৩১. পশুর শিরশ্চেদ

অধ্যায় ৩১. পশুর শিরশ্চেদ

মধ্যযুগে ইউরোপে রানি হওয়া বেশ বিপজ্জনক একটি ব্যাপার ছিল। সেই সময় রানির ভূমিকা ছিল বিভিন্ন জাতির সাথে জোট বাঁধতে সহায়তা করা আর এমন সব মানুষের সন্তান ধারণ করা, যে-ব্যক্তিরা সাধারণত তাকে ভালোবাসতেন না। এমনই পরিস্থিতি ছিল ক্যাথেরিন অব আরাগনেরও, যিনি অষ্টম হেনরির প্রথম স্ত্রী ছিলেন। তবে তিনি অন্তত তার নিজের বিছানায় শুয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। অষ্টম হেনরির বোনের নাতনি মেরি কুইন অব স্কট মারা গিয়েছিলেন জল্লাদের কুঠারের আঘাতে, তার সময়ে ধর্মীয় সহিংসতার একজন শিকার। রাজা পঞ্চম জেমস ও তার ফরাসি স্ত্রী মেরি অব গিসের কন্যা মেরি ১৫৪২ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জীবনে হারাবার পর্বটি বেশ আগেই শুরু হয়েছিল। তার জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। এবং তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে স্কটল্যান্ডের রানি হয়েছিলেন। তবে তার বয়স যখন পাঁচ, তাকে ফ্রান্সে থাকার জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে পনেরো বছর বয়সে ফরাসি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী চৌদ্দবছরের ফ্রান্সিসের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল।

তার শ্বশুর, ফরাসি রাজা দ্বিতীয় হেনরি, তার পিতার ভূমিকা নিয়েছিলেন, নিজের পিতার সাথে যার কখনোই পরিচয় হয়নি। মেরি নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি পশুপ্রেমী ছিলেন, বিশেষ করে কুকুর ভালোবাসতেন। ফ্রান্সে তিনি বেশ সুরক্ষিত আর স্বাচ্ছন্দ্যের একটি জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু তার হারাবার পর্ব আবার শুরু হয়েছিল। ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে তার শ্বশুর মারা যান, এবং তার স্বামী রাজা দ্বিতীয় ফ্রান্সিস নামে সিংহাসনে আরোহণ করার মাধ্যমে তিনি ফরাসিদের রানি হয়েছিলেন। এর একবছর পর তার মা, স্কটল্যান্ডের কুইন রিজেন্ট মৃত্যুবরণ করেন, আর তার ছয় মাস পরেই তার স্বামী ফ্রান্সিস পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আঠারো বছর বয়সে মেরি অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রথমে অনাথ এবং পরে বিধবা হয়েছিলেন। শৈশবে দীক্ষা পাওয়া তার ক্যাথলিক বিশ্বাস তাকে তার দুঃখের সময় আশা নিয়ে বাঁচতে সাহায্য করেছিল। এবং সেই বিশ্বাসটি তিনি তার সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন, যখন রানি হিসাবে তাকে স্কটল্যান্ডে ফিরে আসতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু যে বছরগুলোয় তিনি স্কটল্যান্ড থেকে দূরে ছিলেন, সেই সময়ে স্কটল্যান্ড একটি প্রটেস্টান্ট রাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর ক্যাথলিক রানির সাথে তাহলে এর প্রজাদের আচরণ কেমন হতে পারে?

১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট, তিনি তার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। যখন তিনি এডিনবরায় রয়াল মাইলের পাদদেশে তার প্রাসাদে প্রথম রাত কাটাতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, জানালা দিয়ে বাইরে থেকে ভেসে আসা একটি গান তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের লোকগীতি গেয়ে অবশ্য সেখানে কেউ তাকে স্বাগত জানাতে আসেননি। সেই গানটি গাইছিলেন বিক্ষোভকারীদের একটি দল, যারা তাকে স্কটল্যান্ডের নতুন প্রার্থনা সংগীত সম্বন্ধে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। বিচার বিবেচনা করে খুব সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিন, এটাই ছিল বার্তা, স্কটল্যান্ডের পুরানো মিত্র ফ্রান্স এখনো ক্যাথলিক হতে পারে ঠিকই কিন্তু স্কটল্যান্ড এখন প্রটেস্টান্ট। সুতরাং খুব সতর্ক থাকুন, পোপবাদী রানি! এটি একটি অশুভ সংকেত ছিল। কোনো সন্দেহ নেই তরুণী রানির জন্যে ভবিষ্যতে আরো সমস্যা অপেক্ষা করছিল। এই গায়কদের নেতা ছিলেন দীর্ঘ দাড়িসহ খর্বকায় একজন ব্যক্তি, আর তার নাম ছিল জন নক্স।

রিফরমেশন আন্দোলন স্কটল্যান্ডে এসেছিল খানিকটা বিলম্বে। এটি শুরু হয়েছিল যখন প্যাট্রিক হ্যাঁমিলটন নামের একজন তরুণ প্রটেস্টান্ট ধারণাগুলো ইউরোপ থেকে তার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, যেখানে তিনি পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন। আপনি এখনো সেই জায়গাটি সেইন্ট অ্যানড্রিউজে গিয়ে দেখতে পারবেন, যেখানে ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে তার বিশ্বাসের জন্যে ক্যাথলিক চার্চ তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। এই মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করার অব্যবস্থাপনার কারণে ছয় ঘণ্টা তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু সেইন্ট অ্যানড্রিউজের পরবর্তী শিকার জর্জ উইশার্ট, যার মৃত্যু সেই আগুনটি প্রজ্বলিত করেছিল, যা অবশেষে স্কটল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চকে ধ্বংস করেছিল। উইশার্ট খুবই দয়ালু আর জনদরদী মানুষ ছিলেন, যিনি তার বিছানার চাদর অবধি ক্যামব্রিজের গরিবদের দান করে দিয়েছিলেন, যখন তিনি সেখানে ছাত্র ছিলেন।

কিন্তু তার এই মহত্ব চার্চকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি, যখন তাকে প্রটেস্টান্টবাদ সমর্থন করার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এবং ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে তাকেও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কার্ডিনাল বিটন, স্কটল্যান্ডের তকালীন চার্চপ্রধান, সেইন্ট অ্যানড্রিউজ দুর্গের জানালা দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখেছিলেন। হয়তো তিনি এমন শাস্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এবার তারা নিশ্চিত করেছিলেন যেন কোনো সমস্যা না হয়। তারা উইশার্টের পকেটে বারুদ খুঁজে দিয়েছিলেন যেন তিনি দ্রুত পুড়ে মারা যান।

উইশার্টের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে একদল প্রটেস্টান্ট সেইন্ট অ্যানড্রিউজ দুর্গ আক্রমণ করেছিলেন এবং প্রতিশোধ হিসাবে কার্ডিনাল বিটনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছিলেন। অন্যরাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে তারা নিজেদের অবরোধ করে রেখেছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন জন নক্স। যার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে এডিনবরায় রানির জানালার বাইরে। তিনি নিজেই একজন প্রাক্তন ক্যাথলিক যাজক ছিলেন, জর্জ উইশার্টের প্রটেস্টান্টবাদ যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

নক্স বাইবেল পড়েছিলেন অনেক পরে, বিশেষ করে এর দুটি বই দৈনিক পত্রিকার শিরোনামের মতো তার উদ্দেশ্য চিৎকার করে কিছু সত্য জানিয়েছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টে ডানিয়েল এবং নিউ টেস্টামেন্টের শেষ বই রিভিলেশন। ১৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইজরায়েলের রাজা অ্যান্টিওকাস পরিচালিত নির্যাতনকালীন সময়ে ‘ডানিয়েল’ লেখা হয়েছিল। আর রিভিলেশন’ লেখা হয়েছিল প্রথম শতাব্দীতে সম্রাট ডমিশিয়ান যখন সদ্যজাত খ্রিস্টীয় চার্চ এবং খ্রিস্টানদের ওপর তার দমননীতি পরিচালনা করছিলেন। দুটো বইই সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়েছিল যেন শুধুমাত্র নির্যাতিতরাই সেটি বুঝতে পারতেন, যা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে অবিচল থাকতে শক্তি জুগিয়েছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ, কিন্তু এটি ভোর হবার আগের সেই অন্ধকার, একটি মহাযুদ্ধের শেষ যুদ্ধ, যেখানে তারা জয়লাভ করবেন। তার সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করতে আসা সেই পশুটির অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে ঈশ্বর শীঘ্রই আসছেন। নক্স তীব্রভাবেই আন্দোলিত হয়েছিলেন এই বইগুলো পাঠ করে। তবে তিনি অনুভব করেছিলেন, এই বইগুলো আসলে অতীত নিয়ে নয়। এই বইগুলো বর্তমানে স্কটল্যান্ডে যা ঘটছে সেই বিষয়েই যেন কথা বলছে। ক্যাথলিক চার্চ ছিল রাজা অ্যান্টিওকাস! এটি ছিল সম্রাট ডমিশিয়ান। আর কাজটি ছিল ক্যাথলিক চার্চকে সংস্কার নয় বরং এটিকে ধ্বংস করা এবং পুরোপুরিভাবে ভিন্নকিছু দিয়ে সেটি প্রতিস্থাপন করা।

সেইন্ট অ্যানড্রিউজে তার একটি বক্তৃতায় তিনি ডানিয়েলের সাংকেতিক বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন :

এই রাজ্যের দশটি শিং হচ্ছে দশজন রাজা যাদের আবির্ভাব হবে : এবং তাদের পরে আরো একজনের উত্থান হবে … এবং তিনি সর্বোচ্চ সত্তার বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় কথা বলবেন, এবং সর্বোচ্চ সত্তার সব সাধুদের নিঃশেষ করবেন এবং তার হাতেই সব ক্ষমতা দেওয়া হবে সাড়ে তিন বছরের জন্য।

এমন কিছুই কি তাদের সাথে ঘটছে না এখনই, যখন তিনি কথা বলছেন? এরপর তিনি রিভিলেশনের সেই পশুর প্রসঙ্গে আসেন।

আমি সেই পশুকে দেখেছি, এই পৃথিবীর রাজা ও তাদের সেনাদলদের… এবং সেই পশুকে পরাজিত করা হয়েছে, তার সাথে মিথ্যা নবীও, যিনি তাদের সামনে অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। এই দুজনকেই জীবন্ত নিক্ষেপ করা হয়েছে জ্বলন্ত গন্ধকের আগুনের হ্রদে…।

নক্সের জন্যে, এটি ইজরায়েলের মৃত অতীতের কোনো বিষয় ছিল না। এটি বর্তমানের সেইন্ট অ্যানড্রিউজ-সংক্রান্ত। স্কটল্যান্ডের উপর শেষবিচারের দিন আসন্ন। সবাইকে এই যুদ্ধে কোনো একটি পক্ষ বেছে নিতে হবে। এখানে কোনো সমঝোতা হতে পারে না। আপনি হয় ঈশ্বরের সাথে, নয়তো সেই ক্যাথলিক পশুর পক্ষে, যা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো মধ্যপথ নেই, না মিডডিস’, যেভাবে নক্স শব্দটি প্রকাশ করেছিলেন, তার স্কটভাষায়। এভাবেই প্রথম আমরা নক্সের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কিন্তু এটি হয়তো শেষবারের মতো।

১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখন এইসব কিছু ঘটছিল, স্কটল্যান্ড তখনো একটি ক্যাথলিক দেশ ছিল। এটি শাসন করতেন একজন কুইন রিজেন্ট বা রানির প্রতিনিধি, মেরি অব গিস, মেরি কুইন অব স্কটের মা। তিনি তার কন্যার সিংহাসনে আরোহণ করার ক্ষেত্রে একটি হুমকি হিসাবেই প্রটেস্টান্ট-সংস্কারবাদীদের দেখেছিলেন। সুতরাং এই প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি ফরাসিদের সহায়তা চেয়েছিলেন। তারা জাহাজ ও সেনাদল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং সেইন্ট অ্যানড্রিউজে অবরোধ অবসান ঘটিয়েছিল। নক্সকে গ্রেফতার করা হয় এবং দুই বছরের জন্যে ফরাসি গ্যালিতে সশ্রম দণ্ড দেওয়া হয়। গ্যালি ছিল প্রায় ১৫০ ফুট দীর্ঘ আর ৩০ ফুট প্রশস্ত জাহাজ। এই নৌকাগুলোয় পাল ছিল, কিন্তু যখন বাতাস থাকত না তখন তাদের ভরসা করতে হত দাঁড়িদের ওপর। দুই পাশে ছয়জন করে দাঁড়ি থাকত, যাদের বৈঠার সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো, সেখানে তাদের খাওয়া, ঘুমানো এবং সব প্রাকৃতিক কাজ সারতে হতো। প্রায় দুই বছর গ্যালিতে কাজ করার পর নক্সকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্কটল্যান্ডে ফিরে না-আসার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে ফরাসিরা তাদের প্রভাব আরো দৃঢ়তর করে তুলেছিল। পরের কয়েক বছর তিনি ইংল্যান্ডে প্রটেস্টান্ট-আন্দোলনের হয়ে বেশকিছু কাজ করেন, কিন্তু ব্লাডি মেরির শাসনামলে, যখন প্রটেস্টান্টদের জন্যে সেখানে থাকা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল, তিনি জেনেভা পালিয়ে যান, যে-শহরটি তখন প্রটেস্টান্টরা। নিয়ন্ত্রণ করতেন।

১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি আবার স্কটল্যান্ডে ফিরে আসেন, যখন প্রটেস্টান্টরা বিজয়ের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। আবারো নক্সের একটি বক্তৃতা সংগ্রামের শেষপর্যায়ের মূল সুরটি নির্দিষ্ট করেছিল। কুইন রিজেন্ট তখনো স্কটল্যান্ডকে তার মেয়ে মেরির জন্যে ক্যাথলিক রাখার চেষ্টা করছেন। যখন তিনি প্রটেস্টান্ট যাজকদের নিষিদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন, নক্স পার্থে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। নক্সের জন্যে ক্যাথলিক চার্চের ছবি আর মূর্তিগুলো নিষ্পাপ কোনো শিল্পকলা ছিল না। সেগুলো ছিল ধর্মনিন্দার প্রতীক। ঈশ্বরের প্রতি নির্দেশিত অপমান, আরো প্রমাণ যে ক্যাথলিকবাদ সেই পশুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নক্স মূর্তি নিয়ে একইভাবে তীব্র মনোভাব পোষণ করতেন, যেমন মুহাম্মদ করতেন এবং তাদের দুজনের কারণই ছিল এক। এটি সত্যিকার এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ঈর্ষার উদ্রেক করে যিনি তার দ্বিতীয় কম্যান্ডমেন্টে এমন কিছু করতে নিষেধ করেছিলেন।

তার বক্তৃতা ভয়ানক একটি দাঙ্গার সূচনা করেছিল। ক্ষুব্ধ জনগণ চার্চ থেকে সব ছবি টেনে নামিয়েছিল, তারা এর বেদি আর মূর্তি ভাঙচুর করেছিল। ধ্বংসের একটি তীব্র উন্মাদনার সূচনা করেছিল এটি, যার কারণে স্কটল্যান্ডের দীর্ঘ ক্যাথলিক ইতিহাসের সেই পর্বে সৃষ্ট চিত্রগুলোর খুব সামান্যই টিকে ছিল। প্রটেস্টান্ট ‘কার্ক’ বা গির্জাগুলোয় উপাসনার জায়গা ছিল সাদা চুনকাম করা খুব সাধারণ একটি ভবন, তাদের উদ্দীপ্ত করার একমাত্র নির্ভরযাগ্য উৎস, বাইবেল থেকে ঈশ্বরের বার্তা শোনার সময় যেন কারো মনোযোগ বিক্ষিপ্ত না হয়, সে কারণে সেখানে কোনো ছবি থাকার অনুমতি ছিল না।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল স্কটল্যান্ডে ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টদের মধ্যে এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তারপর হঠাৎ করেই এটি শেষ হয়েছিল। কুইন রিজেন্ট মারা যান এবং স্কটিশ অভিজাতশ্রেণি একটি সমঝোতায় আসেন। নক্স যেমন কঠোররূপে চেয়েছিলেন স্কটল্যান্ড ঠিক তেমনই একটি প্রটেস্টান্ট দেশ হবে। কিন্তু এই চুক্তিটি রানি রিজেন্টের কন্যা মেরির রানি হিসাবে স্বদেশে ফিরে আসা এবং তার ক্যাথলিক বিশ্বাস অপরিবর্তিত রাখার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিল। তিনি একান্তে ব্যক্তিগতভাবে ‘মাস’ শুনতে পারবেন, কিন্তু জনসম্মুখে তিনি অবশ্যই স্কটল্যান্ডকে একটি প্রটেস্টান্ট রাষ্ট্র হিসাবে শাসন করবেন। এটি একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল। এবং যেমন আমরা দেখেছি, নক্স সমঝোতা করতে অপছন্দ করতেন। সেই সময় তিনি হলিরুড প্যালেস থেকে এক মাইল দূরে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সেইন্ট যাইলজের প্রধান যাজক ছিলেন। নক্স খুশি হননি যখন স্কটল্যান্ডের রানি হিসাবে ক্যাথলিক মেরি ফিরে এসেছিলেন। আর সে কারণেই তিনি তার জানালার বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে সাম বা পবিত্র সংগীত গাচ্ছিলেন।

কিন্তু তাদের দুজনের সময়ই শেষ হয়ে এসেছিল। নক্স স্কটিশ অভিজাতশ্রেণির সদস্যরা মেরি কুইন অব স্কটের সাথে যে সমঝোতা করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি ভয় পেয়েছিলেন, নিশ্চয়ই ক্যাথলিক মেরি কোনো-না-কোনো একটি উপায়ে পোপ পশুটিকে স্কটিশ প্রটেস্টান্টবাদের বিশুদ্ধ মন্দিরে ঢোকাতে সক্ষম হবেন। মেরি ছিলেন একজন তরুণী রানি, যাকে ক্যাথলিক ধর্মাচারগুলো সান্ত্বনা দিয়েছিল এবং তিনি আসলেই বুঝতে পারছিলেন না, কেন ক্যাথলিসজম এই মানুষটির মনে এত তীব্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যিনি প্রায় বিরতিহীনভাবেই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জন নক্স আর মেরি কুইন অব স্কটের মধ্যে এই সংঘর্ষ প্রদর্শন করে কীভাবে ধর্ম অন্যথায় ভালো আর সমবেদনাপূর্ণ মানুষদের মধ্যে সহিংসতা উসকে দিতে পারে। নক্স অবশ্যই খারাপ কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনিও তার ধর্মবিশ্বাসের জন্যে বহু যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন। কিন্তু সবকিছুই তিনি সাদা আর কালো দেখতেন। কোনো ধূসর রং, কোনো মধ্য উপায় না, ‘না মিডডিস’!

আর ঘটনাচক্রে রাজরক্ত বহন করার কারণে, বারবার স্বজনহারানোর শোকের সাথে সংগ্রামরত ভালোবাসার কাঙাল মেরি এই ধর্মীয় সংঘর্ষে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জড়িয়ে পড়েছিলেন, যে-ধর্মটি তাকে যন্ত্রণায় পুড়িয়েছিল ঠিকই তবে কখনোই তার হৃদয় জয় করতে পারেনি। সুরক্ষা আর ভালোবাসা পাবার প্রয়োজনীয়তাই তাকে ভুল কিছু সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিল। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে যখন তার বয়স বাইশ, তিনি তার ক্যাথলিক জ্ঞাতিভাই, বদমেজাজি এবং অজনপ্রিয় মাতাল হিসাবে পরিচিত লর্ড ডার্নলিকে বিয়ে করেছিলেন, নক্স এই বিয়ের বিরুদ্ধেও প্রচারণা করেছিলেন। ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডার্নলির ছেলে জেমসের জন্ম দেন, যিনি চতুর্থ জেমস অব স্কটল্যান্ড এবং প্রথম জেমস অব ইংল্যান্ড হয়ে একদিন এই দুটি রাজ্যকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করেছিল। ডার্নলি ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে আততায়ীর হাতে খুন হয়েছিলেন। মেরির পরবর্তী স্বামী লর্ড বোথওয়েল আরেকজন বেপরোয়া মানুষ ছিলেন, যিনি প্রথমে তাকে অপহরণ ও পরে ত্যাগ করেছিলেন। ধারাবাহিক এই বিবাহ-ব্যর্থতা স্কটিশ অভিজাত পরিবারগুলোর কাছে যথেষ্ট অনুভূত হয়েছিল। রানি তাদের রাজ্যে স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন, এমন দাবিতে তাকে প্রথমে গ্রেফতার ও পরে তার ছেলে জেমসের পক্ষে সিংহাসনত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।

এবং এর সাথে তার জীবনের ট্র্যাজেডিটির শেষ অঙ্কের পর্দা উঠেছিল। তিনি পালিয়ে যান এবং ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তার জ্ঞাতিবোন রানি এলিজাবেথ তাকে অবশ্যই সহায়তা করবেন। কিন্তু এটিও তিনি ভুল বুঝেছিলেন। এলিজাবেথের কাছে মেরির উপস্থিতি ছিল একটি হুমকির মতো। ইংল্যান্ডে এলিজাবেথ একটি মাত্রায় ধর্মীয় স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তিনি খুব সতর্কভাবে রিফরমেশন আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিণতিগুলো সামলে নিয়েছিলেন। তিনি ক্যাথলিকদের নির্যাতন করেননি যেভাবে তার বোন ব্লাডি মেরি প্রটেস্টান্টদের নির্যাতন করেছিলেন। কিন্তু এই ভারসাম্যটি তখনো নড়বড়ে ছিল, আর মেরি কুইন অব স্কট হয়তো এই ভারসাম্যটি বেশি অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন, এমন আশঙ্কা করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। ক্যাথলিক উচ্চাশা আর অসন্তোষের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারেন মেরি : মেরিকে কেন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করছি না, যেন আমরা ক্যাথলিকবাদে ফিরে যেতে পারি? তিনি ছিলেন প্রকৃত রানি। এলিজাবেথ ছিলেন অ্যান বোয়েলিনের মেয়ে। এবং অনেকেই ছিলেন যারা অ্যানের সাথে হেনরির বিয়ের বৈধতায় বিশ্বাস করেননি। এলিজাবেথের বিরুদ্ধে তাই অসন্তোষ সৃষ্টি করার এটি একটি জোরালো কারণ হতে পারে, এবং মেরিকে ইংল্যান্ডের প্রকৃত রানি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি আন্দোলনও গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

সুতরাং এলিজাবেথ পরবর্তী উনিশ বছর মেরিকে ইংল্যান্ডে ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন। যখন তিনি শুনেছিলেন যে, মেরি হয়তো তাকে সিংহাসনচ্যুত করতে ষড়যন্ত্র করছেন, তিনি খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে মেরির শিরশ্চেদ করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ডের সময় তিনি লাল রঙ পরার ওপর জোর দিয়েছিলেন, যে-রঙটি ক্যাথলিক শহীদদের রঙ। শরীর থেকে তার মাথাটি বিচ্ছিন্ন করতে বেশ কয়েকবার আঘাত করতে হয়েছিল জল্লাদকে। আর জল্লাদ যখন তার মাথা উপরে তুলে ধরেছিল, যেভাবে সাধারণত দেখানো হয় কারো মৃত্যুর প্রমাণ দিতে, তখন শুধু মেরির মাথার পরচুলাটি তার হাতের মুঠোয় উঠে এসেছিল, মেরির ছিন্ন মাথাটি তখনো ঝুড়িতে পড়েছিল।

ইউরোপের ধর্মীয় এই যুদ্ধগুলো অব্যাহত ছিল আরো কয়েক শতাব্দী। প্রটেস্টান্টদের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক, এক গোষ্ঠীর প্রটেস্টান্টদের বিরুদ্ধে অন্য আরেক গোষ্ঠীর প্রটেস্টান্টরা। কিন্তু কখনো কখনো যুদ্ধের অস্পষ্ট এই কুয়াশাচ্ছন্ন সময়ের মধ্যেই মাঝে মাঝে কিছু গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিল, যারা রিফরমেশনের ফলে সৃষ্ট ঘৃণা আর রাজনৈতিক সংঘর্ষের সীমানা অতিক্রম করে যেতে পেরেছিলেন। এরকমই একটি গোষ্ঠী একটি ডাকনাম জুটিয়েছিল, যা পরে বিখ্যাত হয়েছিল : কোয়েকারস। আমরা পরের অধ্যায়ে তাদের নিয়ে আলোচনা করব আর এই আলোচনা আমাদের আটলান্টিক অপরপ্রান্তে আমেরিকায় নিয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *