সাইমুম ৬৪ – বিপদে বুজুমবুরা – আবুল আসাদ
১
বুজুমবুরা জিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের দক্ষিণ পাশের লেন দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে এলো। উঠল লেক ড্রাইভ এভিনিউতে।
কালো রং-এর গাড়ি। জানালার কাঁচে কালো শেড দেওয়া। গাড়িটি এগিয়ে চলল সেন্ট্রাল স্কোয়ারের দিকে।
সেন্ট্রাল স্কোয়ার থেকে কয়েকটা বড় রাস্তা এদিক-ওদিক বেরিয়ে গেছে। লেক ড্রাইভ এভিনিউ সেন্ট্রাল স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেছে।
কালো গাড়িটা লেক ড্রাইভ এভিনিউ ধরে পশ্চিম দিকে ছুটে চলল। রাত তখন ৯টা। এ সময় লেক ড্রাইভের গোটা এই এলাকা জনবিরল হয়ে পড়ে।
লেকের রুজিজি নদী তীরের রুজিজি ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি তখন গাড়িটা।
কালো গাড়িটা বেশ স্পিড নিয়ে এগিয়ে চলছিল। এলাকাটা জনবিরল বলে নির্ধারিত গতি মানার তেমন প্রয়োজন ছিল না, তার উপর ছিল রাত। কালো গাড়িটা ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার মুখে তার সামনে হঠাৎ দুটি হেডলাইট জ্বলে উঠলো।
আলোর উৎস রাস্তার ঠিক মধ্য স্থান থেকে। তার মানে একটা গাড়ি রাস্তার উপর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
কালো গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে যে ছিল সে বলল, ‘গাড়ি থামাবে না। আগাও। গাড়িকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করো।’
যে নির্দেশ দিলো তার হাতে একটা সাব মেশিনগান।
গাড়ির পেছনের সিটে তিনজন। তাদের মাঝের জনের চোখ হাত-পা বেঁধে রাখা। তার দুপাশে দুজন, তাদের হাতে স্টেনগান।
কালো গাড়িটা আরো সামনে এগিয়ে গেলো। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ি থেকে দূরত্ব তখন দশ গজের বেশি নয়। কালো গাড়ির গতি আগের চেয়ে কিছুটা কমে এসেছে। সামনের গাড়িটা পুলিশের।
একজন পুলিশ গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
তার ডান হাতে রিভলভার বাম হাতে রেড লাইটের সিগনাল। সিগনালটা উপরে তুলে ধরা কিন্তু হাতের রিভলভারটা টার্গেটেড নয়। পুলিশ বোধ হয় মনে করেছিল গাড়িটা থামবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে যখন মনে হলো গাড়িটা থামছে না, তখন চোখের পলকে তার ডান হাতটা উপরে উঠলো। একটা গুলি বেরিয়ে গেল তার রিভলভার থেকে কালো গাড়ির পেছনের চাকার লক্ষ্যে।
চাকায় গুলি লাগার পর কালো গাড়িটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে বাম দিকে বেঁকে ছেঁচড়ে চলতে শুরু করেছিল।
এর মধ্যে কালো গাড়ির ড্রাইভিং জানালা দিয়ে নিঃশব্দে এবং দ্রুত স্টেনগানের কালো ব্যারেল বেরিয়ে ব্রাশফায়ার করল পুলিশ লক্ষ্যে।
গুলিবিদ্ধ পুলিশটি গাড়ির সামনেই আছড়ে পড়ল মাটিতে।
গুলি করেই লোকটি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তোমরা ওকে নিয়ে এসো পুলিশের গাড়িতে। পুলিশের গাড়িতেই নিতে হবে।’
লোকটি ছুটল পুলিশের গাড়ির দিকে।
তার দুই স্টেনগানধারী সাথী বন্দি লোকটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটলো তার পিছনে পিছনে।
কালো গাড়ির লোকদের দৃষ্টি গাড়ির সামনে দাঁড়ানো একজন পুলিশের দিকে কেন্দ্রীভূত থাকায় তারা দেখতে পায়নি সড়কের দক্ষিণ পাশের ব্যারাকের মতো ঘর থেকে চারজন পুলিশ তাড়াতাড়ি ছুটে এসে গাড়ির দক্ষিণ পাশে অবস্থান নিয়েছে।
পুলিশের গাড়ির দিকে প্রথম ছুটে আসা লোকটি ছুটে আসছিল ড্রাইভিং সিটের পাশের সিট লক্ষ্যে, তার পিছনে ড্রাইভার।
দুজন পুলিশ তাদেরকে টার্গেট করেছে আর একজনকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটে আসা দুজন গাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই অন্য দুজন পুলিশ কাভার করেছে তাদের দুজনকে।
চারজন পুলিশেরই স্টেনগানের নল এখন টার্গেটে স্থির হয়েছে। বলল তারা চিৎকার করে, ‘তোমরা হাতের স্টেনগান ফেলে দাও, না হলে স্টেনগানের গুলি তোমাদের ভর্তা করে ফেলবে।’
তারা স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়ালো।
গাড়ির আড়াল থেকে চারজন পুলিশ গাড়ির ওপারে ওদের কাছে গেল। একজন পুলিশ নির্দেশ দিল, ‘ওদেরকে বেঁধে ফেলো।’
দুজন পুলিশ ওদের সামনে পাহারায় থাকলো আর দুজন পুলিশ ওদেরকে হ্যান্ডকাপ পরাতে গেল।
আর একটা গাড়ি রাস্তার ওধার থেকে দ্রুত এসেছিল।
দুজন পুলিশ ওই গাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকালো কিন্তু তেমন গা করলো না। মনে করলো কত গাড়িই তো আসছে যাচ্ছে। আসলে হাতেনাতে ধরাপড়া সন্ত্রাসীদের নিয়ে ওরা ব্যস্ত ছিল। হাত, পা, চোখ বাঁধা বন্দি লোকটার বয়স ও চেহারা দেখে তারা মনে করেছিল হতে পারে এই লোকটিকে তারা খুঁজছে।
দ্রুতবেগে আসা গাড়িটা পুলিশ ও বন্দিদের সোজাসুজি এসে গাড়ি ডেড স্লো করল। তার সাথে সাথেই খুলে গেল গাড়ির এ পাশের দরজা। সঙ্গে সঙ্গেই স্টেনগানের একটা ব্যারেল বের হয়ে গুলিবৃষ্টি করে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই পুলিশের গাড়ির এ পাশের সব মানুষকে ঝাঁঝরা করে দিল। নিহতদের মধ্যে চারজন পুলিশ, একজন বন্দি এবং চারজন সন্ত্রাসী ছিল। গুলির ফলাফলটা দেখে নিয়ে হার্ডব্রেক কষা গাড়িটা দ্রুত পশ্চিম দিকে চলে গেল।
গাড়িটা খেয়াল করল না তাদের স্টেনগানের ফায়ারের সাথে সাথেই পুলিশ ব্যারাক থেকে একজন পুলিশ বের হয়ে দ্রুত এসে চারদিকে একবার তাকিয়ে পুলিশের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। তারপর ছুটে চলা শুরু করলো গাড়িটা সামনের পলাতক গাড়ির পেছনে পেছনে।
কিন্তু সামনের গাড়িটা তখন দৃষ্টির সামনে থেকে হারিয়ে গেছে। লেক ড্রাইভ এভিনিউটা ন্যাশনাল পার্ক এলাকায় ঢোকার পর ছোট্ট একটা বাঁক নিয়েছে।
ন্যাশনাল পার্ক পার হওয়ার পর রুজিজি নদী। বেশ বড় নদী এটা। বেশ বড় ব্রিজ এখানে। ব্রিজ পার হওয়ার জন্য গাড়িকে লাইন ধরতে হয় ব্রিজের ওপারে। লেক এভিনিউ বরাবর দক্ষিণ পাশে ডেল্টা ন্যাচারাল রিজার্ভ ন্যাশনাল পার্ক। ডেল্টা নেচার রিজার্ভ এলাকাটা তখন একেবারেই জনবিরল। কিন্তু রিজার্ভ এলাকা পার হয়েই লেক ড্রাইভ এভিনিউ লেক পাড়ের জনবসতি এলাকায় প্রবেশ করেছে। জনবসতির পরেই আবার জনবিরল বনজ এলাকা। এরপরেই বুরুন্ডি কঙ্গো সীমান্ত। এখানে সীমান্ত পারাপার খুব সহজ। ন্যাশনাল আইডি দেখিয়ে রেজিস্টারে নাম ও আইডি নাম্বার এন্টি করেই চলে যাওয়া যায়।
কালো গাড়ির পিছু নিয়েছিল যে পুলিশ তার আত্মবিশ্বাস খুব নড়বড়ে। কালো গাড়িটাকে পাকড়াও করতে পারবে এটা মনে করে না সে। কিন্তু সে চায় গাড়িটা কোথায় যায়, কোন্ দিকে যায়- তা জানতে।
কঙ্গো সীমান্তে পৌঁছা পর্যন্ত কালো গাড়িটাকে পুলিশটি একবারই দেখেছিল ঘনবসতি এলাকার পশ্চিম প্রান্তের দিকে গুটুমবা তেমাথার ট্রাফিক সিগনালে। তার নাকের ডগার উপর যখন রেড সিগনাল জ্বলে ওঠে তখন সে দেখতে পায় কালো গাড়িটা ট্রাফিক পুলিশের সাথে কি কথা বলে এই এভিনিউ ধরে পশ্চিম দিকে ছুটে চলছে।
পুলিশ বুরুন্ডি সীমান্ত ফাঁড়িতে গিয়ে রেজিস্টার চেক করে দেখলো কালো গাড়িটা সীমান্ত ক্রস করে কঙ্গোতে ঢুকেছে। রেজিস্টারে দুজনের নাম ও আইডি লেখা আছে। যদিও পুলিশ বুঝল নাম ও নাম্বার ভুয়া। তবুও পুলিশ একটা ছবি নিল রেজিস্ট্রারের ওই পাতার।
.
হুলুস্থুল পড়ে গেল পুলিশ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলো। ঘটনাস্থলে একমাত্র জীবিত থাকা পুলিশ অফিসারকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করলো। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসল পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা।
বৈঠক বসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিসের মিটিং রুমে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনারী মোনিমপার মুখ গম্ভীর। সবার দিকে একবার চোখ বুলাল। বলল, ‘গুডমর্নিং, ঈশ্বর আমাদের সকলের প্রতি সদয় হোন।’
একটু থামল। সংগে সংগেই বলল আবার, ‘আমি দুঃখিত, স্বাধীনতার পর দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এমন উদ্বেগজনক ঘটনা আর ঘটেনি। এক সময়ে এক ঘটনায় পাঁচজন পুলিশ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হবার ঘটনা কোনো সময়ই ঘটেনি। শুধু তাই নয় দেশের অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মুসলিম ছাত্রের লাশও তাদের সাথে পাওয়া গেল। সে কিডন্যাপ হয়েছিল কয়েকদিন আগে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। মুসলমানদের তিনজন মুবাল্লেগ এক সাথে নিখোঁজ হলো। তাদের কোনো হদিশ আমরা করতে পারলাম না এখনও। কয়েকটা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অতি সম্প্রতি ঘটল, তার কোনো কুলকিনারা আমাদের দিয়ে হয়নি। পার্লামেন্টে প্রচণ্ড হৈচৈ উঠবে। প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। ঘটনার যুক্তিসংগত একটা প্রাইমারি রিপোর্ট তিনি অবিলম্বে চেয়েছেন। কারা, কীভাবে, কেন এই ঘটনা ঘটাল, সেটাও তিনি অতিসত্বর খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে যারা অব্যাহত সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, এটা সরকার, পার্লামেন্ট, জনগণ সবারই দাবি। এখানে পুলিশ, গোয়েন্দা প্রধানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সকলেই আছেন। আমাদের করণীয় সম্পর্কে আপনারা বলুন।
পুলিশ প্রধান অ্যান্টিনিও বাতুমবুরা নড়েচড়ে বসল। বলল, স্যার, প্রাথমিক রিপোর্ট আমরা দিতে পারি। রিপোর্ট আমরা ফাইনাল করেছি। ফাইলটা এখনি এসে যাবে।
আপনাদের প্রাথমিক রিপোর্টে কি আছে, বলতে নিশ্চয় পারবেন? বলল স্বরাষ্ট্র ও জননিরাপত্তামন্ত্রী।
‘জি স্যার, বলছি।’
বলে শুরু করল পুলিশ প্রধান, ‘গতকাল যে বড় ঘটনাটা ঘটেছে, তা গোটা শহর জুড়ে আবিউলা আমাদীকে উদ্ধারের জন্যে যে পুলিশ অ্যাকশন শুরু হয়েছে তারই ফল। গোটা শহরে পুলিশের কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে। তার সাথে প্রতিটি রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসীরা যখন ধরাপড়া আসন্ন জেনেছে, তখন তারা আবিউলাকে নিয়ে দেশের বাইরে নিরাপদ স্থানে পালাবার চেষ্টা করছে। তারা পুলিশের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসী হিসাবে তারা আইডেনটিফায়েড হওয়ার আগে তাদের আকস্মিক আক্রমণে একজন পুলিশ মারা পড়লেও অবশিষ্ট পুলিশ সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এবং আবিউলা আমাদীকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করে। সন্ত্রাসীদের যখন বেঁধে ফেলার প্রক্রিয়া চলছিল, সেই সময় একটি গাড়ি আকস্মিকভাবে সেখানে এসে পড়ে এবং চলন্ত অবস্থাতেই সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ার করে। তাতেই আত্মসমর্পণকারী চারজন সন্ত্রাসী, চারজন পুলিশ ও আবিউলা নিহত হয়। ধরাপড়া সন্ত্রাসীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে তাদের হত্যাই সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল। এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা পালাতে পারে কারণ, চেকপোস্ট থেকে এ্যাকশনে আসা সব পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে মারা পড়ে। নতুন ব্রাশফায়ারের শব্দে চেকপোস্টে অবশিষ্ট একমাত্র পুলিশ, ডিউটি অফিসার, ছুটে আসে এবং পলায়নরত সন্ত্রাসীদের গাড়িকে ফলো করে। সন্ত্রাসীদের গাড়িটা সীমান্ত পেরিয়ে কঙ্গোতে ঢুকে যায়। তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। সন্ত্রাসী যারা নিহত হয়েছে পরিচয় সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চারজন সন্ত্রাসীর সবাই বুরুন্ডির অধিবাসী। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়েছে, তাদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হচ্ছে, সন্ত্রাসী যারা পালিয়েছে, তারাই মূল সন্ত্রাসী। তারা আবিউলা আমাদীকে বহনকারী গাড়িকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এদের পরিচয় উদ্ধার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ তাদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। থামল পুলিশ প্রধান।
‘যারা পালিয়ে গেছে, তাদেরকে আপনারা মূল সন্ত্রাসী বলছেন, তারা কি বুরুন্ডির? আপনারা কি মনে করেন?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘সীমান্ত চেকপোস্টে সন্ত্রাসীরা যে নাম লিখিয়েছে, তা সব কঙ্গোলিজদের নামের সাথে মিলে। এ নামগুলো ভুয়া। এ নাম থেকে বলা যাবে না তারা কঙ্গোর লোক।’ পুলিশ প্রধান অ্যান্টেনিও বাতুমবুরা বলল।
‘বুজুমবুরার কিছু হত্যাকাণ্ডের দায় M23 স্বীকার করেছে। M23 তো কঙ্গোবেজড সন্ত্রাসী সংগঠন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবী।
‘ঠিক স্যার, এরা M23 এর লোক হতে পারে। স্যার, আমরা ভেতর- বাইরের সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে চাই।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘এ সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের বুজুমবুরা বা বুরুন্ডিতে কোনো দিনই ছিল না, বিশেষ করে স্বাধীনতার পর। হুতো- তুতসির জাতিগত দ্বন্দে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু সে সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী রুয়ান্ডা, উগান্ডায় কিন্তু অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার সাথে পুরোপুরিই যুক্ত ছিল কঙ্গোবেজড সন্ত্রাসীরা। আমার আশংকা হচ্ছে, আমাদের বুরুন্ডিতে ঐ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে কিনা! এই দিকটি আমাদের গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘নিশ্চয় স্যার, এদিকটি আমাদের অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। তবে আমার মনে হয়, কঙ্গোবেজড বা বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন আমাদের দেশে সক্রিয় হবার মতো অবস্থা নেই, যা রুয়ান্ডা ও উগান্ডায় ছিল। উগান্ডা ও রুয়ান্ডায় তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করেছিল এবং ডেকে এনেছিল বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। পর্দার অন্তরালে যা ঘটছে তার সবটা আমরা জানি না। পূর্ব কঙ্গোর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর উদ্ভব ঘটেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। এ ক্ষেত্রে বাম রাজনীতির বিভিন্ন ফ্যাকশনের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কিন্তু সশস্ত্র সেই গ্রুপগুলো বিশেষ করে বাম গ্রুপগুলোর রাজনীতি এখন নেই। এরা রাজনৈতিক বেকারে পরিণত হয়েছে। তাদের এখন দলরক্ষার ও পেট চলার জন্যে প্রচুর টাকা চাই। এই টাকার জন্যে সশস্ত্র গ্রুপগুলো এখন ভাড়া খাটতে শুরু করেছে। বুরুন্ডির কেউ বা কোনো গ্রুপ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তাদের ভাড়া করতে পারে। তার ফল হতে পারে এখানকার হত্যাকাণ্ডগুলো।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘এমনটা অবশ্যই ঘটতে পারে স্যার। তবে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তার অধিকাংশই প্রতিভাবান ছাত্র এবং সাধারণ মুসলিম ব্যক্তিত্ব! যদি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কারণ মুসলিম বিদ্বেষ হয়, তাহলে এরা টার্গেট হলো কেন? টার্গেট হতে হতো মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়িক নেতা বা সমাজপ্রধানরা। আর মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম ছাত্রের দেশের বাইরে শত্রু থাকার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। হত্যাকাণ্ড কোনো পারিবারিক কারণে ঘটেনি, সেটাও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং হত্যাকাণ্ডগুলো সত্যি দুর্বোধ্য। আমার মতে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর নতুন এবং পূর্ণ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ বলল বুরুন্ডির গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।
‘ধন্যবাদ অফিসার, কয়েকটা মুসলিম হত্যাকাণ্ডের দায় পূর্ব কঙ্গো থেকে কার্যরত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী M23 স্বীকার করেছে। তারা মৃতদেহের সাথে এ সংক্রান্ত স্লিপ রেখে গেছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
মুইজি বোকুমিই কথা বলল, ‘M23 এর দাবির বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হয়নি। তবে হত্যার দায় স্বীকারের যে চিরকুট পাওয়া গেছে, তার ভাষা পূর্ব কঙ্গোর নয়, বুরুন্ডির। কঙ্গোর লোকরা বুরুন্ডির ভাষা যেভাবে বলে, লিখে তার সাথেও এ চিরকুটের ভাষার মিল নেই। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে উপসংহারে পৌঁছার আগে আরও গভীর তদন্তে যাওয়া প্রয়োজন।’
‘ধন্যবাদ মি. মুইজি বোকুমি, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন। তবে এর সাথে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। বাইরের লোকরা আমাদের ঘরের লোকদের বাহন সাজাতে পারে। যেমন আজকের ঘটনায় সন্ত্রাসী যারা মারা গেছে, তারা সবাই বুরুন্ডির নাগরিক। তাদের যারা হত্যা করেছে মুখ বন্ধ করার জন্যে, তারাই আসল সন্ত্রাসী এবং তারা পালিয়ে গেছে কঙ্গোতে। বলা যায় কঙ্গোর সন্ত্রাসীরা বাহন সাজিয়েছে আমাদের লোকদের।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘আপনার কথা ঠিক স্যার। কিন্তু M23 বা কঙ্গোর সন্ত্রাসীদের মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না। কেন তারা বিশেষ করে আমাদের প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্রদের টার্গেট করবে! পূর্ব কঙ্গো অঞ্চলে প্রচুর মুসলমান আছে। দুটি শহরে তো তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সেখানে মুসলিম বিরোধী কোনো তৎপরতা নেই। সুতরাং বিষয়টি আমার কাছে খুব জটিল মনে হয়, স্যার।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘হ্যাঁ, বিষয়টি খুবই জটিল। আচ্ছা, বুরুন্ডির কোনো বিশেষ গ্রুপ বাইরের সন্ত্রাসীদের সাহায্য নিচ্ছে কিনা? গ্রুপটির নিশ্চয় বিশেষ মোটিভ আছে যা আমরা জানি না।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘এটা হতে পারে স্যার। তবে এমন কোনো গ্রুপের সন্ধান পুলিশের কাছে নেই। এ ধরনের গ্রুপ বা গ্রুপরা রাজনৈতিক চরিত্রের হয়। কিন্তু বুরুন্ডিতে এ ধরনের কোনো গ্রুপ নেই। পালিপ হুতু নামে বুরুন্ডির হুতুদের পরিচালিত একটা বিদ্রোহী গ্রুপ ছিল। FNL (ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স) ছিল পালিপ হুতুর সামরিক শাখা। হুতু–তুতসিদের সমস্যা সমাধান হওয়ার পর এরা এখন পুরোপুরিই নিষ্ক্রিয়। রাজনীতি বা কোনো ব্যাপারেই তারা নাক গলাচ্ছে না। বলা যায়, এরা সরকারের সাথেই আছে।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘পালিপ হুতু বা এফএনএল-এর মধ্যে কোনো মুসলিম কখনও কি ছিল?’ জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
‘স্যার, এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হুতুদের মধ্যে প্রচুর মুসলিম আছে। হুতুদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো। মুসলমানদের শান্তিকামী বলে মনে করা হয়। হুতু-তুতসিদের দীর্ঘ জাতিগত সংঘাতে মুসলমানরা কোনো পক্ষেই অংশ নেয়নি। শান্তিরক্ষার ভূমিকা তারা পালন করেছে বলে মনে করা হয়। তাই মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ থাকার কথা নয় কারও।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘পুলিশ প্রধান ঠিক বলেছেন। আমি দেখেছি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা সবসময় শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে। প্রত্যেক ক্যাবিনেটেই তাদের দু একজন মন্ত্রী থাকেন। তাদের ভূমিকাও খুব ভালো। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রয়োগে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষায় একেবারে অটল।’
থামল একটু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তারপর সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমাদের সমস্যার তো সমাধান হলো না। কারা তাহলে এই বিশেষ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে?’
পুলিশ প্রধান বলল, ‘সংঘটিত প্রত্যেকটি সন্ত্রাসী ঘটনার নতুন করে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কেন্দ্রীয়ভাবে গোয়েন্দা সংস্থারই এই তদন্ত করা উচিত। এর সাথে বাইরের সম্পর্ক আছে কিনা সেটাও আমাদের দেখা প্রয়োজন।
‘ঘটনাগুলোর নতুন তদন্তের ব্যাপারে আপনার কথা ঠিক আছে। বাইরের ব্যাপার নিয়ে কীভাবে আমরা এগুবো? পূর্ব কঙ্গো প্রশাসন নিজেই সমস্যায় আছে। আমাদেরকে কতখানি সহযোগিতা করতে পারবে, সেটা বলা মুস্কিল। আমার মনে হয় স্যার, প্রথমেই ওদের সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার, যা এখন আমাদের নেই।’ পুলিশ প্রধান বলল।
খুশি হয়ে উঠল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, ‘খুব ভালো একটা কথা বলেছেন আপনি। কঙ্গোর সাথে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের চুক্তি নেই। এটা অবিলম্বে করতে হবে।’
কথা শেষ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলে উঠল, ‘যাক, একটা উপসংহারে আমরা পৌঁছেছি। নতুন তদন্তের কাজটা আপনারা শুরু করুন। কঙ্গোর সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের ব্যাপারটা সরকার জরুরিভিত্তিতে দেখবে।’
একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকাল সবার দিকে। বলল, ‘কারো কোনো কথা আর না থাকলে আমরা উঠতে পারি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সবাই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল।
পুলিশ প্রধান দাঁড়িয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশেই। তার গাড়িও এসে দাঁড়িয়েছিল তার পাশেই।
একটা ওয়্যারলেস কল এসেছিল পুলিশ প্রধানের। কথা বলছিল। সে। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা।
পুলিশ প্রধান ওয়্যারলেস থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘একটা মর্মান্তিক খবর স্যার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি খবর?’
‘স্যার, সম্মানিত আসুমানি-সালিহ পরিবারের দুই জমজ বোন তাদের বাড়ির সামনে তাদের গাড়িসহ ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে। তাদের বড় বোন সরকারি বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলতে যাওয়ায় বেঁচে গেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘এটা কি অ্যাকসিডেন্ট? কি বলল ওখান থেকে?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘টহল পুলিশ ছাড়াও লোকাল থানার পুলিশ ও একজন পুলিশ কমিশনার ওখানে গেছেন। ওদের প্রাথমিক রিপোর্ট, ওটা ক্লিন মার্ডার উপস্থিত সকলের সাক্ষ্য হলো ট্রাকটি টার্গেট করে এসে গাড়িটাকে আঘাত করেছে। তখন রাস্তাটা একদম ফাঁকা ছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।
ট্রাকের নাম্বার পাওয়া গেছে?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা।
‘নাম্বার পাওয়া যায়নি। ট্রাকের বিবরণ পাওয়া গেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান। বিষণ্ণতা নামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে-মুখে। বলল, ‘গড সেভ আস। আবার সেই হত্যাকাণ্ডের মুখেই আমরা পড়লাম!’
‘শুধু হত্যাকাণ্ড নয় স্যার। আগের সেই জটিলতাই নতুন করে সামনে এলো স্যার। আবিউলা আমাদীর মতোই এ দুই যমজ বোন এবারের সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাডভানসড পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে। তারা সরকারি স্টেট কলেজে ভর্তি হয়ে বড় বোনের সাথে বাড়ি ফিরছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘সর্বনাশ! সেই একই ঘটনা! ঐতিহ্যবাহী আসুমানি-সালিহ পরিবার তো গোটা বুজুমবুরায় অত্যন্ত সম্মানিত। একদম হৈ চৈ উঠে যাবে চারদিকে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘শুধু বুজুমবুরা নয় স্যার, কিগোমা, ইউজিজিসহ গোটা তানজানিয়ার মানুষ এই পরিবারকে খুব সম্মানের চোখে দেখে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু থেকেই পুলিশ প্রধান আবার বলল, ‘আমি ওখানে যাচ্ছি স্যার।’
‘চলুন, আমিও যাব।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ধন্যবাদ স্যার, এটা খুব ভালো হবে।’ পুলিশ প্রধান বলল। কথা শেষ করেই পুলিশ প্রধান তাকাল পেছনে দাঁড়ানো অফিসারদের দিকে।
এগিয়ে এলো গোয়েন্দা প্রধান। বলল, ‘আমিও যাচ্ছি স্যার।’
‘আপনি কি আরও কিছু খবর পেয়েছেন?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘একই রকম খবর, মাত্র দুটি বিষয় নতুন আছে। এক. ট্রাকে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল না। গাড়ির ড্রাইভারের পাশের দরজায় চাঁদ-তারা আঁকা ছিল একটা বর্গক্ষেত্রের মধ্যে। ওটা ট্রাকের মনোগ্রামও হতে পারে।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।
‘চাঁদ-তারা? ওতো মুসলমানদের একটা সিম্বল!’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘ঠিক স্যার। চলুন যাওয়া যাক।’ বলল পুলিশ প্রধান।
মিনিট খানেকের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়ি, পুলিশ প্রধানের গাড়ি ও গোয়েন্দা প্রধানের গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি এক সাথে যাত্রা করল।
.
আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাস লেক থেকে একটু দূরে লেক এভিনিউয়ের মধ্যবর্তী কাবুন্দো এলাকায়। ন্যাশনাল-৯ হাইওয়ে লেক এভিনিউয়ের যেখানে মিশেছে, সেখান থেকে একশ’ গজের মতো দক্ষিণে। লেক এভিনিউ থেকে বেরিয়ে একটা প্রশস্ত রাস্তা লেকের দিকে চলে গেছে। এটা আসমানি রোড। লেক এভিনিউ ও আসুমানি রোড যে কোণ সৃষ্টি করেছে, এই কোণের উপর বিশাল বাড়ি আসমানি সালিহ পরিবারের। বাড়ির প্রধান গেট লেক এভিনিউ ঘেঁষে। আরেকটা ছোট গেট আছে আসুমানি রোডের উপর। আসুমানি-সালিহ পরিবারের পশ্চিম পাশেই বড় জুমআ মসজিদ। বুজুমবুরার প্রথম মসজিদ এটা। এই মসজিদের প্রথম ইমাম ছিলেন ইদি আসুমানি। তার বংশ ছিল যেমন অভিজাত, তেমনি তিনিও ছিলেন শিক্ষিত এবং গোটা বুজুমবুরায় অত্যন্ত সম্মানিত। আর বুজুমবুরা তখন মুসলিম শহর, অধিবাসীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান।
স্বরাষ্ট্র ও জননিরাপত্তামন্ত্রী জোসেফ বারনাবী মোনিমপা এবং পুলিশ প্রধান অ্যান্টিনিও বাতুমবুরা একটা গাড়ি বহর নিয়ে পৌঁছল লেক এভিনিউতে, আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাড়ির সামনে। সেখানে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসাররা তাদের স্বাগত জানাল। রাস্তায় ও রাস্তার দুপাশে তখন জনতার ভিড়। আসুমানি-সালিহ পরিবারের দুই মেয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে, একথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মতো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামল। চারদিকে তাকিয়ে সে বিস্মিত হলো। এমন বিশাল জনসমাগমের কথা সে ভাবেনি।
অভ্যর্থনা জানানো পুলিশ অফিসারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকরা কি সব স্থানীয়?’
‘স্থানীয় স্যার, তবে যেখানেই খবর যাচ্ছে, সেখান থেকেই লোকজন আসছে।’ বলল অফিসার।
‘তা আসবে। খুব সুপরিচিত ও সম্মানিত পরিবার তো! আমাদের সরকারের সাথেও এ পরিবারের সুসম্পর্ক রয়েছে। তা তোমরা মানুষকে কিছু বলেছ?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘ঘটনাস্থলের কাছাকাছি না আসতে অনুরোধ করেছি, যাতে কোনো আলামত নষ্ট না হয়।’ বলল অফিসার।
‘গুড, ধন্যবাদ অফিসার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আসা অফিসাররা সবাই গাড়ি থেকে নামল। অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়িটা পরীক্ষা করল। লাশ- দু’টো পুলিশ আগেই নিয়ে গেছে।
আসুমানি-সালিহ পরিবারের গাড়িটা দক্ষিণে অল্প কিছু দূরে লেক এভিনিউয়ের একটা টার্নিং পয়েন্ট ঘুরে এসে আসুমানি-সালিহ হাউজের সামনে দাঁড়িয়েছিল। ট্রাকটি এসে সরাসরি গাড়িটার পেটে আঘাত করে। গাড়িটা একদম চিড়াচ্যাপ্টা হয়ে গেছে। নিহত দুইজনের বড় বোন সামিরা সাদিয়া গেট খুলতে না গেলে সেও ছোট দুই বোনের মতো পিষ্ট হয়ে যেত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঘাতকারী ট্রাকের চাকার দাগটির দিকে নজর বুলিয়ে বলল, ‘মি. বাতুমবুরা দেখুন, ট্রাকটি ঠাণ্ডামাথায় দেখে শুনে প্রায় ৮০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ছুটে এসে দাঁড়ানো গাড়িটাকে আঘাত করেছে একদম খুন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই। কে হতে পারে এদের এত বড় বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর শত্রু?’
পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বলল, ‘ঠিক বলেছেন। ট্রাকটা তাড়াহুড়া করেনি। টার্গেটেড গাড়িটার প্রায় সমান্তরালে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আঘাত করার জন্যে। মনে হয় রাস্তাও তখন ফাঁকা ছিল।
‘হ্যাঁ, তাই মি. বাতুমবুরা।’
বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাড়ির দিকে তাকাল। দেখেন গেটে একজন দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী লোক।
‘এত বড় ঘটনা ঘটেছে বাড়ির লোকজনদের সাথে কিছু কথা হওয়া প্রয়োজন।
বলে তাকাল স্থানীয় অফিসারটির দিকে। বলল, ‘বাড়ির লোকজনদের সাথে তোমরা কি কথা বলেছ?’
‘বলেছি স্যার। বাড়ির গেটে যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আসুমানি আব্দুল্লাহ। আমরা তার সাথে কিছু কথা বলেছি, তার কাছ থেকে ঘটনা জানতে চেয়েছি। তার পিতাও আছেন, নাম ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তার সাথে কথা হয়নি।’ বলল স্থানীয় পুলিশ অফিসারটি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন মি. আসুমানি আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলা যাক।’
‘চলুন স্যার, ভিকটিমদের বড় বোন গাড়ি ড্রাইভ করছিল, তার সাথেও কথা বলা দরকার।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আপনারা আসুন স্যার। আমি ওকে বলছি।’ স্থানীয় পুলিশ অফিসারটি বলল।
দ্রুত গেটের দিকে চলে গেল সে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা গেটে গিয়ে পৌঁছল।
আসমানি আব্দুল্লাহ গেট খুলে বেরিয়ে এসেছিল। তার দুই চোখ অশ্রুভেজা। সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে স্বাগত জানালো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানকে। বলল, ‘আমি সাঈদা ও সাবিয়ার পিতা।’
ট্রাকের ধাক্কায় নিহত দুই বোনের একজনের নাম সাফিয়া সাঈদা, অন্যজনের নাম সাফা সাবিয়া।
ভিকটিম সাবিয়া ও সাঈদার পিতা আসমানি আব্দুল্লাহর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘মি. আব্দুল্লাহ, আপনার দুই মেয়ের মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন। খবর শুনেই আমি পুলিশ প্রধানকে নিয়ে ছুটে এসেছি।’
‘চরম দুঃখের মধ্যে এটা আমাদের জন্যে সান্ত্বনা স্যার।’
বলেই আসুমানি আব্দুল্লাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলকে ভেতরে এসে বসার অনুরোধ করল। বলল, ‘একটু বসেই আমরা কথা বলি স্যার।’
গেটের পরেই একটা সবুজ চত্বর।
সবুজ চত্বরের মধ্যে দিয়েই একটা কংক্রিটের রাস্তা গাড়ি বারান্দায় গিয়ে মিশেছে। গাড়ি বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই একটু সামনে ড্রইং রুমের বড় দরজা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলেই ড্রইংরুমে এসে বসল। বড় ড্রইংরুম। পঁচিশ তিরিশজন লোক সহজেই বসতে পারে। ‘আপনার বাবা আছেন বাড়িতে?’ বসেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল। ‘বাড়িতে আছেন। তিনি অসুস্থ। ডাক্তারের নির্দেশে তার উঠা, চলাফিরা নিষেধ। এই অবস্থায় মর্মান্তিক খবর শুনে উনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন।’ বলল আসমানি আব্দুল্লাহ।
‘স্যরি। তিনি দেশের একজন শীর্ষ সম্মানিত নাগরিক। আমাদের সরকারের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও শান্তি- শৃঙ্খলা স্থাপনে তার মূল্যবান অবদান রয়েছে। ঈশ্বর তাকে দ্রুত সুস্থ করুন।
একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একটু নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘মি. আব্দুল্লাহ, মর্মান্তিক ঘটনাটা তো আপনি দেখেননি?
‘জি না, দেখিনি। আমি বাড়ির ভেতরে ছিলাম। বাইরে শব্দ, হৈ চৈ, আমার বড় মেয়ের চিৎকার শুনে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমরা কি তার সাথে কয়েকটা কথা বলতে পারি?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘অবশ্যই স্যার।’
বলে আসুমানি আব্দুল্লাহ ভেতরে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো। সাথে তার বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া। বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপিকা। গায়ে বোরখা, মুখে নেকাব। বসল পিতার পাশে
‘মা সাদিয়া, তুমি কেমন আছ, একথা জিজ্ঞেস করব না। এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদেরকেও মর্মাহত করেছে। আমরা কালপ্রিটকে অবশ্যই খুঁজে বের করব, উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করব। আমরা তোমার সহযোগিতা চাই মা।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘অবশ্যই সাহায্য করব স্যার। আমার বোনের হন্তা বা হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি আমরা চাই।’ সামিরা সাদিয়া বলল।
‘ধন্যবাদ মা। তুমি নিশ্চয় নিশ্চিত যে, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘অবশ্যই স্যার।’ সাদিয়া বলল।
‘কি দেখেছ তুমি?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
‘একটি ট্রাক রাস্তার ওপ্রান্ত থেকে আড়াআড়ি এসে আমাদের গাড়িকে আঘাত করল। আমি গেট খোলার জন্যে গেটের কাছে পৌঁছেছি মাত্র, এই সময় ভারি গাড়ির শব্দ শুনে আমি পেছনে তাকিয়েছিলাম।’ সাদিয়া বলল। ‘তুমি কি গাড়ির নাম্বার কিংবা ড্রাইভারকে দেখতে পেয়েছিলে?’ বলল পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা।
‘গাড়ি দেখেছি, গাড়ির ড্রাইভারও আমার চোখে পড়েছে। কিন্তু গাড়ির নাম্বার মনে রাখার মতো করে দেখার অবস্থা আমার ছিল না। যা ঘটতে যাচ্ছে তা আমাকে আতংকিত করে তুলেছিল, স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রাণপণ একটা চিৎকারই শুধু আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।’ সাদিয়া বলল।
‘বলতে পারবে কি ধাক্কা মারার পর ট্রাকটি কীভাবে কোন দিকে যায়?’ প্রশ্ন আবার পুলিশ প্রধানেরই।
‘ধাক্কা মেরে ট্রাকটি ডানদিকে টার্ন নিয়ে সামনের দিকে চলে যায়।’ সাদিয়া বলল।
‘একদম ঠাণ্ডামাথার হত্যাকাণ্ড মি. বাতুমবুরা।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘জি স্যার। ভিকটিমদের মৃত্যু যাতে নিশ্চিত করা যায় এজন্যেই ট্রাকটিকে আড়াআড়ি এনে শক্তির সবটুকু দিয়ে আঘাত করেছিল ভিকটিম গাড়ির উপর।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘কিন্তু দু’জন বা তিনজন বাচ্চা মেয়ের উপর এই নিষ্ঠুরতা কেন, এই জিঘাংসাটা কিসের জন্যে? মোটিভ কি হতে পারে এই হত্যাকাণ্ডের?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘এটাই এখন বড় প্রশ্ন স্যার।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘এক্ষেত্রে পারিবারিক কোনো শত্রুতা এবং বাচ্চাদের কোনো রিলেশন বা এই ধরনের এক তরফা কোনো বিষয় মুখ্য মোটিভের মধ্যে পড়তে পারে?’
কথাটা বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল সামিরা সাদিয়ার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আপনাদের কি এমন পারিবারিক শত্রু আছে, যে বা যারা আপনার পরিবারের উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে?’
আসুমানি আব্দুল্লাহ সংগে সংগেই জবাব দিল, ‘স্যার, এমন শত্রু তো আমাদের অবশ্যই নেই, এমনকি আমাদের পরিবারের কোনো শত্রুই নেই। আমাদের পরিবারের ভেতর ও বাইরে কারো সাথে আমাদের অপ্রীতিকর, বিরোধপূর্ণ বা ঝগড়া-ঝাটির কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘ধন্যবাদ। আরেকটা কথা, নারী-নির্যাতন বা নারী-হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। তরুণ- তরুণীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা আজকাল বেশি বেশি ঘটছে। এ বিষয়টা কি আপনারা চিন্তা করেছেন মি. আব্দুল্লাহ?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে।
আসুমানি আব্দুল্লাহর গম্ভীর মুখোভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। সে বলল, ‘না স্যার, এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা আমি জানি না। আমাদের পরিবারে এ ধরনের ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক নয়, কোনো দিন এমন ধরনের কিছু ঘটেনি।’
‘মি. আব্দুল্লাহ অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটতে পারে। আবার কোনো দিন ঘটেনি এমন ঘটনাও ঘটে যায়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কথাটা বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল সামিরা সাদিয়ার দিকে। বলল, ‘মা সাদিয়া, ওরা তোমার ছোট বোন। প্রাত্যহিক জীবনে বাবা-মায়ের চেয়েও তুমি তাদের ক্লোজ ছিলে। তাদের সব কথা তোমার পক্ষে জানা সহজ। আমার প্রশ্নটা তোমাকেও করছি মা।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমার ছোট দুই বোনের কারো জীবনেই এমন ঘটনা নেই। আমাদের পরিবারের যে লাইফ স্টাইল, আমার দু’বোন সে লাইফ স্টাইলও ফলো করতো। যে ধরনের মেশামিশি ও সম্পর্ক থেকে এ ধরনের ঘটনার সৃষ্টি হয়, আমাদের পরিবারের মেয়েরা সে ধরনের মেশামিশি ও সম্পর্কের ক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থাকে। আমার দু’বোনকে আমাদের গাড়ি স্কুল বা কলেজে রেখে আসে, আবার ঠিক সময়ে নিয়ে আসে। স্কুল বা কলেজ থেকে অন্য কোথাও কারো বাড়িতে, এমনকি আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের পরিবারের মেয়েরা শপিং করতে বের হয় না। কখনও তার খুব বেশি প্রয়োজন হলে বাবা বা মা অথবা অভিভাবক কেউ সাথে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবারের সবাই মিলে আমরা শপিং-এ বের হই। সেদিন আমাদের বেড়ানো বা পিকনিক করা অথবা ‘সবাই মিলে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাওয়ার প্রোগ্রাম থাকে। আমরা আমাদের এ লাইফ স্টাইল নিয়ে খুশি। আমি জোর দিয়েই বলছি স্যার, আমার দুই বোন ঐ ধরনের অনাচার থেকে মুক্ত ছিল।’
‘ধন্যবাদ মা। তোমাদের পারিবারিক লাইফ স্টাইল সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাদের বুজুমবুরায় তোমাদের পরিবার একটা আদর্শ পরিবার। এজন্যেই সবার শ্রদ্ধা তোমরা পাও। তারপরও বলছি মা, তাদের দু’জনের মোবাইল চেক করা দরকার।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘স্যরি স্যার, তাদের মোবাইল ছিল না, আমারও মোবাইল নেই স্যার। বিয়ের দিন আমরা গিফট হিসাবে একটা মোবাইল পাব, তার আগে নয়। দরকার হলে আমরা ফ্যামিলি মোবাইল ব্যবহার করি। সে মোবাইলটা আম্মার কাছে থাকে। ফ্যামিলি মোবাইলে সবার স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় নাম্বার আত্মীয়-স্বজনের নাম্বারসহ দরকার হতে পারে এমন সব নাম্বারের এন্ট্রি থাকে।’ সামিরা সাদিয়া বলল।
‘অশেষ ধন্যবাদ। তোমার কাছ থেকে এক বিস্ময়কর বিষয় শুনলাম মা। আজকের যুগেও এমনটা আছে!’
বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘সত্যি মি আব্দুল্লাহ, আপনাদের পারিবার আমাদের বুরুন্ডির একটা গৌরব। প্রার্থনা করি, ঈশ্বর আপনাদের সৌভাগ্য আরও বাড়িয়ে দিন। আপনাদের অনেক সময় নিয়েছি, এবার আমরা উঠতে চাই। আরেকদিন এসে আপনার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করে যাব। আপনাদের শোকের কোনো সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয় আপনাদের ক্ষতির পূরণও সম্ভব নয়। তবে কথা দিচ্ছি, আমরা আমাদের সব সাধ্য দিয়ে চেষ্টা করব অপরাধীদের যাতে ধরা যায় এবং তাদের যথোপযুক্ত শাস্তিও হয়।’
বলেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ প্রধানসহ পুলিশ অফিসাররা।
‘স্যার, খুবই কষ্ট হচ্ছে, মেহমানকে খালি মুখে বিদায় দেয়ার ঘটনা আমাদের পরিবারে নেই। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
দুঃখের কিছু নেই মি. আব্দুল্লাহ। আমরা মেহমান হিসাবে আসিনি। একটা দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলাম সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক এক ঘটনার প্রেক্ষিতে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। আসুমানি আব্দুল্লাহ তাদেরকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল।
.
রায়া তার মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাবার কাছে এসে মোবাইলটা তার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘বাবা নাদার টেলিফোন।’
রায়ার পুরো নাম রায়া রায়হানা। আর নাদা হচ্ছে নাদা ডেনিসা।
রায়া রায়হানার বাবা শাকির সাঈদ সালিহ জাঞ্জিবার নৌবাহিনীর একজন রিটায়ার্ড কমান্ডার মেজর। অবসরগ্রহণ করার পর সে নিজ শহর ইউজিজির নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
তার দুই ছেলেমেয়ে, রায়া রায়হানা ও সাদ সালাদিন। মেয়ে রায়া রায়হানা জাঞ্জিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপিকা এবং বিবাহিতা। স্বামী জাঞ্জিবার নেভির মেরিন একাডেমির ট্রেইনার।
মেয়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘সাদ, মেহমান কোথায় ওরা? বিকেলের নাস্তার সময় তো হয়েছে।’
‘তুমি কথা বলো বাবা। আমি ওদিকে দেখছি। তোমার জামাইকেও ওদের সাথে দেখেছি।’ বলল রায়া রায়হানা।
মোবাইলের কলের দিকে মনোযোগ দিল শাকির সাঈদ সালিহ।
‘হ্যাঁ নাদা মা, কেমন আছ?’ শাকির সাঈদ সালিহ বলল।
‘জি আংকেল আমরা সবাই ভালো আছি। কয়েদিন খুব ব্যস্ত থাকায় আমি টেলিফোন করতে পারিনি। মেহমান স্যার তো ঠিকমত পৌঁছেছে। কেমন লাগছে তার ইউজিজি?’
নাদার মেহমান স্যার হলো আহমদ মুসা।
‘অত বড় মাপের মানুষ? লেক তীরের পুরনো শহর ইউজিজি তাঁর কত আর ভালো লাগবে। তবে গত দুই দিন ধরে লেক ট্যাঙ্গানিকার তীর এবং গোটা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খুব খুশি দেখছি তাঁকে।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘একা একা কি ঘুরছেন? তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো আপনাকে সব বলেছি।’ নাদা ডেনিসা বলল।
‘সে একা নয়। তার সাথে আমার ছেলে সাদ সালাদিন এবং জামাই কমান্ডার রাদওয়ান রাফিক সব সময় থাকে।’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।
একটু থেমে নিজেই আবার বলে উঠল, ‘মা নাদা। বলতে পার, ‘আমরা গত দু’দিন ধরে স্বপ্নের মধ্যে আছি। মাঝে মাঝে মন বিশ্বাস করতে চাইছে না, সেই কিংবদন্তীর আহমদ মুসা আমাদের বাড়িতে, আমাদের মাঝে, আমাদের মেহমান। তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার জন্যেই আমাদের এই সৌভাগ্য। তোমার কথাতেই আমাদের বাড়িতে তিনি এসেছেন।’
‘না আংকেল, আমি মাত্র তাঁকে আপনাদের পরিচয় ও ঠিকানা দিয়েছিলাম। পরিচয় দেখে সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়েছেন। সম্ভবত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে, এমন একটা পরিবার বা মুসলিম পরিবার ইউজিজি ও বুজুমবুরায় তিনি খুঁজছিলেন। নাদা ডেনিসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক আমার বাড়িতে উঠেছেন। আমাদের পরিবারের জন্যে এটা ঐতিহাসিক ঘটনা।’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।
‘আচ্ছা আংকেল উনি বুজুমবুরায় কবে যাচ্ছেন বলেছেন কি?’ নাদা ডেনিসা বলল।
‘না, বলেননি। নাদা মা, সেদিন তুমি দারুস সালাম বিমানবন্দরে তার কিডন্যাপ হওয়ার কথা বলেছিলে। তারা নাকি খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ওরা কি ইউজিজি ও বুজুমবুরায়ও আহমদ মুসাকে ফলো করতে পারে?’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।
‘অবশ্যই পারে আংকেল। জগৎ জোড়া ওদের সংগঠন। টাকা-পয়সা শক্তি সব দিক থেকেই বলা যায় অতুলনীয়। তাছাড়া ইউজিজি ও বুজুমবুরায় ওদের নিজস্ব বা সমমনা সংগঠন থাকতে পারে।
‘তাহলে এখানেও দেখছি তার বড় বিপদ আছে।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘সেটা আহমদ মুসা অবশ্যই জানেন। আর আংকেল আহমদ মুসা যখন বুজুমবুরায় আসছেন তখন নিশ্চয় কোনো বড় কাজ নিয়েই আসছেন। বড় কাজ হলে বড় শত্রুও তাঁর থাকবে। ভাববেন না আংকেল, গতকাল কঙ্গোর এক বড় গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে আলাপ হলো। তিনি বললেন, আমার জানা দুনিয়ার সংগ্রামী মানুষদের মধ্যে আহমদ মুসাই সবচেয়ে ভাগ্যবান। তার বিপদ যেমন বড়, তেমনি সাফল্যও বড়। তিনি খুব সাধারণ হয়েও খুবই অসাধারণ। নাদা ডেনিসা বলল।
তাদের টেলিফোন আলাপ চলল আরও কিছুক্ষণ।
তখন বেলা পাঁচটা। নাস্তা চলছিল।
এক টেবিলে বসেছে শাকির সাঈদ সালিহ; আহমদ মুসা, রাদওয়ান রাফিক এবং সাদ সালাদিন। কিছুটা ব্যবধানে আরেকটা টেবিলে বসেছে মিসেস শাকির সাঈদ আয়েশা আলিয়া এবং মেয়ে রায়া রায়হানা আর পরিচারিকা রাবেয়া।
খেতে খেতেই দুই টেবিল তদারকি করছেন মিসেস শাকির আয়েশা আলিয়া। মেয়েরা পূর্ণ হিজাবে, কপালের নিচে মুখাংশটুকুই শুধু খোলা।
পাশের রুমে মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল ধরল গিয়ে রায়া রায়হানা। মোবাইল নিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার বাবার কাছে নিয়ে বলল, ‘বাবা বুজুমবুরা থেকে আংকেলের কল।
‘তোমার আসমানি আব্দুল্লাহ আংকেল? দাও আমাকে।’ বলল মেয়েকে শাকির সাঈদ সালিহ।
মোবাইল নিয়ে শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মাফ করুন জনাব, আসছি।’ বলে পাশের রুমে ঢুকে গেল।
তিন চার মিনিট পরে ফিরে এলো। তার মুখ বিমর্ষ, চোখে-মুখে তার উদ্বেগ।
আহমদ মুসার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে যাচ্ছিল। ‘জনাব আহমদ মুসা, প্লিজ একটু বসুন। বুজুমবুরার একটা খবর আছে।’ বলে সে নিজেও বসল।
আহমদ মুসাসহ সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই ধরে নিয়েছে কোনো খারাপ খবর আছে নিশ্চয়।
শাকির সাঈদ স্ত্রীর টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলিয়া আমাদের শেখ সালিহ পরিবারে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। আসমানি আব্দুল্লাহর ছোট দুই মেয়েকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
শুনেই আয়েশা আলিয়া, শাকির সাঈদের স্ত্রী মুখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নিচু করল। আর রায়া রায়হানা চাপা চিৎকার জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করেছে? কেন? কীভাবে?’
‘তাদের বাড়ির গেটের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছে। সামিরা সাদিয়া ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গেট খুলতে না গেলে সেও নাকি নিহত হতো।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘বুজুমবুরায় আরও দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল!’ অনেকটাই স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা কথাটা।
‘খুবই মর্মান্তিক জনাব।’ আহমদ মুসার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল শাকির সাঈদ। আহমদ মুসার নাস্তা আগেই হয়ে গিয়েছিল।
শাকির সাঈদ আর খেল না। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘চলুন আমরা ড্রইংরুমে বসি।
আহমদ মুসা ও শাকির সাঈদ দু’জনেই উঠল।
ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় শাকির সাঈদ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘আয়েশা, তুমি সাদিয়ার মা’র সাথে একটু কথা বলো।’
তারা উঠে গিয়ে ড্রইংরুমে বসল।
‘মাফ করবেন, পরিবারটি কি আপনাদের আত্মীয় পরিবার?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা একই পরিবার জনাব। আমি যার সাথে কথা বললাম সেই আসমানি আব্দুল্লাহর দাদার বাবা এবং আমার দাদার বাবা আপন সহোদর ছিলেন। এই ইউজিজিতেই তাদের বাস ছিল। দুই সহোদরের একজন আমার দাদার বাবার ভাই শেখ সালিহ বিন মোহাম্মদ জবরদস্ত আলেম ছিলেন। ধর্মপ্রচার ছিল তার জীবনের ব্রত। তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশেই বুজুমবুরায় যান। সেখানকার প্রথম মসজিদের ইমাম ইদি আসুমানিও প্রবীণ ও বড় আলেম। আমার দাদার বাবার ভাই শেখ সালিহ বিন মোহাম্মদ সেখানেই অবস্থান নেন। ইমাম ইদি আসুমানির মেয়ের সাথে বিয়ে হয়। পরবর্তীকালে দুই পরিবার মিলে ‘সালিহ-আসুমানি পরিবার’ নামে এক হয়ে যায়। আমাদের পরিবার ইউজিজি এবং বুজুমবুরায় ভাগ হয়ে গেলেও আমরা সুখে-দুঃখে সব সময় এক পরিবার হিসেবেই আমাদের সম্পর্ক আমরা রক্ষা করি।’
‘আসুমানি আব্দুল্লাহর ছোট দুই মেয়ে, যারা গাড়ি চাপায় নিহত হয়েছে, তারা শিক্ষার্থী ছিল কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি, শিক্ষার্থী ছিল। খুবই মেধাবী ছাত্রী। সেকেন্ডারি অ্যাডভানসড় পরীক্ষার মেধা তালিকায় তারা প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে। তার বড় মেয়ে সা-ি মরা সাদিয়া, যে গাড়ি চালিয়ে ছোট বোনদের নিয়ে আসছিল, সে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে খুব সম্প্রতি যোগ দিয়েছে।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘আপনি নিশ্চয় জানবেন, ঘটনাটা কোনো পারিবারিক সমস্যা বা বিরোধের ফলে কি হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘সালিহ-আসুমানি পরিবার বলা যায় বুজুমবুরায় নাম্বার ওয়ান পরিবার। সকল মহলে সম্মানিত। যদিও সরকারের সাথে এই পরিবারের সুসম্পর্ক আছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক তাদের পরিবার নিয়ে নেই। কোনো সময়ই কোনো কথা তাদের পরিবার নিয়ে উঠেনি। ব্যক্তিগত কোনো বিরোধও তাদের কারো সাথে নেই। বলল শাকির সাঈদ।
‘কিন্তু একটা হত্যাকাণ্ড যখন, বিশেষ করে তিন জনকেই যেখানে টার্গেট করা হয়েছিল, তখন একটা তো মোটিভ থাকবেই, সেটা কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনাব, ঘটনাটা শোনার পর থেকেই আমি এটা ভাবছি, ওটা যদি দুর্ঘটনা না হয়ে টার্গেটেড হত্যাকাণ্ডই হয়, তাহলে একটা কারণ এর পিছনে রয়েছে।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘কিছু দিন আগে থেকে বুজুমবুরায় যে টার্গেটেড হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে, তা সবই মুসলমান এবং অধিকাংশই মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা তাকাল শাকির সাঈদের দিকে। বলল, ‘শীঘ্রই আমি বুজুমবুরায় যেতে চাই জনাব।’
‘যাবেন আজ? আমিও স্ত্রীকে নিয়ে আজই যেতে চাচ্ছি। ভালো হয় যদি আমরা এক সাথে যাই।’ বলল শাকির সাইদ। আনন্দে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘এক সাথে নয়, এক গাড়িতেও নয়। এক সাথে যাতে ও বাড়িতে আমাদের ঢুকতে না হয় এমন দূরত্ব থাকা দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ বলল শাকির সাঈদ। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘ও বাড়িতে কিছু দিন পুলিশ ও গোয়েন্দা পাহারা থাকবে।
আমি কোনোভাবে আপনাদের সাথে সম্পর্কিত, এটা তারা না জানুক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি জনাব। আপনি এত দূর দিয়ে চিন্তা করেন? আল্লাহর হাজার শোকর। তাহলে আপনি কীভাবে যাবেন? বাড়ি তো চিনেন না আপনি?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘আপনারা ঠিকানা দেবেন আর আমি খুঁজে নেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কি আমরা এক সাথে বেরুচ্ছি? ‘জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে বলল, ‘ইউজিজিতে আমার একটু কাজ বাকি আছে। শেষ হয়ে গেলে আজ রাতেই বের হতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার খুব আনন্দ লাগছে। আপনি ওখানে গেলে আমরা সবাই খুশি হবো। আমাদের জন্যে অকল্পনীয় আপনার সেই সাহায্য আমরা পাবো। আপনার কাজে কতটুকু দেরি হবে ইউজিজিতে?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘আপনাদের ইউজিজি ছোট্ট নগরী, কিন্তু আয়তনের চাইতে তার ঐতিহ্য অনেক বেশি বড়। ইউজিজিকে যদি মা ধরা হয়, তাহলে বুজুমবুরা তার সন্তান মাত্র। আর ইউজিজি যদি শিক্ষক হয়, তাহলে বুজুমবুরা তার নবীন ছাত্র। বুজুমবুরার জাদুঘর আমাকে সম্মোহিত করেছে বলা যায়। ইউজিজি ও বুজুমবুরা দুই নগরীরই পত্তন করেছে মুসলমানরা। এ দু’টি শুরু থেকেই মুসলিম নগরী। বুজুমবুরা শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকে ইউজিজি প্রভাবশালী এক নগরী ছিল, যার অধিবাসীরা ছিল মুসলমান। অন্যদিকে ১৮৯৭ সালে বুজুমবুরায় ঔপনিবেশিক জার্মানদের সেনা গ্যারিসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এর অধিবাসীরা ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাই বলেছেন, ‘A traditional process of identity and community building explains how Bujumbura became an almost entirely Muslim city, from its foun- dation to the end of the 19th century until around 1930.’ অর্থাৎ আত্মপরিচয় ও সমাজ বিনির্মাণের ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৩০ সালের আশেপাশের সময় পর্যন্ত বুজুমবুরা প্রায় সার্বিকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত নগরী ছিল। কিন্তু…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে শাকির সাঈদ বলে উঠল, ‘প্লিজ জনাব, একটা কথা। লেক ট্যাঙ্গানিকার তীর ধরে আমরা যতই দক্ষিণে এগোই, তারপর লেক নিয়াসার পূর্ব তীর হয়ে আমরা যদি আরও দক্ষিণে যাই, আমরা দেখি হাজার হাজার মাইল প্রলম্বিত এই পথের উপর হাজারো নগর, শহর জনপদ এমন পাব যেখানে মুসলিম বসতি, ইসলামী সংস্কার-সংস্কৃতির চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। এর কারণ কি? ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব।
‘কারণ হলো, আফ্রো-আরবদের ইসলাম চর্চার ইতিহাস উপনিবেশিকরা মুছে ফেলতে চেয়েছে। মধ্য আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল লেক ট্যাঙ্গানিকা, লেক নিয়াসার পূর্ব উপকূল এবং জাম্বেসী নদী ও জাম্বেসী নদীর উপকূল জুড়ে আরব ও আফ্রো-আরব মিশনারী ও বণিকদের অবাধ বিচরণ ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। হাজারো শহর, জনপদ ও ব্যবসায় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে। আপনাদের এই ইউজিজি তার একটা। তাঞ্জানিয়ার পূর্ব উপকূলের বাগামোয়া (জাঞ্জিবার-এর বিপরীত দিকে) থেকে ইউজিজি পর্যন্ত নিয়মিত একটা বাণিজ্য পথ ছিল মুসলিম আফ্রো-আরব বণিকদের। তাদের এরকম বাণিজ্যপথ ইথিওপিয়া-উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক, মালাবী, জাম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিছুটা নদী পথসহ এই বাণিজ্য পথ ধরেই ইউরোপীয় পর্যটক, মিশনারী ও উপনিবেশিকদের আগমন ঘটেছিল মধ্য পূর্ব আফ্রিকায়। মুসলিম নগরী এই ইউজিজিতেই ১৮৫৮ সালে আসেন খ্রিস্টান মিশনারি রিচার্ড বার্টন এবং জন স্পিক। মিশনারি পর্যটক হেনরি এই ইউজিজিতেই ১৮৭১ সালের ২৯ অক্টোবর দেখা পান মিশনারি পর্যটক ডক্টর লিভিং স্টোনের। এই খ্রিস্টান মিশনারী পর্যটকরা এবং ইউরোপীয় উপনিবেশিকরা এমনভাবে ইতিহাস লিখেন যেন তাদের মাধ্যমেই সভ্য মানুষের পা পড়ে এই অঞ্চলে। অথচ তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সভ্যতার অধিকারী মুসলমানদের বিচরণস্থল ছিল এই অঞ্চল কয়েক শতাব্দী ধরে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুসলমানদের ইতিহাস নেই কেন? কেন আমরা নির্ভর করি ওদের ইতিহাসের উপর?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাইদের।
‘এটা একটা যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্ন জনাব। ইতিহাস না থাকার একটা বড় কারণ হতে পারে, বাগদাদে যেমনটা ঘটেছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলমানদের ইতিহাস নষ্ট করা হয়েছে। খ্রিস্টান উপনিবেশিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও পূর্বের ইতিহাস নষ্ট করেছে। ইতিহাস যতটুকু অবশিষ্ট থাকে, তা ছিল আরবি ভাষায়। ইসলামের কেন্দ্রভূমি আরব-অঞ্চলের উপর দিয়ে কয়েকশ’ বছরের একটা ঘোর অন্ধকার কাল বয়ে গেছে। এই অন্ধকারের কারণেই আল বিরুনী, ইবনে বতুতার মতো বিশ্ববিখ্যাত পর্যটকদের লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ আমরা সবেমাত্র হাতে পাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। আমার কাছে আরেকটা বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ইউজিজি ও বুজুমবুরার মতো মুসলিম নগরীতে মুসলমানরা ছোট্ট একটা সংখ্যালঘু কম্যুনিটিতে পরিণত হলো কীভাবে?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘সে আর এক বেদনাদায়ক কাহিনী। জার্মান ও বেলজিয়ানরা পর পর রাজত্ব করেছে এই অঞ্চলের উপর। এই দুই ঔপনিবেশিক শক্তিই ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষী। বুজুমবুরা যখন তাদের শাসনকেন্দ্র ও বড় বন্দরনগরী হয়ে উঠল, তখনই তারা মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্যে বিভি- ন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক লোককে বুজুমবুরায় এনে বসাল। কিন্তু কিছুদিন পর নতুন লোকরা মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করে এবং বিশ্বাসের দিক দিয়ে সবাই মুসলমান হয়ে যায়। একজন খ্রিস্টান ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘ The majority became at least nominal Muslim with a minimum of religions prac- tice.’ অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি-বিধান খুব কম পালন করলেও তারা অধিকাংশ নামে মুসলমান হয়ে যায়। ঔপনিবেশিকরা দেখল, তারা মুসলমানদের সংখ্যা কমাতে গিয়ে বেশিই করে ফেলেছে। এরপর ঔপনিবেশিকরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করল তাতে মুসলিম সমাজ খণ্ড-বিখণ্ড ও বিছিন্ন হয়ে পড়ল। মুসলমানদেরকে তারা আরব ও আরব-আফ্রিকী উপমহাদেশীয়, সোহাইলি, আফ্রিকান লোকাল-এই চার ভাগে ভাগ করে শহর ও শহরের উপকণ্ঠের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে নতুন করে বসতি-স্থাপন করতে তাদের বাধ্য করে। গ্রুপগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক ও যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হলো। মুসলমানদের ধর্মপ্রচারের কোনো সুযোগ রাখা হলো না। অতঃপর বাইরে থেকে আনা হতে থাকল প্রচুর সংখ্যক লোক। এভাবেই বুজুমবুরায় মুসলমানরা পরিণত হলো সংখ্যালঘু সমাজে। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার সময় বুজুমবুরায় মোট জন সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার। এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ থেকে ১৪ হাজার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুজুমবুরায় আমাদের সালিহ-আসমানি পরিবার কিন্তু শুরুতে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। শাকির সাঈদ বলল।
‘আরব ও আফ্রো-আরব বংশোদ্ভূতদের স্থান পরিবর্তন হয়নি। শুরু থেকেই তাদের অধিকাংশের বসতি ছিল লেকের তীর এবং প্রশাসনিক জোনের মাঝখানে। এখনও তাই আছে। তবে ঐ এলাকায় সোহাইলি, আফ্রিকি, ও উপমহাদেশীয় মুসলমান যারা ছিল, তাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং অন্যসব এলাকা আরব ও আফ্রো-আরব বংশোদ্ভূতদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
রায়া রায়হানা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সে বলে উঠল, ‘দুঃখিত কথার মাঝখানে এসে পড়ার জন্যে। বাবার একটা টেলিফোন এসেছে।
‘আমি উঠছি জনাব। একটু বাইরে বেরুব, তৈরি হতে হবে।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
শাকির সাঈদও উঠে দাঁড়িয়েছিল। রায়া রায়হানা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার আপনি তৈরি হোন। আমি রাদওয়ানকে বলছি, সে আপনার সাথে যাবে।
‘ধন্যবাদ মা। মেহমানের প্রতি এভাবে খেয়াল রেখ। একা যেন উনি না বের হন। আমি ও তোমার মা এখনি বুজুমবুরা যাচ্ছি। মেহমানও যাবেন। তাঁর কিছু কাজ আছে এখানে। শেষ করেই উনি যাবেন।’ বলল শাকির সাঈদ।
‘জনাব আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছেন আপনারা। সব সময়–একাই চলা আমার অভ্যেস।’ আহমদ মুসা বলল।
‘একা থাকলে একাই চলতে হবে। কিন্তু সব সময় একরকম নয়। আল্লাহ যখন যে সময় ও সুযোগ দেন তা গ্রহণ করতে হবে।’ বলল রায়া রায়হানা।
‘ধন্যবাদ বোন।’ বলে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে পা বাড়াল।
রায়া রায়হানা এবং তার বাবা চলল ভেতর বাড়ির দিকে।
২
আহমদ মুসা বুজুমবুরার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে পার্কিং-এ এসে গাড়িতে উঠল। এটা ম্যাকাওদের দেয়া সেই গাড়িটাই।
গাড়ির সিটে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নিল। চোখে-মুখে তার কিছুটা ক্লান্তির চিহ্ন।
ভোরে ইউজিজি থেকে যাত্রা করে সকাল আটটায় এসে পৌঁছেছে সে বুজুমবুরায়। সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে সে চীন, মার্কিন, রুশ, সৌদি আরব ও মধ্যএশিয়ার দূতাবাসে গেছে। বুজুমবুরা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছে। নতুন কিছু বিষয়ে তাদের সাথে মত বিনিময় করেছে। সব শেষে সে এসেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার এখানে। সবচেয়ে বড় কাজ ছিল তার অস্ত্রগুলোর অ্যাক্রেডিটেশন নেয়া। দেশীয় ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা কর্মীদের বাইরে কাউকে এ ধরনের অ্যাক্রেডিটেশন দিতে হলে সরকার প্রধানের সম্মতি লাগে। এ নিয়ে আহমদ মুসার কোনো অসুবিধা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবী মোনিমনা আহমদ মুসার নাম শুনেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘বসুন জনাব। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে আপনার ব্যাপারে আমাকে বলেছেন।’
হ্যান্ডশেক করে আহমদ মুসা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই বসে পড়ে।
‘জনাব, ফরমালিটি ও প্রয়োজনীয় স্পেসিফিকেশনের জন্য কাগজপত্র একটু দেখতে হয়।’ আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘অবশ্যই জনাব।’ বলে পকেট থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘অস্ত্রগুলো?’
‘প্রয়োজন নেই। তবে আপনি একটু কষ্ট করলে, আমার আনন্দ হতো, অস্ত্রগুলো আমি দেখার সুযোগ পেতাম। আপনার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে অনেক কথা বলেছেন। আপনি আমাদের রাষ্ট্রের মেহমান হলে তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু আপনি নাকি স্বাধীনভাবে থাকতেই পছন্দ করেন। এমনকি আমেরিকা, রাশিয়া, চীনেও নাকি আপনি এভাবেই থেকেছেন।’ বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘স্বাধীনভাবে থাকা সবারই পছন্দ। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘কিন্তু জনাব, সব মানুষ স্বাধীন হলে বা স্বাধীন থাকতে চাইলে তো বিপদ।’ বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘মানুষ কোনো ব্যক্তির নয়, আইনের অধীন হবে। তাহলে আর কোনো বিপদের ভয় থাকে না।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে-মুখে বিস্ময় ও প্রশংসার জড়াজড়ি। বলেছিল সে, ‘জনাব, আপনি খুব ভারি কথা বলেছেন, খুব সাংঘাতিক কথা বলেছেন। আমাদের বাস এমন এক সমাজে যেখানে আমি এবং আমরা এ কথা বলিও না, মানিও না। অথচ এটাই দরকার ছিল। আপনাকে ধন্যবাদ জনাব।’
আহমদ মুসা কাগজপত্র এবং তার অস্ত্রগুলো বের করে টেবিলে রেখেছিল।
‘ধন্যবাদ’ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঝুঁকে পড়ে অস্ত্রগুলো এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘বলেছি না জনাব। অস্ত্রগুলো দেখলে আমি খুশি হবো। এ অস্ত্র তিনটির প্রত্যেকটিই আমাদের কাছে নতুন। এর কোনোটিই আমাদের দেশে এখনও আসেনি। এম-১০ আমাদের আছে, কিন্তু এম-১৬ আমরা ছবিতে দেখেছি। এখনও পাইনি। আর রিভলভার দুটির নামও আমার অজানা।’
কথা শেষ করেই ইন্টারকমে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ডেকে এনে এখনি অস্ত্র তিনটির অ্যাক্রেডিটেশন করে দেবার নির্দেশ দিয়ে কাগজপত্র তার হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
নাস্তা শেষ হবার আগেই অ্যাক্রেডিটেশন এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসার গাড়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল।
আহমদ মুসার গন্তব্য এখন ইউজিজির শাকির সাঈদ-এর ভাই আসমানি আব্দুল্লাহর বাসা। আসুমানি আব্দুল্লাহ আসুমানি-সালিহ পরিবারের নিহত দুই মেয়ের বাবা।
ওদের বাসা বুজুমবুরা নগরীর পশ্চিমাংশে লেকভিউ এভিনিউয়ের ফোর্ট কর্নারে, লেকভিউ এভিনিউ ও আসুমানি-সালিহ রোডের মিলনস্থলে। এই ঠিকানাই শাকির সাঈদ তাকে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস, পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্ট হাউসসহ সকল সরকারি অফিস একই এলাকায়। এখান থেকে লেকভিউ এভিনিউ- এর ফোর্ট কর্নার সোজা পশ্চিমে। আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যে সড়কে উঠেছে, সেটা সেন্ট্রাল এভিনিউ। এই এভিনিউ পশ্চিমে এগিয়ে মিশেছে গিয়ে লেকভিউ এভিনিউতে।
চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
সামনেই একটা পার্ক এলাকা আহমদ মুসা দেখতে পেল।
পার্কটা এভিনিউ-এর দুপাশ নিয়ে বিস্তৃত। পার্কের মধ্যে দিয়ে একটা লেক। এভিনিউয়ের উপর একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। লেকের উপর দিয়েই ব্রিজটা। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বেশি নয়। আর এভিনিউটাও বেশ প্রশস্ত।
এভিনিউ-এর এপাশটা যাওয়ার, ওপাশটা আসার। মাঝে মার্কিং ছাড়া কোনো ডিভাইডার নেই।
পার্কের এরিয়া শুরু হয়েছে। রাস্তার ব্রিজটা সামনেই।
হঠাৎ একটা পাজেরো রং সাইড দিয়ে আহমদ মুসার গাড়িকে ওভারটেক করে রাস্তার মাঝের মার্কিং ডিঙিয়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে পড়ল।
ওপাশের রাস্তা দিয়ে একটা কার পূর্ব দিকে আসছিল। পাজেরোটি রাস্তার ওপাশে পড়েই ছুটে গিয়ে কারটির সামনে গিয়ে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল।
অ্যাকসিডেন্ট এড়ানোর জন্যে কারটি থেমে গিয়েছিল।
পাজেরোটি কারটির রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াবার সংগে সংগেই পাজেরো থেকে চারজন লোক বেরিয়ে ছুটল কারটির দিকে। তাদের তিনজনের হাতে রিভলভার, এক জনের হাতে হাতুড়ি। কারটির পাশে গিয়ে তারা ঝড়ের গতিতে গাড়ির জানালা ভেঙে দরজা খুলে একটা মেয়েকে টেনে বের করে আনল।
কার থেকে মধ্যবয়সী একজন পুরুষ বেরিয়ে মেয়েটিকে রক্ষার চেষ্টা করছিল।
সন্ত্রাসীদের একজন তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলল, ‘আর এক পা এগোলে বা চিৎকার করলে মাথা গুঁড়ো করে দেব।’
কিন্তু মেয়েটি বাঁচার জন্যে চিৎকার করছিল।
রং সাইড দিয়ে ওভারটেক করা পাজেরোর অস্বাভাবিক ছুটার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আহমদ মুসার গতি স্লো হয়ে গিয়েছিল। কারটি ভাংচুর এবং একজন মেয়েকে ছিনিয়ে আনতে দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেল আহমদ মুসার কাছে।
দ্রুত আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পাজেরোর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। জ্যাকেটের পকেটে অটো-রিভলভারের ট্রিগার বোতামে আঙুল রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে পাজেরোর কাছাকাছি ওরা পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমেই ধীর গলায় কঠোর স্বরে নির্দেশ দিল, ‘মেয়েটিকে ছেড়ে দাও তোমরা।’
আহমদ মুসার নির্দেশ শুনে চারজনই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। এ সময় পাজেরোর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ এলো। আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে একটা রিভলভারের নল দেখতে পেল ড্রাইভিং সিটের বিপরীত পাশের জানালা দিয়ে।
আহমদ মুসার চোখের পলক ওদিকে পড়ার সাথে সাথেই তার জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলভার নিয়ে হাতটাও বেরিয়ে এসেছিল এবং টার্গেটে উঠে আসতে পলকমাত্রও দেরি হয়নি। আর সেই সাথে আহমদ মুসা বসেও পড়েছিল চারটি রিভলভারের সহজ টার্গেট হওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
বসার সময়ই আহমদ মুসা পাজেরোর ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটিকে গুলি করেছিল। তার দিক কোনো গুলি আসেনি। কিন্তু আহমদ মুসা বসে পড়ার সাথে সাথেই গুলি এসেছিল মেয়েটিকে ধরে নিয়ে আসা লোকদের দিক থেকে। আহমদ মুসা বসে পড়ায় তিনটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
ওরা আর দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ পেল না।
আহমদ মুসা পাজেরোর ড্রাইভিং সিটের লোকটিকে গুলি করেই রিভলভার ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ওদের রিভলভারের প্রথমগুলির ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আহমদ মুসার অটো-রিভলভারের তিনটি গুলি প্রায় এক সাথেই আঘাত করেছিল রিভলভারধারী তিনজনকে।
হাতুড়িধারী চতুর্থজন পকেট থেকে বের করে এনেছিল ক্ষুদ্রাকৃতির হাত বোমা। আহমদ মুসার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্যে হাত উপরে উঠাচ্ছিল। ওদিকে টার্গেট করা আহমদ মুসার অটো রিভলভার তাকে বোমা ছোঁড়ার সুযোগ দিল না। পঞ্চমগুলিটা ঠিক কপালে গিয়ে বিদ্ধ হলো লোকটির।
বাইশ তেইশ বছরের অনিন্দ্য সুন্দর এক তরুণী ভয়-আতংকে কুঁকড়ে গিয়ে বসে পড়েছিল। তার মাথার হিজাব, মুখের নেকাব, গায়ের ওড়না রাস্তায় ছিটিয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা একবারই মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর ছুটে গিয়ে হিজাব, নেকাব, ওড়না কুড়িয়ে নিয়ে ওগুলো ভয়, আতংকে বোধহীন বোবার মতো দাঁড়ানো মধ্যবয়সী লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনি কি ওর বাবা?
এগুলো ওকে পরতে দিন, গাড়িতে নিয়ে আসুন ওকে।’
স্বগতোক্তির মতো লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ওর বাবা। কি ঘটল, কেন ঘটল এসব?’ অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনা গেল তার কণ্ঠ।
লোকটি গিয়ে মেয়েটিকে ওড়না দিয়ে ঢেকে দিল। বলল, ‘উঠে দাঁড়াও মা। এগুলো পরে নাও।’
এ সময় কয়েকজন পুলিশকে ছুটে আসতে দেখা গেল।
তাদের কারও হাতে স্টেনগান, কারও হাতে রিভলভার।
এসে তারা মহাব্যস্ত হয়ে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল।
রিভলভার হাতে একজন অফিসার চারদিকটা দেখে নিয়ে অনেকটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই বলল, ‘পাঁচজনই তো গুলিতে মারা গেছে! কে এদের মারল?’
কথা শেষ করার পরই পুলিশ অফিসারের চোখ এসে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ হলো। তার তীব্র চোখের চাহনিতে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি।
‘মি. অফিসার, আপনার তো প্রথমেই জানা উচিত কি ঘটেছে এখানে।
বলল শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘পাঁচজন নিহত, তাও আবার গুলিতে। এটাই তো বড় ঘটনা।
‘না মি. অফিসার। এই ঘটনার আগে বড় ঘটনা ঘটেছে, পরের এই ঘটনা আগের ঘটনার অপরিহার্য ফলশ্রুতি।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল মেয়ের বাবার দিকে। বিপর্যস্ত মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে। এগোলো পুলিশ অফিসার তার দিকে। বলল, ‘আপনি কি মেয়ের বাবা? মেয়েটিকে কি ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল?’
হ্যাঁ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। আমি মেয়েকে নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ি এখানে পৌঁছলে এই ঘটনা ঘটে।
বলে মেয়ের বাবা মধ্যবয়সী লোকটি যা ঘটেছে তার বিররণ দিল সংক্ষেপে।
ঘটনার বিবরণ শেষ হলে পুলিশ অফিসার তাকাল পুলিশদের দিকে। জানতে চাইল সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি শেষ কিনা। পুলিশরা হ্যাঁ জবাব দিল। পুলিশ অফিসার লাশগুলো এবং আলামত হিসাবে তাদের অস্ত্র ও গাড়ি থানায় নিতে বলল।
পুলিশ অফিসার ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘যে রিভলভার দিয়ে মানুষ মেরেছেন, সেটা কোথায় বের করুন।
রিভলভার বের করতে করতে আহমদ মুসা বলল, ‘মানুষ নয় সন্ত্রাসী মেরেছি।’
পুলিশ অফিসার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে ক্রোধের চিহ্ন।
আহমদ মুসা তাকে রিভলভার দেখাল।
রিভলভার দেখে চমকে উঠল পুলিশ অফিসার। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘এ অস্ত্র কোথায় পেলেন? এ অস্ত্র তো এদেশে পাওয়া যায় না, এমনকি দুনিয়ার কোনো বাজারেও পাওয়া যায় না। এটা একটা এক্সকুসিভ আমেরিকান অস্ত্র। এ অস্ত্র বৈধ কি না, চোরাই কি না, কাগজপত্র দেখান।
আহমদ মুসা কাগজপত্রসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ দেখাল। চমকে উঠল পুলিশ অফিসার আবার। অসহায়ের মতো তাকাল আহমদ মুসার দিকে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনার ভিসা দেখি?’
আহমদ মুসা পাসপোর্ট দেখাল।
ভিসা দেখে আবার তার চমকে উঠার পালা। একেবারে ভিভিআইপি ভিসা। কোনো দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরাই এ বিশেষ ভিসা পায়।
পুলিশ অফিসার কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যরি স্যার, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। মাফ করবেন।’
পুলিশ অফিসার তাকাল মেয়ের বাবা ও মেয়ের দিকে। বলল, আমাদের সাথে আপনাদের থানায় যেতে হবে। আপনাদের প্রাথমিক স্টেটমেন্ট লিখিত আকারে দরকার।’
পুলিশ অফিসারের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. পুলিশ অফিসার, ওরা এখন বিপর্যন্ত, অপ্রস্তুত। ওদের সিটিজেন আইডি’র কপি তো পেয়েছেন। এই স্টেটমেন্ট পরে বাসায় গিয়ে নিলেও ক্ষতি নেই। প্লিজ, ওদের পুলিশ প্রহরা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিন।’
‘তাতে একটু বিলম্ব হবে। ঠিক আছে স্যার। আপনার একটা কার্ড আমাকে দিন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
আহমদ মুসা তার নেম কার্ড পুলিশ অফিসারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে দরকার হলে কার্ডের কন্ট্যাক্ট নাম্বারে ইনফরমেশন দিলেই আমি পেয়ে যাব।’
কার্ডের দিকে একবার তাকিয়েই পুলিশ অফিসার বলল, ‘স্যার, আপনি দূতাবাস ক্লাব রেস্ট হাউজেই কি থাকছেন?’
‘না, ওখানে থাকছি না, তবে আমাকে পাওয়া যাবে ওখানে টেলিফোন করলে।
বলে আহমদ মুসা তাকাল মেয়ের বাবার দিকে। বলল, ‘পুলিশ আপনাদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব, সন্ত্রাসীদের মোটিভ ও তাদের পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা একটু সাবধানে চলাফিরা করবেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জনাব। আপনার কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য।’ বলল মেয়েটির বাবা।
‘ঠিক বললেন না জনাব। ঋণ আমার কাছে নয়, আল্লাহর কাছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. অফিসার, আমাকে অনুমতি দিন, আমি লাশগুলোকে একটু দেখতে চাই।’
‘ওদের পরিচয় জানতে চান? আমাদের পুলিশরা ওদের সার্চ করেছে। কিছুই পায়নি ওদের কাছে। তবু দেখতে চাইলে দেখুন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘আমার নিছক একটা কৌতূহল এটা, বলে আহমদ মুসা পাঁচটা লাশেরই বাহু ও জ্যাকেট জামার কলার ব্যান্ড পরীক্ষা করল। পাঁচজনেরই কলার ব্যান্ডের ‘মেড ইন’ স্টিকারে আহমদ মুসা একটা ব্ল্যাক ক্রসকে সার্কল করা SCA বর্ণ তিনটি দেখতে পেল।
মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে উঠে দাঁড়াল। ‘কিছু পেলেন স্যার?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘চেষ্টা করলাম।’ বলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসা। বলল, ‘মি. অফিসার, ওদের বাড়িতে পৌঁছানোর কি ব্যবস্থা হলো?’
‘জি স্যার হয়েছে। আমি অনুমতিও নিয়েছি। পুলিশের একটা গাড়ি রেডি। ওদের সাথে যাচ্ছে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি
‘আমিও যাব। তবে আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, সেটাই ভালো হবে স্যার। বুজুমবুরার জন্যে অনেক বড় ঘটনা এটা।’
বলেই পুলিশ অফিসার পুলিশদের লক্ষ্য করে বলল, ‘কুইক, ওদের পৌঁছে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
‘ইয়েস স্যার’ বলে অধস্তন এক পুলিশ অফিসার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মেয়েকে তাদেরকে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে তার গাড়ির দিকে ছুটল।
মেয়ের বাবা মধ্যবয়সী লোকটি আহমদ মুসার দিকে দু’ধাপ এগিয়ে এলো। বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর। জনাব আপনি কে আমি জানি না। আপনার মতো একজন মিরাকল মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ আমার মেয়েকে নতুন জীবন দিয়েছেন। সংকট কবলিত একজন পিতাকে আরও বড় সংকট থেকে বাঁচিয়েছেন। খুশি হতাম আপনাকে অতিথি হিসাবে পেলে, আপনার পরিচয় জানলে।’ কথা শেষ করে মেয়ের বাবা একটি নেম কার্ড আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আহমদ মুসা কার্ডটি হাতে নিল। একটু হাসল। কার্ডটা জ্যাকেটের পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ওটাও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন জনাব।’
‘নিজের ইচ্ছাও চাই জনাব।’ বলল মেয়ের বাবা।
‘আল্লাহর ইচ্ছা হলে বান্দার ইচ্ছা হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল। ‘চাই, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইচ্ছা করুন। অনুমতি দিন, আসি।’ বলল মেয়ের বাবা।
‘আসসালামু আলাইকুম।’ আহমদ মুসা সালাম দিল।
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
সালাম নিয়ে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল গাড়ির দিকে।
তখন কানে এলো ‘আসসালামু আলাইকুম।’ মেয়েটিও সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলার পর মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল গাড়ির দিকে।
বাবা-মেয়ের গাড়ি আগে চলল। পেছনে চলল পুলিশের গাড়ি।
.
একটি মুসলিম মেয়েকে প্রকাশ্য দিবালোকে কিডন্যাপ করার এই ভয়ানক ঘটনা এবং এর সাথে একটা গ্যাং বা গ্রুপ কিংবা কোনো গোপন সংগঠন জড়িত থাকার বিষয়টি আহমদ মুসাকে খুবই চিন্তিত করে ফেলেছিল। কিছু প্রশ্নও তাকে পীড়া দিচ্ছিল। সম্প্রতি কিছু মুসলিম ব্যক্তিত্ব যে নিখোঁজ হচ্ছে, মেধাবী মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী নিহত হচ্ছে, এর সাথে কি এই কিডন্যাপের ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে? এসব কি একই গ্রুপের কাজ? কারা এরা? এদের কি কোনো বিশেষ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় আছে?
এসব চিন্তা মাথায় আসায় আহমদ মুসা বুজুমবুরার কয়েকটা জায়গায় এখনই যাওয়া উচিত বলে মনে করল। কাজগুলো সেরে সে ইউজিজি’র শাকির সাঈদের ভাই আসুমানি আব্দুল্লাহর বাসায় যাবে ঠিক করল।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আহমদ মুসা।
কাজ সারার পর সন্ধ্যা ছয়টায় আহমদ মুসার গাড়ি আসুমানি আব্দুল্লাহর গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর ভেতর বাড়ির বৈঠকখানায় তখন আসমানি আব্দুল্লাহ, তার বাবা শাকির সাঈদ, আসমানি আব্দুল্লাহর মেয়ে সামিরা সাদিয়া এবং শাকির সাঈদ ও আসমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির মহিলারা বসে। সবারই মুখ চোখে দুঃখ ও দুশ্চিন্তার ছায়া।
আসুমানি আব্দুল্লাহ তাকাল শাকির সাঈদের দিকে। বলল, ‘কি বুঝলেন ভাইজান, পুলিশ তো বিষয়টিকে নারীঘটিত কিডন্যাপের ঘটনা হিসাবে সাজাতে চাচ্ছে।’ শুকনো কণ্ঠ আসমানি আব্দুল্লাহর।
‘ঠিক বলেছ। মা সাদিয়াসহ আমাদেরকে তাদের প্রশ্নগুলো অমর্যাদাকর। তাদের সব প্রশ্নেরই লক্ষ্য ঘটনাকে নারীঘটিত বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে নেয়া।’ বলল শাকির সাঈদ। তার কণ্ঠ কাঁপা। খুব বিমূঢ় ভাব চোখে-মুখে।
‘এটাই ওদের জন্যে সহজপথ। ঘটনাকে এভাবে সাজাতে পারলে ওদের দায়-দায়িত্ব অনেকটাই কমে যায়। আমার দুই নাতনির নিহত হওয়ার ঘটনাকেও ঐদিকে ঘুরিয়ে নেবার একটা চেষ্টা ওদের আছে।’ আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ কথাগুলো বলল। দুর্বল কণ্ঠ তার, কিন্তু খুবই স্পষ্ট। সে ইজি চেয়ারে শোয়া অবস্থায় ছিল। কথা বলার জন্যে সে শোয়া থেকে একটু উঠেছিল।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বুজুমবুরার একজন প্রধান সম্মানিত নাগরিক।
তাকে শুধু বুজুমবুরা নয়, গোটা বুরুন্ডির মুসলিম কমিউনিটির একজন মুখপাত্র বলে মনে করা হয়।
‘আব্বাজান, আপনি আমাদের বিষয়টা নিয়ে একবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বললে ভালো হয় না?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘ইতিমধ্যেই তাঁর সাথে কথা বলেছি আব্দুল্লাহ। তিনি বিষয়টি জানেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত থাকার মতো কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি দেখবেন বলেছেন। তিনি বললেন তারা বড় মুসিবতে আছেন। কিডন্যাপ হওয়া, নিখোঁজ হওয়া, নিহত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। অথচ কোনো ঘটনার সুরাহা হচ্ছে না। আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
এই হতাশার সুরে সবার মুখ মলিন হয়ে পড়ল।
কারও মুখে কোনো কথা নেই।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘শাকির তুমি যে আহমদ মুসার কথা বললে তার খবর কি?’
‘তিনি আসবেন চাচাজান। আমি না এলেও তিনি এখানে আসতেন।’ বলল শাকির সাঈদ।
ভাইজান, আপনি বলেছিলেন বুরুন্ডিসহ লেক ট্যাংগানিকা অঞ্চলের মুসলমানদের হত্যা, গুম ও সংকট নিয়ে কাজ করার জন্যেই তিনি এসেছেন। কিন্তু তিনি তো একা। তিনি কি সরকারের সাথে মিলে কাজ করবেন?’ শাকির সাঈদকে লক্ষ্য করে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। তিনি নিজে থেকে যা বলেন তার বেশি জিজ্ঞাসা করতে আমার খুব সংকোচ বোধ হয়। অসাধারণ এক কিংবদন্তী তিনি।’ শাকির সাঈদ বলল।
‘বাবা তিনি একাই কাজ করেন। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় তিনি একাই অসাধ্য সাধন করেছেন। অন্য সব ক্ষেত্রেও এমনটাই আমি পড়েছি।’ বলল সামিরা সাদিয়া, আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে, বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপিকা বলল।
‘তুমি তো দেখি তার সম্পর্কে অনেক কিছু জান।’ শাকির সাঈদ
‘জানতাম না। তাঁর নামটাই জানতাম মাত্র। তিনি আসছেন, একথা আপনার কাছ থেকে শোনার পর আমি ইন্টারনেট সার্চ করে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছি। আপনি তাঁকে কিংবদন্তী বলেছেন, সত্যি এ বিশেষণ তাঁকেই মানায়।’
‘সবই আল্লাহর কাজ বোন। তিনিই যাকে দিয়ে যা ইচ্ছা করান।’
একটু থেমেই সামিরা সাদিয়ার দাদা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ছেলে আসুমানি আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যে লোকটি সাদিয়া বোনকে উদ্ধার করল, তার নাম-ঠিকানা কি রেখেছ?’
‘না আব্বাজান, সে সুযোগ পাইনি। অদ্ভুত লোক তিনি। নিশ্চয় বড় কেউ হবেন। প্রথম দিকে পুলিশ তার সাথে বলা যায় খারাপ ব্যবহারই করেছিল। কিন্তু তার কাগজপত্র দেখে তাঁকে স্যার বলা শুরু করল। অভিভাবকের মতোই তিনি পুলিশকে এবং আমাদেরকে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয়নি, সাহসও পাইনি। তাকে আমার কার্ড দিতে পেরেছি। কিন্তু কার্ডটি তিনি না দেখেই জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিয়েছেন।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘বাবা, আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছ, তিনি যে রিভলভার ব্যবহার করেছেন, তা দুনিয়ার কোথাও কোনো বাজারে বিক্রি হয় না। মার্কিন সামরিক অফিসার ও তাদের গোয়েন্দাদের ওটা এক্সক্লুসিভ অস্ত্র। অস্ত্রটি চোরাই নয়, বৈধ কাগজপত্র আছে, তা পুলিশ দেখেছে। আরেকটা বিষয়ও খুব উল্লেখযোগ্য বাবা, বুজুমবুরার দূতাবাস ক্লাবের টেলিফোন তাঁর কনট্যাক্ট নাম্বার।’ সামিরা সাদিয়া বলল।
‘অদ্ভুত! এমন লোক তো আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কেমন দেখতে লোকটি?’ বলল শাকির সাঈদ।
‘লম্বা, ফর্সা, একহারা, সুঠাম চেহারা। মাথার চুল বড় নয়, খুব ছোটও নয়। বয়স অনুমান করতে পারছি না। এ ধরনের ফিট শরীরের লোকদের যা বয়স হয়, তার চেয়ে সব সময় পাঁচ-দশ বছর কম মনে হয়।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘মনে আছে পায়ের জুতা কেমন? চোখ দু’টো কেমন দেখতে?’ বলল শাকির সাঈদ।
‘অতটা খেয়াল করতে পারিনি ঐ সময় ভাইজান।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘বড় চাচাজান, তাঁর জুতা ব্রাউন এবং কিছুটা পয়েন্টেড। আর গুলিগোলা শেষ হলে একবারই মাত্র তিনি আমার দিকে চোখ তুলেছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিকে তখন স্থির গভীর, শান্ত ও লাজুক মনে হয়েছে আমার কাছে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘মিলে গেছে। নিশ্চিতই তিনি আহমদ মুসা।’ শাকির সাঈদ বলল। বলার সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রবল এক উচ্ছ্বাস তার বেরিয়ে এলো।
শাকির সাঈদের হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই বাইরের দরজায় নক হওয়ার শব্দ ভেসে এলো।
উৎকর্ণ হলো আসুমানি আব্দুল্লাহ।
সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। এ সময় তার স্কুল পড়ুয়া ছোট ছেলে আমর আসুখানি মোহাম্মদ ছুটে এসে বলল, ‘গেটের পুলিশ ডাকছেন।
ঐ বাড়ির দুই মেয়ে নিহত হওয়ার পর থেকে গেটে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে।
‘দেখছি, ধন্যবাদ।’
বলে আসুমানি আব্দুল্লাহ পা বাড়াল যাবার জন্যে।
‘চল আমিও যাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল শাকির সাঈদও।
সবার চোখে-মুখেই প্রশ্ন, নতুন আশংকা।
দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই আসুমানি আব্দুল্লাহ গেটের বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো দেখল কিডন্যাপারদের হাত থেকে তাদের বাঁচানো সেই লোকটিকে। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা শেষ হতেই ছুটল আসুমানি আব্দুল্লাহ গেটের দিকে।
শাকির সাঈদও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সে দেখতে পেল গেটের বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো আহমদ মুসাকে। ছুটল সেও। তারপর পরিচয়, বিস্ময়, আনন্দ ও কুলাকুলির পালা, যেন ঈদের খুশি।
আহমদ মুসার গাড়ি ভেতরে নিয়ে আসার কথা বলে শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে নিয়ে চলল ভেতরে। আসুমানি আব্দুল্লাহ খবরটা জানাবার জন্যে ইতিমধ্যেই ভেতরে চলে গেছে।
শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে নিয়ে বাইরের বৈঠকখানাতেই বসতে যাচ্ছিল।
আসমানি আব্দুল্লাহ এ সময় এলো। বলল, ‘এখানে নয়, আব্বাজান বলেছেন মেহমানকে ভেতরের বৈঠকখানায় নিয়ে যেতে।’
সবাই চলল ভেতরের বৈঠকখানায়। ভেতরের বৈঠকখানাও বেশ বড়। দুই সেট সোফা ছাড়াও বসার কুশন আছে বেশ কয়েকটা। এ ছাড়া আরেকটা সুবিধা এখানে আছে। মেয়েদের বসার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে। মাঝখানে পাতলা একটা স্ক্রিন টাঙানো। বৈঠকখানায় মেয়েদের অংশটাতেও দুইটা সোফাসেটসহ বসার কুশন রয়েছে। দুই পাশেই রয়েছে সমান সংখ্যক সিট। একটু বড় ফ্যামিলি গ্যাদারিং হলে পর্দা রক্ষা করে তা এখানে করা যায়।
বৈঠকখানায় ঢুকে শাকির সাঈদ আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে পরিচয় করিয়ে দিল আহমদ মুসার সাথে।
আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ডশেক করে তার ইজি চেয়ারের পাশেই কার্পেটের উপর বসে পড়ল কথা বলতে বলতে।
‘কি করছ বাবা তুমি! তুমি হলে আমাদের মাথার মুকুট! তুমি নিচে কার্পেটে বসবে কেন?’ বলে মাথা তুলে উঠতে চেষ্টা করল ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘ছেলেকে ছেলে হিসাবেই দেখুন, সেটাই উচিত।’
‘কিন্তু বাবা, বড়কে বড় বলাই তার হক।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘কিন্তু সেটা তার সামনে নয় জনাব। সামনে বলাটা তার জন্যে জুলুম। আহমদ মুসা বলল।
বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ একটু নীরব হলো। ভাবল একটু। বলল, ‘বাবা তুমি গভীর জ্ঞানের কথা বলেছ। রাসুল (স.)-এর একটা হাদিসের দিকে তুমি ইংগিত করেছ। শুনি এবং জানি, সংগ্রাম-সংঘাত নিয়ে তুমি থাক। এমন গভীর ভাবনার সময় কখন পাও তুমি?’
‘জনাব আমি প্রথমে আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল (স.)-এর উম্মত। তারপর অন্য সব কিছু।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই যে তোমার ‘অন্য সব কিছু।’ এগুলো কি তোমার আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল (স.)-এর উম্মত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘না জনাব। আমার এই ‘অন্য সব কিছু’ আল্লাহর আদেশ- ‘তা’মরুনা বিল মা’রুফ’ এবং ‘তান হাওনা আনিল মুনকার’-এর মধ্যে পড়ে৷’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
আসুমানি আব্দুল্লাহ বৈঠকখানায় ঢুকে বলে উঠল, ‘জনাব, খাবার টেবিলে আপনার নাস্তা দেয়া হয়েছে।’
একটু থেমেই আসুমানি আব্দুল্লাহ আবার বলে উঠল, ‘জনাব স্ক্রিনের ওপারে বৈঠকখানার ঐ অংশে আমার মা, আমার স্ত্রী, শাকির ভাইজানের স্ত্রী এবং আমার বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া রয়েছে। তারা সকলে আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর আমার আম্মা জানতে চেয়েছেন, আপনি দুপুরে খেয়েছেন কিনা?’
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলল আহমদ মুসা। একটু থামল, একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জনাব আব্দুল্লাহ আপনার মা আমাকে মায়ের মতোই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু খুব ভালো উত্তর আমি দিতে পারছি না। মুসলিম হোটেল কিংবা ভালো হোটেল খোঁজার ঝামেলায় আমি যেতে পারিনি। আমার ব্যাগে দু’টো সিদ্ধ ডিম ছিল, একটা আপেল ছিল। এসবই একটা পার্কে বসে খেয়ে নিয়েছি। যোহরের নামাজের জন্যে পথের পাশে একটি পার্কে গিয়েছিলাম।’
‘আল্লাহু আকবর। সব অবস্থার সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেন। যাও বাবা নাস্তা সেরে এসো।’ বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আমরা ঘণ্টা খানেক আগে বিকেলের নাস্তা সেরেছি।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা ও আসুমানি আব্দুল্লাহ বেরিয়ে গেল বৈঠকখানা থেকে।
তারা বেরিয়ে যেতেই স্ক্রিন সরিয়ে সামিরা সাদিয়া তার দাদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দাদাজী, স্যারকে জিজ্ঞাসা করবেন তো বেলা দশটায় আমাদের ঘটনার পর বিকেল পর্যন্ত উনি কি করেছেন? ভালো হোটেল বা মুসলিম হোটেল খুঁজে পাননি কেন? আরেকটা বিষয় দাদাজী, ঘটনায় পাঁচজন সন্ত্রাসী যারা নিহত হয়েছিল, তাদের বাহু, জামার হাতা, কলার তিনি উল্টে-পাল্টে পরীক্ষা করেছেন। তাঁকে খুশি মনে হয়েছিল। কি পেয়েছিলেন তিনি? এ ব্যাপারে পুলিশের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন তিনি।’
‘তোমার প্রশ্নগুলোও তো গোয়েন্দাদের মতো। তুমি এত কিছু খেয়াল করেছ? তুমিই প্রশ্নগুলো তাকে কর না বোন।’ বলল সামিরা সাদিয়ার দাদা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘এত প্রশ্ন করা মানায় না আমার জন্যে দাদাজী।’ সামিরা সাদিয়া বলল। তার মুখ জুড়ে লজ্জার ছাপ।
‘কেন? তুমি না অধ্যাপিকা? ছাত্র-ছাত্রীদের তো কত প্রশ্ন করতে হয়। উত্তর দিতে হয়।’ বলল সামিরা সাদিয়ার দাদা।
‘উনি কি আমার ছাত্র-ছাত্রী দাদাজী! প্রশ্ন করা তো দূরে থাক, দু’একটা জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে গেলেও তো বুক কাঁপার কথা।
‘এত আপন, এত সাধারণ সে! তাকে ভয় করলে তোমার ভয় করার বাইরে আর কে থাকে শুনি?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, সাদিয়ার দাদা।
‘এত সাধারণের মধ্যে অতি অসাধারণ তিনি। ভয়ের কারণ তো এখানেই দাদাজী।’ সামিরা সাদিয়া বলল। তার কণ্ঠে আবেগের কম্পন।
সামিরা সাদিয়ার দাদাজী ইদি আসুমানি মোহাম্মদ চোখ তুলে তাকাল নাতনীর দিকে। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘তোমার কথাই হয়তো ঠিক বোন, কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, চীনের প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞীর প্রিয়পাত্র হবার কারণে বিন্দুমাত্র অহংকার তার মধ্যে থাকলে আমার মতো এক বৃদ্ধের পায়ের কাছে কার্পেটে সে বসতে পারতো না। এটাই বাস্তবতা বোন।’
‘এই বাস্তবতা একজনকে আকাশের মতো উঁচু করে দাদাজী।’ বলল সামিরা সাদিয়া। তার কণ্ঠের আবেগের সেই কম্পন এবার আরও গভীর।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। কিন্তু কথা আটকে গেল। ঘরে ঢুকছে তখন আহমদ মুসা এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ।
বৈঠকখানার মধ্যেকার স্ক্রিন টেনে দিয়েছে সামিরা সাদিয়া দ্রুত উঠে এসে।
ঘরে ঢুকেই সালাম দিয়েছে আহমদ মুসা। বসল গিয়ে ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহর সামনের এক সোফায়। শাকির সাঈদ ও আসমানি আব্দুল্লাহ বসল আরেক সোফায়।
‘ভাই আহমদ মুসা, খেতে পারলে আমাদের গ্রামীণ নাস্তা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘জনাব জিজ্ঞেস করুন আপনার ছেলেকে টেবিলে কোনো খাবার আমি রেখে এসেছি কিনা।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। দেহের একটা হক আছে, তা পূরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তোমাকে ধন্যবাদ।’
কথাটা শেষ করে একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহ, ‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার কাছে দুটি প্রশ্ন এসেছে আমার বোন সামিরা সাদিয়ার তরফ থেকে। তুমি কি তাকে জান?’
‘এই মাত্র আপনার কাছে তার নাম শুনলাম। তিনি বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। তাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা হচ্ছিল। তিনি আপনার নাতনী, জনাব আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে। তার ছোট দুইবোন দুইদিন আগে গাড়ি চাপায় নিহত হয়েছে বাড়ির গেটের সামনে। এবার তার প্রশ্নগুলো বলুন জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তার প্রথম প্রশ্ন হলো, আজ সকালের ঘটনার পর বিকেল পর্যন্ত একটা ভালো হোটেল বা মুসলিম হোটেল খুঁজে না পাবার কারণ কি? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, নিহত পাঁচজন সন্ত্রাসীকে সার্চ করে নিশ্চয় তুমি কিছু পেয়েছ, সেটা কি? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর না বলার মতো হলে অবশ্যই বলবে না। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার নাতনীর বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ জনাব। আমি সন্ত্রাসীদের সার্চ করে কিছু পেয়েছি, এটা পুলিশ বুঝতে পারেনি, কিন্তু আপনার নাতনী বুঝতে পেরেছেন।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘প্রশ্ন দু’টির মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন থেকেই শুরু করি। আমি মৃত সন্ত্রাসীদের কলার ব্যান্ডের ‘মেড ইন’ স্টিকার থেকে সন্ত্রাসীদের একটা প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। প্রতীকটিতে একটা সিম্বল ছিল এবং তিনটি ইংরেজি বর্ণ ছিল। বর্ণগুলোর অর্থ খুঁজে পেতে দেরি হয়। আর খোঁজাখুঁজি করতেও দীর্ঘ সময় পার হয়। এভাবেই বিকেল হয়ে যায়। থামল আহমদ মুসা।
একটু নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, ‘এভাবে না খেয়েদেয়ে আজই কি প্রয়োজন ছিল খোঁজাখুঁজির?’
‘একটা বড় সমস্যা সামনে এলে তখনি তার সমাধান আমার কাছে জরুরি মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সমস্যা কি খুব বড় ছিল?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘অবশ্যই বড়। সন্ত্রাসীরা কারা, তারা একটা বড় দল বা গ্রুপ কি না, এ সবের কিছুটা বা সবটা জানা যাবে প্রতীক মনোগ্রাম থেকে। সুতরাং কাজটা খুব বড় ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার কৌতূহল হচ্ছে, জাদুঘর থেকে আপনি কি কিছু পেয়েছেন?’ জিজ্ঞাসা করল শাকির সাঈদ।
‘এক হিসেবে বলা যায়, কিছুই পাইনি, আবার বলা যায় কিছু পেয়েছি। যে সিম্বল ও তার তিনটি ইংরেজি বর্ণের অর্থ খুঁজতে আমি জাদুঘরে গিয়েছিলাম, তার অর্থ আমি পাইনি। তবে দুনিয়ার কয়েকটা দেশে | অনুরূপ সিম্বল এবং একটু ভিন্ন কম্বিনেশনের তিনটি ইংরেজি বর্ণ পেয়েছি। আজ সন্ত্রাসীদের কাছে যে তিনটি বর্ণ পেয়েছি তা হলো SCA, ল্যাটিন আমেরিকায় অনুরূপ সিম্বলের সাথে যে ইংরেজি বর্ণ পেয়েছি, সেটা SCLA, আবার ইন্দোচীনে একই ধরনের সিম্বলের সাথে SIC কম্বিনেশনে তিনটি ইংরেজি বর্ণ পাওয়া গেছে। প্যাসেফিকের কিছু দ্বীপপুঞ্জ এবং ককেশাস অঞ্চলেও এই ধরনের সিম্বল এবং ইংরেজি বর্ণের কম্বিনেশন খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আফ্রিকায় এ ধরনের সিম্বল ও ইংরেজি বর্ণের কম্বিনেশন পাওয়া গেল না।’ থামল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আজ সন্ত্রাসী ঘটনায় এই সিম্বল ও ইংরেজি বর্ণমালার কম্বিনেশন তো পাওয়া গেল। বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘এই পরিচয়ের গ্রুপ বা সন্ত্রাসী সংগঠন আফ্রিকায় পুরানো নয়, এ জন্যেই অথবা তাদের নাম পরিচয় ও কাজ কোনো ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়নি বলেই জাদুঘরে তা রেকর্ড হবার সুযোগ হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা। ‘আজকের সন্ত্রাসীদের স্টিকারে পাওয়া সিম্বল এবং SCA বর্ণগুলোর নিশ্চয় আপনি অর্থ করেছেন? কি সেটা?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘সর্বদিক বিচার করে একটা অর্থে আমি পৌঁছেছি। দেখুন, বিভিন্ন দেশের যে সিম্বলগুলোর কথা আমি বললাম, প্রত্যেক বর্ণ ও কম্বিনেশনের শুরুর বর্ণ হলো S, এই S-এর আমি অর্থ করেছি ‘সেভিয়ার’ (Saviur)। S-এর পরের বর্ণগুলো দেশ বা অঞ্চলের নাম হবে, এটা আমি মনে করেছি। সুতরাং আজ সন্ত্রাসীদের স্টিকার থেকে যে SCA বর্ণ- কম্বিনেশন পাওয়া গেছে, তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’। অনুরূপভাবে ল্যাটিন আমেরিকার SCLA-এর করেছি ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল ল্যাটিন আমেরিকা।’ এভাবে ইন্দোচীনের SIC- এর অর্থ হচ্ছে ‘সেভিয়ার অব ইন্দোচায়না’।
‘সন্ত্রাসীরা সেভিয়ার? পৃথিবীর অন্যান্য অনুরূপ সংগঠনগুলোও কি সন্ত্রাসী?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।
‘নিশ্চিত জানি না। তবে সন্ত্রাসী হওয়ার কথা। এ সংগঠনগুলোর নাম আগে আমি শুনিনি। হতে পারে এগুলো বড় কোনো সংগঠনের ছদ্মবেশী সামরিক উইং। এদের নাম তেমন প্রচার করা হয় না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সর্বনাশ, এরা তাহলে ভয়ংকর। আমাদের শান্তির বুরুন্ডিতে কি করে আসল, কেন আসল? কারা এরা? আজকের SCA সন্ত্রাসীরা কোনো বড় সংগঠনের সামরিক উইং হলে বড় সংগঠনটির কি পরিচয়? নিশ্চয় আপনি ভেবেছেন এ নিয়ে?’ শাকির সাঈদ এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করল। সবার চোখে-মুখেই আতংকের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
SCA বর্ণ সমষ্টির সাথে যে সিম্বল রয়েছে, সে সিম্বলটা হলো ‘ব্ল্যাক ক্রস’, একক একটি ব্ল্যাক ক্রস। ‘ব্ল্যাক ক্রস’ নামক এক সংগঠনকে আমি চিনি। তাদের বিশ্বজোড়া নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং খুবই শক্তিশালী ও বিত্তশালী সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু তাদের সিম্বল তিনটা ব্ল্যাক ক্রস। SCA সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের একটা ছদ্মবেশী ও নতুন উইং হতে পারে অথবা স্বাধীন সংগঠনও হতে পারে এরা। সত্যটা আরও অনুসন্ধান সাপেক্ষ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাদের বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসী সংগঠন বললেন, সেই ব্ল্যাক ক্রস কি আফ্রিকায় কাজ করে?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।
‘মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় ওরা খুবই সক্রিয় ছিল। সেখানে হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে তারা উচ্ছেদ করে, লক্ষ লক্ষ একর মুসলিম ভূমি তারা দখল করে। এই তো দুই সপ্তাহ আগে বুজুমবুরা আসার পথে দারুস সালাম বিমানবন্দরে ওরা আমাকে কিডন্যাপ করে জাম্বিয়ার লুসাকায় নিয়ে যায়। নিজেকে মুক্ত করে সেখান থেকেই তো আমি সড়ক পথে বুজুমবুরায় আসছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল ওরা? আপনার সাথে ওদের শত্রুতা কি?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা বলল, ‘ওরা আমার পুরানো শত্রু। পশ্চিম ইউরোপে ওদের সাথে আমার সংঘাত হয়। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় বাস্তুহারা, সহায়-সম্পদহারা মুসলমানদের পক্ষ নিতে গিয়ে ওদের সাথে আমার সংঘাত বাধে।’
‘স্যার, পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন অঞ্চলে মুসলমানদের সাথে খ্রিস্টানদের যে সংঘাত বাধে, যার পরিণতিতে খ্রিস্টান সংগঠনগুলো মুসলমানদের লাখ লাখ একর সম্পত্তি ফেরত দেয় এবং বাস্তুহারাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসনে বাধ্য হয়, সেই সংগ্রামে কি আপনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? প্রচার মাধ্যমে শুধু সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হয়, সংঘাত- সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের কোনো উল্লেখ ছিল না।’ পর্দার ওপার থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। কণ্ঠটা সামিরা সাদিয়ার।
‘আমি সেখানে ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েই নাম প্রচার করা হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একটু জানতে চাচ্ছি, সেখানে কি কেউ আপনাকে ডেকেছিল? না ইউজিজি, বুজুমবুরায় যেভাবে এসেছেন, সেভাবে ওখানে এসেছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল শাকির সাইদ।
‘সে অনেক কথা। দক্ষিণ ক্যামেরুনের এক বিপদগ্রস্ত যুবককে সাহায্য করতে গিয়ে সমগ্র ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। দক্ষিণ ক্যামেরুনের সব মুসলিম ভূমিই খ্রিস্টানরা দখল করে ফেলেছিল দশ হাজার একরের একটা ফার্ম ছাড়া। নানা প্রলোভন ও শত ভয়-ভীতি দেখানো সত্ত্বেও সেই জমির মালিক খ্রিস্টানদের হাতে সেই জমি তুলে দেয়নি। অবশেষে জমির মালিক গুপ্তহত্যার শিকার হয়। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো এবার ধরে জমির মালিকের ছেলে তরুণ বয়সের ওমর বায়াকে। ভয়ে ওমর বায়া উত্তর ক্যামেরুনে পালিয়ে যায়। সেখানেও গিয়ে হাজির হয় জমি কেনার লোকা। ওমর বায়া প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় ফ্রান্সে। তাকে ধাওয়া করে ফ্রান্সে যায় সেই সন্ত্রাসী লোকরা। একদিন এক হোটেলে বসে আমি খাচ্ছিলাম। সে সময় আমি দেখি এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে কয়েক জন সাদা চামড়ার লোক টেনে-হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে। কিন্তু বাঁচাবার জন্যে কেউ কোথাও থেকে এলো না। আমি গিয়ে যুবকটিকে উদ্ধার করলাম। এর পরে ফ্রান্সেই যুবকটিকে কেন্দ্র করেই ব্ল্যাক ক্রসের সাথে সংঘাত সংঘর্ষের অনেক ঘটনা ঘটে। এই সংঘাত ফ্রান্স থেকে যায় ক্যামেরুনে। দেশজোড়া ঘটনায় রূপ নেয়। শেষে জয় মুসলমানদেরই হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখা যাচ্ছে ব্ল্যাক ক্রস এখনও সাংঘাতিকভাবে সক্রিয়। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল। কেন কিডন্যাপ করেছিল?’ আসমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা তো ওদের একটা থাকবেই। বন্দি অবস্থায় ওদের লোকদের কাছে শুনেছিলাম, আমেরিকার কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে এক বিলিয়ন ডলারে ব্ল্যাক ক্রস আমাকে বিক্রি করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
শাকির সাঈদ, আসুমানি আব্দুল্লাহ সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। ‘এক বিলিয়ন ডলারে কিনে আপনাকে নিয়ে ওরা কি করত?’ জিজ্ঞাসা করল, আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘হতে পারে, হত্যা করে প্রতিশোধ চরিতার্থ করতো।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় বিজড়িত কণ্ঠে আসমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘আপনি সব কিছুই জানেন, ভয় করে না আপনার? এই তো বন্দি হয়েছিলেন। সেখানেই তো আপনার মৃত্যু হতে পারতো!’
‘ভয় আল্লাহকে করি, তাঁর উপরই নির্ভর করি। তাঁর উপর নির্ভরতা থাকলে কোনো ভয়ই আর থাকে না। আর মৃত্যুর ব্যাপার তো একেবারেই আল্লাহর হাতে। তিনি আমার মৃত্যুর দিন ক্ষণ ঠিক করে রেখেছেন। সে সময়টা আসার আগে দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাকে মারতে পারবে না। আর সে সময় এলে আমাকে বাঁচাবার সাধ্য কারও নেই। সুতরাং লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যু ভয় সামনে এনে অহেতুক নিজেকে দুর্বল ও দ্বিধাগ্রস্ত করার প্রয়োজন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
কারও মুখে কোনো কথা নেই।
নীরব সবাই।
এক সময় বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ আধা শোয়া থেকে মাথা তুলে একটু বসল। বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তুমি যা বললে সেটা ঈমানের কথা। এটাই প্রকৃত ঈমানের রূপ। এ ঈমান আমাদের নেই। আবেগে গলা কাঁপছিল বৃদ্ধের।
‘আল্লাহু আকবর। জনাব আহমদ মুসা আপনার মুখ নিঃসৃত কয়েকটা বাক্য আমাদের গোটা জীবন গ্রন্থের সারকথা, আমাদের জীবন-সংগ্রামের জয়-পরাজয়ের মূলমন্ত্র, কিন্তু অত্যন্ত কঠিন আমাদের মতো আ’ম মানুষের জন্যে।’ শাকির সাঈদ বলল।
‘আ’ম বা খাস মানুষ বলে কিছু নেই। আমরা সকলেই আল্লাহর বান্দা। আর আল্লাহ সকল বান্দার জন্যেই রহমান, সকল বান্দার জন্যেই রহিম। আমরা যদি তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলি। সর্বক্ষণ হেদায়েত ও সিরাতুল মুস্তাকিম তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, তাহলে আমাদের ঈমান আমলে আল্লাহ বরকত দান করবেন। তখন আজ যা কঠিন মনে হচ্ছে, তা সহজ হয়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের এমন ঈমান আমলের তৌফিক দিন।
কথাটা শেষ করে একটু থেমেই আসুমানি আব্দুল্লাহ আবার বলে উঠল, ‘জনাব আমরা যে সংকটে পড়েছি, তার সমাধান কীভাবে হবে? আমরা এভাবে টার্গেট হলাম কেন? আমার দুই মেয়েকে দু’দিন আগে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আজ বড় মেয়েকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হলো। আরও কি ঘটবে কে জানে! ওদিকে পুলিশ দুই ঘটনাকেই নারীঘটিত হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করছে। তার মানে আসল অপরাধী তাহলে ধরা পড়বে না এবং আমাদের বিপদও যাবে না। কি করব আমরা বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে আল্লাহ দয়া করে আপনাকে আমাদের মাঝে এনেছেন। মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাদেরকে একটা অবলম্বন জুটিয়ে দিয়েছেন।
থামল আসুমানি আব্দুল্লাহ। তার কণ্ঠ শেষ দিকে ভারি হয়ে উঠেছিল। ‘ঠিক বলেছ আব্দুল্লাহ, আল্লাহ আমাদের একটা অবলম্বন জুটিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া এমন বড় অবলম্বন অসহায় মুসলমানদের জন্যে আর নেই।’
একটু থেমে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ আহমদ মুসার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না ভাই আহমদ মুসা, ব্ল্যাক ক্রস কিংবা ব্ল্যাক ক্রসের কোনো ছদ্মবেশী উইং অথবা কোনো সন্ত্রাসী খ্রিস্টান সংগঠন আমাদের পেছনে লাগবে কেন? আমাদের পরিবার রাজনীতি বা সামাজিক কোনো বিতর্কে নেই। আমাদের পারিবারিক কোনো শত্রু নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও স্কুল কলেজ ও আত্মীয় বাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না, বাইরের কোনো কিছুতেই নেই তারা। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে ভয়ানক শত্রুর সৃষ্টি হলো কি করে?
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল বৃদ্ধের দিকে। তার চোখে-মুখে চিন্তার একটা সুস্পষ্ট প্রকাশ।
বৃদ্ধ থামলেও আহমদ মুসা সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল সে। একটু সময় নিয়ে সে বলল, ‘জনাব সন্ত্রাসীদের পরিচয় নিয়ে আমি চিন্তা করছি, আপনাদের এ বিষয়টা আমি গভীরভাবে ভেবে দেখিনি। তবে শাকির সাইদ সাহেবের বাসায় যখন আপনার দুই নাতনীর নিহত হবার ঘটনা শুনলাম এবং জানলাম যে তারা অত্যন্ত মেধাবী এবং গত অ্যাডভানসড হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় দুই বোন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল, তখন হঠাৎই আমার মনে হয়েছিল মেধাবী হওয়াই তাদের নিহত হবার কারণ কিনা। এই…’
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘আপনি কি এ রকমই মনে করেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহর কণ্ঠে উদ্বেগ। তার এবং উপস্থিত অন্য সকলের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া।
‘আমি ঠিক মনে করি না, কিন্তু সে সময় হঠাৎই আমার মনে হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন মনে হয়েছিল জনাব?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘একাধিক মুসলিম প্রতিভাবান ছাত্র নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আমি পড়েছিলাম সংবাদপত্রে।’ বলল আহমদ মুসা।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, প্রতিভাবান ছাত্র সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই চায়। আপনার মেয়েকে নিয়ে সেরকম কোনো ঘটনার কি সৃষ্টি হয়েছিল?’
‘প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই যোগাযোগ করেছিল। কেউ টেলিফোনে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকরা এসে যোগাযোগ করেছিল এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিল। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন জনাব?’
‘মনে এলো তাই প্রশ্নটা করলাম। আর আমাদেরকে ছোট-বড় সব বিকল্প নিয়েই ভাবা উচিত। অনেক সময় ছোট বিষয় বড় হয়ে দাঁড়ায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাবা,, একটা ঘটনা আছে, প্রয়োজন হবে কিনা জানি না। আমার বোনদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগের রাতে অর্থাৎ মর্মান্তিক ঘটনাটার আগের রাতে একটা টেলিফোন এসেছিল। আম্মা ধরেছিলেন, পরে আমাকে দিয়েছিলেন। কে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাদের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কি সিদ্ধান্ত নিলেন? আমি বলেছিলাম, ওরা আগামীকাল ইনশায়াল্লাহ বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। উত্তরে সে লোকটি বলেছিল, আপনারা ঠিক করলেন না। আমরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে চেয়েছিলাম। বলেই সে টেলিফোন রেখে দেয়। পর্দার ওপার থেকে বলল আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া।
‘ধন্যবাদ। লোকটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছিল?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তিনি পরিচয় দেননি, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। তবে সে টেলিফোন নাম্বারটা আমাদের টেলিফোন রেজিস্টারে আছে।’ সামিরা সাদিয়া বলল পর্দার ওপার থেকে।
‘ধন্যবাদ। নাম্বারটা আমার দরকার হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। আমার এখন মনে হচ্ছে.. ছোট ঘটনাটা বড়ও হতে পারে। আপনি কি মনে করছেন জনাব?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘আপনারা ঠিক করলেন না’ কথাটাকে এক অর্থে আমরা থ্রেট ধরতে পারি। অন্য অর্থে থ্রেট নাও হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা বিষয় জনাব। ছোট দুই মেয়ের হত্যার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি জড়িত থাকলে, আমার বড় মেয়ে কিডন্যাপের শিকার হলো কেন? আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘আপনারা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার বড় মেয়েকে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হিসাবে তার স্টেটমেন্ট নেবার জন্যে ডেকেছিল।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘কারণ এটাই ছিল। আপনার বড় মেয়ে ঘটনার একমাত্র চাক্ষুস সাক্ষী। সে যাতে তার সাক্ষ্য দিতে না পারে, এই জন্যেই তাকে কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
আসুমানি আব্দুল্লাহসহ সবার মুখ উদ্বেগে ভরে গেল। একটু নীরবতা। নীরবতা ভেঙে কথা বলল শাকির সাইদ। বলল, ‘তাহলে তো তার আরও বিপদ হতে পারে!’
‘সেটা আল্লাহ জানেন। কিন্তু তাকে সাবধান থাকতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা একটু চুপ করল। তার চোখে-মুখে ভাবনার ছায়া। একটু ভেবে বলল সে, ‘একটা কথা বলতে চাই, বুজুমবুরায় থাকার আপনাদের কি কোনো বিকল্প জায়গা আছে?’
আসুমানি আব্দুল্লাহ, শাকির সাইদসহ সবার চোখে-মুখে একটা উদ্বেগ নেমে এলো। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘বিকল্প জায়গার কথা বলছেন কেন, আমরা কি এখানে নিরাপদ নই?’
‘এ বাড়ি নিরাপদ নয়, তা আমি বলছি না। কিন্তু সাবধান থাকা ভালো। শত্রুদের পরিচয় এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এরা যদি ব্ল্যাক ক্রসের কোনো শাখা বা তাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন কোনো শত্রু হয়, তাহলে তারা খুবই হিংস্র এবং বেপরোয়া হবে। বিশেষ করে শিকার হাত ছাড়া হলে তারা অনেকটাই উন্মাদ হয়ে যায়। কোনো সময় না দিয়ে শিকারকে আবার আটকাবার জন্যে তারা শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদসহ উপস্থিত সকলেরই মুখ ভয়ে চুপসে গেছে।
শাকির সাইদ বলল, ‘বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসেছে। এই অবস্থায় তারা কি সাহস করবে?’
‘সাহস নাও করতে পারে, আবার করতেও পারে। কোনোটাই আমাদের কাছে নিশ্চিত নয়। সাবধানতার পথ অবলম্বন করাই ভালো। বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি মনে করেন এখনি বাড়ির সবাইকে, অন্তত মেয়েদের শিফট করা দরকার? আরও কিছুটা দক্ষিণে লেকের কাছাকাছি আমাদের আর একটা বাড়ি আছে। সেখানে গিয়েও আমরা মাঝে মাঝে থাকি।’
‘আমি মনে করি শুধু মেয়েরা নয়, সবাই আপনারা কয়েক দিনের জন্যে ওখানে চলে যেতে পারেন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই গেটের দিক থেকে একটা ব্রাশফায়ারের শব্দ হলো।
আহমদ মুসা স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল। বলল দ্রুত, কিন্তু শান্ত কণ্ঠে আসমানি আব্দুল্লাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনাদের দক্ষিণ গেটের অবস্থা কি?’
আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদও উঠে দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখে-মুখে প্রবল উৎকণ্ঠা। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘দক্ষিণ গেট দু’দিন আগে থেকেই কমপ্লিট বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমটির চারদিকে চাইছিল। বলল দ্রুত কণ্ঠে ‘দুদিকে দরজা সিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে আপনারা সকলে এ ঘরেই থাকুন।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘ভয় নেই, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। আমি ওদিকে যাচ্ছি।’ বলে আহমদ মুসা দরজার দিকে ছুটল।
উৎকণ্ঠা, উদ্বেগে আসমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদ বাকহীনের মতো হয়ে গেছে। আহমদ মুসার ছুটে যাওয়াই শুধু দেখল অপলক চোখে।
পূর্ব দিক দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার একটাই প্রবেশ পথ। সেটা ড্রইংরুম হয়ে। এ গেট দিয়ে অতিথিদেরকেই শুধু স্বাগত জানানো হয়।
আহমদ মুসা ছুটছে। ড্রইং রুমের বাইরের বারান্দায় অনেকগুলো পায়ের শব্দ হচ্ছে। আহমদ মুসা ড্রইংরুমে পৌঁছেছে।
ড্রইংরুমের গেট এক পাল্লার বড় দরজা। দরজা খুললে দরজা উত্তর দিকে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে সেট হয়ে যায়। দরজা আনলক করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা চিন্তা করল, সন্ত্রাসীরা দরজা খোলার পর ওরা দরজার ওপারে থাকতেই কি সে আক্রমণে যাবে, না ওদের ঘরে ঢুকিয়ে আক্রমণ করবে। দরজা খুলে ওদের আক্রমণ করলে দরজা নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ওরা ভেতরে ঢুকলে এই সুযোগ পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে দরজা খুলে আক্রমণ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ, যদি ওরা দরজা খোলার সাথে সাথেই গুলি বৃষ্টি শুরু করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা হয় না। সাধারণত আক্রমণকারীরা অস্ত্র বাগিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা জানে, তাদের মোকাবিলা করার মতো এ বাড়িতে কেউ থাকার কথা নয়। পুলিশ ছিল, তাদের ব্যবস্থা তো আগেই হয়েছে।
এই চিন্তা করে দরজাতেই ওদের ঠেকিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তার এম-১৬ মেশিন রিভলভার কাঁধে ঝুলিয়ে দুই হাত খালি রাখল। এম-১৬টা এমনভাবে ঝুলন্ত থাকল যা ডান হাত চোখের পলকে তুলে নিতে পারে ট্রিগারে তর্জনি রেখে।
আহমদ মুসা দরজার পাল্লার পেছনে এমনভাবে দুই হাত দরজার পাল্লার দিকে প্রসারিত করে রাখল যাতে দরজার পাল্লা ওদের ধাক্কায় পেছনে ছুটে এলে আহমদ মুসা আরও বড় ধাক্কায় তা আবার সামনে ফেরত পাঠাতে পারে।
সন্ত্রাসীরা দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল দরজা খোলা। পর মুহূর্তে দ্রুত দরজার নব ঘুরিয়ে প্রবল ধাক্কায় ঠেলে দিল ভেতরে। সেই সাথে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘরে ঢুকতে শুরু করল।
আহমদ মুসা তার হাতের উপর এসে স্থির হয়ে যাওয়া দরজার পাল্লা এবার প্রবল শক্তিতে ছুঁড়ে দিল সামনে।
ঘরে ঢুকতে শুরু করা কয়েকজন সন্ত্রাসী দরজার পাল্লার প্রবল ধাক্কায় দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ওদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে দরজার পাল্লা আবার ভেতরের দিকে কিছুটা সরে বড় একটা ফাঁক সৃষ্টি করল।
আহমদ মুসা তার এম-১৬ হাতে তুলে নিয়ে ট্রিগার চেপে সেই ফাঁক দিয়ে এম-১৬ এর ব্যারেল প্রথমে বুক বরাবর উঁচুতে ঘুরিয়ে নিল বারান্দার উপর যাতে দরজার বাইরে বারান্দায় থাকা সন্ত্রাসীরা আক্রমণে আসার সুযোগ না পায়। পরে এম-১৬ এর ব্যারেলকে বাইরের দিকে তাক করে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল। দেখল, দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া দু’জন সন্ত্রাসী আঘাত সামলে নিয়ে উঠে বসেছে। তারা হাতে তুলে নিয়েছে ছিটকে পড়া ওদের স্টেনগান। ওদের স্টেনগানের ব্যারেল উঠে আসছে। আহমদ মুসার এম-১৬ বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করল না। এক পশলা গুলি ছুটে গেল ওদের লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা গুণে দেখল বারান্দায় মারা পড়েছে চারজন এবং দরজার উপর মারা পড়েছে দু’জন।
আহমদ মুসা তাকাল গেটের দিকে। একজন পুলিশের দেহ গেটের বাইরে মাটিতে পড়ে আছে। আরেকজন মাটিতে পড়ে থাকা পুলিশ আহমদ মুসার দিকে তাকাচ্ছে।
আহমদ মুসা ছুটল সেদিকে। বসল গিয়ে আহমদ মুসা তার পাশে।
‘স্যার, দেখুন আমাদের একজনের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আমার কাঁধে, উরুতে ও পাঁজরে গুলি লেগেছে। আমি হেড কোয়ার্টারে খবর দিয়েছি স্যার। ওরা আসছে।
কথা শেষ করে পুলিশটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আবার, ‘স্যার ওদের গাড়িতে আরেকজন আছে। দেখুন স্যার, বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত তাকাল সেদিকে, পকেট থেকে তার রিভলভারটাও তার হাতে উঠে এসেছে। আহমদ মুসা চোখের পলকে রিভলভারটা টার্গেটে তাক করেছে। দেখল লোকটার মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠছে।
আহমদ মুসার রিভলভার ইতিমধ্যেই তাকে টার্গেট করেছিল। গুলিও বেরিয়ে গেল। একেবারে তার হাত লক্ষ্যে। হাত গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই তার হাতেই বিরাট এক বিস্ফোরণ ঘটল।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করল।
প্রবল বিস্ফোরণে দেহ শূন্যে উঠে টুকরো টকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। ঠিক এ সময়েই দূরে বাঁশি বাজিয়ে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আসমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির দিকে আসতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে এলো এবং ভেতরের যে ড্রইংরুমে বাড়ির সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে ডেকে তাদের বের করে আনল।
ঘরের বাইরে দ্রুত বেরিয়ে এলো আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদ। উদ্বেগ-আতংকে তারা বিপর্যস্ত। বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ, ‘আপনি ঠিক আছেন? আল্লাহর হাজার শোকর। কি অবস্থা এখন?’ কম্পিত, শুকনো কণ্ঠ তার।
‘আল্লাহর রহমতে ভালো খবর। পুলিশকে মেরে ওরা ভেতরে ঢুকছিল। ওদের সাতজন মারা গেছে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন পুলিশ নিহত হয়েছে, আরেকজন মারাত্মক আহত।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘এসব কথা পরে। আপনারা আসুন। পুলিশ আসছে। আপনারাই স্বাগত জানাবেন পুলিশকে।’
আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরুবার সময় বাইরের ড্রইংরুমের দরজা, বারান্দায় ৬টি লাশ পড়ে থাকতে দেখল।
পুলিশের তিনটি জীপ ও দুইটি ক্যারিয়ার এসে আসুমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। পুলিশের তিনটি জীপ থেকে প্রায় এক সাথেই নামল পুলিশ প্রধান এবং পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার। গাড়ি থেকে নেমেই তারা বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মানুষের দেহ ও গাড়ির দিকে নজর করল। তাদের চোখ এরপর ছুটে গেল গেটের সামনে পড়ে থাকা পুলিশের দিকে। তারা ছুটল নিহত, আহত পুলিশের দিকে। তারা তাকাল আহমদ মুসাদের দিকেও।
.
পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা বসেছে আসুমানি আব্দুল্লাহর বাইরের ড্রইংরুমে।
দরজা ও বারান্দার উপরের লাশগুলো পুলিশ নিয়ে গেছে। ড্রইংরুম ও বারান্দা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেছে বাড়ির কাজের লোকজন।
পুলিশ অফিসারদের সামনে একই সোফায় বসেছে আহমদ মুসা, আসমানি আব্দুল্লাহ ও শাকির সাঈদ।
পুলিশ প্রধান আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আবু আব্দুল্লাহ। আমি আতংক বোধ করছি আপনি না থাকলে আজ এ বাড়িতে যা ঘটত তা নিয়ে।
‘না থাকলে আল্লাহ্ অন্য কোনোভাবে বাড়ির লোকদের রক্ষা করতেন, যদি তিনি চাইতেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের কাছে দৃশ্যমান যা তা নিয়েই আমরা কথা বলছি জনাব।’ বলেই পুলিশ প্রধান তাকাল আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আপনাদের নিয়ে এসব কি ঘটছে জনাব আব্দুল্লাহ?’
‘আমাদেরও কথা এটাই স্যার, এসব কি ঘটছে, কেন ঘটছে? আমাদের অপরাধ কি?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমরাও তো সেটাই চিন্তা করছি। কিছু একটা ঘটনাতো আছেই। তা না হলে অন্য কেউ নয় আপনারা টার্গেট হলেন কেন? সেই কিছু একটা ঘটনারই আমরা সন্ধান করছি। আজ সকালে আপনার মেয়ে ম্যাডাম সাদিয়াকে কিডন্যাপ করতে তারা পারেনি। সন্ধ্যায় আবার তারা শিকারকে ধরার জন্যেই এসেছিল, এটাই আমরা মনে করছি। যদি তাই হয়, তাহলে ম্যাডাম সাদিয়াই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। কেন্দ্রবিন্দু কেন? ম্যাডাম সাদিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক কি? এ প্রশ্নের উত্তর পেলে সামনে অগ্রসর হওয়া আমাদের জন্যে সহজ হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল পুলিশ প্রধান।
‘আমি কিছু বলতে পারি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। ওয়েলকাম।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘সন্ত্রাসীদের সন্ধ্যার আক্রমণের কারণ প্রতিশোধ নেয়াও হতে পারে। তাদের পাঁচজন লোক মারা গেছে সকালের ঘটনায়। এ পরিবারের লোকদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়াটাও তাদের লক্ষ্য হতে পারে। আরেকটা বিষয়, আজ সকালে ম্যাডাম সাদিয়া টার্গেট হয়েছিলেন কেন? আমার মনে হয় ম্যাডাম সাদিয়া তাদের টার্গেট ছিল না, টার্গেট ছিল ম্যাডাম সাদিয়া স্টেটমেন্ট রেকর্ড করার জন্যে যাতে পুলিশ অফিসে যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। ম্যাডাম সাদিয়াই একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, যে ড্রাইভারকে এবং গাড়িকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। বিশেষ করে ড্রাইভারকে দেখা তারা বিপজ্জনক মনে করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে একটু ঝুঁকে পড়ে পাশের অফিসারের সাথে কথা বলল। ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ। আপনি ঘটনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, যা খুবই যৌক্তিক। আমারও নিশ্চিত মনে হচ্ছে, ম্যাডাম সাদিয়া টার্গেট হবার এটাই প্রকৃত কারণ হতে পারে।’
‘আরেকটা বিষয় জনাব। প্রথম ঘটনায় ট্রাকটি যখন ম্যাডাম সাদিয়াদের গাড়িটাকে আঘাত করে, তখন গাড়িতে ম্যাডাম সাদিয়ার ছোট দুই বোন ছিল, কিন্তু ম্যাডাম সাদিয়া নেমে গিয়েছিলেন গেট খুলতে। এটা আক্রমণকারী ট্রাক ড্রাইভারের অবশ্যই চোখে পড়েছে। এ সত্ত্বেও সে কারটিকে চাপা দিয়ে ম্যাডাম সাদিয়ার দুই বোনকে মেরেছে। এর অর্থ বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি হয়ে ফেরা ম্যাডাম সাদিয়ার দুই বোনই ছিল তাদের টার্গেট।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধানের চোখে-মুখে প্রসন্নতা। কিন্তু সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল সে।
একটু সময় নিয়ে পুলিশ প্রধান বলল, ‘আপনি একটা সূক্ষ্ম বিষয় ধরেছেন, ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ। আপনার যুক্তির সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ঐ দু’টি ছোট্ট কিশোরী টার্গেট হলো কেন? আপনি কি এ নিয়ে কোনো চিন্তা করেছেন?’
‘আমি অনেকগুলো অপশন নিয়ে ভাবছি জনাব। কিন্তু কোনোটাই সিদ্ধান্তের জন্যে যথেষ্ট হয়নি। সিদ্ধান্তের জন্যে সন্ত্রাসীদের পরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিচয় উদ্ধারে আপনাদের অনুসন্ধান কত দূর জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলতে গেলে এখনও শূন্যের কোঠায়।
বলে পুলিশ প্রধান তাকালো গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমির দিকে বলল, ‘এ ব্যাপারে আপনার কি কিছু বলার আছে?’
‘স্যার যা বলেছেন, সেটা আমারও কথা। পরিচয় উদ্ধারে আমাদের অগ্রগতি প্রায় শূন্য। ১২টি লাশ ছাড়া আর কোনো তথ্য-উপাত্ত আমরা পাইনি। বিস্ময়কর হলো, লাশগুলোর পকেট থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি আগের পাঁচটি লাশের কাছ থেকে যে স্টেনগান রিভলভার পাওয়া গেছে, সে সব লাইসেন্সবিহীন অবৈধ অস্ত্র। এই ঘটনায় যে অস্ত্র পাওয়া গেছে সেগুলোও তাই। যে ১২টি লাশ পাওয়া গেছে তারা সবাই বুরুন্ডির। থামল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।
‘ওদের কাছ থেকে একটা সিম্বল বা মনোগ্রাম পাওয়া গেছে, যা ওদের পরিচয় জ্ঞাপক বলে আমার মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনেই পুলিশ প্রধান রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। গোয়েন্দা প্রধানও নড়ে-চড়ে বসেছে। ‘আপনি পেয়েছেন? সন্ত্রাসীদের লাশ থেকে?’ পুলিশ প্রধান বলল। ‘সন্ত্রাসীদের জ্যাকেট ও শার্ট থেকে সিম্বল পেয়েছি। লাশগুলো এখনো গাড়িতে আছে নিশ্চয়। আপনি কোনো পুলিশকে নির্দেশ দিন লাশের শার্ট- জ্যাকেটের কলারে ‘মেড ইন’ স্টিকার চেক করার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা পুলিশ প্রধানকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগে পুলিশ প্রধান তাকাল পাশের পুলিশ অফিসারের দিকে।
‘আমি দেখছি স্যার।’ বলে উঠে দাঁড়াল পুলিশ অফিসারটি।
বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
‘সিম্বলটি এই ৬টি লাশে পেয়েছেন, না সকালের লাশগুলোতে পেয়েছিলেন মি. আবু আব্দুল্লাহ?’ বলল পুলিশ প্রধান আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘এগারোটি লাশেই আমি পেয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের পুলিশরা কিন্তু সার্চ করে কিছুই পায়নি। ধন্যবাদ মি. আবু আব্দুল্লাহ আপনাকে। আপনাকে যতই দেখছি, বিস্ময় আমার বাড়ছে। প্রথমে কাগজ-পত্র দেখেই আমার অবাক লেগেছিল যে, একজন লোকের ব্যাপারে এতগুলো দেশ বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ একই রকম আগ্রহ দেখাতে পারে কি করে?’ বলল পুলিশ প্ৰধান।
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘নানা ঘটনায় দেশগুলো আমাকে চেনে। তারা আমাকে পছন্দও করে। তাই তারা হয়তো আমার উপকার করতে চেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনাব দেশগুলোকে সবার মতো আমিও চিনি। তারা বড় মানে খুব বড় উপকার না পেলে এভাবে যেচে কারও উপকার করতে আসা তাদের জন্যে স্বাভাবিক নয়।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আমি বুজুমবুরায় এসে দেশগুলোর দুতাবাসের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। এ কারণে ব্যাপারটা তাদের সৌজন্যমূলক হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। হাসল পুলিশ প্রধান। বলল, ‘জনাব, আপনি বুজুমবুরায় এসেছেন আজ সকালে। আমি খবর নিয়ে জেনেছি ইউজিজি এসেছেন আপনি তিনদিন আগে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনার ব্যাপারে আমাকে ব্রিফ করেছেন তারও আগে। আর…’
পুলিশ প্রধানের কথার মাঝখানেই প্রবেশ করল বাইরে যাওয়া সেই পুলিশ অফিসার।
পুলিশ প্রধান কথা বন্ধ করে তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘আসুন মি. অফিসার। কি ফল নিয়ে এলেন?’
‘স্যার, ৬টি লাশের শার্ট ও জ্যাকেটের ‘মেড ইন’ স্টিকারে সত্যিই একটা বিশেষ সিম্বল আছে। ওটা আসলেই ‘মেড ইন’ স্টিকার, না কোনো কিছুর সিম্বল তা হঠাৎ করে বলা মুস্কিল। আমি একটা স্টিকার ছিঁড়ে এনেছি।’
বলে অফিসারটি স্টিকারটা পুলিশ প্রধানের হাতে তুলে দিল।
মনোযোগের সাথে স্টিকারটার উপর নজর বুলিয়ে পুলিশ প্রধান তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘জনাব আবু আব্দুল্লাহ, এটা ‘মেড ইন’ স্টিকার নয় কেন? এটা একটা ব্ল্যাক ক্রস। এর বটমে রাউন্ড করে SCA লিখা। হতে পারে তো এটা একটা ‘মেড ইন’ স্টিকার। SCA কোনো কোম্পানির নাম হতে পারে, যদিও SCA-এর অর্থ করা যাচ্ছে না।’
আহমদ মুসা SCA কোনো রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী সংগঠন কিনা এর উত্তর সন্ধানে তার রাজনৈতিক জাদুঘরে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস সিম্বল-এর বটমে রাউন্ড করে তিন বা তার চেয়ে বেশি বর্ণের সমষ্টি পাওয়া গেছে। এমন প্রত্যেক মনোগ্রামের বর্ণমালার প্রথম অক্ষর S সবক্ষেত্রেই কমন। এটা একটা দিক, আর একটা বিষয় হলো, জ্যাকেট, শার্ট, টিশার্ট সবক্ষেত্রে ‘মেড ইন’ মনোগ্রামের জায়গায় এই সিম্বলটা আছে এবং কোনো একজন লোকের জামায় এ সিম্বল অনুপস্থিত নেই। এই দুই বিবেচনা থেকে ধরে নিতেই হবে যে, ‘মেড ইন’ নিশ্চয় কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সিম্বল, স্টিকার নয়।’
পুলিশ প্রধানের ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছে। অন্যান্য পুলিশ অফিসারের চোখে বিস্ময়।
কেউ কথা বলল না। পুলিশ প্রধানের চোখেও বিস্ময় এবং কৌতূহল। তার দুই চোখ আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। এক সময় সে বলে উঠল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ, আপনার সূক্ষ্ম দৃষ্টি এবং বিবেচনা বোধ অতুলনীয়। মন আমার খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেছে জানার জন্যে যে, আপনি আসলে কে? অতুলনীয় আপনার সূক্ষ্ম দৃষ্টি, অতুলনীয় অ্যাকশন। সকালের ঘটনায় এবং এই সন্ধ্যায় আপনি একা এক হাতে আক্রমণে আসা সন্ত্রাসীদের যে নির্মূল করেছেন, তার কোনো দৃষ্টান্ত আমার কাছে নেই। একমাত্র ফিল্ম ছাড়া এমন অ্যাকশন আমি দেখিনি এবং শুনিনি। জনাব আসলে আপনি কে? কেন আপনি আমাদের বুজুমবুরায়?’
আহমদ মুসা সংগে সংগে কথা বলল না। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে
একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘মি. অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা, সাম্প্রতিককালে বুজুমবুরায় কিছু অস্বাভাবিক ঘটনাসহ কয়েকটি বিশেষ হত্যাকাণ্ড ও কিডন্যাপের ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি তার কারণ অনুসন্ধানেই বুজুমবুরায় এসেছি। আমি যে সন্দেহ করেছিলাম, মনে হচ্ছে আমার সে সন্দেহ বাস্তব হতে যাচ্ছে।’
পুলিশ প্রধানসহ উপস্থিত সবার চোখে-মুখেই প্রবল বিস্ময় ও অপার কৌতূহল।
‘কি বাস্তব হতে যাচ্ছে? দয়া করে বলবেন কি? আমাদের অনুসন্ধানেও কাজে লাগবে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘বিষয়টা এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। আরও একটু নিশ্চিত হবার পর অবশ্যই আপনাদের জানাব। আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অপেক্ষা একটা কঠিন ব্যাপার, তবে মনে করি আপনার কথাই ঠিক।’
পুলিশ প্রধান একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক ক্রস সিম্বলের সাথে যে তিনটা বর্ণ রয়েছে, তার অর্থ নিশ্চয় করেছেন। সেটা কি?’
‘আমি বলেছি, ‘ব্ল্যাক ক্রস’ সিম্বলের তিন বা ততোধিক বর্ণের সমষ্টি দুনিয়ার অনেক দেশের সংস্থা-সংগঠনের তালিকায় পাওয়া গেছে যেমন SIC, SCC, SPI ইত্যাদি। এগুলোর অর্থ হলো যথাক্রমে Saviour of Indo- China (SIC), Saviour Caucasus Countries (SCC) এবং Saviour Pacific Island (SPI). অনুরূপভাবে এখানে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আমরা যে সিম্বল পেয়েছি, তার তিনটি বর্ণ SCA-এর অর্থ করতে পারি Saviour of Central Africa.’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে এই সন্ত্রাসীরা সেন্ট্রাল আফ্রিকার ত্রাণকর্তা?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘তাদের নামের দাবি তো সেটাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা বর্ণ তিনটির অর্থ হলে ক্রসের অর্থ কি? ক্রস তো খ্রিস্টানদের সিম্বল। তাহলে SCA কোনো খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সংগঠন?’ পুলিশ প্রধান বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের সাথে উদ্বেগ।
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামলেও কথা বলল না কেউ। পুলিশ প্রধানসহ সব পুলিশ অফিসারের চোখে-মুখেই উদ্বেগ এবং বিস্ময়। সবার চোখে-মুখে প্রবল বিব্রত ভাব।
শেষে নীরবতা ভাঙল পুলিশ প্রধানই। বলল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ, মনে হয় আমরা বিরাট একটা সমস্যায় পড়লাম। ঘটনাগুলোর মোড় তো ঘুরে যাচ্ছে একটা উদ্বেগজনক দিকে।
একটু থামল পুলিশ প্রধান। একটু নড়েচড়ে বসল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ আপনার সাহায্য আমাদের দরকার হবে। আপনাকে কি আমাদের সাথে পাব?’
‘অবশ্যই পাবেন। তবে সাথে থাকার দরকার নেই। আপনারা কাজ করুন, আমি আমার মতো করে কাজ করি। প্রয়োজনে আমি আপনাদের সাহায্য চাইব, আর আমিও সব সময় আপনাদের সাহায্যে আসতে প্রস্তুত থাকব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে কথা বলব। প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও বিষয়টা জানবেন। কিন্তু আপনার পরিচয়টা কি হবে। কি পরিচয় দেব আপনার?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আমার পরিচয় মনে হয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় জানেন। আপনারাও নিশ্চয় জানবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। অনেক ধন্যবাদ। দেখা হবে আবার। উঠছি আমরা এখন। উঠে দাঁড়াল পুলিশ প্রধান। হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে।
পুলিশ প্রধান আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের সৌভাগ্য যে জনাব আবু আব্দুল্লাহর মতো লোকের সাহায্য লাভের সুযোগ ঈশ্বর আপনাদের করে দিয়েছেন। চিন্তা করবেন না। আপনাদের বাড়িতে পুলিশ প্রহরা আজ থেকে বাড়বে। আপনারা কেউ বাইরে গেলে পুলিশ প্রহরা পাবেন। এ অবস্থা থাকবে না। অপরাধীরা অবশ্যই ধরা পড়বে।’
পুলিশরা সবাই চলে গেল। পাঁচজনের একটা পুলিশ প্রহরা বসল আসুমানি আব্দুল্লাহদের গেটে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে আসুমানি আব্দুল্লাহ, শাকির সাঈদ বাড়ির ভেতরে চলল।
.
‘এটাকে শুধু বিপদ বললে ভুল হবে দাদু। বড় একটা সংকট আমাদের পরিবারে এটা। এর শিকড় শুধু বুরুন্ডি নয়, বুজুমবুরা নয় বাইরেও বিস্তৃত।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
তার দাদু ইদি আসুমানি মোহাম্মদ সেই ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। সেই ইজি চেয়ার এটা হলেও এটা সেই বাড়ি নয়।
সেই রাতেই সেই বাড়িটা ছেড়ে তাদের আরেকটা বাড়িতে তারা এসে উঠেছে। তাদের এই বাড়িটাও লেক ট্যাংগানিকা-তীরের কাছাকাছি, কিন্তু আগের বাড়ি থেকে প্রায় মাইল খানেক দক্ষিণে। প্রথমে কথা ছিল শুধু বাড়ির মেয়েরাই এ বাড়িতে উঠবে, কিন্তু আহমদ মুসার পরামর্শে সবাই এসে উঠেছে এই বাড়িতে। দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াত চললে এ বাড়ি শত্রুদের চোখে পড়ে যেতে পারে, এই জন্যে সবাই একসাথে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সবার অনুরোধে নিরাপত্তার দিকটা চিন্তা করে অন্তত কয়েক দিন এ বাড়িতে থাকতে রাজি হতে হয়েছে আহমদ মুসাকে। বাড়িটাও বেশ বড়, কয়েকটা পরিবার এক সংগে থাকার মতো।
সামিরা সাদিয়ার কথা শেষ হতেই তার দাদু তার দিকে চোখ টেনে তুলে বলল, ‘কি বলছিস সাদিয়া, ঘটনা বুরুন্ডির রাইরেও বিস্তৃত? তাহলে আমরা কি কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছি, মানে কোনো ষড়যন্ত্র আমাদের জড়িয়ে ফেলেছে?’
ঘরে ঢুকেছিল সাদিয়ার মা, বাবা। তারাও শুনেছে তাদের বাবার কথা।
বসতে বসতে সাদিয়ার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল তার বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে, ‘ঠিক বাবা, বিরাট এক ষড়যন্ত্রে আমাদের জড়ানো হয়েছে।’
‘কারা জড়াবে? কি ষড়যন্ত্রে জড়াবে? আমাদের তো এ রকম কোনো শত্রু নেই।’ বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘কি ষড়যন্ত্র সেটাই তো জানা যাচ্ছে না বাবা। তবে আমাদের মেহমান আহমদ মুসা সন্ত্রাসীদের একটা সিম্বল দেখে যে গ্রুপ বা সংগঠনের নাম বলছেন, সে সংগঠন ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিস্টান।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘খ্রিস্টান সংগঠন? এই ভয়াবহ কাজগুলো করছে একটা খ্রিস্টান সংগঠন!’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তাঁর কণ্ঠে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ বাবা। নাম ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’।’
‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। স্বগত কণ্ঠে প্রশ্নের আকারে নামটি উচ্চারণ করল সে। তার কণ্ঠে হতাশা। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ইদি আসমানি আব্দুল্লাহ। চোখ দু’টিও তার বুজে গেছে। অল্পক্ষণ পরেই চোখ খুলল সে।
ইজি চেয়ারে শোয়া অবস্থায় থেকেই সে ধীরে ধীরে বলল, ‘অতীতের কি পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আব্দুল্লাহ! অনেক অনেক বছর আগে কতকটা এই নামেরই একটা সন্ত্রাসী খ্রিস্টান সংগঠনের উদ্ভব ঘটেছিল এই বুজুমবুরায়। নাম ছিল ‘সেভিয়ার অব রাইটস অব আফ্রিকান পিপলস’ (SRAP)। মুসলিম বিদ্বেষী বেলজিয়ান উপনিবেশিক শাসকরা এদের পরিচালনা করতো পর্দার অন্তরালে থেকে। হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করা ছিল এই সন্ত্রাসী গ্রুপের কাজ। একদিকে এরা যখন প্যানিক সৃষ্টি করছিল মুসলমানদের মধ্যে, ঠিক সে সময় ঔপনিবেশিক সরকার মুসলমানদের উপর এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় যে, মুসলমানদেরকে বুজুমবুরা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সরে গিয়ে শহরের প্রান্ত বা উপকণ্ঠ এলাকায় বসতি স্থাপন করতে হবে। তারা জায়গাও ঠিক করে দেয়। উপমহাদেশীয় ও আরব মুসলমানদেরকে শহরের প্রশাসনিক এলাকার পশ্চিমে লেক ট্যাংগানিকার তীর এলাকায় বসতি স্থাপন করতে হবে। সোহাইলিদের যেতে হবে শহরের প্রান্তে বুয়েনজি এলাকায় এবং আফ্রিকী মুসলিমদের বসতি হবে বেলজি অঞ্চলে। ঔপনিবেশিক শাসকরা আরও আইন করল এক গ্রুপের বসতিতে অন্য গ্রুপ যেতে পারবে না, যোগাযোগও রাখতে পারবে না। এছাড়া অমুসলিম এলাকায়ও তাদের যাওয়া চলবে না এবং ধর্মীয় প্রচারমূলক কোনো কাজও তারা করতে পারবে না। একদিকে ‘এসআরএপি’র সন্ত্রাস ও অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সরকারের শাসন-খড়গ মুসলমানদের বাধ্য করে তাদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে।’ একটু দম নিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
এই ফাঁকে আসমানি আব্দুল্লাহ তার বাবাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘বাবা, ঔপনিবেশিক বেলজিয়ান শাসকরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে?’
একটু হাসল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘আজ থেকে সত্তর বছর আগে আমার বাবাকে এই প্রশ্নই করেছিলাম। তিনি সংক্ষিপ্ত জবাবে বলেছিলেন, শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বুজুমবুরাকে মুসলিম সংখ্যালঘু শহরে পরিণত করার লক্ষ্যেই ছিল এই পদক্ষেপ। পরে আমি অনেক কাগজ-পত্র ঘেঁটে জেনেছিলাম আরও কিছু।’
‘কি সেটা দাদু?’ প্রশ্ন সামিরা সাদিয়ার। সে এই কথাগুলোকে গোগ্রাসে গিলছিল।
‘আমার বাবা যেটা বলেছিলেন, মূল কথা সেটাই। আসলে ঔপনিবেশিক খ্রিস্টান শাসকরা ভয় করছিল, মুসলমানদের স্বাধীনভাবে থাকতে দিলে তাদের খ্রিস্টান স্বার্থ এক ইঞ্চিও সামনে এগুবে না এবং শুধু বুজুমবুরা নয়, গোটা বুরুন্ডি মুসলিম জনপদে পরিণত হবে। এমনটা তারা তাদের চোখের সামনে দেখেছিল। ১৯১০ সালে বুজুমবুরার মূল বসতি ছিল ২০০০ যাদের সবাই ছিল মুসলমান। এই সময় ঔপনিবেশিক শাসকরা গ্রাম এলাকা ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে এসে হাজার খানেক অমুসলিম বসতি গড়ে তোলে বুজুমবুরায়। ১৯৩০ সালে বসতির সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজার। ধর্মীয় পরিচয় গণনায় দেখা গেল চার হাজার বসতির প্রায় সবাই মুসলমান। অমুসলিম যারা নতুন বসতি গড়েছিল সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এটা দেখার পরই ঔপনিবেশিক খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহণ– করে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। ১৯৬২ সালে বুরুন্ডি যখন স্বাধীন হয়, তখন বুজুমবুরায় বসতি ছিল পঞ্চাশ হাজার, যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র বার থেকে চৌদ্দ হাজার।’
থামল একটু ইদি মোহাম্মদ। একটু ভাবল। বলল, ‘ভাবছি তখন সন্ত্রাসী গ্রুপ SRAP উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল বুজুমবুরায় মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্যে, আজকের সন্ত্রাসী গ্রুপকে কেন সামনে আনা হলো? কারা আনল? আমরা তার টার্গেট হলাম কেন?’
‘এই ‘কেন’-এর উত্তর পেলে তো সবই পাওয়া হয়ে গেল দাদু। স্যার হয়তো কিছু আন্দাজ করেছেন বা জেনেছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত না হয়ে এ সম্পর্কে কিছু বলবেন না, এটা তো তিনি পুলিশকেও জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে এখন কিছু জানা যাবে না।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘তা না বলুন মা, তিনি কিছু জেনেছেন এটাই আমাদের জন্যে সান্ত না। তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর রহমত। তিনি যে আমাদের শুধু রক্ষা করেছেন তা নয়, হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনার নিমিত্ত পুলিশ আমাদের উপরই চাপাতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা সেটা ঘুরিয়ে আসল দিকে নিয়ে গিয়েছেন। পুলিশ এটা গ্রহণও করেছে। আসমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘বাবা, স্যার শুধু যুদ্ধ নয়, যুক্তি-বুদ্ধিতেও বিস্ময়কর। কথারও জাদুকর তিনি। কখন কি বলতে হবে, সেটা যেন তার ঠিক করাই থাকে। বলল সামিরা সাদিয়া।
‘তাতো হবেই মা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, চীনের প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী যেখানে তাঁকে সমীহ করেন, সেখানে তিনি অসাধারণের মধ্যে এক অসাধারণ তো হবেনই। আল্লাহ তাকে আমাদের সাহায্যে না পাঠালে যে কি হতো সেটা ভাবতেও ভয় লাগে। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল। তার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর অনুভূতি সকলেরই অনুভূতি হয়ে উঠেছিল। তাদের সকলেরই মুখ ভারি, নিচু। একটা নীরবতাও নেমে এসেছিল।
‘এত বড় মানুষ। আমাদের সকলের অনুরোধে এখানে থাকছেন আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। দেখ, সব সময় তার খোঁজ-খবর রেখ তার কোনো অসুবিধা যেন না হয়।’ নীরবতা ভেঙে বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘তিনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন, আমরা সব সময় তার আশেপাশে থাকি। আর দাদু, আমরা তার খোঁজ খবর রাখব কি, তিনিই তো আমাদের . সব খোঁজ-খবর রাখেন।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘কেমন খোঁজ-খবর?’ বৃদ্ধ ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘দাদু গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আজ ক্লাস বণ্টনের একটা পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, যেখানে সব শিক্ষকের উপস্থিতি অপরিহার্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব কি না। তিনি বললেন, না যেতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে এক মাসের ছুটি দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে হলো, আমি তো ছুটি চাইনি, দরখাস্ত করিনি? তিনি জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই ঘটনা জানত। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ভিসিকে বলেছিলাম, অবস্থার কারণে কিছু দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া তার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ। শুনেই তিনি আপাতত এক মাসের ছুটি দিয়েছেন।’ একটু থামল সাদিয়া।
সংগে সংগেই তার বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘কি পরিচয় উনি দিয়েছিলেন?’
‘আমিও অবাক হয়ে এ প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে, আমাদের কেসটা তিনি দেখছেন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। এত দিকে তাঁর নজর! আমাদের নিজেদের ব্যাপারে যে চিন্তা আমরা করতে পারিনি, মাথায়ও আসেনি, সেটা তিনি করলেন! আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। আল্লাহ্ তাঁকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছ তো বোন?’ ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘আমি ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, আমাকে নয়, ধন্যবাদ আল্লাহকে দেবেন। আমি আলহামদুলিল্লাহ! বলেছিলাম। তিনি আর কিছু বলেননি। পর্দার এপারে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সালাম দিয়ে আমি চলে আসি। সালাম নেয়ার শব্দ আমি শুনেছিলাম। বলল সাদিয়া।
‘তোমার এই শেষ বক্তব্যটা অপ্রাসঙ্গিক। কেন বললে তুমি?’ সাদিয়ার দাদু ইদি মোহাম্মদ বলল। তার মুখে একটু হাসি 1
‘বললাম এই কারণে দাদু যে, তাঁর কাছে আমাদের শেখার বহু কিছু আছে। তখন শয়তান আমার ভেতর থেকে বলছিল, তিনি আরও কিছু আমাকে বলুন। তাঁর নীরবতা, নির্লিপ্ততা আমার ভেতরের শয়তানকে চপেটাঘাত করেছে।’ বলল সাদিয়া।
‘ধন্যবাদ বোন, একথা প্রকাশ করে তুমিও শয়তানকে চপেটাঘাত করলে। সাদিয়ার দাদু ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘এ শক্তি আমি পেয়েছি দাদু তাঁর কাছ থেকে, আল্লাহর সাহায্যে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
এ সময় সাদিয়ার ছোট ভাই ঘরে ঢুকেই বলল, ‘আপাজি, স্যার বাইরে গেলেন।
‘তো তুমি সেখানে অপেক্ষা কর। তিনি এলে দরজা খুলে দেবে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘সেই বাইরে যাওয়া নয় আপা। তিনি তাঁর ছোট ব্যাগটা নিয়ে, কেটস পরে মুখে মোচ লাগিয়ে বেশ তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন। আমাদের গাড়ি নেননি, একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতেই গেলেন।’ আমর ইদি মোহাম্মদ বলল। আসমানি আব্দুল্লাহ তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘এই রাত দশটায় তিনি বেরুলেন! কোথায় বেরুলেন, কিছু বলেছেন? জান কিছু তুমি আমর?’
আমর ইদি মোহাম্মদ কিছু বলার আগেই সামিরা সাদিয়া বলল, ‘তাঁর প্রস্তুতি বলে দিচ্ছে বাবা, তিনি বিশেষ কোনো জায়গায় গিয়েছেন।’
‘বিশেষ কোনো জায়গা মানে? শত্রুর সন্ধানে কোনো অভিযানে?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমি তাই মনে করি বাবা।’ সাদিয়া বলল, তার মুখ মলিন। কণ্ঠ অনেকখানি শুষ্ক।
আসমানি আব্দুল্লাহর চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ। আমর মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলেছেন তোমার স্যার?’
আমর মোহাম্মদ তার ডান হাতের মুঠো থেকে একটা চিরকুট বের করে তার বাবাকে দেখিয়ে বলল, ‘স্যার আমাকে বলে গেছেন যে, রাত দু’টার মধ্যেও যদি তিনি না ফেরেন? তাহলে আমি যেন এই নাম্বারে টেলিফোন করে তিনি না ফেরার কথাটা বলি।’
‘ফিরবেন না মানে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
সামিরা সাদিয়ার চোখে-মুখে আতংকের কালো ছায়া। সে আমরের হাত থেকে টেলিফোন নাম্বার লিখা চিরকুট নিয়ে বলল, ‘বাবা, ফিরবেন না মানে, হয় তিনি শত্রুর হাতে বন্দি হবেন, নয়তো…।’
কথা শেষ করতে পারল না সামিরা সাদিয়া। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
‘নয়তো কি সাদিয়া?’
‘আমি ঐ কথা উচ্চারণ করতে পারবো না বাবা। ভেঙে পড়ল সাদিয়ার কণ্ঠ।
কষ্ট করে ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘তোমরা মৃত্যুর কথাটাই উচ্চারণ করতে পারছ না, আর আমার সে ভাইটি মৃত্যুকে আগাম বরণ করে নিয়েই বেরিয়েছেন অভিযানে এবং সেটা নিশ্চয় আমাদের জন্যে, তাঁর নিজের কোনো স্বার্থে নয়।’
‘আর বলো না দাদু। আমরা তাঁকে বিপদে ফেলেছি।’ বলল সাদিয়া। আবেগের একটা আর্তনাদ তার কণ্ঠে। চোখ দু’টি অশ্রু সজল।
‘তাঁকে আমাদের পর্যায়ে নামিয়ে দেখলে আমাদের কষ্ট বাড়বে বোন। তিনি আল্লাহর সৈনিক। বিপদ মাথায় থাকে তার সব সময়। জীবন-মৃত্যুর লড়াই যেখানে, তেমন একটা বিপজ্জনক অভিযানে তিনি যাচ্ছেন, আমাদেরকে কিছুই জানালেন না। এর কারণ এ লড়াইকে তিনি জীবনের একটা সাধারণ অংশ মনে করেন। বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘জীবন-মৃত্যুর লড়াই যদি সাধারণ হয়, তাহলে তার জীবনে অসাধারণ কি দাদাজী?’ সাদিয়া বলল।
‘জানি না বোন তাঁর জীবনে অসাধারণ কোনো কিছু আছে কিনা। তবে এটা জানি, নববধূ ফেলে, বাসর ঘর ফেলে যারা জেহাদের ময়দানে ছুটে গেছেন, তিনি ও আমরা তাদেরই উত্তরসূরী। এদের কাছে শান্তির গৃহাঙ্গন এবং রক্তঝরা রণাঙ্গন সবই জীবনের অংশ, ভিন্ন কিছু নয়।’ বলল ইদি মোহাম্মদ।
‘তোমার কথা মানলাম দাদু। কিন্তু মানুষ তো মানুষই। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। স্যার যখন বললেন ‘রাত দুইটার মধ্যেও যদি আমি না ফিরি’, তখন কি তার বুকটা কেঁপে উঠেনি? আমার বুক এখনও তো কাঁপছে দাদু।’ সাদিয়া বলল। উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়া তার কণ্ঠ।
‘জানি না বোন। আমার ভাবনা তোমার মতোই। ভাইটিকে আল্লাহ ফিরিয়ে আনুন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করব।’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তাঁর কণ্ঠও ভারি।
কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব।
নীরবতা ভেঙে সাদিয়ার মা বলল, ‘রাত হয়েছে, বাবাকে ঘুমাতে হবে। সবাই আমরা উঠি। আমর তুমি তোমার দাদুকে তার শোবার ঘরে নিয়ে যাও।’ বসা থেকে উঠল সাদিয়ার মা।
‘তোমরা যাও। রাত ২টা পর্যন্ত না দেখে আমার ঘুম ধরবে না। আমি এখানেই রেস্ট নেব।’ বলল ইদি আসমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমারও ঘুম ধরবে না দাদু। টেলিফোন নাম্বারের চিরকুটটা আমার কাছে থাক। সবাই আমরা দোয়া করি। আল্লাহ করুন এ চিরকুটটা যেন ব্যবহার করতে না হয়।’ সামিরা সাদিয়া বলল বসা থেকে উঠতে উঠতে।
সামিরা সাদিয়ার আব্বা, আম্মাসহ সবাই বলল, ‘আমিন।’
৩
মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা এবং মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রি তার অফিস চেয়ারে বসে। উদ্ধুদ্ধু তার মাথার চুল। কিন্তু চোখ দু’টি তার শান্ত। কথা বলছিল সে সামনে বসা পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের সাথে।
‘না মি: স্টিফেন ফোবিয়ান, একক এক ব্যক্তির হাতেই সকাল ও সন্ধ্যার দুই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের খুবই বিশ্বস্ত পুলিশ সোর্স থেকে এটা জানা গেছে। বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘বিষয়টা অবিশ্বাসেরই। মুখোমুখি অ্যাকশনে সকালে সে পাঁচ জনকে মারল এবং সন্ধ্যায়ও সে একাই মুখোমুখি লড়াইয়ে সাতজনকে মারল, অথচ তার কিছুই হলো না, এটা কি বিশ্বাস করার মতো? বুজুমবুরা কেন, গোটা বুরুন্ডিতে এমন করিতকর্মা কেউ আছে, এটা বিশ্বাস করার মতো নয়।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। যে লোকটি এই দুইটি ঘটনা ঘটিয়েছে, সে এদেশের নয়।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘সে কোন্ দেশের?’ জিজ্ঞাসা স্টিফেন ফোবিয়ানের।
‘সেটা সোর্স বলেনি। নিশ্চয় জানতে পারেনি।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘আমি উদ্বিগ্ন মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমরা নীরবে, নিরাপদে খ্রিস্টীয় করণের যে প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটা কোনো মুস্কিলে পড়বে না তো?’ স্টিফেন জোরিয়ান বলল।
‘তা পড়বে কেন? যা ঘটেছে, সেটা রাস্তায় কিডন্যাপ ও খুনোখুনির ব্যাপার। তিনটি মেয়েকে কেন্দ্র করে এটা ঘটেছে। এর সাথে আমাদের প্রোগ্রামের কি সম্পর্ক?’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর করুন, তাই যেন হয় মি. বাতিস্তা সান্ড্রি।’
‘উদ্বেগের কিছু নেই মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। আমরা তো পুলিশকে বোঝাতে চাচ্ছি যে, বুজুমবুরায় যে সব হত্যা, সন্ত্রাস ও কিডন্যাপ, ইত্যাদির ঘটনা ঘটছে, তার সাথে বাইরের কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের যোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনজন সুন্দরী মেয়ে তাদের টার্গেট ছিল। মেয়ে ঘটিত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এটা হতে পারে অথবা এই পরিবারের সাথে বাইরের সন্ত্রাসীদের কোনো সংঘাত হতে পারে পারস্পরিক স্বার্থের কারণে বা অন্য কোনো কারণে। বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘ঠিক মি. সান্ডি, এ দু’টি ঘটনার সাথে তিনটি মেয়ে জড়িত থাকায় ঘটনাকে সবাই মেয়েঘটিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করবে।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করবেন না মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। এখন তো প্রতিপক্ষের মোকাবিলা এবং আমাদের প্রোগ্রামকে সহায়তার সব কাজ করতে হবে ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ (SCA) নামের নতুন সংগঠনটির। সবাইকে আশ্রয় দেয়া ছাড়া আমাদের কোনো দায় দায়িত্ব নেই। কোনো দিকে আমাদের তাকাতে হবে না। আমরা শুধু আমাদের কাজ করে যাব।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘ঈশ্বরকে যিশুকে অনেক ধন্যবাদ যে, ব্ল্যাক ক্রস আমাদের মাথার ভার পুরোটাই লাঘব করে দিয়েছেন। আমাদের জন্যে SCA গঠন করে দেয়ায় আমাদের নিরাপত্তা, টার্গেট বাগে আনা এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা, ইত্যাদি সব চিন্তা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। অসংখ্য ধনবাদ ব্ল্যাক ক্রস প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারকে। স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
মোবাইল বেজে উঠল বাতিস্তা সান্ড্রির।
মোবাইল ধরেই সোজা হয়ে বসল বাতিস্তা সান্ড্রি। বলল, ‘গুড ইভেনিং মি. ক্রিস্টোফার।’
‘গুড ইভেনিং মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। জরুরি কথা আছে, আপনি কি অফিস থেকে বলছেন?’ ও প্রান্ত থেকে বলল কলিন ক্রিস্টোফার, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের নতুন চিফ।
‘আমি এখন অফিসে। অফিসে এসেছেন মি. স্টিফেন ফোবিয়ানও বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ভালোই হলো, দুজনকেই পাওয়া গেল।’
একটু থামল কলিন ক্রিস্টোফার। পর মুহূর্তেই আবার শুরু করল, ঐ লোকটি সম্পর্কে আর কিছু জানা গেছে?’
‘না মি. ক্রিস্টোফার। আপনাকে যা বলেছি, তার বেশি আর কিছু জানা যায়নি। আমি ও স্টিফেন ফোবিয়ান এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম। আমাদের পুলিশ সোর্সের সাথে পরেও আরও কথা হয়েছে, কিন্তু নতুন কিছু জানা যায়নি।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘কিন্তু তার পরিচয় তো জানতেই হবে মি. সান্ড্রি। একদিনে সে আমাদের বারোজন অতি দক্ষ কমান্ডোকে মেরেছে। তাকে আমাদের পেতেই হবে।’ কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
‘আপনাকে তো বলেছি, যেদিন ঘটনা দু’টি ঘটেছে, সেদিনই সে বুজুমবুরায় এসেছে ইউজিজি থেকে। কিন্তু কোথায় থাকে, কি করে কিছুই জানা যায়নি।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘লোকটি রাস্তায় যে মেয়েটিকে কিডন্যাপ থেকে বাঁচাল, তার বাড়িতে সে সন্ধ্যায় গিয়েছিল কেন? পরিবারটির সাথে কি তার সম্পর্ক আছে, না তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাদের বাড়িতে? এসব প্রশ্নের জবাব দরকার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘সন্ধ্যায় ঘটনা ঘটে, অনেক রাত পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষ সে বাড়িতে ছিল, পাঁচ সদস্যের একটা পুলিশ টিম প্রহরায় রেখে তারা চলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়িটিতে চোখ রাখার জন্যে আমরা নতুন পাহ- ারা বসাই। লোকটিকে বাইরে যেতে তারা দেখেনি। অবাক ব্যাপার হলো, সকালেই আমাদের লোকরা জানতে পারে, বাড়িতে কেউ নেই।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
রাতেই তারা সরে পড়েছে। নিশ্চয় বাড়ি থেকে বেরুবার কোনো গোপন পথ আছে। তারা কোথায় গেল জানার কি আপনারা চেষ্টা করেছেন। ঐ পরিবারকে পেলে লোকটিকে পাওয়া অনেকখানি সহজ হবে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘সেদিন থেকেই আমরা চেষ্টা শুরু করেছি। কিন্তু কোনো হদিশ করতে আমরা পারিনি। আমরা একটা খবর পেয়েছি, এই পুরনো পরিবারটির একটা অংশ ইউজিজিতে বাস করে। সেখানে তারা চলে যেতে পারে। ওখানেও আমরা খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করছি।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ধন্যবাদ। এই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ অফিসেও খোঁজ রাখ। যাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছিল, সে মেয়েটাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা যোগাযোগ রাখবেই। তাছাড়া দুটি কেসের ব্যাপারে পুলিশ তাদের সাথে যোগাযোগ করবে এবং তারাও পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখবে।
‘ঠিক বলেছেন মি. ক্রিস্টোফার। এ দু’টো জায়গার কথা আমাদের মাথায় ছিল না। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘কিছু উদ্বেগের খবর আছে মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। মূলত এ বিষয়ে আলোচনার জন্যেই এই টেলিফোনটা আমি করেছি।’
একটু থামলো কলিন ক্রিস্টোফার। আবার শুরু করল, ‘বুজুমবুরার ভ্যাটিক্যান দূতাবাস সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, SCA নামের একটা গ্রুপ সেদিনের হত্যাকাণ্ড ও কিডন্যাপের সাথে জড়িত বুজুমবুরা পুলিশ তা জানতে পেরেছে। আর…।’
‘মেড ইন স্টিকারের SCA যে একটা গ্রুপ বা দল এটা পুলিশ ধরতে পেরেছে তাহলে? কি করে ধরল? আমাদের পুলিশ তো এতটা যোগ্য হয়ে উঠেনি!’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি কলিন ক্রিস্টোফারের কথার মাঝখানেই।
‘শুধু এটুকুই নয়, তারা এও জানতে পেরেছে যে, গ্রুপটা ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে খ্রিস্টান।’ কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
‘কি বলছেন মি. ক্রিস্টোফার? এটা কি করে সম্ভব? ধরে নিলাম SCA বর্ণ সমষ্টির অর্থ ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ তারা অনুমান করেছেন। এই নামের সাথে খ্রিস্টান বিশ্বাসের সম্পর্ক কি? গ্রুপটি যে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী তা বলতে পারে তারা কি করে? যে লাশগুলো তারা পেয়েছে, তাদের সাথে ক্রস কিংবা কোনো খ্রিস্টান, চিহ্ন অবশ্যই থাকার কথা নয়।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আমারও বিস্ময় তো এখানেই। SCA কমান্ডো গ্রুপের লোকরা সবাই পুরানো, উপযুক্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং খুবই সাবধানী। এঁরা অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছে। আমি নিশ্চিত তাদের দ্বারা কোনো ভুল হয়নি।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘পুলিশের এই জানার বিষয়টা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার পাওয়া তথ্যে কোনো ভুল নেই তো?’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘না মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমার তথ্যে কোনো ভুল নেই। বুজুমবুরার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ভ্যাটিকান দূতাবাসকে রিকুয়েস্ট করেছে বিষয়টির একটু খোঁজ নিতে, মধ্য আফ্রিকার খ্রিস্টান দল ও গ্রুপগুলোর মধ্যে এই নাম কারও আছে কিনা।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আমাদের পুলিশ এই অসাধ্য সাধন করতে পারে বলে আমি মনে করি না। এমন সব ঘটনার সাথে ‘খ্রিস্টান’ নাম সংশ্লিষ্ট করতে তারা যাবেও না। কারণ আমাদের পুলিশের অধিকাংশই চার্চের এনলিস্টেড খ্রিস্টান। এ ধরনের ঘটনা পেলে তারা ভ্যাটিক্যানকে বলার আগে নিশ্চয় চার্চ কর্তৃপক্ষকে জানাবে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘আপনার সাথে আমি একমত মি. বাতিস্তা। কিন্তু তাহলে ঘটনার ব্যাখ্যা কি?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘এটা করিতকর্মা ঐ লোকটার কাজ কিনা? একটা তথ্যের কথা আমার মনে পড়ছে। সেদিন সকাল বেলা আমাদের পাঁচজন লোক নিহত হওয়ার পর, হত্যাকারী লোকটি আমাদের নিহত লোকদের উল্টে-পাল্টে দেখেছে, দূরে দাঁড়ানো আমাদের লোক এটা প্রত্যক্ষ করেছে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ঠিক বলেছেন মি. বাতিস্তা। হতে পারে এটা। যে লোক এমন অনন্য একজন শুটার, তার আইকিউ অনন্য হবে তা বলা যায়। এই লোকটিকে তাহলে হাতে পাওয়া আরও জরুরি হয়ে উঠল মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘অবশ্যই মি. কলিন ক্রিস্টোফার। কিন্তু সমস্যা হলো, যার চাল-চুলা নেই, এমন কি যার চেহারাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।’ বাতিস্তা সান্ড্রি কথা বলার মধ্যেই পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর স্টিফেন ফোবিয়ান তার চেয়ার থেকে উঠে এসে বাতিস্তা সান্ড্রির পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং অনুচ্চ স্বরে বলল, ‘আমি মি. ক্রিস্টোফারের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’
‘নিজের কথা শেষ করার সাথে সাথেই বাতিস্তা সান্ড্রি বলে উঠল, ‘মি. ক্রিস্টোফার মি. স্টিফেন ফোবিয়ান আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।’
‘ওয়েলকাম। তাকে দিন।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘গুড ইভেনিং মি. কলিন ক্রিস্টোফার। কেমন আছেন?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘যিশু ভালো রেখেছেন। কিন্তু শান্তির জায়গা বুজুমবুরায় দেখছি আমরা বিরাট সমস্যায় পড়লাম।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘মি. ক্রিস্টোফার, মাত্র একজন ব্যক্তি সব ওলটপালট করে দিয়েছে, পুলিশকে জাগিয়ে তুলেছে। বুজুমবুরার প্রতিটি পুলিশ ইউনিট খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘তা উঠারই কথা। আমি বুজুমবুরার ভ্যাটিকান দূতাবাসের সাথে কথা কলেছি। দেখলাম, তারাও আতংকিত। সন্ত্রাসীরা এবং এই সন্ত্রাসীদের যে হত্যা করেছে দুই পক্ষই তাদের ভীত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মাত্র একজন লোক আক্রমণকারী দুই সন্ত্রাসী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিল, অসাধারণ সে লোকটি কে হতে পারে? অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের খ্রিস্টান পরিচয় সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল বলল, ‘মি. কলিন ক্রিস্টোফার সরকার তো উদ্বিগ্ন হবেই। কিন্তু আমরা কতটা উদ্বিগ্ন হবো, সেই কথা বলুন।’
‘আমরা উদ্বিগ্ন হবো কেন, আমরা সতর্ক হবো। বাতাস মানুষের জন্যে এবং পানি মাছের জন্যে যেমন জীবনদায়িনী, তেমনি আমাদের কাজ আমাদের জীবনধারণ ও জীবন বিকাশের জন্যে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আমি আপনার সাথে একমত। কিন্তু আপনি তো সতর্ক হওয়ার কথা বললেন। তাহলে আমরা কি আমাদের পথ পরিষ্কারের জন্যে যে নির্মূল প্রোগ্রাম চালাচ্ছি সেটা কি আপাতত স্থগিত রাখবো?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘কার ভয়ে? সরকারের ভয়ে? সরকারকে আমরা গণনার মধ্যেই ধরি না। আমাদের স্বার্থের বাইরে এক ইঞ্চি যাবার ক্ষমতা সরকারের নেই আমরা শুধু আমাদের কাজের গোপনীয়তা প্রকাশের ভয় করি। আমরা চাই না আমাদের কাজ নিয়ে কেউ হইচই করার সুযোগ পাক। হইচই জানাজানি হলেই আমরা বিপদে পড়ব। যেমন পড়েছিলাম ক্যামেরুনসহ মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায়। আহমদ মুসা যে সর্বনাশ করেছিল তার ক্ষতিপূরণ কোনোদিন হবে বলে মনে হয় না।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আহমদ মুসা লোকটির কথা আমিও অনেক বার শুনেছি। সে নাকি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। সে যেখানে যায়, সৌভাগ্যও তার সাথে সেখানে যায়। আমাদের ইস্ট আফ্রিকায় তো সে কোনো ঝামেলা পাকাবে না?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘সে আসার মতো পরিস্থিতি এই অঞ্চলে নেই। তবু সাবধানের মার নেই। যে লোক আমাদের ১২ জন লোক মারল, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে সামনে আনতে হলে আমাদের প্রোগ্রামের কাজ বাড়াতে হবে সে চুপ করে বসে থাকার লোক নিশ্চয় নয়। কাজ বাড়লে আমাদের কাজই তাকে টেনে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে। সুতরাং কাজ বাড়ান মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘ধন্যবাদ মি. কলিন ক্রিস্টোফার। এটাই ছিল আমার বিষয়। আপনি যা বলেছেন তার সাথে আমরা একমত। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন হবে উপযুক্ত জনবলের। আপনি নিশ্চয় এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘হ্যাঁ মি. স্টিফেন ফোবিয়ান শীর্ষ পর্যায়ের ১২ জন কমান্ডোকে আমরা হারিয়েছি। দু’একদিনের মধ্যেই আরও ট্রেইন্ড, আরও চৌকশ একটা দলকে আমি বুজুমবুরায় পাঠাচ্ছি। চিন্তা করবেন না আপনারা, আমাদের লোকবলের অভাব নেই।
‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। আমি মোবাইলটা মি. বাতিস্তা সান্ড্রিকে দিচ্ছি মি. কলিন ক্রিস্টোফার। স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘ওয়েলকাম মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। যিশু সেভ আস।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
.
বাস থেকে নেমে আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো রাস্তার বাম পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। পোশাকে-আশাকে চাওসিকোকে অন্য দিনের চেয়ে বেশ ফরমাল বলে মনে হচ্ছে। হাল্কা নীল ফুলপ্যান্টের উপর হাল্কা নীল কোট, ভেতরে সাদা শার্ট পরেছে। কেডসের বদলে পরেছে সু। সামনে তাকিয়ে হাঁটছিল সে।
তার পাশে একটা গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ পেল। তাকাল চাওসিকো সেদিকে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আনা আরিয়াকে হাত নাড়তে দেখল। আনা আরিয়া গাড়ি থেকে নেমে ইব্রাহিক চাওসিকোর পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘সালাম আলায় কুম। আমি আন্টির বাড়ি থেকে আসছি। আপনি…’
‘হঠাৎ সালাম আলায় কুম কেন?’ আনা আরিয়ার কথার মাঝখানেই বলে উঠল চাওসিকো।
‘হঠাৎ হবে কেন? আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে মুসলমানদের পারস্পরিক দেখা হওয়ার সময়কার সম্বোধন বের করেছি এবং মুখস্থও করেছি। আপনার সাথে দেখা না হওয়ায় তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি। বলুন উচ্চারণ ঠিক হয়েছে কিনা?’ বলল আনা আরিয়া।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছি। আপনিও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলল চাওসিকো।
‘তাহলে আসুন।’ বলে আনা আরিয়া এগোলো গাড়ির দিকে। চোখে-মুখে চাওসিকোর একটা বিব্রত ভাব প্রকাশ পেল। একটু ইতস্তত করে এগোলো গাড়ির দিকে।
আনা আরিয়া তার ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের দরজা খুলে ডাকল চাওসিকোকে সেদিকে।
চাওসিকো দাঁড়িয়ে পড়ল। আনা আরিয়ার পাশের সিটে বসতে তার মন চাইল না। একটু দ্বিধা করতে লাগল।
মুখে হাসি ফুটে উঠল আনা আরিয়ার। বলল, ‘অসুবিধা নেই। আমার দিকে নয়, সামনের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন।’
‘মিস আনা আরিয়া, কাউকে দেখা, কারও দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকাকেই শুধু নিষেধ করা হয়নি, আরও কিছু আছে।’ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসতে বসতে বলল চাওসিকো।
‘হ্যাঁ, সেদিনের আলোচনা তো মুলতবি আছে। এই ‘আরও কিছু তো সেখানে অবশ্যই আসবে। আচ্ছা বলুন তো, সেই ঘনিষ্ঠজন কারা, যারা ছাড়া অন্য কারও সাথে খোলামেলা দেখা সাক্ষাত ও মেলামেশা করা যাবে না?’ আনা আরিয়া বলল।
‘স্ত্রী বাদে অন্যেরা হলো মা, মেয়ে বোন ফুফু, খালা, ভাতিজী, ভাগ্নী, দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ি, স্ত্রীর অন্যপক্ষের মেয়ে, ছেলের স্ত্রী, অধিকার ভুক্ত ক্রীতদাসী। আরো একটা তালিকা দিয়েছে আমাদের ধর্মগ্রন্থ। সেই তালিকায় যারা আছে, তারা ছাড়া অন্য পুরুষের সামনে মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে না।’ বলল ইব্রাহিম চাওসিকো।
‘সৌন্দর্য কি?’ আনা আরিয়া বলল।
‘স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ হয় যেমন মুখ, হাতের কব্জি পর্যন্ত ও পায়ের টাকনুর নিচের অংশ ছাড়া নারীর অন্যসব অংগই তার সৌন্দর্যের অধীন।’ বলল চাওসিকো।
‘ও গড, এতো একদম প্যাকেট হয়ে যাবার মতো! খুব ভারি ব্যাপার।’ আনা আরিয়া বলল।
‘কারও জন্যে ভারি, কারও জন্যে আনন্দের। এটা মানসিক ব্যাপার।’ বলল চাওসিকো।
‘ব্যাপারটা ভালো মানসিকতার অথবা খারাপ মানসিকতার, তাই কি?’ আনা আরিয়া বলল। তার দৃষ্টি সামনে, ঠোঁটে হাসি।
‘মানসিকতা খারাপ কিংবা ভাল বিষয়টা ঠিক তা নয়। মানসিকতা আসে বিশ্বাস থেকে এবং অনুশীলিত সংস্কৃতি থেকে।’ বলল চাওসিকো।
‘একজন ইসলামী বিশ্বাসের অনুসারী হলেই কি তার এ ধরনের পোশাক ভালো লেগে যাবে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘শুধু মুসলিম কেন, অন্য ধর্মের অনেক মেয়ে নিজস্ব ভালো-মন্দের বিশ্বাস থেকে শরীর ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরে থাকে। এখানে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের ব্যাপারটাই মুখ্য।’ বলল চাওসিকো।
‘ইসলাম নিশ্চয় এই বিবেচনাতেই মেয়েদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করেছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ইসলামের সকল আইনই মানুষের কল্যাণ, মানুষের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ইসলামের বিশ্বাস, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, আদেশ-নিষেধ সবই মানুষের মুক্তি ও মঙ্গলের জন্যে। এ সবের কোনোটাই স্রষ্টা আল্লাহর প্রয়োজনে নয়, এসব থেকে আল্লাহর কোনো উপকারও হয় না। বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়ার চোখে-মুখে বিস্ময়। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকল চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘একটা বড় কথা বলেছেন। ধর্ম মানুষের জন্যে, এর সকল বিধি-বিধান মানুষের মঙ্গলের জন্যে। স্রষ্টা বা আল্লাহর এতে কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। এ থেকে একটা প্রশ্ন আমার মনে আসছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির মতো এ বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞ স্রষ্টা তাহলে কেন করলেন? এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, জীব-জন্তু সৃষ্টি করলেন, গাছ-পালা পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা-সমুদ্র সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন বাতাস, পানি, আবহাওয়া, শুধু তাই নয়, সৃষ্টি করলেন ভাসমান পৃথিবীকে তার কক্ষপথে সুরক্ষার জন্যে সূর্যকে মধ্যমণি করে বিশাল সৌরজগত, সৌরজগতকে রক্ষার জন্যে সৃষ্টি করলেন লক্ষ কোটি সূর্য বা তারকা নিয়ে গ্যালাক্সি বা তারকা-পুঞ্জ আবার এ গ্যালাক্সির সুরক্ষার জন্যে সৃষ্টি করলেন লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে সৃষ্টি করলেন মহাবিশ্ব, যা এখন পর্যন্ত জানা চৌদ্দ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাসের মহাবিশ্ব যার প্রতি স্থানের ভর ও ভারসাম্য বিস্ময়করভাবে একই রকম। এই মহা, মহা কর্মযজ্ঞ স্রষ্টা আল্লাহ সৃষ্টি করলেন শুধু মানুষের জন্যে। কেন এটা, কেন?’
কথা শেষ করল আনা আরিয়া। আবেগে তার মুখ ভারি হয়ে উঠেছে এবং তার সাদা মুখটা হয়ে উঠেছে লাল।
আবেগের স্পর্শ চাওসিকোর চোখে-মুখেও। বলল সে, ‘হতে পারে আনা আরিয়া মানব সৃষ্টি রাব্বুল আলামিন আল্লাহর প্রিয়তম প্রজেক্ট। তিনি তার বান্দাহ মানুষকে অপরিসীম ভালোবাসেন। তার প্রেরিত বাণী বুক অব গাইডেন্স আল কুরআন জুড়ে তার একত্বের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার পরে মানুষকে তার ভালোবাসার দিকটাই মুখ্য। যত আদেশ-নিষেধ, বিধি- বিধান, তিনি দিয়েছেন সব মানুষকে ভালোবেসেই এবং তিনি পথভ্রষ্ট বিদ্রোহী মানুষদের শাস্তির বিধান তুলে ধরে বারবার যে তাদের সতর্ক করেছেন, সেটাও মানুষকে ভালোবেসেই। আল্লাহর মহা-সৃষ্টিতে মানুষই কেন্দ্রবিন্দু, তাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টির আবর্তন, মানুষের শেষ থেকেই শেষ এ পৃথিবীর, সমাপ্তি এই মহাবিশ্বেরও। তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টি করবেন নতুন পৃথিবী, নতুন আকাশ, বেহেস্ত-দোযখ সমন্বিত নতুন ব্যবস্থাপনা। সেটাও মানুষেরই জন্যে’ বলল চাওসিকো।
‘ওয়ান্ডারফুল মি. চাওসিকো। আপনার এ কথাগুলো আবারও শুনতে ইচ্ছা করছে। মানুষকে যে আপনি কত বড় করেছেন! এমনটা কখনও কেউ…।’
‘এই ‘বড় মানুষ’-এর স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রত্যাবর্তন স্থল যিনি সেই আল্লাহ কত যে বড়, তা আমাদের চিন্তা, জ্ঞানের আয়ত্ত্বাধীন নয়।’ বলল চাওসিকো আনা আরিয়ার কথার মাঝখানেই।
আনা আরিয়ার মুখ এখনও আবেগে আরক্ত। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. চাওসিকো। সত্যি আমার খুব ভালো লাগছে। চিন্তার নতুন দিগন্ত মনে হচ্ছে আমার কাছে খুলে গেছে। মানব সৃষ্টিকে স্রষ্টা আল্লাহর প্রিয়তম প্রজেক্ট বলেছেন। প্রজেক্ট বলতে আমরা একটা পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়ন এবং একটা ফল লাভকে বুঝি। স্রষ্টার এই প্রজেক্টটা কি?’
‘সেটা হলো স্রষ্টার মানব সৃষ্টি।’ বলল চাওসিকো।
‘মানুষ তো দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টির মতোই সৃষ্টি, তাহলে মানব সৃষ্টি আলাদাভাবে প্রজেক্ট হলো কি করে?’ আনা আরিয়া বলল।
দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টি মানব সৃষ্টির সাথেই সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলেই মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজন পূরণের জন্যে সৃষ্টি করেছেন পশু-পাখি, পাহাড়-নদী-সুমদ্র, ফসল, ফল-ফলাদী, গাছ-পালা, মেঘ-বৃষ্টি, আলো-বাতাস, খনিজ দ্রব্য, চন্দ্র-সূর্য, বিশ্ব-মহাবিশ্ব সবকিছু। এ সব কিছুই মহামহিম আল্লাহর মানব প্রজেক্টকে সহায়তা করার জন্যে।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। কিন্তু প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, ফলাফলের বিষয়টাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’ আনা আরিয়া বলল।
‘পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু কি বলার দরকার আছে? শ্রেষ্ঠতম জীব হিসেবে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন এবং স্বাধীন কর্মউপযোগী মানুষের সৃষ্টি,
পৃথিবীকে মানুষের জীবনধারণ ও বসবাসের উপযোগী করা, মানুষের খাদ্য ও ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের সৃষ্টি, সময় ও সভ্যতার পরিবর্তন-উন্নয়নে নতুন নতুন উপকরণ সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখা, এসবই তো স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফল। বলল চাওসিকো।
‘অনেক ধন্যবাদ মি. চাওসিকো। খুব কঠিন, জটিল এবং জগৎজোড়া একটা বিষয়কে খুব সহজ ও সংক্ষেপ করে দিয়েছেন আপনি৷ কিন্তু ফলাফলের বিষয়টা আপনি বলেননি। এক মানব সৃষ্টির জন্যে আল্লাহ এত বিশাল-বিশাল আয়োজন কেন করেছেন? তিনি কি পেয়েছেন?’ আনা আরিয়া বলল।
‘আল্লাহ কিছু পাবেন কেন? কিছু তো তিনি চান না। কিছু পাবার জন্যে, কিছু চাইবার জন্যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেননি। তিনি সকল প্রকার প্রয়োজন ও অভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, সকল অপূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা থেকে পবিত্র তিনি, কোনো মুখাপেক্ষিতা তাঁর নেই। আর স্রষ্টাকে কিছু দেবার ক্ষমতা তাঁর সৃষ্ট মানুষের কোত্থেকে আসবে? আল্লাহ তার ইচ্ছায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষার জন্যে। একদিকে আল্লাহ মানুষকে তার সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অবয়বে সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে তাকে একটা সীমিত জীবন দিয়েছেন। এই জীবনকালে তার সকল প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তার এই জীবনকে সুখী-সুন্দর করার জন্যে পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে একটা সংসার দিয়েছেন। এই সাথে আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের সুস্পষ্ট জ্ঞান এবং তিনি দিয়েছেন মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি। এইভাবে হাজারো নিয়ামত ও স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা মানুষকে দিয়ে তাদের চলার জন্যে তাদের জীবন-পথ হিসেবে সামনে রেখেছেন সত্যপথ ও পথভ্রষ্টতা। নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আসা সত্যপথ হলো আল্লাহর পথ। আর পথভ্রষ্টতা শয়তানের পথ। আল্লাহ চান, মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধির অনুসরণে নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আসা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে আল্লাহর পথে চলুক, শয়তানের কুমন্ত্রণার ফল পথভ্রষ্টতা তারা পরিহার করুক। এই সাথে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, মানুষ যদি আল্লাহর পথে চলে, তাহলে দুনিয়ার সীমিত জীবন শেষে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সে অনন্ত সুখের জান্নাত লাভ করবে, আর যদি শয়তানের পথে চলে তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তাকে অনন্ত শাস্তির জাহান্নামে গিয়ে পড়তে হবে। এখন মানুষ কোন্ পথ বেছে নেবে, কোন্ পথে চলবে, সেটাই এই দুনিয়াতে আল্লাহর পরীক্ষার বিষয়। রাব্বুল আলামিন আল্লাহর একক ও অনন্য মানব প্রজেক্টের এটাই লক্ষ্য। মানুষ কোন্ পথে চলে কোন্ পরিণতি লাভ করে, সেটাই এই প্রজেক্টের ফল।’ চাওসিকো তার দীর্ঘ কথা শেষ করল।
কোনো কথা এলো না আনা আরিয়ার দিক থেকে। তার মুখ গম্ভীর। আনা আরিয়াই নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘কথাগুলো না শুনলেই ভালো ছিল। এখন ভয় করছে। আমি আনা আরিয়া একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে আল্লাহর প্রজেক্টের অংশ আমি। প্রজেক্টের বাস্তবায়ন পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু ফলের ব্যাপারটাই ভয় ধরিয়ে দিল। আল্লাহর পথে না চললে অনন্ত শাস্তির জাহান্নামে যেতে হবে। এতো ভয়াবহ এক সতর্কবাণী। এ সতর্কবাণী তো আমার জন্যেও। তাহলে আমি কি করব? আল্লাহর পথ কোনটি? আমার খ্রিস্টধর্ম কি আল্লাহর পথ নয়? এটাই আমার কাছে এখন বড় প্রশ্ন চাওসিকো।’ শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠ আনা আরিয়ার। যেন হৃদয়ের কোন্ অতল থেকে বেরিয়ে এলো কথাগুলো।
হৃদয়ের একান্ত ছোঁয়া নিয়ে বেরিয়ে আসা আনা আরিয়ার কথা চাওসিকোর হৃদয়কেও গভীরভাবে স্পর্শ করল। সংগে সংগে কথা তারও মুখে এলো না। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আনা, এ এক ভয়াবহ সতর্কবাণী আল্লাহর তরফ থেকে। আর এই সতর্কবাণী তিনি কুরআন মজিদে একবার নয়, বার বার করেছেন। এ ছাড়াও আল্লাহ শতবার শত রকমে মানুষকে বুঝিয়েছেন শয়তানের পথে চললে তার সীমাহীন কষ্টদায়ক পরিণতির কথা।
একটু থামল চাওসিকো। আবার শুরু করল তার কথা, ‘আল্লাহর পথ কোটি, আপনার এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। আল্লাহর…।’
চাওসিকোর কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে ‘আনা’: ডাকলেন, আবার ‘আপনি’ হলাম কেন?’ বলল আনা আরিয়া। তার মুখ জুড়ে লজ্জার লাল আভা।
চাওসিকোর মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, হঠাৎই বলে ফেলেছি। কিন্তু আপনিও তো আমাকে ‘চাওসিকো’ ডেকে আবার ‘আপনি’ বলেছেন।’
‘প্রত্যাহার করলাম, আর ‘আপনি’ বলব না।’
মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলল আনা আরিয়া, ‘গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝখানে কথা বলার জন্যে দুঃখিত। আবার শুরু করার জন্যে কি অনুরোধ করতে পারি?’
‘ধন্যবাদ। তোমার প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ বলেছি। তার কারণ, সব মানুষের পিতা আদম (আ.)। আর আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহর পথ একটিই এবং তা চিনে নেয়া খুব সহজ। সব নবী-রাসুল যেমন হযরত আদম (আ.), নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) বা যিশু এবং মুহাম্মদ (স.) সবাই আল্লাহর এক পথের কথাই প্রচার করেছেন। সবারই এক আহ্বান ছিল, আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই। শুধু তারই ইবাদত করতে হবে, শুধু তারই আদেশ নিষেধ মানতে হবে। মাত্র…।’
চাওসিকোর কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘আমি যিশুর ধর্ম পালন করি, তাহলে আল্লাহর পথের উপরই তো আমি আছি।’
‘ঈসা (আ.) বা যিশু প্রচারিত ধর্ম আল্লাহর পথ ছিল, কিন্তু এখন নেই। কারণ যিশুর পর আল্লাহ তায়ালা আরেকজন রাসুল প্রেরণ করেছেন। এখন এই রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথ অনুসরণ করলেই আল্লাহর পথে চলা হবে।’ বলল চাওসিকো।
‘কেন, তাদের সকলের পথ একই পথ, আল্লাহর পথ- তুমিই তো বললে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘একই পথ হলেও, ধর্মের মূল কথা ঠিক থাকলেও এক নবীর পর যখন আরেকজন নবী এসেছেন, তখন তার মাধ্যমে নতুন আদেশ-নিষেধ, নতুন জীবনাচরণ পাঠানো হয়েছে মানুষের জন্যে। আগের নবীর আইন-কানুন, বিধিবিধান তার ফলে সব বাতিল হয়েছে এবং তার স্থলে নতুন নবীর আইন কানুন, বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন যিশু আসার পর মুসার (আ.) শরিয়ত (আইন-কানুন, বিধিবিধান) বাতিল হয়েছিল, ঠিক তেমনি নবী মুহাম্মদ (সা.) আসার পর ইসা (আ.) বা যিশুর শরিয়ত বাতিল হয়ে গেছে ব্যাপারটাকে তুমি সংবিধান সংশোধনের সাথে তুলনা করতে পার। সংবিধান যখন সংশোধন হয়, সংশোধিত সংবিধানই সকলকে মানতে হয়। আগের সংবিধান কেউ মানে না, মানলে তা অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। বলল চাওসিকো।
সংগে সংগে কথা বলল না আনা আরয়া। তার চোখে-মুখে বিস্ময় ও ভাবনার চিহ্ন। একটুক্ষণ পর বলল সে, ‘এই সহজ কথাটা খ্রিস্ট ধর্ম, ইহুদি ধর্মের কোটি কোটি লোক মানছে না কেন, বুঝছে না কেন?
‘এটা মানুষের বিপজ্জনক একটা প্রবণতা। নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাস, নিজের দেশ, নিজের জাতি এবং সবশেষে খোদ নিজেকে সবার চেয়ে ভালো, সবার চেয়ে বড় করে দেখা মানুষের অত্যন্ত ক্ষতিকর একটা ইগো। অতীতে এটাই ঘটেছে, এখনও সেটাই ঘটছে। মুসা (আ.)-এর পর যখন ঈসা (আ.) বা যিশু আসলেন, তখন মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা যিশুকে মানেনি, বরং তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, যিশুর অনুসারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন করেছে। অনুরূপভাবে যিশুর পর নবী মুহম্মদ (সা.) আসলে যিশুর অনুসারীরা তাকে মানছে না। শুধু মানছে না তা নয়, শুরু থেকে তারা মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা করেছে, ৭টা ক্রসেড চাপিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের উপর গোটা ইউরোপ এক হয়ে। বিভিন্ন নামে, বিভি- ন্ন রূপে সে লড়াই এখনও চলছে।’ বলল চাওসিকো।
চুপ হয়ে গিয়েছিল আনা আরিয়া। ভাবছিল সে। এক সময় বলল, ‘তাহলে আল্লাহর পথের প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব? এ লড়াই কি থামবে? আল্লাহ তো থামাতে পারেন, তিনি সর্বশক্তিমান।’
‘কিন্তু আল্লাহ থামাবেন না, যদি মানুষ না থামায়। তিনিই যদি থামান, তাহলে মানুষের পরীক্ষা হবে কেমন করে? পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তর যদি স্যার বলে দেন, তাহলে পরীক্ষা হবে কেমন করে? আল্লাহর পথ নিয়ে মানুষ কি করছে, কি করবে, এটাই আল্লাহর পরীক্ষা। তিনি পথ দেখিয়েছেন, সে পথে চললে কি হবে, না চললে কি হবে তা তিনি বিশদভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানুষকে ভালো-মন্দ চেনার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। সত্য- মিথ্যা বাছাইয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন, এখন মানুষের দায়িত্ব, আল্লাহর দেয়া জীবন এবং তাঁর দেয়া হাজারো দান-দয়া-অনুগ্রহে কৃতজ্ঞ হয়ে সে আল্লাহর পথে চলবে, না আদি থেকে মানুষের শত্রু শয়তানের পথে চলবে, সেটা নিজে বাছাই করে নেয়া। বলল চাওসিকো।
চাওসিকো থামলেও নীরব আনা আরিয়া। তার স্থির দৃষ্টি সামনে। ভারি হয়ে উঠেছে তার চোখ-মুখ। তার রক্তাভ ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা কম্পন! তার হৃদয়ের কোনো অস্থিরতার প্রকাশ কি এটা? চলছে গাড়ি। প্রবেশ করল গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
ভাইস-চ্যান্সেলর স্টিফেন ফোবিয়ানের বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কেন্দ্র প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি বিল্ডিং পার হয়ে আরও পশ্চিমে।
আনা আরিয়া গাড়ি থামাল লাইব্রেরি বিল্ডিং-এর গেটে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে এসে চাওসিকোর পাশের দরজা খুলে দাঁড়াল আনা আরিয়া। গাড়ি থেকে নামল চাওসিকো।
‘চাওসিকো তুমি লাইব্রেরিতে বসো। আমি ঠিক সাড়ে নয়টায় আসব। আমি তোমাকে কনভেনশন হলে নিয়ে যাব। আপত্তি নেই তো?’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটে এক টুকরো ম্লান হাসি।
‘আমি তো আপত্তি করিনি।’ চাওসিকো বলল।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তাহলে আসি।’
বলে গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল আনা আরিয়া যাওয়ার জন্যে। কিন্তু থমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল চাওসিকোর দিকে। তার গম্ভীর মুখ। বলল, ‘চাওসিকো তোমার আল্লাহকে আমার পক্ষে বোলো তিনি যেন দয়া করে আমার হৃদয়কে শান্ত করে দেন, স্থির করে দেন।’
‘আল্লাহ তো শুধু আমার নয়, তোমারও। তোমার ঘাড়ের যে শাহরগ আছে তার চেয়েও আল্লাহ তোমার বেশি কাছে। তুমি তাঁর সাথে কথা বলো। তোমার সব তিনি জানেন। বান্দার সরাসরি কথা তিনি পছন্দ করেন।’
আনা আরিয়া মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল। ঠোঁট তার কাঁপছিল ভেতরের কোনো এক উচ্ছ্বাস রোধ করতে গিয়ে। বলল সে, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো।’ দুই শব্দের এই কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল প্রবল এক উচ্ছ্বাসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি সে গাড়িতে উঠল।
লাইব্রেরি বিল্ডিং অতিক্রম করে ছুটে চলল আনা আরিয়ার গাড়ি।
বিস্মিত, বিব্রত চাওসিকো।
তার মন স্বগতই বলে উঠল, ‘খুব বুদ্ধিমান, খুব সরল, খুব ভালো মেয়ে আনা আরিয়া। হে আমার কারিবুম মুজিব আল্লাহ, তাকে দয়া করুন। তার ডাকে দয়া করে সাড়া দিন?’
হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল চাওসিকো। সকাল সাড়ে আটটা বাজে আজ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন হলে জগৎবিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অ্যাডাম আলেস্কিস ইডেলম্যান বক্তৃতা দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে। মি. অ্যাডাম ইডেলম্যান ট্রিপল নোবেল প্রাইজ উইনার, দুইটি পদার্থ বিজ্ঞানে, একটি কেমিস্ট্রিতে। আফ্রিকা মহাদেশে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তার একটি হলো পোপ ভিক্টর, ইউনিভার্সিটি। অনেকদিন ধরে আয়োজন চলছে এই প্রোগ্রামের। বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের আকর্ষণ এই প্রোগ্রামের প্রতি বেশি। এজন্যে শিক্ষক ও এই দুই বিভাগের ছাত্রদের কনভেনশন হলের প্রোগ্রামে ডাকা হয়েছে। অন্যান্য ছাত্র ও শ্রোতাদের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বড় স্ক্রিনের মাধ্যেমে প্রোগ্রাম দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কনভেনশন হলের প্রোগ্রামের জন্যেই সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে চাওসিকো। আনা আরিয়ার গাড়ি চলে যাবার পর চাওসিকো ঘুরে দাঁড়িয়ে লাইব্রেরির দিকে পা পাড়াল।
.
দশটা বাজার আগেই কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেল কনভেনশন হল। পৌনে দশটায় আনা আরিয়া ও চাওসিকো গাড়ি থেকে নামে। কনভেনশন হলের দিকে এগুতে এগুতে বলল আনা আরিয়া, ‘চাওসিকো তুমি হলে গিয়ে বসো। আমি দেখি বাবা কোথায়। বাবা আমাকে তাঁর সাথে বসতে বলেছেন।
‘ঠিক আছে আনা। লিফট দেবার জন্যে ধন্যবাদ তোমাকে।’ বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়া ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ডেকে গাড়িতে তুলেছি। সুতরাং লিফট দেবার সুযোগ দেয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ আনা আরিয়ার মুখে হাসি।
চোখ নিচু করে দাঁড়ানো চাওসিকোর ঠোঁটেও এক টুকরো হাসি। বলল, ‘দুই ধন্যবাদ ইজ ইকুয়াল টু প্লাস ওয়ান প্লাস ওয়ান। দুজনেই সমান, দুজনেই বিজয়ী।’
‘দেখ তোমার ইকুয়েশন কিন্তু আমার মুখে আরেকটা কথা এনে দিয়েছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘কি কথা?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর
‘আজ নয়, আরেকদিনের জন্যে থাকল। আসি, সালাম।’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল আনা আরিয়া।
চাওসিকো কনভেনশন হলে ঢুকে গেল।
সামনের কিছু সিট বাদে হল কানায় কানায় ভর্তি। হলের সামনের প্রায় অর্ধেকটা রিজার্ভ রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের বাছাই করা কিছু বিজ্ঞান শিক্ষকের জন্যে। এর মধ্যে দু’দশটা সিট রয়েছে শহরের বিশেষ গণ্যমান্যদের জন্যে বরাদ্দ। আর হলের বাকি অর্ধেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের জন্যে। উপরের ব্যালকনিতে জায়গা দেয়া হয়েছে শহরের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের।
চাওসিকো তাদের জন্যে বরাদ্দকৃত জায়গায় গিয়ে বসল।
চাওসিকোর হাতে সুন্দর একটা নোট বুক।
ঠিক নয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে অতিথি পদার্থ বিজ্ঞানী অড্যাম আলেক্সিস ইডেলম্যানকে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর এবং কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক মঞ্চে প্রবেশ করল।
মঞ্চের লাউড স্পিকারে ঘোষণা হলো।
সভাপতির আসনে বসল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান। এবং অতিথির আসনে বসল পদার্থ বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। মঞ্চ থেকে সিনিয়র শিক্ষকরা নেমে এসে দর্শকের সারিতে তাদের আসনে বসল। এই শিক্ষকরা বসার আগে মাঝ বয়সী একজন সুবেশধারী মহিলার সাথে আনা আরিয়া এসে সামনের সারিতে সেই মহি- লার পাশে বসল।
‘বিস্মিত হলো চাওসিকো। আনা আরিয়ার এত সম্মান কেন? মহিলা কি আনার মা? মহিলা কে? কিন্তু আনা তো বলেছিল সে তার পিতার সাথে বসবে। তার পিতা কোথায়?
চাওসিকোর চিন্তা আর এগুতে পারল না। মঞ্চের মাইক্রোফোন কথা বলে উঠল। অনুষ্ঠান শুরু হলো।
সূচনা বক্তব্যের পর পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সবচেয়ে প্রবীণ অধ্যাপক প্রফেসর অলিভার ইউজিন এলভিস নোবেল বিজ্ঞানী পদার্থবিদ অ্যাডাম আলেক্সিস ইডেলম্যানকে স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দিলেন। ভাষণের শেষের দিকে তিনি জানালেন, বহুদিন থেকে যার কথা শোনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি, সেই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মহান পদার্থবিদ অ্যাডাম অ্যালেক্সিস ইডেলম্যান যাকে তিনটি নোবেল পুরস্কার দিয়ে দুনিয়া ধন্য হয়েছে, এখন আমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন। তাঁর রীতি অনুসারে তার বক্তৃতার শুরুতে থাকছে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব। স্বাভাবিকভাবেই এ পর্বে একজন মহান শিক্ষক হিসেবে তিনি হবেন প্রশ্নকর্তা। আর আমাদের বিজ্ঞানের ছাত্ররা হবে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দাতা। বিজ্ঞানের ছাত্রদের সাথে মত বিনিময়ের এক মাধ্যম হিসেবেই তিনি এটা করে থাকেন। আমাদের সকলের জন্যে এটা হবে একটা মজার বিজ্ঞান- সংলাপ। আমাদের বিজ্ঞানের ছাত্ররা একে এই দৃষ্টিতেই নেবে আশা করি।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মি. ইডেলম্যান তার টেবিলে বসেই বক্তৃতা করবেন, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সব ছেড়ে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। শুরু করল তার বক্তৃতা।
প্রাথমিক কথার পর তার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু করল।
বলল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান, ‘আমার প্রিয় ছাত্র ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্যে আমার প্রশ্ন নয়। তোমাদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমি নতুন কিছু পেতে চাই, বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে চাই।’
মুহূর্তের জন্যে থামার পর বিজ্ঞানী বলল, ‘আমি এ বছর এ পর্যন্ত বত্রিশটি-বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছি। সবটাতেই আমি আমার ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের তিনটি প্রশ্ন করেছি। আমি অনেক উত্তর পেয়েছি, নতুন কথাও পেয়েছি, কিন্তু আমার মন ভরেনি। মনে হয়েছে, আমি যে উত্তর চাই, সে উত্তর এগুলো নয়। বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমি কি উত্তর চাই সেটা আমি নিজেই জানি না। প্রশ্নের সমাধান তাই এখনও হয়নি। আমার সেই তিনটি পুরানো প্রশ্নই এখানে আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের কাছে পেশ করব।’
আবার তিনি মুহূর্তের জন্য বিরতি নিলেন। বললেন তারপর, ‘একটি প্রশ্নের জবাবের পর আরেকটি প্রশ্ন করব, এইভাবে আমি তিনটি প্রশ্ন করব। আর আমি প্রশ্ন করব এক বাক্যে, উত্তর দিতে হবে এক বাক্যে। ব্যাখ্যা চাইলে, সে ব্যাখ্যা ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা স্বাধীনভাবে করতে পারবে, কিন্তু খুব সংক্ষেপে। প্রশ্ন করার পর এক মিনিট সময় থাকবে। এর মধ্যে উত্তর দিতে কেউ না দাঁড়ালে প্রশ্ন বাতিল হয়ে যাবে। এরপর আসবে পরবর্তী প্রশ্ন।’
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান একবার চোখ বুলাল হলের উপর। পিনপতন নীরবতা তখন গোটা হলে। ধ্বনিত হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কণ্ঠ, ‘মেক এ কমেন্ট অন সিংগুলারিটি (সিংগুলারিটি’র উপর মন্তব্য কর)।
প্রথম প্রশ্ন এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান-এর কাছ থেকে।
নীরব গোটা হল। পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়। দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড; তিরিশ সেকেন্ড, চল্লিশ সেকেন্ড…। চাওসিকোর হাত ঘড়িতে তখন পঞ্চাশ সেকেন্ড। তার দৃষ্টি তার চারদিকে। কেউ দাঁড়ায়নি উত্তর দেবার জন্যে। দাঁড়াল চাওসিকো। তার ডান হাতে কলম, বাম হাতে তার নোট খাতা।
মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পর তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘সিংগুলারিটি ইজ নাথিং বাট অ্যা রিটার্ন অব অ্যা ক্রিয়েটেড টু ইটস হ্যাঁভেন, দ্যা ক্রিয়েটর। (সিংগুলারিটি স্রষ্টার আশ্রয়ে সৃষ্টির ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।) ‘
চাওসিকোর উত্তর শোনার পর বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কপাল কুঞ্চিত হলো। বিস্ময়ের একটা ছাপ তার চোখে-মুখে। চাওসিকোর উত্তরটা তার মুখে উচ্চারিত হলো একাধিকবার। বলল সে চাওসিকোকে উদ্দেশ্য করে, ‘মাই বয়, তুমি বলতে চাচ্ছ সিংগুলারিটি প্রকৃতপক্ষে একটা সৃষ্টির তার স্রষ্টার আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।’
চাওসিকো দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ‘ইয়েস স্যার।’
বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এক্সপ্রেইন মাই বয়।’
‘সিংগুলারিটি বস্তুর সংকোচনের শেষ একটা পর্যায়, যখন সূর্যের মতো বা তার চেয়েও বহুগুণ বড় বস্তু মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ব্যাসহীন অদ্বৈত এক বিন্দুতে পরিণত হয়। যা কার্যত বস্তু নয়, বস্তুর একটা অশরীরী শক্তি। মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে স্রষ্টার আশ্রয়ে আমাদের মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান মনে হয় এমনই ছিল। যা অন্যকথায় বস্তুর উপস্থিতি শূন্য পরম শূন্যতার পর্যায়ে পড়ে। একেই আমি বস্তুর তার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাওয়া মনে করি। থামল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান লাউড স্পিকারের সামনে থেকে মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় সরে এলো। চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ মাই ডিয়ার বয়।’ বলেই বিজ্ঞানী ইডেলম্যান হ্যান্ডক্লাপিং শুরু করল।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ভাইস-চ্যান্সেলরসহ হল ও ব্যালকনির সকলের হ্যান্ডক্লাপিং শুরু হয়ে গেল তার সাথে সাথে।
দাঁড়িয়েছিল চাওসিকো, বসে পড়ল সে।
সামনের সারি থেকে আনা আরিয়া চাওসিকোর প্রথম কথা বলার সময় থেকেই পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়েছিল চাওসিকোর দিকে। তার চোখে-মুখে প্রথমে ছিল প্রবল উত্তেজনা, কিন্তু পরে তার মুখ বিস্ময় ও আনন্দে ভরে উঠেছিল।
চাওসিকো বসলে আনা আরিয়া তার মুখ ঘুরিয়ে নিল।
স্পিকারস্ট্যান্ডে ফিরে এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। বলল, ‘এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- ‘বিইং অ্যা মেইডেন ইভেন্ট ইন ক্রিয়েশন হাও দ্যা ‘বিগ ব্যাং’ হ্যাঁপেনড। (সৃষ্টির প্রথম ঘটনা ‘বিগ ব্যাং’ কীভাবে ঘটে?)।’
আবার প্রশ্নের পর সেই নীরবতা।
দেয়ালের ডিজিটাল ঘড়ির সেকেন্ডের ডিজিটটা একটার পর একটা স্টেপ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেকেন্ডের ডিজিটটা আবার চারের ঘরে।
কেউ উঠে দাঁড়ায়নি, দেখলো চাওসিকো।
‘বিসমিল্লাহ’ বলে উঠে দাঁড়াল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান ছাত্রদের দিকেই তাকিয়েছিল সাগ্রহে। চাওসিকো উঠে দাঁড়াতেই বিজ্ঞানী ইডেলম্যান একমুখ হাসি নিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম মাই বয়, আগেরবার নাম বলনি। এখন তোমার নাম বলে উত্তর বলো।’
‘আমার নাম চাওসিকো।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ। এখন তোমার উত্তর বলো।’ বিজ্ঞানী বলল।
‘দ্যা বিগ র্যাং, অ্যা হিউজ এক্সপ্লোসন ফ্রম নাথিং, ইজ অ্যান অর্ডার ফ্রম ক্রিয়েটর। শূন্য থেকে ঘটা মহাবিস্ফোরণ বিগ ব্যাং স্রষ্টার একটা আদেশ মাত্র।’
ঠোঁটে হাসি মাখা কুঞ্চিত কপাল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান আগের মতোই চাওসিকের বলা বাক্যটি স্বাগত কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করল।
তার ঠোঁটের হাসিটি বিস্তৃত হলো। বলল, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো। এক্সপ্লেইন ইয়োর পয়েন্ট।’
চাওসিকো শুরু করল, ‘বিজ্ঞান অনুমিত বিগ ব্যাং নামক মহা- বিস্ফোরণ, যা পরম শূন্যের মাঝে সংঘটিত হয়েছিল, আমাদের জাগতিক বিচারে অসম্ভব একটি ঘটনা। সে বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে বস্তুকণার সৃষ্টি হয়েছিল, সে বস্তুকণাসমূহের সৃষ্টি সম্ভব করতে হলে বিস্ফোরণ শক্তির উপাত্ত হিসাবে সেখানে ‘কোয়ান্টাম ক্ষেত্র, স্থান-কাল ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এসব কিছুর জন্ম তো মহাবিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে হয়েছে। তখন মহাবিস্ফোরণের আগে এ সবের কিছুই ছিল না, ছিল শুধু পরম শূন্য। এই পরম শূন্যে বিগ ব্যাং-এর মতো সৃষ্টিমূলক বিস্ফোরণ কীভাবে হতে পারে? হতে পারে শুধু স্রষ্টার হুকুমে। আমি একথাই বলেছি।’
গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান চাওসিকোর কথা। চাসিকোর কথা শেষ হলে ঠোঁট টিপে একটু হাসল বিজ্ঞানী। বলল, ‘চাওসিকো তুমি কি মাদার ইউনিভার্স-তত্ত্বে’র কথা শুনেছ? সেখান থেকেই হয়তো মহাবিস্ফোরণের উপাত্তগুলো এসেছিল।’
‘এক্সকিউজ মি স্যার, সে ক্ষেত্রেও ‘মাদার ইউনিভার্স’ নিয়েও একই প্রশ্ন উঠে। যে কারণে আমাদের ইউনিভার্সের বিগ ব্যাং একটি অসম্ভব ঘটনা, সে কারণেই ‘মাদার ইউনিভার্সের’ বিগ ব্যাংকেও অসম্ভব বলতে হবে আমাদের।’ বলল চাওসিকো।
চাওসিকোর কথা শেষ হতেই হ্যান্ডক্লাপিং শুরু হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের। তার সাথে শামিল হলো মঞ্চ, হল ও ব্যালকনির সবাই।
আনা আরিয়া আগের মতোই পেছন ফিরে শুনছিল চাওসিকোর কথা।
সে হাততালি দিতে গিয়ে আবেগে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
মায়ের ইশারায় সংগে সংগে সে বসে পড়ে।
হাততালি শুরু হলে চাওসিকো মাথা নিচু করে বসে পড়েছিল।
হ্যান্ডক্লাপিং শেষ হলে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোনের সামনে নড়েচড়ে দাঁড়াল। বলল, ‘এবার আমার তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন : ‘মাই ডিয়ার বয়েজ, এন্ড গার্লস, হোয়ট ইজ দ্যা রিয়ালিটি এন্ড ইউটিলিটি অব প্যারালাল অ্যান্টি-পার্টিকল ইউনিভার্স?’ (আমার প্রিয় ছেলে-মেয়েরা, প্যারালাল অ্যান্টি-পার্টিকল ইউনিভার্সের বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা কী?)
এবারও অন্য কোনো ছাত্র জবাবের জন্যে দাঁড়াল না। ঠিক পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় চাওসিকো দাঁড়াল জবাব দেবার জন্যে।
‘অভিনন্দন মাই বয়, বলো তোমার এক বাক্যের জবাব।’ বলল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
‘অ্যাজ দ্য লাইফ এন্ড ম্যাটার ইন ক্রিয়েশন আর ইনপিয়ারস, সো ইউনিভার্স এন্ড প্যারালাল অ্যান্টি পারটিকল ইউনিভার্স অ্যাজ পিয়ার বি টেকেন টু বি অ্যা রিয়ালিটি এন্ড দ্য পিয়ারস, ইউনিভার্স এন্ড প্যারালাল অ্যান্টি পার্টিকল ইউনিভার্স, ফাইনালি নিডেড টু ডেস্ট্রয় দ্য প্রজেক্ট ক্রিয়েশন টু বি রিপ্লেসড বাই নিউ ক্রিয়েশন ফর আওয়ার লাইফ ইন হেয়ার আফটার- যেহেতু সৃষ্টির সব জীবন ও বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি, তাই জোড় বাধার জন্যে আমাদের ধনাত্মক কণার ইউনিভার্সের পাশে প্রতিকণার ইউনিভার্সকে বাস্তবতা হিসাবে ধরে নিতে হবে এবং এই জোড় দরকার বর্তমান সৃষ্টিকে অবশেষে ধ্বংস করার জন্যে, যা পথ করে দেবে স্থিতি’র এক নতুন ইউনিভার্স গঠনের, আমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রয়োজনে।’ বলল চাওসিকো।
বিস্ময় ও আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে। সে চাওসিকোর এক বাক্যের উত্তরটাকেই পুনরাবৃত্তি করছিল, যা মাইক্রোফোনে সবাই শুনতেও পাচ্ছিল। অনুষ্ঠানের সভাপতি ভাইস- চ্যান্সেলরের মুখে একটা স্তম্ভিত ভাব। সম্মুখভাগে বসা শিক্ষকদের মুখে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মতোই বিস্ময়ের সাথে আনন্দ।
আর আনা আরিয়ার দু’চোখ থেকে গড়াচ্ছিল অশ্রু-আনন্দের অশ্রু অনেকক্ষণের আবেগ-উত্তেজনায় তার সাদা মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
পাশে বসা তার মা তার হাতে একখণ্ড টিস্যু গুঁজে দিল।
সপ্রতিভ হয়ে উঠল আনা আরিয়া। তাড়াতাড়ি অশ্রু মুছে ফেলল।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোনে ফিরে এলো। বলল, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো, ‘জটিল ও বড় একটা বিষয়কে একবাক্যে যথেষ্ট সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ। এখন ব্যাখ্যা কর তোমার কথাটাকে।’
চাওসিকো দাঁড়িয়েই ছিল। বলল, ‘কণা, প্রতিকণা উভয়েরই সৃষ্টি করেছিল মহাবিস্ফোরণ। যতগুলো কণা সৃষ্টি হয়েছিল, ততগুলোই সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিকণা। কিন্তু আমাদের এই মহাবিশ্ব কণার সৃষ্টি, এখানে প্রতিকণা নেই। নেই কারণ, বিপরীতধর্মী কণা-প্রতিকণার সংস্পর্শ, সম্মেলন উভয়কেই ধ্বংস করে। কণাদের সৃষ্টির শুরুতে প্রতিকণাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান-এর তত্ত্ব বলছে, মহাবিস্ফোরণের শুরুতেই সময়ের সম্মুখ গতি ও পিছন গতির সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের ইউনিভার্সের সময়ের সম্মুখ গতি ধনাত্মক ধরলে, পেছন গতির সময় ঋণাত্মক। কণাগুলো সম্মুখ গতি নিয়ে আমাদের ইউনিভার্স গঠন করেছে, আর প্রতিকণারা ছুটে গেছে সময়ের পেছন গতির দিকে। পদার্থ বিজ্ঞানী মিশিও কাকু বলেছেন, বিপরীত দিকে অর্থাৎ সময়ের পেছন গতির দিকে প্রবাহিত প্রতিকণারা প্যারালাল একটা প্রতিকণার ইউনিভার্স সৃষ্টি করেছে। বল বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে দুই প্যারালাল ইউনিভার্সের স্থিতির সীমা আছে। তারপর স্রষ্টার বিধানেই দুই বিপরীত ইউনিভার্সের সংস্পর্শ ঘটবে এবং দুইয়ের মিলিত আরেক মহাবিস্ফোরণ পুরাতনকে ধ্বংস করে নতুন এক স্থিতির ইউনিভার্সের জন্ম দেবে, আমাদের মৃত্যু পরবর্তী চিরবাসস্থানের জগত হিসাবে। শেষোক্ত মহাবিস্ফোরণ বা আমাদের এই ইউনিভার্সের ধ্বংসের খবর ওহিভিত্তিক ধর্মের সব স্ক্রিপচার আমাদের দেয়, যা আমরা সবচেয়ে বিস্তারিত জানতে পারি ওহিভিত্তিক সর্বশেষ ধর্মের স্ক্রিপচার থেকে।’ থামল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে হাসি। তার দুই হাত তালি দেয়া শুরু করলো। গোটা হল, ব্যালকনি এবং মঞ্চ তার সাথে সাথে হাততালি দিল। শত শত হাতের সম্মিলিত তালিতে গোটা হল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোন থেকে পিছিয়ে গিয়ে মঞ্চে সভাপতির চেয়ারে বসা ভাইস চ্যান্সেলরকে একটা দীর্ঘ বাউ করে বলল, ‘আপনার ছাত্র চাওসিকো আমাকে মুগ্ধ করেছে। চাওসিকোর এই অভাবনীয় মেধার বিকাশে আপনার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্বই বেশি।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান তারপর মঞ্চের সম্মুখ প্রান্তে হলের সামনে বসা শিক্ষকসারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সকলের উদ্দেশে বাউ করল এবং বলল, ‘সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ চাওসিকোকে আপনারা তৈরি করেছেন, এজন্যে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।’
মাইক্রোফোনে ফিরে এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
ভাইস-চ্যান্সেলর, শিক্ষকবৃদ্ধ ও ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মোধন করে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান বলল, ‘আমার এই তিনটি প্রশ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ বছর ৩ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড এবং ১১ জানুয়ারি এমআইটি (MIT) থেকে। তারপর বিশ্বের আরও তিরিশটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছে আমার এই তিনটি, প্রশ্ন। MIT-সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রশ্নের ভালো জবাব দিয়েছে এবং অনেক নতুন কথা এসেছে তাদের কাছ থেকে। বিজ্ঞানকে তারা বিজ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে থেকেই দেখেছে। তার বাইরে কোনো সূত্র তারা খুঁজে পায়নি বা খোঁজেনি। তাদের জবাব আমাকে আনন্দিত করেছে, কিন্তু মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। তাই আমার তিন প্রশ্নের যাত্রাও আমি শেষ করতে পারিনি। আমার এ বছরের অভিযাত্রার তেত্রিশতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আজ আমার যাত্রা বিরতি আপনাদের পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকায়। সেই সাথে আমার তিন প্রশ্নের যাত্রার শেষ দিন এটা। আমার তিনটি প্রশ্ন তাদের জবাব পেয়ে গেছে। চাওসিকোর সব উত্তরের সাথে আমি পুরোপরি একমত একথা বলতে পারছি না। কারণ এ নিয়ে আমাকে আরও ভাবতে হবে। তার উত্তরগুলো সবদিক দিয়েই সঠিক তাও বলা যাচ্ছে না। তবে তার উত্তরে আমার মন পরিতৃপ্ত, যে পরিতৃপ্তি আমি আগের বত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে পাইনি। চাওসিকোর বড় বৈশিষ্ট্য হলো সে বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেনি, স্রষ্টার ইচ্ছা ও কাজকেও সে সন্ধান করেছে। বিজ্ঞানের বিশেষ ইস্যুর যৌক্তিক ব্যাখ্যার জন্যে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবন পরকালকেও সে নিয়ে এসেছে। বর্তমান বিজ্ঞানের বস্তুবাদিতা স্রষ্টা, ও পরকাল কোনোটিকেই চোখে দেখে না। কিন্তু স্রষ্টা বাদ দিয়ে সৃষ্টির চিন্তা করা হাস্যকর, তেমনি প্রতিফল-এর জগৎ পরকাল না থাকলে মানব জীবন অযৌক্তিক ও অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। চাওসিকো বিজ্ঞান ও সৃষ্টজগতকে এভাবেই দেখেছে, আমিও এভাবেই দেখতে চাই।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে একটু থামল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। তাকাল সে চাওসিকোর দিকে। তারপর সবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘আমি এটা ঠিক করে রেখেছি, যার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হবো, এ ঘটনার স্মারক হিসাবে তাকে আমি একটা ছোট্ট গিফট দেব। সেটা স্বর্ণের একটা কোটপিন। কোটপিনটা আমাদের ভিজিবল ইউনিভার্সের শিল্পীর আঁকা গোলাকার প্রতিকৃতি। তার বটমে আমার সিগনেচার আছে।’
কথা শেষ করে তাকাল আবার চাওসিকোর দিকে। বলল, চাওসিকো, মাই বয়, একটু কষ্ট করে এসো। তোমাকে কিছুটা সম্মানিত করার সুযোগ দাও।’
চাওসিকো বিনীত পদক্ষেপে উঠে এলো মঞ্চে।
দাঁড়াল বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সামনে। বলল, ‘স্যার, গোটা বিশ্ব যাকে সম্মানিত করেছে, আমাদের সেই মহান শিক্ষক আপনি। শিক্ষক ছাত্রকে সম্মানিত করে না স্যার। আশীর্বাদ করে, দোয়া করে।’
‘ধন্যবাদ, মাই ডিয়ার বয়।’ বলে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান চাওসিকোর কোটে পিন পরিয়ে দিল।
বলল, ‘স্রষ্টার কাছে আমার প্রার্থনা, তিনি যেন তোমাকে ভালো মানুষ, ভালো বিজ্ঞানী বানান।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বলে সে ভাইস-চ্যান্সেলরের দিকে কিছুটা এগিয়ে তার ক্যাডেট জীবনের অভ্যেস অনুসারে ভিসি’কে একটা স্যালুট দিল। অনুরূপভাবে মঞ্চের সামনের প্রান্তে গিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশে একটা স্যালুট দিয়ে সে নেমে এলো মঞ্চ থেকে। বসল তার সিটে এসে।
সামনের সারিতে একটি সোফায় সুবেশধারী সেই মাঝবয়সী মহিলার পাশে আনা আরিয়াকে বসে থাকতে দেখেছিল চাওসিকো। চোখে অশ্রু, আর মুখভরা হাসি নিয়ে আনা আরিয়া তাকিয়েছিল চাওসিকোর দিকে।
মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলার মুডে এসে দাঁড়াল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
‘অনারেবল ভাইস চ্যান্সেলর, রেসপেক্টেড টিচারস, মাইডিয়ার স্টুডেন্ট, লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান’ ধ্বনিত হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কণ্ঠে। বলল সে, ‘আমার বক্তৃতার একটা অংশ শেষ হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্বে। এই প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। বরং আমি বলব, সৃষ্টি সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়ের খুব কম প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে। আসলে বিজ্ঞান বা মানুষের জ্ঞান মৌলিক কোনো কিছুই সৃষ্টি করে না, সৃষ্ট বিষয় এবং তার গুণাগুণ আবিষ্কার করে ও তা কাজে লাগায় মাত্র। সৃষ্টিগত মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে স্রষ্টাকেই সন্ধান করতে হয়, চাওসিকো যেমন করেছে। এটাই হয়তো বিজ্ঞানের পরিণতি, আমাদের মহাবিশ্বের অব্যাহত বিস্তার অনন্ত নয়, তার সমাপ্তি আছে। তেমনি মানুষের জীবনের মতো তার জ্ঞানও নির্দিষ্ট একটা পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বড় একটা মৌলিক প্রশ্ন এখানে ওঠে, সময়ের গতি, ইউনিভার্সের গতি, জীবনের গতি থেমে যাওয়ার পর কি আছে? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান জানে না। এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে চাওসিকোকে তাই যেতে হয়েছে স্রষ্টার কাছে, স্রষ্টা প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের কাছে। সামনে আনতে হয়েছে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী চিরন্তন এক স্থিতির জগত ‘পরকাল’-এর কথা। যে ‘পরকাল’-জগতে মানুষ মৃত্যুহীন অনন্ত, স্থির জীবন লাভ করবে, নতুন বিশ্বজগতও হয়ে যাবে স্থির, অনন্ত, যেখানে থাকবে না কোনো কাল বা সময়, কারণ যেখানে গতি নেই, সেখানে সময় বলতে কিছু থাকে না। কিন্তু এই কথাগুলো আমাদের বিজ্ঞান বলতে পারছে না। বলার মতো যোগ্য হতে হলে তাকে আরও সাবজেক্ট নিয়ে ভাবতে হবে, শুধু বস্তু নয়, ‘গায়েবে’ বিশ্বাস করতে হবে। এভাবে স্রষ্টার ইচ্ছা-অভিপ্রায়কেও তাকে জানতে হবে। এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞান। লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান, আমার বক্তৃতার দ্বিতীয় পর্বে ভবিষ্যতের এই বিজ্ঞান নিয়েই কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
একটু থেমে এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে বিজ্ঞানী আবার শুরু করল তার বক্তৃতা। পিনপতন নীরবতার মাঝে চলল তার কথা। আরও পাকা একঘণ্টা চলল তার বিস্ময়কর বক্তৃতা’। বক্তৃতা শেষ হলো।
অনুষ্ঠান শেষ হলো।
অতিথিকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও সিনিয়র শিক্ষকরা প্রথমে বেরিয়ে গেল। তারপর বের হলো অবশিষ্ট শিক্ষকরা। তারপর বের হলো ব্যালকনি ও হলের ছাত্র-ছাত্রীরা। সবশেষে বের হলো চাওসিকো।
তাকে নিয়ে ছাত্রদের নীরব কৌতূহল আছে, কিন্তু উচ্ছ্বাস নেই, আনন্দ নেই। চাওসিকো নামে খ্রিস্টান; কাজে মুসলমান এটা সবাই জানে। আর চাওসিকোও সে মুসলমান এ কথা প্রকাশ করতেই বেশি ভালোবাসে।
চাওসিকো সবাইকে এড়িয়ে ভিড়ের এক প্রান্ত দিয়ে এগিয়ে রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে উঠল। এগিয়ে চলল ফুটপাত ধরে।
ঠিক সকালের মতোই একদম তার পাশে ফুটপাত ঘেঁষে একটা কার এসে দাঁড়াল। তাকাল চাওসিকো গাড়ির দিকে। দেখল, ড্রাইভিং সিটে আনা আরিয়া। সে গাড়িতে উঠার জন্যে হাতের ইশারায় ডাকছে তাকে।
তখন রাস্তা দিয়ে চলছে আরও অনেক গাড়ি। ফুটপাত ধরে চলছে ছাত্ররা। চাওসিকোর দাঁড়ানো এবং আনা আরিয়া তাকে ডাকা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
আনা আরিয়া তার পাশের সিটের দরজা খুলে দিয়েছিল। চাওসিকো কিছু বলার সুযোগ পেল না, তাকে উঠে বসতে হলো গাড়িতে। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আনা আরিয়া কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল চাওসিকোর দিকে। ঠিক সে সময় একটা কার তার ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে তার গাড়ির সামনে গিয়ে ব্রেক কষল এবং সে গাড়ির দুই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো রিটা রেমন্ড এবং তার বন্ধু হ্যারি হামিল্টন। দু’জনেই আনা আরিয়ার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রিটা রেমন্ড মধ্য আফ্রিকার চার্চ গুরু বিশপের মেয়ে। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ছেলে হ্যারি হামিল্টন। দু’জনেই আনা আরিয়ার বন্ধু গ্রুপের সদস্য।
রিটা রেমন্ড ও হ্যারি হামিল্টন দু’জনেই ছুটে এলো আনা আরিয়ার দিকে। ‘আনা, তোকেই আমরা খুঁজছি। ভিসি সাহেব তোকে ডাকছেন, আমাদের খুঁজতে পাঠিয়েছেন। চল।’
কথা শেষ করেই রিটা রেমন্ড তাকাল চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘চাওসিকো কনগ্রাচুলেশন তোমাকে। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রেখেছ। আরও ভালো লাগত যদি তুমি…’
কথার মাঝখানে রিটাকে বাধা দিয়ে আনা আরিয়া বলল, ‘কথা বাড়াস না রিটা।’
আনা আরিয়ার কথাটা শেষ হতেই চাওসিকো বলল, ‘ওয়েলকাম, মিস রিটা।
চাওসিকোর কথা শেষ হলে আনা আরিয়া রিটা রেমন্ডকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বাবাকে বলো। আমার একটু কাজ আছে। মাকে আমি বলে এসেছি।
‘স্যারের যদি জরুরি কোনো কাজ হয়?’ হ্যারি হামিল্টন বলল।
‘আমি তা মনে করি না। বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সম্বর্ধনায় বাবা দুপুরে লাঞ্চের আয়োজন করেছেন। সেখানেই অংশ নিতে বাবা আমাকে ডাকছেন। আমি সেখানে যাচ্ছি না।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ড একবার চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে আনা আরিয়াকে বলল, ‘কি এমন কাজ তোর আছে?’
‘আমরা করি না বটে, কিন্তু পৃথিবীতে কাজের শেষ নেই।’ বলল আনা আরিয়া।
‘আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছিস।’ রিটা রেমন্ড বলল।
‘কেন শুনলি না, বিজ্ঞানী স্যার ইডেলম্যান বললেন, সব প্রশ্নের জবাব বিজ্ঞানও দিতে পারে না।’
গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিটা রেমন্ড আনা আরিয়ার পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘চাওসিকোর বিজ্ঞান কি তোর মাথাতেও ঢুকল?’
‘ঢুকলে খুশি হতাম, খুব খুশি।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ডের মুখে হঠাৎ বিমর্ষতার একটা ঢেউ খেলে গেল। বলল সে, দেখিস খুব খুশির পরিসীমা যেন বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা চলি, স্যারকে গিয়ে আবার বলতে হবে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ড ও হ্যারি হামিল্টন চলে গেল। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তারা ফিরে চলল।
‘আনা আরিয়া, স্যার ডেকেছেন। তুমি না গিয়ে ঠিক করলে না। চাওসিকো বলল।
আনা আরিয়ার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না চাওসিকো। আমার মাথায় এখন অন্য চিন্তা।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কি চিন্তা?’ চাওসিকো বলল।
‘তোমাকে বলেছিলাম, আমার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে। করেছিলে? আমি কিন্তু আল্লাহর সাথে কথা বলেছি। আমার সব কথা বলেছি। তিনি আমার কথা শুনেছেন। আমার মন এখন শান্ত। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কি সিদ্ধান্ত?’ চাওসিকোর জিজ্ঞাসা।
‘সর্বশেষ ধর্ম ইসলামই এখন আল্লাহর একমাত্র পথ। এই পথ আমি আমার জীবনের জন্যে গ্রহণ করব।’ বলল আনা আরিয়া। তার কণ্ঠ গম্ভীর, ভারি। তার মুখে স্থির সিদ্ধান্তের ছাপ।
চমকে উঠেছে চাওসিকো। তাকিয়েছে আনা আরিয়ার দিকে। হঠাৎ তার মুখে কোনো কথা যোগাল না। আনা আরিয়ার পরিচয় সে জানতো না। এই মাত্র রিটার সাথে আনা আরিয়ার কথার মধ্যে দিয়ে সে জানল পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকার পাওয়ারফুল ভাইস চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মেয়ে সে। যার বাবা, যার বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে খ্রিস্টান বানাচ্ছে, তার মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে! চমকে উঠার মতো কথাই এটা। কি বলবে, কি বলা উচিত এই অবস্থায়, ঠিক করতে পারল না চাওসিকো।
আনা আরিয়াই কথা বলল। বলল সে, ‘চাওসিকো ইসলাম কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, নিয়ম কি?’
চিন্তার জটটাকে পেছনে ঠেলে সোজা হয়ে বসল চাওসিকো। বলল, ‘সেটা খুব সহজ ব্যাপার। ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল এবং দাস।-এই সাক্ষ্য মুখে ঘোষণা করতে হয়, অন্তরে বিশ্বাস করতে হয়, তা কাজে বাস্তবায়িত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
আনা আরিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘এই সাক্ষ্য কি বিশপ ফাদার ও গির্জার মতো কোথাও গিয়ে, কারও কাছে গিয়ে ঘোষণা করতে হয়?’
‘মসজিদে গিয়ে, মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এটা শর্ত নয়। যে কেউ যে কোনো স্থানে অথবা যে কোনো কারও কাছে গিয়ে এই সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। চাওসিকো বলল।
‘আমি কি তোমার কাছে এই সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘কোনো বাধা নেই।’ চাওসিকো বলল।
‘আমাকে ইসলাম গ্রহণ করাও- এই অনুরোধ কি তোমাকে আমি করতে পারি?’ বলল আনা আরিয়া। ভারি, অশ্রুরুদ্ধ তার কণ্ঠস্বর।
চাওসিকো তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘অনুরোধ কেন? এটা আমার দায়িত্ব একজন মুসলিম হিসেবে। কিন্তু…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল চাওসিকো।
‘কিন্তু কি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তাড়াহুড়োর দরকার নেই। তুমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছই। যে কোনো দিন যে কোনো সময় এটা করা যাবে।’ চাওসিকো বলল।
‘কিন্তু চাওসিকো তুমি বলেছ, আল্লাহর পথ গ্রহণ না করে, আল্লাহর পথে না চলে মৃত্যুবরণ করলে তার জন্যে পরজীবনে রয়েছে অনন্ত শাস্তি। তাহলে দেরি করব কেন? আমি যদি এর মধ্যে মরে যাই কিংবা পরে ইসলাম গ্রহণ করা না হয় কোনো কারণে?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি ঠিক বলেছ আনা, তোমাকে ধন্যবাদ। আজই এখনি তোমাকে আমি সাক্ষ্য বা শাহাদাহ পাঠ করাবো, কিন্তু একটা অনুরোধ আছে। চাওসিকো বলল।
‘বলো কি সেটা?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা কিছু দিন গোপন রাখতে হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে, আমার বিরুদ্ধে বা কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুজুমবুরায় যাই ঘটুক তুমি ধৈর্য ধরবে, তোমার ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারটি কথায় বা কাজে প্রকাশ করবে না।’ চাওসিকো বলল।
‘তোমার কথা আপাতত মানলাম আমি আমার বয়সের বিবেচনায় এবং আমি আত্মনির্ভরশীল নই এই বিবেচনা সামনে রেখে, যে বিবেচনা তুমিও করেছ। তবে এই আত্মগোপন কতদিন চলবে, তা ঠিক করার অধিকার শুধু আমারই থাকবে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ঠিক আছে।’ বলল চাওসিকো।
‘কিন্তু চাওসিকো, অবশ্য কর্তব্য নামাজ এবং রোযা কীভাবে করব, এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘নামাজ তোমাকে গোপনে পড়তে হবে। দিনে কোনো ওয়াক্ত কোনোভাবে পড়ার সুযোগ না পেলে রাতে কাজা পড়বে এবং আল্লাহর কাছে এজন্যে ক্ষমা চাইবে। আর রোযার ব্যাপার পরে বলবো, রোযার দেরি আছে আরও নয় দশ মাস।’ চাওসিকো বলল।
‘তাহলে শাহাদাহ-এর কাজটা চলো শেষ করি।’ বলল আনা আরিয়া। লেকের ধারে ভিক্টরি পার্কের একটা নির্জন স্থানে গাড়ি পার্ক করল আনা আরিয়া। এ সময় পার্কে লোক থাকে না বললেই চলে।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে আনা আরিয়া তার ড্রাইভিং সিটেই চাওসিকোর দিকে মুখ করে বসল।
চাওসিকো বলল, ‘আনা আরেকবার ভাব। তুমি একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছ যা তোমাকে তোমার সমাজ, স্বজন, এমনকি বাবা-মা থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। ভেবে দেখ তুমি নিছক একটা আবেগবশত সিদ্ধান্ত নিচ্ছ না তো!’
সংগে সংগে উত্তর দিল না আনা আরিয়া। মুখ নিচু করল। বয়ে গেল কিছুটা সময়। ধীরে ধীরে মুখ তুলল এক সময়।
তার মুখ গম্ভীর। দুই চোখ ভরা অশ্রু। বলল সে, ‘বড় বিষয় বলেই অনেক ভেবেছি। আমার ভাবনার শুরু সেই রাতের পর থেকে। সে রাতের পরই আমি প্রথম বুঝলাম, সব মানুষ মানুষ নয়। চারদিকে আমি মানুষ নামের পশুদের দেখতে লাগলাম। আমার বড় ভাবনার বিষয় ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত রাতে একটা নির্জন বাড়িতে দুর্যোগতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয়া এক সুন্দরী কুমারিকে উপেক্ষা করতে পারল যে সুন্দর যুবক, সে কীভাবে এমন সোনার মানুষ তৈরি হলো! এই চিন্তার মধ্যেই তোমার সাথে আমার দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিতে। সেদিন আমার জিজ্ঞাসার জবাব পেলাম, তার ধর্ম ইসলাই তাকে এমন সোনার মানুষ তৈরি করেছে। সেদিন তোমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে আরও জেনেছিলাম। বুঝেছিলাম ইসলামই আজকের পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত ধর্ম। সেদিন থেকেই আমার মন বদলের শুরু। সেদিনই আমি একজন বিশ্ববিখ্যাত গায়কের কনসার্টে গিয়েছিলাম, কিন্তু একেবারেই বিস্বাদ লেগেছে, মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার রুচি হয়নি। অথচ সেদিনের আগে পর্যন্ত কনসার্ট ছিল আমার প্রাণ। মন. বদলের সাথে আমার চোখ বদলে গেছে, কান বদলে গেছে, রুচি বদলে গেছে, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আমার সম্পূর্ণই বদলে গেছে চাওসিকো। আজ গাড়িতে তোমার কথাগুলো পুরানো আনা আরিয়াকে একদম ধ্বংস করে দিয়েছে, নতুন আনা আরিয়া এখন ইসলামের আশ্রয় ছাড়া বাঁচবে না। একটা বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে মনের যে স্থিরতা দরকার, আল্লাহ তা আমাকে দিয়েছেন। আমার সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট, অনড় চাওসিকো।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আনা আমি শাহাদাহ পাঠ করছি, তুমিও আমার সাথে পাঠ কর। প্রথমে আরবিতে তারপর তোমার নিজ ভাষায়। চাওসিকো বলল।
নিজেই প্রথমে বিসমিল্লাহ পড়ল আনা আরিয়া। তারপর চাওসিকোর অনুসরণে শাহাদাহ পাঠ করল, প্রথমে আরবিতে, তারপর নিজের ভাষায়।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল দুইজনেই শাহাদাহ ঘোষণার পর।
মুখ গম্ভীর আনা আরিয়ার। তার দু’চোখ দিয়ে নামছে নীরব অশ্রুর দু’টি ধারা। চাওসিকো টিস্যু বক্স থেকে একখণ্ড টিস্যু নিয়ে এগিয়ে দিল আনা আরিয়ার দিকে।
‘থাক চাওসিকো, অশ্রু নামতে দাও। এ পাওয়ার অশ্রু, আনন্দের অশ্রু। অনেক দুর্লভ এই অশ্রু। অনেক চাওয়ার পর পাওয়া থেকেই এ অশ্রু নামে। বলল আনা আরিয়া।
‘নতুন জীবনে তোমাকে অভিনন্দন আনা আরিয়া। চাওসিকো বলল। ‘এ নতুন জীবনের কারিগর আল্লাহর পর এ মাটির পৃথিবীতে তুমিই। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। তোমাকে আমার অভিনন্দন।’ বলল আনা আরিয়া।
‘আমাকে যিনি বদলেছেন, তিনিই তোমাকে বদলে দিয়েছেন। মানুষকে বদলাবার মালিক একমাত্র তিনিই আনা।’ চাওসিকো বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। চাওসিকো তুমি আমাকে ‘আনা’ বলেই ডাকবে। তোমার ‘আনা’ ডাকের চেয়ে মিষ্টি আমার কাছে আর কিছু নেই। এটুকু দয়াময় আল্লাহ মাফ করবেন। সীমালংঘন থেকে অবশ্যই আমরা দূরে থাকব ইনশাআল্লাহ।’ বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল আনা আরিয়া।
গাড়ি বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। ছুটে চলল গাড়ি লেক ভিউ এভিনিউ ধরে।
‘কোথায় আমরা যাচ্ছি আনা?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর।
‘কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘রেস্টুরেন্টে?’ প্রশ্ন চাওসিকোর।
‘হ্যাঁ রেস্টুরেন্টে। বাবা বড় বিজ্ঞানীকে লাঞ্চ করাবেন, আর আমি লাঞ্চ করাব ছোট বিজ্ঞানীকে।’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
‘আমাকে ছোট বিজ্ঞানী বলছ?’ চাওসিকো বলল।
‘বড় বিজ্ঞানী তো হওনি, হলে বড় বিজ্ঞানীই বলব।’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটের হাসি আর একটু বড় হয়েছে।
‘তা নয়। আমাকে বিজ্ঞানী বলছ কেন। তিলকে তাল করা ঠিক নয়।’ চাওসিকো বলল।
‘জান বিজ্ঞানী ইডেলম্যান বিজ্ঞানের ঐ জটিল প্রশ্নগুলোর আলোচনায় কতবার তোমার নাম করেছেন? ঐ তিনটি প্রশ্নের আলোচনায় তিনি তোমার ব্যাখ্যাকে এনডোর্স করে বলেছেন, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান ও ব্যবহারে স্রষ্টার ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সন্ধান করতে হবে। তাঁর মতো বিজ্ঞানীর এই স্বীকৃতি তোমাকে তো বিজ্ঞানী বানিয়ে দিয়েছে। বলল আনা আরিয়া।
‘তার মতো বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ছাত্রদের ব্যাপারে অমন উদার হয়েই থাকেন। আমার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, সেটা তাঁর উদারতা। ওটাকে দলিল না বানানো উচিত।’ চাওসিকো বলল।
‘ব্যাপার তা নয় চাওসিকো। তাঁর তিনটি প্রশ্ন বত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছে। মনোপুত জবাব তিনি পাননি। তোমার কাছে পেয়েছেন। সুতরাং ওটা উদারতা নয়, সত্যের স্বীকৃতি। তাঁর দেয়া তোমার কোর্টপিন তার সাক্ষ্য বহন করে চলবে।’
কথা শেষ করেই চাওসিকোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘সত্যি চাওসিকো, সব শিক্ষক, সব ছাত্র, সবাইকে তুমি অবাক করেছ। সবাই ভবিষ্যতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসেবে তোমাকে দেখছে। আমি তোমাকে ছোট বিজ্ঞানী বলে দোষ করিনি। যাক, এই স্মরণীয় অকেশনে তোমাকে একটা গিফট দেবার ইচ্ছা করছে আমার।’ বলল আনা।
‘গিফট তুমি দিয়েছ।’ চাওসিকো বলল।
‘গিফট দিয়েছি? কি বল তুমি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘দুইটা গিফট দিয়েছ।’ চাওসিকো বলল।
‘সেটা কি অদৃশ্য বস্তু? অদৃশ্য হলেও তো আমি জানব, গিফট যদি আমার হয়।’ বলল আনা আরিয়া।
‘হ্যাঁ, তাকে অদৃশ্যই বলতে হবে।’ চাওসিকো বলল।
‘বল, এখনি বল। না হলে ঐ সামনে গাড়ি দাঁড় করাব। না বললে গাড়ি চলবে না।’ বলল আনা আরিয়া।
চাওসিকো গম্ভীর হলো। বলল, ‘একটি পুরস্কার তোমার ইসলাম গ্রহণ। আমার জন্যে এটা একটা বড় পুরস্কার।’
আনা আরিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে ধন্যবাদ চাওসিকো, তুমি একে তোমার জন্যে গিফট মনে করেছ। এবার দ্বিতীয়টা কি বল?’
‘তুমি আমাকে ‘আনা’ বলে ডাকার অধিকার দিয়েছ, এটা দ্বিতীয় পুরস্কার।’ চাওসিকো বলল।
কোনো উত্তর এলো না আনা আরিয়ার কাছ থেকে। আনা আরিয়ার চোখ দু’টি ছিল সামনে স্থির। চোখ দু’টিতে আলোর এক চমক যেন খেলে গেল। সলাজ এক অনুরাগ রাঙিয়ে দিল তার গোটা মুখ। স্নিগ্ধ শিহরণের একটা প্রবাহ খেলে গেল তার গোটা দেহে। তার মাথাটা কিছুটা নুয়ে পড়ল। আনা আরিয়া তার গাড়িটা সরিয়ে নিল রাস্তার পাশে, এটা গাছের ছায়ায়।
ড্রাইভিং সিটে বসেই নিজের মুখটা ঘুরিয়ে নিল আনা আরিয়া কাবার দিকে। একটা সিজদা করল সে সিটে বসেই। ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মুখ তুলে বলল আলহামদুলিল্লাহ। অশ্রুধোয়া রাঙা মুখ তুলে তাকাল সে চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘আল্লাহর অসীম দয়া, শাহাদার ঘোষণা দেয়ার পর একাকিত্বের শংকা যখন আমার সামনে, তখন তুমি এসে আমার হাত ধরলে। অনেক ধন্যবাদ চাওসিকো।’ কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়ার শেষ কথাগুলো।
‘ওয়েলকাম আনা, একজন বিশ্বাসী মুসলিমের যা করণীয়, তুমি তাই করলে। একজন মুমিনের সব কাজ, সব চাওয়া, সব পাওয়া এভাবে আল্লাহমুখী হওয়া উচিত। আল্লাহ তোমাকে তাঁর অশেষ বারাকায় ধন্য করুন। আর আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। তাঁর রহম ও করম দিয়ে আমাদের ঘিরে রাখুন।’ চাওসিকো বলল
‘আমিন।’ বলল আরিয়া।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আনা আরিয়া। ছুটে চলল গাড়ি ভালো রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে।
.
মায়ের ঘরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল আনা আরিয়া
মায়ের ঘরে বাবার কণ্ঠ শুনতে পেল। বাবা ‘হ্যালো’ বলে কার যেন কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করে বলে উঠল, ‘গুড ইভেনিং মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। কখন পৌঁছলেন বাসায়?’
মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা এবং মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির ছিল। বিকালে চার্চ কাউন্সিলের একটা জরুরি বৈঠক ছিল। সেখানে আনা আরিয়ার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান এবং বাতিস্তা সান্ড্রি দু’জনেই উপস্থিত ছিল।
ও প্রান্ত থেকে বাতিস্তা সান্ড্রির কথা শোনার পর আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘এইমাত্র পৌঁছেই আবার টেলিফোন! জরুরি কিছু?’
বাতিস্তা সান্ড্রির দীর্ঘ বক্তব্য শুনে আনা আরিয়ার বাবা একরাশ উচ্ছ্বাসের সাথে বলল, ‘তাহলে ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে আমরা স্টুডেন্ট ডেলিগেশন পাঠাতে পারছি। গুড। স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের নেতা হিসাবে চাওসিকোকে আপনার চয়েস আমার খুব ভালো লেগেছে। তাকে দ্রুত বাগে আনার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত আমাদের দারুণ সহায়ক হবে। আপনি ঠিকই বলেছেন তার মতো অসাধারণ প্রতিভাকে আমরা ছাড়তে পারি না। হয় সে আমাদের হবে, না হয় কারোই হবে না সে। তবে আমাদের খারাপ চিন্তা করতে হবে না। তাকে বাগে আনার সব চেষ্টাই আমরা করছি।’ থামল আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান।
ওপার থেকে কথা বলল বাতিস্তা সান্ড্রি। আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘ওকে মি. সান্ড্রি, যিশু আমাদের সহায় হোন। বাই।’
কথা শেষ করে মোবাইল’ রেখে দিতে দিতে আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘শিলা, আজ একটা ভালো দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ভালো দিন সেটা তো দেখেই এলে। উন্নত বিশ্বের জগত বিখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে আমরা শীর্ষে উঠে গেলাম। আরেকটা বড় খবর হলো, ভ্যাটিক্যানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণের সুযোগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া হয়েছে এবং সে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে চাওসিকোকে মনোনীত করেছি আমরা।’
‘ঠিক দু’টিই খুশির খবর। তবে দ্বিতীয় খবরে খুশির সাথে উদ্বেগও আছে। চাওসিকো শুধু অসাধারণ প্রতিভা নয়, তার সাথে ছেলেটিকে আমার খুব নীতিনিষ্ঠ এবং নির্ভিকও মনে হয়েছে।’ বলল শিলা, আনা আরিয়ার মা।
‘দেখ নামের বিষয় নিয়ে সে আমাদের সাথে আপোষ করেছে, তার নীতি থেকে সে সরে এসেছে। নীতি থেকে যখন কিছুটা সরে এসেছে, আরও সরতে পারে। আর না সরে তার উপাই নেই শিলা। শুনলে না মি. বাতিস্তার সাথে কথা হলো, হয় সে আমাদের হবে, না হয় কারোই হবে না।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘না স্টিফেন, তাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করো না। সে খুব ভালো ছেলে। মায়া ধরানোর মতো ছেলে সে। আনা আরিয়ার মা শিলা বলল।
‘আরেকটা বড় খবর আছে, তোমার মেয়েকে ডাক। বলল আনা : আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান।
মায়ের ঘরে দরজার ওপাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ানো আনা আরিয়া উদ্বেগ-আতংকে আড়ষ্ট। তার মুখ হয়ে গেছে ফ্যাকাশে। বুকের ভেতরটা তার কাঁপছে। তার মনে চিন্তার সাইক্লোন। ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে বা একজন হয়ে চাওসিকোর যাওয়া কি সম্ভব! না গেলে কি হবে, সেটার ইংগিত তো সে পেয়েছে। চাওসিকো হয় তাদের হবে, তা না হলে সে কারোই হবে না। কথাটা মনে করতেই গোটা দেহ কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার।
বাবা-মায়ের শেষ কথা, তাকে ডাকার বিষয়, শুনতে পেল আনা আরিয়া। দৌড় দিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল। ঢুকল ওয়াশরুমে। মুখ-চোখ ধুয়ে নিল ভালো করে। তোয়ালেই মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। তার মা’র সাথে মুখোমুখি দেখা হলো। তার মা বলল, ‘ডাকলাম, তুমি বোধ হয় শুনতে পাওনি। ঘুমিয়ে ছিলে? চল তোমার বাবা আমার ঘরে, ডাকছেন তোমাকে।’
‘চল মা।’ তোয়ালেটা হাত থেকে রাখতে রাখতে বলল আনা আরিয়া।
আনা আরিয়া তার মায়ের সাথে তার মায়ের ঘরে ঢুকল।
‘এসো মা।’ বলে তার সোফার এক পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল আনা আরিয়াকে।
আনা আরিয়া পিতার সাথে না বসে তার পাশের সোফাটায় বসল। তার মা গিয়ে বসল তার পিতার পাশে।
‘মুখটা তোমার কেমন যেন লাগছে। রোদে ঘুরেছ বুঝি? চাওসিকোকে নিয়ে তুমি কোথায় গেলে?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, পোর্ট ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি।
‘রেস্টুরেন্টে বাবা। বাবার দিকে চোখ তুলে বলল আনা আরিয়া।
‘গুড। চাওসিকোর সাথে তোমার পরিচয় কবে হলো?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘লাইব্রেরিতে বাবা। ও খুব পড়ুয়া ছেলে। আনা আরিয়া বলল।
‘পড়ুয়া তো হবেই। সে তো আজ গোটা দুনিয়াকে অবাক করে দেয়ার মতো কাজ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আজ গর্বিত তাকে নিয়ে। তুমি তো এক সময় খুব ক্ষেপা ছিলে তার উপর।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘আমি ক্ষ্যাপা ছিলাম তার উপর! কবে? কেন?’ আনা আরিয়া বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘ঐ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হলো, তুমি দ্বিতীয় হয়েছিলে, প্রথম হয়েছিল সে। তুমি কাঁদাকাটি করেছিলে খুব। তোমাকে আমরা…।’
বাবার কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘সে তো অ্যাডাম আব্রাহামের কথা বাৰা, যাকে তোমরা নাম বদলাতে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলে।’
‘সেই অ্যাডাম আব্রাহামই তো এই চাওসিকো। তার পুরো নাম আড্যাম আব্রাহাম চাওসিকো। আর নাম বদলাবার আগে তার মুসলিম নাম ছিল আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো। কেন তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করনি?’
আনা আরিয়ার মনে বিস্ময়, আনন্দ দুই-ই। বলল সে, ‘না বাবা জিজ্ঞাসা করিনি। নিজ থেকে তার নাম চাওসিকো বলেছে। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।’
‘আসলেই সে এক বিস্ময়কর প্রতিভা মা। বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তাকে আমরা বাধ্য করেছি। আমাদের সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল, আজ নতুন করে তার আমরা প্রমাণ পেলাম। যিশুকে অশেষ ধন্যবাদ যে, তোমার সাথে তার সুসম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। শুরু থেকেই এটা আমরা চেয়েছিলাম। আমরা যদি তাকে আমাদের করে নিতে পারি, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে, সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে আমাদের খ্রিস্টান স্বার্থ।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
বুকের ভেতরটা কাঁপছিল আনা আরিয়ার। তার বাবার কথাই বলে দিচ্ছে সামনের দিনগুলো তাদের জনে, কত ভয়ংকর হবে। বাবার মুখে চাওসিকোর সাথে তার সম্পর্ক গড়ার কথা তার মনে এক প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করল। বাবা কি তার মেয়ে নিয়ে এমন কথা বলতে পারেন! খ্রিস্টান স্বার্থই কি তাহলে বাবার কাছে সব! এর মধ্যেই আনা আরিয়া যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।
‘মা আনা, আরেকটা বড় খবর আছে মা। ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। সে প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত হয়েছে চাওসিকো। তুমি হবে ডিপুটি লিডার অব দ্য মিশন।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘কথাটা আনা আরিয়ার মনে নতুন করে আবার যন্ত্রণার সৃষ্টি করল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘চাওসিকো কি রাজি হয়েছে বাবা?’
‘রাজি হবে না কেন? এটা কত বড় একটা সম্মান! গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের কাছে সে পরিচিত হয়ে যাবে। খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদলের নেতা ও প্রতিনিধিদলের ছবি ও পরিচয় নিয়ে বিরাট আকারের স্মরণিকা বের হচ্ছে।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘কিন্তু বাবা, সে নাম বদলেছে বটে, মুসলমান সে রয়েই গেছে। রেস্টুরেন্টেও দেখলাম তাকে দুপুরের নামাজ পড়তে।’ আনা আরিয়া বলল। ‘ওটা একটা আবেগের ব্যাপার। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে মা। তার উপর তোমার মটিভেশন বড় কাজ দেবে বলে আমি মনে করি। তার সাথে তুমিও ভ্যাটিকান যাচ্ছ। খ্রিস্টান জগতের বিরাটত্ব, তাদের শক্তি- সামর্থ্য, প্রাচুর্য, এখানকার রঙিন জীবনের কথা বার বার তার সামনে নিয়ে আসবে। তোমাকে নিশ্চয় সে ভালো মনে করে। তোমার কথাকে, মতকে সে গুরুত্ব দেবে।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
তার বাবার কথাগুলো আনা আরিয়ার বুকে শেলের মতো বিদ্ধ হলো। তার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা করল। একজন বাবা তার মেয়েকে এ ধরনের কথা কীভাবে বলতে পারেন? বাবা কি খ্রিস্টান স্বার্থে অন্ধ হয়ে গেছেন?
আনা আরিয়া একটা ঢোক গিলে নিজের মনকে স্থির, শান্ত করার চেষ্টা করল। তার মনে পড়ল চাওসিকো বলেছিল, যে যাই চক্রান্ত করুক, তা সবই আল্লাহর এখতিয়ারের অধীন। তিনি না চাইলে কিছু করার সাধ্য কারও নেই। বলল সে তার বাবাকে, ‘আজ বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সাথে চাওসিকোর যে কথাগুলো শুনলাম বাবা, তাতে আমার মনে হয়েছে সে শুধু অসাধারণ বুদ্ধিমান নয়, সে অত্যন্ত ম্যাচিওর চিন্তার ছেলে।
সেই জন্যেই তো তাকে আমাদের বেশি প্রয়োজন। এরা পৃথিবীর বিরল প্রতিভা। তাকে আমরা খ্রিস্টানরা আমাদের করে পেতে চাই। এতে দুই কাজ হবে, মুসলমানরা বঞ্চিত হবে, আর আমরা লাভবান হবো।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘বাবা, কোনো প্রতিভাকে কি জোর করে কাজে লাগানো যায়, না তারা আন্ডার কম্পালশন কোনো কাজ করে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমরা যদি তার কাজ না পাই, তাতে আমাদের ক্ষতি নেই, বিজ্ঞানী আমাদের অনেক আছে। আমাদের আসল লাভ যা, সেটা হলো, মুসলমানরা তার মূল্যবান সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হবে। মুসলমানদেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে দেউলিয়া বানাবার এ একটা উৎকৃষ্ট প্রোগ্রাম আনা।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ভিসি।
‘কিছু মনে করো না, তোমাদের ডেডলি এই প্রোগ্রামে তো জ্ঞান- বিজ্ঞানের পক্ষে নয়, একদমই বিপক্ষে। মুসলমানরা যদি এই মানসিকতার হতো, তাহলে তারা স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউরোপের খ্রিস্টান ছেলেদের ঢুকতেই দিত না এবং তাহলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ কয়েকশত বছর পিছিয়ে পড়ত অথবা ইউরোপীয় রেনেসাঁ নামের কোনো কিছু সৃষ্টিই হতো না। বলল আনা আরিয়ার মা শিলা।
আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘তুমি দেখি তোমার মেয়ের চেয়েও দু’ধাপ এগিয়ে। দেখ, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ঔদার্য ভালো, কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে ঔদার্য ভয়ংকর। তুমি স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য, ভারতের মোগল সাম্রাজ্য, আব্বাসীয় ও তুরস্কের ওসমানি খিলাফতের পতনের কারণগুলো যদি অনুসন্ধান করো অনেক বড় বড় কারণ খুঁজে পাবে, কিন্তু মূল কারণ ছিল তাদের জাতীয় নীতির ক্ষেত্রে অন্যজাতির প্রতি তোষণমূলক ঔদার্য। তুর্কি খিলাফতের অধীনে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী ও কৃষকরা যে সুযোগ-সুবিধা পেত, তুর্কি মুসলিম কৃষক-ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ পেত না। এটা ছিল তাদের তোষণমূলক ঔদার্য। তারা চেয়েছিল খ্রিস্টান প্রজাদের, সেই সাথে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের খুশি রাখতে। কিন্তু তাদের খুশি রাখতে পারেনি। এ নীতির কারণে অনেক মাশুল গুণতে হয়েছে তুর্কিদের। আমরা সেই ভুল করতে চাই না। আমাদের ক্রসেডের কারণ ছিল এটাই। এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ঔপনিবেশিকীকরণের ক্ষেত্রে আমরা এই ভুল করিনি।’
‘আমি সব ব্যাপার জানি না। হয়ত তোমার কথাই সত্য। কিন্তু চাওসিকোকে তোমরা ঐ ধরনের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো না। অমন সরল, স্বচ্ছ, নিরহংকার, সুবিবেচক ছেলে আমি দেখিনি। দেখ, অত জ্ঞানী ছেলে, কিন্তু সে তার বিদ্যা জাহির করতে চায়নি। প্রশ্নের সংগে সংগে লাফ দিয়ে দাঁড়াবার মতো অহংকার সে দেখায়নি। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, এ সত্ত্বেও সে অন্য কেউ দাঁড়াক, উত্তর দিক এজন্যে শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কেউ না দাঁড়ানোয় অবশেষে সে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখেছি, প্রতিটি উত্তরের ক্ষেত্রে সে বরাদ্দ এক মিনিট সময়ের মধ্যে মানে ৫০ সেকেন্ড পার হবার পর সে উত্তর দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই একটা গুণ তাকে আমার কাছে আকাশ স্পর্শী করে দিয়েছে। আর যাই কর, এই ছেলেটা নিয়ে তোমরা কোনো খারাপ চিন্তা করো না।’ আনা আরিয়ার মা শিলা বলল।
মায়ের কথা আনা আরিয়ার গোটা দেহে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। সে ভেবে খুশি হলো, তার মা চাওসিকোকে ঠিক চিনতে পেরেছে। শংকিত আনা আরিয়া মায়ের মধ্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেল।
স্ত্রী শিলার কথা শুনে হাসল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান আনা আরিয়ার বাবা। বলল, ‘সব মায়েরাই এমন ভালো ছেলেদের সন্তান হিসাবে ভাবতে ভালোবাসে। যাক শোন, তাকে নিয়ে আমরা কোনো খারাপ চিন্তা করব কেন? সে ভালো ছেলে, তাকে আমাদের ভালো লেগেছে বলেই তো তাকে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে ভর্তি করেছি। তাকে আমাদের মধ্যে আমাদের কম্যুনিটির একজন সদস্য হিসেবে আপন করে পেতে চাই। অর্থ, যশ, সম্মান, পদ সব দিক দিয়েই আমরা তাকে সম্মানের আসনে রাখতে চাই। তাকে আমরা ভ্যাটিকানে পাঠাচ্ছি এই কারণে যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খ্রিস্টান যুৰ শক্তির সাথে কয়েকদিন ধরে মেলামেশার ফলে খ্রিস্টান বিশ্বাস ও সমাজের সাথে তার একটা একাত্মতার সৃষ্টি হবে। সবাই যিশুর কাছে প্রার্থনা করো, আমাদের এই আশা যাতে পূরণ হয়।’
‘যদি আশা পূরণ না হয়?’ জিজ্ঞাসা শিলার, আনা আরিয়ার মায়ের। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ ভাব।
‘তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না শিলা। তবে একটা কথা পরিষ্কার জানি শিলা, নাম পরিবর্তন করে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে খ্রিস্টান কম্যুনিটিতে প্রবেশ করেছে, তার এখান থেকে বেরুবার কোনো পথ নেই।’ বলল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা।
বলেই আনা আরিয়ার বাবা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা মা-মেয়ে গল্প কর। আমার স্টাডিতে একটা কাজ আছে। যাই।’
বেরিয়ে গেল আনা আরিয়ার বাবা ঘর থেকে।
বাবার কথায় বুক কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার। একটা প্রবল শক এসে যেন আঘাত করল তাকে। মুখটি তার চুপসে গেল।
আনা আরিয়ার মায়ের মুখটাও বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। সে তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। আনা আরিয়াও তাকিয়েছে তার মায়ের দিকে।
আনা আরিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়ের কষ্টটা আরও বাড়ল। মেয়ের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এসো মা।’
আনা আরিয়া এসে জড়িয়ে ধরল মাকে।
মা শিলা আনা আরিয়ার মুখ নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুমি আমার খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। তুমি কোনো অন্যায় সহ্য করতে পার না, প্রতিবাদী হয়ে উঠ, সেটাও ভালো মা। ভালো-মন্দ জ্ঞান তোমার আছে। তোমাকে সাবধানে চলতে হবে। তোমাকে কোনো বিপদ বা সমস্যায় জড়ানো চলবে না।’
আনা আরিয়া-মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘চাওসিকো খুব ভালো ছেলে মা। অ্যানজেল আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষ চাওসিকো অ্যানজেলের চেয়ে ভালো মা। তোমাকে এক রাতের ঘটনা এবং একটা ছেলের কথা বলেছিলাম। তুমি তাকে দেখার আশা প্রকাশ করেছিলে। চাওসিকো হলো সেই ছেলে মা। আশ্চর্যের বিষয় লাইব্রেরিতে তার সাথে একদিন আমার দেখা হয়। সে আমাকে চিনতেই পারেনি। অনেক কথা বলেছিলাম, তারপরও আমাকে চিনতে পারেনি। তার মানে সেই রাতে সে আমাকে ভালো করে দেখেইনি।
আনা আরিয়ার মা আনার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘সে এক সোনার ছেলে আনা। কিন্তু সে যে মুসলমান! আর সব বিদ্বেষের টার্গেট এখন মুসলমানরা। তোমার বাপের কথা তো শুনলে। ছেলেটা যদি তার বিশ্বাসে অনড় থাকে, তাহলে কি ঘটবে তা ভাবতেও আমার ভয় হয়। তোমাকে কোনো বিপদে জড়াতে দিতে আমি পারবো না।’
‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষ কেন মা? তারা কি দোষ করেছে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘মুসলমানরা একত্ববাদী ধর্মের অনুসারী এবং তাদের ধর্মই সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম। সে কারণে মানুষের জন্যে ঈশ্বরের বার্তা একমাত্র তাদের কাছে আছে বলে তাদের দাবি। দাবিটা কোনো দিক দিয়েই অমূলক নয়। কিন্তু দোষ তো তাদের এটা নয়। দোষ তাদের অস্তিত্ব, দোষ তাদের ক্রমবর্ধমান বিস্তার। এ বিস্তার না আটকালে, তাদের পেছন দিকে ঠেলে দিতে না পারলে খ্রিস্টানদের অগ্রযাত্রাই শুধু স্তব্ধ হওয়া নয়, তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। সুতরাং মুসলমানদের বিরোধিতা আসলে খ্রিস্টানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এ কারণে এ লড়াইয়ে খ্রিস্টানরা অন্ধ, কোনো যুক্তির মূল্য তাদের কাছে নেই।’ বলল আনা আরিয়ার মা।
‘এ অন্যায় লড়াই মা। আমি যদি এর প্রতিবাদ করি? আমি সত্যকে যদি সত্য বলতে চাই, যেমন তুমি বললে। কেন…।
আনা আরিয়ার মা তার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘খবরদার, ভুলেও তুমি এ ধরনের কথা আর মুখে আনবে না। বরং মা তুমি চেষ্টা করো চাওসিকোকে এ দিকে ফেরাতে। এতে তারও মঙ্গল, আমাদেরও মঙ্গল।’
কোনো জবাব দিল না আনা আরিয়া।
গোটা বুক তার তোলপাড় করে উঠল। মা এটুকুই সহ্য করতে পারছে না, তার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে মা তাহলে কেমন হবে, কি করবে! বুকের তোলপাড়টা তার বাড়ল। মনকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল আনা আরিয়া। মা-বাবাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসে সে চাওসিকোকে। সে ভালোবাসে আল্লাহর পথ ইসলামকে। মা-বাবাকে ভালোবাসা তার শেষ দু’টি ভালোবাসার বিকল্প নয়। এই সত্যটা তার বুক ভেঙে দেয়ার মতো, কিন্তু তবু এটাই সত্য।
একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল, আনা আরিয়া মায়ের বুকে মুখ গুঁজে। মা শিলা তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না মা। ঈশ্বরকে ডাক। তিনি সাহায্য করবেন নিশ্চয়।’
আনা আরিয়া মুখ তুলল মায়ের বুক থেকে।
.
রাত ৯টা।
চাওসিকো তার পড়ার টেবিলে এসে বসল খাওয়া-দাওয়া শেষে। একটা বই টেনে নিচ্ছিল পড়ার জন্যে। এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
কল রিসিভ করল সে। ওপার থেকে কথা বলল ভিসির পিএ। বলল, ‘ভিসি স্যার কথা বলবেন আপনার সাথে।’
‘ঠিক আছে, দিন তাঁকে।’ বলল চাওসিকো।
ওপার থেকে ভিসি’র ‘হ্যালো’ সম্বোধন কানে আসার সাথে সাথে চাওসিকো বলল, ‘গুড ইভেনিং স্যার, আমি চাওসিকো বলছি স্যার।’
‘গুড ইভেনিং। তুমি সব সময় তোমার নামের এক তৃতীয়াংশ বল কেন? তুমি অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো। বলল ভিসি।
‘এক্সকিউজ মি স্যার। আমার দুই নামের কমন হলো চাওসিকো। সে জন্যে চাওসিকো নামটাই সব সময় ব্যবহার করি স্যার।’ চাওসিকো বলল।
তুমি খুবই বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার আজকের অসাধারণ পারফরমেন্সের জন্যে আবারো তোমাকে ধন্যবাদ চাওসিকো। তোমার জন্যে একটা বড় সুখবর আছে চাওসিকো।’ বলল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘কি খবর স্যার? জানতে পারি?’ চাওসিকো বলল।
‘অবশ্যই চাওসিকো। রোমের ভ্যাটিকানে খ্রিস্টান যুব কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার শত বার্ষিকী পালন হচ্ছে। সে কংগ্রেসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা প্রতিনিধিদল যাচ্ছে। সে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দান করবে তুমি।’ বলল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
চাওসিকোর চোখ-মুখ মুহূর্তেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এক পোঁচ কালি যেন কেউ ছড়িয়ে দিল তার মুখে। তার চিন্তা-চেতনায় একটা বিমূঢ় ভাব নেমে এলো। সংগে সংগেই সে কিছু বলতে পারল না।
নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে চাওসিকো বলল, ‘স্যার, খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে পাঠানো প্রতিনিধিদলে আমার শামিল হওয়া, তার নেতৃত্ব দেয়া আমার জন্যে কি উচিত হবে? আপনি তো জানেন স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শর্তে আমি খ্রিস্টান নাম গ্রহণ করলেও, আমি তো একজন মুসলিম স্যার। প্রতিনিধি দলে আমার অংশগ্রহণ, নেতৃত্বদান প্রতিনিধিদলের জন্যে এবং আমার জন্যেও বিব্রতকর হবে এবং সমস্যাও হবে স্যার।’
‘চাওসিকো, তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত জানালাম। এখানে তোমার মত প্রকাশের সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত ফাইনাল। তুমি প্রস্তুতি গ্রহণ করো। রাখছি চাওসিকো। বিশ্ববিদ্যালয় ও আমি তোমার শুভ কামনা করছি।’ কথা শেষ করল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
কথা শেষ হলো। মোবাইলটা টেবিলে রাখল চাওসিকো।
মনে হলো, তার হাত কিছুটা কাঁপল। তার মনে প্রবল ঝড়। বিদ্রোহের ঝড়। বিস্বাদে ভরে গেছে তার মনটা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকে তার উপর জুলুমের শুরু। মনে হয় জুলুমটা চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছে। একজন মুসলিম কি করে ভ্যাটিক্যানের মতো জায়গার একটা অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান যুব প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এখন সে কি করবে? মনের বিদ্রোহ কি বাইরে প্রকাশ করার সাধ্য তার আছে? মনে মনে ভাবল, তবে একটা কাজ সে করতে পারে, সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, পড়াশুনার ইতি ঘটানো। কিন্তু খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করা তার জন্যে যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, লেখাপড়ার ইতি ঘটানো। কি করবে সে? সে আর টেবিলে বসে থাকতে পারছে না। মনের সাথে সাথে দেহটাও তার দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সে পড়ার টেবিল থেকে উঠল। শুয়ে পড়ল গিয়ে তার বেডে। অস্থির মন তার। শুয়ে শুধুই এপাশ-ওপাশ করতে লাগল।
কত কথা তার মনে জাগছে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে তাকে এ সংকটে পড়তে হতো না। হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা নয়, সে কারণেই বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছা না থাকলে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে সে নিশ্চয় ভর্তি হতো না। তাহলে তাকে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছা কি? আমি তো আল্লাহরই মুখাপেক্ষী। ঈমানদার বান্দাদের তিনি নেগাহবান। আমার এই সংকটে আল্লাহর দয়া আমি চাই, পথ তিনিই আমাকে দেখাবেন।
অশ্রুতে দুই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল চাওসিকোর। তার দু’গণ্ড বেয়ে নেমে এলো অশ্রুর দুই ধারা। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল চাওসিকো। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙল চাওসিকোর।
মোবাইলটা টেনে কল অন করতেই ওপার থেকে কণ্ঠ পেল আনা আরিয়ার। সালাম দিল আনা আরিয়া চাওসিকোকে।
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলে চাওসিকো সালামের উত্তর দেয়ার সংগে সংগেই আনা আরিয়া বলল, ‘তোমার গলা ভাঙা কেন? তুমি ভালো নেই না?’ ভারি কণ্ঠ আনা আরিয়ার।
‘তোমার গলা পানি ভরা মেঘের মতো কেন? মনে হচ্ছে তুমি কেঁদেছ। বলল চাওসিকো।
‘অল্প একটু কেঁদেছি। তুমি আবার একে…।
আনা আরিয়ার কথার মধ্যেই চাওসিকো বলে উঠল, ‘দেখ, কাঁদার মধ্যে অল্প বা বেশি এরকম কোনো বিষয় নেই। মানুষ যতটুকু কাঁদার ততটুকুই কাঁদে। কিন্তু কেঁদেছ কেন, সেটা বল।
‘আমার প্রশ্নের আগে উত্তর দাও।’ বলল আনা আরিয়া।
চাওসিকোর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। মুহূর্তের নীরবতার পর বলল, ‘ভালো আছি বললে মিথ্যা বলা হবে আনা।’ কণ্ঠ তার গম্ভীর শোনাল।
‘সেটা আমি বুঝেছি। অফিস থেকে তোমাকে টেলিফোন করেছিল না?’ বলল আনা আরিয়া।
‘আফিস নয়, তোমার বাবা টেলিফোন করেছিলেন আনা। চাওসিকো বলল।
‘বাবা? তাই হবে, বাবা বিষয়টাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তুমি কখন বিষয়টা জেনেছ?’ বলল চাওসিকো।
‘সন্ধ্যার পর মায়ের ঘরে মাকে বাবা এসব কথা বলছিলেন। আমি মায়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে আড়ি পেতে প্রথম এই কথা শুনি। খুব খারাপ লাগে আমার, আমি চলে যাই আমার ঘরে। পরে বাবা আমাকে মায়ের ঘরে ডেকে নেন এবং খুব বড় সুসংবাদ হিসেবে বাবা বিষয়টা আমাকে জানান এবং আরও বলেন যে, আমিও ঐ প্রতিনিধিদলে আছি এবং আমি ডেপুটি লিডার।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তুমি ডেপুটি লিডার? তার মানে এক সাথে দুই মুসলিমকে কুরবানির ব্যবস্থা!’
‘সেটাই চাওসিকো।’ আনা আরিয়া বলল। কম্পিত ও কান্না জড়িত কণ্ঠস্বর তার।
ভেঙে পড়ো না আনা। আল্লাহর উপর ভরসা করো। দুনিয়ার সবকিছু তারই নিয়ন্ত্রণে। দেখ, আমার সামনে দুইটা পথ- হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, নয়তো প্রতিনিধিদল নিয়ে ভ্যাটিকানে যাওয়া। দুটিই আমার জন্যে কঠিন। এই অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তার ইচ্ছায় যা ঘটবে, তার উপর নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আনা। এসো, আমরা এটাই করি।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তুমি অনেক বোঝ, অনেক বড় তুমি, আল্লাহকে যেভাবে তুমি চিন, আমি সেভাবে চিনে উঠতে পারিনি। আমার জন্যে দোয়া করো। আমি যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন দাঁড়াতে পারি। বাবারা খুব অন্যায় করছেন। বাবাদের এ সিদ্ধান্তের আমি প্রতিবাদ করেছি। জেনে বুঝে তারা কেন একজন মুসলিমকে খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে পাঠাচ্ছেন। মা’ও আমার পক্ষ নিয়ে বাবাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তার একই কথা চাওসিকোর আমরা ক্ষতি করছি না, তার উপকার করছি। আর কি করার আছে বলো?’ আনা আরিয়া বলল। তার কথা শেষের দিকে আবার ভারি হয়ে উঠেছিল
কিছু করার নেই আনা। আমি শুধু একটা কাজই করতে পারি। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া।’
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে বাঁচবে, আমি বাঁচব কি করে? তুমি তোমার ঈমান রক্ষা করতে পারবে, আমার ঈমান রক্ষা কীভাবে হবে?’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছ। আমি তো একটা বিকল্পের কথা বলেছি।’ বলল চাওসিকো।
‘না, তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার কথা বলবে না কখনও। তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লে আমাকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লে চলবে না, বাড়িও ছাড়তে হবে আমাকে।’ কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে আনা আরিয়া বলল।
‘আগাম এসব ভাবতে নেই আনা। তোমার আমার সব ভাবনা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। মানুষের ইচ্ছায় কিছু ঘটে না, যদি আল্লাহ ইচ্ছা না করেন। এসো আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি।’ বলল চাওসিকো।
‘আমার ভরসা আল্লাহর উপরই চাওসিকো। এখন বলো ভ্যাটিকান যাওয়া নিয়ে আমাদের করণীয় কি?’ আনা আরিয়া বলল।
‘কিছুই করণীয় নেই। ভিসি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত ইনফরমেশন আমাকে জানানো হয়েছে। আমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং করণীয় কি থাকবে? সর্বোচ্চ ব্যক্তি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন।’ বলল চাওসিকো।
‘কেন, রিভিউ আবেদনের সুযোগ সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ক্ষেত্রেও আছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘বিশ্ববিদ্যালয় সুপ্রিমকোর্ট নয়।’ বলল চাওসিকো।
‘তার মানে ভ্যাটিকানে আমাদের যেতে হচ্ছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তাও বলতে পারছি না। এর মধ্যে আল্লাহ কিছু না ঘটালে, আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই হবে।
‘আমি তোমার এই চিন্তার সাথে একমত চাওসিকো। আচ্ছা চাওসিকো একটা কথা কি বলতে পার, যদি আমাদের যেতেই হয়, তাহলে আমাদের সমস্যা কি কি হবে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমার কোনো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে চিন্তা এখন করতেও চাই না। এমন চিন্তার অর্থ হবে ভ্যাটিকানে যাওয়া আমরা শিরধার্য করে নিয়েছি। আমি তা করতে চাই না। আল্লাহর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করতে চাই।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তোমার কাছে অনেক কিছু শিখছি।
কথা শেষ করেই আনা আরিয়া কণ্ঠটা একটু নামিয়ে বলল, ‘আমার দরজায় নক হচ্ছে চাওসিকো। নিশ্চয় মা এসেছেন। আমি এখন রাখছি। পরে কথা বলব। বাই। সালাম।’
‘ঠিক আছে। আসসালামু আলাইকুম।’
কল অফ করল চাওসিকো।
৪
চাওসিকোর দরজায় নক হলো, ‘ঠক, ঠক, ঠক।’
চাওসিকো দরজা খুলে দেখল আনা আরিয়া।
চাওসিকোর রুমের পাশের রুমটাই আনা আরিয়ার। প্রতিনিধিদলে লিডার ও ডেপুটি লিডার হিসেবে তারা দু’টি পাশাপাশি রুম বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতিনিধিদলের অন্য দশজন ভ্যাটিক্যানের কমন ডরমিটরির এই ব্লকেই অন্যান্য রুমে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। কে কোন্ রুম নেবে সদস্যদের চয়েসের উপর তা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সবার জন্যে এই একই সরকারি ব্যবস্থা।
চাওসিকো এই ব্যবস্থার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিল। কিন্তু তার আপত্তি টিকেনি। যুক্তি দেখিয়ে তাকে বলা হয়েছে, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন এখানে নেই। তাছাড়া চলে আসা এই ব্যবস্থাকে সকলেই ওয়েলকাম করেছে।
‘সালাম আলাই কম। ফিস ফিস কণ্ঠে বলল আনা আরিয়া।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল চাওসিকো।
ঘরে প্রবেশ করে আনা আরিয়া বলল, ‘প্রোগ্রাম পেপারস নিয়ে এসেছি, এখন আলোচনা করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ আনা, চল আমরা লাউঞ্জে গিয়ে বসি।’ বলল চাওসিকো।
‘ওখানে নিরিবিলি কথা বলা যাবে না। তোমার এখানেই বসি, না হয় আমার বেড রুমে চল।’ আনা আরিয়া বলল।
হাসল চাওসিকো। বলল, ‘এখানে যে সমস্যা ওখানেও তো সেই একই সমস্যা।’ চাওসিকো চোখ নিচু রেখে কথা বলছিল।
আনা আরিয়া বলল, ‘বুঝেছি চাওসিকো। তার মুখে লজ্জার একটা আরক্ত প্রবাহ।
ক্ষণেক থেমেই আনা আরিয়া আবার বলে উঠল, ‘জরুরি হিসাবে অল্পক্ষণ বসারও কি অনুমতি নেই?’
‘কোনো বিকল্প না থাকলে আমরা এক ঘরে রাত কাটাতে পারি, এ অনুমতি আছে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে এই বদ্ধ বেডরুমে আমরা কিছুক্ষণও বসতে পারি না।’ বলল চাওসিকো।
হাসল আনা আরিয়া। স্বচ্ছ এক হাসি তার মুখে। বলল সত্যি আল্লাহর এ ধর্ম খুবই বাস্তববাদী। স্বাভাবিক অবস্থায় নীতির প্রশ্নে একচুলও ছাড় নেই, কিন্তু অস্বাভাবিক অবস্থার প্রয়োজন অনুসারে ছাড় দেয়া হয়। আলহামদুলিল্লাহ, তোমার কাছে প্রতিদিনই কিছু করে শিখছি চাওসিকো।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘চল চাওসিকো লাউঞ্জেই যাই।’
দু’জন গিয়ে লাউঞ্জের এক প্রান্তে বসল।
আনা আরিয়া তার হাতের ফোল্ডার থেকে খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসের প্রোগ্রাম ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাগজ-পত্র বের করল। প্রোগ্রামটা তুলে দিতে যাচ্ছিল চাওসিকোর হাতে।
চাওসিকো বলল, ‘তুমি তো পড়েছ। আমিও দেখেছি। আমাদের জন্যে অসুবিধাজনক দিকগুলো নিয়েই এসো আমরা আলোচনা করি।
‘প্রথম দিন প্রার্থনা দিয়েই যুব কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে। প্রার্থনা নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রথম দিনের দুই অধিবেশনে আমাদের কোনো সমস্যা দেখি না। সমস্যা দাঁড়াবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের অধিবেশনে। দুনিয়ার ১৬০টি প্রতিনিধি দলকে বিশটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। আফ্রিকায় চারটি গ্রুপ। মধ্য আফ্রিকা গ্রুপের নেতা হয়েছ তুমি। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে মধ্য আফ্রিকায় খ্রিস্টান ফেইথের সম্প্রসারণের উপর তোমার বিশ মিনিটের একটা রিপোর্ট পেশ করতে হবে। আর তৃতীয় দিনের কর্মসূচির ১০ মিনিটের একটা প্রোগ্রাম সবচেয়ে বিপজ্জনক। দশ মিনিটের এই প্রোগ্রামে যিশুর জীবন নিয়ে কথা বলতে হবে চাওসিকোকে। আনা আরিয়া বলল।
চাওসিকো কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কথা বলা হলো না।
তাদের দিকে আসতে দেখল মধ্য আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদলের নেতাকে। চাওসিকো এবং আনা আরিয়া উঠে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগত জানালো। বসলো তারা। তাদের সবার সাথে পারস্পরিক পরিচয় আগেই হয়েছিল।
তাদের একজন, গ্যাবনের প্রতিনিধিদলের নেতা জিন মেরী বলল, ‘আমরা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কামেরুন, গ্যাবন, নিরীক্ষীয় গিনি, কঙ্গো, কেনিয়া, উগান্ডার প্রতিনিধিরা আমাদের কান্ট্রি রিপোর্ট নিয়ে এসেছি। দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, নাইজেরিয়ার রিপোর্ট আমাদের মাধ্যমে তারা পাঠিয়েছে। রুয়ান্ডা ও ডেমোক্রাটিক কঙ্গোর রিপোর্ট তারা সরাসরি আপনাকে দেবে। আঞ্চলিক রিপোর্ট পেশের সময় দেখলাম বিশ মিনিট। বিশ মিনিটে আপনি কীভাবে ১৫টি দেশের কান্ট্রি রিপোর্ট কভার করবেন? আমরা সবাই চাই, আমাদের রিপোর্টের খ্রিস্টান ফেইথের সম্প্রসারণ ও বিরোধিতার প্রকৃতি বিষয়টা হুবহু আসুক।’
‘সবাইকে ধন্যবাদ যে, আপনাদের রিপোর্ট এবং যারা এখানে আসেনি তাদের সবার রিপোর্ট আপনারা নিয়ে এসেছেন। ডেমোক্রাটিক কঙ্গো এবং রুয়ান্ডার রিপোর্ট যোগাড় করে নেব।’
একটু থামল চাওসিকো। কথা শুরু করল আবার, ‘অধিবেশনে রিপোর্টের প্রেজেন্টেশন নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমাদের প্রত্যেকের কান্ট্রি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। সেগুলোই তারা মূল্যায়ন করবেন। অধিবেশনে রিজিওনাল রিপোর্ট পেশ একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। লাভটা হবে, গোটা দুনিয়ায় খ্রিস্টান ফেইথের সম্প্রসারণ ও বিরোধীদের অবস্থার একটা সামারি আমরা জানতে পারব। আমি…।’
চাওসিকের কথার মাঝখানে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের ডেপুটি লিডার ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত বলে উঠল, ‘সামারিতে তাহলে তো দেশগুলোর নামের জন্যেও জায়গা হবে না?’
হাসল চাওসিকো। বলল, ‘১৫টি কান্ট্রি রিপোর্ট সামনে রেখে আমি একটা রিজওনাল রিপোর্ট তৈরি করব। তাতে শুধু প্রত্যেক দেশের নাম নয়, সব দেশের কাজের একটা সমন্বিত রিপোর্টও থাকবে।’
‘লর্ড জেসাসকে ধন্যবাদ। নিশ্চয় আপনি তা পারবেন। আমি শুনেছি, আপনি খুব প্রতিভাবান ছাত্র। একজন তরুণ বিজ্ঞানীও। আমি আপনার শুভ কামনা করি।’
বলল নিরক্ষীয় গিনীর ডেপুটি লিডার আইমান এলিজাবেথ।
প্রথম যে কথা শুরু করেছিল, সেই জিন মেরীও চাওসিকোকে ধন্যবাদ জানাল এবং সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমার এবং যারা আসেনি তাদের রিপোর্ট আমি চাওসিকোকে দিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের রিপোর্টও আপনারা তার কাছে জমা দিন।’ বলেই জিন মেরী উঠে দাঁড়াল।
নিজ দেশের রিপোর্টসহ অন্যদের রিপোর্ট সে চাওসিকোর কাছে জমা দিল।
জিন মেরী তাকাল পাশের সোফার আনা আরিয়ার দিকে। হাসল। বলল, ‘তোমার পরিবারের কান্ট্রি অব অরিজিন জিজ্ঞাসা করতে পারি মিস আনা আরিয়া?’
‘অবশ্যই মিস জিন মেরী। আর্মেনিয়া। বলল আনা আরিয়া।
‘জান, কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সিক্রেট রেটিং-এ তুমি সব দিক থেকে ‘গার্ল অব দ্যা কংগ্রেস’ হয়েছ। শ্রীঘ্রই ঘোষণা আসছে। জিন মেরী বলল।
‘দুঃখিত মিস জিন মেরী, আমি পণ্য নই যে আমার রেটিং হবে। আর যারা কোনো কিছুর বহিরাঙ্গ দেখে বিচার করে তারা সব সময় ভুল করে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি ঠিক বলেছ মিস আনা আরিয়া। কিছু মনে করো না তুমি, ওটা মজা করা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে একথা ঠিক যে, আর্মেনিয়ানরা সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত।’ জিন মেরী বলল।
‘ওটা স্রষ্টার ব্যাপার মিস জিন মেরী। স্রষ্টার একটা দানকে পণ্য বানানো একটা সামাজিক অপরাধ।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস আনা আরিয়া। তোমার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করি। জিন মেরী বলল।
চাওসিকো প্রত্যেকের রিপোর্ট নিয়ে ভালো করে দেখে তা আনা আরিয়াকে দিয়ে দিচ্ছিল। মধ্যআফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের রিপোর্ট নেবার সময় ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাতকে এবং নিরক্ষীয় গিনীর রিপোর্ট নেয়ার পর আইমান এলিজাবেথকে একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল চাওসিকো।
সবাই চলে গেল, শুধু বসে ছিল ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত এবং আইমান এলিজাবেথ।
আইমান এলিজাবেথ দেহের দিক দিয়েও মিশ্র কাঠামোর এবং রং উজ্জ্বল শ্যামলা। আর ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত দেহের গড়নে নন-আফ্রিকান এবং রংয়ের ক্ষেত্রে খাঁটি আফ্রিকান।
চাওসিকো আনা আরিয়ার হাত থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে গুণে দেখার পর ভাঁজ করে রেখে তাকিয়েছিল এলিজাবেথ ও ব্রুনোর দিকে। মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে। বলা হলো না।
বেয়ারা কফির ট্রে এনে সামনের টেবিলে রাখল।
চাওসিকো বিস্ময় নিয়ে তাকাল আনা আরিয়ার দিকে।
‘আমি অর্ডার দিয়েছিলাম। মি. ব্রুনো ও মিস এলিজাবেথ তো এখন তোমার মেহমান।’
‘ধন্যবাদ আনা।’ বলল চাওসিকো। তার মুখ প্রসন্ন।
‘ওয়েলকাম।’ আনা আরিয়া বলল। ওদিক থেকে ব্রুনো ও এলিজাবেথ দু’জনেই বলে উঠল, ‘আমরা মেহমান হলাম কেমন করে? আমরা সবাই এখানে তো একই আয়োজনের অংশ।
‘মেহমান হওয়ায় ক্ষতি নেই। আমাদের কিছু লাভ আছে। উপযুক্ত সময়ে এক কাপ করে কফি খাওয়া হলো। বলল আনা আরিয়া মুখ টিপে হেসে।
সবাই হেসে উঠল। সবাই কফির কাপ হাতে তুলে নিল।
চাওসিকো কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে কফির কাপটা টেবিলে রেখে ব্রুনো ও এলিজাবেথের দিকে চেয়ে বলল, ‘মাফ করবেন মি. ব্রুনো ও মিস এলিজাবেথ, মাত্র একটা কৌতূহলের কারণে আপনাদের কষ্ট করে অপেক্ষা করতে বলেছি।’
‘কোথায় কষ্ট দেখলেন? আমরা তো খুশি। অপেক্ষা না করলে তো এই কফি পেতাম না।’ বলল এলিজাবেথ। হাসি মুখে সমর্থন করল ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত।
‘ধন্যবাদ আপনাদের। আমার কৌতূহলের বিষয় হলো, মি. ব্রুনোর নামের ‘মাহামাত’ শব্দ এবং মিস এলিজাবেথের নামের ‘আইমান’ শব্দ।
ব্রুনো এবং এলিজাবেথ দু’জনের মুখই একটু ম্লান হলো।
মুহূর্তের জন্যে মাথাটাও একটু তাদের নিচু হয়েছিল।
‘আপনার কৌতূহলটা কি মি. চাওসিকো?’ জিজ্ঞাসা করল ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত।
‘মিস এলিজাবেথের নামের ‘আইমান’ অংশ এবং আপনার নামের ‘মাহায়াত’ শব্দ সম্পর্কে আমার কৌতূহল। ‘আইমান’ আরবি শব্দ এবং ‘মাহামাত’ও একটা বিখ্যাত আরবি নামের একটু ভিন্নতর উচ্চারণ। আপনাদের নামে এ শব্দ দু’টো এলো কি করে?’ বলল চাওসিকো।
‘এ দু’টো আরবি শব্দ আপনি বুঝলেন কি করে? আমার নামের এ অংশ নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলেনি। আমার মনে হয় মিস এলিজাবেথও এই কথাই বলবেন। তাহলে…।’
ব্রুনো ফ্রান্সিসের কথার মাঝখানেই এলিজাবেথ বলে উঠল, ঠিক। আমার ‘আইমান’ নাম নিয়েও কখনও কারও মধ্যে জিজ্ঞাসা জাগতে দেখিনি।’
‘ধন্যবাদ মিস এলিজাবেথ। আমাদের তাহলে প্রশ্ন মি. চাওসিকো, আপনার মনে প্রশ্ন উঠল কেন?’ ব্রুনো ফ্রান্সিস বলল।
‘কারণ আমারও পিতৃদত্ত আরবি নাম আবিদ ইব্রাহিম। আরবি নামের সাথে তাই আমি পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আমার আরবি নাম বদলে যায়।’ বলল চাওসিকো।
‘শুধু নাম নয় আপনিও বদলে গেছেন।’ মিস এলিজাবেথ বলল। বিষয়টাকে এভয়েড করে চাওসিকো বলল, ‘আপনাদের বদলের কাহিনীটা কি ছিল?’ হালকা কণ্ঠ চাওসিকোর।
এলিজাবেথ এবং ব্রুনো ফ্রান্সিস দু’জনেই তাদের বদলে যাবার কাহিনী জানাল। তাদের দু’জনের বাবা-মা মুসলমান ছিল। এলিজাবেথের নাম ছিল আইমান। তার বাবা-মা তাদের গ্রামের পাশের ছোট শহরে খ্রিস্টান মিশন স্কুলের হোস্টেলে মাছ সরবরাহের কাজ করত। আইমানও সেখানে যাতায়াত করত। তারা তাকে এলিজাবেথ বলে ডাকত। স্কুলে
ভর্তির সময় এই নামেই তাকে স্কুলে ভর্তি করে। নাম বদলের পর কখন সে মুসলমান থেকে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, তা সে জানে না। লেখা-পড়া শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের সময় সে নিজে এলিজাবেথ নামের সাথে তার আইমান নাম যোগ করে পিতা-মাতা ও নিজ গোত্রের স্মৃতি স্মরণে রাখার জন্যে। আর ব্রুনো ফ্রান্সিসের কাহিনী হলো, তার বয়স যখন নয় দশ বছর, সে সময় তাদের গোত্রের সাথে মিশনারীদের একটা বিরাট সংঘর্ষ হয়। মিশনারীদের মিলিত বিরাট শক্তির কাছে তাদের গোত্র পরাজিত হয়। যুবকরা প্রায় সকলে মারা যায়। অবশিষ্টরা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। শিশু-কিশোরদের পালিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। মিশনারীরা তাদের ধরে নিয়ে আসে। ব্রুনো ফ্রান্সিস তাদের একজন ছিল। তার নাম ছিল মাহামাত। এ নামের সাথে তারা যুক্ত করে ব্রুনো ফ্রান্সিস। সে কখন বদল হয়েছে সে জানে না।
‘তাহলে আপনাদের দু’জনের কেউ সজ্ঞানে, মানে সিদ্ধান্ত নিয়ে বদলে যাননি। বলল চাওসিকো।
‘সে ধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠানোর সুযোগ দেখা যাচ্ছে আমাদের হয়নি।’ এলিজাবেথ বলল।
‘স্মৃতির কোনো টানতো আপনাদের নেই?’ বলল চাওসিকো।
‘এমন ভাবনা আমাদের মনে কখনও জাগেনি। এলিজাবেথ ও ব্রুনো ফ্রান্সিস দু’জনেই বলল।
‘মাহামাত নামের বিখ্যাত লোকটি কে? যেটা আপনি বললেন। ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত বলল।
‘মাহামাত নামটি আরবির বিখ্যাত নাম ‘মুহাম্মদ’-এর আফ্রিকি রূপ। আর ‘মুহাম্মদ’ হলো ইসলামের নবী বা প্রফেট-এর নাম। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন তাঁরই উপর স্রষ্টার তরফ থেকে নাজিল হয়।’ বলল চাওসিকো।
‘ও গড়, কত বড় লোকের নাম আমার নামের সাথে যুক্ত?’ ব্রুনো ফ্রান্সিস বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আপনার বাবা-মা তার নামেই আপনার নাম রেখেছিলেন। আর দেখ মিশনারীরা তোমার খ্রিস্টান নাম রাখার সময় তোমার এ নামটা ছেঁটে ফেলা উচিত ছিল, তা তারা করেনি বা করতে পারেনি। তোমার এ নামের এটা একটা মিরাকল।’ বলল চাওসিকো।
‘এ মিরাকলটা কেন?’ বলল ব্রুনো ফ্রান্সিস। তার চোখে-মুখে ভাবনার প্রকাশ।
‘এ প্রশ্নটা আমারও! আমার নাম আইমান তারা বাদ দিল, কিন্তু ওর নামের মাহামাত তারা বাদ দিতে পারল না কেন?’ আইমান এলিজাবেথ বলল।
‘এর উত্তর আমি জানি না। সব মিরাকলের মালিক জগৎস্রষ্টাই এর উত্তর জানেন। তবে আমার মনে হয়, ‘মুহাম্মদ’ নামের এক অশরীরী প্রভাব এটা, তার নামের বরকত এটা। মুহাম্মদ নামটি দুনিয়ার পূর্বাপর ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে প্রভাবশালী, সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে সফল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অ্যাডাম থেকে শুরু হওয়া এবং আব্রাহামের মধ্যে দিয়ে চলে আসা নবী-রাসুলদের ধারাবাহিকতায় মুহাম্মদ আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসুল। সুতরাং তাঁর নামের একটা মিরাকল তো থাকবেই।’ বলল চাওসিকো।
ব্রুনো ফ্রান্সিস ও এলিজাবেথ গভীর মনোযোগের সাথে শুনছিল চাওসিকোর কথা। ব্রুনো ফ্রান্সিসের মুখ গম্ভীর ও ভারি। এলিজাবেথের মুখেও গভীর চিন্তার প্রকাশ।
চাওসিকোর কথা শেষ হলেও দু’জনের কেউ কথা বলল না। কথা বলল আনা আরিয়া, ‘চাওসিকো তুমি তো সবার কফি ঠাণ্ডা করে দিলে।
এলিজাবেথ ও ব্রুনো ফ্রান্সিস দু’জনেই বলে উঠল, ‘না আমরা কফি খাচ্ছি। খুব গরম আছে।’
বলে দু’জনেই আবার কফির কাপে চুমুক দিল।
কফি খাওয়া শেষে এলিজাবেথ ও ব্রুনো ফ্রান্সিস দু’জনেই বিদায় নিল। বিদায় নেবার সময় দু’জনেই বলল, ‘ধন্যবাদ মি. চাওসিকো, আপনি আমাদের শেকড় ধরে নাড়া দিয়েছেন। আমরা কখনই এভাবে পেছন ফিরে তাকাইনি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘চাওসিকো তুমি আমাদের রাসুল (স.)-এর নামের মিরাকল সম্পর্কে বললে, আসলেই সেটা কি?’ জিজ্ঞাসা করল আনা আরিয়া কাগজ-পত্র সব গুছিয়ে নিতে নিতে।
‘আল্লাহ রাসুল (স.)-এর নামের মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব দিয়েছেন বা দিতে পারেন। কিন্তু আমি অলৌকিকত্ব বলতে তাঁর নামের অসীম বরকতের কথা বলেছি। এই বরকতের নানারকম প্রকাশ হতে পারে। ব্রুনো ফ্রান্সিসের নামের ক্ষেত্রে তার একটা সম্মানজনক প্রকাশ ঘটেছে। নামটা তারা হেঁটে ফেলতে পারেনি।’ বলল চাওসিকো
‘অলৌকিকত্ব ও বরকতের প্রকাশ কখনও কখনও সমার্থক হতে পারে। অতএব আমাদের রাসুল (স.) নামের মধ্যে অলৌকিকত্ব আছে বলা যায়।’ আনা আরিয়া বলল।
‘হ্যাঁ এক্ষেত্রে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায় আনা। আমাদের রাসুল (স.)-এর দাদা আব্দুল মোত্তালিব তার নাতির নাম মুহাম্মদ রেখেছিলেন। অথচ এই নাম মক্কায় বা আরবে প্রচলিত ছিল না। নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছায় এটা ঘটেছে।’ বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়া শিশুর মতো হাততালি দিয়ে উঠল। বলল, ‘বলেছি না যে আমাদের রাসুল (স.)-এর নামে আল্লাহ অলৌকিকত্ব দিয়েছেন। অলৌকিকত্ব দিয়েই তো তাঁর নামের শুরু!’ আনা আরিয়ার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
‘আল্লাহর রাসুল (স.)-কে তুমি খুব ভালোবাস না?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর। ‘ভালোবাসব না! তিনি তো আমাদের ভালোবাসেন। সমস্ত মানুষকে ভালোবাসেন। সমস্ত সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ আনা আরিয়া, মানুষের মনে এই ভালোবাসার তৌফিক আল্লাহই দেন, যাকে তিনি ভালোবাসেন।’ বলল চাওসিকো।
‘আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন…।’ কথা শেষ করতে পারলো না আনা আরিয়া আবেগজড়িত কণ্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে গেল।
লাউঞ্জে ঢুকছিল যুব কংগ্রেস আয়োজনের একজন কর্মকর্তা, অ্যানজেলা অ্যানি। আনা আরিয়া নিজেকে সামলে নিল।
‘হ্যাল্লো চাওসিকো, আনা আরিয়া তোমরা কেমন আছ? সব ঠিকঠাক চলছে তো?’ লাউঞ্জে ঢুকে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে লক্ষ্য করে বলল অ্যানজেলা অ্যানি।
চাওসিকো ও আনা আরিয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘ওয়েলকাম মিস অ্যানজেলা অ্যানি। আমরা ভালো আছি। বসুন, প্লিজ।’
‘না বসব না, একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এলাম তোমাদেরকে। আজ পাঁচটার মধ্যে ২০ মিনিটের রিজিওনাল রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এর মধ্যেই কান্ট্রি রিপোর্টগুলোর সমন্বয় করে রিজিওনাল রিপোর্ট তৈরি শেষ করতে হবে।’ বলল অ্যানজেলা অ্যানি।
‘পাঁচটার মধ্যে পেয়ে যাবেন, আশা করি।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো।’
বলেই তাকাল অ্যানজেলা অ্যানি আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘সময় থাকলে সুন্দরী মিস আনার হাতের এক কাপ কফি খেতাম। কিন্তু তা হবার নয়। আসি মিস আনা আরিয়া, আসি চাওসিকো।
অ্যানজেলা অ্যানি চলে গেল।
আনা আরিয়ার মুখ বিষণ্ন। তাকে সুন্দরী বলা সে পছন্দ করেনি। সে ভাবল, সৌন্দর্য আমার নিজস্ব কোনো বিষয় নয়, একান্তভাবেই স্রষ্টার দেয়া। যার জন্যে আমার বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই। কেন মানুষ আমিত্বের সাথে একে যুক্ত করবে?
চাওসিকো ব্যাপারটা কিছুটা বুঝল।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘আনা, এখানকার কাজ শেষ। চল আমরা যাই।’
‘তোমার তো অনেক কাজ পড়ল। এতগুলো কান্ট্রি রিপোর্ট বিশ মিনিটের টাইম-ফ্রেমে সাজানো সহজ কাজ নয়। আমি কি কোনো কাজে লাগব? কি করে লাগব, তুমি তো আমাকে তোমার ঘরে বসতেই দেবে না।’ আনা আরিয়া বলল। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
‘বসতে দিলেই কি তুমি আমার ঘরে গিয়ে বসবে। এখানে দরজা খোলা রাখার কালচার নেই।’ বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘আগের অবস্থায় হলে না. ডাকলেও গায়ে পড়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তোমাকে সহযোগিতা করতাম! সে আনা আরিয়া আর নেই। এখন তুমি ডাকলেও বন্ধ ঘরে গিয়ে তোমার সাথে বসব না। শয়তানের হাত থেকে আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন।’
‘ধন্যবাদ আনা, চল এবার উঠি।’ বলে উঠে দাঁড়াল চাওসিকো।
আনা আরিয়াও উঠল। চলল তাদের ঘরের দিকে। আগে আগে চলছিল আনা আরিয়া। চাওসিকোর দরজাটার পরেই আনা আরিয়ার দরজা। আনা আরিয়া দাঁড়াল চাওসিকোর দরজার সামনে। পেছনে চাওসিকোও দাঁড়িয়েছে। আনা আরিয়া পেছন ফিরে চাওসিকোকে বলল, ‘দেখি, তোমার ঘরের চাবি দাও।
‘কেন?’ বলে চাবিটা চাওসিকো তার হাতে দিয়ে দিল।
আনা আরিয়া চাওসিকোর ঘরের দরজা খুলল।
হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। পেছন ফিরে চাওসিকোকে বলল, ‘তুমি দরজায় অল্পক্ষণ দাঁড়াও।’
ঘরে ঢুকে গেল আনা আরিয়া। বন্ধ করে দিল দরজা।
মিনিট দশেক পর বেরুল ঘর থেকে। চাবিটা চাওসিকোর হাতে দিয়ে বলল, ‘বাড়িতে তোমার ঘর ড্রেসিং করে কে?’
‘মা করেন। মাঝে মাঝে বোনও করেন।’ বলল চাওসিকো।
‘ছেলেরা ভাগ্যবান। আমি কলেজে উঠলে মা কিংবা পরিচারিকা কেউ আমার রুম ড্রেসিং করেনি। মায়ের হুকুমে আমাকেই করতে হয়েছে।’
বলে আনা আরিয়া দৌড় দিল তার নিজের ঘরের দিকে।
চাওসিকো ঘরে ঢুকল। আনা আরিয়া ঘরের আলো বন্ধ করে গিয়েছিল। ঘরের আলো জ্বালল চাওসিকো। উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন হেসে উঠল 1
নতুন সাজ পরেছে যেন ঘরটা।
নতুন চাদর, বালিশে নতুন আবরা। টেবিলের বিশৃঙ্খল কাগজ-পত্র ও বই চমৎকার করে সাজানো। কাপড়-চোপড় আলমারির হ্যাংগারে ঝুলানো। ব্যবহৃত কাপড়, চাদর ইত্যাদি সার্ভিস ঝুড়িতে দেখল। ফুলদানিটা ঝেড়ে- মুছে যথাস্থানে সরিয়ে রাখা। হাসল চাওসিকো।
ভাইস চ্যান্সেলরের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে এই ছোট্ট বয়সেও তার নারীত্বকে খুব বেশি মনে রেখেছে, পুরুষ হতে চায়নি। পরিবারে প্রয়োজন অনুসারে সবাইকে সব কাজ করতে হবে, এরপরও নারীকে নারী আর পুরুষকে পুরুষ থাকতে হবে। স্রষ্টারই এটা ফায়সালা।
এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই চাওসিকো এগোলো তার টেবিলের দিকে। সময়ের আগেই রিপোর্ট তাকে তৈরি করতে হবে। তৈরি রিপোর্ট আনা আরিয়াকে একবার অন্তত পড়াতে হবে। বসল চাওসিকো চেয়ারে।
টেবিল থেকে লেখার প্যাডটা টেনে নিল।
.
আনা আরিয়া চাওসিকোকে যিশু খ্রিস্টের জীবনের উপর সুন্দর, সত্যনিষ্ট বক্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে তার ঘরে চলে এলো। লম্বা প্রোগ্রামে ক্লান্ত সে।
চাওসিকোর মন তখন এক অপার্থিব প্রশান্তিতে ভরে আছে। বিরাট এক সমস্যা ছিল তার সামনে। কি বলবে সে হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবনের উপর। হযরত ঈসা (আ.) অর্থাৎ যিশু খ্রিস্টের জীবনের উপর খ্রিস্টানরা যা বলে তার মূল কথার সাথে যিশু খ্রিস্টের জীবনের কোনো মিল নেই। সেটা সে বলতে পারবে না। সে যেটা বলবে তা এরা গ্রহণ করবে না। প্রফেট হিসাবে যিশু খ্রিস্টকে তুলে ধরাই কঠিন এবং বিতর্কের সব ব্যাপার এখানেই। শেষ পর্যন্ত সে ঠিক করে, প্রফেট হিসেবে যিশুর পরিচয় সম্পর্কে সে বেশি কিছু বলবে না। তার মিশন, তার কাজ নিয়েই বেশি কথা বলবে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে প্রফেট যিশুর পরিচয় সম্পর্কে ওপেনিং প্যারাগ্রাফটা লিখেছিল সে এইভাবে:
‘কোটি কোটি মানুষের অপার ভালোবাসা সিক্ত প্রফেট জেসাস ক্রাইস্ট মহান ঈশ্বরের প্রেরিত ও মনোনীত, তার একজন প্রশংসিত বার্তাবাহী। আদি মানুষ আদমের স্বর্গচ্যুতির পর জগৎস্রষ্টা ঈশ্বর আদমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুগে যুগে তিনি তাঁর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে বার্তা দিয়ে প্রফেট পাঠাবেন। মানুষদের যারা তাদের কথা শুনবে, বিশ্বাস করবে, পালন করবে, তাদের কোনো ভয় ও চিন্তা থাকবে না। মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের অনন্ত সুখের স্বর্গ লাভ হবে। প্রফেট জেসাস ক্রাইস্ট মহান ঈশ্বর কর্তৃক প্রতিশ্রুত সেই প্রফেটদের একজন। তিনি বহুল আলোচিত প্রফেট নুহ, ইব্রাহিম, মুসা প্রমুখের একজন মহান উত্তরসূরী।’
পকেট থেকে নোট বের করে প্যারাগ্রাফটি আবার পড়ল চাওসিকো। মন তার খুশিতে ভরে গেল। আমাদের রাসুল (স.)-এর পূর্বসুরী প্রিয় নবী হযরত ঈসা (আ.) মানে যিশু খ্রিস্ট নবী হিসেবে যা, সেটাই সে তুলে ধরতে পেরেছে।
চাওসিকো চেয়ার থেকে উঠল বিছানায় একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে। তখন দরজায় নক হলো।
চাওসিকো গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে যুব কংগ্রেস আয়োজনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যানজেলা অ্যানি এবং গ্যাবন প্রতিনিধিদলের নেত্রী জিন মেরী।
চাওসিকো কিছু বলার আগেই অ্যানজেলা অ্যানি বলল, ‘গুড ইভেনিং চাওসিকো।’
‘গুড ইভেনিং আপনাদের দু’জনকে। ভেতরে আসুন, প্লিজ।’ বলল চাওসিকো। বলে চাওসিকো ঘরের ভেতরে সরে এলো।
‘নিশ্চয়’ বলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। বসল গিয়ে দু’জন সোফায়।
দু’সিটের একটাই সোফা ঘরে। চাওসিকো গিয়ে বসল তার চেয়ারে।
কথা শুরু করল অ্যানজেলা অ্যানি। বলল, ‘প্রভু যিশুর জীবনের উপর একি বক্তৃতা দিলে চাওসিকো? তুমি কি জান, সমন্বয়কৃত ২০ মিনিটের তোমার রিপোর্ট রেটিং-এ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু তুমি কি বক্তৃতা দিলে বলত?
‘কেন কি হয়েছে মিস অ্যানজেলা অ্যানি?’ বলল চাওসিকো।
‘তুমি আবার জিজ্ঞাসা করছ কি হয়েছে? অধিবেশনের পরেই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তোমার দশ মিনিটের গোটা বক্তব্য অধিবেশনের প্রসিডিংস থেকে এক্সপাঞ্চ হয়েছে।’
‘যেকোনো বক্তব্য কর্তৃপক্ষ অবশ্যই এক্সপাঞ্চ করতে পারেন। কিন্তু এক্সপাঞ্চ হওয়ার মতো কোনো অসত্য, অসংগত কথা আমি বলিনি। মহান জেসাস ক্রাইস্টের জীবন ও কর্ম নিয়ে অন্যেরা যা বলেছে, আমিও তাই বলেছি।’ বলল চাওসিকো।
‘কিন্তু শুরুটা, যেখানে জেসাস ক্রাইস্টের পরিচয় বলেছ, সেখানে কি বলেছ? তার পরিচয়ের মূল কথাই তো তিনি ঈশ্বরের পুত্র। সেটাই তো বলনি। তুমি যা বলেছ তাতে তিনি অন্যান্য প্রফেটদের মতো একজন প্রফেট হয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি অন্যদের মতো প্রফেট হয়েও তিনি ঈশ্বরপুত্র, সবার চেয়ে ভিন্ন তিনি। ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র যিশু এবং পবিত্র মাতা মেরী এ তিন নিয়ে ট্রিনিটি, তাও তুমি বলনি।’ অ্যানজেলা অ্যানি বলল।
‘বাইবেলের সব অনুসারীদের মধ্যে এই দুই ব্যাপারে একমত নেই। আমি আমার স্বাধীন মত বলেছি। মতানৈক্য তো থাকতেই পারে, কিন্তু আমি কোনো দিকদিয়েই মহান যিশুকে ছোট করিনি, বরং বড় করেছি। বলল চাওসিকো।
‘দেখ, তুমি তোমাকে ডিফেন্ড করার জন্যেই এসব বলছ। ক্যাথলিক মত কি তুমি জান। সেই কাথলিক যুব কংগ্রেসেই তুমি বক্তব্য দিয়েছো। আর বলতো, তোমার গোটা বক্তব্যে ‘লর্ড যিশু’, ‘প্রভু যিশু’-শব্দ নেই কেন? সত্যি তুমি একটা মহাভুল করেছ চাওসিকো। তোমার বক্তব্য উইথড্র করা উচিত এবং ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ অ্যানজেলা অ্যানি বলল।
আনা আরিয়া বেশ অনেকক্ষণ আগে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। সে নীরবে ওদের কথা শুনছিল। এবার সে কথা বলে উঠল, ‘মিস অ্যানি, এটা কি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ?’
সবাই তাকাল আনা আরিয়ার দিকে।
‘না, আনা আরিয়া। এটা আমাদের একটা পরামর্শ চাওসিকোকে। অ্যানজেলা অ্যানি বলল।
‘যখন বক্তব্যটা এক্সপাঞ্চই হয়েছে, তখন বিষয়টা আমাদের সবার এড়িয়েই যাওয়া উচিত।’ বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি ঠিকই বলেছ আনা আরিয়া। বিষয়টা যৌক্তিক মনে হচ্ছে। কিন্তু সবাই কি এ যুক্তি মেনে নেবার মতো? আমার মনে হয়, উপরে এর একটা বড় রিঅ্যাকশন হয়েছে।’ অ্যানজেলা অ্যানি বলল।
‘হতে পারে মিস অ্যানজেলা অ্যানি। আমরা যিশুকে খুব ভালোবাসি, কিন্তু তাঁর শিক্ষাকে কয়জন আমরা ভালোবাসি, মেনে চলি? কেউ আমার গালে এক থাপ্পড় দিলে, তার গালে আমি চার থাপ্পড় লাগাই।’ বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি মূলে হাত দিয়েছ আনা আরিয়া। আমরা মূলের দিকে কেউ তাকাই না, মাথার ফল নিয়ে আমরা কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত।
বলে হেসে উঠল অ্যানজেলা অ্যানি। বলল, ‘আমরা উঠছি চাওসিকো। গুডলাক তোমাদের দু’জনকে।’
চলে গেল অ্যানজেলা অ্যানিরা।
‘ঘরে ঢুকতে পারি স্যার?’ বলল আনা আরিয়া।
‘দরজা খোলা রেখে এসো। কিন্তু স্যার হলাম কখন?’ চাওসিকো বলল।
সোফায় বসতে বসতে আনা আরিয়া বলল, ‘বড় বিজ্ঞানীরা স্যার হলে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা স্যার হবে না কেন?’
‘দেখ বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী বলো না। সেদিনের অহেতুক প্রশংসাই মনে হয় আমাকে ডেলিগেশনের নেতা বানিয়েছে। নেতা হয়ে এখন দেখ কি ঝামেলা।’ চাওসিকো বলল।
‘না, ঠিক বললে না। আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি নেতা হয়েছো, সেদিনের প্রশংসাকে আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা প্রকাশের একটা মাধ্যম করতে পারেন।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ঠিক বলেছ আনা, আল্লাহর অ্যাকশন ইচ্ছা ছাড়া সৃষ্টিতে কিছু ঘটে না, ছোট কিংবা বড়। কিন্তু সমস্যা একটা দাঁড়িয়েই গেল। আমার বক্তব্য এক্সপাঞ্চ করেছে, সেটা তো শুনেছ।’ চাওসিকো বলল।
‘হ্যাঁ, শুনেছি। আল্লাহ করুন ঘটনা যেন এখানেই শেষ হয়ে যায়।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কি আর হবে। আমি কিন্তু খুব খুশি। এখন মনে হচ্ছে আনা আমার তোমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে। সত্যিকার যিশু খ্রিস্ট (আ.)-কে আমি তুলে ধরতে পেরেছি।’ চাওসিকো বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার খুব খুশি লাগছে চাওসিকো। আমি প্রার্থনা করি, আল্লাহও খুশি হোন।
কথা শেষ করে আনা আরিয়া আবার বলে উঠল, ‘এখন উঠতে হয় চাওসিকো। ঘরে ঢুকার অনুমতি তুমি আনলিমিটেড সময়ের জন্যে দাওনি।’
‘আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন? অনুমতি তো আল্লাহ দেননি।’ চাওসিকো বলল।
‘আল্লাহ সর্বদোষ মুক্ত। তিনি যা করেন, বলেন, তা মানুষের, সৃষ্টির মঙ্গলের জন্যেই। আর দোষ করা মানুষের একটা ফিতরাত। বলল আনা আরিয়া।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তুমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছ আনা।’ চাওসিকো বলল।
‘শিখব না? কে আমার পাশে আছেন দেখতে হবে তো! সে জন্যেই তো মাঝে মাঝে স্যার বলে ফেলি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘আমাকে স্যার বলে স্যারদের বদনাম করো না।’ চাওসিকো বলল।
‘বদনাম হবে কেন? তুমি তো একান্ত আমারই স্যার, আর কারও তো নও।’ বলল আনা আরিয়া।
বলেই দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল আনা আরিয়া ঘর থেকে।
.
রাত ৯টা। নিরক্ষীয় গিনীর প্রতিনিধি দলের ডেপুটি লিডার আইমান এলিজাবেথ এবং মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধি দলের নেতা ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত আনা আরিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দরজার দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে কক্ষে ফিরে এসে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল আনা আরিয়া। তার মুখ শুকনো। তার মুখ জুড়ে উদ্বেগের একটা কালোছায়া। তার মনে নানা চিন্তার আকুলী-বিকুলী। এখানকার কর্তৃপক্ষ চাওসিকোর ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্তটি কি হতে পারে? সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে তারা পরিকল্পনাও করেছে। পরিকল্পনাটি আজ রাত থেকে কালকে ইয়ারপোর্টে পৌঁছা এবং বুরুন্ডি ইয়ারপোর্টে নামা থেকে বাড়িতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিস্তৃত। মনটি তার আনচান করে উঠল। আজ রাতে তাদের কি পরিকল্পনা রয়েছে? তারা কি চাওসিকোকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করতে পারে? কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার বুক।
ভাবনার কোনো কুল কিনারা নেই আনা আরিয়ার। ভেবেই চলল সে।
ভাবনা তাকে অস্থিরই করে তুলল। চাওসিকো কি করছে? কিছু কি ভাবছে? কিছু কি আঁচ করেছে? আর বসে থাকতে পারল না আনা আরিয়া। উঠল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাইরে আলো ঝলমল করিডোর। সবে রাত দশটা। কোনো ঘরেই কেউ ঘুমায়নি নিশ্চয়।
এ ব্লকের যে লাউঞ্জ তার একটু দূরে লিফট-এর-পাশে সিকিউরিটি সেন্টার। এই ব্লকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তাদের।
আনা আরিয়া চাওসিকোর কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু অপেক্ষা করল। তারপর নক করল দরজায়।
নক হওয়ার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল।
খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়িয়েছে চাওসিকো। বলল, ‘ভেতরে এসো।
‘আসছি, কিন্তু বলো, এত তাড়াতাড়ি দরজা খুললে কেন? জিজ্ঞাসা করলে না কেন, কে নক করছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমি জানতাম তুমি আসবে।’ বলল চাওসিকো।
‘কেমন করে জানতে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘গ্যাবনের জিন মেরী এসেছিল কিছু কথা জানাবার জন্যে।’ বলল চাওসিকো।
ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল আনা আরিয়া। নব চেপে দরজা লাগিয়ে দিল। দ্রুত গিয়ে বসল সোফায়। বলল, ‘দরজার দিক থেকে সরে এসো। চাওসিকো গিয়ে তার চেয়ারে বসল। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি বলল, ‘তুমি সিরিয়াস কিছু বলবে মনে হয়?’
‘জিন মেরী কি জন্যে এসেছিল, কি বলেছিল, যার জন্যে তুমি মনে করেছ যে আমি আসব?’ জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার।
একটু গাম্ভীর্য নামল চাওসিকোর চোখে-মুখে। বলল, ‘জিন মেরী আমাকে কয়েকটা কথা জানিয়েছে, এক. এখানকার খ্রিস্টান শীর্ষ কর্তৃপক্ষ ভীষণ ক্ষেপেছে আমার উপর, দুই. আমাকে অনুপ্রবেশকারী মনে করছে এবং তিন. দেশে ফেরা পর্যন্ত আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।’ মুহূর্তের জন্যে সে থামল। বলল সে আবার, ‘তৎক্ষণাতই আমি ভাবলাম, এ সব কথা তোমার কাছেও নিশ্চয় পৌঁছেছে। তাই তুমিও আসবে এখানে।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। আমার কাছে এসেছিল আইমান এলিজাবেথ এবং ব্রুনো ফ্রান্সিস মাহামাত। তারা আমাকে এসব কথাই জানিয়েছে। বলেছে তারা, তুমি আজ রাত থেকে বাড়িতে না পৌঁছা পর্যন্ত নিরাপদ নও। আনা আরিয়া বলল।
আনা আরিয়া চেপে গেল চাওসিকোকে কিডন্যাপ করা ও হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা। ‘কিডন্যাপ’, ‘হত্যা’-এসব শব্দ এতোই ভয়াবহ যে তা উচ্চারণ করতেও ভয় পেল আনা আরিয়া।
‘আল্লাহ ভরসা আনা, চিন্তা করো না।’ বলল চাওসিকো।
‘আল্লাহই আমাদের ভরসা চাওসিকো। কিন্তু তোমাকে আমাকে সাবধান হতে হবে। আল্লাহ ভরসার এটা একটা শর্ত আল্লাহর তরফ থেকেই।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমি তোমার সাথে একমত আনা। কিন্তু সাবধানতার অর্থ ভীতু হয়ে পড়া নয়। আল্লাহ ছাড়া ভয়ের যোগ্য আর কেউ নেই, আর কিছু নেই।’ বলল চাওসিকো।
‘আমিও তোমার সাথে একমত।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ধন্যবাদ আনা।’ বলল চাওসিকো।
‘ওয়েলকাম। শোনো কাল দুপুর একটায় আমাদের প্লেন। প্লেন বুজুমবুরা ইয়ারপোর্টে পৌঁছবে রাত ৯টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, তোমার বাড়িতেও নয়, বুজুমবুরায় অন্য কোনো বাসায় তোমাকে উঠতে হবে। আজ রাত থেকে কাল রাতে তোমার আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছা পর্যন্ত তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘অবশ্যই আনা। বুজুমবুরায় আত্মীয়ের বাসায় উঠার কথা বলেছ, এটা খুবই যৌক্তিক পরামর্শ। এটা আমার মাথায় আসেনি। ধন্যবাদ আনা।’ বলল চাওসিকো।
‘আর শোন, দরজায় শুধু লক নয়, সিটকিনি লকটাও অন করে রাখবে। কেউ নক করলে কিংবা ধাক্কাধাক্কি করলে তুমি দরজা খুলবে না, আমি না বলা পর্যন্ত। এ ব্যাপারে আমাকে পাকা কথা দিতে হবে যে, তুমি এটা মেনে চলবে। পাকা কথা না পেলে এই ঘর থেকে আমি বেরুব না, এই সোফায় বসে আমি রাত কাটাব।’ আনা আরিয়া বলল।
‘এই বেআইনি কাজ তুমি করবে?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর।
‘করব। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা এবং আহকামুল হাকেমীন। তিনি জানেন আমি এটা কেন করছি।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ধন্যবাদ আনা। তুমি যা বলেছ তাই হবে। এটাই আমার পাকা কথা।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ। আরেকটা কথা, কাল ৯টায় ইয়ারপোর্টে যাওয়া ছাড়া সকাল থেকে আমরা ঘর থেকে বেরুব না। আমাদের প্রতিনিধিদলের সাথে একই গাড়িতে আমরা ইয়ারপোর্টে যাব। আমাদের প্রতিনিধিদলের সবাই সতর্ক আছে। সব ব্যাপারে সবাই আমাদের সাহায্য করবে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ঠিক আছে, আনা।’ বলল চাওসিকো।
‘চিন্তা করো না, ঘুমিয়ে পড়। আল্লাহ ভরসা।’
বলে উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়া।
‘তুমি আমাকে ঘুমাতে বলে তুমি যেন জেগে থেকো না। বলল চাওসিকো।
‘আল্লাহ জানেন।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তিনি সব জানেন। কিন্তু তুমি আমার কথার জবাব দিলে না।’ বলল চাওসিকো।
‘সব কথার জবাব হয় না, চাইতে নেই। সালাম আলাইকুম।’
বলে হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আনা আরিয়া। বাইরে থেকে টেনে দরজা বন্ধ করে দিল।
.
ফাদার শিরাক শেরম্যান তার সুদৃশ্য চেয়ারে বসল। মি. শিরাক শেরম্যান ভ্যাটিক্যানের যুব কংগ্রেস আয়োজনের নিরাপত্তা প্রধান। চাওসিকোর কেসটা ডিল করার দায়িত্ব তার উপরই পড়েছিল।
টেবিল থেকে একটা ফাইল টেনে নিতে যাচ্ছিল মি. শেরমান এ সময় তার ইন্টারকমের কলার সিগনাল সংকেত দিতে শুরু করল।
মি. শেরম্যান ইন্টারকমের স্পিকার বাটন অন করল।
‘গুডমর্নিং মি. শেরম্যান।’ ইন্টারকমে ভেসে আসা কণ্ঠটি ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক প্রধান কার্ডিনাল ফিলিপ জোন্সের। পোপসহ কয়েকজন ছাড়া তিনিই ভ্যাটিকানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি।
ফাদার শিরাক শেরম্যান তার চেয়ারে একটু নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘গুড মনিং মাই লর্ড।
‘আমাদের রাতটা কিন্তু গুড ছিল না মি. শেরম্যান। নাবালক একজন ছোকরার বিরুদ্ধে আমাদের মিশন ফেল হলো কেন?’ বলল ফিলিপ জোন্স।
‘এক্সিলেন্সি, মাইলর্ড রাতেই প্রাথমিক রিপোর্ট শুনেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট এসে পৌঁছবে আমার অফিসে। আমি আপনাকে পূর্ণ রিপোর্ট পাঠাচ্ছি এক্সিলেন্সি কিছুক্ষণের মধ্যেই। বলল শিরাক শেরম্যান।
‘তা পাঠান। কিন্তু যতটুকু আপনি জানেন, তা বলুন।’ বলল ওপার থেকে ফিলিপ জোন্স।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, বলছি আমি।’
বলে শিরাক শেরম্যান বলা শুরু করল: ‘এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন, আমাদের পরিকল্পনা ছিল, চাওসিকোর দরজার লুকিং হোল দিয়ে সুক্ষ টিউব ঢুকিয়ে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাস ফায়ার করে চাওসিকোর সংজ্ঞা লোপ করা। পরে তার দরজা খুলে তার ঘরে প্রবেশ করে তাকে নিয়ে আসা। সে অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে, এটাই ছিল আমাদের কৌশল তাকে কিডন্যাপ করার। কিন্তু সব বানচাল করে দিয়েছে চাওসিকোর পাশের ঘরের মেয়েটি, আনা আরিয়া। সে সারারাত চাওসিকোর দরজা পাহারা দিয়েছে। যুব কংগ্রেস আয়োজনের একজন কর্মকর্তাকে আমাদের লোকরা পাঠিয়েছিল তার কাছে। সে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ম্যাডাম কোনো অসুবিধা, আপনি অসুস্থ নন তো? এই ঠাণ্ডার মধ্যে আপনি বাইরে কেন? মেয়েটি বলেছিল, ‘আশপাশের কোনো কক্ষে নাকি আজ রাতে ডাকাত পড়বে। আমি সেটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি। আশপাশের সবাইকে বলে রেখেছি, তারা যেন সজাগ থাকে। গেটের পুলিশ বক্সও এদিকে নজর রেখেছে।’ মেয়েটা খুব সাহসী। আমাদের লোকরা আশংকা করেছে তার কাছে রিভলভারও আছে। আমরা বুঝলাম ব্যাপারটা কোনোভাবে জানাজানি হয়ে গেছে। কিডন্যাপের কাজটা সবার অলক্ষে সারা যাবে না। আমাদের বলা হয়েছিল যাতে কোনোভাবেই ব্যাপারটা জানাজানি না হয়, এমনভাবে কাজটা সারার জন্যে। আমাদের লোকরা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সে পরিবেশ পায়নি। সবাই জেগে উঠে বাইরে না আসা পর্যন্ত মেয়েটা চাওসিকোর ঘরের সামনে অপেক্ষা করেছে। সাংঘাতিক মেয়ে মাইলৰ্ড। আমাদের মিশন তার কারণেই বানচাল হয়েছে, মাইলর্ড।’
‘মেয়েটা খুব বড় পরিচয়ের মেয়ে। গোটা মধ্য আফ্রিকার প্রভাবশালী খ্রিস্টান নেতা এবং ‘পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’-এর ভাইস চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মেয়ে। যাক, আমাদের…।’
ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক প্রধান ফিলিপ জোন্সের কথার মাঝখানেই ফাদার শিরাক শেরম্যান বলে উঠল, তাহলে তো মাইলৰ্ড মেয়েটা আমাদের ঘনিষ্ঠ। আমাদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল কেমন করে?’
‘সে অনেক কথা। থাক সে সব। গতকাল বিকেলে আমি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছিলেন, তার মেয়ের অজ্ঞাতে কিডন্যাপের কাজটা সারতে। সেটা যখন সম্ভব ছিল না। তখন মিশনটা নিয়ে না আগানো ঠিক হয়েছে। আমি এখন বুরুন্ডিতে সবার সাথে কথা বলব, ব্ল্যাক ক্রস পরিকল্পনার শেষাংশ নিয়ে কি চিন্তা করছে দেখব।’ বলল ফিলিপ জোন্স।
‘পরিকল্পনার শেষাংশটা কি, জানতে পারি এক্সিলেন্সি?’ শিরাক শেরম্যান বলল।
‘সেটা হলো, ইতালিতে যদি কিছু করা সম্ভব না হয়, তাহলে চাওসিকো বুরুন্ডি পৌঁছার সাথে সাথেই তার উপর শেষ আঘাত হানা হবে। তাকে কিডন্যাপ করতে না পারলে, তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
বুরুন্ডি কি এত বড় কাজ পারবে, হঠাৎ করে? ৯টায় তো ওদের প্লেন।’ বলল শিরাক শেরম্যান।
‘বুরুন্ডি করবে না, করবে ব্ল্যাক ক্রস। হঠাৎ করে হচ্ছে কোথায়? গতকাল ওদেরকে বিস্তারিত ব্রিফ করা হয়েছে। তারা রেডি, একথা আমাদের জানিয়েছে। এখন আবার আলোচনা করব।’ ফিলিপ জোন্স বলল।
প্রভু খ্রিস্ট আমাদের সহায় হোন। তাঁর সম্মান রক্ষার জন্যেই তো আমাদের এই কাজ। বলল শিরাক শেরম্যান।
তথাস্তু মি. শেরম্যান, রাখলাম। বাই।’ কথা শেষ করল ফিলিপ জোন্স। ‘বাই এক্সেলেন্সি।’ শিরাক শেরম্যান কথা শেষ করল।
.
ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান টেলিফোনে কথা বলছিল। তার রাগান্বিত উত্তেজিত চেহারা।
তার স্ত্রী শিলা, আনা আরিয়ার মা পাশে বসে আছে। তার মুখ আষাঢ়ে মেঘের মতো পানি ভরা। দু’গণ্ডে তার অশ্রুর দাগ। বুঝা যাচ্ছে, এর আগে সে কেঁদেছে।
ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান তার দু’কান থেকে ইয়ার ফোন সরিয়ে মোবাইল সমেত টিপয়ের উপর রেখে দিয়ে তাকাল স্ত্রী শিলার দিকে। তার মুখ গম্ভীর। তাতে উদ্বেগের কিছু চিহ্ন। বলল, তুমি কাল থেকে বলছ, তোমার মেয়েকে যেন কোনো বিপদে না জড়াই। এর আগে চাওসিকোর ব্যাপারেও একই কথা বলেছ তুমি। কিন্তু দেখেছ তো, সে নিজে ডুবেছে, তার সাথে আমরা যারা তাকে প্রতিনিধিদলে মনোনীত করেছি, তাকে প্রতিনিধিদলের নেতা বানিয়েছি, তাদেরকেও সে ডুবিয়েছে। খ্রিস্টের জীবনী খ্রিস্টানদের মতো করে বলা যেত না? মুসলমানরা যা মনে করে, বিশ্বাস করে সেটা বলতে গেল কেন? এখন তার গ্রেভ কনসিকুয়েন্স তাকে ভোগ করতেই হবে। মাঝখানে আমাদের মেয়েটাকেও সে এর সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। এখন মুখ রাখার আমাদের জায়গা নেই। আমি তাকে বিপদে জড়াব কেন? সেই তো বিপদ ডেকে আনছে। জান…।
শীলা, আনা আরিয়ার মা, স্টিফেন, ফোবিয়ানের কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘কি করেছে আমার মা? আমার মা আনা কোনো অন্যায় করতে পারে না।’
‘কি করেছে, শুনবে? গত সারা রাত সে চাওসিকোর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। পাহারা দিয়েছে তার দরজা সকাল পর্যন্ত। যে কারণে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ চাওকিসোকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এটাও আরেকটা ব্লেম আমার উপর।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘অন্যায় কি করেছে আমার মেয়ে। তোমরা নির্দোষ, নিরপরাধ একটা ছেলেকে কিডন্যাপ করবে, হত্যা করার চেষ্টা করবে, আমার মেয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। তার দিক থেকে তো সে অন্যায় কিছু করেনি।’ বলল শীলা, আনা আরিয়ার মা, স্টিফেন ফোবিয়ানের স্ত্রী।.
‘চাওসিকোকে নির্দোষ, নিরপরাধ বলছ? ভরা যুব কংগ্রেসের সম্মেলনে, হাজারও দর্শকের সামনে সে ঈশ্বরপুত্র প্রভু যিশু খ্রিস্টকে ডুবিয়ে দিয়েছে।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘চাওসিকো তো খ্রিস্টান যুব প্রতিনিধিদলে যেতে চায়নি। সে পরিষ্কার বলেছে সে মুসলিম, খ্রিস্টান নয়। সে ঐ প্রতিনিধিদলের একজন সদস্যও হতে পারে না, নেতা হওয়া দূরের কথা। কিন্তু তোমরা গোটা বিষয় তার উপর চাপিয়ে দিয়েছো। মুসলিম হিসেবে যা করার, সেটাই তো সে করেছে।’ বলল শীলা, আনা আরিয়ার মা।
‘তুমি সোজা হিসাবের কথা বলছ শীলা, এ হিসাব সবক্ষেত্রে চলে না। সে যখন খ্রিস্টান যুব প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে ভ্যাটিকানে গেলই, তখন একটু সমঝোতায় তার আসা উচিত ছিল। খ্রিস্টান প্রফেটকে খ্রিস্টানদের মতো করে পেশ করায় কি ক্ষতি ছিল তার। তাকে লর্ড জেসাস, ঈশ্বরপুত্র বললে কি আর এমন হতো। সে বুদ্ধিমান ছেলে। বুদ্ধিমান ছেলের এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য শিলা। তার কেচ্ছা খতম। এখন দেখ, নিজের মেয়েকে বাঁচাবে কি করে! সে চাওসিকোর দিকে কতটা অগ্রসর হয়েছে আমি জানি না। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘আমি জানি না, আমি বলতে পারবো না। তোমরাই তো আমার মেয়েকে তার দিকে ঠেলে দিয়েছ।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়ার মা শীলা, স্টিফেন ফোবিয়ানের স্ত্রী।
.
ভ্যাটিকান এয়ার পোর্টের ডিপারচার লাউঞ্জ মধ্য আফ্রিকার যুব কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের সবাই লাউঞ্জে বসে। সবাই এক সংগে ফ্লাই করছে এই প্লেনে। কায়রো বিমানবন্দরে গিয়ে রুট বণ্টন হবে তাদের।
চাওসিকো এক সোফায় বসে। তার বাম পাশে আনা আরিয়া এবং ডানপাশে জিন মেরী, গ্যাবন প্রতিনিধিদলের নেত্রী।
চাওসিকো, আনা আরিয়া দু’জনেই সে দিনের খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল আনা আরিয়ার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল, আর আনা আরিয়া সোফায় হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন।
চাওসিকো আনা আরিয়ার হাতের কাগজটা গুছিলে সামনে টিপয়ে রেখে দিল।
সে সোজা হয়ে বসতেই জিন মেরী ঝুঁকে এলো তার দিকে। বলল, ‘মি. চাওসিকো আপনি কি জানেন আজ সারারাত আনা আরিয়া ঘুমায়নি?’
‘না জানি না তো!’ বলল চাওসিকো।
‘আপনি কি জানেন, সে সারা রাত জেগে আপনার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে পাহারা দিয়েছে?’ জিন মেরী বলল।
‘আমার দরজায় দাঁড়িয়ে সারারাত পাহারা দিয়েছে! আমি কিছুই জানি না।’ চাওসিকোর চোখে-মুখে অপার বিস্ময়–
ভাবনার ছায়া চাওসিকোর চোখে-মুখে। তাকাল চাওসিকো জিন মেরীর দিকে। বলল, ‘এই জন্যেই সকালে আমি দেখেছি তাকে উষ্কখুষ্ক, চোখ লাল। এখনও তার দিকে চেয়ে দেখুন, গোসল ও ভালো ব্রেকফাস্টের পরেও তার চোখে-মুখে ক্লান্তি ও ডিপ্রেস্ট ভাব।’
‘সকালে বিভিন্ন ঘরে সবাই ঘুম থেকে উঠলে সে শুতে গেছে তার ঘরে। সারারাত সে ছিল দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে।’ বলল জিন মেরী।
‘স্যরি, আমি কিছুই জানতে পারিনি। স্যরি।’ চাওসিকো বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
‘দুঃখিত হবেন না মি. চাওসিকো। আপনি বড় ভাগ্যবান। এমন মনের মেয়ে খুব কম জন্মায়। বলল জিন মেরী।
‘ঠিক মিস জিন মেরী।’ আবেগপূর্ণ কণ্ঠে চাওসিকো বলল। দু’ফোঁটা বিচ্ছিন্ন অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চাওসিকোর চোখ থেকে।
হঠাৎ পাশ থেকে আনা আরিয়ার কণ্ঠ, ‘লাগানো-ভাঙানো হচ্ছে মেরী, এটা ভালো নয়। চাওসিকোর দু’ফোঁটা অশ্রুর অনেক দাম।’.
চাওসিকো ও জিন মেরী দু’জনেই তাকাল আনা আরিয়ার দিকে।
‘ভাঙাইনি আনা আরিয়া, লাগিয়েছি বলতে পারো। তুমি যেটা গোপন করেছ, আমি সেটা বলে দিয়েছি। আর তাতেই দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরেছে চাওসিকোর চোখ থেকে। এ অশ্রুর মূল্য তো অনেক হবেই। কারণ চাওসিকোর এ অশ্রু তোমার জন্যে। বলল জিন মেরী।
লাউঞ্জ মাইক্রোফোনে ঘোষণা ভেসে এলো, ‘ভ্যাটিকান-কায়রো এয়ার আইতালিয়া ফ্লাইটে বোর্ডিং শুরু হয়েছে।
আনা আরিয়ার আর মুখ খোলা হলো না।
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বোর্ডিং-এর জন্যে গোছগাছ শুরু করে দিল।
আনা আরিয়া চাওসিকোর কানের কাছে ফিস ফিসিয়ে বলল, ‘বোর্ডিং লাইনে তুমি আমার সামনে থাকবে।’
‘তোমার নির্দেশ নিশ্চয় পালিত হবে। তুমি তো এখন আমার গাইড, সিকিউরিটি, সব। বলল চাওসিকো। মুখে হাসি চাওসিকোর।
‘নির্দেশ নয়, অনুরোধ। আর গাইড, সিকিউরিটি আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। আমি যা করছি, সেটা মহান আল্লাহই বলে দিচ্ছেন আমাকে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আল্লাহ তোমাকে বলে দিচ্ছেন?’ বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা চাওসিকোর
‘কেন তুমিই তো বলেছ বিবেক মানুষের জন্যে আল্লাহর দেয়া গাইড। এখানে আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের জন্যে প্রেরণা, ইলহামও আসে। আর তুমি বলার পর থেকে আমি সব সময় আল্লাহর সাথে কথা বলি। জান, তাতে মনের টেনশন দূর হয়ে যায়, মনে প্রশান্তি আসে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ধন্যবাদ আনা। তুমি আল্লাহকে জানা, ইসলামকে বোঝার ক্ষেত্রে দ্রুত এগোচ্ছ। আল্লাহ তোমাকে আরও তৌফিক দিন। চাওসিকে বলল।
‘আমরা মেয়েরা তো দুর্বল, আল্লাহর দয়া ও সাহায্যই তো আমাদের সম্বল।’ বলল আনা আরিয়া। আবেগে ভারি হয়ে ওঠে তার কণ্ঠ।
গোছগাছ হয়ে গিয়েছিল। সবাই চলতে শুরু করেছে।
‘এবার চলো আমরাও এগোই। তুমি আগে ঢল।’ বলল আনা আরিয়া। কণ্ঠকে তার স্বাভাবিক করার চেষ্টা।
চলতে শুরু করল চাওসিকো।
পেছনে চলছে আনা আরিয়া।
৫
বুজুমবুরা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল এয়ার আইতালিয়ার সেই বিমানটিই। সবগুলো গ্যাংওয়ে অকুপায়েড থাকায় কোনো গ্যাংওয়ের মুখে ল্যান্ড করতে পারেনি বিমানটি। ল্যান্ড করেছে অ্যারাইভাল লাউঞ্জ থেকে একটু দূরে। বিমানবন্দরের গাড়িতে চড়ে এই দূরত্বটা পার হতে হবে যাত্রীদের।
বিমান থেকে নামছে আনা আরিয়া ও চাওসিকো।
চাওসিকো আগে, আনা আরিয়া তার পেছনে।
বিমানের সিঁড়ি থেকে তারা পা রেখেছে মাটিতে।
তাদের সামনেই বেশির ভাগ যাত্রী, তাদের অল্প কিছু পেছনে। সামনের যাত্রীদের বেশির ভাগ গাড়িতে উঠে গেছে। আরও দুটি গাড়ি আসছে।
গাড়ির কাছেই যাত্রীরা বেশি। আনা আরিয়ারা যেখানে দাঁড়িয়েছে, সে জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা। চারদিকটা আলোকিত।
ইয়ারপোর্ট বিল্ডিংটা বিমানবন্দরের পূর্বাংশে। ইয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর দক্ষিণ পাশে পূর্বদিকের সিকিউরিটি প্রাচীরে দুইটা গেট, একটা ঢোকার আরেকটা বের হবার। ইয়ার ফিল্ডের কর্মীরা এ পথ দিয়ে যাতায়াত করে।
আনা আরিয়াদের রানওয়ের সামান্য কিছু পূর্বে একটা কালো মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল। তার থেকে আরেকটু পূর্বে আরেকটা পাজেরো জীপ দাঁড়িয়েছিল, তার গায়ে ইয়ারপোর্ট অথরিটির মনোগ্রাম।
আনা আরিয়া অলস দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চাইবার সময় এসবই তার চোখে পড়েছিল। যাত্রী বহনকারী আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছিল। যাত্রীদের চোখ সেদিকে। দ্রুত এগুচ্ছিল তারা গাড়ির দিকে।
আনা আরিয়া ও চাওসিকো তাদের হ্যান্ডব্যাগ হাত থেকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিচ্ছে সামনে এগুবার জন্যে।
ঠিক এ সময় এদিক ওদিক থেকে চারজন লোক এসে চোখের পলকে ঘিরে ফেলল চাওসিকোকে। একজন লোক চাওসিকোর মাথার উপর একটা কালো কাপড় ছেড়ে দিয়েছে। মুহূর্তে কালো কাপড়ে ঢেকে গেল তার শরীর। দু’জন লোক তাকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর ছুটতে শুরু করল মাইক্রোর দিকে। অবশিষ্ট দুজনের একজন একটা বোমা ছুঁড়ল। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল সবদিক।
আনা আরিয়া প্রথমটায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কি ঘটছে কি করবে তা ভাবতে পারেনি। সম্বিত ফিরে পেয়েই কিডন্যাপার’
‘কিডন্যাপার’ বলে চিৎকার করতে লাগল। কালো ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যাওয়ায় সে বুঝতে পারলো না তার চিৎকার কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো কি না।
আনা আরিয়া বুঝতে পারল চাওসিকোকে কিডন্যাপাররা মাইক্রোবাসে তুলবে। আনা আরিয়া ছুটল সেদিকে।
আনা আরিয়া যখন পৌঁছল মাইক্রোবাসের কাছাকাছি। দেখল, মাইক্রোটি চলতে শুরু করেছে।
আর কোনো উপায় না দেখে আনা আরিয়া ছুটল জীপটার দিকে।
এক ঝটকায় টান দিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ফেলল।
জীপের কী হোলে চাবি দেখে আনাঃ আরিয়া আল্লাহর লাখো শোকর আদায় করল।
কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে ঝড়ের গতিতে চলছে মাইক্রোটি। জীপের স্পিড যদিও মাইক্রো’র চেয়ে ভালো, কিন্তু রাস্তার গাড়ি ও জনচলাচলের মধ্যে গাড়ির স্পিড অতটা বাড়াতে ভয় করছে আনা আরিয়ার। আনা আরিয়া চেষ্টা করতে লাগল মাইক্রোটা যাতে চোখের আড়ালে না যেতে পারে, এই ধরনের স্পিড অব্যাহত রাখতে।
মাইক্রোটি ইয়ারপোর্ট রোড থেকে মূল শহরে ঢুকে এপথ ওপথ ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ায় প্রবেশ করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ার পুরানো এলাকায় পৌঁছল। মাইক্রোটি অবশেষে প্রবেশ করল পুরানো ও পরিত্যাক্ত প্রশাসনিক ভবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালে এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন।
মাইক্রোটি পুরানো প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে যাবার পর আনা আরিয়া গাড়ির আলো নিভিয়ে গাছের ছায়ার আড়াল নিয়ে নিঃশব্দে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। গাড়িতে কিছুক্ষণ বসল আনা আরিয়া।
ঘড়ি দেখল রাত দশটা চল্লিশ বাজে।
কি করবে সে এখন? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আনা আরিয়া। পুলিশকে কি টেলিফোন করবে? পুলিশ ছাড়া চাওসিকোকে উদ্ধার করবে সে কীভাবে। ওরা চারজন ছাড়াও ভেতরে আরও লোক আছে নিশ্চয়। এসব ভাবতে গিয়ে কিছুটা আত্মস্থ হয়ে পড়েছিল আনা আরিয়া। তার গাড়ির দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে বাইরে তাকাল আনা আরিয়া। দেখল, চারপাঁচজন লোক তার গাড়ি ঘিরে ফেলেছে। একজন তার পাশের দরজা খুলে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে। রিভলভারের নল তার কপাল বরাবর উদ্যত। সব লোকই মুখোশ পরা।
রিভলভারধারী বলল, ‘তাহলে ম্যাডাম তুমিই আমাদের লোককে ফলো করেছ। তারা আমাদেরকে টেলিফোনে জানাবার পর ভেবেছিলাম সেই বড় শয়তান আহমদ মুসাই আমাদের লোকদের ফলো করল কিনা। সে ছাড়া আমাদের লোকদের ঘাটাবার সাধ্য আর কারও নেই। এখন দেখি বাঘ ধরতে গিয়ে বিড়াল পেয়ে গেলাম। বেরিয়ে এসো ম্যাডাম। মুসলমানের বাচ্চার সাথে ফষ্টিনষ্টি আজ থেকে শেষ।
‘চাওসিকোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবনে ধরে এনেছ তোমরা কারা?’ বলল আনা আরিয়া চিৎকার করে।
‘তোমার কোনো কথার জবাব দেব না। তোমাকে নিয়ে কি করব, সেটা উপর থেকে জানার পর আমরা ঠিক করব। তবে তোমাকে ছাড়বো না। থাকতে হবে তোমাকে আমাদের সাথে।
বলে লোকটি এক হাতে রিভলভার বাগিয়ে অন্য হাত দিয়ে টেনে গাড়ি থেকে বের করল আনা আরিয়াকে। বলল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা সুন্দরীকে প্রভু যিশু আমাদের হাতে এইভাবে তুলে দেবেন, তা আমরা ভাবিনি। চলো সুন্দরী। এসেছিলে মুসলমানের বাচ্চাকে উদ্ধার করতে, এবার তোমাকে কে রক্ষা করবে?’
‘তোমরা কে জানি না। কিন্তু মুখ সংযত করে কথা বলো। ভুলে যেও না, রক্ষা করার একজন আছেন, যিনি…।
আনা আরিয়ার কথায় বাধা দিয়ে সেই রিভলভারধারী বলে উঠল অট্টহাসির সাথে, ‘আহমদ মুসা এখানে কোত্থেকে আসবে। ডাকো একবার দেখি তাকে।
‘আহমদ মুসাকে আমি চিনি না। আমি ডাকছি, সবার রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা, সবার স্রষ্টাকে।’ বলল আনা আরিয়া।
অন্য চারজন মুখোশধারীর একজন চিৎকার করে বলে উঠল, এই ছুকরীর বক বক আমরা আর শুনতে পারছি না। এ মাল তো হঠাৎ করে জুটেছে, লণ্ডভণ্ড করে দিল আমাদের প্রোগ্রামকে। এর একটা হাল করে আমাদের তো দ্রুত ফিরে আসতে হবে এখানে। রাতের মধ্যেই তো আমাদের সব কাজ শেষ করতে হবে।’
‘ঠিক বলেছ জীম। একে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলো গাড়িতে। কুইক বলল রিভলভারধারী লোকটি।
দু’জন আগ্রহ ভরে ছুটে এলো আনা আরিয়ার দিকে।
‘দাঁড়াও। মেয়েটার গায়ে কেউ হাত দেবে না। পেছন থেকে বলে উঠল একটা শান্ত, কিন্তু খুবই শক্ত কণ্ঠ।
সবাই মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। সেই সাথে সবার হাতে উঠে এলো রিভলভার। দেখল সবাই, গাছের আড়াল থেকে একজন বেরিয়ে এসেছে। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।
উত্তরে পাঁচজনের কেউই কথা বলল না। হঠাৎই চোখ-মুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে তাদের। তাদের রিভলভার উঠে আসছে ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে।
ব্ল্যাক ক্রসের কাল সাপগুলোকে ছোবল দেবার কোনো সুযোগ দিল না ছায়ামূর্তিটি। ছায়ামূর্তির হাতের রিভলভার চোখের পলক পড়ার মতো পাঁচবার নড়ে উঠল। পাঁচটি লাশ বোঁটা থেকে খসে পড়া পাকা ফলের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল
আনা আরিয়া বসে পড়েছিল, গাড়ি থেকে তাকে টেনে নামাবার পরই।
ছায়ামূর্তিটি এগিয়ে এলো আনা আরিয়ার কাছে। বলল, ‘গাড়িতে উঠে বসো বোন। আপাতত আর কোনো ভয় নেই। নরম স্নেহমাখানো কণ্ঠ ছায়ামূর্তির।
আনা আরিয়া তাকিয়ে ছিল ছায়ামূর্তির দিকে। তাকিয়ে থেকেই সে উঠে দাঁড়াল। ছায়ামূর্তির এক কথায় তার মনের সব ভয় যেন এক মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে। সে অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো ছায়ামূর্তির নির্দেশ পালন করে গাড়িতে উঠে বসল।
‘তুমি কে? এখানে কেন তুমি? ওরা কারা?’ বলল ছায়ামূর্তিটি। তার সেই আশ্বাসপূর্ণ নরম কণ্ঠ।
‘আমি আনা আরিয়া। এই পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডেলিগেশন নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত আসছিলাম ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে থেকে। আমার এক সাথীকে এরা কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে এসেছে। উদ্ধারের আশায় তাদের ফলো করে আমি এখানে এসেছি।’ এক নিঃশ্বাসে দ্রুত বলল আনা আরিয়া।
‘তোমাকে বা আর কাউকে কিডন্যাপ না করে তাকে কিডন্যাপ করল কেন?’ বলল ছায়ামূর্তি।
‘তার আগে বলুন প্লিজ আপনি কি আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা করল আনা আরিয়া। তার কণ্ঠটি একটু কাঁপা, ভয় মিশ্রিত।
‘তুমি এ প্রশ্ন করছ কেন? তুমি কি আহমদ মুসাকে চেন?’ ছায়ামূর্তিটি বলল।
‘আমি আহমদ মুসাকে চিনি না। কিন্তু এরা বার বার ভয়ের সাথে আহমদ মুসার নাম করছিল। তাদের একটা কথার উত্তরে আমি যখন বললাম, ভুলে যেও না রক্ষার জন্যে একজন আছেন, যিনি…। আমি এর দ্বারা আল্লাহর কথা বলছিলাম। কিন্তু তখন অট্টহাসির সাথে তাদের একজন বলেছিল, আহমদ মুসা এখানে কোত্থেকে আসবে। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনিই তাদের সেই আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তাদের আহমদ মুসা নই, আমি তোমাদের আহমদ মুসা। ওদের সাথে তোমার শেষ কথাটা আমি শুনতে পেয়েছি। তুমি কি মুসলিম?
‘জি, আমি মুসলিম। আমার যে সাথীকে উদ্ধারের আশায় ওদের ফলো করে এখানে এসেছি, সেই সাথীকে দেখেই আমি ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হয়েছি এবং ইসলাম গ্রহণ করেছি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে তোমরা গিয়েছিলে কেন? তোমার সাথী নিশ্চয় মুসলিম?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে অনেক কথা স্যার। ডেলিগেশনে অংশ নিতে এবং ডেলিগেশনের প্রধান হতে আমার সেই সাথীকে বাধ্য করা হয়েছে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মেয়ে। আমাকে না জানিয়েই আমাকে ডেলিগেশনের ডেপুটি প্রধান করা হয়েছিল। বলল আনা আরিয়া।
‘কিন্তু তোমার সাথীকে এখন ফেরার পথে কিডন্যাপ করা হলো কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
মুখটা ম্লান হয়ে গেল আনা আরিয়ার। বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার চোখ-মুখ। অবরুদ্ধ এক আবেগের ভারে কেঁপে উঠল তার শুকনো ঠোঁট। বলল সে, ‘এখানেও অনেক কথা আছে স্যার। আমার সাথী খুবই প্রতিভামান ছাত্র এবং বিজ্ঞানীও। তার সাথে সে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। ভ্যাটিক্যানের যুব কংগ্রেসে তাকে মধ্য আফ্রিকা রিজিওনের প্রতিনিধির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যুব কংগ্রেসে অন্যান্য রিজিওনাল নেতাদের মতো তাকেও যিশু খ্রিস্টের জীবনের ১০ মিনিটের একটা বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। তার এই বক্তৃতা নিয়েই গন্ডগোলের সৃষ্টি। তার বক্তৃতা এক্সপাঞ্চ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তার বক্তৃতা মুসলমানদের চিন্তার একদম কপি। অভিযোগ তোলা হয় সে অনুপ্রবেশকারী। ইতালিতেই তাকে কিডন্যাপ ও হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। অল্প সময়ের কারণে ওখানে সে সুযোগ তারা পায়নি। অবশেষে বুজুমবুরায় ফেরার সময় বিমানবন্দরে নামলেই তাকে কিডন্যাপ করা হয়। আমি জানি না, এতক্ষণে তারা ওকে কি করেছে!’ কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়ার কণ্ঠ।
‘কেঁদো না বোন। আল্লাহর উপর ভরসা করো। তিনি ইচ্ছা না করলে কিছুই ঘটে না, কিছুই হয় না। এসো আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন দয়া করে সব ঠিক করে দেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিন।’ বলল আনা আরিয়া।
চোখ মুছল সে। বলল, ‘স্যার, চাওসিকোর কাছেও এমন কথা আমি বারবার শুনেছি।’
‘তোমার সাথীর পুরো নাম কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার তার মুসলিম নাম আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে নাম নিতে তাকে বাধ্য করা হয়, সে খ্রিস্টান নাম হলো, অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ধন্যবাদ বোন।’
কথাটা শেষ করে থামল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘শোন আনা আরিয়া, তোমাকে এখন বাড়ির সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে জংগলে লুকিয়ে থাকতে হবে আমি না ফেরা পর্যন্ত। তুমি…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘দুঃখিত স্যার, আপনি কোথায় যাবেন?’
‘আমি এখন এ বাড়িতে ঢুকব চাওসিকোর সন্ধানে।’ বলল আহমদ মুসা। আনা আরিয়ার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি একা ঢুকবেন স্যার?’
‘না আমরা দু’জন ঢুকব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আমাকে তো জংগলে অপেক্ষা করতে বললেন।’ আনা আরিয়া বলল। তার চোখে-মুখে প্রশ্ন।
‘না, তুমি জংগলেই অপেক্ষা করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আপনি একা?’ আনা আরিয়া বলল।
‘একা নয়, আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহু আকবর।’ ধ্বনিত হলো শব্দ দু’টি আনা আরিয়ার কণ্ঠে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা। বলল, ‘ভুলে গিয়েছিলাম স্যার আল্লাহর কথা। নতুন ঈমান তো?’
‘ঈমান কারও ক্ষেত্রে নতুন অর্থে নতুন থাকে না বোন। বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই আল্লাহকে পাওয়ার শত যোজন পথ সে অতিক্রম করে একনিমেষেই। তখন ঈমান তার পুরানো ও পূর্ণ হয়ে যায়। আসলে কিন্তু মানুষের ঈমান সবসময় চির নতুন থাকে। চলার পথে সৃষ্টির প্রতিটি ঘটনা ও নিদর্শনের মধ্যে ঈমানের নবায়ন হয়, নতুন জীবন পায়, পায় নতুন শক্তি, নতুন গভীরতা।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তুমি কি রিভলভার চালাতে জানো বোন?’
‘জানি, কিন্তু প্রাকটিক্যালি কখনও ব্যবহার করিনি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘তাতেই চলবে। বলে আহমদ মুসা পায়ের মোজায় আটকানো একটা রিভলভার বের করে আনা আরিয়ার হাতে তুলে দিল।
আনা আরিয়া ‘বিসমিল্লাহ’ বলে রিভলভার হাতে নিয়ে বলল, ‘স্যার, রিভলভারের সাথে দোয়াও চাই।’
‘আল্লাহ তার রহম ও করম দিয়ে আমাদের সকলকে ঘিরে রাখুন।’ বলে আহমদ মুসা তার জ্যাকেটের পকেট থেকে তার এম-১৬ বের করে হাতে নিয়ে চলার জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোর আগে বলল, ‘আসি বোন। আল্লাহ হাফেজ।’
চলতে শুরু করল আহমদ মুসা। জংগলের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে সে দৃঢ় পায়ে অগ্রসর হচ্ছে পোড়ো ধরনের পুরানো বাড়িটার দিকে।
আনা আরিয়া তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার চলার পথের দিকে।
বুকে তার চিন্তার তোলপাড়। আহমদ মুসাকে এখনই মাত্র সে দেখল। তার পরিচয় এখনও সে জানে না। কিন্তু মনে হচ্ছে যুগ-যুগান্তরের সে চেনা। এক ‘বোন’ ডাকেই সে তাকে আপন করে নিয়েছে।
কে এই আহমদ মুসা?
দেখা গেল কিডন্যাপারদের কাছে সে পরিচিত ও ভয়ের বস্তু। ভয়ের বস্তু তো হবেই। ওদের পাঁচজনকে সে চোখের পলকে পাখির মতো শিকার করল। ওরা একটা গুলি ছোঁড়ারও সুযোগ পায়নি।
কে সে? নিশ্চয় বড় কেউ হবে।
বিনা দ্বিধায় শত্রুপুরীতে সে ঢুকে যাচ্ছে।
চাওসিকো তো তার কেউ নয়, পরিচয়ও তার সাথে নেই।
আরেকটা প্রশ্নেরও সে কোনো জবাব পাচ্ছে না। সে কেন এখানে, এই সময়ে? বোঝাই যাচ্ছে সে আগে থেকেই এখানে কোথাও ছিল। কেন ছিল?
আনা আরিয়া এখানে এসেছে চাওসিকোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা দেখার জন্যে এবং সম্ভব হলে তাকে উদ্ধারের কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে। আহমদ মুসারও কি কোনো মিশন আছে এখানে আসার পেছনে? সে যাইহোক, আল্লাহই তাকে এনেছেন আনা আরিয়াকে এবং চাওসিকোকে সাহায্য করার জন্যে। সে এখন মুক্ত তারই জন্যে। সে সময়ের অবস্থা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার। ওদের হাতে থাকলে তার কি হতো। একেবারেই নিম্ন শ্রেণির ক্রিমিনাল ওরা। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আনা আরিয়া। আল্লাহই তাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ আহমদ মুসাকে সাহায্য করুন, চাওসিকোকে ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল আনা আরিয়া।
.
পুরনো বাড়িটাতে প্রবেশ করে এঘর ওঘর পেরিয়ে বাড়ির মাঝখানে একটা বড় খোলা চত্বরের সামনে, চারদিকে ঘোরানো খোলা বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো চাওসিকোকে। বারান্দায় ইতস্তত ছড়ানো কিছু হাতলবিহীন চেয়ার ছিল।
এপাশ ওপাশের রুম থেকে আরো জনা আটেক লোক বেরিয়ে এলো। সকলে একই বয়সের। একজন চিৎকার করে বলল, ‘প্রাভো! প্রভু যিশুর শত্রুকে ধরে এনেছিস। এখনও দেখছি আস্ত রেখেছিস। আধমরা করে জীবন্ত কবর দেব তাকে।’
‘বসের সাথে কথা বলার আগে কিছু করা যাবে না। বসকে মোবাইল করছি আমি।’ বলে একজন তার মোবাইল বের করল এবং তাদের বসকে কল করল।
‘স্যার, আমরা লোকেশনে পৌঁছে গেছি। এখন আপনার নির্দেশ বলুন। বলল এ প্রান্ত থেকে লোকটি।
উত্তরে ও প্রান্ত থেকে কথা এলো। লোকটি ওপার থেকে বসের বলা কথা শুনল, মাঝে মাঝে স্যার, স্যার বলল। ওপারের কথা শেষ হলে সে বলল, ‘স্যার, সে আমাদের প্রভু যিশুর শত্রু। সকলেই চাচ্ছে, তার উপর তাদের কিছু রাগ মেটাতে।’
আবার ওপর থেকে কথা এলো। শুনল লোকটি।
কথা শেষ হলো তাদের দু’জনের।
মোবাইল পকেটে রেখে দিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘শোনো তোমরা, যা তোমরা চেয়েছ, সে আদেশ বসও দিয়েছে। তার জীবন্ত সমাধির হুকুম হয়েছে। রাত বারোটার মধ্যে সব শেষ করে বসকে জানাতে হবে। আরেকটা খারাপ খবর তিনি দিয়েছেন। আমরা চাওসিকোকে নিয়ে আসার সময় তার সহযাত্রী এবং প্রেমিকা আনা আরিয়া একটা গাড়ি নিয়ে আমাদের ফলো করেছিল। এটা জানতে পেরে বসরা আনা আরিয়াকে ধরার জন্যে পাঁচজনের একটা দল পাঠিয়েছিল। এই বাড়ির সামনে আনা আরিয়াকে তারা পেয়ে যায় এবং তাকে আটক করে। তারা জানিয়েছিল আনা আরিয়াকে নিয়ে তারা যাচ্ছে। কিন্তু আনা, আরিয়াকে নিয়ে তারা পৌঁছেনি এবং তাদের সাথে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। সব মোবাইলেই রিং বাজছে, কিন্তু কেউ ধরছে না। এই অবস্থায় বস নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত কবর খুঁড়ে চাওসিকোকে সামলাবার জন্যে।
আর তিনি বলেছেন মারধোর বা গণধোলাই-এর মতো কাজের সময় এখন নেই। আমরা এখন ইমারজেন্সির মধ্যে।
দ্রুত গর্ত খোঁড়ার কাজ চলছে।
চাওসিকো সবই শুনেছে। তার মনে কোনো উদ্বেগ বা ভয় নেই, আল্লাহ তার জন্যে যা নির্ধারিত রেখেছেন সেটাই হবে। এ দুঃখের মধ্যেও তার খুশি লাগছে আনা আরিয়া তার জন্যে শেষ চেষ্টা করেছে। এই সাথে তার মনে একটা ভয় উঁকি দিচ্ছে। আনা আরিয়ার বড় কিছু ঘটেনি তো। আনা আরিয়াকে নিয়ে তার আটককারীরা যেখানে পৌঁছার কথা সেখানে পৌঁছল না কেন? কি হলো আনা আরিয়া এবং তাদের!
চাওসিকোর এই চিন্তার মধ্যে একজন এসে তাকে বলল, ‘এই শয়তানের বাচ্চা শয়তান, দেখছিস ওটা কি খোঁড়া হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ জানি, ঐ গর্তে তোমরা আমাকে মাটি চাপা দেবে।’ বলল চাওসিকো। ‘বলছিস এমন করে, যেন তোর শ্বশুর বাড়ি যাবার আয়োজন হচ্ছে। জীবন্ত মাটি চাপা পড়বি, ভয় করছে না?’ লোকটি বলল।
‘সব মৃত্যুই মৃত্যু। একদিন মরতেই হবে। মৃত্যুকে ভয় পেলে কি তোমরা মুক্তি দিরে? দিবে না। তাহলে ভয় করে লাভ?’ বলল চাওসিকো।
লোকটি চিৎকার করে চাওসিকোর কথা সকলকে জানাল।
সংগে সংগে একজন চত্বর থেকে ছুটে এলো। সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি চালাল চাওসিকোর মুখে।
চাওসিকো তার মুখ সরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেনি।
ঘুষিটি প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল চাওসিকোর মুখে।
নাক ও ঠোঁট ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো।
‘মার শালা শয়তানের বাচ্চাকে, বড় বড় কথা।’ বলে আরও কয়েকজন ছুটে এলো।
কিল, ঘুষি, লাথি চলতে লাগল চাওসিকোর উপর। পড়ে গিয়েছিল চাওসিকো। ঐ অবস্থাতেই তার উপর চলতে থাকল কিল, ঘুষি, লাথির আঘাত।
‘থাম তোমরা?’ একটা বজ্রকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল
সবাই তাকাল সেদিকে। দেখল, একহারা গড়নের চেহারার যুবকটিকে। তার এই বজ্রকণ্ঠের ধরন অচেনা লাগছে। যুবকটির পিঠে আটকে আছে একটা ব্যাগ।
লোকরা তাদের আকস্মিকতার বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই যুবকটির বজ্রকণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘তোমরা সকলেই হাত তুলে দাঁড়াও।’
হাত তুলে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকেই তাদের অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে। দ্রুত উঠে আসছে তাদের রিভলভারের ব্যারেলগুলো যুবকটির দিকে।
চোখের পলকে যুবকটির এম-১৬ মেশিন রিভলভার লোকদের উপর দিয়ে ঘুরে এলো। গুলি বেরিয়েছিল বৃষ্টির মতো।
মুহূর্তেই বারোটি লাশ পড়ে গেল।
একজন লাফ দিয়েছিল গর্তে। সে বেঁচে গেছে।
যুবকটি আহমদ মুসা। চাওসিকোর উদ্ধারের জন্যে সে ঢুকেছিল পরিত্যক্ত এই পুরানো বাড়িতে। একজন বেঁচে যাওয়ায় খুশি হলো আহমদ মুসা। এদের অন্তত একজনকে সে জীবিত চায়। বারান্দা থেকে নেমে আহমদ মুসা এগোলো গর্তের দিকে। তার হাতের রিভলভার গর্তের দিকে তাক করা। গর্তের উপরের একটা অংশ সে দেখতে পাচ্ছে।
গর্তের মুখের আয়তন দেখে আহমদ মুসা ভাবল, এ ধরনের একটা গর্ত তারা এখানে কেন খুঁড়ছিল! কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার জন্যে?
আহমদ মুসার ভাবনার এই মুহূর্তে একটা লোক গর্ত থেকে স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল এবং গুলি করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার তখন করার কিছুই ছিল না।
কিন্তু তার চিন্তা নতুন করে সক্রিয় হবার আগেই তার সিকথ সেন্স সক্রিয় হয়ে উঠেছিল
আহমদ মুসার দেহ চোখের পলকে ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার এম-১৬ তার ডান হাতে ঠিকঠাক ছিল। বাম হাতটা মাত্র একবারের জন্যে কেঁপে উঠেছিল লোকটির গুলি আহমদ মুসার কাঁধের নিচে বাম বাহুর মাথায় বিদ্ধ হওয়ার সময়।
আহমদ মুসার দেহ মাটিতে পড়ার আগেই এম-১৬ এর ট্রিগারে রাখা আহমদ মুসার শাহাদাত আঙুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। চেপে বসেছিল ট্রিগারে। বেরিয়ে গিয়েছিল এম-১৬ থেকে এক পশলা গুলি।
লোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই দ্বিতীয় গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু গুলি করার আর সুযোগ সে পায়নি। আহমদ মুসার এম-১৬ এর গুলি তাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তাকাল চাওসিকোর দিকে। বলল, চাওসিকো ওদের আর কোনো লোক কি আশেপাশে আছে?’
চাওসিকো উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ রক্তাক্ত।
তার চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় এবং মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড়।
যুবকটির বাহুতে গুলি লেগেছে, তাও দেখতে পেয়েছে সে।
আঁৎকে উঠেছিল সে তাকে রক্ষাকারী যুবকটিকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখে। চাওসিকো অবাক হলো, যুবকটি তার আহত স্থানে একবারও হাত দিল না, দেখলও না। সবচেয়ে অবাক হয়েছে চাওসিকো, গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই সে গর্তের লোকটিকে মেরেছে গুলি করে।
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার জবাবে চাওসিকো বলল, ‘আমার মনে হয় ওদের আর কোনো লোক এখানে নেই।’
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। বারান্দার একটা চেয়ারে তুমি বসো। আমি আসছি।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় কাটছে না চাওসিকোর। এই যুবককে সে দেখেওনি, চিনেও না। পরিচিতজন, বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তার নেই। সে আসছে ইতালি থেকে। বিমানবন্দর থেকে সে কিডন্যাপ হলো। কিন্তু কোত্থেকে এলো এই লোকটি তাকে উদ্ধারের জন্যে। শুরু থেকেই সে তার নাম ধরে ডাকছে। নাম বলছে এমন করে যেন সে চাওসিকোর কোনো আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধব।
আহমদ মুসা মৃত লোকদের তল্লাসিতে লেগে গেছে। তেরোজনকেই তল্লাসি করল সে। তাদের পকেটে, মানিব্যাগে টাকা ছাড়া আর কিছুই পেল না। তবে প্রত্যেকের কলার ব্যান্ডে পেয়ে গেল সেই ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ (SCA)-এর মনোগ্রাম। আশ্চর্য হলো আহমদ মুসা, ব্ল্যাক ক্রসের এই লোকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবনে এলো কি করে? আসুমানি পরিবারের নিহত দুই মেয়ের ভর্তির ব্যাপারে তাদের কাছে যাওয়া একটা টেলিফোন কলের গ্রেট বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্যেই আহমদ মুসার এখানে আসা। এই বিল্ডিংটাই ছিল টেলিফোন কলটির লোকেশন। এসে পেল ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের। তাহলে কি এদেরই কেউ টেলিফোন করেছিল আসুমানি পরিবারে, কিন্তু কেন?
এই ‘কেন’-এর উত্তর খোঁজা আপাতত বন্ধ করে তাকাল চাওসিকোর দিকে। উঠে এলো সে বারান্দায় বসা চাওসিকোর কাছে। বলল, ‘চাওসিকো তুমি কেমন আছ, কেমন বোধ করছ?’
‘ভালো স্যার। কোনো অসুবিধা বোধ করছি না।’ চাওসিকো বলল। ‘তোমার রক্তাক্ত চেহারা, শরীরের অবস্থা তোমার কথাকে সত্য বলছে না চাওসিকো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আপনি গুলিবিদ্ধ। বাম কাঁধের এ পাশটা রক্তে ভিজে গেছে। কিন্তু আপনি কোনো অসুবিধা বোধ করছেন বলে মনে হচ্ছে না।’ চাওসিকো বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি মানুষ, মানুষের সব অনুভূতি আমার আছে। তাহলে আমি অসুবিধা বোধ করব না কেন? কষ্ট পাব না কেন? আমি যথেষ্ট কষ্ট বোধ করছি। কিন্তু কষ্টকে আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি না ধৈর্যের আশ্রয় নিয়ে। ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন।’ সাহায্য করেন।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘সত্যিই তুমি ভালো আছো তো চাওসিকো?’
‘স্যার, আপনার মতোই আমি ধৈর্য ধরেছি। শরীরে বড় কোনো অসুবিধা আমি দেখছি না স্যার, আলহামদুলিল্লাহ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। চল চাওসিকো, আমরা চলি। হাঁটতে পারবে তো?’
‘স্যার, দৌড়াতেও পারব স্যার।’ চাওসিকো বলল।
‘গুড, এই তো চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
দু’জনে কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করল বাইরে বেরুবার জন্যে।
আহমদ মুসা চাওসিকোর নাক, ঠোঁট, মুখ অ্যান্টিসেপটিক মেশানো লিকুইড দিয়ে মুছে দিয়েছে। ওষুধও খাইয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসার বাহুসন্ধিতে লাগা গুলি একটা পাশকে আহত করে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তার আহত স্থানের ব্যান্ডেজ নিজেই বাঁধতে যাচ্ছিল। চাওসিকো বলল, ‘স্যার, ফাস্ট এইড ট্রেনিং আমার আছে। ব্যান্ডেজ বাঁধায় আমি খুব দক্ষ। আমাকে সুযোগ দিন প্লিজ। সারা জীবনের জন্যে আমার একটা বড় সঞ্চয় হবে যে, আমি একদিন আহমদ মুসার বাহুতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলাম।
.
আহমদ মুসার নাম চাওসিকো আনা আরিয়ার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই শুনে নিয়েছিল।
আহমদ মুসার নাম শুনে চাওসিকো আবেগে, উত্তেজনায় কেঁদে ফেলেছিল। সিজদায় পড়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘ইয়া আল্লাহ আপনার হাজার শোকর। আহমদ মুসার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন আমার ও আনা আরিয়ার কঠিন এক দুঃসময়ে। আপনার এ বান্দার একটা চাওয়া আপনি পূর্ণ করেছেন ‘
সিজদা থেকে উঠে চাওসিকো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘স্যার, ক্যামেরুনের ঘটনাসহ আপনার কথা ইন্টারনেটে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এত পড়েছি যে, আমি স্বপ্ন দেখতাম আপনার সব ঘটনা নিয়ে। আল্লাহর কাছে কত যে প্রার্থনা করেছি, আল্লাহ আপনার সাথে যেন আমাকে সাক্ষাৎ করান। জানেন, রবিনহুড, শার্লক হোমস, চেগুয়েভারা, হো চি মিন, মাওসেতুং প্রমুখের সব ভালো দিকের যোগফল হিসাবে আপনাকে আমি দেখি। আমার দেখা যে ঠিক আজকের ঘটনা আমাকে তা বলে দিচ্ছে।
একটু আড়ালে গিয়ে আহমদ মুসার বাহুসন্ধিতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল চাওসিকো।
আহমদ মুসারা কথা-বার্তা বলাসহ এই কাজগুলো করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানের গাছ-পালা ঘেরা একটা চত্বরে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সেবা-শুশ্রূষার সব কাজ শেষ হয়ে গেলে আহমদ মুসা চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে নিয়ে বসল।
আনা আরিয়ার দু’গণ্ড জুড়ে তখনও অশ্রুর দাগ।
চাওসিকো ও আহমদ মুসার আহত অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আনা আরিয়া। আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ও চাওসিকোর সামান্য আহত হওয়া দেখে তুমি কাঁদছ, কিন্তু এ দুর্ঘটনায় সতেরজন লোকের প্রাণ গেল। আল্লাহ তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
‘স্যার, আমি কাঁদছি, আপনার গুলিটা আর কয়েক ইঞ্চি ডানে গিয়ে লাগলে কি হতো এবং আপনাকে আল্লাহ না পাঠালে আমার ও চাওসিকোর কি অবস্থা দাঁড়াতো?’ আনা আরিয়া বলেছিল।
‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। তাঁর শুকরিয়া আদায় করে এসো বর্তমান নিয়ে আলোচনা করি। এখন রাত বারোটা। আমাদের সামনে কিছু জরুরি বিষয় আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার বলুন।’ চাওসিকো ও আনা আরিয়া দুজনেই বলে উঠল
‘আজ এ পর্যন্ত চাওসিকো ও আনা আরিয়ার জীবনে যা ঘটেছে তা নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। চাওসিকো তোমার বিশ্ববিদ্যালয় হলে যাওয়া বা বাড়িতে যাওয়া নিরাপদ কিনা?’
‘না নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলের ঠিকানা ওরা জানে, বাড়ির ঠিকানাও ওরা জানে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘তৃতীয়, চতুর্থ কোনো জায়গা চাওসিকোর আছে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
আনা আরিয়া তাকাল চাওসিকোর দিকে।
‘আমার দুই ফুফুর বাড়ি আছে বুজুমবুরাতে। বলল চাওসিকো।
‘তুমি সেখানে নিরাপদ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি, নিরাপদ বলে আমি মনে করি।’ বলল চাওসিকো।
‘ঠিক আছে আমি সেখানে তোমাকে পৌঁছে দেব।’ আহমদ মুসা বলল। আহমদ মুখ ঘুরাল আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘বোন, তুমি তো বাড়িতে যেতে পারবে?’
‘রাত নয়টার পর থেকে যা ঘটেছে, ‘সে সব সংবাদ আমার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। অন্তত বাবা সবই জানতে পেরেছেন এবং এখানকার ঘটনাও বিস্তারিত জানবেন। তাই বাড়িতে আমিও নিরাপদ নই।
‘বিকল্প ব্যবস্থা তোমার কি আছে আনা আরিয়া?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমার কোনো বিকল্প নেই স্যার। যে আত্মীয়ের বাড়িতেই যাব, বাবা সংগে সংগেই তা জানতে পারবেন।’ বলল আনা আরিয়া।
সংগে সংগে কথা বলল না আহমদ মুসা।
ভাবছিল সে।
বলল অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, ‘বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়েদের নিরাপদ জায়গা বাপের বাড়ি এবং স্বামীর বাড়ি। আনা আরিয়া তুমি বাপের বাড়ি নিরাপদ মনে করছ না। আমিও মনে করি আরও কিছু কারণে তুমি তোমার বাড়িতে নিরাপদ নও। তাহলে তোমরা দু’জন এখন কি বিয়ে করতে রাজি আছ?’
চাওসিকো ও আনা আরিয়া দু’জনেই মাথা নিচু করল। দু’জনের কেউ কিছু বলল না।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাদের সবাইকে বাস্তববাদী হতে হবে। আনা আরিয়া তুমি খুব সাহসী, স্পষ্টবাদী ও বুদ্ধিমতি মেয়ে। তোমার কাছ থেকে বাস্তব পরামর্শ আশা করি বোন।
আনা আরিয়া মুখ তুলল। বলল ‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমি বিয়েতে রাজি। যে পরিস্থিতিতে দু’জন পড়েছি, তাতে বিয়ে করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ আছে। কিন্তু ভাইয়া, মন বলছে আমি চাওসিকোকে বিয়ে করছি, এটা আমার মা-বাবাকে বলা উচিত।’
‘ধন্যবাদ বোন। তোমার মন ঠিক বলেছে। তাহলে তোমরা ওঠো, আনা আরিয়ার বাড়িতে প্রথম যাব।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল চাওসিকো এবং আনা আরিয়া।
আনা আরিয়ার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘ভাইয়া আমাদের বাড়িতে যাবেন? কেন?’
‘তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে।’ আহমদ মুসা বলল।
আনা আরিয়ার বিস্ময় আরও বাড়ল। বলল, ‘কি কথা ভাইয়া? বিয়ের ব্যাপারে বাবা-মাকে কিছু বলার সময় এটা নয় ভাইয়া। কিছুই বলা এখন সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’
‘তুমি তো কথা বলবে না। কথা বলব আমি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া আরেকটা কথা। বাবা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শুধু নন, তিনি মধ্য আফ্রিকায় শীর্ষ খ্রিস্টান নেতাদের একজন।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ধন্যবাদ, বিষয়টা আমাকে আরও সাহায্য করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভয় হচ্ছে আমার ভাইয়া, আপনি যদি সেখানে ভালো ব্যবহার না পান।’ বলল আনা আরিয়া।
‘খারাপ ব্যবহার পাবার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাকে আটকে রাখবেন আমার বাবা-মা, আমি ভয় করি ভাইয়া।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কোনো ব্যাপারেই কিছু ভেব না। আল্লাহর উপর ভরসা কর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট।’ বলল আনা আরিয়া।
গাড়িতে উঠে বসল সবাই। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে। তার পাশের সিটে চাওসিকো। আর পেছনের একা বসেছে আনা আরিয়া।
গাড়ি চলতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগান থেকে ভিসির বাড়ি খুব কাছেই। ভিসি’র বাড়ির গেট বন্ধ। গাড়িটিকে দাঁড়াতে হলো।
গেট বক্স থেকে বেরিয়ে এলো দারোয়ান। সে গাড়ির সামনের সিটে দু’জন অপরিচিত লোক দেখতে পেল। কিন্তু পেছনের সিটে তাকিয়েই দেখতে পেল ছোট ম্যাডাম, মানে আনা আরিয়াকে। গেটম্যান আনা আরিয়াকে একটা বাউ করে দ্রুত গিয়ে গেট খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে গেল গাড়ি। গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আনা আরিয়াদের গাড়ি বারান্দায়।
কয়েক মুহূর্ত সময় গেল। আনা আরিয়া বলল, ‘ভাইয়া আস্তে তিনটা শর্ট হর্ন দিন। এটাই আমার হর্ন-কোড।
হর্ন দিতে হবে না আনা আরিয়া। তোমার বাবা-মা এখনি এসে পড়বেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেমন করে জানবেন তারা। আপনি গেটেও তো হর্ন দেননি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘গেটম্যান ওদের জানিয়ে দিয়েছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ভাইয়া, এ সহজ কথাটা আমার মনে আসেনি। আল্লাহর হাজার শোকর, কোনো ছোট বিষয়ও দেখি আপনার নজর এড়ায় না।’ বলল আনা আরিয়া।
আনা আরিয়ার কথা শেষ না হতেই গাড়ি বারান্দার সামনের বড় গেটটা খুলে গেল। ছুটে বেরিয়ে এলো আনা আরিয়ার বাবা-মা।
এসে দাঁড়াল গাড়ির পাশে। আনা আরিয়াও দ্রুত বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। প্রথমেই পেল বাবাকে।
বাবা দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আনা আরিয়াকে।
‘প্রভু যিশুকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি আমাদের সহায় হয়েছেন?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
আনা আরিয়া বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। তার মা শিলা স্টিফেন তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বলল, ‘গত দুই ঘণ্টায় আমরা শেষ হয়ে গেছি মা। তোমাকে বলেছি না যে, কোনো বিপদে জড়াবে না। কেন বিপদের মধ্যে ছুটে গেলি।
স্ত্রী শিলাকে একটু শান্ত করে ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান গাড়ির দিকে আর একটু এগিয়ে এলো। বলল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘তোমাদেরকে ধন্যবাদ। আমাদের মেয়েকে আমরা পেয়ে গেছি। চাওসিকোও উদ্ধার হয়েছে। প্রভু যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন। আমাদের আর কিছু বলার নেই, শোনারও নেই। ধন্যবাদ।’
বলে ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান তাকাল স্ত্রী শিলা ও মেয়ে আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘চলো।
গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসা। গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মি. স্টিফেন, আপনার বলারও নেই, শোনারও নেই। কিন্তু আমার বলারও আছে, শোনারও আছে। আশা করি আমাকে সুযোগ দেবেন।’ আহমদ মুসার শান্ত, কিন্তু শক্ত কণ্ঠ।
ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান ঘুরে দাঁড়াল।
তাকাল স্থির এবং কিছুটা বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে আহমদ মুসার দিকে। তার কোনো কথার এ রকম জবাব কোনো দিন সে শোনেনি এবং শুনতে তার ভালোও লাগেনি। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কিছুটা সম্মোহিত হলো। মনে হলো এ যুবক অনর্থক কথা বলে না, অহংকারের ফাঁকা বুলিও এটা নয়। যুবকটির শান্ত চেহারার মধ্যে যেন আগুন দেখতে পাচ্ছে সে। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান, ‘আমি কথাটা বলেছিলাম এজন্যে যে, আমাদের বাড়ির উপর পুলিশের দৃষ্টি আছে। কথা আমাদের তাড়াতাড়ি শেষ করাই ভালো।’
‘পুলিশকে আমাদের কোনো ভয় নেই, পুলিশকে আমারও প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। বলো এবার তোমার কথা।’ ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘যা বলার, তার আগে আরও কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। বিমানবন্দরের ভেতর বিমানের পাশ থেকে পাঁচজন সন্ত্রাসী চাওসিকোকে কিডন্যাপ করে। আতংকিত আনা আরিয়া চাওসিকোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা দেখা এবং পারলে উদ্ধার করার উদ্দেশে আনা আরিয়া সন্ত্রাসীদের পিছু নেয়। সন্ত্রাসীরা চাওসিকোকে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ও পরিত্যাক্ত প্রশাসনিক ভবনে এনে তুলে। আনা আরিয়া ভবনটির সামনে পৌঁছে পাশের ঝোঁপ এলাকায় একটা অন্ধকারে আশ্রয় নিয়ে ভাবতে থাকে কি করবে সে। এই সময় সন্ত্রাসীদের পাঁচজনের আর একটা গ্রুপ খবর পেয়ে সেখানে এসে আনা আরিয়াকে আটক করে। আনা আরিয়াকে তারা নানা অশোভন কথা বলে এবং শেষে চ্যাংদোলা করে তাকে তারা তাদের গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিল। আমি অন্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ঐ ভবনে এসেছিলাম এবং ঐ ঝোঁপেরই অন্যপাশে বসে সমগ্র বিষয়টা দেখছিলাম। যখন আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে তাদের গাড়িতে তুলছিল, তখন আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করি। সংঘর্ষে ওদের পাঁচজনই মারা যায়। মুক্ত আনা আরিয়ার কাছে সবকিছু শোনার পর আমি চাওসিকোকে উদ্ধারের জন্যে ভবনটিতে ঢুকি। আমি যখন চাওসিকোকে খুঁজে পাই, তখন দেখি অনেকে মিলে চাওসিকোকে মারধর করছে এবং তার জন্যে কবর খোঁড়া হচ্ছিল তাকে জীবন্ত কবর দেয়ার জন্যে। আমার সাথে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ হয়। সংকর্ষে সেখানে তেরজন’ সন্ত্রাসীর সবাই মারা পড়ে। চাওসিকো উদ্ধার হয়। চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সাথে পরে অলোচনা করে আমি বুঝলাম চাওসিকো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাড়ি কোথাও নিরাপদ নয় এবং আনা আরিয়াও বাড়িতে নিরাপদ নয়। এই অব…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘আনা আরিয়া বাড়িতে নিরাপদ নয় কেন?’
‘আনা আরিয়াকে মুক্ত অবস্থায় বাড়িতে দেখলে সন্ত্রাসীরা ছুটে আসতে পারে দুই কারণে, আনা আরিয়ার উপর প্রতিশোধ নেয়া এবং তাকে মুক্তকারী লোকদের খোঁজ করা এবং আনা আরিয়ার কাছ থেকে তাদের পরিচয় জানা। সন্ত্রাসীদের সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে আনা আরিয়া দায়ী, এ অভিযোগ তারা তুলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যদি সন্ত্রাসীরা এ অভিযোগ না তুলে? কারণ আনা কাউকে হত্যা করেনি, বরং সেই কিডন্যাপ হতে যাচ্ছিল।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘স্যার, আপনি সন্ত্রাসীদের কতটুকু চেনেন জানি না, কিন্তু আমি ওদের ভালো করে চিনি। ব্ল্যাক ক্রসের সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের লোকদেরকেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
ফাদার স্টিফেন শুধু একবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কোনো কথা বলল না। ব্ল্যাক ক্রসরা কেমন, তা সে জানে। কিন্তু এই যুবকটি ওদের নাম পরিচয় জানল কি করে?
‘স্যার, আরেকটা বিষয়। আজ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবনে যা ঘটল, তা আমি পুলিশকে জানাতে চাই, যাতে আমার কোনো দায় না থাকে এবং পুলিশও জানতে পারে চাওসিকোকে • কিডন্যাপ কারা করেছিল। আনা আরিয়াকে পেলে পুলিশ আনা আরিয়াকে সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘শুধু আনা আরিয়া নয়, আমরাও মানে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশী ঝামেলায় পড়তে পারে।’ আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলল। তার কণ্ঠ অনেকটাই নরম।
‘স্যার, ওটা কোনো চিন্তার বিষয় নয়। পরিত্যাক্ত ভবনের দায় বিশ্ববিদ্যালয় সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। তুমি ঠিকই বলেছ।’ বলে একটু থামল ফাদার স্টিফেন ফোরিয়ান।
একটু ভাবল। বলল, ‘ইয়ংম্যান তুমি আনা সম্পর্কে যা বলেছ, সেটাও বড় এক বিষয়। সন্ত্রাসীদের সতেরজন লোক মারা গেছে, অবশ্যই ওরা প্রতিহিংসাপরায়ন হবে। তারপর ওদের পেছনে পুলিশ তৎপর হলে ওরা আরও ক্ষেপবে। সুতরাং আনা এখানে নিরাপদ নয়। তাকে অবশ্যই ওদের নজরের বাইরে কিছু দিন থাকতে হবে। ভাবছি আমি এই রাতে তাকে নিয়ে কি করা যায়।’
‘আমি একটা বাস্তব কথা আপনাকে বলতে চাই স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলো।’ আনা আরিয়ার বাবা বলল।
‘একজন বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়ের আত্মগোপনের জায়গা বাবা-মায়ের বাড়ি হতে পারে, অথবা স্বামীর সাথে স্বামীর বাড়ি হতে পারে। আনা আরিয়া বাবা-মায়ের সাথে নিরাপদ নয়, দ্বিতীয় বিকল্প হলো তার স্বামীর সাথে থাকা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ও গড! আমার মেয়ের তো বিয়েই হয়নি। দ্বিতীয় বিকল্পের প্রশ্ন তো তার ক্ষেত্রে ওঠে না।’ আনা আরিয়ার বাবা বলল।
আনা আরিয়ার মা কথা শুনে চমকে উঠে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে, তারপর নিজের মেয়ের দিকে।
‘বিয়ে অবশ্যই হয়নি, তবে বিয়ে হতে পারে।’
কথাটা বলে আহমদ মুসা একটু হেসে আবার বলল আনা আরিয়ার মা- বাবার দিকে তাকিয়ে, ‘এই বিষয় নিয়ে আমি আনা আরিয়া এবং চাওসিকো দু’জনের সাথেই আলোচনা করেছি। বিয়েতে দু’জনেরই মত আছে। বাবা- মা হিসেবে এই ক্ষেত্রে আপনাদের দায়িত্ব বেশি। এখন আপনারা বলুন।’
আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে, তবে সেখানে ক্রোধের কোনো চিহ্ন নেই। আর আনা আরিয়ার মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণ দু’জনের কেউ কথা বলল না। আনা আরিয়ার মা শিলা স্টিফেন তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে
‘কোনো ধর্মমতে বিয়ে হবে?’ নীরবতা ভেঙে বলল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা।
সংগে সংগেই আনা আরিয়ার মা স্বামীকে বলল, ‘এসব প্রশ্নে আমরা এখন না যাই। মেয়ের উপর ছেড়ে দাও এ বিষয়টা।’
ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি ও তোমার মেয়ে যা ইচ্ছে তাই করো। আমাকে কিছু বলো না।’
কথাটা বলেই মেয়ে আনা আরিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দ্রুত হেঁটে বাড়িতে প্রবেশের দরজার দিকে চলে গেল। আনা আরিয়ার মা জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। কান্নায় ভেঙে পড়ল মা, মেয়ে দুজনেই।
মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে এক সময় আনা আরিয়ার মা ডাকল চাওসিকোকে। চাওসিকো এলো।
তার দু’চোখ থেকেও অশ্রু গড়াচ্ছিল।
আনা আরিয়ার মা চাওসিকোর ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবা তুমি খুব ভালো ছেলে, সোনার ছেলে তুমি। তুমি আমাদের মেয়েকে অবশ্যই ভালো রাখবে।’
বলে আনা আরিয়ার ডান হাত এনে চাওসিকোর হাতে তুলে দিল আনা আরিয়ার মা।
আনা আরিয়া ও চাওসিকো দু’জনেই জড়িয়ে ধরল আনা আরিয়ার মাকে। তিনজনের কান্না এক হয়ে মিশে গেল বাতাসে।
আহমদ মুসার দু’চোখ থেকেও তখন অশ্রু গড়াচ্ছিল।
আনা আরিয়ার মা চাওসিকোদের ছেড়ে দিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তুমি কে বাবা? সব অসাধ্য সাধনই তুমি করতে পার দেখছি। সতেরোজনকে মেরে আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে উদ্ধার করলে, দু’জনকে একজোড়ায় এনে বাঁধলে, ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মতো লোককেও মাত্র কয়েক কথায় বাগে আনলে, আবার তোমার চোখে মানব- হৃদয়ের মায়াময়তার বিগলিত রূপ অশ্রুও দেখছি। তুমি তো তোমার নামও বলনি, পরিচয়ও তো দাওনি।
‘মা, ওটা এক সময় আনা আরিয়ার কাছ থেকে জেনে নেবেন। মায়ের কাছে ‘সন্তান’ হওয়াই সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমাকেও আপনার এক সন্তান মনে করবেন। আনা আরিয়া আমার বোন।’ বলল আহমদ মুসা।
.
আনা আরিয়াকে এক পশলা চুমু খেয়ে তাকে এনে গাড়িতে বসাল আনা আরিয়ার মা। নিজের গলার হিরের নেকলেসটি পরিয়ে দিল আনা আরিয়ার গলায়।
চাওসিকোকেও হাত ধরে এনে গাড়িতে আনা আরিয়ার পাশে বসাতে গেল।
আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না মা, চাওসিকো আনা আরিয়ার পাশে বসার অধিকার এখনো পায়নি, বিয়ে হয়নি এখনো তাদের। চাওসিকো সামনে আমার পাশে বসবে।’
‘কি জানি বাবা, তোমাদের ইসলাম ধর্মের, অনুশাসন সব তো আমরা জানি না। তবে এটা ভালো বাবা। আমার ভালো লাগল খুব।’ আনা আরিয়ার মা বলল।
‘না মা, ইসলাম ধর্ম শুধু আমাদের নয়, আপনার, আমার সব মানুষের ধর্ম।’
‘এসব এখন বলো না বাছা, আনার বাবা শুনতে পাবে। তাকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না।’ বলল আনা আরিয়ার মা।
গাড়িতে উঠল চাওসিকো।
আহমদ মুসা বসল ড্রাইভিং সিটে।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আনা আরিয়ার মা। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘বাবা, আমার মেয়ে আনাকে নিয়ে এত নিরাপদ বোধ আর কখনই করিনি। তোমাদের সকলের জন্যে আমার শুভকামনা।’
‘আল্লাহ হাফেজ। বিসমিল্লাহ।’ বলে গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। মুখে হাসি চোখে অশ্রু নিয়ে হাত নাড়ছিল আনা আরিয়ার মা।
গাড়ির ভেতর থেকে হাত নাড়ছিল, আনা আরিয়া ও চাওসিকো। দু’জনের চোখেও অশ্রু। আনা আরিয়ার হৃদয় জুড়ে আনন্দ-বেদনার এক মধুর-যন্ত্রণা।
.
আহমদ মুসার গাড়ি চলছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে।
ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিস পার হয়ে এগিয়ে চলছিল গাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট দূরত্বে আলোর ব্যবস্থা আছে। এর পরেও গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে আলো-আঁধারির খেলা।
সামনেই ডান দিক থেকে আসা একটা রাস্তা আহমদ মুসাদের রাস্তাকে ক্রস করে বামে মানে উত্তরে চলে গেছে খুব কাছে একটা বিল্ডিং-এর দিকে। বিল্ডিংটির দিকে চোখ গেল আহমদ মুসার। দেখতে পেল, বিল্ডিংটির পাশ থেকে একজন লোক হাত তুলেছে। তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে।
রাস্তার ক্রসিং-এ গিয়ে আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল বাম দিকে।
আহমদ মুসার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল লোকটির পাশে।
হাত তুলে দাঁড়ানো লোকটি দুই ধাপ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘একজন ছাত্র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। আমাদের গাড়ি অন্য কাজে গেছে।’
লোকটির কথা শেষ হতেই আনা আরিয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার, উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আমাদের স্যার, রেভারেন্ড স্যার। ছাত্র-কল্যাণের দায়িত্বে আছেন তিনি।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
হ্যান্ডশেক করল রেভারেন্ড স্যারের সাথে। বলল, ‘আপনার উপর একটা মহৎ দায়িত্ব স্যার।’
‘যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়, সেটাই পালন করি। এর আগে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের দায়িত্বে।’ বলল রেভারেন্ড স্যার হেনরি উইলিয়াম।
‘চলুন আপনার ছাত্রকে দেখি।’
বলেই আহমদ মুসা গাড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘আনা আরিয়া তুমি ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসো। চাওসিকো এবং স্যার অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে বসবেন পেছনে।’
অসুস্থ ছেলেটিকে আহমদ মুসাই পাজা-কোলা করে নিয়ে এসে পেছনের সিটের মাঝখানে বসিয়ে দিল। রেভারেন্ড স্যার ও চাওসিকো বসল তার দুই পাশে। গাড়ি চলছিল হাসপাতালের পথে।
হাসপাতালের নাম ও লোকেশনের বিষয় আগেই বলে দিয়েছে রেভারেন্ড স্যার…।
রাতের বুজুমবুরা। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে। প্রায় ফুল স্পিডে চলছিল গাড়ি। আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সামনে।
‘রেভারেন্ড স্যার আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেই চলেছে। আপনার মন ভালো থাকার কথা নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যেমন।’ রেভারেন্ড স্যার বলল।
‘বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্র আবিউলা আমাদী কিডন্যাপড হলো এবং নিহত হলো মর্মান্তিকভাবে। তার আগে আরেক প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্র হেনরি বুফোর্ট মুহিজী এবং সারা সুসান রোজ তাদের বাড়ির সামনে নৃশংসভাবে খুন হলো। আর আজ প্রতিভাবান ছাত্র চাওসিকো কিডন্যাপ হয়েছিল। এছাড়া…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই রেভারেন্ড স্যার হেনরি উইলিয়াম বলল, ‘চাওসিকো কিডন্যাপড হয়েছিল? ও গড! সে তো ভ্যাটিকান গিয়েছিল একটা প্রতিনিধিদল নিয়ে?’
‘আজ ফিরেছে, আজই কিডন্যাপ হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সত্যি বলেছেন, এসবই খুব মর্মান্তিক ঘটনা। আমার খুব মনে পড়ে হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসানের কথা। ঠিক এই মোড়েই হেনরি বুফোর্ট সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিল। সারা সুসান আমার সাহায্য চেয়েছিল হেনরি বুফোর্টকে হাসপাতালে নেয়ার জন্যে। সে ছিল দারুণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাকে পাঁচশ’ ফ্রাঙ্ক দিয়ে একটা হায়ার্ড ট্যাক্সিতে করে আমি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। পরদিন বিকেলেই হেনরি বুফোর্ট হাসপাতাল থেকে চলে যায়। বাড়ি যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান খুন হয়।
‘হেনরি বুফোর্ট সংজ্ঞা হারিয়েছিল কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি জানি না। সারা সুসান জানতো কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। হাসপাতালেও কোনো রেকর্ড নেই।’ বলল রেভারেন্ড স্যার।
‘হাসপাতালে তো অবশ্যই রেকর্ড থাকার কথা। নেই কেন?’
জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘হাসপাতালে এ রেকর্ড কেন, হেনরি বুফোর্টের কোনো রেকর্ডই নেই। সে যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, হাসপাতালে ছিল, সে সবের কোনো কিছুই হাসপাতালের রেকর্ডে নেই। বলল রেভারেন্ড স্যার।
আহমদ মুসা কিছু বলল না। রাজ্যের বিস্ময় এসে ছায়া ফেলেছে তার চোখে-মুখে। ভাবল সে, হাসপাতালে আরও খোঁজ-খবর নিতে হবে এবং হেনরি বুফোর্টের বাড়িতেও একবার তার যাওয়া উচিত।
অসুস্থ ছাত্রকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে রেভারেন্ড স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা এলো চাওসিকোর ফুফুর বাড়িতে।
চাওসিকো আগেই তার ফুফা-ফুফিকে মোবাইলে সব কথা বলে রেখেছিল। তাই নতুন করে কোনো বলাবলির দরকার হলো না। ফুফা- ফুফি, ভাই-ভাবিরা সাদরে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে গ্রহণ করল। আহমদ মুসাকে তারা অনেক ধন্যবাদ দিয়ে অনুরোধ করল আপনি আসুন ভেতরে। সবার সাথে আপনার পরিচয় হবে এবং এখনকার করণীয় সম্পর্কে আপনার পরামর্শ দরকার।
‘এখনকার করণীয় একটাই। সেটা হলো আমার এই দুই ভাইবোন, আনা আরিয়া ও চাওসিকোর এখনি বিয়ের ব্যবস্থা করা। আনা আরিয়ার বাবা-মা’র অনুমতি নেয়া হয়েছে, এখন চাওসিকোর বাবা-মা অনুমতি দিলেই হয়ে যায়। আমি এখন বসতে পারছি না।
আমাকে এখনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজি’র সাথে দেখা করা দরকার।
আমি যাচ্ছি। আপনারা চাওসিকোর বাবা-মাদের ডাকুন। আমি কাজ সেরেই চলে আসব।
৬
মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রির অফিস। বাতিস্তা সান্ড্রির অফিস-কনফারেন্স রুমের বিশাল টেবিলের হোস্টের চেয়ারে বসে বাতিস্তা সান্ড্রি। তার সামনে টেবিলের ওপাশে চীফ গেস্টের চেয়ারে বসেছে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার। টেবিলের আরেক প্রান্তে বসে আছে ব্ল্যাক ক্রসের অপারেশন কমান্ডার কর্নেল হ্যারিস হামিল্টন। বাতিস্তা সান্ড্রির চোখ-মুখ লাল। গতরাত তার একদমই নির্ঘুম অবস্থায় কেটেছে।
ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার এবং অপারেশন কমান্ডার কর্নেল হ্যারিস হামিল্টনের চোখে-মুখে রাতজাগা ও সফরের ক্লান্তি। তারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সকাল নয়টায় বুজুমবুরায় পৌঁছেছে। বিমানবন্দর থেকে সোজা তারা বাতিস্তা সান্ড্রির অফিসে চলে এসেছে। কলিন ক্রিস্টোফারের চেয়ারের পাশে একটা ব্রিফকেস রাখা। তাতে এয়ার লাইন্সের একটা ট্যাগ ঝুলছে। এয়ারপোর্ট থেকে অফিসে পৌঁছেই সে এই মিটিং-এ বসেছে।
‘মি. বাতিস্তা সান্ড্রি, ফাদার স্টিফেনের খবর কী? উনি কি আসছেন?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘সারারাত তো কান্নাকাটিতে কেটেছে তাদের। সকালেও মেয়ে ফিরেনি, খোঁজ-খবরও পায়নি। তবু বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন আসার।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ঐ একটিই তো মেয়ে তাদের?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘হ্যাঁ।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘উনি আসলেই বরং ভালো হতো। মেয়েকে এখানে-সেখানে খুঁজে লাভ নেই। চাওসিকোকে যে উদ্ধার করেছে, সেই নিয়ে গেছে তাঁর মেয়েকে এটা পরিষ্কার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘এটাই ঘটেছে। আনা আরিয়াকে ধরে আনার জন্যে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল, তাদের পাঁচজনেরই লাশ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে পাওয়া গেছে। এদেরকে মেরেই কেউ বা কারা আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে এবং এরাই চাওসিকোকে উদ্ধার করে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘এসব কথা থাক মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমি হতাশ। এত বড় ঘটনা এখানে ঘটতে পারল কি করে? বিমানবন্দর থেকে পাঁচজনে চাওসিকোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসল ঘাঁটিতে। একটা পুঁচকে মেয়ে তাদের ফলো করলো। তাকে আটকাবার জন্যে পাঁচজনকে পাঠানো হলো। তারাসহ ঘাঁটিতে মোট তখন সতেরোজন লোক। এই সতেরোজন এক পুঁচকে ছোঁড়া ও এক পুঁচকে মেয়েকে আটকাতে পারল না, উল্টো সতেরোজন সবাই নিহত হলো। এটা কি করে মেনে নেয়া যায়? আপনারা সর্বশেষ কি জানতে পেরেছেন?
‘একমাত্র পুলিশ সোর্স থেকেই কিছু জানা গেছে। পুলিশ বলছে, ‘সতেরোজনকে হত্যা করা এবং দু’জনকে উদ্ধার করা একজনের কাজ। তার নাম আবু আব্দুল্লাহ। সেই চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। আনা আরিয়া যেমন বাড়িতে আসেনি, তেমনি চাওসিকোও বাড়িতে যায়নি। পুলিশের ধারণা তাদেরকে তাদের আত্মীয়-স্বজন বা তৃতীয় কোনো স্থানে রাখা হয়েছে। পুলিশের এই সূত্রে আরও একটা বড় বিষয় জানা গেছে। সেটা হলো, আবু আব্দুল্লাহ পুলিশকে খবর দিয়ে ঘটনা স্থলে পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।’
‘এই একজন লোক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এটা কোনো বড় বিষয় নয় এবং নতুন বিষয়ও নয়। এই একজন লোকেই এ পর্যন্ত সবকিছু করেছে। এই একজন লোকেরই আপনারা সন্ধান করছেন শুরু থেকে। এখনও খুঁজেই পেলেন না। অথচ সে এই শহরে বহাল তবিয়তে আছে এবং আমাদের সব কাজ ভণ্ডুল করে দিয়ে চলেছে। কোনোই সন্দেহ নেই, এই আবু আব্দুল্লাহই আহমদ মুসা। তার মাধ্যমে বুরুন্ডি সরকার আমাদের পরিচয় ও কাজ অনেকটাই জানতে পেরেছে। ধুরন্ধর আহমদ মুসা অন্য সব জায়গায় যা করেছে, এখানেই তাই করার চেষ্টা করছে। সরকারকে সে পক্ষে নিয়ে আমাদের সব প্রকল্প, পরিকল্পনা বানচাল করার চেষ্টা করছে। থামল কলিন ক্রিস্টোফার। বিক্ষুদ্ধ তার কণ্ঠস্বর।
বাতিস্তাও বিক্ষুদ্ধ, বিব্রত। বলল, ‘মি. ক্রিস্টোফার আপনি যা বললেন সবই সত্য। কি করণীয় এখন আমাদের?’
‘পার্লামেন্ট এবং জনমতের ক্ষেত্রে এখন আপনাদের অবস্থান কেমন?’ বলল ক্রিস্টোফার।
‘হুতু ও তুতসি কমুনিটির পার্লামেন্ট সদস্যের মধ্যে আমাদের নিজস্ব লোক আছে। মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী একেবারে আমাদের নিজস্ব। অন্যদের মধ্যে প্রায় সবাই আমাদের ঘনিষ্ঠ লোক।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘মেজরিটি এমপি সমর্থন না পেলে বড় কিছুই করা যাবে না। কতজন এমপি-কে দলে টানতে পারবেন?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘বুরুন্ডির জাতীয় পরিষদ ও সিনেটে হুতু প্রভাবিত ও তুতসি প্রভাবিত দলই প্রধান। এই দুই দলে বেলজিয়ান ও ইউরোপীয়রা আছে। তাদেরও বেশ প্রভাব আছে। সিনেটে মোট সিট ৩৯টি। এর মধ্যে তুতসিদের আছে মাত্র ১টি আসন। আর হুতু প্রভাবিত দলের আছে ৩৪টি আসন। এখানে আমাদের সিনেটরের সংখ্যা হবে বিশ। আর জাতীয় পরিষদে ১২৩টি আসনের মধ্যে তুতসি প্রভাবিত দলের রয়েছে ৩২টি আসন এবং হুতুদের নিয়ন্ত্রিত দলের ৮৬টি আসন রয়েছে। জাতীয় পরিষদে আমাদের অনুগত সদস্যের সংখ্যা চল্লিশ। তবে সব সদস্যের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ধন্যবাদ মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। সিনেটে আসনের দিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আমাদের অনুগত লোকদের মেজরিটি আছে। কিন্তু জাতীয় পরিষদে মেজরিটি হওয়ার জন্যে আরও পঁচিশজন আপনার পেতে হবে। আর সিনেটের জন্যে আরও জনাচারেক সিনেটর যোগাড় হওয়া দরকার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার 4
‘অসুবিধা হবে না স্যার। জাতীয় পরিষদের জন্যে ২৫ জন এমপি’কে দরকার হলে আমরা কিনে ফেলব। এইভাবে জনাচারেক সিনেটরও আমরা পেয়ে যাব।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘মি. বাতিস্তা সান্ড্রি আপনি সিনেট ও জাতীয় পরিষদ সম্পর্কে যা বললেন, সে ব্যাপারে আপনি কতটা নিশ্চিত?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আমি শতভাগ নিশ্চিত মি. ক্রিস্টোফার।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘গুড। তাহলে চলুন আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করি। দেখুন, কোন সময় আজ আমরা তার দেখা পেতে পারি।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার। তার মুখ উজ্জ্বল।
‘একবারেই একদম সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকার?’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘নিচের লোকদের সাথে দেখা করলে কোনো ফল হবে না, শুধু সময় নষ্ট হবে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘কি ফল আমরা চাই? প্রধানমন্ত্রীকে আমরা কি বলব?’ জিজ্ঞাসা বাতিস্তা সান্ড্রির।
‘আমার মনে হয় আহমদ মুসা নানা রকম তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সরকারকে পক্ষে নেবার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনেই আমরা আমাদের কথা ও দাবি-দাওয়া ঠিক করব।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘ঠিক চিন্তা করেছেন মি. কলিন ক্রিস্টোফার। তাহলে আমি প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নাস্তাটা সেরে নিন।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। সবাই উঠে দাঁড়াল।
.
‘বসুন মি. বাতুমবুরা।’ বলল বুরুন্ডির জননিরাপত্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবি মোনিমপা।
পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বসতে বসতে বলল, ‘আবার কিছু ঘটেছে স্যার? এত জরুরি তলব?’
‘আরও কিছু ঘটুক চাইবেন না মি. বাতুমবুরা। যা ঘটেছে তা নিয়েই মহাসংকটে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডেকেছেন। সেখানে যাওয়ার আগে আমরা কিছু কথা বলে নেয়ার জন্যেই আপনাদের ডেকেছি। বুরুন্ডির গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমিও আসছেন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমিকে নিয়ে মিটিং রুমে প্রবেশ করল।
সম্ভাষণ বিনিময় শেষে বসল গোয়েন্দা প্রধান। পিএস বেরিয়ে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাতের ঘটনা সম্পর্কে নতুন কিছু কি জানা গেছে মি. বাতুমবুরা?’
‘যা কিছু জানা গেছে গোয়েন্দা প্রধানই আমাকে জানিয়েছেন। সরাসরি তিনি বললেই ভালো হয়। বলল পুলিশ প্রধান।
‘বলুন মি. মুইজি বোকুমি। ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বলে শুরু করল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবনের ভেতর ও বাইরে থেকে যে ১৭টি লাশ পাওয়া গেছে, তাদের কেউই বুরুন্ডির নয়। তাদের থাকার ঘর থেকে ১৭টি পাসপোর্ট উদ্ধার হয়েছে। তাদের তিনজন জার্মানীর, পাঁচজন ফ্রান্সের, দুইজন স্পেনের, চারজন পর্তুগালের এবং অবশিষ্ট তিনজন ইতালির। তারা সাত আট দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ভবনে থাকত। ভবনটিতে বাইরে বেরুবার দুটি পথ আছে, তা বহুদিন ধরে বন্ধ ও অব্যবহৃত। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করত। তাদের জামা ও জ্যাকেটে যে পরিচয়-চিহ্ন পাওয়া গেছে, তা আগের পাওয়া লাশগুলোর মতোই। তাদের অস্ত্রগুলোতে একই ধরনের পরিচয় চিহ্ন পাওয়া গেছে। অস্ত্রগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তৈরি। তাদের পকেটে বা ঘরে তাদের পরিচয়সূচক আর কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। আহমদ মুসা তাদেরকে আন্তর্জাতিক গোপন খ্রিস্টান সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের সদস্য বলেছে। তারাই মধ্য আফ্রিকায় (SCA)-এর নতুন নামে কাজ করছে।
তাদের মোটিভ ও কাজ সম্পর্কে জানার জন্যে আরও তদন্ত দরকার।
‘তারাই যে চাওসিকোকে কিডন্যাপ করেছিল, এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হওয়া গেছে?’ জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
‘যেখানে লাশগুলো পাওয়া গেছে, সেই একই বারান্দায় একটা কলম, একটা চিরুণী ও একটা কার্ড হোল্ডার পাওয়া গেছে। কার্ড হোল্ডারে চাওসিকোর পাঁচটি নেম কার্ড, আনা আরিয়ার একটি কার্ড এবং ভ্যাটিকান ঠিকানার আরও ছেলেমেয়ের নেম কার্ড পাওয়া গেছে। কলম, চিরুণী ও কার্ড হোল্ডারে যে ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে, তা চাওসিকোর। আহমদ মুসা বলেছে, সে যখন ওখানে যায়, তখন অনেকে মিলে চাওসিকোকে মারধোর করছিল। সম্ভবত মারধোরের সময় তার পকেট থেকে কলম, চিরুণী ও কার্ড হোল্ডার পড়ে যায়।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।
‘কিডন্যাপারদের মোটিভ সম্পর্কে জানার জন্যে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে আমাদের দরকার। আহমদ মুসা ব্যবস্থা করবে বলেছে। কিন্তু এছাড়া কিডন্যাপারদের মোটিভ জানার আর কোনো পথ আছে কিনা?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বলল, ‘পথ আছে। চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ভ্যাটিকান গিয়েছিল। তারা এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারে।’
‘ধন্যবাদ মি. অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা। ঠিক বলেছেন। এর ব্যবস্থা করুন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্নও ওঠে, আহমদ মুসা ঐ সময় ঐ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবন এলাকায় কেন গিয়েছিল?’ পুলিশ প্রধান বাতুমবুরা বলল।
‘সে সম্পর্কে আহমদ মুসা বলেছে। সে আসুমানি পরিবারের দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার নিজের মতো করে তদন্ত করছিল। মেয়ে দুটির হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে একটা টেলিফোন গিয়েছিল আসমানি পরিবারের বাড়িতে। মেয়ে দু’টিকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করে ঠিক করা হয়নি– এমন একটা থ্রেট ঐ টেলিফোনে ছিল। আহমদ মুসা টেলিফোনটির লোকেশন অনুসন্ধান করে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবন এলাকা থেকে টেলিফোনটি করা হয়। ঐ ভবনে বা ঐ এলাকার কোথা থেকে ফোন করেছিল তা খোঁজ নেবার জন্যেই আহমদ মুসা সেদিন রাত সাড়ে দশটার দিকে ওখানে যায় এবং কাকতালীয়ভাবেই সে কিডন্যাগের ঘটনার মুখোমুখি হয়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘আহমদ মুসা ভাগ্যবান স্যার। ঠিক দিনে ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় সে যায়।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘ঈশ্বরই তাকে নিয়ে গেছে। না হলে একটা প্রতিভাবান নিরপরাধ ছেলের জীবন্ত সমাধি হতো। আরেকটি প্রতিভা হারাতো বুজুমবুরা। আর গ্যাংটিও এভাবে ধরা পড়তো না। আমরা জানতেই পারতাম না, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পরিত্যক্ত ভবনে এ রকম একটা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী একটা গ্যাং।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘গ্যাং বললেন স্যার! ওরা তো গোটা দুনিয়ায় খ্রিস্টানদের স্বার্থে কাজ করে। নিশ্চয় খ্রিস্টানদেরই কেউ তাদের ডেকে এনেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান। ‘ক্রিমিনালকে ক্রিমিনালই বলতে হবে মি. বাতুমবুরা। পরিচয় তাদের যাই হোক তারা ক্রাইম করেছে, এটা আমরা এড়িয়ে যাব কি করে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘ঠিক স্যার। রাষ্ট্রের আইন আমাদের এ কথাই বলে।’ বলল পুলিশ প্ৰধান।
‘আহমদ মুসা আমাদের মাথাব্যথা দূর করে দিয়েছে মি. বাতুমবুরা। প্রতিভাবান ছাত্রদের খুন, কিডন্যাপ নিয়ে আমরা যে দিশেহারা অবস্থায় পড়েছিলাম, তা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। ব্ল্যাক ক্রসই অন্য নামে এই অপরাধগুলো সংঘটিত করেছে। তাদের সাথে দেশের কারা জড়িত সেটাও গতরাতের ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুধু আমরা নই, খোদ রাষ্ট্র আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘কিন্তু স্যার, আমাদের দেশের যারা জড়িত, তাদের নাম কি নেয়া যাবে, না তারা স্বীকার করবে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আপনি ঠিক বলেছেন। এটা আমাদের জন্যে, সরকারের জন্যে একটা বড় ব্যাপার। দেখা যাক। প্রধানমন্ত্রীকে সব জানানো হয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টকেও নিশ্চয় বলবেন। সব বিষয় নিয়ে তাদেরকেই চিন্তা করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অয়্যারলেস বিপ বিপ করা শুরু করল।
‘নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট।’
বলে অয়্যারলেস তুলে নিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি অয়্যারলেসের স্পিকার সাইলেন্ট মুডে নিয়ে কথা শুরু করল। কথা শুরু করল মানে শুধু ইয়েস ইয়েস করে চলল। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলল। শেষে বলল, ‘আমরা এখনি বেরুচ্ছি স্যার। পুলিশ প্রধান মি. বাতুমবুরা, গোয়েন্দা প্রধান মি. মুইজি এসে গেছেন।
কল অফ করে অয়্যারলেস পাশে রেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল, ‘আমরা বোধ হয় আরেক জটিলতায় পড়তে যাচ্ছি। ক্যাথলিক চার্চ কাউন্সিলের সভাপতি, পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মি. স্টিফেন এবং ব্ল্যাক ক্রসের সর্বোচ্চ নেতা মি. কলিন ক্রিস্টোফার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন। তারা উদ্বেগজনক কিছু কথা বলে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রিসভার জরুরি মিটিং ডেকেছেন। সে মিটিং-এ আপনাদের দুজনকেও হাজির থাকতে বলা হয়েছে। আমাদেরকে এখুনি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে যেতে হবে।’
‘মন্ত্রিসভার মিটিং ডাকা হয়েছে। কয়টায়?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধানের।
‘এখন থেকে এক ঘণ্টা পর, বেলা চারটায়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ও গড! এত জরুরি? বিষয়টা তাহলে কি?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘চলুন। গেলেই জানা যাবে। গত রাতের পর যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, সে পরিস্থিতিতেও মধ্য আফ্রিকা চার্চ কাউন্সিলের সভাপতি ও ভিসি মি: স্টিফেন ফোবিয়ান ব্ল্যাক ক্রসের প্রধানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে সাহস করেছেন, তখন নিশ্চয় কোনো বড় বিষয়ই হবে।’
বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন’।
উঠে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ প্রধান এবং গোয়েন্দা প্রধানও।
সকলে বেরিয়ে এলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস থেকে।
গাড়ি বারান্দায় তিনটি গাড়িই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তারা তিনজন এগোলো গাড়ির দিকে।
.
প্রধানমন্ত্রীর অফিস।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা তিনজন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করতেই প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাইকে স্বাগত, আমি আপনাদেরই অপেক্ষা করছি।’
সবাই বসল।
প্রধানমন্ত্রী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্যাবিনেটের বৈঠকের আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে। তার আগে আমাদের বিস্তারিত আলোচনার সময় নেই। রাতের পুরো ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ব্রিফ করেছেন। এছাড়া বিভিন্নসূত্রে বিভিন্ন তথ্য আমার কাছে এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বসার পর আহমদ মুসা ঘটনা পরম্পরার একটা সামারি আমাকে জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধান এখানে একসাথে আছেন। আপনারা আমাকে ঘটনার একটা অফিসিয়াল সামারি দেন যা মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার আগে জানলে ভালো হতো, মন্ত্রিসভার বৈঠকের এজেন্ডা কি? কি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে আমরা বসছি।’
‘মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কাউন্সিল অব চার্চসের তরফ থেকে আমাদেরকে হুমকি ও আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনার জন্যে আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠক। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দেশে বিশেষ করে বুজুমবুরায় যে গুম, খুন ও কিডন্যাপের ঘটনা ঘটছে, তা অবশ্যই আলোচনায় আসবে। উদ্ভূত অবস্থায় আমাদের করণীয় কি সেটাই হবে বৈঠকের প্রধান আলোচনা।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘হুমকি ও আলটিমেটাম নিয়ে কি আমরা এখন আলোচনা করব?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘এখন সে আলোচনায় লাভ নেই। মন্ত্রিসভার রুদ্ধদ্বার বৈঠকেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। অনলাইনে প্রেসিডেন্টও আলোচনায় হাজির থাকবেন। তিনি আলোচনায় অংশ না নিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার পরামর্শ পাওয়া যাবে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী
‘ঠিক আছে স্যার, সেটাই ভালো।’
বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল পুলিশ প্রধানের দিকে। বলল, ‘মি. বাতুমবুরা, সংঘটিত উক্ত ঘটনাসমূহের পূর্বাপর একটা সামারি আপনি পেয়েছেন। ঘটনাসমূহের উপর ওটাই আমাদের অফিয়াল রিপোর্ট। রিপোর্টটা আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করুন।’
পুলিশ প্রধান হাতের ফাইল রিপোর্টটি বের করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিল। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট হাতে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি তো রিপোর্টটা পড়েছেন।’
‘জি হ্যাঁ, পড়েছি। আমার কাছেও এক কপি আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী রিপোর্টের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘দেখছি রিপোর্টে সব ঘটনাই আনা হয়েছে। হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান রোজ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও রিপোর্টে আছে। এ বিষয়ে আপনাদের তদন্ত শেষ হয়েছে?’
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যেহেতু হত্যাকাণ্ডটির সাথে বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা জড়িত থাকায় অভিযোগ উঠেছে, তাই তদন্ত শেষ করা যায়নি। বাইরে, বিশেষ করে পূর্ব কঙ্গোর সন্ত্রাসী দলগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর করা হয়েছে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘আহমদ মুসা যে তথ্য দিয়েছে, তাতে এ ঘটনারও মূল এ দেশের মাটিতেই প্রথিত।’
কথা শেষ করেই প্রধানমন্ত্রী ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘চলুন সব বিষয় নিয়ে মন্ত্রিসভাতেই আলোচনা হবে।’
উঠে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী। উঠে দাঁড়াল তার সাথে অন্য সবাই।
.
শুরুর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে মন্ত্রিসভার বৈঠকের কার্যক্রম শুরু হলো।
শুরু হলো প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েই। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বললেন, ‘মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবৃন্দ, দেশের একটা সংকটকে সামনে রেখে মন্ত্রিসভার এ বৈঠক ডেকেছি। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে বুজুমবুরায় বেশ কিছুদিন ধরে হত্যা, অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে। এ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যাবে বিশেষ করে মুসলি- মরা এই হত্যা, অপহরণের শিকার হচ্ছে। আরেকটা উদ্বেগজনক বিষয় হলো প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্ররাই হত্যা, অপহরণের শিকার বেশি হচ্ছে, আমরা প্রথমে মনে করেছি, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক নানা কারণে এই সব ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এখন একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা ভয়াবহ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মুসলমানদের অধিক হারে ধর্মান্তরিত করা এবং শিক্ষা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের মুসলিম প্রতিভাকে ধর্মান্তরিত করা, তা না পারলে তাদের হত্যা করাই এই পরিকল্পনার লক্ষ্য। সন্ত্রাসী চরিত্রের একটা বড় খ্রিস্টান সংস্থা এর সাথে জড়িত। দুঃখজনকভাবে স্থানীয় খ্রিস্টান সংগঠন ও সংস্থা তাদের সহযোগিতা করছে। গতরাতের ঘটনা আপনারা জেনেছেন। এই ঘটনায় একজন প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্রকে কিডন্যাপ করে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পুরানো ভবনে তোলা হয়। তাকে উদ্ধারে সামান্য দেরি হলে ছেলেটিকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। গতরাতের এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে হত্যা, অপহরণের ঘটনার সাথে যারা জড়িত, তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, এই অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন অপরাধীদের গ্রেফতার ও তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এখানে আরেকটা কথা বলা দরকার অপরাধীদের পরিচয় বের করা, তাদের চিহ্নিত করা, তাদের হাত থেকে তাদের কিছু শিকারকে বাঁচানোর কাজে আবু আব্দুল্লাহ নামক একজন লোক আমাদের সাহায্য করেছে। তার সাহায্য না পেলে আসুমানি পরিবারের একজনসহ চাওসিকোকে বাঁচানো যেত না এবং অপরাধীদের পরিচয় চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এখন আমরা যে সংকটে পড়েছি, সেই সংকটটা হলো, আজ বেলা একটার দিকে মধ্য আফ্রিকা ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি, পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস- চ্যান্সেলর এবং গোপন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংস্থা ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা দুটি দাবি করেছেন, এক. আগামী দুই দিনের মধ্যে আবু আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে অথবা আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বুরুন্ডি থেকে বহিষ্কার করতে হবে, দুই. হত্যা, অপহরণের সব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রচার করতে হবে এবং প্রকৃত যা ঘটেছে, তাকে চাপা দিতে হবে। এই দুই দাবি যদি যথাসময়ে মানা না হয়, তাহলে আগামী চারদিনের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানো হবে। মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবর্গ এই আল্টিমেটামের মুখে আমাদের কি করণীয়, সে বিষয়ে আলোচনা ও মতামত দেয়ার জন্যে আপনাদের আহ্বান করছি। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’ থামল প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রিসভার সদস্যদের চোখে-মুখে অস্বস্তি। নীরব তারা। সবাই ভাবছে।
নীরবতা ভাঙল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টর ভেনান্ট কামানা। বলল, ‘আবু আব্দুল্লাহ লোকটি কে? আমরা যা পারছি না, সে তা করছে কেমন করে?’
‘সে একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সে ভিভিআইপি পাসপোর্ট হোল্ডার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং আরও কিছু দেশ তাকে সহযোগিতার জন্যে আমাদের অনুরোধ করেছে। সাম্প্রতিক হত্যা, গুম, অপহরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে সে আগ্রহী। নিজ ইচ্ছায় না, হঠাৎ করেই সে এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টা জানেন। বলল প্রধানমন্ত্রী। ‘বাইরে থেকে যোগাযোগের বিষয়টা আমি জানি না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এটা হয়নি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘বাইরের সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা আমাদের রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেছেন।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি যে সমস্যা বা সংকটের বিষয় সামনে এনেছেন, তা আমাদের সরকারের জন্যে খুবই বিপজ্জনক। দেশের খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের সাথে আমাদের বিরোধ বাধলে আমাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা যে আলটিমেটাম দিয়েছে, সেটা কোনো শূন্যগর্ব আস্ফালন নয়। তারা যা বলেছে, তা করার শক্তি তাদের আছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট মত দিয়েছেন, এ জন্যে ধন্যবাদ। তবে খ্রিস্টান পক্ষ, যারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসেছিল, তারা যে অপরাধ করেছে, যে অপরাধের স্বীকৃতিও তারা দিয়েছে, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলেননি। তারা পরিষ্কার বলেছে, তাদের অপরাধ আমাদের ধামাচাপা দিতে হবে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবি মোনিমপা।।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই অর্থমন্ত্রী পল মার্টিন নিভিয়াবাদী বলে উঠল, ‘এ ধরনের ধামাচাপা দেয়া কাজটা অনৈতিক, আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এটা একটা বড় অপরাধ। কিন্তু অনেক সময় কিল খেয়ে কিল হজম করতে হয়। আমাদের সরকারকে রক্ষার জন্যে এটা আমাদের হজম করতে হবে। আরেকটা কথা, সব দোষ খ্রিস্টান সংস্থাগুলো করেনি, তার দায় তারা নেবার প্রশ্নও উঠে না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান রোজ-এর হত্যাকাণ্ডের দায় পূর্ব কঙ্গোর একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ স্বীকার করেছে। এ দায় তো খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের উপর চাপানো যায় না।’
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সম্মানিত রাজনীতিক মাননীয় অর্থমন্ত্রী হেনরি বুফোর্টদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত বক্তব্য- শুরুর দিকের অবস্থা সম্পর্কে কঙ্গোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যে তদন্ত হয়েছে, তাতে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের বিষয়টা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের এ হত্যাকাণ্ডের দায়ও পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট খ্রিস্টান সংগঠনের উপর বর্তায়। যে দিন হেনরি বুফোর্টরা নিহত হয়, তার আগের রাতে হেনরি বুফোর্টকে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরের দিন বিকেল পর্যন্ত সে হাসপাতালে ছিল। তারপর সে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পরপরই সে খুন হয়। কি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তাকে কি ওষুধ দেয়া হয়েছিল, প্রেসক্রিপশন ও হাসপাতালের রেকর্ডে তার অসুস্থতা সম্পর্কে লিখা হয়েছিল, তার কিছুই পাওয়া যায়নি। হেনরি বুফোর্টের হাসপাতালে ভর্তির সব রেকর্ড গায়েব করে ফেলা হয়েছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তার কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট নেই।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারো বলল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা ঘটনার এত ডিটেইলে গেলে আমরা আরও বিপদে পড়ব। বিবেকের দায়বদ্ধতা আরও বাড়বে। আমি মনে করি, বিষয়টা অত্যন্ত পরিষ্কার। খ্রিস্টান সংস্থাগুলো বলা যায় তাদের অপরাধ তারা স্বীকার করেছে। অপরাধী না হলে তারা অপরাধ ধামা-চাপা দিতে বলবে কেন? এখন আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, আমরা তাদের অপরাধ ধামাচাপা দেব কিনা এবং আবু আব্দুল্লাহকে বহিষ্কার, অথবা তাদের হাতে তুলে দেব কিনা। তাদের হুমকিকে আমরা ভয় করব কিনা?’
শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রীর কথার পর অধিকাংশ মন্ত্রী প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, ‘শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। এ বিষয়েই আলোচনা হোক। অর্থমন্ত্রী প্রধান রাজনীতিক পল মার্টিন আবার কথা বলল, ‘আলোচনাটা আরও সংক্ষেপ করার জন্যে আমি একটা কথা বলতে চাই। প্রকাশ্য ও গোপন খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনগুলোর সাথে বিরোধ করে আমরা সরকার পতনের ঝুঁকি নিতে যাব কিনা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সকলের মত নিতে পারেন।
‘প্রধানমন্ত্রী সকলের দিকে তাকাল। বলল, ‘অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। এ বিষয়ে সকলের মত এলে পরবর্তী কাজ সহজ হয়ে যায়। ‘আমরা সরকার পতনের ঝুঁকি নিতে যাব কি যাব না’ প্রথমে আপনারা এ বিষয়ের উপর আপনাদের মত বলুন।’
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ছাড়া সকলেই ঝুঁকি নিতে যাব না’-এর পক্ষে মত দিল।
তরুণ একজন মন্ত্রী বলল, ‘আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তারা দেশের আইন ও বিচারকে ধুলায় লুটিয়ে দিতে চাননি। আমি ঝুঁকি না নেয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছি, কিন্তু আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তে গর্বিত। আমাদের সরকারের উপর ঝুঁকি আসবে না, কিন্তু অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বিচার হবে, এটা আমি চাই।
প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন আপনারা?’
‘তরুণ মন্ত্রী এনডি কুমাসা কিছুটা বলে দিয়েছে আমাদের কথা। আমরাও বুঝি, সবাই একটা মজবুরি থেকে এই মত দিয়েছে। বলল আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা তাদের অপরাধ চাপা দিতে পারি, কিন্তু আবু আব্দুল্লাহকে কোনো অবস্থাতেই ওদের হাতে দিতে পারি না এবং তাকে বুরুন্ডি থেকে বহিষ্কারও আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এখন এ বিষয়ে আপনাদের মত বলুন।’
সেই তরুণ মন্ত্রী এনডি কুমাসা বলল, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে একমত। মি. আবু আব্দুল্লাহকে বহিষ্কার করার কোনো কারণ আমাদের কাছে নেই। বরং তিনি আমাদের অশেষ উপকার করেছেন। খুন, কিডন্যাপ-এর ধাঁধাকে তিনি মোটিভসহ অপরাধীদেরকে অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে নিয়ে এসেছেন। এজন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন।’
আলোচনায় এলো আবার অর্থমন্ত্রী। বলল, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আমাদের তরুণ মন্ত্রীর কথায় আবেগের প্রাবল্য থাকলেও তিনি কথাটা সত্য বলেছেন। তবে মি. আবু আব্দুল্লাহকে পুরস্কৃত করার দরকার নেই। উভয়কূল রক্ষা করার জন্যে আমাদের একটা মধ্যবর্তী পথ বেছে নিতে হবে। আমার মতে খ্রিস্টান সংগঠনকে বলা হোক, আমরা তাদের ব্যাপারে নীরব থাকব। খুন, কিডন্যাপের কেসগুলোর ব্যাপারে আমরা আগের মতো রুটিন তৎপরতার বাইরে কোনো কিছু করতে যাব না। অন্যদিকে আবু আব্দুল্লাহর ব্যাপারেও আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারব না। তাকে আমরা কোনো প্রকার সহায়তাও করব না। আপনারা তাকে কিছু করতে পারলে করবেন, আমরা সেদিকে তাকাব না। ঠিক এই ধরনের কথা আমরা আবু আব্দুল্লাহকেও বলব। রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা ও অপারগতার কারণে খুন, কিডন্যাপের কেসগুলো নিয়ে সামনে আগানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি নিজে যদি কিছু করেন, করতে পারেন, তাতে আমরা বাধা দেব না, সহায়তাও করতে পারব না।’
অর্থমন্ত্রী কথা শেষ করলেও সংগে সংগে কোনো কথা কোনো দিক থেকে এলো না। সবাই নীরব
প্রধানমন্ত্রী তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর দিকে।
তারাও কিছু বলল না।
অবশেষে মুখ খুলল প্রধানমন্ত্রীই। বলল, ‘আমাদের অর্থমন্ত্রী ও প্রধান রাজনীতিক পল মার্টিন উভয়কূল রক্ষা করে সংকট সমাধানের যে প্রস্তাব করেছেন, সে ব্যাপারে আপনাদের সকলের মতামত আহ্বান করছি।’
সকলেই হাত তুলে অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন করে বলল, ‘আমরা মনে করি আমাদের বর্তমান অবস্থায় এটাই সর্বোত্তম সমাধান।’
মন্ত্রিসভার দূরবর্তী এক প্রান্ত থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারোর কণ্ঠ ভেসে এলো।
ইম্মাকুলি নাহারো হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলা।
এই মন্ত্রিসভায় আরেকজন মুসলিম মন্ত্রী আছে। তার নাম ইব্রাহিম ইউজেয়ি।
দুই মুসলিম মন্ত্রীই ক্ষমতাসীন হুতু প্রভাবিত দল থেকে নির্বাচিত। তুতসি প্রভাবিত দল থেকেও দু’জন এমপি রয়েছে।
ইম্মাকুলি নাহারো বুরুন্ডির কারুরুই গোত্রের প্রবীণ রাজনীতিক মাহমুদু কারুরুই-এর মেয়ে। সে জাঞ্জিবার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে মেডিকেল সাইন্সে। বুজুমবুরা মেডিকেল কলেজের সে একজন অধ্যাপিকা।
ইম্মাকুলি নাহারো বলল, ‘মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব সংকট উত্তরণের জন্যে সর্বোত্তম সন্দেহ নেই। এতে আমাদের সরকার সংকট থেকে বাঁচবে, অপরাধীরাও অপরাধের দায় থেকে বাঁচবে। কিন্তু অপরাধীদের বন্দুকের নিশানায় থাকা বিপদগ্রস্ত মানুষদের কি হবে? আসুমানি পরিবার এবং চাওসিকো, অবিউলা আমাদী ও হেনরি বুফোর্টের পরিবার বিচারের জন্যে কোথায় যাবে? আমরা তাদেরকে কি বলব? আমার মনে হয় এ নিয়েও আমাদের কিছু চিন্তা হওয়া দরকার।’
থামলো ইম্মাকুলি নাহারো।
অর্থমন্ত্রী দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ পল মার্টিনের স্পিকার স্ট্যান্ডের লাল সংকেত জ্বলে উঠল। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সে কথা শুরু করল। বলল, ‘সম্মানিতা মন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারো যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছেন, তার কোনো জবাব আমার কাছে বা কারো কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা অপরাধীদের শর্ত যে মেনে নিয়েছি, সেটাই প্রমাণ করে আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমার ভাবতে খুব খারাপ লাগছে যে, আমি ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে খ্রিস্টান। মন্ত্রিসভার মেজরিটি সদস্যই খ্রিস্টান। এ থেকে এ ভাবনা আসতে পারে যে, আমরা খ্রিস্টান বলেই খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের মারাত্মক অপরাধকে আমরা আড়াল করতে চাচ্ছি, অপরাধীদের অন্যায় এবং আইন-সুবিচার বিরোধী শর্ত আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। অন্তত বলতে পারি আমার মনে খ্রিস্টান অপরাধীদের প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব নেই। তাদের…’
অর্থমন্ত্রীর কথার মাঝখানেই কয়েকজন মন্ত্রী সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমরা খ্রিস্টান হলেও আমাদের মনেও তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব নেই।’
এই সমস্বর কণ্ঠের সাথে মাত্র জনা চারেক খ্রিস্টান মন্ত্রী তাদের কণ্ঠ মিলায়নি।
অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদ দিয়ে তার কথা আবার শুরু করল। বলল, ‘তাদের অপরাধ আমরা ধামাচাপা দিয়েছি, কিন্তু সব কাজ আমরা বন্ধ করে দেইনি। আমার প্রস্তাব হলো, অ্যাফেক্টেড পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখা দরকার। তাদের জন্যে কিছু করা উচিত। আর মামলার চলমান গতি চালু রাখা দরকার। চাওসিকোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের সাথে আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি। তাদের যেসব সমস্যার কথা তারা কোথাও বলতে পারে না বা বলার সুযোগ পায় না, সেসব কথা আমাদের শোনা দরকার।’
মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন করল।
প্রধানমন্ত্রী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘আমরা যে সংকট বিষয়ে আলোচনার জন্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছিলাম, তার কোনো ন্যায়ানুগ সমাধান আমরা করতে পারছি না। সে শক্তি, সে সুযোগ আমাদের নেই। আমরা যে হুমকির কাছে নতিস্বীকার করলাম, সে রকম নতিস্বীকার আমাদের আফ্রিকার অনেক দেশের ভাগ্যে লেখা। একথা তিক্ত হলেও সত্য যে, খ্রিস্টান মিশনারী ও তাদের বিভিন্ন রকম সংস্থা-সংগঠন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ তাদের সহায়তায় রয়েছে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। সুতরাং আমাদের নতিস্বীকারকে যদি আমরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে দুঃখের মধ্যে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাব। আমি মনে করি ঈশ্বর কারও পক্ষে নয়, ন্যায়ের পক্ষে। আমি মন্ত্রিসভার সম্মানিতা সদস্য ইম্মাকুলি নাহারোকে ধৈর্যধরার অনুরোধ করছি। অসহায়দের যখন করার কিছু থাকে না, তখন, আপনারা যাঁকে আল্লাহ বলেন, আমরা যাঁকে ঈশ্বর বলি, তিনি সক্রিয় হন। মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত অর্থমন্ত্রী উভয়কূল রক্ষার জন্যে সংকটের সমাধানে যে প্রস্তাব করেছেন, সেটাকেই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হলো।’ সকলকে ধন্যবাদ।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ হলো।
.
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ডাইনিং-এর পাশের সে বৈঠকখানায় ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে।
তার ইজি চেয়ারের পাশে ট্রলিতে রয়েছে তার বিকেলের নাস্তা।
আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী বৈঠকখানার সোফায় বসে আছে। তাদের সামনেও নাস্তার প্লেট।
‘বাবা আপনি না খেলে তো আমরা খেতে পারছি না। নাস্তা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বাবা।’ বলল আসমানি আব্দুল্লাহর স্ত্রী।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ উঠে বসতে বসতে বলল, ‘মোটেই খেতে ইচ্ছা নেই মা। রাতে আহমদ মুসার কাহিনী শোনার পর ক্ষুধা তৃষ্ণা সব যেন উঠে গেছে। সারা জীবন তো শুধু খেয়েই গেলাম। জীবনে কারও জন্যে তেমন কিছুই করিনি, গায়ে একটা আঁচড়ও লাগাইনি। আর আহমদ মুসা নিজের জন্যে নয়, কোনো আত্মীয় বা স্বজনের জন্যে নয়, একেবারেই পরের এক অযাচিত কাজের জন্যে বেরিয়ে গিয়ে গুলি খেয়ে ফিরে এলো। সে প্রতিপক্ষের সতেরোজনকে মেরেছে একথা ঠিক, কিন্তু তার বাহুতে লাগা গুলিটা যদি আর কয়েক ইঞ্চি ডানে লাগত, তাহলে সেও সেই সতেরোজনের মতো একজন হয়ে যেত পারত। কথাটা আমি ভুলতে পারছি না মা। এর মধ্যে সে আবার বাইরে গেল আহত অবস্থায়। এখন তো সাড়ে পাঁচটা বাজে কখন ফিরবে সে! মনে করছি সে ফিরলে এক সাথেই নাস্তা করব।’
‘চিন্তা করবেন না বাবা, আল্লাহ আছেন। আল্লাহর হাজার শোকর যে তার সাথে সাদিয়া ও আমরকে দেয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর জরুরি টেলিফোন পেয়ে নিজেই ড্রাইভ করে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। আপনার ছেলে বাসায় নেই, আপনিও সবে ঘুমিয়েছেন। আমি সাদিয়াকে পাঠিয়েছিলাম আহমদ মুসাকে এটা বলার জন্য, আহমদ মুসা আহত হাত নিয়ে নিজে ড্রাইভ না করে সাদিয়াকে যেন নিয়ে যায়। আহমদ মুসা বলেছিল, না তার তেমন কিছুই হয়নি। ড্রাইভ করতে বা অন্য কোনো কাজে তার তেমন কোনো অসুবিধাই হবে না। শেষ পর্যন্ত আমাকেই বলতে হয়েছিল। আমি গিয়ে বলেছিলাম, বাবা তোমাকে ড্রাইভ করতে দেব না এবং ভাড়া গাড়িতেও তোমার যাওয়া হবে না। এই অবস্থায় যদি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে তোমাকে যেতেই হয়, তাহলে গাড়ি সাদিয়া ড্রাইভ করবে। মায়ের এটাই সিদ্ধান্ত বেটা। সে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। তবে সে বলে যে, মায়ের সিদ্ধান্তের পরে আমার একটা সংযোজন আছে। সেটা হলো, আমর আসুমানি মোহাম্মদকে আমাদের সাথে যেতে হবে। দু’জন সাথে থাকায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে বাবা। তাদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই ইনশাআল্লাহ। আপনি খেয়ে নিন বাবা।’
‘ধন্যবাদ মা। তুমি ভালো করেছ। আহমদ মুসা ছেলেটা নিজের ব্যাপার নিয়ে কোনো সময়ই চিন্তা করে না। কিন্তু আমাদের তো দায়িত্ব আছে তার প্রতি।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘বাবা আহমদ মুসাকে আল্লাহ বোধ হয় বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তার গুলিটা লেগেছিল বাহুর গোড়ার পেশিতে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন, গুলিটা ভেতরে ছিল না। কিন্তু বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করে বেরিয়ে গেছে গুলিটা। এ ক্ষত নিয়েই সে সেদিন রাতে আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রাখা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়াসহ অনেক কাজ করেছে। গাড়ি চালিয়েই সে এ বাড়িতে এসেছে। আমি তাকে দরজা খুলে দিয়েছি। তাকে দেখেছিলাম একদম হাসিখুশি অবস্থায়। তার বাহু এবং পোশাকে রক্ত দেখে আমি আঁতকে উঠি এবং কম্পিত কণ্ঠে বলি, তুমি কি আহত বাবা? কোথায় কি হয়েছে? সে বলে, তেমন কিছুই না, গুলি লেগেছিল। ভাববেন না এসব নিয়ে। ভালো তুলা থাকলে আমাকে একটু তুলা এনে দিন। ব্যান্ডেজ মেডিসিন আমার কাছে আছে। আমি ছুটে আসি ভেতরে। দরজার এ পারেই দাঁড়িয়েছিল আমর ও সাদিয়া। আমাকে দেখেই সাদিয়া বলল, গুলির ক্ষত খুব জটিল হয়। তিনি একা এর ড্রেসিং করতে পারবেন না। আমার এ ব্যাপারে ট্রেনিং আছে। আমি এবং আমর ড্রেসিং করে দেব। আমি তুলা নিয়ে গিয়ে তাকে সাদিয়ার কথা বললাম। শুনে হাসল আহমদ মুসা। বলল, এ রকম ড্রেসিং আমাকে বহু বার করতে হয়েছে। আপনারা কেউ চিন্তা করবেন না আমাকে নিয়ে। শেষে আহমদ মুসা এটুকুতে রাজি হয় যে, আমি তার পাশে থাকব। বাবা আমি তার ড্রেসিং করাটা দেখেছি। আমি হলে ঐ ধরনের ক্ষত স্থানে হাত দিতে পারতাম না, কেউ হাত দিলে চিৎকার করে বাড়ি ফাটাতাম। কিন্তু ক্ষত পরিষ্কার ও ড্রেসিং করার সময় তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখিনি।
সর্বক্ষণ তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। বাবা, তিনি আমাদের মতো মানুষ নন বাবা।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আল্লাহর সৈনিকরা এমনই হয় আব্দুল্লাহ। তাদের তাওয়াক্কুল আল্লাহর উপরে। আর আল্লাহর উপরে ভরসা থাকলে সে সব দুঃখ-বেদনাকে জয় করতে পারে। তাছাড়া কুরআন মজিদে আছে, শহীদদের কষ্ট-যন্ত্রণা আল্লাহ লাঘব করে দেন। শহীদদের ক্ষেত্রে এটা হলে-আল্লাহর জীবন্ত সৈনিকদের দুঃখ-কষ্টও আল্লাহ লাঘব করতে পারেন।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
হলো না বলা। ঘরে প্রবেশ করল সাদিয়া এবং আমর।
খুশি হলো ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘সাদিয়া বোন, আমার কাছের এ সোফাটায় বসো। তোমাদের এত দেরি হলো কেন? প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক তো এত দীর্ঘ হয় না।’
‘দাদাজী, প্রধানমন্ত্রীর ওখানে উনি আধাঘণ্টা বসেছিলেন। পরের এক ঘণ্টা তিনি কাটিয়েছেন আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে। রাতেই ওদের দু’জনের বিয়ে হয়েছে। আর…’
‘কি ব্যাপার এই রাতেই ওদের বিয়ে হয়েছে? এই বিপদের মধ্যে?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ সামিরা সাদিয়ার কথার মাঝখানে।
‘হ্যাঁ, বাবা, বিয়েটাও জরুরি বিষয় ছিল।’ বলে ঘটনার যেটুকু সে জানত বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ আহমদ মুসাকে। কঠিন বিপদের জটিল মুহূর্তেও ইসলামী নীতিমালা থেকে এক চুল সে নড়েনি। একজন বয়স্ক মেয়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো তার পিতার বাড়ি, অথবা স্বামীর বাড়ি। আনা আরিয়া যখন পিতার বাড়িতে থাকতে পারছে না, তখন স্বামীর বাড়িরই ব্যবস্থা করেছে আহমদ মুসা। আশ্চর্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং একজন বড় খ্রিস্টান নেতার মেয়েকে কীভাবে আহমদ মুসা চাওসিকোর সাথে বিয়ে দিল!’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘দাদাজী, তিনি বন্দুক দিয়ে যেমন অসাধ্য সাধন করতে পারেন, তেমনি তিনি কথা দিয়েও তা পারেন। কিন্তু দাদাজী, স্যার যখন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তাকে প্রসন্ন মনে হয়নি। আবার চাওসিকো আনাদের ওখানেও তাকে খুব ব্যস্ত এবং কিছুটা চিন্তান্বিত মনে হয়েছে। চাওসিকোরা যেখানে থাকছে, সেখানে চাওসিকোর পিতামাতাসহ বাইরের সকলের আসা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। সারাক্ষণই তার চোখে-মুখে সেই চিন্তান্বিত ভাবটা ছিলই। তিনি গাড়িতে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে চলার যখন নির্দেশ দিলেন, তখন আমি বলেছিলাম, ‘সব কাজ ঠিকমত হয়েছে স্যার?’
‘কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক সেটা আল্লাহ জানেন। এখন যেটাকে আমার কাছে খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে, তার মধ্যেই হয়তো আল্লাহ আমাদের জন্যে কল্যাণ রেখেছেন। জবাবে স্যার গম্ভীর কণ্ঠে একথাগুলো বলেছিলেন।’ বলল সাদিয়া।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ইজি চেয়ারে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘আমর ভাই, তুমি একটু দেখ। আহমদ মুসা ফ্রেশ হয়ে থাকলে এখানে তাকে নিয়ে এসো। এখানেই সে নাস্তা খাবে। তার কথাও আমরা শুনব। প্রধানমন্ত্রীর ওখানে কি হলো তা শোনার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে।’
কথাটা শেষ করে ইদি আসমানি তাকাল নাতনি সাদিয়ার দিকে। বলল, ‘তোমরা দুই ভাই বোনও তো নাস্তা করনি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।’
দশ মিনিট পর। আহমদ মুসা ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে এসেছে। তাকে নাস্তা দেয়া হয়েছে। আমরও নাস্তা খেয়েছে।
আহমদ মুসা আসার পর মেয়েদের অংশকে আলাদা করার পর্দাটা উঠেছে। পর্দার ওপারে সাদিয়া ও অন্যান্য মেয়েরা বসেছে।
আহমদ মুসার নাস্তা শেষ হলে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার এখন রেস্ট নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কি করব আমি, আমরা যে তোমার কথা শোনার জন্যে অস্থির। কথাগুলোর সাথে আমাদের ভাগ্যও তো জড়িত থাকতে পারে! তোমার আহত অবস্থার কথা জেনেও প্রধানমন্ত্রী তোমাকে ডাকায় আমার মনে হয়েছে জরুরি কিছু বিষয় ছিল নিশ্চয়। সবকিছু বলো আহমদ মুসা?’
‘আপনার ধারণা সত্য জনাব। প্রধানমন্ত্রী যা বলার জন্যে ডেকেছিলেন, সেটা খুবই জরুরি।’
বলে একটু থামল। সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাম্প্রতিক হত্যা, কিডন্যাপের সাথে যারা জড়িত, সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে না। সরকার নীরব থাকবে। এই ব্যাপারে আমাকেও তারা কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। সেই সাথে আমার বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো সহযোগিতাও সরকার অপরাধীদেরকে করবে না। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত জানাবার জন্যেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকেছিলেন।’
‘তার মানে লড়াইটা এখন চলবে তোমার ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে। আর সরকার দর্শকের মতো লড়াইটা অবলোকন করবে। উত্তরে তুমি কি বলেছ ভাই? তোমার জবাব এটাই হওয়া উচিত ছিল যে, তোমাদের দেশ, তোমাদের জনগণকে নিয়ে আমার কি দায় পড়েছে যে, আমি তোমাদের অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাব। আমি চললাম এসব থেকে দূরে।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। গম্ভীর, বেদনার্ত তার কণ্ঠ।
‘আমি এ জবাব দিতে পারিনি জনাব। কারণ লড়াইটা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে, হক ও বাতিলের মধ্যে এবং মজলুম ও জালেমের মধ্যে। মজলুম যে দেশেরই হোক সে মজলুম এবং জালেম যেখানেই বাস করুক সে জালেম। সুতরাং জুলুম যেখানেই ঘটুক, অন্যায়-অসত্যের সয়লাব যেখানেই চলুক, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের জন্যে অপরিহার্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আহমদ মুসা তুমি তোমার মতোই কথা বলেছ। ইনসাফের কথা এটাই। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি একা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘একা নয়। সাথে আল্লাহ আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। এই ঈমান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দিন।’ একটু থামল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল আবার, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তের পিছনে নিশ্চয় খ্রিস্টানদের চাপ রয়েছে। তাদের চাপে সরকার এত বড় জঘন্য সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারল আহমদ মুসা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘বুরুন্ডিতে খ্রিস্টানরা কাগজে-কলমে সংখ্যাগরিষ্ঠ। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো এখানে শক্তিশালী। তার উপর বাইরের খ্রিস্টান শক্তি, এমন কি বাইরের খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এদের সহযোগী। বুরুন্ডির রাজনীতিতেও তারা খুবই প্রভাবশালী। জাতীয় পরিষদ ও সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তারা যে কোনো সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতা করে ফেলতে পারে টাকা ও শক্তির জোরে। এটাই ঘটেছে। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো হুমকি দিয়েছে তাদের শর্ত সরকার না মানলে তারা সরকারের পতন ঘটাবে। সুতরাং অসহায় হয়ে পড়েছে সরকার। আমাকে এটাই তারা বলেছে। সেই সাথে বলেছে সরকারের বিপদের চেয়ে আমার বিপদ নাকি আরও বেশি। যে কোনো মূল্যেই তারা আমাকে ধরার অথবা মারার চেষ্টা করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব। সকলের চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ আতংকের গভীর ছাপ।
কথা বলে উঠল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘আহমদ মুসা সরকারকে ঠিক পরামর্শ দিয়েছে। আমরাও মনে করি, দেশ-বিদেশের এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে তুমি একা কি করবে?’
‘তাদের শক্তি আর কতটুকু। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আমি তারই উপর নির্ভর করি, তাঁরই সাহায্য চাই আমি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একথা তোমার মুখেই মানায়। তুমি আল্লাহ্র হতে পেরেছ, তাই আল্লাহ তোমার হবেন, এ কথাই ঠিক। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি এগোবে কীভাবে? ওদের শত চোখ, সহস্র চোখ আর তোমার মাত্র দুটি চোখ। কোথায়, কীভাবে তুমি পথ খুঁজে পাবে, আমি বুঝতে পারছি না।’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘পথ বন্ধ করার ক্ষমতাও আল্লাহর, আবার পথ খুলে দেবার ক্ষমতাও আল্লাহর। সরকারের সহযোগিতা লাভের ফলে যে পথ উন্মুক্ত হয়েছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। বিকল্প পথের ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন। ইতিমধ্যেই একটা পথের দিশা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সে পথেই আমি এগোবো ঠিক করেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি পথ সেটা বলা যাবে?’ ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘আপনাদের তো বলতেই হবে। এই কাজে আমার সামিরা সাদিয়ার সাহায্য দরকার হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সামিরা সাদিয়ার সাহায্য? সে তোমার যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগবে?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু বন্দুক, তলোয়ার নয়, কলমেরও দরকার হয়। সেই কলমেরই একটা সার্ভিস সামিরা সাদিয়া দিতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি রকম?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ-মুখে দারুণ উৎসুক্য।
‘সামিরা সাদিয়াকে সাংবাদিক হতে হবে। আপনারা যাকে যুদ্ধ বলছেন, সেই যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বাপর অবস্থার উপর একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
‘বুরুন্ডির এই যুদ্ধে কাগজের রিপোর্ট দিয়ে কি হবে?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ-মুখ থেকে বিস্ময় যায়নি।
‘ইনশাআল্লাহ কাগজের একটা রিপোর্ট এটম বোমার মতো কাজ করবে?’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
‘এটম বোমার মতো কাজ করবে?’ ঘরের সকলের বিস্ময়-বিজড়িত কণ্ঠ থেকে এই ধ্বনি উচ্চারিত হলো। তাদের সকলের বিস্ফারিত চোখ আহমদ মুসার মুখের উপর নিবদ্ধ।
একটু নীরবতা।
এই নীরবতা ভেঙে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তুমি সত্যবাদী। তাই তোমার এ কথা আমাদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বেশি। ব্যাপারটা একটু খুলে বলো।’
হাসল আহমদ মুসা।
তারপরেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘জনাব, মানুষ এটম বোমা তৈরি করে সুনির্দিষ্ট একটা ফলের আশায়। সে ফল না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে ফল আসবেই। কারণ মানুষ এটম বোমা তৈরি করে, কিন্তু বোমার বিস্ফোরণ ঘটা, ফল দেয়া এটা এককভাবে নির্ভর করে আল্লাহর উপর। আল্লাহ চাইলে ফল দেবেন, না চাইলে ফল দেবেন না। আমি যাকে এটম বোমা বলেছি, সেটারও ফল দেয়া, না দেয়ার মালিক আল্লাহ। সুতরাং আমি মনে করি জনাব, ফল আমরা সকলে চাইব, কিন্তু ফল পাওয়ার আগে আমরা কিছু বলব না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহর হাজার শোকর। বড় একটা শিক্ষা তুমি তুলে ধরেছ। আল্লাহ আমাদের এ শিক্ষা গ্রহণের তৌফিক দিন। কিন্তু আহমদ মুসা, কলমের এটম বোমা কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে আমরা তৈরি করছি এটাও কি আমরা জানতে পারবো না?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘বিনা রক্তপাতে যুদ্ধে জেতার জন্যে আমরা মিডিয়া অস্ত্র ব্যবহার করতে চাচ্ছি। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বুরুন্ডিতে, বিশেষ করে বুজুমবুরায় হত্যা, কিডন্যাপসহ মানবাধিকার লংঘনের যে হাজারো ঘটনা ঘটছে, অসহায়দের উপর ধর্মান্তরকরণ সুকৌশলে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে যেভাবে খ্রিস্টানরা চাপিয়ে দিচ্ছে, উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে যেভাবে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে, এই কাজে যে বিদেশি সন্ত্রাসীদেরও হায়ার করা হয়েছে, এই সব কথা আমরা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চাই মিডিয়া রিপোর্টের মাধ্যমে। এটাই হলো এটম বোমা। এই বোমাকে দয়াময় আল্লাহ নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাহদের জন্যে ফলপ্রসূ করবেন।’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।
আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। সবার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে বিস্ময়ের সাথে এবার আশা আনন্দের দ্যুতি।
এবার নীরবতা ভাঙল আসমানি আব্দুল্লাহ, সামিরা সাদিয়ার বাবা। বলল, ‘জনাব, একি কথা শুনালেন আমাদের! আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহ যদি চান, তাহলে আপনার এ মিডিয়া বোমা এটম বোমার চেয়ে বেশি কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু এমন মিডিয়া রিপোর্ট কি আমাদের সাদিয়া মা লিখতে পারবে?’
‘আমি নিশ্চিত জনাব, রিপোর্টটি খুব ভালোভাবে লিখতে পারবে। সেদিন গাড়ির সিটে ভাঁজ করা দুই সিট কাগজ পেয়েছিলাম। সেটা ছিল দুই সিট কাগজের একটা রিপোর্ট। সেটা ছিল আপনাদের দুই মেয়ে নিহত হওয়া, সামিরা সাদিয়া আক্রান্ত হওয়া, আপনাদের বাড়িতে হামলা হওয়ার উপর একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট। সম্ভবত পুলিশকে দেবার জন্যে যে রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, তার কপি ওটা। রিপোর্টে সাদিয়ার দস্তখত ছিল। বুঝেছিলাম, রিপোর্টটি সাদিয়ার তৈরি। রিপোর্টটা খুব ভালো ও পূর্ণাঙ্গ ছিল। এই ধরনের রিপোর্টে যেসব দিক থাকতে হয়, তার সবই ঐ রিপোর্টে আমি পেয়েছি। বুজুমবুরার ঘটনা-প্রবাহ যাকে আমরা যুদ্ধ বলছি, তার উপরও সাদিয়া একটা ভালো রিপোর্ট তৈরি করতে পারবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সাদিয়া বোন তো পর্দার ওপারেই আছে। তার কথা তো আমরা শুনতে পারি।
একটু থেমে পর্দার ওদিকে তাকিয়ে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ সাদিয়ার দাদা বলল ‘বোন সাদিয়া, সব কথাই তো তুমি শুনেছ। তুমি তোমার মতামত আমাদের বলো।’
‘আসসালামু আলায়কুম। ধন্যবাদ তোমাকে দাদাজী। মুহতারাম স্যারকেও ধন্যবাদ যে, এতবড় কাজ করার ব্যাপারে তিনি আমার উপর আস্থা রেখেছেন। আমি তার মতো করেই বলব, আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সবচেয়ে সুন্দরভাবে সম্পাদনের চেষ্টা করতে পারি, আমার চেষ্টা কি ফল দেবে সেটা দয়াময় আল্লার উপর নির্ভর করবে। এ ব্যাপারে আমার আর একটু কথা, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বুজুমবুরায় যা ঘটেছে, ঘটছে, তার অল্পই জানি আমি। একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরির জন্যে সবকিছুই সামনে থাকা দরকার।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘ধন্যবাদ সাদিয়া। আমি বুজুমবুরার ঘটনার উপর পূর্বাপর একটা ব্রিফ তৈরি করেছি। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে। আরো কোনো কিছু প্রয়োজন হলে, তোমাকে দেয়া হবে। তবে সাদিয়া, হয়তো তোমার খুব কষ্ট হবে, রিপোর্টটা আমার কাল সকালের মধ্যেই দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আপনি যে কষ্ট করছেন, সে তুলনায় একে কষ্ট বলা খুবই হাস্যকর। ইনশাআল্লাহ আপনি সকালেই পাবেন স্যার।’ বলল সাদিয়া।
‘সাদিয়া আরেকটা কথা। তোমার অনুমতি না নিয়েই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড টিভি চ্যানেল ও নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
সামিরা সাদিয়ার তোলপাড় করা বুক আর এক দফা আর্তনাদ করে উঠল! তিনি আমার অনুমতির প্রত্যাশী হবেন কেন! যে কোনো সিদ্ধান্তই তো আমার ব্যাপারে তিনি নিতে পারেন! সাগর কি কোনো দিন ঝরনাধারার মুখপেক্ষী কখনও হয়! এই তোলপাড় করা চিন্তার মধ্যেই সাদিয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ও ব্যক্তিত্ব আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন স্যার। কিন্তু স্যার, যে টিভি চ্যানেল ও নিউজ চ্যানেলের পরিচয় এখনও জানি না, জানলে বুঝব আমি তার আসলেই উপযুক্ত কিনা?’
‘নিউজ মিডিয়া দু’টি কিছুটা নবীন হলেও খুবই জনপ্রিয় নিরপেক্ষ নিউজ কাস্টিং-এর জন্যে। তুমি অবশ্যই নিউজ মিডিয়া দু’টিকে চিনবে। একটি হলো FWTV (Free World TV), অন্যটা WNA (World News Agancy). বলল আহমদ মুসা।
‘এ দু’টি চ্যানেল আমরাও দেখি স্যার। WNA আগে শুধু নিউজ সরবরাহ করত প্রিন্ট, ইলেট্রনিক মিডিয়ায়। কিন্তু এখন নিউজ সরবরাহের সাথে সাথে অনলাইনে নিউজও কাস্টিং করে থাকে। ওদের রিপোর্টগুলো সুলিখিত। এ ধরনের সাংবাদিকতার জন্যে বড় প্রতিভার অধিকারী হতে হয়, বড় সময় পেতে হয় অভিজ্ঞতার জন্যে।’ সামিরা সাদিয়া বলল।
‘আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি বোন। এখন এসব যুক্তি, বিবেচনার সময় নয়। তাহলে কথা রইল আমি রিপোর্টটা কাল সকালে পাচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা তাকাল আমরের দিকে। জ্যাকেটের পকেট থেকে কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজের শিট তাকে দিয়ে বলল, ‘তোমার আপাকে পৌঁছে দাও।
ব্রিফটা পাঠিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘সাদিয়া ঘটনার ধারাবাহিকতা অনুসারে ব্রিফের পয়েন্ট সাজানো হয়েছে। ব্রিফের বটমে দেখবে BBSS আছে। তার উপরে তুমি নাম লিখবে এবং সিগনেচার করবে।’
সাদিয়া ব্রিফটা পেয়ে গেছে।
ব্রিফের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘BBSS লেখাটার নিচে AM-11 লেখা আছে। আমি কি AM-1l ও BBSS-এর অর্থ জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘অবশ্যই। BBSS এবং AM-11 কে তুমি রিপোর্টের ‘কোড’ বা ‘পাসওয়ার্ড’ বলতে পার। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার জন্যে এ দু’টি কোড বা পাসওয়ার্ড অবশ্যই থাকতে হবে। BBSS-এর অর্থ হলো- বুরুন্ডি বুজুমবুরার সামিরা সাদিয়া’ এবং AM-11 অর অর্থ হলো- ‘আহমদ মুসার ১১ নং রিপোর্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এর অর্থ হলো এর আগে আপনার আরও দশটি রিপোর্ট চ্যানেল দু’টিতে গেছে। সামিরা সাদিয়া বলল।
‘হ্যাঁ সাদিয়া, এই অর্থই দাঁড়ায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ক্যামেরুনের ঘটনার উপর রিপোর্ট এইভাবে আপনিই পাঠিয়েছিলেন। সেটাও কি কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন?’ সাদিয়া বলল।
‘সেখানকার আমার এক ছোট ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোনকে দিয়ে লিখিয়েছিলাম। সে এখন ভালো সাংবাদিক হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি এই রিপোর্ট লিখব। সাংবাদিক হিসাবে আমার নামও সেখানে যাবে। কিন্তু আমি তো ভালো সাংবাদিক হতে পারবো না।’ সাদিয়া বলল।
‘দেখ বোন, বিনয়ী হবার অর্থ আল্লাহ যে প্রতিভা, যোগ্যতা দিয়েছেন, তার না-শোকরি করা নয়।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কণ্ঠ কিছুটা কঠোর।
‘আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। মানুষ অনেক সময় নিজেকে নিজে না জানতেও পারে। আপনি যে আশা আমার উপর করেছেন তা আল্লাহ সত্য করুন।’ সাদিয়া বলল। তার কণ্ঠ ভারি এবং কাঁপা শোনাল।
‘আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন। বোন, জাগতিক প্রয়োজন পূরণে আল্লাহ মানুষকে অসীম শক্তি, সীমাহীন প্রতিভা দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব এর ব্যবহার করা।’
‘আল্লাহ তৌফিক দিন। ধন্যবাদ স্যার।’ সাদিয়া বলল।
‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার রিপোর্ট কোড, AM-11, এই রিপোর্টে দিতে হবে কেন? সাদিয়ার রিপোর্ট পেলে ওরা প্রকাশ করবে না?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘দুই কারণে এটা দরকার। রিপোর্টের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা, কারণ সাদিয়া তাদের সাংবাদিক নয়, দুই. সাদিয়াকে আমি সাংবাদিক হিসাবে রিকমেন্ড করছি, এটা তাদের জানানো। এই রিকমেন্ডই সাদিয়াকে তাদের রেজিস্টারড সাংবাদিক বানিয়ে দেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এরপর সাদিয়া তাদের নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে পারবে?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘হ্যাঁ পারবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারবে, তার কোনো পরামর্শ আছে কিনা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘নিউজ হওয়ার মতো সব বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারবে। তবে মজলুম মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঐ দুই নিউজ মিডিয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ ইদি মোহাম্মদের জিজ্ঞাসা।
‘তারা আমার ভাই। আমরা সকলে মজলুম মানুষের স্বার্থে কাজ করছি।
‘ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। বলল ইদি মোহাম্মদ।
‘আমার পক্ষ থেকেও অনেক ধন্যবাদ। বাড়িতে একজন সাংবাদিক পেলাম।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করলো।
চাওসিকোর কল।
আহমদ মুসা তাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বলো চাওসিকো।’
চাওসিকো সালাম গ্রহণ করে বলল, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে স্যার।’
‘কি ভুল চাওসিকো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কল করতে এবং কল রিসিভ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সেই কাজটাই ভুল করে হয়ে গেছে। আনা আরিয়ার মা টেলিফোন করেছিল। মায়ের টেলিফোন দেখে আনা আরিয়া ধরে ফেলেছে। তারপর থেকে সে কাঁদছে আপনার আদেশের অন্যথা হওয়ার জন্যে।’ চাওসিকো বলল।
‘ভুল করে কেউ কাঁদে নাকি? ভুল তো ভুলই। কাঁদতে নিষেধ কর। আর বলো টেলিফোন কলটা কখন হয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দপুরে।’ চাওসিকো বলল।
‘আমাকে অনেক পরে জানালে। যাক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। শোন, তোমরা রেডি হও। দু’জনের কাছে মাত্র দুইটা ব্যাগ থাকবে আর কিছুর দরকার নেই। আনা আরিয়ার মোবাইল থেকে সীম খুলে নিয়ে মোবাইল ফেলে দিতে বল।
তোমরা অপেক্ষা কর আমি আসছি। গাড়িতে বসেই আমি মাগরিবের নামাজ পড়ব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, কোনো কিছুর আশংকা করছেন?’ চাওসিকো বলল তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আনা আরিয়ার বাড়ির কল সন্ত্রাসীরা মনিটর করবে। যদি করে, তাহলে আনা আরিয়ার লোকেশন তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাকে ধরার জন্যে তারা তোমাকে ও আনা আরিয়াকে ধরার চেষ্টা করবে এবং তোমরা যেখানে আছ, সেখানে তারা যেতে পারে। হয়তো কিছুই ঘটবে না, আমি যেটা ভাবছি সেটা আশংকামাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি নিশ্চিত, আপনি ঠিক ভাবছেন স্যার।’ চাওসিকো বলল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি আসছি। আল্লাহ ভরসা। তোমাদের দু’জনকে সালাম।’
বলে আহমদ মুসা রাখল মোবাইল।
তাকাল আহমদ মুসা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং ইদি আসুমানি আবদুল্লার দিকে। আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই আসুমানি আব্দুল্লাহ বলে উঠল, চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সামনে বিপদ দেখছি। আপনি কি ভাবছেন?’
‘ভাবছি, এই মুহূর্তে ওদেরকে ওখান থেকে সরাতে হবে। কোথায় সরাবো সেটাই সমস্যা। ওখানে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলে দেখতে হবে, ওদের কোনো নিরাপদ জায়গা আছে কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার আমার প্রস্তাব, ওদেরকে এখানে নিয়ে আসুন। তাহলে ওখানে গিয়ে জায়গা খোঁজার জন্যে সময় নষ্ট হবে না।’ পর্দার ওপার থেকে বলল সামিরা সাদিয়া।
সাদিয়ার কথা শেষ হতেই তার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহ বলে উঠল, ‘সাদিয়া মা ঠিকই বলেছে ওদেরকে এখানে নিয়ে আসুন।’
‘ভাই আহমদ মুসা, এটাকেই আমার সিদ্ধান্ত হিসাবে ধরে নাও। আমাদের অনেক ঘর পড়ে আছে। নিরাপত্তার বিচারেও তাদের জন্যে এ জায়গাটা ভালো হবে। সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখানে আছ।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ!
‘ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। আপনারা নিজেরা বিপদে থেকেও বিপদগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাদেরকে এর উত্তম যাযাহ দিন।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘তাহলে উঠছি। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সেখানে আমি পৌঁছতে চাই।
‘আপনার সাথে আমি যাচ্ছি। আপনার একটা হাত অসুস্থ। আমি গাড়ি ড্রাইভ করব। আপনি পাশে থাকবেন।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। বাবা আপনি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহ আপনাদের এই অভিযানে বরকত দিন।’ বলল ভেতর থেকে সামিরা সাদিয়া।
‘আমিন।’ বলে উঠে দাঁড়াল আসমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসাও উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনাদের মাধ্যমে আল্লাহ একটা কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছেন…।’
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই তৌফিক দেয়ার জন্যে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’ বলল পর্দার ওপার থেকে সামিরা সাদিয়া।
‘আমরা তাহলে আসি। চলুন জনাব আহমদ মুসা।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ দু’জনেই বেরিয়ে এলো বাড়ির গেট দিয়ে। এগোলো সামনের গাড়ির দিকে
৭
বুজুমবুরা শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এলাকা।
বুরুন্ডির এক নাম্বার জাতীয় সড়কটি এই এলাকার উপর দিয়েই পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে।
কামেংগি বসতি এলাকাটা এক নাম্বার জাতীয় সড়কের উত্তর ধার ঘেঁষে।
কামেংগি এলাকার পূর্ব পাশে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে আছে একতলা একটা সুন্দর বড় বাংলো।
এটাই চাওসিকোর বড় ফুফুর বাসা।
বাড়িতে বাস করে তার বড় ফুফু, ফুফা এবং কয়েকজন কাজের লোক। তার বড় ফুফুর তিন ছেলে, তিন মেয়ে। সবাই দেশের বাইরে, কেউ পড়ার জন্যে, কেউ চাকুরি নিয়ে বিদেশে আছে। চাওসিকোর ফুফা সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। এখন রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়িতে অবসর যাপন করছেন।
তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রশন্ত সড়ক। তিন পাশের বাড়িগুলো একটু দূরে। হাউজিং-এর সব প্লটে বাড়ি হয়নি বলেই জায়গা একটু জনবিরল।
মাগরিবের নামাজ শেষ।
চাওসিকো, আনা আরিয়া প্রস্তুত হয়ে বসে আছে ড্রইংরুমে। ফুফি ও তাদের ফুফাও সাথে বসে আছে।
ফুফা বলছিল, ‘তোমরা টেনশন করো না। সব আশংকাই সত্য হয় না। কিছুই নাও ঘটতে পারে। আল্লাহ ভরসা।’
‘ফুফা, যিনি আশংকা করেছেন, তিনি একটা নিশ্চিত বিষয়কেই আশংকার কভারে বলেছেন। ভয় এখানেই।’ বলল চাওসিকো।
‘কোনো ভয় নেই চাওসিকো। আল্লাহর উপর ভরসা করো।’ চাওসিকোর ফুফা বলল।
‘ফুফা, আমি ভয় করছি আনাকে নিয়ে। সে আমার জন্যে বিপদে পড়েছে।’ বলল চাওসিকো।
‘ফুফাজী, আমি কোনো ভয় করছি না। আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই হবে। আমাদের দায়িত্ব সাধ্যানুসারে সাবধান হওয়া। আমরা সেটার জন্যে চেষ্টা করছি। বাকিটা আল্লাহই করবেন।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ধন্যবাদ মা আনা, আল্লাহর উপর এই ঈমান আমাদের রাখতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ।
বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার তখন আরও গাঢ় হয়েছে।
একটু দূরে দূরে বিজলীর আলো। সে আলো ‘বিদঘুঁটে আলো আঁধারীর সৃষ্টি’ করেছে।
সেই আলো আঁধারীর মধ্যে একটা মাইক্রো এবং দুটো বড় জিপ এসে দাঁড়াল চাওসিকোর ফুফার বাড়ির সামনে। গাড়ি তিনটি রাস্তার পাশে নিয়ে ঘুরিয়ে রাখা হলো ফেরার প্রস্তুতি হিসাবে।
তিন গাড়ি থেকে নামল আট দশজনের মতো লোক। তাদের সকলের মুখে মুখোশ।
বাড়িটা প্রাচীর ঘেরা।
রাস্তা থেকে নেমে তিন চার গজ এগুলেই রাস্তার সমান্তরাল প্রাচীরে বাড়িতে প্রবেশের প্রশস্ত গেট। গ্রিলের গেট ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করা।
ছিটকিনি খুলে মুখোশধারীরা ভেতরে প্রবেশ করল।
গেটটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে বাড়ির সামনে এগিয়ে গেল।
সবার হাতে স্টেনগান।
একজনের হাতে সর্বাধুনিক মডেলের কারবাইন। এই লোকটিই মনে হয় দলনেতা। সে দু’জনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা দু’জন দু’পাশ দিয়ে গিয়ে বাড়ির তিন দিকটা দেখে এসো পেছন দিয়ে বেরুবার কোনো গেট আছে কিনা। তোমরা না ফেরা পর্যন্ত আমরা বাড়ির গেটে অপেক্ষা করছি।’
লোক দু’জন তিন চার মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো।
এবার সকলে এগোলো বাড়ির গেটের দিকে।
দলনেতা লোকটি দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল দরজা লক করা।
লোকটি পকেট থেকে একটা পেন্সিল টর্চের মতো কিছু বের করল।
দেখা গেল টর্চই, তবে সেটা ল্যাসারবিম টর্চ। ওটা দিয়ে অনেক বড় বড় কাজ হয়। দরজার লক তো সেকেন্ডেই হাওয়া করে দেয়া যায়।
ল্যাসারবিম দিয়ে দরজার লক হাওয়া করে দেয়া হলো।
অস্পষ্ট একটা শব্দ করে দরজা লুজ হয়ে গেল এবং জানান দিল যে, দরজা খুলে গেছে।
দরজার পরেই স্বল্প দীর্ঘ প্রশস্থ করিডোর। তার ডান পাশে একটি বন্ধ দরজা। অন্য পাশে খোলা দরজা, ভেতর থেকে মানুষের কথা কানে আসছে।
দলনেতা পেছনে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমরা চারজন আমার সাথে এসো। অবশিষ্টরা করিডোরে দাঁড়াও। দু’দিকেই চোখ রাখবে।’
দলনেতাসহ অস্ত্র উঁচিয়ে পাঁচজন ঢুকে গেল ড্রইং রুমে। চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে দলনেতা বলল, ‘আমরা শয়তান চাওসিকো এবং ভ্রষ্টা আনা আরিয়াকে নিয়ে যেতে এসেছি। তারা আমাদের শিকার। কেউ বাধা দিলে তাকে আমরা নির্দয়ভাবে গুলি করে মারবো।’
চাওসিকো, আনা আরিয়া, চাওসিকোর ফুফা ও ফুফি সকলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। চাওসিকোর ফুফা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে বলল। ‘এরা তোমাদের কি ক্ষতি করেছে, কাউকে কি হত্যা করেছে? কেন তারা তোমাদের হিংসার শিকার হবে।’
‘কারো কথার জবাব দিতে আমরা বাধ্য নই। তবু বলছি, চাওসিকো হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ করেছে। আমাদের প্রভু জেসাসের অবমাননা করেছে। আর আনা আরিয়া আমাদের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জাতির একজন হয়ে সে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। আমাদের সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে দায়ী সে।’
এ পর্যন্ত বলেই দলনেতা তাকাল দু’জনের দিকে। বলল, ‘তোমরা এদের হাত-পা বেঁধে ফেল এবং চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলো গাড়িতে।
চাওসিকোর ফুফা-ফুফি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাদের বাধা দিয়ে বলল। ‘আমরা কোনো কথা শুনব না। আমাদের তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। ঝামেলা করলে কিন্তু অযথাই দুটি বুলেট খরচ করতে হবে আপনাদের জন্যে।’
দু’তিন মিনিটের মধ্যে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে সবাই বেরিয়ে এলো বাড়ির গেট দিয়ে।
ওদিকে আহমদ মুসাদের গাড়ি তখন চাওসিকোর ফুফুদের বাড়ির রাস্তায়।
বাড়ির সামনের রাস্তায় মাইক্রোসহ তিনটি গাড়ি দাঁড়ানো দেখে আহমদ মুসা গাড়ি আস্তে চালানোর জন্যে আসুমানি আব্দুল্লাহকে অনুরোধ করেছে। ‘জনাব সন্ত্রাসীরা আমাদের আগেই মনে হয় পৌঁছে গেছে। আপনি প্লিজ আমার সিটে আসুন। ড্রাইভিং সিটে আমাকে বসতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে।
‘আপনি আহত হাত নিয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘জনাব অনেক সময় প্রয়োজন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়।’ বলল আহমদ মুসা।
সিট চেঞ্জ হলো দু’জনের মধ্যে। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়িটা আর একটু সামনে এগিয়ে নিল যাতে চাওসিকোর ফুফিদের বাড়ির গেট দিয়ে সামনের সব কিছু সে দেখতে পায়।
আহমদ মুসা নাইটভিশন দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে পেল, আট দশজন সন্ত্রাসী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। কারবাইনধারী একজন ও স্টেনগানধারী চারজন- এই পাঁচজন অস্ত্রধারী সামনে। তাদের পেছনে চারজন চাওসিকো, আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসছে। তাদের পেছনে আরও একজন অস্ত্রধারী।
আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে, সেখান থেকে বাড়ির প্রাচীরের গেটটা একশ’ গজের বেশি হবে না। গেটটা খোলা।
আহমদ মুসা পরিকল্পনা করে নিল।
জ্যাকেটের পকেট থেকে এম-১৬ বের করে ডান পাশে সিটের উপর রাখল যাতে ডান হাত সহজেই তা কাছে পেয়ে যায়।
মাঝারি গতির চেয়ে একটু বেশি জোরে গাড়ি চলতে শুরু করে ঠিক রাস্তায় চলা সাধারণ গাড়ির মতোই।
আহমদ মুসার চোখ সন্ত্রাসীদের উপর।
আহমদ মুসা অংক কষে নিয়েছে ঠিক কোন অবস্থায় ওদের উপর আঘাত হানবে যা হবে ওদের জন্যে এক অকল্পনীয় সারপ্রাইজ।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি অব্যাহতভাবে বাড়াচ্ছে।
বাইরের প্রধান গেটটা তখন ২০ গজ দূরে।
সন্ত্রাসীদের সামনের কয়েকজন গাড়ি বারান্দায় নামার সিঁড়িতে পা দিচ্ছে।
‘জনাব আপনি সিটে শুয়ে পড়ে সিট আঁকড়ে ধরুন।’
আসুমানি আব্দুল্লাহর উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলেই আহমদ মুসা গাড়ির স্পিড একদম টপে নিয়ে এলো।
গাড়ি লাফ দিয়ে উঠে বুলেটের মতো ছুটল।
গাড়ি যখন গেটের মুখ বরাবর, তখন সন্ত্রাসী দলটির সামনের কয়েকজন সিঁড়ি ভেঙে গাড়ি বারান্দায় নেমে এসেছে। চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নেয়া চারজনসহ পাঁচজন তখনও সিঁড়িতে আসেনি। সিঁড়ির কারণে তাদের গতি কিছুটা মন্থর হয়েছে।
আহমদ মুসার বুলেটের মতো চলা গাড়ি একটুও গতি না কমিয়ে গেটের মুখে এসে একটা বিপজ্জনক টার্ন নিল বাড়ির গাড়ি বারান্দার দিকে। ক্যাচ করে একটা তীক্ষ্ম, প্রচণ্ড শব্দ তুলে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল গাড়িটি। কিন্তু গতি একটুও কমেনি। বুলেটের মতো ছুটছে গাড়ি।
গাড়ির শব্দে সন্ত্রাসীরা পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল।
তাকিয়েই আতংকে সবার চোখ বিস্ফারিত। ঝড়ের গতি নিয়ে একটা গাড়ি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
দেখা ছাড়া তাদের করার কিছুই ছিল না।
তারা সরে দাঁড়াবারও সময় পেল না।
গাড়ি পিশে ফেলল সন্ত্রাসীদের সামনের কয়েকজনকে।
গাড়ি সন্ত্রাসীদের আঘাত করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আহমদ মুসা হার্ড ব্রেক কষে ছিল। সিঁড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার আগেই গাড়ি থেমে গিয়েছিল। গাড়ি থামার মুহূর্তেই আহমদ মুসা তার এম-১৬ নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
পেছনের সন্ত্রাসীদের আতংকিত ও বিমূঢ় ভাব তখনও কাটেনি।
চাওসিকো ও আনা আরিয়া তাদের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের হতে দেখে সন্ত্রাসীদের হাত নড়ে উঠেছিল। তাদের স্টেনগানে হাত দিয়েছিল এবং স্টেনগানের ব্যারেল আহমদ মুসার দিকে তাক করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল।
‘বাঁচতে চাইলে স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে…।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। ওদের স্টেনগানের ব্যারেল আহমদ মুসার দিকে উঠে আসতে দেখল।
আহমদ মুসার কথা থেমে গেল।
এম-১৬ এর ট্রিগারে আহমদ মুসার ডান তর্জনি চেপে বসল।
এম-১৬ ঘুরে এলো সন্ত্রাসীদের উপর দিয়ে।
পাঁচটি দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল মুহূর্তেই।
আহমদ মুসা এগোলো চাওসিকো ও আনা আরিয়ার দিকে।
বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো চাওসিকোর ফুফা ও ফুফি।
চাওসিকোর ফুফি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর তুমি ঠিক সময়ে এসেছ বেটা। একটু দেরি হলে আমার চাওসিকো ও আমার আন্না মা’র সর্বনাশ হয়ে যেতো। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন।’
চাওসিকোর ফুফা চাওসিকো ও আনা আরিয়ার বাঁধন খুলে দিয়েছে।
চাওসিকো এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্নাচাপা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার বাঁচার আশা আমি’ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন।’
আনা আরিয়া আহমদ মুসার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, আল্লাহর এত দয়ার কৃতজ্ঞতা তাকে জানাব কীভাবে। সে যোগ্যতা তো আমার নেই।’
‘খুব সহজ বোন। আখেরাতে তাঁর সামনে দাঁড়াবার জন্যে যত ভালোভাবে তৈরি হবে, তাঁর পুরস্কার জান্নাত লাভের জন্যে নিজেকে যত ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলবে, তত বেশি তিনি খুশি হবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চাওসিকো দেখো, আনা আরিয়ার কাপড়-চোপড় কোথায়। তাঁকে ঠিক করো। আমরা এখনি বেরুব।’
এবার আহমদ মুসা গাড়ির পাশে দাঁড়ানো আসমানি আব্দুল্লাহকে দেখে চাওসিকোর ফুফা-ফুফিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ইনি জনাব আব্দুল্লাহ। আমি তাদের মেহমান। চাওসিকো ও আনা আরিয়া এদেরই মেহমান হবেন।
চাওসিকো ফুফা-ফুফি আসুমানি আব্দুল্লাহকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা খুশি হলাম। আল্লাহ তাদেরকে, আপনাদেরকে- সবাইকে নিরাপত্তা দিন। তার অনুগ্রহ পাবার চেয়ে বড় কিছু নেই।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। পরিচিত হওয়ায় খুশি হলাম। সুযোগ হলে ইনশাআল্লাহ আপনাদের একদিন নিয়ে যাব।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা চাওসিকোর ফুফা- ফুফিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব যা কিছু যেখানে যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। আপনি পুলিশে খবর দিন। যা ঘটেছে সবই তাদের বলবেন। শুধু মি. আব্দুল্লাহর নাম করবেন না। আমরা যে সেখানে গেছি, সেটাও বলবেন না। আর আমি মনে করি আপনারা কয়েক দিন বাড়িতে না থাকলেই ভালো হয়।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আমরাও সেটাই ভাবছি। পুলিশের সাথে কাজটা আমাদের মিটে গেলেই ইনশাআল্লাহ আমরা শিফট হবো।’
‘ধন্যবাদ। তাহলে অনুমতি দিন আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা
‘ঠিক আছে। আসুন। আল্লাহ আপনাদের, আমাদের সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখুন। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন। মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক আল্লাহ আপনাকে আরও বেশি বেশি দান করুন।’
সালাম বিনিময়ের পর আহমদ মুসারা সবাই বিদায় হলো।
চাওসিকোর ফুফা তার মোবাইলটা হাতে নিল পুলিশকে টেলিফোনের জন্যে।
.
বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা।
ঘরে ঢুকল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান।
বসল স্ত্রীর পাশে। বলল, ‘সেই বিকেল থেকে কাঁদছ। বিকেলের নাস্তা করনি। এখন ডিনারের সময়। এভাবে কাঁদলে কি চলবে? যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে, তাতে আমার তোমার করার মতো কিছুই ছিল না।’
উঠে বসল আনা আরিয়ার মা। তার আলুথালু বেশ। অশ্রুধোয়া মুখ। কিন্তু চোখ ভরা বিক্ষোভ। বলল, ‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তুমি এদেশের খ্রিস্টানদের একজন শীর্ষ নেতা। তুমি তোমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারলে না, বাঁচাতে পারলে না শয়তানদের হাতে পড়া থেকে? ঐ মেয়েটাই তো আমাদের সব। আমাদের সব ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আমাদের সব স্বপ্ন-সাধ তো তাকে ঘিরেই। কেন পারলে না মেয়েটাকে উদ্ধার করতে?’
‘দেখ তোমার মেয়ে চাওসিকোর সাথে গিয়ে আরও খারাপ করেছে। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘না গেলেও তো বাঁচতে দিত না। আমরাও বিপদে পড়তাম। সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে সে দায়ী। এটাই তোমার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ। না গেলেই এ অভিযোগ থেকে সে বাঁচত?’ আনা আরিয়ার মা বলল।
‘কিন্তু গিয়েও তো বাঁচতে পারলো না। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘বাঁচবে কি করে? তুমি তো মেয়ের পক্ষে দাঁড়াওনি। বিদেশ থেকে আসা লোকরা যা ইচ্ছে তাই করবে, এটা তোমরা মেনে নিচ্ছ কেন? কেন তারা চাওসিকোকে কিডন্যাপ করেছিল বিমানবন্দর থেকে? চাওসিকো যদি প্রভু যিশুর অপমান করেই থাকে, তাহলে কি অপমান করেছে দেখে তোমরা বিচার করতে পারতে। অনেক রকমের শাস্তি আছে। তাকে শাস্তিও দেয়া যেত। আর চাওসিকো নিজের ইচ্ছাতে যায়নি, যেতেই তো চায়নি সে।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ শিলা। কিন্তু এখন যুক্তির চেয়ে শক্তির অগ্রাধিকার চারদিকে। বিশেষ করে যাদের বিদেশি বলছ, তারা শক্তি ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘কিন্তু তুমি যুক্তির পক্ষে দাঁড়াওনি কেন? কেন শক্তির দাপট মেনে নিয়েছ?’ বলল আনা আরিয়ার মা, স্টিফেন ফোবিয়ানের স্ত্রী।
সংগে সংগে উত্তর দিল না স্টিফেন ফোবিয়ান।
সে গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
তার চোখে-মুখে গ্লানির একটা ছায়া। বলল, ‘শিলা, তুমি মেয়েকে হারাতে বসেছ, আমাকেও হারাতে চাও?’
মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা চমকে উঠে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘কি সব অলুক্ষুণে কথা বলছ। আমি মেয়েকেও হারাতে চাই না, তোমাকেও হারাতে চাই না। কিন্তু তুমি এ কথা বলছ কেন?’
‘এখন হয়তো অধিকাংশই আমরা মনে করছি, মানুষ বড় নয়, জাতির স্বার্থ বড়। জাতির স্বার্থে ব্যক্তিকে কোরবানী দেয়া যায়।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘কিন্তু যাকে জাতির স্বার্থ বলা হচ্ছে, সেটা কি আসলেই জাতির স্বার্থ? প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে যা অর্জিত হয়, তা জাতীয় স্বার্থ নয়। কারও মাথায় বাড়ি দিয়ে কিছু পাওয়া বা নেয়া জাতীয় স্বার্থ হতে পারে না।’ বলল আনা আরিয়ার মা।
‘এসব কথা ঘরে বলতে পারো কাউকে না শুনিয়ে, বাইরে বলা যাবে না। কোথাও কখনও বলতেও যেও না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আমাদের মেয়েটার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। তাকে যেন আমরা ফিরে পাই। তার কণ্ঠ ভারি।
স্টিফেন ফোবিয়ানের শেষ কথাটায় কেঁপে উঠল মিসেস শিলা স্টিফেন। বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে, ‘কোথায় নিয়ে যাবে?’
‘জানি না শিলা। ব্ল্যাক ক্রসের লোকরা ছাড়া আমাদের কেউ এটা জানে বলে মনে হয় না।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
কেঁদে উঠল আনা আরিয়ার মা মিসেস শিলা স্টিফেন। বলল, ‘তোমরা এটা মেনে নিয়েছ কেন? মেয়েদের এভাবে রাখা যায় না। এর পরিণাম কি তুমি জান?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠের কথা আর্তনাদের মতো শোনাল।
‘আর বলো না শিলা এ সব। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি সব কিছু ভুলে থাকতে চাই। আমি এক অপদার্থ পিতা। আমার মেয়েটার বাবা ডাকের যোগ্য আমি নই। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল স্ক্রিনে দেখল বাতিস্তা সান্ড্রির নাম। মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। কল অন করল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘গুড ইভেনিং মি. বাতিন্তা, সান্ড্রি।’ গুড শব্দটি খুব কষ্ট করে বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘গুড নয়, ইভেনিংটা ব্যাড হয়ে গেছে মি. স্টিফেন ফোবিয়ান।’ উত্তরে ও প্রান্ত থেকে বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘কেন কি ঘটেছে? কেন এমন কথা বলছেন?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান। কি ঘটেনি মি. স্টিফেন ফোবিয়ান! আপনার মেয়েকে উদ্ধার এবং চাওসিকোকে ধরতে গিয়েছিল আমাদের দশজন শীর্ষ কমান্ডো। কিন্তু তাদেরকে ধরে আনতে পারা তো দূরের কথা দশজন কমান্ডোই নিহত হয়েছে, খবর জানাবার মতও কেউ বেঁচে ছিল না। পুলিশে আমাদের সোর্স- এর কাছ থেকেই মাত্র এই ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘কীভাবে এত বড় ঘটনা ঘটল মি. বাতিস্তা?’ জিজ্ঞাসা স্টিফেন ফোবি- য়ানের।
‘আমাদের কমান্ডোরা ঠিক ঠিকই গিয়েছিল। ওদের দু’জনকে ধরে, বেঁধে যখন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসছিল, সেই সময় সেখানে এসে উদয় হয় আমাদের কুগ্রহ আহমদ মুসা। সে আমাদের দশজন কমান্ডোকে মেরে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে চলে যায়।’ বলল বাতিস্তা সাড়ি।
‘খুবই দুঃখের বিষয় মি. বাতিস্তা। আমাদের দশজন কমান্ডো তার কিছুই করতে পারল না?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘পারবে কি করে? আহমদ মুসার কাছে এরা শিশু। তার কৌশল, তার বুদ্ধি তার ক্ষিপ্রতার কোনো তুলনা নেই। কলিন ক্রিস্টোফার নিজে আমাকে বলেছেন, আহমদ মুসার হারার কোনো রেকর্ড নেই।’
‘তাহলে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান
‘আপনার মেয়েকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আহমদ মুসা শত্রু হলেও বলছি, সে খুব ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিনিষ্ঠ ও মানবিক। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সে সব সময় মা ও বোনের চোখে দেখে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ধন্যবাদ মি. বাতিস্তা। কিন্তু আমি ভাবছি, আমরা আগাবো কি করে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘দেখা যাক, কলিন ক্রিস্টোফাররা কি চিন্তা করছেন। সব দায়িত্ব তো ওদের উপরই দেয়া হয়েছে।’
কথা শেষ করেই বাতিস্তা সান্ড্রি বলল, ‘ঠিক আছে, মি. স্টিফেন এখন রাখছি। কোনো ডেভলপমেন্ট থাকলে আপনাকে ডাকা হবে অথবা জানানো হবে।
‘ঠিক আছে। বাই মি. বাতিস্তা।
‘বাই মি. স্টিফেন।
কল অফ করে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে মি. স্টিফেন ফোবিয়ান গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। বলল, শিলা, আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে, আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে।’
বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা কিছুটা বুঝেছিল, কিন্তু বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। বলল, ‘আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে, তাহলে তুমি কাঁদছ কেন? বল কি হয়েছে?
কান্নাজড়িত কণ্ঠ আনা আরিয়ার মার।
স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে স্টিফেন ফোবিয়ান বলল, ‘শিলা, এবারও আহমদ মুসাই আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। চাওসিকো ও আমাদের মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। ঠিক সময়েই আহমদ মুসা এসে পড়ে এবং একাই দশজন কমান্ডোকে হত্যা করে চাওসিকো ও আনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’
সংগে সংগেই আনা আরিয়ার মা আকাশের দিকে মুখ তুলে দুই হাত জোড় করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ, ঈশ্বর যে নামই হোক, হে আল্লাহ! আপনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আমাদের প্রাণপ্রিয় মেয়ে এবারও আপনার দয়ায়ই বেঁচে গেছে। আহমদ মুসাকে আরও শক্তিশালী করুন। তার পরোপকারী হাতকে আরও মজবুত করুন।’
স্টিফেন ফোবিয়ান চোখ মুছে বলল, ‘শিলা তুমি যে একেবারে আমাদের স্বার্থের বিপক্ষে প্রার্থনা করছ। আহমদ মুসা তো আমদের প্রতিপক্ষ।
‘আমি পক্ষ-বিপক্ষ বুঝি না। যে ন্যায়ের পক্ষে আমি তার পক্ষে। ধর্মের জন্যে জোর-জবরদস্তি, খুন, গুম, অত্যাচার-উৎপীড়ন, প্রলোভন-প্রতারণার কথা কোনো ধর্মই বলে না, আমাদের ধর্ম বলবে কেন? যদি বলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না। আর…’
আনা আরিয়ার মাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘শিলা তুমি আর এগিয়ো না। এসব বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের ধর্ম আজ জাতিগত রূপ নিয়েছে। এবং সেই জাতি আজ ধর্মের উপর নেই, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে মাত্র। স্বীকার করতে লজ্জা নেই একমাত্র মুসলমানদের মধ্যে ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের নামে পরিচিত জাতি-সদস্য ও সমাজ-সদস্যদের আচার- আচরণে, চিন্তা-কর্মে, কায়কারবারে, লেনদেনে, ব্যক্তি পরিবার-সমাজ নিয়ন্ত্রণে ধর্মের অনুশাসন নেই। যাক এ সব কথা শিলা। এসো আমাদের মেয়ের কথা ভাবি। আজ তো সে বাঁচল। কিন্তু কতদিন এভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারবে। পরিণতি ভেবে খুবই আতংক বোধ করছি শিলা।’
‘আমি শুরু থেকেই আতংকে আছি। কিন্তু আবার মনে মাঝে মাঝে আশা জাগে, মুসলমানদের আল্লাহকে তো এখনও আমার চেনা হয়নি। তবে আহমদ মুসার উপর আমার ভরসা আছে। আমাদের মেয়েকে সে বোন ডেকেছে। নিশ্চয় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সে করবে। সেদিন তার কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। এক বয়স্কা মেয়ের নিরাপত্তা শুধু পিতা-মাতা কিংবা স্বামী সংসারেই আছে। আহমদ মুসা খুব ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিনিষ্ঠ বলেই আমাদের মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে ঐ সময় সে এই কথা বলতে পেরেছে। চারদিকের লোভাতুর মানুষের মিছিলে আহমদ মুসারা অনন্য।’ বলল আনা আরিয়ার মা শিলা স্টিফেন।
তুমি ঠিকই বলেছ শিলা, আহমদ মুসা আমাদের দেখা মানুষদের মধ্যে অনন্য কিন্তু তারও সামর্থ্যের তো একটা সীমা আছে। এখন প্রকৃতপক্ষে সরকারও তার পক্ষে নেই। লোভী পুলিশরা তো আহমদ মুসার প্রতিপক্ষকে সব শক্তি দিয়ে সহযোগিতা করবে। এই অবস্থায় আহমদ মুসা নিজেকে কীভাবে নিরাপদ করবে এবং আমাদের মেয়েকে নিরাপত্তা দেবে কীভাবে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘স্টিফেন তুমি যে অংক কষলে, তাতে আমাদের জন্যে আশার কিছু নেই। কিন্তু আহমদ মুসারও তো একটা অংক নিশ্চয় আছে। তোমার কাছ থেকেই তো শুনেছি, সব পথ বন্ধ করলেও স্রষ্টা আহমদ মুসার জন্যে একটা পথ খোলা রাখেন। অত…’
মিসেস শিলা স্টিফেনের কথার মাঝখানেই স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘ওটা আমার কথা নয় শিলা, ইন্টারনেটে একজন আহমদ মুসা- বিশেষজ্ঞের একটা কমেন্ট ওটা।’
‘যাই হোক। আমি বলতে চাই আমি হতাশ নই, তোমার হতাশ হলে চলবে না। আশাই এখন আমাদের বাঁচার অবলম্বন। আমি অন্তর দিয়ে আহমদ মুসার আল্লাহকে ডাকছি। যে আল্লাহ আহমদ মুসাকে এত ভালো মানুষ বানিয়েছেন, পরোপকারী বানিয়েছেন, সে আল্লাহ নিশ্চয় অনেক দয়ালু হবেন এবং মজলুমের রক্ষাকর্তা হবেন।’ বলল মিসেস শিলা স্টিফেন। তার কণ্ঠ আবেগ কম্পিত ও ভারি শুনাল।
‘ধন্যবাদ শিলা। তোমার কথায় মনে জোর পাচ্ছি। কিন্তু শিলা তুমি আহমদ মুসার আল্লাহকে ডাকছ কেন? প্ৰভু যিশুকে ডাক।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘প্ৰভু যিশু তো আহমদ মুসার মতো কাউকে বানিয়েছেন, আমি দেখছি না। তাই যাঁকে আমি চোখের সামনে সক্রিয় দেখছি, তাঁকেই আমি ডাকছি।’ আনা আরিয়ার মা মিসেস স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘সাবধান শিলা, তুমি কিন্তু পথ হারাচ্ছ। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘না আমি পথ হারাইনি। আমি আমার আনা মা’র পথে চলছি। সেই তো আমাদের সব।’ মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা বলল। ‘আমাদের আনা মা’র পথ কোনটি?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান। ‘খুঁজে নাও তুমি।’
বলে উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়ার মা, মিসেস স্টিফেন ফোবিয়ান। বলল, ‘চলো ডিনার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
গম্ভীর স্টিফেন ফোবিয়ান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তোমাকেও খুঁজতে হয়নি, আমাকেও খুঁজতে হবে না। আনা তো শুধু তোমার মেয়ে নয়, আমারও মেয়ে।’
‘ধন্যবাদ স্টিফেন’ বলে স্বামীর হাত ধরল মিসেস শিলা স্টিফেন।
দু’জন এগিয়ে চলল ডিনার টেবিলের দিকে।
.
বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টের টেলিফোনে বুরুন্ডির প্রধানমন্ত্রীর ঘুম ভাঙল এবং প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম ভাঙল।
অন্যদিকে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারের টেলিফোনে মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা ও মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রির ঘুম ভাঙল এবং বাতিস্তা সান্ড্রির টেলিফোনে ঘুম ভাঙল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের।
ঠিক একই সময়ে আসমানি আব্দুল্লাহর ডাকে ঘুম ভাঙল সামিরা সাদিয়ার, আনা আরিয়া ও চাওসিকোর।
সবাই সবখানে সবার ঘুম ভাঙিয়ে একই কথা বলল, FWTV (ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি)-র ভোর বেলার এক ঘণ্টার বিশেষ নিউজ বুলেটিন শুনেছেন কিনা।
এর দুই ঘণ্টা পর ঐ টেলিফোনগুলো আবার সক্রিয় হলো এবং টেলিফোনের কণ্ঠগুলোতে এবার নতুন জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হলো : আজকের ওয়াশিংটন পোস্ট.. নিউইয়র্ক টাইমস, লা’মন্ডে এবং বুরুন্ডির লেক ট্যাংগানিকা টাইমস ও বুজুমবুরা পোস্টের প্রিন্ট ভারসন ও অনলাইন ভারসন দেখেছেন কিনা, পড়েছেন কিনা।
FWTV-এর এক ঘণ্টার দীর্ঘ নিউজ বুলেটিনে কি আছে?
পত্রিকাগুলোর অনলাইন ও প্রিন্ট ভারসনের রিপোর্ট কি বলেছে?
সামিরা সাদিয়া বুজুমবুরার ঘটনা-প্রবাহের উপর যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল তার পুরোটাই ব্রডকাস্ট করেছে FWTV এবং পত্রিকাগুলোও ছেপেছে রিপোর্টের পুরো কাহিনীটা।
আনন্দের অশ্রুতে ভাসছে সামিরা সাদিয়া নতুন সাংবাদিক হওয়ার আনন্দে নয়, সত্য প্রকাশ হওয়ার খুশিতে।
বাতিস্তা সান্ড্রির অফিসে তখন ক্ষোভে-দুঃখে চুল ছিঁড়ছে খ্রিস্টান পরিচয়ের গোপন সন্ত্রাসী সংস্থা ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার। তার চোখ-মুখ লাল। সীমাহীন রাগের ভারে কাঁপছে তার শরীর। সে চিৎকার করে বলল, ‘বলতে পারেন মি. বাতিস্তা, আহমদ মুসাকে শেষ করতে কত কোটি ডলার চাই?’
কথার মধ্যেই সে হাত বাড়িয়ে তার মোবাইলটি তুলে নিল।
***
[পরবর্তী বই – শান্তির দ্বীপে সংঘাত]
আবার
সাইমুম সিরিজের ৬৪ তম থেকে বইগুলো আপলোড করার উপায় কি???
ওগুলো এখনও বের হয়নি।
সাইমুম সিরিজ ৬৪ : বিপদে বুজুমবুরা বই তো প্রকাশিত হয়েছে।বইটা পড়তে চাই। বইটার pdf কবে আপলোড করবেন?? কবে পড়তে পারব??
বিপদে বুজুমবুরা বইটা পড়তে চাই এখন। বইটার pdf দয়া করে দিন।
বিপদে বুজুমবুরা বই তো প্রকাশিত হয়েছে।বইটা পড়তে চাই। বইটার pdf কবে আপলোড করবেন?? কবে পড়তে পারব??
আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের প্রকাশিত কাশ্মীর সিরিজের নয় নম্বর বইয়ের পর পরের খন্ড কেন পাচ্ছি না বলবেন দয়া করে। অনুগ্রহ পূর্বক দশ খন্ড সহ বাকি বইয়ের প্রকাশিত কপি আশা করছি।
কাশ্মীর সিরিজ মানে ঠিক কোন বই, বুঝলাম না।
ঝিলাম নিরবে কাদে, টার্গেট তিন শয়তান, বাচনাথের মন্দির, পোখরানের পাহাড়ে, ইহুদি এজেন্ট এই রকম নয়টি বই দিয়ে কাশ্মীর সিরিজ তৈরি। দশম খন্ড কবে পাওয়া যেতে পারে জানাবেন প্লিজ।
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় ভাই
আপনি যে সিরিজের কথা বলেছেন
সেই সিরিজের লিংকটি আমাকে দিতে পারবেন.?
ধন্যবাদ
সাইমূম সিরিজ ৬৪ থেকে পরবর্তী গুলো আপলোড দিন।
কাশ্মির সিরিজ বই গুলোর পিডিএফ লিংক থাকলে দেন।
ভাই পরবর্তী পর্ব গুলো আসবে কিনা????
পরের পর্বের বই এখনও আসেনি।
আসার সম্ভাবনা আছে?? নাকি আর আসবে না??
বিপদে বুড়িনপুরা বইটা pdf কি এখনো করা সম্ভব হয়নি? অনুগ্রহপূর্বক তাড়াতাড়ি আপলোড দিন।
সাইমুমের ৬৪ নাম্বার বই তো অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছ। পোষ্ট করবেন কবে।
Thanks bro ar jodi kasem bin abubakar ar book ar pdf jegulo baki a6a
সাইমুমের ৬৫ নাম্বার বই কি প্রকাশিত হয়েছ। প্রকাশিত হলি পোষ্ট করবেন কবে।
প্রকাশিত হয়নি এখনও। তবে নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে দেয়া ঠিক নয়। এতে লেখক/প্রকাশকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।