নিতল – রুমানা বৈশাখী

নিতল

এক

ছেলেবেলায় পানির কাছে যেতে দেখলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসত বুড়ি। নিতল পানি, বাপজান। নামিস না। থাউক, বাপজান, থাউক!

হাজা-মজা পুকুরটার ধারে বসে শ্যাওলা-সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে বহুকাল পর বুড়ির জন্যে মনটা কেমন করতে থাকে আজ রাশেদের। দুপুরের রোদ ডানায় মেখে অলস ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে কয়েকটা কাক, ছায়ার খোঁজে। আকাশজোড়া রোদরূপী সোনালি আগুন, পুকুরটার চারদিক ঘিরে তপ্ত আলোর আঁকিবুকি করছে। তবুও কিছুতেই বুঝি এতটুকু কাটে না হাজা-মজা পুকুরটার শ্যাওলা-সবুজ পানির অন্ধকার অতলতা। চারপাশের আলোর ছড়াছড়িতে বুঝি আরও বেশি করে আঁধার-কালো মনে হয়।

ছেলেবেলায় বুড়ি কোনওমতেই কখনও নামতে দেয়নি পুকুরের পানিতে। এমনকী বড়বেলায়ও না। ছোট্ট বয়সে অনাথ হওয়া রাশেদের সাত কুলে আপনজন বলতে ওই এক বুড়ি নানিই তো ছিল। বাবা মারা গিয়েছিল জন্মের আগেই, কিছুকাল বাদে নাকি মা-ও। মায়ের চেহারাটা এক বিন্দুও মনে নেই, থাকবার প্রশ্নও ওঠে না। বুদ্ধি হবার পর থেকে এই এক নানিকেই দেখেছে, পরিবার সম্পর্কে যা একটু টুকিটাকি শোনা আছে তার সবটুকুই বুড়ির মুখ থেকে। নানি, রাশেদ আর এই একতলা ঝরঝরে বাড়িটা-এই ছিল এতকাল রাশেদের দুনিয়া।

হ্যাঁ, ছিল। এখন নেই।

গতকাল থেকে বুড়ি নেই জীবনে। আর আগামীকাল থেকে এই অভিশপ্ত বাড়িও থাকবে না। যক্ষ হয়ে আগলে বসেছিল এই বাড়িটাকে বুড়ি। ঢাকা শহরের ওপরে এতখানি জায়গা নিয়ে মাত্র একতলা একটা বাড়ি আর সাথে হাজা-মজা এই পুকুর আগলে বসে থাকার মত বোকামি আর কী হতে পারে? নিজের সামর্থ্য না থাকুক, কোনও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে দিলেই তো লারে লাপ্পা। নগদ টাকার সাথে তৈরি ফ্ল্যাট গোটা কয়েক, আর কী লাগে জীবন হেসে খেলে পার করতে?

কিন্তু নানিকে এসব বোঝাবে কে? নানির বাবার বাড়ি ছিল এটা, জন্মের পর থেকে এখানেই কেটেছে বুড়ির জীবন। প্রথমে ছিল টিনের ঘর, পরে এই একতলা বাড়ি করেছিলেন। রাশেদের নানাজান। ঘর-জামাই ছিলেন তিনি, খুব সম্ভব স্ত্রীর কারণে হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী বন্ধন যে ছিল এই বাড়ির সাথে নানির, বিয়ের পর স্বামী নিয়েও এই বাড়িতেই থেকে গেছে মৃত্যুর আগের মুহূর্তটা পর্যন্ত। শেষের দিকে তো ঘর থেকেও বেরতে চাইত না, ডাক্তারের কাছে যাবার জন্যেও না। মাঝে মাঝে এসে কেবল বসে থাকত এই হাজা-মজা পুকুরের ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটে। বয়স হয়েছিল নব্বই, ছানি পড়া চোখে দেখতে পেতও না ভাল করে। পুকুর পাড়ে বসে নিকষ কালো পানির শরীরে কী দেখার চেষ্টা করত বুড়ি কে জানে। মাঝে তো মনে হত বুঝি বাপের ভিটা নয়, বুড়ির বন্ধন আসলে এই পুকুরটার সাথে।

দুজনের সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ ছিল না, কাজেই অর্থ-কষ্ট তো ছিলই বরাবর। একতলা বাড়িটার একটা অংশ ভাড়া দিয়ে চলত সংসার খরচ, আর বিপদে-আপদে হাত দিতে হত নানাজানের রেখে যাওয়া সামান্য কিছু সঞ্চয়ে। বিক্রি না করুক, পুকুরটা ভরাট করে গোটা দুই টিনের ঘর তুললে কিন্তু অনায়াসে আয় বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারত। কিন্তু না , বুড়িকে রাজি করাতে পারেনি কিছুতেই। কেন যেন মনে হত, পুকুরটার অস্তিত্বকে কেমন একটু ভয়ই করে বুড়ি।

সে যাই হোক, আজ আর সে নেই। এবং কোনও বাধাও নেই জীবনে। সত্যি বলতে কী, বুড়ির মৃত্যুতে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে রাশেদ। মনে-মনে এই একটা কামনাই ছিল যে বুড়ি মরুক, কেননা বুড়ি না মরলে মরতে হত তার নিজেকেই। নানান জায়গায় বিশাল অঙ্কের সব ঋণ জমেছে তার, আর পাওনাদারেরা সব পেশাদার ঋণ ব্যবসায়ী। পাওনা টাকা কী করে উদ্ধার করতে হয় তা ভালই জানা আছে তাদের, সাথে চড়া সুদ আদায়টাও। বুড়ি তো আর বুঝত না যে আজকাল অল্প-বিস্তর নেশাপানি সকলেই করে, না হলে বন্ধু সমাজে ঠিক প্রেস্টিজ থাকে না। আর একটু স্টাইল নিয়ে বাঁচতে, গেলে পকেট গরম না হলে কি চলে নাকি?

ঠিক আছে, ঠিক আছে, রাশেদ না হয় নেশাটা একটু। বেশিই করে। কিন্তু তাতে কী? বন্ধুরাও তো সব করছে, সে-ই বা কেন পিছিয়ে থাকবে? দুই দিনের তারুণ্য, একটু মৌজ মাস্তি করা যেতেই পারে। আজ এ পার্টি, কাল সে পার্টি-সব মিলিয়ে একটা চটকদার জীবনধারার পিছনে খরচ অনেক। আর এই জীবনধারার জন্যেই তো বন্ধুমহলে আজকাল এত জনপ্রিয় সে।

বুড়ি হয়তো বুঝত না তেমন কিছুই, তবে যেটুকুই বুঝত তাতে চোখ রাঙাত বড় বেশি। একদিকে রোজকার ফুর্তির খরচ জোগানো, অন্যদিকে পাওনাদারের ক্রমাগত হুমকি ধমকি, সাথে বুড়ির চোখ রাঙানি-সবমিলিয়ে অসহ্য ঠেকছিল জীবনটা। টাকার অভাবে মেয়েগুলোও একের পর এক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, অথচ নাকের নিচে পড়ে ছিল অর্থের এত বড় খনি। কতদিন আর সহ্য হয় এসব?

সুতরাং…

রাশেদ তাই করেছে, যা করবার দরকার ছিল নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে। বুড়ির বয়স হয়েছিল, বড় কষ্ট পাচ্ছিল বার্ধক্যের নানান জ্বালায়। রাত হলেই শ্বাসকষ্টে কেঁদে-কেঁদে মত্যকামনা করত সষ্টিকর্তার দরবারে। রাশেদ বেশি কিছু করেনি, সে চাওয়াটাই পূরণ করেছে কেবল। ডাক্তার যে ঘুমের ওষুধ দিতে বলেছিল, সেটার মাত্রাটাকেই কেবল বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যস, পরম শান্তিতে মৃত্যুলোকের ওপারে পাড়ি জমিয়েছে বুড়ি।

একে কি খুন বলা যায়?

মোটেই না, অন্তত রাশেদের তা মোটেই মনে হয় না। তবুও আজকের এই রোদজ্বলা অলস দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে। বুড়ির জন্যে মনটা কেমন-কেমন করছে। আবার কী মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাসও আসে বুক ঠেলে। নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে কতরকমের কাজই না করতে হয় এই জীবনে!

দুই

ঘরে ফিরে নিজের এটা সেটা গোছগাছ করতে শুরু করে রাশেদ একসময়। এতকালের সংসার, তবু নেবার মত বেশি কিছু নেই, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেবল। সত্যি বলতে কী, নিতে চাইলে নেয়া যায় বুঝি অনেক কিছুই। এতকালের সংসার ঠাসা কত শত হরেক রকমের জিনিসপত্রে। তবে বুড়ি নানির কাছে এসবের যতটা মূল্য ছিল, রাশেদের কাছে এখন ততটাই মূল্যহীন। কাল থেকে রাশেদের ঠিকানা হবে গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে, বন্ধুদের সাথে স্বপ্নের স্বাধীন জীবনের শুরু। আর নতুন সেই জীবনে এই জরাজীর্ণ পুরানো বাড়ির কিছুই সাথে নিতে চায় না সে। এ দুটো ঢাউস সুটকেসে পরনের জামা-কাপড় আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ধরে যায় সব। টেবিলের এক কোণে পড়ে আছে ভার্সিটির বইপত্রগুলো, সাথে নেবে কি নেবে না ভাবে একবার। শেষে না নেবারই সিদ্ধান্ত নেয়। আগামীকাল কোম্পানির সাথে চুক্তি হবার পর মোটা অর্থের অর্ধেকটা জমা হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, আর সেই অর্থের পরিমাণ এতই বিশাল যে এমন বইপত্রের কাড়ি কয়েক লক্ষবার কেনা যাবে অনায়াসে। অযথা টেনে নেয়ার মানে নেই।

বাইরে বেলা পড়ে আসছে ক্রমশ, পুকুরটার চারপাশে আস্তে-আস্তে ঘনাচ্ছে বিকালের ছায়া। জানে না কেন, কাজের ফাঁকেও পোড়ো পুকুরটার অন্ধকারের দিকে নজর যায় বারবার। পুকুরের দিকে, নাকি পুকুর পাড়ে বুড়ির কবরের দিকে? অযথা কবরস্থানের জায়গা কিনে পয়সা নষ্ট করতে চায়নি রাশেদ, বুড়ির এত পছন্দের পুকুর পাড়েই শেষ করেছে। সমাহিত করার কাজ। কিছুদিন পরে এখানে মাথা তুলে দাঁড়াবে বিশাল শপিং মল। না থাকবে এই পুকুর, না থাকবে বুড়ির কবরের চিহ্ন। কিন্তু তাতে কী? রাশেদের মনে হয় না যে সে কোনও অন্যায় করেছে। বুড়ির বাপের ভিটাতেই সমাহিত করেছে দেহ, এবং বুড়ি নানির আত্মা তাতে শান্তি পাবে বলেই মনে হয়।

তবুও বারবার নজর যায় কবর আর পুকুর পাড়ের দিকেই। পোড়ো এই বাড়ির সীমানায় কুকুর-বেড়াল দূরে থাক, এই দিনের বেলাতেও একটা কাক-পক্ষীর সাড়া শব্দ নেই আজ। বুড়ির কটা পুষি বেড়াল ছিল, গতকাল তার। মৃত্যুর পর থেকে সেগুলোও গায়েব। মনে হচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বুঝি। থমথমে, দম বন্ধ করা একটা পরিবেশ। কেমন জানি ভৌতিকও।

নাহ্, আজ রাতটা থাকা যাবে না এখানে। এই পোডড়া বাড়িতে কোনও সুস্থ মানুষ একঘণ্টা থাকলেই পাগল হয়ে যাবে। কী করে যে এতগুলো বছর কাটিয়েছে, তাই এখন বুঝে উঠতে পারে না।

ছপ…ছপ…

মনে হয় কী যেন একটা হেঁটে জানালার ধার দিয়ে গেল। বেড়ালগুলো ফিরে এল কি? মনে-মনে একটু স্বস্তিই লাগে রাশেদের, এতবড় বাড়িতে সে একদম একা নয় ভেবে। এগিয়ে দেখে জানালার ধারে পরম আগ্রহে, তবে চোখে পড়ে না কিছুই। বেড়াল তো, এক জায়গায় বসে থাকার প্রাণী নয়। এতক্ষণে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পাঁয়তারা করছে নিশ্চিত।

একটা বাটিতে গরুর দুধ যা আছে, ঢেলে রাখে কেন জানি। আজই তো শেষ, কাল থেকে বেড়ালগুলোরও ঠিকানা বদলে যাবে, আশ্রয় নিতে হবে অলি-গলিতে। শেষমুহূর্তে একটু আহ্লাদ করলে কিছু আসবে যাবে না।

ছপ…ছপ…

এবার শব্দ আসে বসার ঘর থেকে। বেড়ালগুলোই নিশ্চিত। তবে বেড়াল দৌড়ালে ছপছপ আওয়াজ হবে কেন? ভেজা কাপড় পরনে কেউ হাঁটাহাঁটি করলে বরং এমন শব্দ হতে পারে।

একতলা বাড়ি হলেও তেমন অন্ধকার নয়, ভালই আলোর যাওয়া-আসা আছে। তবুও বসার ঘরটা এ মুহূর্তে কেমন অন্ধকারই ঠেকে রাশেদের। আরও অবাক লাগে, যখন দেখতে পায় বসার ঘরের কার্পেটটা ভিজে চুপচুপ করছে। ভিজে আছে সোফা সেটও। বেড়ালগুলোই নিশ্চিত, ভিজে শরীরে জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাইরে তো বৃষ্টি-বাদলের চিহ্ন নেই। বেড়ালগুলো ভিজল কী করে? যাই হোক, ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। নিজের ঘরের দিকে রওনা হয় রাশেদ। যাবার সময় চোখে পড়ে বুড়ির ঘরের ভেজানো দরজার গোড়াতেও একরাশ পানি। বেড়ালগুলো তাদের প্রভুকে খুঁজছে বোধহয়।

দেখার আগ্রহ বোধ করে না আর। কোথায় পানি জমল, কোথায় কী নষ্ট হলো এসব নিয়ে মাথা খারাপ করবার সময় কই? কাল থেকে এই বাড়ি, এই বেড়াল, এই পরিবেশ সব ইতিহাস হয়ে যাবে। টুকটাক শখের জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলে সময়টা বাঁচবে বরং। সন্ধ্যার আগেই চলে যাবে ঠিক করেছে, অযথা রাত কাটাবার দরকারটাই বা কী? বন্ধু সিয়ামকে বলেছে গাড়ি নিয়ে আসতে, চলে আসবে যে কোনও সময়। রাতে জোস একটা পার্টির পরিকল্পনা আছে উত্তরার দিকে। এখানে একা পচে মরার চাইতে পার্টি করা ঢের ভাল। হাতে এখনও সময় আছে কিছু, আর কাজও প্রায় শেষ। বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয়া যেতে পারে, কেননা বাকি রাত তো আর আরাম করার সুযোগ মিলবে না। তা ছাড়া… ছপ..ছপছপছপ…ছপ…

সে আওয়াজ! মনে হয় বুঝি ঘরের ঠিক সামনে দিয়েই হেঁটে যায় কেউ। তাও ভেজা শরীরে একরাশ পানি নিয়ে। চট করেই ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ। কিন্তু নাহ্, কেউ নেই। কীসের না কীসের শব্দ, কোথাও পানি-টানি পড়ছে বোধহয়। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল, বাড়ির আশপাশে গর্তগুলোতে পানি। জমেছে। সে পানিতে ব্যাঙ লাফাচ্ছে বোধহয়, আর সেই আওয়াজ জানালা দিয়ে আসছে…

হ্যাঁ, তাই হবে। বুঝতে পেরে একটু স্বস্তি লাগে রাশেদের। আসলে হয়েছে কী, বুড়ির মৃত্যুর পর থেকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। গতকালের সকাল-দুপুর তো পার হয়ে গেছে বুড়ির দাফন-কাফন ইত্যাদি করে। আশপাশের প্রতিবেশীরা কেউ কেউ এসেছিল, তারাই সব গুছিয়ে করেছে। রাতেও দূর-সম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয় ছিল, বাড়িতে, একা হবার সুযোগ ঘটেনি আর।

কিন্তু সকালের পর থেকে…।

অস্বস্তি অবশ্য হতেই পারে। আর সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে বুড়ির বয়স হয়েছিল, হতে পারে যে বার্ধক্যজনিত কারণে বড় বেশি ভুগছিল, কিন্তু আরও কিছুকাল হয়তো বাঁচত। তারপর আপনা থেকেই আশ্রয় নিত মৃত্যুর কোলে। কিন্তু এটাও ঠিক যে সেই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে রাশেদ নিজেই। নিজ হাতে দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছে নানিকে। সরল বিশ্বাসে একমাত্র নাতির হাত থেকে গ্লাসের দুধ পান করেছিল বুড়ি।

বড় বৃষ্টি হচ্ছিল সে রাতে এই শহরের বুকে…

তিন

বৃষ্টি মানে রীতিমতন ঝুম বৃষ্টি। রান্নাঘরে যখন কুসুম গরম দুধের গ্লাসে ঘুমের ওষুধগুলো খুঁড়ো করে মেশাচ্ছিল, জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বারবার।

চোখে ছানি পড়েছিল শেষকালে, ঠিকমতন দেখতে পেত না নানি। নিজের হাতেই গ্লাসখানা বুড়ির হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল রাশেদ।

এটা খেয়ে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।

মনে কয় না, বাপ। আইজকে খাইয়াম না।

খাবে না মানে কী? রাতে তো কিছু খাও নাই। কলা দিব সাথে?

ফোকলা দাঁতে হাসে বুড়ি পরম মমতায়। ওরে, আমার বাপ রে, মনে কয় না রে দুধ খাইতে।

ডাক্তার বলেছে খেতে। খাও, আরাম হবে। খাও।

ছোট একটা চুমুক দেয় গ্লাসে নানি, আর চিলের মতন প্রখর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রাশেদ। এই এক গ্লাস দুধ শেষ হবার ওপর নির্ভর করছে তার আগামীকাল। এবং সত্যি বলতে কী, তার জীবনের নিরাপত্তাও। অনেক বুঝিয়েছে বুড়িকে সে, কিন্তু কিছুতেই বাড়ি বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করতে রাজি হয়নি বুড়ি। বুড়িকে পরপারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা ছাড়া আসলেই কোনও পথ ছিল না সামনে।

ও, নানি, তুমি না একবার এই পুকুরে ডুবে গেছিলে… বহুকালের পুরানো প্রসঙ্গ আবার টেনে তোলে নাতি। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কথার ছলে দুধটুকু খাইয়ে দেয়া কেবল। বলো না ওই গল্পটা। পানির নিচে কী জানি ছিল?

আলোক আছিল রে। হ্যাঁজাকের বাত্তির মতন আলোক। …তখুন তো এইখানে এত্তবড় দালান আছিল না, আছিল টিনের ঘর। দালান তো অনেক পরে তুর নানাজানে করছে। …আমার বাপজানে বড় শখ কইরে এই পুষুনি কাটায়েছিল একমাত্র কইন্যার জন্যে। আমার বড় হাউশ আছিল পুষুনিতে গোসুল করুম, সাঁতার কাটুম।

তোমার আব্বা তোমাকে অনেক ভালবাসতেন, তাই না?

ওরে, পোলায় কয় কী? আমার বাপজানের জান আছিলাম আমি, বুঝছোস? বাপজান আমার জনমের পর থেইকে নাকি কইত, এই মাইয়া আমি বিয়া দিমু না। ঘরের খুঁটি বানায় রাখুম প্রয়োজনে, তাও বিয়া দিমু না।

এই জন্যে নানাজানকে ঘরজামাই রেখেছিল? টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না নাতি।

ধুরো, হারামজাদা। তুর নানাজানে তো ঘরজামাই আছিল আমার কারণে। পীর সাহেবে কইছিল এই ভিটার থেইকে আমারে পৃথক না করতে, পুস্কুনি থেইকে পৃথক না করতে। হেই কারণে তো নানাজানে এই ভিটায় আছিল। তুর নানাজানে কি আর শখ কইরে থাকত নাকি…

নানাজানের গল্প বাদ। তুমি পুকুরে ডোবার গল্পটা বলো তো। আর দুধটা খাচ্ছ না কেন? খেতে খেতে গল্প বলো… তাড়া দেয় রাশেদ।

অগত্যা দুধের গ্লাসে আবার চুমুক।

আমার বয়স তখন বারো, বুঝছোস? ডাঙর হইছি, এইদিক-ওইদিক থেইকে বিয়ার প্রস্তাব আসে। মাথায় অনেক লম্বা চুল আছিল, ওই চুলের জইন্যেই আসত বিয়ার প্রস্তাব। একদিন হইছে কী জানোস, পুষুনির ঘাটে বইসে চুলে তেল দিতেছি…হঠাৎ দেখি সামনে ইয়া বড় এক সাপ। মাগো মা, কী সেই সাপ! ফণা তুইলে বইসে আছে সামনে। বাড়ির দুয়ার থেইকে আম্মাও দেখছে সেই সাপ, আর সাথে সাথে তো দিছে চিক্কুর। বাপজান আছিল না বাড়িত, আমি আর আম্মায় শুধু…হইল কী, চিকুরের সাথে-সাথেই সাপে দিল ছোবল। আমার আর তারপরে কিছু মনে নাই।

তুমি তো পুকুরে পড়ে গেছিলে, নাকি?

সেইটাও আমার মনে নাই রে, বাপ। আম্মার কাছে শুনছি যা শুনার। আম্মায় বলছে সাপে কাটার সাথে-সাথে নাকি আমি তো অজ্ঞান। ছিলাম পুষুনির ঘাটে, অজ্ঞান হইয়ে। সোজা গিয়া পড়লাম পানিতে। আর তলায় গেলাম। আম্মা একলা মেয়েমানুষ কী করবে? খালি চিক্কর দিতেছিল। লোকজন জড় হইয়ে খুঁজাখুঁজি কইরে শেষমেশ দুইঘণ্টা পরে পাওয়া গেছিল নাকি আমারে।

মনে মনে হাসে রাশেদ। আদ্যিকালের মানুষের এই হলো এক ব্যাপার, সবকিছু বাড়িয়ে বলবে। পাঁচ-দশ মিনিটকে বাড়িয়ে বলছে দুই ঘণ্টা। দুই ঘণ্টা পানির নিচে থাকলে কি মানুষ বাঁচে নাকি? তাও যে মানুষকে সাপে কেটেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে তো সাপের বিষেই মরে যাবার কথা।

…পানির থেইকে তোলার পরে তো আরেক কাহিনি, বুঝছোস? সকলে তো ভাবছে আমি বাইচে নাই, এত সময় পানির তলে থাইকে তো আর মানুষ বাঁচে না। পানি থেইকে তোলার পরে তো দেখা গেল আমি নিঃশ্বাস নেই না। আমি পষ্ট দেখছি যে আমারে সাপে কাটছে। আমি একা না, আম্মাও দেখছে। পানির থেকে তোলার পরে দেখা গেল কোথাও সাপে কাটার চিহ্নও নাই। ওঝা ডাকছিল বাপজান। বিষ ঝাড়নের জইন্যে। ওঝায় কইছিল, শরীলে বিষের কুনো বালাই নাই। আমারে নাকি সাপেই কাটে নাই কুনোদিন..

কণ্ঠস্বরটা স্তিমিত হতে-হতে নিভে যায় একসময়, বর্ষণের প্রচণ্ড আওয়াজের সাথে মিলেমিশে যায় বুঝি। জানালার ধারে দাঁড়ানো রাশেদ একবার ফিরে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করে না, কেননা জানা আছে তার কী ঘটছে। সামনে এখন অনেক কাজ-লোকজন ডাকা, নানির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠাণ্ডা মাথায় সেই সব পরিকল্পনাই করেছে বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

একটু ভাল করে ভাবলেই রাশেদ হয়তো বুঝতে পারত যে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসা এই গল্পের মাঝে অন্যরকম কী যেন একটা আছে। বুঝতে পারত যে রূপকথার গল্প মনে করে যে গল্প এতকাল জেনে এসেছে, সেটা গল্প না হয়ে সত্যিও হতে পারে!

চার

সেদিন বোঝেনি, বিশ্বাস করেনি।

বিশ্বাস আজও করে না। তবুও আজ এই একলা বাড়িতে কেমন যেন খটকা লেগেই থাকে মনে। বাইরে সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষণ, দিনের শেষ চিহ্নগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চার দেয়ালের এই ঘেরাটোপে আস্তে আস্তে নেমে আসতে শুরু করেছে অন্ধকার ছায়া।

ভীষণ অস্থির লাগে, ছটফট লাগে মনের মাঝে। নাহ্, আর দেরি করা যাচ্ছে না। বন্ধুরা আসুক বা না আসুক, বেরিয়ে পড়বে এখন। প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, কিন্তু এই সীমানার মাঝে না। অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে নইলে।

সুটকেস দুটো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে বাইরে। কী মনে করে দরজায় তালা আঁটে, মেইন গেটের তালার চাবিটাও নেয় সাথে। দুনিয়ার লোকজনকে বিশ্বাস নেই, রাতারাতি পরের বাড়ি দখল হয়ে যায় আজকাল। শহরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে…

এ কী! এমন লাগছে কেন?

শ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে, বুঝি হঠাৎ করে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়েছে সৃষ্টিকর্তার দুনিয়ার বুকে…উফ!

কী কষ্ট!! কী কষ্ট!!

মুখ খুলে প্রাণপণে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে, আর বুঝতে পারে যে কঠিন দুটো হাত পেছন থেকে চেপে ধরেছে গলা। সাঁড়াশির মতন শক্ত দশটি আঙুল চেপে বসেছে গলার ওপরে। শীতল…হিমশীতল দুটো হাত।

মৃত মানুষের মতন শীতল! আর ভেজা!

প্রাণ বাঁচাবার ভীষণ তাগিদে নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে রাশেদ। নিজেকে নিয়োগ করে নিজেকেই বাঁচাবার কাজে। অন্ধকার হয়ে আসছে চোখের সামনে দুনিয়াটা ক্রমশ, একটু বাতাস পাওয়ার আকুতিতে ছটফট করছে বুকের খাঁচায় ফুসফুস। এখনই…আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র! এর মাঝে যদি নিজেকে মুক্ত করতে না পারে, তো জীবনের এটাই শেষ দৃশ্য।

আহ!

নিজেকে কোনওমতে সাঁড়াশি আঙুলগুলো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণে অক্সিজেন টানে রাশেদ। শান্তি…শান্তি…

কিন্তু এর পরে যা দেখতে পায়, তাতে জমাট কংক্রিট হয়ে যায় বুকের রক্ত। এই তো…এই তো একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পরা জবুথুবু এক বুড়ি, সন্ধ্যার অন্ধকারের মাঝেও যার চোখজোড়া ধকধক করছে অপার্থিব হিংস্রতায়। এটা কী করে হয়? মৃত মানুষ জীবিত হয় কী করে?

কী করে হয়?

না-না, বুড়ি জীবিত নয়। হতে পারে না। কিছুতেই না! নিজের অজান্তে পেছাতে শুরু করে রাশেদ একটু একটু করে। আর এক পা এক পা করে এগোয় বুড়ি। ভিজে চপচপ করছে। পুরো শরীরটা তার, একটি একটি পদক্ষেপের সাথে শব্দ তোলে পরনের ভেজা শাড়ি…ছপ-ছপ-ছপ…ছপছপ-ছপ।

হাতদুটো সামনে বাড়ানো, ফোকলা মুখে কুৎসিত হাসি হাসছে প্রেতাত্মা। এবং রাশেদ জানে…জানে যে এই হাতদুটো তাকে ধরেই ফেলবে। চেপে ধরবে তার গলা, আর ধরেই থাকবে যতক্ষণ না প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।

কী যে হয়ে যায়, শরীর-মনের সমস্ত সাহস একত্রিত করে। ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ, আর খিচে দেয় দৌড়।

কিন্তু…

শরীর সামনে বাড়ে না এতটুকুও। কেননা পেছন থেকে চেপে ধরেছে সেই সাঁড়াশি আঙুলগুলো আবার। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে রাশেদ, দুহাতে সর্বোচ্চ জোর প্রয়োগ করে ছাড়া পেতে চায় সেই মরণ-বাঁধন থেকে।

লাভ হয় না কোনও। জীর্ণ-শীর্ণ সেই হাত মাটিতে ঘষটে-ঘষটে নিয়ে যেতে থাকে ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবক রাশেদকে। টেনে নিয়ে যেতে থাকে অমোঘ সেই। নিয়তির দিকে..

যে নিয়তি সে নিজ হাতে নিজের জীবনের ললাটে লিখেছে।

পাঁচ

কীভাবে এরপর কী হলো, জানে না রাশেদ। শুধু অনুভব করে…

অনুভব করে যে একরাশ কালো শীতল জল প্রবল শক্তিতে টেনে নিচ্ছে তাকে। টেনে নিচ্ছে অতল গহ্বরে। শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবেশ করছে অপার্থিব সেই পানি। বুক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে পানি। তারপর প্রবেশ করছে চোখের পাতায়, নাসারন্ধ্রে, কানের গহ্বরে…আর…

শীতল হয়ে আসছে চারপাশ ক্রমশ।

পরিশিষ্ট

দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়বে কি না ঠিক বুঝতে পারে না রতন।

বেশ অনেক মাস যাবৎ দেখছে বাড়িটায় লোকজনের আনাগোনা নেই। রাতে বাতি-টাতিও জ্বলে না। এক বুড়ি আর বুড়ির নাতি থাকত এখানে। বুড়িটা তো মাস তিন-চার আগেই মরেছে, নাতিটাও বোধকরি থাকে না আর। অবশ্য এই ভাঙাচোরা শ্যাওলা ধরা বাড়িতে কেই-বা থাকতে চাইবে।  

যাই হোক, যা আছে কপালে, রাত হয়েছে, আশপাশে লোকজন নেই। সুযোগ বুঝে তাই ভেতরে ঢুকেই পড়ে রতন। যা পাওয়া যায়, তাই লাভ। স্টিলের বাসনপত্র পেলেও লাভ আছে। আজকাল চোরা বাজারে সবই বিকোয়। পেশায় সে ছ্যাচড়া চোর, শ পাঁচেক টাকার মাল-সামান পেলেও আজকে রাতের মত খুশি।

নাহ, কেউ নেই। পুরো বাড়ি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সাথে টর্চ নেই, থাকলে ভাল হত। অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেলে আয়েসী ভঙ্গিতে এগোয় রতন। এঘর-ওঘর ঘুরেফিরে দেখে। কিছু বাসনপত্র পায়, বস্তায় ভরে। কিছু বিছানার চাদর, ক জোড়া জুতো, দামি কিছু ইংরেজি বইপত্র, আরও টুকটাক নানান জিনিস। যা পায়, বস্তায় ভরার যোগ্য হলে ভরে ফেলে।

একে তো নড়বড়ে শ্যাওলা ধরা পুরানো বাড়ি, তার ওপরে মেঝে থইথই করছে পানিতে। পানির কারণে বহু কিছুই পচে গলে গেছে। অনেকদিন যাবৎ বুঝি জমে আছে পানি, বোটকা একটা পচা গন্ধ আসছে। পানির উৎস কোথায় বুঝতে পারে না রতন। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করে না। নাক চেপে কোনওমতে ঘরগুলোতে সন্ধান করে মূল্যবান কিছুর।

বাকি কেবল একটা ঘর। ওটা দেখা হলেই সোজা বাউণ্ডারির বাইরে। কেমন গা ছমছম করছে এই কালি গোলা অন্ধকারে। বের হয়ে খোলা বাতাসে শ্বাস নিতে না পারলে জানে মারা পড়বে।

করিডরের একদম শেষমাথায় ঘরটা। অন্ধকার বুঝি এখানে আরও বেশি জমাট। আর শীতল। ঘরের দরজাটা ভেজানো।

ধাক্কা দিতেই কাঁচকোচ আওয়াজে খুলে যেতে শুরু করে দরজাটা। আস্তে…খুব আস্তে! দৌড় দেবে কি না বুঝতে পারে রতন। কেননা এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মাঝে পষ্ট দেখতে পায় বিছানায় বসে আছে এক বুড়ি, আর তার পায়ের কাছে একটা পুরুষ কাঠামো। বসে আছে, পিছন ফিরে।

এ কি সেই বুড়ি না? ওই যে বুড়িটা মারা গেল কয়মাস আগে…মানে কী? মানে কী এসবের? এই বুড়ি তো মরেছে, নিজের চোখে লাশ দেখেছে রতন।

বুড়িটা নামে বিছানা থেকে। ধীরে, খুব ধীরে। নিচু কণ্ঠে কী যেন বলে বিড়বিড়িয়ে। অস্পষ্ট, এলোমেলো। ভয় নাই, ব্যাটা…এরপরে আর কুনো ভয় থাকব না…কুনো ভয় নাই… শান্তি…শান্তি…

পরনের প্যান্টটা কখন ভিজে গেছে ভয়ে টেরও পায় না রতন। চিৎকার করে প্রাণপণে, কিন্তু গলা দিয়ে বেরয় না, আওয়াজ। কারণ…

একজোড়া জীর্ণ-শীর্ণ বুড়ো মানুষের হাত কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে রতনের।

সাঁড়াশির মত শক্ত একজোড়া হাত!

রুমানা বৈশাখী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *