আগমন – নাজনীন রহমান

আগমন

গ্রামের মানুষ ভীষণ ভয় পায় ভূত-প্রেতে, ওদের ধারণা অশুভ, খারাপ জিনিস মিশে থাকে বাতাসে, তারপর সুযোগ মত মানুষের ঘাড়ে চাপে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষ মন। থেকে দূর করতে পারে না ভীতি। গ্রামে বেল গাছ, ঘন বাঁশ ঝাড়, শেওড়া গাছ, গাব গাছের অভাব নেই-সবার বদ্ধমূল ধারণা, এসব গাছ ভূত-পেত্নিদের খুবই প্রিয়, তাই নানা খারাপ জিনিস এই গাছগুলোতে থাকে।

এমনই এক গ্রামে বাস করে সচ্ছল কৃষক রমিজ আলী। তার দুই ছেলে রতন ও মণি।

রতন বিয়ে করেছে, দুই বছরের ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে আছে তার।

রমিজ এখন বৃদ্ধ হয়েছে, শরীরে শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই, রতনই বাবার সম্পত্তির দেখভাল করে। বিশ্বস্ত-কর্মঠ কামলা, মজুর আছে-অসুবিধে হয় না।

মণি বৈষয়িক কাজে নেই, তার ভাল লাগে নদীতে ঝাপাঝাপি করে মাছ ধরতে, গাছে উঠে ফল পাড়তে, সঙ্গী সাথী নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় ও গল্প-গুজব করতে। রমিজ রাগ করেছে, হ্যাঁ রে, এইভাবে গায়ে বাতাস দিয়া কদ্দিন চলবি? বড় ভাইটা একলা খাইট্টা শেষ হইল, অরে সাহায্য করা লাগে না? আর কিছু না করিস, শাক-সবজির চালান নিয়া শহরে তো যাইতে পারিস?

আমার ওসব ভাল লাগে না, বলে নির্বিকারভাবে সরে পড়ে মণি।

মণির সর্বক্ষণের সাথী হলো রাজু, একেবারে ছোট থেকে আছে সে এই বাড়িতে। এতিম ছেলেটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল রমিজ, তারপর বাড়ির ছেলের মতই হয়ে গেছে সে। রতন আর মণি গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, তারপর, পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয়নি বলে স্কুল বাদ দিয়ে রতন বাবার কাজে সাহায্য করেছে।

আর মণি?

মনের সুখে দুষ্টুমি করে বেড়িয়েছে। কোন্ গাছের ডালে পাখির ছানা আছে, কার গাছের ফল পেকেছে, এসবে সে পুরোপুরি হাফেজ। আর রাজু তো মণির অন্ধ চামচা। দুজনে। ঘুমায়ও এক ঘরে, মণি চৌকিতে আর কাছেই মাটিতে বিছানা করে শোয় রাজু। ঘুমাবার আগে কত গল্প হয় দুজনার।

রতনদের ধান-চাল, নানা ফল, সবজির ব্যবসা-বিশাল কারবার। মণি বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়ায়, বাবার সেটা একদম সহ্য হয় না। দুই ভাই মিলেমিশে কাজ-কর্ম করবে, এটাই রমিজের মনের ইচ্ছে। বকাবকি, শাসন করেও কোনও লাভ হয় না। মণি তার ইচ্ছেমতই যা খুশি করে বেড়ায়। রতন খুবই ভালবাসে ছোট ভাইকে, বাবাকে বোঝায়, থাক, বাপজান, ওরে কিছু বইলো না, আমি তো আছিই, হেসেখেলে চলুক কিছুদিন, দেইখো সব ঠিক হইয়া যাইব।

রাজু খুব হাসি-খুশি-রসিক ছেলে, সে-ও সেদিন গম্ভীর মুখে মণিকে বলল, ছোট ভাই, আপনে একটা বিয়া কইরা ফালান, তাইলে বাজান বউয়ের সামনে আপনারে বকতে পারব না।

রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল মণি, বলল, ফাজিল ছোকরা, তুই বিয়া কর, খুব শখ-না?

মুখটা করুণ করে রাজু বলল, আমারে মাইয়া দিব কেডা? একদিন সালাম চাচার মাইয়ারে একটা গোলাপ ফুল দিছিলাম। গালি তো যা দিবার দিলই, শ্যাষে স্যাণ্ডেল ছুঁইড়া মারল।

হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল মণির।

আস্তে আস্তে কাজ শুরু করল মণি। করতেই হলো। বিরাট কারবার তাদের, অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার। রতন একা সবদিক সামলাতে পারে না, কর্মচারী থাকলেও নিজেদের খেয়াল রাখা দরকার। মণি আর গাফিলতি করল না, ভাইকে সাহায্য করতে লাগল। শহরে চালান নিয়ে যায়, কখনও ধান, চাল, শাক, সবজি, কখনও ফল। রাতের বেলায় ট্রাক নিয়ে রওনা হয়, ভোরে কাজ শেষ করে ফিরে আসে। রাজুকে সঙ্গে নেয়, সেজন্য খারাপ লাগে না, বরং প্রতিটি ট্রিপ বেশ উপভোগ্য হয়।

মাঘ মাস, শীতকালীন সবজি দিয়ে ভরা হয়েছে ট্রাক। তিনজন শ্রমিক নিয়ে রওনা হলো মণি। আজ আর রাজু সঙ্গে নেই। জ্বর হয়েছে ওর। সবজির যাতে ক্ষতি না হয়, সেভাবে ব্যবস্থা করে শ্রমিকরা গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ট্রাকের খোলা জায়গায় শুলো। মণিও ওদের একপাশে শুয়ে পড়ল। ড্রাইভার বলল, ভাইজান, আপনে বাইরে কষ্ট করবেন ক্যান? ঠাণ্ডা লাগব, ভিতরে আসেন।

মণি রাজি হলো না। ওদের ঠাণ্ডায় কষ্ট হবে, আর আমি আরামে থাকব? তা হয় না। ভাল করে শরীর ঢেকে নিল মণি।

রাস্তায় তেমন যানবাহন নেই, ড্রাইভার গতি বাড়িয়ে গন্তব্যে ছুটে চলল। এসব রাস্তায় বাতির ব্যবস্থা নেই, অন্যান্য গাড়ির হেডলাইটে চারদিক মাঝে-মাঝে আলোকিত হচ্ছে। নিকষ কালো অন্ধকার ভীতিকর করে তুলেছে শীতের রাতকে। আজ ঠাণ্ডাটা খুব বেশি। মণি যতই শরীর ঢেকে শুয়েছে, তারপরও ঠাণ্ডায় জমে যাবার অবস্থা হলো। ঠাণ্ডার চোটে একসময় ভেঙে গেল ঘুমটা ওর। ভাবল, ট্রাকের ক্যাবে চলে যাবে? অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখল, দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ওরা। খেটে খাওয়া মানুষ, তাপ কিংবা ঠাণ্ডা ওদেরকে কাবু করতে পারে না।

কম্বলটা ভাল করে গায়ে টেনে নিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করল মণি। প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই অবস্থায় হঠাৎ ওর মনে হলো কী যেন অসঙ্গতি আছে ট্রাকে। পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠল সে, অন্ধকারে অত ভাল দেখা যায় না, তারপরও মণি বুঝল শেষ শ্রমিকটার পাশেই আরও একজন শুয়ে আছে।

কী ব্যাপার?

শ্রমিক ছিল তিনজন, চারজন হলো কেমন করে?

একেবারে ট্রাকের শেষদিকে শুয়ে আছে মানুষটা। চলন্ত ট্রাকে কেউ উঠবে, তা-ও অসম্ভব। রাজুই কি শেষ মুহূর্তে ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে উঠেছিল? তা-ই বা কী করে হয়! ট্রাক ছাড়ার পরও তো তিনজন শ্রমিকই ছিল। তা হলে? শরীরটা কেমন ছমছম করে উঠল মণির। ভয় পেলেও সাহস সঞ্চয় করে বলল, কে রে ওখানে? রাজু নাকি?

ভারী জান্তব এক স্বর শোনা গেল, না, আমি রাজ নই

তারপরই মণির ভয়ার্ত চোখের সামনে ধীরে ধীরে যে উঠে বসল, মানুষ নয় ওটা, ভয়াল এক পিশাচ! রাতের অন্ধকারে, অশুভক্ষণে শিকারের সন্ধানে ঘুরছে সে, আজ সুযোগ পেয়েই ট্রাকে চলে এসেছে।

শয়তানটার কালো কুচকুচে চিকন, রোমশ শরীর। অন্ধকারে দুটুকরো অঙ্গারের মত জ্বলছে চোখ দুটো। কুৎসিত মুখে সাদা চোখাচোখা দাঁত বের করে বীভৎসভাবে হেসে উঠল বিভীষিকাটা, তারপর লিকলিকে কালো হাত দুটো লম্বা হতে হতে পেঁচিয়ে ধরল মণির গলা। বরফ-শীতল সেই হাতের স্পর্শে থরথর করে কেঁপে উঠল মণি। সাপের মত ঘিনঘিনে পিচ্ছিল গা।  

চিৎকার করতে পারল না মণি, দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘৃণিত রোমশ হাতের ছোঁয়ায়। পাশে যে শ্রমিক শুয়ে আছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাবার শক্তিও পেল না।

পিশাচটা শ্রমিকদের ওপর দিয়ে ভেসে এসে আষ্টেপৃষ্ঠে মণিকে পেঁচিয়ে ধরে গলায় বসিয়ে দিল ধারাল দাঁত। দুচোখ আঁধার হয়ে এল মণির। তারপরই জ্ঞান হারাল। এতবড় ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল টেরও পেল না শ্রমিকরা, জানতে পারল না হেলপার-ড্রাইভারও।

ড্রাইভার তো একমনে গাড়ি চালাচ্ছে, সমস্ত মনোযোগ সামনের রাস্তায়।

এক সময় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামল ট্রাক।

মাল খালাস করছে শ্রমিকরা, গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মণি, কথায় কথায় একে-ওকে ধমক দিচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপারে বিশ্রী গালাগালি করছে। সবাই খুব অবাক হয়ে গেল, হাসিখুশি মানুষটার আজ হলো কী? অন্যদিন কত কথা বলে, তামাশায় মেতে ওঠে, সবাইকে চা-নাস্তা খাওয়ায়। অথচ এখন? সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, ভয়ে কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না। _ ওই রাতের ঘটনার পর খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল মণি। কাজে যায় না, অন্ধকার ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না, ছেড়ে দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া। চিন্তিত হয়ে পড়ল বাড়ির সবাই। রতন ডাক্তার দেখাবার কথা বলল, কিন্তু মার ধারণা অন্য: রাত-বিরাতে যাওয়া-আসা করেছে, খারাপ বাতাস লেগেছে। বুঝি! ভাল হয় ইমাম সাহেবকে দিয়ে দোয়া পড়ালে।

ওই কথা শুনে ঘরের মধ্য থেকেই গর্জে উঠল মণি, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, একলা থাকতে দাও আমাকে।

রাজু, যে অত প্রাণের দোস্ত ছিল, তার সাথেও কথা বলে না মণি। রাতে শুয়ে এখনও রাজু নানারকম কথা তোলে, কিন্তু কোনও জবাব পায় না। অনেক অনুনয় করে বলেছে রাজু, ছোট ভাই, আপনের কী হইছে, আমারে বলেন, আমি কাউরে বলুম না।

ভয়াল স্বরে জবাব দিয়েছে মণি, আমারে বিরক্ত করলে তোর খবর আছে।

আজকাল মণিকে ভয় পায় রাজু।

ছোট ভাই আর আগের মত নেই, কেমন করে তাকায়, চেহারাতেও পরিবর্তন হয়েছে। মোমের মত সাদা, তেলতেলে

অদ্ভুত ভাব মুখে, শরীরটা কেমন কালো হয়ে গেছে।

সবচেয়ে আশ্চর্য কথা, একেবারে না খেয়ে সে আছে। কীভাবে?

শরীরও দিব্যি সতেজ ও সবল।

এ কী রহস্য?

কেউ ভেবে পায় না মণিকে নিয়ে কী করবে।

কিছুদিন পর, এক রাতে ভেঙে যায় রাজুর ঘুম। বাথরুমে যাবে। মণির বিছানায় চোখ পড়ে। নেই সে, এত রাতে গেল। কোথায়? বাথরুমে? রাজু নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাথরুম দেখল। খালি, কেউ নেই। সদর দরজায় নজর পড়তেই চমকে উঠল রাজু। দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে মণি।

রাজু সাহসী ছেলে, ভয়-ভীতি কমই তার। ভাবল, এত রাতে ছোট ভাই কই যায়? অবশ্য একটা ব্যাপার রাজুকে একটু অস্বস্তিতে ফেলল। মণি খুব লম্বা নয়, কিন্তু সামনে যে রয়েছে, সে অসম্ভব লম্বা, বড়সড় গাছের সমান প্রায়। এবার একটু ভয় পেলেও চুপিসারে মণির পিছু নিল রাজু। ভয়ের চাইতে কৌতূহলই বেশি, তাকে দেখতেই হবে, ছোট ভাই কোথায় যায়।

গ্রামের পাশেই কবরস্থান। বড় বড় গাছপালায় ঘেরা জায়গাটায় দিনের বেলায় যেতেই মানুষ ভয় পায়, আর এই অন্ধকার রাতে কবরস্থানেই গিয়ে ঢুকল মণি!  

বুক ঢিবঢিব করছে, গা ছমছম, তবু একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল রাজু। কবরস্থানে মণি কী করবে, দেখবে সে। না দেখলেই বোধহয় ভাল ছিল। মণি কবর খুঁড়ে লাশ বের করে আয়েশ করে খাচ্ছে!

ভয়ে গায়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল রাজুর। কীভাবে ঘরে ফিরল, বলতে পারবে না। বেহুশের মত বিছানায় পড়ে রইল সে।

সকাল হতেই হুঁশ ফিরল রাজুর। সভয়ে দেখল, মণি তার বিছানায় ঘুমাচ্ছে, ঘরের মধ্যে বিশ্রী দুর্গন্ধ। রাতের কথা মনে হতেই গা গুলিয়ে বমি এসে গেল রাজুর। কোনওমতে বেরিয়ে এসে পুকুরপাড়ে গলগল করে বমি করে ফেলল, তারপর ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে ঘাটেই বসল। ঘরে যাওয়ার সাহস হলো না।

সুস্থির হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে লাগল। কাল রাতে যাকে দেখেছে, সে মণি হতে পারে না। গ্রামের ছেলে, ভূত-পেত্নির ব্যাপার জানা আছে রাজুর। সে ঠিকই বুঝল, মণির ওপর খারাপ জিনিস ভর করেছে। কখন কোথায় ধরল ছোট ভাইকে? মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ওর। কাঁদতে লাগল, ওর এত ভাল ভাইটার এই পরিণতি হলো? এ রাজু যেমন সাহসী, তেমনি বুদ্ধিমানও। বুঝতে পারল, এই নিয়ে এখনি হৈ-চৈ করলে সর্বনাশ হবে। মণি যদি টের পায় যে তার গোমর ফাঁস হয়ে গেছে, তা হলে সবাইকে মেরে ফেলবে সে।

খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল রাজু।

অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা কাকে বলা যায়?

বড় ভাইকে বললে তো সে হাউমাউ করে উঠবে।

এমন কাউকে বলতে হবে, যে এই বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে।

এরপরেই তার মাথায় এল: বাড়িতে হাঁস-মুরগির অভাব নেই, রোজই একটা-দুটো করে গায়েব হয়ে যায়। সবাই ভাবে, শিয়ালে নিয়ে যায়। তা হলে এই ব্যাপার? এসব পচা লাশ, কাঁচা মাংস, অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়েই ছোট ভাই তরতাজা থাকে, ভাবতেই বমি বমি লাগল রাজুর।

সেদিন থেকে রাজু ভাবতে লাগল, কী করা যায়?

যা করার জলদি করতে হবে।

রাজু আর মণির ঘরে শোয় না, অন্য কামলাদের সাথে ঘুমায়। একটা ভূতের সাথে ঘুমাবার সাহস তার নেই।

হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এল: আরে, এই কথাটা সে ভাবেনি কেন? মসজিদের ইমাম সাহেবকে তো বলা উচিত ছিল! একমাত্র তিনিই যোগ্য লোক, যিনি এই ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবেন তাদেরকে। আর দেরি না করে মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবকে সব খুলে বলল রাজু।

শুনে তিনি বললেন, আমাকে দেখাতে পারিস?

সেদিন রাতেই মণির লাশ খাওয়ার দৃশ্য দেখলেন ইমাম সাহেব। রাজুকে বকলেন, হতভাগা, আমারে আরও আগে বলতে পারিস নাই? এ তো সর্বনাশা এক পিশাচের পাল্লায় পড়েছে মণি! জলদি এর একটা বিহিত না করলে আস্ত গ্রাম বিপদে পড়বে। রতনকে এবার জানাতেই হবে।

সে রাতেই ইমাম সাহেব গিয়ে সব খুলে বলতে কান্নাকাটি শুরু করল রতন, ভয়াল প্রেতের পাল্লায় পড়েছে। আদরের ছোট ভাই?

ইমাম সাহেব বললেন, মনকে শক্ত করো, বাবা। এখন কান্নার সময় নয়, দিনের বেলা অশুভ জিনিসের শক্তি থাকে না। সুতরাং যা করবার দিনের বেলায়ই করতে হবে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নাই, তোমার মা-বাবারে তো বলবাই না। আমি কাল সকালেই তোমাদের বাসায় যাব। খুব সাবধান, মণি যেন কিছু টের না পায়। রাতে ও যা খুশি করুক, বাধা দিতে যেয়ো না, ওর সামনেই থাকবা না কেউ তোমরা।

রাতের অশুভ অন্ধকার দূর হয়ে ভোর হলো। সূর্যের আলো ঝলমল করছে।

ইমাম সাহেব এলেন, মণি তখনও অন্ধকার ঘরে ঘুমে বিভোর।

প্রথমে পুরো বাড়িতে দোয়া পড়া পানি ছিটালেন ইমাম সাহেব, তারপর কয়েকজন শক্তিশালী কামলাকে নির্দেশ দিলেন ঘর থেকে মণিকে বের করতে।

বাইরে নিয়ে এসে শক্ত একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো মণিকে।

সমানে, দোয়া পড়ে চলেছেন ইমাম সাহেব, এরমধ্যে জেনে গেছে পুরো গ্রামের লোকজন। সবাই এসে জড় হয়েছে। রতনদের উঠানে, অবশ্যই মণির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে।

ততক্ষণে ছুটে এসেছে রতন-মণির মা-বাবা।

বিষয়টা কী? মা চিৎকার করে উঠল, আমার পোলারে বাইন্ধা রাখছ ক্যান! কী করছে সে?

মণির সর্বনাশের কথা রতনের কাছে শুনল মা-বাবা।

মা পাগলের মত হাহাকার করে উঠল, আমার এমুন, লক্ষ্মী পোলা, তার এই অবস্থা হতে পারে না, তোমরা মিথ্যা বলছ।

ইমাম সাহেবের ইশারায় রতনের বউ জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল মাকে।

মণি তার রক্ত-লাল চোখ মেলে, মুখে ফেনা তুলে গালাগালি দিতে লাগল, তারপর রাজুর দিকে তাকিয়ে কুৎসিত মুখভঙ্গি করে ভয়াবহ স্বরে বলল, আমি জানি, তুই-ই আমারে ধরাইয়া দিছিস! তোরে আমি ছাড়ম না! তোর হাড় মাংস চিবাইয়া খামু!

ভয়ের চোটে মুহূর্তে ওখান থেকে গায়েব হয়ে গেল রাজু।  

গর্জে উঠলেন ইমাম সাহেব, চুপ থাক, শয়তানের বাচ্চা, তোর শয়তানি আমি বাইর করতাছি, ব্যাটা ইবলিস।

কাজ শুরু করলেন ইমাম সাহেব। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে, মাটির বাসনে আরও নানা উপকরণ সাজিয়ে মণির মুখের সামনে ধরলেন। জিনিসগুলোর ঝাঁঝাল ধোঁয়া ওর নাকে-মুখে প্রবেশ করতে লাগল। সেই সাথে দরাজ কণ্ঠে জোরে জোরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতে লাগলেন মণির শরীরে। তারপর হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কে তুই? এরে ধরলি কোথায়?

বলুম না। কিছু বলুম না।

রেগে গিয়ে দুজন কামলাকে হুকুম দিলেন ইমাম সাহেব, যেন মোটা দুই বাঁশ দিয়ে মারতে শুরু করে।

নিজে দোয়ার জোর আরও বাড়িয়ে দিলেন।

যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মণিরূপী পিশাচ কাতর স্বরে বলল, আমি কে, জানতে চাইস না। এক আন্ধার রাইতে খোলা ট্রাকে এই ব্যাটারে ধরছি।

ইমাম সাহেব দ্বিগুণ রেগে গিয়ে বললেন, জানি, তুই একটা বদ, হারামি পিশাচ! ট্রাকে তো আরও মানুষ ছিল, ওদের কাউরে ধরলি না ক্যান?

ভয়াল হেসে পিশাচ্ বলল, দূর-দূর, চিমড়া কামলাদের শরীরে আছে নাহি কিছু? এই ব্যাটা হইল দুধ-ঘি খাওয়া টসটসা জিনিস-শরীল ভরা তাজা মিঠা রক্ত, তাই এরেই ধরছি।

ইমাম সাহেব বললেন, অহন এরে ছাড়বি নাকি বল? না ছাড়লে তোর আরও খারাবি আছে, কইয়া দিলাম।

ওরে ছাইড়া কোনও লাভ হইব না, শরীলের সব রক্ত খাইয়া শ্যাষ কইরা, ব্যাটারে তো সেইদিনই মাইরা ফালাইছি। অহন আমি ছাড়লেই লাশ হইয়া যাইব।

শুনে থমকে গেলেন ইমাম সাহেব, দুঃখ হলো তাঁর মণির জন্য। চিৎকার করে উঠলেন, বেশ করছিস, খবিসের পুত। বাইর হইয়া যা জলদি।

গোঁয়ারের মত পিশাচটা বলতে লাগল, কতদিন পর একটা শরীল পাইছি, ছাড়ম না অরে।

ইমাম সাহেব তখন শুকনো একটা গাছের শিকড় বের করে ওটাতে আগুন ধরালেন, তারপর পিশাচটার নাকের কাছে ধরে সমানে দোয়া পড়তে লাগলেন।

এইবার কাবু হলো পিশাচ, চেঁচাতে লাগল সমানে, যাইতাছি, যাইতাছি, সরা ওইটা। ১ গম্ভীর হয়ে বললেন ইমাম সাহেব, দূর হ, হারামজাদা, আর কোনওদিন যেন এই গ্রামে তোরে না দেহি।

তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মণির নাক-মুখ দিয়ে বের হতে লাগল কালো ঘন ধোয়া।

ইমাম সাহেবের শক্তিশালী দোয়ার জোরে ধোয়াটা দ্রুত সরে যেতে লাগল। তারপর আর দেখাই গেল না। পরিষ্কার নীল আকাশ, কোথাও কোনও কালিমা নেই, অশুভ ছায়ামুক্ত প্রকৃতি।

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

নিষ্প্রাণ মণি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা। মাথা ঝুলে পড়েছে। বুকের ওপর। বিশ্রী দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কতদিনের বাসি মড়া।

রতনদের বাড়িতে নেমে এল শোকের ছায়া।

রমিজ আলী মাথায় হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মনে পড়ল কত বকাবকি করেছে ছেলেটাকে। দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল তার।

মণির মা তো পাগলের মত হয়ে গেল।

এরপর থেকে দিন-রাত কাঁদতে লাগল মণির মা। আকুল হয়ে ডাকত: বাজান, আমার বাজান, কই গেলি? ফিরে আয়, ফিরে আয় রে!

রতনের অবস্থা দারুণ শোচনীয়। ছোট ভাইটাকে হারিয়ে সে-ও পাগলের মত হয়ে গেছে।

মণি নেই, এই সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না কেউ।

কিন্তু সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয় মানুষকে।

দিন থেমে থাকে না।

প্রকৃতি তার আপন নিয়মে চলতে থাকে।

রাজুর মনের দুঃখও একসময় কমল। ছোট ভাইয়ের মুখটা ভাল করে মনে পড়ত না। আগের চাইতেও বেশি কাজ করতে লাগল সে, যাতে কোনওমতেই তার প্রিয় মানুষটার কথা মনে না পড়ে।

রতনের ফুটফুটে নাদুস-নুদুস বাচ্চাটা রাজুর খুব ন্যাওটা, ওর কাছেই বেশিরভাগ সময় থাকে সে।

রাজুও খুব আদর করে বাচ্চাটাকে।

একদিন সকালে বাচ্চাটাকে আর পাওয়া গেল না।

রতন সেদিন বাসায় ছিল না, মাল নিয়ে শহরে গেছে। বউ একাই ছিল ঘরে। ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখল বাচ্চা নেই। ঘরের দরজা খোলা। তার চিৎকারে ছুটে এল সবাই।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাঁশঝাড়ের মধ্যে পাওয়া গেল। বাচ্চাটাকে। অক্ষত নয়, রক্তাক্ত মাথাটা শুধু পড়ে আছে। বন্ধ দরজা খুলে বাচ্চাটাকে বাইরে নিয়ে গেল কে, কেউ বুঝল না। আরও একবার শোকের মাতম উঠল গ্রামে।

ভূত-পিশাচ মানুষ নয় যে, তাদের অনুভূতি, বিবেক, নীতি থাকবে।

রাজু যে এখন স্বাভাবিক খাবার খায় না, সেটা কেউ খেয়াল করেনি। রাতের আঁধারে সে যায় কবরস্থানে। কবর থেকে তুলে খায় পচা লাশ। হাঁস-মুরগির কাঁচা মাংস তৃপ্তি করে পেটে পুরছে। এবং সে-ই চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে রতনের তুলতুলে নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে।

রাজুর উপর ভর করেছে সেই ভয়ঙ্কর পিশাচ।

ইমাম সাহেবকে দেয়া কথা রাখার প্রয়োজন মনে করেনি, ফিরে এসেছে আবারও।  

তা ছাড়া, রাজুর ওপর তার আক্রোশ ছিল।

রাজুকে তো বটেই, পুরো গ্রামকে সে ধ্বংস করবে।

ঠিক করেছে এরপর শেষ করবে ইমাম সাহেবকে।

এক সকালে দেখা গেল, তার ঘরে মরে পড়ে আছেন। ইমাম সাহেব।

কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে পিশাচটা মেরে ফেলেছে। তাঁকে।

গ্রামবাসী জানে না, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কী ভয়ঙ্কর বিপদ।

মসজিদে ইমাম সাহেব না থাকলে কি চলে?

নতুন ইমাম সাহেবের জন্য আহ্বান করা হয়েছে।

গ্রামবাসী তারই অপেক্ষা করছে।

ভয়াবহ অশুভ থেকে গ্রামকে রক্ষা করতে পারবেন নতুন ইমাম সাহেব?

নাজনীন রহমান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *