পঞ্চবক্র তান্ত্রিক – আফজাল হোসেন

পঞ্চবক্র তান্ত্রিক

এক

ঝড়-বৃষ্টির রাত।

জয়নাল হ্যারিকেনের আলোতে বই পড়ছে। তাদের গ্রামে এখনও ইলেকট্রিসিটি এসে পৌঁছয়নি। প্রায় দশ বছর আগে ইলেকট্রিক লাইন টানার খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। খুঁটি পোঁতা পর্যন্তই, লাইন টানা আর হয়ে ওঠেনি। গ্রামের মানুষ অপেক্ষায় আছে নিশ্চয়ই কোনও এক দিন খুঁটিতে লাইন টানা হবে, আর তারাও আলোর মুখ দেখতে পাবে।

জয়নাল হাজী মোঃ আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। এ বছর সে ডিগ্রি পরীক্ষা দিচ্ছে। কাল ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজিতেই তার যত ভয়। তার ধারণা, যদি সে ডিগ্রিতে ফেল করে এক মাত্র ইংরেজিতেই ফেল করবে।

রাত পৌনে একটার মত বাজে। ঘুমে জয়নালের চোখ বুজে আসছে। বার-বার হাই উঠছে। এর পরও পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। আরও আধ ঘণ্টার মত পড়ার পরে বিছানায় যাবে।

জয়নালের মা নেই। ওর জন্মের পরপরই মা মারা যান। কোনও ভাই-বোনও নেই। আপনজন বলতে আছেন শুধু। বাবা। বাবাই তাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে থা-ও করেননি। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। যা রোজগার করেন তাতে তাদের বাপ-ছেলের সংসার খেয়ে-পরে ভালই চলছে।

জয়নালের বাবা অনেক আগেই ঘুমিয়েছেন। আকাশের মেঘ ডাকার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুড়-গুড় করে নাক ডেকে তিনি ঘুমাচ্ছেন। সারা দিনে অনেক পরিশ্রম করতে হয় তাকে। এক দিকে যেমন বাইরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, তেমন ঘরে ফিরে রান্না-বান্না সহ যাবতীয় সাংসারিক কাজ সারতে হয়। জয়নালকে কোনও কাজেই হাত লাগাতে দেন না। তার শুধু একটাই চাওয়া, জয়নাল যেন লেখা-পড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হয়। বড় চাকরি করে। তার মত হাড় ভাঙা খাটুনি যেন জয়নালকে করতে না হয়।

জয়নাল তার বাবার ইচ্ছে পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়েই থাকে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মেরে, চায়ের দোকানে বা অন্য কোথাও সময় কাটানো, অথবা টিভি দেখে বা কোনও খেলা নিয়ে মেতে থেকে সময় নষ্ট করে না। অত্যন্ত নিরীহ-ভদ্র-লাজুক প্রকৃতির ছেলে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরেও বেরোয় না। গ্রামের সবাই তাকে ভাল ছেলে হিসেবেই চেনে।

পড়তে-পড়তে হঠাৎ জয়নাল অনুভব করল কেমন একটা অদ্ভুত বিদঘুঁটে গন্ধ পাচ্ছে নাকে। যেন ইঁদুর মরা গন্ধের সঙ্গে মুর্দার আতরের গন্ধের মিশেল।

জয়নাল বসার ঘরের খোলা জানালার সামনে টেবিলে বসে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে হু-হুঁ করে বৃষ্টি ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। সে মাথা তুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠনটা দেখা যাচ্ছে। ঘন-ঘন বিজলি চমকানোর আলোতে উঠনে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ঝিকমিক করছে। উঠনের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাকড়া আম গাছটাও দেখা যাচ্ছে। দমকা হাওয়া ভেজা আম গাছটার ডাল-পালায় আলোড়ন সৃষ্টি করছে।

জয়নাল আবার পড়ায় মন দিল। ভাবল, দমকা হাওয়ার তোড়ে দূরে কোথাও থেকে হয়তো ওই বিদঘুঁটে গন্ধটা ভেসে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই ওটা আর পাওয়া যাবে না।

খানিকবাদে লক্ষ করল গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। যেন গন্ধের উৎস আশপাশেই রয়েছে। চোখ তুলে আবার জানালার দিকে তাকাল। জানালায় চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল। জানালার শিক ধরে অদ্ভুত ভয়ানক চেহারার এক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

লোকটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাকাতের মত বড়-বড় লাল চোখ জোড়ায় ভয়ানক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। মাথায় জটা ধরা লম্বা চুল। গায়ে কালো রঙের আলখিল্লা। গলায় কয়েক ধরনের মালা। রুদ্রাক্ষের, গাছের শিকড়-বাকড়ের, প্রাণীর হাড়-গোড়ের, পাখির পালকের, তাবিজের আর টকটকে লাল জবা ফুলের মালা। কাঁধে কাপড়ের পুঁটলি। হাতে ধরা সাপের মত একটা আঁকা-বাঁকা লাঠি।

ওই লোকটার গা থেকেই ভর-ভর করে সেই বিদঘুঁটে ঘ্রাণটা আসছে। গন্ধে জয়নালের কেমন মাথা ঝিমঝিম করছে।

লোকটাকে দেখে জয়নাল এতটাই চমকে গেছে যে তার মুখে কথা ফুটতেই বেশ সময় লাগল।

কে আপনি?

লোকটা কোনও জবাব দিলেন না। পলকহীন জয়নালের দিকে তাকিয়েই রইলেন।

জয়নাল আবার জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? এত রাতে কোথা থেকে এসেছেন? কী চান?

এবারে লোকটা কথা বলে উঠলেন। গমগমে গলায় ধমকের সুরে বললেন, আমি তোকে চাই। চল আমার সঙ্গে। আমি তোকে নিতে এসেছি।

জয়নাল অবাক গলায় বলল, কে আপনি?! আমাকে নিতে এসেছেন মানে?!।

লোকটা গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন, আমি তান্ত্রিক পঞ্চবক্র। সময় নষ্ট না করে চল আমার সঙ্গে, চল। তোকে আমার খুব প্রয়োজন।

জয়নাল বলল, না, আমি আপনার সঙ্গে যাব না। চিনি না, জানি না, কেন যাব আপনার সঙ্গে?!

লোকটা প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, বেয়াদব! আমার কথা না শুনলে তোর অনেক বিপদ হবে। তুই সব হারাবি!

জয়নাল কিছুটা চটা গলায় বলল, চিৎকার করছেন কেন? আস্তে কথা বলুন। আমার বাবা ঘুমাচ্ছেন। তার ঘুম ভেঙে যাবে। রাস্তার পাগল কোথাকার!

লোকটা মেঘের গর্জনের মত গলায় বলে উঠলেন, তুই আমাকে রাস্তার পাগল ভাবছিস?! আমি তান্ত্রিক পঞ্চবক্র। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোর কোনও ধারণাই নেই।

জয়নাল বলল, রাস্তা-ঘাটে পীর-ফকির, সাধু-ওঝা তান্ত্রিকের ভেক ধরা আধ পাগল অনেককেই দেখা যায়। তাই বলে এই মাঝ রাতে আপনি কোথা থেকে এসেছেন?!

লোকটা গর্জে উঠলেন, তুই আমাকে ভণ্ড ভাবছিস! তার মানে তুই আমার সঙ্গে যাবি না?

ভণ্ড না ভেবে সত্যিকারের তান্ত্রিক ভাবলেও যেতাম না। এত রাতে বাবাকে না বলে অচেনা কারও সঙ্গে কোথাও যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না!

লোকটা ঠোঁটের কোনায় তির্যক হাসি ফুটিয়ে বললেন, তোর বাবা যদি তোকে ফেলে কোথাও চলে যায়?

জয়নাল আঁতকে উঠে বলল, না, আমার বাবা আমাকে ফেলে কোনও দিনও কোথাও যাবেন না।

লোকটা বললেন, আমার সঙ্গে না গিয়ে বিরাট ভুল করলি। অনেক বড় মাশুল দিতে হবে তোকে। চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, আবার আমি তোকে নিতে আসব। সেদিন তুই স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে যেতে চাইবি।

লোকটা হাতে ধরা লাঠিতে ভর দিয়ে খালি পায়ে উঠনের কাদা-পানির মধ্যে পা ফেলে-ফেলে যেতে লাগলেন। জয়নাল। তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। এখনও বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিজলি চমকাচ্ছে। সারা রাতই বোধহয়। এমন বৃষ্টি হবে।

কী আশ্চর্য! জয়নাল অবাক-বিস্মিত চোখে দেখতে পেল, বৃষ্টিতে লোকটার গা ভিজছে না। তার চলার পথের বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে।

জয়নাল বিস্ফারিত চোখে চেয়েই রয়েছে। লোকটা বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। বসার ঘরের এই জানালা দিয়ে রাস্তাটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

হঠাৎ তীব্র নীলচে আলোর ঝলকানিতে বিজলি চমকের সঙ্গে কান ফাটানো বিকট শব্দে বাজ পড়ল। সেই সঙ্গে অদ্ভুত লোকটাও গায়েব হয়ে গেলেন। অথচ তার আগমুহূর্তেও থেমে-থেমে বিজলি চমকানোর আলোতে লোকটাকে দেখা যাচ্ছিল। যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি বজ্রপাতের তীব্র আলোর ঝলকানিতে লোকটাকে দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলেছে।

দুই

সকালে ঘুম ভেঙে জয়নাল, নিজেকে টেবিলে বইয়ের উপর মাথা রাখা অবস্থায় পেল। তার মানে গত রাতে সে পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল জয়নাল। গত রাতের অদ্ভুত লোকটার কথা মনে পড়ল। লোকটা চলে যাবার পরপরই বোধহয় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে দ্বিধায় পড়ে গেল, সত্যিই কি সেই লোকটা এসেছিলেন? নাকি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখেছে?

ঝড়-বৃষ্টির রাতের পর রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে সকাল। জয়নালের বাবা খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছিলেন। তিনি সকালের রান্না সেরে ফেলেছেন। আজ রান্না করেছেন মোটা চালের ভাত, শুকনো মরিচ দিয়ে করা লালচে রঙের আলু ভর্তা, ধনে পাতা দেয়া ডিম ভাজি, চিংড়ী মাছ দিয়ে কলমি শাক আর কলাই ডালের চচ্চড়ি।

প্রতিদিনই জয়নাল জেগে ওঠার আগেই তিনি সকালের রান্নার কাজ সেরে ফেলেন। জয়নাল জেগে উঠলে একসঙ্গে খেয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। টিফিন ক্যারিয়ারে করে সকালের রান্না খাবার থেকে কিছু খাবার দুপুরে খাওয়ার জন্যও নিয়ে যান। বাকি খাবার থেকে যায় দুপুরে জয়নালের খাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে আবার রাতের খাবার রান্না করেন। এভাবেই চলছে তাদের বাপ-ছেলের সংসার।

বাবা-ছেলে একসঙ্গে সকালের খাওয়া সেরে দুজনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। জয়নাল যাচ্ছে পরীক্ষা দিতে। সকাল নটায় পরীক্ষা শুরু হবে। তার আগেই তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে হবে।

জয়নালের বাবা যাচ্ছেন তাঁর কাজের সাইটে। তারও সকাল নটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। আজ একটা পাঁচতলা বিল্ডিঙের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করবেন।

.

পরীক্ষা শেষে জয়নাল হল থেকে বেরিয়েছে। বেশ ভাল হয়েছে পরীক্ষা। ইংরেজি নিয়ে অনেক ভয় ছিল তার মনে। এখন মনে হচ্ছে ভয়ের কিছু নেই। ইংরেজিতে সে ষাটের উপরে নম্বর পাবে। বাকি পরীক্ষাগুলো আশানুরূপ হলে এস.এস.সি-এইচ.এস.সি-র মত ডিগ্রিতেও সে ফাস্ট ডিভিশন পাবে।

পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বাইরে বেরিয়ে জয়নাল তার চাচাকে দেখতে পেল। জয়নালের বাবার এক মাত্র বড় ভাই বেলায়েত হোসেন। তাঁর মুখ অসম্ভব রকমের ভার। চেহারা কেমন। বিধ্বস্ত। চোখ-মুখ লাল আর ফোলা-ফোলা।

এ জয়নাল তার চাচার দিকে এগিয়ে গিয়ে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, চাচাজান, আপনি এখানে?

বেলায়েত হোসেন থমথমে গলায় বললেন, তোকে নিতে এসেছি।

জয়নাল আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল, আমাকে নিতে এসেছেন মানে?! শঙ্কিত গলায় আরও যোগ করল, বাড়িতে কোনও সমস্যা হয়েছে নাকি?

বেলায়েত হোসেন বুজে আসা গলায় বললেন, তোর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

জয়নাল ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, বাবা অসুস্থ! কী হয়েছে তাঁর?! সকালে তো দুজন একসঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরোলাম। তিনি চলে গেলেন তাঁর কাজের সাইটে। কী হলো বাবার?!

বেলায়েত হোসেন ভারাক্রান্ত গলায় বললেন, চল, বাড়িতে গিয়েই দেখতে পাবি।

জয়নাল চাচার সঙ্গে রিকশা করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। ওর মনের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তার বাবার সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। চাচাজান তাকে সব বলছেন না। কিছু একটা লুকাচ্ছেন।

জয়নাল তাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখতে পেল উঠনে অনেক লোকের ভিড়। রিকশা থেকে নেমেই সে ছুটে চলে গেল বাড়ির দিকে। তাকে ছুটে আসতে দেখে লোকজন দুপাশে সরে তার যাওয়ার জায়গা করে দিয়েছে।

উঠনের মাঝখানে চাটাইয়ের উপর কে যেন শুয়ে রয়েছে। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। সমস্ত চাদরটা ছোপ-ছোপ রক্তে মাখা। জয়নাল সেখানে গিয়ে থামল।কেউ একজন শোয়ানো লোকটার মুখের উপর থেকে চাদর সরাল। রক্ত মাখা একটা মুখ দেখা গেল। জয়নালের বাবার মুখ। নিথর পড়ে আছেন। জয়নালের বুঝতে দেরি হলো না তার বাবা মারা গেছেন।

আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে জয়নাল কাঁদতে শুরু করল। ওর কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল।

জয়নালের বাবা মারা গেছেন পাঁচতলা বিল্ডিঙের ছাদ ঢালাইয়ের সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। তবে তাঁর পড়ে যাওয়াটা বেশ রহস্যজনক। তিনি এমনি-এমনি পড়ে যাননি। ছাদ ঢালাইয়ের মাঝে হঠাৎ কালো রঙের একটা চিল এসে তাঁর উপর চড়াও হয়। আরও অনেকেই সেখানে ছিল, কিন্তু তাদের সবাইকে ছেড়ে চিলটা শুধু ওর বাবাকেই লক্ষ্য বানায়। চিলটা উড়ে-উড়ে এসে ছোঁ মেরে ওর বাবার মুখে মাথায় আঁচড়-খামচি আর ঠোকর বসাতে থাকে। হঠাৎ অতর্কিত হামলায় তিনি দিগ্বিদিজ্ঞান হারিয়ে ছাদের কিনারে চলে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যান।

.

আসরের নামাজের পর জয়নালের বাবার জানাজা হয়েছে। এখন কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়া হচ্ছে। জয়নাল কেঁদে-কেঁদে আকুল। তার দুই চাচাতো ভাই আর চাচা মিলে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিছুতেই যেন জয়নালের চোখের পানি আটকানো যাচ্ছে না।

কবরটা পুরোপুরি মাটি চাপা দিতে দিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ততক্ষণে লাশের সঙ্গে আসা লোকেরা প্রায় সবাই-ই চলে গেছে। শুধু জয়নাল, তার দুই চাচাতো ভাই, চাচা আর দুই গোরখোদক আছে। হঠাৎ জয়নালের চোখ পড়ল কবরস্থানের উত্তর মাথায়। সেখানে বেশ মোটা একটা রেইনট্রি গাছ রয়েছে। গাছটার আড়াল থেকে কে যেন তাদেরকে লক্ষ করছে। লোকটার গায়ে কালো পোশাক।

এক পর্যায়ে লোকটার মুখ দেখতে পেল জয়নাল। গত রাতের সেই অদ্ভুত লোকটা। লোকটা সোজা তাকিয়ে রয়েছেন জয়নালের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি।

জয়নাল তার চাচা আর চাচাতো ভাইদেরকে লোকটার কথা জানাল। চাচা বেলায়েত হোসেন অবাক গলায় বললেন, কোথায়?! কে আমাদের লুকিয়ে দেখছে?

জয়নাল আঙুল তুলে রেইনট্রি গাছটার দিকে দেখাল।

চাচা, চাচার দুই ছেলে সহ গোরখোদকরাও সেদিকে তাকাল। নাহ, কাউকেই তারা দেখতে পেল না। তবে কুচকুচে কালো রঙের একটা কুকুর দেখতে পেল সবাই।

বেলায়েত হোসেন বললেন, ওখানে তো একটা কুকুর। মনে হয় লাশের গন্ধে এসেছে। গোরখোদকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ভালভাবে মাটি চাপা দিয়ে। শেয়াল-কুকুর যেন কিছুতেই মাটি সরিয়ে লাশের নাগাল না পায়।

জয়নাল দেখল তার চাচা ঠিক কথাই বলছেন। সত্যিই রেইনট্রি গাছটার ওখানে একটা কুকুর। সেই অদ্ভুত লোকটা নয়। তা হলে কি এতক্ষণ সে চোখে ধাঁধা দেখেছে?

তিন

জয়নাল নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চাচার বাড়িতে উঠেছে। চাচাই তাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। বাবাকে হারিয়ে জয়নালের পক্ষে পুরো একটা বাড়িতে একা থাকা সম্ভব নয়। তার উপর এখনও পরীক্ষা শেষ হয়নি। তাই চাচা চাইছেন তাঁর কাছে থেকে জয়নাল যাতে বাকি পরীক্ষাগুলো নির্বিঘ্নে দিতে পারে। তা ছাড়া এই মুহূর্তে জয়নালকে একা রাখাটা কিছুতেই ঠিক হবে না। তাতে একা-একা বাবার কথা মনে করে আরও বেশি কান্নাকাটি করবে।

চাচার স্ত্রী মারা গেছেন বহু বছর আগেই। চাচার সংসার তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে। বড় ছেলে স-মিলে কাজ করে। জয়নালেরই সমবয়সী ছোট ছেলের গ্রামের বাজারে চায়ের দোকান রয়েছে। চাচা তার বড় ছেলেকে বিয়ে করাতে চাইছেন। পছন্দসই মেয়ে পাচ্ছেন না বলে বিয়ে করানো হচ্ছে না।

চাচার সংসারে জয়নালের দিন ভালই কাটছে। চাচার দুই ছেলেই সারা দিন বাইরে কাটায়। শুধু দুপুরের খাওয়ার সময় তারা এসে খেয়ে যায়। চাচা বাড়িতেই থাকেন। তার দুটো দুধেল গাভী আছে। তিনি ঘরের রান্না-বান্না আর গাভী দুটোর দেখ-ভাল নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। জয়নালকে বিছানা, আলনা, পড়ার টেবিল সহ আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে। চাচা এবং দুই চাচাতো ভাইয়ের কথা হচ্ছে কিছুতেই যেন জয়নালের পড়ায় কোনও ব্যাঘাত না ঘটে

জয়নাল তাদের বংশের গর্ব। যে করেই হোক জয়নালকে পড়াশোনা শেষ করে ওর বাবার। ইচ্ছে পূরণ করতে হবে। বাবার কাছে জয়নাল যেভাবে আদরে ছিল, বলা যায় চাচার কাছেও সেভাবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।

.

মাঝ রাত। জয়নালের ঘুম ভেঙে গেছে।

সে আবার সেই অদ্ভুত লোকটাকে দেখেছে। ঠিক ধরতে পারছে না, সে কি স্বপ্নে নোকটার দেখা পেয়েছে, নাকি সত্যিই লোকটা এসেছিলেন?

সে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। হঠাৎ সেই রাতের মত নাকে বিশ্রী গন্ধ পায়। ইঁদুর মরা দুর্গন্ধের সঙ্গে মুর্দার আতরের গন্ধের মিশেল। এক সময় অনুভব করে তার মাথার কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। যে এসেছে তার গা থেকে লালচে আলোর দ্যুতি বেরোচ্ছে। অন্ধকার ঘর লালচে আভায় ভরে গেছে।

গমগমে গলার স্বর শোনা যায়, তোর বাবা পৃথিবী থেকে, চলে গেছেন, এখনও তুই আমার কথা শুনবি না?

জয়নাল ভীত গলায় বলে ওঠে, কে আপনি?

আমি তান্ত্রিক পঞ্চবক্র।

আপনি আবার এসেছেন?

হ্যাঁ, তোকে নিতে এসেছি।

আপনার সঙ্গে আমি কেন যাব? কী চান আমার কাছে?

শুধু তোকে চাই। বিনিময়ে তুই কী চাস বল? ধন সম্পদ-ক্ষমতা এমনকী পরমায়ু-সব আমি তোকে দিতে পারব।

আপনার কাছে কোনও কিছুই চাই না আমি। শুধু আপনার সঙ্গে যেতে চাই না।

আবার ভুল করবি? বাবাকে তো হারালি, আরও কত হারাতে চাস?

বাবার কথা ওঠায় জয়নালের মনটা ভীষণ কেঁদে উঠল। অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনি আমার কাছ থেকে চলে যান। চলে যান বলছি।

ঠিক তখন জয়নাল নিজেকে ফিরে পেল। যেন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে। সমস্ত গা ঘামে ভিজে গেছে। কেউ নেই তার মাথার কাছে। নেই লালচে আভা। অন্ধকার ঘর। তবে বিশ্রী গন্ধটা তখনও পাওয়া যাচ্ছে।

জয়নাল বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান করে আবার শুয়ে পড়ল।

.

সকালে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল জয়নালের। আওয়াজটা আসছে বাইরে থেকে।  

জয়নাল ঝট করে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরোল। বাইরে তার দুই চাচাতো ভাই তাদের বাবাকে পাজাকোলা করে গোয়াল ঘরের দিক থেকে নিয়ে আসতে-আসতে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে।

জয়নালও ছুটে গিয়ে চাচাকে ধরল।

চাচাকে সাপে কেটেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি গোয়াল ঘরে গিয়েছিলেন গরু দুটোকে খড় কেটে দিতে। সেখানে কুচকুচে কালো রঙের একটা সাপ তাকে ছোবল মেরে পালিয়ে যায়। তাঁর আর্তচিৎকারে প্রথমে চাচাতো ভাইদের একজন ছুটে যায়। সেই ভাইয়ের চিৎকার শুনে অন্য ভাইটিও জেগে উঠে ছুটে যায়। ততক্ষণে তিনি একেবারে ঢলে পড়েন। সমস্ত শরীর নীলচে রঙ ধারণ করেছে। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে।

মুহূর্তেই আশপাশের বাড়ির লোকজন জড় হয়ে যায়। একজন চলে যায় সাপের ওঝা ডেকে আনতে। কিন্তু ওঝা আসার আগেই তিনি মারা যান।

চার

মাঝ রাত। জয়নালের ঘুমের মাঝে আবার সেই অদ্ভুত লোকটা এসেছেন।

বজ্রগম্ভীর গলায় বলছেন, এবারে চাচাকেও হারালি, এখনও কি আমার কথায় রাজি হবি না?

জয়নাল বলল, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

আমার কথা না শুনলে একে-একে সবাইকে হারাবি। এরপর পর্যায়ক্রমে তোর দুই চাচাতো ভাই। প্রয়োজনে সমস্ত গ্রাম উজাড় করে ফেলব।

জয়নাল বিস্মিত গলায় বলল, আপনার কথার মানে। বুঝতে পারছি না।

তুই কী ভেবেছিস, তোর বাবার আর চাচার মৃত্যু এমনিতেই হয়েছে? তোর কারণে হয়েছে। তুই আমার কথায় রাজি হসনি বলে তাঁদের মরতে হলো।

জয়নাল অবাক গলায় বলল, আমার কারণে তাদের মৃত্যু হবে কেন?! বাবা মারা গেছেন ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে, চাচা মারা গেছেন সাপের ছোবলে।

পঞ্চবক্র হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, আমার হাতে যে আঁকা-বাঁকা লাঠিটা দেখিস, এটা কোনও সাধারণ লাঠি নয়। এটা সাক্ষাৎ মৃত্যু। এই লাঠি আমি যার নাম বলে ছুঁড়ে মারব তার মৃত্যু ঘটবে। লাঠি মাটিতে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে জীবন্ত হয়ে উঠবে। যাকে মারতে যে রূপের প্রয়োজন সেই রূপ নেবে। তোর বাবাকে মারতে চিলের রূপ, আর চাচাকে মারতে সাপের রূপ নিয়েছিল। তুই যদি আরও মৃত্যু দেখতে চাস কী আর করার! তোকে আমার চাই-ই চাই।

জয়নাল বুঝতে পারল তান্ত্রিক পঞ্চবক্র যা বলছেন ঠিকই বলছেন। তার অনেক ক্ষমতা। তিনি চাইলে সব কিছুই করতে পারেন। সে মরিয়া গলায় বলে উঠল, তারচেয়ে আপনি আমাকেই মেরে ফেলেন।

না, তোকে কিছুতেই মারা যাবে না। তোকে পাবার জন্য পৃথিবীর সবাইকে মেরে ফেললেও, তোকে কিছুতেই মারব না। না অন্য কাউকে তোক মারতে দেব।

আপনি কী চান আমার কাছে?

কতবার বলেছি আমি শুধু তোকে চাই। তোকে নিয়ে যেতে চাই। ইচ্ছে করলে আমি তোকে সম্মোহন করেও নিতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার কাজ হবে না। তোকে নিজের ইচ্ছেতে যেতে হবে। যতক্ষণ না তুই রাজি হবি, তোকে বাধ্য করার জন্য সব করব আমি।  

জয়নাল হার মানা গলায় বলল, ঠিক আছে, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

তান্ত্রিকের চেহারায় পরিতৃপ্তির ছাপ দেখা গেল। চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আয়েশি গলায় বললেন, চল, তা হলে।

.

জয়নাল তান্ত্রিক পঞ্চবক্রের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। নিশুতি রাত। আকাশে ঘোলাটে চাঁদ। চারদিক থমথম করছে। কোথাও কেউ নেই। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে সমস্ত গ্রাম। এমনকী আশপাশে কোনও রাত জাগা কুকুর-বিড়ালও দেখা যাচ্ছে না। যেন কোনও অশুভ শক্তির ভয়ে সবাই লুকিয়ে রয়েছে।

জয়নাল তান্ত্রিকের পিছু-পিছু এগিয়ে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! চাঁদের আলোতে জয়নালের ছায়া পড়ছে, কিন্তু তান্ত্রিকের ছায়া দেখা যাচ্ছে না।

তান্ত্রিক জয়নালকে নিয়ে গ্রামের উত্তর দিকের শেষ মাথায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এই জঙ্গল সুন্দরবনের একটা অংশ। এখান থেকে যতই সামনে এগোবে ততই সুন্দরবনের গভীরে চলে যাবে।

তান্ত্রিক জয়নালকে নিয়ে জঙ্গল চিরে এগিয়েই যাচ্ছেন। কোথায় তার গন্তব্য কে জানে! পথ যেন আর ফুরোবার নয়! ক্লান্তিতে জয়নালের শরীর ভেঙে আসছে। বার-বার হাই উঠছে। যেন চলতে-চলতেই সে ঘুমিয়ে পড়বে।

রাত ফুরিয়ে চারদিক ফর্সা হয়ে উঠছে। পাখির কলতানে নতুন একটা দিনের সূচনা হচ্ছে। তান্ত্রিক আর জয়নাল গিয়ে পৌঁছেছে জঙ্গলের মাঝের পরিত্যক্ত এক শ্মশান কালী মন্দিরে। বিশাল জায়গা জুড়ে পলেস্তারা খসে পড়া, শেওলা ধরা, রাজ্যের আগাছা গায়ে জড়িয়ে কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা কাঠামোটা। কমপক্ষে দেড়-দুশো বছর আগে হয়তো শ্মশানের পাশ ঘেঁষে কেউ এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। এখন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে গত একশো বছরেও কেউ হয়তো এই মন্দিরের চাতালে পা রাখেনি। শ্মশানেও হয়নি কোনও শবদেহ পোড়ানো।

তান্ত্রিক জয়নালকে মন্দিরের ভিতরে এক গুপ্ত কামরায় নিয়ে গেলেন। এটাই বোধহয় তান্ত্রিকের ডেরা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

তান্ত্রিক বললেন, আমার সঙ্গে এখানেই থাকবি তুই।

জয়নাল কিছু বলল না। পথশ্রমে তার শরীর ভেঙে আসছে।

তান্ত্রিক বললেন, যা, নদী থেকে স্নান করে আয়। মন্দিরের পাশ ঘেঁষেই একটা নদী বয়ে গেছে। পঞ্চাশ-ষাট হাত এগোলেই নদীটা দেখতে পাবি। ততক্ষণে আমি তোর খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

জয়নাল নদী থেকে গোসল করে এল। তান্ত্রিক তার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আস্ত দুটো ঝলসানো বন মোরগ, পোড়া বুনো আলু, আর নানান ধরনের বুনো ফল-মূল।

জয়নাল দেরি না করে খেতে বসল। সারা রাত ধরে হেঁটে আসায় পেটে তার কুমিরের খিদে। খাবার দেখে নিজেকে। আর সামলাতে পারল না।

জয়নাল গোগ্রাসে খাচ্ছে আর তান্ত্রিক দূরে বসে তৃপ্তি ভরা চোখে তার খাওয়া দেখছেন। খেতে-খেতে জয়নালের খেয়াল হলো তান্ত্রিক নিজে কিছুই খাচ্ছেন না। সে বুনো মোরগের রান চিবুতে-চিবুতে বলে উঠল, আপনি কিছু খাচ্ছেন না। কেন?

তান্ত্রিক বললেন, আমার খাওয়ার দরকার হয় না। মানুষ খায় কেন? শরীরে শক্তি জোগানোর জন্য। আমি ধ্যানে বসে সরাসরি সূর্যের আলো আর বাতাস থেকে শক্তি শুষে নিই।

জয়নালের খাওয়া শেষ হলে তান্ত্রিক বললেন, আমি এখন ধ্যানে বসছি। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আমাকে কখনও বিরক্ত করবি না।

জয়নাল কিছু না বলে ওপাশে মাদুরের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। চোখ দুটো আর মেলে রাখতে পারছে না।

পাঁচ

তান্ত্রিকের আস্তানায় জয়নালের প্রায় সপ্তাহ দুই কেটে গেছে। প্রতি বেলায়ই তান্ত্রিক তাকে যথা সম্ভব ভাল-ভাল খাবার দাবার দিচ্ছেন। ঝলসানো বন মোরগ, না হয় ঝলসানো হরিণের মাংস, পাখির মাংস, বুনো হাঁসের মাংস, বুনো মহিষের মাংস, কবুতরের মাংস, নদী থেকে ধরে আনা বড় বড় মাছ-কিছু একটা থাকছেই। সেই সঙ্গে সিদ্ধ বুনো আলু, সিদ্ধ কচি বাঁশের কাণ্ড, সিদ্ধ সবজি, মধু, বুনো কলা, আম, লিচু, কাঁঠাল, ডালিম সহ নাম না জানা অনেক বুনো ফল মূল।

তান্ত্রিক এসব খাবার কীভাবে সংগ্রহ করেন সেটা জয়নাল বুঝতে পারছে না। সব সময়ই ধ্যানে মগ্ন থাকেন, অথচ খাওয়ার বেলায় ঠিকই জয়নালের সামনে এসব খাবার পরিবেশন করছেন। অবশ্য এই জঙ্গলে এ সবই পাওয়া যায়।

তান্ত্রিকের আস্তানায় জয়নালের দিনগুলো খুব একটা খারাপ কাটছে না। বলা যায় জামাই আদর পাচ্ছে। কিন্তু তাকে কী জন্য আনা হয়েছে সেটা তান্ত্রিক এখনও বলেননি। জয়নালের মনে ভয় জাগছে, তান্ত্রিকের আস্তানাটা হচ্ছে শত বছরের পুরানো একটা শোন কালী মন্দির, শুনেছে মা কালীর সামনে অনেক সময় নরবলি দেয়া হয়-তান্ত্রিক কি তা হলে তাকে বলি দেবার উদ্দেশ্যে এনেছেন? বলি দেবার আগে খাইয়ে-পরিয়ে হৃষ্ট-পুষ্ট করে নিচ্ছেন? তবে এই মন্দিরের মূর্তির বেদির জায়গাটা খালি। সেখানে কোনও কালী মূর্তি নেই। কোনও এক সময় হয়তো ছিল। কেউ সেটাকে সরিয়ে ফেলেছে বা চুরি করে নিয়ে গেছে।

জয়নাল রাতের খাওয়া শেষ করে উঠল। একট দরেই তান্ত্রিক পদ্মাসনে বসে আছেন। জয়নাল ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনার এখানে অনেক দিন হয়ে গেল, কিন্তু এখনও জানতে পারলাম না কেন আমাকে নিয়ে এসেছেন!

তান্ত্রিক আয়েশি গলায় বললেন, সময় হলেই জানতে পারবি। সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আর বেশি দেরি নেই।

জয়নাল বলে উঠল, আপনি কি আমাকে বলি দেবেন?

তান্ত্রিক ধমকে উঠলেন, আহাম্মকের মত কথা বলবি না। আমি তোকে বলি দেব কেন? আগেই বলেছি না তোকে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবাইকে মেরে ফেলতে পারি, কিন্তু তোকে কিছুতেই মরতে দেব না।

তা হলে কেন আমাকে নিয়ে এসেছেন? বলিও দেবেন না, আপনার কী কাজে আমি লাগতে পারি?

আমার মেয়েকে তোর কাছে বিয়ে দেব।

জয়নাল হতবাক হয়ে গেল। মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দেবার জন্য তার বাবা-চাচাকে মেরে তান্ত্রিক তাকে এভাবে নিয়ে এসেছেন!

জয়নাল বসে-যাওয়া গলায় প্রশ্ন করল, আপনার মেয়ে আছে?

তান্ত্রিক কিছুটা বিষাদগ্রস্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমার একটি মেয়ে আছে। পরীর চেয়েও রূপবতী মেয়ে।

জয়নাল বলল, পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব আছে? আপনার মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য আমাকেই বেছে নিতে হলো?  

তান্ত্রিক বললেন, তুই ছাড়া পৃথিবীর আর কেউই আমার মেয়ের যোগ্য নয়।

কী এমন আছে আমার মাঝে, যে আমার কাছেই আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে?

আমার মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য এমন একটা ছেলের প্রয়োজন ছিল যার জন্ম শুক্লপক্ষের তেরোতম রাত্রির পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের মুহূর্তে। যে জন্মের পরপরই মাকে হারিয়েছে। বড় হয়েছে কোনও নারীর আদর-ভালবাসা আর স্পর্শ ছাড়া। বড় হয়েও কোনও নারীর সান্নিধ্য পায়নি। প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কেও জড়ায়নি। হারায়নি কুমারত্ব। অথবা কোনও নারীকে নষ্ট করেনি বা হত্যা করেনি। কোনও মাদী জন্তু জানোয়ারও হত্যা করেনি। একজন নারীকে নষ্ট করা আর হত্যা করা একই ব্যাপার। মোদ্দা কথা, এমন একজন যার দ্বারা কোনও দিনও কোনও নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অথচ সে কোনও দিন কোনও নারীর ভালবাসা পায়নি। এই সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে তোর মাঝে। তোর জন্ম শুক্লপক্ষের। তেরোতম রাত্রিতে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের মুহূর্তে। জন্মের পরই মা মারা গেছে। বড় হয়েছিস বাবার কোলে। মায়ের অবর্তমানে খালা, ফুপু, মামী, চাচী, নানী, দাদী বা বড় বোন সম্পর্কিত কারও কোলেই বড় হসনি। মুখচোরা লাজুক স্বভাবের বলে বড় হয়েও কোনও নারীর কাছে যাসনি। কোনও মাদী জন্তু জানোয়ারও হত্যা করিসনি। হত্যা করা তো দূরের কথা, কোনও জন্তুকে তোর সামনে অন্য কেউ হত্যা করতে গেলেও ভয়ে পালিয়ে যাস। তা মাদী বা মর্দা যে, কোনও ধরনের জন্তুই হোক।

জয়নাল ভেবে দেখল তান্ত্রিক তার সম্পর্কে যা বলছেন সব ঠিকই বলছেন। তার সামনে কেউ মুরগি-হাঁস জবাই করতে নিলেও সে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। তাই তার বাবা বাড়িতে কখনও মুরগি-হাঁস জবাই দিতেন না। ছোটবেলা থেকেই তার এই মানসিক সমস্যাটা রয়েছে।

জয়নাল বলল, এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে আপনি আপনার মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দিতে চান, এ কথাটা তো সহজভাবেও বলা যেত। আমার বাবা-চাচাকে হত্যা করে আমাকে বাধ্য না করলেও পারতেন।

সহজভাবে বললে তুই রাজি হতি না।

কেন রাজি হতাম না? আপনার মেয়ে নাকি অসম্ভব রূপবতী!

তান্ত্রিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার মেয়ে জীবিত নয়, মৃত। মৃত মেয়েকে বিয়ে করতে কেউ কি রাজি হয়?

কথাটা শুনে জয়নালের মুখ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অস্ফুটে বলল, আপনার মেয়ে মত?!

তান্ত্রিক বলতে লাগলেন, হ্যাঁ, মৃত। প্রায় দেড়শো বছর আগে মারা গেছে আমার এই মেয়ে। আমি তখন কালী মন্দিরের সাধারণ এক পুরোহিত ছিলাম। মা মরা মেয়ে আমার। তিন দিনের জ্বরে মেয়েটা আমার কুমারী অবস্থায় মারা যায়। মেয়ের মৃত্যুতে মাথা খারাপের মত অবস্থা হয় আমার। প্রাচীন লিপি, পুঁথি এসব নিয়ে আমার অনেক পড়াশোনা ছিল। প্রাচীন এক পুঁথিতে পেয়েছিলাম এক মস্ত অপদেবতা রয়েছেন, যার আরাধনা করে মৃত্যুকে রোখা যায়, মৃত মানুষকে আবার জীবিত করা যায়।

আমি লোকালয় থেকে পালিয়ে জঙ্গলের পরিত্যক্ত এই মন্দিরে এসে সেই অপদেবতার আরাধনা শুরু করি। প্রথমে অপদেবতা আমাকে নিজের মৃত্যুকে পরাজিত করার ক্ষমতা দেন। এরপর ক্ষমতা আসে অন্যকে মৃত্যু শাস্তি দেবার, আমার হাতের এই আঁকা-বাঁকা লাঠির মাধ্যমে। আরও একশো বছর ধরে আরাধনা চালিয়ে যাবার পর মেয়েকে বাঁচিয়ে তোলার ক্ষমতাও আসে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তোর মত নিষ্পাপ এক যুবকের প্রয়োজন পড়ে। যার দ্বারা কোনও দিনও কোনও নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তেমন এক যুবকের সান্নিধ্যেই পুনর্জীবন লাভ করবে আমার মেয়ে। আবার গড়ে উঠবে তার দেহ। আমার কাঁধে সব সময় এই যে কাপড়ের পুঁটলিটা দেখিস, এটার মধ্যেই রয়েছে আমার মেয়ের অস্থি। এই অস্থির সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। তোর জন্ম তিথিতে। শুক্লপক্ষের তেরোতম রাত্রির পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের মুহূর্তে। খুব শীঘ্রিই আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি।

ছয়

শুক্লপক্ষের তেরোতম রাত। রাত একটা এক মিনিট থেকে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে। শেষ হবে একটা তেত্রিশ মিনিটে। চন্দ্রগ্রহণের এই মুহূর্তে তান্ত্রিকের মেয়ের কঙ্কালের সঙ্গে জয়নালের বিয়ে সম্পন্ন হবে। বিয়ে হবার পরপরই পুনর্জীবন লাভ করবে তান্ত্রিকের মেয়ে। বিয়ের সব আয়োজন শেষ। অপেক্ষা শুধু চন্দ্রগ্রহণের।

জয়নাল নদী থেকে স্নান করে এসেছে। নগ্ন হয়ে পর-পর তিনটা ডুব দিয়ে সেলাইবিহীন এক খণ্ড সাদা কাপড় কোমরে জড়িয়ে, একবারের জন্যও পিছনে না তাকিয়ে সোজা মন্দিরের চাতালে এসে পৌঁছেছে। আসার পথে বার-বারই মনে হয়েছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা তার পিছু-পিছু চলে আসছে। কিন্তু তান্ত্রিকের নির্দেশ মেনে একবারের জন্যও পিছনে তাকায়নি।

মন্দিরের চাতালের ঠিক মাঝ বরাবর দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনকে সামনে রেখে পদ্মাসনে বসেছেন তান্ত্রিক। আগুনের সামনে লাল সালু কাপড়ের উপর মানুষের আকৃতিতে লম্বালম্বিভাবে বিছিয়ে রাখা হয়েছে তান্ত্রিকের মেয়ের কঙ্কাল। মাথার জায়গায় খুলি, এরপর গলার হাড়, পাঁজরের হাড়, উরুর হাড়, পায়ের জায়গায় পায়ের হাড়-যথাক্রমে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। লাল রঙের এক বিয়ের শাড়ি দিয়ে উপর থেকে ঢেকে দেয়া হয়েছে লাল সালুতে বিছিয়ে রাখা হাড়-গোড়গুলোকে। শুধু খুলিটা বাইরে বেরিয়ে আছে।

তান্ত্রিক উচ্চস্বরে দুর্বোধ্য বিভিন্ন মন্ত্র-তন্ত্র আওড়ে যাচ্ছেন আর সামনে থাকা আগুন একটু পর-পর উসকে দিচ্ছেন। চন্দন কাঠের টুকরো আগুনে ঠেলে দিচ্ছেন, ঘি ঢালছেন, ঢালছেন করমচা তেল, ছিটাচ্ছেন ধূপ-ধুনো আর লোবানের গুঁড়ো সহ আরও যেন কী সব। ওদিকে আগুনের সামনে থাকা কঙ্কালের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছেন মন্ত্রপূত জল, আতর-গোলাপজল সহ বিভিন্ন সুগন্ধী।

চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবার ঠিক আগমুহূর্তে তান্ত্রিক জয়নালকে নির্দেশ দিলেন কঙ্কালের উপর গিয়ে বসতে। শবসাধনার ভঙ্গিতে কঙ্কালের পেট বরাবর উঠে বসতে হবে।

জয়নাল তা-ই করল। কঙ্কালের পেট বরাবর উঠে বসল। তান্ত্রিক মন্ত্র-তন্ত্র চালিয়েই যাচ্ছেন। ওদিকে মাথার উপর আকাশে চাঁদটা ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। নেমে আসছে অন্ধকার।

চাঁদ পুরোপুরি গ্রাস হবার পর তান্ত্রিক ওকে নির্দেশ দিলেন কঙ্কালের খুলিতে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়ে নেমে আসতে।

জয়নাল কঙ্কালের খুলিতে সিঁদুর মাখিয়ে নেমে এল। চাঁদটাও গ্রাসমুক্ত হতে শুরু করল। আলোর রেখার মত চাঁদের সামান্য অংশ দেখা গেল। সেই রেখা ক্রমেই বিস্তার লাভ করতে থাকল।

গ্রাসমুক্ত হতে থাকা চাঁদের আলো বনভূমিতে এসে পৌঁছতেই প্রচণ্ড দমকা হাওয়া ছাড়ল। চাঁদের গ্রাসমুক্ত হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দমকা হাওয়া ধীরে-ধীরে ঝড়ো হাওয়ায় রূপ নিল। হাওয়ার তোড়ে তান্ত্রিকের সামনের আগুন নিভে। গেল। কঙ্কালটিকে ঢেকে রাখা বিয়ের শাড়িটাও উড়ে গেল।

কী আশ্চর্য! কঙ্কালের পাঁজরের মাঝে একটা হৃৎপিণ্ড দেখা যাচ্ছে! জীবন্ত! ধক-ধক করে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে।

ঝড়ের তীব্রতা আরও বেড়েছে। ঝড়ো হাওয়া আশপাশের সব ধুলো-বালি উড়িয়ে আনছে। ওগুলো উড়ে এসে কঙ্কালের গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে।

লেপ্টে যাওয়া ধুলো-বালিগুলো ধীরে-ধীরে কঙ্কালের গায়ে রক্ত-মাংস, শিরা-উপশিরা আর চামড়ার রূপ নিচ্ছে। পা থেকে শুরু হয়েছে। প্রথমে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল। এরপর সবগুলো আঙুল। পায়ের পাতা। এক সময় সম্পূর্ণ পা। পর্যায়ক্রমে পা থেকে উপরের দিকে সবগুলো অঙ্গ গড়ে উঠতে লাগল। নমনীয়-কমনীয় মাখনের মত ফর্সা মোলায়েম নারী অঙ্গ।

তান্ত্রিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে-হাসতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, পেরেছি! আমি পেরেছি! আমার সাধনা সফল হয়েছে! আমার মেয়েকে আবার জীবিত করতে। পেরেছি…

সব ঠিকঠাকই হচ্ছিল। কঙ্কালের কাঁধ পর্যন্ত নারীর অঙ্গ সৌষ্ঠবই গড়ে উঠেছে। কাঁধের উপরে গলা থেকে দেখা দিল বিকৃতি। নারীর মুখের জায়গায় গড়ে উঠেছে শিয়ালের মুখ।

তান্ত্রিকের হাসি থেমে গেল। মুহূর্তে তার চেহারায় নেমে এল এক রাশ আতঙ্ক। আতঙ্কিত তান্ত্রিক আর্তচিৎকারের মত করে বলে উঠলেন, একী হচ্ছে?! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কোথায় ভুল করেছি? আমার মেয়ের মুখের জায়গায়

কেন শিয়ালের মুখ গড়ে উঠেছে?

এবারে হেসে উঠল জয়নাল। হাসতে-হাসতে বলতে লাগল, তান্ত্রিক পঞ্চবক্র, তুই ভেবেছিস কী, আমার বাবা চাচাকে মেরে আমাকে বাধ্য করে তোর মেয়েকে তুই ফেরত পাবি? আমি কোনও প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করব না? শুধু মুখ বুজে সব সহ্য করে যাব? তোর মুখ থেকে শুনে এবং তোর অবর্তমানে তোর ডেরায় থাকা পুরানো পুথি পড়ে এটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি যদি কোনও নারীর প্রতি অন্যায় করি, বা নিজের কুমারত্ব নষ্ট করি, তা হলে তুই সফল হতে পারবি না। সেই চেষ্টাই নিই। তুই যখন ধ্যানে থাকিস তখন এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোনও প্রতিতালয়ে গিয়ে নিজের কুমারত্ব নষ্ট করে আসতে চাই। সেই চেষ্টা আমার সফল হয় না। দিনের পর দিন জঙ্গলে ঘুরে মরি কিন্তু জঙ্গল থেকে কিছুতেই বেরোতে পারি না। পথ গুলিয়ে ফেলি। তুই হয়তো নজরবন্দি করে রেখেছিলি। বার-বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। হাতে আর সময় থাকে না। আজকের এই রাত এসে যায়। তোকে বিফল করতে কিছুই আর করার থাকে না। আমাকে নদী থেকে, পর-পর তিনটা ডুব দিয়ে স্নান করে আসতে বলিস। নদীতে যাওয়ার পথে হঠাৎ মাথায় খেয়াল আসে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময় দুটো বাচ্চা সহ একটি মা শিয়ালকে দেখেছিলাম। শিয়ালটার বাসাও দেখেছিলাম। মোটা একটা গাছের খোড়লে। বাচ্চা দুটো বড় হয়ে গেছে। মায়ের অভাবে এখন আর মারা পড়বে না। আমি গিয়ে গাছের খোড়লের ভিতর থেকে শিয়ালটাকে বের করে হত্যা করি। জীবনে প্রথম কোনও জন্তুকে হত্যা। তা-ও আবার একটা মাদী জন্তু। শিয়ালটার রক্ত সারা গায়ে মেখে নদী থেকে গোসল করে আসি। তুই কিছুই বুঝতে পারিসনি। তুই হয়তো মেয়েকে বাঁচিয়ে ভোলার যজ্ঞ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলি যে কিছুই ধরতে পারিসনি।

চাঁদটা পুরোপুরি গ্রাসমুক্ত হয়েছে। ঝড় থেমে গেছে। চারদিক থমথম করছে। সেই সঙ্গে তান্ত্রিকের মুখটাও।  

তান্ত্রিকের মেয়ে বেঁচে উঠেছে। রূপবতী কোনও নারী নয়, অদ্ভুত এক জম্ভ হয়ে। পুরো শরীর মেয়েমানুষের মত, শুধু মাথাটা শিয়ালের।

অদ্ভুত জন্তুটা গা ঝাড়া দিয়ে চার হাত-পায়ে উঠে দাঁড়াল। ক্রোধের হুঙ্কার ছাড়তে লাগল। মুখ থেকে গড়িয়ে নামছে লালা। মুখের দুপাশ থেকে বেরিয়ে পড়েছে লম্বা শ্বদন্ত। হাতে-পায়েও গজিয়ে উঠেছে হিংস্র জন্তুর মত লম্বা সূচালো তীক্ষ্ণ নখ।

তান্ত্রিক আহত গলায় চিৎকার করে উঠলেন, কাজটা তুই ঠিক করলি না। মোটেই ঠিক করলি না। তন্ত্রবিদ্যার কিছুই না জেনে ভুল পদক্ষেপে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তুই ভয়ঙ্কর এক। পিশাচীকে ডেকে এনেছিস। যে পিশাচী নারী এবং শিয়ালীর অস্তিত্বে ভর করে নরক থেকে চলে এসেছে। তুই শুধু তোের আর আমারই বিপদ ডেকে আনিসনি, পুরো মানব জাতির জন্যও বিপদ ডেকে এনেছিস।

তান্ত্রিকের বলা শেষ হবার আগেই শিয়াল এবং নারীর মিশেল, অদ্ভুত দেখতে জন্তুটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লম্বা-লম্বা সূচালো নখযুক্ত একটা হাত তার পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। রক্তে ভেসে যেতে লাগল তান্ত্রিকের পুরো শরীর। হাতটা টেনে বের করে নিল কলিজাটা। এরপর রক্ত মাখা কলিজাটা কচ-কচ করে চিবিয়ে খেতে আরম্ভ করল।

মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে-করতে তান্ত্রিকের দেহ নিথর হয়ে গেল। ততক্ষণে অদ্ভুত জন্তুটা তান্ত্রিকের কলিজাটাও খেয়ে শেষ করেছে। এবারে ওটা চোখ তুলে তাকাল জয়নালের দিকে।

জয়নাল বুঝতে পারল ওটার লক্ষ্য এখন সে। এক মুহূর্তও আর দেরি না করে সে পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করল। জন্তুটাও থেমে রইল না। ধাওয়া শুরু করল। চার হাত-পায়ে চিতা বাঘের গতি ওটার।

ফুটফুটে চাঁদের আলোতে দিগ্বিদিজ্ঞানশূন্য জয়নাল ছুটতে-ছুটতে নদীর পাড়ে এসে পড়ল। কীসের সঙ্গে যেন পা হড়কে চাঁদের আলোতে ঝিকমিক করা নদীতটের বালির উপর আছড়ে পড়ল। সেই সুযোগে ধাওয়া করে আসা অদ্ভুত জন্তুটা তার উপর চেপে বসল।

কী অবাক কাণ্ড! জন্তুটা তাকে মারছে না! বরং আদর। জানাচ্ছে! পশুরা যেভাবে আদরের ভাষা জানায়। নাক দিয়ে তার গায়ের গন্ধ শুঁকছে। জিভ দিয়ে শরীর চেটে দিচ্ছে। গায়ের সঙ্গে গা ঘষছে। চার হাত-পায়ে জড়িয়ে ধরে লুটোপুটি খেলার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ সুযোগ এসে গেল জয়নালের। লুটোপুটি খেলতে গিয়ে জন্তুটার চার হাত-পায়ের বাধন আলগা হয়ে গেছে। সেই সুযোগে জয়নাল লাফ দিয়ে সরে গিয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নদীতে নেমে পড়ল। জটা তাকে আর ধরার চেষ্টা না করে নদীতটে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।

সাঁতার কেটে বেশি দূর এগোতে পারল না জয়নাল। ভয়ে-আতঙ্কে টেনে-টেনে শ্বাস নিতে থাকায় নাকের ফুটো দিয়ে শ্বাসনালীতে পানি ঢুকে পড়ছে। ভয়ানক কাশি উঠল। কাশির দমকে শ্বাস টেনে আর কুলোতে পারল না। জ্ঞান। হারিয়ে নদীর গভীরে তলিয়ে গেল।

পরিশিষ্ট

জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নদীর কিনারে চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সের এক যুবককে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। তারা তাকে উদ্ধার করে জেলে পল্লীতে নিয়ে যায়। তিন দিনেও জ্ঞান ফেরে না যুবকের। তিন দিন পর। যুবক জ্ঞান ফিরে পেলেও তার স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। সে  তার নাম-ধাম, পরিচয়, বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারে না। শুধু এটুকুই বলে, অদ্ভুত একটা জন্তু তাকে তাড়া করেছিল। জন্তুটার মুখটা শিয়ালের মত আর গলার নিচ থেকে মেয়েমানুষের মত। আর কিছুই মনে নেই তার। ঘুমের মাঝেও যুবক স্বপ্নে সেই অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে। স্বপ্নে জন্তুটা তাকে নিতে আসে। অবশ্য সে দাবি করে সত্যি সত্যিই জন্তুটা তাকে নিতে আসে। জন্তুটা তাকে আদর ভালবাসা জানায়। যেন তার সঙ্গে কোনও এক গোপন সম্পর্ক রয়েছে জটার।

.

কিছুদিন ধরে সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামবাসীরা ভয়ানক আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তাদের গবাদি পশু, পোষা পাখি সহ বিভিন্ন বয়সী মানুষদেরকে কীসে যেন ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহের পেটটা চেরা থাকে। পেট চিরে কলিজাটা বের করে নেয়া হয়েছে। কেউ বলছে এটা মানুষখেকো কোনও বাঘ বা চিতা বাঘের কাজ। কেউ বলছে মস্তিষ্ক বিকৃত কোনও মানুষের কাজও হতে পারে। কেউ-কেউ আবার দাবি করছে তারা স্বচক্ষে জানোয়ারটাকে দেখেছে। বাঘ বা চিতা বাঘ কিছুই নয়, শিয়াল জাতীয় অদ্ভুত এক জন্তু। ওটার মুখ শিয়ালের মত, আর শরীরের বাকি অংশ মেয়েমানুষের মত। কেউ আবার দাবি করছে ওরকম জল্প একটা নয়, দুটো। এক জোড়া। একটা পুরুষ, অন্যটা মহিলা। মাঝে-মাঝে পুরুষটাকেও দেখা যায়।

আফজাল হোসেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *