গোরস্থানের কাছে – নাশমান শরীফ

গোরস্থানের কাছে

এক

ইনায়া সবসময় নানুর সাথেই থাকে। জন্মের পর থেকে নানুই ওর সব, সেটা বুঝে গেছে। বাবা ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে, মা কোর্ট আর ক্লায়েন্ট। নানুও ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে।

ইনায়া এটুকু জানে, নানুর সংসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও। স্বাভাবিকভাবেই নানুর প্রভাব ওর চরিত্রে অনেকখানি। শান্ত-স্নিগ্ধ নরম পরিপাটি ও, দেখতেও নানুর মতই সুশ্রী।

ওরা থাকে উত্তরায়। নানুর বাড়ি মূল শহর থেকে একটু ভেতরে। তবু প্রতিদিনই নানুকে দায়িত্ব পালন করতে হয় ওর। সেটা কখনও হয়তো নানুকে গিয়ে অথবা ওকে নানুর বাসায় নিয়ে।

চতুর্থ শ্রেণীতে পড়লেও বুদ্ধিতে ভীষণ পাকা ও।

অন্যান্য শিশুদের মত গল্প শুনতে ভালবাসে। ভূতের গল্প। পছন্দ করে ও, তবে একটু বড়দের। নানুর গল্প বলতে হয়। ওকে প্রতিদিন।

ইনায়ার মা তানতা গেছে একটা কনফারেন্স-এ যোগ দিতে সিঙ্গাপুর। আর ও এসেছে গ্রামে। এই প্রথম, নানা নানুর সাথে বেড়াতে।

নানু, তোমাদের গ্রামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। দেখতে গ্রাম হলেও এখানে তো ঢাকার মত সবই আছে। শুধু এসিটা লাগালেই ঢাকা হয়ে যেত। দুপুরে খাওয়া সেরে নানুর কোলের ভেতর শুয়ে বলছিল ইনায়া।

সেটা ঠিকই বলেছ, নানু, এখন আর এই নাদুরিয়া গ্রাম নেই, যেন এক টুকরো শহর। অথচ জানো, তোমার নানুর ছোটবেলা কেটেছে এই বাড়িতেই, কত ভয়ে! টিমটিমে হারিকেনের আলোয় ভূতের ভয়ে কেঁপেছি।

নানু, তুমি কি সত্যি ভূত কখনও দেখেছ?

হ্যাঁ, দেখেছি। শুধু দেখাই না, ভূত আমার অতি আপনজন।

তা হলে তো আজ তোমার আপন ভূত-এর গল্পই শুনব। বলবে না আমাকে?

না, নানু, তুমি যে ভয় পেতে পারো। ওটা তো তোমার শোনা সাধারণ ভূতের গল্প নয়, ওটা সত্যি আপন। ভূত–অতি আপন!

প্রমিয, নানু! আমি একটুও ভয় পাব না, আর দিনের বেলা ভয় কীসের?

তবে তো বলতেই হয়। ভয় পেলে কিন্তু আমার দোষ নেই, নানু।

দুই

প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানা। গড়াই নদীর শাখা নদী-স্থানীয় নাম ছোট নদী। তারই এপারে অপূর্ব সুন্দর সাজানো গ্রাম নাদুরিয়া। হয়তো নদীর পারে বলেই নামটা নদীর সাথে মিলিয়ে নাদুরিয়া। ওপারের গ্রামটা আরও সুন্দর। ওটা সরাইল গ্রাম। তখন গ্রামগুলো ছিল অন্ধকারে ঢাকা এক নিভৃত পল্লী। বিদ্যুৎ ছিল না; রাস্তা, যানবাহন, হাসপাতাল, ডাক্তার কিছু ছিল না। সে সময় আশপাশের গ্রামের মেয়েরা হাইস্কুলে পড়তে যেত গড়াই নদীর পাড়ে পাংশা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে।

ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণীর ছাত্রী আফসানা। ও আসত সরাইল গ্রাম থেকে। সেটা ছিল স্কুল থেকে দেড় মাইল মানে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে।

গ্রামের আরও সঙ্গীদের সাথে হেঁটে যখন কিশোরী আফসানা স্কুলে পৌঁছত, ওর মুখটা মনে হত, ডালিমের মত ফেটে যাবে।

গোলাপি গায়ের বরন কন্যার, মাথা ভরা কেশ। মৃণাল বাহু। দুই গায়ের রূপসী কন্যা সে। তখনকার দিনে পথে ঘাটে অত রূপসী মেয়ে চোখে পড়ত না। তাই কারও ঘরে রূপসী মেয়ে থাকলে তার খবর ছড়িয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রামে।

আর যদি সে হত উঁচু বংশের মেয়ে, তবে তো কথাই নেই। অমুক বাড়ির মেয়ে গো সে। সাথে যদি হত, গুণবতী, তা হলে তো সোনায় সোহাগা।

রূপবতী, গুণবতী, বড় বাড়ির মেয়ে। মানুষের মুখে মুখে ফিরত আফসানার নাম। ওরা অনেক ভাইবোন। আফসানা সারাদিন গৃহকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ছোেট ভাইবোনদের দেখভাল, মাকে সংসারের কাজে সাহায্য, নিজের লেখাপড়া নিঃশব্দে করে চলত। মা গর্ব করে বলতেন, মাটি কাঁপবে তা আমার বেটি কাঁপবে না। বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন আফসানাকে নিয়ে। প্রায় দিনই দুটো-একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে ওর।

তিন

এই, আফসানা, দেখ, মুলাম দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্যি। এখন পিছু নেবে আমাদের, দেখিস! কী যন্ত্রণা! প্রতিদিন ছেমড়া তোর জন্যি ওই বটগাছের তলে দাঁড়ায় থাকে। আমরা এলি ও পিছু নেয়। তোর আব্বাকে বলতি হবি। ওই ছেমড়ার মাসের কদিন যায় বুঝবে। মজি চাচা যে মিজাজি মানুষ, ওর টান দে ছিঁড়ে ফেলবিন। বলে আড়চোখে মুলামকে খেয়াল করল মিনু।

তুই বড় বেশি বকিস রে, মিনু। কোনদিক তাকাবিনে। তুই আব্বার কাছে বলে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা বন্ধ করতি চাস? মিনমিন করে বলল আফসানা।

সরাইল গ্রামের বিখ্যাত হাজীবাড়ি। হাজী সাহেবের বড় ছেলে মজিদ রহমান। এক সময় বাপের জমিদারি ছিল। কালের গর্ভে তা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। জমিদারি না থাকলেও জমিদারি ঠাট-বাট তারা সযত্নে আঁকড়ে আছে। তাদের বাড়ির মেয়ের দিকে সাধারণ ঘরের কেউ চোখ তুলে তাকালে তার যে খবর হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

ওদিকে নাদুরিয়া গ্রামেরই মেম্বার রওশনআরা। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁকে ভালবেসেই তার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। মনে বিশ্বাস, তার প্রিয় আওয়ামী লীগ সংগঠনের একজন কাণ্ডারী একদিন সে হবেই!

এমন নিবেদিত প্রাণ, জনদরদি রাজনৈতিক কর্মীর ঘর সংসার হওয়া কঠিন। তারও হয়নি। সুসংসার প্রত্যাশী স্বামী, ছেলে আর মাকে ফেলে আরেক গাঁয়ে ঘর পেতেছে। ওদিকে মুলাম মায়ের যক্ষের ধন, আদরের দুলাল, তাই তো মা তার নাম রেখেছে মুলাম।

মা দিন-রাত গ্রামের জনগণ আর তার চেলা-চামচা নিয়ে মিটিং করে বেড়াচ্ছে। স্বামী ঘর ছেড়েছে, একমাত্র ছেলে যে বাউণ্ডুলে হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ছেলের আবদার রক্ষা আর আহ্লাদ দেয়া ছাড়া শাসন বা দায়িত্বে আগ্রহ নেই রওশনআরার।

চার

নাদুরিয়া গ্রামের মেম্বার রওশনআরা এসেছে আফসানাদের বাড়ি। ওর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে।

আপনার মেয়েটা আমাকে ভিক্ষে দেন, আপা। আমি ওর জীবন দিয়ে হলিও সুখে রাখার চিষ্টা করব। আমার মুলাম যে। ওর না পালি মরে যাবিনি। অনুনয় আকুতিতে রাজি করানোর চেষ্টা করল রওশনআরা আফসানার বাবা-মাকে।

আফসানার মা সম্ভ্রান্ত ঘরের, শিক্ষিত মেয়ে। যথেষ্ট অনুভূতিশীল। তিনি বুঝলেন, স্বামীহারা একমাত্র ছেলের মা, রওশনআরার মনের ব্যথা। তাই তো হাজীবাড়ির সবার বিরুদ্ধে গিয়ে একক সিদ্ধান্তে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন।

অবশ্য তিনি মেয়ে আফসানার ব্যাপারটা জানতেন। মুখচোরা। মেয়ে কিছু না বললেও বুঝতেন মুলামের প্রতি তার দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। মাত্র চোদ্দ বছরের আফসানার বিয়ে হয়ে গেল মুলামের সাথে।

পাঁচ

নাদুরিয়া গ্রামের শেষ সীমা। বিশাল গোরস্থান। আশপাশের দুই-তিন গাঁয়ের লোক মারা গেলে কবর হয় এখানে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন-নতুন কবর তৈরি হচ্ছে। এই গোরস্থানের নিকটতম বাড়িখানা মুলামদের। চারপাশে ধু-ধু মাঠ, মাঝখানে বাড়ি। বাড়ির পশ্চিম দিকে কবরস্থান। এ বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই মৃতদেহ নেয়া হয় গোরস্থানে। ছোট্ট আফসানা প্রচণ্ড ভীতু। ওদের বাড়িতে বইয়ের লাইব্রেরি ছিল। ছোটবেলা থেকে ভূতের গল্প পড়েছে অসংখ্য। এমন রাজনৈতিক আর ভুতুড়ে পরিবেশে নিজেকে মানানো ওর জন্য কষ্টের। তবু অসম্ভব ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু আফসানা মানিয়ে নেয় সবকিছু।

শাশুড়ি মা ব্যস্ত থাকে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর নির্দ্বিধায় স্বচ্ছন্দে চলে দিনমান ভালবাসাবাসি। আফসানা লেখাপড়া, গৃহকর্ম, স্বামী, শাশুড়ি সামলানো সবই করে সুনিপুণভাবে। বৈষয়িক সবকিছু বুঝলেও বোঝেনি তার নিজের শরীর। তিন মাসের গর্ভবতী কিশোরী আফসানা বুঝতেই পারেনি সে মা হতে চলেছে।

সেটা না বুঝলেও শরীর আর মন, পরিবর্তনটা জানান দিয়েছে ভালভাবে। এখন সে আরও ভীতু হয়েছে। কদিন ধরেই ভয়টা ভীষণ বেড়েছে তার। গোরস্থানে যেদিন নতুন কেউ ঢুকছে, সেদিন রাতে আর তার ঘুম হয় না। মুলাম সারারাত পোয়াতি বউকে পাহারা দেয়, যত্ন-আত্তি করে।

ছয়

সেদিন অমাবস্যার রাত। সন্ধ্যা লাগতেই চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। মুলাম গেছে উত্তরপাড়া জরুরি কাজে, শাশুড়ি মা গেছে তার মিটিঙে। ঘরে হারিকেন জেলে খাটের ওপর বসে আছে আফসানা। প্রচণ্ড ভয় লাগছে ওর। আজ নতুন একটা কবর হয়েছে। একটু পরেই মুলাম চলে আসবে, সেটুকু সময়ও একা থাকা কঠিন ওর কাছে।

হঠাৎ থপথপ একটা শব্দ! আফসানা সচকিত হলো। শব্দটা হচ্ছে খাটের তলায়। এ ঘরে আবার দুতিনটে কুনোব্যাঙ আছে। যদিও ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে, তবু ও ব্যাঙের কথাই ভাবল।।

ওটা কী? স্পষ্ট ওর সামনে, খাটের তলা থেকে বের হলো মাথাটা! ছোট্ট একটা চিনে পুতুলের মত। ধবধবে সাদা চোখজোড়া বন্ধ। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আফসানা। অতিরিক্ত ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে ও। হঠাৎ মাথাটা নড়ে উঠল। কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল ও। একটা শিশুর মাথা ওটা। শরীরটা দেখার চেষ্টা করল। না, শরীর নেই বা হয়তো আছে, ও দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ মাথাটা চোখ খুলল। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, মা।

আফসানা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল।

মুলাম বউকে সেবা-যত্ন, সঙ্গ দেয়া বাড়িয়ে দিল অনেকগুণ। দিনরাত সানা মানে আফসানাকে আদর-আহ্লাদ করাই এখন ওর প্রধান কর্ম।

ও, মা, তুই আর সন্ধের পর বাইরে থাকবিনে। আমার সানা ভয় পায় যে, আহ্লাদ করে মাকে বলল মুলাম।  

হ্যাঁ, তাই তো তুই তোর কাজকম্ম রেখে দিনরাত পাখির সানা নিয়ে আছিস, আবার এখন আমার কাজকম্মও ছাড়তে কচ্ছিস, একটু জোর গলায় বলল রওশনআরা। যদিও আফসানাকে সে-ও কম ভালবাসে না। নিজে অসংসারী হলেও আদরের বৌমাকে সময় দেয়া বা রেধে খাওয়াতে চেষ্টা করে সে।

মুলাম সারারাত বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। হারিকেন নিভিয়ে দিলে ঘরটা একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে যায়। মুলাম মাথার কাছে জানালাটা খুলে দিল। যদিও অন্ধকার রাত তবুও কিছুটা আলো হলো ঘরটা। জানালার পাশে হাস্নাহেনার ঝোঁপটায় অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে। ফুলের গন্ধে ম-ম চারদিক। বুকের মাঝে সানাকে জড়িয়ে আধো ঘুম জাগরণে পাখা দিয়ে বাতাস করছিল মুলাম।

বাতাস আর ফুলের গন্ধে একাকার…আফসানা জানালার ফাঁক গলে আসা হালকা আলো আর বাতাসের অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। মুলাম পাখা হাতে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ জানালার পাশে থপথপ করে শব্দ…

সচকিত হলো আফসানা। স্বামীর হাতটা ভাল করে টেনে নিল বুকের ওপর। ও স্পষ্ট শুনছে মাথার কাছে কেউ চিউ চিউ করে ডাকছে, ম…ম।

ও ঘোরের ভেতর চলে গেল। যদিও শরীর অসাড় তবু ঘুরে তাকাল জানালায়। সেই মাথা! শুধু মাথাটাই দেখা যাচ্ছে জানালায়।

আস্তে টোকা দিল স্বামীকে। মুলাম ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

এই, কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার? আবার কিছু দেখেছ?

কাত হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে আফসানা। মুখে কোন শব্দ নেই।

দিনকে দিন শরীরটা অবনতির দিকে যাচ্ছে আফসানার। খাওয়া-দাওয়া করে নামে মাত্র। ঘুমও কম। শুধু পেটটা বাড়ছে অতি দ্রুত।

বাড়ির পাশেই পুকুর। মুলাম গেছে হাটে। পুকুরঘাটে বসে আছে রওশনআরা। গোসল করছে আফসানা। একমাত্র গোসল করতেই ওর আরাম বোধ হয় শরীরে। শীর্ণ দেহ, এক মুহূর্ত মা-ছেলে কেউ চোখের আড়াল করে না বউকে। পাছে কোন দুর্ঘটনা ঘটে।

পানিতে ডুব দিল ও। কিছু একটা ওর শাড়ির আঁচলের তলে নড়ে উঠল। ও আস্তে করে আঁচল টান দিতেই মাথাটা মা বলে ডেকে উঠল।

মা-গো, বলে চেঁচিয়ে পাড়ে উঠে এল আফসানা।

সাত

আফসানা এখন ওর প্রিয় পুকুরে আর গোসল করতে নামে না। গোসলখানাতেই গোসল করে। রাতে যত, দম বন্ধই লাগুক জানালা খোলে না; যত জরুরি কাজই থাকুক, কেউ ওকে একা রেখে কোথাও যায় না।

গত রাতে যা মুলামের সামনে ঘটেছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই।

গভীর ঘুমের মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে আফসানা। ওই দেখো।

মুলাম ঘুমের মাঝে আঁতকে জেগে চোখ মেলে। ওটা কী? দুজনেই দেখল তীব্র সবুজ আলোর একটা সাপ জড়িয়ে আছে খাটের মশারি স্ট্যাণ্ডের সাথে, আফসানার পাশে। এরকম দ্যুতি ছড়ানো সাপ এর আগে কেউ দেখেছে কি না জানা নেই ওদের।

এ বাড়ির তিনটা প্রাণীই বুঝে গেছে এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে।

আফসানা বাপের বাড়ি যেতে চাইলে মা-ছেলে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। আর আফসানারও অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ওদের ছাড়া একবেলাও সে থাকতে পারে না। এখন। দিনের আলোতেও ঘটে চলেছে অদ্ভুত সব ঘটনা।

কাল দুপুর বেলা, আফসানা ঘুমাচ্ছিল মুলামের কোলের মধ্যে। হালকা ঘুমে নিজের কানে শুনল কেউ একজন নিচু স্বরে ওর মাথার কাছে বলে চলেছে…।

আঙুল ভাজা খাবা, খাবা আঙুল ভাজা, খাবা-খাবা! এত ভারী শরীরটা নিয়ে ওর চলাফেরা করা কঠিন। সারাদিন ধরতে গেলে বিছানায়ই থাকে। মুলামের দূর সম্পর্কের এক ফুফু এসেছে। সে-ই আফসানাকে দেখাশোনা করে।

আট

গত রাতে জানালার পাশে মাথাটা আবার দেখেছে আফসানা। ওর প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসছে। কাল গ্রামের একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী জোবায়দা এসে দেখে গেছে। বলেছে বাচ্চা ভাল আছে। বাচ্চার আকার বেশ বড় গ্রামে সাধারণত ছোট আকারের বাচ্চাই হয়। এত বড় বাচ্চা বাড়িতে প্রসব নিয়ে সে মনে-মনে একটু শঙ্কিত হলেও ওদেরকে কিছু বুঝতে দেয়নি।

আজ তিন দিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলছে। মুলাম কোথা থেকে জাল বোনা শিখেছে। সারাদিন ঘরের দোরে বসে বউকে পাহারা দেয় আর জাল বোনে। যে সুচ দিয়ে জাল বোনা হয় স্থানীয় ভাষায় তাকে নলী বলে। ওরকম একটা ঝুলছিল খাটের রেলিঙে। আফসানা বিছানায় শুয়ে থাকে সারাদিন, কেবলি চোখটা বুজে এসেছিল। হঠাৎ খেয়াল করল। নলীটা একা-একাই নেমে আসছে ওর দিকে। সোজা এসে ওর হাতে ইঞ্জেকশনের মত ঘঁাচ করে ঢুকে গেল। চিৎকার করে বসে পড়ল ও।

সর্বনাশ! এ কী অবস্থা! বিস্ময়ে হতবাক মা-ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সারা বিছানা ভেজা। পানি যা ছিল, সব ভেঙে গেছে। বাইরে তুমুল বর্ষণ। মুলাম ছুটল জোবায়দার কাছে।

জোবায়দা এসে একখানা ইঞ্জেকশন দিল। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে আফসানার শরীর। চেঁচিয়ে বলল, একটু আগে নলী

এসে আমাকে ইঞ্জেকশন দিল, এখন আবার তুমি?

কিছু বুঝল না জোবায়দা। সাধ্যমত চেষ্টা করে চলেছে। ও। কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমশই জটিল হচ্ছিল। এক সময় জোবায়দা আত্মসমর্পণ করল।

খালাম্মা, আফসানার অবস্থা ভাল না। ওর সদরে নিয়ার চিষ্টা করেন। বাচ্চা অনেক বড়, তারপর পানি সব ভাঙে গেছে। বাচ্চা বাঁচে আছে কি না বুঝতিছিনে। এখন ওকে বাঁচাতি হবি।

ও, মা, আমার সানারে বাঁচাও, ও মরে গিলি আমি কিন্তু মরে যাব, বিলাপ করতে থাকল মুলাম।

ও রে, মুলাম, শিগ্‌গির সরাইল লোক পাঠা, ওর বাপ মারে খবর দে। দুই মা-ছেলে মরা কান্না জুড়ে দিল। ওদিকে আবহাওয়া চরম রূপ নিল।

সন্ধ্যায় আফসানার বাবা-মা এলেন। ধাইমা গুলজানকে সঙ্গে করে। সে দুই-চার গ্রামের অভিজ্ঞ ধাত্রী। আফসানার ভাইবোনরা সবাই তার হাতেই জন্মেছে।

প্রায় সংজ্ঞাহীন পড়ে আছে আফসানা। ওদিকে দুজন ধাত্রীর অবিশ্রান্ত চেষ্টা চলছে বাচ্চা খালাসের।

দুর্ঘটনাটা ঘটল গুলজানের হাতেই। প্রায় খালাস হয়েই এসেছিল। যদিও বাচ্চা মারা গিয়েছিল আগেই। অতিরিক্ত টানাটানিতে হঠাই ছিঁড়ে এল মাথাটা!

নয়

আফসানার বাঁচার আশা ক্ষীণ। ইতোমধ্যেই মরা কান্না শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে। প্রকৃতিও আফসানার শোকে যেন কেঁদে চলেছে নিরন্তর। আঁদরের পুত্রবধূর এ অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা মানতে চায় না রওশনআরা। সারা জীবন সে মানুষের জন্য করে গেল আর তারই কি না এত শাস্তি। বিরূপ আবহাওয়ায় ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। নিকষ কালো রাত। তখন এমনিতেই তেমন কোন যানবাহন ছিল না ঘোড়াগাড়ি ছাড়া। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ঘোড়াগাড়ি চলা অসম্ভব।

খাঁটিয়ায় তোলা হলো আফসানাকে। রওশনআরার মত। তার একই কথা, বাঁচাতেই হবে আফসানাকে।

গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকজনকে জোগাড় করা হলো। মড়ার খাঁটিয়া বহনের জন্য। প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো খাটখানা।

খাঁটিয়া চলল মৃতপ্রায় আফসানাকে নিয়ে। পিছনে সব আপনজনেরা। অঝর বৃষ্টি। পথঘাট কাদা-পানিতে মাখামাখি। সবার মাথায় ছাতা, হাতে হারিকেন। গ্রামসুদ্ধ মানুষ চেয়ে থাকল। যেন নিশুত রাতের শবযাত্রা চলেছে…

.

চার দিন পর রোদ উঠল সেদিন। ছিন্ন মাথাটা সমাধিস্থ করা হলো নাদুরিয়া গোরস্থানে। খবর এল, আফসানার জীবন শঙ্কা কেটে গেছে। শিশুটার দেহটা ওখানে গিয়ে সহজেই বের করা। হয়েছিল। ছেলে শিশু ছিল ও। কোন অপারেশনও করতে হয়নি। পরে দেহটাকে সমাধিস্থ করা হয় রাজবাড়ি গোরস্থানে। মড়ার খাঁটিয়া থেকে মৃতপ্রায় আফসানা ফিরল জীবন নিয়ে।

কয়েক বছর পর মুলাম আফসানাকে নিয়ে পাড়ি জমাল ঢাকায়।

দশ

গল্প শুনতে-শুনতে ইনায়া ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিল।

নানু, আফসানা তো তুমি? আর আমার নানুভাই মোত্তালিব হোসেন, তার নাম মুলাম? জানো, নানু, তোমার গল্প শুনে আমি কাঁদছিলাম, তার জন্য খুব মায়া লাগছিল! যাকে আমি দেখিনি, সে-ই তো তোমাকে বাঁচাল। তোমার শাশুড়ি মানে নানাভাইয়ের মা, তাই না? খুব খারাপ লাগছে, আমি তাকে দেখতে পেলাম না, বলল ছোট্ট ইনায়া।

হ্যাঁ, তিনি তোমার বড়মা। আর আমার দ্বিতীয় জনম দেয়া মা ছিলেন। বলে চোখ মুছল আফসানা।

সত্যি তোমাদের জীবন কী কঠিন ছিল!

তোমার ভয় লাগেনি, নানুয়া? প্রশ্ন করলেন আফসানা।

একদম না, বরং মামার মাথাটা দেখতে ইচ্ছে করছে। সে বেঁচে থাকলে তো তৌসিফ মামা সহ আমার আরেকটা মামা থাকত। অদ্ভুত তুমি, কী করে ভেঁড়া মাথাটা তুমি আগেই দেখতে, তার মুখে মা ডাক শুনতে?

এগারো

আজ রাতটাই আছে ইনায়ারা। সকালেই রওনা হবে ঢাকা। ওর মা তানতা ফিরবে আগামীকাল।

বাইরে রুপোর থালার মত একাদশীর চাঁদ উঠেছে। দোতলার ওপর দক্ষিণে খোলা বিশাল শোবার ঘরখানা। নানা, নানুর মাঝেই শোয় ইনায়া। ওরা দুজন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ইনায়ার ঘুম নেই। ও শুধু নানুর ছোট বেলার গল্পটার কথা ভাবছে। হঠাৎ থপথপ শব্দ! ইনায়ার একটু ভয়-ভয় লাগল। বুকের ওপরের লেপটা মুড়ি দিতে টান দিল। এ কী, একটা মাথা! প্রায় ওর বুকের কাছে! বুঝতে বাকি রইল না ওর, এটা কার মাথা, ও তো দেখতেই চেয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল ওটার দিকে। একসময় চিৎকার করে উঠল ও। নানা-নানু জেগে গেল, জড়িয়ে ধরল। ইনায়াকে।

তুমি কেন ওকে এসব গল্প বলতে গেলে? একটু রেগেই বললেন মুত্তালিব হোসেন।

সরি! নানুয়া আমার, বলেছিলাম তুমি ভয় পাবে।

না, নানু, আমি তেমন ভয় পাইনি। আমি সত্যি মামার মাথাটা দেখেছি। স্পষ্ট চাঁদের আলোয়। তুমি যে বলেছিলে? চিনে পুতুলের মতই। আমার লেপের ওপর। তবে একটু ময়লা ছিল। তুমি বিশ্বাস করো।

বারো

সব গোছানো চলছে, আজই ওরা ঢাকা রওনা করবে। বিছানা থেকে ইনায়াকে উঠিয়ে দিলেন আফসানা। সব ঝেড়ে লেপ কম্বল গোছাচ্ছিলেন।

এ কী? বলে অবাক হয়ে মেলে ধরলেন ধবধবে সাদা লেপটা। দেখো, লেপের কভারে এটা কীসের দাগ?

মুত্তালিব আর আফসানা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন নিজেদের দিকে। সাদা ধবধবে লেপটার ওপর গোল-গোল ময়লার ছোপ। লেপের ওপর যেন কোন গোল ময়লা কিছু গড়িয়ে গেছে।

চোখ ভিজে উঠল আফসানার! বুঝতে বাকি রইল না। ছোট্ট ইনায়া ভুল দেখেনি।

কালের গর্ভে বিলীন সময়, আত্মা অবিনশ্বর!
এ মায়ার ভুবন, কত কী খেলেন ঈশ্বর,
যুক্তিতে তার মেলে কি তাবৎ উত্তর??

নাশমান শরীফ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *