অশনি সঙ্কেত

অশনি সঙ্কেত

দেখে মনে হবে, গোধূলি। আসলে, তা নয়। থোকা থোকা মেঘে ভারাক্রান্ত মনে হয় আকাশটাকে। চিরস্থায়ী লাল রং ওখানে। নিচের জমিনে আকাশের সেই লালেরই প্রতিফলন। কেমন অপ্রাকৃত রং। যেন পশু জবাই করে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে রক্ত চরাচর জুড়ে।

পাহাড়ি অঞ্চল। লালচে-কালো অসুস্থ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে এবড়ো-খেবড়ো, চোখা আকৃতির অসংখ্য পাহাড় যত দূর চোখ যায়। নিচের উপত্যকায় অশুভ অন্ধকার। না হলে দেখা যেত, লাল ধুলো ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে নাম না জানা বিশালাকার প্রাণীর সাদা হাড়, করোটি, বক্ষপিঞ্জর। হাঁ। হয়ে থাকা মুখে সারি সারি দাঁত দেখে মনে হবে, কুটিল হাসি হাসছে মৃত প্রাণীগুলো।

আর… সর্বত্র চোখে পড়ে চলমান ছায়া। অন্ধকারের জীব ওগুলো।

হু-হুঁ করে বাতাস বইছে। বিচিত্র সুর তুলেছে পাহাড়ে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে। জোরাল মন্ত্রোচ্চারণের মতো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে-আওয়াজ।

কে জানি কাঁদছে কোথায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না, সুরটা নাকি।

দীর্ঘ এক মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসে পাথুরে এক মালভূমির চূড়ায়। কিনারার কাছে দু হাতে ভর রেখে ঝুঁকে আছে। সামনে। নিচে অতল খাদ।

চওড়া, ঢালু কপাল ছায়ামূর্তির। যেন পাথর কুঁদে বের করে আনা হয়েছে। চুল নেই। ভুরু নেই। কানে বড় বড় মাকড়ি। লম্বাটে গ্রীবা থেকে ঝুলছে হাড়ের মালা। সামনের দিকে বাঁক নেয়া চিবুকটা চেহারাটাকে ভয়াবহ করে তুলেছে আরও। বাঁকা চাঁদের মতো কাস্তে গোঁজা কোমরে। উদোম গায়ে আঁকিবুকি।

রক্তগোধূলির ছটায় জ্বলজ্বল করছে কাস্তেধারীর অস্বাভাবিক বড় চোখ জোড়া।

দুই

বড্ড আওয়াজ করে এই ফ্যানগুলো- ঘটাং-ঘট… ঘটাং-ঘট…

চার-চারখানা বৈদ্যুতিক পাখাতেও দূর হয় না চৈত্রের ভাপসা দিনের গুমট। একঘেয়ে ঢিমে-তানে ক্লান্তি বরং জমাট বাঁধে আরও।

পুরানো এই দালানটার মতোই পুরানো এই ফ্যানগুলো। কদ্দিন পরিষ্কার করা হয় না, কে জানে। ব্লেডে সাত জনমের ধুলো।

কিচ্ছু নেই… কালিঝুলি মাখা নিরানন্দ এই ক্লাসরুমগুলোতে একটা কিছু উপকরণ নেই মন ভালো হওয়ার।

মনটা পালাই-পালাই করছে অরণ্যর। সবারই বোধ হয় করে। লাঞ্চ-টাইমের পরের পিরিয়ডগুলো শেষ যেন হতেই চায় না! তার উপর রয়েছে দায়সারা গোছের বোরিং লেকচার। ঝিমুনি এসে যায় শুনতে শুনতে। চোখ জ্বালা করে ওঠে। চেয়ার-টেবিলের সস্তা কাঠ নিবিষ্ট মনে চিবোতে থাকে ঘুণ পোকা।

ইচ্ছা করলে ফাঁকি দেয়া যেত- একে অখ্যাত কলেজ, তায় সরকারি- কিন্তু এমন জায়গাতেও কীভাবে-কীভাবে যেন জুটে যায় দু -একজন, ডিসিপ্লিনের নামে যারা ছাত্র-ছাত্রীদের জান একেবারে ভাজা-ভাজা করে ফেলে। পড়ানোর বেলায়। লবডঙ্কা, কিন্তু নিয়মকানুন কড়া ওদের। ক্লাসে মনোযোগ না দাও- থোড়াই কেয়ার খবর আছে, যদি অ্যাটেণ্ড্যান্সের খাতায় লাল কালির দাগ পড়ে!

পুরোটা কামরায় অলস চোখ জোড়া বুলিয়ে আনল অরণ্য। স্যরকে এড়িয়ে গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফাসুর চলছেই। ওর পাশের বন্ধু সাউণ্ড মিউট করে পর্নো দেখছে মোবাইলে।

স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে সেঁতো হাসি হাসল জুনায়েদ। টিপে দিল ডান চোখটা।

অরণ্যর মনটা ছেয়ে গেল বিতৃষ্ণায়। হতাশ শ্বাস ফেলে ঘাড় ফেরাল বিপরীত দিকে।

জানালা এপাশে। সবচেয়ে পিছনের, দেয়ালের দিকের এই সিটটা এ কারণেই এত প্রিয় ওর। দম বন্ধ করা পরিবেশে সামান্য স্বস্তি।

উজ্জ্বল রোদের পটভূমিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, জানালার গোবরাট ধরে মার্চ করে চলেছে কালো পিঁপড়ের বাহিনী।

মরচে পড়া মোটা লোহার গরাদে পেরিয়ে দৃষ্টি চলে গেল। বাইরে।

জঙ্গলমতো হয়ে আছে এদিকটায়। কলেজেরই প্রপার্টি। মালি-টালি নেই বলে এ অবস্থা। গোটা শহরতলিটাই এমন। অতি পুরানো এলাকাটা। বিবর্ণ সব দালানকোঠা।

কলেজের ক্ষয়া সীমানা-পাঁচিলের উপরে রোঁয়া ওঠা বাদামি বিড়াল একটা। হুলো। গোশত নেই গায়ে খেতে পায় না বোধ হয়। ইকড়ি-মিকড়ি ছায়ার নিচে নেতিয়ে পড়ে। আছে হতক্লান্ত, ক্ষুধার্তের মতো। ভরদুপুরের গরমে শ্রান্ত। C ইলেকট্রিকের তারে আটকে ঝুলছে একটা কাক অনেক দিন থেকেই। মরে, শুকিয়ে অপরিপুষ্ট লাউয়ের মতো দোল খায় বিষণ্ণ বাতাসে।

পাঁচিলের ওপাশে নির্জন গলি। রাস্তাটার ওদিকে দোকান একটা- এক কালে ছিল আর কী। এখন বহু বছর ধরে শাটার নামানো। ৭ অরণ্য একদিন গিয়েছিল ওই গলিটায়। কৌতূহল, আর কিছু নয়। দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল রং জ্বলা সাইনবোর্ডটা। Dacca ছাড়া বুঝতে পারেনি কিছুই। আরেকটা জিনিস বুঝেছে। কত আগের চিহ্ন ধারণ করে ঘুমিয়ে গেছে দোকানটা।

গিরিবাজ পায়রার একটা ঝাঁক আচমকা ঝটপট আওয়াজ তুলে উড়াল দিল আকাশে। সেদিকে চেয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরণ্য। আহা, কত না স্বাধীন ওরা! ·

তিন

বড় রাস্তায় পড়ল অরণ্য। কাঁধে ব্যাগ। বাঁ হাতে একটা ডায়েরি। ওটাকে শরীরের পাশে রেখে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছে ও। মিনিট পনেরো আর লাগবে বাসায় পৌঁছোতে।

পড়ন্ত দুপুর। ক্লান্তিকর পাঁচটা ক্লাসের পর এনার্জি বলে কিছু থাকার কথা না শরীরে। কিন্তু হয়েছে উলটো। আগের চাইতে তাজা লাগছে ওর নিজেকে। ক্লাসরুম নামের কারাগার থেকে মুক্তির ফল।

লোকজন কম রাস্তায়। গাড়িঘোড়াও নেই তেমন। ফাঁকা রাস্তায় একটা বাস কান ঝালাপালা করা আওয়াজে হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বিচ্ছিরি! অনর্থক। এই অসময়েও মাইক ফাটিয়ে ওয়াজ হচ্ছে কোথায় জানি। মসজিদে না। সম্ভবত ভ্রাম্যমাণ কোনও ধর্মীয় সিঁড়ি বিক্রেতার ভ্যান-গাড়িতে।

ময়লার ডিপোর কাছাকাছি হতেই নাক কুঁচকে ফেলল অরণ্য। অর্ধেকটা রাস্তা দখল করে ফেলে রাখা হয়েছে বড় বড় চার-পাঁচটা কন্টেইনার। কিন্তু আবর্জনার বেশির ভাগটাই বাইরে। পরিচ্ছন্ন-কর্মীরা প্রফেশনালিজমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে রেখেছে, বর্জ্য ঘাটাঘাটি করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার; এদিকে জনগণের প্রাণ যে ওষ্ঠাগত, সেদিকে নজর নেই কারও।

স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা পেরোনোর সময় পচা-গলা গন্ধে বমি আসার জোগাড় হলো ওর। শ্বাস চেপে রেখেও রেহাই নেই- এমনই তীব্র দুর্গন্ধ! কয়েকটা কাক নোংরা খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। থেঁতলে যাওয়া মরা একটা বিড়ালের নাড়িভুড়ি নিয়ে হুটোপুটি লাগিয়েছে কতগুলো ঘেয়ো কুকুর। নরক আরও গুলজার করে তুলেছে নীল মাছির ঝাঁক।

পালিয়ে বাঁচল অরণ্য।

একটা মোড় এরপর। একটু এগোতেই টিভির একটা শো-রুম। বিক্রিবাট্টা ভালো- এমনটা কখনওই মনে হয়নি ওর।

দোকানটার পাশ কাটিয়ে গিয়েও কী ভেবে ফিরে এল আবার।

লাস্যময়ী মেয়েটা। কী যেন নাম… ও, তানহা মেহজাবিন। যত বারই দেখেছে ওকে, প্রত্যেক বারই মনে হয়েছে অরণ্যর, আপত্তিকর কিছু আছে এ-মেয়ের চোখে। সারাক্ষণই চোখ হাসছে ওর নষ্টামির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তাতে। শরীর দেখানোর সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা তো রয়েছেই।

কর্পোরেট বেশ্যা! মনে মনে গাল দিল অরণ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে খেয়াল হলো ওর, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ পড়ছে তানহা। বুঝতে পারল টিভি-স্ক্রিনে খবরের হেডলাইন দেখে। আরে, ধরা পড়েছে ফারজানা মিতার খুনি!

ডিটেইলস জানার জন্য আঁকুপাঁকু করে উঠল ওর মনটা। কিন্তু উপায় কী! ফুটেজে চলে গেছে চ্যানেল।

…না, আছে উপায়। দোকানের ডিসপ্লেতে উপরে-নিচে সারি দিয়ে রাখা সবগুলো টিভিতেই খবর দেখাচ্ছে। এক একটায় এক-এক চ্যানেল। বাঁচোয়া। এই মাত্র এক পাঠক পড়তে আরম্ভ করেছে নিউজটা…

ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ডান কানে আঘাত পেয়েছিল অরণ্য। বছর খানেক বেশ ভুগেছে এজন্য। কম শুনত কানে। একটাতে কোনও গণ্ডগোল হলে আরেকটাও নাকি কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠেকায় পড়ে লিপ রিডিং শিখে নিয়েছিল তখন। সেই জ্ঞান কাজে লাগছে এখন। এ মুহূর্তে ওর সমস্ত মনোযোগ সংবাদ পাঠকের ঠোঁটের দিকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

চাঞ্চল্যকর সংবাদ! বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রী ফারজানা মিতার অভিযুক্ত খুনি আজ সকালে পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। শ্রীমঙ্গলের কলেজ রোড এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সী ফারজানাকে ধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে জবাই করে হত্যার অভিযোগে খুনি নাজিমুদ্দীন হিকমতকে পুলিস কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে…

চার

আচ্ছা, কবুতরগুলো উড়ে গেল কেন ওভাবে?

এ পাড়ার জহিরুল ইসলাম মিঠু নামে এক ভদ্রলোকের পোষা ওগুলো। নির্জন বলে প্রায়ই আসে কলেজের এপাশটায়; বুনো ফল, দানা-টানা খায়, পোকা-মাকড়ও রয়েছে বিস্তর। কিন্তু এভাবে তো কোনও দিন উড়াল দেয় না জানালা ঘেঁষে!

ভয় পেয়েছে?

কেন? কীসের?

জুনায়েদের দিকে ঘাড় ফেরাল অরণ্য। হারামিটা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে। কী দেখছে, দেখার রুচি হলো না ওর।

না, কিছুই টের পায়নি ও- দেখা দূরে থাক। পাশ দিয়ে ডাইনোসর গেলেও একবার চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিত। ওর এক মাত্র আগ্রহ নিষিদ্ধ জিনিসে।

অরণ্যর খেয়াল হলো এখন, ভোঁতা একটা আওয়াজ শুনেছিল না পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আগে! থ্যাপ করে একটা শব্দ?

দেখতে হয়… কিন্তু জায়গা ছেড়ে ওঠার উপায় নেই এখন।

কবজি উলটে ঘড়ি দেখল ও। আরও অন্তত কুড়ি মিনিট। পর্যাবৃত্তিক গতি পড়াচ্ছেন নঈম স্যর। দু -এক লাইন শুনেই আগ্রহ হারাল অরণ্য। উসখুস ভাব নিয়ে চাইল। জানালার দিকে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিকের মতো মনের মধ্যে বেজে উঠল হেমন্তের গান: পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব, মা গো, বলো, কবে শীতল হব… কত দূর… আর কত দূর…।

কিন্তু ম্যারাথন রানারের দৌড়ও শেষ হয় এক সময়। ফিজিকস স্যর দরজার দিকে এগোতেই জানালায় গিয়ে হামলে পড়ল অরণ্য।

পাঁচ

জীর্ণ দালান। হলদে ডিসটেম্পার চটে গেছে কবেই। পশ্চিমের এপাশটায় সচরাচর পা পড়ে না কারও। বড় বড় ঘাস হয়ে গেছে। রোদ আছে, ছায়া আছে। আকাশ ছোঁয়ার নিষ্ফল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মাথা তুলেছে গগন শিরীষ গাছ। বাতাসে মদির গন্ধ।

দোতলা থেকে মনে হচ্ছিল- ডায়েরি। তা-ই মনে হচ্ছে এখনও। খয়েরি রঙের মলাট- চামড়ার? আসল চামড়া, নাকি রেক্সিন- হাতে নিলে বোঝা যাবে।

ঘাসের উপর পড়ে থাকা ডায়েরিটার দিকে এগোতে। এগোতে ঘাড় উঁচু করে তাকাল অরণ্য। ঘষা কাঁচের মতো আকাশ দেখছে।

কোত্থেকে এল জিনিসটা? যেরকম থ্যাপ করে আওয়াজ হলো, মানেটা দাঁড়ায় পড়েছে বেশ উপর থেকেই। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই এই বিল্ডিং থেকে নয়। ওদের কলেজটা দোতলা। আর দালানের পিছন দিকের শেষ কামরাটাই ওদের। ডায়েরিটা পড়েছে জানালার বাম, ধার দিয়ে।

ছাত থেকে? হালে পানি পাঁয় না। কিন্তু কাছাকাছি আর কোনও উঁচু বাসা-বাড়িও তো নেই!

একটাই অর্থ এর: জিনিসটা পড়েছে আকাশ থেকে।

কীভাবে সম্ভব, সেটা নিয়ে আর ভাবতে চাইল না অরণ্য। দাঁড়িয়ে রয়েছে ডায়েরিটার সামনে। টিপ-বোতাম দিয়ে কাভার আটকানোর ব্যবস্থা রয়েছে ডায়েরিটায়।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঝুঁকল ও। জিনিসটা স্পর্শ করতেই শক খেল যেন বিদ্যুতের! ঝটকা মেরে সরিয়ে আনল হাতটা। কী হচ্ছে এসব! এ কেমন আজব ব্যাপার-স্যাপার!

সময় লাগল ধাতস্থ হতে। ফের ধরবে কি ধরবে না, ভাবনার ঝড় চলছে। শেষমেশ জয় হলো কৌতূহলেরই।

কাঁপা হাত বাড়াল অরণ্য। সতর্ক এবারে। ভয়ও লাগছে কিছুটা।

আঙুল ছুঁইয়েই সরিয়ে নিল ঝট করে। কই, এবার তো হলো না কিছু!

সাহস পেয়ে হাতে তুলে নিল ডায়েরিটা। সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র এক শিহরণ বয়ে গেল ওর গোটা দেহ জুড়ে। ঝিমঝিম করে উঠল মাথাটা। ফেলে দিতে গিয়েও আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে রাখল জিনিসটা।

ডায়েরিটা খসখসে, আবার রোমশ ভাবও রয়েছে যেন। কী প্রাণীর চামড়া, বুঝতে পারল না অরণ্য। গাছের পাতার গায়ে যেরকম সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরা থাকে, এখানেও তা-ই। …অদ্ভুত!

।দেখল উলটে-পালটে। মোটাসোটা বেশ। সাধারণত ডায়েরির উপরে যেসব কথা লেখা থাকে- সাল কিংবা কোম্পানির নাম- সেরকম কিছুই নেই। সোনালি ধাতব ক্যাপ দিয়ে মুড়ে দেয়া কোনাগুলো।…বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানানো নয় তো? ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তৈরি?

বোতামটায় আঙুল বোলাচ্ছে অরণ্য। মসৃণ, সাদাটে জিনিসটা কীসের তৈরি? হাড়?

আটকানো নয় বোতামটা। ভিতরে কী দেখবে, ভাবতে ভাবতে ডায়েরিটা খুলল ও কম্পিত হস্তে।

.

টিভির শো-রুমের সামনে থেকে সরে এল অরণ্য। শক্ত করে। চেপে ধরেছে ডায়েরিটা।

ছয়

প্রায় আধ হাত সমান রক্তলাল জিভটা বাতাস চাটছে লকলক করে, এবারে সেটা সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল মুখের মধ্যে। গলার ভিতর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বের করল পিশাচী।

তীব্র সে আওয়াজে জেগে উঠে ধড়মড় করে উঠে বসল অরণ্য।

ঝনঝন করছে মগজটা। চিত্তারের রেশ এখনও রয়ে গেছে মনের মধ্যে। মুহূর্ত পরে উপলব্ধি করল, চিৎকারটা আসলে নাইটগার্ডের বাঁশি।

কত হলো রাত?

সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল জবাবটা। ওর দাদার আমলের পেণ্ডুলাম-ঘড়ি ঢং-ঢং শব্দে জানিয়ে দিল- দুটো।

অস্থিরতা। সেই যে বিকেল থেকে শুরু হয়েছে, কাটবার নাম নেই এখনও। বাড়ছেই বরং উত্তরোত্তর। …সহজে দূর হচ্ছেও না এ অস্থিরতা… যদি না… যদি না কয়েকটা প্রশ্নের জবাব মেলে।

হাতড়ে মিনারেল ওঅটরের বোতলে রাখা, পানি খেল। অরণ্য। তারপর দৃষ্টিহীনের মতো আঁধারে হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ঠেকল পড়ার টেবিলটার কিনারে।

ক্লিক শব্দের সঙ্গে জ্বলে উঠল রিডিং ল্যাম্প।

ব্যাগের ভিতর থেকে ডায়েরিটা বের করল অরণ্য। চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল টেবিলে।

অন্ধকারের মাঝে, এক চিলতে আলোর নিচে উন্মুক্ত হলো রহস্যময় দিনলিপি।

না, সাধারণ ডায়েরির মতো কোনও দিনপঞ্জি নয় এটা। নেই আগে-পিছে কোনও ধরনের ইনডেক্স। একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়েছে লেখা- এমন কী লাইন-টানাও নয় পাতাগুলো, তার পরও আঁকাবাঁকা হয়নি একটুও। ডায়েরির মতো দেখালেও আসলে খাতা এটা।

ফাউন্টেন-পেনের লেখা সময়ের আবর্তনে কালো থেকে যেরকম বাদামি হয়ে আসে, কালির রঙটা ঠিক সেরকমই। তুলট কাগজের মতো হলদেটে ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো।

ইন্টারনেটে দেখা ভিঞ্চির কোডেক্স লেসটারের ছবি ভেসে উঠল অরণ্যর মনের মধ্যে।

কোনও রকম শিরোনাম ছাড়াই শুরু হয়েছে লেখা:

যার নাম একবার লেখা হবে এ-খাতায়, মরণ তার অবধারিত।

হাহ, হাস্যকর ব্যাপার! কোন্ পাগলে বিশ্বাস করে এসব? হয় নাকি এরকম? বিকেলের ভাবনাটাই মাথায় ফের হানা দিল ওর। এ তো দেখছি ফেসবুকের চেইন-পোস্টের মতো: এই পোস্ট যে শেয়ার করবে, সাত দিনের মধ্যে সুসংবাদ পাবে।…এত সোজা?

কেবল নাম লিখলেই কাজ হবে না অবশ্য; যার নাম লেখা হচ্ছে, কল্পনা করতে হবে তার চেহারাটাও। কারণ, একাধিক মানুষ থাকতে পারে একই নামে। থাকেও। ঠিক কোন জনের মৃত্যু চাইছে, সেটা নির্দিষ্ট করার জন্য হতভাগ্যের মুখটা ফুটিয়ে তুলতে হবে লেখকের মনের পরদায়।

ধুস… প্র্যাকটিক্যাল জোক!

কী উপায়ে মারতে চায়, চাইলে সেটাও লিখে দিতে পারে লেখক।

দিলে?

কারও নাম খাতায় তোলার চল্লিশ সেকেণ্ডের মধ্যে মৃত্যুর কারণটা লেখা হলে সেভাবেই মারা যাবে ব্যক্তিটি। যদি নাম ছাড়া অন্য কিছুই লেখা না হয়, মৃত্যু ঘটবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।

গাঁজা! ভূমিকাটা এখানেই শেষ। পৃষ্ঠা ওলটাল অরণ্য।

এরপর নাম রয়েছে। একটার পর একটা… একটার পর একটা…

আমুর ফাতি। কোন দিশি নাম এটা? ছেলে, না মেয়ে? মিস্টি মাইলস। জেভিয়ার জু। লিং লেসলি। বজ্রপাত। জামাল জ্যারেট। ডোমেনিক ডিলরেনজো। ফুড-পয়জনিং।

ফাল্গুনী মাহতানি। সিঁড়িতে পা পিছলে মৃত্যু। তারেক বিন রফিক (রাজু)। অ্যালার্জিজনিত শ্বাসকষ্টে ভুগে।

সিধু সিং।

অপূর্ব ভট্টাচার্য।

অ্যানা নিকোল স্মিথ। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে। এহ!

এরপর আরও নাম… আরও নাম… ফালতু! সময় নষ্ট বেহুদা! কিন্তু পনেরো সেকেণ্ডের মাথায় এই অরণ্যকেই দেখা গেল আঙুলের ডগায় বলপয়েন্ট নাচাতে। শেষমেশ লিখল ও… শেষ নামটার শেষে:

নাজিমুদ্দীন হিকমত

 কল্পনায় ভাসছে টেলিভিশন-ফুটেজে দেখা চেহারাটা…

সাত

নিজের ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে বাইরে এল অরণ্য। মিষ্টি একটা ঘুম-ঘুম আলস্য ওর দু চোখে। হাই তুলল। চিলতে এক বারান্দা রয়েছে ওদের। পায়ে পায়ে চলে এল সেখানে।

ধূসর গম্ভীর এক ছায়া ঢেকে রেখেছে বাড়িটাকে। ভোরের আবেশের মতো। কিন্তু ভোর নয় এখন। সকাল পেরিয়েছে আটটা। আকাশে কি মেঘ করেছে তবে? না, তা-ও নয়। আসলে, এঁদো এই গলিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না সহজে। সেজন্যই বারান্দার কোনায় রাখা টবের আগ্রাসী শিম গাছের পাতায় হলদে ছোঁয়া। মলিন ইট-কংক্রিটের খাঁচাগুলোর ফাঁক-ফোকর চুঁইয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে ঝিরঝির করছে পাতাগুলো। কার্নিশ থেকে একটা দোয়েল ডেকে উঠল গলায় সবটুকু দরদ ঢেলে।

সদ্য রচিত এক লাইন কবিতা আওড়াল অরণ্য মনে মনে:

ধুলোর শহরে কে পাঠাল সাগরপারের হাওয়া?

মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে ড্রইং রুম থেকে। কথার। আওয়াজ। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল অরণ্য। পরক্ষণেই খেয়াল হলো, ওর- ও, আজ তো শুক্কুরবার। শুক্রবার সকালে টিভিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম দেখেন ওর আব্বু।

বারান্দা ছেড়ে ধীর পায়ে বৈঠকখানার দিকে এগোল। অরণ্য।

হার্টের উপরে দর্শকদের ফোনকলের জবাব দিচ্ছেন কার্ডিয়োলজিস্ট- নিশ্চয়ই প্রখ্যাত কেউ হবেন, অনুমান করল। ও

কেমন জানি ব্যাপারটা। এক দিকে হার্ট ভালো রাখার কথা বলা হচ্ছে অনুষ্ঠানে, অন্য দিকে টিভি-স্ক্রিনের নিচের দিকে অটো-স্ক্রল হচ্ছে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার মতো খবর। …ক্যালিফোরনিয়ায় বাংলাদেশি দম্পতি খুন… কাভার্ড ভ্যান চাপায় দুই পরীক্ষার্থী নিহত… সন্ত্রাসী হামলায় আহত ব্যবসায়ী নৃপেন্দ্রলাল দাশের মৃত্যু… শীতলক্ষ্যায় নৌকাডুবি… আফগানিস্তানে ভূমিকম্প… গাঁজায় মিসাইল হামলা…

এই সব চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিদের কমন সেন্স নিয়ে সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক।

এদিকে আবার নীল টেলপের উপরে স্থির হয়ে আছে লাল একটা ব্যানার। সেখানে লেখা: পুলিস…

হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল অরণ্যর। টলে উঠল খানিকটা। মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পেল নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি…

এ হতে পারে না! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ভরসা। হয় না ওর! অসম্ভব!

আট

পুলিস হেফাজতে নাজিমুদ্দীনের মৃত্যু!

টক অভ দ্য কান্ট্রি এখন এটা, ফেসবুকের নতুন ইস্যু।

এক দল ভাবছে: যাক, ভালোই হলো; সমাজ থেকে নরকের কীট কমল একটা। বিচার-আচার মানেই তো দীর্ঘসূত্রতা, লাল ফিতের দৌরাত্ম। মাসের পর মাস- হয়তো বছরভর ঝুলে থাকবে বিচারকার্য। তার চেয়ে এ-ই ভালো, স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবছে ওরা, একেবারেই চুকেবুকে গেল সব কিছু। নাজিম হিকমতের মতো ঘৃণ্য অপরাধীদের এই দুনিয়ার আলো-হাওয়ার স্বাদ নেয়ার অধিকার নেই কোনও। ( কিন্তু আরেক দিকে মানবতাবোধ উথলে উঠছে কারও কারও। তাদের বক্তব্য: হোক খুনি, বিচার পাওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে যদি নিকেশ করে ফেলা হয়, কোর্ট-কাছারি-আইনের প্রয়োজন কী হবে? রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়… ইত্যাদি-ইত্যাদি।

ব্যাঙের ছাতার মতো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনও রাজনৈতিক দলের নামকাওয়াস্তে মিছিলের মতো দলে হালকা এই গোষ্ঠীটা। তবে কথায় আছে: সূর্যের চেয়ে বালি গরম। এরই মধ্যে শাহবাগে মানববন্ধন-টন্ধন করে ফেলেছে ওরা। পুলিশী নির্যাতনে আসামি মরল কেন, জবাব চাই

ভাবে অরণ্য: এরা কি আকারে-প্রকারে তা হলে মেল শোভিনিস্ট? সম্পূর্ণ নিরপরাধ যে-মেয়েটি অবিচারের শিকার হলো, সেটা ওদের চোখে পড়ছে না এক বিন্দু!

অবস্থা বেগতিক দেখে সংবাদ-সম্মেলন ডাকতে বাধ্য হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এক। বাক্যে উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা বিরুদ্ধবাদীদের সন্দেহ। হিকমতের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয় পুলিস…

মরল কেন তা হলে?

সেটারও সদুত্তর দিতে পারছেন না তারা। যত দোষ পুলিস ঘোষদের তাই মিডিয়া সামলাতে কালঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা।

পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়েছে লাশ… যদিও সাংবাদিক সহ অনেকেরই মনে সংশয়: আসল কারণটা হয়তো জানা যাবে না কোনও দিনই। ফলস একটা রিপোর্টের নিচে ধামাচাপা পড়ে যাবে প্রকৃত ঘটনা।

আর যদি সত্যই হয় পুলিসের বক্তব্য? কীভাবে মারা গেল তবে ফারজানা মিতার খুনি?

হার্টফেল করে?

না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ডায়েরিটাকে পাত্তা দিতে চায় না অরণ্য। যুক্তি-বুদ্ধি গুলিয়ে যাবে তাতে। হ্যাঁ, হতেই পারে হার্ট-অ্যাটাক। হায়াত-মউতের কথা তো বলা যায় না কিছুই। কিন্তু ডায়েরির কারণে হয়েছে বলে মনে করছে না ও। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ।

কী সেটা?

গত কাল থেকে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে অরণ্য। টিভির খবরে, ইন্টারনেটে, তারপর আজকের পত্রিকায়…

লোকটা কি আত্মহত্যা করতে পারে? পারেই তো। পুলিসের বিব্রত হওয়ার কারণ হয়তো এটাই। নিজেদের গাফলতি প্রকাশ পেয়ে যাক, কে-ই বা চায় তা।

আরে… অ্যাই! দাও, বলছি! প্লিজ, দিয়ে দাও ওটা!

ভাবনার জগৎ থেকে ক্লাসরুমে ফিরে এল অরণ্য। লাঞ্চ-টাইম।

ইবলিস নাম্বার টু- সালমান, ছিনিয়ে নিয়েছে জয়ন্তর মানিব্যাগ। ওটা পাওয়ার জন্য অনুনয় করছে সরল-সিধে ছেলেটা। হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে। ওঅলেটটার। পাচ্ছে না। খেলাচ্ছে ওকে সালমান। এ ব্যাগটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল ইবলিস। ধরতে চেয়ে ব্যর্থ হলো জয়ন্ত। খপ করে লুফে নিয়েছে সেটা ইবলিস নাম্বার ওয়ান।

এমিল… গলাটা বুজে এল জয়ন্তর।

এই তো, বাপ… দিচ্ছি… চট করে পাঁচ শ টাকার একখানা নোট বের করে নিল এমিল ডিকস্টা। নিয়েই মানিব্যাগটা ছুঁড়ে মারল জয়ন্তর দিকে। বুকে বাড়ি খেয়ে জয়ন্তর পায়ের কাছে পড়ল ওটা।

আমার টাকা… কেঁদে ফেলবে যেন জয়ন্ত।

ভুল,  বলল এমিল কথার পিঠে। তোর না… তোর বাপের টাকা।

আলাল ও দুলাল… সুর করে বলল ইবলিস নাম্বার দুই।

আলাল ও দুলাল… আলাল ও দুলাল… আলাল ও দুলাল,…

তাদের বাবা হাজি চান…

চান খাঁর পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি… পৌঁছেতে এসে সশব্দে হাই-ফাইভ করল দুই ইবলিস।

আলাল ও দুলাল.:. আলাল ও দুলাল… লা-লা-লা-লা-লা… লা-লা-লা-লা-লা…

চোয়াল শক্ত হয়ে আছে অরণ্যর। অক্ষম রাগ। কিছু বলাও যাবে না এগুলোকে। হেল করে দেবে লাইফটা।

ডায়েরিতে নাম তুলে দেবে নাকি বজ্জাত দুটোর? …উঁহু! লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে যায়। উইদ গ্রেট পাওয়ার কামস গ্রেট রেসপন্সিবিলিটি।

নিজের উপরেই বিরক্ত হয়ে উঠল অরণ্য। ডায়েরিটা সত্যি বলে ভাবছে কেন ও? যত্ত সব!

নয়

আর তো সহ্য হয় না, মামা! কাতরে ওঠার মতো আওয়াজ করল আরাফাত। মনডা চায়…

হ, মামা। আমার তো অহনই বিচি কান্ধে!

কী কস, রিপইন্না… মাল-টাল মিলব তো ভালো? কী মনে হয় তর?

আশা তো করি, মাম্মা,  বলল রিপন। আর চান্স পাইলেই…

খিকখিক করে হেসে উঠল টিপু- তৃতীয় জন। সিনেমা হলের গলি। আধো আলোকিত, আধো অন্ধকার। অর্ধনগ্ন-পোস্টারে ছাওয়া জায়গাটা যেন নরকেরই অংশ একটা। পাপ-পঙ্কিলতায় নীল হয়ে আছে।

রোজকার মতো দুটো মোটরসাইকেলে ঠেস দিয়ে বসে আচ্ছা পিটাচ্ছে তিন বখাটে। আলাপের বিষয়বস্তু ওদের আরেক বন্ধু ড্যানিদের রুফটপে বারবিকিউ পার্টি। আলালের ঘরের দুলাল। আগামী কাল বাসায় থাকছেন না ওর আব্বা আম্মা। সুযোগটা নষ্ট করেনি ড্যানি। পার্টির আয়োজন করছে। মেয়ে-টেয়েও থাকছে নাকি- মচ্ছব হবে।

লাস্ট যেই পার্টি দিল হালায়… উফ! রঙিন হয়ে উঠেছে টিপু মোল্লার চোখ দুটো।

…নাদিয়া মাগিড়া… আরাফাতেরও মনে পড়ে গেছে।

আহ, দোস্ত! সিরাম মাক্ষি ফিগার… সুখস্মৃতি ভাসছে রিপনের চোখের সামনে। পানি এসে গেছে জিভে।

অন্ধ কামোত্তেজনায় কুকুরের মতো শ্বাস ফেলতে লাগল তিনজনে।

সহসা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠল রিপন: দোস্ত!

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল তিন যুবকের। মাংসের লোভে উন্মত্ত হয়ে আছে, আর এখন গলির সামনে দিয়ে চলে গেল আস্ত এক নারী। অদৃশ্য সঙ্কেত চালাচালি হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে। অন্ধকার রাত। নির্জন গলি। আর কী চাই!

বুঝতেও পারল না মেয়েটা, কী থেকে কী হয়ে গেল। খপ করে একটা বাঘের থাবা পিছন থেকে চেপে ধরল ওর মুখটা। চিৎকারের সব পথ রুদ্ধ। আরও দুটো হাত ওর পা জোড়া ধরে তুলে ফেলল শূন্যে।

চ্যাংদোলা করে গুলির মধ্যে এনে ফেলল ওরা মেয়েটাকে। হাত আর মুখ চেপে ধরেছে দু জনে, এ অবস্থায় এক টানে সালোয়ারের ফিতে খুলে ফেলল আরাফাত। পরক্ষণেই আঁক করে ছিটকে পড়ল দু হাত দূরে।

জায়গামতো বেমক্কা এক লাথি ঝেড়ে দিয়েছে তরুণী। পাক্কা তিন মিনিট লাগল ঘোলা চোখে দৃষ্টি ফিরে পেতে। মাতালের মতো টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল আরাফাত। অণ্ডকোষ চেপে ধরে গর্জাচ্ছে আহত জন্তুর মতো। সামনে এগোনোর ফাঁকে উচ্চারণ করল চিবিয়ে চিবিয়ে: খাড়া, ছেমরি! ফাটামু তরে আইজকা! …আমারে চিনস না! …আরাফাত! আরাফাত এই বান্দার নাম! আইজ পাশা খেলমু, রে, শাম!

আত্মরক্ষার তাগিদে আবারও লাথি মারতে গেল মেয়েটা।

এবারে সতর্ক ছিল আরাফাত। একটুও মায়া না করে ঘুষি বসিয়ে দিল শিকারের নাকে। এক ঘুষিতেই নিথর হয়ে গেল। মেয়েটা। শিথিল হয়ে পড়ল ওর হাত, পা, সারা দেহ।

মেয়েটাকে ছেড়ে দিল টিপু। আতঙ্কিত গলায় ওগরাল, ড্যামিট! শালীরে মার্ডার কইরা ফেলছস তুই! নাকের ভাঙা হাড় ঢুইকা গেছে মগজে! বলেই আর থাকল না সেখানে। বাস্তব বুদ্ধি টনটনে ওর। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দৌড় দিল গলির আরও ভিতরে। ভয়ার্ত মোল্লাকে গিলে নিল অন্ধকার। ওর ছুটন্ত পদশব্দ ক্রমশ কমতে কমতে হারিয়ে গেল একেবারে।

এতক্ষণে বিপদ টের পেল আরাফাত। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা পর্যন্তই দৌড় ওর। স্বয়ং শয়তান খানিক আগে ভর করেছিল ঘাড়ে… রেপিস্ট পরিচয়ে দাগী হয়ে যেত আরেকটু হলেই। কিন্তু খুন… না, বাবা! অত হিম্মত নেই ওর। রাগের মাথায়…

পড়িমরি করে দৌড় দিল আরাফাত। তবে উলটো দিকে। একদমই কাজ করছে না মাথা। দামি মোটরসাইকেলটা ফেলেই পালাচ্ছে…

গলি থেকে বেরোতেই ধাক্কা খেল একজনের সঙ্গে।

ধাক্কার চোটে পুরো এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল অরণ্য। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে। কোন হারামজাদা… আরে, আরাফাত না? মহল্লার মাস্তান আরাফাত ওরফে রাফাঁকে চিনতে ভুল হলো না ওর। এই ভাবে ছুটছে। কেন গুণ্ডাটা? ভূতের তাড়া খেয়েছে নাকি?

ভটভট আওয়াজ ভেসে এল অন্ধকার গলিটা থেকে। কিন্তু কাছিয়ে আসার বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে আওয়াজটা।

এক ছুটে গলিতে ঢুকল অরণ্য। কয়েক সেকেণ্ডেই বেরিয়ে এল আবার। যা দেখার, দেখে নিয়েছে। বুঝে নিয়েছে, যা বোঝার।

কী করছে, বুঝতে পারছে না ও। নিজের মধ্যে নেই যেন। ভিন্ন এক সত্তা চালিত করছে যেন ওকে। ফিরছিল প্রাইভেট পড়ে। ঝটপট ব্যাগ থেকে বের করে আনল ডায়েরিটা।

সোডিয়াম-আলোয় লেখা হয়ে গেল আরাফাত করিমের মৃত্যু-পরোয়ানা।

দস্তুরমতো হাঁপাচ্ছে অরণ্য। হাঁটু গেড়ে বসে রাস্তার উপরে। হৃৎপিণ্ডের মাঝে টিক-টিক করছে অদৃশ্য কোনও ঘড়ির কাঁটা।

চল্লিশ সেকেণ্ড! চল্লিশ সেকেণ্ড!

আচমকা তীব্র এক আওয়াজে চিন্তার জাল ছিন্ন হলো ওর। শুনল উৎকর্ণ হয়ে। ভারি কোনও গাড়ির চাকা স্কিড করার শব্দ। উঠে দৌড় লাগাল ও আওয়াজটা লক্ষ্য করে।

বেশি দূর যেতে হলো না। পাঁচ টনী ট্রাকটা তখন। ভাগবার পায়তারা করছে। ও ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পগারপার।

হঠাৎ করেই ব্রেক কষল অরণ্য। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে দু হাত রাখল হাঁটুতে। খুব জোরে ছুটে আসায় খিল ধরে গেছে পেটে। শ্বাস ফেলছে ফেস-ফোঁস করে। বাজে একটা গন্ধ ভক করে ধাক্কা মারল ওর নাকে।

হাইওয়ের সঙ্গে মিশে গেছে আরাফাত করিম! রক্ত, মাংস, হাড় আর মগজের একটা দলা।

ঘুরেই হড়হড় করে বমি করে দিল অরণ্য।

দশ

ধীরে ধীরে বসা অবস্থা থেকে সিধে হলো মূর্তিটা। তবে ঘাড়টা এখনও ঝুঁকে রয়েছে সামনে। স্থির দৃষ্টি বহু নিচের গহ্বরে।

অস্বাভাবিক লম্বা সে। প্রায় নয় ফুট। তেমন মাংস না থাকায় হাঁটু, কোমর ও পাঁজরের হাড়গুলোকে এক-একটা ধাপ বলে মনে হয় মইয়ের। রোমের নিশানা নেই সারা শরীরের কোথাও।

নাকটা যেন ঈগলের চঞ্চ। ঠোঁটের দুই প্রান্ত এতটাই দূরে যে, তার দিয়ে বেঁধে টেনে ধরা হয়েছে যেন। দীর্ঘ, বাঁকা নখ হাত-পায়ের আঙুলে।

আর দেরি করা যায় না। ঘাড়টা তুলে একবার লাল আকাশটার দিকে চাইল দীর্ঘদেহী। নিচু হলো সামান্য। তারপর সাঁতারুর ডাইভ দেয়ার ভঙ্গিতে লাফ দিল কৃষ্ণগহ্বরে। এ পড়ছে… পড়ছে… আচম্বিতে পিঠ ফুড়ে বিশাল, কালো দুই ডানা বেরোল শরীরের ভিতর থেকে। গুমট বাতাস কেটে সাঁই-সাই ছুটে চলল ওটা নিচের দিকে।

আকাশ আলোকিত করে ঝিলিক দিল বিজলি। প্রকাণ্ড

কোনও দানবের লাল শিরা-উপশিরা সৃষ্টি করেই মিলিয়ে গেল আবার।

এগারো

ধীরে, খুব ধীরে চোখ মেলে তাকাল ও।– কীসের জানি ছুটি আজকে। অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে এ নিয়ে একটুও গ্লানিবোধ নেই মনে। বরঞ্চ অনুভব করছে আশ্চর্য এক তৃপ্তি। এই তৃপ্তির উৎস কী, জানে ও।

ঝকর-ঝকর শব্দ তুলে চলে গেল শেষ দুপুরের ট্রেনটা। খান-খান হয়ে ভেঙে পড়ল পড়ন্ত বেলার নিঝুমতা। সঙ্গে বাতাস চিরে দেয়া বিষণ্ণ হুইসেল। শুনলে কেমন যেন ধক করে ওঠে বুকটা।

দুটো ট্রেন যায় এদিক দিয়ে। দুপুরে আর শেষ রাতে। থামে না কখনওই। আসে দক্ষিণ থেকে। নিশুতি অন্ধকারে সাঁই-সাই ছুটে চলা ট্রেনের গুমগুম আওয়াজটাকে ভারি অদ্ভুত মনে হয় অরণ্যর। কল্পনায় দেখতে পায়, মরচের গন্ধ ভরা চলন্ত কামরাগুলোতে ফ্যাকাসে আলো।

চলে যাওয়া ট্রেনটার ধাতব ঝঙ্কারের রেশ শুনতে শুনতে মনে হলো অরণ্যর: রাত্তির কি এখন? …ঠিক বুঝতে পারছে। না। কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে মাথার ভিতরটা।

না, তা তো হওয়ার কথা নয়!

এত অন্ধকার কেন তা হলে! ঠিক যেন কালবোশেখী ঝড় আঘাত হানার আগের অবস্থা।

আর- সহসাই টের পেল ও- এত ঠাণ্ডা! আরিব্বাপ, রে!

কাঁপছে রীতিমতো অরণ্য। মেরু অঞ্চলে রয়েছে যেন। শীত ভীষণ! শুরু হয়েছে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়া।

ব্যাপারখানা কী!

মজা লাগছে, তা-ই না? মেঘগম্ভীর একটা কণ্ঠ গমগম করে উঠল ঘরের মধ্যে।

তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল অরণ্য। অস্ফুট এক চিৎকার বেরিয়ে এসেছে গলা দিয়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো চাইছে এদিক-ওদিক।

কোথাও কেউ নেই! অবশ্য এত অন্ধকারে ঠিক মতো ঠাহর করার উপায়ও নেই।

এদিকে!

ঠিক ওর বাম দিক থেকে এসেছে আওয়াজটা। অথচ প্রথম বার মনে হয়েছিল- ডান থেকে!

কই, কেউ তো নেই ওখানটায়! …না, আছে…– আবছা আঁধারে ফুটে উঠছে একটা অবয়ব! ধীরে ধীরে। এ কী অবাক কাণ্ড!! যেন অদৃশ্য ছিল, দৃশ্যমান হচ্ছে একটু একটু করে!

হলো না পুরোপুরি। শরীর ভেদ করে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ওপাশটা।

আঁতকে উঠল অরণ্য। প্রায় ছাত-ছোঁয়া তাল গাছটাকে কি মানুষ বলবে ও? কী বীভৎস চেহারা! কামানো মাথা, নাকি চুলই গজায় না? সারা গায়ে তো রয়েছেই, এমন কী চকচকে নির্লোম টাকটাও বাদ পড়েনি আঁকাআঁকি থেকে। জানা নেই।

ওর- উল্কি নয় ওগুলো; নয়-ফুটী খাম্বাটার ত্বকই ওরকম। এ শেয়ালের কানের মতো চোখা ওটার লম্বাটে কানের আগা দুটো। হাড্ডিসার শরীরে নানা রকম গহনা।

ঠাকুরমার ঝুলি থেকে উঠে আসা রাক্ষস যেন!

ক-কে আপনি!? কেউ যেন বালি ঘষে দিয়েছে অরণ্যর গলার ভিতরটায়।

মেঘ ডাকল আবার। আমি মা-উ-ল।

মাউল!

মাউল। মৃত্যুর প্রতিনিধি।

যতটা আতঙ্কিত হওয়ার কথা, ততটা যেন হলো না অরণ্য। এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা যেন জানত ওর অবচেতন মনটা। আরও নিশ্চিত হতে চাইল ও আগন্তুকের পরিচয় সম্বন্ধে।

মানে… যমদূত?

বলতে পারো। মৃত্যুর দেবতার অসংখ্য প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন আমি।

মনে সাহস সঞ্চয় করল অরণ্য। আন্দাজ করতে পারছে, তার পরও জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছেন আমার কাছে?

ভয়াল হাসি হাসল মাউল। গত পাঁচ দিনে অন্তত পাঁচ শ নাম লিখেছ যে-খাতাটায়, আমার জিনিস ওটা।

অনেক কষ্টে ঢোক গিলল একটা অরণ্য। আ… আপনি জানেন?

এবারে শব্দ করে হাসতে লাগল মৃত্যুর প্রতিনিধি।

নির্বোধের মতো প্রশ্ন,  বলল হাসি থামলে।

বুকটা দুরুদুরু করছে অরণ্যর। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটাই এল প্রথমে মাথায়।

আ-আপনি কি আমার… জ-জান কবজ করবেন?

হ্যাঁ, জলদগম্ভীর উত্তর।

না! খোদ মৃত্যুর মুখ থেকে সত্যিটা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অরণ্যর।

খুকখুক করে আবারও হাসতে লাগল যমদূত। হাসির ফাঁকেই অভয় দিল, ভয় পেয়ো না, বাছা! ঠাট্টা করছিলাম আমি। কোনও ক্ষতিই করব না আমি তোমার। …করতে পারব না আসলে।

খুব সাবধানে স্বস্তির শ্বাস গোপন করল অরণ্য।

নিতে এসেছেন ডায়েরিটা?

হাসি-হাসি মুখটা কি একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল?

উপায় নেই!

জি?

যে মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে খাতাটা, তখন থেকেই পৃথিবীর অংশ হয়ে গেছে ওটা। আর খাতাটা স্পর্শ করে তুমিও হয়ে গেছ ওটার অংশ। বুঝতে পারছ, কী বলছি? আমি নই, অরণ্য, তুমিই এখন ওটার মালিক!

সত্যি! অদম্য আবেগ টের পেল ও বুকের মধ্যে।

খুশি লাগছে বুঝি?

না… মানে…

অদ্ভুত!

জি?

তোমরা… মানে, বড়ই অদ্ভুত এই মানব জাতিটা! কোথায় আমার পরিচয় পেয়ে ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে ফিরিয়ে দেবে খাতাটা, তা না! অন্য কিছু ভাবছ!

আপনি চাইলে…

উঁহু! আমি চাইলে তো হবে না, বাছা! তুমি চাও কি না, সেটাই হলো প্রথম কথা। ফেরত দিতে চাও খাতাটা?

ইতস্তত করছে অরণ্য। না দিলে কি…

না। জোর খাটাতে পারব না আমি তোমার উপরে। নিজ থেকে নিয়ে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ওটা এমন কী ছুঁতেও পারছি না, যতক্ষণ না তুমি নিজ থেকে দিচ্ছ। আমাকে।

চুপচাপ কী যেন ভাবল অরণ্য। যদি না দিই কখনও?

কৌতুকের ছাপ ফুটে উঠল মাউলের চোখেমুখে। সেটাই মতলব বুঝি?

বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল অরণ্য।

কিন্তু পরক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে উঠল মৃত্যুদূতের চেহারা। ভাঁজ পড়েছে কপালে। থুতনি ডলতে ডলতে স্বগতোক্তি করল, তা তুমি পারো, বৎস… তা তুমি পারো!

বলছেন, ডায়েরিটা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারব আমি, আর এর জন্য কোনও রকম শাস্তি-টাস্তি পেতে হবে না আমাকে?

মাথা নাড়ল দূত। না। যত দিন আমাকে বা আর কাউকে না দিচ্ছ খাতাটা… আরও স্পষ্ট করে বললে, স্পর্শ করতে না দাও যদি, তত দিন তোমারই থাকবে ওটা। তবে তুমি যদি মালিকানা ত্যাগ করো খাতাটার, আমাকে তখন ওটার স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে তোমার মগজ থেকে।

জি… বুঝতে পেরেছি।

আরও কয়েকটা ব্যাপারে জানা থাকা দরকার তোমার… খাতাটা রাখতে চাইছ যখন…

বলুন…

বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হবে… ভয়… যন্ত্রণা… আগে যারা-যারা মালিক ছিল খাতাটার, তাদের চিন্তার সাথে পরিচিত হবে তুমি…

আমি ছাড়াও আরও কেউ পেয়েছিল এটা?

কয়েক জন। দূর-অতীতের কথা সেসব।

আচ্ছা… তারপর?

যত দিন তোমার কাছে থাকবে খাতাটা, অপঘাতে মৃত্যু হবে না তোমার। স্বাভাবিক মৃত্যুই ঘটবে। তুমি মারা গেলে, আপনা-আপনিই চলে আসবে ওটা আমার কাছে।

স্বাভাবিক মৃত্যু হবে শুনে প্রশান্তির একটা ছায়া ফুটে উঠছিল অরণ্যর মুখের চেহারায়- সেটা লক্ষ করে বাগড়া দিল মাউল। অত খুশি হোয়ো না, বৎস। মৃত্যুর খাতা একই সাথে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ।

কী রকম?

এর আগে যারাই ব্যবহার করেছে ওটা, কেউই কিন্তু স্বর্গ কিংবা নরকে প্রবেশ করেনি…

তা হলে?

অতৃপ্ত আত্মা হয়ে আটকা পড়ে গেছে পৃথিবীতে। অনন্ত, কালের জন্য!

হাসল মাউল। তোমার ভবিতব্য কিন্তু নির্ধারিত হয়ে গেছে, খোকা!

ঠক-ঠক ঠক!

ছোটখাটো লাফ মারল একটা অরণ্যর হৃৎপিণ্ডটা। টোকাটা যেন দরজায় নয়, পড়েছে ওর বুকের মধ্যে।

মাউলের দিকে তাকাল ও।

সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল মৃত্যুর দূত। খোলো দরজাটা।

চোখের ইশারায় বলতে চাইল অরণ্য: চোখের আড়ালে থাকুন আপনি।

ধীর কদমে হেঁটে দরজার কাছে গেল ও। একটা হাত রাখল পাল্লার উপরে। দরজার কাছাকাছি নিয়ে এল কান।

কে?

দরজাটা খোল, খোকা! ওপাশ থেকে বললেন মিসেস মালিক- অরণ্যর আম্মু।

খুলল ও। সাবধানে। তবে পুরোপুরি উন্মুক্ত করল না কবাটটা। দাঁড়িয়ে রইল পাল্লাটা ধরে।

কী, মা?

আপেল খাবি? ফল সহ ডান হাতটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন মিসেস মালিক। আপেল এনেছে তোর বাবা। খেয়ে দেখ… দারুণ মিষ্টি!

বড়সড় লাল আপেলটা হাতে নিয়ে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মিসেস মালিকের ছেলে।

ধুয়ে এনেছি…

উঁ?

যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন মহিলা। উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছেন অরণ্যর ঘাড়ের উপর দিয়ে। অ্যাই, এত অন্ধকার কেন তোর ঘরটা? চোখ খারাপ হয়ে যাবে তো!

চট করে এক নজর ভিতরে চাইল ছেলে। আড়ালে দূরে থাক, ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মাউল- আম্মুর একেবারে চোখের সামনে! ভীত চোখে তাকাল ও মিসেস মালিকের দিকে।

মাঝবয়সী মহিলার দৃষ্টিতে ভাবান্তর নেই।

কী ব্যাপার! আম্মা কি দেখতে পাচ্ছে না লোক -টাকে?

আলো জ্বাল তাড়াতাড়ি…

এই তো, মা… জ্বালছি!

তাড়াতাড়ি করে দরজাটা লাগিয়ে দিল অরণ্য। প্রশ্ন চোখে চাইল মৃত্যুর দিকে।

আম্মা কি…?

দেখেননি, বলল মাউল মাথা নেড়ে। খাতাটা তো আমার আসলে, আমার জিনিস ব্যবহার করছ তুমি, সেজন্য এক মাত্র তুমিই দেখতে পাচ্ছ আমাকে… তুমিই শুধু শুনতে পাচ্ছ আমার কথা…

আপেল খাবেন?

দাও! লোভীর মতো হাত বাড়াল মাউল।

আলগোছে ছুঁড়ে দিল ওটা অরণ্য।

খপ করে লুফে নিল মৃত্যুর প্রতিনিধি। ওঁর বিরাট হাতে ছোট্টটি দেখাচ্ছে আপেলখানা। বাদামের মতো ছুঁড়ে চালান করে দিল মুখের ভিতরে।

শব্দ হচ্ছে কচর-মচর।

আম… স্বাদু! এখানে আসাটা সার্থক হলো আমার।

স্কুল এই রসিকতায় হাসি পেল না অরণ্যর। বুকে হাত বেঁধে বলল ও, ক টা প্রশ্নের জবাব দেবেন?

নির্দ্বিধায়।

আমার প্রথম প্রশ্ন: আমাকেই কেন? হোয়াই মি?

প্রশ্নটা কিন্তু পরিষ্কার হলো না…

বলতে চাইছিঃ আমাকেই কেন বেছে নিলেন আপনি? আর কি কেউ ছিল না ডায়েরিটা দেয়ার মতো?

ভুল ভাবছ। আমি বেছে নিইনি তোমাকে। কী জন্য নেব? আছে কোনও কারণ? তুমি তো চালাক-চতুর নও তেমন… গোবেচারা গোছের। কাউকে দেয়ার ইচ্ছে থাকলে অসংখ্য বিকল্প ছিল আমার সামনে।

সত্যি কথাটা জানতে চেয়েছিল অরণ্য। কিন্তু শোনা মাত্র তেতো হয়ে গেল ওর মুখটা। কারই বা ভালো লাগে অপ্রিয় সত্য!

…না, যা ভাবছ তুমি, তা নয়, কথার রেশ টানছে।–মাউল। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আসলে…

দুর্ঘটনা!

হুম। খাতাটা স্রেফ পড়ে গেছে আমার হাত থেকে। আর তমি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছ। এই হলো গে আসল ব্যাপার।

পড়ে গেছে! চড়ে গেছে অরণ্যর গলা। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, দুঃখিত! এ-জাতীয় ভুল করা তো মানায় না আপনাদের! মানুষ হলেও একটা কথা ছিল!

আবারও নিঃশব্দ হাসিতে উদ্ভাসিত হলো মাউলের চেহারাটা।

নাহ… যতটা ভাবছিলাম, ততটা বোকা নও তুমি! পারলাম না ফাঁকি দিতে…

তার মানে…

সত্যি কথাটা বলছি এবার… আমিই ফেলে দিয়েছি ওটা!

কেন?

জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল আরেক ভুবনের প্রতিনিধি। আসলে… হাঁপিয়ে গেছি আমি!

অবাক হলো অরণ্য। হাঁপিয়ে গেছেন?

হ্যাঁ। ধারণাও করতে পারবে না তুমি, কী রকম একঘেয়ে আমাদের জীবনটা! তেমন কিছু নেই করার শুধু নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করা ছাড়া। সেজন্য খুব হাঁপ ধরে যায় মাঝে মাঝে। বিনোদন নেই… কিছু নেই। সেজন্যই বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলেছি খাতাটা। পরে খেয়াল হলো, ওটা ফিরে পাওয়ার জন্য হলেও পৃথিবীতে নেমে আসতে হবে আমাকে। হাসল মাউল। ভালো হলো না? একঘেয়েমি দূর করার সুযোগটা তো পাচ্ছি এখন।

কী বলবে, বুঝে পেল না অরণ্য।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতে মুখ খুলল আবার।

আরেকটা কোশ্চেন ছিল…

বলো।

রাফা… মানে, আরাফাত… মানে…

চিনি। প্রশ্নটা কী?

খটকা লাগছে। ডায়েরির লেখা অনুযায়ী, হার্টফেল করে মরার কথা ওই ব্যাটার… কিন্তু…

তা-ই তো হয়েছে।

না, হয়নি। ট্রাকের তলে চাপা পড়েছে ও।

উঁহু… মরেছে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল ছোকরা… আতঙ্কে, উত্তেজনায়… বুঝতে পারছ? মারা গিয়েছিল মহাসড়কে ওঠার সাথে সাথেই। তার পরই ভারি যানটা চাপা দেয় ওকে।

ও, তা-ই! এই সম্ভাবনাটার কথা একদমই মাথায় আসেনি আমার।

কাস্তেটা হাতে নিয়ে শান পরীক্ষা করছে মাউল। বলল, প্রশ্নগুলোর জবাব তো পেলে। এবার আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, দেখি। খেলছেটা কী তোমার মাথায়? প্রথমটায় তো বিশ্বাসই করোনি… এখন যে একের পর এক নরহত্যা করছ!

বিশ্বাস করিনি, কারণ, ডায়েরির কথাগুলো ইংরেজিতে লেখা। হিব্রু বা ল্যাটিন হলেও বুঝতাম যে

ইংরেজি নয়। এমন এক ভাষায় লেখা ওটা, পৃথিবীর কোনও মানুষেরই তরজমা করার সাধ্য নেই।

তা হলে? ইংরেজি দেখছি যে!

বদলে গেছে। মানুষের পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় ভাষা হচ্ছে ইংরেজি- সেই কারণেই।

যুক্তি আছে লোকটার কথায়।

আমার প্রশ্নটার জবাব দিলে না কিন্তু! খাতাটা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা আছে তোমার। বড় কোনও পরিকল্পনা। যেভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চলেছ, খুব বেশি দিন লাগবে না মানুষের টের পেতে যে, একটাও স্বাভাবিক নয় মৃত্যুগুলো! …উদ্দেশ্যটা কী তোমার?

চুপ রইল অরণ্য।

জবাব দাও।

ওটাই চাইছি আমি… থামল ও এক সেকেণ্ডের জন্য। জানুক লোকে, কে আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব…

বুঝেছি। পৃথিবীর মনোযোগ চাও তুমি। তাই বলে এভাবে? অন্য ভাবেও তো পেতে পারো এটা। ভালো ছাত্র তুমি… লেখাপড়া শেষ করে বড় কিছু করবে…

বিরক্ত হয়ে হাত তুলল অরণ্য। ভালো মানুষের ভাত নেই দুনিয়ায়! …অপরাধীদের দুঃস্বপ্ন হতে চাই আমি। দুষ্টের। দমন করে সাব্বাসি কুড়াতে চাই পৃথিবীর। আপাতত বড় বড় ক্রিমিনালদের শায়েস্তা করছি। পরে ছোটখাটো অপরাধগুলোর দিকে নজর দেব। একজন দোষীও রেহাই পাবে না আমার হাত থেকে!

দুনিয়ার সব লোক সাফ করে ফেলবে, দেখছি… ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়! এভাবে তো নায়ক নয়, খল নায়ক হয়ে উঠবে একটা সময়!

ক্রুর হাসি দেখা দিল অরণ্যর ঠোঁটে। ভলতেয়ার-এর একটা কথা আছে: আ সোসাইটি গেটস আ ক্রিমিনাল ইট ডিজার্ভস। ক্রিমিনালদের জন্য ক্রিমিনাল হতে আপত্তি নেই আমার।

নিশ্চুপ মাউল।

পৃথিবীটা পচছে… এক্কেবারে পচে গেছে! এভাবে আর। চলতে পারে না। কিছু একটা করতেই হবে। …আর সেটাই করছি আমি।

আসলে… আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি আপনার মতো। একঘেয়েমি কাটানোর সুযোগ হয়ে এসেছে ডায়েরিটা। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

দু জনে দু জনের দিকে তাকিয়ে আছে।

চন্দ্রাহতের বিচিত্র এক টুকরো হাসি অরণ্যর মুখে।

1 Comment
Collapse Comments

Ata death note anime aar moto golpo onektai aak kintu khub bhalo laglo golpota pore

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *