সেই আংটি – মুহাম্মদ শাহেদুজ্জামান

সেই আংটি

সামনে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল পাভেল। লোকটার কালিঝুলি মাখা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। চুল উষ্কখুষ্ক, কতদিন পানি লাগেনি কে জানে! গায়ে একটা ত্যানার মত পাঞ্জাবী, আর লুঙ্গি। বসে বসে গাছের ডাল দিয়ে মাটিতে আকিবুকি কাটছে। এই লোক আবার জ্যোতিশ্চন্দ্র হয় কীভাবে!

ছোটবেলার বন্ধু রুদ্রর কাছে এই জ্যোতিষের সন্ধান পেয়েছে পাভেল এই লোক নাকি বিরাট এলেমদা আদমি। কারও উপর প্রসন্ন হলে তাকে রাজা বানিয়ে দিতে পারেন, আর খেপে গেলে পথের ফকির বানাতেও দেরি হয় না।

দুই বন্ধুর আবার এইসব অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ। ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুজন ঘুরে বেড়াত বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীর আস্তানায়, আর পীর ফকিরের মাজারে। অবশ্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাস করার মতলবে ফকিরদের দ্বারস্থ হওয়ার সেই ভূত পাভেলের মাথা থেকে অনেক আগেই নেমে গেছে। কিন্তু রুদ্র সেই আগের মতই অন্ধভাবে এসবে বিশ্বাস। করে। পরের দিকে পাভেল রুদ্রকে অনেকটা এড়িয়েই চলত। রুদ্রর বাবা বিশাল ধনী, তার ছেলের পক্ষে এসব পাগলামি মানায়। ছাপোষা পরিবারের সন্তান পাভেল। তিনবেলা। ভাতের চিন্তা, সেই সঙ্গে পরিবারের ভার মাথায় চেপে বসলে সেখানে আর কোন খেয়াল রাখার জায়গা থাকে না।  

এতদিন পর পাভেল আবার বাধ্য হয়েছে কোন জ্যোতিষীর কাছে আসতে। গত ছয় মাসে তার জীবনে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে পরপর। প্রথমে তার বাবা মারা গেলেন, বাবার শোকে তিন মাস পর মা।কয়েকদিন পরেই অফিস থেকে এল বরখাস্তের নোটিশ, কোন কারণ দেখানো হয়নি তাতে। প্রেমিকা তুলির বিয়ে হয়ে গেল মাস খানেক আগে, লণ্ডন প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে। পাভেল শুনেছিল বিয়েতে তুলির খুব একটা অমত ছিল না।

এসব ঘটনার যে কোন একটাই বড়সড় ধাক্কা দেয়ার জন্য যথেষ্ট, সেখানে এতগুলো পরপর। হতাশ হয়ে পাভেল এমনকী আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিল। ঠিক এই সময়, অর্থাৎ এক সপ্তাহ আগে রুদ্রর আগমন। পাঁচ বছর কোন খবর নেই। তারপরে হুট করে দুপুরবেলা সে পাভেলের বাসায় এসে হাজির। অনেকদিন নাকি পাভেলের সঙ্গে দেখা হয়নি, বন্ধুর জন্য মনটা আনচান করছিল। এসেই পাভেলের মুখ দেখে বুঝে নিল অবস্থা বেশি ভাল না। সবকিছু শুনল রুদ্র পাভেলের মুখ থেকে। তারপর সে এই জ্যোতিষীর ঠিকানা দিয়েছিল পাভেলকে। বলেছিল, এই লোক অনেক বড় গুণী মানুষ। যোগসাধনা করেন, মানুষের চোখে চোখ রেখে তার ত্রিকাল বলে দিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধনায় অসুবিধা করে বলে লোকচক্ষুর আড়ালে, শ্মশানে-গোরস্থানে পড়ে থাকেন। এই লোককে যদি পাভেল খুঁজে বের করতে পারে তা হলে তিনিই তার সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। তোর তো এখন আর এসবে বিশ্বাস নেই। কিন্তু এই লোকের দেখা পেলে তোর বিশ্বাস ফিরে আসতে দেরি হবে না। বলেছিল রুদ্র।

হঠাৎ মুখ তুলে পাভেলের দিকে তাকাল লোকটা। কোটরে বসা দুই চোখ, দুটুকরো কয়লার মত জ্বলছে। শয়তানি হাসি সে চোখে। তারপর, লোকটা কথা বলে উঠল।  

কী জন্য এসেছিস? তোর কপালটা কি স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড নাকি যে ডাস্টার দিয়ে লেখা মুছে আবার নতুন করে লিখে দেব? কপালের লিখন খণ্ডানো যায় না রে, পাগলা!

অবাক হলো না পাভেল। কে জানে, এই লোকের কাছে যারা আসে তারা হয়তো ভাগ্য বদলানোর ইচ্ছা নিয়েই আসে। বলল, আমাকে রুদ্র পাঠিয়েছে।

ওই পাগলটা? নিজে জ্বালিয়ে শখ মেটেনি, এখন আবার তোকে পাঠিয়েছে আমাকে জ্বালাতে? বলল বটে লোকটা, তবে পাভেল দেখল রুদ্রর নাম শুনে লোকটার মুখ এখন, কিছুটা প্রসন্ন। ব্যঙ্গের একটা হাসি মুখে লটকে বলল লোকটা, তা বলুন, রুদ্রর মহামান্য অতিথি, কী করতে পারি আমি আপনার জন্য?

রুদ্র যা বলল তা যদি সত্যি হয়, তা হলে তো আপনি ত্রিকালজ্ঞ। কিছুই আপনার অজানা নয়। আমি কেন এসেছি আর কীভাবে আমাকে সাহায্য করবেন সেটা আপনিই বলুন। না? কিছুটা তেড়িয়া মেজাজ দেখাল পাভেল।

স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল লোকটা পাভেলের দিকে। তারপর আচমকা বাম হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর কপালের দুপাশ চেপে ধরল। পাভেল চমকে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটা ওর কপাল চেপে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হলো ওর পুরো শরীরটা নরম কাদা দিয়ে তৈরি। নড়াচড়া করার শক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে যেন সে।

যেমন আচমকা পাভেলের কপাল টিপে ধরেছিল তেমন আচমকাই আবার কয়েক সেকেণ্ড পরে ছেড়ে দিল লোকটা। তারপর গড়গড় করে মুখস্থ বলার মত বলে গেল, ছিয়াশিতে জন্ম। ম্যাট্রিক দিয়েছিস দুহাজার দুই-এ। এইচ এস সি দুই বারে পাশ। ভাল চাকরি করতিস। চাকরিটা চলে গেছে। বিয়েটাও ফসকে গেছে। বাবা-মার একজন অথবা দুজনেই মারা গেছে কিছুদিন আগে। আরও বলব? পাভেলের হাঁ করে তাকিয়ে-থাকা মুখের দিকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেল লোকটা, যে মেয়েটার সাথে তোর বিয়ের কথা ছিল তার বাম গালে একটা তিল আছে। মেয়েটা নদী ভালবাসে। তোরা ঠিক করেছিলি বিয়ের পর নৌকা নিয়ে দেশের সব কয়টা নদী ঘুরে দেখবি…

লোকটার হাত চেপে ধরল পাভেল। থামুন! ধমকে উঠল ও। যেসব কথা কারও জানার কথা নয় সেসব এই লোক কীভাবে জানে? কে বলেছে আপনাকে এসব কথা? জিজ্ঞেস করল ও।

তুই বলেছিস। এইমাত্র। ফিক ফিক করে হাসছে লোকটা, পাভেলের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে খুব মজা পেয়েছে যেন।

ভাষা হারিয়ে চুপ করে থাকল পাভেল। কিছুক্ষণ পর বলল, তা হলে আপনি এখন বলুন, আমি কী করব?

শোন। উপরে একজন বসে আছে। আঙুল দিয়ে উপরে দেখাল লোকটা। আমরা হচ্ছি তার হাতের সুতোয় বাঁধা পুতুল। সে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচায়। আমরা নাচি। তার ইচ্ছে রদ করার ক্ষমতা কোন বাপের ব্যাটার নেই। লোকটার গলা এখন কিছুটা নরম। আমারও ক্ষমতা নেই তোর জন্যে কিছু করার। সামনে আরও বিপদ আসতে পারে তোর। আমি সেগুলো আটকাতে পারব না। তবে এটা রাখ। এই বলে নোংরা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী একটা বের করে পাভেলের হাতটা টেনে নিয়ে খোলা তালুর উপর রাখল লোকটা। জিনিসটা কালো রঙের একটা আংটি। খুব সম্ভব লোহার তৈরি। পাথরের জায়গায় একটা মানুষের মুখ খোদাই করা।

কী হবে এটা দিয়ে? জিজ্ঞেস করল পাভেল।

বাড়ি গিয়ে গোসল করে পরবি আংটিটা। সবসময় এটা পরে থাকিস। বিপদ-আপদ যা আসে আসবে। এই আংটিটা তোর বিপদ কাটাতে না পারলেও তোর মাথা ঠাণ্ডা রাখবে, কীভাবে বিপদ কাটবে সেটা বুঝতে সাহায্য করবে। কখনও খুলবি না। আর এইবার চোখ বন্ধ কর। আমি তিন পর্যন্ত। গোনার পর চোখ খুলবি।

চোখ বুজল পাভেল। লোকটা গুনতে শুরু করল, এক…দুই…তিন।

চোখ খুলতেই পাভেল দেখল, একা একা বসে আছে। সে। সামনে কেউ নেই। আশপাশে যতদূর চোখ যায় কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন। লোকটা।

.

বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল পাভেলের। মধ্যরাতের সুনসান গলি দিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরছে তখন হঠাৎ ঘাড়ের কাছটা। শিরশির করে উঠল। পিছনে কার পায়ের শব্দ? ঘুরে তাকিয়ে অবশ্য কাউকেই দেখতে পেল না পাভেল। মনের ভুল ভেবে আবার পা চালাল সে। বাসায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। পাভেল। বসার ঘরের আলো জ্বলছে। আর সোফায় বসে পা নাচাচ্ছে রুদ্র। পাভেল ঢুকতেই জ নাচাল। কী রে? দেখা হলো জ্যোতিশ্চন্দ্রের সাথে?

তা হয়েছে। কিন্তু তুই ভিতরে ঢুকলি কীভাবে? জিজ্ঞেস করল পাভেল।

অনেকদিন মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, দোস্ত। নিয়মকানুন সব ভুলে গেছি। পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়েছি আর কী। পরে ছাদে উঠে তোদের বাসার ভেতর। ক্ষমাপ্রার্থনার হাসি দিল রুদ্র। এখন বল, কী বললেন জ্যোতিশ্চন্দ্র?

কী বলবেন? এই আংটিটা দিয়ে বললেন সবসময় পরে থাকতে। পকেট থেকে আংটিটা বের করল পাভেল।

আংটিটার দিকে চোখ পড়া মাত্র লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। মুখের ভাব আমূল বদলে গেছে। চোখে যে দৃষ্টি সেটা একমাত্র ছাগলের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত বাঘের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। দেখি আংটিটা! পাভেলের দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল সে।

ত-তুই এরকম করছিস কেন? রুদ্রর ভাবভঙ্গি দেখে ভড়কে গেছে পাভেল।

আংটিটা দে আমাকে! আবার গর্জে উঠল রুদ্র। মনে হলো বুকের অনেক গভীর থেকে উঠে এল গর্জনটা। গলার স্বরও বদলে গেছে তার। কেমন, ঘড়ঘড়ে, জান্তব আওয়াজ। চোখ দুটো জ্বলছে জ্বলজ্বল করে।

কী মনে হলো পাভেলের, আংটিটা মুঠোয় ভরে ফেলল সে। তারপর, হঠাৎ করে রুদ্রর বাড়ানো হাতের দিকে চোখ গেল তার। বহুদিনের পচন ধরে শুকিয়ে যাওয়া মড়ার মত শুকনো, কোঁচকানো সে হাতের চামড়া আঙুলের মাংসহীন হাড়গুলো জড়িয়ে রেখেছে। বড় বড় লোম উঠেছে এখানে সেখানে। পাঁচটা আঙুলের মাথায় তীক্ষ্ণ, বাকানো নখ! এ গলা শুকিয়ে এল পাভেলের। এ আর যে-ই হোক, রুদ্র নয়! প্রচণ্ড অবিশ্বাসে পিছু হটতে গিয়ে সোফায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। ওদিকে রুদ্রর মুখেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক চেহারা দ্রুত বদলে রূপ নিচ্ছে এক ভয়াবহ দানবে। মুখের চামড়ায় কালচে রং ধরল, তারপর পচে গলে গিয়ে খসে পড়তে শুরু করল চামড়া। একটা চোখ কোটর থেকে খসে বাইরে ঝুলে পড়ল, চোয়ালের চামড়া দুফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত। লকলকে জিভ বেরিয়ে ঝুলে পড়ল মুখের এক পাশ দিয়ে। দমকা বাতাসের একটা ঝাঁপটার সঙ্গে পাভেলের উপর ঝুঁকে এল শয়তানটা। দে আংটিটা!

আংটি দেবে কী, পাভেল তখন ভয়ে আধমরা। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। দানবটা ধীরে-ধীরে পাভেলের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল। এত কাছে যে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল পাভেলের নাকে। যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে সে। তারপর, হঠাৎ করে পাভেলের উপর থেকে সরে গেল বীভৎস মুখটা। মনে হলো কে যেন এক টান মেরে সরিয়ে নিয়ে গেল। তৃতীয় এক ব্যক্তি এসে ঢুকেছে ঘরে। সেই জ্যোতিষী!

রুদ্রবেশী দানবটার ঘাড় ধরে তাকে টেনে সরিয়ে এনেছে। লোকটা। নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা ছুঁড়ছে দানবটা, কিন্তু জ্যোতিষীর কোন বিকার নেই। যেন একটা ছমাসের শিশুকে ধরে রেখেছে। তা হলে এই ব্যাপার? এই শয়তান তোর পিছনে লেগেছে? আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার! কথা কটা বলে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে পাভেলের দিকে ছুঁড়ে দিল লোকটা। এটা খুলে ওর গায়ে ছিটিয়ে দে দেখি!

শিশিটা পাভেলের গায়ে এসে পড়ল। তখনও সংবিৎ ফিরে পায়নি সে। কোনমতে কাঁপা কাঁপা হাতে শিশির মুখ খুলল। ওদিকে, পাভেলের হাতে শিশিটা দেখেই তীব্র আক্রোশে গর্জন করে উঠল দানবটা, আর তার ছটফটানির মাত্রাও বেড়ে গেল দ্বিগুণ।

পাভেল আর দেরি করল না। শিশির ভেতরের তরলটুকু ছুঁড়ে দিল দানবটার গায়ে। মনে হলো আগুন ধরে গেছে, এভাবে চেঁচিয়ে উঠল শয়তানটা। কিন্তু ঘাড়ে চেপে বসে আছে জ্যোতিষীর বজ্রমুষ্টি, একচুলও শিথিল হলো না। ছটফট করতে করতে তীব্র আক্ষেপে ধারাল নখ দিয়ে নিজের গায়ের মাংস খুলে আনতে শুরু করল দানবটা, সেই সঙ্গে চলছে।

পাভেল এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যের দিকে। হঠাৎ দেখল, দানবটার জায়গায় ছটফট করছে রুদ্র, সেই পুরানো রক্তমাংসের রুদ্র। মুখ তুলে পাভেলের  দিকে তাকাল সে। দোস্ত, বড় কষ্ট হচ্ছে আমার! আমাকে বাঁচা, দোস্ত, আমাকে বাঁচা!

কেমন যেন ঘোর পেয়ে বসল পাভেলকে। ধীরে ধীরে দুপা এগিয়ে গেল সে, উদ্দেশ্য রুদ্রকে জ্যোতিষীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ধমক শুনতে পেল, খবরদার! ওর মায়ায় ভুলিস না! বিড়বিড় করে কী যেন বলে তীব্র ঘৃণায় এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিল জ্যোতিষী রুদ্রর মুখে। পরক্ষণে আরেকবার বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠল রুদ্র। তারপর দপ করে আগুন জ্বলে উঠল তার শরীরে, নিমিষে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সে। ঘরের বাতাসে কেবল ভেসে রইল মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ।

এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পেয়ে লোকটার দিকে তাকাল। পাভেল। আ-আ-আ-আপনি… তোতলাচ্ছে সে।

হ্যাঁ, আমি। মুচকি হাসল জ্যোতিষী। দেখা যাচ্ছে ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম।

কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?

ধ্যানে। তোর পিছনে আমি একটা কালো ছায়া দেখতে পাই। বুঝতে পারি তোর বড় কোন বিপদ আসন্ন এবং সেটা এই পৃথিবীর কারও কাছ থেকে নয়। আংটির ক্ষমতা খুব সামান্য, ওটা তোকে বাঁচাতে পারত না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে নিজেই আসতে হলো।

আর…আর রুদ্র?

এ রুদ্র নয়, সে তো নিজের চোখেই দেখলি। তোর বন্ধু রুদ্র তিন বছর আগেই মারা গেছে। এই প্রেত তোর পিছে লেগেছিল অনেক আগে থেকে। তোর জীবনে ইদানীংকালের ভেতর যেসব বিপদ এসেছে তার সবগুলোর পিছনেই এর হাত ছিল।

ত-তার মানে? আমাকে এসব বিপদে ফেলে ওর কী লাভ?

ও আসলে আমার কাছেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু খুবই নিম্নস্তরের শক্তি ধরে ওর মত অশরীরীরা, আমার ধারে কাছেও যে কারণে ও ভিড়তে পারত না। এজন্যেই ও তোর সাহায্য নিয়েছিল। প্রথমে তোকে নানা বিপদে ফেলে মানসিকভাবে দুর্বল করে নেয়। তারপর রুদ্র সেজে আসে তোর কাছে। জানত আমার কথা বললে পুরানো বন্ধুর কথা তুই ফেলবি না। আংটিটা আমার কাছে আছে এটা কেউ জানত না। আমি বেশিদিন হাতে রাখতে চাইনি, কারণ অশরীরী জগতে আমার একটু বেশিই আনাগোনা। যে কেউ জেনে যেতে পারত। এই আংটিটা দেখতে খুবই সাধারণ, কিন্তু এটা হাতে পেলে ওর শক্তি বহুগুণে বেড়ে যেত। জিনিসটা মানুষের চেয়ে অশরীরীদের জন্যেই বেশি দরকারী।

কিন্তু ও যদি ভালভাবে চাইত, তা হলেই তো আমি দিয়ে দিতাম। এর জন্য এত ঝামেলার কী দরকার ছিল?

ওই যে বললাম, নিম্নস্তরের অশরীরী। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আংটিটা দেখে লোভের ঠেলায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আর এমনিতেও ও তোকে মেরেই ফেলত।

এখন তা হলে কী হবে? অসহায় মুখে প্রশ্ন করল পাভেল।

ওরা যেহেতু জেনে গেছে এটা তোর কাছে আছে, আমার মনে হয় আংটিটা তোর কাছে রাখা আর উচিত হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি। আর তোর বিপদের কারণ উদ্ঘাটিত হয়ে গেল, আশা করা যায় আর কোন বিপদে তুই পড়বি না। সুতরাং এই আংটিরও আর কোন দরকার নেই তোর। আসি। মৃদু হেসে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যোতিষী। হতভম্বের মত দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল পাভেল।

.

শেষ চমকটা অবশ্য তখনও পাভেলের জন্য অপেক্ষা  করছিল।

পরদিন সকালবেলা।

এমন ভয়ই পেয়েছিল পাভেল, শেষ পর্যন্ত একা একা নিজের বাড়িতে না থেকে পাশের আঙ্কেলের বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়েছিল। সাতসকালে বাড়িতে আসতেই দেখল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে দুজন লোক। সেই জ্যোতিষী! …আর…রুদ্র!

র-রুদ্র? তুই? তুই না মরে গেছিস? প্রায় ককিয়ে উঠল পাভেল।

আমি মরিনি। ভয় পাসনে। গায়ে হাত দিয়ে দেখ, আমি রক্তমাংসের মানুষ। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল রুদ্র। এ রুদ্রর হাত স্পর্শ করে ভয় অনেকটা কাটল পাভেলের।

তা ছাড়া সকালের আলো, চারদিকে, রাস্তা দিয়ে লোকজন। চলাফেরা করছে। কাল রাতের ঘটনাগুলো কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল এখন। কিন্তু…ওরা এখানে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জ্যোতিষীর দিকে তাকাল পাভেল।

আংটিটা কোথায়? পাভেলের চোখ তার দিকে ফিরতে জিজ্ঞেস করল জ্যোতিষী।

কোথায় মানে? আমি না ওটা কাল রাতেই আপনাকে দিয়ে দিলাম? হকচকিয়ে গেল পাভেল।

সব কথা খুলে বল। গতকাল আমার কাছ থেকে আসার পর কী কী হয়েছে সবকিছু।

জ্যোতিষীর কথা মত সব খুলে বলল পাভেল। কথা শেষ হতেই হতাশায় মাথার চুল খামচে ধরল রুদ্র। সব শেষ হয়ে গেল, গুরু! হতচ্ছাড়া প্রেতটাকে কিছুতেই আটকানো গেল না!

চল, দেখি কী করা যায়। কিছুতেই ছাড়ব না ওই শয়তানকে আমি। দৃঢ় গলায় বলল জ্যোতিষী।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বলল পাভেল।

অল্প কথায় বুঝিয়ে দিচ্ছি। জ্যোতিষী থেমে দাঁড়াল। ওই আংটিটা প্রেতজগতের অনেকেই হাতে পেতে চায়। রুদ্রর রূপ ধরে একটা প্রেত তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল আংটিটা হাতানোর জন্য। তোর মুখে রুদ্রর নাম শুনেই আংটিটা আমি তোকে দিই। কিন্তু রুদ্রর রূপধারী এই প্রেত আংটিটা দখল করার আগেই আরেকটা অশরীরী, এবং এ প্রথম প্রেতের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী, তোর বাড়িতে পৌঁছে যায় এবং প্রথম প্রেতকে সরিয়ে আংটিটা দখল করে।

তার মানে,..তার মানে… বিশ্বাস করতে পারছে না পাভেল।

তার মানে কাল রাতে দ্বিতীয় প্রেত আমার চেহারা নিয়েই তোর বাড়িতে গিয়েছিল। তুই বিনা দ্বিধায় তাকে আংটিটা দিয়ে দিয়েছিস।

আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি… কী বলবে বুঝতে পারল না পাভেল।

তোর কোন দোষ নেই। তুই তো আর আসল ঘটনা জানতিস না।

এবার রুদ্র মুখ খুলল। যাই হোক, দোস্ত, এবার আমরা যাই। অনেক কাজ বাকি। শয়তানটাকে ধরতেই হবে।

– হ্যাঁ, হাতে সময় বেশি নেই। তা হলে এবার তুই চোখ বন্ধ কর! পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলল জ্যোতিশ্চন্দ্র। চোখ বুজল পাভেল।

এক…দুই…তিন!

মুহাম্মদ শাহেদুজ্জামান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *