কয়লা-বালতির সওয়ারি

কয়লা-বালতির সওয়ারি

সব কয়লা শেষ; কয়লার বালতি শূন্য; কয়লার বেলচাটার এখন আর কোনো মানে নেই; উনান থেকে বেরোচ্ছে হিম; ঘরটা জমে যাচ্ছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় জানালার বাইরের গাছগুলো বরফ পড়ে পাথর; ওপরে খোদার কাছ থেকে যদি কেউ সাহায্য চাইছে তো আকাশ তার জন্য হয়ে আছে ধাতব ঢাল। কয়লা আমাকে পেতেই হবে; ঠান্ডায় জমে আমি মরতে পারি না; আমার পেছনে নির্দয় উনানটা, আমার সামনে একই রকম নির্দয় আকাশ; তাই আমাকে জলদি এ দুয়ের মধ্যে ভেসে পড়তে হবে, আর এদের মধ্যেখানে যে কয়লা-ব্যাপারী, তার কাছে সাহায্য চাইতে হবে। কিন্তু আমার রোজকার কান্নাকাটিতে তার তো মন গলবে না একটুও; তার কাছে আমাকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে হবে যে আমার কাছে কয়লার আর একটা গুঁড়ো পর্যন্ত নেই, আর সেজন্যই তিনি এখন আমার কাছে আকাশের সূর্যদেবতার সমার্থক। তার দরজায় গিয়ে আমাকে হাজির হতে হবে সেই ভিখারির মতো, যে গলায় মরণের ঘর্ঘর আওয়াজ তুলে গিয়ে দাঁড়ায় গেরস্তের বাড়ির সামনে, বলে মারা যাচ্ছে এখনই, এতে করে ঐ বিরাট বাড়ির রান্নার মেয়েটা শেষে রাজি হয় তাকে কফিকাপের তলানিটুকু দিয়ে দিতে; আমি চাচ্ছি ঐ একই রকম বিবেচনা থেকে কয়লা-ব্যাপারী, খেপে গেলে যাক, তবু নরহত্যা কোরো না’ এই ঐশ্বরিক আদেশে উদ্দীপ্ত হয়ে আমার কয়লা-বালতিতে ছুঁড়ে দেবেন এক বেলচা কয়লা।

আমি কীভাবে গিয়ে হাজির হচ্ছি, তার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু; সুতরাং আমি চড়ে বসলাম আমার কয়লা-বালতিতে। কয়লা-বালতির সওয়ারি হয়ে, বালতির হাতলের ‘পরে হাত রেখে– এর চেয়ে আর সহজ কোনো লাগাম হয় না– আমি বেশ খানিকটা কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম; তবে নিচে নামার পরে আমার বালতি ওঠা শুরু করল ওপরে, চমৎকার, চমৎকারভাবে; মাটিতে আসন গেড়ে বসা উটেরা তাদের চালকের ছড়ির নিচে কাঁপতে কাঁপতেও এর চেয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে পারে না। বরফে ঢাকা রাস্তাগুলো বেয়ে আমরা চলতে লাগলাম এক ছন্দের দুলকি চালে; প্রায়ই আমি উঠে যাচ্ছি বাড়িগুলোের একতলা সমান উঁচুতে; একবারও নামছি না বাড়িগুলোর সামনের দরজার উচ্চতায়। তারপরে একটা অস্বাভাবিক উচ্চতায় আমি ভেসে থাকলাম কয়লা-ব্যাপারীর বাড়ির বেজমেন্টের সামনে, ওখানে অনেক নিচে তিনি তার ছোট টেবিলটাতে পড়ে আছেন গুটিসুটি মেরে, লিখছেন; ঘরের ভেতরের অতিরিক্ত তাপটা বের করে দিতে খুলে রেখেছেন দরজা।

‘কয়লা-ব্যাপারী!’ আমি চিৎকার দিলাম, চরম ঠান্ডায় নিঃসাড় হওয়া এক গলায়, আমার শ্বাসের পুঞ্জ মেঘের মধ্যে মুড়ে গিয়ে, দয়া করুন গো কয়লা-ব্যাপারী, আমাকে একটুখানি কয়লা দিন। আমার কয়লা-বালতি এতই খালি যে আমি এখন ওটাতে চড়ে বসতেও পারছি। একটু দয়া করুন। যত শিগগির পারি আমি এর দাম মিটিয়ে দেব।’

কয়লা-ব্যাপারী হাত রাখলেন তার কানের ওপরে। কেউ কি কিছু বলল? কাঁধ বাঁকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তার স্ত্রীকে, মহিলা উনানের দিকে পিঠ ফিরিয়ে তার আসনে বসে উল বুনছেন। কিছু শুনলাম মনে হচ্ছে? কোনো কাস্টমার নাকি?

‘আমি তো কিছুই শুনিনি, তার স্ত্রী বললেন, উল বুনতে বুনতে কী প্রসন্ন মনে শ্বাস ফেলে চলেছেন, ওনার পেছন দিকটা কত সুন্দর গরম হয়ে আছে।

‘হ্যাঁ, তাই,’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, এই যে আমি; আপনার পুরোনো এক কাস্টমার; বিশ্বস্ত ও স; স্রেফ অল্প কদিনের জন্য হাত একদম খালি।

‘বউ,’ ব্যাপারী বললেন, ‘কেউ এসেছে, অবশ্যই কেউ; পুরোটা আমার কল্পনা হতে পারে না; এত আপন করে ডাকছে, তখন নিশ্চয় আমার কোনো পুরোনো, অনেক পুরোনো কাস্টমার হবে।

‘তোমার সমস্যা কী, বলো তো?’ জিগ্যেস করলেন তার স্ত্রী, একটুর জন্য থেমে উলের কাজটা বুকের কাছে চেপে ধরে, কেউ আসেনি, রাস্তাঘাট ফাঁকা, আমাদের সব কাস্টমারকেই কয়লা দেওয়া হয়ে গেছে। এখন আমরা বেশ কদিনের জন্য দোকান বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে পারি।

‘কিন্তু এই যে, আমি তো এখানে উপরে আমার কয়লা-বালতিতে বসে আছি, আমি কেঁদে ফেললাম, আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে নির্দয় ঠান্ডায় জমে যাওয়া অশ্রুতে, ‘একটু দয়া করে একবার এই ওপরে তাকান; তাহলেই আমাকে দেখতে পাবেন; আমি আপনার কাছে মাত্র এক বেলচা কয়লা ভিক্ষা চাচ্ছি; আর যদি দুই বেলচা দেন তো খুশিতে কী যে হব! অন্য সব কাস্টমাররা তো তাদের কয়লা পেয়ে গেছেন, নাকি? ওহ্, যদি এক্ষুনি আমার বালতিতে কয়লা পড়ার ঠনঠন শব্দটা শুনতে পেতাম!

‘আমি আসছি,’ বললেন ব্যাপারী, তার খাটো দুপায়ে বেজমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলেন, কিন্তু তার স্ত্রী ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন, তার হাত ধরে ফেলেছেন আর বলছেন: ‘ওখানেই থাকো। এমন যদি গোঁয়ারের মতো করো তো আমি নিজেই যাচ্ছি। কাল রাতের বিশ্রী কাশিটা একবার মনে করে দেখো। তার পরও শুধু একটু ব্যবসার লোভে, যদিও বলছি এটা স্রেফ তোমার কল্পনাই, তুমি কিনা তোমার বউ-বাচ্চার কথা আর নিজের ফুসফুসের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য তৈরি! আমিই যাচ্ছি।’

‘ঠিক আছে, তাহলে তাকে কিন্তু আমাদের কাছে মজুত সব রকম কয়লার কথাই বোলো; তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমি জোরে জোরে দাম বলে যাব।’

‘ঠিক আছে,’ বললেন তার স্ত্রী, আর সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন রাস্তায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তক্ষুনি আমি তার চোখে পড়ে গেলাম।

‘ম্যাডাম কয়লা-সওদাগর,’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, আমি আপনার অধম সেবক, শুধু এক বেলচা মাত্র কয়লা; সোজা আমার এই বালতিতে; আমি নিজেই বাড়ি বয়ে নিয়ে যাব; আপনার সবচেয়ে পচা মানের কয়লার একটা বেলচা মাত্র। আপনাকে পুরো দামই দেব, নিশ্চিত থাকুন, তবে ঠিক এখন না, ঠিক এখন না। কীরকম মৃত্যুঘণ্টার মতো শোনাল আমার ঠিক এখন না’ কথাটা, আর কীরকম গুলিয়ে-টুলিয়ে ওটা মিশে গেল কাছের কোনো গির্জার চূড়া থেকে আসা সন্ধ্যার সুরেলা ঘণ্টার সঙ্গে!

‘তা চাচ্ছেটা কী সে? ব্যাপারী চিল্লিয়ে উঠলেন।

‘কিছু না, তার স্ত্রী ওনার দিকে চিৎকার করে বললেন, এখানে কিছু নেই; আমি কিছুই দেখছি না, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না; শুধু ছয়টা বাজার ঘণ্টা পড়ছে, দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। কী ভয়ংকর ঠান্ডা; কাল মনে হয় আমাদের আজকের চাইতেও বেশি কাজ পড়বে।

তিনি কিছুই দেখলেন না, কিছুই শুনলেন না; কিন্তু তাতে কী? তিনি ঠিকই তার অ্যাপ্রনের ফিতা খুলে নিয়েছেন আর আমাকে অ্যাপ্রনটা দিয়ে তাড়িয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। হায়, তিনিই সফল হলেন। আমার কয়লা-বালতির সব গুণই আছে একটা তেজি ঘোড়ার যা যা থাকে, কিন্তু কোনোকিছু রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এর নেই; বেশি হালকা এটা, কোনো মহিলার অ্যাপ্রনই যথেষ্ট এর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে নিতে।

‘ওই বদমাশ বেটি, চলে যেতে যেতে আমি চিৎকার করে বললাম, তখন তিনি দোকানের দিকে ঘুরে বাতাসে একটা হাত নেড়ে যাচ্ছেন, অর্ধেকটা অবজ্ঞায়, অর্ধেকটা। তৃপ্তিতে, ‘ওই বদমাশ বেটি। আমি তোর কাছে সবচেয়ে খারাপ কয়লার একটামাত্র বেলচা চাইলাম আর তুই দিলি না!’ এ কথা বলে আমি উঠে গেলাম হিমবাহদের দেশে আর হারিয়ে গেলাম চিরতরে।

——

কাফকার প্রকাশিত গল্পটি এখানে শেষ হয়, কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপিতে গল্পটি কাফকা শেষ করেছিলেন নিচের প্যারাগ্রাফটি যোগ করে। বিস্তারিত জানতে পরিশিষ্ট (পৃ.৪৪০) দ্রষ্টব্য:

এই হিমবাহ ভরা পর্বতের দেশটা নিচের ঐ বরফঢাকা পৃথিবীর চেয়ে কি উষ্ণ না? চারদিকে সবকিছু সাদা হয়ে আছে, শুধু আমার বালতিটাই যা কালো রঙের। এর আগে আমি অনেক উঁচুতে ভেসে থাকলেও এখন আছি অনেক নিচে; আমি ঘাড় লম্বা করে ওপরে তাকালাম পর্বতমালার দিকে। বরফের একটা ত ষার-সাদা পাতলা খণ্ড এখানে-ওখানে ফেটে আছে অদৃশ্য স্কেটারদের পায়ের চাপে। আমার এজন্যে এক ইঞ্চিও দাবছে না, এমন পুরু বরফের ওপর আমি চলতে লাগলাম ছোট মেরু অঞ্চলের কুকুরের পায়ের চিহ্ন ধরে। আমার কয়লা-বালতিতে চড়ার এখন আর কোনো অর্থ নেই। তাই আমি নেমে পড়েছি আর বালতিটা বয়ে চলেছি আমার কাঁধের ‘পরে ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *