২৪. সংগ্রাম

অধ্যায় ২৪. সংগ্রাম

একজন নবী ছাড়াও মুহাম্মদ একজন যোদ্ধা ছিলেন, যিনি ইসলামের প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার অনুসারীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর এই দুটি ভূমিকার মধ্যে। তিনি কোনো স্ববিরোধিতাও লক্ষ করেননি। যুদ্ধগুলো তিনি যুদ্ধ করার উত্তেজনা কিংবা লুটতরাজ করার লক্ষ্যে পরিচালনা করেননি, যদিও কোনো সন্দেহ নেই তার বহু অনুসারী দুটোই উপভোগ করেছিলেন। তার আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনে যুদ্ধ একটি উপকরণ ছিল, আর আমরা যদি তাকে বুঝতে চাই–অথবা ইতিহাসে যে কোনো ধর্মীয় নেতা, যারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহিংসতা ব্যবহার করেছিলেন– আমাদের তাহলে অবশ্যই তার মনের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতে হবে।

প্রথম যে-জিনিসটি বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে নবীর মতো ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা কোনো মানুষের জন্যে এই পৃথিবীর জীবনটি মূল লক্ষ্য ছিল না, এটি এমন কিছু ছিল যা মূল লক্ষ্যটি অর্জনের খাতিরেই উপভোগ করতে হয় মাত্র। এটি ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখের, মোয়াজ্জিনের আজানের মতো বিষণ্ণ। এটি শুধুমাত্র শুরু, সংগীতের আবেগগাদ্দীপক সূচনা অনুচ্ছেদ, একটি ভূমিকা, আর নাটকের মূল অঙ্কটি, যা মৃত্যুর পর আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, যেখানে আসল কাহিনিটি মঞ্চস্থ হবে। আর এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান করার উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্ধারণ করা কীভাবে আমরা সেই অনন্ত জীবনটি কাটাব, যা মৃত্যুর পরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

ধরুন আপনাকে ইস্পাত-কঠিন একটি নিশ্চয়তা দেওয়া হলো, যদি আপনি কয়েক মিনিটের জন্যে তীব্র যন্ত্রণাপূর্ণ একটি পরীক্ষা সহ্য করতে পারেন তাহলে আপনাকে এক বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে, যা ইতিমধ্যে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে গেছে, শুধুমাত্র সক্রিয় হবার জন্যে আপনার সম্মতি দরকার। আপনি কীভাবে জবাব দেবেন? আপনি কি সেই কয়েক সেকেন্ডের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করবেন, সেই সম্পদ জয় করতে, যা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে, যখন এটি শেষ হবে? সম্ভাবনা আছে আপনি হয়তো এই সুযোগটা নিতে রাজি হবেন।

আর এটাই হচ্ছে সহিংসতার নেপথ্যে থাকা যুক্তিপ্রক্রিয়াটি, যা প্রায়শই ধর্মকে চিহ্নিত করে। শল্যচিকিৎসকদের নিষ্ঠুরতাই আমাদের কেটে উন্মুক্ত করে, তবে আমাদের কষ্ট দিতে নয়, বরং আমাদের জীবন বাঁচাতে। কিছু বিশ্বাসী শহীদ হিসাবে তাদের জীবন বিসর্জন দেয় সেই পরমানন্দের জন্যে, যা মৃত্যুর অন্যপাশে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। আর অন্যরা, বন্ধু কিংবা আগন্তুকদের শরীরের উপর যন্ত্রণা আর মৃত্যু আরোপ করাটাকেই তাদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বিশ্বাসকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তাদের কর্তব্য বলে মনে করেন। পছন্দ করুন বা না করুন, এটাই পবিত্র যুদ্ধ আর নিষ্ঠুর জাতিগত বিশোধনের নেপথ্যে থাকা যুক্তি, যা ধর্মের ইতিহাসে অপরিবর্তনীয় একটি বৈশিষ্ট্য।

নিকটবর্তী এলাকা এবং তারপর জানা পৃথিবীর সর্বশেষ প্রান্ত অবধি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে মুসলমানরা প্রথম লড়াই করেছিলেন, পবিত্র যুদ্ধ-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তাদের মতো এত দক্ষ আর কেউ ছিলেন না। মুহাম্মদের মৃত্যুর একশো বছর পরেই উত্তরে সিরিয়া আর পশ্চিমে মিশরের নিয়ন্ত্রণ দখলে নিয়েছিল ইসলাম। মিশর থেকে উত্তর-আফ্রিকার অন্য দেশগুলোয় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি সময় প্যালেস্টাইন ও পারস্যের একটি বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল ইসলামি যোদ্ধারা। ইসলাম ভারত এবং চীনে পৌঁছেছিল। এবং এটি স্পেন বিজয় করেছিল, যেখানে এটি খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সীমিত আকারে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছিল। একটি সময় ছিল যখন মনে হচ্ছিল এটি পুরো ক্যাথলিক ইউরোপই দখল করে নেবে, তবে তাদের সেই আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এটি যত যুদ্ধ লড়েছে বা যে-পরিমাণ এলাকা জয় করেছিল সেগুলো বর্ণনা করার চেয়ে বরং যে ধর্মতাত্ত্বিক যৌক্তিকতা ধর্মটি প্রস্তাব করেছিল, সেই বিষয়টি অনুসন্ধান করতেই বরং আমি আরো বেশি আগ্রহী। এবং তাদের একটি এখনো বর্তমান সময়ের এই পৃথিবীতে খুবই প্রাসঙ্গিক। এটি হচ্ছে ‘জিহাদ’ বা সংগ্রামের ধারণা।

মুসলমানদের একটি অংশ জিহাদকে ইসলামের অনানুষ্ঠানিক ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। আসলেই, ইসলামের পাঁচটি কর্তব্য পালন করার সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টাকেই ‘জিহাদ’ হিসাবে দেখা হয়। শব্দটির অর্থ সংগ্রাম অথবা প্রচেষ্টা। হতে পারে এটি ধর্মবিশ্বাসকে ধরে রাখা এবং একটি ন্যায্য সমাজপ্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম অথবা ইসলামকে এর শত্রুদের থেকে সুরক্ষা করার সংগ্রাম। বহু শতাব্দী ধরেই এই দুটি অর্থেই জিহাদের চর্চা করে আসা হচ্ছে, এবং এর হিংস্রতম রূপে এমনকি মুসলমানরা এটি মুসলমানদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সহিংস মতানৈক্য ইতিহাসে বেশ সাধারণ একটি ঘটনা। নবীন, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি সমাজের মধ্যে ফাটল ধরা শুরু হবার জন্য শুধুমাত্র মুহাম্মদের মৃত্যুই যথেষ্ট ছিল। আর যে রূপ এটি নিয়েছিল সেটি ধর্ম কীভাবে নিজেকে সংগঠিত করে এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদের কারণগুলো মীমাংসা করে সে-বিষয়ে আমাদের অনেক কিছুই বলে।

এই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি ছিল, নবীর উত্তরাধিকার কার হওয়া উচিত আর কোন নীতির ওপর ভিত্তি করে এই নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যা ঘটেছিল তা হলো মুহাম্মদের বন্ধু এবং অনুগত সহকর্মী আবু বকর প্রথম খলিফা’ বা উত্তরসূরি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সমস্যাটি শুরু হয়েছিল চতুর্থ খলিফা হিসাবে মুহাম্মদের নিজের চাচাত ভাই এবং জামাতা আলীকে যখন নির্বাচিত করা হয়েছিল, যিনি নবী-কন্যা ফাতিমার স্বামী ছিলেন। আলীকে খলিফা হিসাবে নিয়োগ করা ব্যাপারটি অনেকেই সমর্থন করতে পারেননি। এটি ইসলামকে বিভাজিত করেছিল, যা এখনো টিকে আছে। একটি গোষ্ঠী নবীর নিজের আত্মীয় আলী নয়, বরং তৃতীয় খলিফার একজন জ্ঞাতিভাই, মুয়াবিয়াকে চতুর্থ খলিফা হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। এর পরবর্তীতে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সূচনা হয়েছিল, সেখানে আলীকে হত্যা করা হয় এবং মুয়াবিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। আলীর সমর্থকরা এরপর দাবি করেছিলেন আলীর পুত্র হুসাইনকে এরপর খলিফা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হোক। কিন্তু ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে একটি যুদ্ধে হুসাইন নিহত হয়েছিলেন।

এই সংঘর্ষের পরিণতিতে ইসলামে একটি বিভাজন ঘটেছিল, ধর্মতত্ত্বে যার কারিগরি নাম ‘স্কিজম’ (ধর্মবিচ্ছেদ), ধর্মের ইতিহাসের যে-কোনো ছাত্রের জানার জন্যে বেশ উপযোগী একটি শব্দ, যা তাদের কারিগরি শব্দভাণ্ডারে থাকা দরকার। উপযোগী অন্য বহু শব্দের মতো, ‘স্কিজম’ শব্দটিও এসেছে গ্রিকভাষা থেকে, যার মানে কাটা বা ছেদ করা। একটি স্কিজম হচ্ছে একটি গোষ্ঠী, যা মূল দলের শরীর থেকে নিজেদের ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে পৃথক করে নেয়, এবং নিজেদের স্বতন্ত্র একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের বিচ্ছেদের নেপথ্যে সাধারণত ধর্মীয় মতানৈক্য থাকে। আর এই ক্ষেত্রে একটি খুব সাধারণ মতানৈক্য হচ্ছে, কীভাবে তাদের আধ্যাত্মিক নেতাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। খ্রিস্টধর্মে করা যিশুর সেই বারোজন অ্যাপোস্টলের সত্যিকার উত্তরসূরি কে হবেন, সেই মতানৈক্যটি একসময় খ্রিস্টীয় চার্চেও ধর্মবিচ্ছেদের কারণ হয়েছিল, যা এখনো অব্যাহত আছে, ঠিক ইসলামের ধর্মবিচ্ছেদের মতো।

ইসলামের ভাঙন সুন্নী এবং শিয়া নামে দুটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিল। সুন্নীরা ছিল অপেক্ষাকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ, শিয়ারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুন্নী অর্থ হচ্ছে সেই মানুষ যারা মূল সুন্না বা নবীর পথের অনুসারী। শিয়া মানে আলী’র দল, যারা বিশ্বাস করে নবীর উত্তরসূরিকে একজন ইমাম বা নবীর বংশধর হতে হবে। মূল দুটি দলের প্রত্যেকটির মধ্যেই এখন অসংখ্য বিভাজন আছে, এই বাস্তব তথ্যটি আমাদের ধর্ম আসলে কতটা ভঙ্গুর হতে পারে সেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়, বিশেষ করে যখন নেতৃত্বের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সেই বিতর্কটির মুখোমুখি হতে হয় তাদের।

ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোতে নেতৃত্ব নিয়ে সংগ্রামকে আমরা অন্যদের ওপর প্রভুত্ব করার মানবিক দুর্বলতার একটি উদাহরণ হিসাবে বাতিল করতে পারি। সেগুলো। ধর্মের পার্থিব দিকটির প্রতিনিধিত্ব করে। সেই ঘটনাগুলো দুঃখের, তবে অবশ্যম্ভাবী। ঈশ্বরের ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে সৃষ্ট ধর্মগুলো, অন্যদিকে, সরাসরি আমাদেরকে ঈশ্বরের মনের মধ্যে আর স্বর্গের জীবনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা। সুতরাং খুবই অস্বস্তিকর যখন আবিষ্কার করতে হয় যে, পৃথক আর বিভাজিত হবার সেই একই তাড়না সেখানে উপস্থিত থাকে। এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবন অনেকটাই মৃত্যুর আগের জীবনের মতোই মনে হয়। স্মরণ করুন, কুরআন দাবি করে, যখন পার্থিব এই দৌড়-প্রতিযোগিতার সমাপ্তি হবে, তখন অন্যদিকের সেই। জীবনটি কেমন হবে, এটি আমাদের তা প্রদর্শন করে। দুটি সম্ভাব্য পরিণতি যা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি আমাদের কারো কারো মনে শঙ্কার সৃষ্টি করতে পারে।

এটি আমাদের বলে, অন্যপাশে প্রত্যেকের জন্যই চূড়ান্ত গন্তব্য ইতিমধ্যেই সুনির্দিষ্ট করা আছে। সেখানে যাবার টিকিটও ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়ে গেছে। বাস্তবিকভাবেই এমনকি আমাদের জন্মের আগেই সেটি বিতরণ করা হয়েছে। এটাকেই বলে ‘প্রিডেস্টিনেশন’ বা অদৃষ্টবাদের মতবাদ (নিয়তিবাদ বা দৈববাদ)। আর ধারণাটি খ্রিস্টধর্মসহ অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসেও আমরা খুঁজে পাই। যেখানেই ধারণাটিকে পাওয়া গেছে, সেখানেই সেটিকে নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, আর বিতর্কের কারণ আপাতদৃষ্টিতে এই মতবাদটির নিষ্ঠুরতা এবং অবিচারের বিষয়টি। কিন্তু আসুন ধারণাটিকে এর শর্তগুলো দিয়েই আমরা বিশ্লেষণ করি। অধিকাংশ ধর্মই এই পৃথিবীর জীবনকে মৃত্যুপরবর্তী অনন্ত জীবনের একটি প্রস্তুতি হিসাবে দেখে থাকে। তত্ত্বটি হচ্ছে যে, যদি আমরা সততার সাথে এই জীবনটি কাটাই এবং আমাদের ধর্মবিশ্বাসের অনুশাসনগুলো মেনে চলি –যেমন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ –ঈশ্বর আমাদের পুরস্কৃত করবেন এবং স্বর্গে আমাদের স্বাগত জানাবেন। কিন্তু অদৃষ্টবাদ মতবাদটির একধরনের পাঠ অনুযায়ী, পরীক্ষায় বসার আগেই ঈশ্বর সবার পরীক্ষার খাতা দেখে সেখানে নম্বর দিয়ে রেখেছেন। তাহলে ঈশ্বর কেনই বা অযথা সব নবীদের পাঠিয়েছেন আমাদের সতর্ক করে দিতে, যেন আমরা আমাদের জীবনাচরণ পরিবর্তন করি আর তার অনুশাসনগুলো মেনে চলতে আরো কঠোরভাবে পরিশ্রম করি? কেন এত সংগ্রাম করতে হবে, কেন জিহাদের জন্য আত্মত্যাগ করতে হবে, যদি আমাদের নিয়তি ইতিমধ্যেই পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে? আমরা আবার ফিরে আসি আমাদের সেই পুরনো বন্ধুর কাছে, ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে থাকা সেই লেখক, যে তার নিজের ইচ্ছামতোই তার চরিত্রদের নিয়তি নির্ধারণ করছেন, কারো জন্য সুখ আর সফলতা আর কারো জন্যে দুঃখ আর ব্যর্থতা।

যে-কণ্ঠটি মুহাম্মদের সাথে কথা বলেছিল, সেটি কুর’আনে এভাবে প্রকাশ করেছে : ‘আমি তাদের গলায় চিবুক পর্যন্ত বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি, ফলে তারা উধ্বমুখী হয়ে আছে। তাদের সামনে একটি প্রাচীর ও তাদের পিছনে একটি প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর আমি তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি, ফলে তারা দেখতে পায় না। আর আপনি তাদের সতর্ক করেন বা না করেন, তাদের কাছে দুটোই সমান, তারা ঈমান আনবে না’। আরো সুস্পষ্টভাবে বললে পুরো বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত, ইসলামে আরো পবিত্র কিছু লেখা আছে যেখানে এটি সত্যায়িত করা হয়েছে।

কুর’আন ছাড়াও মুসলমানদের কাছে আরো একগুচ্ছ লেখা আছে, যাকে বলা হয় ‘সুন্নাহ’ অথবা পথ। মুহাম্মদ জিবরাইল ফেরেশতার কাছ থেকে যা শুনেছিলেন সেটি হচ্ছে কুর’আন আর ‘সুন্নাহ’ হচ্ছে যা কিছু মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সহচররা আর তার পরিবারের সদস্যরা তার কাছ থেকে সরাসরি শুনেছিলেন। এর মধ্যে আছে ‘হাদিস’, অথবা নবীর উপদেশ, শিক্ষা ও কথপোকথনের নানা বিবরণ। এবং এরকমই একটি হাদিসে আমরা অদৃষ্টবাদের সবচেয়ে সুস্পষ্ট বিবরণ পাই, ‘আপনাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, জন্ম নিয়েছে এমন কোনো আত্মা নেই, স্বর্গ অথবা নরকে, যার জন্য ইতিমধ্যেই জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখা নেই, অথবা, অন্যভাবে যদি বলা হয়, দুঃখ বা সুখের নিয়তি তার জন্যে পূর্বনির্ধারিত। ঢোক গিলতে হলো, কিন্তু এটি কীভাবে সংগতিপূর্ণ হয় আল্লাহর ঐসব সুন্দর নামের সাথে, যেমন, পরম দয়ালু আল্লাহ, সবচেয়ে বেশি সহমর্মী এবং ক্ষমাশীল, যিনি সবসময়ই ক্ষমা করতে প্রস্তুত?

না, বিষয়টি সেভাবে সংগতিপূর্ণ মনে হয় না, আর সে-কারণে এই শিক্ষাটি নিয়ে ইসলামের পণ্ডিতরা বিতর্ক করে আসছেন সেই সপ্তম শতক থেকে, যখন এটি লেখা হয়েছিল। যদি আল্লাহ ন্যায়বিচারক হয়ে থাকেন, পণ্ডিতরা ঘোষণা করেছিলেন, তাহলে অদৃষ্টবাদের এই মত তার প্রকৃতির সাথে স্ববিরোধী। ধর্মীয় সগ্রামের যুক্তি, যেমন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অনুসরণ করা, ইঙ্গিত দিচ্ছে মানুষের অবশ্যই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। তাহলে কেনই বা আল্লাহ, নবীদের পাঠাবেন, যদি তার নির্দেশ শোনা, অনুশোচনা করা এবং পরিত্রাণ পাবার পথ অনুসরণ করার কোনো স্বাধীনতাই না থাকে? এভাবেই যুক্তিটি অগ্রসর হয়েছিল।

এই বিতর্ক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রথম দৃষ্টিতে যতটা মনে হয়, কুর’আনের ব্যাখ্যা তাহলে হয়তো ততটা সরল নয়। ধর্ম-গবেষকদের এটি আরেকটি সমস্যার উৎসের দিক নির্দেশ করে। প্রতিটি ধর্মেই একটি গোষ্ঠী থাকে, যারা ‘লিটারেলিস্ট বা যারা কুর’আন কিংবা ধর্মশাস্ত্রে লিখিত বাক্য যা বলছে, সেটিকে তারা আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ধর্মতাত্ত্বিকরা, যারা গ্রন্থের আধেয় আর শব্দগুলো সম্বন্ধে এইসব আক্ষরিকতাবাদীদের চেয়ে আরো বেশিকিছু জানেন, এবং সেগুলো পাঠ করার সময় আরো সূক্ষ্ম অর্থগুলো তারা বিশ্লেষণ করতে পারেন। তারা প্রায়শই রূপক হিসাবে ধর্মগ্রন্থ পড়েন, আক্ষরিকতাবাদীরা যা গলাঃধকরণ করেন বাস্তব সত্য হিসাবে। ধর্মশাস্ত্রগুলোর ইতিহাস হচ্ছে এইসব প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবনাগুলো অনুসরণকারীদের পরস্পরের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্কের একটি ইতিহাস। প্রায়শই এটি গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ বিতর্কের বিষয়টি আমাদের জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করে না। তবে কখনো কখনো এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের জীবনে, কারণ সাধারণ মানুষের জীবনে এটি অস্বাভাবিক পরিমাণ ভয় আর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অদৃষ্টবাদের মতবাদটি এমনিতেই যথেষ্ট পরিমাণ দুশ্চিন্তার কারণ, কিন্তু এটি কিছুই নয়, যদি এটিকে স্বর্গ আর নরকের অস্তিত্ব-সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট মতবাদটির সাথে তুলনা করা হয়।

কুর’আনে বহু সুরা আছে, যেখানে স্বর্গ আর নরকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমি সবচেয়ে বিখ্যাতটির বর্ণনা দেব। সুরা ৫৬ য়, ‘শেষ বিচারের দিনে বেহেশত বা স্বর্গকে বর্ণনা করা হয়েছে আনন্দ আর সুখের একটি বাগান হিসাবে, যার বিবরণ শুনলে মনে হয় যেন সেটি মানবপ্রজাতির শুধুমাত্র পুরুষ-সদস্যদের জন্যই বিশেষভাবে পরিকল্পিত হয়েছে। সেখানে সারাক্ষণ মদের ঝর্না বহমান, যে মদ পান করলে কেউ যেমন মাতালও হবে না, তেমনি মদ্যপান-পরবর্তী অসুস্থতায় আক্রান্তও হবেন না। পৃথিবীতে তারা যে কষ্ট সহ্য করেছেন তারই পুরস্কার হিসাবে সেখানে আগত নতুন অতিথিদের উপভোগের জন্য থাকবে সুন্দরী, আয়তলোচনা তরুণীরা। আরো আকর্ষণীয় ব্যাপার, স্বর্গে কোনো অযথা বাদানুবাদ থাকবে না, শুধুমাত্র শান্তি, শান্তি!’ উচ্চারণ ছাড়া। আর এটাই অপেক্ষা করছে সেই মানুষদের জন্যে, যাদের কুরআন বলেছে ডানদিকের সঙ্গী বা কম্পানিয়ন অব দ্য রাইট। আর যারা বামপাশে থাকবেন, কম্পানিয়ন অব দ্য লেফট, তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে ভিন্ন নিয়তি। তাদের জন্যে আছে নরক, দাবদাহের বাতাস, ফুটন্ত পানি, জ্বলন্ত শিখার ছায়া…’।

স্বর্গ আর নরককে রূপক হিসাবে ব্যাখ্যা করে যেতে পারে, সদগুণের পুরস্কার আর অনাচারের পরিণতি নিয়ে কথা বলার একটি উপায় হিসাবে। আবার এগুলোকে আক্ষরিকভাবেই সত্য হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যদি নরকের অস্তিত্ব থাকে, এর মানে ঈশ্বর তার কিছু সন্তানের নিয়তিতে অসহনীয় যন্ত্রণা নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমরা ইতিমধ্যেই অন্য ধর্মগুলোয় নরকের ধারণাটি আবির্ভূত হতে দেখেছি, সুতরাং, আমরা এখানে কুরআন নিয়ে আলোচনা বন্ধ করব। পরের অধ্যায়ে, আমরা মানবতার বিষণ্ণ একটি আবিষ্কার নিয়ে চিন্তা করব এবং আগুনের কুণ্ড আর ফুটন্ত পানির জগতে একবার ঢু মারব। আমরা নরক। সম্বন্ধে জানব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *