রায়

রায়

ভরা বসন্তের দিনে এক রোববারের সকাল। গেয়র্গ বেডেমান, এক তরুণ ব্যবসায়ী, নদীর পাশে লম্বা সারি বেঁধে দাঁড়ানো ছোট হালকা গাঁথুনির বাড়িগুলোর একটার প্রথম তলায় তার নিজের ঘরে বসে আছে। উচ্চতা আর রঙের ভিন্নতা বাদ দিলে বাড়িগুলো সব দেখতে প্রায় একই রকম। তার এক পুরোনো বন্ধুর উদ্দেশে একটা চিঠি সে মাত্র লেখা শেষ করেছে। বন্ধুটা বর্তমানে বাস করছে বিদেশে। ওটা হাতে নিয়ে খেলার ছলে ধীরে সে খামে ভরল, আর তারপর তার লেখার টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে জানালার বাইরে তাকাল– নদী, সেতু আর নদীর ওপারে হালকা সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে।

তার মনে পড়ল, বেশ কত বছর আগে তার এই বন্ধু কীভাবে নিজের দেশে সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে আশাভঙ্গ হয়ে একরকম দৌড়ে পাড়ি জমিয়েছিল রাশিয়ায়। এখন সে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটা ব্যবসা করছে। তার ব্যবসার শুরুটা হয়েছিল খুব ভালোই, কিন্তু আজ বেশ অনেকদিন যাবৎ মনে হয় ভালো যাচ্ছে না। তেমনই সে সব সময় অসন্তোষ নিয়ে বলত তার আস্তে আস্তে দুর্লভ হয়ে উঠতে থাকা বাড়িতে বেড়াতে আসার দিনগুলোয়। ওইখানে পড়ে আছে সে; বিনা কারণে কোনো অচেনা-অজানা দেশে বসে নিঃশেষ করছে নিজেকে। তার বিদেশি চেহারার গালভর্তি দাড়ি গেয়র্গের সেই ছোটবেলা থেকে খুব ভালো করে চেনা মুখটা পুরোপুরি লুকাতে পারেনি; আর তার চামড়ার হলদে ভাবটা যেন জানান দিচ্ছে কোনো লুকিয়ে থাকা অসুখের। তার নিজের কথামতেই, ওখানে বাস করা স্বদেশি লোকজনের সঙ্গে তার সত্যিকারের কোনো যোগাযোগ কখনোই ছিল না, আর রাশিয়ান পরিবারগুলোর সঙ্গেও কোনো সামাজিক মেলামেশা বলতে গেলে সে একেবারেই করে না। সুতরাং সারা জীবন চিরকুমার থেকে যাওয়ার ব্যাপারে নিজেকে তৈরি করে নেওয়া ছাড়া তার তেমন কোনো বিকল্পও নেই।

ওই রকম একটা লোকের কাছে লেখার থাকেই বা কী, যে কিনা আসলেই পথ হারিয়েছে, আর যার জন্য শুধু দুঃখই করা যায়, কিন্তু যাকে সাহায্য করার কোনো সুযোগই নেই? তাকে কি আসলে দেশে ফিরে আসতেই বলা উচিত –এখানে এসে ব্যবসাটা আবার শুরু করো, পুরোনো সব বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগটা চালু করো (তাতে তো সমস্যার কিছু নেই), আর তারপর বাকিটা ছেড়ে দাও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতার ওপর? কিন্তু এই কথাগুলো বলার অর্থ তো এটাই দাঁড়াবে (আর যত দ্রভাবে বলা হবে, ততই আঘাত আরো বাড়বে) যে তার এই পর্যন্ত নেওয়া সমস্ত চেষ্টাই বিফলে গেছে; তার উচিত এখন ওসব ছেড়েছুঁড়ে ঘরে ফিরে আসা, তারপর স্থায়ীভাবে-দেশে-ফেরত এক উড়নচণ্ডী হিসেবে সবার হাঁ-করা দৃষ্টির সামনে ছোট হওয়া, আর এটা স্বীকার করা যে শুধু তার বন্ধুরাই বুঝেছে জীবনে কী করে সফল হতে হবে, আর সে ছিল আসলে এক বয়স্ক খোকা, যার কিনা এখন শুধু তা-ই করা উচিত, যা তার সফল বন্ধুরা (যারা দেশে থেকে গিয়েছিল) তাকে করতে বলছে। তা ছাড়া এরই বা নিশ্চয়তা কী যে তাকে এই যন্ত্রণাগুলো দিলে আদৌ সত্যিকারের কোনো কাজ হবে? এই সম্ভাবনা আছে যে, তাকে আদতে দেশে ফিরিয়ে আনাটাই সম্ভব হবে না কখনো– সে নিজেই বলেছে ঘরের সঙ্গে তার সব সুতোই ছিঁড়ে গেছে চিরতরে। ফলে দেখা যাবে, সে রয়ে গেল সেই দূর বিদেশেই; মাঝখান থেকে বন্ধুদের সঙ্গে –তাদের উপদেশে তিক্ত হয়ে –দূরত্বটাই বেড়ে গেল আরো। আর ধরা যাক, সে সত্যিই তাদের উপদেশ শুনল, কিন্তু দেশে ফিরে– কারো কোনো ক্ষতিসাধনের ইচ্ছা থেকে নয়, বরং স্রেফ পরিস্থিতির কারণেই –হয়ে পড়ল বিষাদগ্রস্ত দেখা গেল, না পারছে তার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে, না পারছে তাদের ছাড়া চলতে, নিজেকে সব সময় বোধ করছে অপমানিত, শেষমেশ সত্যিকার অর্থেই হয়ে দাঁড়াল ঘরহীন আর বন্ধুহীন একজন মানুষ –সে ক্ষেত্রে এটাই কি বরং তার জন্য অনেক বেশি ভালো হয় না যে, বিদেশে যেখানে আছে, সেখানেই সে থেকে যাক? এই সবকিছু বিবেচনায় নিলে সত্যিই কি এমনটা ভাবা যায় যে, সে দেশে ফিরে আদৌ জীবনে কোনোকিছু করতে পারবে?

এ সমস্ত কারণেই এই বন্ধুকে –ধরলাম যে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো ইচ্ছা আদৌ আছে –সেই সত্যি কথাটুকুও বলা যায় না, যা কিনা সবচেয়ে দূরের কোনো পরিচিতজনকেও নিঃসংকোচে বলা সম্ভব। এখন প্রায় তিন বছরেরও বেশি হয়ে গেছে তার এই বন্ধু শেষবার দেশে এসেছে। এর কারণ হিসেবে সে খোঁড়া এক অজুহাত তুলে ধরেছে যে রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা অনিশ্চিত –এতটাই অনিশ্চিত যে তার মতো এক খুদে ব্যবসায়ীর পক্ষে ওখান থেকে একটুকুও অনুপস্থিত থাকা সম্ভব নয়, ওদিকে কিনা হাজার হাজার রাশিয়ান মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দুনিয়াময়। ঠিক এই গত তিন বছরেই, অন্যদিকে, গেয়র্গের নিজের জীবন বদলে গেছে অনেকখানি। দুই বছর আগে মারা গেছেন। গেয়র্গের মা –তখন থেকেই গেয়র্গ আর তার বাবা আছেন একা বাসাতেই। সেই খবর ঠিকই পৌঁছেছে তার বন্ধুর কাছে, উত্তরে সমবেদনার যে শুকনো চিঠি পাঠিয়েছে তার বন্ধু, তাতে স্রেফ এটাই পরিষ্কার হয় যে, ওরকম একটা ঘটনার বেদনা কারো পক্ষে দূর বিদেশে বসে অনুভব করা অসম্ভব। যা-ই হোক, তার পর থেকেই গেয়র্গ আরো দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শুধু নিজের ব্যবসাই না, অন্য সবকিছুতে ও মন দিয়েছে। হতে পারে, মা বেঁচে থাকতে তার বাবা, নিজের মতো করে ব্যবসা চালাবেন এই গো থেকে গেয়র্গকে ব্যবসায় কোনো স্বাধীনতা দেননি। হতে পারে, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তার বাবা– যদিও ব্যবসাটাতে সক্রিয়ই আছেন –নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন পর্দার আড়ালে; হতে পারে (এটার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি) পর পর ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটা অনুকূল ঘটনার ভূমিকাই এতে সব থেকে মুখ্য। যেটাই হোক, এই গত দুই বছরে তাদের ব্যবসা সবচেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে, কর্মচারীর সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হয়েছে, বেচা-বিক্রি বেড়েছে পাঁচ গুণ, আর সামনের দিনগুলোয় আরো উন্নতি ঘটার সম্ভাবনা খুবই পরিষ্কার।

কিন্তু এই পরিবর্তন সম্বন্ধে গেয়র্গের বন্ধুর কোনো ধারণা নেই। আগে– শেষবার সম্ভবত মায়ের মৃত্যুতে লেখা সেই সমবেদনার চিঠিটাতে– সে চেষ্টা করে ছিল গেয়র্গকে রাশিয়ায় পাড়ি জমানোয় রাজি করাতে, সেন্ট পিটার্সবার্গে যে ঠিক গেয়র্গের লাইনের ব্যবসা সফলভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেটা বিশদ বোঝাতে। তার ব্যবসার বর্তমানের ব্যাপ্তির হিসাবে সেসব অঙ্ক এখন অতি সামান্যই ঠেকে। কিন্তু গেয়র্গের কখনোই। ইচ্ছা হয়নি তার ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা বন্ধুকে লিখে জানায়, আর এত দিন পরে এসে সে কথা বলতে গেলে নিশ্চিত তা সুবিবেচনাসুলভ কাজ হবে না।

এসব কিছু মিলে গেয়র্গ তার বন্ধুকে চিঠিতে গুরুত্বহীন সব ঘটনার কথাই লেখা শুরু করল, এমন সব মামুলি বিষয় যেমনটা কিনা মানুষের মাথায় এসে পারম্পর্যহীনভাবে ভিড় করে রোববারের অলস চিন্তার সময়ে। গেয়র্গের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তার বন্ধু এই দীর্ঘ প্রবাসজীবনে নিজের শহরের যে-ছবিটা মনে মনে সম্ভবত গড়ে নিয়েছে আর যার সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে, সেটা বিঘ্নিত না করা। তাই দেখা গেল, গেয়র্গ তার বন্ধুকে তিনবার তিনটা আলাদা চিঠিতে, একটা থেকে অন্যটা বহুদিন পর পর লেখা, এক গুরুত্বহীন লোকের সঙ্গে সমানভাবে গুরুত্বহীন এক মেয়ের বাগদানের বিষয়ে লিখে বসল; আর শেষমেশ তার বন্ধু– গেয়র্গের ইচ্ছা কখনোই এটা ছিল না –এই আজগুবি ঘটনাটা নিয়ে কিনা ভালোই আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করল।

তবে গেয়র্গ তার বন্ধুকে এক মাস আগে মিস ফ্রিডা ব্রান্ডেনফেল্ড নামের এক সচ্ছল ঘরের মেয়ের সঙ্গে নিজের বাগদান হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করার চেয়ে বরং ওইসব মামুলি বিষয়ে লেখাটাই বেশি পছন্দ করছে। তার হবু বউয়ের কাছে সে বেশ কবার তার এই বন্ধুর ব্যাপারে গল্প করেছে, দুজনের চিঠি লেখালেখির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছে। তাহলে আমাদের বিয়েতে সে তো আসছে না, মেয়েটি বলেছে, ‘তোমার সব বন্ধু নিয়ে আমার কিন্তু জানার অধিকার আছে। আমি ওকে ঝামেলা দিতে চাচ্ছি না,’ উত্তরে বলেছে গেয়র্গ, ‘তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, বললে সে হয়তো আসবে, আমার অন্তত তা-ই মনে হয়, কিন্তু এখানে এসে ওর খুব বেখাপ্পা লাগবে, ওর মনে হবে আমি ওকে একটা অসুবিধার মধ্যে ফেললাম, এমনকি আমাকে নিয়ে ঈর্ষাও হতে পারে ওর, আর এইসব মিলে ও নিশ্চিত মন খারাপ করে বসবে, আর তারপর সেই অসুখী অবস্থা থেকে বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছাড়াই ওকে কিনা আবার একা ফিরে যেতে হবে রাশিয়ায়। একা– তুমি কি বুঝতে পারছ কথাটার মানে?’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের বিয়ের কথা সে কি অন্য কোনোভাবে জেনে যাবে না?’ ‘যেতেই পারে, সেটা তো আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারি না। কিন্তু তার জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে সে সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু গেয়র্গ, তোমার যদি এই ধরনের বন্ধুবান্ধব থাকে, তাহলে আমি বলব তোমার কখনোই বিয়ের চিন্তা মাথায় আনা ঠিক হয়নি। “ঠিক আছে, কিন্তু সেটার দায় তো আমাদের দুজনেরই; তবে এখনো যদি ফের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে, আমি কিন্তু একই সিদ্ধান্ত নেব।’ তারপর যখন গেয়র্গের চুমুর তোড়ে দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে মেয়েটি আবারও নালিশ জানিয়ে যাচ্ছে: ‘যা-ই বল না কেন, আমি কিন্তু দুঃখ পেলাম,’ গেয়র্গের তখন মনে হলো যে আদতে তার বাগদান হয়ে যাওয়ার পুরো গল্পটা বন্ধুকে লিখে জানানোয় আসলে কোনো অসুবিধা নেই। আমি আমিই। বন্ধু হিসেবে আমাকে ঠিক আমি যা, সেভাবেই মেনে নিতে হবে, মনে মনে বলল গেয়র্গ, ‘ওর আরো যোগ্য বন্ধু হতে পারব বলে তো আমি আর নিজেকে বদলে অন্য মানুষ হয়ে যেতে পারি না।’

এভাবেই, সেই রোববারের সকালে, বন্ধুর উদ্দেশে লেখা লম্বা চিঠিটায় গেয়র্গ সত্যিই বিস্তারিত জানাল তার বাগদানের কথা: ‘আমার সবচাইতে সেরা খবরটা শেষে জানাব। বলেই রেখে দিয়েছিলাম। মিস ফ্রিডা ব্রান্ডেন্‌ফেল্ড নামের ধনীঘরের এক মেয়ের সঙ্গে আমার বাগদান হয়েছে। ওরা এখানে এসেছে তুমি চলে যাওয়ার বেশ অনেক পরে, সুতরাং ওদেরকে তোমার চেনার কথা না। আমার এই হবু বধূকে নিয়ে তোমাকে বিস্তারিত লেখার সুযোগ নিশ্চিত পরে আরো আসবে, আজ শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, আমি খুব সুখী; আর এই কারণে আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে যদি কোনো পরিবর্তনের কথা বলো, সেটা এটুকুই যে আমার মধ্যে এখন থেকে এক সাধারণ সাদামাটা বন্ধুর বদলে তুমি দেখবে এক সুখী বন্ধুকে। তা ছাড়া আমার হবু বধূকেও তুমি পাচ্ছ (সে তোমাকে জানাচ্ছে তার উষ্ণ শুভেচ্ছা আর শিগগিরই সে নিজেই লিখবে তোমাকে) এক খাঁটি মেয়ে বন্ধু হিসেবে, তোমার মতো একজন ব্যাচেলরের জন্য যা একেবারে ফেলনা বিষয় না। আমি জানি, আমাদের এসে দেখে যাওয়ার ব্যাপারে তোমার কত সমস্যা, কিন্তু আমার বিয়েটাই তো হতে পারে সেই যথার্থ উপলক্ষ যার জন্য ওসব সমস্যা ঝেড়ে ফেলা যায়। তবে যা হোক, তোমার জন্য ভালো হয় এমনটাই কোরো, আমাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ার দরকার নেই।

এই চিঠি হাতে নিয়েই গেয়র্গ অনেকক্ষণ বসে থাকল তার লেখার ডেস্কে, মুখ জানালার দিকে ফিরিয়ে। তার চেনা একজন নিচের রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে তাকে সুপ্রভাত জানাল, কিন্তু গেয়র্গ উত্তর দিল মাত্র একটা আনমনা মৃদু হাসি দিয়ে।

অবশেষে চিঠিটা পকেটে ভরল সে, আর নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে একটা সরু বারান্দা ধরে হাজির হলো তার বাবার ঘরে, যেখানে সে পা রাখেনি অনেক মাস। তাদের দিনগুলো সাধারণত যেভাবে যায়, সে হিসেবে বাবার ঘরে যাওয়ার দরকারও পড়েনি গেয়র্গের –কারণ অফিসে বাবার সঙ্গে তার এমনিতেই দেখা হচ্ছে সব সময়, তারা দুজন দুপুরের খাবার খাচ্ছে একই রেস্তোরাঁয়, আর রাতের খাওয়াটা তারা যার যার মতো আলাদা সেরে নিলেও দেখা যায় পরে –যদি গেয়র্গ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, বা আজকাল যেটা বেশি হচ্ছে, তার হবু বধূর সঙ্গে দেখা করতে না গেছে তো –তারা একসঙ্গে খানিকক্ষণ বসছে দুজনের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া বসার ঘরটাতে, যার যার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে।

এই রোদে ভরা সকালেও খাবারঘরটা এত অন্ধকার দেখে অবাকই হলো গেয়র্গ। সরু উঠানের ওপাশে উঁচু দেয়ালটার ছায়া কী অন্ধকারই না করে রেখেছে সবকিছু। তার বাবা বসে আছেন জানালার পাশে, ঘরের এককোনায় যেখানে জড়ো করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার মায়ের নানা স্মৃতিচিহ্ন। তিনি খবরের কাগজ পড়ছেন– দৃষ্টিশক্তির একটু অসুবিধার কারণে কাগজটা তার চোখের সামনে বিশেষ একভাবে কাত করে ধরা। টেবিলে পড়ে আছে তার সকালের নাশতার উচ্ছিষ্টটুকু; দেখে মনে হয় না তিনি খেয়েছেন খুব একটা।

‘আহ্, গেয়র্গ!’ তার বাবা বললেন, আর উঠে এগিয়ে এলেন ছেলের দিকে। তার ভারী ড্রেসিং গাউনটা হাঁটার সময় দুপাশে খুলে যাচ্ছে আর এর ঝুলতে থাকা পাশগুলো পতপত করছে তাকে ঘিরে। আমার বাবা আজও কী বিশাল, মনে মনে বলল গেয়র্গ।

‘এই ঘরটায় ভয়ংকর রকম অন্ধকার, তারপর বলল সে।‘

‘হ্যাঁ, অন্ধকারই,’ উত্তর দিলেন তিনি।

‘আর আপনি জানালাও বন্ধ করে রেখেছেন?’

‘আমার ওভাবেই ভালো লাগে।‘

‘বাইরে কিন্তু বেশ ঝলমলে, বলল গেয়র্গ, অনেকটা তার আগের কথার সুর ধরেই, তারপর বসল। তার বাবা নাশতার জিনিসগুলো সরিয়ে তৈজসপত্র রাখার আলমারির উপরে রাখলেন।

‘আপনাকে আসলে বলতে এসেছি যে,’ গেয়র্গ বলতে থাকল, তার চোখ দুটো অসহায়ভাবে অনুসরণ করছে বৃদ্ধ মানুষটার নড়াচড়া, আমার বাগদানের কথাটা এই এখন সেন্ট পিটার্সবার্গে চিঠিতে জানিয়ে দিলাম। সে চিঠিটা পকেট থেকে সামান্য বের করে আবার সেখানেই রাখল।

‘সেন্ট পিটার্সবার্গে?’ জিজ্ঞেস করলেন তার বাবা।

‘আমার বন্ধুকে, আপনি তো চেনেন,’ বলল গেয়র্গ, বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে। ‘অফিসে তো ওনাকে দেখতে একটুও এমন লাগে না, ভাবতে লাগল সে, কীভাবে নিজেকে ছড়িয়ে বসে আছেন চেয়ারটায়, হাত দুটো কেমন বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা!

‘চিনি। তোমার বন্ধুকে’ জোরের সঙ্গে বললেন তার বাবা।

‘আপনি তো জানেন বাবা, আমার বাগদানের খবরটা আমি শুরুতে ওকে জানাতে চাইনি ওর কথা ভেবেই। ওটাই ছিল একমাত্র কারণ। আপনি নিজেই জানেন, ও কী রকম এক জটিল মানুষ। তাই আমি নিজেকে বললাম, অন্য কারোর কাছে থেকে ও হয়তো আমার বাগদানের কথা ঠিকই শুনবে, তা তো আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারব না, যদিও যেরকম একা একা থাকে সে, তাতে করে সেই সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু যা-হোক না কেন খবরটা আমি নিজে থেকে ওকে দিচ্ছি না।’

‘আর এখন কী হলো, মন বদলে ফেললে?’ জিজ্ঞেস করলেন তার বাবা, বিশাল খবরের কাগজটা রাখলেন জানালার চৌকাঠে, এবার চশমাটা তার উপরে, তারপর হাত দিয়ে চশমা ঢাকলেন।

‘হ্যাঁ, আসলেই বদলে ফেললাম। ভাবলাম, সে যদি আমার সত্যি কোনো ভালো বন্ধু হয়, তবে আমার বাগদানের এই আনন্দের খবরে সেও তো খুশিই হবে। এটা ভেবেই আর কোনো দ্বিধা রাখলাম না খবরটা তাকে জানাতে। কিন্তু চিঠি ডাকে দেওয়ার আগে মনে হলো আপনাকে জানাই।’

‘গেয়র্গ,’ তার বাবা বললেন, দাঁতহীন মুখটা বড় রকম হাঁ করে, আমার কথা শোনো! আমার কাছে তুমি এ বিষয়ে কথা বলতে এসেছ, আমার মতামত নিতে এসেছ, ভালো কথা। তোমার প্রশংসা করছি আমি সেজন্য, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর আসলে কোনো মানে হয় না, সত্যি বলতে, যতক্ষণ না তুমি আমাকে সব সত্যি খুলে বলছ, ততক্ষণ এর কোনো মানে হয় না বললেও কম বলা হবে। আমি এখানে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ঝড় তুলতে চাচ্ছি না। আমাদের প্রিয় মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেশকিছু বাজে জিনিস ঘটছে নিশ্চিত। সেসব নিয়েও কথা বলার সময় বোধ করি আসবে, হতে পারে আমাদের ধারণার আগেই সে সময় আসবে। অফিসে অনেক কিছুই ঘটছে, যে ব্যাপারে আমি কিছু জানতে পারছি না, হতে পারে ওগুলো ইচ্ছে করে আমার থেকে লুকানো হচ্ছে না –আমি আপাতত ভেবে নিচ্ছি আমার থেকে কেউ ইচ্ছে করে লুকাচ্ছে। না কিছু– আগের মতো আর শক্তি নেই আমার, স্মৃতিশক্তিও অনেক খারাপ হয়ে গেছে, আর আগের মতো সবকিছুর হিসাব রাখা আমার পক্ষে এখন অসম্ভব। প্রথমত, এটাই প্রকৃতির নিয়ম, আর দ্বিতীয়ত, তোমার মায়ের মৃত্যু তোমাকে না যতটা, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ধাক্কা দিয়েছে আমাকে।– কিন্তু আসো, যে বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছি, তোমার এই চিঠির বিষয়ে, এ ব্যাপারে তোমার দোহাই লাগে গেয়র্গ আমাকে মিথ্যা বোলো না। এটা অতি সামান্য একটা বিষয়, মাথা ঘামানোর মতো কোনো বিষয়ই না, সুতরাং আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা কোরো না। তোমার কি আসলেই সেন্ট পিটার্সবার্গে কোনো বন্ধু আছে?

বিব্রত হয়ে উঠে দাঁড়াল গেয়র্গ। আমার বন্ধুদের কথা বাদ দিন। হাজারটা বন্ধু মিলেও আমার কাছে আমার বাবার জায়গাটা নিতে পারবে না। বুঝছেন তো, আমি কী ভাবছি? আপনি ঠিকমতো নিজের দেখভাল করছেন না। বয়স বাড়লে নিজের অনেক যত্ন নিতে হয়। আপনি খুব ভালোমতোই জানেন, আপনাকে ছাড়া আমাদের ব্যবসা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু সেই ব্যবসা যদি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কালই আমি ব্যবসা বন্ধ করে দেব চিরতরে। এভাবে আসলে হবে না। আপনার প্রতিদিনকার রুটিনে আমাদের একটা পরিবর্তন আনতে হবে। একটা সত্যিকারের, সার্বিক পরিবর্তন। এই যেমন আপনি এখানে অন্ধকারে বসে আছেন, ওদিকে। বসার ঘরটায় কত আলো-বাতাস। যেভাবে এক কামড়ে নাশতা খেয়ে রেখে দিচ্ছেন আপনি, তাতে আপনার পুষ্টি আসবে কোত্থেকে? জানালা বন্ধ করে আপনি বসে থাকেন, যদিও জানেন বাইরের হাওয়া আপনার জন্য কত ভালো। না, বাবা! আমি ডাক্তার নিয়ে আসব আর আমরা তার নির্দেশমতো চলব। আমাদের ঘর দুটোও বদলে নেব আমরা; আপনি নেবেন সামনের ঘর আর আমি চলে আসব এই ঘরে। আপনার জন্য কোনো ঝামেলাই হবে না, আপনার সব জিনিসপত্তরও আপনার সঙ্গেই আমি ওই ঘরে নিয়ে দেব। কিন্তু ওসব করার যথেষ্ট সময় হাতে আছে। এখন আপনি বরং কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকুন, সত্যিই আপনার খানিক বিশ্রাম দরকার। আসেন, আমি আপনার জামাকাপড় বদলে দিচ্ছি, এক্ষুনি দেখবেন কী সুন্দর করে আমি তা পারি। কিংবা আপনি সোজা সামনের ঘরটাতেই বরং চলে যান, আপাতত আমার বিছানাতেই গিয়ে শোন। ওটাই সত্যিকারের সবচেয়ে সুবুদ্ধির কাজ হবে।

গেয়র্গ দাঁড়াল তার বাবার কাছ ঘেঁষে, তিনি তার অগোছালো সাদা চুলে ভরা মাথাটা নুইয়ে রেখেছেন নিজের বুকের উপর।

‘গেয়র্গ,’ একটুও না-নড়ে নরম গলায় বললেন তার বাবা।

গেয়র্গ সঙ্গে সঙ্গে তার বাবার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল আর বুড়ো মানুষটার ক্লান্ত মুখের মাঝে সে দেখল ওনার বিরাট চোখের মণি দুটো তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ট্যারাভাবে।

‘তোমার সেন্ট পিটার্সবার্গে কোনো বন্ধু নেই। তুমি সব সময় তোমার ঠাট্টা-মশকরা নিয়েই আছে, এমনকি আমার সঙ্গেও সেগুলো করতে ছাড়ছ না। এত জায়গা থাকতে ওখানে কী করে তোমার বন্ধু থাকতে পারে! আমি বিশ্বাসই করি না।

‘একটু পেছনের কথা মনে করে দেখুন, বাবা,’ বলল গেয়র্গ। বাবাকে ধরে ওঠাল চেয়ার থেকে আর উনি ওখানে ভীষণ দুর্বলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সে খুলতে লাগল ওনার ড্রেসিং গাউন। নিশ্চিত বছর তিনেক আগের কথা, যখন আমার এই বন্ধু আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিল। আমার এখনো মনে আছে, ওকে আপনার খুব একটা পছন্দ হয়নি। অন্তত দুই বার হবে যে আপনি ওর খোঁজ করেছিলেন, আর আমি বলেছিলাম ও চলে গেছে, যদিও সত্যি কথা হচ্ছে, তখন ও দিব্যি বসা আমার ঘরে। ওর প্রতি আপনার অপছন্দের ব্যাপারটা আমি সত্যিই বুঝতে পারতাম; আমার বন্ধুর অদ্ভুত কিছু ব্যাপার তো অবশ্যই অস্বীকার করার মতো না। কিন্তু তবু, পরে দেখা গেল, ওর সঙ্গে আপনার বেশ ভালোই যাচ্ছে। আমার সত্যিই দেখে গর্ব হতো যে আপনি ওর কথা শুনছেন, ও যা বলছে তাতে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন, আর ওকে প্রশ্নও জিজ্ঞেস করছেন। মনে করে দেখুন– আপনার নিশ্চিত মনে পড়বে –ও রাশিয়ার বিপ্লব নিয়ে কীসব অবিশ্বাস্য গল্প বলত আমাদের। যেমন ওই গল্পটা, ওই যে সে একটা ব্যবসার কাজে কিয়েভে গিয়েছিল, আর ওখানে এক দাঙ্গার সময়ে এক যাজককে দেখেছিল একটা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত উপরে তুলে সামনে জড়ো হওয়া ভিড়ের দিকে চিৎকার করে কিছু বলছে –তার হাতের তালুতে রক্ত দিয়ে বড় একটা ক্রুশচিহ্ন কাটা। ওর ওই গল্পটা আপনি নিজেই পরে দু-একবার লোকজনকে বলেছেনও।

ইতোমধ্যে গেয়র্গ তার বাবাকে সফলভাবে আবার চেয়ারে বসাতে পেরেছে, সাবধানে খুলেছে ওনার লিনেন প্যান্টের উপরে পরা উলে বোনা পাওয়ালা অন্তর্বাস, সেই সঙ্গে পায়ের মোজাও। এইসব নোংরা হয়ে যাওয়া অন্তর্বাসগুলো দেখে তার নিজের প্রতি খেদ হলো বৃদ্ধ পিতাকে এভাবে অবহেলা করার জন্য। সময়মতো বাবার অন্তর্বাস বদলানোর প্রতি চোখ রাখাটা নিশ্চিত তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই এখন পর্যন্ত সে তার হবু বধূর সঙ্গে তার বাবার ভবিষ্যৎ দেখভালের বিষয় নিয়ে কী ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে খোলাসা করে কোনো আলাপ করেনি –তারা দুজনে নীরবে এটাই ধরে নিয়েছে যে এই পুরোনো ফ্ল্যাটেই তিনি নিজের মতো বাস করতে থাকবেন। এখন, যা হোক, মুহূর্তের মধ্যে গেয়র্গ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে তার নিজের সংসার হওয়ামাত্র বাবাকে সে সঙ্গে নিয়ে যাবে। পরমুহূর্তেই তার এমনকি এটাও মনে হলো যে, যে যত্ন আর মনোযোগ দিয়ে সে তার বাবাকে নিজের বাসায়। নিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে, তত দিনে অনেক দেরিও হয়ে যেতে পারে।

বাবাকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল গেয়র্গ। বিছানার দিকে ওই কয় পা এগোতে গিয়েই ভয়ংকর এক অনুভূতি হলো তার; সে বুঝতে পারল তার বাবা তার কোলের মধ্যে গুটি হয়ে বসে, তার কোটের কলারে লাগানো ঘড়ির চেইনটা নিয়ে খেলছেন। এমন জোরেই তিনি ঘড়ির চেইন আঁকড়ে ধরে রেখেছেন যে, ওনাকে সোজা বিছানায় শুইয়ে দিতে গেয়র্গের রীতিমতো কষ্টই হলো খানিকটা।

তবে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পরে অবশ্য আর কোনো ঝামেলা হলো না। তিনি নিজেকে নিজেই কম্বলে ঢাকলেন, কম্বল টেনে নিলেন কাঁধেরও বেশ খানিক উপরে। গেয়র্গের দিকে তাকালেন তিনি, মোটামুটি বন্ধুসুলভ দৃষ্টি নিয়েই।

‘এখন কী, তোমার মনে পড়ছে তো ওকে, তাই না? জিজ্ঞেস করল গেয়র্গ, বাবার প্রতি উৎসাহের ঢঙে মাথা নেড়ে।

‘আমাকে ঢাকা হয়েছে ঠিকমতো? জানতে চাইলেন তার বাবা, মনে হচ্ছে তিনি দেখতে পারছেন না তার পা দুটো কম্বলে ঠিকভাবে গোঁজা রয়েছে কি না।

‘বলেছি না, বিছানায় আপনার ভালো লাগবে,’ বলল গেয়র্গ, বাবার চারপাশে কম্বল ভালোভাবে মুড়ে দিতে দিতে।

‘আমাকে ঢাকা হয়েছে ঠিকমতো?’ আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন তার বাবা, আর মনে হলো বিশেষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন উত্তরটার জন্য।

‘চিন্তা করবেন না, আপনাকে ভালোভাবেই ঢেকে দিয়েছি।’

‘না!’ গর্জে উঠলেন তার বাবা, এমনভাবে যে উত্তরটার সঙ্গে প্রশ্নটার ধাক্কাধাক্কি লেগে গেল, আর কম্বল তিনি এত জোরে ছুঁড়ে ফেললেন যে খানিকের জন্য ওটা শূন্যে খুলে গিয়ে ভেসে রইল। বিছানার উপর দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি, তারপর এক হাত দিয়ে ছাদ ধরে নিজের শরীর সোজা করলেন কোনোরকমে। আমাকে তুমি যে ঢেকে দিতে চাও তা আমি জানি, আমার বদমাশ বাচ্চা ছেলে। কিন্তু আমাকে ঢাকতে পারোনি এখনো। আমার শরীরের সব শক্তি একদম শেষ হয়ে গেলেও তোমাকে সোজা করার জন্য ওইটুই যথেষ্ট, যথেষ্টরও বেশি। তোমার বন্ধুকে তো আমি অবশ্যই চিনি। সে আমার এমনই একটা ছেলে হতো যে কিনা আমারই ছায়া। সেজন্যই তো এতগুলো বছর ধরে তুমি তাকে ঠকিয়ে চলেছ, নাকি? তা ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? তোমার কি মনে হয়, তার জন্য আমি কাঁদিনি? সেজন্যই তো অফিসে নিজের কামরা বন্ধ করে বসে থাকো তুমি– বস্ ব্যস্ত, কেউ তাকে বিরক্ত করবে না, যাতে করে রাশিয়ায় ওসব মিথ্যা চিঠির পরে চিঠি লিখে যেতে পারো। কিন্তু ভাগ্যক্রমে নিজের সন্তানের ভেতরটা পড়ে ফেলার জন্য কোনো বাবারই অন্য কারো কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। আর এখন এই যেমন তুমি ভাবলে ব্যাটাকে এবার পেড়ে ফেলেছি, এত শক্ত করে নিচে ফেলেছি যে তার উপর পাছাটা দিয়ে বসব আর ও ব্যাটা নড়তেও পারবে না, এ রকম, এ রকমই একটা সময়ে আমার সুযোগ্য পুত্র কী সিদ্ধান্ত নিল– বিয়ে করবে! বাহ!

গেয়র্গ চোখ তুলে তাকাল তার বাবার এই দুঃস্বপ্নময় চেহারার দিকে। সেন্ট পিটার্সবার্গে তার এই বন্ধু, যাকে হঠাৎ করেই তার বাবা এত ভালোভাবে চিনে ফেলেছেন, গেয়র্গের হৃদয় স্পর্শ করল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গাঢ়ভাবে। সে ভাবল তাকে নিয়ে, রাশিয়ার বিশালত্বের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক মানুষ। তাকে সে দেখল তার ফাঁকা, লুট হয়ে যাওয়া দোকানের দরজার সামনে। কোনোমতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে তার দোকানের ধ্বংস-হয়ে-যাওয়া তাকগুলো, লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া মালপত্র আর বেঁকেচুরে যাওয়া গ্যাস-বার্নারগুলোর মধ্যখানে। তাকে কেন চলে যেতেই হলো এত এত দূরে?

‘আমার দিকে মনোযোগ দাও!’ গর্জে উঠলেন তার বাবা, আর গেয়র্গ, কী করছে ঠিকমতো বুঝতেই পারছে না, সবকিছু আঁকড়ে ধরতে ছুটে গেল বিছানার দিকে, কিন্তু শেষে থমকে দাঁড়াল মাঝপথে।

‘কারণ কী, কারণ মেয়েটা তার স্কার্ট তুলেছে, তার বাবা শুরু করলেন বাঁশির সুরে, ‘কারণ সে এই এমন করে তার স্কার্ট উঠিয়েছে, জঘন্য বদ মেয়ে কোথাকার, আর ব্যাপারটা দেখাবার জন্য তার বাবা রীতিমতো রাতের ঢোলা জামাটা এতই উপরে ওঠালেন যে ওনার উরুর উপরে যুদ্ধের ক্ষতটা পর্যন্ত দেখা গেল, কারণ সে তার স্কার্ট উঠিয়েছে। এই এমন করে আর এই এমন করে আর এই এমন করে, আর তাই তুমি ওর পেছনে ছুটলে, আর নিঝঞ্ঝাটে যেন ওর সঙ্গে ফুর্তিবাজি করতে পারো তাই তুমি চুনকালি দিলে তোমার মায়ের স্মৃতিতে, প্রতারণা করলে নিজের বন্ধুর সঙ্গে আর নিজের বাবাকে ঠুসে দিলে বিছানাতে, যেন তিনি নড়তে-চড়তে না পারেন। কিন্তু নড়তে তিনি পারেন কি পারেন না?’ এবার তিনি দাঁড়ালেন কোনোকিছুর সাহায্য না নিয়েই, লাথি মারতে লাগলেন শূন্যে। আকস্মিক এক উপলব্ধিতে ঝলমল করছেন তিনি।

গেয়র্গ দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়, বাবার থেকে যতটা সম্ভব দূরে পারা যায়। বেশ অনেক আগেই সে মনস্থির করে রেখেছিল যে সবকিছুর ওপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে যেন পেছন থেকে বা উপর থেকে হঠাৎ কোনো আক্রমণে সে হতবিহ্বল কিংবা ধরাশায়ী হয়ে না যায়। তার মনে পড়ল এই অনেক-আগেই-ভুলে-যাওয়া সিদ্ধান্তের কথা; আর আবার তার মন থেকে পিছলে চলে গেল সেটা, যেভাবে সুইয়ের মুখ দিয়ে ঢোকানোর সময় সরে যায় ছোট সুতো।

‘কিন্তু তোমার বন্ধুকে শেষমেশ ঠকাতে তুমি পারোনি!’ তার বাবা চিৎকার দিলেন, তার আন্দোলিত তর্জনী সুনিশ্চিত করল কথাটা, এই এখানে, ঘটনার ঘটার জায়গাতে, আমিই তার প্রতিনিধি।

‘ভড় একটা!’ নিজেকে আর চিৎকার করে ওঠা থেকে থামাতে পারল না গেয়র্গ, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল কী ক্ষতি হয়ে গেছে, আর বিস্ফারিত চোখে সে কামড় দিল – অনেক দেরিতেই– নিজের জিভে, এত জোরে যে ব্যথায় মুচড়ে উঠল তার শরীর।

‘হ্যাঁ, ঠিকই তো, আমি তো ভড়! ভাঁড়ামিই চলছে! একদম ঠিক শব্দ! তোমার বউ-মরে-যাওয়া বুড়ো বাপের জন্য আর অন্য কোনো সান্ত্বনা আছে কি? বলো আমাকে– উত্তরটা দেওয়ার সময় আমার জীবিত পুত্র হিসেবেই কথা বোলো– আমার ওই পেছনের ছোট ঘরটাতে অবিশ্বস্ত কর্মচারীদের হাতে হয়রান হয়ে হয়ে আর কী আছে আমার জন্য, হাড্ডির মজ্জা পর্যন্ত হাড়জিরজিরে এই লোকটার জন্য? আর আমার পুত্রধন বেশ বিজয়োল্লাস করে বেড়াচ্ছে দুনিয়াজুড়ে, আমার আনা ব্যবসাগুলো নিয়ে মাতব্বরি ফলাচ্ছে, ফেটে পড়ছে খুশিতে বাগবাগ, আর বাপের কাছ থেকে কী সুন্দর দূরে পালাচ্ছে ভদ্রলোকের কঠিন মুখোশ পরে! তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, আমি, যে তোমাকে জন্ম দিয়েছি?

এবার উনি সামনে ঝুঁকবেন, ভাবল গেয়র্গ, কী হবে যদি খাটের থেকে পড়ে যান, আর টুকরো টুকরো হয়ে যান! এই কথাগুলো তার মাথার মধ্যে হিসৃহিস্ করে উঠল।

তার বাবা সামনে ঝুঁকলেন বটে, কিন্তু পড়লেন না। যেহেতু গেয়র্গ সামনে তার দিকে এগিয়ে গেল না যেমনটা তিনি আশা করেছিলেন, আবার তিনি দাঁড়ালেন খাড়া হয়ে।

‘যেখানে আছ সেখানেই থাকো, তোমাকে দরকার নেই আমার। ভাবছ, আমার কাছে আসার শক্তি এখনো তোমার আছে, কিন্তু আসছ না মন চাচ্ছে না বলেই। হুঁ, এত নিশ্চিত হোয়ো না। এখনো তোমার চাইতে আমার শক্তিই বেশি। নিজে একা হলে হয়তো আমি পিছিয়ে যেতাম, কিন্তু তোমার মা আমাকে তার শক্তিগুলো দিয়ে গেছেন; তোমার বন্ধুর সঙ্গে একটা চমৎকার জোটও বেঁধে ফেলেছি আমি, তোমার সব কাস্টমার এই আমার পকেটে!

‘তার রাতের জামার আবার পকেটও আছে!’ মনে মনে বলল গেয়র্গ, ভাবল এই কথাটার মাধ্যমে সে তার বাপকে সারা দুনিয়ার সামনে এক হাস্যকর চিড়িয়ায় পরিণত করতে পারে। শুধু এক মুহূর্তের জন্যই সে ভাবল সেটা, পুরো সময় ধরে সবকিছুই কেমন যেন ভুলে যাচ্ছে সে।

‘তোমার বউয়ের হাতটা ধরে আসো না আমার কাছে! চেষ্টা করে দেখো! একদম তোমার পাশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করব ওই বেটিকে, যদি না করি তো দেখো!’

গেয়র্গ এমন একটা মুখ বানাল যেন তার এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বাবা গেয়র্গের কোনাটার দিকে মাথা নাড়লেন, নিজের বলা হুমকিটার সত্যতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতেই।

‘হাসালে আমাকে তুমি আজ, আমার কাছে জানতে এসেছ তোমার বাগদানের খবর বন্ধুকে জানাবে কি না! বাহ্! সে সব জানে, গর্দভ, সে সবই জানে! আমি নিজে ওকে লিখে জানিয়েছি, আমার লেখার জিনিসগুলো তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে ভুলে গেছ বাছাধন। এজন্যই তো এত বছর সে এখানে আর আসে না। তোমার চাইতে সে শতগুণ ভালো করেই জানে সবকিছু। তোমার চিঠিগুলো না পড়েই সে তার বাঁ হাতে ওগুলো মুচড়ে ফেলে, আর ওদিকে আমার সব চিঠি ডান হাতে ধরে থাকে পড়ার জন্য!

নিজের মাথার উপরে একটা হাত তিনি দোলাতে লাগলেন মহা উৎসাহের সঙ্গে। “সে তোমার চেয়ে সবকিছু হাজার গুণ ভালোভাবে জানে! তিনি চিৎকার করে বললেন।

‘দশ হাজার গুণ!’ বাপকে নিয়ে মশকরা করার জন্যই বলল গেয়র্গ, কিন্তু শব্দগুলো তার ঠোঁটের থেকে বের হওয়ার আগেই একটা ঐকান্তিক চেহারা নিয়ে নিল।

‘বহু বছর ধরে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি কখন তুমি আমাকে এটা জিজ্ঞেস করবে! তোমার মনে হয় অন্য কোনোকিছু নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা আছে? তুমি মনে করো যে আমি ওই খবরের কাগজগুলো আসলেই পড়ি? এই যে!’ গেয়র্গের দিকে তিনি ছুঁড়ে মারলেন খবরের কাগজের একটা পাতা, ওটা কে জানে কীভাবে তার সঙ্গে বিছানায় গিয়ে উঠেছিল। একটা পুরোনো খবরের কাগজ, যার নামটা গেয়র্গের একেবারেই অচেনা লাগল।

‘বড় হতে তোমার কত লম্বা সময় লাগল! তোমার মাকে মরতে হলো, সুখের দিনটা তিনি দেখে যেতে পারলেন না, তোমার বন্ধু তার ওই রাশিয়ায় পড়ে পড়ে মরছে; তিন বছর আগেই তাকে দেখতে এত হলুদ লাগছিল যে মনেই হচ্ছিল এই দুনিয়াতে তার দিন শেষ, আর আমাকে তো দেখতেই পারছ আমার কী অবস্থা। ওটুকু দেখার তো চোখ আছে তোমার!

‘তো আপনি তাহলে অপেক্ষা করে ছিলেন আমাকে ধরার জন্য!’ চিৎকার করে উঠল গেয়র্গ।

সমবেদনার স্বরে তার বাবা হালকা চালে বললেন, আমার মনে হয় কথাটা আরো আগে বললে কোনো অর্থ হতো। এখন আর এ কথার কোনো মানে নেই।

আর এবার আরো উঁচু গলায়: ‘সুতরাং আজ তুমি জানলে যে নিজেকে ছাড়াও পৃথিবীতে আর কী কী আছে; এর আগ পর্যন্ত নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বোঝোনি তুমি! নিরপরাধ একটা শিশু ছিলে তুমি, সত্যিই, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হলো তুমি ছিলে একটা শয়তানতুল্য মানুষ! –আর তাই জেনে নাওঃ আমি তোমাকে পানিতে ডুবে মরার মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছি!

গেয়র্গের মনে হলো তাকে ঘরটা থেকে বহিষ্কার করা হলো, সে দৌড়ে বের হয়ে যাচ্ছে, তার কানে বাজছে তার বাবার বিছানায় ধপ করে পড়ে যাওয়ার শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে সে, এমনভাবে যে যেন কোনো ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে; ঠিকা ঝিটার সঙ্গে ধাক্কা খেল সে, সকালবেলার ঘর পরিষ্কারের কাজ করার জন্য মহিলা যাচ্ছিল উপরের ফ্ল্যাটে। যিশু!’ চিৎকার দিয়ে উঠল মহিলা, অ্যাপ্রোন দিয়ে মুখ ঢাকল, কিন্তু ততক্ষণে গেয়র্গ হাওয়া। সামনের দরজা দিয়ে ছিটকে বের হলো সে, তার ঝোড়ো গতি তাকে রাস্তা পার করে নিয়ে চলেছে পানির দিকে। এমনভাবে রেলিংটা আঁকড়ে আছে সে, যেমন কোনো ক্ষুধার্ত মানুষ আঁকড়ে ধরে খাবার। ওটার উপর দিয়ে শরীর ঘুর খাইয়ে সে নিয়ে গেল ওপাশে, ঠিক ছোটবেলার সেই দক্ষ জিমন্যাস্টের মতো, যাকে নিয়ে গর্ব করতেন তার বাবা-মা। দুর্বল হয়ে আসা মুঠিতে তখনো রেলিংটা ধরে, রেলিংগুলোর ফাঁক দিয়ে সে দেখল একটা বাস চলে যাচ্ছে, বুঝল এর আওয়াজে তার পতনের শব্দ সহজেই ঢেকে যাবে, আর নরম গলায় বলে উঠল, ‘প্রিয় বাবা-মা, তোমাদের সব সময়ই ভালোবেসেছি আমি, আর ছেড়ে দিল নিজেকে।

সে সময় সেতুটার উপর দিয়ে পার হচ্ছে এক রীতিমতো অফুরন্ত যানবাহনের স্রোত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *