নেমেসিস

নেমেসিস

সিয়াটল, ওঅশিংটন।

এ জায়গাটা একটা বোউলিং (বল গড়িয়ে দিয়ে বোতল সদৃশ বস্তুতে লাগাবার খেলা) অ্যালি। সাধারণত অ্যালি বলতে গলি বোঝানো হলেও বোউলিং অ্যালি মানে ক্লাব, যেখানে বিশেষ এই খেলাটার সুবন্দোবস্ত রয়েছে।

ফ্যান্টম স্ট্রাইকারস নাম ক্লাবটার। খিদে পেলে খাওয়াটাও সেরে নেয়া যায়।

খেলে-টেলে ডাইনিং-এ এসে বসেছে ক্লাবের দুই সভ্য। ডিনার প্রায় শেষের দিকে। খেতে খেতে আলাপ করছে। দুজনে।

আরও লোক রয়েছে রেস্তোরাঁয়। সম্মিলিত কথাবার্তার বিজবিজ গুঞ্জন বাতাসে।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে দুর্যোগের হিমেল হাওয়া।

এই ট্রাম্প লোকটার ব্যাপারে যতই শুনছি, ততই অপছন্দ করছি লোকটাকে! খেদ প্রকাশ করল দুজনের একজন। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, রাশার সাথে গোপন আঁতাত আছে ব্যাটার!

খুব খেয়াল করে, অ্যাণ্ডু। লোকটা কিন্তু এখন মিস্টার প্রেসিডেন্ট। এখন এসব বললে হবে? এত করে বললাম, ব্যাটাকে ভোট দিয়ো না… দিয়ো না… শুনলে আমার কথা?

ডিজার্ট এনে ওদের টেবিলে রাখল এক ওয়েইট্রেস।

থ্যাঙ্কস।

তরুণীর চোখ চলে গেল ডাইনিং-এর এন্ট্রান্সের দিকে। দাড়িঅলা এক যুবক এই মাত্র পদধূলি দিল রেস্টুরেন্টে। দেড়েলটা একটা টেবিল বেছে নিতে নিতে যন্ত্রচালিতের মতো নয়া অতিথির কাছে পৌঁছে গেল পরিচারিকা।

আপনার জন্য কী আনব, স্যর?

বিয়ার আর স্যাণ্ডউইচ দিয়ো… টুউনা সালাদ দেয়া।

মেয়েটা অর্ডার আনতে চলে গেলে অলস দৃষ্টিতে আশপাশে নিরীখ করল দাড়িঅলা। কী খুঁজছে, জানে। কিছুটা দূরের এক টেবিলে সেঁটে গেল যুবকের দৃষ্টি। বিশেষ একজনকে লক্ষ করছে ও, সেই দুই সদস্যের একজন। অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান লোকটা লাইম পাই খাচ্ছে তারিয়ে তারিয়ে। প্রতিটি গ্রাস মুখে পুরে চামচ চাটছে বাচ্চাদের মতো। দৃশ্যটা অশ্লীল। গা ঘিনঘিন করে। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, সবুজ হয়ে আছে লোকটার জিভ। ড্রিঙ্ক আর স্যাণ্ডউইচ চলে এলেও মনোযোগ টুটল না যুবকের।

টার্গেটের উপর থেকে চোখ না সরিয়েই বিয়ারের বোতলে চুমুক দিল ও।

ডিজার্ট শেষ করেছে ওরা। অ্যালিসিয়া মাশাদো-র সেক্স-টেপটা দেখেছ? কানে এল যুবকের।

ওহ… ওটা! স্মৃতি রোমন্থন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মোটার সঙ্গীর চেহারা। দারুণ জিনিস।

ভেনেজুয়েলার মেয়েরা এত সুন্দরী হয় কেন, বলতে পারো?

ঈশ্বরের, পক্ষপাতিত্ব ছাড়া আর কী! মন্তব্য দ্বিতীয় জনের।

বিল নিয়ে এসেছে ওয়েইট্রেস। শেষ কাস্টমারের টেবিলের দিকে তাকাতেই ভ্রু দুটো কুঁচকে উঠল ওর। হাওয়া হয়ে গেছে দেড়েল। স্যাণ্ডউইচটা, মনে হচ্ছে, ছুঁয়েও দেখেনি। তবে বড় একটা নোট চাপা দেয়া বোতলের তলায়। খাবারের দামের চেয়ে বেশিই হবে।

.

দোতলায় অ্যালি, নিচের ফ্লোরে গ্যারাজ। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে নিজের গাড়ির দিকে চলেছে মোটা খেলোয়াড়। ওর সঙ্গীটির বাসা কাছেই, হেঁটেই চলে যাবে।

দূরে কোথাও বাজ পড়ল জোরে। সেই আওয়াজে কেঁপে উঠল জনহীন গ্যারাজ।

নিসান-এর দরজায় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই পিছনে কারও উপস্থিতি টের পেল গাড়ির মালিক। দাড়িঅলা এক ছোকরা। অল্প আলোতে চেহারাটা পরিষ্কার না।

ইভনিং, ভদ্রতাবশে বলল ক্লাব-সদস্য।

জবাবটা এল শারীরিক ভাবে। দু হাতে ধরা ভারি বলটা সজোরে মোটুর মাথায় নামিয়ে আনল যুবক। এক বাড়িতেই জগৎ আধার।

দুই

দরজার বেলটা বাজছে। এই অসময়ে আবার কে এল! হাত মুছতে মুছতে কিচেন থেকে বেরোল গৃহকত্রী।

ডেলিভারি ম্যান। বিগলিত হাসি দিল মহিলার উদ্দেশে। মিসেস মারগট রোবি?

জি!

একটা পার্সেল আছে আপনার জন্য।

বিভ্রান্ত দেখাল মিসেস রোবিকে। আর ইউ শিয়োর? কিন্তু আমি তো কোনও কিছু অর্ডার করিনি!

এই যে, দেখুন! হাতের প্যাকেজটা মহিলার দিকে বাড়িয়ে ধরল ডেলিভারি ম্যান।

বিড়বিড় করে ঠিকানা লেখা লেবেলটা পড়ল মিসেস রোবি। থ্রি এইট ফোর ফোর রিজেন্ট সেইন্ট সিয়াটল… ঠিকই তো আছে!

তা হলে এটা আপনারই। চওড়া হেসে জিনিসটা প্রাপকের হাতে বুঝিয়ে দিল কুরিয়ার সার্ভিসের লোক। গুড ডে, ম্যাম।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বসার ঘরের সোফায় এসে বসল মহিলা। কে… কী… ধারণার বাইরে। তবে হালকা কিছুই হবে ভিতরের জিনিসটা। আন্দাজে সময় নষ্ট না করে খুলেই ফেলল কার্টনের গা থেকে হলুদ টেপের লম্বা স্ট্রিপটা।

পার্সেল করা জিনিসটা সেলোফেনে মোড়া। মোড়ক না খুলেই কোলের উপর রাখল ওটাকে প্যাকেট থেকে বের করে। ছাড়াল সেলোফেনটা। ওটা ছাড়াও মোড়ানো হয়েছে ছোপ ছোপ লাল দাগে ভরা খবরের কাগজ। শেষ আবরণটাও সরাল মহিলা রহস্যময় জিনিসটার উপর থেকে।

অবাক হলো। কালচে-সবুজ কী জিনিস এটা! বোঝার জন্য চোখের কাছে নিয়ে এল ওটাকে। ৭ মাত্র গাড়িতে উঠেছে ডেলিভারির লোকটা, ধড়াস করে এক লাফ মারল ওর হৃৎপিণ্ড। ৩৮৪৪ নং বাড়ি থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের নারকীয় চিৎকার। থামছেই না মহিলা, চিৎকার করেই যাচ্ছে… করেই যাচ্ছে!

তিন

গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকাল জন ডিউক। অদ্ভুত সজীব গন্ধ বাতাসে! আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আশ্চর্য সবুজ দেখাচ্ছে প্রকৃতি। পৃথিবীটা যেন মিষ্টি এক স্বপ্নপুরী।

কিন্তু স্বর্গেও সাপ থাকে। রোবি পরিবারের এই বাড়িটার উপরে পড়েছে অশুভ কোনও ছায়া।

রেডিয়োর আওয়াজ কানে এল জনের। পড়শিদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন পুলিসের লোককে। ও যখন বাড়ির ভিতরে ঢুকল, তখনও কাঁপুনি থামেনি মিসেস রোবির। বমি-টমি করে জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। যেন। জনের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে ফিরল মহিলা লেফটেন্যান্ট বিলি বব থর্নটনের দিকে। বুঝতে পারছি না আমি, আমার সাথেই কেন! আমি তো কারও ক্ষতি করিনি!

চিন্তা করবেন না। যে-ই এটা করে থাকুক, পার পাবে না! জনের দিকে তাকিয়ে আরও গম্ভীর হলো লেফটেন্যান্ট। জিভ!

লিভিং রুমের মেঝেতে পড়ে আছে কাটা অঙ্গটা। গোড়ার দিকটা টকটকে লাল। ভালো করে দেখার জন্য গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসল জন। ও-ও বসল, ফোটোগ্রাফারেরও ছবি নেয়া সারা।

ডেলিভারি সার্ভিসের সাথে কথা হয়েছে? সিধে হতে হতে জানতে চাইল জন। চোখ ছোট্ট কার্টনটার উপরে।

হ্যাঁ, খুন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বন্ধুটিকে জানাল লেফটেন্যান্ট। প্রেরকের নাম আর ধাম- দুটোই ভুয়া। নাম্বারটাও।

বাইরে বেরিয়ে এল দুই বন্ধু।

মোটিভ পরিষ্কার না, তাই না? বলল জন।

পুরোপুরি ধোঁয়াশা। মহিলা এক খামারির হিসাব রক্ষকের কাজ করে। নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি। বারো বছর আগে বিধবা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা থাকে অন্য শহরে। তবে মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে নিয়মিত। অজাতশত্রু বলতে যা বোঝায়, তা-ই হচ্ছে মিসেস রোবি। এমন একজন মহিলাকে…

মহিলার কি অ্যাফেয়ার আছে কারও সাথে?

না, নেই।

কাউকে সন্দেহও করে না?

বললাম তো- অজাতশত্রু।

মাথা দোলাল জন। বুঝতে পেরেছে।

একবার নয়, দু বার নয়, চার-চার বার ঘটল এমন ঘটনা! সখেদে বলল বব। এ পর্যন্ত চারজন পেল শরীরের কাটা অংশ। চোখ, কান, নাক, আর এখন জিভ

কে পাঠাচ্ছে, কেন পাঠাচ্ছে- কিছুই বুঝে আসছে না!

পরের জন কী পাবে, আন্দাজ কর।

কী?

থিয়োরি ঠিক হলে- পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চমটা।

কল্পনা করে শিউরে উঠল লেফটেন্যান্ট।

আচ্ছা, এই চার প্রাপকের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে? জিজ্ঞেস করল জন।

উঁহু, একটুও না।

চার

কলিং বেল বাজছে। লাতিন সুর। দোতলা থেকে নেমে এল জনের ইতালিয়ান বউটা। সদর দরজাটার দিকে এগোতে এগোতে ভাবছে: এই সন্ধ্যা বেলা কে এল আবার!

অল্প বয়সী এক ডেলিভারি ম্যান। নীল উর্দি আর মাথায় একই রঙের বারান্দাঅলা ক্যাপ পরেছে। তেলতেলে হাসল। মনিকা লোরেনের উদ্দেশে।

পার্সেলটা নিয়ে বেডরুমে ফিরে এল মনিকা। বিছানায় আধশোয়া হয়ে নন-ফিকশন পড়ছিল জন, চোখ তুলল বই থেকে।

তুমি কি কিছুর অর্ডার দিয়েছ? স্বামীর উদ্দেশে জিজ্ঞেস করল মনিকা।

না তো! সামান্য উঁচু করল প্যাকেজটা মহিলা। তোমার নামে।

হঠাৎ করেই মনে পড়ল জনের। ও… মনে হয়, ববের কাছ থেকে। সশব্দে বন্ধ করল বইটা। দেখি! বলে হাতটা বাড়াল।

কী আছে এর ভিতরে?

নথি।

বাক্সটা নিয়ে নিচতলায়, ওর কাজের ঘরে চলে এসেছে জন।

অন্যান্য ডকুমেন্টের সঙ্গে এক গাদা ছবি পেল বাক্সে, নানান অ্যাঙ্গেল থেকে নেয়া চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা আর জিহ্বার।

অদ্ভুত কেস! প্যাথলজি রিপোর্ট বলছে, শিকারি ওর শিকারের শরীর থেকে জ্যান্ত অবস্থায় বিচ্ছিন্ন করেছে।

ওগুলো। শুধু একটা বাদে।

ছবি আর কাগজগুলো দেখতে দেখতে কে ফোন করল জন।

চোখ-কান-নাক হারানো কারও রিপোর্ট আসেনি তোদের কাছে? লেফটেন্যান্টের সঙ্গে তুই-তোকারির সম্পর্ক ওর।

উঁহু।

সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া কেউ কেউ হয়তো পড়েছে গিয়ে স্যাডিস্টটার খপ্পরে…

সেটা আমিও ভেবেছি।

হুম… জিভটার ব্যাপারে বোধ হয় ফাইনাল রিপোের্ট পাওয়া যাবে কালকে?

হ্যাঁ।

দেখা হবে।

পাঁচ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে… কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে… যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ… মরিবার হলো তার সাধ…

মর্গের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনগুলো মনে এল জনের। আব্বুর কণ্ঠে অসংখ্যবার শুনে শুনে মুখস্থই হয়ে গেছে কবিতাটা। বাবা, বাংলাদেশি ওর, মা আমেরিকান।

এফবিআই-এর হমিসাইড এক্সপার্ট জনের বর্তমান এই কেসের সঙ্গে লাইনগুলোর পার্থক্য হলো: ভিকটিমরা কেউই এখানে সাধ করে মরতে যায়নি। মরতে ওদের বাধ্য করা হয়েছে।– জিভটা যে পরীক্ষা করছে, নামটা তার আজব। ড্যানিয়েলা শর্ট। নামে খাটো হলেও এবনি এই মহিলা যথেষ্ট লম্বা।– জন, বব আর আরেক জন অফিসারের উপস্থিতিতে পরীক্ষা থেকে পাওয়া ডাক্তারি তথ্যগুলো রিভিউ করা শুরু করল সে।

আগের পরীক্ষাগুলো থেকে আমরা এটা নিশ্চিত হয়েছি যে, ভিকটিম জীবিত থাকা অবস্থায় শরীরের অংশগুলো কেটে আলাদা করা হয়েছে ওদের, বলল মহিলা। কিন্তু এটার ব্যাপারে পরীক্ষা বলছে ভিন্ন কথা। হতভাগ্য লোকটার মৃত্যুর পর কেটে নেয়া হয়েছে জিভটা।

স্ক্যালপেল ব্যবহার করে জিভের গা থেকে পাতলা এক টুকরো ছাল ছাড়াল পরীক্ষক।

পরীক্ষা এ-ও বলছে, আবার বলল মহিলা। যে অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে অঙ্গটা, যথেষ্ট ধারাল ছিল না সেটা। আবার এ-ও ধরে নেয়া যায়, এ ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে অঙ্গচ্ছেদ করতে পারেনি শিকারি। যেমনটা পেরেছিল আগেরগুলোর বেলায়।

আ… এমন কি হতে পারে না, নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না লোকটার, বাতলাল বিলি বব থর্নটন। উত্তেজিত হয়ে ছিল কাটাকাটির সময়?

সন্দেহ আছে। উত্তেজিত অবস্থায় কাটলে যেরকম শক্তি প্রয়োগের চিহ্ন থাকার কথা, সেরকম কোনও আলামত পাইনি আমি। স্রেফ আনাড়ি হাতের কাজ এটা। একবারে কাটতে পারেনি… ভুল ভাবে শুরু করেও থেমে গেছে কয়েকবার, ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেল মহিলা। একাধিক চেষ্টার চিহ্ন রয়েছে জিভে।

জন? সহকর্মীর মত চাইল লেফটেন্যান্ট।

এটা একটা লক্ষণীয় বিষয়,  বলল জন। প্রত্যেকবার যে সুন্দর ভাবে কাজ সমাধা করছে, এবারে তার ব্যতিক্রম হলো কেন?

আমিও সেকথাই ভাবছিলাম,  বলে উঠল অপর অফিসার। নিজের ছকবাঁধা নিয়ম থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে না।

তো, এ থেকে আমরা কী ধরে নিতে পারি? অনিশ্চিত জিজ্ঞাসা লেফটেন্যান্টের।

হয়তো কোনও কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল খুনি, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাটির ধারণা। হয়তো ভাবতে পারেনি সে, জিভটা কাটার আগেই মারা যাবে ভিকটিম।

কিংবা হয়তো একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে লোকটাকে, ধারণা করল অপর অফিসার স্মিথ। যে কারণে সুচারু ভাবে কাজ সমাধার দিকে মনোযোগ নেই এখন।

তার মানে খুব বেশি তথ্য পাচ্ছি না আমরা, তাই তো? উপসংহারে পৌঁছোতে চাইছে বব।

জন দিল জবাবটা।

ওয়েল। আমরা যা জানছি, তা হলো, ধরা পড়া নিয়ে খুব একটা গা করছে না অপরাধী। নইলে আরেকটু সাবধান। হতো। তাই বলে কম বিপজ্জনক বলা যাবে না লোকটাকে। হয়তো সে আমাদের ধারণার চাইতেও বিপজ্জনক। চিন্তিত চেহারায় জিভটার দিকে চেয়ে রয়েছে ও। এমন কিছু জানতে পারিনি আমরা, যেটা থেকে নিশ্চিত হতে পারি, এটাই ওর শেষ অপকর্ম। আর সেটাই হচ্ছে ভয়ের কথা।

ছয়

রাত। রাস্তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে লোকটি। উপরের ঠোঁটে বিচ্ছিরি এক কাটা দাগের মালিক সে।

একটু পরে সামনের এক কোণ ঘুরে থামল এসে এক প্রিজন ভ্যান। ব্রেট বেকার নামে এক লোক নেমে এল গাড়ি থেকে। রাস্তার উলটো দিকের বারটার উদ্দেশে পা চালাল লোকটা।

এরই অপেক্ষাতে ছিল এতক্ষণ কাটা দাগ। খানিক অপেক্ষা করে বারে ঢুকে পড়ল অনুসরণকারী।

হালকা মিউজিক বাজছে ভিতরে। কাউন্টারে একটা টুল দখল করে বিয়ার টানছে বেকার। টিভির খবরে চোখ ছিল বারটেণ্ডারের, নতুন কাস্টমারের আগমনে চোখ নামাল দরজার দিকে।

টারগেটের পাশে বসতে বসতে বারম্যানকে ড্রিঙ্কের সঙ্কেত দিল কাটা দাগের মালিক।

চরম ফালতু একটা রাত! স্বগতোক্তির ভান করল অনুসরণকারী।

কী আনব আপনার জন্য? সামনে এসে জানতে চাইল। বারটেণ্ডার।

খালি বৃষ্টি আর বৃষ্টি… পানি। এক গ্লাস পানি।

এ-ই? তাচ্ছিল্য ঝরল টেকো বারটেণ্ডারের কণ্ঠ থেকে।

একজন অপরিচিত লোকের সাথে যে টোনে কথাটা বললে তুমি, তার জন্য তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম, হালকা সুরে বলল কাটা দাগ। সাবধান। খুব সাবধান। …মিস্টার বেকারের জন্য আরেক রাউণ্ড।

ধন্যবাদ। একটু অবাক হয়েছে বেকার। সম্মানটা কী জন্য, জানতে পারি?

জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, সেজন্য। নতুন করে আবার জীবনটা শুরু করতে যাচ্ছেন, সেজন্য। ব্রেট বেকারের চোখে প্রশ্ন ফুটতে দেখে বলল ঠোঁট কাটা, একটু আগেই ভ্যান থেকে নামতে দেখেছি আপনাকে। সন্তুষ্ট এবারে?

দেখুন, মিস্টার… আপনি যদি সমকামী হয়ে থাকেন…

যদি ভেবে থাকেন যে সমকামী? বলেই প্রসঙ্গটা পাশ কাটাল কাটা দাগ। পনেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে ছ -ছ বার জেল খেটেছেন আপনি এ পর্যন্ত। কিন্তু সব মিলিয়ে এক বছরও হবে না, জেলখানার বাইরে কাটাতে পেরেছেন!

পুলিস নাকি আপনি?

এবারে ছাড়া পেলেন আট বছর পর, নিজের মনে বলে চলেছে কাটা দাগ। সহিংস ডাকাতির অভিযোগ, ঠিক? …এ পর্যন্ত যা-যা কাণ্ড ঘটিয়েছেন আপনি, বেশির ভাগই চেষ্টা করে দেখা হয়নি আমার! কেমন জানি দুঃখ ঝরল লোকটার কণ্ঠ থেকে।

প্যারোল অফিসার নাকি? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ভিতরে ফের ফেরত যাওয়ার কথা আমার।

দুটো খুন, একঘেয়ে স্বরে বলে চলেছে বক্তা। একজন টাকোমা-র এক মেয়ে। গত বার এই খুনের দায়ে জেল খাটা অবস্থায় পেয়েছিলেন প্যারোল। আরেক জন এক হোমোসেক্সয়াল। রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছিল আপনাকে লোকটা। সতেরো বছর বয়স তখন আপনার। অন্যদের জেলখানার ভিতরেই খুন করেছেন। মাল আছে, বলতে হবে, আপনার মধ্যে! …বিশ্বাস করুন, পৃথিবীকে কিছু দেয়ার আছে। আপনার, মিস্টার বেকার। সেটা যাতে পারেন, সেটাই চাইছি আমি। আরও বড় কিছুর জন্য জন্ম হয়েছে আপনার মতো লোকেদের।

আমার দায়িত্ব নিচ্ছেন আপনি? চাইছেন যে, ওখানে আর ফিরে না যাই আমি?

আমি সাহায্য না করলে কাস্টডিতে নিয়ে যাবে ওরা আপনাকে। কিছু দিনের মধ্যেই, খুব সম্ভব। কিন্তু আমি যদি সাহায্য করি…

বুঝেছি। আপনি একজন লইয়ার, রাইট?

না, মিস্টার বেকার। আমি একজন বিচারক।

সাত

রাত্রি। অন্ধকারে ডুবে আছে শুয়োরের খামারটা। ওটার মালিক স্বঘোষিত সেই বিচারক।

খোয়াড়ের ভিতরে ঘোঁত-ঘোত করছে শূকরগুলো। নিজ বাড়িতে আদালত বসিয়েছে বিচারক।

খবর এসেছে, আদালতের কঠোর নির্দেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে, তথাকথিত বিচারক অভিযোগ তুলল নৈর্ব্যক্তিক ভাবে।

সত্যি কথাটা জানা দরকার আপনার, মহামান্য বিচারক! বলে উঠল দোষী রজারস। জ্যান্ত অবস্থায় কারও জিভ কেটে নেয়া যে কত কঠিন একটা কাজ, যে না করেছে, বুঝবে না সেটা! কারও সন্দেহ না জাগিয়েই কবজা করতে চেয়েছিলাম লোকটাকে। কিন্তু রক্তপাত একেবারে এড়ানো যায়নি পার্কিং লটে। জিভটার জন্য যখন চেষ্টা করছিলাম, গোঁ-গোঁ চিৎকার করছিল হারামজাদা!

তোমার উলটোপালটা কাজের জন্য আদালত কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হলো, বুঝতে পারছ? ঠাণ্ডা স্বরে বলল বিচারক।

মার্জনা চাইছি, ধর্মাবতার! মাথা হেঁট করল রজারস। আর হবে না এরকম ভুল!

আমি কে বা কী, স্মরণ রাখবে সব সময়! শাসাল ভণ্ড বিচারক। লাশটার কী করেছ?

ওই তো… যা করা হয় সব সময়।

আমার ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্মত হয়েছিলে তুমি! রায় ঘোষণার সুরে বলল বিচারক। তুমি মনে করো, নিজের সাথে যেরকম প্রতারণা করো তুমি, আমার সাথেও লাগাতার মিথ্যা। বলে পার পেয়ে যাবে… ।

ল-লাশটা খুঁজে পাবে না কেউ! ভয় দেখা দিয়েছে। মিথ্যুক রজারসের দু চোখে। আ-আমার তৃ-তাড়া ছিল, ম্‌-ম্‌–

স্টিভ রজারস! স্বার্থপরের মতো কাজ করেছ তুমি! একে তো বিচার-প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে পালন করোনি, তার উপরে শাক দিয়ে মাছ ঢাকছ এখন। রাগে জ্বলছে বিচারকের চোখ দুটো। আদালতের দেয়া দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করলাম আমি তোমাকে!

ব্রেট বেকার প্রবেশ করল কামরায়।

বেকার… নামটা উচ্চারণ করল বিচারক। ওর দলে। লোকটা অন্তর্ভুক্ত হতেই সম্বোধন পালটে নিয়েছে দলনেতা–আপনি থেকে নেমে এসেছে তুমিতে।

নিজ হাতে বিশেষ এক ধরনের টুপি পরিয়ে দিল সে দলের নতুন সদস্যটির মাথায়। শাস্তিদাতার ভূমিকা পালন করতে হবে তোমাকে!

খপ করে রজারসের চুল ধরে শক্ত ঝাঁকি দিল বেকার। বহু দিন পর আবার মনের মতো কাজ পেয়েছে সে।

বাইরে, ঘোঁতঘোঁতানি বেড়ে গেল শুয়োরগুলোর।

আট

জঙ্গলাকীর্ণ একটা জায়গা। পায়ে চলা একটা পথ চলে গেছে বনের ভিতর দিয়ে। সেই পথ ধরে হেঁটে আগে-চলে-যাওয়া পোষা কুকুরটার দিকে এগোচ্ছে দু জন মহিলা। সেই সঙ্গে চলছে ডাকাডাকি।

কিছু একটা ধরা পড়েছে কুকুরটার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। পাগলের মতো খুঁড়ে চলেছে ওটা এক জায়গার মাটি।

হারকিউলিস! হারকিউলিস! চলে আয়, বদমাস! চেষ্টা অব্যাহত রাখল দুজনের একজন। এলি!

চলে আয়, হারকিউলিস! বলছে অপরজন। নইলে পিটি আছে তোর কপালে। পাশের জনের দিকে চেয়ে হেসে বলল, না জানি কোন্ গন্ধঅলা হাড় পেয়ে গেছে ওখানটায়। …কী রে! কী হলো!

খোঁড়া থামিয়ে দিয়েছে কুকুরটা। মাটিতে পড়ে থাকা পচা পাতার দঙ্গলের মধ্যে অস্থির ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে শ্বাপদের দৃষ্টি। ভক করে একটা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল দুই মহিলার নাকে।

ওরে, খোদা! নাক টিপে ধরেছে এক মহিলা। কী দুর্গন্ধ, বাপ রে, বাপ!

ওয়াক!

হারকি! ভাগাড় থেকে উঠে আয়, বলছি! এক্ষুনি উঠে আয়!

কী জানি টানাটানি করতে লেগেছে কুকুরটা। কিছু একটা ছিঁড়ে আনল দাঁত দিয়ে।

অ্যাই, ছোঁড়া! এলি না এখনও? কী পেয়েছিস তুই ওখানে!

ভালো করে দেখার জন্য কাছাকাছি হলো দুজনে।

ওসব পচা-গান্ধা, নোংরা জিনিস নিয়ে করবিটা কী, অ্যাঁ? বল তুই, কী করতে চাস!

অবাধ্য কুকুরটাকে ওটার আগ্রহের জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে সচেষ্ট হতেই মহিলার নাকে-মুখে হামলা চালাল, গোটা কতক মাছি। তার পরই প্রাতঃভ্রমণকারিণীর চোখে পড়ল অর্ধগলিত শরীরটা।

নাদিয়া! নাদিয়া! ডাকল মহিলা বান্ধবীকে। ভয়ানক ব্যাপার… দেখে যা!

ক্‌-কী! কী দেখব!

একটা লাশ!

নয়

নিজ বাড়ির বেইসমেন্টে কাজের মধ্যে ডুবে রয়েছে জন। কুরিয়ারে আসা চার ইন্দ্রিয়ের ছবিগুলো দেখছে এক মনে। একটা হার্ডবোর্ডে গেঁথেছে ও ছবিগুলো।

এসময় নেমে এল মনিকা নিচে।

জন?

হ্যাঁ, মনি। ডেস্কের উপরে উলটে রাখল জন বোর্ডটা। কিছু বলবে?

তেমন কিছু না। বলেই ইতস্তত করতে লাগল মনিকা। আম্… জন, সেরাতে পেয়েছিলে যে পার্সেলটা… কী নিয়ে কাজ করছ ইদানীং?

কেন, বলো তো!

না, মানে… অফিসের একজনের সাথে লাঞ্চ করছিলাম আজকে। যাদের কাউন্সেলিং করছে মহিলা, তাদের মধ্যে এক হাউসওয়াইফ রয়েছে, যে কি না কিছু দিন আগে একটা কাটা জিভ পেয়েছে ডাকে আসা পার্সেলে!

হ্যাঁ। মারগট রোবি।

আমার ওই কলিগ অবশ্য নাম বলেনি ওই মহিলার। …কিছু জানো নাকি মিসেস রোবির ব্যাপারে? মানে, ওর অতীত সম্পর্কে?

পুলিস কথা বলেছে মহিলার সাথে। না, উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু পাইনি আমরা।

তা-ই? দেখো তো, এই তথ্যটা কাজে লাগে কি না! ডাকাতির কারণে বারো বছর আগে জেলে গিয়েছে মহিলার স্বামী। এদিকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে লোকটার বিরুদ্ধে, এই মর্মে আপিল করেছিল অভিযুক্ত।

ফলাফল?

দুঃখজনক। বিষয়টার সুরাহা হওয়ার আগেই জেলের ভিতরে খুন হয় লোকটা!

মাথা ঝাঁকিয়ে তথ্যটা হজম করল জন। কৃতজ্ঞ হেসে স্ত্রীর হাত ধরল ও। থ্যাঙ্ক ইউ।

যাক। উদ্ভাসিত হেসে হাঁফ ছাড়ল মনিকা। ভাবছিলাম, অনধিকার প্রবেশ করে ফেললাম কি না এখানে।

আমার রাজ্যে সব সময়ই স্বাগত তুমি! খুশি মনে অনুমতি দিয়ে দিল জন।

ফোনটা বেজে উঠল এসময়। তুরিত উঠে রিসিভ করতে। গেল জন।

ইয়াহ?

জন! বব বলছিলাম,  বলা হলো ওপাশ থেকে।

দশ

বব আর জন যখন মর্গে প্রবেশ করল, ইতোমধ্যে বন্ধুকে ব্রিফ করার কাজ প্রায় সারা লেফটেন্যান্টের।

যেন-তেন ভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল লাশটাকে,  দুই মহিলা আর ওদের কুকুরটা যে মৃত দেহ আবিষ্কার করেছে, সেটার ব্যাপারে বলছে বব। ঢেকে দেয়া হয়েছিল লতাপাতা ছড়িয়ে। কি জানিস, জিভটা কাটা এই লোকের! মনে হচ্ছে, বড় একটা ব্রেক পেলাম, জন!

শবদেহটার জন্য অপেক্ষা করছে ওরা, এসময় চাকা লাগানো খাটে করে আরেকটা লাশ নিয়ে ঢুকল এক মর্গ সহকারী। পলকের জন্য ওটার প্রতি কৌতূহল বোধ করল জন। লাশের দুটো পা-ই হাঁটুর নিচ থেকে গায়েব। ডিটেক্টিভ ফ্রিম্যান মর্গে পৌঁছোতে নতুন আসা লাশটার কথা ভুলে গেল জন।

আসছে জিভ কাটা, জানাল গোয়েন্দা। এক্ষুনি আমাদের সাথে যোগ দেবেন প্যাথলজিস্ট।

বলতে-না-বলতেই দু জন মর্গ-সহকারীকে নিয়ে হাজির হলো প্যাথলজিস্ট লোকটা। জঙ্গলে পাওয়া লাশটা এসেছে। ওদের সঙ্গে।

যাকে খুঁজছি আমরা, এ-ই কি সেই লোক? শুরুতেই কাজের কথা পাড়ল লেফটেন্যান্ট।

সব কিছুই ম্যাচ করছে,  সন্তোষজনক জবাব দিল প্যাথলজিস্ট। শ্বেতাঙ্গ। পুরুষ। পা দিয়েছে পঞ্চাশের ঘরে। ভালো স্বাস্থ্যের ইঙ্গিতও পেয়েছি। খুলিতে ভোতা বি। আঘাতের ফলে হয়েছে মৃত্যুটা… হ্যাঁ, ছুরি-চাকুর আঘাতগুলোর আগেই, খুব সম্ভব।

ভালো করে দেখার জন্য ঝুঁকে পড়ল বব। রাবারের একটা গ্লাভ এক হাতে গলিয়ে লাশের ডান হাতটা দেখতে লাগল ও। ওদিকে অন্য হাতটা পরীক্ষা করছে জন।

আত্মরক্ষার ফলে সৃষ্ট ক্ষত নেই কোনও,  জানাচ্ছে। প্যাথলজিস্ট।

ওই লাশটা কার? সিধে হয়ে চোখের ইঙ্গিত করল জন। আবারও ওর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে একটু আগে আসা অন্য লাশটা।

ভবঘুরে-টুরে নাকি? প্যাথলজিস্টকে জিজ্ঞেস করল বব। সেরকমই তো মনে হচ্ছে কাপড়চোপড় দেখে।

হ্যাঁ। ঘাড় দোলাল প্যাথলজিস্ট। ভোরের দিকে পাওয়া গেছে লাশটা… পেয়েছে রেলওয়ে পুলিস। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে লোকটার। সম্ভবত চলন্ত মালগাড়িতে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে হড়কে গেছে পা, কাটা পড়েছে চাকার নিচে।

ফি-বছর দুটো-তিনটে করে ঘটবেই এমন ঘটনা! গাল কুঁচকে উঠল লেফটেন্যান্টের। জনের উদ্দেশে বলল, দেখতে চাস নাকি লাশটা?

সায় জানিয়ে পা বাড়িয়েছে জন সেদিকে, এসময় প্রবেশ অফিসার স্মিথের।

জিভ কাটার পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জানাল অফিসার। ক্রিস্টোফার মার্কাস। সিয়াটল পুলিস অফিসার… প্রাক্তন।

পুলিস? বিস্মিত হয়েছে জন।

সাত বছর আগে রিটায়ার করেছে। ডিভোর্সড। তর্কবাজ হিসাবে কুখ্যাতি ছিল লোকটার। ওর আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলব আমরা।

প্রথম লাশটার কাছে পৌঁছে গেল জন। পরীক্ষা করতে লাগল একটা হাত তুলে নিয়ে।

খানিক বাদেই বলল ও, সম্পর্ক আছে দু জনের মধ্যে!

মানে? বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়েছে লেফটেন্যান্টের মুখের চেহারায়।

বলছি, সম্পর্ক আছে এই দুটো লাশের মধ্যে।

ভবঘুরে আর মার্কাস? চোখ জোড়া কপালে তুলেছে। লেফটেন্যান্ট। কী বলছিস, জন! একটা খুন… আরেকটা অ্যাকসিডেন্ট! বিস্তর ব্যবধান! ।

আপাতত আর কোনও মন্তব্য করল না জন। আবারও ঝুঁকে পড়েছে ও পা হারানো লাশটার উপরে।

এগারো

হ্যাঁ, জন?

স্মিথ?

হ্যালো!

শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?

ফড়ফড় করছে লাইনে। গাড়িতে আছি তো! কেটে যেতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে!

শোনো, পুরানো কিছু কাগজপত্র দরকার আমার।

কীসের?

মারগট রোবির স্বামীর অ্যাফিডেভিট, পিটিশন সহ আর। যা-যা পেয়েছে, সেসব নিয়ে কমপিউটারে বসেছে জন। বলল, ডগ রোবির কোর্ট রেকর্ডগুলো। হার্ড কপি ছাড়া পাওয়া যাবে না এগুলো।

ওকে, জন, ব্যবস্থা হবে… যদি অনুমতি পাই।

ঠিক আছে, রাখলাম।

.

ফোন রাখতেই বেজে উঠল ডোরবেল।

বাইরে, দরজার দিকে পাশ ফিরে সূর্যালোকিত চারপাশ দেখছে বিলি বব থর্নটন।

দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল জন।

পাঁচ শ বছর আগে হলে ডাইনি হিসাবে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হতো তোকে! নিশ্চিত বিশ্বাসের সুরে রসিকতা করল বব।

ঠোঁটের এক পাশ দিয়ে হাসল জন। না, বব। আমি যা করেছি, সেটা কোনও তুকতাক নয়। ইনটুইশন বলতে পারিস। আর কিছুটা সিক্সথ সেন্স।

কিন্তু… এই যুগে… নিষ্প্রাণ হাসল বব। যাক গে! তোর কথাই ঠিক হয়েছে। সম্পর্ক আছে লাশ দুটোর মধ্যে! ভবঘুরেটার নখের নিচে অন্য মানুষের টিসু পেয়েছে। প্যাথলজিস্ট। মার্কাসের টিসু, জন! ব্লাড টাইপ মিলে গেছে। ডিএনএ রিপোর্ট পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। কিন্তু আর সন্দেহ নেই আমার। ভবঘুরে আর মার্কাস… শিকারি আর শিকার ওরা দুজনে!

কিছু জানা গেল ভবঘুরেটার ব্যাপারে?

হ্যাঁ। স্টিভ রজারস নাম লোকটার। প্রাক্তন কয়েদি।

কেসটা কী ওর?

একটা না, অন্তত হাফ ডজন বার ফাটকে ঢুকেছে লোকটা। সশস্ত্র ডাকাতি… গাড়ি চুরি… ইত্যাদি-ইত্যাদি। ছাড়া পেয়েছে পাঁচ বছর আগে।

তারপর আর অপরাধ করেনি?

না। একদম ক্লিন রেকর্ড। এমন কী প্যারোল অফিসারের দেয়া একটা ডেটও মিস করেনি।

বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বব। অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে জনকে। সম্ভবত স্টিভ রজারসের সুনাগরিক হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না ও!

মিলছে না, বব! বলেই ফেলল শেষমেশ।

তো, আমি কী করব, চাঁদ! যা সত্য, তা-ই তো বললাম তোকে।

মাথা-গরম একটা লোক… বার-বার আইন ভাঙছে, বার-বার ধরা খাচ্ছে… এত সহজে সাধু হয়ে যাবে! না, বব, জন্ম-ক্রিমিনাল লোকটা।…অন্য কিছু আছে এর মধ্যে!

বারো

বিচারক-ভবন।

ব্রেট বেকারের বাম পায়ে প্লাসটার করছে বিচারক। কাজটা শেষ করে হাত ধুতে গেল লোকটা।

এবারের অভিযুক্ত তরুণ এক ছোকরা। আর আমাদের মক্কেল হচ্ছে- বাষট্টি বছরের এক বুড়ি। ছোকরাটার কারণে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সিঁড়ি থেকে পড়ে মারাত্মক চোট পেয়েছে মহিলা। তদন্তে পর্যাপ্ত প্রমাণও মিলেছে অভিযোগের। সত্যিই লাথি মেরে বুড়িকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে ছোকরাটা। …ঠিক আছে, এবার রায় ঘোষণার পালা আমার।

পরনের কালো আলখেল্লাটার মস্তকাবরণ মাথায় তুলে দিল বিচারক। বেকার, শুরু করল। তোমার উপরে নির্দেশ রইল অভিযুক্তের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার। নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাবে ওকে তুমি, তারপর হাঁটু থেকে আলাদা করে। ফেলবে ডান পা-টা।

জো আজ্ঞা, ধর্মাবতার!

কাজটা করার সময় চেতনা থাকে যেন ছেলেটার। নিজ চোখে নিজের পাপের পরিণতি দেখুক, তা-ই চাই আমি।

চিন্তা করবেন না। সত্যিকারের বিচার কী, হাড়ে-মাংসে ৫ টের পাবে কুত্তার বাচ্চাটা!

উঁহু। ভুলেও কোনও রাগ রাখবে না পাপিষ্ঠের প্রতি। প্রতিশোধের আদালত নয় এটা- ন্যায় বিচারের আদালত। পাপ যে করবে, আমার আদালতে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কখনওই এর কোনও নড়চড় হবে না।

আপনি মহান! মহা নায়ক আপনি! ভক্তিতে গদগদ কণ্ঠে বলল বেকার। আপনার জন্য কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, সেজন্য অশেষ কৃতজ্ঞ এই অধম। জীবনটা সার্থক হলো আমার!

.

কালো রাত্রির পটভূমিতে নির্জন হাইওয়ে। পুরোপুরি জনহীন। নয় অবশ্য। নকল প্লাসটার-করা-পা নিয়ে রাস্তায় উপস্থিত রয়েছে বেকার। নিজের অচল হয়ে পড়া গাড়ির পাশে ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারও অপেক্ষায়।

শিগগিরই অপেক্ষার অবসান হলো ওর। দূরে থাকতেই বুঝতে পারল, আসছে ওর কাক্ষিত জন। থামাতে হবে হাল ফ্যাশনের গাড়িটাকে। অথচ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে, সে-ভয়টাও আছে। অতএব, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল বেকার, মাথার উপরে দু হাত তুলে অভিনয় করছে সাহায্যপ্রার্থীর। প্রবল বেগে নাড়াচ্ছে হাত দুটো।

কাজ হলো। খিস্তি দিয়ে থামতে বাধ্য হলো তরুণ ছোকরা। ।

তেরো

ধূসর, স্যাঁতসেঁতে একটা দিন। খুব বেশি আলো নেই আজ। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলছে এখনও।

সিয়াটল পোস্ট অফিসটা শহরের পুরানো অংশে। বিষণ্ণ চেহারার দালানটার ভিতরে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। রোজকার নিয়মে। কনভেয়র বেল্টে চেপে একের পর এক প্যাকেট আসছে, আর করা হচ্ছে এক্স-রে। মনিটরে চোখ রাখার দায়িত্বে কম বয়সী এক মহিলা। প্রতিটি প্যাকেট চেক করছে, ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে। প্যাকেটের ভিতরে কী-কী রয়েছে, ফুটে উঠছে। মনিটরে।

মেন ইন ব্ল্যাকের তিন নম্বর পার্টটা দেখেছ? জিজ্ঞেস করল পুরুষটি। দেখলাম কাল রাতে। যা একখান টুইস্ট এ দিয়েছে না শেষটায়!

দেখতে হবে। উইলি আছে এটাতে?

আরে, ওর জন্যই তো দেখা!

তা হলে তো দেখতেই- ইয়াল্লা, কী এটা! সটান উঠে দাঁড়িয়েছে মহিলা। বেল্ট পিছাও! বেল্ট পিছাও! বলল সে চিৎকার করে।

নগ্ন আতঙ্ক নিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা।

প-পু-পা!!!

সুপারভাইজারকে ডাকো! সুপারভাইজারকে ডাকো!

৩০২ গলার রগ-টগ ফুলিয়ে গোটা অফিস মাথায় তুলল মহিলার কলিগ।

চোদ্দ

মর্গ। পোস্ট অফিসে পাওয়া পা-টা নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছে প্যাথলজিস্ট লেফটেন্যান্ট, জন, ডিটেক্টিভ, স্মিথ- ওরাও উপস্থিত রয়েছে মর্গে। দাঁড়িয়ে আছে। এগজামিনেশন টেবিল ঘিরে।

কাটা পা-টা থেকে মোজাটা খুলে আনল প্যাথলজিস্ট। লেফটেন্যান্ট থটনের এগিয়ে দেয়া ট্রেতে রাখল মোজাটা।

আশা করছি, জমে শক্ত হয়ে যায়নি মাংস, মনের ভাবগুলো মুখে প্রকাশ করছে প্যাথলজিস্ট। ছত্রিশ থেকে এক শ ঘণ্টার মধ্যে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে পা-টা,  বলল কিছুক্ষণ পর।

এটাও কি রজারসেরই কাজ? আপন মনে মন্তব্য করল গোয়েন্দা। মারা যাওয়ার আগেই করেছে জঘন্য কাজটা?

আরও কাছাকাছি হলো জন। পরিচয় জানা গেছে পায়ের মালিকের?

হুম, জেনেছি। লোয়েল কানিংহ্যাম। অকালে বিপত্মীক হয়েছে ছোকরা।

প্যাকেজের সিল-ছাপ্পড় থেকে কী জানা গেল?

নাথিং। ড্রপ-বক্সে ফেলে যেতে পারে কেউ প্যাকেটটা, বলছে ওরা।

সুন্দর ভাবে কাটা হয়েছে পা-টা,  যেন প্রশংসা করছে, এমনি ভাবে বলল প্যাথলজিস্ট। ঠিক প্রথম তিনটার মতো। একটু পরে মন্তব্য করল, কাটার সময় জীবিতই ছিল ভিকটিম।

আমার মনে হয় না, রজারস করেছে এই কাজ,  মন্তব্য জনের।

তা হলে কে? প্রশ্ন ববের।

অন্য কেউ। মোজাটা দেখি তো!

ময়লা মাখা মোজাটা এগিয়ে দেয়া হলো ওকে।

একটা খাম তুলে নিল জন। মুখটা ফাঁক করে ববের হাতে তুলে দিল খামটা। গ্লাভস পরতে পরতে বলল, আমার ধারণা, ভিকটিম এখনও জীবিত।

মোজাটা তুলে নিল ও ট্রে থেকে। মুখ-খুলে-ধরে-রাখা খামটার ভিতরে ঝাড়তে লাগল ধুলো।

.

ল্যাব। ধুলোর নমুনাটুকু একটা টিউবের মধ্যে ঢোকাল ড্যানিয়েলা শর্ট। এর সঙ্গে দরকারি লিকুইড যোগ করে ছিপি এঁটে সেন্ট্রিফিউজে ঢুকিয়ে রাখল টিউবটা।

পনেরো

মারগট রোবির স্বামীর কোর্ট রেকর্ডগুলো জোগাড় করতে পেরেছে স্মিথ। ডকুমেন্টগুলো ফ্যাক্স করে দিচ্ছে, এই ফাঁকে জনকে ফোন করল অফিসার।

হ্যাঁ, স্মিথ, নিজের বেইসমেন্ট থেকে বলল জন।

পেয়েছ?

পেলাম এই মাত্র। চোখ বোলাচ্ছি এখন। থ্যাঙ্কস আ লট, ম্যান!

আমিও দেখে নিয়েছি এক নজর। মার্কাস নামের ওই জিভ কাটা পুলিস আর মারগট রোবির মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কার করেছি আমি! সাবেক ওই পুলিস অফিসার ছিল মহিলার স্বামীর কেসটার প্রসিকিউশন উইটনেস। লোকটার দেয়া সাক্ষ্য ডগ রোবির বিপক্ষে যায়।

মিথ্যা সাক্ষ্য, খুব সম্ভব। এজন্যই ডকুমেন্টগুলো দেখতে চাইছিলাম আমি।

তা হলে কি ব্যাপারটা এই যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে লোকটার জিভ কেটে পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্যায়ের শিকার মারগট রোবির কাছে? কিন্তু পাঠালটা কে? উদ্দেশ্যটা কী লোকটার?

আমার ধারণা, নিজের থিয়োরি গুছিয়ে এনেছে জন। কেউ একজন চাইছে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে!

ষোলো

মোজা থেকে পাওয়া স্যাম্পলের অ্যানালাইসিস নিয়ে লেফটেন্যান্টের অফিসে দেখা করল ড্যানিয়েলা। সেসময় কিছু একটা নোট করছিল বিলি বব থর্নটন।

সয়েল কম্পোজিশন বলছে, মাটিটা এসেছে জলা অঞ্চল থেকে! উত্তেজিত স্বরে বলতে লাগল মহিলা। কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক সারের অস্তিত্ব নেই মাটিতে। বদলে পেয়েছি ক্র্যানবেরি বীজের নমুনা। বিস্তারিত ব্যাখ্যা করছি না, আমি যেই সিদ্ধান্তে এসেছি, সেটা হচ্ছে: এমন এক ক্র্যানবেরি ফার্ম থেকে এসেছে এই মাটি, যেখানে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে কয়েক বছর ধরে।

শোনো, স্মিথ (এই মাত্র ঢুকেছে সে লেফটেন্যান্টের চেমবারে)! কী বলছেন উনি!

আপনারা কি শাহলান কাউন্টির নাম শুনেছেন?

শাহলান কাউন্টি? বলল বব। নিশ্চয়ই!

এক্ষুনি একটা টপোগ্রাফিক ম্যাপ চাই আমার! ওই ধরনের খামার কোথায়-কোথায় থাকতে পারে, দেখাতে পারব হয়তো।

.

সম্ভাব্য সাইটগুলোর একটিতে চলছে চিরুনি-অভিযান। ধুব ধুব শব্দে কয়েকটা হেলিকপটার চক্কর কাটছে আকাশে। পিপডের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে শেরিফের ডিপার্টমেন্টের ডেপুটিরা। দল আরও ভারি করেছে। লেফটেন্যান্ট বব ও তার লোকজন। আদেশ-নির্দেশ, হাঁকডাকে গোটা অঞ্চল সরগরম।

মাটির দিকে চোখ রেখে অনুসন্ধান করছিল লেফটেন্যান্ট; জুতোর নিচে, ঘাসের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা গোচরে আসতে থামতে হলো ওকে।

তাজা টায়ারের-দাগ সোজা চলে গেছে সামনের দিকে। একজন ডেপুটিকে নিয়ে এগোল ও সেদিকে।

কিছু দূর যেতে-না-যেতেই পুরানো এক অয়েল স্টোরেজ ট্যাঙ্কের সামনে থমকে দাঁড়াতে হলো ওদেরকে।

ট্যাঙ্কের পাশের হ্যাঁচটা খোলার চেষ্টা করল লেফটেন্যান্ট। না পেরে পাশের ঝালাই-করে-জুড়ে-দেয়া মই বেয়ে উঠে গেল ট্যাঙ্কের ছাতে। উপরের গোল ঢাকনাটা খুলতে পারল এবারে।

বোটকা, গুমট একটা গন্ধ ধাক্কা মারল লেফটেন্যান্টের নাকে। চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে ভিতরের আবছা অন্ধকারে উঁকি দিল অফিসার।

অন্ধকার কিছুটা সয়ে আসতে মৃতপ্রায় এক যুবককে আবিষ্কার করল ভিতরে। কাটা পা নিয়ে পড়ে আছে রক্তের মধ্যে।

পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! ডেপুটির উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল লেফটেন্যান্ট। স্ট্রেচার… স্ট্রেচার আনতে বলো জলদি!

ওয়্যারলেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শেরিফের ডেপুটি।

অস্বস্তি উপেক্ষা করে ট্যাঙ্কের ভিতরে নামল থর্নটন। চোখ খোলা আহত যুবকের। গায়ে হাত দিয়ে উপলব্ধি করল, আহত নয়, নিহতই হয়েছে লোকটা!

সতেরো

মর্গ।

কতক্ষণ হলো, মারা গেছে লোকটা? জানতে চাইল বব।

বেশিক্ষণ না, জবাব দিল কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। ঘণ্টা দুই হবে। কিছুটা কমও হতে পারে।

আরও আগেই মারা যেত,  মন্তব্য করল প্যাথলজিস্ট। রক্ত পড়াটা বন্ধ করতে পারায় বিলম্বিত হয়েছে মৃত্যুটা।

ভিকটিমের বেল্ট দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল রক্তক্ষরণ, নিজেকেই শোনাল যেন বব।

কল্পনা করতে পারেন ওই সময়ের অনুভূতিটা? মমতায় ভরে উঠেছে ড্যানিয়েলা শর্টের নারী-হৃদয়। আপনি জানেন, মারা যাচ্ছেন আপনি! ইশশ!

খুব সম্ভব নিজস্ব কোনও তরিকা অনুসরণ করছে খুনি, ধারণা করল জন। শিকারকে তিলে তিলে হত্যা করাটা হয়তো তারই অংশ।

হয়তো কারও কাছ থেকে নির্দেশ পাচ্ছে খুনি, ধারণা জোগাল স্মিথ।

কার কাছ থেকে? জিজ্ঞাসা ববের।

এমন কেউ, একমত জন স্মিথের সঙ্গে। নিজের হাত যে-লোক নোংরা করতে চায় না। কিংবা অভ্যস্ত নয় খুনোখুনিতে। সে কারণে দাগী কাউকে বেছে নিচ্ছে এ কাজের জন্য।

এই সব দাগী আসামীদের চলাফেরার গণ্ডিটা খুব সীমিত,   বাতলে দিচ্ছে স্মিথ। সামাজিক ভাবে অনেকটা একঘরে তারা।

ও কী বলতে চাইছে, বুঝতে পারল জন। বোঝাতে চাইছে, কোথায়-কোথায় হানা দিলে হদিস পাওয়া যেতে পারে কালপ্রিটের।

আঠারো

বেশ কয়েকটা জায়গায় টু মেরে এবারে একটা বার-এ ঢুকেছে। জন আর বব। স্মিথ আর ফ্রিম্যান অপেক্ষা করছে বাইরে, গাড়ির মধ্যে।

নজর রাখার জন্য কোণের একটা টেবিল দখল করল। জন। বব গেল কাউন্টারে। হালকা বাতচিতের ফাঁকে কোনও তথ্য আদায় করা যায় কি না বারটেণ্ডারের কাছ থেকে, সে উদ্দেশ্যে।

বন্ধুর টেবিলে এসে বসল সে কিছুক্ষণ পর। স্বাভাবিক কৌতূহলের ভান ধরে ভিতরে উপস্থিত প্রত্যেককে জরিপ করছে জন। খেয়াল করছে, কে আসছে বাইরে থেকে।

নাহ, লাভ হলো না! হতাশা ব্যক্ত করল বব। মাথামোটা বারম্যানটা হয় কিছুই জানে না, না হয় বলবে না। কিছুই।

দ্বিতীয়টা হলে তো মাথামোটা বলা যায় না ওকে, নাকি? রসিকতা করল জন। এই মাত্র ঢোকা এক কাস্টমারকে অনুসরণ করছে ওর চোখ জোড়া।

কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা কাউন্টারে গিয়ে বসল ব্রেট বেকার।

অনেক তো দেখলাম, আশা নেই লেফটেন্যান্টের কণ্ঠে। মনে হয় না, কাজ হবে এভাবে। এর চে রিলিজ আর প্যারোল রেকর্ডগুলো চেক করাটাও বেটার।

আপাতত না। চলো, উঠি।

টেবিল ছাড়ল ওরা দুজনে। দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, জনের চোখ আটকে গেল একটা আয়নায়। দেখতে পেল; ওর পিঠের উপর সেঁটে রয়েছে মাত্র আসা লোকটার চোখ জোড়া।

.

বার-এর বাইরে, গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছে ওরা।

কেন মনে হচ্ছে তোর, ওই লোককেই খুঁজছি আমরা?

ঘাড়ের পিছনটা খেয়াল করেছিস ওর? উল্কিটা?

না। তো?

একটা সংখ্যা ওটা। চোদ্দ। সাধারণত সংখ্যা দিয়ে ট্যাটু করানোর প্রবণতা থাকে কয়েদিদের।

এবারে আর জনের কথা ফেলতে পারল না বব।

.

ওরা যখন কথা বলছে, সেসময় ব্রেট বেকারও আলাপ সারছে। ফোনে ওর নিয়োগকর্তার সঙ্গে।

হাবেভাবে আইনের লোক মনে হচ্ছে ওদের,  জানাল বেকার। কী করব, স্যর?

ভয় পেয়ো না। লক্ষ করেছে ওরা তোমাকে?

করেছে, মনে হয়।

হুম। যদি সন্দেহ করে থাকে তোমাকে, ধরে নিয়ে যাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আর যদি না নেয়, বুঝতে হবে, ফলো

করবে। ওকে। যা বলি, শোনো…

.

আর অপেক্ষা করতে পারছি না! বলল ধৈর্যহারা বব।

বেরোয় না কেন ব্যাটা? স্মিথ, দেখো তো!

সন্দেহভাজনের বর্ণনা পেয়েছে, গাড়ি থেকে নেমে বার-এ ঢুকল অফিসার। ডিটেক্টিভ ফ্রিম্যানও সঙ্গ নিয়েছে তার।

কোথাও দেখতে পেল না ওরা লোকটাকে। শেষে রেস্টরুম চেক করতে গিয়ে টের পেল, ভেন্টিলেটর গলে পালিয়ে গেছে পাখি।

.

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বার। এখনও বসে রয়েছে ওরা গাড়িতে। ফিরে এসে জানিয়েছে স্মিথরা, ফাঁকি দিয়েছে ওদের লোকটা। এতে আরও নিশ্চিত হয়েছে জন, ওই লোকই জড়িত খুনগুলোর সঙ্গে।

এখনও বসে আছি কী জন্য? বিরক্তি ঝরাল বব।

বোঝার জন্য। হাসল জন ঠোঁট টিপে।

কী বোঝার জন্য?

ওই যে, দেখ… এক-এক করে বেরিয়ে গেছে সবাই বার থেকে। অথচ একটা গাড়ি রয়ে গেছে এখনও বাইরে। কার ওটা? বারটেণ্ডারের? অসম্ভব। এত দামি গাড়ির মালিক হতে পারে না, লোকটা। তা হলে কি আমাদের সন্দেহভাজন? সেটাও পানি পায় না হালে… যদি না অন্য কারও গাড়ি ব্যবহার করে থাকে সে। ওকে যে নিয়ন্ত্রণ করছে, ধর, যদি তার গাড়ি হয়?

চোরাই গাড়িও তো হতে পারে। ভুয়া হতে পারে নাম্বারপ্লেট।

দেখা যাক।

উনিশ

গাড়িটার রেজিস্ট্রেশন যেখানে নিয়ে এল ওদের, সেটা একটা শুয়োরের খামার।

খামার-মালিকের দরজায় নক করল লেফটেন্যান্ট। দরজা খুলে যেতেই ব্যাজ দেখাল। লেফটেন্যান্ট বিলি বব থর্নটন। সিয়াটল পিডি। কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল আপনাকে।

অফিসারের ঘাড়ের উপর দিয়ে সামনে চাইল বিচারক।

ব্যাক-আপ টিম নিয়ে এসেছে বব।

আসুন, স্মিত হেসে বলল বাড়ির মালিক।

তার চেয়ে ভালো হয়, আপনিই যদি আমাদের সাথে আসেন।

.

সিয়াটল পাবলিক সেফটি বিল্ডিং-এর ইন্টেরোগেশন রুমে জেরা করা হচ্ছে বিচারককে।

চেনেন একে? টেবিলের উপর দিয়ে একটা ফোটোগ্রাফ ঠেলে দিল লেফটেন্যান্ট।

রক্তাক্ত স্থির চিত্রটা দেখল বিচারক। চিনি। স্টিভ। লাস্ট নেম জানি না, জিজ্ঞেস করিনি কখনও। শুয়োরের দেখাশোনা করার জন্য ভাড়া করেছিলাম ওকে। লোকটা ড্রিফটার, এবং অ্যালকোহলিক।

তারপর? কোথায় এখন সে?

ছবিতে। আঙুল দিয়ে দেখাল বিচারক। মারা গেছে, মনে হচ্ছে।

রসিকতা করবেন না। আমি জানতে চাইছি, ওকে কি, তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আপনি? থাকত কোথায় লোকটা?

যত দিন আমার ওখানে কাজ করেছে, থাকত আমার সাথেই। তারপর কোথায় গেছে, বলতে পারব না।

আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, আপনার এই ভাড়াটে একটা খুনের সাথে জড়িত। ক্রিস্টোফার মার্কাস নামে এক লোককে খুন করেছে সে। নামটা কি পরিচিত লাগছে?

লাগছে না।

স্টিভ রজারসের ছবিটা সরিয়ে নিয়ে নতুন একটা ছবি দেখানো হলো বিচারককে। এটা?

ব্রেট।

আরেক জন ভাড়াটে?

সে?

ভাগলওয়া।

কিছুক্ষণ পর। রুষ্ট চেহারা নিয়ে সাউণ্ডপ্রুফ কামরাটা থেকে বেরিয়ে এল বব। ঘড়েল মাল শালা!

ওয়ান-ওয়ে মিরর দিয়ে সবই দেখেছে জনরা। স্পিকারের মাধ্যমে শুনতে পেয়েছে ভিতরের কথাবার্তা।

ছেড়ে দিতেই হচ্ছে! মলিন চেহারা করে বলল লেফটেন্যান্ট।

বিশ

ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। বিচারকের খামারের অদূরে, এক ঢিপির আড়ালে ঘাপটি মেরে রয়েছে জন আর বব। নাইটভিশন দুরবিন দিয়ে নজর রাখছে বাড়িটার উপরে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই ঘটল না।

তোর কথা শুনে আসাই উচিত হয়নি এখানে! গজগজ করল বব। শরীরের অর্ধেক রক্তই তো নাই করে দিল ভ্যাম্পায়ার শালারা!

পরে অন্য রকম মনে হবে। এখনও দৃঢ় বিশ্বাস আমার, ওখানেই রয়েছে ব্রেট বেকার।

বেকার মানুষ, কই আর যাবে!

যাচ্ছি। উঠে দাঁড়াল জন আড়াল ছেড়ে।

যাচ্ছি মানে?

গিয়ে দেখি। কাছাকাছিই থাকিস। কাভার দিস কিছু হলে। বন্ধু আপত্তি করার আগেই বাড়িটার দিকে হাঁটা দিল। জন।

.

ঘোঁত-ঘোঁত করছে শুয়োরের দল। সতর্ক পদক্ষেপে গোটা বাড়ি এক চক্কর ঘুরে এল জন। ঘুমিয়ে পড়েছে বাড়ির মালিক। নাকি নেই বাড়িতেই? রাতটার মতোই অন্ধকারে ডুবে আছে একতলা দালানটা।

দেখা দরকার। ভিতরে ঢুকবে বলে মনস্থির করে ফেলল। জন। আগের চাইতেও ধীর পায়ে এগোল ও বন্ধ দরজাটার দিকে।

নব ঘুরিয়ে বুঝল, দরজাটা খোলা। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে উঠল ওর সমগ্র সত্তা।

পুরোপুরি অন্ধকার ভিতরটা। এবং নীরব। না… ক্ষীণ শব্দ আসছে… বোধ হয় কিচেন থেকে। ক্ষীণ আলোও বুঝি রয়েছে ওখানে।

পায়ে পায়ে এগোল জন রান্নাঘরের দিকে।

ব্রেট বেকার। একটা বিয়ারের ক্যান হাতে। এক চুমুকে অবশিষ্ট তরলটুকু শেষ করল বেকার, মুঠোর মধ্যে ভর্তা বানাল ক্যানটাকে, তারপর ঠাস করে মেঝেতে আছাড় মারল ওটা। নীরব রাতে পীড়াদায়ক ভাবে কানে আঘাত করল শব্দটা।

পুলিস তুমি? একটুও যেন অবাক হয়নি বেকার। আগন্তুককে দেখে। যেন জানতই, আসবে জন।

না, পুলিস নই আমি,  সাবধানে উত্তর দিল জন। একজন সাধারণ নাগরিক।

আমার মতোই।

আরেকটা বিয়ারের জন্য রিফ্রিজারেটরের কাছে হেঁটে গেল বেকার। খোলা ফ্রিজের আলোয় দেখা গেল, ঊর্ধ্বাঙ্গে শার্ট নেই লোকটার। বাহু আর বুক উল্কি আর কাটাকুটিতে। ভর্তি। নতুন কাটাগুলো। শরীরের এখানে-সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত।

নতুন একটা ক্যান খুলল বেকার। দীর্ঘ একটা টান দিল বিয়ারে।

খুঁজছ কাউকে? জিজ্ঞেস করল হাতের চেটোয় মুখ মুছে।

এই বাড়ির মালিককে। কোথায় সে?

সর্বত্র।

কথাটা বিশ্বাস করেই যেন চারপাশে তাকাল জন। তারপর নিজের বোকামি বুঝতে পেরে বলল, বুঝলাম না তোমার কথা।

নিজেকে ঈশ্বরের সমকক্ষ মনে করে শালা। ভাবে, সর্বত্র বিরাজমান সে।

নাগালের মধ্যে লাইটের সুইচ পেয়ে টিপে দিল জন।উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল কিচেন।

পালানোর রাস্তা নেই তোমার, বেকার।

পালাব না। কাঁধের উপর দিয়ে ঠাণ্ডা বিয়ার পিঠে ঢালল বেকার। বাড়ি ফিরে যেতে চাই আমি।

বাড়ি!

জেলখানা।

এত কাটাকাটি হলো কীভাবে?

ও কিছু না। কাজ করতে গিয়ে কেটে গেছে।

নতুন কথা খুঁজছে জন। ট্যাঙ্কের ভিতরের ছোকরাকে তুমিই খুন করেছ?

ওকে এবং আরেক জনকে।

স্টিভ রজারস?

বুলস আই!

মালিক কোথায় তোমার? আবার জিজ্ঞেস করল জন।

সে আমার মালিক নয়! রাগে জ্বলে উঠল ব্রেট বেকারের ভাসা ভাসা চোখ জোড়া।

এই বাড়ির মালিক… কোথায় সে?

শুয়োরের বাচ্চাকে জায়গামতো পাঠিয়ে দিয়েছি! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল বেকার।

হঠাৎ কেমন একটা আশঙ্কা হলো জনের। তুমি কি… তুমি কি…

বিচিত্র হাসল বেকার। অসুস্থ মানুষের ভীতিকর হাসি।

কেউ কি জানে, আমি একজন সাইকোপ্যাথ?

বিমূঢ় হয়ে পড়ল জন। সাইকোপ্যাথরা বুঝতে পারে না যে, সাইকোপ্যাথ তারা! বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল ও।

আমি ব্যতিক্রম, গর্বিত কণ্ঠ বেকারের।

.

আধঘণ্টা পর। পুলিসে লোকারণ্য শুয়োরের খামারটা। ক্রাইম-সিন টেপ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে গোটা এলাকা। একের পর এক ছবি নিচ্ছে পুলিসের ফোটোগ্রাফাররা। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে আলোকিত করা হয়েছে খামারবাড়ির চতুর্দিক।

হাতকড়া পরিয়ে পুলিস-কারে তোলা হয়েছে বেকারকে। আক্ষেপ করল লেফটেন্যান্ট, পালের গোদাটা পালিয়ে গেল!

মনে হয় না, এখন নিশ্চিত জন।

মানে?।

ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ ভেসে আসছে খোয়াড় থেকে। কানে বাজছে জনের: শুয়োরের বাচ্চাকে জায়গামতো পাঠিয়ে দিয়েছি!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। খোঁয়াড়ের মাটিটা খোঁড়ার ব্যবস্থা কর।

জানে ও, কী পাবে ওখানে। নিশ্চিত, ভুল নয় ওর অনুমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *