ্চিন্ত। ড্রাইভার না যাওয়া পর্যন্ত সুমি আসতেও পারবে না। ফলে তার অপ্রত্যাশিত আগমনের আশঙ্কাও নেই। কিন্তু ঘটনা ঘটল তেমনই।

ঠিক দুপুরবেলা বাসার কলিং বেল বাজল। হতভম্ব মাহমুদ কি-হোলে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সুমি। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না। রিয়া অবশ্য ভদ্র মেয়ের মতো ড্রয়িংরুমে এসে বসল। তারপর চারপাশে বই-খাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্টের কাজ করতে বসে গেল। তার ভাবখানা এমন যে জটিল, দুর্বোধ্য কোনো টপিক বুঝতে না পেরে সে স্যারের বাসায় এসেছে।

মাহমুদ দরজা খুলে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাসলেন। বললেন, তুমি? শরীর খারাপ নাকি?

সুমি কথা বলল না। রিয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। আগের সেই উদ্ধত, দুর্বিনীত ভাবটা আর দেখাল না সে। বরং উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, মালিকুম ম্যাম।

সুমি বলল, ওয়ালাইকুম সালাম।

কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো। আপনি?

রিয়া একটু অবাকই হলো। সুমি কেন তাকে আপনি করে বলছে? সম্ভবত আগেরবারের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে সে।

রিয়া বলল, জি ভালো।

চা খাবেন? শান্ত গলায় বলল সুমি।

প্রশ্নটা শুনে মাহমুদ ও রিয়া, দুজনই ভারি অবাক হলো। সুমির কাছ থেকে এমন আচরণ তারা আশা করে নি। সেটি স্বাভাবিকও নয়।

রিয়া বিড়বিড় করে বলল, না না। আমি এখুনি চলে যাব। একটা জরুরি বিষয় বুঝতে না পেরে এসেছিলাম। কালই টপিকটার ওপর পরীক্ষা।

না না, চা বানিয়ে আনছি। খেয়ে যান।

সুমি চা বানিয়ে আনল। তারপর রিয়াকে পাশে বসিয়ে চা খাওয়াল। মাহমুদ রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে তাদের সামনে বসে রইলেন। চা খাওয়া শেষে রিয়া বলল, আমি তাহলে আজ যাই, ম্যাম?

এখুনি যাবেন কি? বসুন, আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি?

তারা গল্প করতে বসলেও কেউ যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। যেন সকলেই বুঝতে পারছিল তাদের পরস্পরের মনের কথা। রিয়া যাওয়ার আগে সুমি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। তারপর আচমকাই দরজার সঙ্গে চেপে ধরল তাকে। তারপর মাথা ঠুকে দিতে লাগল দেয়ালে। একবার, দুবার, তিনবার। মাহমুদ ছুটে এসে সুমিকে। ঠেকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পুরোপুরি পারলেন না। রিয়ার কপালে, মুখে থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন। এখানে-সেখানে রক্ত জমে গেছে। এই সুমিকে এর আগে কখনো দেখেন নি মাহমুদ। যেন সাক্ষাৎ উন্মাদিনী সে। হাতের কাছে থাকা চায়ের কাপটা হঠাৎ মাহমুদের মুখে ছুঁড়ে মারল সে। তবে কাপটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। একটুর জন্য এড়িয়ে যেতে পারলেন মাহমুদ।

সুমি সেদিনই বাসা ছেড়ে চলে গেল। মাহমুদ অবশ্য হাল ছাড়লেন না। পরদিনই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু সুমিকে আর কিছুতেই বোঝানো সম্ভব হলো না। সে আর এলই না। মাহমুদ ভগ্নমনোরথে বাসায় ফিরে এলেন। দিন দুই থাকলেন। একা একাই। তারপর একদিন রিয়াকে ফোন করে ডাকলেন। ওই দিনের ঘটনার পর আর রিয়ার সঙ্গে কথা হয় নি তার। তা ছাড়া বিষয়টা এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে। ফলে এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলাও জরুরি। রিয়া অবশ্য সেদিন এল না। এল পরদিন। তার মুখের আঘাতগুলো বীভৎসভাবে ফুটে উঠেছে। ছটফটে, উচ্ছল মেয়েটা মাত্র কয়েক দিনেই যেন শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে। মাহমুদ তাকে যতটা সম্ভব বোঝালেন। রিয়া অবশ্য কথা বলল না। চুপচাপ শুনল। তারপর চলে গেল সে। এল পরদিন বিকেলে। তারপর আবার পরদিন। মাহমুদের স্টাডিরুমেই সময় কাটতে লাগল। মাহমুদ তাকে নানা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন পুরোপুরি নিস্তেজ, নির্জীব হয়ে গেল সে।

আশ্চর্য বিষয় হলো, এরপর আর রিয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। কোথাও না। যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল সে।

৩৮

হৃদির কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। থুতনির কাছেও আঘাতের চিহ্ন। নেহাল অবশ্য তাতে দমল না। সে তার কোমর বরাবর লাথি বসাল। হৃদি ছিটকে পড়ল বিছানায়। নেহাল ছুটে গিয়ে তার মাথা চেপে ধরল। তারপর হিসহিসে গলায় বলল, আর কখনো ঢুকবি ওই ঘরে? ঢুকবি আর কখনো?

হৃদি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, না।

এর আগেও বলেছিলি ঢুকবি না। তারপরও কেন ঢুকলি?

আমি বুঝি নি।

কী বুঝিস নি?

আমি বুঝি নি যে এভিলিন ওখানে আছে।

এভিলিন না থাকলেও ঢুকবি না। ফের ওখানে ঢুকলে আমি তোকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলব। বুঝেছিস?

হৃদি মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে। তার সামনে সোফায় যে মেয়েটা বসে আছে, তার চুল সোনালি। লম্বা নাক। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। ঈষৎ নীল চোখ। সচরাচর এমন সুন্দর মেয়ে দেখা যায় না। মেয়েটি কথা বলে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। তবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না হৃদির। যদিও সে এখন আর কিছুই বুঝতে চায় না। দেখতেও চায় না কিছু। যা যা দেখার, বোঝার, তা কয়েক মাসেই বুঝে গেছে সে।

নেহাল যে মৃত এভিলিনের কথা বলেছিল, সে এখন তার সামনে বসে আছে। অপূর্ব রূপবতী এক মেয়ে। কিন্তু এই জীবনে এমন নৃশংস, বিকৃত মানসিকতার মানুষ। আর দেখে নি সে।

নেহাল এভিলিনের দিকে তাকাল, একে নিয়ে তো ভারি যন্ত্রণায় পড়া গেল। কী করব এখন?

এভিলিনের ঠোঁটে সিগারেট। সে বৃত্তাকারে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, তুমি কি বাংলাদেশে বিয়ে করতে গিয়েছিল?

নেহাল হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, এই এক কথা আর কতবার বলব? না।

তাহলে?

তাহলে আর কী! স্নেক ভেনমের প্রজেক্ট আর লংটার্ম প্ল্যানিংগুলো দেখতে।

আর?

আর…ওখানে স্নেক ভেনম থেকে ড্রাগস ও মেডিকেল রিলেটেড এক্সপেরিমেন্টগুলো ঠিক করতে।

কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্টে বসে এত এত বছর ধরে এত কিছু প্ল্যান করলে, অথচ কখনো আমাকে কিছু বললেও না?

নেহাল একটু থমকাল। তারপর বলল, ওই সময়টার কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে?

হুম, আছে। গম্ভীর গলায় বলল এভিলিন। আই ওয়াজ আউট অব এভরিথিং। ইন আ ডিপ ডার্কনেস।

নেহাল খানিক চুপ করে রইল। তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, মাদক নিয়ে আমারও বিচিত্র ধরনের এক্সপেরিমেন্ট আছে। নিয়েছিও। কিন্তু এটা আমাকে যতটা আরও মাদক নিতে অ্যাডভেঞ্চারাস করেছে, তার চেয়েও বেশি করেছে ইনোভেশনে। আমি কখনোই তোমার মতো পুরোপুরি ডুবে যাই নি। নিয়ন্ত্রণহীন হই নি।

এভিলিন কথা বলল না। সে জানে, নেশার যে অতল অন্ধকারে সে ডুবে গিয়েছিল, তা থেকে এখনো পুরোপুরি বের হতে পারে নি। বরং সুদীর্ঘ চিকিৎসায় প্রায় মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেও ওই ঘোর এখনো কাটাতে পারে নি সে।

নেহাল বলল, বেশ কয়েক বছর আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউনিভার্সিটিতেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ইন্টারেস্টিং একটা বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তার কারণেই চট করে চিন্তাটা মাথায় আসে।

কী চিন্তা? থমথমে মুখে বলল এভিলিন।

বলছি। কিন্তু তার আগে বলো, তুমি কি তত দিনে সেই অবস্থাতে ছিলে যে আমি বিষয়টা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব?

এভিলিন কথা বলল না। বছরের পর বছর বিচিত্র সব মাদক সে গ্রহণ করেছে। সেই মাদক ধীরে ধীরে তাকে তার বাস্তব পৃথিবী থেকে উধাও করে দিয়েছিল। ডুবিয়ে দিয়েছিল ভয়াল এক নেশার জগতে। সেই নেশা থেকে আর বের হতে পারছিল না সে। তবে মাস ছয়েক হলো দীর্ঘ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষে আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। সে। কিন্তু এ কদিনে এভিলিনকে যতটুকু দেখেছে নেহাল, তাতে তার মনে হয়ে নি যে আসলেই কোনো লাভ হবে। বরং একটু একটু করে যেন আবারও পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে শুরু করেছে এভিলিন।

নেহাল বলল, ফ্রাঙ্কফুর্টে তখন একদল তরুণকে মাদক গ্রহণের দায়ে আটক করেছিল পুলিশ। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, তাদের মাদকে সাপের বিষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

আমি নিতে পারব? উষ্ণ গলায় বলল এভিলিন। আই ওয়ান্ট টু গেট দ্যাট এক্সপেরিয়েন্স!

ওয়েট। আমাকে আগে শেষ করতে দাও। তখনই ইউনিভার্সিটিতে ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় আমার। তিনি আমাকে এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দেন। ফলে বিষয়টা নিয়ে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠি আমি। পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি আঠারো শতকের দিকে নেশা হিসেবে চীনে আফিমের ব্যবহার ভয়াবহ রকম বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষ সেখানে এত আফিম গ্রহণ করত যে একটা সময় গিয়ে আফিমের নেশা আর তাদের ওপর কাজ করত না। তাদের নার্ভ তখন এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল যে আরও কড়া নেশার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময়ে চীনা রাজকর্মচারীরা ভয়ংকর এক কাজ করতে শুরু করে।

সাপের বিষের নেশা করতে শুরু করে?

হুম। আফিমের সঙ্গে সাপের বিষ ব্যবহার করে নেশা করার চেষ্টা করে তারা।

ইন্টারেস্টিং। ঠোঁট গোল করে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল এভিলিন।

ইন্টারেস্টিং হলেও ব্যাপারটা বিপজ্জনক। কারণ, কী পরিমাণ সাপের বিষ নেশায় ব্যবহার করা যাবে, এটা তারা জানত না। ফলে বেশির ভাগ মানুষই মারা যেত। কারণ, এটা খুব সেন্সিটিভ এবং বিপজ্জনক ড্রাগ। একটু এদিক-সেদিক হলেই সব শেষ। আসলে একেক সাপের বিষ একেক রকম। কিছু বিষ হেমোটক্সিক–এটা রক্তে ক্ষতিকর। প্রভাব ফেলে। কিছু মায়োটক্সিক–পেশির ক্ষতি করে। আর কিছু হচ্ছে নিউরোটক্সিক– এটা স্নায়ু বা মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে। নেশায় মূলত এটারই ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে এটা আলাদা করার ব্যাপার থাকে। আবার এগুলো কিন্তু সরাসরি শরীরে নেওয়াও যায় না। অন্য কোনো মাদকের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। তবে এর পরিমাণ নির্ধারণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ খুবই কঠিন। স্পর্শকাতর। আমি একটা প্রতিবেদনে দেখলাম, এক শ লিটার মদে মাত্র অল্প কয়েক গ্রাম ফ্রিজ ড্রাইড স্নেক ভেনম গুঁড়ো করে ইউজ করলেই সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ নেশার কাজ করে। মাত্র কয়েক গ্রাম। সো, বুঝতেই পারছ, এর বাজারমূল্য কী অস্বাভাবিক বেশি হতে পারে?

হুম। কপাল কুঁচকে বলল এভিলিন।

বাংলাদেশে তখন সাপের বিষ পাচারের প্রচুর ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসতে শুরু করেছে। ধরাও পড়েছে কোটি কোটি টাকার বিষ। এখনো হচ্ছে। সব মিলিয়ে আইডিয়াটা মাথায় আসে আমার। এখানে যে কাজটা কঠিন, সেটা হয়তো বাংলাদেশে তুলনামূলক সহজ হতে পারে। কনভেনিয়েন্টও। দেন, উই স্টার্টেড দ্য প্রজেক্ট।

কিন্তু তুমি সেদিন বলেছিলে, হৃদির বাবাকে তুমি গিনিপিগ বানাতে চাইছিলে? তার ওপর কিছু একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলে?

হুম। সেটাও একটা চিন্তা ছিল। হয়তো ছেলেমানুষি চিন্তা। বাট, আমি ওটাও ভাবছিলাম। আমি আসলে কেবল মাদক রিলেটেড ইমপ্যাক্টই না, একই সঙ্গে ওষুধে এটার প্রভাবটাও এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু আমার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এই রিলেটেড, আর এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে, এমন মানুষের সঙ্গেও তত দিনে আমার পরিচয় হয়েছে…।

বলে থামল নেহাল। হৃদিকে ছুঁড়ে দিল দেয়ালের দিকে। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে সোফায় এসে এভিলিনের মুখোমুখি বসল। বলল, ধরো, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হলো থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বাঁধা। তো ফ্রাঙ্কফুর্টেরই একজন জীবরসায়নবিদ ইয়োহনেস এব্লের। উনি বলেন যে সাপের বিষেই আছে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের ওষুধ, যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি রোধে কাজ করবে। কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্ট অত্যন্ত বিপজ্জনকও। কারণ, সাপের বিষে রয়েছে নানা ধরনের হাজার হাজার মলিকিউল বা অণু। এদের থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল আলাদা করা সহজ নয়। এটা খুঁজে বের করাও দীর্ঘ গবেষণার কাজ। যেহেতু তারা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন, সো, মোটামুটি একটা বেজ রেডিই ছিল। সো, উই স্টার্টেড। আর আমার চিন্তা ছিল এমন যে–এটা হলে হবে, না হলে নাই। কারণ, সাপের বিষ উৎপাদন আর পাচার তো আমরা করবই। আর সেটা থেকে বিশাল অঙ্কের টাকাও আসবে। অর্থনৈতিকভাবে বিরাট লাভের ব্যাপার। ফলে একই সঙ্গে দুটো কাজই শুরু করি আমরা। একদিকে মাদক ও ওষুধ তৈরির এক্সপেরিমেন্ট, অন্যদিকে স্নেক ভেনম পাচার।

হুইই! বলে অদ্ভুত শব্দে উল্লাস প্রকাশ করল এভিলিন। ইউ আর অ্যাম্বিশিয়াস। অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাজ ওয়েল। কিন্তু…। বলে থামল সে। তারপর চোখ নাচিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল, কিন্তু… তারপর তুমি সেখান থেকে ফিরলে বিয়ে করে বউ নিয়ে! টোটাল ব্যাপারটাই ফানি হয়ে গেল না?

হয়তো। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি যে হৃদির ওপর আমার একটা দুর্বলতা ছিল। একটা ভালো লাগাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট টাইপ। তা ছাড়া মা-বাবাও চাইতেন যে আমি বাঙালি কোনো মেয়েকেই বিয়ে করি। তো সেটাও একটা কারণ ছিল। তবে এর সঙ্গে তাৎক্ষণিক অন্য একটা চিন্তাও মাথায় আসে।

এভিলিন হাসল। মৃদু, মাপা হাসি। বলল, পৃথিবীর সব দেশের পুরুষের জাতই আসলে ওই এক। তারা প্রাণী হিসেবে মাংসাশী। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী মাংসই তাদের সবচেয়ে প্রিয়।

উফ! হতাশ ভঙ্গিতে বলল নেহাল। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে একটা বিয়ের প্রোগ্রামে। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। সেখানে ওর মায়ের সঙ্গেও কথা হয়। আর তখন একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও ঘটে।

কী?

কথা প্রসঙ্গেই ওর বাবার অসুখ সম্পর্কে জানতে পারি আমি। রক্তে জন্মগতভাবেই সমস্যাটা ছিল তার। জমাট বেঁধে যাচ্ছিল রক্ত। বিষয়টা কাকতালীয় হলেও সত্য যে আমি এমন কারও ওপরই স্নেক ভেনম থেকে বানানো ওষুধটার ইমপ্যাক্ট দেখতে চাইছিলাম। এটা নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের কারোরই হিউম্যান বডিতে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ হয়েছিল কি না, আমি জানি না। কারণ, এই এক্সপেরিমেন্ট নিষিদ্ধ। ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু আমার মনে হলো, আমার একটা সুযোগ আছে। কেউ বুঝতেও পারবে না। ও রকম সহজ সুযোগ আর কোথায় পেতাম আমি?

হুম। বলে নেহালের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল এভিলিন। বলল, তারপর এই বাঙালি ললনার প্রেমে পড়ে গেলে?

হুম। ঠোঁট চেপে বলল নেহাল।

তো প্রেমিকার বাবাকে কেউ গিনিপিগ বানায়?

এ ছাড়া আর কী করতে পারতাম আমি? এই সুযোগ কি আর কোথাও পেতাম? ওনার রক্তে জমাট বাধার কারণে ছোট-বড় বেশ কয়েকটা স্ট্রোকও হয়েছিল। ফলে শরীরের কিছু অংশ অসাড়ও হয়ে গিয়েছিল। সব শুনে চট করেই বুদ্ধিটা মাথায় চলে এল। কিন্তু ওনার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তো আমার ছিল না। ছিল? আমার তো পুরো এক্সপেরিমেন্টটা চালাতে দীর্ঘ একটা সময় দরকার ছিল। তার সুবিধা, অসুবিধা, নানান কন্ডিশন বোঝ। অবজার্ভ করা। তাই না?

এ কারণেই তুমি ওকে বিয়ে করতে চাইলে?

ঠিক এ কারণেই না, ওকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। সঙ্গে এটাও যুক্ত হয়। তবে পরে একটা জেদও কাজ করছিল।

জেদ! অবাক গলায় বলে এভিলিন।

হুম।

কী জেদ?

শি রিফিউজড মি।

হোয়াট! বিস্মিত কণ্ঠে বলল এভিলিন।

শি রিফিউজড ইউ?

হুম। বিষয়টা আমি নিতে পারি নি। তুমি তো আমাকে চেনেনা। খুব ইগো হার্ট হয়েছিল আমার। ফলে একটা সময় ব্যাপারটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জও হয়ে দাঁড়ায়। তুমি জানো, চ্যালেঞ্জ নিতে আমার ভালো লাগে। আর আমি তা জিততেও চাই।

তা শেষ পর্যন্ত কী মনে হয়? জিতেছ?

এই প্রশ্নে চুপ করে গেল নেহাল। সে বাংলাদেশে যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিল, তা এখনো সফল হয় নি। মাঝখান থেকে বরং হৃদির ব্যাপারটা তাকে বেশ খানিকটা এল পিছিয়েই দিয়েছে। তার এখন সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছে, পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় দুর্বলতা আর নেই। কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।

নেহাল ভেবেছিল মাসখানেক এখানে থেকেই হৃদিকে নিয়ে আবার দেশে ফিরে যাবে। তারপর নির্বিঘ্নে নিজের বাকি কাজগুলো শেষ করবে সে। কিন্তু আপাতত সেটি আর হচ্ছে না। আসার কিছুদিনের মধ্যেই অঘটনটা ঘটে গেল। নেহালের আই প্যাডে থাকা একটা ছবি দেখে চমকে গেল হৃদি। ঠিক এই ছবিটাই বছরখানেক আগে অনিকের ফোনে দেখেছিল সে। সেই একই ছবি নেহালের কাছে এল কী করে? এতটা অবাক আর কখনো হয় নি হৃদি। ফলে বিষয়টা জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠল সে।

নেহালকে কিছু না বললেও পরে গোপনে ছবিটা দেখতে গিয়ে গা শিউরে উঠল হৃদির। ছবিটা অনিকের বাবা শাখাওয়াত হোসেনের। জামশেদ নামের একজন নেহালকে মেইল করে লিখেছে, কী করব এখন? এই লোক আমাদের ট্র্যাফিকিংয়ে কিছুদিন হলো কাজ শুরু করেছে। ইমার্জেন্সি অল্টারনেটিভ হিসেবে। বাট হি ইজ বিট্রেয়িং।

জবাবে নেহাল লিখেছে, সিদ্ধান্ত আপনার। কিন্তু মনে রাখবেন, নেভার লিভ ইয়োর ট্রায়াল ইন হাইডিং। লুকাতে গিয়ে কখনো পথের চিহ্ন রাখা যাবে না।

হৃদির চোখের সামনের পৃথিবীটা মুহূর্তেই যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল তার। কাঁদলও সে। কিন্তু এই বিদেশ বিভুঁইয়ে তার সেই কান্না শুনবে কে? আর এই কথা তো সে কাউকে বলতেও পারবে না। না মা, বাবা, তিথি। কিংবা অন্য কাউকে। বাবা তো নেই-ই। আর অনিককে তো সে নিজে তার জীবন থেকে সমাধিস্থ করে রেখে এসেছে। তাহলে?

তারপরও অনিককেই ফোনটা করল সে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। কোনোভাবেই পাওয়া গেল না তাকে। তিথিকে ফোনে পাওয়া গেলেও নেহালকে নিয়ে এই কথা বলতে পারল না সে। মা শুনে কী করবে? তার চেয়ে যেকোনোভাবেই হোক, আগে দেশে ফিরে আসতে হবে তাকে। তত দিনে অবশ্য বাড়িতে ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা করবে বলে হৃদিকে কেউ কিছু জানাল না।

সমস্যা হলো, হৃদি যে এর মধ্যেই নেহাল সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে, সেটা প্রকাশিত হয়ে গেল হঠাত্ব এবং সেই দোষটা হৃদিরই। বার্লিনের বাসায় পা দিয়েই সবকিছু কেমন অস্বাভাবিক লাগতে লাগল হৃদির। নেহাল এখানে তার বাবা-মার সঙ্গে থাকে না। আলাদা বাসা আছে তার। সেই বাসায় কিছুদিন পরই এক মেয়ে এসে উঠল।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মেয়েটির নাম এভিলিন।

এই এভিলিনকে নিয়েই কি হৃদির কাছে গল্প ফেঁদেছিল নেহাল? হৃদি জানে না। তবে সে তত দিনে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই নেহাল সেই মানুষটি নয়, যার জন্য সে সব ছেড়েছিল। এ অন্য এক মানুষ। ভয়ংকর, অননুমেয়, নিষ্ঠুর। নিজের ইচ্ছে পূরণে সে অনমনীয়, সর্বগ্রাসী। যে নেহালকে সে ভালোবেসেছিল, সে কেবল এক ভ্রমের নাম।

ভুলে হোক কিংবা ইচ্ছে করে, নেহাল নিজেই হৃদির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল। ভালো বন্ধু হলেও নানা কারণেই দীর্ঘদিন তাদের যোগাযোগ ছিল না। হাসপাতালেও ভর্তি থাকতে হয়েছিল এভিলিনকে। হৃদি অবশ্য কিছুই বলল না। সব জেনেবুঝেও না বোঝার ভান ধরে চুপ করে রইল সে।

এভিলিন আসতে থাকল নিয়মিতই। যেন এই ঘর, বাড়ি, বিছানা-বালিশ সবকিছুতেই তার অবাধ অধিকার। হৃদির সঙ্গে অবশ্য খুব একটা কথা বলে না সে। সারা দিন গুম হয়ে থাকে কোনার ওই ছোট্ট অন্ধকার ঘরখানায়। সেদিন নেহাল বাসায় ছিল না। সন্ধ্যার দিকে হৃদি চুপি চুপি এভিলিনের ঘরটায় ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝল মেয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটা নীল মৃদু আলো জ্বলছিল ঘরে। সেই আলোতে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে শুয়ে ছিল সে। তার পাশে নানা রকম কৌটা। তাতে ছড়ানো-ছিটানো ওষুধ। কতগুলো সিরিঞ্জ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘর। বিকট দুর্গন্ধ। সব মিলিয়ে গা গুলিয়ে, উঠেছিল হৃদির।

নেহাল ফিরেছিল একটু রাত করেই। তবে হৃদি তাকে কিছু বলল না। তত দিনে যা বোঝার বুঝে গেছে সে। পরদিন অবশ্য জরুরি কাজের কথা বলে এভিলিনকে নিয়ে বের হলো নেহাল। ফিরল সন্ধ্যায়। কিন্তু ঘরে ঢুকে হৃদির সঙ্গে কোনো কথা বলল না। কেমন গম্ভীর, থমথমে হয়ে রইল। বিষয়টা খুব অস্বস্তি দিতে লাগল হৃদিকে। কোনো ঝামেলা হয় নি তো?

পরিস্থিতি বোঝার জন্যই কথাটা জিজ্ঞেস করল সে, কী হয়েছে?

নেহাল হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। প্রথম বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল না সে। ফিরেও তাকাল না। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, ইউ চিটেড অন মি।

হোয়াট? অবাক গলায় বলল হৃদি। কী করেছি আমি?

তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ।

মিথ্যে? হৃদির বুক কেঁপে উঠল।

ইউ চিট…!

মানে কী, নেহাল? নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল হৃদি।

মানে…। বলে থামল নেহাল। তারপর শীতল কণ্ঠে বলল, তোমার দুবছরের বেশি আগে বিয়ে হয়েছিল। কোর্ট ম্যারেজ। হাউ ইউ হাইড ইট ফ্রম মি?

হৃদি হঠাৎ থমকে গেল। এই আশঙ্কাটাই করছিল সে। কিন্তু খবরটা এত দ্রুত নেহালের কাছে পৌঁছাল কী করে? দেশের থানা-পুলিশের ঘটনা তখনো জানে না সে।

নেহাল বলল, আমার তো মানুষ চিনতে সহজে ভুল হয় না। তাহলে তোমাকে চিনতে ভুল হলো কীভাবে?

হৃদি চুপ করে রইল।

নেহাল বলল, আমার নিজেকে বোকা বোকা লাগছে, হৃদি। কারও কাছে বোকা হতে আমার একদম ভালো লাগে না। একদম ভালো লাগে না।

হৃদি বুঝতে পারছিল না সে কী বলবে। তবে এত বড় ঘটনার পরও নেহালের এমন শান্ত, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তাকে অবাক করছিল।

কিন্তু নেহাল হঠাৎ পাগলের মতো মাথা নাড়াতে লাগল। আর বলতে লাগল, কেউ আমাকে বোকা বানাতে পারে না। কেউ না। কেউ না। আই অ্যাম নট আ ফুল। ননা ওয়ান মেড মি…। নো ওয়ান।

হঠাই যেন উন্মাদনা ভর করতে লাগল তার ওপর। সে থক করে এক দলা থুতু ফেলল। তারপর বলল, এত নোংরা, জঘন্য একটা মানুষ তুই। নিজেকে ঘেন্না লাগে না তোর? বমি পায় না?

কথাটা খুব গায়ে লাগল হৃদির। নিজের সম্পর্কে এমন কথা কেউ বলতে পারে, এটা কখনো ভাবে নি সে। নেহাল এক পা এগিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলল, ইউ বিচ। স্লট। ইউ ব্লাডি হোর।

কী বললে তুমি আমাকে! কী বললে? হৃদি যেন হঠাৎ নিজের স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভুলে গেল। এত জঘন্য কথা কেউ আর কখনো বলে নি তাকে। সে-ও এগিয়ে এল নেহালের দিকে।

নেহাল খপ করে তার চুলের মুঠি ধরে ফেলল। তারপর বলল, ইউ ব্লাডি হোর। ইউ আর আ প্রস…! তোকে আমি রাস্তার কুত্তা…। বাকিটুকু শেষ করতে পারল না নেহাল। তার আগেই উন্মাদের মতো নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে এল হৃদি। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। এলোপাতাড়ি হাত-পা চালাতে লাগাল। নেহাল ধাক্কা দিয়ে তাকে বিছানায় ফেলে দিল। বলল, তোর মতো মেয়ে, স্রেফ টাকার জন্য নিজের হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স দিয়ে…।

হৃদি এবার ফুঁসে উঠল। বলল, আর একটা বাজে কথা আমাকে নিয়ে বলবে না তুমি। একটাও না।

নেহাল হাসল। ঠান্ডা ক্রুর হাসি। কেন? বললে কী করবি? বেশ্যাকে বেশ্যা বলা। যাবে না? তুই তো একটা রাস্তার মাগি। মাগিকে মাগি বলা যাবে না?

হৃদি এক ঝটকায় উঠে বসল। তারপর বলল, তুই কত সাধু, তা-ও আমি জানি। সব জানি আমি…সব। আই নো এভরিথিং। আই নো হু একচুয়ালি ইউ আর! নিজেকে আর সামলাতে পারল না সে। কিন্তু তার ওই একমুহূর্তের ক্রোধ, রাগ আর নিয়ন্ত্রণহীনতাই তাকে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করাল। গত কয়েক মাসে সে

নেহাল সম্পর্কে যা যা জেনেছে, তা একের পর এক বলে যেতে লাগল। যা জানে নি, তা-ও অনুমানে বলতে লাগল। হতভম্ব, ক্রুদ্ধ নেহাল যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। তারপর আচমকা লাথি বসাল হৃদির কোমর বরাবর। হৃদি ছিটকে পড়ল মেঝেতে। নেহাল তার মাথা চেপে ধরে বলল, ইউ নো এভরিথিং। এভরিথিং অ্যাবাউট মি? বলে বীভৎস ভঙ্গিতে হাসল সে। তারপর বলল, ইউ নো নাথিং অ্যাবাউট মি। নাথিং। আই উইল লেট ইউ নো মেনি মোর থিংস। মেনি মোর থিংস। কাম অন…।

শুরু হলো হৃদির জীবনের ভয়াবহ এক অধ্যায়। এই অধ্যায়ের যবনিকা কিসে, হৃদি তা জানে না। হয়তো জানে না নেহালও।

৩৯

আবছার আহমেদ অবন্তীকে থানায় ডেকেছেন। অবন্তী বলল, আমার সঙ্গে রিয়ার শেষ কথা হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে।

কী কথা হয়েছিল?

ওই চিঠির বিষয়েই।

তাকে দেখে কী মনে হয়েছিল, স্বাভাবিক, নাকি কিছু নিয়ে ভীত ছিলেন তিনি?

না। তেমন কিছু না। তবে…।

তবে কী?

ও যেন একটু কেমন হয়ে যাচ্ছিল। আগের সেই ছটফটে ভাবটা আর ছিল না।

আপনাকে মঈন সম্পর্কে কিছু বলেছিল সে?

না।

মঈন যে তার বাসায় গিয়েছিল, এটা সে বলেছিল?

মঈন ভাই রিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন? কী বলছেন আপনি? কেন? অবাক গলায় বলল অবন্তী।

হুম। বলে থামলেন আবছার আহমেদ। তারপর বললেন, মঈনের সঙ্গে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছিল তার।

কী ঝামেলা?

সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে মঈন তাকে দীর্ঘদিন থেকেই অনুসরণ করত এবং একদিন সে সরাসরি রিয়াদের বাসার গেটে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে তীব্র কথা কাটাকাটি হয় তাদের। মঈন একপর্যায়ে রিয়াকে আঘাত করে বসেছিল।

এসব কী বলছেন আপনি?

হুম। রিয়ার মুখে কিছু আঘাতের চিহ্নও ছিল এবং এর কয়েক দিন পরই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় রিয়া।

অবন্তীর মাথা ঝিমঝিম করছে। কান বেয়ে যেন উঠে আসছে উষ্ণ হাওয়া। সে দিশেহারা গলায় বলল, মঈন ভাই এখন কই?

তাকে আজ ভোররাতেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

অবন্তী আর বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। সে বুঝতে পারছে না তার আশপাশে এসব কী হচ্ছে। আবছার আহমেদ বললেন, সে এখনো তেমন কিছুই স্বীকার করে নি রিয়ার ওপর নজর রাখার ওই ঘটনা ছাড়া। তবে আমরা আশা করছি, শীঘ্রই সে আমাদের সব বলবে।

আপনাদের ধারণা মঈন ভাই রিয়ার কোনো ক্ষতি করেছে?

সেটা এখুনি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ কি আছে?

কিন্তু মঈন ভাই কেন এটা করবে?

সে বারবার একটি কথাই বলছে যে আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করতে পেরে রিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সে। তার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, যাতে মঈনের হয়ে রিয়া আপনাকে বোঝায়। কিন্তু রিয়া তাকে সেই সুযোগটাই দেয় নি। এমনকি কোনো কথাই বলতে চায় নি সে!

কিন্তু এই জন্য মঈন ভাই রিয়াদের বাসায় গিয়ে তাকে…।

সে বলছে ওটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। মুহূর্তের উত্তেজনায় হয়ে গেছে। কারণ, রিয়া তার সঙ্গে প্রতিবারই খুব বাজে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সে তারপরও কিছুতেই নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারছিল না। তার ধারণা ছিল, রিয়া যদি একবার তার সব কথা মন দিয়ে শোনে, তাহলে রিয়া কোনো না কোনোভাবে আপনাকে বোঝাতেই পারবে। এই কারণেই অত কিছুর পরও রিয়ার পেছনে লেগে ছিল সে। কিন্তু রিয়া ওই দিন। এতটাই বাজে ব্যবহার করেছিল যে আর নিজেকে সামলাতে পারে নি সে।

আপনাদের কী মনে হচ্ছে?

হতে পারে মঈনের কথাই সত্যি। কিন্তু…।

কিন্তু কী?

মুহূর্তের উত্তেজনায় যদি সে কোনো মেয়েকে আঘাত করতে পারে, তবে সেই মুহূর্তের উত্তেজনায় অন্য কিছুও ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু না।

অন্য কিছু কী? শঙ্কিত কণ্ঠে বলল অবন্তী।

খুন!

খুন? আর্তনাদ করে উঠল অবন্তী।

না মানে আমি আশঙ্কার কথা বলছি। এমন তো হতেই পারে, তাই না? আমাদের কাছে যত খুনের কেস আসে, তার সবই যে খুনি ইচ্ছে করেই করেছে, তা কিন্তু নয়। অনেক খুনই কিন্তু আছে যে ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে। মঈনের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে। কিংবা না-ও হতে পারে। অন্য কিছুও হতে পারে।

অন্য কী হতে পারে? অবন্তী ফ্যাকাশে গলায় বলল।

একটা মেয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ কী কী হতে পারে? খুন, গুম, রেপ-এই তো?

অবন্তী আর কিছু বলতে পারল না। তার মাথা কাজ করছে না। চারপাশের পৃথিবীটা যেন বনবন করে ঘুরছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মঈন এমন কিছু করতে পারে। কিন্তু সে যে দীর্ঘদিন ধরেই রিয়াকে অনুসরণ করছিল, তা তো মিথ্যে নয়! রিয়াকে আঘাত করেছিল, তা-ও না। তাহলে?

কিন্তু এসব কেন করতে গেল সে? এই প্রশ্নে এসেই থমকে গেল অবন্তী। তার হঠাৎই নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগতে লাগল। মনে হতে লাগল, এসবের জন্য। আসলে সে নিজেই দায়ী। তার কারণে আজ সবকিছু এ রকম হয়ে গেছে। এমনকি মঈনও। কেবল তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, তার হঠাৎ এমন বদলে যাওয়ার কারণটা জানার জন্যই মঈন এমন বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। সে যদি কারণটা মঈনকে খুলে বলত, তাহলে আর এই সব কিছু হতো না। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল অবন্তীর। কিন্তু মঈন কি সেই সত্যিটা নিতে পারত? অসহ্য যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েও যে ভয়াল সত্যিটা সে নিজের ভেতর পুষে রেখেছে? প্রতিমুহূর্তে ছাইচাপা আগুনে পুড়ে গেছে। পারত মঈন সেই সত্যিটা মেনে নিতে?

অবন্তী ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আর কোনো কিছুই গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। রিয়ার জন্য তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে মঈনের জন্যও। অথচ এই দুজন মানুষই এখন পরস্পরের জন্য ভয়াল এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে এখন কী করবে?

অবন্তী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কিন্তু একটা কথা।

কী কথা? বললেন আবছার আহমেদ।

সেদিন রাতে তাহলে কে আমাকে গুলি করেছিল? মঈন?

আবছার আহমেদ এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।

অবন্তী বলল, যেই মানুষটা আমার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য, যোগাযোগ করার জন্য, আমাকে একটু বোঝানোর জন্য এত কিছু করেছে, সেই মানুষটাই আবার আমাকে খুন করার জন্য রাতের অন্ধকারে গুলি করবে, এটা আপনার বিশ্বাস হয়?

আবছার আহমেদ কথা বললেন না। এটা তারও বিশ্বাস হয় না। তিনি বললেন, আপনি তো আবার বাসা থেকে হলে উঠে গেছেন?

জি। কিছুদিন হলো। আসলে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।

কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

না।

আচ্ছা। বলে চুপ করে রইলেন আবছার আহমেদ। তারপর হঠাই প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আর ওই চিঠিগুলো পাচ্ছেন?

অবন্তী আচমকা থমকে গেল। বলল, না।

আবছার আহমেদ কথা বললেন না। তবে তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *