১১০. লক্ষ্ণৌ হাসপাতাল

১১০

অক্টোবরে কসবায় যুদ্ধক্ষেত্রে দুই চোখের মাঝখানে নাকের ওপরে কপালে গুলি লেগেছে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের। ঢাকায় তখন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে খালেদ মোশাররফ মারা গেছেন। পুরো ঢাকা শোকার্ত হয়ে পড়ে। মমিনুল হক খোকা এই খবর হাসিনা রেহানাকে দিলে তাঁরাও প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করেন। পরে জানা যায় যে তিনি মারা যাননি। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

আগরতলা থেকে বিমানে করে খালেদকে আনা হয় দমদমে। এখান থেকে অচেতন গুলিবিদ্ধ-ললাট এই যোদ্ধাকে নেওয়া হবে লক্ষ্ণৌতে। তাজউদ্দীন ছুটে এসেছেন দমদমে। খালেদ অচেতন। তাঁকে স্টেচারে তোলা হচ্ছে কার্গো বিমানে। বিমানের বাইরে বিমানবন্দরে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে স্টেচার ধরার চেষ্টা করছেন তাঁর স্ত্রী সালমা। সঙ্গে দুটো অবোধ শিশু।

তাজউদ্দীন সালমাকে বললেন, খালেদকে আমরা মরতে দেব না। খালেদ মরতে পারে না। যেভাবেই হোক, যে চিকিৎসাই লাগুক, আমরা তা নিশ্চিত করব।

.

খালেদের পাশে দুজন চিকিৎসক। দুজনই লে. কর্নেল। খালেদের চিকিৎসার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা কেবল মেজর জেনারেলদের জন্যই ভারতে বরাদ্দ ছিল। এই কথা শুনে ফারুক আজিজ খান বলেছিলেন, আমাদের মেজররাই আমাদের মেজর জেনারেল।

খালেদ এখন ভারতের লক্ষ্ণৌতে। ১৬ ডিসেম্বরে লক্ষ্ণৌতে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার মাথার খুলির ভেতর থেকে প্লিন্টার বের করতে আট ঘণ্টার অপারেশন লেগেছিল। পুনে থেকে নিউরোসার্জন ক্যাপ্টেন। মদনকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল এই অপারেশনের জন্য। তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। মেজর তাহেরকেও এখানে আনা হয়েছে নভেম্বরে। তার পা উড়ে গিয়েছিল শেলের বড় প্লিন্টার লেগে, কিন্তু তার জুতাটা একটা রগের সঙ্গে ঝুলেই ছিল। সেটা নিয়েই তিনি গৌহাটি হাসপাতাল হয়ে লক্ষ্ণৌতে এসেছেন। মানে তার পা কেটে ফেলা হলেও তিনি সেই না-পায়ের বুটটা ছাড়েননি। বিছানার পাশে রেখে দিয়েছেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এই হাসপাতালে এলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। তাঁর পায়ে গুলি লেগেছিল, হাঁটু ভেঙে গিয়েছিল। পায়ে গুলি নিয়ে জামালপুরের নকশি ফ্রন্ট থেকে এখানে এসেছেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী। এই হাসপাতালে ৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা নিচ্ছেন। জামালপুরের একজন ১৫ বছরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকেও এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। লক্ষ্ণৌ রেডিও থেকে একজন পাঞ্জাবি সাংবাদিক আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিতে। কিশোরটির সাক্ষাৎকারের সময় দোভাষী। ছিলেন আমীন। ছেলেটি বলছিল, হালার পাঞ্জাবিটা ওই হানে লুকায় আছে, ওই হালার পাঞ্জাবিরে আমি তো দেখি নাই…। সাক্ষাৎকারগ্রহীতা জিজ্ঞেস করলেন, ও পাঞ্জাবিদের গালি দিচ্ছে কেন…হামভি পাঞ্জাবি হ্যায়…ইসকো জারা গালি না দেনে কো বোলো…।

১৬ ডিসেম্বরে ৯৭ জন চিকিসাধীন মুক্তিযোদ্ধা লক্ষ্ণৌ হাসপাতালের একটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেডিও শুনতে লাগলেন। পাকিস্তানিরা একটু পর সারেন্ডার করবে…একজন গাইতে শুরু করলেন, আমার সোনার বাংলা…

সবাই কাঁদতে লাগলেন।

.

খালেদ মোশাররফ যখন লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে, তার যোগ্য সহযোগী মেজর এ টি এম হায়দার চলে এসেছেন ঢাকায়। মেজর হায়দার ডিসেম্বরের ৮ তারিখেই নির্দেশ দিয়েছেন, ২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা গেরিলারা কেউ ঢাকা ছাড়বে না। রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ হতে পারে। তোমাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বালু নদের পারে ছিল তাদের বাহিনী। সাভারের গ্রামে ছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফের দল। তাদের কমান্ডার মানিকের মৃত্যুর পর নাসির উদ্দীন। ইউসুফ বাচ্চুই কমান্ডার। সাভার-ঢাকার রাস্তায় ঢাকামুখী পাকিস্তানি মিলিটারিদের অ্যাম্বুশ করে তাঁরা ছত্রখান করে দিচ্ছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রাস্তা ভরে ফেলে। রাস্তায়। যদিও কারফিউ, কিন্তু মুক্তি, ভারতীয় বাহিনী, পাকিস্তানি মিলিটারি সবাই রাস্তায় চলাচল করছিল। নিয়াজি আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধ পরিত্যাগ করতে। মানেকশ নিজেও যুদ্ধবিরতি সকাল ৯টা থেকে বাড়িয়ে বিকেল ৩টা পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন।

মেজর হায়দারের গায়ে লম্বা একটা লেদার জ্যাকেট। এটা তিনি কিনেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের লান্ডিকোটাল মার্কেট থেকে। তিনি ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকায় ব্যস্ত। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংকে নিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গেলেন। এটা রেডক্রসের এলাকা। নো ওয়ার জোন। ভেতরে গভর্নর মালিকসহ অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন। সামনে মুক্তিযোদ্ধারা ভিড় করে আছে। জনতা উত্তেজিত। এর মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থেকে পদত্যাগী গভর্নর ডা. মালিকের সঙ্গে দেখা করে বের হলেন জেনারেল রাও ফরমান। মুক্তিবাহিনী, যাদের অনেকের পরনে লুঙ্গি, হাতে স্টেনগান, তাঁকে মেরে ফেলতে চায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। উৎসুক জনতা। তারা চিৎকার করছে, রাও ফরমান আলীকে আমাদের হাতে দাও। সে খুনি।

ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বললেন, খবরদার। যুদ্ধবিরতি চলছে। ওরা সারেন্ডার করবে। নো মোর ওয়ার।

হায়দার বললেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি।

রাও ফরমান আলী বাংলা জানতেন। তিনিও বললেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি।

রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। হাজার হাজার মুক্তিবাহিনীর ছেলে। সবার হাতে রাইফেল। তারা চিৎকার করছে : তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। তারা স্লোগান দিচ্ছে : তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। হঠাৎ জনতার নজরে পড়ল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশেই রেডিও অফিস। সেখানে একটা পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। জনতা কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে গেল সেখানে। মুহূর্তে নামিয়ে ফেলল পাকিস্তানের পতাকা।

বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল তারা ঝটপট। তখন ১৬ ডিসেম্বরের দুপুর। ঝকঝকে রোদ্দুরে সবুজের মধ্যে লাল, লালের মধ্যে হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে পতাকাটি পতপত করে উড়তে লাগল।

হায়দারের পাশে এসে দাঁড়াল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছেই বাড়ি ছিল যার, সেই জহিরউদ্দিন জালাল। হায়দার তাকে বললেন, তোমরা আমার সঙ্গে থাকো। হায়দার আর সাবেগ সিংয়ের সঙ্গে জালাল আরও দুজন তরুণ গেরিলা অস্ত্র হাতে পাশাপাশি চলতে লাগল। তারা জিপ নিয়ে ছুটে গেলেন। বিমানবন্দরে। হেলিকপ্টারে নামলেন জেনারেল জ্যাকব।

তাঁরা নিয়াজির সদর দপ্তরে চলে গেলেন।

.

দুপুর ১২টা পর্যন্ত ডেমরায় যুদ্ধ করছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। ভীষণ যুদ্ধ। শেষে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। সফিউল্লাহ ভীষণ ক্লান্ত। এই সময় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের কাছ থেকে খবর এল, নিয়াজি সারেন্ডার করবে, তিনটায় এয়ারপোর্টে থাকতে হবে। চারটায় রমনা রেসকোর্সে। ডেমরা থেকে এয়ারপোর্টের রাস্তায় তখনো পাকিস্তানি বাহিনী গোলাগুলি করছিল। মেজর সফিউল্লাহ আত্মসমর্পণকারী কমান্ডার খিলজিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দেন। কে ফোর্সকে বলেন রমনায় ৪টার মধ্যে হাজির থাকতে।

গোলাগুলির মধ্যেই সফিউল্লাহ বিমানবন্দরে হাজির হন তিনটার আগেই।

বেলা তিনটার দিকে সাবেগ সিং এবং মেজর হায়দার আবার গেলেন বিমানবন্দরে। এর দায়িত্ব এরই মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে নিয়েছে। জালালদের নিয়ে মেজর হায়দার ও সাবেগ সিং বিমানবন্দরে ঢুকলেন। ১৫-২০টা হেলিকপ্টার নামল। জেনারেল অরোরা, তাঁর স্ত্রী, এ কে খন্দকার হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। জনতা ছুটে গেল ফুলের মালা নিয়ে। তাঁদের মাল্যভূষিত করা হলো বিপুলভাবে। কাদের সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে ছিলেন এদিকটায়, তাকে দেখে মিসেস অরোরা দৌড়ে এলেন, জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার বিয়ে কিন্তু আমি দেব। পাত্রী আমি ঠিক করব।

.

বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজি তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। জ্যাকব তো সঙ্গে ছিলেনই। বিমানবন্দর পর্যন্ত আসতেও তাঁদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনী আটকাচ্ছিল। ভাগ্যিস সঙ্গে শিখ সৈন্য ছিল। তার পাগড়ি দেখে মুক্তিবাহিনী ছেড়ে দিচ্ছিল।

অরোরা গাড়িতে উঠলেন। সঙ্গে মিসেস অরোরা। নিয়াজি আর এয়ার ভাইস মার্শাল দেওয়ান এক গাড়িতে উঠলেন। জ্যাকবকে আরেকটা গাড়িতে উঠতে হলো। সবার সামনের গাড়িতে সাবেগ সিং আর মেজর হায়দার। শিখ থাকলে মুক্তিরা ছেড়ে দেয়। আর হায়দারের চেহারায় বাঙালিত্বের ছাপ স্পষ্ট। গাড়িবহর সোজা চলছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে।

রাস্তায় মানুষ। রাস্তায় মুক্তিবাহিনী। রাস্তায় চিৎকার জয় বাংলা। রাস্তায় আনন্দ। রাস্তায় অশ্রু। আকাশে-বাতাসে জয়ধ্বনি। মানুষ ছুটছে রেসকোর্সের দিকে।

হায়দার নামলেন গাড়ি থেকে। সঙ্গে জালাল আর একজন মুক্তি। হায়দার বললেন, জালাল, যাও, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার নিয়ে এসো।

জালাল ছুটল ঢাকা ক্লাবে। মুক্তি দেখে অবাঙালি ড্রাইভার ভয়ে কাঁদতে লাগল। জালাল বলল, ভয় নাই, দুইটা চেয়ার আর একটা টেবিল দাও। দুইটা কাঠের চেয়ার আর একটা কাঠের টেবিল পাওয়া গেল। সেগুলো তিনজনে ধরাধরি করে শাহবাগের রাস্তায় আনার সঙ্গে সঙ্গে জনতাই ধরাধরি করে চেয়ার-টেবিল পৌঁছে দিল রেসকোর্সে।

হায়দার নিয়াজির বাঁ পাশে। নিয়াজির ডানে অরোরা। সবার সামনে তাঁরা। পেছনে আরও আরও অফিসার। তারা বড় বড় পা ফেলে রেসকোর্সের চেয়ার-টেবিল পাতা জায়গাটায় গেলেন। পৌনে পাঁচটার পৌষের রোদ এসে পড়ল হায়দারের মুখে। তাঁকে দেখতে লাগছিল একটা দেবদূতের মতো।

পাকিস্তানি সৈন্যদের একটা দল অরোরাকে গার্ড অব অনার দিল।

টেবিলে বসলেন অরোরা আর নিয়াজি। পেছনে দাঁড়িয়ে জ্যাকব, বিমানবাহিনীর মার্শাল দেওয়ান, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, এ কে খন্দকার। জ্যাকব দেখলেন, কাগজে লেখা : ইনস্ট্রমেন্ট অব সারেন্ডার। টু বি সাইনড অ্যাট ১৬৩১ আওয়ারস আইএসটি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জ্যাকব দেখলেন ৪টা ৫৫।

নিয়াজি ও অরোরা সাইন করলেন। নিয়াজি তাঁর ব্যাজ খুলে অরোরাকে দিলেন। একটা রিভলবার তুলে দিলেন অরোরার হাতে। তাঁর চোখে টপ টপ করে জল ঝরছে।

ঠিক সামনে থেকে সেই দৃশ্য দেখলেন মেজর সফিউল্লাহ।

জেনারেল নাগরা একটা মাইকে সামনে দাঁড়ানো সারি সারি পাকিস্তানি সৈন্যদের বললেন, তোমাদের ওপরে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। মর্যাদার সঙ্গে তোমাদের ট্রিট করা হবে।

.

পাকিস্তানি সৈন্যরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বেল্ট খুলে ফেলে। গায়ের পোশাক প্যান্টের ভেতর থেকে বের করে। তারা হাতের অস্ত্র মাটিতে রাখে। তারা সবাই কাঁদছিল।

আর চারদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা জয় বাংলা চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এত মানুষ কোথায় ছিল এই ঢাকায়।

জনতা চিৎকার করে বলে, নিয়াজিকে আমাদের হাতে ছেড়ে দাও।

জয় বাংলা, জয় হিন্দ, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ স্লোগানে মুখর তখন রমনার আকাশ-বাতাস।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তখন রমনার গাছের ডালে ওড়ে আর গেয়ে ওঠে : জয় বাংলা বাংলার জয় হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়…

ব্যাঙ্গমা বলে, তোমারে কি কইছিলাম, বহুদিন আগে, এই ট্র্যাজেডি পূর্বনির্ধারিত?

ব্যাঙ্গমি বলে, হ কইছিলা। গ্রিক ট্র্যাজেডির পরিণতি দেবতারা আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখেন। ক্যাস্টালিয়া ঝরনার জলকল্লোল, গভীর গর্ত থাইকা উইঠা আসা বাষ্পমালা, তারই আড়ালে তিন ঠ্যাংওয়ালা চৌকি থাইকা অ্যাপেলো করতেন ভবিষ্যদ্বাণী!

মনে আছে তোমার তাইলে? আর আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে বইসা আমেরিকাওয়ালারা কয়, পৃথিবীতে কে হাসব, কে কান্দব, এইটা ঠিক করুম আমরা। তারা বাঙালিরা কান্নারে কান্না মনে করে নাই। এক লক্ষ লোক মারা গেল, দুই লক্ষ লোক মারা গেল, দশ লক্ষ লোক মারা গেল, বিশ, ত্রিশ, তারা কয়, আমরা নীরব থাকুম। নীরব না থাইকা তারা পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাইল, শেষে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ তথা সপ্তম নৌবহর পাঠাইল বঙ্গোপসাগরের দিকে, কিন্তু তাতে কি নিয়াজির কান্না, ইয়াহিয়ার অপমান ঠেকাইতে তারা পারল?

পারে নাই। কিন্তু ইতিহাসে একদিন এই প্রশ্ন তো উঠব যে, নিক্সন যদি ইয়াহিয়ার প্রেমে না পড়তেন, ইন্দিরা গান্ধীরে এত অপছন্দ না করতেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অফিসারগো কথা যদি তিনি শুনতেন, তাইলে এত লক্ষ লক্ষ বাঙালি মারা যাইত না, এত এত ভারতীয় সৈন্যরেও জীবন দিতে হইত না, এত এত পাকিস্তানি নারীকে বিধবা হইতে হইত না, এত এত বিহারিকেও বিপদে পড়তে হইত না।

১৯৪৭ সালে যে সুময় পাকিস্তান হয়, সেই সুময় আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল চিঠি লেখছিলেন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানরে, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান নামে একটা রাষ্ট্র হইতে যাইতেছে ভারতের উত্তর পশ্চিমের বড় অংশ আর দক্ষিণ-পুবের একটা ছোট্ট অংশ লইয়া, এইটারে আমগো পকেটে পুরতে হইব, সবচায়া বড় মুসলিম দ্যাশ আর সবচায়া ইম্পরট্যান্ট স্ট্র্যাটেজিক এলাকা, চীনের পাশে, রাশিয়ার কাছে, এইটারে আমার আছর করতেই হইব। সেই যে ট্রমান আর মার্শাল মিইলা পাকিস্তানের লগে পিরিত শুরু করলেন, বিধি এই যে, আমেরিকা যারে জাপ্টায়া ধরছে, তার কপালে আর কোনো দিনও উন্নতি নাই। এই যে পাকিস্তান জ্বলতে শুরু করল, ২৩ বছরে একটা সংবিধান দিতে পারল না, একটা ইলেকশন হইল, মিলিটারি আর কায়েমি শাসকশ্রেণি, সামন্ত প্রভু, বণিক আর শিল্পপতিরা মিইলা জনগণের ইচ্ছারে ট্যাংকের তলায় পিষল, সেই আগুন কোনো দিনও নিভব না। পাকিস্তান জ্বলছে, জ্বলতেই থাকব। পাকিস্তানের গরিব মানুষ কানতাছে। কানতেই থাকব। পাকিস্তানে বোমা ফোটে। ফুটতেই থাকব।

ত্রিকালদর্শী ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলে :

মানুষ ভাবতে থাকে সে হইল সব।
আমি সব, আমি কেন্দ্র, করে কলরব ॥
ওপরে বিধাতা হাসে, তিনি অন্তর্যামী!
পূর্বনির্ধারিত সব, এতটুকু জানি ॥
তোমার ভাগ্যের লাইগা, দায়ী করো কারে?
আমেরিকা চীন পিছে কলকাঠি নাড়ে!
রাশিয়া ভারত আছে, তারা বইসা নাই,
আমেরিকা-পিরিতিতে পাকিস্তান ছাই ॥

ব্যাঙ্গমা বলে, পাকিস্তানের পাপ হইল জন্মের পাপ। জন্মের সুময়ই আমেরিকার নজর পড়ছিল তার ওপরে, ট্রমান আর মার্শাল ঠিক করছিল তারে পিরিতের আঠায় বাইন্দা রাখব। সেই পাপে পাকিস্তানিরা, চিরটাকাল ছারখার হইয়া গেল। যে শিশু কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, অবোধ শিশু স্কুলে। গেছে, বোমায় পুইড়া মইরা গেল। ২০২১ সালের মে মাসে রমজানের দিনেও হ্যাঁগো স্কুলে বোমা পইড়া স্কুলের বাচ্চারা মইরা গেল। হায় পাকিস্তান!

১১১

তখন দিল্লিতে লোকসভার অধিবেশন চলছে। ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন : ঢাকা মুক্ত। ঢাকা এখন মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী। আজ ৪টা ৩১ মিনিটে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ডের প্রতিনিধি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছেন। এই হাউস এবং এই জাতি এই আনন্দের মুহূর্তে উদ্বেলিত। আমরা বাংলাদেশের মানুষকে এই জয়ে অভিনন্দন জানাই। অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের সাহসী মানুষ এবং ছেলেদের। কী সাহসিকতাই না তারা দেখিয়েছে! এই জয় অস্ত্রের নয়। আদর্শের। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এত কষ্ট স্বীকার করে এত বীরত্ব দেখাতে পারত না, যদি না তারা জানত তারা লড়ছে আদর্শের জন্য, একটা স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের বাহিনীও লড়তে পারত না যদি না তারা বাংলাদেশের এই কারণটিকে হৃদয়ে ধারণ করতে না পারত।

১১২

রেডিও ঘিরে বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার শাজাহান ভলুম বাড়িয়ে দিলেন। সৈয়দপুরের কাছে তাদের ক্যাম্প। মিত্রবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ হিসেবে তারা এগিয়ে চলেছেন রংপুরের দিকে। পাকিস্তানিরা পালাচ্ছে। এখন শীতের রাতে তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন। মুক্তিযোদ্ধারা। জোনাকির আলো আশার মতো জ্বলছে। কুয়াশা এই আলো ঢাকতে পারছে না। শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে চষা-জমির ওই ওপারের বাঁশঝাড় থেকে। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হতে শুরু করল চরমপত্র।

তারা শুনছেন আর হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।

মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেকা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা-আ-আ আ দম ফালাইতাছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। তোমরা কেডা? ও-অ-অ টাঙ্গাইল থাইক্যা আইছ বুঝি? কতজন ফেরত আইছ? অ্যাঃ ৭২ জন! কেতাবের মাইদে তো দেখতাছি লেখা রইছে টাঙ্গাইলে দেড় হাজার পোস্টিং আছিল। ব্যস্ ব্যস, আর কইতে হইব না–বুইজ্যা ফালাইছি। কাঁদেরিয়া বাহিনী বুঝি বাকিগুলার হেই কারবার কইরা ফালাইছে। এইডা কী? তোমরা মাত্র ১১০ জন কীর লাইগ্যা? তোমরা কতজন আছলা? খাড়া খাড়াও–এই যে পাইছি। ভৈরব-১,২৫০ জন। তা হইলে ১,১৪০ জনের ইন্নালিল্লাহে ডট ডট ডট রাজেউন হইয়া গেছে। হউক কোনো ক্ষেতি নাই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলারে বঙ্গাল মুলুকে আনা হইছিল। রংপুর দিনাজপুর, বগড়া-পাবনা মানে কিনা বড় গাং-এর উত্তর মুড়ার মছুয়া মহারাজ গো কোনো খবর নাইক্যা। হেই সব এলাকায় এক শতে এক শর কারবার হইছে। আজরাইল ফেরেশতা খালি কোম্পানির হিসাবে নাম লিখ্যা থুইছে।

শাজাহান বললেন, আমাদের এলাকার খবরও তো বলল।

১৪ বছরের রাখালবালক বাদল, যে এই এলাকায় পথনির্দেশনা দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা দলে সঙ্গী হয়েছে, সে বলল, কমান্ডার বাহে, যুদ্ধ তো শ্যাষ হয়া আসতেছে, আপনেরা তো টাউনত চলি যাইবেন, মুই কী করমো? হামাক তোমরা সাথে করি ধরি নিয়া যান।

শাজাহান যুদ্ধের আগে পড়তেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সত্যি, যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, কত মৃত্যু, কত কান্না, কত ত্যাগের মধ্য দিয়ে আসছে স্বাধীনতা, তারপর কী? তিনি তো রাজশাহী চলে যাবেন, এই বাদল কই যাবে? তারা কি আর কোনো দিনও একই থালায় খাবার ভাগ করে খাবেন?

১১৩

রাসেলকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই সে দৌড়ে ছাদে যাচ্ছে আর চিৎকার করে উঠছে : জয় বাংলা। রেহানাও প্লেন দেখলেই উঁকিঝুঁকি মারে।

অথচ ছাদে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংকার বানিয়ে রেখেছে।

আবদুল আর রমা দুই কিশোর পরিচারক সুযোগ পেলেই বাইরে যাচ্ছে। এসে বলছে, মুক্তিবাহিনী ঢাকায় ঢুইকা পড়ছে আর চিন্তা নাই।

রেহানা রেডিও কোলে করে ঘুরছে, হাতিয়ার ডাল দো। পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসাররা, তোমরা সারেন্ডার করো। তোমাদের জেনেভা কনভেনশন অনুসারে মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। উর্দুতে আর ইংরেজিতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে আকাশবাণী থেকে।

রেডিও বলছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। জেনারেল নিয়াজি ঘোষণা দিয়েছেন সমস্ত ইস্ট কমান্ড যেন অস্ত্র সংবরণ করে।

আকাশবাণী থেকে বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছেন। তিনি সারা বাংলাদেশে তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছেন আত্মসমর্পণ করার জন্য।

রেহানা ছুটে বাইরে যেতে চাইছে। দূরে রাস্তায় শোনা যাচ্ছে জয়ধ্বনি জয় বাংলা।

হাসিনা জয়কে কোলে নিয়ে পায়চারি করছেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছে। যুদ্ধ শেষ হবে। আমরা মুক্তি পাব।

কিন্তু আব্বা কোথায়? আব্বা কেমন আছেন? আব্বার বিচার করা হচ্ছে, এটা তো তারা শুনেছেন। নজমুল হক সাংবাদিক তো আব্বাকে দেখে এসেছেন পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারে। আব্বার নাকি মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। আব্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছে? নাকি মেরে ফেলেছে?

আকাশে আবার হেলিকপ্টারের শব্দ। রাসেল ওপরে যেতে চায়। মা বলেন, আরে বাবা। যাস না। গোলাগুলির মধ্যে পড়বি।

হাসিনার মনে নানা দুশ্চিন্তা। কামাল কেমন আছে? জামাল কেমন আছে? নাসের চাচা কেমন আছে? মণি ভাই কোথায়? শহীদ ভাই?

রাস্তা থেকে হাজার কণ্ঠের স্লোগান ভেসে আসছে। জয় বাংলা। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব।

কিন্তু এই রাস্তায় কাউকে আসতে দিচ্ছে না। ফোন নেই। বাড়িতে কোনো আসবাবও নেই। শুধু দুইটা চৌকি ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই যাতে কেউ বসে থাকতে পারে।

নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছে, তো এই পায়েন্দা খানেরা আত্মসমর্পণ করছে না কেন।

এই রাস্তা দিয়ে লোকেরা যাচ্ছে। অমনি গুলির শব্দ।

এই বাড়ির পাহারাদার মিলিটারিরা ১৮ নম্বর সড়কটির দুই মাথায় ব্যারিকেড বসাল। এই রাস্তা দিয়ে কাউকে যেতে দেবে না।

লোকজন আনন্দে যেন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। রাস্তায় অস্ত্র হাতে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে একটা মিছিল যাচ্ছে।

রেহানা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল : মুক্তিবাহিনী মুক্তিবাহিনী।

কাঁদেরিয়া বাহিনীর একদল লোক এই রাস্তা দিয়ে অস্ত্র হাতে মিছিল করতে করতে যাচ্ছিল। এই বাড়ির মিলিটারিরা গুলি করা শুরু করল। তারা পাল্টা গুলি করবে। ওদের নেতা নিবৃত্ত করলেন। ভেতরে বঙ্গবন্ধুর পরিবার আছে। তোমরা গুলি করলে ওরা মারা যাবে।

.

স্লোগান। মিছিল। গুলি। রেডিওতে শোনা যাচ্ছে বিজয়ের নানা সংবাদ।

হাসিনা জয়কে কোলে নিয়ে মেঝেতে বসেছেন। সবাই মাদুরে বসা। রেনু, রেহানা, খোকা কাকু।

বিকেলের দিকে হঠাৎ বাড়ির সামনে গাড়ির শব্দ। কে এই রাস্তায় এসেছে? তারা আবার চিৎকার করছে জয় বাংলা। নারীকণ্ঠের স্লোগান।

অমনি গুলি। পানি পানি বলে চিৎকার।

রেনু ছুটে বাইরে গেলেন। বললেন, তোমরা কী করছ? ওদের মেরে ফেললে নাকি? তোমাদের নিয়াজি সারেন্ডার করেছে। তোমরাও সারেন্ডার করো। আমাকে যেতে দাও। আমি পানি নিয়ে যাব। তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে জগে করে পানি নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। মিলিটারিরা দরজা আটকে রইল।

সরো। তোমাদের সেনাবাহিনী প্রধান তো সারেন্ডার করছে।

নিয়াজি কর সকতা হ্যায়, হাম নেহি করেঙ্গা। হামারা পাস এতনা তাগদ হ্যায়, হাম নেহি করেঙ্গে। সিপাহির উত্তর।

রেহানাও ছুটে বের হলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে বললেন, মা এ তো ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী সাহেবের গাড়ি। গাড়িতে মহিলারা ছিলেন। বোধ হয় গুলিতে মারা গেছেন।

এক মহিলা নেমে গেলেন। মনে হচ্ছে হাতেম আলীর স্ত্রী। তার হাত বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে।

ওরা চিৎকার করছেন, পানি পানি। রেহানা রেনুর হাত থেকে জগ কেড়ে নিয়ে বললেন, সরো, আমি যাব।

অন্দর যাও কুছ নেহি হোতা।

সাদা পতাকা উড়িয়ে দুজন এলেন। গাড়ির ভেতর থেকে একজন মহিলাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটছেন। মহিলার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। ইমা গো। রেহানা বললেন, মনে হয় মাথায় গুলি লেগেছে।

আরেকজন লোককে বের করল একজন। তাকেও কোলে করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গাড়িটা রেহানাদের বন্দিবাড়ি থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার ধারে আটকে আছে বলে হয়তো মিলিটারিরা আর গুলি করছে না।

মা, ডোরা আপা মারা গেছেন। রেহানা বললেন।

কোন ডোরা?

ডাক্তার ডোরা।

রনো-জুনোর বোন?

হ্যাঁ।

কেমন করে বুঝলি।

ওরা বলছিল। আমি শুনেছি। আর মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

হাসিনা জয়কে বুকে চেপে ধরলেন। রাসেল গিয়ে শান্ত ছেলের মতো মায়ের কোলে বসল।

রেহানা কাঁদতে লাগলেন।

একটু পরে রেডিওর খবরে বলা হলো, রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছেন। যৌথ বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার জেনারেল অরোরার কাছে তিনি করেছেন এই আত্মসমর্পণ।

হাসিনার মনে নানা চিন্তা পাক খাচ্ছে। দেশ আজ বিজয়ের আনন্দে হাসছে। আব্বা যেখানে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন, সেই রেসকোর্স মাঠেই পাকিস্তানি মিলিটারি সারেন্ডার করল। এই ময়দানেই তো বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এই মাঠেই তো এমএনএ, এমএলএরা শপথ নিয়েছিলেন যে তাঁরা ৬ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।

দেশ স্বাধীন হচ্ছে। আব্বার সারা জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ হচ্ছে। আব্বা-আম্মার সারা জীবনের কষ্ট আজ সার্থকতা পাচ্ছে। আব্বার সারা জীবনের সাধনা আজ সফল হচ্ছে। আব্বা নেই।

এদিকে দাদা-দাদি পিজিতে ছিলেন। তাঁদেরই-বা খবর কী। পিজি হাসপাতালে ওয়াজেদ মিয়াও ছিলেন। খোদা জানে, তার কী খবর।

হাসিনা হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝতে পারেন না।

রেনু হঠাৎ বললেন, হাসু, তোর আব্বা ২৫ মার্চ রাতে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, আমি বাড়ি থেকে পালায়া যাব, আমি বলছিলাম, না, পালাবা না। তোমাকে ধরে নিয়ে গেলে কী হবে? মেরে ফেললে দেশ স্বাধীন হবে। বাঁচায়া রাখলেও দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু পালায়া তুমি যাবা কোথায়? তোমার মতো বড়সড় মানুষ আর এত বড় নেতা ক্যান পালাবে? পালালে পাকিস্তানিরা পালাবে।

রেনু হঠাৎ কেঁদে ফেললেন, তোর আব্বার স্বপ্ন সফল হলো। এখন আমার তো ওই চিন্তা হচ্ছে, তিনি বেঁচে আছেন নাকি তাকে মেরেই ফেলল।

সবাই মিলে গোল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। শুধু জয় কিছু বুঝতে পারছে না। সে আ আ আ করতে লাগল।

রাসেল বলল, জয় মামা, বলো জয় বাংলা।

আবার একটা গাড়ির শব্দ। আবার গুলি। আবদুল বলল, এই গাড়ির ড্রাইভারও মইরা গেছে। গাড়িটা গাছের গায়ে গিয়া খাড়ায়া আছে।

মিলিটারিরা চিৎকার করছে, বাত্তি বন্ধ করো, বাত্তি বন্ধ করো। কে বন্ধ করবে? চালক তো মারা গেছে।

.

রাতের বেলা সবাই মিলে বিবিসি শুনলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভাষণ দিলেন। রাস্তায় লোকেরা জয় বাংলা ধ্বনি দিচ্ছে, তার রেকর্ড বাজাল বিবিসি আকাশবাণী। কিন্তু এই বাড়ির মিলিটারিরা তাদের পোস্ট ছাড়ছে না। কী মুশকিল!

১১৪

রিমি বলল, মা, দেশ তো স্বাধীন হলো। আজ কি আব্বু আমাদের কাছে আসবেন না!

রিপি বলল, আজকে তো আল্লুকে আসতে হবে।

তারা অপেক্ষা করতে লাগল। লিলি ওদেরকে বললেন, ভাত খেয়ে নাও।

রিমি-রিপি বলল, আন্ধু আসবে তো। আব্বু আসবে, তারপর খাব।

লিলি বললেন, তোমার আব্দুর আজকে তো আরও বেশি কাজ। কেবল পাকিস্তানি মিলিটারি সারেন্ডার করেছে, এখনো তো দেশে কোনো আইনকানুন হয়নি। আজকে রাতে তোমার আব্বকে বেশি কাজ করতে হবে। তোমরা খাও। আব্বু এলে তো দেখা পাবেই।

ওরা বলল, আচ্ছা ভাত খাব না। অন্য খাবার দাও। ভাত আব্বু এলেই খাব।

.

তাজউদ্দীনের কাছে এসেছেন সাংবাদিকেরা। থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অফিসে বিকেলের পর থেকেই ভিড়। সবাই মিষ্টি বিতরণ করছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবী, নেতারা ছুটে আসছেন। জয় বাংলার লোকেরা আসছে। বাংলাদেশ মিশন তো লোকে লোকারণ্য। কলকাতাবাসী রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। তারাও স্লোগান দিচ্ছে জয় বাংলা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

রেডিওর সাংবাদিক টেপ রেকর্ডার ধরেছেন তাজউদ্দীনের সামনে। বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে গেল, পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করল, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

তাজউদ্দীন বললেন, যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তাঁকে মুক্ত করে আনা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই। বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন।

.

রাত ১২টার পর তাজউদ্দীন এলেন বাসায়।

রিমি আর রিপি তার আব্দুর কোলে গিয়ে উঠল। বলল, তোমার সঙ্গে ভাত খাব বলে আমরা ভাত খাই নাই।

প্রায় ৯ মাস পরে আব্দুর সঙ্গে বসে একসঙ্গে খেল তারা।

১১৫

১৬ ডিসেম্বর। জেনারেল গুল হাসান দাঁড়িয়ে আছেন ইয়াহিয়ার খাসকামরার দরজায়। প্রেসিডেন্ট বের হচ্ছেন না। গুল হাসান নিজেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে। প্রেসিডেন্ট তখনো বসে বসে মদ খাচ্ছেন।

কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে তার অবিরাম মদ্যপান। রাতে মদের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে তিনি হঠাৎ ভেসে উঠলেন। বললেন, রেডিও-টিভিকে খবর দাও। আমি এখনই আমার বিশেষ ক্ষমতাবলে নতুন সংবিধান ঘোষণা করব। পাকিস্তান হবে ইসলামিক দেশ। এই দেশ আজ থেকে ইসলামিক রাষ্ট্র। ব্যস। বলেই তিনি বমি করতে লাগলেন। বমির দুর্গন্ধে প্রেসিডেন্ট ভবন ভেসে যেতে লাগল।

গুল হাসান বললেন, স্যার। আপনাকে রেডিওতে যেতে হবে।

কেন?

স্যার, আপনাকে একটা ভাষণ দিতে হবে।

শোনো, থার্টি ফার্স্টে আমি রাওয়ালপিন্ডির রাস্তায় মানেকশকে দিয়ে প্যারেড করব। জ্যাকবকে প্যারেড করাব। জগজীবনকে কোমরে দড়ি বেঁধে। রাস্তায় ঘোরাব।

স্যার। আপনাকে উঠতে হবে, স্যার।

জেনারেল হামিদও এলেন, স্যার প্লিজ।

হামিদ। এসো, তুমিও খাও। তোমার মনে আছে আমরা লারকানায় ভুট্টোর বাগানবাড়িতে কত মদ খেয়েছিলাম। সেদিনই তো আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মুজিবকে আমরা ক্ষমতা দেব না। আলোচনা সব লোকদেখানো। মনে আছে? তোমরা দুজনে আমাকে রাজি করিয়েছিলে। মনে আছে?

স্যার। এই সব মনে রাখার সময় আর নাই। পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটে গেছে। আপনি অনুমতি দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে আমরা সারেন্ডার করতে যাচ্ছি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।

হামিদের চোখে জল।

হামিদ তুমি কাঁদছ কেন?

আমি সেনাবাহিনীর প্রধান। আমার সৈন্যরা সারেন্ডার করছে, আমি কি হাসব?

গুল হাসান। তুমি কী মনে করো? কোনো মরদ লোক কাঁদতে পারে? ইয়াহিয়া বললেন।

না স্যার। গুল হাসান নিজেই কাঁদতে শুরু করলেন।

১১৬

পাশার কানে লাগছে ডিসেম্বরের সন্ধ্যার শীতের বাতাস। সে খিলখিল করে হাসছে। গাড়ি চালাচ্ছেন বাচ্চু ভাই। তাঁদের কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু (২১)। নয়াপল্টন এলাকায় বাচ্চু ভাইয়ের বাসা, তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সাভার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল দলটির তিনিই এখন কমান্ডার।

তৌফিকুর রহমান ওরফে পাশা আগরতলার ২ নম্বর সেক্টর থেকে মেজর হায়দারের নির্দেশে নভেম্বরে এসে যোগ দিয়েছে সাভার দলের সঙ্গে। ২৫ মার্চের গণহত্যার নিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বচক্ষে দেখে ১৬ বছরের পাশা সেই যে বেরিয়েছিল যুদ্ধের খোঁজে, পল্টনে গিয়েছিল মানিক ভাইয়ের। বাড়িতে, সেই মানিক ভাই, রেজাউল করিম মানিক, সাভার এলাকার কমান্ডার। ছিলেন। নভেম্বরে মানিক ভাই শহীদ হলেন। ভায়াডুবি ব্রিজ অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন মানিক ভাই।

তারপর বাচ্চু ভাই হলেন কমান্ডার।

এখন পাকিস্তানি বাহিনী সারেন্ডার করেছে। বাচ্চু ভাই সাভার ডেইরি ফার্ম থেকে একটা জিপ জোগাড় করে এনেছেন। পাশাকে বলেছেন, পাশা, চলো, ঢাকা যাই, তোমাকে তোমার বাড়ি নামিয়ে দিই। আজ রাতে বাড়িতে ঘুমাও। কাল আবারও এই ক্যাম্পে এসে রিপোর্ট করবে।

পাশা খুশিতে কী করবে বুদ্ধি পাচ্ছে না। তার গায়ে একটা মলিন সাদা শার্ট। পরনে লুঙ্গি। শাহিন স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র পাশার হাতে একটা জি ৩ রাইফেল।

এটা সে নিয়েছে তাদের হাতে ধরা পড়া পাঠানের কাছ থেকে।

পাঠানটার জন্য বড় মায়া লাগে কিশোর বয়সী পাশার। বড় নরমসরম। ভালো মানুষ পাঠানটা। ১৪ ডিসেম্বরের যুদ্ধে সে তাদের হাতে ধরা পড়ে।

১৪ ডিসেম্বরের যুদ্ধেই পাশা হারায় তার মানিকজোড় বন্ধু টিটোকে। গোলাম দস্তগীর টিটো তারই মতো ক্লাস টেনের ছাত্র। সে পড়ত মানিকগঞ্জের এক স্কুলের ক্লাস টেনে। তারই মতো সে-ও আগরতলা থেকে এসে পড়েছে। সাভারে। আশুলিয়ার গ্রামে তাদের ক্যাম্প।

১৪ ডিসেম্বর তাদের ওয়াচম্যানরা খবর আনল, পাকিস্তানি বাহিনীর একটা বড় দল তাদের ক্যাম্পের দিকেই আসছে। সম্ভবত রাজাকাররা খবর দিয়েছে। তারা পথ দেখিয়ে আনছে। তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করবে। বাচ্চু ভাই সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়ে ডিফেন্স নিতে বললেন। তারপর আবার লোক পাঠালেন আসল খবর আনতে।

খানিক পরে খবর এল। পাকিস্তানিরা আসলে পালিয়ে ঢাকা শহরের দিকে যাচ্ছে। আরিচা সড়ক ধরে গেলে ভারতীয় বাহিনী, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পড়বে, এই ভয়ে তারা গ্রামের পথ নিয়েছে।

বাচ্চু ভাই বললেন, আমরা ওদের অ্যাম্বুশ করব। তিন ভাগে ভাগ করলেন পুরো দলকে। ডানে এক দল। বাঁয়ে একদল। মাঝখানে আরেক দল।

টিটো ছিল পাশার পাশেই। কথা ছিল, পাকিস্তানিদের সামনে থাকা স্কাউটরা চলে যাবে। তাদের আক্রমণ করা হবে না। মূল দল তাদের নিশানার মধ্যে ফাঁদে এসে পড়বে, তারপর একযোগে গুলি করা শুরু হবে। কিন্তু উত্তেজনার বশে কেউ একজন স্কাউটদেরই গুলি করে বসে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের মূল দল বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করা শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আর এগোচ্ছে না। জায়গা থেকেই তারা গুলি করছে। তাদের কাছে আছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। গুলি আর থামছে না।

পাশা আর টিটো একবার দম নিতে গেল। কলা আর পাউরুটি খেল। আবার এসে পজিশন নিয়ে গুলি করতে শুরু করল।

আড়াই ঘণ্টা গোলাগুলির পর একটু যেন ঠান্ডা হলো পরিস্থিতি। আর কোনো গুলি হচ্ছে না।

টিটো বলল, পাশা, পাকিস্তানিরা কি পলায়া গেল নাকি? দেখা দরকার।

পাশা বলল, টিটো। খবরদার, মাথা তুলবি না।

টিটো কথা শুনল না। দাঁড়িয়ে হাতের মেশিনগান তুলে গুলি করতে লাগল।

অমনি একটা গুলি এসে ওর পেটে লাগল। টিটো লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পাশা এগিয়ে গেল। টুনি, জামিসহ আরও দু-তিনজন এগিয়ে গেল ক্রল করে করে। টিটোকে তুলে নিয়ে তারা ছুটল ক্যাম্পের দিকে।

রক্তে টিটোর শরীর ভেসে যাচ্ছে।

টিটোকে ক্যাম্পে এনে পাশা তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। গাড়ি আনা হচ্ছে। টিটোকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিতে হবে।

টিটো বলল, পাশা, আমাকে বাঁচা। আমি বাঁচতে চাই।

একটা গামছা টিটোর পেটে বাঁধা হয়েছে। গামছা রক্তের স্রোত আটকাতে পারছে না।

টিটো বলল, পাশা, তুই না আমাদের ডাক্তার। মেডিকেলে থাকিস। আমার চিকিৎসা শুরু কর। আমাকে বাঁচা।

বাচ্চু ভাই এলেন। বললেন, গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ান আর্মি আরিচা-ঢাকা রোড ধরে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। যেকোনো সময় দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। আমরা অবশ্যই টিটোকে বাঁচিয়ে রাখব।

টিটো বলল, ভাই, আমি কি স্বাধীনতা দেইখা যাইতে পারুম না? আমার ঠান্ডা লাগে।

টিটোকে কম্বলে জড়িয়ে রাখা হলো।

টিটোকে বাঁচানো গেল না। গাড়ি আসার আগেই পাশার কোলে টিটো মারা গেল।

সাভার ডেইরি ফার্মের সামনে তাকে কবর দেওয়া হলো।

ততক্ষণে পাকিস্তানিরা ওই এলাকা ছেড়ে অন্য দিকে চলে গেছে। এখানে ওখানে পড়ে আছে কতগুলো পাকিস্তানি সৈন্যর লাশ।

শুধু টিটোকে গুলি করেছিল যে দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সৈন্য, তাদের ধরে ফেলেছে গ্রামবাসী।

মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গেল পাকিস্তানি সৈন্য দুজনকে উদ্ধার করতে। একজনের পা ছিল অনেক ফোলা। গ্রামবাসী তার প্যান্ট তুলে দেখল, পা ভরা ঘড়ি। সে পায়ে ঘড়ি পরেছে অনেকগুলো। মানিকগঞ্জে ঘড়ির দোকান লুট করেছে সে। তাকে গ্রামবাসী পিটুনি দিতে লাগল। আরেকজন পাঠানকে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে নিয়ে আসতে পারলেও আরেকজন পাঞ্জাবি সেনা ঘড়ি চুরির অপরাধে গণপিটুনিতে মরেই গেল।

সেই পাঠানটা বলেছিল, আমাদের আসলে পাঠানো হয়েছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। এখানে এসে দেখি সব মুসলমান। কেন যে এসেছি যুদ্ধ করতে জানি না। সে বলেছিল, আমার সঙ্গের সৈনিকটা কই?

সে মারা গেছে।

আমার কাছে ৪০ টাকা আছে। এটা দিয়ে ওই সৈন্যকে একটু দাফন কাফন কোরো।

সেই পাঠান সৈনিকটির কাছ থেকেই একটা জি-৩ রাইফেল নিয়ে বাচ্চু ভাইয়ের পাশে বসেছে টিটো। তাদের গাড়িতে ঢাকার আরও কজন মুক্তিযোদ্ধা।

বাচ্চু ভাই বললেন, পাশা, দেখো, ঢাকায় আলো জ্বলছে।

জি বাচ্চু ভাই।

এর মানে কী?

এর মানে ঢাকায় আর ব্ল্যাকআউট হচ্ছে না।

রাইট। দেশ শত্রুমুক্ত। আমরা জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি।

জি বাচ্চু ভাই।

তোমার কেমন লাগছে, পাশা।

আশ্চর্য লাগছে বাচ্চু ভাই।

আশ্চর্য কেন?

দেশ স্বাধীন, অথচ আমি বেঁচে আছি। বাড়ি যাচ্ছি। টিটো তো বাঁচল না বাচ্চু ভাই। মানিক ভাই বাঁচলেন না। আমার প্রথম অপারেশনেই জাকির ভাই। শহীদ হলেন।

যুদ্ধ তো এই রকমই পাশা।

চারদিকে জয় বাংলা স্লোগান। মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলেই হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারাও হাত নেড়ে জবাব দিচ্ছে। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত ঢাকার আকাশ-বাতাস।

চানখারপুলে পাশাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালেন বাচ্চু ভাই।

বাচ্চু ভাই, আমাদের বাসায় চলেন।

তুমি যাও। আমি আরেক দিন যাব। এই ছেলেদেরও তো আমার নামাতে হবে।

আচ্ছা। সবাইকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে পাশা ঢুকল তাদের বিল্ডিংয়ে। বাসার দরজায় গিয়ে বেল টিপল।

দরজা খুললেন আম্মা। দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠলেন, পাশা এসেছে। ছোট দুই ভাই রামা আর ডারা ছুটে এল। আব্বা একটা ইজিচেয়ারে বসে রেডিওতে বিবিসির খবর শুনছিলেন, দৌড়ে এলেন। সবাই হাসছে। পাশা হাসছে, ভাই দুটো হাসছে, মা হাসছেন। আম্মা জড়িয়ে ধরলেন পাশাকে। তারপর একবার হাসেন, একবার কাঁদেন। শেষে বললেন, গরম পানি চুলায় দিই। গোসল কর।

আব্বা বললেন, তোর হাতে এটা কী?

জি-৩ রাইফেল।

এটার গুলি আনলোড কর। বাচ্চারা ধরে অ্যাকসিডেন্ট করে বসতে পারে।

পাশা এটা খুব ভালো জানে। কিছুদিন আগেই তাদের একজন সহযোদ্ধা। আলতাফ মারা গেছে অ্যাকসিডেন্টে। অস্ত্রে গুলি নেই ভেবে একজন ট্রিগার টিপে বসেছিল। পাশার সামনেই ঘটে এ দুর্ঘটনা।

অস্ত্র ভয়াবহ জিনিস। ট্রেনিংয়ের সময় বারবার করে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।

পাশা ম্যাগাজিন আলাদা করে ফেলল।

আম্মা ভাত চড়ালেন।

গরম পানিতে গোসল করে সে খেতে বসল। সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে। ছোট ভাই দুটো প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

কত দিন পরে গরম পানিতে গোসল। কত দিন পরে টেবিল-চেয়ারে বসে গরম ভাত খাওয়া। কত দিন পরে আম্মার হাতের রান্না।

ভাত খেয়ে পাশা বিছানায় গেল। কত দিন পরে বিছানায় ঘুম।

রাজ্যের ঘুম জমেছিল তার চোখে। সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

১১৭

ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন পিজি হাসপাতালের কেবিনে। চিকিৎসাধীন। ডা. নুরুল ইসলাম এলেন ভোর ছয়টায়। বললেন, ইন্ডিয়ান রেডিও বলছে, আজ নয়টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি। এরপর একযোগে নয়টা থেকে বিমান হামলা শুরু করবে। পিজি হসপিটাল বড় বিল্ডিং। এখানে বোমা পড়ার চান্স বেশি। এর মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট কাছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলেও আর্মি ক্যাম্প। আপনি আপনার দাদাশ্বশুর, দাদিশাশুড়ি, ফুফুশাশুড়িকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যান। আমি আমার আম্মাকে নিয়ে যাচ্ছি। উনিও এই হাসপাতালেই আছেন।

একটা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল। তাতে নুরুল ইসলাম, শেখ লুৎফর রহমান, সায়েরা খাতুন, ডাক্তার সাহেবের আম্মা, ওয়াজেদ আর হাসিনা রেহানাদের লিলি ফুফু উঠলেন। প্রথমে নুরুল ইসলাম সাহেবকে তার বাড়িতে নামিয়ে দেওয়া হলো। তারপর অ্যাম্বুলেন্স গেল সোবহানবাগে। লিলিদের বাসায়। লুত্বর রহমান সাহেবেরা নামলেন। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া এলেন ৩২ নম্বর সড়কে। মোশাররফ সাহেবের বাসায় আশ্রয় নিলেন।

পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। ওয়াজেদ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেন যে হাসিনারা কেমন আছেন। কিন্তু ১৮ নম্বরের দিকে যাওয়া যাচ্ছে না। সবাই নিষেধ করছে। ওই বাড়ির কাছে গেলেই গুলি করে লোকদের মেরে ফেলছে।

রাতের বেলা আর তিনি চেষ্টা করলেন না। পরের দিন আবার গেলেন ১৮ নম্বর রোডে। তখন সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে।

দূর থেকে দেখলেন হাজি মোরশেদ সাহেবকে।

হাজি মোরশেদ এগিয়ে এলেন। বললেন, ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে মাথায় টুপি দিয়ে এই বাড়ির দিকে আসছিলাম। নানাজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার থাকেন। আমি একটা গাড়ি করে আসছি। ওই গাড়িটা। আমার মামাতো ভাইয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মিলিটারির চিৎকার : মাত আও।

তখন আরেকজন নামাজ পড়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, বললেন, করছেন। কী! কালকে সারা দিনে গুলি করে কয়েকজনকে এই রাস্তায় মেরে ফেলছে। হায়দার আকবর খান রনোর বোন ডাক্তার আয়েশাকে মেরে ফেলেছে।

আমি তখন গাড়ি করে চলে গেলাম সার্কিট হাউস। দেখা পেলাম ভারতীয় মেজর গঞ্জালেসের। তাঁকে বললাম, শেখ মুজিবস ফ্যামিলি ইন সিরিয়াস কন্ডিশন। ওদের মেরে ফেলবে। তুমি চলো ওদের উদ্ধার করতে হবে। মেজর গঞ্জালেস বললেন, গাড়ি আছে তোমার সঙ্গে? আমি বললাম, আছে। বললেন, চলো তো এয়ারপোর্ট যাই। এয়ারপোর্টে গিয়ে আমার গাড়ি আর মিলিটারিদের আরেকটা গাড়িতে করে মেজর অশোকতারাকে নিয়ে এলাম। সঙ্গে কয়েকজন সৈন্য। মেজরের হাতে অস্ত্র নেই। সৈন্যদের সঙ্গে ছিল। উনি সৈন্যদের গাড়িতে রেখে একা হেঁটে গেছেন।

ওয়াজেদ সব শুনলেন। তাঁরা দূর থেকে দেখছেন কী হয়। এর মধ্যে ভিড় হয়ে গেছে।

মেজর অশোকতারা অস্ত্র রেখে দিলেন গাড়িতে। তার সৈন্যদের কাছে।

তাঁর জীবনের কঠিনতম অ্যাসাইনমেন্ট আজকে। তিনি শত্রুদের ওপর গুলি চালাতে জানেন। কীভাবে হামলা করতে হয়, কীভাবে রিট্রিট করতে হয়, এটা তার জানা। কিন্তু একটা বাড়িতে আছেন শেখ সাহেবের ফ্যামিলি, সেটার চারপাশে খেপা একদল পাকিস্তানি সৈন্য, যারা কাল থেকে পাগলের মতো গুলি করছে, তাদের তিনি নিবৃত্ত করবেন কীভাবে? গুলি করা যাবে না, কারণ বাড়িতে নারী-শিশুরা আছে। আবার ওদের কেউ একটা গুলি ছুড়লেই তিনি মারা যেতে পারেন।

তিনি নিজের সৈন্যদের বললেন, তোমরা এখানে থাকো। কেউ এগোবে না।

তারপর তিনি খালি হাতে একা একা গেটের কাছে এগোতে লাগলেন। বাড়ির সামনে বালুর বস্তা। বাড়ির ওপরে অনেক কজন পাকিস্তানি সেনা মেশিনগান বসিয়ে সদা প্রস্তুত ভঙ্গিমায় গুলি করার জন্য প্রস্তুত। মেজর অশোকতারা এগোচ্ছেন।

পাঞ্জাবিতে বললেন, কোই হ্যায়?

বালুর বস্তার আড়ালে পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে। ছাদের ওপরে ওদের নড়াচড়া আর বন্দুকের নলে পড়া সূর্যের আলোর ঝলকানি চোখে পড়ছে। অশোকের।

তিনি বললেন, পাঞ্জাবি বোঝো না তোমরা?

ওরা বলল, এগোনোর চেষ্টা কোরো না। এগোলেই গুলি করব।

অশোক বললেন, আমি মেজর। ইন্ডিয়ান আর্মির মেজর। তোমাদের এখানে অফিসার কে?

অফিসার কেউ নেই। কাল চলে গেছে। সুবেদার আছে।

সুবেদারকে ডাকো।

সুবেদার সারা রাত গোলাগুলি করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলেন। তিনি এলেন।

অশোক বললেন, তোমাদের সঙ্গে কোনো অফিসার নেই। এই জন্য তোমরা গুলি করছ। তোমাদের সঙ্গে অফিসার থাকবে কী করে? সব অফিসার তো হেডকোয়ার্টারে। আমাদের কাছে সারেন্ডার করেছে। তোমার পুরো বাহিনী সারেন্ডার করেছে। তোমরা কেন এখনো অস্ত্র ধরে আছ? অস্ত্র নিকাল দো।

দুজন ১৮-১৯ বছরের সৈন্য বেয়নেট ধরে আছে অশোকের গলা বরাবর–আমরা আমাদের অফিসারদের হুকুম ছাড়া তো এটা করতে পারি না।

ওই দিকে দেখো মানুষের ভিড়। দুই পাশে দেখো কত মানুষ। আকাশে দেখো, ভটভট করে হেলিকপ্টার যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ ওটা ইন্ডিয়ান হেলিকপ্টার। আমি তোমাদের নিরাপত্তা দিতে আসছি। আমি মেজর। এখন তোমাদের আমার হুকুম শুনতে হবে। আমার কথা যদি না শোনো, মুক্তিরা আসবে। তারা তোমাদের হত্যা করবে। আর আমি তোমাদের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে পারি নিরাপদে। তোমরা বেঁচে থাকবে। তোমাদের সোলজারের সম্মান দেওয়া হবে। তুমিও পাঞ্জাবি আমিও পাঞ্জাবি। তুমিও সোলজার। আমিও সোলজার। সোলজার সোলজারকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারে না। এটা খাঁটি ওয়াদা। বাড়িতে তোমাদের বাবা-মা আছে। স্ত্রী-সন্তান আছে। তোমরা আবার তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে। মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়লে কিন্তু আর বাঁচবে না।

ওরা একটু একটু নরম হচ্ছে। একজন বলল, আমাদের অফিসারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও।

এখানে কোনো ফোন নেই। তার ওপর ওরা সবাই সারেন্ডার করেছে। ওরা তো আর কথা বলতে পারবে না। আমার কথাই তোমাদের শুনতে হবে।

তাহলে আমাদের দুই ঘণ্টা সময় দাও। ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে হাসিনা, রেহানা, বেগম মুজিব সব শুনছেন। রেহানা জানালা থেকে চিৎকার করলেন, সময় দেবেন না। সময় পেলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।

মেজর অশোক বললেন, আধঘণ্টা সময় দিলাম।

ওরা বলল, আমাদের অস্ত্রসমেত যেতে দিতে হবে।

অশোকের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে যে দুজন, অশোক দেখলেন, তারা থরথর কাঁপছে। ভয়েই না তারা ট্রিগারে আঙুল বসিয়ে ফেলে।

তিনি ছেলে দুটোকে বললেন, এই অস্ত্র দুটো আমার দিক থেকে সরাও তো।

তারপর ওদের সুবেদারকে বললেন, ঠিক আছে। যাও। তবে আমার গাড়িতে সাদা পোশাক আছে। তোমরা সেসব পরে নাও। রাস্তায় জনতা গিজগিজ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা খোলা অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে। পাকিস্তানি মিলিটারি দেখলে গুলি করে বসতে পারে।

অশোকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর ওয়্যারলেস ম্যান। তিনি বললেন, গাড়ি থেকে কাপড়চোপড়গুলো এনে এদের দাও।

আধঘণ্টায় পোশাক পাল্টে নিয়ে যার যার ব্যাগ রেডি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেরিয়ে এল। অস্ত্রগুলো সব রাখল অশোকের পায়ের কাছে। অশোক দেখলেন, সবগুলোতে গুলিভরা। একটা অস্ত্রে ট্রিগার পড়লেই তিনি শেষ।

.

ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেহানা, হাসিনা দৌড়ে বারান্দায় এলেন।

দুজন নিচের ট্রেঞ্চে ঢুকে আছে। রেনু হুকুম করলেন, সারেন্ডার করো। পায়েন্দা খান। যাও। হাতিয়ার ডাল দো।

দুই সেপাই ট্রেঞ্চের ভেতর কাঁপছে। রেনুর অর্ডারে তারা বেরিয়ে এল আর এগিয়ে গিয়ে সারেন্ডার করল।

একটা মাইক্রোবাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে গেল।

রেনু হুকুম দিলেন, আবদুল পাকিস্তানি পতাকা নামা। ওটা পোড়াতে হবে।

আবদুল চলে গেল বাইরে। পতাকাঁপোস্টে। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আবদুল দিল রেনুর হাতে। রেনু সেটায় আগুন ধরিয়ে দিলেন।

খোকা একটা বাংলাদেশের পতাকা আনলেন। সেটা তোলা হলো।

রেহানা-রাসেলের মুখে হাসি আর ধরে না। তাদের বাড়িতে উঠছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তারা চিৎকার করে উঠল : জয় বাংলা।

রেনু ভারতীয় অফিসারকে বললেন, তোমার নাম কী?

অশোকতারা।

এসো ভেতরে এসো। আমাদের বাড়িতে কোনো ফার্নিচার নাই। তোমাকে বসতে দিতে পারব না। তবু তুমি আসো। তোমাকে এক কাপ চা খাওয়াই।

অশোক ভেতরে গেলেন। সত্যি বাড়িতে কোনো ফার্নিচার নেই। দুটো চৌকি আছে মাত্র।

তিনি মাদুরে বসলেন। রেনু চা বানাতে লেগে পড়লেন। শেখ সাহেবের বড় মেয়ে সন্তান কোলে এসে দাঁড়ালেন। ছোট ভাই রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে এলেন ছোট মেয়ে রেহানা।

অশোকতারার ওয়্যারলেসে মেসেজ এল। শেখ সাহেবের বাড়ির নিরাপত্তা এনশিয়োর করার দায়িত্ব তোমার।

অশোকতারা ওয়্যারলেসে ফোর্স পাঠাতে বললেন। ভারতীয় সৈন্যরা এসে বেগম ফজিলাতুন্নেছার পরিবার যে বাড়িতে আশ্রিত, সেই বাড়ির চারপাশে অবস্থান নিল।

.

লোকেরা আসছে। ওয়াজেদ এলেন। জয়কে কোলে নিলেন। হাজি মোরশেদ এলেন। তাঁর দাড়ি-গোঁফ অনেক বড়। তাঁকে চেনাই যাচ্ছে না। তিনি বললেন তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে কী অমানুষিক নির্যাতনই না করা হয়েছে মাসের পর মাস।

রেনু খোকাকে ডাকলেন, ভাইডি। গাড়িটা বের কর। সুফিয়া আপার বাড়ি যাব। রেহানা, তুই যাবি? সুফিয়া ফুফুর বাড়ি?

রেহানা বলল, যাব। দেশ মুক্ত, একটু বাইরে না গেলে হয়। এখন তো আর আমরা পরাধীন না, তাই না! চলো মা।

রাসেল বলল, আমিও যাব। বাইরে গিয়ে জয় বাংলার মিছিল করব।

রেনু বললেন, হাসু, তুই একটুখানি থাক। আমি যাব আর আসব। দেরি করব না।

রেহানা আর রাসেলকে নিয়ে রেনু খোকার গাড়িতে উঠে পড়লেন। ৩২ নম্বর কাছেই। তিন মিনিট লাগল গাড়িতে যেতে। কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি সাঁঝের মায়ায় ঢুকলেন রেনু। এই একজন, সুফিয়া আপা, সব সময় খোঁজ নিয়েছেন তাঁদের, হাসিনার বাচ্চা হওয়ার সময় পিজি হাসপাতালে গেছেন। সব সময় বলেন, মুজিবের জন্য দোয়া করি। আমার ছোট ভাই।

সুফিয়া কামাল পরে আছেন সাদা শাড়ি, কালো পাড়, চোখে চশমা, ধবধবে ফরসা মুখটা আরও ফরসা দেখাচ্ছে। ৬০ বছরের মার্জিত রুচির সুফিয়া কামালের চুল অনেকটাই পাকা, আজকে যেন আরও বেশি পাকা দেখাচ্ছে। তিনি শাড়ির ওপরে একটা কালো চাদর জড়িয়ে নিলেন।

রেনু গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সুফিয়া কামালকে।

দুজনেই কাঁদতে লাগলেন। রেনু জানেন না, হাসুর আব্বা কোথায়, কামাল-জামাল কোথায়। সুফিয়া কামাল জানেন না, তার দুই মেয়ে টুলু, লুলু গেছে মুক্তিযুদ্ধে, মাঝেমধ্যে খবর পেয়েছেন যে তাঁরা আগরতলা বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন!

এরই মধ্যে সুফিয়া কামাল খবর পেলেন, ডা. ডোরা মারা গেছে।

রেনু বললেন, হ্যাঁ। কালকে আমাদের চোখের সামনে তো ঘটল সব। গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে বাইরে গেলাম। পাকিস্তানি মিলিটারিরা পাগল হয়ে গেছিল। ওদের অফিসার দুইজন চলে গেছে। বাকিরা কী করবে বোঝে না। জয় বাংলা স্লোগান শুনলেই গুলি।

সুফিয়া কামাল বললেন, আমি তাহলে হাতেম আলী সাহেবের বাসায় একটু যাই।

রেনু বললেন, সময় পেলে পরে আমিও যাব একবার। এখন ওয়াজেদ মিয়া এসেছে, হাজি মোরশেদ এসেছে, লোকজন আসছে, বাসায় থাকা দরকার।

রেনু, রাসেল, রেহানা, খোকা চলে এলেন ১৮ নম্বরের বাড়িতে।

সুফিয়া কামাল চললেন হায়দার আকবর খান রনোর বাড়িতে। একই রাস্তায় বাড়ি। ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়ক।

সুফিয়া কামাল রনোদের বাড়িতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। লাশ হাসপাতালের মর্গ থেকে এসেছে একটু আগে। গুলিতে চুল উড়ে পড়ে ছিল পাশে, সেই চুলও আনা হয়েছে।

ডোরা মেয়েটা ডাক্তার। ডাক্তার আয়েশা বেদোরা চৌধুরী। ৩৬ বছর বয়স। কলকাতায় জন্ম, ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল, মেট্রিক ফার্স্ট ডিভিশন, আইএসসি ফার্স্ট ডিভিশন, মেডিকেলে ডাবল গোল্ড মেডেল। ওদের ড্রাইভার মনির, ডোরার খালু হাতেম আলী, নানি, ডোরার খালা মোহসিনা, হাতেম আলীর ছোট পুত্রবধূ চপল আর ডোরা গাড়িতে উঠেছিল, আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে জয় বাংলা বলতে বলতে, বিজয়ের উদ্যাপন দেখতে। তারা গাড়ির জানালা দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা নাড়ছিল। ১৮ নম্বরে বেগম মুজিবকে বন্দী করে রাখা বাড়ির কাছাকাছি যেতেই গুলি। মাথা বাঁচাতে ডোরা মাথা নামিয়ে হাঁটুর কাছে রাখল। গুলি এসে লাগল ডোরার মাথায়। ড্রাইভার মনিরও মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। গুলিবিদ্ধ হলেন মোহসিনা আর চপল। এখন হাসপাতাল থেকে ফিরেছে ডোরার লাশ। ফিরে এসেছে আহত চপল আর মোহসিনা। তাদের হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ।

সুফিয়া কামাল দেখতে লাগলেন ডোরার মেয়ে দুটোকে। দুই বছরের মেয়ে মোনালিসা। এক বছরের মেয়ে বেলারোসা। ফুটফুটে দুই বাচ্চা। বড়টা মাকে খুঁজছে। মা মা বলে ডাকছে। নানি ওদের সামলানোর চেষ্টা করছেন।

সুফিয়া কামাল কোমরে আঁচল খুঁজলেন। ডোরাকে গোসল করাতে হবে। দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করবেন কী। করে? মৃত্যুর মিছিল তো থামছেই না!

ডোরার পোষা কুকুরটা ডোরার পাশে বসে আছে। সে কিছুতেই ডোরার পাশ ছাড়বে না।

১১৮

১৭ ডিসেম্বর দুপুরে ১৮ নম্বর সড়কের বাড়িতে এসে ঢুকলেন জামাল। তার পরনে যুদ্ধের পোশাক। কাঁধে মেশিনগান। তার মাথায় যুদ্ধক্যাপ। যশোর। থেকে হেলিপ্টারে উড়ে এসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেছেন তিনি। বের হয়ে একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করেছেন। চলো ধানমন্ডি ১৮ নম্বর।

বেবিট্যাক্সিওয়ালার মুখে বিশাল হাসি। তিনি বললেন, ভাইজান, আপনে মুক্তিযোদ্ধা!

হ্যাঁ।

আপনার এই অস্ত্রটার নাম কী? মেশিনগান?

হ্যাঁ।

আমরাও সব অস্ত্রের নাম শিইখা ফেলছি। দ্যাশ স্বাধীন হয়া গেছে। আর কোনো চিন্তা করি না। এখন জিনিসপাতির দাম কমব। আমরা দুইটা খাইয়া পইরা শান্তিতে ঘুমাইতে পারুম। তাই না ভাইজান।

জি।

খালি একটাই ভাবনা ভাইজান, শেখ সাহেব না ফিরলে দেশটারে সামলাইব কেমনে? ওনার লাইগা রোজা রাখছি।

জি দোয়া করবেন যেন উনি দেশে সুস্থভাবে ফিরতে পারেন।

একতলা বাসার সামনে এসে থামল বেবিট্যাক্সি। জামাল দেখলেন, বাড়ির সামনে ইন্ডিয়ান সৈন্য।

আপনার ভাড়া কত হয়েছে?

আপনার কাছ থাইকা ভাড়া নিমু না ভাইজান।

ক্যান? ভাড়া নিবেন না ক্যান?

আপনে মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা দ্যাশের লাইগা প্রাণ দিতে গেছলেন। আমরা ঢাকা থাইকা কী করছি? মাঝেমধ্যে মুক্তিবাহিনীর লাইগা দুই-দশ টাকা চান্দা পাঠাইছি গোপনে। আর কিছু করি নাই। খালি দ্যাশের বাড়ি রাজাকাররা পোড়ায়া দিছে। বাড়ির মানুষ পালায়া চরে গিয়া বাঁচছে। বাঁচছে তো। আপনের কাছে ভাড়া নিমু না ভাইজান।

আপনি ভাড়া নিন। আপনার বাড়ি পুড়ে গেছে। লাগবে। নিন। কুড়ি টাকা জোর করে বেবিওয়ালার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিলেন জামাল। বেবিট্যাক্সির সামনে একটা বাংলাদেশের পতাকা লাগানো। বেবি চলে গেল।

এই বাড়ির পতাকাস্ট্যান্ডেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা।

তখন দুপুর। পতাকার ছায়া ছোট্ট হয়ে পতাকাস্ট্যান্ডের নিচে মাটিতে পড়ে আছে।

ইন্ডিয়ান গার্ড আটকে দিল।

জামাল বললেন, আমি শেখ সাহেবের ছেলে। শেখ মুজিবুর রহমান আমার পিতা।

তারা তবু সন্দেহ করছে। শেষে তিনি বিএলএফের দেওয়া আইডি কার্ড বের করলেন। শেখ জামাল। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তারা স্যালুট করল।

জামাল গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

আলো থেকে ভেতরে যাওয়ায় প্রথমে চোখে খানিকটা অন্ধকার দেখলেন।

তারপর দেখলেন ওই যে মা, হাতে একটা জগ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন।

মা…

জামাল, এসেছিস…

এমন একটা চিৎকার দিলেন রেনু যে হাসিনা, রেহানা ছুটে এলেন ডাইনিং, ড্রয়িং চত্বরে..

জামালকে পেয়ে রেনু জড়িয়ে ধরলেন। আর ছাড়েন না।

ছাড়ো, জয়কে দেখে আসি… জামাল মায়ের চোখের পানিতে ভেজা গাল মুছতে মুছতে বললেন।

হাসিনা, রেহানা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। জামাল জয়কে কোলে নিলেন। হাসিনা সেই অবস্থায় জামালকে জড়িয়ে ধরলেন। আহা রে আমার ছোট ভাইটা। যুদ্ধের মাঠ থেকে এসেছে। লম্বা চুল। নাকের নিচে, গালে সদ্য ওঠা গোঁফ আর পাতলা দাড়ির আভাস। গায়ে বুনো গন্ধ।

তারা একবার হাসছেন, একবার কাঁদছেন।

জামাল ভাব করছেন তিনি বড় হয়ে গেছেন।

রাসেল জামালের অস্ত্রটা হাতে নিতে চাইল। জামাল বললেন, নাও। কাঁধে নাও। রাসেল বলল, জয় বাংলা।

জামাল একবার রেহানার কাছে গেলেন। চুপি চুপি বললেন, থ্যাংক ইউ কুট্টি বুনডি। ছোট বোন, তোকে ধন্যবাদ।

রেহানা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। এবার তার মনপ্রাণ খুলে কাঁদবার পালা। চুপি চুপি, মাকে, আপাকে না জানিয়ে, রেহানা তার প্যান্টের ভেতরে। গোপন পকেট বানিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর দুজনের গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জামালের যুদ্ধে যাওয়া, ১৪ বছরের রেহানা সেই গোপন খবরটা তো বুকের মধ্যে অনেক দিন গোপন করে রেখেছিলেন, আর তার কী যে কান্না পেত। ভাইটার আমার যদি যুদ্ধের গোলা, বোমা, মাইন গ্রেনেডের মধ্যে কিছু হয়ে যায়! সে যদি ধরা পড়ে! আমার সেই ভাইটা, আমার পিঠোপিঠি সেই ভাইটা ফিরে এসেছে।

কানতেছ কেন?

তুই ফিরে এসেছিস! তুই যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসেছিস! কান্না মুছে রেহানা বললেন, কামাল ভাই কই? কবে আসবে?

কামাল ভাই সিলেট গেছলেন কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে। তারপর আর খবর জানি না!

.

বাড়িতে স্রোতের মতো লোকজন আসতে শুরু করল। ক্যামেরা নিয়ে। সাংবাদিকেরা আসতে লাগলেন। হুলুস্থুল পড়ে গেল।

১৮ ডিসেম্বর এলেন কাদের সিদ্দিকী। তাকেও রেনু জড়িয়ে ধরলেন। কান্নাকাটির পর রেনু বললেন, এবার তোমাদের মুজিব ভাইকে তোমরা ফিরিয়ে আনো।

কাদের সিদ্দিকী একটা জনসভা করবেন। তিনি বললেন, ভাবি, জামালকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই।

রেনু হাসলেন। বললেন, ও কি আমাকে বলে যুদ্ধে গেছে? ওকেই জিজ্ঞেস করো ও যাবে কি না।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, জামাল, যাবে আমার সঙ্গে?

জামাল একবাক্যে রাজি। তিনি চলে গেলেন জনসভায়। স্বাধীন দেশে ঢাকার প্রথম জনসভায় কাদের সিদ্দিকীর পাশে মঞ্চে রইলেন শেখ জামাল। পল্টন ময়দানে তখন লাখ দেড়েক মানুষ।

১১৯

ঢাকার মানুষেরা আস্তে আস্তে জানতে পারল, গত কয়েক দিন কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে কাদালেপা মাইক্রোবাস, নিয়ে গেছে মুখোশ-পরা আলবদররা, তারা সবাই চোখবাধা, পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা পড়ে আছেন মিরপুর, মোহাম্মদপুরের জলাজংলার ভেতরে। লাশ পচে গেছে। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। উন্মাদের মতো কাঁদছেন কবীর চৌধুরী, ভাই মুনীর চৌধুরীকে হারিয়ে, পাগলিনীর মতো ছুটছেন শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, স্বামী ডাক্তার আলীম চৌধুরীকে হারিয়ে, এক বছরের শিশু কোলে মাথা চাপড়াচ্ছেন পান্না কায়সার, শহীদুল্লা কায়সারের খবর নাই, শাহীন, জাহীদ, ফাহিম, ছোট ছোট ছেলেগুলো কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে ফেলল, তাদের আব্বা সিরাজউদ্দীন হোসেন যে আর আসেন না…

যারা মরে আছেন এই জলাভূমিতে, তাঁদের নামের তালিকা পাওয়া গেল রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে। হাতের লেখা রাও ফরমান আলীরই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *