দুটি কথোপকথন

দুটি কথোপকথন

১. প্রার্থনাকারীর সঙ্গে কথোপকথন

একটা সময় ছিল যখন আমি প্রতিদিন এক গির্জায় যেতাম কারণ সেখানে একটা মেয়ে, আমি যার প্রেমে পড়েছি, রোজ সন্ধ্যায় আধা ঘণ্টা হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করত, ফলে তাকে শান্তিমতো মন ভরে দেখতে পেতাম।

একদিন সে আসেনি, আমি হতাশ হয়ে চোখ রাখছি অন্য প্রার্থনাকারীদের ওপর, আমার চোখ পড়ল এক তরুণের দিকে, সে তার লম্বা হালকা-পাতলা শরীর পুরো মেঝেতে টানটান করে পড়ে আছে। একটু পর পর সে শরীরের সব শক্তি নিয়ে তার মাথা আঁকড়ে ধরছে আর জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাথরের মেঝেতে উপুড় করে রাখা হাতের তালুতে ঠুকছে মাথাটা।

গির্জায় তখন শুধু অল্প ক’জন বৃদ্ধ মহিলা, তাদের চাদরে ঢাকা মাথা ঘুরিয়ে তারা বারবার দেখছে এই প্রার্থনাকারীকে। এই মনোযোগ পেয়ে সে মনে হলো খুশি হয়েছে, কারণ তার প্রতিটা ভক্তিভরা চিৎকারের আগে সে একবার করে চোখ ঘোরাচ্ছে, কতজন মানুষ তাকে দেখছে তা মনে হয় বুঝে নিতে চাইছে। আমার কাছে এটা অশোভন লাগল, আমি তাই ঠিক করলাম সে যখন গির্জা থেকে বেরোবে, আমি তাকে গায়ে পড়েই জিজ্ঞাসা করব কেন সে এইভাবে প্রার্থনা করে। কারণ এই শহরে আমার আসার পর থেকেই আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার করে জানার ব্যাপারটা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বের হয়ে উঠেছে, যদিও সে-মুহূর্তে ঐ মেয়ের গির্জায় না-আসায় আমার বিরক্তিই লাগছিল শুধু।

কিন্তু তার দাঁড়াতে দাঁড়াতে এক ঘণ্টা লেগে গেল, তার প্যান্ট সে এত লম্বা সময় ধরে ঝাড়ল যে আমার মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি: ‘হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি, তুমি প্যান্ট পরে আছ। এবার সে খুব কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকল, আর নাবিকদের মতো ঝাঁকি মেরে চলার ভঙ্গিতে হেঁটে গেল পবিত্র জলের আধারটার দিকে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজা ও জলাধারটার মাঝখানে, আমাকে কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে তাকে যেতে দেব না এ-ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমার মুখে আমি ঠুলি আঁটলাম, যেমনটা আমি সব সময় করি কোনো জোরদার বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে। তারপর আমি শরীরের সব ভর দিয়ে দাঁড়ালাম আমার ডান পায়ের উপরে, বাঁ পাটা কোনোমতে বুড়ো আঙুলের উপরে ঠেকিয়ে ভারসাম্য রাখছি, বেশ ক’বার দেখেছি যে এভাবে দাঁড়ালে নিজের মধ্যে একটা সুস্থিতির অনুভূতি আসে।

এখন এমনটা হতে পারে যে এই তরুণ পবিত্র জল তার মুখে ছিটানোর সময়ই, ইতোমধ্যে, আমাকে দেখে নিয়েছে; হতে পারে আমার চোখ গোলগোল করে তাকে দেখার কারণে সে আরো আগে থেকেই আমাকে ভয় পেয়েছে, কারণ এবার সে, বেশ হঠাৎ করেই, দরজার দিকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। এমনটা আমি আশা করিনি। নিজের অজান্তেই আমি তাকে থামাবার জন্য লাফ দিয়ে উঠলাম। কাঁচের দরজা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্ত পরে আমি যখন ওখান থেকে বেরিয়েছি, কোথাও তাকে দেখলাম না, কারণ আমার সামনে অনেক সরু সরু গলি আর রাস্তায় যানবাহনও কম ছিল না।

এর পরের দিনগুলোতে সে আর এল না, কিন্তু মেয়েটা আবার এল, পাশের একটা উপাসনার বেদির কোনায় বসে প্রার্থনা করল। তার পরনে একটা কালো রঙের পোশাক, কাঁধের উপর দিয়ে গেছে স্বচ্ছ লেসের কাপড় –তার শেমিজের অর্ধেক চাঁদের মতো আকারটা দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে– পোশাকটার নিচের পাড় থেকে ঝুলছে সুন্দর ঝালর করে কাটা রেশমি কাপড়। মেয়েটা যেহেতু ফিরে এসেছে, আমি খুশিমনেই ভুলে গেছি ঐ তরুণকে, এরপর সে যখন আবার নিয়মিত আসা শুরু করেছে, তার বরাবরের ঐ একই ভঙ্গিতে প্রার্থনা করছে, আমি তার দিকে আর কোনো খেয়ালই দিলাম না।

তার পরও, যেই-না এসে আমার পাশ দিয়ে যায়, আমি দেখি সে হঠাৎ খুব জোরে হাঁটা শুরু করে আর তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে। অন্যদিকে, প্রার্থনার সময়ে সে বারবার চোরা-চোখে আমাকে দেখতে থাকে। আসলে মনে হয় তাকে চলা ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় আমি ভাবতে পারি না আর তাই সে যখন স্থির দাঁড়িয়ে আছে তখনো তাকে আমার মনে হয় যেন পিছলে চলে যাচ্ছে।

এক সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে একটু বেশিক্ষণ ধরে বসে থাকলাম। তার পরও শেষে ঠিকই গির্জায় গিয়ে হাজির হলাম। আমার মেয়েটা ভেতরে নেই, ঠিক করলাম আবার ঘরে ফিরে যাব। কিন্তু দেখলাম ঐ তরুণ মেঝেতে শুয়ে আছে। তাকে প্রথমবার দেখার সেই কথা মনে পড়ে গেল আর আবার আমার কৌতূহল জেগে উঠল।

পা টিপে আমি দরজার কাছে গেলাম, ওখানে বসে থাকা অন্ধ ভিখারিকে একটা পয়সা দিলাম, আর দরজার খোলা পাল্লার পেছনে তার পাশে ঠাসাঠাসি করে বসলাম। পুরো এক ঘণ্টা ওখানে বসে থাকলাম আমি, সম্ভবত আমার চেহারায় একটা ধূর্ততার ছাপ। ওখানে বসে থাকতে আমার ভালোই লাগল; মনে মনে ঠিক করলাম, আবার প্রায়ই এখানে বসব। দ্বিতীয় ঘণ্টায় ওখানে ভেতরে প্রার্থনারত এক মানুষের জন্য ওভাবে বসে থাকাটা বোকামি বলে মনে হওয়া শুরু হলো আমার। তার পরও, তিন ঘণ্টা চলছে তখন, আমার বিরক্তি বেড়ে চলেছে, মাকড়সাগুলোকে আমি কাপড়ের উপর হাঁটতে দিচ্ছি, ওভাবেই বসে দেখছি গির্জার অন্ধকারের ভেতর থেকে, লম্বা শ্বাস টেনে, শেষ লোকগুলো বেরিয়ে আসছে।

তবে অবশেষে সে-ও এল। আমি বুঝলাম, একটু আগে শুরু হওয়া গির্জার বড় ঘণ্টাগুলোর ঢং ঢং শব্দ তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সে হাঁটছে সাবধানে পা ফেলে, প্রতিবার ভাল করে পা ফেলবার আগে হালকাভাবে পা দিয়ে বুঝে নিচ্ছে নিচের মাটিটা।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি, লম্বা একটা পা ফেলে সামনে এগোলাম, তাকে ধরে ফেললাম। “শুভ সন্ধ্যা,’ বললাম আমি, তার কোটের কলারে হাত রেখে তাকে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কিয়ে নিচে নামিয়ে আনলাম আলো-জ্বলা স্কোয়ারটার ওখানে।

আমরা যখন নিচে পৌঁছেছি, কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল: ‘শুভ সন্ধ্যা, বন্ধু, প্রিয় স্যার, আমার ওপরে রাগ হয়ো না, আমি তোমার সবচেয়ে বাধ্যগত চাকর।’

‘বটে’, আমি বললাম, তোমাকে আমি কিছু কথা জিগ্যেস করতে চাই। অন্যবার তুমি আমার আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছ কিন্তু আজ রাতে আর সেটা পারছ না।’

‘স্যার, তুমি তো দয়ালু এক মানুষ, আমাকে বাড়ি যেতে দাও। আমি খুব হতভাগা একজন, এটাই সত্যি কথা।

‘না, পাশে চলে যেতে থাকা ট্রামের শব্দের মধ্যে আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম। ‘তোমাকে আমি ছাড়ছি না। আমার এ ধরনের সাক্ষাই পছন্দ। তুমি আমার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনা শিকার। আমি নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।’

তারপর সে বলল: ‘ওহ্ খোদা, তোমার মন তো ঠিকই আছে, কিন্তু তোমার মাথা তো কাঠের গুঁড়ির। তুমি আমাকে বলছ “সৌভাগ্যের শিকার, কী সৌভাগ্য বিষয়ে তুমি এতটা নিশ্চিত হচ্ছ? কারণ আমার দুর্ভাগ্য খুব পড়ো-পড়ো অবস্থায় ভারসাম্য রেখে আছে, এটার দিকে যে-ই প্রশ্নের আঙুল তুলবে, এটা গিয়ে পড়বে তারই মাথার ওপরে। শুভ রাত্রি, স্যার।

‘চমৎকার,’ আমি বললাম, তার ডান হাত ধরলাম জোরের সঙ্গে। তুমি যদি আমার কথার উত্তর না দাও, আমি তাহলে এখানে রাস্তায় চিৎকার শুরু করব। আর দোকানে কাজ করা যত মেয়ে আছে আর তাদের যত ভালোবাসা-প্রার্থীরা খুশিমনে তাদের অপেক্ষায় আছে, সব দৌড়ে আসবে তখন; কারণ তারা ভাববে, কোনো চার-চাকার ঘোড়াগাড়ি উল্টে গেছে কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর তখন আমি লোকজনকে তোমাকে দেখিয়ে দেব।

এ কথা শুনে সে ভেজা চোখে আমার হাতে চুমু খেল, একটার পরে আরেকটা হাতে। ‘তুমি যা জানতে চাও তা বলব আমি, কিন্তু দয়া করে ওখানে ওই পাশের রাস্তায় চললো।’ আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম, আমরা রাস্তা পার হয়ে ওখানে গেলাম।

ওখানে যাওয়ার পরে ছোট রাস্তার ঐ অন্ধকার দেখে তার ভালো লাগল না, ওখানে সামান্য কিছু হলুদ বাতি একটা থেকে অন্যটা অনেক দূর পর পর ঝুলছে। সে আমাকে একটা পুরোনো বাড়ির নিচু বারান্দাপথের ভেতরে নিয়ে এল, আমাদের মাথার উপরে ঝুলছে একটা ছোট বাতি, কাঠের এক সিঁড়ির সামনে ওটার থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় মোম পড়ছে। ওখানে সে গম্ভীর মুখে তার রুমাল বের করল, আর একটা ধাপের উপরে তা মেলে রাখল, বলল: ‘বসো, প্রিয় স্যার আমার, বসো, বসে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে তোমার সুবিধা হবে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকছি, উত্তর দিতে আমারও তাহলে সুবিধা হবে। স্রেফ আমাকে যন্ত্রণা কোরো না।’

অতএব আমি বসে পড়লাম, সরু চোখে উপরের দিকে তাকে দেখতে লাগলাম, আর বললাম: ‘তুমি পুরো পাগল, একেবারে পাগল! গির্জায় তুমি কী করো তা যদি দেখতে! কী বিরক্তির তোমার ঐ প্রার্থনা আর আমরা যারা দেখছি, তাদের জন্য কী অস্বস্তির সেটা! তোমাকে যদি বারবার ওভাবে দেখতে হয় তাহলে কীভাবে কেউ নিজের প্রার্থনায় মন দেবে?

সে তার শরীর দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু তার মাথাটা বাধাহীন নড়তে পারছে সামনে পেছনে। রাগ হোয়ো না– যা তোমার ব্যাপার না, তা নিয়ে তুমি কেন রাগ হবে? আমি যখন খারাপ আচরণ করি তখন আমার রাগ হয়; কিন্তু অন্য কেউ যদি ভুলটা করে, তাহলে খুশিই লাগে। তাই রাগ হোয়ো না, যদি তোমাকে বলি যে আমার জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষকে আমার দিকে তাকাতে বাধ্য করা।

‘কী যে বলো তুমি, আমি চেঁচিয়ে বললাম, এই নিচু ছাদের বারান্দাপথের হিসেবে একটু জোরেই হয়ে গেল চিৎকারটা, কিন্তু আবার আমি নীরব হয়ে যাব এই শঙ্কাও পেয়ে বসেছিল আমাকে, ‘সত্যি, কী কথা যে বললে এটা। কোনো সন্দেহ নেই আমার অনুমান এমনই ছিল, তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার এটাই অনুমান হয়েছিল, আমি তোমার অবস্থা আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমারও কিছু অভিজ্ঞতা আছে, তুমি ঠাট্টা হিসেবে নিয়ো না যদি বলি অবস্থাটা অনেকটা শুকনো মাটিতে সমুদ্রপথের বমি বমি ভাব হওয়ার মতো। ঐ অবস্থায় জিনিসের সত্যিকারের নাম আর মনে করা যায় না, তাই তড়িঘড়ি ঐ সবকিছুকে অস্থায়ী, কাজ-চালানোর মতো নাম দিতে হয়। তুমি সেটা হয়তো যত তাড়াতাড়ি পারা যায় করলে। কিন্তু ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াতেও পারোনি, তার আগেই তুমি ভুলে গেছ কোটাকে কী নাম দিয়েছিলে। মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো একটা পলার গাছকে তুমি নাম দিয়েছিলে “ব্যাবেলের চূড়া”, কারণ তুমি তখন জানতে না কিংবা মনে করতে পারতে না যে ওটা একটা পপলার গাছ, আবার এখন ওটা নামহীন দাঁড়িয়ে, আর এবার তুমি ওটাকে বললে “পাঁড় মাতাল নূহ”।

আমি একটু বিব্রত হয়ে গেলাম যখন সে বলল: ‘আমি খুশি যে আমি তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিনি।

বিরক্তি নিয়ে আমি চটজলদি বললাম: তুমি যে বললে তুমি খুশি, এতেই বোঝা যাচ্ছে আমার কথা তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি।’

‘সেটা ঠিক আছে স্যার, মানলাম, কিন্তু তুমি যা বললে তা কিন্তু সত্যি অদ্ভুত কথা বললে।

আমি আমার হাত রাখলাম আমার উপরের দিকের একটা সিঁড়ির ধাপে, সোজা পেছনের দিকে হেলান দিলাম, আর এই প্রায় আয়ত্তে-আনা-অসম্ভব আসনে বসে (কোনো কুস্তিগিরের শেষ আশ্রয় এ ধরনের আসন) তাকে জিজ্ঞাসা করলাম: ‘তোমার এই কোনোকিছুর মধ্যে থেকে মুচড়ে বেরিয়ে আসার কৌশলটা কি হাস্যকর নয়, নিজের মানসিক অবস্থাটা এভাবে তুমি অন্যের ওপরে ঝাড়ছ?’

এতে মনে হয় তার সাহস বেড়ে গেল। সে তার শরীরকে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য দিতে আর কিছুটা বিরোধিতা জানাতে তার দুই হাত একসঙ্গে করল, বলল: ‘না, আমি কারো সঙ্গেই অমনটা করি না, এমনকি যেমন ধরো তোমার সঙ্গেও না, কারণ আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না। কিন্তু যদি করতে পারতাম, খুশিই হতাম তাহলে, কারণ তখন আর গির্জায় অন্যদের আমার দিকে তাকাতে বাধ্য করা লাগত না। তুমি কি জানো, কেন আমার তা করা লাগে?’

এই প্রশ্নটা আমাকে কিছুটা অসুবিধায় ফেলে দিল। কোনো সন্দেহ নেই আমি তা জানি না, আর আমার বিশ্বাস আমি জানতেও চাই না। আমি কখনোই এখানে আসতে চাইনি, মনে মনে বললাম আমি, কিন্তু এই চিড়িয়া আমাকে বাধ্য করেছে তার কথা শুনতে। অতএব বুঝলাম যে আমার খালি মাথা নাড়তে হবে, এভাবে জানাতে হবে যে আমি জানি না, তার পরও দেখলাম যে আদৌ আমি আমার মাথা নাড়াতে পারছি না।

আমার সামনে দাঁড়ানো তরুণ একটু হাসল। তারপর সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আর চেহারার মধ্যে স্বপ্ন দেখছে এমন একটা ভঙ্গি নিয়ে আমাকে বলল: এর আগে আর কোনো দিন আমার এরকম নিজের একদম ভেতর থেকে বিশ্বাস আসেনি যে আমি বেঁচে আছি। দেখো, আমার চারপাশে সবকিছু নিয়ে আমার সচেতনতা এমন ক্ষণস্থায়ী যে সব সময় আমি মনে করি এরা একদিন সত্যি ছিল আর এখন দূরে ক্ষিপ্র বেগে সরে যাচ্ছে। প্রিয় স্যার আমার, আমার অবিরাম বাসনা সবকিছু আমার চোখের সামনে হাজির হওয়ার আগে কেমন ছিল তা যদি একপলক একটু দেখতে পারতাম। আমার ধারণা, তখন ওরা সব ছিল শান্ত ও সুন্দর। নিঃসন্দেহে তা-ই হবে, কারণ আমি প্রায়ই শুনি লোকজন সবকিছু নিয়ে ওভাবেই বলছে, যেন ওরা শান্ত ও সুন্দরই ছিল আসলে।

যেহেতু আমি কোনো উত্তর করলাম না আর যেহেতু নিজের অজান্তে কেঁপে ওঠা আমার মুখের পেশির মাধ্যমেই শুধু বোঝা গেল আমার অস্বস্তিটুকু, সে জিজ্ঞাসা করল: ‘তোমার কি বিশ্বাস হয় না যে লোকজন ওভাবে বলে?

আমি জানি আমার হা-বোধক মাথা নাড়ানো উচিত, কিন্তু পারলাম না।

‘তুমি আসলেই তা বিশ্বাস করো না? কেন, শোনো; আমি যখন শিশু, তখন একদিন দুপুরে ছোট একটু ঘুম দিয়ে জেগে উঠে শুনি, তখন আধো ঘুমে আছি, শুনি যে আমার মা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তার সবচেয়ে সাধারণ গলায় জোরে কাকে যেন বলছেঃ “কী করছে ওখানে, বন্ধু? কী গরম পড়েছে।” আর নিচে বাগান থেকে এক মহিলা উত্তর দিল: “আমি ঘাসে শুয়ে আনন্দে কাটাচ্ছি।” সে এটা বলল খুব সহজভাবে, কথার মধ্যে কোনো পীড়াপীড়ির কিছু নেই, যেন তার কথাটা অবধারিত বলে ধরে নিতে হবে।’

আমার মনে হলো সে আমার কাছ থেকে একটা উত্তরের আশা করছে, তাই আমি আমার প্যান্টের হিপ-পকেটে হাত ঢুকিয়ে এমন ভাব করতে লাগলাম যেন কিছু একটা খুঁজছি। কিন্তু আসলে কিছুই খুঁজছিলাম না, শুধু চাচ্ছিলাম একটু নড়েচড়ে বসি, যাতে করে তার মনে হয় আমি তার কথা মন দিয়েই শুনছি। তারপর আমি বললাম ঘটনাটা মনে রাখার মতো বটে, আর আমার বোধের অগম্য। আমি আরো যোগ করলাম যে আমার বিশ্বাস হয় না এটা কোনো সত্যি ঘটনা, বরং কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গল্পটা বানানো হয়েছে, উদ্দেশ্যটা আমি ধরে উঠতে পারছি না। তারপর আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম, কারণ আলো ওদের পীড়া দিচ্ছিল। ওহ্, আমার কী যে খুশি লাগছে, তুমি আমার সঙ্গে একমত হয়েছ। আর আমাকে তা জানাবার জন্য যেভাবে তুমি থামিয়ে দিলে তাতে বোঝা যায় তুমি একেবারেই স্বার্থপর গোছের না। কেন আমার এতে লজ্জা লাগবে যে– কেন আমাদের লজ্জা লাগবে যে –আমি সোজা হয়ে আর গদাই লরি চালে হাঁটি না, হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে আমার হাঁটার ছড়ি দিয়ে টুকটুক বাড়ি মারি না আর পাশ দিয়ে ওরকম হইচই করে হেঁটে যাওয়া লোকজনের কাপড়ে ঘষা দিয়ে চলি না, তাতে আমার লজ্জিত হওয়ার কী আছে? আমার কি বরং যুক্তিসংগত ক্ষোভের সঙ্গে নালিশ জানানো উচিত না

যে কেন আমাকে বাসার দেয়ালে দেয়ালে ফুরফুর করে ছায়ার মতো উড়তে হচ্ছে, কাঁধ নিচু করে লাফিয়ে চলতে হচ্ছে, আর অনেকবারই দোকানের জানালাগুলোর কাঁচের মধ্যে মিলিয়ে যেতে হচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে?

‘কীসব ভয়ংকর দিনই না কাটাতে হচ্ছে আমাকে। আমাদের দালানগুলো এত বাজেভাবে একসঙ্গে রাখা কেন যাতে করে বেশি উঁচুগুলো মাঝেমধ্যে, বাইরের কোনো বোধগম্য কারণ ছাড়াই, ধসে পড়ছে? ঐসব ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমি হাঁচড়েপাঁচড়ে চলি আর যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই জিগ্যেস করি: “কীভাবে আবার এরকম ঘটনা ঘটল! আমার শহরে– একদম নতুন একটা বাড়ি– আজকের পাঁচ নম্বর এটা– শুধু ভেবে দেখুন একবার।” আমাকে কেউ কোনো উত্তর দিতে পারে না।

‘আর প্রায়ই মানুষ রাস্তায় পড়ে যায়, মরে পড়ে থাকে। তখন ব্যবসায়ী লোকজন। সবাই তাদের দোকানের দরজা খোলে, দরজায় ঝোলে কত কত মালসামান, তারা দুলকি চালে বাইরে বেরিয়ে আসে, মরা লোকটাকে কোনো বাসার ভেতরে নিয়ে যায়, তারপর আবার হাজির হয়, তাদের চোখেমুখে হাসি, বলে: “সুপ্রভাত– কীরকম মেঘলা দিন– আমার দোকানে প্রচুর মাথা-ঢাকার কাপড় বিক্রি হচ্ছে– হ্যাঁ, যুদ্ধ।” আস্তে বাসাটার ভেতরে সটকে ঢুকে পড়ি আমি, তারপর আঙুলগুলো টোকা দেওয়ার জন্য বাঁকা করা অবস্থায় ভয়ে ভয়ে কয়েকবার হাত উপরে তুলে শেষমেশ দারোয়ানের ছোট কাঁচের জানালায় ঠকঠক করি। “ভাই,” তাকে বন্ধুর গলায় বলি আমি, “একটু আগে একজন মরা মানুষকে এখানে আনা হয়েছে। আমি তাকে একটু দেখব, প্লিজ।” তারপর যখন সে এমনভাবে মাথা ঝাঁকায় যেন কী করবে মনস্থির করে উঠতে পারছে না, আমি স্পষ্ট করে বলি: “ভাই রে, ভাবছটা কী? আমি গোয়েন্দা পুলিশের লোক। এক্ষুনি আমাকে মরা লোকটা দেখাও তো দেখি, ঝটপট।” “মরা লোক?” সে প্রশ্ন করে, তার প্রায় আহত গলার স্বর । “না, এখানে কোনো মরা মানুষ নেই। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।” আমি তখন বিদায় জানিয়ে কেটে পড়ি।

‘আর তারপর আমাকে যদি কোনো বিরাট ফাঁকা চত্বর পার হতে হয় তো সবকিছু আমি ভুলে যাই। এই বিশাল উদ্যোগ নিয়ে বানানো চত্বর আমাকে মুশকিলে ফেলে দেয়, বিভ্রান্ত করে, আমার এ কথা না-ভেবে আর উপায় থাকে নাঃ “মানুষকে যদি স্রেফ খেয়ালের বশে এত বড় বড় চত্বর বানাতেই হবে, তাহলে এধার থেকে ওধারে যেন যাওয়া যায় সেজন্য তারা পাথরের একটা রেলিংও যোগ করে দেয়নি কেন? আজ দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কী জোর হাওয়া বইছে। চত্বরের মাঝখানে হাওয়া পুরো ঘুরপাক খাচ্ছে। টাউন হলের চূড়াটা কেমন ছোট ছোট বৃত্তাকারে টলমল নড়ছে। এইসব নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিটা জানালার শার্সি খটখট করছে আর ল্যাম্পপোস্টগুলো নুয়ে পড়ছে বাঁশের কঞ্চির মতো। মাতা মেরির গায়ের ঢিলে জামা তার থামের গায়ে পতপত করছে আর ঝোড়ো হাওয়া ওটাতে ঝাঁপটা মারছে কীরকম। কারোর কি এসবের কোনো খবর নেই? ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা, যাদের এখন হাঁটার কথা পাথরের আস্তর দেওয়া পথে, তাদের যেন তাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। হাওয়া একটু পড়ে আসতেই তারা সবাই থামল, নিজেদের মধ্যে দু-একটা কথাটথা বলল, একে অন্যকে কুর্নিশ জানাল, কিন্তু আবার যখন ঝড়ের মতো শুরু হলো, তাদের আর কোনো উপায় থাকল না, ঠিক একই সময়ে তাদের সবার পা মাটি থেকে উপরে উঠে গেল। তাদেরকে তাদের টুপি আঁকড়ে থাকতে হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে, তবে তাদের চোখগুলো কিন্তু আনন্দে-ফুর্তিতে জ্বলজ্বল করছে, ভাবটা যেন স্রেফ কোনো মৃদু বাতাস বইছে। আমি ছাড়া আর কেউই ভয় পাচ্ছে না।”

আমার মনে তখন অনেক ব্যথা, আমি বললাম: তুমি যে আমাকে তোমার মা আর বাগানের ঐ মহিলার গল্পটা বললে, আমার ওটা একটুও অসামান্য কিছু বলে মনে হচ্ছে না। আমি যে ওরকম গল্প আরো অনেক শুনেছি বা ওরকম শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, শুধু তা-ই নয়, এর কোনো কোনো গল্পের মধ্যে আমি অংশও নিয়েছি। তোমারটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তোমার কি মনে হয়, আমি যদি ওই ব্যালকনিতে থাকতাম, আমিও কি একই কথা বলতাম না আর বাগান থেকে একই উত্তর পেতাম না? কী সাধারণ একটা ঘটনা।

আমি যখন এটা বললাম, দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই খুশি হলো। সে বলল যে আমার জামাকাপড় খুব সুন্দর, আর বিশেষ করে আমার টাই তার খুব পছন্দ হয়েছে। আর আমার তৃক কী সুন্দর। আর স্বীকারোক্তি জিনিসটা আরো স্পষ্ট, আরো দ্ব্যর্থহীন হয়ে ওঠে, যখন তাদের প্রত্যাহার করে বা তুলে নেওয়া হয়।

২. মাতালের সঙ্গে কথোপকথন

সামনের দরজা দিয়ে আমি এক পা বাইরে দিয়েছি, আর তখনই আকাশ, আকাশের বিশাল খিলানে থাকা চাঁদ ও তারা, টাউন হলের পাশের রিংপ্লাৎসের প্রশস্ত স্কোয়ার, স্তম্ভের উপরে দাঁড়ানো কুমারী মেরি আর গির্জা আমাকে অভিভূত করে দিল।

ছায়া থেকে শান্ত পায়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম চাঁদের আলোতে, আমার ওভারকোটের বোতামগুলো খুললাম, শরীর গরম করলাম; তারপর আমার দুই হাত তুলে থামিয়ে দিলাম রাতের গুঞ্জন আর ধ্যানমগ্ন হয়ে ভাবতে শুরু করলাম।

‘কী কারণ আছে যাতে তোমরা সবাই এই এমনভাবে আচরণ করছ, যেন তোমরা বাস্তব? তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছ যে আমি বাস্তব নই, আমি এখানে সবুজ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি জোকারের মতো? আর তুমি, আকাশ, তুমি যে বাস্তব কিছু ছিলে তা বহু আগের কথা, আর তুমি রিংপ্লাস, পুরোনো টাউন স্কোয়ার, তুমি তো কখনোই বাস্তব ছিলে না।

‘সত্যি, তোমরা সবাই এখনো আমার চেয়ে উঁচু আসনে, তবে তা কেবল যখন আমি তোমাদের একলা ছেড়ে যাই।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, চাঁদ, তুমি আর চাঁদ নও,তবে আমি যে এখনো তোমাকে চাঁদ নামে ডেকে যাচ্ছি শুধু এজন্য যে একদিন তোমার নাম চাঁদই ছিল, সেটা সম্ভবত আমার অমনোযোগের কারণেই। কেন তোমার উচ্ছ্বাস কমে আসে যখন আমি তোমাকে ডাকি “অদ্ভুত রঙে বানানো ভুলে যাওয়া কাগজের লণ্ঠন” নামে? আর কেন তুমি একরকম গুটিয়েই যাও যখন তোমাকে ডাকি “কুমারী মেরির স্তম্ভ” নামে, আর তুমি, কুমারী মেরির স্তম্ভ, তোমার চোখ-রাঙানি কত কমে আসে যখন আমি তোমাকে ডাকি “হলুদ আলো ছড়ানো চাঁদ” নামে?

‘আমার সত্যিই মনে হচ্ছে যেন তোমাকে নিয়ে চিন্তা করলে তোমার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে; তোমার সাহস ও সুস্বাস্থ্য তাতে কমে যায়।

‘খোদা, কত প্রশংসার কাজ হবে যদি কোনো ভাবুক কিছু শিখতে পারে কোনো মাতালের থেকে!

‘সবকিছু এত স্তব্ধ হয়ে গেছে কেন? মনে হচ্ছে হাওয়া থেমে গেছে। আর ছোট বাসাগুলো যারা প্রায়ই স্কোয়ারের উপরে গড়াগড়ি যেত (অনেকটা যেন তারা ছোট ছোট চাকার উপরে আছে), তারা বেশ পোক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে– স্থির– স্থির– না, ঐ সরু কাল রেখাগুলো যারা সাধারণত বাড়িগুলোকে মাটি থেকে আলাদা করে, তাদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না।’

আর আমি দৌড় শুরু করলাম। তিনবার ঐ বিশাল স্কোয়ারে বাধাহীন চক্কর দিলাম, আর যেহেতু আমার সামনে কোনো মাতাল পড়ল না, আমি গতি না কমিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চালর্স স্ট্রিটের দিকে দৌড়াতেই থাকলাম। আমার পাশে পাশে দেয়ালে দৌড়াচ্ছে আমার ছায়া, প্রায়ই তা আকারে আমার চেয়ে ছোট, দেখে মনে হচ্ছে বাসাগুলোর দেয়াল ও রাস্তার মাঝখানে ছায়াটা কোনো গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে।

দমকল স্টেশন পেরিয়ে আসতেই আমি ক্লেইনার রিং নামের ছোট স্কোয়ারের দিক থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম, ওদিকে ঘুরতেই দেখলাম ফোয়ারার লোহার রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক মাতাল, তার হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো আর কাঠের জুতো পরা তার পা তিনি ঠকঠক শব্দ তুলে ঠুকছেন রাস্তায়।

শ্বাস ফিরে পেতে একটুখানিকের জন্য আমি থামলাম, তারপর হেঁটে তার কাছে। গেলাম, আমার মাথার রেশমি টুপি উপরে উঠালাম আর নিজের পরিচয় দিতে বললাম:

‘শুভ সন্ধ্যা, হে সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক, আমার বয়স এখন তেইশ, কিন্তু আজও আমার কোনো নাম নেই। কিন্তু আপনি, নিঃসন্দেহে আসছেন বিরাট ঐ প্যারিস শহর থেকে, আপনার নামটা নিশ্চয়ই অসাধারণ কোনো গানের সুরের মতো নাম। আপনাকে ঘিরে আছে স্বেচ্ছাচারী ফ্রান্সের আদালতের কেমন অস্বাভাবিক গন্ধ।

‘কোনো সন্দেহ নেই আপনার ঐ হালকা রং মাখা চোখ দিয়ে আপনি দেখেছেন উঁচু ঝলমলে গ্যালারির বারান্দায় দাঁড়ানো সম্মানিত মহিলাদের, তারা শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে ঘোরাচ্ছে তাদের সরু কোমর, তাদের নকশা-তোলা দীর্ঘ পোশাকের পাড়ের দিকটা পুরো ছড়িয়ে পড়েছে গ্যালারির সিঁড়িতে কিন্তু একইসঙ্গে তখনো ঘসটে চলেছে বাগানের বালিতে। আর নিশ্চিত বেপরোয়াভাবে কাটা ধূসর রঙের টেইল-কোট ও সাদা আঁটসাঁট পাজামা পরা পুরুষ ভৃত্যেরা লম্বা লম্বা খুঁটি বেয়ে উঠছে, খুঁটিগুলো একটু পর পর রাখা, তাদের প্রত্যেকেই পা দিয়ে খুঁটি আঁকড়ে ধরে আছে কিন্তু শরীর বারবার পেছনে ঝুঁকে পড়ছে কিংবা পাশে বেঁকে যাচ্ছে, কারণ তাদেরকে মোটা রশি দিয়ে মাঠের থেকে টেনে ওঠাতে হচ্ছে ধূসর লিনেনের বিশাল শামিয়ানা আর ওটা উঁচুতে টানা দিয়ে রাখতে হচ্ছে শূন্যে, কারণ সম্মানিত ঐ ভদ্রমহিলা একটা মেঘলা সকাল দেখবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি ঢেকুর তুললেন, আমি প্রায় ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম: ‘এটা কি সত্যি যে স্যার, আপনি এসেছেন আমাদের ঐ প্যারিস থেকে, ঐ ঝাবিক্ষুব্ধ প্যারিস –আহ্, ঐ প্রবল-উৎসাহের শিলাবৃষ্টিতে ভেজা প্যারিস থেকে? আবার তিনি যখন ঢেকুর তুললেন, আমি বিব্রত হয়ে বললাম: ‘বুঝতে পারছি আপনি আমাকে অনেক সম্মান জানালেন।

আর চটপট আঙুল চালিয়ে আমি আমার ওভারকোটের বোতামগুলো লাগালাম, তারপর লাজুক এক আকুলতার সঙ্গে তাকে বললাম:

‘আমি জানি আপনি আমাকে উত্তর পাওয়ার মতো যোগ্য বলে মনে করছেন না, কিন্তু আজ যদি আপনাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করতাম তাহলে আমার জীবন কাটত কাঁদতে কাঁদতে।

‘হে আমার চমৎকার ভদ্রলোক, আমি জানতে ব্যাকুল যে আমি যা যা শুনেছি ওগুলো কি সব সত্যি গল্প? আসলেই কি প্যারিসে ও রকম লোক আছে, যারা কোনো কিছু না, স্রেফ শুধু আছে ঢোকার মুখের সিংহদরজা, আর এটা কি সত্যি যে গ্রীষ্মের দিনে আকাশের রং কেমন ছুটতে থাকা নীল, তাতে নকশা হিসেবে আঠা দিয়ে লাগানো আছে ছোট সাদা সাদা মেঘ, সেগুলোর আকার মানুষের হৃদয়ের মতো? আর সত্যি কি ওখানে আছে মানুষে গিজগিজ এক সুন্দর জায়গা, যেখানে অনেক গাছ ছাড়া আর কিছু নেই, ওই গাছগুলো থেকে ঝোলানো রয়েছে ছোট ছোট ঘোষণাপত্র, তাতে লেখা আছে সবচেয়ে বিখ্যাত বীর, অপরাধী আর প্রেমিকদের নাম?

‘তারপর আছে এই আরেকটা খবর। কীরকম মিথ্যা এক সংবাদ! যেমন ধরুন প্যারিসের রাস্তাগুলো নাকি আচমকা নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছে, পড়েনি? রাস্তাগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে, নয় কি? সব সময় সবকিছু নিয়মের মধ্যে রাখা যায় না, কীভাবে তা রাখা সম্ভব? কোনো-না-কোনো দুর্ঘটনা ঘটবেই, লোকজন জড়ো হতে থাকবে, আশপাশের গলিগুলো থেকে তারা উপচে পড়বে, তাদের হাঁটার ভঙ্গি ঠাকঠমকে ভরা, তাদের পা বলতে গেলে ফুটপাত ছোঁয়ই না; তাদের সবার মাথাভরা কৌতূহল, কিন্তু হতাশ হওয়ার ভয়ও আছে; তারা দ্রুত শ্বাস ফেলে আর তাদের ছোট ছোট মাথা কেমন করে সামনে বাড়ায়। কিন্তু তাদের যখন একজন আরেজনের সঙ্গে গায়ে ছোঁয়া লেগে যায়, তারা অনেক নিচু হয়ে কুর্নিশ করে আর একজন অন্যজনের কাছে ক্ষমা চায়: “আমি খুব খুবই দুঃখিত– একদমই অনিচ্ছায় ঘটে গেছে –দেখছেন তো কী বিশাল ভিড়, আমাকে মাফ করবেন, প্লিজ– কেমন আনাড়ির মতো একটা কাজ করলাম আমি– পুরোটাই আমার দোষ। আমার নাম– আমার নাম জোরামে ফারোখ, আমি রু দ্য কাবোতিনের এক মশলা ব্যবসায়ী– কাল আপনাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিতে চাচ্ছি– আমার স্ত্রী খুব খুশি হবে।” এভাবেই তারা কথা বলে, এমনকি যখন রাস্তা ভরে যায় হই-হট্টগোলে আর চিমনির ধোয়া গিয়ে পড়ে বাড়িগুলোর মাঝখানে। নিশ্চয়ই এমনটাই হবে। আর হঠাৎ হয়তো দেখা যাবে শহরের কোনো কেতাদুরস্ত, ধনী এলাকায়, ভিড়ে ভরা কোনো অ্যাভিনিউতে বেশ কটা চার-চাকার ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। ভাবগম্ভীর মুখে পুরুষ ভৃত্যেরা গাড়িগুলোর দরজা খুলল। আটটা অভিজাত সাইবেরিয়ান নেকড়ে-কুকুর উদ্ধত ভঙ্গিতে বাইরে নামল, আর বড় বড় লাফ দিয়ে রাস্তার উপরে চলতে লাগল, ঘেউঘেউ করছে তারা। কে যেন তখন বলল, এরা সব ছদ্মবেশী তরুণ প্যারিসিয়ান ফুলবাবু।’

তিনি শক্ত করে তার চোখ বন্ধ রেখেছেন। আমি কথা থামাতেই তিনি তার দুই হাত নিজের মুখের মধ্যে ঝট করে ঢোকালেন আর নিচের চোয়াল ধরে হেঁচকা টান দিলেন। তার জামাকাপড় সব নোংরা হয়ে আছে। সম্ভবত তাকে কোনো সরাইখানা থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেওয়া হয়েছে আর তিনি তা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি।

সময়টা এখন মোটামুটি দিন আর রাতের সেই ছোট, শব্দহীন বিরতির সময়; এ সময়ে আমাদের মাথা আচমকাই ভারী হয়ে হেলে থাকে পেছনের দিকে, আর আমরা বুঝতেও পারি না সবকিছু কীভাবে শ্বাস বন্ধ করে আছে, কারণ কেউ এদিকে তাকাচ্ছে না, তারপর সবকিছু মিলিয়ে যায়। এরই মধ্যে আমরা ওখানে দাঁড়াই শরীর নুইয়ে, তারপর উপরের দিকে তাকাই, দেখি যে আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, আমাদের আর মনে হচ্ছে যে হাওয়া বইছে, বরং আমরা ভেতরে ভেতরে জড়িয়ে ধরি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর স্মৃতি, ওদের ছাদ এবং ভাগ্যগুণে চোখা-কোনাওয়ালা চিমনিগুলো বেয়ে বাইরের অন্ধকার চুঁইয়ে পড়ছে বাড়ির ভেতরে, একদম চিলেকোঠা থেকে বিভিন্ন ঘরের মধ্যে। আর কী সৌভাগ্য যে কাল শুরু হবে আরেকটা নতুন দিন, যেদিন, যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন, আমরা সবকিছু দেখতে পাব।

এবার মাতাল লোকটা তার ভুরু এতই উপরে তুললেন যে তার ভুরু ও চোখের মাঝখানে একটা চকচকে কিছু দেখা গেল, আর তিনি খিচুনি দিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন: ‘ব্যাপারটা এরকম, বুঝলে– আমার ঘুম পেয়েছে, বুঝলে, তাই আমি বিছানায় যাচ্ছি। ওয়েনসেস্লাস্ স্কোয়ারে আমার একটা শালা আছে, বুঝলে– আমি ওখানেই যাচ্ছি, কারণ আমি ওখানেই থাকছি, কারণ ওখানেই আছে আমার বিছানা। আমি ওখানে যাচ্ছি এখনই। শুধু আমি জানি না কী নাম তার আর সে কোথায় থাকে –মনে হয় আমি তা ভুলে গেছি– কিন্তু কোনো ব্যাপার না, কারণ আমার আদৌ কোনো শালা আছে কি না সে-ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ঠিক আছে, আমি চললাম। তোমার কি মনে হয়, তাকে কোনো দিন খুঁজে পাব আমি?

আমি কোনোকিছু না চিন্তা করেই তাকে উত্তর দিলাম: ‘নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন। কিন্তু আপনি এখানে আগন্তুক মানুষ আর যেভাবে হোক আপনার ভৃত্যদের আপনি হারিয়ে বসেছেন। চলুন আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই।’

তিনি কোনো জবাব দিলেন না। তাই আমি তাকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম, তিনি আমার হাত ধরলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *