২৬. খ্রিস্টের প্রতিনিধি

অধ্যায় ২৬. খ্রিস্টের প্রতিনিধি

চতুর্থ শতাব্দীতে কনস্টান্টিনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম রোমসাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা হবার পর হাজার বছরের মধ্যে খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকা নিপীড়িত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে চার্চ এই গ্রহে সবচেয়ে বৃহত্তম আর শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিল। একই সাথে আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব। শক্তিতে বলীয়ান চার্চ পৃথিবী এবং স্বর্গকে সন্ধিহীন একটি ঐক্যে যুক্ত করার দাবি। করেছিল। একটি বিস্ময়কর প্রতিষ্ঠান, পাপ এবং পুণ্য উভয়ক্ষেত্রেই চমকে দেবার। মতো ইতিহাস এটি ধারণ করে। এটি পৃথিবীর উপর তার প্রভাব বিস্তার করেছিল, যা সম্রাটদের দর্পচূর্ণ করেছিল, নতিস্বীকার করিয়েছিল, একই সাথে সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। এবং যদিও এটি ক্রুশবিদ্ধ সেই নবী, যাকে তারা অনুসরণ করে বলে দাবি করেছিল, তার থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে সরে এসেছিল, যিশু তারপরও নেপথ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একটি অস্বস্তিকর উপস্থিতি হিসাবে, বিশ্বাসীদের মনে যার প্রভাব কখনোই নির্বাপিত হয়নি।

এয়োদশ এবং চতুর্দশ শতকে এর ক্ষমতার শীর্ষে ক্যাথলিক চার্চ এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল, যে-শিক্ষাটি কোনো ধর্মকে অবশ্যই শিখতে হবে ইতিহাসের প্রমত্ত সাগরে যদি এটি নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে চায়। যেমন, আমরা দেখেছিলাম, তাদের বিশেষ প্রকৃতির কারণে ধর্ম খুব সহজেই খণ্ডিত হতে পারে। এই ভাঙনের সূত্রপাত ঘটাতে খুব বেশিকিছুর দরকার হয় না। একজন মানুষের মৃত্যুই সেটি করতে পারে। একটি শব্দের মধ্যে একটি স্বরবর্ণ নিয়ে বিতর্কের কারণেও যেমন হতে পারে। ক্যাথলিক চার্চ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই ভাঙন ঠেকানোর শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে একক ব্যক্তির ওপর সব ক্ষমতা ঘনীভূত করা, এবং তাকে ঘিরে একটি কাঠামো তৈরি করা, যা তার কর্তৃত্বকে টিকিয়ে রাখবে।

ক্যাথলিক চার্চ সেটি অর্জন করেছিল যাজকদের একটি নিবেদিত অর্ডার বা সংঘ প্রতিষ্ঠা করে, যারা এই বিশাল সংগঠনের নিচের স্তরটির তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করবেন। ক্যাথলিক যাজকদের জন্যে বিবাহ এবং কোনো ধরনের মানব আনুগত্য গড়ে তোলা নিষিদ্ধ ছিল, যা কিনা তাদের আধ্যাত্মিক দায়িত্বপালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। চার্চই হবে তাদের পরিবার। আর তাদের জন্য আবশ্যিক এই ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের বিনিময়ে তাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছিল বিশেষ সম্মান এবং পবিত্র মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান। আর এটি দেওয়া হয়েছিল একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যাকে ‘অ্যাপোস্টলিক সাকসেশন’ বলা হয় (যিশুর অনুসারীদের সেই ধারাবাহিক উত্তরসূরি)। ইসলামের শিয়াতো সংস্করণে ইমামের মতো, ক্যাথলিক যাজক তাদের কর্তৃত্ব পেতেন মানুষ নয় বরং একটি স্বর্গীয় উৎস থেকে। আর এটি এভাবে কাজ করেছিল।

যিশু বারোজন অ্যাপোস্টল বা প্রথম অনুসারীদের তার লক্ষ্যপূরণে তাকে সহায়তা করতে আহ্বান করেছিলেন। এবং তিনি তাদের মাথার উপর হাত রেখে এই কাজের জন্যে দীক্ষিত করেছিলেন। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাপোস্টলরাও তাদের কর্তৃত্ব তাদের পরবর্তী অনুসারীদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। ক্যাথলিক চার্চ দাবি করে, এভাবে মাথার উপর হাত রেখে অর্পণ করা দায়িত্বের এই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতার শৃঙ্খল কখনোই ভাঙেনি। কল্পনা করুন সুবিশাল। একটি পাইপ-লাইন, যা ইতিহাসে অবিকৃতভাবে প্রবাহিত হয়েছে। এই ধারাবাহিতার শৃঙ্খল ভঙ্গ করে যদি আপনি অন্য কোনো গ্যাস-সরবরাহকারীর গ্রাহক হন, তাহলেই আপনি যিশুর কর্তৃত্ব হারাবেন। ক্যাথলিক বিশপ আর যাজক আর ডিকনরা, যারা এভাবে দীক্ষা পান, তারা একটি বিশেষ বর্ণের সদস্যে রূপান্তরিত হন, যারা সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক একটি শ্রেণি। কোনো একটি যাজককে অপমান অথবা আহত করা হচ্ছে বিশেষ ধরনের একটি অপরাধ। এটি ধর্মদ্রোহিতা, ধর্ম অবমাননা, সরাসরি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে করা একটি অপরাধ। এবং সেভাবেই এই অপরাধের শাস্তি দেওয়া হতো।

ক্যাথলিক চার্চের অখণ্ডতা রক্ষার্থে এই বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি সৃষ্টি করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এই কাঠামোর সবচেয়ে সফলতম কার্যকরী উপায়টি ছিল, যেভাবে এটি একজন ব্যক্তির ওপর চূড়ান্ত ক্ষমতা ঘনীভূত করেছিল, আর সেই ব্যক্তিটি ছিলেন রোমের বিশপ–পোপ। যে সময় সাংগঠনিক এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল, রোমের এই বিশপ পদের ব্যক্তিটি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তার মুখের উচ্চারিত শব্দের শুধুমাত্র পৃথিবীর জীবনের ওপরেই কর্তৃত্ব ছিল না, মৃত্যুপরবর্তী জীবনের ওপরে সেগুলোর কর্তৃত্ব ছিল। তিনি যেমন আপনাকে পৃথিবীতে বন্দি করতে পারতেন, এবং একইভাবে অনায়াসে পরকালে আপনার স্বর্গে প্রবেশও নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখতেন। যখন এর ক্ষমতার শীর্ষে, রোমের বিশপের ক্ষমতা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। কিন্তু বহু শতাব্দী সময় লেগেছিল এটি অর্জন করতে। আর কীভাবে এটি হয়েছিল সেটি বুঝতে হলে আমাদের চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্টান্টিনের সময়ে ফিরে যাওয়া দরকার।

রোম থেকে রোম সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবসময় পরিচালিত হয়েছিল এমন ধারণাটি ভুল। তবে এটি তেমনই ছিল ৩৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যখন সম্রাট কনস্টান্টিন তার রাজকীয় কর্মকাণ্ডের মূল দপ্তরগুলো সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি একটি বিস্ময়কর সুন্দর শহর নির্মাণ করেছিলেন, নিজের নামেই যে-শহরের নাম রেখেছিলেন কনস্টান্টিনোপল। আজ সেটিকে আমরা তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর নামে চিনি। শহরটির প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল। কনস্টান্টিনোপল, সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল আর এই শহরটির গর্বিত অবস্থান স্থানীয় বিশপকেও একটি বিশেষ মহিমান্বিত অবস্থান ও মর্যাদা দিয়েছিল। রোম আর কনস্টান্টিনোপলের মতো শহরগুলোর বিশপরা খুবই ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, যারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বিশপদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন।

সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের শহরগুলোর বিশপরা নিজেদের ‘প্যাট্রিয়ার্ক’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন, গ্রিক যে-শব্দটি থেকে এর উৎপত্তি, সেটির অর্থ ‘পিতা’। আর পশ্চিমে তারা নিজেদের পোপ’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, শব্দটির ল্যাটিন উৎসের অর্থও হচ্ছে ‘পিতা। তাদের ব্যবহৃত ভাষার ভিন্নতার নেপথ্যে আরো গভীর মতপার্থক্য সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল। যদিও তাত্ত্বিকভাবে একই চার্চ, কিন্তু পরস্পর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। ইতিহাসের বহু বাবিতণ্ডার মতো, বিচ্ছেদ যখন এসেছিল, তখন তার কারণ ছিল চার্চের মূল দায়িত্বে কে আছেন সেই প্রশ্নটিকে ঘিরে। ঈশ্বরের রাজ্য পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা হলে তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হবেন এই বিষয় নিয়ে যখন যিশুর অ্যাপোেস্টলরা নিজেদের মধ্যে তর্ক করতেন, তিনি তাদের তিরস্কার করতেন। কনস্টান্টিনোপল আর রোমের বিশপের মধ্যেও একই ধরনের একটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। কে শ্রেষ্ঠ, পূর্ব প্যাট্রিয়ার্ক নাকি পশ্চিমের পোপ? আর বিষয়টি মীমাংসা করার জন্যে তখন যিশুও ছিলেন না।

বাস্তবে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রবাহিত হচ্ছিল রোম-অভিমুখে। আর সম্রাট যে এখন রোমের বাসিন্দা নন এই বাস্তবতাটির মানে সাম্রাজ্যের প্রাক্তন রাজধানীতে পোপই সব ক্ষমতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী উৎসে পরিণত হয়েছিলেন। অন্যদিকে, কনস্টান্টিনোপলে প্যাট্রিয়ার্ক সবসময়ই সম্রাটের চেয়ে কম মর্যাদাশীল ছিলেন, যিনি সারাক্ষণই তার কাজের তদারকি করতেন। ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা দ্বন্দ্বের ছাইচাপা আগুনটি প্রবল শিখায় প্রজ্বলিত হয়েছিল, দ্য গ্রেট স্কিজম বা মহাবিভাজন নামে যা পরিচিত পেয়েছিল। খ্রিস্টান ধর্মের সুনির্দিষ্টভাবে দুটি ভিন্ন সংস্করণের সূচনা হয়েছিল : পূর্বের অর্থোডক্স চার্চ আর পশ্চিমের ক্যাথলিক চার্চ, যার পোপ তখন রোমে। এই বিভাজন এখনো আছে, প্রত্যেকটি ধারার নিজস্ব রীতি আর সংস্কৃতি আছে। অর্থোডক্স যাজকদের সাধারণত দাড়ি থাকে, ক্যাথলিক যাজকদের সাধারণত থাকে না। অর্থোডক্স যাজকরা চাইলে বিয়ে করতে পারেন, ক্যাথলিক যাজকরা যা করতে পারেন না। কিন্তু এইসব উপরি পার্থক্যের নেপথ্যে রোমের পোপ যে চূড়ান্ত কর্তৃত্ত্ব অধিগ্রহণ করেছিলেন তার উৎস নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি গভীর মতানৈক্য আছে।

আপাতদৃষ্টিতে এটিকে সাধারণ ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখা যেতে পারে। আর যাই হোক না কেন, আমরা জানি ক্ষমতা মাদকের মতোই কতটা আসক্তি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে এবং এটি অর্জন আর কুক্ষীগত করে রাখার জন্যে মানুষ অনেককিছুই করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরা সবসময়ই তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পবিত্র কাপড়ে আচ্ছাদিত করে রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। এই দ্বন্দ্ব কখনোই মানব-রাজনীতি নিয়ে নয়। এটি সবসময়ই ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সাথে জড়িত। আমরা এটি ইসলামে শিয়া আর সুন্নী দ্বন্দ্বেও দেখেছি। শিয়ারা তাদের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেনবীর উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত একটি আধ্যাত্মিক তত্ত্ব দিয়ে আচ্ছাদিত করেছিল। রোমের পোপের হাতে খেলার মতো একই রকম একটি তাশ ছিল। রোম, সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর, এটাই পোপের খ্রিস্টধর্মের ক্ষমতার নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দাবি করার একমাত্র যুক্তি ছিল না। আরো কিছু দাবি এর সাথে যুক্ত ছিল। যিশুখ্রিস্ট নিজেই সেভাবে সেটি পরিকল্পনা করেছিলেন! আর যুক্তিটি ছিল এরকম।

যখন যিশু তার বারোজন ‘অ্যাপোস্টলের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানটির জন্যে পিটারকে মনোনীত করেছিলেন। এবং পিটারের অবস্থান নিয়ে যেন অন্যরা কোনো ধরনের সন্দেহে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে, তিনি এমনকি পিটারকে একটি ডাকনামও দিয়েছিলেন। তার আসল নাম, তার ইহুদি নাম ছিল, সাইমন। কিন্তু যিশু তাকে ডেকেছিলেন তার রক’ বা পাথর হিসাবে, গ্রিকভাষায় ‘পেট্রোস’, ল্যাটিন ভাষায় ‘পেট্রা’। তোমাকে আগে সাইমন নামে ডাকা হতো’, যিশু বলোছলেন, ‘কিন্তু এখন থেকে তোমার নাম হবে সাইমন পিটার, সাইমন দ্য রক। তোমার ওপরেই আমি আমি আমার সমাজ গড়ব’। এবং শুধুমাত্র এটাই নয়।

আপনি কি মনে করতে পারছেন পিটার কোথায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন? এটি ঘটেছিল রোমে, খ্রিস্টানদের উপর প্রথম নির্যাতনপর্বে, ৬৫ খ্রিস্টাব্দে। যেহেতু পিটার রোমে ছিলেন যখন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল, তিনি নিশ্চয়ই রোমের প্রথম বিশপ ছিলেন। আর যেহেতু তিনি অ্যাপোস্টলদের নেতা ছিলেন, তাহলে আপনি যুক্তি দিতে পারেন পরে যারা তার অনুসরণে রোমে বিশপ হয়েছিলেন তারা এই মর্যাদাটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। সুতরাং রোমের বিশপ, পিটারের উত্তরসূরিও অবশ্যই সব বিশপদের প্রধান হবেন। এই পৃথিবীতে তিনিই হবেন খ্রিস্টের ‘ভাইকার’ বা প্রতিনিধি। পূর্বের চার্চ পিতারা এই যুক্তির সাথে একমত হতে পারেননি। এমনিতে বিষয়টি বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, যখন পিটারকে রোমের প্রথম বিশপ হিসাবে দাবি করা হয়। তার সময়ে খ্রিস্টানরা এমনিতেই বেশিদিন বেঁচে থাকা আশা করতেন না। তাদের বলা হয়েছিল খুব শীঘ্রই যিশুখ্রিস্ট্র ফিরে আসবেন। তাহলে কেন তারা একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ঝামেলা মাথায় নেবেন, যা আর সবকিছুর মতোই খুব শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যাবে?

পূর্বের চার্চের এই যুক্তির ক্ষেত্রে ইতিহাস সাক্ষী ছিল। চার্চ যেভাবে সংগঠিত হয়েছে সেটির জন্য তারা যিশুর চেয়ে বরং সম্রাট কনস্টান্টিনের কাছেই বেশি ঋণী। সুতরাং তারা তাদের ওপরে রোমের পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন, এবং নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। সুতরাং পশ্চিমা চার্চের শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন রোমের পোপ। কিন্তু তখনো তার ক্ষমতা কুক্ষীগত করার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। আর এর পরবর্তী পর্যায়টি বুঝতে হলে আমাদের ঐসব আত্মাদের কাছে ফিরে যেতে হবে, যারা অবসন্ন পায়ে পারগেটরির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

মনে রাখবেন : ধর্মীয় মনের কাছে এই জীবনের সময়কালটি শুধুমাত্র পরকালে অশেষ জীবনের জন্যে একটি প্রস্তুতি ছিল মাত্র। আর কীভাবে আপনি সেই জীবনটি কাটাবেন সেটি নির্ভর করবে এই পৃথিবীতে আপনি কেমন আচরণ করেছিলেন। পাপ আপনাকে নিয়ে যেতে পারে নরকে, অথবা পারগেটরিতে, যদি আপনি একটি সুযোগ পান। আর সে-কারণে মৃত্যুর আগে আপনার পাপের জন্যে। ক্ষমা পাওয়া এত বিশাল একটি ব্যাপার ছিল। কিছু মানুষ অন্য ধরনের একটি খেলা খেলতেন, তারা ব্যাপটাইজ হবার সময়টি আরো বিলম্বিত করতেন এবং তাদের মৃত্যুর আগে আচারটি পালন করে তাদের আগের সব পাপ ধুয়ে ফেলতেন। এর মানে এখানে নিচে, পৃথিবীতে তারা একটি উপভোগ্য জীবনের মোটামুটি নিশ্চয়তা অর্জন করতে পারতেন, এবং পরবর্তী পৃথিবীতে, পরকালে একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন কাটানোর যথেষ্ট পরিমাণ নিশ্চয়তাও পেতেন। কনস্টান্টিন নিজেও সেটি করেছিলেন। তিনি তার ব্যাপটিজম বিলম্বিত করেছিলেন, যতক্ষণ-না তিনি মৃত্যুর সন্নিকটে পৌঁছেছিলেন। তিনি খুব বিচক্ষণতার সাথে এই সময়টি নির্ধারণ করেছিলেন এবং ঠিক সময়মতো তার ব্যাপটিজম অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আপনার শুধু কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হবে অনুধাবন করার জন্যে যে, যদি মানুষকে তাদের সব পাপের জন্যে ক্ষমা করার ক্ষমতা থাকে আপনার এবং স্বর্গে তাদের জায়গা হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারেন, এটি আপনাকে সব মানুষের ওপর প্রভাব খাটানোর মতো অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ক্ষমতায় বলীয়ান করবে। পোপ বিশ্বাস করতেন তার সেই কর্তৃত্ব আছে। যিশু এটি পিটারকে দিয়েছিলেন এবং তিনি (পোপ) হচ্ছেন পিটারের উত্তরসূরি। দ্বাদশ শতকে পোপরা তাদের এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এমনভাবে, পরিশেষে এটি ক্যাথলিক পাথরের ভিত্তিতেও ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল। আর এর জন্যে ইসলামই দায়ী ছিল।

আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকাই, আমরা লক্ষ করব যে, নবীর মৃত্যুর পরে রোম সাম্রাজ্যের দক্ষিণ আর পূর্বাঞ্চলে তারা নাটকীয়ভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এবং তাদের দখলকৃত জায়গার মধ্যে একটি ছিল প্যালেস্টাইন। সুতরাং জেরুজালেম, সেই পবিত্র শহরটি, যা খ্রিস্টান আর ইহুদিদের কাছে বিশেষ মর্যাদায় পবিত্র ছিল, সেটি মুসলমানদের হাতের মধ্যে এসে পড়েছিল। অবশ্যই মুসলমানদের কাছেও জেরুজালেম পবিত্র একটি শহর ছিল। তাদের নবী কি আব্রাহাম, মোজেস আর যিশুর স্বর্গীয়ভাবে চিহ্নিত উত্তরাধিকারী ছিলেন না?

তবে পোপ বিষয়টি সেভাবে দেখেননি। তার কাছে খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে পবিত্র শহরটি মুসলমানদের দখলে যাওয়া একটি চূড়ান্ত অপমান ছিল। সুতরাং তিনি সেটি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। একটি বিশাল অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল খ্রিস্টান যোদ্ধাদের প্ররোচিত করতে, যেন তারা ইউরোপ থেকে জেরুজালেম অভিমুখে যান এবং এই শহরটিকে ক্যাথলিক চার্চের পক্ষে পুনরায় জয় করে নিয়ে আসতে পারেন। যারা এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে চেয়েছিলেন, এবং যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন তাদের বলা হতো ক্রুসেডার, এই শব্দটির অর্থ কুশদ্বারা চিহ্নিত। কনস্টান্টিনের মতো, যিনি ক্রুশের ব্যানারের নিচে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন রোমের মিলভিয়ান সেতুর নিকটে, ক্রুসেডাররাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন, যারা সেই সময় প্যালেস্টাইন শাসন করছিলেন।

১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় আরবান প্রথম ক্রুসেডারদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে এধরনের সাতটি অভিযান হয়েছিল। যদিও কিছুদিনের জন্যে জেরুজালেম আবার দখল করে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু ক্রুসেডাররা যেমন মুসলমানদের ক্ষতি করেছিলেন, তেমনি তারা প্রাচ্যের অর্থোডক্স চার্চেরও একই পরিমাণ ক্ষতি করেছিলেন। এই যুদ্ধ ক্যাথলিকদের ইতিহাসে একটি অমোচনীয় কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। কিন্তু নিয়তিনির্ধারক সেই পরিবর্তনটি ছিল এরকম। যোদ্ধাদের ক্রুসেডে আসার জন্যে পোপ যে-পুরস্কারটি তাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন, সেটি হচ্ছে তাদের সব পাপের জন্যে ক্ষমা ঘোষণা। আর এই বোঝাপড়াটির কারিগরি নাম হচ্ছে ‘ইনডালজেন্স’, ল্যাটিন শব্দ উৎসটির অর্থ বিশেষ সুবিধা বা ছাড় দেওয়া। এই প্রস্তাবে একটি আধ্যাত্মিক যুক্তি ছিল। আর যাই হোক না কেন, বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরে ঘোড়ায় চড়ে বা পায়ে হেঁটে, যুদ্ধের সব বিপদ আর ঝুঁকি সহ্য করাকে হয়তো খারাপ আচরণের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে ভাবা যেতে পারে, যেমন, বর্তমানে বিচারব্যবস্থার দ্বারা আরোপিত জরিমানা বা বাধ্যতামূলক সামাজিক সেবামূলক কাজে নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় দেওয়া।

আর যখন একজন ভবিষ্যৎ পোপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার একটি প্রিয় স্থাপত্য-নির্মাণ প্রকল্প অর্থায়ন করার জন্যে ‘ইনডালজেন্স’ বিক্রয় বেশ চমৎকার একটি টাকা বানানোর উপায় হতে পারে, তখন চার্চের জন্যে সমস্যার সূচনা হয়েছিল। আমরা পরের কিছু অধ্যায়ে সেটি দেখব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *