ডেয়ার-ডেভিল

ডেয়ার-ডেভিল

গভীর রাত।

নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে লোকটা। নিবিষ্ট মনে।

চল্লিশের কোঠায় বয়স। কোঁকড়া চুল। সাদা হাফ শার্ট গায়ে।

ঘরটা অন্ধকার, কিন্তু একটা টেবিল-ল্যাম্প প্রয়োজনীয় আলো বিলাচ্ছে।

দুই

পোর্টল্যান্ড, অরেগন।

মাল্টনোমাহ/ক্র্যাকেম্যাস কাউন্টি অ্যানিমেল সেন্টার # ৪।

রাত। তিনটা একচল্লিশ।

চিড়িয়াখানার মূল অংশে ঢোকার মুখে একটা সাইন ঝুলছে দেয়ালে। সাদার উপরে লাল কালিতে লেখা। বহিরাগতদের প্রবেশ কাম্য নয়।

জনকে দেখেই ঘেউ-ঘেউ করতে লাগল কুকুরগুলো। সম্মিলিত চিৎকারে কান পাতা দায়।

লম্বা করিডরটাতে আঘো আলো। ভালো মতো তাকিয়ে ঠাহর করতে হয়। তবে সারমেয়কুল তো চোখ নয়, গন্ধ দিয়ে আইডেন্টিফাই করে। অবশ্য অ্যানিমেল সেন্টারের বাসিন্দারা পরিচিত-অপরিচিত কারোরই তোয়াক্কা করে না। নির্বিশেষে সবাইকে একই অভ্যর্থনা জানায়।

দরকার নেই, তবু সতর্ক পা ফেলছে জন। মুখটা ঘর্মাক্ত। পরিবেশ ভাপসা।

ওর দুপাশে তার আর শিক দিয়ে বানানো অসংখ্য খাঁচা। হরতন আকৃতির ফোকর। পাশাপাশি, আবার একটার উপরে

আরেকটা এভাবে বিন্যস্ত দেয়াল ঘেঁষে। কয়েকটা খালি। তবে বেশির ভাগই কোনও-না-কোনও জন্তুর দখলে। পোষা প্রাণী রয়েছে, কয়েকটা। বাদবাকি সব বুনো। কিংবা বেওয়ারিশ। শেয়াল। কুকুর। নেকড়ে। খরগোশ। ব্যাজার। গিনি পিগ। কাঠবিড়ালি। …অধিকাংশই অসুস্থ, না হয় আহত। সেবাযত্ন আর ওষুধ-পথ্য দিয়ে সুস্থ করা গেলে ছেড়ে দেয়া হয়। নচেৎ বন্দিজীবন।

বাতাসে গু-মুত আর পশুর গায়ের বোটকা গন্ধ।

থামছেই না কুকুরগুলো। গলায় রক্ত উঠে না আসাতক ক্ষান্ত দেবে না, মালুম হচ্ছে। দু -চারটা পাগল না থেকেই যায় না এগুলোর মধ্যে!

ঝিমাচ্ছে, কোনও কোনওটা। কোনওটা সন্দিগ্ধ চোখে আগন্তুকের পদক্ষেপ মাপছে। গরগর আওয়াজে অপছন্দ।

চাপা, ভারি গর্জন ছাড়ল একটা কয়োটে। নিচের ঠোঁট টেনে দাঁত দেখাল। লালা গড়াচ্ছে। ভাটার মতো জ্বলছে দুই চোখ।

প্যাসেজের শেষ মাথায় রুপালি আলো ঝলসে উঠতে দেখল জন। ক্রাইম সিনের স্থির চিত্র নিচ্ছে পুলিসের ফোটোগ্রাফার। খোলা এক দরজার পাশে এক ট্রুপারকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাদামি হ্যাট মাথায়। ইউনিফর্মেরই অংশ। কাছেপিঠে আরও কিছু লোক রয়েছে। নিজেদের কাজে মগ্ন।

নিজের পরিচয় দিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল জন। বরাবরের মতো প্লেইন ক্লদে এসেছে। ফিল্ড জ্যাকেট। সাদা পোশাকে কাজের সুবিধা অনেক।

লেডিস টয়লেট। দরজার কপালে চিহ্ন রয়েছে।

ওকে দেখে এগিয়ে এল আলফ্রেড মোলিনা। গোয়েন্দা। চেহারাটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো। সাদা চুল-দাড়ি। গলা থেকে ঝুলছে গোল ফ্রেমের চশমা। চেনে জনকে। ওর। অপেক্ষাতেই ছিল। ফেডারেল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) কেসটার ব্যাপারে আগ্রহী, জানানো হয়েছে ওকে। • আপাতত হমিসাইড টিম না পাঠিয়ে একজন এজেন্টকে পাঠানো হচ্ছে।

ঝটপট সৌজন্য সারল মোলিনা। এদিকে, প্লিজ।

চকিতে চারপাশে দষ্টি বুলিয়ে আনল জন। দেয়াল আর। মেঝেতে বর্গাকৃতি টাইলস। একরঙা। ওশন-বু। দুজন টেকনিশিয়ান টেপ মেজার দিয়ে মাপজোক করছে। আরেক জন প্রাসটিকের ছোট এভিডেন্স-ব্যাগে ভরছে কিছু।

ডিটেক্টিভের কাছ থেকে নিয়ে রাবার-গ্লাভস পরল জন।

খণ্ডিত লাশ। বেসিনের কাছে পড়ে রয়েছে। কোমর। থেকে উপরের অংশ একদিকে, নিচেরটা আরেক দিকে। গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন দুই হাত। মাথাটাও। মুখে শক্ত করে গ্রে। ডাক্ট টেপ সাঁটা।

দেখে-টেখে আবার সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিল জন। চাদরে ছোপ ছোপ রক্ত

নৃশংস ব্যাপার। অভ্যস্ত, তার পরও গা গোলাচ্ছে।

সিধে হলো দুজনে।

ধূসর-সুটের বোতাম আটকাল মোলিনা। সিকিউরিটির লোক,  জানাল ভিকটিমের পরিচয়।

লাশের একটা হাত আর কবজির কিছুটা বেরিয়ে আছে। রক্তমাখা চাদরের নিচ দিয়ে। সেদিকে চেয়ে রয়েছে জন।

বড় বড় নখ আঙুলে। নখে ম্যাজেন্টা নেইলপলিশ।

তিন

সিয়াটল, ওঅশিংটন।

যদিও সাতসকাল, কিন্তু ইতোমধ্যে বেশ রোদ উঠে গেছে।

পর-পর দু কাপ কফি খেয়েও রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিটা গেল না জনের। আয়না দেখেনি, তবু শত ভাগ নিশ্চিত, চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে।

কফিশপটা নতুন। নামটা ক্রিয়েটিভ। আহ। মালিক এক বাঙালি ভদ্রলোক। খাস চাটগাইয়া। অল্পদিনেই পসার জমিয়ে। নিয়েছেন। যতক্ষণ ওপেন লেখা সাইনবোর্ড ঝোলে দরজায়, পুরোটা সময়ই ভিড় লেগে থাকে তার দোকানে। সব বয়সী নারী-পুরুষ আসে গলা ভেজাতে। আড্ডা পেটায়।

শুরুতে নামের টানে আসত। ভিনদেশি মালিকের সুরুচির পরিচয় পেয়ে মজতে সময় লাগেনি। এখন অনেকেই নিয়মিত খদ্দের।

অন্যান্য ক্যাফেটেরিয়ার সঙ্গে এটার পার্থক্য হচ্ছে, শুধু কফিই পাওয়া যায় এখানে। আর কিছু না। তার পরও বাঙালির জয়-জয়কার। হবে না-ই বা কেন! কী নেই এখানে? সারা পৃথিবীতে যত রকম বেভারেজ রয়েছে কফির, প্রায় সবগুলোই মিলবে এই পানশালায়। সেই কারণে একচ্ছত্র আধিপত্য বাংলাদেশি এই কফিবারের।

দোকানের ভিতরটাতে শোভাবর্ধন করছে গোটা পাঁচেক সুদৃশ্য বনসাই আর কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা ল্যাণ্ডস্কেপ। বিশাল ক্যানভাসে বিধৃত হয়েছে আবহমান বাংলা। লাল আর সবুজেরই আধিক্য।

সময় আর আবহাওয়া বুঝে বাজানো হয় গান বা মিউজিক। মৃদু ভলিউমে। যেমন- এখন বাজছে রাগ বিভাস। সকালের রাগ। কাঁচঘেরা আলোকোজ্জ্বল অভ্যন্তরে অপূর্ব আবেশ ছড়াচ্ছেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। ঢিমেতালে ঘোরা চার ব্লেডের ফ্যানগুলো যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে।

নতুন ন্যাপকিন বিছিয়ে তার উপরে ধূমায়িত কাপ রাখল গোরা ওয়েইট্রেস। এটা তিন নম্বর কফি।

রীতিমতো সুন্দরী মেয়েটা। ব্রুনেট। নীল নয়না। ভারি চোখের পাপড়ি। বাম কানে এক জোড়া দুল। লতি ফেঁড়ায়নি, কানের পাশে। হালকা হলুদ কাপড়ের পোশাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ওকে। সকালটার মতোই সজীব। ঠোঁটে হালকা শেডের লিপস্টিক।

জনের ডান পাশের কাঠের টুল দখল করল একজন। ফরমাইকা লাগানো কাউন্টারে কনুই রাখল।

রিফ্লেক্স-অ্যাকশনের বশে মাথা ঘুরিয়ে চাইল জন।

জেফরি রাশ। এজেন্ট সে-ও। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে বলে ওকে ঢুকতে দেখেনি জন।

কফি খাও! অফার করল জন।

প্লিজ।

ওয়েইট্রেসের উদ্দেশে মাথা নাড়ল জন।

কোন ফ্লেভার? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

ব্রেজিলিয়ান, পছন্দ রাশের।

ঘুরে চলে গেল নীলাঞ্জনা।

তারপর? খবর জানতে চাইল জন।

নেগেটিভ। কারও সাথেই মেলেনি খুনের আলামতগুলো। ডেটাবেইসে নেই কালপ্রিট।

এখন তা হলে…

অপেক্ষা।

কিন্তু খুনি কি অপেক্ষা করবে? আরও খুন করে যদি?

সেটারই অপেক্ষা। হোমস ক্রাইটেরিয়া অ্যাপ্লাই করা ছাড়া আর তো কোনও রাস্তা দেখছি না।

মানতে পারলাম না। অসন্তোষে মাথা নাড়ল জন। তদন্তের এই পদ্ধতিটা একদম পছন্দ নয় ওর। তিরিশ দিনের মধ্যে একই রকম আরও দুটো খুন হয় যদি, আলামত মিলিয়ে তখন হন্তারককে ধরার চেষ্টা করা হয়।

হোমস ক্রাইটেরিয়ার বাজে দিক এটাই- দু জনকে অন্তত মরতে হবে। ওর কাছে অমানবিক মনে হয় এটা।

তা হলে তুমিই বলো, কীভাবে এগোব আমরা।

জবাব এল না জনের মাথায়।

ভালো কথা। এই কেসে তুমি একজন পার্ডনার পাচ্ছ। লি অ্যারেনবার্গ নাম তার। পোর্টল্যাণ্ড পি. ডি.-তে আছে। স্যান ডিয়েগোর খুনটার কথা মনে আছে তোমার? হাইওয়ে এইট কিলার?

আছে।

ব্যাটাকে ধরার পিছনে অবদান রয়েছে এই মানুষটার।

আই সি।

বিহেভিয়োরাল সায়েন্সে অগাধ জ্ঞান লোকটার। একটাই সমস্যা- তার নিজের মেজাজ-মর্জির ঠিকঠিকানা নেই। কাষ্ঠ হাসল রাশ। সমঝে চোলো, উপদেশ দিল।

চার

লি অ্যারেনবার্গের অফিস।

উজ্জ্বল আলো সইতে পারে না সে। শেড দেয়া কয়েকটা বাতি জ্বলছে কামরায়।

অন্য সব অফিসরুমের সঙ্গে আরেকটা পার্থক্য চোখে পড়ে সহজেই- দেয়ালে লাগানো বিশাল এক আয়না। যে-ই। ঘরে ঢুকবে, ওটার উপরেই চোখ পড়বে সবার আগে। তারপর অবধারিত ভাবেই বাঁধাই করা সার্টিফিকেট দুটোর দিকে। আয়নার পাশে ঝুলছে ওগুলো।

সাত। নয়। চার। শেষ ডিজিটটা চেপে অপেক্ষা করল অ্যারেনবার্গ। কানে ফোন-রিসিভার।

ওপাশে এক সুকণ্ঠী।

দুঃখিত। এই নাম্বারটি বর্তমানে খালি আছে। অনুগ্রহ করে টেলিফোন অফিসে যোগাযোগ করুন…

রেকর্ডেড মেসেজ।

হাউ দ্য হেল…

আপনি যদি সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে কথা বলতে চান, তা হলে ১ চাপুন।

চাপল অ্যারেনবার্গ।

অন্য একটা মেসেজ শোনা গেল।

আমাদের প্রতিনিধিরা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছেন। আপনি চাইলে লাইনে থাকতে পারেন। সিরিয়াল অনুযায়ী আপনার কলটি রিসিভ করা হবে। তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে, আগামী তিরিশ মিনিটের আগে সেটি সম্ভব হচ্ছে না…

দুঃখের খ্যাতা পুড়ি! নিরর্থক বলা। তার পরও নিজেকে রুখতে ব্যর্থ হলো অ্যারেনবার্গ। টং হয়ে আছে রেগে। ওর কথার মাঝখানে যে নক হয়েছে দরজায়, বেমালুম এড়িয়ে গেছে কান।

অগত্যা নব ঘুরিয়ে দরজা ফাঁক করল জন। দেখল, আছাড় দিয়ে রিসিভার রাখছে অ্যারেনবার্গ। দৃশ্যটা পীড়াদায়ক। ওকে দেখে খেঁকিয়ে উঠল কুকুরের মতো, কী?

পিত্তি জ্বলে গেল জনের। কিন্তু চেহারায় কোনও এক্সপ্রেশন নেই। ভিতরে ঢুকে লাগিয়ে দিল, দরজাটা। এজেন্ট ডিউক।

ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল অ্যারেনবার্গ। শব্দ করে ছাড়ল সুইল চেয়ার। অতটা ব্যস্ত হওয়ার দরকার ছিল না। তবু। এ থেকেই বুঝল জন, সত্যিই স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে। লোকটা। মানসিক ভারসাম্য নেই।

মেলাবার জন্য তুলছিল জন ডান হাতটা, খপ করে দু হাতে চেপে ধরল সেটা অ্যারেনবার্গ। সরি, অফিসার! বলল কাচুমাচু ভঙ্গিতে। রাগ পানি হয়ে গেছে তার। উপরের টেলিফোন পেয়েছে আগেই। জন ডিউক যে আসছে, জানানো হয়েছে তাকে।

না-না, ঠিক আছে! বিব্রত হয়ে বলল জন। ভদ্র ভাবে ছাড়িয়ে নিল হাতটা।

ওয়েলকাম টু পোর্টল্যাণ্ড! নাটকীয় ভঙ্গিতে স্বাগত জানাল অ্যারেনবার্গ।

অতি-অভিনয় মনে হলো- জনের কাছে। ভদ্রতা করে বলল তবু, ধন্যবাদ।

কী সৌভাগ্য আমার! হমিসাইড ডিপার্টমেন্টে আপনি তো একজন ইয়ে… কী বলে… জীবন্ত কিংবদন্তি! আপনার সাথে কাজ করতে পারব বসুন না! কফি?

তোষামোদি জিনিসটা একেবারেই পছন্দ করে না জন। নিজে ও তেল দেয় না কাউকে, কেউ দিলে বিরক্ত হয় রীতিমতো।তিক্ততায় ছেয়ে যাচ্ছিল মনটা, আপ্যায়নের প্রসঙ্গ উঠতে আপাতত মুলতবি ঘটল সেটার।

থ্যাঙ্কস, জানাল সম্মতি।

ওয়েটারের ভূমিকা পালন করতে চলল লোকটা। কামরাতেই রয়েছে রেডিমেড কফির বন্দোবস্ত।

দু কাপ কফি ঢেলে প্রস্তাব করল অ্যারেনবার্গ, আমাকে কিন্তু লি বলে ডাকবেন। ওসব মিস্টার-ফিস্টার শুনতে অস্বস্তি লাগে আমার।

জনের ঠোঁটে দেখা দিল সৌজন্যের হাসি। ঠিক আছে, লি।

থ্যাঙ্ক ইউ, অফিসার।

নো অফিসার। জন। অর ইউ ক্যান কল মি জে. ডি.।

আই প্রেফার- জেডাই। হাসছে অ্যারেনবার্গের পান্না সবুজ চোখ।

মে দ্য ফোর্স বি উইদ ইউ,  স্টার ওঅরস মুভির জেডাইদের অনুকরণে বলে উঠল জন।

হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল কথা। ডিসপোজেবল কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে ওরা নীরবে। বন্ধুত্বপূর্ণ নজরে পরস্পরকে দেখছে। এ কদমছাট চুল। হুটহাট মাথা গরম হয়ে যায় বলেই হয়তো চুল ছোট রাখে অ্যারেনবার্গ। কালো চুলগুলো বেশির ভাগই সাদা হয়ে এসেছে। অকালে। বয়সে জনের চেয়ে ছোটই হবে সে। চুলের সাইজে দাড়ি-গোঁফ রেখেছে। সেগুলোও সাদাকালো। প্রশস্ত কপাল। বড় বড় কান। মোটা ভুরু। ধূসর। ফুটবলের মতো গোল মাথা। শুধু কপালটা, মনে হয়, পাথর কুঁদে বানানো। ঠেলে বেরিয়ে আছে। উপরিভাগ। চকচক করছে। রাগী মানুষের সিগনেচার প্রশস্ত ওই ললাট। পাতলা ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে থাকে সব সময়।

জামা-কাপড়ের ব্যাপারে উদাসীন লোকটা। পরনের শার্টটা অতি ব্যবহারে মলিন। ভালো করে দেখলে ফিরোজার উপর প্রায়-অদৃশ্য সাদা স্ট্রাইপগুলো চোখে পড়ে। আস্তিন দুই ভাঁজ করে গোটানো। ভাঁজ খেয়ে গেছে কলারের প্রান্ত। স্টিল-ব্যাণ্ড ঘড়ি আঁটা সুঠাম কবজিতে।

জনের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে জানা থাকলেও চেহারায় চিনত অ্যারেনবার্গ। তবে কল্পনায় যে ছবিটা এঁকেছিল, তার সঙ্গে মিলে গেছে প্রায়।

আহামরি কোনও চেহারা নয় জন ডিউকের। মিশ্র রক্ত রয়েছে বোধ হয় শরীরে, ভাবল। মুখটা লম্বাটে। ক্লিন শেভড। চিবুকে খাঁজ আছে। চোখের দৃষ্টিটা ভাসা ভাসা। কবিদের মতো। সাধারণ বেশবাস। তার পরও কী যেন। রয়েছে, লোকটার টোটাল অ্যাপিয়ারেন্সে। একবার তাকালে সহজ নয় চোখ সরানো।

কী নাম আপনার মেয়ের?

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অ্যারেনবার্গ, দেখল, টেবিলে রাখা ফোটোগ্রাফটার দিকে তাকিয়ে আছে এজেন্ট ডিউক।

পরক্ষণে তাকাল চোখ তুলে।

কন্যার ছবির দিকে এক ঝলক চাইল বাপ। রেনেসমি।

দারুণ নাম তো! অর্থ কী?

অর্থ… আসলে আমিই বানিয়েছি নামটা… ডিকশনারিতে পাবেন না… অর্থটা আমারই দেয়া…

আই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট।

মানেটা হলো- রিবর্ন।

ইট স টু গুড। রিয়েলি।

থ্যাঙ্কস আ মিলিয়ন! খুশি উপচে পড়ছে গর্বিত পিতার চোখমুখ থেকে।

মেনশন নট। বাপ-বেটি পোজ দিয়েছে- ভাবছে জন মা নেই কেন? সেপারেটেড? হবে হয়তো।

কাল রাতেই জেনেছি এভিডেন্সগুলো সম্পর্কে। ফ্যাক্স করে দিয়েছে ইনফোগুলো, চট করে কাজের কথায় চলে এল। এজেন্ট অ্যারেনবার্গ। কেসটা নিয়ে কিছু হোমওঅর্ক করেছি আমি। সবগুলো আলামত মিলিয়ে খসড়া ডিসিশন তৈরি করেছি একটা। দেখবেন?

আগ্রহের সঙ্গে।

ডেস্কের উপরেই ছিল কাগজপত্রগুলো। হলদে রঙের এক প্লাসটিক ফোল্ডার তুলে নিয়ে জনের দিকে বাড়িয়ে ধরল। অ্যারেনবার্গ।

ফোল্ডার খুলে তাতে মনোনিবেশ করল জন। মিনিট বিশেক লাগল দেখে শেষ করতে। একটা শব্দও করল না এই সময়টাতে।

বিশ মিনিট পর চেয়ারে হেলান দেয়া থেকে সোজা হলো অ্যারেনবার্গ। কেমন বুঝছেন? আপনি কি একমত আমার সঙ্গে? মেয়েদের প্রতি বিতৃষ্ণা… ঠিক আছে না? সেই তাড়না থেকেই খুন।

বিতৃষ্ণার কারণ?

এটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। ধরা যাক, স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে লোকটার…

উঁহু। সম্ভবত বিয়েই করেনি লোকটা। খুব সম্ভব সেক্সও করেনি কোনও দিন।

অবাক হলো লি অ্যারেনবার্গ। বলতে চান, যৌন-বিষয়ে অনীহা রয়েছে খুনির? …অ, বুঝেছি। লোকটা ওকে রেপ করেনি… কোনও রকম ক্ষতি করেনি যৌনাঙ্গের… এই তো আপনার পয়েন্ট?

হুম, বলল জন মাথা নেড়ে।

আমার কী মনে হয়, জানেন? শিকারি ও শিকারের পূর্ব পরিচয় ছিল।

কীভাবে?

ডাক্ট টেপ। কীভাবে পেঁচিয়েছে, খেয়াল করেননি? শুধু চোখ আর মুখ। মুখ না হয় বেঁধেছে চিৎকার করবে বলে। কিন্তু চোখ? চোখ কেন বাঁধল! চিনে ফেলার ভয়ে? না। যাকে সে মেরেই ফেলছে, যা-ই দেখুক না কেন সে, বলবে কার কাছে? চোখে টেপ পেঁচানোর একটাই ব্যাখ্যা: মেয়েটার চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনি খুনি। কোনও ভালো মানুষকে মন্দ হিসেবে আবিষ্কার করলে যেরকম বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় লোকে, সেই চোখে চোখ রাখাটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। সম্ভবত অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করেছিল খুনি… অপরিচিত লোকের বিবেকের দংশনে ভোগাটা একটু অস্বাভাবিক। কী বলেন?

যা বললেন। মনে মনে তারিফ করল জন অফিসারের।

লোকটা যদি ভিকটিমের সমাধিতে গিয়ে উপস্থিত হয়, একটুও অবাক হব না।

গিয়ে…?

ক্ষমা চাইবে মেয়েটাকে মারার জন্য। বলবে, কাজটা করে কেমন কষ্ট পাচ্ছে সে।

সম্ভব?

সম্ভাবনা আছে।

মেসেজটার ব্যাপারে কী বলবেন?

মেসেজ! কয়েকটা ভাজ পড়ল কপালে।

কিলার যে মেসেজ রেখে গেছে…

ও… মানে, বলতে চাইছেন, খুনি তার নৃশংসতা দিয়ে বোঝাতে চাইছে কিছু? লাশটা টুকরো-টুকরো করে বার্তা দিতে চাইছে কোনও?

না। প্লেইন অ্যাণ্ড সিম্পল- লিখিত বার্তা।

কোথায়?

যেখানে খুনটা হয়েছে।

কই, এমন কিছুর তো উল্লেখ পাইনি!

তার মানে, অন্যদেরও চোখ এড়িয়ে গেছে।

শিয়োর তো আপনি?

ইয়েস, আই অ্যাম।

পাঁচ

দিন।

খোলা জানালাপথে উজ্জ্বল সূর্যালোক ঢুকছে প্রায়ান্ধকার ঘরে।

আলোটা সবজে। লতাপাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসছে। মৃদু বাতাসে দুলছে দু দিকে টেনে দেয়া পরদাগুলো।

জানালার বিপরীতে বসে কাজ করছে লোকটা। সেই লোকটা। পিঠ খাড়া করে বসে ছোট চেয়ারটাতে। সাদা হাফ শার্টে পোলকা ডট।

বেশ কয়েকটা যন্ত্রপাতি তার সামনে। কলমের মতো অনেকটা। ধাতব জিনিসের গায়ে খোদাই আর মিনা করা হয় ওগুলো দিয়ে। একখানা ব্রাশ আর কাঠ কাটার একটা ছুরিও রয়েছে ডেস্কের উপরে।

চশমাটা নামানো।

একটা টাইপরাইটারও পড়ে আছে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে।

মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলল লোকটা। রাবারের দস্তানা পরা হাত তুলে নিল কলাই (Engrave) করার যন্ত্র। চোখা মাথাটা ভেজাল পাশে রাখা কালির দোয়াতে। তুলে এনে বাড়তি কালিটুকু ঝেড়ে ফেলল বোতলের মুখে কলমের টোকা দিয়ে। এবার আবার চোখ রাখল মাইক্রোস্কোপের আইপিসে।

হাত চলছে। বিশেষ কলমটা দিয়ে কী লিখছে সে, সে-ই জানে। আর জানে কেবল খোদা।

ছয়

দ্বিতীয় বারের মতো আসা। লি অ্যারেনবার্গের অবশ্য প্রথম বার। ( যথারীতি উঠল ভৌতিক আপত্তি। ভাবল জন: আমরা কি এতই খারাপ? নাকি বাইরের লোক বলে এই অপমান?

স্রেফ অগ্রাহ্য করল ও কুকুরগুলোকে।

শেরিফের রিপোর্ট খুঁটিয়ে পড়ল অ্যারেনবার্গ। বেশির ভাগ তথ্যই জানা। তবু ক্রস-চেক করে নেয়া। হতভাগিনীর ছবিগুলোও দেখল।

ইত্যবসরে ব্লাডহাউণ্ডের ভূমিকা পালন করল জন। একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে গরুখোঁজা করল ওঅশরুম। চোখ এড়িয়ে গেছে, এমন কিছুর আশায়।

ডেবরা জিলেট। ব্রিটিশ। বয়স বাইশ। পার্কিং এনফোর্সমেন্ট অফিসার। সদ্য মুভ করেছে নর্দার্ন ক্যালিফোরনিয়া থেকে। আকর্ষণীয়া। কিন্তু কোনও বয়ফ্রেণ্ড নেই। দারুণ ফ্রেণ্ডলি বলছে সবাই, গড়গড় করে বলে গেল অ্যারেনবার্গ। অনেকটা আপন মনে। অরেগনের শেষ মাথায় পাওয়া গেছে ওর কাপড়চোপড়গুলো। সুয়ারেজ লাইনে। ব্রা, প্যান্টি, ইউনিফর্ম… সব কিছুই রয়েছে। দলা পাকিয়ে রাখা হয়েছিল। কাপড় ঘেঁড়ার ধরন দেখে নিঃসন্দেহ, মেয়েটাকে টুকরো করার পর ছাড়ানো হয়েছে ওগুলো।

ব্যস্ততার মাঝেই কয়েকবার চকিত দষ্টি হানল জন বক্তার মুখের দিকে। অ্যারেনবার্গ যখন থামল, তখন ও পরীক্ষা করছে মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টের ট্রেটা।

একজন পার্কিং অফিসারের সাথে কীভাবে আলাপ হতে পারে কারও? আবার শুরু করল অ্যারেনবার্গ। সিম্পল। টিকেট খেয়েছিল খুনি। — কোনও মন্তব্য করল না জন। সঙ্গীর কথায় কান রয়েছে। নিজের কাজও করছে একই সঙ্গে। এ মুহূর্তে দেখছে সিঙ্কের উপরে লাগানো আয়ন

আমরা দেখতে পারি, ডেবরা জিলেট গত এক হপ্তায় কাকে-কাকে পার্কিং টিকেট ধরিয়ে দিয়েছে, বাতলাল। অ্যারেনবার্গ। হয়তো কোনও লিড পেয়ে যাব।

এবারও নিশ্চুপ রইল জন। অ্যারেনবার্গের মনে হলো, তার কথায় মনোযোগ নেই। এজেণ্ট ডিউকের। ধৈর্যহারা হলো সে। শুনছেন আপনি। আমার কথা?

তাকাল জন। ফের মন দিল কাজে।

কামন, ম্যান! মনে মনে গালি দিল একটা পোর্টল্যাণ্ড অফিসার। কী দেখছেন অত? আয়নার ভিতরে কী? খুনি ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডে পালিয়ে গেছে, ভাবছেন নাকি?

বিরক্ত হলেও কিছু বলল না জন। মনে পড়ল, জেফরির উপদেশ। সমঝে চোলো।

একটা অসন্তোষের বিষবাষ্প ঘনিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, সেটা আর হলো না। খুদে বার্তা এসেছে। দু জনেরই সেলফোনে। একই সঙ্গে।

চেক করে দেখা গেল, দুজনেই একই মেসেজ পেয়েছে।

সাত

ইউ.এস. পোস্ট অফিস। পোর্টল্যাণ্ড, অরেগন।

কাগজ আর আঠার মিষ্টি একটা মিলিত গন্ধ গোটা দালান। জুড়ে।

ডাক বিভাগের ভয়ার্ত কয়েক জন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলছে ইনভেস্টিগেশন অফিসাররা। নোট নিচ্ছে।

মাত্র পৌঁছেছে অ্যারেনবার্গ আর জন। জানে, কোথায় যেতে হবে। জানানো হয়েছে। সে উদ্দেশেই চলেছে।

আরেকটা খুন। এবারেরটা এখানে।

গাদা করে রাখা বাক্স সবখানে। অসংখ্য ফাইলিং ক্যাবিনেট। জায়গায় জায়গায় ক্যানভাসের বস্তা। হাঁটার জায়গা খুব কম।

চলতে চলতে জনের নজর আটকে গেল একখানা নির্দেশিকার উপর। ডেড লেটারস অফিস। পাশের দেয়ালে সাঁটা। তীরচিহ্ন নির্দেশ করছে। সামনে। সেদিকেই এগোচ্ছে। ওরা।

সামান্য আগে হাটছিল অ্যারেনবার্গ। থেমে পিছনে চাইল। দেখল, দাঁড়িয়ে গেছে জন ডিউক।

অ্যারেনবার্গ চাইতেই পা চালাল ফের জন। এগিয়ে গেল ওকে অতিক্রম করে।

অ্যারেনবার্গও দেখল নির্দেশিকাটা।

অসংখ্য মৃত চিঠির বোঝা বুকে নিয়ে থম মেরে আছে। ডেড লেটারস এরিয়া। কত বছর ধরে চিঠি জমা হচ্ছে। এখানে, কে জানে! মড়া-পচা গন্ধ যে নেই, বাঁচোয়া! আছে। রক্তের গন্ধ! টাটকা!

মুখে মাস্ক আর হাতে রাবারের দস্তানা পরে কাজ শুরু করে দিয়েছে টেকনিশিয়ানরা। ধুলো পরীক্ষা করে দেখছে। ছাপ-টাপ যদি পাওয়া যায়।

হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে গোটা এলাকা।

এলিভেটরের ভিতরে হয়েছে খুনটা। এটাও নারী। যথারীতি খণ্ডবিখণ্ড। নির্দেশ করছে: অভিন্ন খুনি করেছে খুনগুলো।

কালো প্লাসটিকে ঢাকা দেয়া লাশের শরীরটা। একখানা রক্তাক্ত উরু শুধু অনাবৃত। মাথাতেও প্লাসটিক-চাপা দেয়া হয়নি। কারণ, আগাগোড়া ডাক্ট টেপে মোড়া ওটা। আধুনিক মমি যেন।

নহর বইছে রক্তের। কালচে হয়ে আসছে রংটা। তারই মাঝে একটু পরে-পরে বসানো হয়েছে মার্কার। প্রাপ্ত

এভিডেন্সের সংখ্যা নির্দেশ করছে ওগুলো।

অদৃশ্য কোনও দেয়ালে বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে যেন অ্যারেনবার্গ। মমি করা মাথাটার দিকে চেয়ে রয়েছে। খুনের নৃশংসতায় বিহ্বল। বেশিক্ষণ দেখতে পারল না দৃশ্যটা। তাড়াতাড়ি সরে গেল আরেক দিকে।

এক জোড়া গ্লাভ টেনে নিল জন। সাবধানে পা ফেলে এগোল। বিচ্ছিন্ন মাথাটার পাশে বসল উবু হয়ে।

রক্ত। রক্ত। রক্ত। চামড়া। মাংস। হাড়। ভুরভুর করছে। বাজে গন্ধ। কোত্থেকে যেন হাজির হয়েছে এসে কয়েকটা নীল। মাছি। মহাভোজ আজ তাদের।

কিছু একটা মনোযোগ কাড়ল জনের। কুচকে গেল ভুরু।

টেপ! চাইল সে কাছের টেকনিশিয়ানের কাছে। নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। হাতের বুরুশ আর ফ্ল্যাশলাইটটা নামিয়ে রাখল কিটে। তারপর একটা রোল তুলে নিয়ে লম্বা এক ফালি টেপ খুলে ছিঁড়ে আনল লোকটা ওটার গা থেকে। হাত বাড়িয়ে রয়েছে জন, হস্তান্তর করল ওকে স্ট্রিপটা।

স্কচটেপটার এক মাথা ডাক্ট টেপের গায়ে সেঁটে দিল জন। অন্য প্রান্তটা ধরা রইল আঙুলে। অ্যাসিটেট চাইল সে এবারে।

কখানা শিট এগিয়ে দিল টেকনিশিয়ান।

নিল জন একটা। এবার ডাক্ট টেপে লাগানো অংশটা খুলে স্থাপন করল স্বচ্ছ প্লাসটিক-শিটে।

না চাইতেই ম্যাগনিফাইং গ্লাস এগিয়ে দিল টেকনিশিয়ান। বিশেষ ধরনের আতশি কাঁচ এটা। আলো জ্বালবার ব্যবস্থা রয়েছে।

চোখে কাঁচ লাগিয়ে টেপটা দেখল জন।

আরেকটা মেসেজ!

স্মরণ করল প্রথমটার কথা। লেন্স নামিয়ে বিড়বিড় করল, হেয়ার টুডে… গন টুমরো! হেয়ার টুডে… গন টুমরো!

আট

HAIR TODAY. GONE TOMORROW.

পোলারয়েড ইমেজ নেয়া হয়েছে বাক্য দুটোর। এক হাজার গুণ বড় করে। বড় একটা হার্ডবোর্ডে সাঁটা। বোর্ড পিন দিয়ে।

অ্যারেনবার্গের অফিস।

বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা আমাদের জন্য, সখেদ মন্তব্য তার। কত্ত বড় সাহস! খুন করে আবার মেসেজ রেখে যায়! গাধা পেয়েছে নাকি আমাদেরকে!

অ্যারেনবার্গের উত্তেজনাটা উপভোগ করছে জন । বসে রয়েছে সে। জ্যাকেট খুলে চড়িয়ে দিয়েছে চেয়ারের পিঠে।

অপর জন দাঁড়িয়ে। একটু পর-পর পায়চারি করছে।

আরও কিছু শুনবার আশায় চুপ করে রইল জন।

হেয়ার টুডে। আমরা ওর চুল পেয়েছি। বয়স্ক লোকটা। তা-ই বলছে চুলের রং। কিন্তু গন টুমরো মানে কী?

দুই লাশের অনেকগুলো করে ছবিও লাগানো হয়েছে বোর্ডে। সেগুলোতে চোখ বোলাতে লাগল অ্যারেনবার্গ। মনে হয়, বুঝতে পেরেছি। চুলটা বোধ হয় আসল না। মানে, ওর না। অন্য কারও। নিজেকে যেরকম চালাক ভাবে লোকটা, ডিএনএ টেস্টের সুযোগ দেয়ার কথা না তার।

গুড শট, অফিসার, উৎসাহ দিল জন।

পুলিসের লোক হতে পারে? এক্স?

ঠাস করে খুলে গেল দরজাটা, কোনও উত্তর দেয়ার আগেই। আব্বু! আব্বু! বলতে বলতে দৌড়ে ঢুকল কামরায় রেনেসামি। দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে সামনের দিকে। আশা করছে, কোলে তুলে নেবে ওকে ওর আব্বু।

কিন্তু তার বদলে শুনতে হলো ধমক।

যে মুহূর্তে উপলব্ধি করল অফিসার, রক্তমাখা ছবিগুলো দেখে ফেলবে মেয়েটা, সামলাতে পারল না নিজেকে। আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হলো, বেরোও! যাও, বলছি!

ফোলানো একটা বেলুন ঠুস করে চুপসে গেল যেন। ছোট্ট মেয়েটার মুখের হাসি নিভে গেল দপ করে। কাঁচের হৃদয়, ঠুনকো বড় ভেঙে চুরমার। নত হতে হতে বুকের সঙ্গে লেগে গেল চিবুকটা।

ঝড়ো বেগে ঘুরে দাঁড়াল বাচ্চাটা। ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের উপর। একটা পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজল উরুতে। ফোঁপানির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

এই মাত্র উদয় হয়েছে মহিলা। সুশ্রী। ব্যক্তিত্বসম্পন্না। কোঁকড়া, বাদামি চুলে ভরা আত্মজার মাথাটা চেপে ধরল গায়ের সঙ্গে। কটমট চোখে চাইল সাবেক স্বামীর দিকে।

তুমি কি মানুষ, লি! নগ্ন ভর্ৎসনা। তোমাকে দেখার জন্য খেপার মতো হয়ে ছিল মেয়েটা। সারাক্ষণ এক কথা: শুক্রবার কবে আসবে। বলল চিবিয়ে চিবিয়ে, আর তুমি!

ক্রন্দনরত মেয়েকে কোলে তুলে নিল ওর মা। চুকচুক শব্দ করল মুখ দিয়ে। চলো, আম্মু। এই আব্বুটা না পচা একদম!

গটমট করে কামরা ছাড়ল ভদ্রমহিলা।

পস্তাচ্ছে লি। ভীষণ বিব্রত। চট করে তাকাল জনের দিকে।

গো! চাপা গলায় হুঙ্কার দিল জন।

জিনা! জিনা! ডাক পাড়তে পাড়তে বউ-বাচ্চার পশ্চাদ্ধাবন করল অ্যারেনবার্গ।

বেশি দূর যায়নি মহিলা। হলওয়ে থেকে ওদের টুকরো টাকরা কথা কানে এল জনের। কল্পনায় দেখল, বাপের কোলে এখন পুঁচকি মেয়েটা। জড়িয়ে ধরে রেখেছে পচা আব্লুটার গলা। বাচ্চার মন- রাগ, ক্ষোভ, অভিমান মুহূর্তেই উধাও।

…তোমাদের না চারটায় আসার কথা!

…কী করব! জেদ ধরল রেনিটা। ও নাকি সারপ্রাইজ দেবে তোমাকে।

…রেনি আবার কী!

…ও-ই হলো। অত বড় নাম আওড়ানো যায় নাকি!

…দেখো, রেনির মা–

…এই যে… তুমিও বললে।

…ভুল করে বলেছি… স্লিপ অভ টাং।

…বাবা, জানো, আমাদের ক্লাসে না ছেলে আছে একটা। নাম হচ্ছে- ওমাং। আমরা বলি- ওরাংওটাং। হি-হি!

…ছি-ছি, মা! বলতে নেই এসব। যিশু আঙ্কেল রাগ করবে।

মুচকি একটু হাসল জন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেল ডিসপ্লে-বোর্ডের দিকে। এক-এক করে নামিয়ে ফেলল সবগুলো ছবি।

নয়

দস্তয়েভস্কির একটা কথা আছে। নিভৃত জীবনের চাইতে দুঃখময় আর কিছু নেই। বন্ধু নেই, স্বজন নেই। কারও যেন কিছু এসে যায় না হতভাগ্য মানুষটির নিঃসঙ্গতায়।

সিরিয়াল কিলাররা নিঃসঙ্গ। এই লোকও তার ব্যতিক্রম নয়। ভিকটিমের উপর যেভাবে আক্রোশ দেখিয়েছে, সেটা তার পুঞ্জীভূত রাগেরই বহিঃপ্রকাশ।

কেন এই ক্ষোভ? একাকী বলে? নিজের ঘৃণা তাকে প্ররোচিত করছে বাইরের জগত্তার উপর নিষ্ঠুর হতে। তবে কি ওর একাকীত্বের জন্য সভ্য জগতের কেউই দায়ী? কোনও মেয়ে? প্রতারণা, প্রত্যাখ্যান, বিশ্বাসঘাতকতা? নাকি চাকরিচ্যুতি, অবমূল্যায়ন, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা? …মহিলা বস?

যৌন-হতাশা থেকে যে খুনগুলো করেনি, এটা তো পরিষ্কার। যৌন-নির্যাতনের কোনও চিহ্নই নেই মৃতার দেহে।

ভাবো, জন, ভাবো।

পোস্টমর্টেম বলছে: ডাক্ট টেপের কারণে মৃত্যু হয়নি ভিকটিমের। নাকের ফুটো ছিল উন্মুক্ত। শুধু মুখ আর চোখ বন্ধ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, সারা মুখে টেপ পেঁচানোর কারণ কী? লোকটা কি কোনও ইঙ্গিত দিতে চাইছে যে, আমার কোনও মুখ নেই! পোস্ট অফিসের ডেড লেটারের মতো জীবন আমার। গন্তব্যহীন। বেঁচে থেকেও মৃত। সম্ভবত বলতে চাইছে, ওর কোনও পরিচয় নেই। বড় ধরনের কোনও অন্যায়ের শিকার? ভাতা বন্ধ? ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে? সব রকম লাইসেন্স বাতিল? কোনটা? নাকি সবগুলোই?।

ডেয়ার-ডেভিল, সন্দেহ নেই। আলামত রেখে যাচ্ছে। পরোয়া করছে না কোনও কিছুর। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ধরা পড়বে না যেন।

কিন্তু আমরা জানি, অহঙ্কার পতনের মূল।

দশ

আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্কিং গ্যারাজ। সেন্ট জোসেফস হসপিটাল। পোর্টল্যাণ্ড, অরেগন।

নার্সের পোশাকটা গা থেকে খোলেনি ক্যারোলিন। ভীষণ টায়ার্ড। একেবারে বাসায় গিয়েই খুলবে। টানা ডিউটির ধকল সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! তার উপর করতে হয়েছে

ওভারটাইম। ও সাদা ড্রেসটার উপরে বোতাম খোলা কার্ডিগান চড়িয়েছে মেয়েটা। সবুজ রং- বটল-গ্রিন। ডান কাঁধে ব্যাগ। চাবির রিং ঝুলছে আঙুল থেকে। আরেক হাত অ্যাপ্রনের পকেটে।

দাঁড়িয়ে গেল হাঁটতে হাঁটতে।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। বুটের মচমচ। বিশাল পার্কিং লেভেলের থমথমে পরিবেশের কারণে জোরাল।

ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর তীব্র আলোয়। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ আড়াল করল স্বর্ণকেশী ক্যারল। ঘাড় কাত।

কে যায়? শুধাল টর্চধারী।

কে? লোকটার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না নার্স। প্রদীপের নিচে অন্ধকার।

সিকিউরিটি।

আলো সরান! বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলল ক্যারোলিন। কুঁচকে রেখেছে চোখ দুটো।

মালটা ভালো, মনে মনে মন্তব্য করল প্রহরী। মুখের কাটিংটা জোস। মোম-তেলতেলে নাক। মরাল গ্রীবা। ম্যাট লিপস্টিক দেয়া আকর্ষণীয় ঠোঁটের ফাঁকে চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে অল্প একটু। ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে লাগল আলোটা। উঁচু বুক। নামটা পড়ল নেমপ্লেট থেকে। …নির্লোম পা। হলিউডে যায় না কেন এই মেয়ে, ভাবল সে। গলার আওয়াজটাও ভারি ভালো মেয়েটার।

দপ করে নিভে গেল টর্চটা।

চোখ জোড়া স্বাভাবিক হয়ে এল ক্যারলের। শান্তি! নামাল হাতটা। সোজা হলো ঘাড়।

গার্ডের ইউনিফর্ম পরা এক লোক। মোটাসোটা। চেহারাটা পরিষ্কার না এখনও। আলোকস্বল্পতা। ক্যাপ আছে মাথায়।

গুড নাইট, ম্যাম। সরি। কর্তব্যজ্ঞানের সঙ্গে ভদ্রতাবোধও রয়েছে নিরাপত্তা রক্ষীর। চলে গেল আরেক দিকে।

বড় করে দম নিল ক্যারল। স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বাতাসে।

বিরাট সব পিলারের পাশ কাটিয়ে নিজের জেলপির কাছে চলে এল সে এপাশ-ওপাশ চাইতে চাইতে। চাবি ঢোকাল দরজার তালায়। মোচড় দেয়া মাত্রই

হেল্প! হেল্প! পুরুষকণ্ঠ একটা।

গলা বাড়িয়ে চাইল ক্যারল। গাড়ির ওপাশ থেকে এসেছে আবেদনটা। ভালো করে দেখার জন্য সরু করল চোখ দুটো।

মাইক্রোবাস, মনে হচ্ছে। গজ তিরিশেক তফাতে। একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। হুম… গাড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। হাত জোড়া বন্ধ তার; এক গাদা জিনিসপত্র ধরে রেখেছে বুকের কাছে।

কী হয়েছে? বাতাসে প্রশ্ন ছুঁড়ল ক্যারোলিন।

চশমা! কাঁদো কাঁদো শোনাল গলাটা। চশমাটা পড়ে গেছে আমার! ফোঁপানির মতো একটা আওয়াজ বেরোল। সাহায্য করো, মিস! প্লিজ! কাতর আর্তি। চশমা ছাড়া কিছুই দেখি না আমি!

ওকে-ওকে! আসছি আমি! বিরক্ত স্বরে বলল ক্যারোলিন। মহা জ্বালা!

কমলা বাসটার কাছে এসে দেখতে পেল, ভারি জিনিসগুলো নিয়ে রীতিমতো কসরত করছে লোকটা। চোখ ছাড়া গোটা মুখটাই পড়ে গেছে আড়ালে। লালচে চুল, কোঁকড়া। হাফ শার্ট গায়ে। হাত ভর্তি বড় বড় লালচে রোম। রিস্টওঅচটা গাবদা।

মাইক্রোর দরজাটা খোলা। রেড ক্রসের লোগো সম্বলিত স্টিকার কালো কাঁচে: হিউম্যান ব্লাড সাপ্লাই।

কোথায় পড়েছে? জানতে চাইল নার্স।

জবাব পেল: এখানেই।

হাঁটু মুড়ে বসল ক্যারোলিন। তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল আশপাশটা। কই, দেখছি না তো! ছাড়ল না হাল। দাঁড়ান… তলাটায় দেখি একবার…

উবু হলো। গাড়ির গায়ে একটা হাত রেখে উঁকি দিল তলায়। আহ… এই যে!

পেয়েছ, মিস?

হ্যাঁ। গাড়ির নিচে হাত ঢুকিয়ে দিল নার্স। বেশ দূরে চলে গেছে চশমাটা। অবশ্য রয়েছে নাগালের মধ্যে। তুলে আনল ওটা।

ফুঁ দিল ক্যারোলিন চশমাটায়। ভাঙে-টাঙেনি, মনে হচ্ছে। সিধে হতে হতে বাড়িয়ে ধরল ওটার মালিকের দিকে। এই নিন।

জিনিসগুলো গাড়ির ভিতর নামিয়ে রেখেছে হাফ শার্ট। ধক করে উঠল ক্যারলের বুকটা। কৃতজ্ঞতা নয়, পাশবিক ক্রোধে মুখটা বিকৃত লোকটার। হাতে একটা হাতুড়ি এখন।

ধাঁই করে মেরে বসল মেয়েটার মাথায়। ঢ্যাপ!

এবার দু টুকরো হলো চশমাটা। সহস্র সূর্য জ্বলে উঠল ক্যারোলিনের মগজে। তারপর… সমস্তই আঁধার।

এগারো

আরও একটা খুন।

এবং যথারীতি খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে লাশটা।

টুকরোগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। যেখান যেখানটায় পাওয়া গেছে, আউটলাইন করা হয়েছে চক দিয়ে। আটটা জায়গায়- A থেকে H পর্যন্ত মার্কা।

মার্কা আরও আছে। সূত্র খোঁজা অব্যাহত রয়েছে অকুস্থলে। খুনের সঙ্গে যোগ রয়েছে বলে সন্দেহ হচ্ছে, এরকম প্রত্যেকটা আলামতের পাশে ১, ২, ৩, ৪ করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে মার্কা।

ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে লোকটা। জনের চেহারা থমথম করছে গাম্ভীর্যে। বেপরোয়া আর আত্মবিশ্বাসী।

বেপরোয়া, বুঝলাম, দ্বিধাজড়িত গলায় বলল অ্যারেনবার্গ। আত্মবিশ্বাসী?

ঠিক তা-ই। যেখানে অ্যাটাক, সেখানেই মাংসের দোকান খুলে বসেছে এবার।

কই, গার্ড তো বলছে, অস্বাভাবিক কিছুই ধরা পড়েনি ওর চোখে! মারা যাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিল। তার। পুলিসী তদন্তেও প্রমাণ মেলেনি যে, এখানেই হয়েছে। খুনটা।

গ্যারাজের মেঝেতে গোড়ালির ভর দিয়ে বসল জন। দেখাদেখি অ্যারেনবার্গও। হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা নামিয়ে রাখল জন মাটিতে। আলোয় দৃশ্যমান হলো কয়েক ফোঁটা রক্ত।

এই ফোঁটাগুলোর প্যাটার্ন লক্ষ করুন। দৃষ্টি আকর্ষণ করল জন। ক্রাইম সিন থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়েছে। বাইরে থেকে আসেনি ভিতরে।

কীভাবে বুঝলেন?

দেখতেই পাচ্ছেন… ঠিক গোলাকার নয় ড্রপগুলো… লম্বাটে… অনেকটা ধূমকেতুর মতো… লেজটা এক্সিটের দিকে…

দারুণ আবিষ্কার! উত্তেজিত হয়ে উঠল অ্যারেনবার্গ। আরও একটা মানে দাঁড়ায় কিন্তু এটার!

কী?

বোঝেননি আপনি? ,

বলুন, শুনি। দেখি, আমি যা বুঝেছি, আপনিও তা-ই ভাবছেন কি না।

দম নিল অ্যারেনবার্গ। গাড়ি। ভ্রাম্যমাণ কসাইখানা।

ভুল নেই তাতে।

খুব সম্ভব এখানেই ছিল গাড়িটা। গাড়ির মালিক আক্রমণ করে মেয়েটাকে; যদি কোনও সঙ্গীসাথী না থেকে। থাকে লোকটার। বাড়ি-টাড়ি মেরে বেহুঁশ করে নিয়েছিল। সম্ভবত। চিৎকার করতে পারেনি। তারপর তো টেপ দিয়ে বন্ধই করে দিল মুখ। …গাড়িতে তুলল, এবং ফলাল কসাইগিরি। লাশের টুকরোগুলো ফেলে পালানোর সময়। যেভাবেই হোক, গাড়ি থেকে চুঁইয়েছে রক্ত।

দশে দশ।

এসব কাজের জন্য মাইক্রোবাসের বাড়া কিছু নেই।

হুম।

কিন্তু খুঁজব কোথায়? হতাশার সুর অ্যারেনবার্গের কথায়। সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও হতো।

জবাব দিল না জন। অন্য দিকে সরে গেছে মনোযোগ।. সিধে হয়ে আগে বাড়ল দু কদম ঝুঁকল মাটির দিকে। ভাঙা

একটা কাঁচের টুকরো কুড়িয়ে নিল দস্তানা পরা হাতে।

চোখের সামনে ধরল সে কাঁচটা। পুরু ওটা। বেশ পুরু।

অ্যারেনবার্গও এসে দাঁড়িয়েছে জনের পাশে। জনের কাছ থেকে কাঁচটা নিয়ে দেখল সে-ও।

বাঁ দিকের লেন্স… যা মনে হচ্ছে,  মন্তব্য তার।

কালপ্রিটের, সন্দেহ করছেন?

সন্দেহ নয়, আমি নিশ্চিত।

কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না লি। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, চশমার দোকানে খোঁজ নেয়া যায়। এত, ভারি পাওয়ারের চশমা… কে ব্যবহার করে, খুঁজে বের করা সহজই হওয়ার কথা।

বারো

সুভেনিয়ার জমানোর বাতিক রয়েছে লোকটার। শিকারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে স্মারক। তবে চাইলেই তো আর দেবে না কেউ। অতএব, মৃত্যুর পর…

ক্যারোলিন বার্কলের বুক থেকে খুলে নিয়েছে প্লাসটিকের নেমট্যাগ।

পোস্টাল সার্ভিসের মেয়েটার কাছ থেকে নিয়েছে প্যান্টি চিড়িয়াখানার সেই গার্ডের কাছ থেকে পেয়েছে হুইসল।

ফ্রণ্ট পেজে ছেপেছে খবরটা। প্রধান শিরোনাম করেছে। এবার হাসপাতালে: নৃশংস ভাবে খুন হলো নার্স।

টেবিলের দেরাজ থেকে কচি বের করল খুনি। কেটে রাখবে খবরটা। আরেকটা হবি ওর। নিজের কর্মকাণ্ডগুলোর পেপার-কাটিং জমায়। [ কাজ শেষ করে স্ক্র্যাপ-বইটা তুলে আনল ড্রয়ার থেকে। কালো চামড়ার মলাট। নিচের দিকে রূপার জলে খোদাই করা: স্মৃতি।

প্রথম পৃষ্ঠার হেডিং: হতভাগ্য তরুণীকে ১১ টুকরো করল পাষণ্ড খুনি! ইউনিফর্ম পরনে ছবি আছে মেয়েটার। পাশেই ক্যাপশন সহ ক্রাইম সিনের ছবি। কিছু-কিছু অংশ ঘোলা করে দেয়া হয়েছে পত্রিকার এথিকস অনুসারে।

ডাক বিভাগের কর্মী খুন, এলিভেটরে খণ্ডিত লাশ! দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়। সচিত্র এটাও।

নতুন একটা পাতা খুলল খুনি। তুলি চুবাল আঠার ডিব্বাটায়। নতুন ক্লিপিং-এর উলটো পিঠে চালাল ব্রাশটা। কাগজটা আবার সোজা করে বসিয়ে দিল স্ক্র্যাপবুকের কালো বুকে। আলতো হাতে ডলে ডলে সমান করতে লাগল কিনারাগুলো। সচিত্র প্রতিবেদনটার উপরে আগেই সেঁটেছে খবরের কাগজটার নাম। পোর্টল্যান্ড হেরাল্ড।

এবার পড়বে।

পড়তে পড়তে থেমে গেল এক জায়গায় এসে। লিখেছে: নিহত নার্সের স্মরণে আজ সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালন করা হবে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।

মুচকি হেসে ভাবল: আরেকটু সাহসী হওয়া যাক না! …হবে?

তেরো

সেই সাঝ থেকে ঠায় অপেক্ষায়, এখন রাত দেড়টা। ছায়ায় দাঁড়ানো কালো গাড়িটা আলাদা করে কেউ লক্ষ না করলেও বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে, ওটার। কালো কাঁচ-ঢাকা গাড়ির ভিতরে তিন জোড়া সতর্ক চোখ। কেন জানি মনে হচ্ছে জনের, ঘটবে কিছু একটা। ইন্সটিঙ্কট। এত দিন ধরে হমিসাইডে কাজ করার কারণে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর ওর।

সেইন্ট জোসেফ স হসপিটাল– ইমার্জেন্সি অ্যাডমিটিং লেখাটার নিচে ডান দিকে তীর চিহ্নঅলা জ্বলজ্বলে নিয়ন সাইন। ওটার পাশেই স্মৃতিতর্পণের ব্যবস্থা। ওই পর্ব শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। শোকার্তরা ফিরে গেছে যার-যার জীবনে।

অদূর থেকে নজর রাখছে ওরা জনরা।

ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে জায়গাটা। ঘাস-ঢাকা গোল একটা অংশ। ইট দিয়ে ঘেরা। ক্যারোলিন বার্কলের বড় একটা বাঁধাই করা ছবির সামনে মোমবাতির ইতস্তত সারি। দু-একটা ছাড়া বাকি সব শেষ হয়ে গেছে গলে গলে। বড় একটা জপমালা ঝুলছে ফোটোফ্রেমের এক কোণ থেকে। ক্যারোলিনের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাডোনা। প্রার্থনার ভঙ্গিতে দু হাত বুকের কাছে জড়ো করা ছোট সিরামিক মূর্তিটার। সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে লাল রঙের ব্যানার। নিহত নার্সের নাম লেখা ওতে। এক ধারে কাঠের অলঙ্কৃত ক্রুশ। বাইবেলও রয়েছে একটা।

ফ্লোরেসেন্ট আলোয় আলোকিত চত্বরটা নির্জন। উলটো পাশের রাস্তার পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে জনদের গাড়িটা। কিছু করার নেই আপাতত। বসে বসে চোখ রাখা শুধু। হাসপাতাল ছাড়া দুটো টেলিফোন বুথ আর দূরে একটা গ্যাস পাম্প দেখতে পাচ্ছে গাড়ি থেকে। জনবিরল পাম্পটা দেখে মনে হচ্ছে, পড়ে আছে নষ্ট হয়ে। ব্যবহার হয় না। তা গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে সময়। অস্থির বোধ, করছে অ্যারেনবার্গ। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে টেনশনে স্টাইরোফোম কফিকাপ ছিঁড়ছে। পিছন থেকে ওর নার্ভাসনেস লক্ষ করছে ডিটেক্টিভ হুইটলি। সামনে জন।

শুধু শুধু বসে আছি কেন? এই নিয়ে এক শ বারের মতো প্রশ্নটা করল অ্যারেনবার্গ।

জবাব দিল না কেউ। তাতে বিরক্তি আরও বাড়ল পোর্টল্যাণ্ড পি. ডি. অফিসারের।

ভোর হওয়া তক থাকতে চান? জিজ্ঞেস করল ডিটেক্টিভ।

অত লাগবে না, বলল জন।

মৃদু নড করল হুইটলি।

হাতের রেডিয়োতে কথা বলল জন। অল ইউনিটস। দিস ইজ চার্লি ওয়ান।– ছায়া থেকে বেরিয়ে এল এক পুলিস অফিসার। হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডের ছদ্মবেশে রয়েছে। আড়াআড়ি পেরিয়ে গেল চত্বরটা। এক হাত কানের কাছে। নির্দেশ শুনছে কমাণ্ডারের। অন্য হাতে পরা ঘড়ির দিকে তাকাল।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাততাড়ি গোটাব আমরা,  বলে চলেছে জন। শেষ বারের মতো চেক করে নিন আশপাশটা।

কপি, শোনা গেল রেডিয়োতে।

চলে যাচ্ছে গার্ড। এমন ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে চারপাশে, যেন শিফট শেষ হওয়ার আগে দেখে নিচ্ছে, সব কিছু ঠিক আছে কি না। একটু পরে আর দেখা গেল না তাকে। তা ছদ্মবেশী অফিসার গায়েব হতেই যেন প্রকাশ্যে এল একাকী এক লোক। মেমোরিয়ালটার দিকে পা চালিয়ে চলেছে। পিছনে তাকাল একটি বার। গাড়িতে বসা তিনজনেরই মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে; বিশেষ করে, অ্যারেনবার্গ আর জনের।

অল ইউনিটস,  তৎপর হলো জন। ফিসফিসিয়ে বলল, স্পটের দিকে এগোচ্ছে সন্দেহভাজন।

ক্যারোলিন বার্কলের ছবির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল লং কোট পরা লোকটা।

অ্যাকশন! তীক্ষ্ণ স্বরে নির্দেশ দিল জন। দিয়েই বসে থাকেনি, ঝোড়ো হাওয়ার মতো দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে।

ওদিকে ওর কথা মাটিতে পড়ার আগেই ওত পেতে থাকা শ্বাপদের মতো জায়গায় জায়গায় জ্বলে উঠল গাড়ির চোখগুলো। ছদ্মবেশী পুলিস কার ওগুলো। ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সজাগ হয়েছে। কালো পিচের উপর টায়ারের ঘষা খাওয়ার বিশ্রী, কর্কশ শব্দ উঠল। সব ক টা সাইরেন মহা বিপৎসঙ্কেত ঘোষণা করছে একযোগে।

জুতো পরা পায়ের আওয়াজ অনেকগুলো। ব্যস্ত। দৌড়চ্ছে। জন আর অ্যারেনবার্গও রয়েছে এদের মধ্যে।

সবার আগে লোকটার কাছে পৌঁছল অ্যারেনবার্গ। ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্দেহভাজন। পালাবার আগেই পাকড়াও করে ফেলল ওকে অ্যারেনবার্গ। এই মাত্র ওখানে পৌঁছনো পুলিসের এক গাড়ির ইঞ্জিন-হুঁডের উপরে দড়াম করে আছড়ে ফেলল সাসপেক্টকে। কোনও রকম প্রতিরোধেরই সুযোগ পেল না লোকটা। চেষ্টা করল মাথা তুলতে। বেমক্কা এক ঘুষি খেয়ে হুডের সঙ্গে বাড়ি খেল। মাথাটা।

প্রথমটার চাইতেও জোরদার আরেকটা ঘুষি হাঁকাতে যাচ্ছিল অ্যারেনবার্গ, জন ওকে না আটকালে ঘটে যেত রক্তারক্তি। দুটো কঠিন হাত ওর কাধ ধরে ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে। ঝাঁকানি দিল জোরে।

জোরাজুরি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অ্যারেনবার্গ। ফুঁসছে। হাঁপাচ্ছে।

এবার এক কদম আগে বেড়ে মার খাওয়া যুবকের বাহু পাকড়াল জন। অনেকগুলো উদ্যত পিস্তল কাভার করছে। লোকটাকে। জনের হাতটা নেমে এল যুবকের কবজিতে। একটা ব্রেসলেট ওখানে। ফ্যাশন করার জন্য পরা হয়নি। হসপিটাল আইডি ওটা। প্লাসটিকের বালাটা ধরে গরম চোখে চাইল জন অ্যারেনবার্গের দিকে।

এখানকার পেশেন্ট তুমি? যুবকের দিকে ফিরে জানতে চাইল জুন।

মাথা নাড়ছে ছেলেটা। ঘোলাটে ভাবটা দূর করতে চাইছে চোখ থেকে।

হ্-হ্যাঁ! বলল অস্ফুটে। আমার কোনও দোষ নেই, স্যর! বিশ্বাস করেন, স্যর, যদি জানতাম, এখানে আসা নিষিদ্ধ, বেরই হতাম না কেবিন থেকে!

কিন্তু কোন রাজ্য উদ্ধার করতে এসেছ এখানে? রাগত স্বরে বলল জন।

মেয়েটা আমার নার্স ছিল, স্যর। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলাম ওকে। কিন্তু অনুমতি দিল না আমার ডাক্তার। সেজন্য… চুপি চুপি…

একজন অফিসারের দিকে চাইল জন। ওকে ওর কেবিনে নিয়ে যান, প্লিজ।

হাতের পিস্তলটা খাপে ভরল অফিসার। আসুন।

এবার আবার অ্যারেনবার্গের দিকে ঘুরল জন। লোকটার বাহু খামচে ধরে সরিয়ে নিয়ে এল দূরে। রাগে থমথম করছে। মুখটা।

আমি ভেবেছিলাম, ওই লোকই আমাদের কালপ্রিট! আত্মরক্ষার চেষ্টা করল অ্যারেনবার্গ। আমরা সবাই-ই তা-ই ভেবেছিলাম।

ভাবাভাবি পরে! কথা নেই, বার্তা নেই, ঘুষোঘুষির মানে কী, অ্যাঁ?

কাম ন, জন! লোকটা সত্যি সত্যি কালপ্রিট হলে তো এ কথা বলতেন না! একটা হারামজাদা আপনার বউকে এক শ টুকরো করলে সবার আগে আপনিই ওকে কুপোকাত করতেন এক ঘুষিতে!

কে আপনার বউকে এক শ টুকরো করল! খোঁচাটা ফিরিয়ে দিল জন।

আরেক দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল অ্যারেনবার্গ।

ওর উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল জন। তাকাল স্মারকের স্তূপটার দিকে।

অভিযানটা মাঠেই মারা গেল তা হলে! ফলল না সম্ভাবনাটা। এলই না খুনি!

চোদ্দ

টাক মাথা। শুধু কানের উপরে আর মাথার পিছন দিকে টিকে গেছে ক গাছি চুল। লালচে। বাইফোকাল চশমা চোখে গাল দুটো পানি ভরা বেলুনের মতো। যেন-তেন ভাবে পরা কালো জ্যাকেটের গলার কাছ আর হাতার নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা শার্টের অংশ। মুঠি দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে আছে লোকটা।

সুদর্শন, কিন্তু বিষণ্ণ চেহারার এক যুবক। বাদামি চুল। পরে আছে সুট-টাই।

পরের জন। খয়েরি চুল। একই রঙের জ্যাকেট। চেইন খোলা। নিচে পোলকা ডটের শার্ট। বেদনায় কুঁচকে রয়েছে কপাল।

সাদা শার্টের উপরে ধূসর ওভারকোট চাপিয়েছে তার। পরের জন। লাল টাই। পরিপাটি করে আঁচড়ানো কালো চুল। লম্বা জুলফি। শেয়ালের মতো চোখা কানের আগা। পাথুরে মুখে তেমনই অভিব্যক্তি।

সিসিটিভি ফুটেজ দেখছে জন অ্যারেনবার্গের অফিসে বসে। শোক-সমাবেশের ভিডিয়ো। শোকাত পুরুষদের চেহারাগুলো খুঁটিয়ে দেখছে। আশা, কোনও-না-কোনও অসঙ্গতি ধরা পড়বে চোখে। এক মুখ থেকে আরেক মুখে চলে যাচ্ছে ফাস্ট ফরওঅর্ড করে। পজ চেপে ধরে রাখছে এক-একটা মুখ। দেখা শেষে চলে যাচ্ছে আরেকটায়।

কোথায় জানি গিয়েছিল অ্যারেনবার্গ। ফিরে এল হাতে এক পাতা কাগজ নিয়ে।

সন্দেহভাজন কয়েক জনের লিস্ট করে ফেললাম। প্রিন্টারে ছাপা কাগজটা দেখাল ও জনকে। হাসপাতালের কেউ না এরা। হাসপাতালের সাথে সম্পর্ক নেই কোনও।

ভালো একটা কাজ করেছেন।

তালিকাটা ফ্যাক্স করে দেয়া হচ্ছে পোর্টল্যাণ্ডের সমস্ত চোখের ডাক্তার আর আইগ্লাস ল্যাবে।

হাতে নিল জন কাগজটা।

সাদা-কালো প্রিন্ট-আউট। সবার উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা: পোর্টল্যাণ্ড পুলিস বুলেটিন। তার নিচে: আপনি কি চেনেন এদের?

পরের দু লাইনে রয়েছে: এদেরকে শনাক্ত করতে আপনার সহায়তা কামনা করছে পোর্টল্যাণ্ড পুলিস ডিপার্টমেন্ট।

এরপর রয়েছে ছবিগুলো । পাঁচটা। দুই সারিতে। স্রেফ ছবিই। নাম নেই। নাম জানবার সুযোগ নেই যেহেতু।

ছবির নিচে লেখা: ছবিগুলো নেয়া হয়েছে সেইন্ট জোসেফস হটপিটালের এক অনুষ্ঠান থেকে ৫ জুলাই, ২০১৫ তারিখে সন্ধ্যা ৭:০০ থেকে ৮:৩০-এর মধ্যে।

সব শেষে: এদের কাউকে যদি চিনে থাকেন আপনি, তা হলে দয়া করে ফোন করুন এই নাম্বারে: ১-৫০৩-৫৫৫ ০৫০৫।

বেজে উঠল ফোন। রিসিভার কানে তুলল অ্যারেনবার্গ। ইয়াহ? কথাগুলো শুনল ওপাশের। হু-হ্যাঁ করল কয়েক বার। তারপর প্যাড টেনে নিয়ে কিছু একটা লিখে রেখে দিল ফোনটা। তার আগে ধন্যবাদ দিতে ভুলল না কলারকে।

জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে আছে জন।

ওর উদ্দেশে চওড়া হাসল অ্যারেনবার্গ। একদম হাতেনাতে ফল পাওয়া গেছে!

পনেরো

এই লোক, বিজ্ঞপ্তিটাতে আঙুলের টোকা দিয়ে বলল সেলস লেডি।

– নিচের সারির প্রথমটা। পোলকা ডট।

রে অভ লাইফ নাম দোকানটার। বিক্রয়কর্মী একজন মুলাটো। মুলাটো হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের দো-আশলা।

কাঁচের প্যানেল করা সারি সারি তাক মেয়েটার পিছনে। হরেক ডিজাইন আর ব্র্যাণ্ডের চশমা শোভা পাচ্ছে। রয়েছে সানগ্লাসও। বাঁধাই করা বেশ কয়েকটা মাঝারি আকারের ছবি ঝুলছে দেয়ালে। সবই চশমা পরা মডেলদের।

নিশ্চিত আপনি? জিজ্ঞেস করল অ্যারেনবার্গ।

অবশ্যই! জোর দিয়ে বলল সেলস-লেডি জেনিথ।

চাইলেও ভোলা সম্ভব না। হি ইজ অ্যান অ্যাসহোল।

কোন্ দিক থেকে? প্রশ্ন জনের।

অ্যাটিচুড। চিল্লাচিল্লি করছিল, মনে আছে।

কী জন্য?

সিরিয়াল মেইনটেইন করতে চাইছিল না অন্যদের মতো। তার নাকি তাড়া আছে।

এ লোকটা কি রিসেন্টলি লেন্স বদলাতে এসেছে? বা দিকের লেন্স?

হ্যাঁ। দু বার দেখেছি আমি তাকে। একবার চশমা নেয়ার সময়। আরেক বার লেন্স পালটানোর সময়। লোকটা আজব।

কী রকম?

আমার খেয়াল ছিল না, কী রকম ফ্রেম ইউজ করে সে। সেজন্য রিসিট চাইলাম তার কাছে। আনতে ভুলে গিয়েছিল লোকটা। তখন ডেলিভারি ট্রেগুলো নামাই আমি। এক-এক করে দেখতে থাকি চশমাগুলো, যদি মনে পড়ে। কিংবা দেখে যদি বলতে পারে লোকটা। রিসিট ছাড়া দিতাম না অবশ্য। …তো, অনেক চশমা। সবগুলোতেই নাম্বার দেয়া। ওই একই নাম্বার রয়েছে যার-যার রসিদে। একটা-একটা করে দেখছি, এরই ফাঁকে চোখ পড়ল গিয়ে লোকটার মুখের চেহারায়। এসি-রুমের মধ্যেও ঘেমে উঠছিল সে। বুঝলাম না কারণটা। অস্বাভাবিক লাগছিল চোখের দৃষ্টিটা। জিজ্ঞেস করলাম: ঠিক আছেন তো আপনি?

জবাব দিল না। তার বদলে বলল: অ নাম্বারস! আমার একটা নাম আছে!

তারপর? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে জন।

আর খোঁজাখুঁজির মধ্যে গেলাম না আমি। বললাম, রিসিট নিয়ে আসুন। তারপর দেখা যাবে।

এসেছিল?

বলতে পারব না। আমি আর দেখিনি তাকে।

আসেনি।

অবাক হলো মেয়েটা। আপনি জানেন কী করে?

অ্যারেনবার্গের দিকে চাইল জন।

বুঝে ফেলল পোর্টল্যাণ্ড পুলিস। সে-ই দিল জবাবটা। অ্যাটিচুড।

দোকানের ঠাণ্ডা থেকে বাইরের উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল ওরা। পেভমেন্টে চির-হরিৎ বৃক্ষের ইকড়ি-মিকড়ি।

আমি যা ভাবছি, আপনিও কি তা-ই ভাবছেন, জেডাই? জনকে জিজ্ঞেস করল অ্যারেনবার্গ।

সম্ভবত।

বলুন। মিলিয়ে নিই ভাবনাগুলো।

এর পরের টার্গেট সম্ভবত মেয়েটা সেলস-গার্ল!

ষোলো

সেরাতে মস্ত চাঁদ উঠল আকাশে।

ডিউটি শেষে একে একে বাড়ির পথ ধরেছে রে অভ লাইফ-এর কর্মীরা। রয়ে গেছে শুধু জেনিথ। সে-ও বেরোবে। তবে একটু পরে।

দোকানের বাইরে ওত পেতে রয়েছে ওরা। গাড়ির মধ্যে। জন। অ্যারেনবার্গ। হুইটলি। এবং আরও অন্তত বিশ জন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

হয়তো খুনিও!

আগের প্রতিটা অ্যাটাকই যেহেতু অফিস আওয়ারের পরে, কাজেই, এটাই আমাদের সুযোগ, আশাবাদ জনের কণ্ঠে।

সচরাচর সোয়া নয়টার দিকে দোকান ছাড়েন মিস উইনফ্রে,  বলল ডিটেক্টিভ হুইটলি। পনেরো মিনিট আছে এখনও।

এক, দুই করে মিনিটগুলো কাটতে লাগল উকণ্ঠায়। যতই গড়াচ্ছে সময়, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ওদের।

এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ফ্রন্ট ডোরের OPEN সাইনটা উলটে CLOSED করে দিল দিল জেনিথ উইনফ্রে। ছোট্ট করে তার নিচে লেখা- সকাল ন টায় খুলবে।

বাতি-টাতি নিভিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল সে। তালা লাগাল দরজায়। চলল কার পার্কিং-এর দিকে। চাবি হাতে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।

ভান করুন, যেন কিছু ফেলে এসেছেন, রেডিয়োতে বলল জন। দোকানে ঢুকুন আবার। বেরোন।

কানের ফুটোয় গোঁজা ক্ষুদ্র শর্ট রেঞ্জ রিসিভারে কথাগুলো শুনল জেনিথ। তবে ওর আচরণে প্রকাশ পেল না কিছুই। শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়া হয়েছে আগে। তার পরও একটু যে নার্ভাস লাগছে না, তা নয়। [ কাঁধের ব্যাগের ভিতরটা হাতড়াতে লাগল ও। অভিনয়। বিরক্ত চেহারা করে দোকানের দিকে চলল আবার।

এসময় কমলা একটা মাইক্রোবাস বেরোতে চাইছে। পিছনের পার্কিং লটটা থেকে। এতক্ষণ অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল ওটা আর ওটার চালক। হেডলাইট না জেলেই এগোচ্ছে এখন এক্সিটের দিকে। গতি মন্থর।

বাধা পেল।

পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে গাঢ় নীল রঙের এক টরাস। সিট থেকে নামল এক মাত্র আরোহীটি।

লি অ্যারেনবার্গ। একটা হাত তুলে এগোচ্ছে কমলা গাড়িটার দিকে।

বিড়বিড় করে জঘন্য একটা গালি দিল মাইক্রোর চশমা পরা ড্রাইভার।

সাহায্য করবেন একটু? গলা চড়িয়ে বলল অ্যারেনবার্গ। চলে এসেছে মাইক্রোবাসটার পাশে।

ভাবলেশহীন চেহারায় দেখছে ওকে চশমা।

হাওয়া বেরিয়ে গেছে আমার… থুড়ি- বোকাটে হাসল অফিসার। …টায়ারের। নড়তে পারছি না আর। জ্যাক হবে আপনার কাছে?

মাইক্রো-চালক নির্বিকার।

পাত্তা দিল না অ্যারেনবার্গ। পিছনে রেখেছেন নিশ্চয়ই? জিজ্ঞেস করল ও। নামতে হবে না আপনার। নিজেই বের করে নিচ্ছি। মাত্র পাঁচ মিনিটের মামলা।

দাঁড়ান! ছিটকে বাস থেকে বেরোল ড্রাইভার। খপ করে ধরল টরাস চালকের এক হাতের কবজি।

কী পাগলামো… আরে! আমি না সরলে বেরোবেন কীভাবে? কঠিন হাসছে অ্যারেনবার্গ। দৃষ্টি বলছে: বার-বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এই বার পেয়েছি তোমাকে! খোলা হাত দিয়ে মাইক্রোবাসের স্লাইডিং ডোরটা ঠেলে দিল টেনে। বাধা দিয়েও রুখতে পারল না চশমাধারী।

ভক করে একটা বোটকা পচা গন্ধ ধাক্কা মারল অ্যারেনবার্গের নাকে। নাকে হাত চাপা দিতে বাধ্য হলো ও। ডাক্ট টেপের বড় একটা রোল বাইরে পড়ল খোলা দরজা দিয়ে। গড়িয়ে চলে গেল অন্ধকারের দিকে। চেয়ে চেয়ে ওটার চলে যাওয়া দেখল, দুজনে। তারপর তাকাল। পরস্পরের দিকে। এরপর গাড়ির ভিতরে।

আধো অন্ধকারেও ঝিলিক মারছে করাত, কুড়াল, ক্লিপার…। গাড়িময় লেগে থাকা কালচে দাগগুলো যে রক্তের, সেটা আর বলতে!

চোয়ালে বিরাশি সিক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অ্যারেনবার্গ। চশমাধারী লোকটা ঝাঁপ দিল গাড়ির ভিতরে।

ঝটকা দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বেরোল জন। চরম মুহূর্ত হাজির হয়েছে এসে। মাইক্রোফোনের কল্যাণে কিছুই অজানা নেই ওদের।

ছুটছে, যত জোরে পারে। কলেজ স্পোর্টসের পর এত জোরে আর ছুটেছে বলে মনে হয় না।

ও লম্বা একটা স্কু-ড্রাইভার নিয়ে অ্যারেনবার্গের উপরে চড়াও হয়েছে কিলার। গেলে দিতে চাইছে চোখ দুটো। মগজ ঘোলা, তা-ও প্রাণপণ চেষ্টায় ঠেকিয়ে রেখেছে অ্যারেনবার্গ। কিন্তু কতক্ষণ পারবে, বলা মুশকিল।

আরেকটা ঘুষিতে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল ওর। এক পাশে কাত হয়ে গেছে মাথাটা। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়ল প্রতিরক্ষা।

ওকে পরাস্ত হতে দেখে বুনো উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল খুনি। দু হাতে মুঠো করে ধরে মাথার উপরে তুলল ধাতব। শলাকাটা।

পৌঁছে গেছে জন। গুলি করল। সিগ সাওয়ারের তপ্ত বুলেট মৃত্যুচুম্বন এঁকে দিল নোংরা হৃৎপিণ্ডে।

গায়ের উপর থেকে ভারি বস্তাটা খসে যেতেই লোভীর মতো হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল অ্যারেনবার্গ। আহ, শান্তি!

কোলাহলমুখর হয়ে উঠল পুরো চত্বরটা। এস্ত পায়ের ছুটোছুটি, টর্চের আলো, সাইরেনের শব্দে ভরে গেল চারদিক। অ্যামবুলেন্স থেকে দৌড়ে এল ডাক্তার আর তার সহকারী।

খেলা শেষ, ভাবল জন।

দি এণ্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *