ফিয়ানচেত্তো

ফিয়ানচেত্তো

বিশপরা হলো যাজক…তারা একটি পথই বেছে নেয়…প্রায় প্রত্যেক বিশপই জাগতিক লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।

–কোয়ানডাম মোরালিটাস দ্য স্কাক্কারিও
পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট
(১১৯৮-১২১৬)

.

প্যারিস
১৭৯১ সালের গ্রীষ্মকাল

“ওহ্ মার্দে। মার্দে!” জ্যাক-লুই ডেভিড বললেন। রেগেমেগে হাতের ব্রাশটা মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “আমি তোমাদেরকে নড়াচড়া করতে মানা করেছিলাম। এখন তো কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে গেলো। সব শেষ!”

ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের দিকে তাকালেন তিনি, স্টুডিওর মাচাঙে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। বলতে গেলে নগ্নই, তবে পাতলা আর স্বচ্ছ কাপড় জড়িয়ে রেখেছে বুকের উপর, অনেকটা প্রাচীণ গ্রিসের ফ্যাশন অনুযায়ী, যা কিনা এখন প্যারিসের নতুন ফ্যাশন হিসেবে দারুণ চলছে এটা।

 নিজের বুড়ো আঙুলটা কামড়ালেন ডেভিড। তার ঘন-কালো চুল চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর কালো চোখ দুটোতে ঝিলিক দিচ্ছে বন্যতা। হলুদ নীল রঙের স্ট্রাইপের একটি রেশমী কাপড় গলায় পেচিয়ে রেখেছেন তিনি। সেটাতে লেগে আছে চারকোলের গুঁড়ো। পরনের সবুজ রঙের জ্যাকেটটা দুমরেমুচরে আছে।

“আমাকে এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে,” অনুযোগের সুরে বললেন তিনি। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে কোনো কথা বললো না। তাদের মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে চিত্রশিল্পী ডেভিডের পেছনে খোলা দরজার দিকে।

 জ্যাক-লুই অধৈর্য হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। লম্বা আর বেশ সুঠাম শরীরের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে চোখ ধাঁধানো সুন্দর, অনেকটা দেবদূতের মতো। মাথার সোনালী চুল পেছন দিকে টেনে রিবন দিয়ে বাধা। বেগুনি রঙের সিল্কের কাসোক পরে আছে সে।

চোখ দুটো গভীর আর গাঢ় নীল রঙের, চিত্রকরের দিকে নিবদ্ধ সেই চোখজোড়া। অবশেষে তার ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। আশা করি আমি বিরক্ত করছি না,” মাচাঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুণীর দিকে তাকালো সে। তারা হরিণের মতো ভঙ্গি করে পোজ দিয়ে আছে, যেনো এখনই লাফ দেবে। লোকটার কণ্ঠ শুনে মনে হলো উচ্চবংশের কেউই হবে।

“আরে মরিস যে, কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন জ্যাক-লুই। “তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো কে? তারা তো ভালো করেই জানে কাজের সময় আমি কারো সাথে দেখা করি না।”

 আশা করি আপনি এই গ্রীষ্মে আপনার সব লাঞ্চন অতিথিকে এভাবে সম্ভাষণ জানান না, মুচকি হেসে যুবক বললো। “তাছাড়া এটা দেখে আমার কাছে কোনো কাজ বলেও মনে হচ্ছে না। নাকি এটা এমন একটা কাজ যেটাতে আমার হাত লাগানো উচিত।”

ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের দিকে আবারো তাকালো সে, উত্তর দিকের জানালা দিয়ে আসা সোনালী রোদে তারা স্নাত। স্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তাদের কম্পমান দেহ তার নজর এড়ালো না।

“মনে হচ্ছে এরকম কাজে তুমি অনেক বেশিই হাত লাগিয়েছে,” বললেন ডেভিড। ইজেল থেকে আরেকটা ব্রাশ তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু ভদ্রলোকের মতো-মাচাঙের কাছে গিয়ে কাপড়গুলো আবার ঠিক করে দেবে কি? আমি তোমাকে এখান থেকে নির্দেশ দিচ্ছি কি করতে হবে। সকালের আলো অবশ্য এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আর বিশ মিনিট পরই আমরা লাঞ্চের জন্যে বিরতি নেবো।”

“আপনার স্কেচটা কি?” যুবক জানতে চাইলো। মাচাঙের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেলো এক পা টেনে টেনে হাটছে।

“চারকোল আর ওয়াশের,” জবাব দিলেন ডেভিড। “অনেক দিন ধরে এই আইডিয়াটা নিয়ে ভেবে গেছি, পুশিনের দ্য রেইপ অব অ্যা স্যানিন উইমেন-এর থিম।”

 “কী দৃষ্টিনন্দন ভাবনারে বাবা,” মাচাঙের কাছে যেতে যেতে বললো মরিস। আমি কাপড়গুলো কি করবো? দেখে তো বেশ লাগছে।”

ভ্যালেন্টাইন দাঁড়িয়ে আছে মরিসের মাথার উপর মাচাঙে, তার এক হাটু সামনে বাড়িয়ে রাখা আর হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত। তার পাশেই আছে মিরিয়ে, হাটু মুড়ে হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে অনুনয়ের ভঙ্গিতে। তার ঘন লালচে চুল কাঁধের উপর দিয়ে সামনের দিকে ছড়িয়ে আছে, তবে নগ্ন বক্ষ ঢেকে রাখতে পারছে না সেগুলো।

“ঐ যে লালচুলগুলো, একটু সরিয়ে দাও,” দূর থেকে চোখ কুচকে বললেন ডেভিড। “না, এতোটা না। শুধু বাম স্তনটা যাতে ঢেকে যায় এমনভাবে সরিয়ে দাও। ডান স্তনটা পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে। একেবারে উন্মুক্ত। কাপড়টা আরেকটু নামিয়ে দাও। তারা সৈনিকদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, বুঝলে, কোনো সতী-সাধ্বী নান নয় তারা।

যেভাবে বলা হলো সেভাবেই কাজ করলো মরিস কিন্তু বুকের কাছে কাপড়টা সরাতে গেলে তার হাত কেঁপে উঠলো।

“সরাও। আরেকটু সরাও, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, আমি যেনো স্তনটা দেখতে পাই। আরে এখানে চিত্রকর কে, বলি?” চিৎকার করে বললেন ডেভিড।

মরিস একটা দিক সরিয়ে দূর্বল হাসি দিলো। জীবনে সে এতো সুন্দরী তরুণী দেখে নি। মনে মনে ভাবলো, ডেভিড এদের কোত্থেকে খুঁজে পেয়েছে। এই সমাজের সবাই জানে মহিলারা তার স্টুডিওর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডেভিডের তুলির আঁচড়ে গ্রিক ফেমে ফাটাল হবার জন্য। কিন্তু এই মেয়ে দুটো একেবারে আনাড়ি আর গ্রাম্য, প্যারিসের অভিজাত নারী বলে মনে হয় না।

প্যারিসের যে কোনো পুরুষের চেয়ে এই সমাজের নারীদের স্তন আর উরু অনেক বেশি হাতিয়েছে মরিস। তার শয্যাসঙ্গিনীদের মধ্যে ডাচেস দ্য লুইনেস, ডাচেস দ্য ফিজ-জেমস, ভিকোমতে দ্য লাভাল এবং প্রিন্সেস দ্য ভদেমোয় রয়েছে। এটা তার এমন একটি ক্লাব যেখানে সদস্য হবার জন্য সব সময়ই দরজা খোলা থাকে।

মরিসের বয়স সাইত্রিশ হলেও তাকে দশ বছর কম দেখায়। আর নিজের এই তারুণ্যকে সে বিশ বছর ধরে দারুণভাবে সদ্ব্যবহার করে আসছে। এই সময়ের মধ্যে পন্ত নুয়েফ দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, যার পুরোটাই উপভোগের কাজে ব্যয় করেছে সে। তার শয্যাসঙ্গিনীরা তার জন্যে সব সময়ই দরজা খোলা রাখে। শুধু যৌনতাই নয়, তার জন্যে তারা অনেক কিছুই করেছে।

 অন্য যে কারো চেয়ে মরিস ভালো করেই জানে, ফ্রান্স চালায় নারীরা। সে মনে করে আইনগতভাবে নারীদের জন্যে সিংহাসন আরোহন নিষিদ্ধ থাকার কারণেই মেয়েরা তাদের ক্ষমতা চরিতার্থ করে অন্যভাবে। তারাই সিংহাসনে বসায় তাদের পছন্দের প্রার্থীকে।

“এবার ভ্যালেন্টাইনের কাপড়টা ঠিক করো তো,” অধৈর্য হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমাকে মাচাঙে উঠতে হবে, ঐ যে, ওখানে সিঁড়িটা আছে।”

মরিস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে মাচাঙে উঠে গেলো। মেঝে থেকে সেটা বেশ কয়েক ফুট উপরে। ভ্যালেন্টাইনের পেছনে দাঁড়ালো সে।

“তাহলে তোমার নাম ভ্যালেন্টাইন?” মেয়েটার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো। “নামটা ছেলেদের হলেও তুমি দেখতে দারুণ সুন্দরী।”

“আর আপনি একদম লুইচ্চা,” চট করে জবাব দিলো ভ্যালেন্টাইন। “বিশপের মতো বেগুনী রঙের কাসোক পরে থাকা একজন লুইচ্চা!”

“ফিসফিসানি বন্ধ করো,” চিৎকার করে বললেন ডেভিড। “কাপড়টা ঠিক করো, মারস! বাইরের আলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।” মরিস কাপড়টা সরাতে যাবে ঠিক তখনই ডেভিড বলে উঠলেন, “আহ, মরিস। আমি তোমার সাথে এদের পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। এ হলো আমার ভাতিজি ভ্যালেন্টাইন আর তার খালাতো বোন মিরিয়ে।”

 “আপনার ভাতিজি!” কাপড়টা পড়ে গেলো মরিসের হাত থেকে, যেনো আগুনের ছ্যাকা খেয়েছে সে।

 “আমার দূরসম্পর্কের ভাতিজি,” যোগ করলেন ডেভিড। “তারা আমার অভিভাবকত্বে আছে। তার দাদা ছিলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বেশ কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে। কাউন্ট দ্য রেমি। আমার বিশ্বাস তোমার পরিবার তাকে চেনে।”

ডেভিডের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো মরিস।

“ভ্যালেন্টাইন, ডেভিড বললেন, “এই ভদ্রলোক ফ্রান্সে খুবই বিখ্যাত একজন লোক। অ্যাসেম্বলির সাবেক প্রেসিডেন্ট। এ হলো মঁসিয়ে শার্ল মরিস দ্য তয়িরাঁ-পেরিগোর্দ। আঁতুয়ার বিশপ…”

মিরিয়ে লাফ দিয়ে মাচাঙ থেকে নেমে পড়লো, কাপড়টা জড়িয়ে নিলো গায়ে। ভ্যালেন্টাইনও একই কাজ করলো সঙ্গে সঙ্গে। তবে সে এমন চিৎকার দিলো যে মরিসের কান ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো।

“আঁতুয়ার বিশপ!” মরিসের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে চিৎকার করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “শয়তানের চিহ্ন নিয়ে যে লোক জন্মেছে!”

নগ্নপদেই মেয়ে দুটো ঘর থেকে দৌড়ে চলে গেলো।

মুখ টিপে হেসে ডেভিডের দিকে তাকালো মরিস। “বিপরীত লিঙ্গের কেউ সচরাচর আমার সাথে এরকমটি করে না,” বললো সে।

“মনে হচ্ছে তোমার সুখ্যাতি ধীরে ধীরে কমে আসছে,” জবাব দিলেন ডেভিড।

.

স্টুডিওর পাশে ছোট্ট ডাইনিংরুমে বসে জানালা দিয়ে রুই দ্য বাক দেখছেন ডেভিড। মরিস বসে আছে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। তাদের দু’জনের সামনে বিশাল একটি মেহগনি টেবিল। কয়েক বোল ফলমূল আর কিছু মোমবাতি রয়েছে সেটার উপর।

“এরকম প্রতিক্রিয়া কে-ই বা আশা করতে পারে?” বললেন ডেভিড। একটা কমলার কোয়া তুলে নিলেন তিনি। “এরকম ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। উপর তলায় গিয়েছিলাম, যাইহোক, তারা জামাকাপড় পাল্টে লাঞ্চ করার জন্যে নীচে আসতে রাজি হয়েছে।”

“এটা কি করে হলো, মানে এরকম দুই সুন্দরী তরুণীর অভিভাবক হবার কথা বলছি?” মদের গ্লাসে আস্তে করে চুমুক দিয়ে বললো মরিস। “একজন জানষের পক্ষে এরকম সৌন্দর্য উপভোগ করা একটু বেশিই হয়ে যায় না? তাছাড়া আপনার মতো একজনের সাথে থাকাটা কি অপচয় ছাড়া আর কিছু হচ্ছে?”

ডেভিড মুখ তুলে তাকিয়ে দ্রুত জবাব দিলেন, “আমিও একমত এ ব্যাপারে। তাদেরকে কিভাবে সামলাবো সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। প্যারিসের প্রায় সবখানে ভালো একজন গভর্নেস খুঁজে বেরিয়েছি তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য। কয়েক মাস আগে আমার বউ আমাকে ছেড়ে ব্রাসেলসে চলে যাবার পর থেকে আমার কাণ্ডজ্ঞানও কমে এসেছে। বুঝতে পারছি না এদের নিয়ে কী করবো।”

“আপনার বউয়ের চলে যাওয়ার কারণ নিশ্চয় এই দু’জন ভাতিজির আগমণ নয়, নাকি?” মুচকি হেসে বললো মরিস।

“মোটেই না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ডেভিড। “আমার বউ আর তার পরিবার রাজপরিবারের সাথে একটু বেশিই জড়িত ছিলো। অ্যাসেম্বলিতে আমার জড়িত হবার ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারে নি। তারা মনে করে আমার মতো একজন বুর্জোয়া চিত্রকর, যাকে রাজপরিবার সাপোর্ট দিয়ে এসেছে, তার পক্ষে প্রকাশ্যে বিপ্লবের প্রতি সমর্থন দেয়াটা উচিত হয় নি। বাস্তিল দূর্গ পতনের দিন থেকে আমার বিয়েটা নড়বড়ে হয়ে যায়। আমার বউ দাবি করে আমি যেনো অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করি, আর সেইসঙ্গে বন্ধ করে দেই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকাআঁকি। এইসব শর্ত মানলেই সে ফিরে আসবে।

 “কিন্তু বন্ধু, আপনি যখন রোমে দ্য ওথ অব দি হোরাতু ছবিটা উন্মোচন করলেন তখন লোকজন দল বেধে আপনার পিয়াজ্জা দেল পোপোলো স্টুডিওতে এসে ছবিটার উপর পুস্পবর্ষণ করে গেছে! নতুন রিপাবলিকের ওটা হলো প্রথম মাস্টারপিস, আর আপনি হলেন সেটার চিত্রকর।”

 “আমি সেটা জানি কিন্তু আমার বউ জানে না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডেভিড। “বাচ্চাদেরও ব্রাসেলসে নিয়ে গেছে সে, আমার এই দুই ভাতিজিকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তবে তাদের অ্যাবিসের সাথে আমার যে শর্ত ছিলো

তাতে করে তাদেরকে প্যারিসে রাখার কথা। এ কাজের জন্যে আমাকে বেশ ভালো পরিমাণের টাকা দেয়া হয়। তাছাড়া এটা তো আমার জন্মস্থান।”

“তাদের অ্যাবিস? আপনার ঐ দুই ভাতিজি নান ছিলো নাকি?” মরিস প্রায় হেসেই ফেলতে যাচ্ছিলো। “কী আজব ব্যাপাররে বাবা! দু দু’জন তরুণীকে, জিশুর নববধূকে কিনা তেতাল্লিশ বছরের এক লোকের হাতে তুলে দেয়া হলো, যার সাথে তাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ঐ অ্যাবিস কি ভেবে এ কাজ করেছে?”

“তারা নান ছিলো না, নান হিসেবে শপথ নেয় নি এখনও। যেমনটা তুমি করেছিলে?” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বললেন ডেভিড। “মনে হচ্ছে ঐ অ্যাবিসই তাদেরকে তোমার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো তুমি হলে শয়তানের পূণর্জন্ম হওয়া একজন।”

“ঐ অ্যাবিস যে আমার ব্যাপারে এরকম কথা বলেছে তাতে আমি খুব একটা। অবাক হই নি।”

“তুমি একজন যাজক ছিলে, সুতরাং তোমার পরবর্তী কার্যকলাপে তারা অখুশি হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।”

 “আমাকে কখনও যাজক হবার জন্যে জিজ্ঞেস করা হয় নি,” তিক্ত কণ্ঠে বললো মরিস। “উত্তরাধিকারসূত্রেই সেটা হয়েছি। তবে যেদিন আমি যাজকের। আলখেল্লাটা খুলে রাখলাম সেদিন সত্যিই নিজেকে প্রথমবারের মতো মুক্ত বলে মনে হয়েছিলো।”

ঠিক এই সময় ডাইনিংরুমে ঢুকলো ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে। তারা দু’জনেই একই রকম পোশাক পরে আছে, যে পোশাকে পরে তারা অ্যাবি ছেড়ে এখানে এসেছিলো। পার্থক্য শুধু মাথার চুলগুলো রঙ্গিন ফিতা দিয়ে বেধে রাখা। দু’জন পুরুষই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালো, দুটো চেয়ার টেনে তাদেরকে বসতে দিলেন ডেভিড।

 “আমরা প্রায় পনেরো মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্যে,” মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন তিনি। “আশা করি এখন আমরা সবাই ভালো ব্যবহার করবো। মঁসিয়ের সাথে ভদ্র ব্যবহার করার চেষ্টা কোরো। ওর সম্পর্কে তোমরা যা-ই শুনে থাকো না কেন, সেটা যদি পুরোপুরি সত্যিও হয়ে থাকে, মনে রাখবে ও এখন আমাদের অতিথি।

“তারা কি এও বলেছে, আমি একজন ভ্যাম্পায়ার?” মরিস ভদ্রভাবেই জানতে চাইলো। “বাচ্চাদের রক্ত পান করি?”

“ওহ্ হ্যাঁ, মঁসিয়ে,” ভ্যালেন্টাইন জবাব দিলো। “আপনি শয়তানের চিহ্ন, মানে ঘোড়ার খুঁড়ের মতো পা নিয়ে জন্মেছেন। হাটেনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সুতরাং এটা অবশ্যই সত্যি!”

“ভ্যালেন্টাইন,” বললো মিরিয়ে, “এভাবে বোলো না!”

ডেভিড মাথায় হাত দিলেও কিছু বললেন না।

“ঠিক বলেছো,” বললো মরিস। “ব্যাপারটা আমার বুঝিয়ে বলা দরকার।”

গ্লাসে কিছু মদ ঢেলে ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের বিপরীতে বসে কথা বলতে শুরু করলো সে। “আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম আমার পরিবার আমাকে দুধমা’র কাছে রেখেছিলো কয়েক দিনের জন্য, একদিন মহিলা আমাকে একটা আলমিরার উপর রেখে চলে গেলে আমি সেটা থেকে পড়ে যাই, আমার পা ভেঙে যায় তখন। ঐ মহিলা ছিলো অশিক্ষিত আর গ্রাম্য। সে ভয়ে ব্যাপারটা আমার বাবা-মাকে জানায় নি। এ কারণে আমার পাটা আর ঠিক হয় নি। আমার মা যখন টের পেলো আমার পাটা একটু বেঁকে বড় হচ্ছে তখন ঠিক করার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ হলো আসল গল্প। কোনো রহস্য-টহস্য নেই, বুঝলে?”

“এটা কি আপনাকে খুব যন্ত্রণা দেয়?” জানতে চাইলো মিরিয়ে।

“পায়ের কথা বলছো? না।” তিক্তভাবে বললো মরিস। “শুধু পাটা বেঁকে গেছে। তবে এজন্যে আমি বড় সন্তান হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার মা পর পর দুই ছেলের জন্ম দেন। সেই দুই ভাই, আৰ্চিমবদ আর বোসোনের কাছেই সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তর করে যান। তিনি চান নি একজন খোঁড়া প্রাচীনপদবী তয়িরাঁ-পেরিগোর্দের উত্তরাধিকারী হোক। বুঝলে? আমার মাকে আমি শেষ দেখি যখন তিনি আঁতুয়াতে এসেছিলেন আমার বিশপ হবার ব্যাপারে আপত্তি জানাতে। যদিও তিনি চেয়েছিলেন আমি যাজক হই, চিরটাকাল লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাই। তিনি বলেছিলেন আমি নাকি বিশপ হবার মতো যথেষ্ট ধার্মিক নই। তিনি অবশ্য সত্যি কথাটাই বলেছিলেন।”

“কী বাজে ব্যাপার!” উত্তেজিত হয়ে বললো ভ্যালেন্টাইন। “তাকে আমার ডাইনী-বুড়ি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে!”

ডেভিড ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে লাঞ্চের জন্যে বেল বাজিয়ে দিলেন।

“তুমি আসলেই তাই করতে?” মরিস কণ্ঠে জানতে চাইলো। “তাহলে তো তোমাকেই আমার দরকার ছিলো। আচ্ছা করে তাকে ডাইনী-বুড়ি ডাকানো যেতো। স্বীকার করছি এটা করার জন্যে আমি মুখিয়ে ছিলাম দীর্ঘদিন।”

গৃহভৃত্য যখন সবার জন্য খাবার পরিবেশন করে চলে গেলো তখন ভ্যালেন্টাইন বললো, “আপনার আসল গল্পটা বলার পর আপনাকে আর আগের মতো খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না, বঁসিয়ে। স্বীকার করছি আপনি দেখতে দারুণ হ্যান্ডসাম।”

ভ্যালেন্টাইনকে বিরত রাখার জন্য মিরিয়ে কটমট করে তাকালে ডেভিড হো হো করে হেসে ফেললেন।

 “অ্যাবিটা যদি সত্যি সত্যি আপনিই বন্ধ করে দিয়ে থাকেন তাহলে মিরিয়ে আর আমি আপনাকে ধন্যবাদই দেবো,” হরবর করে বলে চললো ভ্যালেন্টাইন। “তা না হলে আমরা এখনও মাগ্লেইনেই পড়ে থাকতাম। আমাদের স্বাপের শহর প্যারিসের এই জীবন কখনই উপভোগ করতে পারতাম না…”

 কাটাচামচ আর রুমাল টেবিলের উপর রেখে তাদের দু’জনের দিকে তাকালো মরিস।

“মন্তগ্লেইন অ্যাবি? বাস্ক-পিরেনিজে অবস্থিত? সেখান থেকেই কি তোমরা এসেছো? কিন্তু তোমারা সেখানে থাকলে না কেন? কেন ওখান থেকে চলে এলে?”

মরিসের অভিব্যক্তি আর প্রশ্নটা শুনে ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পারলো একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে সে। মঁসিয়েকে দেখে যতোই ভদ্রলোক আর ভালো। মানুষ বলে মনে হোক না কেন তিনি তো আঁতুয়ার বিশপই। এই লোকটার ব্যাপারেই অ্যাবিস তাদের সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। এই লোক যদি জানতে পারে তারা দু’বোন শুধুমাত্র মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ব্যাপারেই জানে না, বরং ওটার বিভিন্ন অংশ অ্যাবি থেকে সরিয়ে ফেলতেও সাহায্য করেছে তাহলে পুরো জিনিসটা না জানা পর্যন্ত এই লোক থামবে না।

তারা যে মন্তগ্লেইন থেকে এসেছে এটা জানাই মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে গেছে। আর যদি জানতে পারে তারা এখানে আসার দিন রাতেই স্টুডিওর বাইরে বাগানের মাটির নীচে দাবার খুঁটি দুটো লুকিয়ে রেখেছে তাহলে বিপদ আরো বেড়ে যাবে। অ্যাবিস যে তাদের দু’জনকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে শপথ করিয়েছে সেটা তার ভালোই মনে আছে। অন্য নানদের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে তাদেরকে। যদি কেউ দেশ ছাড়ে যায় কিংবা অন্য কোথাও চলে যায় তাহলে তাদের কাছে থাকা খুঁটিগুলো অন্যদের কাছে রেখে যাবে। এখন পর্যন্ত এটা ঘটে নি। তবে ফ্রান্সে যেরকম অস্থিরতা চলছে তাতে মনে হয় যেকোনো সময় এটা ঘটবে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের পক্ষে শার্ল মরিস তয়িরাঁর মতো লোকজনের কড়া নজরদারিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

“আমি আবারো বলছি,” মরিস জোর দিয়ে বললো মেয়ে দুটোকে চুপ মেরে থাকতে দেখে, “তোমরা মন্তগ্লেইন ছেড়ে এলে কেন?”

“কারণ ওখানকার অ্যাবিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, মঁসিয়ে।”

“বন্ধ করে দিয়েছে? কিন্তু কেন?”

“চার্চের সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইনের কারণে, মঁসিয়ে। অ্যাবিস আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন-”

“আমার কাছে অ্যাবিস যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছেন পোপের কাছ থেকে নাকি অ্যাবিটা বন্ধ করে দেবার অর্ডার পেয়েছেন,” বললেন ডেভিড।

“আর আপনি সেটা বিশ্বাস করে ফেললেন?” মরিস বললো। “আপনি কি একজন রিপাবলিকান নন? আপনি তো ভালো করেই জানেন ঐ পোপ পায়াস আমাদের বিপ্লবকে নিন্দা করেছেন। আমরা যখন অ্যাসেম্বলিতে বিল এর সি পাস করাই তখন তিনি অ্যাসেম্বলির সব সদস্যকে একমিউনিকেট করার পর্যন্ত দিয়েছিলেন! এই অ্যাবিস মহিলা তো ইতালিয়ান পোপের কাছ থেকে এ অর্ডার পালন করে রষ্ট্রদ্রোহী কাজ করে ফেলেছেন। আপনি কি জানেন ভ্যাটিকান কারা চালায়? জামান রাজপরিবার হাপসবার্গ আর স্পেনিশ বং দল!”

 “আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই তোমার মতো আমিও মনেপ্রাণে একজন রিপাবলিকান,” রেগেমেগেই বললেন ডেভিড। “আমার পরিবার কোনো অভিজাত বংশের নয়। আমি একেবারেই সাধারণ একজন নাগরিক। নতুন সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পক্ষে আমি। এই মন্তগ্লেইন অ্যাবি বন্ধ করে দেবার সাথে কোনো রাজনীতি নেই।”

“প্রিয় ডেভিড, এই বিশ্বের সব কিছুর সাথেই রাজনীতি জড়িয়ে আছে। আপনি ভালো করেই জানেন মন্তগ্লেইন অ্যাবির মাটির নীচে কি লুকিয়ে রাখা আছে, জানেন না?” ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তবে অদ্ভুত চোখে মরিসের দিকে তাকিয়ে নিজের মদের গ্লাসটা তুলে নিলেন ডেভিড।

“আহ্। সেটা তো দাদি-নানিদের কিসসা,” ব্যঙ্গাত্মকভাবে হেসে ফেললেন তিনি।

“তাই নাকি?” বললো মরিস। গাঢ় নীল চোখে দুই বোনকে দেখে যাচ্ছে সে। এরপর মদের গ্লাসটা তুলে নিয়ে কয়েক চুমুক পান করলো, তাকে দেখে মনে হলো উদাস হয়ে গেছে। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে কাটাচামচ তুলে আবার খেতে আরম্ভ করলো সে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে বরফের মতো জমে আছে, খাবার স্পর্শ করলো না তারা।

“মনে হচ্ছে আপনার ভাতিজিরা খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছে,” মন্তব্য করলো মরিস।

তাদের দুজনের দিকে তাকালেন ডেভিড। “কি হয়েছে? তোমরা আবার আমাকে বোলো না এইসব আজগুবি কাহিনী আসলেই সত্যি!”

“না, আঙ্কেল,” শান্তকণ্ঠে বললো মিরিয়ে। আমরা জানি এটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু না।”

“অবশ্যই এটি খুব পুরনো একটি কিংবদন্তী, তাই না?” আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো মরিস। “তবে একটা কথা নিশ্চয় নিজের কানে শুনেছো তোমরা। আমাকে বলল, তোমাদের ঐ অ্যাবিস মহিলা গেছে কোথায়? এখন তো। মনে হচ্ছে মহিলা পোপের সাথে মিলে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তাই না?”

“ঈশ্বরের দোহাই লাগে, মরিস,” বিরক্ত হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বুঝি ইনকুইজিশন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি বলছি ঐ মহিলা কোথায় গেছে, এটা জানার পর ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিও। সে গেছে রাশিয়ায়।”

কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলো মরিস। এরপর এমন মুচকি হাসি দিতে লাগলো যেনো মনে মনে বেশ মজার কিছু ভাবছে। “আমারও ধারণা আপনার কথাই ঠিক,” বললো সে। “এবার আমাকে বলুন, আপনার এই ভাতিজিরা কি এখনও প্যারিসের অপেরা দেখার সুযোগ পেয়েছে?”

“না, মঁসিয়ে, হরবর করে বলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “তবে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাদের স্বপ্ন ছিলো এটা দেখার।”

 “তাই নাকি?” হেসে ফেললো মরিস। “তাহলে তো এ ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হয়। লাঞ্চের পর তোমাদের ওয়ার্ডরোব দেখবো। ফ্যাশনের ব্যাপারে আমাকে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারো…”

“প্যারিসের অর্ধেক মহিলাকে ফ্যাশনের ব্যাপারে এই মঁসিয়েই উপদেশ দিয়ে থাকে,” বাঁকা হাসি হেসে বললেন ডেভিড।

 “পার্টিতে বলডান্স করার জন্যে মেরি আতোয়ানেত্তের চুলের সাজ আমি নিজে করে দিয়েছিলাম, সেই গল্পটা তোমাদেরকে জানানো উচিত। তার পোশাকের ডিজাইনও আমি করেছিলাম। সেই পোশাক পরার পর তার প্রেমিকও তাকে চিনতে পারে নি, আর রাজার কথা না হয় বাদই দিলাম!”

“ওহ আঙ্কেল, আমরা কি বিশপ মঁসিয়েকে আমাদের জন্যেও এসব করতে বলবো?” ভ্যালেন্টাইন অনুনয় করে বললো। আলোচনার বিষয়বস্তু যে বিপজ্জনক ব্যাপার-স্যাপার থেকে ফ্যাশনের মতো পছন্দের বিষয়ে চলে গেছে সেটা ভেবে দারুণ স্বস্তি পেলো সে।

“তোমরা দুজনেই অসম্ভব সুন্দরী, মরিস হেসে বললো। “তবে তার উপর বাড়তি কি করলে আরো ভালো হবে সেটা আমরা দেখবো। তোমাদের ভাগ্য ভালো, আমার এক বন্ধু আছে যার অধীনে রয়েছে প্যারিসের সবচাইতে সেরা পোশাক নির্মাতারা-হয়তো তোমরা মাদাম দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছো?”

.

প্যারিসের সবাই জারমেঁই দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছে, ফলে ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়েও খুব জলদিই এই নামটার সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। অপেরা-কমিকের গোল্ড অ্যান্ড বু-বক্সে তার সাথে বসলো তারা। অপেরা হাউজের বেলকনির বক্সগুলো পূর্ণ করে রেখেছে প্যারিসের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে। সবচাইতে জাঁকজমক পোশাক আর জুয়েলারি পরে আছে যারা তাদেরকে জুইসে। দোরি বলে ডাকা হয়। ভেতরে যে হীরা-জহরত, মণি-মুক্তা আর লেসের সমারোহ দেখা যাচ্ছে সেটা এখন বাইরে রাস্তায় সচরাচর দেখা যায় না, কয়ে এখনও বিপ্লবের বেশ চলছে। রাজপরিবার চরম দুর্দশার মধ্যে বন্দী হয় তা নিজেদের প্রাসাদে। প্রতি সকালে ঘোড়ার গাড়িতে করে আর্তনাদরত যাজক আয় অভিজাত পরিবারের লোকদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেস দ্য রেভুলুশনের পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে। অপেরা-কর্মিকের ভেতরে অবশ জাঁকজমক আর উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তারমধ্যে সবচাই জাঁকজমক হলো জারমেঁই দ্য স্তায়েল।

এই মহিলা সম্পর্কে ভ্যালেন্টাইন যা কিছু জানতে পেরেছে তার সবটাই তার আঙ্কেল জ্যাক-লুইয়ের কাজের লোকদেরকে নানা ধরণের প্রশ্ন করার মাধ্যমে। তারা তাকে বলেছে মাদাম স্তয়েল হলো সুইজারল্যান্ডের অসাধারণ মেধাবী অর্থমন্ত্রী জ্যাক নেকারের মেয়ে। যোড়শ লুই তাকে দু দু’বার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, আবার ফরাসি জনগণের দাবির মুখে দুবারই তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো আগের পদে। তার মা সুজান নেকার প্যারিসে সবচাইতে শক্তিশালী। সেলুন পরিচালনা করেছেন বিশ বছর ধরে, সেখানে জারমেঁই ছিলো সবচাইতে বড় আকর্ষণ।

নিজের যোগ্যতায় মিলিয়নেয়ার হয়েছে মহিলা, টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে মাত্র বিশ বছর বয়সী ফ্রান্সে নিযুক্ত অকর্মা সুইডিশ রাষ্ট্রদূত ব্যারোন এরিক স্তায়েল ফন হোলস্টেইন নামের এক স্বামীকে। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সে সুইডিশ অ্যাম্বাসিতে একটি সেলুন খুলেছিলো। আর সেখান থেকেই রাজনীতির ময়দানে ঢুকে পড়ে ভদ্রমহিলা। তার বাড়িতে সব সময়ই ভীড় করে থাকে ফ্রান্সের রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক জগতের হোমরাচোমরারা : লাফায়েত, কোঁদোরসে, নারবোনে, তয়িরাঁ। জারমেঁই হয়ে উঠেছে একজন দার্শনিক বিপ্লবী। সব ধরণের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তার সেলুনের চৌহদ্দির মধ্যেই নেয়া হয়ে থাকে। এমন সব লেকজন তার বাড়িতে আসে যাদেরকে একসাথে জড়ো করা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। বর্তমানে পঁচিশ বছর বয়সী এই মহিলা সম্ভবত ফ্রান্সের সবচাইতে ক্ষমতাশালী নারী।

মরিস তয়িরাঁ অপেরা হাউজের বক্সে এসে তিনজন মহিলার সাথে বসতেই ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো মাদাম দ্য স্তায়েলকে। কালো-সোনালি লেসের লো-কাট গাউন তার ভারি হাত দুটো আর পেশীবহুল চওড়া কাঁধকে প্রকট করে তুলেছে, ভারি কোমরের কারণে তার দৈহিক অবয়বটা আরো বেশি দর্শণগ্রাহ্য মনে হয়। গলায় পরে আছে রুবি আর দামি রত্ম বসানো স্বর্ণের নেকলেস। মাথায় সোনালি রঙের যে পাগড়ির মতো টুপি পরে আছে সেটা তার ট্রেডমার্ক। ভ্যালেন্টাইনের পাশেই বসে আছে সে, একটু ঝুঁকে তার সাথে নীচু স্বরে কথা বলছে। নীচুস্বর হলেও সেই কণ্ঠ এতোটাই গমগম করছে যে আশেপাশের সবার সেটা নিতে পাওয়ার কথা।

“মাই ডিয়ার, আগামীকাল সকালের মধ্যে প্যারিসের সবাই আমার দরজার সামনে হুমরি খেয়ে পড়বে, অবাক হয়ে তারা ভাববে কারা এই দুই তরুণী। এটা হবে একটি উপভোগ্য কেলেংকারি, আমি নিশ্চিত তোমাদেরকে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, তা না হলে আরো ভালো পোশাকে তোমাদেরকে এখানে নিয়ে আসতেন।”

“মাদাম, আমাদের পোশাক কি আপনার কাছে ভালো লাগে নি?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো ভ্যালেন্টাইন।

“তোমরা দু’জনেই দারুণ সুন্দরী, মাই ডিয়ার,” বললো জারমেঁই। “কিন্তু সাদা হলো কুমারিদের রঙ, টকটকে গোলাপি নয়। আর যদিও তরুণীদের বক্ষা হলো বর্তমান সময়ে প্যারিসে আকর্ষণীয় একটি জিনিস, তারপরও বিশের নীচে যাদের বয়স তারা হালকা একটা ওড়না ব্যবহার করে শরীর ঢাকার জন্য। এটা মঁসিয়ে তয়িরাঁ ভালো করেই জানেন।”

ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো। তবে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো মরিস তয়িরাঁ, “আমি আমার নিজস্ব ফ্যাশনে ফ্রান্সকে মুক্ত করেছি।” জারমেঁই এবং সে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললে মহিলা কাঁধ তুললো।

“আশা করি তোমরা এই অপেরা দারুণ উপভোগ করেছো, মিরিয়ের দিকে তাকিয়ে বললো জারমেঁই। “এটা আমার অনেক প্রিয় অপেরার একটি। সেই ছেলেবেলা থেকে এটা আর দেখি নি। এর সঙ্গিতকার আদ্রে ফিলিদোর ইউরোপের সেরা দাবা খেলোয়াড়। দার্শনিক আর রাজ-রাজাদের সামনে তিনি সঙ্গিত পরিবেশন করেন, দাবা খেলে থাকেন। তোমাদের কাছে হয়তো সঙ্গিতটা একটু পুরনো ধাঁচের মনে হতে পারে, এর কারণ অপেরায় বিপ্লব এনে দিয়েছেন। গ্লাক। খুব বেশি আবৃত্তি শোনাটা একটু কষ্টকরই হয়ে যায়…”

“আমরা কখনও অপেরা দেখি নি, মাদাম,” ভ্যালেন্টাইন বললো।

“কখনও অপেরা দেখো নি!” অবাক হয়ে বললো জারমেঁই। “অসম্ভব! তোমাদের পরিবার তোমাদেরকে কোথায় রেখেছিলো এতোদিন?”

“একটা কনভেন্টে, মাদাম,” ভদ্রভাবেই জবাব দিলো মিরিয়ে।

জারমেঁই এমনভাবে চেয়ে রইলো তাদের দিকে যেনো এই জীবনে সে কনভেন্ট কাকে বলে শোনে নি। এরপর তয়িরাঁর দিকে ফিরলো মহিলা। মনে হচ্ছে কিছু বিষয় আপনি আমাকে বলেন নি, বন্ধু। আমি যদি জানতাম ডেভিডের পোষ্য হিসেবে যারা আছে তারা কনভেন্টে বড় হয়েছে তাহলে কোনোক্রমেই টম জোন্স অপেরাটি বেছে নিতাম না।” মিরিয়ের দিকে ফিরে আরো বললো সে, “আশা করি তোমরা ভড়কে যাও নি। এটা এক অবৈধ সন্তানের ইংলিশ গল্প…”

“অল্প বয়সে নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়াটাই বেশি ভালো,” হেসে বললো তয়িরাঁ।

“একদম সত্যি কথা, আস্তে করে বললো জারমেঁই। “তারা যদি আঁতুয়ার বিশপকে নিজেদের মেন্টর হিসেবে রাখে তাহলে এটা বেশ ফলপ্রসূ হিসেবেই প্রমাণিত হবে।”

মঞ্চের পর্দা উঠতে শুরু করলে মহিলা সেদিকে ফিরলো।

.

“আমার বিশ্বাস এটা আমার জীবনে সবচাইতে সুন্দর অভিজ্ঞতা,” ভ্যালেন্টাইন বললো, অপেরা থেকে ফিরে তয়িরাঁর স্টাডিরুমের ভারি কার্পেটের উপর বসে আছে তারা। ফায়ারপ্লেসের আগুনের শিখা দেখছে।

তয়িরাঁ বসে আছে নীল রঙের সিল্কের একটা চেয়ারে, তার পা দুটো কুশনের উপর রাখা। কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে চেয়ে আছে মিরিয়ে।

“এই প্রথম আমরা কগন্যাগও পান করলাম,” ভ্যালেন্টাইন যোগ করলো।

“তোমাদের বয়স মাত্র ষোলো,” বললো তয়িরাঁ, তার হাতে ব্র্যান্ডির গ্লাস, সেটাতে একটা চুমুক দিলো সে। “আরো অনেক অভিজ্ঞতা নেবার যথেষ্ট সময় পড়ে আছে এখনও।”

“আপনার বয়স কতো, মঁসিয়ে তয়িরাঁ?” জানতে চাইলো ভ্যালেন্টাইন।

“এটা তো কোনো ভদ্র প্রশ্ন হলো না,” ফায়ারপ্লেসের কাছ থেকে বললো মিরিয়ে। “কাউকে তার বয়সের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই।”

“আর দয়া করে আমাকে মরিস বলে ডাকবে,” বললো তয়িরাঁ। “আমার বয়স সাইত্রিশ তবে তোমরা যখন আমাকে মঁসিয়ে’ বলে ডাকো তখন মনে হয় আমার বয়স নব্বই। এবার বলো, জারমেঁইকে তোমাদের কেমন লাগলো?”

“মাদাম দ্য স্তায়েল খুবই চার্মিং,” বললো মিরিয়ে, তার লালচুল ফায়ারপ্লেসের আগুনের আভায় জ্বলজ্বল করছে।

“উনি নাকি আপনার প্রেমিকা, কথাটা কি সত্যি?” ভ্যালেন্টাইন জানতে চাইলো।

“ভ্যালেন্টাইন!” আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে কিন্তু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মরিস।

 “তুমি আসলেই অসাধারণ,” ভ্যালেন্টাইনের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো সে। মেয়েটা তার কাছে হাটু মুড়ে বসে আছে। মিরিয়েকে সে আরো বললো, “তোমার খালাতো বোনের মধ্যে কোনোরকম ভণ্ডামি আর কপটতা নেই, যেমনটি প্যারিসের সোসাইটিতে খুব বেশি পাওয়া যায়। তার প্রশ্ন শুনে আমি মোটেও রাগ করি না। বরং আমার কাছে সেগুলো ভালোই লাগে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি তোমাদের সাথে আছি, ব্যাপারটা বেশ ভালোই বুঝতে পারি। যাইহোক, তোমাকে কে বললো মাদাম দ্য স্তায়েল আমার প্রেমিকা?”

“বাড়ির কাজের লোকদের কাছ থেকে আমি শুনেছি, মঁসিয়ে-মানে, আঙ্কেল মরিস। কথাটা কি সত্য নয়?”

“না, মাই ডিয়ার। কথাটা সত্যি নয়। একদমই না। এক সময় আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম তবে সেটা অতীতের কথা। এখন আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু।

“হয়তো আপনি ধোঁড়া বলে উনি আপনাকে প্রেমিক হিসেবে বাদ দিয়েছেন?” ভ্যালেন্টাইন জানতে চাইলো।

“হায় হায়!” আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে। তুমি এক্ষুণি মঁসিয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। দয়া করে আমার বোনকে ক্ষমা করে দিন, মঁসিয়ে। ও আপনাকে আহত করার জন্য কথাটা বলে নি।”

তয়িরাঁ নিশ্চুপ বসে রইলো, যেনো হতভম্ব হয়ে গেছে। যদিও একটু আগেই বলেছে ভ্যালেন্টাইনের কথায় রাগ করে নি, কিন্তু এটাও ঠিক ফ্রান্সে কেউ তার। শারিরীক ত্রুটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না। আবেগে কাঁপতে শুরু করলো সে। আস্তে করে ভ্যালেন্টাইনের হাতটা ধরে তাকে নিজের পাশে বসালো। আস্তে করে তাকে জড়িয়ে ধরলো মরিস তয়িরাঁ।

“আমি খুব দুঃখিত, আঙ্কেল মরিস,” বললো ভ্যালেন্টাইন। আলতো করে তার গালে হাত বুলিয়ে হাসলো সে। “এর আগে কখনই শারিরীক ত্রুটি আছে। এমন কাউকে স্বচক্ষে দেখি নি। আপনি যদি পাটা আমাকে দেখান তাহলে আমার জন্যে সেটা খুবই শিক্ষণীয় ব্যাপার হবে।”

আবারো আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে। তয়িরাঁ এবার এমন অবাক হয়ে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো যে মনে হলো সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অনুরোধের ভঙ্গিতে ভ্যালেন্টাইন তার হাতটা চাপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর গম্ভীরকণ্ঠে বললো মরিস তয়িরাঁ, “বেশ। তুমি যখন চাইছো।” পা থেকে স্টিলের বুটটা খুলে ফেললো সে। এটা পরে থাকার কারণেই তার পক্ষে হাটা সম্ভব হয়।

ফায়ারপ্লেসের মৃদু আলোতে ভ্যালেন্টাইন তার পা’টা ভালো করে দেখে নিলো। পায়ের পাতা এমনভাবে বেঁকে আছে যে গোড়ালীর বলটা প্রায় নীচে চলে গেছে। সেই পা’টা নিজের হাতে তুলে নিলো ভালেন্টাইন তারপর উপুড় হয়ে আলতো করে চুমু খেলো তাতে। চেয়ারে বসে থাকা তয়িরাঁ যারপরনাই অবাক। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে।

“বেচারা পা’টা,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছিস তুই অথচ এতোটা তোর প্রাপ্য ছিলো না।”

তয়িরাঁ ঝুঁকে ভ্যালেন্টাইনের থুতনীটা ধরে আলতো করে তার ঠোঁটে চুমু খেলো।

“তুমি ছাড়া আর কেউ আমার পা’কে এভাবে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে নি, হেসে বললো সে। “তুমি আমার পা’টাকে অনেক অনেক সুখি করেছে।”

দেবদূতের মতো সুন্দর আর নিষ্পাপ মুখে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো সে। তার সোনালি চুলগুলো ফায়ারপ্লেসের আগুনের আলোয় আভা ছড়াচ্ছে। মিরিয়ের ভাবতে খুব কষ্ট হলো, এই লোকটাই একক প্রচেষ্টায় নির্দয়ভাবে ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চকে ধ্বংস করছে। এই একই লোক মন্তগেইন সার্ভিসটাও হস্তগত করতে উদগ্রীব।

.

মরিসের স্টাডিতে মোমবাতিগুলো শেষ হয়ে আসছে। ফায়ারপ্লেসের নিভু নিভু আলোয় পুরো ঘরে অন্ধকার নেমে এলো। বিশাল দেয়ালঘড়িটায় তাকিয়ে মরিস বুঝতে পারলো রাত দুটোরও বেশি বেজে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেয়ারের নীচে মেঝের কার্পেটের উপর বসে আছে মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইন।

“আমি তোমাদের আঙ্কেলকে বলেছিলাম বেশি রাত হওয়ার আগেই তোমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দেবো,” মেয়ে দুটোকে বললো সে। “এখন দ্যাখো, কটা বাজে।”

“ওহ্ আঙ্কেল মরিস,” অনুনয় করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমাদেরকে এখনই যেতে বলবেন না, প্লিজ। এই প্রথম কোনো সামাজিক পরিবেশে থাকার সুযোগ আমরা পেয়েছি। প্যারিসে আসার পর থেকে আমাদের মনে হচ্ছিলো আমরা বুঝি কনভেন্টেই রয়েছি।”

 “আরেকটা গল্প বলেন, মিরিয়েও আরো কিছুক্ষণ থেকে যাবার পক্ষে। “আমাদের আঙ্কেল কিছু মনে করবেন না।”

“উনি খুব রাগ করবেন,” হেসে বললো তয়িরাঁ। “তবে এরইমধ্যে এতো রাত হয়ে গেছে তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছানো যাবে না। রাতের এই সময় ভদ্রলোকদের এলাকায়ও মাতাল আর জোচ্চোরের দল ঘুরে বেড়ায়। আমার মনে হয় একজন লোক মারফত তোমাদের আঙ্কেলের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়। আমি আমার গহপরিচারিকাকে বলছি তোমাদের জন্য একটা ঘর ঠিক করে দিতে। আমার মনে হয় তোমরা একসাথে থাকতেই পছন্দ করবে, তাই না?”

মেয়ে দুটোকে এ সময় বাড়িতে পৌঁছানোটা বিপজ্জনক হবে, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। তয়িরাঁর বাড়িতে অসংখ্য চাকর-বাকর আছে, আর ডেভিডের বাড়িটাও খুব বেশি দূরের নয়। কিন্তু আচমকাই তার মনে হচ্ছে মেয়ে দুটোকে এ মুহূর্তে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাচ্ছে না সে। হয়তো চিরদিনের জন্যেই রেখে দেয়ার বাসনাও জেগেছে মনে। গল্প বলারছলে সে দেরি করে ফেলেছে। এই অল্পবয়সী দুটো মেয়ে, তাদের নিষ্কলুষতা আর তারুণ্য দিয়ে মরিসের মনের গভীরে এমন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে যে সে নিজেও সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। তার জীবনে পরিবার বলতে তেমন কিছু ছিলো না। এই মেয়ে দুটোর উপস্থিতিতে যে উষ্ণতার ছোঁয়া সে পাচ্ছে সেটা তার জন্য একেবারে নতুন একটি অভিজ্ঞতা।

“ওহ সত্যি! আমরা তাহলে আজ রাতটা এখানেই থাকছি?” ভ্যালেন্টাইন উঠে দাঁড়ালো, মিরিয়ের হাত ধরে মোচড়াতে শুরু করলো সে। মিরিয়ে নিজেও থাকার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলো তবে সেটা প্রকাশ করলো না।

“অবশ্যই,” কথাটা বলেই মরিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বেল বাজানোর জন্য। তবে এই কামনা করো কাল সকালে যেনো প্যারিসে আবার বদনাম রটে যায়, জারমেঁই যেমনটা বলেছিলো।”

 দ্রগোছের দেখতে গৃহপরিচারিকা লোকটি স্টাডিতে ঢুকেই এলোমেলো চুলের দুই তরুণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, তারপর নজর গেলো তার মনিবের দিকে। এক পায়ের জুতা নেই। খালি পা। কিছু না বলে চুপচাপ মেয়ে দুটোকে নিয়ে উপরতলায় গেস্টরুমে চলে গেলো সে।

“মঁসিয়ে, শোয়ার জন্যে পরতে পারি এরকম দুটো পোশাক কি জোগার করে দিতে পারবেন?” বললো মিরিয়ে। “আপনাদের মহিলা গৃহপরিচারিকাদের পোশাক হলেও চলবে…”।

“কোনো সমস্যা নেই, ব্যবস্থা করা যাবে,” গৃহপরিচারিকা দ্রভাবে বলেই দুটো সিল্কের গাউন এনে দিলো তাদের জন্য। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো কোনো চাকরানীর পোশাক নয়। খুবই সুন্দর আর অভিজাত। গৃহপরিচারিকা চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো তাদের রেখে।

ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে জামা পাল্টে চুল আঁচড়িয়ে নরম আর রাজকীয় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মরিস দরজায় টোকা মারলো।

 “সব ঠিক আছে তো?” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো সে।

“এটা আমার জীবনে দেখা সবচাইতে চমৎকার বিছানা,” জবাব দিলো মিরিয়ে। “কনভেন্টে আমরা কাঠের শক্ত খাটের উপর শুতাম নিজেদের শরীর ঠিক রাখার জন্য।”

“দারুণ আরাম পাবে, ভালো ঘুমও আসবে, দেখো,” হেসে বললো মরিস। বিছানার পাশে ছোট্ট সোফায় বসে পড়লো সে।

“এখন আরেকটা গল্প বলেন,” বললো ভ্যালেন্টাইন।

“অনেক রাত হয়ে গেছে তো…”

“একটা ভুতের গল্প বলেন তাহলে!” ভ্যালেন্টাইন আগ্রহভরে বললো। “অ্যাবি আমাদেরকে কখনই ভুতের গল্প শোনার অনুমতি দিতেন না, তারপরও আমরা শুনতাম। আপনি কি কোনো ভুতের গল্প জানেন?”

“দুঃখের বিষয়, একটাও জানি না, বিষণ্ণ হয়ে বললো মরিস। “তোমরা তো জানোই আমার স্বাভাবিক কোনো শৈশব ছিলো না। এরকম কোনো গল্প আমাকে কেউ শোনায় নি।” একটু ভেবে সে আবার বললো, “তবে সত্যি বলতে কি, একবার ভুতের সাথে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিলো।”

“সত্যিকারের নয় নিশ্চয়?” ভ্যালেন্টাইন বললো। চাদরের নীচে মিরিয়ের হাতটা ধরে ফেললো সে। মেয়ে দুটোকে দেখে খুব রোমাঞ্চিত বলে মনে হলো তার।

 “শুনতে হয়তো একদম অবাস্তব মনে হবে,” বলেই হেসে ফেললো সে। “তবে বলতে পারি একটা শর্তে। তোমরা কখনও তোমাদের আঙ্কেল জ্যাক সুইকে এটা বলতে পারবে না। যদি বলো তাহলে আমি অ্যাসেম্বলিতে হাসিরপাত্র হয়ে যাবো।”

 চাদরের নীচে মেয়ে দুটো খিল খিল করে হেসে ফেললো, তারা প্রতীজ্ঞা করলো কাউকেই এ কথা বলবে না। মৃদু মোমবাতির আলোয় গল্পটা বলতে শুরু করলো তয়িরাঁ মরিস…

বিশপের গল্প

যাজক হবার আগে, আমার বয়স তখন খুব কম ছিলো, সেন্ট রেমি ছেড়ে চলে গেছিলাম সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওখানে বিখ্যাত রাজা কোলভিস শায়িত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বছর থাকার পর আমার ডাক এলো।

জানতাম আমি যদি তাদের কথামতো যাজক না হই তাহলে বিরাট একটা কেলেংকারী হয়ে যাবে। তারপরও যাজক হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিলো না। সঙ্গোপনে আমি একজন রাষ্ট্রনায়ক হবার ইচ্ছে পোষণ করতাম সব সময়।

 সরবোনের ভেতরে যে চ্যাপেল আছে তাতে শুয়ে আছেন আমার আর্দশ, ফ্রান্সের সেরা সন্তানদের একজন, তার নাম তোমরা অবশ্যই জানো : আরমান্দ জঁ দু পেসিস দয়ে দ্য রিশেলু। ধর্ম আর রাজনীতির এক বিরল মিশ্রণ ছিলো তার মধ্যে। ১৬৪২ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিশ বছর ধরে তিনি আমাদের দেশটাকে শক্ত হাতে শাসন করেছিলেন।

এক মাঝরাতে আমি আমার ডরমিটরি ছেড়ে মাথায় ক্যাপ পরে রওনা হলাম সরবোনের চ্যাপেলের উদ্দেশ্যে।

প্রবল বাতাস বইছিলো। লনের উপর উড়ছিলো গাছের মরা পাতা। রাতের নিশুধিতে পেঁচা আর নিশাচর প্রাণীদের অদ্ভুত ডাক শোনা যাচ্ছিলো চারপাশে। আমি নিজেকে অনেক সাহসী ভাবলেও এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে খুব ভয় পেয়েছিলাম। চ্যাপেলের ভেতরে কবরটা দেখতে অন্ধকারাচ্ছন্ন আর শীতল বলে মনে হচ্ছিলো। রাতের ঐ সময়টাতে প্রার্থনা করার জন্য কেউ ছিলো না সেখানে। থাকার কথাও নয়। কবরের পাশে একটা মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছিলো। আমি আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ি প্রার্থনা করার জন্য যাতে করে ফ্রান্সের এই সাবেক যাজক আমাকে পথ বাতলে দেন। ঐ কক্ষে নিজের হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি আমার আবেদন জানাতে শুরু করলাম শান্তকণ্ঠে।

আমার কণ্ঠ ছাপিয়ে আচমকা বাতাসের শব্দ হতে লাগলো। প্রচণ্ড হিমশীতল বাতাস নিভিয়ে দিলো মোমবাতি দুটো। ভয়ে আমার হাত-পা বরফের মতো জমে গেলো। অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে আরেকটা মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম আমি। কবর থেকে উঠে আসতে দেখলাম সাদা, জ্বলজ্বলে কার্ডিনাল রিশেলুর ভূতটাকে! তার চুল, গায়ের রঙ, এমনকি আলখেল্লাটা পর্যন্ত ধবধবে সাদা আর স্বচ্ছ। আমার উপরে ভাসতে লাগলেন তিনি।

 আমি যদি হাটু গেড়ে বসে না থাকতাম তাহলে ঐ দৃশ্যটা দেখেই মাটিতে পড়ে যেতাম। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। এরপর আবারো একটা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম কাছ থেকে। কার্ডিনালের ভুতটা আমার সাথে কথা বলছে! আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। কার্ডিনালের কণ্ঠটা বেশ ভরাট আর গম্ভীর।

“আমাকে জাগালি কেন?” বিস্ফোরিত হলো তার কণ্ঠ। অন্ধকারে আমার চারপাশে দমকা বাতাস বইতে লাগলো এ সময়। কিন্তু আমার পা দুটো এতোটাই দূর্বল ছিলো যে পালানোর শক্তিও ছিলো না। ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।

“কার্ডিনাল রিশেলু। আমি উপদেশ চাইছি আপনার কাছে। জীবিত অবস্থায় আপনি ছিলেন ফ্রান্সের সেরা রাষ্ট্রনায়ক, যদিও আপনি একজন যাজক ছিলেন। এরকম ক্ষমতা আপনি কিভাবে আয়ত্তে আনতে পারলেন? দয়া করে আপনার সিক্রেটটা আমার সাথে শেয়ার করুন, কারণ আমি আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই।”

“তুই?” ভুতটা যেনো অন্ধকারে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে এরকম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আমি নিজের ভেতরে কুকড়ে গেলাম। অবশেষে ভুতটা কথা বললো।

“যে সিক্রেটটা আমি হন্যে হয়ে খুঁজেছি সেটা চিরতরের জন্যে রহস্য হয়ে আছে…” সাদা-স্বচ্ছ ভুতটা ঘরের ছাদের উপর ভাসছে। এর ক্ষমতা শায়িত আছে শার্লেমেইনের সাথে। আমি শুধু প্রথম চাবিটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি সেটা খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখেছি…”

 উনি, মানে উনার ভূতটা দেয়ালের মাঝে যেনো মিশে গেলেন আস্তে আস্তে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো তাকে ধরে রাখতে চাচ্ছিলাম, চাচ্ছিলাম উনি যেনো চলে না যান। আমাকে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন? শার্লেমেইনের সাথে কোন্ সিক্রেটটা লুকিয়ে আছে? আমি চিৎকার করে ভুতটার কাছে এই প্রশ্ন করলাম কিন্তু ততক্ষণে উনি উধাও গেছেন।

“হে মহান যাজক! আপনি কোন্ চাবি খুঁজে বের করার কথা বললেন আমাকে?”

সঙ্গত কারণেই কোনো জবাব এলো না। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর তখনও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।

“ফ্রাসোঁয়া…ম্যারি…আরুয়েঁ…” শুধু এইটুকুই।

 থিতু হয়ে এলো দমকা বাতাস। মোমবাতির আলো আবার জ্বলে উঠলো। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। দীর্ঘক্ষণ পর ওখান থেকে ফিরে এলাম ডরমিটরিতে।

পর দিন সকালে আমার বিশ্বাস করা উচিত ছিলো পুরো ঘটনাটি নিছক কোনো স্বপ্ন। কিন্তু মরা পাতা আর কবরের কাছে যে হালকা ঘ্রাণ সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো পুরো ব্যাপরটাই সত্যি ছিলো। কার্ডিনাল আমাকে বলেছেন তিনি। রহস্যের প্রথম চাবিটা পেয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই আমি এই চাবিটা খুঁজতে শুরু করলাম ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ফ্রাসোয় মারি আরুয়েঁ, যিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত, তার মাধ্যমে।

ভলতেয়ার তখন স্বেচ্ছা-নিবাসন থেকে ফিরে এসেছেন প্যারিসে। নতুন একটি নাটক মঞ্চায়নের কাজেও হাত দিয়েছেন তখন। তবে সবাই বিশ্বাস করতো তিনি নিজ শহরে ফিরে এসেছেন মৃত্যুবরণ করার জন্য। এই কট্টর নাস্তিক নাট্যকার রিশেলুর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর জন্মেছিলেন, তিনি কার্ডিনালের সিক্রেটটার ধারক, এটা আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আমাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর আমি ভলতেয়ারের সাথে দেখা করার সুযোগ পাই।

যাজকের পোশাকে আমি যথা সময়ে হাজির হই তার বাড়িতে। আমাকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি। দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে তিনি পছন্দ করতেন না। মাঝেমাঝে সারাটা দিনই বিছানায় কাটিয়ে দিতেন। চল্লিশ বছর ধরেই আশংকা করা হচ্ছিলো তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।

সাদা ধবধবে একটি গাউন পরে বেশ কয়েকটি বালিশে মাথা রেখে আধো শায়িত আধো বসা অবস্থায় ছিলেন তিনি। ফ্যাকাশে মুখে তার ঘন কালো চোখ দুটো সবার আগে চোখে পড়ে। খাড়া নাক দেখে শিকারী কোনো পাখির মতোই মনে হয়।

বেশ কয়েকজন যাজক তার ঘরে ছিলো। তাদেরকে চলে যাবার জন্যে অনুরোধ করছিলেন বার বার। কোনো রকম প্রার্থনা কিংবা ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না। যাজকের পোশাকে আমাকে দেখে যখন মুখ তুলে তাকালেন আমি যারপরনাই বিব্রত বোধ করলাম। ভালো করেই জানতাম তিনি যাজকদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। রোগাটে হাত নেড়ে যাজকদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন:

“দয়া করে এবার আমাদের একটু একা থাকতে দিন! এই তরুণের জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম এতোক্ষণ। সে কার্ডিনাল রিশের দূত হিসেবে এসেছে আমার কাছে!”

যাজকের দল পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালে তিনি অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লেন। তড়িঘড়ি করে তারা ঘর থেকে চলে গেলো, যেনো ভয় পেয়ে গেছে। ভলতেয়ার আমাকে তার কাছে এসে বসতে বললেন।

“এটা আমার কাছে সব সময়ই রহস্যের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিলো,” রেগেমেগে বললেন তিনি। “ঐ বাগাড়ম্বরপ্রিয় ভুতটা কেন তার কবরে চুপচাপ থাকতে পারে না বুঝি না! এক মৃত যাজকের ভুত কবর থেকে উঠে তরুণদের উপদেশ দেয় আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, ব্যাপারটা একজন নাস্তিক হিসেবে আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। ঐ ভুতটার কাছ থেকে যখনই তারা আসে আমি তাদেরকে দেখামাত্রই বলে দিতে পারি সেটা। তাদের চোখে-মুখে এক ধরণের ভাবালুতা থাকে, ঠিক এখন তোমার যেমন হচ্ছে…ফার্নিতে যখন ছিলাম সেখানেও এমনটি হতো, কিন্তু প্যারিসে আসার পর থেকে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে!

 তার কথা শুনে বিরক্তি লুকিয়ে রাখলাম। একই সাথে অবাক আর সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি-কারণ ভলতেয়ার এখানে আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আগে থেকেই জেনে গেছেন বলে। তিনি আরো বললেন, অন্য অনেকেই নাকি একই উদ্দেশ্যে তার কাছে আসে।

“ইস্…ঐ লোকটার বুকে যদি একটা বিশাল চাকু বসিয়ে দিতে পারতাম, ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলতে লাগলেন তিনি। “তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম।” কথাটা বলেই কাশতে লাগলেন। দেখতে পেলাম তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি হাত নেড়ে আমায় বারণ করে। দিলেন।

“ডাক্তার আর যাজকদের একই দড়িতে ফাঁসি হওয়া উচিত!” চিৎকার করে বলেই পানির গ্লাসটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। আমি সেটা তুলে তার হাতে দিলে তিনি কয়েক চুমুক পানি পান করলেন।

“সে ঐ পাণ্ডুলিপিটা চায়, জানি। কার্ডিনাল রিশেলু এটা মেনে নিতে পারছে না তার মহামূল্যবান ব্যক্তিগত জানালটা আমার মতো নাস্তিকের কাছে আছে।”

“আপনার কাছে কার্ডিনাল রিশেলুর ব্যক্তিগত জানালটা আছে?”

“হ্যাঁ, আছে। অনেক বছর আগে, আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন আমাদের রাজার রোমান্টিক জীবন নিয়ে একটা কবিতা লিখে রাজদ্রোহের অভিযোগে জেলে গেছিলাম। জেলে বসে যখন পচছিলাম তখন এক ধনী পৃষ্ঠপোষক আমার কাছে কিছু জানাল নিয়ে আসে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করার জন্য। ওগুলো তাদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বহুকাল থেকেই সংরক্ষিত ছিলো। কিন্তু একটা সিক্রেট কোডে লিখিত ছিলো বলে সেটা কেউ পড়তে পারে নি। আমার যেহেত করার মতো কিছু ছিলো না তাই সেগুলোর অথোদ্ধার করি এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় কার্ডিনাল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানতে পারি।”

 “আমি তো জানতাম রিশেলু তার সমস্ত জানাল সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দান। করে গেছেন?”

“তোমরা এমনটাই জানো, বাঁকা হাসি হাসলেন ভলতেয়ার। “একজন যাজক তার ব্যক্তিগত জানাল সাংকেতিক ভাষায় লিখে যাবে না, যদি না লুকিয়ে রাখার মতো কিছু থাকে। ঐ সময় যাজকেরা কী রকম আকাম-কুকাম করতে তার সবই আমি জানতাম : হস্তমৈথুন, লালসা। আমি জার্নালের উপর হুমরি খেয়ে পড়লাম কিন্তু যা আশা করেছিলাম তার কিছুই পেলাম না। পেলাম একেবারে অন্য কিছু। পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা। অর্থহীন আর আজগুবি জিনিসই সেটাকে বলা যেতে পারে। এরকম অর্থহীন জিনিস জীবনেও আমি দেখি নি।”

ভলতেয়ার এমনভাবে কাশতে লাগলেন যে আমার কাছে মনে হলো পাশের ঘরে গিয়ে যাজকদের ডেকে আনি, যেহেতু তখনও আমার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। পালন করার অনুমতি ছিলো না। কিন্তু তিনি মৃত্যুবৎ কাশি দিতে দিতে আমাকে একটা চাদর এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। মাথাটাও চাদরে মুড়িয়ে নিলেন তিনি। লক্ষ্য করলাম তার সারা শরীর কাঁপছে।

“আপনি ঐসব জার্নালে কি পেলেন, সেগুলো এখন কোথায় আছে?” আমি তাড়া দিলাম তাকে।

“ওগুলো এখনও আমার কাছেই আছে। আমি যখন জেলে তখন আমার। পৃষ্ঠপোষক কোনো উত্তরাধিকার না রেখেই মারা যায়। ঐতিহাসিক মূল্য ছিলো বলে ওগুলোর আর্থিক মূল্যও ছিলো অনেক। কিন্তু সাদা চোখে ওগুলো পাগলের প্রলাপ আর কুসংস্কার ছাড়া কিছু ছিলো না। ডাইনীবিদ্যা আর জাদুমন্ত্র।”

“আমার মনে হয় আপনি ওগুলোকে পাণ্ডিত্যপূর্ণও বলেছিলেন একটু আগে?”

“হ্যাঁ। একজন যাজকের যা বিদ্যাবুদ্ধি থাকার কথা সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পাণ্ডিত্যপূর্ণই ছিলো বলা চলে। বুঝলে, কার্ডিনাল রিশেলু যখন সমগ্র ইউরোপের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি তখন একটা কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলো, আর সেটা হলো শক্তি নিয়ে স্টাডি করা। তার সমস্ত স্টাডির কেন্দ্রে ছিলো একটা জিনিস-সম্ভবত তুমি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছে, শোনন নি?”

 “শার্লেমেইনের দাবাবোর্ডের কথা বলছেন?” নিজের কণ্ঠ যতোটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম আমি, যদিও আমার হৃদস্পন্দন ঘোড়ার মতো ছুটছিলো তখন। তার দিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম যেনো উত্তেজিত হয়ে আবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ না হয়ে যায়। মন্তগ্লেইন সার্ভিস সম্পর্কে আমার জানা দরকার। কিন্তু জিনিসটা শত শত বছর আগে হারিয়ে গেছে। আমি শুধু জানি এর অকল্পনীয় মূল্য রয়েছে।

“আমি তো মনে করতাম ওটা নিছক কোনো কিংবদন্তী,” বললাম তাকে।

“কিন্তু রিশেলু সেটা মনে করতো না,” বৃদ্ধ দার্শনিক জবাব দিলেন। “এই জিনিসটার উৎপত্তি আর গুরুত্ব সম্পর্কে ভদ্রলোক বারোশ’ পৃষ্ঠার গবেষণাধর্মী জানাল লিখে গেছে। এজন্যে আচেন অথবা আয়-লা-শ্যাপিয়ে তেও ভ্রমণ করেছে সে। এমন কি মন্তগ্লেইনেও তদন্ত করেছে, কারণ তার বিশ্বাস ছিলো ওটা। ওখানেই কোথাও মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা আছে। তবে সে সফল হতে পারে নি। বুঝলে, আমাদের কার্ডিনাল মনে করতো এই সার্ভিসটায় রয়েছে রহস্যের। চাবি, দাবার চেয়েও পুরনো কোনো রহস্য, সম্ভবত মানবসভ্যতার সমবয়সী কোনো রহস্য। এমন একটা রহস্য যা ব্যাখ্যা করতে পারবে সভ্যতার উত্থান আর পতনকে।”

“এটা কি ধরণের রহস্য হতে পারে?” নিজের উত্তেজনা আবারো লুকিয়ে রেখে জানতে চাইলাম।

“আমি তোমাকে বলবো সে কি ভাবতো,” বললেন ভলতেয়ার। “যদিও সে ধাঁধাটার সমাধান করার আগেই মারা যায়। এ থেকে তুমি নিজে নিজে বুঝে নিও, কিন্তু এরপর এই ব্যাপরটা নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্নটশ্ন করতে পারবে না। কার্ডিনাল রিশেলু বিশ্বাস করতো মন্তগ্লেইন সার্ভিসে একটি ফর্মুলা রয়েছে। দাবাবোর্ডটির বিভিন্ন অংশে সেই ফর্মুলা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ ফর্মুলাটি প্রকাশ করে এক মহাজাগতিক শক্তির সিক্রেটকে…”

.

তয়িরাঁ মরিস তার গল্প বলা থামিয়ে মৃদু আলোর মধ্য দিয়ে ভ্যালেন্টাইন আর। মিরিয়ের দিকে তাকালো। বিছানার চাদরের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে তার গল্প শুনে যাচ্ছে দু’বোন। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করছে। মরিস উঠে দাঁড়ালো, তাদের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো এক ঝটকায়। আলতো করে মেয়ে দুটোর চলে হাত বুলালো সে।

“আঙ্কেল মরিস,” চোখ খুলে বললো মিরিয়ে, “আপনি তো আপনার গল্পটা শেষ করলেন না। কার্ডিনাল রিশেলু কোন্ ফর্মুলাটা সারা জীবন ধরে খুঁজে ফিরেছেন? মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন অংশে কি লুকিয়ে আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন?”

“এই জিনিসটাই আমরা একসাথে আবিষ্কার করবো, ডার্লিং।” তয়িরাঁ মুচকি হেসে বললো। এবার চোখ খুলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো মেয়ে দুটো।

“আমি কখনও ঐ পাণ্ডুলিপিটা দেখি নি। আমার সাথে কথা হবার কিছু দিন। পরই ভলতেয়ার মারা যান। তার সমস্ত লাইব্রেরিটা এমন একজন কিনে নেয় যিনি কার্ডিনাল রিশেলুর জানাল সম্পর্কে বেশ ভালোই অবগত ছিলেন। তিনি মহাজাগতিক শক্তিটা কি সেটা বোঝেন এবং এরজন্যে লালায়িতও বটে।”

 “এই মানুষটি আমাকে এবং মিরাবুকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলেন, যিনি বিল অব সিজার অ্যাসেম্বলিতে পাস বার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, যাতে করে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করতে পারে, কোনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এবং নীতিহীন কেউ হস্তগত করতে না পারে।”

 “কিন্তু আপনি তো ঘুষ নেন নি, আঙ্কেল মরিস?” বিছানায় উঠে বসে বললো ভ্যালেন্টাইন।

“ঐ ক্রেতা অর্থাৎ মহিলার কাছে আমার মূল্য একটু বেশিই ছিলো বলতে পারো!” হেসে বললো তয়িরাঁ মরিস। কারণ আমি নিজেই সার্ভিসটা চাই। এখনও সেটা খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

ভ্যালেন্টাইনের দিকে নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় তাকিয়ে মুচকি হেসে আরো বললো, “তোমাদের অ্যাবিস মারাত্মক একটি ভুল করে ফেলেছে…মানে সে যা করেছে তা যদি বিবেচনা করে দেখো। মহিলা অ্যাবি থেকে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলেছে। আহ, আমার দিকে ওভাবে তাকিও না, মাই ডিয়ার। এটা কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হতে পারে, তাই নয় কি, কারণ তোমাদের আঙ্কেলের মতে মহিলা চলে গেছেন রাশিয়ায়। বুঝলে, যে মহিলা ভলতেয়ারের লাইব্রেরিটা কিনে নিয়েছেন, আমাকে আর মিরাবুকে ঘুষ দিতে চেয়েছেন, যিনি বিগত চল্লিশ বছর ধরে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে তিনি আর কেউ নন, সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দি গ্রেট।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *