২০. নেহাল যেদিন চলে গেল

২০

নেহাল যেদিন চলে গেল, সেদিন ঠিক সন্ধেবেলা হৃদি দাঁড়িয়ে ছিল ছাদে। তার মাথার ওপর দিয়ে মেঘের আড়ালে হারিয়ে যেতে যেতেও উড়োজাহাজটা ডানা দেখিয়ে গেল। খানিক কান স্তব্ধ করে দিয়ে একটা বিদঘুঁটে শব্দ ছড়িয়ে গেল। সেই শব্দ ক্রমশই হৃদির বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে লাগল তীব্র হাহাকার। অন্তহীন শূন্যতার অনুভব। ওই মেঘের ফাঁকে উঁকি দেওয়া ডানা জোড়া যেন পাখির ডানা হয়ে ঝাঁপটাতে লাগল বুকের ভেতর। হৃদির আচমকা মনে হলো সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা চিনচিন করে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার শরীরজুড়ে। এমন কখনো হয়?

হৃদি বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ সময়। যেন নিজেকে স্থির করতে চাইছে সে। নেহাল চলে গেছে সেই কখন, ভোরবেলা। অথচ একটা আস্ত দিন পেরিয়ে এই সন্ধ্যাবেলাও আকাশে কোনো এক নাম না-জানা গন্তব্যের উড়োজাহাজ দেখে তার বুক কেন এমন ভার হয়ে রইবে? এ কেমন কথা? এমন কি আর কখনো হয়েছিল তার?

অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না হৃদি। সে মোটেও এমন এলোমেলো হতে চায় না। এমন অস্থির, বুকভার হতে চায় না। কিন্তু তার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু হলো না। বরং তার পরের কটা দিন একটা মুহূর্তও আর স্বস্তি পেল না সে। সারাক্ষণ নিজের ঘরে থম মেরে বসে রইল। তিথি এল, তোর কী হয়েছে, আপু?

কী হবে?

এই যে সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকিস। ঘর থেকে বের হোস না। কারও সঙ্গে কথা বলিস না। ইউনিভার্সিটিতে যাস না।

হৃদির একবার মনে হলো সে বাবার কথাটা বলে। এই তো মাত্র কিছুদিন হলো বাবা মারা গেলেন। তার মৃত্যুশোক কি এত দ্রুতই সবাই কাটিয়ে উঠেছে? কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজের কাছে নিজে খুঁজতে গিয়েই অবাক হয়েছে! খানিক লজ্জিতও বোধ করেছে। বাবার জন্য তার দুঃখানুভূতি যে কম কিছু, তা নয়। কিন্তু সেই বিষাদিত অনুভবে তীব্রতা নিয়ে এসেছে নেহালের অনুপস্থিতি। যে কটা দিন সে পাশে ছিল, মনে হয়েছে কেউ একজন আছে, যে তাকে প্রবল শীতেও খানিক উত্তাপ দিতে পারে। ভয়ংকর অসহায়ত্বেও নির্ভরতা দিতে পারে। কিন্তু সেটি নেহাল থাকতে সে যতটা না উপলব্ধি করেছে, চলে যাওয়ার পর তা উপলব্ধি করছে তার সহস্রগুণ বেশি।

তিথি বলল, তোর কি অনিক ভাইয়ার সঙ্গে কিছু হয়েছে?

নাহ্। কী হবে?

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ভাইয়ার সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে তোর?

কেন এমন মনে হলো?

এই যে এত দিন হয়ে গেল, এত কিছু হলো, অথচ তুই একবারও ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলি না। তোর ফোনও দেখি বেশির ভাগ সময় বন্ধই থাকে।

তাতে কী?

না, তেমন কিছু না। আমি ভাইয়াকে একদিন ফোন করেছিলাম। কিন্তু উনিও ঠিকভাবে কথা বললেন না। মনে হলো কিছু একটা নিয়ে খুব আপসেট।

তুই ফোন করেছিলি কেন?

এমনি।

এমনি এমনি তোর অনিককে ফোন করার দরকার নেই।

কথাটার মধ্যে কিছু একটা ছিল। শুনে হৃদি থমকে গেল। বলল, তুই সত্যি করে বল তো আপু, অনিক ভাইয়ার সঙ্গে তোর কী হয়েছে?

কিছু হয় নি।

তাহলে?

তাহলে সবকিছুই হঠাৎ এমন কেন মনে হচ্ছে?

সব বুঝে তোর কাজ নেই। আর এটা নিয়ে তুই আমার সঙ্গে যেমন আর কখনো কথা বলবি না, তেমনি অনিকের সঙ্গেও না। ক্লিয়ার?

তিথি মাথা নাড়ল। তবে বিষয়টা মাথা থেকে তাড়াতে পারল না সে। তার কেবলই মনে হতে লাগল, কোথাও কিছু একটা ঝামেলা আছে এবং সেটা হৃদির দিক থেকেই। অনিককে সে যতটুকু চেনে, সে মুখচোরা প্রকৃতির মানুষ। কোনো কিছু নিয়েই অভিযোগ নেই তার। প্রবল ভালোবাসলেও যেমন সেটি তাকে দেখে বোঝা যায় না, তেমনি প্রবল অভিযোগ কিংবা ঘৃণা থাকলেও না।

নেহালের সঙ্গে হৃদির সম্পর্কটাও তিথির চোখ এড়ায় নি। বিষয়টি নিয়ে রোখসানা বেগম ভারি খুশি। বার কয়েক তিথির সঙ্গে এই নিয়ে কথাও বলেছেন তিনি। তিথি অবশ্য খুব একটা পাত্তা দেয় নি। বলেছে, আপু এখন মানসিকভাবে প্রচণ্ড খারাপ অবস্থায় আছে। এই জন্য এমন হচ্ছে।

এই সময়েই মানুষ কারও প্রতি সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়।

কিন্তু সে তো একজনের প্রতি দুর্বল আছেই।

আমি মা যেমন, তেমনি মেয়েও তো, নাকি?

তিথি হাসল, এটা কী ধরনের কথা? মেয়ে না হলে কি কেউ মা হতে পারে?

সেটা না। একজন মেয়ে হিসেবে তোদের এই বয়সটা তো আমিও পার করে এসেছি, তাই না?

হুম।

তো আমি চোখ দেখলেই বুঝতে পারি হৃদির ভেতরে কী চলছে?

তাহলে এক কাজ করো না কেন?

কী কাজ?

রাস্তায় একটা টিয়াপাখি নিয়ে বসে যাও। মানুষ টিয়াপাখি দেখে ভাগ্য গণনা করাতে আসবে। আর তুমি তাদের চোখ দেখেই সব বলে দেবে। কয়েক দিনের মধ্যেই তোমার নাম ছড়িয়ে পড়বে। আয়রোজগারও ভালোই হবে। রোখসানা বেগম অনেক কষ্টেও নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলেন না। বললেন, এই ধরনের কথা আর কোনো দিন আমার সামনে বলবি না। আমার কখনো চিন্তায়ই ছিল না যে আমার পেটে এ রকম বেয়াদব জন্মাবে।

সরি মা। বলল তিথি। তবে তার আচরণ দেখে মনে হলো না যে সে সত্যি সত্যিই দুঃখিত অনুভব করছে। রোখসানা বেগম বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে বললেন, আমার ধারণা, নেহালের প্রতি হৃদির মনোভাব পাল্টেছে।

কিন্তু মা…। বলে আবার চুপ করে গেল তিথি। রোখসানা বেগম বললেন, বল।

না মানে…। দুদিনের মধ্যেই অনিক ভাইয়ার সঙ্গে আপুর এত দিনের সম্পর্কটা নাই হয়ে যাবে?

যাবে। যায়ও। মানুষের এর চেয়েও ঘনিষ্ঠ, এর চেয়েও দীর্ঘদিনের সম্পর্ক হঠাৎ নাই হয়ে যায়। বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরও। আর ওদের তো একটু চেনাজানা, প্রেম। এ এমন কিছু না। আর আমার মেয়েকে আমি চিনব না?

কিন্তু আপু যে বলল অনিক ভাইয়াকে ও বিয়ে করেছে?

তুই এটা বিশ্বাস করিস?

ও তো বলল! তারপরও করব না?

না, করবি না।

কেন?

কারণ, এটা ও সত্যি বলে নি। মিথ্যে বলেছে। নেহালের সঙ্গে ওর বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য বলেছে।

কিন্তু যদি সত্যি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে?

এই কথায় রোখসানা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে হৃদি সত্যি সত্যিই কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে একা একা বিয়ে করে ফেলতে পারে। সেই দিনের ছোট্ট সেই হৃদি, সে অল্পতেই রেগে যায়। কাঁদে। হাসে। খানিক বেপরোয়া এবং খেয়ালিও। কিন্তু তাই বলে কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলার মতো সাহস তার হতে পারে, এটা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না।

নেহালের সঙ্গে হৃদির এখনকার যে বোঝাপড়া, যে পারস্পরিক সংযোগ, তা তিনি দূর থেকেই টের পান এবং বুঝতে পারেন, এই সম্পর্ক একটা পরিণতির দিকে যাওয়ার জন্য অবচেতনেই উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু হৃদি যদি সত্যি সত্যিই অনিককে বিয়ে করে। থাকে, তাহলে?

.

হৃদি অবশ্য এত কিছু ভাবে না। তার ভাবনার জগজুড়ে কেবলই নেহাল। একটা মানুষ এমন কী করে হয়! এত অসাধারণ হয়েও এত সাধারণ! আচরণে, ভাবনায়, অনুভবে কী আশ্চর্য গভীর আর স্বচ্ছ! কী আলগোছে বুকের ভেতর মানুষের জন্য মায়া পুষে রাখে সযত্নে, অথচ প্রয়োজন না হলে প্রকাশ করে না। বরং দূর থেকে চুপচাপ দেখে যায়। আবার প্রয়োজন হলেই কোন অদৃশ্য থেকে চোখের পলকে ছুটে এসে চট করে দুয়ারে দাঁড়ায়। তারপর অপেক্ষায় থাকে ঝড়-ঝঞ্ঝায় বুক পেতে দিতে।

এভিলিনের কথাও মনে পড়ে তার। কী সৌভাগ্যই না ছিল মেয়েটার! এমন একটা মানুষের ভালোবাসা সে পেয়েছে। কে জানে, হয়তো মৃত্যুর ওপার থেকেও এখনো সে ঠিক ঠিক নেহালের এই তীব্র ভালোবাসাটা টের পায়। অনুভব করে। আচ্ছা, এই যে নেহাল সেদিন তাকে ভালোবাসি বলে ওভাবে জড়িয়ে ধরল, সেই ভালোবাসা কি এভিলিনকে ভালোবাসার মতোই?

এই প্রশ্নটাও নিজেকে করেছে হৃদি। করেছে নেহালকেও। নেহাল চলে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই তার পুরো পৃথিবী যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন অনন্তকাল। কবে আসবে সে? আজকাল নেহালের সঙ্গে তার ইন্টারনেটে কথা হয়। সেই সব কথার বেশির ভাগেই থাকে নেহালের বাবা, মা। তার ফিরে আসার কথা। মাঝখানে নেহালের মায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে। অপারেশনের পর অনেকটাই সুস্থ তিনি। কী সুন্দর করে কথা বলেন। যেন ব্যক্তিত্ব ঠিকরে পড়ে প্রতিটি শব্দে।

হৃদির মাঝে মাঝে মনে হয়, যে পরিচিত, অভ্যস্ত জগতে এত দিন তার বিচরণ ছিল, সেই জগৎ, জগতের মানুষেরা ভীষণ ম্লান, বিষাদিত। কিন্তু নেহালের ওই জগৎটা

যেন ভোরের ঝলমলে আলোর মতো প্রাণবন্ত। ঝরনার জলের মতো উচ্ছল।

এভিলিনকে নিয়ে প্রশ্নটা করতেই নেহাল হেসেছে। বলেছে, আমি যদি তোমাকে এভিলিনের মতো ভালোবাসি, তা কি তোমার ভালো লাগবে?

প্রশ্নটা বুঝতে পারে নি হৃদি। সে চুপ করে ছিল। নেহাল বলল, শোনো, পৃথিবীতে কেউ কারও জায়গা কখনো নিতে পারে না। অনুভূতিও না। ধরো, তুমি যদি কখনো না থাকো, তাহলে তিথিকে কি মা তোমার মতো করে ভালোবাসবেন বা তোমার ভালোবাসাটাও কি তাকে দেবেন? নাকি তিথিকে ভালোবাসবেন তিথির মতো করেই?

ওখানে কোন ভালোবাসাটা শক্তিশালী, তিথিকে তিথির মতো করে ভালোবাসা না। তোমার মতো করে?

এই প্রসঙ্গে কথাটা খুব ভালোভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারলেও হৃদির হঠাৎ মনে হলো, সে আসলে চায় না যে নেহাল তাকে এভিলিনের মতো ভালোবাসুক। সে বরং চায় নেহাল তাকে তার মতোই ভালোবাসবে। এমনকি এভিলিনের সঙ্গে তার কোনো তুলনায়ও সে যেতে চায় না।

কথাটা নেহালও বলল, আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি, অতটা ভালো এই জগতে আর কেউ কখনো তোমাকে বাসে নি। বলে খানিক চুপ করে রইল সে। তারপর বলল, তোমাকে একটা কথা বলি, হৃদি?

হুঁ।

ভালোবাসার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মেছি। কিন্তু জীবনভর সত্যিকারের মানুষটাকেই কেবল খুঁজেছি। একজনকে পেয়েও হারিয়েছি। তবে ভুল মানুষকে কখনোই ভালোবাসতে চাই নি। তুমি আমার ভুল মানুষ নও। ফলে এই জীবনে আর যা-ই হোক, অন্তত ভালোবাসা নিয়ে কখনো আক্ষেপ করতে হবে না তোমায়।

হৃদির বুকের ভেতর জলের ঢেউয়ের মতো শব্দ হয়। নেহাল একটা মেসেজের উত্তর দিতে দেরি করলে অস্থির লাগে। দুশ্চিন্তা হয়। অনিকের কথা ভেবেও যে খারাপ লাগে না, তা নয়। তবে সেই খারাপ লাগার অনুভূতিটা অন্য রকম। তার বরং মনে হয়, অত বড় ভুল করাটা তার ঠিক হয় নি। বছর কয়েক আগে ঝোঁকের বশে বিয়েটা সে না করলেই পারত। তার কারণেই অনিকের জীবনটাও হঠাৎ থমকে গেল। এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। আর এখন? এখন সে কী করবে?

এই প্রশ্নে নিঃসাড় হয়ে থাকে হৃদি। যেন অথই সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া পায়ের নিচে একটু মাটির স্পর্শ চায় সে। দিনরাত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চলতে থাকে। এই যুদ্ধের কথা কাউকে বলতেও পারে না। ঠিক করতে পারে না নিজের করণীয়ও।

মাঝখানে নেহালের সঙ্গে দুদিন কথাও বলে নি, তাতে যদি নিজেকে খানিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। প্রবল স্রোতস্বিনী নদীতে বাঁধ দিয়ে রাখলে সেই নদী যেমন দুকূল প্লাবিত করে ছুটে আসে, উপচে পড়তে চায়, হৃদির অবস্থাও হলো তেমন। তৃতীয় দিন রাতে সে ফোন করে খুব শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি কবে আসবে?

এখানে একটু সমস্যা হয়ে গেছে, হৃদি। আমার তো নেক্সট উইকেই রিটার্ন টিকিট ছিল। আরও তো অন্তত পাঁচ দিন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু দেরি হবে।

মানে, দেরি কেন হবে?

আমার এক বন্ধু আসবে ফ্লোরিডা থেকে। ওকে কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে। এই জন্য একটু দেরি হচ্ছে। ওই পাঁচ দিনের সঙ্গে হয়তো আরও এক সপ্তাহ যোগ হবে।

হৃদি খানিক চুপ করে থেকে বলল, তুমি কাল চলে আসবে।

কাল চলে আসব মানে! অবাক গলায় বলল নেহাল।

কাল চলে আসব মানে কাল চলে আসবে। বলেই হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল হৃদি। বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, নেহাল। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। খুব তাড়াতাড়ি।

নেহাল পরদিন না পারলেও টিকিট বদলে চলে এল দুদিন বাদেই। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এল হৃদিদের বাড়ি। তখন গভীর রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। জেগে ছিল হৃদি একা। নেহাল ফোন করতেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে।

নেহাল উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার?

আমি জানি না।

বলো আমাকে?

আমার খুব ভয় করছে।

কিসের ভয়?

তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

আমাকে কেন হারিয়ে ফেলবে তুমি?

আমি জানি না। কিন্তু আমার ভয় করছে। তীব্র ভয়। আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব। আর কখনো ফিরে পাব না।

হৃদি কাঁদছে। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে নেহাল। রোখসানা বেগম এই সময়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল তারা। রোখসানা বেগম অবশ্য হৃদিকে তেমন কিছুই বললেন না। তবে নেহালকে বললেন, তুমি এখন বাসায় যাও, বাবা। কাল দিনে এসো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

.

সেই রাতে আর এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারল না হৃদি। সে জেগে রইল অদ্ভুত এক সংকট, সংশয় নিয়ে। তার একবার মনে হলো, সে আসলে অনিককে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে চেয়েছিল। কারণ, সে জানে, যে ভয়ানক অপরাধটা সে করতে যাচ্ছে, এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। এমন জঘন্য কাজ সে করতে পারে না। অনিকের মতো মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া একজন মানুষকে ছেড়ে সে এভাবে চলে যেতে পারে না।

ফলে তার আসলে নিজেকে সমর্পণ করা উচিত অনিকের কাছেই। তার বুকে যে ক্লেদ, যে লোভ জন্মেছে, তার জন্য তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু তা তো সে পারছে না। ফলে একটা অপ্রতিরোধ্য অপরাধবোধ তাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। সে মূলত তার ওই ভাঙা টুকরোগুলো নেহালের কাছে জমা দিয়ে আবার যুক্ত করে নিতে চাইছে। হতে চাইছে পরিপূর্ণ অন্য কোনো মানুষ।

এ এক অদ্ভুত দ্বিধার জগৎ। এই জগৎ থেকে সে বেরোতে পারছে না। আবার পরিপূর্ণ শান্তিতে থাকতেও পারছে না। তবে এ কদিনে অন্তত একটি কথা সে বুঝতে পেরেছে। আর তা হলো, নেহালকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। তাতে যত বড় অন্যায়ই তাকে করতে হোক না কেন।

যে অনাঘ্রাত ভালোবাসার সুবাস সে নেহালের কাছ থেকে পেয়েছে, এই সুবাস থেকে তার মুক্তি নেই। এ যদি মৃত্যু হয়, তবে সেই মৃত্যু গ্রহণেও কুণ্ঠা নেই তার। অনিকের প্রতি যে অন্যায়টা সে করছে, সেই অন্যায় নিয়ে তার অনুশোচনাও হয়। কিন্তু হৃদি জানে, জগৎ এমনই, এখানে কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতেই হয়। সে না হয় অনিককেই বিসর্জন দিচ্ছে।

২১

লাল চানের সামনে টেবিল। টেবিলের ওপর দুটো চকচকে এক শ টাকার বান্ডিল। সে ভ্রু কুঁচকে বলল, এগুলা কী?

বিষ।

বিষ মানে? কিসের বিষ?

সাপের বিষ।

লাল চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, আস্তে হারামজাদা। কেউ শুনব।

রাশু কথা বলল না। লাল চান বলল, এই টাকা পাইছস কই?

জামশেদ স্যারে দিছে।

কত টাকা?

গুনি নাই।

গোন।

রাশু টাকা গুনল, পঞ্চাশ হাজার।

টাকা দিছে কেন? কী করতে বলছে?

আপনেরে দেয় নাই। আমারে দিছে।

তোরে? অবাক গলায় বলল লাল চান। তোরে এত টাকা দিছে কেন?

আপনেও দিতে পারেন। থাপ্পড়প্রতি পঁচিশ হাজার। জিনিসটা আমার ভাল্লাগছে। পত্রিকায় খবর হওনের মতো ব্যাপার।

তোর কী হইছে? আবোলতাবোল বকতেছস কেন?

আবোলতাবোল না, কথা সত্য। আমারে থাপ্পড় মারবেন, প্রত্যেক থাপ্পড়ের দাম। পঁচিশ হাজার টাকা। এক শ টাকার চকচকা নোটের বান্ডিল দিতে হবে। মারবেন থাপ্পড়?

রাশু থামলেও লাল চান কথা বলল না। সে সরু চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে। বাদামি চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। রাশু বলল, আপনেরে যদি এই সুযোগ দেওয়া হইত, আপনে কী করতেন?

কোন সুযোগ?

আপনের গালে কেউ থাপ্পড় মারব। প্রতি থাপ্পড় পঁচিশ হাজার। দিতে দিতেন থাপ্পড়? তাইলে গাল আগাই দেন, দুইটা চড় মারব। পেমেন্ট নগদ। এক শ টাকার চকচকা নোটে পঞ্চাশ হাজার টাকা।

রাশুর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল লাল চান। এই ছেলে বলে কী! এই সেদিনও সে তার ধমকে প্যান্ট নষ্ট করে দিত। আর আজ সে এ কী কথা বলছে! লাল চান তীক্ষ্ণ চোখে রাশুর দিকে তাকাল। তার মুখ ভাবলেশহীন। তবে চোখে কিছু একটা আছে। বিষয়টা সে ধরতে পারছে না। রাশু বলল, আমি এখন রেগুলার বাইরে থাকব।

কেন?

স্যারে বলছে।

কী বলছে?

বলছে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে যেমনে ছাত্রগো টেস্ট পরীক্ষা দিতে হয়, তেমনি সাপের বিষেরও টেস্ট পরীক্ষা দিতে হইব। তারে বর্ডার পাসের পরীক্ষা দিতে হইব।

তোর কী হইছে? তুই এমন আউলাঝাউলা কথা বলতেছস কেন? ঘটনা খুইলা বল আমারে।

রাশু কথা বলল না। হাসল। মলিন হাসি। লাল চান ক্যাশ ছেড়ে উঠে এসে তার পাশে বসল। তারপর বলল, তোরে কি জামশেদ স্যার মারছে?

রাশু এবারও জবাব দিল না। লাল চান বলল, চড়-থাপ্পড় মারছে? চড়-থাপ্পড় মারলে মনে দুঃখ নিস না। সে এখন তোর ওস্তাদ। ওস্তাদের হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া মন্দ কিছু না, বরং ভালো। এতে শিক্ষাদীক্ষা ভালো হয়। দ্রুত হয়।

রাশু এবারও চুপ করে রইল। লাল চান একটা গামছা ভিজিয়ে এনে রাশুর মাথা, মুখ, ঘাড় মুছে দিতে থাকল। রাশু বলল, আইড় মাছ দিয়া ভাত খাব। নদীর আইড়।

এখন আইড় মাছ পাব কই?

পদ্মার ঘাটে গেলেই পাওয়া যাইব।

এখন পদ্মার ঘাটে যাইব কে?

আপনে যাইবেন।

আমি এহন যাব পদ্মার ঘাটে? ওই হারামজাদা, লাটসাহেব, আমি এহন যাব পদ্মার ঘাটে? তারপর তোর জন্য আইড় মাছ আইনা রাইন্ধা খাওয়াব?

রাশু কথা বলল না। সে দোকানের পেছনের খুপরিঘরটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলা। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বিছানার পাশে গামলাভর্তি ভাত। ভাতের গামলার পাশে জামবাটি। বাটিতে আলু বেগুন ধনেপাতা দিয়ে ঝোল ঝোল করে রান্না করা আইড় মাছের তরকারি। সে হাতমুখ না ধুয়েই ভাত খেতে বসল। ভাত খাওয়া শেষে দোকানের বাইরে এল। এসে শোনে পুলিশ লাল চানকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘটনা শুনে ভারি অবাক হলো সে। লাল চানকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে? কী করেছে সে?

লাল চান অবশ্য এল ঘণ্টাখানেক পরই। তাকে দেখে গুরুতর কিছু মনে হলো না। রাশু বলল, কী হইছিল?

আরেহ, পুলিশের একটা নতুন মেস হবে। সেইখানে বিছানা-বালিশ লাগবে। কাজ দিচ্ছে আমারে। আমার কি এখন এইসব খুচরাখাচরা কাজ করার সময়?

রাশু কথা বলল না। লাল চানের দিকে তাকিয়ে রইল। কদিন আগেও এমন একটা কাজ পেলে আনন্দে তার চোখমুখ ঝলমল করত। অথচ এখন সেখানে আরও লাভের লোভ। এই লোভের ছায়া তাকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! তবে আপাতত সে তাকেও সেই ছায়ায় ঠেলে দিয়েছে। এই ছায়া কত দূর বিস্তৃত হবে, রাশু জানে না।

.

জামশেদ গাড়ি পাঠিয়েছেন। কম দামি পুরোনো আমলের সেডান কার। রাশু গাড়িতে উঠে দেখে বাইরে থেকে যতটা সাধারণ দেখায়, ভেতরে ঠিক অতটা সাধারণ নয়। গাড়িটা। বসার আসনগুলোও ভালো। তবে এর আগে যতবার সে ঢাকা থেকে গিয়েছে, ততবারই ভালো গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। হঠাৎ এমন গাড়ি পাঠাল কেন কে জানে! সে বৈদ্যবেলঘরিয়া পৌঁছাল দুপুরে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন জামশেদ। সঙ্গে মতিন মিয়া। সে রাশুকে দেখে বলল, এই ছেলে এইখানে থাকতে পারব স্যার?

আমার তো মনে হয় পারব। তোমার কী মনে হয়?

ঠিক বুঝতে পারছি না। এইটুক বাচ্চা একটা ছেলে।

জামশেদ হাসলেন, একটা কথা শোনো নাই?

কী কথা?

ছোট সাপের বড় বিষ?

এই কথায় মতিন মিয়া চুপ হয়ে গেল। জামশেদ রাশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, মুরগি আনছিস?

রাশু কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। মতিন মিয়া বলল, স্যার, মাগুর মাছরে মুরগি খাওয়াবে। সেই মুরগি আনছ কি না, সেইটা জিজ্ঞাস করছে।

জি না। রাশু মিনমিনে স্বরে বলল, যেন বড় ধরনের অপরাধ করে ফেলেছে সে।

জামশেদ বললেন, কাজটা কি ঠিক হলো, রাশু মিয়া?

রাশু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়তে গিয়ে আচমকা থমকে গেল। বলল, আমাকে তো মুরগি আনতে বলা হয় নাই। আর আমি জানতামও না যে এইখানে আসলে সব সময়ই মুরগি নিয়া আসতে হয়। এমন কিছু কেউ বলে নাই আমারে।

জানো নাই যখন, এখন জানলা। এখন থেকে নিয়ে আসবা। বলল মতিন মিয়া।

জামশেদ বললেন, ওইখানে ওই বেতের ঝাপিটার নিচে দুইটা মুরগি আছে। ওই দুইটা আন।

রাশু তাকাল। উঠানে একটা ওলটানো বেতের ঝাপি রাখা। সেই ঝাঁপির নিচে মুরগি আছে বলেছেন জামশেদ। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে ওই ঝাঁপির নিচে মুরগি নেই। আছে অন্য কিছু। সে ধীরপায়ে ঝাপিটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক তখুনি তীব্র আতঙ্কে তার সারা শরীর হিম হয়ে এল। জামশেদ বিষয়টা লক্ষ করলেন। বললেন, কী? ঝাঁপি ফাঁক করে ঝাপির নিচে হাত দে। আঁপি তুলবি না। ফাঁক দিয়ে হাতে টেনে মুরগি বের করবি।

রাশু মুহূর্তেই ঘটনা বুঝে গেল। ঝাপির নিচে মুরগি আছে, এ কথা সত্য। সে রক্তের দাগও দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেই মুরগির সঙ্গে সম্ভবত ভয়ংকর বিষধর কোনো সাপও আছে ওখানে। জামশেদ চাইছেন ওই সাপের সামনে থেকে অনুমানে হাতড়ে মুরগিটা বের করে আনবে সে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সে ঝাঁপির নিচে হাত দেওয়ামাত্র সাপ তাকে ছোবল মারবে। কথাটা ভাবতেই রক্তশূন্য হয়ে গেল রাশুর মুখ। মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। সে-ও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্য যেকোনো মৃত্যুর চেয়ে সাপের ছোবল তার কাছে সহস্রগুণ বেশি ভয়ের। সে হাত দিয়ে তা ছুঁতেও পারবে না।

জামশেদ বললেন, কী হলো? বের কর। রাশু দাঁড়িয়ে আছে। তার পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। আক্ষরিক অর্থেই নড়তে ভুলে গেছে সে। কিংবা পারছে না। জামশেদ ঠান্ডা হিসহিসে গলায় বললেন, আমার কথা না শুনলে আমার কেমন লাগে তুই জানিস না?

রাশু জানে। কিন্তু সেই জানাও তাকে সামান্যতম উদ্দীপ্ত করতে পারল না। ভীতও করতে পারল না। বরং মনে হলো, এই অবিশ্বাস্য ভয়ংকর কাজের তুলনায় ওই শাস্তি নেহাতই তুচ্ছ। কিংবা ওর চেয়েও বড় যেকোনো শাস্তি সে মাথা পেতে নিতে পারবে।

জামশেদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটা কালো চকচকে পিস্তল। রাশুর হঠাৎ মনে হলো, সে আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছে। জামশেদ কোনোভাবেই তাকে খুন করতে চান না। তিনি মূলত তাকে ভয় দেখাতে চান এবং দেখতে চান, এমন ভয়ংকর মুহূর্তে রাশুর কি বেশি কাজ করে, মন না মগজ?

রাশু অকস্মাৎ টুপ করে বসে পড়ল। তারপর চোখের পলকে হাত ঢুকিয়ে দিল ঝাপির তলায়। সেখানে একটা মুরগি। সেই মুরগিটার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে একটা সাপ। রাশু চোখের পলকে ঝাপির তলা থেকে মুরগিটা টেনে বের করে আনল। তবে সাপটা ততক্ষণে সচকিত হয়ে উঠেছে। সে কুণ্ডলী ভেঙে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে শুরু করেছে। রাশু এবার সবাইকে চমকে দিয়ে আবারও হাত ঢুকিয়ে দিল ঝাঁপির ভেতর। তারপর বের করে আনল সাপটা। ভীত মতিন মিয়া হতভম্ব হয়ে গেছে। আতঙ্কে তার চোখ জোড়া যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।

রাশু অবশ্য সাপটাকে ছাড়ল না। তাকে ছোবল দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তবে তার ধারণা, সে যখন প্রথমবার ঝাপির তলায় হাত ঢুকিয়েছে, সাপটা তখুনি তাকে ছোবল মেরেছে। মতিন মিয়া চিৎকার করে বলল, ছাইড়া দাও। ছাইড়া দাও।

রাশু ছাড়ল না। তাকে আরও বার দুই ছোবল মারল সাপটা। জামশেদ বিস্ফারিত চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে তার সেই চোখে সমীহও। রাশুর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সেই হাসি বিদ্রুপাত্মকও। জামশেদ বললেন, এদিকে আয়।

রাশু এল। জামশেদ বললেন, তুই কখন বুঝলি যে ঝাপির তলায় যে সাপটা আছে, ওইটার বিষ নাই?

আপনে যখন পিস্তল তাক কইরা দাঁড়াইলেন, তখন।

কেন, পিস্তলের সাথে সাপের বিষ না থাকার সম্পর্ক কী?

আমার হঠাৎ মনে হইল আপনে আসলে আমারে মারতে চান না, ভয় দেখাইতে চান। দেখতে চান ভয়ের মুহূর্তে আমি কী করি? কারণ, আমারে মাইরা তো আপনের লাভ নাই। বরং আমি যদি ভয়টারে জয় করতে পারি, ওইটাতে আপনের লাভ। আপনে তাই চাইছেন আমি যেন ভয়টারে জয় করি। এই জন্য বিষদাঁত নাই এমন কোনো সাপ রাখছেন ওইটার মধ্যে।

জামশেদ কথা বললেন না। তিনি স্থির চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাশু তাকিয়ে আছে তার হাতের সাপটার দিকে। সাপটা এখন আর তাকে ছোবল মারতে চাইছে না। সে ধীরে রাশুর বাহু বেয়ে কাঁধের দিকে উঠে যাচ্ছে। খানিক বাদে হয়তো গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে থাকবে। দৃশ্যটা দেখতে ভয়ংকর হবে। তবে জামশেদ জানেন নারাশু তখন কী করবে!

২২

পরদিন বাড়িতে এল নেহাল। রোখসানা বেগম সরাসরিই প্রসঙ্গটা তুললেন। বললেন, আমার মনে হয় হৃদির সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যে কনফিউশনটা তোমার ছিল, তা কেটে গেছে।

জি আন্টি।

তাহলে এটা নিয়ে আর দেরি করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া হৃদি একটু খামখেয়ালি টাইপের। কখন কী করে ফেলে কে জানে! তুমি বিয়ের ব্যাপারে কথা বলো।

জি। আচ্ছা।

রোখসানা বেগম হৃদির সঙ্গেও বিষয়টা নিয়ে কথা বললেন। হৃদি সরাসরি কিছু না বললেও তার নীরবতার ধরন স্পষ্টতই সম্মতির লক্ষণ। বিষয়টাতে রোখসানা বেগম যারপরনাই আনন্দিত হলেন। নেহালকে বললেন হৃদির সঙ্গে বাদবাকি বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে, তাদের নিজেদের যদি বিশেষ কোনো প্ল্যান-পরিকল্পনা থাকে। হৃদি অবশ্য তেমন কিছু বলল না। তবে সে যেন খানিক থম মেরে রইল। নেহাল বলল, হৃদি?

হুম।

তুমি কি কোনো কারণে আপসেট?

না তো।

বাট, তোমাকে দেখে তেমনই মনে হচ্ছে।

হৃদি কথা বলল না। নেহাল বলল, কোনো সমস্যা?

একটু। অবশেষে বলল হৃদি।

কী?

হৃদি আবারও চুপ করে রইল। নেহাল তার হাত ধরে বলল, বলো আমাকে।

বলব। বলে থামল হৃদি। তারপর বলল, কিন্তু সেটা শোনার পর তুমি যদি আমাকে আর ভালো না বাসো?

নেহালের মনে হলো সে দূরন্ত গতিতে ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে হঠাৎ তার সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ানো দেয়ালটাতে ধাক্কা খেয়েছে। তবে নিজেকে সামলে নিল সে। বলল, কী এমন সমস্যা যে সেটা শুনলে আমি আর তোমাকে ভালোবাসব না?

আছে।

থাকুক। তুমি যেকোনো সমস্যা নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।

কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সমস্যাটা শোনার আগেই তুমি ধাক্কা খেয়েছ। একটা অজানা আশঙ্কার ছাপ পড়েছে তোমার মুখে।

নেহাল হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হৃদির কথা মিথ্যে নয়। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যে শঙ্কার কালো মেঘ নেহালের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে, তা তার চোখ এড়ায় নি।

হৃদি ভেবেছিল অনিকের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারটা জানলেও নেহাল হয়তো তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, যেহেতু এ বিষয়ে একটা প্রাথমিক আভাস সে পেয়েছিল। কিন্তু তার ওই হঠাৎ বদলে যাওয়া মুখচ্ছবি শেষ মুহূর্তে থমকে দিল হৃদিকে। সে বলল, আমার একটা সম্পর্ক ছিল, সেটি নিশ্চয়ই তুমি জানো?

নেহাল হাসল, অমন সবারই কিছু না কিছু থাকে। বাট, সেসব তেমন সিরিয়াস কিছু না।

যদি সিরিয়াস কিছু হয়?

সিরিয়াস কিছু হলে তুমি কি তাকে ছেড়ে দিতে পারতে?

এই প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল হৃদি। কী কঠিন, কী রূঢ় একটি কথা কত অবলীলায় বলে ফেলল নেহাল! আসলেই কি অনিকের সঙ্গে সম্পর্কে কখনো সিরিয়াস ছিল না সে? কিন্তু সেটা তো হওয়ার কথা নয়। বরং শেষের দিকে এসে তার ক্রমশই মনে হচ্ছিল, নিজের আগেকার সেই ভঙ্গুর, অস্থির মানসিক দশা থেকে সে বের হয়ে এসেছে। নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখেছে এবং সেখানে অনিক হয়ে উঠছে তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। সবচেয়ে বড় অনুভব। তাহলে হঠাৎ কী হলো তার? সবকিছু কেন এমন ওলট-পালট হয়ে গেল!

এই প্রশ্নের উত্তর হৃদির কাছে নেই।

নেহাল বলল, আমি এটাই বলেছিলাম। আমরা এই বয়সে যাকে ভালোবাসা ভাবি, সেটা আসলে ইনফ্যাচুয়েশন। লাভ অ্যান্ড ইনফ্যাচুয়েশন–এ দুটোয় বিস্তর তফাত। কিন্তু এই বয়সটা সেটা আমাদের বুঝতে দেয় না। একটা ঘোরে অন্ধ করে রাখে।

হৃদি বলল, কিন্তু আমি যে তোমাকে বলেছিলাম আমরা গোপনে বিয়ে করে ফেলেছি!

কথাটা শুনে মুহূর্তের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল নেহাল। যেন সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করল হৃদিকে। তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসল। বলল, এখনো কেন এসব নিয়ে মজা করছ? এখন তো আর আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ব্যাপার নেই। সেবার তো প্রেগন্যান্সির কথা অবধি বলতে চাইছিলে। মাই গড! তুমি না ডেঞ্জারাস। নিজের সম্পর্কে এমন মজা কেউ করে? নিজের বিয়ে, প্রেগন্যান্সি নিয়ে!

হৃদি কী করবে বুঝতে পারছে না। সে বার কয়েক ভাবল বিষয়টা পুরোপুরি স্পষ্ট করেই বলবে। কিন্তু শেষ অবধি পারল না। তার বারবার মনে হতে লাগল, সব শুনে নেহাল যদি ভয়ানক কিছু করে বসে! যদি তাদের বিয়েটা ভেঙে যায়! এমনই হওয়ার কথা। কারণ, যে মেয়ে মাত্র এ কদিনের পরিচয়ে তার এত দিনকার বিয়ের সম্পর্কটা ভেঙে দিতে পারে, সেই মেয়ে সম্পর্কে কারোরই কোনো ভালো ধারণা তৈরি হওয়ার কথা নয়। তাহলে? কী করবে সে?

হৃদি শেষ অবধি বলল, একটা কথা।

হা?

অনিকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। প্রথমে বিষয়টা ফানই ছিল। তারপর কী যে হলো আমার! হঠাই মনে হলো, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

তারপর? কৌতূহলী চোখে তাকাল নেহাল।

তারপর…। বলে খানিক চুপ করে রইল হৃদি। যেন কী বলবে তা এখনো গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আমি বিশ্বাস করি, আমার ভালোগুলো যেমন তুমি ভালোবাসবে, তেমনি আমার সীমাবদ্ধতাগুলোও। ওগুলোর জন্য অন্তত কখনোই আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না।

কখনোই না।

আমি আর অনিক…। বলে সামান্য থামল হৃদি। তারপর যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলল, আমরা বিয়ে করে ফেলেছিলাম।

হোয়াট! নেহালের মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। মানে তোমরা সত্যি সত্যিই বিয়ে করেছিলে? কোর্ট ম্যারেজ? নেহালের ঠোঁট কাঁপছে।

হৃদি নিজেকে হঠাৎ কী বোঝাল কে জানে! সে ঠোঁট উল্টে শ্রাগ করার ভঙ্গিতে বলল, নিজেরা নিজেরা। আমি আর অনিক। বাংলা সিনেমায় যেমন দেখতাম, ও রকম।

মানে?

মানে চাঁদ-তারা-সূর্য, আকাশ-বাতাস সাক্ষী রেখে আরকি!

নেহাল এবার আর হাসল না। তবে এতক্ষণ আটকে রাখা দমটা ছাড়ল সে। বলল, উফফ, গড ড্যাম ইউ। তুমি কীভাবে এমন করে হার্টবিট মিস করিয়ে দিতে পারো, বলো তো? আই ওয়াজ সাপোসড টু ডাই…।

হৃদি জানে কাজটা তার ঠিক হয় নি। কিন্তু তারপরও শেষ অবধি বিষয়টা আর স্পষ্ট করে বলতে পারল না সে। বরং একটা আবছায়া রেখে দিল। এ যেন না বলেও বলা। নিজেকে খানিক দায়মুক্ত করে রাখা।

কিন্তু অনিককে সে কী বলবে? কিংবা মাকে?

২৩

রাহিমা বানুর শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। গত কিছুদিন হলো বিছানা থেকে উঠতেই কষ্ট হচ্ছে তার। অনিক বলল, মা, তুমি কি তাহলে এখুনি গিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে? ডাক্তারও বলল, বাড়ির ফ্রেশ আলো-হাওয়ায় কয়েক দিন থেকে এলে তোমার ভালো লাগবে।

এইটা কি আমি আজ থেকে বলছি! রাহিমা বানু যেন একটু রেগেই গেলেন। কত দিন হয় এই এক কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম। তুই-ই তো দেরি করছিস।

মা। নরম গলায় ডাকল অনিক।

হুম।

তুমিই না বললে হৃদির সঙ্গে দেখা না করে যাবে না?

একটা কথা বলি, বাবা? হঠাই যেন রাহিমা বানুর গলার স্বর বদলে গেল।

বলো।

রাহিমা বানু অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই কথা বললেন না। বেশ খানিকটা সময় নিলেন। তারপর বললেন, বড় কোনো ঝামেলা হয়েছে?

না, মা। বড় কোনো ঝামেলা না। হৃদি খুব ইমোশনাল। অল্পতেই হাসে, অল্পতেই কাঁদে। দেখলে না মাত্র কয়েক দিনেই তোমার জন্য কেমন করল!

হুম।

ও ওর বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। সেই মানুষটা হঠাৎ চোখের সামনে নাই হয়ে গেলেন। বিষয়টা ওকে মানসিকভাবে একদম ভেঙে দিছে। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

এই জন্য তোর ফোন ধরবে না? একটা কথা পর্যন্ত বলবে না?

কথা হয়েছে, মা।

কথা হয়েছে? রাহিমা বানুর বিষণ্ণ মুখে যেন খানিক আলো ফুটল। তিনি হড়বড় করে বললেন, কবে, কখন, কী কথা হয়েছে? আসবে আমাকে দেখতে? আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে নাই?

করেছে। আমি যখন বললাম বাড়ি নিয়ে যাব তোমাকে, বলল, তোমাকে পুরোপু রি সুস্থ না করেই কেন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

বলেছিস যে আমি খুব অসুস্থ? দেখতে চাইছি ওকে? ওই যে…তোকে যা শিখিয়ে দিলাম!

বলেছি, মা।

তাহলে, এল না যে?

আসবে।

সত্যি? যেন কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না রাহিমা বানুর। তিনি যেন মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন যে হৃদি আর তাকে দেখতে আসবে না। অনিকের সঙ্গে নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো ঝামেলা হয়েছে। হয়তো সম্পর্কটাই আর নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন হয়। হুটহাট সম্পর্ক হয়ে আবার হুটহাটই ভেঙে যায়। সত্যি সত্যিই আসবে? সে বলেছে? কবে আসবে? রাহিমা বানুর যেন আর তর সইছে না।

ও একটু খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, মা। নিজ থেকেই ফোন করল। তারপর হঠাৎ কাঁদল।

কী বলিস! রাহিমা বানুর গলায় আর্দ্রতা। বুকটাও কেমন ভার। কেন কেঁদেছে? কী হয়েছে ওর?

এখনো জানি না, মা। বলেছে, আগে আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। তারপর তোমাকে দেখতে আসবে।

ঠিকই তো। এখানে এলে আমি তো ওকে সারাক্ষণ সাথে সাথে রাখি। তোর সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলার সুযোগও দিই না। আসলে হয়েছে কি, আমরা পুরোনো আমলের মানুষ। সোমত্ত বয়সের দুটো ছেলেমেয়েকে আলাদা ঘরে ছাড়তে আমাদের বাধে। এই জন্য সব সময় চোখে চোখে রাখতাম। আফসোসের ভঙ্গিতেই কথাটা বললেন রাহিমা বানু। কিন্তু তোদেরও তো কিছু কথা থাকতে পারে, যেটা মায়ের সামনে বলা যায় না। এই সামান্য ব্যাপারটাই আমি বুঝতি পারি নাই। কে জানে, হয়তো এ কারণেও আমার ওপর ওর মন খারাপ হয়ে থাকতে পারে। তুই একটু ওকে বুঝিয়ে বলিস। আমি মোটেও অমন না। আমার বোঝার ভুল।

মা, ও মোটেও তোমাকে ভুল বোঝে নি। তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না। ও একবার এলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। হৃদির মতো এমন সহজ, ভালো মেয়ে তুমি আর পাবে না। ওর রাগ, অভিমান একটু বেশি। হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অল্পতেই কষ্ট পায়। আবার আনন্দও। ওকে জাস্ট একবার আসতে দাও, দেখবে গ্রামে গিয়ে সারাক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকবে।

আমি সে কথাই বলতে চাইছিলাম। যদি সম্ভব হয় বিয়েটা করে ফেল। তুই চাইলে আমিই কথা বলতে পারি। প্রয়োজনে ওর মায়ের সঙ্গেও কথা বলব।

অনিক মায়ের দিকে তাকিয়ে খানিক অবাকই হলো। ক্রমশ দুর্বল, ক্ষীণ হয়ে পড়া তার রোগা, নিষ্প্রাণ মা যেন মুহূর্তেই ঝলমল করে উঠলেন। তার চোখেমুখে আলোর আভা। বললেন, আমি ওকে গায়ে নিয়ে যাব। তুই দেখিস, একবার ও আমার সঙ্গে গিয়ে কটা দিন থাকলে আর ওর মন খারাপ থাকবে না।

অনিক হাসল, আমি জানি, মা। ও কী বলে, জানো?

কী?

বলে আমাকে না হলেও নাকি ওর চলবে। তোমাকে পেলেই হবে। তোমার সঙ্গে সারা জীবন থাকতে পারবে।

কথাটা শুনে কী যে ভালো লাগল রাহিমা বানুর! একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার অনুভবটা যেন ক্রমশই আড়াল হয়ে যেতে লাগল। কবে দেখা করবে ও? তুই কিন্তু ওকে কিছু নিয়ে প্রেশার দিস না। এত ভালো মেয়েটা…। বলতে বলতে গলাটা যেন ধরে এল তার।

অনিক মায়ের শীর্ণ হাতখানা ধরল। এই কদিনেই কী রোগা হয়ে গেছেন মা। হাত কাঁপছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে। অনিক প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলল, দেব না, মা।

এ কদিনে একটা বিষয় অনিক বুঝতে পেরেছে, হৃদিকে ছাড়া তার চলবে না। যত দুঃখ, যন্ত্রণা, ঝড়-ঝঞ্ঝাই জীবনে আসুক না কেন, ওই মেয়েটাকে তার চাই-ই চাই। বরং সে থাকলে এই সব বিপৎসংকুল পথ সে পেরিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু কবে দেখা করবে হৃদি? মায়ের হাতে যে আর বেশি সময় নেই!

প্রতিটি দিন সে ঘুমাতে যায় তীব্র শঙ্কা নিয়ে। তার ঘুম ভাঙে অবর্ণনীয় আতঙ্কে। ওই বুঝি মায়ের ঘরে গিয়ে দেখবে, বিছানায় নিথর, নিষ্প্রাণ এক মৃতদেহ। আচ্ছা, সত্যি সত্যিই যখন এমন কিছু ঘটবে, তখন কী করবে সে?

এরপর আর ভাবতে পারে না অনিক। বরং মা যখন দুপুরবেলা একটু ঘুমায়, তখন সে দরজার বাইরে থেকে তাকিয়ে থাকে। কই, মাকে তো একবারও মৃত মানুষের মতো মনে হয় না তার। বরং এত শান্ত, স্নিগ্ধ আর মায়াময় মনে হয়! মনে হয়, টুক করে গিয়ে মায়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে আসে! মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পায়ের কাছে বসে থাকে। মা মরে যাওয়ার পরে তাহলে কেমন লাগবে তাকে? মৃত্যুও তো একধরনের ঘুমই। তখন কি মায়ের মুখ অন্য রকম হয়ে যাবে? সেই অন্য রকমটা কেমন?

আচ্ছা, মায়ের মুখের মতো এমন মায়াময় মুখ কেন আর নেই পৃথিবীতে? এই যে এত এত দুঃখ-দহন-যন্ত্রণা, এসবের মধ্যেও সারা দিন পর যখন সে ঘরে ফেরে, তখন। মাকে দেখে মনে হয় একটা কনকনে ঠান্ডা জলের ঝরনাধারা যেন বুকের ভেতর অবিরাম বয়ে যেতে থাকে। কী শান্তি, কী আশ্চর্য স্থৈর্য আর আদর ওই মুখ, ওই হাসিতে!

ওই মুখ না দেখে সে থাকবে কী করে?

মায়ের এই না থাকার ভাবনাটুকুতে এসেই হৃদি হয়ে ওঠে অনিকের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। সে জানে, এক অকল্পনীয় বিভীষিকাময় জীবন তার সামনে। সেই জীবনে হৃদিকে তার ভীষণ দরকার। জগতে মাতৃহীন জীবনের চেয়ে ভয়ংকর অভিশাপ আর নেই। সেই অভিশপ্ত জীবনে কেবল হৃদিই তাকে খানিক মায়া দিয়ে, ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে পারে। কিন্তু হৃদি কোথায়? কবে দেখা করবে সে?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ফোনটা এল সেই রাতেই। হৃদি বলল, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই, অনিক।

অনিক হড়বড় করে বলল, কবে, কোথায়?

কালই।

কালই! অনিকের যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কত দিন পর স্বদিকে দেখবে সে? নাকি কত বছর? এ যেন সহস্র জনমের তেষ্টায় খাক হয়ে যাওয়া বুকের গহিনে আজন্ম বৃষ্টির অপেক্ষা। অনিক বিড়বিড় করে বলে, তোমাকে আমি কত দিন দেখি না, তুমি জানো?

কত দিন?

মহাদেব সাহার ওই কবিতাটা পড়েছ?

কোন কবিতা?

তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার, আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।

হৃদি কথা বলে না। অনিকের বুকের ভেতর যেন জ্বলতে থাকে দহনের নদী। অপেক্ষায় থাকে এক সমুদ্র জলের। সেই জল ছলছল সমুদ্রের নাম হৃদি। হৃদি কি তা জানে?

আচ্ছা, মায়ের এই ভয়ানক দুঃসংবাদটা শুনে কী করবে সে? নিশ্চয়ই কেঁদে বুক ভাসাবে। তারপর পাগলের মতো ছুটে আসবে। কিন্তু মাকে তো কিছুই বুঝতে দেওয়া। যাবে না। তার সামনে এমন কিছুই করা যাবে না যাতে সে ঘুণাক্ষরেও কিছু আঁচ করতে পারে। কিন্তু হৃদিকে সামলাবে কী করে সে?

এই নিয়ে কত কী ভাবে অনিক! সেই ভাবনায় তার বিদ্রি রাত কাটে। ভোরের আকাশ জেগে উঠতে থাকে। কাছের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসে আসোলাতু খাইরুম মিনান নাউম। অনিক ঘুম থেকে উঠে বসে। বহুদিন পর অজু করে জায়নামাজে বসে সে। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এই কান্নার উৎস সে জানে না। তবে সেই কান্নায় ভোরের ওই আবছা আলো যেন আরও ম্লান হয়ে যেতে থাকে। মা, মা গো, মা। অনিক নিজেকে আর সামলাতে পারে না। সে হঠাৎ মায়ের বুকের কাছে গিয়ে বসে। রাহিমা বানু চোখ মেলে তাকান। অনিক ফিসফিস করে ডাকে, মা। মা।

রাহিমা বানু জবাব দেন না। তবে উঠে বসেন। তারপর অনিকের মাথাটা কোলের সাথে চেপে ধরে বলেন, কী হয়েছে? হৃদির জন্য খারাপ লাগছে?

না, মা।

তাহলে?

আমি জানি না, মা। আমার খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।

কেন বাবা?

আমি জানি না, মা। খুব ভয় হচ্ছে আমার।

দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?

অনিক হঠাৎ মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।

কী দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?

দেখেছি তুমি হঠাৎ দূরে কোথাও চলে যাচ্ছ।

দূরে কোথায় যাব? এই তো বাড়ি গিয়ে কদিন থাকব। তারপর আবার চলে আসব।

অনিক কথা বলে না। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে থাকে। বাইরে কাকের কর্কশ ডাক শোনা যায়। কিন্তু মায়ের শরীরের ওই স্পর্শটুকু, ওই ঘ্রাণটুকু তাকে অপার্থিব আনন্দময় এক অনুভব দিতে থাকে।

.

হৃদিকে দেখে চমকে গেল অনিক। কেমন অচেনা লাগছে তাকে। আচ্ছা, তার চোখে কি কিছু হয়েছে? অনিক ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে যে হৃদিকে সে চেনে, এত বছর ধরে দেখে এসেছে, সেই হৃদি এ নয়। এই হৃদির চোখের ভাষা অন্য রকম এবং তা সে পড়তে পারছে না। এমন নয় যে হৃদি খুব অন্য রকম হয়ে গেছে। বরং সে দেখতে আগের মতোই আছে। কিন্তু তারপরও তার ওই চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে, যা তাকে বদলে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, এই মানুষটা অন্য কেউ। এর সঙ্গে কথা বলতে হলে ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিতে হবে।

হৃদি বলল, কেমন আছ?

হা ভালো। তুমি?

আমি? উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে বলল হৃদি।

হ্যাঁ।

আমি…। বলে থমকাল সে। আমি…আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না।

কেন?

হৃদি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। অনিক বলল, কী হয়েছে তোমার?

কিছু হয় নি তো!

উঁহু। কিছু একটা তো হয়েছেই। সেটা কেবল বাবার মৃত্যুই না, অন্য কিছু।

নাহ্। অন্য কী হবে? বলে আবার আনমনা হয়ে গেল সে। ইতিউতি তাকাতে লাগল আশপাশে। অনিকের কেন যেন মনে হলো হৃদি তার চোখ লুকাতে চাইছে। সে বলল, আমার দিকে তাকাও।

হৃদি তাকাল। অনিক বলল, তুমি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছ?

ভয় কেন পাব?

আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাতে চাইছ। কিংবা বলতে ভয় পাচ্ছ।

হৃদি হাসল, কী লুকাব? লুকানোর মতো কী আছে আমার? তার ঠোঁটে স্লান বিবর্ণ হাসি। চোখে শঙ্কার কালো মেঘ। কিন্তু কিসের শঙ্কা? কী হয়েছে তার? গুরুতর কিছু? অনিক অবশ্য সমস্যাটা ধরতে পারল না। হৃদি বলল, তুমি কেমন আছ? তোমার মা? উনি কেমন আছেন? শরীর ভালো?

মা…আছেন। আসলে…।

বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করল অনিক। সে আগে হৃদির সমস্যাটা শুনতে চায়। কে জানে, হয়তো মায়ের কথা শোনার পর নিজের সমস্যাটাই আর বলবে না সে। কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলবে। তারা বসেছে একটা রেস্তোরাঁয়। চারপাশে মানুষ। এর মধ্যে কান্নাকাটি শুরু করলে বিপদ। সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। অনিককে চুপ। করে থাকতে দেখে হৃদি বলল, তুমি ভালো আছ?

অনিক জবাব দিল না। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদির দিকে। হৃদি বলল, কথা বলছ না কেন?

তুমি কি জানো যে এই একই প্রশ্ন তুমি আমাকে এই নিয়ে তিনবার করেছ? বলল অনিক।

ওহ্! ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হৃদি। তাই?

হুম।

সরি।

সরি কেন?

হৃদি কথা বলল না। চুপ করে রইল। অনিকের দিকে তাকাচ্ছে না সে। এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে। অনিক বলল, মায়ের কথা শুনবে না?

হুঁ। বলো।

তার আগে বলো সব শুনে তুমি শান্ত থাকবে।

আমি তো শান্তই আছি।

না মানে…মায়ের কথা শুনে। মানে, যদি…।

সমস্যা নেই, বলো। অস্থির ভঙ্গিতে বলল হৃদি।

গত প্রায় দুই মাস..জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সময়টা পার করছি আমি। আমি জানি তুমিও…।

হুম। বলে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৃদি।

সেদিন সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরলাম। তখনো সব ঠিকঠাক। কিন্তু পরদিন বিকেলে হঠাৎ করেই মা…।

হৃদি আচমকা হাত তুলে বলল, একটা কথা বলি?

বলো।

আমার না একটু তাড়া আছে। এই জন্য আগে আমার কথাটা বলি?

হৃদির আচরণে অবাক হলেও কিছু বলল না অনিক। প্রথম থেকেই কেমন অস্থির আর অমনোযোগী লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে সে তার কথা শুনছে না। অন্য কিছু ভাবছে। সারাক্ষণ মনে মনে সেই ভাবনাটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বলার সুযোগ খুঁজছে। অনিক বলল, বলো।

হৃদি সরাসরিই কথাটা বলল, আই নিড ডিভোর্স।

মানে! অনিকের মনে হলো সে ভুল কিছু শুনছে।

হৃদি স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, আমি তোমাকে দুয়েক দিনের মধ্যেই ডিভোর্স লেটার পাঠাব। আশা করছি এটা নিয়ে তুমি কোনো ঝামেলা করবে না। বলে সামান্য থামল। সে। তারপর বলল, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, বাট কান্ট হেল্প। বাবা নেই, মা, রিলেটিভসরাও হঠাৎ এমন…। কথা শেষ না করেই থামল সে। তারপর বলল, আই অ্যাম গেটিং ম্যারেড সুন।

অনিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এসব কী বলছে সে!

হৃদি উঠে দাঁড়াল। তার ভঙ্গি ধীর, স্থির। কিন্তু তাতে তার ভেতরের অস্থিরতাটা লুকানো গেল না। সে বলল, আরেকটা কথা, আমি জানি আমি খুব জঘন্য একটা কাজ করছি। আই কুড বি দ্য ওয়াস্ট গার্ল অব দিস ওয়ার্ল্ড। হৃদির গলা কাঁপছে। কিন্তু যতটা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করছে সে। অ্যান্ড আই একসেপ্ট ইট। এটা তোমাকে আর বলতে হবে না। বাট প্লিজ, ডু মি আ ফেভার। ডোন্ট মেক অ্যানি নুইস্যান্স প্লিজ। সে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। অনিক দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে রইল। হৃদি ভেবেছিল অনিক তাকে কিছু বলবে। হয়তো কান্নাকাটি করবে। জোরজবরদস্তি করবে। অনুরোধ করবে। কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু অনিক তার কিছুই করল না। সে কেবল তাকিয়েই রইল। তার চোখ স্থির, নিষ্কম্প।

হৃদি বলল, প্লিজ!

অনিকের আচমকা মনে হলো, খানিক আগে হৃদির চোখের যে ভাষাটা সে পড়তে পারে নি, ভীষণ অচেনা লাগছিল, সেই ভাষা সে পড়তে পারছে। তার চোখে ঘোর। তীব্র নেশা। ওই নেশা থেকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে ফেরাতে পারবে না। কিন্তু মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল, আর কিছুক্ষণ পরই তাকে ঘরে ফিরে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে মায়ের মুখোমুখি হতে হবে। মা তাকে হৃদির কথা জিজ্ঞেস করবেন। তখন কী করবে সে?

মাকে নিয়ে হয়তো কালই গ্রামে চলে যাবে। তারপর অপেক্ষায় থাকবে। মায়ের মৃত্যুর অপেক্ষায়। তারপর তাকে কবর দিতে হবে। উত্তর দিকে রাস্তার ধারে বাবার কবর, ওই কবরটার পাশেই হয়তো মায়ের কবর হবে। তারপর তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে হবে। এই যে তার সামনে হৃদি দাঁড়িয়ে আছে, এই শহরেই। কিন্তু এই শহরে সে কেন ফিরবে? কার কাছে ফিরবে?

এই যে লোকে লোকারণ্য শহর, সকাল-সন্ধ্যা ভিড়ভাট্টা জাগে,
তবুও এমন একলা লাগার মানে, নিজের একটা মানুষ সবার লাগে!

এই শহরে কিংবা এই পৃথিবীতে তার নিজের বলে তো আর কিছু রইল না। কিচ্ছু না। তারপরও এই শহরে সে কেন ফিরে আসবে?

আচ্ছা, হৃদি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কেন? সে কি তার কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাইছে? কিসের নিশ্চয়তা? ভালো না বাসার নিশ্চয়তা? নাকি বিচ্ছেদের? বিচ্ছেদের নিশ্চয়তা না হয় মানুষ দিতে পারে, কিন্তু কেউ কি কাউকে কখনো ভালো না বাসার নিশ্চয়তা দিতে পারে? সেই ক্ষমতা কি মানুষের আছে?

হৃদি আচমকা ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। অসংখ্য মানুষের মাঝ দিয়ে ক্রমশ চোখের আড়াল হয়ে যেতে থাকল সে। অনিক তাকিয়েই রইল। তার চোখের কোলে কি এক ফোঁটা জল জমতে শুরু করেছে? অনিক জানে না। তবে সেই জলের ফোঁটাটাকে গড়িয়ে পড়তে দিল না সে। কেবল তার বুকের বাঁ দিক থেকে উঠে আসা আশ্চর্য সূক্ষ্ম এক ব্যথা চিনচিন করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল শরীরজুড়ে। অনিক সেই ব্যথাটাকে গ্রাহ্য না করে পারল না। তার খুব দমবন্ধ লাগতে লাগল। মনে হতে লাগল, দুরারোগ্য এক ব্যাধি ক্রমশ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। কিন্তু ওই অসুখের নাম সে জানে না।

২৪

মাহমুদ হাসানের রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রিয়া অভ্যস্ত গলায় বলল, মে আই কাম ইন স্যার?

দীর্ঘ ক্লাস নিয়েছেন মাহমুদ। ফলে খানিক ক্লান্ত তিনি। সেই ক্লান্তি মুছতেই চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে কেবল চেয়ারে এসে বসেছিলেন। রিয়ার গলা শুনে চোখ তুলে তাকালেন। তারপর দরজায় দাঁড়ানো রিয়াকে দেখে যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, খুব জরুরি কিছু, রিয়া?

জি স্যার।

আমি একটু ব্যস্ত। আপনি কি ঘণ্টাখানেক পরে আসতে পারবেন? মানে, যদি সমস্যা না থাকে?

একটু জরুরি ছিল।

ওহ। হতাশ গলায় বললেন মাহমুদ। আচ্ছা, আসুন।

রিয়া রুমে ঢুকল। তার হাতে একগাদা বই। সে সেগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখল। মাহমুদ দেখে বললেন, কোনো সমস্যা?

রিয়া গম্ভীর ভঙ্গিতে খানিক কী ভাবল। তারপর বলল, আপনার কি এমন কিছু কখনো হয়েছে যে আপনি সব বুঝতে পারছেন, কঠিন কঠিন বিষয়ও। কিন্তু আপাতদৃষ্টে খুব সহজ কোনো একটা বিষয় আপনি বুঝতে পারছেন না?

হুম। এমন তো হতেই পারে।

আমারও তেমন হচ্ছে।

পার্টিকুলার কোনো সাবজেক্ট?

রিয়া সাথে সাথেই জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তারপর বলল, অ্যাস্ট্রোনমি থেকে অ্যানাটমি… ফিজিকস থেকে কেমেস্ট্রি, ম্যাথস…পড়লে কমবেশি সবই তো বুঝতে পারি। কিন্তু আই ক্যান্ট রিড মাইসেলফ।

মানে? ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মাহমুদ।

মানে আমি আমাকে বুঝতে পারছি না।

আপনি আপনাকে বুঝতে পারছেন না মানে কী?

মানে…। বলে সামান্য থামল রিয়া। যেন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কথাটা বলবে কি না। তবে শেষ পর্যন্ত বলল, আপনি এইমাত্র প্রায় দেড় ঘণ্টার একটা ক্লাস নিয়ে এলেন আমাদের, না?

হুম।

অথচ তারপরও আমার মনে হয়েছে আপনার সঙ্গে আমার আরও কথা বলা উচিত। অনেক কথা।

অনেক কী কথা?

তা তো জানি না। মানে, পার্টিকুলার কিছু না। কিন্তু বলা দরকার। কিংবা এমনও হতে পারে, মিনিংলেস কিছু। আপনি বলবেন, আমি শুধু শুনব। পৃথিবীর সব কথাই যে

অর্থপূর্ণ হতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই, তাই না?

মাহমুদ কিছু বললেন না। তিনি হতাশ চোখে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাসখানেকের স্বেচ্ছানির্বাসনের পর বাড়ি থেকে ফিরে এসে রিয়া যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত দু-তিন মাসে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটিয়েছে সে।

মাহমুদের ধারণা, প্রথম প্রথম বিষয়টা হালকাভাবে নিলেও এখন তিনি মেয়েটাকে ভয় পান। অল্প ভয় না, বেশি ভয়। এমন অঘটনঘটনপটীয়সী মেয়ে তিনি জীবনে আর দেখেন নি।

রিয়া বলল, সরি স্যার, আসলে আপনার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম নিজেকে বোঝাতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারি নি। অ্যান্ড দিস ইজ মাই প্রবলেম। আমি আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। বুঝতে পারলেও বোঝাতে পারছি না। আমি কি চেষ্টা কম করেছি? আপনি কিন্তু সাক্ষী। তাই না? আমার অবস্থায় থাকলে আপনি কী করতেন?

মাহমুদ কথা বললেন না। তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করছেন।

স্যার?

মাহমুদ গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার কি আর কোনো কথা আছে?

হুঁ। আছে।

কী কথা?

আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলেন, এটা আমার ভালো লাগে না।

আমি সবাইকেই আপনি করে বলি, রিয়া। শুধু আপনাকে না।

এই যে আপনি আমাকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করেন, এটাও আমার পছন্দ না।

রিয়া। শান্ত গলায় বললেন মাহমুদ। আপনাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই।

জি বলুন?

আপনার এই বয়সটা আমি পার করে এসেছি না?

জি।

এই বয়সে আমাদের সবারই নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবতে ভালো লাগে। একটু রেকলেস, আনকনভেনশনাল হতে ইচ্ছে করে। আর এ কারণে আমরা এমন কিছু উদ্ভট কাজ করি যে তাতে সবার মনোযোগ পাওয়া যায়। বাট…অ্যাট দ্য। এন্ড অব দ্য ডে, দিস উইল মেক ইউ আনইম্পর্ট্যান্ট টু আদারস।

রিয়া কথা বলল না। সে বুঝতে পারছে মাহমুদ তাকে আঘাত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে সে আহত হলো না। বরং ত্যাগ করার ভঙ্গিতে মৃদু ঠোঁট উল্টে হাসল।

মাহমুদ বললেন, আপনি যা করছেন, সেটার জন্য আপনার গিল্টি ফিলিং হয় না?

গিল্টি ফিলিং! যেন অবাক হলো রিয়া। কেন, গিল্টি ফিলিং হবে কেন?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন মাহমুদ? তিনি নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, আমার সত্যি সত্যিই হেল্পলেস লাগছে, রিয়া। আপনি রাতবিরাত যখন-তখন আমাকে ফোন করবেন। ফেসবুকে মেসেজ পাঠাবেন। ডিপার্টমেন্টে রুমে চলে আসবেন। আপনার বোঝা উচিত যে আমি আপনার শিক্ষক। আর এটা অন্য সবার চোখে লাগতে পারে।

শিক্ষককে ছাত্রী ফোন করতে পারবে না?

নিশ্চয়ই পারবে। কেন পারবে না? কিন্তু আপনি কি বিষয়টাকে আর সেই জায়গাতে রাখছেন?

তাহলে? কোন জায়গায় রাখছি?

মাহমুদ জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেলেন। বললেন, রিয়া, আপনাকে নিয়ে আমার বাসায়ও সমস্যা হচ্ছে। কদিন আগে আপনি কিছু না জানিয়ে হুট করে আমার বাসায় চলে গিয়েছিলেন। বিষয়টা সুমি ভালোভাবে নেয় নি।

কেন? আপনার বাসায় আপনার স্টুডেন্টরা যেতে পারবে না? যায় না?

যায়। বাট আপনার বিষয়টা তেমন না।

তাহলে স্বীকার করছেন যে আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা? চোখ সরু করে। কথাটা বলল রিয়া।

মাহমুদ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, সুমিকে আপনি কী বলেছিলেন?

কী বলব?

আপনিই বলুন?

বলেছি সুমি আন্টি, মাহমুদ ভাইয়া আছেন?

সুমি আন্টিটা কে?

আপনার স্ত্রী।

আর মাহমুদ ভাইয়া?

আপনি! আমি ভাই হলে সুমি আপনার আন্টি হয়?

হা, হয়।

ওয়েল, কিন্তু আমি আপনার ভাই কী করে হই?

ভাই না, ভাইয়া হন।

দুটোয় পার্থক্য কী?

আছে।

কী পার্থক্য?

মেয়েরা যখন নিজের আপন ভাই ছাড়া অন্য কাউকে খুব নরম গলায় সুর তুলে আহ্লাদী স্বরে ভাইয়া বলে ডাকে, তখন বুঝতে হবে সামথিং ইজ রং। আসলে আপনার সঙ্গে তো আমার বিশাল জেনারেশন গ্যাপ, সো আপনি এসব বুঝবেন না।

রিয়া…। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন মাহমুদ। আমি আপনার শিক্ষক। আপনি বয়সেও আমার থেকে অনেক ছোট। এগুলো আপনার মনে রাখা উচিত। আই অ্যাম অলমোস্ট অ্যান ওল্ড ম্যান।

ইউনিভার্সিটিতে তো আমি আপনাকে স্যারই ডাকি, তাই না? আর ওল্ড ম্যান। আমার ভালো লাগে। কী করব? ভাবছি আপনাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলেছি। নাম কী হবে জানেন?

মাহমুদ কথা বললেন না। ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়ের থেকে তার মুক্তি কিসে কে জানে! রিয়া বলল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটা বই আছে না, দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি? আমার বইয়ের নাম হবে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য মি। নামটা। সুন্দর না?

মাহমুদ এবারও কথা বললেন না।

রিয়াই বলল, এটা কিন্তু মেটাফোরিক্যাল নাম। বুঝেছেন তো? এখানে আপনি হচ্ছেন ওল্ড ম্যান আর আমি হচ্ছি সি, মানে সমুদ্র। সি ইজ মি। অ্যান্ড ইউ আর দ্যাট ওল্ড-অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার। বলেই খিলখিল করে হাসল সে।

মাহমুদ কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। এই মেয়ের সাহস দিন দিন বাড়ছে। তাকে এখনই থামানো দরকার। কিন্তু কেন যেন তিনি তা পারছেন না। বরং কোথায় যেন একটা অন্য রকম অনুভব কাজ করছে। এই অনুভবটা তিনি স্বীকার করতে চান না। আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করতে পারেন না।

মেয়েটার হাসি সুন্দর। সহজাত সরলতা আছে। চোখেমুখে সারাক্ষণ একটা অকপট উচ্ছ্বাস লেগে থাকে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবতে চান না তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্ক নিয়ে এমনিতেই নানান গালগল্প প্রচলিত আছে। এত বছর শিক্ষকতার পর সেই গল্পে আর নিজেকে যুক্ত করতে চান না মাহমুদ। বরং যতটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্বেই থাকতে চান। কিন্তু এমন সর্বগ্রাসী, সর্বপ্লাবী কারও কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। তারপরও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কে জানে কত দিন পারবেন!

সেদিন হঠাৎ করেই রিয়া তার বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। তারপর তার স্ত্রী সুমিকে বলেছে, হ্যালো আন্টি, মাহমুদ ভাইয়া আছেন?

সুমি তাকে চেনে। কিন্তু চট করে আন্টি ডাক শুনে হতভম্ব হয়ে গেল সে। বলল, সরি?

না, মানে আন্টি, মাহমুদ ভাইয়া আছেন? উনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন ফোন ধরছেন না। আপনি কি একটু বলবেন যে উনি কখন আসবেন?

আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। সুমি দরজায় দাঁড়ানো রিয়ার দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রিয়া অবশ্য তা গ্রাহ্য করল না। সে মৃদু হেসে বলল, আমার কথা বুঝতে পারছেন না, আন্টি? ওয়েল, ভাইয়া এলে বলবেন যে আমি এসেছিলাম। আজ যাই। পরে আবার আসব। বলে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগল সে।

দরজায় দাঁড়ানো সুমি হতভম্ব চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিয়া তাকে আরও হতভম্ব করে দিয়ে সিঁড়ির নিচ থেকে হাত নেড়ে বলল, ভালো থাকবেন, আন্টি। আবার দেখা হবে। বাই।

এই নিয়ে শুরু হলো ভয়ানক অশান্তি। মাহমুদ এমনিতে চুপচাপ, নির্বিরোধ মানুষ। কিন্তু তারপরও শেষ অবধি বিষয়টা আর এড়াতে পারলেন না তিনি। অল্প সময়েই পুরো

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সেই ঘটনার রেশ কেবল কাটতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রিয়া যদি এখন আবার এমন কিছু করতে থাকে, তাহলে ভয়াবহ বিপদ। মাহমুদ নরম গলায় বললেন, রিয়া, আপনার কি মনে হয় না আপনি অতিরিক্ত করছেন?

হ্যাঁ, হয়।

তাহলে?

তাহলে কী?

আপনার উচিত না বিষয়টা এখানেই শেষ করা?

কী জানি! আমার কথা তো ভাবি নি। তবে আপনার কথা ভেবেছি।

আমার কথা কী ভেবেছেন?

ভেবেছি, আপনার তো কোনো উপায় নেই, স্যার।

রিয়ার কথা সত্য। গত এক বছর ধরেই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন তিনি। কিন্তু পান নি। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু ইচ্ছে করেই ড্রপ দিয়ে ফার্স্ট ইয়ারেই রয়ে গেছে। এর যৌক্তিক কোনো কারণও নেই। সে এমনই খেয়ালি, অবিমৃশ্যকারী। সমস্যা হচ্ছে, তার এই অপরিণামদর্শিতার শিকার হচ্ছেন এখন তিনি। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথাও বলা যায় না। বুদ্ধি-পরামর্শও নেওয়া যায় না। বিষয়টা ভীষণ সংবেদনশীল। পান থেকে চুন খসলেই বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতে পারেন তিনি। খুব কাছের বন্ধুদের সঙ্গে বার দুয়েক শেয়ার করারও চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয় নি। তারা বরং সমাধান দেওয়ার পরিবর্তে হাস্যরস করার চেষ্টা করেছেন। যেন জগতে এর চেয়ে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক বিষয় আর নেই। দুয়েকজন তো রীতিমতো তাকে হিংসে করতে শুরু করেছেন। এই বয়সে এসেও নিজেকে এমন আকর্ষণীয় রাখার সিক্রেট জানতে চেয়েছেন।

মাহমুদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, আপনি আমার কাছে আসলে কী চান?

রিয়া সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। চুপ করে রইল। দীর্ঘ সময় পর খুব শান্ত, নরম গলায় বলল, সময়।

সময়?

হুম, সময়। বলে টেবিলের কাঁচে জমে থাকা জলের ফোঁটা আঙুলের ডগায় মিলিয়ে দিতে লাগল সে। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, মানুষ তো মানুষের কাছে সময়ই চায়। সময় ছাড়া এই জীবনে আর কী চায় মানুষ?

কথাটা যেন বুকে গিয়ে বিঁধল মাহমুদের। আসলেই তো, মানুষ মানুষের কাছে সময় ছাড়া আর কী চায়? কিছুই না। এই জীবন যদি অন্তহীন সময়ের ভগ্নাংশ হয়, তবে সেই জীবন থেকে মানুষ আবার ওই সময়ই চেয়ে বেড়ায়। একাকিত্বে সাহচর্যের সময়। বিষাদে আনন্দের সময়। আনন্দে উদ্যাপনের সময়। কিন্তু সময় ক্রমশই ধূসর আর বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। মানুষকে করে দিতে থাকে নিঃসঙ্গ, একা।

মাহমুদের হঠাৎ মনে হলো, এই সত্য তার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। উপলব্ধি করে না।

২৫

রোখসানা বেগম সব শুনে হতভম্ব ভঙ্গিতে বসে রইলেন। হৃদি বলল, আমি এখন কী করব?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন হৃদির চোখের দিকে। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। সেখানে অচেনা মানুষের প্রতিচ্ছবি। এমন হদিকে এর আগে কখনো দেখেন নি তিনি। হৃদি বলল, মা, আমার যা বলার আমি তোমাকে বলেছি। আমার সিদ্ধান্তও জানিয়েছি। এখন বাকি কাজ তোমার।

আমার কী কাজ?

বিয়ের ব্যবস্থা করা।

আমি বললাম আর ফট করে বিয়ে হয়ে গেল?

তুমি তো তা-ই চাইতে। চাইতে না? তোমার চাওয়াই তো এখন পূরণ হচ্ছে।

তুই যে আমাকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলবি, এটা আমি জানতাম? এটা আমি চেয়েছি?

মানুষের চাওয়ামতো তো আর সবকিছু হয় না। হয়? তোমার চাওয়ার বাইরে ওই ঘটনা ঘটেছে। এখন বাকি ঘটনা তোমার চাওয়ামতো হবে। বলে সামান্য থামল হৃদি। তারপর বলল, এখন বলো, আমি কী করব?

তুই কী করবি সেটা আমি বলব?

হুম।

আমার টেবিলের ওপর একটা পার্স আছে। পার্সে টাকা আছে। টাকা নিয়ে গিয়ে দোকান থেকে ভালো দেখে এক বোতল বিষ কিনে আনবি। তারপর দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে সেই বিষ মেখে খেয়ে ফেলবি।

আমি বিষ খাওয়ার মতো কিছু করি নাই, মা।

তুই যা করছিস, তা বিষ খাওয়ার চেয়েও খারাপ। তুই আমার মেয়ে না হয়ে অন্য কারও মেয়ে হলে আমি যে ভাষা ব্যবহার করতাম, সেই ভাষা শুনে তোর বমি চলে আসত।

চেষ্টা করে দেখতে পারো। হৃদির কণ্ঠ ঠান্ডা। দৃষ্টি স্থির।

রোখসানা বেগম বেশ খানিকটা সময় চুপ করে রইলেন। তারপর অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, তুই সত্যি করে বল তো, তুই কি আসলেই ওই ছেলেকে বিয়ে করেছিস? নাকি আমার সঙ্গে আবারও কোনো ট্রিকস করছিস?

এক কথা বারবার বলতে ভাল্লাগে না, মা। তুমি এখন ডিভোর্স দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

বিয়ে করেছিস তুই, আর ডিভোর্স দেব আমি?

আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে বলি নি। দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছি।

ডিভোর্স কি মুখের কথা যে বললাম আর হয়ে গেল? আর ওই ছেলে যদি কোনো ঝামেলা করে?

করবে না।

তোকে বলেছে?

বলে নি। কিন্তু আমি ওকে চিনি।

কী চিনিস?

সেটা তোমার জানতে হবে না।

জন্ম দিয়ে এত দিন লালন-পালন করেও তো তোকে আমি চিনতে পারলাম না!

আমাকে তোমার চিনতে হবে না। যা বলেছি, তুমি সেটা করো।

নেহাল যদি এখন তোর বিয়ের বিষয়টা জানে? ওই ছেলে যদি জানায়?

জানাবে না।

তুই কী করবি? জানাবি?

এই প্রশ্নে হৃদি কথা বলল না। সে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। আসলেই কি সে ঘটনাটা নেহালকে খুলে বলবে? নাকি চেপে রাখবে? কিন্তু এই নিয়ে যদি পরে কোনো ঝামেলা হয়? তা ছাড়া বিষয়টা নৈতিকভাবেও ঠিক হবে না।

রোখসানা বেগম বললেন, কী হলো, কথা বলছিস না কেন? এত বড় ঘটনা তুই চেপে যাবি?

বুঝতে পারছি না, মা। একবার ভেবেছিলাম বলব। এত বড় ব্যাপার লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়া দেখে আর সাহস পাই নি। আকারে ইঙ্গিতে কিছুটা বলার চেষ্টা করেছি। ও অবশ্য ভেবেছে আমি ফান করছি।

রোখসানা বেগম চুপ করে রইলেন। হৃদি বলল, তুমি অনিককে নিয়ে ভেবো না। ও কিছু করবে না। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ সাইন করে দেবে। তুমি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

.

অনিককে ডিভোর্স লেটার পাঠানো হলো স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে। তবে তার আগে এক খাঁ খাঁ দুপুরে রোখসানা বেগম তাকে ফোন করলেন। অনিক ফোন ধরে বলল, কে বলছেন?

আমি হৃদির মা।

মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল অনিক। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, আচ্ছা।

কেমন আছ তুমি?

জি ভালো।

তোমার মা?

ভালো।

আর সবাই?

ভালো।

রোখসানা বেগম এরপর আর কথা খুঁজে পেলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন না পরের কথাগুলো কীভাবে বলবেন। তা ছাড়া অনিকের কাছ থেকে এমন নির্লিপ্ত আচরণও তিনি আশা করেন নি। অনিক বলল, আপনি কি কিছু বলবেন?

রোখসানা বেগম জবাব দিতে পারলেন না। কী বলবেন তিনি? কীভাবে বলবেন? অনিক বলল, সমস্যা নেই, আপনি বলুন। তা ছাড়া আমাকে মার কাছে যেতে হবে। বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারব না আমি।

কেন?

মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তার সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ই কাউকে না কাউকে থাকতে হয়। একা রাখা যায় না।

কী হয়েছে ওনার? যেন কথা বলার প্রসঙ্গ খুঁজে পেলেন রোখসানা বেগম।

তেমন কিছু না। আপনি বলুন।

রোখসানা বেগম অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই কথা বললেন না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন, না, মানে হৃদি আর তোমার বিষয়টা আমি শুনেছি। কিন্তু… মানে হৃদি মনে হয় তোমাকে…। বলতে গিয়েও কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন তিনি।

অনিক শান্ত গলায় বলল, আমি শুনছি, আপনি বলুন।

আসলে হৃদি…। বলেই হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন রোখসানা বেগম। বললেন, আমার মনে হয় কথাগুলো ফোনে না বলে সামনাসামনি বললেই ভালো হতো, অনিক। আমি কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি?

কেন?

কথাগুলো বুঝিয়ে বলার জন্য। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ফোনে কথা বললে অনেক সময়ই ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। সামনাসামনি বললে হয়তো অনেক কঠিন কথাও সহজে বুঝিয়ে বলা যায়।

আমার বরং উল্টোটাই মনে হয়।

কী?

যেসব কথা খুব কঠিন, সেসব বলার জন্য আড়াল দরকার হয়। সব কথা মুখোমুখি বলা যায় না।

কথাটা মনে ধরল রোখসানা বেগমের। অনিককে তিনি যে কথাগুলো বলতে চান, সেগুলো আসলেই সহজ কোনো কথা নয়। এসব চট করে কারও মুখের ওপর বলেও দেওয়া যায় না। কিন্তু তার সামনে আর কোনো পথও খোলা নেই।

অনিক বলল, আপনি সম্ভবত ভাবছেন আমি কোনো ঝামেলা করব। কিন্তু আপনার ভাবনা ঠিক না।

তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।

অনিক মৃদু হাসল, আচ্ছা, ভুল বুঝব না। আপনি বলুন?

আসলে…। হৃদির বয়স অল্প। ও একটু ইমোশনাল, একরোখা। তুমি তো জানোই, হুটহাট ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছু করে বসে ও। পরে যখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারে, তখন…।

আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলি? রোখসানা বেগমকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল অনিক।

হ্যাঁ, বলো?

আসলে আমাকে ফোনটা রাখতে হবে। মা ডাকছেন। আমি বরং একটা কাজ করি?

কী কাজ?

আমি আপনাকে আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিই?

মানে? আমি তোমার গ্রামের বাড়ি গিয়ে কী করব?

অনিক আবারও হাসল। মৃদু, ম্লান হাসি, আপনি না। আপনি বরং আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় ডিভোর্স লেটারটা পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমি সাইন করে দেব।

তুমি এখন গ্রামে?

হুঁ।

বলে চুপ করে রইল অনিক। রোখসানা বেগমও। তিনি ভেবেছিলেন অনিক তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে। চিৎকার-চেঁচামেচি করবে। তেমন হলে অনিকের ভেতরের অবস্থা অন্তত কিছুটা হলেও আঁচ করা যেত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটি সম্ভব নয়। বরং এই ছেলের অন্তর্জগতের খবর সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। এমন নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে কথা বলবে, সবকিছু মেনে নেবে, এটা তিনি আশা করেন নি। কিন্তু তেমন কিছু না হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে শঙ্কিত বোধ করতে লাগলেন রোখসানা বেগম। তার হঠাৎই মনে হলো, এই ধরনের মানুষ বিপজ্জনক। এদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সহসা ধারণা করা যায় না।

তোমার মায়ের শরীর কি বেশি খারাপ? যেন অযথাই প্রশ্নটা করলেন তিনি।

অনিক সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমি যদি এখন ফোনটা রাখি, আপনি কি কিছু মনে করবেন? তার গলা শান্ত, স্বাভাবিক। রোখসানা বেগম জবাব দিলেন না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ফোনের ওপাশের মানুষটাকে হৃদি যত সহজ ভাবছে, সে তত সহজ নয়। বরং সে আর সকলের চেয়ে কঠিন, দৃঢ়। এমন মানুষের অনুভূতি প্রখর হয়। কিন্তু সেই অনুভূতি তারা কখনো প্রকাশ করতে পারে না। ফলে অন্যরা তাদের সম্পর্কে দ্বিধান্বিত হয়। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, তুমি হৃদির ওপর রাগ রেখো না, বাবা। আসলে…।

রোখসানা বেগম তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই ফোন কেটে দিল অনিক। তিনি দীর্ঘ সময় বন্ধ ফোনখানা কানে চেপে ধরে বসে রইলেন। যেন খানিক আগে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটার না-বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। পড়তে চেষ্টা করতে লাগলেন তার নিস্তব্ধতার ভাষা। কিন্তু পারলেন না। বিষয়টা তার মধ্যে অজানা এক আশঙ্কা তৈরি করতে লাগল। মনে হতে লাগল, অনিকের এই নীরবতা কোনো প্রলয়ংকরী ঝড়ের পূর্বাভাস।

.

তারপরও সবকিছুই হতে লাগল অতি দ্রুত। হৃদির ডিভোর্স-সম্পর্কিত প্রক্রিয়াও এগোতে লাগল ঠিকঠাক। সে অবশ্য বার কয়েক অনিককে ফোন করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি আর হয়ে উঠল না। রোখসানা বেগমের শঙ্কাও ভুল প্রমাণিত হলো। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিল অনিক। সবকিছু যে এত সহজে, এত দ্রুত ঘটে যাবে, এটা কারও কল্পনাতেই ছিল না। অনিকের সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও হৃদির কিঞ্চিৎ আশঙ্কা ছিল যে শেষ অবধি না কোনো একটা ঝামেলা পাকিয়ে বসে সে। কিন্তু তার এমন ভাবলেশহীন, নিরুপদ্রব প্রতিক্রিয়ায় হৃদিও খানিক অবাক হয়ে গেল।

অনিক কি তবে মনে মনে এটাই চেয়েছিল? সে-ও কি তবে কোনো একটা বাহানায় এই সম্পর্কের জোয়ালটা তার কাধ থেকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল?

এই ভাবনাও ক্ষণে ক্ষণে হৃদিকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। তার মনে হতে লাগল, অনিক তার এই বিরূপ-বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে হয়তো সর্বান্তঃকরণেই মুক্ত, ভারহীন হতে চাইছিল। হৃদিকে বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। আর এ কারণেই সে-ও মনে মনে একটা অজুহাত খুঁজছিল এবং হৃদি নিজ থেকেই সেই সুযোগটা তাকে করে দিল!

ভাবনাটা চকিতে কয়েকবার মনের অলিগলি ঘুরে গেলেও তাতে খুব একটা স্থির হতে পারল না হৃদি। সে বরং ব্যস্ত হয়ে পড়ল নেহালকে নিয়ে। তাকে এখনো এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি। এমনকি এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না সে। সেদিন বিষয়টা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার কথাও হলো। হৃদি বলল, তুমি একটা বুদ্ধি দাও তো, মা।

আমি কী বুদ্ধি দেব?

নেহালকে কি আমি ঘটনাটা বলব?

বুঝতে পারছি না।

ও খুব ভালো ছেলে, মা। মনটা খুব নরম। বললে হয়তো একটু মন খারাপ বেকরবে। রাগ করে থাকবে। কিন্তু তারপর ঠিকই সব মেনে নেবে। কারণ, আমাকে ছেড়ে

ও থাকতে পারবে না।

তুই পারবি?

মানে?

মানে সব শুনে ও যদি বেঁকে যায়? বিয়েতে রাজি না থাকে, তখন? তখন কি তুই ওকে ছাড়া থাকতে পারবি?

এই প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল হৃদি। আসলেই, নেহালকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না।

জীবন কী আশ্চর্য রহস্যে মানুষের অনুভবের দেয়ালে অসংখ্য চোরাগলির গোপন দরজা লুকিয়ে রাখে। সেই সব দরজা কখন কোন ফাঁকে হুটহাট খুলে যায়, মানুষ তা টেরই পায় না। কিংবা যখন পায়, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে সেই সব চোরাগলির মাঝপথে। সেখান থেকে তার ফিরে যাওয়ার আর উপায় থাকে না। সে নিজের অজান্তেই ততক্ষণে হেঁটে গেছে অনেকটা পথ।

নেহালও তেমনই এক চোরাগলির গোপন দরজা। হৃদি আলগোছে অজান্তেই সেই দরজা পেরিয়ে ঢুকে গেছে সম্মোহনী এক অনুভবের জগতে। ওই জগৎ থেকে ফিরে আসবার পথ তার জানা নেই। ফলে নেহালকে হারানোর ভয়ে সে জড়সড় হয়ে যেতে থাকে। আর ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে অনিক।

তবে এত কিছুর মধ্যেও ওই একটা বিষয়ই সারাক্ষণ তটস্থ করে রাখে তাকে। অনিকের সঙ্গে তার বিয়ের ঘটনাটা সে নেহালকে বলবে কী করে? বললে যদি নেহাল ফিরে যায়? আবার না বলেও স্বস্তি পায় না সে। নিজেকে অতটা অনৈতিক ভাবতে মন সায় দেয় না তার। ফলে এক প্রবল দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে কেটে যেতে থাকে সময়। ওই দ্বিধা কাটাতেই আকারে-ইঙ্গিতে নানা কিছু বলতে চেষ্টা করে সে। তবে নেহাল তার কতটুকু বুঝতে পারে, তা স্পষ্ট নয়।

হৃদি সেদিন বলল, মানুষ কি তার অতীতে বাঁচে, না বর্তমানে?

নেহাল বলল, অতীত হলো শিকড় আর বর্তমান তার বৃক্ষ।

তার মানে মানুষ কেবল তার বর্তমান নিয়ে বাঁচতে পারে না?

পারে। তবে অতীতকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নয়। ধরো বৃক্ষবিহীন শাখা যেমন হয় না, তেমনি শিকড়বিহীন বৃক্ষও না। ভবিষ্যৎ হলো বর্তমানের শাখা। অতীত হলো শিকড়। এরা কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারে না।

তুমি এত কঠিন করে কথা বলা কবে শিখলে?

নেহাল হাসল, কঠিন তো নয়। আজ যা বর্তমান, কাল তা অতীত। তাই না? আবার আজ যা ভবিষ্যৎ, আগামীকাল তা বর্তমান। এটা অনেকটা সিঁড়ির মতো। প্রথম ধাপ না পেরিয়ে দ্বিতীয় ধাপে যেমন পৌঁছানো যায় না, তেমনি দ্বিতীয় ধাপ পেরিয়েই অন্য ধাপে পৌঁছাতে হয়। তার মানে প্রতিটি মুহূর্তই ইম্পর্ট্যান্ট। একটি ছাড়া অন্যটাতে পৌঁছানো যায় না।

হৃদি কথা বলল না। নেহাল বলল, যে সিঁড়ির প্রথম ধাপ নেই, তার শেষ ধাপও থাকে না।

কিন্তু কেউ যদি ভুলে অসতর্কতায় পা হড়কে আবার উঠে দাঁড়াতে চায়? ভাঙা, জীর্ণ কোনো ধাপে হোঁচট খেয়ে পা কেটে ফেলে, তারপর আলগোছে সেটিকে ডিঙিয়ে পরের ধাপে চলে যায়, তখন কি আর সে ওই ফেলে আসা ধাপটার দিকে তাকাতে চাইবে? কিংবা এতে তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে?

তা যাবে না। কিন্তু জীবন কেমন, জানো তো?

কেমন?

জীবন হচ্ছে দর্শন। তুমি কীভাবে দেখছ, তা-ই তোমার জীবন। কিংবা তুমি। এখানে দৃষ্টিভঙ্গিটাই আসল।

দৃষ্টিভঙ্গিই জীবন?

হুম। জীবন হচ্ছে তা-ই, যেভাবে তাকে তুমি উপলব্ধি করছ। দেখছ। তুমি যদি ভাবো ওই ভাঙা ধাপটা তোমার জীবনের ভুল, ক্ষতির কারণ, সেটাকে তুমি ভুলে যেতে চাও, তাহলে সেটা যেমন সত্যি, তেমনি আবার এটাও হতে পারে যে ওটা তুমি ভুলতে চাও না। বরং মূল্যবান এক অভিজ্ঞতা হিসেবে মনে রাখতে চাও। তখন সেই অভিজ্ঞতা তোমার জীবনের বাকি সিঁড়ির ধাপগুলোতে তোমাকে আরও সাবধানে পা ফেলতে সাহায্য করবে।

হৃদি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, যদি আমার জীবনেও তেমন কোনো গল্প থাকে! ভুলের গল্প। যেই ভুল থেকে ওই উপলব্ধিটুকু আমার হয়েছে যে আমি আর ভুল করতে চাই না। তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে জীবনের পরের ধাপের মানুষগুলো কি আমার ওই ভুলটাকে মেনে নেবে?

কেন নেবে না? কেউ যখন তোমাকে ভালোবাসবে, সত্যি সত্যি তোমার পথ চলার সঙ্গী হতে চাইবে, তখন সে তোমার সবকিছু নিয়েই ভালোবাসবে। তোমার ভুল, শুদ্ধ, শক্তি, সীমাবদ্ধতা। সব।

তুমিও?

কেন, সন্দেহ আছে?

না না, তা না। তবে অনিকের সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি যদি কখনো ওটা নিয়ে আমাকে কষ্ট দাও? আঘাত করো?

তাহলে এভিলিনকে নিয়ে তুমিও তো আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে পারো। পারো না?

কিন্তু আমাদের সবার দেখার ভঙ্গি তো এক নয়। আমি যেভাবে দেখি, ভাবি, তুমি তো সেভাবে না-ও ভাবতে পারো।

তুমি কীভাবে ভাবো?

আমি? বলে সামান্য থমকাল হৃদি। যেন কী ভাবল। তারপর বলল, এভিলিনকে ভালোবাসার যে অসম্ভব ক্ষমতা আমি তোমার মধ্যে দেখেছি, এত দিন পরও একজন মৃত মানুষকে যে এতটা ভালোবাসতে পারে, তার সেই ভালোবাসার সামান্যও যদি আমি পাই, তাহলে এ জীবনে আর কিছু চাই না আমার। হয়তো পেয়েছিও। ফলে তোমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ–সবই আমার কাছে কেবল তোমার ওই ভালোবাসতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতায় পরিমাপযোগ্য।

তাহলে তোমার অতীত সম্পর্কে আমার অনুভূতি নিয়ে তোমার সংশয় কেন?

এই প্রশ্নে চুপ করে গেল হৃদি। কী জবাব দেবে সে? বলবে অনিকের সঙ্গে তার সম্পর্কের সবটুকু? নেহাল কি তা মেনে নিতে পারবে? হয়তো পারবে। কিন্তু যদি না নেয়? তখন কী হবে?

এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না হৃদি। বরং সারাক্ষণ আলপিনের মতো বিধে যেতে থাকে তার মন ও মগজে। নেহাল বলে, তুমি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছ?

হুম। স্বীকার করে হৃদি।

অনিক তোমার কোনো ক্ষতি করবে, এই ভয়?

না। মাথা নাড়ে হৃদি।

তাহলে?

আসলে আমাদের সম্পর্কটা কেমন অদ্ভুত। একটা ঘোরের মতো। এখন মনে হচ্ছে যা কিছু ঘটেছিল, তার সবই একধরনের ঝোঁক। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় তুমি যদি বড় ধরনের কোনো ভুল করে ফেলো, তা তো আর শুদ্ধ হয়ে যায় না। তাই না? তা ভুলই থেকে যায়।

কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে কেউ যখন সেই ভুল পথ থেকে সরে আসে, অনুশোচনায় ভোগে, তখন তো আর তাকে দোষ দেওয়া যায় না। যায়?

তা যায় না। কিন্তু ওই যে অনিকের সঙ্গে আমার বিয়ের বিষয়টা…? কথা শেষ করতে পারে না হৃদি। তার আগেই নেহাল হাসিতে ফেটে পড়ে। বলে, তুমি এত ছেলেমানুষ, বুঝলে?

কেন?

ও রকম একটা সিনেমা সিনেমা ব্যাপার নিয়ে কেউ এত সিরিয়াস হয়?

ওটা ঠিক সিনেমা সিনেমা ব্যাপার না, নেহাল। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। কিংবা বলতে পারছি না।

নেহাল অকস্মাৎ কাছে সরে আসে হৃদির। তারপর দুহাতে তাকে বুকের ভেতর টেনে নেয়। তারপর গভীর আশ্লেষে ঠোঁট টেনে নেয় ঠোঁটের ভেতর। ফিসফিস করে বলে, তোমার অত কিছু বলতে হবে না। বোঝাতেও হবে না। এখন থেকে আমরা আমাদের না-বলা কথাগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। এই চেষ্টাটাই আসল। একটা সময় দেখবে, না বলতেও আমরা আমাদের বুঝে ফেলতে পারব। আমাদের অভিমান, কষ্ট, ভালোবাসা–সব। এই জন্য খানিক সময় তো আমাদের নিজেদের দিতে হবে, তাই না?

হৃদি আর কথা খুঁজে পায় না। তার চোখের কোলে জল জমে। এমন ভালোও হয় মানুষ? এমন করে ভালোবাসতে পারে? অনিককে নিয়ে অপরাধবোধের যে সূক্ষ্ম কাঁটা তার বুকের ভেতর খচখচ করছিল, তা ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। মিইয়ে যেতে থাকে নেহালকে নিয়ে সংশয়ও। সময় কেটে যেতে থাকে চড়ই পাখির ডানায়। আর মাত্র কটা মাস। তারপর এই মানুষটা পুরোপুরি তার হয়ে যাবে। হয়ে যাবে জীবনের বাকি পথের নির্ভার, নিশ্চিন্ত সঙ্গী। যে তাকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারবে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে দাঁড় করাতে পারবে। তারপর হেঁটে যেতে পারবে বহুদূর পথ। সেই পথে অনিক ক্রমশই বিস্মৃত হতে থাকবে। মুছে যেতে থাকবে তার ছায়া ও ছবি। বিভা ও বিভ্রম।

২৬

অবন্তী এসে উঠেছে হলে রিয়ার রুমে। তারা একই বিছানা ভাগাভাগি করে ঘুমায়। বিষয়টা অবন্তীর পছন্দ না। কারও সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে অভ্যস্ত নয় সে। কিন্তু। চাইলেই তো আর চট করে হলে সিট পাওয়া যায় না। আগে কোনোভাবে একটা রুমে উঠে যেতে হয়। তারপর অপেক্ষায় থাকতে হয় কোনো সিট ফাঁকা হওয়ার। এতে দ্রুত সিট পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বুদ্ধিটা রিয়ার। সে এই কারণেই অবন্তীকে তার রুমে নিয়ে এসেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বুদ্ধিটা কাজেও লেগেছে। রুমের সিনিয়র এক আপুর সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে অবন্তীর। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই হল ছেড়ে দেবেন। তখন অনায়াসে তার সিটের দখল নিতে পারবে অবন্তী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি হল ছাড়ছেন না। আবার তার মুখের ওপর কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না অবন্তী। সে বরং মাঝে মাঝেই রিয়াকে বলে, তুই একটু

আপুকে বল না?

কী বলব?

উনি কবে যাবেন?

কেন?

কেন মানে? আর কত দিন আমরা ডাবলিং করব?

সারা জীবন।

মানে কী?

মানে তোকে আর আমি ছাড়ছি না। এমন নরম তুলতুলে পাশবালিশ আমি আর কই পাব? নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে রিয়া।

অবন্তী হাতের উল্টো পিঠে তার মাথায় চাটি মারে, ফাজলামো রাখ। তুই একটু জিজ্ঞেস কর না?

ফাজলামো না। সত্যি বলছি। চিন্তা করেছি ওল্ড ম্যানকে আর বিয়ে করব না। ওই বুড়ো হাড়ে ঠনঠন বাড়ি খাওয়ার চেয়ে তোর তুলতুলে শরীর লেপ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেব। আইডিয়া কেমন?

খুবই বাজে। জঘন্য।

কোনটা?

দুটোই।

তার মানে ওল্ড ম্যানও নেই, তুইও নেই? তাহলে আমার জীবনে আর রইলটা কী?

অবন্তী অনেক চেষ্টা করেও আর সেদিন অন্য কিছু মাথায় ঢোকাতে পারল না। রিয়ার। তবে পরদিন হঠাৎ তাকে চমকে দিল রিয়া। বলল, যাবি আমার সঙ্গে?

কোথায়?

ডেটিংয়ে।

ধ্যাৎ। সব সময় ফান।

ফান না। সিরিয়াস। তোকে আজ একটা ভূত দেখার অভিজ্ঞতা দেব।

ভূত দেখার অভিজ্ঞতা কী?

ভূত দেখার অভিজ্ঞতা হলো হঠাৎ অকল্পনীয় কিছু দেখে চমকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার অভিজ্ঞতা।

কী সেটা?

চল। নিজের চোখেই দেখতে পাবি।

নিজের চোখে দেখার আগে একটু হিন্টস দিয়ে রাখ। পরে যদি ভূত দেখে চমকে গিয়ে নিজেই মরে ভূতটুত হয়ে যাই?

আমার প্রেম হয়েছে। আজ প্রথম বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

ঘ্যাট! বলে গাল বকল অবন্তী। তুই সারাক্ষণ কেন এমন হেঁয়ালি করিস? একটু সিরিয়াস হতে পারিস না?

রিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হেঁয়ালি করলাম কই? আমি সত্যিই বললাম। কিন্তু আমি যা-ই বলি, তা-ই তোদের কাছে হেঁয়ালি মনে হয়। এখন আমি কী করব বল?

আচ্ছা, কিছু করতে হবে না। কিন্তু তুই তোর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেট করতে আমাকে নিয়ে যাবি? এখন আবার বলিস না যে এটাও সিরিয়াস?

রিয়া হঠাৎ খিলখিল করে হাসল। বলল, সমস্যা কী? গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে জাস্ট ফ্রেন্ড ফ্রি! স্পেশাল অফার। ভালো না? একের ভেতর দুই, আমি আর তুই।

ধুর! এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল অবন্তী। সবকিছু নিয়ে এত ফাজলামো ভালো লাগে না রিয়া। বলে উঠে দাঁড়াল সে। তার মুখ থমথমে। রিয়া হঠাৎ তার হাত টেনে ধরল। তারপর বলল, সরি। আর ফান করব না। এবারই শেষ। এই দেখ, কান ধরছি। বলেই সে অবন্তীর কান মুচড়ে দিল। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ছিটকে দূরে সরে গেল অবন্তী। রিয়া শরীর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। যেন তার জীবনে এর চেয়ে আনন্দময় কিছু আর নেই। অবন্তী বেশ খানিকটা সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

পরদিন সন্ধ্যায় অবশ্য সত্যি সত্যিই চমকে গেল অবন্তী এবং তা চোখের সামনে হঠাৎ ভূত দর্শনের চেয়ে কম কিছু নয়। ধানমন্ডির যে রেস্তোরাঁটায় তারা গেল, তা বেশ চুপচাপ, নির্জন। লোকজনের ভিড় একদমই নেই। পরিচিত স্প্যানিশ গানের টুংটাং সুর বাজছে গিটারে। একটা আবছায়া ধোঁয়াশা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে চারপাশ। যে দুয়েকজন মানুষ এখানে আছে, আধো আলো-অন্ধকারে তাদের মুখও দেখা যাচ্ছে না। তবে রিয়াকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অবন্তী। সে তাকে এখানে একা বসিয়ে রেখে পশ্চিম দিকের দেয়ালঘেঁষা টেবিলটাতে গিয়ে বসেছে। জায়গাটা মূল রেস্তোরাঁ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। ফলে অন্যরা খুব একটা খেয়াল করছে না। অবন্তী অবশ্য একমুহূর্তের জন্যও চোখ সরাল না। রিয়া তাকে কী এমন দেখাবে যে তা দেখে চমকে যাবে সে? সুদর্শন, লম্বা চুলের ঋজু মানুষটা এলেন ঠিক তখুনি। মানুষটাকে দেখে অবন্তীর বুকের ভেতরটা যেন ধক করে উঠল। মাহমুদ হাসান এখানে? রিয়ার সঙ্গে? যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

.

তারা হলে ফিরল ঘণ্টা দুয়েক বাদে। তবে রিকশায় উঠতেই অবন্তী খপ করে হাত চেপে ধরল রিয়ার। বলল, এটা কী হলো?

কী?

স্যার তোর সঙ্গে এখানে?

কী করবে তাহলে? এখানে ছাড়া আর কোথায় যাবে? বেডরুমের ব্যবস্থা তো। এখনো হয় নি। বলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চোখ টিপল রিয়া।

রিয়া! কটমট করে তাকাল অবন্তী। ঘটনা কী, আমাকে খুলে বল।

ঘটনা কিছুই না। উই আর ডেটিং ফর দ্য ফার্স্ট টাইম।

মানে তুই বলতে চাইছিস যে স্যারের সঙ্গে তোর কোনো একটা…মানে ইউ আর ইন আ রিলেশনশিপ উইথ হিম?

রিয়া এবার আর সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, এখনো না। তবে…হুম, সম্ভবত।

মানে কী!

মানে…আমরা ইদানীং কথা বলছি।

রেগুলার?

অলমোস্ট।

কী কথা?

অনেক কিছু। উনি সিনেমা, লিটারেচার নিয়ে অনেক জানেন। সেসব নিয়েও।

ফোনে কথা হয়?

।হুম। বাইরেও।

বাইরে মানে কোথায়?

ক্যাম্পাসে। ডিপার্টমেন্টের করিডরে। ওনার রুমে। কিন্তু জানিসই তো, একটুতেই চারপাশে কেমন ফিসফাস। আর উনি বিষয়টা নিয়ে খুব সতর্ক। ফলে একভাবে বাধ্য হয়েই আজ এখানে আসতে হলো।

তোরা সত্যি সত্যিই…? মানে সত্যি সত্যিই তোরা একটা সম্পর্কে…! যেন। কিছুতেই রিয়ার কথা বিশ্বাস হতে চাইছে না অবন্তীর।

ওভাবে কিছু তো বলা হয় নি। আমিও না। উনিও না। রিয়ার কণ্ঠ শান্ত, গভীর।

তবে তুই তো বুঝতেই পারছিস, সামহাউ ইটস হ্যাঁপেনিং। মানে ওনার চারপাশে যে শক্ত দেয়ালটা উনি তুলে রেখেছিলেন, সেটা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে।

তা কেমন?

ধর, আগে এক শ বার ফোন করলেও একবার ধরতেন না। আর এখন আমরা প্রায় নিয়মিতই কথা বলি। দেখা হয়। কখনো কখনো উনি নিজে থেকেই মেসেজ করেন। এমনকি আজ যে আমরা এখানে দেখা করতে এসেছি, এটাও কিন্তু উনিই বলেছেন। অথচ এর আগে আমি কতবার অনুরোধ করেছি, লাভ হয় নি। উনি আজ কী বললেন, জানিস?

কী? অবন্তী যেন গলায় জোর পাচ্ছে না। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে মাহমুদ হাসানের মতো কেউ সত্যি সত্যিই তার ছাত্রীর সঙ্গে এমন একটি বিশেষ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। সে বলল, কী বলেছেন উনি?

বলেছেন, ওনার খুব গিল্টি ফিলিং হচ্ছে।

কেন?

সেটাই। আমরা তো এখনো কেউ কাউকে কিছু বলিই নি। বিশেষ কোনো সম্পর্কের কথাও না। হ্যাঁ, আমরা ইদানীং কথা বলছি। কিন্তু সেটা তো হতেই পারে, তাই না? তাহলে ঠিক কী কারণে উনি গিল্টি ফিল করছেন, বল?

অবন্তী কথা বলল না। রিয়া বলল, তার মানে উনিও জানেন কিংবা বুঝতে পারছেন যে উই আর গোইং টু হ্যাভ আ স্পেশাল রিলেশনশিপ। তাই না?

অবন্তী চুপ করেই রইল। সে এখনো বিষয়টা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। মাহমুদ হাসান সম্পর্কে তার যে ধারণা, তা অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। মধ্যবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুদর্শন, আকর্ষণীয় শিক্ষক তিনি। এতে তার চিন্তা, আচরণ ও ব্যক্তিত্বের ভূমিকাও প্রবল। সেই মানুষটি তার বিবাহিত জীবনের বাইরে এসে এই বয়সে রিয়ার মতো কারও সঙ্গে এমন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন, এটি ভাবা কষ্টকরই বটে। ফলে বিষয়টা মেনে নিতে একভাবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধই করতে হচ্ছে অবন্তীর।

সে মৃদু গলায় বলল, তোর কোনো গিল্টি ফিলিং হচ্ছে না?

কেন? ওনার ঘরে বউ-বাচ্চা আছে বলে?

আরও নানান কারণ আছে। তবে হ্যাঁ, এটাও একটা কারণ। কিংবা প্রধান কারণ।

বুঝতে পারছি না। আর ওই কথাটা শুনিস নি?

কোন কথা?

নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার?

শুনেছি। বাট কথাটাকে আমার খুব গা-ঘিনঘিনে মনে হয়। বলল অবন্তী।

কেন? এত সুন্দর একটা কথাকে কেন গা-ঘিনঘিনে মনে হবে?

এটা মোটেও সুন্দর কোনো কথা না, রিয়া। ইটস আ ফিলদি কোট। এই এক কথা দিয়ে মানুষ ভালোবাসার নামে অন্যায়কেও জাস্টিফাই করতে চায়। কিন্তু আসলেই। কি তা হওয়া উচিত? তুই ভালোবাসার জন্য কাউকে খুন করতে পারিস? কারও ঘর ভেঙে দিতে পারিস? পারিস না। কেউই পারে না। ভালোবাসা হবে কনস্ট্রাকটিভ। ডেস্ট্রাকটিভ না।

কিন্তু কিছু গড়তে হলে তো কিছু ভাঙতেই হয়।

যদি কিছু ভঙ্গুর না হয়, জরাজীর্ণ না হয়, তবে তা ভেঙে সেখানে অন্য কিছু গড়ার দরকার নেই। হি হ্যাঁজ আ গুড ফ্যামিলি লাইফ। ওনার ওয়াইফের সঙ্গে ওনার সম্পর্কও ভালো। তুই একবার ভাব, তুই যদি এমন দিনের পর দিন তার পেছনে লেগে না থাকতি, তাহলে এটা হতো?

রিয়া মাথা নাড়ল, না।

তাহলে? উনিও তো মানুষ, তাই না?

হুম এবং ভালো মানুষ। আমি জানি, ওনার এইটুকু অবধি পৌঁছাতে আমাকে কী করতে হয়েছে!

কিন্তু কাজটা কি ভালো হলো, রিয়া?

রিয়া এবার আর জবাব দিল না। চুপচাপ কী ভাবল। তারপর বলল, আমি সম্ভবত খুব খারাপ মানুষ, অবন্তী। কী করব বল? নিজেকে তো সামলাতে পারলাম না। চেষ্টা কি কম করেছি? তুই দেখিস নি?

অবন্তী কথা বলল না। রিয়া বলল, আমি জানি, সামথিং ইজ রং। টেরিবলি রং। বাট আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেলফ। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তুই বল, করি নি? কিন্তু পারি নি, সেটা কি আমার দোষ? বলেই হঠাৎ ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল রিয়া। অবন্তী রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল। এমন রিয়াকে দেখতে অভ্যস্ত নয় সে। রিয়া বলল, আমি খুব খারাপ মানুষ, তাই না? খুব খারাপ?

অবন্তী তার এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। তারা যখন হলের গেটে নামল, তখনো স্বাভাবিক হয় নি রিয়া। অবন্তী বলল, শরীর খারাপ লাগছে?

হুঁ।

ডাক্তারের কাছে যাবি?

না।

তাহলে?

কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকি?

আচ্ছা।

তারা হলের উল্টো দিকের খোলা জায়গাটাতে বসে রইল। কোথা থেকে একটা ফুরফুরে হাওয়া এসে খানিক আরামদায়ক অনুভব দিল। ঠিক এই সময়ে ছেলেটাকে চোখে পড়ল অবন্তীর। মঈন দাঁড়িয়ে আছে তার হলের সামনে। সে কি তার খোঁজে এসেছে? কিন্তু তাহলে তো তাকে ফোন করার কথা। সে ফোন বের করে দেখল। না, কেউ তাকে ফোন করে নি। তাহলে মঈন ওখানে কী করছে?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সে যখন রিয়াকে নিয়ে হলের গেটের দিকে এগোল, তখন চট করে আড়ালে চলে গেল মঈন। বিষয়টাতে ভারি অবাক হলো অবন্তী। তার মানে, মঈন তার সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসে নি! সে এসেছে অন্য কোনো কারণে। কিন্তু কী সেই কারণ? সে যদি তার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তবে আগের মতোই এগিয়ে এসে কথা বলার চেষ্টা করত। কিন্তু আজ ঠিক অন্য কী কারণে সে এখানে এসেছে? কেন সে তাকে দেখে ওভাবে আড়ালে চলে গেল?

অবচেতনেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতে লাগল অবন্তী।

একটা তীব্র অস্বস্তি সারা রাত জাগিয়ে রাখল তাকে।

২৭

উঠানের দখিন দিকে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল তেঁতুলগাছ। সেই গাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন রাহিমা বানু। তার পাশে আয়েশা। রাহিমা বানু ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন, ও আয়েশা? আয়েশা?

মা। আয়েশা মৃদু স্বরে জবাব দেয়। মায়ের অবস্থা সে জানে। অনিক তাকে সব বলেছে। এই যে ছোট্ট সংসার, এই সংসারে এখন তারা দুই অসমবয়সী ভাই-বোনই যেন কূলহারা নৌকার মাঝি। ফলে তারা পরস্পরের কাছে কিছু লুকায় না। কিংবা যতটুকু বললে সামনের অকূল পাথারে খানিকটা হলেও স্থির থাকা যাবে ততটুকু বলে। রাহিমা বানু বললেন, তোর ভাই কই?

বাজারে গেছে, মা।

এই দুপুরবেলা বাজারে কী?

তা তো জানি না। বলল, এখনই চলে আসব।

কখন আসবে? কতক্ষণ হলো ও বাড়িতে নাই। তোরে এইভাবে একলা একলা রেখে সে যখন ইচ্ছা তখন বাড়ির বাইরে চলে যাবে, এইটা কেমন কথা?

আমি তো একলা না, মা। তুমি তো আছ।

আমি আছি? যেন স্বগতোক্তির মতো কথাটা বললেন রাহিমা বানু। আমি কি সত্যই আছি? আমি তো নাই।

কে বলছে তুমি নাই? এই যে তুমি আছ! বলেই খানিক ঝুঁকে মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল আয়েশা। রাহিমা বানুর গালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। সেই গর্তের এখানে-সেখানে জমে আছে জলের ফোঁটা। আয়েশা বলল, তুমি কাঁদতেছ কেন, মা?

কাঁদতেছি নাকি?

এই যে তোমার চোখে পানি?

রাহিমা বানু এবার আর কথা বললেন না। তিনি আজকাল সত্যি সত্যিই বুঝতে পারেন কখন কাঁদেন, কখন ঘুমান, কখন জেগে ওঠেন। তার কাছে দিন-রাত, ঘুম-জাগরণ– সব একই রকম মনে হয়। আয়েশা বলল, তোমার খুব খারাপ লাগতেছে, মা?

বুঝতে পারতেছি না।

তুমি কি একটু উঠে বসবা?

গায়ে জোর নাই। উঠতেই পারি না। বসব কেমনে?

আমি তোমারে ধরে বসাই?

বসা।

আয়েশা অবাক হয়ে লক্ষ করে সে খুব সহজেই মাকে ধরে তুলে বসাতে পারে। কী আশ্চর্য, মা কখন এত শীর্ণ, ক্ষীণকায়, তুলোর মতো পলকা হয়ে গেল? এই তো বছর কয়েক আগেও মা তাকে কোলে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়াত। আর রাগে গজগজ করতে করতে বলত, এত বড় ধাড়ি মাইয়া হইছে, তাও মায়ের কোল থেকে নামনের নাম নাই। এই মাইয়া নিয়া আমি কী করব? একলা বিছানায় ঘুমাইতে পারে না। বাতি নিভাইলে ভয় পায়। আমি না থাকলে তোর কী হইব, হ্যাঁ? কী হইব?

তুমি থাকবা না কেন? ছোট্ট আয়েশা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকাত।

থাকব না কেন মানে কী? সবাই কি সারা জীবন থাকে?

না থাকলে কই যায়?

আল্লাহর কাছে যায়। আল্লাহ তার কাছে নিয়া যায়।

তাইলে আমিও যাব। তুমি যখন যাবা, তখন একলা কেন যাবা? আমারেও নিয়া যাবা।

বালাই ষাট। বলেই তটস্থ ভঙ্গিতে মেয়ের মাথা, মুখ, বুকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতে থাকেন রাহিমা বানু। এমন কথা কইতে হয় না, মা। এমন অলক্ষুনে কথা আর কখনো বলবা না।

তোমার সঙ্গে যাইতে চাইব না? তাইলে একলা থাকতে চাইব? আমার একলা থাকতে ভয় করে, মা।

রাহিমা বানু প্রসঙ্গ পাল্টাতেন, একলা থাকতে ভয় লাগলে কেমনে হইব? বড় হইতেছ। কয় দিন পর বিয়া দিতে হইব। তখন তো শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইব।

এই কথায় চুপ করে যেত আয়েশা। এই শ্বশুরবাড়ি ব্যাপারটা তার ভীষণ অপছন্দের। মানুষ কী করে মাকে রেখে দূরে কোথাও যায়? সে তো এক ঘণ্টাও মাকে

দেখে থাকতে পারে না। মাকে ছাড়া শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার এই ব্যাপারটা কী বিচ্ছিরি। সে গুনগুন করে বলে, আমি বিয়া করব না, মা।

তাইলে কী করবা?

আমি তোমার সঙ্গে থাকব। সব সময় তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি না থাকলে আমার ভয় লাগে, মা। অনেক ভয় লাগে।

রাহিমা বানু মেয়েকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে রাখতেন। তারপর চুমু খেতে খেতে বলতেন, আচ্ছা। তোমার কোথাও যাইতে হবে না। তুমি মার সঙ্গে থাকবা। সারা জীবন থাকবা।

রাহিমা বানু মাঝেমধ্যেই আদরে-আহ্লাদে-রাগে মেয়েকে তুমি করে বলতেন। সেই তুমিতে কি খানিক আলাদা কিছু মিশে থাকত? আয়েশা জানে না। তবে তার সেই মা তাকে ছেড়ে চলে যাবেন? সত্যি সত্যিই চলে যাবেন? এ কেমন কথা? এমন কেন হবে? অনিক প্রথম যেদিন তাকে সামনে বসিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে সব কথা খুলে বলেছিল, সেদিন নিজেকে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব মানুষ। মা সত্যি সত্যিই আর বাঁচবেন না? মরে যাবেন? তার একটুও বিশ্বাস হয় নি। মনে হয়েছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন। খানিক বাদেই ভাইয়া তার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। মা তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে বলবেন, এত বড় মাইয়া এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাইলে বিয়া দেওন যাইব? শ্বশুরবাড়িতে এত আহ্লাদ চলত না। ওঠ, ওঠ। হাঁস-মুরগির খোপ থেকে ওইগুলান বাইর কর। খাইতে দে। ওঠ। তারপর স্কুলে যা। পড়াশোনা নাই, নামাজ-রোজা নাই। আদব-কায়দা, কাজ-কর্ম কিছু নাই। এই মাইয়া নিয়া আমি কী করব, আল্লাহ। কী করব? এরা দুই ভাই-বইনই হইছে বাপের মতন। কোনো কিছুর ঠিকঠাকানা নাই।

কিন্তু তেমন কিছু আর হয় নি। তার দুঃস্বপ্ন কেউ ভাঙিয়ে দেয় নি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে। সময় যত গিয়েছে, মা ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছেন। তার শক্তি কমেছে। গায়ের মাংস শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়েছেন। এখন প্রায়ই বিছানায় পেশাব পায়খানা করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অনিক নিজে সেসব পরিষ্কার করে। কাউকে কিছু বলে না। আত্মীয়স্বজনকেও না। আয়েশা বড় ভাইকে বাঘের মতো ভয় পায়। এর। কারণ এই নয় যে অনিক তাকে কখনো গালমন্দ করেছে। রেগে কথা বলেছে। এর কারণ, সে কথা বলে কম। ফলে আপনা-আপনিই ভাইয়ের প্রতি একটা সমীহ কিংবা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় তার তৈরি হয়েছে। সেই ভয়টা কখনো কাটে নি। কিন্তু অনিকের মতো স্বল্পভাষী, চুপচাপ, খানিক নির্বিকার ভঙ্গির ভাবলেশহীন মানুষটাই যে তার মায়ের জন্য এমন কিছু করতে পারে, এটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি।

রাহিমা বানু বললেন, তোর ভাইরে ডাক। বল যে আমার সময় বেশি নাই। কোথায় কবর দিতে হবে, কার কাছে কী দেনা-পাওনা আছে, সেই সব তারে বলে যেতে হবে।

এগুলা তুমি কী বলছ, মা? তোমার কিছু হয় নাই। ভাইয়া তোমারে ঢাকায় নিয়া যাবে। তুমি আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবা।

রাহিমা বানু কথা বলেন না। শূন্য চোখে মাথার ওপরের তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আয়েশার সামনে এসব কথা তিনি বলতে চান না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই কী জানি হয় তার। নিজের প্রতি আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন কত কিছু যে বলেন! এইটুকু এক মেয়ে আয়েশা। তার সামনে এসব কথা বলা তার একদম ঠিক নয়। তারপরও কেন বলেন কে জানে!

তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। বলেন, মা রে। একটা কথা বলি?

বলো।

তোমার বয়স অল্প। কিন্তু মা ছাড়া মাইয়ামানুষের বয়স আর অল্প থাকে না। তাদের এক দিনের মধ্যেই বড় হইতে হয়। দুনিয়ার সব হালচাল বুঝতে হয়। কে তার আপন, কে পর–এই সব বুঝতে হয়। যদিও মা না থাকলে মাইয়ামানুষের দুনিয়াতে আর আপন কেউ থাকে না।

মা। আয়েশা মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। তুমি এই সব কেন বলতেছ?

কেন বলতেছি জানি না। আমার মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে যাইতেছে। কখন কী বলি তার ঠিক নাই। এক কাজ কর। আমারে একটু শোয়াই দে। আমি বসে থাকতে পারতেছি না। যন্ত্রণা শুরু হইছে। মরার যন্ত্রণা।

রাহিমা বানুকে আবার শুইয়ে দেয় আয়েশা। তারপর উঠানে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় ভাঁজ করে। রান্নার খড়িকাঠগুলো ঘরে নিয়ে রাখে। আশপাশটা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে। রাহিমা বানু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। সেই দিনের সেই মেয়েটা, মাকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারত না। নিজের হাতে ভাত অবধি খেতে চাইত না। সেই মেয়ে মাত্র কদিনেই কেমন করে এমন বড় হয়ে গেল? তার নিজের এখন মনে হচ্ছে ওই মেয়েটা যেন তিনি। আর এই তিনি আসলে আয়েশা। ছোট্ট এক মেয়ে। কী আশ্চর্য, সবকিছু কোন অগোচরে হঠাৎ এমন হয়ে গেল!

আয়েশার জ্বর হলে সারাক্ষণ খ্যানখ্যানে গলায় কাঁদত আর বলত, মা, তুমি আমার কাছে আসো। এইখানে বসে থাকো। আমার পাশে। আমার পাশ থেকে তুমি কোথাও যাবা না। তুমি পাশ থেকে গেলেই আমার ডর লাগে, মা।

কিন্তু রাহিমা বানুর রাজ্যের কাজ। সেই সব কাজ রেখে তিনি সারাক্ষণ মেয়ের পাশে বসে থাকবেন কী করে! তারপরও যতটুকু পারতেন বসে থাকতেন। এক বিকেলে অমন জ্বর নিয়েই মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। সেই ঘরে মা তার পাশে নেই। সে হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ও মা, মা। মা গো।

রাহিমা বানু ঝড়ের বেগে ছুটে এলেন। বললেন, কী হইছে? কী হইছে? আমি ঘরে বাতি দিতে গেছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে বাতি দিতে হয় না?

আয়েশা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তিনি মেয়ের মাথা বুকে চেপে ধরে বললেন, কিছু হয় নাই তো, মা। কিছু হয় নাই। এই যে আমি তোমার পাশে আছি। এই যে মা। মা, তোমার পাশে আছি।

আয়েশা কথা বলতে পারে না। কান্নায় তার গলা বুজে আসে। তারপরও সে বলে, আমি ভাবছি আমি মরে গেছি, মা। আমি ভাবছি আমি কবরের মধ্যে। এই জন্য চারদিকে এত অন্ধকার। আর তুমি নাই। ও মা। আমি ভাবছি…। বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে সে।

সেই মেয়ে কত বড় হয়ে গেছে! তার বয়স যে খুব বেড়েছে, তা নয়। কিন্তু সময় তাকে বয়সের আগেই বড় করে ফেলেছে। এখন ওই উঠানের মাঝখানে ঝাড় হাতে ঝাঁট দিতে থাকা সেই মেয়েটাকে দেখেই তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যদি সব কাজ ফেলে রেখে এসে তার পাশে খানিক বসে থাকত। গলায়, কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, তাহলে হয়তো একটু ভালো লাগত তার। যন্ত্রণাটা একটু কমত। কী করে তিনি এমন করে আয়েশার মতো হয়ে গেলেন? আর আয়েশা হয়ে গেল তার মতন। সময়ের এই এক আশ্চর্য খেলা। এই খেলার কাছে সকলই তুচ্ছ, অসহায়। সব হিসাবনিকাশ ব্যর্থ।

.

অনিক যখন বাড়ি ফিরল, তখন বিকেল পড়ে এসেছে। কিন্তু বাড়ি ঢোকার সরু পথটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল সে। তেঁতুলগাছটার তলায় অদ্ভুত এক দৃশ্য। মা আধশোয়া হয়ে গাছে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আর তাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আয়েশা। কিন্তু সে যতটুকু ভাত এক নলায় মায়ের মুখে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, মা তার সবটুকু গিলতে পারছেন না। ফলে তার ঠোঁটের কোষ গড়িয়ে দানা দানা ভাত গড়িয়ে পড়ছে। এখানে-সেখানে লেগে থাকছে। আয়েশা তখন তার ওড়না দিয়ে মায়ের মুখ মুছে দিচ্ছে। পানির মগ তুলে ধরছে ঠোঁটের কাছে। মা খুব ধীরে একটু একটু করে পানি খাচ্ছেন। বার কয়েক বিষমও খেলেন। আয়েশা তখন যত্ন করে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দৃশ্যটা কি অস্বাভাবিক কিছু? হয়তো না, কিন্তু তারপরও অনিকের চোখের ভেতরটা হঠাৎ জ্বালা করে উঠল। সে আর বাড়ির ভেতর ঢুকল না। বরং হেঁটে আবার রাস্তার দিকটাতে চলে গেল। রাস্তার দুধারে শূন্য খা খা ফসলের মাঠ। দূরে লাল সূর্য। সন্ধ্যার পাখিরা দল বেঁধে ঘরে ফিরছে। সে সেই শূন্য ফসলের মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তারপর দাঁড়িয়েই থাকল। ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, অনিকের মনে নেই। ততক্ষণে চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। গাঢ় হয়ে। জোনাক পোকার দল আলোর মিছিল নামিয়েছে।

এই সময়ে ফোনটা বাজল তার। ফোন করেছে তিথি। তিথির ফোন দেখে একটু অবাকই হলো অনিক। ধরবে না ধরবে না করেও শেষ পর্যন্ত ধরল সে। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে তিথি কোনো কথা বলল না। অনিক বলল, তিথি?

হুম।

কিছু বলবি?

হুম।

বল। তিথি অবশ্য বলল না। চুপ করে রইল। অনিক বলল, কিছু হয়েছে?

তুমি কিছু জানো না?

চিনা মা সেলিনা

কী জানব?

তুমি সত্যিই কিছু জানোনা?

তুই কিসের কথা বলছিস, সেটি না বললে কী করে বুঝব জানি কি না?

হৃদি আপুর যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?

অনিক সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না। চুপ করে রইল। বাইরের ঝিঁঝি পোকার ডাক কি বেড়েছে? হঠাৎ করেই কেমন যেন চারপাশটা উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। যেন অসংখ্য পোকামাকড় এলোমেলো ছুটতে শুরু করেছে। তাদের একঘেয়ে বিকট চিৎকারে কান। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। অনিকের মনে হলো সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ওই তীক্ষ্ণ। বিকট শব্দ ছাড়া।

তিথি বলল, তুমি জানো না?

অনিক হাসল। বলল, আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, জানিস?

কোথায়?

খাঁ খাঁ শূন্য বিরান ভূমিতে একটা শুকনো মাটির ঢিবির ওপর। আমার চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অসংখ্য জোনাক জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে আমি বুঝি মহাশূন্যে ভাসছি। চারপাশের জোনাকিগুলোকে মনে হচ্ছে তারার আলো।

তুমি আমার কথা শুনতে পাও নি?

তুই আমার কথা শুনতে পেয়েছিস?

পেয়েছি।

তাহলে আরেকটা কথা শোনাই?

তিথি কথা বলল না। অনিক বলল, এই যে অসংখ্য জোনাক জ্বলছে, তাদের যদি তারা ভেবে ভুল করি, তাহলেই কি তারা তারা হয়ে যাবে?

না।

কিন্তু তাদের তারা ভাবাটাও তো ভুল নয়। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে অন্য জগতের মানুষ মনে হয়। মনে হয় আমি একটা স্বপ্নের জগতে আছি। কিন্তু স্বপ্ন তো ভেঙে যায়, না? দিনের আলোয় সবকিছু যেমন দেখায়, এই ফসলের মাঠ, মাটির ঢিবি, জোনাক পোকার আলো, রাতের অন্ধকারে কি সেসব তেমন দেখায়?

না।

কিন্তু আমাদের তো দুটোই দেখতে হয়। আর দুটোই দেখতে পারি বলেই অন্ধকারে জোনাকির এই মিটিমিটি আলোকে তারার আলোর মতো মনে হলেও আমরা জানি এ তা নয়। আলোয় সবকিছু আবার অন্য রকম হয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে এই মুহূর্তটাও তো মিথ্যে কিছু নয়।

তুমি এসব কেন বলছ? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না?

আমিও পারছি না। আমার সবকিছুই এমন আলো আর অন্ধকারে দেখা বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি তাই দুটোকেই অনুভব করার চেষ্টা করছি।

তার মানে হৃদি আপু এই যে এমন করল, এটাও তুমি উপভোগ করার চেষ্টা করছ?

উপভোগ শব্দটা কেমন জানি। একটা ভোগ ভোগ ব্যাপার আছে। ফলে ওই শব্দটা ঠিক ব্যবহার করতে মন সায় দেয় না। তবে জীবন তো এই আলো আর অন্ধকারেরই। এখানে কেবল আলোতে দেখা পৃথিবীই ধরা দেবে, তা তো না। তাই না?

কী জানি! তোমার এই অতি ফিলসফিক্যাল কথাবার্তা আমি বুঝতে পারি না।

সব বুঝে কাজ কী! যত কম বোঝা যায়, তত ভালো। জীবন সহজ হয়ে যায়।

তোমার জীবন কি সহজ? তুমি তো কম বোঝো না?

চেষ্টা তো করাই যায়। আর যার কিছুই থাকে না, না স্বপ্ন, না সম্ভাবনা, তার হারানোর ভয়ও থাকে না। মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় তো ওই হারিয়ে ফেলার ভয়ই। আমার কি আর হারিয়ে ফেলার মতো কিছু আছে?

ছিল তো?

ছিল আর থাকা তো এক নয়। যা ছিল বলা হয়, তার মানে তা আর নেই। আর যা নেই, তা হারিয়ে ফেলার ভয় কী করে হবে?

কথাটা খট করে কানে বিধল তিথির। সে বিড়বিড় করে বলল, তুমি কি কাঁদছ?

একদম না। বলে হাসল অনিক। কাঁদব কেন?

তুমি হৃদি আপুকে কতটুকু ভালোবাসতে আমি জানি।

অনিক কথা বলল না। তিথি বলল, কিন্তু আপু যে কেন এমন…। কথাটা শেষ করল না সে। অনিক বলল, ভালোবাসার জন্য কি কাউকে পেতে হয়? মানে কাউকে

পেলে কি ভালোবাসা যায় না?

যায় হয়তো। কিন্তু মানুষ তো তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেতেই চায়।

পাওয়াটা আসলে খুব রহস্যময় এক ব্যাপার। যা দেখে আমরা পেয়ে গেছি ভাবি, এমনও তো হতে পারে যে ওই পাওয়ার আড়ালেই সবচেয়ে বেশি না পাওয়া।

তাহলে কি না পাওয়ার আড়ালেও পাওয়া থাকে?

অনিক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বলল, আমি অনেকক্ষণ থেকে বাড়ির বাইরে। আয়েশা একা মার কাছে। আমি এখন যাই?

যাবে?

হুম।

তিথির হঠাৎ কেন যেন কান্না পেয়ে গেল। তার খুব ইচ্ছে করছিল অনিককে এমন কিছু একটা বলে যে তাতে তার বুকের ভেতর উত্তরে হিম হাওয়ার যে তীব্র হাহাকার মাতম তুলছে, সেই মাতমটা ক্ষণিকের জন্য হলেও থেমে যায়। কিন্তু সে জানে সেই ক্ষমতা তার নেই। হয়তো এই পৃথিবীর কারোরই নেই।

.

রাহিমা বানু মারা গেলেন শুক্রবার জুমার নামাজের আগে আগে। অনিক চুপচাপ মায়ের পাশে বসে রইল। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলল না সে। কাঁদল না। চিৎকার করল না। কেবল তার ডান পাশে বসে থাকা আয়েশাকে এক হাতে ধরে রাখল সে। আসরের নামাজের পর মায়ের দাফন হবে। তার জোগাড়যন্ত্র করছে আত্মীয়স্বজন। সন্ধ্যায় ফোনটা এল তিথির। অনিক ধরল।

কী করছ? বলল তিথি।

অনিক জবাব দিল না। তিথি বলল, তোমার কি মন খারাপ?

না।

তুমি ঠিক আছ তো?

হু।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তোমার মন খারাপ।

অনিক কথা বলল না। তিথি বলল, আমি তোমাকে কেন ফোন করেছি, জানো?

না।

এবার চুপ করে রইল তিথি, বেশ খানিকটা সময়। তারপর বলল, আমি চাই নি খবরটা তুমি অন্য কারও কাছ থেকে পাও। কিংবা অন্ধকারে থাকো।

কী খবর?

হৃদি আপুর আজ বিয়ে হয়ে গেল।

আচ্ছা।

নেহাল ভাইয়া আপুকে নিয়ে জার্মানি চলে যাচ্ছে নেক্সট মান্থেই।

হুম।

তুমি কি কিছু বলবে?

না।

কিছুই না?

অনিক কথা বলল না। তিথিও না। তারা দুজনই দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। একটা অদ্ভুত অসহ্য নীরবতা কেবল তাদের মাঝখানে অব্যক্ত অসংখ্য কথা, কান্না, অনুভবের নদী হয়ে বয়ে যেতে লাগল।

আমি কি ফোন রাখব?

হুম।

সত্যি রাখব?

হুম। তিথি ফোন রেখে দিল।

সন্ধ্যার আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। বাবার পুরোনো কবরের পাশে মায়ের নতুন কবর। চারপাশে বাঁশের কঞ্চি কেটে বেড়া দেওয়া হয়েছে। অনিক সেই কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দীর্ঘ সময়। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন যেন কাঁদতে পারছে না সে। তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল আয়েশা। অনিক এক হাতে বোনকে জড়িয়ে। ধরে রাখল। আয়েশা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। নিঃশব্দ কান্না। তবে সেই কান্নায় তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। অনিক বোনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর দুহাতে তার মাথা চেপে রাখল কাঁধের সঙ্গে। তার হঠাৎ মনে হলো, বুকের ভেতর যে নোনাজলের অথই সমুদ্র সে পুষে রেখেছে, তা যেন আয়েশার চোখ বেয়ে অবিরল। জলের ঝরনাধারার মতো নেমে আসছে। আর সে সিক্ত হচ্ছে সেই উষ্ণ জলের তীব্র গভীর স্রোতে।

২৮

রাত গভীর। রাশু একা বসে আছে মজা ডোবাটার কাছে। মাঝেমধ্যেই ডোবার ভেতর থেকে ছটাৎ ছটাৎ শব্দ আসছে। সে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে যেন উন্মত্ত হয়ে উঠল দানবীয় জন্তুগুলো। রাশু মৃদু হাসল। তবে অন্ধকারে তার সেই হাসি দেখা গেল না। মতিন মিয়ার উপস্থিতি টের পাওয়া গেল তখুনি। তার হাতে ছোট টর্চ। সে সাবধানে আলো ফেলল মাটিতে। রাশু চট করে উঠে দাঁড়াল। মতিন মিয়া প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি মতিন।

ওহ্, মতি ভাই?

হুম।

সাথে আর কে?

তুমি চিনবা না। বলেই হাসল মতিন মিয়া। লাল চানকে ঠাহর করতে খানিক সময় লাগল রাশুর। সে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল, আপনে এইখানে?

জামশেদ স্যার আসতে বলল।

কেন?

চালান রেডি করতে হবে।

কিসের চালান?

বিষের। সগ্রহ করতে হবে।

কে করবে, আপনে? অন্ধকারেই চোখ বড় বড় করে তাকাল রাশু। সে জানে, কাজটা সহজ নয়। এই কাজে অভিজ্ঞ লোক দরকার।

না না। আমি না। লোক আছে। সে সব পদ্ধতি জানে।

রাশু অবাক হয়ে লক্ষ করল, দীর্ঘাকৃতির একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পেছনে। লাল চান বলল, যা করার উনিই করবেন।

উনি একা পারবেন?

হুম।

কিন্তু এইখানে তো রাতের বেলা আলো জ্বালানো নিষেধ।

সেইটা উনিই বুঝবেন।

আমাকে শিখাবে না? রাশুর চোখে কৌতূহল।

এখুনি না।

তাহলে?

দীর্ঘকায় লোকটা একটা কথাও বললেন না। তিনি ধীরে হেঁটে উঠানের ভেতর দিকে যেতে লাগলেন। রাশু বলল, উনি একলা একলাই যাইবেন? সঙ্গে আর কেউ থাকবে না? আমি যাই?

বলেই সামনে যেতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু লাল চান তার হাত ধরে নিবৃত্ত করল। বলল, আগবাড়াইয়া কিছু করতে না নিষেধ করছে তোরে?

হুম। বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রাশু। দীর্ঘকায় লোকটা অভ্যস্ত, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হেঁটে গেলেন টিনের ঘরটার দিকে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন না তিনি। দাঁড়িয়ে পিঠের ব্যাগ থেকে কী কী সব বের করতে লাগলেন। সম্ভবত আত্মরক্ষামূলক কিছু। তারপর সেসবে নিজেকে আবৃত করতে লাগলেন। রাশু ফিসফিস করে বলল, উনি কী করতেছেন?

সেইটা উনিই ভালো জানেন। অত কিছু তো আমাদের বোঝার দরকার নাই। আমাদের যেই দায়িত্বটা দিছে, সেটা পালন করলেই তো হলো। না?

তাও ঠিক। বিড়বিড় করে বলল রাশু। তবে তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হলো না তাকে। বরং বেশ খানিকটা অসন্তোষ নিয়েই মাটিতে থুতু ফেলল সে।

লাল চান বিষয়টা লক্ষ করল। বলল, কী হইছে তোর, এমন করতেছস কেন?

রাশু কথা বলল না। তার হঠাৎ মনে হলো, এই পুরো বিষয়টার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে খুব অল্প কিছু মানুষ। রাশু কিংবা লাল চান তাদের পুরোপুরি চেনে না। এই না চেনার কারণও আছে। কাজটা যেহেতু বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ, দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধও, তাই নিজেদের নিরাপদ রাখতেই যতটা সম্ভব আড়ালে থাকছেন তারা। রাশু আর লাল চান মূলত কাজ করছে বেতনভুক্ত ভাড়াটে শ্রমিকের মতো। তারা যদি কখনো ধরা পড়ে, তখন যেন সহসাই আড়ালের ওই মানুষগুলোর কথা কাউকে না। বলতে পারে–এই বিষয়টাই নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা।

বিষয়টা আগেও লক্ষ করেছে রাশু। জামশেদের অফিসে একবার গেলেও সেটি যে তার স্থায়ী কোনো ঠিকানা নয়, তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি তার। শুধু তা-ই নয়, জায়গাটাতে এরপর আর কখনো একা একা যেতেও পারবে না সে। এর অবশ্য কারণও আছে। যাওয়ার সময়টা ছিল গভীর রাত। প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে গাড়িতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। এমনকি ফেরার সময়ও।

আজ এই মুহূর্তে রাশুর হঠাই মনে হলো, বিষয়টা ক্লান্তি বা কাকতালীয় নয়, হয়তো অন্য কোনোভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল তাকে! কথাটা ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। ঘুরে উঠানের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল সে। লাল চান তার হাত ধরে থামাতে চাইল। কিন্তু রাশু থামল না। সে এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, সবকিছু তাদের মনমতো হইলে তো হবে না। আমরা এত কিছু করি, আর…।

সে কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই তাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন জামশেদ এবং সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান কানের নিচের নরম জায়গাটায় ঠান্ডা কিন্তু তীব্র কিছুর চকিত স্পর্শ টের পেল সে। মুহূর্তখানেক সময়। তারপর কাটা গাছের মতো নেতিয়ে পড়ল রাশু। তার আচমকা মনে হলো চোখের সামনের অন্ধকারে অজস্র তারাবাতি জ্বলছে, নিভছে। পা, মাথা, শরীর অবশ হয়ে আসছে।

জামশেদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন, লাল চান, ওরে ঘরের ভেতর নিয়ে যাও। চোখেমুখে পানির ঝাঁপটা দাও। ঠিক হয়ে যাবে।

লাল চান ততক্ষণে রাশুকে দুহাতে ধরে ফেলেছে। সে অন্ধকারেই জামশেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জামশেদ বললেন, এর মধ্যে আমরা কাজ সেরে আসছি।

বলেই টিনের ঘরটার সামনে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। জামশেদের হাতে টর্চ। খুব সাবধানে আলো জ্বাললেন তিনি। তারপর নিজের পিঠে থাকা ব্যাগটা খুলে হাতে নিলেন। লাল চান জানে না সেই ব্যাগের ভেতর কী আছে। তবে জামশেদ সেই ব্যাগ থেকে নানা রকম যন্ত্রপাতি বের করতে লাগলেন। তারপর নিচু গলায় কথা বলতে লাগলেন তার সামনে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তিটির সঙ্গে।

লাল চান অবশ্য আর দাঁড়াল না। সে রাশুকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। রাশুর জ্ঞান ফিরল ঘণ্টা দুই বাদে। ততক্ষণে জামশেদদের কাজ আজকের মতো শেষ হয়ে গেছে। রাশু চোখ মেলে তাকাতেই তাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। জামশেদ অবশ্য খানিক আগের প্রসঙ্গটা তুললেনই না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, তোর বদলে আগামী কয়েক দিন লাল চান এইখানে থাকবে। তুই কাল ঢাকায় চলে আয়। কাজ আছে।

রাশুর জবাবের অপেক্ষা না করেই ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জামশেদ। রাশু হতভম্ব চোখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। এতক্ষণ কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে। লাল চান বলল, ওঠ। হাতমুখটা একটু ধুয়ে নে।

রাশু অবশ্য উঠল না। সে শুয়েই রইল। তার চোখের সামনে এখনো অন্ধকারে দাঁড়ানো জামশেদের আবছায়া মুখখানা ভাসছে। ভাসছে সাপের মতো ছোবল তোলা হাতখানা। চোখের পলকে কী করে ওভাবে তাকে আঘাত করলেন জামশেদ? এই লোকটাকে সে যতই দেখছে, ততই তার ভাবনার জগৎ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ এক অতলস্পর্শী সমুদ্র। সে যতই ভাবুক এই বুঝি জামশেদের সকল রহস্যময়তা সে ভেদ করে ফেলেছে, আসলে ততই বাকি রয়ে যাচ্ছে অচেনা, অজানা আরেক মহাসমুদ্র।

ওই মহাসমুদ্রের রহস্য সে ভেদ করবে কী করে?

.

রাশু ঢাকায় এসেছে সপ্তাহখানেক হলো। কিন্তু এই এক সপ্তাহেও তাকে কেউ ডাকল না, না জামশেদ বা অন্য কেউ। হঠাৎ করেই তার রোমাঞ্চকর, সদা সতর্ক রোমহর্ষ জীবনটা যেন নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে দোকান খোলে। তারপর সারা দিন লেপ-তোশক, বিছানা-বালিশ বিক্রি করে। কর্মচারীদের কাজ বুঝিয়ে দেয়। ক্রেতাদের সাথে দর-কষাকষি করে। কিন্তু এসব করতে আর ভালো লাগে না তার। বরং নিজেকে কেমন নিস্তেজ, নির্জীব মনে হয়। যেন এই আটপৌরে, একঘেয়ে জীবন তার নয়। এই জীবনের জন্য সে জন্মায় নি। কথাটা সেদিন লাল চানকে ফোনে বলল সে।

লাল চান বলল, তোর হইল গল্পের সেই বাঘের বাচ্চার দশা।

বাঘের বাচ্চার আবার কী দশা?

একবার এক বাঘের বাচ্চার জায়গা হলো গরুর খামারে। জন্মের পরপরই তারে সেখানে নিয়ে আসা হইল। তো সে গরুর সাথেই ঘাস, লতা-পাতা, খইল-ভুসি খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেল। দিনের পর দিন বেড়ে উঠতে লাগল তাদের সঙ্গে। আচার-আচরণেও তাদের মতো হয়ে গেল। কোনো দিন মাংসের ঘ্রাণও তার ভাগ্যে জোটে নাই। জুটবে কেমনে? সে তো থাকে গরু-বাছুরের সঙ্গে। তারা তো আর রক্তমাংস খায় না। খায়। ঘাস-লতাপাতা।

হুম।

তো ঘটনাচক্রে একদিন এক গরুর বাছুরের গায়ে কামড় বসাই দিল সে। আর সাথে সাথেই তার জিবে রক্তমাংসের স্বাদ লেগে গেল। কিন্তু তখনই বিষয়টা ধরতে পারল না সে। ধরতে পারল আরও পরে। সে হঠাই বুঝতে পারল যে ঘাস, লতাপাতা খাইতে আর ভালো লাগতেছে না তার। সারাক্ষণ কিসের জানি খিদা, কিসের জানি তেষ্টা! না খেয়ে না খেয়ে শুকাইয়া প্রায় মরণদশা। এর মধ্যে হঠাত্র একদিন সেই বাছুরটারে দেখল সে। তারপর কৌতূহলবশত তার সেই ক্ষতস্থানে জিব লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা কী। ততক্ষণে তার ভেতরের মাংসাশী ভয়ংকর প্রাণীটা জেগে উঠছে। সে তো জন্মগতভাবেই মাংসাশী। এত দিন বিষয়টা বুঝতে পারে নাই। যেই না বুঝতে পারল, অমনি শুরু হলো তার রক্তমাংসের নেশা।

আপনের ধারণা আমি ওই রকম?

তোর ভাবভঙ্গিতে তো তা-ই মনে হয়। যেই তোরে আমি চিনতাম, আজকাল তো তোরে দেখে আর সেই তুই মনে হয় না। মনে হয় অন্য মানুষ।

কী অন্য মানুষ মনে হয়?

কী অন্য মানুষ মনে হয়, সেইটা তো তুই নিজেই বুঝতেছিস। বুঝতেছিস না?

কথা সত্য। রাশু নিজেও ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে। ওই বিষধর সাপের সঙ্গে একা একা বসবাস করার সময়গুলোতে সে ভয় পেত না এমন নয়, বরং তীব্র ভয়ে সারাক্ষণ সচকিত হয়ে থাকত সে। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারত না। মনে হতো যদি কখনো ওই টিনের ঘর, ওই জালের দেয়াল ডিঙিয়ে তারা কোনোভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে? কিংবা তার ঘর অবধি এসে যায়? তখন কী করবে সে?

এই ভাবনা তাকে সারাক্ষণ তটস্থ করে রাখত। কিন্তু তারপর কীভাবে কীভাবে যেন বিষয়টাতে অভ্যস্ত হয়ে গেল সে। ওই ভয়ের মধ্যেও কোথায় যেন একটা তীব্র রোমাঞ্চ, একটা দুর্নিবার আকর্ষণ আছে। নেশার মতো। ওই নেশা থেকে সে অনেক চেষ্টা করেও বের হতে পারছে না। এই যে কয়েকটা দিন সে আবার তার আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, আগের সেই সহজ, সাদামাটা, নিস্তরঙ্গ জীবন, কিন্তু এই জীবনে তার কেবলই হাঁসফাঁস লাগতে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সে সারাক্ষণ উকৰ্ণ হয়ে থাকে কখন জামশেদ তাকে ডাকবেন। কখন সে নতুন কোনো কাজ পাবে। ভয়ংকর, রোমহর্ষ কোনো কাজ।

রাশুকে অবশ্য জামশেদ ডাকলেন পরদিনই। তারা একই সঙ্গে গেলেন বৈদ্যবেলঘরিয়া। লাল চান এ কদিন এখানে একা থাকে নি। তার সঙ্গে থাকতে হয়েছে মতিন মিয়াকেও। জামশেদ মতিন মিয়াকে ডেকে বললেন, সামনে আরও একটা কাজ ধরব। এইটাই শেষ টেস্ট। এরপরই আসল চালান শুরু। কাজটাতে তুমি লাল চানকে হেল্প করবা।

আর রাশু?

রাশু আপাতত কোনো কাজ করবে না।

কেন?

কারণ আছে।

কী কারণ? ফট করে প্রশ্নটা করে বসল রাশু

যে কারণে ওই দিন রাতে তুই পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেয়েছিলি কানের নিচে, সেই কারণ।

আমি তো আর অবাধ্য হই নাই। আর আপনি বলছিলেন নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগাইতে।

এই জন্যই তো। ওই দিন তোর বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করে নাই। তুই লাল চানের কথা না শুনে উঠানের দিকে যাচ্ছিলি।

রাশু কথা বলল না। সেদিন রাতের ওই সামান্য ঘটনাটা যে এত বড় ব্যাপার হয়ে যাবে, এটা সে ভাবে নি। জামশেদ লাল চানের দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, আর এইখানে থাকলে ফোনে অপ্রয়োজনে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলা যাবে না। রাশুর সঙ্গেও না।

জামশেদের কথা শুনে লাল চান চমকে গেল। সে আমতা আমতার করে বলল, আমি তো কারও সঙ্গে কথা বলি নাই।

জামশেদ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বললেন, মিথ্যা কথা আমার একদম পছন্দ না, লাল চান। তুমি গতকাল সন্ধ্যায় রাশুর সঙ্গে কথা বলেছ। কী কী কথা হয়েছে, বলব?

রাশু হতভম্ব চোখে জামশেদের দিকে তাকিয়ে রইল। এই কথা জামশেদ জানলেন কী করে! এ কী ভয়ংকর চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছে সে? অথচ সে ভাবছে তার পায়ের তলায় শক্ত মাটি! জামশেদ অবশ্য তাকে আরও একবার চমকে দিলেন। বললেন, মন বেখারাপের কিছু নাই, রাশু। সামনে বড় কাজ শুরু হচ্ছে। সেই কাজ দিয়েই তোর শুরু। গেট রেডি।

২৯

সুমি বললেন, তুমি কি বিকেলে ফ্রি আছ?

মাহমুদ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, কেন?

বিকেলে একটু বাইরে যাব ভাবছিলাম। তুমি গেলে ভালো হতো।

বাইরে কোথায়?

মায়ের বাসায়।

হঠাৎ?

মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তুমি গেলে খুব খুশি হবে।

মাহমুদ খানিক কী ভাবলেন। তারপর বললেন, যাওয়া যায়। কিন্তু কাল একটা সেমিনার আছে আমার। রাতে প্রেজেন্টেশন রেডি করতে হবে।

ওহ। বলে হতাশ ভঙ্গিতে তাকালেন সুমি। তাহলে তো হবে না। মা বলছিল। আজ রাতটা ওখানে থাকতে।

না না, তাহলে একদমই পারব না। তুমি বরং জিতুকে নিয়ে যাও।

সুমি আর কথা বললেন না। তিনি মাহমুদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে দিয়ে দুপুরের দিকেই বের হয়ে গেলেন। পুরো বাড়িতে মাহমুদ একা। তিনি বিকেল অবধি বসে রইলেন বারান্দায়। সুমি না থাকলে বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করে। এই সময়ে খুব অস্থির লাগে তার। তবে সেই অস্থিরতার কারণটা ঠিকঠাক বুঝতে পারেন না। কারণ, সুমি থাকলেও নিজের কাজে মনোযোগ বসানো কঠিন হয়ে যায়। সারাক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা হতে থাকে। গল্প, আচ্ছা, খুনসুটি। তখন মনে হয় নিজের জন্য আলাদা সময় পেলে হয়তো কাজে মন বসাতে পারতেন। কিন্তু এই যে এখন, এখনো তো কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। লেখায়ও না। এমন কেন হচ্ছে? তিনি কি তবে কোনো কিছুর অভাব বোধ করছেন?

মাহমুদ ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। এটা-সেটা দেখলেন। কাউকে টেক্সট পাঠানোর কথা ভাবলেন। তারপর মনে হলো সুমিকেই একবার ফোন করবেন কিংবা তিনিই চলে যাবেন সুমিদের বাসায়। গিয়ে চমকে দেবেন তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না তার। কারণ, ফোনটা বেজে উঠল তখুনি।

সাধারণত বাসায় থাকলে দিনের বেলা তাকে ফোন করে না রিয়া। সে ফোন করে রাতে, যখন তিনি তার স্টাডিরুমে একা লিখতে বসেন। কিন্তু আজ এই অসময়ে কেন ফোন করল সে?

মাহমুদ ফোনটা ধরলেন। রিয়া বলল, আপনি কি কোনো কারণে আপসেট?

মাহমুদ ভ্রু কুঁচকে বললেন, না।

শিওর?

হুম।

আমার ওপর বিরক্ত?

না তো। কেন?

এই যে আমি অসময়ে ফোন করলাম? মাহমুদ হাসলেন, না।

কিন্তু দিনের এই সময়ে বাসায় থাকাকালে আমি ফোন করলে তো বিরক্ত হন আপনি?

আজ হচ্ছি না।

কী কারণ?

কারণ…। বলে সামান্য থামলেন মাহমুদ। বললেন, আমারও সম্ভবত কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।

কেন, কথা বলার মতো কেউ নেই?

না।

কেউ না?

উঁহু।

সুমি কই? চট করে প্রশ্নটা করল রিয়া।

মাহমুদ গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি সব সময় কেন ওর নাম ধরে এভাবে বলো?

আমার ইচ্ছে। উদাস ভঙ্গিতে বলল রিয়া। প্রয়োজনে আপনার নাম ধরেও বলব।

মাহমুদ কঠিন হতে গিয়েও শেষ অবধি পারলেন না। তার হঠাৎ মনে হলো, রিয়া যদি তাকে নাম ধরে ডাকে, তুমি করে বলে, তবে সেটা শুনতে কেমন লাগবে তার?

ভাবনাটা মাথায় এলেও প্রশ্রয় দিলেন না তিনি। একা বাসায় থাকলে হুটহাট কী সব আজেবাজে চিন্তা যে মাথায় চলে আসে! এমন কি সব মানুষেরই হয়? নাকি কেবল পুরুষমানুষের? না কেবল তার? মাহমুদ নিজেকে সংযত করলেন। বললেন, ও বাসায়। নেই।

কোথায় গেছে?

ওর মায়ের বাসায়।

কখন ফিরবে?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও থমকালেন মাহমুদ। তার হঠাত্র মনে হলো, অবচেতনেই তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বিশেষ কিছু ভাবছেন এবং সেই ভাবনাটা শোভন কিছু নয়। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেও সেটি মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন না।

রিয়া বলল, কী হলো, কথা বলছেন না কেন?

এই একটু পরেই চলে আসবে।

একটু পরে কখন?

মাহমুদ উত্তর দিতে গিয়ে এবারও থমকে গেলেন। কিন্তু কেন থমকে গেলেন, সেটি যেন নিজের কাছেই নিজে স্বীকার করতে চাইলেন না।

রিয়া বলল, কী হলো?

কী হবে?

কখন আসবে?

বললাম তো একটু পরেই।

একটু পরে কখন?

সন্ধ্যার পর।

সন্ধ্যার পর? রিয়া দ্বিরুক্তি করল।

হুম।

তার মানে এখনো অনেকটা সময়। তাই না?

মাহমুদ কথা বললেন না। তিনি স্পষ্টই টের পেতে শুরু করেছেন তার ভেতর একটা অদম্য অবদমিত ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন সেই ইচ্ছেটাকে দমন করতে। কিন্তু পারছেন না।

রিয়া বলল, আপনি চুপ করে আছেন কেন?

কী বলব?

সুমির আসতে তো এখনো বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে, তাই না?

হুম।

এই সময়ে আপনি তো বাসায় একা?

মাহমুদ আবারও চুপ করে গেলেন। রিয়া বলল, আমার কিন্তু খুব রাগ লাগছে। আপনি এভাবে কথা বললে আমি কিন্তু বাসায় চলে আসব।

বাসায় চলে আসবে? কপট বিস্ময়ের ভান করলেও মাহমুদের ভেতরের একটা অবচেতন সত্তা যেন ততক্ষণে সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

আপনি কথা না বললে তো আসবই।

কী করবে এসে?

আপনি চান আমি আসি? এবার সরাসরিই প্রশ্নটা করল রিয়া।

মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। চুপ করে কী ভাবলেন। আসলে নিজের সঙ্গে অদ্ভুত এক যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। এই যুদ্ধে তার জয় কিসে, তা তিনি জানেন না। তবে যে অবদমিত ইচ্ছেটা তার ভেতরে প্রবল আলোড়ন তুলতে শুরু করেছে, সেই ইচ্ছেটা ক্রমশ যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

রিয়ার গলা হঠাৎ নরম হলো। খানিক গাঢ়ও। সে কেমন মোহনীয় কণ্ঠে বলল, আসব আমি?

না। বললেন মাহমুদ। তবে তার সেই বলায় তেমন দৃঢ়তা নেই। স্পষ্টতা নেই। বরং ওই না-এর ভেতরই যেন একটা অনুচ্চারিত হ্যাঁ উঁকি দিয়ে গেল।

রিয়া বলল, না কেন?

এমনি।

এমনি কেন? আপনি তো বাসায় একা। আমরা তো বাইরে কোথাও দেখাই করতে পারি না। কথাও বলতে পারি না। হাতে তো কিছুক্ষণ সময় আছে। খানিক না হয় নিরিবিলি কথা বলা যাবে।

কিন্তু বিষয়টা ভালো দেখায় না।

কেন? ভালো দেখাবে না কেন? আর আমরা তো এমন কিছু করব না যে ভালো দেখাবে না।

তা না।

তা নয় তো কী? বলে হঠাৎ কেমন খিলখিল করে হাসল রিয়া। বলল, আর করলেই-বা কী? দেখার তো কেউ নেই ওখানে, আছে?

মাহমুদ কথা বললেন না। রিয়া বলল, আমি আসছি।

মাহমুদ আঁতকে ওঠা ভঙ্গিতে বললেন, একদম না, রিয়া। প্লিজ। একা বাসায় এভাবে তোমার আসা ঠিক হবে না।

ঠিক না হলে কেন বললেন যে আপনি বাসায় একা? তার মানে আপনিও মনে মনে চাইছিলেন যে আমি আসি। ঠিক না?

মোটেও তা না। সুমি হঠাৎ চলে গেল। আমার কেন যেন ভালো লাগছিল না।

আমি আসি। ভালো লাগবে।

মাহমুদ তারপরও নানাভাবে রিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন, এই বোঝানো পুরোপুরি তার মন থেকে নয়, বরং নিজের। সত্তার সচেতন অথচ দুর্বল অংশটা তাকে জোর করে কথাগুলো বলাচ্ছে। অন্যদিকে তার অবচেতন অথচ শক্তিশালী অংশটা সর্বান্তঃকরণে চাইছে রিয়া আসুক। এটা রিয়াও বুঝতে পারছে।

ফলে তার ওই বোঝানোটা যে কেবল তার নিজের কাছেই নিজের দায়মুক্তির আনুষ্ঠানিক চেষ্টামাত্র, তা তাদের দুজনের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। মাহমুদ ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইলেন।

রিয়া বলল, আমি আসছি। বলেই ফোন কেটে দিল সে। মাহমুদ চুপচাপ বসে রইলেন। তার মাথা কাজ করছে।। একটা সূক্ষ্ম ভয়ও জেগে উঠছে। কোনো কারণে যদি সুমি অসময়ে ফিরে আসে, তাহলে?

তিনি সুমিকে ফোন করলেন। সুমি বলল, কী হলো, কোনো সমস্যা?

না। তুমি ঠিকঠাক পৌঁছেছ?

হুম।

মায়ের কী অবস্থা?

ভালো।

আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন?

করেছে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি বুঝিয়ে বলেছি। পরে একদিন এসে দেখা করে যেয়ো।

আচ্ছা। বলে আর কথা খুঁজে পেলেন না মাহমুদ। সুমি বলল, আর কিছু বলবে?

আমার না ভালো লাগছে না।

কেন?

এই যে ফাঁকা বাসায় আমি একা। কেমন অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে আমিও চলে আসি।

সুমি হাসল। সে জানে মাহমুদ যতই একা থাকতে চান, কিন্তু সে বাসায় না থাকলে একমুহূর্তের জন্যও স্বস্তি মেলে না তার। সারাক্ষণ কেমন অস্থির হয়ে থাকেন। এই অনুভূতিটা অদ্ভুত। এত বছর পরও যখন কেউ এমন করে কারও অনুপস্থিতি অনুভব করে, তখন সেই সম্পর্কটা বিশেষ কিছু। তারও এখন ইচ্ছে করছে মাঝরাতে বাসায় গিয়ে মাহমুদকে চমকে দিতে! আচ্ছা, সে যদি এমন কিছু করে, তাহলে কী করবেন মাহমুদ?

আসবে? কিন্তু কাল না তোমার একটা সেমিনার? বলল সুমি।

হুম, সেটাই ভাবছি। কিন্তু ভালোও লাগছে না।

আজ একটু কষ্ট করো, প্লিজ?

মাহমুদ খানিক চুপ করে থেকে বললেন, তুমি না হয় কিছুক্ষণ থেকে চলে আসো?

আজ?

হুম। রাতে।

পাগল তুমি? এত দিন বাদে এলাম। মায়ের শরীরটা খারাপ। আর এখুনি যদি আবার চলে যাই, তখন মা কী ভাববে?

তাও তো কথা। তাহলে আসতেই পারবে না?

আজ একটু থাকো, প্লিজ। আমি কাল সকাল সকাল চলে আসব।

সকাল সকাল এসে কী হবে? আমি তো বের হয়ে যাব।

ওহ্। তাহলে এক কাজ করো, তুমি সেমিনার থেকে ফেরার পথে আমাকে নিয়ে যেয়ো?

প্রস্তাবটা পছন্দ হলো মাহমুদের। তারপরও তিনি মলিন গলায় বললেন, আচ্ছা।

.

সুমির ফোনটা রাখার পর যেন খানিক স্বস্তি পেলেন মাহমুদ। অন্তত এই একটা ব্যাপারে এখন তিনি নিশ্চিত যে সুমি আর আজ রাতে ফিরবে না। কিন্তু এটি কেন নিশ্চিত হতে চাইলেন তিনি? তিনি কি তবে চাইছেন যে রিয়া আজ রাতে এখানে থাকুক? এই বাসায়?

কথাটা ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো মাহমুদের। সেই অনুভূতি একই সঙ্গে শঙ্কা ও শিহরণের যুগপৎ যুদ্ধে তাকে এলোমেলো করে দিতে লাগল।

রিয়া এল তার কিছুক্ষণ পরই। মাহমুদ বিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, তুমি?

কেন, অন্য কারোর আসার কথা ছিল নাকি?

না না। কিন্তু তুমি যে এভাবে সত্যি সত্যি চলে আসবে, তা কিন্তু আমি ভাবি নি।

আপনাকে বাইরে থেকে যতটা সাদাসিধে মনে হয়, ভেতরে ভেতরে কিন্তু আপনি তেমন নন। বসতে বসতে বলল রিয়া।

মানে?

মানে, আপনি জানেন কী করে কাউকে মুখে না বলেও কাছে ডাকা যায়। প্রলুব্ধ। করা যায়।

আমি কি তেমন কিছু করেছি?

অবকোর্স করেছেন। আপনি চাইছিলেন আমি যেন আসি। আবার সেটা এমনভাবে চাইছিলেন যেন পরে আমি আপনাকে ব্লেমও করতে না পারি। এই ধরনের আচরণ কারা করে, জানেন?

কারা?

যারা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোত্রের প্রাণী।

মাহমুদ এবার আর কথা বললেন না। এই মেয়েটার কাছে কেন তিনি বারবার এভাবে হেরে যাচ্ছেন? এমন না যে সুমি ছাড়া আর কোনো মেয়ে তার জীবনে আসে। নি। কিন্তু তারা সকলেই তার ব্যক্তিত্ব, আচরণের সামনে মিইয়ে থাকত। তাকে তুষ্ট করতে তটস্থ থাকত। একমাত্র রিয়ার কাছেই উল্টোটা ঘটে। এখানে তিনিই বরং গুটিয়ে যান। তার সপ্রতিভ, স্পষ্ট আচরণ, কথার কাছে বিনা যুদ্ধে সমর্পণ করেন।

রিয়া বলল, ওল্ড ম্যানের কি মন খারাপ হলো?

মাহমুদ এবারও কথা বললেন না। রিয়া তার পাশে এসে বসল। তারপর বলল, আপনি যেমন হোন, তেমনই আমার ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটা বিরল এক অসুখের মতো। আপনি ছাড়া এর আর কোনো ওষুধ নেই।

মাহমুদ চুপ করে আছেন। রিয়া বলল, এবার বলুন আপনি কেন চেয়েছিলেন যে আমি আসি?

আমি একবারও তোমাকে আসতে বলি নি, রিয়া।

বলেছেন। স্পষ্ট করেই বলেছেন। আপনার কী ধারণা, আপনি সত্যি সত্যি না চাইলে এ সময়ে আমি এখানে আসতে পারতাম? সুমি বাসা থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন যে আমাকে এখানে আসতে বলবেন। আপনি চেয়েছেন আমি এখানে আসি। কিন্তু আপনি এটাও চান নি যে আপনার সেই আমন্ত্রণ আর দশজন সাধারণ পুরুষের মতো সরাসরি হোক। অশোভন উপায়ে উপযাচকের আমন্ত্রণ হোক।

তোমার কথা ঠিক নয়। আমি কিন্তু তোমাকে ফোন করি নি। ফোনটা তুমিই আমাকে করেছ।

কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমি ফোন করার আগে আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে একটা ব্ল্যাঙ্ক মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, যাতে পরে বলতে পারেন যে ওটা ভুল করে চলে গেছে। আর আমি ওই ব্ল্যাঙ্ক মেসেজের কারণ জানতে আপনাকে ফোন করি। আমি তা ই করেছি। আপনি নির্ভুল টোপ ফেলেছেন। কারণ, আপনি জানতেন যে ওই টোপ আমি গিলবই। কথা কি মিথ্যা?

মেসেজটা ভুল করেই গিয়েছিল।

রিয়া হাসল। শ্লেষাত্মক হাসি। মাহমুদ বললেন, আর আমি বারবার তোমাকে বলছিলাম যে তুমি এসো না। এখন উল্টো আমাকেই অভিযুক্ত করছ তুমি!

একদমই না। মানুষ অভিযোগ কখন করে? যখন কোনো কিছু তার বিরুদ্ধে চলে যায়। কিন্তু এই যে বাসা ফাঁকা হওয়ামাত্রই আপনি আমাকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন…। বলে সামান্য থামল রিয়া। তারপর বলল, ওয়েল…ইনডিরেক্ট ইনভাইটেশন পাঠিয়েছেন, তাতে তো আমি বরং খুশিই হয়েছি। সো, আমার কোনো অভিযোগ নেই মি. ওল্ড ম্যান। আই অ্যাম হোল হার্টেডলি হ্যাপি।

মাহমুদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। রিয়া তার আরও কাছে সরে এল। তারপর কেমন ঘোরলাগা গলায় বলল, আপনি ভালো হতে পারেন। আমি তো আত্মস্বীকৃত খারাপ মেয়ে। খারাপ মেয়েদের কথায় মন খারাপ করতে নেই।

কিন্তু তুমি যা বললে তা মোটেই ঠিক নয়, রিয়া। আমার বরং এখন গিল্টি ফিলিং হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি কেন তোমাকে আরও শক্ত করে নিষেধ করলাম না! কেন বললাম যে সুমি বাসায় নেই!

কেন বলেছেন, বলব?

তুমি যেটা বলবে, সেটা সত্যি নয়। কিন্তু তোমার ভাবনা আমি বদলাতে পারব না।

হবেও না। পৃথিবীর সব মানুষের ভাবনা কি আমরা বদলাতে পারি? পারি না। আমাকে নিয়েও তো কতজন কত কিছু ভাবে। কই, আমি তো সেসব পাত্তা দিই না। অবন্তী কী বলে, জানেন?

কী?

ওর ধারণা, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। আপনারও তো তেমনই ধারণা। না?

মাহমুদ কথা বললেন না। রিয়া বলল, অসুস্থ হই আর যা হই, কিন্তু এটাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে আপনার জীবনে আমার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর কোনো মেয়ে আর কখনো আসে নি। এমন করে কেউ কখনো আপনাকে ভেঙেচুরে দিতে পারে নি। পেরেছে?

রিয়ার কথা মিথ্যে নয়। মাহমুদ জীবনভরই মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকা মানুষ। তার চারপাশে অসংখ্য বিকল্প। মেঘ না চাইতেই ঝড়-জল-বৃষ্টিতে বারবার ভিজে গেছেন তিনি। ফলে সহসা কেউ তাকে নাড়িয়ে দিতে পারে নি। মুগ্ধ করতে পারে নি। বরং তিনি যেমন চাইতেন, তেমন করেই অন্যরা নিজেদের সাজাত। তার মনমতো নিজেদের উপস্থাপন করতে চাইত। কিন্তু এই একটিমাত্র মেয়ে, যে তার সহজাত আচরণে, স্বাতন্ত্রে, ঔদ্ধত্যে তাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। কেবল এই মেয়েটির কাছেই তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।

যে শক্ত ব্যক্তিত্বের আবরণে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইতেন তিনি, সেই আড়াল থেকে যেন মুহূর্মুহূ তাকে বের করে নিয়ে এসেছে রিয়া। যেন তার চোখে তাকিয়েই বুকের ভেতর অবধি দেখতে পায় সে। ফলে রিয়ার সামনে নিজেকে আজকাল ভীষণ নিরাভরণ, নগ্ন মনে হয় তার। নাহলে খানিক আগেই কী অকপটে কত কত কথা বলে গেল সে! কী অবলীলায় তার ভাবনা, আচরণ সব ব্যাখ্যা করে ফেলল! সেসব কি মিথ্যে?

রিয়া বলল, আমার সঙ্গে মিথ্যা বললেও ক্ষতি নেই। ওসব নিয়ে ভাবি না আমি। আমি কেবল আমার প্রাপ্তি নিয়েই ভাবি। আপনি অস্বীকার করলেও এটা সত্যি যে আপনি ইচ্ছে করেই কৌশলে আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন। আর এতে আমি খুশিই হয়েছি। সুতরাং আপনার ওই অভিনয়টুকু নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। এখন বলুন, কী চাই?

কী চাইব?

কিছুই না?

মাহমুদ কথা বললেন না।

রিয়া বলল, একটি সুন্দরী তরুণী একা বাসায় আপনার গা ঘেঁষে বসে আছে, আর আপনি তার কাছে কিছু চাইবেন না?

মাহমুদ এবারও চুপ। তবে তিনি টের পাচ্ছেন তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে আসছে। রিয়া আরও খানিক ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। তার শরীরের মোহনীয় সুগন্ধির সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। সেই সুবাসে মাহমুদের চিন্তাভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। তিনি নিজের অজান্তেই যেন রিয়ার আরও কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে চাইলেন।

রিয়া গাঢ়, গম্ভীর গলায় বলল, কী, চাই কিছু?

মাহমুদ প্রায় কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, কী চাইব?

অন্তত চা কিংবা বিস্কুট? বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলল রিয়া। তারপর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, রান্নাঘরটা কোন দিকে?

মাহমুদ হতভম্ব ভঙ্গিতে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই জীবনে কখনো এত বিব্রত আর হন নি তিনি। রিয়া চা বানিয়ে এসে দেখে মাহমুদ তার পড়ার ঘরের টেবিলে বসে আছেন। এখানে আলো কম। বাইরে ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। ফলে জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন মাহমুদ। টেবিলে একটা নরম আলোর ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলোতে মাহমুদের মুখোমুখি বসল রিয়া। তারপর বলল, সুমি আজ রাতে ফিরবে না, তাই না?

মাহমুদ চমকে উঠলেন, মানে?

মানে আপনি আগে থেকেই জানতেন যে সুমি আজ রাতে ফিরবে না।

কে বলল তোমাকে?

কে বলল সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার কথা সত্যি কি না।

নিজেকে আচমকা ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো মনে হতে লাগল মাহমুদের। তিনি মিনমিন করে বললেন, কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে?

রান্নাঘর দেখে। বারান্দা, শোবার ঘর, খাবার টেবিল দেখে। সে যাওয়ার আগে সব গোছগাছ করে রেখে গেছে। বারান্দায় একটাও কাপড় ঝোলানো নেই। সব ভাজ করে তুলে রেখে গেছে সে। সন্ধ্যার আগেই রাতের খাবার রেডি করে রেখেছে। আরও অনেক ব্যাপার আছে। সে যদি আজই ফিরে আসত, তবে সবকিছু অন্য রকম থাকত।

মাহমুদ কী বলবেন ভেবে পেলেন না। রিয়া বলল, আমার অনুমান কি ঠিক?

মাহমুদ এবারও কথা বললেন না। তবে কাঁপা কাঁপা হাতে রিয়ার হাত ছুঁয়ে দিলেন তিনি। এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছে এমন সর্বৈব পরাজয় ঘটল তার; কিংবা আত্মসমর্পণ। এত দিন অন্যরা তার কাছে নিঃশেষে নিজেদের সমর্পণ করত। কিন্তু আজ এই অল্প বয়সের প্রগল্ভ, আপাতদৃষ্টে অগভীর, চঞ্চল মেয়েটার কাছে তিনি কী করে এমন নিঃশর্তে নিরঙ্কুশভাবে পরাজিত হলেন?

.

রিয়া সেই রাতটা থেকে গেল সেখানেই। সুমি মাহমুদকে মাঝরাতে চমকে দেওয়ার কথা ভাবলেও তা আর করা হলো না। বরং পরদিন সেমিনার থেকে ফেরার পথে তাকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরলেন মাহমুদ। সবকিছুই যেন আগের মতো। কিন্তু মাহমুদ জানেন, রিয়া নামের ওই ডানপিটে, দুরন্ত স্বভাবের মেয়েটির কাছে তিনি ক্রমশ উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। নিজের সহজাত শক্তিশালী সত্তাটাকে তার কাছে আর খুঁজে পান না। নতজানু হয়ে থাকেন এবং একটা অব্যাখ্যেয় ভয়ও কাজ করতে থাকে সারাক্ষণ। এই ভয়টা কিসের কে জানে!

তবে ভয়টা অন্যভাবেও ধরা দিল। বেশ কিছুদিন বাদে সুমি হঠাৎই একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, বাসায় কি কেউ এসেছিল, মাহমুদ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *