০১. অপরিচিত নম্বর

প্রিয়তম অসুখ সে – সাদাত হোসাইন
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০২২

উৎসর্গ

মোঃ হেদায়েত উল্লাহ বেপারী
আমার বাবা। আকাশ ছুঁতে চাওয়া মাটির মানুষ।

আমার বাবা তখন দেখতে ছিলেন অনেকটা হলিউড অভিনেতা রাসেল ক্রোর মতো। চওড়া কাঁধ, বিশাল বুকের ছাতি, ধবধবে ফর্সা মানুষটা যখন স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাঁটতেন তার মাসল দেখে আমার বন্ধুরা বলত, আল্লাহ, কত্ত মোটা! আমরা তখন সিক্স-সেভেনে পড়া টিনটিনে বালক। মাঠে গিয়ে একদিন আমার এক বন্ধু তার লুঙ্গি ঊরু অবধি তুলে বলল, দ্যাখ, দ্যাখ, আমগো রান আর তোর আব্বার হাতের ড্যানা সমান!

পিতৃগর্বে আমার ছোট্ট বুকের ছাতি তখন ফুলে উঠেছিল।

আব্বা তখন ঢাকায় থাকেন। ছোট্ট চাকুরি করেন। সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার। তিনি প্রতিমাসে একবার বিষ্যুদবার সন্ধ্যায় সদরঘাটে এসে লঞ্চে ওঠেন। সারা রাত লঞ্চযাত্রায় শুক্রবার কাকভোরে বাড়িতে। পরের দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে বিকেলের লঞ্চে আবার ঢাকায়।

সেবার আব্বা ভোরবেলা ঘরের দরজায় এসে আম্মা-কে ডাকলেন। তারপর হাতের ব্যাগ রাখতে রাখতে বললেন, বাবু এখনো ঘুম থেকে ওঠে নাই?

মা বললেন, ও তো বাড়ি নাই, ওর নানুবাড়ি গেছে।

আব্বা কোনো কথা বললেন না, তিনি গম্ভীর মুখে বাড়ি থেকে বেরুলেন। আম্মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন, ঘটনা কী!

নানুবাড়ি মাইল ছয়েকের পায়ে হাঁটা দূরত্বে। যানবাহন নেই। আব্বা সেই কুয়াশা ভোরে ছমাইল পথ পায়ে হেঁটে নানুবাড়ি পৌঁছালেন। আমি তখনো ঘুমাচ্ছি। ঘুমের ভেতরই আব্বা আমাকে বিছানা থেকে টেনে কাঁধে তুলে নিলেন। তারপর আবার ছমাইল পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন।

আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি, শুয়ে আছি বাড়িতে। আর আমার পাশে শুয়ে আছেন আব্বা!

সেবার প্রচণ্ড গরম পড়েছে।

আব্বার সাথে ঝগড়া করে নানুবাড়ি চলে গেছেন আম্মা। আব্বা অবশ্য এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য কিছু করেন নি। সারা দিন নানান কাজ-টাজ সেরে সন্ধ্যার আগে আগে আমাকে বললেন, চল ব্যাটা, তোর মারে গিয়া নিয়া আসি।

আমি তখন ছ-সাত বছরের দুষ্টু বালক। আব্বা আগে আগে হাঁটছিলেন, আমি পিছে পিছে। বাড়ি থেকে কিছু দূর যেতেই রাস্তায় পড়ে থাকা টুকরো কাঠে চোখ আটকে গেল আমার। কাঠের বুক ভেদ করে জং ধরা পেরেকের অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। আমার মাথায় হঠাৎ কী দুষ্ট বুদ্ধি চেপে গেল। পায়ের গোড়ালি দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম কাঠে। ঘ্যাঁচ শব্দে অর্ধেকটা পেরেকের প্রায় পুরোটাই আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেল ভেদ করে ঢুকে গেল পায়ে।

আমি আকাশ কাঁপানো চিৎকারে পা চেপে ধরে বসে পড়লাম।

আব্বা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। নানুবাড়ির বদলে আবার ফিরে এলেন বাড়িতে। আশপাশে কোনো ডাক্তার নেই। দাদি নানা গ্রাম্য চিকিৎসা শুরু করলেন।

রাতের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগল আমার কান্নাও, আম্মার কাছে যাব।

কিন্তু অত রাতে তো তা সম্ভব না। আব্বা আমাকে কোলে তুলে উঠান ঘিরে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি যখন হাঁটেন, তখন তাঁর হাঁটার ছন্দে পায়ের ব্যথা খানিক কম টের পাই। কিন্তু হাঁটা থামালেই যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। আব্বা থামলেই তাই আমি গুঙিয়ে উঠি।

সেই সন্ধ্যা থেকে ফজরের আজান অবধি সারাটা রাত আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটলেন। হাঁটলেন ভোরের আলো ফোঁটার অপেক্ষায়।

আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি।

জলবসন্ত উঠেছে। শরীরজুড়ে বড় বড় টসটসে বসন্ত। অসহ্য ব্যথা, অস্বস্তিকর অনুভূতি। সম্ভবত কোনো এক ঈদের আগের দিন। আব্বা ঢাকা থেকে এলেন দুপুরবেলা। আমি শুয়ে আছি উঠানে ডালিম গাছের নিচে। আব্বা বাড়ি ঢুকেই দেখলেন আমাকে। তারপর খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, এত অল্পতে ব্যাটা মাইনষের কিছু হয়? হয় না। এইটুকুতে এইরকম কাতর হইলে চলে না, ব্যাটা মাইনষের কাছে এইটা কোনো অসুখ হইলো?

আব্বা আর আমার পাশে দাঁড়ালেন না। আম্মাকে ডেকে চিৎকার করে বললেন, কই, ভাত দাও, খিদা পাইছে।

আমার চোখ ফেটে কান্না চলে এল, আব্বা এমন করলেন!

মেঝেতে পাটি পেতে ভাত খেতে বসেছি আমি, ছোটভাই, আব্বা আর আম্মা। আব্বার দুধ কলা-ভাত খুব পছন্দ। আমি আড়চোখে আব্বার দিকে তাকালাম। আব্বার প্লেটভর্তি দুধ। কিন্তু তিনি প্লেটে হাত দিচ্ছেন না। বসে আছেন। হঠাৎ দেখি প্লেটভর্তি দুধের ভেতর টুপটাপ টুপটাপ কিছু একটা ঝরে পড়ছে।

কী পড়ছে? আমি আব্বার দিকে ভালো করে তাকালাম। তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন।

আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। হঠাৎ স্ট্রোক করে অনেকটাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন আব্বা। তার ডান পাশটা নড়াতে পারেন না। রাসেল ক্রোর মতন দেখতে সেই মানুষটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেলেন। যেন বুড়ো হয়ে গেলেন হঠাৎ।

সারা দিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। চুপচাপ। নিঃশব্দ। কারও কাছে কোনো চাওয়া নেই, অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। বাইরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। আদিগন্ত নীল আকাশ। তিনি নির্বাক তাকিয়ে থাকেন।

আমার খুব ইচ্ছে হয়, মানুষটাকে কাঁধে নিয়ে ছুটি। আমাকে নিয়ে যেমন ছুটেছেন মাইলের পর মাইল, ঠিক তেমনি।

তারপর উড়ে যাই আদিগন্ত দিগন্তে।

ভূমিকা

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, আমি গল্পের প্লট কীভাবে নির্ধারণ করি? পুরোটাই ইমাজিনেশন, নাকি বাস্তবতাও আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি একটু দ্বিধায় পড়ে যাই, আসলেই তো, গল্পে কী থাকে শুধুই কল্পনা? নাকি বাস্তবতাও?

ভেবে দেখলাম, দুটোই থাকে। চারপাশে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার নির্যাস যেমন থাকে, তেমনি থাকে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখকের অসীম কল্পনার যৌক্তিক জগতও। অর্থাৎ বাস্তব কোনো ঘটনা যদি গল্পের শেকড় হয়, তবে তার বৃক্ষ কিংবা ডালপালা হয়ে ওঠে লেখকের ইমাজিনেশন।

কল্পনা ও বাস্তবতার এই দারুণ খেলা সম্ভবত লেখকমাত্রই উপভোগ করেন। আমিও। বিশেষ করে এই উপন্যাসে সেটি দারুণভাবেই করেছি।

প্রিয়তম অসুখ সে-উপন্যাসটির গল্পভাবনা আমার মাথায় প্রথম আসে মূলত দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া দুটি সংবাদ দেখে। প্রতিদিনই আমাদের দেশে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে। তাতে আনন্দ যেমন থাকে, থাকে বেদনাও। তবে পত্রিকা-টেলিভিশনগুলো সাধারণত চমকপ্রদ খবর ছাপাতেই বেশি আগ্রহী থাকে। এই উপন্যাসের প্লটও তেমনই চমকপ্রদ কিছু খবর থেকে উৎসারিত। বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে। লেখকের কল্পনাপ্রবণতাও। আমার ধারণা, পাঠক সেই বাস্তব ও কল্পনার জগতে ঢুকে যেতে যেতে চমকে যাবেন, আপুত ও আহত হবেন। আবার প্রবল ভালোবাসা ও মমতায় আচ্ছন্ন হবেন।

প্রিয় পাঠক, ভালোবাসা, ঘৃণা, রহস্য ও রোমাঞ্চের এই বহুমুখী জগতে আপনাকে আমন্ত্রণ।

সাদাত হোসাইন
আগারগাঁও
০৯. ০২. ২০২২

ফোনটা এল ঠিক বেলা দুটোয়। অপরিচিত নম্বর। অনিক প্রথমে ভেবেছিল ধরবে না। কিন্তু কী ভেবে শেষ পর্যন্ত ধরল সে। ওপার থেকে খসখসে পুরুষ কণ্ঠটা বলল, তুমি অনিক?

জি।

আমি তোমার আব্বার রুমমেট, ছাত্তার চাচা। মেসে একই সাথে থাকি। তোমার সাথে দেখাও হইছে।

জি চাচা। কেমন আছেন?

এই তো…আছি কোনোরকম। ওপারের কণ্ঠটা থমথমে।

অনিক উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোনো সমস্যা, চাচা?

একটু…। বলে সামান্য থমকাল লোকটা। তারপর বলল, তোমার আব্বা অসুস্থ।

আব্বা অসুস্থ! কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল অনিক। তার বাবা শাখাওয়াত হোসেন পেশায় গাড়িচালক। থাকেন মিরপুরের এক মেসে। গত রাতেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। অথচ এইটুকু সময়ের ব্যবধানেই তিনি কী এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাকে অন্য কাউকে দিয়ে ফোন করাতে হলো?

কী হয়েছে আব্বার?

অ্যাকসিডেন। গাড়ি অ্যাকসিডেন করছে।

অনিক একঝটকায় উঠে দাঁড়াল। হলের ডাইনিংয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় কেবল গা এলিয়ে দিয়েছিল সে। তৃতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সারা বছরের প্রস্তুতিহীনতায় পরীক্ষার আগের এই রাতটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু তা আর হলো না। তাকে এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে।

অনিক আবিষ্কার করল তার গা কাঁপছে। দুই কানের পাশ দিয়ে সরু ঘামের উষ্ণ প্রস্রবণ নামতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই বাবার গুরুতর কিছু হয়েছে। না হলে এ সময়ে এভাবে তাকে ফোন করে জানানোর কথা নয়। সে যতটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করল। বলল, আব্বা এখন কোথায়?

হাসপাতালে।

কোন হাসপাতালে?

ঠিকানা বলল লোকটা। অনিক বলল, আপনি কি আমাকে বলবেন যে আব্বার অবস্থা কতটা খারাপ?

লোকটা কথা বলল না। অনিক বলল, চাচা, আমাদের সবকিছুই আপনি জানেন। আব্বার খারাপ কিছু হয়ে গেলে আমাকেই সব সামলাতে হবে। ফলে আমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। আমার মা, ছোট বোন গ্রামে থাকে। ওদের কথাও আমাকেই ভাবতে হবে।

বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। তার অবস্থা ভালো না। মাথায় আঘাত লাগছে। রক্ত গেছে অনেক। সময় বেশি নাই।

অনিক যতক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছাল, ততক্ষণে শাখাওয়াত হোসেন মারা গেছেন। তার নিথর শরীর পড়ে আছে হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায়। আপাদমস্তক আবৃত সেই শরীর দেখে অনিকের কান্নাকাটি করার কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন কাঁদল না সে। বরং একধরনের আশ্চর্য নির্লিপ্ততা তাকে অসাড় করে রাখল। যেন এই জগতের কোনো কিছুতেই আর কিছু যায়-আসে না তার। সে দীর্ঘ সময় বাবার বিছানার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একা। নিঃশব্দ। বাবার ওই ফ্যাকাশে, প্রাণহীন মুখটাও আর দেখতে ইচ্ছে করছিল না তার।

রাতে যখন সে বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন পদ্মায় তুমুল ঢেউ। আকাশজুড়ে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে অসংখ্য তারা জোনাক পোকার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ফেরিতে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটার গা ঘেঁষে চুপচাপ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর তার হঠাই মনে হলো, সে আসলে কিছু ভাবছে না। না বাবার কথা,

মায়ের কথা, কিংবা অন্য কিছু। কেবল এক অদ্ভুত শূন্যতা তাকে ক্রমশই গ্রাস করে ফেলছে। ওই শূন্যতা থেকে উঠে আসার ক্ষমতা তার নেই।

হৃদির ফোনটা এল তখুনি। এর আগেও বেশ কবার ফোন করেছে সে। কিন্তু এত ঝামেলার মধ্যে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি অনিকের। বাবার মৃত্যুর খবর জানাতে হয়েছে বাড়িতে। তার পর থেকেই একের পর এক ফোন। সেই সব ফোনও ধরতে ইচ্ছে করছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, ফোনটা বন্ধ করে রাখে। কিন্তু এই সময়ে সেটি সম্ভব নয়। ফলে অনবরত কথা বলতে হয়েছে। এখন এই মাঝরাতে যখন সবকিছু সুন সান, খানিক অবসর, তখন ফোনটা ধরল অনিক। হৃদি থমথমে গলায় বলল, আমি তোমাকে কতবার ফোন করেছি, জানো?

না।

না মানে কী? তুমি ফোন দেখো নি?

দেখেছি।

তাহলে?

অনিক জবাব দিল না। চুপ করে রইল। হৃদি বলল, কী হলো? কথা বলছ না কেন?

সব সময় কথা বলতে ইচ্ছে হয়, হৃদি?

অনিক খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাটা বলল। কিন্তু হৃদি কেন যেন থমকে গেল। বলল, কিছু হয়েছে, অনিক?

কী হবে?

সত্যি করে বলো?

অনিক কথা বলল না। হৃদি বলল, তুমি কোথায়? তোমার চারপাশে কিসের শব্দ?

অনিক এবারও কথা বলল না। বাবার মৃত্যুর খবরটা কেন যেন কাউকে দিতে ইচ্ছে করছে না তার। হৃদিকেও না। মানুষ কেন প্রিয়জন বিয়োগের খবর সবাইকে বলে বেড়ায়? এতে কি তার দুঃখ কিছু কমে, নাকি সে শোক সইবার জন্য খানিক সান্ত্বনা চায়? অনিক জানে না। তার কেবল মনে হচ্ছে, বাবা বুঝি এখনো মিরপুরের ছোট্ট ওই ঘুপচি মেসঘরটাতে শুয়ে আছেন। ছুটির দিনে সে গেলেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলবেন, কিরে, কিছু খেয়েছিস? না খেলে বস। আজ আলু দিয়ে গুঁড়া মাছের চচ্চড়ি করেছি। খেয়ে দেখ। জিবে সাবান ঘষেও স্বাদ ওঠাতে পারবি না।

অনিক অবশ্য বাবার রান্না খুব একটা খায় নি। এর কারণও আছে। বুয়ার পয়সা বাঁচাতে বাবা নিজেই রান্না করতেন। আর সেই ব্যঞ্জনে তেল-নুন-মসলার অপ্রতুলতা এত তীব্র ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ থাকত যে তা মুখে তোলা যেত না। ফলে ইউনিভার্সিটির হলের খাবারই বরং তার কাছে অধিক সুস্বাদু মনে হতো। বাবা অবশ্য কোরবানির ঈদে তাকে গরুর মাংসের স্টেক বানিয়ে খাওয়ানোর কথা বলেছিলেন। বাবার এই এক অভ্যেস। ভালো, পছন্দের কিছু কোথাও দেখলেই তা তাদের জন্য রপ্ত করতে চাইতেন। হয়তো এটাও তেমন কিছুই। কিন্তু কোরবানির ঈদের এখনো তিন মাস বাকি! তাদের একসঙ্গে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। বাবার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের গা ঘেঁষে অনিক দাঁড়িয়ে আছে। তারা একসঙ্গেই বাড়ি যাচ্ছে। সে আর বাবা। কিন্তু তাদের মাঝখানে এক জীবনের দূরত্ব।

হৃদি বলল, কী হলো, কথা বলছ না কেন?

অনিক আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আচমকা ফোন কেটে দিল। হৃদি আবার ফোন করল। আবার। কিন্তু অনিক আর ধরল না। সে ফোন বন্ধ করে রাখল।

এই মুহূর্তে লোকটাকে দেখতে পেল সে। ফেরির মৃদু আলোয় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে ঘন দাড়ি। মাথায় ক্যাপ। বয়সটা ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারল না অনিক। তবে লোকটা সিগারেট খাচ্ছিল। শেষ ধোঁয়াটুকু তখনো তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হচ্ছে। খুব অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অনিকের পাশে এসে দাঁড়াল সে। তারপর অ্যাম্বুলেন্সের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আপনার বাবা?

অনিক মৃদু মাথা নাড়ল। তবে মুখে জবাব দিল না।

কী করে হলো?

অ্যাকসিডেন্ট।

উফফ! অস্ফুট স্বরে বলল লোকটা। স্পট ডেড?

অনিক এবার আর কথা বলল না। লোকটা আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল, সরি। আমার হয়তো এ সময়ে এসব কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আপনাকে একা একা এই রাতে একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যেতে দেখে।

কেমন যেন লাগল! তার গলায় সহানুভূতির সুর।

ঢাকায় আমাদের কেউ নেই।

ওহ্। বলে চুপ করে রইল লোকটা। তারপর দীর্ঘ সময় শেষে আবার জিজ্ঞেস করল, কী করেন আপনি?

পড়ছি।

কিসে?

থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।

ওহ্। বলে আবার চুপ করে রইল। তারপর বলল, পরে নিশ্চয়ই পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে? না, মানে…যদি ডিপার্টমেন্টে ইনফর্ম করে রাখেন?

আমি কাউকে কিছু জানাই নি।

কেন?

অনিক এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। লোকটার এসব উদ্ভট প্রশ্ন তার ভালো লাগছে। বাকি সময়টুকু সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটাও। তবে ফেরি থেকে ঠিক নামার আগে আগে লোকটা হঠাৎ বলল, আপনি চাইলে আমি আপনার সঙ্গে কিছু দূর যেতে পারি।

মানে? ভারি অবাক হলো অনিক।

না, মানে…। ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল লোকটা। বিষয়টা আপনার কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে। হওয়ারই কথা। আমি আসলে এখানে কোনো কাজে আসি নি। প্রায়ই মাওয়া ঘাটে ঘুরতে আসি একা একা। ভাসমান ফেরিতে বসে পানিতে জোছনা দেখি। এটা একটা নেশার মতো ব্যাপার। ভালো লাগে একা একা ঘুরতে। তবে এতে অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও ঘটে।

সামান্য থেমে দম নিল লোকটা। তারপর বলল, অনেক ধরনের লোকের সঙ্গে দেখা হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা জানা হয়। আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাবছেন। কিন্তু জগতে কত ধরনের মানুষই তো থাকে। তাই না?

অনিক এবারও জবাব দিল না। তার লোকটাকে আর একটুও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, বিশেষ কোনো মতলব আছে মানুষটার। না হলে প্রথম থেকেই এভাবে আগবাড়িয়ে কথা বলত না। তা ছাড়া প্রথম দেখাতেই সে চট করে জিজ্ঞেস করেছে, অ্যাম্বুলেন্সে তার বাবার লাশ কি না। এ কথা তো তার জানার কথা নয়! অনিকের হঠাৎ অস্বস্তি হতে লাগল। একটা ভয়ও। এই প্রায় মাঝরাতে সে একা একটা মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে! বিষয়টা যে কারও জন্যই ভয়ের। কিন্তু এতক্ষণ এসব কিছুই মাথায় আসে। নি তার। অথচ এখন লোকটার কথা শুনে প্রবল অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ঝামেলা আছে।

লোকটা বলল, অনেকক্ষণ ধরেই আপনাকে দেখছিলাম আমি। মানুষ দেখা আমার স্বভাব বলতে পারেন। পথে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখি। আপনি ফোনে আপনার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখান থেকেই শুনেছি যে আপনার বাবা মারা গেছেন। আর এখন হঠাই মনে হলো, আপনার সঙ্গে কেউ একজন থাকলে হয়তো আপনার ভালো লাগবে। নাথিং এলস।

না। ধন্যবাদ। বলেই গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল অনিক। সে জানে না কেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার হঠাৎ গা ছমছম করতে লাগল।

.

অনিক বাড়ি পৌঁছাল ফজরের আজানের সময়। চারদিকে তখন সুনসান নীরবতা। শেষরাতের শীতল আবহাওয়ায় কেমন একটা হাহাকারের সুর। সেই হাহাকারে মায়ের মিহি গলার গুনগুনে কান্নাটা যেন ধারালো সুতোর মতো তীক্ষ্ণ। তাতে কেটে ফালি ফালি হয়ে যেতে লাগল ভোরের অন্ধকার। অনিকের অকস্মাৎ মনে হলো, এটা একটা স্বপ্নের মতো। কিছুক্ষণের মধ্যে এই নিস্তব্ধ বাড়ি ভরে যাবে মানুষে। উঠানের এখানে সেখানে। চেয়ার পেতে গল্প জমে উঠবে। পুকুরধারের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হবে। কবর খোঁড়া হবে উত্তর দিকের রাস্তার ধারে। মা বার কয়েক মূৰ্ছা যাবেন। তার ছোট বোন আয়েশা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদবে। আত্মীয়স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশী এসে সান্ত্বনা দিতে থাকবে। আর বাবার লাশটা নিঃসাড় পড়ে থাকবে খাঁটিয়ায়। তারপর এই সব শোকের উদযাপন ফুরিয়ে যাবে। এই যে ঘর, এই যে উঠান, ওই যে বাঁশবাগান–সকলই পড়ে থাকবে আগে যেমন ছিল, তেমন। কেবল ওই মানুষটাই থাকবে না। কিংবা যতটুকু ছিল, তাও ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে থাকবে। জলে জমে ওঠা বুদবুদের মতো। মানুষ কিংবা জীবন তো জলের বুদবুদই। সময়ের শরীরে জেগে ওঠে। তারপর মিলিয়ে যায়। সেই মিলিয়ে যাওয়া চিরন্তন। আর কখনো জেগে ওঠে না। লীন হয়ে যেতে থাকে বিস্মৃতিতে। মৃত্যুর ওই সময়টুকুতেই বরং সবচেয়ে বেশি জেগে ওঠে জীবন। একজীবনে মৃত্যু ছাড়া এতটা আড়ম্বরে কি আর কখনো উদ্যাপিত হয় জীবন?

অনিকের মনে হয় না। আর হয় না বলেই হয়তো সকলে হঠাৎ উচ্চকিত হয়ে ওঠে। যে মানুষটির সঙ্গে কারও কখনো কথা বলার ফুরসত মেলে না, তারাও তার মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসে। আফসোস করে। স্মৃতিতাড়িত হয়। যেন এই জীবনে ওই মৃত মানুষটির সঙ্গে এই শেষ স্মৃতিটুকুই তার শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়। এই যে স্মৃতিকাতরতা, এই যে দুঃখবোধ, শূন্যতা–এ সবই তো মানুষের বেঁচে থাকা। কিন্তু এই পরিপূর্ণ বেঁচে থাকাটুকু সমবেত স্বরে জেগে ওঠে কেবল ওই মৃত্যুতেই। তারপর মিলিয়ে যেতে থাকে জলের বুদ্বুদ জীবনের মতোই।

.

অনিক ঢাকায় ফিরল প্রায় কুড়ি দিন পর। এই সময়টাতে সে কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে নি। হৃদি দিনের পর দিন ফোন করেছে। কাছের বন্ধুরা খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ হয় নি। কারণ, তার ফোন বন্ধ। আজ যখন সে হলে এসে উঠেছে, তখন চারদিকে মোটামুটি হইচই পড়ে গেল। পরীক্ষার মাঝখানে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল সে। ফলে রাজ্যের উল্কণ্ঠা, দুশ্চিন্তা নিয়েই অপেক্ষা করছিল সবাই। অনিক অবশ্য শান্তই রইল। খুব একটা কথা বলল না কারও সঙ্গে। হৃদির সঙ্গে তার দেখা হলো বেশ কিছুদিন পর। তত দিনে পরীক্ষা শেষ। অনেকেই ছুটি কাটাতে বাড়ি চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ ট্যুর দিচ্ছে এখানে-সেখানে। কেবল অনিকই পড়ে রইল একা।

সেদিন সন্ধ্যায় কলাভবনের পাশের নির্জন মাঠের মতো জায়গাটায় খানিক আড়াল দেখে বসল তারা। তবে সেই বসে থাকাটা ভীষণ আড়ষ্টতারও। যেন দুজনের মাঝখানে অদৃশ্য এক দেয়াল চুপি চুপি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ওই দেয়ালখানা তারা কেউ ডিঙাতে পারছে না। অনিক মাথা নিচু করে সসংকোচ বসে আছে। হৃদি বলল, আমি এ কদিন কেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসি নি, তুমি জানো?

হুম। অনিক হৃদির দিকে তাকাল না। তবে মৃদু জবাব দিল।

কেন?

তোমাকে কিছু জানাই নি বলে।

কেন জানাও নি?

আমার খুব খারাপ লাগছে। কতটা খারাপ লাগছে আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। একটা প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করছে।

অপরাধবোধ! বাবার মৃত্যুতে? ভ্রু কুঁচকে তাকাল হৃদি।

কিসের অপরাধবোধ?

এই প্রশ্নে অনিক চুপ করে রইল। হৃদি বলল, আমরা কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি বলে?

অনিক এবারও জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তার পায়ের কাছে জেগে ওঠা ঘাসের ডগাগুলো আঙুলের ডগায় মিইয়ে দিতে থাকল সে। হৃদি বলল, বলো? এ ছাড়া তো আর কোনো কারণ নেই। আছে?

অনিক বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, ঠিক তা নয়।

তাহলে?

আসলে…তুমি তো জানো, আব্বা খুব চাইতেন গ্রামে ফিরে যেতে। খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বয়স বেড়ে যাচ্ছিল। নানান অসুখবিসুখ। তার ওপর দিনরাত এত পরিশ্রমের কাজও আর ভালো লাগছিল না। কিন্তু উপায়ও তো ছিল না। আমার কিছু একটা না হওয়া অবধি তো ওনার পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এ জন্যই সারাক্ষণ ফোন করে বলতেন, তোর পাস করতে আর কত দিন লাগবে? পড়াশোনা কবে শেষ হবে? চাকরি কবে পাবি?

অনিকের গলা ভার। সে তার ভাঁজ করা দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে ফেলল। একটা ফুরফুরে হাওয়া কোথা থেকে উড়ে এসে ভ্যাপসা গরমটা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলো না। এই তপ্ত সন্ধ্যায় দরদর করে ঘামতে লাগল সে। হৃদি ডাকল, অনিক?

অনিক সাড়া দিল না। হৃদি আলতো করে হাত রাখল তার মাথায়। আর তখুনি সে আবিষ্কার করল, অনিক কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। তবে তার কান্নায় থরথর করে কাঁপছে শরীর।

হৃদি অস্থির গলায় ডাকল, অনিক, অনিক?

অনিক এবারও কথা বলল না। সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল তার কান্না সংবরণ করতে। কিন্তু কতটা পারল, তা ওই আবছা অন্ধকারে বোঝা গেল না। হৃদি অনিকের পাশে সরে এল। তারপর এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কি জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি?

অনিক কথা বলল না। হৃদি বলল, জানো না?

অনিক মাথা নাড়ল। হৃদি বলল, তোমার এই যে এত খারাপ সময় যাচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, তা তুমি আমায় বলবে না?

অনিক চোখ তুলে তাকাল। হৃদি বলল, আমরা যদি আমাদের দুঃসময়টা ভাগাভাগি করে নিতে না পারি, একজনের কষ্ট অন্যজন বহন করতে না পারি, তাহলে আমাদের ভালো সময়টা পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পৌঁছাব কী করে? আর যদি পৌঁছাইও, তখন দেখব সেখানে আমরা আর একসঙ্গে নেই। আলাদা। তাহলে? এই যে তোমার জন্য আমার এত কষ্ট হয়, হাহাকার লাগে, এসবই কি অর্থহীন?

অনিক তার হাতের মুঠোয় হৃদির হাতখানা শক্ত করে ধরল। তারপর ফ্যাকাশে গলায় বলল, আমার খুব গিল্টি ফিলিং হচ্ছে, হৃদি। প্রচণ্ড খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগাটা তো স্বাভাবিক। এর চেয়ে খারাপ কিছু তো আর হতে পারত না। কিন্তু গিল্টি ফিলিং কেন হচ্ছে তোমার?

এই প্রশ্নে আবারও চুপ করে রইল অনিক। তারপর বলল, এত দিনে আমার পড়াশোনাটা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তুমি জানো, হয়তো একটা চাকরিবাকরিও কিছু জুটিয়ে নিতে পারতাম। আর তা হলে, আব্বার জন্য যে সেটা কত বড় রিলিফ হতো, আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি সেসব কিছুই করি নি…। আমি কিনা ঝোঁকের মাথায় তোমাকে বিয়ে করে ফেললাম…।

ঝোঁকের মাথায় না। অনিককে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল হৃদি। আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছি। তাই তো?

তুমি কেন বাধ্য করবে? কারও ইচ্ছে না থাকলে কেউ কি তাকে বাধ্য করতে পারে?

হৃদি কথা বলল না। কেমন গম্ভীর আর জড়সড় হয়ে গেল সে। অনিক বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, হৃদি।

ভুল কেন বুঝব, অনিক? এটা তো সত্যিই। তুমি তো ওভাবে হুট করে বিয়েটা চাও নি। আমার কারণেই ঘটনাটা ঘটেছে। হঠাৎ কী খেয়াল চাপল মাথায়! আর তারপর তুমিও খুব প্রেশার নিয়ে নিলে। একের পর এক সেমিস্টার ড্রপ। টিউশন করাতে লাগলে রাতদিন। বাড়িতে টাকা পাঠাতে চাইতে।

কী করব, বলো? ফোন করলেই আব্বা জিজ্ঞেস করতেন, কবে চাকরি পাব, কবে পাস করব। আর তখন খুব ভয় হতো আমার। মনে হতো, এই বুঝি তিনি কোনোভাবে বিয়ের ঘটনাটা জেনে গেছেন। আর জেনে গেলে এত কষ্ট পেতেন! তুমি জানো না, আব্বা শেষ দিকে খুব বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলেন!

বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলেন মানে?

এই প্রশ্নে অনিক চুপ করে রইল। হৃদি বলল, বলো?

অনিক বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আব্বা শেষ কিছুদিন প্রচণ্ড অস্থির হয়েছিলেন। কেন যেন খুব ভয়ও পেতেন। তবে ঠিকঠাক কাউকেই কিছুই খুলে বলতেন না। মা বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেই প্রচণ্ড রেগে যেতেন। তার অস্থিরতাটা টের পাওয়া যেত।

কী হয়েছিল?

তা তো জানি না। তবে শেষের দিকে মাকে নাকি বেশ কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন আব্বা। বলেছিলেন, এবার যে করেই হোক বাড়ি ফিরে যাবেন তিনি। ঢাকায় আর থাকবেন না।

তারপর?

তারপর আর কী? বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অনিক। ছাত্তার চাচা আমাকে ফোন করে জানালেন যে আব্বা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো?

কী?

উনি আমার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি যেতে চাইলেন না। ওনার যাওয়া উচিত ছিল না?

হ্যাঁ।

অথচ উনি সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে একদম শেষ মুহূর্তে বললেন ওনার নাকি কী একটা ঝামেলা আছে, উনি যেতে পারবেন না।

তুমি একা চলে গেলে? একদম একা? আর কেউ ছিল না?

নাহ্, আর কেউ ছিল না। কথাটা বলতে বলতেই যেন অকস্মাৎ থমকে গেল অনিক। সেদিন গভীর রাতে ফেরিতে দেখা সেই মানুষটার কথা নানা ঝামেলায় এ কদিনে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে লোকটার কথা আবার মনে হলো তার। সঙ্গে সঙ্গেই কেমন একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হলো। অত রাতে ওখানে কী করছিল লোকটা? তা ছাড়া তার কথাগুলোও খুব একটা স্বাভাবিক মনে হয় নি অনিকের। তবে তখন যতটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, এখন যেন তার চেয়েও ঢের বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে। আচ্ছা, বাবার মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক? শেষ কিছুদিনে বাবা তাহলে অমন অস্থির আর সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন কেন? অতগুলো টাকাই-বা কোথায় পেয়েছিলেন তিনি?

ছাত্তার মিয়ার পান খাওয়া লাল দাঁত। দাঁতের ফাঁকে এটা-সেটা আটকে থাকে। সে সেই পান খাওয়া লাল দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, আমি তো বাবা অত কিছু জানি না। আমারে একজন অফিস থিকা ফোন দিয়া বলল, তোমার আব্বার গাড়ি অ্যাকসিডেন হইছে। তার অবস্থা ভালো না। আমি তখন কুমিল্লা থিকা ট্রিপ নিয়া আসতেছিলাম। ঘটনা ঘটছে চিটাগাং রোডে। আমার পৌঁছাইতে বেশি সময় লাগে নাই। গিয়া দেখি অবস্থা ভালো না।

আব্বা কিছু বলেছিলেন আপনাকে?

না। কথা বলনের মতো অবস্থায় তোত সে ছিল না।

গাড়িতে কী ছিল?

কী আর থাকব? আমরা গার্মেন্টসের গাড়ি চালাই। আমাদের গাড়িতে পোশাক আশাক অথবা টেক্সটাইল মিলের সুতা, ডাইং-স্পিনিংয়ের কাঁচামাল–এই সবই থাকে।

হুম। বলে সামান্য চুপ করে রইল অনিক। তারপর বলল, আব্বা বেতন পেতেন কত?

আমার আর তার বেতন সমানই। হাজার পনেরোর মতো।

আচ্ছা। বলে আবারও চুপ করে রইল অনিক। ছাত্তার মিয়া বলল, কেন? কোনো সমস্যা?

অনিক বেশ কিছু সময় কী ভাবল। সে বুঝতে পারছে না কথাটা বলা তার ঠিক হবে কি না। বেশ কিছুদিন ধরে এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে সে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে নি। আজ ঘুম থেকে উঠেই তার হঠাৎ মনে হলো, বিষয়টা নিয়ে কথা বলবে সে। তাতে যদি ভুল কিছু হয় তো হবে। তারপরও নিজের ভেতরে যে তীব্র অস্বস্তির যন্ত্রণাটা সে বয়ে বেড়াচ্ছে, তা একটু হলেও প্রশমিত হবে।

আব্বা মারা যাওয়ার আগে বাড়িতে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন। শান্ত গলায় বলল অনিক।

টাকা! যেন চমকে উঠল ছাত্তার।

হুম।

কত টাকা?

অনেক।

অনেক কত?

অনিক ইচ্ছে করেই ছাত্তারের কৌতূহল বাড়াচ্ছে। তার স্থির দৃষ্টি ছাত্তারের চোখে। ছাত্তার অধৈর্য গলায় বলল, কত?

এই ধরেন লাখ দুয়েক।

ছাত্তার অবশ্য তার চমকে ওঠাটা লুকাল না। সে বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, এত টাকা!

জি।

কত দিন আগে?

এই তো মাস দেড়েক।

এত টাকা শাখাওয়াত ভাই কই পাইলেন?

সেটা তো আমারও প্রশ্ন। মাকে ফোন করে বললেন যে মা যেন ভালো দেখে একটা জমি কেনে গ্রামে। এইটা বায়নার টাকা। সব ঠিক হলে আব্বা পরে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেবেন।

পরে আর পাঠায় নাই?

না।

তোমার মা জিজ্ঞাস করে নাই যে হঠাৎ এত টাকা সে কই পাইছে?

করছে। কিন্তু আব্বা কিছু বলেন নাই। আর শেষের দিকে মা কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যেতেন।

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেল ছাত্তার। তারপর বলল, জমি কিনছে তোমার মা?

বায়না করছে। কিন্তু এখন তো আর কিনতে পারবে না। ছাত্তার আর কথা বলল না। অনিক বলল, চাচা, আপনারে একটা কথা বলি?

বলো।

আব্বার মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক?

মানে?

মানে আপনি আমাকে সত্যি করে বলবেন। আপনি ভালো করেই জানেন, অস্বাভাবিক হলেও আমি কিছুই করতে পারব না। সেই ক্ষমতাও আমার নাই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, আব্বার কী হয়েছিল?

ছাত্তার এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোমার একটা ছোট বইন আছে?

জি।

ওর বয়স কত?

বারো।

তোমার উপর এখন অনেক দায়িত্ব। এত দিন যা-ই করছ না করছ, এখন একটু দায়িত্ব নিয়ে বাবা। তোমার উপরে এমনিতেই তোমার আব্বার অনেক মন খারাপ আছিল। কিন্তু সে কখনো বলতে পারত না।

আমি জানি, চাচা। বলে চুপ করে রইল অনিক। তারপর বলল, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন না?

কী প্রশ্ন?

আব্বার মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক ছিল?

অ্যাকসিডেন তো আর স্বাভাবিক ঘটনা না। দুর্ঘটনা। এ ছাড়া আর কী?

আর কিছুই না?

নাহ্। আর কী হইব?

আর কিচ্ছু না? অনিক জোর দিয়ে জানতে চাইল।

না বাবা। আর কিছু না। তোমার আব্বায় ভালো লোক ছিল। আর বাড়িতে যাওয়ার জন্য খুব অস্থির হয়ে গেছিল। তুমি তো জানোই, নানা অসুখবিসুখ তার ছিল। তার উপর রাতের পর রাত গাড়ি চালাইতে হইত। মাইলের পর মাইল। গার্মেন্টসের মাল নিয়া চিটাগাং, ময়মনসিংহ, খুলনা। এক ট্রিপ রাইখা সাথে সাথেই আবার আরেক ট্রিপ। একটু রেস্টও মিলত না। কিন্তু সে যে বাড়ি যাইব, গিয়া খাইব কী? তোমাদের তো কোনো জমিজমাও নাই যে চাষবাস করব। তার ওপর তোমার পড়াশোনাও শেষ হয় না। এইটা নিয়াও ভিতরে ভিতরে খুব অস্থির হইয়া গেছিল সে।

বলে একটু থামল ছাত্তার। তারপর বলল, শোনো, আমার ডিউটিতে যাইতে হইব। পরে আবার তোমার সাথে কথা হইব। এখন আমি তাইলে যাই। বলেই হাঁটতে শুরু করল সে। ছাত্তার থাকে খুপরিঘরের মতো ছোট এক বাসায়। এই বাসায়ই অনিকের বাবা থাকত। কিন্তু আজ কেন যেন আর ঘরের ভেতর ঢুকতে ইচ্ছে করল না অনিকের। সে বেশ খানিকটা সময় একা একা দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। তার বার কয়েক মনে হলো, এই বুঝি বাবা সামনের ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন। সে যখন মাঝেমধ্যে হাতখরচের টাকার জন্য আসত, বাবা তখন বাসার সামনের এই ফাঁকা জায়গাটাতে এসে দাঁড়াতেন। তারপর তার সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতেন। সেই সব গল্পের বেশির ভাগই ছিল তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়া নিয়ে। একটা মানুষ তার জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে। অথচ তার সেই ফিরে যাওয়া সংঘটিত হলো চিরপ্রস্থানে।

ছাত্তার বেরিয়ে এল বেশ কিছুক্ষণ পর। কিন্তু তখনো অনিককে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাকই হলো সে। বলল, তুমি এখনো যাও নাই?

এই তো যাচ্ছি, চাচা।

আচ্ছা যাও। বলেই হাঁটতে শুরু করল সে। অনিক জানে না কেন তার আচমকা মনে হতে লাগল, ছাত্তার কিছু একটা লুকাচ্ছে। কিন্তু কী লুকাচ্ছে, তা সে জানে না। সে ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। এই মুহূর্তে তাকে ডাকল ছাত্তার। তারপর তার কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়। অনিক তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ছাত্তার কেমন ফ্যাকাশে চাপা গলায় বলল, যা হওনের হইছে। এর চাইতে খারাপ কিছু তো আর হইতে পারত না। পারত?

না।

তোমারে একটা অনুরোধ করি?

জি।

এই বিষয় নিয়া তুমি আর ঘাঁটাঘাঁটি কইরো না। যা গেছে, তা কি আর কোনো দিন ফিরা আসব?

অনিক কথা বলল না। ছাত্তার তার কাঁধে হাত রাখল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, যাও। আমার কাছেও আর কখনো আইসো না। কথাটা মনে রাইখো।

রোখসানা বেগমের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার মাথায় পানি ঢেলেছেন তিনি। কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। বরং যতবারই তিনি হৃদিকে দেখেছেন, ততবারই তার ব্রহ্মতালু গরম হয়ে গেছে। মনে হয়েছে, এখুনি তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও হৃদির যে তাতে কিছু যাবে-আসবে না, তা স্পষ্ট। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে বরং এতে খুশিই হবে। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাবে। গত রাতে সে ভয়ানক এক ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এমন কিছু। কখনো ঘটেছে। বরং বারান্দায় বসে নির্বিকার ভঙ্গিতে গান শুনছে সে। যেন কোথাও কিছু হয় নি।

রোখসানা বেগমের দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে রাতুল দেশের বাইরে থাকে। হৃদি আর তিথি পড়াশোনা করছে দেশেই। ছোট মেয়ে তিথি মাধ্যমিক পাস করে সদ্য কলেজে উঠেছে। বয়সে ছোট হলেও তিথি বেশ পরিপক্ক, গোছানো, সপ্রতিভ। ফলে তাকে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। তার যত দুশ্চিন্তা বড় মেয়ে হৃদিকে নিয়ে।

রোখসানা বেগমের ধারণা, এই মেয়ে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। তা করছেও। সে থার্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। কেমন বেপরোয়া আর খামখেয়ালি হয়ে উঠেছে। এ কারণেই একটা ভালো পাত্র দেখে তাকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু হৃদির ওই এক কথা, সে এখুনি বিয়ে করবে না। বিয়ে করবে মাস্টার্স শেষ করার পর। এই নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল অশান্তি। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় নি যে এটিই তার বিয়ের আদর্শ সময়।

সমস্যা হচ্ছে, পড়াশোনাটাও ঠিকমতো করছে না সে। ইউনিভার্সিটিতে হাজারটা কাজের সাথে যুক্ত হয়েছে। সেই সব কাজ আর হইচই করেই তার জীবন কাটছে। ঘরসংসারের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার সকল আগ্রহ সাজগোজ আর নানান। অনুষ্ঠান-আয়োজনে।

বিষয়টা নিয়ে রোখসানা বেগম যারপরনাই অস্থির হয়ে আছেন। আর এই অস্থিরতা কাটাতেই তিনি একের পর এক ছেলে দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেই ছেলেদের কাউকেই হৃদির পছন্দ হচ্ছে না। বিচিত্র সব বাহানায় সে তাদের নাকচ করে দিচ্ছে।

কিন্তু এবারের ঘটনা সবচেয়ে খারাপ। বিষয়টা শোনার পর থেকেই মাথা এলোমেলো হয়ে আছে তার। হৃদি এখনো বুঝতে পারছে না যে নিজের কত বড় সর্বনাশ সে করেছে। এই ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী অবধি নানান রটনা রটাবে। সেই রটনা কত দূর গিয়ে পৌঁছায় কে জানে!

তিনি সন্ধ্যার আগে আগে আবারও হৃদির সঙ্গে কথা বললেন, তুই সত্যি করে বল তো, ওই ছেলেকে তুই কী বলেছিস?

কোন ছেলেকে?

কোন ছেলেকে আবার? নেহালকে।

বলেছি আপনি বিয়ের আগে ঘন ঘন আমাকে ফোন করবেন না। বিষয়টা ভালো দেখায় না।

আর কিছু বলিস নি?

না।

সে ফোন করলে ভালো দেখাবে না কেন?

ভালো দেখাবে না কেন মানে কী, মা? তুমিই তো এত দিন সারাক্ষণ মিলিটারির মতো আমার ওপর নজর রাখতে, যেন কোনো ছেলের সঙ্গে আমি কথা বলতে না পারি। আর এখন সেই তুমিই বলছ একটা অজানা-অচেনা ছেলের সঙ্গে আমি রাতবিরেতে, সকাল-সন্ধ্যায় যখন-তখন কথা বলব? আর সেটাতে তুমি খারাপ কিছু দেখছ না?

সে তো আর অজানা-অচেনা কেউ না।

তাহলে? সে আমার কোন জনমের চেনা?

চেনা না হলেও চেনা হবে। তুই একটু কথা বল। বার কয়েক আলাদা দেখাসাক্ষাৎ কর। দেখবি চেনা হয়ে যাবে।

চেনাজানা তো হয়েছেই। সে বাসায়ও এসেছে কয়েকবার।

সে তো তোর বাবাকে দেখতে এসেছিল। তার অসুস্থতার খোঁজখবর নিতে।

কেন, আমাকে দেখতে আসে নাই? একদম আয়োজন করেই তো এল।

তাতে কী? কাউকে পছন্দ হলে তাকে দেখতে আসা যায় না?

দেখা তো তাহলে মিটেই গেল। আবার নতুন করে দেখাসাক্ষাতের কী আছে?

আছে। তোরা একজন আরেকজনকে চিনে নিতে পারবি।

তার সঙ্গে চেনাজানা হওয়াতে তোমার এত উৎসাহ! অথচ অন্য কারও সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে দিতেও তো তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত! কেন? অন্যরা বাঘ-ভল্লুক? আর এই ছেলে সুফি সাধক?

রোখসানা বেগমের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তবে তিনি রাগলেন না। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। বললেন, বিষয়টা তা নয়। নেহাল ছেলে হিসেবে চমৎকার। এত বড় ডিগ্রি। তার সঙ্গে তোর চারপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করা ওই সব ফালতু ছেলেকে মেলালে চলবে না। নেহাল তাদের মতো সুযোগসন্ধানী নয়।

তুমি জানো সে সুযোগসন্ধানী নয়?

অবশ্যই জানি।

কীভাবে জানো?

সে ইউরোপের মতো উন্নত জায়গায় থাকে। উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত। তার কিসের অভাব যে তাকে সুযোগ খুঁজতে হবে? সে যে তোর মতো একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, এটাই তোর সাতজনমের ভাগ্য।

তাই?

কেন? তোর সন্দেহ আছে?

আছে।

কী সন্দেহ?

তারও অভাব আছে।

তার আবার কিসের অভাব? ভ্রু কুঁচকে বললেন রোখসানা বেগম।

তার অভাব চরিত্রের।

মানে?

মানে হলো তোমার উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, আমার সাতজনমের ভাগ্যের চরিত্রে সমস্যা আছে। সে কী করেছে, জানো?

কী করেছে?

সে বিয়ের আগেই আমাকে তার সঙ্গে শেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

কী! যেন কথাটা বুঝতে পারলেন না রোখসানা বেগম। কী বললি তুই?

কেন, তুমি বোঝো নি?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তিনি হতভম্ব চোখে হৃদির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হৃদি হঠাৎ গলা নরম করে বলল, এটা অবশ্য তার দোষ নয়, মা। সে ইউরোপ-আমেরিকায় থাকে। ওখানকার কৃষ্টি-কালচার দেখে বড় হয়েছে। সেসব থেকেই হয়তো শিখেছে। ওসব দেশে তো এগুলাই চলে, মা। বিয়ের আগেই বেশির ভাগ কাপলের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যায়। দু-তিনটা বাচ্চা নিয়ে তারপর বিয়ে করতে যায় তারা। দৃশ্যটা একবার ভাবো? আমি তোমার ইউরোপিয়ান ডায়মন্ড জামাইকে নিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে একটা চার-পাঁচ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা। সে তোমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, এখানে কী হচ্ছে, নানি? কী হচ্ছে এখানে? বাবা মা এমন সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে? ইন্টারেস্টিং না বিষয়টা?

রোখসানা বেগম হৃদির কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। তিনি থমথমে গলায় বললেন, নেহাল সত্যি সত্যি তোকে এই কথা বলেছে?

কোন কথা?

তুই এইমাত্র যা বললি?

কী বললাম আমি?

এই যে বললি। বিভ্রান্ত গলায় বললেন রোখসানা বেগম। সে নাকি বিয়ের আগেই তোর সঙ্গে…। কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না তিনি। হৃদি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তুমি কি বোকা, মা?

বোকা কেন হব?

বোকা না হলে তুমি আমাকে যে কথা মুখ ফুটে বলতে পারছ না, সেই কথা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা ও রকম নম্র-ভদ্র-সভ্য একটা ছেলে বিয়ের আগেই আমাকে বলতে পারে? এটা তুমি বিশ্বাস করে ফেললে?

মানে কী?

মানে হলো যা শুনবে, তা-ই চট করে বিশ্বাস করে ফেলবে না। একটু ভাববে, মাথা খাটাবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।

তার মানে তোকে এমন কিছু নেহাল বলে নি?

না।

তুই নেহালকে কী বলেছিস?

আমি কী বলব?

তুই নাকি বলেছিস যে তোর বিয়ে হয়ে গেছে? গোপন বিয়ে। এই বিয়ের কথা তুই বাসায় বলতে পারছিস না বলে বাসার লোকজনও তোর জন্য পাত্র দেখা বন্ধ করছে না?

মা! আহ্লাদী স্বরে ডাকল হৃদি। এই কথা তুমি বিশ্বাস করো? কোনো বুদ্ধিমতী মেয়ে নিজের সম্পর্কে এমন কথা কাউকে বলবে?

তুই তো বুদ্ধিমতী না।

বুদ্ধিমতী না হলেও বলবে না। নিজের ভালো কে না বোঝে! এই কথা যদি আমি কাউকে বলি, তাহলে তা দশজনের কানে যাবে না? আমাদের আত্মীয়স্বজন পরিচিতজনরা জানবে না? তখন কী হবে? একবার যদি এই কথা চাউর হয়ে যায় যে একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তখন দেখবে মানুষের মুখে মুখেই তার বাচ্চাকাচ্চাও হয়ে যাবে। তারপর সেই মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে?

রোখসানা বেগম চুপ করে রইলেন। হৃদিকে আজকাল তিনি বুঝতে পারছেন না। আগে মেয়েটাকে তার বোকাসোকা, সহজবোধ্য মনে হতো। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই মনে হয়, এই মেয়েকে বোঝা তার সাধ্য নয়। তিনি তারপরও বললেন, তোর কোনো ছেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই তো?

কার সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে? তুমিই তো বলো, আমার সঙ্গে কেউ এক দিনও টিকতে পারবে না। তো কার দায় পড়েছে আমার সঙ্গে সম্পর্ক করতে?

ওই যে, কী যেন নাম ছেলেটার? অনিক না? ওর খবর কী?

আমি জানি না, মা। এই সব অথর্ব, স্টুপিড ছেলেপুলের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। এদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। এই ছেলে আমাদের তিন-চার বছরের সিনিয়র ছিল। ফেল করতে করতে আর ড্রপ দিতে দিতে এখন প্রায় আমার ক্লাসমেট হয়ে গেছে। হা হা হা। এই ধরনের ইউজলেস ছেলেপুলে দেখলেই মনে হয় কষিয়ে চড় মারি।

বলেই শরীর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল হৃদি। যেন এমন আনন্দের কথা সে বহুদিন বলে নি। রোখসানা বেগম একদৃষ্টে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু তার সেই দৃষ্টিতে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু ধরা পড়ল না। বরং তিনি ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে গেলেন। তার কেন যেন মনে হতে লাগল, এই মেয়ে ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। সেই ঘটনা থেকে যে করেই হোক তাকে বের করে নিয়ে আনতে হবে। নাহলে বিপদ।

.

অবন্তীর এই বাড়িটা খুব পছন্দের। সে ঢাকায় এলেই মেজ খালার বাসায় ওঠে। তার মেজ খালা রোখসানা বেগমদের বাড়িটা আগারগাঁওয়ে। পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে খানিক খোলা জায়গাও রয়েছে। সেখানে নানা রকম গাছ, লতাপাতার সমাহার। একটা বড় আমগাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। ছাদে উঠলেই সেই গাছের পাতা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। বিষয়টা অসম্ভব ভালো লাগে অবন্তীর। মনে হয়, ইট-কাঠ-পাথরের এই শহরে এখনো খানিক মায়াময় আদুরে স্পর্শ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। গ্রাম থেকে হঠাৎ এতটা দূরে এই শহুরে কোলাহলের ভেতর এসে ওই মায়াময় স্পর্শটুকু যেন খুব দরকার ছিল তার।

অবন্তী এবার দীর্ঘদিনের জন্য ঢাকায় এসেছে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। সে। ফলে হলে সিট পাওয়ার আগ অবধি বেশ কিছুদিন তাকে এ বাড়িতেই থাকতে হবে। এতে অবশ্য হৃদি আর তিথি খুশিই হয়েছে। অবন্তীকে তারা প্রচণ্ড পছন্দ করে। শান্ত, চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে সে। তার আচার-আচরণও সহজ। অল্পতেই মিশে যাওয়া। যায়। নিজের লুকিয়ে রাখা গোপন কথা অকপটে শেয়ার করা যায়। কাউকে বলে দেওয়ার ভয়ও থাকে না। মা সপ্তাহখানেক হলো অবন্তী এখানে এসেছে। এর আগে তারা তিনজন একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলেও এবার যেন হৃদি আর অবন্তীর কাছ থেকে খানিক আলাদাই হয়ে পড়ল তিথি। এর অবশ্য কারণও আছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে নানা প্রয়োজনে, জিজ্ঞাসায় হৃদিই হয়ে উঠল অবন্তীর ভরসার মূল জায়গা। তাদের যাতায়াত, গল্প, আড্ডাও হয় একই সঙ্গে। বিষয়টা রোখসানা বেগমেরও চোখ এড়ায় নি।

তিনি সেদিন ইচ্ছে করেই অবন্তীকে খানিক আলাদা করে ডেকে নিলেন। তারপর এটা-সেটা কথার শেষে বললেন, অনিক ছেলেটা কেমন রে?

অবন্তী চট করে প্রশ্নটা ধরতে পারল না। সে বলল, কোন অনিক?

আরেহ, ওই যে হৃদি যে ছেলেটাকে পছন্দ করে?

কই? আমি তো কিছু জানি না, খালা। হৃদি আপু আমাকে কিছু বলে নি।

তুই কিছু জানিস না?

না।

শোন, ছেলেটাকে আমারও পছন্দ। হৃদির সঙ্গে যেহেতু ছেলেটার একটা ভালো বোঝাপড়া আছে, সেহেতু আমি চাই একটু খোঁজখবর নিয়ে ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে। কিন্তু বুঝিসই তো, মা হয়ে তো আর মেয়ের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলা যায় না! তা ছাড়া হৃদিকে তো তুই চিনিসই। ও কখনোই আমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু তোর সঙ্গে তো ওর বান্ধবীর মতোই সম্পর্ক। ওর নাড়িনক্ষত্র জানিস তুই। তাই ভাবছিলাম তোর মাধ্যমেই যদি একটু খোঁজখবর করা যেত, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে সিদ্ধান্তটা নিতে পারতাম।

আপু আমাকে এই সব বিষয়ে কিছু বলে নি, খালা।

ধ্যাৎ! বলে অবন্তীর কথাটা যেন উড়িয়ে দিতে চাইলেন রোখসানা বেগম। বললেন, তুই শুধু শুধু আমাকে ভয় পাচ্ছিস। হৃদি নিশ্চয়ই আমাকে কিছু বলতে নিষেধ করেছে?

একদমই না, খালা। হৃদি আপু আমাকে এসব কিছু বলে নি।

তাহলে সারাক্ষণ তোরা কী নিয়ে কথা বলিস?

তেমন কিছু না। বেশির ভাগ সময়ই সিনেমার ড্রেস, মেকআপ–এই সব নিয়ে কথা হয়। আপনি তো জানেনই হৃদি আপুর সাজগোজ কত পছন্দের। আপু সারাক্ষণই ওই হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের সাজগোজ দেখেন, আর সেসব নিয়েই কথা বলেন।

অবন্তীর উত্তর শুনে রোখসানা বেগম চুপ করে গেলেন। তার এখন মনে হচ্ছে, অবন্তীও তার সঙ্গে সত্যি কথা বলছে না। হৃদি নিশ্চয়ই তাকে আগেভাগেই সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে। না হলে এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে এত মিথ্যে কথা সে বলতে পারত না। বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড মানসিক অশান্তি অনুভব করতে লাগলেন তিনি।

.

নেহাল ছেলেটা ভালো। এ যুগে এমন দ্র, শিক্ষিত ছেলে পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া ছেলের পরিবারও বিদেশে থাকে। সে বছর দুয়েকের জন্য কী একটা প্রজেক্ট নিয়ে দেশে এসেছে। প্রজেক্ট শেষ হলেই আবার চলে যাবে। এই সময়ের মধ্যে যদি বিয়েটা দিয়ে দেওয়া যেত, তাহলেই নিশ্চিন্ত। সমস্যা হচ্ছে, হৃদি নিজে ছেলেকে বলেছে যে তার বিয়ে হয়ে গেছে। এমন কথা শুনলে কোনো ছেলেরই আর সেই মেয়ের প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়। নেহালও বেশ দমে গিয়েছিল। কিন্তু রোখসানা বেগম জানেন, হৃদিকে অসম্ভব পছন্দ করে ফেলেছে সে। প্রথম দেখাতেই রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে গেছে। ফলে সুযোগটা নিলেন তিনি। সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, হৃদি মিথ্যে কথা বলেছে, বাবা।

নেহাল খুবই বিনয়ী ছেলে। সে বিনীত ভঙ্গিতেই বলল, কিন্তু আন্টি, সে যদি মিথ্যে কথাও বলে থাকে, তাহলে তার সেই মিথ্যে কথার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে? শুধু শুধু তো আর কেউ এত বড় মিথ্যে কথা বলবে না?

কারণ ছাড়া সে মিথ্যে কথা কেন বলবে? কারণ অবশ্যই আছে।

তাহলে? সে যদি সত্যি সত্যিই কারও সঙ্গে এনগেজড থেকে থাকে…।

কারণ মানেই তো শুধু অন্যের সঙ্গে এনগেজড বা প্রেম থাকা নয়, বাবা। নেহালকে থামিয়ে দিয়ে বললেন রোখসানা বেগম। আরও অনেক কারণই থাকতে পারে।

আর কী কারণ? নেহাল অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল।

তার বাবা যে ভয়াবহ অসুস্থ, তুমি নিজ চোখেই তো তাকে দেখেছ?

জি।

সে তার বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসে। একদম ছোটবেলা থেকেই, এক দিন তাকে দেখে থাকতে পারে না। তার ধারণা, সে দূরে কোথাও গেলেই আর ফিরে এসে বাবাকে দেখতে পাবে না। এই কারণে বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতেও চায় না। বন্ধুদের সঙ্গে কোনো ট্যুরেও না। এখন সেই মেয়ে যদি হঠাৎ বুঝতে পারে যে তাকে বিয়ের পরে সারা জীবনের জন্য বিদেশে চলে যেতে হবে, তাহলে সেটা কি সে সহজে মেনে নিতে পারবে? পারবে মেনে নিতে?

না। তা পারবে না। ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল নেহাল।

আসল ঘটনা হলো এই। এখন তুমিই বলো, সে যদি এ রকম উল্টাপাল্টা কিছু বলে, এ জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায়?

নেহাল কথা বলল না। তবে মনে মনে হৃদির প্রতি একধরনের সহানুভূতি অনুভব করতে লাগল সে। খানিক আগে যে মন খারাপের অনুভূতিটা তার ছিল, তা যেন ক্রমশই দ্রবীভূত হয়ে যেতে লাগল। রোখসানা বেগম বললেন, এই সব ব্যাপারে সে খুবই একগুঁয়ে। বিদেশে থাকতে হবে শুনেই অস্থির হয়ে গেছে। এমনিতে তোমাকে তার অসম্ভব পছন্দ। তুমি একটু ধৈর্য ধরো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

নেহাল তার কথায় আশ্বস্ত হলেও হৃদি আর অবন্তীর কথায় কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারলেন না রোখসানা বেগম। বরং সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে। এত বড় একটা ব্যাপার, অথচ অবন্তীকে কিছুই বলে নি সে? কথাটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না রোখসানা বেগমের। তিনি দুঃখী দুঃখী গলায় অবন্তীকে বললেন, তুই তো আমাদের সবই জানিস। জানিস না?

কী বিষয়ে, খালা?

এই যে বাড়ি, তোর খালুর অসুস্থতা…। তোর রাতুল ভাইয়ার বিদেশে চলে যাওয়া। তারপর সেখানে গিয়ে বিয়ে করা। সবই তো জানিস?

অবন্তী মাথা নাড়ল, জি।

রোখসানা বেগম বললেন, আমাদের কি আর কোনো ইনকাম আছে বল? এই বাড়ি ভাড়া দিয়েই তো সংসার চলে। তার ওপর রাতুলকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর সময় ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকাপয়সা লোন করতে হয়েছিল। সঙ্গে তোর খালুর চিকিৎসার খরচ। সব তো এই বাড়ির ওপর দিয়েই, না? তার ওপর এই বাজারে ও রকম দুটো মেয়ের পড়াশোনার খরচও কি কম?

রোখসানা বেগমের গলায় বেদনার সুর। তিনি ভাঙা গলায় বললেন, এখন আমার মাথায় কী দুশ্চিন্তা, একবার চিন্তা কর? কয়েক দিন পর তিথিরও তো বিয়ে দিতে হবে, তাই না? রাতুল তো কবেই আমাদের খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তোর খালুর ওই অবস্থা। এর মধ্যে আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন এই মেয়ে দুটোর

কী অবস্থা হবে? কোথায় যাবে তারা? কী করবে?

রোখসানা বেগম শেষের দিকে এসে প্রায় ভেঙে পড়লেন। তার গলা ভার। অবন্তী হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল। তিনি ভেজা গলায় বললেন, তুই একটু সত্যি করে আমাকে বল তো মা, হৃদির ঘটনাটা আসলে কী? তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই যে এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারে। অনিক নামের ওই ছেলেটার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

খালা, আমি সত্যিই জানি না। হৃদি আপু আমাকে কিচ্ছু বলে নি।

কিচ্ছু না?

না। এমনকি অনিক নামে কারও কথা আমি জানিও না। দেখিও নি কোনো দিন।

রোখসানা বেগম আর কথা বললেন না। তিনি উঠে সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিথি কলেজ থেকে ফিরছে। তার হাতে একগাদা বই। সম্ভবত আবারও নীলক্ষেতে গিয়েছিল সে। এই এক অভ্যাস সে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। দিনরাত গল্পের বই পড়বে। কিন্তু এই গল্পের বই পড়তে গিয়ে যে তার আসল পড়ার বারোটা বেজে যাচ্ছে, সে খেয়াল নেই। বিষয়টা নিয়ে ভীষণ বিরক্ত রোখসানা বেগম। আজ যেন বিরক্তির মাত্রাটা আরও বাড়ল। তিথি ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, কই গেছিলি তুই?

কেন? কোচিংয়ে।

কোচিং থেকে ফিরতে এত দেরি? কটা বাজে এখন?

সন্ধ্যা ছটা।

তো, এতক্ষণ কী করছিলি?

নীলক্ষেত গিয়েছিলাম।

নীলক্ষেত কী?

কিছু পুরোনো বই কিনে আনলাম।

কী বই?

গল্পের।

এখন তোর গল্পের বই পড়ার সময়?

গল্পের বই পড়ার জন্য আলাদা কোনো সময়ের দরকার হয় না, মা। গল্পের বই পড়ার জন্য দরকার হয় ইচ্ছার। আর ইচ্ছা যেকোনো সময়ই হতে পারে।

তোর না সামনে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা?

হুম। তাতে কী?

তাতে কী মানে, এই সময়ে কেউ গল্পের বই পড়ে? পরীক্ষার পরে পড়া যাবে না?

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের পরই আমার জীবনের সব পরীক্ষা শেষ না, মা। এরপর সেকেন্ড ইয়ারের হাবিজাবি নানান পরীক্ষা। তারপর বোর্ড ফাইনাল। তারপর ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন টেস্ট। তারপর আবার পরীক্ষা। তারপর আবার। এই পরীক্ষার শেষ নেই, মা। জীবনভর চলতেই থাকবে। কিন্তু বই পড়ার এই ইচ্ছেটা আর। জীবনভর থাকবে না। বনফুলের পাঠকের মৃত্যু গল্পের কথা শোনো নি? সময়, বয়স, রিয়েলিটি কী করে মানুষের পাঠকসত্তাটাকে মেরে ফেলে? এই জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যখনই বই পড়তে ইচ্ছে করবে, পড়ে ফেলব। পরীক্ষা এবার না হলে পরেরবার দেওয়া যাবে। কিন্তু বই পড়ার এই ইচ্ছে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। বয়স। যত বাড়ে, জীবনের নানান যন্ত্রণায় বই পড়ার ইচ্ছে তত কমে। এইটা একটা বাজে রকম সত্য, মা।

এই কথা তোকে কে বলেছে?

কে বলবে, আমি নিজেই আবিষ্কার করেছি। চারপাশের মানুষদের দেখে বুঝতে পারছি। খুব কম মানুষেরই বয়স হওয়ার পরও বই পড়ার ওই আগ্রহটা টিকে থাকে। বেশির ভাগ মানুষেরই থাকে না। কেন, তুমি নিজেও তো বলো, আগে কী বই পড়তাম! দিনরাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতাম। কিন্তু এখন পাঁচ মিনিটের বেশি দশ মিনিট কোনো বইতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। কী, বলো না?

রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে তিথির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েও কি বয়স বাড়ার সাথে সাথে হৃদির মতো হয়ে যাচ্ছে? একগুঁয়ে, বেপরোয়া? আগে তো সে মুখের ওপর এমন তর্ক করত না? যা বলতেন, চুপচাপ সব মেনে নিত। আজ তাহলে কী হয়েছে তার?

সেই সারাটা সন্ধ্যা প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে কাটল তার। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অস্থিরতা আরও বাড়ল। এর অবশ্য কারণও আছে। তিনি রাতে চুপি চুপি তিথির ঘরে গেলেন। সে তখন টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। মাকে দেখেই দেয়ালে হেলান দিয়ে উঠে বসল। তারপর আনমনা ভঙ্গিতে বলল, কিছু বলবে, মা?

হুম।

বলো।

আগে বইটা বন্ধ কর তুই।

তিথি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বই বন্ধ করল। রোখসানা বেগম বললেন, তুই অনিক নামের কাউকে চিনিস?

কোন অনিক?

হৃদির সঙ্গে পরিচয় আছে। ওর কোনো বন্ধু বা সিনিয়র এমন কিছু?

ওহ। অনিক ভাইয়া? খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল তিথি। হ্যাঁ, চিনব না কেন? খুব ভালো করেই চিনি।

রোখসানা বেগম ভারি অবাক হলেন। নিজেকে এবার তার সত্যি সত্যিই বোকা মনে হচ্ছে। ওই ছেলের কথা তাহলে তিথিও জানে!

হুম। তুই তাকে চিনিস কী করে?

ভাইয়া তো আমাদের কোচিংয়েই পড়ায়। অবশ্য বেশ কিছুদিন হলো তিনি পড়াতে আসছেন না। সম্ভবত তার বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে। আর হৃদি আপুই তো আমাকে ওই কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিল! তুমি জানো না?

না।

আপুর তো খুব ভালো বন্ধু উনি। অনেক আগে আমাদের বাসায়ও একবার এসেছিলেন। তুমি ভুলে গেছ।

রোখসানা বেগম এবার আর কথা বললেন না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, মনে মনে তিনি যা আশঙ্কা করছিলেন, ঘটনা তা-ই। এই ছেলের সঙ্গে হৃদির গুরুতর কোনো ব্যাপার আছে। বিষয়টা আর হেলাফেলার পর্যায়ে নেই।

বাবার মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে লাগল অনিক। সে এখন নিশ্চিত, তার কারণেই মারা গেছেন বাবা। তার ওপর প্রচণ্ড অভিমান, হতাশায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই টাকা উপার্জনের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই পথই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

সেদিন ছাত্তার মিয়ার কথা শোনার পর থেকে আর একমুহূর্তও স্থির হতে পারে নি। সে। সারাক্ষণ কেবল মনে হয়েছে সে নিজ হাতে বাবাকে খুন করেছে। হ্যাঁ, খুনই। অনিক এখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে সে জানে না কারা তার বাবাকে খুন করেছে, কেন খুন করেছে? সে শুধু এটুকুই জানে, এই খুনের জন্য দায়ী মূলত সে নিজে। আজ যদি সে সত্যি সত্যিই সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারত, তাহলে বাবাকে আর এভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠতে হতো না। তিনি তখন নিশ্চিন্তে গ্রামে ফিরে যেতে পারতেন।

এই ভাবনাগুলো তাকে প্রতিমুহূর্তে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খেতে লাগল। একটা তীব্র অক্ষম আক্রোশ আর অপরাধবোধ ক্রমশই ভেতরে-বাইরে সংকুচিত করে ফেলতে লাগল। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারল না সে। এমনকি হৃদিকেও না। হৃদি অবশ্য বুঝতে পারছিল অতলান্ত এক বিষাদ-সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে অনিক। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই গভীর জলের অন্ধকার থেকে তাকে টেনে তুলতে পারে না সে।

সেদিন সন্ধ্যায় ভারী বৃষ্টিপাত হলো। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের ভেজা আলো। সেই আলোতে তারা বসে ছিল নির্জন চওড়া ফুটপাতে। তাদের সামনে দিয়ে টুংটাং শব্দে চলে যাচ্ছিল নীল পলিথিনে মোড়া রিকশা। অনিক হঠাৎ বলল, মৃত্যুর সবচেয়ে খারাপ দিক। কি জানো?

হৃদি জবাব দিল না। তবে চোখ তুলে তাকাল। অনিক বলল, মৃত্যুর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো তুমি ছাড়া তোমার আশপাশের আর সবাই রয়ে যাবে। কেবল তুমিই থাকবে না।

এ কথা কেন বলছ?

কেন বলছি তা জানি না। তবে এই যে কেউ মরে যাওয়ার পরও পৃথিবীর আর সবকিছু ঠিক আগের মতোই থাকে, কিছুই বদলায় না, এটা খুব কষ্টকর না?

হৃদি কথা বলল না। সে একদৃষ্টে অনিকের দিকে তাকিয়ে রইল। অনিক কেমন উদ্দেশ্যহীন গলায় বলল, এই যে বৃষ্টি…ওই যে দেখো রাস্তার ওপর জমে থাকা পানিতে ল্যাম্পপোস্টের আলো, গাড়ির লালরঙা ব্যাক লাইটের আলোর সঙ্গে ওই আলো মিলেমিশে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য তৈরি করেছে। রিকশার নীল পলিথিনগুলো চকচক করছে। টুংটাং শব্দগুলোও শুনতে কী ভালো লাগছে, তাই না? অথচ ভাবো, আমরা মরে গেলে কেবল আমরাই থাকব না, আর সবকিছু ঠিক এমনই থাকবে! এমনই আলো ঝলমলে, রঙিন!

তুমি এমন কেন করছ, অনিক?

কেমন?

এই যে, আজকাল প্রায় সারাক্ষণই তুমি মৃত্যুর কথা বলো।

সারাক্ষণ?

হুম। মানুষ কখন এত মৃত্যুর কথা বলে, জানো?

কখন?

যখন তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। যখন সে ভয়ানক কোনো যন্ত্রণায় ভোগে। যখন তার মনে হয় মৃত্যু ছাড়া এই যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায় তার নেই।

অনিক এই কথায় চুপ করে যায়। হৃদি কী ভেবে কথাটা বলেছে সে জানে না। তবে তার মনে হয়, হৃদির কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি সত্যিই তার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সে কতগুলো সম্পর্কের জালে আটকে আছে। দায়িত্বেরও। চাইলেই এই দায়িত্ব আর সম্পর্কের জাল ছিঁড়ে বের হয়ে যাওয়া যায় না। মা আর আয়েশার সঙ্গে কত দিন কথা হয় না তার! অথচ এই সময়ে তাদের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি কথা বলা দরকার ছিল। কিন্তু যতবার সে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেছে, ততবারই মনে হয়েছে এই বুঝি মা তাকে বলবে, অনিক, তুই কি জানিস তোর বাবা কেন খুন হয়েছে? সে খুন হয়েছে তোর কারণে!

কথাটা মাথায় এলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মনে হয় এই কথাটা সারাক্ষণ তার বুকের ভেতর বাজতে থাকে। তীব্র যন্ত্রণার কাটা হয়ে বিধতে থাকে মুহূর্মুহূ। ওই যন্ত্রণা থেকে আর পরিত্রাণ মেলে না। কিন্তু অনিক জানে, যে করেই হোক মাকে আর আয়েশাকে ভালো রাখতে হবে তার। ভালো রাখতে হবে হৃদিকেও। যেভাবেই হোক, হৃদির সঙ্গে জীবনের সবচেয়ে পারস্পরিক, সবচেয়ে সংবেদনশীল সম্পর্কটাতে জড়িয়েছে সে। এই সম্পর্কে তার দায়িত্বও একটু বেশি। কিন্তু এখন অবধি সেই দায়িত্বের ছিটেফোঁটাও পালন করতে পারে নি সে। বরং হৃদি একাই যেন সবকিছু ধরে রেখেছে। রোজই বাসায় নানান ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে। তবে সেসবের বেশির ভাগই নিজের মধ্যে চেপে রাখে সে। সচরাচর বলে না। কিন্তু অনিক বোঝে। আর বোঝে বলেই আরও অসহায় লাগে তার।

হৃদি বলল, আমাদের জীবনে যা ঘটে গেছে, সেসব কি আমরা বদলাতে পারি, অনিক?

অনিক মাথা নাড়ল, না।

তাহলে যা বদলাতে পারবে না, সেসব নিয়ে না ভেবে যা এখনো বদলানো সম্ভব, সেসব নিয়েই কি ভাবা উচিত নয়?

অনিক কথা বলল না। হৃদি বলল, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এভাবে বসে থাকলে হবে?

উঁহু।

তাহলে?

তাহলে কী? অসহায় ভঙ্গিতে বলল অনিক, কী করব আমি?

তুমি আবার পড়াশোনাটা শুরু করবে। অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করো। তখন যেকোনো একটা চাকরিতে ঢুকে যেতে পারবে। তোমার ওপর দায়িত্ব তো আর কম নয়? তা ছাড়া…।

তা ছাড়া কী?

বাড়িতে খুব সমস্যা হচ্ছে আমার। কথাটা আমি তোমাকে বলতে চাই নি। এমনিতেই তুমি খুব খারাপ সময় পার করছ। কিন্তু আমি সত্যিই জানি না এভাবে আর কত দিন সামলাতে পারব!

এই কথায় আবারও চুপ করে গেল অনিক। এসব যে সে বোঝে না, তা নয়। কিন্তু ভেতর-বাইরে রোজ যেভাবে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সে, তাতে তার পক্ষে আবারও শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়ানো কঠিন। হৃদি হঠাৎ তার কাছে সরে এল। তারপর বলল, তোমাকে একটা সত্যি কথা বলব?

হুঁ।

এই যে তোমার জন্য আমার এত কষ্ট হয়, এই যে তোমাকে আমি এমন পাগলের মতো ভালোবাসি, এর কারণ আমি জানি না। আমার কাছে এগুলো সব জটিল ধাঁধার মতো মনে হয়।

কেন?

কারণ, আমি তো এমন মেয়ে নই।

কেমন মেয়ে তুমি?

আমি খানিক তরল, অগভীর। বলে সামান্য হাসল হৃদি। তারপর বলল, মানে সবাই তা-ই বলে। জীবনে কখনোই তো কিছু নিয়ে তেমন সিরিয়াস হই নি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে করেছি। পরে কী হবে ভাবি নি। আর এসব কারণে আমাকে নিয়ে বাসার সবাই খুব ভয়েও ছিল। এমনকি তোমাকে যখন হুট করে ভালো লেগে গেল, তখনো মনে হয়েছিল এটাও তেমন কিছুই। দুদিন বাদেই ওই ঝোঁকটা কেটে যাবে। কিন্তু তারপর কী হলো, জানো?

কী?

তোমার জন্য আমার কেমন কষ্ট হতে শুরু করল। সারাক্ষণ কেবল মনে হতো, তোমাকে ছাড়া আমি দম নিতে পারছি না। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যথা। কী আশ্চর্য, বলো তো? আমি তো আর বারো-তেরো বছরের কিশোরী মেয়ে নই যে আমার অমন হবে। তাহলে?

অনিক হৃদির এই প্রশ্নের জবাব দিল না। হৃদিই বলল, আমি তোমাকে একটা ঝোঁকের মাথায় ভালোবেসেছিলাম। ভেবেছিলাম, কদিন পরেই ওই ঝোঁকটা কেটে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানো, দিন যত যেতে লাগল, আমার আসক্তি তত বাড়তে লাগল। মনে হতে লাগল, তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।

এখন কী মনে হয়?

এখন মনে হয় আমার নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো সমস্যা আছে।

কেন?

না হলে তোমার মতো এমন একটা গুড ফর নাথিংকে কেউ এভাবে ভালোবাসতে পারে? বলে হাসল হৃদি। তোমার কী মনে হয়, আছে কোনো কারণ?

অনিক কথা বলল না। হৃদি বলল, কী, মন খারাপ হলো?

কেন?

কারণ, পৃথিবীতে কারণ ছাড়া কিছু ঘটে না। তা যা-ই হোক না কেন। সব সময় যে আমরা বিজয়ী মানুষটাকেই ভালোবাসি, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় পরাজিত মানুষটার প্রতিও আমাদের মায়া হয়। হয় না?

তোমার প্রতি আমার তাহলে কী–মায়া, না ভালোবাসা?

তা তো জানি না। তবে আমি তো পরাজিত মানুষ। তোমার চারপাশে এত এত আলো-ঝলমলে বিজয়ী মানুষ যে সেখানে আমি খুব মলিন, বিবর্ণ। তবে কী হয়, জানো?

কী?

অনেক কোলাহল আর আলোর ভিড়েও আমরা কিন্তু খানিক নির্জনতা খুঁজি। মনে হয়, একটু অন্ধকার বা আড়াল পেলে খানিক জিরিয়ে নেওয়া যেত। বলে থামল অনিক। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমার এই আলো-ঝলমলে জীবনে আমি হয়তো ওই মলিন নির্জনতাটুকু।

কথাটা কী যে ভালো লাগল হৃদির! তোমার এই আলো-ঝলমলে জীবনে আমি হয়তো ওই মলিন নির্জনতাটুকু। কে জানে, অনিকের কথাই হয়তো ঠিক। না হলে তাকে কেন এভাবে ভালোবাসবে সে?

মাঝেমধ্যে এত সুন্দর করে কথা বলে অনিক যে কেবল তন্ময় হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, এই কারণে কি তাকে ভালোবাসা যায়? হৃদি জানে না। তবে অনিককে। স্বাভাবিক করে তুলতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে সে। কখনো পারে, কখনো পারে না। এই যে এখন তার মনে হচ্ছে অনিক যেন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এই মানুষটা অদ্ভুত মায়াময়। বিষণ্ণও। তবে এই বিষণ্ণতার একটা আকর্ষণ আছে। তার চারপাশের মানুষকে পাখির পালকের মতো আদুরে স্পর্শে ছুঁয়ে দেয়। হয়তো সেই স্পর্শেই ঝুঁদ হয়ে আছে হৃদি। আচ্ছা, অনিকের প্রতি এই যে তন্ময়তা, এই তন্ময়তা কি কখনো কেটে যাবে? আর যদি যায়, তখন কী করবে সে?

অনিক বলল, আমাকে এমন ভালোবাসো বলে কখনো আফসোস হয় না?

হয়। বলে হাসল হৃদি।

তাহলে?

তাহলে কী?

তারপরও ভালোবাসো কেন?

ভালোবাসা কি হিসাব কষে হয়?

হয়। জগতে কত মানুষই তো হিসাব কষে ভালোবাসে।

আমি বাসি না। আমার ভালোবাসা অফুরন্ত, বেহিসেবি। যুক্তিহীনও।

যা অফুরন্ত, বেহিসেবি, তার মূল্যটাও কিন্তু একটু গোলমেলে। মানে সহজে মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।

তা কেমন?

এই যে ধরো এক সমুদ্র জল, তা অফুরন্ত। কিন্তু মানুষের কাছে তার চেয়েও মূল্যবান হয়ে ওঠে এক বোতল সুপেয় পানি। তাই না?

উল্টো যুক্তিও আছে।

কিন্তু তুমি তো বললেই যে তুমি ভালোবাসায় যুক্তিহীন।

কে জানে, হয়তো ওই যুক্তিহীনতার কোথাও অগোচরে যুক্তিও আছে, যা আমি বুঝতে পারি না।

একদম। জগতে যুক্তিহীন বলে আসলে কিছু নেই। বেহিসেবিও না। এখানে সবকিছুই ফুরন্ত। আর যা ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তা অসীম কোনো কিছুর চেয়ে অধিক মূল্যবান। অধিক আরাধ্য।

তাহলে…। বলে খানিক ভাবল হৃদি। তোমাকে যে ভালোবাসি, তা সসীম, যৌক্তিক হলে বেশি মূল্যবান হতো?

অনিক এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে বলল, যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে, তাকে আমরা যতটা ভালোবাসি, ততটা ভালো কি তাকে বাসতে পারি যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে না? মানে যে আমাদের জীবনে গ্রান্টেড হয়ে থেকে যায়?

প্রশ্নটা যেন ঠক করে বুকে এসে বিঁধল হৃদির। এভাবে তো কখনো ভাবে নি সে। আসলেই তো, অনিককে হারিয়ে ফেলার ভয় সে কখনো করে নি। সব সময়ই মনে হয়েছে, এই সম্পর্কের নিয়ন্ত্রক সে। তাকে ছেড়ে যাওয়ার ক্ষমতা অনিকের নেই। বরং এই সিদ্ধান্তটা পুরোপুরিই তার। কিন্তু কই, তারপরও তো কখনো তাকে কম ভালোবাসে নি সে? কথাটা বলল হৃদি, তোমার কী মনে হয়, আমাদের সম্পর্কে কে গ্রান্টেড? আর কার হারানোর ভয় নেই?

অনিক মৃদু হাসল, এ তো সহজ প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না। ওটা এমনি এমনিই জানা থাকে সবার।

তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো? প্রশ্নটা করল হৃদি।

আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব? আর তুমি আমার কাছে গ্রান্টেড? তোমার কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই নেই?

অনিক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা ভেজা পাতা তুলে নিল দুই আঙুলের চিমটিতে। তারপর বলল, এই যে দেখো, এই পাতাটাতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। কিন্তু পানিটুকু ক্রমশই বাষ্প হয়ে উড়ে চলে যাবে। পাতাটা পড়ে থাকবে এখানে। এটা সবাই জানে। হয়তো পাতাটাও। কিন্তু তারপরও সে কি কখনোই বৃষ্টি হলে ওই পানিতে বুক না ভিজিয়ে পারে?

কথাটা শুনে হৃদির ভীষণ মন খারাপ হলো। এই যে সে এত যুদ্ধ করছে, এত যন্ত্রণা সইছে, কার জন্য? অনিকের জন্যই তো! অথচ সেই মানুষটাই কিনা এমন অকপটে, এমন সহজে তার সকল অনুভূতি প্রশ্নবিদ্ধ করছে!

অনিক বলল, তুমি মন খারাপ কোরো না, প্লিজ। আমার খুব ভয় হয়, হৃদি। খুব ভয়।

কেন?

কারণ, তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যাব। এই জগতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার। এই যে আমি এত খারাপ সময় পার করছি, বুকের ভেতর সারাক্ষণ অসহনীয় এক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি, তারপরও কী মনে হয়, জানেনা?

কী?

মনে হয়, তুমি আছ। আমার মন খারাপ হলে, রাতদুপুরে হঠাৎ কান্না পেলে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব। তুমি আমাকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখবে। তোমার ওইটুকু স্পর্শ, ওইটুকু কথা আমাকে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর এক অতল অন্ধকার থেকে টেনে তোলে। এমন একটা মানুষকে যদি আমি হারিয়ে ফেলি? যদি সে আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যায়, তখন কোথায় যাব আমি? কী করব?

অনিকের গলা কাঁপছে। ল্যাম্পপোস্টের ভেজা ম্লান আলোয় তার চোখ জোড়া ছলছল করছে। হৃদি হঠাৎ তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, অনিক। কোথাও না। কখনো না।

অনিক হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল যেন। তার কম্পমান শরীরের প্রতিটি স্পন্দন কী গভীর আশ্লেষে ছুঁয়ে যেতে লাগল হৃদিকে। হৃদি তার কাঁধে অনিকের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। ওই স্পর্শে কী ছিল সে জানে না। সে কেবল জানে, এই মানুষটা তার। এই মানুষটার সকল দুঃখ, শোক, সন্তাপ তার। সে। তার জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি এই মানুষটাকে তার সর্বস্ব দিয়ে এভাবেই আগলে রাখবে। তাতে তার যত কষ্ট হোক। যত ঝড়-ঝঞ্ঝা, যুদ্ধ-যন্ত্রণাই আসুক না কেন, এই মানুষটাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবে না সে।

তিথি বলল, তোমার ইউনিভার্সিটি কেমন লাগছে?

অবন্তী হাসল, শহুরে জীবন খুব জটিল। না?

কী জানি? আমার তো সেটা আলাদা করে বোঝার কথা না। ছোট থেকে তো এখানেই বড় হয়েছি।

হুম। এখানে সবকিছুতেই কেমন তাড়া মানুষের। যেন কারোরই একটু থমকে দাঁড়ানোর সময় নেই। কারও কথা শুনবার কিংবা বুঝবার ফুরসত নেই।

এটা কেন বলছ?

হঠাৎ মনে হলো।

উঁহু। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তুমি কি এর মধ্যেই কারও প্রেমেট্রেমে পড়ে গেলে নাকি?

অবন্তী মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। সে হলে ওঠার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ করে জমা দিয়েছে। হৃদি কী এক কাজে ব্যস্ত বলে আজ তিথিকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে সে। তিথি বলল, কী হলো, জবাব দিচ্ছ না যে?

কী জবাব দেব?

কারও প্রেমেট্রেমে পড়েছ?

হুম।

কার?

নির্জনতার।

মানে কী?

মানে হলো আমার এত মানুষ, এত কোলাহল ভালো লাগে না, তিথি। এই শহরে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তোদের বাড়িটা। এত শান্ত, চুপচাপ। মনে হয় সারাক্ষণ ওখানেই বসে থাকি। গ্রামে বসে আলাদা করে নির্জনতার এই অনুভূতিটা এভাবে টের পাওয়া যায় না। এখানে যায়। কারণ, চারদিকের কোলাহলের মধ্যে ওইটুকু খুব শান্তি দেয়। আর মা-বাবার জন্য খুব মন খারাপ হয়। মনে হয়, যদি চড়ুই পাখির মতো ফুড়ৎ করে উড়ে চলে যেতে পারতাম!

তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছ?

একদমই না। শোন, ক্লাস কেবল শুরু হলো। আমি এখনো এই বিল্ডিং থেকে সেই বিল্ডিং, এই ফরম থেকে সেই ফরম পূরণ করতে করতেই শেষ। প্রেম করব কখন?

তুমি এত মিষ্টি! দেখো প্রেম তোমাকে করতে হবে না, উল্টো তোমার ওপর এসেই রাজ্যের প্রেম হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

অবন্তী হাসল, তাহলে তো ভালোই। এসব নিয়ে তোর যা আগ্রহ, আমি না হয় আমার ওই রাজ্যের প্রেম থেকে তোকে কিছু ট্রান্সফার করে দেব।

তুমি অনিক ভাইয়াকে চেনো?

অনিক ভাইয়া? কপাল কুঁচকে তাকাল অবন্তী। নাহ।

হৃদি আপু তোমাকে কিছু বলে নি?

কী বলবে?

সত্যি বলে নি?

নাহ্। তবে ওই দিন খালাও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি সত্যিই জানি। অবশ্য খালা মনে হয় না আমার কথা বিশ্বাস করেছে!

হুম। বলে সামান্য চুপ করে রইল তিথি। তারপর বলল, মায়ের ধারণা, অনিক ভাইয়ার সঙ্গে হৃদি আপুর কোনো ব্যাপার আছে। মজার ব্যাপার কী, জানো?

কী?

আমি এই এত দিন ধরে অনিক ভাইয়াকে চিনি। তার সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হতো আমার। আমাদের কোচিংয়ে পড়ায়। ইদানীং কী একটা ঝামেলা হওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে আসছে না। তো সেই অনিক ভাইয়ার সঙ্গে যে হৃদি আপুর কিছু থাকতে পারে, এটা আমার মাথায়ই আসে নি। ইনফ্যাক্ট, তেমন কিছু কখনো ধরতেও পারি নি আমি।

কিন্তু খালা না হৃদি আপুর জন্য ছেলে দেখছে?

সমস্যাটা তো সেখানেই। হৃদি আপু নাকি সেই ছেলেকে বলেছে যে তার বিয়ে হয়ে গেছে।

ধ্যাৎ! কী বলছিস তুই?

হুম। তুমি সত্যিই কিছু জানো না? হৃদি আপুর সঙ্গে তোমার এত ভাব, অথচ সে তোমাকে কিছু বলে নি?

উঁহু। তোকেও তো বলে নি!

আমাকে? আমাকে এই সব বলবে ও? ঠোঁট উল্টে বলল তিথি। তুমি জানো কিছু?

কী জানব?

হৃদি আপু তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না। ওর একটা জামা পর্যন্ত ধরতে দেয় না আমাকে। ওর ঘরভর্তি কত কত মেকআপ, পারফিউম। কিন্তু কিছু ছুঁতে দেবে না। এই জন্য ওর ঘরে ও তালা পর্যন্ত মেরে রাখে।

কী বলিস?

হুম। আর ও আমাকে বলবে ওর প্রেমের কথা?

খালা এখন কী করবে?

মা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে বোঝাতে। মার ধারণা তুমি কিছু না কিছু জানোই।

ওহ্। বলে হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অবন্তী। বলল, কী করি আমি, বল তো?

হৃদি আপুর ফোনটোন চেক করতে পারো। কিছু না কিছু পাবেই। তুমি তো ওর সঙ্গেই থাকো রাতে।

ছি! এটা কী কথা হলো, তিথি? আমি হৃদিপুর ফোন সার্চ করব? এটা আমি মরে গেলেও পারব না।

তাহলে আর কী! আমাকেই করতে হবে। বলে হাসল তিথি।

তারা একটা বাঁধানো বেঞ্চি দেখে বসল। খাঁ খাঁ দুপুর হলেও মৃদু হাওয়া বইছে। শুকনো পাতা উড়ে এসে ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। দৃশ্যটা ভারি সুন্দর। তবে সেই সুন্দর দৃশ্যের ভেতর বাঁ হাতে চোখ ঢেকে যে ছেলেটি এগিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল তিথি। সে চিৎকার করে ডাকল, অনিক ভাইয়া।

অনিক থমকে দাঁড়াল। তারপর বলল, তুই এখানে? তিথি বসা থেকে উঠে সামান্য এগিয়ে গেল। বলল, অবন্তী আপুর সঙ্গে এলাম। আমার খালাতো বোন। এবারই এখানে ভর্তি হয়েছে।

ওহ্। বলে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল অনিক। সৌজন্যের হাসি। তবে কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখাল না। তারপর তিথিকে বলল, তোর পড়াশোনা কেমন। চলছে?

আমার পড়াশোনার কথা বাদ। তার আগে বলো তুমি হঠাৎ কোথায় উধাও হলে?

কোথাও উধাও হই নি। তবে কোচিংটাতে আর পড়াব না ভাবছি।

কেন, কেন? উদ্বিগ্ন গলায় বলল তিথি।

অনেক পরিশ্রম হয়ে যায়। রাত জেগে জেগে লেকচার শিট তৈরি করতে হয়। তার ওপর গুচ্ছের ক্লাস, পরীক্ষা। এত এত খাতা দেখা। এসব করতে গিয়ে আমার পড়াশোনার বারোটা বেজে গেছে।

কী করবে তাহলে?

আদু ভাই হওয়ার আগেই পাসটাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।

আদু ভাই হওয়ার আর কী বাকি রেখেছ? বলে টিপ্পনী কাটল তিথি। তোমার ক্লাসমেটরা সবাই পাস করে চাকরিবাকরি করছে। কেউ কেউ বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার বাবাও হয়ে গেছে। তুমিও কিছু একটা করো। বিয়ে করতে হবে না?

অনিক হাসল, সবাইকেই কেন চাকরি করে বিয়ে করতে হবে? আমার মতো কেউ কেউ বিয়েটাকেই চাকরি মনে করে করে ফেলবে!

মানে কী? তুমি কি বিয়েটিয়ে করে ফেলেছ নাকি?

বিয়ে করে ফেলার বিষয় না। বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়। কেউ কেউ অনেক চেষ্টা করেও করতে পারে না। আবার কারও কারও ঘাড়ের ওপর এসে সিন্দবাদের ভূতের মতো চেপে বসে। তখন অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে নামানো যায় না।

তুমি কিন্তু কেমন রহস্য করে কথা বলছ। ঘটনা কী, খুলে বলো তো?

কোনো ঘটনা নেই। অনেক দিন পর তোর সঙ্গে দেখা। নানা কারণে মনটন খারাপ। এই জন্য একটু তরল রসিকতা করে মন ভালো করার চেষ্টা করছি।

তিথি অবশ্য অনিকের কথায় সন্তুষ্ট হলো না। সে বলল, হৃদি আপুর সঙ্গে কথা হয় তোমার?

কম।

আপু কিছু জানিয়েছে?

কী জানাবে?

আপুর যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?

কী! যেন শুনতে পায় নি এমন ভঙ্গিতে বলল অনিক। কার বিয়ে ঠিক হয়েছে?

হৃদি আপুর। কেন, আপু তোমাকে কিছু জানায় নি? তিথি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।

উমমম…। বলে সামান্য কী ভাবল অনিক। তারপর বলল, কবের ঘটনা এটা?

এই মাসখানেক তো হবেই। ছেলের নাম নেহাল। জার্মানি থাকে। আপুকে নিয়েই চলে যাবে। ওনার ফ্যামিলিও ওখানে থাকে। বিয়ের কথাবার্তাও সব ফাইনাল।

অনিক কী বলবে ভেবে পেল না। হৃদির সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছে দুদিনও হয় নি। সেদিন সন্ধ্যার ওই মুহূর্তটা যেন দীর্ঘদিন পর তাকে খানিক জীবনীশক্তি দিয়েছে। আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্পৃহা দিয়েছে। হৃদি তার বিয়ে করা বউ। সে চাইলেই হুট করে কাউকে বিয়ে করে ফেলতে পারে না। তেমন সম্ভাবনাও নেই। তা ছাড়া হৃদির প্রতি ওই বিশ্বাস তার আছে। সেদিন সন্ধ্যার পর সবকিছু আরও দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু তারপরও বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা স্পষ্ট দ্বিধার কাটা জেগে উঠতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও ওই অস্বস্তিটুকু উপেক্ষা করতে পারল না সে। নাকি ভেতরে ভেতরে সব সময়ই এই অনিশ্চয়তাটুকু ছিল তার? একধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধও? এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর অনিকের কাছে নেই। তবে সে টের পাচ্ছে, তিথির কথাটা চিরাচরিত অবিশ্বাস হয়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোয়ার মতো ক্রমশই তার বুকের ভেতর ছড়িয়ে যাচ্ছে। সে প্রায় মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, কই? না তো? আমি তো কিছু জানি না।

ওহ। কে জানে, আপু হয়তো তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই এত আগে কিছু বলে নি। তা ছাড়া বুঝতেই পারছ, বিয়েতে তো কত ধরনের উটকো ঝামেলা হয়। হয়তো সেসব এড়াতেই আগেভাগে কাউকে কিছু জানায় নি।

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেল অনিক। অনেক চেষ্টা করেও নিজের চেহারায় জেগে ওঠা বিমর্ষ ভাবটা লুকাতে পারছে না সে। এমন কেন হচ্ছে তার? হৃদিকে তো সে এত দিন ধরে চেনে! আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তাদের সম্পর্কটাও এখন অনেক বেশি সুসংহত। ক্রমশ স্থির আর শান্ত হয়ে উঠেছে হৃদি। আগের সেই ছটফটে, অগভীর মানুষটা যেন বুঝতে পারছে, এই কঠিন দুর্গম পথে সে-ই নাবিক। তাকেই শক্ত করে হাল ধরে রাখতে হবে। ফলে ধীরে ধীরে আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে সে। অনিকের এই চরম দুঃসময়ে যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে তাকে নিয়ে এমন সন্দেহ থাকা লজ্জারই। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ওই সংশয়টুকু যেন দূর করতে পারল না অনিক।

তিথি বলল, কী হলো? মন খারাপ হয়ে গেল তোমার?

না না, মন খারাপ হবে কেন?

এই যে আপু তোমার এত ভালো বন্ধু, অথচ তোমাকেই এখনো কিছু জানাল না?

আরে ধুর! স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল অনিক। একদমই তা না। আমি আসলে অন্য একটা বিষয় ভাবছিলাম। তার সঙ্গে পরে কথা বলি আমি?

আচ্ছা। বলে অনিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তিথি। অনিক অবশ্য অনেক চেষ্টা করেও কিছুই লুকাতে পারল না। বরং তার চোখেমুখে ক্রমশ আরও প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করল তীব্র একধরনের অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা। সে আর কারও দিকে তাকাল না। মাথা নিচু করে হনহন করে হেঁটে যেতে লাগল।

কে জানে, বাবার কারণে যে ভয়ানক মানসিক দশার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে, তা-ই হয়তো তাকে এমন নড়বড়ে করে দিল। না হলে তিথির ওইটুকু কথাতেই কী করে এমন এলোমেলো হয়ে গেল সে! এই এত দিনে হৃদিকে কি এতটুকুও চেনা হয় নি তার? বিশ্বাস করতে পারে নি? বিষয়টা বেশ ভাবাল অনিককে। মাথার ভেতর অসংখ্য ভাবনা ক্রমশ ডালপালা ছড়াতে লাগল। সেই ভাবনার কোনোটাকেই আর কোনোটা থেকে আলাদা করতে পারল না সে। ফলে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস, দ্বিধা আর দৃঢ়তা–সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল।

.

তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তিথি। অনিকের অবস্থা দেখে থমকে গেছে সে। মা যখন তাকে কথাটা বলেছিলেন, তখন কিছুতেই বিশ্বাস হয় নি তার। বরং মায়ের সঙ্গে তর্কই জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন অনিকের এই ব্যথাভার বিচলিত পাণ্ডুর মুখ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। মানুষটাকে অসম্ভব পছন্দ করে তিথি। সে কোনোভাবেই চায় না। তার কোনো ক্ষতি হোক। কিন্তু মাকে গিয়ে সে কী বলবে? যদি সত্যিই হৃদির সঙ্গে অনিকের কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে তাদের তা এখুনি প্রকাশ করা উচিত। না হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। হয়ে যাবে সমাধান-অযোগ্য।

তাদের হাতে অফুরন্ত সময়ও নেই যে তারা এই সম্পর্কটাকে এভাবে গোপন রেখে, প্রলম্বিত করে সুবর্ণ কোনো সময়ে গিয়ে সব ঠিক করে নেবে! বরং যা করার করতে হবে এখুনি। ভেতরে ভেতরে নেহালের সঙ্গে হৃদির বিয়ের প্রায় সবই ঠিক করে ফেলেছেন মা। অথচ তারা কেউ জানে না অন্য কোথাও অন্য কোনো গল্প আড়াল হয়ে আছে। সেই গল্পের পরিণতিতে কী আছে কে জানে!

খানিক আগে যে তিথি ফড়িংয়ের মতো ছটফট করছিল, সে-ই যেন মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেল। আনমনা ভঙ্গিতে অবন্তীর দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর বলল, চলো বাসায় যাই।

কেন, কোনো সমস্যা?

হুম।

কী হয়েছে?

কী হয়েছে এখনো জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে অনিক ভাইয়া আর হৃদিপুর মধ্যে সিরিয়াস কোনো ব্যাপার আছে। বিষয়টা এখুনি স্পষ্ট হওয়া উচিত। তারা হয়তো ভাবছে যে বিষয়টা লুকিয়ে রাখাই সমাধান। কিন্তু আমার ধারণা, এতে বরং সমস্যাটা। বাড়বে।

রিকশায় ফিরতে ফিরতে বাকি ঘটনাও শুনল অবন্তী। শুনে তার মনে হলো তিথির কথা সত্য। যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাতে অনিক আর হৃদিকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আসতে হবে। না হলে এই সমস্যা থেকে তাদের মুক্তি মিলবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হৃদির বিয়ের বিষয়ে অনিক কেন এখনো কিছুই জানে না? হৃদি কি তবে তাকে কিছুই জানায় নি? জানাল না কেন? প্রশ্নটা করল সে।

তিথি বলল, এটা আমিও বুঝতে পারছি না। একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছ?

কী?

এই যে তোমার সঙ্গে এত কিছু শেয়ার করে হৃদিপু, অথচ অনিক ভাইয়ার কথা কিছু বলল না?

এমন তো হতেই পারে। আপু হয়তো ভেবেছে আমি খালার কাছে বলে দিতে পারি। আবার কেউ কেউ আছে না, যারা নিজেদের প্রাইভেসি খুব মেইনটেইন করে। কাউকে কিছু বলে না।

তোমার মতো? বলে উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসল তিথি।

আমার মতো কেন হবে?

এই যে তুমিও আমাকে কিছু বলছ না। যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না। অথচ কদিন পরে দেখা যাবে হঠাৎ বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে বসে আছ।

এই…। কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল অবন্তী। বেশি পাকামো করবি না। ভুলে যাস না যে তুই আমার থেকে তিন বছরের ছোট।

আচ্ছা, আচ্ছা। ভুল হয়ে গেছে, বড়পা। বলে হাসি চাপল তিথি। তারপর হঠাৎ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, শোনো, আরেকটা কথা। ধরলাম হৃদিপু আমাদের কিছু বলে নি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বা ওই যে তার প্রাইভেসি। কিন্তু অনিক ভাইয়াকে তো অন্তত কিছু জানানো উচিত ছিল। তাই না? এই নেহাল ভাইয়ের ইস্যু তো আর আজকে থেকে না। মাসখানেক ধরেই বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াস কথাবার্তা হচ্ছে।

কী জানি! আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। তুই এখন কী করবি, খালাকে বলবি?

ভাবছি। তোমার কী মনে হয়, বলা উচিত, নাকি না?

একবার মনে হয় হ্যাঁ। আবার মনে হয় না।

তুমি তো আমাকে আরও কনফিউজ করে দিচ্ছ। আচ্ছা, মাকে বললে মার কী প্রতিক্রিয়া হবে বলে তোমার মনে হয়? তুমি তো মাকে চেনো?

প্রথমত খুব কষ্ট পাবেন। ওই দিন আমাকে অনেক কথা বলছিলেন। তারপর কী করবেন সেটা বুঝতে পারছি না। হয়তো…।

অবন্তী তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই মৃদু চিৎকারে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল তিথি। অবন্তী ভীত গলায় বলল, কী হয়েছে?

জানি না কী হয়েছে। তবে কিছু একটা তো হয়েছেই। বলে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল তিথি। তারা প্রায় বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সম্ভবত এ কারণেই তিথিকে বেশ নির্ভার লাগছে। সে পেছনের রিকশাটা কাছাকাছি আসা অবধি অপেক্ষা করল। তারপর সটান সেই রিকশার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিকশায় যে ছেলেটা বসে আছে, তার চেহারায় একটা ডাকাবুকো ব্যাপার আছে। পরনে ফ্যাকাশে নীল জিনস। কালো শার্ট। কিন্তু সে বসে আছে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। তিথিকে হঠাৎ এমন রুদ্রমূর্তিতে পথ আগলে দাঁড়াতে দেখে থতমত খেয়ে গেল সে। তিথি কঠিন গলায় বলল, আপনার সমস্যা কী?

জি? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটা।

আপনার সমস্যা কী?

আমার? আমার তো কোনো সমস্যা নেই।

সমস্যা নেই মানে? আপনি সেই কখন থেকে আমাদের পিছু নিয়েছেন? আপনার কি ধারণা, আমরা চোখে দেখতে পাই না? ঢাকা শহরে অন্ধ মেয়েদেরও পথ চলতে হলে চোখকান খোলা রাখতে হয়। আর আমরা তো চোখে দেখতে পাই। এখন বলেন, আপনার কী ঘটনা?

কোনো ঘটনা নেই।

কোনো ঘটনা নেই মানে? আপনি সেই ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের পিছু নিয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন। আর এখন আবার রিকশা নিয়ে আমাদের অনুসরণ করে একদম বাড়ি পর্যন্ত চলে আসছেন? অথচ বলছেন আপনার কোনো ঘটনা নেই?

সত্যি বলছি…।

ছেলেটা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই চারপাশ থেকে লোকজন হইহই করে উঠল। উত্তেজনায় বিষয়টা এতক্ষণ খেয়াল করে নি তিথি। তার কণ্ঠ শুনে চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। তারা ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। তিথি বলল, এই লোক আমাদের সেই ইউনিভার্সিটি থেকে ফলো করছে। আর তারপর আমাদের পিছু পিছু রিকশা নিয়ে এত দূর চলে এসেছে…।

তিথির কথা শেষ হওয়ার আগেই ভিড়ের মধ্য থেকে অতি উৎসাহী একজন বিচ্ছিরি শব্দে বকল ছেলেটাকে। আরেকজন তার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হলো। ছেলেটা লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। তাকে সেই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করল অবন্তী। সে তিথিকে বলল, উনি আমার পরিচিত, তিথি।

কী? অবাক গলায় বলল তিথি। তোমার পরিচিত?

হুম।

কে উনি?

বলছি। আগে লোকগুলোকে বিদায় কর।

তিথি মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত বোধ করলেও শেষ অবধি লোকগুলোর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তাদের বিদায় করল। তারপর বলল, ঘটনা কী, আপু? লোকটা সেই কখন থেকে আমাদের ফলো করছিল। তুমি ভয় পাবে দেখে আমি এতক্ষণ কিছু বলি নি।

আমি দেখেছি।

তুমিও দেখেছ? অবাক ভঙ্গিতে বলল তিথি।

হুম। বলেই ছেলেটার দিকে তাকাল অবন্তী। তারপর শান্ত গলায় বলল, আপনার কি মনে হয় কাজটা আপনি ঠিক করছেন?

ছেলেটা কথা বলল না। অবন্তী বলল, সবকিছুতেই পরিমিতি বোধ থাকতে হয়। ওটুকু না থাকলে ভালো কিছুও টক্সিক হয়ে যায়।

আমি সরি। কথা বলল ছেলেটা। সে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অবন্তী বলল, এটা সরি বলার মতো কোনো বিষয় না। উপলব্ধির বিষয়। কিন্তু আমার ধারণা সেই বোধ আপনার নেই। থাকলে এই ঘটনা আপনি আবারও ঘটাতেন না।

ছেলেটা কথা বলল না। তিথি খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের করণীয় ঠিক করতে পারছে না সে। তবে এটুকু স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে এই ছেলের সঙ্গে অবন্তীর বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে।

অবন্তী বলল, আপনি প্লিজ, এই কাজটি আর কখনো করবেন না। আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগে। মনে হয় সারাক্ষণ কেউ একজন আমার ওপর চোখ রাখছে। আপনিই বলুন, এমন কিছু যদি কেউ আপনার সঙ্গে করত, তাহলে কেমন লাগত আপনার?

ছেলেটা এবারও কথা বলল না। অবন্তী ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। সঙ্গে তিথিও। সে এখনো দ্বিধান্বিত। ছেলেটা যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল।

.

রাতে কী ভেবে তিথির ঘরে এল অবন্তী। তারপর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল, শোন?

হুঁ।

তুই আমাকে খুব খারাপ ভাবছিস, তাই না?

উঁহু। তা কেন?

না। মানে সবার সামনে তোকে আমি ওভাবে…।

আরে ধুর। এটা কোনো ব্যাপারই না। বলে হাসল তিথি। আমি কি আর জানতাম নাকি যে উনি তোমার পরিচিত!

আসলে…। বলে সামান্য থমকাল অবন্তী। যেন বুঝতে পারছে না কথাটা কীভাবে বলবে সে। উনি আমাদের কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মজিবর চাচার ছেলে। মঈন ওনার নাম। মজিবর চাচা হলো বাবার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।

আচ্ছা। নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করল না তিথি।

সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে খুব পছন্দ করতেন উনি। তো ওই সময়টাতে যা হয় আর কি, একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করত। ব্যাপারটা ঠিক প্রেম না। কিন্তু কেমন একটা লাগত সারাক্ষণ। মনে হতো, মানুষটার ওই আগ্রহটুকু থাকুক। আমি যে খুব পাত্তাটাত্তা দিতাম, তা না। বরং ইগনোরই করতাম। কিন্তু উনি অদ্ভুত সব কাণ্ড করতেন।

বলে সামান্য থামল অবন্তী। তার চোখের কোণে যেন একটা স্পষ্ট ভয়ের ছায়া। এসএসসিতে আমার রেজাল্টটা ঠিক আশানুরূপ হলো না। বিশেষ করে ইংরেজিটা। এই নিয়ে বাবা-মা খুব আপসেট হয়ে গেলেন। ফলে কলেজে উঠতেই আমার সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ল মজিবর চাচার ওপর। আমি ওনার কাছে পড়তে যেতাম। মঈন ভাই ঠিক শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ না। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগ ছিল না। ঢাকায় থাকতেন। তবে প্রায়ই বাড়িতে যেতেন। তখন দেখা হতো। একটু ডাকাবুকো স্বভাবের। ছাত্ররাজনীতি করতেন। সিগারেট-টিগারেট খেতেন। এই নিয়ে ওনাদের পরিবারেও খুব ঝামেলা হচ্ছিল। আর আমিও খুব গুটিয়ে থাকতাম। কিন্তু…।

কিন্তু কী?

উনি কখনো আমাকে কিছুতে জোর করেন নি। বরং যখন দেখতেন যে আমি ভয় পাচ্ছি বা গুটিয়ে যাচ্ছি, তখন উনিও আর এগোতেন না। দূরে দূরে থাকতেন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় কি জানিস?

কী?

এই যে আমি ওনাকে পছন্দ করতাম না, ওনার ওপর একধরনের বিরক্তি বা ভয়ই কাজ করত। অথচ সেই উনিই যখন দূরে সরে যেতেন, তখন খুব খারাপ লাগত আমার। মনে হতো, উনি কেন আগের মতো আমাকে গুরুত্ব দেন না।

তিথি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, খুব ইম্পর্ট্যান্স পেতে ইচ্ছে হতো, না?

হুম। তবে সেটা আমি সচেতনভাবে বুঝতে পারতাম না। ওনাকে দেখলে বরং বিরক্তিই লাগত। আর প্রচণ্ড রাগী ছিলেন। বাসার সবার সঙ্গে যখন-তখন রেগে যেতেন। রাস্তাঘাটেও। ফলে একটা ভয়ও কাজ করত। অথচ অবচেতনে আমি চাইতাম উনি আমার আশপাশেই থাকুন। আমাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিন।

তারপর?

তারপর একটা সময় গিয়ে…মানে ঠিক ও রকম প্রেম প্রেম ব্যাপার না…কিন্তু একটা সম্পর্ক হয়ে গেল আমাদের। আমি না আসলে তখনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কনফিউজড ছিলাম খুব। এই মনে হতো সব ঠিকই আছে। আবার পরমুহূর্তেই মনে হতো, না, আমি আসলে এটা চাই না। ওনাকে আমি পছন্দ করি না। এই সব। একটা প্রচণ্ড দ্বিধা কাজ করত সারাক্ষণ। নিজেকে বুঝতে না পারার ফলে যে অস্পষ্ট অনুভূতিটা হয় আরকি!

সম্পর্কটা ভাঙল কী করে?

এই প্রশ্নে চুপ করে গেল অবন্তী। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ধবধবে সাদা দেয়ালের দিকে। সেখানে একটা পোকা। পোকাটার পেছনে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে একটা টিকটিকি। টিকটিকিটা কি পোকাটাকে ধরে ফেলতে পারবে, নাকি তার আগেই উড়ে চলে যাবে সে?

কী এক ঝামেলায় হঠাৎ পুলিশ গ্রেপ্তার করল ওনাকে।

পুলিশ? প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় বলল তিথি। মানে কী? কী করেছিলেন উনি?

আমি ঠিক জানি না। নানাজন নানা কথা বলে। আমি সেদিনই মজিবর চাচার সঙ্গে লঞ্চে ঢাকায় আসছিলাম। আমার পরীক্ষা তত দিনে শেষ হয়ে গেছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হতে হবে। চাচা আমাকে ওনার এক স্টুডেন্টের কোচিংয়ে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে এলেন। খবরটা আমরা শুনতে পাই পরদিন। মাস কয়েক পর উনি ছাড়া পেলেন।

তারপর?

তারপর আর কী! বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অবন্তী। ঘটনা গ্রামে জানাজানি হয়ে গেল। ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হলো। মানুষের মুখে মুখে নানা কথা ছড়াতে লাগল। মা বাবাও সম্ভবত ওনার আর আমার ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ফলে ওনারাও…।

সব শেষ হয়ে গেল?

হুম।

ওনার সঙ্গে আর কথা বলো নি তুমি?

নাহ্।

কেন? তোমার কথা বলা উচিত ছিল না?

এই প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে রইল অবন্তী। দীর্ঘ সময়। তারপর বলল, ওই যে পোকাটাকে দেখছিস, দেয়ালে?

হুম।

পেছনের টিকটিকিটাকে?

হুম।

পোকাটা কী নিশ্চিন্ত, না! কিন্তু সে কি জানে যে ওই টিকিটিকিটা এখুনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?

তিথি এবার আর জবাব দিল না। সে বিভ্রান্ত চোখে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। অবন্তীর চোখের কোণে টলমল করছে জল। সে আলতো হাতে অবন্তীর হাতখানা ধরল। অবন্তী প্রায় ফিসফিস করে বলল, তুই প্লিজ, খালাকে কিছু বলিস না। আজকের ঘটনাটাও না।

তিথি মাথা নাড়ল, বলব না।

তার হঠাৎ মনে হলো, জীবনজুড়েই আশ্চর্য সব দুঃখ বুকে পুষে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায় মানুষ।

হৃদির বিয়ের ব্যাপারটা রোখসানা বেগম জানতে পারলেন পরদিন সন্ধ্যায়। তিথি অবশ্য তার আগে বাড়ি ফিরেই অস্পষ্ট একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মাকে। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না তিনি। বললেন, অন্য কোনো ব্যাপার আছে।

অন্য কী ব্যাপার?

আরও খারাপ কিছু।

আরও খারাপ কিছু কী, মা?

তা তো জানি না। তবে আমার মন কু ডাক দিচ্ছে। তুই হৃদির ভাবভঙ্গি দেখে কিছু বুঝছিস না?

কই? আমার চোখে তো কিছু পড়ছে না।

আমার চোখে পড়ছে।

কী?

হৃদি প্রায়ই বাসা থেকে কাপড় নিয়ে বের হয়।

মানে?

মানে ওর ব্যাগে এক-দুই সেট এক্সট্রা কাপড় থাকে।

তাতে কী? হয়তো টেইলারের দোকানে যায়। তা ছাড়া আপুর তো ইউনিভার্সিটিতে নানান প্রোগ্রাম থাকে। সেখানেও লাগতে পারে। পারে না?

পারে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে তো সে কোনো লুকোছাপা করে না। লুকোছাপা করে অন্য ক্ষেত্রে। একবার তিন্নিদের বাসায় গেল। তারপর ফোন করে বলল রাতে ফিরবে না। ফিরল পরদিন সন্ধ্যায়। তখন কী হলো, জানিস?

কী?

পরদিন সন্ধ্যায় সে যখন বাসায় ফিরল, দেখি তার পরনে অন্য জামা।

তাতে কী? আমি যদি আমার বান্ধবীর বাসায় এক রাতের জন্য যাই, তাহলে তার জামা পরতে পারি না? নাকি সঙ্গে করে আমার অন্য জামা নিয়ে যাব?

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন রোখসানা বেগম। বললেন, তার পরনে তার নিজেরই অন্য জামা ছিল। তার মানে কী? সে কি তিন্নিদের বাসায় যাওয়ার সময় নিজের আরেক সেট জামা নিয়ে গিয়েছিল?

এই কথায় চুপ হয়ে গেল তিথি। সে তার নিজের যুক্তির ফদেই আটকে গেছে। রোখসানা বেগম বললেন, ধরলাম রাতে থাকবে বলে সে নিয়ে গেছে। কিন্তু সে তো আর আগে থেকেই তিন্নির বাসায় থাকার প্ল্যান করে যায় নি। হঠাৎ করে থেকে গেছে। তাহলে সে জামা নিয়ে গিয়েছিল কেন?

তিথি দেওয়ার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পেল না। রোখসানা বেগম বললেন, আরও ঘটনা আছে।

কী ঘটনা?

আজ আমি কিছুক্ষণ আগে তিন্নির মায়ের সঙ্গে কথা বললাম। এটা-সেটা বলার পর হঠাৎ সেদিন রাতের কথা জিজ্ঞেস করলাম। মানে সরাসরি না। সে যাতে ঘটনা বুঝতে না পারে, এমনভাবে জিজ্ঞেস করলাম। সে কী বলল, জানিস?

কী?

সেদিন রাতে হৃদি তিন্নির বাসায় যায় নি।

কী বলো?

হুম।

তাহলে কোথায় গিয়েছিল আপু?

আমার ধারণা নেহালকে সে যা বলেছে, সেটাই সত্যি।

কী! আপু লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে?

হুম। সে ওই অনিক ছেলেটাকেই বিয়ে করেছে। সম্ভবত তাদের আলাদা কোনো বাসাও আছে। কিংবা অন্য কারও বাসায় মাঝেমধ্যে গিয়ে থাকে তারা।

এই কথায় তিথি থ হয়ে গেল। তার এখন মনে হচ্ছে মায়ের কথাই সত্যি। রোখসানা বেগম বললেন, এখন আমার আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। তখন সেসব মাথায় নিই নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ রকম আরও অনেক ঘটনাই আছে। তাকে কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে দেখতি আগে?

নাহ্।

কিন্তু আমি যখন বাসায় থাকতাম না, তখন সে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে রান্না করত। সেই রান্না সে কার জন্য করত? তার নিজের জন্য? নিজের জন্য তো সে জগ থেকে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খায় না। তাহলে?

তিথির কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না। কিন্তু তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে হৃদি সত্যি সত্যিই অনিককে বিয়ে করে ফেলেছে এবং সেটা সে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। কী আশ্চর্য, এত কাছে থেকেও তারা কেউ সেটা এত দিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি। রোখসানা বেগম হঠাৎ গুনগুন করে কাঁদতে শুরু করলেন। তিথি বলল, মা, এখন কী করবে?

কী করব?

হুম।

আমি গলায় দড়ি দেব।

তুমি গলায় দড়ি দেবে কেন?

কেন দেব জানিস না? আমি আরও আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে ধরে ধরে বলেছি যে নেহালের সঙ্গে হৃদির বিয়ের সবকিছু ফাইনাল। এখন কেবল ডেটটাই বাকি। অত ভালো ছেলে। বড় মুখ করে দশজনকে বলা যায়। সবাই কেমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তুই-ই বল, এ রকম একটা ছেলে তুই আশপাশে আর দেখেছিস?

তিথি কথা বলল না। সে মায়ের করুণ, পাংশুটে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রোখসানা বেগম বললেন, আমার গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো উপায় নাই। এই মুখ আমি কাকে দেখাব? দেখাতে পারব কাউকে? কে জানে, এর মধ্যে আরও কোনো ঘটনা আছে কি না।

আর কী ঘটনা থাকবে?

দেখা গেল পেট বাধিয়ে বসে আছে।

ছি মা, এসব কী বলছ?

এসব কী বলছি মানে কী, হ্যাঁ, এসব কী বলছি মানে কী? রোখসানা বেগম হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। তার চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। তিনি চিৎকার করে বললেন, নতুন বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে কোনো ছেলে এক বাসায় এক বিছানায় বসে বসে বিবিসি-সিএনএনের সংবাদ দেখে দেখে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, খেলাধুলার আলোচনা করে? করে না। তারা নিজেরা খেলাধুলা করে। বিয়েই যখন করতে পারছে, তখন পেট বাঁধাতে আর সমস্যা কী?

বলেই আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। সঙ্গে দুহাতে বুক চাপড়াতে লাগলেন। তিথি অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মা যে তার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতে পারে, এটা সে কস্মিনকালেও ভাবে নি। কিন্তু এখন কী হবে?

এরপরের ঘটনা অবশ্য সহজ। তিনি তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি কেন গলায় দড়ি দেব? আমার মা বলত, দুষ্ট গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভালো। আমি গোয়াল শূন্য করব। আমার কোল খালি করব। এই রকম পোলাপান থাকার চাইতে না থাকা ভালো।

মা! বলে তিথিও উঠে দাঁড়াল। কী হয়েছে তোমার? আপু যদি ও রকম কিছু করেই থাকে, তাহলে সেটা তো এইভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে তুমি ঠিক করতে পারবে না। পারবে?

পারব। আমি আমার মতো করে করব।

কী করবে তুমি?

আমি এক কোপ দিয়া তারে দুই টুকরা করে ফেলব। তারপর জেলে যাব। পত্রিকায় খবর আসবে–মায়ের হাতে মেয়ে খুন। আমি হলাম খুনি মা।

বলেই ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন তিনি। তারপর ছুটলেন হৃদির ঘরের দিকে। কিন্তু হৃদির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পরও সে দরজা খুলল না। কোনো শব্দও করল না। মাকে সামলানোর চেষ্টায় তটস্থ তিথি হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। সে বলল, মা, তুমি একটু শান্ত হও। আগে আমার কথা শোনো।

রোখসানা বেগম ধাক্কা দিয়ে তিথিকে সরিয়ে দিলেন। তারপর দুহাতে সজোরে আঘাত করতে লাগলেন দরজায়। এই মুহূর্তে ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল হৃদি। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল বাইরে। তাকে দেখে থমকে গেলেন রোখসানা বেগম। হৃদির চোখ লাল। এলোমেলো চুল। মুখ ফোলা।

তাকে দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় কান্নাকাটি করেছে সে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা এড়াতে তিথি হঠাৎ দুজনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। হৃদি অবশ্য রোখসানা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সে থমথমে গলায় বলল, এত চিৎকার-চেঁচামেচি করার মতো কিছু হয় নি, মা। আমি অনিককে বিয়ে করেছি। আমার বয়স আঠারো পার হওয়ার পরই করেছি। এটা নিয়ে এত সিনক্রিয়েট করার তো কিছু নাই।

রোখসানা বেগম মেয়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি তিথির কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেন নি। বরং ভেবেছিলেন, সে ভয়ে, অপরাধবোধে সংকুচিত হয়ে থাকবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে একই রকম শান্ত গলায় বলল, অনিককে তোমার মেনে নিতে সমস্যা হলে আমাকে বলো। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এই নিয়ে অযথা হইচই করবে না।

রোখসানা বেগম অনেক চেষ্টা করেও বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তিনি বরং মুখ চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লেন। তারপর কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। হৃদি বলল, মাকে ঘরে নিয়ে যা, তিথি। মাথায় পানিটানি দে। দেখ, প্রেশারটা আবার বেড়েছে কি না! বাড়লে ওষুধ খাওয়া। আর আমাকে অযথা বিরক্ত করবি না। আমার মনমেজাজ ভালো না। বলেই আবার ঘরে ঢুকে গেল সে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

বিষয়টাতে যারপরনাই অবাক হলো তিথি। অবন্তীও ভীতসন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। তারা দুজন রোখসানা বেগমকে ধরে নিয়ে গেল ঘরে। সেই রাতে আর কোনো কথা বললেন না রোখসানা বেগম। তার দুপাশে দুজন সারা রাত বসে রইল। ভোররাতের দিকে খানিক ঘুমালেন তিনি। কিন্তু সেই ঘুমের মধ্যেও বারবার যেন দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতে লাগলেন।

অবন্তীকে পরদিন ডাকল হৃদি। বলল, তোদের সঙ্গে পরশু অনিকের দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

তিথি ওকে কী বলেছে?

আমি তো ওদের কাছে ছিলাম না, আপু। অবন্তী ভয়ে ভয়ে জবাব দিল। ওরা আমার থেকে একটু দূরে গিয়ে কথা বলেছে।

পরে তিথি তোকে কিছু বলে নি?

অবন্তী কী বলবে বুঝতে পারল না। অনেক ভেবে শেষে বলল, হ্যাঁ।

কী বলেছে?

ওই যে নেহাল ভাইয়ার সঙ্গে তোমার বিয়ে নিয়ে।

আমি কি ওই বিয়েতে মত দিয়েছি?

অবন্তী মাথা নাড়ল, না।

হৃদি বলল, তাহলে? তিথি নাকি অনিককে বলেছে যে বিয়ের সিদ্ধান্ত ফাইনাল। আমি মত দিয়ে দিয়েছি। জোগাড়যন্তর চলছে। কেউ একটা বিয়ের সম্পর্কে থাকা অবস্থায় আরেকটা বিয়ে করতে পারে?

না।

তাহলে?

অবন্তী এবার আর কথা বলল না। হৃদি বলল, অনিক একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার লাইফে ভয়াবহ সব ক্রাইসিস চলছে। এই সময়ে আমি আর ওর ওপর এই এক্সট্রা প্রেশারটা দিতে চাই নি। নিজে নিজেই যতটা সম্ভব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিথি তাকে এসব কী বলল! এখন ছেলেটার অবস্থা একবার চিন্তা কর। সেদিনের পর থেকে সে না পারছে আমাকে বিশ্বাস করতে, না পারছে বিষয়টা মেনে নিতে। এমনিতেই নিজের নানা ঝামেলায় বিপর্যস্ত সে। এর মধ্যে এমন ঘটনা শুনলে কারও মাথা ঠিক থাকে?

অবন্তী না-সূচক মাথা নাড়ল। হৃদি বলল, কাজটা একদমই ঠিক হয় নি। তুই তিথিকে একটু বল আমার ঘরে আসতে। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

.

তিথির নিজেরও এখন খুব অপরাধী লাগছে। কিন্তু সে কোনোভাবেই নেতিবাচক উদ্দেশ্য থেকে কিছু করে নি। বরং অস্পষ্ট হয়ে থাকা সমস্যার শিকড়গুলোকে সামনে এনে একটা সমাধানের পথ তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে যে পুরো বৃক্ষটাই উপড়ে পড়ে সব লন্ডভন্ড করে দেবে তা কে জানত!

হৃদি বলল, তুই অনিককে একটা ফোন কর।

আমি! সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল তিথি।

হু। ফোন করে বল যে তুই যা বলেছিস, তা সত্য না।

অনিক ভাইয়া কি খুব রেগে আছেন, আপু? তোমার সঙ্গে অনেক বাজে ব্যবহার করেছে?

অনিক তো রেগে যাওয়ার মানুষ না। বাজে ব্যবহারও করে না কখনো। সে চুপ হয়ে যাওয়ার মানুষ। কেউ তাকে চড় মারলেও সে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে আসবে। তাকে যদি তার একশটা চড় ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তারপরও।

তোমাকে কী বলেছেন উনি?

কিছুই বলে নি।

তাহলে?

তাহলে কী?

তুমি যে কাল দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলে?

আমি কেঁদেছি তোকে কে বলল?

কেউ বলে নি। কিন্তু…। বলে সামান্য থমকাল তিথি। তারপর বলল, না মানে…তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

ও তেমন কিছুই বলে নি। শুধু জানতে চাইছিল আমি ওকে জানাই নি কেন?

তুমি কী বললে?

কী বলব? এমন কিছু তো হয়ই নি। তা ছাড়া আমি নতুন করে আর কোনো স্ট্রেস দিতে চাই নি ওকে।

ভাইয়া কি শেষ পর্যন্ত বুঝেছে?

ও তো মুখ ফুটে কখনোই কিছু বলবে না। আসলে সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে ওর। আর এই সময়গুলোতে মানুষ প্রচণ্ড ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। ভাবে, কাউকেই ধরে রাখার ক্ষমতা তার নেই। কে জানে, এ কারণেই হয়তো একটা কনফিউশন কাজ করছে।

আমি ফোন করে কী বলব?

যা সত্যি তা-ই বলবি।

তিথি ফোন করল। অনিক অবশ্য খুবই শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলল। তিথি বলল, তুমি কি এখনো রেগে আছ?

রেগে থাকব কেন?

এই যে আমার কারণে এত কিছু হয়ে গেল?

কিছু হয়ে গেলে রাগলে আবার তা ঠিক হয়ে যায়?

তুমি এত কঠিন করে কথা বলছ কেন?

অনিক হাসল, আচ্ছা, সহজ করে বলছি। আমি রাগি নি।

খুব মন খারাপ করেছ?

আজকাল আর আলাদা করে কিছু বুঝতে পারছি না।

ধ্যাৎ, সেটা কখনো হয়?

কী হয় না?

কী কারণে মন খারাপ, সেটা মানুষ বুঝতে পারে না?

গাছ উপড়ে গেলে ডাল ভাঙার কথা আর মনে থাকে?

কঠিন হলেও কথাটা কানে গেঁথে রইল তিথির। মনেও। আসলেই তো, গাছ উপড়ে গেলে ভাঙা ডালের কষ্ট আর কেউ আলাদা করে মনে রাখে না। তখন সবাই গাছটাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

মানুষটা যেন কেমন। শান্ত, চুপচাপ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না ভেতরে কী চলছে! এই যে তার সঙ্গে দেখা হলো, এত কথা হলো, অথচ একবারের জন্যও বাবার মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত দিল না। আবার সেই মানুষটাই হৃদির বিয়ের কথা শুনে মুহূর্তেই কেমন ভঙ্গুর, এলোমলো হয়ে গেল। কিন্তু সেই ভঙ্গুরতাও প্রকাশ করতে চাইল না। আড়াল করে রাখল নিজের ভেতর। বিষয়টা অবাকই করেছিল তিথিকে। কাউকে কতটা ভালোবাসলে এমন কঠিন আবরণে ঢাকা একজন নির্বিকার মানুষও অমন চূর্ণ হয়ে যেতে পারে?

ফোন রাখতেই হৃদি বলল, কী? কথা হলো?

কী বলল?

তেমন কিছু না। বলে সামান্য থামল তিথি। তারপর বলল, একটা কথা বলি, আপু?

বল?

অনিক ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে, না?

কেন?

কারণ, উনি একটা কথা বললেন। কথাটা অন্যদের ক্ষেত্রে সত্যি হলেও ওনার ক্ষেত্রে সত্যি না।

কী কথা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেদিনের ঘটনায় ওনার মন খারাপ কি না। উনি বললেন গাছ উপড়ে পড়লে ডাল ভাঙার খবর আর কে রাখে! মানে নানা ঘটনায় উনি উপড়ে পড়া গাছ। ফলে আলাদা করে ওনার মন খারাপ কি না, উনি জানেন না। কিন্তু কথাটা সত্যি না।

সত্যি না কেন?

তিথি সেদিনের ঘটনাটা বলল। শুনে চুপ করে রইল হৃদি। বেশ খানিকটা সময়। তারপর বলল, সম্ভবত এই একটা কারণেই ওকে আমি ভালোবাসি। সম্ভবত এই একটা কারণেই ওভাবে বোকার মতো ওকে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। সবার ভালোবাসায় অনেক বেশি দেখালেপনা, আড়ম্বর, উদ্যাপন থাকে। কিন্তু ও আড়ম্বরহীন এক মানুষ। উদ্যাপনও নেই। সবকিছুতেই কেমন নির্বিকার, নির্লিপ্ত। বাইরে থেকে দেখে সহসা কিছু বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ওর মতো নীরবে ভালোবাসতে পারে, এমন আর একটা মানুষও কখনো দেখি নি আমি।

হৃদির গলায় যেন বাষ্প জমেছে। তিথি এসে বোনের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর বলল, কিন্তু এখন কী করবে?

জানি না। বলে উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল হৃদি। তারপর বলল, কিছু করতে হলে আমাদের সময় দরকার। কিন্তু সেই সময়টাই তো কেউ দেবে না আমাদের। বরং সবাই চাইবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমার মাঝে। মাঝে কী মনে হয়, জানিস?

কী?

যদি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কোথাও চলে যেতে পারতাম! কিন্তু কোথায় যাব? যাওয়ার তো কোনো জায়গা নেই আমার।

অনিক ভাইয়ার বাড়ি…? ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল তিথি।

ওদের বাড়ি?

হুম।

গ্রামে। আজ খবর এসেছে ওর মা হঠাৎ প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ঢাকায় এনেই-বা তাকে রাখবে কোথায় ও? সেই আশ্রয়টুকুই তো নেই।

তিথি কথা বলল না। হৃদি হঠাৎ বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

আমি যদি নেহালের সঙ্গে দেখা করি?

নেহাল ভাইয়ার সঙ্গে? ভীষণ অবাক হলো তিথি।

হুম।

তার সঙ্গে দেখা করলে কী হবে?

এই প্রশ্নে চুপ করে রইল হৃদি। বেশ খানিকটা সময় কী ভাবল। তারপর বলল, সেটা দেখা করার পর তাকেই না হয় বলব। এই অবস্থায় একমাত্র সে-ই আমার ভরসা।

তিথি হৃদির কথা কিছুই বুঝতে পারল না। তবে হৃদির চোখে খানিক আগে যে বিষণ্ণতার গাঢ় মেঘ ছায়া ফেলেছিল, সেই ছায়ায় হঠাৎ আলোর ঝলকানি তার দৃষ্টি এড়াল না।

জায়গার নাম বৈদ্যবেলঘরিয়া। ঢাকার কাছেই প্রত্যন্ত এক গ্রাম। যত দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেই মাঠে মাইলের পর মাইল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আখখেত। আখখেতের আল ধরে হেঁটে চলছে তিনজন মানুষ। প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচতে তিনজনের মাথায়ই মাথাল। এ অঞ্চলের কৃষকেরা গনগনে রোদে খোলা মাঠে কাজ করতে বাঁশ ও তালপাতায় তৈরি হ্যাটসদৃশ এই মাথাল মাথায় পরে থাকে। ছোট্ট দলটার সামনে থাকা লোকটার নাম জামশেদ। তিনি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, কারও চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তো?

পেছনের কৃশকায় লোকটা বলল, না স্যার। আমাদের পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সবই এখানকার কৃষকদের মতোই।

জামশেদ হাসলেন, তা ঠিক আছে, মতিন মিয়া। কিন্তু সাবধানের মার নেই। সামান্য ভুলও অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

মতিন মিয়া তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল। এবড়োখেবড়ো পথের কষ্টকর যাত্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে এসে তারা যেখানে দাঁড়াল, সেখানে মানুষের সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে কেবল আখের পাতায় হাওয়ার একটানা খসখস শব্দ। যেন অসংখ্য সাপ একসঙ্গে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। জায়গাটা ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। দূর থেকে দেখলে অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা দুর্গম জঙ্গল বলে ভ্রম হয়। জামশেদ হাত তুলে পেছনের দুজনকে থামতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, এখন তো এখানে কেউ নেই, না?

জি না, স্যার।

এইটাও মাথায় রাখবা, মতিন মিয়া। খুব প্রয়োজন না পড়লে তুমিও বেশি একটা এখানে আসবা না। জাস্ট সময়ে সময়ে এসে বাচ্চাগুলোরে খাবার দিয়া যাবা। আর তুমি তো জানোই এদের সপ্তাহে এক দিন খাবার দিলেই হয়।

জি স্যার।

যতটা পারো লোকের দৃষ্টি থেকে দূরে থাকবা। খবরদার, কারও চোখেই পড়া যাবে না। একবার যদি এই খবর জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তুলকালাম হয়ে যাবে। থানা-পুলিশের আগে এলাকার মানুষই পিটায়ে মেরে ফেলবে তোমাকে। বুঝলে?

বুঝি নি আবার! এই কারণেই তো আমি কোনো কাজের লোকও রাখি নাই এইখানে। যা করার নিজে একা একা এসে করি।

গুড। আরেকটা কথা।

জি স্যার।

খুব সাবধান। এরা কিন্তু একেকটা ভয়ংকর জিনিস। যদি কোনোভাবে এরা এখান থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ। একবার ভাবো তো, এরা এখান থেকে। বের হয়ে গ্রামে, লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ল?

কথাটা ভাবতেই গা শিউরে উঠল মতিন মিয়ার। সে ভীত গলায় বলল, ওই দুশ্চিন্তায়ই তো রাতে ঘুমাতে পারি না, স্যার। মাঝেমধ্যে ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন দেখি। তখন মনে হয় এই সব ছেড়েছুঁড়ে আমি আমার আখ চাষেই ফিরে যাই।

আখ চাষ থেকে বছরে কত টাকা পেতে?

এবার মতিন মিয়ার চোখে হতাশা ফুটে উঠল। সে বলল, খুবই কম, স্যার। এত এত জমি আমার। প্রতিবছর হাড়ভাঙা খাটুনি, গুচ্ছের পয়সা খরচ করে ফসল চাষ করি। তারপরও দিন শেষে খরচের টাকাটাও ওঠে না। কত রকমের ফসলের চেষ্টাই তো করলাম। কিন্তু লাভ হলো কই? দিন শেষে যেই লাউ সেই কদু।

আর আমার সঙ্গে কাজ করার পর থেকে?

মতিন মিয়া এবার আর কথা বলল না। তবে তার চোখেমুখে খানিক আগের হতাশার বদলে আশার আলো ফুটে উঠল।

জামশেদ বললেন, কিছু পেতে হলে কিছু তো দিতেই হবে। ভয়কে জয় করতে হবে। কিন্তু ভয়কে জয় করা মানে কিন্তু দুঃসাহসী বা অসাবধান হওয়া না। থাকতে হবে সতর্ক। তা কেমন আছে আমার বাচ্চাগুলা?

মতিন মিয়া সামনে এগিয়ে খোলা জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে বড়সড় একটা পুকুর। পুকুরে নানা জাতের মাছ। তবে জামশেদ সেই মাছের বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখালেন না। তিনি সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

মতিন এগিয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলে ঢোকার পথটা খানিক পরিষ্কার করে দিল। যদিও বাইরে থেকে জঙ্গল যত ঘন আর দুর্গম দেখায়, বাস্তবে তা নয়। বরং বিঘা পাঁচেক জায়গাজুড়ে পুরোনো কোনো বাড়ির চিহ্ন ফুটে ওঠে। সেখানে প্রাচীন আমলের আদলে তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখা যায়। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা দেয়াল, ক্ষয়ে যাওয়া ইট, বিদীর্ণ মেঝে। লতাগুল্ম, ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে সেসব। লোকালয় থেকে এত দূরের বিচ্ছিন্ন এই বাড়ি দেখে অন্তত এটুকু অনুমান করা যায় যে কোনো জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যক্তি শখের বশে এখানে বাগানবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন। বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা দিঘির মতোও খনন করা হয়েছিল। সেই দিঘির বাঁধানো ঘাটও ভেঙেচুরে একাকার। তার ফাঁকে ফাঁকে বেড়ে উঠেছে ঘাস, লতা-পাতা। প্রায় ভরাট হয়ে যাওয়া পুকুরে যেটুকু জল জমে আছে, তা পচা, দুর্গন্ধযুক্ত। তবে সেই দুর্গন্ধযুক্ত পচা জলে মৃদু আলোড়ন তুলছে ভয়ংকর কালচে কিছু প্রাণী। দিনের পর দিন বড় গাছের ঝরা পাতা পচে পুকুরের জল ঘোলা হয়ে আছে। ফলে জলে আলোড়ন তোলা। ভয়ালদর্শন ওই প্রাণীগুলোকে চট করে খেয়াল করা যায় না।

জামশেদ মজা পুকুরটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, তোমার বাচ্চাগুলা কেমন আছে?

মতিন মিয়া সন্ত্রস্ত গলায় বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় আপনারগুলার চাইতে বুঝি এইগুলাই বেশি ভয়ংকর।

জামশেদ হাসলেন। বললেন, এইগুলাও কম ভয়ংকর না। আস্ত মানুষ ছেড়ে দিলে উঠে আসার চান্স কম। খেয়ে সাফ করে ফেলবে।

এই জন্যই রেগুলার খাবার দিয়া রাখি। কিন্তু ভয় লাগে। দিন দিন একেকটার যা সাইজ হচ্ছে!

ভয়ের কী আছে? এরা তো আর পানি থেকে উঠে আসতে পারবে না। পানির শ্বাসে এদের বাস। বুঝলা? এরা ডাঙায় কিছু না। আর যেগুলা বেশি বড়, মাঝে মাঝে সেগুলা দুয়েকটা তো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রান্নাবান্না করে খেতেও পারো। পরে না হয় আবার ছোট দেখে এনে ছাড়বে?

দুয়েকবার নিয়া গেছিলাম, স্যার। কিন্তু অত বড় দেখে কেউ খেতে চায় না। আমার বউ তো ভয়ই পেয়ে গেছিল। তার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে মাছ এত বড় হতে পারে। তাও আবার দেখতে রাক্ষসের মতন।

তুমি রাক্ষস দেখছ?

মতিন মিয়া বিব্রত হাসল, জি না।

তাহলে বুঝলা কীভাবে যে এরা রাক্ষসের মতো?

এরা যখন বিরাট বড় মুখ হাঁ করে গোল গোল চোখে তাকায়, তখন কলিজা উড়ে যায়। একবার একটার সাইজ কত হলো, জানেন?

কত?

আড়াই ফুট। ভয়ার্ত গলায় বলল মতিন।

জামশেদ হাসলেন, এই মাগুর আফ্রিকান মাগুর। এরা জাতে সর্বভুক। প্রাপ্তবয়স্ক একেকটা সাইজে তিন-চার ফুট পর্যন্তও হয়।

কী বলেন!

হুম।

মতিন আর কথা বলল না। জামশেদ আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলেন। তারপর পেছনে ফিরে তাকাল। তার সঙ্গে আঠারো-উনিশ বছরের এক ছেলে। ছেলেটার নাম রাশু। রাশুর নাকের নিচে কেবল মিহি গোঁফের আভাস। ভাঙা, চিমসানো গাল। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। তবে এত কিছুর মধ্যেও তার ঈষৎ বাদামি রঙের চোখ জোড়া দৃষ্টি কাড়ে। বয়সের তুলনায় দেখতে খানিক ছোটই মনে হয় রাশুকে। জামশেদ তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর বললেন, ব্যাগ থেকে মুরগি দুইটা দে তো।

রাশু তার হাতের ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো মুরগি দুটো বের করে দিল। দুটো মুরগিরই গলা কাটা। সেই কাটা গলা থেকে রক্তের স্রোত নেমে এসেছে বুক অবধি। তারপর জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে আটকে গেছে বুকের পালকের সঙ্গে। জামশেদ ধীরপায়ে হেঁটে পুকুরটার আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তার হাতের মুরগি দুটোকে ছুঁড়ে মারলেন জলে। সঙ্গে সঙ্গেই জলের বুকে তীব্র জলোচ্ছ্বাস তৈরি হলো। খানিক আগের মৃদু আলোড়ন পরিণত হলো তীব্র কম্পনে। সেই কম্পনে জল ছলকে উঠতে লাগল চারপাশে। আর ভয়ালদর্শন মাছগুলো যেন সত্যি সত্যিই রাক্ষসে পরিণত হতে লাগল। তারা একযোগে হামলে পড়ল খাবারের ওপর। তার পরের দৃশ্যটা গা গুলিয়ে ওঠার মতো। জামশেদ অবশ্য নড়লেন না। তিনি দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি।

মতিন মিয়া বলল, ভিতরের দিকে চলেন, স্যার।

হুম। বলে কী ভাবলেন জামশেদ। তারপর বললেন, এদিকে কেউ আসে না তো?

না, স্যার। এত দূরে কে আসবে? আর সামনের এই আখখেত আমার। ফলে আমি খেয়াল রাখি যাতে কেউ না আসে। আর কেউ আসলে তো ব্যবস্থা আছেই। সামনের বড় পুকুরে তো মাছের চাষই করি। ওইখানে একটা টংঘরও আছে। আমি আইসা মাঝেমইধ্যে ওইখানে থাকি। পুকুর পার হইয়া এই দিকে সহজে আসি না। তারপরও ধরেন কেউ যদি এইখানেও আসে, তারাও কিন্তু এসে দেখবে যে এই ছোট্ট ডোবাতেও মাছের চাষ হয়। তখন তো আর সন্দেহ করার উপায় নাই যে ভেতরে আসল ঘটনা কী?

হুম। কিন্তু সামনের বড় পুকুরের মাছ চাষে সমস্যা না থাকলেও আমাদের দেশে কিন্তু এই ছোট্ট ডোবার আফ্রিকান মাগুরের চাষ বৈধ না। সুতরাং সাবধান।

জামশেদ ডোবা পেরিয়ে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালেন। তারপর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বোলালেন। এই খাঁ খাঁ রোদের দুপুরেও চারপাশটা শান্ত, শীতল। গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ। সূর্যের আলো নকশা কেটেছ মাটিতে। আশপাশে কোথাও একটা ঘুঘু ডাকছে। একটা ডাহুক। বহুদিন ডাহুক দেখা হয় নি। এই নির্জন জল ও জঙ্গলের ধারে হঠাৎ ডাহুকের ডাক শুনে যেন খানিক স্মৃতিকাতরও হয়ে গেলেন জামশেদ।

মতিন মিয়া বলল, একটু বসে জিরাই নিবেন, স্যার?

নাহ্। আমাকে সন্ধ্যার আগেই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। তার আগে বাচ্চাগুলার অবস্থা দেখে যাই। অনেক কাজ বাকি।

উঠানের দুই পাশে দুটি টিনশেড ঘর। একটি ঘরের দেয়াল পাকা। অন্যটি সাধারণ টিনের। মতিন মিয়া টিনের বেড়ার ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে কতগুলো জাল স্তূপ করে রাখা। সে জালগুলো সরিয়ে ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, বাচ্চাগুলা এখন এই ঘরে থাকে, স্যার।

জামশেদ জবাব দিলেন না। মতিন মিয়া ঘরের আলগা টিনের বেড়াটা টেনে একদিকে সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকটা পুরো উন্মুক্ত হয়ে গেল। সেই উন্মুক্ত অংশে চোখ রেখে মুহূর্তের জন্য আঁতকে উঠল রাশু। ঘরটার চারপাশে ঘন জাল দিয়ে ঘেরাও করা। সেই জালের গায়ে ঝুলে আছে ভয়ংকরদর্শন এক পদ্মগোখরা। হঠাৎ মানুষের পায়ের কম্পনে ফোঁস করে ফণা তুলল সাপটা। দেখে ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল সে। তবে বাইরে তা প্রকাশ করল না। জামশেদ আরও সামনে এগোলেন। ঘরটার মেঝেতে কিছু কাঠের বাক্স। বাক্সগুলোর ডালা খোলা। সেখানে কিলবিল করছে অসংখ্য সাপ। দৃশ্যটা রক্ত হিম করা। এত দিন ধরে এদের দেখাশোনা, পরিচর্যা করা সত্ত্বেও চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল মতিন মিয়ার। তবে জামশেদ স্বাভাবিক। তিনি বেশ খানিকটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হাত দিয়ে জালটা এক পাশে সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। মতিন মিয়া প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় বলল, স্যার! এই দিক দিয়ে না। এই দিকটায় সব কিলবিল করতেছে। ডান দিকে আলাদা ঢোকার জায়গা আছে…।

জামশেদ অবশ্য তার কথা শুনলেন না। তিনি বরং হাত তুলে তাকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই এগিয়ে গেলেন সাপগুলোর দিকে। মেঝেতে জড়াজড়ি করে থাকা সাপগুলে কারও পায়ের স্পন্দনে ফণা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কয়েকটি ধেয়ে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় পারছে না। জামশেদ অবশ্য সেসব গ্রাহ্য করলেন না। তিনি হাত বাড়িয়ে জালে ঝুলে থাকা সাপটা খপ করে ধরে ফেললেন। তারপর মুখের কাছটা দুই আঙুলে চেপে ধরে নিয়ে এলেন বাইরে। ভেতরের চেয়ে বাইরের এই জায়গাটিতে আলো বেশি। সেই আলোয় নিখুঁত দক্ষতায় সাপটার মুখ ফাঁক করে চোখের সামনে তুলে ধরলেন তিনি। তারপর দীর্ঘ সময় গভীর চোখে নিরিখ করে কী দেখলেন। মতিন মিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা, স্যার?

জামশেদ জবাব দিলেন না। আরও বেশ কিছুক্ষণ একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর খানিক নিচু হয়ে পকেট থেকে একটুকরো কাঁচ বের করে আনলেন। সাপটা ততক্ষণে অনেকটা চুপ হয়ে গেছে। জামশেদ সেই কাঁচের টুকরোটা সাপের দুই দাঁতের সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য চেপে ধরলেন। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করে কী দেখলেন। রাশু আর মতিন মিয়া ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। জামশেদ অবশ্য কাউকে কিছু বললেন না। তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঘরের ভেতর। মেঝেতে পড়েই ফোঁস ফোঁস শব্দে আবার ফণা তুলে দাঁড়াতে লাগল সাপটা।

নেহাল বসে আছে ধানমন্ডির এক রেস্তোরাঁয়। এই রেস্তোরাঁটা লেকের গা ঘেঁষে। চারদিকে কাঁচঘেরা। বাইরে তাকালেই শান্ত জলের হ্রদ। তার ওপারে সবুজ গাছের সারি। গাছের পাতার সবুজ ছায়া পড়েছে হ্রদের জলে। মৃদু হাওয়া বইছে। চারপাশে একটা শান্তি শান্তি ব্যাপার। তবে সেই শান্তি শান্তি ব্যাপারের মাঝেও নেহাল খানিক অস্থির হয়ে আছে। হৃদি হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা করতে চাইল কেন?

নেহাল যে খুব প্রেমিক ধাচের পুরুষ, তা নয়। কিন্তু হৃদিকে দেখে কিছু একটা হয়েছিল তার। প্রথম দর্শনেই প্রেম টাইপ ব্যাপার। ফলে বিয়ের ভাবনাটা এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তার পরিবার থেকেও কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু সেই ভাবনায় অকস্মাৎ দেয়াল হয়ে দাঁড়াল হৃদি নিজেই। সেদিন ফোনে তার কথাটা শুনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল নেহাল। তবে তাকে সেই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উদ্ধার করেছেন রোখসানা বেগম। তিনি তার নিভে যাওয়া আশার সলতেতে আবার আলো জ্বেলেছেন। আর তারপরই হৃদি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। বিষয়টা নিয়ে খানিক দ্বিধান্বিত হলেও কিছু বলে নি সে। বরং কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেছে। নেহাল সপ্রতিভ, আত্মবিশ্বাসী মানুষ। সে জানে অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই এমন হয়। প্রথম জীবনে উড়নচণ্ডি, চালচুলোহীন ভবঘুরে ছেলেদের প্রেমে পড়ে যায় তারা। কিন্তু সেই প্রেম বেশি দিন থাকে না। কিছুদিনের মধ্যেই ঘোর কেটে যায়। বাস্তবতা বুঝতে শেখে। কে জানে, হৃদির ক্ষেত্রেও হয়তো তেমন কিছুই হবে। না হলেও ক্ষতি নেই। নেহালের ধারণা, খুব বেশি বিরূপ পরিস্থিতি না হলে বিষয়টা সে সামলে নিতে পারবে। এই আত্মবিশ্বাস তার আছে।

.

হৃদির মুখ ভার। চোখ ফ্যাকাশে। সে ধীরপায়ে এসে বসল। নেহাল বলল, মন খারাপ?

হৃদি জবাব দিল না। তবে ম্লান হাসল। নেহালও। বলল, কাদের মন খারাপ থাকা উচিত, জানেন?

কাদের?

যাদের ভালোবাসার কেউ নেই। কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম উল্টো। এখানে তারাই মন খারাপ করে, কাঁদে, যাদের ভালোবাসার কেউ আছে।

মানে?

মানে…। বলে সামান্য থামল নেহাল। তারপর বলল, আমি তখন আমস্টারডামে পড়তে গিয়েছিলাম। একদিন রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ পিয়ানোবাদক পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। সেই পিয়ানোর সুর এমন যে অকারণে আপনার চোখে পানি চলে আসবে। আমি দীর্ঘ সময় তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা গাছের ছায়ায় চুপচাপ বসে ছিলাম। দিন শেষে যখন তিনি সবকিছু গুছিয়ে উঠে যাবেন, ঠিক তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

কী ঘটনা?

বৃদ্ধ হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো অন্য কোথাও যাচ্ছেন। কিন্তু বৃদ্ধ ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো অবাক! আমি কাঁদলেও অত দূর থেকে ওনার তা বোঝার কথা না।

আপনি কাঁদছিলেন?

ঠিক জানি না। নেহালের গলা ভার। তবে উনি বলার পর হঠাৎ মনে হলো হয়তো কাঁদছিলাম।

কেন?

কারণ, আমি তখন আমস্টারডামের একটা হাসপাতালের বাইরে দিনরাত বসে থাকতাম।

হাসপাতালের বাইরে?

হুম।

কেন?

এভিলিন তখন ভয়ানক এক অসুখে আক্রান্ত।

এভিলিন কে?

নেহাল এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে বলল, তাকে রাখা হয়েছে ইনকিউবেটরের মতো একটা জায়গায়। কাঁচের ঘরের বাইরে থেকে তাকে দেখা যায়। সে সারাক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে চায়। কিন্তু পারে না। তার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁট কাঁপে। কিন্তু সে কোনো শব্দ করতে পারে না। আমিও না। আমরা জানি, আমরা কেউ আর কখনো কাউকে শুনতে পারব না। কখনোই না। নেহালের গলা বুজে এল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। তারপর বলল, পারিও নি কখনো আর।

এভিলিন কে?

নেহালের চোখের কোনায় চিকচিক করছে জলের ফোঁটা। হৃদির হঠাৎ মনে হলো, এই যে তার আশপাশে এত মানুষ, তাদের সবারই এমন অসংখ্য বুকভার যন্ত্রণা। কিন্তু সেই যন্ত্রণার কথা তার সবচেয়ে কাছের মানুষটারও কখনো জানা হয় না। ফলে তারা পরস্পরের কাছ থেকে রয়ে যায় এক আলোকবর্ষ দূরে। সে নরম গলায় বলল, ওকে খুব ভালোবাসতেন?

নেহাল যেন চকিতে তার চোখ জোড়া আড়াল করল। তারপর হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলল জল। বলল, আমাদের খুব অল্প দিনের পরিচয়। ও রাশান। আমি বাংলাদেশি। কিন্তু তাতে আমাদের পরস্পর ভালোবাসতে কোনো অসুবিধে হয় নি। বলে আবার থামল সে। দীর্ঘ সময়। তারপর বলল, যদি আমাদের কেউ ভালো না বাসত, কিংবা আমরা কাউকে, তাহলে পৃথিবীর কারও মৃত্যুতে, অসুখেই কিছু যেত আসত না আমাদের। না?

হু। মৃদু কণ্ঠে বলল হৃদি।

বৃদ্ধ পিয়ানোবাদক তখন আমাকে ওই কথাটিই বলেছিলেন। তিনি বললেন, যাদের জীবনে ভালোবাসা নেই, তাদের জীবনে দুঃখ-যন্ত্রণা কম। কিন্তু যারা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, তাদের জীবন যন্ত্রণাময়। কান্নায় টলমল। ফুল অব টিয়ার্স।

হৃদি কথা বলল না। চুপ করে বসে রইল। নেহালকে অনেক কিছু বলবে ভেবেই এখানে এসেছিল সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেসব কথা এই ছেলেকে বলা যায় না। এই ছেলে তার ভাবনার মতো নয়। বরং বাইরের ঝলমলে আনন্দময় চেহারার আড়ালে গভীর সংবেদনশীল এক হৃদয় তার রয়েছে।

সে নেহালের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেও না। তার সঙ্গে পরিচয় নন্দিতার বাসায়। নন্দিতা তার কলেজের বন্ধু। ওর বড় বোনের বিয়েতে এসেছিল নেহাল। সেখানেই টুকটাক কথা। হৃদি তখুনি শুনেছিল, নেহাল উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই বাইরে গিয়েছিল পড়তে। তারপর পরিবারসহ সেখানেই স্থায়ী হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর দেশে এসেছে সে। ফলে দেশের সবকিছু নিয়েই তুমুল উচ্ছ্বাস তার। তবে সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশের ধরনটা এত তরল যে হৃদির তা পছন্দ হয় নি। ফলে খানিক বিরক্তই হয়েছিল সে।

তাদের যোগাযোগটা অবশ্য হয়েছিল অন্যভাবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে রোখসানা বেগমও ছিলেন। তিনি তখন সদা সতর্ক প্রহরীর মতো চারদিকে নজর রাখেন। এই বুঝি তার কন্যার জন্য একজন আদর্শ পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল! সেদিন নেহালকে দেখে, তার সম্পর্কে শুনে আগ্রহের পারদটা ক্রমশই উধ্বগামী হয়ে উঠেছিল তার। কথা প্রসঙ্গে হৃদির বাবা তোফায়েল হোসেনের প্রসঙ্গও উঠল। তিনি জটিল রোগে ভুগছেন। জন্মগতভাবেই রক্তের কণিকায় কিছু জটিলতা তার ছিল। অস্বাভাবিকভাবে জমাট বেঁধে যাচ্ছে রক্ত। ফলে নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় স্ট্রোকেও আক্রান্ত হতে হয়েছে তাকে। এতে শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করেছে। অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তাররা এর স্থায়ী বা পরিপূর্ণ কোনো সমাধান দিতে পারেন নি। বলা হয়ে থাকে যে বিভিন্ন দেশে এই সমস্যার ট্রায়াল বেসিসে চিকিৎসা কিংবা ওষুধ তৈরির চেষ্টাও চলছে। নেহাল ফার্মাসির শিক্ষার্থী হওয়ার কারণেই এ বিষয়ে কিছু জানাশোনা কিংবা আগ্রহ তার ছিল। ফলে নিজে থেকেই তোফায়েল হোসেনকে একবার দেখার কথা জানাল সে।

হুদিদের বাড়ির সঙ্গে তার অল্পবিস্তর যে যোগাযোগ, তার শুরুটাও সেখান থেকেই। তবে হৃদিই যে এই যোগাযোগর মুখ্য কারণ, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল আরও কিছুদিন পর।

একদিন হুট করেই নন্দিতার মা তাদের বাসায় এলেন। কথা বললেন। সেই কথায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব! শুনে ভয়াবহ রাগ হয়েছিল হৃদির। এমনকি তাকে যখন নেহাল বাসায় দেখতে এল, তখনো। কিন্তু আজকের এই নেহালকে যেন আগে কখনো দেখা হয় নি। ফলে যে কথাগুলো তাকে বলবে বলে এখানে এসেছিল সে, সেই কথাগুলো আর বলতে ইচ্ছে হলো না।

নেহাল বলল, সরি। মন খারাপ কারোর সঙ্গে এত গম্ভীর ভারী ভারী কথা বলা বোধ হয় মানায় না।

উঁহু। ইটস অলরাইট।

এভিলিন মারা যাওয়ার পর…। বলে থামল নেহাল। সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে যেন গুছিয়ে নিলে। তারপর বলল, আমি দীর্ঘদিন কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারতাম না। মনে হতো কাঁচের ওই ঘরটার ভেতর থেকে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছলছল।

হৃদি চুপচাপ তাকিয়ে আছে। যেন পড়তে চেষ্টা করছে মানুষটার ভেতরের যন্ত্রণা। নেহাল প্রায় বুজে আসা গলায় বলল, ইটস অ্যান আনবিয়ারেবল, ইনটলারেবল লাইফ।

হৃদি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তবে তার সামনে বসা ভগ্নপ্রায় মানুষটার কষ্ট সামান্য হলেও অনুভব করতে পারছে সে। নেহাল বলল, সরি। প্রোবাবলি আই শুড নট টেল দিস হিয়ার। আই অ্যাম সরি…।

উঁহু। ইটস ওকে।

তারপর দীর্ঘ সময়। মৃদু হাওয়ায় জলের বুকে জেগে উঠল অজস্র কম্পন। কিছু হলুদ পাতা উড়ে এসে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই কম্পনে। একটা চড়ই পাখি টুপ করে এসে বসে পড়ল বাইরের লাল ইটবাঁধানো চত্বরে। তারপর খুঁটে খেতে থাকল পড়ে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট। কাছের কোনো টেবিল থেকে চামচ, গ্লাস আর প্লেটের টুংটাং শব্দ ভেসে আসতে লাগল। দুজন থমকে যাওয়া, যন্ত্রণাকাতর মানুষ যেন অকারণ আকর্ষণে কিংবা তুমুল মনোযোগে সেই সব অর্থহীন শব্দ ও দৃশ্য শুষে নিতে থাকল। কিংবা নিজেদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর খানিক উপলক্ষ খুঁজে নিতে চাইল।

অবশেষে নীরবতা ভাঙল হৃদি। বলল, এখন?

নেহাল কথা বলল না। তবে চোখ তুলে তাকাল। হৃদি বলল, এখন পারছেন?

কী?

অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে? ভালোবাসতে?

না।

তাহলে?

তাহলে কী?

এই প্রশ্নে হৃদি চুপ করে গেল। কী বলবে সে? খানিক চুপ থেকে বলল, এই যে…না, মানে…।

মানে…এই যে আপনাকে চাইছি? সরাসরিই কথাটা বলল নেহাল। তবে হৃদি জবাব দিল না। সে চুপচাপ আঙুলের ডগায় জলের আলপনা আঁকতে লাগল টেবিলের কাঁচে।

নেহাল প্রায় ফ্যাকাশে গলায় বলল, আমি জানি না, হাও আই এক্সপ্লেইন দ্য থিংস টু ইউ। ইটস বিট মিস্টেরিয়াস, বাট ইনটেনডেড অ্যাজ ওয়েল। আর…। বলে যেন। সঠিক শব্দটা খুঁজে পাওয়ার জন্য খানিক সময় নিল সে। তারপর বলল, ইট কুড বি সিলি, বাট ট্র। আপনার সঙ্গে আমার দেখাটা…মানে একদম প্রথম মুহূর্তটাই আমাকে এলোমেলো করে দিল। পুরোপুরি। মনে হচ্ছিল, আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউ…ওয়েটিং ফর আ লং…লং টাইম। অ্যান্ড ফাইনালি দ্য টাইম হ্যাঁজ কাম। অ্যান্ড ইউ ক্যান বি দ্য লিটমাস পেপার অব দিস লাইফ অব অ্যাগেনি…। অ্যাবজর্ব এভরি বিট অব ইট।

হৃদি কথা বলল না। সে জানে না কেউ এমন কিছু বললে তাকে উত্তরে কী বলতে হয়! ফলে চুপ করে রইল সে। নেহাল বলল, এর মানে কিন্তু মোটেই এই নয় যে আমি। আপনাকে চাইছি বলে আপনারও আমাকে চাইতে হবে! আমি জাস্ট আমার অনুভূতিটা আপনাকে জানিয়েছি। কিন্তু আপনার অনুভূতির প্রতি আমার শতভাগ শ্রদ্ধা আছে। এমনকি আপনি যদি এই মুহূর্তে আমাকে বলেন যে আপনার সামনে থেকে আমাকে। চলে যেতে হবে, আই উইল…। আর কখনো আপনার সামনেও আসব না আমি। কিন্তু অনুভূতিটা তো…ইউ নো, ইরেসিসটেবল! না?

আমি আপনাকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলতে এসেছিলাম। অবশেষে বলল হৃদি। সঙ্গে একটা মিথ্যেও। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অন্তত আর যা-ই হোক, আপনার সঙ্গে মিথ্যে বলা যায় না।

কেন?

কারণ, আপনি মানুষ ভালো। বলে হাসল হৃদি। নেহালও। বলল, মিথ্যে কথাটা কী?

আমি প্রেগন্যান্ট। শান্ত গলায় বলল হৃদি।

আর সত্যিটা, মানে যে কঠিন কথাগুলো আপনি আমাকে বলতে চেয়েছিলেন?

আমি বিয়ে করেছি, কথাটা সত্য এবং এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে আপনি আমাকে উদ্ধার করবেন।

আমি?

হুম।

আমি কীভাবে?

তা আমি জানি না। বাট মা যেন বিষয়টা নিয়ে আমাকে আর প্রেশার না দেন, এটা আপনি আমাকে নিশ্চিত করবেন। এই ফেভারটা আমি চাইছি।

নেহাল কথা বলল না। হৃদি বলল, আই অ্যাম সরি ফর এভরিথিং। এভরিথিং। বাট…। আমি আসলে আপনাকে বোঝাতে পারব না যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছি। ইটস সিম্পলি আনএক্সপ্লেইনেবল।

কী করতে হবে আমাকে?

আমি জানি না। বাট, প্লিজ…। হৃদির কণ্ঠে কাতর অনুরোধ।

নেহাল হাসল। মৃদু, মলিন হাসি। হৃদি বলল, আমি সত্যি সরি। কিন্তু…।

কিন্তু দেয়ার ইজ নো আদার ওয়ে। তাই তো?

হৃদি বিমর্ষ ভঙ্গিতে মৃদু মাথা নাড়ল। নেহাল বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, আই উইল।

অনিকের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তার চোখ বসে গেছে। সেই চোখে ক্লান্ত, প্রাণহীন দৃষ্টি। হৃদি বলল, খারাপ কিছু?

এখনো ঠিক জানি না। তবে খুব ভালো কিছু না-ও হতে পারে।

কী করবে এখন?

আপাতত কিছুদিন ঢাকায়ই রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ট্রিটমেন্ট দরকার। তারপর বোঝা যাবে ঘটনা।

কিন্তু রাখবে কোথায়?

সেটাই ভাবছি। এখন আমার এক বন্ধুর বাসায় আছেন।

কিন্তু সেটা কত দিন?

অনিক উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। উষ্কখুষ্ক লম্বা চুলে এলোমেলো হাত বোলাতে লাগল। হৃদি বলল, কিছু ভেবেছ?

হুম।

কী?

একটা বাসা নিয়ে নেব।

বাসা! অবাক গলায় বলল হৃদি। এত টাকা কোথায় পাবে?

একটা টিউশন পেয়েছি নতুন। তুলনামূলক ভালো বেতন। তবে তাতেও যে সব সামলানো যাবে, এমন নয়। ভাবছি বাসাটা অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করব।

কীভাবে?

দুই রুমের বাসা। ড্রয়িংরুম। এক রুমে মা থাকবে। অন্য রুমটা কাউকে দেব। আমার কোনোভাবে চলে যাবে।

হুম। বলে খানিক চুপ করে রইল হৃদি। তারপর বলল, হলের রুম ছেড়ে দেবে?

হ্যাঁ। এত জুনিয়র ছেলেপুলেদের সাথে থাকতে আর ভালো লাগে না। আমাদের ব্যাচের সবাই তো সেই কবেই চলে গেছে।

বাসা দেখেছ?

একটা মোটামুটি ঠিকও করে ফেলেছি।

আচ্ছা। বলে আবার চুপ করে রইল হৃদি। তারপর বলল, খুব মন খারাপ?

অনিক হাসল। তারপর বলল, মন খারাপ করে কী হবে?

মন খারাপ হলে? অনিকের প্রশ্নেরই পুনরাবৃত্তি করল হৃদি।

হুম।

আদর হবে। বলে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে হাসল হৃদি। তারপর অনিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। অনিক বলল, আদরে মন খারাপ ভালো হয়ে যায়?

চেষ্টা তো করা যায়। দেখি, এই নারীজনম কতটুকু ব্যর্থ?

ব্যর্থ কেন হবে?

ব্যর্থই তো! নিজের মানুষটাকেও যদি আদরে বাঁদর বানাতে না পারি, তবে সেই নারীজনম ব্যর্থ না?

তারা বসে আছে ক্রিসেন্ট লেকের পাশের লাল ইটের দেয়ালে। মাথার ওপর কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ঘন হয়ে নেমে এসেছে গাছের ডাল, পাতা। সন্ধ্যার আধো আলো, আধো অন্ধকারে জায়গাটা বেশ নির্জন। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। হৃদি হঠাৎ সেই নির্জনতায় অনিককে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার গালে আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, এটা আমার খুব ভালো লাগে?

কী?

এই যে না কামানো এলোমেলো দাড়ি।

আমার লাগে না।

তাহলে কী? আমার জন্য এমন করে রাখো?

উঁহু।

তাহলে? যেন মন খারাপ হলো হৃদির।

অনিক অবশ্য তা খেয়াল করল না। সে বিষণ্ণ গলায় বলল, আমার কিছু ভালো লাগে না, হৃদি। কিছু না। মনে হয়, এই সবকিছু রেখে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না। আমিও কাউকে না। আমার কোনো কষ্ট থাকবে না। মনে হবে এই পৃথিবীতে আমি একা। আমার কোনো পিছুটান নেই।

আমিও না?

অনিক এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। হৃদি তার গলার কাছে নাক ঘষছে। তার নিশ্বাসে উত্তাপ। ঠোঁটে কম্পন। অনিক নিজের অজান্তেই যেন খানিক কাছে সরে এল। তারপর বলল, উঁহু। কেবল তোমাকেই আমার লাগবে।

লাগবে তো?

হুম।

কখন লাগবে? হৃদির গলায় উষ্ণতা।

সব সময়।

আর এখন? এখন লাগবে না?

অনিক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল হৃদি। দীর্ঘ সময়। কিন্তু অনিকের মনে হলো সময়টা হঠাৎ থমকে গেছে। তার চারপাশের কোলাহল, চলমান যানবাহন, মানুষ–সকলই স্থির হয়ে গেছে ঘড়ির স্তব্ধ কাঁটার মতো। একটা উষ্ণ জলপ্রপাত ক্রমশই উঠে আসছে শরীর বেয়ে। তারপর ছড়িয়ে পড়ছে শিরা উপশিরায়। সেখানে মেঘের মতো জমে থাকা থমথমে সব মন খারাপ ভেসে যাচ্ছে তুমুল স্রোতে। ঝোড়ো হাওয়ায়। সে ক্রমশই পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে। তারপর ভেসে যাচ্ছে নাম না জানা কোনো এক অচিনপুরের ঠিকানায়।

হৃদি হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু অনিক হাত বাড়িয়ে আবারও কাছে টেনে নিতে লাগল তাকে। হৃদি বলল, উঁহু।

উঁহু কী?

আর না।

কেন?

কারণ, পরীক্ষা শেষ।

কী পরীক্ষা? অবাক গলায় বলল অনিক।

আমার নারীজনম ব্যর্থ না সফল?

অনিক হাসল, কী মনে হলো?

মনে হলো–

আমি হতে পারি ভোর, অথই আদর, নামহীন নদী, কাছে রাখো যদি।

তোমাকে দূরে রাখা যায়?

যায় না?

না।

তাহলে এই যে এমন মন খারাপ করে থাকো?

সে তো আর সব কারণে।

কিন্তু সেই আর সব কারণের মধ্যে আমার কথা মনে থাকে না? এই যে আমি তোমার সঙ্গে আছি, এই কথাটা?

থাকে।

তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে…। বলে কী ভাবল হৃদি। তারপর বলল, তাহলে মন খারাপ থাকে কী করে? এই যে একজন মানুষ তোমাকে এত ভালোবাসে–তোমার কারণে জীবনের আর সব প্রাপ্তি, দুঃখ, আনন্দ তুচ্ছ করে তোমার কাছে ছুটে আসে–অপেক্ষা করে–এসব ভাবলে একটুও মন ভালো হয় না।

হয়।

উঁহু, হয় না। কেন হয় না, জানো?

কেন?

যা আমরা না চাইতেই পেয়ে যাই, যে সারাক্ষণ না বলতেও আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে, তার অস্তিত্ব আমরা টের পাই না।

তাহলে তোমাকে হারিয়ে ফেলার এত ভয় কেন হয়?

সেটা অন্য কারণ।

অন্য কী কারণ?

এই যে তুমি একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ। এই সময়টা তোমাকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে একধরনের ইনফিরিওরিটির ফিলিংস দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, সবাই তোমাকে উপেক্ষা করছে বা ছেড়ে যাচ্ছে।

অনিক কথা বলল না। হৃদিই বলল, এটা কেবল আমার একার ক্ষেত্রে না। তুমি একটু ভেবে দেখো, আর সবার ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে কি না। তোমার বন্ধু, কাছের মানুষ, পরিচিতজন। তাদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে না?

হৃদির কথার উত্তর দিল না অনিক। তবে মনে মনে ভাবল সে। হৃদি ভুল বলে নি। এই বোধটা আজকাল খুব হয় তার। মনে হয় সকলের কাছেই ক্রমশ অযাচিত, অনাকাক্ষিত হয়ে পড়ছে সে।

হৃদি হঠাৎ গাঢ় গলায় তাকে ডাকল, অনিক?

হুঁ।

তুমি কি জানো এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে বেশি ভালো আমি আর কাউকেই বাসি না?

অনিক জবাব দিল না। চুপ করে রইল। হৃদি বলল, কিন্তু কেন যেন আমার এই অনুভূতিটা আমি তোমাকে কখনো বোঝাতে পারি না। আমি এত চেষ্টা করি, তাও না। সারাক্ষণ মনে হয় আমাকে নিয়ে তোমার যেন একটা দ্বিধা রয়ে গেছে। একটা সংশয়। কেন?

আমি কি তা বলেছি?

ওই যে বললো, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় হয় তোমার?

সে তো দ্বিধা বা সংশয় থেকে নয়।

তাহলে?

অনিক সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। চুপ করে রইল অনেকটা সময়। তারপর বলল, প্রথম প্রথম যখন ঢাকায় এলাম, তখন বাবা কখনোই আমাকে একা রাস্তা পার হতে দিতেন না। কেন জানেন?

কেন?

বাবার সব সময়ই মনে হতো, একা পার হতে গিয়ে আমি কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলব। আমি কিন্তু তখন একা একাই সব করি। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুদের সঙ্গে কত জায়গায় যাই। কিন্তু বাবার সঙ্গে কোথাও গেলেই বাবা সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে তটস্থ থাকতেন।

এর সঙ্গে আমাকে নিয়ে দ্বিধার সম্পর্ক কোথায়?

অনিক মৃদু হাসল, আছে। আমরা যাকে খুব ভালোবাসি, তার অনুপস্থিতি কখনো সইতে পারব না বলে সব সময় তাকে হারানোর ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি তাকে হারিয়ে ফেললাম। তার কিছু হয়ে গেল!

অনিক থামলেও দীর্ঘ সময় কথা বলল না হৃদি। তাদের এই এত বছরের সম্পর্ক, বিয়ে, লুকিয়ে-চুরিয়ে একসঙ্গে থাকা, পরস্পরকে জানা, বোঝা–অথচ তারপরও আজকের সন্ধ্যার এই মুহূর্তটুকু তার কাছে বিশেষ হয়ে রইল। অনিক মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। সহজে মনের কথা কাউকে বলতে চায় না সে। কিন্তু আজ এখন যে কথাটি সে বলল, তা হৃদির বুকের ভেতর শিরশিরে আনন্দের এক অনুভূতি বইয়ে দিল। সে আলগোছে সরে এল অনিকের কাছে। তারপর তার বুকের ভেতর ছোট্ট পাখির মতো গুটিসুটি মেরে মিশে যেতে যেতে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমায় তুমি এমন করেই ভালোবেসো?

অনিক জবাব দিল না। হৃদি বলল, তাহলে আমি আর কিছু চাই না। কিছু না। যত ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদই আসুক না কেন, আমি সব সামলে নেব। তুমি দেখো।

অনিক হাত তুলে হৃদির মাথাটা ছুঁয়ে দিল। তার বুকটা খানিক কাঁপছিল বোধ হয়। গলার কাছটাও। হৃদি সেই কম্পন টের পাচ্ছিল কি না কে জানে! সে অকস্মাৎ মাথা তুলে তাকাতে চাইল। কিন্তু অনিক তাকে তাকাতে দিল না। বরং দুহাতে বেষ্টন করে রাখল বুকের সঙ্গে।

সে তার চোখের জল কাউকে দেখাতে চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *