৫. হালখাতা

হালখাতা

১.

চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ট্রাকে এবং প্রফুল্লরঞ্জন সিংহের সৌজন্যে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের এক ট্রাকে আমাদের সংসারের সব মালপত্র ঢাকায় এলো। বইপত্র সব রাখা হলো আমার ছোটো ভায়রা মোবারকের বাড়িতে, কিছু জিনিস আমার মেজো শ্যালিকা নাজুর বাড়িতে। রুচি তো আগে থাকতেই নানাবাড়িতে ছিল, এখন পরিবারের বাকিরাও সেখানে যোগ দিলাম। একদিন শুনলাম, ও-বাড়ির এক ঠিকে ঝি শুচিকে প্রশ্ন করছে : ‘এ-বাড়ি কার?’

‘আমার নানার।’ শুচির উত্তর।

‘ও, আপনের বাপে ঘরজামাই থাকে?’ তার পুনরপি প্রশ্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি পাওয়ার জন্যে উপাচার্যের কাছে যাই। তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে যদি তিনি কিছু করেন। তাঁর স্ত্রী যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। তবে উপাচার্য নিয়মের বাইরে যাবেন না। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে যতদিন না আমার দান আসে। উপাচার্যকে দোষ দিতে পারি না।

বেবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে চাকরি করে যাচ্ছে। যতখানি ছুটি নেওয়া সম্ভব, নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে বাস করে ওর ছোটো ভাই আমের–সে দেখাশোনা করে আজিজের মাছ রপ্তানির ব্যবসা। বেবী তারই সঙ্গে থাকে। বাসে চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে চাকরির দরখাস্ত করেছে।

আনন্দকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করা সম্ভবপর হয়েছে। অধ্যক্ষা রাজিয়া মতিন চৌধুরী একাধারে আমার ছাত্রী এবং শিক্ষকতুল্য সহকর্মীর স্ত্রী। তিনি প্রথম থেকেই আনন্দকে স্নেহের চোখে দেখছেন। শুচি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেছে, ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে ভিকারুন্নিসা স্কুল ও কলেজে এবং হলিক্রস কলেজে। ভিকারুন্নিসার ফল প্রকাশ হতেই অধ্যক্ষা হামিদা আলী বেবীকে বললো, আমার সারের মেয়ে আমার কলেজেই পড়বে। হলিক্রসে পরীক্ষার ফলাফল দেখতেও আর যাওয়া হলো না।

ঢাকায় এসে আমার একেবারেই ভালো লাগছে না। চট্টগ্রামের জন্য মন খারাপ করছে। তার ওপর মে মাস থেকে ধূমপান ত্যাগ করেছি–উইথড্রয়াল সিম্পটম খুব প্রবল। চিত্তে সুখ নেই যাকে বলে, জীবন ও জগৎ বিস্বাদ মনে হয়। বেশির ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে থাকি। আহসান হাবীবকে মনে পড়ে। জুন মাসে সপরিবারে ঢাকায় এসেছিলাম, তখন সবাই মিলে তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই শেষ দেখা–জুলাই মাসে তিনি চলে গেলেন। হাসান হাফিজুর রহমানকে মনে পড়ে। তিনি চলে গেছেন দু বছর আগে। আমি যেন কোথাও গিয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দু-কলম লিখেছিলাম। ঢাকায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা করি ঠিকই, কিন্তু জীবনের ছন্দ ঠিক খুঁজে পাই না। চট্টগ্রামে থাকতে প্রায় রোজ বিকেলে কনট্রাকট ব্রিজ খেলতাম। ঢাকায় এসে একদিনও খেলিনি–তেমন তাগাদাও অনুভব করিনি।

বিভাগে আমাকে দেওয়া হয়েছে কারো পরিত্যক্ত রুটিন। সুতরাং এমন অনেক কিছু পড়াতে হচ্ছে যা আমার নিজের এলাকার নয় এবং যা আমি কখনো পড়াইনি। নিজের বইপত্র থেকে অনেক দূরে আছি–বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভরসা। বিভাগের আবহাওয়া মোটের ওপর ভালোই। আহমদ শরীফ ও নীলিমা ইব্রাহিমকে নিয়ে যে-দ্বন্দ্ব ছিল সেখানে, তাদের অনুপস্থিতিতে সেটা অনেকখানি দূর হয়েছে। বিভাগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবাইকে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি তেমন সুবিধাজনক নয়। রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে–তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে সরকারপন্থী ছাত্রদের সশস্ত্র সংঘাত দেখা দিচ্ছে। আমি ক্লাসে বক্তৃতা করছি, তার মধ্যে বোমা বা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। কোত্থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে হুড়মুড় করে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে গেল এবং বিনা বাক্যব্যয়ে বেঞ্চিতে আসন নিয়ে বক্তৃতা শোনার ভান করতে লাগলো। এই অবস্থায় আমার পক্ষে পড়িয়ে যাওয়ার ভান করা মুশকিল।

১৫ অক্টোবর জগন্নাথ হলের ভবন ধসে ৩৬ জন ছাত্র (পরে আরো চারজন) মারা যায়, দুই শতাধিক আহত হয়। খবর পেয়ে ছুটে এলাম। আমার কিছু করার নেই–বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া। জানতে পারলাম, ওই ভবন সংস্কার করার চেষ্টা একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছে। ওই ভবনেই ছাত্রদের টিভি রুম। সংস্কারকাজ চললে টেলিভিশন দেখার ব্যাঘাত হবে, তাই ছাত্রেরা নাকি কাজে বাধা দিয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে কাজটি আত্মঘাতী হয়েছে। এই দুঃখের দিনে একটা ব্যাপার দেখে ভালো লাগলো–ত্রাণকাজে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রিকশাওয়ালা আহতদের নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে–বিনি পয়সায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, শুনলাম, লম্বা লাইন লেগেছে রক্তদানকারীদের। প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে কিছু করতে চেষ্টা করছেন। জগন্নাথ হল থেকে যখন রাজ্জাক সাহেবের বাসায় গেলাম, তিনি এই দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলেন, কী কন আপনেরা সাম্প্রদায়িকতার কথা! দেখেন তো সকলে কেমন করত্যাছে। হিন্দু-মুসলমান বিচার করে নাই।

রাজনৈতিক সংঘর্ষ বাড়ছে বই কমছে না। জানুয়ারি মাসের একদিনে স্বয়ং উপাচার্যের ভবন আক্রান্ত হলো। সেটি ছিল ছুটির দিন। উপাচার্য ও তার স্ত্রী বাড়ি ছিলেন না। তাঁদের সন্তানেরা ছিল। বাইরে থেকে বিস্ফোরকজাতীয় কিছু ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তাতে দোতলার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় আগুন লেগে যায়–দোতলাই তো আবাসিক অংশ। বড়োরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু হুমকিটা বড়ো ধরনের নিঃসন্দেহে। আমি গিয়ে দেখি উপাচার্য-দম্পতি ততক্ষণে ফিরে এসেছেন–শিক্ষক ও কর্মকর্তা অনেকেই এসেছেন সমবেদনা জানাতে। অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক ভয়ানক ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। বলছেন, আমার উপর রাগ থাকতে পারে, আমার ছেলেমেয়েদের ওপর তার জন্যে শোধ নেবে নাকি? তার কথায় এমন আভাস পাওয়া গেল যে, এই ঘটনার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির যোগ আছে। পরদিনই তিনি পদত্যাগ করলেন। প্রো-ভাইস চান্সেলর অধ্যাপক আবদুল মান্নান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পেলেন। মাস ছয়েক পর তিনি উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তিলাভ করেন। আহমদ শরীফের বিখ্যাত গুঁড়ি ক্লাবে তার সঙ্গে আমার একদিন পরিচয় হয়েছিল–আমি অবশ্য ওই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, বোধহয় শরীফ সাহেবের খোঁজে গিয়েছিলাম। আমার স্নেহভাজন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বিয়ে করে অধ্যাপক মান্নানের কন্যা শামীমা নাসরীন ওরফে রোজীকে। সেই সুবাদে মান্নান সাহেবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। শাহেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তরের কর্মকর্তা।

ব্যবসায় প্রশাসন ইনসটিটিউটের সহকারী গ্রন্থাগার পদে বেবী নিয়োগ পেলো। ইনসটিটিউটের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নির্বাচকমণ্ডলীর সুপারিশ অনুমোদনের সময়ে উপাচার্য জানতে পারেন যে, যার নাম সুপারিশ করা হয়েছে, সে আমার স্ত্রী। তিনি পরে শাহেদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বেবী যে প্রার্থী, তা আমি তাকে আগে বলিনি কেন। তাতে যে বেবীর বিন্দুমাত্র সুনাম হয়েছিল, তা নয়। ইনসটিটিউটের পরিচালক তখন মোজাফফর আহমদ। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা সুবিদিত। সুতরাং যাঁরা বলতে চাইলেন, তাঁরা ঠিকই বললেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাত ঘটেছে। তাতে যে বেবীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়েছিল, তাও নয়। নিয়োগলাভ করায় মোজাফরের প্রতি নিশ্চয় বেবী কৃতজ্ঞতাবোধ করেছিল, আমিও করেছিলাম। এপ্রিল মাসে সে কাজে যোগ দেয়। তাতে বাড়তি একটা সুবিধে এই হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ি পাওয়ার ব্যাপারে আমার আর তার পয়েন্ট যোগ হয়ে আমাদের দাবি অনেকখানি এগিয়ে যায়। উপাচার্য কিছুটা আনুকূল্য করেন। বাড়ি বরাদ্দদাতা কমিটির দুই সদস্য–শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাদউদ্দীন এবং কলা অনুষদের ডিন মমিন চৌধুরী–আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেওয়ার তেরো মাস পরে বাসা বরাদ্দ হয় আমার নামে।

জায়গা হলো ৩২ নম্বর বাড়ির তিনতলায়। ওখানে যে-রাস্তা ছিল বাড়ি বানাবার আগে, তার নাম ছিল স্যাভেজ রোড। পরে আমরা বাস করবো ভেবে নয়, কোনো কৃতী সাহেবের নামে রাস্তার নামকরণ হয়েছিল। পাকিস্তানি জোশ থেকে সে-নাম পালটে ঈসা খান রোড করা হয়। আমার ফ্ল্যাটের উলটো দিকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবার, আমার ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেই মুনীর চৌধুরীর পরিবার বাস করেন। আমার দুই শহীদ শিক্ষকের পরিবারের সান্নিধ্য আমার পক্ষে আনন্দজনক হলো। তাছাড়া, চারতলায় থাকেন মৃত্তিকাবিজ্ঞানের আমিনুল ইসলাম ও বাংলার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান; দোতলায় ইসলামের ইতিহাসের মমতাজুর রহমান তরফদার; একতলায় লোকপ্রশাসনের নূর মোহাম্মদ মিয়া ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের আহমদ শামসুল ইসলাম–যাঁকে আবাল্য বড় ভাই বলে ডাকি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও তাঁকে ছেলেবেলা থেকে চিনতেন বলে বিশেষ খাতির করতেন। ও-বাড়িতে আমরা বেশির ভাগ সমমনা।

আমি ভেবেছিলাম, মাসপয়লায় ফ্ল্যাটে উঠবো। জাফর বললো, বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়া দরকার, নইলে বেদখল হয়ে যাবে। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, তাও হয়? সে দৃষ্টান্ত দিলো। আর দেরি করলাম না।

সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে ফ্ল্যাটে উঠলাম। স্বস্তিটা ছিল অপরিসীম।

তার আগে স্বামীবাগে থেকে দুটি কাজ করেছি বাংলা একাডেমীর তাগিদে। মুনীর চৌধুরী রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকা লেখা আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ডের সম্পাদনা। মনজুরে মওলার অন্তহীন দাবি না থাকলে তা করে উঠতে পারতাম না।

এই সময়ে আরো একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হই। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহম্মদ শামসউল হককে সভাপতি করে সরকার একটি পরীক্ষা-সংস্কার কমিটি গঠন করেছিল। মুহম্মদ ফেরদাউস খান, আবদুল্লাহ্ আল-মুতী, এ এম হারুন অর রশীদ ও আমি ছিলাম সদস্যদের মধ্যে। এঁদের সঙ্গে কাজ করা আনন্দদায়ক ছিল। কমিটির সদস্যেরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। আমি কোথাও যেতে চাইনি, যাইওনি। আমরা সর্বসম্মত সুপারিশ দাখিল করেছিলাম। তার একটি বা দুটি মাত্র গৃহীত হয়েছিল।

২.

এতদিনে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণের সাড়ে চার বছর হয়ে গেল। তিনি প্রথমে সেনানিবাসের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দেখালেন, তারপর নিজে গাড়ি চালিয়ে শহরের পথে চললেন, তারপর সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে আটরশির পীরের সন্দর্শনে যেতে থাকলেন। তার আগে ক্ষমতাসীনদের কাউকে কাউকে দুর্নীতির দায়ে সাজা দিলেন, তারপর তাকে আসন দিলেন নিজের মন্ত্রিসভায়। ভয় ও লোভ দেখিয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল ভাঙলেন, সেসব দলের নেতাদের টেনে নিলেন নিজের কাছে। এক সময়ে ড. কামাল হোসেনসহ বিরোধী দলীয় নেতাদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় সামরিক গোয়েন্দারা–তাতেও সকলে ভয় পাননি। আমাদের দেশে সামরিক শাসন এলেই লোকে তাকে সমর্থন করে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান সে-সমর্থন পেয়েছেন, এরশাদও পেয়েছেন। তারপরে লোকে তাদের শাসনের স্বরূপ বুঝতে পারে, তখন বিদ্রোহ করে। এরশাদ খুনোখুনির পথে না গিয়ে দুর্নীতি অবাধ করার পথ ধরেন। তাতে অনেককে সঙ্গে পান, জনগণকে পান না। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়–প্রথমে ছাত্রেরাই পথ দেখায়, তারপর রাজনীতিবিদেরা। তিনি রাজনীতি বন্ধ করেন, সময় বুঝে রাজনীতি অনুমোদনও করেন। তিনি গণভোটে জনসমর্থন দেখান, দেশি-বিদেশি সকল সাংবাদিকই বলেন, ভোটের সঙ্গে ফলাফলের কোনো সংগতি নেই।

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পাটি গঠিত হয়। সেপ্টেম্বরের আগে এরশাদ তাতে যোগ দেন না, কিন্তু প্রথম থেকে সবাই জানে, এটাই তার দল। তিনি সংসদ নির্বাচন দেবেন বলে স্থির করেন। শোনা যায়, বিরোধী দল একজোট হয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ১৫০টি করে আসনে প্রার্থী হবেন। নতুন অধ্যাদেশ জারি হয়, পাঁচটির অধিক আসনে কেউ প্রার্থী হতে পারবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে সাতদল এবং স্বতন্ত্রভাবে জামায়াতে ইসলামী এরশাদবিরোধী একই ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর একটা ফল এই হয় যে, দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত বৈধতা পেতে শুরু করে। এরশাদ সংসদ-নির্বাচনের সময়সূচি নতুন করে ঘোষণা করেন। বিরোধী দলগুলো তা বর্জন করবে বলে জানায়। তারপর হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। শুনেছি, আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন এর মূল প্রবক্তা। আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত ১৫ দলের মধ্যেই ভাঙন ধরায়। সংসদ-নির্বাচন হয় ৭ মে। জাতীয় পার্টি সংসদে অর্ধেকের বেশি আসন পায়। কামাল হোসেনকে এবং আরো কাউকে কাউকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টির সেই সংখ্যাধিক্য আরো দৃঢ় হয়। এতদিনে এরশাদ সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী এবং মওদুদ আহমদ, ডা. এম এ মতিন ও কাজী জাফর আহমদ উপপ্রধানমন্ত্রী হন।

নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী গ্রহণ করে এরশাদের সামরিক শাসনকালে গৃহীত সকল ব্যবস্থা অনুমোদন করে। আওয়ামী লীগ অবশ্য সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বিরোধী দলের কিছু সদস্য এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থন লাভ করে সরকার সংবিধান-সংশোধনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। লায়লা সিদ্দিকী সম্ভবত স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন, তাঁর স্বামী লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘকাল কারাগারে আটক ছিল। লায়লা সিদ্দিকী সপ্তম সংশোধনী সমর্থন করেন, দুদিন পরে লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিলাভ করে।

সংসদের বাইরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠন রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সির সহায়তায় অর্থ ও অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। তারা অব্যাহতগতিতে সন্ত্রাস চালাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রভাব পড়ে সর্বাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন, প্রকৌশলী-কৃষিবিদ ও চিকিৎসকেরা সমষ্টিগতভাবে ভূমিকা নেন, পেশাজীবীদের ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে। তারপরও সামনে কী ঘটবে, তা অজ্ঞাত রয়ে যায়।

৩.

বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কোনো একটা উদ্‌যোগ নেওয়া যায় কি না, এমন ভাবনা যখন মনকে অধিকার করেছে, তখন একদিন ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে আমার বাসায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও আমার আলাপ হলো। তারা বললেন, সংবিধানের আওতায় বিকল্প একটি সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে যদি একটা বিবৃতি দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো নতুন একটা চিন্তার সূচনা হতে পারে। মোজাফফর ও আমি মিলে একটা খসড়া তৈরি করলাম, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের ভার নিলেন অধ্যাপক মুশারফ হোসেন। খসড়া নিয়ে আলোচনার জন্যে পরে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বাড়িতে বসবার ব্যবস্থা হলো। আমি সেখানে যেতে পারলাম না–হঠাৎ জ্বর হয়ে গেল বলে। বিবৃতির চূড়ান্ত রূপদান এবং তাতে স্বাক্ষরদান সেখানেই হলো–আমি পরদিন সই করলাম। ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ সব কাগজে বিবৃতিটা প্রকাশ পেলো। স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩১ হওয়ায় এটি পরিচিত হলো ৩১ বুদ্ধিজীবী বা ৩১ নাগরিকের বিবৃতি বলে। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে বিবৃতির শুরু ও শেষটা তুলে দিচ্ছি :

বাংলাদেশে এখন এক গুরুতর সংকটের মধ্যে আমরা কালাতিপাত করছি। সর্বতোমুখী এই সংকট আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্র স্পর্শ করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক গম্ভীর হতাশা বিদ্যমান, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও অসাম্যের বিস্তার, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি, সামাজিক ক্ষেত্রে চরম নৈরাশ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, তা হলো, দেশের প্রায় সকল পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামে প্রহসনের অবতারণা করায় রাষ্ট্রপতির আসনের মর্যাদা ও জাতীয় সংসদের বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের ভোটদানের মতো প্রয়োজনীয় অধিকার হরণ করে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে অনেকেই সংশয়গ্রস্ত। তেমনি ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে দল ভাঙাভাঙি ও সুবিধাবাদের যে খেলা চলছে, তাতেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের শ্রদ্ধা নষ্ট হচ্ছে।…

এই নৈরাজ্য থেকে মুক্তির পথ অবিমিশ্র গণতন্ত্র। সন্ত্রাসের মাঝে মানুষের ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে যে তথাকথিত প্রহসনমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে দেশকে মুক্ত করতে সংবিধানের পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রকৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সংবিধানের অধীনে দলনিরপেক্ষ, চরিত্রবান ব্যক্তিসমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রতিষ্ঠা সহায়ক হবে। সে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হবে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বনিম্ন সময়ে দলীয় ভিত্তিতে সুষ্ঠু সন্ত্রাসমুক্ত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, যে জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান-পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অগণতান্ত্রিকতা আর্থ-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে, তার নিরসন করবেন। রাজনীতিকে অস্ত্রমুক্ত এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করার পদক্ষেপও তারা গ্রহণ করবেন। দলনিরপেক্ষ সরকারের কেউই নির্বাচনে কোনপ্রকার অংশগ্রহণ করবেন না বা অর্থবহভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবেন না। আমরা মনে করি, বর্তমান নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য থেকে মুক্তির এটিই একমাত্র পথ। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গঠনের জন্য এ ব্যাপারে আমরা দেশের সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় সমর্থন প্রার্থনা করি।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, প্রাক্তন বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বেগম সুফিয়া কামাল, প্রাক্তন উপাচার্য ও অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রাক্তন সচিব এ কে এম আহসান, প্রাক্তন সচিব সানাউল হক, প্রাক্তন সচিব আবদুল খালেক, পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক এ বি এম জি কিবরিয়া, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দীন আহমাদ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন অধ্যাপক জহুরুল হক, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক ইকবাল মাহমুদ, অধ্যাপক সজীদা খাতুন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদ, শিল্পী কামরুল হাসান, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও ড. ফসিহউদ্দীন মাহতাব।

সকালবেলায় বিবৃতি পড়ে বেজায় ক্রুদ্ধ হয়ে আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন ছুটে এলো আমার বাড়িতে। আমরা এমন একটা বিবৃতি দিতে যাচ্ছি, অথচ তাকে কিছু জানতে দিইনি, এ ছিল তার অভিযোগ। আরো গুরুতর অভিযোগ এই যে, আমরা একটা মার্কিন পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়েছি এবং এর পেছনে বড়রকম অসদুদ্দেশ্য আছে। একটু পরে এলো ডা. সারোয়ার আলী–সে তখনো কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তার স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে একেবারেই অনুত্তেজিত কণ্ঠে সে বললো, আনিস ভাই, বলেন দেখি, ব্যাপারটা কী। আপনারা এতজনে সই করলেন, অথচ বাইরের কেউ জানতে পারলো না–এমনটা তো বাংলাদেশে সচরাচর ঘটে না। সত্যি বলছি, আমি বুঝতে এলাম, কী ভেবে আপনারা এমন একটা প্রস্তাব তুললেন এবং এর পরে আপনারা কোন দিকে যাবেন।

পরে খবরের কাগজে অন্যান্য প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত-ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সংসদ-সদস্য–আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব জাফর ইমাম বিবৃতিকে বলেন অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক, অসৎ ও হঠকারী আর বিবৃতিদাতাদের অভিযুক্ত করেন বুদ্ধিবৃত্তির অসততার দায়ে। প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিবৃতিটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অন্তর্বর্তী সরকারগঠনের বিধান যেখানে সংবিধানে নেই, সেখানে তা দাবি করে আমরা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছি। উপপ্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বললেন, অন্তর্বর্তী সরকারগঠনের দাবি অবান্তর।

বিবৃতি সমর্থন করলো পাঁচ দল, অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন ছয় দলীয় জোট, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাকশাল; ছাত্রলীগের দুটি অংশ এবং ছাত্রদল। বিবৃতিপ্রকাশের সময়ে শেখ হাসিনা ছিল বিদেশে। কয়েকদিন পরে দেশে ফিরে। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সে বললো, বিবৃতিটি সুনির্দিষ্ট নয়, অস্পষ্ট; সংবিধানের কোন ধারায় কে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কিছুদিন আগে আ স ম আবদুর রব জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, তারপরই আমাদের বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। ঘটনাটি, শেখ হাসিনার ভাষায়, বোঝা যাচ্ছে না। দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগ আছে কি না, সে জানে না। তবে, তার মতে, এরশাদ সাহেবেরা অনেক খেলাই খেলতে পারেন।

আমাদের প্রস্তাবের সাংবিধানিক ব্যাখ্যা এবারে তৈরি করলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন–আমি তার পুনর্লিখন করলাম। এবারে কিন্তু ৩১ জনের সই পাওয়া গেল না। প্রথমে সরে দাঁড়ালেন সজীদা খাতুন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি রাজনীতি করেন না, মুশারফ হোসেনের কথায় একবার বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন, তবে বারবার দেবেন না। একটু তিক্তভাবেই জানতে চাইলেন তিনি, ‘মোশাররফ সাহেব কি আড়কাঠি হয়েছেন?’ আরো একজন কেউ স্বাক্ষর দিতে অপারগ হন। তবে ২৯ জনের স্বাক্ষরে ৩১ জনের পক্ষেই বিবৃতি প্রকাশ পেলো।

জেনারেল এরশাদের পতন পর্যন্ত অর্থাৎ পরবর্তী তিন বছর আট মাস পর্যন্ত ৩১ জনের এই গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, তবে সকলে আমরা একযোগে থাকতে পারিনি। অনেকের ওপরে চাপ আসছিল নানারকম, কেউ কেউ উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন, পরিবারের সদস্যদের অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কেউ কেউ আর একসঙ্গে থাকতে চাইছিলেন না। রাজ্জাক সাহেব একদিন আমাকে বললেন তাকে আর না জড়াতে। আরেকদিন রফিকুল হক বললেন, ৩১ জনের মধ্যে থাকায় তার পেশাগত কাজের ক্ষতি হচ্ছে–তিনি আর আমাদের বৈঠকে যোগ দিতে পারবেন না। সরকারি-আধাসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের তিনি আইনি পরামর্শক ছিলেন–মনে হয়, সেসব দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছিল। তার অবস্থাটা বুঝে আমরা তাঁকে রেহাই দিলাম। তবে অল্পকালের মধ্যে তিনি যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন। আমাদের একটু খারাপ লেগেছিল বই কি! ড. মল্লিক, নীলিমা ইব্রাহিম, এ কে এম আহসান, সানাউল হক, এ বি এম জি কিবরিয়া, খন্দকার মাহবুবউদ্দীন–এঁদের সঙ্গে যোগ শিথিল হয়ে গেল। স্ত্রীহত্যার দায়ে পুত্র গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ডা. আবুল কাসেম আর বাইরে তেমন বের হতেন না–সে পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ফসিহউদ্দীন মাহতাব যে-প্রকৌশলী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার ওপরেও সরকারের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আসে। এক পর্যায়ে

মনে হয়েছিল, পেশাগত সংশ্লেষ এবং বিবৃতিদাতাদের সঙ্গে সংযোগের মধ্যে একটা তাঁকে বেছে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা যখন প্রথম বিবৃতি দিই, তখন দৈনিক বাংলার প্রিন্টার্স লাইন থেকে সম্পাদক হিসেবে শামসুর রাহমানের নাম সদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে সরকারি আদেশে–৩১ জনের অনেকেই অন্যদের সঙ্গে মিলে তারও প্রতিবাদ করেছি। কিছুকাল পরে শামসুর রাহমান ওই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগ করলেন। সংসারের চাপ পুরোদমেই ছিল তার ওপরে, উপার্জনের কোনো বিকল্প উপায় তাঁর ছিল না। তবু তিনি একটা পথ বেছে নিয়েছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকায় চাকরি করে। তাঁর পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে বলাটা নৈতিকতার মাপকাঠিতে ঠিক ছিল না।

আমাদের বেশিরভাগ বৈঠক হতো মুশারফ হোসেন কিংবা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানে। বক্তব্য স্থির করার পর মুসাবিদা করার ভার অধিকাংশ সময়ে আমার ওপর পড়তো। বিবৃতি তৈরি হয়ে গেলে মইনুল হোসেন ইত্তেফাঁকের লোকবলের সাহায্যে তা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন।

অল্প সময়ের মধ্যেই জনসমাজে আমাদের বিবৃতির একটা গ্রহণযোগ্যতা দাঁড়িয়ে যায়। বিরোধী দলের কেউ আর আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কটাক্ষ করেননি। সরকারি প্রতিক্রিয়া যে বিরূপ ছিল, তা আগেই বলেছি। তবে সরকারের পক্ষ থেকেও আর কেউ প্রকাশ্য বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হননি।

৪.

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষকদের যেসব পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে থাকতেন, কর্তৃপক্ষ সেসব পরিবারকে বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন ১৫ বছরের জন্য। আমি স্পষ্টই দেখতে পাই, ১৯৮৭ সালে যদি তাদের বাসস্থান ছেড়ে দিতে হয়, অনেকেই বিপদে পড়বেন; অন্তত আরো পাঁচ বছরের জন্যে তাঁদের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। কথাটা বিভাগের শিক্ষকদের কাউকে কাউকে বলায় তারা কর্তৃপক্ষের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব করতে সম্মত হলেন। বাংলা বিভাগের শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের জন্যে এই সুবিধা চেয়ে বেশ কয়েকজনের স্বাক্ষর সংবলিত আবেদনপত্র নিয়ে আমি গেলাম উপাচার্যের কাছে। তিনি যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। বললেন, বিষয়টা সিন্ডিকেটে নিতে হবে। যে সিদ্ধান্তই হোক, তা প্রযোজ্য হবে সকল শহীদ শিক্ষকের পরিবারের জন্যে–কেবল বাংলা বিভাগের শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের জন্যে নয়। আমি বললাম, তাহলে তো আরো ভালো কথা।

পরদিন হুমায়ূন আজাদ আমার কাছে এসে অভিযোগ করলো। বললো, ‘আপনারা কি ক্যাম্পাসের বাড়িঘর কেবল মৃতদেরকেই দেবেন, যারা জীবিত তাদের পরিবারের কথা ভাববেন না?’ আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, যে-প্রস্তাব আমরা করেছি, তা আমাদের কর্তব্য ছিল। সে তা মানতে চাইল না, উলটো প্রশ্ন করলো, এ-বিষয়ে তো শিক্ষকদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, কোন অধিকারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখলাম? এবারে আমি বিরক্তি গোপন করে বললাম, আমরা বিভাগের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত তো জানাইনি, ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন এমন আবেদন করেছি।’ হুমায়ূন বললো, তাই যদি হবে, তাহলে বিভাগের প্যাডের কাগজে আপনারা চিঠি লিখলেন কোন অধিকারে?’ জবাব দিলাম, তুমি কি জানো না, ব্যক্তিগতভাবে আনুষ্ঠানিক চিঠি। লিখলেও বিভাগের প্যাডের কাগজ ব্যবহার করার অধিকার আমাদের প্রত্যেকের আছে?’ এবারে আমার কথাটা বোধ হয় রূঢ় শুনিয়েছিল। হুমায়ূন খানিক চুপ করে থেকে বললো, আপনাদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তাহলে আমিও উপাচার্যকে লিখব।’ সে লিখেছিল কি না জানি না। সম্ভবত লেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ সকল শহীদ পরিবারকে আরো পাঁচ বছরের জন্যে বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন।

আমি চট্টগ্রামে থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক নিয়োগের জন্য গঠিত নির্বাচক কমিটির একজন সদস্য ছিলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। চট্টগ্রাম থেকে একবার কী কাজে এসেছি ঢাকায়–উঠেছি বড়ো বোনের বাড়িতে। একদিন শুনলাম, সন্‌জীদা খাতুন ফোন করেছিলেন আমার খোঁজে। আমি তাকে ফোন করায় তিনি বললেন, তিনি নিজের জন্যে কিছু বলছেন না, তবে অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাচ্ছে না বলে হুমায়ূন খুব খারাপ বোধ করছে–আমি কি এ-বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে কিছু বলতে পারি? বললাম, আমি সিলেকশন কমিটির মেম্বার, আমার পক্ষে কিছু বলা সংগত হবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যোগ দেওয়ার পরে কথাটা আবার উঠল। এবারে রাজ্জাক সাহেব বললেন, হুমায়ূন খুব ফ্রাষ্ট্রেটেড বোধ করছে। একদিন সুযোগ পেয়ে আমি উপাচার্য অধ্যাপক মান্নানকে বললাম, নির্বাচকমণ্ডলীর সভা ডাকার বিষয়টা তিনি বিবেচনা করতে পারেন। যদিও তখনও আমি এই মণ্ডলীর একজন, তবু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে কথাটা বলতে অত বাধা অনুভব করলাম না। আমার বলার জন্যে হয়তো নয়, তবু উপাচার্য অল্প সময়ের মধ্যেই নির্বাচক কমিটির বৈঠক আহ্বান করলেন, আমি তাতে অংশ নিলাম এবং সন্‌জীদা খাতুন ও হুমায়ূন আজাদকে অধ্যাপকপদে নিয়োগের সুপারিশ করা হলো। যথারীতি নিয়োগ হয়ে গেল, তারা নতুন পদে যোগ দিলেন।

বছরখানেক পরে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির এক সভায় পরীক্ষা কিংবা এ-ধরনের কোনো বিষয়সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। কে যেন ‘নেক্সট সিনিয়র হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করলো। হুমায়ূন দুম করে বলে বসলো, আনিস সারের চেয়ে আমি সিনিয়র। সবাই একটু অবাক হওয়ায় সে ব্যাখ্যা করলো, সন্‌জীদা খাতুন ও সে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন, তাই তাঁদের অবেক্ষাধীন কাল–প্রবেশন পিরিয়ড-এক বছরের, আমি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে অধ্যাপক হয়েছি। বলে আমার অবেক্ষাধীনকাল দু বছরের। আমার দু বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয়নি, তাদের এক বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অতএব, আমার আগে তাঁদের। নিয়োগ কনফার্মড–পাকা–হয়েছে। ফলে তারা আমার সিনিয়র হয়ে গেছেন। এ-বিষয়ে হুমায়ূনের কাছে রেজিস্ট্রারের চিঠি আছে। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তখন বিভাগের সভাপতি। তিনি হুমায়ূনকে বললেন, ‘চিঠিটা নিয়ে আসুন আমরা দেখি।’ আমি বললাম, তার কোনো দরকার নেই, হুমায়ূনের মুখের কথাই যথেষ্ট। তাদের দু জনকে আমার সিনিয়র ধরে কমিটির বিষয়ে যা। করণীয়, তা করা হোক।

১৯৬৯ সালে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাই তখন, বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার হিসেবে আমার স্থান ছিল সপ্তম। আমার জ্যেষ্ঠ যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনজন বেঁচে নেই, দুজন অবসর নিয়েছেন। তারপরও চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসার পরে জ্যেষ্ঠতার নিরিখে আমার স্থান হয়। সপ্তম। এখন নবম হলো। সাত থেকে নয় এমন কিছু নয়ছয়ের বিষয় নয়।

৫.

শিল্পী রশিদ চৌধুরীর জীবনের শেষ দিনগুলি কষ্টেই কেটেছিল।

দুই স্ত্রীর থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকায় বাস করছিলেন তিনি। বেশি কাজ করতে পারছিলেন না বলে তার ওপর একটা আর্থিক চাপ ছিল। এরই মধ্যে বেশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুদিনের মধ্যে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন প্যারিসে। সেখানে অ্যানি এবং রোজা-রীতার সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটলো। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় ভর্তি হলেন হাসপাতালে। তাঁর ফুসফুস ও পেটে পানি জমেছিল খুব বেশি। পানি বের করা হলো বটে, কিন্তু চিকিৎসকেরা। তার জীবনের আশা দেখতে পেলেন না। রশিদ নিজেই দেশে ফিরে আসতে চাইলেন। প্যারিসে তাকে দেখাশোনা করছিল ওবায়েদ জায়গীরদার। ডাক্তারেরা। তাকে বলেন, রোগী চাইলে দেশে ফিরে যেতে পারে, তবে তার ভ্রমণকালে সঙ্গী হতে হবে একজন চিকিৎসককে। ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ তখন ছিলেন। লন্ডনে। ওবায়েদের অনুরোধে তিনি প্যারিসে আসেন, হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে রোগীর অবস্থা বুঝিয়ে দেন, তিনি রশিদের সঙ্গে ঢাকায় আসতে সম্মত হন। একই সঙ্গে অ্যানি এবং রোজা-রীতাও ফিরে আসে। ওবায়েদ সকলের যাত্রার ব্যবস্থা করে দেয়, রশিদ যাতে বিমানে শুয়ে আসতে পারেন, সেজন্যে বাড়তি টিকিটও কিনে দেয়।

ঢাকায় ফিরে রশিদ ভর্তি হন ধানমন্ডির মহানগর ক্লিনিকে। খবর পেয়ে বেবী ও আমি তাকে দেখতে যাই। তাঁর, যাকে বলে, মুমূর্ষ অবস্থা। তবু, মনে হয়, চিনতে পারলেন আমাদের, মুখে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন স্মিত হাসি। ওইটুকুই। জানলাম, সে-সময়ে তাঁকে দেখতে আসতে চেয়েছিল জান্নাত, কিন্তু অ্যানি এবং রোজা-রীতার প্রবল আপত্তির মুখে তার আর আসা হয়নি। শারীরিক কারণেই পরিস্থিতির ওপর রশিদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

রশিদকে যখন আবার দেখতে যাই, তখন তাঁর জ্ঞান ছিল না। সংজ্ঞাহীন অবস্থায়ই ৫৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়।

পরদিন তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে। সেখানকার ছাত্র-শিক্ষকেরা ভিড় করেছিল তাকে ঘিরে, চারদিক থেকে বন্ধু বান্ধবেরা ছুটে এসেছিল। জান্নাত শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকে রশিদকে দেখতে যেতে পেরেছিল।

৬.

জওহরলাল নেহরু এবং অং সানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে এশিয়ান রিলেশন্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত অং সান এতে যোগ দিতে পারেননি (ওই এপ্রিলেই সাধারণ নির্বাচন ছিল বার্মায়), তবে এশিয়ার ত্রিশটি দেশের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকেরা এসেছিলেন, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল।

এই সম্মেলনের স্মরণে চল্লিশ বৎসর পর আরেকটি সম্মেলন আয়োজিত হয় নয়াদিল্লিতে, ভারত সরকারের উদ্যোগে। এশিয়ান রিলেশন্স কোমেমোরেটিভ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন ও আমি তাতে যোগ দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে আরো কেউ কেউ বোধহয় গিয়েছিলেন। এশিয়ার নানা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন এই বিশাল আনন্দযজ্ঞে। ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি স্বাগত ভাষণ দিয়েছিলেন। শঙ্কর দয়াল শর্মা উদ্ধৃত করেছিলেন বৈদিক মন্ত্র, রাজীব গান্ধি বাংলায় ও ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছিলেন নজরুল ইসলামের কবিতার চরণ।

সম্মেলন হয়েছিল বিজ্ঞান ভবনে। বহু লোকজন, আলোচ্য বিষয় অনেক। একই সঙ্গে একাধিক কক্ষে অধিবেশন বসছে। অধিবেশনের বাইরেও একান্তে। কিংবা দল বেঁধে গল্পসল্প অথবা তর্ক চলছে। রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী–নানা পেশার, নানা মতের লোক রয়েছেন। কে আসছেন, কে যাচ্ছেন, তাও সবসময়ে ঠাহর করা যায় না।

সব দেশের প্রতিনিধিরাই এশিয়ায় শান্তি ও ঐক্যপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। কথাটা বলা যত সহজ, করা ততটা নয়। তখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলছিল। সেই যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা কেমন, তা জানতে চেয়েছিলাম এক ইরানি প্রতিনিধির কাছে। তাঁর আশা, যুদ্ধ অচিরে শেষ হবে। উৎসাহভরে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে। তিনি বললেন, ইরাককে হারাতে পারলেই। ইরাকের জনদুই প্রতিনিধিও বললেন, ইরানকে পর্যুদস্ত করেই শান্তিপ্রতিষ্ঠা ঘটবে।

ভারতীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে বরুণ দে ছিলেন। এশীয় ঐক্যপ্রচেষ্টার ইতিহাস স্মরণ করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ওকাকুরার কথা বললেন। তার ইচ্ছাক্রমে সে-সম্পর্কে আমি দু-চারটে কথার জোগান দিলাম।

সম্মেলনের বাইরেও জমেছিল ভালো। মুশারফ হোসেন ও আমার বন্ধু অর্জুন সেনগুপ্ত–সে বোধহয় তখন ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সচিব–বেশ বড়ো। এক ভোজের আয়োজন করলো। সেখানে পরিচয় হলো পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. আলাগের সঙ্গে। তিনি তার আগে ছিলেন দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিসের অধ্যাপক, পরে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অর্জুনের ভোজে আর যদের সঙ্গে পরিচয় হয়, তাঁদের মধ্যে ওবেরয়-পরিবারের এক দম্পতি ছিলেন–নেপালে তাঁদের বোতলের ব্যবসা। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাঠমান্ডুতে তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মনুভাই নামে এক বিদ্যানুরাগী ব্যবসায়ীর সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার অনুরোধে পরের বার নয়াদিল্লিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন আমাকে। ড. আলাগও প্রথমবার আমাদের আলাদা করে খাইয়েছিলেন। তিনি উপাচার্য হওয়ার পরে আবার দেখা হয়েছিল। চিনতে ভুল করেননি।

৭.

১৯৮৭ সালের অনেকখানি জুড়ে, বিশেষ করে বছরের শেষদিকে, এবং ১৯৮৮ সালের শুরুতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে অন্তরীণাবদ্ধ করা হয়, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, জাতীয় সংসদ বিলোপ করা হয়, বাংলাদেশে বিবিসির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়–তার আগে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদও গ্রেপ্তার হন। বিরোধী দলের আহ্বানে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে–বিশেষত ঢাকায়–সরকারপক্ষীয় ও বিরোধী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত ঘটতে থাকে ক্রমাগত। চট্টগ্রামে হাসিনার নেতৃত্বাধীন মিছিলে পুলিশের গুলিচালনায় কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে।

এ-সময়ে রাজনীতিবিদ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে। আত্মগোপন করে থাকেন। আত্মগোপনে থেকে ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা। চৌধুরী আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতেন। একদিন কথা বলে তিনি টেলিফোন আরেকজনকে দিলেন। গলা শুনে টের পেলাম তিনি তার ভায়রাভাই আসাদউল্লাহ। বুঝলাম তাঁর বাড়িতেই ডা. চৌধুরী বাস করছেন। সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ আত্মগোপন করেছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদের বাড়িতে। কিছুকাল পরে ইশতিয়াক আহমদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর দুর্গতির জন্যে আমরা অনেকে ফয়েজ আহমদকে দায়ী করেছিলাম।

ইশতিয়াক কারাগারে থাকতে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটে। জানাজায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। ইশতিয়াকের সঙ্গে দেখা করতে আমরা ছুটে যাই। দেখলাম, শারীরিক অসুবিধে সহ্য করেও তাঁর মনোবল অক্ষুণ্ণ আছে। পরে ইশতিয়াক যেদিন মুক্তি পান সেদিনই গ্রেপ্তার হন ফয়েজ আহমদ। এমনই অদ্ভুত সংঘটন! ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে-প্রকোষ্ঠ থেকে ইশতিয়াক মুক্তি পান, সে-প্রকোষ্ঠেই তার জায়গায় স্থান হয় ফয়েজ আহমদের।

এমন পটভূমিকায়, তবে শেষোক্ত ঘটনার আগে, ১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে জাতীয় কবিতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে কবিতা-পাঠের আসরে কবি আবুল হোসেনকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি শারীরিক কারণে অসমর্থ হওয়ায় ওই আসন দেওয়া হয় শিল্পী কামরুল হাসানকে। মঞ্চে বসে জেনারেল এরশাদের ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন তিনি, চিত্রের পরিচিতি লিখেছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে। সেই সন্ধ্যায়ই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই মঞ্চে ঢলে পড়েন তিনি। শেখ হাসিনার গাড়িতে তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে, কিন্তু ততক্ষণে বড়ো দেরি হয়ে গেছে।

পরদিন তার লাশ নিয়ে আসা হলো চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ছাত্র-শিক্ষকদের ইচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সিন্ডিকেট এর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর কাউকে এখানে সমাধিস্থ করা হবে না। যারা সেখানে কামরুল হাসানকে দাফন করার অনুরোধ নিয়ে উপাচার্যের কাছে গেলেন, তাদেরকে উপাচার্য সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বললেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পক্ষে অনুমতি দেওয়া অসম্ভব। শেষকালে বিষয়টি বিবেচনার জন্যে তিনি সিন্ডিকেটের বিশেষ সভা আহ্বান করতে সম্মত হলেন।

ইত্যবসরে ফয়েজ আহমদ ঘোষণা দিলেন, কামরুল হাসান তাঁর প্রিয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণেই শেষ শয্যা নেবেন। তিনি তার ব্যবস্থা করতে উপস্থিত সবাইকে আহ্বান করলেন। কবর খোদাইকারদের আগেই ডেকে আনা হয়েছিল। ফয়েজের ঘোষণার পরে তুমুল হইচইয়ের মধ্যে কোদাল পড়ল মাটিতে।

এই কামরুল ভাইই আমাদের ব্রতচারীর গান শিখিয়েছিলেন : ‘চল কোদাল চালাই/ভুলে মানের বালাই।’ কিন্তু সে-কোদালচালনার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন।

কামরুল হাসানের মৃত্যু নিয়ে, ওই অনুষ্ঠানে তাদের জায়গা-বদল নিয়ে, পরে ‘নিয়তি’ নামে একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লেখেন আবুল হোসেন।

৮.

চট্টগ্রামের সুসন্তান ডা. বি বি চৌধুরী পূর্ব লন্ডনে জেনারেল প্র্যাকটিস করেন। সেখানে পিপলস হেল্থ ক্লিনিক নামে তার একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে–ওই কেন্দ্রে প্রায় বিনামূল্যেই চিকিৎসা পাওয়া যায়, কয়েকজন উদীয়মান ডাক্তারও সেখানে প্রায় বিনাভাড়ায় বাস করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ডা. চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠিত করতে, বিশেষ করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে, সক্রিয়। এতে তার কিছু বিরূপ সমালোচনাও হয়, কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য করেন না। কানুনগোপাড়ায়ও তিনি একটি দাঁতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র চালান।

এহেন ডা. চৌধুরী ১৯৮৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বড়ো করে পালন করবেন বলে স্থির করে সেখানে আমাকে আহ্বান করলেন অতিথি-বক্তা হওয়ার জন্যে। সেইসঙ্গে যোগ করলেন, আমি যেন আমার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে যাই সঙ্গে করে–তিনি আমার হৃদয়কে শাসিত করবেন। তার আমন্ত্রণের সমর্থন জানালেন আমার বন্ধু এ বি এম শফিউল্লাহ, আমার ছাত্র গোলাম মুরশিদও সবুজ সংকেত জানালো।

যথারীতি হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানো গেল। এঁরা তিনজনই আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। শফিউল্লার গাড়িতে করে আমরা সবাই তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম।

তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছিন্ন করে শফিউল্লাহ্ তখন থাকেন উত্তর লন্ডনে। সুসজ্জিত এক বিশাল বাড়িতে–গোলডার্স গ্রিন ও ব্রেষ্ট ক্রসের মাঝামাঝি জায়গায়। এক ফিলিপিনা মেয়ে রোজ দুবেলা এসে শফির বাড়ি পরিষ্কার করে, বিছানা করে, ডিশওয়াশারে হাঁড়িবাসন ধোয়, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধুয়ে ড্রায়ারে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে, তার অনুপস্থিতিতে টেলিফোনের বার্তা লিখে রাখে–শফির সঙ্গে তার পিতা-পুত্রীর সম্বন্ধ। শফির পরিচ্ছন্নতার বাতিক আগের চেয়ে বেড়েছে–আমি তো না-বুঝেই জুতো নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়লাম, অন্যদের জুতোবিহীন পা দেখে পরে জুতো খুলে রেখে এলাম দরজার বাইরে। শফি অবশ্য প্রতিবাদ করতে থাকলেন, কিন্তু সেদিন বিকেলেই আমার জন্যে একজোড়া কালো মোকাসিন কিনে আনলেন–যাতে জুতোর ফিতে খোলা ও বাধার কষ্ট করতে না হয়। আমরা পৌঁছোবার পর শফি নিজেই চা বানিয়ে আনলেন–চিনির পাত্রে ব্রাউন সুগার। দেখে আমি বললাম, শফি, ব্রাউন সুগার পর্যন্ত চলবে, কিন্তু ব্রাউন ব্রেড চলবে না।’ শফি বললেন, ‘স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি আপনার বিরাগ–একবার খেয়েই দেখুন না।

সন্ধ্যার পরে ফোন করলেন শফিক রেহমান। বললেন, তুমি এমন একটা অনুষ্ঠানে এসেছ যা বিতর্কিত। ভালো হয়, তুমি যদি না যাও।’ আমি বললাম, ‘আমার ঢাকার ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে। আগে ফোন করলেন না কেন? এদের টিকিটে এখানে এসেছি–তারপর এদের অনুষ্ঠানে না গিয়ে পারি কী করে!’ শফিক রেহমান হাসলেন। বললেন, ‘সিক হয়ে যাও।’ বললাম, তা হয় না। খানিক পরে আরো একজন একই মর্মে ফোন করলেন। তাঁকেও আমি একই উত্তর দিলাম। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল।

অনুষ্ঠানের আগের রাতে অনুষ্ঠানস্থলে হাঙ্গামা হলো। একটা ছোট্ট শহিদ মিনার করা হয়েছিল–সেটা ভেঙে দেওয়া হয়। বন্ধ মিলনায়তনে প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে জনদুই তরুণ গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। শুনলাম, লন্ডনে নিযুক্ত আমাদের হাই কমিশনার এবং দূতাবাসের আরো দু-একজন কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে আসবেন–সরকারবিরোধী বাঙালিরা তা চান না। হাই কমিশনার বা কর্মকর্তাদের অবশ্য বক্তৃতা দেওয়ার কথা নয়, তারা শ্রোতা হিসেবে যোগ দেবেন, কিন্তু তাও অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

গ্রেপ্তারের সংবাদে মনটা আরো বেশি খারাপ হলো। তবু যথাসময়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলাম।

লন্ডনে তখন আমাদের হাই কমিশনার জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ডিফেনস অ্যাটাশে কর্নেল আমসা [এ এম এস এ] আমিন–প্রতিবাদীদের আপত্তি মূলত তাকে নিয়েই, আরো দু-একজন কর্মকর্তা। ডা. বি বি চৌধুরী চাইছেন যতটাসম্ভব আমার সরকারবিরোধী ভাবমূর্তি বড়ো করে তুলে দিতে। আমাকে মঞ্চে আহ্বান করার সময়ে তিনি প্রবল আবেগাক্রান্ত হয়ে আমার পরিচয় দিলেন এবং বলে ফেললেন, ‘গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার জন্যে যিনি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন, সেই ড. আনিসুজ্জামান। প্রাণ ধারণ করে আছি বলে সেই মুহূর্তে যতটা লজ্জিত হয়েছিলম, বোধহয় তার আগে বা পরে আর কখনো ততটা হইনি।

বক্তৃতাটা উতরে গেল। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বললাম, ভাষা-সংস্কৃতির কথা বললাম, গণতন্ত্রের অপরিহার্যতার কথা, দেশে গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামের কথা বললাম। প্রতিবাদীরা সমগ্র অনুষ্ঠানে আপত্তির কিছু খুঁজে পেলেন না।

আমার আগে গোলাম মুরশিদ বক্তৃতা করেছিল। তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই কেতকী কুশারী ডাইসন এসেছিলেন অক্সফোর্ড থেকে। অনুষ্ঠানের পরে আমরা তিনজন চা খেতে বসেছিলাম একটা রেস্টুরেন্টে। কেতকী বললেন, সবাই যখন আপনাকে সার বলে, আমিও তাই বলব। তারপর তার রবীন্দ্রনাথ ও ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে বইটি উপহার দিলেন আমাকে, তাতে কৌতুকচ্ছলে আমাকে সম্বোধন করলেন স্যার/ আনিসুজ্জামান বলে। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠানের পালা চুকল। এবারে আমার চিকিৎসার উদ্‌যোগ।

৯.

১৯৮৬ সালের একেবারে শেষদিকে আমার হৃদযন্ত্রের গোলযোগ ধরা পড়ল। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর চিকিৎসাধীন থাকলাম। বিলেত যাওয়ার আগে তার কাছ থেকে আমার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সংক্ষিপ্তসার লিখিয়ে নিলাম। সেটা সেখানকার চিকিৎসককে দেখাতে হবে। ডা. চৌধুরী বলে দিলেন, লন্ডনের পরীক্ষায় সম্ভবত একটা ব্লক ধরা পড়বে।

ড. কামাল হোসেন পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, লন্ডনে গিয়ে যেন তার বোন আহমদীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আহমদীকে ফোন করতেই তিনি বললেন, কিংস হসপিটালে ডা. জ্যাকসনের সঙ্গে আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে রেখেছেন। আমি যেন যথাসময়ে তার সঙ্গে দেখা করি। একটু বিব্রত হলাম। কেননা ডা. বি বি চৌধুরী বলে রেখেছেন, আমাকে নিয়ে আরেক ডাক্তারের কাছে যাবেন। তিনি অবশ্য এখন বললেন যে, ডা. জ্যাকসন নামকরা চিকিৎসকতার মতামত কাজে আসবে।

প্রাথমিক পরীক্ষার পরে ডা. জ্যাকসন জানালেন, আমার অ্যানজিওগ্রাম করা দরকার–তারপরই কেবল বলা যাবে কী ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।

ডা. বি বি চৌধুরী এবারে আমাকে নিয়ে গেলেন ডা. মার্টিন রথম্যানের কাছে। তিনিও নানারকম পরীক্ষা করতে দিলেন। যে-তরুণীটি এক্স-রে করলো, সে খুবই সুন্দরী। আমাকে নির্দেশ দিলো, আমি বললেই শ্বাস বন্ধ করে রাখবে খানিকক্ষণের জন্যে। বললাম, তোমাকে বলতে হবে না, তুমি ঘরে ঢুকলেই আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কী!

ডা. রথম্যান শেষে একই কথা বললেন, অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। শফিউল্লাহর সঙ্গে পরামর্শ করে এবং বাড়িতে কথা বলে ঠিক করলাম, তারই কাছে অ্যানজিওগ্রাম করবো। তিনি আসতে বললেন স্টেপনি গ্রিনের কাছে লন্ডন ইনডিপেনডেন্ট হসপিটাল নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে।

ইত্যবসরে তসন্দুক আহমেদের আয়োজনে একুশে ফেব্রুয়ারি-উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলাম পূর্ব লন্ডনে। সেখানে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক শ্রোতা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে, তাহলে বলেন, আমরা সিলেটিরা কেন সিলেটিতে শিক্ষা নিতে পারবো না? আমি ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছিলাম, কিন্তু তার আগেই তসদুক আহমেদ–তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন–বলে দিলেন, আপনাকে এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তারপর প্রশ্নকর্তাকে বললেন, ‘এ-বিষয়ে অন্য কোনো সময়ে আলোচনা হবে। প্রশ্নকর্তা খুশি হলেন না। সভাশেষে আমি তসন্দুক আহমেদকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তো ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম–আপনি বাধা দিলেন কেন? উনি বললেন, আপনি উত্তর দিলে আলোচনাটা সেখানেই থামতো না–অন্যদিকে গড়াতে থাকতো। আমি ওকে জানি।’

পরে তসদুক আহমেদ ফোন করে জানান, ওই বক্তৃতা বাবদ আমার কিছু সম্মানী প্রাপ্য হয়েছে। কাউকে পাঠিয়ে আমি যেন আনিয়ে নিই।

যেদিন হাসপাতালে গেলাম, শফি ছিলেন সঙ্গে। তাকে বললাম, আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলে তিনি যেন তসন্দুক আহমেদের কাছ থেকে সম্মানীটা নিয়ে আসেন। তাঁর অবস্থান হাসপাতালের কাছেই।

হাসপাতালে আমাকে একটা কেবিন বরাদ্দ করা হলো। পোশাক পালটে রক্ত ইত্যাদির নমুনা দিয়ে খানিক বিশ্রাম। তারপর হুইল চেয়ারে করে অপারেশন থিয়েটারে যাওয়া।

ডা. রথম্যান বুঝিয়ে বললেন, হাতের যেখানটা আমরা ভাজ করি, সেখানে একটু কেটে ধমনী দিয়ে একটা তার ও ডাই, একটু গরম বোধ হবে, ঢুকিয়ে দেবেন–যে-কোনো পর্যায়ে ব্যথা পেলে বা অস্বস্তিবোধ হলে তাঁকে যেন জানাই। আমাকে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হবে, সুতরাং আমার জ্ঞান থাকবে–পাশে মনিটরের দিকে তাকালে আমার কী হচ্ছে তার ছবি দেখতে পাবো।

ছবি মোটেই চিত্তাকর্ষক নয়–তাই দেখতে ইচ্ছে হলো না। একটু ঘোর-ঘোর ভাব ছিল। একবার বোধহয় অনিচ্ছায় হাত টেনে নিয়েছিলাম। ডাক্তার খুব ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলেন, আমার কষ্ট হচ্ছে কি না। বললাম, ও কিছু না। তিনি বললেন, তাঁকে জানাতে যেন ইতস্তত না করি। তারপর আমার কাছে সব অস্পষ্ট।

ট্রলিতে করে আমাকে কেবিনে ফিরিয়ে আনা হলো। ডাক্তার জানালেন খানিক পরে তিনি আসবেন কথা বলতে।

কেবিনে পাংশুমুখে শফি দণ্ডায়মান। জানতে চাইলাম, টাকা আনতে গিয়েছিলেন কি না। তিনি ধমকে উঠলেন, রাখেন আপনার টাকা। আমি আপনার চিন্তায় অস্থির–আর আপনি ওই কটা টাকার কথা ভাবছেন!’

ডা. রথম্যান জানালেন, একটা ব্লক পাওয়া গেছে। তার মতে, অ্যানজিওপ্লাস্টি করানো দরকার। আমি সম্মত হলে তিনি ব্যবস্থা করবেন। বললাম, দু-একদিনে জানাবো আপনাকে।

বিশ্রাম সেরে শফির বাসায় ফেরা। শফি খুবই চিন্তিত। আমি ভাবছি, অতটা খরচ করবো কীভাবে।

বাড়ির সকলের মত, চিকিৎসা করেই ফেরা ভালো। আমার ভাগ্নে মামুন তখন সউদি আরবে। সে বললো, সে কিছু টাকা পাঠাচ্ছে–চিকিৎসা যেন হয়। টাকা অনেক লাগবে। শফি চেনাজানা সকলকে ফোন করে চাদা তুলতে শুরু করলেন। ওসমান জামাল, সিরাজুর রহমান, শফিক রেহমান, শামসুদ্দীন আহমদ মানিক (পরে হাইকোর্টের বিচারপতি), আরো কেউ কেউ চেক পাঠালেন। প্রয়োজন অবশ্য অনেক বেশি। কথাটা চাউর হতে এক-আধটা অপ্রিয় মন্তব্যও কানে ভেসে এলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমদ তখন বিসিসিআই ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। তিনি দেশ থেকে লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছিলেন সস্ত্রীক। কার কাছে খবর পেয়ে শফিকে ফোন করলেন–আমাদের দুজনকে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানালেন তার হোটেলে।

খেতে খেতে আমার স্বাস্থ্যের খবর নিলেন, ডাক্তারের মতামত শুনলেন, চিকিৎসার সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ জানতে চাইলেন। শেষে বললেন, আমার আপত্তি না থাকলে পুরো খরচটা তিনি বিসিসিআই ফাউন্ডেশনকে বহন করতে বলবেন। আমাকে কিছুই করতে হবে না, কোনো আবেদনও নয়। ফাউন্ডেশনকে তিনি লিখবেন, শফি আমার হয়ে চেক গ্রহণ করবেন, শুধু ব্যয়সংক্রান্ত সকল রসিদপত্র ফাউন্ডেশনকে পাঠিয়ে দিতে হবে।

আমি একেবারেই হতবাক। নাজিরউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার পরিচয় এতটা ঘনিষ্ঠ নয় যে আমার চিকিৎসার দায়দায়িত্ব তাঁকে ঘাড়ে তুলে নিতে হবে। আমি যে-পরিস্থিতিতে ছিলাম তাতে বললে অর্থ-সাহায্যের জন্যে আবেদন করতে আমি যে খুব ইতস্তত করতাম, তা নয়। কিন্তু আমার সম্মান তিনিই রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। এসব বিষয়ে তিনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন। তার ব্যবহারে আপ্লুত না হয়ে উপায় ছিল না।

ঘরে ফিরে শফি পাওয়া চেকগুলো ফেরত দিতে শুরু করলেন। প্রত্যেককেই দীর্ঘ কৈফিয়ত দিতে হলো। নাজির ভাই যদিও বলে দেননি, তবু শফি ও আমি বিসিসিআই ফাউন্ডেশনের নামটা প্রচার না করারই সিদ্ধান্ত নিলাম। ফলে, যাদের সাহায্য ধন্যবাদের সঙ্গে ফেরত দেওয়া হলো, তাঁদের সবার মনে নিশ্চয় এই প্রশ্ন জেগেছিল যে, হঠাৎ করে এত অর্থের সংস্থান কীভাবে হলো।

ডা. বি বি চৌধুরী খুব খুশি। তিনি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ চিকিৎসা করে আমাকে ফেরত পাঠাতে। কাজটা হবে কি না, এমন সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এখন মনে হলো, তরী তীরে ভিড়বে। তার উৎসাহে জোয়ার এসে গেল।

নির্দিষ্ট দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গেল। শফির চিন্তা বাড়ছে–আমার ভালোমন্দের সকল দায় তাঁর। আমার কিছু ঘটে গেলে আমার পরিবারকে কী কৈফিয়ত দেবেন!

ভর্তির সময়ে মাসিমাকে নিয়ে বুলু এলো। আমাকে সাহস জোগাবার দরকার ছিল না, তা সে জানতো। তবু মৃদুকণ্ঠে বলতে চেষ্টা করলো যে, অ্যানজিওপ্লাস্টি ব্যাপারটা শক্ত কিছু নয় এবং যদিও আপকালে সাহায্যের জন্যে সার্জনদের একটা টিম তৈরি রাখা হয় অপারেশন থিয়েটারে (বলা বাহুল্য, রোগীর খরচে), তবু তেমন কিছুর দরকার হয় না সচরাচর।

প্রাইভেট হাসপাতাল–প্রায় পাঁচতারা হোটেলের মতো। সন্ধ্যায় মেনু নিয়ে এলো একটি মেয়ে–চঞ্চল বালিকাই বলা চলে–সঙ্গে ওয়াইন লিস্ট। রোগশয্যায় ওয়াইন খাওয়ার স্পৃহা নেই, খাবারের তালিকা দেখছি মনোযোগ দিয়ে। মেয়েটির আর তর সয় না। জিজ্ঞেস করলো, সে কিছু পরামর্শ দিতে পারে কি না। হেসে বললাম, শুনি তোমার সুপারিশ। সে বললো, তোমার যা যা খাওয়া নিষেধ–সব খেয়ে ফেলো, কাল তো অপারেশন হচ্ছে। তার সরলতা দেখে এবার জোরেই হেসে ফেললাম।

পরদিন অ্যানজিওপ্লাস্টি–বেলুনিং কথাটারই চল বেশি, তখনো স্টেনটিংয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে শফির কাছে আমার পকেট-চিরুনিটা চাইলাম। শফি বিরক্তির সঙ্গে জানতে চাইলেন, এখন চিরুনি দিয়ে কী করবেন?

বললাম, চুলটা একটু আঁচড়ে নিই, ও টি-তে যদি সুন্দরী নার্স থাকে!

শফির চিন্তাক্লিষ্ট মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটলো।

শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন ছাত্রকে : ‘গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে তুমি সামনে দেখতে পেলে বাঘ। তোমার সঙ্গে কেউ নেই, হাতে কোনো অস্ত্র নেই। এই অবস্থায় তুমি কী করবে?’ ম্লানমুখে ছাত্র উত্তর দিয়েছিল : আমি আর কী করবো সার, যা করার তা বাঘই করবে!

ও টি-তে ঢুকে আমারও কিছু করার ছিল না, যা করার ডাক্তারই করলেন এবারে আমাকে অজ্ঞান করে।

জ্ঞান যখন ফিরলো, তখন আমি কেবিনের বিছানায়। দেখি, শরীরে নানারকম তার লাগানো আর আমার পা-দুটো দুহাতে ধরে আছে ঊর্মি–ঊর্মি মজহার, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ছোটো বোন। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন পা না নাড়াই–সে দায়িত্ব নিয়েছে ঊর্মি। তার সঙ্গে এসেছে ফারুক হায়দার–সেই পরিচয় হলো। অদূরে ম্লানমুখে শফি। আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে বললেন, আমি বাসায় গিয়ে বরঞ্চ ভাবিকে টেলিফোন করি।’

ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটে বাড়ির সবাই ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের ভিড়। শফির টেলিফোন পেয়ে সবার স্বস্তিবোধ হলো।

আমার কেবিনে শর্ট-সার্কিট টিভি ক্যামেরা। কয়েকটা মাত্র কেবিনের মনিটর করছে তিন-চারজন নার্স। কখনো অস্ফুট আওয়াজ করেছি। লাউডস্পিকারে প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘ইয়েস মিস্টার জামান, এনি প্রবলেম?

অমন সেবা-শুশ্রূষা কখনো পাইনি–আগেও নয়, পরেও নয়। যখন দাড়ি কামালাম, নার্স সামনে আয়না ধরে থাকলো। যেদিন গা মোছার অনুমতি পাওয়া গেল, সেদিন নার্স বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সর্বাঙ্গ স্পঞ্জ করে দিল। কেবিনে-কেবিনে ম্যানিকিউরিস্ট ঘুরে যাচ্ছে–বাড়তি পয়সা দিয়ে নখ কাটবো কি না জানতে। পথ্যবিদ এলেন পরামর্শ দিতে। কথা বললেন অনেকখানি সময় নিয়ে। একটা ছাপানো কাগজ দিলেন মহিলা। বললেন, এ-কাগজে লেখা আছে কোনটা তোমার খাওয়া উচিত, কোনটা অনুচিত। তবে আমরা তো সামাজিক জীব–সবসময়ে নিয়ম ধরে চলা যায় না। একবেলা যদি অনিয়ম হয়ে যায়, আরেক বেলায় সেটা পুষিয়ে নিও। তুমি নিজেই বুঝবে কী তোমার করণীয়।

ডাক্তার এসে জানালেন, তাঁর কাজ সফল হয়েছে, এখন আমার ছুটি। বললেন, আজ বিকেলে ক্লান্তিবোধ না হওয়া পর্যন্ত তুমি হাঁটবে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রত্যেকদিন হাঁটবে–এর ব্যত্যয় করা চলবে না।

হাসপাতাল থেকে বের হবার ঠিক আগে জেনারেল শফিউল্লাহ্ দেখতে এলেন। সঙ্গে হাই কমিশনের আরো দু-তিনজন। জেনারেল শফিউল্লাহ্ অভিজ্ঞ রোগী–তিনি বাইপাস করিয়েছেন, তারপর অ্যানজিওপ্লাস্টিও। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, বাইপাসের পরে আবার অ্যানজিওপ্লাস্টি কেন? তিনি বললেন, ‘একাধিক ব্লক থাকায় বাইপাস করা হয়েছিল, তারপর আবার একটি আর্টারিতে ব্লক দেখা দিলো–তখন অ্যানজিওপ্লাস্টি।’

তখনই বুঝতে পারলাম, আমি যে অ্যানজিওপ্লাস্টি করলাম–সেটাই নিরাময় নয়। এ-পথেই আবার হাঁটতে হতে পারে।

হাই কমিশনের সবাই চলে যাওয়ার পরে সর্দার নার্স এলেন। বললেন, তুমি, মনে হয়, তোমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ লোক।

কেন?–পালটা প্রশ্ন করি।

নাহলে সদলবলে হাই কমিশনার দেখতে আসে!

বলি, ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে–তাই এসেছিলেন। আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই।

তিনি হাসেন। বলেন, আমরা ঠিকই বুঝতে পারি, কখন কাকে কেন কোনো উচ্চ পদাধিকারী দেখতে আসে!

হাসপাতাল থেকে আনন্দিতচিত্তে শফির বাড়ি পৌঁছোলাম। সেই বিকেলেই শফি নিয়ে গেলেন ব্রেনট ক্রস শপিং সেন্টারে। বললেন, ‘হাঁটাহাঁটিটা এখান থেকেই আরম্ভ হোক। কিছু কেনাকাটার থাকলে তাও করে নিতে পারেন।’

একটা সুটকেস কিনে ফিরলাম।

পরদিন বাড়িতে অনেকে এলেন দেখতে। প্রত্যাশিতভাবে রোজী, অপ্রত্যাশিতভাবে আনোয়ারা সৈয়দ হক। আরো অনেকে।

ডা, মার্টিন রথম্যান ফোন করে জানালেন, একটা কনফারেসে তিনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। আরেকজন ডাক্তারের নাম ও ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, কোনো অসুবিধে হলে যেন তাকে ফোন করি। অসুবিধে হবে ভাবিনি, কিন্তু হলো। জ্বর এলো এবং ছাড়তে চাইলো না। বদলি ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো, সুবিধেজনক সাড়া পাওয়া গেল না।

মাসিমাকে নিয়ে বুলু এলো দেখতে। বললো, ‘চলো আমার বাড়িতে। কাল অন্য ডাক্তার দেখাবো।’

রাতটা তার ওখানে কাটিয়ে পরদিন অন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম বুলুর সঙ্গে। তিনি বুলুকে বললেন, তুমি জানো আমি প্রাইভেট রোগী দেখি না। আমি পরামর্শ দিতে পারবো না–দেওয়াটা উচিত হবে না। তুমি হাসপাতালের ডাক্তারের কাছেই রোগীকে নিয়ে যাও।

বুলু তাই করলো। এবারে বদলি ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু কী যে করবেন, সে-সম্পর্কে তাঁকে নিশ্চিত মনে হলো না। ওষুধ দিলেন বটে, তবে যেন দ্বিধার সঙ্গে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য জ্বর গেল–সেটা এমনিতে হোক অথবা ওষুধের গুণে হোক। তবে রোগীর প্রতি আগ্রহ ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে, রোগীর আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে, নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে জনে-জনে যে পার্থক্য ঘটে, তার পরিচয় আবার পেলাম।

১০.

শফির ফিলিপিনা মেড বললো, আপনাকে শওকত নামে একজন ফোন করেছিলেন। বললেন, আগরতলায় তার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল। ফোন নম্বর দিয়েছেন, কথা বলতে বলেছেন।

আগরতলায় যে-শওকতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী ছাড়া আর কেউ নন। তিনি যুক্তরাজ্যে আমাদের সাবেক হাই কমিশনার, জার্মানিতে সাবেক রাষ্ট্রদূত। কিন্তু কাছের পরিচয়টা না দিয়ে আগরতলার কথা কেন বললেন?

ফোন করে সেটাই প্রথমে জানতে চাইলাম। মীর শওকত আলী হাসলেন। বললেন, ‘আগরতলায়ই তো আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল। আর আমার তখনকার পরিচয়ই তো আসল পরিচয়। পরেরগুলো যেমন এসেছে, তেমনি গেছে।

তিনি ফোন করেছিলেন আমি কেমন আছি, তা জানতে। যদি ভালো থেকে থাকি, তাহলে দু-একদিনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারি কি? অনেক দিন দেখা হয় না, অনেক কথা জমে আছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি আমার কাছে শুনতে চান।

মীর শওকত মুক্তিযুদ্ধের পরে চট্টগ্রামের জিওসি হয়েছিলেন। তখন তার সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা হতো। টেলিফোনে কথা হতো তার চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম থেকে তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। এতদিন পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি আমার খবর নিচ্ছেন, তা আমার জন্যে আনন্দের বিষয়।

আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে জেনারেল শওকতের বাসস্থান একটু দূরে। টিউব বদলে যেতে হয়। যতক্ষণে পৌঁছোবো ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বেশি সময় লেগে গেল। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডের নিষ্ক্রমণপথে অপেক্ষা করছেন, প্রতিবার ট্রেন এলেই যাত্রীদের দিকে নজর রাখছেন। দুপুরে খাওয়ার সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, চা-কফি কিছু একটা খেয়ে নিয়ে প্রতীক্ষার ক্ষণ পার করছেন তিনি। আমি ট্রেনে বসে অথবা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত-সময়মতো পৌঁছোতে পারছি না, ওঁকে তা জানাতেও সমর্থ হচ্ছি না।

স্টেশনে পৌঁছে মাফ চাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। মীর শওকতের গাড়িতে তার বাড়ি আসা গেল। তিনি বললেন, আপনার পরিচিত একজনকে আসতে বলেছি। সে বলেছে, আপনি পৌঁছোলে খবর দিতে–চলে আসবে শিগগির।

ফ্রিজ থেকে খাবার-দাবার বের করে উনি নিজেই সব গরম করতে লাগলেন। টেবিলও সাজালেন। এর মধ্যে চলে এলো আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু জিয়াউল হক ওরফে টুলুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা-সিরাজুল হক ওরফে দুলু। তাকে আমি। অনেককাল চিনি, সে শওকতের বিশেষ বন্ধু। খেতে খেতে দেশের কথা উঠলো। দুলু মূলত শ্রোতা–আমরা দুজনই কথা বলছি।

বন থেকে ফিরে জেনারেল লন্ডনেই আছেন। এ-মুহূর্তে দেশে ফেরার কথা ভাবছেন না। তবে দেশের কল্যাণের জন্যে এরশাদ-সরকারের যে-পতন হওয়া দরকার, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। অনির্দিষ্টকাল তিনি এ দেশে থেকে যেতে পারবেন না, তবে এই সরকারের কালে দেশে ফিরতে চান না। ফিরলে সরকার-পতনের আন্দোলনেই তিনি যোগ দেবেন। বললাম, সরকারবিরোধী আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে, খুব বেশিদিন এরা ক্ষমতায় থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। দেশে ফিরে তিনি প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

জেনারেল শওকত স্পষ্ট করে কিছু না বললেও আমার মনে হলো, রাজনীতিতে প্রবেশ করলে তিনি সম্ভবত বিএনপিতেই যোগ দেবেন।

তাঁর স্ত্রী বোধহয় খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এতক্ষণ। এখন আমাদের চা খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শওকত তার গাড়িতে আবার স্টেশনে পৌঁছে দিলেন–আমাদের সঙ্গে দুলু।

১১.

এবার লন্ডনে আসার ঠিক আগে বড়ো দুলাভাইকে হারালাম। সে-কথা বলার আগে আরো কয়েকটি মৃত্যুর কথা বলতে হয়।

জীবন ও মৃত্যুর বাস, মনে হয়, পাশাপাশি ঘরে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে সময় লাগে না। কেবল পরের ঘর থেকে আগেরটায় ফেরা যায় না।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসার পরে প্রথম যে-মৃত্যু আমাকে আঘাত করে, তা আমার বাল্যবন্ধু নেয়ামাল বাসিরের। তখনো স্বামীবাগে থাকি। রাতে (৩০ নভেম্বর ১৯৮৫) টেলিভিশনের খবরে জানলাম, সে মারা গেছে এবং তার দাফন কাফন সব হয়ে গেছে। খুবই কষ্ট পেলাম। কষ্ট আরো বেশি এ-জন্যে যে, তার মৃত্যুসংবাদ আমাকে জানতে হলো টেলিভিশনের খবর থেকে কেউ আমাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করলো না। নেয়ামাল বাসির, সৈয়দ আহমদ হোসেন ও আমি প্রিয়নাথ হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তাম–সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আহমদও তার মৃত্যুসংবাদ পায়নি–আমার কাছ থেকেই জানলো।

স্কুলে থাকতেই নেয়ামাল–আমরা ওকে এ-নামেই ডাকতাম, যদিও ওর ডাকনাম ছিল বসির–কবিতা লিখতো এবং কবিতা অনুবাদ করতো। ওর আব্বার কাছ থেকে সে উর্দু ও ফারসি শিখেছিল। ম্যাট্রিকে উর্দুতে লেটার পেয়েছিল, আইএ-তে সে পড়ল ফারসি–তাতেও ভালো নম্বর পেয়েছিল। আমার এক বছর পর আইএ পাশ করে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। বিভাগের অধ্যক্ষ ড. শহীদুল্লাহ সকল ছাত্রকেই ইংরেজি সাবসিডিয়ারি নিতে উৎসাহ দিতেন, ওর ফারসি জ্ঞান দেখে তিনি বললেন, ইংরেজি ও ফারসি পড়তে। একসঙ্গে তিন সাহিত্য পড়ার নিয়ম ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শহীদুল্লাহর বিশেষ চেষ্টায় অ্যাকাডেমিক কাউনসিল নেয়ামালকে এই অনুমতি দেয়। কিন্তু ইংরেজি যাদের পক্ষে কাল হয়, সে ছিল তাদের একজন। বেশ পরে সে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও এমএ পাশ করে।

স্কুলের ছাত্রাবস্থা থেকেই সে নিজের খরচ চালাতো। এক বাড়িতে জায়গির থাকতো, হাতখরচের টাকাটাও জোগাড় করতে হতো তাকেই। কলেজে উঠে থেকেছে মেসে, টিউশনি করেছে, কাগজে টুকটাক লিখে উপার্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ফজলুল হক মুসলিম হলে আবাসিক হয়েছে, কাজ করেছে দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজে। করাচিতে সে চলে যায় রেডিও পাকিস্তানের কাজ নিয়ে সেখানে সে সংবাদও পাঠ করতো। তারপর চাকরি নেয় সেখানকার ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে–তাদের পত্রিকা-সম্পাদনার কাজ। সেখান থেকে জাতীয় পরিষদের দোভাষী হয়ে চলে যায় রাওয়ালপিন্ডিতে, তারপর ঢাকায় বদলি হয় জাতীয় পরিষদের সহকারী বিতর্ক সম্পাদক হয়ে। ১৯৭২ সালে সে বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক সম্পাদক পদে উন্নীত হয়।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে, কলেজের ছাত্রাবস্থায়, নেয়ামাল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সে আমাদের বাড়িতে ওঠে, কয়েকদিন পরে তাদের মেস খুললে সেখানে ফিরে যায়। ভাষা-আন্দোলনের সময়ে সে বাংলাভাষার দাবির পক্ষে অনেক জায়গায় উর্দুতে বক্তৃতা করে। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়েও তার একটা প্রধান দায়িত্ব ছিল উর্দুতে বক্তৃতা করা। সে একসময়ে ঢাকা টেলিভিশনে উর্দু শিক্ষার আসর পরিচালনা করতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ-নিয়ে সে বিড়ম্বিত হয়। কর্তৃপক্ষ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউও তাকে সরকারের লোক মনে করতো।

বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য রচনার দায়িত্ব পেয়ে আমি নেয়ামালকে সঙ্গে নিই এবং তার পরামর্শক্রমে তার এক সহকর্মীকেও আমাদের দলভুক্ত করি। তার ভাষাজ্ঞান এবং সংসদীয় রীতিনীতির অভিজ্ঞতা সংবিধানের বাংলা করার কাজে আমাদের বড়ো সহায় হয়। সে বারবার বলতো, বাংলা শব্দ উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করার যে-সুযোগ আমরা পেয়েছি, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। তবে সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সদস্যেরা অনেকক্ষেত্রে প্রচলিত ইংরেজি পরিভাষা রক্ষা করার পক্ষপাতী ছিলেন, তাই আমাদের সকল প্রস্তাব তারা মেনে নেননি। ন্যায়পালের মতো অনেকগুলো পরিভাষা ছিল নেয়ামালেরই উদ্ভাবন। ভাষাব্যবহারে সে খানিকটা রক্ষণশীল ছিল এই অর্থে যে, মূল ইংরেজিতে বহুবচন থাকলে বাংলায়ও বহুবচন-ব্যবহার সে আবশ্যক বিবেচনা করতো। যেমন, পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্সের বাংলা সে করেছিল সংসদীয় বিষয়াবলী। আমার মতে, এখানে বিষয় বললে চলে, বিষয়াবলি বলার দরকার হয় না। তার যুক্তি ছিল এই যে, ইংরেজি ও বাংলা দুই পাঠের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্যে ব্যাকরণগত গঠন একরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি তার কথা মেনে নিয়েছিলাম।

পরবর্তীকালে নেয়ামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ও ফারসিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছিল। ফারসিতে সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। আরো পরে ইরানের মাশহাদের ফিরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশি ছাত্রদের জন্যে ফারসি ভাষার পরীক্ষায়ও সে খুব ভালো ফল করেছিল। দেশে ফিরে তার ইচ্ছে হয়েছিল সরকারি চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে-সুযোগ না পেয়ে সে আমাকে একবার বলেছিল যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেলে সে ঢাকা ছেড়ে যেতে দ্বিধা করবে না–যদিও এখানে বেতারকেন্দ্র এবং অন্যান্য সূত্র থেকে তার রোজগার ছিল বেশ ভালো। আমি এ বিষয়ে চেষ্টা করি। তার সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ আনুকূল্য করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তার অনূদিত সাজ্জাদ জহিরের উপন্যাস লন্ডনে এক রাত কলকাতার র‍্যাডিকাল বুক ক্লাব প্রকাশ করে ১৯৫৬ সালে। তাতে আমরা সবাই যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, তা বলা যায় না। ঢাকা থেকে তার একাধিক অনুবাদ এর আগে-পরে প্রকাশিত হয়েছিল, অনুবাদকর্মের জন্যে সে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিল। শেষকালে দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে গ্রাস করে। চট্টগ্রাম থেকে এসে পিজি হাসপাতালে যখন তাকে দেখতে গেছি, তখনো তার মনোবল অটুট ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয়।

নেয়ামালের মৃত্যুর পরদিন যখন তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন তার স্ত্রী আভা লজ্জিতমুখে বলেছিলেন, আমি যে ঢাকায়, সে-কথা তাঁর মনে ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে আমি ফিরে এসেছি তখন তিন মাসের কিছু বেশিদিন মাত্র। তাঁকে আমি দোষ দিইনি। নেয়ামালের ইচ্ছানুসারে আজিমপুর কবরস্থানে সাধারণ কবরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়–সে কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চায়নি বলে। পরে তার বড়োভাই নেয়ামাল ওয়াকিল আমাকে বলেছিলেন, ওর কবরটা পাকা করা যায় কি না, সে-চেষ্টা করে দেখতে।

আমি আর সে-চেষ্টা করিনি–খানিকটা তা নিষ্ফল হবে ভেবে, খানিকটা নেয়ামালের ইচ্ছার বিরুদ্ধ কিছু করতে চাইনি বলে।

এর কয়েকমাস পরে মৃত্যুবরণ করেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিল, বেবীদের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল নিকটতর, তবে আমি তাকে চিনেছিলাম আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের অগ্রজ হিসেবে। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ এবং আইন পড়েন। তখনই তার খ্যাতি ছিল আবৃত্তিকার হিসেবে এবং বেতার ও মঞ্চের অভিনেতা হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশেও অভিনয়ের জন্যে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু চলচ্চিত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোক প্রভৃতির উত্তাপে বিব্রত হয়ে তিনি আর তার কাজ শেষ করতে পারেননি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ঝুঁকেছিলেন বামপন্থার প্রতি। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন গণতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন তার প্রচার-সম্পাদক। পরিণামে, ১৯৫৪ সালে প্রদেশে ৯২ক ধারার শাসন জারি হলে, তিনি কারারুদ্ধ হন। পরের বছরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী-প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং পরে তার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। তিনি পাকিস্তান আর্টস কাউনসিল পূর্বাঞ্চল শাখারও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা হাইকোর্টে বিশ বছর আইনব্যবসার কালে তিনি জড়িত ছিলেন অর ডিগনাম অ্যান্ড কোম্পানি নামের আইন-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ১৯৭৪ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। এরশাদের শাসনকালে বিভিন্ন জেলা শহরে হাইকোর্টের আসন স্থাপিত হলে তিনি রংপুরে নিয়োগলাভ করেন। তিনি ছিলেন এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদ এবং সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি নানা ক্ষেত্রে বক্তৃতা দিয়েছেন। ফলে ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের এক আদেশবলে বিচারকের পদ থেকে তিনি অপসৃত হন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, তাঁর জীবনযাপনপ্রণালি ছিল খুবই সাদাসিধে। রঙ্গব্যঙ্গে তাঁর দক্ষতা ছিল স্বভাবজ–আসর জমাবার এমন নৈপুণ্য খুব কমই দেখা যায়।

১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিলে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাড়ির কাছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে বেবী ও আমিও সেখানে দ্রুত পৌঁছেই, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে।

পর বছর আমার মেজো দুলাভাই সৈয়দ আলী হোসেনের জীবনাবসান ঘটে।

মেজোবুর যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স আট বছর। মেজো দুলাভাইয়ের আধুনিক জীবনযাপন-পদ্ধতি আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। তিনি আমাকে কলকাতার খুব নামি হোটেলের দামি রেস্টুরেন্টে একাধিকবার খাইয়েছেন, ট্যাকসি করে বেড়াতে নিয়ে গেছেন গঙ্গার ধারে। আমার প্রতি তাঁর বিশেষ স্নেহ ছিল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমার দরকারি অথচ ঢাকায় দুষ্প্রাপ্য অনেক বই তিনি বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি সরকারি আমলা হই, কিন্তু আমি শিক্ষকতার পেশা বেছে নেওয়ায় আমাকে ডাকতে শুরু করেন পণ্ডিতমশাই বলে। আমি বাংলা পড়ে বিদেশে গিয়ে কী গবেষণা করি বা কী সেমিনার সম্মেলন করি, তা ছিল তার কাছে খানিকটা জিজ্ঞাসা ও আনন্দমিশ্রিত বিস্ময়ের বিষয়। আমাকে এবং আমার স্ত্রী-সন্তানদের সবাইকে নিজে বাজার করে খাইয়ে। খুব আনন্দ পেতেন তিনি। ১৯৭০ সালে খুলনায় ইতিহাস পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে ড. হবিবুল্লাহ, ড. মল্লিক এবং অন্যান্য অতিথির সম্মানে তিনি। একটা রেস্টুরেন্টে বড়রকম ডোেজ দিয়েছিলেন।

মেজোদুলাভাই বেশ কিছুকাল ধরে ভুগছিলেন। তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটায়। ১৯৮৭ সালের জুন মাসে বেবী, বড়ো দুলাভাই ও আমি খুলনায় চলে গেলাম। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। আমাদের দেখে খুশি হলেন। কথাবার্তা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল, তবু বলতে থাকলেন। ২৭ তারিখে তিনি চলে গেলেন। খবর পেয়ে আমার ছোটোভাই আখতার খুলনায় গিয়ে পৌঁছোলো দাফন-কাফনের ঠিক আগে।

বৃহত্তর পরিবারের প্রতি তিনি কর্তব্যের অধিক করেছিলেন। তাঁর চেনাজানা অনেকের প্রতিও তাঁর আনুকূল্য ছিল। তাঁর মৃত্যুতে তাই শোকগ্রস্ত হয়েছিলেন তাঁর নিজের পরিবারের বাইরে অনেকে।

এর কিছুকাল পরে হঠাৎ করেই বড়ো দুলাভাইয়ের পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়ল। যাকে বলে নীরব ঘাতক, তারই শিকার হলেন তিনি। কী যে করা যাবে, তা ভেবে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। চিকিৎসকেরা দুলাভাইকেই বললেন, তাঁরা অস্ত্রোপচার করতে চান, তার ফল ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। দুলাভাই সম্মতি দিলেন। তলপেট কেটেই জোড়া দিলেন শল্যবিদেরা–আর কিছু করার ছিল না। ১৫ ফেব্রুয়ারিতে রাতে তাকে দেখে বাড়ি ফিরেছি, বেবী রয়ে গেল হাসপাতালে বড়োবুর সঙ্গে। একটু পরই খবর পেলাম তিনি আর নেই।

বড়োবুর বিয়ে হয়েছিল ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে। বিয়ের পরে দীর্ঘকাল দুলাভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরাও আবার ঢাকায় এসে তার সঙ্গে ছিলাম। অনেকদিন। এ-সবের মধ্য দিয়ে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তো বটেই। তার ওপর, আব্বা বলতেন, বড়ো জামাইই তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, দুলাভাইও সববিষয়ে কর্তব্যের অধিক করতেন। আব্বাকে কিছু বোঝাতে হলে আমরা দুলাভাইয়ের শরণাপন্ন হতাম। আমাদের পরিবারের সকল সিদ্ধান্তে তিনি শরিক ছিলেন। কতদিক দিয়ে যে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা-নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যায় না।

১৫ তারিখে দুলাভাই মারা গেলেন, ১৬ তারিখে আমার লন্ডনে যাওয়ার টিকিট সংগ্রহ করার কথা। যাবো কি যাবো না, এমন দোটানায় পড়ে গেলাম। উদ্ধার করলো বড়োবুই। বললো, তুমি যাও–সবকিছুর ব্যবস্থা যেখানে করা আছে, সেখানে না-যাওয়াটা ঠিক হবে না।

লন্ডনে আমি চিকিৎসা নিয়ে বেরোতে না বেরোতেই সেখানে গিয়ে সস্ত্রীক হাজির হলেন আমার মেজো ভায়রা তফাজ্জল আলী ওরফে মাখন। তিনি বেশ কিছুকাল ক্যানসারে ভুগছিলেন। কেমোথেরাপি নিয়ে তিনি গেলেন অক্সফোর্ড স্ট্রিটের নিকটে তার চাচির বাড়িতে। সেখানে শফি ও আমি কয়েকদিন আড্ডা জমালাম। বেশ ভালোই মনে হলো তাকে। আমি দেশে ফেরার পরে তিনিও ফিরলেন। শরীর খারাপ হওয়ায় আবার তাঁকে নেওয়া হলো লন্ডনে। সেখান থেকে তাগাদা এলো তার ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে দিতে। ওরা দুজনেই অল্পবয়স্ক। মাখনের একটা ব্যবসা ছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের জেনারেল সেলস এজেন্সি। সেই সুবাদে ছুটির দিনে ব্রিটিশ হাই কমিশনের ভিসা অফিস খুলিয়ে ওদের ভিসা দেওয়া হলো। ওরা চলে গেল এবং সৌভাগ্যক্রমে বাপ-মায়ের সঙ্গেই ফিরে এলো। কিন্তু মাখনকে ধরে রাখা গেল না। ১৯৮৮ সালের ২০ জুন তিনি চিরতরে চলে এলেন।

তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো সিলেটে–হজরত শাহজালালের দরগায় সমাধিস্থ করার জন্যে। তার পরিবারের সঙ্গে বেবী ও আমিও গেলাম। দাফন কাফন সেরে মাখনের বন্ধু অ্যাডভোকেট আবদুল ওদুদ খোন্দকার ও আমি ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলাম।

মাখন ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল। নানা সময়ে অনেকের অনেক উপকার করেছেন। তার মৃত্যুতে বোঝা গেল, তারা তা ভোলেননি।

২.

সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের একমাত্র সন্তান নিগার ফোনে বললো, নানা, আল্লু আপনাকে দু-তিনদিনের মধ্যে আসতে বলেছেন সকাল দশটা থেকে এগারোটার ভেতরে।

গিয়ে হাজির হলাম। বিচারপতি সায়েম বললেন, বঙ্গভবনে আমার শেষদিনগুলো নিয়ে একটা ছোটো বই লিখেছি। ভেবেছিলাম, বেঁচে থাকতে ওটা ছাপাবো না–আমার মৃত্যুর পরে ছাপাতে বলে যাবো। মৃত্যু যখন আসছে না, তখন বইটা প্রকাশের কথা ভাবছি। তোমাকে একজন প্রকাশক খুঁজে দিতে হবে–এমন প্রকাশক যে আমার ইচ্ছে-অনুযায়ী বইটা বার করবে।’

বললাম, প্রকাশক পেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু বঙ্গভবনে শুধু শেষদিনগুলো নিয়ে লিখছেন কেন? পূর্বাপর ঘটনা বলছেন না কেন?

বিচারপতি বললেন, তোমাদের নিয়ে মুশকিল এই। যা আছে তা ছেড়ে যা নেই তা নিয়ে কথা বলতে শুরু করো।’

বললাম, সবাই জানতে চায়, কী অবস্থায় আপনি রাষ্ট্রপতি হতে সম্মত হলেন। তেসরা নভেম্বর-সাতই নভেম্বরের ঘটনা আপনি কীভাবে দেখেছেন। পরের দিকের ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ আছে। তাই বলছিলাম, সবটা যদি লিখতেন, তাহলে আমাদের ইতিহাসের বড়ো দলিল হয়ে থাকতো।

সাবেক রাষ্ট্রপতি বললেন, নিজের কথা লিখে যাবো কি না, সে-সম্পর্কে নিজের মনেই অনেক তর্ক করেছি। যতটুকু লেখা ঠিক মনে করেছি, তা-ই লিখেছি। এখন বলল, যেটুকু লিখেছি, তা ছাপার জন্যে প্রকাশক পাওয়া যাবে কি না। প্রকাশককে আমার শর্ত-অনুযায়ী বই ছাপতে হবে।’

বললাম, বই ছাপার শর্ত মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড। আপনার কি বিশেষ শর্ত আছে?

উনি বললেন, ‘আছে। তবে তা টাকা-পয়সাসংক্রান্ত নয়। এ-বই থেকে আমি কোনো রয়ালটি চাই না। আমি চাই, বইটা পেপারব্যাক হবে, এমন সাইজের হবে যা একজন পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে–ট্রেনে-বাসে বসে পড়তে পারে। বইটার দাম যথাসাধ্য কম রাখতে হবে–যাতে ইচ্ছে করলেই কেউ কিনতে পারে। ছাপাটা নির্ভুল হতে হবে। আমাদের প্রকাশকেরা বড্ড অযত্ন করে বই ছাপায়।

একটু থেমে বললেন, যাবার সময়ে ম্যানাসক্রিপ্টের একটা কপি নিয়ে যেও–তোমার জন্য করিয়ে রেখেছি। তোমার কোনো কমেন্ট থাকলে বোলো। কিন্তু যা লিখেছি, তার অতিরিক্ত ইনফরমেশন যোগ করতে বলবে না। তুমি আগে পড়ো। তারপর প্রকাশককে বইয়ের সাবজেক্টটা বোলো। যে রাজি হবে, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। প্রকাশককে ম্যানাসক্রিপ্ট আমি দেবো–তোমার কপিটা হাতছাড়া করবে না।’

নিগারকে যখন এসব কথাবার্তার সারমর্ম জানালাম, সে বললো, :, আব্দুর বই পকেটে নিয়ে ঘোরার জন্য যেন সবাই বসে আছে! আপনি কাউকে আনরিজনেবুল রিকোয়েস্ট করতে যাবেন না।

প্রকাশক-নির্বাচনের বিষয়ে আমার চট্টগ্রামের সহকর্মী গোলাম মুস্তাফার পরামর্শ চাইলাম। সে সুপারিশ করলো হাক্কানী পাবলিশার্স তথা গোলাম মোস্তফার নাম। তাদের দুজনকে নিয়ে একদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে গেলাম। কথাবার্তা যা হওয়ার, তা হয়ে গেল।

পরে মুস্তাফা ও মোস্তফা একবার আমাকে ছাড়াই তার কাছে গিয়েছিল। সেদিন বিচারপতি মুস্তাফার ইংরেজি জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছিলেন।

গোলাম মোস্তফা মুখে যদিও লেখকের অভিপ্রায়-অনুযায়ী বই প্রকাশ করতে সম্মত হয়, পরে সে তার ইচ্ছার ওপরে নিজের ইচ্ছা আরোপ করে। তার প্রধান উদবেগ ছিল যে, বইটি খুব ছোটো হয়ে যাবে। সুতরাং সে পি আই ডিতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির সংক্ষিপ্ত জীবনী, তার কয়েকটি বক্তৃতা, তাঁর বক্তৃতাসংক্রান্ত দুটি খবর, সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী এবং তার আরো কিছু ছবি জোগাড় করে পরিশিষ্টে জুড়ে দিলো। এই অংশ হয়ে দাঁড়ালো মূল রচনার চেয়ে বড়ো। তাতে বই খানিকটা স্ফীত হলো, দামও বাড়লো। এমন সংযোজনে লেখক নিমরাজি হলেন, তবে খুব যে প্রসন্নচিত্তে হলেন, তা নয়।

At Bangabhaban: Last Phase (১৯৮৮) প্রকাশিত হলে তার মুদ্রণ ও বিন্যাস দেখেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হননি। পাতলা মলাটের সংস্করণের পাশাপাশি বইটির শক্ত মলাটের সংস্করণও বের হয়। তা নিয়ে অবশ্য তিনি আর কিছু বলেননি। তবে বই যে বের হলো, তাতে তিনি খুশি হয়েছিলেন।

এই সময়েই একদিন আবু রুশদ তার তোপখানার বাসায় আমাকে বলেন, তার আত্মজীবনীর একটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। রচনাটি বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখন প্রকাশক পাওয়া গেলে তা গ্রন্থাকারে বের হতে পারে।

আমি আবার গোলাম মোস্তফাঁকেই বললাম। সে প্রকাশ করতে সানন্দে সম্মত হলো। লেখক-প্রকাশকের যোগাযোগ ঘটিয়েই আমার দায়িত্ব শেষ হয়। জীবন ক্রমশ ছাপা হয়ে বের হয় ১৯৮৯ সালের গোড়ার দিকে। আবু রুশদ বইটি উৎসর্গ করেন তার আযৌবনের বন্ধু আবুল হোসেন ও শওকত ওসমানকে।

শওকত ওসমানের অভ্যেস ছিল সক্কালবেলায় তার পরিচিতজনদের ফোন করা। সুপ্রভাত ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণীয়, প্রাতঃস্মরণীয় হও’ বলে তিনি কল্যাণকামনা করতেন। পশ্চিমবঙ্গীয় প্রচলন অনুসরণ করে তিনি আমার স্ত্রীর উল্লেখ করতেন বউমা বলে এবং তারও কল্যাণকামনা করতেন। তার কণ্ঠে স্নেহ ঝরে পড়তো। তারপর তার বক্তব্যের পালা শুরু হতো। তখন জনকণ্ঠে তার ‘শেখের সম্বরা’ প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তার কিছু ফটোকপি তার জামার পকেটে ফিরতো এবং তাঁর প্রীতিভাজনদের তা বিলিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ে স্থানকালপরিবেশের কথাও তিনি ভুলে যেতেন। সানাউল হকের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমরা তাঁর বাড়িতে সমবেত হয়েছি। জানাজায় যাওয়ার অপেক্ষায় সকলে। শওকত ওসমান হঠাৎ করে ‘শেখের সম্বরা’র সর্বশেষ কিস্তির ফটোকপি সবাইকে দিতে শুরু করেছেন। আমি উঠে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলাম। বললাম, শওকত ভাই, এখানে নয়। তাছাড়া আপনার লেখা আপনাকে বিলোতে হবে কেন? আমাদের দেবেন, আমরা সবার হাতে দিয়ে দেবো। আমার ঔদ্ধত্যে তিনি যে কিছু মনে করেননি, তার কারণ, তিনি আমাকে যথার্থই ভালোবাসতেন এবং আমি যে তার প্রতি যথার্থই শ্রদ্ধাশীল, তা জানতেন। অনেক সময়ে ‘শেখের সম্বরা’র ফটোকপির সঙ্গে তিনি নিজের হাতে নতুন একটা পদ্য লিখে তা দান করতেন। এমন কয়েকটি অংশ আমার কাছে এখনো আছে। শেখের সম্বরার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের আগে তিনি আমার কাছে বইটির একটি উপযুক্ত নাম চান। আমি বলি, দোভাষী পুথির স্টাইলে ‘শেখের সম্বরা–দোসরা বালাম’ রাখতে পারেন। প্রস্তাবটি তার পছন্দ হয়।

শওকত ওসমান একদিন আমাকে ডেকে পাঠালে আমি তার মোমেনবাগের বাসায় যাই। তিনি জানান, তার অর্থসংকট চলছে। আমি কি তাঁর একটা পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমিকে দিয়ে কিনিয়ে নিতে পারি? বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান লেখকদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে রাখে–বাংলা একাডেমি ইচ্ছে করলে তা করতে পারে–সে-পাণ্ডুলিপি মুদ্রণের জন্যে নয়, সংগ্রহ ও প্রদর্শনের জন্যে। মোহাম্মদ হারুন-উর-রশীদ তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। আমি গিয়ে তাঁকে কথাটা বলি। তিনি শওকত ওসমানকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক, কিন্তু বাংলা একাডেমির কোননা প্রদর্শশালা নেই, ওভাবে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও নেই। মহাপরিচালক বিপন্ন বোধ করলেন। আমাদের এই আলোচনার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ইকবাল আহমদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন–তিনি হারুন-উর-রশীদের কাছে কোনো কাজে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ঢাকা কলেজে শওকত ওসমান তাঁর শিক্ষক ছিলেন। কোনো ব্যক্তির কাছে পাণ্ডুলিপি বিক্রি করতে যদি শওকত ওসমান রাজি হন, তবে তিনি তা কিনে নিতে পারেন এবং কোনো উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি তা দান করতে পারেন। আমি শওকত ওসমানকে এই প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মতি দেন। প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে কিছু বেশি দিয়ে ইকবাল পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে নেন এবং, আমি যতদূর জানি, তা জাতীয় জাদুঘরে দান করেন।

১৩.

চট্টগ্রাম থেকে আমার ঢাকা ফিরে আসা অবধি বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের (আপসো) সাধারণ সম্পাদক ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান এই সংগঠনের কাজে আমাকে যোগ দিতে প্রণোদিত করছিলেন। আমি নিমরাজি, তবে কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারবো, সে-সম্পর্কে সন্দিহান। ১৯৮৮ সালের ২৪ থেকে ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিতে আপসোর সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে যোগদান না করার কোনো উপায় সাইদুর রহমান রাখলেন না। বস্তুত কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বেশ বড়সড়ড়া হলো : শেখ হাসিনা, আহমদুল কবির, হায়দার আকবর খান রনো, সুধাংশুশেখর হালদার, মোনায়েম সরকার, কামাল হায়দার, সাইদুর রহমান, আমি, আরো দু-তিনজন। হাসিনা গিয়েছিল পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে। দিল্লি পৌঁছোবার পরে জয়কে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার ৫৪টি দেশের প্রতিনিধিদল এসেছিল। সহযোগীরূপে ইউরোপের ৯টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন, ইউরোপ ও লাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশের সাংগঠনিক প্রতিনিধিরা ছিলেন, জাতিসংঘ এবং আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও এসেছিলেন। ভারতীয় প্রতিনিধির সংখ্যাই ছিল পাঁচ শতাধিক। তার মধ্যে ছিলেন ই এম এস নামবুরিপাদ, রাজ্যেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, হরকিষণ সিং সুরজিৎ, সীতারাম ইয়েচুরি, সমর মুখার্জি, চন্দ্রজিৎ যাদব, শেখর গাঙ্গুলি, রশীদউদ্দীন খান, রইস আহমেদ, ডা. ভাস্কর রায়চৌধুরী, এয়ার কমোডর যসজিৎ সিং, কে পার্থসারথী, সত্যসাধন চক্রবর্তী, বিপ্লব দাশগুপ্ত। রমেশ চন্দ্র এসেছিলেন বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে, তাঁর স্ত্রী পেরিন ছিলেন ভারতীয় দলে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলে আবদুল ওয়ালি খান, মিরাজ খালিদ, তাহেরা মজহার আলী, খাদিজা গওহর, আবদুর রহিম ও মিরাজ মোহাম্মদ খানসহ ১৫/১৬ জন ছিলেন। শ্রীলঙ্কা থেকে আবদুল আজিজ ও এ এ এম মারলিন ছাড়াও কয়েকজন। ভিয়েতনামের প্রতিনিধিদলে মাদাম নগুয়েন থি বি এবং নামিবিয়ার প্রতিনিধিদলে সাম নুজোমা ছিলেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছিলেন আলফ্রেড এনজো এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ হুরি। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলে ছিলেন কালানদাররাভ সামানদার, ব্রিটিশ আপসোর প্রতিনিধিদলে ছিলেন মোহাম্মদ আরিফ। কায়রোতে আপসোর সদর দপ্তর–সেখান থেকে এসেছিলেন সভাপতি ডা. মোরাদ গালিব, মহাসচিব নূরি আবদুল রাজ্জাক, সচিবদের একজন চিত্ত বিশ্বাস, অপরজন বিদ্যাশেখরা।

দিল্লিতে হোটেলে পৌঁছে দেখা গেল, আমাদের সবার জন্যে একক কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, হাসিনার জন্যে একটি স্যুইট। আহমদুল কবির বললেন, তাঁর একটা স্যুইট চাই, নইলে দলের সকলে আড্ডা দেবে কোথায়? হোটেল কর্তৃপক্ষের গড়িমসি দেখে তিনি জানালেন, বাড়তি ভাড়া যা লাগে, তা তিনি নিজেই দেবেন, নিমন্ত্রণকর্তাদের ঘাড়ে চাপাবেন না। তাতে কাজ হলো। কিন্তু আমরা ফিরে আসার সময়ে দেখা গেল, বাড়তি ভাড়া নয়, স্যুইটের পুরো ভাড়াটাই হোটেল তাঁর কাছে দাবি করেছে। তারা বলছে, কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ করা কক্ষ তিনি নেননি, কর্তৃপক্ষও ভাড়া সমন্বয় করার কথা কিছু বলেনি। অতএব। সম্পূর্ণ ভাড়াটাই আহমদুল কবির দিলেন।

আমরা যেদিন দিল্লি পৌঁছোলাম, সেদিনই আলাপ হলো সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে। তখন সে এখনকার মতো স্বনামধন্য হয়নি, তবে সি পি এমের একজন নেতা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছিল। কথায় কথায় জানলাম, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে সেদিনই মধ্যদিনে তার স্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। সে-বিষয়ে আমি উদ্‌বেগ প্রকাশ করায় সীতারাম মৃদু হেসে বললো, কয়েকদিন তাঁকে জেলহাজতে থাকতে হবে–এর অন্যথা হওয়া মুশকিল। দেখলাম, সীতারাম অবিচলিতভাবে সম্মেলনের কাজ করে যাচ্ছে এবং তাও ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে একযোগে।

পরদিন সকালে সম্মেলন উদৃবোধন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি। ভাষণে যেসব অতিথিকে তিনি বিশেষভাবে স্বাগত জানালেন, তাঁরা হলেন পাকিস্তানের আবদুল ওয়ালি খান, আফগানিস্তানের উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুর রহিম হাতিব, ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্রের উপমন্ত্রী হাসান মক্কী, ভিয়েতনামের (পরে উপরাষ্ট্রপতি) মাদাম বিন, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, তানজানিয়ার আলী আহমেদ, এ এন সির আলফ্রেড এনজো ও পি এল ওর আবদুল্লাহ হুরানি। এই ভাষণে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর পরে এশিয়া মহাদেশে আপসোর কংগ্রেস এই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজীব গান্ধির বক্তৃতায় বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চের নানা সংকটের বিষয় ছিল, সেই সঙ্গে ছিল স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের আশা।

সম্মেলনের একটি দিন জওহরলাল নেহরুর শতবার্ষিকী পালনে নিয়োজিত হয়। নানারকম ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের দিনগুলি কেটে গেল। অনেকের সঙ্গে হাসিনা আমার পরিচয় করিয়ে দেয় তার শিক্ষক বলে-ফলে কিছু অতিরিক্ত সম্মান পাওয়া গেল। হাসিনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভালোরকম আলাপ জমে গেল–পুতুল ঢাকায় নানারকম চা খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিলো। ওদিকে আহমদুল কবিরের ঘরে সন্ধ্যার পর জমজমাট আড্ডা। তাতে অন্যদেশের প্রতিনিধিরাও মাঝে মাঝে এসে যোগ দিলেন।

এই সম্মেলনে আপসোর কেন্দ্রীয় সংগঠনের নতুন কমিটিতে সহ-সভাপতির একটি পদ বাংলাদেশের মনোনয়নের জন্যে শূন্য রাখা হয়। পরে সেখানে আমার নাম যুক্ত হয়।

১৪.

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. ভাস্কর রায়চৌধুরীর সঙ্গে দিল্লিতে দেখা হলো বটে, তবে তার সঙ্গে এর আগেই পরিচয় হয়েছিল। কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক নিয়োগের জন্যে যে-নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়, তার বিশেষজ্ঞ-সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল আমাকে। নির্বাচনী কমিটির যে-সভায় আমি যোগ দিতে গিয়েছিলাম, তাতে রবীন্দ্র-অধ্যাপক এবং একজন সহযোগী অধ্যাপক মনোনয়নের কথা ছিল। এই নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য ভাস্কর রায়চৌধুরী ও সহ-উপাচার্য ড. ভারতী রায়ের সঙ্গে আমার মতদ্বৈধ হয়েছিল। ওঁদের মনোনয়নের সমর্থনে আরো একজন সদস্য ছিলেন। অন্যপক্ষে কলা অনুষদের ডিন, বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য এবং আমি অন্য প্রার্থীর বিষয়ে একমত হয়েছিলাম। রবীন্দ্র-অধ্যাপক নিয়োগের প্রশ্নে শেষ মুহূর্তে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে উপাচার্যদের মত সমর্থন করেন। ফলে ওঁদের প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত হয়, তবে ডিন ও আমি মতান্তরসূচক মন্তব্য লিপিবদ্ধ করি। সহযোগী অধ্যাপক বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বোধহয় তিন-তিন ভোটে কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তবে মজার কথা এই যে, এই মতবিরোধ সত্ত্বেও সহ-উপাচার্য ভারতী রায়ের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা এখনো অটুট রয়েছে। উপাচার্য প্রথমটায় আমার প্রতি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। দিল্লিতেও আমার তা মনে। হয়েছিল। আমার সদস্যপদের মেয়াদকালে নির্বাচকমণ্ডলীর আর কোনো সভা ডাকা হয়নি। পরে অবশ্য উনি যখন একবার ঢাকায় আসেন, তখন নিজের উদ্‌যোগেই আমাকে টেলিফোন করেছিলেন যদিও ঢাকায় আমাদের দেখা হয়নি।

কলকাতায় সেবারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, ‘চলো দেবীর ওখানে-সে তোমাকে দেখলে খুশি হবে। প্রায় ত্রিশ বছর পরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলো এবং প্রথমবারের মতো তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট গবেষক অলকা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। দেবীপ্রসাদ জানতে চাইলেন, কলকাতায় কী উপলক্ষে এসেছি। বললাম, বাংলার অধ্যাপকের সিলেকশন কমিটির সভায়। উনি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, আমি কি প্রার্থী? বললাম, না, আমি কমিটির সদস্য। উনি এবার আরো বিস্ময় এবং অনেকখানি আনন্দের সঙ্গে বললেন, তাহলে তো তুমি মস্ত পণ্ডিত হয়েছ!’ বললাম, এমন কিছু নয়। নিয়মরক্ষা করতে একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ রাখতে হয়। তাই আমাকে রাখা–বাড়ির কাছে আছি বলে।’ দেবীপ্রসাদ অনেকক্ষণ আনন্দের হাসি হাসলেন।

সেই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা।

১৫.

১৯৮৮ সালের জুন মাসে সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী গৃহীত হয়। এতে ঢাকার বাইরে ছটি জেলায় হাইকোর্ট বিভাগের আসন নির্দিষ্ট হয় এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রধর্ম-ঘোষণার প্রতিবাদে পরদিনই ঢাকা এবং দেশের আরো কয়েকটি শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনকে সভাপতি করে আমরা স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করি এবং একাধিক সভা করে রাষ্ট্রধর্মের প্রত্যাহার দাবি করি।

আমাদের আইনজীবী বন্ধুরা অষ্টম সংশোধনীর হাইকোর্ট-সংক্রান্ত বিধানের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করেন এই বলে যে, তা সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। মামলাটি শুনানির জন্যে গৃহীত হয়।

আমরা কয়েকজন ভাবলাম, রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী–এই যুক্তিতে আমরাও হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করবো। এটা করা উচিত হবে কি না, সে-প্রশ্নও উঠলো। কেউ কেউ বললেন, আদালতে যদি আমাদের আবেদন অগ্রাহ্য হয়, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম আদালতের অনুমোদন পেয়ে যাবে। তাতে বিষয়টা আরো খারাপ হবে। আমরা কেউ কেউ বললাম, মামলা দায়ের না করলেও তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের আবেদন অগ্রাহ্য হলে আর কতোই বা ক্ষতি হবে!

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রধর্মের বিধানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হাইকোর্টে দায়ের হয়ে গেল। একটি মামলা করলেন এক হিন্দু ভদ্রলোক। তিনি বললেন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় হিন্দু হিসেবে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন এবং এমন বৈষম্য সংবিধানবিরোধী। আরেকটি মামলা করলেন এক মুসলিম মহিলা। তিনি বললেন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় মহিলা হিসেবে তিনি বৈষম্যের শিকার হতে যাচ্ছেন।

এবারে আর আমাদের মামলা না করার কোনো অর্থ রইলো না। প্রধানত সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আবেদনটি তৈরি করলেন। আবেদনকারী হলেন দশজন : বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, ফয়েজ আহমদ ও আনিসুজ্জামান। মামলা রুজু করতে দাঁড়ালেন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। আবেদনকারীদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকলাম ফয়েজ আহমদ ও আমি। আদালত বললেন, এমন মামলা তো আরো দুটি হয়ে গেছে, সুতরাং এটি বাহুল্যমাত্র। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ড. কামাল হোসেন বললেন, এই আবেদনটির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে–তার একটি আবেদনকারীদের নাম থেকে প্রতীয়মান হবে। এই বলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের তিন প্রাক্তন বিচারক এবং সাবেক অ্যাটর্নি-জেনারেল হিসেবে ইশতিয়াকের নাম বললেন। তারপর তিনি আবেদনের কয়েকটি অনুচ্ছেদের প্রতি বিচারপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এতে সংবিধান-সম্পর্কিত কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।

আমাদের মামলা গৃহীত হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটি নিয়ে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হয়নি। তার প্রধান কারণ মামলার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আমাদের দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা। ফলে মামলাটি নথিভুক্ত হয়ে রইলো, তার আর শুনানি হলো না। তবে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি বেশ কিছুকাল সক্রিয় ছিল। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে আমরা সভা করেছি, একটি প্রবন্ধসংকলন প্রকাশ করেছি। কয়েকটি ঘরোয়া বৈঠক হয় আমার বাসায়। তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন।

আমার বন্ধু ও সংগীতশিল্পী মনোতোষ বড়ুয়া তখন ভিক্ষুজীবন যাপন করছেন। আমার বাসায় এক ঘরোয়া বৈঠকের শেষে সবাই চলে গেলে তিনি রয়ে গেলেন। পোশাকের ভেতর থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজেসের একটা প্যাকেট বের করে তিনি সিগারেট ধরালেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, স্বতন্ত্র নির্বাচন ফিরিয়ে আনা ছাড়া সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার উপায় নেই।’

এই অপ্রত্যাশিত উক্তি শুনে আমি বললাম, তাহলেই ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরাজয় হবে। আমাদের নেতারা স্বতন্ত্র নির্বাচন-ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন অনেক আন্দোলন করে। এখন তা ফিরিয়ে আনলে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানকেই ফিরিয়ে আনা হবে।’

তবে তিনি কী গভীর বেদনা ও হতাশা থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

১৬.

রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) এক রাতে এসে জানতে চাইলেন, বড়ো মেয়ের বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবছি কি না।

রুচি তখন অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করে এমএ পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার ইচ্ছে, আগে সে এমএ পাশ করুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। রুচির কাউকে পছন্দ নেই, পছন্দ করার আগ্রহও নেই। সেক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব সবটাই তার বাপ-মায়ের।

দাদাভাই বললেন, তাঁর হাতে সৎপাত্র আছে। মরহুম বিচারপতি আবদুল মওদুদের কনিষ্ঠ পুত্র আবু রায়হান আজিমুল হক। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসে মাস্টার্স করেছে। বছরখানেক পড়াশোনা করেছে লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এখন ঢাকায় আইসিডিডিআরবিতে কাজ করে। থাকে তার বড়ো বোন বেবী মওদুদের সঙ্গে। ইচ্ছে করলে আমি গিয়ে তাকে দেখে আসতে পারি। এখানে বিয়ে দিলে মেয়ের পড়াশোনার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।

বিচারপতি মওদুদের সঙ্গে আব্বার পরিচয় ছিল কলকাতায়। আমি তাকে চিনতাম লেখক হিসেবে তো বটেই, বিশেষ করে, অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে। তিনি যখন কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন সেখানে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল বিপরীতমুখী, তা সত্ত্বেও আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম, তিনিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। বেবী মওদুদকে দাদাভাই খুব ভালোবাসতেন, আমিও স্নেহ করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথমবারের শিক্ষকতাকালে সে ছিল আমার ছাত্রী।

এক সকালে বেবীর বাড়ি গিয়ে অপ্রস্তুত রায়হানকে দেখে এলাম। কথাবার্তা আরেকটু এগোলে জানা গেল, তার বড় ভাবি নাজমা অনতিদূর সম্পর্কে আমার খালাতো বোন এবং তার সেজো ভাই হুমায়ূন আমার সাবসিডিয়ারি ক্লাসের ছাত্র ছিল।

বিয়ের সিদ্ধান্ত স্থির হয়ে গেল।

এবারে আমরা সপরিবারে কলকাতায় গেলাম–বহুদিন পরে একসঙ্গে সবাই মিলে বেড়াতে।

জিল্লুর রহিম ওরফে দুলালের সৌজন্যে তার এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট পাওয়া গেল আলিপুরে। সেখানে ওঠা গেল। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাতটা সেখানে থাকি। কাছাকাছি মিষ্টির দোকান থেকে সকালের নাশতা আনা হয়। তারপর সবাই মিলে নেমে ফুটপাতের দোকানে চা খেয়ে আমাদের দিন শুরু হয়।

অল্পবয়সী একটি মেয়ে চায়ের দোকানটি চালায়। তার স্বামীকেও দেখা যায় মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করতে। সহজেই ভাব হয়ে যায় মেয়েটির সঙ্গে। সে আমাকে দাদা বলে ডাকে, বসার জায়গা পরিষ্কার থাকলেও গামছা দিয়ে নিজে হাতে আরেকবার মুছে নিয়ে তবে আমাকে বসতে দেয়। আমরা বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে বলে, ওদের বাড়িও এককালে ছিল খুলনা অঞ্চলে, তবে মেয়েটি তা দেখেনি কখনো। তার বাপ-মা কোনকালে পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে এদিকে। একসময়ে বেশ কষ্টে গেছে দিন। এখন মোটামুটি চলে যাচ্ছে। তারপর সে কৌতূহলভরে জানতে চায়, বাংলাদেশে কি এখনো অনেক বাঙালি আছে?

আমি বুঝি, বাঙালি বলতে সে কী বোঝাচ্ছে। তবু, সে-ভুল না ভাঙিয়ে বলি, আছে বইকি, বাঙালিরাই তো নিজেদের জন্যে দেশটা গড়েছে।

মেয়েটির মনে এবারে সন্দেহের ঝিলিক দেখা দেয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সে জানতে চায়, আমরা কোন জাতের মানুষ।

মুসলমান শুনে তার মুখে বেদনার একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে। তা দেখে আমারই কষ্ট লাগে। তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নেয় মেয়েটি। কথা ঘুরিয়ে চলে যায় অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে।

পরদিনও সে আগের মতোই বসবার জায়গা মুছে দেয়, যত্ন নিয়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। তবু আমার মনে হয়, সরু একটা তার কোথাও ছিঁড়ে গেছে।

যেদিন সকালে ওকে বললাম আমরা ফিরে যাচ্ছি দেশে, তার দু চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে বিস্কুটের টিনের দিকে। অস্ফুটকণ্ঠে জানতে চাইলো, কবে আমরা আবার আসবো কলকাতায়। বললাম, ঠিক নেই। যে-কথা বললাম না, তা এই যে, কলকাতায় এলেও এখানে উঠবো না, সুতরাং এমন করে তার দোকানে চা খাওয়া হবে না।

সেদিন ওকে সামান্য কয়েকটা টাকা বেশি দিয়েছিলাম। দিতে বেশ জোর করতে হয়েছিল। পরে কলকাতায় গিয়ে অনেকবার মেয়েটির খোঁজ করতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু খোঁজ করা হয়নি।

কলকাতায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে অনেক সময় চলে যায়। এবারেও তার ব্যত্যয় হলো না। নতুন করে যাওয়া হলো অধ্যাপক রামকৃষ্ণ মুখার্জীর বাড়িতে।

নিউ মার্কেট থেকে ফোন করতেই তিনি কোলাহল শুরু করে দিলেন। বললেন, সেখান থেকে দুপা হেঁটে মেট্রো ধরতে। তারপর টালিগঞ্জে নেমে দুটো রিকশা নিয়ে ওঁর বাড়ি যেতে। আমরা একটা ট্যাকসি নিয়ে গেলাম। ফাঁকিটা উনি ধরে ফেললেন সহজেই। বললেন, আমার মনে হচ্ছিল, আমার কথা ঠিক তোমার মনঃপূত হচ্ছিল না। ট্যাকসি করে আরামেই এসেছে, তবে অনেকগুলো টাকা খরচ করলে। আমাদের মেট্রো কিন্তু বেশ ভালো।

আনন্দকে নিয়ে ম্যানেজার, ম্যানেজার করে বেশ কিছুক্ষণ হইচই করলেন। তারপর আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা। উঠতে চাইলে বলেন, ‘আহা বোসোনা আরেকটু।

এক ফাঁকে প্রভাতী মুখার্জী আমাকে বললেন, প্রফেসর আর কে মুখার্জীর জন্য একটা ফেলিসিটেশন ভলিউম হচ্ছে–তাতে কেউ লিখতে বলেছে আপনাকে?

বললাম, যশ নন্দনের একটা চিঠি পেয়েছি কিছুকাল আগে–আমেরিকা থেকে লেখা। কিন্তু কী লিখবো, তা ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে সময়ও বোধহয় বেশি নেই।’

প্রভাতী মুখার্জী বললেন, আপনাকে একটা লেখা দিতেই হবে–উনি (রামকৃষ্ণ খুবই খুশি হবেন। যে-কোনো বিষয় নিয়ে লিখুন–বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে লিখলেই বা অসুবিধে কোথায়?

যশ নন্দনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। রামকৃষ্ণ মুখার্জীর ৭০ বছরপূর্তিতে যে-বই বেরোবার কথা, তা বের হলো ৭৫ বছরপূর্তিতে। আমি একটা লেখা প্রভাতী মুখার্জীর কাছে পাঠালাম–On the periodization of Bengali Literary History and some related issues নামে। প্রভাতী সেটা জায়গামতো পাঠালেন। R. K. Bhattacharya ও Asok K Ghosh-সম্পাদিত Sociology in the rubric of Social Sciences (Calcutta: Anthropological Survey of India, 1995) বইতে সেটা বের হলো, কেবল সূচিপত্রে আমার নামে s-এর জায়গায় r ছাপা হলো। সে অবশ্য অনেক পরের কথা।

রামকৃষ্ণ মুখার্জীর বাড়ি থেকে সেদিন সপরিবারে ফিরেছিলাম ওই দম্পতির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে। বিশেষ করে রামকৃষ্ণ মুখার্জীর নিরভিমান আচরণ তাঁর পাণ্ডিত্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে যেভাবে আড়াল করেছিল, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মতো মনে হয়েছিল।

সেবারে কলকাতা থেকে ফিরে আসার মাসতিনেকের মধ্যে রুচির বিয়ে হয়ে গেল–১৯৮৯ সালের ১০ মার্চে।

১৭.

১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ (ডাকসু) এবং সবকটি আবাসিক হলের ছাত্র-সংসদের নির্বাচন হলো বহু বছর পর। ডাকসুর নির্বাচন-পরিচালনার জন্যে উপাচার্য শিক্ষকদের যে-দল গঠন করেছিলেন, তাতে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। কলাভবনে কর্তব্য পালন করতে হলো–খানিকটা ভোটগ্রহণকেন্দ্র পরিদর্শন, বেশির ভাগ সময়ে উপাচার্যের কাছাকাছি থাকা–এই ছিল দায়িত্ব।

এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় এই নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারপক্ষীয় যে-অল্পসংখ্যক ছাত্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাদের নির্ভরতা ছিল পেশীশক্তিতে, ছাত্রসাধারণের সমর্থনে নয়। নির্বাচনে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল যারাই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধীদের আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কর্তৃত্ব নিয়ে আবার বিরোধী দলীয় ছাত্র-সংগঠনের মধ্যে প্রতিযোগিতা।

পুলিশ ও গোয়েন্দাবিভাগকেও এই নির্বাচনের বিষয়ে উৎকণ্ঠিত মনে হলো। আরো মনে হলো, নির্বাচনে বিরোধী দলীয় ছাত্রদের বিজয় যে অবধারিত, সরকার তা বুঝে গেছেন। সেক্ষেত্রে ছাত্রদলের চেয়ে ছাত্রলীগ তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।

নির্বাচনে ডাকসুতে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের প্যানেল জয়ী হলো।

ফলাফল ঘোষণার পরে শিক্ষার্থীদের বিজয়-মিছিল বের হয় ক্যাম্পাসে। রোকেয়া হল থেকে ছাত্রীদের যে-মিছিল বের হয়, সেটি সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে সভাপতি করে তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। আমরা রোকেয়া হলে গিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করি। দেখা যায়, তদন্ত কমিটির কাছে কারা আসছে, দূর থেকে কিছু ছাত্রী তা লক্ষ করছে।

এক ছাত্রী সে-কথাই বললো তদন্ত কমিটির কাছে। আমি যে সাক্ষ্য দিতে আসছি, সেটা দেখছে সবাই। আপনারা কি আমার নিরাপত্তা দিতে পারবেন?

কবুল করতে হলো, আমরা নিরুপায়। সে-মেয়েটি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, ‘এসব তদন্তে কিছু হবে না, সার। যারা আমাদের মারধর করেছে, তারা বহালতবিয়তে আছে। তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিলে পরিণাম ভালো হবে না বলে শাসাচ্ছে। ভয়ে কেউ সত্য কথা বলতে আসছে না। তাছাড়া ওরা এত শক্তিশালী, ওদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না।’

এরপরও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা যা আঁচ করতে পেরেছিলাম, তার। ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করা হলো, কাউকে কাউকে ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করাও গেল।

কিন্তু, সাক্ষ্যদাতা মেয়েটি যেমন আশঙ্কা করেছিল, এ-সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হলো না। ব্যবস্থা নিতে গেলে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। বলে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করেছিলেন।

ওই মেয়েটি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী হয়েছিল। আমাদের রিপোর্টে যার সম্পর্কে গোলযোগে সংশ্লিষ্টতার সর্বাধিক অভিযোগ আনা হয়, সে মেয়েটিও যথাসময়ে আমাদের সহকর্মী হয়েছিল।

১৮.

জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেনের আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ (আপসো) থেকে আকস্মিকভাবেই আমন্ত্রণ এসে গেল। এডেনে তাঁরা এক আন্তর্জাতিক সভা আহ্বান করেছেন–তাতে যোগ দিতে হবে। তাদের চিঠি নিয়ে ঢাকায় এরোফ্লোত অফিসে যেতেই টিকিট পাওয়া গেল–যাতায়াত করতে হবে মস্কো হয়ে। বোঝা গেল, টিকিটটা আসছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৌজন্যে। তাতে ভালোই হলো। সেই ১৯৭৩ সালে রাশিয়া গিয়েছিলাম, তারপর কত বছর ওমুখো হইনি।

১৯৯০ সালের জানুয়ারি। প্রচণ্ড শীত মস্কোতে। অবশ্য খোলা আকাশের নিচে বের না হলে ঠান্ডা বোঝার উপায় নেই। এডেন যাওয়ার পথে দুদিন এবং ফেরার পথে একদিনের কম থাকার কথা। সোভিয়েত অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের ইনসটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে রেখেছেন কর্তৃপক্ষ–তাছাড়া সবটা সময়ই আমার নিজের।

যে-তরুণীটি আমার দোভাষী, মনে হলো, সে একটু দায়সারাভাবে কর্তব্য পালন করছে। আসতে একটু দেরি করে ফেলে, চলে যেতে চায় তাড়াতাড়ি। এক সন্ধ্যায় প্রশ্ন করলো, আমার কুপন দিয়ে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যদি চলে যাই, আপনি কি কিছু মনে করবেন?

বললাম, মনে করার কি আছে? আমার সঙ্গে খাওয়া তোমার পক্ষে আবশ্যিক হতে পারে না।

সে বললো, আমি যে খাবার নিয়ে চলে গেলাম, অনুগ্রহ করে তা কাউকে বলবেন না।

বললাম, আমার তো মনে হয় না, এটা একটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে।

যেটা তাকে বললাম না কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম, সে নিয়ম ভঙ্গ করছে এবং নিয়মভঙ্গের বিষয়টা স্বভাবতই গোপন রাখতে চাইছে।

এর পরে বুঝলাম, মেয়েটি সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। এই যে শুনতে পাই স্কুল থেকেই এদের মগজ ধোলাই শুরু হয়, সে-ব্যবস্থা বোধহয় এর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

পথে যেতে খাদ্যসামগ্রীর দোকানে লম্বা লাইন দেখি। আমার প্রশ্নের উত্তরে দোভাষী বলে, আমাদের এমন লম্বা লাইন দিয়েই জিনিসপত্র কিনতে হয়। মস্কোতে যত দোকান দেখবেন, সর্বত্রই এ রকম অবস্থা। শুধু রাইসাকে (গর্বাচেভের স্ত্রী) কিউতে দাঁড়াতে হয় না। তার জন্যে অন্য ব্যবস্থা। হয়তো

আরো দু-একজনের জন্যে। কিন্তু আপামর জনসাধারণকে ভোগ্যপণ্য কিনতে হলে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময়ে কেউ দোকানে। ঢুকে দেখে, তার দরকারি জিনিসের মজুদ শেষ হয়ে গেছে, কখনো দোকানের সিঁড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে কারো মুখের ওপর দোকানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

কথাগুলো যে সত্যি, তা আমাদের স্বদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেই জানতে পারি। তারপরও মেয়েটির প্রতি বাক্যে যে-তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করি, তা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।

গর্বাচেভের পেরেসত্রোইকার কি এই হাল? তাঁর গ্লাসনস্তে কি এই ফল? মেয়েটি তো পারলে চোখের আগুন দিয়েই সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা ভস্ম করে ফেলে!

বন্ধু দ্বিজেন শর্মা অনেককাল আছেন মস্কোতে। তরুণ-তরুণীর মধ্যে এই বিক্ষোভ তিনিও লক্ষ করেছেন। আমাদের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলামও কিউ নিয়ে নাগরিকদের বিক্ষোভের কথা বললেন।

ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজে যেতেই এক মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আগের বছর দিল্লিতে আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের কংগ্রেসে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। সৌজন্য-বিনিময়ের বাইরে তার সঙ্গে কোনো কথা হয় না।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক কথাপ্রসঙ্গে বললেন, দেখুন, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রে বহু বাধা, বহু বিঘ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে মেধাবী ছাত্রকে আমি নিয়োগ করতে চাইবো। আমি তাকে যে-মাইনে দেবো, ট্রাক-ড্রাইভার হলেও সে তার কয়েকগুণ বেশি পাবে। কেন সে গবেষণা করতে আসবে? আপনি তো আমাদের জার্নালের সঙ্গে পরিচিত। সরকার বলছে, তোমরা স্বাবলম্বী হও, যত্র আয় তত্র ব্যয় করো। আপনি বলুন, পৃথিবীর কোন গবেষণা পত্রিকার আয়-ব্যয় সমান। আমরা ভাবছি, ইংরেজি জার্নালটা বন্ধ করে দেবো।

বলেন কী! তাহলে অন্য দেশের বিদ্বানেরা কী করে আপনাদের গবেষণার খোঁজ-খবর রাখবে?

রুশ ভাষার জার্নালটা তো বন্ধ হতে দিতে পারি না। যারা রুশ জানে, তারা আমাদের গবেষণার খবর পাবে। এক-আধটা অ্যাবসট্রাক্ট আছে ইংরেজিতে–তারা আমাদের গবেষণা-প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ ছাপে। তাতে যতটুকু চলার, ততটুকু চলবে। আমি আর কী করতে পারি!

হোটেলের রেস্টুরেন্টে অনেক রুশ দেখি। সোভিয়েত আপসোর এক কর্মকর্তা বললেন, মনে হয়, এরা নব্য ধনী। ব্যবসা করে দু-পয়সা করেছে। একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। আমাদের যেসব ব্যবসায়ী স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছে বাংলাদেশি তরুণদের খুব সমাদর। বাংলাদেশি আর প্যালেস্টিনিয়ানদের। বিমানে করে ওদের সিঙ্গাপুর-হংকং পাঠায়, ওরা সেখান থেকে জিনিসপত্র স্মাগল করে নিয়ে আসে–খুব পটু এ ব্যাপারে। ধরা না পড়লে তারাও বেশ করে খাচ্ছে। তোমার দেশের অনেক ছেলেই এখন লেখাপড়া স্থগিত রেখে এই কাজে নেমেছে। নগদ পয়সার বিকল্প নেই।

আমি ভাবি, সোভিয়েত ইউনিয়ন কোথায় যাচ্ছে!

সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানেই যাক, আমাকে যেতে হবে এডেন বন্দরে–জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেনের রাজধানী এডেনে।

শৈশব থেকে এডেন বন্দরের নাম শুনে আসছি–পাঠ্যপুস্তকে ও সংবাদপত্রে তার কথা পড়ে আসছি। এডেনের ডাকটিকিট ও ধাতব মুদ্রা দুইই এক সময়ে আমার সংগ্রহে ছিল। উনিশ শতকে ব্রিটিশ অধিকারে চলে যাওয়ার পরে এডেন কিছুকাল শাসিত হয়েছিল বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত এলাকা হিসেবে, তারপর তা ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায় এবং আরো পরে একটি স্বতন্ত্র ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। বন্দরটি ইয়েমেনের একেবারে দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। ষাটের দশকে ইয়েমেন রাজ্য উত্তর-দক্ষিণে দু ভাগ হয়ে যায়। উত্তরের ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র পাশ্চাত্যের এবং দক্ষিণের ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত বলয়ের প্রভাবাধীন হয়। সত্তরের দশকের শেষে দুই অঞ্চলে স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সম্প্রতি দুই দেশের একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ দেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছে মাত্র আগের মাসে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই দুই দেশ এক হয়ে প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন গঠন করবে। তখন উত্তরের সানা হবে ইয়েমেনের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রাজধানী, আর এডেন হবে তার অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক রাজধানী।

এডেনে গিয়ে আমি দেখতে পাই আসন্ন একত্রীকরণের নানা নিশানা। চারদিকে উৎসবের একটা ভাব। তা থেকে মনে হয় একত্রীকরণের সম্ভাবনায় লোকজন খুশি। উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাললা–তার সুফল গোটা রাজ্যে পড়বে বলে অনেকে আশা করছে। অনেকে আবার ভাবছে, বাজার অর্থনীতির চাপে যখন দক্ষিণের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসে যাবে, তখন উত্তরের সামাজিক বৈষম্য দক্ষিণেও আসন গেড়ে বসবে।

এডেনের সভায় কী আলোচনা হয়েছিল, তা এখন মনে নেই। তবে ওখানকার দিনগুলো যে ভালো কেটেছিল, তা মনে আছে।

১৯.

কয়েক মাসের মধ্যে আমন্ত্রণ এলো কেন্দ্রীয় আপসো থেকে। বান্দুংয়ের ৩৫ বছরপূর্তি-উপলক্ষে কায়রোতে আন্তর্জাতিক সেমিনার। তাতে বাংলাদেশ থেকে দুজনকে নিতে চান তাঁরা, তার মধ্যে একজনকে লিখিত প্রবন্ধ পড়তে হবে। ঠিক হলো, মোস্তাফিজুর রহমান (এখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক) আর আমি যাবো, তবে লেখাটা আমাকেই তৈরি করতে হবে। এবারো কায়রো যাতায়াত করতে হবে মস্কো হয়ে।

মস্কো বিমানবন্দরে পৌঁছে এবার লক্ষ করলাম, আমাদের সহযাত্রী বাঙালি তরুণের অনেকের সঙ্গেই মোটা মোটা বোঁচকা। আগেরবার চোরাচালানের বিষয়ে যা শুনেছিলাম, তা মনে পড়ল।

মস্কোতে কেউ আমাদের নিতে আসেনি। মোস্তাফিজ এখানে লেখাপড়া করেছেন, রুশ ভাষা তার অধিগত। তিনি একটু হাঁটাহাঁটি করলেন, এখানে সেখানে খবর নিলেন, কোনো লাভ হলো না। বসে বসে কিছুটা সময় কাটাবার পর ভোর হলো। তদ্দণ্ডেই দ্বিজেন শর্মাকে ফোন। তিনি তখনি তাঁর বাড়িতে চলে আসতে বললেন।

একটা ট্যাকসি নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছোনো গেল। মুখহাত ধুয়ে নাশতা-পর্ব সারা হলো। খানিক পরে দ্বিজেন ফোন করলেন আপসোর দপ্তরে। তারা বললেন, আমাদের লোক তো থাকার কথা এয়ারপোর্টে। ঠিক আছে, ওঁদেরকে আপনার বাড়িতেই অপেক্ষা করতে বলুন। আমাদের অফিস থেকে আর কেউ গিয়ে ওঁদের হোটেলে পৌঁছে দেবে।

হোটেলে যিনি পৌঁছে দিলেন, তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। এমন তো হয় না, এমন হওয়ার কথা নয়। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট দোভাষীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল বিমানবন্দরে। সে বলছে, গিয়ে আমাদের পায়নি। যা হোক, সে এখনি এসে পড়বে হোটেলে।

খানিক বাদে মূর্তিমান সশরীরে হাজির। চেহারা দেখে বোঝা গেল, বকুনি খেয়েছে। হাসি-হাসি মুখ করে বলতে থাকলো, সে সময়মতোই বিমানবন্দরে গিয়েছিল, আমাদের পায়নি। বোধহয় একদিকে সে খুঁজেছে, অন্যদিক দিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি।

মোস্তাফিজ যখন জানালেন যে, আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি, তারপরও সে ভাঙে কিন্তু মচকায় না।

ছেলেটি যে স্বভাবতই মিথ্যেবাদী, তার পরিচয় সে পরেও দিয়েছে। তার ওপর সে পাশ্চাত্যজগতের পরম ভক্ত। মুখে বলছে বটে তার অনুরাগ পাশ্চাত্য সংগীতে (তার মধ্যে তো রুশ সংগীতজ্ঞেরাও আছেন), কিন্তু পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার যতটুকু সে জেনেছে তার সবটুকুই তার ভালো লেগে গেছে। তার মতে, স্বদেশে সেই প্রাণশক্তির প্রকাশ নেই, যা পশ্চিমে আছে।

আমি কোন কোন দেশে গেছি, তা সে সাগ্রহে জানতে চায়। ফ্রান্সে গেছি শুনে সে এমন ভাববিহ্বল হয়ে পড়ে যেন আমার পাদুকাযুগলের পূজা করবে।

১৯৭৩ সালে যে-ছেলেটি আমাদের দোভাষী ছিল, তার কথাবার্তার বিষয়, রসবোধ, চালচলনের সঙ্গে এর এমনই পার্থক্য যে, দু-একজনকে দিয়ে একটা দেশের বিচার করা অনুচিত জেনেও আমার মনে হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত পতনের দিকে ধাবমান।

মস্কোর হোটেলে মাদাম গুয়েন থি বিনের সঙ্গে দেখা হয়। তার সঙ্গে আগের বছরে দেখা হয়েছিল দিল্লিতে। ভিড়ের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল–কথাবার্তার তেমন সুযোগ হয়নি। এবারে হলো।

ভদ্রমহিলা বয়সে আমার বছর দশেক বড়ো হবেন। ফরাসি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন ছাত্রাবস্থায়। কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অপরাধে জেল খেটেছেন কয়েক বছর। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে যোগ দিয়ে দ্রুত তার নেতৃস্থানীয় পদে উন্নীত হয়েছেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পূর্বাপর প্যারিস শান্তি আলোচনায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শেষ দফা আলোচনায় টেবিল ঘিরে কীভাবে বসা হবে, সে-সম্পর্কে আপত্তি তুলে সভার কাজ বন্ধ রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। তাঁর দৃঢ়চিত্ততা পাশ্চাত্য সাংবাদিকদের প্রশংসা অর্জন করেছিল।

মস্কোতে তাকে আমি দেখলাম অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র, মৃদুভাষী মানুষ হিসেবে। এমনিতে গম্ভীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ রসবোধেরও পরিচয় দেন। তাঁকে আমার খুবই ভালো লাগতে থাকে।

লেখালেখির কাজ আমি কখনোই সময়মতো শেষ করতে পারি না। মস্কোতে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে হোটেলের কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ রেখে প্রবন্ধ লিখি। আর প্রায় সেভাবেই পৌঁছে যাই কায়রোতে। সেখানে নেমে আমাদের ভিসা পাওয়ার কথা–তাতে একটু দেরি হয়।

হোটেলে পৌঁছে দেখি, ঘরে দুটো আমন্ত্রণপত্র রাখা। সেদিনই বিকেলে আফ্রিকা হাউজে নেলসন মান্ডেলা বক্তৃতা দেবেন। রাতে মান্ডেলাকে মিশরের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবর্ধনা দেবেন এক হোটেলে। ২৮ বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এটাই বোধহয় তাঁর প্রথম বিদেশসফর।

গত বছরে নেলসন মান্ডেলার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ আপসোর পক্ষ থেকে খুব ভালো একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম আমরা ইন্‌জিনিয়ারস ইন্সটিটিউশনে। এতে আমাদের প্রধান সহায় ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে মান্ডেলার বিবৃতির কিছু কিছু অংশ আমি। অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। কবরী সারোয়ার প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী তা পাঠ করেছিল। আমার অনুরোধে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান একটি গান রচনা করেছিলেন–তাতে সুর দিয়ে গেয়েছিল বেবী নাজনীন। পরে ডা. সাইদুর রহমান এই অনুষ্ঠানের ভিডিও প্রদর্শন করেছিলেন আপসোর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সকলেই তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে যার মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম, সেই লোকনায়কের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনায় রোমাঞ্চিত হলাম বই কি!

কোনোমতে চা খেয়েই দৌড় দিলাম আফ্রিকা হাউজে। যানজটের কারণে বেশ খানিকটা আগে নেমে যেতে হলো। আফ্রিকা হাউজে পৌঁছে দেখি, লোকে লোকারণ্য-তিলধারণের জায়গা নেই। মান্ডেলা তখনো আসেননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা ঠিক করলাম, বরঞ্চ সংবর্ধনার জায়গায় চলে। যাই আগে আগে।

সেখানেও মান্ডেলার আসতে দেরি। পান-পর্বের শেষে ভোজের সূচনা হয়ে গেল। মান্ডেলা পৌঁছোলেন না। অতিথিরা বিদায় নিতে শুরু করলেন। কেবল আমরা কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম।

অতিথিদের ভিড় কম হলে নিমন্ত্রণকর্তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। পাতলা গড়নের লম্বা মানুষ, সদালাপী, নিরহংকার। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পারদর্শী বলে যার সঙ্গে কথা বলেন, মনে হয়, তার সম্পর্কে কিংবা তার দেশ বা পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

অল্পকাল পরে জাতিসংঘের নতুন সেক্রেটারি-জেনারেল বুট্রোস বুট্রোস গালির ছবি যখন দেখলাম খবরের কাগজে, তখন বুঝতে পারলাম, কায়রোর সেই রাতের নিমন্ত্রণকর্তা ছিলেন তিনিই। আমি তার নাম মনে রাখতে পারিনি।

সেই রাতে অবশেষে মান্ডেলা এলেন। এসেই মাফ চাইলেন। বললেন, কোথাও তিনি সময়মতো যেতে পারছেন না, সময়মতো বের হতে পারছেন না। মানুষের ভালোবাসা, কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা তাঁর কর্মসূচি নষ্ট করে দিচ্ছে।

মান্ডেলা দেরি করে আসায় আমাদের লাভ হলো। তিনি প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার শ্রম স্বীকার করতে পারলেন।

আমি তাকে আমাদের ঢাকার অনুষ্ঠানের কথা বললাম। তিনি হাসলেন। করমর্দনের সময়ে হাতে মৃদু চাপ দিয়ে চলে গেলেন।

পরদিন সকালে নাশতা খেতে যাচ্ছি। দেখি, মাদাম বিন্ আমার সামনে। তিনি বসতে বললেন, তার টেবিলে। আমি কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি আবার বললেন, বোসো।

বললাম, আপনি আগে বসুন। প্যারিস সম্মেলনে বসা নিয়ে কী কাণ্ডই না আপনি করেছিলেন!

মাদাম বিন্ হাসলেন। বললেন, তখন আমি শত্রুদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছিলাম। আর এখন তো বন্ধুদের সঙ্গে বসছি। এখন আমার তো কোনো শর্ত থাকার কথা নয়।

তিনি খুব আন্তরিকভাবে আমাকে ভিয়েতনামে আমন্ত্রণ জানালেন। তবে যাওয়া তো সহজ নয়। অল্পকালের মধ্যে মাদাম বিন ভিয়েতনামের উপরাষ্ট্রপতি হয়ে যান। তখন তার নিমন্ত্রণের কথা আবার মনে পড়ে।

সেমিনার ভালোই হলো। আমার লেখাটি বড়ো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত নির্ধারিত সময়ে আমি বক্তব্য শেষ করতে পারি। এবার পারিনি। সভাপতির তাড়া খেয়ে এত দ্রুত পড়তে লাগলাম যে, যে-মহিলা ইংরেজি-আরবি দোভাষী, তিনি ইংরেজিতেই বললেন, ‘হি ইজ রিডিং টুউ ফাস্ট ফর মি।’ তারপর থেমে গেলেন।

নিজের স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে অনুতপ্ত হয়েছিলাম। তবে লেখাটি অনেকের ভালো লেগেছিল। বিদ্যাশেখরা বললো, প্রফেসর, তুমি তো দেখছি থিসিস লিখে ফেলেছ।

কায়রোতে সেই আমার প্রথম সফরে দ্রষ্টব্য অনেক কিছু দেখলাম। নীল নদ, পিরামিড, স্ফিংস। সন্ধ্যার পর হোটেলে আড্ডা।

আপসোর সভাপতি ড. মোরাদ গালিব এককালে মিশরের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা তাঁকে বললাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ছেলেটি ভালো।

আনোয়ার আবদেল-মালেক যদি তার কাছে ছেলে হয়, তাহলে আমি তো এখনো জন্মাই নি! আর কথা বাড়ালাম না।

২০.

মৃত্যুর আগে আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে যে আবার আমার মনোমালিন্য হয়ে গেল, সে কথা ভাবতে এখনো খারাপ লাগে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি খুশিই ছিলেন। উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীর সৌজন্যে মহসিন হলের প্রোভোস্ট নিযুক্ত হন তিনি, প্রশস্ত বাসগৃহ পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেন। কিন্তু তার মধ্যে অস্থিরতা ছিল, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছিল, নানাক্ষেত্রে নিজের দক্ষতাপ্রমাণের অভিপ্রায় ছিল। তাই যখন আমন্ত্রণ পেলেন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের পদে যোগ দেওয়ার, তখন শিক্ষকতা থেকে ছুটি নিলেন। সেখান থেকে হলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি উদযোগ নিয়ে আমাকে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য করলেন এবং একাডেমির নানাকাজে যুক্ত করলেন। এর মধ্যে একটি ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলা বৈদ্যুতিক টাইপরাইটারের কী-বোর্ড তৈরির কাজ। একইসঙ্গে কী-বোর্ডের বিন্যাস এবং হরফের আদলসৃষ্টি। বিন্যাসের বিষয়ে মূল কাজটি করলেন জামিল চৌধুরী। মুনীর অপটিমার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে ছিল, তার বিন্যাস সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের কিছু সমালোচনা বা পরামর্শ আমরা গণ্য করেছিলাম। হরফের বিষয়ে কাইয়ুম চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে একাধিক নমুনা আঁকিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে আমরা তখনই প্রশ্ন তুলেছিলাম, কম্পিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের উদ্ভাবনের বিষয় যখন আমাদের চিন্তা করা উচিত, তখন আমরা ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের জন্য চেষ্টিত হচ্ছি কেন? দেখা গেল, মন্ত্রণালয় মনে করছে, কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহার করতে সময় নেবে, ততদিনে ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের ব্যবহার আমাদের কাজে গতি দেবে।

আবু হেনা আরেকটি কাজে আমাকে যুক্ত করেছিলেন–বাংলা ভাষাপ্রয়োগে সাধারণ ভুলগুলো সংকলন করে সকলের সামনে তুলে ধরা। এখানে মোহাম্মদ আবদুল কাইউম আমাদের সঙ্গে ছিলেন, একাডেমির একাধিক কর্মকর্তাও এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ (১৯৮৭) নামে বইটি যখন বের হলো, তখন তা সমাদৃত হয়।

‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’র আদলে বাংলা একাডেমী থেকে জীবনী গ্রন্থমালা’র প্রকাশও ছিল আবু হেনার নিজের পরিকল্পনার অংশ। তিনি আমাকে দিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮) বইটা লিখিয়ে নিয়েছিলেন। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় যাদের জীবনী আছে,

‘জীবনী-গ্রন্থমালা’য় তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। একাডেমীর কর্মকর্তারা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে, পূর্ববাংলায় জন্মগ্রহণকারী যেসব সাহিত্যিকের জীবনী চরিতমালা’য় আছে, তাঁদেরও নতুন জীবনী লেখার সুযোগ আছে এবং সেক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে পুনরাবৃত্তি বলে মনে হলেও এঁদের নতুন জীবনী প্রকাশ করা উচিত। সেটাই হয়েছিল।

এই দৃষ্টান্তটি ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হতে পারে, সাধারণত তিনি আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায়ও তিনি অনেক সময়ে প্রকাশ্যেই আমার মতামত প্রথমে শুনতে চাইতেন। একবার একটি বইয়ের সংকলন ও মুদ্রণ নিয়ে একজন পরিচালকের কাজে গাফিলতির অভিযোগ আনলেন এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের প্রস্তাব করলেন। কাজের ত্রুটি দৃশ্যমান ছিল। আমি বললাম, আগে পরিচালকের কৈফিয়ত চাওয়া হোক, সেটা সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তিনি ভাবলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে আমি পরিচালকের পক্ষ নিচ্ছি মহাপরিচালকের মতের বিরুদ্ধে। তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া অসংগত হবে–তা তার ত্রুটি যত বড়ড়াই হোক না কেন। আমার বাধাদানের কারণেই পরিষদের ওই সভায় সেই পরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, কিন্তু আবু হেনা খুবই খারাপ বোধ করলেন, এটাকে তার পরাজয় হিসেবে দেখলেন, তাঁর মধ্যে প্রবল তিক্ততা দেখা দিলো।

কয়েকদিনের মধ্যে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে এই ঘটনা অনেকখানি ক্রিয়াশীল ছিল। তাঁর শরীর খারাপ হওয়ায় তাঁর স্ত্রী আমাকে খবর দিতে চান–ভাবির পক্ষে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু আবু হেনা নিষেধ করেছিলেন। তিনি চৈতন্য হারিয়ে ফেলার পরে আমি খবর পাই। বেবী ও আমি তখনই তাঁর বাসায় যাই। তার পরপরই অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইন্সটিটিউটে। আমিও তার অনুগমন করি। অল্পকাল পরে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আর কিছু করার নেই।

সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর।

পরে বাংলা একাডেমী আমাকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল-রচনাবলী সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়। বিশ্বজিৎ ঘোষের সহযোগে আমি তা করেছি। এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে (২০০১), দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। তার আগে শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত তাঁর গানের সংকলন আমি সাগরের নীলের ভূমিকাও আমি লিখেছি–তার পরিবারের ইচ্ছাক্রমে।

২১.

১৯৮৯ সালের শেষদিকে একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। কাজ ছিল টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফাও সেখানে আমন্ত্রিত বক্তা ছিল।

এক ফাঁকে মুস্তাফাঁকে নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাই। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, এবার ঢাকায় যাচ্ছি।

উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলাম, তাই নাকি? কী উপলক্ষে?

কবি বললেন, ‘এশীয় কবিতা উৎসবে।’

আমার উৎসাহে ভাটা পড়ল। বললাম, এ তো প্রেসিডেন্ট এরশাদের শো। আপনি যাবেন?

সুভাষ বললেন, ‘কতদিন ধরে তোমরা এরশাদকে সরাবে-সরাবে বলছ। কিছু তো করতে পারছ না! আমি আর কতদিন ঢাকায় না গিয়ে থাকব!’

তার কথার সত্যতা স্বীকার করতেই হয়।

দ্বিতীয় এশীয় কবিতা-উৎসবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন নভেম্বর মাসে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কবিতা-উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ছাড়া তাকে অধিকার করে রেখেছিল সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সে বাবা বলে সম্বোধন করত।

১৯৯০ সালে কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রবল হলো। ছাত্রদের ধর্মঘট ও সংঘর্ষ, চিকিৎসকদের ধর্মঘট, আইনজীবীদের প্রতিবাদ, শ্রমিক-সংঘর্ষ, পরিবহণ-ধর্মঘট, ছাত্র-পুলিশ সংঘাত, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, হরতাল–এসব লেগেই রইল। অক্টোবর মাসে সারাদেশে রাজপথ ও রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি পালিত হলো।

ঠিক সেই সময়ে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো বড়ো অক্ষরে খবর ছাপা হলো : বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত।

বাবরি মসজিদ নিয়ে অযোধ্যায় সংঘাতময় পরিস্থিতি গড়ে উঠেছিল কিছুকাল ধরেই। কিন্তু মসজিদটি তখনো বিধ্বস্ত বা আক্রান্ত হয়নি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তা। ভেঙে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছে–তাদের সঙ্গে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ। পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ, কিন্তু বিস্ফোরণ তখনো ঘটেনি।

ইনকিলাবেমিথ্যা সংবাদের সঙ্গে ছিল উত্তেজনাকর সম্পাদকীয়। যেদিন এটা প্রকাশ পেল, ৩০ অক্টোবর, সেই রাতেই চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। দাঙ্গা নয়, নির্যাতন।

পরদিন, শুনেছি, মিথ্যে খবর ছাপানের দায়ে ইনকিলাব্বে কৈফিয়ত চায় সরকার। মওলানা মান্নান তাঁর পুত্রকে নিয়ে–তিনিই পত্রিকার সম্পাদক-রাষ্ট্রপতি এরশাদের দরবারে হাজির হন। সম্পাদক কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চান এবং ভ্রম-সংশোধনী ছাপবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ৩১ অক্টোবর কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছোটো করে তা ছাপা হয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সব ব্যাপারটা ছিল লোক-দেখানো এবং ৩১ তারিখে নাকি স্বল্পসংখ্যক ইনকিলাব মুদ্রিত হয়। ওই সংশোধন এবং ক্ষমাপ্রার্থনা কোনো কাজে আসেনি।

ঢাকায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় ৩১ তারিখ সকালেই আমরা প্রেস ক্লাবে জড়ো হলাম। কিন্তু করণীয় নির্ধারণ করতে আমাদের অহেতুক বিলম্ব হয়। দাঙ্গাবিরোধী মিছিল নিয়ে আমরা প্রেস ক্লাব থেকে শাঁখারিবাজারে যাই, সেখান থেকে ফিরে আসি প্রেস ক্লাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা বের হবার আগেই বিজয়নগরে মিষ্টির দোকান লুঠ হয়, নারিন্দায় বাড়ি আক্রান্ত হয়, ইসলামপুরে স্বর্ণালঙ্কারের প্রতিষ্ঠান লুষ্ঠিত হয়–তার মধ্যে মুসলমানের মালিকানাধীন দোকানও ছিল। ক্রমে ঢাকার বাইরে পরিস্থিতির অবনতি হয়।

আমাদের মিছিলে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। কোতোয়ালি থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে শান্তিরক্ষা সম্পর্কে আমাদের আলোচনা। ভালোই হয়েছিল, কিন্তু আমাদের অনেকেরই মনে হয়, পুলিশকে যথেষ্ট সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ তখনো ওপর থেকে আসেনি। তবে ৩১ অক্টোবরেই কয়েকটি পাড়ায় শান্তিরক্ষার জন্যে স্কোয়াড গঠন করা সম্ভবপর হয়েছিল। ‘

শেষ পর্যন্ত ওইদিনেই সান্ধ্য আইন জারি হয়। পরদিন কিছুক্ষণের জন্যে শিথিল করে আবার তা প্রয়োগ করা হয়। কারফিউ প্রত্যাহার করা হলেও কোতোয়ালি, সূত্রাপুর ও লালবাগ থানা এলাকায় বলবৎ করা হয় ১৪৪ ধারা। পরে এই ধারার অধীন থানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

১৪৪ ধারা জারি করায় শান্তিমিছিল বেরোনোর অসুবিধে হয়। তবু যেখানে ১৪৪ ধারা ছিল না, সেখানে মিছিল হয় এবং যেখানে তা ছিল সেখানেও শান্তিরক্ষার উদ্যোগ চলতে থাকে। সম্মিলিতভাবে শান্তিমিছিল বের হয় ৮ নভেম্বরে। ততদিনে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুর আস্থা ভয়ানকভাবে বিচলিত হয়।

আমরা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, সরকারবিরোধী আন্দোলন থামাতে। এই ধরনের পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবেই সরকার তৈরি করেছে, কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হবে না। সাম্প্রদায়িক পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে মূল আন্দোলন আবার গতি পায়। আন্দোলনের একটি মূলকেন্দ্র বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি নির্দেশে। সে-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আমরা ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ছাত্রেরাও ক্লাসে আসতে থাকে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিতে বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সিরাজুর রহমান ঢাকায় চলে আসেন। এর আগে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারপর এক পর্যায়ে সরকারি আদেশে বাংলাদেশে বিবিসির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিবিসির বহির্বিশ্ব বিভাগের কর্মকর্তারা দেনদরবার করে সে-কার্যক্রম পুনরায় চালু করার অনুমতি পান। খবরের যাথার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেজন্যে সরাসরি সিরাজুর রহমানকে পাঠানো হয় বাংলাদেশে। তিনি এসে ওঠেন শেরাটন হোটেলে, অবসর পেলেই আমি সেখানে চলে যাই। আমরা পরস্পর খবরাখবর বিনিময় করি, শেরাটনে ও ঢাকা ক্লাবে আড্ডা দিই। অনেক সময়ে শহরের অবস্থা দেখতে যাই একসঙ্গে।

এক বিকেলে সিরাজুর রহমান ও আমি এক রিকশায় যাচ্ছি। জিপিওর কাছে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল যাচ্ছে মহিলাদের। আমরা দুজনেই প্রায় একইসঙ্গে সেই মিছিলে বেবীকে দেখতে পাই। বেবী যে মিছিলে যোগ দেবে, তা আমার জানা ছিল না। আমার ও বেবীর নাম না করে ঘটনাটি বিবিসিতে প্রচার করেন সিরাজুর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপক্ষ ও বিরোধী দলের ছাত্রদের মধ্যে একদিন প্রবল গোলাগুলি হলো। আমরা কলাভবনে আটকে রইলাম অনেকক্ষণ। সামনের রাস্তায় গাড়ি ও লোক-চলাচল বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ সেখানে অবস্থান নিলো। আমার ধৈর্যে আর কুলোচ্ছিল না। বন্ধুদের বাধা অগ্রাহ্য করে কলাভবন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথচারীদের চলাচলে বাধা দিলেও পুলিশ আমাকে বাধা দেয়নি। সামনে গিয়ে দেখি, আমাদের আবাসিক এলাকার গেটে বহুজন অপেক্ষমাণ। তাদের মধ্যে দর্শন বিভাগের রাশিদা আখতার খান রোরুদ্যমানা। তাঁর মেয়ে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রী–সেখানেই সে আটকা পড়েছে, বাড়িতে আসতে পারছে না। রাশিদা চাইছেন, নিজে স্কুলে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসতে, কিন্তু সকলেই তাকে বাধা দিচ্ছেন। আমাকে নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে দেখে মেয়েকে উদ্ধার করার ইচ্ছে তার প্রবল হলো। শেষকালে আমি বললাম, স্কুলে কথাবার্তা বলে দেখি, অধ্যক্ষ বা শিক্ষকেরা কী বলেন। দরকার হলে আমি গিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে আসবো। স্কুলে ফোন করে কথা বললাম। তারা বললেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই তারা স্কুল থেকে বের হতে দেবেন না। ছাত্রছাত্রীরা যেমন আছে সেখানে, তেমনি আছেন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা। এই অবস্থায় দু-একজন চলে গেলে বাকিদের ধরে রাখা কষ্টকর হবে। খুবই যুক্তিসংগত কথা। রাশিদাকে আমি বোঝালাম। পরে তাঁর মেয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে এসেছিল।

এদিকে সংবাদপত্রের ওপর সেনসরশিপ আরোপ করলো সরকার : সাংবাদিকদের রিপোর্ট ছাপাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। এই আদেশের প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা ধর্মঘট করলেন, কালো ব্যাজ পরে মিছিল করলেন। পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। কেউ বললেন, এতে সরকারেরই লাভ হলোদেশবাসী সত্য খবর জানুক, এটা তারা চায়নি; এখন লোকের কাছে খবর পৌঁছোনোই বন্ধ হয়ে গেল। কেউ বললেন, কোনো দেশে সাংবাদিকেরা পত্রিকা প্রকাশ করতে অস্বীকার করছে, এটা এত বড়ো খবর এবং সরকারের এত বড়ো নিন্দাবাদ যে সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের বাস্তবচিত্র সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেল।

ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও সান্ধ্য আইন জারি হলো। পুলিশ অথবা সরকারি মাস্তানের গুলিতে রোজই মানুষ প্রাণ দিতে থাকলো। সবচেয়ে উত্তেজনাকর হলো ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ড। সমস্ত দেশ এতে স্তম্ভিত হয়ে গেল, প্রতিবাদের ঢেউ উঠল, সরকারের মৃত্যুঘণ্টা বাজল।

২৯ নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে শিক্ষক সমিতির সভায় স্থির হলো যে, আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, একযোগে পদত্যাগ করবো। আমাদের মধ্যে দু-একজন প্রশ্ন তুললেন, উপাচার্য পদত্যাগ করবেন কি না। আমি বললাম, এটা তাঁর বিবেকের বিষয়; আমাদের পদত্যাগের সঙ্গে তাঁর পদত্যাগের প্রশ্নটি জড়িত করা ঠিক হবে না। আমার কথাটি সকলে মেনে নিলেন। সভাশেষে আমরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। কার্জন হল পার হতেই পুলিশের বাধা। প্রথমে আমাদের গতিরোধ। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকায় একটু পরে আমাদের ওপরে উপর্যুপরি কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া। মুহূর্তমধ্যে সংকল্প ত্যাগ করে আমরা পশ্চাদপসরণ করলাম। সহকর্মীরা কেউ কেউ রাস্তার ওপরেই পড়ে গেলেন। তাদের ধরে তুলে আমরা আবার ক্লাবে ফিরে এলাম। আমাদের পদত্যাগের খবর দেওয়া হলো বিবিসিতে।

পরদিন সকালে কলাভবন-প্রাঙ্গণে শিক্ষকেরা জড়ো হলেন, তবে আগের দিনের চেয়ে অনেক কম সংখ্যায়। হলগুলো থেকে এবং বাইরে থেকে ছাত্রেরা জড়ো হতে হতে এক বিশাল সমাবেশ হয়ে গেল। পদত্যাগ করায় শিক্ষকদের অভিনন্দন জানালো ছাত্রেরা, তারা দাবি করলো উপাচার্যের পদত্যাগ। সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ সেখানে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি অবতীর্ণ হলেন ত্রাতার ভূমিকায়। কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে তিনি উপাচার্য ভবনে গেলেন এবং ছাত্রদের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে একা উঠে গেলেন দোতলায়। কিছুক্ষণ পরে নেমে এসে ঘোষণা করলেন, উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ছাত্রদের প্রবল হর্ষধ্বনি। বিবিসির সংবাদে উপাচার্যের পদত্যাগের সংবাদ প্রচার।

বস্তুতপক্ষে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা পদত্যাগ করেননি। তিনি উপাচার্য হয়েছেন মাত্র মাসছয় আগে। তার দিক থেকে পদত্যাগ করার কোনো কারণ ঘটেনি। তিনি নিজমুখেও কাউকে বলেন নি যে, তিনি পদত্যাগ করেছেন। ফয়েজ আহমদের কথার জন্যে তিনি তো আর দায়ী হতে পারেন না। সে-কথায় পদত্যাগ করার জন্যে তার ওপরে চাপ যদি কমে যায়, তাতে তিনি কী করতে পারেন!

ফয়েজ আহমদকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ-কাজটি তিনি কেন করতে গেলেন! তিনি বললেন, ছাত্রেরা যেমন চাপ সৃষ্টি করছিল, তাতে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো। সেই পরিস্থিতি এড়াতেই তিনি মুহূর্তের একক সিদ্ধান্তে এমন কাজটি করলেন।

পরবর্তী তিন-চারদিনে আন্দোলন আরো জোরালো হলো, আরো প্রাণহানি ঘটলো। সচিবালয় এবং সরকারি-আধা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এবারে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে রাজপথে মিছিল করে নামলেন। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে নানারকম প্রস্তাব দেওয়া হলো, কিন্তু সরকারের পদত্যাগ ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁরা রাজি নন বলে জানিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাগ্রহণের জন্য যথেষ্ট প্ররোচণা দিলেন এরশাদ, কিন্তু সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট-জেনারেল নূরউদ্দীন তাকে বলে দিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সে-পথে পা বাড়াবে না। ৪ ডিসেম্বর জানা গেল, এরশাদ পদত্যাগ করবেন এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদে তিন রাজনৈতিক জোট প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নিয়োগদানে একমত হয়। তাঁর সম্মতি পেতে দেরি হচ্ছিল। তখন বিকল্পের সন্ধান শুরু হয়। মঈদুল হাসানের পরামর্শে আমি এয়ার ভাইস-মার্শাল (অব) এ কে খোন্দকারের নাম প্রস্তাব করি ড. কামাল হোসেনের কাছে। কামাল তখন আত্মগোপনে ছিলেন। এই নাম আলোচিত হতে হতে জানা গেল, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন এই শর্তে যে, দায়িত্বকালশেষে তাকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যেতে দেওয়া হবে।

৫ তারিখ রাতের খবরে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, এরশাদ যাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢল নামলো রাজপথে। মুহূর্তের মধ্যে বেবী ও আনন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিছিলে যোগ দিতে। আমি ঘরে বসে রইলাম টেলিভিশন সেটের সামনে। তাতে মানুষের আনন্দের যে-প্রকাশ দেখা গেল, তা বহুকাল দেখিনি।

৬ তারিখে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগের জন্যে বেচারি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি পরিস্থিতির বিকল্প সমাধানের প্রস্তাব করছিলেন। সেখান থেকে বের হয়েই তাকে যেতে হলে ক্ষমতার কেন্দ্রে এবং তাকেই প্রথম ক্ষমতা ছাড়তে হলো। রাষ্ট্রপতি তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।

২২.

এরশাদের পতনের পর সারাদেশে মানুষের মনে যে-উল্লাস ও আশাবাদ দেখা দেয়, তার একমাত্র তুলনা হতে পারে স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরে দেশবাসীর আনন্দ ও প্রত্যাশার সঙ্গে। ১৯৯০ সালের বিজয় দিবস সংখ্যা সংবাদ-এ ‘এবারে’ নামে আমি একটা ছোটো লেখায় এই আশাবাদের কথা উল্লেখ করে বলেছিলাম, এবারে তাকে কোনোক্রমে মিথ্যে প্রতিপন্ন হতে দেওয়া চলবে না। হায়, ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কত কঠিন!

৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহের সংগ্রামময় জীবনের অবসান হলো। পুস্পার্ঘ্য দিয়ে আমরা শেষবারের মতো তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা যাঁরা হলেন, তাঁদের অধিকাংশই আমাদের চেনাজানা মানুষ, আপনজনই বলা যেতে পারে। তাদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ ছিল না। একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন যে অনুষ্ঠিত হবে, সবার মনে সেই প্রত্যয় দেখা দিলো।

এরশাদকে প্রথমে আটক রাখা হয় স্বগৃহে। বিবিসিকে দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হলে দুর্নীতির দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশানের একটি বাড়িকে সাব-জেল ঘোষণা করে সেখানে তাঁকে সপরিবারে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। বেশ পরে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁর দলের অনেকে গ্রেপ্তার হন বটে, কিন্তু জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হয়।

দেশের সরকারপদ্ধতি নিয়ে তুমুল আলোচনা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ এবং বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে মতপ্রকাশ করে। বিএনপির স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। শেষকালে অবশ্য তারাও সংসদীয় পদ্ধতির আনুকূল্য করে।

নির্বাচনী প্রচারণা প্রায় প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায়। আট দলের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে মতৈক্য না হওয়ায় প্রত্যেক দল স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়নপত্র পেশ করে। পরে মনোনয়ন-সমন্বয়ের প্রয়াস নেওয়া হয়। তারপরও মনোমালিন্য রয়ে যায়।

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, ভোটার তালিকায় বেবীর নাম আছে, আনন্দের নাম আছে, আমার নাম নেই। দিনশেষে সংবাদ-সম্মেলনে ভোটার-তালিকার অসম্পূর্ণতার দৃষ্টান্ত হিসেবে শেখ হাসিনা এই বিষয়টির উল্লেখ করে। কয়েকটি পত্রিকা থেকে ফোন করে আমার কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চাওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের সচিব আইয়ুবুর রহমানও আমাকে ফোন করে তার অফিসে যেতে বলেন এবং প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দেন।

পরদিন জানা যায়, বিএনপি ১৪০টি এবং আওয়ামী লীগ ৮৪টি আসনে জয়লাভ করেছে।

৩৫টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি নিয়েছে তৃতীয় স্থান। সেদিন নাকি সংবাদ-সম্মেলন করে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হয়নি বলে বিএনপির অভিযোগ করার কথা ছিল। এখন পট বদলে গেল। শেখ হাসিনাই বললো, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বললেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনে তিনি অবশ্য পরাজিত হন–অনেকে সে-পরাজয়ের কারণ মনে করেন আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ। তবে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা সম্পর্কে কামালের এই মন্তব্য তার দলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরই জের ধরে কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর গাড়ি আক্রান্ত হয়, তিনিও কটুকাটব্যের শিকার হন।

খালেদা জিয়া ও এরশাদ পাঁচ-পাঁচটি আসনেই নির্বাচিত হলেন। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শেখ হাসিনা জিতলো একটিতে।

নির্বাচনের আগে বেতারে-টেলিভিশনে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিল, সেটি তার অনুকূলে যায়নি বলে অনেকেই মনে করেন।

পরে দলীয় ব্যর্থতার দায়স্বীকার করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করে। আরো পরে দলীয় নেতা ও কর্মীদের অনুরোধে পদত্যাগপত্রটি সে প্রত্যাহার করে নেয়।

দুই প্রধান দলের সংসদ-সদস্যরাই এরশাদ-আমলের স্পিকারের কাছে শপথগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ শপথবাক্য পাঠ করান।

নতুন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়েও কিছু টানাপোড়েন হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার বলেন যে, কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, সে-সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাউকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আমন্ত্রণ জানাবেন না। এতে বিএনপি শঙ্কিত হয়ে প্রতিবাদ করে। আওয়ামী লীগ বলে, সাংবিধানিক বিষয়টির আগে নিষ্পত্তি হোক, পরে মন্ত্রিসভা-গঠনের আমন্ত্রণ। বিএনপির প্রতি জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানালে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আমন্ত্রণ জানান। আওয়ামী লীগ তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে রাষ্ট্রপতি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন।

২৩.

১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ঘোষণা করে যে, অধ্যাপক গোলাম আযম এই সংগঠনের আমির নির্বাচিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিতপূর্বে গোলাম আযম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই তিনি বাংলাদেশে আসেন তার অসুস্থ মাকে দেখতে। সেই থেকে তিনি। এদেশে রয়ে যান এবং নেপথ্য থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রার্থনা করেও তিনি বারবার ব্যর্থ হন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার। জাতীয় সংসদে জানান যে, তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যর্পণ করার ইচ্ছা সরকারের। নেই। সকল রীতিনীতি ভঙ্গ করে এহেন ব্যক্তির প্রকাশ্যে এদেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পেছনে গূঢ় অভিসন্ধি কাজ করছে। বলে সকলের মনে হয়।

গোলাম আযমকে আমির ঘোষণার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের দাবিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-সংগঠন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিবৃতি দেয়। বড়ো দুটি রাজনৈতিক দলের কোনোটিই তার মধ্যে ছিল না, তবে আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগ ছিল। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে গোলাম আযম সম্পর্কে আলোচনায় আওয়ামী লীগ তাঁর বহিষ্কার দাবি করে।

জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকেই শাহরিয়ার কবির আমাকে জানান যে, একটি গণ-আদালত গঠন করে গোলাম আযমের বিচারের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। এমন একটা উদ্‌যোগ নেওয়া হলে আমি তাতে অংশ নেবো কি না তিনি তা। জানতে চান। আমি বলি, অবশ্যই নেবো। পরে তিনি আমাকে কর্নেল কাজী নূরউজ্জামানের বাড়িতে আহূত দুটি সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। আমি এর কোনোটিতেই যেতে পারিনি। প্রথম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শাহরিয়ারের কাছ থেকে শুনে আমি একাত্মতা প্রকাশ করি। দ্বিতীয় সভায় গণ আদালত আহ্বানের জন্যে কমিটির নাম স্থির হয় ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। ‘নিমূল’ শব্দটি আমার পছন্দ হয়নি, সেকথাও আমি শাহরিয়ারকে জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন সর্বসম্মতিক্রমে নামটি গৃহীত হয়েছে, এখন আর তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই। এই দ্বিতীয় সভাতেই জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১০১ জন সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। তার মধ্যে আমাকেও রাখা হয়।

এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী আমাকে বলেন যে, তিনি এই উদযোগে সংশ্লিষ্ট হতে চান। আমি তাঁকে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিই। এরপরই অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর উদযোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চ’ গঠিত হয়, মান্নান চৌধুরী তার একজন নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তারা আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনলাভ করেন। কয়েক দফা আলোচনার পর দুটি সংগঠন মিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামকেই আহ্বায়ক রেখে। পরে আবদুল মান্নান চৌধুরী হন এর সদস্য-সচিব। স্থির হয়, ২৬ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত প্রকাশ্যে বসবে এবং গোলাম। আযমের বিচার অনুষ্ঠিত হবে।

জাহানারা ইমাম আমার ছাত্রী ছিলেন। সেই দাবিতে তিনি বললেন, গণ আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমাকেই অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। আমি তাকে বললাম, এতে আমার আপত্তি নেই, তবে যেহেতু ১৯৭১ সালে আমি দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম, তাই গোলাম আযমের তখনকার কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার অভিযোগ হবে শোনা কথার সামিল। আমি বরঞ্চ ১৯৭২ সাল থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা যা করেছেন, সে-সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ আনবো। আর কেউ ১৯৭১ সালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ করুক।

আলোচনার পরে স্থির হলো, গণ-আদালতে অভিযোগকারী হবো আমরা তিনজন : বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবেন সৈয়দ শামসুল হক; মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; আর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীর নানাদেশে তার বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবো আমি।

গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে–এমন একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্র মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেল। ছাত্রেরা ছিল সামনের কাতারে। প্রজন্ম ‘৭১ ছিল খুব সক্রিয়। জাতীয় কবিতা উৎসবে উপস্থিত প্রায় সকলেই বিচারকার্যের সমর্থনে গণস্বাক্ষরে অংশগ্রহণ করলেন। ৩ মার্চে ঢাকায় সমন্বয় কমিটি-আহূত জনসভায় শেখ হাসিনা বললো, বাংলার মাটিতে গোলাম আযমসহ একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার হবেই।’ কয়েকদিন পরে ১০০ জন সংসদ-সদস্য গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ৫২ জন আলেম বিচারের উদ্‌যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। কয়েকটি নারী-সংগঠনও একযোগে আমাদের সমর্থন করে। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে।

জাহানারা ইমাম যেখানেই যান, সেখানেই মানুষ তাঁর কথা শুনতে ছুটে আসে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তার সন্তান রুমীর সূত্রে তিনি শহীদ-জননী আখ্যা লাভ করেন। দেখতে দেখতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গণ আদালতের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন গড়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকার এতে বিচলিত হয়। এক পর্যায়ে জাহানারা ইমাম এবং সমন্বয় কমিটির নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। সরকার গণ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলে। সমন্বয় কমিটি থেকে বলা হয়, ২৫ মার্চের মধ্যে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গণ আদালত বসানোর প্রয়োজন হবে না। কোনো পক্ষই অপর পক্ষের প্রস্তাবে সম্মতি না হওয়ায় আলোচনা নিষ্ফল হয়।

জামায়াতে ইসলামী এবং তার সমর্থকেরাও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। নানাভাবে গণ-আদালতের বিরুদ্ধে তারা প্রচার চালান। জাহানারা ইমামকে জাহান্নামের ইমাম ও ঘসেটি বেগম নামে অভিহিত করা হয়। পুরো উদ্যোগকে সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কোনো একটি রাজনৈতিক দল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে লাভবান হতে চাইছে, একথাও বলা হয়। বায়তুল মোকাররমের খতিব খুব তীব্র ভাষায় সমগ্র প্রক্রিয়াকে আক্রমণ করেন।

১৭ মার্চ গোলাম আযমের প্রতি নির্দিষ্ট দিনে গণ-আদালতে হাজির হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সমন জারি করা হয়। ২০ মার্চ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলি গণ-আদালতের কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানায়। ২২ মার্চ লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযম আইনের ঊর্ধ্বে নন, তবে গণ-আদালতে তার বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। ২৩ মার্চ সরকার গোলাম আযমকে কারণ দর্শানোর একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। তাতে বলা হয়, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কেন তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন না এবং আইনভঙ্গ করে জামায়াতের আমিরের পদ গ্রহণ করায় কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যা করতে। একই দিনে সমন্বয় কমিটিকেও সরকার কারণ দর্শানোর বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। গণ-আদালতের কার্যক্রম কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তাতে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। পরের দিন গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। জাহানারা ইমামকে গ্রেপ্তার করা হবে বলেও গুজব ছড়িয়ে যায়। সরকারি প্রচারমাধ্যমে গণ-আদালতে বিচার-প্রক্রিয়াকে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অভিহিত করে তার অধিবেশন বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাহানারা ইমাম আবার ঘোষণা করেন যে, পরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত বসবে এবং গোলাম আযমের বিচার হবে।

২৫ মার্চ রাতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালতের মঞ্চ নির্মাণ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। সেখানে আনীত মাইক্রোফোনগুলি জব্দ করা হয়। চারুকলা ইনসটিটিউটের ছাত্রেরা ব্যানার নিয়ে সেখানে পৌঁছোলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করতে উদ্যত হয় এবং তাড়া করে ইনসটিটিউট পর্যন্ত নিয়ে আসে। ২৬ মার্চ সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবদিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই অবস্থায় স্থির হয়, গণ-আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে আগে মিলিত হবেন। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। গাজীউল হক রায় লিখে নিয়ে এসেছিলেন। কিছু সংশোধনের পরে বিচারকেরা তাতে স্বাক্ষর দিলেন।

গণ-আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন জাহানারা ইমাম (চেয়ারম্যান), অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, মওলানা আবদুল আউয়াল, কর্নেল (অব.) কাজী নূরউজ্জামান, কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিস্টার শওকত আলী খান। বিচারকমণ্ডলীতে বেগম সুফিয়া কামাল ও শওকত ওসমানের নাম ছিল। সরকার ২৬ মার্চ কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে সুফিয়া কামাল তা কতটা মোকাবেলা করতে পারবেন, তা চিন্তা করে শেষ মুহূর্তে বিচারকমণ্ডলী থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। শওকত ওসমান নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌঁছোতে পারেননি–তাকে যারা আনতে গিয়েছিলেন, তারা তাকে বাসায় পাননি, তাই তাকে বাদ দিয়ে সাক্ষীদের একজন, সাংবাদিক মওলানা আবদুল আউয়ালকে বিচারকের আসন দেওয়া হয়। তার জায়গায় সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ। অভিযোগকারীদের কৌসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই পান্না, অ্যাডভোকেট শামসুদ্দীন বাবুল ও অ্যাডভোকেট কুলসুম রেখা। গণ আদালতের সমনের কোনো জবাব গোলাম আযম দেননি। তাঁর পক্ষসমর্থনের জন্যে গণ-আদালত অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে (আসিফ নজরুল নামে অধিকতর পরিচিত) নিযুক্ত করেন। আমাদের অভিযোগগুলোকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অপরাপর সাক্ষী ছিলেন ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, শাহরিয়ার কবির, মুশতারী শফী, সাইদুর রহমান, অমি কায়সার, ড. হামিদা বানু (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, আলী যাকের ও ডা. মুশতাক হোসেন। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। তিনিও সুপ্রিম কোর্ট ভবনে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তার অভিযোগ ছিল প্রধানত তার স্বামী শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। তাঁকে বলা হলো, সাঈদীর বিচারের জন্যে আরেকটি গণ-আদালত বসবে, তখন তিনি হবেন সেই মামলার প্রথম সাক্ষী। তিনি এরপরও আমাদের সঙ্গে থাকেন এবং হেঁটে আসেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে সোসাহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কুষ্টিয়া থেকে তিনজন বীরাঙ্গনা এসেছিলেন সাক্ষ্য দিতে। ওই পরিস্থিতিতে তাঁরা সাক্ষ্য দিতে পারেননি। তাঁদেরকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমেছিল উদ্যানে। জামায়াত-সমর্থক পত্রিকায় তাঁদের সম্পর্কে অমার্জিত কটাক্ষ করা হয়েছিল।

দশটা বাজতে না বাজতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ বিভিন্ন দিক দিয়ে। প্রবেশ করতে শুরু করে। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও তার কয়েকজন সঙ্গী দুটি ট্রাক সেখানে ঢুকিয়ে দেয়। তা জোড়া দিয়ে তৈরি হয় গণ-আদালতের মঞ্চ। সুপ্রিম কোর্ট ভবন থেকে আমরা হেঁটে যাই উদ্যানে সাড়ে এগারোটা থেকে। বারোটার মধ্যে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা যখন প্রবেশ করি, তখন লোকে লোকারণ্য। যদিও আমাদের পথ করে দেওয়া হচ্ছিল, তবু চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমি একসময়ে পড়ে যাই–বোধহয় হোঁচট খেয়ে। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাঁরা ভয় পেয়ে গেলেন এবং আমাকে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে বাধ্য করলেন। ফলে আমি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বিচারকেরা ট্রাকে উঠেছেন, অন্য এত লোকে তাঁদের সঙ্গে উঠে পড়েছে যে আমরা অভিযোগকারীরা কাছে যেতে পারলাম না। এদিকে নতুন করে মাইক বসানোর চেষ্টা সফল হয়নি। জাহানারা ইমাম একটি ছোটো বক্তৃতা দিয়ে আবদুল মান্নান চৌধুরীকে রায় পড়ে শোনাতে। বলেন। কিন্তু তার আগেই কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন–যদিও তার কোনো সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না।

গণ-আদালতের সাক্ষ্য ও দাখিলকৃত প্রদর্শনী বিবেচনা করে বিচারকেরা রায়ে বলেন, অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি এবং আনীত প্রতিটি অভিযোগের প্রত্যেক অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করছি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে উপরোক্ত অপরাধ দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।

‘যেহেতু গণ-আদালত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর করে না, সেহেতু গোলাম আযমকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।’

একে মাইক্রোফোন নেই, তার ওপর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস, সর্বোপরি ট্রাকে দাঁড়ানো নেতাকর্মীদের কোলাহল–কেউ কিছু শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না। কর্তাব্যক্তিরা স্থির করলেন, উদ্যান থেকে প্রেস ক্লাবে গিয়ে জাহানারা ইমাম সাংবাদিকদের কাছে বিচার-প্রক্রিয়া ও রায় ব্যাখ্যা করবেন। তাঁর সঙ্গে আবদুল মান্নান চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, সৈয়দ শামসুল হক, ফয়েজ আহমদ ও মওলানা আবদুল আউয়াল গেলেন, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জাসদের কয়েকজন নেতাও।

প্রেস ক্লাবে যাওয়ার পরে ধীরস্থির হয়ে বসার আগেই জাহানারা ইমামের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, রায় কী হয়েছে। তিনি বলেন, গোলাম আযমের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।

আমি পরে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি এ কথা বললেন কেন–রায়ে তো ফাঁসির কোনো কথা নেই। তিনি বলেন, উত্তেজনাবশত তিনি অমন বলে ফেলেছিলেন–তার ভুল হয়েছে।

আমি প্রেস ক্লাবে যাইনি, আমার যাওয়ার কথাও ছিল না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা ক্লাবে যাই। সেখানে অনেকে অপেক্ষা করছিলেন উদ্যানে কী হয়, তা জানার জন্যে। তেমন একজন ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের এককালীন সদস্য মফিজুর রহমান। তাঁর স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে জোর করে চা খাওয়ালেন। আমার কাছে রায়ের কপি আছে কি না জানতে চাইলেন। সেটা নেই শুনে আমার অভিযোগপত্রের কপি চাইলেন। আমার কাছে একটিমাত্র কপি ছিল, সেটা বের করে দিলাম। তাঁর স্ত্রীকে শোনাবার জন্যে অভিযোগপত্রটি তিনি জোরে জোরে পড়তে থাকলেন :

মাননীয় আদালত,

আমি, মরহুম ডা. এ টি এম মোয়াজ্জমের পুত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অভিযোগ উত্থাপন করছি।

আমি অভিযোগ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আল বদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতামাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে।

আমি অভিযোগ আনছি মরহুম মওলানা গোলাম কবিরের পুত্র গোলাম আযমের বিরুদ্ধে–ইনি একজন পাকিস্তানি নাগরিক, তবে বহুদিন ধরে বেআইনিভাবে বসবাস করে আসছেন ঢাকার রমনা থানার মগবাজার এলাকার ১১৯ নম্বর কাজী অফিস লেনে।

ইনি সেই গোলাম আযম–যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন; যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; যিনি আল বদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন। গোলাম আযমের প্ররোচনায় নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষকুমার ভট্টাচার্য ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, আমার অগ্রজপ্রতিম শহীদুল্লা কায়সার, আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আমার সহকর্মী আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও মোহাম্মদ মোর্তজা, আমার ছাত্র আ ন ম গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ নজমুল হক–যাদের মৃত্যুতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত, শোকাহত ও ব্যথাতুর।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমার বিশেষ অভিযোগ : তিনি সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন এবং এখনো করছেন; বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

আমার অভিযোগের সমর্থনে গোলাম আযমের কিছু কার্যকলাপের পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।

১. ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনের মতো দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে নিজের পরিচয় দিতেন।

২. ১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখণ্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩ এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউ কে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির হয় যে, তারা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭-এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।

৩. ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি সাতবার সউদি বাদশাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানান এবং কখনো তিনি বাদশাহকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ও কখনো বাংলাদেশকে আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।

৪. অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

৫. ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেনটস অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা অ্যান্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সবাইকে কাজ করতে আহ্বান জানান।

৬. ১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইসতামবুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেনটস অরগানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা করেন।

মাননীয় আদালত,

আমি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করছি। ইনি সেই গোলাম আযম-যাকে ফেরার ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিজ এলাকার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেন; ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনবলে বাংলাদেশ সরকার যার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন; যিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যিনি বেআইনিভাবে এ দেশে রয়ে যান; ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেও যিনি নাগরিকত্ব ফেরত পাননি; বাংলাদেশ সরকার যাকে ১৯৮৮ সালের ২০শে এপ্রিলের মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিলেও যিনি বাংলাদেশে থেকে যান; যার নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের নেই বলে ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন; সেই গোলাম আযমের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের জন্য এই গণ আদালতের কাছে আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করলাম।

২৪.

গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার সারাদেশে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের সম্পর্কে সরকার কিছু করুক আর নাই করুক, নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর যে ধ্বনিত হয়েছে, এটাই বড়ো কথা। জাহানারা ইমামকে দেশবাসী অত্যন্ত অল্পসময়ে জাতীয় নেতার সম্মানে ভূষিত করে। অন্তত এই একটি বিষয়ে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হতে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। বিভিন্ন জায়গায় গণ-আদালতের রায় কার্যকর করতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।

গণ-আদালতের সাফল্য, মনে হয়, সরকারকে ক্রুদ্ধ করে। গণ-আদালতের অধিবেশনে জনসমাবেশের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে শেখ হাসিনা এক চিঠি লিখেছিল জাহানারা ইমামকে। তার একটা ফটোকপি জোগাড় করে সংবাদপত্রে ছেপে দেন কোনো সাংবাদিক। সরকার নিশ্চিত হয় যে, গণ-আন্দোলনের মূলে আছে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র।

পরে জানতে পারি, ২৮ মার্চে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শাহরিয়ার কবির ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফকে ডেকে পাঠিয়ে গণ-আদালতের বিষয়ে আলাপ করেন। এই আলোচনার বিবরণ শাহরিয়ার কবির লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর গণ আদালতের পটভূমি (ঢাকা, ১৯৯৩) গ্রন্থে। প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে জানতে চান, গোলাম আযমের বিষয়ে প্রচলিত আদালতে না গিয়ে কেন তারা গণ আদালত বসাতে গেলেন। তিনি অভিযোগ করেন, গণ-আদালত গঠন করে দেশের প্রচলিত আদালতকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকার যখন দেশে গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তখন সেই সরকারকে বিব্রত করতে এই উদযোগ নেওয়া হয়েছে। গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করার পরেও এ-ধরনের উদযোগ নেওয়ায় দেশে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে, ব্যাংকে এলসি খোলা কমে গেছে। আওয়ামী লীগ দেশের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট করতে চায়, আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের হাতে খেলছে। গণ আদালতের অনুষ্ঠান কোনোভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয় এবং গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্যে অবিলম্বে এই আন্দোলন বন্ধ করা দরকার।

শাহরিয়ার কবির ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এসব অভিযোগের যথাযথ জবাব দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের কথায় সন্তুষ্ট হননি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে শাহরিয়ার চলে যান কর্নেল নূরউজ্জামানের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, গণ-আদালতের প্রশ্নে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা বেরিয়েছে তার মধ্যে তিনিও আছেন। তখন তারা জাহানারা ইমামের বাড়িতে যান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে।

সে-সময়ে আমি ঘরে বসে গল্প করছি। বন্ধু এ জেড এম আবদুল আলী আছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফা আছে, আছে আরো দু-একজন। এমন সময়ে টেলিফোন এলো এক সাংবাদিকের : একটু আগে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত থেকে জাহানারা ইমাম ও আরো ২৩ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা বেরিয়েছে, তার মধ্যে আমার নামও আছে। দণ্ডবিধির ১২০, ১২১, ১২৪ (ক), ১৪৮, ৫০৪ এবং ৫০৫ (ক ও খ) ধারায় অভিযোগ আনীত হয়েছে। সাংবাদিক আমাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য খবর দিচ্ছেন।

খবর শুনে আমি ফোন করলাম, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদকে। তাকে না। পেয়ে ফোন করলাম অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলামকে (পরে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি-জেনারেল)। তিনি বললেন, যেসব ধারায় অভিযোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে কোনো কোনোটি জামিনের অযোগ্য। আজকের রাতটা বাড়িতে না থাকাই ভালো। কাল হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।

জাহানারা ইমামের বাড়িতে ফোন করলাম, তিনি নেই। শাহরিয়ার কবিরের বাড়িতে ফোন করলাম, তিনি নেই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বাড়িতে ফোন করলাম, সেও নেই।

বুঝলাম, সকলেই খবর পেয়ে গেছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। মনে একটু ক্ষোভও জন্মালো-যারা খবরটা পেলেন, তাঁরা কেউ আমাকে কিছু জানাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না!

গুলশানে আমার বন্ধু মসিহুর রহমানকে ফোন করে বললাম বাড়ির গেট খোলা রাখতে। একটা ব্যাগে সামান্য কিছু কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস আর ওষুধ নিয়ে নিলাম। আবদুল আলীর গাড়িতে করে মসির বাড়ি এলাম। আমার হাতে ব্যাগ দেখে মসি বললো, ‘কিছু একটা ঝামেলা বাধিয়েছিস, বুঝতে পারছি।’

খানিক বাদে বাড়ি থেকে ফোন এলো। সমন্বয় কমিটির হয়ে কেউ ফোন করে জানিয়েছেন, কাল সকাল দশটায় যেন হাইকোর্টে উপস্থিত থাকি।

রাতটা মসির বাড়িতে কাটালাম। সকালে খবরের কাগজ এলেই দেখতে পেলাম, এটাই বিশাল শিরোনামযুক্ত প্রথম সংবাদ। আসামি ২৪ জন হলেন গণ আদালতের বিচারক জাহানারা ইমাম, গাজীউল হক, আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম, শফিক আহমেদ, ফয়েজ আহমদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, মওলানা আবদুল আউয়াল, কর্নেল নূরউজ্জামান, কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী ও শওকত আলী খান; উভয় পক্ষের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শামসুদ্দীন বাবুল, উম্মে কুলসুম রেখা ও নজরুল ইসলাম (আসিফ নজরুল); অভিযোগকারী আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও সৈয়দ শামসুল হক; গণ-আদালতে সাক্ষ্যদাতা শাহরিয়ার কবির, মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, আলী যাকের ও ডা. মোশতাক হোসেন; এবং সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব আবদুল মান্নান চৌধুরী। যে-পাঁচজন সাক্ষী অভিযুক্ত হননি, তাঁরা হলেন মেঘনা গুহঠাকুরতা, মুশতারী শফী, সাইদুর রহমান, অমি কায়সার ও হামিদা বানু–এঁরা সকলেই শহীদ পরিবারের সদস্য। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেআইনি সমাবেশের, রাষ্ট্রদ্রোহিতার, সরকারের বিরুদ্ধে বৈরিতা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর, বিশৃঙ্খলাসৃষ্টির, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার, জনশৃঙ্খলার ক্ষতিসাধনের ইত্যাদি ইত্যাদি।

মসির গাড়িতে করে হাইকোর্টে এলাম। হাইকোর্টে যে কোথায় যাবো, তা জানা ছিল না। তবে বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে যেতেই কেউ না কেউ এদিকে এদিকে’ বলে আমাকে নিয়ে গেলেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে। আমার ব্যাগ রয়ে গেল মসির গাড়িতে। সে বললো, ‘যদি জেলে যাস, তাহলে সেখানে পৌঁছে দেবো। আর যদি বাড়ি ফিরে যেতে পারিস, তাহলে সেখানে দিয়ে আসবো। মসি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে জেল খেটেছিল।

বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে অভিযুক্তদের অধিকাংশই ততক্ষণে জমা হয়েছেন। গাজীউল হক প্রস্তাব করলেন, অভিযুক্তেরা সবাই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে মিছিল করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতের দিকে যাবেন। পথে যদি পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে তো তাই সই।

কথাটা আমার একেবারেই পছন্দ হলো না। তবু অন্যেরা কী বলেন, তা শুনতে চুপ করে রইলাম। কবীর চৌধুরীই প্রথমে মুখ খুললেন। বললেন, এমন সিদ্ধান্ত হবে হঠকারী। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আইনি লড়াই চালানো।

আমি তাকে সমর্থন করলাম। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কলিম শরাফী, জেড আই পান্নাও কবীর চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে মতৈক্য ঘোষণা করলেন। . প্রথমে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং তারপরে ড. কামাল হোসেনের মত চাওয়া হলো। তারা বললেন, হাইকোর্ট বিভাগে জামিন চেয়ে আবেদন করা উচিত। তাঁরা দুজনেই আমাদের পক্ষে আবেদন পেশ করার আশ্বাস দিলেন।

খানিক বাদে ওই দুজনের পেছনে আমরা সবাই এবং অনেক আইনজীবী গিয়ে হাজির হলাম বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী ও বিচারপতি এম এ করিমের এজলাসে। সেখানে আমীর-উল ইসলাম ও সুধাংশুশেখর হালদারও এলেন। ইশতিয়াক আহমেদ ও কামাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার! কামাল হোসেন সামান্য একটু বলতেই তিনি বললেন, আমি তো এদের চাই না। যে-আদালত এঁদের চান, আপনারা সেখানে যান। যে-আদালত পরওয়ানা জারি করেছেন, সেখানে আত্মসমর্থন করেই জামিন প্রার্থনা করা বিধেয়।

কামাল হোসেন বললেন, এই মামলাটি খুব ভিন্ন ধরনের, এদেশের ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। অভিযুক্তরা এদেশের অত্যন্ত মান্যগণ্য মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে যে-ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তারা করেননি, তাঁদের পক্ষে করাও সম্ভবপর নয়। কষ্টকল্পিত অভিযোগের ভিত্তিতে নিম্নআদালত গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করেছেন, সেখানে গিয়ে সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা এই আদালতে এসেছি।

বিচারপতি টি এইচ খান–যার কাছে জগন্নাথ কলেজে আমি লজিক পড়েছি, তিনি–উঠে দাঁড়ালেন, কামাল হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে। তিনি বেশ উত্তেজিত ছিলেন। এক পর্যায়ে আদালতকে উদ্দেশ করে বাংলায় বললেন, ‘এরা তো আপনাকে মানে না, দেশের কোনো আদালতই মানে না, এরা নিজেদেরকে আদালত ঘোষণা করে বসে আছে। এরা এখানে এসেছে কেন?

বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী পালটা প্রশ্ন করলেন, আমাকে যদি না ই মানে, তবে আমার কাছে আসবে কেন? মানে বলেই তো এসেছে।

আমাদের পক্ষে ইশতিয়াক আহমেদ, কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম কিছু নিবেদন করলেন।

টি এইচ খান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি-জেনারেল আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া এবং আরো দু-একজন আইনজীবী সরকারের পক্ষ নিলেন। তাদের যুক্তিতর্কের মধ্যে। আদালত-কক্ষে প্রবেশ করলেন অ্যাটর্নি-জেনারেল আমিনুল হক। বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী তাঁকে দেখে বললেন, এই যে অ্যাটর্নি-জেনারেল এসে গেছেন। আমরা এখন তার কথা শুনি।

আমিনুল হক দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, এই মামলায় তিনি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, এ-বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিচারপতি টি এইচ খানকে। সরকারের পক্ষে যা কিছু বলার, তিনিই বলবেন।

আমরা জানতাম, আমিনুল হক যখন অ্যাটর্নি-জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম আনুগত্য। সেই বোধ থেকে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে অস্বীকার করেছিলেন। এমন নীতিবোধের দৃষ্টান্ত সুলভ নয়।

বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীর ভাষা ও ভঙ্গি ছিল খুবই চিত্তাকর্ষক। এক পর্যায়ে টি এইচ খান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ডু ইউ সি মাই পয়েন্ট, মাই। লর্ড? তিনি জবাব দেন, অ্যাজ ক্লিয়ার অ্যাজ দি টুইঙ্কলিং স্টার।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এবং সমাজে অভিযুক্তদের কয়েকজনের ভূমিকার উল্লেখ করে ইশতিয়াক আহমেদ বলেছিলেন, এই যাঁদের অবদান, তাঁরা। রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কোনো কাজে জড়িত হবেন, এ-কথা অবিশ্বাস্য। তাতে বিচারপতি চৌধুরী মন্তব্য করেন, অর্থাৎ আপনি বলতে চান, যারা সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তারা তার ঘাতক হতে পারে না?

বেলা গড়িয়ে এলো। আদালত পরদিন পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করলেন এবং আদেশ দিলেন, শুনানির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আবেদনকারীদের কাউকে যেন গ্রেপ্তার না করা হয়।

এজলাস থেকে বেরিয়ে দেখি আমার মামাতো ভাই–কামরু ভাই–অপেক্ষা করছেন। সংবাদপত্রের খবর দেখে খোঁজখবর নিয়ে তিনি আদালতে এসেছেন এবং নীরবে ও না-খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

কেবল তিনি নন, বহুজন সেদিন আদালত-প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের জামিন হয়েছে–এ খবরটি জেনে যাওয়ার জন্যে। যদিও সেদিন। জামিন হয়নি, তবু আমরা যে গ্রেপ্তার হইনি, তাতেই তারা খুশি হয়ে ফিরে যান।

আদালত থেকে আমরা তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে বের হলাম। একটু এগিয়ে রিকশা পাওয়া গেল। কামরু ভাই ও আমি এক রিকশায় বাড়ি ফিরলাম। সেখানেও দেখি অনেক মানুষের ভিড়–আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা উদ্‌বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন কী হলো, তা জানার জন্যে।

পরে বেবীর কাছে শুনলাম, আমাদের বিরুদ্ধে মামলার খবর জেনে সমাজকল্যাণ ইনসটিটিউটের মুহাম্মদ সামাদের স্ত্রী রীমা তার সংসারখরচের বরাদ্দ থেকে দু হাজার টাকা নিয়ে বেবীর হাতে দিয়েছিল আমার পক্ষে মামলা চালানোর খরচ জোগাতে। টাকাটা বেবী নেয়নি প্রয়োজন হয়নি বলে, কিন্তু রীমার সহৃদয়তা তাকে ও আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল।

সেদিন বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বারোটি রাজনৈতিক দলের এক সভা হয়। সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারির নিন্দা করা হয়। সারাদেশে রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কোথাও মিছিল নিয়ে, কোথাও সভা করে, কোথাও বিবৃতি দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়। আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করায় মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্যে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতি।

৩০ মার্চে আবার হাইকোর্টে আমাদের জামিনের আবেদনের শুনানি হলো। সারাদিন কার্যক্রম চলার পরে আদালত আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মনজুর করেন। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিম্নআদালতে জামিনের আবেদন করতে আমাদের নির্দেশ দেন।

২৫.

হাইকোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মনজুর করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। নিম্নআদালতে যথাযথ জামিনের আবেদন করতে আমাদের নির্দেশ দেন। তবে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আমরা যাইনি। কয়েকদিন পরে আমরা গিয়েছিলাম, যতদূর মনে পড়ে, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে। সেদিন বোধহয় জেলা আইনজীবী সমিতির শ খানেক সদস্য আমাদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন। মামলা পরিচালনা করেছিলেন আমীর-উল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

আদালতে হাজির হয়ে আমরা দেখি, আসামীর কাঠগড়ায় জনাতিনেক দাঁড়িয়ে আছে কোমরে দড়ি পরে–তারা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। আইনজীবীরা। আমাদের বসতে বললেন তাদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে আর স্থানাভাবে তারা অনেকে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে বিচারক এসে আসন নিলেন (বিচারকের তো স্ত্রীলিঙ্গ হয় না, আর হলেও আমরা তা ব্যবহার করতাম না)। মামলা শুরু হতেই আসামীর কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, অভিযুক্তেরা কোথায়? আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাঁরা সবাই আদালতে। হাজির আছেন। বিচারক আবারো কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তো অভিযুক্তদের দেখতে পাচ্ছি না। আমীর-উল ইসলাম বললেন, সকলেই উপস্থিত, আপনি চাইলে একেক করে নাম ডেকে তাদের উঠে দাঁড়াতে বলতে পারি। আদালত বললেন, অভিযুক্তদের যথাস্থানে থাকতে হবে। এই কথায় সমবেত আইনজীবীরা একবাক্যে আপত্তি জানালেন–সেই কোলাহলে কে যে কী বললেন, তা শোনা গেল না। এই প্রতিবাদে বিচারক বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, অভিযুক্তেরা যেই হোন, আদালতে নির্দিষ্ট স্থানে তাদের দাঁড়াতে হবে–এই হলো রীতি। আমি গাজীউল হককে বললাম, চলুন, আমরা কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াই–তবে সেখানে সকলের জায়গা হবে কি না সন্দেহ। একজন আইনজীবী তা শুনে বললেন, না, আমরা কিছুতেই আপনাদের কাঠগড়ায় উঠতে দেবো না।’ আরেকজন ততক্ষণ বিচারককে বলছেন, অভিযুক্তদের পক্ষে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক নয়–তাদেরকে আদালতে হাজির থাকতে হবে, এটাই আসল কথা। তারা যে আদালতে হাজির, এ-বিষয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। আমরা তাদেরকে একযোগে উপস্থিত করতে পারি, একজন-একজন করেও উপস্থিত করতে পারি–আপনি যেমনভাবে চান। অনুগ্রহ করে এঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলবেন না। এ-কথা উপস্থিত আইনজীবীরা জোরেশোরে সমর্থন করলেন। তাদের উচ্চগ্রামের কথায় যথেষ্ট উন্মা প্রকাশ পেলো।

শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের কথা মেনে নিলেন এবং সেদিনই আমাদের জামিন হলো।

মাস দু-আড়াই পরে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে আমার যোগদানের কথা। কানাডীয় হাই কমিশনের বাণিজ্য ও অর্থনীতি-বিষয়ক কাউনসেলরের সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। আমি কাগজপত্রসমেত পাসপোর্টটা ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বললাম, সাক্ষাৎকারের জন্যে আপনি যদি একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিতে পারেন, তবে উপকৃত হবো।

তখন ঢাকায় কানাডার ভিসা অফিস ছিল না। প্রতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লির কানাডীয় হাই কমিশন থেকে দুজন ভিসা অফিসার ঢাকায় এসে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ভিসা দিতেন বা দিতেন না।

কয়েকদিন পর বাণিজ্য ও অর্থনীতি-বিষয়ক কাউনসেলর ফোন করে আমাকে বললেন, আমি যেন হাই কমিশনে এসে বিশেষ একজন ভিসা অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সে-ভদ্রলোকের নাম বলতেই আমাকে সাদরে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। ভদ্রলোকের আচরণ খুবই সৌজন্যপূর্ণ। তিনি বললেন, আপনার কাছে একটা বিষয় জানার আছে। আপনার নামে কি কোনো ফৌজদারি মামলা আছে? প্রশ্নটা এমনই আকস্মিক যে আমার প্রথমে মনে পড়ল না, তারপরই বললাম, হ্যাঁ, একটা রাজনৈতিক বিষয়ে আমাদের কয়েকজনের নামে ফৌজদারি মামলা করেছে সরকার। তিনি জানতে চাইলেন আমি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি কি না। জানালাম, মামলার কারণে আমি জামিনে আছি–তাছাড়া অন্য সব বিষয়ে আমার জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চলছে। তিনি বললেন, দেখুন, কানাডার আইন-অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে তাকে ভিসা দেওয়া যায় না। আমি দুঃখিত। বললাম, এটাই যদি আপনাদের আইন হয়, তবে তো আমি ভিসার আশা করতে পারি না। তিনি একটু পরে বললেন, এ-কথাটা আমার আপনাকে জানাবার কথা নয়। আপনার বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি মামলা আছে, তা আমাদের জানার কথাও নয়। তবে আপনাদের সরকার আমাদের কাছে আপনাদের নামের একটা তালিকা পাঠিয়েছে–খবর হিসেবে।

আমার পাসপোর্টে একটা ছোটো সিল নিয়ে ফিরে এলাম। এত বছর ধরে যখনই কোনো দেশের ভিসার জন্যে আবেদন করি, আমাকে লিখতে হয়, ১৯৯২ সালে কানাডার ভিসার জন্যে আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাতে অবশ্য অন্য দেশের ভিসা পেতে কখনো অসুবিধে হয়নি। তবে তারপর বহুদিন আর কানাডীয় ভিসার জন্যে আবেদন করিনি।

২০০৫ সালে যখন আবার আবেদন করি, কানাডীয় হাই কমিশন আমাকে ওই মামলার কাগজপত্র দেখাতে বলে। আমি জানাই, আমার কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজ নেই এবং কখনো ছিল না। হাই কমিশন বলে, কিছু একটা কাগজ দেখাও যে মামলা হয়েছিল এবং উঠে গেছে। আমি জাতীয় আর্কাইভস থেকে সংবাদপত্রের কিছু খবর ফটোকপি করে জমা দিই। তা দেখে ভিসা অফিসার অবাক হয়ে বলেন, শুধু এইজন্যে তোমার ভিসা হয়নি!

১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁদের মেয়াদের একেবারে শেষে জাহানারা ইমাম ও অপর ২৩ জনের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এতদিনে ঝামেলা থেকে মুক্ত হই।

ওদিকে ১৯৯২ সালের মার্চে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আটকাঁদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন গোলাম আযম। নিজের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধেও তিনি আরেকটি মামলা করেন হাইকোর্টে। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্ট তাঁর আটকাঁদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। নাগরিকত্বের মামলার শুনানি হয় বিচারপতি ইসমাইলউদ্দীন সরকার ও বিচারপতি বদরুল ইসলাম চৌধুরীর আদালতে। তাঁরা দুজন দুরকম সিদ্ধান্ত দেন। ফলে মামলা যায় তৃতীয় বিচারকের কাছে। বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী–যিনি আমাদের ২৪ জনকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছিলেন–নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ বলে রায় দেন। তারপর মামলাটি যায় আপিল বিভাগে। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে গোলাম আযমের বিষয়সংশ্লিষ্ট কোনো নথিতে কোনো আদেশ দিয়েছিলেন। তাই তিনি আপিলটি শোনেন নি। আপিল বিভাগের বাকি চারজন বিচারক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান ১৯৯৪ সালের জুন মাসে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। ততদিনে গোলাম আযম কারাগার থেকেও মুক্তি পেয়ে যান।

এ সময়ে কেউ কেউ আমাকে বলেন, গোলাম আযমের বিচারের জন্যে আমরা অমন তৎপর না হলে হয়তো নাগরিকত্বের প্রশ্নে তিনি মামলা করতেন না এবং তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার হতো না। আমাদের আন্দোলনটি পরিণামে তাঁর পক্ষেই গেছে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। গোলাম আযমের গণবিচারের বিষয়ে আমরা যা করেছি, তা যথার্থ ছিল। আমরা যে আরো অগ্রসর হতে পারিনি, তার জন্য দায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা এবং আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতার সীমাবদ্ধতা।

গণ-আদালতের রায়ের পর গোলাম আযমের বিচারের দাবি তুঙ্গে উঠেছিল। এ-নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়–একাধিক দিন হরতাল পর্যন্ত হয়। জাহানারা ইমাম অসুস্থ শরীর নিয়ে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তাঁর পক্ষে আর সক্রিয় থাকা সম্ভবপর হয়নি, চিকিৎসা নিতে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়। তার অনুপস্থিতিতে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে।

আন্দোলন থেকে আমিও খানিকটা সরে আছি। আমি বলেছিলাম, আমরা গোলাম আযমের বিচার চাইবো, কিন্তু কোনো শাস্তি (যেমন, ফাঁসি) নির্দিষ্ট করে দাবি করবো না। শাস্তি দেবেন সাংবিধানিক আদালত, আমরা তা মেনে নেবো। আমার বক্তব্যের প্রতি তেমন সমর্থন মেলেনি। তবে সমন্বয় কমিটির জনসভা প্রভৃতিতে আমি তারপরও উপস্থিত থেকেছি। সুফিয়া কামালকে প্রধান করে যে তথ্য অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়, তার রিপোর্ট প্রদানের সময়েও আমি জনসমক্ষে হাজির ছিলাম।

একটি কাকতালীয় ঘটনা এই যে, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার অব্যবহিত পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাহানারা ইমামের মৃত্যু হয়। মাঝখানে দিন চারেকের ব্যবধান ছিল, তখন তিনি সম্পূর্ণ চেতনও ছিলেন না। তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনতে কয়েকদিন সময় লাগে। তার লাশ গ্রহণ করতে আমরা বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম, বহুসংখ্যক মানুষও সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই তিনি ঢাকায় সমাহিত হন।

২৬.

একটু আগের কথায় ফিরে যাই। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে আবুল খায়ের লিটু একদিন জানালো যে, চিকিৎসার জন্যে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নেওয়া। দরকার সিঙ্গাপুরে, কিন্তু তিনি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, লিটুর বুঝতে কোনো ভুল হয়নি। উপরন্তু সারের ইচ্ছে, আমিও যেন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়ে আসি।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে যাত্রা। কলকাতায় যাত্রাবিরতি। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নেমে ভিসা সংগ্রহ। তারপর হলিডে ইনে ওঠা। সেখানে লিটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। সে অবশ্য ফিরে আসবে আগে। সারুকে সামলানো হবে আমার কাজ।

রাজ্জাক সাহেবের চিকিৎসকেরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে উপদেশ দিলেন। আমি এক অর্শ-বিশারদের শরণাপন্ন হলাম। আমার হৃদয়ঘটিত কাহিনি শুনে তিনি বললেন, অস্ত্রোপচারের আগে তাহলে হৃদ্‌রোগ-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সার বললেন, ঝামেলা বাড়িয়ে কী হবে! আপনিও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।

আমরা দুজনেই গ্লেনইগলস হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সার আর আমার কেবিন এক সারিতে, তবে কয়েকটা কেবিনের ব্যবধানে। ব্যবস্থা অতি উত্তম।

সেদিন বিকেলে এক নার্স এসে আমাকে বললেন, তোমার বন্ধু, মানে তোমার সঙ্গী, তিনি কি ইংরেজি জানেন?

নার্সকে সারের পরিচয় দেওয়া বাহুল্য। বললাম, জানেন বইকি!

তা শুনে তিনি মুখ আরো বেজার করে বললেন, আমি তাকে ওষুধ খাওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়েছিলাম। তিনি হা-না কিছুই বললেন না। কথা শুনলেন কি না, বুঝলেন কি না, কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। তুমি কি অনুগ্রহ করে তাকে এই কথাগুলো বুঝিয়ে বলবে?–বলে সে ওষুধসংক্রান্ত একটা ফিরিস্তি দিয়ে গেল।

সারের কেবিনে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সার, নার্স আপনাকে ওষুধের বিষয়ে কী বলতে এসেছিল, শুনেছেন কি?

তিনি বললেন, ‘হ।’

‘তা আপনি তার কথার জবাব দেন নি কেন?’

‘হে বেডি তো যা কওনের কইয়া গেল। আমারে তো কিছু জিগগাস করে নাই। আমি কী কমু?’

‘একটা হ্যাঁ-না বলতে পারতেন।’

‘তার যা কওনের কইয়া গ্যাছে। আমি শুনছি। তার লগে তো আমার গল্প করার কথা নাই।’

আমি আর কী বলব!

সারের নানারকম পরীক্ষা চলতে থাকল।

আমার ইসিজি ইত্যাদি হলো। স্ট্রেস টেস্ট দেখে ডাক্তার খুশি হলেন না। বললেন, অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে।

আমি রাজি হলাম না।

ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে সারের অবস্থা জানতে লিটু ফোন করেছে। সার তাঁকে আমার সংবাদ দিয়েছেন। সে ফোনে আমাকে বললো, ডাক্তার যা পরীক্ষা করতে চায়, আপনি তা করিয়ে আসবেন। অবশ্যই।

অ্যানজিওগ্রাম হলো। লন্ডনে যে-ধমনিতে ব্লক পাওয়া গিয়েছিল এবং যেটায় অ্যানজিওপ্লাস্টি করা হয়েছিল, দেড় বছরের ব্যবধানে সেটা আবার বন্ধ হয়ে এসেছে। অ্যানজিওপ্লাস্টির আগের অবস্থায় প্রায় ফিরে গেছে।

রিপোর্ট দেখে অর্শ-বিশেষজ্ঞ বললেন, তোমার অস্ত্রোপচার করা যাবে না। অর্শ থেকে যে-রক্তক্ষরণ হয়, হাজার হোক, তাতে তুমি মরবে না। কিন্তু অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তোমার হৃদযন্ত্র যদি বন্ধ হয়ে যায়, সেটা ভালো কাজ হবে না।

অতএব, যেমন এসেছিলাম, তেমনি ফেরা। মাঝখানে ভেতর থেকে হাসপাতাল দেখা।

চিকিৎসকেরা সারুকে পরামর্শ দিলেন, ফুসফুসের জন্যে ইনহেলার ব্যবহার করতে আর কানের জন্যে হিয়ারিং এইড নিতে। ইনহেলার তিনি নিচ্ছিলেনই, এখন বেশি বেশি মাত্রায় নিতে হবে। হিয়ারিং এইড কেনা হলো, কিন্তু অস্বচ্ছন্দ বোধ করায় সিঙ্গাপুরে থাকতেই তার ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন তিনি।

গ্লেনইগলস হাসপাতালের পাশেই চমৎকার উদ্যান। তাতে আমরা বেড়াই।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে সমাজতত্ত্ব পড়ায় হাবিব খোন্দকার। সে রাজ্জাক সাহেবের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তার সঙ্গে পরিচয় হলে জানতে। পারি, তার দু ভাইকে আমি চিনি। আমরা হাসপাতালে ঢোকার আগে সে আর তার স্ত্রী ঝোরা রেস্টুরেন্টে নিয়ে আমাদের খাওয়ায়। হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর তার বাড়িতে যেতে হয় খেতে। তার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানকার বাঙালি শিক্ষক আরো কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। কিছুকাল আগে শেখ হাসিনা হাবিব খোন্দকারের এই বাড়িতে এসে থেকে গেছে। শেখ কামালের সঙ্গে হাবিবের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।

বাংলাদেশ বিমানের আঞ্চলিক ম্যানেজার আসেন। আমরা ব্যাংকক হয়ে ঢাকা ফিরব। সেই যাত্রার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে দেন। দশ দিন সিঙ্গাপুর বাসের। পর আমরা ব্যাংকক পৌঁছাই।

সার বলেন, একটা দেশকে জানতে হলে যেতে হয় তার কাঁচাবাজারে আর বইয়ের দোকানে। কাঁচাবাজারে যেতে আমার উৎসাহের অভাব। পথের ধারে ফলের দোকান, তরকারির দোকান অজস্র। তারই কয়েকটায় সার থামেন, কিছু কেনাকাটা করেন। ঢাকায়ও কিছু ফলমূল আনবেন, সে-ব্যবস্থা হয়। বইয়ের দোকানে যাই আমরা। কিছু বই কিনি, নাড়াচাড়া করি তার চেয়ে বেশি। সেখানে অনেক সময় কাটে।

রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময়ে একবার সার বললেন, আপনার যা পছন্দ, তা অর্ডার দেন। আমি একটু অবাক হই। আমার পছন্দসই বলেই তো বিফস্টেক আনতে বলেছি। পরে বুঝি, খাদ্য নয়, উনি পানীয়ের কথা বলছেন। গুরুবাক্য পালনে আমি তৎক্ষণাৎ তৎপর হই।

তিন দিনের মাথায় ঢাকায় ফেরা। বিমানে। আমরা বেশ নির্ভার। স্বদেশি যাত্রীদের হাতে ব্যাগ আর ব্যাগ। একজন দুহাতে ব্যাগ নিয়েছেন বলে বোর্ডিং কার্ডটা দাঁত দিয়ে ধরেছেন। বিমানের যিনি বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন, তিনি হাত বাড়াতেই যাত্রী তাঁর মুখটা এগিয়ে দিলেন। উদ্ভাবনী প্রতিভা আর কাকে বলে!

২৭.

বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতে একটা সংকট ঘনিয়ে আসছিল অনেকদিন ধরে। হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করে আসছিলেন যে, অযোধ্যায়–রামের জন্মভূমিতে-মন্দির ভেঙে ওই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এখন তারা মসজিদ ভেঙে মন্দির পুনর্নির্মাণ করবেন। ভারতের অনেক ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখে ও বিবৃতি দিয়ে বলেন যে, এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই এবং স্বয়ং রামেরই জন্ম কবির মনোভূমিতে। তাতে হিন্দুত্ববাদীদের ক্রোধ কেবল বৃদ্ধি পায় এবং জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস ও ইতিহাস একাকার হয়ে যায়। সারা ভারত থেকে স্বেচ্ছাসেবক অযোধ্যায় জড়ো হতে থাকে ধর্মযুদ্ধ করতে। ভারত সরকারের এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তারা বাবরি মসজিদের আংশিক ধ্বংসসাধন করে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে–এমন মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-নির্যাতন ও মন্দির-ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছিল, সেকথা আগে বলেছি। সে-মসজিদ যখন সত্যিই ভাঙলো, বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া হলো তীব্র এবং সবটা ক্ষোভ গিয়ে পড়ল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসহায় ব্যক্তিদের এবং তাদের উপাসনালয়ের ওপর। বীর চট্টলায় বড়োরকম দুর্যোগ ঘটে, রাজধানী ঢাকাও পিছিয়ে থাকে না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলায় বাংলাদেশ সরকার তীব্র নিন্দাজ্ঞাপন করে, কিন্তু নিজের নাগরিকদের রক্ষার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় না। সরকারের বাইরে অনেক রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি এই নির্যাতন রোধ করতে এগিয়ে আসে বটে, কিন্তু তা ঘটে অনেক অসংগঠিতভাবে এবং কম শক্তি নিয়ে। অন্যদিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নামধারী সংগঠনগুলি যেসব কর্মসূচি দেয়, তা ছিল বেশ জঙ্গি। সাধুভাষায় যাকে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি বলে, এতে তাই হয়। শুনেছি, খুলনার ডেপুটি কমিশনার তখন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দলের নেতাদের ডেকে বলেছিলেন, আপনারা অনুগ্রহ করে প্রতিবাদ মিছিল করবেন না, শান্তি মিছিলও করবেন না, দুবৃত্তদের আমি সামলাতে পারবো-আপনারা পথে নামলে আমার কাজ অনেক কঠিন হয়ে যাবে। সে কর্মকর্তা সেখানে সত্যি সত্যি পরিস্থিতি সামাল দেন। সরকারের ভাবটা ছিল এমন যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, তাদের রক্ষার ভার আওয়ামী লীগই নিক। আওয়ামী লীগ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, সরকার সংখ্যালঘু-নির্যাতন বন্ধ করুক, নইলে ব্যর্থতার দায়ভার তার ওপরেই বর্তাবে। মাঝে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অবর্ণনীয় কষ্ট ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়। ক্ষেত্রবিশেষে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানেরাও আক্রান্ত হয় এবং বৌদ্ধমন্দির ও গির্জায়ও হামলা চলে। যেখানে আমলারা ব্যক্তিগতভাবে দাঙ্গা বন্ধ করতে উদ্যোগী হন, সেখানে কিছুটা কাজ হয়।

ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ঢাকায় আমরা নিষ্ফল দৌড়াদৌড়ি করেছি। ৮ তারিখেও কোনো শান্তি মিছিল করা সম্ভব হয়নি, সংগঠিত প্রতিরোধও নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা দাঙ্গাপ্রতিরোধে তেমন ভূমিকা এবার পালন করেনি–এ ছিল আমার বড়োরকম দুঃখ। ৯ তারিখে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করা হয়। সেদিন বিএনপিও একটা লোকদেখানো মিছিল করে। ১০ তারিখ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। এ-কয়দিনে দেশের অন্যান্য জায়গায়ও গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ক্ষুব্ধ হয়ে আমি ভোরের কাগজে একটি প্রবন্ধ লিখি ‘সাম্প্রদায়িকতার প্রত্যাবর্তন’ নামে, তাতে কারো কোনো লাভ হয় না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিজয়মেলা-উপলক্ষে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচারণা চালায়, কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে।

যেসব মূল্যবোধের জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া, তার পরাজয়ের গ্লানি বুকে বড়ো বাজে।

তবে এরই প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে এসেছিল শামসুর রাহমানের ‘সুধাংশু যাবে নার মতো অনবদ্য কবিতা এবং হাসনাত আবদুল হাইয়ের বাবুরের প্রার্থনা’র মতো গল্প। শফি আহমদ ও পূরবী বসুর সম্পাদনায় প্রকাশ পায় প্রবন্ধ-সংকলন এখনো গেল না আঁধার (ঢাকা, ১৯৯২) এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনা নিয়ে মফিদুল হক ও অরুণ সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধ্বংসস্তূপে আলো/বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ (ঢাকা ও কলকাতা, ১৯৯৩)। বহু অকীর্তির মধ্যেও এমনি করে ঘোষিত হয় মানুষের বিবেকের কণ্ঠস্বর, এই এক সান্ত্বনা। তসলিমা নাসরিনের লজ্জাও লেখা হয়েছিল এ সময়ে। বিষয়বস্তুর সাহসী উপস্থাপনা সত্ত্বেও উপন্যাস হিসেবে তা সার্থকতা লাভ করেনি, তবে নানাকারণে বইটি ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।

২৮.

১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে–ড. কামাল হোসেনের এই মন্তব্য শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক কর্মী প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কামাল হোসেনের কিছু কিছু মন্তব্যে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনাও প্রকাশ পায়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, কামালের পক্ষে আওয়ামী লীগে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে কামাল হোসেন পরামর্শ করেন। তাঁরা অনেকে তাকে বিকল্প পথ সন্ধান করতে বলেন। তারা কামালকে এমন ধারণা দেন যে, তিনি কোনো বিকল্প সংগঠন গড়ে তুললে তারাও তাতে যোগ দেবেন। তেমন ইচ্ছে হয়তো এঁদের অনেকের আদৌ ছিল না, কামাল আওয়ামী লীগ ছাড়লে দলের মধ্যে নিজেদের গুরুত্ব আরো বাড়বে, এমন কথা হয়তো তাদের মনে ছিল। কামাল ধরে নেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে তার বড়োরকম সমর্থন আছে।

কামাল আমাকে যা বলেন, তাতে সেই মুহূর্তে তার রাজনৈতিক দল গড়ার অভিপ্রায় আছে বলে আমার মনে হয়নি। তিনি নাগরিক সমাজের একটি মঞ্চের কথা বলছিলেন। যারা রাজনীতি করেন, তাঁদের চেয়ে যারা রাজনীতি করেন না, এমন মানুষের কাছে তিনি বেশি যাচ্ছিলেন। যেমন, শিক্ষকদের মধ্যে খান সারওয়ার মুরশিদ, ফজলুল হালিম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এক পর্যায়ে কামালের কয়েকজন সহকর্মী–কম্যান্ডার আবদুর রউফ, গোলাম মরতুজা, শাহেদ আলী–আমাকে অনুরোধ করেন প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক ফোরামে যোগ দিতে। আমার অনিচ্ছার কথা তাদের জানালে কামাল একদিন এ-বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর চেম্বারে বসে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা হয়। আমি কামালকে বলি, তিনি রাজনীতিবিদ, আজ যে-অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন, কাল তা রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত করতে তিনি ইচ্ছুক হবেন। তাঁর সহকর্মীরা সেদিকে তাঁকে টানবেন। যারা তাকে আওয়ামী লীগে চান না, তাঁরাও তাঁকে সেপথে ঠেলবেন। গণতান্ত্রিক ফোরাম রাজনৈতিক দল হলে তাতে আমি থাকতে পিরবো না। এখন যোগ দিয়ে পরে বেরিয়ে আসার চেয়ে বরঞ্চ গোড়া থেকেই আমার পক্ষে বাইরে থাকা ভালো। বাইরে থেকে আমার পক্ষে যতটুকু সাধ্য তার সঙ্গে সহযোগিতা করবো।

১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে গণতান্ত্রিক ফোরামের উদ্বোধন হলো। সে উপলক্ষে বড়ো সমাবেশ ঘটলো ঢাকায়। সুফিয়া কামাল, মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিশিষ্ট আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমিও সে-সভায় কিছু বললাম। ধুমধাম করে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো।

পরের মাসে আওয়ামী লীগ থেকে ড. কামাল হোসেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২৯.

দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি ন্যাশনাল সেন্টার ফর দি আর্টস থেকে আমন্ত্রণ এলো, ইউনেসকোর সহায়তায় দিল্লিতে তারা ইন্টারফেস অফ কালচারাল আইডেনটিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সভা করছেন ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে, তাতে প্রবন্ধ পড়তে হবে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সেমিনারে উন্নয়ন-বিষয়ে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই একটা প্রবন্ধ দাঁড় করালাম, নামটা ভারীই দিলাম, ইউনিভার্সালিটি, ইউনিফর্মিটি অ্যান্ড স্পেসিফিসিটি : এ ভিউ ফ্রম এ ডেভেলপিং কান্ট্রি’। এপ্রিলের ১৯ থেকে ২৩ পর্যন্ত আইজিএনসিএর ক্যাম্পাসেই সেমিনার হলো। আমি প্রবন্ধ পড়লাম, একটা অধিবেশনে সভাপতিত্বও করলাম। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, নেপাল, মঙ্গোলিয়া ও শ্রীলঙ্কা থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন। ভারতের তো অনেকে ছিলেন–তাঁদের মধ্যে কপিলা বাৎস্যায়নের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছিল একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তার যেমন পাণ্ডিত্য, তেমনি বলবার ক্ষমতা। আমার সঙ্গে কিছু কিছু বাংলাও বললেন। বি এন [বৈদ্যনাথ সরস্বতী–সবটা আয়োজনের দায়িত্ব যার কাঁধে–তিনি সদাশিব মানুষ, খুবই পণ্ডিত, কিন্তু বিনয়ের আবরণে তা ঢেকে রাখেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্র জৈন, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ আর মোমিন এবং নর্থ-ইস্ট হিল ইউনিভার্সিটি থেকে মৃণাল মিরি। ইউনেসকোর প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ফ্রানসিস চাইল্ড–তাঁর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। প্যারিসে গেলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, এমন অনুরোধ তিনি করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েও সে অনুরোধ রাখতে পারিনি। আমার সঙ্গে ভালো আলাপ হয় তুরস্কের প্রবীণ নৃতত্ত্ববিদ বোজকুর্ট গুঁজেন্চ এবং ইরানের নবীন গবেষক ফাতেমা ফারাহানির। ফাতেমা ইরানের সরকার অনুমোদিত পোশাকে আচ্ছাদিত থাকতো। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই পোশাক সে স্বেচ্ছায় পরেছে, না তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার সরাসরি জবাব দেয়নি। বলেছিল, তার এমন পোশাক পরার ফলে সবার যদি কল্যাণ হয়, তবে সেটা অনেক বড়ো পাওয়া হবে।

এই সভা থেকে ইউনেসকো এবং ইউনেসকোর সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের কাছে অনেকগুলো প্রস্তাব গিয়েছিল। তাতে কোনো কাজ হয়েছিল বলে আমার মনে হয় না।

এই সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলো পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল : Baidyanath Saraswati (ed), Interface of Cultural Identity and Development (New Delhi, 1996).

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিল সরকারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সে এখন এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ। তারই উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইন্দিরা গান্ধি স্মারক বক্তৃতা দিতে। সোসাইটি জানিয়েছে, এই স্মারক বক্তৃতা প্রবর্তিত হয় ১৯৮৫ সালে। এ পর্যন্ত যারা বক্তৃতা দিয়েছেন, তাঁরা হলেন, গোঁয়ার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ড. গোপাল সিং, বিচারপতি মুহম্মদ হিদায়েতউল্লাহ, সাহিত্যিক উমাশঙ্কর যোশী, রাজনীতিবিদ হীরেন মুখার্জি, সাংসদ ড. কিরীট যোশী, সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্করদয়াল শর্মা। এবারে আমাকে অনুরোধ করা হচ্ছে কালচারাল প্লুরালিজম’ সম্পর্কে বলতে। প্রলুব্ধ হলাম, ভীতও হলাম। শেষ অবধি দুরুদুরু বক্ষে লেখা। নিয়ে হাজির হলাম। ১৯৯৩ সালের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর দুদিন বক্তৃতা দিলাম। এবং যথেষ্ট প্রশংসা পেলাম।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বক্তৃতাটি ছেপে বের হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভাষণটি পুনর্মুদ্রিত হলো।

৩০.

নভেম্বরের শেষে শ্রীলঙ্কায় গেলাম আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের এক সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে আছি আমরা তিনজন। ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. আবদুল গফুর ও আমি। অন্য কোনো কাজে আমি আগেই কলকাতায় পৌঁছেছিলাম। সেখান থেকে বাকি দুজনের সঙ্গে মাদ্রাজ হয়ে কলম্বো পৌঁছলাম। গিয়ে বুঝলাম, এটা ঠিক পথ নয়, এ-পথে বড়ো কষ্ট। মাদ্রাজ বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা মানে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া। সে পরীক্ষায় প্রায় অসফল হই আর কী!

তবে কলম্বো পৌঁছোবার পর সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। আয়োজকদের ব্যবস্থা চমৎকার। অনেক চেনাজানা মানুষের সঙ্গে পুনর্মিলন। নতুন পরিচয় যাদের সঙ্গে হলো, তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের ড. হারুন রশীদ এবং শ্রীলঙ্কার গামিনি কোরিয়া ও সুশীল সিরিবর্ধনা উল্লেখযোগ্য। ডা. হারুন রশীদ মনোচিকিৎসক। পাকিস্তানে নিতান্ত নিম্নশ্রেণির মানুষ নানাধরনের উৎপীড়নের শিকার হয়। হারুন তাদের চিকিৎসা করেন এবং এই ধরনের অজানা উৎপীড়ন সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রকাশ করেন। গামিনি শ্রীলঙ্কায় খুব শ্রদ্ধেয়। সুশীল অকসফোর্ডে ডি ফিল করে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়েছিল। এতে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। তাকে এক সময়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়। পরে আবার কারাগার থেকে বের করে শ্রীলঙ্কার স্কুল-শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সংস্কারের কাজেও তাকে লাগানো হয়।

আমাদের সম্মেলনের মূল আয়োজক এ এম মারলিন খুব মজার মানুষ। এক অবসরে তিনি আমাদের অনেককে ক্যান্ডিতে নিয়ে গেলেন তাঁদের পারিবারিক আবাসে। সেখানে আমরা খাইদাই, ক্যান্ডি নাচ দেখি। মারলিনদের কয়েকপুরুষ মূল্যবান পাথরের ব্যবসা করেন। অতিথিদের অনুরোধে খাওয়াদাওয়ার শেষে কর্মচারীদের ডেকে দোকান খোলান মারলিন। অতিথিদের অনেকেই দামি পাথর কেনেন–তবে এটা মারলিনের উদ্দেশ্য ছিল না, তা হলফ করে বলতে পারি।

কলম্বোতে তখন শাব্বির আহমদ চৌধুরী থাকে। সে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী। একদিন শিক্ষকতা ছেড়ে সে চলে আসে শ্রীলঙ্কায়–ব্যবসায়ে অর্থ নিয়োগ করে এখানে রয়ে যায়। আমাদের আগমনবার্তা তাকে দিই। সে বলে, আপনাদের শ্রীলঙ্কা দেখাতে নিয়ে যাবো–দুদিন লাগবে। সম্মেলনের শেষে হোটেল ছেড়ে আমরা তার বাড়িতে উঠি। সে আমাকে রাত্রিবাস করতে পাঠায় আরেক স্বদেশি ড. আজহারুল হকের বাড়িতে, সেটা আরো আরামদায়ক বলে। আজহার পরে দেশে ফিরে ওয়াসার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

আমাদের শ্রীলঙ্কা ঘোরাতে হবে, অতএব শাব্বির তার গাড়ি বেচে বড়ো ধরনের জিপ কিনে ফেলে। আমরা তিনজন ছাড়া সে সঙ্গে নেয় এক শ্রীলঙ্কানকে। তিনি মাগরেব ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শাব্বিরের ধারণা, এই গৃহযুদ্ধরত দেশে দূরে যেতে হলে একজন দেশীয় লোক থাকলে সুবিধে হবে।

আমরা পশ্চিম উপকূল ধরে উত্তরে যেতে থাকি। এক সময়ে নিরাপত্তাবাহিনী আর আমাদের যেতে দেয় না। আমরা পুবদিকে ঘুরি। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী। অনুরাধাপুরে রাত্রিযাপন করি। তারপর ক্যান্ডির কাছ ঘেঁষে দেশের মধ্যভাগ ধরে ফিরে আসি কলম্বোয়। অত্যন্ত আরামদায়ক, উপভোগ্য, শিক্ষাদায়ক ভ্রমণ।

তারপর মাদ্রাজ হয়ে ফেরা। যে-ফ্লাইটে আমরা মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ফিরি, সেটা নানা বিমানবন্দরে থামতে থামতে আসে। অনেক সময় লাগে। মাঝে একজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশের মানুষ, মাদ্রাজে চিকিৎসা নিয়ে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন। উড্ডয়নকালে উচ্চতায় তার অসুবিধে হয়। উড়োজাহাজের ক্রুরা যাত্রীদের মধ্যে ডাক্তার খোঁজ করেন। একজনকে বোধহয় পাওয়া যায়। তিনি যান রোগীর পাশে, তবে তেমন কোনো সাহায্য করতে পারেন বলে মনে হয় না। পরের বিমানবন্দরে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর মালপত্র খুঁজে বের। করে প্রত্যর্পণ করতে অনেক সময় লাগে।

পরে শ্রীলঙ্কায় যখনই গেছি, নিশ্চিত করে নিয়েছি, যাতে মাদ্রাজ হয়ে যেতে না হয়।

শ্রীলঙ্কায় সেবারে যে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেকথা বলা যাক।

আমরা দল বেঁধে সৌজন্য-সাক্ষাৎকার করতে গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের সঙ্গে। তিনি প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তাঁর জামাতা তখন বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার। আমরা বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে স্পিকার একটু বাড়তি সমাদর করলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, শ্রীলঙ্কার জনগণকে প্রথাগতভাবে তিনভাগে ভাগ করা হয়–সিংহলা, তামিল ও মুসলমান। দুটি গোষ্ঠীর পরিচয় নৃতাত্ত্বিক, অপরটির ধর্মীয় কেন, তার সদুত্তর পেলাম না। দেশব্যাপী সিংহলা-তামিলের বিরোধের পটভূমিকায় সিংহলা মুসলমান ও তামিল মুসলমান একযোগে তৃতীয় একটি পক্ষ, তা আশ্চর্যের বিষয়। পরে জানলাম, এ-কারণে অনেকে, বিশেষ করে সিংহলারা, মুসলমানদের সুবিধাবাদী বলে গণ্য করে। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তখন সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। এ-অবস্থায়ও সিংহলাদের কারো কারো মত এই যে, সলোমন বন্দরনায়েকের সরকার যদি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চাপের কাছে অতটা নতিস্বীকার না করতেন, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম ও সিংহলি ভাষার অতটা পৃষ্ঠপোষকতা না করতেন, তাহলে হয়ত তামিলদের সঙ্গে সিংহলাদের দূরত্ব এই পর্যায়ে পৌঁছোতো না। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন নিয়ে সলোমন বন্দরনায়েকে ক্ষমতায় এসেছিলেন বটে, তবে ভিক্ষুদের একদেশদর্শিতার সঙ্গে পেরে ওঠাও সম্ভবপর ছিল না তার। পক্ষে। পরিণামে তো বৌদ্ধ ভিক্ষুর হাতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হলো কয়েক বছরের মধ্যে।

সলোমনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন–পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরো এক দফা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কয়েক দফা বিরোদী দলীয় নেত্রী। কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন প্রেমাদাসার কাছে। আপসোর সম্মেলনে আগত সকল প্রতিনিধিকে তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে। আমরা যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে গেছি, কিন্তু শ্রীমাভো আসতে পারেননি–তার শরীর ভালো নেই। তার হয়ে আমন্ত্রণকর্তার ভূমিকা পালন। করলেন বিরোধী দলীয় উপনেতা। ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি ও লম্বা-চওড়া। বললেন, আমার নাম রানাতুঙ্গা। আমার ছেলে অর্জুন ক্রিকেট খেলে–আপনারা অনেকে হয়তো তাকে চিনবেন। মিসেস বন্দরনায়েকের শরীর একটু খারাপ, তাই তিনি আসতে পারেননি। তিনি আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। খাওয়াদাওয়ার পরে আপনারা যদি তাঁর বাড়ি যেতে সম্মত হন, তাহলে তিনি আপনাদের সঙ্গে কফি খেতে পারেন।

বেশির ভাগ অতিথি এই কষ্ট স্বীকার করতে চাইলেন না। আমরা কয়েকজন। মাত্র গেলাম।

শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের বাড়ি প্রাসাদোপম নয়, বরঞ্চ প্রত্যাশার তুলনায় ছোটোই বলা যেতে পারে। ড্রইং রুমটি সুসজ্জিত। তাতে শোভা পাচ্ছে সলোমন ও শ্রীমাভোর একটি ছবি এবং ইন্দিরা গান্ধির স্বাক্ষরযুক্ত একটি প্রতিকৃতি। আমরা ছবি দেখতে দেখতে শ্রীমাভো দেখা দিলেন। তার বয়স তখন ৭৭/৭৮। রাজনীতিতে থাকলেও সক্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে–কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজনৈতিক মঞ্চে স্থান করে নিয়েছেন।

কথায় কথায় শ্রীমাভো বললেন, সলোমন একবার কলকাতায় গিয়েছিল লুকিয়ে। বোধহয় ১৯৪৬ সালে। কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কোনো একটি সভায় সে উপস্থিত ছিল নেহরুর আমন্ত্রণে–নেহরুর সঙ্গে তার খুব সখ্য ছিল।

সেদিন তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রতি খুব ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বললেন, বিশ্বব্যাংক কৃষিতে ভর্তুকি দিতে নিষেধ করছে আমাদের। এর ফল কী হবে জানেন? শ্রীলঙ্কায় অন্তত অনেকে চাষবাস ছেড়ে ছোটোখাটো ব্যবসা ধরবে বা দোকান খুলবে। তাতে তারা টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু কৃষি-উৎপাদন অনেকখানি ব্যাহত হবে। বিশ্বব্যাংক এই নীতি প্রয়োগ করবে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়। সবাই মিলে যদি তা প্রতিরোধ না করা যায় তাহলে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্বপ্ন মিলিয়ে যাবে।

ওই বয়সেও শ্রীমাভোর কথাবার্তা স্পষ্ট এবং সৌজন্যবোধ অসাধারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটা যথেষ্ট প্রীতিকর না হওয়ার সম্ভাবনায় আর তুললাম না।

৩১.

বাংলাদেশের এক সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম ১৯৯৩ সালের মার্চে–সেকথাটাও বলা হয়নি। প্রতিনিধিদলে ছিল হুমায়ূন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মনসুর মুসা, সেলিনা হোসেন, আরো অনেকে। ড. আশরাফ সিদ্দিকীও ছিলেন–প্রতিনিধিদলের নেতা হওয়া উচিত ছিল তাঁরই, কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় মনসুর মুসা আমার নাম প্রস্তাব করে ফেলায় আশরাফ সিদ্দিকী তা সমর্থন করে বসলেন। আমিও মজা পেলাম। তখন আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঝুলছে। এক মন্ত্রণালয় মামলা করছে, আরেক মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি করে আমাকে বিদেশ পাঠাচ্ছে। সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাহানারা বেগমের উদারতার কথা স্বীকার করতে হয়।

কলকাতায় নন্দনে একটা সভা হয়েছিল দুদেশের সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মের আদানপ্রদান নিয়ে। সেখানে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু বলেই বসলেন, বাংলাদেশের বই আমদানি করতে তারা আগ্রহী নন, বরঞ্চ যেসব বই ওদেশে চলবে বলে মনে করবেন, তারা তার ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশে আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের জাল সংস্করণ যে বাংলাদেশে প্রকাশিত হচ্ছে এবং আমরা কিছু করছি না–এ-বিষয়েও তারা উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

আশরাফ সিদ্দিকী সেবারে পরিচয় করিয়ে দিলেন জগদীশ বসাকের সঙ্গে। ঢাকার সন্তান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিংয়ে তার বইয়ের দোকান, স্ত্রী ড. শীলা বসাক-লোকসংস্কৃতি-বিশেষজ্ঞ। পরে জগদীশ ঢাকায় আসায় তার সঙ্গে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেওয়া হয়। তারপরে এমনি হলো যে, তার বাড়িই হয়ে গেল আমার কলকাতার ঠিকানা।

ডিসেম্বরে আমি গেলাম হায়দরাবাদে–একটি মার্কিন সংগঠনের উদযোগে সাহিত্যের ইতিহাস-বিষয়ক এক সেমিনারে। সেমিনারের পরিচালক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের ববরিনস্কয় অধ্যাপক শেলডন পোলক। শেলি আর আমি ছাড়া আর সকলেই ভারতীয়, তবে সংখ্যায় অল্প। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সাহিত্য অকাঁদেমির সম্পাদক ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। আমি হায়দরাবাদে পৌঁছে রাত জেগে প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেটা ভালো লেগেছিল শেলি ও ইন্দ্রনাথের এবং আরো কারো কারো।

হায়দরাবাদে সালার জঙ্গ জাদুঘর দেখবার মতো। নবাবের প্রাসাদের এক কোণে আলোছায়ায় ইতিহাস-বর্ণনাও খুব উপভোগ্য।

হায়দরাবাদ যাওয়ার পথে বেবী, শুচি ও আনন্দকে কলকাতায় জগদীশের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। স্ত্রী শীলা ও মেয়ে মিলিকে সঙ্গে নিয়ে জগদীশ। বেবীদের পুরী বেড়াতে নিয়ে গেল। তারাও পুরী-ভ্রমণ খুব উপভোগ করেছিল।

৩২.

ভারত সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনসটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর পরিচালক নিযুক্ত হন ড. বরুণ দে। ইনসটিটিউট-প্রতিষ্ঠার এবং বরুণ দের নিয়োগের পেছনে প্রবল সমর্থন ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল অধ্যাপক সৈয়দ নূরুল হাসানের। ইনসটিটিউটের দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসেবে বরুণ নিয়ে আসেন রণবীর সমাদ্দারকে। রণবীর দুর্দান্ত ছাত্র ছিল, অত্যন্ত ভালো বক্তা, নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে কারাবাসও করে দীর্ঘকাল। কয়েকজন তরুণ গবেষক দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া নিয়ে সেখানে গবেষণাকর্মেও নিযুক্ত হয়।

১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমি যখন এশিয়াটিক সোসাইটিতে বক্তৃতা দিতে কলকাতায় যাই, তখনি বরুণ দে প্রস্তাব করেন, আমি যেন দু মাসের জন্যে তাঁদের ইনসটিটিউটে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে আমি এক বছরের সাবাটিকাল লিভ নিই এবং ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ওই ইনসটিটিউটের প্রথম ভিজিটিং ফেলোর দায়িত্বপালন করি। আমার থাকার ব্যবস্থা হয় গোল পার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের ইনসটিটিউট অফ কালচারের অতিথি-ভবনে এবং বসার ব্যবস্থা হয় বেহালায় মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটের দপ্তরে। আমাদের রাজনীতিবিদ অজয় রায়ের কন্যা পর্ণা তখন ওই অতিথি-ভবনে থেকে লেখাপড়া করছিল। তার সুবাদে আমি একদল তরুণ ছেলেমেয়ের কাকা হয়ে মহানন্দে থাকছিলাম। অতিথি-ভবনে খাওয়ার সময়ে আমার সঙ্গীর অভাব হতো না। একটি চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটলো একদিন। অতিথি-ভবনের এক কর্মচারী আমাকে বললেন, আমাদের ল্যাংগুয়েজ প্রোগ্রামের হেড সরকার সাহেব আপনার খোঁজ করছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করার সময় কি আপনার হবে?’ ‘সরকার সাহেব কে?’ ‘আজ্ঞে, বি এন সরকার। চিনতে পারলাম না, তবু গেলাম। গিয়ে দেখি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বি এন সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন–প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। তাকে বললাম, আপনি যে জেনারেল সরকার, তা ওরা একবারও বললো না, সুতরাং আমি বুঝতেই পারিনি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, সে তো গতজীবনের কথা। সামান্যত যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, ব্যক্তিগত জীবনে তার ওপর দিয়ে বড়োরকম ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। সেই দুঃখশোক নিয়ে একরকম বৈরাগ্য গ্রহণ করেছিলেন, তারপর আবার মূলধারায় ফিরে এসে স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন এখানে বিদেশি ভাষাশিক্ষার কর্মসূচি দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি যাদের চিনতেন, তাঁদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। সুতরাং মাত্র দু-একজনের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিবিষয়ে কি সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো কিছুই জানতে চাইলেন না।

মওলানা আজাদ ইনসটিটিউট থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে চারটি লিখিত বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল আমাকে। কিছু মালমশলা আমি সঙ্গে নিয়ে যাই–তার বেশ খানিকটা সংগ্রহ করতে আমাকে সাহায্য করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফা। বাকিটা সংগ্রহ করি মওলানা

আজাদ ইনসটিটিউট, রামকৃষ্ণ মিশন ইনসটিটিউট এবং কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের গ্রন্থাগার থেকে। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারিক ছিলেন বেবীর সহপাঠী নূরুননাহার–তিনি যথাসাধ্য সহযোগিতা করেন। তার স্বামী নজীবর রহমান ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপক এবং তারও আগে আমার প্রথম জীবনের ছাত্র। নজীবর রহমান তখন অবসর নিয়ে কলকাতায় থাকেন–তাঁদের বাড়িতেও একদিন যাওয়া হয়।

ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮, ১৯, ২২ ও ২৩ তারিখে মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটে লিখিত বক্তৃতা দিই। যেদিন আমার দ্বিতীয় বক্তৃতা সেদিন সকালেই বেবী ফোন করে জানালো, আমাদের বন্ধু চৌধুরী মহীউদ্দীনের একমাত্র পুত্র বাবু ঢাকায় বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি-দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মারা গেছে। মহীউদ্দীন তখন মেদিনীপুরে পীরের উরসে। এ-মর্মান্তিক খবরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।

Tooteome facciata 1509: A Question of Identity, Religion and Politics, Looking Back at 1971 978 Looking Forward to What? বক্তৃতার সারাংশ শ্রোতাদের মধ্যে বিলি করা হয়। প্রশ্নোত্তর-পর্বের আলোকে বক্তৃতাগুলি সামান্য পুনর্লিখন করি। রণবীরের পরামর্শও কাজে লাগাই। ইনসটিটিউটের হয়ে পর বছর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে নয়া উদ্যোগ–Identity, Religion and Recent History নামে। বইটির উৎসর্গপত্র Boy 4997: To those friends in India/who, in 1971, had shared/our dream of Bangladesh/and our drive for its realization. 0759157 সম্পর্কে হ্যাজলিটের একটা উক্তি উদ্ধৃত করেছিলাম : ‘We often forget our dreams so speedily : if we cannot catch them as they are passing at the door, we never set eyes on them again.’gency 44 spousta on 63– স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার সম্পর্কে, আমার বিশ্বাস, কথাটা খুব প্রযোজ্য।

মার্চ মাসে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ এলো। সেখানকার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ডিভিশনের ড. সুখরঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে দুদিনব্যাপী সেমিনার আয়োজন করেছেন। তিনি যখন জয়পুরে রাজস্থান ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। এখন তিনি আমাকে চান তাঁর সেমিনারে। মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটে দেওয়া একটি বক্তৃতা খানিক অদল-বদল করে পড়ে দিয়ে এলাম Religion and Politics in Bangladesh নামে। এই সেমিনারে বাংলাদেশের অনেকে ছিলেন : অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, রঙ্গলাল সেন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইমতিয়াজ আহমদ ও আবদুর রব খান। মওলানা আজাদ ইনসটিটিউট থেকে রণবীর সমাদ্দার ও মোহাম্মদ তাজউদ্দীন গিয়েছিল, মনে হচ্ছে বরুণ দেও। তার বাইরে মুচকুন্দ দুবের মতো কূটনীতিক ছিলেন, কলিম বাহাদুর, অনিরুধ গুপ্ত, কান্তি বাজপেয়ী, ইন্দ্রনাথ মুখার্জী, ন্যান্সি জেটলি ও শ্যামলী ঘোষসহ আরো অনেক বিদ্বজ্জন যোগ দিয়েছিলেন। সেমিনারের প্রবন্ধগুলো S. R. Chakravarty (ed.) Society, Polity and Economy of Bangladesh Foreign Policy of Bangladesh নামে দু খণ্ডে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় (১৯৯৪)।

৩৩.

মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনসটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং ফেলো হিসেবে ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আমি যখন কলকাতায় থাকি, তখন একদিন শুনতে পাই, অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব মাহমুদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পি জি [প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অধ্যাপক এ ডব্লিউ মাহমুদ ওরফে বাচ্চু মিয়ার কথা এই রচনায় আগে বলেছি, সুতরাং তার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। রণবীর সমাদ্দার ও আমি তাকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে, সঙ্গে আরো দু-একজন ছিলেন। হাসপাতালে ঢোকার মুখে তাঁদেরই কেউ যেন বললেন, ‘কল্পনা যোশীও আছেন এই হাসপাতালে, দেখতে যাবেন?’

কল্পনা যোশী আমাদের কাছে বহুদিন ধরে বহু শ্রদ্ধেয় এক নাম। ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিপ্লব সরকারি চাকুরে পরিবারের মেধাবী সন্তান কল্পনা দত্তকে এমনই উদ্দীপ্ত করে যে তিনি কলকাতায় অধ্যয়ন স্থগিত করে জন্মভূমি চট্টগ্রামে চলে এসে মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ বিপ্লবীর সঙ্গে কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণের পর তিনি গ্রেপ্তার হন। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গেই তার বিচার হয়, তাতে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়, পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়, তবে গান্ধির প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তখন তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং একই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি (পূরণচাঁদ) যোশীকে তিনি বিয়ে করেন ১৯৪৩ সালে, তবে তারপরও অনেক বছর চট্টগ্রামেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যান এবং ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এখান থেকেই প্রার্থী হন। শুনেছি, পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি কিছুকাল চট্টগ্রামে ছিলেন, পরে প্রথমে কলকাতা ও তারপর দিল্লিতে থেকে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতেন।

সুযোগ পেয়েও কল্পনা যোশীকে দেখতে যাব না, তা কেমন করে হয়? তবে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। তখন তাঁর বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, শরীর ভেঙেছে, মানসিক বিপর্যয়ও ঘটেছে। পাছে পড়ে যান, তাই বিছানার চারপাশে রেলিং দেওয়া আছে। আমাদের দেখে তার কী আকুতি! আপনারা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন?’, ‘আপনারা আমার কাছে থাকবেন তো?’, ‘আমাকে ফেলে আপনারা চলে যাবেন না তো?’–সর্বক্ষণ এসব কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে থাকলেন। একবার তার ছেলের কথা বললেন, ছেলে যে তার কাছে নিশ্চিত আসবে সেকথাও জানালেন। তারপর আবার সেই আগের কথা। আমরা চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই কান্নাভেজা গলায় আমাদের ডাকতে লাগলেন, তার কাছে থাকতে মিনতি করতে লাগলেন। আমরা একরকম পালিয়েই গেলাম।

অধ্যাপক মাহমুদকে দেখলাম খুব দুর্বল, কিন্তু তার মনোবল বরাবরের মতো। তবে তাঁর কথায়ও সেদিন মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, কল্পনা দত্তের আর্তকণ্ঠ বারবার কানে বাজছিল। এঁদের কারো সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। অধ্যাপক মাহমুদ বেঁচে ছিলেন আরো দু বছর, কল্পনা দত্তের জীবনাবসান হয় এক বছরের মধ্যেই।

যেদিন ওঁদের দেখে এলাম, তার পরদিনই বোধহয় জীবনানন্দ দাশের জন্মবার্ষিকী-উপলক্ষে তার কন্যা মঞ্জুশ্রী-আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম প্রধান অতিথিরূপে। এই অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটি কীভাবে ঘটলো, তা আনুপূর্বিক বলা চলে।

আমি একদিন মঞ্জুশ্রী দাশের একটি চিঠি পাই। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা করতে–তাঁর সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে তিনি বাংলাদেশে আসতে চান এক বছরের জন্যে। আমাকে অনুরোধ করেছেন, ওই সময়ের জন্যে তাকে একটা বৃত্তি জোগাড় করে দিতে। আমি তাকে জানিয়েছিলাম, এক বৎসরের জন্যে বৃত্তি পাওয়া দুরূহ, তবে তিনি যদি অল্প সময়ের জন্যে আসেন, তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভবপর। তিনি আমাকে আর কিছু জানাননি।

এবারে রামকৃষ্ণ মিশন ইনসটিটিউটের অতিথিশালায় এক সকালে তিনি এসে হাজির। রিসেপশন থেকে আমার ঘরে ফোন করে জানাচ্ছেন, তিনি মঞ্জুশ্রী দাশ–আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

অভ্যাগতদের ঘরে গিয়ে দেখা করলাম। তাঁর চিঠির যে জবাব দিয়েছি, সেজন্যে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর জানালেন, তিনি পিতার জন্মোৎসব করছেন, আমাকে তার প্রধান অতিথি হতে হবে। আমি যতই নিজের অযোগ্যতার কথা বলি, তিনি ততই বলেন, যে-বাংলাদেশ জীবনানন্দ দাশকে এত ভালোবাসে, সে-বাংলাদেশের প্রতিনিধিস্বরূপ আমাকেই প্রধান অতিথি থাকতে হবে। তাঁর ইচ্ছে, বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশকে সবাই কেমন ভালোবাসে, সে-কথাটা যেন আমি শ্রোতাদের জানিয়ে দিই।

তিনি আরেকদিন এলেন মুদ্রিত আমন্ত্রণপত্র পৌঁছোতে। সেদিন তিনি বললেন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্লিন্টন বি সিলি যে আমার বন্ধু, তা তিনি জানেন। ক্লিন্টকে বলে আমি কি তাকে শিকাগো পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারিনে? নিশ্চয় পারি, ইচ্ছে করলেই পারি। ক্লিন্ট তো তার অচেনা নয়, বস্তুত সে তাদের পারিবারিক বন্ধুই, কিন্তু নিজের কথা তিনি কেমন করে ক্লিনকে বলবেন? আমি যদি বলি–বলা মানে সুপারিশ করা–তাহলে সবদিক রক্ষা হয়।

আমার মনে হলো, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার আসল যোগ্যতা আমার ক্লিন্টের বন্ধু হওয়া।

অনুষ্ঠানে গেলাম বরুণ দের সঙ্গে। তিনিও বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত। জীবনানন্দ দাশ তাঁর মেসোমশায়। বরুণও বলেছিলেন যে, আত্মীয়তা সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশের সম্পর্কে সভাস্থলে বক্তৃতা করবার যোগ্যতা বা অধিকার তার নেই, কিন্তু সেকথা মঞ্জুশ্রীর কাছে দায়িত্ব এড়ানোর প্রয়াস বলে অগ্রাহ্য হয়েছে।

আমাদের পৌঁছোতে একটু বিলম্ব হয়েছিল–সেদিন ইনসটিটিউটে আমার বক্তৃতা ছিল, সেটা শেষ করে তবে যেতে পেরেছিলাম–তবু আমরা সাদরে বৃত। হয়েছিলাম। বরুণ সংক্ষেপে যা বললেন, তা থেকে বোঝা গেল, জীবনানন্দ দাশের প্রশ্রয় তিনি পাননি, কেননা আত্মীয় হলেও কবি মিশুক মানুষ ছিলেন না, বরং একটু সন্দেহবাতিক ছিলেন। সভায় আমার সম্পর্কে খানিকটা কৌতূহলের উদ্রেক হয়েছিল। আমি সামান্য যা বলেছিলাম, তাকে প্রধান অতিথির ভাষণ বললে অনেক বাড়িয়ে বলা হয়।

পরে আমি ক্লিন্টকে মঞ্জুশ্রীর অনুরোধের কথা জানিয়েছিলাম। ক্লিন্ট বলেছিলেন, মঞ্জুশ্রী স্বয়ং এমন একটি লিখিত প্রস্তাব তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে-ইচ্ছাপূরণ ক্লিন্টের পক্ষে দুরূহ।

তারপর মঞ্জুশ্রীও খুব বেশিদিন বাঁচেননি।

সেবার কলকাতায় আমাকে আরো একটি বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। অনুষ্টুপ আয়োজিত সমর সেন স্মারক বক্তৃতা। ৫ মার্চে স্টুডেন্টস হলে বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য বক্তৃতা দেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী : শ্রেণিচরিত্র ও রাজনীতি বিষয়ে। তারপর আমি বলি বাংলাদেশ : বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ সম্পর্কে। দুটোই ছিল মৌখিক বক্তৃতা। ভাগ্যিস মৌখিক ছিল–লিখিত বক্তৃতা আবশ্যক হলে পেরে উঠতাম না।

৩৪.

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ও ওয়াশিংটন ডিসির প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিরা ১৯৯৪ সালে সাড়ম্বরে নজরুল-জয়ন্তী উদ্যাপন করতে মনস্থ করেন। তাতে আমন্ত্রিত হয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাই ২৯ বছর পরে। সেই কবে শিকাগো ছেড়েছিলাম, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দিয়ে গেছি, তার বিমানবন্দরে থেমেছি, কিন্তু দেশে ঢোকা হয়নি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ইকবাল। বাহার চৌধুরী, তারই আতিথ্য উপভোগ করার ব্যবস্থা হয়েছে।

অনুষ্ঠানটি বেশ সুন্দর হলো। যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গা থেকে শ্রোতা ও অংশগ্রহণকারীরা এসেছিলেন। প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর। হুমায়ূন কবীর ভালো বললেন, তবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বক্তৃতা ছিল অতি চমঙ্কার। তিনি যে আশৈশব বাড়িতে নজরুলের কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছেন, তার মাতামহ মাতামহীর সঙ্গে নজরুলের যে কী আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে নজরুলের লেখা চিত্ত-নামা তাদের সকলকে যে কী অসাধারণ আলোড়িত করেছিল–সেসব কথা খুব হৃদয়গ্রাহী করে বললেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতি থেকে নজরুলের কবিতাংশ উদ্ধৃত করেও তিনি সকলকে চমৎকৃত করেছিলেন।

তাঁর অপরিসীম সৌজন্যও উল্লেখযোগ্য। অনুষ্ঠানের পরে চা-পানের সময়ে তিনি আমাকে তাঁর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি থাকতে পারছি না শুনে অনুযোগ করলেন, এত দূর থেকে এত কম সময় হাতে নিয়ে আসি কেন!

গোলাপের কাটার মতো এই অনুষ্ঠানেরও একটা অন্য দিক ছিল। নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানস্থল ছিল মেরিল্যান্ডের একটি কলেজের মিলনায়তন। আমরা যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দেখি পুলিশ আর পুলিশ এবং আমাদের প্রবেশ আপাতত নিষিদ্ধ। কী ব্যাপার? কেউ ফোন করে পুলিশকে বলেছে, মিলনায়তনে বোমা পাতা আছে। অতএব সবটা তল্লাশি করে নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ কাউকে ঢুকতে দেবে না। বলা বাহুল্য, কিছুই পাওয়া যায়নি।

কাজটা যে কোনো উদ্যমী বাঙালির, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। সম্ভবত সেখানেও বাঙালিদের মধ্যে এ-পক্ষ ও-পক্ষ ছিল। যারা মিথ্যে খবর দিয়েছিলেন, তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেন নি, তবে বিলম্বিত করেছিলেন।

সেবার ইকবালের জন্যে একটা অবাক-করা উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম : নজরুল-পাণ্ডুলিপি। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে এসেছিলেন। মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের আগ্রহাতিশয্যে। তিনি অতিথি ছিলেন বাহারের মাতামহ খান বাহাদুর আবদুল আজীজের তামাকুমুণ্ডি লেনের বাড়িতে। দুবারই একটি করে রুল-টানা খাতায় তিনি বেশ কিছু কবিতা ও গান লিখেছিলেন। প্রথম খাতার কবিতাগুলি মূলত গ্রন্থভুক্ত হয় সিন্ধু-হিল্লোল (১৯২৭) কাব্যে, দ্বিতীয় খাতার কবিতাগুলি প্রধানত চক্ৰবাকে (১৯২৯)। পাণ্ডুলিপি দুটি বাহারের কাছেই ছিল। তাঁর কন্যা সেলিনা বাহার জামান সেগুলো বাংলা একাডেমিকে প্রদান করলে নজরুলের হস্তলিপিতেই নজরুল-পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয় (১৯৯৪)। বইটির সম্পাদক সেলিনা বাহার জামান, উপদেশকমণ্ডলীর সদস্য আমি, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। মান্নান সৈয়দ পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত পাঠ মিলিয়ে পাঠভেদ নির্দেশ করেছিলেন। নজরুল-পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত সুচারুভাবে মুদ্রিত হয় কাইয়ুম চৌধুরীর নির্দেশনায় এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদের আগ্রহে।

নজরুল-পাণ্ডুলিপি ছাপার আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেটা এর আগে কোথাও বলা হয়নি। বাংলা একাডেমিকে খাতা দুটি দেওয়ার আগে সেলিনা তার ফটোকপি করে রাখতে চেয়েছিলেন। ফটোকপি করতে যে নিয়ে গিয়েছিল, সে ফিরে এলে দেখা গেল, খাতার প্রত্যেকটি পাতা বাধাই থেকে এমনভাবে বিযুক্ত করে নিয়ে ফটোকপি করা হয়েছে যে, কোন পাতা কোন খাতার তা আর বোঝার উপায় নেই এবং পাতার ক্রমও হারিয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত সেলিনা ওই অবস্থায় পাণ্ডুলিপি ও ফটোকপি এনে আমাকে দেন। আমি খানিকটা শ্রমস্বীকার করে। খাতার কালি ও কাগজ এবং মুদ্রিত কবিতা দেখে দেখে খাতাদুটি পুনর্বিন্যাস করি।

যুক্তরাষ্ট্র রওনা হওয়ার পূর্বমুহূর্তে দু কপি নজরুল-পাণ্ডুলিপি সেলিনা আমার হাতে দেন ইকবালকে পৌঁছোবার জন্যে। বই পেয়ে ইকবাল যে কী খুশি হয়েছিল, তা বর্ণনাতীত।

ইকবালের ব্যবস্থাপনায় দিনদশেক ভালোই কেটেছিল। মাসুমা খাতুন ওয়ালীউল্লাহ ফাহমীদের বাড়ি গেলাম–তারা তখন একটি বাংলা বেতারকেন্দ্র চালাতে ব্যস্ত। ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগে যাওয়া এবং অনিবার্যভাবে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়া হলো। কামরু ভাই-ভাবি তখন মেরিল্যান্ডে থাকেন বড়ো ছেলে চন্দনের কাছে। সেখানে একরাত কাটানো গেল। আমার সঙ্গে সেখানে দেখা করতে নিউ জার্সি থেকে এলো আমার খালাতো ভাই ফজলে এবং মামাতো বোন রোখসানা। আমার সম্পর্কে-নাতি সৈয়দ আখতার মাহমুদের বাড়িতে একদিন চা-পর্ব সারলাম। তারপর সে আমাকে পৌঁছে দিল ওয়াশিংটন ডিসিতে এ কে এন আহমদের বাড়িতে। সেখানে আরেক দফা চা-পর্ব।

ফিরতি পথে লন্ডনে পাঁচ-ছদিন কাটিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন।

৩৫.

ফ্রাঁস ভট্টাচার্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও সভ্যতা বিষয়ক ইনসটিটিউটে (ইনালকো) বাংলা ভাষার অধ্যাপক। তিনি অনেকদিন ধরে চাইছিলেন, তাঁর ইনসটিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিনিময় কর্মসূচি নিয়ে একটা চুক্তি হোক। তাঁদের দিকে আনুষ্ঠানিকতা চুকিয়ে তিনি আমাকে লিখলেন এ-বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তৎপর করে তুলতে। আমাদের। উপাচার্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা ফরাসিপ্রেমী–তার নিজের ডিগ্রিও ফ্রান্সের। তাঁকে বলায় তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। ফ্রাঁস চুক্তির খসড়া পাঠালেন এবং কিছুদিন পর জানালেন, যদিও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সাড়া পাননি, তবু আমার কথার ওপরে নির্ভর করে ঢাকায় আসছেন চুক্তি সই করতে। আমি উপাচার্যকে সতর্ক করতে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের প্রান্তে সে-চুক্তি সম্পর্কে নথিতে দরকারি টীকা-টিপ্পনী রচিত হয়নি। তখনো–খসড়াটি নথিভুক্ত হয়ে আছে মাত্র। আমার কথায় তিনি সংশ্লিষ্ট শাখাকে তাগাদা দিলেন। এদিকে ফ্রস এসে পড়লেন, আমরা তখনো প্রস্তুত নেই। উপাচার্য এবারে জোরালো তাগাদা দিলেন। চুক্তি সই হলো। ফ্রস বুঝে গেলেন, তিনি চলে গেলে নথি আবার ঘুমিয়ে পড়বে। সুতরাং তিনি উপাচার্যকে বললেন, তার ইচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই চুক্তির অধীনে আমাকে এক মাসের জন্যে তাঁর ইনসটিটিউটে পাঠাক। সকল আর্থিক দায় ইনসটিটিউটের, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল আমাকে মনোনয়ন দেবে। পরের বছরে একজন ফরাসি বিদ্বানের শুধু স্থানীয় আতিথেয়তার ব্যবস্থা করবে বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর আসা যাওয়ার খরচও দিতে হবে না। উপাচার্য এ-প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।

ফরাসি দূতাবাস থেকে টিকিট ও ভিসা সংগ্রহ করে ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে উড়ে গেলাম প্যারিসে। পরদিনই একদিনের জন্যে লন্ডন গিয়েছিলাম কোচে-ডোভার দিয়ে। প্যারিসে তিন সপ্তাহ থাকবো। সোরবোনের অদূরে একটি অতিথিশালায় আমার থাকার চমৎকার ব্যবস্থা। সেখানে ঢুকেই অতিথিদের তালিকায় নাম দেখি অনিরুদ্ধ রায়ের, কিন্তু খোঁজ করে শুনি, দিন দুই আগে পাখি উড়ে গেছে স্বদেশে। প্যারিসে আমাকে দুটি বক্তৃতা দিতে হবে সি এন আর এসে, একটি সোরবোনে এবং দুটি ইনালকোতে। সি এন আর এসে তখনো আনোয়ার আবদেল-মালেক আছেন, ক্রিস্টিন কলপা তাঁর সঙ্গে না থাকলেও ওই বিদ্যাভবনে আছেন–উভয়েই খুব খুশি আমাকে দেখে। সিতেয় না থাকলেও হাসনাত জাহানও প্যারিসে আছে এবং আছে প্রলয় দুতা অর্থাৎ দত্ত। ফ্রাঁস তো আছেনই, উপরন্তু লোকনাথ ভট্টাচার্য এখন আছেন। অধিক আর কি চাই?

আগে প্যারিসে এসে বিবলিওথেক নাসিওনালে ওগুস্তে ওসার বাংলা-ফরাসি শব্দকোষের পাণ্ডুলিপি দেখে গিয়েছিলাম। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগরে সংকলিত বাংলা-ফরাসি শব্দের এই সর্বপ্রথম সংকলনটির একটি ফটোকপি সংগ্রহ করেছেন ফ্রস। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে তার বাড়িতে বসে এর পাঠোদ্ধার করি, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সারি, বিকেলে চা খেয়ে তবে তাঁর বাড়ি থেকে উঠি। লোকনাথ ভট্টাচার্য বেছে বেছে ওয়াইন সংগ্রহ করে রাখেন, তার সত্ত্বার হয়। ফ্রাঁস নিরামিষাশী, মদ্যমাংস স্পর্শ করেন না। আমি ঠাট্টা করলে বলেন, ভুলে যাবেন না, আমি ভাটপাড়ার পুত্রবধূ। আমি বলি, ভাটপাড়ার ঐতিহ্যরক্ষার দায়িত্ব পুত্রকে টপকে পুত্রবধূর ওপর বর্তালো কেমন করে? তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব আমি পালন করছি, ওরটা ও বুঝে নেবে। সত্যি, খুব ভালো সময় কেটেছিল ওঁদের সান্নিধ্যে। বাজারে নতুন ওয়াইন ওঠার মোচ্ছব হয় সারা শহর জুড়ে। লোকনাথ আমাকে নিয়ে যাবেন সেখানে। কিন্তু তিনি গাড়ি চালান না। ফ্রাঁসই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন, যদিও তিনি আনন্দে শরিক হলেন না। শব্দকোষের কাজটিতেও মজা পাচ্ছিলাম। বাংলা শব্দের তালিকায় ফরাসি শব্দ ঢুকে গেছে–তা আমার পরিচিত নয়, ফ্রাঁস তা শনাক্ত করেন। আবার বাংলা বা ফরাসি শব্দের তালিকায় এমন শব্দ পাওয়া গেল, যা ফ্রাঁস বা আমি কেউ শনাক্ত করতে পারলাম না। পরে অভিধান ঘেঁটে ফ্রস বের করলেন, ওগুলো পর্তুগিজ শব্দ।

সোরবোনে তখন হেগিওগ্রাফি তথা সন্ত-জীবনী নিয়ে একটি বক্তৃতামালা চলছিল। ফ্রস তাতে আমার নাম ঢুকিয়ে দিলেন। আমি সপ্তদশ শতাব্দীর কবি সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। নবীদের তালিকায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও হরির নাম যে কবি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, এ-তথ্য জেনে শ্রোতারা খুব মজা পেয়েছিলেন এবং এর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল।

সিএনআরএসে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম বাংলাদেশে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে। বক্তৃতার শেষে এক মহিলা এসে বললেন, আমার নাম আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ্। আপনার বক্তৃতা আমার ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে ওয়ালীউল্লাহ যদি বক্তৃতা দিতো, সে আপনার মতোই বলতো। বললাম, তিনি নিশ্চয় অনেক ভালো বলতেন। তারপর তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, ১৯৬৯ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও তিনি যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে আমরা তাদের নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলাম। আমাকে চিনতে না পারার জন্যে আন-মারি লজ্জিত হলেন। বললাম, লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই, পরিচয় না দিলে আপনাকেও আমি চিনতে পারতাম না। ২৫ বছর আগে স্বল্পকালের জন্যে দেখা–এতদিন মনে থাকবে কী করে?

আন-মারি আশ্বস্ত হলেন। বললেন, আপনার সঙ্গে এ-যাত্রায় আরো দেখা। হবে আশা করি। আমরা টেলিফোন নম্বর বিনিময় করলাম। পরে চায়ের টেবিলে মিলিত হলাম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে তাঁর প্রেমপূর্ণ কথাবার্তা শুনে আপ্লুত হলাম। তিনি বললেন, অচিরে তাঁর ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে; এলে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন।

ইনালকোতে বাংলা ভাষা-শিক্ষার্থীদের কাছে বক্তৃতা দেওয়া ছিল অন্য ধরনের ব্যাপার। আমি ইচ্ছে করেই বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে প্রশ্ন ও উত্তর পর্বের জন্যে বেশি সময় রেখেছিলাম। সেটাই উপযুক্ত হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল, আমি সাধ্যমতো উত্তর দিয়েছিলাম।

এর মধ্যে ঢাকা থেকে খবর পেলাম, আমার বন্ধু টোনি স্টুয়ার্ট ফোন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে–সে আমাকে নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দু মাসের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে চায়। আমি যথাসময়ে যেতে পারবো কি না, তাকে যেন জানিয়ে দিই। পরদিন ফোন করলাম টোনিকে। স্থির হলো, ফেব্রুয়ারিতে যাবো তাদের ওখানে।

আমার সর্বশেষ বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পরে ফ্রস আমাকে নিয়ে গেলেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিতে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, থাইল্যান্ড থেকে। আগত আমার মতো এক অতিথি সেদিন সকালে ফিরতি টিকিট কিনতে এয়ারলাইনসের অফিসে যাচ্ছিলেন। পথে দুবৃত্তরা সব টাকাকড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে। তার থেকে। উপস্থিত সকলে আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। আমি বললাম, আমি আছি আর দুদিনমাত্র, এতদিন যখন নিরাপদ ছিলাম, তখন আর দুটি দিন মনে হয় নিরাপদেই কাটিয়ে দিতে পারব।

সেই সন্ধ্যায় আমি একটু আয়েশ করার পরিকল্পনা করেছি। সঁজে-এলিসের দিকে যাবো। পথের ধারে কোনো টেবিলে কিছু সময় কাটাবো। সন্ধ্যা নামার পরে ভালো একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করবো। কাজে যাচ্ছি না বলে ধীরপদে চলছি। একটা মেট্রোতে লাইন বদলাতে হবে। আমি ট্রেন থেকে নেমে ধীরে ধীরে হেঁটে এসকেলেটরে উঠেছি। প্রায় শেষ প্রান্তে যখন এসেছি, তখন। পেছন থেকে ধাক্কা খেলাম। আমি লাফিয়ে সমান জায়গায় পড়লাম উপুড় হয়ে। পেছন থেকে লাফিয়ে এসে একজন আমার ঘাড়ের ওপর পড়ল। সামনে থেকে একজন এলো সাহায্য করতে–আমাকে নয়, আমার আক্রমণকারীকে। আমি সাহায্যের জন্যে চীৎকার করতেই একটা ঘুসি খেলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার ট্রাউজারের পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ, শার্টের বুকপকেট থেকে আইডি, কলম, মেট্রোর টিকিট কার্ড এবং জ্যাকেটের পকেট থেকে অ্যাড্রেসবুক নিয়ে তারা চলে গেল–শুধু পকেট-চিরুনিটা দিয়ে গেল।

ভূমিশয্যা ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফরমে উঠলাম। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের কাছে অনুচ্চকণ্ঠে জানতে চাইলাম, কেউ ইংরেজি বলেন কি না। একজন উত্তর দেওয়ায় তাঁকে আমার অবস্থার কথা বললাম। ট্রাউজারের পেছনের পকেটটা আক্রমণকারী ছিঁড়ে ফেলেছিল-সেটা দেখালাম। বললাম, আমি ফেরত যাবো, কিন্তু বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা কি ঠিক হবে? আমার কাছে টিকিটের মূল্য সাত ফ্রা কেন, একটি ফ্রাঁও নেই। ভদ্রলোক আমাকে দশ ফ্রা দিলেন। জানতে চাইলাম, কোথায় তার অর্থ ফেরত দেবো? তিনি বললেন, ফেরত দিতে হবে না, এমন আমারও ঘটতে পারতো। ভিক্ষার টাকায় টিকিট করে ঘরে ফিরে এসে ফ্রাঁসকে ফোন করলাম। তার কাছে খবর পেয়ে প্রলয় দত্ত এলো। আমাকে নিয়ে কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে সে অনেকখানি সময় কাটালো। স্নায়বিক আঘাতে ভুগি কি না, সেটাই বোধহয় ছিল তার দুশ্চিন্তা।

পরদিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের বাড়িতে আমার বিদায়ী নৈশভোজ। তাকে বললাম ঘটনাটা। তিনি জানতে চাইলেন, আক্রমণকারীরা দেখতে কেমন। বললাম, সামান্য যা দেখেছি, তাতে তো আরব মনে হলো।

তা শুনে তার ফরাসি বান্ধবী খুব একচোট হাসলেন।

প্যারিস থেকে লন্ডনে এলাম কোচে। আমাকে নিতে এলেন আমার ছাত্রী হাসিনা হক ও তাঁর স্বামী, লন্ডনের সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, নাজমুল হক। উঠলাম পূর্ব লন্ডনে আমার ছাত্রী এবং আমার বড়ো মেয়ে রুচির ননদ মুনীরা ওরফে বিউটির কাউনসিল ফ্ল্যাটে। বিউটির স্বামী নাসিরুল হোসেন ওরফে জসীমও সোনালী ব্যাংকে কর্মরত। ওদের মেয়ে মালিহা নিতান্তই ছোটো–দৌড়ঝাঁপ করে বিউটিকে ব্যস্ত রাখে। বিউটিদের বাসায় থাকার সময়ে একদিন কেমব্রিজ থেকে আমার ছাত্র মহীবুল আজিজ ও তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা ওরফে মিতু এলো দেখা করতে। তারা দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছে। মিতু এসেছে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচ ডি করতে। মহীবুল এসেছে তাকে সঙ্গ দিতে, হাতে যথেষ্ট সময় আছে বলে লাইব্রেরিতে বসে মনের সুখে পড়ছে। তাদেরকে পেয়ে দিনটা খুব ভালো কাটলো।

নাজমুল হকদের বাড়িতেও থাকা হলো। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটালাম। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, স্থান-পরিবর্তনের উদ্‌যোগ চলছে। তাদের জন্যে অন্য যে-ক্যাটালগটি করেছিলাম, মনে হলো, সেটা ছাপতে সময় নেবে।

৩৬.

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো বটে, তবে তার চর্চা তেমন নেই। সরকার ও বিরোধী দলে বিরোধ ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার-প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে চলেছে। সেই দাবিতে সভা-সমাবেশ-মিছিল-হরতাল চলছে। সভা-সমাবেশ-মিছিলে সরকারের পুলিশ কিংবা দলীয় কর্মীরা প্রায়শই হামলা চালাচ্ছে।

১৯৯৪ সালের ২০ মার্চে মাগুরায় উপনির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী কাজী সলিমুল হক কামাল নির্বাচিত হলেন। এই উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে সকল বিরোধী দল অভিযোগ করলো। ভোটগ্রহণের দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাগুরায় গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অচিরেই ফিরে আসেন। কারো কারো মতে, তিনি ফিরে আসেন সেখানকার অব্যবস্থা দেখে অসহায় বোধ করে। যে-ধরনের ভ্রান্তির সুযোগে ট্রাজেডিতে নায়কের পতন ঘটে, সরকারের পক্ষে মাগুরা উপনির্বাচন ছিল তেমনি। অনেক কিছু করে সরকার পার পেয়ে গেছে, কিন্তু এবারে স্বেচ্ছাচারটা এত বড়োরকম হলো যে সবার ধৈর্যের বাধ ভালো। ফলে এখন থেকে সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রবল হয়। এমনকী তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা পর্যন্ত বলে ফেলেন যে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে বিদ্যমান সংকটের সমাধান হবে। ফলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাত প্রবলতর হতে থাকে। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে, বিরোধী দলীয় নেত্রী সরকারি বাসভবন ছেড়ে দেন এবং ডিসেম্বর মাসে সকল বিরোধী দলীয় সংসদ-সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন।

৩৭.

আমার বন্ধু টোনি কে. স্টুয়ার্ট নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ধর্ম ও দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্ম তার অধ্যয়ন-অধ্যাপনার বিশেষ ক্ষেত্র। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক এবং তার শিক্ষকতুল্য এডওয়ার্ড সি. ডিমক জুনিয়রের সঙ্গে মিলে সে তখন কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত অনুবাদ করছিল ইংরেজিতে। টোনিই আমার জন্যে একদিকে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজের কাছে প্রস্তাব দিয়ে অর্থবরাদ্দ করিয়েছিল এবং অন্যদিকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লিখে আমন্ত্রণ সংগ্রহ করেছিল।

লন্ডনে থামবার সুযোগ আমি সচরাচর ছাড়ি না। এবারে বিশেষ উৎসাহ জোগালেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বইয়ের দুটি তালিকা ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। তালিকাভুক্ত বইগুলি তার জন্যে যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে লন্ডন পৌঁছোলাম। এবারে বোধহয় নাজমুল হকের বাড়িতে উঠি, পরে সিরাজুর রহমানের বাড়িতে বদলি হই। এর মধ্যে আবুল খায়ের লিটু লন্ডনে এসে উপস্থিত। পিকাডেলির কাছে এক রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করে সে জানতে চাইলো, ‘মাইজা আব্বা আমাকে বই আনতে দিয়েছেন কি না। আমি হাঁ বলায় সে বললো, ‘উনি নিশ্চয় আপনাকে কোনো টাকা-পয়সা দেননি।’ বললাম, ‘সে পরে দেখা যাবে। লিটু আমার হাতে তিন শ পাউন্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো, রাজ্জাক সাহেবের পছন্দের বইয়ের দাম বেশি হওয়ারই কথা–এই টাকায় যা হয়, আমি যেন তাই কিনি, নিজের থেকে যেন খরচ না করি।

লন্ডনে সারের জন্যে বই খুঁজতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অল্প যে-কটি বই কিনেছিলাম, তাতে দেড় শ পাউন্ডের অধিক খরচ হয়ে গিয়েছিল। সিপরি ইয়ারবুকের দামই ছিল পঞ্চাশ পাউন্ড। গোটা চারেক অ্যাটলাস কিনেছিলাম–প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ও সাম্প্রতিক কালের। আরব ইতিহাসবিদদের সম্পর্কে একটি বই ছিল, একটি ছিল যান্ত্রিক উদ্ভাবন সম্পর্কে, আরেকটি ছিল ইংরেজদের খাদ্য বিষয়ে। এসব বই বাক্সবন্দি করে আমেরিকায় নিতে হবে, তারপরে ফেরার সময়ে দেশে। তালিকার বেশ কিছু বই ছাপা ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না।

সিরাজুর রহমানের বাড়ি থেকে ট্যাকসিতে ভিক্টোরিয়া। সেখানে চেক-ইন করে ট্রেনে করে গ্যাটউইক। সেখান থেকে বিমানে করে রলে। যাত্রার শেষদিকে শরীরটা খারাপ লাগছিল–মাথা ঘুরছিল কেন জানি না। স্টুয়ার্ডকে বলতে সে সামনের কেবিনে নিয়ে বসালো। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। খাওয়ার সময়ে আমি আর কিছু মুখে দিলাম না।

বিমানবন্দরে টোনি নিজেই এসেছে আমাকে নিতে। অ্যাভেন্ট ফেরি কমপ্লেক্স নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসন আছে। মূলত ছাত্রছাত্রীদের আবাস। তারই নিচতলায় একটি ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা। ঘরটি প্রশস্ত–একধারে মাইক্রোআভেন এবং হাঁড়িকুঁড়ি বাসনপত্র। লাগোয়া বাথরুম। ঘর পরিষ্কার করা, বিছানার চাদর ইত্যাদি বদলে দেওয়ার দায়িত্ব এদের। নিচতলায় লন্ড্রি আছে, পৃথক রান্নাঘর আছে।

জিনিসপত্র ঘরে রেখে টোনি আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল। সে খেতে ভালোবাসে। ফলে শুধু সে-রাতে নয়, প্রায়ই আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ অথবা ডিনার খেতাম।

পরদিন টোনি এসে আমাকে তার বিভাগে নিয়ে গেল। একটা জয়েনিং রিপোর্ট লিখলাম–জুড়ি নামে সেক্রেটারি সেটা টাইপ করে দিলো। তারপর অনেকগুলো কাগজে সই নিলো আমার। যখন উঠে বেরিয়ে আসছি, সে বললো, তোমার পি সি ফেলে যাচ্ছ।

জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের পি সি?

বললো, তোমার কম্পিউটার–ঘরে বসে কাজ করার জন্যে।

বললাম, আমি তো তার ব্যবহার জানি না।

এবারে টোনি হাল ধরলো, এটা বিভাগ থেকে তোমার নামে বরাদ্দ হয়েছে, ঘরে নিয়ে চলো। ব্যবহার জানো না তো শিখে নেবে। শিখতে দিন দুইয়ের বেশি লাগবে না।

টোনি আমাকে নিয়ে গেল আমার ঘরে টেলিফোন-সংযোগের ব্যবস্থা করতে। তারপর সুপারমার্কেটে। সে খাবারদাবার বাছাই করছে দেখে আমি বললাম, টোনি, আমি রাঁধতে পারবো না, বাইরে খাবো।

সে বললো, অর্ধেক রান্নাকরা খাবার কিনে নাও, মাইক্রোআভেনে গরম করে নিলেই হবে। অনর্থক বাইরে খেয়ে পয়সা নষ্ট করবে কেন? ব্রেকফাস্টটা অনায়াসে ঘরে সারতে পারবে, মাঝে মাঝে দুপুর বা রাতের খাবারটাও।

নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির তিনটে ক্যাম্পাস–রলে, ডিউক ও চ্যাপেল হিল। একটার সঙ্গে যুক্ত হলে বাকি দুটোর সকল সুবিধে ভোগ করা যায়। একটা থেকে অন্যটায় যাবার বাসও আছে। রলেতে ইউনিভার্সিটির বাস সারা ক্যাম্পাস ঘোরে। উঠে পড়লেই হলো–টিকিট লাগে না। পরে বাস ড্রাইভারদের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে গেলে তারা অনেক সময়ে নিময়ভঙ্গ করে আমার সুবিধামতো জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে।

রলেতে পৌঁছোবার পরের দিন সন্ধ্যায় ইতিহাস বিভাগের ডেভিড গিলমার্টিন এসে আমাকে নিয়ে গেল ডিনারে। ডেভিড মজার লোক। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে এক পাত্র পান করবে কি না, তার উত্তর হবে, যদি তুমি জোর করো-ইফ ইউ টুইস্ট মাই আর্ম। জোর করতে হতো না, একবার বলাই যথেষ্ট হতো।

প্রথম সপ্তাহান্তেই নিমন্ত্রণ কার্ল আর্নস্টের বাড়িতে। তিনি মস্ত বড়ো পণ্ডিত। টোনি ও তার স্ত্রীকে ডেকেছেন, সেই সঙ্গে আমাকেও। টোনি শহরের বাইরে থাকে, আর্নস্টরাও শহরের অন্য প্রান্তে। টোনির স্ত্রী জুলি বড় এক কোম্পানির একজিকিউটিভ–প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়। সে-ই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল।

রলের সামাজিক জীবনে আমাদের স্বদেশিদেরও ভূমিকা কম নয়। আমি পৌঁছোবার পরপরই টেলিফোন করে আমার বাসস্থানে এলো আশফাঁক ও মাহবুব। তারা আমাকে দিনে ক্যাম্পাসে দেখেছে। তারা যে সকল সময়ে সাহায্য করতে রাজি, সে কথা জানাতেই তাদের আসা। তারা সে কথা রেখেছিল। এছাড়া খুব উল্লেখযোগ্য ফারুক ও লোপার নাম। তারা দুজনেই প্রকৌশলী, বড়ো চাকরি করে। পরিচয় পাওয়ার পরে জানলাম, ফারুকের ভাইবোনেরা আমার অনেককালের চেনা। লোপা জানালো, শৈশবে সে একদিন তার খালু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাদের বাড়ি গিয়েছিল। এরপর তাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া আমার নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

রলে থেকে অদূরে এলিজাবেথ সিটিতে অধ্যাপনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পূর্বতন শিক্ষক ড. আবদুল লতিফ চৌধুরী, আর আমার পূর্বপরিচিত ড. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী। তারা একদিন রলেতে এলেন এবং একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে–খেয়েদেয়ে দিনটা কাটালেন। আশরাফুলের আত্মীয়েরা আছেন রলেতে, সেইসূত্রে পরিচিতদের গণ্ডি আরো বাড়লো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৫ মার্চে বাংলাদেশ সমিতি আয়োজন করলো অনুষ্ঠানের। অনিবার্যভাবে আমি সেখানে একজন বক্তা।

রলেতে আমার কাজ হালকা। এখানে একটা বক্তৃতা দিতে হবে মাত্র। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা দুই-তিন বক্তৃতা, গোটা দুই সম্মেলনে যোগদান। নিজের মতো পড়াশোনা করাই আসল। এখানে বক্তৃতার জন্যে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের প্রাথমিক পর্ব সম্পর্কে গবেষণায় লেগে গেলাম।

এপ্রিল মাসে আমার কর্মসূচি দীর্ঘ। প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ায় একটা বক্তৃতা–বাংলা সাহিত্যে নারী-বিষয়ে। সেখানকার বাংলা শিক্ষক ক্যারল সলোমন এর আয়োজক। তাছাড়া ক্যারল, টোনি ও আমি একটা সিম্পোজিয়ম করলাম একসঙ্গে। ক্যারলের কথা আগে জানতাম–লালনগীতির একনিষ্ঠ চর্চাকারী। এই প্রথম দেখা। সেইসঙ্গে পরিচয় হলো তার ছাত্রী সুফিয়া উদ্দীনের সঙ্গে। সুফিয়ার বাবা বাঙালি, মা পোর্টোরিকান, স্বামী মার্কিন ইহুদি। সে মূলত আরবি পড়ে। বাড়িতে সিলেটি উপভাষা শিখেছে, এখন ক্যারলের কাছে প্রমিত বাংলা শিখছে। আমার ভারী সুটকেস টানাটানির কাজ সে-ই করলো। তারপর এক দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়ালো–টোনি, ক্যারল, আমি আর তার স্বামী সেখানে অতিথি। ইউ অফ পেনে দেখা হলো দীনার সঙ্গে–অধ্যাপক হাফিজ জি এ সিদ্দিকী ও নাজমা সিদ্দিকীর কন্যা। অতএব তার ও ডেভিডের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলো ক্যারল, টোনি ও আমাকে।

ফিলাডেলফিয়া থেকে নেওয়ার্কে গেলাম একটা ছোটো প্লেনে। নজন বা দশজন যাত্রীর আসন, একজন ক্যাপ্টেন, একজন ক্রু। খুব নিচে দিয়ে যায় আর হরদম লাফায়। বেশ অস্বস্তিকর যাত্রা। নেওয়ার্কে নেমে এক যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিমান কি সবসময়ে এমনই করে? তিনি বললেন, বলতে পারি না। এই আমার প্রথম যাত্রা, আশা করি, এই শেষ যাত্রাও।

নেওয়ার্কে এলাম আমার ছোটো শ্যালিকা সিমীনের পরিবারের সঙ্গে নিউ জার্সিতে দুদিন কাটাতে। মোবারক আমাকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে পরে নিউ ইয়র্কে পৌঁছে দিলো। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা-ইউ অফ পেনে যেটা দিয়েছিলাম, সেটারই পুনরাবৃত্তি। আগের সন্ধ্যায় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু খাওয়ালো, পরের সন্ধ্যায় আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সাবিয়া। মুহিত।

এবারে এলাম ওয়াশিংটন ডি সিতে। সেখানে অ্যাসোসিয়েশন অফ এশিয়ান স্টাডিজের বার্ষিক সম্মেলন। প্রথমে উঠলাম ইকবাল বাহার চৌধুরীর বাড়িতে, পরে নির্ধারিত হোটেলে–বাড়িতে খাইয়ে সেখানে পৌঁছে দিলেন ওয়ালিউল্লাহ। ও মাসুমা ফাহমী। সম্মেলন চললো দুদিন ধরে। এখানে দেখা হলো ক্যারলের ইতিহাসবিদ স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে। গেইল মিনোর সঙ্গে দেখা হলো অনেকদিন পরে-সম্মেলন ফাঁকি দিয়ে বাইরে বসে গল্প করে আমরা বিকেলটা পার করলাম। আর দেখা হলো কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক, আমার বন্ধু, শেলি ফেল্ডম্যানের সঙ্গে। সম্মেলনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় গেলাম ভাইপো চন্দনের বাড়িতে।

ওয়াশিংটনে দেখা আবদুন নূরের সঙ্গে। কথাসাহিত্যিক এবং বিশ্বব্যাংকের গ্রন্থাগারিক। তাঁকে বললাম, রাজ্জাক সাহেবের জন্যে বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রকাশনা কিনতে চাই। তিনি বললেন, আমাকে লিস্ট পাঠিয়ে দেবেন–আমি অনেক ডিসকাউন্টে কিনতে পারবো।’ শুধু তাই নয়, বইগুলো তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার ভারও নিলেন। লন্ডনে এবং রলেতে সারের জন্যে যেসব বই কিনেছিলাম, সেগুলোও তাকে পাঠিয়ে দিলাম ডাকযোগে। সবসুদ্ধ তিনি পাঠালেন ঢাকা অফিসে। সেখানে সাহানা ইকবালের কাছ থেকে পরে সেগুলো বুঝে পেয়েছিলাম। আরো পরে জেনেছিলাম, এই সাহানা হলো লেখক ও শিল্পী সৈয়দ ইকবালের স্ত্রী।

এপ্রিল মাসের ২০-২২শে ডিউকে একটা বড়ো সেমিনারের আয়োজন হলো তিন দিন ধরে। সেখানে আমাকে বক্তৃতাটা দিতে হবে। নিজে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারছি না–টোনিকে ধরে জুডিকে দিয়ে বক্তৃতা টাইপ করালাম। সেমিনারের আগেই টোনির জ্বর–সে যেতে পারছে না। ডেভিড নিয়ে গেল আমাকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বক্তৃতা শেষ করতে পারলাম না। বাড়তি সময়ে বক্তৃতা দ্রুত পড়ে গেলাম–কেউ বুঝতে পারলো কি না সন্দেহ।

মাসের শেষে শিকাগোয়। সেখানে বেঙ্গল স্টাডিজ কনফারেন্স। জিল্লুর রহমান খান তার আয়োজক। রশীদুজ্জামানও এসেছে সেখানে। বঙ্গদেশ নিয়ে কাজ করে, এমন বিদ্বান অনেকেই এসেছেন। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে মুখেই কিছু বললাম। অনেক পরে এক মার্কিন বিদ্বজ্জন আমাকে বলেছিল, আমার সেই বক্তৃতা থেকেই সে তার গবেষণার বিষয়ের সন্ধান পায়।

শিকাগোর খানিকটা দূরে বোলিংব্রুকে আমার বন্ধু আবদুল আলীর ভ্রাতুস্পুত্র মিল্টন থাকে সপরিবারে। সপরিবারে বললে ঠিক হয় না, সগোত্রে বললেই যথার্থ হয়। তার স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও বাপ-মা আছেন সেখানে। অবকাশে অনুজ টিটো গেছে তার কাছে। আমার বন্ধু মোহাম্মদ আলী ও বুড়ীও সেখানে গেছে। বেড়াতে। অতএব আমাকে যেতেই হবে। ইন্টারন্যাশনাল হাউজ থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন আলা ভাই ও মিল্টন। এর মধ্যে মিল্টনের চাচাতো ভাই মাইকেল তার মার্কিন স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে হাজির। মিল্টনের বাড়িটা বড়ো–তার মধ্যেও এতজনের জায়গা কী করে হলো, সে এক বিস্ময়! তার স্ত্রী নিলির অসীম ধৈর্য আর বানু ভাবির স্বাভাবিক নৈপুণ্য!

শিকাগো থেকে ফিরে আমার প্রকৃতপক্ষে ছুটি। দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া। গ্রীষ্মবকাশ শুরু হয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। টোনি তার ছাত্রছাত্রীদের খাওয়াবার আয়োজন করেছে বাড়িতে। সেইসঙ্গে আমাকেও ডেকেছে। পার্টি শেষ না হতেই জুলি বিদায় নিলো। টোনি আমাকে বললো, প্রিয়া কামদার নামে। একটি ভারতীয় মেয়ে তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেবে।

গাড়িতে আসতে আসতেই প্রিয়ার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। নামার সময়ে আমি বললাম, চলো, একদিন ডিনার খাই একসঙ্গে। সে বললো, যখনই তোমার সুবিধে হয়।

এক সন্ধ্যায় সে এলো আমাকে নিতে। তারপর তার পছন্দসই একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম বেশ খানিকটা দূরে। আমাকে আবার যখন সে পৌঁছোতে এলো, তখন সে ঘরে আসবে কি না জিজ্ঞেস করতেই সে নেমে এলো এবং দরজা খুলতেই সটান আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বিছানার ধারে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম এবং দুজনে গল্প করতে থাকলাম। তার মধ্যে। বেশির ভাগই তার নিজের এবং তার পরিবারের কথা।

খানিক বাদে সে উঠে পড়ল এবং বিদায় জানিয়ে চলে গেল। বছরখানেক পরে তার বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। তাতে দেওয়া বোম্বাইয়ের ঠিকানায় তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম, কিন্তু তার প্রাপ্তিস্বীকার পাইনি।

পরে টোনির কাছে তার খোঁজ করেছিলাম। টোনি তাকে ভালো মনে করতে পারলো না। না, সে তার কোনো খবর জানে না, তার বিয়ের কথাও জানে না।

রলে ছাড়ার আগে আমারও কর্তব্য সবাইকে আপ্যায়ন করা। কোথায় করবো? অ্যাভেন্ট ফেরি কমপ্লেসে তেমন কোনো জায়গা নেই। টোনি বললো, আমার বাড়িতেই পার্টিটা দাও। তুমি বাজার করে দিও, আমি রাঁধবো। বললাম, জুলির ওপর অত্যাচার হবে। টোনি বললো, তার সয়ে গেছে।

তাই হলো। টোনি খুব ভালো বিফস্টেক তৈরি করেছিল। জুলিও ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেছিল। সবাই খুব উপভোগ করেছিল।

জুডি আসতে পারেনি। টোনির সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়ে কয়েকটা গিফ্ট ভাউচার দিয়ে এলাম।

আসার আগে আমার বাঁধাবাঁধিতে অনেকে সাহায্য করলো–তার মধ্যে আশফাঁক ও মাহবুব ছিল। ওদেরকে কিছু খাদ্য ও অন্য সামগ্রী দিয়ে এলাম। সবশেষে ওস্তাদের মারের মতো হাত লাগালে টোনি। তারপর বিমানবন্দরে তুলে দিলো আমাকে। আবার লন্ডনে একদিন থেমে ঢাকায় ফিরলাম।

জুলির সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। আমি চলে আসার অল্পকাল পরে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।

৩৮.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে আমরা যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপন করেছিলাম, তা বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বিশেষ করে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের নির্বাচিত অংশের পাঠ, অভিনয় ও গান সকলে খুব উপভোগ করেছিলেন। বেতারে-টেলিভিশনে তখনই এর খানিকটা স্বতন্ত্রভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে নানা বিদ্যায়তনে এবং সাধারণ মঞ্চে হাজার বছরের বাংলা কবিতা বা গানের অনুষ্ঠান করার একটা ঝোঁক দেখা দিয়েছিল।

১৯৬৩ সালে নরেন বিশ্বাস ছিল আমাদের ছাত্র এবং পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানের এক সফল অংশগ্রহণকারী। পুরো আয়োজনটা তার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সেও নানা সময়ে ওই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আশির দশকের শেষে নরেন স্থির করে যে, হাজার বছরের বাংলা কবিতা ও গান, গদ্য ও নাটকের অডিও ক্যাসেটের একটা সিরিজ প্রকাশ করবে ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নাম দিয়ে। এই পরিকল্পনায় সে আমাকে যুক্ত করে উপদেষ্টা হিসেবে। ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নামটি আমার পছন্দ ছিল না, কিন্তু ওই নামের প্রতি নরেনের দুর্বলতা ছিল এবং সে নামটি প্রচারও করে ফেলেছিল, সুতরাং তা মেনে নিতে হয়। আমার কাজ ছিল রচনা নির্বাচন করা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুখবন্ধস্বরূপ কিছু বলা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নরেনের নির্বন্ধাতিশয্যে পাঠ করা। প্রথমে গোলাম মোর্শেদ ও আজিজুল হক চৌধুরী মানিক আর্থিক সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন, পরে এই কাজের অংশীদার হন ড. নারায়ণ বিশ্বাস ও ড. আখতার বানু। নরেন নির্দেশনা দেয়, আশরাফুল আলম আগাগোড়া গ্রন্থনার কাজটি করেন। দেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও শিক্ষকেরা এতে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত বোধহয় ১৪টি ক্যাসেট প্রকাশ পেয়েছিল।

১৯৯৩ সালে কলকাতায় গৌরকিশোর ঘোষ একদিন আমার কাছে। ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ সম্বন্ধে জানতে চান এবং এর কয়েকটি সেট কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তখন পর্যন্ত বোধহয় আটটি ক্যাসেট বের হয়েছিল। পরেরবার আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন তাঁকে কয়েকটি সেট উপহারস্বরূপ দিয়ে আসি। অচিরেই বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পাই যে, আমাদের এই প্রয়াস আনন্দ পুরস্কার লাভ করতে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী আনন্দ পুরস্কার প্রবর্তন করেন ১৯৫৮ সালে। তখন আনন্দবাজার পত্রিকার লোকান্তরিত সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকার এবং এই গোষ্ঠীর পত্রিকাসমূহের সূচনাকারী ও বাংলায় লাইনো হরফের প্রবর্তক সুরেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিযুক্ত দুটি পুরস্কার প্রদানের উদযোগ নেওয়া হয়। পুরস্কার-দুটির প্রথম প্রাপক ছিলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ও সমরেশ বসু। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে মননশীল সাহিত্যের জন্যেও এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারের উদ্যোক্তা আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোককুমার সরকারের মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে তাঁর স্মৃতিযুক্ত তৃতীয় একটি আনন্দ পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা হয়। এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক ছিলেন সুকুমার সেন, সাগরময় ঘোষ ও বিমল মিত্র। পরে উইলিয়ম রাদিচে, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অমিতাভ ঘোষ ও ক্লিনটন বি সিলি এই পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে নরেন ও আমাকে যুক্তভাবে অশোককুমার-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমিকে আনন্দ পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার গ্রহণ সংগত হবে না বিবেচনা করে একাডেমি সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সে-বছর তসলিমা নাসরিন (সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার পায়। সেই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সাহিত্যিক আনন্দ পুরস্কার পেল। ১৯৯৪ সালে প্রবন্ধসমগ্র গ্রন্থের জন্যে অন্নদাশঙ্কর রায় পান (সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার, আকাশ আসবে নেমে কাব্যের জন্যে শামসুর রাহমান পান (প্রফুল্লকুমার-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার, সেই সঙ্গে ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকারের জন্যে আমরা দুজনও পুরস্কৃত হই।

পুরস্কার নিতে শামসুর রাহমান, নরেন ও আমি সস্ত্রীক কলকাতায় যাই। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল চৌরঙ্গীর পিয়ারলেস ইনে। শামসুর রাহমানের কাছে অগুনতি অনুরাগী ও সাহিত্যিকের আনাগোনা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেহিসেবি পান করে শামসুর রাহমানকে বিব্রত করেছিলেন, কেননা বিলটা তাঁকেই সই করতে হয়েছিল। নরেনের এক ভাই কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা, আরো কিছু আত্মীয়স্বজন সেখানে আছেন। সুতরাং তার কাছেও ভিড় কম হয়নি।

পুরস্কার-প্রদান অনুষ্ঠানটিকে উদযোক্তারা অভিহিত করেন সাহিত্য-সমাবেশ বলে। এটি গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত হয়। সেবারের অনুষ্ঠানটির তারিখ ছিল ৩০ এপ্রিল ১৯৯৪। প্রধান অতিথি শিবনারায়ণ রায়ের হাত থেকে আমরা পুরস্কার গ্রহণ করি। শংসাবচন পাঠ করেন সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে পরিবেশিত ‘শ্রুতি সংস্কৃতির উপদেশনার জন্য আমাকে এবং সমগ্র প্রকল্পের নির্বাহী নায়ক’ হিসেবে বাংলাভাষী মানুষের হাতে এমন একটি ঐতিহ্যময়, অথচ আধুনিক সাংস্কৃতিক উপহার তুলে দেওয়ার জন্য নরেনকে সম্মানিত করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

অপরিসীম আনন্দের মধ্যেও আমার জন্যে দুঃখের বিষয় ছিল যে, অসুস্থতার কারণে গৌরকিশোর ঘোষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি। বস্তুতপক্ষে সেই যে তিনি অসুস্থ হলেন, ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর সুস্থ হননি। তবে তারই মতো আরেকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমি পেয়ে যাই। তিনি নিখিল সরকার। আমার মনে হয়, নিখিল সরকারের দৌত্যেই বোধহয় ১৯৯৬ থেকে আমি আনন্দ পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর একজন সদস্য নির্বাচিত হই।

বিচারকমণ্ডলীর প্রথম সভায় আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসটি বিবেচনার জন্যে প্রস্তাব করি এবং সর্বসম্মতিক্রমে বইটিকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইলিয়াস তখন কলকাতার এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। সে ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং দু-একদিনের মধ্যেই অস্ত্রোপচার করে তার একটি পা কেটে ফেলতে হবে। বিচারকমণ্ডলীর সভা থেকে বেরিয়েই আমি ক্লিনিকে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি। পুরস্কারগ্রহণের বিষয়ে ইলিয়াস দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। পুরস্কারলাভের সংবাদে সে প্রীত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর পুরস্কারগ্রহণ তার বামপন্থী ভাবমূর্তির সঙ্গে আদৌ সংগতিপূর্ণ হবে কি না, এ-বিষয়ে সে চিন্তিত ছিল। আমি বলি, এই পুরস্কারের সঙ্গে কোনো রাজনীতি জড়িত নেই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিমনস্ক সাহিত্যিকও এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, তাছাড়া তার চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহে পুরস্কারের অর্থ কাজে আসবে, এটাও সে বিবেচনা করতে পারে। ইলিয়াস শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়। প্রশ্নের মুখে পরে সে কোথাও বলেও ছিল যে, আমার অনুরোধেই সে এটি গ্রহণ করে। এই উত্তর পুরস্কারদাতাদের জন্যে আনন্দদায়ক ছিল না। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার তৃণমূল পত্রিকায় ইলিয়াসের ডায়েরির যে অংশ ছাপা হয়, তাতেও এমন কথা আছে। পুরস্কারলাভের পর ইলিয়াস এক বছরও বাঁচেনি।

‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে’র আরো কয়েকটি ক্যাসেট প্রকাশ করে নরেন। বিশ্বাসেরও মৃত্যু হয় ১৯৯৮ সালে। তার মৃত্যুকালে নাটকের দুটি ক্যাসেট প্রক্রিয়াধীন ছিল–সে দুটি প্রকাশ করা যায়নি। অবশ্য তার আগে থেকেই আমি তাকে বলছিলাম যে, আমাদের প্রকল্পের পূর্ণতি টানা দরকার, কেননা ভালো কিছুরও শেষ আছে। কাকতালীয়ভাবে নিখিল সরকারও তা মনে করেছিলেন।

পরে আনন্দ পুরস্কার তিনটি মিলে একটি হয়ে যায়। তার প্রথম প্রাপক ছিল তসলিমা নাসরিন। সেটি তার পক্ষে ছিল দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার পাওয়া।

৩৯.

ঠাটারিবাজারে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে ১৯৮০ সালে আমার ভাগে যে-টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে রামপুরায় জমি কিনে একটা ছোটো বাড়ি বানিয়ে দেন বড়ো দুলাভাই। সেখানে আমার তিন বোন এবং মামাতো ভাই ও ফুফাতো ভাই পরস্পরসংলগ্ন জমি কিনেছিলেন। ফুফাতো ভাই তাঁর অংশ বিক্রি করতে চাওয়ায় সেটি আমার জন্যে কেনা হয়। ওই বাড়িতে আমার সত্য ও সৎ বোনেরা এবং মায়ের পক্ষের ছেলে বাস করতো। পরে আমার এই ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেলে আম্মা তার ছেলের সঙ্গে থাকবেন বলে স্থির হয়। বড়োবু বাড়িটা বিক্রি করার আয়োজন করে যাতে আমি অন্যত্র নিজের মতো মাথা গোঁজার ঠাই। করে নিতে পারি। আমার মামাতো ভাই তার জমি বিক্রি করে দেন। একই জনের কাছে বড়োবুর জমি ও আমার বাড়ি বিক্রি করা হয়।

এই অবস্থায় আমার ভাগ্নে তৌহিদ একদিন বেবীকে নিয়ে যায় বনানীতে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ফ্ল্যাট দেখাতে। বেবী ফ্ল্যাটটি ভালো বলায় তৌহিদ নিজে থেকে একটি চেক লিখে ফ্ল্যাটটি বেবীর নামে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। তখনো রামপুরার বাড়ি বিক্রি হয়নি। ফ্ল্যাটের কিস্তি দিতে আমাকে ধার করতে হয়। আমাকে প্রথম ধার দিয়েছিল আমার মামাতো বোন হালিমা, তারপর ভায়রা হাসান। তারপর অন্য বন্ধুবান্ধব। পরে সকলের টাকা পরিশোধ করেছিলাম একজনেরটা ছাড়া। সে টাকা ফেরত নেয়নি।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রূপসা টাওয়ারের ফ্ল্যাটের দখল পাওয়া যায়। ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করে আমি নর্থ ক্যারোলাইনা চলে যাই।

নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে আমার ফিরে আসার পর ছোটোমেয়ে শুচির বিয়ের তোড়জোড় লেগে গেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই বাস করতেন আমার শিক্ষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবার। এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান তাসনিম হায়দার চৌধুরী ওরফে সুমন কালক্রমে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করে। তার সঙ্গে শুচির মেলামেশার একটা সহজ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ভাবির অর্থাৎ সুমনের মায়ের মৃত্যুর পরে ও-বাড়িতে শুচির যাতায়াত বেড়ে যায়। শুচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিল লোকপ্রশাসনে প্রথমে অনার্স ও পরে এম এ ক্লাসে। একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানে শহীদ পরিবারের থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সুমনেরা দু ভাই গুলশানে তাদের পৈতৃক বাড়িতে উঠে আসে। আমার পিতৃবন্ধু সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন ভাবির মামা অর্থাৎ সুমনের নানা। তাঁর স্ত্রী বেগম আফিফা হক একদিন ফোন করে আমার কাছে জানতে চান শুচির বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবছি। কি না। আমি তাকে বলি, শুচির এম এ পরীক্ষাটা হয়ে গেলে এ-বিষয়ে ভাবা যাবে। যথাসময়ে তিনি আবার আমাকে ফোন করেন এবং তাঁর বড়ো ছেলে সৈয়দ মঈনুল হককে পাঠান সুমনের সঙ্গে শুচির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মঈনু আমার অনুজপ্রতিম। তার সঙ্গে বিয়ের আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলার জন্যে আমার চতুর্থ ভায়রা ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ হাসানকে অনুরোধ করে আমি ঘর থেকে উঠে যেতে চাই। মঈনু বাধা দিয়ে বলে, আপনার উঠে যাওয়ার দরকার নেই, কেননা আম্মা বলেছেন, আপনার মেয়ে, আপনি যে-শর্ত চাইবেন, সেই শর্তেই তার বিয়ে হবে। আমি এমন উদারতা আর কখনো দেখিনি।

১৯৯৫ সালের ২৫ আগস্ট শুচির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। রুচির মতো শুচির বিয়ের আসরও নির্ধারিত হয় নিউ ইস্কাটন রোডের সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে। এ-বিয়েতেও চট্টগ্রাম থেকে আমার অনেক সহকর্মী এবং এ এফ রহমান হলের চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন কর্মী যোগ দিতে এসেছিলেন। এবারে মোহাম্মদ আলী না-থাকায় রান্নাবান্না তত্ত্বাবধানের ভার পড়েছিল আমার ভায়রা হাসানের ওপর। আয়োজন ভালোই হয়েছিল, তবে যতজন অতিথি ছিলেন, ততজনের খাওয়ার জন্যে মাশুল দেওয়া হয়নি। ফলে মাশুল ও জরিমানা ধার্য হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জরিমানা দিতে হয়নি, অতিরিক্ত মাশুল দিয়েই পার পেয়েছিলাম। সেই সময়ে আমার হাত একেবারে খালি। এই টাকাটা আমাকে ধার করতে হয়েছিল ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকে। তিনি অবশ্য পরে টাকা ফেরত নেননি আমার অনুরোধ সত্ত্বেও।

ছেলেমেয়ে নিয়ে রুচি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরত এসেছিল ১৯৯৪ সালেই। রায়হান রয়ে গিয়েছিল, তবে শুচির বিয়ের ঠিক আগে আগেই সেও চলে আসে। উপস্থিতির দিক থেকে তাই পারিবারিকভাবে কোনো অপূর্ণতা থাকেনি।

৪০.

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছে। একাদিক্রমে ৩৬ ঘণ্টা কী তারও বেশি সময় ধরে হরতাল চলছে–জনজীবন বিপর্যস্ত। সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারি মাসে। জানুয়ারি মাসেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা। মাঠে রয়েছেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী, গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলের কিছু প্রার্থী, কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই বিক্ষোভ হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত ঘটছে। এরই মধ্যে, ১ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে খালেদা জিয়া বাংলা একাডেমিতে আসবেন বলে ঘোষিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকায়। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদে ছাত্রেরা প্রবল বিক্ষোভ করে। এতে সরকারের রোষ ধাবিত হয় মূলত জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের প্রতি। ওই হলে প্রবেশ করে পুলিশ দরজা-জানালা-আসবাবপত্র ভাঙে, ছাত্রদের প্রহার করে, তাদের বইখাতা নষ্ট করে, অনেককে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই জগন্নাথ হলের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে যাই। যা দেখি এবং ছাত্রদের মুখ থেকে যা শুনি তাতে আমরা প্রত্যেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসি। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিই। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে। মিছিল করে আমরা বাংলা একাডেমির দিকে যেতে চাই ১ ফেব্রুয়ারিতে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছোতেই পুলিশ আমাদের গতিরোধ করে। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই রাস্তার ওপরে বসে পড়ি। তাতে কোনো কাজ হয় না। আমরা বসে, পুলিশ দাঁড়িয়ে–এমন সহাবস্থান। অনেকক্ষণ চলে। শেষ পর্যন্ত আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে কলাভবনে ফিরে আসি। পরে আমরা নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করি বইমেলা-উপলক্ষে আয়োজিত সাহিত্যসভা বর্জন করে।

সরকার ও বিরোধী দলের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে বিদেশি কূটনীতিকেরা কিছু চেষ্টা করেন। কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রয়াস নেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদিও প্রকাশ্যে বলে যে এ-বিরোধের মীমাংসা করার দায়িত্ব তাদের নয়, তবু ভেতরে-ভেতরে তারাও চেষ্টা করে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদকে নিয়ে গঠিত পাঁচ-সদস্যের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে কয়েকদফা দৌড়াদৌড়ি করে। কিছুতেই কোনো ফল হয় না।

১৫ ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। সরকার গঠনের উদ্যোগ শুরু হলো। বিরোধী দল দিলো অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। জনসাধারণ তাতেই সাড়া দিলো। সচিবালয়েও বিক্ষোভ, মিছিল। সচিবালয়ের সামনে তোপখানা রোডে জনতার মঞ্চ নির্মিত হলো। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানালেন। কর্মকর্তা সমিতির এক প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও সরকার সম্পর্কে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, মন্ত্রীরাই আর সচিবালয়ে যেতে। পারেন না।

এই সময়ে বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো এক সাংবাদিক আমার মন্তব্য চান। আমি বলি, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়, তবে সংকট-উত্তরণের একটা সুযোগও এতে দেখা দিয়েছে। ষষ্ঠ সংসদ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ করে, তাহলে সেই অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায় এবং তার অধীনে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। সংবাদপত্রে আমার বক্তব্য তেমন গুরুত্বের সঙ্গে মুদ্রিত হয়নি, কিন্তু আতাউস সামাদ খুব গুরুত্বসহকারে তা। বিবিসিতে পাঠান এবং বিবিসির বাংলা সংবাদেও তা খুব প্রাধান্য লাভ করে। কেউ কেউ অবশ্য এতে খুব ক্ষুব্ধ হন। আওয়ামী লীগ নেতা সালাহউদ্দীন ইউসুফ পরে আমাকে বলেছিলেন, এভাবে ষষ্ঠ সংসদকে বৈধতা দান করায় আমার প্রতি তিনি এতই ক্রুদ্ধ হন যে, রিকশাভাড়া করে আমার বাড়িতে এসে তিনি ঝগড়া করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফোন করে তিনি যখন জানতে পারেন যে, আমি দেশে নেই, তখন আর ঝগড়ার সুযোগটা তিনি নিতে পারেননি। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল করবেন এবং ষষ্ঠ সংসদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবেন। সালাহউদ্দীন ইউসুফ পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলে আমি তাকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলি যে, এ-বিষয়ে তো তারা কিছুই করেননি। তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।

আমাকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে দৈনিক আজকের কাগজ। সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমদ স্বনামে কলাম লিখে ষষ্ঠ সংসদকে বৈধতাদানে আমার কূটকৌশলের নিন্দা জ্ঞাপন করেন। কলামের প্রথমে আমাকে উল্লেখ করা হয় ড. আনিসুজ্জামান বলে, তারপরে আনিসুজ্জামান এবং শেষকালে তা আনিসে নেমে আসে।

আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করে। তাঁর পরামর্শ-অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং ষষ্ঠ সংসদে পাশ করা আইন (সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী)-অনুযায়ী। দেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে আহ্বান জানান।

তার একদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ভোরের কাগজের সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে বলে যে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান আমাকে খুঁজছেন–আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমার টেলিফোন বিকল থাকায় বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে অভিনন্দনও জানাতে পারিনি। আমি সেদিনই তার মিন্টো রোডের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করি। বস্তুত আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আমি এড়িয়ে চলছিলাম। এবারে তাঁর কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘তোমরা সব এমন মামলাবাজ হয়েছ। যে আমি অসুবিধায় পড়ে গেছি। আমি বললাম, মামলা তো আমি করিনি, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

কারা উপদেষ্টা হচ্ছেন, এ-নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কোনো আলাপ হয়নি। বাজারে হবু উপদেষ্টা হিসেবে অনেকের নাম ছড়িয়েছিল। তার মধ্যে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের নামও ছিল। এক সন্ধ্যায় ইশতিয়াকের বাড়িতে তিনি আর আমি টেলিভিশন সেটের সামনে বসে গল্প করে এবং খবর শুনে কাটালাম। তাতে কিছু জানা গেল না। পরদিন তাঁর এবং আরো নজন উপদেষ্টার শপথ গ্রহণের সচিত্র সংবাদ দেখলাম টেলিভিশনে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কখনো বিচারপতির আহ্বানে কখনো নিজে থেকে তাঁর বাড়িতে গেছি। একবার দল বেঁধে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম–জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী কবির ও আমি। নানা বিষয়ে কথা বলেছি। নিজের জ্ঞানমতো সীমা মেনে চলেছি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তো অতি বিবেচক মানুষ। এরপরও কোনো একটি দৈনিক পত্রিকায় বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে কটাক্ষ করে সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়েছিল, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আনিসুজ্জামান যাঁর বন্ধু, তাঁর কাছ থেকে আর অধিক কী আশা করা যেতে পারে!

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সবচেয়ে উদ্‌বেগের ঘটনাটি ঘটে মে মাসের ২০ তারিখে। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করলে নাসিম তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ঢাকার বাইরের তিন সেনা-অধিনায়ক তার পক্ষে সৈন্য নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আরেক সেনা-অধিনায়ক ঢাকার উপকণ্ঠে এসব সেনাদলের গতিরোধ করার প্রস্তুতি নেন। এই শেষোক্ত সেনা-অধিনায়কের সৈন্যেরা ঢাকায় বেতার ও টেলিভিশন ভবন ঘিরে রাখে এবং কোথাও কোথাও দায়িত্বরত অসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। নাসিম ছাড়া আরও দুজন সেনা-কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সেনাবাহিনীতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সেনাবাহিনীকে লক্ষ। করে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, তাঁরা মুখোমুখি কোনো রেষারেষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন না, যেন বড় দুঃখী এই বাংলাদেশের মাটি ভাইয়ের রক্তে কলঙ্কিত না হয়।’

সারাদিনের উত্তেজিত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। সন্ধ্যাবেলায় ঢাকা ক্লাবে গিয়ে এ-সম্পর্কে শুনতে পাই। সেখানেই টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শুনি। বিপদের আশঙ্কায় মন ভরে ওঠে। ক্লাব থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফোনে খবরাখবর বিনিময় করি। দু একদিনের মধ্যেই অবশ্য পরিস্থিতি শান্ত হয়ে থাকে। জেনারেল নাসিম কম্যান্ড ছেড়ে দিতে সম্মত হন। তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। জেনারেল মাহবুবুর রহমান নতুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এই ঘটনা নিয়ে দশগুণ বলার দায়িত্ব নেয় যায়যায়দিন। পত্রিকাটি নানারকম তথ্য প্রকাশ করে–সবই তাদের আবিষ্কার। এর আগে পত্রিকাটি প্রধান উপদেষ্টার ডায়েরির অংশ বলে কিছু একটা মুদ্রণ করেছিল। তাতে কী ছিল, তা আমার জানা নেই, তবে সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে, ওটি প্রধান উপদেষ্টার ডায়েরি নয়। এবারে তারা কোনো কোনো সামরিক কর্মকর্তার টেলিফোন সংলাপ এবং আরও কিছু কিছু দলিল প্রকাশ করে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলো। যে, সমস্ত ব্যাপারটি ছিল আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের ফল–সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। পত্রিকায় এসব তথ্যপ্রকাশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, তবে পরে এর সত্যতায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়। যাহোক, পরবর্তীকালে গৃহবন্দিদশা থেকে নাসিমকে মুক্তি দেওয়া হয়, সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তা মুক্ত হন। অবশ্য এসবই ঘটে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে।

১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই সংসদ ষষ্ঠ না সপ্তম, তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না, আগের সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করলেন না, তাদের তৈরি আইন মেনে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না। আমি ভোট দিয়ে চলে যাই কুমিল্লায়–পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর নিভৃতে নিজের কাজ করতে। সেখানে বসেই টেলিভিশনে নির্বাচনের ফলাফল জানতে পারি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কোথাও কোথাও অনিয়ম হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, বিএনপি দাবি করে যে প্রায় এক শ আসনে কারচুপি হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা বলেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

বিএনপি বোরকম প্রতিবাদের পরিকল্পনা করেছিল–পরবর্তীকালে আমাকে তা জানিয়েছিলেন একজন হাই কমিশনার ও একজন অ্যামবাসাডর। তাঁদের দুজনের ভাষ্য ছিল হুবহু এক। আমার কাছে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদার কোনো কারণ তাদের ছিল না। তারা বলেন যে, তাঁরা খবর পেয়েছিলেন, ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছেন। তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে, বিশেষ করে রাজধানীতে, ব্যাপক গোলযোগের সৃষ্টি হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি কোনো চরম ব্যবস্থা নিয়ে ফেলবেন। এই খবর জানার পরে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের অফিসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং কানাডার হাই কমিশনার মিলিত হন। এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বেগম জিয়াকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে ফোনে বেগম জিয়ার সঙ্গে ওই পাঁচজন দেখা করবেন বলে সময় চাওয়া হয়, কিন্তু তাদের বলা হয় যে, তিনি ব্যস্ত আছেন, পরদিন রাতে ছাড়া দেখা করতে পারবেন না। পরদিন বিকেলেই ছিল পরিকল্পিত সংবাদ-সম্মেলনের সময়। উপায়ান্তরবিহীন হয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান যে, তিনি তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি জরুরি বার্তা বেগম জিয়াকে পৌঁছাতে চান এবং তাঁর সঙ্গে দুজন রাষ্ট্রদূত ও দুজন হাই কমিশনার থাকবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে ওঁরা পাঁচজন খালেদা জিয়ার সামনে উপস্থিত হলে তিনি বিরক্ত হয়ে বাংলায় বলেন, এরা কেন এসেছে? এরা কিছু জানে না, বোঝে না, শুধু শুধু মাতব্বরি করতে চায়। বেগম জিয়ার দোভাষী ইংরেজিতে বলেন, আপনারা আসায় ম্যাডাম অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং তিনি আপনাদের আন্তরিক স্বাগত জানাচ্ছেন। জাপানি রাষ্ট্রদূত বাংলা জানতেন, ফরাসি রাষ্ট্রদূত জানতেন জাপানি। ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে জাপানি রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার মন্তব্য তখনই জাপানিতে অনুবাদ করে শোনান। অনেকক্ষণ ধরে এই পাঁচজন কূটনীতিক বেগম জিয়াকে নির্বাচনের ফলাফল

মেনে নিতে অনুরোধ করেন, নইলে বাংলাদেশ নতুন করে সংকটে পড়বে বলেও তাঁরা সতর্ক করে দেন। বেগম জিয়া তাদের কথায় আনুষ্ঠানিক সম্মতি না জানালেও একসময়ে তারা উপলব্ধি করেন যে, তিনি নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করবেন না। তারা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসেন।

৪১.

বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুন মাসের শেষে–সম্ভবত তাদের শেষ কার্যদিবসে–জাহানারা ইমাম ও অপর ২৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। সংবাদপত্রে পড়ার আগে এ বিষয়ে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। ফৌজদারি অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলা যে কী দায়, ততদিনে তা বেশ বুঝতে পেরেছি। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেছি, সকলে এটা ভালোভাবে নেয়নি; কেউ কেউ মনে করেছেন, এতে তার ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকাশ পেয়েছে, হয়তো বা দুইই।

আপাতত আমি আছি হৃষ্টচিত্তে। সেই প্রফুল্লতা নিয়েই আগস্টের গোড়ার দিকে জার্মানি রওনা হলাম। বার্লিনে আয়োজিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুদিনের আলোচনা-সভা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাচ্ছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহ, বিশ্বভারতীর দুই প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইসাধন বসু ও অম্লান দত্ত এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রদের শিরোমণি অমিতাভ চৌধুরী। ঢাকা থেকে নিমন্ত্রিত সজীদা খাতুন ও আমি। যাত্রাপথ সরল নয়। আমাদের দুজনকে যেতে হবে ঢাকা থেকে কলকাতা, তারপর বাকি চারজনের সঙ্গে সেখান থেকে এরোফ্লোতে দিল্লি ও মস্কো হয়ে বার্লিন। এরোফ্লোতের কলকাতা-দিল্লি ফ্লাইট। বেশ বাজে। উড়োজাহাজে কিছুই পাওয়া যায় না, সৌজন্যও নয়। দিল্লি বিমানবন্দরে নিজের পয়সায় তৃষ্ণা নিবারণ করা গেল। দিল্লি-মস্কো-বার্লিন ফ্লাইট বরঞ্চ সহনীয়।

বার্লিনে মামুন নামে এক বাংলাদেশি তরুণের বাড়িতে সন্জীদা খাতুন ও আমার থাকার ব্যবস্থা। তার স্ত্রী বা বান্ধবী এলিজাবেথ জার্মান। ভদ্রমহিলা কিঞ্চিৎ বয়স্কা, পূর্ববিবাহের সূত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়গামী এক কন্যা আছে–মেয়েটির ঝোঁক যন্ত্রসংগীতে, পরে তার সঙ্গেও একদিন দেখা হয়েছিল। গৃহকত্রী ইংরেজি খুব সামান্য জানেন, সবার সামনে তা বলতে সংকোচ বোধ করেন, তবে সর্বদা হাসিমুখ এবং আমাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। মামুন বেশ কিছুকাল এদেশে আছে, চাকরি করে লুটহাসায়, প্রয়োজনের অধিক সমাদর করে। মামুনরা থাকতো পূর্বতন পূর্ব বার্লিনে–পশ্চিমের চেয়ে তা খানিকটা মলিন, ভাঙা জার্মানি জোড়া লাগার পাঁচ ছ বছর পরেও সে-পার্থক্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

আমরা পৌঁছবার খানিক পরে মামুন জানালো, তসলিমা নাসরিন আমার। খোঁজে ফোন করেছিল, আমি এসে তার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলি–এই। অনুরোধ জানিয়ে রেখেছে। এটা খানিকটা প্রত্যাশিত ছিল। তসলিমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও ভালোই পরিচয় ছিল। পরিচয় হয়েছিল শামসুর রাহমানের মারফত, সাগর পাবলিশার্সে। আমার বাড়িতে ৩১ জন নাগরিকের সভা শেষ করে শামসুর রাহমানের প্রয়োজনে সেখানে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তসলিমা তখন শান্তিনগর বাজারের কাছে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে থাকে। সে খুব চাইছিল শামসুর রাহমানকে সেখানে নিয়ে যেতে। শামসুর রাহমান সেই সন্ধ্যায় তার বাড়ি যেতে চাইছিলেন না, কিছুটা হয়তো আমি তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে। পরে তসলিমার সঙ্গে আমার অনেকবার যোগাযোগ হয়েছে। আমার এক বন্ধু-দম্পতি তার সঙ্গে আলাপ করতে খুব আগ্রহী ছিল। আমার অনুরোধে তসলিমা তাদের আতিথ্যগ্রহণে সম্মত হয়, আমিই তার ফ্ল্যাট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাই এবং ফিরিয়ে আনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসে সে কয়েকবার এসেছে, একাধিকবার সবান্ধব। পরে একবার কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রসঙ্গত বলেছিলাম, আমি তসলিমার কবিতা ও কলামের গুণগ্রাহী, তবে তার উপন্যাসের নই। ঢাকায় ফিরে আসতে-না-আসতে তসলিমার ফোন পেলাম–তার উপন্যাস কেন ভালো লাগে না তার কারণ দর্শাতে। ধর্মান্ধ ব্যক্তির দল যখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, তখন অনেকের সঙ্গে আমিও তার লেখার ও ভাবপ্রকাশের অধিকারের সমর্থনে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছি।

বার্লিনে তসলিমাকে ফোন করায় সে জানতে চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা সম্পর্কে কোনো খবর আছে কি না। আমি বললাম, শামসুর রাহমান তাকে জানাতে বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তসলিমার মামলা নিয়ে শামসুর রাহমান নিজেই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছেন, তসলিমা দেশে ফিরে মামলার মুখোমুখি হোক। সরকার তেমন জোরের সঙ্গে মামলা লড়বে না, ফলে তসলিমা ছাড়া পেয়ে যাবে। তবে সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক কারণেই তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভবপর নয়।

আমার কথা শুনে তসলিমা বেশ বিমর্ষ হলো। সে আশা করেছিল, সরকার মামলা তুলে নেবে–এমন একটা প্রতিশ্রুতির খবর আমি তাকে দেবো। সে বললো, মামলা মাথায় নিয়ে সে দেশে ফিরবে না, ফিরলে যে-কোনো সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। যে-সরকার রাজনৈতিক কারণে মামলা তুলতে সাহস করে না, রাজনৈতিক কারণেই হয়তো সে-সরকার মত বদলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে। আমি বললাম, সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে, তবে সরকারের বৈরিতার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে বললো, সরকারের ওপর সে ভরসা রাখতে পারছে না। সুতরাং সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত সে দেশে ফিরবে না।

তসলিমাকে আমি আর কী বলতে পারি! জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার সঙ্গে কি দেখা হবে? সে বললো, ‘বোধহয় না।’ আমি তার কাছ থেকে টেলিফোনেই বিদায় নিলাম।

একদিন পর তসলিমা আবার ফোন করলো। বললো, অম্লান দত্ত তার বাড়ি যাচ্ছেন। আমি যদি একই সময়ে সেখানে যাই, সে খুশি হবে। আগের বারের কথোপকথনের শেষটা আমার মনে পড়ল। বললাম, আমি পেরে উঠব না।

বার্লিনে আর যাদের সঙ্গে পরিচয় হলো, তাঁদের মধ্যে সুনীল দাশগুপ্তের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তখনই তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি ভারতীয় নাগরিক, বিয়ে করেছেন জার্মান, কিন্তু জন্মভূমি বরিশালকে ভোলেননি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সকলের সঙ্গে তাঁর বেজায় ভাব। দীর্ঘকাল কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন, এখন আর রাজনীতিতে নেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর চাচাকাহিনীর মূল চরিত্র, শুনেছি, তাঁরই পিতৃব্যের আদলে আঁকা। সুনীলদার স্ত্রী বারবারা ভালো বাংলা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন জার্মান ভাষায়।

শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের স্ত্রী উটাও জার্মান–তাদের দুটি সন্তান। ওয়াকিল স্বল্পভাষী, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, তবে খুবই সহৃদয় মানুষ।

আমাদের সফরসঙ্গীদের মধ্যে অম্লান দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি যেমন পণ্ডিত, তেমনি সজ্জন। নিমাইসাধন বসুর সঙ্গে আগে ঢাকায় পরিচয় হয়েছিল, দেখলাম তিনি তা ভোলেননি। দিলীপকুমার সিংহ গণিতের অধ্যাপক, কথা কম বলেন, রবীন্দ্রসংগীত গান বেশি। অবাক হয়ে লক্ষ করি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংসবের পরেও অমিতাভ চৌধুরীর কথায় সিলেটি টান রয়ে গেছে। তিনি জানতে চান, আমি মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে চিনতাম কি না। বললাম, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তার ছাত্র ছিলাম, উপরন্তু তার বড়ো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার ছোটো মেয়ের। অমিতাভ চৌধুরী এক ঝটকায় আপনি থেকে তুমিতে চলে এলেন, তাহলে তো তুমি আমার বেয়াই। অনতিবিলম্ব দিলীপ সিংহকে আক্রমণ : ‘দিলীপ, তুমি আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসছ না কেন?’ দিলীপ সিংহ হতভম্ব, কে যে অমিতাভ চৌধুরীর বেয়াই, তা তিনি ঠাহর করে উঠতে পারেন না। পরদিন আবার দিলীপ সিংহের প্রতি অমিতাভ চৌধুরী : ‘এই যে দিলীপ, আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে আনছ কবে?’ নিরুপায় উপাচার্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় আনবো। আপনি অনুগ্রহ করে আপনার একটা সিভি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন?’ আমি বলি, ‘অবশ্যই’, যদিও জানি পাঠাবো না, কেননা এমন কথার ভিত্তিতে কোনো উপাচার্যকে জীবনবৃত্তান্ত পাঠানো তাঁকে বিব্রত করা এবং নিজে বিব্রত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

আলোচনা-সভা ভালোই হলো। আলোচনার মাধ্যম ইংরেজি। নারীপুরুষ মিলে আট-দশজন জার্মান বিদ্বান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে এনেছেন। নিমাইসাধন বসু, দিলীপ সিংহ, সজীদা খাতুন ও আমিও লিখিত বক্তব্য নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রবন্ধটি সদ্য লেখা–’টেগোর অ্যান্ড দি ওয়েস্ট’। মনে হলো, একেবারে মন্দ হয়নি। কোনো এক জার্মান অংশগ্রহণকারীর বক্তব্যের খানিক বিরূপ সমালোচনা করেছিলাম আমি। আরেক জার্মান বিদ্বান পরে। আমাকে বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, তবে অতটা মোলায়েম করে না। বললেও পারতেন। জার্মানির একত্রীকরণের এই ফল হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোকও বিশ্ববিদ্যালয়ে উঁচু পদ পেয়ে যাচ্ছে যোগ্যকে বঞ্চিত করে। দুই জার্মানি এক হয়েছে বটে, তবে ক্ষমতাসীনরা লক্ষ রাখছেন যাতে পূর্ব জার্মানির লোকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল না করতে পারে। যিনি এ-কথা বললেন, তিনি পূর্ব জার্মানির এবং কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের, এটুকু নিঃসন্দেহে বোঝা গেল।

আমার ছাত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী আবদুল্লাহ আল ফারুক জার্মান বেতার ডয়েশভেলের বাংলা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সে প্রথম থেকেই কোলনে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। যাবো বলে কথা দিলাম, কিন্তু তার আগে আমাদের একটা সমস্যাপূরণের প্রয়োজন ছিল।

আমরা যেভাবে এসেছি, ফিরতেও হবে ওভাবে। কিন্তু ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে দু-পথের ট্রানজিট ভিসার আবেদন করেও পেয়েছি এক পথের ভিসা, অথচ এর আগে অনেকবার দু-পথের ট্রানজিট ভিসা লাভ করেছিলাম। ভারতীয় হাই কমিশনে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ভিসা নিয়ে বার্লিন পৌঁছাবো ঠিকই, কিন্তু ফিরব কেমন করে, তারা বললেন, বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসে আবেদন করলে ফিরতি ট্রানজিট ভিসা পাওয়া যাবে। সৰ্জীদা খাতুন ও আমি বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসে গিয়ে আবেদন করলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জাবেদ আশরাফ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। তিনি বারবার জানতে চাইলেন, কেন আমাদের দু পথের ট্রানজিট ভিসা দেওয়া হলো না? সদুত্তর দিতে পারলাম না, তারপরও ভিসা পাওয়া গেল। তবে দুদিন দুবেলা সময় নষ্ট হলো তার পেছনে ছুটে। আমি পরিকল্পনা করলাম লন্ডন যাওয়ার। বার্লিনে এরোফ্লোত অফিসে গিয়ে সামান্য চেষ্টায় বার্লিন-কলকাতার টিকিটটা লন্ডন-কলকাতার টিকিটে রূপান্তর করা গেল। অতঃপর ট্রেনে করে কোলন-যাত্রা। এলিজাবেথ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ফারুককে ফোনে জানিয়ে দিলেন আমি কখন পৌঁছাবো। ফারুক স্টেশনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো এবং তার বাড়ি নিয়ে গেল। তার স্ত্রী মালা হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষকতার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। বিনয়ী, স্বল্পভাষী, অতিথিপরায়ণ।

পরের দিন ডয়েশভেলে গিয়ে একটা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলাম। তারপর ফারুকের অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময়ে নাজমুননেসা ওরফে পিয়ারী সে-ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমাকে দেখে দোরগোড়াতেই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে গেল। পিয়ারী এককালে আমার ভাগ্নে মামুনের বন্ধুবৃত্তে ছিল, তখন সে আমাকে মামা বলতো। শহীদ কাদরীর সঙ্গে বিয়ের পরে আমি ভাই হয়ে যাই এবং সেই সম্বোধন এখনো অটুট আছে। পিয়ারী আমার আসার খবর একেবারেই জানতো না, ফলে তার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। ওদের অফিস থেকে বেরিয়ে পথে-পথে সে ও আমি অনেক হাঁটলাম, অনেক গল্প করলাম, হাতে যে আরো সময় নেই সেজন্য দুঃখ করলাম। তারপর যখন আর না-ফিরলেই-নয়, তখন ফিরে এলাম। বেতারভবনে।

পরদিন আমি বন থেকে ট্রেনে যাত্রা করলাম লন্ডনের পথে। খুবই আরামদায়ক ভ্রমণ। তার ওপর, ট্রেনটা যাবে ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে। সেটা চাঞ্চল্যকর। বস্তুত চ্যানেল-টানেল আসার আগে ট্রেনের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে জানান দেওয়া হয়, কিছু কিছু পালনীয় নির্দেশ থাকে। যাত্রাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।

সেই ভালো-লাগা কিছুটা ম্লান হয়ে গেল লন্ডনের ওয়াটারলু রেলওয়ে স্টেশনে শুল্ক-সংগ্রাহকদের বাড়াবাড়িতে। মনে হয়, র‍্যানডম স্যাম্পলিংয়ের শিকার হয়েছিলাম আমি। সুতরাং আমার স্যুটকেস খুলতে হলো। ওয়াকিলুর রহমান আর্ট গ্যালারি দেখাতে নিয়ে গিয়ে ছবির একটা প্রিন্ট কিনে আমাকে উপহার দিয়েছিল। সেটি ছিল একটা পিজবোর্ডের চোঙার মধ্যে, ফলে তা। সন্দেহের উদ্রেক করে। সন্দেহভঞ্জন হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কাস্টমসের তরুণী বেশ একটা উচ্চমন্যতার সঙ্গে যখন জিজ্ঞাসা করলো আগে কখনো লন্ডনে এসেছি কি না, তখন যথেষ্ট খারাপ বোধ করলাম। রূঢ়ভাবে বললাম, ‘বহুবার। এবারে প্রশ্ন, কবে?’ বললাম, ‘প্রথম এসেছিলাম তোমার জন্মের আগে–তারপর আরো অনেকবার এসেছি। দেখলাম, রূঢ়তায় ফল ফলে।

লন্ডনে সেবার কী করেছিলাম, তা আর এখন মনে পড়ে না। আমার সেই তালিকাগ্রন্থটি প্রকাশিত হবে কি না তার খোঁজ নিতে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। গ্রাহাম শ এখন বিভাগীয় কর্তা। তিনি মুখে বলছেন হবে, কিন্তু তার শরীরের ভাষা সেটা সমর্থন করছে বলে মনে হলো না।

এরোফ্লোতের লন্ডন-মস্কো ফ্লাইট বেশ ভালো। আমার পাশে মস্কোযাত্রী যে রুশ তরুণী বসেছিল, সেও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মস্কো-দিল্লি অংশের ফ্লাইট সহনীয়। দিল্লি-কলকাতা আবার বেশ খারাপ।

৪২.

সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি-পদে মনোনয়ন দিলো বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। তাঁর মতো একজন নির্দলীয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার এ-সিদ্ধান্ত বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

তার আগেই, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে সৃজনশীলতা, গতিময়তা, জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলা আনয়ন এবং এ দুটি প্রতিষ্ঠানের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রদানের নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার একটি কমিশন গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সংগীতশিল্পী ও ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ এই কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (জালালউদ্দিন আহামেদ) তার সদস্য-সচিব নিযুক্ত হন। এর সদস্য নিযুক্ত হন ড, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক, ড. আনিসুজ্জামান, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ হাসান ইমাম, জামালউদ্দীন হোসেন, কে জি মুস্তাফা, কলিম শরাফী, রামেন্দু মজুমদার এবং পদাধিকারবলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ম. নজরুল ইসলাম সিদ্দিকী, পরে শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল), বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক (শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল, পরে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী), বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক (এম আই চৌধুরী), অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (এম নূরুন নবী) ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (আবদুল মতিন খান)।

কমিশনের চেয়ারম্যান আসাফউদ্দৌলাহ্ আওয়ামী লীগের না হলেও শেখ হাসিনার কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁদের দুই পরিবারের মধ্যে বিলক্ষণ সৌহার্দ্য ছিল। আসাউদ্দৌলার বোন মরিয়ম বেগম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে সদ্য সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে। তা সত্ত্বেও আসাউদ্দৌলাহ্ গোড়া থেকেই কমিশনকে সরকারি আওতার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তার ধারণা ছিল–এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত ছিলাম যে–স্বাধীনভাবে চলতে হলে কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে। তিনি এককভাবে ইউএনডিপির সঙ্গে কথা বলে কমিশনের কাজের জন্যে প্রায় ৮০ লাখ টাকার অনুদান সংগ্রহ করেন। অনুদানটি অবশ্য দেওয়া হয় তথ্য মন্ত্রণালয়কে, তবে স্পষ্টই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে, এই অর্থ ব্যয়িত হবে বেতার-টেলিভিশন স্বায়ত্তশাসন কমিশনের কাজে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। কমিশন যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে রইল না, এতে বোধহয় তিনি খুশি হননি। শুরুতেই কমিশনের সঙ্গে–আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর সংঘাত লেগে গেল। তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ সচিবালয়ে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে, কমিশনের উদৃবোধন হোক এবং সেই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান বেতার টেলিভিশনে প্রচারিত হোক–তাতে হয়তো সরকারের সুনাম হবে। আমরা হোটেল পূর্বাণীর একটি কক্ষে আমাদের প্রথম অধিবেশনের আয়োজন করলাম এবং উদ্বোধনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা রাখলাম না। পরবর্তী অধিবেশনগুলোও সেখানেই হলো। এর জন্যে অল্পস্বল্প যে-ব্যয় হয়, তা বহনের সামর্থ্য তো আমাদের হয়েই গিয়েছিল। মোটকথা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের বলয়ের বাইরে থেকে আমরা কাজ করতে মনস্থ করলাম। প্রতিমন্ত্রী তা পছন্দ করেছিলেন বলে মনে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দপ্তরে কমিশনের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয় অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছিল, সে বাস্তবিকই বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন চায়। হাসিনা বারবারই বলছিল যে, স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টা তার দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্তর্গত। সে প্রতিশ্রুতিপালনে সে আমাদের সহায়তা চায়। তবে কমিশনের বৈঠকে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে ইতিমধ্যে আমরা যে-ধারণা করেছি, তার সঙ্গে তার ধারণার পার্থক্য আছে, একথাও আমাদের মনে হয়েছিল। অবশ্য সে-ব্যবধান দুরতিক্রম্য বলে মনে হয়নি।

কমিশনে একপর্যায়ে কথা উঠলো, অন্য কোথাও প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে কার্যকর হয়েছে, সেটা একবার সরেজমিনে দেখতে পারলে ভালো হয়। এ-প্রসঙ্গে বিবিসির নাম যে উঠবে, তা খুব স্বাভাবিক। ভারত পাকিস্তানের কথা উঠলো এবং ফিলিপাইনসের কথাও উঠলো। এসব দেশে বেতার-টেলিভিশন কিছুকাল আগেও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন তারা স্বাধীনতা ভোগ করছে। স্থির হলো, আমাদের এক দল যাবে ইংল্যান্ডে, এক দল ভারত-পাকিস্তানে এবং আরেক দল ফিলিপাইনসে।

ইংল্যান্ডে গেলেন আসাফউদ্দৌলাহ, কলিম শরাফী, এম আই চৌধুরী, নূরুন নবী ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আঞ্জু মনোয়ারা–কমিশনের কাজে সহায়তা করার দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানে গেলেন আসাফউদ্দৌলাহ্, কে জি মুস্তাফা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার নওয়াজেশ আলী খান। ফিলিপাইনসে গেলাম তথ্যসচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, আরেফিন সিদ্দিক, সৈয়দ হাসান ইমাম, জামালউদ্দীন হোসেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এম এ কাদের, ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক টি এইচ শিকদার ও আমি।

আমাদের এই বিদেশ-সফর নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল, এখনো হয়। সমালোচনার যে কিছু ছিল না, তা নয়। তবে গরিব করদাতাদের পয়সায় আমরা বিলাস-ভ্রমণ করে এসেছি, এমন মন্তব্য তথ্যনিষ্ঠ নয়। ইউএনডিপি আমাদের খরচ জোগায়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমাদের জন্যে কোনো ব্যয় হয়নি। আমাদের অনুদান দেওয়ায় ইউএনডিপি যে রাষ্ট্রকে কিছু কম দিয়েছে, তাও নয়।

১৯৯৭ সালের ১ জুন আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংকক গেলাম। থাই এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় সেখানে রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন ম্যানিলা পৌঁছলাম। ব্যাংককের হোটেলটি খারাপ ছিল না, তবে ঘর পেতে একটু দেরি হয়েছিল, এই যা।

ম্যানিলা বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা। তারা আমাদের নিয়ে গেলেন একটা মাঝারি ধরনের হোটেলে, মনে হলো শহরের একপ্রান্তে। হোটেলটা তারাই বাছাই করেছেন, সম্ভবত আমাদের দৈনিক ভাতার আনুপাতিক হিসেবে। ম্যানিলায় আমি আগেও এসেছি, সুতরাং নূতনত্বের কোনো আকর্ষণ ছিল না। তবে ফিলিপাইনস সরকারের অকৃপণ আতিথ্য আমরা সর্বক্ষণ উপভোগ করেছি। পথপ্রদর্শক ও দোভাষী, যানবাহন ও প্রহরার যে-আয়োজন তারা করেছিল, তাতে নিজেদের রাষ্ট্রীয় অতিথি বলেই মনে হয়েছিল। আমাদের সম্মানে ফিলিপাইনসের তথ্য মন্ত্রণালয় যে-ভোজ দিয়েছিল, তাতে প্রেসিডেন্ট রামোস যোগ দিয়েছিলেন। এই বিরল। সম্মানলাভের একটা কারণ বোধহয় এই ছিল যে, অল্পকাল আগে প্রেসিডেন্ট রামোস বাংলাদেশ সফর করে খুশি হয়ে ফিরেছিলেন।

চারদিনে ম্যানিলায় যা দেখার, তা দেখলাম। যা দেখার নয়, তাও দেখলাম। এক সরকারি দপ্তরের এক কক্ষে দেখি ফিল্মের ক্যাসেট বোঝাই করা। আমাদের কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ করে এক সামরিক কর্মকর্তা বললেন, এগুলো বাজেয়াপ্ত করা পর্নো ছবি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আমাদের সেনারা যেখানে যুদ্ধ করছে সেখানে পাঠাই তাদের বিনোদনের জন্যে। তোমাদের চাই নাকি?

৭ তারিখে ম্যানিলা থেকে ব্যাংকক। হোটেলে এক রাত কাটিয়ে পরদিন ঢাকা।

তারপর কমিশনে বসে অভিজ্ঞতা-বিনিময়, নানারকম কথা, রিপোর্ট লেখা। রিপোর্ট মাজাঘষা করতে কয়েকজন এক সন্ধ্যায় আমার বাসায়ও বসলাম। রিপোর্ট ছাপা হলো। নির্ধারিত দিনে সেটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে আমরা তার দপ্তরে গেলাম।

বসে আছি, বসে আছি। প্রধানমন্ত্রী আর আসে না। শুনতে পেলাম, তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক চলছে। অনেকক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী এলো, সঙ্গে তথ্য প্রতিমন্ত্রী। তথ্য প্রতিমন্ত্রী ঢুকেই বললেন, এখানে আমি এসে কী করবো! আমার তো কিছু করার নেই এখানে!’ প্রধানমন্ত্রী তাকে থাকতে বললো। একপর্যায়ে আমিও বললাম, আপনি থাকুন। যদিও সেখানে তাঁকে থাকতে বলার কোনো অধিকার আমার ছিল না, কিছু একটা না বললে ভালো দেখাচ্ছে না বলেই বললাম।

সভার শুরুতে কমিশনের চেয়ারম্যান কথা বলতে উঠলেন। তিনি দু তিনজনের নাম করে বললেন, কমিশনের সৌভাগ্য যে, এর কাজে এমন সব ব্যক্তির সহায়তা পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে বললো, তাদেরও সৌভাগ্য যে এমন জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন কাজের দায়িত্ব তাদেরকে অর্পণ করা হয়েছে। আসাফউদ্দৌলাহর মতো বাকপটু মানুষও তাতে থমকে গেলেন।

বাকি কথাবার্তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললো। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট তুলে দেওয়ার পরে আমাদের সবাইকে রিপোর্টের কপি দেওয়া হলো। রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল আঞ্জু মনোয়ারার দায়িত্বে। কাজেই তিনিই সবাইকে রিপোর্টের কপি দিচ্ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বললেন, সবাইকে কপি দিচ্ছেন কেন? কত কপি ছাপা হয়েছে? ভদ্রমহিলা খুব অপ্রস্তুত হলেন। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘১০০ কপি, সার্।’ প্রতিমন্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘১০০ কপি কেন? আমি তো ৫০ কপি ছাপতে বলেছিলাম। কমিশনের চেয়ারম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে আঞ্জু মনোয়ারা বললেন, ‘সাক্ ১০০ কপি ছাপতে বলেছিলেন।

আমরা তড়িঘড়ি চা খেয়ে বিদায় নিলাম। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চা খুব সুস্বাদু মনে হয়নি। ওঠার সময়ে আমরা সকলেই রিপোর্টের কপি টেবিলে রেখে চলে এসেছিলাম।

পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সেসব কপি আমাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। আর আঞ্জু মনোয়ারা কয়েকদিনের মধ্যে বদলি হয়ে যান টাঙ্গাইলে।

রিপোর্টে আমরা একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন-প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। এর চেয়ারম্যান ও সদস্যেরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। এই কমিশন জবাবদিহি করবে তথ্যসম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সংসদের কাছে। মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব এর ওপর থাকবে না। বেতার ও টেলিভিশন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানরূপে এর তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। সেখানেও মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ থাকবে না।

করদাতার টাকা যেখানে খরচ হবে, করদাতাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেখানে নাক গলাবেন না–এমন একটা পরিস্থিতি অনেকের পছন্দ হয়নি। তারা বেতার-টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন দিতে চেয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বজায় রেখে।

ওই রিপোর্ট সম্পর্কে এবং বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে তারপর আমরা আর কিছু শুনিনি।

৪৩.

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়লাভের পঁচিশ বছরপূর্তি উপলক্ষে ড. রওনক জাহান ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্তর্জাতিক আলোচনা-সভার আয়োজন করে। তাতে যোগ দিতে রেহমান সোবহান (সিপিডি), আবু আবদুল্লাহ ও বিনায়ক সেন (বিআইডিএস), জরিনা রহমান খান ও আমি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মহিউদ্দীন আহমদ (ইউপিএল) ও সারা হোসেন (আইনজীবী) ২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লন্ডনগামী ফ্লাইটে উঠে বসলাম। উড়োজাহাজের দরজা বন্ধ হলো, কিন্তু টার্মিনাল ভবনের গেট ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আমরা অস্থির। এয়ার হোস্টেসদের বললাম কিছু পানীয় সরবরাহ করতে। তারা বললেন, উড়োজাহাজ ওড়ামাত্র তারা খেতে দেবেন। তারপর টার্মিনাল ভবন ছেড়ে বিমানটি কিছুদূর এগোলো, কিন্তু কিছুদূরমাত্রই। অবশেষে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল : ছোটো একটি যন্ত্রাংশ পাল্টাতে হবে; সেটা আমাদের কাছে নেই, অন্য একটি এয়ারলাইনসের ভাঁড়ারে আছে। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়েছে। সে এলেই ওটা পাওয়া যাবে এবং আমরা উড়তে পারবো। একসময়ে জানানো হলো, যন্ত্রাংশটি পাওয়া গেছে। তারপর জানা গেল, যন্ত্রাংশটি লাগানো হয়েছে। তারপর : আমরা দুঃখিত। যে যন্ত্রাংশটি লাগানো হয়েছে, সেটি বোয়িংয়ের নয়, তাই আটলান্টার বোয়িং কর্তৃপক্ষ সেটা নিয়ে ওড়ার অনুমতি দিচ্ছে না। এদিকে এতক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র চালু থাকায় জ্বালানিও অনেক খরচ হয়ে গেছে। ক্রুদের কাজ করার যে-সময়সীমা, তারও অনেকখানি ব্যয় হয়ে গেছে। এ-অবস্থায় আজ আর এই ফ্লাইট ছাড়া সম্ভবপর নয়। আপনাদের রাতের খাবার এখন সরবরাহ করা। হচ্ছে। এরপর টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে গিয়ে আপনারা নিজেদের মালপত্র সংগ্রহ করবেন। তারপর এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় আপনাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আগামীকাল একই সময়ে আপনাদের নিয়ে আমরা উড়ে যাবো।

তখন আর খাওয়ার ইচ্ছেও থাকলো না। টার্মিনালে পৌঁছে দেখি একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। মালপত্র খুঁজে নিয়ে নিজেদেরই টানাটানি করতে হচ্ছে। যে বাসে হোটেলে যাওয়ার কথা, তাতে সবার স্থানসংকুলান হবে না। সুতরাং তাতে ওঠার জন্যে ভয়ংকররকম প্রতিযোগিতা। কোনোমতে গন্তব্য জানা গেল : গুলশানের হোটেল মিডটাউন। আমরা কয়েকজন একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে সেখানে এলাম। আনন্দকে ফোন করে সেখানে গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। সেই গাড়িতে সারাকে বাড়ি পৌঁছে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।

পরদিন প্লেনে উঠে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করে লেখা চিঠি পাওয়া গেল। আর পাওয়া গেল নব্বই পাউন্ডের একটা ভাউচার-পরবর্তী কোনো যাত্রায় কাজে লাগবে।

হিথরোতে পৌঁছে আমাদের ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে হবে। কেননা আমরা বিমানবন্দরেই একটি হোটেলে থাকবো এয়ারলাইনসের ব্যবস্থায়। অনেক যাত্রীর যুক্তরাজ্যের ভিসা নেই। তাদের জন্যে অনুমতি সংগ্রহ করতে অনেকক্ষণ লাগলো। আমাদের যাদের ভিসা আছে, তাদেরও অপেক্ষা করতে হলে সবার জন্যে। ফলে যখন আমরা টার্মিনাল ছাড়লাম, তখন মনে হলো, আর কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়েই আমরা নিউ ইয়র্ক রওনা হতে পারতাম।

হোটেলটি ভালো, তবে ঘুমোবার সময় তেমন পাওয়া গেল না। প্রাতিক্কালে উঠেই রওনা দিতে হলো–কেউ ব্রেকফাস্ট করলো, কেউ করলো না। আমাদের সহযাত্রীদের কাউকে অকারণ হয়রানি করলো ইমিগ্রেশন। এতকিছুর পর আটলান্টিক পার হওয়া।

নিউ ইয়র্কে আমাদের থাকার ব্যবস্থা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে। ঘরগুলো ছোটো, কিন্তু ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। এতই অত্যাধুনিক যে ম্যানুয়াল হাতে করে বাথরুমে ঢুকে মুদ্রিত নির্দেশ অনুসরণ করে করে শাওয়ার খুলতে হলো। ব্রেকফাস্টের সময়ে জানতে পারলাম যে, মহিউদ্দীন আহমদ নির্দেশাবলির খেই হারিয়ে ফেলে গোসল সারতে পারেননি। টেলিফোন ব্যবহার করতেও প্রায় একইরকমের ঝামেলা।

সেমিনারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন আমার দুই বন্ধু–আজিজুর রহমান খান (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) ও শেলী ফেল্ডম্যান (কর্নেল) এবং হ্যারি ব্লেয়ার (বাকনেল) ও স্ট্যানলি কোচানেক (পেনসিলভ্যানিয়া); আমস্টারডাম থেকে ভিলেম ভ্যান শ্যান্ডেল এবং কোপেনহেগেন থেকে কানে ওয়েস্টারগার্ড। মওদুদ আহমদ ও মঈন খানও খবর পেয়ে এসেছিলেন–মঈন। যদিও শ্রোতাই ছিলেন, মওদুদ কথা না বলে পারেননি।

সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলি পরে রওনক জাহানের সম্পাদনায় Bangladesh Promise and Performance (ঢাকা : ইউপিএল, ২০০০) নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

সেমিনারের বাইরে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল সুগত বসু (রাজনীতিবিদ শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র) এবং তার পাকিস্তানি বান্ধবী ও পণ্ডিত আয়েশা জালালের সঙ্গে। সুগত আমার পূর্বপরিচিত–তখন টাক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে। আয়েশা কলাম্বিয়া ছাড়তে যাচ্ছে। আয়েশার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় খানাপিনা হলো। তার অনুরোধে পরে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ও ফারসি পাণ্ডুলিপির তালিকা পাঠিয়েছিলাম। সে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।

৪৪.

ড. ক্যারল সলোমান পেনসিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে সিয়াটলে চলে এসেছে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে তার স্বামী রিচার্ড সলোমান ইতিহাসের অধ্যাপক। ক্যারল আপাতত পড়াচ্ছে না, নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। আমি কলাম্বিয়াতে আসছি জেনে সে খবর পাঠালো, সিয়াটলে যেতে হবে এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে বক্তৃতা দিতে হবে, নিউ ইয়র্ক থেকে সিয়াটলে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া তারাই দেবে। আমি জানালাম, কলাম্বিয়ার জন্যে প্রবন্ধ লিখতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, আবার সিয়াটলের জন্যে লিখব কখন? ক্যারল লিখলো, ওই প্রবন্ধটাই সিয়াটলে পড়লে চলবে–এখানকার শ্রোতাদের কেউ তো আর কলাম্বিয়ার সেমিনারে উপস্থিত থাকছে না। সমাধান। এত সহজ যে দ্বিরুক্তির অবকাশ নেই।

সেইমতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তে চলে এলাম। বিমানবন্দরে রিচার্ড এবং ক্যারল উভয়েই উপস্থিত। আমার ভারী সুটকেসটা টানাটানির ভার রিচার্ড নিয়েছেন দেখে লজ্জা পেলাম। টার্মিনাল ভবন থেকে শাটল ট্রেনে করে গাড়ি পার্কিংয়ের এলাকায় পৌঁছোনো গেল। রিচার্ডই গাড়ি চালিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। ক্যারলদের দোতলা বাড়ি–আমার জন্যে বরাদ্দ কক্ষটা ওপরতলায়। রিচার্ড সেখানেই আমার সুটকেস পৌঁছে দিলেন।

পরদিন ক্যারল আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকা ঘুরিয়ে দেখালো। শিক্ষকদের ক্লাবে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখানে আমাদের শিকাগো-যুগের বন্ধু ফ্র্যাংকের সঙ্গে দেখা। সে আমার আসবার খবর জানতো, তাই আমাকে দেখে অবাক হয়নি। তবে তার ভালুকোচিত আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমি একটু অবাক হলাম বইকি! ফ্র্যাংক বললো ক্যারলকে, জানো, আনিস আমাকে ডোনার কাবাব খাওয়া শিখিয়েছে! আমি একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করি, সে কবে? ফ্র্যাংক বলে, তোমার কিছু মনে নেই-লন্ডনে, ১৯৭৯ সালে।

খেতে খেতে কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ক্লাব-ভবনের গা ঘেঁষেই চমৎকার একটি লেক। লেকের অন্য প্রান্তে মনোরম একটি বাড়ি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্র্যাংক বলে, বাড়িটা কার জানো? বিল গেটসের। আমি বলি, তাহলে আমরা এখানে বসে মিছেমিছি সময় নষ্ট করছি কেন? ভিক্ষা দাও গো বলে ওই বাড়ির দরজায় করাঘাত করা যাক।

ফ্র্যাংক বললো, লোকটা আসলে মন্দ নয়। যদি সত্যি সত্যি ওর সামনে গিয়ে হাত পাততে পারো, তাহলে হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে না। তবে তার সামনে যাওয়াটাই সমস্যা। সেজন্যে শক্তিসঞ্চয় করতে হলে আরো এক পাত্র পান করতে হবে।

ক্যারল তার বাড়িতে রাতে খেতে ডেকেছে আরো কয়েকজনকে। তাদের মধ্যে আছে নন্দিনী এবং তার স্বামী ফাহাদ। নন্দিনী ঢাকা বেতারের এককালীন অধিকর্তা জায়নুল আবেদীন এবং আমাদের অনেককালের নূরু আপার কন্যা। ফাহাদ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের পুত্র। খাওয়া দাওয়ার পরে ওরা দুজন আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো। সিয়াটল পার্বত্য এলাকা। এদিক-ওদিকে বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলছে তারার মতো–তবে একই তলে নয়, উঁচুনিচুতে–তাই নক্ষত্রখচিত আকাশের চেয়ে চারপাশটা মনোরম দেখাচ্ছে।

পরদিন আমার প্রবন্ধপাঠ। প্রবন্ধের শিরোনাম বোধহয় ছিল Identity and Politics in Bangladesh-এই প্রবন্ধটাই কলাম্বিয়ায় পড়েছিলাম (রওনক জাহান-সম্পাদিত বইতে শিরোনাম খানিকটা বদলে দেওয়া হয়েছে, আমার নামের আগেও একটা অনাবশ্যক এম’ এসে জুটেছে)। কলাম্বিয়ার শ্রোতারা ছিলেন দক্ষিণ এশীয় বিদ্যার শিক্ষক ও ছাত্র–আমার বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে বেশ খানিকটা পরিচিত। সিয়াটলে নানা বিদ্যার লোক এসেছেন। ছাত্রদের কেউ কেউ অতি সরল প্রশ্ন করে বসলো, এক স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে বসলেন–আমার পক্ষপাত উদ্ঘাটন করাই তার লক্ষ্য বলে মনে হলো। ফেরার পথে রিচার্ডকে বললাম, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। রিচার্ড সারাক্ষণই চুপচাপ ছিলেন। এবারে মুখ খুললেন, তুমি কি এমন কাউকে জানো যে ওঁকে খুশি করতে পেরেছে?

সিয়াটল থেকে পরদিন নিউ ইয়র্কে ফিরলাম। জে এফ কে থেকেই টার্মিনাল ভবন বদলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ধরে স্বদেশযাত্রা। লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি, দেখা হয়ে গেল মাহফুজ আনামের সঙ্গে। কলাম্বিয়ার সেমিনারে যোগ দিতে মাহফুজ নিউ ইয়র্কে এসেছিল আমাদের পরে–এখন ফিরে যাচ্ছে। আমরা একই বিমানের যাত্রী।

ঢাকায় ক্লাস নেওয়ার তাগাদা থাকায় এবারে লন্ডনে থামছি না। হিথরো বিমানবন্দরে অনেকক্ষণ বসে থাকতে তাই বেশি খারাপ লাগছিল। আরো একটা ফ্যাকড়া আছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আমাদের ঢাকা পর্যন্ত নেবে না–ফেলে যাবে দুবাইতে। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরতে হবে এমিরেট্‌সে, তবে দুবাই বিমানবন্দরে থাকতে হবে প্রায় সাত ঘণ্টা।

এতক্ষণ সময় কী করা যায়? আয়েশ করে মুখহাত ধোওয়া হলো, জানলা দিয়ে দোকানের জিনিসপত্র দেখা হলো, কিছু চকোলেটও কেনা হলো। তারপর? মাহফুজ বললো, ‘চলেন, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক্।

বললাম, ‘প্লেনে উঠলেই তো খেতে দেবে।’

মাহফুজের যুক্তি, ‘তার তো অনেক দেরি।’

চীনা খাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সারা হলো। খাবার যা আনা হয়েছিল, তার সবটা খাওয়া যায়নি।

খেয়েদেয়ে যথাসময়ে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করা হলো। তার অনেকক্ষণ পরে যখন উড়োজাহাজে উঠতে যাচ্ছি, এমিরেটসের এক কর্মী ‘একটু অপেক্ষা করো। বলে মাহফুজ আর আমার বোর্ডিং কার্ড নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এলো একজিকিউটিভ ক্লাসের দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে এবং মাথা ঝুঁকিয়ে তা আমাদের হাতে সমর্পণ করলো।

জানতে চাইলাম, আমাদের কোন সুকৃতির ফলে এই সমাদর? তরুণটি মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিলো, এটা এমিরেটসের সেবার ধরন। তারপর বললো, দেখা যাচ্ছে, তোমরা নিউ ইয়র্ক থেকে আসছ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। বাকি পথটা একটু আরামে যেতে তোমাদের নিশ্চয় ভালো লাগবে।

আমি বললাম, তুমি তো জানো না আমি সিয়াল থেকে আসছি আরো বেশি পথ পেরিয়ে। জানলে বোধহয় আমাকে ফার্স্ট ক্লাসে বসাতে। তাই না?

৪৫.

নিউ ইয়র্কেই সুগত বসু বলে রেখেছিল, ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আমাকে যোগ দিতে হবে–লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন আবশ্যিক নয়, মুখে বললেই চলবে। ঢাকায়। ফিরে আসার পরপরই নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাওয়া গেল সুগতর বাবা ডা. শিশিরকুমার বসুর স্বাক্ষরে।

শিশিরকুমার বসু খুব নামজাদা শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ। ১৯৪১ সালে যখন তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, তখন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনাটি ঘটে। শিশির বসুই এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গাড়ি চালিয়ে ছদ্মবেশী সুভাষ বসুকে বিহারের গোমো রেলস্টেশনে পৌঁছে দেন-সুভাষ চলে যান পেশোয়ারে এবং সেখান থেকে কাবুল হয়ে মস্কোয়। পুলিশ শিশির বসুকে গ্রেপ্তার করে দিল্লির লাল কেল্লা ও লাহোর দুর্গে দুবছর বন্দি করে রাখে। মুক্তিলাভের পর তিনি কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে ভিয়েনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ২০ বছর ধরে কলকাতার ইনসটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের ডিরেক্টর ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিসের একজন প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি অনেক কাজ করেছিলেন। আশির দশকে কংগ্রেসপ্রার্থীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। পিতা ও পিতৃব্য এবং তাঁদের কাল সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন, আরো কয়েকটি সম্পাদনা করেছেন। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুও সুভাষ সম্পর্কে অনেক লিখেছেন। তিনি প্রথমে কংগ্রেস দলের ও পরে তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়ন লাভ করে লোকসভার সদস্য হন।

সুগত নিজেও কলকাতায় এসেছিল সুভাষ-জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার সুবাদে ডা. বসু ও কৃষ্ণা বসু আমাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। ১৯৭১ সালে শিশির বসুর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল, সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিই। তিনি যে তা মনে রাখেননি, তার জন্যে যথেষ্ট লজ্জিত হয়েছিলেন, যদিও অত সামান্য আলাপ মনে রাখার কোনো কারণ ছিল না।

সুভাষের জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় সুভাষ ও তার সময়ের রাজনীতিতেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল না, সমকালীন ভারতীয় পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। কাশ্মিরের হুররিয়াত কনফারেন্সের তিন প্রতিনিধি এসেছিলেন আবদুল গনি লোনের নেতৃত্বে–তাঁরা কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার দাবি করেছিলেন এবং সেখানে মানবাধিকার-পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছিলেন। অনেক নামিদামি ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা–তিনি ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমাদের কালের পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমি সুভাষ বসু সম্পর্কে দু চার কথা বলেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষের সহপাঠী কাজী আবদুল ওদুদের সুভাষচন্দ্র’ কবিতাটির কথা। দেখলাম, কাজী আবদুল ওদুদের নাম জানলেও তিনি যে সুভাষের সহপাঠী ছিলেন, সে কথা উপস্থিত কেউ জানতেন না এবং তাঁর ওই কবিতাটিও কেউ পড়েননি। শিশির বসুর অনুরোধে পরে তাকে আমি কবিতাটি পাঠিয়ে দিই। তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসুর বক্তৃতা ও রচনার দুটি সংকলন।

সেবারের অনুষ্ঠানে জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে আমার খুব সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের সকল অংশগ্রহণকারীকে শিশির বসু ক্যালকাটা ক্লাবে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। পুরো সময়টা জেনারেল অরোরা এবং আমি এক সোফায় বসে গল্প করে কাটিয়েছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ১৯৭১ সম্পর্কে তিনি কিছু লিখলেন না কেন? তিনি মৃদু হেসে বললেন, যুদ্ধে জয়লাভ করলে সে-সাফল্য অনেকে দাবি করে, কিন্তু পরাজিত হলে তার দায় কেউ নিতে চায় না। ১৯৭১ সম্পর্কে অনেকেই তো লিখেছে, আমি আর ভিড় বাড়াই কেন? আমার আমার একাত্তর বইটি তখন প্রকাশের পথে। ১৫-১৬ ডিসেম্বরের কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই, তিনিও অকপটে উত্তর দেন। কিছুকাল আগে ফুয়াদ চৌধুরীকে জেনারেল অরোরা ক্যামেরায় যে-সাক্ষাৎকার দেন, ফুয়াদ তা আমাকে দেখিয়েছিল। সেখানে তিনি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। আমি সে-প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। জেনারেল অরোরা আবার তাজউদ্দীনের নানা গুণের কথা বললেন এবং তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে শোকপ্রকাশ করলেন। তিনি যে লোকসভার নির্বাচনে একবার প্রার্থী হয়েছিলেন, সে-বিষয়ে প্রশ্ন করায় জেনারেল বললেন, আমার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তবে ইন্দিরা গান্ধির দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পরে শিখেরা যেভাবে সর্বত্র নিগৃহীত হয়, তার প্রতিবাদে ওই সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে একটা ভূমিকা নিতে চেয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে নির্বাচনপ্রার্থী হওয়াই তার একটা উপায় বলে মনে হয়েছিল। বিদায় নেওয়ার সময়ে তিনি বেশ আবেগের সঙ্গে আমাকে তার দিল্লির বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন।

সুতরাং এর কয়েক মাস পর যখন দিল্লি যাই, তখন জেনারেল অরোরাকে ফোন করি। নাম বলতেই তিনি চিনতে পারলেন এবং তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। তিনি থাকতেন দিল্লির ফ্রেন্ডস কলোনি ইস্টে। নির্ধারিত সময়ে তাঁর ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে দেখি, তিনি পানীয় সাজিয়ে বসে আছেন। তাঁর স্ত্রী অল্পকাল আগে মারা গেছেন, একটিমাত্র মেয়ে নিজের সংসারে থাকে। এসব। বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো। ১৯৭১-এর পর তিনি আর বাংলাদেশে যাননি। ১৯৯৬ সালের বিজয় দিবস বেশ জমকালো করে পালিত হয়েছে, অনেক বিদেশি অতিথি তাতে যোগ দিয়েছিলেন–এসব কথা তিনি শুনেছেন। বাংলাদেশে যে তিনি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রিত হননি, তার জন্যে একটু দুঃখবোধ হয়তো তার মধ্যে ছিল, কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যেমন এ ধরনের বোধ নিজের মধ্যেই রেখে দেন, তিনিও সম্ভবত তাই করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জেনারেল অরোরাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানাবার কথা ভাবছিলেন এর ট্রাস্টিরা। তাঁদের কথায় আমি ঢাকা থেকে তাঁকে ফোন করি। আমার অনুরোধ তিনি সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের সম্ভবত ১৯ তারিখে তিনি ঢাকায় এলেন। অন্যদের সঙ্গে আমিও বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় হোটেল শেরাটনে। রাতে সেখানে আমরা একত্রে খেলাম। ২১ তারিখে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিক বক্তৃতা। সেখানে লোকে লোকারণ্য। রেহমান সোবহান সভাপতি, আমি স্বাগত ভাষক, জেনারেল অরোরা মূল বক্তা। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সাহায্য ছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায়, তবে তাতে সময় লাগত, অনেক বেশি রক্তক্ষয় হতো। জেনারেল অরোরার সঙ্গে আমি গেলাম সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে তার কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে। তিনি সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন, সাভারে রক্ষিত দর্শক বইতে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করলেন।

জেনারেল অরোরা একটি সরকারি আমন্ত্রণের প্রত্যাশা করছিলেন। তিনি আমাকে খোলাখুলিই বলেন যে, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়মে তার একটা নিমন্ত্রণ আছে। তবে ২৬ মার্চ যদি ঢাকায় সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি আর সেখানে যাবেন না। আমার মনে হলো, আমাদের স্বাধীনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হবে না। আমি বললাম, আপনার কর্মসূচি আপনি ঠিক রাখুন, এখানে কিছু হলে পরে দেখা যাবে।

অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাঁকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি-ভবনে। সেখানে অনেকে এসেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসতে দেরি হয়েছিল, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী যথাসময়ে উপস্থিত ছিলেন। পৌঁছোবার পরও মধ্যাহ্নভোেজ শুরু করতে মন্ত্রী দেরি করছিলেন–কারণ তিনি অপেক্ষা করছিলেন শেরে খাজার কন্যার জন্যে। মেয়েটি কমবয়সী ও চঞ্চল, ওই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। মন্ত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখে প্রতিমন্ত্রীও বিরক্ত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়েটি উপস্থিত হওয়ার আগেই ভোজ শুরু হয়েছিল।

একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। দলমতনির্বিশেষে তারা এসেছিলেন। ঢাকায় উপস্থিত সকল সেক্টর কমান্ডার হাজির ছিলেন। রাষ্ট্রদূত আশরাফ-উদ্-দৌলার মতো আহত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এই সন্ধ্যার স্বতঃস্ফূর্ততা জেনারেল অরোরার হৃদয় স্পর্শ করেছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ তারিখে জেনারেল অরোরা দিল্লি ফিরে গেলেন। আরেকবার দিল্লিতে গেলাম খুশী কবিরের ব্যবস্থাপনায়–সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি সম্মেলনে। রথ দেখা কলা বেচার মতো তখন নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করালাম। সেবারেও জেনারেল অরোরার বাড়িতে যাই, তিনি বলেন, যদি ডা. ত্রিহানকে দেখাই তবে আমি যেন তাঁর উল্লেখ করি।

এর পরে আবার যখন দিল্লি যাই, তখন তার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে। টেলিফোনে কথা শুনতে পাচ্ছেন না বললেন; আমার মনে হলো, তিনি। আমাকে চিনতে পারছেন না। তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।

৪৬.

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর পরে–১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে–তার স্মরণে কলকাতায় একটি সভা হয়। প্রকৃতপক্ষে সেই সভার আয়োজন করেছিল শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন পবিত্র সরকার। সেই সময়ে আমি কলকাতায় থাকায় সভায় কিছু বলতে আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়। সভায় জনসমাগম ভালো হয়েছিল। শ্রোতাদের অধিকাংশই যে ইলিয়াসের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাতে সন্দেহ ছিল না। আলোচনাও বেশ হৃদ্য হয়েছিল।

সেই সভার পরে রণবীর সমাদ্দার আমাকে নিয়ে যায় ঢাকুরিয়ার কাছে এক বাড়িতে। সেখানে পরিচয় হয় তপন বোস আর দেবযানী দত্তের সঙ্গে। তপন একসময়ে চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন কাঠমান্ডু-ভিত্তিক সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটসের (সাফর) অধিকর্তা। কাশ্মিরের। আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সে অনেক বলেছে এবং সভা-সমিতি-জনমত গঠনের প্রয়াস চালিয়েছে। দেবযানী একসময়ে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনে নিবেদিত ছিল, এখন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে কিছু সামাজিক কাজ করছে এবং ঘর সংসার করছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বারীন দত্ত এবং শিক্ষক ও মহিলা আন্দোলনের নেতা হেনা দাস তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমার বিষয়ে তপনের সঙ্গে রণবীরের আগেই কথা হয়ে থাকবে–তারা অনেককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তপন সেই রাতেই আমাকে আমন্ত্রণ জানালো সাফরের উদ্যোগে পরের মাসে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় সভায় যোগ দিতে। জানলাম, ঢাকায় বেসরকারি সংগঠন অধিকারের সঙ্গে সাফরের একটি যোগসূত্র আছে এবং সেই সুবাদে অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান তাদের খানিক দৌত্য করে।

ঢাকায় ফিরে আসার পরে জানতে পারলাম, আদিলুর রহমান যাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তার মধ্যে আমার শালাজ ফাহমিদা রহমান ওয়াহাব ওরফে ঝিনুকও আছে। সে তখন সিরডাপে কর্মরত। আমি আনন্দিত হলাম। এপ্রিলের ২১ তারিখে আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংককে পৌঁছোলাম। সেখানে তখন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ কর্মরত। এর আগে একবার তাকে কথা দিয়েছিলাম, ব্যাংকক যাওয়া হলে তাঁর বাড়ি যাবো। ঝিনুককেও রাজি করালাম বিমানবন্দরের বাইরে যেতে। আমাদের সহযাত্রী এনায়েতউল্লাহ খান ওরফে মিন্টু আর ভাইয়ের কাছে যাওয়ার তাড়না অনুভব করলেন না। সেন্টু ভাইকে ফোন করে একটা ট্যাসি নিয়ে ঝিনুক আর আমি রওনা হলাম। পৌঁছোতে একটু বেশি সময়ই লাগল।

মণি ভাবি ঝিনুককে নিয়ে বাজারে বের হলেন। সেন্টু ভাই আর আমি বসে গল্প। করতে থাকলাম। পুরোনো দিন ও বন্ধুদের কথা উঠলো, বর্তমান সময়ের কথা হলো। তবে তিনি বৃহত্তর পারিবারিক পরিস্থিতি নিয়ে সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে শহীদুল্লাহ খান বাদলের প্রশংসা ছিল। বলেছিলেন, বাদল ছোটো ভাই হয়েও বড়োর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

ব্যাংকক থেকে রাতে রওনা দিয়ে মাঝরাতে কলম্বো পৌঁছোলাম। সেখানে এক হোটেলে রাত্রিযাপন করা গেল। ব্রেকফাস্টের পর হোটেল ছেড়ে শহরের উপকণ্ঠে অন্য একটি হোটেলে আশ্রয় নিতে হলো। সেখানেই আমাদের আলোচনা-সভা অনুষ্ঠিত হবে। সবই ভালো, কেবল হোটেলকক্ষ ভাগ করে নিতে হবে আরেকজনের সঙ্গে। আমি রণবীরের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। দেশীয় সুসন্তানদের সংসর্গ পরিহার করে কেন আমি এক ভারতীয়ের সঙ্গে থাকতে চাইলাম, তা নিয়ে আমাদের বন্ধুবান্ধবেরা কিঞ্চিৎ গবেষণা করলেন। ঝিনুক ঘর ভাগ করেছিল কলকাতার পলা ব্যানার্জীর সঙ্গে। সেক্ষেত্রে অবশ্য ভ্রু কুঞ্চিত হয়নি। কেননা অতিথিদের মধ্যে তৃতীয় কোনো মহিলা ছিলেন না।

প্রারম্ভিক একটি অধিবেশনে রণবীরের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার এক তরুণীর বেজায় তর্ক লেগে গেল। মেয়েটি ছদ্ম-বিনয়ের সঙ্গে বললো, উনি কী বললেন, তা আমি বুঝতে পারিনি, বস্তুত ওঁর ভাষাই আমার পক্ষে দুর্বোধ্য। তিনি যদি একটু সহজ করে বলেন, তাহলে আমার মতো অল্পশিক্ষিতের পক্ষে সুবিধা হয়। উত্তর-আধুনিকতার প্রতি এই শ্লেষ নিক্ষিপ্ত হওয়ায় রণবীর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের মতো বলে গেল, তাহলে তাঁকে এই ভাষা শিখে নিতে হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে উনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় সমাজ-বিশ্লেষণ করা সংগত হয় না। তরুণীর অগ্রজও ওই আলোচনা-সভায় উপস্থিত ছিলেন। আমার মনে হলো, ভাইবোনদুটি এলটিটিইর সমর্থক। পরে অন্য এক শ্রীলঙ্কান বলেছিলেন, আমার অনুমান যথার্থ, তবে আমি কী করে তা বুঝলাম, তা ভেবে তিনি অবাক হচ্ছেন।

আমি যে-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলাম, তাতে বোমা ফাটালেন। আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফতাব আহমাদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রসঙ্গে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের আদিবাসী বলতে অস্বীকার করলেন এই যুক্তিতে যে, আমাদের অঞ্চলে তাদের প্রবেশ ঘটেছে বহু জাতির পরে। নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু হিসেবে যে তাদের স্বাতন্ত্র্য আছে এবং সে-স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার যে তাদের আছে, সেটাও তিনি ঠিক স্বীকার করতে চাইলেন না। পেশোয়ার থেকে আগত এক পাকিস্তানি প্রতিনিধি এতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে জানতে চান, বাংলাদেশের বন্ধুরা পার্বত্য অধিবাসীদের আদিবাসী বলে স্বীকার করেন কি না এবং তাদের স্বতন্ত্র অধিকাররক্ষার পক্ষপাতী কি না। আরো দু-একজন একইসঙ্গে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। রণবীরের সঙ্গে পরামর্শ। করে আমি চা-বিরতি ঘোষণা করলাম।

তপন বোস খবর পেয়ে এলো। সে আদিলুর রহমানকে বললো, তুমি এই প্রতিনিধি (আফতাব আহমাদ) নিয়ে এসেছ, তার কারণে যে-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা তুমিই সামলাও। আদিলুর রহমান আমাকে এসে বললো, আফতাব সাহেব আর কথা বলবেন না, এখন অবস্থা আপনি সামলে দিন। বিলম্বিত বিরতির পর অধিবেশন শুরু হলে আমি বললাম, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের। আদিবাসী বলার বিষয়ে আমাদের দেশে মতভেদ আছে। কে কখন দেশের কোন খণ্ডে প্রবেশ করেছে, তা হিসাব করতে গেলে দেখা যাবে, আদম ও হাওয়া ছাড়া আমরা সকলেই কোথাও না কোথাও থেকে এসেছি। এমনকী, আদম-হাওয়াও পৃথিবীতে এসেছেন স্বর্গোদ্যান থেকে। আদিবাসী অর্থে কেবল বসতিস্থাপনের সনতারিখ বোঝায় না, তাদের কতকগুলি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে, জোর দেওয়া হয় তার ওপরে। আমরা যারা পাকিস্তান-আমলে বাঙালির স্বাধিকারের দাবি করেছি, তাদের পক্ষে দেশবাসীর যে-অংশ বাঙালি নয় তাদের নিজস্ব অধিকারের পক্ষাবলম্বন করা অবশ্যকর্তব্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে-রক্তপাত ঘটেছে, তা ঘটা উচিত ছিল না। আশা করি, আমরা এতদিনে বুঝতে পেরেছি। যে, রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান কোথাও হয়নি, হতেও পারে না। অতএব আমাদের যে-সমস্যা তার সমাধান খুঁজতে হবে সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে।

৪৭.

আমি যখন এসব কথা বলেছিলাম, তার কয়েকমাসের মধ্যে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে। রাঙামাটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শান্তি বাহিনীর সদস্যেরা অস্ত্র সমর্পণ করে। সমতলবাসী ও পাহাড়িদের অনেকে এ চুক্তি সমর্থন করেনি। এক পক্ষ ভেবেছে, পাহাড়িদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে; অন্যপক্ষ ভেবেছে, পাহাড়িরা ঠকে গেছে। অস্ত্রসমর্পণ-অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ হতে পারে ভেবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সজাগ ছিল। কিন্তু কালো ওড়না পরে পাহাড়ি মেয়েদের আসা বন্ধ করা যায়নি। তাদের। অনেকে সেই ওড়নাকে কালো পতাকার মতো ব্যবহার করেছিল। বিএনপি ও জামায়াত শান্তিচুক্তির প্রবল বিরোধিতা করে। চুক্তিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তারা ক্ষান্ত ছিলেন না, জুন মাসে এই চুক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত তারা লং মার্চ করেন। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এই চুক্তির ফলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের সীমানাভুক্ত হয়ে যাবে। তবে তাঁরা যখন লং মার্চ করেছিলেন, তখন ফেনীর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেতে তাদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগেনি। লং মার্চে অংশগ্রহণকারীদের স্ব-উদ্যোগে। পানি খাইয়েছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র। বেশ কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন এই চুক্তির কার্যকরতা বন্ধ করতে তাঁর ভূমিকাঁপালনের দাবিতে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁদের বলেছিলেন, জাতীয় স্বার্থে এমন একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল। এই চুক্তি সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি আলোচনা-সভার আয়োজন করেন। তাতে যোগ দিতে ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, আমিও গিয়েছিলাম। মনিরুজ্জামান মিঞা চুক্তিটি সংবিধানসম্মত নয় বলে মতপ্রকাশ করেন। তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তার জন্যে সংবিধান সংশোধিত হবে, কিন্তু চুক্তিটি অপরিবর্তিত থাকবে। তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারি দলের নেই। তবে কি সংবিধান সংশোধন করতে বিএনপি-দলীয় সদস্যেরা সরকারকে সাহায্য করবেন বলে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞার কাছে খবর আছে?

সরকার উদযোগী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষককে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে নিয়ে যান দুভাগে। একভাগে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শওকত আরা হোসেন, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ ও আমি ছিলাম। আমাদের ভ্রমণে তত্ত্বাবধান করেন ঢাকায় কর্নেল ফজলে এলাহী (মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত, পরে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত)। চট্টগ্রামের জিওসি তখন মেজর জেনারেল আবদুল মতিন (পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা)। আমরা বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাই। চট্টগ্রামে জিওসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে আমরা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি যাই এবং রামগড়, থানচি, সাজিক প্রভৃতি জায়গায় অল্পসময়ে অবস্থান করি। তিন জেলা শহরেই আমরা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করতে বসি।

আমরা লক্ষ করি, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব বাঙালি পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে পাহাড়িদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে–পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানের কালে–যেসব সমতলবাসীকে সেখানে সরকারি উদ্যোগে বসানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে পাহাড়িদের দ্বন্দ্ব প্রবল। খাগড়াছড়িতে আলোচনা-সভায় উপস্থিত ছিলেন হংসধ্বজ চাকমা। শান্তি-আলোচনায় তিনি একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার দৌত্যেই পাহাড়ি নেতারা অজ্ঞাতস্থান থেকে আলোচনাস্থলে আসা-যাওয়া করেছিলেন। হালে বসতিস্থাপনকারী একজন বেশ চীৎকার করে বাঙালিদের ওপর পাহাড়িদের অত্যাচারের বিবরণ দিচ্ছিলেন। হংসধ্বজ তাঁকে থামাবার চেষ্টা করতে গিয়ে বললেন, ‘থামেন, থামেন। আপনি যে আমার ঘরে আগুন দিয়েছিলেন, সেকথা কি আমি কাউকে বলেছি?’ অভিযোগকারী একথা শুনে সত্যিই থেমে গেলেন।

খাগড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাকে পৃথকভাবে বললেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-পদ যদি পাহাড়িদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে, তাহলে বাঙালিরা তা মেনে নেবে না। আমি বললাম, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যদি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়, তাহলে কি চেয়ারম্যান-পদ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্যে সংরক্ষিত রাখা সম্ভবপর?

ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী পাহাড়িদের প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তারা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারেনি–সেসবই দখল হয়ে গেছে এবং তাদের জমি বা পাহাড়ও তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রশাসন তাদের ভূমিস্বত্বের কাগজ দেখতে চায়, কিন্তু তাদের কাছে তো কোনোকালে কোনো কাগজ ছিল না। কারবারিরা (মোড়ল) জানে, কোন জমি কার, কোন পাহাড়ে চাষ করার অধিকার কার। কিন্তু প্রশাসন বলে, কারবারির মুখের কথায় হবে না, দলিল চাই। দলিল কোথায় পাবে তারা?

বান্দরবনে মারমা সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি নিম্নকণ্ঠে বললেন, স্বায়ত্তশাসন পেলে চাকমাদের লাভ হবে–তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর, রাজনৈতিকভাবে সচেতন। কিন্তু পাহাড়িদের অন্য সম্প্রদায়ের তেমন লাভ হবে না। এখন তারা বাঙালিদের অধীন, তখন তারা চাকমাদের অধীন হবে।

রাঙামাটিতে স্থানীয় অধিবাসীদের সভায় নব্য বসতিস্থাপনকারীরাই উচ্চকণ্ঠে কথা বললেন। একজন বললেন, পাহাড়িরা অস্ত্র ধরেছে বলে সরকার তাদের সুবিধা দিচ্ছে। আমরাও অস্ত্র ধরতে জানি। এই অবস্থা চললে আমরাও অস্ত্র ধরবো।

রাঙামাটিতে আমি সামরিক বাহিনীর জিপে করে চলেছি, দেখি, উলটো দিক থেকে রিকশায় আসছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক, আমার বিশেষ স্নেহভাজন প্রশান্ত ত্রিপুরা। আমি জিপ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে বললো, ‘আপনি, সার্‌!’ আমার মনে হলো, জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের ছুরিকাঘাতে আহত সিজারের উক্তি, তুমিও ব্রুটাস, যেন আবার ধ্বনিত হলো। প্রশান্তকে বললাম, সার্কিট হাউজে আছি। সন্ধ্যার পর এসো। অনেক কথা আছে। প্রশান্ত আসেনি। সামরিক বাহিনীর জিপে আমাকে দেখার পর হয়তো তার আর আমার কাছে আসতে ইচ্ছে হয়নি।

আমার এক প্রশ্নের উত্তরে সাজিকে এক সামরিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এরা আমাদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। একবার এক অসুস্থ বুড়িকে রক্ত দেওয়ার। প্রয়োজন হয়। আমাদের নিয়মানুযায়ী ওই গ্রুপের রক্ত যাদের, সেসব সৈন্য রক্ত দিতে দাঁড়িয়ে যায় লাইন করে। এক বৃদ্ধা পাহাড়িকে বাঁচাতে বাঙালি সৈন্যেরা রক্ত দিচ্ছে–এটা এরা ভাবতে পারেনি। রক্ত-দেওয়া দেখতে পাহাড়িদের লাইন লেগে গেল। ওই একটিমাত্র ঘটনা এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বদলে দেয় সম্পূর্ণভাবে।’

আমরা যখন হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে ফিরে আসি, তখন সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত বেশ কয়েকজন জওয়ানকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হলো। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাদের চিকিৎসা হবে। এমন অনেক আছে। হেলিকপ্টার যদি আসে, তবেই তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্যে চট্টগ্রামে পাঠানো যায়। নচেৎ যে যেখানে, সেখানেই পড়ে থাকে।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এলাম। জেনারেল মতিন আবার অভ্যর্থনা জানালেন। আমি তার কাছে কল্পনা চাকমার খোঁজ করলাম। তিনি বললেন, ‘আমরা তার খোঁজ পাইনি। ওই নামে সত্যিই কেউ ছিল কি না, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।

ঢাকায় ফিরে আসার পরে একদিন আমরা দল বেঁধে সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমানের কাছে আমাদের অভিজ্ঞতার সার জানিয়ে এলাম। তিনি খুব সৌজন্য প্রকাশ করলেন।

দূরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো অনেক কিছুর মতো পারস্পরিক সৌজন্যপ্রকাশের বড়ো অভাব।

৪৮.

১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার আমাকে নজরুল-ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি নিযুক্ত করে। বোধহয় এটি ছিল আমাকে দেওয়া শেখ হাসিনার গুরুদক্ষিণা।

নজরুল ইন্সটিটিউটের সঙ্গে আমার প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগ ঘটে ১৯৯১ সালে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা-উপদেষ্টা ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সংস্কৃতির বিষয়টা ছিল তাঁরই মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তিনি আমাকে ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করেন। বিএনপি সরকারের আমলে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জাহানারা বেগম। তিনি আমার সদস্যপদের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর পিতামাতাকে চিনতাম, বোধহয় সে জন্যে কেবল নয়, মানুষ হিসেবেই তিনি শিষ্টাচারে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি পূর্বাপর আমার সঙ্গে খুব সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেন। সরকারের গ্রন্থনীতি-প্রণয়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেন; তাছাড়া, আগেই লিখেছি, আমার নেতৃত্বে কলকাতায় একটি লেখক-প্রতিনিধি দলও পাঠান।

ইন্সটিটিউটের সদস্য হয়ে আমি যখন যোগ দিই, তখন তার সদ্য নির্বাহী পরিচালক হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং সভাপতিরূপে সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করেছেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। শারীরিক সামর্থ্যের অভাব না ঘটলে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় অবশ্যই আসতেন এবং ইন্সটিটিউটের অন্যান্য অনুষ্ঠানেও যোগ দিতেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় এলে তিনি চাইতেন আমি যেন তাঁর পাশে বসি এবং প্রয়োজনমতো আলোচনার বিষয়বস্তু তাকে বুঝিয়ে বলি, কেননা তখন তিনি কানে কম শুনতেন। সভায় আসতে না পারলে তিনি বলে পাঠাতেন আমি যেন সেখানে সভাপতিত্ব করি। সেটা সবসময়ে ভালো শোনাতো না। সদস্য হিসেবে আমাকে পেয়ে মনিরুজ্জামানও খুশি হয়েছিল।

প্রায় একই সময়ে বাংলা একাডেমী আবদুল কাদির-সম্পাদিত পাঁচ খণ্ড নজরুল-রচনাবলীর (১৯৬৬-৮৪) একটি নতুন সংস্করণ-প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার জন্যে সরকারের বিশেষ অর্থ-মনজুরি পাওয়া গিয়েছিল। একাডেমীর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ নতুন সংস্করণের জন্যে যে সম্পাদনা-পরিষদ গঠন করেছিলেন, তা এ রকম: সভাপতি–আনিসুজ্জামান; সদস্য–মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, করুণাময়। গোস্বামী; সদস্য-সচিব–সেলিনা হোসেন। বৎসরাধিক পরিশ্রম করে আমরা চার খণ্ডে এই নতুন সংস্করণ প্রকাশ (১৯৯৩) করতে সমর্থ হই। এই সংস্করণে কবির প্রকাশিত বইগুলি কালানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত হয়। কবির সুস্থাবস্থায়। প্রকাশিত বইপত্রের সর্বশেষ সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয় এবং কবির অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত বইগুলির প্রথম সংস্করণের পাঠ গৃহীত হয়। গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত নজরুলের কিছু রচনা নানা গুচ্ছ করে আবদুল কাদিরের দেওয়া ভিন্ন। ভিন্ন নামে রচনাবলীতে সংকলিত হয়েছিল। সেসব নামে এবং সেসব লেখা নিয়ে কখনো কোনো বই প্রকাশিত হয়নি বলে আমরা গ্রন্থনাম বাদ দিয়ে সেসব লেখা। ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনার অন্তর্ভুক্ত করি। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে আমরা

অনুসরণ করি মুদ্রিত পাঠ, রেকর্ডে ধারণকৃত বা স্বরলিপিতে বিধৃত গানের পাঠে ভেদ থাকলে আমরা তা নির্দেশ করিনি, কেননা তা করতে গেলে বহু সময়। লাগতো। নজরুলের অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত যেসব গ্রন্থে তার অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, আমরা সেসবের পুনরাবৃত্তি বর্জন করি, তবে এ-সংক্রান্ত তথ্য গ্রন্থপরিচয়ে উল্লেখ করি। আবদুল কাদির-প্রদত্ত গ্রন্থপরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা ‘পুনশ্চ’ শিরোনামে অতিরিক্ত তথ্য সন্নিবেশ করি। আমরা সাধারণভাবে আধুনিক বানানপদ্ধতি অনুসরণ করি, তবে নজরুলের গ্রন্থনামের বানান এবং যেসব ক্ষেত্রে বানানের কোনো বিশেষত্ব রক্ষা করা অপরিহার্য বিবেচিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে মূলের বানান অপরিবর্তিত রাখি। আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সম্পাদনা-পরিষদের নামের ওপরে। আমরা ‘আবদুল কাদির-সম্পাদিত নজরুল-রচনাবলী’ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করি।

বইটি প্রকাশের পরে প্রায় সকলেই এটাকে প্রামাণ্য এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্করণ বলে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা একাডেমী থেকে এটির পুনর্মুদ্রণও হয়, কিন্তু তারপর বইটি নিয়ে আমি এমন অশিষ্টাচারের সম্মুখীন হই, যার কথা এখানে বলে ফেলাই ভালো।

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে জানা গেল যে, একাডেমী নজরুল্ল রচনাবলীর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক এবং সেই উদ্দেশে তাঁর দপ্তরে আহূত একটি সভায় আমি আমন্ত্রিত। বস্তুত ওই রচনাবলীর একটি নতুনতর সংস্করণ প্রকাশের আবশ্যকতা ছিল। ১৯৯৩ সালের পরে নজরুলের আরো কিছু লেখা উদ্ধার করা গিয়েছিল, আমাদের সংস্করণের এক-আধটি পুনরাবৃত্তি বর্জনের অপেক্ষায় ছিল। সুতরাং চিঠি পেয়ে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু সভা-অনুষ্ঠানের একদিন আগে একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ফোন করে বললেন যে, মহাপরিচালক ওই সভা স্থগিত করেছেন, পুনর্নির্ধারিত সভার স্থানকাল পরে জানানো হবে। এ-বিষয়ে একাডেমী থেকে কেউ আর কিছু জানাননি। অনেক পরে অন্য সূত্রে জানতে পারি, নজরুল-রচনাবলীর সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠিত হয়েছে এবং তাতে আগের সম্পাদনা-পরিষদের যে পাঁচজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আমি একজন, আর নতুন যে-দুজন যুক্ত হয়েছেন, তার মধ্যে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ একজন। সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠনের অধিকার তো একাডেমীর আছেই, তবে তা নিয়ে লুকোচুরি খেলতে হবে কেন?

নজরুল ইন্সটিটিউটের কথায় ফিরে যাই। দু-বছর কার্যকাল শেষ করে মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলে ১৯৯৩ সালে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকরূপে আবার যোগ দেন মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। ১৯৮৫ সালে ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদেই নিযুক্ত ছিলেন। তিনি চাইলেন কবির ছবির একটা অ্যালবাম প্রকাশ করতে এবং এর জন্যে সরকারের বিশেষ অনুদানও পেয়ে গেলেন। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশের জন্যে তিনি একটি কমিটি গঠন করলেন আমাকে আহ্বায়ক করে। ট্রাস্টি বোর্ডের তিনজন সদস্য-ওয়াকিল আহমদ, রফিকুল ইসলাম এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব তাজুল ইসলাম–থাকলেন এই কমিটির সদস্য, আর মাহফুজুউল্লাহ্ হলেন তার সদস্য-সচিব। ছবি সংগ্রহ করতে এবং বাছাই করতে কিছু সময় লেগেছিল। চারটি ছবি আমি জোগাড় করে দিই–বন্ধু আবদুল আলীর বড়ো ভাবি বেগম এ জেড এম আব্দুল আলিমের কাছ থেকে তিনটি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইরশাদ কামালের কাছ থেকে একটি। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। অ্যালবামের শিল্প-নির্দেশনা দিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আমি এর মুখবন্ধ লিখেছিলাম, তা পড়ে মাহফুজউল্লাহ্ বলেছিলেন, আপনি কবিতা লিখলে পারতেন!’ তবে তা বোধহয় কেবল বন্ধুত্বের অনুরোধে।

১৯৯৪ সালের মে মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। নজরুল ইন্সটিটিউটে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়েদ-উল-হক। ওদিকে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্র কার্যকাল শেষ হলে মুহম্মদ নুরুল হুদা সে-জায়গায় এলো ১৯৯৬ সালে। সে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো এবং খুব জোর দিলো প্রকাশনার বিষয়ে। পর বছর সভাপতির কার্যকালও শেষ হয়ে যায়। ওবায়েদ-উল-হকের শরীরও খুব ভালো যাচ্ছিল না, তাঁর পক্ষে সভায় যোগদান করাও একটু কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সংস্কৃতি-সচিব সৈয়দ ইউসুফ হোসেন আমার কাছে প্রস্তাব করে। আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করায় সংস্কৃতি-প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের টেলিফোনে আমার কাছে একই অনুরোধ জ্ঞাপন করে। সে বলে, পর বছর থেকে নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হবে এবং তার খুবই ইচ্ছা যে, এই উদ্যাগে আমি নেতৃত্ব দিই। নিজের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও শেষ পর্যন্ত আমি সে-অনুরোধ রক্ষা করি। দায়িত্ব নেওয়ার কিছুকাল পরে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, আমি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবারো ওবায়দুল কাঁদেরের আন্তরিক ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠানো থেকে বিরত হই।

যথাসময়ে নজরুল-জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে জাতীয় কমিটি গঠিত হলো। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় জাতীয় সংসদের স্পিকার, সাত-আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলের উপনেতা (ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী), চার মহানগরের মেয়রসহ

আরো আঠারোজন যুক্ত হলেন। বেগম সুফিয়া কামাল সভাপতি, ওবায়দুল কাদের। নির্বাহী সভাপতি। শেখ হাসিনার তিন শিক্ষক–রফিকুল ইসলাম, আমি ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সহ-সভাপতি। ২০১ জনকে নিয়ে কমিটি করার কথা ভাবা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা ২০৫ জনে গিয়ে দাঁড়ালো। কমিটি বড়ো হয়ে যাওয়ায়। একটি স্টিয়ারিং কমিটি বা কর্মপরিচালনা-পরিষদ গঠনের আবশ্যকতা দেখা দিলো। জাতীয় কমিটির নির্বাহী সভাপতিই তার সভাপতি, তিন সহ-সভাপতি বিরাজমান, শিল্পী-সাহিত্যিক-অধ্যাপক এবং সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলে মোট ৩৩ জন। জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব মুহম্মদ নুরুল হুদা এখানেও সদস্য-সচিব। তার আগ্রহে সবার অতিরিক্ত দুজন প্রতিবেদক এতে যুক্ত হলেন। জাতীয় কমিটির সভায় লোকজন বেশি হয় না; অসুস্থ সভাপতি তেমন আসতে পারেন না, কর্মব্যস্ত নির্বাহী সভাপতিও সাধারণত সময় দিতে পারেন না। সভাপতির আসন গ্রহণ করে রফিকুল ইসলাম দোর্দণ্ডপ্রতাপে সভা চালিয়ে যান। তিনি যা বলেন, নুরুল হুদা তাতে সায় দেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেশি কিছু বলেন না, আমি প্রায় নীরবেই থাকি। তাতে শবনম মুশতারী কোনো এক পত্রিকায় লিখেছিল, জাতীয় কমিটিতে আমার ভূমিকা মৃত সৈনিকের। আমি যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, তা নয়।

কবির জন্মশতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে অন্তত শখানেক বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিল নুরুল হুদা। যেসব বিষয়ে ফরমায়েশি বই লেখানো হবে, তারও একটা তালিকা সে করেছিল। আলাপ-আলোচনার পর ট্রাস্টি বোর্ডে স্থির হলো যে, এ-ধরনের বই লেখানোর জন্যে কয়েক মাসের বৃত্তি দিয়ে কয়েকজন তরুণকে নিযুক্ত করা হবে এবং যারা তাদের কাজ তত্ত্বাবধায়ন করবেন, তাঁরাও উপযুক্ত সম্মানী পাবেন। এই লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদনপত্র। আহ্বান করা হলো, প্রার্থী বাছাই করতে একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হলো, আমিও তাতে–সদস্য কিংবা সভাপতি হিসেবেই–থাকলাম। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের সময়ে এক পণ্ডিত একজন প্রার্থীকে এত বেশি নম্বর দিলেন যে, আমরা বাকিরা পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকলাম এবং সকল শিষ্টাচার ভঙ্গ করে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম যে, সত্যিই তিনি ওই প্রার্থীকে অত নম্বর পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন কি না। সত্যি সত্যি উপযুক্ত মনে করলে ভদ্রলোকের উচিত হতো আমার কথার প্রতিবাদ করা। তা না করে তিনি শান্তভাবেই বললেন যে, নিজের বিবেচনামতোই নম্বর তিনি দিয়েছেন। বাকিরা সেই প্রার্থীকে কম নম্বর দিলেও যোগফলে সে-ই অগ্রাধিকার পেলো।

আমার তত্ত্বাবধানে দুজন কাজ করেছিল। নজরুলের চিকিৎসা বিষয়ে ডা. গৌতম দত্ত এবং নজরুল-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার সম্পর্কে সালাহউদ্দীন। আইয়ুব। আর যারা এই গবেষণা-প্রকল্পে কাজ করে বই লিখেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল শাহনাজ মুন্নী–এখন প্রথিতযশা টেলিভিশন-সাংবাদিক ও ছোটো গল্পকার।

শতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুলের বইপত্রের অনেকরকম পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে। মুদ্রাকরেরা স্বনামে-বেনামে টেন্ডার দিয়ে কূল পাচ্ছিল না। ইন্সটিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। নুরুল হুদার ব্যস্ততা ও উৎসাহেরও সীমা ছিল না। উৎসাহবশত সে এমন একটি কাজ করে বসলো যা আমি সংগত বিবেচনা করিনি, কিন্তু বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগও পাইনি। সে একটা মস্ত বড়ো সারণি তৈরি করে দেখাল যে, জন্মদিন ও জন্মবার্ষিকী আলাদা। যেদিন কেউ জন্ম নেয়, সেদিনই তার প্রথম জন্মদিন, আর পরের বছর ওই তারিখ হচ্ছে তার প্রথম জন্মবার্ষিকী। বাংলায় জন্মদিন কথাটা ইংরেজি বার্থডের অনুবাদ। বার্থডের মুখ্য অর্থই জন্মবার্ষিকী, নিতান্ত গৌণ অর্থেই যেদিন জন্মায় তা সূচিত করে। যেদিন জন্মায় সেদিন বোঝাতে ডেট অফ বার্থ কথাটাই ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, তাই ১৯৬১ সালেই বিশ্বব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছিল। কিন্তু নুরুল হুদার সারণিতে ১৮৯৯ সালে নজরুলের প্রথম জন্মদিন, ১৯০০ সালে প্রথম জন্মবার্ষিকী। অতএব ১৯৯৯ সালে–যখন কবির শতবর্ষ পালিত হওয়ার কথা–তখন তার ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং ২০০০ সালে শততম জন্মবার্ষিকী। এমনিতেই ভাবা হয়েছিল, নজরুল জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান ১৯৯৮তে শুরু হয়ে ১৯৯৯ পর্যন্ত চলবে। নুরুল হুদার গণনায় ২০০০ সালে শতবার্ষিকী পালনীয় হয়ে গেল। অতএব, শতবর্ষ উদ্যাপন চলল ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল অবধি।

নজরুল-জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২৫ মে (১৪০৫ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) সকালে, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। মূল অনুষ্ঠান ছিল তিন দিনের। ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশাল, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামেও তিন দিনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ঢাকায় যখন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা, আমাদের ভাগ্যদোষে তার একটু আগেই বিদ্যুৎ-সরবরাহে বিঘ্ন ঘটল। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি–তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানস্থলে বিদ্যুৎ-সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাকে ঘর থেকে রওনা হতে দিলেন না। বিদ্যুৎ এলো, শেখ হাসিনা এলো আরো পরে। শিল্পীরা এবং অতিথিরা ঘর্মাক্তকলেবর হয়ে অতিষ্ঠ। তবে অনুষ্ঠান ভালো হয়েছিল। সুফিয়া কামাল আসতে পারেননি, তাঁর লিখিত সভাপতির ভাষণ অন্য কেউ পড়ে দিয়েছিল। সংস্কৃতি-সচিব ড. শামসুজ্জামান মজুমদার স্বাগত ভাষণ দেন লিখিত আকারে, রফিকুল ইসলামের নজরুল-জন্মশতবর্ষ বক্তৃতাও ছিল লিখিত। প্রধান অতিথির উদৃবোধনী ভাষণ এবং ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ছিল মৌখিক। নৃত্যগীতবাদ্যআবৃত্তি মানসম্মত হয়েছিল। বেতারে-টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে প্রচারও হয়েছিল ভালো।

পরের বছরে, যথার্থ শতবর্ষে, অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল ১৭ বৈশাখ থেকে ১১ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। কী হিসাবে, তা আর এখন মনে নেই। প্রথম দিনে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে সম্মেলনমালা’ উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পদাধিকারবলে বক্তাদের মধ্যে কিছু যোগবিয়োগ ঘটেছিল। আমার নতুন পদবি জুটেছিল নজরুল-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বায়ক বলে। প্রধান অতিথির আগে আমরা জনাদশেক বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তার পরে সভাপতির ভাষণ দিয়েছিল ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠান ভালো হলেও এবারে প্রচার ভালো হয়নি। সেদিন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে। সব প্রচারমাধ্যমে সে-খবরই প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে ১১ জ্যৈষ্ঠে ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় মূল অনুষ্ঠান। তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। সে-অনুষ্ঠানের প্রচার মন্দ হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্মেলন তেমন আন্তর্জাতিক না হওয়ায় তাকে বলা হয়েছিল প্রস্তুতি পর্ব। এর একটি অধিবেশন হয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, বাকি তিনটি নজরুল ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে। অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করেন যথাক্রমে খান সারওয়ার মুরশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু রুশদ ও কবীর চৌধুরী।

জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সমাপ্তি ঘটে ২০০০ সালে ২৫ থেকে ২৭ মে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। তবে লোকজনের উৎসাহ ছিল প্রচুর। শিল্পীরা পূর্বাপর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছিলেন। ঢাকার বাইরে সেবারও অনেক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ততদিনে নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বপালন আমার শেষ হয়েছে।

৪৯.

শিকাগো থেকে বন্ধু রালফ নিকোলাসের চিঠি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা স্বতন্ত্রভাবে একটি এশীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তার সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকতে আমার সম্মতি আছে কি না জানতে চায়। ১৯৭০ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় লেখার সুযোগ পেয়েও পরিস্থিতির কারণে তা হারানোর দুঃখ আমার মনে ছিল। কালবিলম্ব না করে র‍্যালফকে জানালাম, আমি রাজি। তার পরপরই আনুষ্ঠানিক চিঠি এলো শিকাগোতে ওই বিশ্বকোষের সদর দপ্তর থেকে। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা।

সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছিল ভারত থেকে বিশিষ্ট পণ্ডিত কপিলা বাৎস্যায়ন, ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার, ভূগোলবিদ সত্যেশ চক্রবর্তী ও এক বিজ্ঞানী, পাকিস্তান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মুঘল, শ্রীলঙ্কা থেকে পেরোনিয়া ইউনিভার্সিটির ভাইস-চান্সেলর ইতিহাসবিদ লেসলি গুণারত্নে, বাংলাদেশ থেকে আমাকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রালফ নিকোলাস এবং আরো একজন সমাজবিজ্ঞানী নিয়ে। দিল্লিতেই সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক হতো। সে-সময়ে ব্রিটানিকার সদর দপ্তর থেকে একজন সম্পাদক নিয়মিত যোগদান করতেন। আবাসিক সম্পাদক ছিল ইন্দু রামচন্দ্রানী। সে যে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ, তা নয়, তবে প্রকাশনা-সংস্থায় সম্পাদক হিসেবে তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা আছে।

ব্রিটানিকার ব্যবস্থাপনা ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। বিমানে আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল বিজনেস ক্লাসে। দিল্লিতে থাকা ইন্ডিয়ান হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। স্থানীয়ভাবে চলাফেরা দিল্লি অফিসের সৌজন্যে ভাড়া-করা সার্বক্ষণিক গাড়িতে। সম্পাদকীয় বৈঠক হতো দু দিন ধরে।

বাংলাদেশের নানান দিক নিয়ে লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। অনেকের লেখা পেয়েছিলাম। সংগৃহীত রচনার লেখক-তালিকাকে র‍্যালফ তুলনা করেছিল ‘হুজহু’র সঙ্গে। দুটো লেখার ভার ছিল আমার ওপরে। তার একটি বাংলা ভাষা সম্পর্কে। সেটি জমা দেওয়ার পরে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অপর লেখাটি বাংলাদেশের সাহিত্য-বিষয়ে–সেটা শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি।

কিছুকাল পরে একটা সমস্যা দেখা দিলো। লেসলি হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার শিক্ষামন্ত্রী, ফলে তার পক্ষে আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় যোগ দেওয়া সম্ভবপর হলো না। ওদিকে ভারতীয় ভিসা পেতে প্রায়ই রফিক মুঘলের অসুবিধে হচ্ছিল। তিনিও আর আমাদের বৈঠকে নিয়মিত আসতে পারছিলেন না। ইন্দু রামচন্দ্রানীর কাজেকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে সত্যেশ চক্রবর্তী একদিন পদত্যাগের হুমকি দিলেন, অবশ্য তাঁকে নিরস্ত করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।

ইন্দুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল খুব ভালো। আমাদের প্রথম সম্পাদকীয় সভারও আগে আমি দিল্লিতে গিয়েছিলাম একবার–বোধহয় খুশী কবিরের উদযোগে সহমতের সভায় খুশী আর চিত্রনির্মাতা শামীম আখতারের সঙ্গে–ছিলাম ইন্ডিয়া হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। খবর জেনে ইন্দু এসে সেখানেই আমাকে লাঞ্চ খাওয়ালো এবং হোটেল থেকে আমি আমাদের হাই কমিশনের প্রেস কাউনসিলর আতিকুর রহমানের বাড়িতে স্থানান্তরিত হবো জেনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার গাড়িতে সেখানে সে আমাকে পৌঁছে দিল। তার গাড়িতে আমি কোট ফেলে যাওয়ায় সে-বাড়িতে সে দ্বিতীয়বারও এলো কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ না করে। তারপর তো কয়েকটি সম্পাদকীয় বৈঠকে দেখাসাক্ষাৎ। ইন্দু এবারে ঢাকায় এলো এবং আমাকে অনুরোধ করলো এখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। ব্যবস্থা করলাম শেরাটনে, ডিসকাউন্টও পাওয়া গেল। ঢাকায় ইন্দুকে কে যেন বললো, ওই পয়সায় সে সোনারগাঁও হোটেলেই থাকতে পারতো। তাতে আমার প্রতি সে একটু বিমুখ হলো। তার কোনো পরিচিত ভদ্রলোক তাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন কস্তুরীতে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে কস্তুরীতে হাজির। দেখি, কেউ নেই। খানিক পরে ফোন করে জানলাম, ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে নিমন্ত্রণকর্তার মতিঝিল অফিসে, সেখানেই নাকি সবার মিলিত হওয়ার কথা ছিল। আমার তো সেকথা কিছুতেই মনে পড়ল না। আমি যতই বলি, দেখো, আমার তো ইউনিভার্সিটি থেকে আসার কথা–আমি কেন পুরানা পল্টন ছেড়ে মতিঝিলে গিয়ে সবার সঙ্গে আবার কস্তুরীতে আসতে চাইব, তাতে কোনো কাজ হলো না। ইন্দু ভাবল, আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি তাকে। পরে দিল্লিতে একদিন সে বলছিল, অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য। আমি বললাম, কথাটা ঠিক নয়। এ নিয়ে তর্ক, তার মুখ ভার। তারপর একদিন সে আমার সংগৃহীত একটি লেখা হারিয়ে ফেললো–আমি তাকে বললাম, ভদ্রলোকের কাছে আরেকবার লেখা চাইতে আমার খুব খারাপ লাগবে, তিনিই বা কী ভাববেন! তাতে সে মন খারাপ করলো। ওদিকে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় আমার লেখা ছাপা হয়ে গেছে, সে আমাকে একসেট বই দিতে গড়িমসি করছে, তাতে আমি তার প্রতি বিরক্ত। এই অবস্থায় আমাকে না জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে সে একজনের লেখা চাওয়ায় আমি ঠিক করলাম, আর এই প্রকল্পের সঙ্গে আমি যুক্ত থাকব না। সে অবশ্য বললো, সে আমাকে ই-মেইল করে ব্যাপারটা জানিয়েছিল, আমার উত্তর না পেয়ে ধরে নিয়েছে, আমার সম্মতি আছে।

মাঝে আমি র‍্যালফকে একবার বলেছিলাম, ইন্দুর সঙ্গে কাজ করতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। র‍্যালফ ভালোমানুষ, সে বলে, ইন্দু অনেক চাপের মধ্যে কাজ করে, তাই সবসময়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না–তুমি নিজগুণে ক্ষমা করে দিও। এবারে র‍্যালফকে কিছু না বলে আমি সরাসরি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলাম শিকাগোতে, ব্রিটানিকার সদর দপ্তরে মনে হয় ২০০০ সালে। লিখলাম, আমার মনে হয়, ইন্দু আর আমি পরস্পরকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনে। আবাসিক সম্পাদক হিসেবে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে–সুতরাং সম্পাদকমণ্ডলী থেকে আমার নামটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

সত্যেশদা আমায় বললেন, তুমি পদত্যাগ করে ঠিক করোনি, পদত্যাগের ভয় দেখালেই পারতে। পরে রমিলা আমাকে জানিয়েছিল, ইন্দুর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে-ও ওই প্রকল্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাখেনি। আরো পরে জানলাম, প্রকল্পটা বাতিল করা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের দ্বিতীয় সুযোগটাও এভাবে নষ্ট হলো।

৫০.

যেবার সহমতের সম্মেলনে গিয়েছিলাম, সেবারই নিজের হৃদয়ঘটিত সমস্যার কারণে দিল্লির এসকর্ট হাসপাতালের দ্বারস্থ হলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনই ডলারের ওয়ালেটটা হারিয়ে ফেললাম। খবর শুনে মিসেস মুলে আমার চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহের জন্যে প্রায় চাঁদা তোলারই আয়োজন করেছিলেন, অতি কষ্টে তাঁকে নিবৃত্ত করা গেল এই কথা বলে যে, আমার ভায়রা হাসান এই মুহূর্তে এসকর্টেই আছে। সে বের হলে আমি ঢুকব। আমার চিকিৎসার খরচ আপাতত তার কাছ থেকেই নেওয়া যাবে। মিসেস মুলের আরেক পরিচয়, তিনি খ্যাতনামা অভিনেতা সুহাসিনী মুলের মা। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ হয় তার আগের বছর–সেকথা পরে বলছি।

প্রাথমিক পরীক্ষার পর সাব্যস্ত হয় যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জমা দেওয়ার পরই ক্যাশিয়ার মেয়েটি জানালো, এখানে জায়গা নেই, কাল সকাল বেলায় হাসপাতালে আমি হাজির হলে চলবে। আমার ভায়রা হাসান বললো, তাহলে তোমরা হাসপাতালে থাকার যে খরচটা নিয়েছ, সেটা ফেরত দাও, সেই পয়সা দিয়ে উনি কোনো হোটেলে থাকবেন। মেয়েটি বললো, পয়সা ফেরত দেওয়ার নিয়ম নেই, তোমাদের ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। অগত্যা আতিকুর রহমানের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়া।

খুব সকালে হাসপাতালে এসে ওয়েটিং রুমের মতো একটি জায়গায় অনেকক্ষণ বসে থাকা। তারপর কাপড় বদলিয়ে ট্রলিতে করে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া, বিছানায় শোয়ানো। তখনই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম : কী সার, আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছেন!’ আরে, এ তো ঢাকায় আমার কার্ডিওলজিস্ট ডা. সোহরাবউজ্জামানের গলা। বললাম, এক মাস ধরে আপনাকে খুঁজে পেলাম না, আর আপনি এখানে!’ তিনি জানালেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ নিয়ে তিনি এখানে এসেছেন কিছুকালের জন্যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করার দায়িত্ব তারই। ভালোই হলো।

অ্যানজিওগ্রাম হয়ে গেল। এবারে একটা ট্রলিতেই আমাকে শুইয়ে রাখা হলো বারান্দায়। বহুক্ষণ পরে দুই শয্যাবিশিষ্ট কেবিনের একটিতে আমাকে আশ্রয় দেওয়া হলো–বোধহয় ঘণ্টাখানেকের জন্যে। রিপোর্ট যা পাওয়া গেল, তার মর্ম এই যে, আমার ধমনীতে ব্লক আছে, তবে এখনই কিছু করার দরকার নেই।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবার আতিকুর রহমানের বাড়ি।

আতিকুর রহমানের দিল্লির বাড়িতে আমি একাধিকবার থেকেছি। তারা স্বামী-স্ত্রী সজ্জন মানুষ, খুবই অতিথিপরায়ণ। আমাকে যথেষ্ট যত্নে রেখেছিলেন। ১৯৭১এ আতিক কাজ করতেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। আমার ছাত্র চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছিল তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মঈনুদ্দীন আতিকের ঠিকানা চেয়েছিল। এটা স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় আতিক তাকে অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে সেই ভুল ঠিকানায় আল বদর বাহিনী হানা দিয়েছিল আতিকের খোঁজে। আমার ছাত্র মঈনুদ্দীন, পরে জানা যায়, তখন ছিল ওই বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ। তার এবং আমার শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে সে-ই ধরে নিয়ে যায়, তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।

এবার মুলেদের কথা বলি।

আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু তপন বোস ভাগ্যবান মানুষ। একাদিক্রমে তিনবার বিয়ে করেছে। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যার বিয়েতে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলাম। তপন চিত্রনির্মাতাও। বিয়েতে অতিথিদের মধ্যে দুই বিখ্যাত তারকা নাসিরউদ্দীন শাহ্ ও সুহাসিনী মুলেকে দেখে তাই অবাক হইনি। খানিক পরে জানতে পারি, সুহাসিনী ছিল তপনের দ্বিতীয় স্ত্রী, বিয়েবাড়িতে তার মাও উপস্থিত ছিলেন। বনফুলের কাহিনি-অবলম্বনে মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি ভুবন সোমে সুহাসিনীর অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নাসিরউদ্দীন শাহ ও মিসেস মুলের সঙ্গে আলাপ করলাম বটে, তবে বেশি সময় দিলাম সুহাসিনীকে–তাতে কোনো বাধাও অনুভব করলাম না। মিসেস মুলেও আমাকে বেশ সহৃদয়তার সঙ্গে গ্রহণ করলেন।

সুহাসিনীর সঙ্গে আমার ভাব এমনই জমে গেল যে, পরেরবার দিল্লিতে দেখা হলে আমরা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম। সে খুব গল্প করতো সত্যজিৎ রায়ের সহকারী হিসেবে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সে বলতো, রোজ সকালে কলকাতায় স্টুডিও যাওয়ার পথে একটা মিষ্টির দোকান পার হতে হতো তাকে–সেখানে ওই সকালেই সদ্য তৈরি সন্দেশ সে খুব উপভোগ করতো–এমন দিন ছিল না যেদিন সে তা খায়নি। আমাকে বললো, ‘ঢাকা থেকে আবার যখন আসবে, আমার জন্যে কাঁচা সন্দেশ নিয়ে এসো।’

আমি যেবার তার কথা রাখতে পারলাম, সেবার সে বুম্বাই গিয়েছিল। সন্দেশ অন্য কাউকে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর বেশ কিছুদিন বাদে আবার দিল্লি গেছি–সুহাসিনীর হাতে এবার সন্দেশ দিতে পারলাম। তবে বেশ বুঝতে পারলাম, ততদিনে সে আমাকে ভুলে গেছে।

৫১.

১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলা উদবোধন করলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে গেল বিরাট এক দল–লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, আমলা। কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনার তখন জালাল আহমেদ। ষাটের দশকের শেষদিকে তিনি যখন টোকিওতে দৈনিক ইত্তেফারে প্রতিনিধি, তখন থেকে তাঁকে চিনি। তার স্ত্রী আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রী ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি তাদের দুজনকে এতই অভিভূত করেছিল যে, অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়ার অবস্থা তাদের কারো ছিল না। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর সহচর ছাড়া, বাকিদের থাকা-খাওয়া চলা-ফেরায় বেশ অসুবিধে হয়েছিল। সাংবাদিকেরা এই অব্যবস্থায় যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং এ-সম্পর্কে কাগজে লিখতে দ্বিধা করেননি।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইমেলায় উপস্থাপনের জন্যে মূল প্রবন্ধ লিখতে। বই এবং বইমেলা সম্পর্কে প্রবন্ধ একটা সঙ্গে নিয়েছিলাম, কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেটা উপস্থাপনের কোনো সুযোগই হয়নি। উদ্ববাধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা উদ্ববাধক, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সভাপতি, আরো কয়েকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অংশগ্রহণকারী। তার কর্মসূচিতে কোনো প্রবন্ধ-উপস্থাপনের সুযোগ ছিল না। আমি বিষয়টা মেনেও নিলাম, কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু এ-নিয়ে ভয়ানক আপত্তি তুললেন। ফলে একটা অধিবেশনের ব্যবস্থা হলো এবং আমি প্রবন্ধ পড়লাম।

এর চেয়ে বেশি বিপত্তি ঘটল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঘোষণা নিয়ে। সঞ্চালক শেখ হাসিনার পরিচয় দিলেন বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলে। আমাদের সকলেই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। এ-নিয়ে দেশে বিরোধী দল বেশ কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের নেত্রী বললেন, ‘উনি ভারতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে।’ পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ-নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল, ভারত সরকারও নাকি দুঃখ প্রকাশ করেছিল।

মেলার শেষে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিল চুরুলিয়া ও শান্তিনিকেতনে। নজরুলের উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে এসেছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে। বিশ্বভারতী তাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।

শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আরেকটি কথা দিয়ে শেষ করি। সেই বইমেলার কয়েক মাস পরে জাতীয় জাদুঘরে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। তারই সৌজন্যে তার পাশেই বসেছিলাম। একটা বিরতির সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো কর্তাব্যক্তি তার কাছে এসে সংগোপনে কিছু বলে গেলেন। তিনি চলে গেলে হাসিনা আমাকে বললো, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন, আমি জানার আগেই সাংবাদিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।

কিছুদিন ধরেই সরকারদলীয় ব্যক্তিরা মোহাম্মদ আবু হেনার সমালোচনায় নানা কথা বলছিলেন। আবু হেনাও ছুটি নিয়ে অনেকদিন বিদেশে থেকে এলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল। না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল আমরা একসঙ্গেই শিক্ষকতা করেছি। আমি তাঁকে জানি একজন সজ্জন ও বিবেচক মানুষ হিসেবে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন এবং বিরোধী দলের অন্যায় সমালোচনার মুখে পড়েন। তাতে অবশ্য তিনি অবিচলিত ছিলেন। এখন তাঁর ‘অসুস্থতাজনিত’ পদত্যাগের ঘটনা এমনভাবে ঘটলো যে, এটা আর পুনর্বিবেচনার সুযোগ রইল না।

শেখ হাসিনাকে আমি বললাম, ‘তুমি বিরোধী দলের নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানাও পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রশ্নে আলাপ করতে।’

হাসিনা বললো, ‘উনি আসবেন না।’

আমি বললাম, সেক্ষেত্রে তুমি বলতে পারবে, এ-বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা তুমি করেছিলে। যদি উনি আসেন এবং তোমরা একমত হতে পারো, তাহলে সকলেই স্বস্তি পাবে। যদি উনি না আসেন কিংবা একমত না হন, তখন নিয়োগের ব্যাপারটা তোমার হাতেই রয়ে যাবে।’

সামান্য একটু ভেবে নিয়ে হাসিনা কথাটা মানলো। তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললো, নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শের জন্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে একটা সময় দিয়ে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিন।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে আমি এই একবারই তাকে অযাচিত পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং সেটা সে গ্রহণ করেছিল। পরে আরেকবার তাকে কিছু বলেছিলাম, কিন্তু কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।

বিরোধী দলের নেত্রী অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী তখন নিজের অভিপ্রায়-অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন।

৫২.

২০০০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময়ে হুমায়ূন আহমেদ জানালো, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিয়ে সে পরিবারের লোকজনসমেত সেখানে একদিনের প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করতে যাচ্ছে।

শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে জাহানারা ইমামের নামে সদ্যনির্মিত একটি আবাসিক হলের নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ-নিয়ে তারা উগ্রপন্থীদের আক্রমণের শিকার হন এবং তার প্রতিবাদে তারা অবিরাম ধর্মঘট করতে শুরু করেন। আক্রান্ত শিক্ষকদের দাবির সমর্থনে হুমায়ূন অনশনের চিন্তা করে।

হুমায়ূনের কথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘যদি পরিবারের বাইরের লোকজন সঙ্গে নাও, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যেতে পারি।’

হুমায়ূন বললো, ‘আপনি গেলে খুব খুশি হবো। আপনাকে আমি পরিবারের বাইরে ভাবি না।’

২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমরা সিলেটে রওনা হলাম। হুমায়ূনের দলে অনেক মানুষ, বেশিরভাগ ওর পরিবারের বাইরে। অন্যদিরে সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আছে সদলবলে, অনেক তরুণ-তরুণীও যোগ দিয়েছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে, কমলাপুর স্টেশনে নিরাপত্তার বিশাল ব্যবস্থা।

সিলেটে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানেও নিরাপত্তার আয়োজন খুব বিশাল। বাংলা একাডেমির ওবায়দুল ইসলাম–আমার ছাত্র-আমাকে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়িতে মুখহাত ধুয়ে নাশতা খাওয়ার জন্যে। হোটেলে অবশ্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, তবে ওবায়েদের কথামতো আগে ওর সঙ্গে গেলাম, পরে এলাম হোটেলে।

হুমায়ূন শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে তার কর্মসূচির সূচনা করলো। আমরা অনেকে সরাসরি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখানে এবং সারা পথেই পুলিশ প্রহরা। অনশনকারীরা একরকম পুলিশ প্রহরায়।

হুমায়ূনের সঙ্গে ওর ভাইবোনেরা আছে, ওর মাও। মাজহারের সঙ্গে একদল। হায়াৎ মামুদ ও প্রকাশক আলমগীর রহমান একসঙ্গে। ওবায়েদের সঙ্গে আমি।

আমরা বসে থাকতে থাকতে উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এলেন। তিনি ভালোমানুষ, কেউ কেউ অবশ্য তাকে ভুল বুঝছে।

বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদেরও বিরাট বাহিনী। পুলিশের পাহারা সত্ত্বেও কৌতূহলী মানুষেরও ভিড় কম নয়। কেউ কেউ নজর রাখছেন অনশনকারীরা লুকিয়ে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না তা দেখতে। সামনের একটা বাড়িতে অনেকে যাচ্ছিল টয়লেট ব্যবহার করতে। সেটা খানিকটা সন্দেহের উদ্রেক করে।

হুমায়ূন একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাঠ করেছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, ‘শাহজাল বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য’ এই অনশন।

অনশনের সময় শেষ হলে সবাই হুড়মুড় করে হোটেলে ফিরে গেল। আমি একা পড়ে থাকলাম। পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাকে লক্ষ করে ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।

সেই রাতেই আমরা ট্রেনে ঢাকার পথে রওনা হলাম।

তার কয়েকদিন পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে এলেন। তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, হুমায়ূনকে বুঝিয়ে আন্দোলনের ইতি টানার। নইলে, তার আশঙ্কা, বড়ো ধরনের গোলযোগ হবে এবং তা সামলানো তাঁর পক্ষে অসাধ্য হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে।

আমি হুমায়ূনকে কথাগুলো জানালাম। হুমায়ূন এই সংকট নিয়ে আর কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি।

৫২.

২০০০ সালে আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয় : অন্যপ্রকাশ থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ, শিখা প্রকাশনী থেকে পূর্বগামী এবং সাহিত্য প্রকাশ থেকে বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে। এর আগের বছর অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয় আমার চোখে এবং আগামী প্রকাশনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর। আমার লেখা বই বছরে একটা প্রকাশ পায় কি না সন্দেহ (১৯৯৭তে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বেরিয়েছিল আমার একাত্তর, ১৯৯৮তে কোনো বই বের হয়নি)। সেখানে পর পর দু বছরে একাধিক বই বেরোনো আমার জন্যে ঘটনা বই কি!

বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি পাঠদান চলে। ১৯৯৫ সালে বিভাগীয় সভাপতি হওয়ার নিয়োগপত্র পেলে ওই দায়িত্বগ্রহণে অপারগতা জানাই। তাতেও কিছু কটু কথা শুনতে হয় তাদের কাছ থেকে যারা এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ফিরে আসার বিরোধিতা করেছিল। পরে যখন ফিরে আসি, তখনো তা যথাসম্ভব বিলম্বিত করতে অনেকেই তৎপর ছিলেন, যাতে আমার অন্য কয়েকজন সহকর্মী অধ্যাপক পদলাভের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার কাল পূর্ণ করতে পারেন। হয়তো এসবের মূলে ছিল আমার বিভাগীয় প্রধান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ওই আসনে না বসাই ভালো বলে মনে হয়েছিল। নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষকতা করি আর মাঝে-মধ্যে এদেশ-সেদেশে সভাসমিতিতে যোগ দিতে যাই।

এই সভাসমিতিতে আমার যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের খুব অপছন্দ ছিল। উনি বলতেন, আপনি লেখালিখি করবেন নিজের প্ল্যান-অনুযায়ী, নিজের পছন্দের বিষয়ে। অন্যেরা সেমিনার-কনফারেনস করে, তাদের ফরমাইশ আপনি খাটতে যাবেন কেন? সারের এই তিরস্কার সত্ত্বেও বাইরে যাই। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়, অনেক বিষয়ে জানতে পারি, অভিজ্ঞতা বাড়ে, দৃষ্টিভঙ্গির কিছু উন্নতি হয়।

প্রবন্ধ পড়া বা বক্তৃতা করা ব্যতিরেকে বিদেশভ্রমণের সুযোগ হলো ২০০০ সালের এপ্রিলে। জার্মানির হ্যাঁনোফার শহরে এক্সপো ২০০০ অনুষ্ঠিত হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিদল গেল সেখানে। বাণিজ্য-সচিব গোলাম রহমান তার নেতা। বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক ফরিদুল হাসান ও আমি তার সদস্য। বার্লিনের এক স্থপতির সহযোগিতায় সামসুল ওয়ারেস এক্সপোতে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন নির্মাণের নকশা করে দিয়েছিলেন, আর সেখানে বাংলাদেশ-বিষয়ে যে-পুস্তিকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটার পাঠ দেখে দিয়েছিলাম আমি। দুর্ভাগ্যবশত পুস্তিকায় প্রকাশিত লেখাটি যেভাবে আমি সংশোধন করে দিয়েছিলাম, আমার এবং ব্যুরোর অজ্ঞাতেই শেষ পর্যন্ত তা উপেক্ষিত হয়। ফলে পুস্তিকাটির বক্তব্য যে-রূপ নেয়, তা স্পষ্টতই সরকারি নীতির সঙ্গে–এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে–মেলেনি। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল মাসুদের কাছে। তিনি হ্যাঁনোফারে আমাদের প্রতিনিধিদলে এসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিই এ-বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ব্যুরোর কাছে সরকার কৈফিয়ত চায় এবং আমি ফিরে আসার পরে ব্যুরোর বিপন্ন প্রধান। এ বি চৌধুরী আমার শরণাপন্ন হন। আমি লিখিতভাবে এই ভ্রান্তির দায়িত্ব স্বীকার করি, তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, মনে হয়, বিষয়টা সেখানেই থামিয়ে দেন।

তবে এক্সপো ২০০০ বেশ উপভোগ্য হয়েছিল আমাদের জন্যে। বেশ স্বাধীনভাবে আসা-যাওয়া, ঘোরা-ফেরা। গোলাম রহমান অতি সজ্জন ব্যক্তি, তার সৌজন্যের শেষ ছিল না। হ্যাঁনোফারের পালা শেষ করে আমরা এলাম। বার্লিনে। সেখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে অকৃপণ আপ্যায়ন এবং আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখাশোনার অপরিমিত সুযোগ। বার্লিন থেকে লন্ডন হয়ে। আমাদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন।

লন্ডনে সেবারও আমি ছিলাম সিরাজুর রহমানের বাড়িতে। ততদিনে তিনি প্রবলভাবে আওয়ামী লীগ-বিরোধী। তার বাড়িতে আমার থাকা নিয়ে কেউ কেউ বিস্মিত ও সমালোচনামুখর এবং ঢাকায় সরকারের উচ্চমহলে তা জ্ঞাপনের কষ্টস্বীকারে প্রবৃত্ত। এ-নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেননি বটে, তবে সরকারপ্রধানের নাম করে একটা কটু কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

আমাকে ঘর-সংসার দেখতে হয় না, বলা যায়। সে-দায়িত্ব বেবী নিজের কাঁধেই নিয়েছে। মেয়েরা যার যার মতো সংসার করছে। রুচির দুই সন্তান : অরণি আর অলয়–একজন দশ, একজন নয় বছর বয়সী। শুচির একটাই ছেলে, সবে এক বছর পেরিয়েছে। আনন্দেরও বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। পাত্রী শারমিন রশীদ, ডাক নাম ইলোরা, ডা. রশীদ আহমদের ছোটো মেয়ে। ওঁরা লালমাটিয়ায় থাকেন, চাঁদপুরের শাহরাস্তি গ্রামের আদি বাসিন্দা। আনন্দের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আগস্ট মাসে যেদিন ডা. রশীদের বাড়ি যাওয়া হয়, হুমায়ূন আহমেদের পীড়াপীড়িতে তার আগের দিন সকালে বেবী ও আমি গিয়েছিলাম নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন এবং মাজহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যথাসময়ে আমাদের ফিরে আসার ব্যবস্থা করে দেবে। ওরা যথাসাধ্য কথা রাখতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পথের মধ্যে গাড়ি বিকল হয়ে যায়। আরেক গাড়ি এসে আমাদের উদ্ধার করে আনতে আনতে অত্যধিক দেরি হয়ে গেল। যারা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন, পাত্রের বাপ-মার এমন দায়িত্বহীন আচরণে তারা অত্যন্ত বিরক্ত হন। যথাসময়ে তাদের যেতে না পারার দায়টা আমারই। অবশ্য অক্টোবরে বিয়ের কথা পাকাপাকি হলো যখন, তখন দায়িত্বপালনে শৈথিল্য ঘটেনি। ঠিক হলো, বিয়ে হবে ২০০১-এর জানুয়ারিতে।

আরো নিকটজনকে হারালাম এরই মধ্যে। আমার শ্বশুর লোকান্তরিত হলেন ১৯৯৪ সালের ১৫ জুলাইতে। তিনি হাসপাতালে ছিলেন মাত্র কয়েকদিন। তখন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদের চিকিৎসাও চলছিল ওই হাসপাতালে, ওঁর পাশের কেবিনেই। প্রেস ক্লাবে আমার শ্বশুরের জানাজায় অনেক জনসমাগম হয়েছিল। আমার মামাতো বোন হালিমাকে হাসপাতালে দেখে আমি গেলাম কলকাতায়। ফিরে এসে শুনি ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়েছে। কী যেন সে বলতে চেয়েছিল আমাকে তার মৃত্যুর আগে, তা আর জানা হলো না। ১৯৭৫ সালের পরে, বিশেষ করে জীবনের শেষদিকে, দেশ সম্পর্কে তার উদ্‌বেগ অনেক বেড়ে যায়, কবিতায় তা সে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। তার কয়েকটায় সুর দিয়ে গানের একটা সিডিও বেরিয়েছিল। এরপর বড়োবু। এক্ষেত্রেও আমি কলকাতায় ছিলাম। ফিরে এসে বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলাম হাসপাতালে। তাকে আর পেলাম না। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিদের ইচ্ছায় লাশের সঙ্গে আমিই এলাম তার বাড়িতে–১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। আমার জীবনের খুব বড়ো একটা বন্ধন কেটে গেল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৯৯ সালের ৬ মে হাসপাতালে জীবনাবসান ঘটল আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের। আমরা একসঙ্গে স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর একটা অচ্ছেদ্যবন্ধনে আমরা জড়িত ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের বন্ধুমহলে সত্যি সত্যি শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল।

কথা ফুরোয় না, সময় ফুরিয়ে যায়। লেখায় ছেদ টানা যায়, জীবন কিন্তু প্রবহমান। জীবন ক্রমাগত সামনের দিকে চলে। আমাদের পথচলা এক সময়ে থেমে যায়, জীবন থামে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *