৩৮. ক্রুদ্ধ ধর্ম

অধ্যায় ৩৮. ক্রুদ্ধ ধর্ম

ফান্ডামেন্টালিস্ট বা মৌলবাদী হচ্ছে একটি লেবেল বা মোড়ক, যা বেশকিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে আজ যুক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকার প্রটেস্টান্টবাদের একটি বিশেষ ধারাকে বর্ণনা করতে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান তখন ঐসব খ্রিস্টানদের জীবন ক্রমশ আরো বেশি। জটিল করে তুলছিল, যারা তাদের বাইবেলকে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন। বাইবেল তাদের বলেছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে ঈশ্বরের ছয়দিন লেগেছিল এবং সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এবং ষষ্ঠ দিনে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে গঠিত মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। ঊনবিংশ শতক অবধি অনেকেই। ভেবেছিলেন এভাবে আসলে সবকিছু ঘটেছিল। তারপর সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এই খেলায় প্রবেশ করেছিলেন এবং তারা এই ধারণাটিকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন। তাদের একজন বিশ্বাসীদের বিশেষ মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিলেন।

তার নাম ছিল চার্লস ডারউইন। তার গবেষণায় ডারউইন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন, আমাদের এই গ্রহে সব প্রজাতি খুবই দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তিত হয়েছে তাদের পরিবেশের সাথে ক্ষুদ্র অভিযোজনগুলো পুঞ্জিভূত হবার একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ছয় দিনের সেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদের ধারণাটি ধসে পড়েছিল। ধর্মীয় খ্রিস্টানদের জন্যে এটাই যথেষ্ট পরিমাণ একটি বিপর্যয় ছিল, কিন্তু আরো বড় বিপর্যয়টি ছিল তার সেই দাবিটি, ছয় হাজার বছর আগে একদিন বিশেষভাবে সৃষ্টি হবার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে গঠিত মানুষ আবির্ভূত হয়নি। তারাও বহু মিলিয়ন বছর ধরে ধীরে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছিল। এবং নরবানর বা এইপরা ছিল তাদের। সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম পূর্বসূরি! যখন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ডারউইনের ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, এটি সেইসব মানুষগুলোর জন্যে বেশ বড় একটি সংকটের সৃষ্টি করেছিল, যারা ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার প্রশস্তিতে লেখা একটি কবিতা হিসাবে বাইবেলের গল্প না-পড়ে সেটিকে আসলেই তিনি কীভাবে এই কাজটি করেছিলেন তার একটি বিস্তারিত নিখুঁত বিবরণ হিসাবে পড়তেন। ডারউইনের এই বইটির প্রতি খ্রিস্টানরা বিভিন্ন উপায়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

অনেকেই বইটি পড়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে, ডারউইন সঠিক কথাই বলছেন। সুতরাং অবশ্যই বাইবেল ভুল। এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে ধস নেমেছিল। আর ধর্মকে এভাবে হারিয়ে ফেলা তাদের জন্যে সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, অনেকটা সেই অনুভূতির মতো, যা শিশুরা অনুভব করে, যখন তারা সান্টা ক্লস বিশ্বাস করা থামিয়ে দেয়। কিন্তু অন্য বিশ্বাসীরা ডারউইনের বই থেকে একটি পাতা বাতিল করে, তাদের ধর্মকে নতুন বিজ্ঞানের সাথে সংগতিপূর্ণ করে তুলেছিল। নতুনভাবে বাইবেল পড়া শেখার মাধ্যমে তারা এটি করেছিলেন। বাইবেল হচ্ছে শিল্পকলা, বিজ্ঞান নয়। এটি এমনভাবে পরিকল্পিত যে, এটি আপনাকে জীবনের অর্থ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে, কিন্তু জীবনের যন্ত্র কোন্ প্রক্রিয়ায় চলছে সেই বিষয়ে কোনো তথ্য দেবে না।

তাদের ধর্ম টিকে গিয়েছিল। তবে এটি এর আগের সেই নিশ্চয়তাটি হারিয়েছিল। এর মানে প্রথমবারের মতো এটি একটি ‘ফেইথ’ বা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। নিশ্চয়তা কোনো ‘বিশ্বাস’ নয়। এটি বিশ্বাসের বিপরীত। আপনি যদি কোনোকিছুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে থাকেন, তাহলে সেটি বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি সেটি জানবেন। আমি যেমন ২+২=৪ এটি বিশ্বাস করি না, আমি এটি ‘জানি’। আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। আমি আমার হাতেই গণনা করে এটি দেখাতে পারব। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারব না যে, জীবনের একটি সামগ্রিক অর্থ আছে এবং এই বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি এটিকে ভালোবাসেন। অথবা এই জীবনে মৃত্যু হলে আমরা আরেকটি জীবনে প্রবেশ করব। এসবের কোনোটাই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না। আমরা হয় এটি বিশ্বাস করব, নয়তো করব না, অর্থাৎ ফেইথ আছে অথবা নেই। আর এর নিজেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে এবং যেভাবে এটি নিজের সম্বন্ধে কথা বলে সেটি পরিবর্তন করতে সহায়তা করে আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মের উপকার করেছিল।

কিন্তু কিছু খ্রিস্টান আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তারা যেমন তাদের বিশ্বাস কখনো আত্মসমর্পণ করবেন।, একইভাবে তারা এর কারণে তাদের বিশ্বাসকে ভিন্নভাবে বোঝার কোনো উপায় খুঁজতেও অস্বীকার করেছিল। তারা এর বিরুদ্ধে লড়তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিজ্ঞান তাদের যেমন বিষণ্ণ করেনি, তেমনি এটি তাদের চিন্তা করতেও প্ররোচিত করতে পারেনি। এটি তাদের ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। আর মৌলবাদে মূল উপকরণে পরিণত হয়েছিল এই ক্রোধ। এটি বুঝতে আপনাকে সেই হতাশা আর ক্রোধটি অনুভব করতে হবে, যা এটিকে উসকে দিয়েছে।

বিকল হয়ে যাওয়া কোনো যন্ত্রের ওপর কি আপনি কখনো আপনার মেজাজ হারিয়েছেন, চেয়েছেন এটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ঘরের অন্যদিকে? আপনি কি কখনো কোনো টেনিস-খেলোয়াড়কে দেখেছেন রাগে মাটির উপর তাদের র‍্যাকেট আছড়ে ফেলতে, যেন এই মাত্র যে-শটটি তিনি খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন তার জন্যে দায়ী হচ্ছে সেই র‍্যাকেটটি? জীবন নিরন্তরভাবেই আমাদের দিকে নানা পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আমাদের যা স্বস্তির বলয় থেকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। আর কিছু মানুষ এই পরিবর্তনগুলো সামাল দেবার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ। কেউ কেউ জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। আমরা তাদের বলি আর্লি অ্যাডপটার’। যেমন, নতুন আইফোন বা আইপ্যাড হাতে নেবার জন্যে তারা খুবই অস্থির হয়ে থাকেন। অন্যরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হন। আর কেউ কেউ খাপ খাইয়ে নিতে অস্বীকার করেন। তারা পরিবর্তন ঘৃণা করেন এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েই লড়াই করেন। বিশেষ করে যদি এটি তাদের বহুদিনের লালিত কোনো বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে। আধুনিক যুগে পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে বিজ্ঞান, সুতরাং এটি বহু ক্রুদ্ধ বিশ্বাসীর ক্ষোভের নিশানায় পরিণত হয়েছিল, যারা অনুভব করেছিলেন এটি অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করেছে। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ক্রোধ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। আর ডারউইনের বিবর্তনের প্রস্তাবনাটি এই যুদ্ধটি শুরু করেছিল।

এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রচণ্ড আক্রমণটি সূচনা করেছিল একটি ধারাবাহিক পুস্তি কা, যা প্রকাশ করেছিল একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ক্রিশ্চিয়ান ফান্ডামেন্টালস অ্যাসোসিয়েশন’। ফান্ডামেন্টাল হচ্ছে শক্তিশালী ভিত্তি। এমন ভিত্তির ওপর যদি আপনি কোনো বাড়ি নির্মাণ করেন তাহলে সময়ের প্লাবন সেটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এই পুস্তিকার লেখকদের মতে, যে ভিত্তির ওপর খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত এবং নির্মিত হয়েছে, সেটি বাইবেলের অভ্রান্ত সত্য। এর প্রতিটি শব্দ স্বয়ং ঈশ্বর উচ্চারণ করেছেন, আর ঈশ্বর কখনোই ভুল করতে পারেন না। বাইবেলে যা আছে তা সবই চূড়ান্ত সত্য, ঈশ্বরের নিজের শব্দ। আর মানুষের কোনো শব্দ, যা এর সাথে ভিন্নমত প্রদর্শন করে, সেটি অবশ্যই ভুল। ডারউইন এর বিরোধিতা করেছিলেন। সে-কারণে ডারউইন ভুল!

মৌলবাদীরা বিজ্ঞানকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা করেননি। তারা এর বিরুদ্ধ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে কোনো বিতর্ক করেননি। এর বিরুদ্ধে তারা তাদের অভিমত ‘ঘোষণা’ করেছিলেন। এটি কোনো শিশুর সাথে বিতর্কের সময়ে পিতামাতারা যখন বিতর্কটি জিততে গিয়ে চিৎকার করে বলে থাকেন : ‘এটি ঠিক কারণ আমি বলছি’, এটি তার সমতুল্য ছিল। আর মৌলবাদী ধর্ম এটাই করে থাকে। এটি কোনো প্রমাণ দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করে না বরং তর্কে জিততে এটি ‘কর্তৃত্বের’ সহায়তা নেয়। ডারউইন কেন ভুল? কারণ, বাইবেল সেটাই বলছে। কিন্তু বাইবেলের কর্তৃত্বকে অভ্রান্ত হিসাবে দাবি করা ছাড়াও তারা আরো কিছু করেছিল। তারা বিজ্ঞানকেই নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। আর তখন সেটি প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞান পাল্টা যুদ্ধ শুরু করেছিল।

খ্রিস্টান চার্চ নেতা আর যাজকদের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে প্ররোচিত হয়ে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্য এর সব স্কুলে বিবর্তন বিষয়ে শিক্ষাদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গীয়ভাবে মানব সৃষ্টি হবার কাহিনিটি অস্বীকার করে, এর পরিবর্তে মানুষ নীচুশ্রেণির কোনো প্রাণীদের থেকে উদ্ভব হয়েছে এমন দাবি করা কোনো তত্ত্ব শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করা টেনেসি রাজ্যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হয়েছিল। একজন তরুণ শিক্ষক জন থমাস স্কোপস এই নতুন আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদের বিবর্তন বিষয়ে পড়িয়ে আইন ভঙ্গ করার অপরাধে কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা ছিল আদালতের এই বিচারপ্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে প্রদর্শন করা যে, জেনেসিস থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বিবর্তনকে অপ্রমাণ করার প্রচেষ্টা কতটা বোকামি হতে পারে। আমেরিকার সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী ক্লারেন্স ড্যারো তার পক্ষে আদালতে কেসটি লড়েছিলেন। স্কোপসের এই কেসটি ‘দ্য মাঙ্কি ট্রায়াল’ নামে পরিচিত পেয়েছিল কারণ, ডারউইন দাবি করেছিলেন নরবানরের বংশধারায় মানুষরা বিবর্তিত হয়েছে। স্কোপস বিবর্তন পড়িয়েছেন বলে তার দোষ স্বীকার করেন, এবং তাকে ১০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। ড্যারো এই আইনি লড়াই ব্যবহার করেছিলেন মৌলবাদীদের অবস্থানের স্ববিরোধিতাগুলো প্রদর্শন। করতে এবং প্রমাণ করতে যে, এর প্রধান মুখপাত্ররা নিজেরাই জানেন না যে, তারা কী বিষয়ে কথা বলছেন। স্কোপস কেসটি হেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু ড্যারো তার তর্কে জিতেছিলেন। তবে ১৯৬৮ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট শ্রেণিকক্ষে বিবর্তন পড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এই আইনটি বাতিল করেছিল।

স্কোপের এই আইনি লড়াইটি দেখিয়েছিল যে, কীভাবে নতুন জ্ঞান মৌলবাদীদের ক্রোধ জাগিয়ে তুলতে পারে। যে-কোনো বর্ণনার মৌলবাদীরা ইতিহাস আর এর বহন করে আনা পরিবর্তনগুলো পছন্দ করেন না। তারা বরং টেনিস কোর্টে তাদের র‍্যাকেট আছড়ে ভাঙবেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে তাদের কাছে যা আসছে, তা মেনে নেবেন না। অতীত তাদের একমাত্র কাম্য। তারা চিৎকার করে বলেন, কেন আপনারা বারবার ভবিষ্যতের কথা তুলছেন?’ মৌলবাদ হচ্ছে বদমেজাজের একটি ঘোর, এটি সেই উন্মত্ত ক্রোধ, নতুন বাস্তবতা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি।

কিন্তু যদি বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন আর নতুন জ্ঞান, যা এটি বহন করে আনে, সেটি যদি মৌলবাদী মনের পক্ষে গ্রহণ করে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা যেভাবে সমাজ পরিচালনা করছি সেখানে কোনো পরিবর্তন মেনে নেওয়া তাদের জন্যে এমনকি আরো বেশি কঠিন প্রমাণিত হয়। আমাদের এই সময়ে, ধর্মীয় মৌলবাদ বিজ্ঞানের চাপের চেয়ে বরং সামাজিক পরিবর্তনের কারণে আরো অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র ক্রুদ্ধই হয় না, সহিংস হয়ে ওঠে।

বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক যে-পরিবর্তনটি পৃথিবীকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেটি ছিল নারীদের মুক্তি। বাইবেল এবং কুর’আন এসেছিল এমন সমাজ থেকে, যা পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখানে বিস্মিত হবার কোনো কারণই নেই। বেশ সাম্প্রতিক সময় অবধি পৃথিবীর সর্বত্র এভাবেই চলছিল। আর এই প্রসঙ্গটির গভীরে প্রবেশ করার আগে একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ক্ষমতায় থাকায় পুরুষরা কখনোই স্বেচ্ছায় তাদের সুবিধাগুলো ছেড়ে দেননি। একদিন তারা ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু বলেননি যে, ‘আমি হঠাৎ করে অনুভব করলাম, যেভাবে আমি অন্যদের নিয়ন্ত্রিত আর প্রভাবিত করি সেটি ভুল। আমাকে অবশ্যই আমার আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। সুতরাং আমি তাদের সাথে আমার ক্ষমতা ভাগ করে নেব। আমি তাদের ভোটের অধিকার দেব’! কখনোই পরিবর্তন আসলে এভাবে ঘটেনি। ইতিহাস দেখিয়েছে ক্ষমতা যাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে আসলেই ক্ষমতা জোর করে আদায় করে নিতে হয়। সাফরাজেটসরা, যারা নারীদের সাফরেজ বা ভোটাধিকারের জন্যে লড়াই করেছিলেন, তারা সেই শিক্ষাটি পেয়েছিলেন। পুরুষরা স্বেচ্ছায় নারীদের ভোটাধিকার দেয়নি। নারীদের সেটি আদায় করে নিতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

ক্ষমতার ব্যাপারে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, আর এখানেই আলোচনায় ধর্মের প্রবেশ ঘটবে। ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থেই ক্ষমতা ভালোবাসেন কিন্তু তারা তাদের সেই লালসাটিকে নানা তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে রাখেন, যে-তত্ত্বগুলো এটির সত্যতা প্রতিপাদন করে। নারীদের ভোটের অধিকার না-দেবার জন্যে তারা যে তত্ত্বটি ব্যবহার করেছিলেন, সেটি হচ্ছে নারীদের মস্তিষ্ক রাজনীতির জটিলতা বোঝার মতো ক্ষমতা রাখে না। রাজনীতি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্যে। আর নারীদের কাজ সন্তান জন্ম দেয়া। আর মানুষকে তাদের অবস্থানে বন্দি করে রাখার কারণগুলোর সবচেয়ে সেরা জোগানদাতা সবসময়ই ছিল ধর্ম। আমরা এটিকে কাজ করতে দেখেছি দাসপ্রথা বিলোপ নিয়ে তর্কের সময়। বাইবেল আর কুর’আন দুটি ধর্মগ্রন্থই দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক মেনে নিয়েছে। নারীদের অবস্থানে অধস্ত নতাও তারা খুব স্বাভাবিক হিসাবে সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং আমরা সেই অস্বস্তি কর বাস্তব তথ্যের মুখোমুখি হই, পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থগুলোকে সেই মানুষগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যারা অন্যদের তাদের নিয়ন্ত্রণে আটকে রাখতে চান।

এবং এখনো এই বইগুলোকে একইভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। মৌলবাদী খ্রিস্টানদের জন্যে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ থেকে নারীদের মুক্তি একটি বিশালমাত্রার সমস্যা, কারণ বাইবেল বলেছে নারীদের পুরুষদের অধস্তন থাকা উচিত এবং তাদের ওপর নারীরা কখনোই কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবেন না। আজও বেশিরভাগ খ্রিস্টীয় জগৎ এখনো নারীদের চার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে যাজক হবার প্রবেশাধিকারটিকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এই বিষয়টি এমনকি ক্যাথলিক চার্চে আলোচনার কথা ভাবাই হয় না, যে-কোনো মাত্রায় এই গ্রহে যারা সবচেয়ে বৃহত্তম একটি সংগঠন, যাদের সদস্যসংখ্যা হাজার কোটির উপরে। এমনকি খ্রিস্টধর্মের অপেক্ষাকৃত উদারনৈতিক শাখাগুলোও বহুযুগ ধরে এই প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক করেছে। কেবলমাত্র ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে চার্চ অব ইংল্যান্ড নারীদের জন্য বিশপ হবার পথ উন্মুক্ত করেছিল। ঠিক যেভাবে তারা ডারউইনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, আর প্রক্রিয়াটি যতই কষ্টকর অনুভূত হোক না কেন, নারী স্বাধীনতা আর অধিকারের প্রশ্নে উদারনৈতিক ধর্মগুলো খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। কিন্তু সময় একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না, আর তাদের এখন এমনকি আরো কষ্টকরভাবে সমকামীদের মুক্তির প্রশ্নটিরও মুখোমুখি হতে হবে।

খ্রিস্টধর্মের জন্যে এই পরিবর্তনগুলো বেশ যথেষ্ট পরিমাণ কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল বেশকিছু কারণে, ইসলামের জন্যে এটি এমনকি আরো বেশি কঠিন। আর এখানে পরিবর্তনের সাথে সমঝোতা করার বিষয়টি আরো বেশি সহিংসতায়। পরিণত হয়েছিল। মৌলবাদী মুসলমানরা শুধুমাত্র ক্রুদ্ধ নয় : তাদের সবচেয়ে চরম রূপে তারা নৃশংসভাবে মানব-হত্যাকারীও। ইসলামের এই সমস্যার নেপথ্যে আছে বেশকিছু নিয়ামক, যাদের অনেকগুলোই এই বইয়ের বিষয়বস্তুর আওতার বাইরে। কিন্তু অন্যসব ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে তারাও একটি সাধারণ সমস্যা ভাগ করে নিয়েছে। এমনকি ইজরায়েলের মৌলবাদী ইহুদিদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। ইজরায়েলে মৌলবাদী ইহুদিরা তাদের তথাকথিত পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইনিদের সাথে ভাগ করে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে ঈশ্বর বহু হাজার বছর আগেই প্যালেস্টাইনকে তাদের বসবাসের জন্য দান করেছিলেন, আর তারা শুধু সেটি নিজেদের দখলে নিচ্ছেন, যা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আপনি যদি তাদের এই অবস্থানের কারণ সৃষ্ট বিপদগুলোর কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন তাহলে তারা সেই বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করবে, খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা, যা ডারউইনকে বলেছিলেন। আমরা ঠিক বলছি, এবং আপনি ভুল, কারণ বাইবেল আমাদের সেটি বলছে।

আর যেহেতু বাইবেল আর কুর’আন এভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, মনে হতে পারে এই বইগুলোই সমস্যা, এইসব সংঘর্ষগুলোর প্রাদুর্ভাবের কারণ। অথবা, অন্যভাবে যদি বলি : এই বইগুলোর আধেয় ঈশ্বরের কাছ থেকে আশা ঐশী প্রত্যাদেশ, এই ধারণাটি মূলত সমস্যা। আর যাই হোক না কেন, আমি আপনার সাথে নারী অথবা সমকামীদের অবস্থান ও অধিকার বিষয়ে তর্ক করতে পারি, এবং আমরা একমত বা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু যখনই আপনি আমাকে বলবেন এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিকোণ আপনার নিজের না বরং ঈশ্বরের, তখন বির্তক অসম্ভব হয়ে যায়। এটি আবার সেই মাঙ্কি ট্রায়ালের পুনরাবৃত্তিতে পরিণত হয়।

মৌলবাদীরা বিতর্ক করেন না, তারা কোনো প্রমাণ দেবার চেষ্টা করেন না। তারা একটি রায় ঘোষণা করেন। রায়টি সবসময়ই হবে ‘দোষী’, কারণ তাদের পবিত্র বই এই বিষয়টি ইতিমধ্যেই নির্ধারণ করেছে। এর মানে আমাদের সময়ে এর সহিংস সংস্করণগুলোসহ মৌলবাদের সমস্যা একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করে, যার শিকড় ধর্মের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, যা দাবি করে এর ভিত্তির মূলে আছে। সরাসরি ঈশ্বরপ্রেরিত প্রত্যাদেশগুলো। যদি শুধুমাত্র অজ্ঞতার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনই নয় বরং সহিংসতার প্রতি তাদের ভালোবাসাকে যুক্তিযুক্ত করে এটি ব্যবহৃত হয়, নিশ্চয়ই তাহলে মৌলিকভাবেই এই অবস্থানে একটি বড় ভ্রান্তি আছে, অর্থাৎ তারা ভুল করছেন, যদি তাদের নিজেদের শব্দ ঋণ করে বলি। তাহলে ধর্ম কীভাবে এই সুনির্দিষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা ভাববে? আর সেই প্রশ্নটির উত্তর বিবেচনা করব পরের অধ্যায়ে, যখন আমরা ধর্মের সহিংস ইতিহাসটি আরো নিকট থেকে দেখব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *