৩৬. অতীন্দ্রিয়বাদী এবং চলচ্চিত্র তারকা

অধ্যায় ৩৬. অতীন্দ্রিয়বাদী এবং চলচ্চিত্র তারকা

ধর্মের ইতিহাসের শিক্ষার্থীরা চার্চ আর সেক্ট বা ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে একটি পার্থক্য। চিহ্নিত করে থাকেন। একটি চার্চ কোনো একটি সেক্ট থেকে সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি জটিল। এটি নানাধরনের বিশ্বাসকে ধারণ করে, আর সেই বিশ্বাসগুলোর মধ্যে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করে। কোনো সেক্ট বা ধর্মগোষ্ঠী মূলত ধর্মের কোনো একটি বিশেষ দিককে আঁকড়ে ধরে, আর সেটাই তাদের ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কীভাবে সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস আর জিহোভাস উইটনেস বাইবেলের কিছু অংশের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিল, যে-অংশটি শেষবিচার এবং সময় আর ইতিহাসকে সমাপ্ত করতে যিশুর প্রত্যাবর্তনের বিষয় নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। আর সে-কারণেই শ্রেণিবিন্যাসকারীরা তাদের বোর্ডের উপর এদের চার্চ নয় বরং সেক্ট হিসাবে পিন দিয়ে সেঁটে রাখেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার বোস্টনে ‘দ্য চার্চ অব ক্রাইস্ট সায়েন্টিস্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর এটিকেও একটি সেক্ট হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। যিশুখ্রিস্টের জীবনে একটি বিশেষ দিকের ওপর এই গোষ্ঠীটি জোর দিয়েছিল এবং যে-বিষয়টিকে তারা তাদের গোষ্ঠীর মূল ভাবনা হিসাবে অনুসরণ করেছিল।

আর সেই দিকটি হচ্ছে একজন হিলার বা নিরাময়কারী হিসাবে যিশুর কাজ, যা ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স (খ্রিস্টীয় বিজ্ঞান)-এর মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিল। আর যে নবী এই আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন মেরি বেকার, ১৮২১-এ নিউ হ্যাঁম্পশায়ারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মেরি শৈশব থেকেই অসুস্থ আর বেশ দুর্বল শরীরের ছিলেন, আর বিরতিহীন অসুস্থতা আমৃত্যু তাকে অনুসরণ করেছিল। মার্কের গসপেলে বর্ণিত সেই নারীর মতো, যাকে চিকিৎসকের হাতে অনেক দুর্দশা সহ্য করতে হয়েছিল, আরোগ্য অনুসন্ধানে মেরিও অনেক সময় ব্যয় করেছিলেন। গতানুগতিক চিকিৎসা ছাড়াও তিনি সম্মোহন ও অন্যান্য বিকল্পপদ্ধতিও চেষ্টা করেছিলেন। কোনোকিছুই বেশিদিন কাজ করেনি। তারপর ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি একবার বরফে ঢাকা রাস্তায় পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন এবং সেই আঘাতে তার মেরুদণ্ডের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। তবে চিকিৎসার জন্যে এবার তিনি ভিন্নকিছু চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে না গিয়ে। বরং নিউ টেস্টামেন্টে একটি সমাধান খুঁজেছিলেন। ম্যাথিউ’র গসপেলের একটি অংশ নিয়ে ধ্যান করার সময়, যেখানে যিশু একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি নিজেও সেই নিরাময়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। আর শুধুমাত্র তার ক্ষতিগ্রস্ত মেরুদণ্ডেরই নিরাময় হয়নি, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন তিনি সেই বিজ্ঞানটি আবিষ্কার করতে পেরেছেন, যা যিশুর এই আরোগ্যদান করার ঘটনাগুলোর ভিত্তি।

এছাড়া যে-অনুধাবনটি তার মনে এসেছিল সেটি হচ্ছে : অসুখের ভিত্তি হচ্ছে একটি বিভ্রম বা মায়া। আর সেই মায়াটি হচ্ছে পদার্থের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা। কিন্তু পদার্থের সে-ধরনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলো সৃষ্টি করেছে ঈশ্বরের মন। মন হচ্ছে এর কারণ। পদার্থ হচ্ছে এর ফলাফল। সুতরাং নিরাময় পাবার উপায় হচ্ছে বস্তু বা পদার্থের ওপরে মনের ব্যবহার। এভাবে তিনি তার সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ’ বইটিতে লিখেছিলেন : ‘মানুষের জ্ঞান এগুলোকে পদার্থের শক্তি নামে ডাকে। কিন্তু স্বর্গীয় বিজ্ঞান ঘোষণা করেছে যে, সেগুলো সম্পূর্ণভাবেই স্বর্গীয় মনের অংশ… আর এই মনেরই অন্তর্গত অংশ। বস্তুর ওপর মন, এই মূলনীতি মানব দুঃখ লাঘবে ব্যবহার করা মানে স্বীকৃতি দেওয়া, যে-অসুখগুলো আমাদের আসলে আক্রান্ত করেছে সেগুলোর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এগুলো ছলনা, বিভ্রম, মায়া, মনের ওপর বস্তুর কারসাজি। আর আরোগ্যলাভের উপায় তাই ডাক্তারদের মাধ্যমে নয়, যারা একই খেলা খেলছেন, বস্তুবাদী খেলা। ঈশ্বরের ভালোবাসার শক্তির সামনে নিজেদের উন্মোচন করার মাধ্যমেই কেবল আরোগ্য আসে, আমাদের সুস্বাস্থ্য আর বাস্তবতাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যা এই অসুস্থতার বিভ্রমটি দূর করে। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স আমাদের অসুস্থতা থেকে আরোগ্য দান করছে না। এটি সেই বিভ্রমটি থেকে আমাদের মুক্তি দেয়, যা আমাদের বিশ্বাস করিয়েছিল যে, আমাদের সেই অসুখটি আছে!

আর এটি এমন কোনো মতবাদ ছিল না, যা-কিনা নিউ ইংল্যান্ডের মূলধারা চার্চগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতে পারে। তারা বিশ্বাস করতেন না যে, এত সহজেই মানব-দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব হতে পারে। এর আসলেই অস্তিত্ব আছে, কোনো বিভ্রম নয়। তারা সন্দেহ করেছিলেন, মেরি বেকার, ‘পাপ’ আর ‘স্বর্গীয় বিচারে’ বাস্তবতা কিংবা স্বর্গ আর নরকের ধারণাটি বিশ্বাস করেন না। আর তিনিও আসলেই তা বিশ্বাস করতেন না। তার বইয়ে সবার জন্যে পরিত্রাণের নিশ্চয়তা ছিল। আর কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়, একবার যখন বস্তুর ওপর মনের সেই মূলনীতিটি বোঝা সম্ভব হবে। তার এই আবিষ্কারের সাথে মূলধারা চার্চের বিরোধিতায় হতাশ হয়ে, মেরি ১৮৭৯ সালে বোস্টনে, তার তৃতীয় স্বামী এ. গিলবার্ট এডিকে নিয়ে (যাকে তিনি ১৮৭৭ সালে বিয়ে করেছিলেন) চার্চ অব। ক্রাইস্ট সায়েন্টিস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি একটি সংবাদ পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’, যা এখনো প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপকভাবে সম্মানিত। একই সাথে বিখ্যাত মাদার’ চার্চ অব ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স’টিও, যা বোস্টনের ব্যাক বে এলাকায় চৌদ্দ একরের একটি বিশাল ভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে।

ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের ধর্মীয় সভায় মূলত বাইবেল এবং মেরি বেকার এডির মূল কাজ থেকে পড়া হয়, বিশেষ করে তার সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ’ বইটি। এছাড়া স্তব সংগীত গাওয়া হয় এবং নীরবতা পালন করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র একধরনের প্রার্থনা ব্যবহার করা হয়, সেটি হচ্ছে লর্ডস প্রেয়ার। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স কখনোই ব্যাপক গণআন্দোলনে পরিণত হতে পারেনি কিন্তু পৃথিবীর বহু জায়গায় এটি বিস্তার লাভ করেছিল। বহু শহরেই আপনি এই ধর্মগোষ্ঠীর কোনো একটি রিডিংরুম পাবেন, যেখানে মেরি বেকার এডির লেখা প্রদর্শনীতে সংরক্ষিত আছে, আর আপনি খুঁজে বের করতে পারেন, কীভাবে বস্তুর ওপর মনের সেই মূলনীতিটি, আপনাকে আক্রান্ত কোনো অসুখ থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশ্যে আপনি ব্যবহার করবেন। ১৯১০ সালে বোস্টনের একটি শহরতলীতে তার নিজের বাড়িতে মেরি বেকার মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

চল্লিশ বছর পরে, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে, আরেকটি আমেরিকান ধর্মের জন্ম হয়েছিল, যা ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের চেয়ে আরো অনেক বেশি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিরোধী ছিল। এই ধর্মগোষ্ঠীটি তাদের নাম দিয়েছিল, চার্চ অব সায়েন্টোলজি’, এবং এর নবী ছিলেন কল্প-বিজ্ঞানের একজন লেখক, লাফায়েট রোনাল্ড হুবার্ড, যিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হলিউডের তারকাদের মধ্যে এই ধর্মটি বেশ জনপ্রিয়। টম ক্রুজ আর জন ট্রাভোল্টা তাদের পেশাগত সাফল্যের জন্যে এই ধর্মের অনুশীলন আর মূলনীতির কাছে ঋণস্বীকার করেছিলেন। সায়েন্টোলজি আধুনিক প্রযুক্তি এবং মনো-বিশেষণের নানা কৌশল ব্যবহার করে থাকে। এর ভিত্তিমূলক দর্শনটি হচ্ছে পুনর্জন্ম-সংক্রান্ত প্রাচীন হিন্দু মতবাদ বা সামসারা’। এটি ‘থিটানস’ নামক একধরনের অমর আত্মাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যারা বহু ট্রিলিয়ন বছর ধরে একটি শরীর থেকে অন্য শরীরে প্রচরণ/ভ্রমণ করে আসছে। সায়েন্টোলজিতে এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নিশ্চিত হওয়া বেশ মুশকিল, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই থিটানরা কারো দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে হয় না। তারা নিজেরাই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। আর সেই মহাবিশ্বের মধ্যে তাদের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে তারা নিজেদের জন্য নানাধরনের বাহন সৃষ্টি করেছিলেন, আর মানুষের শরীর হচ্ছে তাদের সৃষ্টি করা বহু রূপগুলোর মধ্যে একটি মাত্র।

আর এখানে বিষয়গুলো আরো বেশি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। পৃথিবীর সব ধর্মগুলোই অশুভ বিষয় আর দুঃখকে ব্যাখ্যা আর সেটি একটি প্রতিকার সরবরাহ করার চেষ্টা করেছে। বাইবেল যেমন অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে করা একটি কাজকে এর জন্য দায়ী করেছিল, ঈশ্বরের করুণা আর দয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো একটি পতন, যার কারণে ইডেন থেকে আদম আর হাওয়াকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর মানব-ইতিহাস সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর স্বর্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার একটি অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মতত্ত্বে এটি ছিল কার্মা, কর্মের সূত্র, আমাদের যা বহু মিলিয়ন জীবনের চক্রের মধ্যে প্রচলিত করে, এতদিন-না আমরা সব পাপ থেকে মুক্ত হতে পারি এবং পরিশেষে নির্বাণে মুক্ত হতে পারি। সায়েন্টোলজি-এর শিক্ষায় এই দুটি জায়গা থেকেই প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করেছিল।

বহু মিলিয়ন জীবনের মধ্যে দিয়ে তাদের এই পরিক্রমায় থিটানরা তাদের কাটানো জীবনগুলোর অভিজ্ঞতার আঘাতজনিত কারণেই আবেগীয় এবং মনোজাগতিক স্তরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এটি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত আর দুর্বল করে। তোলে, যেভাবে খুব সহিংস কোনো শৈশব একজন মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ওপর ছায়া ফেলে। আর এই ক্ষতিকর অভিজ্ঞতাগুলোর কিছু ঘটে দুর্ঘটনাবশত। হুবার্ড তাদের বলেছিলেন এনগ্রামস। এগুলো শুধুমাত্র ক্ষত, যা এক সময় থিটানদের ওপর ফেলে যায়, যখন তারা বহু মিলিয়ন জীবনের মধ্যে তাদের ভ্রমণ। করে থাকে, যা মূলত সাধারণ কাটাছেঁড়ার মতোই। কখনো এই ক্ষতি পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত, যা থিটানরাই আরোপ করে, যারা অশুভ দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং অন্য থিটানদের ওপর যারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

হুবার্ড মানবমনের ওপর এইসব পরিকল্পিত ক্ষতগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘ইমপ্লান্টস’। এগুলো শুধুমাত্র শারীরিক কিংবা মানসিক যন্ত্রণারই মূল উৎস নয়, এগুলো খারাপ ধারণারও উৎস, যা পরিকল্পিতভাবে থিটানদের দিভ্রান্ত করে বিপথে পরিচালনা করতে রোপণ করা হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন : ‘এই ইমপ্লান্টের পরিণতি হচ্ছে নানা ধরনের অসুখ, উদাসীনতা, পদভ্রষ্টতা, নিউরোসিস আর মানসিক অসুস্থতা’। আর মানুষের সব দুর্গতির কারণই হচ্ছে এটি। তিনি বলেছিলেন, স্বর্গ-সংক্রান্ত খ্রিস্টীয় ধারণাটি ৪৩ মিলিয়ন বছর আগে মানবমনের মধ্যে প্রবিষ্ট করা হয়েছিল। আর প্রতারণার একটি কৌশল হিসাবে খুব সতর্কভাবে পরিকল্পিত দুটি ইমপ্লান্টই মূলত থিটানদের ভাবতে প্ররোচিত করেছিল যে, অসীমসংখ্যক ধারাবাহিক জীবনের বদলে তারা একটি মাত্র জীবন পাবেন।

এনগ্রাম আর ‘ইমপ্লান্টগুলো হচ্ছে সায়েন্টোলজির একটি সংস্করণ, খ্রিস্টধর্মে যেটিকে বলা হয় পতন বা ‘দ্য ফল’। মানব-দুর্দশার ব্যাখ্যা হচ্ছে এগুলো। এবং যা আমাদের আক্রান্ত করেছে তার জন্যে সায়েন্টোলজির নিরাময়টি একইভাবে সুনির্দিষ্ট। এনগ্রামগুলো নিজেদের মানুষের অবচেতন বা হুবার্ডের ভাষায় ‘রিঅ্যাকটিভ মাইন্ড’ বা ‘প্রতিক্রিয়াপ্রবণ’ মনের সাথে যুক্ত করে ফেলে, যা আমাদের জীবনে হতাশাগুলোকে উসকে দেয়। এর থেকে মুক্তি আসে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশোধন বা সেগুলোকে ‘পরিষ্কার করার মাধ্যমে, যে-প্রক্রিয়াটিকে ‘অডিটিং’ বলা হয়। শুনলে মনে হতে পারে একজন কাউন্সিলর কোনো রোগীর কথা শুনছেন, যিনি ধীরে ধীরে অতীতের কোনো ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, বর্তমানে যা তার হতাশার কারণ। কিন্তু সায়েন্টোলজি সেভাবে কাজ করে না। অডিটররা শোনেন তবে সেটি করার জন্যে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তাদের একটি যন্ত্র আছে, যাকে বলা হয় ইলেক্ট্রোসাইকোমিটার অথবা ই-মিটার, যা লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের মতো কাজ করে। এই ই-মিটার অডিটরদের সেই প্রশ্নগুলো খুঁজতে সহায়তা করে, যা মনের গভীরে ডুবে-থাকা স্মৃতিকে চেতনার স্তরে উন্নীত করে নিয়ে আসে। প্রতিটি এধরনের সেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ‘উইন’ বা উন্মোচনের একটি মুহূর্ত। এই ‘উইন’ অপরাধী অভিজ্ঞতাগুলোকে চেতনার উপরের স্তরে নিয়ে আসে এবং যেখানে যন্ত্রটি ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে এটি বিলুপ্ত করে দেয়। এমন নয় যে, ঘটনাটি মনে করা হয়েছে এবং তারপর এটি নিরাময় হয়েছে। এটি স্মৃতি থেকেই চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতীতের কোনোকিছুর জন্য স্বীকারোক্তি করা হয় না বা এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা হয় না, এটি মন থেকে মুছে ফেলা হয়।

সায়েন্টোলজিতে এটি ছাড়াও অন্য আরো পরিত্রাণমূলক কৌশল আছে, যার মাধ্যমে এটি এর অনুসারীদের নিজস্ব সংস্করণের একটি পরিত্রাণ সরবরাহ করে। কিন্তু এই পরিত্রাণটি খুবই বিশেষায়িত অর্থে। এটি এই জীবনেই সীমাবদ্ধ, যে জীবন এই মুহূর্তে বিশ্বাসীরা কাটাচ্ছেন। সুতরাং কোনো চূড়ান্ত মুক্তি কিংবা নরকদণ্ড নেই। কোনো স্বর্গ বা নরক নেই। জীবন মাত্র একবার কাটানোর বিষয় নয়। শুধুমাত্র এই জীবনের পরে অন্য জীবনে চিরন্তন প্রত্যাবর্তন। এটি একটি ‘সামসারা’ যেখানে নির্বাণ নেই। আর সায়েন্টোলজি যা করে সেটি হচ্ছে, আপনার শরীর থেকে এনগ্রামগুলো বিশোধন আর ইমপ্লান্টগুলোর উপস্থিতির স্বীকৃতি দিয়ে আপনার সাম্প্রতিক জীবনটিকে উন্নত করে তোলে।

কিন্তু বিষয়টি শস্তা নয়। আপনাকে এইসব নিরাময়ের পদ্ধতিগুলোর জন্যে সত্যিকারের অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর এগুলো খুবই ব্যয়সাধ্য। সায়েন্টোলজির রহস্যগুলোর যত ভিতরে আর গভীরে আপনি প্রবেশ করবেন, তত বেশি আপনাকে নগদ অর্থ অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। আর সে-কারণে এর সমালোচকরা বলেন, এটি আসলে ‘ব্যবসা’, কোনো ধর্ম নয়। যার উত্তরে সায়েন্টোলজিস্টরা দাবি করেন যে, ধর্মীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে টাকা আদায় করতে অন্য ধর্মগুলোও তাদের নিজস্ব উপায় ব্যবহার করে, তাহলে তারা কেন সেটি করতে পারবে না? লাফায়েট রন হুবার্ড ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তিনি আবার একজন সায়েন্টোলজিস্ট, নাকি অন্য কোনো রূপে ফিরে এসেছেন, তা বলা অসম্ভব। সুতরাং আমরা জানি না তিনি এখনো তার উদ্ভাবিত এই প্রোগ্রামে আছেন কিনা।

সায়েন্টোলজির মতো ধর্মগুলো একের-পর-এক আবির্ভূত হতে থাকে, এবং তারা তাদের ধর্ম নিয়ে যা কিছু দাবি করেন, সেখানে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। হয়তো এর কারণ, যেমন, ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব ইকলিজিয়াস্টিজ বলেছে, কোনোকিছু সম্বন্ধেই আর নতুন কিছু বলার নেই : যা কিছু ছিল তাই থাকবে এবং যা কিছু করা হয়েছে সেগুলো আবার করা হবে, এবং এই সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই। আর এটি অবশ্যই সত্য শেষ যে, ধর্মটির ক্ষেত্রে, যা নিয়ে আমি আলোচনা করতে যাচ্ছি এই অধ্যায়ে : ‘দি ইউনিফিকেশন চার্চ অথবা হলি স্পিরিট অ্যাসোসিয়েশন ফর দি ইউনিফিকেশন অব ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি, যাদের ডাকনাম হচ্ছে, মুনিস’, আর তারা এই নামটি পেয়েছেন তাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং নবী সুন মিউঙ মুনের নাম থেকে। মুন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যখন তার বয়স ষোলো, একবার যিশু তার সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাকে বলেছিলেন, তার লক্ষ্য পূরণ করতে তার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। মুন যৌনতার ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইভ/হাওয়া ভালোবাসা থেকে এটিকে পৃথক করে মানবতার জন্যে যৌনতাকে ধ্বংস করেছে। অ্যাডামের সাথে মিলন করা ছাড়াও, সে শয়তানের সাথে মিলিত হয়েছিল। এবং সেই কলঙ্ক পরবর্তীতে মানবতার মধ্যে প্রবেশ করেছে।

সুতরাং এই পরিস্থিতির সমাধান করতে ঈশ্বর যিশুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনাটি ছিল, তিনি বিয়ে করবেন এবং পাপমুক্ত সন্তান উৎপাদন করবেন। এভাবে সায়েন্টোলজি থেকে একটি শব্দ ধার করে মানবতার যৌন-অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবিষ্ট ইভ/হাওয়ার সেই পাপের ইমপ্লান্ট’ বিশোধন করা যেতে পারে এবং যিশু ও তার স্ত্রী পাপহীন সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সঠিক সঙ্গিনী খুঁজে বের করার আগেই যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল, এবং সে-কারণে মানবজাতিকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঈশ্বরের পরিকল্পনা আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি আবার সফল হবার সব সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। যিশুর অসমাপ্ত কাজটি সম্পূর্ণ করতে সুন মিউঙ মুনকে মেসাইয়া হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর একটি আদর্শ পরিবার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এটি করা সম্ভব হবে, যার ভালোবাসার বিশুদ্ধতা অবশেষে ইভ/হাওয়ার পাপের নিষ্পত্তি করবে।

মুনের অবশ্য চতুর্থ স্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, যিনি তার জন্যে সবচেয়ে সঠিক সঙ্গী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। এবং বিয়ের মাধ্যমে তিনি তার মানবতার আত্মার মুক্তির আন্দোলনটি শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারপর তিনি তার অনুসারীদের তার উদাহরণ অনুসরণ করতে বলেন। আর তিনি সেটি একটি সম্মিলিত অনুষ্ঠানে করতে তাদের উৎসাহ দিয়েছিলেন, যেখানে কিছু সম্মানীর বিনিময়ে কয়েক হাজার দম্পতি একই সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গী নির্বাচন করে দেওয়া হয়েছিল। এটি নিশ্চয়ই বেশ ব্যবসা-সফল একটি পরিকল্পনা ছিল। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ৯২ বছর বয়সে যখন সুন মিউঙ মুন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন তার সম্পদের মূল্য ছিল প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার।

ইউনিফিকেশন চার্চ সত্তরের দশকে পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং এর সদস্য হতে বহু তরুণকে এটি আকৃষ্ট করেছিল। ধর্মটির মূল শিক্ষার এই সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্রটি প্রদর্শন করে কীভাবে ধর্মে ‘দ্য ফল, পাপে পতিত হওয়া এবং পরিত্রাণ পাবার মূল ধারণাগুলোর পুনরাবৃত্তি আর পুনর্নবায়ন করা হয়েছে। মানব অসন্তুষ্টি নিরন্তর এর সমস্যাগুলোর সমাধান অনুসন্ধান করে। আর সবসময়ই আরো একটি নতুন ধর্ম সরবরাহ করতে অত্যুৎসাহী কেউ মঞ্চের উইংএ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। আর সে-কারণে পরের অধ্যায়ে একটি আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করা স্বস্তির মনে হতে পারে, যাদের উদ্দেশ্য ধর্মের সংখ্যা বহুগুণে বাড়ানো নয় বরং তাদের একত্রে নিয়ে আসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *