মৃত্যুভয়াল নীল

মৃত্যুভয়াল নীল

নীল পানির দিকে তাকিয়ে আছে লিয়ানা, যত দূর দৃষ্টি যায়।

বিশাল-জায়গা-নিয়ে-হদটার দরের সীমানা চিহ্নিত করছে পাড় জুড়ে জন্মানো নিবিড় সবুজ। জঙ্গল ওদিকটায়। সদ্য সকালের অনুজ্জ্বল, মায়াময় আলোতে কালচে দেখাচ্ছে বনটাকে। তারও পিছনে নীলচে সাদা একটা দেয়াল চলে গেছে দিগন্তের এমাথা-ওমাথা। সব গাছ ছাড়িয়ে, আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে যেন রহস্যঘেরা, কুয়াশাচ্ছন্ন ওই প্রাচীর। পাহাড়সারি ওটা, অ-নে-ক দরে।

পাড়ের পানিতে পড়া গাছের ছায়াটুকু বাদ দিলে লেকটা যেন অতিকায়, নীলাভ এক আয়না। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো পাতলা ফিনফিনে মেঘদল সাঁতার কাটছে তার ভিতরে। মন কেমন করা আলুথালু বাতাসে শান্ত ঝিলিমিলি ছড়িয়ে পড়ছে দূর থেকে দূরে। একটু পরে রোদ উঠলে চোখ না কুঁচকে তাকানো যাবে না আর লেকের আয়নায়।

নাতিদীর্ঘ, এক মাত্র ডকটার কিনারের কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। টু-পিস ফ্লোরাল বিকিনি পরনে। পরিবেশের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই যেন ও-দুটোও নীল রঙের। খুলে রাখা ট্র্যাক সুটটা স্তূপ হয়ে পড়ে আছে নির্জন ডকের এক ধারে পাতা হাতলঅলা কাঠের বেঞ্চিটার উপরে। আরেক ধারে পানিতে ভাসছে ছোট্ট, সাদা এক বোট।

এখানে আসার আগে মিনিট বিশেক জগিং করেছে লিয়ানা। হালকা ঘামের প্রলেপ সারা শরীরে। শীতল হাওয়ায় শিউরে উঠছে গা-টা। বাতাস অবশ্য এমনিতেও ভিজে। আর কী সজীব! বন-পাহাড়ের গন্ধ আনছে বয়ে। ক্লান্তি টিকতে পারে না এরকম বাতাসে। ঝেটিয়ে দূর করে দেয় মনের সমস্ত ক্লেদ।

স্মিত অভিব্যক্তি খেলা করছে লিয়ানার চেহারায়। শ্বাসের সঙ্গে ধীরেসুস্থে উঠছে-নামছে সুগঠিত সোনালি কাঁধ, মেদহীন সমতল পেট। খুব ফিটনেস ফলো করে ও। নিয়ম করে সাঁতরায়, ইয়োগা করে। ধ্যানের পর্বটাও সারা খানিক আগে।

বড় করে দম নিল তরুণী। হাত দুটো পিছিয়ে এনে এক কদম এগিয়েই ডাইভ দিল বাতাসে। স্বয়ংক্রিয় ভাবে মাথার সামনে এসে এক হয়ে গেল হাত জোড়া। শূন্যে অধিবৃত্ত রচনা করে তার এক সেকেণ্ড পর জলের শরীর ভেদ করল মানব-বর্শা। ঝুপুস! সকাল বেলার পাখপাখালির কলকাকলিতে ব্যাঘাত ঘটাল না জলের এই উচ্ছ্বাস।

পতনের ধাক্কায় তলিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। গতিজড়তা কাটিয়ে ভেসে উঠল মুহূর্ত কয় পরে। বাতাসের জন্য আপনা আপনি হাঁ হয়ে গেল মুখটা। শ্বাস ছাড়ার সঙ্গে ফুর-র-র করে পানি ছিটাল মুখ দিয়ে। হিমশীতল হয়ে জুড়িয়ে গেছে। অন্তস্তলটা।

শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলে শুরু করল সাঁতার। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়াচ্ছে ডকের সঙ্গে।

এক শ গজমতো চলে এল এভাবে। তারপর সাঁতরানো থামিয়ে মাথা নিচের দিক করে ডুব দিল ডলফিনের কায়দায়।

দ্বিতীয় বারের মতো মাথাটা জাগাতেই ঘিরে ধরল বিচিত্র এক ধরনের অস্বস্তি। হাজারও ফড়িং উড়ছে যেন পেটের মধ্যে। গভীর পানির স্বাভাবিক অনুভূতিই বলা যায় এটাকে। যত ওস্তাদ সাঁতারুই হও না কেন তুমি; পাহাড়-জঙ্গলঘেরা, দৈত্যের বাটির মতো প্রাগৈতিহাসিক কোনও সরোবরে নামলে ছমছম করবেই ভিতরটা। এই বুঝি টান দিল কেউ পানির নিচ থেকে। খাঁ-খাঁ হাহাকারের জন্ম দেবে উপরের আদিগন্ত নীলিমা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এখন কেমন এক বিজাতীয় সিক্সথ সেন্স। কেউ যেন আড়াল থেকে লক্ষ করছে ওকে।

ডানে তাকাল লিয়ানা। অকারণ ভয় ধরিয়ে দিল থইথই তরল চাদর। পাইন বনের মাথা ভেদ করে ঠায় দাঁড়িয়ে কেইবল-টাওয়ারের উন্নত শির। খেলনার মতো দেখাচ্ছে এত দূর থেকে। প্রযুক্তির বারতা নিয়ে কয়েক সারি তার চলে গেছে এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে।

কাউকে দেখতে পাওয়ার আশা করেনি লিয়ানা। তাকাল বাঁয়ে। কেউ নেই কোথাও। কে থাকবে এত সকালে! আকাশ, পানি, বনভূমি- সমস্তই বিরান।

আর নয়। ফিরে যাবে এবার। চাপ আর নিতে পারছে না স্নায়ু। কেবলই বাতাস ভরতে শুরু করেছে ফুসফুসে, এই সময় আক্রান্ত হলো মেয়েটা। কে বা কী, চিন্তা করার আগেই পায়ের গোছে হেঁচকা টান খেয়ে চলে গেল জলের তলায়। গবগ করে বুদ্বুদ উঠল কিছুক্ষণ। তারপর সব কিছু আগের মতোই স্বাভাবিক। কিছুই ঘটেনি যেন। 7 পানি সম্বন্ধে মানব মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা যুগ যুগান্তরের আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেল। বারমুডা-হৌক্সের মতো লিয়ানা অ্যানিসটনকে গিলে নিয়েছে নীল পানির হ্রদ।

মালকিনের অপেক্ষায় ডকেই পড়ে রইল কাপড়চোপড়, জুতো। কখনওই ওগুলো আর নিতে আসবে না অ্যানিসটনদের মেয়েটা।

কোনও কি সাক্ষী আছে ওর অন্তর্ধানের? একজনও না।

দুই

খালি হয়ে এসেছে আয়মানের প্লেটটা। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বারের মতো পড়াও শেষ করল পত্রিকার খবরটা। চিন্তায় ডুবে রয়েছে।

চিন্তার সুতো ছিন্ন করল লণ্ডন নেমট্যাগধারী মেয়েটা। টেবিলের কাছে এসে দু হাতের ভর রেখে ঝুঁকল ও। আর কিছু লাগবে?

নামে লণ্ডন হলেও লণ্ডনী কন্যা নয় মেয়েটা। আমেরিকার প্রাচ্য দেশীয় অভিবাসীদের সর্বশেষ প্রজন্ম। মাঝারি উচ্চতা। কালো চুল। এ ওয়েইট্রেসের বুকের উপরে চোখ আটকে গেল। আয়মানের। ফুলতোলা যে-টপটা পরেছে মেয়েটা, সেটার। গলাটা এত বড় যে, দুই-তৃতীয়াংশই উন্মুক্ত বক্ষদেশের। সামনের দিকে ঝুঁকে থাকায় পানি ভরা বেলুন দুটোর মাঝখানে অন্ধকার খাদ দেখতে পাচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনও উপমা মাথায় এল না আয়মান ইকরামুল্লাহর। গলার লম্বা, সোনালি চেইনের নিচের অংশটা হারিয়ে গেছে তরুণীর। বুকগহ্বরে।

আচ্ছা, কোন্ দেশি ও? চকিতে ভাবল তরুণটি। বলা মুশকিল। চিনাথাই, ফিলিপিনো… যে-কোনওটাই হতে পারে। জাপানি অন্তত না। প্রশ্নটা মনে আসার কারণ, ওই সব মেয়েদের ভাইটাল স্ট্যাটের প্রথম অংশটা খাটে না এই মেয়ের ক্ষেত্রে। রীতিমতো বমশেল।

উম? হঠাই খেয়াল হলো আয়মানের, একটা প্রশ্ন করেছে মেয়েটা। অনেক কষ্টে খাদ থেকে টেনে তুলল ও নিজেকে, তাকাল ওয়েইট্রেসের মুখের দিকে।

আর কিছু?

অদ্ভুত তো! না ভেবে পারল না আয়মান। মাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করেছে মেয়েটা। কিন্তু প্রশ্নটার সঙ্গে অতিরিক্ত আরও কিছু যেন শুনতে পেয়েছে ও। ভিজে ঠোঁট জোড়া গা ছুঁল। পরস্পরের, জিভের সঙ্গে ঘষা খেল টাকরা, দাঁতের ফাঁক গলে বেরিয়ে এল বাতাস। যেন খাবার না, অন্য কিছু সাধছে। চোখ দুটোয় ঝিকমিক করছে কৌতুক। কান দুটো গরম হয়ে উঠল আয়মানের। মেয়েটা কি বুঝতে পেরেছে ওর চিন্তাটা? চেহারাটার দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হলো ও।

চকচকে মুখটা আরও সেক্সি করে তুলেছে ছোট ছোট নাকের-ফুটো। গ্লসি লিপস্টিক, বড় বড় আঁখিপল্লবের উপরে হালকা নীল আইশ্যাডো, হীরকদ্যুতি ছড়ানো শুভ্র দাঁত, ডিম্বাকৃতি চিবুক… সবটা মিলিয়ে আয়মানের মনে হলো, এখানে করছেটা কী মেয়েটা? মডেলিং-এ নামছে না কেন? শাইন যে করবে, চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। কেবল যোগ্যতা দিয়ে নয়, উপরে ওঠার জন্য সব কিছুই করতে পারে এই মেয়ে। গায়ে পড়া স্বভাবটা থেকে আঁচ পাচ্ছে যেন আয়মান।

হ্যাঁ… চেকটা, প্লিজ।

ও দেয়নি জবাবটা। দিয়েছে ওর প্রতিচ্ছবি। আগেই খাওয়া শেষ করে রেস্টরুমে গিয়েছিল আরেক ইকরামুল্লাহ, চেয়ারে বসে কফির কাপটা টেনে নিল আয়মানের যমজ।

যেন হতাশ হয়েছে, এমনি ভাবে ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা। চলে যাচ্ছে… ভাইটাল স্ট্যাটের শেষ অংশটা চেক না করে পারল না আয়মান। শর্টস জিনিসটা এমনিতেই খাটো; তার চাইতেও খাটো, মেয়েটা যেটা পরেছে। পা ফেলার ছন্দে ঢেউ উঠছে বারুদ ঠাসা নিতম্বে।

আয়মানের অলক্ষে মুচকি হাসল ওর সহোদর।

গলা খাঁকারি দিয়ে ভাইয়ের দিকে চোখ ফেরাল আয়মান বিব্রত চেহারা করে। গায়েব হয়েছে আয়ান ইকরামুল্লাহর, হাসি। নিজের কফিতে চুমুক দিল আয়মান। ভাজ করা পত্রিকাটা ঠেলে দিল দ্বিতীয় ইকরামুল্লাহর দিকে। রেস্তোরাঁর নিউজস্ট্যাণ্ড থেকে কিনেছে কাগজটা।

দেখ এটা। রহস্যময় লাগছে আমার কাছে। লেক ম্যানিটোঅক, উইসকনসিন। গেল হপ্তার ঘটনা। লিয়ানা অ্যানিসটন, বয়স উনিশ, সাঁতার কাটতে হ্রদে নেমে ফিরে আসেনি আর। ডুবুরি নামিয়ে কিছু পায়নি পুলিস। কথা সেটা না। কথা হচ্ছে: লেক ম্যানিটোঅকে এ বছরের তৃতীয় সলিল-সমাধি কেস এটা। …হ্যাঁ, অন্য লাশ দুটোও পাওয়া যায়নি খুঁজে।

এখানে লিখেছে: দু দিন আগে ফিউনেরাল হয়েছে মেয়েটার… বলল আয়ান কিছুক্ষণ পর। ইতোমধ্যে খাবারের দাম আর টিপস নিয়ে গেছে ওয়েইট্রেস।

হুঁ,

অদ্ভুত না?

কোনটা?

ডেড বডি তো বলছে পাওয়াই যায়নি। কী কবর দিল তা হলে?

প্রশ্নটা যেন থমকে দিল আয়মানকে। দাঁত খিচানো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মাথাঅলা রুপালি লকেট পরছে ও ইদানীং। মাথাটায় হাত বোলাতে বোলাতে স্বগতোক্তি করল: …খালি একটা কফিন… ঠিক… ভাবতেই কেমন জানি লাগে।

ধীরেসুস্থে কফিটুকু শেষ করল আয়ান। টিসু-পেপারে ঠোঁট মুছে বলল, এটা আমাদের কত নম্বর কেস যেন?

বাইরে, রেস্টুরেন্ট কাঁপিয়ে চলে গেল একটা লরি।

জবাবটা দিতে হলো না। দু জনেরই জানা কথাটার মানে। যমজ হলেও অমিল কম নেই দুই ভাইয়ের মধ্যে। যেমন: আয়মানের দেড় মিনিটের বড় হলেও লম্বায় খাটো ওর বড় ভাই। ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো পাট করে রাখে জেল দিয়ে। অন্য দিকে, নিজের চুলগুলো খানিকটা বাড়তে দিয়েছে আয়মান। আঙুল দিয়েই চিরুনির কাজ চালায়। আরও আছে। একজন ক্লিনশেভড়। আরেক জন খেচা-খোঁচা দাড়িতেই স্বচ্ছন্দ। একজনের পছন্দ সফট গান। আরেক জনের ধুমধাড়াক্কা। কিন্তু একটা ব্যাপারে একই আত্মা বাঙালি দুই সহোদর। রহস্যের পোকা দু জনেই।

উত্তেজনার খোরাক পেয়েছে ওদের বেপরোয়া রক্ত।

তিন

উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু চোখে পড়ল না পথে আসতে আসতে। ঠাণ্ডা রোদের মধ্যে এক জায়গায় দেখল, কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে মেহেদির বেড়া দেয়া কোন্ বাড়ির উঠানে। পাশাপাশি ঝুলছে ব্রা আর পুরুষের আণ্ডারওয়্যার। দেখে দুষ্টু চিন্তাটাই সবার আগে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

শহর ছাড়িয়ে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তায় পড়ল ওরা। নীলচে ধূসর আকাশে তখন হলদে মেঘের অক্লেশে ভেসে যাওয়া।

পিছনে ধুলোর মেঘ রেখে ছুটে চলল ইমপালা। একটা ফ্লাইওভার পড়ল পথে। ব্রিজের, এক ধারে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে সৌখিন এক মৎস্যশিকারি। পরনে ব্যাগি। ক্রিকেট-ফিল্ডারদের মতো চওড়া কিনারাঅলা টুপি মাথায়। কাঠের রেইলের উপর দিয়ে ছিপ ফেলেছে নিচের খালে।

ব্রিজ পেরোনোর একটু পরেই দুই ধারে গাছগাছালি নিয়ে মফস্বলের পাকা রাস্তা। এক পর্যায়ে লেক ম্যানিটোঅক। কাউন্টির সীমা নির্দেশক সাইনপোস্ট অতিক্রম করল ইকরামুল্লাহ ভাইদের গাড়ি। স্থানীয় আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকানো নীল সরোবরের এক টুকরো ছবি শোভা পাচ্ছে পুরু তক্তা দিয়ে বানানো সাইনবোর্ডে। একখানা সেইল-বোট ভাসছে ওখানে নীল পানিতে। ওটার পিছনে, দিগন্ত থেকে উঁকি। দিচ্ছে টকটকে লাল সূর্য। বাহারি হরফে আগন্তুকদের স্বাগত জানাচ্ছে সাইনবোর্ডটা।

অ্যানিসটন হাউসের আঙিনায় এসে বন্ধ হলো ইমপালার ইঞ্জিন। খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি বাড়িটা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বাতলে দিয়েছে ঠিকানা।

জঙ্গলের কোলেই বলা যায় অ্যানিসটনদের বাসস্থান। বড় বড় গাছগুলো চেপে এসেছে তিন দিক থেকে। কী এক আগ্রহে বাড়িটার উপরে ঝুঁকে রয়েছে যেন আঁকাবাঁকা ডালপালাগুলো। ছায়া-ছায়া গাম্ভীর্য বিরাজ করছে পরিবেশে। দেখেই মনে হয়, শোক পালন করছে পরিবারটি।

জমিন থেকে হাত খানেক উঁচুতে, খুঁটির উপরে দাঁড়ানো বাড়িটা বাংলো প্যাটার্নের। সামনে-পিছনে ঢালু ছাত ইটের মতো লাল রং করা। পেরিস্কোপ ধরনের ভেন্টিলেটর রয়েছে ছাতের গায়ে। আর একেবারে মাথা ছুঁড়ে বেরিয়েছে চিমনি। সামনের দিকের ঢাল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু সমতল চালার। ঘাস-দূর্বা গজিয়ে গেছে ওখানটায়। নিচে কাঠের রেইল-ঘেরা পোর্চ। বারান্দাটার মাঝামাঝি অংশে সিঁড়ি নেমে গেছে বাইরে। সিঁড়িতেও রেইলিং দেয়া। তবে মূল দরজা নয় এদিকে। বাংলোর বাঁয়ে ওটা। ওদিকের পোর্চে চালার বদলে টোপর আকৃতির ছাউনি। পোর্চটাও বাঁয়ে এসে দুই ধাপ নিচু হয়েছে ডান দিকের চাইতে।

দুটো চেয়ার পাতা বারান্দার ডান দিকের অংশে। আর আছে টব, বেশ কয়েকটা।

কী পরিচয় দেবে, ঠিক করেই এসেছে ইকরামুল্লাহ ভাইয়েরা। আসল পরিচয় অবশ্যই না। নাম ফাটুক, একেবারেই চায় না ওরা। খ্যাতির তকমা একবার গায়ে লেগে গেলে মুশকিল হয়ে যায় ছোটানো। অযাচিত প্রত্যাশার চাপ এসে পড়ে তখন চারদিক থেকে। আর, রহস্যটা যদি অপ্রাকৃত হয়, মুশকিল আসানের গ্যারান্টি দেয়া তো সম্ভব না কাউকে। দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়ার পর, চায় না যে, কেউ পরে খোঁজ করুক ওদের। ব্যর্থতার কারণে যেমন বিব্রত হতে চায় না, সাফল্যের জন্যও তেমনি কারও কাছে ঋণী থাকাটা পছন্দ নয়।

হাতে সময় ছিল না বলে বানাতে পারেনি নকল আইডি কার্ড- এমন কোনও সমস্যা নয় এটা। মরাবাড়িতে কেউ পরিচয়পত্র দেখতে চাইবে বলে মনে হয় না।

ফ্রন্টডোরের উপরটা গ্লাস-প্যানেল করা। জানালার মতো দরজার ওদিকেও ঝুলছে হালকারঙা কারটেন।

নক করল আয়ান কাঁচের গায়ে।

অবিন্যস্ত চুলের, আধময়লা টি-শার্ট গায়ে যে-তরুণটি দরজা খুলল; ভিজে, লাল চোখ দেখে অনুমান করা যায়, কাঁদছিল। ফুলে রয়েছে চোখ দুটো। সম্ভবত ঘুমও হয়নি রাতে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগন্তুকদের দিকে।

চার

আপনারা নিশ্চিত, উনি স্রেফ ডুবে যাননি?

প্যাণ্টের দু পকেটে হাত ভরে রেখেছে জিউস অ্যানিসটন। প্রশ্নকর্তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল শান্ত পানির দিকে। সুদূরে হারিয়ে গেল দৃষ্টি। দমবন্ধ লাগছিল ঘরের ভিতর। আগন্তুক দুই ভাইকে নিয়ে তাই লেকের ধারে চলে এসেছে কথা বলতে বলতে। বাড়ির পিছনে একটু এগোলেই লেকটা। পাইনের বনজ গন্ধ মাখা সোঁদা ঘ্রাণ বাতাসে।

এটা এক রকম অসম্ভবই। ফের আয়ান ইকরামুল্লাহর চোখে চোখ রাখল অ্যানিসটন। অন্তত আমার বোনের বেলায়। চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু ছিল ও ওদের কলেজের। বলতে পারেন, এই লেকের পানিতেই হেসে-খেলে বড় হয়েছে। নিজের বাথটাবে একটা মানুষ যতখানি নিরাপদ বোধ করে, এই লেক ওর কাছে ছিল তা-ই।

একমত নয় দু ভাইয়ের কেউই। পায়ে ক্র্যাম্প ধরলে দক্ষ সুইমারও অসহায় হয়ে পড়তে পারে। তবে মনোভাবটা প্রকাশ করল না সদ্য বোনহারা তরুণের সামনে। বদলে জানতে চাইল আয়ান: আচ্ছা, কত দূর পর্যন্ত সাঁতরাতেন তিনি?

এই তো… এক শ গজের ভিতরেই। এমনটাই জানি আমরা।

কোনও ধরনের আলামতই পাওয়া যায়নি? অস্বাভাবিক কোনও আওয়াজ… চিৎকার… প্রত্যক্ষদর্শী?

উম… না। আমাদের অন্তত জানা নেই। রানিং সুট-টুট খুলে পানিতে নেমেছিল। ডকের উপরে পাওয়া গেছে ওগুলো।

হুম।

এখানকার পানি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই তো? প্রশ্ন করল আয়মান।

অবাক মনে হলো লিয়ানার ভাইকে। কী রকম?

এই আর কী… কিছু দেখা-টেখা যায় কি না পানিতে…

কী দেখা যাবে! আরও অবাক হয়েছে ছেলেটা।

হিংস্র কোনও প্রাণীর কথা ভাবছি। মাছ-টাছও হতে পারে। এরকম কিছুই হয়তো ঘাপটি মেরে আছে জলের তলায়।

আরে, নাহ! অবিশ্বাসের হাসি হেসে উড়িয়ে দিল জিউস। তবে হাসিটা নিষ্প্রাণ। পরক্ষণেই আগের মতো করুণ হয়ে উঠল মুখটা। ছোট থেকেই বড় হয়েছি এখানে। ওরকম কিছু থাকলে জানতে পারতাম।

তার পরও… স্বাভাবিক নয়, এরকম কিছু কি চোখে পড়েনি কখনও? মনে করে দেখুন তো! এই ধরুন, লেকের আশপাশে? এত তাড়াতাড়ি নিজের থিয়োরি থেকে সরে আসতে রাজি নয় আয়মান।

দপ করে আলো জ্বলে উঠল জিউসের চোখে। ঠিক কী আশা করছেন আপনারা, বলুন তো! লক নেস মনস্টার জাতীয় কিছু?

না, মানে…

বাবা কেমন আছেন আপনার? প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিল আয়ান। কথা বলা যাবে ওঁর সাথে? পত্রিকা থেকেই জেনেছে, কে-কে আছে অ্যানিসটনদের পরিবারে।

ওই তো… চোখের ইঙ্গিতে দূরের ডক দেখাল জিউস অ্যানিসটন। শীত লাগছে। শক্ত করে দু হাত বাঁধল বুকে। সেই অবস্থাতেই কাঁটা দিয়ে উঠল সারা গায়ে।– তাকাল ছেলেরা। লগ-কাঠের এক মাত্র বেঞ্চিটায় বসে আছে একলা একজন মানুষ। মেঘের পরে মেঘ জমেছে। অবেলায় আঁধার হয়ে আসছে চারপাশটা। বিবর্ণ আকাশ আর পানির ফাঁকা পটভূমিতে কী রকম নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে মানুষটিকে! পরাজিত, বিধ্বস্ত। মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে। পাইনের দেয়ালের দিকে।

আব্বুকে আপাতত ডিসটার্ব না করাই ভালো,  বলল পুত্র। কান্নাভেজা ঢোক গিলল ঠোঁটে ঠোঁট চেপে। বুঝতেই তো পারছেন…

মাথা দুলিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করল আয়ান। একটা হাত রাখল ছেলেটার কাঁধে। ঠিক আছে। পরেই কথা বলব না হয়।

পাঁচ

ঠিক বুঝলাম না। সন্দেহের ভাজ শেরিফ নিক কারটারের কপালে। বন্যপ্রাণী সংস্থার আগ্রহ কেন এই কেসে? এটা তো একটা দুর্ঘটনা।

ও ছাইরঙা হাফ-শার্টের দুই বাহুতেই সেলাই করে সাঁটা কাপড়ের ব্যাজ। কালো ঢাকনাঅলা এক জোড়া বুকপকেট উর্দিতে। বাঁ দিকের পকেটের উপরে ঝুলছে ধাতব হেক্সাগ্রাম। ডানে নামফলক। দুই পকেটের মাঝখানে ভাঁজ করা বোতামের-ঘর। বোতাম লাগানো কালো স্ট্রাপ দুই কাঁধে।

শার্টের নিচে সাদা টি-শার্ট পরেছে অফিসার। রেশমি ধূসর চুলের কাটিং প্রাচীন আমলের রোমান অভিজাতদের মতো। চেহারার আদলও তা-ই।

অ্যানিসটনদের ওখান থেকে সোজা পুলিস ডিপার্টমেন্টে চলে এসেছে দুই ভাই। দরজার মুখেই দেখা শেরিফের সঙ্গে। ইউএস ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসের এজেন্ট হিসাবে পরিচয় দিতেই কুঁচকে উঠেছে আইন রক্ষকের ভুরু। এতটাই অবাক হয়েছে যে, খেয়ালেই এল না দুই তরুণের আইডি সম্বন্ধে কনফার্ম হওয়ার বিষয়টা।

অল্প পরিসর নিয়ে অফিস করা একতলা দালানটায় লোকজন নেই বললেই চলে এ মুহূর্তে। ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কয়েকটা ডেস্ক। রিসেপশনে ফাইল চেক করছে আঁটসাঁট শার্ট পরা সুশ্রী এক মহিলা। পুরো মনোযোগ কাগজে।

অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত আপনারা? আয়মানের জিজ্ঞাসা। জবাবটা গুরুত্বপূর্ণ।

আর কী হবে! অকারণেই বিরক্ত হচ্ছে কারটার।

না, মানে… কিছু যদি পানির নিচে নিয়ে যায় মেয়েটাকে,

আরও বিরক্ত হলো অফিসার। তা, সেই কিছু-টা কী?

কত কিছুই তো হতে পারে…

যেমন?

হাঙর… কুমির… তারপর ধরেন, পিরানহা…

ফিক করে হেসে ফেলল প্রৌঢ় অফিসার। রিসেপশনিস্ট মহিলার ঠোঁটেও হাসি। যুক্তি শুনে মুখ তুলে চেয়েছে প্লাসটিকের ফোল্ডার থেকে।

লেক ম্যানিটোঅকের পানিতে হাঙর! কুমির!! পিরানহা!!! কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠেছে অফিসারের। হাবেভাবে প্রকাশ পাচ্ছে ব্যঙ্গ।

আছে, বলছি না। আই মিন, ওরকমই কিছু

না, দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করে দিল কারটার। এ ধরনের মাংসাশী প্রাণীর অস্তিত্ব নেই আমাদের লেকে। …আচ্ছা! এবার বুঝলাম আপনাদের আগ্রহের কারণটা।

জি,  সংক্ষিপ্ত জবাব আয়ানের। শেরিফের পারসোনাল চেমবারে এসে বসল ওরা।

…পুরো হদ ঢুড়ে ফেলেছি আমরা, ডেস্কের ওপাশে, নিজের আসন থেকে বলল কারটার। সোনার (Sonar) দিয়েও পরীক্ষা করা হয়েছে। না, সন্দেহজনক কিছু নেই ওখানে।

কিন্তু… ব্যাপারটা কেমন না? সন্দেহের জায়গাটা টাচ করল ওরতেগা ওরফে আয়ান ইকরামুল্লাহ। একই ধরনের ঘটনা তৃতীয় বারের মতো!

থতমত খেল অফিসার। পালা করে তাকাল সামনে বসা দু জনের দিকে। হ্যাঁ, তা ঠিক… স্বীকার করল নরম গলায়।

তিনটা ঘটনাই একই রকম।

একই রকম শুধু না, একদম একই জায়গায়, সুযোগ। বুঝে চেপে ধরল আয়মান। আপনার কি মনে হয় না, বড় বেশি কাকতালীয় এই দুর্ঘটনাগুলো? দুর্ঘটনা শব্দটার উপরে বাড়তি জোর দিল ও।

পাটকেল খেয়ে কোণঠাসা অবস্থা হলো অফিসারের। যুক্তিতে হেরে গিয়ে অযথাই টেবিলের উপরে ঘোরাতে লাগল কাঁচের পেপার-ওয়েটটা।

আচ্ছা, কোনও ধরনের প্রাকৃতিক ঘূর্ণি-টুনি নেই তো ম্যানিটোঅকে? একটা সম্ভাবনা বাতলাল আয়ান। কিংবা, কোনও কারণে সৃষ্টি হতে পারে না?

একটু ভাবল অফিসার। পারে কি পারে না, বলতে পারব না। নেই যে, এটুকুই কেবল জানাতে পারি। ঘোরা থেমে গেল পেপার-ওয়েটের। তবে…

হ্যাঁ, বলুন!

ড্যাম।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল পাশাপাশি বসা দুই ভাই। বুঝতে পারছে না, কীসের উপরে বিষোদগার করল লোকটা।

সরি?

বাঁধ… বাঁধের কথা বলছি…

ও, আচ্ছা, বাঁধ! কী সমস্যা ওখানে?

ভেঙে পড়ছে ওটা। ফাটল দেখা দিয়েছে বাঁধের গায়ে। পরিস্থিতি জানিয়ে কয়েক বারই যোগাযোগ করেছি কর্তপক্ষের সাথে। পাত্তাই দেয়নি ওরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় হয়তো পানির চাপ আর নিতে পারবে না ড্যামটা। ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে শহরটা। উপায় না দেখে স্পিলওয়ে খুলতে হয়েছে একটা। এতে করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে মরে যাচ্ছে লেকটা। আর লেকটা মরলে শহরটাও বাঁচবে না। কেন, ফেডারাল ওয়াইল্ডলাইফের তো জানা থাকার কথা বিষয়টা!

কৈফিয়ত দেয়ার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল আয়ান, এসময় দুটো টোকার শব্দ হলো ফ্রস্টেড গ্লাস লাগানো দরজায়। পাল্লা ঠেলে চেমবারে মাথা গলাল সপ্রতিভ এক তরুণী। সরি। ডিসটার্ব করলাম?

না, আয়, স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলতে বলতে চেয়ার ছাড়ল অফিসার।

হটপট হাতে ভিতরে প্রবেশ করল তরুণীটি। পিছন পিছন এল পোলা শার্টের উপর টি-শার্ট পরা আট-ন বছরের একটা বাচ্চা। লম্বা বাদামি চুল নেমে এসেছে চোখের উপরে। চেহারা দেখেই বোঝা যায়- ইন্ট্রোভার্ট। গাল ফুলিয়ে রেখেছে। গোস্বা করেছে যেন কোনও কারণে। একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল।

খাবারের পটটা অফিসারের হাতে তুলে দিল মেয়েটি। শেরিফ সেটা নামিয়ে রাখল ডেস্কের ওধারে। রিস্টওঅচ

দেখল সিধে হয়ে। ১৯ একই রঙের চোখ শেরিফ আর তরুণীর। প্রসাধনবিহীন চেহারাটায় নিষ্পাপ এক ধরনের সারল্য। ঠোঁট দুটো কমলার কোয়া। লালচে আভা ফরসা গালে। সাদাসিধে, একেবারেই ঘরোয়া ধরনের ম্যাক্সি স্কার্ট পরেছে। তাতেই হয়ে উঠেছে। অসামান্যা।

দাঁড়িয়ে গেছে ইকরামুল্লাহ ভাইয়েরা। দু জনের চোখেই তারিফের দৃষ্টি। কিছুটা ক্লান্ত, চেহারার বিষণ্ণ ছাপটা আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব দিয়েছে মেয়েটাকে।

আমার মেয়ে, আলাপ করিয়ে দিল নিক কারটার।

প্লেজার টু মিট ইউ,  দু জনের পক্ষ থেকে বলল আয়মান। ভদ্রতা সূচক হাসি ধরে রেখেছে চেহারায়। চেহারার মিল দেখে আগেই আন্দাজ করেছে, বাপ-বেটি। ওরা।

এজেন্ট ওরতেগা আর এজেন্ট বালবোয়া, ছেলেদের পরিচয় জানাল মেয়ের বাবা। ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস থেকে। লেকের ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করছেন।

ওহ, মার্জিত উচ্চারণে বলল তরুণী। চোখে চোখে কিছু কথা হয়ে গেল কি বাপ-বেটির মধ্যে? আমি এলিজা।

আর তোমার? তোমার কী নাম? পিছন থেকে বাচ্চাটার দু কাঁধে দু হাত রেখেছে তরুণী। ছেলেটার গাল ছুঁয়ে দিল আয়ান।

অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল যেন প্রশ্নটা। ঘুরে, চঞ্চল পায়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।

রুফাস, রুফাস নাম ওর। ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টি তরুণীর চোখে। ফিরল বাপের দিকে। ওকে, আব্বু। এখন আসি তা হলে। পাঁচটার সময় পার্কে যাচ্ছি রুফাসকে নিয়ে।

এলিজা কারটার বেরিয়ে গেলে হেসে মন্তব্য করল আয়মান: বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হচ্ছে বাচ্চাটা। আপনার নাতি নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেছে কারটার। ধূসর চোখে ঘনাল ছায়া।

ড্যামের ব্যাপারটা নিয়ে বলছিলেন আপনি… পুরানো প্রসঙ্গে ফেরত গেল আয়ান।

মাথা দোলাল অফিসার। ঘটনাগুলোর পিছনে আদৌ কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে কি না, জানা নেই আমাদের। যদি থাকেও, ক মাস পরই, আর কোনও মৃত্যু ঘটবে না ওই লেকে,…,

তার মানে, বিষয়টা তলিয়ে দেখতে চান না আপনি? সাধ্যমতো সব কিছুই করছি আমরা। ড্যাম-কেয়ার ভাবটা আবার ফিরে এসেছে অফিসারের মধ্যে। আমার শহর এটা… আমার লোক। দায় এড়ানোর সুযোগ নেই আমার।

ওকে, থ্যাঙ্কস। হতাশ হয়েছে আয়ান। ছোট্ট একটা উপকার করতে পারেন বোধ হয়। কমের মধ্যে ভালো মোটেল পাব কোথায়, বলতে পারেন?

থাকার ইচ্ছে?

নো ওয়ে। রিপোর্ট তো করতে হবে অফিসে।

জবাবটা পছন্দ হলো না শেরিফের। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হলো: লেকফ্রন্ট নামে একটা মোটেল আছে আমাদের। দুই ব্লক দক্ষিণে এখান থেকে।

থ্যাঙ্ক ইউ।

ভাববেন না, ঠিক মতোই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। তা ছাড়া, ব্যাপারটা ব্যক্তিগতও।

সেটা কী রকম? সকৌতূহলে জানতে চাইল আয়ান।

আমার মেয়েকে দেখলেন না? থমথমে গলায় বলল নিক কারটার। লেক ম্যানিটোঅকের শিকার ও!

ছয়

তথ্যটার জন্য একেবারেই তৈরি ছিল না ওরা। বিহ্বল দৃষ্টিতে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল।

বলতে চাইছেন,  ধাক্কা সামলে বলল আয়ান। উনিও

না, ডুবে যায়নি।

তা হলে?

অভিশপ্ত লেকটা বিধবা করেছে ওকে!

সরি! দুজনেই বুঝতে পারছে এখন, কী বিশাল ঝাঁপটা গেছে বাচ্চাটার উপর দিয়ে।

ইট স ওকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অফিসার। ক্যালিফোরনিয়ায় থাকত ওরা। ছুটি কাটাতে আমার কাছে এসেছিল মেয়েটা। এক সকালে বাপের সঙ্গে বোট-রাইডে বেরোয় রুফাস। ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে সম্ভবত ছেলেকে নৌকায় রেখে গোসলে নামে জামাই। তারপর…!

বাচ্চাটা তা হলে একজন আই-উইটনেস! ঝিকিয়ে। উঠল আয়মানের চোখ দুটো। ও নিশ্চয়ই

লাভ নেই, ওকে থামিয়ে দিল অফিসার।

সরি?

সেদিনের পর থেকে জবান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। রুফাসের, ব্যাখ্যা করল কারটার। অনেক চেষ্টা করা হয়েছে… একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি বাচ্চাটা।

সাত

অদ্ভুত! নিজের মনে মন্তব্য করল আয়মান।

কীসে বিস্মিত হয়েছে, দেখার জন্য ভাইয়ের কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে এল অন্য জন।

লেক ম্যানিটোঅক ট্রিবিউন-এর উইণ্ডো খোলা ছোট ভাইয়ের ল্যাপটপে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে ও মোটেলের ওয়াই-ফাই দিয়ে।

লেক-ট্র্যাজেডি এই তিনটাই না… আরও আছে!

কী বলিস! চেয়ারের পিঠে হাত রেখে আরও ঝুঁকল আয়মানের সহোদর।

এই যে দেখ- প্রথমটা। স্ক্রিনে আঙুল দেখাল আয়মান।

আইস-ফিশিং ফেস্টিভ্যালে বিষাদের ছায়া। প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম। নিচে সাব-হেড: পানিতে ডুবে ১২ বছরের শিশুর মৃত্যু।

তা দ্রুত পড়ল আয়ান খবরটা। ভালো করে দেখল নিহতের ছবি। হতভাগ্যের নাম ভিনসেন্ট মোমোয়া।

এরপুর পঁয়তিরিশ বছরে আরও ছয়টা আছে এমন ঘটনা। তফাত কেবল, প্রথম লাশটাই খালি পাওয়া গেছে, [ বাকিগুলো বেমালুম গায়েব। কোনও চিহ্ন না, কিছু না! হানড্রেড পারসেন্ট শিয়োর, কিছু আছে ওই পানির নিচে। লক নেস কিংবা লেক চ্যাম্পলেইনের মতো।

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে আয়ান। কিন্তু ওর মনটা চলে গেছে দূরে। ঝাপসা হয়ে গেছে কমপিউটারের পরদা। সংবিৎ ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করল: বাই দ্য ওয়ে… ওসব জায়গার মতো মিথ-টিথ নেই লেক ম্যানিটোঅককে নিয়ে?

সেটাও খুঁজলাম। …নাই, পাইনি এমন কিছু,  বলল। আয়মান মাথা নেড়ে।

ভাবছি, কী দেখেছিল সেদিন রুফাস। ছেলেটার সাথে একবার দেখা করা দরকার।

লাভ কী? ও তো নাকি কথাই বলে না!

কথা না বললেও লিখতে পারে নিশ্চয়ই!

আঁই! এটা তো ভাবিনি, ভাইয়া! …কিন্তু… উত্তেজনাটা থিতিয়ে এল পরক্ষণে। ওরাও কি চেষ্টা করেনি?

ওদেরটা ওরা করেছে। আমরা আমাদের মতো করব। পার্কে যাবে, বলেছিল না?

আট

পার্কটা আদতে প্লেগ্রাউণ্ড। পর্যাপ্ত স্পেস রাখা হয়েছে খেলাধুলার জন্য। বিকেলের নরম রোদে দস্তুরমতো সময়টা উপভোগ করছে নানান বয়সী শিশু-কিশোররা। ছুটোছুটি, ছোঁয়াছুঁয়ি চলছে; দড়ি লাফাচ্ছে মেয়েদের দু -চারজন। বিচ্ছিরি কাঁচ-কুঁচ আওয়াজে দুললেও দোলনা নিয়ে অভিযোগ নেই কারও। স্লিপারে উঠে পিছলে নামছে কেউ মনের আনন্দে, কারও-বা আনন্দ সি-স র দুই প্রান্তে বসে উপর-নিচ করাতে। হাওয়ায় ভাসছে রং-বেরঙের ফ্রিসবি। বাদ নেই ফুটবল-ক্রিকেটও। একটু বেশি বয়সী মেয়েরা এখানে-ওখানে জমে গেছে আঁড়ায়। মেলা বসেছে যেন সবুজে ঘেরা গোল জায়গাটায়। হাসি-হুঁল্লোড়ে মুখর পরিবেশ। অভিভাবকদের বেশির ভাগই গল্প জমিয়েছে ছোট ছোট জটলা তৈরি করে। অল্প কিছু লোক টাইম পাস করছে পত্রিকা বা সেলফোনে।

এসবের মধ্যে নেই রুফাস। পার্কের ঘেসো এক অংশে উবু হয়ে বসে মগ্ন হয়ে আছে ছবি আঁকায়। হইচই কম ওদিকটায়। রোদ নেই।

এলিজা কারটারের পাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল কিছুক্ষণ আয়ান। একটু দূর থেকে ছেলের খেয়াল রাখছে ওর মা। মেয়েটার অনুমতি নিয়ে পা বাড়াল ও রুফাসের উদ্দেশে।

ভাইয়ের বদলে বিধবা তরুণীকে সঙ্গ দেয়াটাই বেটার মনে করল আয়মান। তা ছাড়া বাচ্চাদের সঙ্গে বনে না ওর খুব একটা।

হেই, চলছে কেমন? কথাটা বলেই ঝপ করে আসন পিড়ি হয়ে বসে পড়ল ইকরামুল্লাহ মাস্টার রুফাসের পাশে।

ড্রইং খাতায় এক মনে ক্রেয়ন ঘষছিল বাচ্চাটা, তাকিয়ে পর্যন্ত দেখল না। শরীরী ভাষাতেও ফুটে উঠল না কোনও পরিবর্তন। পাশে যেন অস্তিত্বই নেই কারও। ক পাশে হেলে খাতাটায় চোখ রাখল আয়ান। কী আঁকছে। এটা রুফাস? জিলাপি? এ ছাড়া মাথায় এল না অন্য কিছু। সাদা কাগজের বুকে বড়সড় এক স্পাইরাল।

নাইস, ভেরি নাইস, বোদ্ধার মতো মন্তব্য করল আয়ান। আসলেও বোধ হয় দারুণ কিছু। কালো রঙের জিলাপি! বাচ্চাটা বোধ হয় বিমূর্ত চিত্রশিল্পী হবে বড় হলে।

না, প্রশংসায় ভাবান্তর হয়নি রুফাসের।

রঙের প্যাকেটের পাশে ছড়ানো এক গাদা ক্রেয়ন থেকে বেছে নিল একটা আয়ান। কিছুটা ইতস্তত করে বলল, কাগজ হবে, রুফাস?

জবাব না দিয়ে নিজের কাজই করে চলল বাচ্চাটা।

অসহায় চেহারা হলো আয়ানের। ওকে একটুও পাত্তা দিচ্ছে না ছেলেটা।

ওকে দেন। উঠে পড়তে গেল ও। ডিসটার্ব করার জন্য এ দুঃখিত।

কাজ হলো এবারে। জিলাপি আঁকা থামিয়ে ফড়াত করে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ল ছেলেটা খাতার পিছন থেকে। না তাকিয়েই বাড়িয়ে দিল ওটা আয়ানের দিকে।

থ্যাঙ্কস! থ্যাঙ্কস, এটুকুই বলতে পারল ও কাগজটা হাতে নিয়ে।

আশপাশে তাকিয়ে কোনও কিছু দেখতে পেল না আয়ান পাতাটার নিচে রাখার জন্য। আঁকার সুবিধার জন্য ভাঁজ করতে হলো ওটাকে। কাগজটা উরুর উপরে রেখে আঁচড় কাটতে লাগল ও ক্রেয়নের। কী আঁকছে, সে-ই জানে। বিন্দু মাত্র আগ্রহ দেখাল না রুফাস। জি মিনিট দুয়েক কেটে গেল নীরবে।

তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি, রুফাস,  বলল আয়ান আঁকা না থামিয়ে। হয়তো ভাবছ, কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। ভুল ধারণা। আর-কেউ না করুক, আমি করব। বিশ্বাস করো! কাজেই, সব কথা খুলে বলতে পারো আমাকে। …মুখে বলাটা যদি সমস্যা মনে হয়, লিখে দিলেও চলবে তা হলে… চাও না, তোমার আব্বুর মৃত্যুরহস্যের কিনারা হোক?

প্রতিক্রিয়া নেই। শ্রবণ-প্রতিবন্ধীর মতো নির্বিকার রইল বাচ্চাটা।

হয়ে গেছে! ছবির নিচে নিজের নামটা সই করল। আয়ান। কাগজটা ঘাসের উপর রেখে তার উপরে রাখল ও কফি-কালারের ক্রেয়নটা। উঠে দাঁড়িয়ে চাপড় মারতে লাগল। প্যান্টের পিছনে। আসি, কেমন? দেখা হবে আবার।

আলাপরত আয়মান আর এলিজার সঙ্গে মিলিত হতে চলল ও।

আয়ানের রেখে যাওয়া ছবিটা মাটি থেকে তুলে নিল রুফাস। ক্যারিকেচার করে আঁকা একটা পোর্ট্রেট। দাঁত বের করে থাকা চেহারাটা নিজের বলে চিনতে পারল ছেলেটা।

…ওই ঘটনার পর একটা কথাও বলেনি আমার বাচ্চাটা,  এলিজা বলছে, শুনতে পেল আয়ান। ইভেন আমার সাথেও না।

এক ধরনের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস,  বলল ও মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে। আবছা ভাবে মাথা নাড়ল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। বোঝাল, কাজ হয়নি।

নড় করল এলিজা। হা… ডাক্তারও তা-ই বলেন… শকটা কাটিয়ে উঠলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু…

অবশ্যই ঠিক হয়ে যাবে, ভরসা দিল আয়ান। ছোট মানুষ তো, এজন্য একটু সময় লাগছে। দেখবেন- থেমে যেতে হলো ওকে জ্যাকেটের ঝুলে টান পড়ায়। তাকিয়ে দেখে- রুফাস।

হ্যাঁ, রুফাস?

খাতা থেকে ছেঁড়া একটা ছবি ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল বাচ্চাটা। আগেই আঁকা ছিল এটা।

নিল আয়ান ছবিটা। আমার জন্য?

উত্তর না দিয়ে এক দৌড়ে আগের জায়গায় ফিরে গেল ছেলেটা।

নয়

প্রবল শোকও এক সময় ফিকে হয়ে আসে পেটের খিদের কাছে। জিউস অ্যানিসটনকে তাই এখন জোগাড়যন্ত্র করতে হচ্ছে রাতের খাবারের।

কিচেন-সিঙ্কে ভালো করে ধুয়ে নিল ও মাছটা। ওটাকে বেসিনের পাশে ট্রেতে রেখে চাকুটা তুলে নিল হাতে ট্যাপটা বন্ধ করল না। অবিরল ধারায় অপচয় হতে লাগল পানি।

মাছের মাথাটা কেটে আলাদা করেছে, এসময় সোঁদা একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই খেয়াল করল ছেলেটা, বদলে গেছে ট্যাপের পরিষ্কার পানি। শেওলা-সবুজ রং ধরেছে এখন।

হয় অনেক সময় এরকম। আধ মিনিট অপেক্ষা করার পরেও যখন স্বাভাবিক হয়ে এল না পানি, চাবি টিপে বন্ধ করে দিল ট্যাপটা।

কিন্তু সেকেণ্ড কয়েক বাদেই আরেক বিপত্তি। ভলকে ভলকে ময়লা পানি উঠতে লাগল সিঙ্কের ফুটোটা দিয়ে! এ ঘাবড়ে গেল জিউস। এ আবার কোন্ ধরনের সমস্যা! কালচে পানিতে ভরে যাচ্ছে বেসিন, এক হাতের হাতা টেনে কনুইয়ের উপরে তুলে ফেলল ফুটোয় প্লাগ-চাপা দেয়ার জন্য। নোংরা পানিতে ডুবে থাকায় দেখতে পাচ্ছে না ওটা।

গলগল করে উপচে উঠছে পানি। ছিটে এসে লাগছে। জিউসের চোখে-মুখে। এরই মধ্যে আধা-আধি পরিমাণ এসেছে বেসিনটা। দুধের সরের মতো ভাসছে ফেনা পানির উপরে।

মুখখানা বিকৃত করে হাত ডোবাল ও পানির মধ্যে।

দশ

হলফ করে বলতে পারি এবার, নেসি কিংবা চ্যাম্প না আমাদের কালপ্রিট! তুবড়ির মতো কথাগুলো বেরিয়ে এল আয়ানের মুখ দিয়ে।

মরনিং-ওঅকে বেরিয়েছিল। মিনিট দশেকও হয়নি, মাথায় উঠেছে প্রাতঃভ্রমণ। ছুটতে ছুটতে ফিরে এসেছে মোটেলে। ধড়াম করে দরজা খুলে ঢুকেছে কামরায়। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে বসেছিল আয়মান, চমকে গিয়ে আধহাত লাফিয়ে উঠল চেয়ারে।

আস্তে! আস্তে! ভাইয়ের উপরে খিঁচড়ে উঠল আয়মানের মেজাজটা। সুস্থির হয়ে বল, কীসের তাড়ায় ফিরে এলি!

জিউস!

কোন্ জিউস? হারকিউলিসের বাপটা?

রসিকতা রাখ! অবস্থা কিন্তু সিরিয়াস!

আরে, বলবি তো, কী হয়েছে!

মারা গেছে ছেলেটা!

কীই! বিস্ফারিত হলো আয়মানের দৃষ্টি।

হ্যাঁ। যাচ্ছিলাম পুলিস-স্টেশনের পাশ দিয়ে। সাতসকালে ওদের অস্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য দেখে কৌতূহল হলো। পেয়ে গেলাম শেরিফকে। সারা রাত ঘুমায়নি লোকটা। ওর কাছেই জানতে পেরেছি খবরটা ।

আহ! আক্ষেপ ঝরল আয়মানের কণ্ঠে। মরল কীভাবে?

ডুবে!

মাথা নাড়ছে আয়মান। যা ভেবেছিলাম…

কোথায় ডুবেছে, জানতে চাইলি না?

লেকের পানিতে না?

ওখানেই তো রহস্য প্যাঁচ খেয়ে গেছে, ভ্রাতা!

তা হলে কোথায়?

কিচেনের সিঙ্কে!

হোয়াট!? কেউ যেন চড় কষিয়েছে আয়মানকে।

বেসিন ভর্তি পানিতে চেপে ধরা হয়েছে মুখটা! সেজন্যই তো বলছি, নেসি-ফেসি নিয়ে কারবার না আমাদের!

কিন্তু… কিন্তু… এটা তো তা হলে মার্ডার!

এগারো

অ্যানিসটনদের বাড়ি আর থানা- চোখের পলকে উড়ে গেল। যেন সকালটা। নিজেদের গাড়ি নিয়ে ঘুরল ওরা এরপর এদিক-সেদিক। সূত্র পাওয়ার আশায় জায়গায় জায়গায় থেমে জিজ্ঞাসাবাদ করল কয়েকজনকে।

লাভ হলো না বিশেষ।

শেষ পর্যন্ত আশার আলো দেখাল লাল-সাদার কমবিনেশনে তেকোনাকৃতি এক দালানবাড়ি। ওটার সামনে, রাস্তাটার উলটো দিকে থমকে দাঁড়াল ধূসর ইমপালা।

উঁচু টাওয়ার-বিশিষ্ট স্থাপনাটাকে চিনিয়ে দিচ্ছে মিনারের মাথায় বসানো খ্রিস্টানদের পবিত্র যোগচিহ্ন।

কোথায় দেখেছি গির্জাটা, বল তো, ভাইয়া! নিজের ভিতরটা হাতড়াচ্ছে আয়মান।

গত কাল,  মনে করিয়ে দিল বড় ভাই।

ওহ, ইয়েস! চটাস করে তুড়ি বাজাল ছোট জন।

রুফাসের আঁকা ছবিটায়! যেটা তোকে উপহার দিয়েছে।

আমিও ভেবেছি- উপহার। কিন্তু এখন…

কেন, ভাইয়া?

ওকে তো বললাম, সেদিন কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, লিখে দেয়ার জন্য। বদলে দিয়েছে ছবিটা। তার মানে কি, কোনও মেসেজ দিতে চাইছে ওটা দিয়ে?

সম্ভাবনাটা ধরতে পেরে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল আয়মানের।

কিন্তু চার্চের সাথে ওর বাপ ডুবে মরার কী সম্পর্ক?

আসলেই কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সেটা তো ওখানে গেলে বোঝা যাবে না।

বারো

কে ভেবেছিল, পঁয়তিরিশ বছর আগে মারা গিয়েছিল যে ভিনসেন্ট মোমোয়া, ফাদারের সন্তান ও!

গির্জার উলটো দিকের ছোট এক হলদে বাড়িতে থাকেন। বৃদ্ধ যাজক। লাঞ্চের আগে আগে চলে যান বাসায়। ওখানেই ওঁর সঙ্গে দেখা করেছে ছেলেরা।

আর, দেয়ালের ওই ছবি? যোগ করল আয়ান। ভিনসেন্টের পাশের ছেলেটা যে জিউসের বাবা, এই আবিষ্কারটাও তো ফেলে দেয়ার মতো না!

আমি ভাবছি, রুফাস ছেলেটা কি জানে এই– কানেকশনটার ব্যাপারে? ২ মনে হয় না, ভাইয়া। ও বোধ হয় শুধু ভিনসেন্টকেই ইঙ্গিত করেছে।

সেটা যদি ধরি, শুধু ভিনসেন্টকে দিয়ে কী বোঝাতে চাইল বাচ্চাটা? ভিনসেন্ট যে ওই লেকের প্রথম শিকার, সেটা বুঝলাম। আমরাও জানি সেটা। অবশ্য, আমরা যে জানি, রুফাসের তা জানার কথা না।

আমার অদ্ভুত লাগছে, চার্চের ছবি থেকে ফাদার, সেখান থেকে ভিনসেন্ট- এই ব্যাপারটা। রুফাস এটা আগে থেকে জানত কি না, সন্দেহ আছে আমার।

ট্রমাটিক এক্সপেরিয়েন্স থেকে সাইকিক টেনডেনসি বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড কিন্তু আছে মেডিকেল সায়েন্সে।

ও সমঝদারের মতো মাথা নাড়ল আয়মান। ওর মা-ও বলছিল সেদিন, হঠাৎ করে আঁকাআঁকির ঝোঁক বেড়ে গেছে রুফাসের। স্বামী মারা যাওয়ার আগে দেখা যায়নি এরকমটা।

তা হলেই বোঝ।

কী-কী পাচ্ছি তা হলে? প্রথমে পানিতে ডুবে মারা গেল ভিনসেন্ট। ছেলেটাকে চিনত মিস্টার অ্যানিসটন। ওই লোকের ছেলেমেয়েরাও মারা গেছে রহস্যময় ভাবে। মেয়ে মরেছে লেকে। হদিস পাওয়া যায়নি ওর লাশের। জিউস ছাড়া অন্য মৃত্যুগুলোর বেলাতেও তা-ই। লেকেও মারা যায়নি, ডেড বডিও গায়েব হয়নি লিয়ানার ভাইয়ের। নাম্বার ওয়ান খটকা।

না, এটা খটকা নাম্বার দুই।

তা হলে প্রথমটা কোটা?

ভিনসেন্ট। এক মাত্র ও ছাড়া লেকে ডোবা কারও লাশই পাওয়া যায়নি। আর যায়নি তো, যায়ইনি। একটা কিছু সূত্র পর্যন্ত না। দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যেন। পুরোপুরি। এর মধ্যে আমি অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছি, আয়মান। সুপার-ন্যাচারাল কিছু। অন্যদেরকে যদি গায়েব করে দিতে পারে, ভিনসেন্ট মাফ পেল কেন?

ভিনসেন্ট শুধু না, জিউসও মাফ পেয়েছে।

জিউসের ব্যাপারটা আলাদা। লেকে মৃত্যু হয়নি ওর।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল আয়মান। ভিনসেন্ট যেহেতু প্রথমে মারা গেছে, তা হলে কি ধরে নেব, ও মরেছে বলেই পরবর্তী ট্র্যাজেডিগুলো ঘটেছে? রিভেঞ্জ-থিয়োরি?

হয় না, হোরেশিয়ো?

হলে তো এটাও ধরে নিতে হবে, ভিনসেন্টের মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্ট না- মার্ডার।

অ্যাণ্ড দ্যাট স দ্য পয়েন্ট। আমার ধারণা, চুবিয়ে মারা হয়েছে ওকে। সেজন্য ভূত হয়ে শোধ নিচ্ছে। মৃত্যুনীল ফাঁদ হয়ে উঠেছে লেকটা। খালি গোলমাল বাধাচ্ছে জিউস ছোঁড়াটা। ওর মৃত্যুটা আমাদের এই তত্ত্বের সাথে খাপে-খাপ মিলছে না।

তবে মৃত্যুটা কিন্তু হয়েছে পানি থেকেই। আচ্ছা, এখানকার পানিটা আসে কোত্থেকে, বল তো?

লেক থেকে নিশ্চয়ই। বলেই মুখের চেহারা পালটে গেল আয়ানের।

…আয়মান, রে!

কী হলো, ভাইয়া!?

শেরিফ কী বলেছিল, মনে আছে তোর? লেকটা, না বাঁচলে শহরটাও বাঁচবে না! কেন বলেছিল ওকথা?

পানির জোগান বন্ধ হয়ে যাবে, তা-ই?

এটাই তো সহজ উত্তর, নাকি? আর লেকই যদি না থাকে, কোথায় যাবে ভিনসেন্টের আত্মা?

খেল খতম!

ঠিক, ছয় মাসের মধ্যে! সেজন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে…

কী বলতে চাস?

অদ্ভুত হলেও আর কোনও ব্যাখ্যা নেই যেটার…

আমি বুঝতে পারছি না…

সহজ কথা। পাইপ বেয়ে হাজির হয়েছে এসে জিউসদের বাসা পর্যন্ত… একই পানি যেহেতু! ওটার দৌড় সম্ভবত পানি পর্যন্তই।

তা-ই বলে যাকে ইচ্ছা, খুন রিবে!

মনে হয় না যে, নির্বিচারে করছে কাজটা। তা না হলে পঁয়তিরিশ বছরে লাশের সংখ্যা বাড়ত আরও। আর দেখ, এ বছরের হিসাব বাদ দিলে অতগুলো বছরে মরেছে মাত্র তিনজন। বুঝতেই পারছিস, তাড়াহুড়ো শুরু হয়েছে ওটার।

বেছে বেছে খতম করার অর্থ কিন্তু দাঁড়ায়, এরাই দায়ী ভিনসেন্টের অকাল মৃত্যুর জন্য!

নিশ্চয়ই তা-ই।

জিউস! লিয়ানা! ওদের কী অপরাধ? ওদের তো জন্মই জ হয়নি তখন!

বাপটার কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন? বন্ধুর মৃত্যুর জন্য সে-ই যদি দায়ী হয়?

চোয়াল ঝুলে পড়ল আয়মানের। আল্লা, রে! বাপের অপরাধের জন্য শাস্তি পাচ্ছে সন্তান?

এখন আমার ইকটুও সন্দেহ নেই।

আমার আছে। এলিজার হাজব্যাণ্ড! ওই লোকের সাথে লিঙ্ক কই অ্যানিসটনদের?

খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে, মারা যাওয়া প্রত্যেকের সাথেই কোনও-না-কোনও সম্পর্ক আছে মিস্টার অ্যানিসটনের। …গাড়ি ছোটা জলদি! পাকড়াও করতে হবে লোকটাকে!

তেরো

কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না সন্দেহভাজন ডেভিড অ্যানিসটনকে। কবরখানার মতো নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। ডাকাডাকি, চিল্লাচিল্লি করেও ফল হলো না কোনও। ভেলকিবাজির মতো মিলিয়ে গেছে যেন পরিবারের এক মাত্র জীবিত সদস্যটি।

খুঁজতে খুঁজতে ডকের উপরে চলে এল ছেলেরা। তখনই দেখতে পেল ওরা নিখোঁজ-রহস্যের সম্ভাব্য উত্তরটা।

লেকের দূরে আরোহীবিহীন ভাসছে ছোট্ট বোটটা।

ছোট বেলার বন্ধুকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে ভিনসেন্ট মোমোয়া!

অ্যানিসটন কেন নৌকা নিয়ে গেল ওখানে, কোনও দিনই জানা যাবে না আর।

.

গাড়ির ভিতরে গুম হয়ে রয়েছে দুই ভাই।

ইট স ওভার, ভারি স্বর আয়মানের।

না, আয়মান,  বলল ওর ভাই। অতটা নিশ্চিত হতে পারছি না আমি।

আবার কেন?

শান্তি যদি না হয় ওটার? কী ঘটবে তা হলে? রুফাসের বাবাকে মেরেছে ভিনসেন্ট। তা হলে তো রুফাস, শেরিফ, এলিজা- ওরাও বিপৎসুক্ত না। সতর্ক করতে হবে ওদেরকে।

গাড়ি স্টার্ট দিল আয়মান। কোথায় যাব? শেরিফের ওখানে?

কী ভাবল আয়ান। না, ওর বাসায় চল। বাচ্চাটার সাথে দেখা করতে চাইছি। পথে কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যাবে ঠিকানাটা।

চোদ্দ

ঈষদুষ্ণ পানিতে লিকুইড সাবান মিশিয়েছে; লেস লাগানো খাটো, বেগুনি রোবটা গা থেকে খুলে ফেলল এলিজা। পানি এখনও ছাড়া। একটু একটু করে ভর্তি হচ্ছে পোরসেলিনের প্রকাণ্ড বাথটাবটা।

ওঅশ-ক্লদটা হাতে নিয়ে পানিতে নামল মেয়েটা। হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল টাবে। আহ, আরাম! আপনা-আপনি বুজে এল চোখ জোড়া। লম্বা গলার কলটা পায়ের দিকে। একটা পা উঁচু করে পানির আদর নিতে লাগল আঙুলে। তারপর আরেক পা। সেই সঙ্গে হাতের কাপড়টা ঘষছে গ্রীবায়।

টেরও পেল না, শেওলার মতো ফ্যাকাসে-সবুজ রং ধরল পানির ধারা!

.

ডোরবেলের সুইচে হাত দিয়েছে কি দেয়নি, ঝট করে খুলে গেল দরজা। এ দিশাহারার মতো দেখাচ্ছে রুফাসকে। শ্বাস নিচ্ছে হাঁ করে। গালে পানির দাগ। দু চোখ বিস্ফারিত।

নিচু হয়ে ছেলেটার দু কাধ ধরল আয়ান। কী হয়েছে, রুফাস?

উলটো ঘুরে ঘরের ভিতরে ছুট লাগাল বাচ্চাটা। দোতলার সিঁড়িটা লক্ষ্য। হলওয়ে ধরে পিছু নিল হতচকিত দুই ভাই।

সিঁড়িতে পা দিয়েই বিপদটা উপলব্ধি করল ওরা। হুড়মুড় করে ফেনায়িত পানি নামছে গড়িয়ে! পিছলে পড়ে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সেই মতো দু ধাপ করে ডিঙিয়ে উঠে এল উপরে।

দোতলায় উঠেই হাতের বাঁয়ে একটা দরজা। তলার ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে আসছে পানি। ছোট হাতের মুঠি দিয়ে বন্ধ পাল্লায় দুমদুম কিল দিতে লাগল রুফাস। ডুবন্ত মানুষের দাপাদাপির শব্দ আসছে ভিতর থেকে!

এক মুহূর্তে, পরিস্থিতিটা বুঝে নিল ওরা। ধাক্কা দিয়ে ভাইয়ের দিকে ঠেলে দিল আয়মান রুফাসকে। সজোরে লাথি হাকাল নবের নিচে। এক আঘাতে ধড়াম করে ফাঁক হয়ে গেল কবাট।

পনেরো

শরীর মুছিয়ে, কাপড় পরতে সাহায্য করে লিভিং রুমে এনে বসানো হয়েছে এলিজা কারটারকে। কিচেনে গিয়ে কড়া করে কফি তৈরি করে এনেছে আয়ান। দুঃসহ এ অভিজ্ঞতার ধকল কাটাতে কাজে দেবে ক্যাফেইন। আরও ভালো হতো ব্র্যাণ্ডি পেলে।

দু চুমুক দিয়েই পানীয়টা নামিয়ে রেখেছে রুফাসের আম্মু। সিরামিকের মগে ঠাণ্ডা হচ্ছে তেতো কফি।

সোফায় পা তুলে দু বাহুতে হাঁটু বেড় দিয়ে ধরেছে। এলিজা। মাথাটা কাত করে গাল রেখেছে হাঁটুতে। ফোঁপানির সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে পিঠটা কেঁপে উঠছে এখনও। কোনও ভাবেই মন থেকে তাড়াতে পারছে না দুঃস্বপ্নটা।

ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, জানতে চায়নি ওরা। বোঝাই যখন যাচ্ছে! নিজ চোখে নিজেদের ধারণার সপক্ষে প্রমাণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে দুই যমজ বাথটাব ভরা কালচে সবুজ পানিতে রুফাসের মায়ের মাথাটা ঠেসে ধরে রেখেছিল অদৃশ্য কোনও শক্তি। ছুটে গিয়ে ওরা মেয়েটাকে ধরতেই পালিয়ে যায় ভিনসেন্টের আত্মা। ভাগ্যিস! তা না হলে কী যে হতো, বলা মুশকিল।

ফাদারের ছেলের মৃত্যু থেকে শুরু করে অল্প কথায় সব কিছু খুলে বলেছে আয়মান এলিজাকে। শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে মেয়েটা। বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে যেন।

এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো বুকশেলফটার সামনে দাঁড়িয়ে আয়ান। মৃদু স্বরে সান্ত্বনা দিচ্ছে আয়মান এলিজাকে, আই-লেভেল বরাবর তাকটায় একটা বই দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর ভাইয়ের। স্পাইনের (বইয়ের পুট বা দাঁড়া) লেখাটা কলম দিয়ে লেখা। দেখলই শুধু, আগ্রহ জাগল না।

একটা প্রশ্ন জানার আছে আমার,  মুখ ফিরিয়ে বলল ও।

অ্যানিসটন পরিবারের সাথে কী ধরনের আত্মীয়তা আপনাদের?

অবাক চোখে গাল তুলল এলিজা। লাল হয়ে রয়েছে চোখ দুটো। কোনও আত্মীয়তা নেই তো!

নেই! তারপর যেন বুঝতে পেরেছে, এমনি ভাবে জিজ্ঞেস করল আয়ান: রিলেশনটা কি তা হলে আপনার স্বামীর সাথে?

হতেই পারে না। অ্যারন তো কেউ নয় এখানকার। হার্ভার্ডে পড়তে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে।

আচ্ছা… কেমন যেন হতবুদ্ধি মনে হলো আয়ানকে। তার পরই ভয়ঙ্কর একটা সন্দেহ উঁকি দিল মগজে।

চোখ আটকে যাওয়া দাঁড়াটার উপরে আঙুল রেখে বইয়ের ভিড় থেকে টেনে বের করল ও খাড়া করে রাখা স্ক্র্যাপবুকটা। লাল, চামড়ার-মলাটেও স্কচটেপ দিয়ে হাতে লেখা লেবেল সাঁটা।

খুলল বইটা। একটা-একটা করে ভিতরে লাগানো ছবি আর পেপার-কাটিংগুলো দেখতে দেখতে উলটে চলল পাতা। অবশেষে পেয়ে গেল, যেটা আশা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে কাঠিন্য ভর করল চোয়ালে।

তোমরা! শোনা গেল একটা বাজখাই কণ্ঠ।

হলওয়ের মুখটার দিকে ঘুরে গেল সব কটা ঘাড়।

সম্বোধন থেকেই বুঝতে পারল আয়মানরা, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।

তোমরা কী করছ এখানে? এগিয়ে আসতে আসতে কর্কশ কণ্ঠে কৈফিয়ত দাবি করল শেরিফ।

আমরা–

জবাবটা পুরো করতে দিল না অফিসার আয়ানকে। ওয়াইল্ডলাইফে খোঁজ নিয়েছি আমি। তোমাদের নামই শোনেনি ওই ডিপার্টমেন্ট!

কী বলছ, আব্বু! নগ্ন অবিশ্বাস এলিজার চোখের তারায়। এরা তা হলে কারা?

প্লিজ, ব্যাখ্যা করতে দিন বিষয়টা… আত্মরক্ষার চেষ্টা করল আয়ান।

একটা কথাও শুনতে চাই না! ফোঁস করে উঠল শেরিফ। সরকারি অফিশিয়াল হিসাবে, পরিচয় ভাড়ানোর দায়ে গ্রেপ্তার করতে পারি তোমাদের। করছি না। এখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠবে তোমরা। সোজা বেরিয়ে যাবে শহর থেকে। আর যেন না দেখি তোমাদের। যা বললাম, পরিষ্কার?

প্লিজ, স্যর! কথাটা শুনলে—

কোমরের হোলস্টার থেকে ঝট করে পিস্তল বের করল আইন-রক্ষক। বেরোও!

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আয়মান।

ভিনসেন্টের মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছিল, শেরিফ? শেষ। চেষ্টা নিল ওর ভাইটা।

ভিনসেন্ট! কোন্ ভিনসেন্ট? খেঁকিয়ে উঠল নিক কারটার।

ভালো করেই বুঝতে পারছেন, কার কথা, বলছি! ভিনসেন্ট মোমোয়া। ফাদারের ছেলে। আজ থেকে পঁয়তিরিশ বছর আগের ঘটনা! মনে পড়ে?

না পড়ার কী আছে? ভয়ানক বিরক্ত মুখে ওগরাল কারটার। প্রথম লেক-দুর্ঘটনা ছিল ওটা।

হ্যাঁ… কিন্তু কী হয়েছিল আসলে? মরল কীভাবে ছেলেটা?

আর কীভাবে! সপাং করে উঠল অফিসারের কথার চাবুক। পত্রিকা-টত্রিকা পড়ো না নাকি?

সত্যি কথাটা, জানতে চাই আমরা, মিস্টার কারটার! লোকে কী জানে, সেটা নয়! কীভাবে ডুবল ভিনসেন্ট মোমোয়া?

আমি তার কী জানি? দেখে মনে হচ্ছে, পারলে আয়ানকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে শেরিফ।

অবাক দৃষ্টিতে একবার ওর দিকে, একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে আয়মান। কী বলতে চাইছে ওর ভাইয়া? কিছু যেন আবিষ্কার করেছে আয়ান!

দৃঢ় বিশ্বাস, জানেন আপনি! এই যে… বইটা… কাভার তুলে দেখাল ছেলেটা। নিক- বারো বছর বয়সে। এবারে খুলল আঙুল গুঁজে রাখা পাতাটা। এই ছবিটা পেয়েছি এখানে। পড়ল ক্যাপশনটা: এক্সপ্লোরার টুপ-থারটি সিক্স। মোমোয়া আর আপনাকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে।

তাতে কী ঘোড়ার ডিমটা হয়েছে! সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে যেন শেরিফের। আশ্চর্য! একই ব্যাচে পড়তাম ও, আর আমি। এটাই কি আমার অপরাধ হয়ে গেল?

নো, মিস্টার কারটার! আপনার, অপরাধ আরও গুরুতর!

অ্যাই, মুখ সামলে!

কেয়ারই করল না আয়ান। এখনও হয়তো অন্ধকারে থাকতাম, যদি না দেখা হতো ফাদারের সাথে! যদি না

জানতাম, ডেভিড অ্যানিসটনও ব্যাচমেট ছিল আপনাদের! এই যে… উনিও আছেন ছবিতে।

কী প্রমাণ হয় তাতে?

কিছুই না- ঠিক,  স্বীকার করল আয়ান। কিন্তু এলিজা ম্যামের একটা কথাই পরিষ্কার করে দিয়েছে সব রহস্য!

লিজি! কী বলেছে ও? ক্রুর চোখে তাকাল নিক কারটার।

তার আগে বলুন, মিস্টার অ্যানিসটনের ছেলেটা কীভাবে মারা গেছে বলে আপনার ধারণা?

খুন করা হয়েছে ওকে।

কে সেই খুনি?

আরে… আমি কি সবজান্তা নাকি? তদন্ত চলছে। ঠিক বের করে ফেলব!

যদি বলি- ভিনসেন্ট মোমোয়া?

কীহ! টপ-টপ করে চোখের কোটর থেকে খসে পড়বে যেন এক জোড়া রসগোল্লা। গাঁজা খেয়ে এসেছ নাকি?

না, স্যর, অম্লান বদনে বলল আয়ান। একটু আগেই আমাদের থিয়োরিটা ব্যাখ্যা করছিলাম ম্যাডামকে। খুন হয়েছে ভিনসেন্ট। সে-কারণে নিচ্ছে প্রতিশোধ। যারা ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের কাছের লোকগুলোকে দিয়ে শুরু করেছিল প্রথমে। তারপর ধরল মিস্টার অ্যানিসটনকে। হ্যাঁ, নিশ্চিত আমরা, ভিনসেন্টের মৃত্যুটার পিছনে হাত আছে ওঁর। কিন্তু আদায় করতে পারিনি স্বীকারোক্তিটা। তার আগেই…

 ক্‌-কী হয়েছে ডেভিডের?

লেক ম্যানিটোঅক গিলে নিয়েছে ওঁকে! বাড়িতে নেই কেউ। শূন্য বোটটা ভাসছে পানির মাঝখানে!

যিশাস ক্রাইস্ট! আঁতকে উঠল আইন। ফোর্স পাঠাতে হবে- এক্ষুনি!

লাভ নেই, অফিসার। পাওয়া যাবে না ওনাকে। যেমন পাওয়া যায়নি ওঁর মেয়েকে… যেমন পাওয়া যায়নি আপনার জামাইকে! প্রশ্ন হলো: কেন মরতে হলো ওকে? আপনার মেয়ের কাছে শুনলাম: অ্যানিসটনদের সাথে কোনও ধরনের আত্মীয়তা নেই আপনাদের। তবে এত আক্রোশ কেন রুফাসের বাবার উপরে? কার আপন মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক? উত্তরটা কঠিন নয়: আপনার। অতএব, এটাই প্রমাণ হয়, ভিনসেন্টের মৃত্যুর জন্য দায়ী আপনিও!

ফালতু কথা বলবে না! একদম ফালতু কথা বলবে না!!

বলছিও না। প্রিয়জনদের মেরে মিস্টার অ্যানিসটনকে শাস্তি দিচ্ছিল ভিনসেন্ট। লোকটার মৃত্যুর পর প্রয়োজন ফুরিয়েছে সেটার। বাকি রইলেন আপনি। আপনার জামাইকে মেরেছে ওটা। আরেকটু হলেই মেরে ফেলত মিস

কী হয়েছিল! ভয়ঙ্কর চমকে উঠল শেরিফ। কী হয়েছিল আমার লিজার?

আব্বু! কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল এলিজা। ওটা… ওটা… এঁরা না থাকলে…

বাথরুমে হাজির হয়েছিল ভিনসেন্ট… রক্ত সরে গেছে। অফিসারের মুখ থেকে, লক্ষ করল আয়মান। যেমন করে হাজির হয়েছিল অ্যানিসটনদের কিচেনে!

কিন্তু…ক্‌-কীভাবে!

পানির পাইপ দিয়ে। এখানকার পানিটা কি লেক থেকে আসে, মিস্টার কারটার?

হ্-হ্যাঁহ…

তবে তো আর কোনও সন্দেহই রইল না।

আব্বু! অনুযোগের সুরে বলল এলিজা। এসব কি সত্যি? তুমি… ভিনসেন্ট… বলো না ওঁদেরকে, কাউকে খুন করতে পারো না তুমি!– কোণঠাসা জানোয়ারের অবস্থা শেরিফের। ঢোক গিলল। পিস্তল ধরা হাতটা কাঁপছে থরথর করে। যমজ ভাইদের প্রতি কঠোর মনোভাবটা নেই আর।

মুখ খুলুন, স্যর, নরম গলায় অনুরোধ করল আয়ান। একবার ব্যর্থ হয়েছে বলেই যে আবার চেষ্টা করবে না প্রেতটা, জোর দিয়ে বলা যায় না এ কথা। এরপর হয়তো… না ধপ করে সোফায় ধসে পড়ল শেরিফ। পিস্তলটা খসে পড়ল হাত থেকে। পঁয়তিরিশ বছর ধরে বুকের অন্তরালে চাপা দিয়ে রেখেছিল যে সত্যটা, হাঁপানির সঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগল বাঁধ ভেঙে।

ডেভ, আমি আর ভিনসেন্ট… ডকটার উপরে ছিলাম আমরা। হাবাগোবা টাইপের ছেলে ছিল ভিন্স। সব সময় তাই জ্বালাতাম ওকে। দুজনে মিলে চ্যাংদোলা করে ফেলে দিই সেদিন পানিতে। বার-বার বলছিল, ও নাকি সাঁতার জানে না। তারপর, সত্যিই যখন ডুবে গেল… ভয় পেয়ে গেলাম। এত ভয় পেলাম যে… দু হাতে মুখ ঢাকল কারটার। কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। আমি… আমি… মাফ করে দাও আমাকে!

ক্ষমা আপনাকে করতে পারে একজনই, নিষ্ঠুরের মতো বলল আয়মান। ভিনসেন্ট!

রুফাস! চিল-চিৎকার দিল আচমকা এলিজা। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, গুটিগুটি পায়ে লেকের দিকে এগোচ্ছে ওর ছেলেটা। ঘরেই ছিল এতক্ষণ, বেরিয়ে পড়েছে কোন্ ফাঁকে।

হায়, আল্লাহ, লেকটা! শ্বাস চাপল আয়মান। ভিনসেন্ট তো ছাড়বে না ওকে! ,

রুফাস! রুফাস!! ডাকতে ডাকতে ছুটল সবাই বাইরে এসে।

পানির কিনারে পৌঁছে গেছে বাচ্চাটা। বাড়িটার দিকে চাইল ঘাড় ফিরিয়ে। তক্ষুনি একটা কালো হাত টেনে নিল ওকে পানিতে!

রুফাআস! বাতাস চিরল বিধবা মায়ের বুক ফাটা আহাজারি।

সামনের দৃশ্যটা দেখে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল অফিসার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে চোয়ালের পেশি।

কিনারে এসেই পর-পর ঝাঁপ দিল আয়ান আর আয়মান। এলিজাও করতে যাচ্ছিল কাজটা। পিছন থেকে টেনে থামাল ওকে ওর বাবা। মেয়ের বদলে নিজে নামল পানি ভেঙে।

ডুবছে… ভাসছে… ডুবছে… ভাসছে… নিশানাই পাচ্ছে না যমজরা রুফাসের। হারিয়ে গেছে যেন চিরতরে।

ভিনসেন্ট… দোস্ত! কান্না জুড়ল কারটার। বুক পর্যন্ত নেমে পড়েছে পানিতে। আমি জানি, শুনতে পাচ্ছিস তুই আমার কথা! প্লিজ, দোস্ত! মাফ করে দে আমার নাতিটাকে! একটা বাচ্চা ও… মাসুম বাচ্চা! কিছুই দেখেনি এ দুনিয়ার! প্লিজ, দোস্ত, প্লিজ! হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছি তোর কাছে! ছেড়ে দে রুফাসকে! রেহাই দে আমার মেয়েটাকে!

কাঁদতে কাঁদতে হদের পাড়ে বসে পড়ল এলিজা। রুফাস!

তালাশ চালিয়ে যাচ্ছে আয়ান আর আয়মান। শেষ পর্যন্ত বুঝি দয়া হলো ঈশ্বরের। অচেতন ছেলেটাকে এক হাতে জাপটে ধরে ভেসে উঠল এক ভাই। এগোতে লাগল তীরের দিকে।

আর বসে থাকতে পারল না এলিজা। সে-ও নেমে পড়ল পানিতে।

ভাসতে ভাসতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে অন্য ভাই। আরে, শেরিফ গেল কই? এই না দেখল ওখানটায়!

পরক্ষণে পেয়ে গেল জবাবটা।

অপার রহস্য নিয়ে থইথই করছে নীল পানি। পুরানো দোস্তকে কাছে পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে কি ভিনসেন্ট?

হয়তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *