২৭. প্রতিবাদ

অধ্যায় ২৭. প্রতিবাদ

১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে বসন্তের এক সকালে একজন যাজক জার্মানির জুটেরবগ শহরের মূল চত্বরে একটি অস্থায়ী মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে তার কথা শুনতে সেখানে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে একটি ভাষণ দিতে শুরু করেন। তিনি সেদিন যা বলেছিলেন সেটি ডিনামাইটে আগুন দেবার মতোই ছিল, যা খ্রিস্টজগৎকে সহিংস একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে দুটি খণ্ডে বিভক্ত করেছিল।

.

আসুন! আসুন! এটাই আপনার জন্যে সুদিন, আমার বন্ধুরা। এটাই হচ্ছে সেই দিন যেদিন আপনি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন। আপনার শুধু দরকার এই ছোট চিঠিটা। এই ছোট চিঠিটা, আমার হাতে যেটা দেখছেন; এর দাম মাত্র এক শিলিং, কিন্তু এটি আপনাকে পারগেটরিতে বহু বছরের দুর্গতি থেকে মুক্তি দিবে।

আপনরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। আপনার জানেন যে, পাপের জন্যে শাস্তি পেতে হবে। পাপের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে মূল্য দিতে হয়। যতই পাপ স্বীকার করুন না কেন, পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন করবে না সেদিন। পারগেটরিতে ঐ পাপগুলোর জন্যে আপনাকে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। প্রতিটি বড় পাপের জন্যে সাত বছরের যন্ত্রণা।

একটি বছরে আপনি কয়টা বড় পাপ করেন? আপনার জীবদ্দশায় কতগুলো এই ধরনের গুরুতর পাপ আপনি করে থাকেন? সবগুলো যোগ করুন এবার। আপনি বুঝে ওঠার আগেই দেখবেন যে পারগেটরিতে শতবর্ষ কাটানোর মতো পাপ আপনার জমা হয়ে গেছে। বিষয়টি ভেবে দেখুন।

কিন্তু এই ছোট চিঠিগুলোর একটি আপনাকে এর থেকে নিস্তার দিতে পারে। এই বাক্সে এক শিলিং ফেলুন, আপনি ঐসব দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবেন। এবং আরো শুনে রাখুন। এই চিঠি শুধুমাত্র ইতিমধ্যে করা পাপগুলোর জন্যে পারগেটরিতে আপনার সময়কাল কমিয়ে দেবে না, এমনকি যে পাপ আপনি এখনো করেননি তার জন্যে মুক্তি দিবে। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আপনি পাবেন না।

ঐ চিঠিতে কী আছে? এটি হচ্ছে একটি ইনডালজেন্স বা ছাড়পত্র। আর এটি এসেছে আমাদের পবিত্র পিতা স্বয়ং পোপের কাছ থেকে। পোপ নিজেই আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন আপনাদের জানাতে যে, যদি আপনারা এখন একটি ইনডালজেন্স কেনেন, যখন আপনি মারা যাবেন, নরকের দরজা তালাবদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু আপনার জন্যে স্বর্গের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

আর এই সুযোগটি শুধুমাত্র জীবিতদের জন্যেই নয়। এটি মৃতদের জন্যে উপযোগী। আপনার নিকটাত্মীয় আর বন্ধুদের কথা ভাবুন, যারা পারগেটরিতে আটকে আছে। সেই দীর্ঘ বছরগুলোর কথা ভাবুন, তাদের সেখানে কাটাতে হবে ভবিষ্যতে। তাদের জন্যে এটি চলতেই থাকে। যন্ত্রণাময় বছরগুলো, শাস্তির বছরগুলো। কিন্তু এইসব ইনডালজেন্সগুলোর একটি কিনুন এবং আপনার আত্মীয়দের পারগেটরি থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং চোখের পলকে তারা স্বর্গে হাজির হবেন।

আরো একটি বিষয়। এই ইনডালজেন্স শুধু আপনার আর আপনার প্রিয়জনেরই উপকার করবে না, এটি পবিত্র ক্যাথলিক চার্চের জন্যেও উপকারী। রোমের সেই মহান চার্চে যেখানে সেইন্ট পিটার ও সেইন্ট পলের দেহাবশেষ আছে, যেখানে তাদের খুব খারাপ উপায়ে সমাহিত করা হয়েছিল। আমাদের পবিত্র পিতা পোপ লিও সেখানে এমন একটি চার্চ নির্মাণ করতে চাইছেন, যার সৌন্দর্য আর মাহাত্মের কাছে পুরো পৃথিবী মাথা নত করবে। আপনি সেটি নির্মাণ করতে সহায়তা করতে পারেন। আপনার শিলিং একটি পাথরের মূল্য পরিশোধ করবে, এবং পাথরের উপর পাথর দিয়ে নতুন সেইন্ট পিটার’স তার মহিমা দিয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দিতে জেগে উঠবে।

আসুন! আসুন! সবাই, প্রতিটি ইনডালজেন্সের দাম মাত্র এক শিলিং।

.

এই যাজকের নাম ছিল ইয়োহান টেটজেল, এবং তিনি চার্চের একটি বিশেষ সংঘের একজন সদস্য ছিলেন, যাদের বলা হতো অর্ডার অব প্রিচারস’ অথবা ‘ডমিনিকানস’। তার বয়স ছিল বাহান্ন বছর, কঠোর প্রকৃতির শক্তিশালী গড়নের একজন মানুষ। এবং তার সময়ে তিনি চার্চের জন্য বেশকিছু নিষ্ঠুর কাজ করেছিলেন।

জুটেরবগ শহরের চত্বরে টেটজেলের এই ভাষণের দুই শতাব্দী আগে, পোপ নবম গ্রেগরী ধর্মীয় আইনপ্রয়োগকারীদের একটি সংস্থা গঠন করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘ইনকুইজিশন’। এর এজেন্ট বা ইনকুইজিটরদের যে-কোনো উপায়ে চার্চের বিরুদ্ধে মিথ্যা সব শিক্ষা আর প্রচারণাগুলোকে সমূলে উৎপাটিত করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই যে-কোনো উপায়ের একটি ছিল শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। আর সবচেয়ে কার্যকরী নির্যাতনের একটি উপায় ছিল, র‍্যাক, একটি কাঠের ফ্রেম, যার নিচে দুটি দড়ি শক্ত করে বাঁধা, অন্য দুটি উপরে একটি হাতলের সাথে বাঁধা। অভিযুক্ত ব্যক্তির হাত আর পা এই দড়িগুলোর সাথে বাঁধা হতো, এবং নির্যাতনকারী সেই হ্যাঁন্ডেলটি ঘোরাতেন যতক্ষণ-না তাদের হাড়গুলো এর সন্ধি থেকে কুৎসিত শব্দ করে ছিটকে বের হয়ে আসে। এবং এই নির্যাতনের ফলেও যদি তাদের চাহিদামতো স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব না হয়, নির্যাতনকারীরা সেটি ঘোরানো অব্যাহত রাখেন যতক্ষণ অভিযুক্ত ব্যক্তির শরীর থেকে হাতপা ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি সেই জগৎ থেকে বহুদূরে যখন যিশু বলেছিলেন, ‘তোমার শত্রুকে ভালোবাসো, যারা তোমাকে গালমন্দ করছে তাদের আশীর্বাদ করো। একটি উদাহরণ কীভাবে পরকালের জীবন নিয়ে ধর্মের মোহ, এটিকে মৃত্যুপূর্ববর্তী জীবনের একটি শত্রুতে পরিণত করে।

টেটজেল ইনকুইজিশনের একজন এজেন্ট ছিলেন। আর মানুষকে প্ররোচিত করতে পারার ক্ষেত্রে তার ক্ষমতাই মূলত মাইনজের আর্চবিশপকে উদ্যোগী করেছিল তাকে ‘ইনডালজেন্স’ বিক্রয়ের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিতে। আর্চবিশপ নিজেও বেশ সমস্যায় ছিলেন। তার বিশাল ডাইওসিস ঋণের ভারে জর্জরিত ছিল। এর ওপর পোপ রোমের সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের জন্যে মোটা অঙ্কের অর্থ চাদা দিতে তাকে তাগাদা দিচ্ছিলেন। আর তখনই আর্চবিশপের মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছিল। রোমের সাথে একটি চুক্তি করলে কেমন হয়? তিনি পোপকে রাজি করাবেন যেন আনুষ্ঠানিক ইনডালজেন্স বিক্রয় করার প্রতিনিধি হিসাবে টেটজেল দ্য পারসুয়েডারকে লাইসেন্স দেওয়া হয়, তবে একটি শর্তে, তিনি যে-পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করবেন তার অর্ধেক থাকবে মাইনজের আর্চডাইওসিসে, বাকি অর্ধেক যাবে রোমে। আর ঋণগ্রস্ত আর্চবিশপ আর তার ওপর চাপ দিয়ে টাকা তুলতে চাওয়া পোপ, উভয়পক্ষই লাভবান হবে। এই চুক্তি করা হয়েছিল। আর সে-কারণে টেটজেল তার সার্কাস নিয়ে জুটেরবগে হাজির হয়েছিলেন ১৫১৭ সালের সেই এপ্রিল সকালে। এবং খুব শীঘ্রই টাকা আসতে শুরুও হয়েছিল।

কিন্তু ইন্ডালজেন্স বিক্রির জন্যে দেওয়া টেটজেলের সেই বিজ্ঞাপনী বক্তৃতার কয়েক মাস পরে আরো একজন শক্ত-সমর্থ জার্মান যাজক তাদের এই বোঝাপড়াটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। খ্রিস্টানরা টাকার বিনিময়ে তাদের স্বর্গে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারে, এই ধারণায় ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে, তিনি পাশের শহর ভিটেনবার্গের একটি চার্চের দরজার উপর ল্যাটিন ভাষায় লেখা একটি কাগজ পেরেক দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি এই ইনডালজেন্স বিক্রয় করাকে অখ্রিস্টীয় একটি আচরণ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার সেই লেখাটি জার্মান ও অন্য ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বরের শেষে এটি ইউরোপের মূল আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। রোমে পোপ লিও এটিকে কৌতুক বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি মৃদুস্বরে বলেছিলেন, আরেকজন মাতাল জার্মান। মদের নেশা কেটে গেলে সে তার মন পরিবর্তন করবে।

এই ‘মাতাল জার্মান’ ব্যক্তিটি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ যাজক সন্ন্যাসী মার্টিন লুথার। এবং তার মতামত কখনোই তিনি পরিবর্তন করেননি। বরং পোপই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পোপের হাসি-তামাশা ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়েছিল যখন তাকে জানানো হয়েছিল এই সন্ন্যাসীর সেই লেখাটির কারণে তার ইনডালজেন্স বিক্রয়ের পরিমাণ বেশ কমে গেছে এবং তার তহবিলে টাকা আসার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবেই হাস পেয়েছে। সুতরাং তার সেইন্ট পিটার পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনাটি এখন ঝুঁকির সম্মুখীন। সুতরাং পোপ লিও একটি নির্দেশ জারি করেছিলেন, যাকে বলা হয় ‘পাপাল বুল’, এটি যাজকের পদ থেকে মার্টিন লুথারকে অপসারণ করেছিল এবং তার সব লেখাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। যখন লুথার এই পাপাল বুলের তার অনুলিপিটি হাতে পেয়েছিলেন, তিনি প্রকাশ্যে সেটি আগুনে পুড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন পাপাল বুল ছাড়াও আরো অনেককিছুই তিনি পুড়িয়েছিলেন। তিনি সেই সেতুটিও পুড়িয়েছিলেন, যা তাকে ক্যাথলিক চার্চের সাথে যুক্ত করে রেখেছিল এবং তিনি এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, যে-বিদ্রোহটিকে ইতিহাসবিদরা বর্ণনা করেছিলেন ‘দ্য রিফরমেশন’ নামে। এবং এটি যখন শেষ হয়েছিল, খ্রিস্টীয় ইউরোপ বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

মার্টিন লুথার ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে ১০ নভেম্বর আইসলেবেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন হান্স এবং মার্গারেথ লুথারের ছেলে। যদিও দরিদ্র, এবং সাতটি সন্তান প্রতিপালন করতে সংগ্রামরত, তারপরও মার্টিনের পিতামাতা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যেন তাদের এই বুদ্ধিমান ছেলেটি ভালো একটি শিক্ষা অর্জন করতে পারে। তিনি এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন এবং ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত অগাস্টিনিয়ান অর্ডারের একজন সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। এর দুই বছর পরে যাজক হিসাবে তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভিটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। খুব দ্রুত পদোন্নতির জন্যে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর আগে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে একবার রোমে প্রেরণ করেছিলেন তাদের হয়ে একটি আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে।

মফস্বল শহর ভিটেনবার্গের ধীরগতির জীবনে অভ্যস্ত লুথারকে, বিখ্যাত ‘ইটার্নাল সিটি’ রোমের লঘুচিত্ততা, বিলাসিতা আর দুর্নীতি হতবাক আর বিতৃষ্ণ রেছিল। কিন্তু মহান রোমান ক্যাথলিক চার্চের অবস্থা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাসহ তিনি ভিটেনবার্গে ফিরে এসেছিলেন। তিনি তার নিজের আত্মা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন, চার্চ কি আসলেই এর নিজেকে নরক থেকে বাঁচাতে পারার মতো ক্ষমতা রাখে কিনা আর। এই ইনডালজেন্সের অশুভ বাণিজ্য এবং অন্য দুর্নীতি তার দুশ্চিন্তা প্রশমনে কোনো সহায়তা করেনি। কিন্তু তার উৎকণ্ঠার মূল কারণ চার্চ ছিল না। বরং মূলত এর কারণ তিনি বাইবেলের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এটিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

এমন নয় যে, বাইবেল চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন ‘মাস’-এর সময় এখান থেকে কিছু অংশ ল্যাটিন ভাষায় পাঠ করা হতো। সেই সময় নাগাদ ক্যাথলিক চার্চ বাইবেলকে শুধু ব্যবহার করত তাদের নিজের কর্তৃত্বের নেপথ্যে শক্তি ও সমর্থন জোগাতে। এটি সেই খ্রিস্টের কথা বলেছিল যিনি বহুদিন আগে পবিত্রভূমিতে বাস করতেন, সেই একই পবিত্রভূমি, যেখানে চার্চ ক্রুসেডারদের এটিকে মুসলমানমুক্ত করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, পোপ এখন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা ভাইকার। বাইবেলের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখন পোপের সমতুল্য। এখন পোপই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি স্বর্গ-নরকের চাবির সংরক্ষক, কোনো একটি বইয়ের পাতায় লেখা কিছু পুরনো শব্দ নয়, যা খুব অল্প কয়েকজনই পড়তে পারতেন, কারণ এটি লেখা ছিল ল্যাটিন ভাষায়। আর মাসের সময় এখান থেকে বাছাইকৃত অংশ উচ্চারণ করা খুব অল্প কয়েকজন যাজকই আসলে বুঝতেন। এটি আবৃত্তি, কুর’আন আবৃত্তির মতো : শক্তিশালী, এমনকি যখন আপনি সেটির একবর্ণও বুঝবেন না।

লুথারের সময় নাগাদ কিছু মানুষ ছিলেন যারা বাইবেল পড়তে ও বুঝতে পারতেন। শুধুমাত্র ল্যাটিন ভাষায় নয়, যে-ভাষায় এটিকে অনূদিত করা হয়েছিল আরো হাজার বছর আগে। লুথারের মতো কিছু শিক্ষিত যাজক মূল হিব্রুভাষায় ওল্ড টেস্টামেন্ট আর মূল গ্রিকভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট পড়তে শুরু করেছিলেন। এবং এর বার্তাগুলো তাদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তারা অনুধাবন করেছিলেন, ‘এগুলো স্বয়ং ঈশ্বরের কথা, পোপের মুখ থেকে আসা কিছু শব্দ নয়। বাইবেল সুসংবাদ, যদি আপনি এটি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন এবং খুবই খারাপ সংবাদ, যদি আপনি বিষয়টি ভুল বোঝেন। আর ক্যাথলিক চার্চ যে-বিষয়টি খুব বড়মাত্রায়, ভয়ানকভাবেই ভুল বুঝেছিল, সেটি বুঝতে পেরে লুথার বেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।

বাইবেল হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর গল্প, যাদের ঈশ্বর নিজের পছন্দের গোষ্ঠী হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। এটি একটি বিয়ের মতো বিষয় ছিল। ঈশ্বর ইজরায়েলের সাথে নিজেকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কনে হিসাবে ইজরায়েল অবিশ্বস্ত ছিল। আর যিশুর সময় নাগাদ তার অবিশ্বস্ত কনে ইজরায়েলের সাথে ঈশ্বরের বিচ্ছেদপর্ব সমাপ্ত হয়েছিল এবং তিনি একটি নতুন কনে নির্বাচন করেছিলেন, আর সেটি হচ্ছে খ্রিস্টীয় চার্চ। ইতিহাসের কি তাহলে পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে? ক্যাথলিক চার্চ কি আর যিশুর পবিত্র কনে নয়? নাকি পার্থিব সফলতা আর এর সাথে আসা সব বিলাসিতা আর সুখানুভূতির দম্ভে সে একজন অবিশ্বস্ত স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে?

ইজরায়েল আর ঈশ্বরের মধ্যবর্তী চুক্তিভঙ্গের কাহিনিটি হচ্ছে মূল চাবি, যা দিয়ে আমরা রিফরমেশনের মূল অর্থটি ব্যাখ্যা করতে পারি। এর শক্তি অনুভব করতে আমাদের সেই সুবিশাল দাবিটিকে স্মরণ করতে হবে, যা খ্রিস্টীয় চার্চ নিজের সম্বন্ধে করেছিল। এটি নারী-পুরুষকে পরমানন্দের সুসংবাদ আর অনন্ত দুঃখের খারাপ খবরের বার্তা দিয়েছিল। যদি তারা ঈশ্বরের সাথে তাদের প্রতিজ্ঞায় বিশ্বস্ত থাকত, স্বর্গে তাদের জন্যে অপেক্ষায় থাকত চমৎকার একটি ভবিষ্যৎ। কিন্তু অবিশ্বস্ত হবার মূল্য ছিল সেই অনন্তকালের নির্যাতন, যা বিস্তারিতভাবে চিত্রিত হয়েছে সালিসবুরির সেইন্ট থমাসের চার্চের সেই ‘ডুম’ চিত্রকর্মটিতে।

কীভাবে এই নিয়তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সেই ভাবনাটি মার্টিন লুথারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তিনি যখন সেইন্ট পলের চিঠিগুলো পড়ছিলেন, আরেকজন নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান, তার একটি বোধোদয় ঘটেছিল, ঈশ্বরের বিষয়ে একটি অন্ত দৃষ্টির মুহূর্ত। অশেষ প্রার্থনা কিংবা তীর্থযাত্রা করে তিনি মুক্তি পাবেন না। অথবা পোপের সই করা ইনডালজেন্সও তাকে কোনো সহায়তা করবে না। এগুলো ঈশ্বরের সাথে তার সম্পর্কটিকে একটি বাণিজ্যিক সম্পর্কে রূপান্তরিত করবে, এমন কিছু যা-কিনা তিনি ক্রয় করতে পারেন। কিন্তু তিনি জানতেন ঈশ্বরের ভালোবাসা ক্রয় করা অসম্ভব। তারপর তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তিনি ঈশ্বরের ভালোবাসা ক্রয় করতে পারবেন না কিন্তু তার সেটি করার দরকারও নেই কারণ ঈশ্বর এটি বিনামূল্যেই দান করছেন। এবং ঈশ্বরের ভালোবাসাই তাকে রক্ষা করবে। চার্চের কোনো গোলমেলে চুক্তি নয়। তিনি সেই ভালোবাসার ওপর ভরসা করতে পারেন এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরের ওপর ভরসা করতে পারেন, চার্চ কিংবা পোপ নয়, বা অন্য কোনো মধ্যস্থতাকারীর ওপর তার বিশ্বাস রাখার দরকার নেই।

যদিও তিনি তখন অনুধাবন করতে পারেননি, আগত শতাব্দীগুলোয় তার এই অন্তর্দষ্টির প্রভাব কত বিশাল হতে পারে, কারণ লুথারের মনে সেই ভাবনার। সূচনাটাই ছিল মানব-ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্ন। এটি দুটি শক্তিকে উন্মুক্ত করেছিল, যা চিরকালের জন্যে ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল : বাইবেল এবং স্বাধীন ব্যক্তি, যারা সরাসরি তাদের ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল সেই একতার ভাঙন, যা একটি সময় ক্যাথলিক চার্চ অলঙ্ঘনীয় ভেবেছিল। প্রটেস্টান্ট রিফরমেশনের সূচনা হয়েছিল। পরে কয়েকটি অধ্যায়ে আমরা এর পরিণতি নিয়ে আলোচনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *