০৬০. জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম

৬০

ডি পি ধর আর পি এন হাকসার তাজউদ্দীন আহমদের কাছে একটা জিনিস চাইছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে দেখে, সে জন্য রুশপন্থী দলগুলোকে– কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মোজাফফর)–সরকারের সঙ্গে যুক্ত করতে।

তাজউদ্দীন বললেন, দলের যে অবস্থা, এমনিতেই তারা তাজউদ্দীনকে বাম বলে চিহ্নিত করে মন্ত্রিত্ব থেকে সরাতে চায়, এর মধ্যে কমিউনিস্টদের সরকারে নিলে দলের বেশির ভাগ লোকই মানবে না। একটা কাজ করা যায়। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক কমিটি বা উপদেষ্টা কমিটি করা যায়।

এই প্রস্তাবটা তিনি মন্ত্রীদের মানাতে পারছিলেন না। ডি পি ধর মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি সরাসরি বললেন, বাংলাদেশকে ভারত সাহায্য করছে কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই। আপনাদের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত হোক, এ ছাড়া আমাদের আর কোনো চাওয়া নেই। আপনারা একটা জাতীয় ঐক্যজোট গঠন করুন।

মন্ত্রিসভা একটা উপদেষ্টা কমিটি করতে রাজি হলো।

ডি পি ধর বিদায় নেওয়ার পর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বললেন, ভাত খাওয়ার জন্য একটা মাটির সানকি পাওয়া গেছে। এখন নিজেরা ঝগড়া করে এই সানকিটা ভাঙার কোনো মানে হয় না। ভারত সরকার চাইছে, আমরা একটা জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতেই পারি।

বাকিরাও রাজি হলেন।

৬১

মওলানা ভাসানী দেরাদুনের সার্কিট হাউসে। তাঁকে দেখাশোনা করেন ব্রিগেডিয়ার লবরাজ। তাঁর স্ত্রী জয়া লবরাজ। বিদুষী, চটপটে, হাসিখুশি। আর আছেন সাইফুল।

ভাসানী সকালের নাশতার টেবিলে বললেন, স্বাধীনতাসংগ্রাম যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, ততই মঙ্গল।

জয়া বললেন, সেকি কথা দাদু। স্বাধীনতাসংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হওয়া মানে আরও বেশি মানুষের মৃত্যু, বেশি মানুষ উদ্বাস্তু, বেশি বাড়িঘর পুড়ে যাওয়া, বেশি কষ্ট, বেশি অশ্রু।

ভাসানী হাসলেন।

না দাদু, হাসলে চলবে না। বলুন। ব্যাপারটা কী?

ভাসানী বললেন, বেশি যুদ্ধ মানে বেশি কষ্ট। বাংলার প্রত্যেক ঘরে অন্তত একজন মারা যাউক। তাহলে মানুষ বুইঝবে স্বাধীনতার মূল্য। তখন স্বাধীনতা পাইলে সেইটারে মুক্তিতে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করব। তা না হইলে মানুষ সোনা হইব না। না পুড়লে মানুষ খাঁটি হয় না।

কলকাতা থেকে নির্দেশ এসেছে মওলানা ভাসানীকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। বিমানে চড়ে তিনি গেলেন কলকাতা। তাঁকে তোলা হলো হাজরা স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের বাড়িতে। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

সেখানে গিয়ে ভাসানী খুশি। দেখা পেলেন মণি সিংহের। মোজাফফর আহমদের। মণি সিংহ জানালেন, তিনি ছিলেন যশোর কারাগারে। এপ্রিলে যশোর মুক্ত হলে কারাগারের বন্দীরা জেলারকে বলেন, আমাদের ছেড়ে দিন।

জেলার বলেন, আমি ছাড়তে পারব না। কারাগার ভেঙে পালিয়ে যেতে পারলে যান।

তখন বন্দীরা পেছনের একটা গেট ভেঙে ফেলে। সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মণি সিংহ হাঁটতে হাঁটতে নদীতীরে যান। নৌকায় উঠে চলে আসেন পশ্চিম বাংলায়।

তাজউদ্দীন বললেন, আমরা একটা পরামর্শ কমিটি গড়তে চাই। পাঁচটি দল থাকুক। আওয়ামী লীগ, দুই ন্যাপ, সিপিবি, বাংলাদেশ কংগ্রেস। হুজুর, আপনি এই উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি।

খাবারদাবার ভালো দেওয়া হলো। মওলানা ভাসানী তিন ঘণ্টার বক্তৃতা দিলেন। কতগুলো প্রস্তাব পাস হলো। এর মধ্যে আছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন বন্ধ করা, জাতিসংঘের মাধ্যমে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা, মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের সব দেশকে আহ্বান, ভারত সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিমত প্রকাশ।

ফটোগ্রাফার রেডি ছিল। ছবি তুলল। সেই ছবি হয়ে উঠল এক মূল্যবান দলিল। দিল্লিতে ছবি পাঠানো হলো, পাঠানো হলো রুশদের কাছে।

৬২

১৪ মে থেকে মুর্শিদাবাদের পলাশীতে নৌকমান্ডোদের ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। মুজিবুর তার আগেই যশোরে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে যান। যশোরের পতন হলে তিনি আর আফতাব সীমানা পেরিয়ে চলে যান বনগাঁ। ৫ নম্বর টালিখোলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিলেন। ১২ মে কর্নেল ওসমানী এলেন, এলেন নৌবাহিনীর গাজী রহমতউল্লাহ, ভারতীয় নৌবাহিনীর সমীর কুমার দাস। ৪০০ জন যুবককে লাইন করে দাঁড় করানো হলো। ৪৫ জন টিকে গেল নৌকমান্ডোতে যোগ দেওয়ার জন্য। একটা মিলিটারি ট্রাকে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো মুর্শিদাবাদে। সেখানে মিলিটারি ক্যাম্পে রাত কাটিয়ে পরদিন তাঁরা গেলেন পলাশীতে।

পলাশী নামটা শুনেই মুজিবুর রহমানের সিরাজউদ্দৌলার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধের কথা। সবাই বলে, তিনিও বলেন, এক আমবাগানে স্বাধীনতার সূর্য ডুবে গিয়েছিল, মেহেরপুরের মুজিবনগরের আরেক আমবাগানে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হয়েছে।

পাশেই ভাগীরথী নদী। সেই নদীতে শুরু হলো তাদের ট্রেনিং। তাঁদেরটা হলো ১০ নম্বর সেক্টর। সেক্টর অধিনায়ক কর্নেল ওসমানী স্বয়ং। ফ্রান্সের তুল পোতাশ্রয়ে পাকিস্তানের সাবমেরিন ম্যানগ্রোতে কয়েকজন বাঙালি নাবিক ছিলেন। তাঁদের আটজন অনেক কষ্ট করে পালিয়ে স্পেন, সুইজারল্যান্ড হয়ে ভারতে চলে এসেছেন বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবেন বলে। আর আছেন পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং হওয়া নৌবাহিনীর সদস্যরা। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন যুবশিবির থেকে বাছাই করে আনা ছাত্র-যুবারা। সব মিলিয়ে ৪১৫ জন ট্রেনিং নিচ্ছে। ১৩ মে উদ্বোধন হলো ট্রেনিং। প্রথম নৌ কমান্ডো ট্রেনিং ক্যাম্পের নাম সি-২ পি। তাদের প্রথম দিনেই বলা হলো, এটা সুইসাইডাল স্কোয়াড।

তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পটা নির্জন এলাকায়। চারদিকে কোনো জনবসতি নেই। শুধু গাছ আর গাছ। তারই মধ্যখানে একটা জায়গা পরিষ্কার করে বানানো হলো তাদের ক্যাম্প। তাঁবু গেড়ে তৈরি সেই ক্যাম্প দুদিন পর প্রচণ্ড ঝড় নিল উড়িয়ে। ট্রেইনাররা পরের দিন এসে বললেন, ঝড়ে কে কে যুদ্ধ করতে যাওয়ার মনোবল হারিয়ে ফেলেছ?

কেউই না ওস্তাদ।

সবাই যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত?

ইয়েস, ওস্তাদ।

ট্রেনিং মানে ভয়াবহ ট্রেনিং। মাইলের পর মাইল সাঁতার কাটো। পেটের মধ্যে মাইন বেঁধে চলো। ডুবে জাহাজের গায়ে মাইন সেট করো। সুইচ চালু করে বিস্ফোরণ ঘটাও। কিন্তু নিজে বিপদের আগেই নিরাপদ দূরত্বে চলে এসো।

প্রথম দিকে খাবার ছিল কাকরভরা ভাত, ডাল, মাছ। জুন মাসের শুরু থেকে খাবার আসতে লাগল রাজসিক। ডালডা ভাজা পরোটা, ডিম, দুধ, কমলার রস, ফল, মিষ্টি, দুবেলা মাছ, মাংস। কারণ, এদের শক্তপোক্ত হতে হবে। আর? আর এরা আর ফিরে আসবে কি না কেউ জানে না।

ভারতীয় প্রশিক্ষক সমীর দাস মাঝেমধ্যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে দেখে নিজেই কাঁদতেন। কী ভয়াবহ অপারেশনেই না এরা যাবে!

১১ জুলাই তাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, সেনাপতি কর্নেল ওসমানী।

প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে ওসমানী বললেন, যুগে যুগে যুবকেরা দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। তোমাদেরও নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাজউদ্দীন আবেগহীন মানুষ। কিন্তু তিনিও আজ বক্তৃতা দিতে গিয়ে চোখের কোনা শার্টের হাতায় মুছতে লাগলেন।

কমান্ডো যুবকেরাও সবাই ভেজা চোখ মুছতে লাগল।

.

আগস্টের ১ তারিখ থেকে কমান্ডোদের দেশের নানা স্থান টার্গেট করে পাঠানো শুরু হলো। চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর, হিরণ পয়েন্ট, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ।

মোংলা বন্দরের জন্য রওনা হলেন ৬০ জন। সাবমেরিনার আহসানউল্লাহ তাদের কমান্ডার। তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আনা হলো খিদিরপুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ডায়মন্ড হারবারের অদূরে ক্যানিংয়ে। তারা শুনতে পেলেন এখানেই নাকি রবার্ট ক্লাইভ প্রথম জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন।

৬ আগস্ট ৫টা বড় দেশি নৌকায় তাঁদের ষাটজনকে তোলা হলো। ৫টা দলে ভাগ হলেন তারা। কমান্ডোদের সঙ্গে দেওয়া হলো স্থল গেরিলাদের। পথে যদি শত্রুসেনার সামনে পড়ে যায়, তাহলে যেন তারা যুদ্ধ করতে পারে।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকা চলছিল। হাল ধরতেন মুজিবুর রহমান। ঝড় এল। সবাই দোয়া পড়ছে। নৌকায় মাইন আছে। না জানি তীরে ধাক্কা লেগে সব বিস্ফোরিত হয়।

১৩ আগস্ট সকালে রেডিও ধরে বসে আছেন। আক্রমণ করার জন্য আকাশবাণী থেকে সংকেত আসবে। পঙ্কজ মল্লিকের গান : তুমি আমায় যত শুনিয়েছিলে গান। গানটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবার স্নায়ু শক্ত হয়ে যায়। তার মানে তারা কমান্ডো অভিযান করতে যাচ্ছেন।

১৩ আগস্ট বিকেলে মোংলার কাছাকাছি সুতারখালী গ্রামে এসে নৌকা ভেড়ালেন তাঁরা। ১৪ আগস্ট ৭ জন বের হলেন রেকি করতে। মুজিবুর রহমানের মনে আছে, তাঁরা সুন্দরবনের খালের মধ্যে বুকপানিতে হাঁটছেন। আর পাশে গোলপাতার মধ্যে একটা বাঘ তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁদের দেখছে। তাদের হাতে অস্ত্র। বাঘকে পেছনে রেখে সেই দিকে চোখ রেখে উল্টো দিকে পানির মধ্যে হাঁটতে হয়েছিল তাদের।

.

১৫ আগস্ট সকালে আকাশবাণী থেকে বেজে উঠল দ্বিতীয় গানটি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে–আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুরবাড়ি। দলনেতা আহসান উল্লাহ সবাইকে ডেকে শপথ করালেন :

আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য দরকার হলে নিজের জীবন উৎসর্গ করব। আমরা সবাই একই মায়ের সন্তান, বাংলা মা, কেউ কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। শত্রুভয়ে ভীত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত হব না। যুদ্ধ শেষে সবার সঙ্গে দেখা হবে না, কিন্তু কারও মৃত্যু ঘটলেই আদর্শচ্যুত হব না। সবার চোখে পানি। সবাই সবার সঙ্গে বুক মেলালেন।

সারা দিন ধরে মাইনগুলো প্রস্তুত করা হলো।

সন্ধ্যার সময় সবাই খাওয়া সেরে নিল। নিজ নিজ ফিনস, ড্যাগার, সুইমিং কস্টিউম, পলিথিনে মোড়ানো দেশলাই নিলেন। শরীরে প্রচুর পরিমাণে শর্ষের তেল মাখলেন। রাত দুইটায় জোয়ার শুরু হবে। তখন রওনা হতে হবে। তারা নৌকায় ওঠেন। বানিয়া শান্তা পতিতাপল্লির কাছে গিয়ে উঠলেন যখন, তখন ভোর হয়ে গেছে। কমান্ডোরা প্রায় সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের হাতে অস্ত্র। তাদের দেখে পতিতাপল্লির মেয়েরা চিৎকার করতে শুরু করলে গেরিলাদলের নেতা আফজাল ও আনোয়ার তাদের বোঝান যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমরা চুপ করে থাকো। কোনো কথা বলবে না।

এবার জাহাজের উদ্দেশে পানিতে নেমে পড়লেন নৌকমান্ডোরা।

ছয়টা জাহাজ। প্রতিটাতে যাবেন আটজন করে। ৪৮ জন যাবেন।

এঁরা পানিতে নেমেছেন। প্রবল স্রোত। কচুরিপানার আড়ালে চলেছেন তাঁরা। ওই যে আসছে পাকিস্তানি মিলিটারির গানবোট। তারা ডুবে নিজেদের আড়াল করছেন। তারপর ঠিকই ছয়টা জাহাজের নিচে নেমে ড্যাগার দিয়ে শেওলা পরিষ্কার করে মাইন পেতে ফিউজ জ্বালিয়ে তারা ফিরে আসতে থাকলেন তীরে। সকাল ছয়টায় একটার পর একটা জাহাজের নিচে মাইন বিস্ফোরিত হতে লাগল। আগুন জ্বলে উঠল। জাহাজগুলো তলিয়ে যেতে লাগল। নাবিকেরা এসওএস সংকেত দিতে লাগলেন। পাকিস্তানি গানবোট ছুটে আসতে লাগল। তীরে থাকা স্থলমুক্তিযোদ্ধারা একযোগে এলএমজির গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। তারপর তারা নৌকায় উঠে পূর্বনির্ধারিত কামারখোলা স্কুলে উপস্থিত হলেন। দুজন কেবল নৌকায় আসতে পারেননি। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তারাও এসে উপস্থিত হলেন।

গেরিলাদের সঙ্গে নৌকমান্ডোদের মতের অমিল হলো। ইমাম বারী বলছেন, আমাদের ওপরে নির্দেশ হলো ভারতে ফিরে যাওয়া। স্থল গেরিলারা। ফরেস্ট অফিস আক্রমণ করে ওই অস্ত্রগুলো লুট করে নিতে চান।

ইমাম বারী সাতজন নৌকমান্ডোকে নিয়ে নৌকায় করে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মুজিবুর রহমানও তাঁর সঙ্গে।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, গেরিলাদের নেতা আছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। তিনি আসলে অস্ত্র জমায়া রাখতেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য আলাদা। তিনি চাইতেছিলেন যুদ্ধ শ্যাষ হইয়া গেলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লাইগা আবার লড়াই করবেন। সর্বহারাগো লগে তার যোগাযোগ আছিল। আর খিজির আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা বন বিভাগের দুইটা লঞ্চ বনলক্ষ্মী আর বনহুর–বহুত মালামাল, অর্থ, রাইফেলসমেত ভারতে লইয়া গিয়া মেজর জলিলের হাতে তুইলা দেয়।

ব্যাঙ্গমি বলল, ওই দিন চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর, দাউদকান্দি ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে একযোগে ২৬টা জাহাজ, লঞ্চ, গানবোট ধ্বংস হয়। এই অপারেশনটা অপারেশন জ্যাকপট নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হইয়া আছে। নৌকমান্ডো এরপরেও আরও অনেকগুলা অপারেশন করছিল।

.

মুজিবুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন তারা পাকিস্তানিদের খাঁচায় বন্দী।

খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান, ইমাম বারী, ইমদাদুল হক ধরা পড়ে গেছেন। ধরা পড়েছেন সাতক্ষীরা জেলার বুধটায়ে। ১৫ দিনের ঘুমহীন শ্ৰান্তিহীন পরিশ্রমে তারা নৌকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ছইওয়ালা নৌকা। ১৮ আগস্ট রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। ১৯ আগস্ট প্রথম প্রহর। দুটো বাজে ঘড়িতে হয়তো। বর্ষাকালের এই রাতটায় প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। একটুখানি হালকা বাতাস তাদের শরীরে আরামের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ গুলির শব্দে তাঁরা জেগে উঠলেন। দেখতে পেলেন, নৌকা ঘাটে ভেড়ানো। গুলিবিদ্ধ আফতাব আর সিরাজুল ইসলাম কাতরাচ্ছেন। পাহারা দেওয়ার জন্য জেগে ছিল খুলনা পাইকগাছার মোহসীন আলী। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিপদ দেখে সে হয়তো পানিতে নেমে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু তার উচিত ছিল সবাইকে আগেই জাগিয়ে দেওয়া। তা হয়নি। কীভাবে কী হয়েছে, এই নৌকমান্ডোদের বোঝার মতো সময়, পরিস্থিতি এটা নয়।

ঘুমভাঙা চোখে তাঁরা তাঁদের সঙ্গে থাকা এসএমজি তুলে নিলেন। ডাঙায় চারদিক থেকে অসংখ্য টর্চলাইটের আলো তাদের ওপরে এসে পড়েছে। সেই আলো লক্ষ্য করে তারাও এসএমজির গুলি চালাতে লাগলেন। একনিশ্বাসে এক ম্যাগাজিন গুলি চালিয়ে শেষ করে ফেললেন। আরেকটা ম্যাগাজিন আছে। সেটাও চালানো হলো। আর গুলি নেই। এখন কী করবেন?

এরা পালানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দেবেন। কিন্তু ততক্ষণে তাদের একেবারে কাছে এসে গেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। একেবারে গানপয়েন্টে তাঁদের অবস্থান। হ্যান্ডস আপ। হাত তোলা ছাড়া এই চারজনের কোনো উপায় নেই। তারা ধরা পড়লেন।

চারজন অক্ষত, দুজন গুলিবিদ্ধ।

এই চারজনের হাত বাঁধা হলো পিঠমোড়া করে। চোখ বাঁধা হলো তাঁদেরই পরনের কাপড় খুলে। তারপর তাদের তোলা হলো গানবোটে।

কোথায় নামানো হলো, তারা বলতে পারেন না। বোঝা গেল, তাদের রাখা হয়েছে একটা অন্ধকার ঘরে।

অন্ধকারের মধ্যেই কথা বলে উঠলেন ইমাম বারী। এই দলের তিনিই কমান্ডার। ফিসফিস করে বললেন, শোনো। আমরা যদি স্বীকার করি যে আমরা নৌকমান্ডো, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছি, এখন জাহাজ ডুবিয়ে ফিরছি, তাহলে সরাসরি মেরে ফেলবে। কিন্তু আমরা বলব, আমরা নিরীহ গ্রামবাসী। ভারতে গেছলাম শরণার্থী হিসাবে। কিন্তু ভারত আমাদের শত্রুদেশ। তাই পলায়ে এসেছি। আমরা সাতক্ষীরায় যার যার বাড়ি যাব।

সবাই বুঝছ?

জি।

সবাই এক কথা বলব। আর বলব, গুলি কারা করছে, আমরা জানি না। মনে হয় সাথে মুক্তি ছিল। আমরা নৌকায় উঠছি এই চারজন।

.

প্রথমে পাশের ঘরে ধাক্কা দিয়ে মারতে মারতে নেওয়া হলো খলিলুর রহমানকে।

নাম কী?

মোহাম্মদ খলিলুর রহমান।

বাড়ি কই?

ভাতশালা, দেবহাটা।

বাপের নাম?

মওলানা আয়েজউদ্দিন বিশ্বাস।

কী করিস?

আমি মাস্টারি করি। হাইস্কুলে পড়াই।

মুক্তির ট্রেনিং কই নিছিস?

নেই নাই।

শুরু হলো নির্যাতন।

মারতে মারতে প্রায় অচেতন করে ফেলল খলিলকে। চিৎকার-চেঁচামেচি।

মুজিবুর রহমান আল্লাহকে ডাকছেন। কেউ যেন কোনো কিছু স্বীকার না করে। স্বীকার করলেই মৃত্যু। যদিও নৌকমান্ডো ট্রেনিংয়ের আগেই সবার কাছে বন্ডসই নেওয়া হয়েছে। আমরা যে কাজে যাচ্ছি, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশমাতৃকাকে উদ্ধারের এই মহান কাজে নিয়োজিত হতে গিয়ে আমাদের মৃত্যু হতে পারে, আমরা শহীদ হতে পারি, এটা আমরা জানি। জেনে-শুনে বুঝে সজ্ঞানে আমরা এই কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দিচ্ছি ও ট্রেনিং নিচ্ছি।

মুজিবুর রহমানের বয়স ১৯। তাঁদের সবারই বয়স এই রকমই। ১৮, ১৯, ২০, ২১।

মুজিবুর রহমানের কষ্ট ডাবল। কারণ, তার নিজের ভাতিজা তাঁদের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকেও এই বিল্ডিংয়ে এনেছে বলে মনে হয়। যদিও চোখ বাঁধা থাকায় সবটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু আফতাবের গলা, সিরাজের গলা, ও বাবা গো, মরে গেলাম গো, একটু পানি তিনি শুনতে পেয়েছেন বলে তাঁর মনে হচ্ছে।

মুজিবুরকেও টেনে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের ঘরে।

নাম কী?

মুজিবুর রহমান!

মুজিবুর রহমান। মুজিবুর রহমানকে পাওয়া গেছে। মারো মারো। পাকিস্তানি সৈন্যরা উল্লাস করছে। বাংলা ভাষার লোকও পাওয়া যাচ্ছে। তাদের উচ্চারণ শুনেই মনে হচ্ছে তারা সাতক্ষীরারই লোক। মুজিবুর বুঝতে পারছেন। এরা রাজাকার। জামায়াতে ইসলামীর লোকজন সব রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বাঙালিদের ওপরে অত্যাচারে তাদের তৎপরতা বেশি, আরও নিষ্ঠুর।

একপশলা বেদম প্রহার। একটুখানি দম নিচ্ছে প্রহারকারী। দুই হাতের। ওপরেই বুট। গলার মধ্যে বুট। মুখের মধ্যে বুটের লাথি।

বাবার নাম?

হাজি অহেদ আলী। মায়ের নাম ছবিরুন্নেছা।

ওই মুজিবুর রহমান। তোর বাবার নাম ইন্দিরা গান্ধী।

আবারও মার।

কী করিস?

ছাত্র। ম্যাট্রিক পাস।

কোত্থেকে আসছিস তোরা?

ভারতে চলে গেছলাম।

ভারতের কোথায়?

খিদিরপুর।

ট্রেনিং নিয়েছিস কোথায়?

ট্রেনিং নেই নাই।

দলনেতা কে? মানে বুঝি না।

ভারতে আর কে কে মুক্তিযুদ্ধে গেছে?

জানি না।

কী কী অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিলি?

অস্ত্র চিনি না।

গুলি করল কে?

আমরা ঘুমায়ে ছিলাম। নৌকাতে অচেনা লোক ছিল। তাদের চিনি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি আর্মি।

ডাকা হলো ইমাম বারীকে। ছ্যাচড়াতে ঘঁাচড়াতে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। মাটিতে চিত করে শোয়ানো হলো। একটা বুটের পাড়া পড়ল গলায়। দুইটা বুট দুই হাতের ওপরে। এরপর শুরু হলো পায়ের নিচে লোহার রড দিয়ে বাড়ি।

বল তোর নাম কী?

ইমাম বারী।

বাবার নাম কী?

আতিয়ার রহমান।

বাড়ি কই?

কাঠিয়া, সাতক্ষীরা।

পেশা?

ছাত্র।

মুক্তির ট্রেনিং কোথা থেকে নিয়েছিস?

নেইনি। আমি মুক্তিযোদ্ধা না।

মুক্তিযোদ্ধা না? গুলি করলি। আবার বলিস মুক্তিযোদ্ধা না। পায়ের নিচে মার চলছে। এরপর বুটের লাথি। চোখে-মুখে সবখানে।

তাতেই ওই এক কথা। আমি মুক্তিযোদ্ধা না। ভারতে গেছলাম। ভারত আমাদের শত্রু। তাই পলায়ে আসছি। সাতক্ষীরা বাড়ি যাব।

এবার পায়ের নিচে সুই ফোঁটানো হতে লাগল।

.

তাদের আবার পাশের ঘরে আনা হলো। চোখ খোলা। হাত বাঁধা। সবাই রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। কে কার দিকে তাকাবে।

মুজিবুর তবু তাকালেন। আফতাব আর সিরাজুল গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত পড়ে আছে। কাতরাচ্ছে।

মুজিবুরের কান্না পাচ্ছে। আফতাব তাঁর ভাইয়ের ছেলে। যদিও বয়সে তিনিই বড়। তাঁকেই সে চাচা বলে ডাকে। ছেলেটার চিকিৎসা দরকার। তাকে বাঁচানো দরকার। না হলে ভাইকে তিনি কী জবাব দেবেন?

আফতাব পানি পানি বলে কাতরকণ্ঠে মিনতি করছেন। একজন রাজাকার এসেছে। সে বলল, পানি চাস! হারামজাদা পানি চায়।

সে তার লুঙ্গি তুলল। হ্যাঁৎ ঘঁাৎ শব্দ তুলে আফতাবের মুখে পেশাব করে দিতে লাগল।

মুজিবুরের মনে হলো, এখনই এই রাজাকারটার গলা তিনি টিপে ধরেন। কিন্তু হাত বাঁধা। মেঝেতে পড়ে আছেন তিনি। অসহায়ভাবে এই অমানবিক অত্যাচার দেখতে হচ্ছে।

আফতাবকে নিয়ে গেছে বাইরে।

প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়বে। তখন ভোর চারটার মতো হবে। ঘরের কোণে একটা হারিকেন জ্বলছে।

একটু পরে দুটো গুলির শব্দ হলো। মুজিবুর পড়লেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইল্লাইহি রাজিউন।

মুজিবুর রহমানের চোখের সামনে ভাতিজা মারা গেল। মারা যায় নাই, বলতে হবে শহীদ হলো। তিনি সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

এরপর তারা আহত সিরাজুলকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিল। ঘরের জানালা খুলে দিল দুই রাজাকার। তারপর এদের চারজনকেই দাঁড় করাল জানালার ধারে। বলল, দ্যাখ গাদ্দারির শাস্তি কী।

পাশেই নদী। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভোরের আলোয় ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে সিরাজুল। তার ক্ষত থেকে আবার রক্ত পড়তে শুরু করেছে।

সে পড়ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…একজন রাজাকার গুলি করল রাইফেল থেকে। সিরাজুল পড়ে গেল।

.

ওঠো। চলো। তাদের হাত বেঁধে তোলা হলো ট্রাকে।

ট্রাকের সঙ্গেও শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো চারজনকে। চোখ বাঁধা। তাদের একটা দোতলা বাড়িতে তোলা হলো। একটা হল ঘরে ঢোকানো হলো। তাদের চোখ খুলে দেওয়া হলে তাঁরা দেখতে পেলেন, বিরাট হলঘর। ফ্যানের হুকের সঙ্গে পা বেঁধে রাখা হয়েছে ১০-১২ জনকে।

চলল আরেক প্রস্থ লাথি। প্রহার।

সন্ধ্যায় তাঁদের বের করা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো একটা কক্ষে। সেই কক্ষটা সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে মানচিত্র। মনে হচ্ছে একটা ড্রয়িংরুম। পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা।

মুজিবুর রহমান।

ইয়েস স্যার।

তোমরা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছিলে?

স্যার ভুল করে ভারতে ঢুকে পড়ছিলাম স্যার। ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসছিলাম স্যার।

একটা লিখিত স্টেটমেন্ট নিলেন। কী ঘটেছে, লেখো। তাঁরা লিখলেন একে একে।

সাইন করলেন। তাদের ফেরত পাঠানো হলো আগের বিল্ডিংয়ে। মেলা রাত। এবার তারা বুঝতে পারলেন, এটা হলো সাতক্ষীরার হোটেল ডায়মন্ড। এটা হলো রাজাকারদের ক্যাম্প। রাজাকার বাহিনীর প্রধান জামায়াত নেতা আবদুল্লাহিল বাকি। রাজাকার কমান্ডার ইসহাক। এই ইসহাকই আফতাব আর সিরাজুলকে গুলি করে।

রাত বাড়ছে। তারা সারা দিন কিছু খাননি। আগের রাতে ধরা পড়েছেন। তারপর আর কোনো খাবার জোটেনি। শুধু জুটেছে মার।

আবার মিলিটারি এল। পেটাতে শুরু করল নৃশংসভাবে। মুজিবুরের নাম শুনে বেল্ট দিয়ে পেটাতে পেটাতে তাকে একেবারে মাটির সঙ্গে যেন মিশিয়ে দেবে।

ইমদাদুল হক দেখতে পেলেন, রাজাকারদের মধ্যে একজন তার স্কুলের সহপাঠী।

এই ঘরের বন্দীদের একজন একজন করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাইরে।

ইমদাদুল তার ক্লাসমেট রাজাকারকে জিজ্ঞেস করলেন, এই, যাদের নিয়ে যাচ্ছে, কই নিয়ে যাচ্ছে।

সে জানাল, বিনের পোতা ব্রিজে নিয়ে যাবে। বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে মেরে ফেলা হবে। রোজ ৪০ থেকে ১০০ জন দুষ্কৃতকারীকে এইভাবে মারা হয়।

ডায়মন্ড হোটেলের এই হলরুমের পাশে সারি সারি কক্ষ। এই কক্ষগুলোতে বাঙালি মেয়েদের ধরে ধরে এনে রাখা হয়েছে। রাত বাড়তে থাকলে আসতে থাকল মিলিটারিরা। মেয়েদের আর্তনাদে এই নৌকমান্ডোরা নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতে লাগলেন।

এখান থেকে তাদের তুলে দেওয়া হলো মুসলিম লীগ এমপি গফুর ও চেয়ারম্যান মজিদের হাতে। তারা তাদের বলল, তোমাদের মরতেই হবে। মরার আগে তোমাদের একটু খাওয়ানো দরকার। সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে। বসিয়ে তাঁদের মাছ, মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ানো হলো।

গফুর বলল, দই খাও। মরার আগে দইয়ে স্বাদ ভালো পাবে।

সেখান থেকে তাদের নেওয়া হলো থানাহাজতে।

একদিন পর তাদের নেওয়া হলো খোলা মাঠে। চারজনকে বলা হলো, চারটা কবর খোড়ো। তাঁরা কবর খুঁড়লেন। এবার তাঁদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে। বলা হলো, সত্য স্বীকার করো। তাঁরা সবাই আগের কথাই বললেন। আবার তাদের পাঠানো হলো থানায়। সাত দিন পর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো যশোর ক্যান্টনমেন্টে।

ব্যাঙ্গমা বলল, ১৭ সেপ্টেম্বর এঁরা চারজন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থাইকা পালায়া যাইতে সমর্থ হইছিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, রাজাকার আলবদরদের অত্যাচারের কিছুটা নমুনা এই কাহিনিতে পাওয়া গেল।

ব্যাঙ্গমা বলল, হ। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বালুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানের লগে দেখা করেন নুরুল আমিন, গোলাম আজম, ফরিদ আহমদ, খাজা খয়েররা। তাঁরা টিক্কা খানের বাঙালি নিধনে তাগো মনের খুশি প্রকাশ কইরা মিলিটারিগো সব ধরনের সাহায্য করনের প্রতিশ্রুতি দেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, ৬ এপ্রিল গোলাম আজম আবার গেলেন টিক্কা খানের কাছে। সাথে গেলেন হামিদুল হক চৌধুরী, পীর মোহসিন, এ টি সাদীসহ কয়েকজন। তারা আবারও টিক্কা খানরে সাপোর্ট দিয়া আইলেন। ৯ এপ্রিল গঠন করলেন শান্তি কমিটি।

প্রথম রাজাকার বাহিনী গড়া হইল ময়মনসিংহে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়া। মে মাসে জামায়াত নেতা ইউসুফ ৯৬ জন জামায়াত সদস্যরে নিয়া খুলনায় রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী গইড়া তুললেন। রাজাকার বাহিনীর সদস্যসংখ্যা লাখখানেক হইছিল ডিসেম্বর নাগাদ।

আবার ইসলামী ছাত্রসংঘ গইড়া তুলল আলবদর। এর প্রধান আছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। প্রধান পরামর্শক গোলাম আজম। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে তাগো ট্রেনিং দেওয়া হইত। এইটাই ছিল তাগো হেডকোয়ার্টার। ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে এই আলবদরেরা কসাইয়ের ভূমিকা পালন করছিল।

জামায়াত বাদে অন্য ইসলামপসন্দ দলগুলা গইড়া তুলছিল আলশামস। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার প্রাধান্য আছিল এই দলে। আরও আছিল মুজাহিদ বাহিনী। এইটা আছিল আধা সামরিক বাহিনী।

৬৩

ইন্দিরা গান্ধী এসেছেন কোচবিহারে। আগের রাতে ছিলেন শিলিগুড়িতে। ত্রিপুরায় স্বচক্ষে দেখেছেন শরণার্থীশিবির। যা দেখেছেন, তা অবর্ণনীয়। মানুষ কীভাবে যে আছে! সব শিশু উলঙ্গ, তাদের চোখ বড় বড়, বুক যেন। কঙ্কাল। পেট কৃমিতে ঠাসা। সব নারীর পরনে মলিন ছিন্ন শাড়ি। তাদের চোখমুখের হাড় বেরিয়ে এসেছে, একেকজন কাঠি হয়ে গেছেন। কোথাও সারি সারি শণে ছাওয়া ঘর, কোথাও তাঁবু। মানুষ বাস করছে বড় বড় সিমেন্টের পাইপেও। বৃষ্টি-কাদায় পুরো জায়গাটা অগম্য। এর মধ্যে ভাসছে মনুষ্যবর্জ। খাবার নাই। পানীয় জল নাই। বাথরুম নাই। তারপরও মানুষ কেন আসছে ভারতে? প্রায় ৮০ লাখ মানুষ কেন এই পশুর জীবন বেছে নিল জন্মভূমি ছেড়ে? কত অত্যাচারে পীড়িত হলে মানুষ এখানে এসে আশ্রয় নিতে পারে!

রাতে তার ঠিকমতো ঘুম হলো না। শিলিগুড়ির সার্কিট হাউসে পৌঁছেই তিনি বললেন, আমি তাপুরহাট মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখতে যাব।

তার সিকিউরিটির লোকজন প্রমাদ গুনলেন। ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ। তার মধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে দিনরাত। তাঁরা বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি যাবেন কী করে?

হেলিকপ্টারে নয়। প্লেনে যাব।

রাতারাতি সব ব্যবস্থা করা হলো। গোলোক মজুমদার আর ব্রিগেডিয়ার ওবেরয় জিপ গাড়ি চালিয়ে রওনা হলেন রাতের অন্ধকারে। বৃষ্টির মধ্যে সকাল সকাল হাজির হলেন তাপুরহাটে।

প্লেনে শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার। সেখান থেকে জিপ গাড়িতে ইন্দিরা এলেন তাপুরহাট।

একটা নালা ছিল। পাহাড়ি নালায় কলকল শব্দ তুলে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সেটা পার হতে হবে বাশের সাঁকোয়।

গোলোক মজুমদার বললেন, ম্যাডাম, আপনি তো বোধ হয় যেতে পারবেন না। নালা তো।

ইন্দিরা বললেন, আমি সাঁকো পার হতে পারব।

ম্যাডাম, বৃষ্টি তো!

আমি রেইনকোট পরে নেব। আর ছাতা তো আছেই।

ছাতা হাতে ধরে তো আপনি সাঁকো পার হতে পারবেন না।

তাহলে রেইনকোটই যথেষ্ট।

শাড়ি। শাড়ির নিচে রেইনবুট। শাড়ির ওপরে রেইনকোট। ইন্দিরা গান্ধী তিন বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে পাহাড়ি নালা পার হলেন। সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর এ আই ডায়াস। আর তার উপদেষ্টা সিদ্ধার্থ শংকর রায়।

তিনি ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করলেন। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাঁশের ব্যারাক। ৮০০-এর বেশি মুক্তিযোদ্ধা এখানে গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছেন। তিনি ছেলেদের সঙ্গে দেখা করলেন।

একজন কিশোর বয়স্ক ছেলেকে দেখে তিনি কৌতূহলী হলেন। বললেন, তোমার বয়স কত?

ছেলেটি তাড়াতাড়ি তার বয়স বাড়িয়ে ফেলল তিন বছর। বলল, ১৮।

এখানে তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?

সে বলল, না, কষ্ট হচ্ছে না। কিসের কষ্ট। আমার বাড়ি পাকিস্তানি মিলিটারিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমি এখানে বেঁচে আছি।

তোমার কি কিছু লাগবে?

না। আমার কিছু লাগবে না।

না। যদি কিছু লাগে তো বলো।

ছেলেটা বলল, আমাদের রেডিওটা ভালো শোনা যায় না। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনি। একটা ভালো রেডিও যদি দিতেন!

ইন্দিরা গান্ধী আবেগাপ্লুত হলেন। এই ছেলেকে যে দেশ জন্ম দিতে পারে, সেই দেশ স্বাধীন হবেই।

এমএনএ মতিউর রহমান সঙ্গে ছিলেন। তিনি বললেন, ম্যাডাম, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।

ইন্দিরা বললেন, আমিও খুব উদ্বিগ্ন। আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়েছি। অন্য সব জায়গাতেই আমি চিঠি দিয়েছি। আমাদের যা কিছু করার আমরা করছি, করব।

মতিউর রহমান বললেন, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দরকার। আরও বেশিসংখ্যক ছেলের ট্রেনিং দরকার। এক লাখ পাঞ্জাবি সৈন্য, এক লাখ রাজাকার। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের তিন লাখ মুক্তিযোদ্ধা দরকার হবে। ট্রেনিংয়ের গতি বাড়াতে হবে।

ইন্দিরা একটা শামিয়ানার নিচে একটা গার্ডেন চেয়ারে বসলেন।

ব্রিগেডিয়ার ওবেরয় বললেন, ম্যাডাম, আপনি এক কাপ চা খাবেন।

তিনি বললেন, আকাশে কী রকম মেঘ দেখছেন। এই রকম পরিবেশে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না।

ফ্লাস্কে করে চা এল। কাপ এল।

ইন্দিরা নিজ হাতে চা ঢাললেন কাপে। এক কাপ এগিয়ে দিলেন গোলোক মজুমদারের হাতে। তারপর উঠলেন চেয়ার থেকে। গোলোক মজুমদারকে বললেন, একটু এই দিকটায় আসুন। বৃষ্টিতে গাছপালাগুলো কী রকম সবুজ দেখাচ্ছে, না!

গোলোক এগিয়ে গেলেন। ইন্দিরা বললেন, চা ভালো হয়েছে। এটা কি দার্জিলিং চা, নাকি আসাম চা?

গন্ধ তো বলছে দার্জিলিং!

এই গতিতে যদি আমরা চলি, কবে আপনি আশা করছেন যে আপনি ঢাকায় হাজির হতে পারবেন?

কখনো না। গোলোক মজুমদার বললেন।

কেন? আমাকে তো সব সময় বলা হয়েছে, বিএসএফ একাই এটা করতে পারবে!

না, পারবে না। ওদের আছে গোলন্দাজ বাহিনী, বিমানবাহিনী, ভারী অস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনী। আমাদের আর্মি এবং বিমানবাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে।

আমিও তা-ই ভাবছি। আমার শুধু একটাই দুশ্চিন্তা। পশ্চিমে কী হবে!

পশ্চিমা বিশ্বে আমাদের প্রচার বাড়াতে হবে। এমনিতেই আমেরিকার জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। এডওয়ার্ড কেনেডির মতো মানুষ অনেক। রবিশঙ্কর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ করেছেন। সেখানে জর্জ হ্যারিসনের মতো বড় পপগায়ক বাংলাদেশ নিয়ে গান করেছেন।

আমি পশ্চিম সীমান্তের কথা বলছি।

ও। আমাদের সৈন্য, আমাদের ট্যাংক, আমাদের বিমান ওদের তিন গুণ। আমাদের প্রস্তুতি থাকলে না পারার কথা না।

হুম।

শুধু বর্ষাকালটা চলে যেতে দিতে হবে। আমাদের মাঠগুলো শুকনো থাকতে হবে। ট্যাংকগুলোকে পজিশন নিতে দিতে হবে। আখের খেতগুলো পরিষ্কার হতে হবে।

ঠিক বলেছেন।

তাহলে কবে আমরা গ্রিন সিগন্যাল পাব বলে আশা করতে পারি?

ধরুন। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। চায়ে দুধটা মনে হচ্ছে মোষের। আসার পথে রাস্তার ধারে অনেক মোষ দেখেছি। কী বলেন!

হ্যাঁ। মোষের দুধের চা-ই হবে।

.

ইন্দিরা গান্ধী চলে গেলেন দিল্লি।

গোলোক মজুমদার এই বার্তা জানালেন রুস্তমজিকে। রুস্তমজি জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করলেন গোলোক মজুমদারকে।

গোলোক, সোজা দিল্লি চলে এসো।

গোলোক মজুমদার দিল্লি গেলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব, তিন বাহিনীর প্রধান, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রধান এবং র-এর প্রধান উপস্থিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে।

গোলোক বললেন, নভেম্বরের তিন নম্বর সপ্তাহ। মানেকশ বললেন, গোলোক, এখন থেকে তুমি তোমার সব ইনফরমেশন আমার সঙ্গে শেয়ার করবে।

বিএসএফের ভেতরে পরিকল্পনা ঠিক করতে শুরু করা হলো। বিএসএফ এবং মুক্তিবাহিনী একযোগে এগোতে থাকবে। তারা পথ দেখাবে মানেকশর বাহিনীকে।

৬৪

কমান্ডার, ও বাহে কমান্ডার! আধখানা চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে ধলা মিয়ার ছোট করে কাটা চুলে। তার দুচোখের মণিতে দুই টুকরো চাঁদ ফুটে আছে। কার্তিকের সবুজ ধানখেত পড়ে আছে বিস্তারিত, চরাচরজুড়ে যেন। আলপথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তারা অনুভব করে ভেজা ঘাসে শিশিরের আদর। ধলা মিয়ার ষোলো বছরের দেহটা ঢেকে রেখেছে একটা মলিন পিরান, চাঁদের আলোয় তার আসল রংটা বলা মুশকিল, তবে তার বোতামের যে ঠিক নাই, তা বুঝতে দিনের আলো দরকার পড়ে না। লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে তোলা। তাতে চলতে সুবিধা! কোমরে একটা গামছা প্যাঁচানো।

কমান্ডার মাহবুব হোসেন (২২) পিঠের রাইফেলের বেল্টটা কাঁধে একটু সরিয়ে নেন। তারা তিনজন চলেছেন মড়াঘাটির ভেতর দিয়ে চিকন নালার দিকে। ধলা মিয়া ছাড়াও তাদের সঙ্গে আছেন আবদুল খালেক। আবদুল খালেক ইপিআরের জওয়ান, তার কাঁধেও রাইফেল, চাঁদের আলোয় রাইফেলের নল চকচক করছে, আবদুল খালেক হাতিয়ারের যত্ন নেন খুব। বোধ হয় নলে নারকেলের তেল মাখেন।

এত সুমসাম রাত। এখনো রাতের প্রথম প্রহর কাটেনি, তাতেই পুরো পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, প্রলম্বিত হুক্কাহুয়া ডাক, তারপরেই কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের পশলা ওঠে। কুকুরের ডাকের উৎসের দিকে তাকালে আবছায়া গ্রামের আভাস দেখা যায়।

ধানখেত থেকে উঁচুতে তারা একটা রাস্তায় ওঠে। মাটির রাস্তা। সেটা থেকে নেমে আবার তারা চলে আলপথ ধরে।

একটা পাকুড়গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় তারা। সামনে একটা খাল। খালে সরু জলের ধারা, আর বালু, চাঁদের আলোয় জল আর বালু যার যার মতো করে চিকচিক করছে।

বাঁ দিকে খাল ধরে এগোবে তারা।

মাইলখানেক হাঁটলে গোরুমারা ব্রিজ। সেটা পাহারা দেয় তিনজন রাজাকার। এইটাই খবর তাদের কাছে। আজকে তাদের কাজ রেকি করে দেখা, কজন আসলেই পাহারা দেয়। তারা কোথায় পজিশন নেয়। তাদের হাতে কী অস্ত্র থাকে।

ধলা মিয়া বলে, বাহে কমান্ডার, এই নালা পার হইলেই কইলাম মোর বাড়ি।

কমান্ডার মাহবুব হোসেন বলেন, তাই নাকি। কোন বাড়িটা?

ওই যে উঁচা একখান গাছ দেখা যায়, জামগাছ, বাজে পোড়া জামগাছ, ওইটার বগলত।

তাইলে তো গোরুমারা ব্রিজ তুই ভালো করেই চিনিস।

হ। এইসব জায়গাত মুই কত গরু চরাইছ। গরুক ধরি আইল-চরা দিছ। আইলের দূর্বাঘাস খাইলে গাইয়ের দুধ বেশি হোয়ায়।

আর কতক্ষণ হাঁটা লাগিবে? আবদুল খালেক বলেন। তার কপালে একটা উঁচু ঢিবির মতো আছে, চাঁদের আলোয় সেটাও চকচক করে।

ধলা মিয়া বলে, আর বেশি হাঁটা লাগিবে না। আসিয়াই পড়ছোম। ওই দেখেন, হামার বাড়ির টিনের চাল দেখা যায়।

ধলা মিয়ার চোখ চকচক করে।

খালের ধারে বিষকাটালির ঝোঁপ। তাতে জোনাকির মেলা। খালের পানিতে মাছ নড়ে ওঠে। মাহবুব হোসেন টর্চের আলো ফেলেন। মাছ বুঝিবা দেখা যায়।

ধলা মিয়া বলে, কমান্ডার, ও বাহে কমান্ডার, মুই একনা যাওঁ বাড়িত, মাওয়ের সাথত একনা দেখা করি আসি!

মাহবুব হোসেন বলেন, তোর মা এই বাড়িতে থাকে!

হয় হয় বাহে। মোর মাও আছে, মোর ছোট বোইন আছে। ধলা মিয়া উৎসাহের সঙ্গে বলে।

তোর ছোট বোনের নাম কী? মাহবুব হোসেন জিজ্ঞেস করেন।

উপালি।

রুপালি?

হয়। উপালি।

তোর মতোই ফরসা তোর বোনটা?

মুই আর কী ফরসা! মোর বোইন একেরে ধরেন এই চান্দের মতন ধবধবা ফরসা।

কত বছর বয়স তোর বোনের?

বারো হইবে ধরেন।

তুই আদর করিস বোনকে?

করি মানে ধরেন উয়াকে মুই কত যে বরাই পাড়ি দেই, তেঁতুল পাড়ি দেই।

বোনটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে?

হয় হয়। বোইনটাক দেখমো বলি মনটা পোড়াইতেছে। আর মা-ও আছে। মা-ও তো মোকে খুব আদর করে। মোকে ধরেন জামবাটিতে গরম দুধ দিবে, তাতে দিবে লাল মুড়কি, সর দিবে তুলি, মুই মার সামনত পিঁড়াতে বসি দুধ খামো, আর যদিল ধরেন দুধভাত খাই, গুড় দিবে, গুড় দিয়া পাত মোর একেরে লাল হয়া যাইবে।

তুই একাই খাস। বোনকে দিস না?

বোনকও দেই। মোর বোন দুধের চাইতে ধরেন কুড়ানি জিনিস বেশি পছন্দ করে। পানিয়াল তার এক নম্বর পছন্দ।

তারা আবার হাঁটে।

কমান্ডার, ও কমান্ডার বাহে, চলেন বাহে, মোর বাড়িত যাই, মাকে একনা দেখি, বোইনটাকে একবার দেখি, কত দিন দেখোম না, ৯৭ দিন হইবে না?

মাহবুব হোসেন বলেন, না না, যে কামত আসছিস সেই কামত মন দে। এলা যাওয়া না যাইবে। রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র মাহবুবও রংপুর অঞ্চলের কথ্যভাষাটা ভালোভাবেই জানেন। তিনি বুঝিয়ে বলেন, এখন যদি আমরা তোর বাড়িতে যাই, তোর মা ঘুম থেকে জাগবে, বোন জাগবে, কুকুর ডাকাডাকি করবে, আশপাশের তোর চাচা-চাচির বাড়ির লোকজন জেগে যাবে, তারা বুঝতে পারবে মুক্তিরা এসেছে, এ-কান ও কানে কথা ছড়িয়ে পড়বে। আমরা আজকে যাচ্ছি রেকিতে। কাল বা পরশু আমরা আসব অপারেশনে। তার আগে কথা এ-কান ও-কান হলে আমাদের এই অপারেশনটা আর হবে না রে ধলা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। আর মাকে-বোনকে দেখার লোভ সামলাতে পারব না?

আবদুল খালেক বলেন, ধলা মিয়া, তাইলে কাইল হোক পরশু হোক হামরা অপারেশন শ্যাষ করি ফেরার সময় তোর মার বাড়ি যামো। তখন তুই তোর মা আর বোনক দেখিস। আইজকা-কাইলকা দুইটা দিন সবুর কর।

বর্ডার থেকে প্রায় ১২ মাইল হেঁটে তারা এসেছে এই গ্রামে। গ্রামটা ধলা মিয়ার নিজের এলাকায় বলে তাকে সঙ্গে আনা হয়েছে গাইড হিসেবে। আর ধলা মিয়া যোদ্ধা হিসেবেও ভালো। গ্রামের রাখাল ছেলে, পরিশ্রম করা অভ্যাস আছে, তার নিশানাও খুব ভালো। সাহসেরও তুলনা নাই।

ধলা মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, ঠিক আছে, তাইলে আইজকা আর না যাওঁ। পরশু দিন লড়াই শ্যাষ করি রাজাকারগুলানক খতম করি, তারপর যামো।

হাঁটতে হাঁটতে তারা দূর থেকে দেখতে পায় গোরুমারা ব্রিজ।

মাহবুব হোসেন গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার বের করেন। সামনে। আখের খেত। তার ভেতরে ঢুকে তারা নিঃশব্দে এগোতে থাকেন। তবু পাতার খসখস আওয়াজ তাঁদের বুকে এসে বেঁধে। নিজেদের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। একটা শিয়াল ঘাড় বাঁকিয়ে অবাক হয়ে তিন মানবসন্তানের সন্তর্পণে এগিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করে।

রাজাকার তিনজনই। তিনজনের হাতেই টর্চ আছে। মাঝেমধ্যে তারা টর্চ জ্বালে। আর এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলে। ঝোঁপের মধ্যে। ঝাড়ের মধ্যে। পানির মধ্যে।

তিনটার কাঁধেই রাইফেল।

কাজটা কঠিন হবে না। ছয়জনের দলই যথেষ্ট। খালের দুপার থেকেই আক্রমণ করতে হবে। এপাশে তিনজন। ওপাশে তিনজন। রাস্তা ধরে দুজন। দুপাশের নামা থেকে চারজন। মাহবুব হোসেন ছক কষতে থাকেন।

কিছুক্ষণ আখের খেতে ঘাপটি মেরে থেকে রাজাকারগুলোর গতিবিধি দেখে তারা ফিরে আসে।

ধলা মিয়া বলে, পরশু দিন ফির আসিবার দরকার কী। রাইফেলটা দ্যান মোর হাতত, মুই এটে থাকি গুলি করি খতম করি দেই।

একটা গুলি করিলে তিনটায় শুতি পড়িবে, তখন কী করিবি।

তা-ও তো কথা?

না পরশু একেরে রেডি হয়া আসমা। গ্রেনেড আনমো। রাজাকারগুলাক খতম করিয়া এক্সপ্লোসিভ দিয়া ব্রিজটা উড়ি দেমো। তাইলে এই রাস্তা ধরি মিলিটারি জিপ আর না যাইবার পারিবে। বর্ডারত যাওয়া ওমার বন্ধ হয়া যাইবে।

তারা ফিরে আসে। প্রথমে আখখেত ধরে। তারপর খালের পার হয়ে।

আবার তারা চলে আসে ধলা মিয়ার বাড়ির কাছাকাছি। ধলা মিয়া বলে, ও বাহে কমান্ডার, মুই একনা যাও মোর বাড়িত। কাকেও না ডাকিমো। খালি ওই দেখেন বেড়াত মোর মার শাড়ি দেখা যায়, মুই খালি যায় মায়ের শাড়িটা একবার ধরিমো। উয়ার গন্ধ একনা শুকিমো। আর কিছু না করিমো।

তার এই আকুতিতে মাহবুব হোসেনের হৃদয় গলে যায়। মাহবুবেরই-বা কী এমন বয়স। তিনি বলেন, আচ্ছা যা, হামরা এটে কোনা পাকুড়গাছের নিচে বসি থাকি। একনা জিরাই। তুই এক দৌড়ে দিয়া যা, আর এক দৌড় দিয়া আয়। দেরি করিস না জানি। তাইলে কিন্তু ম্যালা ফাপর লাগিবে।

কথা শেষ হওয়ার আগেই ধলা এক লাফে খালের কিনারে। দুই লাফে হাঁটুজলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে সে খাল পেরিয়ে যায়। মাহবুব হোসেন আর আবদুল খালেক তাকিয়ে থাকেন। সে খালের ওপারে ওঠে। তারপর আলপথ বেয়ে ওই যে তার বাড়ির ভিটার দিকে যায়। মাঝেমধ্যে গাছের আড়ালে পড়ে তার ছায়ামূর্তি, কখনোবা তাকে ফের দেখা যায়।

খানিক পরে দৌড়েই ফিরে আসে ধলা মিয়া। তার হাতে তার মায়ের শাড়ি। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, অত সময় নাই, তাই মুই মার শাড়িখান ধরি নিয়া আসছোম। এইটা মুই মোর কাছে থোমো। মুই এইটাকে খ্যাতা বানায়া গায়ত দেমো।

তার চোখে জল, মুখে হাসি। বিজয়ীর হাসি।

চলেন এলা।

আবারও মাইল দশেক হাঁটতে হবে। তারপর বর্ডার। সাবধানে বর্ডার পেরিয়ে তারা চলে যাবে ওপারে। ওই পারে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প প্লাস শেল্টার। একটা প্রাইমারি স্কুলের দুইটা রুম দখল করে নিয়ে তাদের থাকার জায়গা। তারই মেঝেতে তারা বাইশজন ঘুমায়।

ধলা মিয়া বেগুনি রঙের ছেঁড়া শাড়িটা দিয়ে তার গা-মাথা মুড়ে রেখেছে। সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে সেই শাড়িতে। মাহবুব হোসেন দেখেন। ঘুমাক ছেলেটা।

মনে হচ্ছে সে ঘুমুচ্ছে তার মায়ের কোলে।

সে সন্ধ্যাতেই তাদের শিবিরের ওপরে মর্টারের গোলা এসে পড়তে থাকে।

পাকিস্তানি মিলিটারি বর্ডার থেকে মর্টার দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বোমা মারছে। এদিক থেকে বিএসএফও পাল্টা গোলা ছুঁড়তে শুরু করে।

মাহবুব হোসেন সবাইকে ক্রল করে দ্রুত পেছনের দিকে সরে যেতে নির্দেশ দেন।

সবাই ক্রল করছে।

পেছাচ্ছে।

একটু পরে বিএসএফের কমান্ডার জগদীশের কল আসে ওয়্যারলেসে। কাউয়ার্ডের দল পেছাচ্ছ কেন? সামনে এগোও।

সব রাইফেল নিয়ে পুরো টিম ভেতরে যাও। মর্টারের গোলা কখনো কাছে পড়ে না।

ভেতরে গিয়ে ওদের রেঞ্জের ভেতরে এনে রাইফেল দিয়ে অ্যাটাক করো। যাও।

মাহবুব নির্দেশ দেন, চলো, ক্রল করে বর্ডারের দিকে চলো।

হাতের কনুই ছিলে যাচ্ছে। হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে। পিঠে অস্ত্র। গোলাবারুদ। তারা সামনে এগোয় দ্রুত। খানিক পরে তারা টের পায়, গোলা যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। এখন তারা হাঁটতে পারে।

কী যে শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যেই ছুটে যাচ্ছে গোলা। আগুন জ্বলে উঠছে দূরে দূরে। মাহবুব হোসেনের দল তড়িৎবেগে দৌড়াচ্ছে বর্ডারের দিকে।

আবার তিনি অর্ডার দেন, শুয়ে পড়ো। আমরা শত্রুর রাইফেলের রেঞ্জে এসে গেছি। আরেকটু এগোব। হাবিলদার কাশেম এলএমজি চালাবে শুরুতে। তারপর আমরা রাইফেল চার্জ করব। একযোগে চলো।

ঢোলকলমির বন ধরে তারা ক্রল করে করে এগোতে থাকে। খুব কাছে। আরও কাছে।

.

ধলা মিয়ার কাঁধে রাইফেল। তার নিশানা সবচেয়ে ভালো। তারা শত্রুর খুব কাছে এসে গেছে। শত্রুদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। মর্টারে গোলা ভরে ভরে তারা চার্জ করছে। জটলা পাকিয়ে। এত কাছ থেকে তাদের কেউ আক্রমণ করে বসতে পারে, এটা তারা ভাবতেও পারবে না। সামনের কলমির গাছগুলো সরিয়ে এলএমজির পজিশন তৈরি করে কাশেম।

সবাই আধা বসা হয়ে একযোগে রাইফেল তাক করে।

মাহবুব আদেশ করেন, ফায়ার।

এই রকম সাফল্য ইদানীংকালে মুক্তিযোদ্ধারা অল্পই দেখিয়েছেন। ১২ জন পাকিস্তানি মিলিটারি মারা গেছে। তাদের অস্ত্র সব বয়ে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিএসএফের কমান্ডার জগদীশ জড়িয়ে ধরলেন কমান্ডার মাহবুবকে। শাবাশ! ইউ ডিড অ্যান এক্সিলেন্ট জব। দিস ইজ হিরোইক অ্যান্ড ব্রেভ। অ্যান্ড দিস উইল রিমেইন অ্যাজ অ্যান এক্সাম্পল ইন দ্য মিলিটারি হিস্ট্রি। মর্টার পোস্টে গিয়ে আক্রমণ করে বসা। ও মাই বয়েজ ও মাই বয়েজ!

তোমাদের তো মাত্র দুজন মারা গেছে, না!

হ্যাঁ।

বডি নিয়ে এসেছ!

হ্যাঁ।

কী করবে।

বর্ডারের ওপারে বাংলার মাটিতে কবর দেব।

তাই করা হয়। আবদুস সবুরের দেহ মার্কিন কাপড়ে মোড়ানো হয়েছিল। ধলার দেহে কাফন হয় তার মায়ের বেগুনি শাড়ি।

গুলি লাগার পরে সে বলেছিল, কমান্ডার বাহে, মোকে কিন্তুক মোর মাওয়ের শাড়ি দিয়া কাফন দিবেন। আর মোর ব্যাগের ভিতরে দেখমেন মোর বোনের লাগি মুই ইন্ডিয়ান স্নো-পাউডার কিনি থুছোম। সেগুলা একনা মোর বোনটাকে দিবেন।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে :

দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর পর ৬২ বছরের কমান্ডার মাহবুব হোসেন। আবার গিয়েছিলেন সেই বোয়ালমারী বর্ডার এলাকায়। খুঁজে পেয়েছিলেন ধলা মিয়া আর আবুদস সবুরের জোড়া কবর। জোড়া কবর নামেই জায়গাটাকে এলাকাবাসী সংরক্ষণ করেছে।

তিনি বললেন, আমি ধলা মিয়ার বাড়ি যাব। তার মাকে-বোনকে খুঁজে বের করব।

মোটরসাইকেল যাত্রা শুরু করে গোরুমারা ব্রিজ ধরে। রাস্তাটা পাকা হয়েছে। ব্রিজ পেরিয়ে ডান পাশের রাস্তায় নেমে তারা যান সেই গ্রামে, যেই গ্রামে বাজে পোড়া জামগাছের নিচে ধলা মিয়ার বাড়ি ছিল।

বাড়িটি আর মাহবুব হোসেন খুঁজে পান না। জামগাছটাই তো নেই। আর এলাকাটা এত বদলে গেছে যে তিনি ধন্দে পড়ে যান।

৬৫

তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে খুব সকালবেলা এসেছেন মঈদুল হাসান। তখন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়িতে ৭টা ২৫, মঈদুল হাসানের ঘড়িতে ৭টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। তাজউদ্দীন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নাশতাপানি সেরে নিয়ে নিজের রুমে বসে জরুরি নোট তৈরি করছেন। কার্তিকের এই সকালটায় সত্যি হেমন্তের আমেজ। বাড়ির চারদিকে খোলামেলা, গাছগাছালি থাকায় আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক।

মঈদুল হাসানকে দেখে তিনি বললেন, আসেন মঈদুল সাহেব। চা খাবেন?

খাই এক কাপ। তাজউদ্দীন তাঁর পরিচারক মকফুরকে চা দিতে বললেন।

মঈদুল বললেন, পাঁচদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ হয়ে গেছে। ভারত সোভিয়েত চুক্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে আপনার মনটা কি এখন আগের চেয়ে ভালো নয়?

তাজউদ্দীন বললেন, আমার যুদ্ধ তো কেবল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নয়। আমার যুদ্ধ ঘরে-বাইরে সবদিকে।

নতুন কী হলো?

নতুন কিছু হয়নি। বারাসাতে ৯ নম্বর জোনাল অফিসে আমাদের ৪০ জন পরিষদ সদস্য বসেছেন। তারা রেজলুশন নিয়েছেন, সরকার বাতিল করতে হবে। ওয়ার কাউন্সিল গঠন করতে হবে। নুরুল ইসলাম এমপিএ সাইন করেছেন।

তাজউদ্দীন একটা ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি বের করে দেখালেন মঈদুলকে। মঈদুল পড়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।

চিঠিতে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ভোটে ম্যান্ডেট পেয়েছে। কিন্তু একটা একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার কাজকর্ম আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনারা জানেন, একটা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাতে ন্যাপের দুই গ্রুপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগকে রাখা হয়েছে। এ রকম একটা ভাইটাল ম্যাটার দলের মধ্যে আলোচনা করে পাস করে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করা হয়নি। একটা প্ল্যানিং সেল গঠন করা হয়েছে, যাতে একজনও আওয়ামী লীগার নেই।

এমএনএ এনায়েত হোসেন খানের সভাপতিত্বে ১১ সেপ্টেম্বরে এই গ্রুপ তাজউদ্দীনকে সরকার ও দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

মঈদুল হাসান বললেন, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড এই কথা শুনবে কেন?

শোনা না-শোনা পরের ব্যাপার। আমরা যুদ্ধ করব, না ঘর সামলাব? আর হেনা ভাই ইউসুফ সাহেব মিলে উত্তরাঞ্চলের নেতাদের সংগঠিত করছেন। টাকা তুলে টাকা ছিটাচ্ছেন। দিনাজপুরের আজিজ সাহেব আমার লোক। তাকে সাইজ করার চেষ্টা করছেন। এই যে রিপোর্ট।

হাতে লেখা একটা গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখালেন তাজউদ্দীন। মঈদুল পড়লেন।

মঈদুল বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে, আপনার ঘরের মধ্যে চার ধরনের শত্রু। ১. খন্দকার মোশতাক, চাষী, আমেরিকা। ২. শেখ মণি এবং ছাত্রনেতা, মুজিববাহিনী। ৩. খুলনা যশোর গ্রুপ। ৪. উত্তরবঙ্গ গ্রুপ। কারও সঙ্গে কারও তো বনিবনা নাই। আপনি আবার আওয়ামী লীগের এবং পরিষদ সদস্যদের জাতীয় সভা ডাকেন।

তাজউদ্দীন বললেন, কারও সাথে কারও বনিবনা নাই। কিন্তু একটা প্রশ্নে সবাই এক। তাজউদ্দীন হটাও।

মঈদুল বললেন, একটা পলিটিক্যাল আদর্শ এদের আছে। তা হলো, এরা সবাই ডানপন্থী। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে বিশ্বাস করে।

তাজউদ্দীন বললেন, মণি ছাড়া বাকি তিনজন যুবনেতা, তোফায়েল, রাজ্জাক, সিরাজ কিন্তু নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলে।

মঈদুল বললেন, তা বলে কিন্তু…

তাজউদ্দীন বললেন, সিরাজ আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। দেখা করব।

মঈদুল বললেন, করেন। আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনি সবার সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।

তাজউদ্দীন বললেন, নুরুল কাদের আমাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন। সবাইকে কাজ দেন। এম আর সিদ্দিকী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মফিজ চৌধুরী সবাইকে বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দেন। জাতিসংঘে বড় দল পাঠানো যায়। দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় জনমত তৈরি করতে প্রতিনিধি পাঠানো যায়। দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিনিধি পাঠানো যায়। খন্দকার মোশতাক সাহেবকে রণাঙ্গন দেখতে যেতে বলি। এক জায়গায় বসে থাকলেই এঁরা দলাদলি করবেন।

খারাপ বুদ্ধি না। তবে আপনি কাউন্সিল ডাকেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

মঈদুল হাসান এসেছিলেন দিল্লির খবর নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো যাচ্ছেন। মস্কোর বাংলাদেশ নীতি এখনো খুবই আলতো, পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী মনে করেন, এটা আর সম্ভব না। একমাত্র উপায় হলো যুদ্ধ করে পাকিস্তানি মিলিটারিকে পরাজিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। কেবল তাহলেই এক কোটি শরণার্থী দেশে ফিরতে পারে। সেসব নিয়ে কিছু কিছু কথা সেরে মঈদুল হাসান বিদায় নিলেন।

বাইরে এসে তিনি ভাবলেন, আজ একটু হাঁটি। সকালটা হাঁটার জন্য বেশ। কলকাতার থিয়েটার রোডে খানিকক্ষণ হাঁটলেন ফুটপাত ধরে। টানা রিকশাগুলো রাস্তার ধারে। অ্যাম্বাসেডর গাড়িগুলো লাইন ধরে দাঁড় করানো।

ট্যাক্সিচালকেরা একখানে হয়ে হল্লা করছে।

মঈদুল হাসানের মনে হলো, তাজউদ্দীন আহমদ না খুন হয়ে যান!

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে :

একজন এসেছিল অস্ত্রসমেত। থিয়েটার রোডের বাড়ির গেটে বিএসএফের প্রহরায় সে ধরা পড়ে। তাকে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে সে বলে, সে মুজিববাহিনীর সদস্য। মুজিববাহিনীর এক নেতা তাকে পাঠিয়েছে তাজউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য। তবে সে হত্যা করতে আসে নাই। তাজউদ্দীনকে সতর্ক করতে এসেছে।

তাজউদ্দীন বলেন, অস্ত্রটা রেখে দিয়ে এর নাম, ঠিকানা, ছবি রেখে একে ছেড়ে দিন। ভালো ছেলে। কোনো অসুবিধা নাই। আর এই নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করবেন না। এটা টপ সিক্রেট।

মুজিববাহিনীর কোন নেতা এই কাজটা করতে পারে? কারও এত কাঁচা কাজ করার কথা নয়। তাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরা গান্ধী পছন্দ করেন, হাকসার, ডি পি ধর পছন্দ করেন, রুস্তমজি, গোলোক মজুমদার পছন্দ করেন, দলের এবং পরিষদ সদস্যদের সভায় তিনি অনুমোদন পেয়েছেন, তাঁকে মারতে একজন ছেলেকে অস্ত্রসহ একেবারে থিয়েটার রোডে পাঠিয়ে দেবে, আর এমন একজনকে পাঠাবে যে এসে বলে যাবে যে আমাকে এই অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে, ব্যাপার তো এত সহজ হওয়ার কথা না। কী। জানি। মানবচরিত্র বড়ই জটিল। কার মনে কী আছে, কে কেন কী বলছে, কী আচরণ করছে, অনেক সময়ই তা ধরা যায় না। এই আততায়ী ছেলের আচরণটাও রহস্যজনকই রয়ে যাবে। হয়তো চিরটাকালই।

.

সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে জয় বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর আর ছবি প্রকাশিত হলো। ছবিটা হলো, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সম্প্রতি ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক গলব্রেথ মুজিবনগরে দেখা করেন।

আর বড় অক্ষরের শিরোনামটা হলো : পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের জাতিসংঘ যাত্রার প্রস্তুতি।

তাজউদ্দীন খবরটা দেখলেন। তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলেন। তার হিসাব হলো, খন্দকার মোশতাক আমেরিকা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ত্যাগ করলে মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু বিভ্রান্তি তো তৈরি হবেই।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, আর খন্দকার মোশতাকের হিসাবটা হইল, এই তাজউদ্দীনের খপ্পর থাইকা বাইরায়া যাই। তারপর আমেরিকার লগে কানেকশন ফিট কইরা শেখ সাহেবরে যদি ছাড়াইতে পারি, তাইলে সবাই মোশতাকের নামেই জয়ধ্বনি দিব। আর যদি ছাড়াইতে পারি, তাইলে কথা একটাই, হয় স্বাধীনতা, নাইলে মৃত্যু। আমগো স্বাধীনতাযুদ্ধে হেল্প করেন, না পারেন তো যুদ্ধ কইরা মরতে দেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, কিন্তু এই দিকে ভারত-সোভিয়েত চুক্তির পর আর পাঁচ দলের উপদেষ্টা কমিটিতে মস্কোপন্থী দল দুইটারে রাখার পর তাজউদ্দীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পাইতাছেন। ইন্ডিয়া বাংলাদেশরে স্বীকৃতি দিব, পাকিস্তান ইন্ডিয়া অ্যাটাক করব, ভারতের সেনাবাহিনী আর বাংলার মুক্তিবাহিনী একযোগে ঢাকা দখল কইরা ফেলব।

তাজউদ্দীন এক প্রতিনিধিদল ঠিক করেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বইলা। এরা জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে কথা কইতে নিউইয়র্ক যাইব।

.

এ আর মল্লিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যিনি মার্চ-এপ্রিলের প্রতিরোধ সংগ্রামে সেনাধ্যক্ষের ভূমিকা পালন করছিলেন, তিনি তখন বোম্বেতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং তাঁর ভাষণের সময় কত তালি পড়ছে, তার হিসাব কষছেন। হঠাই কলকাতা থেকে ফোন এল, তাজউদ্দীন ডেকে পাঠিয়েছেন এবং তাকে নিউইয়র্ক যেতে হবে, জাতিসংঘে। তিনি দ্রুত উড়ে এলেন কলকাতা, দেখা করলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে, তারপর ভবনের দোতলা থেকে নামার পথে দেখা পেলেন খন্দকার মোশতাক, আর তার সঙ্গী তাহের উদ্দীন ঠাকুরের। ঠাকুর বললেন, স্যার, জাতিসংঘে যাচ্ছেন তো?

হ্যাঁ।

স্যুট বানানোর টাকা পেয়েছেন?

তা তো একটা খাম পেলামই।

স্যার কষ্ট করে আর স্যুট বানাতে হবে না। আমি বানিয়েছিলাম। ওটা নিয়ে যান।

তোমারটা আমার গায়ে ফিট করবে বলে মনে হয় না। তুমি যাচ্ছ না। কেন?

এখানে অনেক কাজ স্যার।

আসলে ডি পি ধর খন্দকার মোশতাককে ডেকে ধমক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বাসঘাতক।

তাতে খন্দকার মোশতাক নিজেকে নিবৃত্ত করেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, ডি পি ধরের এই ট্রেইটর বা বিশ্বাসঘাতক কথাটা ইতিহাসে প্রমাণ হইয়া যাইব। সেইটা অনেক রক্তের দামে।

ব্যাঙ্গমি বলে, হ। আর চাইর বছর পর।

.

জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা গেছেন। আবু সাঈদ চৌধুরী, সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ আজাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুস সুলতান, এম আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক, ডা. আসহাব-উল হক জোয়ারদার, ফকির শাহাবুদ্দীন, ড. মফিজ চৌধুরী, ড. এ আর মল্লিক প্রমুখ। আবু সাঈদ চৌধুরী গেছেন লন্ডন থেকে। আমেরিকা থেকে যোগ দিচ্ছেন এ এম এ মুহিত, এস এ করিম, আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আবুল ফতেহ।

তাদের তো আর সদর দপ্তরে স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার নেই। তারা ভিজিটর হিসেবে ঢুকবেন। ভারতের কাছ থেকে ভিজিটর পাস নেওয়া ঠিক হবে না। তাহলে পাকিস্তান বলবে, ওরা ভারতের দালাল। তারা যোগাযোগ করতেন জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ভারতীয় বাঙালি সাংবাদিক জি কে ব্যানার্জির সঙ্গে। তাঁদের অতিথি হিসেবে তাঁরা জাতিসংঘ দপ্তরে ঢোকেন।

একদিন ড. এ আর মল্লিক কয়েকজন বাঙালি প্রতিনিধিসহ দাঁড়িয়ে আছেন সদর দপ্তরের নিচের তলায়। সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।

তখন তারা দেখতে পেলেন, ইয়াহিয়া খানও পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠিয়েছেন কজন বাঙালিকে, তাঁরাও জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সহজেই চিনতে পারলেন রাজাকারগুলোকে–শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, রাজিয়া ফয়েজ।

এর মধ্যে রাজিয়া ফয়েজ এগিয়ে এলেন এ আর মল্লিকের দিকে। এসে বললেন, আপনার সঙ্গে কি আলাদা করে একটু কথা বলা যাবে।

আলাদা করে? আচ্ছা। রাতে হোটেলে আসুন।

রাতে রাজিয়া ফয়েজ এলেন এ আর মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে।

এ আর মল্লিক বললেন, বসেন। চা খাবেন না কফি? হোটেল রুমে চা কফি বানানোর যন্ত্র আছে।

রাজিয়া ফয়েজ বললেন, চা-কফি কিছুই খাব না। আপনি একজন ভাইস চ্যান্সেলর। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মতো নগণ্য লোক, তার আনুগত্য কীভাবে স্বীকার করলেন?

এ আর মল্লিক বললেন, আপনার মতো একজন শিক্ষিত মহিলা যে ভেতরে-ভেতরে অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট, এটা আপনার এই কথাতেই স্পষ্ট। গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্থান বুদ্ধিজীবী হোন, প্রফেশনাল হোন, জেনারেল হোন, তাদের সবার চেয়ে উঁচুতে। এটা আমেরিকাতেও। এটা ভারতেও। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী তো পাস করা গ্র্যাজুয়েট না। কিন্তু তাঁর। কথায় সব পিএইচডিরা, জেনারেলরা ওঠবস করে। এটাকেই বলা হয় গণতন্ত্র। আপনি যে ইয়াহিয়া খানের মতো একটা অশিক্ষিত মিলিটারিম্যান, যে ২৪ ঘণ্টা মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে পড়ে থাকে, তার আনুগত্য প্রকাশ করতে এসেছেন, এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে আপনার মানসিকতাই গণতান্ত্রিক। নয়। আপনি শিক্ষিতও নন।

রাজিয়া ফয়েজ চুপ করে গেলেন।

তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমি আসলে আসতে চাই নাই। আমি ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট। বুঝতেই পারছেন। আমাকে ভয় দেখিয়ে পাঠিয়েছে।

এ আর মল্লিক বললেন, আপনি ভুল করেছেন। বাংলাদেশ আর কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি মিলিটারির মনোবল যে

তলানিতে ঠেকেছে, সেটা আপনি টের পান না?,

হ্যাঁ। ট্রাকে ট্রাকে মিলিটারির ডেডবডি যাচ্ছে, আমি দেখেছি। ট্রাকের নিচ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে। রাস্তায় পড়ে থাকে। সেসব লাশ কফিনে পুরে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আপনি অনেক বড় ভুল করেছেন। যান, দেশে চলে যান।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, ১৬ ডিসেম্বরের পর শাহ আজিজ, রাজিয়া ফয়েজরে জেলে ভরা হয়। আর বীর উত্তম জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হইয়া হ্যাঁগো মন্ত্রী বানান। শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী, রাজিয়া ফয়েজ মহিলা মন্ত্রী। আরেক রাজাকার মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে প্রথমে বানান হইছিল সিনিয়র মিনিস্টার। জিয়াউর রহমানের সমস্যাটা আছিল কী?

৬৬

শেখ কামাল প্যারেডে লাইনে দাঁড়ানো। তার পরনে খাকি ইউনিফর্ম। আজ তারা সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের ব্যাজ লাভ করবেন। তাদের ওয়ার কোর্স মিলিটারি ট্রেনিং শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা বেশ উত্তেজিত। বন্ধুদের সবাই। এত দিন একসঙ্গে ছিলেন। কারও নাম প্যাঁচা, কারও চিপা, কারও নাম চিকা। মজাই হয়েছে এই ট্রেনিংয়ে। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজনে ১৮ সপ্তাহের ট্রেনিংকে ১৫ সপ্তাহে কমিয়ে আনতে হয়েছে। এখান থেকে সবাই যুদ্ধের ময়দানের চলে যাবে। এই কোর্সে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সাইদ।

বড় দুটো ঝোলানো গোঁফ, মাথায় গোল ক্যাপ, ফুলহাতা জলপাই রঙের জামা, আর ট্রাউজার পরা সেনাপ্রধান ওসমানী আগেভাগে এসেছেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিপরিষদ চলে এসেছে। সৈয়দ নজরুল প্যারেড পরিদর্শন করে সালাম গ্রহণ করলেন। তারপর সাইদ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করলেন।

সৈয়দ নজরুল ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, বর্ষাকালে আমাদের যুদ্ধকৌশল ছিল হিট অ্যান্ড রান। এবার আমরা প্রস্তুত। এবার আমরা সব রণাঙ্গনে একযোগে হামলা করব। সম্মুখযুদ্ধ করে শত্রুবাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করব। আমাদের জেন্টলম্যান ক্যাডেটদের পরের ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সে কুচকাওয়াজ হবে ঢাকায়। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে মর্যাদা নিয়ে আছে, আর চিরদিনই থাকবে।

তাজউদ্দীন আহমদও বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনব খুব শিগগিরই। আর তা করব যুদ্ধে জয়লাভ করার মাধ্যমে। আমরা স্বাধীনতাও আনব, বঙ্গবন্ধুকেও আনব। সেই যুদ্ধ জয়ে আজকের সদ্য উত্তীর্ণ জেন্টলম্যান ক্যাডেট যারা সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হলেন, তারা হবেন আমাদের অনেক বড় হাতিয়ার। আপনারা ইতিহাসের অংশ, কারণ আপনারা আমাদের বাংলাদেশ আর্মির প্রথম ব্যাচ। আপনাদের আমি বলব, আমরা দেশপ্রেমিক হব, আদর্শ সৈনিক হব, কিন্তু আমাদের আদর্শ মানুষ হতে হবে। আপনারা নারী ও শিশুদের প্রতি সম্মান দেখাবেন। সে আমাদের মিত্রপক্ষের হোক, বাঙালি হোক, অবাঙালি হোক, শত্রুপক্ষের হোক, নারী ও শিশু মানেই সম্মানের। তাদের রক্ষা করতে হবে। আর আপনারা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাবেন, তখন রাজাকারদের এবং ক্ষুদ্র কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সময় নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবেন। দুই ধরনের রাজাকার আছে। এক ধরনের হলো, রাজনৈতিক কারণে রাজাকার হয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষ, স্বাধীনতার শত্রু, আদর্শের কারণে রাজাকার, আলবদর, আলশামসে যোগ দিয়ে সীমাহীন নিষ্ঠুরতা করছে। আরেক ধরনের লোক আছে, গরিব মানুষ, অশিক্ষিতও, তারা জানে না, তারা কেন এটাতে গেছে, শুধু দিনের শেষে ভাতা পায়, রেশন পায়, একটা চাকরি জুটেছে, এই ধরনের রাজাকার। আপনারা জানেন কি না জানি না, বহু রাজাকার অস্ত্রসমেত মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দলে চলে এসেছে এবং তারা দেশের জন্য ভালো লড়াই করছে। কাজেই বিচার-বিবেচনা দিয়ে কাজ করবেন।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে শেখ কামাল গেলেন তার চাচাঁদের সালাম করতে। সৈয়দ নজরুল বললেন, কামাল, কংগ্রাচুলেশনস।

থ্যাংক ইউ চাচা।

তাজউদ্দীন বললেন, তুমি কলকাতা এসে আমার সঙ্গে কথা বলো। ওসমানী সাহেবের এডিসি হিসেবেই কাজ করতে থাকো।

আমি তো যুদ্ধ করতে যেতে চাই, চাচা।

এটাও তো অনেক বড় যুদ্ধ–তাজউদ্দীন বললেন, তোমার নিরাপত্তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। তোমাকে কাছছাড়া করলে আমরা বড় টেনশনে থাকব।

আব্বার নাকি মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। জানেন কিছু?

এ রকম খবর জয় বাংলা পত্রিকাতে এসেছে বটে। তবে আমাদের কাছে খবর হলো, বিচার এখনো শেষ হয়নি আর রায়ও হয়নি। মুজিব ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করার সাহস ইয়াহিয়া খানের হবে না। আমাদের কাছে এই খবর আছে–তাজউদ্দীন বললেন।

মন্ত্রীরা চলে গেলেন। ৬০ জন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। তাঁদের বিশেষ বিমানে করে কলকাতায় পাঠানো হলো।

ওসমানী সবাইকে পোস্টিং দিলেন। সবাই চলে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে।

কামালকে নিজের কাছেই রাখলেন তিনি।

.

ওসমানীর এডিসি কামাল জানেন কার কোথায় পোস্টিং হচ্ছে। শচীন যাচ্ছেন ৯ নম্বর সেক্টরে। কামাল একটা চিঠি লিখলেন। তাতে সেক্টর কমান্ডারকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন তার চাচা শেখ নাসেরের পরিবারের দিকে খেয়াল রাখা হয়।

.

তাজউদ্দীন আহমদ মুরতি ক্যাম্প থেকে গেলেন রংপুর-দিনাজপুরের

মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আর মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করতে।

১০ অক্টোবর ১৯৭১ সালের দিনটা ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। আশ্বিন মাস, শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। বুড়িমারীতে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের গেরিলাদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে সালাম নিলেন তিনি। ভাষণে বললেন, আমাদের চূড়ান্ত মুক্তির দিন এসে গেছে। এবার আমরা চূড়ান্ত হামলা পরিচালনা করব। দেশের এক ইঞ্চিও আর শত্রুর পদানত থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সব ঘরে ঘরে উড়বে। আর তা ওড়াবে তোমরাই।

এরপর তিনি ক্যাম্পের ভেতরে একটা শামিয়ানার নিচে বসলেন। পরনে একটা গাঢ় রঙের ফুলহাতা শার্ট, তাতে বোতামসহ শোল্ডার স্ট্র্যাপ, পায়ে কেডস। মাথায় ক্যাপ। তাঁকে দেখতে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাই লাগছে। উইং কমান্ডার বাশার তাঁকে বললেন, আপনার জন্য দুপুরের খাবার রেডি।

তাজউদ্দীন বললেন, যোদ্ধারা খেয়েছে?

ওরা খাচ্ছে।

তাজউদ্দীন শামিয়ানার নিচ থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পের ব্যারাকগুলোর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দুই ধারে খড়ের চালা, বাঁশের বেড়ার ব্যারাক। একটা গাছের নিচে তরুণ গেরিলারা মাটিতে বসে টিনের থালায় খাচ্ছে। আজকে একটু উন্নত মানের খাবার। প্রত্যেকের জন্য দুই টুকরা করে মাংস, ডাল। তিনিও একটা টিনের থালা হাতে তুলে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভাত-তরকারি নিয়ে যোদ্ধাদের পাশে গিয়ে বসলেন। দুপাশে বসা দুই তরুণ খাওয়া ভুলে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি দুজনের পাতে নিজের পাতের মাংস তুলে দিয়ে বললেন, খাও। তুমিও যোদ্ধা। আমিও যোদ্ধা। তুমি কি জানো, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত?

ছেলেটা কথা ভুলে গেছে।

তাজউদ্দীন মুখের ভাত চিবিয়ে নিয়ে বললেন, ৭ কোটি ৩০ লাখ। সাড়ে সাত কোটি থেকে কুড়ি লাখ এরই মধ্যে শহীদ হয়েছেন। তাঁরা শহীদ। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা সবাই একই মায়ের পেট থেকে হয়েছি। বাংলা মা। আমরা সবাই ভাইবোন। সবাই সমান। নাও খাও।

তাজউদ্দীন হাঁটছেন। সঙ্গে এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নেতা, এমএনএ, যুব শিবিরের সংগঠকেরা। তিনি পায়ে চলা পথ ধরে ধানখেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। শরতের এই দৃশ্যটা অপূর্ব। দুই পাশে ধানখেতে বাতাস বয়ে চলেছে। আজি ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা। বড়খাতা রণাঙ্গনে চলেছেন তাঁরা। হিমালয়ের কাছে এই এলাকায় এরই মধ্যে শীতের বাতাসও বইতে শুরু করে দিয়েছে। মর্টার আর রাইফেলের আওয়াজও কানে আসছে। তারা গিয়ে পৌঁছালেন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স লাইনে। সারি সারি বাংকার। মেশিনগান পোস্টের পেছনে বাংলার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। তাদের শক্ত চোয়াল, কোটরাগত চোখে বিদ্যুতের ঝলক। রাইফেল কাঁধে সদা প্রস্তুত সারি সারি যোদ্ধা। দুরবিনের পেছনে চোখ রেখে দূরে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করছেন একজন।

পায়ে চলা পথ দিয়ে একসার গ্রামবাসী বাক কাঁধে দুই পাশে বড় বড় হাঁড়ি ঝুলিয়ে চলেছে।

তাজউদ্দীন বললেন, ওদের কাঁধে কী?

স্থানীয় লোকজন বললেন, বাউংকা।

ওর মধ্যে হাঁড়িতে কী?

খাবার। গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের পোস্টে পোস্টে খাবার পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন। এখানে তো ক্যাম্প থেকে এত মাইল দূরে খাবার এনে দেওয়া সম্ভব না। সবখানেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যখন গ্রামে যান, হাইড আউটে থাকেন, গ্রামবাসী জানামাত্রই তাদের জন্য খাবারদাবার দিয়ে যান। দেশবাসী সাধারণ মানুষেরা যে কী সাপোর্ট দিচ্ছেন আর কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করছেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

তাজউদ্দীনের চোখে জল এল। তিনি বাংকারে বাংকারে গেলেন, প্রতিটা যোদ্ধাকে জড়িয়ে ধরলেন। একটা অল্পবয়সী ছেলের হাতে সাব-মেশিনগান। তাজউদ্দীন বললেন, এই খোকা, তোমার বয়স কত?

আঠারো।

না, তুমি আঠারো নও। তুমি ফিরে যাও। ক্যাম্পে গিয়ে সবাইকে সাহায্য করো। তোমার যুদ্ধের ময়দানে আসার দরকার নাই।

ছেলেটা কেঁদে ফেলল। বলল, স্যার মুই যুদ্ধ করুম। মোক ফেরত না পাঠাইবেন, স্যার। মোক বাদ না দিবেন।

তাজউদ্দীন তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেউ তোমাকে ফেরত দেবে না। থাকো তুমি।

সেক্টর কমান্ডার বাশার জানালেন, এই ছেলে সাতটা যুদ্ধে অসমসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।

যুদ্ধের মাঠে প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মুক্তিবাহিনী চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মুজিব ব্যাটারি, বাংলার আর্টিলারি বাহিনী, কাঁধে মর্টার নিয়ে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ে থাকে, তারা তাদের দক্ষতা দেখানোর এই সুযোগ ছাড়বে কেন। তারা মর্টার চার্জ করল। ভীষণ শব্দ হলো। তাজউদ্দীন বাইনোকুলার চোখে লাগালেন। চার শ গজ দূরে শত্রুর বাংকার। সেখানে তাদের নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে।

আবার হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পের দিকে ফিরছেন তাজউদ্দীন। মুক্ত অঞ্চলের গ্রামবাসী খবর পেয়ে ছুটে এসেছে পথের ধারে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ। তারা স্লোগান দিচ্ছে জয় বাংলা। তিনি পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। আমরা জয়লাভ করতে যাচ্ছি। আপনাদের দুঃখের দিন শেষ হতে চলেছে। দোয়া করবেন। জয় বাংলা।

রাত আটটায় পৌঁছালেন পাটগ্রাম। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে তার জন্য। তিনি জনসভায় ভাষণ দিলেন। জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত।

পাটগ্রাম বেশির ভাগ সময় মুক্ত। এখানে বাংলাদেশ সরকারের অধীনেই সব চলছে। পোস্ট অফিস আছে, পুলিশ স্টেশন, বালিকা বিদ্যালয়, আওয়ামী লীগ অফিস। এখান থেকে পত্রিকা বের হয়। আর আছে এদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল।

রাতের বেলা তারা খাওয়াবেই। তাজউদ্দীন মুক্ত অঞ্চলে বসে সবার সঙ্গে খেলেন। এবার তাঁরা জিপ নিয়ে যাবেন বুড়িমারী। সেখানেই ক্যাম্পে রাত কাটানোর প্ল্যান। কিন্তু পাটগ্রামবাসী ধরে বসেছে। তাদের আছে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ। তারা অনেক রিহার্সাল করে রেখেছে। তাদের বড় শখ : প্রধানমন্ত্রীকে তারা অনুষ্ঠান দেখাবেন।

তাজউদ্দীন রাতে থাকলেন হাশর উদ্দীন উচ্চবিদ্যালয়ে। সকাল আটটায় থানা মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। প্রধানমন্ত্রী বসে পুরো অনুষ্ঠান। দেখলেন। গণহত্যা এবং বাংলার প্রতিরোধ নিয়ে শিল্পীরা একটা গীতিনকশা

পরিবেশন করলেন। প্রথমে রংপুর বেতারের ভাওয়াইয়া শিল্পী মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীন গলা খুলে গাইতে শুরু করলেন :

দেশ হামার স্বাধীন বাংলারে,
হামার জন্মস্থান এই দেশেতে,
মহান নেতা মুজিবুর রহমানরে।

কারার ওই লৌহ কবাট, রুখে দাঁড়াও, রুখে দাঁড়াও থাকিতে প্রাণ, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, ছোটদের বড়দের সকলের, আবার আসিব ফিরে, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে…একের পর এক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গাইলেন তাঁরা।

সবশেষে শিল্পীরা গাইতে শুরু করলেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…।

সবাই দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে গলা মেলালেন। এ এমন একটা গান, যেটা গাইতে গেলে চোখের পানি আটকানো যায় না।

আবার জিপে চড়ে তারা ছুটলেন ভূরুঙ্গামারী ফুলবাড়ী রণক্ষেত্রে। ভূরুঙ্গামারী যাওয়ার পথে গাড়িবহরের একটা জিপ রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে গেল পাশের খাদে। তাতে ছিলেন ক্যামেরাম্যান আসিফ আর আলম। তাজউদ্দীন বললেন, জিপ থামান।

তাঁরা নেমে ছুটতে লাগলেন জিপের দিকে। একগলা পানি থেকে আসিফ, আলম, ড্রাইভার উঠে এলেন ডাঙায়। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমরা ভালো আছি। তাঁদের জড়িয়ে ধরলেন তাজউদ্দীন। তাঁর নিজের কাপড় ভিজে যেতে লাগল।

ভূরুঙ্গামারী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তারা যখন পৌঁছাচ্ছেন, তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে একটা ডিমের কুসুমের আকার নিয়েছে, আকাশে সার বেঁধে পাখি উড়ে উড়ে ফিরে যাচ্ছে নীড়ে, গরুর দল নিয়ে রাখাল বাড়ি ফিরছে, গরুর খুরে খুরে ধূলি উড়ছে। ভূরুঙ্গামারীতে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে তাজউদ্দীনের জন্য। সেখানে তাঁকে ভাষণ দিতে হলো। গেলেন ক্যাম্পে। হাত মেলালেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে।

রাতের বেলাই তিনি চললেন ডিফেন্স লাইনে। নেতারা বললেন, না, যাওয়ার দরকার কী! দুই মাইল দূরেই পাকিস্তানি ডিফেন্স লাইন। যেকোনো

সময় মর্টারের হামলা হতে পারে। তাজউদ্দীন বললেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা থাকতে পারলে আমি যেতে পারব না কেন?

ওরা তো আছে বাংকারে, ট্রেঞ্চে, নিজেদের আড়াল করে রেখে।

আরে চলেন। কিছু হবে না।

হাঁটাপথে চলেছেন সবাই। পথের মাঝখানে একটা খরস্রোতা নদী। এটা পার হতে হবে ভুরায় চড়িয়া। ভুরা মানে কী? ভেলা।

কলাগাছের পালা আছে পাড়ে বাধা। তাজউদ্দীন সেই ভেলায় উঠলেন। নদীর মাঝখানে গিয়ে তীব্র স্রোতে ভেলা ঘুরতে লাগল। দুই মুক্তিযোদ্ধা এক হাতে স্টেনগান উঁচু করে ধরে নেমে গেলেন পানিতে, আরেক হাত দিয়ে ভেলা সোজা করে ধরে রাখলেন। লগি ঠেলে ভেলা পার করা হলো।

তিনি চলে গেলেন বাংকারে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।

রাতের বেলা থাকলেন ভূরুঙ্গামারীতে। খুব ভোরে উঠে তাঁরা রওনা হলেন। তেঁতুলিয়ার দিকে। সাড়ে তিনটা বেজে গেল তেঁতুলিয়া পৌঁছাতে। দুপুরের। খাবার খেয়ে নিয়ে চললেন যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রীকে পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গার্ড অব অনার দিল। তিনি তাদের বললেন, এর আগে যখন এসেছিলাম, তখন আপনারা ছিলেন অনেকটা পেছনে। আজকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক ভেতরে চলে এসেছি। আমাদের কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা দেশ শত্রুমুক্ত করব। শোষণহীন ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলব।

ভাষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা আবার তাদের বাংকারে বাংকারে পজিশন নিলেন। তাজউদ্দীন তাঁদের পেছনে পেছনে হেঁটে বাংকার পর্যন্ত গেলেন। দেখতে পেলেন, পানিতে বাংকার ভরে আছে। সেখানেই কোমরপানিতে পজিশন নিয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

সকাল হলো। তাজউদ্দীন গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে। তিন সপ্তাহের ট্রেনিং নিচ্ছে সাড়ে তিন হাজার গেরিলা। তারা তাদের চানমারি প্র্যাকটিস দেখলেন। গুলি করছে কিশোর, তরুণ, যুবকেরা। প্রায় সবার গুলিই লক্ষ্য ভেদ করছে। তিনি যুবাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলেন। বিকেলে গেলেন ফিল্ড হাসপাতালে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা হচ্ছে এখানে। কারও হাত নেই, কারও পায়ে প্লাস্টার। কারও পেটে গুলি লেগেছিল, অপারেশন করে বের করা হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে তাজউদ্দীন চোখ মুছতে লাগলেন।

তাজউদ্দীন একজনের বেডের পাশে বসলেন। তার দুটো হাতই উড়ে গেছে। তিনি বললেন, বলেন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?

তিনি বললেন, আমি যা চাই, আপনি দিতে পারবেন?

বলেন।

আমার হাত দুটো জোড়া দিয়ে দিন। আমি আবারও যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাব। হানাদার পশুদের শিক্ষা দেব।

দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে চমকে উঠলেন তাজউদ্দীন। এই তোমাদের না বড়খাতা রণাঙ্গনে দেখে এলাম? এখানে এসেছ কেমন করে?

কেমন করে এসেছি তা তো জানি না স্যার। আমরা আরও ভেতরে শত্রুর অবস্থানে অ্যাটাক করতে গিয়েছিলাম। ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছি। আমাদের একজন শহীদ হয়েছে। আর আমরা দুজন গুলি লেগে অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি এই হাসপাতালে।

বাঁশের বেড়া, ওপরে ঘরের চাল, এই হলো হাসপাতাল।

তাজউদ্দীন বললেন, আপনাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে বলছি। আপনাদের সবার নাম-ঠিকানা আমরা রেকর্ড রাখছি। দেশ শত্রুমুক্ত হলে

অবশ্যই আমি আপনাদের খোঁজখবর রাখব। আপনাদের পাশে থাকব!

৬৭

ব্যাঙ্গমা বলে, খালেদ মোশাররফ আছিলেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেরিলার চোখে স্বপ্নের নায়ক।

ব্যাঙ্গমি বলে, ৩৪ বছরের খালেদ মোশাররফ জন্ম নেন জামালপুরের একটা গ্রামে, যেই গ্রামের নামই মোশাররফগঞ্জ, খালেদের বাবা পাট ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেনের নাম অনুসারে।

ব্যাঙ্গমা বলে, খালেদ কক্সবাজারে তার মামার বাড়িতে চইলা যান। লেখাপড়া করতে, কক্সবাজার স্কুল থাইকা ম্যাট্রিক পাস করেন, উচ্চমাধ্যমিক করেন ঢাকা কলেজ থাইকা। স্কুলে থাকতে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিছিলেন, কক্সবাজারের রাস্তায় মিছিল করে স্লোগান দিতেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। কলেজে থাকতে ছাত্রলীগের প্যানেল সেক্রেটারি হন, সেইটা ১৯৫৩-৫৪ সালে। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।

ব্যাঙ্গমি বলে, তার পরিবার আওয়ামী লীগ করত, তাঁর ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করে ১৯৭৩ সালে সাংসদ হইবেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, খালেদ মোশাররফ আছিলেন স্বাধীনচেতা, খাঁটি জাতীয়তাবাদী। তিনি সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মতিনকে কইছিলেন, মতিন, তোমার স্ত্রীরে কইছ তো, সন্তান হইলে তাগো মুক্তিযুদ্ধে পাঠাইতে হইব? মতিন কইছিলেন, কইতে হইব না। আমার স্ত্রী এইটা ভালোভাবেই জানেন। খালেদ আরেক দিন রাইতের বেলা মতিনরে কইলেন, মতিন, হারিকেন ধরো। বাথরুম যাব। তারপর তারা অন্ধকার পাহাড়ি পথে হাঁটছেন। খালেদের হাতে লাঠি। মাঝপথে থাইমা খালেদ কইছিলেন, মতিন, কও তো, আমগো দেশ যখন স্বাধীন হইব, আমগো প্রধান শত্রু হইব কে? তারপর হাতের লাঠিটা আগরতলার মাটিতে চুইকা তিনি দেখায়া দিছিলেন, ভবিষ্যৎ সমস্যাটা কার সঙ্গে হইব।

ব্যাঙ্গমা বলবে, তা-ও ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর পর ৭ নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের অনুগত সৈনিকেরা খালেদ মোশাররফরে, আর আরও দুই হিরো হায়দার আর হুদারে গুলি কইরা মারছিল মাঠে নিয়া গিয়া এই ধুয়া তুইলা যে এরা রুশ-ভারতপন্থী।

ব্যাঙ্গমি বলবে, নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দীন সরকারের প্রথম দিকের সিদ্ধান্ত আছিল, মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং আর অস্ত্র শুধু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের দেওয়ার জন্য। বামেগো হাতে অস্ত্র ট্রেনিং গেলে তারা নকশালি হইয়া যাইতে পারে, এই আছিল ভয়। কিন্তু খালেদ মোশাররফ তাঁর ক্যাম্পে ছাত্র ইউনিয়নের উভয় অংশসহ সব দল মত আর দলনিরপেক্ষ তরুণগো ট্রেনিং দিতে থাকেন হাজারে হাজারে। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে এদের দেওয়া হয় গেরিলা ট্রেনিং। পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করতে। রুমি, বদি, বাকের, জুয়েল, হাবিবুল আলম, কাজী কামালগো মতো গেরিলারা আছিল খালেদ মোশাররফের রিক্রুট।

.

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বেরিয়েছেন সীমান্ত বরাবর এক দীর্ঘ সফরে। তারা যাচ্ছেন শরণার্থীশিবিরে। তারা যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে। তাঁদের সঙ্গে আছেন ব্যারিস্টার আমীর।

সকালবেলা। আকাশে মেঘ। ছাইরঙের মেঘে বৃষ্টির পূর্বাভাস। গাড়িবহর ছুটে চলেছে মেলাঘর ক্যাম্পে। ঘন বনের মধ্যে আঁকাবাকা মাটির পথ। সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন একটা জিপে। পেছনে তাদের নিরাপত্তাকর্মীরা বসা। আরেকটা জিপে ব্যারিস্টার আমীর। সঙ্গে সাংবাদিক। আরও জিপে পাবলিক রিলেশন বিভাগের কর্মীরা। আরেক গাড়িতে নিরাপত্তারক্ষীরা।

গেটে তাদের সালাম জানালেন মেজর হায়দার। তারা আরও ভেতরে চললেন।

বাঁশের তৈরি ব্যারাক। খড়ের চাল।

মেজর খালেদ মোশাররফ ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন একটা গাছের নিচে। তার অফিসে রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।

তিনি নেতাদের স্যালুট করলেন। করমর্দন করে তার ছাউনিতে নিয়ে গেলেন।

খালেদ বললেন, চলেন, যুদ্ধের মাঠে যাই।

তাজউদ্দীন বললেন, চলেন।

জঙ্গলের মধ্যে হাঁটছেন খালেদ। তার গায়ে জলপাই রঙের শার্ট। ধূসর রঙের প্যান্ট। পায়ে বুট জুতা। হাতে একটা লাঠি। তিনি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের হাতেও একটা করে স্টিক দিয়েছেন, যাতে চলতে সুবিধা হয়। তারা খালেদকে অনুসরণ করছেন। এই পথের মধ্যে কাটাগাছ। সেসব মাড়িয়ে সবাই এগোচ্ছেন।

সীমান্ত পেরিয়ে তারা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকলেন। সুন্দর ছিমছাম গ্রাম। গ্রামের অধিবাসী সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু। গ্রামের পথের দুই ধারে বর্ষার জলে ভরা পুকুর। গ্রামের নারীরা এসেছেন পানি নিতে। কলসি কাঁখে তারা আসছেন, যাচ্ছেন। পাশ দিয়ে বড় বড় মর্টার হাতে যাচ্ছে এক সারি মুক্তিযোদ্ধা। একটু দূর থেকে গোলার শব্দ আসছে। তারা একটা আমবাগানের মধ্যে ঢুকলেন। তারপর দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধাদের কামানের পোস্ট। আমবাগানের ভেতরে অনেক বড় কামান বসানো হয়েছে। পুরোনো আমলের কামান, কিন্তু বেশ শক্তিশালীই মনে হচ্ছে। বাঙালি গোলন্দাজরা লুঙ্গি পরা। গায়ে গেঞ্জি। তারা ফায়ার করছে।

খালেদ বললেন, স্যার, আসেন। কামানের সামনে যাই।

সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, আমীরসহ দলটি কামানের সামনে চলে গেল। গোলা ছোঁড়া হলো। মাথার ওপর দিয়ে কামানের গোলা যাচ্ছে। আকাশ বিদীর্ণ করে শব্দ হচ্ছে। সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দীনের বাহুতে খামচি মারলেন।

খালেদ বললেন, সামনে যে পাহাড়টা আছে, চলেন, সেটায় উঠি। তাহলে পাকিস্তানিদের পোস্ট দেখতে পাবেন।

পাহাড়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। খালেদ তো অভ্যস্ত। অনায়াসে ওপরে উঠছেন। সৈয়দ নজরুল লাঠিতে ভর দিয়ে সাবধানে পা ফেলছেন। তাজউদ্দীন-আমীর উঠলেন আরেকটু স্বচ্ছন্দ গতিতে।

পাহাড়ে উঠে নিচে দূরে পাকিস্তানি মিলিটারির পোস্ট আর পজিশন দেখা গেল। খালেদ বাইনোকুলার দিলেন প্রেসিডেন্টকে। প্রধানমন্ত্রীকে। তারপর বলতে লাগলেন, ওই দেখুন। ওরা নড়াচড়া করছে। ওই দেখুন। ওই রেস্টহাউসটা। ওইটা ওদের হেডকোয়ার্টার।

পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কামান দাগছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর মাথার ওপর দিয়ে কামালের গোলা গিয়ে শত্রুর অবস্থানের কাছে পড়ছে।

খালেদ বললেন, আমরা চট্টগ্রাম, কুমিল্লা রোড অচল করে রেখেছি। ওই দেখুন। ওইটা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা হাইওয়ে। কোনো যানবাহন নাই।

আচ্ছা চলেন এবার ফিরে যাই।

তারা পাহাড় থেকে নামলেন। আবার জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটে এলেন ক্যাম্পে। দুপুরে একসঙ্গে খেলেন তারা। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন গাফফার চলে এসেছেন একটা ছোট্ট বাহিনী নিয়ে। ঢাকার ছেলে পাশাও আছে এই দলে। তারা কসবা এলাকায় যুদ্ধ করে করে ফিরলেন।

সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, আমীর মুগ্ধ হয়ে শুনছেন গাফফারের কাছ থেকে রণাঙ্গনের কথা।

বিকেলে অতিথিরা চলে গেলেন আগরতলা সার্কিট হাউসে।

পরদিন সকালবেলা তাঁরা বিমানে উঠবেন। সামরিক মালবাহী বিমান। খালেদ এলেন সকাল সকাল। নেতাদের বিদায় জানাবেন। তিনি জানালেন, কোথায় কোথায় তাদের অসুবিধা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কোথায় সমস্যা। আওয়ামী লীগ করে না, এমন ছেলেদের রিক্রুট করে যে তিনি সুবিধা পাচ্ছেন, তা-ও জানালেন।

তবে জানা গেল, মুজিববাহিনী মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা ও ভুল-বোঝাবুঝি মিটে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের এই মনোভাব সম্পর্কে আমার জানা আছে। তারা লেফটিস্টদের রিক্রুট করতে চায় না। আপনি আপনার মতো কাজ করুন। আপনার ওপরে আমাদের আস্থা আছে। তবে নকশাল একটা বাস্তব সমস্যা। মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুটের সময় অবশ্যই স্ক্যানিং করতে হবে। তা না হলে পাকিস্তানি মিলিটারিদের চরেরাও এসে ঢুকে যেতে পারে। এটা আপনি আমার চেয়ে ভালো বুঝবেন। আপনি আপনার নিজের বিবেচনা প্রয়োগ করবেন।

হাজি হাশেম কুমিল্লা এলাকার একজন এমএনএ। তিনি তাঁর নিজের জিপ নিয়ে এসে শরণার্থীশিবির থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে দিবারাত্রি শ্রম ও

সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। হাজি হাশেম একজন শিল্পপতি। জবা টেক্সটাইলসমেত বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল এবং হারিকেনের ফিতা বানানোর কারখানা আছে তার। দানশীল ব্যক্তি। নিজের জমানো টাকা সব নিয়ে এসে আগরতলার শরণার্থীশিবিরে আর মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে দান করে দিচ্ছেন। বয়স ৪৫-৪৬ হবে।

হাজি হাশেম বললেন, আমি তো আগরতলার থানা থাইকা কত ছেলেরে যে। বাইর কইরা আইনা ট্রেনিং ক্যাম্পে দিছি, কোনো ঠিক আছে? গিয়া কইছি, আটকাইছেন ক্যান? ইন্ডিয়ান পুলিশ কয়, পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করে। আমি কই আরে মিয়া, ওইটা আমার ছাত্রলীগের পোলা। অরে ছাড়েন। কইয়া নিয়া আইছি। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। মুখে অহনো দুধের গন্ধ। পরে জিগাই, ওই মিয়া ছাত্র ইউনিয়ন করো? অরা কয়, ছাত্র ইউনিয়ন তো ছাত্র ইউনিয়ন, কোনো ইউনিয়নও জীবনে করি নাই। শাহিন স্কুলে, রেসিডেনসিয়াল স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। টেনে পড়ি। রাজনীতি বুঝি না। দেশ বুঝি। স্বাধীনতা বুঝি। বঙ্গবন্ধুর হুকুম বুঝি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।

তাজউদ্দীন হাজি হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সত্যি, ট্রেনিং ক্যাম্পে, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনি অনেক কিশোরকে দেখেছেন।

খালেদ মোশাররফ বললেন, আমি ঢাকার ছেলেদের ঢাকার ভেতরে পাঠিয়েছি। ওদের বলেছি, আরবান গেরিলা। ঢাকা শহরকে অস্থির করতে না পারলে পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো যাবে না যে যুদ্ধ চলছে।

তাজউদ্দীন বললেন, আমরা খবর পাচ্ছি। আপনার ছেলেরা ঢাকা শহরকে আতঙ্কের শহর বানাতে সক্ষম হয়েছে। গ্রেট জব ইন ডিড।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, মালেক উকিল সবার সঙ্গে দেখা হলো। নেতারা সামরিক মালবাহী বিমানে উঠে বসলেন।

খালেদ মোশাররফ তাঁদের স্যালুট দিয়ে বিদায় দিলেন।

৬৮

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরও এক পেগ হুইস্কি বরফ ছাড়াই ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। তার পা টলছে। জিব জড়। কিন্তু তার মাথা ঠিক আছে। তার সামনে বসে আছেন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নি। পারসোপলিস, ইরান। পারস্য সাম্রাজ্যের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে ইরানের শাহ এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করেছেন ছবির মতো সুন্দর এই শহরে। সারা পৃথিবীর রাজা, রানি, রাজকন্যা, রাজপুত্র প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী এতে যোগ দিয়েছেন। ৬০০ জন বিশ্ব ভিআইপির উপস্থিতিতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার নৈশভোজ গিনেস রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিল। তার মধ্যেও ইরানের শাহ পাকিস্তান আর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টকে আলাদা করে বসিয়ে দিলেন। এদের দুজনের মধ্যে বৈঠক হওয়া খুব জরুরি।

ইয়াহিয়া খানকে পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খান বললেন, স্যার, আর খাবেন না। এই মিটিংটা খুব জরুরি।

ইয়াহিয়া খান বললেন, ইয়েস। ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট। এই জন্য আমাকে আরেক পেগ খেতে হবে। কারণ, না খেলে আমার মাথা খুলবে না।

তিনি আরেক পেগ খেলেন ঢকঢক করে। আহ, ইরানের মেয়েগুলো এত সুন্দর কেন!

প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি তাঁকে বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান কবে করতে পারবেন বলে আশা করছেন?

ইয়াহিয়া খান বললেন, পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সমস্যা নেই। আমি উপনির্বাচন করছি। যে এমএনএরা ইন্ডিয়া গেছে, তাদের পদ শূন্য করা হয়েছে। সেসবে নির্বাচন হবে। তারপর শাসনতন্ত্র হবে। তারপর আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেব। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেব। তবে কিছুই হচ্ছে না, কারণ ইন্ডিয়া অ্যাটাক করছে। আমার কিছু করার নাই। যা করার তা করতে হবে ইন্ডিয়াকে। অথচ আপনি ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছেন। তারা আমার দেশে হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনি কেন আমার দেশের বিরুদ্ধে চুক্তি করলেন?

আপনার দেশের বিরুদ্ধে চুক্তি করিনি। আপনি ভারত আক্রমণ না করলে এই চুক্তি আপনার দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। আর আপনি কাদের জনপ্রতিনিধি বলছেন। আপনার কথা বলতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আপনি তাকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করুন। তাহলেই তো সমস্যা মিটে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল। তিনি পরপর তিন কে মদ খেয়ে নিলেন। তাঁর কান জ্বলতে লাগল। তিনি বললেন, শেখ মুজিব। সে তো বিশ্বাসঘাতক। সে দেশের শত্রু। আমি তার সঙ্গে কথা বলব না। আমি নির্বাচন দেব।

আপনি সময় পার করছেন। তাতে আরও আরও মানুষ মারা যাবে। আরও ঘরবাড়ি পুড়বে। যা সম্ভব নয়, আপনি তা করতে চাইছেন। এটা করবেন না। এরপর পদগোর্নি গলাটা নামিয়ে বললেন, পাকিস্তান আমারে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তার সঙ্গে আমরা সদ্ভাব বজায় রাখতে চাই। আপনার হাতে সময় কিন্তু আছে খুব অল্প।

মাতাল ইয়াহিয়া বললেন, আপনি কি ইরানের মদের প্রশংসা করবেন? এই মদ কি স্কটল্যান্ড থেকে আনা? নাকি এদের আঙুর দিয়ে, নাকি বার্লি দিয়ে তৈরি? আমি আপনাদের ভোদকাও খুব পছন্দ করি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।

পদগোর্নি ভাবলেন, লোকটাকে আমি একটা ইঙ্গিত দিলাম। সময় কম। আজকে অক্টোবরের ১২। আর বড়জোর ৬ সপ্তাহ সময় লোকটা পাবে। তারপর ইন্দিরা তাঁকে আর সময় দেবে না।

ইয়াহিয়া উঠলেন। তিনি গাড়ির জন্য এই প্রাসাদের নিচে নামলেন লিফটে। গাড়িতে উঠবেন, এই সময় পেশাবে তাঁর তলপেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। তাঁর সামনে দুটো উপায় আছে। গাড়িতে পেশাব করা। পার্কিং লটে পেশাব করা। মদ খেলেও তার মাথা পরিষ্কার। গাড়ির চেয়ে গাড়ির বাইরে পেশাব করা ভালো। তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করে জিপার নামিয়ে ছরছর শব্দ তুলে পেশাব করে দিলেন।

৬৯

তাজউদ্দীন জয় বাংলা পত্রিকা হাতে বসে আছেন তার অফিসরুমে। ৫ নভেম্বর ১৯৭১ জয় বাংলা পত্রিকার শিরোনাম করেছে, হাতে বড় বড় ফন্টে লিখে :

ডিসেম্বরের আগেই ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে। বিমান আক্রমণ উপেক্ষা। সকল রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি।

খবরে বলা হচ্ছে :

সকল রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও মৃতদেহ ফেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্রুত বেগে পলায়ন করছে। দলে দলে রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছে। যশোরে হানাদারদের তিনটি চৌকি এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট নাটোরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি দৃষ্টে আশা প্রকাশ করা যাচ্ছে, ডিসেম্বরের আগেই অধিকৃত ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা সগর্বে উড্ডীন হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্যাপক সফর শেষে মুজিবনগরে পৌঁছে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীও এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন একই কথা।

তাজউদ্দীন মাথা নাড়ছেন। যাক। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। ওসমানী সাহেবের সংবাদ সম্মেলনকে নিউজের সোর্স হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের আলাপের কোনো রেফারেন্স দেওয়া হয়নি। ভাগ্যিস।

আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা ছিল মুজিবনগরে। মানে। থিয়েটার রোডের বাড়ির সুপ্রশস্ত আঙিনায়।

তাজউদ্দীন আহমদ ভেবেছিলেন না জানি কত বড় ঝড়ই তাঁকে সামলাতে হবে। ২০ অক্টোবর সভা শুরু হলো। দেখা গেল, বড় কোনো বিরোধিতা আসছে না। এর মধ্যে দিল্লি থেকে খবর এল, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সঙ্গে কথা বলবেন। জরুরি যেতে হবে দিল্লি। কারণ, এরপরেই তিনি চলে যাবেন ইউরোপ-আমেরিকা। ২৪ অক্টোবর থেকে যাত্রা শুরু। ১৯ দিন থাকবেন না।

এই খবর ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দেওয়া হলো। বলা হলো, ২১ অক্টোবর সভা হবে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে এসে বাকিটা হবে ২৭ ও ২৮ অক্টোবর।

প্রথম দুই দিনের সভা শেষে কতগুলো প্রস্তাব পাস হলো, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলের চাওয়ার অনুবর্তী :

১. স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনোভাবে সমস্যার সমাধান করা হবে না।

২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

৩. ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে এই সভা স্বাগত জানায়। এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে শক্তিশালী করবে।

৪. ভারত যে ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করছে, এ জন্য তাদের ধন্যবাদ।

৫. সব শরণার্থীকে স্বাধীন, মুক্ত বাংলাদেশে ফেরত নেওয়া হবে।

.

তারা গেলেন দিল্লিতে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, মুজিববাহিনী বাংলাদেশ সরকার কিংবা সেনাপতির নির্দেশ মানছে না। তারা বহু জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। মুজিববাহিনীকে অবশ্যই বাংলাদেশের সেনাধ্যক্ষের চেইন অব কমান্ড এবং বাংলাদেশ সরকারের অধীনে আসতে হবে। তারা এই রকম অবাধ্যতা করতে পারছে, কারণ র তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। বাংলাদেশের নিয়মিত অফিসাররা সারাক্ষণ এই এক অভিযোগই আমার কাছে পাঠাচ্ছে।

ইন্দিরা গান্ধী ডি পি ধরকে বললেন, মুজিববাহিনীকে নিবৃত্ত করুন। আপনি ব্যবস্থা নিন। কী ব্যবস্থা নিলেন, আমাকে জানাবেন।

তাজউদ্দীনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

সৈয়দ নজরুল বললেন, আমাদের মুক্তিবাহিনী বহু জায়গা শত্রুমুক্ত করে ফেলেছে। প্রতিদিন আমরা বিজয়ের খবর পাচ্ছি। এখন কি আমরা আশা করতে পারি না যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে?

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা হাসলেন। বললেন, আমি পশ্চিমা দেশগুলো সফর করে আসি। আমি চেষ্টা করব যুদ্ধ এড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে। কিন্তু আমার মনে হয় না তা হবে। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকেই রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া আর কোনো কথা বের করতে পারছি না। আমেরিকা ব্রিটেনের কাছ থেকে পাব, এই আশা আমি করি না। তা যদি হয়, তাহলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে রাস্তাঘাট শুকানোর জন্য। আমাদের উত্তরে তুষারপাতের জন্য। এরপর একটা এসপার-ওসপার তো করতেই হবে। এখনই স্বীকৃতি দিয়ে আমি এখনই যুদ্ধ বাধাতে চাই না। আমাদের নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতারা এই কথা শুনে আকাশে ভাসতে লাগলেন। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, এটা গোপন রাষ্ট্রীয় কথা। এটা একটা স্ট্র্যাটেজিক্যাল কথা। আপনাদের গোপন রাখতে হবে। একেবারে গোপন।

কিন্তু এই সুখবর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে আলোচিত হলো। ২৭ ও ২৮ অক্টোবর। তাতে লাভ হলো এই যে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে আর কেউ কোনো কথা বললেন না। আর ক্ষতিটা হলো, এ তো বড় খবরের গোপনীয়তাটা আর বজায় থাকল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *