১০. নতুন বাসায় পড়াতে

১০

অনিক যে নতুন বাসায় পড়াতে এসেছে, সে বাসার গৃহকর্তার নাম মাহমুদ হাসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সুদর্শন, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। তার স্ত্রী সুমি একটি কলেজে বাংলা পড়ান। তাদের একমাত্র সন্তান জিতু ক্লাস ফাইভে পড়ে। মূলত তাকেই পড়াতে হবে অনিককে। ফলে কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল তার জন্য।

প্রথম দিন গিয়েই মন ভালো হয়ে গেল অনিকের। মাহমুদ হাসান অল্প কথা বললেও ভীষণ আন্তরিক। তার স্ত্রী সুমি খানিক চটপটে। তবে বিনয়ী। ছেলের পাঠ্যপুস্তকবিষয়ক পড়াশোনার চেয়েও তারা তাকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে বেশি আগ্রহী। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উপকথা, রূপকথার বইয়ে তার ঘর ভর্তি। বিষয়টা এমন নয় যে তাকে জোর করে এসব বই পড়ানো হচ্ছে। বরং সে নিজ আগ্রহ থেকেই পড়ছে। বিষয়টা দারুণ ভালো লাগল অনিকের।

মাহমুদ বললেন, আমরা দুজনের কেউই কিন্তু সেই অর্থে দায়িত্ববান অভিভাবক নই।

অনিক জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

মানে…। বলে খানিক ভাবলেন মাহমুদ। তারপর বললেন, মানে এই বয়সের বাচ্চাদের প্রতি অভিভাবকেরা যেমন খড়গহস্ত হয়ে থাকেন আরকি, আমরা তেমন নই। আমরা কিছুতেই ওর শৈশবটা নষ্ট করতে চাই না।

জি।

এ কারণেই আপনাকে ঠিক ওর শিক্ষক নয়, বন্ধু হতে হবে। একটু বয়সে বড়, কিন্তু বন্ধু, যে ওর থেকে বেশি জানে, ওর নানান ভাবনার উত্তর দিতে পারে, সুন্দর যৌক্তিক সমাধান দিতে পারে। আর যেকোনো ধরনের হেট্রেড, সুপ্রিমেসি থেকে দূরে রাখতে পারে। আমি চাই না আমার সন্তান কোনোভাবেই নিজেকে অন্যদের চেয়ে সুপিরিয়র ভাবুক।

কথাগুলো শুনে অনিকের এত ভালো লেগেছিল! তার মনে হয়েছিল, ঠিক এই ভাবনাটাই যদি সকল অভিভাবক তার সন্তানকে দিতে পারতেন, তাহলে এই যে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অসহিষ্ণুতা, চিন্তা ও আচরণের প্রবল গোড়ামি আর একটা ক্রমশই অস্থির হয়ে ওঠা সমাজ, তা খানিকটা হলেও অন্য রকম হতে পারত।

সুমি বললেন, আমরা দুজনই ব্যস্ত। ফলে আপনি কখন আসবেন বা আসবেন না, সেটা আমাদের পক্ষে খেয়াল রাখা সম্ভব নয়। বরং বিষয়টা পুরোপুরি আপনার ওপর। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলে, ওর স্কুল বা হোমওয়ার্কের রুটিনের সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক করে নেবেন।

আচ্ছা। বলে সেদিনের মতো উঠে গিয়েছিল অনিক। তবে তার দিন চারেক পরে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। অনিকের দীর্ঘ এই টিউশন জীবনে এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটে নি। সে আর হৃদি গিয়েছিল তাদের নতুন বাসাটা দেখতে। মোহাম্মদপুরের একটু ভেতরের দিকে হলেও ভাড়া বিবেচনায় বাসাটা ভালো। সমস্যা হচ্ছে, তিন মাসের অ্যাডভান্স ছাড়া মালিক কিছুতেই বাসা ভাড়া দেবেন না। এই নিয়ে খানিক তর্কযুদ্ধও হলো। তবে তাতে লাভ বিশেষ হলো না। অনিকের সঙ্গে আর যে ছেলেটা উঠবে, তার নাম জাবেদ। সে বয়সে অনিকের চেয়ে বেশ বড়। একটা সুপারশপে ম্যানেজারের চাকরি করে। ফলে অনিকের দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও অতগুলো টাকা একসঙ্গে দেওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

দুপুর থেকেই বিষয়টা নিয়ে মনমরা হয়ে ছিল সে। জিতুকে পড়াতে গিয়েও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিল না। বারবার ফোনে কথা বলতে হচ্ছিল। হৃদি কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছে। সমস্যা হচ্ছে, তার কাছ থেকে টাকাটা নিতে চায় না সে। এমনিতেই নানান। সমস্যায় জর্জরিত হৃদি। ফলে ওই টাকাটা এই মুহূর্তে তার কাছেই থাকা উচিত। এতে আলাদা একটা শক্তি সে পাবে। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায়ই-বা কী? অনেক ভেবেও কোনো সমাধান মিলল না অনিকের। তবে খানিক অভাবিত উপায়েই টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। জিতুকে পড়ানো শেষ করে যখন সে বের হতে যাবে, তখনই সুমি এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। বললেন, আপনার মায়ের অবস্থা কী?

এই তো।

এই তো কী?

এখনো ঠিক জানি না। ডাক্তার বলেছেন পুরোপুরি বুঝতে একটু সময় লাগবে।

আপনি হলের সিট ছেড়ে দিয়েছেন?

এখনো না। তবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে হয়তো ছেড়ে দেব।

নতুন বাসা ঠিক হয়েছে?

অলমোস্ট। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল অনিক।

সুমি হাসলেন। তারপর বললেন, এই টাকাটা রাখুন। আপাতত আপনার ঝামেলাটা মেটান। তারপর পরে কখনো সময় হলে আমাকে শোধ করে দেবেন।

অনিক প্রায় আঁতকে ওঠা ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, এটা এমন কিছু নয় যে এর জন্য এমন হাত-পা ছুঁড়ে পালাতে হবে। নিন।

সুমির কণ্ঠে কিছু একটা ছিল যে অনিক এড়াতে পারল না। সে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে খামটা নিল। কিন্তু এই ঘটনা তাকে অভিভূত যেমন করল, তেমনি ভেতরে ভেতরে বেশ খানিকটা তটস্থও করে ফেলল। তার মনে হলো, ঠিক এই কারণে হলেও আর এক দিনও টিউশন মিস দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট ঘণ্টার চেয়েও বেশিক্ষণ পড়াতে হবে। অধিক মনোযোগী হতে হবে। এমন নানা কিছু। তবে বিষয়টা খেয়াল করলেন মাহমুদ। তিনি একদিন ডেকে বললেন, আপনি কি কোনো কারণে আপসেট?

অনিক ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, না না।

সুমি আমাকে ওই দিনের ঘটনা বলেছে। তার ধারণা, এর পর থেকে আপনি খুব আপসেট হয়ে আছেন। শুনুন, আপনি আমাদের ছোট ভাইও হতে পারতেন। কিংবা বয়সে ছোট বন্ধু। কি, পারতেন না?

জি।

তাহলে?

অনিক জবাব দিল না। মাহমুদ বললেন, টেক ইট ইজি। এর জন্য আপনাকে আলাদা করে এত কনসার্ন হতে হবে না। ঠিক আছে?

অনিক মৃদু মাথা নাড়ল। তবে সেদিন থেকে এই পরিবার-পরিজনহীন ঢাকা শহরে তার যেন খানিক মায়ার আশ্রয় তৈরি হলো। একটা অব্যাখ্যেয় আনন্দের অনুভব। কিন্তু অনিক স্বভাবে অন্তর্মুখী। ফলে সে তার এই আনন্দটা কখনো প্রকাশ করতে পারল না। বরং নিজেকে আরও গুটিয়েই রাখল। তবে এত কিছুর মধ্যেও একটা বিষয় তার চোখ এড়াল না, তা হচ্ছে মাহমুদ ও সুমির সম্পর্ক। বয়সের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক রসায়নটা মুগ্ধ হওয়ার মতো। বিয়ের এত বছর পর এসেও এমন প্রেমিক যুগলের দেখা মেলা ভার।

সেদিন পড়াতে আসতে খানিক দেরি হলো অনিকের। সন্ধ্যারও ঘণ্টাখানেক পর। আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। জিতুকে পড়িয়ে সে যখন বের হবে, তখন হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল বারান্দায়। বিস্তৃত খোলা বারান্দার দেয়ালজুড়ে বাগানবিলাস। মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো টব। টবে বাহারি রঙের ফুল। মাঝখানে দুটি বেতের চেয়ার। সেই চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন মাহমুদ আর সুমি। মস্ত চাঁদের আলোয় তারা। পরস্পরের গা ঘেঁষে বসে আছেন। এই তপ্ত সন্ধ্যার লু হাওয়াতেও সুমি গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন–

আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে…।

অনিকের অকস্মাৎ মনে হলো, জীবন তো এমনই। এখানে প্রিয়তম মানুষের সান্নিধ্যে চৈত্রের খটখটে দুপুরও হঠাৎ হয়ে ওঠে মাতাল সমীরণের বসন্ত। ঝলসানো আগুনের সূর্যকেও মনে হয় জোছনায় প্লাবিত সন্ধ্যার চাঁদ।

.

বাসায় ওঠার দুই দিনের মাথায় মাকে নিয়ে এল অনিক। তার মা রাহিমা বানু এখনো নিজের সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না। ফলে বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। চারদেয়ালে বন্দী এই শহরে তার মন বসে না। তার ওপর ছোট মেয়েটাকে গ্রামে ভাইয়ের বাড়িতে রেখে এসেছেন। এই নিয়েও একটা অস্থিরতা কাজ করছে। ভাইয়ের বউকে বিশেষ পছন্দ করেন না তিনি। সে কথা অনিককে বললেনও। অনিক বলল, মা, একটা কথা বলি?

বল।

তোমার যে অসুখটা হয়েছে, সেটা এখনো তেমন বড় কিছু না। কিন্তু ধরো, প্রোপার ট্রিটমেন্ট না করিয়েই যদি তুমি বাড়ি চলে যাও, আর তারপর এটা বাড়ে, তখন কী করবে? গ্রামে আশপাশে কোনো ডাক্তার পাবে? আর তোমাকে নিয়ে ছোটাছুটিই বা কে করবে?

কী হয়েছে আমার? খুব খারাপ কিছু?

সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে সব রোগই খারাপ। জ্বর, পেটব্যথাও। তোমার এখনো কিছু হয় নি। কিন্তু ডাক্তার বারবার করে বলেছেন, তোমাকে আপাতত কিছুদিন ঢাকায় রেখেই চিকিৎসা করাতে হবে।

কিন্তু তুই এত টাকা পাবি কই?

টাকার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তোমার যেটা চিন্তা করার, সেটা করো। নিজের শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখো। ডাক্তার যা যা বলেছে, তা করো।

আমার তো এখন চিন্তা ওই একটাই।

কী চিন্তা?

তোর আব্বা অতগুলা টাকা কই পেয়েছিল? আর মারা যাওয়ার আগে আগে অমন অস্থিরই-বা হয়েছিল কেন? এই একটা বিষয় ভেবে ভেবেই আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, শেষের দিকে এসে সে আমাকে কিছু বলতে চাইত, কিন্তু বলত না।

এই কথায় অনিক চুপ হয়ে যায়। তার ছাত্তার মিয়ার কথা মনে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনে হয়, জোর করে ছাত্তারের কাছ থেকে সব কথা আদায় করে সে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও-বা কী? কী করতে পারবে সে? তবে বিষয়টা মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি দেয় না তাকে। রাহিমা বানু বলেন, তোর আব্বার কথামতো অই টাকাগুলা যে মহিদুল মেম্বারের জমি কিনতে বায়না হিসেবে দিলাম, সেই টাকাও তো সে এখন ফেরত দিতে চাইতেছে না।

কী বলে?

বলে টাকা ফেরত দেওয়ার তো কথা ছিল না! কথা ছিল পুরো টাকা দিয়ে জমি কিনে নেবেন।

কিন্তু এখন তো পুরো টাকা দেওয়া সম্ভব না।

এটা সে মানতে চাইছে না। তার এক কথা, পুরো টাকা না দেওয়া পর্যন্ত সে জমিও দেবে না। টাকাও না। বলে সামান্য চুপ করে রইলেন রাহিমা বানু। তারপর বললেন, এই সময়ে ওই টাকাগুলা থাকলে তোর কত উপকার হতো। একটা কাজ করবি নাকি?

কী কাজ?

থানা-পুলিশে জানাবি নাকি? তারে যে আমরা টাকা দিছি, সেই ডকুমেন্টস তো আমাদের কাছে আছে।

অনিক সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। সে বেশ খানিকক্ষণ কী ভাবল। তারপর বলল, দরকার নেই, মা। বাদ দাও। এমনিতেই এই টাকা নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন। তারপর এই নিয়ে থানা-পুলিশ করতে গেলে আবার কী ঝামেলা হয় কে জানে!

কথাটা রাহিমা বানুরও যে মাথায় ছিল না তা নয়। কিন্তু অতগুলো টাকার মায়া তিনি ছাড়তে পারছিলেন না। এই সময়ে ওই টাকা কটা ভারি কাজে লাগত। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। তুমুল কাশির দমকে জেগে উঠে বসে থাকেন। তখন গাছের ছায়ায় ঢাকা শান্ত শীতল ওই বাড়িটা বুকের মধ্যে তিরতিরে হাওয়ার এক অনুভব দিতে থাকে। সেই অনুভবে বাঁশের বেড়ায় ঘেরা স্বামীর কবরটা খুব তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়ে বেঁধে। মনে হয়, মানুষটা কেন এমন করে চলে গেলেন! কতবার বলেছিলেন, সামনে কোরবানিতে বাড়ি আসবেন। তারপর ধুমধাম করে কোরবানি দেবেন। এ তার বহুদিনের শখ। তারপর নিজের জমিতে চাষবাস শুরু করবেন। গরু কিনবেন। গোয়ালঘর করবেন। পুকুরে মাছের চাষ শুরু করবেন।

ঢাকার ফুটপাত থেকে নানা জাতের ফসল, মাছ চাষের নিয়মকানুন-সংবলিত বইপত্র কিনে পাঠাতেন। মানুষটার কত কিছু যে স্বপ্ন ছিল! কিন্তু সাত ভাইবোনের পরিবারে পিতৃহীন বড় সন্তান হওয়ার মাশুলটা তাকে জীবনভর গুনতে হয়েছে। বিয়েও করেছেন সময়ের অনেক পরে। ফলে সন্তানের পিতা হয়েছেন দেরিতে। দায়িত্বের পর দায়িত্ব তাকে শৃঙ্খলের মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। আর ওই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতেই শেষ কয়েক বছরে ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন! যেন যেকোনো উপায়েই হোক, এই ক্লান্তিকর, দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি চান তিনি। গাঁয়ের আলো হাওয়ায় খানিক বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চান। সেই মুক্তি অবশেষে মিলল তার। চিরদিনের জন্য মুক্তি!

একটা দীর্ঘশ্বাস বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর ভাসতে থাকে হাওয়ায়। রাহিমা বানু অন্ধকারে ওই ভারী হয়ে থাকা হাওয়ায় যেন নিশ্বাস নিতে পারেন না। তার দমবন্ধ লাগে। তবে এই দমবন্ধ শহরেও তার জন্য খানিক ঝলমলে তাজা বাতাস নিয়ে আসে হৃদি। একটা মেয়ে এত সুন্দর কী করে হয়! শুধু যে সুন্দর, তা-ই না, এত আদর করে কথা বলে যে তার মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয়, জীবন তাকে একের পর এক যে দুঃসহ যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে, তাতে এই মেয়েটা যেন খানিক উপশম।

সেদিন দুপুরবেলা এল সে। সঙ্গে নানা রকম খাবার। এসেই কোমরে ওড়না বেঁধে ঘর গোছাতে লেগে গেল। তিনি এত বারণ করলেন, কিন্তু শুনল না। বরং চোখের পলকে যেন পুরো বাসার খোলনলচে পাল্টে দিল।

অনিক বলল, ও হৃদি, মা। আমার ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে।

রাহিমা বানু কথা বললেন না। তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন। অনিককে এই মেয়ে ঠিক কী কারণে পছন্দ করেছে, তা তিনি জানেন না। অনিক বলল, তুমি কিন্তু আবার অন্য কিছু ভেবো না, মা। ও এমনই। কারও কোনো বিপদ-আপদ দেখলে এভাবেই ছুটে আসে। তোমার অসুখের কথা শুনে আর অপেক্ষা করে নি। আমি বারণ করা সত্ত্বেও ছুটে এসেছে। দেখো না কত কিছু রান্না করে এনেছে?

হুম। গম্ভীর গলায় বললেন রাহিমা বানু। নিজের উচ্ছ্বাস তিনি অনিকের সামনে। প্রকাশ করতে চান না। হৃদি তখন বারান্দায় কিছু করছিল। অনিক বলল, তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? কোনো সমস্যা?

কী সমস্যা?

মানে তুমি কি অন্য কিছু ভাবছ? ওর সঙ্গে কিন্তু আমার অন্য কোনো ব্যাপার নেই, মা। ও এমনই। তুমি দয়া করে অন্য কিছু ভেবো না।

আমি তো অন্য কিছুই ভাবতে চাই।

মানে?

মানে এই মেয়ে যে ঘরে বউ হয়ে যাবে, সে ঘর আলো করে রাখবে। এ ঘরের লক্ষ্মী। আমার বয়স তো কম হয় নাই। স্বভাব-চরিত্র তো কিছুটা হলেও বুঝি। এই মেয়ে তোর সাতজনমের ভাগ্য! এরে কখনো ছাড়িস না।

অনিক কথা বলল না। তবে বহুদিন পর তার হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। সে ভাবে নি মা হৃদিকে এতটা পছন্দ করবে!

হৃদি বলল, মা, আপনাকে এখন খাবার দেব?

রাহিমা বানুর মনে হলো, হৃদি তাকে বহু বছর ধরেই মা বলে ডাকছে। এটা নতুন কিছু নয়। এমনকি এই ঘরে তারা বহুকাল থেকেই একসঙ্গে আছেন। তিনি নরম গলায় বললেন, তুমি নিজে বেঁধেছ?

না, মা। কিনে এনেছি।

রাঁধতে পারো তুমি?

একটু-আধটু।

শিখবে রান্না?

কীভাবে মা? বাসায় তো আমাকে কেউ রান্না করতে দেয় না।

আমি শেখাব। তুমি সময় পেলেই রোজ এখানে চলে আসবে। আমি তোমাকে শেখাব।

হৃদি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। এই মানুষটাকে এত আপন লাগছে তার। প্রথম দেখায়ই মনে হয়েছে, মায়েদের মুখ মনে হয় এমনই হয়। এমন সহজ, সাধারণ অথচ মায়াময়। দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। সে অবশ্য জড়িয়েই ধরল। দীর্ঘ সময় রাহিমা বানুকে আলিঙ্গন করে বসে রইল সে। ওই মুহূর্তটুকু তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়। মানুষটার গায়ের ঘ্রাণ, শরীরের স্পর্শ, কথা আর কাজে কী আশ্চর্য মায়াবী কোমল প্রকাশ! হৃদি তা বোঝাতে পারবে না।

এর পর থেকে প্রায় রোজই আসতে লাগল সে। সেদিন সত্যি সত্যি হৃদিকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন রাহিমা বানু। অনিক তখন কেবল বাজার করে ফিরেছে। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল হৃদি। তার পরনে মেরুন রঙের শাড়ি। শাড়ির আঁচল শক্ত করে কোমরে প্যাঁচানো। চোখমুখ ঘর্মাক্ত। বুকের কাছটা ঘেমে ভিজে আছে। গলার সরু চেইনের ফাঁক গলে নেমে যাচ্ছে ঘামের প্রস্রবণ। আর একটা অদ্ভুত মাতাল ঘ্রাণ তার শরীর থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

অনিকের হঠাৎ কী যে হলো! সে বাজারের ব্যাগটা পাশে রেখে হৃদিকে খপ করে। ধরে ফেলল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। সেখানে তখন জাবেদ নেই। ফলে তার ঘরটা ফাঁকা। সে তাকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে বেপরোয়া চুমু খেতে লাগল। হৃদি তার সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে চাইল। কিন্তু পারল না। অনিকের শরীরে তখন যেন বুনো উন্মাদনা ভর করেছে। সে ভারী নিশ্বাস ফেলছে। হৃদি কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কটমট চোখে তাকাল। তারপর প্রায় হিসহিসে গলায় বলল, তুমি কি পাগল?

হুঁ। ঘোর লাগা গলায় বলল অনিক।

মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?

হুঁ। আবারও একই স্বরে বলল অনিক।

তুমি আবার কেন এগিয়ে আসছ?

ইচ্ছা।

আর একটুও এগোবে না।

হুঁ।

কী বলছি শুনতে পাচ্ছ না?

হুঁ।

মাকে বলে দেব কিন্তু।

হুঁ। অনিক জানে, আর যা-ই হোক, অন্তত এই মুহূর্তে মাকে কখনো ডাকতে পারবে না হৃদি।

সে এবার কঠিন গলায় বলল, অ্যাই, কী হয়েছে, এমন করছ কেন?

অনিক এবার আর জবাব দিল না। সে আবারও তাকে কাছে টেনে নিতে লাগল। হৃদি হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, মা। মা।

রাহিমা বানু রান্নাঘর থেকে জবাব দিলেন, হ্যাঁ। বলো।

একটু এদিকে আসেন।

কেন, কী হয়েছে?

আপনার ছেলে কী করছে দেখে যান।

অনিক আচমকা ছিটকে দূরে সরে গেল। সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি যে হৃদি এমন কিছু করতে পারে। ফলে হতভম্ব হয়ে গেল সে। হৃদি অবশ্য ওইটুকু সুযোগেই ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমের খোলা জায়গাটায় চলে এল। রাহিমা বানু ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তটস্থ গলায় বললেন, কী হয়েছে, মা? কী করেছে ও?

দেখেন না, এই হলো তার বাজার করার ছিরি! বলে বাজারের ব্যাগটা মেঝেতে উপুড় করে ধরল হৃদি। সেখানে যে খুব খারাপ কিছু রয়েছে, তা নয়। কিন্তু তারপরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান সমস্যা বের করতে লাগল সে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রাহিমা বানুও তার সঙ্গে তাল মেলাতে লাগলেন। তিনি বললেন, একদম বাবার স্বভাব পেয়েছে, বুঝলে? তার বাবাও এমন, বাজারে গেলে ওই এক আলু-পটোল ছাড়া আর কোনো তরকারি কোনো দিন চোখে দেখত না। তাও যা আনত, তা রান্নার যোগ্য থাকত না। যেন দোকানদাররা সব বুঝতেই পারত, সব পচা-গলা জিনিস তাকেই গছিয়ে দেওয়া যায়। একবার কী হলো, শোনো…।

বলে রাজ্যের গল্প শুরু করলেন রাহিমা বানু। হৃদির অবশ্য তাতে মন নেই। সে একফাঁকে অনিককে চোরা চোখে টিপ্পনী কাটল। তারপর জিব ভেংচাল। অনিকের খানিক মন খারাপ হলেও হৃদির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বিস্মিত হয়ে গেল সে। মুহূর্তেই ঘটনা কেমন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল মেয়েটা। আবার মাকেও নিজের পক্ষে টেনে নিল!

তবে এই এত কিছুর মধ্যেও একটা বিষয় খুব প্রশান্তি দিয়েছে অনিককে। এ কদিনে কীভাবে কীভাবে যেন হৃদিকে নিয়ে তার আগের সকল সংশয়, দ্বিধা একটু একটু করে দূর হয়ে গেছে। মনে হয়েছে, এই হৃদি আগের সেই হঠাৎ রোদ, হঠাৎ বৃষ্টির শ্রাবণের আকাশ নয়। অননুমেয় নয়। বরং এ অনেক বেশি ধীরস্থির। একে নির্দ্বিধায় ভালোবাসা যায়, ভরসা করা যায়। এ শান্ত নদীর মতো গভীর। স্থৈর্যময়।

তারা বিয়ে করেছে গোপনে। হৃদির জেদ আর হঠাৎ ঝেকের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল অনিককে। ওই হৃদি ঝঞ্ঝার মতো উত্তাল। তাকে সামলানো কিংবা বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। ফলে অনিককে নির্বিকার ভেসে যেতে হয়েছে তার উন্মাতাল স্রোতে। এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় কাজি অফিসে গিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল তারা। দেনমোহর এক টাকা। বিষয়টা ভারি রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল হৃদির কাছে। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই সেই ঘোর যেন কেটে যেতে লাগল তার। মনে হতে লাগল, কাজটা ঠিক হয় নি। বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছে সে। কিন্তু এই ভুল শোধরানোর উপায় কী?

সেই উপায় বের করতে গিয়েই ভয়ানক অস্থিরতার এক সময় শুরু হলো। যাচ্ছেতাই আচরণ শুরু করল সে। অনিক শান্ত, চুপচাপ মানুষ। ফলে নির্বিকার ভঙ্গিতে সব সয়ে যেতে লাগল। নিজের দুঃসহ যন্ত্রণাটা কখনোই বুঝতে দিত না। কিন্তু তাতে হৃদির পাগলামি যেন আরও বাড়ত। আরও খেয়ালি, বেপরোয়া হয়ে উঠত সে। আবার হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে যেতে। খানিক আগের আচরণের জন্য দুঃখিত হতো। সারিয়ে তোলার চেষ্টা করত তার আঘাতে জরজর অনিকের ক্ষতগুলো।

কিন্তু এই রোদ-বৃষ্টির খেলায় ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্লান্ত বোধ করত অনিক। মাঝে মাঝেই মনে হতো, ঝোঁকের মাথায় করা বিয়ের ওই আগল ভেঙে সত্যি সত্যিই বের হয়ে যেতে চায় সে। কিন্তু তারপরই বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যেত। মনে হতো, ওই খেয়ালি, অনুমান-অযোগ্য, তুমুল পাগলামিতে চারপাশ ভাসিয়ে নেওয়া মেয়েটাকেই ভালোবাসে সে। সেই ভালোবাসা অন্তহীন ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর থেকেই কি একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল হৃদি?

এই প্রশ্নের উত্তর আজকাল খুঁজতে চেষ্টা করেছে অনিক। আর তারপর তার মনে হয়েছে, হ্যাঁ, এই মানুষটা অন্য রকম। এ এক দ্বিধাহীন নির্ভরতার নাম। একে জীবনের দুর্গমতম যাত্রায় চোখ বন্ধ করে সঙ্গী করা যায়। তারপর হেঁটে যাওয়া যায় অন্তহীন অমানিশার পথ। কে জানে, সেই পথও এমন একজন সঙ্গীর কারণে জোছনায় আলোকিত হয়ে ওঠে কি না! বসন্তের ওই মাতাল সমীরণের মতো সুবাসিত হয়ে ওঠে কি না!

মাকে নিয়ে এই বাসাটায় ওঠার পর থেকে অনিকের সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। সে এখন পুরোপুরি নির্ভার, নিঃসংশয়। বরং এই যে কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ানো ঘর্মাক্ত মেয়েটাকে দেখে তার জগত্তা হঠাৎ উথালপাতাল হয়ে উঠল, ওই অনুভূতিটাই যেন এতটা বছর খুঁজে ফিরে হয়রান হয়েছিল সে। আজ ওই মুহূর্তটুকু তাকে যেন ফিরিয়ে দিল দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে ফেরা তার সেই অস্পর্শ অনুভূতির জাদুর জীয়নকাঠি।

.

সে রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে তাকাল। মা হাসিমুখে কী সব বলছেন! হৃদি জগতের সব মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে। তার কপালে, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। চিবুকের কাছে খানিক কালি লেগে আছে। মা হঠাৎ তার শাড়ির আঁচলে সেই কালিটুকু মুছে দিতে লাগলেন। মুছে দিতে লাগলেন তার কপালে জমা ঘামের ফোঁটা। কী আশ্চর্য মায়াময় এক দৃশ্য!

অনিকের হঠাৎ মনে হলো, মা যেন হৃদির আদুরে অধরে লেপ্টে দিতে লাগলেন। অপার্থিব স্পর্শের মায়াঞ্জন।

১১

আলাদা বিভাগের হওয়া সত্ত্বেও অল্প কদিনেই ইউনিভার্সিটিতে অবন্তীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠল রিয়া। সে বয়সে তার চেয়ে খানিক বড়। ক্লাসেও বড়ই ছিল। কিন্তু প্রথম বছরই ড্রপ দেওয়ার কারণে অবন্তীর ব্যাচমেট হয়ে গেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ভাবনা আচরণে তারা পুরোপুরি আলাদা। রিয়া ডাকাবুকো স্বভাবের ঠোঁটকাটা মেয়ে। তার মুখে কিছু আটকায় না। আচরণেও বেপরোয়া। সে দিব্যি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফস করে সিগারেট ধরায়। তারপর গলগল করে ধোয়া ছাড়ে। অবন্তী তখন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে খানিক দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। যেন কেউ বুঝতে না পারে যে তারা একসঙ্গে। রিয়া অবশ্য তাতে কিছু মনে করে না। সে বরং জিনসের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে অবন্তীর দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলে, একটা খেয়ে দেখ। তাহলেই বুঝবি অসৎ সঙ্গে স্বর্গবাস। হা হা হা।

অবন্তী বিব্রত ভঙ্গিতে এদিক-সেদিক তাকায়। তারপর বলে, এহ্, ছিহ্! এটা কী করছিস তুই?

তোকে জীবন শেখাচ্ছি, মিয়াও।

মিয়াও কী?

মিয়াও হচ্ছে বিড়ালের বাচ্চা। তুই দেখতে বিড়ালের বাচ্চার মতো। আদুরে, কিউট। তোর আচার-আচরণও তেমন। দেখলেই মনে হয় এখুনি মিয়াও মিয়াও বলে ডাকতে শুরু করে দিবি। বলেই অবন্তীর গাল টিপে দেয় রিয়া। অবন্তী ছিটকে আরও খানিকটা দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। রিয়া অবশ্য তাকে যেতে দেয় না। শক্ত হাতে ধরে রাখে। অবন্তী মাঝে মাঝে একটু অবাকও হয়। রিয়া এত প্রাণশক্তি পায় কোথায়? তাকে দেখে মনে হয় না জগতে দুঃখ, যন্ত্রণা, মন খারাপ বলতে কোনো ব্যাপার আছে। সে সদা হাস্যময়।

অবন্তী বলে, সিগারেটের সঙ্গে জীবন শেখার সম্পর্ক কী?

দুটোই মিনিংলেস। মনে হয় উপভোগ্য, কিন্তু আসলে পেইনফুল। কেবল লস আর লস। আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে অ্যাশট্রেতে চলে যায়।

শুনে অবন্তী হাসে। মাঝে মাঝে প্রায় নির্বিকার ভঙ্গিতে এমন অদ্ভুত কথা বলে রিয়া যে শুনে থমকে দাঁড়াতে হয়। রিয়ার জীবন কি যন্ত্রণাময়? তাকে দেখে ভুলেও তা মনে হয় না। বরং মনে হয় সে প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

রিয়া অকস্মাৎ মৃদু শিস বাজাল। অবন্তী তাকাতেই চোখ টিপে বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?

কী দেখব?

দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি।

মানে কী?

মানে হচ্ছে একজন বৃদ্ধ নাবিক ও একটি সমুদ্র।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস?

নাহ্।

তাহলে?

আমার। বলে ঠোঁট উল্টে অদ্ভুত ভঙ্গি করল রিয়া।

মানে কী?

মানে হলো…। বলে কী ভাবল রিয়া। তরপর গুনগুন সুর তুলে গাইল, কোথায় পাব হাঁড়-কলসি, কোথায় পাব দড়ি, তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি…।

কী হয়েছে তোর? যেন ধৈর্যচ্যুতি ঘটল অবন্তীর।

কী হবে?

এমন করছিস কেন?

এমন করছি, কারণ…ধর, রাধা যদি যমুনা হতে পারে, তাহলে আমিও তো সমুদ্র হতে পারি। না? মানে সি আরকি!…তাহলে কৃষ্ণের মতো ওই ওল্ড ম্যানের সেই সমুদ্রে। ডুবে মরতে সমস্যা কী? লুক অ্যাট দ্যাট হট অ্যান্ড হ্যান্ডসাম ওল্ড ম্যান। বলেই খিলখিল করে হাসল রিয়া।

এতক্ষণে ঘটনা বুঝল অবন্তী। রিয়ার বিভাগের শিক্ষক মাহমুদ হাসান হেঁটে যাচ্ছেন। তার বগলে একগাদা বই। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি পরেছেন ফুলহাতা সাদা শার্ট আর হালকা নীল রঙের জিনস। মেদহীন, ঋজু শরীর। মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি। তবে সেই দাড়িতেই তাকে সুদর্শন লাগছে। রিয়া অবন্তীকে আরও কিছু বলতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। তারপর বেশ খানিকটা সময় একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

মাহমুদ হাসানের ক্লাসের এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। কিন্তু তিনি শিক্ষক হিসেবে সময়নিষ্ঠ। তাই আগেভাগেই বিভাগে চলে আসেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তাদের নানান সমস্যা মন দিয়ে শোনেন। সমাধানের চেষ্টা করেন। রিয়া হঠাৎ বলল, তুই থাক। আমি একটু আসছি।

কই যাচ্ছিস? অবাক গলায় বলল অবন্তী।

ওল্ড ম্যানের সঙ্গে একটু প্রেম করে আসি।

ইশ! বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল অবন্তী। তোর মুখে না কিছু আটকায় না।

আটকাবে কী করে? মুখের কি লক সিস্টেম আছে নাকি?

তাই বলে স্যারকে নিয়ে এসব আজেবাজে কথা?

কেন, স্যাররা প্রেম-বিয়ে করেন না? তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয় না? চোখ টিপে বলল রিয়া।

তাই বলে ওনাকে নিয়ে? ওনার বয়স কত, জানিস?

জানি।

কত?

একুশ।

মানে কী?

মানে হলো, ওনাকে দেখলেই আমার মনে হয় উনি একুশ বছরের রাশভারী এক তরুণ। তবে তার ওই গম্ভীর ভাবটা ছাড়াতে পারলেই বয়স আঠারোতে নেমে আসবে।

তা তুই এখন তার বয়স আঠারোতে নামাতে যাচ্ছিস?

অ্যাটলিস্ট চেষ্টা তো করে দেখতে পারি। নাকি বলিস?

তখন তো তোর চেয়েও ছোট হয়ে যাবে!

আই ডোন্ট মাইন্ড। এইজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার বেবি। বলে অবন্তীর পিঠে আলতো চাটি মেরে হাসল রিয়া। যাচ্ছি।

যাচ্ছিস?

হুম। বলে আর অপেক্ষা করল না সে। প্রজাপতির মতো হাওয়ায় ডানা মেলে উড়ে চলে গেল। অবন্তী দাঁড়িয়ে রইল একা। এই সকাল সকাল একা হয়ে গেলে দিনটা কেমন থমকে যায়। এখনো গেল। বাকিটা সময় কী করবে ভেবে পেল না সে। আজ তার ক্লাস নেই। সে এসেছিল প্রশাসনিক ভবনে কিছু কাজ করতে। দুপুরের দিকে দুটো পেপার সংগ্রহ করতে হবে। ফলে অনেকটা সময় একা একাই কাটাতে হবে। কিন্তু এতক্ষণ কী করবে?

বিশাল রেইনট্রিগাছটা ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের হলের ঠিক উল্টো দিকে। তার নিচে কখানা কাঠের বেঞ্চি। চা-শিঙাড়ার টংদোকান। অবন্তী সেই বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এই সময়ে মঈন এসে দাঁড়াল তার সামনে। অবন্তী হতভম্ব ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনি এখানে?

মঈন হাসল, আমার তো এখানেই থাকার কথা ছিল।

মানে?

বসো, বলছি।

না। আপনি বসবেন না। অবন্তী কঠিন গলায় বলল।

আচ্ছা, তুমি বসো। আমি দাঁড়িয়েই থাকছি।

প্লিইইজ! প্রায় আর্তনাদের স্বরে বলল অবন্তী। আপনি কেন এখানে এসেছেন? কেন এমন করছেন?

প্রশ্নটা আমার করার কথা ছিল।

কী প্রশ্ন?

তুমি কেন এমন করছ?

কী করছি আমি?

বুঝতে পারছ না কী করছ?

নাহ্। বলেই হাঁটতে শুরু করল অবন্তী।

মঈন আচমকা তার হাত চেপে ধরল। তারপর বলল, এখন নিশ্চয়ই বলবে যে তুমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবে? তারপর আমাকে অপদস্থ করবে? সব সময় যেমন করো?

অবন্তী কথা বলল না। তার শরীর কাঁপছে। সে দুর্বল ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। আশপাশের কয়েকজন মানুষ ফিরে তাকাচ্ছে। তারা সম্ভবত অবন্তীর কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে। সে চিৎকার করে সাহায্য চাইলেই ছুটে আসবে। অবন্তী অবশ্য তেমন কিছু করল না। সে নিজে নিজেই মঈনকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে লাগল। তবে তার সেই চেষ্টা ভীষণ নিস্পৃহ। বিষয়টা লক্ষ করে খানিক আশাবাদী হয়ে উঠল মঈন। তাহলে কি বাইরে তার প্রতি যতটা রূঢ়তা সে দেখায়, আসলে ততটা রূঢ় সে নয়?

সুযোগটা নিল মঈন। বলল, তোমার কি মনে হয় না যে তুমি আমার ওপর ইনজাস্টিস করছ?

আমি? অবাক গলায় বলল অবন্তী।

মঈন তার হাত ছেড়ে দিল। বলল, হুঁ।

আমি কীভাবে আপনার ওপর ইনজাস্টিস করব? আমি কি জাজ?

আমরা সবাই-ই কখনো না কখনো জাজ, অবন্তী।

অবন্তী জবাব দিল না। সে এক হাতে অন্য হাত ডলছে। মঈন খানিক শক্ত করেই ধরেছিল। ফলে লাল হয়ে আছে জায়গাটা। মঈন দুঃখিত গলায় বলল, সরি।

অবন্তী কথা বলল না। মঈন বলল, একটু বসবে, প্লিজ?

অবন্তী বসল। তবে তার মুখ গম্ভীর। চোখ থমথমে। মঈন বলল, কারও যদি ফাঁসিও হয়, সে কিন্তু কারণটা জানে। মৃত্যুর আগে সে জেনে যায় কেন তার ফাঁসি হয়েছে। জানে না?

আপনাকে কেউ ফাঁসি দিচ্ছে না। আপনি মারাও যাচ্ছেন না।

সব মৃত্যু কি চোখে দেখা যায়? হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গেল মঈনের কণ্ঠ। তোমার কি মনে হয় না কারণটা আমাকে স্পষ্ট করে বলা উচিত তোমার?

আমি বলেছি।

কী?

বাবা মা চান না আমি আপনার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখি।

কেন?

কারণটা আপনি জানেন। তা ছাড়া আপনার ওই বিষয়টা নিয়ে সবাই খুব আপত্তিকর কথা বলছিল। আমার রিলেটিভসরাও। আপনার তো তা না জানার কথা নয়!

তুমি কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাও না, তোমার মা-বাবা চান না বলে? নাকি তুমিও বিশ্বাস করো যে ওই ঘটনায় আমি সত্যি সত্যিই দোষী?

অবন্তী জবাব দিল না। মঈন বলল, আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করে হয় নি, অবন্তী। এমনকি মা-বাবার অনুমতি নিয়েও না। বলে সামান্য থামল সে। তারপর বলল, মেয়েটাকে ছেলেদের হলে জোর করে নিয়ে এসেছিল এক ছেলে। সে পলিটিক্যালি আমার চেয়ে পাওয়ারফুল। ফলে অন্য সবার মতো আমারও উচিত ছিল চুপ করে থাকা। কিন্তু আমি তা করি নি। জানতাম যে এর কনসিকুয়েন্স ভালো না। আমাকে এর জের টানতে হবে। তারপরও।

বলে ফস করে সিগারেট ধরাল মঈন। অবন্তী সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে। সে ঝট করে মুখ সরিয়ে নিল। নাকের কাছে হাত নিয়ে ধোয়া তাড়াতে লাগল। খানিক বিলম্ব হলেও বিষয়টা খেয়াল করল মঈন। সে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বাঁ পায়ে মাড়িয়ে দিল। তারপর শান্ত গলায় বলল, তুমি জানো আমি একটু শর্ট টেম্পারড। চট করে রেগে যাই। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ মাই ফল্ট। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে আই অ্যাটাকড হিম। সবাই সেটাই দেখেছে বা দেখতে চেয়েছে। কিন্তু পেছনের ওই ঘটনার কথা কেউ বলল না। কেউ জানলও না। সবাই জানল, আমি মেয়েসংক্রান্ত ইস্যুতে দলে আমার সিনিয়র একজনের সঙ্গে ফিজিক্যালি কনফ্লিক্টে জড়িয়েছি। বিষয়টা সেনসিটিভ। পুলিশ যেহেতু আমাকেই গ্রেপ্তার করেছে, সুতরাং দোষটা আমারই। আর এই ধরনের ঘটনায় যা হয় আরকি! কুৎসিত সব ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কাগজে খবর পর্যন্ত বের হলো।

অবন্তী কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা মেয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মঈন বলল, ওর নাম রিমি। এই সেই মেয়ে। নিজের নিরাপত্তার ভয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও অন্তত তোমাকে ও ঘটনাটা বলবে। আর কারও কাছে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের দায় আমার নেই। কিন্তু তোমার কাছে আছে। বিশ্বাস করা না-করা তোমার ব্যাপার।

রিমির চোখ ফ্যাকাশে। প্রসাধনহীন ক্লান্ত মুখ। তবে সেই মুখেও স্নিগ্ধ, শান্ত সৌন্দর্য। সে ঘটনাটা বলল। অবন্তী অবশ্য তা শুনল কি না বোঝা গেল না। মঈন বলল, আমার কথা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে না, অবন্তী। কিন্তু জানো তো, মানুষ পুরো পৃথিবীকে নির্বিকারভাবে উপেক্ষা করতে পারলেও কোনো একজনের সামান্য উপেক্ষাও সে সহ্য করতে পারে না।

অবন্তী চোখ তুলে তাকাল। মঈন তাকিয়ে আছে মাথার ওপর গাছের ফাঁকে উঁকি দেওয়া আকাশের দিকে। সে সেই আকাশের দিকে তাকিয়েই প্রায় স্বগতোক্তির স্বরে বলল, আমার কী মনে হয়, জানো?

কী? মৃদু কণ্ঠে বলল অবন্তী।

আমার মনে হয়, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো না। এমনকি আমি কোনো ব্যাখ্যা

দিলেও না। কারণ, তুমি আমাকে জানো। কিন্তু…।

কিন্তু কী?

মঈন আচমকা উঠে দাঁড়াল। তারপর কেমন চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রলম্বিত স্বরে বলল, কিন্তু…। যেন খানিক সময় নিয়ে কথাটা আবার গুছিয়ে নিল সে, তোমার এই হঠাৎ বদলে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে। অন্য কোনো কারণ। কিন্তু সেই কারণটা তুমি আমাকে বলতে চাইছ না।

কী কারণ? কাঁপা, ফ্যাকাশে গলায় বলল অবন্তী।

সেটা তুমিই ভালো জানো। তোমার মনের সব কথা তো আমি পড়তে পারব না। বলে আবারও থামল সে। তারপর রিমিকে চোখের ইশারায় সরে যেতে বলল। হাতের সিগারেটের প্যাকেটটা যত্ন করে পকেটে পুরল। তারপর কপালের সামনে এসে পড়া চুলগুলোকে দুহাতে ব্যাব্রাশের ভঙ্গিতে মাথার পেছনে ঠেলে দিতে দিতে বলল, মানুষ ভাবে, মানুষের মন পড়তে পারলে বুঝি সবকিছু খুব সহজ হয়ে যেত। কিন্তু এটা সত্যি নয়। মানুষ যদি মানুষের মন পড়তে পারত, তাহলে পৃথিবীটা বরং আরও কঠিন হয়ে যেত। আরও বীভৎস হয়ে যেত।

অবন্তী কী বলবে ভেবে পেল না। মঈন অবশ্য তাকে কিছু বলার সুযোগও দিল না। সে হঠাৎ ঘুরে লম্বা লম্বা পা ফেলে চোখের আড়াল হয়ে যেতে লাগল।

১২

আজকাল হৃদির মন কিছুটা হলেও শান্ত। তার চারপাশের বিরুদ্ধ পরিস্থিতি হঠাৎ করেই যেন বদলাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মা। তিনি তার একরোখা অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। মাঝেমধ্যে তাদের কথাবার্তাও হয়। তবে সেই কথা যে আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত, তা নয়। বরং তারা দুজনই যেন মাঝখানে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা, ব্যথা আড়াল করে পরস্পরের সঙ্গে সহজ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। তাতে কখনো কখনো সফল হয়, কখনো হয় না। তবে এর জন্য নেহালের কাছে কৃতজ্ঞতা অনুভব করে হৃদি। মানুষটা সম্পর্কে কী বিরূপ ধারণাই না তার ছিল! অথচ সেই মানুষটাই তার জন্য নিজের তীব্র ভালো লাগার অনুভূতিটা অবধি হাসিমুখে বিসর্জন দিয়ে দিল। এমন মানুষ হয় আজকাল?

এভিলিন নামের অজানা-অচেনা মেয়েটার জন্যও দুঃখ অনুভব হয় তার। আচ্ছা, সে কি জানে তার মৃত্যুর পরও এই পৃথিবীতে একজন মানুষ কী অসীম মমতায়ই না তাকে বুকের ভেতর পুষে রেখেছে! ওই বুক থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। এমনকি নেহাল যদি অন্য কাউকে ভালোও বাসে, তারপরও না। জগতে কেউ কারও জায়গা নিতে পারে না। প্রিয়তম মানুষ যত দূরেই যাক, যতই আড়াল হোক চোখের, তার ওই জায়গাটুকু অবচেতনেই সযত্নে সংরক্ষিত থাকে আজীবন। ওখানে অন্য কারও জায়গা হয় না। কেউ যদি কাউকে এমন করে ভালোবাসে, তাহলে আর কী চাই মানুষের?

হৃদিরও আর বেশি কিছু চাই না। যা পাওয়ার, তা পেয়ে গেছে সে। অনিককে নিয়ে যে আক্ষেপ, অভিযোগ, অভিমান তার ছিল, তা যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন রাহিমা বানু। এমন করেও ভালোবাসতে পারে কেউ? মায়েরা নাকি পুত্রবধূদের প্রতি সহজাত একধরনের বিরাগ অনুভব করেন। এই কথার সত্য-মিথ্যা হৃদি জানে না। তবে আশপাশে এমন অসংখ্য ঘটনা সে দেখেছে। ফলে যখন থেকে শ্বশুরবাড়ির কথা বুঝতে কিংবা ভাবতে শিখেছে সে, তখন থেকেই অজানা এক আশঙ্কায় আড়ষ্ট হয়ে থাকত। কিন্তু অনিকের মা এমনই এক জাদুর কাঠি যে তার স্পর্শে সেই সব আশঙ্কা, দ্বিধা নিমেষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

তিনি এখনো তাদের গোপন বিয়ের কথা জানেন না, এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এ-ও তো সত্যি যে তিনি বুঝতে পারছেন, অনিক আর হৃদি পরস্পরকে ভালোবাসে। অথচ তার আচরণে, কথায় কখনো মুহূর্তের জন্যও মনে হয় নি যে তিনি হৃদিকে দূরে সরিয়ে দিতে চান। বরং তাকে একদিন না দেখলেই অস্থির হয়ে ওঠেন।

সেদিন অদ্ভুত এক কাজও করলেন। হৃদি যখন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতে চাইল, তখন হঠাৎ তাকে কাছে ডেকে নিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতে লাগলেন। হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। দরজার চৌকাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আলতো করে চুমুও খেলেন। বিষয়টা এত ভালো লেগেছিল। হৃদির! মনে হয়েছিল, এই মানুষটার জন্য হলেও অনিকের সঙ্গে সারা জীবন থেকে যেতে চায় সে। এমন স্নেহের আঁচল আর কোথায় পাবে?

অনিক অবশ্য মায়ের অসুখের বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। রাতদিন এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করছে সে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, মায়ের খারাপ কিছু হয়েছে। বাবার মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে এমনিতেই প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে সে। এর মধ্যে মায়েরও যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। ফলে আর সবকিছু বাদ দিয়ে ডাক্তার, হাসপাতাল আর টাকার পেছনে দিনরাত ছুটতে লাগল সে। হৃদির সঙ্গে যোগাযোগও যেন খানিক কমে এল। তবে তা নিয়ে হৃদি বিশেষ ভাবিত নয়। সে বরং অনিকের চেয়ে রাহিমা বানুর সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল।

কিন্তু এত সব ভালো ব্যাপারের মধ্যেও সেদিন দুপুরে হঠাৎ শরীর খারাপ লাগতে লাগল হৃদির। সঙ্গে চিনচিনে একটা মাথাব্যথাও। বিকেলের দিকে একা একাই ছাদে হাঁটতে গেল সে। সঙ্গে এক মগ গরম কফি। এতে যদি খানিক আরাম লাগে। তবে তাতে লাভ কিছু হলো না। বরং সন্ধ্যা নামার আগে আগেই হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। তার। এই মন খারাপের কারণ হৃদি জানে না। তবে ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য এক শূন্যতার অনুভূতি হতে লাগল।

এমন কেন লাগছে? আমগাছটার ঝাকড়া ডালপালা বেয়ে হঠাৎ নেমে এল। অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে কেমন একা লাগতে লাগল হৃদির। মনে হলো, সে খুব দুঃখী, নিঃসঙ্গ। কিন্তু তার দুঃখ অনুভব করার মতো কেউ নেই। এমনকি অনিকও না। হৃদির আচমকা কান্না পেয়ে গেল। সে কি মাকে অনেক দুঃখ দিয়ে ফেলেছে? এই যে মা তার সঙ্গে কথা বলেন, তার ভালো-মন্দ জানার চেষ্টা করেন, কিন্তু মায়ের বুকেও কি তার দেওয়া কষ্ট জমে নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু মা সেসব আড়াল করেই তার সঙ্গে হেসে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আগলে রাখতে চান। অথচ বিনিময়ে সে মুহূর্তের জন্যও মার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে পারে না। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে না। সারাক্ষণ কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। এমন কেন করছে সে? দোষটা তো তারই। তবে সে কেন শুধু শুধু মাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে?

কথাটা ভাবতেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল সে। রোখসানা বেগম তখন। কেবল নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসেছিলেন। এই মুহূর্তে তার পেছনে এসে দাঁড়াল হৃদি। তারপর ঝট করে বসে পড়ল। রোখসানা বেগম ভারি অবাক হলেন। তবে কিছু বললেন না। হৃদি ডাকল, মা?

হুম?

আমি কি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তবে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। হৃদি ঝড়ের মতো মায়ের বুকে আছড়ে পড়ল। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। দীর্ঘ সময়। রোখসানা বেগম অবশ্য তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কোনো কথা বললেন না তিনি। কেবল দুহাতে মেয়েকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বসে রইলেন। হৃদি বলল, মা?

হুম?

আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিই, না?

দিস তো।

অনেক?

হুম।

এই জন্য তুমি কি আমার ওপর রাগ?

না।

কেন?

মায়েদের রাগতে নেই।

মায়েদের রাগতে নেই কেন?

মায়েরা হলো পৃথিবীর মতো। ধরিত্রী। ধরণি। তাদের অনেক কিছু ধরে রাখতে হয়। ধারণ করতে হয়। তারা রাগলে চলে? পৃথিবী রেগে গেলে কী হবে? সবকিছু

ধ্বংস হয়ে যাবে না?

হুম।

মায়েরা রাগলেও সব ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণে মায়েরা সত্যি সত্যি রাগতে পারে না।

তাহলে কি মিথ্যেমিথ্যি রাগে?

মায়েদের রাগ জোছনার মতো। তাতে আলো আছে, কিন্তু উত্তাপ নেই।

হৃদি কথা বলল না। মায়ের কথাটা তার বুকে বিঁধে রইল। মায়েদের রাগ জোছনার মতো। তাতে আলো আছে, কিন্তু উত্তাপ নেই। কী সুন্দর কথা! সে চুপ করে ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের বুকের সঙ্গে মিশে রইল। মা যে একসময় স্কুলে পড়াতেন, তা বহুদিন ভুলেই ছিল সে। ছোটবেলায় কত কত গল্প শোনাতেন মা। আজ অনেক দিন। বাদে মায়ের এই কথাগুলো শুনে আবার সেসব মনে পড়ে গেল। রোখসানা বেগম হঠাৎ বললেন, তোর গা তো গরম।

ও কিছু না।

দেখি?

বলে হৃদিকে বসা করালেন। তারপর কপালে হাত দিয়ে আঁতকে উঠলেন, তোর গায়ে তো অনেক জ্বর!

কই? বলে নিজেই নিজের কপালে হাত দিল হৃদি। এটা কিছু না,। প্যারাসিটামল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নিজের বিছানায়ই হৃদির শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। হৃদি বলল, আমি এখানে ঘুমাব?

হুম।

জীবনেও না। তোমার সঙ্গে একটু আহ্লাদ করলাম বলেই তোমার সঙ্গে ঘুমাতে হবে?

এখন শো। পরে উঠে চলে যাস।

আমি কারও সঙ্গে ঘুমাতে পারি না, মা।

রোখসানা বেগম বাধা দিলেন না। বললেন, যা তাহলে, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি ডেকে দেব।

.

তখন কেবল সন্ধ্যা হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায়? হৃদিও ঘুমাল না। তার হঠাৎ মনে হলো, সে গ্রাহ্য করতে না চাইলেও তার শরীর সত্যি সত্যিই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, একটা ঠান্ডা কনকনে অনুভূতি তার পায়ের তালু থেকে মাথা অবধি ছড়িয়ে পড়ছে। সে গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়ল। মায়ের সঙ্গের ওই মুহূর্তটুকু তার সন্ধ্যার মন খারাপের অনুভূতিটা শুষে নিয়েছে। কিন্তু অনিকের সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হলো তার। সে অনিককে ফোন করল। অনিক অবশ্য প্রথম দুবার ধরল না। কেটে দিল। তৃতীয়বার ফোন ধরে খানিক বিরক্ত গলায় বলল, কী হলো? এত ফোন করছ কেন?

কী করছ তুমি?

আমি পড়াতে আসছি।

কোথায়?

ওই যে নতুন টিউশনটা। জিতু।

আচ্ছা। বলে চুপ করে রইল হৃদি। অনিক বলল, কী বলো?

তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ?

কী বুঝতে পারব?

আমার গলা শুনে কিছুই বুঝতে পারছ না?

গলা শুনে কী বুঝব?

আমার যে শরীর খারাপ?

গলা শুনে শরীর খারাপ বোঝা যায়?

যায়।

কীভাবে?

ভালোবাসলে। ভালোবাসা তীব্র হলে ফোনে প্রিয় মানুষটার হ্যালো বলা শুনলেই বলে দেওয়া যায় তার মন খারাপ কি না।

কই? আমি তো বুঝতে পারছি না।

তার মানে তুমি আমায় ভালোবাসো না।

তাহলে কী করি?

খারাপ বাসো।

আচ্ছা।

আচ্ছা মানে কী?

আচ্ছা মানে কিছু না। আমি স্টুডেন্ট পড়াতে এসেছি। বের হয়ে তোমাকে ফোন করছি। বলেই খট করে ফোন কেটে দিল অনিক। হৃদি চুপ করে বসে রইল। তার আবার কান্না পেয়ে গেল। সে জানে এই কান্নার কোনো মানে হয় না। অনিক পড়াতে গিয়েছে। এই সময়ে ছাত্রের সামনে বসে কারও সঙ্গে এই ধরনের কথা বলা সম্ভব নয়। তারপরও তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে ফোনটা গালের সঙ্গে চেপে ধরে শুয়ে রইল।

অনিক তাকে ফোন করল গভীর রাতে। হৃদি তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বার তিনেক রিং হওয়ার পর ফোন ধরল সে। তারপর ঘুম ঘুম গলায় বলল, বলো?

সরি। একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল।

সমস্যা নেই।

কী হয়েছে তোমার, মন খারাপ?

উঁহু।

তাহলে?

শরীর খারাপ।

জ্বর?

হুঁ।

ওষুধ খেয়েছ?

খেয়েছি।

এখন কেমন লাগছে?

ভালো।

আমি কি ফোন রেখে দেব?

হুম।

অনিক বুঝতে পারছিল যে হৃদি ঘুমের ঘোরে কথা বলছে। ফলে সে ফোন রেখে দিল। পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙল হৃদির। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার সারা শরীর ব্যথা। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সে গোঙানির মতো বার কয়েক মাকে ডাকল। রোখসানা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। বললেন, এ কী অবস্থা তোর?

আমার খুব খারাপ লাগছে, মা। কাতর কণ্ঠে বলল হৃদি।

দিনের বাকিটা সময় আর উঠে দাঁড়াতে পারল না সে। বিকেলের দিকে বাসার পাশের ফার্মেসি থেকে এক ডাক্তার নিয়ে এল তিথি। তিনি দেখে কিছু ওষুধ দিয়ে গেলেন। কিন্তু জ্বর তাতে কমল না। বরং বাড়ল। পরদিন গভীর রাতে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। রোখসানা বেগম দিশেহারা গলায় বললেন, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে।

কিন্তু অত রাতে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা কী! তাদের নিজেদের গাড়ি নেই। তিথি উবারে বার কয়েক খুঁজেও কাছাকাছি কোনো গাড়ি পেল না। সুনসান ফাঁকা রাস্তা। তিথি একবার অনিককে ফোন করার কথা ভাবল। কিন্তু মা বিষয়টা ভালোভাবে নেবেন না বলে আর করা হলো না। তবে সে যতক্ষণে উবার থেকে ফোন পেল, ততক্ষণে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছে। তাদের বাড়ির দরজা দিয়ে সাদা একটা গাড়ি ঢুকতে দেখা গেল। গাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এল নেহাল। সম্ভবত রোখসানা বেগম তাকে ফোন করেছিলেন। হৃদিকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো প্রায় শেষরাতে। তাকে হাসপাতালে থাকতে হলো চার দিন। এই চার দিনই নেহাল যতটা সম্ভব তাকে সময় দিল।

অনিক অবশ্য এত কিছু জানে না। সেদিন গভীর রাতে ফোন রেখে দেওয়ার দুদিন বাদে এক সন্ধ্যায় হৃদিকে ফোন করল অনিক, হ্যালো, হৃদি।

হৃদি শান্ত-স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যালো।

আমি মাকে নিয়ে একটু ঝামেলায় আটকে গেছি বলে তোমাকে ফোন করা হয় নি। কেমন আছ তুমি?

ভালো।

শরীর কেমন?

ভালো।

সেদিন যে বলছিলে একটু জ্বর জ্বর?

কবে? ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করল হৃদি।

পরশু।

হৃদির খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, দুদিন পর তুমি খোঁজ নেওয়ার সময় পেলে? কিন্তু সে তা বলল না।

অনিকই বলল, ওই যে আমার ফোন করতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে।

আচ্ছা।

এখন ভালো?

হুম।

কোনো সমস্যা নেই তো?

না।

মা তোমার কথা খুব জিজ্ঞেস করছিল।

আচ্ছা।

অনিক আর বিশেষ কিছু বলল না। ফোন রেখে দিল। হৃদিও কিছু বলতে চাইল না। তবে অনিক ফোন রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল তার। বুকের কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল। তবে সেটাকে সামলাল হৃদি।

সমস্যা হচ্ছে, অনিক আর ফোন করল না। হৃদিও যেন একটা অবচেতন অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে রইল। সেদিন রাতে তার সঙ্গে হাসপাতালে থাকল অবন্তী। তখন রাত প্রায় বারোটা। হৃদি মাথায় পানি ঢালতে ওয়াশরুমে ঢুকল। সে বের হলো দীর্ঘ সময় পর। ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা বেজে দশ। ঘরে পা দিয়েই হতভম্ব হয়ে গেল হৃদি। তার ঘরভর্তি রংবেরঙের ফুল। অজস্র বেলুন উড়ছে হাওয়ায়। একটা বড় কেক টেবিলে। সেই কেকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির আজ জন্মদিন।

হৃদি কী করবে ভেবে পেল না। সে এলোমেলো ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল। দরজার সামনে নেহাল দাঁড়িয়ে আছে। সে এক পা এগিয়ে এসে বলল, শুভ জন্মদিন।

হৃদির হঠাৎ চোখে পানি চলে এল। সে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। এই কান্নার জল সে নেহালকে অন্তত দেখাতে চায় না। কিন্তু কেন দেখাতে চায় না, তা জানে না।

বিষয়টাতে অবন্তীও অবাক হয়েছে। একই সঙ্গে বিব্রতও। হৃদির অসুস্থতা নিয়ে বাড়ির সবাই এত দুশ্চিন্তা করছিল যে তার জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। কিন্তু নেহাল কী করে জানল? হৃদি অবশ্য অত কিছু ভাবতে পারছিল না। কিংবা সে কী ভাবছে, তা কাউকে বুঝতেই দিল না। চুপচাপ বসে রইল বিছানায়। নেহাল বলল, মন। খারাপ?

উঁহু। মাথা নাড়াল হৃদি।

তাহলে?

মা-বাবা নেই তো! আমি কখনো তাদের ছাড়া জন্মদিনের কেক কাটি নি।

ক্যান আই শো ইউ আ ম্যাজিক?

কিসের ম্যাজিক?

নেহাল দরজার পাশ থেকে সরে গিয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল। তারপর বলল, দ্য টু ম্যাজিক ইজ হিয়ার!

সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন মা। তার পেছনে হুইলচেয়ারে বাবা। হৃদির এসব কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে ছুটে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে লাগল নিঃশব্দে। যেন ওই কান্নাটুকুই তার আনন্দের প্রকাশ। তারাও হৃদিকে জড়িয়ে ধরে রইলেন।

হৃদি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল পরদিনই। অনিককে আর ফোন করল না সে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, অনিকও না। বিষয়টাতে এত অবাক হলো সে! এমন কেন করছে অনিক? কী হয়েছে তার? ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রাগ, কষ্ট, অভিমান যেন একসঙ্গে দলা পাকাতে লাগল। এতটা কষ্ট এর আগে কখনো হয় নি তার। তবে সেই কষ্ট কান্নায়। পরিণত হলো দুদিন বাদে।

রাহিমা বানুর জন্য মন কেমন করতে লাগল। মনে হলো তার সঙ্গে খানিক দেখা হলে, কথা বললে হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু অনিককে আর ফোন করবে না সে। কথাও বলবে না তার সঙ্গে। ফলে দিন দুই বাদে এক ভোরবেলা সে অনিকের বাসার দরজায় গিয়ে হাজির হলো। বেশ খানিকক্ষণ কলিং বেল চাপার পর দরজা খুলে দিল

অনিকের বাসায় থাকা লোকটা। হৃদি অবাক গলায় তাকাল, বাসায় কেউ নেই?

জাবেদ বলল, উঁহু।

মা-ও না?

না।

কোথায় গেছে তারা?

আপনি কিছুই জানেন না?

না। কী জানব?

আন্টি তো আজ সপ্তাহখানেক হলো হাসপাতালে।

হাসপাতালে? ভারী অবাক হলো হৃদি। কী হয়েছে মায়ের?

নানান সমস্যা তার। জ্বর, পাতলা পায়খানা। এর মধ্যে কাশি, শ্বাসকষ্ট। নাক দিয়ে নাকি রক্তও পড়ছে।

কী বলছেন আপনি?

হুম। অবস্থা ভালো না।

হৃদি আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না। সে হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিয়ে তখুনি ছুটল।

রাহিমা বানুকে ভর্তি করানো হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। সেখানে গিজগিজ করছে অসংখ্য রোগী। তাদের বসার জায়গা নেই। ঘুমানোর বিছানা নেই। বাথরুম নেই। মাথার ওপর ফ্যান নেই। চারদিকে চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না। হৃদি সেই গিজগিজে ভিড় আর কোলাহলের মধ্যেই অনিককে দেখতে পেল।

একটা দেয়ালের গা ঘেঁষে মেঝেতে কোনোরকমে বিছানা পেতে বসে আছে সে। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন মা। প্রচণ্ড গরমে ঘামছেন তিনি। তবে তাকে। একনাগাড়ে বাতাস করে চলেছে অনিক। রাহিমা বানু ঘুমাচ্ছেন। তার পাশের দেয়ালের সঙ্গে একটা স্যালাইন ঝুলছে। মাঝে মাঝে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অনিক। তার বাঁ দিকটা অন্ধকার। ডান দিকে একটা হলুদ আলো জ্বলছে। সেই আলো এসে পড়েছে তার চুলে। ফলে চুলের প্রান্তগুলো কেমন লালচে হয়ে আছে। তাকে দেখতে লাগছে অপার্থিব এক দেবশিশুর মতো, যেন এখানে তার আগমন বিশেষ কোনো : উদ্দেশ্যে। ফলে চারপাশের এই এত এত রোগ, শোক, জরা, যন্ত্রণার মধ্যেও সে বসে আছে নির্বিকার। যেন তার সত্যিকারের অস্তিত্ব অন্য কোথাও।

আচ্ছা, এমন কেন লাগছে তাকে?

১৩

নীলক্ষেতের বিছানা-বালিশের দোকানটার নাম লাল চান বেডিং স্টোর। দোকানের সামনে বসে আছে রাশু। তার আঙুলের ফাঁকে একটা দেশলাইয়ের কাঠি। সে সেই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছে। দোকানের মালিক লাল চান তার সামনে এসে বসল। বলল, কী

হইল, কথা কস না কেন?

রাশু বলল, কী বলব?

স্যাররে কেমন লাগল?

ভালো।

কেমন ভালো।

ভালোই ভালো।

কী করলি ওইখানে গিয়া?

আপনে যা করেন।

মাগুর মাছরে মুরগি খাওয়াইছে?

খাওইয়েছ।

আর সাপগুলা দেখছস?

হুম।

ডরাস নাই?

ডরাইছি।

কী মনে হয়, ব্যবসা কেমন হইব?

কিসের ব্যবসা?

সাপের ব্যবসা।

সাপের ব্যবসা কেমনে করে? মানুষ সাপ কিন্যা কীরব? রাইন্ধা খাইব, না পালব?

ব্যবসাটা আসলে সাপের বিষের।

সাপের বিষের ব্যবসা! অবাক চোখে তাকায় রাশু।

হুম।

এই বিষয়ে আমার ধারণা নাই। সাপের বিষের যে ব্যবসা করন যায়, এইটাই তো আমি জানি না। সাপের বিষে মানুষ মরে। সেই বিষের আবার ব্যবসা কী?

এই দিকে আয়।

বলে রাশুকে দোকানের ভেতরের দিকে নিয়ে গেল লাল চান। তারপর বলল, ওই যে তোশকগুলা আছে, ওইগুলার নিচে একটা প্লাস্টিকের ফাইল আছে। ফাইলটা বের কর।

রাশু থরে থরে সাজানো তোশকের তলা থেকে ফাইল বের করল। ফাইলের ভেতর অসংখ্য পত্রিকার কাটিং। লাল চান একটা একটা করে সেই পত্রিকা বের করল। তারপর বলল, বানাম কইরা তো পড়তে পারস? নাকি?

বানাম ছাড়াই পারি। বলল রাশু।

সে প্রথম পত্রিকাটা দেখল। বড় বড় করে লেখা, পঁচাত্তর কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার!

পরেরটাতে লেখা, এত বিষ আসে কোথা থেকে? যায় কোথায়?

পরের কাটিংয়ে লেখা, সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।

রা কয়েকটার শিরোনাম দেখে বলল, এ তো আচানক কাণ্ড!

হুম। এই জন্যই তো এত সাবধানতা। দেশে তো সাপের খামারের অনুমতি নাই। আবার করলে যে বিশাল কোনো অপরাধ, তা-ও না। কিছু টাকাপয়সা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।

তাইলে ওনার এত ভয় কিসের?

কার?

আপনের জামশেদ স্যারের?

সমস্যা অন্য জায়গায়।

কী সমস্যা?

সাপের বিষ সোনার চাইতেও দামি। অনেক দামি দামি ওষুধ তৈরিতে লাগে। অনেক দেশে নেশা করতেও ব্যবহৃত হয়! অকল্পনীয় চড়া দাম সেই নেশার।

নেশা করতে সাপের বিষ?

হুম।

বাপের জন্মেও শুনি নাই।

বাপ থাকলে না বাপের জন্মে শুনবি? বলে খিকখিক করে হাসে লাল চান। রাশু জবাব দেয় না। সে পত্রিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলল, দেশে অনুমতি না থাকলে এত বিষ আসে কোথা থিকা? আর যায়ই-বা কোথায়?

এইখানেই তো খেলা।

কিসের খেলা?

আমাগো দেশে যা ধরা পড়ে, তা আমরা চাষও করি না, উৎপাদনও করি না। আবার বেচিও না।

তাইলে?

আমরা হইলাম পাচার ট্রানজিট। আমাদের দেশে তো আর এগুলার কোনো কাজ নাই। কোনো ওষুধপত্র বা কিছু তৈরিতে ব্যবহৃতও হয় না।

তাইলে উনি কী করতে চান যদি কাজেই না লাগে? এত রিস্ক নিয়া এগুলা কইরা তাইলে লাভ কী?

তুই-ই বল কী লাভ।

রাশু মাথা নাড়ে, জানি না।

আগে উনি অন্য দেশ থেকে আসা জিনিস পাচারে হেল্প করত। ওনার একটা নেটওয়ার্ক আছে। সেইটা ইউজ করত। কিন্তু এখন উনি…।

কিন্তু এখন উনি নিজেই জিনিস বানাইতে চান? লাল চানকে থামিয়ে দিয়ে বলল রাশু। তারপর বিদেশে পাচার করতে চান, যাতে লাভ সব তারই থাকে? রাশুর কণ্ঠে বিস্ময়।

কারেক্ট! টক করে জিবে শব্দ করে লাল চান। এর বাজারদর কল্পনাতীত! একবার চিন্তা কর, দুই-দশটা চালান দিতে পারলেই কোটি কোটি টাকা।

রাশু কথা বলল না। চুপ করে রইল। তারপর বলল, যা বুঝলাম…। বলে আবার থমকে গেল সে।

কী বুঝলি?

এইটা তো নিজেই সরাসরি অবৈধভাবে বিষ পাচারের ব্যবসা। এইটা তো বিরাট বড় ক্রাইম।

কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে?

অনেক বিপদ কিন্তু?

তারে দেইখা কী মনে হইছে? সে ভিতু?

রাশু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, নাহ্! সে অন্য কিসিমের মানুষ। চোখ দেখলেই রক্ত ঠান্ডা হইয়া যায়।

হুম।

আপনে এই সবের সঙ্গে মিশলেন কেমনে?

সেইটা অন্য কাহিনি। এইবার আসল কাহিনি শোন।

কী?

তোরে তার খুব পছন্দ হইছে।

আমারে? অবাক গলায় বলে রাশু।

হুম।

বিয়া করব?

মানে?

মানে আমারে কি সে বিয়া করব?

এইটা কী কথা?

নাইলে আমারে তার পছন্দ করার তো কোনো কারণ দেখি না। আমি তার ওই সব ব্যবসারও কিছু বুঝি না। আর সাপখোপ দেখলে কলিজা শুকাই যায়। আমারে ঠিক কী কারণে পছন্দ করব সে?

তা তো জানি না। কিন্তু খুব পছন্দ করছে। এখন থিকা তোর তার সঙ্গেও মাঝে মাঝে থাকতে হবে।

থাকলাম। বলে দাঁতের ফাঁক থেকে দেশলাইয়ের কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলল সে।

আপনে যা বলবেন, তা-ই সই। আপনে যদি বলেন গু সাফ করার কাজ করতে হবে, আমি তা-ই করব। তয় সাপখোপ খুব ডরাই আমি। টিভিতে দেখলেও গায়ের পশম দাঁড়াই যায়।

বলে উঠে দাঁড়াল রাশু। তারপর গিয়ে বসল দোকানের সামনের খোলা চত্বরের মতো জায়গাটাতে। ওখানে বসে তুলা, ঝুট কিংবা নারকেলের ছোবড়া কাটতে হয়। এগুলো দিয়েই মূল্যভেদে বালিশ-বিছানা বানায় তারা। তারপর বিক্রি করে। লাল চান বেডিং স্টোরের বিছানা-বালিশের খুব সুনাম। সারাক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতা লেগেই থাকে। কিন্তু ইদানীং যেন বিছানা-বালিশ বিক্রির চেয়েও লাল চানের আগ্রহ অন্য কিছুতে।

রাশু বসে বসে নারকেলের শুকনো ছোবড়া আলাদা করতে থাকে। ঢোলা জামার ফাঁকে তার লিকলিকে কিন্তু পোক্ত শরীর উঁকি দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাল চান। এই সেদিন তাকে আরিচা ফেরিঘাট থেকে নিয়ে এসেছিল সে। ফেরিতে চা বিস্কুট বিক্রি করত রাশু। সেই ছেলের বয়স এখন উনিশ। ছয় বছর হয়ে গেছে! অথচ এত দিনেও তার মুখচোরা স্বভাব পাল্টায় নি। কোনো কাজে না বলে নি সে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা পয়সা কখনো চায় নি। নিজের আলাদা আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে নি। যেন আপাদমস্তক এক যন্ত্র সে।

মানুষ কি আসলেই কখনো যন্ত্র হতে পারে? বুকভার যন্ত্রণা কি তাকে যন্ত্র করে ফেলে? লাল চান জানে না। সে কেবল জানে, তার সামনে অবিশ্বাস্য এক ভবিষ্যতের হাতছানি। সেই ভবিষ্যতের জন্য রাশুই হতে পারে তার সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড!

১৪

রিয়া বলল, চল না আমার সঙ্গে একদিন?

কোথায়? অবন্তী জিজ্ঞেস করল।

ওল্ড ম্যানের সঙ্গে দেখা করতে।

তার সঙ্গে আমি কেন দেখা করতে যাব?

আরেহ, তুই যদি কাউকে বিয়ে করিস, আমি তাকে দেখব না? দেখে ভালো-মন্দ জানাব না?

তোর মাথা পুরোপুরি গেছে। শ্রাগ করল অবন্তী। আবোলতাবোল বকতে বকতে এখন আর কখন কী বলিস কিছুই বুঝিস না।

বারে! আবোলতাবোল কী বললাম?

আবোলতাবোল না?

নাহ্! আমার কাউকে ভালো লাগলে বলতে পারব না?

তা পারবি না কেন, তাই বলে ওনাকে?

কেন, ওনার সমস্যা কী, বয়স?

এই প্রশ্নে অবন্তী থমকে গেল। আসলেই তো, বয়স তো আর কাউকে ভালো লাগার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে না। বিয়ে করতে চাওয়ার ক্ষেত্রেও না। রিয়া বলল, বল? কাউকে ভালো লাগার ক্ষেত্রে বয়স কি বাধা হতে পারে?

কিন্তু উনি তো ম্যারেড। তাই না?

হুম। এটা অবশ্য একটা সমস্যা। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রিয়া। কী করা যায়, বল তো?

কী করা যায় মানে কী? আচ্ছা, তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো, তুই কি সত্যি সত্যিই এসব ভাবিস?

কী সব?

এই যে যা বলছিস? এগুলো কি তুই মন থেকেই বলিস? নাকি জাস্ট মজা করছিস?

মজা কেন করব?

তুই তো সব সময় তা-ই করিস। কখনো তো কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস হতে দেখি না তোকে! আমি এটাকেও ফান ছাড়া আর কিছু ভাবছি না।

তোর কাছে এটাকে ফান মনে হয়?

নয়তো কী! তোর নিজের কাছে কী মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করল অবন্তী। এটাকে ফান ছাড়া আর কিছু ভাবার সুযোগ আছে? তোকে তো কখনোই কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস মনে হয় না আমার! আর সেই তুই সিরিয়াস হবি এমন একটা উদ্ভট ব্যাপার নিয়ে? আর তাও আবার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

অবন্তী থামলেও রিয়া কোনো জবাব দিল না। নিস্পলক তাকিয়ে রইল। যেন আচমকাই তার চোখে মেঘের ছায়া পড়েছে। অবন্তী হাসল, কদিন এমন মজাটজা করে তারপর সব ভুলে গিয়ে হঠাৎ আবার অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বি। ঠিক কি না, বল?

রিয়া এবার পুরোপুরি থমকে গেল। অবন্তী বলল, কী হলো? হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলি যে?

আমাকে তোদের সবার কাছে খুব ফানি মনে হয়, তাই না? তোরা আমাকে কখনো সিরিয়াসলি নিস না?

বিষয়টা তা না। কিন্তু তুই তো এমন একটা বিষয় নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার মতো মানুষ না। তুই-ই ভেবে বল, তুই কি কখনো সিরিয়াসলি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিস? নাকি জাস্ট মজা করছিস?

রিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে খুব শান্ত, ভারী গলায় বলল, আমি আসলে তোদের সবার কাছে একটা এন্টারটেইনমেন্ট হয়ে গেছি, তাই না? আমার কোনো ভালো লাগা, মন্দ লাগা থাকতে নেই বা সেটা থাকলেও অন্যদের কাছে তা ফানি মনে হওয়ার মতো ব্যাপার!

এই, তুই মন খারাপ করছিস কেন?

মন খারাপ করছি না। ওল্ড ম্যান কি বলেন, জানিস?

কী?

বলেন, আমি নাকি নিজেকে খুব খেলো করে ফেলছি।

তার সঙ্গে তোর এসব নিয়েও কথা হয়?

আমি ওনাকে মাঝে মাঝে ফোন করি। ফেসবুকে মেসেজ দিই। হুটহাট রুমে চলে যাই। এসব নিয়ে উনি খুব বিরক্ত। ওনার ধারণা, আমি অসুস্থ।

যাহ্! অসুস্থ কেন হবি?

তুই এতক্ষণ যা বললি, তার মিনিংও কিন্তু অনেকটা তা-ই দাঁড়ায়।

আমি মোটেও তা বলি নি।

রিয়া স্লান হাসল, সরাসরি বলিস নি, কিন্তু অর্থ ওই একই।

একদমই না, রিয়া। প্রায় কাতর কণ্ঠে বলল অবন্তী। তার এখন খারাপই লাগছে।

তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি জাস্ট বলতে চেয়েছি, এমন একটা বিষয় নিয়ে কি কেউ কখনো সিরিয়াসলি ভাবে? তুইও হয়তো ভাবছিস না। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় না যে আমরা নিজেরাই অনেক কিছু চট করে বুঝতে পারি না? বুঝতে পারি না যে কোনটা সিরিয়াস আর কোনটা না। কিন্তু খানিক ধীরস্থির হয়ে সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে তারপর বুঝি।

রিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে সেদিনের পর থেকে ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল। সে। দিন কয়েক বাদে ডিপার্টমেন্টে আসাও বন্ধ করে দিল। এমনকি ফোনেও আর। পাওয়া গেল না তাকে। যেন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বিষয়টা নিয়ে ভয়ানক অপরাধবোধে ভুগতে লাগল অবন্তী। মনে হলো, এসব তার জন্যই হয়েছে।

বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর একদিন রিয়ার ডিপার্টমেন্টে গেল সে। সেখানে যাদের সঙ্গে তার চেনাজানা ছিল, তাদের কাছ থেকে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলো না। রিয়ার খবর কেউ জানে না। এমনকি তার বাসার ঠিকানাও না। ফলে তার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। এই নিয়ে মনে মনে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠল অবন্তী। নিজেকে শাপশাপান্ত করতে লাগল। তারপর একদিন হুট করেই অদ্ভুত এক কাজ করে বসল সে। সরাসরি চলে গেল মাহমুদ হাসানের রুমে। অবন্তীকে দেখে ভারী অবাক হলেন তিনি। বললেন, আপনি কি আমাদের বিভাগের?

অবন্তী মাথা নাড়ল, না স্যার।

তাহলে?

ফিজিকস।

আচ্ছা আচ্ছা। বলে অবন্তীকে বসতে বললেন।

জি বলুন?

না মানে…। বলে ইতস্তত করতে লাগল অবন্তী। মাহমুদ তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, চা খাবেন?

জি না, স্যার।

খান। ভালো লাগবে।

অবন্তী অবশ্য চা খেল না। তার এখন কেন যেন মনে হচ্ছে রিয়ার বিষয়ে এখানে আসাটা তার ঠিক হয় নি। বিষয়টা দৃষ্টিকটু। তা ছাড়া মাহমুদ হাসান এখন নিশ্চয়ই বুঝে যাবেন যে তাকে নিয়ে রিয়ার পাগলামির বিষয়টা অন্য কেউও জানে। বিষয়টা শিক্ষক হিসেবে তার জন্য বিব্রতকর। ক্ষতিকরও।

মাহমুদ বললেন, কোনো সমস্যা?

জি না, স্যার।

কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে সমস্যা।

না, মনে, স্যার…।

মাহমুদ হাসলেন এবার। বললেন, আপনি কি আমাকে রিয়ার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে এসেছেন?

অবন্তী রীতিমতো চমকে উঠল। বলল, জি স্যার।

রিয়ার কাছে আপনার কথা শুনেছি আমি।

আবারও যেন চমকাল অবন্তী। বলল, আমার কথা?

হ্যাঁ।

কী বলত ও?

মাহমুদ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, শুনতে চান?

খুব।

শুনলে যদি আপনার মন খারাপ হয়ে যায়?

অবন্তী এবার থমকে গেল। রিয়া তার সম্পর্কে কী এমন বলেছে যে সেসব শুনলে তার মন খারাপ হয়ে যেতে পারে।

মাহমুদ বললেন, রিয়ার ধারণা…। বলে আবার থেমে গেলেন তিনি। তারপর চায়ের কাপ থেকে সময় নিয়ে চামচ দিয়ে কিছু একটা তুললেন। তারপর আবার চুমুক দিলেন। তবে তার এই বিলম্বিত, অলস প্রক্রিয়াটুকু অবন্তীর কাছে সুদীর্ঘ অসহ্য সময় বলে মনে হতে লাগল। অবশেষে কথা বললেন মাহমুদ। বললেন, রিয়ার ধারণা আপনি তার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বলে মৃদু হাসলেন তিনি। আপনার মতো এত ভালো বন্ধু নাকি উনি কখনো পান নি। আর পাবেনও না।

উফফ! যেন আটকে রাখা দমটা এতক্ষণে ছাড়ল অবন্তী। বলল, আপনি যে বললেন শুনলে আমার মন খারাপ হবে?

হয় নি?

কেন হবে?

যদি না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সত্যি সত্যিই রিয়ার ভালো বন্ধু।

কীভাবে? মানে…আমি ঠিক আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

আচ্ছা। অনেক সময় এমন হয় না যে আমরা আমাদের খুব কাছের বন্ধুকে নিয়েও অনেক দ্বিধা কিংবা সংশয়ে ভুগি?

হুম। খানিক ভেবে বলল অবন্তী।

এটা আমাদের সবারই হয়। একদম অকৃত্রিম বন্ধু তো আর সহসা জোটে না। ফলে যখন কেউ শোনে যে তার কোনো বন্ধু তাকে নিয়ে তার অগোচরে কারও কাছে খুব ভালো কিছু বলেছে, তখন ভালো লাগার পাশাপাশি অবচেতনেই আমাদের খানিক মন খারাপও হয়। একধরনের অপরাধবোধও কাজ করে।

কেন?

কারণ…। তখন আমাদের মনে হতে থাকে, ইশ, ও আমাকে এত ভালোবাসে। অথচ সেই আমিই কিনা ওকে নিয়ে কত কী ভাবতাম, কত কিছু বলতাম! এই ভেবে মন খারাপ হয়।

কথাটা শুনে অবন্তী হঠাৎ থম মেরে গেল। মাহমুদের কথাটা মিথ্যে নয়। রিয়াকে নিয়েও এমন একটা দোদুল্যমানতা তার মধ্যে কাজ করত। কিন্তু আজ এই কথাটা শোনার পর তার মধ্যে যেন প্রবল অপরাধবোধই কাজ করতে লাগল। মনে হতে লাগল, মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে, অথচ সে-ই কিনা তাকে কী সব বলে দুঃখ দিল!

মাহমুদ বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। উনি ভালো আছেন।

আপনি কি স্যার সবাইকেই আপনি করে বলেন? স্টুডেন্টদেরও? অবন্তী জিজ্ঞেস করল।

মাহমুদ হাসলেন। স্নিগ্ধ, নিঃশব্দ হাসি। তারপর মৃদু মাথা ঝাঁকালেন।

আচ্ছা। বলে খানিক চুপ করে রইল অবন্তী। তারপর বলল, ও সত্যিই ভালো আছে তো?

তেমনই বললেন।

কোথায় আছে?

সম্ভবত বাড়িতেই।

আপনাকে নিজ থেকেই ফোন করেছিল?

হ্যাঁ।

কী বলেছে?

একদিন প্রায় মাঝরাতে অপরিচিত এক নম্বর থেকে হঠাৎ ফোন করে বললেন যে উনি বেশ কিছুদিন ডিপার্টমেন্টে আসবেন না। নিজের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করা দরকার। তাই সবকিছু থেকে খানিক বিরাম নিচ্ছেন।

কবে ফোন করেছিল? যেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে অবন্তী।

এই…দিন দশেক আগে।

কবে ফিরবে কিছু বলেছে?

মাহমুদ মাথা নাড়লেন, না।

ও হঠাৎ এমন কেন হয়ে গেল?

মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। খানিক সময় নিলেন। চায়ের তলানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে কাপটা সরিয়ে রাখলেন। তারপর খুব মনোযোগী ভঙ্গিতে হাতের কাছে রাখা বইপত্রগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আসলে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আমাদের সবারই দরকার। কারণ, জীবনটা তো কেবল উড়ে চলা না, তাই না? এখানে আমাদের মাটিতে পা রাখতেও জানতে হয়। বুঝতে হয়, ডানা ক্লান্ত হয়ে গেলে আমরা ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারব কি না!

অবন্তী তাকিয়ে রইল। কথা বলল না। মাহমুদ উঠে গিয়ে দখিন দিকের জানালাটা খুলে দিতে দিতে বললেন, যে কেবল আলোতে বাঁচে, তার কিন্তু অন্ধকারের মুখোমুখি হতেও জানতে হয়। কারণ, দেয়ার ইজ লাইট অ্যান্ড ডার্ক এভরিহোয়ার। মাছ কেবল জলে বাস করতে জানে বলেই তার ডাঙার আয়ু ক্ষণিকের।

অবন্তীর অকস্মাৎ মনে হলো, এই মানুষটার কথা কিংবা ভাবনায় একটা অদ্ভুত অন্তরঙ্গতা আছে। চট করে নিজেকে খুব একাত্ম মনে হয়। মনে হয়, দীর্ঘ সময় চুপচাপ তার সামনে বসে থাকা যায়। কথা শোনা যায়। আর নিজের ভাবনাগুলোকে ঝালিয়ে নেওয়া যায়।

মাহমুদ চেয়ারে ফিরে বসতে বসতে বললেন, যে জীবনটা রিয়া কাটাচ্ছেন, যদি কখনো সেই জীবনটা তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় কিংবা অন্যরা আর তাকে মনোযোগের কেন্দ্রে না রাখে, তখন সেই জীবনের মুখোমুখি উনি হতে পারবেন কি না, এই বোঝাবুঝিটা ওনার দরকার। শুধু ওনার না, হয়তো আমাদের সবারই।

বলে হাসলেন তিনি। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। অবন্তী কথা বলল না। তবে তার কেন যেন মনে হলো, এই মানুষটার মধ্যে কিছু একটা রয়েছে। হয়তো সেই কিছু একটাই রিয়ার মতো গতিময় এক ঝঞ্ঝাকেও হঠাৎ অমন থমকে দিয়েছে। মাহমুদ বললেন, জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী, জানেন?

অবন্তী তাকাল। তার চোখে জিজ্ঞাসা।

উপলব্ধি। আপনি কখন কী করছেন, সেটি যদি উপলব্ধি করতে না পারেন তো জীবন আপনাকে রিগ্রেট করার সুযোগ দেবে না। এই জন্য যত তাড়াই থাকুক, ছুটতে ছুটতেও আমাদের খানিক থামতে জানতে হবে। খানিক জিরিয়ে নিতে হবে। মানুষ ভাবে, কেবল ছুটলেই বুঝি বহুদূর যাওয়া যায়। কিন্তু কথাটা তো সত্য নয়। বহুদূর যেতে হলে বরং ওই বিরামটুকু দরকার।

জি।

যে ভাবনা, জীবনদর্শন কিংবা আচরণের জীবন রিয়া কাটান, সেটি সম্পর্কে তার ওই উপলব্ধিটুকু খুব দরকার। তাকে বুঝতে হবে তিনি কী করছেন, কেন করছেন। কারণ, এই সময়টা চলে গেলে জীবন তো আর তাকে ফিরে আসার সুযোগটা দেবে না। তাই না?

জি।

সরি। যেন হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন মাহমুদ। আমি বোধ হয় খুব বেশি বাজে বকে ফেলছি।

না না। আমার শুনতে ভালো লাগছে।

শিক্ষক হওয়ার এই এক যন্ত্রণা, বুঝলেন? যখন-তখন যে কাউকে স্টুডেন্ট ভেবে লেকচার দিতে ইচ্ছে হয়। বলে হাসলেন মাহমুদ।

আমি তো তা-ই। হাসল অবন্তীও। তারপর আরও খানিক কথা হলো তাদের। অবন্তী যখন মাহমুদ হাসানের রুম থেকে বের হয়ে এল, তখন খুব নির্ভার লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল, ওই সময়টুকু তাকে কেমন অন্য রকম এক অনুভব দিয়েছে। মনে হয়েছে, এমন একজন মানুষের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়। নিজের জীবনের গল্প অকপটে শেয়ার করা যায়।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাকে একবারও শিক্ষক বলে মনে হয় নি। বরং মনে হচ্ছিল, খুব কাছের কোনো বন্ধু। যেই বন্ধু তার চেয়ে বয়সে খানিক বড়। কিন্তু সবকিছু সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। তবে সেই জ্ঞান সে নিজকে জাহির করতে প্রকাশ করে না। প্রকাশ করে প্রয়োজনে। যখন যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু। আর তাতে তার সঙ্গের মানুষটি খুব নির্ভার অনুভব করে। হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী। জীবনে এমন একজন মানুষ খুব দরকার। তা হোক বন্ধু কিংবা শিক্ষক কিংবা অন্য কিছু।

.

মাহমুদ হাসানের প্রতি রিয়ার অমন উন্মাদনা নিয়ে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াটা অবন্তীর ছিল, তা যেন সেদিনের পর থেকে অনেকটাই বদলে গেল। তার বরং মনে হলো, রিয়ার মতো কারও পক্ষে হুট করে কোনো পুরুষের প্রতি অমন মুগ্ধ হয়ে পড়া সহজ কোনো ব্যাপার নয়। সেটি হলে তা বরং হতে পারত আরও অনেক আগেই। কিন্তু সে সম্ভবত মাহমুদ হাসানের মতো কারও জন্যই অপেক্ষা করছিল। আর তিনিও তার সহজাত কথায়, আচরণে রিয়াকে অবচেতনেই মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন। হয়তো করেছেন আরও অনেককেই। কিন্তু তারা রিয়ার মতো এমন ডাকাবুকো, বেপরোয়া নয় বলেই সেসব তার কাছ অবধি পৌঁছাতে পারে নি। কিন্তু রিয়া পেরেছে।

রিয়া ইউনিভার্সিটিতে এল মাসখানেক পরে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তার ফিরে আসায় অবন্তী যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। বরং সে যেন আগের চেয়েও বেশি বেপরোয়া হয়ে ফিরে এসেছে। অবন্তীকে দেখেই বলল, কী রে, আমি মরে গেছি ভেবে তোর হাড় জুড়িয়েছিল?

কী বলছিস এসব?

ন্যাকামি করিস না। আমি সব বুঝি।

কী বুঝিস?

আমি না থাকলে তোরা কী করিস!

কী করি?

মিত আসা সেই

আমার নামে রাজ্যের বদনাম করিস। গিবত করিস। বলিস যে মালটা আর না এলে ভালো হতো!

ছি রিয়া! এসব কী ধরনের কথা? অবন্তী এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হলো। এই ধরনের আজেবাজে কথা বলার জন্য এত দিন বাসায় ছিলি?

বাসায় ছিলাম অন্য কারণে।

কী কারণে?

ওই ওল্ড ম্যানকে নিয়ে আমার আসল ঘটনা বোঝার জন্য।

তোর আবার আসল ঘটনা কী?

মানে, আমি কি সত্যি সত্যিই ওই বুড়োটাকে ভালোবাসি? নাকি তোর কথাই সত্যি?

আমার কী কথা?

ওই যে, জাস্ট মজা করতে করতেই একসময় হঠাৎ ভুলে গিয়েছিলাম যে ওটা আসলে মজা ছিল! পরে ফান আর সিরিয়াসনেসের মধ্যে ফারাক করতে পারছিলাম না। এমন হয় না অনেক সময়?

হুম হয়। তা শেষে কী মনে হলো?

মনে হলো…। বলে একটু থামল রিয়া। তারপর বলল, শুরুটা ফানই ছিল। ওল্ড ম্যান মূলত আমাদের সর্বজনীন ক্রাশ, বুঝলি? সব মেয়েই ডিপার্টমেন্টে এসে প্রথমে তার প্রেমে পড়ে যায়। মানে…ধর, সিরিয়াস কিছু না হলেও অ্যাটলিস্ট তাকে নিয়ে মজাটজা তো হয়ই। সম্ভবত আমিও প্রথমে তেমনই করছিলাম।

তারপর?

তারপর? বলে আবার চুপ করে রইল রিয়া। তার চোখ যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। একটা ঠান্ডা, শীতল ছায়া। সে প্রায় বিড়বিড় করে বলল, শালা আমাকে শেষ করে দিয়েছে, বুঝলি?

মানে কী?

মানে আই অ্যাম লিটারেলি গন। এই একটা মাস আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে গেছে। একটা মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে পারি নি। সারাক্ষণ মনে হতো বুকের ভেতরটা কেমন দমবন্ধ হয়ে আছে। ব্যাটাকে দেখতে না পেলে মরেই যাব। ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেসবুকে স্টক পর্যন্ত করতাম, মেসেজ পাঠাতাম। কিন্তু কঠিন জিনিস, বুঝলি? সিনই করত না!

সিরিয়াসলি? ভ্রু কুঁচকে বলল অবন্তী।

রিয়া আচমকা সপাটে চাটি বসাল অবন্তীর মাথায়। তারপর বলল, আরেকবার এই কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলব, হারামজাদি।

অবন্তী ভ্যাবাচেকা খাওয়া ভঙ্গিতে বলল, কী কথা?

সিরিয়াস না ফান! তোর ওই এক সিরিয়াস না ফান শুনে শুনে কনফিউজড হয়ে আমি আমার জীবন থেকে একটা মাস শেষ করে দিয়েছি। বলেই কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বাংলা সিনেমার সংলাপের মতো প্রলম্বিত স্বরে বলতে লাগল, দে, আমার জীবন থেকে একটা মাস ফিরিয়ে দে। এখুনি দে। না হলে তোকে আমি খুন করে ফেলব, শয়তান। তুই আমার মনও পাবি না, দেহও পাবি না। যা পাবার সবই পাবে ওই ওল্ড ম্যান।

বলেই শরীর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল রিয়া। অবন্তী হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। রিয়া বলল, চল ওল্ড ম্যানের সঙ্গে দেখা করে আসি।

কেন!

কারণ, ঘটনা তাকে জানাতে হবে না? সে-ই তো বলেছিল এই ব্রেক নেওয়ার পর আমার মানসিক অবস্থা কী হয়, সেটা তাকে জানাতে।

দেখে তো মনে হচ্ছে আরও খারাপ হয়েছে।

সেটাই তাকে জানাতে হবে। গিয়ে বলতে হবে, ঘটনা হ্যাঁজ সিরিয়াসলি ঘটেন।

এর মানে কী?

মানে ঘটনা সিরিয়াসলি ঘটে গেছে। আমার পুরোপুরি প্রেমে পতন ঘটেছে। এই পতনের গভীরতা এগারো হাজার তেত্রিশ মিটার। এর থেকে ওঠার আর কোনো উপায় নেই।

এগারো হাজার তেত্রিশ মিটার মানে?

মানে…। বলে খানিক চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপ করে রইল রিয়া। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, মানে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা এগারো হাজার তেত্রিশ মিটার। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কী, জানিস তো?

অবন্তী একদৃষ্টে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এর ভাবভঙ্গি সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কথাবার্তাও না। তার চেয়ে তো আগেই ভালো ছিল সে।

রিয়া উঠে যেতে যেতে বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থানের সমানই যদি প্রেমে পড়তে না পারলাম, তাহলে সেই প্রেমের আর প্রেস্টিজ কী থাকল, বল?

১৫

হৃদি বসে আছে রাহিমা বানুর মাথার কাছে। তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে সে। রাহিমা বানু বললেন, তুমি এখন যাও। রাত হয়ে গেছে।

এটা এমন কোনো রাত না, মা।

মেয়েদের জন্য সন্ধ্যাই অনেক রাত।

এটা কেমন কথা হলো, মা? রাত হলে সেটা ছেলে-মেয়ে সবার জন্য একই হওয়ার কথা। আলাদা কেন হবে?

দিনকাল তো ভালো না। চারদিকে এত এত খারাপ খবর শুনি যে ভয় লাগে। মেয়েটাকে রেখে এসেছি ভাইয়ের বাসায়। এই বয়সের মেয়ে। কি-না-কি করে, সারাক্ষণ ভয় হয়। তোমাকে নিয়েও হয়।

আমাকে নিয়েও আপনার সারাক্ষণ ভয় হয়?

হবে না? তুমি কি আমার কাছে আর আলাদা কেউ? আয়েশা আমার যেমন, তুমিও। তোমাদের জন্য বুকটা সারাক্ষণ ছটফট করে। এই যে কটা দিন তোমাকে দেখি নি, হাসপাতালে ছিলাম, সারাক্ষণ কেবল মনে হতো, তুমি যদি একটু পাশে এসে বসতে, একটু কথা বলতে, তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যেতাম। ওই হাসপাতাল, ডাক্তার ওসব কিছুই লাগত না।

কথাটা শুনে চুপ হয়ে রইল হৃদি। এই মানুষটা এমন কেন? এত মায়া! সে বলল, এখন তো হাসপাতাল থেকে এসেছেন। আর আমিও রোজ এসে দেখে যাব।

হ্যাঁ, এসো। কিন্তু যতটুকু থাকো, ততটুকু যত দ্রুত কেটে যায়, যখন থাকো না, সেটা তত দ্রুত কাটে না। খালি মনে হয়, কখন আসবে, কখন! রাহিমা বানুর চোখ ছলছল করে। হৃদি তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে, মা, আপনি এমন কেন?

তুমি এমন যে! তোমার মতো ভালো মেয়ে আর দেখি নি! কিন্তু অনিকটা এমন হতচ্ছাড়া যে আমার খুব ভয় করে।

কিসের ভয়?

ও যদি তোমাকে ধরে রাখতে না পারে!

কথাটা শুনে থমকে গেল হৃদি। এই প্রথম এমন স্পষ্ট করে কথাটা বললেন রাহিমা বানু। একটা অনাস্বাদিত সলজ্জ অনুভব যেন হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে আসতে লাগল। তারপর ছড়িয়ে পড়তে লাগল শরীরজুড়ে। রাহিমা বানু বললেন, তুমি এখন যাও। কাল আবার এসো।

বাসায় ফিরেও রাহিমা বানুর ওই কথাগুলো বারবার মনে পড়তে লাগল হৃদির। অনিককে ফোন করল সে। বলল, তুমি কি জানো তোমার ওপর আমার কি অসম্ভব মন খারাপ ছিল?

জানি।

এটা কি জানো এখন আর সেই মন খারাপটা নেই।

কেন?

মায়ের জন্য।

তবে তো মাকে সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। তাহলে আমি অন্তত খানিক নিশ্চিন্ত থাকতে পারব।

কিন্তু সে জন্য তো তোমাকে কিছু করতে হবে। এখন তো মা একটু ভালো।

অনিক কথা বলল না। হৃদি বলল, তুমি একটু প্লিজ, গ্র্যাজুয়েশনটা ঠিকঠাক শেষ করো। তারপর কিছু একটা চাকরিবাকরি জুটিয়ে নিতে পারলেই আমি বাসায় বলতে পারব। আমার মা ইদানীং আমার প্রতি খুব পজিটিভ।

হুম। বলে আবারও চুপ করে গেল অনিক।

কথা বলছ না কেন? এই ভালো সময়টা পাল্টে যেতে কিন্তু একমুহূর্তও লাগবে। আর তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

অনিক তারপরও কথা বলল না। হৃদি বলল, আমি কি ফোন রাখব?

না।

তাহলে?

কিছুক্ষণ ধরে রাখো।

কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ কেন?

আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়, মানুষ হিসেবে আমি কেমন?

এই প্রশ্ন কেন?

বলো না!

সত্যি বলব?

মিথ্যে কেন বলবে?

না মানে…খারাপ বললে তো লোকে বলবে আমার পছন্দ খারাপ। জেনেশুনে খারাপ লোককে বিয়ে করেছি। বলে মৃদু হাসল হৃদি।

অনিক বলল, বলো।

আমি না তোমাকে বুঝতে পারি না। কখনো কখনো মনে হয় এই মানুষটার আদ্যোপান্ত আমি চিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয়, এই মানুষটাকে আমি চিনিই না। কখনো দেখিই নি। এতটাই অচেনা সে।

আমারও ঠিক তা-ই মনে হয়।

কী?

অচেনা।

কাকে, আমাকে? জিজ্ঞেস করল হৃদি।

না। আমার নিজেকে। অনেক চেষ্টা করেও কখনো নিজেকে বুঝতে পারি না আমি। মনে হয়, একটা ঘাসের মাঠে ইটচাপা যে ঘাসগুলো থাকে, আমি ওই ঘাসগুলোর মতো। সবাই ভাবে আর সব ঘাসের মতোই ওই ঘাসগুলোও সবুজ। কিন্তু ইটটা সরালেই দেখা যায় তারা মৃত, ফ্যাকাশে।

এমন করে কেন বলছ?

হঠাৎ মনে হলো তাই। নাথিং সিরিয়াস।

তুমি আসলে বলতে চাইছ ওই ইটটা সরিয়ে সত্যিকারের তোমাকে দেখার মতো কোনো মানুষ নেই?

আমি নিজেই হয়তো চাই না কেউ ওই আমাকে দেখুক। ইটটা সরাক।

আমিও না?

এই প্রশ্নে চুপ করে রইল অনিক। বলল, তুমি কি একদিন আমার সঙ্গে দূরে কোথাও যাবে?

কোথায়?

তা তো জানি না। তবে দূরে কোথাও।

.

ধলেশ্বরী নদীর পাড় দিয়ে চলে গেছে ঘেসো মেঠো পথ। জলে টইটম্বুর নদী সেই পথ ছুঁই ছুঁই। হৃদি তার পরনের হালকা আকাশি রঙের শাড়িটা প্রায় হাঁটু অবধি তুলে ফেলল। তারপর পা ডুবিয়ে দিল জলে। অনিক বলল, আমার কী ইচ্ছে হচ্ছে, জানো?

কী?

তোমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিতে।

হৃদি কটমট করে তাকাল, এটা কী ধরনের কথা?

অশ্লীল কথা।

অশ্লীল কথা? কপাল কুঁচকে বলল নদী।

হুম।

এটা অশ্লীল কথা কী করে হয়? এটা ভয়ংকর কথা।

উঁহু। বলে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে হাসল অনিক। তুমি যখন পানি থেকে উঠবে, তখন হতোমার শরীরে এই আকাশি রঙের শাড়িটা লেপ্টে থাকবে। ওই দৃশ্যটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এমনকি একটা প্ল্যানও ছিল।

হৃদি খানিক ঝুঁকে অনিকের গায়ে পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে বলল, ওরে শয়তান, এই ছিল তোর মনে?

অনিক দৌড়ে সরে গেল। হৃদি তাকে খানিক তাড়া করল। তারপর বলল, আচ্ছা, বিয়ের পর নাকি ধীরে ধীরে মানুষের রোমান্টিসিজম কমে যায়। আমাদেরটা কি কমল না বাড়ল?

আমাদের তো এখনো বিয়েই হয় নি। বলল অনিক।

মানে কী?

মানে বিয়ে বলতে যা বোঝায়, ঘর-সংসার, পরিবার, রিলেটিভ, বাচ্চা, রেসপনসিবিলিটজ। মানে যেসব হয় আরকি, ওসব তো আমাদের হয় নি।

তুমি বলছ ওসবের কারণে এসব আর থাকে না?

অনেকটাই। তখন অসংখ্য রঙের সুতো এসে একটা সুতোর বল তৈরি হয়। এলোমেলো। রাস্তায় ঝুলে থাকা অসংখ্য তারের দঙ্গলের মতো। সেসব থেকে নিজেদের সম্পর্কের এই বিশেষ সুতোটা আলাদা করা কঠিন হয়ে যায়।

কথাটা ভাবল হৃদি। অনিক খুব চুপচাপ, অন্তর্মুখী মানুষ। এ কারণেই হয়তো তার ভাবনাগুলো খুব গোছানো। বাস্তবিকও।

সেই সারাটা দিন তারা ঘুরল। বহুদিন এমন সময় আর কাটায় নি তারা। বিকেলের দিকে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। হৃদি তখন খোলা মাঠে একটা শুকনো খড়ের গাদার ওপর বসে ছিল। যত দূর চোখ যায়, কোথাও কেউ নেই। কেবল ধু ধু ফসলের মাঠ। মাঠের পাশে নদী। নদীর বুকে শব্দ। সেই শব্দে নূপুরের ছন্দ তুলে নেমে এল বৃষ্টি। হৃদি তটস্থ গলায় বলল, এখন? এখন কী হবে?

কী হবে?

এই যে বৃষ্টি চলে এল।

তাতে কী?

তাতে কী মানে কী, অনিক? আমি বাসায় ফিরব কী করে? আর এখান থেকে এত দূর পথ এই শাড়ি পরেই-বা কী করে যাব?

শাড়ি পরে যাওয়ার কী দরকার?

মানে কী?

এসো খুলে দিচ্ছি। ভেজা শাড়ি রেখে কী লাভ?

হৃদি এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল। বলল, তুমি বুঝতে পারছ না আমি কী বলছি? তখন থেকে বললাম যে আকাশ মেঘলা, চলো ফিরে যাই। তুমি গেলে না। এখন?

আমি তো চাইছিলামই বৃষ্টি নামুক। নদীতে না হোক, অন্তত বৃষ্টিতে ভেজো তুমি।

অনিক! এবার শক্ত গলায় বলল হৃদি।

হুম? বলে হৃদির বুকের কাছে এগিয়ে গেল অনিক। তারপর দুহাতে আঁকড়ে ধরল তাকে। বলল, তোমার কাজল ধুয়ে যাচ্ছে।

হৃদি কথা বলল না। অনিকের এই কথা, এই কণ্ঠস্বর, নদী, মাঠ, বৃষ্টি–সবই তার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এ এক অপার্থিব ভালো লাগার মুহূর্ত। কিন্তু এখান থেকে সে যাবে কী করে? এই চিন্তা তাকে আড়ষ্ট করে রাখল। অনিক হৃদির ঘাড়ের কাছের ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিল।

হৃদি বলল, পাগল তুমি?

হুম। কেমন ঘোর লাগা কণ্ঠ অনিকের।

হৃদি বলল, চলো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

অনিক আচমকা তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। হৃদির যে কী হলো! সে-ও যেন ভুলে গেল এই বৃষ্টি, ধূসর খোলা মাঠ, সন্ধ্যার আকাশ, তার ঘরে ফেরার শঙ্কা। তারা। তুমুল চুম্বনে পরস্পরকে শুষে নিতে থাকল। সঙ্গে শুষে নিত থাকল সংকোচ, শোক, সংশয়।

অনিক ফিসফিস করে বলল–

বৃষ্টি এলেই তোমার চুলে খানিক ভুলে গন্ধ নেব
তোমার ঠোঁটেই খুঁজব নেশা, নিকোটিনটা বন্ধ দেব
বেহিসেবি হাটবাজারে ছেড়েই দেব দামাদামি
বৃষ্টি এলেই বদলে যাব, আবার হব তোমার আমি।

হৃদিকে অবশ্য ভেজা শাড়িতে বাড়ি ফিরতে হলো না। বৃষ্টি থেমে যেতেই অনিক তার ব্যাগের ভেতর থেকে নীলরঙা আশ্চর্য সুন্দর এক শাড়ি বের করল। সঙ্গে শাড়ি পরার প্রয়োজনীয় আর সব পরিচ্ছদও। তারপর বলল, এসব তোমার জন্মদিনের। মনে আছে, তুমি একদিন ঘুরে ঘুরে নীলরঙা এই শাড়ি আর তার সঙ্গে মিলিয়ে এই সব খুঁজেছিলে?

হৃদি কথা বলল না। অনিক বলল, কিন্তু মার হঠাৎ অমন হয়ে গেল যে তোমার জন্মদিনের আর কিছুই আমার মাথায় ছিল না।

হৃদি কথা বলল না। সে টলমল চোখে তাকিয়ে রইল। সূর্য লুকিয়েছে অনেক আগেই। মেঘলা আকাশও যেন আগেভাগেই দিনের যবনিকা টেনে দিচ্ছে। কিন্তু হৃদির চোখে, মুখে, বুকে জ্বলে রইল আশ্চর্য দ্যুতিময় এক আলো! সন্ধ্যার অন্ধকারের সাধ্য কী সেই আলো নেভাবে?

১৬

হৃদির বাবা তোফায়েল হোসেন মারা গেলেন পরদিন ভোরে। রাত থেকেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি। বাড়ির সামনের রেইন্ট্রিগাছটার মস্ত দুটি ডাল ভেঙে বেরোনোর পথ রুদ্ধ। সন্ধ্যা থেকেই শরীর খারাপ লাগছিল তার। বাড়ি ফিরে বাবার অবস্থা দেখে অনিককে অসংখ্যবার ফোন করল হৃদি। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। ওই ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মাঝরাতে বাড়ি এসে হাজির হলো নেহাল। ততক্ষণে তোফায়েল হোসেন অচেতন। তার শ্বাসপ্রশ্বাসও টের পাওয়া যাচ্ছে না। রোখসানা বেগম চিৎকার করে কাঁদছেন। কাঁদছে হৃদি, তিথি, অবন্তীও। তাদের ধারণা, তোফায়েল হোসেন মারা গেছেন।

রোখসানা বেগম কান্নাজড়ানো গলায় বললেন, উনি নাই। উনি নাই। উনি আমাদের কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছেন, বাবা।

নেহাল তাকে দেখল। তারপর বলল, আপনি কিছু মনে না করলে আমি একবার ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই।

রোখসানা বেগম বললেন, হাসপাতালে নিয়ে কী হবে? মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ বললেন বুকে ব্যথা। মাথাটা দপদপ করছে। তারপর বার দুই বমি করলেন। তারপরই…। বলে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

নেহাল বলল, আমাকে একবার একটু দেখতে দিন, প্লিজ। একটা শেষ চেষ্টা। তার কণ্ঠে অনুনয়।

সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই তাকে নিয়ে ছুটল নেহাল। সঙ্গে হৃদি আর রোখসানা বেগম। তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছাল, তখন সেখানে বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তার নেই। নেহাল। তার এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে হাসপাতালে আনাল। তোফায়েল হোসেনের জ্ঞান। ফিরল রাত চারটার দিকে। হৃদি সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে ছিল বারান্দায়। বাবার জ্ঞান

ফিরেছে শুনে সে যেন পাগল হয়ে গেল। তোফায়েল হোসেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলেন। বললেন, আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি। পাগল মেয়ে। তুই এমন করলে অন্যদের কে দেখবে?

হৃদি ডাকল, বাবা, বাবা, ও বাবা?

তোফায়েল হোসেন অনেক কষ্টে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। কিন্তু তার শরীর দুর্বল। কণ্ঠ ক্ষীণ। হৃদি তারপরও তাকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল।

রোখসানা বেগম বললেন, তুমি এই ছেলেকে দেখো, এ আল্লাহর কাছ থেকে আসছে। আল্লাহ একে পাঠিয়েছে। বলেই নেহালকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।

ডাক্তার বললেন, ওনার অবস্থা এখনো বিশেষ ভালো না। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। যেকোনো সময় আবার অ্যাটাক হতে পারে। আপনারা একটু বাইরে যান। আমাদের আরও অনেক কাজ আছে।

রোখসানা বেগম অবশ্য গেলেন না। তিনি বসে রইলেন স্বামীর পাশেই। করিডরে এক সারি প্লাস্টিকের নীল চেয়ার। সেখানে চুপচাপ বসে রইল হৃদি। তার পাশে নেহাল। নিঃশব্দ করিডরজুড়ে ফিনাইলের গন্ধ। কোথাও কেউ নেই। কেবল একটা দেয়ালঘড়ির টিকটিক শব্দ। সাদা দেয়ালজুড়ে কাফনের কাপড়ের মতো মৃত্যুর হিমশীতল ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ হৃদিকে কেমন জড়সড় করে রাখল। সে হঠাৎ নেহালের হাতটা শক্ত করে ধরল। নেহাল কিছু বলল না। তবে তার হাতের ভেতর হৃদির হাতের কম্পন অনুভব করতে লাগল সে। দীর্ঘ সময়। তারপর হৃদি প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপনি এমন কেন?

কেমন?

জানি না।

আমরা যা জানি না, তার মধ্যে কিছু কিছু হয়তো এমন যে তা আমরা জানতেই চাই না।

কথাটা ভাবাল হৃদিকে। নেহাল মিথ্যে বলে নি। সে আসলেও তাকে জানতে চায় না। ইদানীং একটা অস্পষ্ট ভয় তার মধ্যে কাজ করে। তার কেবল মনে হয়, এই মানুষটা মাঝে মাঝেই কোথা থেকে এসে যেন টুপ করে তার ভাবনায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু সে খুব সতর্কতায় সেই ভাবনা এক পাশে সরিয়ে রাখে। তাকে নিয়ে ভাবতে চায় না। এমন কেন হয় তার?

নেহাল বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে।

হৃদির হঠাৎ মনে হলো নেহালের একটা হাত আলতো করে তার কাঁধ ছুঁয়ে আছে। তবে সেই ছোঁয়ায় তার কোনো অস্বস্তি হলো না। বরং একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, নির্ভরতা অনুভব করতে লাগল সে। মনে হলো, ওই হাতটা ওখানেই থাকুক। কিংবা তাকে আরও খানিক শক্ত করে ধরে রাখুক। এই মুহূর্তে ওই স্পর্শটুকু তার দরকার।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, নেহাল যেন তার মন পড়তে পারল। সে আলগোছে হৃদির মাথাটা কাঁধে টেনে নিল। হৃদি ঠিক জানে না তার ভেতর কী কাজ করছে! কিন্তু একটা দ্বান্দ্বিক ভাবনা বিপুল দ্ব্যর্থকতা পেরিয়ে তাকে নেহালের ওই নির্ভয় আশ্রয়ের কাছে সমর্পণ করল। এই সমর্পণে তার কোনো সচেতন ভূমিকা ছিল না। কিন্তু সে সমর্পিত হলো। এর পুরোটাই যেন কোনো এক অনাবিষ্কৃত, রহস্যময় অনুভূতির জগৎ থেকে প্রবল আচ্ছন্নতায় উৎসারিত।

.

তোফায়েল হোসেন মারা গেলেন ভোর সাতটায়। হৃদির অবশ্য তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এটা সত্যি। তার বরং মনে হচ্ছিল, এবারও নিশ্চয়ই কোনো একটা ভুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই বাবা আবার জেগে উঠবেন। তারপর খানিক আগের মতোই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন। আর হাসতে হাসতে বলবেন, আমি ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে রে মা। তুই এমন ভেঙে পড়লে আমার কী হবে?

তোফায়েল হোসেন অবশ্য এমন কিছুই আর বললেন না। ডাক্তাররা এসে আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুসংবাদ জানালেন। হৃদি তা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। সে পাগলের মতো ছুটে এসে নেহালকে জড়িয়ে ধরল। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি আমার বাবাকে ঠিক করে দিন। এখুনি ঠিক করে দিন। আমি জানি আপনি পারবেন। আপনি জানেন বাবার কিছু হয় নি। বাবা বেঁচে আছেন। আপনি প্লিজ আমার বাবাকে ঠিক করে দিন। এখুনি দিন।

নেহাল কথা বলল না। সে চুপচাপ হৃদিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এমনকি হাসপাতাল থেকে তোফায়েল হোসেনের লাশ যখন বাড়ি নিয়ে আসা হলো, তখনো। এই পুরোটা সময় একমুহূর্তের জন্যও হৃদি চোখ তুলে তাকাল না। কোনো শব্দ করল না। কাঁদলও না সে। মৃত মানুষের মতো নেহালের বুকের ভেতর নির্জীব হয়ে মিশে যেতে লাগল।

পরের কয়েকটা দিন চলে গেল খুব দ্রুত। একটা আলো-ঝলমলে বাড়ি নিমেষেই হয়ে গেল শোকের সমাধি, যেন এখানে কোনো প্রাণ নেই, কথা নেই, শব্দ নেই। যা আছে, তার নাম কান্না। তবে সেই কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না। কেবল অনুভব করতে পারে। নেহাল সেই দিনগুলোতে শক্ত বৃক্ষের মতো আগলে রাখল হৃদিকে। আর হৃদি হয়ে রইল নেতিয়ে পড়া বিবর্ণ লতাগুল্ম।

.

অনিকের কোনো খবর নেই। অবশ্য এ বাড়ির কারও তার কথা মনেও রইল না। হৃদির ফোন বন্ধ। সে দিনমান তার ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকে। রোখসানা বেগম, তিথি যার যার ঘরে প্রাণহীন লাশের মতো অসাড় হয়ে পড়ে রইলেন। অবন্তীই যা একটু দেখাশোনা করে তাদের। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিলেন, তারাও ধীরে ধীরে চলে যেতে লাগলেন। তবে এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল নেহাল। এমনিতেই তার সঙ্গে হৃদির বিয়ের কথাবার্তা সকলে কমবেশি জানেন। ফলে গৃহকর্তাহারা এই পরিবারের অসহায় তিন নারীর জন্য যেন সে-ই হয়ে উঠল শেষ ভরসা।

এই কথা কেউ কেউ ঠারেঠুরে বলেও গেলেন। হৃদির চাচি তো সরাসরিই বললেন, মারে, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। তার ওপর তো আর কারও হাত নাই। এখন এই সংসারে তুই-ই সবার ভরসা। তোর ওপরই সব দায়িত্ব। তা ছাড়া তোর ভাইয়ের অবস্থা তো দেখলিই। বাপটা মারা গেল, তাও সে দেশে আসতে পারল না।

হৃদি কথা বলল না। রোখসানা বেগম ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছেন। ঘরে আরও অনেক আত্মীয়স্বজন আছেন। তারাও যেন চাচির কথাতেই সমর্থন দিয়ে গেলেন।

চাচি বললেন, এখন যা করার তোকেই করতে হবে। তোর মায়ের এই অবস্থা। তিথিরও কয় দিন পর বিয়েশাদি দিতে হবে। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো তোর বিয়েটা করে ফেলা। যে যত যা-ই বলুক, মাথার ওপরে একটা পুরুষমানুষের ছায়া লাগেই। না হলে বোঝা যায় জীবন কত কঠিন।

তিনি থামলেও হৃদি কথা বলল না। কথা বললেন না রোখসানা বেগম বা তিথিও। তবে হৃদির মামি এর সঙ্গে যোগ করলেন। তিনি বললেন, কথা ঠিক বলছেন, আপা। তবে শুধু পুরুষমানুষ হলেই হবে না, দায়িত্বশীল পুরুষ হতে হবে। সব পুরুষ তো আর পুরুষ না। আজকালকার ছেলেদের তো দেখি, এদের কথার ঠিক নাই, কাজের ঠিক নাই। আর চরিত্রের কথা কী আর বলব!

এই জন্যই কথাটা তুললাম। মরা বাড়িতে এই সময়ে এই সব নিয়া কথা বলা ভালো দেখায় না। কিন্তু বিষয়টা না বলেও পারছিলাম না। বললেন চাচি। হৃদির কপালটা ভালো। ছেলেটারে দেখছেন? কী করে নাই এই কটা দিন! নিজের ছেলেও বাপের জন্য এই রকম করে না। করে?

সেটা তো দেখলেনই। বললেন দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়া। এই জন্যই বলে, ঘরের চাইতে পরই কখনো কখনো আপন হয়ে যায়।

অবন্তীর মা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অবশেষে কথা বললেন। তিনি বললেন, সোনার টুকরা ছেলে। এই রকম ছেলে এই যুগে দেখাই যায় না। আপনি ঠিকই বলছেন, হৃদির ভাগ্যটা ভালো। এখন আপা…। বলে রোখসানা বেগমের দিকে তাকালেন তিনি। বললেন, আর দেরি করার দরকার নাই। কোনো আয়োজনও দরকার নাই। যত তাড়াতাড়ি পারেন, বিয়াটা শেষ করেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিয়াশাদির ব্যাপার, কোন দিক দিয়া কখন কী হয়, বলা যায় না। এই জন্যই শুভ কাজে দেরি করতে নাই। তা ছাড়া এই বয়সের এমন একটা ছেলে! কোন দিক দিয়ে কে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়, বলাও যায় না। এখন এমন মন আছে, পরে ঘুরে গেলে তখন কী করবেন? বললেন মেজ চাচি।

হৃদি চুপ করে রইল। মামি হৃদির কাছে এগিয়ে এসে তার মাথাটা কোলের সঙ্গে আলতো করে চেপে ধরে বললেন, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। সেটা তো আর বদলানো যাবে না। আর বাবা-মাও কারও চিরদিন থাকে না। এখন যা করার সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। তোর ওপরই এখন এই সংসারের সব দায়িত্ব। সুতরাং আর দেরি করিস না।

.

অনিকের সঙ্গে হৃদির কথা হলো বেশ কিছুদিন পর। বাবার মৃত্যুসংবাদটা তাকে দিলেও হৃদি যেন অনুভব করছিল কোথাও কিছু একটা নেই। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা। ওই শূন্যতা ডিঙানোর ক্ষমতা তার নেই। হয়তো অনিকেরও না। সে-ও যেন কেমন নির্জীব হয়ে রইল। তার কণ্ঠ নিস্তেজ। ক্লান্ত। সে বার কয়েক হৃদির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও হৃদি আগ্রহ দেখাল না। বলল, আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ। এখন কিছুই ভালো লাগছে না।

অনিক খানিক চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা।

হৃদি বলল, মা কেমন আছেন?

ভালো।

এটুকুই। এরপর হৃদিও আর কিছু বলল না। অনিকও না। নেহাল এল পরদিন। হৃদি তার সঙ্গেও যেন ঠিকঠাক কথা বলল না। কিংবা কারও সঙ্গেই না। সে গুম হয়ে রইল নিজের ভেতর। নিজের অন্ধকার ঘরে একা। নিস্পন্দ। তবে নেহাল আসতেই লাগল। রোজ সকাল-বিকেল। দুবেলা নিয়ম করে ঘুরে যেতে লাগল সে।

সেদিন বিকেলে হৃদি বসে ছিল ছাদে। একটা চড়ই এসে বসেছে আমগাছের ডালে। তারপর টুক করে লাফিয়ে চলে গেল দূরে। তারপর আবার ফিরে এল। এসে বসল হৃদির চেয়ারের হাতলে। বসেই রইল। হৃদি চড়ইটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো, পাখিটার কি তাকে এতই নির্জীব মনে হচ্ছে যে সে জড়বস্তু ভেবে তার এত কাছে এসে বসেছে? না হলে চড়ুই পাখিকে কখনো কারও এত কাছে এসে এভাবে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে দেখে নি সে।

নেহালকে তার চোখে পড়ল এর বেশ খানিকক্ষণ পর। ঠিক তার পেছনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। হৃদি ফিরে তাকাতেই মৃদু হাসল। হৃদি বলল, আপনি?

সরি।

সরি কেন?

এই যে আপনার একান্ত সময়ে বিরক্ত করলাম। হৃদি স্মিত হাসল, বিরক্ত কেন হব?

আমার তো সব সময় ভয় হয়।

কেন?

যদি কোনোভাবে আপনাকে বিরক্ত করে ফেলি?

একদম না। বরং আপনাকে দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেছে। বলেই যেন লজ্জা পেয়ে গেল হৃদি। এভাবে কথাটা বলা সম্ভবত ঠিক হয় নি তার। কী ভাবল লোকটা? তবে চকিতে একবার ভেবে দেখল সে–কথাটা মিথ্যেও নয়। নেহাল যতক্ষণ তার আশপাশে থাকে, এমনকি আশপাশে না থাকলেও সে যখন জানে যে এই বাড়িতেই কোথাও রয়েছে সে, তখন যেন খানিক নির্ভার লাগে। বাকিটা সময় একটা তীক্ষ্ণ অস্থিরতা বয়ে বেড়াতে থাকে। এমন কেন হচ্ছে?

সত্যি?

কী?

আমি আপনার মন ভালো করে দিতে পারি?

হৃদি এবার আর জবাব দিল না। নেহাল বলল, কিন্তু এখন তো আমার খুব খারাপ লাগছে।

কেন? নিজের উৎকণ্ঠাটা এড়াতে পারল না হৃদি।

নেহাল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। বেশ কিছুটা সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমাকে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য একটু বার্লিন যেতে হবে।

কথাটা শুনে হৃদির বুকের ভেতরটা হঠাৎ থম মেরে গেল। মুখে কিছু না বললেও তার চোখ যেন মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। ওই স্পন্দনটুকু দৃষ্টি এড়াল না নেহালের। সে বলল, আপনাদের এভাবে রেখে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। হয়তো ঠিকও হচ্ছে না। কিন্তু বিষয়টা জরুরি।

কী?

মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি না গেলে কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না। সম্ভবত একটা মেজর অপারেশন লাগবে তার। মা খুব চাইছেন এই সময়টা আমি ওখানে থাকি। নেহালের গলা ভারী। চোখ ছলছল। হৃদি আচমকা নেহালের হাত স্পর্শ করল। আবার গুটিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে। তবে নেহাল তার সেই গুটিয়ে নেওয়া হাতখানা আবার নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে। হৃদির উষ্ণ হাতখানা মৃদু কাঁপছে।

নেহাল গাঢ় গলায় বলল, আমি যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসব হৃদি, যত দ্রুত সম্ভব।

হৃদি কথা বলল না। তবে নেহালের হাতের মুঠো থেকে নিজের কম্পিত হাতখানা ছাড়িয়ে নিল সে। তারপর আবার এগিয়ে দিল তার দিকে। তারপর ধরে রাখল। যেন অনাগত বিচ্ছেদের সময়ে এই স্পর্শটুকুই তার কাছে সঞ্চয় হয়ে থাকবে।

নেহাল বলল, তুমি একদম মন খারাপ করবে না। একটুও না। তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমার সবকিছু এলোমেলো লাগে।

আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, খুব তাড়াতাড়ি।

তুমি অপেক্ষা করবে?

খুব।

আমিও। হয়তো তোমার চেয়ে বেশিই।

হৃদি আর কথা বলল না। তবে এই যে নেহাল তাকে হুট করে তুমি করে বলে ফেলল, তা শুনতে একটুও খারাপ লাগল না তার। বরং মনে হলো নেহাল বুঝি সব সময় তাকে তুমি করেই বলত। কিংবা এই তুমিটুকু শোনার জন্য নিজের অজান্তেই দীর্ঘ দিবস-রজনী অধীর হয়ে অপেক্ষা করে ছিল সে।

ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। ঝুঁকে পড়া আমগাছের ডালের ফাঁকে সেই অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। নেহাল সেই জমাট অন্ধকারে হৃদিকে কাছে টানল। ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া বৃষ্টির জলের মতো ঢলে পড়ল হৃদিও। নেহাল তাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, হৃদি। ভীষণ ভালোবাসি। এমন ভালো তোমাকে কেউ কখনো বাসে নি।

হৃদি কথা বলল না। তবে সে নেহালের বুকের আরও গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। তার চোখের কোণে চকচক করতে লাগল এক ফোঁটা জল। এই জলের ফোঁটাটুকু তার এই জীবনের গভীরতম আনন্দময় অনুভবের নির্যাস। সে সেটুকুকে গড়িয়ে পড়তে দিল না। আলতো হাতে আঙুলের ডগায় সযত্নে সঞ্চয় করল।

১৭

মঈনের ধারণা ছিল অবন্তীর বিষয়টা সে পুরোপুরি মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে। এত কিছুর পরও যে মানুষটা তাকে সামান্য সুযোগ দিতে চায় না, বিন্দুমাত্র অনুরাগ অনুভব করে না, তার জন্য নিশিদিন এমন উদ্গ্রীব হয়ে থাকারও মানে হয় না। সময়টা প্রতিকূলে হলেও এই শহরে সে এখনো নাম-পরিচয়হীন তুচ্ছ কেউ নয়। বরং চাইলেই নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার নানাবিধ বাস্তবায়ন করতে সে সক্ষম। তার চারপাশে রূপবতী মেয়েদের অভাব নেই। ফলে অবন্তীর অমন উপেক্ষা কিংবা প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো অনর্থক। প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন সেই চেষ্টাটাও করল সে। এর-ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়াল। সত্যিকারের প্রেম না হোক, অন্তত একটা প্রেম প্রেম ভাব জমিয়ে তোলার। চেষ্টা করল। কিন্তু দিন শেষে তার সবই নিষ্ফল বলে প্রতীয়মান হলো। বরং রাতে যখন একা অন্ধকার ঘরে ঘুমানোর চেষ্টা করে, তখন কত কত মুহূর্ত আলগোছে এসে তার চোখের পাতা ছুঁয়ে যায়! সেই ছোঁয়া বড় যন্ত্রণাময়। এমন কেন হয় তার?

অবন্তী ভীরু, লাজুক। প্রথম দিনের কথা এখনো মনে আছে মঈনের। মেয়েটা রাজ্যের দ্বিধা, সংকোচ নিয়ে তাদের বাড়ির ঝকঝকে নিকানো উঠোন পেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মঈন গম্ভীর ভঙ্গিতে মুখ তুলে বলেছিল, কী চাই?

সঙ্গে সঙ্গে থমকে গিয়েছিল অবন্তী। পরে তাকে আরও সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল মঈন। রূঢ়, রুক্ষ কথার তিরে ভড়কে দিয়েছিল মুহূর্মুহূ। তখনো কি সে ভেবেছিল যে। এই মেয়েটির জন্য বুকের ভেতর এমন তোলপাড় হয়ে যাবে তার? এই যে কত কত মানুষের কাছে সে কঠোর-কঠিন, নির্মম, হৃদয়হীন; তারা কি জানে একলা রাতের অন্ধকারেও কোনো একজনের জন্য সে নীরবে চোখের জল ফেলে?

একবার অবন্তী তাকে বলেছিল, আপনি এমন কেন?

কেমন?

রুক্ষ, কঠিন, ভীতিকর।

আমাকে ভয় পাও?

হুম।

ভালোবাসো না?

অবন্তী জবাব দেয় নি। মঈন বলেছিল, সবাই তো কোমল, ভালো মানুষদেরই ভালোবাসতে চায়। তুমি না হয় এমন কঠিন, হৃদয়হীন কাউকেই ভালোবাসলে?

আপনি তো হৃদয়হীন নন?

তাহলে?

ভেতরে ভেতরে আপনি খুবই নরম। ভালো মানুষ। কিন্তু আপনার বাইরেটা ভীষণ কর্কশ। কঠিন।

তুমি কোনটা চাও? বাইরের কোমলতা, নাকি ভেতরের কঠোরতা?

দুটোই।

তাহলে তো তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেল।

আমার কী দায়িত্ব?

আমার ভেতরটা খুঁড়ে বের করে বাইরের কঠিন দেয়ালটাকেও কোমল করে তোলা।

আমি কী করে পারব?

তুমিই পারবে। তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না।

কী করে?

ভালোবেসে।

আমার যে অত সাহস নেই। আমি আপনাকে ভয় পাই। কিছু বলতেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

আমারও।

আপনারও! মঈনের কথা শুনে ভারি অবাক হয়েছিল অবন্তী। আপনার কেন হয়?

আমিও যে তোমাকে ভয় পাই?

আপনি আমাকে ভয় পান? যেন এমন অবিশ্বাস্য কথা এই জীবনে কখনো আর শোনে নি, এমন ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল অবন্তী।

হুম।

কেন?

কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কাউকে ভালোবাসলে কেউ ভয় পায়?

হুম। ভালোবাসলেই মানুষ ভয় পায়।

কীভাবে?

হারিয়ে ফেলার ভয়। মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার ভয়। কষ্ট দিয়ে ফেলার ভয়। আমার সারাক্ষণ কেবল মনে হয়, এই বুঝি আমি তোমাকে দুঃখ দিয়ে দিলাম। তোমার মন খারাপ করিয়ে দিলাম। আর তারপর হারিয়ে ফেললাম।

কথাটা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল অবন্তীর! ওই রুক্ষ, রূঢ় মানুষটার ভেতরও যে তার জন্য এমন জল-টলমল গভীর অনুভূতির সরোবর লুকিয়ে আছে, তা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তবে তার ভয়টা যেন খানিক কাটতে থাকে।

একদিন সে নিজে থেকেই বলল, আমার একটু একটু ভয় কেটে যাচ্ছে।

সব ভয় কিন্তু কাটিয়ে ফেলো না।

কেন?

তাহলে আমার ভয় বাড়তে থাকবে।

মানে?

মানে তুমি তখন আমাকে পুরোপুরি চিনে ফেলতে থাকবে। আর দুজনের সম্পর্কে যখন কেউ একজন অন্যজনকে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পারে, তখন অন্যজনের জন্য সম্পর্কটা বড্ড কঠিন হয়ে যায়।

কেন?

কারণ, তখন সে আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জগতে সেই সম্পর্কই সবচেয়ে বেশি গভীর, যেই সম্পর্কে অনাবিষ্কৃত রহস্য থাকে, যা রোজ একটু একটু করে আবিষ্কার করা যায়। সব রহস্য উন্মুক্ত হয়ে গেলে, সবটুকু পড়ে ফেলা গেলে, সেই সম্পর্ক প্রাণহীন হয়ে যায়।

অবন্তী ম্লান হাসল। বলল, মাঝে মাঝে আপনি এমন সব কথা বলেন যে আমি তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝি না। শুধু যে বুঝিই না, তা-ই নয়, বরং মনে হয়, কথাগুলো আপনি বলছেন না। বলছে অন্য কেউ।

কেন?

শেষ কবে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন?

মনে নেই।

আজ গিয়ে দাঁড়াবেন। তারপর এতক্ষণ যে কথাগুলো বললেন, তা বলবেন। দেখবেন আপনার সঙ্গে এগুলো যায় কি না!

অবন্তী মিথ্যে বলে নি। মঈনও জানে, সে অবন্তীর সামনে প্রায়ই অন্য এক মানুষ হয়ে যেত। ওই মানুষটাকে এই এত এত বছরের জীবনে কখনো দেখে নি সে। কিংবা অন্য কেউও না। কে জানে, জগতের রীতিই হয়তো এই যে সব মানুষই তার বুকের ভেতর গোপনে, সযত্নে এমন একজন নিজকেই লুকিয়ে রাখে, যে তাকে সে নিজেও কখনো দেখে নি। দেখে নি তার চারপাশের আর কেউই। কেবল ওই বিশেষ একজনের জন্যই অপেক্ষায় থাকে সে। তারপর বেরিয়ে আসে আলগোছে, অগোচরে।

মঈন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কষ্ট হয় তার। নিজের সব বাঁধ ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। সবকিছু ওলট-পালট করে দিতে ইচ্ছে হয়। এমনকি অবন্তীকেও। কেন সে এমন করছে? অন্তত কারণটা তো তাকে বলতে পারে সে। নিজের সঙ্গে দুর্বোধ্য, অসম এক যুদ্ধে নিরন্তর যুঝতে হয় তাকে। তবে এই যুদ্ধে পরাজয় ছাড়া আর কোনো ফলাফল নেই। সব জেনেও বারবার ওই ব্যর্থ যুদ্ধে শামিল হয় সে। তারপর ফিরে আসে আহত এক সৈনিক হয়ে।

সেদিন অদ্ভুত এক কাজ করল সে। রিয়ার ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র এই মেয়টির সঙ্গেই অবন্তীর ভাব। এর সঙ্গেই সময় কাটায় সে। নিজের সবকিছু শেয়ার করে। একবার কি তার সঙ্গে কথা বলে দেখবে?

চেষ্টাও করেছিল মঈন। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয় নি। রিয়া তখন বসে ছিল বন্ধুদের সাথে। মঈন খানিক দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতেই তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর যতটা সম্ভব বিনয়ের সঙ্গেই বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

উষ্কখুষ্ক চুল, মুখে না কামানো দাড়ি, অবিন্যস্ত পোশাকের অতি সাধারণ ছেলেটাকে দেখে তাদের কারোরই আলাদা কিছু মনে হলো না। তারা পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মঈন বলল, আপনি যদি একটু এদিকে আসতেন?

উপস্থিত মেয়েগুলো হঠাৎ হাসির কলরোল বইয়ে দিল। তারা প্রায় সমস্বরে বলতে লাগল, কে? আমি?

মঈন বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, না না। উনি।

সবাই একযোগে রিয়ার দিকে তাকাল। তারপর টিপ্পনী কেটে বলল, হেই রিয়া, হি ইজ লুকিং ফর ইউ। তাদের কণ্ঠে দুষ্টুমি।

রিয়া তখন কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। সে একপলক তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ ঠোঁট উল্টে বলল, সরি। নো ভ্যাকিন্সি ব্রো। আই অ্যাম এনগেজড!

সঙ্গে সঙ্গেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। মুহূর্তের মধ্যে মাথায় রক্ত চেপে গেল মঈনের। কিন্তু অবন্তীর কথা ভেবে নিজেকে সামলাল সে। যদিও ঘটনাটা মাথা থেকে আর তাড়াতে পারল না। বেশ কিছুদিন লাগল নিজেকে ধাতস্থ করতে।

রিয়াকে তার দরকার। একমাত্র এই মেয়েটিই পারে অবন্তীকে বোঝাতে। কিংবা তার না-বলা কথাগুলো শুনতে। এ কারণেই যতটা সম্ভব নিজেকে বোঝাল মঈন। তারপর আবার এখানে-সেখানে রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তাকে একা প্রায় পাওয়াই যায় না। তা ছাড়া বেশির ভাগ সময়ই তার আসা-যাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানাও থাকে না।

.

এর মধ্যে একদিন হঠাত্র রিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মঈনের। মঈন ছুটে গিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

রিয়া মঈনকে চিনতে পারল না। সেদিনের কথা ভুলেই গেছে সে। মঈন বলল, একটু জরুরি। আপনি যদি আমাকে একটু সময় দিতেন?

আমার সঙ্গে? আমার সঙ্গে আপনার কী কথা?

মঈন চট করে অবন্তীর প্রসঙ্গটা বলতে চায় না। সে চায় আগে পুরো পরিস্থিতিটা রিয়াকে বোঝাতে। তার সঙ্গে একটা আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এতে যদি তার অবস্থাটা বোঝে সে। না হলে হয়তো দেখা যাবে আজই গিয়ে অবন্তীকে সব বলে দিয়েছে। পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সে তাই বিনীত স্বরে বলল, প্লিজ। একটু শুনুন। আমি অনেক দিন থেকেই আপনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। আপনার খোঁজে কত দিন যে ডিপার্টমেন্টে এসেছি, তার ইয়ত্তা নেই। আপনি চাইলে এখানকার অনেককেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। হলের সামনেও গিয়েছি!

কী! এবার রীতিমতো ফুঁসে উঠল রিয়া। ফাজলামোর আর জায়গা পান না, না? আপনি চেনেন আমাকে? জানেন আমি কে?

মঈন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, আপনি রেগে যাবেন না, প্লিজ। আমি শুধু আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। তবে তার আগে আপনার কাছে কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করা দরকার আমার। না হলে আপনি হয়তো আমাকে ভুল বুঝবেন।

আপনার সঙ্গে আমার কিসের কথা?

আছে। আমাকে কয়েকটা দিন একটু সময় দেবেন, প্লিজ। আমি সব আপনাকে বুঝিয়ে বলব। আমার বিশ্বাস আপনি বুঝবেনও।

কয়েকটা দিন! বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল রিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে এতটা বিরক্ত আর কিছু নিয়ে হয় নি সে। রাগও হচ্ছিল তার। সে তখন অপেক্ষা করছিল মাহমুদ হাসানের জন্য। ফলে মঈনের এমন অপ্রত্যাশিত আবদার, অসংলগ্ন কথাবার্তায় ভারি উত্ত্যক্ত বোধ করছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত, অচেনা এই ছেলেটির সঙ্গে তার কী কথা?

জি।

আপনি দয়া করে আর আমার সামনে আসবেন না, প্লিজ। বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেল রিয়া। মঈন একই সঙ্গে আহত ও ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। একটা প্রচণ্ড আক্রোশ জেগে উঠছে তার বুকের ভেতর। কিন্তু কেবল অবন্তীর কথা ভেবেই চুপ করে রইল সে। আবার নিজেকে বোঝাল। বেশ কিছুদিন চুপ করে রইল। অবন্তীকে ফোন করার চেষ্টা করল। কিন্তু অবন্তী তার ফোন ধরে না। নিজের সঙ্গে সেই ব্যর্থ যুদ্ধটা চলতেই থাকল মঈনের। ক্রমাগত পরাজয়ও। সেই পরাজয় সে মেনে নিতে পারে না। ফলে যতবার শপথ করে আর কখনো অবন্তীর কথা সে ভাববে না, ঠিক ততবারই উঠে দাঁড়ায়। নতুন করে ভাবনা সাজায়।

সেই ভাবনা থেকেই রিয়ার বাসার ঠিকানাও খুঁজে বের করে ফেলে সে। বেশ কিছুদিন হয় ডিপার্টমেন্টেও আর আসে না রিয়া। কিংবা এলেও অনিয়মিত। সে কি তবে একদিন সরাসরি তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হবে? ভাবনাটা মাথায় এলেও তাতে স্থির হতে পারে না মঈন। সে বরং মাঝেমধ্যেই রিয়াদের বাসার কাছে গিয়েও অপেক্ষা করে। তবে চট করে কথা বলার সাহস হয় না। সেই দুর্বিনীত, বেপরোয়া মঈন কখন এমন ভীত, এমন শঙ্কিত, দ্বিধাগ্রস্ত এক মানুষে পরিণত হয়ে গেল?

মঈন তা জানে না! তবে সে এটুকু জানে, যে করেই হোক অবন্তীর না-বলা সেই কথাটা তাকে জানতেই হবে। জানতেই হবে ঠিক কী কারণে সে আর তার সঙ্গে এই সম্পর্কটা রাখতে চায় না। আর তার এই জানার পথে একমাত্র উপায় রিয়া। ফলে সে রিয়ার পেছনে লেগে রইল। কিন্তু তখনো সে জানে না অবন্তীর জন্য তার এই চোয়ালবদ্ধ নির্দোষ সংকল্প তাকে কোথায় নিয়ে যাবে!

১৮

এইটার নাম কী? জিজ্ঞেস করল রাশু।

রাসেল ভাইপার।

ইংলিশ সাপ?

বাংলা নামও আছে।

কী নাম?

চন্দ্ৰবোড়া।

বিষ আছে?

জামশেদ হাসলেন, বিষ না থাকলে এই সাপে আমাদের কাজ কী?

অল্প বিষ, না বেশি বিষ?

পৃথিবীর অন্যতম বিষধর সাপ এটা। অনেকেই মনে করেন, বিশ্বে যত সাপ আছে, তার মধ্যে ছোবল মারার দিক থেকে এটিই সবচেয়ে দ্রুতগতির। এক সেকেন্ডের মোলো ভাগের এক ভাগ সময়ে ছোবল মারতে পারে এটা। এর বিষদাঁত পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ।

রাশু ভয়ার্ত চোখে তাকায়। জামশেদের হাতে একটা প্লাস্টিকের বড় বোতল। মুখ খোলা। সেই বোতলের ভেতর বাদামি ফুটকিওয়ালা সাপটাকে দেখলেই আতঙ্কে হিম হয়ে আসে শরীর। এত দূর থেকেও তার তীব্র হিসহিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। জামশেদ বললেন, এর মূল খাবার ইঁদুর, টিকটিকি। এটা এতটাই বিষধর যে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ছাড়াও এর বিষে শরীরের মাংস পচে গিয়ে বা রক্ত জমাট বেঁধে মানুষের মৃত্যু হয়। এমনকি অঙ্গহানিও হয়। বেশ কিছুদিন এটা বাংলাদেশে দেখা যায় নি। এখন আবার দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা নদীর আশপাশের এলাকায়।

ওইটা তো গোক্ষুর?

তফাত আছে। দেখতে প্রায় কাছাকাছি হলেও গোখরার ফণার পেছনে যে চশমার মতো চিহ্ন আছে, এটার কিন্তু তা নাই। এটাই হলো কিং কোবরা বা রাজগোখরা। এর আরেকটা সুন্দর নামও আছে।

কী?

শঙ্খচূড়। বলা হয় এটাই আকারে সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ।

ওটা?

কেউটে।

আর ওইটা?

রাশু একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। জামশেদ সময় নিয়ে উত্তর দেন। ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে। কী যেন একটা আছে ছেলেটার মধ্যে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সে সাপ ভয় পায়। মোটামুটি ধরনের ভয় না, তীব্র ভয়। সাপ দেখলেই তার হাত-পা শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা দুর্নিবার কৌতূহলও অনুভব করে। ফলে তার প্রশ্ন বাড়তেই থাকে। লাল চান যখন প্রথমে তাকে এখানে পাঠিয়েছিল, তখন ফিরে গিয়ে এই কাজে আর আসবে না বলেছিল সে। কিন্তু পরেরবারও তাকে আসতে হয়েছে। লাল চান একপ্রকার জোর করেই তাকে পাঠিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর পর থেকে আর না বলে নি সে। বরং নিজ আগ্রহেই এসেছে। এবং সেই আগ্রহ দিন দিন বেড়েছে।

জামশেদ এ কারণেই তাকে নিয়ে বসেছেন। খামারে থাকা সব সাপের বিষয়ে খুঁটিনাটি জানাচ্ছেন।

রাশু বলল, সাপের বিষের দাম কেমন?

ভালো দাম।

কত ভালো?

উমমম…। বলে কী ভাবলেন জামশেদ। তারপর বললেন, সোনার চেয়েও বেশি।

কী বলেন! রাশু চোখ গোল গোল করে তাকাল।

হুম। সাপের বিষকে বলা হয় লিকুইড গোল্ড। মানে তরল সোনা। আমাদের এই অঞ্চলেই, মানে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেই এক লিটার সাপের বিষের দাম চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা।

রাশুর চোখ আরও বড় হয়ে যায়। এসব কথা বিশ্বাস হতে চায় না তার। সে বলে, লাল চান ভাই একটু-আধটু বলছে। কিন্তু আপনে একটু খুইলা বলেন তো, এই বিষের কামডা কী? এমন তো না যে মানুষ এইটা খাইতে পারে। তাইলে এর এত দাম ক্যান?

এটা বলতে গেলে একভাবে খাওয়ার জন্যই। তবে সরাসরি না।

মানে?

মানে সবকিছুরই তো দুইটা দিক আছে। আছে না?

জি।

কী কী দিক?

ভালো আর মন্দ।

গুড। সাপের বিষের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই রকম দুইটা দিক আছে। একটা ভালো, আরেকটা মন্দ।

কী কী?

সাপের বিষ বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন, মানে ওষুধ বানাতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে সাপে কাটা রোগীর ওষুধ হিসেবে এটা কাজ করে। ইংরেজিতে বলে অ্যান্টিভেনম। এ ছাড়া আরও অনেক ওষুধ আছে।

আর খারাপ?

পৃথিবীতে মানুষ অনেক ধরনের নেশা করে না? খুব দামি নেশাও আছে। যেমন হেরোইন, মারিজুয়ানা, কোকেন এই সব। এগুলার ব্যবসাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসা। তো মানুষ এখন আর এসবেও নেশা করে আনন্দ পায় না। তাই সেই সব নেশাতে সাপের বিষ মেশানো হচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়েই সাপের বিষের অবৈধ ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে।

জামশেদ থামলেও রাশু এবার আর কথা বলল না। তার কাছে এসবই কেমন গল্পের মতো মনে হচ্ছে। গাঁজাখুরি গল্প। না হলে সাপের মতো প্রাণীরও কেউ চাষ করতে পারে! প্রথম প্রথম তার ধারণা ছিল, এই লোক বদ্ধ উন্মাদ। তার মাথায় সমস্যা আছে। না হলে এই কাজ কেউ করে! কিন্তু যতই সে তার সঙ্গে মিশছে, ততই তার কৌতূহল বাড়ছে। একধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করছে সে। সাপের বিষেরও যে এত দাম কিংবা চাহিদা থাকতে পারে, এটা সে কস্মিনকালেও ভাবে নি। তবে চারপাশের গোপনীয়তা, হাবভাব দেখে রাশু এটাও বোঝে যে ভয়ানক বিপজ্জনক একটা কাজে জড়িয়ে পড়েছে সে।

এটা তার এত দিনকার লেপ-তোশকের দোকানের নির্দোষ সেলাইয়ের বা তুলো কিংবা নারকেল ছোবড়া ছড়ানোর কাজ নয়, এটা ভয়ানক বিপজ্জনক এক কাজ। এই কাজ দেশের প্রচলিত আইনেও অপরাধ। এ কারণেই সদা সতর্ক থাকতে হয় তাদের। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই নেমে আসতে পারে ভয়ানক বিপদ। খুব বেশি মানুষ যুক্ত করারও সুযোগ নেই। এখানে বিশ্বস্ততার বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে সাহসেরও ব্যাপার।

রাশুর ধারণা, এই কারণেই তাকে এত করে চাইছেন জামশেদ। কিন্তু একটা প্রশ্ন তার মনে সারাক্ষণ খচখচ করছে। তার যে ভয়ডর একটু কম, সেটা সকলেই জানে। সে বিশ্বস্তও। কিন্তু একদম প্রথম দিন থেকেই নিজের সর্পভীতির কথা সে জামশেদ স্যারকে জানিয়েছিল। জানিয়েছিল লাল চানকেও। তারপরও তাকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে কেন এত উদ্গ্রীব হয়েছিলেন তিনি? সেই কারণটি আসলে কী?

দেরিতে হলেও এই প্রশ্নের উত্তর রাশু বের করতে পেরেছে। তার ধারণা, সাপে ভয় পেলেও ভেতরে ভেতরে যে সে বিষয়টার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল, এটা ধরে ফেলেছিলেন জামশেদ। লোকটাকে বাইরে থেকে দেখে সহজ, হাসিখুশি, সাধারণ মানুষ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে যে তিনি প্রচণ্ড বুদ্ধিমান, তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি রাশুর। তার ধারণা, হাসিখুশি এই মানুষটা ভয়ংকরও। তিনি ভাত খেতে খেতেও হাসিমুখে মানুষ খুন করে ফেলতে পারেন।

জামশেদ বললেন, শোন, এখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জি।

আমরা আমাদের একটা পরীক্ষামূলক ছোট চালান বর্ডার ক্রস করেছি।

এর মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে? রাশু অবাক গলায় বলল।

হুম। তবে খুবই ছোট চালান। তবে সাকসেসফুল। সামনে আরও একটা পরীক্ষামূলক চালান পাঠাব।

পরীক্ষামূলক মানে কী?

মানে ফাইনাল ম্যাচের আগে প্র্যাকটিস ম্যাচ।

বুঝি নাই।

জামশেদ বললেন, আরেহ! যখন একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়, তখন দেখিস না মূল ম্যাচের আগে একটা-দুইটা প্র্যাকটিস ম্যাচ হয়, মানে মেইন খেলার আগে ওইটাই হলো পরীক্ষামূলক খেলা। নিজেদের যাচাই করে নেওয়া আরকি!

বুঝছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে যেমন টেস্ট পরীক্ষা?

একদম। তুই তো দেখি আমার চেয়ে ভালো বোঝাতে পারবি। বলে হাসলেন জামশেদ।

রাশু ঘুরে ঘুরে একের পর এক সাপ দেখতে লাগল। আর এই দেখতে দেখতেই তার একটা উপলব্ধি হলো। সাপ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যাকে দেখলে সবাই ভয় পায়। অথচ তারপরও মানুষ কারণে-অকারণে সাপ নিয়ে ভীষণ কৌতূহলী। যে মানুষ সাপের ছবি দেখলেও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে, সেই মানুষই আবার আড়চোখে তাকায়। কিংবা চোখ ঢেকে রাখা হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে দেখে। অর্থাৎ ওই ভয়ের মধ্যেও কোথায় যেন একটা অব্যাখ্যেয় আকর্ষণ কাজ করে।

বিষয়টা নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছে সে। এত ভয় থাকার পরও যতবারই সে সাপ দেখেছে, ততবারই মনে হয়েছে, আরও একটু দেখতে চায়, বুঝতে চায়। এখন তো মাঝে মাঝে মনে হয়, ফণা তুলে ধরা ওই গোখরার চোখ দেখে সে যতটা ভয় পায়, ঠিক ততটাই অবদমিত আগ্রহও অনুভব করে। যেন একটা প্রবল সম্মোহন ওই চোখে। ফলে দিন যত যেতে থাকে, ততই জামশেদেরও প্রিয়ভাজন হয়ে উঠতে থাকে সে।

.

সেদিন ঢাকায় ফেরার পর জামশেদ তাকে কাছে ডাকলেন। তারপর বললেন, তোর। কে কে আছে?

কে কে থাকব? পাল্টা প্রশ্ন করল রাশু। বিষয়টা লক্ষ করেছেন জামশেদ। ছেলেটা মাঝেমধ্যেই তার মুখের ওপর এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে বসে। এই নিয়ে কোনো জড়তা বা ভয় কাজ করে না। বরং আচার-আচরণে কোথায় যেন একটা চাপা ঔদ্ধত্য কাজ করে। বিষয়টা এখন অবধি তিনি উপভোগই করেন। তবে সেটা খুব বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। কারণ, যে ভয়ানক ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন, তাতে রাশুর মতো কাউকে খুব দরকার। তবে সে জন্য ছেলেটাকে আগে ঘষেমেজে তৈরি করে নিতে হবে।

বাবা-মা? জিজ্ঞেস করলেন জামশেদ।

নাই।

নাই মানে, কোথায় তারা?

জানি না।

জানি না মানে কী, খুলে বল।

আমার মা থাকত মাদারীপুর। বাপের খবর নাই।

মাদারীপুর কী করত?

এই প্রশ্নে আচমকা উঠে দাঁড়াল রাশু। তার হাতের কবজিতে একটা স্টিলের ব্রেসলেট। সে উঠে যাওয়ার সময় সেই ব্রেসলেটে সশব্দে আঘাত করল টেবিলে। তারপর ঘুরে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। বিষয়টাতে প্রচণ্ড অবাক হলেন জামশেদ। আর যা-ই হোক, রাশুর কাছ থেকে এমন আচরণ তিনি আশা করেন নি। তাকে অন্তত এটুকু বুঝতে হবে যে সে কখন কোথায় কী আচরণ করবে!

জামশেদ অবশ্য শান্তই রইলেন। মনে মনে রেগে গেলেও বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। বরং তিনি উঠে এসে রাশুর পাশে বসলেন। বললেন, তোর সঙ্গে লাল চানের পরিচয় নাকি ফেরিতে?

জে।

তুই চা-সিগারেট বিক্রি করতি?

হুম।

কত পেতি দিনে?

যা লাভ হইত, তার তিন ভাগের এক ভাগ।

চা-সিগারেট তোর নিজের ছিল না?

না।

এখন কত পাস, লাল চানের দোকানে?

ঠিক নাই। যখন যা লাগে দেয়। আর থাকা-খাওয়া। আমার তো কোনো খরচ নাই।

কেন, তোর মায়ের কাছে টাকা পাঠাস না?

সে কই থাকে, জানি না।

তুই না বললি মাদারীপুর?

আগে থাকত। এখন আর থাকে না।

এই জন্য তার খবরও জানিস না?

রাশু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, না।

এখন মাদারীপুর থাকে না কেন?

এই প্রশ্নে আবারও উঠে যাচ্ছিল রাশু। জামশেদ আচমকা কষে চড় বসালেন তার গালে। অপ্রস্তুত রাশু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তারপর দীর্ঘ সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো, সে কানে শুনতে পাচ্ছে না। একটা শো শো শব্দ তার কান, ঘাড়, মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পুরো শরীরজুড়ে। চোখের সামনে যেন অসংখ্য তারার মেলা বসেছে! জামশেদের মতো কারও হাতে এত শক্তি থাকতে পারে, এটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি।

জামশেদ শান্ত গলায় বললেন, ওঠ। উঠে বস এইখানে।

রাশু উঠে বসার চেষ্টা করল। তার মাথা ঘোরাচ্ছে। জামশেদ তাকে হাত ধরে বসতে সাহায্য করলেন। তারপর বললেন, আমি যখন বসতে বলব, তখন বসবি। যখন উঠতে বলব, তখন উঠবি। ঠিক আছে?

রাশু কথা বলল না। দ্বিতীয় চড়টা পড়ল তার বাঁ কানের ওপর। এবারও প্রস্তুত ছিল না রাশু। তবে এবার আর ছিটকে পড়ল না সে। পড়ে যেতে যেতেও শেষ অবধি নিজেকে সামলে নিল।

জামশেদ বললেন, আমি কথা জিজ্ঞেস করলে কথার উত্তর দিবি। মনে থাকবে?

জি।

জামশেদ নিজে উঠে গিয়ে রাশুর জন্য পানি নিয়ে এলেন। তারপর তার চোখেমুখে পানির ঝাঁপটা দিলেন। কানের কাছে লাল হয়ে থাকা জায়গাটাতে বরফ ঘষে মুখটা মুছিয়ে দিলেন। রাশু অবশ্য কিছু বলল না। সে চুপচাপ বসে রইল। জামশেদ বললেন, আমার ঘরে আয়।

রাশু গেল। তার দুই কান এখনো ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথার পেছন দিকটা অবশ হয়ে আছে। জামশেদ তাকে তার টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে বসতে বললেন। তারপর বললেন, তোকে যে আমি অসম্ভব পছন্দ করি, এটা তুই বুঝিস?

জে।

তুই কি আমাকে পছন্দ করিস?

জে।

আমার দিকে তাকা।

রাশু তাকাল। জামশেদ বললেন, আমার কথা না শুনলে আমি যতটা রেগে যাই, আমার সঙ্গে কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি তার চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি রেগে যাই। বলে থামলেন তিনি। রাশু কথা বলল না। জামশেদ বললেন, আমার সঙ্গে মিথ্যা। কথা বলা যাবে না। মনে থাকবে?

জে।

তুই আমাকে পছন্দ করিস?

জে না।

তাহলে একটু আগে যে তুই মিথ্যা কথা বললি, কেন?

ভয়ে।

আমার সামান্য কথা না শোনার শাস্তি যদি ও রকম হতে পারে, তাহলে তার থেকে এক হাজার গুণ বড় অপরাধ মিথ্যা বলার শাস্তি কী হতে পারে বলে তোর মনে হয়?

মাগুর মাছভর্তি ওই পুকুরে হাত-পা বেঁধে ছেড়ে দেওয়া। রাশু জানে না কেন, কিন্তু চট করে তার মাথায় এই উত্তরটাই চলে এল। আর কিছু না ভেবেই বলে দিল সে। বিষয়টা এমন নয় যে সে আগে কখনো এমন কিছু দেখেছে বা ভেবেছে। কিন্তু জামশেদের প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, ওই মাগুর মাছের পুকুর সাধারণ কোনো পুকুর নয়। ওটা ভয়ানক কোনো জায়গা। ওই জায়গায় বিশেষ কোনো কাজ করেন জামশেদ। কিন্তু এই কথা চট করে তার মাথায় কেন এল, তা সে জানে না।

জামশেদ বিস্মিত চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাশু হঠাৎ বলল, বিশ্বাস করেন, আমি আগের কোনো কিছু জানি না। কিছু না। আচুক্কা আমার মাথায় আসল। আর বইলা ফেলছি। আল্লাহর কসম। আমি আগের কিছু জানি না।

কী জানিস না?

কিছুই না।

তাহলে এই কথা বললি কেন? আগে ওইখানে কী হইছে?

আমি জানি না, আমি সত্যিই জানি না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমারে মাফ করে দেন। বলে হঠাৎ জামশেদের পায়ের কাছে বসে পড়ল রাশু। তারপর করুণ গলায় কাঁদতে লাগল।

জামশেদ বললেন, উঠে বস।

রাশু উঠে বসল।

জামশেদ বললেন, আমাকে ভয় পাস?

জে।

এখন থেকে আর কখনো কোনো দিন এমন কিছু করবি না, যাতে আমাকে ভয় পেতে হয়। মনে থাকবে?

জে।

এরপর কিন্তু আর আমাকে ভয় পাওয়ারও সুযোগ থাকবে না। ঠান্ডা, শান্ত গলায় কথাটা বললেন জামশেদ। কিন্তু তার সেই কথা শুনে রাশুর সারা শরীর শিরশির করে উঠল। সে এত দিন পর এসে যেন বুঝতে পারল, এ সহজ কোনো জায়গা নয়। এখানে তাকে চলতে হবে ধারালো সূক্ষ্ম কোনো সুতোর ওপর পা রেখে। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই সেই প্রায় অদৃশ্য সুতোখানায় কেটে ফালি ফালি হয়ে যাবে সে। তার সামনে বসা এই অতি সাধারণ চেহারার মানুষটাকে সে যতটা ভয়ংকর বলে ভেবেছিল, এ তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর, নৃশংস। এর সঙ্গে থাকা মানে প্রতিমুহূর্তে জীবনকে মৃত্যুর হাতে বন্ধক রেখে বাঁচা। কিন্তু সে এ-ও জানে, যে ভয়ানক কানাগলিতে সে ঢুকে পড়েছে, সেই কানাগলি থেকে তার মুক্তি নেই।

১৯

অনিক স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ঘরে এয়ারকন্ডিশনও চলছে। অথচ ঘামছে সে। ডাক্তার বললেন, অনেকের ক্ষেত্রেই তো মিরাকল ঘটে। ও রকম রেকর্ডও আছে কিন্তু…।

কিন্তু আমার মায়ের ক্ষেত্রে সেটা ঘটারও কোনো চান্স নেই, তাই তো?

আসলে বিষয়টা এত সূক্ষ্ম যে সহসা ধরা যায় না। আমরাও তো এত দিন পর ধরতে পারলাম।

অনিক উঠে দাঁড়াল। বলল, আর কত দিন বাঁচবেন মা?

ওভাবে নির্দিষ্ট করে তো আর বলা যায় না। তারপরও ধরুন ছয় মাসও হতে পারে, আবার ছয় দিনও হতে পারে।

ছয় দিন!

মানে আমি কথার কথা বললাম। আবার ভাগ্য ভালো হলে এক বছরও। এই অবস্থায়ও একবার এক রোগী অবিশ্বাস্যভাবে…।

অনিক রুম থেকে বেরিয়ে এল। ডাক্তারের কথা শুনতে আর ভালো লাগছে না তার। সে সারাটা দিন বাইরে বাইরে ঘুরল। বাসায় ফিরল রাতে। রাহিমা বানু তার জন্য ভাত রান্না করে বসে ছিলেন। লালশাক দিয়ে শোল মাছ। অনিকের পছন্দের খাবার। তিনি খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন, মেয়েটা আর এল না?

অনিক যেন চট করে বুঝতে পারল না। বলল, কোন মেয়েটা?

হৃদি।

ওহ্।

ওহ্ কী?

আসবে।

কবে? কত দিন হলো দেখি না।

ওর বাবা মারা গেছেন, জানোই তো!

এই কথায় রাহিমা বানু চুপ করে গেলেন। হৃদির বাবা মারা যাওয়ার খবর তিনি শুনেছেন। কিন্তু তখন তার কিছুই করার ছিল না। এখনো যে আছে, তা-ও নয়। তারপরও মেয়েটার জন্য সারাক্ষণই ছটফট লাগে। বুক তড়পায়। এই দুঃসময়ে যদি সামান্য হলেও তাকে সাহস দিতে পারতেন, ভরসা জোগাতে পারতেন! তিনি বিষণ্ণ গলায় বললেন, এই কষ্ট মেয়েটা কী করে সহ্য করছে কে জানে! এত নরম মেয়েটা…তোর একবার যাওয়া উচিত ছিল না?

হুম।

তাহলে গেলি না কেন?

যাব।

আর কবে যাবি?

দেখি।

দেখি কী, এত দিন কী করেছিস?

অনিক জবাব দিল না। তার এখন মায়ের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তার সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটা, তার মা, এই আশ্চর্য মায়ার আধার মানুষটা দুদিন বাদে আর থাকবে না! এই পৃথিবীতে আর কখনো তাকে দেখতে পাবে না সে। কথা বলতে পারবে না। জড়িয়ে ধরতে পারবে না। গায়ের ঘ্রাণ নিতে পারবে না। তার আঁচলে যে শিশুর গালের মতন নরম মায়া লেগে থাকে, সেই মায়া আর কখনো, কোনো দিন ছুঁয়ে দেখতে পারবে না সে।

কী, কথা বলছিস না কেন?

এ কদিন এত ঝামেলা গেল! তুমি তো দেখলেই…তোমাকে নিয়ে দিনরাত ডাক্তার, হাসপাতাল। এখানে-ওখানে ছোটাছুটি…।

তাও ঠিক। আহত স্বরে বললেন রাহিমা বানু। আমার কী মনে হয়, জানিস?

কী?

আমারও একটু ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। আমার জন্য কত কী করল মেয়েটা! ও-ও হয়তো মনে মনে আশা করছিল যে আমি যাব।

হুম।

নিয়ে যাবি আমাকে একদিন?

আচ্ছা।

কবে?

মা! অনিক যেন এবার একটু বিরক্তই হলো। ওদের বাড়িতে এখন তুমি কী হিসেবে যাবে?

তাও তো কথা। বিড়বিড় করে বললেন রাহিমা বানু। তোদের মধ্যে তো এখনো কিছু হয় নি।

অনিক চুপচাপ ভাত খেয়ে উঠে গেল। রাহিমা বানু থালাবাসন ধুতে গেলেন। অনিক অবশ্য তাকে ধুতে দিল না। সে নিজেই সব করল। রাহিমা বানু বললেন, কী হয়েছে তোর?

কী হবে?

কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছিস। কথা বলছিস না। আবার আমাকে রান্নাঘরের কাজও করতে দিলি না।

এমনি। তুমি এখন কী করবে?

শোব।

আচ্ছা। বলে ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়াল অনিক। তারপর হঠাৎ বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাই, মা?

অনিকের কথা শুনে রাহিমা বানু যারপরনাই অবাক হলেন। কত দিন অনিক তার সঙ্গে ঘুমায় না? কত বছর? সেই ছোট্ট অনিক। বুকের কাছ থেকে সামান্য সরে গেলেই গুঙিয়ে উঠত, মা, মা…।

অথচ সেই ছেলেটা, কখন কোন অগোচরে যে এত বড় হয়ে গেল, তা তিনি টেরই পান নি। তারপর ক্রমশই চলে গেল দূরে। আরও দূরে। তিনি বললেন, তুই আমার সঙ্গে ঘুমাবি?

আচ্ছা, না থাক। বলে চুপচাপ ড্রয়িংরুমের মেঝেতে গিয়ে বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল অনিক। মা এলেন আরও খানিক পর। বললেন, কী হয়েছে তোর?

কিছু হয় নি, মা।

কিছু একটা তো হয়েছেই। বল আমাকে?

অনিক পাশ ফিরে শুল। রাহিমা বানু তার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন, তুই ছোটবেলা থেকেই এমন।

কেমন?

নিজের মনের কথা সহজে কাউকে বলতে চাস না।

হুম।

একবার কী হয়েছে, তুই তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়িস। তোর স্কুলের অঙ্ক স্যার এসে বললেন, ভাবি, আপনার ছেলেকে কি স্কুলে খালি টিফিন বক্স দেন? কোনো খাবার দেন না? সবাই যখন লেইজারে বাড়ি থেকে আনা টিফিন বক্স খুলে খাবার খায়, তখন দেখি ও একা একা বসে থাকে। তার টিফিন বক্সও ফাঁকা। আবার জিজ্ঞেস করলেও কোনো জবাব দেয় না।

বলে থামলেন রাহিমা বানু। তিনি ছেলের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। রাহিমা বানু বললেন, স্যারের কথা শুনে তো আমি অবাক। তুই রোজ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যাস। তাহলে? সেই খাবার যায় কোথায়?

অনিক মায়ের কাছে এই ঘটনা কমপক্ষে হাজারবার শুনেছে। অন্য সময় হলে বিরক্ত হতো। কিন্তু আজ আর কিছু বলল না। চুপচাপ শুনতে লাগল। কে জানে আর কদিন সে মায়ের কথা শুনতে পাবে!

রাহিমা বানু বললেন, পরে খোঁজ নিয়ে দেখি তোর স্কুলের বারান্দায় এক পাগলি থাকত। সেই পাগলির এক বাচ্চা ছিল। তুই রোজ স্কুলে গিয়ে প্রথমেই সেই বাচ্চাকে তোর খাবার খাইয়ে দিতি। কিন্তু বাড়িতে কখনো কিছু বলতি না। এমনকি স্কুলেও না। বললে যদি স্যাররা পাগলিটাকে স্কুলের বারান্দা থেকে তাড়িয়ে দেয়! আর থাকতে না দেয় সেখানে! তখন ওইটুকু এক বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবে সে! এই কারণে দিনের পর দিন নিজে না খেয়ে থাকলি। কিন্তু কাউকে কিছু বললি না।

ঘুমাতে যাও, মা। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।

আর শরীর খারাপ! হতাশ গলায় বললেন রাহিমা বানু। রাতভর কাশতে কাশতে শেষ। ঘুমাব কী করে! আমার সঙ্গে ঘুমালে তোর একফোঁটাও ঘুম হবে না। আমি নিজেও পারি না।

অনিক কথা বলল না। তার হঠাৎ মনে হলো, আর কিছুদিন পরই ঘুমাতে পারবেন। নিরবচ্ছিন্ন গভীর ঘুম। সেই ঘুম শান্তির কি না সে জানে না, তবে ওই ঘুম থেকে পৃথিবীর আর কোনো অসুখই তাকে জাগাতে পারবে না।

.

মা তার ঘরে যেতেই হৃদিকে ফোন করল অনিক। এখনো কিছুই জানানো হয় নি তাকে। হৃদি অবশ্য ফোন ধরল না। গতকালও ধরে নি। অনিক ভেবেছিল পরে হয়তো ব্যাক করবে সে। তা-ও করে নি। বাবার মৃত্যু নিয়ে ভয়ানক ভেঙে পড়েছে সে। মায়ের চেয়ে বাবার প্রতিই যেন একটু বেশি টান ছিল তার। অসুস্থ মানুষটার জন্য সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকত। বাইরে সন্ধ্যা হলেই বলত, বাবা না খুব মন খারাপ করে আমি রাত করে বাড়ি ফিরলে। কেন জানো?

কেন?

বাবা রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলে। সন্ধ্যার পরপরই। আমি তাকে রোজ ওই খাবারটা খাইয়ে দিই। বাবা তো নিজ হাতে খেতে পারে না। জানো তো, তার ডান হাতটা পুরোপুরি মুখ পর্যন্ত তুলতেও পারে না?

এই কথা অনিক কতবার যে শুনেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই বাবার মৃত্যুতে হৃদি মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত হয়ে আছে, অনিক তা বুঝতে পারে। সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারে, হৃদি তার ওপর ভীষণ মন খারাপ করে আছে। রাগ কিংবা অভিমানও। এমন একটা সময়ে পাশে থাকা তো দূরের কথা, সেভাবে খবর পর্যন্ত নিতে পারে নি সে! এরপর যে কবার ফোনে কথা হয়েছে, তাতে ভীষণ নিরুত্তাপ আর নির্বিকার মনে হয়েছে তাকে।

অনিক অবশ্য খুব একটা ঘটায়ও নি। কারণ, সে জানে, এখন কোনো কিছুতেই হৃদির এই অভিমানের বরফ গলবে না। এর জন্য সময় দিতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সঠিক সময়ের।

সেদিন সন্ধ্যায় ধলেশ্বরীর পাড় থেকে ঝড়বৃষ্টিতে ভিজেই বাসায় ফিরেছিল অনিক। তার ফোনটা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও সেটিকে আর ঠিক করা যায় নি। এমনকি পরদিনও না। বরং পরদিন বিকেল থেকেই রাহিমা বানু আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার নাক-মুখ দিয়ে ক্রমাগত রক্ত বের হতে লাগল। সঙ্গে ভয়ানক খিচুনি। ভোরের দিকে অচেতন হয়ে গেলেন তিনি।

দিশেহারা অনিক তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। এবার ভর্তি করানো হলো ধানমন্ডির এক ক্লিনিকে। সেখানে এটা-সেটা নানান টেস্ট। দিনের পর দিন দিগভ্রান্ত মানুষের মতো ছোটাছুটি করতে লাগল সে। অনিক তত দিনে বুঝে গিয়েছিল মায়ের খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু সেই খারাপটা আসলে কতটুকু খারাপ, তা সে বুঝতে পারছিল না। এর অবশ্য কারণও আছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে ডাক্তাররাও কিছু বলতে চাইছিলেন না। ফলে একটা ভয়ানক দমবন্ধ অবস্থায় দিন কাটতে লাগল তার।

এর মধ্যে হৃদির সঙ্গে যে দুয়েকবার কথা হয়েছে, তাতে ভীষণ বিচলিত বোধ করেছে অনিক। সে জানে, এই সময়ে খুব যত্নবান, দায়িত্বশীল কাউকে দরকার হৃদির। যে তাকে শক্ত করে আগলে রাখতে পারবে। সাহস ও শক্তি জোগাতে পারবে। কিন্তু হৃদি যেন অনিককে সেই সুযোগটুকুই আর দিল না। সে ফোন ধরে না। কথা বলে না। আর যেটুকুও বা বলে, তাতে সারাক্ষণ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। বিষাদগ্রস্তও।

অনিক খানিক চেষ্টা অবশ্য করেছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। যে অতলান্ত বিষাদসমুদ্রে হৃদি ডুবে আছে, তা থেকে তাকে উত্তোলনের সাধ্য অন্তত এই মুহূর্তে তার নেই। কারণ, সে নিজেও ডুবে যাচ্ছে সীমাহীন যন্ত্রণার অন্ধকার অতল গহ্বরে।

কিন্তু এখন কী করবে সে?

রাত যত গম্ভীর হতে থাকে, তত যেন অনিকের বুকে চেপে বসতে থাকতে জগদ্দল এক পাথর। ওই পাথরের ওজন বইবার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু তাকে ফেলেও দিতে পারে না সে। ফলে ওই একা অন্ধকারে লীন হয়ে যেতে থাকে সে। কাঁদতে থাকে নিঃশব্দে।

জগতে কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের দুঃখগুলো একার, অপ্রাপ্তিগুলো অন্ধকারের আর কান্নাগুলো নৈঃশব্দ্যের। এই কান্না কেউ শুনতে পায় না। ওই দুঃখ কিংবা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা কেউ দেখতে পায় না। কেবল এই একাকী অন্ধকার রাত্রিগুলো সেই সব বেদনার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। আজ যেমন থাকল।

অনিক বিছানা থেকে উঠল প্রায় শেষরাতে। তারপর অন্ধকারে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে রইল। এই সময়ে খানিক তন্দ্রাচ্ছন্ন হন রাহিমা বানু। আজও হয়েছেন। ফলে অনিকের উপস্থিতি টের পেলেন না তিনি। অনিক মায়ের পায়ের কাছে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলতে লাগল, মা, মা গো। ও মা। মা গো।

ওটুকুই। এর বেশি কিছু আর বলতে পারল না সে। অসংখ্য মানুষের ভিড়েও যে একাকিত্বের জীবন সে কাটায়, তাতে তার দুঃখ বোঝার মানুষ কই? ওই তো এক হৃদি। কিন্তু সে-ও যে ঝড়ে বিধ্বস্ত ডানাভাঙা পাখি। তার কাছে কী করে আশ্রয় চাইবে সে? বরং তার নিজেরই তো এ সময়ে বিশাল বৃক্ষ হয়ে তাকে ছায়া দেওয়ার কথা!

অনিক তারপরও অপেক্ষায় থাকে। হৃদি হয়তো কখনো তার ফোন ধরবে। কিংবা ফোন করবে নিজ থেকেই। তারপর তারা পরস্পর তাদের দুঃখের পেয়ালাগুলো উপুড় করে দিয়ে শূন্য হয়ে যাবে। আর সেই শূন্যতা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে প্রগাঢ় ভালোবাসায়, মমতায়। সেই মমতা কি এই সব ক্ষত সারিয়ে দিতে পারবে?

অনিক জানে না। তবে হৃদি তার ফোন ধরে না। কিংবা বেশির ভাগ সময় তার ফোন বন্ধই থাকে। অনিক তারপরও অপেক্ষায় থাকে। এই বুঝি খানিক সহজ হয়ে ওঠে সে। খানিক অভিমান ভুলে কাছে চলে আসে। তার পরেরটুকু অনিক জানে। হৃদিকে তো সে চেনে। যতটা সহজে দূরে চলে যায়, তারও বেশি সহজে কাছে চলে আসতে জানে সে।

হয়তো একটু সময় তার লাগছে। হয়তো আর কটা দিন। তারপর হুট করেই একদিন ফোন করে বলবে, তুমি এমন কেন, অনিক, এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন?

কী করেছি আমি?

তুমি যে কী করেছ, সেটা বোঝার ক্ষমতাও তোমার নেই। ভাবছি, আর কখনোই। তোমার সঙ্গে কথা বলব না।

তাহলে এখন যে ফোন করলে?

এখন তো করলাম সেটা জানানোর জন্য। তোমার সঙ্গে যে আর কখনোই কথা বলব না, সেটা তোমাকে না জানালে তুমি বুঝবে কী করে! এই জন্য ফোন করলাম। এখুনি রেখে দেব।

হৃদি অবশ্য সেই ফোন আর রাখবে না। কথা বলতেই থাকবে। সেই কথায় রাগ, কান্না, অভিযোগ, অভিমান। কিন্তু দিন শেষে তারা আবার আর জনমের হংস মিথুন হয়ে উঠবে। তখন কী করবে অনিক? সে কি তখন মায়ের কথা বলবে? শুনে নিশ্চয়ই দিশেহারা হয়ে যাবে হৃদি! অনিকের প্রতি তার সকল রাগ, অভিমান মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। সে তখন বুঝতে পারবে কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অনিকও। তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসবে মাকে দেখতে। মা তখন কী করবে?

অনিক রাত জেগে জেগে এই সব কত কী ভাবে! আর হৃদিকে ফোন করে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। মাঝখানে তিথি একদিন তাকে ফোন করেছিল। কিন্তু অনিকের তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি। তা ছাড়া স্বদিবিষয়ক কিছু তিথিকে বলতেও চায় না। সে। বিষয়টা হৃদি পছন্দও করবে না।

আচ্ছা, বন্ধ ফোনের ওপারের মানুষটা কেমন আছে? সে-ও কি তার কথা ভাবে? তারও কি জানতে ইচ্ছে হয়, এই মানুষটা কেমন আছে? অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লুকানো গোপন দীর্ঘশ্বাস। অনিক পৃথিবীর সেই সব দুঃখী মানুষের একজন, যার গোপন দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাস কখনোই কেউ দেখে না। জানে না। তারা কেবল জানে বাতাসে যেন কিসের হাহাকার ভেসে বাড়ায়!

হৃদিদের বাড়ি যাওয়ার কথাও দুয়েকবার ভেবেছে অনিক। কিন্তু অনেক কিছু ভেবেই আর যাওয়া হয় নি। তা ছাড়া রাহিমা বানুর শরীরটাও দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকে সে। মানুষটা রোজ চোখের সামনে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না সে।

.

অনিক অবশ্য বাড়ি চলে যাওয়ার কথাও ভাবে। অন্তত শেষ কটা দিন মা গ্রামেই থাকুক। আয়েশার সঙ্গেও কত দিন দেখা নেই তার। মাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে সে। মা-ও আর থাকতে পারছেন না। আয়েশার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গেলেই শুধু কাঁদেন। তবে বাড়ি যাওয়ার আগে হৃদির সঙ্গে একবারের জন্য হলেও দেখা করে যেতে চান তিনি। সেদিন কথাটা বললেনও।

তুই আমাকে সত্যি করে বল তো, মেয়েটার কী হয়েছে?

কার, হৃদির?

হুম।

কী হবে?

এত দিন হয়ে গেল, অথচ আর একবারও এল না?

আসবে। সবকিছু একটু নরমাল হলেই আসবে, মা।

তুই সত্যি করে বল তো, তোর সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয় নি তো?

কী ঝামেলা হবে?

কত কিছুই তো থাকে। শোন।

বলো।

আমি বাড়ি যাব। আর এক দিনও এইখানে থাকব না। আমার বুক শুকিয়ে আসছে। পরান ছটফট করছে। তার আগে তুই এক কাজ কর।

কী কাজ?

তোর সঙ্গে যতই ঝামেলা হোক, তুই হৃদিকে ফোন কর। ফোন করে বলবি মা দেখা করতে চেয়েছে। তোমাকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছে। তার সঙ্গে দেখা করেই আমি বাড়ি যাব। বলে সামান্য থামলেন রাহিমা বানু। বললেন, তারপরও না। আসতে চাইলে একটু মিথ্যাও বলবি।

কী মিথ্যা?

বলবি যে মার শরীর খুব খারাপ। খুবই খারাপ। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে। প্রয়োজনে এইটুকু মিথ্যা বলা যায়। এইটুক মিথ্যাতে কোনো ক্ষতি নাই।

অনিক মায়ের কথা শুনে চুপ করে রইল। মা জানে না যে এটা মিথ্যা নয়, বরং এর চেয়ে নৃশংস কোনো সত্য আর এই মুহূর্তে নেই।

.

হৃদি অবশ্য এল না। তবে সেদিন হঠাৎ ফোন করল সে। অনিক মুহূর্তের উত্তেজনায় কী করবে বুঝতে পারছিল না। তার এই বিভীষিকাময় জীবনে এমন আনন্দের ঘটনা যেন। বহুদিন ঘটে নি। সে ফোন ধরল। হৃদি চুপ করে রইল। অনিক বলল, কেমন আছ?

ভালো।

মন খারাপ?

হৃদি জবাব দিল না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অনিক এরপর আর বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। অথচ এ কদিনে কত কথা বলবে বলে সে ভেবে রেখেছিল!

তোমার শরীর ভালো? শেষ পর্যন্ত বলল অনিক।

হুঁ।

বাসার সবাই কেমন আছে?

আছে। ভালোই।

তোমাকে এ কদিনে যে কতবার ফোন করেছি!

আমি হয়তো ফোনের কাছে ছিলাম না।

বন্ধও ছিল।

কী জানি! খেয়াল নেই।

হৃদির উত্তরগুলো কেমন প্রাণহীন, দায়সারা গোছের। বিষয়টা বুঝতে পারছে অনিক। কিন্তু ঠিক কী কারণে সে এমন করে কথা বলছে, তা বুঝতে পারছে না। আসলেই কি তার ওপর অভিমানের কারণে এভাবে কথা বলছে সে, নাকি এখনো বাবার জন্য মন খারাপ? বিষয়টা নিশ্চিত হতে পারল না অনিক। কথাটা বলল সে, তোমার কি এখনো আমার ওপর মন খারাপ?

হৃদি উত্তর দিল না। তবে তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল অনিক। কী ভেবে মায়ের কথাটা তুলল সে। বলল, মা তোমার কথা খুব বলছিলেন।

আচ্ছা। বলে খানিক চুপ করে রইল হৃদি। তারপর বলল, কেমন আছেন উনি?

এই তো। আসলে…। অনিক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হৃদি তার আগেই বলল, তুমি কি একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?

কেন পারব না? উচ্ছ্বসিত গলায় বলল অনিক। অবশ্যই পারব। কবে আসবে বলো?

বাসায় না। বাইরে কোথাও।

কেন, বাসায় আসো।

আসব। পরে। আসলে তোমার সঙ্গে দেখা করাটা খুব দরকার। বলে সামান্য থামল হৃদি। তারপর বলল, আমার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না, অনিক। মনে হচ্ছে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার মাথা কাজ করছে না। আমি গুছিয়ে কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। আমার নিজের ওপরও কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। যতই চেষ্টা করছি, কাজ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি একটা স্রোতের মতো ভেসে চলছি। অনেক চেষ্টা করেও সেই স্রোতটাকে থামাতে পারছি না। বরং আমার ভেতরে-বাইরে, আশপাশের সবকিছু ভেঙেচুরে সেই স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে।

আজ এই প্রথম একসঙ্গে এতগুলো কথা বলল হৃদি। কিন্তু তার সেই কথাজুড়ে বিষাদ, অসহায়ত্ব, দ্বিধা। অনিক গাঢ় গলায় বলল, তোমার কী হয়েছে, হৃদি?

আমি জানি না, আমি…। কথা শেষ করতে পারল না হৃদি। তার আগেই অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। অনিক উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে? আমাকে বলল, প্লিজ?

আমি জানি না।

হৃদি! অনিক ডাকল। বলো আমাকে?

হৃদি কথা বলল না। কাঁদতেই থাকল। দীর্ঘ সময়। তারপর যেন নিজেকে সামলে নিল। বলল, তুমি আমার সঙ্গে একদিন দেখা করো। সেদিন সব বলব।

কিন্তু কী হয়েছে আগে বলো। তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? বাবার জন্য মন খারাপ হচ্ছে? অনিকের গলায় উৎকণ্ঠা।

যেদিন দেখা হবে, সেদিনই বলি? আমার অনেক কথা বলার আছে, অনিক। অনেক কথা।

অনেক কথা?

হুম।

বলে চুপ করে রইল হৃদি। অনিকও। বেশ খানিকটা সময়। তারপর অনিক হঠাৎ বলল, আমি মাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি, হৃদি।

কবে?

তুমি যেদিন মার সঙ্গে দেখা করবে, সেদিন বা তার পরদিনই। বলে থামল অনিক। তারপর বলল, তোমার অপেক্ষায়ই এত দিন যাওয়া হয় নি। মা তোমাকে একবার না দেখে যেতে চাইছিলেন না।

ওহ্। বলে চুপ করে রইল হৃদি। তারপর বলল, কেন? চিকিৎসা শেষ? সুস্থ হয়ে গেছেন উনি?

অনিক এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোমাকেও আমার অনেক কিছু বলার আছে, হৃদি। অনেক কিছু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *