৩৪. আমেরিকায় জন্ম

অধ্যায় ৩৪. আমেরিকায় জন্ম

আমি এডিনবরায় থাকি এবং হাঁটতে পছন্দ করি। সাধারণত শহরের বাইরে পাহাড়ের দিকেই হাঁটতে বেশি ভালোবাসি, কিন্তু সেটি করার মতো সময় হাতে না-থাকলে আমি আমার বাড়ির আশেপাশের রাস্তাগুলোয় হাঁটি। এই হাঁটার সময় মাসে বেশ কয়েকবার আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসেন কিছু তরুণ। এই কাজগুলো তারা সবসময় জোড়বেঁধে করে থাকেন। সবসময়ই তাদের পরনে থাকে সুন্দর বিজনেস স্যুট, শার্ট আর টাই। আর সবসময়ই তারা বিশেষভাবে বিনয়ী। তাদের বাচনভঙ্গি সবসময়ই আমেরিকান। আর তারা সবসময়ই আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। আপনি কি যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে কিছু জানতে চান? আপনি কি বাইবেল সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে চান? আমি সাধারণত ভদ্রভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি এবং হেঁটে চলে যাই। কিন্তু আমি জানি এই এলাকায় হাঁটার সময় আমাকে আবার এই একই প্রশ্ন করে বিরক্ত করা হবে। আমি অবশ্য রাগ করি না। আমি জানি তারা মিশনারি হিসাবে স্কটল্যান্ডে এসেছেন। আমি জানি তারা আমাকে রক্ষা করতে চাইছেন।

আমার সম্বন্ধে তারা কিছুই জানেন না, কিন্তু আমি তাদের সম্বন্ধে বেশকিছু জানি। আমি জানি যে, তারা মর্মন, চার্চ অব জেসাস ক্রাইস্ট অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্ট থেকে এদেশে এসেছেন। আমি জানি তাদের মূল দপ্তরটি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের একটি রাজ্য, ইউটাহ’র সল্ট লেক সিটিতে অবস্থিত। আর আমি জানি এই চার্চের প্রতিটি পুরুষ-সদস্যকে বাধ্যতমূলকভাবে দেশে অথবা বিদেশে দুই বছর মিশনারি হিসাবে তাদের চার্চকে সেবা দিতে হয়। আর সে-কারণে আমি এই তরুণদের সাথে দ্র ব্যবহার করি, যারা আমাকে ধর্মান্তরিত করতে চেষ্টা করে। নিজ দেশ থেকে এখন বহুদূরে, বেশ শীতল একটি আবহাওয়ায় তাদের কাজ করতে হচ্ছে, এমন একটি দেশে যে-দেশটি সম্বন্ধে খুব সামান্যই তারা জানেন, আর চেষ্টা করছেন আমাকে প্ররোচিত করতে, যেন আমি বিশ্বাস করি যে যিশুখ্রিস্ট ফিরে এসেছেন। অবশ্যই এর আগেও আমি এমন কথা শুনেছি, কিন্তু তারা যেভাবে বলে থাকেন, সেভাবে নয়। তারা আমাকে জানাচ্ছেন যে, এরপর। যখন যিশু আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, তিনি জেরুজালেম নয়, বরং আমেরিকায় আসবেন। এবং এটাই তার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ নয়, এর আগেও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।

কীভাবে তারা সেটি জানতে পারলেন? কোথায় তারা এই তথ্যটি পেয়েছেন? তারা এই তথ্যটি ঠিক সেভাবেই পেয়েছিলেন, যেভাবে সব ধর্মীয় ধারণা সাধারণত পৃথিবীতে প্রবেশ করে থাকে। একজন নবীর কাছ থেকে, যিনি কোনো দৈবদৃশ্য বা কণ্ঠের নির্দেশ শুনেছিলেন এবং তিনি লিখে রেখেছিলেন যা সেই ঐশী উৎস থেকে তার কাছে উন্মোচিত করা হয়েছিল। এবং তিনি অন্যদের সেটি বিশ্বাস করার জন্যে প্ররোচিত করেছিলেন। এই নবী ছিলেন একজন আমেরিকাবাসী। তার নাম ছিল জোসেফ স্মিথ। তিনি ভারমন্টের শ্যারনে একটি সাধারণ কৃষক-পরিবারে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পরিবারটি পরে নিউইয়র্কের উত্তরাঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল। শৈশব থেকেই নিজের শহরের প্রটেস্টান্ট চার্চগুলোর মধ্যে বিভাজন আর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে তিনি বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কীভাবে তিনি এদের মধ্য থেকে একটি বেছে নেবেন?

তার আগে আসা নবীদের মতো এই সমস্যাটি নিয়ে প্রার্থনা করতে তিনি সবকিছু থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন এবং এই প্রার্থনা করার সময় তিনি একটি দৈব্যদৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। একজন ফেরেশতা তাকে স্থানীয় সব চার্চ এড়িয়ে চলতে উপদেশ দিয়েছিলেন। এর কারণ হিসাবে তিনি তাকে বলেছিলেন, তারা যিশুর শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। প্রথম অ্যাপোস্টলের মৃত্যুর পর থেকে দূষিত ধারণাগুলো খ্রিস্টধর্মে প্রবেশ করেছে এবং এটি দিভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু এটি আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, আর তিনি হবেন এই পরিবর্তনের নিয়ামক। তার উচিত হবে নিজেকে প্রস্তুত রাখা। উপযুক্ত সময় হলে তিনি চার্চকে এর মূল বিশুদ্ধরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এবং আবারো এটিকে সত্যপথে চলার নির্দেশনা দেবেন।

সুতরাং তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। এবং যখন তার বয়স পঁচিশ, সেই আমূল–পরিবর্তনকারী ঐশী নির্দেশটি এসেছিল। একজন ফেরেশতা প্রাচীন আমেরিকার নবীদের লেখা একটি সংকলনের অস্তিত্বের কথা তাকে জানিয়েছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীর কোনো একটি সময়ে সোনার ফলকের উপর একটি বই খোদাই করে লেখা হয়েছিল, আর নিউইয়র্কে পালমিরায় একটি পাহাড়ে সেগুলোকে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন মর্মন নামের একজন ব্যক্তি। এগুলোর বিষয়বস্তু এমনকি খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে নেফাইট এবং অন্য গোত্রদের কথা বলেছিল, যারা প্রাচীনে সেই অতীতে আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিলেন। আর যে ফেরেশতা এই তথ্যগুলো জোসেফ স্মিথকে জানিয়েছিলেন তার নাম ছিল মরোনি। পরে স্মিথ আবিষ্কার করেছিলেন, মরোনির কথাও সেই বইয়ে আছে, যার অস্তিত্ব তিনি তাকে জানিয়েছিলেন। একটি যুদ্ধে মারা যাবার পর মরোনিকে পুনর্জীবিত করে ফেরেশতার মর্যাদা দান করা হয়। আর এই ফেরেশতা হিসাবে তার দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্মিথকে বুক অব মর্মনের সোনালি প্লেটগুলোর অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন।

দাবি করা হয়ে থাকে, চার বছর পরে স্মিম এই প্লেটগুলো মাটির নিচ থেকে খনন করে বের করেছিলেন এবং তিনি সেগুলো ইংরেজি অনুবাদ করতে শুরু করেন। তিন মাস ধরে তিনি প্রায় পাঁচশো পাতার একটি বই লিখেছিলেন, যা বুক অব মর্মন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বলা হয় তার অনুবাদ করা মূল বইটি সংকলিত হয়েছিল ৩১১ থেকে ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে এবং এটি পড়তে এর প্রায় বারোশো বছর পরে আরেকটি বিখ্যাত অনুবাদের মতোই অনুভূত হয়, সেটি হচ্ছে ১৬১১ সালে সংকলিত ‘কিং জেমস বাইবেল’, প্রটেস্টান্ট চার্চগুলোর প্রিয় একটি সংস্করণ, এবং যার সাথে স্মিথের পরিচিতি থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। ‘বুক অব মর্মন’ থেকে এই অংশগুলো এর মেজাজ কেমন জানান দিচ্ছে:

কারণ এটিও একদিন অতিক্রান্ত হবে, বলেছেন তোমার পিতা, এবং সেই দিনে যারা অনুতপ্ত হবে না এবং আমার প্রিয় পুত্রের অনুসারী হবে না, আমি তাদের তোমার জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক করে ফেলব, ও ইজরায়েলবাসীরা। আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নেব এবং ক্রোধ বর্ষণ করব, একই সাথে সেই বিধর্মীদের উপরেও, যারা এই বার্তা পায়নি।

বুক অব মর্মন অন্যান্য অ্যাপোক্যালিপটিক বা মহাপ্রলয়বাদী বইগুলোর মধ্যে একটি, যা যিশুখ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন আর সবকিছু তার শাসনের অধীনে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পার্থক্যটি হচ্ছে এবার ‘নিউ জাইওন’ প্রতিষ্ঠিত হবে আমেরিকায়। কোনো বিস্ময় নেই সেখানে, যখন বুক অব মর্মন থেকে আমরা জানতে পারি, ঈশ্বর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার পরিকল্পনা আমেরিকার পশ্চিমে পরিবর্তন করেছেন। এবং নতুন ‘হলি ল্যান্ড’ বা পবিত্রভূমি হিসাবে আমেরিকার মর্যাদা নিশ্চিত করতে যিশু নিজেই ৩৪ খ্রিস্টাব্দে তার পুনরুত্থানের কয়েক মাস পরে এই মহাদেশে স্বয়ং এসেছিলেন। এই বইটি বলছে যে, যিশুখ্রিস্ট নেফাই জনগোষ্ঠীর কাছে তার দর্শন দিয়েছিলেন, যারা বহুসংখ্যায় একত্র হয়েছিলেন এই সমৃদ্ধ দেশে এবং তাদের উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ম প্রচার করেছিলেন…’। এই সবই খুবই শক্তিশালী প্রস্তাবনা ছিল। আর এই বার্তাটি বিশ্বকে জানাতে হবে। সুতরাং ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, জোসেফ স্মিথ নিউইয়র্কের ফ্যায়েটে তার গসপেল (সুসংবাদ) প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার এই আন্দোলনকে একটি নতুন চার্চ হিসাবে নয় বরং প্রাচীন চার্চের একটি শুদ্ধিকরণ হিসাবে দেখেছিলেন। প্রথম খ্রিস্টধর্মীয়রা। নিজেদের সেইন্ট বলে ডাকতেন। এর সদস্যরাও সেইন্ট, আজকের সেইন্ট। সুতরাং চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব ল্যাটার-ডে সেইন্টসদের জন্ম হয়েছিল। এবং বুক অব মর্মন ছিল এর বাইবেল।

এই পুরো বইটিতে আমরা দেখেছি, কোনো একটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলন সূচনা করা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। কারণ মানুষ পছন্দ করে না কেউ তাদের বলুক যে, তাদের ধর্ম ভুল। যিশু নিজেই বলেছিলেন, তাদের নিজের মানুষের কাছে ছাড়া নবীরা অসম্মানিত ব্যক্তি নন। বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে, যখন এমন কেউ, যাকে কিনা আপনি সারাজীবন ধরেই চেনেন, তাকেই একজন নবী হবার জন্যেই ঈশ্বর নির্বাচিত করেছেন। আর জোসেফ স্মিথ এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। কী ভেবেছেন তিনি নিজেকে? তার এমন দাবি শুনে অন্য চার্চ-নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাকে ও তার অনুসারীদের কারাবন্দি করা হয়েছিল, আটক করার জন্যে প্রতিটি শহরে তাদের খোঁজা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঐশী প্রত্যাদেশ আসা অব্যাহত ছিল এবং আরো বই যুক্ত হয়েছিল মর্মন ধর্মশাস্ত্রের বইয়ের তাকে। তবে অন্য খ্রিস্টানদের চোখে যে-বিষয়টি তার। সুনাম পুরোপুরি ধ্বংস করেছিল সেটি হচ্ছে যৌনতা। কোনো ফেরেশতা আপনাকে নতুন একটি বাইবেলের তথ্য উন্মোচন করেছে এমন কিছু বলা এক কথা, কিন্তু খুবই ভিন্ন এমন কিছু বলা, ফেরশতা আপনাকে অন্য ব্যক্তিদের স্ত্রীদের গ্রহণ। করতে বলেছে।

স্মিথকে তার ফেরেশতা বলেছিলেন, ‘চার্চ অব দ্য ল্যাটার ডে সেইন্ট’ প্রাচীন ইজরায়েলের সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। আর যেহেতু আব্রাহাম এবং অন্য গোত্রপিতাদের একাধিক স্ত্রী ছিলেন, তাকে অবশ্যই সেই উদাহরণ অনুসরণ করতে হবে এবং বাইবেল বর্ণিত বহু-বিবাহপ্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা পুরুষদেরকে একই সাথে একাধিক স্ত্রীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। স্মিথ সেই নির্দেশটি মান্য করেছিলেন এবং চল্লিশজন স্ত্রী তিনি সংগ্রহ। করেছিলেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যেই তারই চার্চের অন্য পুরুষদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। আর তার বিরোধীদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করার জন্যে এটাই যথেষ্ট ছিল। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় নির্যাতন এড়াতে স্মিথ তার অনুসারীদের নিয়ে পশ্চিমে ওহাইও এবং ইলিনোয়া রাজ্যে এসেছিলেন, যেখানে ১৮৩৬ সালে প্রথম মর্মন টেম্পল নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু তার পেছনে লেগে-থাকা মানুষগুলো থেকে পালিয়ে বেড়ানো তার জন্যে খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। অবশেষে ১৮৪৪ সালে, ইলিনোয়ার কার্থেজে তার নিয়মিত একটি কারাবাসের সময় তাকে ও তার ভাই হাইরুম স্মিথকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু যে চার্চ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এটি তা আদৌ দমিয়ে রাখতে পারেনি। শহীদের রক্ত সবসময়ই চার্চের বীজ হিসাবে কাজ করে। ১৮৪৭ সালে মর্মনরা ব্রিগহাম ইয়ংকে তাদের নতুন নেতা নির্বাচিত করেছিল। যদি মর্মনদের নবী হয়ে থাকেন স্মিথ, তাহলে ইয়ং হচ্ছেন এটিকে এর শক্তিশালী রূপ দেওয়া একজন সংগঠক, যে-মানুষটি এমন একটি কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যা এই ধর্মটিকে একটি স্থায়ী জীবন দিয়েছিল।

ইয়ং ১৮০১ সালে ভারমন্টে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এগারো সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম। তিনি ছিলেন সেইসব মেধাবী প্রায়োগিক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন, যারা যে-কোনো কাজেই তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। ১৮৩২ সালে যখন তিনি চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্টের সদস্য হিসাবে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তিনি তার সমীহজাগানো সেই প্রতিভাটিকে ব্যয় করেছিলেন এই নতুন আন্দোলনের কল্যাণে। মর্মন চার্চ সংস্কার করার প্রক্রিয়ায় স্মিথ বারোজন সদস্যের শক্তিশালী একটি পরিচালনা কমিটি সৃষ্টি করেছিলেন, ‘গ্রুপ অব টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস’ নামে যারা পরিচিত। ১৮৩৫ সালে একজন অ্যাপোস্টল হিসাবে ইয়ং দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার যোগ্যতা লক্ষ করে স্মিথ তাকে চার্চের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একটি বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মর্মনবাদ একেবারে প্রথম থেকেই পার্থিব এবং বৈষয়িক নানা কর্মকাণ্ড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব দৃঢ়ভাবেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল।

স্মিথের হত্যাকাণ্ডের পর যখন তিনি মর্মন চার্চের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ইয়ংকে প্রথম যে-চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে হয়েছিল, সেটি হচ্ছে চার্চের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তার সমাধান ছিল এটিকে আরো পশ্চিমে, ইউটাহ রাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া, যে-রাজ্যটি তখন মেক্সিকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইউটাহ হয়তো মর্মনদের প্রতিশ্রুত দেশ হতে পারে, কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই বাস করতেন ‘উটে’ ইন্ডিয়ানরা। শুরুতে এটি অবশ্য স্মিথকে ভাবায়নি। বুক অব মর্মন তাকে জানিয়েছিল আদিবাসী এই ইন্ডিয়ানরাও ইজরায়েলাইটদের বংশধর, যারা খ্রিস্টের জন্মের বহুশত বছর আগে আমেরিকায় এসেছিলেন। সুতরাং উটেরা সেই মানুষদের উত্তরসূরি, যাদের প্রতি ধর্ম প্রচার করেছিলেন যিশু, জেরুজালেমে তার মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হবার পর তিনি এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। এর মানে হচ্ছে যে, অন্য কোনো বসতিস্থাপনকারীদের মতো যারা আমেরিকার পশ্চিমে আগ্রাসন করে দখল করেছিল, মর্মনরা তাদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া আদিবাসীদের প্রতি কোনো সহিংস আচরণ করেনি। কারণ তারা ইতিমধ্যেই তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের অংশ ছিল। তাদের ধর্মান্তরিত করা তাদের পরিকল্পনায় ছিল, তারা যিশুর সেই মিশনটি শেষ করতে চেয়েছিলেন, যা তিনি আঠারোশত বছর আগে সূচনা করেছিলেন।

সুতরাং প্রাচীন সেই ইজরায়েলাইটদের সাথে সাক্ষাৎ করার অধীর আগ্রহ নিয়ে ব্রিগহাম ইয়ং বহু ওয়াগন ভর্তি কয়েক হাজার মর্মনদের নিয়ে তাদের নতুন ‘জাইওনে’ অভিনিষ্ক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু খুব দ্রুত স্পষ্ট হয়েছিল যে, মর্মনরা যা উটেদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলেন আর উটেরা তাদের নিজেদের জন্যে যা চেয়েছিলেন সেটি সংগতিপূর্ণ ছিল না। এটি পুরো মহাদেশ জুড়ে ঐসব সাক্ষাতের আরেকটিতে পরিণত হয়েছিল, যা আদিবাসী আমেরিকানদের জন্যে ভয়াবহ সর্বনাশী প্রমাণিত হয়েছিল। ইয়ং যে-বিষয়টিকে সভ্যতার অভ্যাস’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন, তিনি লক্ষ করছিলেন সেটি স্থানীয় আদিবাসী উটেদের জীবনযাত্রার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। আর সভ্যতাকে এখানে অবশ্যই জিততে হবে। উটেদের সংরক্ষিত এলাকায় সীমাবদ্ধ রেখে ইউটাহ মর্মনদের পবিত্রভূমিতে পরিণত হয়েছিল। যখন মেক্সিকোর সাথে যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউটাহ রাজ্য দখল করেছিল। ইয়ং এই রাজ্যের প্রথম গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন। চার্চ অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্ট অবশেষে একটি স্থায়ী ঠিকানা সুরক্ষিত করতে পেরেছিল। কিন্তু এর জন্যে একটি মূল্য দিতে হয়েছিল। তার আগের নেতা স্মিথের মতো, ইয়ং নিজেও বহু বিবাহ করেছিলেন। তার বিশজন স্ত্রী ছিলেন আর তিনি সাতচল্লিশটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যদি তিনি চান যে মর্মনরা শান্তিতে তাদের বিশ্বাস পালন করুক, তাহলে ফেডারেল সরকারের সাথে তাকে একটি সমঝোতায় আসতে হবে, যে সরকার এই বহুবিবাহপ্রথার সমর্থক ছিল না। তারা বহুবিবাহপ্রথা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিল, যদিও এর আকর্ষণ কখনোই ম্লান হয়ে যায়নি। মর্মনবাদের ইতিহাসে সবসময় কিছু নেতা এসেছিলেন, যারা চার্চ জীবনের অংশ হিসাবে এটিকে পুনর্বহাল করার প্রচেষ্টা করেছেন, যা তাদের নবী জোসেফ স্মিথের মূল সংস্করণের সাথে মানানসই ছিল। সাধারণত তারা তেমন কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তাদের জন্যে সান্ত্বনা পুরস্কার ছিল। বহুবিবাহ স্বর্গে এখনো প্রচলিত। যদি কোনো পুরুষের স্ত্রী পৃথিবীতে মারা যান এবং তিনি যদি আবার বিবাহ করেন, পরকালে তিনি দুই স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে পারবেন।

চার্চ অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্টের একটি বর্ণিল সূচনা হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে এটি অনেক সংযত একটি রূপ। মর্মনরা তামাকসহ কোনো ধরনের মাদক সেবন করেন না। এছাড়া তারা মদ্য, কফি অথবা চা পান করেন না। তাদের জন্যে উল্কি আঁকা কিংবা গায়ে কোথাও ছিদ্র করে আংটি পরাও নিষিদ্ধ। তারা জুয়া খেলেন না। বিয়ের আগে তারা সহবাস করেন না। তারা পারিবারিক জীবনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং বিয়ের পরে সাধারণত তারা অনেক সন্তানের জন্ম দেন। তারা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন এবং তাদের অনেকেই খুব বিত্তশালী ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন। এবং তাদের তরুণরা তাদের জীবন থেকে দুই বছর দেশে অথবা বিদেশে মিশনারি কাজের জন্যে উৎসর্গ করে। কোনো রাস্তায় হয়তো তাদের সাথে আপনার হঠাৎ দেখা হয়েও যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *