১৮. রাষ্ট্রীয় খেতাব

রাষ্ট্রীয় খেতাব

ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা এ দেশে তাদের সহযোগী ও তাবেদারদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন এবং সেসব পেয়ে তারা ধন্য হয়েছেন।

ইংরেজদের অধীনতা যারা মেনে নিয়েছেন, তাঁদের নানাভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিয়েছে একটি শ্রেণিকে ব্যবসা বাণিজ্য ও দালালি করে বিত্তবান হওয়ার সুযোগ। অকাতরে তাদের মধ্যে বিতরণ করেছে ভূসম্পত্তি। তারপর ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি প্রথার প্রবর্তন করে বাংলার মানুষকে চিরদিনের জন্য শোষণের শিকারে পরিণত করে। অবশ্য সেই সব অনুগ্রহভাজন বিত্তবানের ছেলেমেয়েরাই কেউ কেউ দু-তিন পুরুষ পরে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এককালের সুবিধাভোগীদের সন্তানদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বহু জমিদার-জোতদারের সন্তানদের আত্মত্যাগ অসামান্য।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় ব্রিটিশ শাসকদের যারা বিশ্বাসভাজন, তাদের তারা বিভিন্ন খেতাব দিয়ে ভূষিত করতেন। সবচেয়ে বড় সামন্তপ্রভুদের বা জমিদারদের খেতাব দিতেন ‘নবাব বাহাদুর’ ও ‘নবাব’ এবং ‘মহারাজা’ ও ‘রাজা’। নবাব বাহাদুর ও নবাব দিতেন মুসলমানদের এবং মহারাজা ও রাজা হিন্দুদের। যেমন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর এবং নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। তা ছাড়া সরকারের অনুগত বিশিষ্ট ব্যক্তি, জমিদার, সরকারি কর্মকর্তারা পেতেন খান বাহাদুর/ ‘রায় বাহাদুর’ এবং ‘খান সাহেব/ ‘রায় সাহেব। খান সাহেব ও রায় সাহেব ছিল সবচেয়ে ছোট খেতাব। মাসে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত যাদের আয় ছিল অথচ সমাজে যারা সম্মানিত, তাঁদের মধ্যে হিন্দুরা পেতেন রায় সাহেব এবং মুসলমানরা পেতেন খান সাহেব খেতাব। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে বহু খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর এবং খান সাহেব ও রায় সাহেব ছিলেন। খেতাবধারীদের সাধারণ মানুষও সম্মান দিতেন। বহু কবি-সাহিত্যিক খেতাব পেয়েছেন।

সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান শুধু পদক-পুরস্কারই প্রবর্তন করেননি, তিনি ব্রিটিশ শাসকদের মতো চালু করেন খেতাব। সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাদের অবদান রয়েছে, এমন শিল্পী সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের তিনি ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ওই খেতাব দিয়ে ভূষিত করতেন। অনুগত ও বিশ্বস্ত সরকারি, আধা-সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূষিত করা হতো খেতাবে।

আইয়ুব-প্রবর্তিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব ছিল হিলাল-ই-পাকিস্তান, তারপর হিলাল-ই কায়েদে আজম, সিতারা-ই পাকিস্তান, সিতারা-ই-সুজাত, সিতারা-ই ইমতিয়াজ, সিতারা-ই খিদমত, তমঘা-এ-ইমতিয়াজ, তমঘা-ই-কায়েদে আজম প্রভৃতি। খেতাবপ্রাপ্তরা নামের শেষে সংক্ষেপে খেতাব লিখতে পারতেন এবং লিখতেনও। যেমন সৈয়দ মুর্তজা আলী এবং কবি ও আমলা সানাউল হক পেয়েছিলেন ‘সিতারা ই-কায়েদে আজম। তিনি তাঁর প্যাডে লিখতেন সানাউল হক এসকিউএ অথবা ইংরেজিতে S.Q.A।

আমার মনে আছে, খেতাব পাওয়ার পর সানাউল হক আমাকে বলেছিলেন, ‘জানো, এই উপাধি ব্রিটিশ আমলের “স্যার” উপাধির সমান। তার একটি বন্ধুচক্র ছিল। তাদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, এ কে এম আহসান, সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হাশেম প্রমুখ। তাঁকে জানতাম বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তায় তেমনটি মনে হতো। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার কাছে চাওড়ায় আমাকে নিয়ে গেছেন। পুকুরের মাছ ও বাঙালির নানা রকম পিঠা খাইয়েছেন। তাঁর প্রয়াত বড় ভাইয়ের নামে বাড়িতে ‘কায়সার স্মৃতি অধ্যয়ন সমিতি গ্রন্থাগার’ নামে একটি ছোট পাঠাগার ছিল।

সুদক্ষ গোয়েন্দাদের রিপোর্টে পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসভাজন না হলে কারও পক্ষে আইয়ুবের খেতাব পাওয়া সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতার পরে সানাউল হককে অত্যন্ত বেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে মনে হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের তিনি ছিলেন খুবই একজন ভক্ত। সে জন্য তিনি ভালো পোস্টিং পেয়েছেন। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতার জন্যই সচিব হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিশেষ অনুরাগী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে ব্রাসেলস পাঠান। একই সঙ্গে তিনি বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন।

যেদিন তিনি ব্রাসেলস যাওয়ার জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন, আমি তাঁকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাই। কিছুদিন পরেই আসে ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে সানাউল হকের অস্বাভাবিক আচরণ। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই রাতে সানাউল হকের বাসভবনে ছিলেন। সকালে ক্ষমতাবদলের কথা শুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের চেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার সঙ্গে তিনি যে আচরণ করেন, তা ছিল একজন কাপুরুষ ও অতি সুবিধাবাদীর মতো। তাই একেক সময় মনে হয়, বাঙালি কখন কী বিশ্বাস করে আর না করে, তা বিধাতার পক্ষেও আঁচ করা কঠিন।

মনে আছে, ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ খেতাব যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি কর্নেলিয়াস, আবদুল জব্বার খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রমুখ ছিলেন। ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পেয়েছিলেন নাট্যকার নুরুল মোমেন, সাংবাদিক-লেখক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, নাট্যকার মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। লেখকদের মধ্যে ‘তমঘা ই-ইমতিয়াজ পেয়েছিলেন শাহেদ আলী, আকবরউদ্দিন, আবু রুশদ, গোলাম মোস্তফা, তালিম হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ এবং চিত্রশিল্পী শফিকুল আমিন। বাঙালি অফিসারদের মধ্যে তমঘা-ই-কায়েদে আজম’ খেতাব পান জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার পরিচালক ও কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তমঘা-ই পাকিস্তান’ পান তল্কালীন কেবিনেট ডিভিশনের উপসচিব আবুল মাল আবদুল মুহিত, আরেক সিএসপি অফিসার ফজলুর রহমান খান প্রমুখ। তমঘা-ই-খিদমত পেয়েছিলেন অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টন্স সার্ভিসের আবু সাঈদ হাফিজুল্লাহ, সিএসপি অফিসার পি এ নাজির প্রমুখ।

আমাদের এক ঘনিষ্ঠজন শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসার জিয়াউল হক পেয়েছিলেন তমঘা-ই-খিদমত। এটি ছোট খেতাব। তাকে অভিনন্দন জানাতে তার কমলাপুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি, আবু জাফর শামসুদ্দিন ও শওকত ওসমান। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ। আমাদের অভিনন্দনে বিব্রত হলেন। চুপ করে বসে রইলেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে নয়, সম্ভবত পেয়েছিলেন খেতাবটি, কারণ তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী অফিসার। অফিসের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ‘ছয়-দফা’র ঘোরতর সমর্থক।

ষাটের দশকে পদক-পুরস্কার-খেতাব যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা কেউই কোনো অযোগ্য ব্যক্তি নন। তাঁদের প্রত্যেকেরই কমবেশি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ রয়েছে। মধ্যবিত্তরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিছু প্রত্যাশা করেন। সেই চাওয়াতে এবং পাওয়াতে দোষও নেই। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসের পরিবর্তন প্রশংসার কাজ নয়।

একাত্তরের মার্চে স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বাংলার মানুষ যখন পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নেমে আসে, তখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেকেই তাদের খেতাব বর্জন করেন। কিন্তু সেটা খুব বেশি দেরিতে। ব্রিটিশরা যে খেতাব দিত, তা ইংরেজি শব্দে নয়, বাংলা ও বাঙালির চেনা বা বোধগম্য শব্দে, যেমন খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, খান সাহেব, রায় সাহেব। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা যে খেতাব প্রবর্তন করেন, সেসব শব্দের অর্থ আজও অনেকেরই অজানা। অনেকেই বলতে পারবেন না কী অর্থ বহন করে ‘সিতারা-ই ইমতিয়াজ’ কিংবা ‘সেতারা-ই-সুজাত’ বা ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ শব্দগুলো।

পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা ছিল বাংলা ও উর্দু। সে জন্য সরকারি যেকোনো ব্যাপারে দুটি ভাষার ব্যবহারই প্রত্যাশিত। কিন্তু এই খেতাবগুলোর কোনোটিই বাংলা ভাষায় নয়। আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদদের বিষয়টির প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তারা তা করেননি। বিজাতীয় ভাষায় দেওয়া খেতাব গভীর আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং তা সগৌরবে ব্যবহার করতেন।

কৃতী ব্যক্তিদের কাজের স্বীকৃতি অপ্রত্যাশিত নয়। পদক-পুরস্কারে মানুষের মর্যাদা কতটুকু বাড়ে তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের মতো গরিব দেশে তারা আর্থিকভাবে কিছুটা উপকৃত হন। পশ্চিম পাকিস্তানি চিত্রশিল্পী জোবায়দা আগা এবং আমাদের কামরুল হাসান একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদক পান দশ হাজার টাকা করে। উভয়েই গুণী শিল্পী। পুরস্কার পাওয়ার পর কামরুল হাসান, তিনি তখন আইয়ুব প্রতিষ্ঠিত ডিজাইন সেন্টারের চিফ ডিজাইনার, তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন:

‘শিল্প-সাহিত্যের এই ধরনের পুরস্কার নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। এতে ব্যক্তিগতভাবে কোনো শিল্পীকে মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। বরং শিল্পীর সাধনার এবং শিল্পীর রং ও তুলির মাধ্যমে যে পরিবেশ ও সমাজের চিত্র প্রকাশিত হইয়াছে তাহাকেই এই পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে।’

নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালন করে যদি কেউ পদক পুরস্কার খেতাব পান, তা নিয়ে তাঁরা গর্ব করতেই পারেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘তমঘা ই-পাকিস্তান’ (টিপিকে) পেয়েছিলেন তার যোগ্যতায় বাংলাদেশের যখন তিনি অর্থমন্ত্রী, তখনো ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ তিনি পেয়ে থাকবেন তার যোগ্যতার জন্য। তবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নিজের পুরস্কার নেওয়া শোভন নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *