সাদা চোখ – সোহানা রহমান

সাদা চোখ

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে এমন হয়। মনটা কেমন জানি তরল থাকে। অজানা দুঃখে মন ভারী হয়ে থাকে। আবার অদ্ভুত ভাল লাগায় হৃদয় অবশ হয়ে আসে। কোথায় দূরে কুহু-কুহু করে একটা কোকিল ডাকছে। ভোরের বেলায় মনটা কেমন করে উঠল। জায়গাটা প্রথমে ভাল লাগেনি একটুও। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিস্তর ফসলের খেত আর সোনালি হয়ে ঝুঁকে পড়া ধান দেখতে-দেখতে খারাপ লাগা খুব বেশিক্ষণ থাকল না। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। একে তো নতুন জায়গা। তার উপর সারারাত ট্রেইন চলে। কুউউউউউউউ করে হুইসেল বাজিয়ে মাঝে-মাঝেই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া এখানকার টি.এন.ও হয়ে এসেছে। বিশাল সরকারি বাংলো। অনেকগুলো রুম, কিন্তু থাকার মানুষ নেই। আমার পরীক্ষা শেষ বলে আমাকেই আসতে হয়েছে সংসার গুছিয়ে দেয়ার জন্য।

কাল অনেক রাতে ট্রেইনে করে আমরা পৌঁছেছি এখানে। তখন আর গুছানোর সময় ছিল না। তাই আমি একটা বেডরুমে আর ভাইয়া ড্রইংরুমে বিছানা করে শুয়ে পড়েছিলাম। আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কুয়াশায়। ঝাপসা হয়ে যাওয়া ধানখেতগুলোতে সেই ভোরেই কৃষকরা কাজ করছিল। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরাও কাজ করছিল,  কেউবা ব্যাগ কাঁধে করে স্কুলের উদ্দেশে রওনা করেছিল। সবকিছু এত ভাল লাগছিল যে আমি উঠে অনেকদূর হেঁটে এসেছিলাম। শিশিরে পা ভিজে উঠছিল, খোলা চুলে হাত দিয়ে মনে হয়েছিল কে যেন ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ঘুরে যখন বাসায় ফিরলাম ভাইয়া তখন উঠে পড়েছে। আজই তার জয়েনিং-এর ডেট। রাস্তার পাশ থেকে গরম-গরম চা আর তেল চুপচুপে পরোটা কিনে এনে তাই দিয়েই নাস্তা হলো। ভাইয়া চলে গেলে আমি গোছগাছ শুরু করলাম। অল্প কটা জিনিস ভাইয়ার। তাই গুছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। তারপর অফুরন্ত সময়। না আছে। টেলিভিশন, না আছে ইন্টারনেট

সময় কাটছিল না একটুও। অদ্ভুত এক জায়গায় বাংলোটা। আশপাশে কোন বাসা নেই। পিছনের দিকে বিস্তৃত ধানখেত, সামনের দিকে ট্রেইন লাইন। সেই ট্রেইন লাইন ছাড়িয়ে অনেকদূর গেলে মূল শহর। এই সৃষ্টিছাড়া জায়গায় কেন এত বড় একটা বাড়ি বানিয়েছিল কে জানে! পরিত্যক্ত সব বাড়ি সরকারি হয়ে যায়, পরবর্তীতে তা রূপান্তরিত হয় বাসভবনে। সেরকমই একটা বাড়ি এটা। কেউ থাকতে চায় না এই জনবিরল জায়গায়। এই বাড়িটা বুঝি ভেঙেই ফেলা হবে। নতুন সরকারি ভবন বানানো হচ্ছে, আর একমাসের ভিতর উঠে যাওয়া যাবে। ততদিন এই বাড়িতে থাকতে হবে। আর আমার ছুটি চলছে বলে এই একমাস আমিও ভাইয়ার সঙ্গে এইখানে থাকব ভেবে রেখেছি। ঠিক পাশের বাড়িটাও বেশ দূর। মাঝখানে একটা খেতের আইল পার হতে হয়।

ঝিম ধরা একাকী দুপুরে বুঝি চোখ লেগে এসেছিল। শুয়ে ছিলাম বড় বেডরুমটায়, হঠাৎ মনে হলো ভাইয়া রুমে এসে ঢুকেছে। আমার দিকে ভাইয়া তাকাতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভাইয়ার চোখে কোন মণি নেই। অদ্ভুত সাদা। আমি চিৎকার দিয়ে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। শীতকালেও আমি ঘেমে জবজবে হয়ে গিয়েছি। এত বাস্তব! এত বীভৎস স্বপ্ন! ঘুমটাও গেল, মনটাও দমে গেল। জায়গাটা আর ভাল লাগছিল না কিছুতেই। হাত-পা বিবশ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল পিছন থেকে কেউ এসে ঠাণ্ডা হাত রাখবে কাঁধে অথবা বিছানার নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে আমার পা টেনে ধরবে কেউ! সে এক অসম্ভব আতঙ্ক। ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। ভাইয়া আসতেই ভয় কমে গেল। তাকে আর কিছু বললাম না।

আমি ওটাকে নিছক স্বপ্নই ভেবেছিলাম। তাই গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আমি রোজ একই স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। কখনও ভাইয়া, কখনও মা, কখনও বাবা এসে মণিহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! সে এক তীব্র আতঙ্ক! কিন্তু কী যেন হত আমার। ভাইয়া আসলেই আমি আর স্বপ্নের কথা বলতে পারতাম না। কী যেন বাধা দিত। পরদিন ভাইয়া আবার অফিসে যাওয়ার পর থেকে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। ঘুমাতে চাইতাম না। কিন্তু ঠিক ওই সময়েই জাদুবলে কে যেন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে ভয়ের জগতে নিয়ে যেত। অসম্ভব এক ভয়, আর ভয় পাওয়ার ভয়ঙ্কর এক নেশা! বুয়া সবসময় থাকত, কিন্তু তাও আমি স্বপ্ন থেকে রেহাই পেতাম না।

একমাসের ভিতরেই নতুন বাসা ঠিক হলো, কিন্তু ততদিনে আমি শুকিয়ে কাঠি-কাঠি হয়ে গেলাম। রোজ ভয় পেতাম। আমি যেন সম্মোহিত ছিলাম। স্বপ্নের কথা বলতে গেলেই আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। কাউকে বলতে পারতাম না। তাই বাসা পরিবর্তনের কথায় আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হয়নি।

চলে যাওয়ার আগের সন্ধ্যায় ভাইয়া আর আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন ভাইয়ার এক কলিগ আর তার স্ত্রী এসে উপস্থিত হলেন। চা খেয়ে বিদায় নেয়ার সময় ওই ভাবী বললেন, তোমরা বেশ অনেকদিন থেকে গেলে এখানে। কিন্তু জানো, এই বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না। পিশাচের দল নাকি আপনজন সেজে এসে ভয় দেখায়! তোমরা কীভাবে থাকলে বলো তো? বলতেই-বলতেই ভাবীর চোখ পুরো সাদা হয়ে গেল!

তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। বোধহয় হার্টফেলই করেছিলাম। সে থেকেই আছি, বেশ আছি। শুধু জানি যে মরে গিয়েছি। একদিন আয়না দেখেছিলাম, দিব্যি ছায়া পড়ে।

আমার চোখও এখন একদম সাদা!

সোহানা রহমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *