ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে এবং অন্যান্য

বেদনাকে বলেছি কেঁদো না – হেলাল হাফিজ
প্রথম প্রকাশ – অক্টোবর ২০১৯

.

উৎসর্গ
কোকিলা খাতুন (আম্মা)
কবি খোরশেদ আলী তালুকদার (আব্বা)

.

ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে

এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,–
তুমি সুখী হবে, খুব সুখী হবে।

বেদনা আমাকে নিয়ে আশৈশব খেলেছে তুমুল, আর
তিলে তিলে শিখিয়েছে সহনশীলতা,
নিলাজ নখের মতো দুঃখ কেটে কেটে আমি
আজকাল অর্জন করেছি মৌন উদ্ভিদের মুখর স্তব্ধতা,
ওলো উল্লাসিনী,
না জেনেশুনেই কেন দিতে গেলে টোকা!
তুমি আর কি বেদনা দেবে, কতোটা কাঁদাবে?
বালখিল্য এ খেলায় আমার চেয়েও বেশি তুমিই হারাবে।

এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,–
তুমি সুখী হবে,
ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, দেখে নিও, খুব সুখী হবে।

দেয়াল

আমি না, আমারও না,
এ দেয়াল তোমার রচনা।
এখন ভাঙ্গার টানে বান বুঝি ডেকেছে অন্তরে!
না না, থিতু হও, যেভাবে আড়ালে আছো
দেয়ালের ওই পাশে ওইভাবে নিরুদ্দেশ রও,
কখনও নাজুক মন উতলা উন্মুখ হলে
আমাকে উদ্দেশ করে না হয় বানিয়ে তুমি
বিরহের টুকটাক কথা কিছু কও।

ঘুড়ি

সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই
আমি তো কাঙাল ঘুড়ি,
বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য
একা একা আজও উড়ি!

ধ্রুবতারা

তোমার সুন্দরে পুড়ে অঙ্গার হয়েছি!
ভেবো না লক্ষ্মীটি,
না কেঁদে বরং তুমি কুলকুল নদী হয়ে যাও,
তোমার পবিত্র জলে স্নান করে শুদ্ধ ও শীতল হবো,
তারপর মিলেমিশে যুগল উল্লাসে, শ্রমে
প্রণয়ের মনোরম আশ্রম বানাবো।

অবেলার খেলা

প্লিজ, অবেলায়
তরঙ্গ তুলিয়া রঙ্গে ভঙ্গ দিও না
ওগো, বাঁচিবো না
মরিয়া যাইবো আমি মরণের আগে।

আপনি

আপনি আমার এক জীবনের যাবতীয় সব,
আপনি আমার নীরবতার গোপন কলরব।

ওড়না

তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ।

থুতু

থুতুও অমৃত হয় চুম্বকীয় চিকন চুম্বনে।

লজ্জা

এতো ভালোবাসা পেয়ে
ভেতরে ভীষণ লাজে
বেদনারা লাল হয়ে গেছে।

তাবিজ

এ কেমন তাবিজ করেছো সোনা,
ব্যথাতো কমে না
বিষ নামে না, নামে না।

স্রোতস্বিনী ভালোবাসা

ভালোবাসা ছিল বলেই তুমিও আছে, আমিও আছি।

ভালোবাসা ছিল বলেই আম্মা ছিলেন, আব্বা ছিলেন
আম্মার আবার আব্বা ছিলেন আম্মা ছিলেন
আব্বার আবার আম্মা ছিলেন আব্বা ছিলেন।

তারও আগে ভালোবাসা ছিল বলেই
আব্বার আব্বার আম্মা ছিলেন
আম্মার আম্মার আব্বা ছিলেন,
তাদের আব্বার আম্মা ছিলেন
এবং আম্মার আব্বা ছিলেন।

আম্মা আব্বা
আব্বা আম্মা,
এমনি করে ভালোবাসা অযুত লক্ষ বছর ধরে
খেলছে নিপুণ ভাবের খেলা,
সবাই যেন প্রণয় পাখি, বুকের ভিতর প্রেমের মেলা!

ভালোবাসা আছে বলেই তুমিও আছে, আমিও আছি।
ভালোবাসা আছে এবং থাকবে বলেই
তোমার তুমি আমার আমি, তোমার আমি আমার তুমি
এখন থেকে তুমিই আমি, আমিই তুমি।

ঢেউ

বিনা জলে, বিনা সমীরণে
দেখো দেখো কত ঢেউ
কটিদেশে, মনে!

নীল খাম

আমারে কান্দাইয়া তুমি
কতোখানি সুখী অইছো
একদিন আইয়া কইয়া যাইও।

লীলা

রোদ্দুরে ভেজাবো তোকে শুকাবো বৃষ্টিতে!

বুকের দোকান

মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ দুপুর কাটে
অভিজাত বিপণী বিতানে,
তৃষিত নয়ন ভরে তুমুল বিস্ময়ে দেখি
কতো বুক বুকে নিয়ে ব্লাউজগুলো ঝুলছে দোকানে।

পিতার পত্র

“রেটিনার লোনাজলে তোমার সাঁতার
পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার!”

সুন্দরের গান

হলো না, হলো না।
শৈশব হলো না, কৈশোর হলো না
না দিয়ে যৌবন শুরু, কার যেন
বিনা দোষে শুরুটা হলো না।

হলো না, হলো না।
দিবস হলো না, রজনীও না
সংসার হলো না, সন্ন্যাস হলো না, কার যেন
এসবও হলো না, ওসব আরও না।

হলো না, হলো না।
সুন্দর হলো না, অসুন্দরও না।
জীবন হলো না, জীবনেরও না, কার যেন
কিছুই হলো না, কিচ্ছু হলো না।

হলো না। না হোক,
আমি কী এমন লোক!
আমার হলো না তাতে কি হয়েছে?
তোমাদের হোক।

রাখালের বাঁশি

কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন–
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।

আছি

আছি।
বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে,–
আছি,
মনে ও মগজে
গুন্ গুন্ করে
প্রণয়ের মৌমাছি।

অভিসার

কোনোদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,–
‘চলো, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে?

অর্ঘ্য

তোমার জন্যে সকাল, দুপুর
তোমার জন্যে সন্ধ্যা,
তোমার জন্যে সকল গোলাপ
এবং রজনীগন্ধা।

প্রতিদান

ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।

লেনদেন

তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ? তোমার যে যন্ত্রণা
খুব মামুলী, বেশ করেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা।

পথ

যদি যেতে চাও, যাও,
আমি পথ হবো চরণের তলে,
না ছুঁয়ে তোমাকে ছোব
ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে।

এন্টিসেপটিক চুমু

আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনিতো?
ইস্! করেছো কী? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।

অধিকার

তুমি কি জ্বলেখা, শিরি, সাবিত্রী নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার
তোমাকে দিলাম না-ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার।

কবিসূত্র

আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে,
মানুষের কাছে এও তো আমার এক ধরনের ঋণ।
এমনই কপাল আমার
অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

জটিল জ্যামিতি

হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয়তো গিয়েছি হেরে,
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।

মরণের পাখা

যুক্তি যখন আবেগের কাছে অকাতরে পর্যদস্ত হতে থাকে,
কবি কিংবা যে কোনো আধুনিক মানুষের কাছে
সেইটে বোধ করি সবচেয়ে বেশি সংকোচ আর সংকটের সময়।

হয় তো এখন আমি তেমনি এক নিয়ন্ত্রণহীন
নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি,
নইলে এতোদিনে তোমাকে একটি চিঠিও
লিখতে না পারার কষ্ট কি আমারই কম!

মনে হয় মরণের পাখা গজিয়েছে।

ভালোবাসার খালা

নখের নিচে           রেখেছিলাম
তোমার জন্য প্রেম,
কাটতে কাটতে           সব খোয়ালাম
বললে নাতো,–‘শ্যাম,
এইতো আমি           তোমার ভূমি
ভালোবাসার খালা,
আঙুল ধরো             লাঙ্গল চষো
পরাও প্রণয় মালা।’

সতীন

তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!

সঞ্চয়

সবাই জমায় টাকা,
আমি চাই মানুষ জমাতে!

কৃষ্ণপক্ষ

আমিতো কাঁচের নই
তবুও চৌচির হয়ে গেছি!

জয়

তোমাকে শোনাবো এক পরাজিত মানুষের বিজয় কাহিনি!

বাসনা

আগামী, তোমার হাতে
আমার কবিতা যেন
থাকে দুধে ভাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *