৩৫. মহা-হতাশা

অধ্যায় ৩৫. মহা-হতাশা

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিউইয়র্ক রাজ্যে জোসেফ স্মিথই শুধু একমাত্র নবী ছিলেন।

। আর তার চার্চ অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্টসও শুধু সেখানে আবির্ভূত হওয়া একমাত্র নতুন ধর্ম ছিল না। অনেক উদ্দীপনা ছিল চারিদিকে কিন্তু সেই উদ্দীপনাগুলোর অনুসরণকারীরা সবাই একই দিকে তাকাননি। স্মিথ মাটি খুঁড়ে অতীতের একটি নতুন সংস্করণ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ ছিলেন যারা অতীতে নয় বরং ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চেয়েছিলেন। তারা অতীত নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তারা ভবিষ্যতের দিকে তাদের মনোযোগ দিয়েছিলেন, কারণ বাইবেলে যিশুর প্রত্যাবর্তন-সংক্রান্ত ঐসব প্রতিশ্রুতিগুলো পূর্ণ হবার সময় আসন্ন। তিনি ফিরে আসছেন এবং খুব শীঘ্রই সেটি ঘটবে!

আর এই বিষয়ে যে-ব্যক্তিটি সবচেয়ে নিশ্চিত ছিলেন, তিনি ছিলেন লো হ্যাঁম্পটনের বাসিন্দা উইলিয়াম মিলার। মিলার খুবই মনোযোগী একজন বাইবেল পাঠক ছিলেন। নিউ আর ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই সূত্রগুলো তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল, যা জীবন্ত আর মৃতদের বিচার করার জন্যে খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সম্বন্ধে পূর্বধারণা করেছিল। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, নিশ্চয়ই বাইবেলে গোপন কোনো সংকেত আছে, যা তাকে যিশুর দ্বিতীয় আগমনের সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ জানাতে পারে, যদি কিনা তিনি বিষয়টি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, ডানিয়েল হচ্ছে পড়ার জন্যে সেই বইটি, যদি আপনি এই রহস্যের সমাধান খোঁজার খেলাটি খেলতে আগ্রহী হন। আর ঠিক সেখানেই মিলার সেই সংকেতগুলো খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তিনি খুঁজছিলেন।

ডানিয়েলের অষ্টম অধ্যায়ে নবী লিখেছিলেন : ‘দুই হাজার আর তিনশো দিন অতিক্রান্ত হবার পর; সেই আশ্রয়স্থল বিশুদ্ধ হবে’। মিলার নিশ্চিত ছিলেন যে এটাই সেই সংকেত, যার অনুসন্ধান তিনি করছিলেন। এর মানে ২৩০০ বছর! সামনের দিকে গণনা করে তিনি সেই তারিখটি নির্ধারণ করেছিলেন, যেদিন খ্রিস্ট আবার ফিরে আসবেন : ২১ মার্চ, ১৮৪৪। তিনি এর জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। তিনি মনে করেছিলেন, নিশ্চয়ই তার গণনায় কোনো ভুল হয়েছে। সুতরাং তিনি আবার চেষ্টা করেছিলেন, এবার তিনি পেলেন এই বছরের ২২ অক্টোবর। কিন্তু সেই দিনটিও এসে চলে গিয়েছিল। আবারও কিছুই ঘটেনি। মিলার ও তার অনুসারীদের জন্যে এই ব্যর্থতা ‘গ্রেট ডিসাপয়েন্টমেন্ট (বা মহা আশাভঙ্গের ঘটনা) নামে পরিচিত ছিল। সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে মিলার এই ভবিষ্যদ্বাণীর খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু অন্যরা এই খেলা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ১৮৬০ সালে তারা নিজেরাই একটি ধর্মগোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন তাদের নিজস্ব নবীসহ। তারা নিজেদের ‘সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট’ নাম দিয়েছিলেন, অ্যাডভেন্টিস্ট, কারণ যিশু খুব শীঘ্রই ফিরছেন এই বিশ্বাসটি তারা ধরে রেখেছিলেন, যদিও তারা সঠিক তারিখটি নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এটি ‘সেভেন্থ ডে’ কারণ, তারা রোববার নয়, শনিবারকে তাদের সাবাথ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তারা সাবাথকে সপ্তাহের প্রথম দিনের বদলে শেষদিন হিসাবে চিহ্নিত করার জন্যে ক্যাথলিক চার্চকে অভিযুক্ত করেছিলেন। আর এই সাবাথ পরিবর্তনের ব্যাপারটি রোমের চার্চের বিরুদ্ধে তাদের সব অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ন্যূনতম একটি অভিযোগ ছিল। ক্যাথলিক চার্চের পোপ এখন খ্রিস্ট-বিরোধী, এ বিষয়ে তারা স্কটিশ সংস্কারক জন নক্সের সাথে একমত ছিলেন।

অ্যাডভেন্টিস্টদের নবী ছিলেন এলেন হোয়াইট। ১৮২৭ সালে জন্ম নিয়ে তিনি ১৯১৫ সালে মারা গিয়েছিলেন। এবং তার লেখাগুলোই সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্টদের মধ্যে বাইবেলের মতোই একটি কর্তৃত্ব পেয়েছিল। তারা অন্য বহু ধর্মগোষ্ঠীর মতো খুব কঠোর নৈতিক মূলনীতি অনুসরণ করতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেমন নিরামিষ ভোজন, আর তামাক, মদ, নাচ এবং অধিকাংশ ধরনের আমোদপ্রমোদই তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তারা ট্রিনিটি আর খ্রিস্টের স্বর্গীয় দেবত্বে বিশ্বাস করতেন। এবং তারা ক্ষমতায় এবং স্বমহিমায় খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে মৃত্যুর পর তাদের সাথে কী হবে সেই ধারণায় প্রচলিত বিশ্বাস থেকে তারা ভিন্নমত পোষণ করতেন।

আনুষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদ হচ্ছে, শেষবিচারের দিনে সমস্ত মানুষকে দুটি দলে ভাগ করা হবে। একটি দল তাদের অনন্তকাল কাটাবে নরকে, জীবদ্দশায় করা তাদের সব পাপকর্মের শাস্তি হিসাবে। এবং অন্যদিকে সন্মানুষরা স্বর্গের অনন্ত পরমানন্দে বসবাস করার অধিকার অর্জন করবেন। এলেন হোয়াইট এই মতবাদটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :

ভালোবাসা আর দয়ার প্রতিটি আবেগের কাছে, এমনকি আমাদের ন্যায়বিচারের ধারণার কাছেও কতটা অসহনীয় আর অগ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন কোনো মতবাদ, যা দাবি করছে পাপী মৃতরা অনন্তকাল একটি জ্বলন্ত নরকে আগুন আর গন্ধকে জীবন্ত দগ্ধ হতে থাকবেন, আর সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনের পাপের জন্যে তাদের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ঈশ্বর যতদিন বাঁচবেন ততদিন অবধি।

পাপীদের অনন্তকালের নরক-যন্ত্রণায় না পাঠিয়ে, হোয়াইট বলেছিলেন, ঈশ্বর তাদের চিরন্তন বিস্মরণের একটি জগতে প্রেরণ করেন। সম্পূর্ণভাবেই নিশ্চিহ্ন, অনন্ত কালের নরক-যন্ত্রণা ভোগ করাই পাপীদের নিয়তি নয় বরং তারা সম্পূর্ণভাবেই অস্তিত্বহীন আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। ‘আর কোনো ঈশ্বর-বিদ্রোহী ভ্ৰষ্ট আত্মাই সেখানে থাকবে না, নরকের গভীরে অনন্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা কোনো আত্মা সেখানে থাকবে না, কোনো অভাগা আত্মার আর্তনাদ পরিত্রাণ পাওয়া আত্মাদের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হবে না’। সেইন্ট থমাস অ্যাকোয়াইনাস অবশ্যই এর সাথে একমত হতেন না।

হোয়াইটের এই ‘নরক’ বিলোপের ধারণাটি পছন্দ করেছিলেন ঊনবিংশ শতকের আরেকজন আমেরিকান, যিনি এই পৃথিবীর কখন পরিসমাপ্তি হবে সেটি অনুসন্ধান করছিলেন। চার্লস টেজ রাসেল ছিলেন পিটসবার্গের একজন দোকানি, উইলিয়াম মিলারের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। তবে মিলারের ব্যতিক্রম, তিনি সেই মহা-আশাভঙ্গের হতাশার কাছে পরাজয় স্বীকার করেননি যখন যিশুর প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তাদের ধারণামতো ঘটেনি। তিনি এই সমস্যাটির সমাধান করেছিলেন এই বলে যে, যিশু আসলে ফিরে এসেছেন, তবে তিনি তার উপস্থিতি লুকিয়ে রেখেছেন অদৃশ্য একটি চাদরের আড়ালে। সুতরাং এই দিনগুলোই ‘ছিল’ শেষদিন এবং সেই ‘এন্ড টাইম বা শেষ সময় আসলেই ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি দৃশ্যগতভাবে এর চরম শিখরে উঠবে ১৯১৪ সালে আরমাগেডনের শেষ যুদ্ধের সময়।

স্কটিশ-সংস্কারক জন নক্সের মতো, রাসেলও ওল্ড টেস্টামেন্টের নবী ডানিয়েলকে নিউ টেস্টামেন্টের নবী জনের সাথে এক করে ফেলেছিলেন, যিনি বুক অব রিভিলেশন লিখেছিলেন। জনকে আইলে অব পাটমসে নির্বাসিত করা হয়েছিল যখন রোমসম্রাট ডমিসিয়ান চার্চ এবং খিস্টানদের উপর তার নির্যাতনপর্বটি শুরু করেছিলেন। এভাবে বইটি শুরু হয়েছিল, যিশুখ্রিস্টের কাছে আসা ঐশী প্রত্যাদেশ, যা ঈশ্বর তাকে জানিয়েছিলেন, সেইসব কিছু তার ভৃত্যদের প্রদর্শন করতে, খুব শীঘ্রই যা শেষ হতে যাচ্ছে…’। জন এরপর আমাদের বলেন, তিনি একধরনের ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন লর্ডস ডে’ বা রোববারে এবং তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন, ‘দেখো, একজন চোর হিসাবে আমি এসেছি। সেই ব্যক্তি আশীর্বাদপুষ্ট, যিনি সতর্ক নজর রাখেন…’। এই কণ্ঠটি ঘোষণা করেছিল যে, শেষ যুদ্ধটি সংঘটিত হবে এমন একটি জায়গায় হিব্রুভাষায় যে-জায়গাটির নাম আর্মাগেডন’। জেরুজালেমের উত্তরে একটি মাঠের নাম ছিল আমাগেডন, এবং ইজরায়েলের ইতিহাসে বেশকিছু যুদ্ধ এখানে সংঘটিত হয়েছিল।

এটুকুই রাসেলের জন্য যথেষ্ট ছিল। ১৮৭৯ সালে তিনি একটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা করেন, যার নাম ছিল দ্য ওয়াচটাওয়ার, সেইসব অনুসারীদের জন্যে যারা যিশুর দ্বিতীয় আগমন ও এর পরে আসা আর্মাগেডনের ব্যাপারে সতর্ক নজর রেখেছেন। ভবিষ্যতে কী আসছে সেই বিষয়ে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব তত সংখ্যক মানুষকে তারা সতর্ক করতে চান। যদিও তাদের হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র ১৪৪,০০০ জন মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন। বাকি সবাই, যেমন, এলেন হোয়াইট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবার জন্যে নিয়তি-নির্দিষ্ট। রাসেল অ্যাডভেন্টিস্টদের থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তিনি খুবই বাছবিচার করেছিলেন। নরকের ধারণাটি বাদ দিতে পেরে তিনি খুশি হয়েছিলেন, তবে তিনি আরো কিছু বাদ দিতে চেয়েছিলেন। ট্রিনিটির ধারণাটি বাদ দিতে হবে, ঈশ্বর বা জিহোভা, তাকে যে নামে ডাকতে তিনি পছন্দ করতেন, শুধুমাত্র তাকেই তার দরকার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় একধরনের আর্মাগেডন আসলেই ১৯১৪ সালে ইউরোপকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু এমন কিছু নয় যা রাসেল প্রত্যাশা করেছিলেন। এবং যখন তিনি ১৯১৬ সালে মারা যান, তিনি তখনো আসল আর্মাগেডনের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ওয়াচটাওয়ারের নেতা হিসাবে যে মানুষটি তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন খুব দক্ষ একজন ব্যবসায়ী, জোসেফ আর. রাদারফোর্ড। তিনি খুব দ্রুত রাসেলের অনুসারীদের একটি দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৩১ সালে তিনি তাদের নাম বদলে রাখেন ‘জিহোভাস উইটনেস’। তিনি অনুসারীদের ওপর কঠোর শৃঙ্খলা আর নিয়ম আরোপ করেছিলেন, যা তাদের চারপাশের মূলধারার সমাজ থেকে পৃথক করে রেখেছে। তিনি তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে, অন্তর্মুখী করে তুলেছিলেন।

বেশ সাহসের প্রয়োজন হয় যখন কেউ আধুনিক সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এর সব মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করে, এমনকি যেভাবে এটি চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। জিহোভাস উইটনেসের সদস্যরা কোনো রক্ত পরিসঞ্চালন গ্রহণ করেন না। রক্ত তাদের জন্যে জীবন এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরই সেটি দিতে পারেন। সুতরাং তারা মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আইনের মুখে পড়েন তখন তারা তাদের শিশুদের শরীরেও রক্ত পরিসঞ্চালন করতে বাধা দেন। আর এভাবে সারা পৃখিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যাপারটি কোনো একটি গোষ্ঠীকে খুব শক্তিশালী আত্মপরিচয়ের একটি অনুভূতি দিতে পারে। আর সব নির্যাতন এই সংকল্পটিকে আরো দৃঢ়তর করে তুলতে পারে। এছাড়া যদি এর বিশ্বাস নিয়ে কেউ মন পরিবর্তন করেন, এমন কোনো পক্ষে সেই গোষ্ঠী থেকে তার হয়ে আসার ব্যাপারটিকেও এটি খুব কঠিন করে তোলে।

রাদারফোর্ড ১৯৪২ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমাগেডন তখনো আসেনি, যদিও এর একটি ভালো অনুকরণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছিল। আরো একবার জিহোভাস উইটনেসের সদস্যরা এই হতাশা সহ্য করেছিলেন। নতুন নেতারা ইতিহাসে আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। খ্রিস্ট অবশ্যই ফিরে আসবেন, সুতরাং নজর রাখা অব্যাহত রাখুন। মর্মনদের মতো, উইটনেস সদস্যরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে ধর্ম প্রচার করার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। এবং তাদের আন্দোলনে এভাবে আরো সমর্থক তৈরি করা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। তাদের উপাসনালয়গুলোকে চার্চ বলা হয় না, কিংডম হল’ বলা হয়। সারা পৃথিবীজুড়েই তারা তাদের মতাদর্শ প্রচারে একটি ম্যাগাজিন বিক্রয় করে, ‘দ্য ওয়াচটাওয়ার। তারা প্রহরীর মতো নজর রেখেছে এখনো, দিগন্তে চোখ রেখে, যিশুর জন্যে, যিনি রাতে চোরের ছদ্মবেশে ফিরে আসবেন।

সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট আর জিহোভাস উইটনেসের মতো ধর্মগোষ্ঠীগুলো বাইবেলের সবচেয়ে অদ্ভুত আর বিব্রতকর একটি বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সেই বাস্তব তথ্যটি : দুই হাজার বছর অপেক্ষা আর নজরদারির পরেও, খ্রিস্ট এখনো ফিরে আসেননি। উদার খ্রিস্টানরা এই সমস্যাটির মোকাবেলা করে থাকেন খানিকটা সূক্ষ্ম উপায়ে। তারা দ্বিতীয় আগমনকে অবিশ্বাস করেন না, কিন্তু কীভাবেই বা তারা সেটি করবেন? কারণ এটি খুব দৃঢ়ভাবে বাইবেলের ভিত্তিতে আছে। তাদের বিশ্বাসে এটি বারবার আলোচিত হয়েছে। ক্রিসমাসের আগের মাসটি- ‘অ্যাডভেন্ট’ –এই বিষয়ের অর্থ নিয়ে ধ্যান করার সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

তারা এটিকে মোকাবেলা করার এমন কিছু প্রস্তাব করে যে, ঈশ্বরের সেই রাজ্য ইতিমধ্যে এখানে উপস্থিত। খ্রিস্টানদের যা করতে হবে তা হলো এর প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে। এটির সন্ধান মিলবে যেখানে দরিদ্র আর অসহায়দের সহায়তা করা হবে, অবিচার আর অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করা হবে। এটি সেখানে পাওয়া যাবে, যেখানে ভালো মানুষরা এই পৃথিবীতে আরো উত্তম করে গড়ে তুলতে কাজ করবেন, এমন একটি পৃথিবী হবে সেটি, যা অনেকটাই যিশুর বর্ণিত সেই ঈশ্বরের রাজ্যের মতো। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনে যিশু প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতিও আছে। সেগুলো এসেছে এমন একটি বই থেকে, যা নিউ টেস্টামেন্টে জায়গা। পায়নি। যদিও এটি যিশুর সত্যিকারের বক্তব্য ধারণ করে। এটির নাম ‘গসপেল অব টমাস’। এখানে অনুসারীরা যিশুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কখন এই রাজ্যটি আসবে’? যিশু উত্তরে বলেছিলেন, এর জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকলে এটি আসবে না। এটি শুধুমাত্র মুখে বলা কোনো কথার কথা নয়, এখন এসেছে বা ঐ যে আসছে ইত্যাদি, বরং পিতার রাজ্য সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে, আর কেউই সেটি দেখতে পাচ্ছে না।

এই দৃষ্টিভঙ্গিকে দ্বিতীয় আগমনের সত্যিকারের বিশ্বাসীরা দুর্বল একটি ধারণা বলেই মনে করেন। তারা আরো সুস্পষ্ট জীবন্ত কিছু চান। তারা একটি আর্মাগেডন চান। আর আমেরিকার খ্রিস্টধর্ম এই আর্মাগেডন সরবরাহ করতে সফল হয়েছে। হয়তো এর কারণ আমেরিকানরা নিজেদের ঈশ্বর-নির্বাচিত একটি জাতি হিসাবে দেখেন, ব্যতিক্রম একটি জনগোষ্ঠী যাদের ঈশ্বর-নির্দেশিত একটি নিয়তি আছে। আমরা যেভাবে এটি ব্যাখ্যা করি না কেন, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে আমেরিকা এমন বহু ধর্মগোষ্ঠী দিয়ে পূর্ণ, যারা পৃথিবীর পরিসমাপ্তি আর খ্রিস্টের ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। এবং তারা এখনো সেটি কামনা করছেন। প্রায়শই নতুন নবীদের আবির্ভাব হয়, যারা ঘোষণা করেন শেষদিন আসন্ন প্রায়। এবং সেই বার্তাটিকে তাদের অনুসারীদের মনের গভীরে প্রবেশ করাতে তারা নতুন আর বিচিত্র নানা উপায়ও খুঁজে নেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল কয়েকটি উপায়ে এই বার্তাগুলো প্রচার করতে একটি দীর্ঘ কাহিনির আশ্রয় নিয়েছে, আর সেটি ধারাবাহিক একটি উপন্যাসের রূপে, যা কেউ তাদের স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে কিনতে পারেন।

ধর্মপ্রচারকারী মিনিস্টার টিম লাহায়েকে বলা হয় গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী একজন আমেরিকান খ্রিস্টান। তিনি মূলত যিশুর দ্বিতীয় আগমনের কাহিনিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন, বলা যায় একধরনের বৈদ্যুতিক উত্তেজনা তিনি সেখানে সঞ্চারিত করেছিলেন। তার লেফট বিহাইন্ড’ ধারাবাহিকে ষোলোটি উপন্যাস আছে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপট থেকে বইগুলো এর শক্তি সঞ্চয় করেছে। এই বইগুলোর কাহিনির প্রেক্ষাপট ইজরায়েল নয়। এটি ঘটছে এখনই, বর্তমান এই সমস্যাপূর্ণ আর সহিংস পৃথিবীতে। ‘দ্য রাপচার’ নামে পরিচিত এই বইগুলোর ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে, অর্থাৎ শেষ শুরু হয়েছে। এবং সত্যিকারের বিশ্বাসীরা যে-মুহূর্তে এটি শুরু হয়েছে, তারা সেই মুহূর্তে যা কিছু করছিলেন সেখান থেকে স্বর্গে আরোহণ করেছেন। তারা যদি তখন গাড়ি বা উড়োজাহাজ চালাতে থাকেন, তাদের চালকের সিট থেকে অনন্তজীবনে টেনে তুলে নেওয়া হয়েছে, তাদের পরিত্যক্ত গাড়ি বা উড়োজাহাজ চোখ-ধাঁধানো বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত হয়েছে।

আর ‘লেফট বিহাইন্ড’ বিশ্বটি বিশৃঙ্খলতায় পতিত হয়েছে, এবং সবাই পাগলের মতো একজন নেতাকে খুঁজছেন, যিনি তাদের এই ভয়াবহ আতঙ্কিত পৃথিবী থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। এবং একজন আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই দৃশ্যে। তারা তাকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে নির্বাচিত করেছিল, কারণ তাদের মনে হয়েছিল, তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই গ্রহে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু পৃথিবীর মানুষরা যা জানতেন না, সেটি হচ্ছে তিনি আসলে বাইবেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই অ্যান্টি-ক্রাইস্ট বা খ্রিস্টবিরোধী একজন চরিত্র। একজন প্রতারক, যিনি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। সেই বিস্ট বা পশু! যদি এই কাহিনিটি রিফরমেশনের সেই সময়ের হতো, তাকে হয়তো তারা পোপের আসনে বসাতেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় আমেরিকানদের ঘৃণার পাত্র আজ আর পোপ নয়। এটি হচ্ছে জাতিসংঘ। উপন্যাসগুলোয় একজন পাইলট আর তার কিছু বন্ধু খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটছে। তারা এই নতুন অ্যান্টি-ক্রাইস্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, যারা বাকি সব প্রত্যাখ্যাতদের প্রস্তুত করেন সেই ‘গ্রেট ট্রাইবুলেশন’ পর্বের জন্যে, আর সেটি হচ্ছে পৃথিবীর শেষদিনটির একটি ভূমিকা। এ-যাবৎ এই উপন্যাসগুলোর ৬৫ মিলিয়ন কপি বিক্রয় হয়েছে। মহাপ্রলয় বা শেষদিনের ধর্ম নিয়ে এখনো অনুশীলন অব্যাহত রাখতে আমেরিকার যথেষ্ট পরিমাণ দম আছে।

কিন্তু এটাই একমাত্র ধর্ম নয়, গত শতবছরে সেখানে যা আবির্ভূত হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *