০৩০. একটা ছোট্ট ডাকোটা প্লেন

৩০

একটা ছোট্ট ডাকোটা প্লেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্লেন। এই উড়োজাহাজের বাইরের রংটা অদ্ভুত। সামনে-পেছনে জলপাই সবুজ, মাঝখানে গেরুয়া। দেখলেই বোঝা যায়, বিমানবাহিনীর প্লেন। এই প্লেনটা ইন্দিরা গান্ধী দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের ব্যবহারের জন্য। এখন এই প্লেনে উঠেছেন তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমীর-উল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ আর গোলোক মজুমদার। তারা। বেরিয়েছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের খোঁজে। বিশেষ রকম দরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে।

তাজউদ্দীনের মনটা ভার। তবে মাথাটা ঠান্ডা। তিনি জানেন, আওয়ামী লীগ হলো বহু নেতার বহু মতের একটা সমাবেশ। মুজিব ভাই বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন কাজ দিয়ে, কারও কাঁধে হাত রেখে, কাউকে বাড়িতে ড্রয়িংরুমে চা খাইয়ে, কাউকে ডাইনিংয়ে ভাত খাইয়ে, কাউকে দোতলার শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে নির্ভুল ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটা বিশাল পাজল, সেই পাজলের একেকটা টুকরা একেকজনের কাছে, আর প্রত্যেকে ভাবছে, সে-ই সব। একমাত্র শেখ মুজিব জানতেন, সবটা একসঙ্গে করলে কীভাবে একটা পরিপূর্ণ অবয়ব দেখা দেবে। তাজউদ্দীন আহমদ সেই পাজলের অল্প কটা অংশ সম্পর্কেই জানেন। তাজউদ্দীনকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে। তিনি যে আরও কাউকে কাউকে এই কাজে নিযুক্ত রাখেননি, তা হওয়ার নয়।

.

ব্যাঙ্গমা বলাবলি করবে :

শেখ ফজলুল হক মণিকে দিয়ে ডেকে এনে সিরাজগঞ্জের ডা. আবু হেনাকে শেখ মুজিব পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। ভারত কানেকশন তৈরি করার জন্য। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ শেখ সাহেব তাঁকে এই দায়িত্ব দেন।

.

তাজউদ্দীন ডাকোটার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। প্লেন কলকাতা থেকে উড়েছে। খুব নিচ দিয়ে যাচ্ছে। নিচের সবুজ বন-বনানী পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে গরু-ছাগলও। প্রথমে তারা নামলেন ধুবড়িতে। গোলোক মজুমদার বিএসএফের মাধ্যমে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, বর্ডারে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা বা বাঙালি মিলিটারি অফিসার থাকলে তাদের সমবেত করে রাখতে। ধুবড়িতে কাউকে পাওয়া গেল না। প্লেন। আবার উঠল, থামল শিলিগুড়িতে। সেখানে একটা ডাকবাংলোতে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের।

বিএসএফ ব্যাপক তৎপর।

গোলোক মজুমদার একে নিজে বাঙালি, বাংলাদেশ আন্দোলনে তাঁর সমর্থন হৃদয় থেকে উৎসারিত, এখন রুস্তমজির নির্দেশ পেয়ে তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দ্বিগুণ উৎসাহে।

শিলিগুড়ির ডাকবাংলোয় এসেছেন লে. কর্নেল নুরুজ্জামান আর আবদুর রউফ। তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন তাজউদ্দীন। নুরুজ্জামান সাহেব, আপনি একটা সেক্টর পরিচালনা করবেন। আমরা একটা বক্তৃতা রেডি করেছি। সেটা রেডিওতে প্রচার করা হবে। তাতে সেক্টরের কথা বলা আছে।

ফজলুল হক মণি বললেন, মামা, একটু কথা আছে।

তাজউদ্দীন এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, চলেন। ওই ঘরে যাই।

তাজউদ্দীনের মনে পড়ল সেই দিনটির কথা, যেদিন মুজিব ভাই তাদের পাঁচজন–শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাকসমেত তাজউদ্দীনকে ডেকে তার বাসার এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, কলকাতার ঠিকানাটা মুখস্থ আছে তো…

কলকাতায় এসে সেই ঠিকানায় বিএসএফের লোক পাঠানো হয়েছিল। সেই ঠিকানায় কোনো বাড়ি পাওয়া যায়নি। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে চিত্ত সুতার বলেও কেউ নেই।

মণি, তোফায়েল এসে চিত্ত সুতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এইটা র-এর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) লিংক। তারা যখন র-এর মাধ্যমে জানতে পারেন, তাজউদ্দীন এরই মধ্যে দিল্লি চলে গেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তখন তারা ক্ষিপ্ত হন।

দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে তাজউদ্দীন ভবানীপুর রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে সবার সঙ্গে দেখা করলেন। আওয়ামী লীগের নেতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যারা কলকাতায় আসতে পেরেছেন, তারা উপস্থিত থাকলেন।

সেখানে কামারুজ্জামান আছেন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আছেন। সবাই। ক্ষিপ্ত। তাজউদ্দীন কেন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর সামনে। হাজির করলেন?

মণি বললেন, এটা সরকার গঠনের সময় না। একটা বিপ্লবী কাউন্সিল করুন। সরকার না।

আমীর যুক্তি দিলেন, আমরা, নির্বাচিত বৈধ গণপ্রতিনিধিরা, সংবিধান তৈরির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আমরা কেন বিপ্লবী পরিষদ গঠন করব। আমরা সরকার করব। সংবিধান রচনা করব। জনগণ আমাদের সে ক্ষমতা দিয়েছে। আমাদের সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আমাদের সামরিক অফিসাররা সবাই আমাদের সেই রিকোয়েস্ট করছেন। সরকার ছাড়া তাদের বিদ্রোহ অবৈধ অভ্যুত্থানমাত্র। সরকার থাকলে তাঁদের বিদ্রোহ দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ। সরকার গঠন করলে ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেবে। আমরা সারা পৃথিবীকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে আবেদন জানাতে পারব আমাদের পাশে কি নিজেদের স্বাধীন করতে পেরেছে? আমরা তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করছি। না, আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করছি।

এ অবস্থায় সবার আগে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। তিনি বললেন, আমরা একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আমরা অন্য একটা দেশে এসেছি। আমাদের একজনই নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু। তাঁকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না। তিনিই আমাদের সর্বাধিনায়ক। তিনিই। প্রেসিডেন্ট। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী কে হলো না হলো তা নিয়ে নিজেরা বিবাদ করলে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব। লক্ষ শহীদের অবমাননা করব। এর চেয়ে যা হয়েছে, তা আমরা মেনে নিই। দেশ শত্রুমুক্ত করি। বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনি। কামারুজ্জামান তাঁকে সমর্থন দিলেন। যুব নেতারাও নরম হলেন। তাঁরা রাজি হলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়বেন সীমান্তে সীমান্তে।

.

শিলিগুড়ির বাংলোয় তখন সন্ধ্যা। অনেক গাছপালাঘেরা বাংলোটা একটা টিলার ওপরে। শেখ ফজলুল হক মণি আর তাজউদ্দীন একটা ঘরে। ঘরের দেয়ালের দুই দিকে দুইটা গোল বাল্ব হলুদ আলো দিচ্ছে। মাথার ওপরে একটা ফ্যান ঘুরছে।

মণি বললেন, মামা, আপনার রেডিওর বক্তৃতাটা থামান।

তাজউদ্দীন বললেন, বক্তৃতার কপি আমার কাছে আছে। তুমি দেখে দিতে পার।

মণি বললেন, আপনার ভাষণ ভালো হবে। এতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। আপনি তো ড্রাফট কম করেন নাই। মামার বহু বিবৃতি আপনার লেখা। সমস্যা হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সভা না ডেকে, বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মামার মত না নিয়ে আপনি তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন না। নজরুল মামা তো ডেপুটি লিডার। বঙ্গবন্ধু লিডার।

তাজউদ্দীন লাল হয়ে গেলেন। হলুদ আলোয় তাঁর রক্তিম গণ্ডদ্বয় খয়েরি দেখা গেল।

তিনি বললেন, আচ্ছা, আমি বলছি গোলোক মজুমদারকে। ভাষণ থামাতে।

গোলোক মজুমদার এরই মধ্যে টেপ নিয়ে চলে গেছেন।

আমীর তাঁকে ফোন করলেন। টেপ কোথায়?

যেখানে যাওয়ার সেখানে গেছে।

এটা থামাতে হবে।

কেন।

সবার সঙ্গে কথা না বলে তো তাজউদ্দীন ভাই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না।

শোনেন। আপনার দেশের মানুষ আপনাদের সরকার গঠনের সংবাদের জন্য কান পেতে আছে। মুক্তিযোদ্ধা মিলিটারিরা সরকার গঠন ছাড়া আস্থা পাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজিকে আপনারা জানিয়েছেন। তাজউদ্দীনই সেকেন্ড ইন কমান্ড। এখন আপনাদের রাজনৈতিক দলাদলি তো আমি সৈনিক বুঝব না। আমি আমার সরকারের কথামতো চলব। আমি ভাষণ প্রচার করে দেব। তাতে আপনাদের দলাদলি নিজে নিজেই থেমে যাবে।

আচ্ছা, আমি আমার অনুরোধ আপনাকে রাখলাম। আপনি এবার বুঝুন কী করতে হবে।

আমীর এলেন মণি-তাজউদ্দীনের কাছে। বললেন, টেপ চলে গেছে। গোলোক মজুমদার ফেরানোর চেষ্টা করবেন। দেখা যাক।

রাতের খাবার ভালো। তিস্তা নদীর বড় মাছ। ভাত, ডাল। সবজি। তারা খেতে বসলেন। তাজউদ্দীন এরই মধ্যে ঠিক করেছেন, দেশ স্বাধীন করবেন বলে পরাশ্রিত থেকে তিনি বিলাসী জীবন যাপন করবেন না। তিনি কৃচ্ছ সাধনা করবেন। তিনি স্বল্পাহারী হবেন।

খেতে বসেছেন তিনজন। মণি, আমীর, তাজউদ্দীন। মনসুর আলীর জ্বর। তিনি শুয়ে পড়েছেন। তোফায়েল আহমেদেরও জ্বর। তিনি চলে গেছেন কলকাতা।

খাওয়া ভালোই চলছে।

এমন সময় শিলিগুড়ি বেতার থেকে ঘোষণা এল : এবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচার করা হবে। কণ্ঠস্বর আমীর-উল ইসলামের। দিল্লির গেস্টহাউসে বেতারকর্মীরা আমীরের কাছ থেকে এ ঘোষণাটাও রেকর্ড করে নিয়েছিল।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তাজউদ্দীনের ভাষণ বাজছে। কেউ কোনো কথা বলছেন না।

পরের দিন তাজউদ্দীনরা আবার সেই ডাকোটা প্লেনে। প্লেন থামল একটা ছোট্ট বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে তাঁরা গাড়িতে এলেন তুড়া পাহাড়ে। গাড়ি থেকে নামলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান বেরিয়ে এলেন। বারান্দায়। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

সৈয়দ নজরুল জানালেন ২৫ মার্চের পর তিনি কীভাবে পালিয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহ। তাঁকে নারীর ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। তিনি পরচুলা পরেছিলেন। সালোয়ার-কামিজ পরেছিলেন। তারপর একটা বোরকা পরে উঠেছিলেন গাড়িতে। ঢাকা থেকে প্রথমে যান ময়মনসিংহ। সেখান থেকে হাঁটাপথে গারো পাহাড় পেরিয়ে এসে পৌঁছেছেন এখানে।

সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সব খুলে বললেন তাজউদ্দীন। জানালেন, সরকার হবে রাষ্ট্রপতিশাসিত। সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আপনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে সজ্জন, রাজনীতিবিদ হিসেবে ঝানু। তিনি বললেন, মুজিব ভাই আমেরিকান কনসাল জেনারেলের সামনে বলেছেন, আমার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুলই আওয়ামী লীগের সেকেন্ডম্যান। কাজেই ঘটনা ঠিক আছে। আমার পর বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি তো তাজউদ্দীনই। কোনো অসুবিধা নাই। লেটস মুভ ফরোয়ার্ড।

তাঁরা গেলেন আগরতলা। একই প্লেনে। প্লেন থেকে নেমে সোজা একটা। সরকারি গেস্টহাউসে। সেখানে একটা বড় সভাকক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা অপেক্ষা করছিলেন। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছিলেন। কর্নেল ওসমানী, এম আর সিদ্দিকী আছেন। আর আছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ।

ওসমানীর সঙ্গে কথা বললেন তাজউদ্দীন।

ওসমানী জানালেন, মেজরদের সঙ্গে তিনি বসেছিলেন। কীভাবে যুদ্ধ। পরিচালনা করা যাবে, তার পরিকল্পনা তিনি পেশ করলেন। দুই ডিভিশন সৈন্য দাঁড় করাবেন। তারপর ঢাকা অভিযানে যাবেন।

তাজউদ্দীন বললেন, আপাতত সেটা করা যাবে না। কারণ এটা জনযুদ্ধ। জনগণকে তার যুদ্ধ করতে দিতে হবে। মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলুন। ট্রেনিং দিন। দেশের ভেতরে গেরিলা পাঠান। গেরিলাযুদ্ধ করে শত্রুদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলুন। ভারতের গেরিলাযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ জেনারেল নগেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে তাজউদ্দীন বসিয়ে দিলেন ওসমানীকে। সঙ্গে রইলেন আমীর।

এরপর এমপিদের সঙ্গে বৈঠক। প্রথমেই কথা পাড়লেন মোশতাক।আমার শরীর ভালো না। টি হোসেন ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন। আমি ক্লিনিকে ভর্তি ছিলাম। রেডিওতে শুনলাম সরকার হয়ে গেছে। তখন চলে আসতে বাধ্য হলাম।

.

ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে :

খন্দকার মোশতাক ২৫ মার্চের পর ঢাকার ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কের সিটি নার্সিং হোমে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা ছিল ডা. টি হোসেনের ক্লিনিক। চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীনের ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর ভারতের খবরে বলা হতে থাকে মন্ত্রিপরিষদের নাম। তাতে খন্দকার মোশতাকের নাম মন্ত্রী হিসেবে উচ্চারিত হওয়ায় তিনি প্রমাদ গোনেন। টি হোসেন তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দেন।

.

মোশতাক বললেন, আমি মন্ত্রী হতে পারব না। শরীর ভালো না। বয়স হয়েছে। শেষ বয়সে এসে আমার এই আর এই ধকল সইবে না। তোমরা আমাকে টিকিট করে দাও। আমি মক্কা শরিফ চলে যাব।

আমীর ধরলেন ডা. টি হোসেনকে। আপনি মোশতাক ভাইকে রাজি করান।

টি হোসেন বললেন, মোশতাক সাহেব, এখন মন খারাপ করার সময় নয়। সরকার হয়েছে। এ তো ভালো কথা।

অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থেকে মোশতাক বললেন, আমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করলে তাহলে আমি রাজি।

তাজউদ্দীন বললেন, ঠিক আছে। উনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীই হবেন।

মনসুর আলী আছেন। মোশতাক আছেন। তাজউদ্দীন আছেন। আছেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল। পুরা ক্যাবিনেট আছে, কামারুজ্জামান ছাড়া। কামারুজ্জামান কলকাতায়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী হিলি দিয়ে ভারতে ঢোকেন, কামারুজ্জামান তার দুই দিন আগে একই পথে কলকাতা গেছেন। তার সঙ্গে কথা হয়েছে আগেই। কলকাতার সভায় তাজউদ্দীন আহমদের নেওয়া উদ্যোগকে সমর্থন করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বক্তৃতা দিলে মনসুর আলীর কথাকেই কামারুজ্জামান নিজের কথা বলে সমর্থন দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম থেকে আসা জহুর আহমেদ চৌধুরী মোনাজাত ধরলেন। আধা ঘণ্টার সেই মোনাজাতের ভাষা বড়ই মর্মস্পর্শী। হে আল্লাহ, আমাদের বাবা মা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন দেশ-মাটি সব ছেড়ে আমরা এখানে এসেছি। আমরা জানি না আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেমন আছেন। হে আল্লাহ, আমরা যেন স্বাধীন দেশে আবার একসঙ্গে ফিরতে পারি। সেই তৌফিক আমাদের দিন।

উপস্থিত সবাই দরদর করে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।

৩১

মওলানা ভাসানী নৌকায় উঠলেন। মাঝি তিনজন। একজন মাঝি, দুজন মাল্লা। একজন কিশোর বয়সী। তার সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে থাকে। মনে হয়, সব সময় হাসছে। আরেকজন প্রবীণ। তবে তার চেহারা দেখলে বোঝা যায় না বয়স কত। পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা। তৃতীয়জন মাঝবয়সী, তার চোখ বাদামি রঙের। গায়ের রং তিনজনেরই রোদে পোড়া। ওরা রোদে বসে নৌকা চালায়, হাল ধরে, দাঁড় টানে আবার নৌকা থেকে নেমে গুন টানে। তিনজনের পরনে লুঙ্গি। প্রবীণ মাঝির ঘাড়ে গামছা। গামছার আদি রং বোঝার কোনো উপায় নেই। নৌকাখানি মাঝারি আকারের। হাল আছে, পাল আছে। দাঁড় আছে, লগি আছে। বড় ছই আছে। নৌকার মধ্যে রান্নার ব্যবস্থা আছে। ঘুমানোর জায়গা আছে।

মওলানা ভাসানীর গায়ে একটা গেঞ্জি। পরনে পাঞ্জাবি। মুখে উদ্বেগের চিহ্ন, চোখে আগুন এবং অশ্রু।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের একটা দিন। চৈত্রের বিকেলে রোদের রংটা সেদিন ছিল হলুদ, হলুদ আলো ধানকাটা হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ মাঠে একটা বিশাল আলোয়ানের মতো পড়ে আছে। খালের পাশে কাশবন। কোনো খেতে কেবল পাট লাগানো হয়েছে। ছোট ছোট পাটগাছ। ধঞ্চের বড় বড় গাছও আছে। কোনো কোনো খেতে আউশ ধানের ছোট্ট চারা। তিনি নৌকায় উঠেছেন। মাঝি নৌকা ভাসিয়ে দিল। জোরে জোরে বইঠা বাইতে লাগল, লগি ঠেলতে লাগল। একটু পরে বাতাস অনুকূল হওয়ায় পাল তুলে দিল।

মওলানা ভাসানী একটু আগে ছিলেন বিন্যাফৈরে। এটা তার সন্তোষের বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫ মার্চের পর টাঙ্গাইল এলাকায় প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। দেশের বহু জেলা-মহকুমার মতো টাঙ্গাইল ছিল সংগ্রাম পরিষদের দখলে। হাজার হাজার মানুষ দা-কুড়াল, লগি-বইঠা, কাস্তে-শাবল, কোদাল-বাঁক, সড়কি-বল্লম, দেশি বন্দুক, এয়ারগান, বাড়িতে বানানো হাতবোমা, স্কুলের রসায়নাগারে বানানো বাল্বের মধ্যে অ্যাসিড রাখা বোমা, বাংলাদেশের পতাকা ইত্যাদি নিয়ে দখল করে রাখে। সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সৈন্য ছিল, সেই একটা জায়গায় উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। বাকি সব ঘরে, দোকানে, অফিসে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা। মার্চের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নির্দেশে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করে আনসারদের কাছ থেকে অস্ত্র এনে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল আলম শহীদ, কাদের সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগ যুব লীগ সংগ্রাম পরিষদ সাকিট হাউসের মিলিটারি পোস্টে আক্রমণ করে। পরে জানা যায়, ভেতরের সৈন্যরা বাঙালি, তাদের মাইকযোগে জনতার সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে তারা সেই আহ্বানে সাড়া দেয় এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ময়মনসিংহ থেকে পিছিয়ে এসে টাঙ্গাইলের জয় বাংলা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।

৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা টাঙ্গাইল শহরে ঢুকে পড়ে। সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে কিছুদিন চাকরি করে চাকরি ছেড়ে দেওয়া কাদের সিদ্দিকীর স্বতঃস্ফুর্ত নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাটিয়াচরায় পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দিয়েছিল, ১৬ জন সাথি সেখানে শহীদ হয়। পাকিস্তানিদের বহু সৈন্য হতাহত হলেও তারা পিছু হটেনি।

পাখি মারার মতো অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা, বাড়িঘরে আগুন দেয়। তারপর তারা এগোতে থাকে সন্তোষের দিকে। মওলানা ভাসানীকে আটক করতে হবে।

মওলানা ভাসানী তখন বিন্যাফৈরের বাড়িতে বসে রেডিও শুনছিলেন। দুজন অবাঙালি মোহাজের, যাদের আদিবাড়ি ভারতের মোজাফফরবাদ, তাদের তিনি জনরোষ থেকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। রাশেদ খান মেনন আর হায়দার আকবর খান রনোরা শিবপুর নরসিংদীতে একটা প্রতিরোধকেন্দ্র গড়ে তুলে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রয়াসের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ি ওখানে, তিনিই নেতা। রনো আর মেননকে বলা হলো, যাও, টাঙ্গাইলে গিয়ে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করো। তারা সন্তোষে গেলেন, মওলানা সেখানে নেই, কাজেই তারা বিন্যাফৈরে গেলেন। মওলানা তাঁদের নির্দেশ দিলেন, কাগজ-কলম লও, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে টেলিগ্রাম লেখো। এর মধ্যেই দেখা গেল, সন্তোষের বাড়িতে আগুন জ্বলছে, আকাশ লাল করে সেই শিখা দাউ দাউ করে একেকবার অনেক ওপরে উঠছে আর কালো ধোঁয়ায় দিগন্ত ছেয়ে ফেলছে। মেনন আর রননা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর, সরে যাবেন না?

ভাসানী বললেন, সইরা গেলে তো ইন্ডিয়া যাইতে হয়। নেহরু আমার বন্ধু আছিল। তার মাইয়া ইন্দিরা আমারে যত্ন কইরাই রাখব, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু তো বিদেশে গিয়া কিছু করতে পারে নাই।

আর শোনো, তিনি তাঁর পাশের কয়েকজন মুরিদকে ডেকে বললেন, এই দুই মোহাজেররে আমি তোমগো জিম্মায় রাইখা গেলাম। অগো য্যান কোনো ক্ষতি না হয়।

সন্তোষ গ্রামেই শুধু ৬ জন বৃদ্ধ, ১৪টি গরু ঘরপোড়ানো আগুনে মারা গেছে। মওলানা ভাসানীর সেক্রেটারি ইরফানুল হক জানালেন, আপনার ইসলামী ইউনিভার্সিটির আটটা শণ আর টিনের ঘর, আর বিল্ডিংগুলা সব পুড়ায়া দিছে।

শুনে মওলানা বললেন, সিন্দুকে আওরঙ্গজেবের হাতের লেখা একটা কোরান শরিফ আছিল, সেইটাও পুইড়া গেল। মেনন, রনো দ্যাখো তো, আমার সন্তোষের আগুন অহনও দেখা যায় নাকি!

মেনন ও রনো ঘরের বাইরে এসে পায়ের আঙুলে দাঁড়িয়ে দূরের ধোয়া আগুন দেখছিলেন। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, মওলানা লুঙ্গিটা। এক হাতে উঁচু করে ধরে ধানখেত, পাটখেত ধরে হেঁটে গিয়ে ধঞ্চেখেতের আড়ালে হারিয়ে গেলেন।

নৌকা নিয়ে যমুনা বেয়ে ভাসানী গেলেন সিরাজগঞ্জের ঘাটে।

বাড়িতে ট্রেসার বুলেট বর্ষণ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করতে থাকে, কাফের মওলানা কিধার হ্যায়। প্রতিটা বাড়িতে তারা উন্মত্তের মতো আগুন দেয়।

ভাসানীর দারাপুত্র-পরিবার আরও শত শত পরিবারের সঙ্গে নদীর বালুচরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সারা রাত খোলা আকাশের নিচে কাপড় বিছিয়ে

পড়ে থাকে তারা।

মওলানা ভাসানী সিরাজগঞ্জের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে খবর পাঠালেন। ন্যাপের (মোজাফফর) সিরাজগঞ্জের সভাপতি সাইফুলকে। আর মোরাদ নামের একজন যুবকর্মীকে।

সাইফুল গেলেন যমুনার ঘাটে। সাইকেলে চড়ে।

ভাসানী বললেন, সাইফুল আইছ। আমি ভারতে যাইতাছি। তুমিও আমার সাথে চলো। লও উইঠা পড়ো।

সাইফুল বললেন, আমি করি অন্য দল। আমার নেতা মোজাফফর সাহেব। আমরা ইলেকশনে অংশ লইছি। আপনে করেন অন্য দল। দুইটাই ন্যাপ হতে পারে, আপনার লাইন আমার লাইন তো আলাদা। কেমনে নৌকায় উঠি?

মওলানা ভাসানী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পেছনে বড় ছই। ছইয়ে একটা হাত রেখে বললেন, খামোশ। এইটা তুমি কী কইলা? অন্য দল! অহন একটাই দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই কথাটা কি মানলা?

জি এই কথা তো মানিই। আমি তো লড়াই-সংগ্রামের মধ্যেই আছি। পুরা সিরাজগঞ্জ বলক দেওয়া ভাতের মতো ফুটতেছে। আমরা ন্যাপ কর্মীরা থানা লুট করে অস্ত্র আনছিলাম। আওয়ামী লীগ সব কেড়ে নিয়ে গেছে। তাতে কী! আমরা পাইপ কেটে অস্ত্র বানাইছি। আমার তো দল আছে। এখন মিটিং থেকে আপনার ডাকে আসলাম।

ভাসানী নদীর পানির দিকে একবার তাকালেন। একবার তাকালেন আকাশের দিকে। বললেন, আরও বড় কাজ আছে সাইফুল। প্রথমে দ্যাশটারে স্বাধীন করন লাগব। এর জইন্য লাখ লাখ গেরিলা লাগব। বিদেশি সমর্থন লাগব। দেশে দেশে চিঠি লেখন লাগব। দ্যাশ স্বাধীন হইলে আবার লড়াই করন লাগব সমাজতন্ত্রের লাইগা। সমাজতন্ত্র তো কেউ তোমারে চামুচে তুইলা মুখে পুরায় দিব না। আসো। নৌকায় ওঠো।

আপনি কী বলেন। আমার একটু প্রিপারেশন লাগবে না? আচ্ছা আমি বলে-কয়ে বিদায় নিয়ে আসি।

ঘণ্টাখানেক পরে সাইফুল একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে এলেন। নৌকায় উঠলেন। ছইয়ের ওই পারে মোরাদ।

উজানে ভাসাও মাঝি–আল্লাহর নামে রওনা দেও। ভাসানি নির্দেশ দিলেন। মাঝি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল নৌকা। বুক বরাবর খুঁটি ধরে টেনে তুলল নৌকার বুক থেকে। তারপর দড়ি ছাড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে যাত্রারম্ভ করল।

আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমছে।

ভাসানী বললেন, সাইফুল, কার কাছ থাইকা বিদায় নিলা?

সাইফুল বললেন, মা আছে। স্ত্রী আছে।

ছেলেপুলে নাই।

নাই। তবে হবে। প্রেগন্যান্ট। কবে বিয়া করছিলা?

৬৯ সালে।

বউ কী কইল?

বউ কী বলবে। মা কান্নাকাটি করল। বউকে বললাম, আমি চললাম। যদি মেয়ে হয়, তোমার আঁচলে বেঁধে রেখো। আর ছেলে হলে আমার খোঁজে পাঠায়া দিয়ো। হাতে একটা কবচ বেঁধে দিয়ো। হালকা কথা বললাম আরকি। শুনে মা বললেন, সাইফুল সব সময়ই নিষ্ঠুর।

মা তোমারে নিষ্ঠুর কয় ক্যান?

আমি তো পলিটিকস করব বলে ছোটবেলায় বাড়ি ছাড়ছি। আব্বা রাগ করছিলেন। কুড়ি বছর আর বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখি নাই।

অ। দ্যাখো সাইফুল। আমগো পলিটিশিয়ানদের কী অবস্থা। তুমি বউ ছাইড়া চইলা আইলা। বউয়ের বাচ্চা হইব। আমিও বউ-বাচ্চা সব ফেলায়া চইলা আইলাম। মোরাদ তো আইছে একবস্ত্রে। ও অবশ্য আমগো আগায়া দিতে আইছে। অরে একটা ভালো নিরাপদ জায়গা দেইখা নামায়া দেওন লাগব।

প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো বেলা তিনটার দিকে। আকাশ ছেয়ে এল কালো মেঘে। দমকা বাতাস। নৌকা বুঝি ডুবেই যায়। পানি দুলছে। নৌকা দুলছে। তিনজন মাঝি হাতে লগি নিয়ে ঠেসে ধরে আছে। নৌকা একটা কাশবনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বাতাসের দাপুটে ঝাঁপটা কম লাগছে না। বরং কাশগাছগুলো এসে নৌকার ছইয়ে বাড়ি খাচ্ছে।

তিনজন সওয়ারি ভাসানী, সাইফুল, মোরাদ ছইয়ের মধ্যে বসে আছেন। চৈত্রের ঝড় থেমে গেল।

তারা আবার চলতে শুরু করলেন। বিকেলটা ঝকঝক করছে বৃষ্টির পর। নদীর জল যদিও এখনো বেশ কালো। দূরে রোদ পড়ে যমুনার জলে একটা রুপালি বুটিদার চাদর চোখ ঝলসে দিতে চাইছে।

দূরে দিগন্তে দেখা গেল ধোয়া। অনেক দূরে দূরে অনেকগুলো জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে।

মোরাদ বললেন, সব ছারখার করে দিল।

ভাসানী বললেন, কী ছারখার করল?

মোরাদ বললেন, ওই দ্যাখেন। আগুন। পাকিস্তানি মিলিটারিরা আগুন। দিয়া সারা দেশ জ্বালায়া দিল।

সাইফুল বললেন, ওরা তো বলেইছে, মিট্টি মাংতা আদমি নেহি মাংতা।

ভাসানী ছইয়ের বাইরে এলেন। দাঁড়ালেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ওইটা আসামের আগুন। জুম চাষ করব। আগুন লাগায়া জঙ্গল সাফ কইরা সেইখানে আবাদ করব।

নৌকা চলছে। রাতে নৌকা দাঁড় করানো হয়। খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। আবার ভোর থেকে নৌকা চলে।

নৌকা ঘাটে ভিড়লেই মুশকিল। একজন যদি দেখেন হুজুর ভাসানী নৌকায়, অমনি গ্রামে খবর হয়ে যায়। লোকজন দল বেঁধে চলে আসে। ভাসানী কথা বলতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভাসানীকে কদমবুসি করতে চায়। কেউবা পানিপড়া চায়।

সাইফুল বলে দিয়েছেন, মাঝি, নৌকা ভিড়াবা না।

মাঝিরা একসময় জানাল যে নৌকায় চালডাল আছে। কিন্তু আগুন নেই। মালসাতে আগুন ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে নিভে গেছে। তামাক খেতে পারছে না তারা। কাজেই নৌকা ভেড়াতেই হবে। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে হবে। দেশলাই লাগবে।

সাইফুল ভাবলেন, আরও কিছু শাকসবজি সংগ্রহ করতে পারলে ভালো।

হাঁড়িভাঙার চরে নৌকা থামল। সাইফুল নৌকা থেকে নেমে চরের ভেতরের নেমে দেশলাই খুঁজতে লাগলেন। দোকান পাওয়া গেল। কিছু কাঁচা তরিতরকারিও কিনলেন তিনি।

ফিরে এসে সাইফুল দেখলেন, নৌকা ঘিরে ভিড়।

সাইফুল বললেন, তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়ো মাঝি।

ভাসানী বললেন, আকাশের অবস্থা দ্যাখছ? মুখটা ব্যাজার কইরা রইছে। নৌকা ছাড়া কি ঠিক হইব।

সাইফুল বললেন, এই পাড়ে ফুলছড়ি, ওই পাড়ে বাহাদুরাবাদ, আর্মির ক্যাম্প। এই লোকগুলার মধ্যে একটা-দুইটা মুসলিম লীগার, জামাতি থাকবেই। গিয়া খবর দিবে। আপনি জানেন আপনি আর্মির কত বড় টার্গেট?

মোরাদ বললেন, ভাসানীরে পাইলেই গুলি, এইটাই অর্ডার। টিক্কা খান বইলা দিছে, লাশ চাই। মওলানার লাশ চাই।

সাইফুল বললেন, হুজুর। আপনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। আর ছইয়ের ভিতর থেকে বের হতে পারবেন না।

ভাসানী উদাস হয়ে গেলেন।

তারপর বললেন, আচ্ছা। তোমরা যা ভালো মনে করো, করো।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার কথা বলা শুরু করলেন, আমারে মৌনব্রত করতে বলো। মহাত্মা গান্ধী করতেন। সপ্তাহে এক দিন চুপ কইরা থাকতেন।… শুরু হলো গল্প। গান্ধী, দেশবন্ধু, সুভাষ বোস, মওলানা আজাদ…গল্পের অবিরল ধারা বয়েই চলেছে…আর বয়ে চলেছে যমুনা…

এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় রেডিওতে শোনা গেল, তাজউদ্দীনের ভাষণ। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের রক্তিম শুভেচ্ছা।

সাইফুল বললেন, হুজুর, সরকার তো গঠন কইরা ফেলছে। আপনে তো লেট হইয়া গেলেন।

ভাসানী বললেন, চলো কলকাতা যাই। অনেক কিছু করনের আছে!

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, এই যাত্রার বিবরণ এবং ১৯৭১ সালে ভারতে মওলানা ভাসানীর অবস্থান লইয়া সুন্দর একটা বই আছে, সাইফুল ইসলামের লেখা স্বাধীনতা ভাসানী ভারত।

ব্যাঙ্গমি বলবে, সেই বই থাইকাই আমরা ভাসানীর এই সব কাহিনি স্মরণ করছি।

ব্যাঙ্গমা বলবে, হ। আমগো এই স্মরণের মধ্যে বেশির ভাগটাই নানান বই থাইকা নেওয়া। এইটা য্যান মনে রাখা হয়।

.

ধল্লাই নদের নামাজের চরে মওলানা ভাসানীর নৌকা তীরে বেঁধে রাখা হয়েছে। চর ধরে হাঁটতে শুরু করলেই সীমান্ত। সাইফুল আর মোরাদ চলেছেন চরের পথ বেয়ে। আলপথ। বালুচর। গাছগাছড়া। বড় বড় কাশ। ভাসানী বলে দিয়েছেন, নাক বরাবর যাবা। গেলে পাবা সামাদের বাড়ি। সামাদ আমার মুরিদ। আমার কথা কওনের সাথে সাথে বাকিটা দেখবা সে-ই কইরা দিব।

নাক বরাবরই হাঁটছেন দুজন। এর মধ্যে এসে গেল সীমান্ত। সীমান্তের খুঁটিগুলো আছে। আর কিছু নেই। সীমান্তচৌকিতে ইপিআর কেউ নেই। বেশির ভাগ ইপিআর জওয়ান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করতে গেছে। বিএসএফের লোকেরা থাকতে পারত। তাদেরও কাউকে দেখা গেল না। সীমান্তচৌকি আছে। টং আছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে আসছে। শুধু একটুখানি লালের পোচ এখনো আকাশের গায়ে। রাতচর পাখিরা বেরোতে শুরু করেছে। নীড়সন্ধানী পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে।

নিজেদের পায়ের আওয়াজে নিজেরাই চমকে উঠলেন সাইফুল আর মোরাদ। আবদুস সামাদের বাড়ি পাওয়া গেল। সামাদ মিয়াকেও।

সাইফুল বললেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এসেছেন।

সামাদ সজোরে বলে উঠলেন, হুজুর আসছেন? কী কন? উনি কই? আমারে নিয়া চলেন। নিয়া আসি।

কিন্তু বর্ডার পার হওয়া কি উচিত হবে? আসাম পুলিশ ধরবে না। তাঁকে?

তা-ও তো কথা। হুজুর আবার আসামরে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকানোর কথা কইছিলেন। আসামের নেতারা তার উপরে ম্যালা খ্যাপ্লা। আচ্ছা চলেন গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে যাই।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, পঞ্চায়েতপ্রধান ভাসানীকে আসতে দিতে নারাজ। তার জিজ্ঞাসা আছিল, কোন দল? ন্যাপ? তাইলে ঢোকা যাইব না। শুধু আওয়ামী লীগ হইলে যাইব!

.

সাইফুলের পাল্টা প্রশ্ন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা মারার সময় আওয়ামী লীগ ন্যাপ আলাদা করে না। বাঁচার জন্য সবাই তো ইন্ডিয়া যাইতেছে। শরণার্থীদের আবার আওয়ামী লীগ, ন্যাপ কী?

মোরাদকে নৌকায় পাঠিয়ে সাইফুল রয়ে গেলেন আসামে, সামাদ মিয়ার বাড়িতে। কারণ, পরের দিন এই এলাকায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী আসবেন।

সাইফুল আর সামাদ মিয়া মন্ত্রীর সভার উদ্দেশে বের হলেন দুপুরবেলা। মূল রাস্তা ছেড়ে পাথারের মধ্য দিয়ে লোকচক্ষু এড়িয়ে গিয়ে সভাস্থলে পৌঁছালেন তাঁরা। সেখানে অনেক বাঙালি। আর আলাদা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হলো না।

মন্ত্রী একটা স্কুলঘরে বসেছেন। সাইফুল কাউকে কিছু না বলে জোর করে গিয়ে ঢুকে পড়লেন মইনুল হক চৌধুরীর ঘরে। বললেন, আমি এসেছি মওলানা ভাসানীর পক্ষ থেকে!

মওলানা ভাসানী? কই তিনি?

নামাজের চরে।

মইনুল বললেন, আপনি আমার জিপে ওঠেন। জিপে ওঠার পর তিনি বললেন, মওলানা সাহেব ছিলেন এইখানকার মুসলিম লীগের সভাপতি, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। বুঝতে পারছেন?

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গেলেন স্থানীয় একটা রেস্টহাউসে, ফুলবাড়ি রেস্টহাউস। যেখানে ফোন আছে। তিনি ফোন করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। একটু পর এসে সাইফুলকে বললেন, জিপ নিয়ে যান। মওলানা সাহেবকে নিয়ে আসুন।

সামাদ সাহেব গেলেন হুজুরকে আনতে। আনতে আনতে রাত ভোর হয়ে গেল। কারণ, খবর রটে গেছে যে হুজুর কেবলা জিন্দাপীর এসেছেন। লোকজন ঘিরে ধরল তার আগমনের পথ। সবাইকে ফুঁ দিয়ে পানিপড়া দিয়ে দোয়া করে আসতে আসতে ভাসানী রাত কাবার করে দিলেন।

পরের দিন মওলানা ভাসানী সাইফুল মোরাদ বিশেষ কার্গো বিমানে চড়ে কলকাতা দমদম এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে গোয়েন্দা প্রহরায় সোজা কোহিনুর প্যালেস। পার্ক সার্কাসের পার্ক স্ট্রিটে।

পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটে দুটো রুম। বড়টাতে রইলেন ভাসানী আর মোরাদ। ছোটটায় সাইফুল। মোরাদের নৌকা থেকে নেমে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি নামতে পারেননি। তবে তিনি ভাসানীর কাঁথাটা ফেলে দিয়ে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন তাঁর রংচটা স্যুটকেসটা। সাইফুলকে মোরাদ বললেন, এইটা হুজুরের বিয়ার যৌতুক। এইটার সাথে স্মৃতি জড়িত। ফেলা ঠিক হবে না।

৩২

আম্মা আম্মা, দ্যাখো আকাশে কত বড় চাঁদ উঠেছে? ও মা! চাঁদটা না তালপিঠার মতো! কত বড়! আম্মা মনে হচ্ছে, চাঁদটাকে খেয়ে ফেলি! ১২ বছরের রিপি বলল।

চৈতালি পূর্ণিমা। শাল-গজারি, তাল-নারকেল-সুপুরি, আম-জাম-কাঁঠাল বাঁশঝাড়ঘেরা বাড়িটার উঠানে চাঁদের আলো পড়ে উঠানটাকেই মনে হচ্ছে। একটা কচ্ছপের পিঠ। নাম না-জানা ফুলের গন্ধ আসছে।

রিমি আর রিপি একটা ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে আপনমনে খেলছিল। ও পাশে একটা টুলে বসে আছেন ওদের মা লিলি, তার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিমি। আরেকটা টুলে বসে আছেন রিপিদের কাকিমা। মফিজ কাকার স্ত্রী। তার কোলে ছোট্ট সোহেল।

রিমি-রিপিদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে সমবয়সী চাচাতো বোন ইপি আর দিপি।

ওরা একটু আগে ছিল খড়ের গাদার আড়ালে। উঠোনের পশ্চিম দিকে খড়ের গাদা। দক্ষিণ দিকে ধান শুকানোর বড় খুলি। খড়ের গাদার পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে গোয়ালঘর। গোয়ালঘর ঘেঁষে গরুর চাড়ি, বাঁশের বেড়া আর মাটি দিয়ে মাচান করে বাধা। চাড়িতে মাড় দেওয়া হয়, পানি দেওয়া হয়, খইল দেওয়া হয়। ওইটা গরুদের ডাইনিং টেবিল, রিপি বলেছিল।

এখন উঠানে রাখা গজারিগাছের গুঁড়িতে বসে হঠাই রিপির চোখ গেল চাঁদের দিকে।

১০ বছরের রিমি ছুটে গেল সোহেল আর মিমির কাছে। সে ছড়া বলতে লাগল, আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।

সে একবার টিপ দিচ্ছে মিমির কপালে, একবার সোহেলের কপালে। মিমি ছড়া শুনে নিজেই চাঁদকে ডাকতে লাগল, আয় আয়…

তাজউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি দরদরিয়ায় এখন তারা। ২৫ মার্চের পর কী করে রিমি, রিপি আর আম্মু, সোহেল, মিমি একখানে হলো, আর অবশেষে এই গ্রামের বাড়িটায় আসতে পারল, সে কথা রিমি, রিপি কিংবা তাদের মা জোহরা ওরফে লিলি কোনো দিনও আর ভুলতে পারবেন না।

রিমি বলে, তাঁতীবাজারে খালার বাসায় আমরা তো ভালোই ছিলাম। হরতাল। অসহযোগ। স্কুল নাই। পড়াশোনা নাই।

রিপি বলে, ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তো আমরা খেলছিলাম।

রিমি বলে, আমি ঘুড়ি বানানো শিখে গেলাম।

রিপি বলে, আমি তো সুতোয় মাঞ্জা দেওয়াতে এক্সপার্ট হয়ে গেলাম। বাজার থেকে সুতোর গুটি কিনে এনে ছাদে এ মাথা থেকে ও মাথায় টেনে মেলে ধরতে হয়। তারপর ভাতের মাড়, আঠা, রং আর কাঁচের গুঁড়ো দিতে হয়। খুব সাবধানে দিতে হবে কিন্তু, না হলে হাত কেটে যাবে, রক্ত বের হবে।

রিমি বলে, কত ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হলো। চৈত্র মাস। বাতাস ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য পারফেক্ট। ছাদে ছাদে ঘুড়ি।

রিপি বলে, আর চক দিয়ে দেয়াল ভরে আমরা লিখতে লাগলাম, জয় বাংলা। আঁকতে লাগলাম নৌকার ছবি।

রিমি বলে, আর একটা বানর পিঠে একটা বাচ্চা নিয়ে ওই বাড়ির ছাদ থেকে এসে গেল এই বাড়ির ছাদে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। বানরটা ভয় না পেয়ে আমাকে ভেংচি কাটতে লাগল।

রিপি বলে, সারা দিন খেলাধুলা করে মাথার চুলভরা ঘাম নিয়ে আমরা ঘুমুতে গেলাম। খালা তো বকা দেবেন না।

রিমি বলে, ঘুম ভেঙে গেল মধ্যরাতে। গুলির শব্দ। মানুষের চিৎকার। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, চারদিকে আগুন আর আগুন। খালু ছাদ থেকে এসে বললেন, নয়াবাজার, শাঁখারীপট্টি, তাঁতীবাজার সব জ্বলছে। মহল্লায় মহল্লায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমন্ত মানুষ ঘর থেকে বের হতেই পড়ছে গুলির মুখে।

রিপি বলে, কী ভয়ঙ্কর ছিল সেই রাত।

রিমি বলে, ভয়ে আমি আধমরা হয়ে গেলাম।

রিপি বলে, সারা রাত গোলাগুলি আর মানুষের চিৎকারে দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

রিমি বলে, ২৬ মার্চ দিনের বেলাতেও, ও মা, কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটল!

রিপি বলে, পাশেই ছিল সিনেমা হল নাগরমহল। বাড়িপোড়া অসহায় মানুষগুলো এসে ঢুকেছিল ওই সিনেমা হলে। দিনের বেলা আগুন লাগিয়ে দিল সিনেমা হলটিতে।

রিমি বলে, কী বিশ্রী ধোঁয়া! কালো। দম আটকানো। খালার বাড়িও ধোঁয়ায় ভরে গেল।

রিপি বলে, খালু আমাদের বললেন, এই তোমাদের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কেউ এসে যদি জিজ্ঞেস করে, তাজউদ্দীন কে হয়, বলবে কেউ হয় না। আমরা এই বাড়ির মেয়ে।

রিমি বলে, আর অমনি তুমি বললে, না, আমার আব্বার নাম কেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হবে! আমার আব্বার নাম তাজউদ্দীন।

রিপি বলে, কারফিউ উঠে গেলে বড় মামু এলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন মগবাজারে। ছোট মামুর বাড়িতে।

রিমি বলে, সেখান থেকে আনার আপার বাড়িতে আবার নিয়ে গেলেন আমাদের সাইদুল দুলাভাই। আনার আপা তো আমাদের নিজেদেরই বোন। কিন্তু আব্ব, আম্মু, সোহেল, মিমির কোনো খবর তো পাই না।

রিপি বলে, তারপর মার্চের ৩০ তারিখে বড় মামু আর সাইদ ভাই আমাদের নিয়ে আবার বের হলেন সকাল সকাল। মগবাজার মোড়ে দেখতে পেলাম বড় মামুর লাল হিলম্যান গাড়ি। আমাদের গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ঢুকে দেখি, আম্মু, সোহেল, মিমি। আমরা যেন আমাদের ধড়ে জান ফিরে পেলাম।

মিমি বলে, আম্মু কেমন করে এইখানে এলেন সেটাও আম্মু এতবার বলেছেন যে আমাদের মুখস্থ। আম্মু আমাদের সাতমসজিদ রোডের বাড়ি ছেড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারফিউ উঠে গেলে বড় মামু আম্মুর খোঁজে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে খোঁজ নিলে আম্মুর দেখা পান। তাকে নিয়ে গেলেন তার ধানমন্ডি ১৩/২ বাড়িতে। দুপুরের পর মুসা সাহেব নিয়ে এলেন। একটা চিঠি। আব্দুর চিঠি। আব্বু লিখেছেন, লিলি আমি চলে গেলাম…

রিপি বলে, আম্মু সেই চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। চোখের জলে তাঁর কাপড় ভিজে যেতে লাগল।

রিমি বলে, আম্মু আর মামুর একটা করুণ ঘটনাও আছে। ২৭ মার্চের পর আম্মু এ-বাড়ি ও-বাড়ি আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। এক রাতে একটা বাড়িতে। আশ্রয় মিলল। খানিকক্ষণ পর বাড়ির লোক বলল, ভাবি, এই বাড়িতে ছেলেমেয়ে বেশি। বিপদ হতে পারে। চলেন পাশের বাড়িতে নিয়ে যাই। ওইটা একটু ভেতরে। ওই বাড়িতে বিপদ কম। সোহেল, মিমিকে নিয়ে আম্মু তার সঙ্গে বের হলেন। রাতের বেলা। চারদিকে ভয়। আলো নাই। অন্ধকার। মিলিটারির গাড়ির শব্দ। কুকুরের চিৎকার। এর মধ্যে লোকটা বলল, ভাবি, একটা জিনিস ফেলে এসেছি। আপনারা দাঁড়ান। নিয়ে আসছি। বলে তিনি বাড়ির ভেতরে গেলেন। আর আসেন না। গেটে তালা দিয়ে দিয়েছেন। দুইটা বাচ্চা নিয়ে আম্মু আড়াল খুঁজছেন।

রিপি বলে, আম্মু বাড়ির পেছনে গেলেন। অনেক ইট পালা করে রাখা। দুই পালা ইটের মধ্যে তিনি দুই বাচ্চাসহ সারা রাত মাটিতে বসে রইলেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, এই ভদ্রলোক ১৯৭২ সালের পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে দরখাস্ত করছিলেন প্রমোশনের লাইগা।

ব্যাঙ্গমি বলবে, এই ভদ্রলোক একজন কর কর্মকর্তা। তিনি দরখাস্ত করলেন তাঁর প্রমোশনের লাইগা। তাজউদ্দীন ফাইল দেখতে আছিলেন হেয়ার রোডের মন্ত্রিবাড়িতে। লিলিরে ডাকলেন। কইলেন, লিলি, তারে প্রমোশন দিয়া দিলাম। লিলি কইলেন, তুমি মন্ত্রী, কারে প্রমোশন দিবা না দিবা তোমার ব্যাপার। তাজউদ্দীন কইলেন, এটার লগে তুমিও জড়িত। ওই যে তোমারে ঘরের বাইর কইরা গেট লাগায়া দিছিল, সেই মানুষ। তুমি সারা রাত খোলা আকাশের নিচে সোহেল-মিমিরে লইয়া আছিলা…লিলি কইলেন, এইটা তোমার ব্যাপার…তাজউদ্দীন কইলেন, আমার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা দুর্ঘটনা দিয়া তো অফিশিয়াল ব্যাপার বিচার করা যায় না…

.

রিপি বলে, তারপর সেই হিলম্যান গাড়িতে আম্মুর ঘাড়ে মাথা রেখে আমরা

এসে পৌঁছালাম টিকাটুলীর মোড়।

রিমি বলে, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমরা বেবিট্যাক্সি নিলাম। গেলাম ডেরমাঘাট পর্যন্ত।

রিপি বলে, ডেরমা না রে ডেমরা।

রিমি বলে, ডেমরা। ডেমরাঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে আমরা গেলাম পাগলা আফতাব চাচার বাড়িতে।

রিপি বলে, গ্রামের এই বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হলো। চারদিকে আমবাগান। ঝড় এল। আমরা আম কুড়াতে গেলাম। আম্মুকে বললাম, আম্মু আমরা এখানেই থেকে যাই।

রিমি বলে, আম্মু হেসে ফেললেন।

রিপি বলে, আমরা খুশি হলাম। আম্মু হেসেছেন।

রিমি বলে, সেখানেও থাকা নিরাপদ নয়। সবাই জেনে গেছে তাজউদ্দীনের ফ্যামিলি আছে এই বাড়িতে।

রিপি বলে, নৌকায় চড়ে আমরা এসে পৌঁছালাম দাদাবাড়িতে। উঠলাম মফিজ কাকুর ঘরে।

রিমি বলে, কী সুন্দর দোতলা কাঠের বাড়ি। নিচতলায় থাকেন কাকুরা। দোতলায় থাকি আমরা।

.

এখন আম্মু ডাকছেন। রিমি, রিপি এদিকে এসো। তোমার কাকুকেও ডেকে আনো।

কেন আম্মু?

রেডিওতে বলছে, তোমার আব্দুর ভাষণ প্রচার করবে।

আকাশবাণী কলকাতা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল একটি গোপন বেতার থেকে ভাষণ দেন। এখন সেই ভাষণের রেকর্ড প্রচার করা হচ্ছে।

দোতলার কাঠের ঘরে সবাই উপস্থিত। মফিজ কাকু। হোসনে আরা কাকিমা। লিলি। রিমি। ইপি। দিপি।

তাজউদ্দীনের গলা শোনা গেল :

স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি…

সোহেল কথা বলে উঠল।

রিমি বলল, সোহেলবাবু কথা বোলো না। আব্দুর কথা শোনো…।

লিলির চোখ ভিজে যাচ্ছে। যাক। মানুষটা বেঁচে আছে। আর বেঁচে আছে বাঙালির স্বাধীনতার আশা। সরকার হয়েছে। এখন মুজিব ভাই না জানি কোথায়?

৩৩

২৬ বছর বয়সী তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেশা শুরু করে এখন সিএসপি অফিসার। লড়াই করছেন স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে, সেই ২৫ মার্চ রাত থেকে। পুলিশ, আনসার, ইপিআর, সংগ্রাম পরিষদের লোকজন মিলে তাঁর বাহিনী। কাঁধে স্টেনগান নিয়ে তিনি চলাফেরা করেন।

মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে দুই হাজার মুক্তিসেনা। পুলিশ, আনসার, ইপিআর আর সাধারণ মানুষ মিলে।

ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার হাজারো ইপিআর নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বাঙালি সৈনিক, বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, আনসার আর হাজার হাজার ছাত্র শ্রমিক সাধারণ মানুষ মিলে মার্চের মধ্যে পদ্মার পশ্চিম পারকে পাকিস্তানি দখলমুক্ত করেই ফেলেছিলেন। কিন্তু দখল ধরে রাখা যাচ্ছে না। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে এগিয়ে আসছে, তাদের সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান বিমানবাহিনী। একের পর এক জেলা মহকুমা সদর ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত। পিছু হটছে মুক্তিবাহিনী।

এই হতাশার মধ্যে বিএসএফের নেটওয়ার্কে তৌফিকের কাছে ফোন এল। বৈদ্যনাথতলায় হবে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। স্ট্রিকট সিক্রেট।

১৬ এপ্রিল ১৯৭১ বৈদ্যনাথ তলায় মাহবুব আর তৌফিক এলেন জিপ নিয়ে। এখানে আসা খুবই কষ্টকর। রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা।

মাহবুব বলেছিলেন, জায়গাটা কিন্তু ভালোই বাছাই করেছে।

তৌফিক বললেন, চুয়াডাঙ্গায় করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি মিলিটারি টের পেয়ে সেখানে ব্যাপক এয়ার অ্যাটাক করে। বম্বিং করে।

মাহবুব বললেন, সেই তুলনায় এই জায়গাটা সব দিক থেকে সেফ। এটা একটা এনক্লেভের মতো। তিন দিকেই ইন্ডিয়া। বিমান হামলা করতে গেলে বিমান ইন্ডিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করবে। পাকিস্তানিরা এত বড় বোকামো করবে না। ইন্ডিয়ান সৈন্য ইনভাইট করে আনবে না। আর এত গাছ যে ঠিক কোন জায়গাটায় প্রোগ্রাম হচ্ছে, আকাশ থেকে বোঝাও যাবে না।

তৌফিক বললেন, আর সড়কপথে মিলিটারি এই জায়গাটাতে এসে পৌঁছাতেও পারবে না। মেহেরপুর দিয়ে আসতে হবে। মেহেরপুর এখনো মুক্তিবাহিনীর দখলে। সেই সাহস পাকিস্তানি মিলিটারির হবে না। শক্তিতেও কুলাতে পারবে না।

দুই দিন আগেই তাজউদ্দীন আহমদ এখানে নাকি লোক পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বিএসএফের অফিসার। তাঁর সঙ্গে সাদাপোশাকের আরও লোকজন। তারা পুরো এলাকাটা রেকি করে গিয়েছেন।

তৌফিক ও মাহবুবকে দেখে একজন-দুজন এলাকার মানুষ ভিড় করতে শুরু করেছে।

এলাকার সংগ্রাম পরিষদের নেতা কে? জানতে চাইলেন তৌফিক।

রুস্তম আলী নামের একজন কলেজছাত্র এগিয়ে এলেন। বললেন, আমি এখানকার সংগ্রাম কমিটিতে আছি।

আপনাদের লোকজনকে ডাকুন।

আবদুল মোমিন চৌধুরী, দোয়াজ উদ্দীন মাস্টার, আইয়ুব হোসেন, রুস্তম আলী, রফিকুল ইসলাম, জামাতী আলী, সৈয়দ আলী–গ্রামের যুবকেরা এগিয়ে এলেন। তাঁরা বললেন, তাঁরা এই এলাকার সংগ্রাম কমিটির নেতা। ২৬ মার্চেই তারা ইপিআর পোস্টে এসে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছেন। পুরা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

সীমান্তচৌকিতে প্রহরারত পুলিশ, আনসার সদস্যরাও এগিয়ে এলেন।

বলা হলো, এখানে নেতারা আসবেন। একটা মিটিং করবেন। আমবাগানের নিচের একটা জায়গা পরিষ্কার করতে হবে।

মানুষের তখন উৎসাহের কোনো অভাব নেই। এলাকার লোকজন বৈদ্যনাথ আমতলার একটা জায়গার জঙ্গল কেটে সাফসুতরো করে ফেলল।

সন্ধ্যার মধ্যে পাশের ইতালীয় মিশনের চার্চ থেকে চৌকি আনা হলো। জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা মঞ্চ খাড়া হয়ে গেল। বাংলাদেশের পতাকার জন্য স্ট্যান্ড লাগানো হলো। সেখানে বাঁশের খুঁটি পোতা হলো পতাকার জন্য।

বৈদ্যনাথতলার এই জায়গায় একটা ইপিআর পোস্ট আছে। কিন্তু ইপিআর জওয়ানরা চলে গেছেন মেজর ওসমানের দলে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছেন। তার বদলে এই পোস্টে এখন ডিউটি করছে আনসার আর পুলিশের একটা দল। তারা তাঁবু গেড়ে পাহারায় রইল। মেহেরপুর থেকে মাইক আসছে। মাহবুব ওয়্যারলেসে খোঁজ নিলেন। রাতের মধ্যেই মাইক রেডি থাকবে।

তৌফিক ও মাহবুব রাতে গেলেন দেই। ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফ ক্যাম্পে। বৈদ্যনাথতলা থেকে বারো মাইল দূরে।

রাতের বেলা প্রচণ্ড ঝড় হলো। দেতাই বিএসএফ ক্যাম্পে শুয়ে তাঁরা আর ঘুমুতে পারলেন না। ঝড়ে মনে হচ্ছে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।

.

১৭ এপ্রিল ৫টায় পশ্চিমবঙ্গের দেতাই বিএসএফ পোস্ট থেকে রওনা দিয়ে ভোর ৬টার মধ্যেই দুজন–মাহবুব আর তৌফিক-দুই গাড়িতে হাজির বৈদ্যনাথতলায়। রাস্তায় তারা সূর্যোদয় দেখতে পেলেন। সূর্য দেখে তৌফিকের মনটা ভালো হয়ে গেল। গতকাল এখান থেকে চলে যাওয়ার পর রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছে।

সকাল সকাল বৈদ্যনাথতলায় এসে তো তারা অবাক। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর গ্রামবাসী সারা রাত জেগে দেবদারুর পাতা দিয়ে তোরণ বানিয়েছে। তাতে বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা ওয়েলকাম, স্বাগতম। জয় বাংলা। মিশনের সিস্টাররা সারা রাত জেগে কাপড়ে তুলা আঠা দিয়ে লাগিয়েছে। ফাদার ফ্রান্সিসও খুবই ব্যস্ত। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংগ্রাম কমিটির লোকেরা খুবই ব্যস্ত। বহু আমগাছ ঝড়ে পড়ে গেছে। তারা সভাস্থল আবারও পরিষ্কার করে ফেলেছেন।

বিএসএফ সাদাপোশাকে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। রাস্তায় রাস্তায় তারা ইনফরমার রেখেছে, যদি কোথাও শত্রুবাহিনী হামলা করে, খবর দেবে। পাল্টা আক্রমণ করার ফোর্সও তারা সীমানার ভেতরে তৈরি করে রেখেছে।

মুক্তিযোদ্ধারাও দুই মাইল ব্যাসার্ধ করে একটা বৃত্ত রচনা করে অবস্থান নিয়েছে। তৌফিক আর মাহবুব সেই ব্যাপারটাও চেক করে নিলেন। ওয়্যারলেস দিয়ে ইনফরমার রাখা হয়েছে। কোনো রকমের হামলা হলে আগে থেকেই টের পাওয়া যাবে।

গাছে গাছে মাইক টাঙানো হয়েছে। তৌফিক মাইকে ফুঁ দিলেন। হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং। জয় বাংলা, জয় বাংলা। মাইক ঠিক আছে!

এর মধ্যে তৌফিকের খিদে পেয়ে গেছে। মাহবুবকে তিনি বললেন, সকালবেলা তো খেয়ে বের হইনি। এখন তো খিদে পেয়ে গেল। কী করা যায়।

দাঁড়া দেখি। মাহবুব একজন আনসারকে ডেকে বললেন, এই তোমাদের ক্যাম্পে তোমরা খাওয়ার ব্যবস্থা কী করেছ?

স্যার। শুধু ডাল আর ভাত। তবে স্যার গরম-গরম। এখনই চুলা থেকে নামল।

তৌফিক বললেন, ভেরি গুড। আমাদের দুজনকেও একটু ভাগ দাও।

আপনাদের সাথে আর যারা এসেছেন, তাঁদেরও খেতে বলেন। আমরা বেশি করে চাল দিয়েছি। আর ডালে পানি মেশালেই পরিমাণে বাড়বে।

তৌফিক-মাহবুব ক্যাম্পে গিয়ে দুইটা টিনের থালায় গরম ভাত আর ডাল খেলেন। ক্ষুধার্ত পেটে সেই ধোঁয়া ওঠা মাড়ভরা নরম ভাতের স্বাদ তাঁর মুখে চিরদিনের জন্য লেগে থাকবে। যেন অমৃত!

খাওয়ার পর হাত ধুতে ধুতে তৌফিক বললেন, মাহবুব, জাতীয় পতাকা?

মাহবুব বললেন, সেটা তো আনার কথা খেয়াল নাই।

এলাকার চেয়ারম্যান এসে হাজির হয়েছেন। তাঁর নাম সোলেমান বিশ্বাস। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল আছে।

তৌফিক বললেন, সোলেমান সাহেব, আপনাকে একটা বিশাল কাজ দেব। বাংলাদেশের জন্য এই কাজটা আপনাকে যেভাবেই হোক করতে হবে।

সোলেমান বিশ্বাস বলেন, জি স্যার। অবশ্যই করব।

এসডিও সাহেবের কাঁধে একটা স্টেনগান। তিনি নিজে এখন যুদ্ধ করছেন। আমরাও যুদ্ধ করছি। সোলেমান বিশ্বাস ভাবলেন।

তৌফিক বললেন, আশপাশের স্কুলগুলোতে যান। বাংলাদেশের পতাকা আনবেন। কী বুঝলেন? কোন পতাকা আনবেন?

বাংলাদেশের পতাকা?

সেইটা কেমন? কী রং?

সেটা সবুজের মধ্যে লাল। লাল গোলের মধ্যে বাংলাদেশের ম্যাপ। সোনার বাংলার ম্যাপ।

একদম ঠিক আছে। সেই পতাকা আনবেন। যান।

সোলেমান বিশ্বাস মোটরবাইক স্টার্ট দিলেন। আনন্দবাস হাইস্কুল, আনন্দবাস প্রাইমারি স্কুল, আনন্দবাস ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হবে। বাংলার পতাকা তাঁকে আনতেই হবে।

মাহবুব, মেজর ওসমান চৌধুরীর আসার কথা তার একটা দল নিয়ে। তাঁদেরই গার্ড অব অনার দেবার কথা। এখনো যে তারা আসছেন না? তৌফিক-ই-ইলাহী বললেন উদ্বিগ্ন স্বরে।

কী করতে বলিস? মাহবুব বললেন।

তুই তোর কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার জন্য তৈরি হ।

আমি তো গার্ড অব অনার কতই নিই। কাজেই কীভাবে দিতে হয় জানি। কিন্তু এই পুলিশেরা কি পারবে? সারদায় ট্রেনিংয়ের সময় শেখানো হয়েছিল। আর তো প্র্যাকটিস নাই।

তুই এখনই ট্রেনিং দে। তারপর এর মধ্যে যদি ওসমান সাহেব আসেন, তাহলে তো আর কথাই নাই।

মাহবুব ডাকলেন তাঁবু গেড়ে রাতে থাকা আনসার-পুলিশদের। বললেন, ইউনিফর্ম পরে চলে আসেন। আমরা গার্ড অব অনার দেব।

স্যার কতজন লাগবে?

দুই সারিতে ১৬ জন হলে ভালো।

মাহবুব নিজের পোশাকের দিকে তাকালেন। তিন সপ্তাহ ধরে একটাই পোশাক তার পরনে। খাকি ড্রেস। সেটা ধুলায়-কাদায় এমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। যে আদিতে আসলে এর রং কী ছিল আর বোঝা যাচ্ছে না। মেজর ওসমান। তাঁকে ক্যাপ্টেনের ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন। সেটা দেখা যাচ্ছে।

১৬ জন পুলিশ তো পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু জুতা আছে, বেল্ট আছে, টুপি আছে, এই রকম ১৬ জন পুলিশ হয় না। কেউ-বা পরে আছে লুঙ্গি। কারও পায়ে রবারের জুতা। কারও পায়ে লাল কেডস।

মাহবুবের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজেরই ড্রেসের ঠিক নেই। অন্যদের কথা তিনি কী বলবেন। তার মাথায় সবুজ বেরেট, পায়ে জঙ্গল বুট। শুধু ক্যাপ্টেনের ব্যাজটা ঠিক আছে।

মাহবুব মোটামুটি চলতে পারে, এমন বারোজনকে আলাদা করলেন। তাদের সামনে দাঁড়ালেন একজন আনসার। হাতে রাইফেল আছে। রাইফেলসহ কীভাবে গার্ড অব অনার দিতে হবে, তিনি দেখিয়ে দিলেন। বারবার প্র্যাকটিস করে ব্যাপারটা যখন রপ্ত হয়ে গেল, তখন মাহবুব ঘর্মাক্ত কলেবরে এসে তৌফিককে জানালেন, হয়ে গেছে। তোর কী অবস্থা?

এখনো জাতীয় পতাকা পাই নাই। তৌফিক বললেন।

এরই মধ্যে সোলেমান বিশ্বাসের মোটরবাইক এসে গেল। সোলেমান বিশ্বাস দুইটা জাতীয় পতাকা আনতে পেরেছেন।

তৌফিকের মুখটা প্রশান্ত হাসিতে ভরে গেল।

সংগ্রাম পরিষদের নেতারা খুবই ব্যস্ত। আশপাশের গ্রাম ভেঙে লোক আসছে। আসছেন আশপাশের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারাও।

চেয়ার দেওয়া হয়েছে গ্রামবাসীর কাছ থেকে ধার করে। স্কুল থেকে আনা হয়েছে, আর হয়েছে মিশন থেকে। গাছে গাছে মাইক। আবার সিস্টারদের বানানো ব্যানারে বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা : জয় বাংলা। মঞ্চের ওপরে কার্পেট, শতরঞ্জি বসানো হয়েছে, তা-ও দিয়েছেন এলাকাবাসী।

পতাকাস্ট্যান্ডে পতাকা লাগানো হলো। দড়ি আগে থেকেই বাঁধাই ছিল।

নয়টার দিকে একটা গাড়ি এল ভারতের দিক থেকে। গাড়ি থেকে নামলেন ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব।

রাজ্জাককে দেখে ছুটে গেলেন শাহাবুদ্দীন আহমেদ সেন্টু। রাজ্জাক সেন্টুকে আগে থেকে চেনেন। সেন্টু পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, প্রথম বর্ষে। শেখ কামালের সঙ্গে খেলাধুলা করেন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গান শেখেন, মার্চ থেকে ধানমন্ডি খেলার মাঠে শেখ কামালের সঙ্গে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং দিয়েছেন কর্নেল শওকত আলী। ট্রেনিং নিয়েছেন হারুন, নুর আলী, বাচ্চু, তারেক, তান্না, ইকবাল ১, ইকবাল ২ প্রমুখ। সেন্টু মার্চের অসহযোগে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হয়ে গান করে বেড়িয়েছেন ঢাকার রাজপথে, শহীদ মিনারে। ২৫ মার্চের পর চলে আসেন মেহেরপুর এলাকায়, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে তিনিও প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন। এরপর চলে আসেন তাঁর বাড়িতে। বৈদ্যনাথতলার আমবাগান থেকে বাড়ি মাত্র মাইলখানেক দূরে।

রাজ্জাক বললেন, সেন্টু, তুই এখানে কী করিস?

সেন্টু বললেন, রাজ্জাক ভাই, যুদ্ধ করতে গ্রামে এসেছি। শেখ কামাল আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যার যার এলাকায় যাও। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিলে এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়ো।

রাজ্জাক বললেন, তোর বাড়ি এখানে নাকি?

হ্যাঁ। এই তো বাগোয়ান। এক মাইল দূরে হবে। তবে এই যে দেখতেছেন সুপারিগাছ, ওই যে, ওই বাড়িটা আমার চাচার বাড়ি।

আ স ম আবদুর রব বললেন, চলো তাহলে তোমার চাচার বাড়ি যাই। খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়া যায় কি না।

রাজ্জাক বললেন, সেন্টু, তোকে পেয়েছি। খুব ভালো হয়েছে। তুই না। রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিস?

হ্যাঁ। এখনো শিখি।

আমার সোনার বাংলা শিখেছিস তো?

হ্যাঁ। সারা মার্চ মাসে শহীদ মিনারে তো রোজ একবার করে গাইতে হয়েছে।

শোন। এখানে তো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেবে। অনুষ্ঠানে তো জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। তুই অ্যারেঞ্জ কর।

জি আচ্ছা।

সেন্টু লেগে পড়লেন। ভবের চরের স্টিফেন পিন্টু ঘোষ ভালো গায়, তিনি জানেন। সেন্টু বলেন, রামনগরের মনসুর মোল্লা কই। কুইক। মোটরসাইকেল নিয়ে যাও। আর শোনো, মিশন থেকে হারমোনিয়াম আর তবলা আনো। দরিয়াপুরের আসাদুল হককে ডাকো। সবাই তখন ওই আমবাগানে হাজির হয়েছে।

পাঁচজন বসলেন আমবাগানের পশ্চিমে। একটা গাছের নিচে। একটু রিহার্সাল করে নেওয়া দরকার। রিহার্সাল শুরু হলে আ স ম আবদুর রবও এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

.

দশটার দিকে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল।

কলকাতা থেকে ডজন ডজন গাড়ি এসেছে।

ব্যারিস্টার আমীর আর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান ১৬ তারিখ রাতে কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে। ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে প্রেসক্লাবে থাকতে হবে। ৬টার মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দেবে।

কেন? কোথায় যাব আমরা?

এটা আমরা কালকে বলব। আজকে আপনারা আর কোনো প্রশ্ন করবেন। না। আর আজকে যে আমরা এসেছি, কালকে ভোরে রওনা দিচ্ছি, এটাও আজ আর কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।

আওয়ামী লীগের এমপিএ-এমএনএ যারা কলকাতায় আছেন, তাঁদের নেওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড়াল সিনহা রোডে।

সকাল ছয়টার মধ্যে ভারতীয় সাংবাদিক, পশ্চিমা সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান দিয়ে ভরে গেল কলকাতা প্রেসক্লাব। সবাইকে নিয়ে ঠিক সময়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। বাংলাদেশের নেতারাও যথাসময়ে উঠে গেলেন গাড়িতে। মোটামুটি ৫০টার মতো অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে আমবাগানের বিভিন্ন জায়গায় গাছের আড়ালে দাঁড়াল। কলকাতা থেকে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত আসতে তাদের লাগল প্রায় চার ঘণ্টা।

সবার মধ্যে একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব। শুধু অবিচল ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীনের। কামারুজ্জামান সাহেব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কাজেই তিনি খানিকটা তৎপর হলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সাদা পাঞ্জাবি, ঢোলা পায়জামা, কালো চশমায় আরও লম্বা দেখা যাচ্ছে।

কলকাতা সিনহা রোডে সৈয়দ নজরুল গাড়িতে ওঠার আগে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মান্নান, চিরুনি নিয়েছ?

হ্যাঁ। মান্নান জানালেন। সৈয়দ নজরুল আবারও বললেন, চিরুনি নিয়েছ? হ্যাঁ। তিনবার তিনি এক প্রশ্ন করলেন। তখন পাশের আরেক নেতা বলে উঠলেন, লিডার, আপনি চিরুনি দিয়ে কী করবেন? আপনার মাথাতে চুলই নাই।

না, কে বলল নাই। সামনে না থাকলেও পাশে তো আছে।

সব নেতা এসেছেন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। খন্দকার মোশতাক এসেছেন লম্বা কোট-প্যান্ট-টুপি পরে। এম এ জি ওসমানী এখানে আসবেন। কিন্তু তার পরার মতো ইউনিফর্ম নেই। তার জন্য আগের রাতে ড্রেস বানানো হয়েছে। কারণ বিএসএফ যা দিচ্ছিল, সবই তাঁর পরনে বড় আর ঢোলা হচ্ছিল।

নেতারা এসে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে স্বাগত জানাল জনতা। তাঁরা সভাস্থলের পাশে পুলিশ ফাঁড়ির কাছাকাছি চেয়ার নিয়ে বসলেন।

শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান। এসেছেন। তারা ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা দেখতে লাগলেন। অনেক কাঠের চেয়ার। কোনো চেয়ার ভাঙা। বেঞ্চি। দুটো মঞ্চ। একটা বড়। আরেকটা ছোট্ট ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। দড়ি দিয়ে সভামঞ্চের সামনের দিকটা ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। মানুষ এসে ভরে যাচ্ছে পুরো আমতলা।

তাজউদ্দীন বললেন, তৌফিক সাহেব, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করতে পারবেন কে, ঠিক হলো?

জি স্যার। বাকের আলী, এদিকে এসো।

কলেজছাত্র বাকের আলী এগিয়ে এল (পরে তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক হবেন)। তার স্কুলশিক্ষক দোয়াজ উদ্দীন জানতেন, স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে বাকের আলী কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করত। দোয়াজ উদ্দীনরা দুই দিন ধরে আম্রকাননের সভাস্থলে বড় খাটছেন।

তাজউদ্দীন বললেন, তোমার নাম কী ভাই?

বাকের আলী।

কী করো?

কলেজে পড়ি।

কোন আয়াতটা পড়বা, একটু শোনাব।

বাকের আলী টুপি মাথায় দিয়ে তিলাওয়াত করল। তাজউদ্দীন হাফেজে কোরআন। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এইটাই কোরো।

নেতারা আগে এসেছেন। একটু পরে এসেছেন কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে গাড়িতে ওঠা সাংবাদিকেরা।

ব্যারিস্টার আমীর সাংবাদিকদের সামলাচ্ছেন।

তাজউদ্দীন আহমদ সব চেক করে নিলেন। নির্বাচিত এমপিএ, এমএনএরা এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এসেছেন। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। এসেছেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী চিফ হুইপ। তিনি শপথ পরিচালনা করবেন। এসেছেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাশে বসে আছেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মোশতাক আহমদ। আছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী। আছেন। তৌফিক, শুরু করে দিন। যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল।

তৌফিকও সেটা জানেন। আক্রমণের শঙ্কা সব সময়ই আছে। পাকিস্তানি মিলিটারি টের পেয়ে গেলে প্লেন নিয়ে মাথার ওপরে একটা চক্কর তো দিতেই পারে। আবার সড়কপথেও তারা আক্রমণ করে বসতে পারে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। মাহবুব, চল, শুরু কর।

মাহবুব আরেকবার পথের দিকে তাকালেন। ওসমান সাহেবের বিশাল বাহিনী কি এসে পৌঁছাবে না? গার্ড অব অনার তাকেই দিতে হবে?

না। আর সময় নেওয়া ঠিক হবে না।

১১ জন পুলিশ দুই সারিতে দাঁড়ালেন। সামনে একজন তাদের নেতা। আনসার ইয়াদ আলী। তার কাঁধে লেখা আনসার। মুখে দাড়ি।

.

সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর, মোশতাক, কর্নেল ওসমানী মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। মঞ্চের পাটাতনে মিশনারি গির্জা থেকে আনা কার্পেট। নিচে চকি। তার নিচে বাংলার মাটি।

হাজার হাজার আমগাছ। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ পরিষ্কার। বৈশাখের এই মধ্যদুপুর আলোয় আলোয় ঝকঝক করছে। বৃষ্টিধোয়া আমপাতাগুলো কী যে সবুজ। আবার অনেক গাছে ছোট ছোট আম ঝুলে আছে। সভাস্থলে অনেকগুলো বড় শিরীষগাছ, সেগুনগাছও আছে। বৃষ্টির পানি কোথাও কোথাও জমে আছে, তাতে আকাশ-আলো-সবুজ পাতার প্রতিবিম্ব পড়ে সামান্য বাতাসে একটু একটু করে দুলছে।

মাহবুব চলে গেলেন তাঁর ১২ জনের গার্ড অব অনার দলের কাছে। ইয়াদ আলী পেছনে গেলেন। মাহবুব সামনে দাঁড়িয়ে কমান্ড করলেন, অ্যাটেনশন।

পুলিশ সদস্যরা পা ঠুকে অ্যাটেনশন হলো।

শোল্ডার আর্মস। তারা কাঁধে রাইফেল তুলল।

এবার তিনি দেহের সব শক্তি মুখে এনে বললেন, প্রেজেন্ট আর্মস। সৈন্যরা বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরল। মাহবুব স্যালুট করলেন।

এই সময় সেন্টু, পিন্টু, আসাদুল, মনসুর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে শুরু করলেন :

আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে
ও মা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি…

গান গাইছেন তারা সমস্ত দরদ ঢেলে দিয়ে।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, এত সুন্দর কইরা এত মায়া দিয়া আমার সোনার বাংলা আর কেউ কখনো গাইছে কি না আমগো জানা নাই।

ব্যাঙ্গমি বলবে, হ। তুমি ঠিকই কইছ।

.

জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হচ্ছে।

মঞ্চে সবার চোখ ভিজে আসছে। দর্শকসারিতে বসা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, পুলিশ ইপিআর সৈনিক আমলা যারা কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল থেকে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন, উপস্থিত গ্রামবাসী–সবার চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। পুরো এলাকার পরিবেশ মুহূর্তে গেল পাল্টে। পরে গোলোক মজুমদার রুস্তমজিকে রিপোের্ট করবেন, যখন আমার সোনার বাংলা গানটা হচ্ছিল, পুরো সভার দশ হাজার মানুষ যেন বিদ্যুতায়িত হলো। ইলেকট্রিফায়েড। ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে–গাইতে গাইতে সবাই কাঁদছেন, সৈয়দ নজরুল কাঁদছেন, তাজউদ্দীন কাঁদছেন, কামারুজ্জামান কাঁদছেন, ক্যাপ্টেন মনসুর কাঁদছেন, ওসমানী কাঁদছেন, মিজান চৌধুরী কাঁদছেন, মান্নান কাঁদছেন, শেখ মণি, রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব, তোফায়েল, সিরাজুল আলম খান, শাজাহান সিরাজ, উপস্থিত এমপিএরা, এমএনএরা, আমীর, উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা, মাহবুব, তৌফিক, নুরুল কাদের, উপস্থিত মেজররা, কর্নেলরা, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ–সবাই দরদর করে কাঁদছেন। কাঁদছে সমবেত হাজার হাজার লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা, পাঞ্জাবি পরা, শার্ট পরা, খালি গা, খালি পা, স্যান্ডেল পা গ্রামবাসী। এমনকি সেই আমের বাগানে গাছে। গাছে পাখিরাও যেন নিজেদের গান ভুলে কণ্ঠ মেলাতে লাগল ওই আমার সোনার বাংলার সঙ্গে। যখন শিল্পীরা গাইছেন, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি…তখন কুড়ি হাজার চোখ অশ্রুর প্লাবনে ভেসে যেতে লাগল! সাদা বিদেশি সাংবাদিকেরা কলকাতার বাঙালি সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কাঁদছে কেন? কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক বললেন, ওরা ওদের জাতীয় সংগীত গাইছে। জাতীয় সংগীত গাইবার সময় কাঁদতে হবে। কেন? এটা তুমি বুঝবে না। এটা কেবল বাঙালিরাই বুঝতে পারে। বলে কলকাতার সাংবাদিক নিজেই চোখ মুছতে লাগলেন।

মাহবুব লেফট-রাইট করে এলেন মঞ্চের সামনে। স্যার, প্যারেড পরিদর্শনের জন্য দল প্রস্তুত স্যার।

সৈয়দ নজরুল আর কর্নেল ওসমানী তাঁর সঙ্গে চললেন। প্যারেড পরিদর্শন করলেন। ওসমানীর পরনে নতুন পোশাক। গতকাল নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে দরজিকে দিয়ে বানানো হয়েছে। নতুন পোশাকে তাঁকে বেশ প্রত্যয়ী মনে হচ্ছে।

প্যারেড পরিদর্শন শেষে সৈয়দ নজরুল মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন। মার্চপাস্ট করে তাদের সালাম জানিয়ে পুলিশ-আনসারের দলটা অনুষ্ঠান চত্বরের প্রান্তে গেল। মাহবুব ঘোষণা দিলেন : হল্ট। ডিসমিস…আনসার-পুলিশরা জনতার সঙ্গে মিশে গেলেন।

কোরআন শরিফ থেকে পাঠ হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী :

মুজিবনগর, বাংলাদেশ

তারিখ : ১০ এপ্রিল ১৯৭১

যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং

যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগদলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং

যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং

যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং

যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং

যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং

যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং

যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে; এবং

যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;

সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।

এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি…

ইউসুফ আলী শপথ করালেন। উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা শপথ নিলেন। সৈয়দ নজরুল ভাষণ দিলেন, তাজউদ্দীন বক্তৃতা করলেন।

দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা ছবি তুলল, চলচ্চিত্র ধারণ করল, এলাকার মানুষের কথা রেকর্ড করে নিল। হাজারও মানুষ চেয়ারে বসে, চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে, আমগাছের ডালে উঠে বসে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটাকে প্রত্যক্ষ করল।

এরই মধ্যে মেজর ওসমানের ইপিআর দল চলে এসেছে। তারাও একবার মার্চপাস্ট করে সালাম জানালেন নতুন সরকারের নেতৃবৃন্দকে।

অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে গেলেন নেতারা। তাজউদ্দীন সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন উপরাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রীদের। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, জায়গার নাম কী?

তাজউদ্দীন বললেন, মুজিবনগর।

সাংবাদিকদের গাড়িতে তুলে আবার কলকাতার উদ্দেশে রওনা করিয়ে দেওয়া হলো।

নেতারা আরও খানিকক্ষণ থাকলেন। এলাকাবাসী মুড়ি, চিড়া, পানি, ভাত-রুটি যে যেভাবে পারে, এনে নেতাদের খাওয়াতে লাগলেন। তারা নেতাদের জড়িয়ে ধরলেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন, আর কাঁদতে লাগলেন।

তাঁদের চোখের পানি নেতাদের চোখের পানির সঙ্গে মিশে পড়তে লাগল বৈদ্যনাথতলার মাটিতে।

তাজউদ্দীনরা গাড়িতে উঠছেন। তৌফিক, মাহবুব, ওসমান তাঁদের বিদায় জানাচ্ছেন। তৌফিক বললেন, স্যার, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আপনারা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ দিলেন।

তাজউদ্দীন বললেন, তোমরা ইতিহাসের সাক্ষী নও। তোমরা ইতিহাসের নির্মাতা।

.

একে একে নেতারা গাড়িতে উঠে কলকাতার দিকে চলে গেলেন।

মাহবুব, তৌফিক, এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা, এলাকাবাসী রয়ে গেলেন। তাদের সামনে অনেক কাজ। যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলবে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা এলাকা থেকে বিতাড়িত করবেনই।

৩৪

বাংকারে এলএমজি পোস্টে মোস্তফা। ২২ বছরের সুঠাম যুবক। ৮০০ গুলি আছে। তিনি চালাতে থাকবেন গুলি। ততক্ষণে তার সঙ্গীরা নিরাপদে সরে যেতে পারবে।

কুমিল্লা, আখাউড়া রেললাইনের ধারে অবস্থান নিয়েছেন তারা। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকেই।

১৮ এপ্রিল ১৯৭১।

মোহাম্মদ মোস্তফা জাত সৈনিক। পাকিস্তানের চেয়ে এক বছরের ছোট। ১৯৪৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম। ভোলার দৌলতখানের হাজীপুর গ্রামে জন্ম তার। তার বাবাও ছিলেন মিলিটারি। সবাই তাঁদের বাড়িটাকে বলত, হাবিব মিলিটারির বাড়ি। বাবার মতো মোস্তফাও মিলিটারি হতে চেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। হাবিলদার বাবার সঙ্গে বালক মোস্তফা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেও থেকেছেন। তাঁরা ছিল দুই ভাই, তিন বোন। মোস্তফাই বড়। বাবার গল্প তাঁকে গর্বিত করে। বাবা ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। সেই সময়ই গ্রামে এসে মালেকা বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরপরই চলে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। বাবার সঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থাকার সময় বালক ছোট্ট মোস্তফা দেখেছেন। কুচকাওয়াজ। বিশেষ করে ব্যান্ডদল যখন বাদ্য বাজাত, আর সৈন্যরা মার্চপাস্ট করত, খুব ভালো লাগত মোস্তফার। ১৯৬৬ সালে মোস্তফার বিয়ে হলো ভোলার গ্রামে, স্ত্রী পেয়ারা বেগম। কিন্তু বিয়ের পরই ছেলে নিখোঁজ। মোস্তফা ফিরেছিলেন ১৯৬৮ সালে, জানিয়েছিলেন, আর্মিতে জয়েন করেছেন।

এলএমজির ট্রিগারে হাত রেখে গুলি চালাতে চালাতে মোস্তফার মনে পড়ছে তার স্ত্রী পেয়ারা বেগমের কথা। বউটা পোয়াতি। তাঁকে বাড়ি রেখে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর। তারপর তো দেশেই ঘূর্ণিঝড় লেগে গেল। নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। মার্চ মাস ধরে অসহযোগ।

৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি তার। মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে। খবর আসছে, পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈন্যদের ওপরে আক্রমণ করবে। মেজর খালেদ মোশাররফকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়, সেখান থেকে আলফা কোম্পানিসহ তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শমসেরনগরের দিকে। শমসেরনগরে মেজর শাফায়াত জামিল আর মেজর খালেদ মোশাররফ বৈঠক করলেন। যুদ্ধ আসন্ন। তাঁরা বিদ্রোহ করবেন।

.

২৫ মার্চের পর কুমিল্লায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে। আর শমসেরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন খালেদ মোশাররফ আর শাফায়াত জামিল। এপ্রিলের শুরুতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব কোম্পানি একত্র হয়। মেঘনার পশ্চিমে তারা শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বিপুল শক্তি সংগ্রহ করে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান, গানশিপসহ এমন আক্রমণ করে যে পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া মুক্তিবাহিনীর কোনো উপায় থাকে না। এরপর তারা আখাউড়াতে তাদের ডিফেন্স লাইন গড়ে তোলে।

১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী আখাউড়া আক্রমণ করতে এলে যুদ্ধ শুরু হয়। একটা পুকুরপাড়ে সর্বডানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মোস্তফা কামাল এলএমজি নিয়ে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত। ১৭ এপ্রিল ব্যাপক গোলাগুলি হয়।

১৮ এপ্রিল প্রচণ্ড বৃষ্টি। পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাগুলিও থেমে গেছে। তবে কি তারা ফিরে গেছে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে।

কিন্তু না। একটু পরে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। দুই দিক থেকে আক্রমণ আসছে। মোগড়াপাড়া, গঙ্গাসাগরের দিক থেকে। দরুইন গ্রামের এই ডিফেন্স পোস্টে ১০ জনের প্লাটুনের কমান্ডার মোস্তফা। মেজর শাফায়াত জামিল তাকে ল্যান্স নায়েকের ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা পরেই তিনি এখন যুদ্ধরত।

দুই দিক থেকে আসা একযোগে আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা চাপে পড়ে গেছে। তাদের পিছিয়ে যেতে হবে। পেছানোর জন্যও কভার দিতে হবে।

মোস্তফা বললেন, আমি এলএমজি চালাচ্ছি। তোমরা সরে যাও।

এলএমজির নল প্রচণ্ড গরম। গুলি বের হওয়ার সময় মাটি পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনী এগোচ্ছে সার বেঁধে। তাদের অনেকের হাতেই এলএমজি। এমনকি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করছে তারা।

মোস্তফা তাঁর কাজ জানেন। কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে হবে শত্রুদের। তারপর তিনিও পিছিয়ে যাবেন।

ঠিক এ সময়ে তার মনে পড়তে লাগল তাঁর বাবার মুখ। বাবা ছিলেন বীর। তিনটা মেডেল পেয়েছেন বিশ্বযুদ্ধের সময়। মনে পড়ে মায়ের মুখ। মা বলছিলেন, বাবা, আবার কবে আসবা? সাইক্লোনে সব ভাসায়া নিয়া গেছে, তবু আমরা তো বাঁচিয়া আছি।

ভোলা থেকে আসার পর চিঠি এসেছে বাবার। বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা। তোমার স্ত্রী গর্ভবতী। একবার আসিয়া দেখিয়া যাইয়ো।

মোস্তফা ভাবলেন, আমার বাবা ছিলেন সৈনিক। আমিও হয়েছি সৈনিক। আমার ছেলেও সৈনিক হবে। তবে সে হবে স্বাধীন দেশের সৈনিক।

ছেলের নাম কী রাখা হবে?

আমি ছেলেকে দেখতে যাব। তবে যখন যাব, তখন এই দেশ শত্রুমুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশ।

মোস্তফা গুলি চালাচ্ছেন তিন দিকে। একবার দক্ষিণে, একবার পশ্চিমে, একবার উত্তরে।

একজন সহযোদ্ধা বললেন, মোস্তফা চইলা আহো।

মোস্তফা বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি যাও। আমি আসতেছি।

গুলি শেষ হয়ে এসেছে। আর থাকার মানে হয় না। বাংকার থেকে বেরোতে যাবেন, অমনি একটা গুলি এসে লাগল তার কাঁধে। উড়ে গেল কাঁধ। পড়ে গেলেন তিনি। বাংলার মাটিতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। এই পানি কি মিশে যাবে মেঘনার স্রোতে?

পাকিস্তানি মিলিটারি চলে এসেছে এই এলএমজি পোস্টে। দেখল, একটা বাঙালি সৈন্য তখনো নড়ছে। এ তো বেঁচে আছে। বেয়নেট চালাল তারা।

মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গেছে তাদের ক্যাম্পে।

পড়ে রইল মোস্তফার নিস্পন্দ শরীর। গুলিবিদ্ধ, বেয়নেট-চেরা।

পরে সৈন্যরা চলে গেলে দরুইন গ্রামের চাষা আর শ্রমিকেরা আসে সেখানে। মোস্তফা কামালকে সমাহিত করে সেই জায়গাতেই।

বড় ছেলে মোস্তফার মৃত্যুসংবাদ ভোলার সেই টিনে ছাওয়া বেড়ার ঘরের বাড়িতে কবে এসে পৌঁছায়, তার মা মালেকা বেগম কবে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আর কবে পেটের ভেতরে সন্তান নিয়ে পেয়ারা নির্বাক হয়ে ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়ান, কে তার খোঁজ রাখে!

জুলাই মাসে পেয়ারা বেগমের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। ছেলে। ছেলের নাম রাখা হলো মোশাররফ হোসেন। দাদা হাবিলদার হাবিব তাঁকে ডাকেন বাচ্চু বলে। তা থেকেই ছেলের নাম হয়ে গেল মোশাররফ হোসেন বাচ্চু।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, মো. মোস্তফাকে স্বাধীনতার পর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হইল। নামের লগে যুক্ত কইরা দেওয়া হইল কামাল। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল।

৩৫

ফজরের আজান হচ্ছে টুঙ্গিপাড়া মসজিদে। আকাশ তখনো অন্ধকার। মোরগ ডেকে উঠছে শেখ বাড়ির মুরগির খুপরিগুলোতে। সারা রাত ভ্যাপসা গরমের পর ভোরবেলাটা একটু ঠান্ডা।

শেখ কামাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। নিজের ছোট্ট ব্যাগটা রেডি করে নিয়ে তিনি গেলেন দাদা-দাদির ঘরে।

শেখ কামাল শুনেছেন তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই ভাষণ পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এক গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে এই ভাষণ প্রচার করা হয়েছিল। সেটার রেকর্ড এখন। প্রচার করা হচ্ছে। শেখ কামালের রক্তের ভেতর যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বর্ডার পার হতে হবে। আকাশবাণী, বিবিসি শুনে বুঝতে পারলেন, যুদ্ধের সন্ধানে যেতে হবে ওপারে।

দাদা বারান্দায় এসেছেন। অজু করবেন। বাড়ির দেখভাল করেন আরশাদ মামু, তিনি কাসার বদনায় পানি এনে দিয়েছেন।

কামাল দাদা লুত্যর রহমানকে কদমবুসি করলেন। দাদিও বেরিয়ে এসেছেন বারান্দায়। তিনিও অজু করবেন। কামাল দাদিকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, দোয়া করেন। আমি যাচ্ছি।

কই যাও? দাদা বললেন।

কামাল বললেন, যুদ্ধ করতে যাই।

দাদা বললেন, দ্যাখো। তোমার আব্বা মানুষের জন্য দেশের জন্য সংগ্রাম করতে গেছে, আমি কোনো দিনও বাধা দেই নাই। তুমি আজকে দেশের জন্য সংগ্রাম করতে যেতে চাচ্ছ, তোমাকেও আমি বাধা দেব না।

কামাল বললেন, দোয়া করেন।

দাদা বললেন, দোয়া করি। ভালো থাকো। সুস্থ থাকো। নিরাপদ থাকো।

কামাল বললেন, আপনারাও ভালো থাকবেন।

দাদা বললেন, এইখানে থাকা আসলে নিরাপদ না। এইটা শেখ মজিবরের বাড়ি। এইখানেও মিলিটারি আসবে। তুমি যাও। সেইটাই ভালো। আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমার সাথে তো কারও শত্রুতা নাই। আমি থাকি।

কামাল, ২১ থেকে বয়স ২২-এর দিকে যাচ্ছে, এরই মধ্যে গোঁফ হেঁটে ফেলেছেন, চুলে দিয়েছেন কদমছাট, পরনে একটা ফতুয়া, যাতে কিছুতেই তাকে চেনা না যায়। সঙ্গে তোক ঠিক করা আছে, তাঁরা চললেন বর্ডারের উদ্দেশে। সূর্য ওঠার আগেই রওনা দিতে হবে। বেলা এগারোটার মধ্যে যতটুকু পারা যায়, এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে যা রোদ, ভীষণ কষ্ট হবে। প্রথমে যেতে হবে কাশিয়ানী থানা। সেইখানে চাপতাবাজারে বর্ডারের লোক আছে। বাকি পথ সেই লোক গাইড করে নিয়ে যাবেন। খালাতো ভাই শেখ শহীদও ঢাকা থেকে এসেছেন টুঙ্গিপাড়া। দুই ভাই একই সঙ্গে যাবেন ওপারে।

শহীদ বলেন, কামাল হাঁটতে পারবি তো!

কামাল বলেন, আমি যে স্পোর্টসম্যান, সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নাই। আমি ক্রিকেট খেলি, ফুটবল খেলি, বাস্কেটবল খেলি। ইউনিভার্সিটিতে আমি দৌড় প্রতিযোগিতা করে মেডেল পাইছি। তোমার দেখি আমার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই।

তোকে তো কোনো দিন হাঁটতে দেখি না। সারাক্ষণ তো তুই গাড়িই চালাস।

কামাল বলেন, গাড়ি চালাই বলে হাঁটতে ভুলে গেছি, ব্যাপার তা নয়।

আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। পাখিরা গাছগাছালিতে প্রাণপণে ডাকছে। লোকজন ঘুম থেকে উঠছে। গরু বের করছে গোয়াল থেকে। মাঠেও যাচ্ছে কৃষকেরা। যত তাড়াতাড়ি যত দূরে চলে যাওয়া যায়, ততই ভালো। না হলে পথে দেখা হলেই লোকে জিজ্ঞেস করে, কোন বাড়ির পোলা? শেখ বাড়ির না?

তারা দ্রুত হাঁটেন। সূর্য উঠছে। সূর্যটাকে পূর্ব দিগন্তে একটা আস্ত ডিম পোচের মতো দেখাচ্ছে। আহা, এই সময় বাজাতে হয় পূরবী রাগ। অদৃশ্য সেতারের তারে আঙুল বোলান কামাল।

এগারোটা পর্যন্ত একটানা হাঁটলেন। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে একাকার। একটা রাস্তার ধারের টিউবওয়েলের মুখে মুখ রেখে পানি পান করলেন পেট ভরে। তারপর বসলেন একটা গ্রাম্য বাজারে। চা খাওয়া দরকার। টোস্ট বিস্কুট পাওয়া গেল বড় বড়। টোস্ট বিস্কুট কিনে ভাঙা কাপের চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলেন।

এখানে ঘোড়া ভাড়া পাওয়া যায়। কামাল বললেন, আর কত মাইল আছে। কাশিয়ানী?

আরও ১৫ মাইল।

তাইলে চলো ঘোড়া ভাড়া করি।

পারবি তুই ঘোড়ায় চড়ে চলতি? পড়েটড়ে যাবি না তো!

আরে কী বলো তুমি। দ্যাখো পারি, না না পারি।

কাশিয়ানীর আগে আগে তারা ঘোড়া ছেড়ে দিলেন। রিকশা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা রিকশা ভাড়া করলেন। কাশিয়ানী বিপজ্জনক জায়গা। ওয়্যারলেস পোস্ট আছে। পাকিস্তানি মিলিটারির জন্য এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মিলিটারি থাকতে পারে।

ওড়াকান্দি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে উঠলেন তাঁরা। ততক্ষণে সূর্য হেলে পড়েছে। পেটও খিদেয় চো চো করছে। রাস্তায় কলা কিনে খেয়েছেন, একটা বাজারে থেমে খেয়েছেন গুড়ের জিলাপিও। কিন্তু ভালোমতো সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার তো আর খাওয়া হয়নি।

পুকুরের পানিতে গোসল সেরে নিয়ে টিনে ছাওয়া বারান্দায় পাতা সেগুন কাঠের হাই বেঞ্চি লো বেঞ্চিতে যখন তাদের কাঁসার থালায় ভাপ ওঠা গরম ভাত দেওয়া হলো, সঙ্গে শুরুতেই সেদ্ধ ডিমের ভর্তা, তখন কামালের জিবে পানি চলে এল। যেন কত দিন তিনি খাননি।

বাড়ির লোকেরা কামাল আর শহীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সবুজ লুঙ্গি পরা এক লোকের সঙ্গে–এই যে আরশাদ আলী, ইনিই আপনাদের নিয়ে যাবেন বর্ডার পর্যন্ত।

রাতের বেলা বাড়ির লোকজনের সঙ্গে গল্প করতে করতে তার ব্যাগ থেকে ছোট্ট ট্রানজিস্টর রেডিও বের করে বিবিসির খবর ধরলেন কামাল। তারা। আকাশবাণী শুনলেন। তারপর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন পাটের স্তূপের পাশে একটা বড় পালঙ্কে। পাশে শহীদের নাক শঙ্খের মতো ডাকছে।

আরশাদ আলীকে নিয়ে কামাল আর শহীদ বেরিয়ে পড়লেন পরদিন খুব ভোরবেলা। সকালের নাশতার চেয়ে রোদ ওঠার আগে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছানো জরুরি। অন্ধকারের মধ্যেই তারা হাঁটতে শুরু করলেন। গাজীর হাট হয়ে দৌলত শরাফপুর পাইকগাছা হয়ে কাটাখালী। সেখানে এসে তাদের আটকালেন একজন ষন্ডামার্কা লোক। তার হাতে বন্দুক। সঙ্গে আরও লোকজন।

কে উনি?

মকবুল চেয়ারম্যান।

কোন মার্কা?

মুসলিম লীগ। হারিকেনের সাপোর্টার।

মুসলিম লীগের এই স্বঘোষিত রাজাকাররা আটকে ফেলল এই তিনজনকে। তোমরা কারা?

আরশাদ আলী বললেন, যা বলার আমিই বলবনে। আপনারা চুপ কইরে থাকেন।

আরশাদ আলী বললেন, আমরা সাতক্ষীরার মানুষ। গোপালগঞ্জ এসেছিলাম। এখন আবার সাতক্ষীরা যেতে চাচ্ছি।

কেন, যেতে চাচ্ছ কেন?

এইখেনে আর কত দিন থাকপ? যেতে হবি না নে! চেয়ারম্যান সাব, দু কুড়ি টাকা আছে। নিয়ে নেন। আমাদের ছেড়ে দেন দিকিনি।

ছয় কুড়ি টাকা নিয়ে মকবুল চেয়ারম্যান ছেড়ে দিলেন ওদের। নৌকা নিয়ে তারা আবারও চলতে শুরু করলেন।

বহু পথ হেঁটে রিকশায়, ঘোড়ার গাড়িতে, নৌকায়, মোষের গাড়িতে চড়ে শেষতক কালীগঞ্জের পাইকাড়া গ্রামের ঠাণ্ডাই গাজীর বাড়িতে এসে উঠলেন তারা। তত দিনে শেখ কামালের শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। বারবার বমি করছেন। এই বাড়িতে থাকলেন কদিন। শরীরটা একটু শক্তপোক্ত হলো। এরাও খুব যত্ন করলেন। শেখ সাহেবের ছেলে শুনে তারা বন্দুক নিয়ে তিন ভাই পালা করে বাড়ি পাহারা দিতেন।

তারপর একদিন বিকেলবেলা রওনা হলেন তারা। প্রথমে দেবহাটা থানার নংলা গ্রামে আশ্রয় নিলেন। সেখান থেকে ছুটিরপুর দিনে দিনে। রাতের অন্ধকারে সীমানা পেরিয়ে বর্ডারের ওপারে চলে গেলেন। পশ্চিম বাংলার হাসনাবাদে তখন সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম নুরুল হুদা। তিনি শেখ সাহেবের ছেলেকে কাছে পেয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরলেন।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আব্বার কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেল?

করাচি নিয়ে গেছে শুনলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু তো জানি না। কামাল বললেন।

হাসনাবাদে ভালো জায়গায় রাখা হলো কামাল আর শহীদকে। রাতের বেলা গোসল করে গরম ভাত খেতে পারলেন।

পরের দিন গাড়ি করে তাদের নামিয়ে দেওয়া হলো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ বাড়িটির সামনে।

বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে। বিএসএফের পাহারা পেরিয়ে নিচতলা থেকে সোজা দোতলায় উঠে গেলেন কামাল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম চাচার ঘরে। তিনি ছিলেন না। এরপর গেলেন তাজউদ্দীন চাচার ঘরে।

তাজউদ্দীন গভীর মন দিয়ে একটা কিছু লিখছিলেন। কামালকে দেখামাত্র উঠে এলেন। এত দিনে কামালের মুখে দাড়ি গজিয়েছে, গোঁফও বড় হয়ে গেছে। ফলে চিনতে একটু দেরি হলেও না চেনার কিছু ছিল না। তাজউদ্দীন শেখ কামালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কামাল সাধারণত আবেগ প্রকাশ করেন না। কিন্তু এখন কাদা ছাড়া কীই-বা করার আছে। দুজনে কাঁদলেন অনেকক্ষণ ধরে।

তাজউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন, ভাবি কেমন আছেন? বাড়ির আর সবাই কে কেমন আছে?

কামাল বললেন, আমি তো বাড়ি ছেড়েছি অনেক দিন আগে। একটার পর একটা বাসা বদল করছিলেন মা। কে কোথায় কীভাবে এখন আছে, সেই খবরটা জানি না। ঢাকা ছাড়ার আগে দেখা করে এসেছিলাম। সেও তো অনেক দিন আগের ঘটনা।

মুজিব ভাইকে করাচি নিয়ে গেছে। জানো?

জি শুনেছি।

তুমি এসেছ। খুব ভালো হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বসো। তোমাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন।

আমি কিন্তু চাচা ট্রেনিং নিয়ে ফ্রন্টে চলে যাব। যুদ্ধ করব। টেবিলে কাজ করব না।

তা করতে চাইলে সেটাও করা যাবে। আগে তোমার থাকার ব্যবস্থা করি।

আমি নজরুল চাচার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।

হ্যাঁ। খুব ভালো হয়! যাও।

তাজউদ্দীন আহমদ একটা গভীর আশ্বাসের স্পর্শ যেন লাভ করলেন। শেখ মণিসহ যুবনেতা ছাত্রনেতারা তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করে তাদের সরকার গঠনটাকে মেনে নিতে পারেননি। শেখ কামাল যদি ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বসেন, কিংবা ফ্রিডম ফাইটারের ট্রেনিংও নেন, তাহলে সেটা তাঁদের জন্য একটা বড় সমর্থন ও স্বীকৃতি হিসেবে অন্যদের সামনে দেখা দেবে। শেখ মণি যদিও তার ফুফাতো ভাই, তবু দুজনের চলাফেরা, মেলামেশা এমনকি উচ্চাশাও আলাদা। কামাল খুবই সংস্কৃতিমনা। খেলাপাগল। তিনি চাইলে কালচারাল ফ্রন্টে লড়তে পারেন। ক্রীড়াক্ষেত্রেও করার আছে অনেক কিছু! বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা স্বাধীন বাংলা খেলোয়াড় দল টাইপ কিছু তো তিনি তৈরি করতেই পারেন। সংগঠক হিসেবে তাঁর সুনাম আছে।

কামাল যুদ্ধে যাবেনই। তাকে আপাতত কাজ দেওয়া হলো, প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি (এইড-ডে-ক্যাম্প) হিসেবে কাজ করতে হবে।

কামাল আবারও দেখা করলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে, চাচা, আমি কিন্তু ফ্রন্টে গিয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করতে চাই।

তাজউদ্দীন বলেন, বাবা, যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমি অবশ্যই তোমার জন্য ভালো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ভালো জায়গায় পোস্টিং দেব। আপাতত তুমি মুজিবনগরে বসো। তোমার উপস্থিতি আমাদের সাহস দেবে, প্রেরণা দেবে। টু স্পিক দ্য ট্রুথ, এইটা একটা এনডোর্সমেন্ট। তুমি দেখো, মুজিব ভাই নাই। রাম যখন ছিলেন না, তখন তাঁর জুতা সিংহাসনে রেখে ভরত রাজ্য পরিচালনা করেন। আমিও বঙ্গবন্ধুর ছবি সামনে রেখে কাজটা করছি। তোমার আমার পাশে থাকাটা কত জরুরি বুঝছ তো! তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, তুমি সহজেই বুঝবে।

কামাল কথাটার মানে বুঝলেন। কলকাতা এসে তিনি নানান কথা শুনছেন। মণি ভাই নাকি বলছেন, তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে ধরিয়ে দিয়েছেন। কামাল ভেবে পান না, আব্বা যদি দেশের কথা ভেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিজে না নিতেন, তাহলে কি তাজউদ্দীনের পরামর্শে তিনি টলতেন! এই সিদ্ধান্ত আব্বার নিজের, আব্বা একজনের সঙ্গেই পরামর্শ করেছেন, তা হলো মা। মায়ের এই সব বিষয়ে সিক্সথ সেন্স প্রবল। মা বলেছেন, তুমি কেন পালাবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা তো ইয়াহিয়া খানের ভয়ে পালিয়ে যেতে পারে না। তোমার মতো নেতা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, দেশের বাইরে যাচ্ছে, এটা হতেই পারে না। এটা তোমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। তোমাকে যদি ইয়াহিয়া খান মেরে ফেলে, তাহলেও দেশ স্বাধীন। যদি বাঁচিয়ে রাখে, তাহলেও দেশ স্বাধীন। মায়ের সঙ্গে এর মধ্যে দুবার দেখা হয়েছে, বিলাপের সঙ্গে মা এই সব কথা বলতেন।

৩৬

মিয়ানওয়ালি কারাগার পাঞ্জাবে, রাওয়ালপিন্ডি রোডে, মিয়ানওয়ালি শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। ১৯০৪ সাল থেকে এই জেলখানা চালু আছে, ১৭২ একর জমিজুড়ে কৃষিখামার, জেল এরিয়া, আর হাই সিকিউরিটি এরিয়া। মিয়ানওয়ালি এলাকাটাই প্রচণ্ড গরম, এপ্রিল, মে, জুনে এখানে। পিচ গলে যায় রাস্তায়, মাঠ থেকে আগুনের হল্কা ওঠে, ছাদের ওপরে রাস্তায় গরম বাতাস আগুনসমুদ্রের মতো ঢেউ তোলে; দৃশ্য এখানে গরম বাতাসে কাঁপতে থাকে। মগজ-গলানো সেই গ্রীষ্মে শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছে একটা ছোট্ট সেলে, জানালা নেই, অনেক উঁচুতে একটা ছোট্ট গবাক্ষ আছে মাত্র। সেই গবাক্ষ দিয়ে আকাশের একটা ক্ষুদ্র অংশ দেখা। যায়।

এই সেলে মুজিব একা থাকেন। গরমে সেদ্ধ হন। তাকে খাবার দেওয়া হয় খুবই খারাপ, বিছানা-বালিশ দেওয়া হয়েছে অপর্যাপ্ত। তারও চেয়ে বড় কথা, তাঁর সঙ্গে কাউকে কথা বলতে দেওয়া হয় না।

তবে বিকেলে চল্লিশ মিনিটের জন্য তাঁকে সেল থেকে বের হতে দেওয়া হয়। সেলের সামনে চল্লিশ গজের চিলতে একটা পরিসরে তিনি হাঁটেন। এই সময় তিনি আকাশ দেখতে পান। তারপর পাশে তাকাতেই বিশাল বড় দেয়াল তাঁর শ্বাসরোধ করে ফেলতে চায়।

অবশেষে তাকে একটা ফ্যান দেওয়া হয়। সেই ফ্যানটা ছোট্ট ভ্যাপসা গরমে তেতে ওঠা ঘরের উত্তপ্ত বাতাসকে আরও গরম করে তুলতমাত্র।

তাঁর কাছে একবার দেখা করতে আসেন একজন ছোটখাটো মানুষ। বলেন, আমি এখানকার জেলার। আমি আপনার কুশল জানতে এসেছি। আশা করি আপনি ভালো আছেন।

শেখ মুজিব ঠিক করে রেখেছেন, তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। তিনি চুপ করে থাকেন।

আমরা আপনার মঙ্গল চাই। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের প্রশংসা করবেন যে আপনাকে আমরা ফ্যান দিয়েছি।

শেখ মুজিবের মনে হলো, লোকটার গালে তিনি কষে চড় মারেন। কিন্তু তিনি জানেন, তারা তাঁকে ফাঁসি দেবে। কাজেই এখন এমন কোনো কিছু করা উচিত হবে না যাতে তারা কারাগারের মধ্যেই তার ওপরে চড়াও হওয়ার কোনো অজুহাত খুঁজে পায়।

আপনার জন্য আমরা তো তামাকের ব্যবস্থা করেছি।

কথা সত্য। শেখ মুজিবকে পাইপ রাখতে দেওয়া হয়েছে। তামাকও দেওয়া হয়।

আপনার স্বাস্থ্য চমৎকার আছে। বলতে গিয়ে লোকটার চোখ কাঁপে। কারণ সে দেখতেই পাচ্ছে যে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। ওজন। কমে গেছে।

আপনার জন্য আমরা তো ইমপ্রুভড ডায়েটের ব্যবস্থা করেছি। আপনাকে এখন দুইটার বদলে তিনটা করে রুটি দেওয়া হচ্ছে।

শেখ মুজিব এই বিদ্রূপগুলো গ্রহণ করতে পারছেন না। তাকে খাবারের নামে যা দেওয়া হচ্ছে, তা তার জন্য অখাদ্য। তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমাগতভাবে খারাপ হচ্ছে। গরমে তাঁর ফ্লু হয়েছে, তিনি অনেক দিন রোগে ভুগেছেন। এখন এসবও সহ্য হয়ে এসেছে।

আপনি লোকটা তো অকৃতজ্ঞ–আমি আপনার জন্য এত কিছু করলাম, আর আপনি আমাকে একটা ধন্যবাদও দিচ্ছেন না। আপনার জন্য আমরা তো একজন ফালতুও নিয়োগ দিয়েছি। সে আপনার সেবাযত্নও করতে পারবে।

মুজিব কিছু বলছেন না দেখে বিরক্ত হয়ে জেলার উঠে গেলেন। জেলার তাঁর নিজের বুকের মধ্যেই একটা চাপ বেদনা তিনি অনুভব করলেন। কারণ, তিনি আসলে মিথ্যা বলছিলেন। সেল এলাকার বাইরে গিয়ে জেলার তাঁর সঙ্গী প্রহরী ও কর্মকর্তাদের বললেন, আকাশ কি মেঘলা হয়ে গেছে? আজ কি বৃষ্টি হবে?

মুজিব জানেন, তার সেলের মধ্যে ইদানীং একটা লোক দিনের বেলা আসে। সে বলে, সে একটা মেয়েকে অপহরণ করেছিল। সে জন্য তার জেল হয়েছে। নিজের নাম সে বলে আকবর। কিন্তু মুজিব এই জীবনে কম জেল খাটেননি! লোকটার উচ্চতা, চুল কাটার ধরন, আর গোলাকৃতি মুখে লম্বা নাকের নিচের কৃত্রিম হাসিটি বলে দেয় যে সে মিথ্যা বলছে। আসলে পাকিস্তানি মিলিটারি তাকে নিযুক্ত করেছে তার ওপরে নজরদারি করার জন্য।

লোকটা মুজিবের সঙ্গে খাতির দিতে চায়, তাঁর সঙ্গে গল্প করতে চায়। মুজিব কোনো কথা বলেন না।

মুজিব জানেন না দেশে কী হচ্ছে। মুজিব জানেন না তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা কেউ বেঁচে আছে কি না। ৩২ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে তারা প্রচণ্ড গুলিগালাজ করছিল। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য গুলিবর্ষণের দরকার ছিল না।

এবার মুজিবের কাছে মিলিটারির লোকজন আসতে শুরু করে। তারা তাঁর কাছ থেকে এমন বিবৃতি বের করার চেষ্টা করে, যা দিয়ে হয় তাঁর ফাঁসি নিশ্চিত করা যাবে, নয়তো যা প্রকাশ করে বাংলাদেশের সংগ্রাম বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মুজিব ঠিক করেছেন, তিনি কোনো কথাই বলবেন না। তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দেন না। তিনি জানেন, তিনি যা বলবেন, তা-ই তাঁর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। তিনি যদি বলেন, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন ২৫ মার্চ রাতেই, তাহলে সেটাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে, তিনি যদি বলেন, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তাহলে সেটার রেকর্ড বারবার করে প্রচার করা হবে। ২৫ মার্চ রাতে তার বাড়িতে যত গোলাগুলি করেছে, পিলখানা আর রাজারবাগে যত গুলি করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যত গোলাগুলি করা হয়েছে, যে খবর তার কাছে ফোনের পর ফোনে আসছিল, যার প্রেক্ষাপটে তিনি নির্দেশ দেন যে মেসেজ প্রচার করো, তারপর বাংলার মানুষ নিশ্চয়ই প্রতিরোধ রচনা করেছে। তিনি নির্দেশ দিয়ে এসেছেন, চট্টগ্রামের বাঙালি সৈন্যদের বলো–নট টু সারেন্ডার, মুভ টুওয়ার্ডস কুমিল্লা, তাজউদ্দীন, মণি, তোফায়েল, রাজ্জাক, সিরাজকে কলকাতার অ্যাড্রেস মুখস্থ করানো আছে, কলকাতাতে তার লোক বাড়ি ভাড়া করে কয়েক বছর ধরেই লিয়াজোঁ করছে–বাংলার মানুষ মুক্তির জন্য লড়ছে–এই মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে বিভ্রান্ত করানোর জন্য তাঁর একটা কথাই যথেষ্ট–তাই আর্মি ইন্টেলিজেন্স বারবার করে তাঁর কাছে আসছে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে, আপনার কোনো দোষ নেই, আপনি বলুন, তাহলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, সেই সব দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় ভোলার লোক তো শেখ মুজিব নন।

তাঁকে কোরআন শরিফ দেওয়া হয়েছে। তিনি কোরআন শরিফ পড়েন। এর বাইরে পড়ার জন্যও তাকে কিছু দেওয়া হয় না। তিনি বই চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা বলেছে, বই দেওয়া হবে না। শুধু তিন বেলা প্রহরীরা এসে তাঁকে খাবার দিয়ে যায়। লোহার গেট খোলার শব্দ হয়। খাবারটা রেখে নিঃশব্দে লোকেরা চলে যায়। আবার গেট বন্ধ হওয়ার শব্দ আসে।

একবার এক প্রহরী তাকে জিজ্ঞেস করল, শেখ সাহেব, আপনি বেঁচে আছেন কীভাবে? এইভাবে কেউ বাঁচতে পারে?

শেখ মুজিব বললেন, আমার দেশের মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

আর একটা কথা তিনি তখন বলেননি। কিন্তু পরে বলেছিলেন। তখন। ভেবেছিলেন। সেটা হলো : আশা। তিনি স্থিরভাবে জানতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এত মানুষের এত আত্মদান, এত রক্ত কোনো দিন বৃথা যেতে পারে না। তিনি তখন আবৃত্তি করতেন :

বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা?
স্বর্গ কি হবে না কেন?
বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবে না এত ঋণ?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?
নিদারুণ দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

৩৭

রেনু স্তম্ভিত। স্তম্ভ নিজেও কখনো এত স্তম্ভিত হয়েছে কি না, কে জানে। তিনি কথা বলছেন না, তিনি একটা আহ শব্দও উচ্চারণ করছেন না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ৩২ নম্বরের বারান্দায়। সঙ্গে মমিনুল হক খোকা।

খোকার হৃদয়টাকে কেউ যেন ব্লেড দিয়ে চিরে চিরে দিচ্ছে, হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, চোখ দুটো ফেটে আসতে চাইছে, যেন দুই চোখ বেয়েও এখন রক্তধারা বইবে।

একটু দূরে বারান্দার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান মেজর জেনারেল গোলাম উমর। মানিক মিয়ার ছেলে ইত্তেফাক-এর আনোয়ার হোসেন মনজুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আর্মিরা, পরে তাকে বাড়িতে ফেরত দেওয়া হয়। রেনু আর খোকা এসেছেন মানিক মিয়ার বাড়িতে, মানিক মিয়ার বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, এসে বিপদে পড়লেন তাঁরা। ঘরে বসে আছে, মমিনুল হক খোকা পরে রেনুকে বুঝিয়ে বলবেন, মেজর জেনারেল উমর। এমন একটা অভাবিত সুযোগ উমরের সামনে।

মেজর জেনারেল উমর রেনুকে প্রস্তাব দিলেন ধানমন্ডিতে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে, যা পাহারা দেবে পাকিস্তানি আর্মি। এর বিকল্প হতে পারে বেগম মুজিবকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, কিংবা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা। রেনু উপস্থিত বুদ্ধিমতো ধানমন্ডিতে বাসা নিয়ে থাকতে রাজি হলেন, তবে তার শর্ত হলো, বাসা ভাড়া তারা নিজেরা দেবেন, আর পাকিস্তানি সরকারের কোনো রকমের অর্থসাহায্য নেবেন না। ওয়াজেদ মিয়া এখন তার সঙ্গেই থাকেন, তাঁর বেতন এখনো পাওয়া যাচ্ছে, মমিনুল হক খোকাও। খরচাপাতি দিতে পারবেন, কিন্তু রেনু আসল চালাকি করলেন, তা হলো হাসুর আব্বার একটা খোঁজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। তিনি বললেন, ৩২ নম্বরের বাড়িতে হাসুর আব্বার ব্যাংকের চেকবই আছে, সেগুলো আনতে হবে, আর। এরপর শেখ সাহেব যদি আমাদের নামে একটা অথরাইজেশন লেটার পাঠান যে ব্যাংকের টাকা তারা তুলতে পারবেন, তাহলেই হয়ে যাবে। মেজর। জেনারেল উমর এ প্রস্তাবে রাজি হলেন, কারণ শেখ মুজিবের স্ত্রী যদি অন্য অনেক নেতার পরিবারের মতো পালিয়ে ভারতে চলে যান, সেটা পাকিস্তানের। জন্য বড় আঘাত হবে, অন্যদিকে বেগম মুজিবকে যদি জিম্মি হিসেবে নিজেদের পাহারায় রাখা যায়, দরকারের সময় দর-কষাকষিতে ব্যবহার করা যাবে। মুজিবের ওপরে বেগম মুজিবের যে অনেক প্রভাব আছে, সেটা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিভাগ খুব ভালো করেই জানে। মেজর জেনারেল উমর বললেন, ঠিক আছে, এখনই চলুন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। মানিক মিয়ার বাড়ি। থেকে ৩২ নম্বরের দূরত্ব খুবই কম, শুধু ৩২ নম্বর সেতুটা পার হলেই তো। সেই বিখ্যাত বাড়িটি।

খোকার গাড়িতে রেনু, পেছনে পেছনে উমরের গাড়ি।

গাড়ি দুটো এসে ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। রেনু নামলেন। খোকা নামলেন। উমর তাঁদের পেছনে পেছনে।

বাড়ির দিকে একবার তাকিয়েই রেনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এই কি সেই বাড়ি, যেখানে ২৫ মার্চ বিকেলেও মিছিলের পর মিছিল। এসেছিল। এই কি সেই বাড়ি, যেই বাড়িতে গমগম করত মানুষজন, আত্মীয় পরিজন, কাজের লোক, অকাজের লোক, মেহমান, পরিদর্শক, সাক্ষাৎপ্রার্থীরা। সারা বাড়ির গায়ে গুলির দাগ, গোলার আঘাতের চিহ্ন। বারান্দায় কাঁচের গুঁড়া, ভাঙা কাঁচের টুকরা, প্রতিটা আলমারির কাঁচ ভাঙা, টেবিল-চেয়ার অনেকগুলো নেই, অনেকগুলো ভাঙা, স্টিলের আলমারি ভাঙা, জনগণের দেওয়া সোনার নৌকা, সোনার ৬ দফা কিছুই নেই, এমনকি স্টিলের আলমারির ড্রয়ারে রেনু আর হাসিনার যত সোনার গয়নাগাটি ছিল, সেসবও নেই। রেনু উঁকি দিলেন নিচতলার বইয়ের ঘরে, যে ঘরে শেখ মুজিব বসতেন, পড়তেন, নেতাদের ডেকে নিয়ে মিটিং করতেন সেই ঘরে, সেই ঘরে ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল, শেলি, কিটস–সব বই গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন। দেয়ালের ছবিগুলোতে গুলির চিহ্ন। রবীন্দ্রনাথের ছবি গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে, হাসুর আব্বার ছবি, পারিবারিক ফটোগুলো সব ছিন্নভিন্ন, লন্ডভন্ড।

রেনু কাঁদবেন না। রেনু একটা আহ্ শব্দও করবেন না। তিনি খোকাকে বললেন, ওই ড্রয়ারটা খোল তো। ওইটাতে চেকবই থাকার কথা।

চেকবই পাওয়া গেল। সোনাদানা, টাকাপয়সা, বাসনকোসন লুট হয়েছে, চেকটা লুট হয়নি, চেকবই নিয়ে ব্যাংকে গেলে ধরা পড়ার ভয় থেকে যায় তো। খোকা ময়লা ড্রয়ার খুলে চেকবইগুলো নিলেন।

বাইরে এলেন তাঁরা। খোকা মেজর জেনারেল উমরকে বললেন, এই যে চেক পাওয়া গেছে, অথরাইজেশন লেটার আনিয়ে দিন।

উমর বললেন, আপনি একটা অথরাইজেশন লেটার লিখে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি ব্যবস্থা করে দেব।

রেনু আর খোকা খোকার গাড়িতে করে মগবাজার পেট্রলপাম্পের পেছনে নতুন ভাড়া নেওয়া বাড়িতে। বদরুন্নেসা আপার বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে তাঁরা এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন, বদরুন্নেসাদের বাড়িটা ছিল বড় রাস্তার ওপরে, আর সন্দেহজনক লোকদের ওই বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছিল। তারপর খোকা বের হলেন অথরাইজেশন লেটার টাইপ করানোর জন্য। টাইপ করা শেষে সেটা উমরের লোকের হাতে তুলে দিয়ে থোকা ফিরে এলেন তার ভাবির কাছে।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, পরে বঙ্গবন্ধুর সাইনসহ সেই অথরাইজেশন লেটার ব্যাংকের ঠিকানায় ফিরা আসে। ব্যাংকের ম্যানেজার যোগাযোগ করেন খোকার লগে। খোকা ব্যাংকে গিয়া তার মিয়া ভাইয়ের সইটা দেইখা জানে পানি ফিরা পান। এর মানে হইল, বঙ্গবন্ধু বাইচা আছেন।

.

রেনু বললেন, ভাইডি, ব্যবস্থা কর। আমরা আজ সন্ধ্যাতেই এখান থেকে পালায়া যাব। পারবি না আমাদের নিয়ে সরে যেতে?

খোকা বললেন, ভাবি। আপনি বললে অবশ্যই পারব। তবে সমস্যা হলো, আপনাকে সবাই চেনে। হাসিনাকেও সবাই চেনে। অন্য দশটা পরিবার সহজে পালাতে পারে। আপনাদের পক্ষে পালানো খুব কঠিন। বাঙালিরা যেখানেই আপনাদের দেখবে, ঘিরে ধরবে। বিহারিরা দেখলে, পাকিস্তানিরা দেখলে, জামাতি মুসলিম লীগাররা দেখলে মেরে ফেলবে। তারপরও আপনি বলছেন, চলেন, বিকেলের দিকে বের হই। ওয়াজেদের গাড়ি আমার গাড়ি দুইটা গাড়ি নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যাব। যা হয় হবে।

শেখ হাসিনা নাজুক শরীর নিয়ে রান্না করেছেন। রেনু নামাজ পড়তে জায়নামাজে বসেছেন। জামালও নামাজ পড়ছেন। জামাল সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত করতে যাবেন, এই সময় আবদুল বারান্দা থেকে বলে উঠল, ভাইয়া, দেখে যান।

জামাল বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকালেন। দুটো ট্রাকের মতো। ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু বন্দুকের নল। তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে মাকে বলতে লাগলেন, মা, গাড়িভর্তি শুধু বন্দুক আর বন্দুক।

খোকা সাব, জামাল বলতে বলতে বুটের আওয়াজ তুলে কতগুলো লোক দোতলায় উঠে এল।

তারা দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।

ওয়াজেদ মিয়া দরজা খুললেন।

সামনে দাঁড়ানো লোকটা বললেন, আমি মেজর হোসেন। এই বাড়িতে শেখ মুজিবের ফ্যামিলি আছে। আমি তাদের অ্যারেস্ট করতে এসেছি।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, আপনাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে?

মেজর বললেন, দেশে মার্শাল ল চলছে। আমি মিলিটারির এমন বিভাগের কর্মকর্তা, যারা যেকোনো কাউকে যেকোনো সময় অ্যারেস্ট করতে পারে। তার হাতের ওয়্যারলেস তুলে তিনি কাউকে খবর দিলেন আরও ফোর্স পাঠাতে।

বেগম মুজিব বেরিয়ে এলেন। বললেন, আমাকে কেন অ্যারেস্ট করবা?

আমি কি রাজনীতি করি?

মেজর বলল, আপনাদের আমাদের সাথে যেতে হবে। বেগম মুজিব, রেহানা, রাসেল আর জামাল যাবে। বাকিরা আলাদা পরিবার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। উনি স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারবেন। খোকা আলাদা ফ্যামিলি।

রেনু বললেন, আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। তাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

আচ্ছা তাহলে তাকে সঙ্গে নিয়েই চলেন।

না। যাব না।

আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, আপনাদের আমরা করাচি পাঠিয়ে দেব।

বাড়িতে তো আসবাব বলতে কিছু ছিল না। যা দুই-চারটা বাসনকোসন ছিল, সেসব বস্তাতে ভরে রমা আর আবদুলকে রাখা হলো সেসবের সঙ্গে। ওয়াজেদ আর খোকার দুই গাড়ি, আর্মির জিপ-ট্রাক মিলে একটা সেনাবহর, ট্রাকের সামনে এলএমজি বসানো, সৈনিকদের হাতে হাতে স্টেনগান, সন্ধ্যার সময় মগবাজার থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল হয়ে তাঁদের আনা হলো ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে। বাড়ির ভেতরে তাঁদের ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা দেওয়া হলো।

পুরো বাড়ি অন্ধকার। মেঝে সঁতসেঁতে। কোনো ফার্নিচার নেই। তারা দিয়ে গেল একটা পুরোনো দুর্গন্ধযুক্ত কম্বল।

দুপুরে তাদের খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যার পর এই বাড়িতে এসেছেন তারা। খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। রাসেলও না খেয়ে। মমতাজ হকের ছোট্ট বাচ্চাটাও কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছেন হাসিনা।

খোকা উল্টো দিকের এক আত্মীয়বাড়ি থেকে বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করে ফেললেন।

রাত ১২টার দিকে সৈন্যরা মিলিটারি চৌকি আর রুটি-ডাল দিয়ে গেল।

মিলিটারি গাড়ি করে রমা আর আবদুলও এসে গেল বস্তাভরা বাসনকোসন নিয়ে। সেই বাসন বের করে রেহানা সবার হাতে হাতে খাবার তুলে দিতে লাগলেন।

সারাটা দুপুর খাওয়া হয়নি। হাসু আপার নিজের হাতের রান্না ফেলে রেখে তারা চলে এসেছেন। রেহানা বললেন, এই ছিল আমারে রেজেকে। আপার রান্না না খেয়ে এখন মিলিটারি রুটি খেতে হচ্ছে।

ওয়াজেদ মিয়া রুটি ঘেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। খোকা বললেন, ওয়াজেদ মিয়া, তোমাকে কি রুটি ছিঁড়ে দেব?

জামাল হেসে উঠলেন। এই রুটি গুলি না করে ভেঁড়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না!

বাইরে সশস্ত্র সেনাপ্রহরা। তারা ক্যাম্প বানিয়ে বাড়ির চারদিকে পাহারা বসিয়ে সঙিন উঁচিয়ে রইল।

৩৮

ইন্দিরা গান্ধীর মন খারাপ। মেজাজও খারাপ। মন খারাপ থাকলেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয় না। অনেক সময় খুব মন খারাপ থাকলে তিনি খুব নরম হয়ে যান। তখন নাশতার টেবিলে রাহুলকে কোলে নেন, আর পরিচারিকা নারীটির হাতে একটা আঙুর তুলে দেন। আবার মেজাজ খারাপ অবস্থায়, তিনি গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীতও গাইতে থাকেন, একা একা, কাউকে না শুনিয়ে। আজকে তার মন খারাপ। কারণ, বাংলাদেশ থেকে খুব মন খারাপ করা খবর আসছে। পাকিস্তানি মিলিটারি সাধারণ মানুষদের ওপরে নির্বিচার গুলি চালাচ্ছে, বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, লাশে লাশে সব ছেয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বলেছেন যে এরই মধ্যে ১০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি রাগে ফুঁসছেন এ জন্য যে র রিপোর্ট করছে, নারীদের ওপরে অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে। সকালবেলা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংবাদপত্রের খবর পড়েই তিনি বিষণ্ণ হয়ে ছিলেন। তার ওপর যখন শরণার্থীদের আসার স্রোত লক্ষ করলেন, তখন তার নিজেকে মনে হলো অসহায়। এরই মধ্যে ৫ লক্ষাধিক শরণার্থী এসে গেছে, মে মাসের শুরুতে সংখ্যাটা ১০ লাখ অতিক্রম করবে। শুধু ১০ লাখ লোককে খাওয়াতে-পরাতে হবে, তা-ই না, এরা সামাজিক রাজনৈতিক আইনশৃঙ্খলা এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি করবে। এরা যদি কলেরায় আক্রান্ত হতে থাকে, তাহলে তো শুধু এরাই মারা যাবে না, আশপাশের জনপদের মানুষও মারা যেতে থাকবে। এরা যদি নকশালবাদী হয়ে যায়, তাহলে এখনই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে ভয়াবহ সমস্যায় ভারত ভুগছে, তা কত গুণ বেড়ে যাবে। এরা যদি সিপিআইএমের ভোটার হয়ে যায়, ভোটের হিসাব পাল্টে দেবে।

মন ও মেজাজ দুটো খারাপ, এই অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী তার অফিসে এলেন। ২৫ এপ্রিল ১৯৭১। দিল্লির আবহাওয়া সবে গরম হতে শুরু করেছে, যদিও তাপমাত্রা এখনো দিল্লির কুখ্যাত গরমের তুলনায় তেমন কিছু না বলেই মনে হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে তিনি একবার বায়ে তাকালেন, চোখে সানগ্লাস, তিনি কী দেখছেন, কী ভাবছেন, তাঁর প্রহরীরাও জানছে না। তিনি কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে করিডর পেরিয়ে নিজের অফিসের দিকে হাঁটতে লাগলেন। আজ মন্ত্রিসভার বৈঠক আছে। নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বসলেন। তার সচিব এবং উপদেষ্টারা তাকে ব্রিফ করলেন। এর মধ্যে আছে তিনটা টেলিগ্রাম। তিনটা এসেছে কলকাতা, গুয়াহাটি আর আগরতলা থেকে। শরণার্থীতে রাজ্যগুলো ভেসে যাচ্ছে, এখন তারা কী করবেন?

তিনি সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। মন্ত্রীরা এবং কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার জানালেন। তিনি বসার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীরা কথা শুরু করলেন।ম্যাডাম, বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আমাদের এখনই কিছু করা উচিত। আমরা কিছুই করছি না। এটা চলতে পারে না।

ইন্দিরা চোখে একটা ডার্ক গ্লাসের চশমা পরেছেন। তিনি অন্যদের তাঁর চোখের ভাষা বুঝতে দিতে চান না।

আমরা কিন্তু বাংলাদেশের জন্য কিছুই করছি না।

আমাদের উচিত এমন কিছু করা, যাতে পাকিস্তান চিরদিনের জন্য একটা শিক্ষা পায়।

ম্যাডাম, পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার এমন সুযোগ আর এক মিলিয়ন বছরেও আসবে না।

ইন্দিরা গান্ধী বললেন, এই, জেনারেল মানেকশজিকে বোলাও।

ইন্দিরা গান্ধী এই মত জানেন, বহু ভারতীয় চায়, এখনই ভারতীয় সৈন্য ঢুকে যাক বাংলাদেশে, পরাজিত করুক পাকিস্তানিদের, সাহায্য করুক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। এই মতের একজন হলেন কে সুব্রামানিয়াম, খুব সিনিয়র আমলা, যিনি যুদ্ধ-রণনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। পরিচালক, ডিফেন্স স্টাডিস অ্যান্ড অ্যানালাইসিস, দিল্লি। সুব্রামানিয়ামের মত হলো, এই লড়াই বেশি দিন চলতে দেওয়া যাবে না, অতি দক্ষ, প্রশিক্ষিত নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার লড়াই বেশি দিন চলতে পারে না, বাঙালিরা হতাশ হয়ে যাবে, যার ফল ভালো হবে না। খুব দ্রুত আক্রমণ করতে হবে এবং এমন করে আক্রমণ করতে হবে যেন পাঁচ দিনের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলা যায়। সুব্রামানিয়ামের এই মত তিনি লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দিয়েছেন, আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ও অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন এখন এই কথাটাই পাড়লেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ এসে হাজির হলেন। মানেকশর চুল সৈন্যদের তুলনায় লম্বা, তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বছর পাঁচেকের বড়, ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুন্দর, উষ্ণ এবং পরিহাসময়। তাঁর সাদাকালো গোঁফে তাকে কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনের বড় সংস্করণ বলে মনে হচ্ছে।

ইন্দিরা বললেন, মানেকশ, এই হচ্ছে টেলিগ্রাম, এটা পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, এটা পাঠিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী, এটা পাঠিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। শরণার্থী আর শরণার্থী। এসব কী হচ্ছে? আপনি এই ব্যাপারে কী করছেন?

মানেকশ আগে থেকেই জানেন তাকে কী বলা হবে। তিনি ঠিক করেছেন তিনি মাথা ঠান্ডা রাখবেন। ঠান্ডাস্বরে কথা বলবেন।

মানেকশ দাঁড়িয়ে থেকে নির্বিকার মুখে বললেন, আমি কিছুই করছি না। আমার এই ব্যাপারে কীই-বা করার আছে।

আপনার কি কিছুই করার নেই? আপনি কেন কিছু করছেন না? ইন্দিরা বললেন।

আপনি কী চান? আমি কী করি? মানেকশ নিরুত্তাপ গলায় বললেন।

আমি চাই আপনি মার্চ ইন করুন। পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ুন।

তার মানে আপনি চাইছেন যুদ্ধ?

যুদ্ধ হলে যুদ্ধ। আমি কিছু মনে করব না যদি তার মানে যুদ্ধই হয়।

মানেকশ বললেন, আপনি কি বাইবেল পড়েছেন?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বললেন, বাইবেলের প্রসঙ্গ এখানে কীভাবে আসছে?

মানেকশ বসে পড়লেন। বললেন, বাইবেলের প্রথম বইয়ে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে আছে, ঈশ্বর বললেন, লেট দেয়ার বি লাইট। আলো আসুক। আর আলো এসে গেল। আপনি বলছেন, লেট দেয়ার বি ওয়ার। যুদ্ধ হোক। আর যুদ্ধ ঘটতে লাগল। আপনি কি প্রস্তুত? আমাকে যদি বলেন, আমি বলব, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমি প্রস্তুত নই।

কেন প্রস্তুত নন। আমরা কি গত বছর থেকেই জানি না যে একটা যুদ্ধ আসন্ন? আমরা কি ১৯৬৮ সাল থেকেই র-এর প্রকল্প বাংলাদেশ বিষয়ে জানি।? আমরা কি মার্চের শুরু থেকেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছি? এপ্রিলের শুরুতেই আমি আপনাকে অভিযানের নির্দেশ পৌঁছে দিইনি?

মানেকশর মনে পড়ছে সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের সঙ্গে তার কথোপকথন। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ পেয়ে মানেকশ ফোন করেছিলেন জ্যাকবকে। সরকার চাইছে তুমি সৈন্যদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে যাও। জ্যাকব বলেছিলেন, একেবারে অসম্ভব একটা নির্দেশ। একেবারে অবাস্তব। আমাদের হাতে আছে শুধু মাউন্টেন ডিভিশন। এরা পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ করতে জানে। এরা জানে না কী করে সমতলে চলতে হয়। বাংলাদেশ একটা নিচু পলিমাটির এলাকা। সমতলের সমতল। একটু পরপর নদী। বর্ষাকালে সেই নদী দুকূল উপচে পুরো বাংলাদেশকে জলমগ্ন করে ফেলে। আমাদের হাতে সেতু বানানোর যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম নেই। বাংলাদেশের ওই পারে আগরতলায় মাত্র একটা গ্যারিসনে মাত্র গোলন্দাজ ব্যাটালিয়ন। মানে আগরতলা অরক্ষিত। আমাদের মাউন্টেইন ট্রুপস ট্রেনিং দিতে হবে, সেতু বানানোর যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম দিতে হবে। ট্রপস আনতে হবে। আগরতলা পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে কত ঘুরে যেতে হয় আপনি জানেন। সামনে বর্ষাকাল। বাংলার নদী কূলহারা হয়ে পড়বে। ধানখেতে ভরে থাকবে ধান আর পানি। আমরা যদি ঢুকেই পড়ি, বড়জোর আমরা পদ্মার পশ্চিম পার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। এখন পর্যন্ত বড় বড় আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো অবস্থান। নেয়নি। মানেকশ জানেন, কথা সত্য। ব্রিটেন এখনো বলছে, এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ২ এপ্রিল ইয়াহিয়ার কাছে সুপ্রিম সোভিয়েত সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। …উদ্ভূত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানকে সমগ্র সোভিয়েত জনগণ সন্তোষের সঙ্গে গ্রহণ করবেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো ইয়াহিয়াকেই অনুরোধ করে যাচ্ছে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য। আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে, কিসিঞ্জার, নিক্সন নীতি নিয়েছেন নিষ্ক্রিয়তার। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডগলাস হোম এটা একটা দেশের দুই অংশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চীন ব্যাপারটাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের অপকর্ম হিসেবে দেখছে। মানেকশ জ্যাকবকে বলেন, তাহলে আমরা কোন তারিখে রেডি হতে পারব?

জ্যাকব বলেন, সেতু বানানোর যন্ত্রপাতি পেলে, সবচেয়ে কাছাকাছি আমরা ১৫ নভেম্বরে রেডি হতে পারব।

পরের দিন মানেকশ আবারও ফোন করতে বাধ্য হলেন জ্যাকবকে।

জ্যাকব, মন্ত্রীরা এবং আমলারা আর্মিকে যদি কাপুরুষ না-ও বলে থাকে, অবশ্যই ওভারকনশাস বলছে। আমরা নাকি বেশি সাবধান! তুমি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হও।

না। আপনি তাদের বলুন, জ্যাকব রাজি না।

তা হয় না। তিনি সেনাপ্রধান। দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে। তিনি অর্ডার করেছেন, তাঁর অধীন লোক অর্ডার মানছে না, এটা তো আর্মিতে হতেই পারে না। তাহলে হয় তাঁকে চলে যেতে হয়, অথবা অধীনস্থকে চলে যেতে হয়।

ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরো মন্ত্রিসভা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মানেকশ বললেন, আমি আপনাদের বলছি কী ঘটছে। এখন এপ্রিলের শেষ। আর ১৫-২০ দিনের মধ্যে শুরু হবে প্রচণ্ড মৌসুমি বৃষ্টিপাত। বর্ষাকালে পূর্ব পাকিস্তানের নদীগুলো সব সাগরের মতো বিশাল হয়ে যায়। নদীর এক পাড় থেকে আরেক পাড় দেখা যায় না। আমাকে পথে আটকে থাকতে হবে। পাকিস্তানি আর্মি আমাকে পেটাতে থাকবে। এ হলো একটা দিক। দুই নম্বর হলো : আমার আর্মার্ড ডিভিশন এখন বাবিয়ানা এলাকায়। আরেকটা আছে সেকান্দারাবাদে। এখন চলছে ফসল তোলার মৌসুম। আমাকে যদি সৈন্য মুভমেন্ট করতে হয়, প্রতিটা ট্রাক, প্রতিটা গাড়ি, প্রতিটা রাস্তা, প্রতিটা রেলগাড়ি রিকুইজিশন দিতে হবে। মানেকশ তাকালেন কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দীন আলী আহমেদের দিকে, বললেন, তারপর যদি দুর্ভিক্ষ হয়, আপনি আমাকে দায়ী করবেন না।

আবারও তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকে ঘুরে তাকালেন, বললেন, আমার আর্মার্ড ডিভিশন হলো আমার স্ট্রাইকিং ফোর্স। এর মাত্র ১২টা ট্যাংক কাজ করে। বাকিগুলো করে না।

অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন বললেন, স্যাম, মাত্র ১২টা ট্যাংক! কেন?

কারণ আপনি অর্থমন্ত্রী! আমি আপনার কাছ থেকে টাকা চেয়ে আসছি। আর আপনি বলেই চলেছেন যে টাকা নেই।

এরপর মানেকশ বলতে লাগলেন, প্রধানমন্ত্রী, যদি ১৯৬২ সালে আপনার বাবা আমাকে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে বলতেন, যাও, চীনাদের ছুঁড়ে ফেলে দাও, তাহলে আমি বলতাম, এই এই বাস্তব সমস্যা আছে। এখন আমি আপনাকে সমস্যাগুলো বললাম। তারপরেও আপনি যদি আমাকে যুদ্ধে যেতে বলেন, আমি যাব, তবে একটা গ্যারান্টি আমি আপনাকে দেব, ১০০ ভাগ পরাজয়।

জগজীবন রাম বললেন, স্যাম, প্রধানমন্ত্রীর কথা মেনে নাও না!

আমি আমার পেশাগত মত দিলাম। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিক। আমাকে জানাক।

ইন্দিরা গান্ধীর মুখ লাল হয়ে আছে। তিনি বললেন, আচ্ছা, চারটার সময় ক্যাবিনেট আবার বসবে। মন্ত্রীরা একে একে বেরিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্যাম, আপনি বসে থাকুন।

সবাই চলে গেল। মিটিং রুমে ইন্দিরা আর মানেকশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মুখ খোলার আগে আমি পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারি। আপনি কোনটা চান, আমি কি মানসিক অসুস্থতার কথা বলব, নাকি শারীরিক অসুস্থতার কথা?

ইন্দিরা বললেন, স্যাম, আপনি বসুন তো। আপনি শুধু বলুন, আপনি যা বললেন তার সবই কি সত্য?

জি সত্য। আমার কাজই তো যুদ্ধ করা। যুদ্ধ করে হারা নয়, জেতা। আপনি বলুন আপনি কি রেডি? আপনার ঘর কি রেডি? আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আপনি কি রেডি? আমার মনে হয় না। আমি জানি আপনি কী চান। আমি আপনাকে সেটাই এনে দেব। তবে সেটা আমাকে আমার সময়ে করতে দিন। আমি আপনাকে ১০০ ভাগ বিজয়ের গ্যারান্টি দিচ্ছি। আরেকটা কথা। আমি বিএসএফের অধীনে কাজ করতে রাজি আছি, সিআরপিএফের (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) অধীনে কাজ করতে রাজি আছি। কিন্তু একটা সোভিয়েত এসে বলবে কী করতে হবে, কী করতে হবে না। এটা চলবে না। আর আমি মাত্র একজন পলিটিক্যাল নেতা চাই, আমি যার কথা শুনব। একবার রিফিউজি মন্ত্রী বলবে, একবার দেশরক্ষামন্ত্রী বলবে, একবার বিদেশমন্ত্রী বলবে, তা হবে না। এখন আপনি আপনার সিদ্ধান্ত নিন।

ইন্দিরা বললেন, আচ্ছা কেউ আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। আপনিই হলেন কমান্ডার।

মানেকশ বললেন, ধন্যবাদ। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনাকে আমি জয় এনে দেব।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, মানেকশ কোয়ারটারডেক পত্রিকায় ১৯৯৬ সালে এই সাক্ষাৎকার দিছিলেন।

ব্যাঙ্গমি, হ। এইটা তাঁর ভাষ্য। এইটাতে একটু রং আর নাটকীয়তা থাকতে পারে। মানেকশ লেখছিলেন, ফিল্ড মার্শাল হওয়া আর বরখাস্ত হওয়ার মাঝখানে ব্যবধান বড় সামান্য।

৩৯

কার্গো প্লেনে এর আগে কেউই চড়েনি। সোহেল ছোট্ট, সে তো কিছুই বুঝবে না, মিমি শুধু বমি করছে, ওর শরীরটা বেশ খারাপ। আম্মুও বললেন, আমিও কোনো দিন এই ধরনের প্লেন দেখিনি।

রিমি বলল, আসলে তো এটা মালামাল পরিবহনের প্লেন।

রিপি বলল, তবু তো প্লেন। আমাদের যে হেঁটে আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে হচ্ছে না এই তো বেশি। না আম্মু?

লিলি মাথা নাড়লেন। ঠিক তা-ই।

রিমি বলল, আমরা তো হাঁটতে পারি। আম্মুর যে পা ভাঙা।

রিপি বলল, সেই ভাঙা পা নিয়েও আম্মুকে কত হাঁটতে হলো।

প্লেন বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামল। এটা শিলিগুড়িতে। তেল নেবে।

প্লেনে উঠলেন তোফায়েল কাকু।

তোফায়েল আহমেদ কাকু লিলিকে সালাম দিলেন। বললেন, ভাবি, আপনাদের কথা ভেবে অনেক দুশ্চিন্তা করেছি। কীভাবে এলেন।

.

প্লেনের ভেতরে চার-পাঁচটা চেয়ার আর দুইটা বেঞ্চ পেতে দেওয়া হয়েছে। আম্মু আর তোফায়েল কাকু পাশাপাশি বসেছেন। রিমি আর রিপি বসল। তোফায়েল কাকুর উল্টো দিকে।

রিমি বলল, কাকু, আমরা যে কতবার কত জায়গায় পালিয়ে গেছি।

রিপি বলল, কাকু, খুব ভয় লাগত। শুধুই খবর আসত, মিলিটারি আসছে। আর আমরা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গেছি।

রিমি বলল, আমরা কতবার কত জায়গায় গেছি, আপনাকে আঙুলে গুনি বলি।

রিপি বলল, আম্মু আমাদের ধানমন্ডির বাড়ির পেছনের বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকে এ বাড়ি ও বাড়ি কত বাড়ি গেছেন।

রিমি বলল, এক বাড়িতে আম্মুকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

রিপি বলল, আমরা ছিলাম খালার বাড়িতে। তারপর কারফিউ তুলে নিলে আমরা চলে যাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে।

রিমি বলল, সেখানেও পাকিস্তানি মিলিটারি এল গুলি করতে করতে।

রিপি বলল, তারপর আমরা পালিয়ে আবার একটা গ্রামে গেলাম। সেখান থেকে আবার আরেকটা গ্রামে। তারপর সেখান থেকে আরেকটা গ্রামে। লঞ্চে চড়ে চড়ে গেছি।

রিমি বলল, আবার ঢাকা ফিরে গেছি। মামুর বাসায় ছিলাম।

রিপি বলল, জানেন আমাদের বাড়িতে মিলিটারি ক্যাম্প বানিয়েছে। সেখানে নানা থাকেন। নানাকে মিলিটারি বলেছে, আপনি এত ভালো উর্দু জানেন, ইংরেজি জানেন, মেয়েকে হিন্দু লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন কেন। ওর নাম তো তাজউদ্দীন না, ওর নাম ত্যাজারাম।

রিমি বলল, তারপর আমরা আগরতলা যাওয়ার জন্য আবার লঞ্চে চড়ে ঢাকা ছাড়লাম।

রিপি বলল, আমরা রামচন্দ্রপুর গ্রামে ওয়্যারলেস অফিসারের বাড়িতে থাকলাম। পরে গেলাম এমএনএর বাড়ি। রাতের বেলা ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, পালাতে হবে। আবার পালানো শুরু।

রিমি বলল, একটা সিঅ্যান্ডবি ব্রিজের ওপরে আর্মির টহল থাকে। নিচ দিয়ে যেতে হবে।

রিপি বলল, আমরা নৌকা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে এসেছি। সেখান থেকে গেলাম সিদলা গ্রামে।

রিমি বলল, তারপর নৌকা। নৌকা ছেড়ে দিয়ে হাঁটা। কত আলপথ, কত টিলা, কত রাস্তা যে আমাদের হাঁটতে হয়েছে। একটা সরু বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়ে…

রিপি বলল, রিমি কেঁদে দিয়েছিল। রিমি বলল, তারপর আমরা বর্ডার পার হলাম।

তোফায়েল আহমেদ মন দিয়ে গল্প শুনছেন। আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কোলে সোহেল। সে জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।

মোট নয় ঘণ্টার উড়াল শেষে বিমান অবতরণ করল দমদম বিমানবন্দরে।

তোফায়েল কাকু বললেন, আপনারা কোথায় যাবেন? আমার সঙ্গে চলুন। আমি পৌঁছে দিই।

লিলি বললেন, আমাদের নিতে লোক আসবে। আমরা তাদের সঙ্গেই যাই। হাইকমিশনে যেতে বলেছে।

তাদের নিতে দুজন ভদ্রলোক এলেন। দুটো অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সিতে তারা চললেন পার্ক সার্কাস। ততক্ষণে দিনের আলো নিভে এসেছে। রিমি, রিপি গাড়ির জানালা দিয়ে কলকাতা দেখছে।

দমদম পুরো গ্রাম। ছোট বিমানবন্দর। সেখান থেকে যাওয়ার পথেও গাছগাছড়া। অনেকক্ষণ চলার পরে কলকাতা শহর শুরু হলো। ল্যাম্পপোস্টে নিয়নবাতি জ্বলছে। অনেক ট্যাক্সি। সব অ্যাম্বাসেডর গাড়ি। টানা রিকশা দেখতে পেয়ে রিমি আঙুল তুলে দেখাল, ওই যে টানা রিকশা। ভয়ানক ভিড় রাস্তাঘাটে। আর ওই যে ট্রাম। টুংটুং শব্দ তুলে চলছে।

শেষে গাড়ি এল কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে। লাল রঙের একটা পুরোনো বাড়ি। কিন্তু বড়ই সৌকর্যময়। আম্মু বললেন, ইংরেজ আমলের বাড়ি।

১৮ এপ্রিল পাকিস্তানের কলকাতা উপহাইকমিশনের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী একযোগে নিজেদের বাংলাদেশ হাইকমিশন বলে ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। সাইনবোর্ডও বদলে ফেলেছে।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, কাজটা করা অত সহজ আছিল না।

ব্যাঙ্গমি বলে, অতিগোপনে তাজউদ্দীন আহমদ আর উপহাইকমিশনার হোসেন আলী একটা গাড়িতে বইসা মিটিং করেন। হাইকমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আগের হারেই বেতন পাইবেন, তাদের লাইগা হাইকমিশনে। জমা টাকা থেকে আলাদা কইরা রাইখা দেওয়া হইব, এই সব শর্ত উত্থাপিত হইলে তাজউদ্দীন রাজি হন।

.

হাইকমিশন অফিসের পাশেই হোসেন আলী সাহেবের বিরাট বাসভবনটাও লাল। দোতলা। অনেক রুম। বিশাল ড্রয়িংরুম। বাড়ির সামনে লন। এতে মাঝেমধ্যেই বড় বড় পার্টি করা যায়, সেই ব্যবস্থা আছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের জন্য হোসেন আলী সাহেব তার গেস্টরুম দিলেন।

সবাই ভীষণ ক্লান্ত, খেয়েদেয়ে সোহেল, মিমি, রিমি, রিপি ও তাদের আম্মু শুয়ে পড়লেন।

একটু পরে হোসেন আলীর ছেলেমেয়েরা ডাকল রিমি আর রিপিকে। এই এসো। একটা জিনিস শোনাই।

রেকর্ড প্লেয়ারে বাজতে থাকল গান :

শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি

প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি, বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। তারপর বাজতে লাগল :

ভায়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি, আপনারা সব জানেন সব বোঝেন…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

রিমি চোখ বড় বড় করে এই গান আর ভাষণ শুনতে লাগল। বড় ভালো লাগার গান। বড় ভালো লাগার ভাষণ। তারা এই গান আকাশবাণীতে আগেও শুনেছে। আর মুজিব কাকুর ভাষণ তো তাদের অনেকবার শোনাই। তবে এই ভাষণ যতই শোনা যায়, ততই ভালো লাগে। সমস্ত গায়ে কাঁটা দেয়।

রাত ১২টার পর তাদের আলু এলেন।

আব্বু রিমি-রিপিকে আদর করলেন। তারপর রিপিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেমন ছিলে?

রিপি বলল, আব্ব, আমাদের কাঁপাসিয়া থানা লুট করে অস্ত্র নিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা। ১০ এপ্রিলে। আপনি যেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন।

রিমি বলল, আব্বু আমরা এক বাড়িতে ছিলাম না। বারবার পালিয়েছি মিলিটারির অত্যাচারে। পথে আমরা অনেক লাশ দেখেছি। লঞ্চে-নৌকায় চলার সময় পানিতে লাশ ভেসে যেতে দেখেছি।

আব্বু উঠলেন। আম্মু যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। বললেন, লিলি কেমন আছ। শোনো, আমি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না। ৭-৮ মিনিটের জন্য এসেছি। অনেক কাজ। তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমরা আপাতত কোহিনূর প্যালেসে উঠবে। পরে নজরুল ভাই, মনসুর আলী ভাইদের বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাটে উঠবে। আরেকটা কথা, আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি। যত দিন দেশ শত্রুমুক্ত না হচ্ছে, যত দিন নিজের দেশে ফিরে যেতে না পারছি, তত দিন দাম্পত্য জীবন যাপন করব না। কাজেই আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না। আমি থিয়েটার রোডে আমাদের অফিসের পাশে রুম নিয়ে থাকি। ওখানেই থাকব।

লিলি থ। তাঁর মনে কত কথা। কত কিছু বলার ছিল। কত কিছু বলবেন। বলে পরিকল্পনা করে রেখেছেন। কিসের কী। আচ্ছা, সেই ভালো। দেশ স্বাধীন করার মিশন নিয়ে এসেছ। দেশ স্বাধীন করো।

আছেন। আমরা তো তবু বন্ধুদেশের আশ্রয় পেয়েছি, আর মুজিব ভাই আছেন। শত্রুর খাঁচায়। তাজউদ্দীনের চোখ ছলছল করে উঠল।

তিনি দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। মিমি আর সোহেলের মাথার চুল বুলিয়ে দিয়ে তাদের কপালে চুমু খেলেন।

আসি লিলি। বলে বের হলেন। রিমি, রিপি বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চুম্বন করলেন।

আট মিনিটের মাথায় তাজউদ্দীন চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *