৩. হননের কাল

হননের কাল

১.

১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। বিমানবন্দরে আত্মীয়স্বজন অনেকেই গিয়েছিলেন আমাদের আনতে। সেই সঙ্গে, একটু অবাক হয়েই দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক-মনসুর মুসা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মোহাম্মদ আবু জাফর, আহমদ কবির–উপস্থিত। এরা সকলেই আমার প্রাক্তন ছাত্র। জানলাম, এরা আমার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চায়। বিকেলে এদের বাড়িতে আসতে বললাম।

আমাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে পেরে আব্বা খুব খুশি হলেন। এপ্রিল মাস থেকে তিনি শয্যাশায়ী, ডাক্তারি করা আর সম্ভবপর হচ্ছে না। তাঁর শরীর ভেঙে পড়েনি, কিন্তু চোখেমুখে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। তিনি যে ক্যানসারে আক্রান্ত, তা তাঁকে জানানো হয়নি। বুকে কষ্ট অনুভব করেন, সে-কথাটিই বললেন।

বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা এলো। বাকশালে যোগ দিতে তাদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে, তবে তারা যোগ দিতে চায় না। ওদিকে চাপও বাড়ছে, এ-অবস্থায় কী তাদের করা উচিত, সে-সম্পর্কে আমার পরামর্শ চায়। বললাম, বাকশালে আমি যোগ দেবো না। তাতে যদি আমার কিছু অসুবিধে হয়, তার জন্যে তোমাদের ভাবিকে প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আশা করি বাকশালে যোগ না দিয়ে আমি থাকতে পারবো। দরকার হলে বঙ্গবন্ধুকে বলতে পারবো, দলে যোগ না দেওয়ার স্বাধীনতা আমাকে দিন–উনি সেই সুযোগটা আমাকে দেবেন বলে বিশ্বাস করি। তোমাদের সেই সুবিধে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি-অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

বুঝলাম, তাদের যেমন দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তেমনি দলে যোগ-না-দেওয়ার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই তো সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন–যোগদানে অনিচ্ছুকদের সংখ্যা অল্প। আমাদের সহকর্মীদের অনেকে যোগ দিয়েছেন, অন্যেরা যাতে যোগ দেয়, তা নিশ্চিত করাও কেউ কেউ নিজের কর্তব্য বিবেচনা করছেন–এঁদের নিয়েই বিপদ। এই অবস্থায় বাইরে থেকে পরামর্শ দেওয়া সহজ নয়।

বাড়ির টেলিফোন কাজ করছে না। সুতরাং লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পারছি না। সবাই মিলে একবার শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এসেছি, এইমাত্র। অনেকদিন পর ফিরেছি, অসুস্থ বাপের সঙ্গেই নাহয় সময় কাটাই। কয়েকদিনের মধ্যেই তো চট্টগ্রামে চলে যাবো।

১৪ তারিখ এভাবে কাটলো। ১৫ তারিখ সকালে তখনো ঘুম থেকে উঠিনি। দরজায় করাঘাত করে আব্বা বললেন, ‘শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে–রেডিওতে বলছে। সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া ভাষায় ব্যক্ত করা শক্ত। খুব বড়রকম শূন্যতা বোধ করেছিলাম, এটুকু শুধু বলতে পারি। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশে জাত কিছু লোক তা অনায়াসে করে ফেললো–ভাবতেও অবাক লাগে! খবরটা দেওয়ার সময়ে আব্বার কণ্ঠস্বরে দুঃখের আভাস ছিল না–তাতেও খুব ব্যথিত হয়েছিলাম।

বেতারের সামনে এসে বসলাম। মেজর ডালিমের উদ্ধত ঘোষণা শুনলাম। তারপর নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমাদের ভাষণ। দেশে সামরিক আইন জারি হয়েছে–তিনি সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ভাষণ শেষ হলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। অভ্যুত্থান যে পাকিস্তানপন্থীরা ঘটিয়েছে, এ যেন। তারই প্রকাশ্য ইঙ্গিত।

বঙ্গবন্ধু, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সবাই যে নিহত হয়েছেন, তা ধীরে ধীরে জানা গেল। প্রথম ধাক্কা সামলে নেওয়ার পরে আমার মনে হলো, কামাল হোসেনের পরিবার অরক্ষিত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে চললাম কাকরাইলে বড়োবুর কাছে। রাস্তায় লোকজন কম, কিন্তু যারা চলাচল করছে, তাদের দেখে মনে হচ্ছে না, এমন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। বড়োবুদের জিজ্ঞাসা করলাম, প্রয়োজন হলে কামালের পরিবারকে তাদের বাসায় এনে তোলা যাবে কি না। বড়োবু ও দুলাভাই নির্দ্বিধায় সম্মতি দিলেন। ওঁদের ওখান থেকে ফোন করে হামিদাকে বললাম, আমি আসছি। নিউ ইস্কাটন রোডে সরকারি কোনো সংস্থার অতিথি ভবনে কামালের সরকারি বাসস্থান। সেখানে পৌঁছে হামিদাকে বললাম, সরকারি বাড়িতে থাকা তাদের জন্যে নিরাপদ নয়। ঠাটারিবাজারে আমাদের বাড়িতে সুবিধের অভাব–কাকরাইলে আমার বোনের বাড়িতে বলে এসেছি, সেখানে তাঁদের নিয়ে যেতে চাই। নিরাপত্তার যে অভাব, তা অস্বীকার করলেন না হামিদা, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তাঁর শাশুড়ি আছেন–তাঁকে অন্য কোথাও যেতে রাজি করানো যাবে না।

কামালের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতির বাস্তবতা তাকে বোঝানো সম্ভবপর নয়।

এমন সময়ে কামালের মামাতো ভাই সৈয়দ আলী কবীর এলেন। তিনিও এসেছেন সকলকে নিয়ে যেতে। হামিদাকে বললেন দ্রুত গুছিয়ে নিতে; ফুফুকে বললেন, কোনো কথা নয়–একটা ব্যাগ বা স্যুটকেস গুছিয়ে নিন, কদিন আমার বাড়িতে থাকবেন। আমাকে বললেন, যদি আমার বাড়ি থেকে ওদের সরে যেতে হয় কোনো কারণে, তাহলে তোমাকে খবর দেবো। আমি সকলকে। রেখে চলে এলাম।

রাস্তা ধরে হাঁটছি আর রিকশার খোঁজ করছি। এমন সময়ে দেখি, সিভিল সার্ভিসের সদস্য এম এম রেজা আমাকে ডাকছেন তার রিকশায় উঠতে। উঠে পড়লাম। বললাম, নীলক্ষেতে যাবো, রাজ্জাক সারের বাসায়।

সেখানে যেতে যেতে অনেক কথা হলো দুজনে। ঘটনার আকস্মিকতা ও নির্মমতায় আমরা উভয়েই হতচকিত ও মর্মাহত। যে যা গুজব শুনেছি, তা। বিনিময় করলাম।

রাজ্জাক সাহেব আমাকে দেখে অবাক হলেন, জানতে চাইলেন কোত্থেকে আসছি। আমার জবাব শুনে বললেন, হামিদাদের কথা তারই আগে মনে। হওয়া উচিত ছিল। তাঁর ভ্রাতৃবধূ–আমাদের হেলু আপা–বললেন তাঁদের বাসায় ওঁদের নিয়ে আসতে। বললাম, আপাতত তার দরকার হচ্ছে না, পরে দেখা যাবে।

রাজ্জাক সাহেবের কাছে শুনলাম, আত্মীয়তার সূত্রে মেজর ডালিম গিয়েছিল তার ওখানে–ঘটনা ঘটিয়ে। তার সঙ্গে ছিল কর্নেল ফারুক। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি বিষয়ে সারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল ফারুক। সার বলেছিলেন, পয়সা খরচ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ছাত্রেরা তাঁর সঙ্গে এসব বিষয়ে। আলোচনা করে। তিনি শুধু শুধু একজনের সঙ্গে তা নিয়ে আলাপ করবেন কেন? তার যদি এতই জ্ঞানপিপাসা থাকে, নিউ মার্কেট থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নোটবই কিনে নিলে সে লাভবান হবে।

ডালিম ও ফারুক যে সারের বাসায় এসেছিল, তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কোনো শিক্ষক–রাজ্জাক সাহেবেরই ছাত্র–কিছু অপপ্রচারণা চালিয়েছিল। হয়তো আরো কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।

সারের বাসা থেকে বড়োবুকে ফোন করে জানালাম, তার বাড়িতে কেউ থাকতে যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হলো। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান, বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক বেতারযোগে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করলেন–বলা উচিত, আনুগত্য জ্ঞাপন করতে বাধ্য হলেন। মন্ত্রিসভা গঠিত হলো : মোহাম্মদউল্লাহ উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন, আগের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা থেকে গেলেন, থাকলেন না সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ ও কোরবান আলী। বঙ্গবন্ধুর সময়ে চাকুরিচ্যুত নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রতিমন্ত্রীর পদে প্রত্যাবর্তন করলেন। বেশির ভাগ মন্ত্রীকেও যে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাহারায় বঙ্গভবনে নেওয়া হয়েছিল, সে-খবরও পাওয়া গেল।

পরে সচিবালয়ে একদিন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দুপুরের খাবার খেতে খেতে শোনালেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের কাহিনি। মন্ত্রিত্ব নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। দু হাত প্রসারিত করে বললেন, ‘মন্ত্রিত্ব যে করছি, মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর রক্ত আমার হাতে লেগে রয়েছে।’ চোখে তার অশ্রু।

১৬ আগস্টে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু সমাধিস্থ হন। হেলিকপ্টারযোগে লাশ নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দাফন করা হয়। কীভাবে কাফনের কাপড় সংগৃহীত হয়, কীভাবে কাপড়-ধোওয়া সাবান দিয়ে তাকে গোসল করানো হয়, যারা তার দাফন সম্পন্ন করেছিলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সঙ্গে কেমন দুর্ব্যবহার করেছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে তার বিবরণ শুনেছিলাম অনেকদিন পরে।

২.

আব্বার চিকিৎসার বিষয়ে একে একে কথা বললাম ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ডা. নূরুল ইসলামের সঙ্গে–তাঁদেরকে আমার কৃতজ্ঞতাও জানালাম। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলুল হকও আব্বাকে দেখেছিলেন–তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি বললেন, ক্যানসারের চিকিৎসা করে হয়তো ছ মাস থেকে এক বছর আব্বাকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে, কিন্তু এই বয়সে কেমোথেরাপি দিলে তিনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কষ্ট পাবেন। তবে সিদ্ধান্ত আমাদের। আব্বাকে যিনি নিত্য দেখেন, ড. করিম, তার সঙ্গে আমাদের আগেই কথা হয়েছিল।

আব্বা এখন থাকছেন বিয়ের আগে আমি যে-ঘরটায় থাকতাম, সেখানে। তার পাশের ঘরে যেখানে তিনি বরাবর থেকে এসেছেন, তার মেঝেতে পাটি পেতে আমরা পাঁচ ভাইবোন বসলাম সিদ্ধান্ত নিতে। আখতার প্রথম থেকেই বলতে থাকল, আমরা যা সিদ্ধান্ত নিই, তার সঙ্গে সে একমত হবে, তার কিছু বলার নেই। আমি বললাম, এই অবস্থায় কেমোথেরাপি না দিয়ে প্যালিয়েটিভ দেওয়াই ভালো হবে। ছোটোবু আমার সঙ্গে একমত হলো। মেজোবু একটু চিন্তা করে বললো, ‘চিকিৎসা করতে গিয়ে আব্বার কষ্ট বাড়ুক, তা আমি চাই না।’ বড়োবু কিছুই বলতে পারছিল না। মেজোবু কেঁদে ফেলে তাকে বললো, ‘তুমি চুপ করে থাকলে হবে না। তোমার যা ইচ্ছে তা খুলে বলতে হবে।’ আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বড়োবু বললো, তোমরা যা বলছ, তাই হোক।’ এবারে তিন বোনই কাঁদতে লাগলো। খানিকক্ষণ পরে সবাই উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলো, আমরা সব ভাইবোন মিলে আব্বাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। আব্বাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানানো হলো–তিনি তা মেনে নিলেন। ডা. করিমকেও বললাম–তিনি তা অনুমোদন করলেন।

আব্বার কষ্ট ক্রমশ বাড়তে থাকল। তিনি একদিন আমাকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, আমার সমস্যা লাংসে, কিন্তু ডাক্তাররা বোধহয় সেটা ধরতে পারছে না। তারা এটা-ওটা করছে, কিন্তু রোগের চিকিৎসা করতে পারছে না।’

এ-কথা শুনে অশ্রু গোপন করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

বেবীদের ঢাকায় রেখে আমাকে চট্টগ্রামে এসে কর্তব্যকর্মে যোগ দিতে হলো। উঠলাম আবু হেনা মোস্তফা কামালের বাসায়। দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি-বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানি ভাবাপন্ন কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলতে কেউ আর এখন দ্বিধা করছেন না–আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের নিন্দাবাদ চলছে। আমি রুশ-ভারতের দালাল বলে অনেকের কাছে গণ্য হয়েছি, কেউ কেউ আমার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কেউ কেউ বলছেন–আমি ভারত থেকে এসেছি, সেখানেই আমার ফিরে যাওয়া উচিত। স্বাধীনতালাভের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের স্বার্থহানির আশঙ্কায় যারা আমার আনুকূল্য প্রার্থনা করেছিলেন, দেখলাম, আমার প্রতি তাদেরই রোষ অধিক। এঁদের মধ্যে এমনো একজন ছিলেন, যার কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, ১৯৭২ সালে আমি তা দেখেছিলাম।

চট্টগ্রামে গিয়ে আমি ড. আউয়ালের কাছ থেকে বিভাগের দায়িত্ব বুঝে নিলাম। তারপর উপাচার্যকে বললাম, আমি বিভাগের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাই যাতে সৈয়দ আলী আহসান সভাপতি হতে পারেন। আবুল ফজল, মনে হলো, খুশিই হলেন। সৈয়দ আলী আহসানকে বলায় তিনি বললেন, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে, প্রশাসনিক দায়িত্বে এতকাল অভ্যস্ত থেকে কেবল বিভাগের অধ্যাপক হয়ে থাকা তার জন্যে অস্বস্তিকর। তিনি সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে খুশিই হলেন। শুধু ড. ইউনূস আমাকে কিঞ্চিৎ ভর্ৎসনা করলেন। বললেন, আপনার বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইনের স্পিরিট যাচাই করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল–ওখানেই সিনিয়র থাকতে জুনিয়র বিভাগের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আপনি সেটা নষ্ট করে দিলেন।

চট্টগ্রামে আমি একনাগাড়ে থাকতেও পারছিলাম না। ছুটিছাটা থাকলে তো ঢাকায় চলেই আসি–আব্বার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা থেকে খবর যায়, আমি তদ্দণ্ডেই ঢাকা রওনা হই, এসব ক্ষেত্রে প্লেনেই। এমনো হয়েছে যে, ট্রেনে করে সকালে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছি, বিকেলেই ঢাকা থেকে খবর গেল। আমি সন্ধ্যার ফ্লাইট ধরে ঢাকায় আবার ফিরে এসেছি।

শেষ কদিন খুব কষ্ট পেলেন আব্বা। হঠাৎ করে বুকের জ্বালা-যন্ত্রণায় শোওয়া-অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। কিংবা মেঝেতে শুয়ে পড়তেন। আমাদের মামা সৈয়দ সাখাওয়াত আলী রোজ এসে দোয়া-দরুদ পড়ে যেতেন কিছুক্ষণ। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, তোমার সাকা মামু যেন আমার জানাজা পড়ায়।

আব্বার অবস্থা জেনে আমার চাচাতো ভাই আমিনুজ্জামান খুলনা থেকে চলে এলো। আমরা পাঁচ ভাইবোন আর আমিন আবার সেই পাশের ঘরে পাটিতে বসেছি। মেজোবু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘তোমরা সবাই মন থেকে আব্বাকে ছেড়ে দাও, তাহলে তার কষ্টের শেষ হবে। তারপর আমাদের একেকজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেড়েছ? কেউ হ্যাঁ বলে, কেউ চুপ করে থাকে। শেষে সে পড়ে বড়োবুকে নিয়ে : ‘তুমি ছাড়তে পারছ না বলে আব্বা যেতে পারছে না। ছেড়ে দাও, আব্বাকে ছেড়ে দাও।’ এক পর্যায়ে বড়োবু অস্ফুটস্বরে বলে, ‘দিলাম।

২৭ অক্টোবর ভোরে আব্বার শেষ নিশ্বাস পড়ল। খানিক পরেই আমাদের আলেম মামা সৈয়দ মজহার আলী–যিনি দীর্ঘকাল ঢাকা বেতারে কোরান তেলাওয়াত ও তরজমা পাঠ করতেন–এসে গেলেন কিছু না জেনেই।

বড়োবু হঠাৎ করেই তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘লোকে যে বলে মরাবাড়িতে চার দিন চুলো জ্বালাতে নেই–এমন কোনো নিয়ম আছে?’

মামা বললেন, মানুষ শোকগ্রস্ত থাকে বলে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে উঠতে পারে না–আত্মীয়-প্রতিবেশীরা খাবার পাঠায়। পারলে নিজেদেরই রান্নাবান্না করা ভালো। চুলো জ্বলল। আমরা চা খেলাম। আমি টেলিফোন নিয়ে বসলাম খবর দিতে। আহমদ এসে বেতারে খবর প্রচারের ব্যবস্থা করলো। নেয়ামাল এসে আব্বার মৃত্যুসংবাদ লিখতে বসলো। সে কিছু তথ্য চায়। আমি বললাম, ‘আমিই বরঞ্চ লিখি।’ লিখলাম, নেয়ামাল কপি করলো। আবুল হাসনাত, হায়াৎ মামুদ–এরা সব কাগজে খবর পৌঁছোনোর দায়িত্ব নিল। একদিন পর দৈনিক বাংলায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ আব্বা সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘একজন সাহিত্যানুরাগী চিকিৎসক’ নামে একটি চমৎকার স্মৃতিকথা।

বায়তুল মোকাররমে বাদ জোহর জানাজা। নারিন্দার পীর নজরে ইমাম সাহেব জানিয়েছেন, উনি আসবেন জানাজায় শরিক হতে। তার শ্বশুর পীর আবদুস সালামের সময় থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে আব্বার সৌহার্দ্য। প্রয়োজনে তারা আব্বার ওষুধ খান, আব্বা তাদের দোয়া চান। পীর সাহেব আসছেন জেনে সাকা মামুর সংকোচের শেষ নেই। তিনি পীর সাহেবের মুরিদ, পীর সাহেবকে কাতারবন্দি করে তিনি নামাজ পড়াবেন কী করে, পীর সাহেবকে কথাটা বলবেই বা কে?

আমিই বললাম। পীর সাহেব অতি সজ্জন, সৌজন্যপরায়ণ, মহানুভব। বললেন, এটা আপনার আব্বার ওয়াসিয়ত–তাই করতে হবে।’ তিনিই মামাকে ডেকে বললেন জানাজা পড়াতে।

আজিমপুর গোরস্থানে মায়ের কবরের পাশে আব্বা নিজের জন্যে জায়গা কিনে রেখেছিলেন। সেখানেই তাঁর মাটি হলো।

কুলখানির পরদিন রাতের ট্রেনে রওনা হয়ে ১ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামে। পৌঁছলাম। ততদিনে ক্যাম্পাসে আমার নামে বাড়ির বরাদ্দ পেয়ে গেছি।

স্টেশনে পরিচিত কে-একজন জানতে চাইলেন, ঢাকা থেকে কী খবর নিয়ে এসেছেন? ৩ তারিখে নাকি কু হচ্ছে?

পালটা প্রশ্ন করলাম, ‘অগ্রিম তারিখ জানিয়ে কু্য হয় নাকি?

৩.

বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর থেকে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক জীবনে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরদিনই নতুন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বার্তা পাঠালেন। কয়েকদিনের মধ্যে সউদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলী প্রমুখ। নেতা প্রথমে এবং জিল্লুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক প্রভৃতি পরে গ্রেপ্তার হলেন। জেনারেল এম এ জি ওসমানী রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেন; জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ও এয়ার ভাইস-মার্শাল এ কে খন্দকার রাষ্ট্রদূত হলেন; মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমান হলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের সভা আহ্বান করলেন রাষ্ট্রপতি–সেখানে নাস্তানাবুদ হলেন তিনি। কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একদল মুজিব-হত্যার প্রতিবাদে, একদল মোশতাকের সমর্থনে মিছিল করলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজে’র নামে প্রচারপত্র বের হলো ‘শেখ মুজিবের দালাল শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়’ শিরোনামে। দুর্নীতির দায়ে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মযহারুল ইসলাম, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন।

বেতারে মযহারুল ইসলামের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলাম সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে দেখা করতে তিনি তখন আজিমপুর কলোনিতে ভাইয়ের বাসায় ছিলেন। দেখলাম, খবরটা উনি জানেন। আমি বললাম, ‘সার, মনে হয়, সরকার আপনাকে কিছু করতে চাইবে–আপনার সম্মত হওয়া উচিত হবে না।’ তিনি বললেন, ‘না, আমি আর কোনো দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি না–অনেক হয়েছে। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার পরে আবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, ‘মোশতাক কিছুতেই ছাড়ল না। বললাম, ‘আপনি দেখা না করতে গেলেই পারতেন।’ তিনি বললেন, ‘এমন করে খবর পাঠালো যে না-গিয়ে পারলাম না।’

গুজবেরও অন্ত নেই। যেমন, ভারতীয় হেলিকপ্টার আসছে–জেলখানা থেকে তাজউদ্দীনকে উদ্ধার করে তাকে ক্ষমতায় বসাবে। দায়িত্বশীল বলে পরিচিত সাংবাদিকেরাও অত্যন্ত দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন করেন। তাতে উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি বাড়ে।

৩ নভেম্বর সকাল থেকে ঢাকা বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছিল না। তা থেকেও অনেক গুজবের জন্ম হয়। রাতে বেতারের এক ঘোষণায় বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চারজন রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে রাষ্ট্রপতি একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। বিচারপতি আহসানউদ্দীন চৌধুরী এর সভাপতি, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মুহম্মদ হোসেন সদস্য। নিহত নেতা কারা, বেতারে তা বলা হয়নি। আমি বেবীকে বললাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এঁরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।

সেদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থান ঘটে–শোনা যায়, তার লক্ষ্য ছিল বঙ্গভবন থেকে খুনি সামরিক কর্মকর্তাদের বহিষ্কৃত করা। মেজর-জেনারেল জিয়া বন্দি হন, খালেদ মোশাররফ ঘোষিত হন সেনাবাহিনী-প্রধান বলে। ৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদে যে-মিছিল হয়। ঢাকা শহরে, তাতে যোগ দেন রাশেদ মোশাররফ ও তাঁদের মা। তাতে খালেদ মোশাররফ চিহ্নিত হন আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ভারতপন্থী বলে। খালেদ চাপ দেন মোশতাককে। ফলে খুনি সামরিক কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে ব্যাংককে চলে যেতে বাধ্য হয়। ৫ তারিখে প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেন মোশতাক। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে সংসদ বাতিল করেন বিচারপতি সায়েম, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ৭ তারিখে সিপাহী বিপ্লব’ বলে পরিচিত আরেক অভ্যুত্থানে খালেদ এবং আরো কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তা নিহত হন, মুক্ত হন। জিয়া। পরে নৌবাহিনী-প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধানের মতো তিনি নিজেও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদবি গ্রহণ করেন, কিন্তু ক্ষমতার চাবিকাঠি তার হাতে রয়ে যায়।

৪.

অল্পকালের মধ্যে জানা গেল যে, ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব-সংগঠনে কাজ করেছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি সদ্যগঠিত সংগঠন এবং তার পেছনে কাজ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা, বিশেষ করে কর্নেল তাহের। তাই আশ্চর্য নয় যে, বিপ্লবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের মতো নেতারা। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতেও কর্নেল তাহেরের ভূমিকা ছিল প্রধান। মুক্তিলাভ করেই জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলে ঘোষণা করেছিলেন বেতারে–সে-ঘোষণা আমি শুনিনি, তবে অনেকেই শুনেছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করলে সেনাবাহিনী-প্রধানরূপে জিয়া উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসকের পদ গ্রহণ করেন, কিন্তু তার ওই প্রথম ঘোষণাটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ঘোষিত লক্ষ্য জওয়ানদের উন্নততর জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং তার দাবিনামার মধ্যে ছিল সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানদের পার্থক্য লোপ করা, তাদের জন্য একইরকম বেতন-স্কেল, বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা প্রবর্তন করা, এবং ব্যাটম্যানের পদ লুপ্ত করা। জওয়ানদের রোষবশত ৭-৮ তারিখে তাদের হাতে কেবল অফিসার হওয়ার কারণে অনেকে নিহত হন–আমাদের এক পরিচিত মহিলা-চিকিৎসকও তার মধ্যে একজন। তার অবহেলায় কোনো এক জওয়ানের স্ত্রীর মৃত্যু হয়–এই ছিল অভিযোগ। এহেন বিপ্লবী সৈনিকদের দাবি কোনো সরকারের পক্ষে কতটা। পূরণ করা সম্ভবপর, কে বলবে!

কয়েকদিনের মধ্যেই কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং তাদের মতাবলম্বী আরো কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেন। শোনা গেল, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা হবে। এরই প্রতিক্রিয়ায় পরদিন কর্নেল তাহেরের দুই ভাইসহ জাসদের বেশ কয়েকজন কর্মী ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা করেন। হাই কমিশনে কর্তব্যরত পুলিশদের গুলিতে কয়েকজন হতাহত হন–এঁদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। গুলিতে সমর সেনও সামান্য আঘাত পান। ১৯৭১এর ডিসেম্বরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে এই সমর সেনই ভুট্টোর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। সমর সেনের অপহরণচেষ্টার সঙ্গে জড়িত আহত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হন।

সে-সময়ে এটাও পরিষ্কার হয় যে, যেসব সাবেক ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৫ আগস্টের রক্তপাত ঘটে, জেলখানার অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তাঁরাই ঘটিয়েছেন। সেই রাতে তাঁদের কয়েকজনকে ব্যাংককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অনেকে পরিবার নিয়েই চলে যান। ব্যাংককে তাঁরা সাংবাদিকদের জানান যে, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ৭ নভেম্বরের পরে শোনা যাচ্ছিল, তারা দেশে ফিরে আসছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডে আশ্রয় না পেয়ে তারা চলে গেছেন লিবিয়ায়। সেদেশে তাদের আশ্রয়লাভের পশ্চাতে পাকিস্তানের হাত ছিল বলে শোনা যায়। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দ্রুত গড়ে উঠছে–উভয় দেশে রাষ্ট্রদূত-বিনিময় হয়েছে। এককালের আওয়ামী লীগ-নেতা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৭০এর জাতীয় পরিষদ-সদস্য, ১৯৭১এ পাকিস্তানের সহযোগী জহিরউদ্দীন সেদেশে আমাদের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি সায়েম তাঁর বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেছেন বিচারপতি সাত্তারকে–যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন সাফল্যের সঙ্গে। উভয়েই একসঙ্গে বিচারপতি থাকা ছাড়াও এক সময়ে শেরে বাংলার কনিষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন–তাঁদের বন্ধুত্ব পাকিস্তানপূর্ব যুগের। রাষ্ট্রপতি আর বিচারপতি একসঙ্গে শুনতে ভালো লাগে না বলে এখন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম বলা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট একটি উপদেষ্টা-পরিষদ গঠন করলেন নভেম্বরের শেষে। এর সদস্য হলেন অধ্যাপক আবুল ফজল, কাজী আনোয়ারুল হক, ড. আবদুর রশীদ ও ড. মীর্জা নূরুল হুদা।

৫.

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সভাপতিরূপে আমাকেই নিযুক্ত করলেন উপাচার্য। এটি আমার প্রাপ্য ছিল না–কেননা, ওই পদ আমি ত্যাগ করেছি। আমার প্রতি স্নেহবশতই নিয়োগটি দিলেন আবুল ফজল। তবে তাঁর বিবেচনা ছিল এই যে, সৈয়দ আলী আহসান যাতে বিভাগের প্রধান হতে পারেন, সেজন্যেই সময়ের আগে আমি পদটি ছাড়ি। যতদিন আমার বিভাগীয় প্রধান থাকার কথা ছিল, অন্তত ততদিন আমাকে দায়িত্ব দিলে কাউকে বঞ্চিত করা হয়। না। এটা ঠিক আইনি সিদ্ধান্ত নয়, খানিকটা মানবিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিভাগের সহকর্মীরা কেউ আপত্তি করলে তার মীমাংসা কী হতো, বলা দুষ্কর। তবে সকলেই এটা মেনে নিলেন, তাই কোনো সমস্যা হলো না।

এর আগে আমি দুটো নৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম–তার একটা রাখতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে সকলকে ভূতাপেক্ষ দু বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার সরকারি নিয়ম হয়েছিল। তার জন্য আবেদন করতে হতো। আমি ওই সুযোগ নেবো না মনে করে আবেদন করিনি। আমাদের সহকর্মী রণধীর বড়ুয়া তখন খুব কুণ্ঠিত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি আবেদন করবেন কি না। আমি বলেছিলাম, এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত–সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়, তিনি অনায়াসে আবেদন করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বকেয়া বেতনও দেওয়া হয়েছিল–যেসব শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যোগ দেননি, তাঁদের সকলকে। আমি তার জন্যেও আবেদন করিনি এই ভেবে যে, এর মধ্যে অনেকটা সময়ে আমি বাংলাদেশ সরকারের বেতন নিয়েছি। পরে একসময়ে, অর্থসংকটের জন্যে, দরখাস্ত করে বকেয়া বেতন তুলে নিই। তবে জ্যেষ্ঠতা কখনোই দাবি করিনি। নীতিনিষ্ঠ হলে দ্বিতীয়বার বিভাগের সভাপতি হতাম না, কিন্তু উপাচার্য যখন দিলেন, তখন আপত্তি করলাম না।

এর অল্পদিন পর আচার্যের আহ্বান পেয়ে উপাচার্য আবুল ফজল ঢাকায় গেলেন, ফিরলেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা-পরিষদের সদস্য হয়ে। রেজিস্ট্রার জানালেন, উপাচার্য ফিরেছেন এবং আমাদের কয়েকজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সাহিত্য-নিকেতনে। অধ্যাপক আবদুল করিম, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, আমি এবং আরো কেউ কেউ গেলাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস গিয়েছিলেন কি না মনে নেই। আমরা সবাই আবুল ফজলকে অভিনন্দন জানালাম। তিনি জানালেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন ড. করিম, তার নিয়োগপত্রও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আমরা অধ্যাপক করিমকেও অভিনন্দন জানালাম। আবুল ফজল বললেন, তিনি পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন এবং কয়েকটি জরুরি ফাইল সই করে তারপর কার্যভার হস্তান্তরিত করবেন। আমরা পরস্পর তাকাতাকি করলাম, শেষে আমিই বললাম, ‘সার, আপনি যেহেতু প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন, সেহেতু আপনার পক্ষে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ফাইল দেখা সমীচীন হবে না। তবে আপনি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা নিশ্চয় অপূর্ণ থাকবে না।’ তিনি আমার কথা সবটা বুঝলেন কি না জানিনা, বললেন, আমার কিছু কাজ করা বাকি রয়েছে–যেমন, মাহবুবউল্লাহ্র অ্যাড হক অ্যাপয়েন্টমেন্ট।’ তখন স্থির হলো, পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পেছনের তারিখ দিয়ে তিনি কয়েকটি ফাইল সই করবেন।

২৮ নভেম্বর সকালে আবুল ফজল উপাচার্যের দায়িত্বভার অর্পণ করলেন আবদুল করিমকে। তখন পর্যন্ত আবদুল করিম কলা অনুষদের ডিনও ছিলেন। তাঁর মেয়াদের অবশিষ্ট অংশের জন্য কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব আমি পেলাম।

এক সময়ে একান্তে আবুল ফজলকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সামরিক শাসনের অধীনে তিনি রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হতে সম্মত হলেন কেন? তিনি বলেছিলেন, বিচারপতি সায়েমের সনির্বন্ধ অনুরোধ তিনি এড়াতে পরেননি; তাছাড়া, উপদেষ্টার পদে থেকে এই দুঃসময়েও যদি ভালো কিছু করতে পারা যায়! এটি যে তিনি মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন, তাতে আমার সন্দেহ ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়-পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদায়-সংবর্ধনা জানানো হলো চট্টগ্রাম ক্লাবে এক অনুষ্ঠান করে। সেখানে আমিও কিছু বললাম–তাতে সেই সময়ের দুরূহতার ইঙ্গিত ছিল। বক্তৃতায় আবুল ফজল বললেন, এই সংকটকালে দেশের জন্যে কিছু করতে পারার আশায় তিনি এই গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন, নইলে এই বয়সে বিদেশে গিয়ে থাকা তার অভিপ্রেত হতো না।

বেবী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, উপদেষ্টাকে কি খুব দেশের বাইরে থাকতে হবে?

বললাম, ‘উনি ঢাকায় থাকার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন দায়িত্ব নিয়ে আমার চলা শুরু হলো।

এর মধ্যে লেখালিখির কাজ কিছু এগিয়েছে।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের উদ্‌যোগে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা–শহীদ এই তিন শিক্ষক সম্পর্কে একটি বক্তৃতামালা আয়োজিত হয়। আয়োজকদের ইচ্ছায় সেখানে আমি ‘মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পড়ি। স্বাধীনতার পরে এটাই ছিল আমার প্রথম লেখা–ঢাকায় বসে লিখি। পরে চট্টগ্রামে এসে লিখি মুনীর চৌধুরীর জীবনী ও তাঁর সম্পর্কে আমার স্মৃতিকথা। মুনীর চৌধুরী নামে তা দৈনিক বাংলার রোববারের সাময়িকীতে তিন কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে। গ্রন্থাকারে এই প্রবন্ধ দুটি প্রকাশের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা করে ভূঁইয়া ইকবাল ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে এটি প্রকাশের ইচ্ছা জ্ঞাপন করে মফিদুল হক। কিন্তু জাহাঙ্গীর যেহেতু আগেই কথাটা পেড়েছে, সুতরাং, তার দাবি, তার কথাই শিরোধার্য। ফলে, ‘থিয়েটার থেকে রামেন্দু মজুমদার এটি প্রকাশ করলো, আর পরিবেশনের ভার নিলো জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী। আমি বিলেত থেকে ফিরে পুনর্লিখন। করলাম। বইটি মুদ্রিত হলো বাংলা একাডেমি প্রেসে–আফজাল হোসেনের যত্নে। মুনীর অপটিমার ফন্ট ব্যবহার করে চমৎকার প্রচ্ছদ করে দিলেন। কাইয়ুম চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী বের হলো ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। বইটি উৎসর্গ করি লিলি চৌধুরীকে।

এখন মফিদুলের দাবি, তার প্রকাশনীকে একটি বই দিতে হবে। অক্সফোর্ড ও সাসেক্সে যে-প্রবন্ধ দুটি পড়েছিলাম, তার বাংলা ভাষ্য করে দিলে সে খুশি হয়। সেই কাজ শুরু করেছিলাম ঢাকায়, আব্বার অসুস্থতার সময়েই, এখন। চট্টগ্রামে এসে শেষ করলাম। মফিদুলকে জানালাম, এইসঙ্গে আগের লেখা দুটি প্রবন্ধ যোগ করবো। ১৯৬৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম। বিভাগের এক আলোচনা-সভায় ড. আবদুল মজিদ খানের আমন্ত্রণে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। সেটি পুনর্লিখন করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য : সমাজের কিছু চিত্র’ নামে যোগ করলাম। আর দিলাম বিলেত যাওয়ার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সমিতিতে পঠিত চর্যাগীতির সমাজচিত্র প্রবন্ধটি–এটি অবশ্য আমার সম্পাদিত পাণ্ডুলিপি পত্রিকায় (চতুর্থ খণ্ড, ১৯৭৫) প্রকাশ করি, অন্যগুলো মুদ্রিত হয়নি। বইয়ের পরিকল্পনাকালে বিজ্ঞাপন দেবে বলে মফিদুল নাম চেয়ে বসলো। বললাম, সমাজ ও সাহিত্য দিয়ে দাও। আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকায় এই নামেই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। পরে মফিদুল বললো, নামটা বড়ো গতানুগতিক হয়ে গেল। আমারও তাই মনে হলো। ততদিনে অকসফোর্ডে-পড়া প্রবন্ধটির বাংলা ভাষ্যের নাম দিয়েছি ‘স্বরূপের সন্ধানে’। মফিদুলকে বললাম, বইয়েরও এই নাম দিলে কেমন হয়? সে লুফে নিলো। স্বরূপের সন্ধানে বের হলো ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এটি উৎসর্গ করি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে। সেকথা এখানে বলা দরকার।

১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একদিন আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাকে বললেন, তিনি বিবিসি বাংলা বিভাগে যোগ দেওয়ার আহ্বান পেয়েছেন এবং সেটি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। আমি জানতাম, লন্ডনে থাকতে তিনি বিবিসি-র বাংলা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন এবং রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তনের পরে তাঁর সেখানে চাকরি নিয়ে যাওয়ার কথা একবার উঠেছিল। তখন সেটা ঘটেনি, সুযোগটি এখন আবার দেখা দিয়েছে। আমি সে-হিসেবেই বিষয়টা দেখলাম। এবং বললাম, এতে তার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ঘটবে, ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষারও হয়তো সুবিধে হবে, কিন্তু আমার তো মনে হয়, শিক্ষকতাই তার যথার্থ ক্ষেত্র, সেটা ছেড়ে যাওয়া কি উচিত হবে? উত্তরে আবু হেনা বললেন, শিক্ষকতায় তাঁকে রাখার ব্যাপারে আমি তো কিছু করছি না। আমি অবাক হলাম বললে কম বলা হয়। ১৯৭৩ সালে আমিই উদ্যযাগী হয়ে তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আমি। ভূঁইয়া ইকবাল যখন তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্পীর রূপান্তর (ঢাকা, ১৯৭৫) প্রকাশের উদযোগ নেয়, তখন আমি যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলাম–বইয়ের ভূমিকায় তার ইঙ্গিত তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। তাহলে আমার ত্রুটি কোথায়? পরে বুঝলাম, সৈয়দ আলী আহসান রাজশাহীতে চলে যাওয়ায় অধ্যাপকের যে-পদটি অস্থায়ীভাবে শূন্য হয়েছে, গত তিন মাসে তা পূরণ করার কোনো প্রয়াসই আমি নিইনি, অথচ তিনি ওই পদের প্রত্যাশী। পদটি বিজ্ঞাপিত হলে হয়তো তিনিই সেটি লাভ করবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর আগে থেকে বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকরূপে কর্মরত দুই শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল ও মাহমুদ শাহ্ কোরেশী-মর্মাহত হবেন, সেকথাও না ভেবে পারা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা, আবু হেনার ধারণায়, অযৌক্তিক। তিনি আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন। এবং একদিন রেজিস্ট্রারের অফিসে বসে আবিষ্কার করলাম যে, তিনি আমার সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করেছেন। তারপর দেখলাম, আনন্দের–তার বয়স তখনো চার বছর হয়নি–’না-চাচা না-চাচা’ ডাকেও সাড়া দিচ্ছেন না। মনটা বিষণ্ণতা ও তিক্ততায় ভরে গেল।

তখনকার পরিস্থিতিতে বিভাগে অধ্যাপক-পদের সংখ্যাবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। সুতরাং, হয় এ-পদ শূন্য রাখতে হবে, নইলে একাধিক জনকে অসন্তুষ্ট করে তা পূর্ণ করতে হবে। আমি শেষের বিকল্পই বেছে নিলাম। উপাচার্যকে বলতে গেলাম, অধ্যাপকের অস্থায়ী পদ বিজ্ঞাপিত করার অনুরোধ জানিয়ে আমি আনুষ্ঠানিক পত্র দিতে যাচ্ছি। তিনি জানতে চাইলেন, এর ফলে বিভাগে কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং কীভাবে আমি তা সামলাবো, তা ভেবে দেখেছি কি না। বললাম, ‘ভেবে দেখেছি, কাজটা সহজ হবে না; কিন্তু আজ হোক কাল। হোক, এ-ঝুঁকি আমাকে নিতে হবে।’

পদ বিজ্ঞাপিত হলো। আবু হেনা নির্বাচিত হলেন। অপর দুই সহকর্মী ক্ষুব্ধ। হলেন। সৈয়দ আলী আহসানও আমার উপর বিরক্ত হলেন। তিনি মনে করলেন, বিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে আমি বিষয়টি মোকাবেলা করতে পারিনি।

পরে আবু হেনার কাছ থেকে এই চিঠিটা আমি পাই।

এস-ই/১১ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
২৫শে অগস্ট, ১৯৭৬

আনিস সাহেব,

গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু অনুষদের নির্বাচন এবং অন্যান্য কাজকর্মের জন্যে আপনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে আমার পক্ষে সময়টা অনুকূল মনে হয়নি। নির্বাচনের ফল বেরুনোর পরে মনটা এত খারাপ হয়ে গেলো যে এ-সব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, ভেবেছিলাম, আর আপনার কাছে তুলবোই না। কিন্তু এখন দেখছি সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ২৮ তারিখে সিন্ডিকেটের মিটিং। হ্যাঁ, আমি বিবিসিতে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত কেন নিলাম, তা বলতে গেলে চিঠিতে কুলোবে না। সংক্ষেপে মানসিক-শারীরিক-আর্থিক, নানাবিধ কারণেই।

আপনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ স্বীকার করতে হবে কোনোদিন ভাবিনি। ১৯৭৩ সালে কী অবস্থায় আপনি আমাকে রাজশাহী থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন–সেটা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমি গত কয়েক মাস আপনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিনি–তার জন্যে নিজে কতোটুকু পীড়িত হয়েছি তা নিজেই জানি। হয়তো আমি এখান থেকে কিছুদিন দূরে থাকলে এইসব কষ্টকর স্মৃতি আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাবে। আপনি কাল ঢাকা যাচ্ছেন। সেখানে ভাবিকে বলবেন যে আমি সত্যি সত্যি অকৃতজ্ঞ নই। তিনি যে ১৯৭৩ সালের তিনটি মাস আমাকে সহোদরের মতো যত্ন করেছিলেন–তা আমি কোনোদিন ভুলবো না–কারণ আমার জীবনে এরকম সমাদর-মমতা খুব কম পেয়েছি। আমি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন দিনের পর দিন আপনাদের ওখানে যেতাম না বলে, আনন্দকে দেখতে পাইনি। ওর সঙ্গে আমার পুরনো সম্পর্কটা আর বাঁচিয়ে তোলা হলোই না।

এসব কথা সাক্ষাতে বলতে পারতাম না বলেই চিঠি লিখলাম। এই বৃদ্ধ বয়সেও, মনে হচ্ছে, বেশ ভাবপ্রবণই হয়ে পড়েছি। ক্ষমা করবেন।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

চিঠিটা যে মর্মস্পর্শী, সেকথা অনস্বীকার্য, তবে তখন আমার উদবেগ হলো এই ভেবে যে, এতকিছুর পর যদি তিনি বিবিসিতে চলে যান, তাহলে সবদিক থেকে আমি বিব্রত হবো। তিনি অবশ্য বিবিসি-তে আর যাননি, অধ্যাপক পদ গ্রহণ করে আপাতত চট্টগ্রামে রয়ে যান। সৈয়দ আলী আহসান পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের দুটি নতুন পদ সৃষ্টি করে আউয়ালকে বাংলা বিভাগে এবং কোরেশীকে ইনসটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজে নিয়ে যান।

আবু হেনার চিঠিতে অনুষদের যে-নির্বাচন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, সে-বিষয়ে কিছু বলি। আবদুল করিম উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ায় আমি কলা। অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন হই, তা আগে উল্লেখ করেছি। কর্তৃপক্ষ ডিন নির্বাচনের তারিখ এমনভাবে দিলেন যাতে মোহাম্মদ আলী বিলেত থেকে ফিরে তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আমি যে নির্বাচনে প্রার্থী হবো, তা ছিল অবধারিত। মোহাম্মদ আলী কাজে যোগ দিয়েই মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন, সৌজন্যের খাতিরেও আমাকে কিছু বললেন না। তাঁর স্ত্রী খালেদা হানুম আমাদের বিভাগে শিক্ষক–তিনিও তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে যোগদানপত্র দিলেন–সেটা আমি সই করে রেজিস্ট্রারের দপ্তরে পাঠাবার আগেই ভোটার-তালিকায় তার নাম মুদ্রিত হয়ে গেল। রেজিস্ট্রারকে ফোন করে জানতে চাইলাম, এটা কীভাবে সম্ভবপর হলো? তিনি লজ্জিত হয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন, আমি যেন যোগদানপত্রটা তখনই তাঁর দপ্তরে পাঠিয়ে দিই। বললাম, ‘ভয় পাবেন না-ওটা আটকে রেখে আমি আপনাকে বিপদে ফেলবো না। নির্বাচনে এখন আমাদের বিভাগ থেকে আরো দুজনকে সঙ্গে পেলেন মোহাম্মদ আলী। আমি হেরে গেলাম।

রাতে আমি যখন শুয়ে পড়েছি, তখন গেট টপকে আমাদের সহকর্মী রশীদ আল ফারুকী আমার বাসায় এলো। বললো, নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সে মামলা করতে চায়। আমি তাকে নিষেধ করলাম।

৬.

১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে টোকিওতে ইউনেসকো আয়োজন করলো এশিয়ার সাংস্কৃতিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি-সভা। উদ্দেশ্য : ইউনেসকোর সদর দপ্তরে কিছু গবেষণা-প্রস্তাব পাঠানো। শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা অধ্যাপক আবুল ফজল এতে যোগ দিতে মনোনয়ন দিলেন আমাকে। উদ্যোক্তারা দাবি করলেন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক গবেষণার সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ; আমি তা উপস্থাপন করতে সম্মতি জানালাম। তাঁরা লিখলেন, টিকিট পাঠাচ্ছেন, কিন্তু সে-টিকিট আর সময়মতো এসে পৌঁছোলো না। প্রবন্ধটাও আর শেষ করতে হবে না ভেবে যখন সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করছি, তখন ঢাকা থেকে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির টেলিফোন : চট্টগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা সময়মতো জানাতে পারেননি যে, আমাকে টিকিট দেওয়ার ফরমাশ তারা পেয়ে গেছেন। আমি বললাম, এখন আর জেনে লাভ কী? তাঁরা জানালেন, আমি অবিলম্বে ঢাকায় পৌঁছোলে সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের মাঝামাঝি ধরতে পারব। আমি বেশি আগ্রহ না দেখানোয় তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন : আমি না গেলে তারা দোষের ভাগী হবেন ইত্যাদি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সেখানে একরাত থেকে ব্যাংককে। ব্যাংককে রাত্রিযাপন করে টোকিওতে যখন পৌঁছোলাম, তখন ১৩ তারিখের অনেক রাত। যিনি বিমানবন্দরে নিতে এসেছিলেন, তাকে আমার বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করায় যথোচিত দুঃখপ্রকাশ করলেন। হোটেলে পৌঁছে দিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমার লেখাটি চাইলেন : যদিও ওটা উপস্থাপনের সময় চলে গেছে, কিন্তু তা বিলি করতে তো হবে। আমার মাথায় বজ্রাঘাত : কী করে বলি যে, সেটা লেখা হয়নি। বললাম, কাল সকালে দেবো–এত রাতে নিয়ে আর কী করবেন! তিনিও ওস্তাদ। বললেন, সকালে নিতে এলে যদি আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হয়, তাই এখনি নিয়ে রাখতে চাইছিলাম, ওটার ফটোকপি করতে হবে তো! বললাম, তার চেয়ে কিছু বেশি করতে হবে–আমার হাতের লেখা থেকে টাইপ করতে হবে, অবশ্য আপনাদের টাইপিস্ট যদি আমার লেখা পড়তে পারে! ভদ্রলোক এবারে রণে ভঙ্গ দিলেন : সকাল সাতটায় এলে কি বেশি আগে হয়ে যাবে? বললাম, আদৌ নয়। নৈশভোজের পর্ব প্লেনেই সেরে এসেছিলাম। নোটটা সঙ্গে এনেছিলাম আর গ্রন্থপঞ্জি। এক কাপ কফি খেয়ে বসে গেলাম লিখতে। হোটেলের যে-স্টেশনারি ঘরে ছিল, তাতেই লিখতে আরম্ভ করলাম। রিসেপশন থেকে কিছু বাড়তি কাগজ নিয়ে এলাম। ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু বিছানার দিকে তাকাচ্ছি না। লেখা শেষ করতে ভোর হয়ে গেল। তারপর গোসল শেষ করে সকালের নাশতার জন্যে যখন তৈরি হয়েছি, তখন কান্ডারি এলেন লেখা নিতে। আমার চুল যদি বুঝেও থাকেন, তা জানতে দিলেন না। বললেন, টাইপ হয়ে গেলে একবার দেখিয়ে নেবো। ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে সুন্দর মুদ্রণ হলো, দেশীয় নাম ও গ্রন্থনামও নির্ভুল। প্রায় তিন পৃষ্ঠার প্রবন্ধ, দেড় পৃষ্ঠার গ্রন্থপঞ্জি। সকালের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে দেখি, লেখাটি বিলির জন্যে প্রস্তুত। পরে টের পেলাম, সময়ের অভাবজনিত সংক্ষিপ্ততা আমার লেখনীর সংযম বলে গণ্য হয়ে প্রশংসাযোগ্য হয়েছে। একেই বলে লীলাখেলা!

মধ্য-এশিয়ার প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন ইতিহাসবিদ বোবোজান গফুরভ। দু বছর আগে প্যারিসে ওরিয়েন্টালিস্ট কংগ্রেসে তিনি ছিলেন, কিন্তু সেবারে আলাপ হয়নি। বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে তিনি জানতে চাইলেন, কেমন আছি এবং আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মুচকি হেসে বললেন, ইউনিফর্ম পরলে প্রত্যেক সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে আলেকজান্ডার মনে করে। বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বয়স তখন ছ মাস পেরিয়েছে। সম্মেলনে যে দুজনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাদের একজন ইন্দোনেশীয় অর্থনীতিবিদ-বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়ো, আরেকজন মালয়েশীয় স্থপতি-কুয়ালামপুরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ডিন–বয়সে আমার ছোটো। তাঁদের দুজনেরই নাম ভুলে গেছি। মনে আছে নারায়ণ মেননকে–একদা অল ইন্ডিয়া রেডিওর বড়োকর্তা, সংগীতবিশেষজ্ঞ, তখন বোম্বাইতে অবসরজীবন যাপন করছিলেন। তাঁর স্ত্রী রেখাও সুপরিচিত সংগীতশিল্পী–তিনি অবশ্য টোকিওতে আসেননি। মেনন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যখনই বোম্বাই দিয়ে আসা-যাওয়া করি, তাঁর বাড়িতে যেন অতিথি হই। আরেকজনের কথাও উল্লেখযোগ্য। তিনি এসেছিলেন আফগানিস্তান থেকে–সরকারি কর্মকর্তা, তখন আছেন বহিঃপ্রচার বিভাগের শীর্ষদেশে, কিন্তু গবেষণার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই। নিতান্ত ভালোমানুষ, খোলাখুলিই বললেন, তোমাদের মতো অ্যাকাডেমিকদের মধ্যে আমি ডাঙায় তোলা মাছ–খেই পাচ্ছি না কিছুতে, কী যে বলব, ঠাহর করতে পারি না। বললাম, কিছু যে বলতেই হবে, এমন কথা নেই। বলার কথা থাকলে বলবেন, নইলে অন্যের কথা শুনবেন কিংবা শোনার ভান করবেন। তিনি খুব একটা স্বস্তির হাসি হাসলেন। আফগানিস্তানের পরবর্তী রাজনৈতিক ডামাডোলের সময়ে আরো অনেকের মতো এই সরল মানুষটিকেও প্রাণ দিতে হলো কি না, এ প্রশ্ন আমার মনে পরে অনেকবার দেখা দিয়েছিল, তবে তার উত্তর পাইনি।

অধিবেশনে যোগ দিয়ে বুঝলাম, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জের এখানেও চলছে–গফুরভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকায়, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় থাইল্যান্ডের প্রতিনিধি। একটি খসড়ায় থাই প্রতিনিধির দেওয়া দুটি বাক্যের প্রবল বিরোধিতা করলেন গফুরভ। মীমাংসায় আসা যাচ্ছে না। আমার পাশেই ছিলেন ইন্দোনেশীয় অর্থনীতিবিদ। তাঁকে বললাম, গফুরভের কথাটা পাদটীকায় দিলে কেমন হয়? তিনি বললেন, ভালোই হয়, প্রস্তাব করে দেখুন। আমি প্রস্তাব করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সমর্থন পেয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যাপারটার শেষ ওখানে হলো না। বিকেলের অধিবেশনে থাই প্রতিনিধি বললেন, মূল খসড়ায় তার প্রস্তাবিত বাক্য তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন এবং আশা করছেন যে, পাদটীকাও সেই সঙ্গে প্রত্যাহৃত হবে। কিন্তু গফুরভ তাঁর কথা ফিরিয়ে নেবেন না। আবার অচলাবস্থা। ইউনেসকোর এশীয় আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক, জাপানি ভদ্রলোক, আমাকে আহ্বান জানালেন মতামত দিতে। আমি বললাম, দুটো বিরোধী মতকে জায়গা দেওয়ার জন্যে আমি পাদটীকার প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা না থাকলে তার টীকার সার্থকতা থাকে না। যেহেতু মূল কথাগুলি প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেহেতু টীকার আর প্রয়োজন নেই। এবারো বড়োরকম সমর্থন পেলাম, কিন্তু গফুরভ খুব বিষণ্ণ হলেন। বিরতির সময়ে বললেন, আমার মনের পরিবর্তনে তিনি খুব। আহত হয়েছেন।

পরদিন আবার এক বিতর্কের যখন অবসান হচ্ছিল না, এশীয় আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক নিজের আসন ছেড়ে আমার আর ইন্দোনেশীয়ের আসনের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা একটা সমাধান বের করো–এক্ষুনি। কিন্তু সেবার আর আমাদের কথায় কাজ হয়নি।

আমাদের প্রতিনিধি-সভা যদিও ইউনেসকোর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়, এর স্থানীয় আয়োজক ছিল টোকিওর সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়ান কালচারাল স্টাডিজ। এই কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম, আমাদের প্রত্যেককে এক বছরের জন্যে বিনা চাঁদায়। সদস্য করে নেওয়া হয়েছে। এক বৎসরের মধ্যে টোকিওয় এলে কেন্দ্রের। অতিথিশালায় সুলভে থাকতে পারবো। পুরো বছর ধরে তাদের কাছ থেকে অনেক কাগজপত্র পেয়েছিলাম।

সেই সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো এক জাপানি রেস্তোরাঁয়। ঢুকতেই সুন্দরী হোস্টেস আমার জুতো খুলতে উদ্যত হলো। আমি বাধা না দিয়ে পারলাম না। আমন্ত্রকদের একজন এগিয়ে এসে বললেন, এটাই এখানকার। দস্তুর–আপত্তি করলে তা রূঢ়তা বলে বিবেচিত হবে। অতি যত্নে মেয়েটি জুতো খুলে নিয়ে দরজা টেনে ধরলো। আমরা ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলাম। নিচু চেয়ার-টেবিল। টেবিলের মাঝখানটা বৃত্তাকারে কাটা। তার নিচে স্টোভের মতো কিছু একটা রাখা। সেটায় আগুন ধরানো হলো। একটা বড়ো পাত্রে সাদা সিরকাজাতীয় জলীয় পদার্থ এনে তার ওপর রাখা হলো। ছোটো ছোটো পেয়ালায় সস ঢেলে প্রত্যেকের সামনে দেওয়া হলো। তারপর ট্রেতে আনা হলো কাঁচা তরিতরকারি এবং গোমাংস। যার যার ইচ্ছেমতো বড়ো পাত্রে সেসব সিদ্ধ করে নিয়ে ছোটো পেয়ালার সস মাখিয়ে খেতে হয়। অতি উপাদেয়। যে গোমাংস সরবরাহ করা হলো, তা অতি বনেদি–কোবে বিফ বলে পরিচিত। গরুকে বিয়ার খাইয়ে যথাযথ পুষ্ট করার পর তা জবাই করা হয়। সে-গোশতের স্বাদই আলাদা। আমি এবং কাবুলি পাশাপাশি বসে খুব খেলাম।

দিনের বেলায় গেলাম জাপানি টি-সেরেমনিতে। অতি চমৎকার এক উদ্যান পুষ্পেপল্লবে সুশোভিত। ঝরনাধারা বয়ে চলেছে সমতলে। তার ওপর চৌকো পাথরের সারি। ইচ্ছে করলে তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে বা হেঁটে যাওয়া যায়। একটু পরে অপেক্ষাকৃত অনলংকৃত প্যাভিলিয়ন। মস্ত বড়ো কিন্তু নিচু একটা টেবিলের চারদিকে একাধিক সারিতে জায়গা করে নেওয়া হলো। জাপানি পোশাকে সুসজ্জিত কয়েকজন মহিলাও আছেন টেবিলের চারপাশে। যথাসময়ে তাদের একজন চায়ের একটি কাপ নেড়ে-চেড়ে ভালো করে দেখে পার্শ্ববর্তিনীর হাতে দিলেন। তিনি আবার একইরকম করে দেখে শুনে দিলেন পরের জনের হাতে। এমনি করে কাপটি এসে থামলো প্রথমে যিনি হাতে নিয়েছিলেন তাঁর বাঁ-পাশের জনে। এভাবে চায়ের পেয়ালা সবার কাছে পৌঁছোবার পর সুদৃশ্য টি পট থেকে চা ঢালা এবং তা ধীরে ধীরে পান করা। সময়সাপেক্ষ, তবে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার। খাওয়ার চাইতে পরিবেশন-প্রণালি এবং সবার একসঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্দোনেশীয় অর্থবিদ আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, পরে তা আমি কোথাও কোথাও উদ্ধৃত করেছি। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে-সময়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, শিক্ষার মাধ্যম ওলন্দাজ থেকে রাতারাতি পরিবর্তন করে বাহাসা ইন্দোনেশিয়া হবে। তাই হয়েছিল। তাদের শিক্ষকেরা অভ্যস্ত ছিলেন ওলন্দাজে পড়াতে। তাদের বেশ অসুবিধে হতো গোড়ার দিকে এবং দেখা যেতো, নতুন মাধ্যমে পড়াতে গিয়ে তাঁরা শতকরা নব্বই ভাগ ওলন্দাজ শব্দ ব্যবহার করছেন। কিন্তু ওইভাবে যে শুরু হলো প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে, কালক্রমে সেটিই হয়ে গেল রীতি। পরবর্তী প্রজন্মের ওই অসুবিধে আর হয়নি।

৭.

টোকিও থেকে ফেরার পথটা নিয়েছিলাম ম্যানিলা ও হংকং হয়ে। অগ্রজপ্রতিম আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন ম্যানিলায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। তাঁর ও সাবিয়ার সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতেই ম্যানিলা যাওয়া। ইউনেসকোর সভায় ফিলিপিনসের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেখানকার ন্যাশনাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। তাঁকে দিয়ে মুহিত ভাইকে আমার ম্যানিলা পৌঁছোবার দিনক্ষণ জানালাম।

ম্যানিলায় মুহিতের বাড়িতে অভ্যর্থনা জানালো তাঁর দীর্ঘকালের সেবক কাদের। প্রথমেই বললো, ‘আপনি গিয়াস সাহেবের সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসতেন না!’ আমাদের বন্ধু শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদকে কাদের আমার চেয়েও বেশি মনে রেখেছে। তাতে যেমন ভালো লাগল, তেমনি গিয়াসের জন্যে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সাবিয়া গিয়াসের সাক্ষাৎ ছাত্রী।

মুহিত-দম্পতির যত্নে সময়টা খুব ভালো কাটল। ম্যানিলার যা দ্রষ্টব্য, তা দেখা হলো। এক ফাঁকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্রন্থাগারিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এলাম। তাছাড়া দেখা হলো মমতাজ ইকবাল এবং আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চাকরি হারিয়ে আমিনুল ইসলাম যোগ দেন পাকিস্তান ইনসটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকসে। সেখান থেকে আসেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে। আমিনুল ইসলাম এক সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে আপ্যায়ন করলেন। তার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সুলতানা আরা ওরফে ইভা, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকেই আমার বছর দুই পরে এম এ পাশ করেন, সুতরাং তাঁর সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। আর ছিল তাদের শিশুকন্যা। অতিথি মুহিত ও আমি। প্রবাসী বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠানে যেতে হলো বলে আমাদের সঙ্গে সাবিয়া যোগ দিতে পারেননি।

সাবিয়া জানতে চাইলেন আমার কেনাকাটির ফর্দ কী। যখন বললাম, বেবীর একমাত্র ফরমাশ মশারির কাপড়, তখন তিনি হেসে অস্থির। বেবী তাঁর সহপাঠী। সাবিয়া বললেন, এখানে এতজন এতকিছু কেনে, কাউকে মশারির কাপড় কিনতে দেখিনি। সেটা কেনা হলো। আরো টুকিটাকি এবং সাবিয়ার দেওয়া উপহারসমেত ম্যানিলাত্যাগ।

হংকং বিমানবন্দরে যখন নামলাম, মনে হলো, প্লেনটা সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। সমুদ্র ভরাট করে জমি বাড়ানো হচ্ছে। শহরটা বড়ো হচ্ছে একটু একটু করে। বিমানবন্দর থেকে সেখানকার কর্মীদের সাহায্যে যোগাযোগ করে হোটেল অ্যামবাসাডরে জায়গা পাওয়া গেল। হংকংয়ে দেখার মতো জিনিস বেশি নেই, কেনার মতো জিনিস আছে প্রচুর। আমার সামর্থ্য ও প্রয়োজন দুইই সীমিত। আর-দশজন পর্যটকের সঙ্গে স্টার ফেরিতে কাওলুন যাতায়াত করি, হেঁটে হেঁটে একটু একটু করে শহর দেখি, দোকানপাটে চুঁ দিই। জিনিসপত্র শস্তা, তবে কোনটি আসল ব্র্যান্ড, কোনটি নকল, তা বোঝা কঠিন। একটা স্যামসোনাইট ব্রিফকেস কিনলাম–আসল-নকলের চিন্তা না করে, সেটি আর ব্যবহার না করলেও এখনো টিকে আছে। হংকংয়ের রাতের জীবনের সামান্য পরিচয় নিলাম–একটা টপলেস বারে বসে পান করে।

ব্যাংককে রাত্রিযাপন করলাম আগেরবারের মতোই এয়ারলাইনসের সৌজন্যে। সেখানে ট্যাকসি নিলেই তার ড্রাইভাররা নানারকম ছবি দেখায়, নানা জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। তাদের এড়াতে কষ্ট করতে হয়। নিজের মতো সামান্য ঘোরাঘুরি করি, খাইদাই। এখানকার হোটেল অ্যামবাসাডরের ফুড কোর্টটি বেশ পছন্দ হলো। হাতে সময় কম, একটু ক্লান্তিও বোধ হয়। তারই মধ্যে অনুভব করি, শহরটা নতুন করে এবং আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার ক্লান্তিহীন প্রয়াস চলছে।

৮.

আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিতে। কিন্তু তার আগেই, ২৯ তারিখ সকালে। খবর পাওয়া গেল, কবি নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম পিজি হাসপাতালে। লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে যখন ওপরে উঠলাম, তখন জানলাম, লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, লাশ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে। সেখানে যারা ছিলেন, তাঁরা বললেন, লাশ বাংলা একাডেমিতে। আসলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে লাশ নেওয়া হয়েছিল, তবে বেশ পরে।

পথ চলছি আর কবির কথা মনে পড়ছে। প্রথমে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৫৯ সালে, কলকাতায়। মানিকতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন তখন। শেষ দেখি বাংলা একাডেমিতে, ১৯৭৪ সালে। তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল গাড়ি করে। তিনি কিছুতেই গাড়ি থেকে নামবেন না। একরকম টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, নিজেদের খাতিরে তার ওপর অত্যাচার করছি। আমরা। সেদিনকার অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম একজন বক্তা। কবির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা ছিল পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আমি সেবারে নজরুলের গদ্যরচনার বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এসব রচনা যতটুকু সমাদর পাওয়ার যোগ্য, ততটুকু পায়নি।

বাংলা একাডেমিতে সেদিন যখন দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে এলাম, তখন দেখি প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম সেখানে উপস্থিত। তাঁর কথা থেকে মনে হলো, তিনি চাইছেন, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে কবিকে সমাহিত করা হোক। তখনই প্রথম উপলব্ধি করলাম যে, কবিকে ঢাকায় সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে কোনো এক পর্যায়ে–সে-বিষয়ে তাঁর পুত্রদের মতামত কেউ নিয়েছেন কি না, বোঝা গেল না। এটা তো সবারই জানা যে, চুরুলিয়ায় যেখানে প্রমীলাকে কবর দেওয়া হয়, তার পাশে কবির সমাধির জন্যে জায়গা রাখা ছিল। মনে হলো, এই মুহূর্তে কবির মৃতদেহের ওপরে তাঁর পরিবারের চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের দাবি অধিক।

প্রেসিডেন্টের কথার জবাবে একাডেমির মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বললেন, একাডেমির পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা-অনুযায়ী ওই প্রাঙ্গণে একটি ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট এক পর্যায়ে রুষ্ট হয়ে বললেন, আপনার পরিকল্পনা আমি ছিঁড়ে ফেলে দেবো। অনেকেই নজরুলের সমাধির স্থান সম্পর্কে সুপারিশ করতে থাকলেন প্রেসিডেন্টের কাছে। কেউ বললেন, রেসকোর্সে তিন নেতার সমাধির পাশে তার জায়গা হতে পারে। আমরা দু একজন বললাম, শহীদ মিনারের উলটো দিকের জায়গাটা বিবেচনা করা যেতে পারে। ড. রফিকুল ইসলাম ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী–সম্ভবত সেইসঙ্গে জাদুঘরের ড. এনামুল হকও-খুব করে বলতে থাকলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দিতে এবং তাঁরা নজরুলের সেই গানটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীকেও অনুরোধ করছিলেন এই দাবি জানাতে। উপাচার্য বললেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তেমন সিদ্ধান্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় সকল আনুষ্ঠানিকতা পালন করবে।

এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ফিরে গেলেন–সম্ভবত বঙ্গভবনে। সেখানে উপদেষ্টা-পরিষদের সভায় স্থির হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণেই। কবির শেষ শয্যা রচিত হবে। যথারীতি সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো। খবর পাওয়া গেল, কাজী সব্যসাচী অচিরেই ঢাকায় এসে পৌঁছোবেন। তাতে একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। রেসকোর্সে জানাজা পড়া হলো। শবাধার বহন করলেন প্রেসিডেন্ট এবং সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান। সেই সময়ে আকাশে একটি উড়োজাহাজ দেখা গেল। অনেকেই বললেন, ওই আসছে সব্যসাচী। ভিড়ের মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়–তিন বাহিনীর গার্ড অফ অনার। দিয়ে–কবিকে সমাধিস্থ করা হলো। সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও আমরা কিছু লোক দাঁড়িয়ে রইলাম। কাজী সব্যসাচী এলেন–কবরের কাছে গেলেন, বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য না করে অস্ফুটস্বরে বললেন, আমার জন্যে একটু অপেক্ষা। করলেন না!’ তিনি চলে গেলেন, আমরাও যে-যার পথ ধরলাম।

বাড়ি ফিরলাম বেশ দেরিতে। শুনলাম, টেলিভিশন থেকে বারকয়েক ফোন এসেছে, রাতে কবির সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হবে–আমি যেন অবশ্যই তাতে যোগ দিই। অবসন্ন দেহ ও মন নিয়ে টেলিভিশন-ভবনে যখন পৌঁছোলাম, তখন অনুষ্ঠান শুরু হতে কয়েক মিনিট বাকি। সকলে স্টুডিওতে একটা বড়ো টেবিল ঘিরে বসে আছেন : কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, মঈনুদ্দীন, কবীর চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফিরোজা বেগম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শাহাবুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। হয়তো হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন, ছিলেন আরো কেউ কেউ। মুস্তাফা মনোয়ার আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো তাদের মধ্যে এবং নিজেকেই জায়গা করে নিতে হলো। অনুষ্ঠানটি মর্মস্পর্শী হয়েছিল। তবে একটু ছন্দপতন হয় কাজী মোতাহার হোসেন যখন নিজের বক্তব্যের শেষে নজরুলের একটি গান গেয়ে শোনালেন, তখন।

এরপর সৈয়দ আহমদ হোসেন ও এনামুল হক মিলে উদ্‌যোগ নিয়েছিলেন নজরুলের জন্যে একটি নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠানের। আমি বাংলা বিভাগে পরীক্ষা নিচ্ছি। এরই মধ্যে আহমদ ঢুকল। তার হাতে শোকসভা আহ্বান করে লেখা পত্র–তাতে অনেকে সই দিয়েছেন এর মধ্যে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ তখন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। আহমদ তার সামনে কাগজটা খুলে ধরলো। তিনি দু-একটি নাম দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন : মস্কোওয়ালাদের সঙ্গে আমি সই দিই না।’ আহমদ বললো, ‘সার, এ তো নজরুলের জন্যে শোকসভার আহ্বান।’ আমিও তার সঙ্গে যোগ দিলাম। কিন্তু আহমদ শরীফ অবিচলিত। এসব লোকের সঙ্গে তিনি স্বাক্ষর দেবেন না। আহমদ ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে গেলো।

নাগরিক শোকসভার আহ্বানে আমার স্বাক্ষর থাকলেও সভায় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। আমাকে চট্টগ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। সভা হয়েছিল ইনজিনিয়ার্স ইনসটিটিউটে। বেশ বড়ো ও ভালো অনুষ্ঠান–দলমতনির্বিশেষে কবির প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন।

৯.

গত এক বছরে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সামরিক আইনের ঘোষণার দ্বারা সংবিধান সংশোধন করে দেশের নাগরিকদের বাঙালি না বলে বাংলাদেশি আখ্যায়িত করা হয়েছে; দালাল আদেশ বাতিল হয়েছে; রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ব্যক্তিগত খাতে ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে–মওলানা ভাসানী এই নীতি সমর্থন করেছেন। বিমানবাহিনী-প্রধান এম জি তাওয়াব পদত্যাগ করে জার্মানিতে ফিরে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সেখানেই ছিলেন, একবার কলকাতায় এসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু বিনিময়ে তিনি কী পাবেন, তা জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে জার্মানিতেই প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার কথা আমি তাজউদ্দীন আহমদের কাছে জেনেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এয়ার ভাইস-মার্শাল এ কে খোন্দকারকে সরিয়ে তাওয়াবকে বিমানবাহিনী-প্রধান করা হয়। যে-সাত মাস তিনি ওই পদে ছিলেন, সে-সময়ে তিনি পাকিস্তানপন্থী ও জামাতপন্থীরূপেই নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলেন। সিরাতুননবী-উপলক্ষে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, সমাবেশে যোগদানকারীদের দুপুরে ভালোরকম খাইয়েছিলেন পঞ্চাশ পয়সায়, সউদি আরব ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতদের দুপাশে বসিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে গালমন্দ করেছিলেন প্রচুর, এবং ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশকে তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সহকর্মীরা বোধহয় সেই মুহূর্তে অতদূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই কোথাও সংঘাত লেগে থাকবে এবং তার ফলে তাওয়াবকে বিদায় নিতে হয়। এদিকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের প্রাণদণ্ডাদেশ হয়, তার প্রাণরক্ষার যে-আবেদন করেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তা প্রত্যাখ্যান করেন, এবং পঙ্গু ব্যক্তিকে ফাঁসি না দেওয়ার প্রচলিত নিয়ম অগ্রাহ্য করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করা হয় কূটনৈতিক নিয়োগ দিয়ে–ব্যতিক্রম শুধু কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, লন্ডনে তাঁরা এই মর্মে বিবৃতি দেন যে, বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংস্রব ছিল।

বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীকে অপসারণ করা হয়। মাস ছয়েকের মধ্যে সিনেট উপাচার্য-নিয়োগের জন্যে যে-নতুন প্যানেল নির্বাচিত করে, তাতে আবার আবদুল মতিন চৌধুরীর নাম থাকে। সেইসঙ্গে নির্বাচিত হন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। উপাচার্য নিযুক্ত হন ফজলুল হালিম চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গণতন্ত্রমনা শিক্ষক–যাঁরা আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাঁরাও–সরকারের কাছে বাকশালপন্থী নির্বাচিত সিনেট ভেঙে দেওয়ার আবেদন জানান।

এ-সময়ে একদিন চট্টগ্রাম শহর থেকে ক্যাম্পাসে বাসায় ফিরে শুনি যে, আমার কাছে একজন অতিথি এসেছিলেন এবং তিনি আমাকে না পেয়ে আলমগীর সিরাজুদ্দীনের বাসায় অপেক্ষা করছেন। ফোন করে জানলাম, তিনি অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ। আসহাবউদ্দীন সাহেবকে আমি চিনি ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সময় থেকে। তিনি লায়লা নূরকে দিয়ে আমার একটি ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে তাঁর সম্পাদিত Teacher পত্রিকায় ছেপেছিলেন। তাঁকে সসম্মানে আমার বাসায় আসতে অনুরোধ করলাম। তিনি এলেন। জানতে চাইলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি কি না। আমার উত্তর শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে ময়মনসিংহ-সীমান্তে ভারত যে-হামলা করছে, আমি তার প্রতিবাদে বিবৃতি দিতে প্রস্তুত কি না। আমি বললাম, এটা সত্যিকার হামলা হলে আমি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতাম, কিন্তু হামলার বিষয়টা অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যে সরকারি প্রচার বলে সন্দেহ করার কারণ আছে। তিনি আমার কথা মানলেন না। এবারে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন কি না। তিনি বললেন, অবশ্যই করেন। আমি জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পরেও তাহলে তাদের পার্টির নামে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবহৃত হচ্ছে কেন? এ-প্রশ্নের জন্যে অধ্যাপক তৈরি ছিলেন না, কিন্তু উত্তর দিতে তার দেরি হয়নি। তিনি বললেন, পার্টি-কংগ্রেস ছাড়া পার্টির নাম বদল করা যায় না, আর কংগ্রেস ডাকার অনুকূল পরিস্থিতি এতদিন ছিল না। এখন পরিস্থিতি অনুকূল হয়েছে, কংগ্রেস করে তারা পার্টির নাম বদল করবেন।

১০.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক টিলার ওপর নির্মিত কোনো ঠিকাদারের তত্ত্বাবধায়কের কোঠা পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে ক্লাব স্থাপন করা হলো। তার আগে বিকেলবেলায় আমরা কয়েকজন পালাক্রমে একেকজনের বাড়িতে কনট্রাক্ট ব্রিজ খেলে বেড়াতাম। এখন এক ছাদের নিচে তাস, দাবা, ক্যারম খেলার এবং সেই সঙ্গে চা-পানের ব্যবস্থা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে আমরা যারা এ-দলে ও-দলে বিভক্ত ছিলাম, তারাও একসঙ্গে ওঠাবসার একটা সহজ সুযোগ পেয়ে গেলাম।

আমাদের ভাগটা ঠিক জাতীয় রাজনীতিকেন্দ্রিক ছিল না, আবার একেবারে রাজনীতিবর্জিতও ছিল না। মোটের ওপর যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের পক্ষের, তাঁরা একদিকে ছিলাম। আমাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জাসদ, সিপিবির সমর্থক ছিলেন, চীনপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন-এমনও অনেকে ছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হওয়া উচিত, কী হওয়া উচিত নয়, এটাই ছিল তাৎক্ষণিক চিন্তার বিষয়। এই ভাগাভাগি তিক্ততার সৃষ্টি করেনি–অন্তত অনেকদিন পর্যন্ত। মোহাম্মদ আলীকে আমি অনেক সময়ে তাঁর বাড়ি থেকে কলাভবনে অথবা কলাভবন থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম আমার গাড়িতে। কলা অনুষদের ডিনের নির্বাচনে যেদিন আমি তার কাছে হেরে যাই, সেদিনও তাকে অফিস থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। বলা যায়, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার একটা চেষ্টা ছিল। তবে শেষরক্ষা করা যায়নি।

ক্যাম্পাসের বাইরে আমাকে অনেক সময় দিতে হতো। ঢাকায় নানাকাজে আসতে হতো, কদাচিৎ রাজশাহীতেও যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে, তার চাইতে বেশি যাওয়া হতো কুমিল্লায় ‘অলক্তে’র নানা উপলক্ষে। তবে চট্টগ্রাম শহরে আসতাম বেশ ঘন ঘন। বন্ধুদের মধ্যে আবদুল আলী তো ছিলেনই, ১৯৭৩ সালে যুগ্ম কর কমিশনার হয়ে মোহাম্মদ আলী এলো–সে থাকলো টানা ছয় বছর। তার আগ্রাবাদের সরকারি বাসভবন বন্ধুদের আড্ডার একটা ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ালো। আমার ভাগ্নি সেলিমা ও ভাগ্নিজামাই আফজালের নাসিরাবাদের বাড়িতে যেতাম। হাবিবুল্লাহ খান ও সালমা খান-দম্পতি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসতেন–তাঁদের বাড়িতে বড়ো বড়ো জমায়েত হতো। সেখানে দুই শিল্পী-দম্পতির সাক্ষাৎ পাওয়া যেতো-রাজিয়া শাহিদ ও শাহিদের এবং চমন আফরোজ কামাল ও শামসুল কামালের। কামালদের বাড়িতেও গেছি। আরেক কামাল-ডা. কামাল এ খানের–আমন্ত্রণও ছিল অপ্রতিরোধ্য।

চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে আমার ছিল নাড়ির যোগ। রবীন্দ্র জয়ন্তী-নজরুল-জয়ন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারি-নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস–এসব পালনের জন্য যত কমিটি হতো, তাতে আমি সক্রিয় থাকতাম। এই ধরনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিবেশনে আবুল মোমেন ও কামাল এ খানের বড় ভূমিকা থাকতো। শামসুল হোসাইন ও মাহবুবুল হকও এসবের সঙ্গে জড়িত থাকতেন। মোমেনের সুচিন্তিত পরামর্শে আমি সবসময়ে উপকৃত হয়েছি।

চট্টগ্রামে যতদিন বাংলাদেশ পরিষদ টিকে ছিল, ততদিন তার অনুষ্ঠানেও যেতাম–মূলত তার পরিচালক ফখরুজ্জামান চৌধুরীর কারণে। তার সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক ছিল, তবে আমার চেয়েও তার অন্তরঙ্গতা ছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। বাংলাদেশ পরিষদের বাইরেও আমরা তিনজন মিলিত হতাম। সময় করতে পারলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন মুর্তজা বশীর এবং চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হাসনাত আবদুল হাই। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জীবনে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল এবং তার উদ্‌যোগেই সেখানে শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়েছিল। মনে পড়ে, ফখরুজ্জামান চৌধুরী একবার স্কুটারযোগে শহর থেকে আমার বাড়িতে আসতে গিয়ে যাত্রার প্রায় শেষে এসে স্পিডব্রেকারে গাড়ির গতি শ্লথ না করায় মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। স্কুটার থেকে নেমে ড্রাইভারকে তিনি একটা চড় মেরেছিলেন এবং তার দরুন তাকে দশ টাকা দিয়েছিলেন ভাড়ার অতিরিক্ত। হাসনাত আবদুল হাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চট্টগ্রামের জেলা জজ নূরুল ইসলামের সঙ্গে আমার একটা বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মুনীর চৌধুরী বইয়ের কোনো মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে জজ সাহেব আমাকে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসছিলাম বিমানে। সহযাত্রীদের মধ্যে। ছিলেন কবীর চৌধুরী এবং শামসুল কামাল। কুমিল্লা পার হতে হতে বিমানটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পড়ে প্রায় ওলট-পালট করতে থাকল। কোনো কোনো যাত্রীর আসনের সামনের ট্রেতে রাখা গ্লাস উড়ে গিয়ে কেবিনের মধ্যে লুটোপুটি খেতে লাগল। ক্রুদের পাংশু মুখ দেখে বিপদের মাত্রা অনুধাবন করতে পারছিলেন যাত্রীরা। শেষ পর্যন্ত আবার ওই দুর্যোগের মধ্য দিয়েই বিমান ফিরিয়ে ঢাকায় নিয়ে এলেন পাইলটেরা। পরে জেনেছিলাম, বিমানের রাডার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং ককপিট থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মহিলা এবং নাবালকদের আগে নামবার সুযোগ দিতে আসনে বসে রইলাম। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ১৪-১৫ বছর বয়সের একটি মেয়ে আমার গায়েই বমি করে দিলো। তেজগাঁও বিমানবন্দরের টয়লেটে গিয়ে যতটা-পারা যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া গেল। কবীর ভাই যাত্রা বাতিল করে বাড়ি ফিরে গেলেন। শামসুল আলম ফোন করে তার অফিস (গ্ল্যাকসো) থেকে গাড়ি আনালেন। সেই গাড়িতে আমরা দুজন চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলাম–ফেনীতে তাঁর বাড়ি হয়ে।

১১.

লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পরিচালক জোন ল্যানকাস্টারের চিঠি পেলাম। লিখেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের যে হ্যান্ডলিস্ট আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম, সেটা নিয়ে আলোচনা করে তাঁরা ওইসব কাগজপত্রের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকাপ্রণয়নের আবশ্যকতা অনুভব করেন। আমি সে-কাজটা করব কি না, তা জানতে যখন তারা আমার খোঁজ করেন, তখন শোনেন, আমি দেশে ফিরে এসেছি। ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ওরিয়েন্টাল ডকুমেন্টস্ কমিটির কাছ থেকে তারা আমার তিন মাসের ব্যয়নির্বাহের একটা ব্যবস্থা করেছেন। এখন আমি যদি কাজটা করতে সম্মত হই এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে তাঁরা বাধিত হন।

আমি প্রলুব্ধ হলাম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করলাম লন্ডন যাওয়া-আসার বিমানভাড়া চেয়ে। উপাচার্যের সুপারিশসহ সে-আবেদন হাতে হাতে নিয়ে গেলাম অধ্যাপক এম এ বারীর কাছে। তিনি খুব উৎসাহী হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কমিশন থেকে এজন্যে অর্থ-মনজুরি সম্ভবপর, তবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কিছু সময় লাগবে।

আবদুল মোমেন ততদিনে লিডসের পাট চুকিয়ে লন্ডনে চলে এসেছেন। সপরিবারে। তাঁকে লিখলাম মাথা গোঁজার একটা ঠাই ঠিক করে দিতে। তিনি পত্রপাঠ লিখলেন, তাঁদের সঙ্গে আমি অনায়াসে থাকতে পারি।

১৯৭৭ সালের ২৫ মার্চ সকালে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ল্যাম্বল স্ট্রিটে মোমেনের কাউন্সিল-ফ্ল্যাটে। তিনি ছিলেন না। রোজী হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন, কৌতূহলের সঙ্গে রঙ্গন। মোমেন সর্বক্ষণের চেয়েও বেশি সময় কাজ করেন ক্যামডেন কাউনসিল ফর রেস রিলেশনসে। রোজী কাজ করেন। খণ্ডকাল। ছেলে স্কুলে যায়। প্রকৃতপক্ষে ছেলের ঘরই আমি অধিকার করলাম। সে গেল বাপ-মার ঘরে।

সপ্তাহের দিনগুলোয় সকালবেলায় নাশতা খেয়ে চলে যেতাম লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে কোনোদিন বিবিসি হয়ে, কোনোদিন আর কোথাও গিয়ে, কোনোদিন সিনেমা-থিয়েটার দেখে রাতে ফিরতাম। ফিরে কখনো একা, কখনো একসঙ্গে, চা-কফি খেতাম। শনিবারে মোমেনদের সঙ্গে বাজারে যেতাম, আমিও টুকটাক কিছু কিনতাম এবং তাঁদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারতাম। রঙ্গনের সঙ্গে আমার একটা লেনদেনও চুকিয়ে ফেলতে হতো সেদিনে। সে বুদ্ধিমান, চঞ্চল ও কৌতুকপ্রবণ। তার চাঞ্চল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমি প্রস্তাব করলাম, তার সেবার জন্যে সে এক পেনি করে পাবে, আর আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করলে তার এক পেনি জরিমানা হবে। যেমন, সকালে সে আমাকে চিঠি এনে দিলে তার হিসেবে এক পেনি জমা হবে, আবার পায়ে-পা দিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তার এক পেনি জরিমানা হবে। এই যোগ-বিয়োগের পরে যা তার প্রাপ্য হতো, সেটা তাকে দেওয়া হতো শনিবারে, বাজারে গিয়ে। তা দিয়ে সেখানেই সে কিছু কিনে নিতো। জরিমানা দিতে তার আপত্তি ছিল না, তবে সে খেয়াল রাখতো যাতে সপ্তাহান্তে তার হাতে কিছু জমা পড়ে। আয় বাড়াবার চেষ্টাও তার ছিল। যেদিন দুটো চিঠি আসততা, সেদিন সে জানতে চাইতো তার পাওনা এক পেনি হলো, না দুই পেনি। আমি বলতাম, এটা একবারের সেবা, অতএব এক পেনি। সে মেনে নিয়ে চলে যেতো। যে-সপ্তাহে সেবা বেশি হতো, সে-সপ্তাহে তার জরিমানা দেওয়ার প্রবৃত্তিও একটু বাড়তো।

আমি একবার আমার ছাত্রী নাসরীন ওরফে হেলেনের বাড়িতে এই ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। কদিন পরে সে বললো, সার, কী গল্প আপনি করে এলেন! এখন কোনো কাজ করতে বললে আমার মেয়ে বলে, এক পেনি দিতে হবে।’

মোমেনদের বাড়িতে আমি মহা-আনন্দে ছিলাম। তার একটা প্রধান কারণ, তারা আমাকে অতিথি জ্ঞান করতেন না। আমি নিজের মতো থাকতাম এবং আসা-যাওয়া করতাম।

একরাতে বাড়ি ফিরে আমি ইলেকট্রিক কেতলি চালু করে দিলাম। আমার মনে হয়েছিল, তাতে পানি আছে, আসলে ছিল না। ফলে সেটা নষ্ট হয়ে গেল এবং আমি খুব বিব্রত বোধ করলাম। একজনের নাম করে মোমেন বললেন, ‘আমি তাঁর ইলেকট্রিক কেটল এরকম নষ্ট করে ফেলেছিলাম। উনি বলেছিলেন, সারিয়ে আনলেই হবে।

আমি পরদিন মোমেনদের কেতলি সারিয়ে এনেছিলাম।

মোমেনের কাজ ছিল ক্যামডেন এলাকার শ্রমজীবী বাঙালিদের দেখাশোনা করা। তার সঙ্গে অমন এক-আধজনের বাড়িও গিয়েছি। বাড়ির লোকদের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয়নি। মোমেনের কাছে লন্ডনের রেস্টুরেন্ট-কর্মী অনেক আসতেন। এঁরা লন্ডনের নানা এলাকায় থাকতেন ও কাজ করতেন। তাঁদের সঙ্গে আমারও ভালোই আলাপ হতো। কর্মীদের সমবায়ভিত্তিক মালিকানায় রেস্টুরেন্ট চালাবার সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা আলাপ করতেন। তাঁদের সে-প্রয়াস পরে সফল হয়েছিল।

মোমেনের সহকর্মীদের কারো কারো সঙ্গে পরিচয় হয়। সামিন ছিলেন সালমান রুশদির বোন। জ্যান ড্রাইডেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গিনী। বর্ণবৈষম্যের দেশ ছেড়ে এসেছে, লন্ডনে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কাজ করে প্রায়শ্চিত্ত করছে অন্যের হয়ে। আশা করছে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবে।

মোমেনের কাজ চিত্তাকর্ষক, সহকর্মীরাও আন্তরিক। তাই কাজে ডুবে থাকা তার পক্ষে সহজ। তিনি স্কোয়াটারদের পক্ষে, আমি দোমনা। গৃহহীনদের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু দল বেঁধে অন্যের সম্পত্তি দখল করা! তিনি। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখান, আমি শুনি।

এমনি করে মোমেনের কাছ থেকে চিন্তা-উদ্রেককারী অনেককিছু শুনতে পাই।

১২.

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসলাম চিঠিপত্রের খাতা নিয়ে। ঢাকা কুঠির অধীনে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরায় কোম্পানির আটটি আড়ং ছিল। এ আড়ং মেলা নয়, কোম্পানির ফরমাশমতো কাপড় বুনে তাঁতিরা এখানে জমা দিয়ে দাম বুঝে নিতো। ফরমাশ আসততা লন্ডন থেকে কলকাতায়, সেখান থেকে ঢাকা কুঠিতে, কুঠি থেকে আড়ংয়ে। আড়ংয়ের গোমস্তা দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করাতেন। কাপড় বিন্যস্ত হতে পাঁচ শ্রেণিতে। গোমস্তার মনঃপূত না হলে একশ্রেণির কাপড় হয়তো নেওয়া হতো তার নিচের শ্রেণিতে, নয়তো ফেরত দেওয়া হতো। তাঁতির পাওনা থেকে দাদনবাবদ দেওয়া টাকার হিসাব বাদ দিয়ে যদি তার কিছু প্রাপ্য হয়, পেতো। নইলে নতুন করে দাদন নিয়ে সে কোম্পানির কাছে বাঁধা পড়ে থাকতো। এক আড়ংয়ে একবার ঢাকা থেকে যে-পরিমাণ টাকা গিয়েছিল, টিক সেই পরিমাণ টাকাই আদায় হিসেবে ফিরে আসে। দাদন নেওয়া তাতি অন্য কারো কাছে কাপড় বেচতে পারতো না। সে মারা গেলে কোম্পানি তার ঘটিবাটি বেচে দাদনের টাকা আদায় করতো। গোমস্তারা যে পরিমাণ কাপড় আদায় করতে চাইতো, তা-অনেক সময়ে তাঁতি দিতে পারতো না। তখন সে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যেতো, পেশা বদল করে অন্য কোথাও বসবাস করতো।

আমি এসব চিঠির সার-সংকলন করতাম ইংরেজিতে। চিঠির ওপরে ইংরেজিতে কিছু নোট রাখতেন ফ্যাক্টর বা তাঁর অধীন কোনো ইংরেজ কর্মচারী। সেগুলো কাজে লাগতো। একবার ferretted শব্দ দেখে খুব বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। যখন নতুন-পুরোনো কোনো ইংরেজি অভিধানে তা খুঁজে পেলাম না, তখন বুঝতে পারলাম, ওটা ফেরত শব্দের সাহেবি রূপ। লাইব্রেরিতে বসে যা নোট করি, বাড়ি এসে সেসব গুছিয়ে পরিষ্কার করে লিখি। তারপর মাইকেল ও’কিফের হাতে দিই। লাইব্রেরির টাইপিস্টকে দিয়ে টাইপ করিয়ে সেগুলো সে। আমাকে দেয়। আমি আবার বাড়িতে বসে সংশোধন করি। তারপর চূড়ান্তভাবে টাইপ হয়। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে মাইকেল ছিল আমার প্রধান সহায়। দুই উপপরিচালক মার্টিন ময়ার ও আর, ডেসমন্ড খোঁজখবর নিয়ে এবং অন্যভাবেও সাহায্য করেন। পুরোনো মানচিত্র থেকে আড়ংয়ের অবস্থানগুলো দেখিয়ে দেন। অ্যানড্র কুক।

লাইব্রেরির সলিম কুরেশি একদিন স্যান্ডউইচের দোকানে পরিচয় করিয়ে। দেন বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক বাললাচের সঙ্গে। আমার পরিচয় দিতেই বালোচ প্রশ্ন করলেন, তোমরা শেখ মুজিবকে মারলে কেন? আমি এ-প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিলাম না। কী বা বলতে পারি তার উত্তরে। সলিম বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদ করায় বালোচকে জেল খাটতে হয়েছিল। এমন লোককে কি বলা যায় যে, তোমার মানবিক মূল্যবোধ বৃথা হয়েছে বাংলাদেশে। বালোচ গবেষণা করছিলেন জার্মানিতে। তার উপকরণ সংগ্রহ করতে গ্রীষ্মকালে এসেছেন লন্ডনে। পরে ১৯৭৯ সালে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল, সেকথা যথাস্থানে।

সেই স্যান্ডউইচের আড্ডায়ই এক তরুণ ইংরেজ আমাকে বলেছিল, তার বাড়িতে মাদকের আসর বসে মাঝে মাঝে। আমি গেলে সে স্বাগত জানাবে। শুনে মোমেন বললেন, অভিজ্ঞতাসঞ্চয়ের জন্যে যেতে পারেন। আমি সাহস করিনি।

১৩.

বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে তখন কমল বোসের বিদায় নেওয়ার পালা। সেই কবে এসেছিলেন, তিনি যে একদিন থাকবেন না বিভাগে, কারো তা মনে হয়নি। তার বিদায়-উপলক্ষে বেশ কটি পার্টি হলো। আমি প্রায়ই উপস্থিত থাকলাম।

সিরাজুর রহমান এখন কমল বোসের জায়গাটি নিলেন–জন ক্ল্যাপহামের পরেই তার স্থান। তিনি আমাকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ডাকেন। ডাকেন দীপংকর ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক, শ্যামল লোধ। নূরুল ইসলাম আমাকে দিয়ে ছোটোদের জন্যে তিন মাসের কথিকা একসঙ্গে রেকর্ড করিয়ে নিলেন। তেরোটা কথিকা একসঙ্গে রেকর্ড করলাম–পানি না খেয়ে, স্টুডিওতে যে-মেয়েটি কাজ করে, সে নাকি একটু অবাক হয়েছিল তাতে।

সৈয়দ হক সবে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় রচনা শেষ করেছেন। আমি তার পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠক। কিছু পরামর্শ দিই নাট্যকারকে। তিনি অনেকখানি গ্রহণ করেন।

বিবিসির অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, নিচের তলায় বিবিসি ক্লাবে আড্ডা হয় অনেকের সঙ্গে। মানসী বড়ুয়া ও সেই সূত্রে সরোজ বড়ুয়ার সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কের সূচনা হয়ে গেল। মানসী তার বাড়িতে একদিন খাওয়াবে আমাকে, আমি লন্ডন ছাড়ার আগে। কিন্তু হঠাৎ সে সড়ক-দুর্ঘটনায় আহত হলো ভয়ংকর। হাসপাতালে দেখতে গেলাম। মানসী কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, আনিস ভাই, তোমাকে আমার খাওয়ানো হলো না।

আমি বলি, ‘এবার না হোক, আবার হবে।’

আমার কথা ঠিক হয়েছিল।

১৪.

আগেরবার যখন লন্ডনে ছিলাম, তখন নবনীতা দেবসেন তার বন্ধু ডা. অমেয়া দেবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। নবনীতার মতো অমেয়া নামটিও, শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তবে নবনীতা দেব, আর অমেয়া দেবা। দেব না হয়ে দেবা কেন, তা কি ইংরেজি বানানের মর্যাদা রক্ষা করতে–কেউ কেউ পরে জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে। বলেছিলাম, ইংরেজি বানান নয়, সংস্কৃত উচ্চারণ রক্ষা করতে। বাংলায়ও সে-উচ্চারণ অটুট আছে ‘যেমন দেবা তেমনি দেবী’ এই প্রবাদবাক্যে। অমেয়ার ডাকনাম বুলু। বহুকাল ধরে সে লন্ডনে। জিপি অর্থাৎ জেনারেল প্র্যাকটিশনার।

এবারে গিয়ে ফোন করতেই বুলুর সাদর আহ্বান। সে থাকে পূর্ব লন্ডনে–আমরা যাকে পূর্ব লন্ডন বলে শনাক্ত করি, তার কিছুটা উত্তরে–এক চারতলা বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে। সাউথ উডফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে একটু হেঁটে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল আসবাব আর বইপত্রে ঠাসা ঘর। পরে জানা গেল বাংলা গান ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিশাল সংগ্রহ তার। বুলু নিজে রান্না করেছিল। কিন্তু যা খেলাম, তার অনেকখানিই উদ্‌গিরণ করে দিলাম। ডাক্তারের বাড়ি, সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে ওষুধও খেতে হলো। আমার লজ্জার মাত্রা তাতে একটু বাড়লো।

বুলু লন্ডনের ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। ইউরোপে কোনো সম্মেলনে অচিরে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে তার প্রবন্ধ পড়ার কথা। এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্ম-আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বাক্যবিনিময় হলো। আমি যতদূর জানতাম, তার প্রায় সবটাই বলা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে বুলুর ভুল ধারণা হলো যে, এ-বিষয়ে আমি অনেক জানি, যা প্রকাশ করেছি তা সামান্যমাত্র। সুতরাং তার দিক দিয়ে আলোচনার একটা তাগাদা রয়ে গেল। আবার যাওয়ার আমন্ত্রণটা আর লৌকিক শিষ্টাচারে সীমাবদ্ধ রইল না।

সেই থেকে উভয়ের অবসরের সময়টা মিলে গেলে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। হয় আমি তার বাড়ি গিয়েছি, নয় ওয়ালথামসটো আন্ডারগ্রাউন্ডের বাইরে অপেক্ষা করেছি–বুলু সার্জারিফেরত তুলে নিয়েছে। কখনো আমরা অন্যত্র মিলিত হয়েছি। বইপড়ার যথেষ্ট সময় না পেলেও বুলু বই কিনতে ভালোবাসততা, সিনেমা-থিয়েটারে যেতে চাইতো। পাবে বসতে বা বাইরে খেতেও সে আগ্রহী ছিল। এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় একা যাওয়া যায় না বা একা যেতে ভালো লাগে না। তার সঙ্গে রুচির মিল থাকায় এসব জায়গায় একসঙ্গে যাওয়া আমরা উপভোগ করেছি। অনেক সময়ে–বিশেষ করে সে ‘অন কল’ থাকলে–তার বাড়িতে বসে গল্প করেছি, কখনো তার রান্না খেয়েছি, কখনো বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া হয়েছে।

গাড়িচালনায় বুলু ক্লান্তিহীন। কখনো কখনো এতটা পথ আমাকে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সাধারণত আমি নিজের মতোই ফিরেছি। একবার গল্প করতে করতে টিউব-চলাচলের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ট্যাকসি নিতে হয়।

আরেকবার ফিরতি ট্রেনে খানিকক্ষণ চলার পরে টের পাই, ঘরের বাইরের দরজার চাবি আনতে ভুলে গেছি। মোমেনরা আগেভাগে শুয়ে পড়েন। অত রাতে ঘুম থেকে তাদের জাগিয়ে আমার বাড়ি ফেরার কথা নয়। সুতরাং পথে নেমে চলে গেছি বুশ হাউজে। বিবিসির ভোরের বাংলা অনুষ্ঠান করতে যিনিই আসেন, তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া যাবে। গিয়ে দেখি, সেদিন শফিক রেহমানের পালা। আমার সংকটের কথা বলতে তিনি বললেন, আজই আমাদের বন্ধু মোকাম্মেল হক এসেছে তার নবপরিণীতাকে নিয়ে। ছেলের ঘরটা তারা নিয়েছে। আরেকটা বাড়তি ঘরে আমার জায়গা হতে পারে, তবে সেটা হয়তো আরামদায়ক হবে না। বললাম, এক রাতের জন্যে এমনকী আর অসুবিধে হবে!

রাতটা কাটিয়ে সকালে নাশতা খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিলাম। মোকাম্মেলের স্ত্রী তালেয়ার সঙ্গে পরিকল্পনা করতে থাকলো দোকানে যাওয়ার এবং বিনোদন সন্ধান করার আগ্রহে।

বুলুর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি কোনো কৌতূহল প্রকাশ করিনি। ফলে একটু একটু করে সে-ই অনেকটা জানাতে থাকে। জীবনের দাক্ষিণ্যলাভ সবার ঘটে না। কেউ কেউ সেই ক্ষতির পূরণ খোঁজে কাজে ডুবে গিয়ে। দেশে বুলুর মা এবং ভাইবোনেরা আছেন তাদের জন্যে সে কর্তব্যের অধিক করতে চায়। সে সহজে বন্ধুত্ব করে, বন্ধুদের জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেয়, মাঝে মাঝে সেখানেও ধাক্কা খায়। ফলে তার স্বভাবের একটা দিক স্পর্শকাতর হয়ে থাকে।

মানসীদের সঙ্গে বুলুর আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে, দীপংকর ঘোষদের সঙ্গে আছে আগে থেকে যোগাযোগ। সিরাজুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় আছে, সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গেও আছে আলাপ। বিবিসি ক্লাবে আসে সে, তবে কদাচিৎ, নাজির আহমদ তাকে খুব পছন্দ করেন।

তার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব অনেক আসেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমার বিশেষ ভালো লাগে রানা বলে তার দূরসম্পর্কের এক ভাইকে।

এবারে লন্ডন থেকে ফেরার পূর্বমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ মনে পড়েছে : প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,/ মাধুর্যসুধায়। মনে মনেই তা বলেছি, কারো সামনে উচ্চারণ করিনি। বোধহয় তার প্রয়োজনও ছিল না।

১৫.

আমাদের ফুপা, পুলিশের ডিআইজি, আবু কামাল লন্ডনে এসেছেন সরকারি কাজে। কাজ সারার পর দিন দুই সময় আছে তার হাতে। ওই দুদিন আমি তার সঙ্গে ঘুরি। দ্রষ্টব্য কিছু দেখাতে নিয়ে যাই অথবা কেনাকাটায় সাহায্য করি।

অক্সফোর্ড স্ট্রিট দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে, অনিরুদ্ধ রায় বসে আছে এক রেস্টুরেন্টে। একই টেবিলে এক শ্বেতাঙ্গিনী ও একটি শিশু।

ফুপাকে বলি, চলুন, এখানে চা খেয়ে নিই। তারপর দ্রুত অনিরুদ্ধের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি, মহিলাকে না হয় বুঝলাম, বাচ্চাটা এলো কোথা থেকে?

অনিরুদ্ধ চমকিত, আমাকে দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত, আমার প্রশ্ন শুনে হেসে কুটিকুটি। প্যারিসে যাচ্ছে সে লাইব্রেরি ও আর্কাইভসে বইপত্র ঘাঁটতে। যাওয়ার পথে লন্ডনে থেমেছে। আরো দু-একদিন থাকবে। আছে ইন্ডিয়ান ওয়াইএমসিএ-তে।

ফুপার কাজ শেষ করে সপ্তাহান্তটা ব্যয় করি অনিরুদ্ধের সঙ্গে। আনন্দদায়ক সময় কাটে।

তখন মারারজী দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সভায় তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। অনিরুদ্ধ যায়নি সেখানে, তবে তার সহবাসীদের কাছে বিবরণ শুনেছে। প্রথমে তো মোরারজী তাঁর বিখ্যাত ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন স্বাস্থ্য ভালো রাখার। তারপর ব্রিটেনে বর্ণবাদী মনোভাব সম্পর্কে এক শ্রোতার অভিযোগের জবাবে দিয়েছেন সহজ সমাধান : ইউ লাভ দেম, দে উইল লাভ ইউ।

আমি যে লন্ডনে কাজের কিছু করছি, অনিরুদ্ধ তা স্বীকার করে না। বলে, ওসব আমার বেড়াতে আসার ছল।

যাওয়ার আগে সে আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। বললো, দোকানে গিয়ে কাপড়টা পালটে নিয়ে তার কাছে যেন ডাকযোগে পাঠাই প্যারিসে। ইচ্ছে না থাকলেও কাজটা করতে হলো।

প্যারিস অনিরুদ্ধের দ্বিতীয় শহর। কারো ভারত ভ্রমণকাহিনি নিয়ে কাজ করছে তখন সে। কাজটা করে খুব সুখ পাচ্ছে।

১৬.

কামাল হোসেনরা অক্সফোর্ডে আছেন। এর মধ্যে রেহমান সোবহান এসে সেখানে যোগ দিয়েছেন কুইন এলিজাবেথ হাউজে। কুইন এলিজাবেথ হাউজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নূরুল ইসলাম–এফএওতে একটা বড়ো পদে যোগ দেবেন, থাকবেন রোমে। ওদিকে মুশারফ হোসেনও চলে এসেছেন অক্সফোর্ডে।

আমাদের বন্ধু অর্জুন সেনগুপ্ত ব্রাসেলসে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিল। দিল্লিতে সরকারবদলের ফলে তার সে-দায়িত্বের অবসান ঘটেছে। সেও চলে এসেছে। অক্সফোর্ডে।

অক্সফোর্ডে গেলে সব সময়ে ভালো লাগতো। এখন সময়টা আরো জমিয়ে কাটে।

তপন রায়চৌধুরীর অধীনে পিএইচি ডি ডিগ্রির জন্যে গবেষণা শুরু করেছেন হামিদা হোসেন। যদিও ছাত্রী তিনি ইংরেজি সাহিত্যের, তবে ইতিহাসের গবেষণায় তা বাধা হয়নি। তাঁর বিষয় : বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাদন নেওয়া তাঁতিদের অবস্থা। গবেষণার কাজে তিনি আসেন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। আমি যেসব চিঠিপত্র ঘাঁটছি, তা তার কাজে আসে। তিনি আমাকে কিছু প্রাসঙ্গিক সূত্রের খবর দেন, তা আমার কাজে লাগে।

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম ও শরীফউদ্দীন আহমদ নিয়মিত আসেন, আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুশীল চৌধুরী। কিংস কলেজের পিটার মার্শাল আসেন, আমার কাজকর্মের খবর নেন।

তার নতুন বই বেরিয়েছে East Indian Fortunes–আমি তা সংগ্রহ করি।

লাইব্রেরিতে একদিন একটি ভারতীয় মেয়ে বললো, আপনাদের রাষ্ট্রপতির মেয়ে থাকে আমাদের হস্টেলে। আমার কাছ থেকে আপনার কথা জেনে সে যেতে বলেছে আপনাকে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছে নিগার। এখন লন্ডনে এসেছে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিতে। গেলাম তার কাছে। গল্পসল্প হলো। রাজনীতির কথা হলো খুবই সামান্য। মনে হলো, বিচারপতি সায়েম খুব ভালো অবস্থায় নেই।

সোয়াসে যাই। প্রফেসর স্মিথ সৌজন্য প্রকাশ করেন, তবে আমার কাজে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। আমি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে কোম্পানির কাগজপত্র নিয়ে এত উৎসাহী কেন, তিনি তা বুঝে পান না।

তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটাই। রাজেশ্বরী দত্তের ঘরটা বন্ধ–কাউকে তা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। সেদিকে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস চাপি। তারাপদর বাড়িতে দেখা হয় সস্ত্রীক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে।

নাজিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সোয়াসে। সাজ্জাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সে এক বয়স্ক ব্রিটিশকে বিয়ে করেছে। তাদের বাড়ি যাই একদিন।

লাইব্রেরির কাজ তিন মাসে শেষ হয় না–আরো এক মাস লেগে যায়। চলে আসার আগে জোন ল্যানকাস্টার আমার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। বাস্তবিকই ভোজ–পাঁচটি কোর্স অন্তত, দুরকম ওয়াইন। লাইব্রেরির ওপর দিকের তিন-চারজন কর্মকর্তার সঙ্গে মাইকেলও আমন্ত্রিত। আমি খুব সম্মানিত বোধ করি।

৩০ জুলাই দেশের পথে রওনা হই।

১৭.

এর মধ্যে দেশে অনেক কিছু ঘটেছে।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। হঠাৎ করেই মওলানা ভাসানী বললেন, দেশবাসী এখন নির্বাচন চায় না। তাহলে কি তারা চায় সামরিক শাসন চলুক? এ-প্রশ্ন ওঠার বা তার জবাব দেওয়ার আগেই মওলানা মৃত্যুবরণ করলেন। আর কী আশ্চর্য! তার পরপরই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করলেন রাষ্ট্রপতি। বললেন, যথেষ্ট সময় নেই। তারপরই তিনি প্রধান সামরিক শাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করলেন উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে। কয়েক মাস পরে স্বাস্থ্যগত কারণে বিচারপতি সায়েম ত্যাগ করলেন রাষ্ট্রপতির পদ। জিয়া রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন-অনুষ্ঠানের, আর ৩০ মে। রাষ্ট্রপতিপদে গণভোটের। তিনি তো স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে খালখনন, খালনদী পুনঃখননের কর্মসূচি দিয়েছিলেন আগে, এখন ১৯ দফা কর্মসূচি দিলেন। তার প্রতি বড়রকম সমর্থন জানালেন মোহাম্মদ তোয়াহা, জিয়ার কাজকর্মের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করলেন–সংবিধানের সূচনায় সংযোজন করলেন বিসমিল্লাহ, প্রস্তাবনায় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের বদলে আনলেন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় আনলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা করলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার বলে।

৩০ মে গণভোট হলো। জিয়াউর রহমান প্রায় ৯৯ শতাংশ হাঁ-ভোট পেলেন। যেদিন এ খবর পাওয়া গেল, সেদিন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ওয়াশরুমে হাত ধুচ্ছি, এক মধ্যবয়সী ইংরেজ জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের রাষ্ট্রপতি শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পেলেন না কেন–তোমার মতো দু-চারজন। দেশের বাইরে আছে বলে?’ গণভোটের পরে তাঁর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন খান আবদুস সবুর খান ও আতাউর রহমান খান।

আরো একটা মজার ব্যাপার ঘটলো। জুনে জিয়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন লন্ডনে। সঙ্গে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক। প্রচারমাধ্যমে দেখি তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ-দেশে উপদেষ্টার কোনো অর্থ হয় না, তাই মন্ত্রী না হলেও তাঁকে অভিহিত করা হচ্ছে মন্ত্রী বলে।

বিচারপতি আবদুস সাত্তার উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন–যেমন, হাফিজউদ্দীন, আকবর কবির। নতুন উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন আমার বন্ধু মোজাফফর আহমদ, আত্মীয় জামালউদ্দীন আহমদ, বহুদিনের পরিচিত শামসুল হুদা চৌধুরী ও আবদুল মোমেন খান।

কোথায় যাচ্ছি আমরা, কে বলবে!

১৮.

এবারে বিদেশে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, এই যাত্রার সময় থেকেই বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে আমি অব্যাহতি নিচ্ছি, অতএব আমার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিযুক্ত না করে যেন পূর্ণ মেয়াদে নতুন সভাপতি নিয়োগ করা হয়। আমার মনের মধ্যে এই ভাবনা ছিল যে, তাতে ১৯৭৫ সালে কিছুটা নিয়মভঙ্গ করে আমার আবার সভাপতি হওয়ার ব্যাপারটার খানিক শোধন হবে। কর্তৃপক্ষ যথারীতি আবু হেনা মোস্তফা কামালকে নতুন সভাপতি নিযুক্ত করেন। ফিরে এসে আমি শুধুই শিক্ষক হয়ে থাকি, তবে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের সঙ্গে নানা কাজে আমার সংশ্লিষ্টতা থেকেই যায়।

জহুরুল হকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশন যে-রিপোর্ট দিয়েছিল, তাতে সরকার খুশি হয়। সুতরাং একই কমিশনকে দেওয়া হয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম তদন্ত করার দায়িত্ব। কমিশন চট্টগ্রামে এলে তাঁদের সামনে হাজির হতে ডাক পড়ে আমার। কমিশনের সভাপতিই আমার কাছে জানতে চান, এই যে কর্মে কনিষ্ঠ একজন বিভাগীয় সভাপতির অধীনে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে, সেটা আমার কেমন লাগছে? আমি বলি, আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। আমি যখন সভাপতি ছিলাম, তখন সহকর্মীদের নিজের অধীন বিবেচনা করিনি, এখনো নিজেকে কারো অধীন মনে করছি না। সভাপতি সহকর্মীদের নেতৃত্ব দেন, তার কমবেশি তো নয়। জহুরুল হক বলেন, ‘ও, আপনি দেখছি তাহলে নব্যপন্থী। আপনার ক্ষেত্রে কী হয়েছে জানি না, তবে সিনিয়রকে বাদ দিয়ে জুনিয়র চেয়ারম্যান হবেন–দিস ইজ হার্ডলি অ্যাকসেপ্টেবল। আমি হাসলাম, তর্ক করলাম না।

তিনি এবারে প্রশ্ন করলেন, আপনার সময়ে সুলতান আহমদ ভূঁইয়া নামে একজন টিচার অ্যাপয়েনটেড হন। তাঁর তো অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ভালো নয়। হাউ ওয়াজ ইট পসিবল?

সুলতান আহমদ ভূঁইয়া আমাদের উপাচার্য আবদুল করিমের সহাধ্যায়ী ছিলেন, তবে এমএ পাশ করেছিলেন পরে, ১৯৫১ সালে। তার পরীক্ষার ফলাফল তেমন ভালো ছিল না, কিন্তু যাকে আমরা বলি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য-বিশেষ করে সে-সময়কার মুসলমান কবিদের বিষয়ে তিনি ভালো জানতেন। ছাত্রাবস্থায় মাহে নও পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে তার উল্লেখ আছে। পরে তিনি যশোর ক্যাডেট কলেজে এবং বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। আবদুল করিম উপাচার্য হওয়ার পরে তিনি তাকে ও আমাকে একই সঙ্গে চিঠি লেখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়োগ হতে পারে কি না, তা জানতে চেয়ে। তার বিশেষজ্ঞতা আমাদের কাজে আসবে ভেবে আমি আগ্রহ প্রকাশ করি। উপাচার্য এতে স্বস্তি পান। আমরা তাঁকে চাকরির জন্য আবেদন করতে উৎসাহিত করি। তিনি নিয়োগলাভ করেন।

মনে হয়, এটা অনিয়ম বিবেচনা করে, আমাদের কোনো সহকর্মী এদিকে তদন্ত কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি কমিশনকে ওপরের কথাগুলো বলি। নিজের দায়িত্ব স্বীকার করি। কমিশনকে বোধহয় ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, উপাচার্যের ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি মাত্র। সেটা যে ঠিক নয়, সে কথা আমি কমিশনকে জানাই।

সুলতান আহমদ ভূঁইয়া অবশ্য আমাকে হতাশ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে গবেষণায় তাঁর আর আগ্রহ দেখা যায়নি। আমি তাকে শেখ। চাঁদের কাব্য সম্পাদন করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পিএইচডি ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে অথবা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের লক্ষ্যে কাজটি তিনি করতে পারেন। তিনি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু কাজে প্রবৃত্ত হননি। তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে ছাত্র বা সহকর্মীদেরও আগ্রহী করে তুলতে পারেননি।

কমিশন এ-বিষয়ে কী বলেছিলেন, তা আমার জানা হয়নি। তদন্তের রিপোর্ট বেরিয়েছিল কি না তা-ই মনে পড়ে না।

এর মধ্যে জানলাম, ড. মুহম্মদ এনামুল হক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন।

কিছুকাল আগে শিক্ষক-নির্বাচনের কাজে এনামুল হক চট্টগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের। পদে তাঁর নিয়োগের আকস্মিক অবসান ঘটেছে। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগের বিরোধিতা। করেছিলেন, তার কারণ এই নয় যে, আমার প্রতি তাঁর মনোভাব প্রতিকূল কিংবা আমার লেখাপড়া সম্পর্কে তাঁর মনে সন্দেহ আছে। তিনি বাধা দিয়েছিলেন, কেননা আমি নিয়মমাফিক আবেদন করিনি। সুতরাং তিনি আশা করেন, তাঁর প্রতি আমি ক্ষোভ পোষণ করব না। আমি বললাম, ‘সার, আমার আচরণে কি আপনার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে কখনো? তিনি বিব্রত হয়েই বললেন, ‘না, আমি তা বলি না।’

এরপরে উপাচার্য আমাকে বলেন যে, জীবনের শেষ দিনগুলো জন্মভূমি চট্টগ্রামে কাটাতে পারলে এনামুল হক খুশি হবেন। এ-বিষয়ে আমরা কি কিছু করতে পারি?

আবুল ফজল তখন শিক্ষা ও সংস্কৃতি-বিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা। তিনিও চেয়েছিলেন এনামুল হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুন।

এনামুল হককে বাংলা বিভাগে নিয়োগদানের একটা প্রস্তাব আমি উপাচার্যের কাছে পাঠাই। সে-বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু হওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। তিনি সেটাই গ্রহণ করেন। নানা কারণে ঢাকায় থাকাই তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক বলে তিনি মনে করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. কাজী দীন মুহম্মদ পদচ্যুত হন। এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন। বিষয়টার ফয়সালা হতে সময় লাগে। এর মধ্যে তাঁকে খুব আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। আমি বিভাগের দায়িত্বে থাকতেই একদিন খাতুনগঞ্জে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ছোটোখাটো একটা ব্যবসার কাজে তিনি এসেছিলেন। আমি তাঁকে বলি, তিনি চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়োগের জন্যে আমি চেষ্টা করতে পারি। তিনি বলেন, না, তিনি হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় থাকবেন। পরে রায় তাঁর পক্ষে যায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।

১৯.

রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার পদ থেকে আবুল ফজলকে পদত্যাগ করতে হয়। সেইদিনই সৈয়দ আলী আহসান তার স্থলাভিষিক্ত হন। আমি তখন লন্ডনে।

ফিরে আসার পরে রশিদ চৌধুরী একদিন আমাকে বলেন যে, আলী আহসান আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। আমি ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে বলেন, ‘দেখো, একটা ব্যাপারে মানুষের দুরকম অ্যাটিচুড হতে পারে। কেউ ভাবতে পারে, আমি এই সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করবো না। আবার কেউ ভাবতে পারে, সরকারে যেই থাকুক, দেশকে আমার যা দেওয়ার, তা আমি দেবো। তুমি কী মনে করো?’

বললাম, আমার কাজ তো আমি করে যাচ্ছি। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে আমার অবস্থার তো হেরফের হয়নি।’

কথাটা বোধহয় ভালো শোনায়নি। তিনি বললেন, ‘তোমাকে কোনো সরকারি দায়িত্ব দিলে তুমি কি তা গ্রহণ করবে?

জানতে চাইলাম, কী ধরনের দায়িত্ব?

বললেন, ‘শিল্পকলা একাডেমী বা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব। তাছাড়া, ভারতে যেমন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট আছে, বাংলাদেশে ওরকম একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা আমি ভাবছি। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রকে রূপান্তরিত করে সেটা হতে পারে, অথবা নতুন করে তা প্রতিষ্ঠা করা যেতে। পারে। পিইএনকেও আমি সক্রিয় করে তুলতে চাই। তার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক নির্বাহী কর্মকর্তা দরকার। সামনেই পিইএনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে অস্ট্রেলিয়ায়, তার জন্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি এসব কাজের জন্যে তোমার কথা ভেবেছি।’

বললাম, ‘সার, আপনি জানেন, শিক্ষকতা ছাড়া আমি আর কিছু করতে চাই না। ৭২ সালে ইউসুফ আলী তো আপনাকে দিয়েই বলিয়েছিলেন আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক হতে। ৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে শিক্ষা-সচিব করতে চেয়েছিলেন। আমি মাফ চেয়ে নিয়েছিলাম। সরকারি দায়িত্ব নেওয়া আমার পোষাবে না।

আলী আহসান এ-প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি, কিন্তু তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পরে রাজ্জাক সাহেবকে বলেছিলেন, আনিস খুব রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে।’ সার জানতে চেয়েছিলেন, এমন মনে হওয়ার কারণ কী? আলী আহসান বলেছিলেন, তিনি আমাকে একাধিক পদের কথা বলেছিলেন, আমি কোনোটাই গ্রহণ করতে সম্মত হইনি। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, ‘এমনো তো হইতে পারে যে, হ্যায় টিচিংটা হাছাই পছন্দ করে।’

তার মেয়ে-জামাই চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরে আলী আহসান ক্যাম্পাসে এসে উঠতেন তাঁর আত্মীয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক, শামসুল আলমের বাড়িতে–আমার একটা বাড়ির পরে। অনেক সময়ে তিনি আসার আগেই খবর পেতাম, অনেক সময়ে তিনি এসে খবর দিতেন। আমি সাধারণত সঙ্গে সঙ্গেই দেখা করতে যেতাম। একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাগজে দেখলাম, আপনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে মসজিদে আজান দেওয়া যেতো না, নামাজ পড়ায় বিঘ্ন হতো। এমন কথা কী করে বললেন?’

আলী আহসান বললেন, এ কথা উনি বলেননি।

বললাম, একাধিক কাগজে এমন রিপোর্ট বেরিয়েছে। আপনি প্রতিবাদ করলেন না কেন?

আমার শিক্ষক বললেন, প্রতিবাদ তো করেছিলাম। আমার পিআরও একটা অপদার্থ। কাগজে প্রতিবাদ ছাপাতে পারেনি।’

একবার বকরিদে আমরা সপরিবারে কাপ্তাই যাবো বলে স্থির করলাম। তারপরই শুনলাম, আলী আহসান চট্টগ্রামে আসছেন। তিনি বোধহয় তখন আর উপদেষ্টা নেই। ঈদের আগের দিন সকালে আমি ক্যাম্পাস ছাড়লাম, তিনি তার খানিক পরই সেখানে পৌঁছোলেন। আমি নেই জেনে তাঁর ধারণা হলো, তাকে এড়াতে আমি কাপ্তাই চলে গেছি। এ কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করেছিলেন, আমাকে কিছু বলেননি, ফলে তাঁর এই ভ্রম নিরসনের কোনো চেষ্টাও আমি করিনি।

আরেকবার ঢাকায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁকে সালাম দিলাম, তিনি সালাম নিলেন না। আমার ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন ভেবে আমি দ্রুত সরে গেলাম। পরে অন্যের কাছে তিনি নালিশ করেন, আমি নাকি তাঁকে দেখেও না-দেখার ভান করে সরে গেছি। আমি খুবই দুঃখিত হলাম।

অনেক পরে, মনে হয়, তাঁর মন থেকে এসব ধারণা দূর হয়েছিল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি আবার আমার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করেছিলেন।

২০.

১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে জাপানি রেড আর্মির কয়েকজন সদস্য মধ্য আকাশে জাপান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানটিতে দেড় শতাধিক আরোহী ছিল, তা ছাড়া ক্রু তো ছিলই। ছিনতাইকারীরা জাপানে কারাবন্দি তাদের কয়েকজন দলীয় সদস্যের মুক্তি দাবি করে এবং সেইসঙ্গে চায় কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার। বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস-মার্শাল এ জি মাহমুদ ঢাকা বিমানবন্দরের কনট্রোল টাওয়ার থেকে দিনরাত ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে থাকেন। তার ফলে কয়েকজন জিম্মি নারী ও শিশু মুক্ত হয়। কিন্তু ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণের দাবিতে অটল থাকে এবং যাত্রীসহ বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। ১ অক্টোবর আরেকটি জাপানি বিমানে কারাবন্দি রেড আর্মির সদস্যদের এবং পণের অর্থ ঢাকায় আনা হয়। জিম্মিরা মুক্তিলাভ করে। পরদিন কিছু আরোহী নিয়ে আটক বিমানটি কুয়েত যাত্রা করে, অপর বিমানে রেড আর্মির সদস্যেরা কোনো অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়। সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে।

২ অক্টোবর সকালে বাংলাদেশ বিমানযোগে আমার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার কথা। ক্যাম্পাস থেকে নিজের গাড়িতে রওনা হয়েছি, জুবিলি রোডে। বিমান অফিসে থামলাম বিমান সময়মতো যাচ্ছে কি না, তা জিজ্ঞেস করতে। বিমান অফিসে থমথমে অবস্থা, উপস্থিতিও কম। একজন বললেন, ‘ঢাকা থেকে ফ্লাইট আসেনি, আপনি বরঞ্চ পরে ফোন করে খবর নিয়ে তারপর এয়ারপোর্টে যাবেন। বিমান থেকে আবদুল আলীর বাড়িতে গেলাম। তিনি গুজব শুনেছেন, ঢাকা বিমানবন্দরে গোলযোগ চলছে। ভাবলাম, কালই তো ছিনতাই নাটকের অবসান হলো, আবার কিসের গোলযোগ। আলীর বাসা থেকে ঢাকায় ফোন। করলাম আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামানকে। তিনি বললেন, ঢাকায় গোলমাল হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই আসবে না। টিকিট ফেরত দিয়ে বাড়ি চলে যাও। অন্য কোনোভাবে আসার চেষ্টা করবে না।’

এদিক-ওদিকে খবর নিয়ে যেটুকু জানা গেল, তা এই : ৩০ তারিখে বগুড়া সেনানিবাসে গোলযোগ হয়েছে, আজ সকাল থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের দু-দলে গুলিবিনিময় হয়েছে। বগুড়া ও ঢাকায় অনেক হতাহত। মনে হয়, কোনো একদল রাষ্ট্রক্ষমতাদখলের চেষ্টা করেছে। সেদিন রাষ্ট্রপতি জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে যেমন বলা হয়, তেমনি।

কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় পাঁচশ সেনা-কর্মকর্তা ও সৈনিকের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। অনেকের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হলো। এসব দণ্ড কার্যকর হলো, তার পাশাপাশি আবার তদন্তের ব্যবস্থাও হলো। বিচার ও শাস্তি হলো বটে, তবে ন্যায়বিচার হলো কি না, সে-সম্পর্কে সন্দেহ রয়ে গেল। আপাতত জিয়া ক্ষমতাসীন রইলেন।

কিছুদিনের মধ্যে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় গণতান্ত্রিক দলের আবির্ভাব ঘটলো। এর আহ্বায়ক উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার। অচিরেই তাতে যোগ দিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হলো। জিয়া প্রার্থী হলেন–জাগদল বা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী। এই ফ্রন্টে জাগদল ছাড়া রয়েছে মশিউর রহমান ওরফে যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ভাসানীপন্থী ন্যাপ, কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ইউপিপি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফসিলী ফেডারেশন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেনারেল ওসমানী–গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী। এই জোটে রয়েছে আওয়ামী লীগের দুটি অংশ (আবদুল মালেক উকিল ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন), ওসমানীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় জনতা পার্টি, পিপলস লীগ ও গণ আজাদী লীগ। কমিউনিস্ট পার্টি জোটভুক্ত হয়নি, তবে ওসমানীর প্রার্থিতা সমর্থন করেছে।

নির্বাচনে প্রত্যাশিতরূপে জিয়া বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। মশিউর রহমান সিনিয়র মন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। ৩০ জনের মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে গেল।

মোজাফফর আহমদ রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে সরকারি কাজে চট্টগ্রামে এলে একবার ক্যাম্পাসে আমাদের কাছে আসতেন। সেবারও তিনি এসেছিলেন। রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে গেলেন। ট্রেনে উঠলেন উপদেষ্টা হিসেবে। ট্রেন থেকে যখন নামলেন, তখন আর তিনি উপদেষ্টা নন। তিনি জিয়ার রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি।

২১.

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সচিব শহীদুল্লাহর সঙ্গে ঢাকায় দেখা হলে তিনি জানালেন, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন, আমি যেন একবার যাই।

হাসপাতালে গিয়ে বুঝতে পারলাম, তার অবস্থা গুরুতর। আমাকে দেখে। তিনি খুশি হলেন। সাঞনয়নে বললেন, আনিস সাহেব, সিগারেট ছেড়ে দেন। আমার যত কষ্ট, সব সিগারেট খাওয়া থেকে।

তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। লাইব্রেরিতে যখন পড়তেন, সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়ে আসতেন। সময় যাতে নষ্ট না হয়, তাই দুই টানে একটা সিগারেট শেষ করে আবার পাঠকক্ষে ফিরে যেতেন। কবে থেকে তিনি সিগারেট খাওয়া ধরেছিলেন, তা আমার জানা নেই। আমি আরম্ভ করেছিলাম এমএ পাশ করার পরে। অতদিনে যখন সিগারেটের নেশা হয়নি, তখন আর হবে না মনে করে বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় কেউ সিগারেট দিলে এক-আধটা খেতে শুরু করি। তারপর দিনে দুটো কিনতে থাকি। এখন রোজ ২০/২৫টা খাই। সিগারেট ছেড়ে দেবার কথা ভাবিনি। মুজাফফর সাহেব সনির্বন্ধ অনুরোধ করায় বললাম, ‘চেষ্টা। করবো, সার্।

কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। একটু পরে কেবিন ছেড়ে চলে এলাম। তিনি যে একবার আমার ওপর রাগ করেছিলেন, সেকথা মনে হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় কীভাবে দিন কাটিয়েছেন, তা মনে পড়ল। স্বাধীনতালাভের পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন–তখন আমাকে সেখানে আনতে চেষ্টা করে কেমন হেনস্তা হয়েছিলেন, তাও মনে হলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠিত হলে তিনি তার প্রথম সভাপতি হন। তখন আমলাদের অসহযোগিতার কথা বলতেন। বাকশাল আমলে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হন, কিন্তু মন্ত্রিত্ব তাঁর ভালো লাগেনি। খন্দকার মোশতাকের আমলেও তাঁকে মন্ত্রিত্ব করতে হয়েছিল, সে ছিল আরো খারাপ অবস্থা। মোশতাকের পতনের পরে মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন।

আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েকদিন পরে তিনি মারা যান। তখন তাঁর বয়স ৫৫ হয়েছে কি হয়নি।

২২.

আনোয়ার আবদেল-মালেকের চিঠি পেলাম। তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা-প্রকল্প হাতে নিয়েছেন দেশীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা সম্পর্কে। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে জাপানের কিয়োটোতে এশিয়ান সিম্পোজিয়াম অন ইনটেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি ইন এনডোজেনাস কালচার অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমাকে প্রবন্ধ পড়তে হবে। আমি সম্মত হলে তিনি জাতিসংঘ। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তারা আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্যাম্পাস নেই, ছাত্র নেই, শিক্ষক নেই। তার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে এক রসিক ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মহত্ত্ব এখানেই যে, তাঁকে না-যায় দেখা,–যায় শোনা। টোকিওতে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর–সেখানে রেক্টর আছেন, ভাইস-রেক্টর আছেন, বেশ কিছু কর্মকর্তা আছেন। ১৯৭৬ সালে যখন টোকিও যাই, তখন সেখানে গিয়েছিলাম। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ-কর্মকর্তা চিদাম্বরম ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত। তিনি আমাকে অফিস ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় নানা গবেষণামূলক প্রকল্প গ্রহণ করে, পৃথিবীর নানা দেশের বিদ্বজ্জনকে তার সঙ্গে জড়িত করে এবং সেসব গবেষণার ফল প্রকাশ করে।

খবরের কাগজে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর পড়ে বেবী একবার জানতে চেয়েছিল, তার সঙ্গে জড়িত হওয়ার আগ্রহ বা সুযোগ আমার আছে কি না। আমি বলেছিলাম, ওরা আর যাই করুক, বাংলার গবেষণা করবে না। এখন আনোয়ার আবদেল-মালেকের কল্যাণে সংযোগটা ঘটলো।

চিঠি এলো ভাইস-রেক্টর কিনহিডে মুশাকোজির কাছ থেকে। আমন্ত্রণ, আসা-যাওয়া-থাকার ব্যবস্থা এবং প্রবন্ধের সম্মানী বাবদ দু হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। সম্মতি জানাতে বিলম্ব করলাম না। প্রবন্ধ লেখার কাজে লেগে গেলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন আদনানকে বললাম আমার কাজে সাহায্য করতে। আমি প্রবন্ধটার খসড়া করবো, সামাজিক পটভূমির সঙ্গে সৃজনশীলতার যে-সম্পর্ক আমি দেখাতে চাই, তিনি সেটার বিচার করবেন এবং সামগ্রিকভাবে পরামর্শ দেবেন। সম্মানীর অর্থ আমরা ভাগাভাগি করে নেবো।

বেশ পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লিখলাম। স্বপন আদনানও প্রভূত সাহায্য করলেন। বিষয়টির একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিও তিনি দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সম্মেলনের আগেই প্রবন্ধটি টোকিওতে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভবপর হলো।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম ৮ নভেম্বরে, ঢাকা থেকে রওনা হলাম ১০ তারিখে। ব্যাংককে একদিন কাটিয়ে শহরটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল। ১২ তারিখে সেখান থেকে পৌঁছলাম ওসাকা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে গাড়িতে কিয়োটোয়।

কিয়োটো জাপানের প্রাচীন রাজধানী। বনেদি শহর। জাপানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলে এই শহরের অধিবাসীরা তাকে দাবি করে। তাদের মতে, টোকিও হতে পারে জাপানের রাজধানী ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, কিন্তু দেশের সংস্কৃতিকে জানতে হলে কিয়োটোয় আসতে হবে। সিম্পোজিয়মের ফাঁকে ফাঁকে কিছু সময় পাওয়া গেল বটে, কিন্তু কাজে এবং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতেই তার অনেকখানি চলে গেল। আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় সামান্য কিছু দেখা হলো–জাদুঘর এবং বৌদ্ধমন্দির, তবে কিয়োটোকে জানবার পক্ষে তা কিছু নয়।

সিম্পোজিয়ম হলো ১৩ থেকে ১৭য়। উদবোধনী ছাড়া চারটি খোলা অধিবেশন এবং প্রতি অধিবেশনের বিষয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের পৃথক বৈঠক। উদৃবোধনী অধিবেশনে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভাষণ দিলেন তার প্রেসিডেন্ট মিশিয়ো ওকামোতো এবং অতিথির ভাষণ দিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর তাকেও কুওয়াবারা। আনোয়ার আবদেল-মালেক সমন্বয়ক হিসেবে দীর্ঘ বক্তৃতা পাঠ করলেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বললেন ভাইস-রেক্টর কিনহিডে মুশাকোজি এবং রেক্টর জেমস হেস্টার। শুনলাম, মুশাকোজি খুব অভিজাত পরিবারের মানুষ, তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আছে। হেস্টার যে পণ্ডিত হিসেবে খুব বিশিষ্ট, তা বোধহয় নন, তবে মার্কিন বলে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেক্টর হওয়ার গৌরব লাভ করেছেন। দুজনেই খুব ভদ্র ও সহৃদয় মানুষ। আরেক ভাইস-রেক্টর, আলেকজান্ডার কোয়াপং, একটু গোমড়ামুখ করে ছিলেন। প্রকল্পটি এই আফ্রিকি বিদ্বানের এলাকার বাইরে বলে সিম্পোজিয়মে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই–হয়তো এই কারণে। প্রোগ্রাম অফিসার হোসাম ইসা, চিফ অফ কনফারেনসেস অ্যান্ড সার্ভিসেস রবিন্দর মালিক এবং সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার পুনা উইগনোরাজা ছোটাছুটি করছেন সব সময়ে। উইগনোরাজাকে তখন কেবল ব্যবস্থাপক মনে করেছিলাম, পরে তাঁর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই।

সিম্পোজিয়মের জেনারেল র‍্যাপোর্টিয়র নিযুক্ত হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি এবং ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য রশীদউদদীন খান। চারটি অধিবেশনের সভাপতি ও র‍্যাপোর্টিয়র যথাক্রমে কলকাতার সেন্টার ফর দি স্টাডিজ অফ সোশাল সায়েন্সেসের পরিচালক বরুণ দে ও আমি; চীনের অ্যাকাডেমি অফ সোশাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনালিটি স্টাডিজের ভাইস-ডিরেক্টর ফেই সিয়াও-তুং ও হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল সায়েন্সেস ফ্যাকালটির অধ্যাপক শিংগো শিবাতা; সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয় স্টাডিজ বিভাগের প্রধান সৈয়দ হুসেন আলাতাস ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক, ভিয়েতনামের সন্তান, লে থান খোয়; এবং কাবুলে ইউএনডিপিতে কর্মরত আফগান কূটনীতিবিদ এ এইচ তাবিবি ও দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ এন পাণ্ডেয়া। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এই তাবিবি। পাণ্ডেয়া পরে। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে যৌথভাবে সিম্পোজিয়মের প্রবন্ধাবলি ও কার্যবিবরণী সম্পাদনা করেছিলেন। সেটা দেখেই এতজনের নাম ও পরিচয় দিতে পারছি।

প্রথম অধিবেশনে এক ইন্দোনেশীয় মহিলা অনর্থক তর্ক জুড়ে দিয়ে এত সময় নষ্ট করলেন যে, কর্মসূচির ব্যাঘাত ঘটে গেল। প্রথম অধিবেশন তো সময়মতো শেষ হলো না, দ্বিতীয় অধিবেশনও শেষ করতে বিলম্ব হলো। তৃতীয় অধিবেশনের সভাপতি তাই ঘোষণা করলেন যে, তিনি কাউকে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক মিনিটও বেশি বলতে দেবেন না; সময় শেষ হলেই টেবিল ঠুকবেন হাতুড়ি দিয়ে, আর সেই সঙ্গে বক্তার মাইক্রোফোন বন্ধ হয়ে যাবে। সৈয়দ হুসেন আলতামাসের দশাসই শরীর, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল গাম্ভীর্যপূর্ণ–তাঁকে অমান্য করবার সাহস কার! আর মাইক্রোফোন বন্ধ হয়ে গেলে কথা বললেও বা শুনবে কে! আমাকে যখন তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে আহ্বান জানালেন, আমি বললাম, আশা করি, হাতুড়ি পেটাবার আগেই আমি বক্তব্য শেষ করবো। আমার প্রবন্ধ প্রচারিত হয়েছে, সুতরাং ইচ্ছা। করলেই যে-কেউ তা দেখে নিতে পারবেন। আমি মাত্র কয়েকটি বিষয়। সকলের গোচরে আনতে চাই। তারপর কিছু কথা বলে নির্ধারিত সময়ের দু তিন মিনিট আগেই বক্তব্যের ইতি টানলাম। এতেই আমার প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। সভাপতি আমার কাণ্ডজ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, রেক্টর হেস্টার পাশ থেকে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন, আনোয়ার আবদেল-মালেক নিজের আসন থেকে উঠে এসে বললেন, তোমার ভদ্রজনোচিত আচরণ সিম্পোজিয়ম বাঁচিয়ে দিয়েছে–এরপর কেউ বেশি বলতে লজ্জা পাবে, আলোচনা-পর্বে তুমি আবার সময় নিও। সত্যি সত্যিই আলোচনা-পর্বে আমার নাম ঘোষিত হলো প্রথমে। আমি বলতে চাইনি, বলতে প্রস্তুতও ছিলাম না। তবু দু-একটা অকিঞ্চিত্ত্বর কথা বললাম, সংক্ষেপে বলায় তার অন্তঃসারশূন্যতা বোধহয় ধরা পড়েনি।

র‍্যাপোর্টিয়রদের একটা অসুবিধা এই হলো যে, তারা যে-অধিবেশনে প্রবন্ধ পড়েছেন, তার ওয়ার্কিং গ্রুপে উপস্থিত থাকতে পারলেন না, রিপোর্ট করার জন্যে থাকতে হলো অন্য অধিবেশনের ওয়ার্কিং গ্রুপে। কারণ, মূল অধিবেশনের বিবরণীর সঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপের কার্যবিবরণী তৈরি করাও ছিল র‍্যাপোর্টিয়রের কাজের অন্তর্ভুক্ত। তার জন্যে সভাপতির সঙ্গে বসার কথা। বরুণ দে বললেন, ‘আর বসতে হবে না। আপনি লিখে ফেললে আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেবো। ভালোই। তবে বরুণের দেখার সময় কখন হবে, তার জন্য কিছু অপেক্ষা করতে হলো। এক সন্ধ্যায় অনেকে বেড়াতে যাচ্ছেন দল বেঁধে। ফিলিপিনসের মেরি রাসলিস হোলনস্টাইনার আমাকে ডাকতে এলেন। বরুণকে ফোন করতে তিনি বললেন, আপনি থাকুন, আমি আসছি।’ মেরিকে বললাম, কর্তব্যের ডাক এসেছে–আমার আর যাওয়া হবে না।’ মেরি চলে গেলেন। পরে বরুণ আড্ডা জমিয়ে ফেললেন। শেষকালে আমার খসড়াটা সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। এমন হবে জানলে বেড়াতে যেতে পারতাম। বরুণ যেমন পণ্ডিত, তেমনি তীক্ষ্ণধী। সামান্য যা যোগ-বিয়োগ করলেন, তাতে রিপোর্ট অনেক উন্নতমানের হলো।

এই পর্যায়ের পরে জেনারেল র‍্যাপোর্টিয়র বসলেন সব ব্যাপোর্টিয়রদের নিয়ে। সেখানে সব অধিবেশনের সভাপতিদের ডাকা হয়েছিল, তবে সবাই। আসেননি। এই বৈঠকে আমি একটু বেশি কথা বলে ফেললাম। তবে সবাই সেটা ভালোভাবে নিয়েছিলেন। ফলে কোথাও আটকে গেলে রশীদউদদীন খান আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, আনিস কি বিষয়টার সমাধান দেবেন?

এই কাজ করতে গিয়ে বাকি র‍্যাপোর্টিয়রদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। লে থান খোয় ও পাণ্ডেয়ার সঙ্গে আমার পরেও দেখা হয়েছিল, শিংগো শিবাতার সঙ্গে হয়নি। তবু আমার বিশ্বাস, আমরা সবাই সবাইকে। মনে রেখেছি।

আর যাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘটেছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জাকার্তার রেক্টর সুলতান তকদির আলিসাভানা। তিনি আমাকে ইন্দোনেশিয়া-ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন একজন জানালেন, বালি দ্বীপের সকল নাচের দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। তিনি যে একজন বড়ো পণ্ডিত, সেকথা আমি ঢাকায় ফিরে জানলাম মনসুর মুসার কাছ থেকে এবং, আরো পরে, তার সম্মানে প্রকাশিত বিদ্বজ্জনদের রচনাসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ দেখে। টোকিওর ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের তাকেশি হায়াশি খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সেই সঙ্গে রসিক মানুষও। আতানেও দ্য ম্যানিলা ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ ফিলিপিনস কালচারের সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেরি রাসলিস হোলনস্টাইনার খুব মিশুক প্রকৃতির। সিম্পোজিয়মেই তিনি এক মজার গল্প করেছিলেন : ফিলিপিনসে জেলে-অধ্যুষিত কিছু দ্বীপ আছে। কিছু পর্যটন-ব্যবসায়ী অমন একটা দ্বীপ কিনে নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে স্থির করে। তবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে তারা পরিকল্পনা করে যে, কিছু সুন্দরী কেবল মাছধরা জাল পরে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাবে। যাদের প্রবল আপত্তির মুখে এই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং দ্বীপটি অক্ষুণ্ণ থাকে, তাদের মধ্যে মেরি একজন। আমার Cultural Pluralism বক্তৃতায় আমি এই ঘটনাটা বলেছিলাম। আরেকজনের সাহচর্য আমার ভালো লেগেছিল–তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লিবারাল আর্টস ফ্যাকালটির অধ্যাপক মুনেসুকে মিতা।

সম্মেলনে আরো যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক স্বনামধন্য সচ্চিদানন্দ মূর্তি, পেনাংয়ের ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়ার সেন্টার অফ পলিসি রিসার্চের পরিচালক কে জে রত্নম, ফিজির ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ প্যাসিফিকের ভাইস-চ্যান্সেলর জেমস মারাজ, বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মিরোস্লাভ পিচুইলিক, ব্রাজিলের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সেলসো ফুরতাদো এবং প্যারিসের ফাদার ব্রুনো রাইস উল্লেখযোগ্য।

পৃথিবীর ২২টি দেশের ৬৬ জন বিদ্বানের সঙ্গে কয়েকদিন যাপন করার সুখস্মৃতি নিয়ে ১৮ তারিখ সকালে কিয়োটো ছাড়লাম।

২৩.

ওসাকা থেকে এলাম হংকংয়ে। এবার কিছু কেনাকাটার ফর্দ নিয়ে গিয়েছিলাম। হংকং বিমানবন্দর থেকে যোগাযোগ করে এবারে কোনো হোটেলে জায়গা পাওয়া গেল না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়! একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে এলাম হোটেল অ্যামবাসাডরে। বিমানবন্দরে যে-মেয়েটি আমার জন্যে জায়গা। খুঁজছিল, সে অবশ্য বলেছিল, ওখানে জায়গা নেই। আবার এ-ও বলেছিল যে, আমি যেতে যেতে কোথাও হয়তো কোনো অতিথি হোটেল ছেড়ে গেলে জায়গা পাওয়া যেতে পারে। সেই ভরসায় অ্যামবাসাডরে এলাম। কিন্তু ঠাই নেই। হোটেলের বেল-ক্যাপ্টেনকে বললাম, আগে এখানে থেকে গেছি, কিন্তু আজ ঘর খালি নেই। আমি কি তোমার কাছে সুটকেস রেখে জায়গার সন্ধানে যেতে পারি? সে সম্মত হলো।

চরণযুগল ভরসা করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। হোটেলে স্থান নেই, গেস্ট হাউজে খোঁজ করি। একটা গেস্ট হাউজে দেখলাম লেখা রয়েছে খালি আছে। কিন্তু রিসেপসনিস্ট মহিলা বললেন, জায়গা নেই। বুঝলাম, আমি প্রাচ্যদেশীয় হওয়ায় তাঁর এই জবাব।

ক্লান্ত ও পিপাসাত হয়ে একটি বারে ঢুকে পড়ি। তখনো বার ভালো করে খোলেনি। অদূরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন মাত্র–আপ্যায়ন করার লোকজন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ শুনি অপর খরিদ্দারের কণ্ঠস্বর : তোমাকে এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন? এসো, কাছাকাছি বসা যাক।

উঠে এসে ভদ্রলোকের পাশে বসলাম। পরিচয় হলো। উনি নিউ ইয়র্কে প্যানাম এয়ারলাইনসে প্রশাসনিক কাজ করেন। আমার দুরবস্থার কথা শুনে বললেন, কিছু মনে কোরো না। এ তোমার অবিবেচনার ফল। একটা ব্যস্ত শহরে আসছো। আগে থেকে বাসস্থান ঠিক করে আসবে না? দু-সপ্তাহ আগে চেষ্টা করলে নিশ্চয় জায়গা পেতে।

কথাটা শুনতে ভালো লাগলো না, কিন্তু তার যথার্থতা অস্বীকার করতে পারলাম না। একটি ছেলে এসে অর্ডার নিয়ে গেল–খুব যে প্রসন্নচিত্তে, তা বলা যায় না। হাসিমুখে একটি মেয়ে অর্ডার নিয়ে এলো।

ভদ্রলোক বললেন, এই যে তোমরা বাংলাদেশ এয়ারলাইনস চালাও, কেন চালাও? ন্যাশনাল ক্যারিয়ার–একটা মর্যাদার ব্যাপার! কিন্তু তার জন্যে কত লোকসান দিতে হয়, তোমার কোনো ধারণা আছে? আমি বলতে পারি, বহুকাল তোমাদের লোকসান দিতে হবে, হয়তো কখনো লাভের মুখ দেখবে না। এত টাকা নষ্ট করে জাতীয় মর্যাদালাভের কোনো অর্থ হয়? স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলো সকলে মিলে একটা এয়ারলাইনস চালায়। দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ মিলে কি একটা এয়ারলাইনস চালাতে পারে না? আমি তোমাকে বলছি, প্যানামের মতো এয়ারলাইনস এখন হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে তোমরা?

আরো খানিকক্ষণ গল্প হলো। আমরা একসঙ্গে বের হলাম, কিছুক্ষণ একসঙ্গে হাঁটলাম। ভদ্রলোক বিদায় নেওয়ার সময়ে বললেন, ‘আই হোপ, ইউ ডোনটু এন্ড আপ ইন এ হোরহাউস।

আবার খোঁজাখুঁজি। কে যেন চুংকিং আর্কেডের কথা বললো। সেখানে গিয়ে ঘর পাওয়া গেল। অত্যন্ত অপরিসর, দরজা খুলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠতে হয় আর কি! তাই সই, অ্যামবাসাডরে গিয়ে সুটকেস নিয়ে এলাম–এবারে ট্যাকসিতে।

তারপর বেরিয়ে খেয়েদেয়ে ফিরলাম, অমন ঘরে ফিরতে মন চাইছিল না যদিও।

পরদিন কেনাকাটা। নিজেদের জন্যে একটা টেলিভিশন, কনিষ্ঠ শ্যালিকা সিমিনের বিয়ে সামনে–তার জন্য পাথরের একটা গয়না। মেজো শালি নাজু। ডলার দিয়ে দিয়েছিল ক্রিস্টালের কিছু জিনিস কিনতে–তাও নেওয়া হলো। এসব জিনিস রাখার মতো জায়গা নেই ঘরে। টেলিভিশনটা গেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষের জিম্মায় রাখলাম।

২০ তারিখে হংকং থেকে ব্যাংককে এলাম। থাই এয়ারওয়েজ অতিরিক্ত মালের মাশুল নিলো না। মনে মনে খুশি হলাম।

ব্যাংককে থাই এয়ারওয়েজের অতিথি হিসেবে রাত কাটালাম। হোটেল বরাদ্দ করতে এবং ট্যাকসির কুপন দিতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় নিলো বিমানবন্দরে। তবে সেখানে সুটকেস বাদে বাকি সব মাল নিজের খরচে রাখা গেল, এই যা স্বস্তি।

পরদিন ঢাকা যাওয়ার সময়ে অতিরিক্ত মালের মাশুল গুনতে হলো। যতই বলি না কেন হংকংয়ে বাড়তি পয়সা নেয়নি, ব্যাংককে নতুন জিনিস যুক্ত হয়নি, তাতে কাজ হলো না।

২৪.

হাসান হাফিজুর রহমান মস্কোতে প্রেস কাউনসেলর হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৪-এ তাঁর সেই নিয়োগের অবসান ঘটে। দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে ওএসডি–অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, আমার এক বন্ধুর ভাষ্যে অফিসার ইন স্পেশাল ডিফিকালটিজ–নিয়োগ করা হয় বছরখানেকের জন্যে। তারপর তিনি বেকার। একটা পর্যায়ে সংসারের জিনিসপত্র বিক্রি করে তাঁকে চলতে হয়। আমার সঙ্গে একবার তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে যোগদানের সম্ভাব্যতাও আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু যে-পদমর্যাদা বা বেতন পেলে তার পোষাতো, সেটা তাঁকে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না বলে কথাটা আর বেশিদূর এগোয়নি। বৎসরাধিকাল বেকারজীবন যাপনের পর তাকে আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয় এক বছরের জন্যে। তারও কিছুকাল পরে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইচ্ছায়, তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ও মুদ্রণ প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার পরামর্শে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার ওই প্রকল্পের একটি প্রামাণ্যকরণ কমিটি গঠন করে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে :

১. ড. মুফীজুল্লাহ্ কবীর, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২. ড. সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

৩. ড. সফর আলী আকন্দ, পরিচালক, ইনসটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

৪. ড. এনামুল হক, পরিচালক, ঢাকা যাদুঘর

৫. ড. কে এম মোহসীন, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৬. ড. শামসুল হুদা হারুণ, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৭. ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৮. ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

৯. জনাব হাসান হাফিজুর রহমান, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের

ইতিহাস প্রকল্প। আহমদ শরীফ এই প্রকল্পে যুক্ত হতে অসম্মত হন। তখন তার জায়গায় জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভসের পরিচালক কে এম করিমকে নিয়ে কমিটি পুনর্গঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এবারে অধ্যাপক মফীজুল্লাহ্ কবীরকে প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভাপতি, হাসান হাফিজুর রহমানকে সদস্য সচিব এবং বাকি সাতজনকে সদস্য বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের অফিস স্থাপিত হয় সেগুনবাগিচায় এবং সামান্য লোকবল নিয়ে এর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের সার্বক্ষণিক গবেষক হিসেবে যোগ দেন ইমামুর রশীদ, আফসান চৌধুরী, শাহ আহমদ রেজা ও ওয়াহিদুল হক। সুকুমার বিশ্বাস ও রতনলাল চক্রবর্তী নানাভাবে সাহায্য করেন। পরে ত্রিদিব দস্তিদার কর্মী হিসেবে প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট হন।

প্রকল্প হাতে নিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান যখন আমার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন আমি তাকে বলি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসরচনার চেষ্টা না করে দলিলপত্র সংকলন করতে। কারণ সরকারি উদযোগে লেখা ইতিহাস পক্ষপাতহীন হওয়া দুরূহ। অন্যদিকে দলিল নিজ থেকেই এক ধরনের সত্য প্রকাশ করে। হাসান আমার যুক্তি মেনে নেন। আরো কেউ কেউ এ-প্রস্তাব সমর্থন করেন। সরকারকে বিষয়টা বোঝাতে কিছু সময় লাগে।

প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর এক বছর করে বাড়তে থাকে। মেয়াদবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ হতে মাঝে মাঝেই বিলম্ব ঘটে। তখন প্রকল্পের পরিচালক ও কর্মীদের বেতন পেতে বিলম্ব হয়। এই মানসিক চাপের মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। দলিলপত্র ছাপা হওয়া শুরু করলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা ছাপা ফর্মা নিয়ে পরীক্ষা করেন বেশ সময় ধরে। তাদের অনুমোদন পেতে দেরি হয়। তাতেও এক ধরনের মানসিক উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট সকলকে।

প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভায় নিয়মিত যোগদান করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়নি-মধ্যে মধ্যে দেশের বাইরে থাকা এবং দেশে থাকলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকা তার কারণ। তবু প্রকল্পের কাজটি আমি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি। প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভায় মাঝে মাঝে উত্তাপের সৃষ্টি হতো। কমিটির কোনো কোনো সদস্য যেমন আওয়ামী লীগের পক্ষপাতী ছিলেন, গবেষকদের কেউ কেউ তেমনি আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিহীন ছিলেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য কখনো কখনো সংঘাতের সৃষ্টি করতো। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পরে। মুক্তিযুদ্ধের বদলে স্বাধীনতা-যুদ্ধ শব্দবন্ধ ব্যবহারের সরকারি সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পকে তা মেনে নিতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবেই কাজটি সম্পন্ন হয়। কমিটির কাজে তবু একটা ত্রুটি রয়ে যায়। প্রামাণ্যকরণ কমিটি কোন কোন দলিল অনুমোদন করলো, সভার কার্যবিবরণীতে তার তালিকা রক্ষা করা হতো না। ফলে এমন অভিযোগের সুযোগ সৃষ্টি হতো যে, প্রামাণ্যকৃত কোনো দলিল মুদ্রিত হয়নি। এমন তালিকা তৈরি করা বা কমিটির পরবর্তী সভায় তা স্থিরীকৃত করিয়ে নেওয়ার জন্যে আমরা কেউ কেউ হাসান হাফিজুর রহমানকে অনুরোধও করেছি। কেন জানি না, সে-অনুরোধ তিনি রক্ষা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, যা-কিছু অনুমোদিত হচ্ছে, তার সবই গ্রন্থভুক্ত হতে যাচ্ছে।

এই প্রকল্পের জন্যে হাসান হাফিজুর রহমান খুব খেটেছিলেন। প্রকল্পের গবেষকেরাও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন। বাংলা একাডেমির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে সংগৃহীত দলিলপত্র এই প্রকল্পের কাছে হস্তান্তরিত হয়। প্রকল্পের উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ দলিল সংগৃহীত হয়। অনেকে অবশ্য নিজেদের সংগ্রহের জিনিসপত্র হাতছাড়া করতে চাননি, কেউ কেউ অনুলিপিও দিতে চাননি। তবু সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার কাগজপত্র সংগ্রহ করা যায়। তার থেকে ছাপা হয় ১৫০০০ পৃষ্ঠার দলিল। মূল পরিকল্পনায় তার অর্ধেক পরিমাণ ছাপার কথা ছিল। বর্ধিত কলেবরে প্রকাশের জন্যে অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয়-বরাদ্দের জন্যে হাসানকে অনেক দেন-দরবার করতে হয়। শেষদিকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। সম্পাদক হিসেবে তাঁর দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় কে এম মাহসীনকে। তবে দলিলপত্রের ভূমিকা হাসান লিখে যেতে পেরেছিলেন। তার ইচ্ছায় তাতে আমি খানিকটা যোগ-বিয়োগ করেছিলাম। হাসান খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে বলেছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির পর আবার একটা কাজ আমরা একসঙ্গে করতে পারলাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রসংকলনে সময় লাগে, মুদ্রণেও যথেষ্ট সময় নেয়। এর ১৫ খণ্ড প্রকাশ পেতে পেতে দেশেও নানারকম পরিবর্তন ঘটে যায়।

২৫.

ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, উদ্‌যোগটা নিয়েছিলেন আবুল ফজল। তিনি উপদেষ্টা-পরিষদ থেকে চলে গেলে কীভাবে যেন ওই কমিটির দায়িত্ব এসে পড়ে তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল হুদা চৌধুরীর ওপরে। একজন সদস্য হিসেবে এর একটি বা দুটি সভায় যোগ দিয়েছিলাম। একটি সভার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে।

সভাস্থলে পৌঁছোবার পরপরই সভাপতি এসে গেলেন। শামসুল হুদা চৌধুরী মজলিসি লোক। আরো সদস্যের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। আমাকে লক্ষ করে বলতে শুরু করলেন : জাতীয় সংগীত করার জন্যে তোরা আর গান পেলি না! বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের গান বেছে নিলি–তাও বাউল সুরের, যাতে উদ্দীপনার একান্ত অভাব। ধনধান্যপুষ্পভরা’ হলেও একরকম হতো। হাসতে হাসতে বললাম, আমার সোনার বাংলা’ গানটি বহুকাল আমাদের মর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া বিদেশিদের দিয়ে আমাদের দেশকে সকল দেশের সেরা’ বলানো কি ঠিক হতো?’ উনি তার জবাব দিলেন না। বলতে থাকলেন : ‘আর আমাদের দাদারা তো আরো এককাঠি এগিয়ে। পঞ্চম জর্জের বন্দনাকে জাতীয় সংগীত বানিয়ে ফেললো।’ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে উপদেষ্টার কথায় সায় দিচ্ছেন কেউ কেউ। আমি এবারে আর হাসতে পারলাম না। বললাম : ‘এ-নিয়ে যেসব বাদানুবাদ হয়েছে, আপনার তা জানার কথা। রবীন্দ্রনাথের নিজের বক্তব্যও রয়েছে এ-বিষয়ে। ওটা যে পঞ্চম জর্জের বন্দনা। নয়, তা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।’ শামসুল হুদা চৌধুরী বললেন : আমি আদ্যোপান্ত জানি। আর যাকে হোক, আমাকে বোঝাতে আসিস না যে, ওটা সম্রাটের বন্দনা নয়। ওটা যে পঞ্চম জর্জের বন্দনা, তার কনটেমপোরারি এভিডেনস আছে।’

শামসুল হুদা চৌধুরী শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বোলপুরের একেবারে পাশে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি জানেন যথেষ্ট। তবে নিজে যা বলছেন, তার পালটা যুক্তি শুনতে রাজি নন। আমি তো সাক্ষ্যপ্রমাণ। সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি না। অতএব, এ-তর্কের ছেদ টানলাম।

পাহাড়পুরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ইউনেসকোর সাহায্য চাইবার একটা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এই কমিটির সভায়। তারপর অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ের লোকজনের স্মৃতিরক্ষার জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সভাপতির কোনোটাতেই আপত্তি নেই।

রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে যাওয়ার পরেও শামসুল হুদা চৌধুরী জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য রয়ে গিয়েছিলেন।

মন্ত্রিসভা গঠনের অল্পকাল পরেই জিয়াউর রহমান জাগদল বিলুপ্ত করেন, গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিযুক্ত করেন সেনাবাহিনীর স্টাফ-প্রধান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুই তৃতীয়াংশের অধিক আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় স্থান লাভ করে–তবে তার আসনসংখ্যা থাকে সামান্য। নির্বাচনের ছয় সপ্তাহের মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মওদুদ আহমদ হন সহকারী প্রধানমন্ত্রী। এই খবরটা আমি পাই বিদেশে বসে।

২৬.

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডসের পরিচালক জোন সি লানকাস্টার অবসর নিয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সোয়াসের গ্রন্থাগারিক বি সি ব্লুমফিল্ড। ১৯৭৭ সালে আমি ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের তালিকা তৈরি করে দিয়ে আসার পরে লাইব্রেরিতে অনুরূপ আরো কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ব্লুমফিল্ড আমাকে লিখলেন, আরেকবার লন্ডনে গিয়ে যদি আমি এগুলোর তালিকা করে দিতে পারি, তবে একসঙ্গে বই করে ছাপা যাবে। এবারেও ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ওরিয়েন্টাল ডকুমেন্টস কমিটি আমার স্থানীয় খরচ নির্বাহ করবেন, যাতায়াত খরচের ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব। তাকে আমার প্রয়োজনের বিষয়টা অবহিত করলাম। তাঁর হাতে যা আছে, তার থেকে কিছু করা গেল না। তিনি ফোন করলেন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম গোলাম মোস্তফাঁকে। সবটা খুলে বলে অনুরোধ করলেন আমাকে বাংলাদেশ বিমানের একটি সৌজন্যমূলক টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। কয়েকদিন পর জানা গেল, ব্যবস্থা হয়েছে।

১৯৭৯ সালের ১০ মার্চ লন্ডন রওনা হলাম। এবারও গিয়ে উঠলাম আবদুল মোমেনের বাড়িতে। গিয়ে দেখি, তার ভগ্নিপতি, ঢাকা বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবু শাহাদাৎ, এক প্রশিক্ষণ-কর্মসূচিতে লন্ডনে এসেছেন বিবিসির সঙ্গে যুক্ত হতে। তিনি স্বাভাবিকভাবে মোমেনদের অতিথি। অনতিবিলম্বে তাঁর পরিবার এসে সেখানেই তাঁর সঙ্গে মিলিত হবে। অতএব অন্যত্র বাসস্থান সন্ধান করা আমার কর্তব্য। এ-বিষয়ে মোমেনই সাহায্য করলেন। তাঁর সহকর্মী জ্যান ড্রাইডেন এই গ্রীষ্মবকাশে খুব শখ করে বাংলাদেশে যেতে চেয়েছিল। এমন কথাও হয়েছিল যে, জ্যান বাংলাদেশে গেলে চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু তার পাসপোর্ট দক্ষিণ আফ্রিকার বলে সে বাংলাদেশের ভিসা পেল না। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে সে স্থির করলো, হংকং যাবে বেড়াতে। এখন তার ফুলগাছে পানি দেওয়ার দায়িত্ব। কাউকে নিতে হবে। মোমেন আমাকে নিয়ে গেলেন জ্যানের বাড়িতে। বললাম, ‘আমি তব মালঞ্চের হবো মালাকর।’

কিংস ক্রস স্টেশনের খুব কাছে জাড স্ট্রিটের একটা বাড়িতে জ্যানের বাস। সেখানে একতলা ও দোতলার খানিকটা নিয়ে থাকেন দুই চিরকুমারী–মেরি ও তার বোন। দোতলার খানিকটা ও তেতলা জ্যানের দখলে। জ্যান খুব আনন্দের সঙ্গে আমাকে থাকতে দিলো, তবে অনেকরকম সাবধানবাণী উচ্চারণ করলো। মেরি ও তার বোন দুজনেরই বয়স হয়েছে, একটু খিটখিটে মেজাজের, তার ওপর বর্ণবিদ্বেষী-মোমেন তাদের চক্ষুশূল। শ্বেতাঙ্গিনী জ্যানের কাছে কৃষ্ণাঙ্গদের আসা-যাওয়া তাঁরা পছন্দ করেন না। আমি যেন ঘরে আওয়াজ না করি, রাতে টয়লেট ব্যবহার করলেও যেন ফ্লাশ না করি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারলে, নিচে যে-লিখিত নোটিশ আছে, তা যেন টাঙিয়ে দিয়ে যাই। বাড়িতে যেন একসঙ্গে বেশি লোককে আমন্ত্রণ না করি। ফুলের টবগুলোয় কখন কতটা পানি দিতে হবে, জ্যান তা বুঝিয়ে দিলো। টেলিফোনে লোকে যেন তাকে বিরক্ত না করতে পারে, তার একটা ব্যবস্থা সে করেছিল। সেটাও বুঝে নিলাম। জ্যান হংকং রওনা হওয়ার আগেই তার বাড়িতে আস্তানা গেড়ে ফেললাম।

জ্যানের বাড়িতে মাসাধিককাল আমি খুব স্বচ্ছন্দে ছিলাম, কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছিলাম। ওর বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা লড্রেটে কাপড় ধুতে যেতাম। সেখানে মহিলাদের ভিড়, ক্কচিৎ কখনো পুরুষের দেখা পাওয়া যেতো। আমাকে দেখে মহিলারা পরস্পর যেসব সংলাপ বিনিময় করতেন, তা এরকম : লন্ডনের আসল বাসিন্দারা কোথায় গেল? শহরটা সব বিদেশিতে ভরে গেল, তাই না? এই পরদেশিরা কী যে করে এদেশে! আমাদের বাড়িঘর দোকানপাট আস্তে আস্তে সব বেদখল হয়ে যাচ্ছে।আমি শুনে না-শোনার ভান করি, বুঝে না বোঝার ভাব করি।

বাড়িতে আমি জ্যানের নির্দেশমতো চলি। খুব কমই কাউকে আসতে বলি। আমার ভাগ্নি শিরিণ কয়েক বছর লিবিয়ায় কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে লন্ডনে এলো। সঙ্গে তার স্বামী ডা. আনওয়ার-উল-আজিম এবং শিশুকন্যা শাওন। তাদের আসতে বলেছিলাম একদিন। আরো কেউ কেউ অল্পক্ষণের জন্যে এসেছে–মূলত আমাকে নিতে। আমার মনে হয়েছে, ডোরবেল শুনলে মেরি অথবা তার বোন পর্যবেক্ষণ করতেন–কে আসছে। কিন্তু কখনো তা নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি, কোনো মন্তব্যও আমার কানে আসেনি। বরঞ্চ বুলু একদিন সামনে পড়ে যাওয়ায় মেরি বেশ সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন।

আমার সঙ্গে রোজই তাদের কুশলবিনিময় হতো। একদিন সকালে ঘরের ভেতরে চাবি রেখে দরজা বন্ধ করে ফেলেছিলাম বাইরে থেকে। সেদিন সাহায্য চাইতে তাঁদের কাছে যেতে হলো। মেরি আমাকে বসতে বলে নিজেই পুলিশে খবর দিলেন, চাবিওয়ালা ডাকিয়ে দরজা খোলার ব্যবস্থা করে দিলেন, অনুরূপ আরেক ঘটনার গল্প করে বোঝাতে চাইলেন এমন হয়েই থাকে। আমি তাদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম।

জ্যান ফিরে আসার আগে মেরি একদিন আমাকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, জ্যান চলে এলে আমি কোথায় যাব? বললাম, কোথাও একটা মাথা গোঁজার ঠাই করে নেবো। তিনি বললেন, কেন, জ্যানের বাড়িতে তো জায়গা আছে–তুমি এখানে থেকে গেলেই পারো। জ্যানকে বলে দেখো না কেন? আমি তো অবাক। বললাম, এখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভবপর হলে জ্যান নিজেই আমাকে বলবে, আমি সে কথা বলে ওকে বিরক্ত বা বিব্রত করতে চাই না।

জ্যান ফিরে আসার পরে আমি তাকে কিছু বলিনি, বোধহয় মেরিই বলেছিলেন। জ্যান আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি মন্ত্র করেছ মেরিকে? যে কালো লোক দেখতে পারতো না, সে তোমাকে রাখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেছে। উত্তরে আমি শুধু হাসলাম।

মানুষ বড়ো জটিল প্রাণী। তাছাড়া, বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বলেছিলেন, মনুষ্য বড়ই পরাধীন।

২৭.

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডসে যেসব কাগজপত্র আমাকে তালিকাভুক্ত করতে হবে, এখন সবসুদ্ধ তা দাঁড়ালো এরকম : (১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির সঙ্গে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরায় অবস্থিত তাদের আটটি আড়ঙ্গ অর্থাৎ সুতি বস্ত্র-উৎপাদন কেন্দ্রের (ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁও, টিটবাদী; জঙ্গলবাড়ি-বাজিতপুর; চাঁদপুর, নারায়ণপুর ও শ্রীপুর) ১৭৯২ ও ১৮০০ সালে লেখা ২৯ খণ্ড দৈনন্দিন চিঠি; (২) ১৭৯১ থেকে ১৮০৯ সালের মধ্যে নানা সময়কার ঢাকা কুঠির বস্ত্র-উৎপাদনের ১৬ খণ্ড হিসাবখাতা; (৩) মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর কুঠির এবং তার অধীন তিনটি আড়ঙ্গের অর্থাৎ রেশমি বস্ত্র উৎপাদন-কেন্দ্রের ১৭৯১ ও ১৮০৯ সালের ১৭ খণ্ড হিসাবখাতা; (৪) মুর্শিদাবাদের কাসিমবাজার কুঠির রেশমি বস্ত্র ব্যবসাসংক্রান্ত ১৮০০-০১ সালের দুটি হিসাবখাতা; (৫) চাকলা জাহাঙ্গীরনগরের ১৭৭৭-৭৮ সালের (বাংলা ১১৮৪ সনের) রাজস্বসংক্রান্ত একটি হিসাবখাতা, চাকলা মেদিনীপুর ও চাকলা জলাসসারের ১৭৮৩ সালের রাজস্বসংক্রান্ত কিছু কাগজ, নদীয়ার কৃষ্ণনগর-বোলান্দিয়ার ভাড়ার রসিদপত্র; মুর্শিদাবাদের আবগারি মহালের ১৮০৮ সালের একটি হিসাবখাতা ও একই সময়ে হিসাবের কিছু কাগজ; ২৪ পরগনার একটি তালুকের ১৮১০ সালের দুটি রোবকারি ও একটি আমলদারি, ওই জেলার বানিয়াঘাটা ফেরিসংক্রান্ত ১৮১২ সালের কিছু কাগজপত্র, ২৪ পরগনা কালেক্টরির ১৮১০ থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যেকার নানা ধরনের পরোয়ানা, দস্তক, শিয়া, তৌজি ও ট্রেজারির মাসিক হিসাব; (৬) ঢাকার কোর্ট অফ অ্যাপিল অ্যান্ড সার্কিটের ১৭৯৫-৯৬ ও ১৮১৪ সালের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কাগজপত্র, হুগলির জেলা জজ আদালতের ১৮০৩ ও ১৮১৪ সালের কাগজপত্র-এর মধ্যে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্রের, হাজি মুহম্মদ মহসিনের এবং রামমোহন রায়ের মামলার কাগজ আছে, সদর দেওয়ানি আদালতে রানি ভবানী ও অন্যান্যের ১৮০৬ সালের আপিলের কাগজপত্র, হুগলির ফৌজদারি আদালতের ১৮১৪ সালের কাগজপত্র, যশোর দেওয়ানি আদালতের ১৭৯০ সালের, বর্ধমান। দেওয়ানি আদালতের ১৭৯৭ সালের ও ২৪ পরগনার দেওয়ানি আদালতের ১৭৯৭ সালের হিসাবসংক্রান্ত কাগজপত্র; (৭) জর্জ বোগলের সংগ্রহে ১৭৭৭ থেকে ১৭৭৯ সালের মধ্যেকার নানা ধরনের কাগজপত্র; (৮) ব্রায়ান হজসনের সংগ্রহে তারিখবিহীন একটি শব্দতালিকা–বাংলা, অসমিয়া ও আরো দুটি ভাষায় লেখা, এবং (৯) ১৭৭৯, ১৮১০ ও ১৮১৩ সালের তিনটি বিবিধ কাগজ।

ঢাকা কুঠির বেশির ভাগ কাগজপত্র ছিল সেখানকার কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জজ টেলরের আমলের। যে-কোনো কারণেই হোক, তিনি এসব নিয়ে দেশে ফিরে আসছিলেন। পথে জাহাজে তাঁর মৃত্যু হলে এসব কাগজ ইন্ডিয়া অফিসে চলে আসে। ২৪ পরগনার রাজস্বসংক্রান্ত কাগজপত্র কলকাতার বোর্ড অফ রেভিনিউ থেকে হেইলিবারি কলেজে পাঠানো হয়েছিল–সম্ভবত সেখানকার ছাত্রদের ব্যবহারের জন্যে। জঙ্গীপুর কুঠির কাগজও বোধহয় কোনো বিশেষ কারণে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল। বোগল ও হজসন নিজেদের সংগ্রহ দিয়ে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়া অফিসে–এগুলো ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপির সহকারী কিপার আর জে বিঙ্গল এগুলোর প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এবারে দেখতে পেলাম কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে ইংরেজিভাষায় পেনসিলে লেখা কিছু টোকা রয়েছে। খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল যে, বেঙ্গলি লিটারেচর (অকসফোর্ড, ১৯৪৮) গ্রন্থের লেখক এবং টমাস অটওয়ের ওয়র্কসের (অকসফোর্ড, ১৯৩২) সম্পাদক ড. জে সি [জ্যোতিষচন্দ্র] ঘোষকে কোনো এক সময়ে এইসব কাগজ তালিকাভুক্ত করতে দেওয়া হয়েছিল। ড. ঘোষ অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি-তবে পুরোনো বাংলা লেখা বোধহয় খুব ভালো পড়তে পারতেন। না। কিছুদিন কাজ করে তিনি আর অগ্রসর হননি।

আমি আগেরবার ১২ খণ্ড চিঠিপত্র তালিকাভুক্ত করেছিলাম। তার তুলনায় এবারে কাজ বেশি। কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। মাইকেল ও’কিফকে বললাম, আরো তিন খণ্ড যদি না-ও হয়, অন্তত আরো এক খণ্ড চিঠিপত্র কোথাও থেকে থাকবে–ভালো করে খোঁজ করে দেখো। আমি থাকতে কিছু পাওয়া গেল না–চলে। আসার পরে একটি খণ্ড বের হলো। সেটা পরে তালিকাভুক্ত করেছিলাম।

এবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহেদা আহমদ ও শিরিন ওসমানীকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পেলাম। শরীফউদ্দীন আহমদ আছেন এখনো, ইফতিখার উল আউয়াল যোগ দিয়েছেন। শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র–এখন স্বনামধন্য সুগত বসু তখন কেমব্রিজে গবেষণা করছিল পিএইচ ডি পর্যায়ে। সেও খুব নিয়মিত আসততা এই লাইব্রেরিতে। তার সঙ্গে দস্তুরমতো হৃদ্যতা হয়ে গেল।

লাইব্রেরিতে ঢুকে একদিন সৈয়দ আলী আহসানকে পেলাম। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে তখন তার নিয়োগের অবসান হয়েছে। তিনি যাচ্ছেন আমেরিকায়, বড়ো মেয়ে জিনাতের কাছে। পথে থেমেছেন লন্ডনে। সেই সুযোগে লাইব্রেরিতে কিছু বইপত্র দেখবেন, তবে বেশি সময় নেই তাঁর হাতে। এই লাইব্রেরি ব্যবহারের প্রস্তুতিও নেই তাঁর। আমি তাঁকে কাগজ-পেনসিল দিলাম। দুপুরে খেতে নিয়ে গেলাম কাছের গ্রিক রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে বসে তিনিই প্রথম মুখ খুললেন : ‘শেখ মুজিব একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন।’ তারপর আরো নানা কথা হলো। সেদিনের পরে লাইব্রেরিতে আর আসতে পারেননি তিনি।

ডেভিড কফ এসেছেন আমেরিকা থেকে। তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলাম ইয়ং ভিকের রেস্টুরেন্টে। যার যার ট্রে-তে খাবার তুলে নিয়েছি। দামটা আমি দিলাম। ডেভিড কফ টেবিলে ট্রে রেখে ফিরে গেলেন। দেখি, নিজের জন্য বিয়ার কিনে আনছেন। আমার কোনো পানীয় লাগবে কি না, একবারও জানতে চাননি।

কোয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বালোচ আবার এসেছেন জার্মানি থেকে। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। চান্সেলর জিয়াউল হককে চিঠি দিয়ে বলেছেন, আপনি জানেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে আমি নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু ভুট্টোকে ফাঁসিতে লটকে আপনি কলঙ্কভাগী হয়েছেন। আপনি যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলর, সে-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হয়ে থাকতে পারি না। বালোচকে জিজ্ঞাসা করি, এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? তিনি বলেন, জিয়াউল হক যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, আমি দেশে ফিরতে পারব না। জানতে চাই, তার পরিবারের কী হবে? বালোচ পিঠ খাড়া করে উত্তর দেন, আমার উপজাতি আছে না?

খান আবদুল ওয়ালী খান কদিন কাজ করলেন লাইব্রেরিতে। যেচে গিয়ে আলাপ করলাম। পাকিস্তানের অবস্থা ভালো নয়, এটুকু বললেন তিনি। যোগ করলেন, তাঁর নিজেরও নিরাপত্তা নেই।

তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করতে চান না বালোচ। বলেন, এই হলো পাকিস্তান। দেশের দুঃসময়ে রাজনৈতিক নেতা নিরাপদে থাকতে চলে এসেছেন লন্ডনে, বই লেখার মালমশলা সংগ্রহ করছেন। নেতা না থাকলে দেশে আন্দোলন করবে কে? সাধারণ মানুষকে চালাবে কারা? এই করেই তো জিয়াউল হকের মতো সামরিক একনায়কেরা নিষ্কণ্টক হয়। আমার দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

২৮.

বেবী জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। এপ্রিলের শেষে মেক্সিকো সিটিতে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার হবে। আনোয়ার আবদেল-মালেক চিঠি পাঠিয়েছেন, ঢাকার কেএলএম অফিস থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে বলেছেন। বেবী তাঁকে জানিয়েছে যে, আমি আছি লন্ডনে। কেএলএমকেও জানানো হয়েছে সেকথা। সব কাগজপত্র সে পাঠিয়ে দিয়েছে জ্যানের ঠিকানায়।

লন্ডনে কেএলএম অফিসে যোগাযোগ করলাম। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, এখান থেকে টিকিট দিতে কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু তার আগে আমাকে মেক্সিকোর ভিসা নিতে হবে।

মেক্সিকোর দূতাবাসে গেলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে তখনো মেক্সিকোর কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়নি, অতএব আমাকে ভিসা দেওয়া যাবে না।

লন্ডনে আমাদের হাই কমিশনে যাই। ডেপুটি হাই কমিশনার মহসিনকে খুলে। বলি আমার অবস্থা। তার পরামর্শে তাঁর অফিস থেকে আনোয়ার আবদেল মালেককে ফোন করি প্যারিসে–তিনি আগাম চলে গেছেন মেক্সিকোয়। তার সেক্রেটারি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে হয় না। মহসিন ভেবেচিন্তে বলেন, তিনি একটা ডিও লিখবেন মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূতকে–তাতে কাজ হবে কি না বলা যাচ্ছে না।

মহসিনের চিঠি নিয়ে আবার যাই মেক্সিকান দূতাবাসে। তারা বিরক্ত হয়। বলে, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীকে কী করে ভিসা দেওয়া সম্ভব? তাদের দপ্তরের এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে পারি? তিনি একটু ভেবে বলেন, জেনে আসি তিনি দেখা করবেন কি না। তবে তিনিই আপনার শেষ আদালত।

রাষ্ট্রদূত দেখা করতে সম্মত হন। মহসিনের চিঠিটা পড়েন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? তাহলে তো তোমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়। তিনি ফোনে কাউকে কিছু বলেন স্প্যানিশে। তারপর আমাকে বলেন, তোমাকে নিচে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে-ভিসা দিতে যতক্ষণ লাগে। আমি অবাক হয়ে যাই এত অল্প সময়ে সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ায়। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কূল পাই না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করেন, নিজে দরজা খুলে দেন।

নিচে নেমে অপেক্ষা করি। সামনে লোকজন কাজ করছে। ভেতর থেকে এক তরুণী এসে কারো সঙ্গে কথা বললো। আমার দিকে একটু তাকালো। তারপর চলে গেল।

অত সুন্দরী আমি এর আগে দেখিনি। পরেও যে খুব দেখেছি, তা নয়। জামার ওপর থেকে সে যেভাবে নিজের স্তনযুগল স্পর্শ করলো, তাতে মনে হলো, নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সে সচেতন।

একটু পরে একটি অল্পবয়সী ছেলে আমার পাসপোর্ট নিয়ে এলো। মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে বললো, রাষ্ট্রদূতের সৌজন্যসহ।

কেএলএম থেকে টিকিট পেতে কোনো ঝামেলা হলো না।

জ্যান এবং মেরি ও তার বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম। ২১ এপ্রিলে লন্ডন থেকে আমস্টারডাম। সেখান থেকে মেক্সিকো সিটিতে পৌঁছোবো পরদিন।

লন্ডন থেকে আমস্টারডাম অল্পক্ষণের যাত্রা। সেখানে পৌঁছে মেক্সিকোগামী ফ্লাইট ধরতে গিয়ে জানা গেল, যাত্রা বিলম্বিত হবে–বিমান খারাপ হয়ে গেছে, সেটা সারানো হচ্ছে।

বিমানবন্দরে অপেক্ষা। এয়ারলাইনসের সৌজন্যে লাঞ্চ খাওয়া। তারপর ঘোষণা, ইচ্ছে করলে এই ফ্লাইটের যাত্রীরা নিজের খরচে শহর ঘুরে আসতে পারে।

এই অবস্থায় বিমানবন্দরে কে বসে থাকতে চায়? পাসপোর্ট রেখে একটা কাগজ নিয়ে বাসে করে শহরের মধ্যস্থলে পৌঁছোলাম। মনোরম দৃশ্য চারদিকে। কিন্তু আসতে যত সময় নিলো, তাতে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরির সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। অল্প খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফেরার বাস ধরার চেষ্টা করলাম। বাস পেতে সময় লাগলো। বিমানবন্দরে বাস থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে বুঝলাম, ভুল টার্মিনালে এসেছি। এখান থেকে হেঁটেই যেতে হবে জায়গামতো। ফেরার সময় চলে যাচ্ছে। দৌড়োতে দৌড়োতে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছোলাম। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বিমান কি আমাকে। রেখে চলে গেল? তারপর জানলাম, যেতে আরো বিলম্ব হবে–যাত্রীরা সব ডিনার খেতে গেছে।

ডিনার খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে যায়। শ্বাসরোধ হবার অবস্থা। আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গলা চেপে ধরে খাবার বের করি। আশেপাশের টেবিল থেকে দু-একজন তাকিয়ে দেখে। সাহায্য করবে-করবে ভাব করে। তার আগে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়ি। হাঁফ ছাড়ি, পানি খাই।

অনেক রাতে বিমান ছাড়ে। মাঝে জ্বালানি নেওয়ার জন্য হিউসটনে বিরতি। তবে বিমান থেকে নামা যায় না। মেক্সিকো সিটিতে পৌঁছোতে খুব বিলম্ব হয়। সেখানে প্রায় ভোর। মালপত্র নিয়ে বাইরে এসে আমার জন্যে অপেক্ষমাণ কাউকে পাই না। কী করবো, কোথায় যাবো? ভাবলাম, কোনো মেসেজ আছে নাকি দেখে আসি। আছে। একটা হোটেলের নামঠিকানা দিয়ে সেখানে সটান চলে যেতে বলা হয়েছে। তাই করলাম। হোটেলকক্ষের বিছানায় ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে মনে হলো, বাঁচা গেল।

২৯.

মেক্সিকোর সভ্যতা অনেক পুরোনো। অন্তত দশ-বারো হাজার বছর আগে সেখানে যে মানববসতি শুরু হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেক্সিকোয় বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে যে অনেক এশীয় ছিল, সে-সম্পর্কেও ইতিহাসবিদেরা একমত। মায়া-সভ্যতা ও অ্যাজটেক-সভ্যতার বিকাশ এ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছিল।

সেমিনারের উদ্যযাক্তারা সেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখাবার ব্যবস্থা দেখলাম। ওই মুহূর্তে তাদের কাজের বেশি নমুনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু মেক্সিকো নগরীর অনতিদূরে অ্যাজটেকদের কীর্তি দেখে মন ভরে গেল। টেনচটিটুলান দেখলাম, দেখলাম সূর্য ও চন্দ্রের মন্দির। তখনো মিশরে যাইনি। সুতরাং অ্যাজটেকদের পিরামিডই আমার প্রথম দেখা পিরামিড। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! স্প্যানিশ বিজয়ীরা তাদের স্থাপত্য-ভাস্কর্য কিছু কিছু নষ্ট করেছিল বটে, কিন্তু যা টিকে রয়েছে, তার বিশালতা ও সৌন্দর্য মনকে। গভীরভাবে আপ্লুত করে। মানুষের কল্পনাশক্তি ও উদ্ভাবননৈপুণ্য এবং সেই সঙ্গে কর্মযজ্ঞ ও শ্রমনিয়োগের বিপুলতার যে-পরিচয় এখানকার ইট-পাথরে এখনো ধরা রয়েছে, তা ক্রমাগত বিস্ময় জাগায়। মেক্সিকোর ইতিহাসে অ্যাজটেকদের কাল একাদশ থেকে যোড়শ শতাব্দী। তারপর স্পেনীয়রা এ-ভূখণ্ড জয় করে নেয়। মিগুয়েলা নামে যে-মহিলা আমাদের প্রদর্শক ছিলেন, তার কথাবার্তায় অ্যাজটেকদের পুরাকীর্তির প্রতি ভালোবাসা এবং সে-সম্পর্কে গর্ববোধ যেমন প্রকাশ পাচ্ছিল, তেমনি স্পেনীয় বিজয়ীদের অসভ্যতা ও নির্মমতা সম্পর্কেও লজ্জাবোধ ও বিতৃষ্ণা লুকোনো থাকছিল না।

আমাদের সভাস্থল মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্মেলন চলল ধীরগতিতে। কোনো অধিবেশনই সময়মতো আরম্ভ হয় না। কারো তেমন তাড়াহুড়ো নেই, দেরির জন্যে আফসোসও নেই। মেক্সিকো নগরীর সংবাদপত্রের সম্পাদক পরিষদ থেকে কয়েকজন এসে পরদিন তাঁদের সঙ্গে চা-পানের আমন্ত্রণ করে গেলেন। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে যখন উদ্‌যোক্তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আমরা। কখন রওনা হবো, তাঁরা অলসকণ্ঠে জানতে চাইলেন, আমি কি সেখানে যেতে খুবই আগ্রহী? বললাম, ওঁরা তো আপনাদের সামনেই কাল আমন্ত্রণ করে গেলেন এবং, মনে হলো, আপনারা সে-আমন্ত্রণ গ্রহণও করলেন, এখন না গেলে কেমন হবে? আপনারা কি জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা যেতে অপারগ? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ, ওরা ভদ্রতা করে নিমন্ত্রণ করলো, আমরা ভদ্রতা করে প্রত্যাখ্যান করলাম না। এখন যাওয়া না-যাওয়া আমাদের ওপরে। আমরা না গেলে ওরা বুঝতে পারবে যে, আমরা অপারগ। তবে তুমি যদি যেতে চাও, আমরা তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমি বললাম, ওঁদের কাউকে তো আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, ওঁদের আমন্ত্রণ আপনাদের সময়-সূচির অন্তর্ভুক্ত না হলে যাবোই বা কেন? তারা বললেন, তুমি দেখছি খুব সিরিয়াস মানুষ। এসব ব্যাপারে এমন হয়েই থাকে।

মেক্সিকোতে একটি ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশাল ভবনে তার অধিষ্ঠান। চমৎকার মিলনায়তন, সুন্দর গ্যালারি, পরিচালকের দপ্তরও মনোরম। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। পরিচালক পরদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমাদের বলা হলো, রাত আটটা নাগাদ আমরা যেন হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করি। বাস এসে আমাদের যথাস্থানে নিয়ে যাবে। আটটা থেকে আমরা অপেক্ষমাণ, নটা বেজে গেল–বাসের দেখা নেই। কর্তৃপক্ষীয় একজনকে পাওয়া গেল–তাঁর কাছে জানতে চাইলাম আমরা কখন রওনা হবো? তিনি বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, বাস এলেই রওনা হবো। জিজ্ঞাসা করলাম, বাস কখন আসবে? তিনি আরো অবাক হয়ে বললেন, যে-কোনো সময়ে এসে যাবে। বাস এলো, আমরা রওনা হলাম। টের পেলাম, পরিচালক থাকেন শহরের উপকণ্ঠে। ফলে, রাত দশটার পরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোলাম। বিলম্বের জন্যে কেউ ক্ষমা চাইলেন না, গৃহকর্তাও তার কারণ জানতে চাইলেন না। পানীয় হাতে আমরা তার প্রাসাদোপম অট্টালিকা, তার চিত্রসংগ্রহ, আসবাবপত্র, গৃহসজ্জা, এমনকী বাগান ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম এবং সুসজ্জিত নরনারীর সঙ্গে আলাপ করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অতিথিদের অনেকেই ইংরেজি জানেন না বলে আলাপ খুব জমলো না। খিদে পেতে লাগলো, কিন্তু তখনো তরল থেকে শক্তে আসার সময় হয়নি। রাত এগারোটার পরে খাবার দেওয়া হলো। প্রচুর আয়োজন। কেউ যে বেশি খেলেন, তা নয়, কিন্তু ভোজনপর্ব চললো অনেকক্ষণ ধরে। রাত বারোটার পরে আমরা বাসে উঠলাম ফেরার জন্যে। যখন গেট দিয়ে বের হচ্ছি, তখন দেখি, দুই গাড়িভর্তি অতিথি সবে আসছেন নৈশভোজে যোগ দিতে।

মেক্সিকো নগরীতে অফিসের সময় কী, তা জানতে চেয়েও আমি প্রায় একই অবস্থায় পড়েছিলাম। উত্তর পেয়েছিলাম, কে কখন অফিসে যায়, তার ওপর নির্ভর করে সে কতক্ষণ সেখানে থাকবে। জানতে চাইলাম, লোকজন কারো। সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কখন যায়? বললো, ফোনে সময় ঠিক করে যায়। একটা কোর-টাইম আছে বটে, কিন্তু সবাই দিনে আট ঘণ্টা অন্তত থাকে অফিসে, তার মধ্যে দর্শনার্থীরা হাজির হয়ে যায়।

হোটেল থেকে ছেলেমেয়েদের একটা পিকচার-পোস্টকার্ড পাঠালাম। পরদিন আরেকটা পাঠালাম ডাকঘর থেকে। মাশুল একরকম নয়। তৃতীয় পোস্টকার্ড ওই ডাকঘর থেকেই পাঠালাম–এবার মাশুল আরেকরকম। বুঝলাম, যার যেমন মনে হয়, সে তেমনি মাশুল সংগ্রহ করছে। নিশ্চয় কোথাও হার লেখা আছে, কিন্তু তা দেখার কষ্ট কেউ করছে না।

আনোয়ার আবদেল-মালেককে অজস্র ধন্যবাদ যে, সেমিনারে আমাকে কোনো দায়িত্বপালন করতে হয়নি। আমি শ্রোতা। বেশির ভাগ প্রবন্ধ স্প্যানিশে, দু-একটি পর্তুগিজে, এক-আধটি ফরাসিতে, কয়েকটি ইংরেজিতে। সব প্রবন্ধ তাৎক্ষণিক অনুবাদের ব্যবস্থা আছে, তবে অনুবাদের মান সব একরকম নয়। ফলে কিছু কিছু লেখার মর্মগ্রহণ বেশ কঠিন হয়েছিল আমার পক্ষে। তাছাড়া, ল্যাটিন আমেরিকা সম্পর্কে আমার পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতা অনেক কিছু বোঝার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়েছিল। তাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো সংগত নয়।

আয়োজকরা খুবই বন্ধুবৎসল। তারা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে ত্রুটি করেননি। নিজেদের মতো চলাফেরার সময়ও দিয়েছিলেন। তারা আরো একটি কাজ করেছিলেন। মেক্সিকো যাওয়ার আগেই আমাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন, আমরা কে কে টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষপূর্তি-অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহী। মেক্সিকো নগরীর সেমিনারশেষে সেখানে যেতে হবে। টাবাসকো বলতে এতদিন কেবল চিলি-সস জানতাম। সেখানে যে দু শ বছরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তা কখনো শুনিনি। এই সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না।

মেক্সিকোর কাজ শেষ, টাবাসকো যাবো। তার ঠিক আগে, সেমিনারে যোগদানকারী কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক একদিন আমার ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল। মলিন মুখ, তাতে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। জানতে চাই, কী হয়েছে। সে বলে, সর্বনাশ হয়েছে। বাড়ির জন্যে কিছু কেনার আগেই দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আমি কাল ফিরে যাচ্ছি। দোকান পরশু খুলবে।

বললাম, আগেভাগে কাজটা করতে হতো। এখন আর কী করবে!

সে বললো, কিছু না নিয়ে আমি বাড়ি ঢুকতে পারবো না। তবে তুমি আমাকে বাঁচাতে পারো।

আমি অবাক হই। বলি, আমি?

হ্যাঁ। ওই সামনের দোকানে মেয়েদের যে-পোশাক আছে এদেশি, তার তিন সাইজের প্রত্যেকটি পাঁচটি করে কিনবে। একটা সুটকেসও কিনতে হবে। তাতে ওসব ভরে কুয়েত এয়ারলাইনসে লন্ডন থেকে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে। এয়ারলাইনসকে পয়সা দিতে হবে না–সুটকেস ছাড়াবার সময়ে আমি ভাড়া দিয়ে দেবো। তুমি শুধু জিনিসপত্র কিনে সুটকেসে ফেলবে আর সুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যাবে লন্ডনে। আর সেখানে কুয়েত এয়ারলাইনসের অফিসে পৌঁছে দিয়ে তোমার কাজ শেষ। বলল, আমার এই উপকারটা করবে। নইলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।

বললাম, করবো।

কুয়েতি এতক্ষণে উঠে বসলো। পোশকের দাম গুনে গুনে দিলো–সুটকেসের দামও ধরে দিলো একটা।

আমি কখনোই বাজার-সওদা করতে পারি না। তারপর এরকম পাইকারি হারে মেয়েদের পোশাক কেনা! ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বউ কটা তোমার? বলেছিল, বউ একটা, কিন্তু শালি আছে, বোন আছে। কোথাও গেলে পনেরো বিশটা কাপড়ের নিচে কিনতে পারি না।

নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো।

বোধহয় সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে আমার মাল-পুল হলো। তীব্র যন্ত্রণায় বিছানা থেকে ছিটকে পড়লাম মেঝেতে। গড়াগড়ি দিলাম কার্পেটে। বেশ অনেক পরে ব্যথার উপশম হলো। তারপর প্রায়ই এই কষ্টে পড়েছি। তবে অত যন্ত্রণা কখনো পাইনি। হয়তো প্রথমবার বলে যন্ত্রণার বোধ তীব্র হয়েছিল।

কুয়েতির জিনিসপত্র কিনে সুটকেসে ভরে হোটেলে রেখে গেলাম। টাবাসকো থেকে ফিরে এখানে আসবো। তখন নিয়ে যাবো।

৩০.

বিমানবন্দরে এসে বসে আছি। এক অ্যাডভোকেট আমাদের পথপ্রদর্শক। তাকে যতই জিজ্ঞাসা করি, প্লেন কটায় ছাড়বে, সে খালি বলে, সবাই এসে পড়লেই রওনা হবো; এই এখনই ছাড়বে; প্লেনে ওঠার ডাক এলো বলে। তাকে পইপই করে বলে দিয়েছি কবে আমরা ফিরে আসতে চাই। সে মাথা নাড়ায় আর বলে, নো প্রবলেম। যাত্রার রহস্যটা বোঝা গেল। আমরা কোনো নিয়মিত ফ্লাইটে যাচ্ছি না। তাই বিমানযাত্রার কোনো নির্ধারিত সময় নেই। টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদ্ববাধন করবেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট। তাঁর বিমানবহরের একটি দয়াপরবশ হয়ে তিনি বরাদ্দ করেছেন আমাদের যাত্রার জন্যে। শুধু আমরা কজন বিদেশি নই, মেক্সিকোর অনেক বিদ্বজ্জন, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট নাগরিক আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। সবাই এসে পৌঁছোলে বিমান ছাড়বে। যিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তিনি তত দেরিতে বিমানবন্দরে আসছেন। সবাই এসে গেলে আমরা যাত্রা করলাম।

টাবাসকোতে একটি পাঁচতারা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। হোটেল কক্ষে পৌঁছোবার পরপরই টেলিফোন বাজল। ফোন তুলতেই একটি নারীকণ্ঠ চমৎকার ইংরেজিতে সঙ্গদানের প্রস্তাব করলো। দুপুরে খেতে বসে আমাদের জাপানি বন্ধু তাকেশি হায়াশি চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ফোন পেয়েছিলে কোনো?

সম্মতিসূচক উত্তর দিলাম।

সে কেবল বললো, হোটেলের রিসেপশনের সঙ্গে নিশ্চয় ওদের যোগ আছে। এটা ভাবতে পারিনি।

পরদিন টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বেশ আগে যেতে হলো। আমরা যাওয়ার পরে একটা মহড়া হলো–সমাবর্তন-অনুষ্ঠানের মহড়া যেমন হয়। তারপর বসে থাকা। তারপর প্রেসিডেন্টের আগমন। অনুষ্ঠান খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু সুচারু। তারপর চা-পান। সেই রাতে টাবাসকো প্রদেশের গভর্নরের নৈশভোজ। সন্ধ্যা হতে না হতেই কয়েকজন লোক কিছু গাউন আর হাওয়াই শার্ট নিয়ে হোটেলে এসে হাজির। কী ব্যাপার! মাননীয় গভর্নর এসব। পোশাক পাঠিয়েছেন নিমন্ত্রিতদের জন্যে–তাঁরা এই পোশাকে সজ্জিত হয়ে গভর্নরের প্রাসাদে নৈশভোজে যাবেন, এই তার বিনীত অনুরোধ। তিন সাইজের গাউন, তিন সাইজের হাওয়াই শার্ট–যার যেটা লাগে। মেয়েদের পোশাক যেমন সব একরকম নকশা ও ছটকাটের, পুরুষদের পোশাকও তেমনি অভিন্ন। হাওয়াই শার্ট আনারসের খোসা থেকে তৈরি তন্তু দিয়ে বানানো–ফিলিপিনসে খুব দেখা যায়।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে, পোশাক বাছাই করতে, কারো কারো পক্ষে বাছাই করা পোশক বদল করতে, সময় নিলো। সরকারি গাড়ির বহর এসেছে–অতিথিদের যেন ঠাসাটাসি করে যেতে না নয়। কিন্তু কর্মকর্তাদের খবরদারি আর একসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টায় আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা। সরকারি গাড়িতে যাচ্ছি বলে নিরাপত্তা বাহিনীর উৎপাত তেমন নেই। তবে মেক্সিকোতে এরা নিরাপত্তা সম্পর্কে বেশ সচেতন। বলে, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে মেক্সিকো থেকে মাদকদ্রব্য চালান হয়, বিনিময়ে আসে আগ্নেয়াস্ত্র। সারা দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে আর কিছুর দরকার নেই।

গভর্নরের প্রাসাদে আনুষ্ঠানিক ভাব-বিনিময়, উস্কৃষ্ট পানভোজন, চমৎকার সংগীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষ আর কোথাও এমন জাতীয়ভাবে পালিত হয় কি না কে জানে!

টাবাসকো ঐতিহাসিকভাবে যেমন প্রাচীন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। নবীন প্রবীণের চমৎকার সমাবেশ। আমরা আজ নগরীর উদ্যানে যাই তো কাল পুরাকীর্তি দেখতে যাই। যেদিন মেক্সিকো নগরীতে ফেরার কথা, সেদিনও বেড়াবার কর্মসূচি। হায়াশি যাবে না। বলে, বেড়াতে গেলে প্লেন ধরতে পারবে না। এদের যা সময়জ্ঞান!

আমাদের অ্যাডভোকেট বলে, চলো চলো। নো প্রবলেম।

আমি যেতে সাব্যস্ত করি। দুই বাস ভর্তি হয়ে যাই। প্রতি বাসে সাত-আটজন তরুণ-তরুণী দোভাষী ও পথপ্রদর্শক। তারা খুবই মিশুক, বন্ধুসুলভ।

ফিরতি পথে দোভাষীদের প্রস্তাবে ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। সদলে, দু তিনজনে, কোনো একজনের সঙ্গে। যে-অল্পবয়সী মেয়েটি আমার দোভাষী ছিল, সে এগিয়ে এসে হঠাৎ আমার গালে গাল লাগিয়ে ছবি তোলার জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। এক তরুণ জিজ্ঞেসা করলো, ছবির কপি চাই নাকি আমার। বললাম, চাই তো বটে, কিন্তু আমি তো আজ রাতেই টাবাসকো ছেড়ে যাচ্ছি। সে বললো, তুমি খরচ দিয়ে গেলে তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারি। দিলাম কিছু। আরেকজন বললো, ছবি প্রিন্ট করার জন্য কিছু দেবে না ওকে? দিলাম। অন্য কেউ কেউও, দেখি, দিচ্ছেন। ওসব ছবি আমি কোনোকালে পাইনি। মনে হয় না, আর-কেউ কখনো পেয়েছেন।

ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়। হোটেলে খোঁজ করে জানতে পাই, হায়াশি বিমানবন্দরে চলে গেছে। মালপত্র গোছানোই ছিল। সেসব নিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বিমানবন্দরে পৌঁছানো গেল।

দেখি, হায়াশি ফুঁসছে। অ্যাডভোকেটকে লক্ষ্য করে বলছে, ইউ আর স্টুপিড।

কী হয়েছে? অ্যাডভোকেট এত বলা সত্ত্বেও সে আমাদের ফেরার আসন সংরক্ষণ করতে ভুলে গেছে। কোনো ফ্লাইটেই এখন জায়গা নেই। আমরা সাতজন আটকে গেছি।

অ্যাডভোকেটের বিকার নেই। বলে, ‘নো প্রবলেম।

একটু পরে বাসে করে হোটেলে ফিরে আসি। রুম ছেড়ে দিয়ে গেছি। নতুন করে রুমও দিচ্ছে না। হোটেলের লোক আমাদের লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলছে আর ইচ্ছেমতো খেয়ে নিতে বলছে। অ্যাডভোকেট একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে–কাকে কে জানে!

অনেকক্ষণ পরে সে বললো, চলো।

কোথায়?

এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট।

বিমানবন্দরে এলাম। আমাদের সাতজনের জন্যে একটা একজিকিউটিভ প্লেন চার্টার করা হয়েছে। মেক্সিকো সিটি থেকে সেটা এসে পৌঁছোলেই আমরা ফিরতি যাত্রা করতে পারব। অ্যাডভোকেট বলছে, ‘নো প্রবলেম।

হায়াশির রাগ তাতেও কমছে না।

জীবনে ওই একবারই একজিকিউটিভ প্লেন চড়লাম। আসনগুলো চমৎকার। গোল টেবিল জুড়ে কনফারেন্সের জায়গা। সেখানে বসে খাওয়া-দাওয়াও চলে। দুজন মাত্র ক্রু। আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট। তারা সর্বক্ষণ খাওয়াতে চায়।

গভীর রাতে মেক্সিকো নগরীতে ফেরা। সেখান থেকে হোটেলে। রাতে আর ঘুমোবার অবকাশ হলো না। ভালো করে সকাল হওয়ার আগেই আবার বিমানবন্দরে রওনা হয়ে গেলাম। লন্ডনের প্লেন ধরতে হবে।

এবারে কুয়েতির সুটকেস আমার সঙ্গে।

৩১.

মেক্সিকো থেকে ফিরে আমার প্রথম কাজ হলো কুয়েতি অধ্যাপকের সুটকেস। নিয়ে কুয়েত এয়ারলাইনসে যাওয়া। সেখানকার লোকজন জানিয়ে দিলো, সুটকেস পাঠাতে হলে পুরো ভাড়া চুকিয়ে পাঠাতে হবে-মাশুল দিয়ে মাল ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাদের নেই। অগত্যা পঞ্চাশ পাউন্ড পকেট থেকে দিয়ে সুটকেস পাঠালাম। পথে-পাওয়া বন্ধুকে সেটা জানিয়ে চিঠিও দিলাম। আশায় আশায় থাকলাম, ধন্যবাদসহকারে একটা ব্যাংক ড্রাফট আসবে। ড্রাফট দূরের কথা–প্রাপ্তিস্বীকারই এলো না।

তবে লন্ডনে ফিরে এটাই যে প্রথম কাজ ছিল, তা বলা ঠিক হলো না। প্রথম কাজ ছিল নতুন ঠিকানা খোঁজা। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির প্রতিভা বিশ্বাসকে। তিনি একসময়ে বলেছিলেন যে, প্রয়োজনে আমার থাকবার ব্যবস্থা করে দেবেন। এখন আমার। ফোন পেয়ে বললেন, খোঁজ নিয়ে জানাবেন। মিনিট ১৫ পরে আবার ফোন করলাম। বললেন, মর্ডেনের দিকে একটা জায়গা আছে। তাঁর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে গৃহকত্রী ছায়া বসাককে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, একটি ঘর খালি আছে এবং সেটা আমাকে দিতে পারবেন। আমি কবে থেকে নিতে ইচ্ছুক–তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে যখন বললাম, এখনই আসতে চাই, তিনি একটু অবাক হলেন, তবে আপত্তি করলেন না। বললেন, মর্ডেন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তাকে যেন আবার ফোন করি। এই মর্ডেনের দু স্টেশন উত্তরে কলিয়ার্স উড–১৯৭৪-৭৫ সালে সেটিই ছিল আমার বাসস্থানের নিকটতম টিউব স্টেশন। মর্ডেন থেকে গৃহকত্রীকে ফোন করে দিকনির্দেশনা চাইলাম–সেটাও বাহুল্য, কেননা স্থানীয় মানচিত্র তো আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনেই থাকে। ছায়া বিশ্বাস বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। আমার আপত্তিতে কাজ হলো না। তিনি গাড়ি চালিয়ে এলেন এবং মালপত্রসমেত আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।

বাড়িটা স্যান্ডবোর্ন অ্যাভিনিউতে–স্টেশন থেকে হাঁটা-পথ। সুন্দর বাড়ি, গৃহকত্রীর যত্নে তা ছিমছাম। ভদ্রমহিলার স্বামী অতুল বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন, পরে পেশাগত পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে, এখন লিবিয়াতে কর্মরত। পরিবারের সবাই–মানে স্বামীস্ত্রী ও পুত্রকন্যা–সেখানেই ছিলেন, ছায়া বিশ্বাস সম্প্রতি সন্তানদের নিয়ে চলে। এসেছেন লন্ডনে। তিনি ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করেন, ওভালের দিকে তার অফিস। জলি হাইস্কুলে পড়ছে, ছেলেটিও সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। বাড়ির একতলায় ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম–সেটা লিভিং রুমও বটে–এবং রান্নাঘর। দোতলায় তিনটি বেডরুম ও বাথরুম। দুটি বেডরুমে ওঁরা তিনজন থাকেন, তৃতীয়টি আমি অধিকার করলাম। পরে জানা গিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে অতুল বিশ্বাস আমাকে চেনেন এবং লিবিয়ায় তাঁদের অন্তরঙ্গ এক পরিবার ঢাকায় আমার পূর্বপরিচিত।

ছায়া বিশ্বাস অতিশয় সদাশয় মানুষ। তার বাড়িতে যাওয়ার পরে সপ্তাহান্তে আমি একটা ব্যাগে ময়লা কাপড় নিয়ে লড্রেটে ধুতে যাচ্ছিলাম। তিনি বাধা দিলেন। বললেন, বাড়িতে তো ওয়াশিং মেশিন আছে–আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে রেখে দিলেন। এরপর থেকে আমাকে আর নিজ হাতে কিছু করতে হতো না–শুধু ময়লা কাপড়ের ব্যাগ রেখে গেলেই হতো। তিনি ধুইয়ে, বাড়ির পেছনের জমিতে টাঙানো দড়িতে শুকিয়ে, ভাজ করে, আমার বিছানার ওপরে রেখে দিতেন।

একবার বুলুর বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম। ছায়া বিশ্বাস সে-কদিনের ভাড়া নিতে অস্বীকার করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমি না থাকলে কী হবে, তাঁর ঘর তো দখল করে রেখেছি। তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, তিনি পেশাদার বাড়িওয়ালি নন।

আমি চেষ্টা করতাম সকালে ওঁদের পরে বাথরুম ব্যবহার করতে–যাতে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে কিংবা মহিলার অফিসে যেতে দেরি না হয়ে যায়। সকালে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম, রাতে খেয়েদেয়ে ফিরতাম। কোনো কোনো বেলা যে তাদের সঙ্গে খাইনি, তা নয়, তবে এটিই ছিল আমার সাধারণ নিয়ম। এঁরা জেগে থাকলে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখতাম কিংবা আমি খাবার টেবিলে লিখতে বসে যেতাম, ওঁরা বা উনি টেলিভিশন দেখতেন কিংবা আমাকে কফি খাওয়াতেন। জলি খুব সরল ও লক্ষ্মী মেয়ে–নানাভাবে সাহায্য করতে চেষ্টা করতো। তার ভাইটিও মিশুক প্রকৃতির–তার দাবি ছিল আমার কলমের ওপরে। আমি লিখতে বসলেই সে জিজ্ঞেস করতো, ‘হোয়্যার ইজ মাই ব্লু পেন? কলমটা অবশ্য নীল ছিল না, নীল ছিল তার রিফিলের কালি।

রিফিলের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। বুশ হাউজের নিচতলা থেকে কলমের রিফিল কিনেছিলাম কয়েকটা। ঘরে ফিরে টের পেলাম, সেল্সগার্ল ভুলে দুটো রিফিল বেশি দিয়েছে। পরদিন যখন তাকে সেগুলো ফেরত দিতে গেলাম, সে সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ইউ আর ভেরি অনেস্ট!’ শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, আমি কৃষ্ণাঙ্গ বলেই সে সততার কথাটি তুললো, শ্বেতাঙ্গ হলে হয়তো শুধু ধন্যবাদ দিতো বা নিজের অসতর্কতার জন্যে লজ্জা প্রকাশ করতো। আবার এমনো হতে পারে যে, সবটাই পরিবেশের কারণে আমার স্পর্শকাতরতার ফল।

৩২.

বুলুর মা উমা দেবা এসেছেন মেয়ের কাছে–পারলে এখানেই থেকে যাবেন। বুলুর কাছে যাঁরা আসেন, তাঁরা সবাই প্রায় তার আত্মীয় বা পরিচিত। আমার মতো দু-চারজন অচেনা যারা আসে, তাদেরকেও তিনি আপন করে নেন। সর্বসংস্কারমুক্ত মানুষ নিজের কথা কম বলেন, অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করেন না। যত বলেন, তার চেয়ে শোনেন বেশি।

বুলুর সঙ্গে মেলামেশার সূত্রটা আবার কুড়িয়ে নেওয়া গেল। মাঝে মাঝে মাসিমা এবং মানসী ও সরোজ আমাদের অভিযানে যোগ দেন। একবার সবাই মিলে বাইরে খেতে যাব। মানসীরা এসে গেছে। বুলু কার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছে–কথা আর ফুরোয় না। শেষ পর্যন্ত যখন সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলো, আমি বললাম, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল না জন্মালে তোমার খুব অসুবিধে হতো। সবাই একচোট হেসে নিলো।

একসময়ে সমুদ্রতীরবর্তী বোর্নমাউথে বেড়াতে গেলাম। এক গাড়িতে মাসিমা, বুলু ও আমি। অন্য গাড়িতে সরোজ ও মানসী। একটা ব্রেড-অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে জায়গা পাওয়া গেল। পুরুষেরা এক ঘরে, মেয়েরা আরেক ঘরে–কড়া বিভাজন। এক জায়গায় বুলু গাড়ি পার্ক করবে–পার্কিংয়ের জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে এক গাড়ি সজোরে এসে আমাকে চাপা দেয় আর কী! আমি পালালাম, পার্কিংটা ওই গাড়িওয়ালাদের দখলে চলে গেলো। বুলু প্রতিবাদ করলো এবং সেই গাড়ির চালক ও আরোহী দুই শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে তার রীতিমতো ঝগড়া লেগে গেলো। বুলুর সমর্থনে মানসীও কিছু বললো–কেবল সরোজ ও আমি দূরে দূরে রইলাম। কাজটা একদম পুরুষোচিত হলো না। এ-নিয়ে বুলুর তিরস্কার শুনতে হলো।

বোর্নমাউথ জায়গাটা খুব সুন্দর। সমুদ্রের ধারের মাটি এখানে নীলাভ। সেই মাটি দিয়ে বাসনপত্র থেকে শুরু করে ঘর সাজাবার জিনিস তৈরি হয়। তার কিছু নমুনাও সংগ্রহ করা গেল। রাতের বোর্নমাউথ আলোকমালাসজ্জিত–আরো আকর্ষণীয়। দিনে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। আমরা কেউই পানিতে নামছি না, সাঁতারের পোশাকপরা নরনারীর মাঝখানে আপাদমস্তক সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-সেটা বেশ বেমানান। তবে এখানে কে কাকে লক্ষ করে! সবাই প্রকৃতির সৌন্দর্যভোগ করতে এবং আমোদফুর্তি করতে ব্যস্ত। দু রাত সেখানে। কাটিয়ে ফিরতি যাত্রা।

ফেরার পথে স্টোনহেনজ দেখলাম। পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে যা ছিল, তার ধ্বংসাবশেষ। এতকাল পরেও যা টিকে আছে তা দেখার এক আশ্চর্য অনুভূতি! মানুষের কী অপরূপ কল্পনা, কী অসাধ্য পরিশ্রম, কী অপরাজিত সংকল্প কাজ করেছে এর পেছনে। ওই বিশাল বিশাল পাথর কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে, কেমন করে টেনে এনেছে, কেমন করে সাজিয়েছে, কত সময়। লেগেছে–কে জানে!

লন্ডনে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে সান্ধ্য দৈনিকের খবরে দেখা গেল–আততায়ীর বোমার আঘাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিহত হয়েছেন। রিপাবলিকান আর্মির কাজ। বুলুর বাড়িতে ফিরে টেলিভিশন ঘিরে বসলাম। কত জানা-অজানা ইতিহাস তার পর্দায় উন্মোচিত হলো।

মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে আমার মনে ক্ষোভ ছিল। ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে ব্রিটিশ সরকার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের জুন পর্যন্ত। মাউন্টব্যাটেন তাড়াহুড়ো করে ১৯৪৭ সালেই সে-কাজ সম্পন্ন করেন। ফলে দ্রুতগতিতে পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাগ করতে গিয়ে মানুষের দুর্দশা কিছু বেড়েছিল। আরেকটু সময় নিয়ে ক্ষমতা-হস্তান্তর করলে হয়তো অত রক্তপাত হতো না। আর এ দ্রুত ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন ভারতবাসীর কথা ভেবে নয়, নিজের পরবর্তী দায়িত্বগ্রহণের সুবিধের কথা চিন্তা করে–এটাই আমার ধারণা।

বছর দুই আগে আমার বন্ধু লেওনার্ড গর্ডন মাউন্টব্যাটেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন তখন যুক্তরাজ্যের বাইরে কোথাও যাচ্ছিলেন–লেনিকে বলেছিলেন, তার বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত গাড়িতে তার সঙ্গে সে কথা বলতে পারে। সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ শুনে মনে হয়েছিল, ভারতে থাকাকালে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে পূর্বধারণাজাত বিরাগ তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল। এতকিছু সত্ত্বেও মাউন্টব্যাটেন নিহত হওয়ায় বেদনা অনুভব করেছি।

বুলু এরপর মাসিমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলো মার্কিন মুলুকে। ফ্ল্যাট বন্ধ করে মানসীর কাছে চাবির গোছা দিয়ে চলে গেলো। কী এক কারণে সেখান থেকে ফোন করে বললো, আমি যেন তার ফ্ল্যাটে কয়েকদিন গিয়ে থাকি। মানসীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে সেখানে সাত-আট দিন থাকলাম।

বুলুর কাছে হরদম ফোন আসে–অপরপ্রান্ত জানতে চায়, আমি কে। পরিচয় দিতে দিতে হয়রান হয়ে পড়ি। এক সকালে এমনি এক ফোন এসেছে। আমার পরিচয় পেয়ে ওপাশের নারীকণ্ঠ বললো, আনিস মামা, আমি মঞ্জু।’ ফাহমিদা মজিদ ওরফে ফাহমিদা হাফিজ ওরফে মঞ্জু। তার বাড়িতে কী একটা অনুষ্ঠানে বুলুকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। বুলু নেই, কিন্তু আমাকে যেতে হবে। বিশেষ আপত্তি করিনি। ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ আমার দীর্ঘকালের পরিচিত। আর মঞ্জু তো শিশুকাল থেকে আমার ভাগ্নি। গেলাম তাদের বাড়ি এবং আপ্যায়িত হয়ে ফিরলাম।

বুলু ফেরার আগে মানসী তার ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রাখলো। আমরা তিনজনে মিলে তাঁদের দুজনকে আনতে গেলাম বিমানবন্দরে। দেখি, বিমর্ষ মুখে বের হচ্ছেন মা ও মেয়ে। কী ব্যাপার? লাগেজ আসেনি। পরে বহুকষ্টে তা উদ্ধার হয়েছিল অথবা সবটুকু উদ্ধার হয়নি।

মাঝখানে আমার শরীরটা খারাপ করেছিল। বুলু আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিলো। হাসপাতালে যখন বুলু আমার থেকে একটু দূরে, তখন কৌতূহলী নার্স আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ইজ শি ইওর ওয়াইফ? বললাম, ‘আই উইশ শি ওয়্যার, বাট শি হ্যাঁপেনস টু বি ওনলি মাই জিপি। মেয়েটি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেলো। এ-কথায় পুরো সত্য বলা হয়নি, তবে প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তা খারাপ হয়নি।

মানুষের জন্যে বুলুর দরদ ছিল অসাধারণ। ভারত থেকে একটি অবাঙালি ছেলে এসেছিল লন্ডনে চিকিৎসা করতে। সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে সে। যোগাযোগ করেছিল বুলুর সঙ্গে। বুলু তার জন্যে অনেক করেছিল, এমনকী, যে হাসপাতালে সে ছিল, তার ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে তার ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটি হাসপাতালেই মারা যায়–বুলু সে-মৃত্যু একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, হাসপাতালের বিরুদ্ধে সে মামলা করার কথাও ভেবেছিল–আমরা কয়েকজন মিলে তাকে নিরস্ত করি। আরেকবার কেরালা থেকে এক ডাক্তার এসেছিলেন কোনো এক সম্মেলনে। সম্মেলনের পরে বুলু তাঁকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিল, লন্ডন ঘুরিয়ে দেখেছিল, আমরা সকলে মিলে নাটক দেখতে এবং বাইরে খেতে গিয়েছিলাম। সেই রাতে তাদেরকে বিবিসি-র বাংলা বিভাগও দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।

৩৩.

বিবিসি-র বাংলা অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিই। আগে থেকে কর্মসূচি স্থির হয়ে থাকে। আবার, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ডাকও পড়ে। একবার ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসে কাজ করছি–সিরাজুর রহমানের ফোন এলো, তখনই যেতে হবে। গিয়ে জানলাম, ভুট্টোর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়ে গেছে, নির্ধারিত বিষয় কিছু বাদ দিয়ে এই প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা হবে। সেইসব বিষয়বস্তু অনুবাদ ও পাঠ করতে হবে।

সেদিন বিকেলে বিবিসি ক্লাবে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে দেখি। তিনি বেশ উদবিগ্ন ছিলেন। সামরিক শাসকদের উন্মত্ত আচরণের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন কি না ভাবছিলেন। ঢাকার খবর জানতে চাইলেন আমার কাছে, তারপর নিজেই বললেন, কী আর জিজ্ঞেস করবো, আমি যাদের জানতাম, তাদের অনেকেই তো আর নেই।

ভুট্টোর প্রতি আমার বিরাগের সীমা ছিল না, কিন্তু সামরিক শাসকদের হাতে, এমন প্রহসনমূলক বিচারে, তাঁর মৃত্যু গ্রহণযোগ্য ছিল না।

একদিন জন ক্ল্যাপহাম আমাকে ডেকে নিলেন তাঁর অফিসে। জানতে চাইলেন, আমি ওসি (অকেশনাল কনট্রিউবিটার) হতে রাজি কি না অর্থাৎ তাদের আরেকটু বেশি সময় দিতে পারব কি না। তাহলে আমাকে দরকারমতো সংবাদ অনুবাদ করে পাঠ করতে হবে এবং রাতের ট্রানসমিশনের–অর্থাৎ যে-অনুষ্ঠান আমাদের দেশে ভোরবেলায় শোনা যায়–তার দায়িত্ব নিতে হবে। একটু সময় চাইলাম, তারপর সম্মত হলাম। এতে কাজ একটু বাড়লো।

একদিন দুপুরে সংবাদের দায়িত্ব আমার ছিল–তা পালন করতে পারিনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমানের পুত্র জিয়াউর রহমান লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল। বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম তার জন্যে–কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউ কারো দেখা পাইনি। সে চলে যাবে পরদিনই। রাতে যখন সে ফোন করলো, তখন পরদিন তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় স্থির করলাম। সে আসতে দেরি করলো–লন্ডনে প্রথম এসেছে, দেরির জন্যে দোষ দিতে পারি না। কিন্তু তাকে খাইয়ে বিদায় দিতে গিয়ে আমার আর সংবাদ অনুবাদ করার সময় রইলো না। অন্য কাউকে তা করতে পাঠানো হলো। পরে আমি গিয়ে সেই সংবাদপাঠকের মূল দায়িত্ব পালন করলাম।

রাতের ট্রানসমিশনের জন্যে বেশ আগে যেতে হতো বার্তা বিভাগে। সেখানে বসে অনুবাদ করতে হতো। তারপর বাংলা বিভাগে এসে বাকি অনুষ্ঠানের রেকর্ড নিয়ে যেতে হতো স্টুডিওতে। সংবাদপাঠের পর সেটা বাজানো হতো। অনুষ্ঠানশেষে বিবিসি-র ভাড়া করা ট্যাকসিতে ফিরতাম মধ্যরাতের অনেক পরে।

এক রাতে সংবাদ অনুবাদ করে স্টুডিওতে চলে গেছি। তার মধ্যে বার্তা সম্পাদক এলেন ইংরেজিতে লেখা এক টুকরো খবর নিয়ে। ওটা প্রচার করতে হবে। অনুবাদ করার সময় নেই। ইংরেজি কাগজটা সামনে রেখে মুখে মুখে অনুবাদ করে গেলাম। ভুল করিনি। তবে লিখিত অনুবাদে একবার ত্রুটি হয়েছিল আমার। কিং অফ জর্ডানকে জর্ডানের বাদশাহ না বলে রাজা বলেছিলাম। সিরাজুর রহমান এই ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন পরদিন।

আরেক সন্ধ্যায় বেশ একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি স্টুডিওতে গেছি, স্টুডিও কমিশনার যে-তরুণী, সেও এসেছে। মাইক্রোফোনে কণ্ঠস্বর যাচাই করার জন্যে দু-চার কথা বলেছি, মেয়েটি কাঁচের ওপাশ থেকে বলে উঠলো, ‘হোয়াট এ লাভলি ভয়েস!’ আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমার কণ্ঠস্বর যদি ভালোও হয়ে থাকে, তার জন্যে নিজে কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারি না।

অনুষ্ঠানের শেষে তার ঘরে প্রবেশ করলাম অনুষ্ঠানের বাকি অংশের ধারণকৃত রেকর্ড ফেরত নিতে। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, অনুষ্ঠানশেষে আমি কোথায় যাবো? বললাম, বাড়ি। সে জানতে চাইলো, কোথায়। এলাকার নাম বললাম। তারপর আমি আর কিছু বললাম না বলে সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

৩৪.

এবারে আমি যখন লন্ডনে এলাম, তখন সেখানে বাংলাদেশের হাই কমিশনার এ আর এস দোহা-মিনু দোহা নামে অধিকতর পরিচিত। তাঁকে অনেকেই পছন্দ করতেন না এবং তা হয়তো অকারণে নয়। তবে সেবারে হাই কমিশনে অনুষ্ঠেয় আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটিতে দেশের প্রবাসী শিশুদের গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি ভালো কাজ করেছিলেন। তারাই সারাদিন গানবাজনা-আবৃত্তি-খেলাধুলা করবে। সন্ধ্যায় সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানটি হবে বড়োদের জন্যে। একাধিক বয়োবর্গের শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশিম বিচারকমণ্ডলী গঠন করেছিলেন, এর তিন সদস্য শিল্পী। কামরুল হাসান, তিনি নিজে এবং আমি। কামরুল হাসান তখন লন্ডনে এসেছিলেন বেড়াতেওবায়েদ জায়গীরদারের বাড়িতে থেকে ছবি আঁকছিলেন প্রচুর, একটা চিত্রপ্রদর্শনীর চিন্তাও ছিল তাঁর মাথায়। যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে। জানতে পারলাম, প্রতিযোগিতার বিষয়ের মধ্যে আছে কবিতা-আবৃত্তি, সংগীত এবং তেলাওয়াত-ই-কুরআন। আমি প্রমাদ গনলাম। কুরআন-তেলাওয়াতের বিচারক হওয়ার অধিকার কামরুল হাসান ও নাজমুদ্দীন হাশিমের আছে, কিন্তু আমার! শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাজটা এড়ানো গেল না–কেবল শ্রুতিমাধুর্যের ভিত্তিতে নম্বর দিলাম। কেউ যে বিচার কিংবা বিচারক সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেনি, তাই ভাগ্যি। বিচার যেমন হোক, বাচ্চাদের উৎসাহ দেখে খুব ভালো লেগেছিল। অনেকের জন্যেই বাংলা আর প্রথম ভাষা নেই, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাংলায় কবিতা পড়তে, গান গাইতে! দুপুরে খাওয়ার সময়ে ছোটোদেরকেই আগে খেতে দেওয়া হয়েছিল–খুব সুশৃঙ্খলভাবে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল তারা। অভিভাবকেরা ছিলেন পেছনে, তবে বাচ্চাদের মতো। সুশৃঙ্খল ছিলেন কি না সন্দেহ।

সন্ধ্যায় সংবর্ধনা। বহু অতিথি এসেছিলেন। ডেপুটি হাই কমিশনার মহসীন খুঁজে পেতে নিয়ে এসেছিলেন প্রফেসর জে এস টার্নারকে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব। থেকে অবসর নিয়েছিলেন প্রায় সিকি শতাব্দী আগে। তাঁকে বসানো হয়েছিল একটা চেয়ারে–কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন, অবশ্য সবাই তাঁকে নিবৃত্ত করছিল। তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। আমি তাঁর জেনারেল ইংলিশ ক্লাসের সাধারণ ছাত্র–আমাকে মনে রাখার কোনো হেতু নেই। তিনি অবশ্য চিনতে না পারার কারণ হিসেবে নিজের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কথা বললেন, আমি তার ছাত্র শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, কতকাল আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এসেছি, তোমরা এখনো আমাকে মনে রেখেছ, এত সম্মান জানাচ্ছ–এ আমার আশার অতীত। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে থাকলেন।

পরে একদিন দুপুরবেলায় এক রেস্টুরেন্টে কামরুল হাসান ও আমাকে খাওয়ালেন নাজমুদ্দীন হাশিম। তাঁর অভিজ্ঞতা বিস্তর, কথা বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয়। যে-বিষয়েই বলেন, শুনতে ভালো লাগে।

কামরুল হাসান শেষ পর্যন্ত চিত্রপ্রদর্শনী করতে পেরেছিলেন কমনওয়েলথ ইনসটিটিউটে। লোকসমাগম ভালো হয়েছিল, ছবির বিক্রিও মন্দ হয়নি। তিনি খুশি হয়েছিলেন। প্রদর্শনীর শেষে প্যারিস ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।

সেবারকার নববর্ষ-উদযাপনের কথাও মনে পড়ে। ফিসবেরি পার্ক এলাকায় তার আয়োজন করেছিলেন জেবউননেসা বখশ। বয়সে আমার চেয়ে। বেশ খানিকটা বড়ো, কিন্তু এম এ ক্লাসে আমার ছাত্রী ছিলেন। তিনি তখন লন্ডনে এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন, সেখানকার স্কুলগুলিতে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যাপক ব্যবস্থা যাতে হয় তার চেষ্টা করেন, আর লেখালিখি করেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কবিতা পড়তে অনুরোধ করায় আমি কিছুটা সংক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ পড়েছিলাম। তার খানিক পরে স্থানীয় পার্লামেন্ট-সদস্য এলেন। জেবউননেসা বখশ পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ঠিক শুনেছি তো-উনি বললেন, তুমি তার শিক্ষক! আমি বললাম, একেই বলে বরাত। তিনি বললেন, শুনলাম, তুমি এখানে কবিতার ব্যাখ্যা করেছ। বুঝলাম, তার কাছে কবিতার যথার্থ আবৃত্তি মানে তার এক ধরনের ব্যাখ্যা-ইনটারপ্রিটেশন। আমার কবিতাপাঠ আবৃত্তির পর্যায়েও পড়ে না, একথা তাঁকে বোঝাতে যাওয়া বৃথা। বললাম, একরকম।

সেবারে এবং তার পরেও জেবউননেসা বখশের বাড়িতে আপ্যায়িত হয়েছি। বখশ সাহেব অতি ভদ্র, দয়ালু ও বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। সব বিষয়ে স্ত্রীকে সাহায্য করেন। তিনিও আমাকে সার’ বলে সম্বোধন করছিলেন–বাধা দিয়ে লাভ হয়নি।

৩৫.

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পূর্বতন ডাইরেক্টর জোন ল্যানকাস্টার লোকমুখে জেনেছেন, আমি আবার লন্ডনে এসেছি লাইব্রেরির কাজে। তিনি নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে। সেইসঙ্গে লাইব্রেরির বর্তমান ডাইরেক্টর ব্লুমফিল্ড, দুই ডেপুটি ডাইরেক্টর ডেসমন্ড ও মার্টিন এবং মাইকেল ও’কিফকেও নিমন্ত্রণ করেছেন। ডেপুটি ডাইরেক্টরদের একজন আমাকে বললেন, তিনি যেতে উৎসাহবোধ করছেন না, কেননা জোনের সাহচর্য সন্ধ্যা কাটানোর সেরা উপায় নয়। আমি শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। ভদ্রমহিলাকে আমার খুবই চমৎকার মনে হতো, অথচ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজনের কাছে তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা এমন দুঃসহ মনে হয়! মানুষ যে কত দুয়ে, এ থেকে তা বোঝা যায়।

নিমন্ত্রণরক্ষা করতে অবশ্য সবাই গেলেন। একদিন লাইব্রেরিতে কিছু বেশি। সময় কাটিয়ে দুই গাড়ি করে আমরা পাঁচজন একসঙ্গে গেলাম। জোন ল্যানকাস্টার লন্ডনের এক প্রান্তে একা থাকেন। সুন্দর, গোছালো বাড়ি। তিনি নিজে রান্না করেছেন। অতিথিদের যত্নের ত্রুটি করলেন না। আমি খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করতে থাকলাম, তার কোনো আচরণ পীড়াদায়ক হতে পারে কি না। সেইসঙ্গে যিনি কেবল ভদ্রতার খাতিরে গেছেন, তাঁকেও পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। হয়তো জোন একটু বেশি কথা বলেন, এর অতিরিক্ত আর কিছু আমি খুঁজে পেলাম না। অপরপক্ষে আমন্ত্রিত কেউ যে অস্বস্তি বোধ করছেন, সেটাও বোঝার উপায় ছিল না। জোন আমন্ত্রণও করেছেন হিসেব করে–পাঁচজন অতিথি এবং গৃহকত্রী মিলে খাবার টেবিলের চারপাশে সুন্দর বসে গেলেন।

আমি নিজে খুবই অভিভূত। জোন ল্যানকাস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে। ব্যক্তিগত কোনো সংযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন, আমিও এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। এমন অবস্থায় আমাকে নিমন্ত্রণ করার বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল না। তবু যে তিনি এত কষ্ট স্বীকার করলেন, তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।

আবার এটা ভেবেও বিস্মিত হলাম যে, যিনি জোনকে অপছন্দ করেন, তিনি অকপটে কথাটা আমাকে বলে দিলেন। না বললে আমি ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা টের পেতাম না, জানতেই পারতাম না যে, সৌজন্যের আবরণে কেউ ভিতরের অস্বস্তি ঢেকে রেখেছেন।

না জানলেই ভালো হতো। সন্ধ্যাটা তাহলে আমার জন্য নিরঙ্কুশ ভালো লাগার হয়ে থাকতো।

৩৬.

বন্ধু এ বি এম শফিউল্লাহর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

পরিকল্পনা কমিশনের চাকরি ছেড়ে শফিউল্লাহ্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন পিএইচ ডি করতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিন ছেলেমেয়ে এবং নববিবাহিত বধূকে। বিদেশ থেকে চিঠি লিখে তাঁর পুনর্বিবাহের কথা জানিয়েছিলেন আমাকে। মেয়েটি অল্পবয়সী। চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী ছিল–কোনো না কোনো সূত্রে তখন তাকে জানতাম। পরে অস্পষ্টভাবে শুনেছিলাম, বিয়েটা ভেঙে গেছে, তবে শফি ডিগ্রি অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়ে গেছেন।

এবার আকস্মিক দেখা হওয়ায় জানলাম, ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড পেরেন্টহুড ফেডারেশনের চাকরি নিয়ে শফি লন্ডনে আছেন। ইলফোর্ডে নিজের বাড়িতে থাকেন। ছেলেমেয়েরা সবাই এখানে স্কুলে যায়। মনে হলো, তিনি ভালো আছেন।

আমার সব খোঁজখবর নেওয়ার পরে শফি বললেন, আমাকে তাঁর বাড়িতে থাকতে হবে। ছাড়াছাড়ি নেই। আমি মৃদু আপত্তি করলাম, তিনি একটু দূরে থাকেন, এই অজুহাতে। শফির হিসেবে কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ায় এখনকার চেয়ে আমার বেশি সময় লাগবে না। ওয়াটারলু স্টেশন পর্যন্ত ব্রিটিশ রেলেই আসতে পারবো।

অগত্যা ছায়া বিশ্বাসকে কুণ্ঠিত হয়ে বললাম, তার আশ্রয় ছেড়ে যাবো। তিনি হেসে বললেন, যেদিন বিমানবন্দর থেকে ফোন করে তাঁর বাড়িতে উঠেছিলাম, তিনি সেদিন ভেবেছিলেন, লন্ডনে আমার কেউ নেই। পরে তো দেখলেন, আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। তাদের কেউ যদি টানে আমাকে–তিনি বাধা দেবেন কেমন করে!

বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কথাটা একটু অন্যভাবে আমাকে একদিন বলেছিল ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ডেকে কর্মরত একটি মেয়ে। আমার কাছে বাইরে থেকে ফোন এলে ডেকে কর্তব্যরতরা ডেকে দিতো আমাকে। মেয়েটি একদিন হাসতে হাসতে বললো, মনে হয়, লন্ডনে তোমার অনেক পড়ুয়া আছে–সবাই মেয়ে।

আমি হেসে বললাম, দেখো, আমার ছাত্রেরা সব দেশে আছে, বেশির ভাগ মফস্বল শহরে অধ্যাপনা এবং কঠোর জীবনসংগ্রাম করছে। ছাত্রীরা অধিকাংশ ভালো বিয়ে করে প্রবাসী হয়েছে। শিক্ষককে খাতির করার দেশীয় রেওয়াজ তারা পালন করে যাচ্ছে। তাই তোমাদের বিরক্ত করে।

সে বলেছিল, বিরক্তিবোধ করি না, পর্যবেক্ষণ করে মজা পাই।

তাকে এবং ডেসকে কাজ-করা আরেকটি মেয়েকে একদিন লাইব্রেরির কাজের শেষে পাবে নিয়ে গিয়েছিলাম।

ছায়া বিশ্বাস আমাকে বিদায়ী ভোজ খাওয়ালেন। বুলু ও মাসিমাকে এবং শফিকে নিমন্ত্রণ করলেন। তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হলো।

শফির বাড়িতে তাঁর গাড়িতে এলাম। বুলু ও মাসিমাও সঙ্গে এলেন পৌঁছে দিতে। এখান থেকে গাড়িতে গেলে বুলুর বাড়ি কাছে, টিউবে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হয়।

শেলী, মণি, মহী আমাকে স্বাগত জানালো। ওদের মধ্যে কেবল শেলীরই মনে আছে আমাকে।

পরদিন টেলিফোন-বই বের করে ফোন করছি শফির বাসা থেকে। মহী ধীর পায়ে এসে জানতে চাইলো, আর দিজ অল লন্ডন নাম্বারস্?’

বলি, হ্যাঁ।

সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ডু ইউ নো সো মেনি পিপল ইন লন্ডন?’

হ্যাঁ, ছায়া বিশ্বাসের ভাষায়, আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই এখানে। সে আমার পরম সৌভাগ্য।

৩৭.

কামাল হোসেনকে নরওয়ের ক্রিশ্চেন মিকেলসন ইনসটিটিউট একটা দায়িত্ব দিয়েছিল–স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা লিখে ফেলতে। নিয়মরক্ষার জন্যে পাণ্ডুলিপি পড়ে একজনকে মতামত দিতে হবে। কামালের পরামর্শে ইনসটিটিউট সেই রিভিউর কাজটা দিলেন আমাকে। তাদের অতিথি হয়ে এক সপ্তাহ থাকার আমন্ত্রণ। কামালও তখন সেখানে থাকবেন।

চাইবামাত্র ভিসা পাওয়া গেল। সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে কামাল ও আমি এসএ এসের ফ্লাইটে বাৰ্গেনে গেলাম।

ইনসটিটিউটের একতলায় সামনের দিকে কয়েকটি সুসজ্জিত শয়নকক্ষ, রান্নাঘর, বাথরুম। তার ওপর তলায় অফিস। চারতলা বাড়ির বাকি সবটা নিয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। প্রত্যেক তলায় ইলেকট্রিক কেটল এবং চা-কফির সরঞ্জাম রাখা আছে। বই পড়তে পড়তে যখন-তখন নিজে বানিয়ে চা-কফি খাওয়া যায়। যারা ইনসটিটিউটে থাকছে, তারা দিনরাত্রির যে-কোনো সময়ে গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারে। এমন চমৎকার ব্যবস্থা আর আমি কোথাও দেখিনি।

আমরা বেশির ভাগ সময়ে ঘরেই খাই। রান্নাবান্নার দায়িত্ব কামালের। অবশ্য রান্নার কাজ সামান্যই। প্রায়-রান্না করা খাবার পাওয়া যায়, হরেকরকম রুটি ও পনির। ইচ্ছে করলে ভাত খাওয়া হয়। ঘরে খেতে না চাইলে খানিক হেঁটে রেস্টুরেন্টে যাওয়া চলে।

আমরা থাকতে থাকতেই রেহমান সোবহান এসে যোগ দিলো। অন্য কোনো কাজে এসেছে। বাইরে খাওয়াই তার পছন্দ। সেইসঙ্গে সিনেমা দেখাও। এসব ক্ষেত্রে আমরা তার অনিবার্য সঙ্গী।

ইনসটিটিউটের প্রধান ইউস্ট ফালান্ডের সঙ্গে ঢাকায় একবার আমার দেখা। হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেই তিনি অর্থনীতি বিষয়ে সরকারকে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন। পাকিস্তান সম্পর্কে বইও লিখেছেন। পূর্বাঞ্চলের প্রতি তাঁর সহানুভূতি গড়ে উঠেছিল তখনই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন আন্তরিকভাবে।

ইউস্ট তাঁর গাড়িতে করে মনোরম বার্গেন শহর দেখালেন। নিজের বাড়িতে নিয়ে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, আমার বাংলাদেশি পৌত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। স্বাধীনতার পরে এদেশের একটি শিশুকে তিনি পোষ্য নিয়েছিলেন। যাকে বলে যুদ্ধ-শিশু, সে তাই। মেয়েটির বাংলা শেখার অবকাশ হয়নি। ইউস্ট তার দোভাষী হয়ে গেলেন।

১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত সময়ের স্মৃতিকথা আছে কামালের। সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ/ দলিলপত্র বইয়ের সাক্ষাৎকার খণ্ডে স্থান পেয়েছে। আমি তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম, ১৯৭১-এ বন্দিজীবনের কাহিনি লিখে ফেলতে। তিনি সময় করতে পারেননি। ইউস্ট ফান্ডের আগ্রহে এখন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত কালপর্বের স্মৃতিকথা লিখলেন। যে-সাতদিন আমরা একসঙ্গে থাকলাম, তখনো পাণ্ডুলিপিতে সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন চলছিল। ঘটনাপ্রবাহ যেমন দেখেছিলেন, তেমন লিপিবদ্ধ করেছিলেন কামাল। পরবর্তীকালের জ্ঞাত তথ্যের আলোকে আগের বিষয় বিচার করেননি। সবকিছুই বলেছেন। খুব মৃদুতার সঙ্গে।

পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে আমার সপ্রশংস মন্তব্য লিখে ফেলতে বেশি সময় লাগেনি। এক-আধটা পরামর্শও বোধহয় দিয়েছিলাম। তা মূলত নিয়মরক্ষার খাতিরে।

১১ তারিখে আমরা লন্ডনে ফিরে এলাম। হিথরো বিমানবন্দরে শুল্ক-কর্তৃপক্ষ কামালের ব্যাগ আর আমার সুটকেস বেশ ভালো করে পরীক্ষা করলেন। সাধারণত এমন হয় না। কামালকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের কি একজোড়া চোরাচালানি মনে হচ্ছে?

৩৮.

চমন আফরোজ কামাল লন্ডনে এসেছেন চিকিৎসা করতে। তাঁকে দেখতে গেলাম। তখন শামসুল কামাল বললেন তাঁর আত্মীয় জামাল নজরুল ইসলামের কথা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতের শিক্ষক। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই শুনে শামসুল কামাল টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, আমি যেন অবশ্যই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করি–করলে আমার ভালো লাগবে।

ফোনে জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলাম। সত্যি ভালো লাগলো। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন কেমব্রিজে। ঠিক হলো, পরের রোববার তার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

বুলুকে কেমব্রিজ যাওয়ার খবর দিতে সে বললো, ওই রোববারে তার অবসর আছে। আমি চাইলে সে আমাকে গাড়ি করে নিয়ে যেতে পারবে। ঈঙ্গিত জায়গায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে বইয়ের দোকান হেফার্সে থাকতে পারে, ফেরার সময় হলে আমাকে তুলে নিতে পারে।

জামাল নজরুল ইসলামকে যখন জানালাম যে, আমি একজন ডাক্তার-বন্ধুর সওয়ার হয়ে কেমব্রিজে আসতে চাই, তিনি তাকেও সাদর আমন্ত্রণ জানালেন।

গৃহকত্রী সুরাইয়া ইসলাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে গবেষণা শুরু করেছেন সবে। তাদের কন্যাদুটি হাই স্কুলে পড়ে। আমরা পৌঁছোতে সকলে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।

জামাল ও সুরাইয়া উভয়েই সদালাপী। সাহিত্যে ও সংগীতে জামালের আগ্রহ আছে। তার মা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনুবাদ করেছিলেন উর্দুতে। আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে তার মামা। জামাল জানালেন, বাংলাভাষায় তাঁর। অধিকার সীমিত, তবে রবীন্দ্রসংগীত তিনি ভালোবাসেন। বুলুর সঙ্গে কথা বললেন পাশ্চাত্য সংগীত নিয়ে। সুরাইয়ার গবেষণার বিষয় উনিশ-বিশ শতকের। বাঙালি মুসলমান সমাজ। আমার লেখার সঙ্গে তার পরিচয় আছে, প্রমাণ হিসেবে আমার একটা আস্ত বই দাখিল করলেন। আলাপ দ্রুত জমে গেল। রন্ধননিপুণ সুরাইয়া অনেক কিছু রান্না করেছেন। সেসব খাওয়ার পরে সংগীতপর্ব। জামাল পিয়ানোতে বসলেন। সদফরা দু-বোন রোমান অক্ষরে লেখা দেখে রবীন্দ্রসংগীত গাইলো।

বিদেশে বড়ো হলে বাংলা উচ্চারণে একটু আড়ষ্টতা থাকে অনেকেরই। আন্তরিক উৎসাহ দিয়ে তারা সেটি পুষিয়ে দিলো। জামাল ভালো পিয়ানো বাজান। মেয়েদের গানের সঙ্গে তো বাজালেনই, একাও রবীন্দ্রসংগীতের সুর তুললেন।

কথায় কথায় ১৯৭১ সালের কথা উঠল। জামাল নজরুল ইসলাম তখন ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু কিছু দেখালেন। বাংলাদেশে গণহত্যা ও নির্যাতনের করুণ চিত্র তিনি তাতে তুলে ধরেছিলেন। সেসব চিঠির উত্তর অনেকে যেভাবে দিয়েছিলেন, তাও মর্মস্পর্শী।

জামাল যখন বললেন যে, তিনি দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখন আমি অবাক হলাম। কেমব্রিজে শিক্ষকতা করছেন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। থেকে তার বই বেরিয়েছে। গবেষক হিসেবে তিনি নাম করেছেন, এখানে গবেষণার এত সুযোগ রয়েছে। এসব ছেড়ে দেশে ফিরে যাবেন–আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ তিনি যে কথার কথা বলছিলেন না, তাও স্পষ্ট। দেশে পড়াশোনার পরিবেশ সম্পর্কে তিনি খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

কেমব্রিজ ইউভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের দুটি কপি আমার হাতে দিলেন জামাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের জন্যে।

এই চমৎকার পরিবারের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে দিন কাটিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।

ফেরার পথে বুলু জিজ্ঞেস করলো, গাড়িতে ১০০ মাইল স্পিডে গেছো কখনো?’

বললাম, যাইনি।’ তার মতলব বুঝে যোগ করলাম, যেতে চাইলে পুলিশের হাতে নির্ঘাত ধরা পড়বে।

‘দেখা যাক।’ বলে বুলু গতি বাড়ালো গাড়ির। হাইওয়েতে গতিবেগের সর্বোচ্চ সীমা আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি। ১০০ মাইল গতিতে উঠে বুলু নেমে এলো ৮০ মাইলে। খানিক পরে আরেকবার কাঁটা ১০০ মাইল স্পর্শ করলো। তারপর অবশ্য নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকলাম আমরা।

বুলুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘তোমার ভাগ্য ভালো। ধরা পড়োনি।’

বুলু হাসলো। ইংরেজিতে বললো, উপভোগ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়।

৩৯.

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি একটা মহামিলনক্ষেত্রও বটে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলনের এবং নতুন বন্ধুলাভের অনুকূল স্থান। লন্ডনে যখন সপরিবারে ছিলাম, তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রন ইনডেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলেছি। পরে আবার দেখা হয় রনের সঙ্গে। আগেরবার যে বই নিয়ে সে কাজ করছিল, সেটি তখন বেরিয়ে গেছে। রন এবারে কাজ করছে। অন্য বিষয় নিয়ে।

তাকে একরাতে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলাম আমাদের দেশি খাওয়া খাওয়াতে। পরিবেশন করতে যে এলো, সে সালাম করে বললো, আমি আপনার ছাত্র। তাকে আমার মনে পড়েনি। তখন সে জানালো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে–বাংলার নয়, অন্য বিভাগে। আমাদের আলাপ শুনে রন মিটিমিটি হাসতে থাকলো।

খাওয়া-দাওয়ার শেষে বিল এনে ছেলেটি বললো, স্টাফ ডিসকাউন্ট দিয়েছি, সা। তাকে ধন্যবাদ জানালাম।

রন বললো, ‘লন্ডনেও দেখছি তোমার অনেক প্রভাব।

বললাম, ‘শুনলেই তো, ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। শিক্ষকজ্ঞান করে। আমাকে খাতির করছে।’

রন বললো, ‘এটা শুধু তোমাদের কালচারেই সম্ভব। আমার সরাসরি কোনো ছাত্রও দেশে-বিদেশে এমন করতো না।’

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতেই বছর বারো বাদে দেখা হয়েছিল লেওনার্ড গর্ডনের সঙ্গে। আমি যখন শিকাগোয়, তখন সে পিএইচ ডি করছিল ইতিহাসে। প্রেমও করছিল। আমি চলে আসার পরে সে ডিগ্রি অর্জন করে, তার অভিসন্দর্ভ Bengal: The Nationalist Phase নামে প্রকাশিত হয়ে সমাদৃত হয়। লেনি অধ্যাপনা করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কে। এখন সে সুভাষ বসু ও শরৎ বসু সম্পর্কে গবেষণা করছে। এই ব্যাপারেই সে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের। পরে তার এই গবেষণাকর্ম Brothers Against the Raj নামে খ্যাতিলাভ করেছিল।

আমি শিকাগো থেকে চলে আসার পরে লেনি বিয়ে করেছিল তার প্রেমিকাকে–সে-খবর দেশে বসে পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, বউ কেমন আছে?

লেনি বললো, ও, তুমি জানো না। আমাদের বিয়ে ভেঙে গেছে।

বললাম, দুঃখিত। আমি জানতাম না।

সে বললো, ঠিক আছে। তবে আমি একজনের সঙ্গে থাকছি। মেয়েটি সংস্কৃতবিদ। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়।

দু বছরের মাথায় এবারে লেনির সঙ্গে আবার দেখা। আবার রেস্টুরেন্টে বসে কুশল বিনিময় করি। তুমি যে-মেয়েটির সঙ্গে থাকো, সে কেমন আছে, এমন প্রশ্ন করতে কুণ্ঠা লাগে। আমি সে-প্রসঙ্গে যাই না।

লেনি নিজেই কথাটা তোলে। গতবারে তোমাকে বলেছিলাম, আমি একজনের সঙ্গে থাকি, মনে আছে?

বলি, হ্যাঁ। এবারে জানতে চাই, কী খবর তার?

লেনি বলে, আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।

বলি, সুখবর। আগাম অভিনন্দন। কতদিন থাকলে তোমরা একসঙ্গে?

প্রায় দশ বছর।

বেশ তো। মধুর সমাপ্তি। অনন্তকাল সুখে থাকো।

এই প্রসঙ্গের আরেকটি পর্ব আছে। সেটি এখানেই বলে নিই।

পরের বছর চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম পাই লেনির। কলকাতা থেকে পাঠিয়েছে। কদিনের জন্যে বেড়াতে আসতে চায় চট্টগ্রামে। আমি থাকবো কি না জানতে চায়।

নির্দিষ্ট দিনে তাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসি বাড়িতে। সে আসতে আসতে বলে, সে কোনো বক্তৃতা দিতে চায় না, কোনো সভায় যেতে চায় না। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেবে, পারলে শুয়ে শুয়ে দিন কাটাবে।

এবারে তার স্ত্রীর সংবাদ নিই। লেনি বলে, একসঙ্গেই এসেছিলাম ভারতে। সে গেল কাঠমান্ডুতে। আমি ভাবলাম, এই ফাঁকে তোমার এখান থেকে বেড়িয়ে যাই।

বললাম, খুব ভালো করেছ। কেমন আছো তোমরা?

লেনি ম্লান হাসি হাসে। বলে, বিয়েটা টিকবে কি না সন্দেহ।

জানতে চাই, কী হলো আবার?

বলে, আমি সন্তান চাই, সে চায় না।

বলি, তুমি একটা হতভাগা। দশ বছর একসঙ্গে কাটালে, আর সে মা হতে চায় কি না, এতদিন তা জানতে পারোনি?

লেনি চুপ করে থাকে।

ইফরাইম মিলারের সঙ্গেও এমনি করে দেখা হয়ে গিয়েছিল লন্ডনে। ইফরাইম ছিল অ্যারোনটিকাল ইনজিনিয়ার। কী খেয়াল হলো, চাকরি-বাকরি ছেড়ে বাংলা পড়তে শুরু করলো। তারপর ডিমকের অধীনে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণায় প্রবৃত্ত হলো পিএইচ ডি পর্যায়ে। কলকাতায় এলো, সেখান থেকে ঢাকায়, সেখান থেকে যোগাযোগ করে চট্টগ্রামে। কদিন থাকলো আমার বাড়িতে।

ওই গবেষণারই কাজ করছিল লন্ডনে। আমাকে একদিন সাউথ ব্যাংকে নিয়ে গেল সিনেমা দেখাতে। শাবানা আজমি-অভিনীত অঙ্কুর।

এবারে একদিন দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে উঠেছি লাইব্রেরির লিফটে। সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে এক শ্বেতাঙ্গিনীও উঠলো তাতে। মুখটা চেনা মনে হলো। চারতলায় লিফট থেকে নেমে তার উদ্দেশে ‘এক্সকিউজ মি বলেছি, দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে-ও আর ইউ’ বলে হেসে দিলো। হাসি দেখে নিঃসন্দেহ হলাম। গেইল মিনো। ঢাকায় ইউএসআইএসে উপ-প্রধান ছিল। পনেরো বছর আগে যখন আমি ফুলব্রাইট স্কলারশিপের জন্যে দরখাস্ত করি, তখন আমার ইংরেজিজ্ঞানের সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম তারই কাছে। আমেরিকা থেকে ফিরে তাকে আর ঢাকায় পাইনি। তবে জানতে পেরেছিলাম, সরকারি চাকরি ছেড়ে সে লেখাপড়ার জগতে প্রবেশ করেছে। তার পিএইচ ডি র কাজ The Khilafat Movment in India প্রশংসিত হয়েছে।

এতকাল পরে দেখা। স্থির হলো, পরদিন লাইব্রেরির কাজ সেরে আমরা কোথাও গিয়ে বসবো এবং এতদিনের হিসাবনিকাশ করবো।

সেইমতো একটা পাবে গিয়ে বসলাম। গেইলের স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য উভয়েরই খানিকটা হানি হয়েছে। বললাম, শিকাগো থেকে ফিরে তোমার খোঁজ করেছিলাম, গেইল। শুনলাম, তুমি ওয়াশিংটনে বদলি হয়ে গেছে। তারপর শুনলাম, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছ। তোমার বইটার খবর রাখি, আর কিছু জানি না।

গেইল আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসি হাসে। একটু একটু খায়, কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরেটা দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে কথা বলে।

ঢাকা থেকে সে বদলি হয়ে গিয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে, ইউএসআইএসের সদর দপ্তরে। কিন্তু সরকারি কাজ তার ভালো লাগছিল না, একদিন চাকরি ছেড়ে দিলো। তারপর ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি করলো, বিয়ে করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলো, সন্তানের জন্ম দিলো। এ পর্যন্ত সবই ভালো। হঠাৎ করে কদিনের অসুখে মারা গেল ছেলেটি। আকাশ ভেঙে পড়ল তার মাথায়। সে যে কী অসহ্য কষ্ট, তা বলা যায় না। চাকরিতে ইস্তফা দিলো, কষ্ট ভুলতে মাদক ধরলো। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, পুরোপুরি মাদকাসক্ত বনে গেল। ধ্বংসের প্রান্তে এসে আবার তার বাঁচতে ইচ্ছে হলো। তখন শুরু হলো মাদক ছাড়ার যুদ্ধ। সেটাও অবর্ণনীয় কষ্টের ব্যাপার। তবে সে হাল ছাড়েনি, শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তার ইচ্ছাশক্তির। এত কিছুর পর বিদ্যায়তনিক জগতে ফিরে আসা সহজ ছিল না। সেখানেও তাকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে, তবে পরিণামে সফল হয়েছে সে।

‘আমাকে খুব খারাপ দেখছ, তাই না?’ গেইল আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

আমি মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে কথাটা স্বীকার করি।

‘এখন অনেক ভালো আছি। সংকটের সময়ে যদি আমাকে দেখতে! হয়তো চিনতেই পারতে না।’ গেইল সামনের পাত্র তুলে অনেকটা চুমুক দেয়। পাত্র নামিয়ে বলে, এবার তোমার কথা বলো।

৪০.

শফিউল্লাহর সংসারে তিনিই কর্তা, তবে কাজেকর্মে তাকে এদেশ-সেদেশ যেতে হয়। তখন তো বটেই, এমনি সময়েও বাড়ির কাজের বেশিটা করতে হয় শেলীকে। শেলীর ইচ্ছে, দেশে ফিরে এসে সে চারুকলা ইনসটিটিউটে পড়বে। ছেলেরা দেশে আসতে আগ্রহী নয়, শফিরও এখন দেশে ফেরার পরিকল্পনা নেই। তবে একবার সবাইকে নিয়ে ঢাকায় বেড়িয়ে যাবে।

সেই বেড়িয়ে যাওয়ার সময় এসে গেল। শফির একটু দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে। একা আমাকে রেখে আসবে–আমার না জানি কত অসুবিধে হবে। আমি খোঁচা দিই, বেশ তো ছিলাম মর্ডেনে। এখন বাড়ি ডেকে এনে সবাই চলে যাচ্ছেন। এ তো বাড়িতে অতিথি নিমন্ত্রণ করে গৃহকর্তার বাইরে বেরিয়ে পড়ার মতো।’ শফি নানারকমভাবে ব্যাখ্যা দিতে চান। আমি হাসি।

শফিদের অনুপস্থিতিতে শুধু সকালের নাশতাটাই নিজে করে নিতাম। দু বেলা বাইরে খেতাম। ফিরতাম দেরিতে। বিবিসি-র নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর যেদিন কাজ থাকতো সেখানে সেদিন তো মধ্যরাতের অনেক পরে অর্ধনিদ্রিত লন্ডন দেখতে দেখতে ট্যাকসিতে ফিরতাম। নইলে টিউব আর ট্রেন ধরে ফেরা।

একবার কামাল হোসেন ও হামিদা এলেন অকসফোর্ড থেকে। তাঁদের সঙ্গে সিনেমা দেখে খেয়ে মার্বেল আর্চে বোধহয় শেষ টিউবটা ধরতে পারলাম দৌড়ে। কামরায় আরেকজন মাত্র যাত্রী। খানিক পরে টের পেলাম, তিনি আমাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। আরো একটু পরে তিনি উঠে আমার কাছে এসে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

আমি একটু ভয়ই পেলাম। অন্যেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, অমন অবস্থায় কনডাক্টর-গার্ডের কাছাকাছি কামরায় উঠতে। এই রাতে তা করার সময় ছিল না। বললাম, না, রাত বেশি হওয়ায় একটু চিন্তা করছি আর কী!’

তিনি জিজ্ঞাসা করে যেতে থাকলেন কোথায় থাকি, কোন স্টেশনে নামবো, কীভাবে বাড়ি যাবো। আমার ভয় বাড়তে লাগলো। পরে অবশ্য কিছু হয়নি।

মানুষের এমনি স্বভাব। গভীর রাতে একা পথ চলতে ভয় হয়। আবার হঠাৎ পদশব্দ পেলেও ভয় লাগে।

৪১.

ফ র মাহমুদ হাসান ও শামসী আরাকে চিনি তাদের ছাত্রজীবন থেকে আমার ভাগ্নে মামুনের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের সুবাদে। আমি যখন সপরিবারে লন্ডনে, তখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা পুনঃস্থাপিত হয়। মাহমুদের পিএইচডির কাজ তখনো বোধহয় শেষ হয়নি। এর মধ্যে সে লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদনা করেছিল কিছুকাল, বিবিসির বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিয়েছিল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে জড়িয়ে গিয়েছিল। বিবিসির অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এক বিপ্লবী স্লোগান প্রচার করায় সেখানকার পথ ওর জন্যে বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে তার পরোয়া ছিল না। শামসী–যাকে আমরা জ্যোৎস্না বলে ডাকতেই অভ্যস্ত–শিক্ষকতা করতো লন্ডনের এক স্কুলে। দুই মেয়ে নিয়ে তারা থাকতো মাহমুদের মেজো ভাই মামুন ও তার স্ত্রীর সঙ্গে একই বাড়িতে। মামুনের অবশ্য পড়াশোনার জন্যে আরেকটা ডেরা ছিল–সেখানেই তিনি বেশির ভাগ সময় থাকতেন। তাঁর স্ত্রী অতি সরল মেয়ে–মাহমুদের ঠাট্টার হুলে বিদ্ধ হয়ে সবসময়ে অস্থির থাকতেন। আমরা সপরিবারে মাহমুদদের বাড়ি গেলে জ্যোৎস্নার কাজ বেড়ে যেতো, তার জা কিছুটা ভাগ নেওয়ার চেষ্টা অবশ্য করতেন। নিদারুণ পরিশ্রমের মধ্যেও জ্যোৎস্নার মুখের হাসিটি অম্লান থাকতো।

পরের দুবার যখন আমি একা লন্ডনে ছিলাম, তখনো মাহমুদদের বাড়িতে একইরকম আপ্যায়ন পেয়েছি। একবার সপ্তাহান্তে ওদের বাড়ি যাবো বলে মাহমুদের সঙ্গে স্থির করলাম, এর মধ্যে শিল্পী রশিদ চৌধুরী চলে এলেন লন্ডনে। মাহমুদকে ফোন করে বললাম, রশিদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে আসবো তার অসুবিধে না হলে। মাহমুদ মহা আনন্দিত হয়ে সম্মতি জানালো; জানতে চাইলো, রশিদ চৌধুরীকে সে ফোন করবে কি না। বললাম, তার দরকার হবে না। রশিদ একটু ইতস্তত করছিলেন। বলছিলেন, আমার যখন যাওয়ার কথা, আমিই যেন মাহমুদদের বাড়ি চলে যাই, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎটা না হয় আরেকদিন হবে। আমি বললাম, তা নয়, ইচ্ছে করলে ওইদিন বাদ দিয়ে অন্য কোনোদিন সেখানে যাওয়া যায়, তবে আমি চাইছিলাম, বিকেলটা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করে রশিদকে নিয়েই সেখানে যাবো এবং সেখানে খাওয়াদাওয়া সেরে একসঙ্গে ফিরবো। একথাও বললাম যে, তাঁর কুণ্ঠিত হওয়ার মতো কারণ থাকলে আমি কখনোই তাকে নিয়ে যেতে চাইতাম না। রশিদ যেতে সম্মত হলেন।

মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। জ্যোৎস্নার মুখ দেখে বোঝ। গেল, সে আমাদের আগমন প্রত্যাশা করছিল না। তবে আমাদের দেখে সে বুঝে নিয়েছিল যে, মাহমুদকে বলে-কয়েই আমি একজন বিশিষ্ট অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে। গেছি। আমি জানতে চাইলাম, মাহমুদ বুঝি তোমাকে বলতে ভুলে গেছে? জ্যোৎস্না বললো, তাতে কিছু নয়, আপনারা বসেন। মাহমুদ যে কখন ফিরবে, কিছু বলে যায়নি। আশা করি, বেশি দেরি হবে না।’ রশিদ বিব্রত হয়ে আমার। দিকে তাকালেন। জ্যোৎস্নাকে বললাম, আজ বরঞ্চ আমরা আসি, আরেকদিন আসা যাবে। সে বললো, তা হবে না। খাওয়াদাওয়া করে তারপরে যাবেন। আমি এখনো রান্না চড়াইনি–কোনো অসুবিধে হবে না।’

রশিদ আর আমি বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। জ্যোৎস্না মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নিতে থাকলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে মাহমুদের প্রবেশ, আমাদের দেখে শিরে করাঘাত, হইচই, খবরদারি। জ্যোৎস্নার আন্তরিকতায় রশিদের বিব্রতভাব খানিকটা দূর হয়েছিল, বাকিটা দূর হয়ে গেল মাহমুদের কথার তোড়ে। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে ভুলে যাওয়া যে এই লোকটির পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক, রশিদের সে-প্রত্যয় জন্মালো এবং জ্যোৎস্নাকে এমন পরিস্থিতি যে প্রায়ই সামলাতে হয়, তা অনুমান করে তার প্রতিও কিছু সহানুভূতি দেখা দিলো। ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে এই দম্পতি রশিদের আপন হয়ে গিয়েছিল।

এর বেশ কিছুকাল পরে লন্ডনেই একদিন ওবায়েদ জায়গীরদার আমাকে বললো, তোমার বন্ধু এখন একটা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে স্থিত হতে চায়। রশিদকে আমার কাছে উল্লেখ করতে হলে সে হয় তোমার বন্ধু’ নয় ‘আমার বন্ধু’ বলতো।

আমি খুবই বিস্মিত হলাম। রশিদের মতো সংসারী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। স্ত্রী অ্যানি ও দুই কন্যা রীতা-রোজার প্রতি তার ভালোবাসার অবধি ছিল না। ঘরের কাজে তিনি ছিলেন নিরলস, গাড়ির পরিচর্যায় ক্লান্তিহীন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিদেশি নাগরিকদের যখন বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আন এবং তার দুই মেয়ে-রোজা ও রীতাও–ফ্রান্সে চলে গিয়েছিলেন। পরে হাবিবুল্লাহ খানের সাহায্যে রশিদ করাচি বিমানবন্দর হয়ে প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন। প্যারিসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকর্মে রশিদ নিজে তো বটেই, আনও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ কথা তিনি বলতেন। এখন কী এমন ঘটলো যে, তাদের দুজনের মধ্যে আবির্ভাব হলো তৃতীয় ব্যক্তির?

ওবায়েদের কথার পিঠে কী বলব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে জানতে চাইলাম, তোমারও এই মতলব নাকি?’

ওবায়েদেরও ফরাসি স্ত্রী। একবার ওদের কেন্টের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, অঁরিয়েতের এক পা পুরো প্লাস্টার করা। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওবায়েদ কি তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল?

সে হাসলো। বললো, তুমি একথা বলছো? আমার এক বান্ধবী আমাকে কী জিজ্ঞাসা করেছিল, জানো? সে বলে, তুমি কি ওকে লাথিটা খুব কষে মেরেছিলে?

ওবায়েদ সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি, খুব একচোট হেসেছিল শুধু। তবে পরে ওদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, যদিও ওবায়েদের সঙ্গে রশিদের বিষয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখন তেমন পরিস্থিতির উদয় হয়নি।

ওবায়েদ সে-মুহূর্তে রশিদের পক্ষ নিয়ে দু-একটি কথা বললো। বাঙালি মেয়েটি যে কে, তা অবশ্য সে খুলে বলেনি, আমিও জানতে চাইনি। ওবায়েদ শুধু বলেছিল, ‘তোমাদেরই ছাত্রী।’

দেশে ফিরে আসার পরে জানতে পাই, সে আমারই প্রিয় ছাত্রী জান্নাত সুলতানা। বাংলায় অনার্স নিয়ে সে যখন ভর্তি হয়, সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে চারুকলা নিতে চাইলে তাকে আমি উৎসাহিত করেছিলাম। সেই সুবাদেই রশিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ।

ততদিনে পরিস্থিতি যতটাসম্ভব জটিল হয়েছে। সম্ভবত জান্নাত রশিদকে বিয়ে করেছে, আন মেয়েদের নিয়ে প্যারিসে চলে গেছেন, তারপর রশিদ কন্যাদের সঙ্গে ও তাদের মায়ের সঙ্গেও পুনর্মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। চট্টগ্রাম থেকেই জান্নাত একটা চিঠি পাঠিয়েছিল আমাকে–সুন্দর চিঠি। কুণ্ঠিত হয়েই সে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার পিত্রালয়ে–আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি যাইনি–যদিও তার সঙ্গে কথা বলার স্পৃহা আমার কম ছিল। না। কিন্তু তার বাড়ি গিয়ে কী বলব আমি? এসব ক্ষেত্রে অন্যের পক্ষে কিছু পরামর্শ দেওয়াও কঠিন।

পরে মনে হয়েছে, জান্নাত যদি আসততা আমার কাছে, তাহলে কি আমি সাগ্রহে তার কথা শুনতাম না? কিছু না কিছু কি বলতাম না? ওই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার আসা ছিল অসম্ভব। তাই আসতে পারেনি। তাই ডেকে পাঠিয়েছিল আমাকে হিতৈষী ভেবে। গেলাম না কেন?

আবার একথাও মনে হয়েছে, ওই মুহূর্তে আন যদি কথা বলতে চাইতেন আমার সঙ্গে, নিশ্চয় আমি যেতাম, কিন্তু তাকেই বা কী বলতাম!

৪২.

আট মাস পরে দেশে ফিরলাম ১৯৭৯ সালের ১২ নভেম্বরে।

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পরে শিক্ষকদের অনেকেই অন্যত্র চলে গেছেন। প্রথমে মোহাম্মদ আবু জাফর যোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লন্ডন থেকে পিএইচডি করে ফিরে এসে সৈয়দ আলী আহসানের টানে চলে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হায়াৎ মামুদ ১৯৭৩ সালে মস্কো চলে যান–ফিরে এসে জাহাঙ্গীরনগরে যোগ দেন। রাজিয়া সুলতানার পক্ষেও সেখানে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ায় তিনি সেখানেই গেলেন। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদও গেলেন সেখানে। এরপর রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল ও মাহমুদ শাহ কোরেশী। অধ্যাপক হচ্ছেন না কেন, সেই ক্ষোভে চট্টগ্রাম ছাড়তে চেয়েছিলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এখন অধ্যাপক হওয়ার পরও চট্টগ্রাম ছাড়তে চাইলেন তিনি। ১৯৭৮ সালের শেষে চলে গেলেন ঢাকায়। আমি তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলাম–এমন দাবি করা বোধহয় অসংগত হবে না। তার বিদায় সভায় তাই বলেছিলাম, ‘একদিন এই বিভাগের মনে হয়েছিল, তাঁকে এখানে। প্রয়োজন। তাই তাকে সাদরে বরণ করা হয়েছিল এখানে। আজ তিনি মনে করছেন, এই বিভাগকে তার আর প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন। জাহাঙ্গীর তারেককেও আমি নিয়ে এসেছিলাম সহযোগী অধ্যাপকরূপে, অ্যাড হক ভিত্তিতে। আবু হেনার পরে সে-ই হয় বিভাগের সভাপতি। আর মাসকয়েক পরে সেও চলে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনসটিটিউটে, ফরাসি ভাষার সহযোগী অধ্যাপক হয়ে। আমার সময়ে আর যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে রাজীব হুমায়ূনও অচিরে চলে যাবে।

নতুন যোগদানকারীদের মধ্যে আর ছিল রশীদ আল ফারুকী, শিপ্রা দস্তিদার, ভূঁইয়া ইকবাল, ফজিলতুননেসা। আমার কার্যকালে, তবে আমার অনুপস্থিতিতে, যোগ দিয়েছিল মুহম্মদ শামসুল আলম, শাহজাহান মনির ও চৌধুরী জহুরুল হক। আমার সহকর্মীদের কার্যকালে, আমি চট্টগ্রামে থাকতে, আরো যোগ দিয়েছিল ময়ূখ চৌধুরী, সৌরেন বিশ্বাস, গোলাম মুস্তাফা, লায়লা জামান, আহমদ নূরুল ইসলাম। এবার ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে আমি যখন ফিরলাম, তখন মনিরুজ্জামান মহীশূর এবং রশীদ আল ফারুকী, দিলওয়ার হোসেন, ভূঁইয়া ইকবাল কলকাতায়, পিএইচডি করতে গেছে আগে-পরে।

এবারে এসে খবর পেলাম মুহাম্মদ ইউনূস দু-বছরের ছুটি নিয়ে টাঙ্গাইলে গেছেন সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করতে। এর পটভূমিটা একটু বলা দরকার।

ইউনূস যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পল্লী-উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুইন-উদ-দীন আহমদ খান। ইউনূস এসে এই প্রকল্পের ভার নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষজনদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-সম্প্রদায়ের একটা যোগাযোগ ঘটানো। আসল অভিপ্রায়–দুদিকের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানো, উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। ১৯৭৫-এ বিদেশ থেকে ফিরে আমি তার সম্পর্কে অবহিত হলাম। কৃষির উন্নয়নের জন্যে এই প্রকল্পে কাজ হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাক্ষরতা অভিযানও চলছিল। আমাদের বিভাগের মনিরুজ্জামান সাক্ষরতার বিষয়ে। প্রকল্পের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। এক-আধদিন আমাকেও সে নিয়ে যায় এ বিষয়ে কর্মীদের কাছে কিছু বলতে। ইউনূস প্রথম থেকেই কিছু উৎসর্গীকৃত। সহযোগী পেয়েছিলেন। তাঁর বিভাগেরই শিক্ষক লতিফি তাঁদের মধ্যে প্রধান। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেও তিনি কর্মী বেছে নিয়েছিলেন। ইউনূসের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন, তাদেরকে ইউনূস প্রেরণা দিয়েছিলেন অন্তহীন।

পরের ধাপে ইউনূস প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নবযুগ’ খামারের–তেভাগার নীতি অনুসরণ করে। এ-সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানার সুযোগ পাইনি। তবে এ প্রকল্প যে সফল হয়েছিল, তা বোঝা গিয়েছিল ১৯৭৮ সালে নবযুগ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ায়।

কিন্তু ইউনূস এতে তৃপ্ত হননি। আশপাশের অতি দরিদ্র মানুষদের দুরবস্থা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। নবযুগ দিয়ে তাদের কষ্ট লাঘব করা যাচ্ছিল না। সরেজমিনে দেখেশুনে তিনি উপলব্ধি করেন, কিছু অর্থ ঋণস্বরূপ পেলে এরা মহাজনদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে, নিজের মতো উপার্জন করতে পারে। নিজের থেকে কিছু মহিলাকে ঋণ দিয়ে যে-পরীক্ষা তিনি করেছিলেন, তা সফল হয়েছিল। ফলে ইউনূস গেলেন রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়–এদের জন্যে ঋণ পাওয়া যায় কি না, তা দেখতে। তারা বললো, ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, আছে আঞ্চলিক দপ্তরের। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সন্নিহিত জোবরা গ্রামের জন্য কিছু ঋণ পাওয়া গেল। সেই ঋণ বিতরণ করেই সূচনা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির।

এই উদযোগে পরে ইউনূস সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন দুজনের কাছ থেকে–তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে গঙ্গোপাধ্যায় আর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ এম আনিসুজ্জামান। তখনই কথা উঠেছিল, জোবরায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প সফল হয়েছে–কারণ, ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের সন্তান, তার জোবরা গ্রাম একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকা। সুতরাং ঋণগ্রহীতারা একরকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকে। বাংলাদেশের অন্যত্র এ-প্রকল্প সফল হবে কি না, সন্দেহ।

ইউনূস তাদেরকেই বলেছিলেন জায়গা ঠিক করে দিতে। তিনি দেখাবেন যে, সেখানেও তার প্রকল্প সফল করা সম্ভবপর। তারা নির্বাচন করেছিলেন টাঙ্গাইল। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখায় এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে। আর তাঁর সহকর্মীরা জোবরায় এবং আশপাশের গ্রামীণ ব্যাংক চালিয়ে যাবেন।

এই প্রস্তাব মেনে নিয়েই ইউনূস চলে যান টাঙ্গাইলে। যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন, সবটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, এ তাঁর অগস্ত্য-যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আর ফিরছেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাহাড়-চূড়ায় যে বাড়িতে আমি কিছুকাল ছিলাম, পরে ইউনূস ছিলেন সে-বাড়িতে। ইউনূস-দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে সেখানে গিয়েছি। একরাতে ওঁরাও এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। বোধহয় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল বলে মোমবাতির আলো জ্বেলে আমরা বসেছিলাম টেবিল ঘিরে। ইউনূস তার প্রকল্পের কথা বলছিলেন উৎসাহ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তখনই মনে হয়েছিল, প্রথাগত শিক্ষকতার মধ্যে তিনি আর আবদ্ধ রইবেন না।

তারপর মনিকার জন্ম হলো, শিশুসন্তানকে নিয়ে ভেরা মার্কিন দেশে ফিরে গেলেন। ইউনূস একাগ্রচিত্তে লেগে রইলেন তাঁর কাজে। তখনো তার এই খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি হয়নি। তখনো তিনি অনিশ্চিত পথের যাত্রী।

৪৩.

এসব লেখার এই এক দায়। সামনের কথা লিখতে শুরু করলে পেছনের কথা আবার ভিড় করে আসে। তখন ফিরে তাকাতে হয়।

এবারে আমার লন্ডন-প্রবাসকালে লতা মঙ্গেশকর সেখানে এসেছিলেন সদলে। বোধহয় প্রতি বছরই আসছেন ইদানীং। অন্তত অল্পকাল আগেই তো এমনি অনুষ্ঠান করে গেলেন রয়াল অ্যালবার্ট হলে–তার রেকর্ড শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। এবার অনুষ্ঠান হবে লন্ডন প্যালেডিয়ামে। লন্ডনের দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে–ধুম পড়ে গিয়েছে টিকিট কেনার। বুলু, মাসিমা, সরোজ, মানসী–সবারই টিকিট কাটা হয়ে গেছে। বুলু যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ওই অনুষ্ঠানে আমি যেতে চাই কি না এবং টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতার কথা না বুঝে আমিও সোৎসাহে বলে দিলাম, হ্যাঁ, তখন শুরু হলো টেলিফোনে তার অভিযান। তাতে কাজ না হওয়ায় আমি তাকে ক্ষান্ত হতে বললাম, কিন্তু ততক্ষণে তার জেদ চেপে গেছে। অনুষ্ঠানের দিন সকালে আমাকে। নিয়ে সরাসরি চলে গেল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে-বাড়িতে উঠেছেন, সেখানে। তার গৃহকর্তা নিশীথ গাঙ্গুলির (পদবিটা ঠিক লিখলাম তো?) সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে বুলুরই বাড়িতে। ভদ্রলোক সবসময়ে চমৎকার চমৎকার রঙিন টুপি পরেন, কথা বলেন গুছিয়ে। তার একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে এবং তার কাছ থেকে বুলু উড়োজাহাজের টিকিট কিনে থাকে। বস্তুত, এই অনুষ্ঠানের টিকিটও সে তাঁরই কাছ থেকে কিনেছে, এখন আর পাচ্ছে না, তবে তার সন্দেহ, নিশীথের হাতে টিকিট আছে, কিন্তু তিনি তা হাতছাড়া করছেন না। বুলু তাই সরাসরি হানা দিলো সে-বাড়িতেই, তবে গৃহকর্তার কাছে নয়, একেবারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ছুটির দিন সকালবেলা, বসার ঘরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ভিড়–কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত করে আমার পরিচয় দিয়ে বললো, ওর জন্যে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, ওকে রেখে যাই বা কী করে, আপনি নিশীথকে বলে দিন একটা টিকিট দিতে।’ হেমন্ত সে-কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে আমার সঙ্গে সৌজন্যমূলক দু-চারটে কথা বললেন, অন্যদের সঙ্গেও বাক্যবিনিময় করলেন। বুলু নিজেকে বেশ সামলে রাখলো ততক্ষণ। তারপর একসময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তবে যাই হেমন্তদা, আপনি নিশীথকে বলে দিন একবার!’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন গৃহস্বামীকে ডেকে বললেন, হ্যাঁ নিশীথ, এই অধ্যাপকের জন্যে তো একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। নিশীথ শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। বুলুকে তো আমি বলেই ছিলাম।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ততক্ষণে পাশের ঘরে বুলু আর নিশীথের লেনদেন চলছে।

অনুষ্ঠানটা ছিল সেই সন্ধেবেলায়ই। আমি বুলুর ওখানেই রয়ে গেলাম। বিকেলে মানসীরা এসে পড়ল। তারপর পাঁচজনে একত্রে যাত্রা। লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে হলে ঢোকা। হল তো নয়-লোকারণ্য।

সংগীতানুষ্ঠানের শুরুতে দিলীপকুমার মঞ্চে উঠে আহ্বান করলেন লতা মঙ্গেশকরকে। শ্রোতাদের করতালি থামতে চায় না। তার মধ্যে সায়রা বানু এসে পুস্পার্ঘ্য দিলেন লতাকে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে দিলীপকুমার নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন উর্দুতে, তবে সে-উর্দু ফারসিবহুল। সব কথার অর্থ বুঝিনি, কিন্তু এমনই শ্রুতিমধুর তাঁর বাচন, শব্দের ঝংকার এমন লালিত্যপূর্ণ, এমন। দৃষ্টিনন্দন তাঁর সর্বদেহের ভঙ্গি যে সে-বক্তৃতা শোনাও এক পরম রমণীয় অভিজ্ঞতা। এরপর একে একে সহশিল্পীদের আবির্ভাব–আশা ভোসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নীতীন মুকেশ, বাদকবৃন্দ। ঘোষণায় বলা হলো, প্রথম দুজনের সঙ্গে গীত লতার কিছু জনপ্রিয় গান আবার তাঁদের কণ্ঠেই শোনা যাবে, আর মুকেশের সঙ্গে যেসব গান গেয়েছিলেন তিনি, তার কয়েকটি গাইবেন লোকান্তরিত শিল্পীর পুত্র নীতীনের সঙ্গে। নীতীন মঞ্চে প্রবেশ করে লতাকে প্রণাম করেছিলেন পা-ছুঁয়ে, তারপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন লতার কাছে এই বলে যে, তাঁর বাবার গাওয়া গান তাঁর মতো অযোগ্য মানুষ গাইবার সুযোগ পাচ্ছেন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে।

লতার একক গান, সহশিল্পীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান এবং দু-একটি সম্মেলক গান হলো। আশা ও হেমন্তও একক গান গাইলেন ফাঁকে ফাঁকে। গনের মাঝে যে দু-চারটে কথা বললেন লতা মঙ্গেশকর–সেও অতি মধুর। সেদিন মিলনায়তন তেমন সজ্জিত ছিল না, মঞ্চসজ্জাও ছিল সাধারণ, কিন্তু কী যে অসাধারণ একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, তা বলার নয়। প্রতিটি গানের পরে শ্রোতাদের করতালি আনন্দ-হিল্লোল বইয়ে দিয়েছিল। কোথা থেকে যে দু-আড়াই ঘণ্টা চলে গেল, টের পাওয়া গেল না। অনুষ্ঠানশেষে দিলীপকুমার আবার মঞ্চে উঠলেন বিদায়বার্তা জানাতে, কিন্তু ততক্ষণে তাঁর কথা জড়িয়ে এসেছে–প্রারম্ভিক ভাষণের ইন্দ্রজাল অপগত হয়েছে। তারপরও, এমনকী মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে আসার পরেও, মোহের ঘোর আমাদের কাটে না।

এই প্যালেডিয়ামেই আমরা পাঁচজন ইউল ব্রাইনারের দি কিং অ্যান্ড আইনাটক দেখতে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশের দশকে তার চলচ্চিত্র আনা অ্যান্ড দি কিং অফ সিয়াম দেখে সকলে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখন দেশের তরুণদের মধ্যে ইউল ব্রাইনারের মতো মাথা কামিয়ে ফেলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। চলচ্চিত্রটি অমন সাড়া জাগিয়েছিল বলে তার নাট্যরূপ দেখার আগ্রহ ছিল বহুজনের। চলচ্চিত্রের অত কারিগরি সুবিধে থাকা সত্ত্বেও নাটকটি বহুগুণ ভালো লাগলো। সকলেই ভালো অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু মনে হলো, ইউল ব্রাইনার একাই মাতিয়ে রাখলেন সবটা সময়। নাটকের শেষে মোহিত দর্শকেরা হলের বাইরে ভিড় করলো–নায়ককে এক নজর দেখবে কিংবা তার স্বাক্ষর শিকার করবে বলে। এমন ভিড়ভাট্টা অপ্রত্যাশিত ছিল না, তাই ইউল ব্রাইনার প্রেক্ষাগৃহের অত্যন্তরেই রয়ে গেলেন অনেকক্ষণ। পুরো ব্যাপারটা তখন ধৈর্যের প্রতিযোগিতায় পরিণত হলো। অভিনেতা বেরিয়ে আসেন না, দর্শকেরাও জায়গা ছাড়ে না। দু-চারজন যে রণে ভঙ্গ দেয়নি, তা নয়, কিন্তু বুলু ও মানসী পণ করেছে, অনুষ্ঠানপত্রে তার স্বাক্ষর নেবেই। দাঁড়িয়ে থাকতে মাসিমার কষ্ট হয়, সরোজ ও আমার ধৈর্য ফুরিয়ে আসে, কিন্তু আমাদের অন্য দুই সঙ্গিনী অদম্য। শেষ পর্যন্ত ইউল ব্রাইনার বেরিয়ে আসেন, প্রবল করতালি রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, কেউ কেউ তার হাতে ফুল গুঁজে দেয়, কেউ কেউ দূর থেকে ফুল ছুঁড়ে দেয়, কেউ কেউ অনুষ্ঠানপত্র এগিয়ে দেয় স্বাক্ষরের দাবিতে। বুলু ও মানসী স্বাক্ষরসমেত অনুষ্ঠানপত্র নিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফেরে। বুলু তারটা আমাকে দান করতে চায়। আমি বলি, কী করবো নিয়ে, আমার তো অটোগ্রাফ জমাবার শখ নেই।’ সে বলে, এটা বাড়ি নিয়ে যাও, তোমার ছেলেমেয়েকে দিও-ওরা খুশি হবে। একবার ইচ্ছে হলো বলি, আমরা থাকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিভৃতে–সেখানে বাইরের পৃথিবীর আঘাত অতি মৃদু–আমার সাত থেকে পনেরো বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা ইউল ব্রাইনারকে জানার সুযোগ পায় না। কিন্তু বুলুর আন্তরিকতা দেখে তা আর বলা হয় না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানপত্র নিই, দেশে ফিরে তা তুলে দিই ছেলেমেয়ের হাতে। তারা নেড়েচেড়ে রেখে দেয় সেটা, তারপর একসময়ে হারিয়ে ফেলে। আমার কাছে থাকলেও তার পরিণতি এমনি অমোঘ হতো।

এইবার প্রবাসকালে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে গেল। প্রতিবারই তার স্ত্রী ছিলেন সঙ্গে, একবার ছিলেন তার মাও। অমিতা সেনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম ও শেষ দেখা। ঢাকার স্মৃতি তাঁর চিত্তে দেদীপ্যমান। আমি সত্যেন সেনকে চিনি বলায় খুশি হলেন। নবনীতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথাও বলেছিলাম। সে-সন্ধের বেশির ভাগ সময়টা তিনি কাটিয়েছিলেন আমার সঙ্গে গল্প করে। শান্তিনিকেতনের নানা প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।

৪৪.

১৯৭৬ সালে আমাকে হারিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের ডিন হয়েছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী। ১৯৭৮ সালে তিনি আবার একই পদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের মনোনীত ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। তিনি সেবার জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৮০ সালে আমি প্রার্থী হলাম এবং এবারে নির্বাচিত হলাম। আলমগীর হয়তো দ্বিতীয়বার ডিন হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন মনে মনে, যদিও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। তবে তাঁর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করলো।

এর মধ্যে আনোয়ার আবদেল-মালেক বললেন, দেশীয় সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে যদি আমি দু-একটি ওয়র্কশপ করতে চাই চট্টগ্রামে, তার প্রকল্প থেকে তার খরচ জোগানো যাবে। আমি কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। দুজন তরুণ সহকর্মী আমাকে খুব সাহায্য করলেন। গোলাম মুস্তাফার বুদ্ধি-পরামর্শ খুব কাজে দিলো ওয়র্কশপের পরিকল্পনায়। আর সৌরেন বিশ্বাস গভীর পরিশ্রম করলো ওয়র্কশপের ব্যবস্থাপনায়।

ওয়র্কশপের নামটি লম্বা রাখা হলো : ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড দি ইন্টিগ্রেশন অফ ট্রাডিশনস অ্যান্ড মডার্ন অ্যাটিচুড়স। একটা উপ-শিরোনামও দেওয়া হলো : উইথ স্পেশাল রেফারেনস টু বাংলাদেশ অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট। প্রথম ওয়র্কশপ হলো ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে। উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম উদবোধন করেছিলেন। উদবোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে। বাকি অধিবেশনগুলো চেরাগি পাহাড়ে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের মিলনায়তনে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশে–সব ছেড়ে-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত উদ্যোগে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে–এটি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়ের ব্যাপার। তার ওপরে যখন জানা গেল যে, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা-প্রকল্পের অধীনে মূলত আমার দায়িত্বে এটা ঘটতে যাচ্ছে, তখন বিস্ময়ের সঙ্গে হয়তো একটু অবজ্ঞাও মিশ্রিত হয়েছিল। তবু বিশিষ্টজনেরা এতে অংশ নিয়েছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে রাজি করিয়েছিলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল ভাষণ দিতে। তার অল্পসংখ্যক লেখার মধ্যে এটি একটি। আয়োজক কমিটির সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ ডিন সামাজিক বিজ্ঞানের আর আই চৌধুরী, সদস্য-সচিব ছিলেন বাংলা বিভাগের সভাপতি মনিরুজ্জামান। সকল ডিন এই কমিটির সদস্য ছিলেন, প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে আমি সদস্য ছিলাম আর ছিল বিভাগের তিন শিক্ষক-দিলওয়ার হোসেন, চৌধুরী জহুরুল হক ও গোলাম মুস্তাফা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা অংশ নিয়েছিলেন–অনুপম সেন, মাহবুবউল্লাহ ও রফিউদ্দীন আহমদ প্রবন্ধ পড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজির অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সরদার ফজলুল করিম, অর্থনীতির মুশারফ হোসেন, বাংলার আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও মনসুর মুসা, ইতিহাসের আবদুল মমিন চৌধুরী ও কে এম মোহসীন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আবু ইমাম ও অর্থনীতি বিভাগের সনৎকুমার সাহা, বাংলাদেশ সরকারের

তৎকালীন অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব আবদুল্লাহ আল মুতী, তাছাড়া হামিদা হোসেন হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব, নয়তো প্রবন্ধপাঠ, নাহয় প্রবন্ধের আলোচনা করেছিলেন। মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও (তিনি উপাচার্য হওয়ায় আমি যখন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, ভাইস-চান্সেলর হওয়াটা শিশুদের হাম হওয়ার মতো–একবার হয়ে গেলে আপদ চুকে যায়’) এসেছিলেন–প্রথমটায় যদি নাও এসে থাকেন, দ্বিতীয়টায় অবশ্যই এসেছিলেন।

দ্বিতীয় কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালের নভেম্বরে। এর উদৃবোধন করেছিলেন উপাচার্য আবদুল আজিজ খান। এবারেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। হয়েছিল ক্যাম্পাসে, বাকিসব চিটাগং পোর্ট ট্রেনিং সেন্টারের মিলনায়তনে। জায়গাটা একটু দূরে বটে, তবে এর সুযোগ-সুবিধে যথেষ্ট আছে এবং তার সবই পাওয়া গেল পোর্ট ট্রাস্টের সচিব মিজবাহউদ্দিন খানের সৌজন্যে। এর কর্মসূচিটি হাতের কাছে থাকায় সবটা তুলে দিতে পারছি :

উদবোধনী অধিবেশন

স্বাগত ভাষণ : মুহম্মদ আনিসুজ্জামান (সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন); উদবোধনী ভাষণ : এম আবদুল আজিজ খান। প্রকল্প-পরিচিতি : আনিসুজ্জামান; সভাপতির ভাষণ : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ধন্যবাদজ্ঞাপন : মনিরুজ্জামান। প্রথম অধিবেশন। প্রবন্ধ : আবদুল্লাহ্ আল-মুতী; আলোচক : এ কে শামসুদ্দীন আহমদ, এখলাসউদ্দীন আহমদ। প্রবন্ধ : শামসুল হক (আই ই আর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); আলোচক : সরদার ফজলুল করিম, আবদুল্লাহ আল-মুতী। সভাপতির ভাষণ : আব্দুর রাজ্জাক।

দ্বিতীয় অধিবেশন

প্রবন্ধ : মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ; আলোচক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ। প্রবন্ধ : মনসুর মুসা; আলোচক : মোহাম্মদ আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সভাপতির ভাষণ : কবীর চৌধুরী।

তৃতীয় অধিবেশন

প্রবন্ধ : এম মোফাখখারুল ইসলাম; আলোচক : রেহমান সোবহান, মাহবুবউল্লাহ। প্রবন্ধ : সিরাজুল ইসলাম; আলোচক : সনকুমার সাহা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; প্রবন্ধ : মাহবুবউল্লাহ; আলোচক : আবদুল গফুর (বিআইডিএস), হামিদা হোসেন। সভাপতির ভাষণ : মুশারফ হোসেন।

চতুর্থ অধিবেশন

প্রবন্ধ : আবদুল মমিন চৌধুরী; আলোচক : আবু ইমাম, কে এম মোহসীন। প্রবন্ধ : রফিউদ্দীন আহমদ; আলোচক : আবদুল মমিন চৌধুরী, অনুপম সেন। সভাপতির ভাষণ : আবদুল করিম। পঞ্চম অধিবেশন প্রবন্ধ : মুইন-উদ-দীন আহমদ খান; আলোচক : আবদুল করিম, মুহম্মদ আবদুল গফুর (আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রবন্ধ : মুহম্মদ আনিসুজ্জামান; আলোচক : সিকান্দার খান, মইনুল ইসলাম। সভাপতির ভাষণ : আবু ইমাম।

সমাপ্তি অধিবেশন

একজন অতিথির ভাষণ; মনিরুজ্জামানের ধন্যবাদজ্ঞাপন; সভাপতির ভাষণে কর্মশালার আলোচনার সারসংক্ষেপ : আনিসুজ্জামান।

.

দুটি কর্মশালাতেই মানবিকী বিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের এতজন সাধক অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও কোনো অভিযোগ শুনিনি। আমার সহকর্মীরা যেমন প্রাণপণে কাজ করেছিলেন, আমার পক্ষে তা ছিল শ্লাঘার বিষয়। অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতাও ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। এ রকম কর্মশালা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। তা করেনি, তবে আনোয়ার আবদেল-মালেক খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন, পরে কোনো আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় এই কর্মশালার বিবরণ উপস্থাপন করতে। আমি তা করেছিলাম আলজিয়ার্সে, সে-কথা যথাসময়ে বলা যাবে।

৪৫.

১৯৭৯ সালে–আমার বিদেশযাত্রার অল্পকাল পরেই–দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়। তার কিছুকাল পরে ১৯৭৪ সালে জারিকৃত জরুরি অবস্থারও অবসান ঘটে এবং সংবিধানে দেওয়া নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়, তা নয়। তবু সামরিক শাসনের অবসান এবং মৌলিক অধিকারের পুনর্বহাল স্বস্তিকর অবস্থা বই কি! এ-সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের জাতীয় সম্মেলনে দলীয় রাজনীতির প্রারম্ভিক পর্যায়ে হঠকারিতা করা হয়েছিল বলে স্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খাল-খনন কর্মসূচি গ্রহণ করে অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন করবেন বলে ঘোষণা দেন। এতে বেশ সাড়া পড়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত এই কর্মসূচিকে সোৎসাহে সমর্থন করে। শুনেছিলাম, মণি সিংহ এ-বিষয়ে একমত হননি, কিন্তু পার্টির অধিকাংশ সদস্যের মত তিনি মেনে নেন। জিয়াউর রহমান কথায় কথায় বিপ্লবের ধুয়া তুলতে থাকেন এবং সাধারণ মানুষ বুঝিলাম, নাই বুঝিলাম, জয় তব জয়’ ভাব নিয়ে তাঁকে সংবর্ধিত করে। তরুণদের মধ্যে জাসদ তখনো জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়তে যায় মাহমুদুর রহমান মান্না। সেখানে সে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগ তখনো বাকশালে-আওয়ামী লীগে এবং আওয়ামী লীগের একাধিক দলে বিভক্ত। তবে তারাও ঘর গোছাতে শুরু করে।

১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের–অন্য কথায়, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের–পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি। চট্টগ্রামে তা উদ্যাপনের জন্যে নাগরিকদের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠিত হয় আমাকে সভাপতি এবং সদ্যপ্রয়াত অ্যাডভোকেট শফিউল আলমকে সম্পাদক করে। সেদিনকার বিপ্লবীদের মধ্যে বিনোদবিহারী চৌধুরী, কালীপদ চক্রবর্তী ও অনঙ্গ সেন আমাদের মধ্যে থাকায় আমরা খুব উৎসাহিত বোধ করি। যে-জালালাবাদ পাহাড়ে সূর্য সেনেরা যুদ্ধ করেছিলেন, তা এখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের চৌহদ্দির অন্তর্ভুক্ত। আমরা সেখানেই একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব করি। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ঢাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ-বিষয়ে চিঠি লিখে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তখন কমিটির পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মনজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্যে আমাদের চিঠি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে কোনো আপত্তি না জানালে–সম্ভবত অনুমোদন ও বাধা কোনোটাই আসবে না–তিনিই স্মারকস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুমতি দেবেন নিজের দায়িত্বে। আমাদের প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে সেদিনই তিনি স্মারকস্তম্ভের জায়গাটি চিহ্নিত করেন। আমরা লিখিতভাবে ও মৌখিকভাবে তাকেই অনুরোধ করি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্যে। তিনি সম্মতি দেন।

জিওসির দপ্তরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আঁকা কয়েকটি তৈলচিত্র টাঙানো ছিল। কিছুক্ষণ পর পর সেদিকে আমার চোখ যাচ্ছিল। তা লক্ষ করে জেনারেল মনজুর বললেন, ‘এগুলো আমি আঁকিয়েছি। ছবিতে যাদের মুখ দেখছেন, তারা সবাই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পীর কল্পনা নয়। ছবি আঁকাবার জন্যে আমি তাদের জড়ো করিয়েছিলাম। আমি তাঁর উদ্‌যোগের প্রশংসা করলে তিনি মৃদু হাসেন। আমি এক ফাঁকে তাঁর স্কুলজীবনের সহপাঠী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোকাদ্দেসুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা। বলি। তিনি আরমানিটোলা স্কুল নিয়ে সামান্য স্মৃতিচারণ করেন। স্থির হয়, ১৮ এপ্রিল সকালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে এবং সেদিন সকলে অবাধে সেনানিবাসে প্রবেশ করতে পারবেন।

চট্টগ্রাম বিপ্লবের পঞ্চাশবর্ষপূর্তি উদ্যাপন পরিষদের সভাশেষে একদিন বেরিয়ে আসছি। দেখি, এক তরুণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মী বলে মনে হয়। সে-ও আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। বোঝাই গেল, আমাকে সে চেনে না। সে জানতে চাইলো, আমি মিটিং থেকে বের হচ্ছি কি না। আমার হাঁ-সূচক উত্তর শুনে সে প্রশ্ন করলো, চট্টগ্রামে বিপ্লব করা সম্পর্কে সভায় কী স্থির হলো। তার জ্ঞানের বহর দেখে আমি বিস্মিত হলাম। পালটা প্রশ্ন করলাম, সে এই সভার খবর পেল কোথা থেকে? সে বললো, খবরের কাগজ থেকে। আমি বললাম, আজ স্থির হয়েছে যে, ১৮ এপ্রিলে আমরা সবাই ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বিপ্লব করবো। আপনিও আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন।’ বেচারির একেবারে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।

১৮ এপ্রিল সকালে ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে সেনানিবাসের একটি প্রবেশদ্বারে আমার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে গন্তব্যে কীভাবে পৌঁছাবো জানতে চাওয়ায় কর্তব্যরত প্রহরী নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, ‘সামনে গিয়ে ডান দিকে যান–ধুতি, হারমোনিয়াম, সব ওদিকেই গেছে।’ তিক্ততা নিয়েই যথাস্থানে পৌঁছোলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সবাই এসে পড়লেন। কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে জেনারেল মনজুর এলেন নির্ধারিত সময়ের একটু পরে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, তার সহকর্মীরা দায়ে পড়ে এসেছেন–তাঁরা আদৌ এ বিষয়ে আগ্রহী নন। মনজুর এসে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলেছিলেন, সূর্য সেনের সহযোগী বিপ্লবীদের কয়েকজন চট্টগ্রামে আছেন–তাঁরা কি এসেছেন?’ বললাম, তারা এখানেই আছেন। উনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন। আমি আলাপ করিয়ে দিলাম। মনজুর তাদের বললেন, আপনারা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন–আমি আপনাদের পেছনে থাকবো। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি আমার পাশে থাকবেন। আমি বললাম, ‘ভিত্তিপ্রস্তরে তো আপনার নাম লেখা হয়েছে–আপনি স্থাপন করলেই ভালো হয়। মনজুর বললেন, ‘লেট’স পে হোমেজ টু হিস্ট্রি। আমি তার কথা শুনে গভীরভাবে আপ্লুত হলাম।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জায়গায় বিনোদবিহারী চৌধুরী, কালীপদ চক্রবর্তী ও অনঙ্গ সেন সামনে দাঁড়ালেন, তার পেছনের সারিতে সামরিক পোশাকে জেনারেল মনজুর, সঙ্গে আমি, তার পেছনে ইউনিফর্মপরা সামরিক কর্মকর্তারা, তার পেছনে বাকি সবাই। বিপ্লবীরা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। মনজুর স্যালুট দিলেন। সেনাবাহিনীর ছোটো বাদকদল বিউগল বাজালো। তারপর দু-তিনটি গান পরিবেশিত হলো। সকালের অনুষ্ঠানের সেখানেই সমাপ্তি। জেনারেল মনজুর ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে করমর্দন করে ফিরে এলাম।

সন্ধ্যায় মুসলিম ইনসটিটিউটে স্মরণসভা। প্রধান অতিথি হয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন বিচারপতি সৈয়দ মুহম্মদ হোসেন। রেলস্টেশন থেকে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে। তাঁর সঙ্গ মানেই আনন্দের উৎস। সভাস্থলে তিনি একটু আগে আসতে চাইলেন–সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে, এই কারণে। তাই হলো। কিছুকাল আগে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর মৌখিক ভাষণ টেপ থেকে অনুলিখিত হয়ে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু’ নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তাৎক্ষণিক সাড়া জাগায়। ফলে, তার বক্তৃতা শুনতে মানুষের খুব আগ্রহ ছিল, তাঁকে দেখতে ও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতেও অনেকে উৎসুক ছিলেন। ফলে তাঁকে ঘিরে সর্বক্ষণ ভিড় লেগে ছিল। সেই সন্ধ্যায় তিনি খুব উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছিলেন–তাতে স্বাধীনতা-ঘোষণার বিষয় নিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম না করে তাঁর প্রতি কিছু শ্লেষোক্তি ছিল। শ্রোতারা তাঁর বক্তৃতা খুব উপভোগ করেছিলেন। প্রধান অতিথি সেই রাতের ট্রেনেই ঢাকায় ফিরে যান।

৪৬.

রুচি এসএসসি পরীক্ষা দিলো ১৯৮০ সালে। ওই পরীক্ষায় তার একটি বিষয় ছিল সংগীত। বোর্ডের নিয়মানুযায়ী, সংগীতের পরীক্ষা দিতে হবে কুমিল্লায়, বোর্ডের অফিসে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে গেলাম কুমিল্লায়, উঠলাম বোর্ডেরই অফিস-সংলগ্ন অতিথি-নিবাসে। যতদূরসম্ভব আত্মগোপন করে থাকলাম–বেশি প্রকাশিত হলে মনে হতে পারে, মেয়ের পরীক্ষার তদৃবির করতে এসেছি। খাওয়া-দাওয়া সারলাম বোর্ড অফিসের উলটোদিকের ছালাহউদ্দীন রেস্টুরেন্টে। কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রক শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল–তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে যেতে বললেন। তাঁর স্ত্রী আমার সহোদরাতুল্যা–আবাল্য তাকে বকুল আপা বলে ডাকি। সুতরাং যেতেই হলো এবং চায়ের সঙ্গে বকুনি খেতে হলো-কুমিল্লায় এসেছি, তাও সপরিবারে, অথচ নিজে থেকে দেখা করিনি। আমার শ্যালক আজিজের বন্ধু–এখন আর সে নেই–দেওয়ান তাইয়েবুর রহমান তখন যমুনা অয়েল কোম্পানির কুমিল্লা অফিসের কর্মকর্তা। কীভাবে যেন খবর পেয়ে সে আমাদের খুঁজে বের করলো এবং ক্রমাগত আফসোস করতে থাকলো। সে কুমিল্লায় আছে, আর আমরা কিনা তার ওখানে না উঠে থাকছি বোর্ড অফিসের অতিথিশালায়, আর খাচ্ছি ছালাহউদ্দীন রেস্টুরেন্টে–এর চেয়ে বড়ো অঘটন আর কী হতে পারে! কবুল করতেই হলো যে, সে যে কুমিল্লায় আছে, সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিনই দুপুরে ওদের বাড়ি যেতে হলো। তার স্ত্রী নাজমা সেই দুপুরেই ঢাকায় ফিরে যাবে–তারই মধ্যে রান্নাবান্না করে সযত্নে আমাদের খাওয়ালো। তাদের ছেলেমেয়েরা তখন খুবই ছোটো। এখন তো নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা চিত্রশিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

দেওয়ানের বাড়ি থেকে খেয়েই আমরা চট্টগ্রামের পথে রওনা হলাম।

যে-সন্ধ্যায় সেবারে এসএসসির ফল প্রকাশিত হলো, সে-সন্ধ্যায় রুচির ফলাফলের খবর পাইনি, কেননা, শহর থেকে দূরে হওয়ায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (স্কুল ও কলেজ শাখা মিলিয়ে) কাগজপত্র এসে পৌঁছোতে দেরি হয়। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান সহকারী আবদুর রশীদ শহর থেকে বিভাগে পৌঁছে আমাকে ফোনে জানালেন, মেধা-তালিকায় রুচি অষ্টম স্থান পেয়েছে, দৈনিক আজাদীতে পুরো তালিকা বেরিয়েছে, বিভাগের পিয়ন দিয়ে তিনি কাগজটা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। খবরটা পেয়ে কী যে অভিভূত হয়ে গেলাম–তা বলার নয়। তারপরেই কলেজের স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক ফোন করলেন, রুচিকে এবং তার বাপ-মাকে অভিনন্দন জানাতে। তাকে বললাম, মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে আমার কোনো ভূমিকা নেই, কিছু আছে তার মায়ের, বেশি আছে তার শিক্ষকদের আর এখলাসউদ্দীনের। এখলাসউদ্দীন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক-কলেজটির দেখাশোনা করার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। তাঁর সমালোচকেরা বলতেন, নিজের বিভাগের চেয়ে কলেজের দিকে তার মনোযোগ বেশি। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর প্রতি তার নজর ছিল–তাদের মধ্যে যারা ক্যাম্পাসে থাকতো, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি পড়াতেন এবং পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করতেন। রুচিদের গৃহশিক্ষক ছিলেন তাদেরই স্কুলশিক্ষক আলেফ হোসেন। তিনি খুবই যত্নের সঙ্গে ওদের পড়িয়েছিলেন। ফলাফল জেনে এখলাস এলেন মুচকি হাসতে হাসতে–তারপর অন্য প্রতিবেশীরা। খাওয়াদাওয়া ছাড়াই এক মহোৎসব হয়ে গেল।

সেইবারই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার কৃতী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হিজবুল বহরজাহাজে আনন্দ-ভ্রমণে গিয়েছিলেন। রুচি যায়নি–সম্ভবত তার চেয়ে যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল, তাদেরই নিমন্ত্রণ ছিল। তবে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দেওয়া সংবর্ধনায় সে উপস্থিত ছিল। টেলিভিশনে হিজবুল বহর অধ্যায়ের যে-দৃশ্য দেখেছিলাম, তা আমার কাছে প্রীতিপ্রদ মনে হয়নি। দেখলাম, জিয়াউর রহমান বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর তার পায়ের কাছে সুরের কুসুমগুলির মতো ছড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রীরা, সামনের দিকে শিক্ষকেরাও আছেন। সেখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কে এম আমিনুল হকও ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, তখন তাঁকে দেখেছি গোঁফ-দাড়ি কামানো এবং নিখুঁত পাশ্চাত্য পোশাকে সুসজ্জিত। পরবর্তীকালে ধর্মানুরাগবশত তিনি বেশ বড়ো দাড়ি রেখেছিলেন এবং আলখাল্লা গোছের পোশাক পরার অভ্যাস করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বক্তৃতার মাঝখানে তাকে যেভাবে ‘এই যে মৌলভি সাহেব বলে সম্বোধন করছিলেন, তাতে তার প্রাপ্য সম্মান জানানো হয়নি বলে আমার মনে হয়েছিল।

এই হিজবুল বহর-ভ্রমণ থেকেই বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কৃতী ছাত্রদের অনেককে রাষ্ট্রপতি কাছে টেনে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার মানে দাঁড়িয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। ছাত্র-রাজনীতি করলে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু কৃতীদের কেউ কেউ যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংঘর্ষ তার আগেই শুরু হয়েছিল, এবারে সে-সংঘাত প্রবল হলো।

৪৭.

১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। এলেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদ তাঁর এই সফরের আয়োজন করেন। সুতরাং তিনি এসেছিলেন মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। এই সুযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে বেশি সক্রিয় ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এখলাসউদ্দীন। আহমেদের উদযোগ, তবে উপাচার্য আবদুল করিমেরও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এ বিষয়ে। অধ্যাপক সালামের মতো গুণী মানুষকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম।

কাছাকাছি সময়ে আরেক গুণী মানুষকে আমাদের মধ্যে পেয়েছিলাম। তিনি সমাজবিজ্ঞানী রামকৃষ্ণ মুখার্জি। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আমন্ত্রণে–এ কে নাজমুল করিম স্মারক বক্তৃতা দিতে–ওই স্মারক বক্তৃতার শুরুই হয়েছিল তাঁকে দিয়ে। এই সুযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওই বিভাগে একটা বক্তৃতা দিতে। তিনি সম্মত হয়েছিলেন এই শর্তে যে, চট্টগ্রামে তিনি থাকবেন আমার বাড়িতে। আমি বাংলার ছাত্র হয়ে অত নামজাদা সমাজবিজ্ঞানীর প্রিয়পাত্র হলাম কী করে, এ-প্রশ্ন আমাদের অনেক সহকর্মীকে আলোড়িত করেছিল। অধ্যাপক মুখার্জি বক্তৃতা দিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আর সস্ত্রীক থাকলেন আমার ক্যাম্পাসের বাড়িতে। পূরবী মুখার্জির সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয় হলো–নিজের গুণে তিনি আমাদের সবাইকে অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছিলেন। আনন্দ তখন বছর আটেকের ছেলে–সে রামকৃষ্ণ মুখার্জির খুব ভক্ত হয়ে গেল, তার আয়েশের দিকে খুব নজর রাখতে থাকলো। তার ক্ষিপ্রতা দেখে মুখার্জি তাকে ডাকতে শুরু করলেন ম্যানেজার বলে। কিছু দরকার হলে আমাকে না ডেকে আনন্দকে ডাকতেন। বলতেন, ওকে বললে সব ম্যানেজ করে দেবে। ওঁদের নিয়ে সপরিবারে রাঙামাটি গেলাম গাড়ি চালিয়ে গিয়ে অবশ্য বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। একটু ভয় পেলাম। তবে সবটা নির্বিঘ্নে কাটলো। রামকৃষ্ণ মুখার্জি অনর্গল কথা বলে গেলেন–আমরা শুনতে থাকলাম।

এর আগেরবার রাঙামাটি গিয়েছিলাম কুণ্ঠিত হয়ে। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ আমার ছোটো ভায়রা মোবারক হোসেনের বড়ো ভাই। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকতে আমাদের দুই পরিবারে বেশ যাতায়াত ছিল। তিনি সদ্য বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির কম্যান্ডান্ট নিযুক্ত হয়েছেন–তার আগে তার দায়িত্ব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। হান্নান শাহ চাইলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার আগে আমাদের একবার সে-অঞ্চল ঘুরিয়ে আনবেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আছেন বিএমএ-র বিদায়ী কম্যান্ডান্ট মেজর জেনারেল আবদুর রহমান এবং পার্বত্য এলাকায় নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুস সালাম সপরিবারে। চতুর্থ পরিবার আমাদেরটা। সামরিক বাহিনীর গাড়িতেই ক্যাম্পাস থেকে রাঙামাটি গেলাম। সেখানে ওঠা হলো লঞ্চে–জলপথেই বেশির ভাগ সময় বেড়িয়ে ও খেয়ে রাঙামাটি ফেরা। আবার সড়কপথে চট্টগ্রাম-প্রত্যাবর্তন।

আবদুর রহমান যখন ব্রিগেডিয়ার হিসেবে বিএমএ-র কম্যান্ডান্ট ছিলেন, তখন কোনো একটা উপলক্ষে আমি তাঁদের অ্যাকাডেমিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। কথায় কথায় আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তরুণ সামরিক কর্মকর্তাদের দেখি অন্যের সঙ্গে খুব রূঢ় আচরণ করতে, এর কারণ কী?’ তিনি বলেছিলেন, আপনি যাদের কথা বলছেন, ওরা নিশ্চয় ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। অল্পবয়সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কঠোর শাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। আদেশ দিতে ও মানতে শিখেছে, মায়া-মমতা পায়নি, করতেও শেখেনি। তারপর তাঁর বিএমএ-র এক ছাত্রের কথা বললেন। তার পিতৃবিয়োগের সংবাদ পেয়ে তিনি তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কারণ না জানিয়েই। সে ফিরে আসার পরে তাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠিয়ে যখন সমবেদনা জানিয়েছিলেন, তখন সে বেশ চটপটে ভাবেই বলেছিল, তার খুব অসুবিধে হবে না। জেনারেল রহমান বলেছিলেন আমাকে, নিজের পরিবারের জন্যেই যার টান নেই, দেশের প্রতি তার টান আসবে কোথা থেকে? তাঁর সেদিনের কথাবার্তায় আমার মনে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় জেগেছিল।

হান্নান শাহর আমন্ত্রণে ভ্রমণে গিয়ে মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সঙ্গে এবার পরিচয়টা প্রগাঢ় হলো। তিনিই বললেন, তাঁর ছেলের নাম রেখেছেন আমার শিক্ষক মুহম্মদ আবদুল হাই। হাই সাহেবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তার তদানীন্তন শ্বশুর ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর মাধ্যমে। এতক্ষণে তাঁর পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হলো। আমিও এই সুযোগে বললাম যে, তাঁর প্রথম শাশুড়ি–তাছাড়াও আত্মীয়া–রাজিয়া মতিন চৌধুরী নিজের অদৃষ্টদোষে আমার ছাত্রী হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনে হলো, ব্যাপারটা তাঁর অজানা নয়।

তিন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে অনিবার্যভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ হলো। সেখানকার রাজনৈতিক সমস্যার যে-সামরিক সমাধান আমাদের সরকার খুঁজছেন, তা যে সফল হতে পারে না, সে সম্পর্কে আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা আমি ব্যক্ত করলাম। ওঁরা বললেন, বিদ্বজ্জনেরা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে থাকেন এবং আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা বললাম, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিনসের নজির দেখালাম। ওঁরা জানতে চাইলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের যেসব স্থাপনা আছে–যেমন, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা উপগ্রহ যোগাযোগ-কেন্দ্র–এসব কি আমি পাহাড়িদের কাছে সমর্পণ করতে বলি? আমি বললাম, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকেরা তো এই ধরনের চিন্তা করেছিলেন। পাহাড়িরা পুরো দেশটাকে নিজের বলে ভাবতে না পারলে একদিন তারা বিচ্ছিন্নই হয়ে যাবে। পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের বসতিস্থাপন করে আমরা যে-পথে অগ্রসর হচ্ছি, তা বাংলাদেশকে আপন ভাবতে তাদের সাহায্য করবে না।

মতপার্থক্য হলেও আমরা কেউ উত্তেজিত হইনি, কেউ আমার দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেননি।

লঞ্চে যেতে যেতে এক তীরে কিছু পাহাড়িকে চলাফেরা করতে দেখেছিলাম। আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিতে প্রবল ঘৃণা ছিল বলে মনে হয়েছিল। ক্যাম্পাসে ফিরে আসার পরে বেবীও আমাকে তার ঠিক একই অনুভূতির কথা বলেছিল।

৪৮.

সৃষ্টিশীলতা নিয়ে সিম্পোজিয়াম। এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার পর এবার আরব ভুবন। পর্যায়ক্রমে তৃতীয় সম্মেলন। এটি অনুষ্ঠিত হলো কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেক্সিকোতে যে-কুয়েতি অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, তিনিই এর আয়োজক।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা কুয়েত-শেরাটনে। ঘরের টেবিল-ল্যাম্পটা কাজ করছিল না। আমার নালিশের জবাবে যে-তরুণ সেটা সারাতে এলো, সে কাজ করতে করতে প্রশ্ন করলো, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’ বললাম, না, আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে। তখন সে হৃষ্টচিত্তে জানতে চাইলো, বাংলাদেশে কোথায় থাকেন আপনি?’ চট্টগ্রাম শুনে সে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্ন করলো, চট্টগ্রামের কোথায়? বুঝিয়ে বললাম। সে নিজে চট্টগ্রামের সন্তান–চাকরি নিয়ে এখানে এসেছে বৎসরাধিককাল। তার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যে-কোনো প্রয়োজন হলে তাকে যেন খবর দিই, সে যথাসাধ্য করবে।

কুয়েত শহরের রাস্তাঘাটে বেশি পুলিশ লক্ষ করলাম না, কিন্তু সকলেই দেখি, ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলছে। ঢাউস ঢাউস গাড়ির চালকেরা সকলেই পথচলার অগ্রাধিকার দিচ্ছে পথচারীকে। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট।

সম্মেলনস্থানে এক কুয়েতি বললেন, আপনার নামটা বেশ অভিনব–আনিসুর রহমান, আনিসুল ইসলাম নয়, আনিসুজ্জামান। এমনটা আর শুনিনি। আমি কিছু বলার আগে পাশ থেকে আরেক আরব বলে উঠলেন, অবাক হওয়ার কী আছে? আনিস আল-জামান, যুগবন্ধু। খাঁটি আরবি নাম। প্রথম ব্যক্তি জানতে চাইলেন, তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন। দ্বিতীয়জন জানালেন, মিশর। প্রথমজন বললেন, মিশরে হয়তো আপনারা এ-ধরনের নামের সঙ্গে পরিচিত, আমরা, কুয়েতিরা, নই।

আয়োজক অধ্যাপক একটু পরে এলেন, আমাকে দেখে সহর্ষে জড়িয়ে ধরলেন। আমি বললাম, তোমাকে যে আমি লন্ডন থেকে সুটকেস পাঠালাম, সেটা পেয়েছিলে? সে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, অবশ্যই অবশ্যই। তুমি আমার প্রিয় ভ্রাতা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বললাম, তুমি একবার প্রাপ্তিস্বীকার পর্যন্ত করলে না! (আমার টাকা খরচের কথা মুখ ফুটে বললাম না, ভাবলাম, এই প্রসঙ্গে তার মনে পড়বে।) সে বললো, প্রাপ্তিস্বীকার করিনি? নিশ্চয় করেছি। তুমি আমার প্রিয় ভ্রাতা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তবে তার কথা শুনে স্পষ্টই বোঝা গেল, প্রাপ্তিস্বীকারের ইচ্ছে থাকলেও সেটা করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে।

চিঠিতে আনোয়ার আবদেল-মালেক লিখেছিলেন, সম্মেলনে আমার কোনো প্রবন্ধ পড়বার দরকার নেই। পঠিত প্রবন্ধ এক-আধটা আলোচনা করলেই হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর তিনি বললেন, প্রিয় আনিস, তোমাকে বলেছিলাম, কিছু লিখতে হবে না। এখন দেখছি, লেখা দরকার। তুমি ভাই রাতের মধ্যে একটা লেখা তৈরি করে ফেলল।

সারারাত জেগে লিখলাম–অ্যান আউটসাইডার’স ভিউ অফ অ্যারাব এনডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি। সারকথা : আরব সৃষ্টিশীলতায় আমি তিনটে বৃত্ত দেখতে পাই। প্রথমটি আঞ্চলিক, উপজাতীয়ও বলা যেতে পারে-আরবদের মধ্যেই অঞ্চলভেদে তার রকমফের আছে। দ্বিতীয়টি ইসলামি–এটা তারা ভাগ করে নেয় সংখ্যাগুরু অনারব মুসলমানের সঙ্গে। তৃতীয়টি অপেক্ষাকৃত আধুনিকতার যোগ সারা বিশ্বের সঙ্গে। প্রায় বছর দুই পরে মরক্কোর কিং হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের মিশরীয় অধ্যাপক হাসান হানাফি আমাকে বলেছিলেন, আরবরা যে মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যালঘু, এ কথাটা তুমিই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলে-সেকথা আমার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি।

রাতে খাওয়ার সময়ে লক্ষ করলাম, অদূরে এক টেবিলে অধ্যাপক আবুদস সালাম আসীন। তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। চট্টগ্রামের স্মৃতি তার একেবারেই সাম্প্রতিক। সুতরাং খুশি হয়েই আমাকে গ্রহণ করলেন। তিনি কুয়েতে এসেছেন আরেকটি আলোচনা-সভায় যোগ দিতে। শেরাটনেই আছেন।

আনোয়ার আবদেল-মালেককে জানালাম, সালাম এই হোটেলেই আছেন। তিনি তাঁকে সম্মত করালেন আমাদের সমাপ্তি অধিবেশনে কিছু বলতে।

পরে, আমার সঙ্গে আলাপে, সালাম খুব হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর আশা ছিল, আরব দেশগুলোর কোনো একটিতে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য ত্রিয়েস্তের মতো একটি কেন্দ্রস্থাপনে তেল-সম্পদের এই মালিকদের উৎসাহিত করতে পারবেন। তাহলে তরুণ মুসলমান গবেষকেরা সেখানে। জড়ো হয়ে গবেষণা করতে সমর্থ হবে। কিন্তু সে-বিষয়ে এঁরা কেউ সাড়া দিলেন না। তিনি আরো বললেন, দেখো, এরা কল-কারখানা বসাচ্ছে বটে, তার সবই টার্ন-কি ব্যবস্থায়। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপান ঠিকা নিয়ে কাজটা করে দিচ্ছে–এরা কেউ চোখে দেখে শিখতেও চাইছে না। তেলের টাকার গরমে এদের মাথা গরম–নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববারও সময় নেই। সালামের ইসলাম ও মুসলমানপ্রীতি সুবিদিত। আমি একসময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি শেষ কবে গেছেন পাকিস্তানে। দুঃখের সঙ্গেই বললেন তিনি, পাকিস্তানে আহমদিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা করার পরে স্বদেশে আর তিনি যাননি।

আয়োজকরা অনারব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে দোভাষী যুক্ত করেছিলেন। যে-ছেলেটি আমার ভাগে পড়েছিল, বুঝলাম, সে সম্পন্ন ঘরের ছেলে। সে ইংরেজি ভাষার ছাত্র, তবে তার পোশাক ঐতিহ্যবাহী আরবদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেওয়াজ-অনুযায়ী আগের বছর গ্রীষ্মকালে সে ইংল্যান্ডে গিয়েছিল ভাষাটা রপ্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়েরই খরচে। দুটি মেয়ে-দোভাষীর সঙ্গে সে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো–তারা ফরাসি পড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে–তারাও সেবারে ঘুরে এসেছে প্যারিস। সম্মেলনের অবকাশে ওদের তিনজনকে নিয়ে কফি শপের এক টেবিলে বসে গল্প করলাম। তরুণটি বললো, লেখাপড়া শেষ করে সে ইংল্যান্ডে নাহয় আমেরিকায় চলে যাবে। কুয়েতে কোনো লাইফ নেই, আছে কেবল ভণ্ডামি। এই শেরাটনে পর্যটকেরাও হার্ড ড্রিংক খেতে পায় না, অথচ সম্পন্ন সব কুয়েতির বাড়িতে একটি করে সেলার আছে। সপ্তাহান্তে ট্রেলার নিয়ে তারা চলে যায় শহরের বাইরে–ফ্রিজে পানীয় ভর্তি করে নিয়ে যায়, খালি বোতল সেখানেই ফেলে আসে। মেয়েদুটির দ্বিতীয় ভাষা যদিও ফরাসি, তবু ইংরেজি খানিকটা বলতে পারে। তারা পরেছে একই রকম পাশ্চাত্য পোশাক। ওদের মধ্যে একজনকে খুবই কমবয়সী মনে হয়েছিল। শুনলাম, তার বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়ে গেছে। সেও ভাবছে, পড়াশোনার শেষে ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডে চলে যাবে। আমার দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা সবাই চলে গেলে দেশে থাকবে কে? আমদানি-করা এভিয়র বোতল থেকে পানি খেতে খেতে সে বললো, যারা নিরুপায়, তারা থাকবে। আর জনশক্তি আমদানি হবে এই এভিয়র বোতলের মতো। সবই তো আমরা আমদানি করি।

কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিভাগের সেক্রেটারি মেয়েটি মিশরীয়। সে বহু বছর এখানে কাজ করছে। সে কথায় কথায় বললো, কুয়েতিরা অ-স্থানীয়দের কখনো মর্যাদার চোখে দেখে না। আমি যে আরব, কিন্তু তাও কখনো এদের কাছে সমকক্ষ হতে পারব না।

এক ফিলিস্তিনি মহিলা–ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক-অনুযোগ করলেন স্বদেশীয়দের সম্পর্কে। বললেন, যারা ফিলিস্তিনে আছে, তারা সংগ্রাম করছে, কষ্টস্বীকার করছে। আমার মতো যেসব ফিলিস্তিনিকে তুমি বিদেশে দেখো, তারা প্রায় সকলেই বিলাসী জীবনযাপনে ব্যস্ত, নইলে কীভাবে তেমন জীবন যাপন করা যায়, তার সন্ধানে রত। আরব দেশগুলোতে আমরা আশ্রয় পাই, কাজ পাই, কিন্তু তারা আমাদের কখনো আপন করে নেয় না।

কুয়েতে সম্মেলনটা হয়েছিল পাঁচ দিন ধরে। সুতরাং সাধারণত সম্মেলনে যেমন চাপ থাকে, তার থেকে এটি ছিল মুক্ত। আমরা বেশ হেসে খেলে বেড়িয়ে গল্প করেও অধিবেশনে যোগ দিতে পেরেছি। খাওয়া-দাওয়াও ছিল অপর্যাপ্ত। বিদায়ী নৈশভোজটা হয়েছিল শেরাটনের ব্যাংকোয়েট হলে। স্থানীয় আমির-ওমরাহ গণ্য-মান্যেরা এসেছিলেন। হলে ঢুকতেই দরজার দু পাশে দুটি আস্ত রোস্ট ল্যাম–সঙ্গে কার্ভিংয়ের হরেকরকম ছুরি-কাঁটা-চামচ। তারপর অফুরান খাদ্যসামগ্রী টেবিল ভরে। সময় হলে প্রথমে অতিথিদের বলা হলো খাবার নিতে। আমরা সে দুম্বার খানিকটা সংগ্রহ করলাম ছুরি-কাঁটা দিয়ে কেটে। আমাদের নেওয়া হয়ে যাওয়ার পরে স্থানীয় বন্ধুরা গেলেন খাবার নিতে। ছুরি-কাঁটা-চামচ ফেলে তাঁদের অনেকেই হাত ঢুকিয়ে দিলেন দুম্বার পেটে–কেউ কেউ প্রায় কনুই পর্যন্ত। ফলে, আমরা আর দ্বিতীয়বার দুম্বার কাছে ঘেঁষলাম না।

পরিকল্পনা করেছিলাম, কুয়েত থেকে আবুধাবি হয়ে ফিরব–সেখানে আমার শ্যালিকা নাসরীন, ভায়রা এফ আর এম হাসান এবং তাদের শিশুপুত্র আন্দালিব আছে। আমার যাতায়াতের টিকিট ছিল কুয়েত এয়ারওয়েজে, কিন্তু কেন যেন এই সেক্টরটার টিকিট ছিল মিল ইস্ট এয়ারলাইনসে (এমইএ)। কুয়েত সিটি বিমানবন্দরে তাদের হয়ে কাজ করে এয়ার ইন্ডিয়া। সেখানে রিপোর্ট করতেই ডেস্ক থেকে বলা হলো, আপনার ভিসা নেই, আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না। বললাম, আমার জন্যে ভিসা নিয়ে লোক অপেক্ষা করবে আবুধাবি বিমানবন্দরে। তাতে কাজ হলো না। বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার ঊর্ধ্বতন এক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, দেখুন, ভিসা ছাড়া যাত্রী আমরা। নিই না, কেননা, ভিসা না পেলে সে-যাত্রীকে নিজেদের খরচে ফিরিয়ে আনতে হয়–সে-ঝুঁকি কোনো স্টাফ নিতে চায় না। আপনি কি নিশ্চিত যে, সেখানে পৌঁছে আপনি ভিসা পাবেন? বললাম, ঢাকা ছাড়ার আগে আমার আত্মীয়ের সঙ্গে সেরকম কথা হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, আপনার আত্মীয়কে ফোন করে জেনে নিন, তিনি আপনার জন্যে ভিসা সংগ্রহ করতে পেরেছেন কি না। কুয়েতি বন্ধু আমার টাকাটা ফেরত দেবে, এই বৃথা ভরসায় হাতের পয়সা সব খরচ করে ফেলেছি। সঙ্গে যা আছে, তাতে দূরপাল্লার ফোন করা যাবে কি না সন্দেহ। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে ভদ্রলোক তার সামনের টেলিফোন দেখিয়ে বললেন, এখান থেকেই কথা বলুন। তাই করলাম। হাসান আমাকে আশ্বস্ত করলো, আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করলাম। তিনি বললেন, চলুন, কাউন্টারের দিকে যাই। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে উচ্চারণ করলেন, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আপনার যাতে অসুবিধে না হয়, তা দেখা আমার কর্তব্য। কাউন্টারে আমাকে নিয়ে গিয়ে, সেই আগের লোকটিকেই বোধহয়, বললেন আমাকে বোর্ডিং পাস দিয়ে দিতে। সে বললো, ওঁর ভিসা নেই, আমি ওঁকে বোর্ডিং পাস দিতে পারব না। ভদ্রলোক অনুচ্চ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, হি ইজ এ ইউনিভার্সিটি প্রফেসর। আই টেক রেসপনসিবিলিটি ফর হিম। ইউ ক্যান গেট ইট ইন রাইটিং ফ্রম মি লেটার, বাট ইস্যু দি বোর্ডিং পাস নাউ।’ বলেই ভদ্রলোক ফিরে গেলেন। আমি অভিভূত হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালাম।

আবুধাবি বিমানবন্দরে হাসান এসেছিল আমার ভিসা এবং তার অফিসের এক আরব যুবককে নিয়ে। কোনো ঝামেলা হলো না। বিমানবন্দর থেকে। বেরিয়ে সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এরা কত কষ্ট করে সবুজ করছে, আর আমরা কত অবহেলায় সবুজ হারাচ্ছি!

তিনটে দিন খুব ভালো কাটলো আবুধাবিতে। বেড়ানো হলো, অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলো। আমার শ্যালক আজিজের বন্ধু হেলালের বাড়িতে এবং রাষ্ট্রদূত মুহম্মদ মহসিনের বাড়িতে খেলাম। দোকান-বাজারে গিয়ে দেখি, বাংলায় আমাদের ডাকাডাকি করছে। এক দোকানে মধ্যবয়সী এক সেলসম্যান নিম্নকণ্ঠে আমার নাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমিই সেই ব্যক্তি কি না। খুব অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ, আপনি কেমন করে চিনলেন? তিনি বললেন, দেশে থাকতে কাগজে আপনার ছবি দেখেছি। তারপর জানালেন, চট্টগ্রামেরই এক গ্রামাঞ্চলে তিনি শিক্ষকতা করতেন। তাতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। তাই চাকরি নিয়ে চলে এসেছেন। পেশার পরিবর্তনে তিনি একটু গ্লানিবোধ করেন, তাঁর কথার ভঙ্গি থেকে তা বেশ বোঝা গেল।

আমি কুয়েতে যাওয়ার আগে উপাচার্য আবদুল করিম বলেছিলেন, তাঁর জন্যে যেন সেখান থেকে এক বোতল জয়তুনের তেল নিয়ে আসি। আমার দোভাষী সেই ছাত্রটিকে বলেছিলাম তা সংগ্রহ করে দিতে। সে প্রায় আধা গ্যালনের এক প্লাস্টিক-কন্টেনারে যা নিয়ে এলো, তা বিদেশি অলিভ অয়েল। সেটা সুটকেসে নেওয়া সম্ভবপর ছিল না বলে কুয়েত থেকে আবুধাবি, আবুধাবি থেকে ঢাকা, এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে হাতে করে নিয়ে আসতে হলো। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে কৌতূহলীদের প্রশ্নের জবাবে বলতেই হলো, ‘তেল–ভাইস চান্সেলরকে দিতে যাচ্ছি।’

৪৯.

মাসখানেক পরেই, কিছুটা আকস্মিকভাবে ও অপ্রত্যাশিতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল আজিজ খান। তিনি মন্ত্রী ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছোটো ভায়রা। কেউ বললেন, তার নিয়োগ হয়েছে সেই সুবাদে; কেউ বললেন, তাঁর সঙ্গে আলাপে প্রীত হয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বয়ং এই দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করেছেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা সুযোগ আমার ঘটেছিল এর অল্পকাল আগে। সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোককে তিনি বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মতবিনিময় ও নৈশভোজের জন্যে। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণরক্ষা কর্তব্যের শামিল–সুতরাং যাতায়াত-খরচ দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম।

গিয়ে দেখি, এলাহি কাণ্ড। বহু লোকের সমাগম। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী গেছেন একাডেমির কিছু প্রকাশনা সঙ্গে নিয়ে–গাড়ি থেকে সেসব নামাতেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যেরা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসেছেন। আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে এসব দেওয়া যাবে না। অনেক বয়স্ক মানুষ এসেছেন–চলাফেরা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হলেও।

রাষ্ট্রপতি বক্তৃতা দিলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে এবং দেশে-বিদেশে সেই স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে আহ্বান করলেন। তিনি আরো জানালেন, তিনিও একসময়ে সাহিত্যচর্চা করতেন এবং তারও একটি লেখার খাতা ছিল। এ-সময়ে মোহাম্মদ মোদাব্বের ব্যাকুলভাবে জানতে চাইলেন, খাতাটা এখনো তাঁর কাছে আছে কি না। তাঁকে হতাশ করে জিয়াউর রহমান বললেন, সেটা হারিয়ে গেছে। বক্তৃতার শেষে রাষ্ট্রপতি জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত ব্যক্তিদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে কি না। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বললেন, ‘রামপ্রাণ গুপ্ত, কেশবচন্দ্র গুপ্তের মতো হিন্দু লেখকেরা হজরত মুহম্মদ, ইসলামের ইতিহাস এবং ভারতে মুসলিম শাসন সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো বই লিখেছেন–সেসব বই এখন দুষ্প্রাপ্য। সরকার যদি বাংলাদেশে এসব বই পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন, তবে সকলে উপকৃত হবে। তার কথাটা জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেননি, সুতরাং বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশি–আপনি হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন তুলছেন কেন?’ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ নিজের কথাটা পরিষ্কার করতে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু এরই মধ্যে আর কেউ প্রশ্ন করে ফেললেন এবং আজরফ সাহেবের নিকটতম উপবিষ্টেরা তাঁকে সযত্নে বসিয়ে দিলেন। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে কিছু একটা বললেন। রাষ্ট্রপতি একটু কুপিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা-যুদ্ধ বলি–আপনি মুক্তিযুদ্ধ বলছেন কেন? আমার কিছুই বলার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এই ক্ষণটিতে আমি উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাননীয় রাষ্ট্রপতি, খবরের কাগজে পড়লাম, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করছেন। মুক্তিযুদ্ধ না হয়ে থাকলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি হচ্ছে কীভাবে? রাষ্ট্রপতি দৃঢ়ভাবে বললেন, আমরা স্বাধীনতা-যুদ্ধ বলি। আর অল্পক্ষণ এরকম মতবিনিময়ের পরে নৈশভোজের ডাক পড়ল। শুরু হয়ে গেল রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাবার প্রতিযোগিতা।

সে-বছরে ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা-দিবস না বলে সরকারিভাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল জাতীয় দিবস হিসেবে।

৫০.

১৯৮০ সালের কোনো এক সময়ে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের এক কর্মকর্তা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের পক্ষ থেকে তাঁকে ভারত-ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতে। তিনি সেই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ড. আনিসুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন না? কর্মকর্তা নিশ্চয় অপ্রতিভ হয়েছিলেন, তবে শিষ্টাচার বজায় রাখতে বলেছিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, ওঁকেও আমরা যথাসময়ে নিমন্ত্রণ করবো। রাজ্জাক সাহেব নিস্পৃহভাবে জানিয়েছিলেন, ওকে যখন নিমন্ত্রণ। করবেন, তখন আমাকে বলবেন; আমরা একসঙ্গে যাবো।

আমি তখন চট্টগ্রামে। এসব কথোপকথনের খবর পাই অনেক দেরিতে। আমাকে নিমন্ত্রণ করার আদৌ কোনো পরিকল্পনা আইসিসিআরের ছিল কি না, আমার জানা নেই। সারের কথায়, মনে হয়, তারা নড়াচাড়া শুরু করলেন। তারা সারকে নিতে চান, তবে এটাও বুঝলেন, তাঁর যাওয়ার শর্ত, সঙ্গে আমাকে নিতে হবে। এই অবস্থায় কিছু না করেও বোধহয় তারা পারলেন না। সুতরাং চট্টগ্রামে আমার কাছে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের একজন প্রতিনিধি এসে জানালেন, তাঁরা আমাকে ভারত-সফরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমি কবে যেতে পারবো, জানতে পারলে তারা বাধিত হবেন। আর হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও এই সফরে আমন্ত্রিত। রাজ্জাক সাহেব বলেছেন, তিনি আমার সঙ্গেই যাবেন। সুতরাং আমি অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে পরামর্শ করে যদি কর্মসূচি তৈরি করি, তাহলে আরো ভালো হয়। তারা কলকাতা, দিল্লি ও বোম্বাইতে আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করেছেন। অধ্যাপক রাজ্জাক তার অতিরিক্ত যেতে চান ত্রিবান্দ্রমে। সেখানে আমাকেও যেতে হবে। তাছাড়া অন্যত্র কোথাও যদি আমি যেতে চাই, তা যেন জানাই। তারা সেখানেও আমাদের দুজনের যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

সারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি আমন্ত্রণ-রহস্যভেদ করতে পারলাম। যথোচিত লজ্জিত হলাম। সার লজ্জার কোনো কারণ দেখলেন না। বললেন, উনি তো ওদের আমাকে দাওয়াত করতে বলেননি, উনি শুধু বলেছেন, আমার সঙ্গে যাবেন। তাদের সামনে সব পথই খোলা ছিল। চাইলে আমাকে নেমন্তন্ন না করলেও পারতো। উনি না গেলে যে ওদের খুব ক্ষতি হতো, তা তো নয়। ওঁর আসল ইচ্ছে, দিল্লিতে তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের দেখা পাওয়া। আর সুযোগ যদি হয়, তাহলে কেরালায় ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে তাঁর বন্ধুস্থানীয় ড. কে এন রাজের সঙ্গে দেখা করা। ভারতে তিনি তেমন কাউকে চেনেন না–আমার যেমন ভালো লাগে, তেমন প্রোগ্রাম করতে পারি। তিনি যে-কোনো জায়গায় যেতে প্রস্তুত, তবে কোথাও বক্তৃতা দিতে পারবেন না। আনুষ্ঠানিক হোক, লেখাপড়াসংক্রান্ত হোক–যেখানে যা বলার দরকার, আমাকেই বলতে হবে।

দিন-তারিখ ঠিক করেই হাই কমিশনকে জানালাম। বললাম, কলকাতায় একটু বেশি সময় থাকতে চাই এবং তার মধ্যে এক ফাঁকে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসতে চাই।

সপ্তাহতিনেকের সফর। ঢাকা থেকে দিল্লি। সার বাজার কুঁড়ে বড় মাপের দুটো ইলিশ মাছ নিয়েছেন তাঁর শিক্ষকের জন্যে। বিমানবন্দর থেকে আমি এক বোতল ব্ল্যাক লেবেল নিয়েছি কলকাতায় পৌঁছে বরুণ দে-কে দেবো বলে।

দিল্লিতে প্রথম সুযোগেই অমিয় দাশগুপ্তের বাড়িতে যাওয়া হলো। এইখানে তার একটু পরিচয় দেওয়া হয়তো প্রাসঙ্গিক হবে। অমিয়কুমার দাশগুপ্তের (১৯০৩-৯২) আদি বাড়ি বরিশাল জেলার গৈলায়। ১৯২২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণির বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি লাভ করে এখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগ আলাদা হয়ে গেলে তিনি অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অল্পকাল কটকের র‍্যাভেন শ কলেজে এবং দীর্ঘকাল বেনারসে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। একসময়ে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকও ছিলেন। আমরা যখন দিল্লিতে যাই, তখন তিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শেষজীবনে তিনি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন এবং শান্তিনিকেতনেই তার মৃত্যু হয়। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ ব্যাপক সমাদর লাভ করে। রাজ্জাক সাহেব তার ছাত্র ছিলেন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, পরে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে সহকর্মী হয়েছিলেন, বিভাগ ভাগ হয়ে গেলে তিনি অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যোগ দেন।

দিল্লিতে গুরুশিষ্যের মিলনের দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো। অমিয় দাশগুপ্ত সাগ্রহে আমাদের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। রাজ্জাক সাহেব তার পা ছুঁতেই তিনি যে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সে-আলিঙ্গন সহজে শেষ হয় না। অমিয়বাবুর স্ত্রী কাছে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে স্নেহের দৃষ্টিতে রাজ্জাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সার তাঁকেও পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। কুশল-বিনিময়ের পরে অমিয়বাবু জানালেন, তাঁর পুত্র পার্থসারথী লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্‌সে অধ্যাপনা করছেন, কন্যা অলকানন্দা বোম্বাইতে, জামাতা আই জি প্যাটেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নরপদের মেয়াদশেষে বোম্বাইতেই কী এক গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। আমরা কি বোম্বাই যাবো? তাহলে যেন অবশ্যই তাদের ওখানে যাই–তিনি ওদের বলে রাখবেন।

অমিয়বাবুর বাড়িতে আমরা একাধিক বেলা খেলাম। গল্পগুজব যা হলো, তাতে ঘুরেফিরে আসতে থাকলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের কথা। একটু পরপরই অতীত পুনরায় নতুন হতে থাকলো। আমি তাঁর ছাত্রের স্নেহভাজন হওয়ায় ছাত্রের প্রতি তার ভালোবাসার একটু ভাগ আমিও পেলাম। তাঁর মৃত্যুর অল্পকাল আগে শান্তিনিকেতনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নুরুল মোমেনের। অমিয়বাবু তাঁর কাছে যেভাবে আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাতে নুরুল মোমেনের প্রত্যয় জন্মেছিল যে, আমি প্রফেসর এ কে দাশগুপ্তের একজন প্রিয়পাত্র।

আমরা গেলাম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে–কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎকার করতে। জওহরলালে তখনো বোধহয় পার্থসারথী ছিলেন উপাচার্য–তিনি খুবই সহৃদয় মানুষ। আমাদের দেখা হলো শিক্ষামন্ত্রী নূরুল হাসানের সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল–তা কি ১৯৭৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় যখন সারুকে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধি দেয়, তখনকার, নাকি আরো আগে যখন তারা উভয়েই বিদেশে ছিলেন, তখনকার, ঠিক বলতে পারবো না। কথাপ্রসঙ্গে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস-সম্পর্কিত মানচিত্রমালার প্রশংসা করেছিলেন সার। নূরুল হাসান বললেন, ওটা আপনার ভালো লেগেছে? তাহলে আমাদের অ্যাটলাসটা আপনি দেখেন নি। সেটা শিকাগোরটার চেয়ে বহুগুণে ভালো। সার, মনে হয়, কথাটা স্বীকার করলেন না, তবে হয়তো। সৌজন্যবশতই এ-নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না।

ডি এস কোঠারি তখন উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কোনো উচ্চপদে আসীন। তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা রজনী কোঠারির সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভেও গেলাম। রজনী জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা-পর্ষদের সদস্য। আমি যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, তা তিনি জানতেন। তবে আমাদের প্রকল্প-পরিচালক আনোয়ার আবদেল মালেক ও তার মধ্যে বোধহয় যথেষ্ট প্রীতি ছিল না। সুতরাং একবারমাত্র ওই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে আমরা থেমে গেলাম। রাজ্জাক সাহেব সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। থাকলে তিনি যেভাবে নিজের বিদ্যা জাহির করেছিলেন, তা করতেন না।

দিল্লি থেকে আমরা ট্যাকসি করে জয়পুর গেলাম, সেই রাতেই আবার ফিরে এলাম। পথের দু পাশে বিস্তীর্ণ ফসলক্ষেত্রে কর্মরত নরনারীর বর্ণবহুল পরিধেয় অতি দৃষ্টিনন্দন। জয়পুরের রাজকীয় প্রাসাদগুলিও মনোমুগ্ধকর।

বোম্বাইতে আই জি প্যাটেলের বাড়িতে নৈশভোজ খাওয়া হলো–ভোেজ কয় যাহারে। শহরের বাইরে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস এবং শহরে নির্মীয়মাণ ক্যাম্পাস–দু জায়গায়ই গেলাম। মালাবার হিলসে জিন্নাহ্ যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা দেখা হলো। হোটেলের ডাইনিং হলের হোস্টেস মেয়েটি দেখতে খানিকটা শাবানা আজমির মতো। বয়স্ক মানুষ বলে রাজ্জাক সাহেবের খুব যত্নআত্তি করতো, স্বাভাবিকভাবে আমিও তার ভাগ পেতাম। সার কিন্তু কোনো কথাই তার সঙ্গে বলতেন না, খাওয়ার অর্ডারটাও আমাকে দিতে বলতেন। হোটেলে আমাদের শেষরাতে খাওয়ার সময়ে সার আমাকে বললেন মেয়েটিকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাতে। সে খুবই অভিভূত হলো। বললো, তার। অবস্থায় বাংলাদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, কিন্তু যদি কখনো তেমন সুযোগ হয়, অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আমাদের সহৃদয়তা তাকে খুব স্পর্শ করেছে।

ত্রিবান্দ্রমে কে এন রাজ খুব সমাদর করলেন। তার সেন্টারটা স্বয়ংসম্পূর্ণ–সেখানেই আমরা থাকলাম। অনেক গবেষক কাজ করছেন, গ্রন্থাগার খুব সমৃদ্ধ। রাজ্জাক সাহেব সেখানে বক্তৃতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সঙ্গে এক বৈঠকের আয়োজন করলেন কে এন রাজ। সেখানে রাজ্জাক সাহেবের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় নাম না করে শুধু সার বলতে আব্দুর রাজ্জাককেই বোঝায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে বলেছেন যে, তাঁর শাশুড়ি–যিনি কোনোদিন স্কুলে যাননি, তিনিও-ওঁকে সার বলে সম্বোধন করেন। সভায় তুমুল হাস্যধ্বনি ও করতালি।

ত্রিবান্দ্রম থেকে মাদ্রাজ যেতে হবে। বিমানবন্দরে যখন উড়োজাহাজে ওঠার ডাক পড়ল, সার আমার ব্যাগটি হাতে করে অগ্রসর হলেন। আমি তাঁকে বারংবার বলতে থাকলাম সেটা আমার হাতে দিতে, তিনি কর্ণপাত করলেন না। নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আমার ঠিক সামনে তিনি। একজন কর্মকর্তা তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে খুললো। ওপরেই স্কচ হুইস্কির বোতল দেখে সারের দিকে অর্থপূর্ণ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সে ব্যাগ বন্ধ করে দিলো। আমার খুবই রাগ হলো। ভর্ৎসনার সুরে সারুকে বললাম, আপনাকে বারবার বলছি আমার ব্যাগ আমার হাতে দিতে, আপনি কিছুতেই শুনলেন না। সার খুব নিস্পৃহভাবে জানতে চাইলেন, ক্যান, কী হইছে?’ বললাম, ‘দেখলেন না, লোকটা আপনার দিকে চেয়ে কীভাবে হাসলো? কী ভাবলো, বলেন তো!’ সার বললেন, ‘তায় কী হইলো? হার লগে আমার জীবনে দেখা হইবো নাকি?’ এরপরে আমি আর কী বলতে পারি!

মাদ্রাজে শুধু রাতটা হোটেলে কাটানো। পরদিন সকালে সমুদ্রোপকূলে কিছুটা গাড়িতে ঘোরা। খানিক পরই কলকাতা যাত্রা।

কলকাতায় হোটেলে পৌঁছে ফোন করলাম অনিরুদ্ধ রায়কে। ইংরেজিতে বললাম, আমি আলীগড় থেকে আসছি। পার্ক হোটেলে আছি। তারপর ওর সুপরিচিত এক মহিলার নাম করে বললাম, তিনি আমাকে আপনার ফোন নম্বর দিয়েছেন, আমার হাতে একটা চিঠিও দিয়েছেন। আপনি কি একবার আসতে পারবেন চিঠিটা নিতে? আমি তো কলকাতা ভালো চিনি না, নইলে নিজেই পৌঁছে দিতাম। অনিরুদ্ধ খুব ব্যগ্র হয়ে বললো, না না, আমিই আসবো। আপনার রুম নম্বরটা বলুন। আমি রুম নম্বর জানালাম। সে আবার বলতে বললো। বললাম। সে এবার বাংলায় বললো, ‘গলাটা চেনা মনে হচ্ছে।’

খানিক পর অনিরুদ্ধ এলো। খবর পেয়ে অনিল সরকারও এলো। আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। বরুণ দে-কে ফোন করে স্কচ-বার্তা জানালাম। স্থির হলো, হোটেলে থাকার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে আমরা কয়েকদিন থাকবো। আর সেন্টারে আমি একদিন বক্তৃতা দেববা ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির বাংলা চিঠিপত্র সম্বন্ধে।

কলকাতায় সারের দুই বন্ধু আছেন। অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ মাহমুদ ওরফে বাচ্চু মিয়া এবং তাঁর অনুজ, ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের কর্মকর্তা, আবদুল হাই মাসুদ ওরফে গেঁদু মিয়া। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র, তবে এ ডব্লিউ মাহমুদ বিশিষ্ট–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে তার খ্যাতি আকাশচুম্বী। সামাজিক ক্ষেত্রেও তার বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে থাকেন তিনি সঙ্গিনীকে নিয়ে। তাঁর বাড়িতে একাধিকবার যাওয়া হলো এবং যথারীতি খাওয়া-দাওয়া হলো। একরাতে এ এইচ মাসুদের কিমবার স্ট্রিটের বাসায় খেলাম এবং তার বিদুষী কন্যার সঙ্গে পরিচিত হলাম।

দিল্লিতে সার যেসব বইয়ের দোকানে গিয়েছিলেন, তা ছিল মূলত ইংরেজি বইয়ের দোকান এবং নতুন বইয়ের দোকান। পুরোনো দিল্লির বনেদি দোকান থেকে বেশ দাম দিয়ে পুরোনো ইতিহাস বইয়ের হাল পুনর্মুদ্রণ কিনেছিলেন। মনোহারলালের পুস্তক-তালিকায় নাম ছিল, কিন্তু দোকানে মজুদ ছিল না, এমন একটি বইয়ের দাম দিয়ে এসেছিলেন সকালে, ওরা বিকেলে সেটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালেই আমাদের দিল্লি ছাড়ার কথা ছিল। কলকাতায় এসে সার কিছু নতুন বা অনেকদিনের আগে প্রকাশিত বই কিনলেন এশিয়াটিক সোসাইটি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে। আমিও অল্পস্বল্প কিনলাম। তখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি দিলীপকুমার বিশ্বাস এবং সম্পাদক সরোজমোহন মিত্র। সৌভাগ্যক্রমে এক সন্ধ্যায় তাঁদেরকে পরিষদে পেয়ে গেলাম। উভয়েই আমাদের খুব সমাদর করলেন। সার অবশ্য ধারণা করলেন যে, সমাদরের লক্ষ্য আমি, তিনি উপলক্ষ মাত্র, তবে তা ঠিক নয়।

সার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন মফিদুল হকের সঙ্গে–ওদের যারা বই পাঠায় কলকাতা থেকে, তারা সেই চালানের সঙ্গে সারের পছন্দ-করা বই পাঠিয়ে দেবে। বইয়ের দামও ঢাকায় দেওয়া যাবে। তবে তাঁর সত্যিকারের অভিযান শুরু হলো পুরোনো বইয়ের সন্ধানে। এসব বইয়ের দোকানদারেরা সহজে তাদের সেরা সংগ্রহ দেখাতে চায় না। যখন বুঝতে পারে, খরিদদার সত্যি সমঝদার, তখনই কেবল সেসব বের করে। সারের পোশাক-পরিচ্ছদ, বাঙাল ভাষায় কথাবার্তা শুনে তারা প্রথমে গা করেনি, তারপর বইপত্র সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং মূল্য সম্পর্কে তার ধারণার পরিচয় পেয়ে তারা ক্রমশ উৎসাহী হয়ে উঠলো। সবচেয়ে আনন্দের কথা, একাধিক খণ্ডের একটি বইয়ের যে-খণ্ডটি ১৯৭১ সালে সারের বাড়ি থেকে খোয়া গিয়েছিল, সেটি তিনি কলকাতায় পেয়ে গেলেন।

হোটেল ছেড়ে আমরা যখন সেন্টার ফর দি স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে থাকছি, তখনই একদিন শান্তিনিকেতনে যাওয়া হলো। সুরঞ্জন দাশ-তখন শান্তিনিকেতনে থেকে গবেষণা করছে, এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-অনিল সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ। তার অভিভাবকত্ব মেনে আমরা শান্তিনিকেতনে গেলাম। কলকাতা থেকে এক গাড়িতে সার, আমি আর অনিল। সুরঞ্জন আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। অম্লান দত্ত তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তিনি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি, আমাকেও প্রীতির চোখে দেখেন। তিনি যথারীতি অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন। সুরঞ্জন আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখালো। পরদিন বিকেলের দিকে রওনা হয়ে রাতে কলকাতায় ফিরে এলাম।

এবার সেন্টারে আমার বক্তৃতার পালা। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিতব্য আমার Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records বইটির ভূমিকার খানিকটা অংশ সামনে খোলা রেখে বাংলায় বলে গেলাম। বক্তৃতা যেমনই হোক, শ্রোতার সংখ্যা ছিল আশাতীত। আমার বন্ধুদের অনেকেই এসেছিলেন। প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত। সকলেই আমার প্রতি দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছিলেন। তাই প্রশ্ন যা হয়েছিল, তার উত্তর দিতে পেরেছিলাম। রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে ভবতোষ দত্তের দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছিল। তাছাড়া, তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলী আরো অনেকে ছিলেন। সভার শেষে তাঁকে ঘিরে আড্ডা জমেছিল।

আমার ঘনিষ্ঠজন বরুণ দে, অনিল সকার ও অনিরুদ্ধ রায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সার খুব প্রীত হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, তাঁদের কালে বাঙালি হিন্দু সমাজে এমন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেনি–অন্তত তিনি লক্ষ করেননি। তিনি নিশ্চয় সে-সময়ে অনেক উদার ছাত্র-শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক যাদের সঙ্গে তাঁর এবার পরিচয় হলো, তাদের অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। তার মনে হয়তো এই কথাটি দেখা দিয়েছিল যে, তাদের কালে এমন উদারতা সর্বব্যাপী হলে দেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।

ভারত-ভ্রমণশেষে সানন্দিতচিত্তে আমরা দেশে ফিরে এলাম।

তারপর একদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সারের বাড়িতে গিয়ে দেখি, কলকাতা থেকে আমাদের বইপত্র এসে গেছে এবং যেসব বইয়ের দুটি করে কপি আছে, আমাদের এক তরুণ সহকর্মী তার থেকে একটি বেছে আলাদা করে রাখছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ডুপ্লিকেটগুলো আমার।’ তখন বোধহয় সারেরও খেয়াল হলো। অদম্য গবেষক বললো, ‘ঠিক আছে, আমি এগুলো দেখে নিয়ে আপনাকে ফেরত দেবো। তারপর যা হওয়ার তা হলো।

তারও বেশ কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের সেই কর্মকর্তা আমার কাছে জানতে চাইলেন আমাদের ভারতভ্রমণ কেমন হলো। বললাম, খুব ভালো। বন্দোবস্ত ছিল খুব ভালো, মানুষজন ছিলেন অতিথিপরায়ণ, দ্রষ্টব্য ছিল চিত্তচমঙ্কারী। তিনি একটু থেমে বললেন, ‘ফিরে এসে আপনারা কেউ আইসিসিআর-কে কিছু লিখে জানালেন না। তাই আমরা একটু চিন্তিত হয়েছিলাম।’

সারের তো চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। কিন্তু আমিও ভারতীয় হাই কমিশন বা আইসিসিআরকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু লিখিনি। ভদ্রলোকের কথায় লজ্জা পেলাম। মনে হলো, এখন লিখি। তারপর মনে হলো, এখন আর লিখে কী হবে, বড়ো দেরি হয়ে গেছে।

৫১.

১৯৮১ সালের ৩০ মে। আমার ভাগ্নি-জামাই কাজী আলী আফজাল চট্টগ্রাম শহর থেকে এসেছেন তার পরিচিত দুই ভদ্রলোককে নিয়ে। ক্যাম্পাসের বাসায় বসার ঘরে বসে কথা বলছি। ওঁরা চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। এরই মধ্যে ফোন এলো বিভাগ থেকে : সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে মধ্যরাত্রির পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কিছুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তার হাতে। ওইটুকু শুনেই শহরবাসীরা দ্রুত প্রস্থান করলেন। আমি চেষ্টা করলাম বেতারে খবর শুনতে।

ঢাকা আর চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষণা একরকম নয়। ঢাকা বেতার বলছে, কিছু দুষ্কৃতকারী সামরিক ব্যক্তি জিয়াকে হত্যা করেছে, এসব বিদ্রোহী সৈনিক ও সেনা-কর্মকর্তাদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে (সেইসঙ্গে মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়)। চল্লিশ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বেতার বলছে, রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন, এক বিপ্লবী পরিষদ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বেতারের কথায় কান না দিতে দেশবাসীকে অনুরোধ করছে ঢাকা বেতার। চট্টগ্রাম বেতার থেকে এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম সফররত নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান বিপ্লবী পরিষদের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন। পরে ঢাকা বেতার থেকে বলা হলো, তিনি একটি জাহাজযোগে ঢাকা রওনা হয়ে গেছেন। আরো পরে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে তিনিও সংবিধানমতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করলেন।

আমার মনে হলো, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ও তাঁর পরিবারের খবর নেওয়া দরকার। বেতারের প্রথম ঘোষণা শুনেই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ফোন করে কম্যান্ডেন্টের বাসায় সংযোগ দিতে অনুরোধ করলাম। টেলিফোন বেজে চলল, কেউ সাড়া দেয় না। বুঝলাম, বাড়িতে কেউ নেই। ভাবলাম, নিরাপদে থাকলেই হলো। পরে ভাবি ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তারা নিজেদের বাসস্থানে নেই, তবে নিরাপদে আছেন।

ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে হাটহাজারিতে গেলাম। থানায় পাওয়া গেল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কুদুসকে। তাঁকে খবরাখবর জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, বিপদের মধ্যে আছেন। শুধু রাষ্ট্রপতিই নিহত হননি, সেনাবাহিনীর হাই কম্যান্ডের সঙ্গে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বিরোধ লেগে গেছে এবং তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। গুজব, ঢাকা বা কুমিল্লা থেকে সেনাবাহিনীর ইউনিট রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের দিকে, চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য পাঠানো হয়েছে শুভপুর ব্রিজে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে।

ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি নিশ্চিত, ভারতের প্ররোচনায় এ-হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ভারতীয়রা সীমান্তের দিকে এগিয়ে এসেছে সংঘর্ষ বাধাবার জন্যে।

যে-সারিতে আমার বাসা, তার দক্ষিণের সারির প্রথম বাসাটি আমাদের উপ রেজিস্ট্রার (জনসংযোগ) আবু হেনা মোহাম্মদ মহসীনের। তার শ্যালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমানকে জানতাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এখন শোনা গেল, জিয়ার হত্যাকারীদের মধ্যে তিনি একজন। আরো শুনলাম, মিলিটারি জিপে করে আজই সকালে তিনি নাকি বোনের বাড়িতে এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্যে।

লোকমুখে ঘটনার দুটি প্রধান ভাষ্য দাঁড়িয়ে গেল। জেনারেল আবুল মনজুরের সঙ্গে কিছুকাল ধরে জিয়াউর রহমানের মনান্তর চলছিল। সামরিক গোয়েন্দারা রাষ্ট্রপতিকে চট্টগ্রামে রাত্রিযাপন করতে নিষেধ করেছিল, জিয়া তা শোনেননি। এ-দুটি বিষয় উভয় ভাষ্যেই ছিল। তারপর, এক ভাষ্য-অনুযায়ী, কিছুসংখ্যক বিক্ষুব্ধ সেনাকর্মকর্তা রাষ্ট্রপতিকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া তাদের এক দাবি; সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষমতার রদবদল ঘটানোও তাঁদের উদ্দেশ্য। তারা ভেবেছিলেন, অপহরণ করে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে তারা এসব কাজ করিয়ে নেবেন। কিন্তু তাঁদেরই মধ্যে এক সামরিক কর্মকর্তা মদোন্মত্ত হয়ে নিজের অস্ত্র দিয়ে জিয়াকে হত্যা করেন। এরপর তারা সবাই সেনানিবাসে ফিরে এসে জিওসি-কে সবকিছু জানান। মনজুর তাঁর কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করতে চান। সদর দপ্তর তাকে আত্মসমর্পণ করতে বললে তিনি অস্বীকার করেন এবং সেনাপ্রধানকে পদচ্যুত করার ঘোষণা দিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দাবি করে বসেন।

অপর ভাষ্য-অনুযায়ী, জেনারেল মনজুর উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষিত ও মার্জিত। তার কিছু ঘনিষ্ঠ অনুসারী আছে। তাদের দিয়ে জিয়া-হত্যা ঘটিয়ে তিনি ক্ষমতা অধিকার করতে চেয়েছিলেন। ঢাকার বাইরের অন্তত দুটি সেনানিবাসের প্রধানেরাও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার। এখন অবস্থা বেগতিক দেখে তারা চুপ করে গেছেন।

তৃতীয় একটি ভাষ্য-অনুযায়ী, এই খেলায় তৃতীয় একজন আছেন। তিনি কৌশলে জিয়াকে সরিয়েছেন, এখন মনজুরকে সরাবেন। তারপর দু-একজন উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তাকে অবসর দিয়ে, দেশের বাইরে পাঠিয়ে, সেনাবাহিনীতে প্রথমে, তারপর দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করবেন।

প্রশ্ন রয়ে যায়, মনজুর কি এতই অর্বাচীন যে, চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করলেই দেশের শাসনভার তার করায়ত্ত হবে বলে ভাবতে পেরেছিলেন? আবার এ-প্রশ্নও রয়ে যায় যে, তিনি কি এতই অপেশাদার যে, তাঁর অধীন কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি-হত্যার পরিকল্পনা করছেন আর তিনি কিছুই জানতে পারছেন না? তিনি হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব নিলেন, অথচ দোষীদের নিরস্ত করার কোনো প্রয়াস নিলেন না কেন? অথবা চট্টগ্রাম বেতার থেকে একবারও তিনি জাতির উদ্দেশে কিছু বললেন না কেন?

পরে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর কাছ থেকে যে-ঘটনাটি জেনেছিলাম, সেটা এখানে বিবৃত করা যায়।

ব্রিগেডিয়ার হান্নান ৩০ মে সকালে মনজুরের প্রতি বিশ্বস্ত সৈন্যদের দ্বারা আটক অবস্থায় ছিলেন। ৩১ তারিখে তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল মনজুরের অভিপ্রায়-অনুযায়ী তিনি ঢাকায় টেলিফোনে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল নূরউদ্দীন খানের সঙ্গে কথা বলেন। মনজুর তাঁর পাশে বসে ছিলেন; ঢাকায় নূরউদ্দীনের পাশেও আরো কেউ বসে ছিলেন। ঢাকার আত্মসমর্পণ-দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মনজুর আলোচনার প্রস্তাব দেন। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে জেনারেল ওয়াহিদসহ উচ্চপদস্থ দুজন সামরিক-কর্মকর্তা চট্টগ্রামে আসবেন বলেও কথা হয়। (তারা কি সমকক্ষ হিসেবে কথা বলতে আসছিলেন, না মনজুরকে বন্দি করে নিয়ে যেতে আসছিলেন, তা পরিষ্কার ছিল না।) টেলিফোনে কথা শেষ করার সময়ে হান্নান শাহ শুনতে পান, পাশের জন বলছেন, এখন পাখি ফাঁদে পড়েছে। এই কণ্ঠস্বর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বলে হান্নান শাহর মনে হয়েছিল।

ততক্ষণে অবশ্য মনজুরের অবস্থা সত্যি খারাপ হয়ে এসেছে। ৩০ মে তাঁকে এবং আরো কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদচ্যুত করা হয়। সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে তার নাম করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। মনজুরের ঘোষিত সান্ধ্য আইন সত্ত্বেও ৩১ তারিখে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জিয়ার গায়েবি জানাজায় বিপুল জনসমাগম হয়। আওয়ামী লীগের সদ্যনির্বাচিত সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রধানেরাই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এতে মনজুরের না থাকে জনসমর্থন, না থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। চট্টগ্রামের বাইরে যেসব সামরিক ইউনিট তিনি পাঠিয়েছিলেন, তার কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ পালিয়ে যান। তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন, সেনানিবাসের অভ্যন্তরেও তাঁর প্রতি সমর্থন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ৩১ মে রাতেই তিনি সপরিবারে সেনানিবাস ত্যাগ করে উত্তরের দিকে চলে যান।

৩১ তারিখে দিনেই আমরা জানতে পারি যে, জিয়াউর রহমানের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় নিহত হন তার প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল মইনুল আহসান এবং তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খান। এঁরা উভয়েই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা-কর্নেল মইন ছিলেন বীরপ্রতীক আর ক্যাপ্টেন আশরাফ রক্ষী বাহিনীর সাবেক অফিসার। তাঁদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের কয়েকজন সদস্য এবং পুলিশের একজন সদস্যও নিহত হন।

জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গীদের মধ্যে মন্ত্রী ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৩০ তারিখ ভোরেই সার্কিট হাউজ থেকে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকেন শহরে। আরেক মন্ত্রী ডা. আমিনা রহমানকে সার্কিট হাউজ থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান চট্টগ্রামের এনডিসি নাসিরুদ্দীন আল মাসুদ। নাসির ও তার স্ত্রী কণার (আমার বন্ধু গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদের ছোটো বোন) মুখে পরে আমরা সে-বৃত্তান্ত জানতে পারি।

১ জুন মানিকছড়ির এক চা-বাগানে দুপুরের খাওয়ার খাওয়ার সময়ে জেনারেল মনজুর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার করে তাঁকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের কিছু সময়ের জন্যে হাটহাজারি থানায় এনে রাখা হয়। শোনা যায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কুদুসকে মনজুর বারবার অনুরোধ করেছিলেন তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার জন্য। কুদুস সেকথা শোনেননি, তিনি সেনা-কর্মকর্তাদের হাতেই মনজুরকে তুলে দেন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে আসেন সেনানিবাসে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সামনেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বলা হয়, জিয়া-হত্যায় বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ সেনারা মনজুরকে হত্যা করেছে। কুদুস পরে ঢাকায় মতিঝিল থানায় বদলি হন। সরকারি কর্ম ত্যাগ করে আরো পরে তিনি দেখা দেন বিশিষ্ট শিল্পপতিরূপে।

মনজুরের সঙ্গে আরো দু-একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। এঁদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও কর্নেল মাহবুব দুজনেই মানিকছড়ির কাছেই নিহত হন। জীবদ্দশায় ধরার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এঁদেরকে হত্যা করা হলো কেন এবং মনজুরকে বাঁচিয়ে রেখে জিয়া-হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা হলো না কেন, এ-প্রশ্ন বহুজনকে আলোড়িত করেছে। আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান একবার এক সামরিক কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, দেশের প্রেসিডেন্টকে মারা আপনাদের প্রেরোগেটিভ, কিন্তু প্রেসিডেন্ট-হত্যার দায়ে অভিযুক্ত লোককে বেসামরিক বাহিনী ধরে দিলোতাকে আপনারা কোন অধিকারে মারলেন?’ ওই কর্মকর্তা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওই স্থান ত্যাগ করেছিলেন।

১ জুন রাঙ্গুনিয়ায় জিয়ার কবর খুঁজে পাওয়া যায়। সেখান থেকে তাঁর দেহাবশেষ তুলে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই হেলিকপ্টারেই ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. আমিনা রহমান। ঢাকায় ফেরেন। শেরে বাংলা নগরে বিশাল জানাজার পরে জিয়ার দেহাবশেষ সমাধিস্থ হয়।

এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য/স্বাধীনতার প্রথম দশক (ঢাকা, ২০০০) বইতে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন যে, জিয়া-হত্যার সংবাদ পেয়েই সেনাবাহিনী-প্রধান জেনারেল এরশাদ ‘পরোক্ষ ইঙ্গিতে সামরিক আইন জারির কথা বললেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা করতে তাঁকে। আরো প্রায় দশ মাস অপেক্ষা করতে হয়। আপাতত তাঁর নির্দেশে মেজর জেনারেল মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে এক তদন্ত কমিটি গঠিত হয় চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহ সম্পর্কে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে। এই কমিটি ৩৫ জন সেনা-কর্মকর্তাকে কোর্ট মার্শাল করার সুপারিশ করেন। মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে গঠিত একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালে ২৯ জন অভিযুক্ত হন। কোর্ট মার্শালে বাদীপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নাজিরুল আজিজ চিশতী ও কর্নেল এ এম এস এ আমিন। আসামিপক্ষকে। সমর্থন করার জন্যে সেনা-কর্তৃপক্ষ যে-তিনজনকে মনোনীত করেন, তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার হোসেন, কর্নেল মুহম্মদ আইনুদ্দীন ও লেফটেনান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর (ঢাকা, ১৯৯৯) বইতে মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম লিখেছেন যে, ‘বিচার প্রক্রিয়াটি অতি সংক্ষিপ্ত ছিল এবং হঠাৎ করে শেষ হয়েছিল। বিচারে ১৩ জন কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড এবং আরো ১৪ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তেরা সবাই এবং কারাদণ্ডপ্রাপ্তেরা প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সর্বকনিষ্ঠ ছিল ক্যাপ্টেন জামিল হক–আমার বন্ধু এ জেড এম আবদুল আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কারাদণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন মেজর লতিফ–আমার ছাত্রী শিরিণ আখতারের স্বামী।

কোর্ট মার্শালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা রুজু করা হয়। আবেদনকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এম এইচ খোন্দকার, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, খন্দকার মাহবুবউদ্দীন আহমেদ, ড. এম জহির, গাজীউল হক ও জাকের আহমদ। সরকারপক্ষে দাঁড়ান অ্যাটর্নি জেনারেল কে। এ বাকের, তাঁর সঙ্গে আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া, সোহরাব আলী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম এম হক ও বি হোসেন। তিনদিন শুনানির পরে বিচারপতি ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি লতিফুর রহমানকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ মামলা খারিজ করে দেন। তাঁরা বলেন, কোর্ট মার্শালের বিরুদ্ধে রিট আবেদন গ্রহণের এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। সেখানে আবেদনকারীদের পক্ষে যোগ দেন ড. কামাল হোসেন ও সিরাজুল হক। পাঁচদিন শুনানির পরে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি রুহুল ইসলাম, বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ আপিল প্রত্যাখ্যান করেন মূলত এখতিয়ারের প্রশ্নেই।

মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের প্রাণরক্ষার দাবিতে তাঁদের স্বজনরা অনশন করেন। ২২ সেপ্টেম্বর আপিল আদালতের রায় ঘোষিত হলে ঢাকায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়, ঢাকার বাইরেও প্রতিবাদ করা হয়। পরে আওয়ামী লীগসহ বহু রাজনৈতিক দল

মৃত্যুদণ্ডদানের নিন্দা করে। অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করার প্রার্থনা অস্থায়ী। রাষ্ট্রপতি না-মনজুর করেন। দেশের বিভিন্ন কারাগারে ২২ সেপ্টেম্বর রাতেই ১২ জন সামরিক কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আরেকজনের ফাঁসি বিলম্বিত হয় তিনি তখন চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে। ক্যাপ্টেন জামিলের পিতা ছিলেন তখন ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ প্রিজনস। শোনা যায়, পুত্রসহ ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার নির্দেশ তাঁকেই স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। কারাদণ্ডে দণ্ডিত কর্মকর্তাদের শাস্তি পরবর্তীকালে লাঘব করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন।

জিয়া-হত্যার তদন্ত হয়নি, সুতরাং সে-রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তদন্ত, বিচার ও শাস্তি যা হয়েছিল, তা সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের কারণে। বহু বৎসর পরে মনজুর-হত্যার জন্যে তাঁর ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর জেনারেল এরশাদকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। নানা কারণেই বাদীপক্ষ সে-মামলা ঠিকমতো চালাতে পারে নি। তবে মামলাটি এখনো বিচারাধীন।

যশোরের জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে জিয়া-হত্যার পরপর সদর দপ্তরে বদলি করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই অবসর দিয়ে মিশরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। জেনারেল মইন লিখেছেন, মেজর জেনারেল আবদুস সামাদের নেতৃত্বে গঠিত একটি বোর্ডের মাধ্যমে ‘আরো প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা নন, এমন কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ অবসরপ্রাপ্ত হন। নিজের অবস্থা সম্পর্কে জেনারেল মইন লিখেছেন :

যেহেতু আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল তাই নিয়ম অনুসারে আমার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা। অথচ, আমাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে না জানিয়ে এবং না জড়িয়ে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ভেঙে ওইসব কোর্ট মার্শাল ও তদন্ত করা হয়। এদিকে আমার পেছনে সর্বক্ষণ গোয়েন্দা। আমার টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা বাসাতে আমার চালচলন পর্যবেক্ষণের জন্য সামরিক গোয়েন্দারা গাড়িতে ওয়ারলেস লাগিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এক পর্যায়ে একদিন আমি গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক পাহারায় অতিষ্ঠ হয়ে টেলিফোনে খুব রূঢ় ভাষায় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী (পরে। এরশাদের মন্ত্রী) ও সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদকে বিষয়টি অবহিত করি। তারা দুজন এমন ভান করলেন যেন তাদের অজান্তেই আমার ওপর নজরদারি হচ্ছে। বস্তুত তাঁদের অজান্তে এমনটি হবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

১৫ নভেম্বর দেশে রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি সাত্তার যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, সেজন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। বিএনপি প্রার্থী হিসেবে তিনি পান এক কোটি ৪২ লাখের ওপর ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবং অন্যদের দ্বারা সমর্থিত ড. কামাল হোসেন পান প্রায় ৫৭ লাখ ভোট। হাফেজজী হুজুর পান চার লাখের কাছাকাছি। জেনারেল ওসমানী পান তিন লাখের কিছু বেশি। মেজর জলিল পান প্রায় আড়াই লাখ। ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ পান প্রায় সোয়া দুই লাখ।

নাগরিকদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন একটি বিবৃতি দিয়ে কামাল হোসেনকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম।

জেনারেল এরশাদ প্রায় প্রকাশ্যেই বিএনপি প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। নির্বাচনে বড়রকম কারচুপি হয়। চট্টগ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে যখন ভোটগণনা চলছিল, তখন বেতার-টেলিভিশনে সেই কেন্দ্রের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *