২৩. সমর্পণ

অধ্যায় ২৩. সমর্পণ

‘ইসলাম’–একটি আরবি শব্দ, যা মুসলিম শব্দটির উৎস শব্দ, এবং এর সবচেয়ে ভালো অনুবাদ হতে পারে, আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সমর্পণ”। এই ধর্মটির মূল বিশ্বাস আর ধর্মীয় আচারগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে, এর নিকটতম সম্পর্কযুক্ত দুটি ধর্ম, ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্মের সাথে এই ধর্মটির পার্থক্যটি কী, সেটি চিহ্নিত করা আমাদের উচিত হবে। একেশ্বরবাদী কোনো ধর্মের প্রথম মূলনীতি হচ্ছে ঈশ্বরের বাস্তবতা। আমরা এটিকে আরো সম্প্রসারণ করে বলতে পারি একেশ্বরবাদের জন্যে একমাত্র বাস্তবতাটি হচ্ছে ঈশ্বর।

এই মহাবিশ্বের কথা ভাবুন : বহু মিলিয়ন ছায়াপথ এবং হয়তো বহু মিলিয়ন মহাবিশ্ব যা আমাদের কাছে অদৃশ্য। একটা সময় ছিল যখন এসব কিছু সেখানে ছিল না। তাহলে কী ছিল সেখানে একেশ্বরবাদের মতে, ঈশ্বর ছিলেন সেখানে। এরপর যা কিছুই অস্তিত্বশীল হয়েছে সেগুলো এসেছে ঈশ্বরের কাছ থেকে, ঠিক যেভাবে কোনো উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা তাদের অস্তিত্ব পায় এর লেখকের মন থেকে। যখন হিন্দুধর্ম নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, মানুষকে উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে ভাবার ধারণাটি আমি ব্যবহার করেছিলাম। আমি আবার এটি ব্যবহার করতে চাই, যখন আমি একেশ্বরবাদ নিয়ে চিন্তা করব, কিন্তু খানিকটা ভিন্ন কৌশলে। হিন্দুধর্মে কৌশলটি ছিল, সেখানে উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা আবিষ্কার করেছিলেন, তাদের আসলে সত্যিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা মূলত একটি মায়া। আব্রাহামীয় ধর্মে চরিত্রগুলোর অস্তিত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু তারা সেই একক ঈশ্বর সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে চান, সেই লেখক যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, তাদের সৃষ্টিকর্তা।

মনে রাখবেন, এই সবকিছু আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে বা মেনে নিতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু আপনি যদি ধর্মকে বুঝতে চান, তাহলে এটি যেভাবে চিন্তা করে আপনার মনকেও একইভাবে চিন্তা করার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে, যদিও শুধুমাত্র এই অধ্যায়টি পড়তে যতটা সময় লাগে, ততক্ষণ। একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো কোনো বইয়ের সেই চরিত্রগুলোর মতো, যারা এর লেখকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। এমনকি এভাবে ভাবতেই আপনার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠার কথা। তাই কি করছে না? এই মহাবিশ্বের বইয়ের কিছু চরিত্র বলছে এটি স্পষ্ট যে, কেউ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সেই কাজটি করেছেন, তার সাথে আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করার ইচ্ছাটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। অন্যরা বলেন, বোকার মতো কথা বলবেন না, কোনো লেখক নেই, শুধু বইটাই আছে, এই মহাবিশ্ব বা যে নামই আপনি এটিকে দেন না কেন, এটি এমনিই ঘটেছিল। এটি নিজেকে নিজেই লিখেছিল। সুতরাং আপনাদের কল্পিত সেই লেখকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা বন্ধ করুন।

কিন্তু যারা এই সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন, তাদের জন্যে এই প্রক্রিয়াটি অন্য যে-কোনো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মতোই। নবী এবং ঋষিরা অপেক্ষা করেন এবং শোনেন এবং দূরদর্শিতা আছে তাদের, ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটি সম্বন্ধে তারা ধারণা করতে পারেন। তারা নিজেদের উন্মুক্ত করেন, যেন তাদের অস্তিত্বের উৎসটি তাদের মধ্যে দিয়ে নিজেকে উন্মোচিত করতে পারে। এবং এর বাস্তবতাটাই তাদের মনে তৈরি হয়, যেভাবে কোনো একটি চরিত্র নিজেকে এর লেখকের মনে বাস্তবায়িত করে তোলে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম, এটি আগের উপায়টির বিপরীত দিক বরাবর। একটি চরিত্র যা এর লেখককে বাস্তব একটি রূপ দেয়। খুব ধীরে ঈশ্বরের একটি চিত্র আবির্ভূত হয় যেন একটি আলোকচিত্র, যা কোনো একটি ডার্করুমে প্রস্ফুটিত করা হচ্ছে। ধর্মতাত্ত্বিকরা এই কর্মকাণ্ডকে বলেন, ইমার্জিং রিভিলেশন বা আবির্ভূত হতে থাকা কোনো উন্মোচন। এবং তারা সাধারণত দাবি করেন, ঈশ্বরের ছবি যা তাদের ধর্ম সমর্থন করে, সেটি এর বিকাশ প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি অগ্রসর এর যে কোনো আদি সংস্করণ থেকে। ইহুদিবাদে সৃষ্টিকর্তার সাথে সাদৃশ্য বহুঈশ্বরবাদ অপেক্ষা বেশি। খ্রিস্টধর্ম ইহুদিবাদ থেকে অনেক উত্তমভাবে সংজ্ঞায়িত। কিন্তু ইসলাম দাবি করে তাদের কাছে এর সবচেয়ে নিখুঁত প্রতিকৃতিটি আছে, যা এর আগের যে-কোনোটির চেয়ে অনেক বেশি শ্ৰেষ্ঠ। সুতরাং আসুন, সেই জিনিসটি দিয়ে আমরা ইসলাম সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখি, যা এটিকে ইহুদিবাদ আর খ্রিস্টধর্ম থেকে সবচেয়ে বেশি পৃথক করেছে : কুর’আন।

কুর’আনকে ইসলামের বাইবেল হিসাবে চিন্তা করবেন না। এখানে তিনটি বড় ধরনের পার্থক্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে বাইবেল বিভিন্ন লেখক আর সম্পাদকের হাতে বহু শতাব্দী ধরে খুব ধীরে একত্রে একটি বইরূপে সংকলিত হয়েছিল। দ্বিতীয় পার্থক্যটি হচ্ছে, বাইবেল একটি লাইব্রেরি, এটি একক বা একটি মাত্র বই নয়। এবং তৃতীয় পার্থক্যটি, যদিও এটি ঈশ্বরের ঐশীবার্তা ধারণ করে, কিন্তু বাইবেল ‘মানবসৃষ্ট, মানুষের হাতে এটি এর রূপ পেয়েছে। কুর’আন সম্বন্ধে এধরনের কোনো বিবরণ ইসলাম ধর্মে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। ক্রমাগতভাবে আসা ঐশী প্রত্যাদেশের ধারারূপে এটি কেবল একজন মানুষের কাছেই এসেছিল তার জীবদ্দশায়। এবং যদিও এটির মাধ্যম ছিল একজন মানুষ, এটি মানবসৃষ্ট নয়। ঠিক যেমন করে বৈদ্যুতিক তার কোনো ভবনে বিদ্যুৎ বহন করে আনে, মুহাম্মদ কুর’আনের বাহক ছিলেন, এটির প্রবাহিত হবার পথ ছিলেন, কিন্তু সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এর মূল ক্ষমতাটি এসেছে। কুর’আন হচ্ছে আল্লাহর মনের পার্থিব একটি রূপ, পৃথিবীতে আল্লাহর উপস্থিতি।

বাস্তবিকভাবে কুর’আন মুসলমানদের কাছে সেটাই, যিশুখ্রিস্ট খ্রিস্টানদের কাছে ঠিক যেমন। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যিশু হচ্ছেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। মানুষরূপে ঈশ্বর নিজেকে লভ্য করেছিলেন এই পৃথিবীর কাছে। বেশ, মুসলমানদের কাছে কুর’আন সেরকমই। এটি তাদের কাছে ঈশ্বরের সমান। কুর’আন শব্দটির মানে হচ্ছে আবৃত্তি। এটি ফেরেশতা জিবরাইল আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন নবীর কানে। এরপর এটি নবী তার অনুসারীদের জন্যে আবৃত্তি করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর এর একটি লিখিত রূপ অর্জন করেছিল। আর ধর্মনিষ্ঠ মুসলমানরা এখনো এটিকে সম্পূর্ণরূপে মুখস্থ করেন, যেন তারা এর ১১৪টি অধ্যায় বা সুরা, প্রথম থেকে এর শেষ অবধি তাদের স্মৃতি থেকেই আবৃত্তি করতে পারেন।

মুহাম্মদ বিশ্বাস করতেন, যা শুরু হয়েছিল ইহুদিদের মাধ্যমে এবং আরো অনেকটা বিবর্তিত হয়েছিল খ্রিস্টানদের সাথে, সেটি পূর্ণতা পেয়েছে তার নবুয়তের অধীনে। কুর’আন তাকে বর্ণনা করেছে নবীদের সিলমোহর’ বা শেষ নবী হিসাবে। তারপরে আর কোনো নবীই আসবেন না। নবীদের এই ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হয়েছে। এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এবং ইসলাম হচ্ছে এর ক্রটিহীন চূড়ান্ত রূপ।

ইহুদি আর খ্রিস্টানরা যখন বিষয়টি সেভাবে দেখেননি, মুহাম্মদ হতাশ হয়েছিলেন। যদিও তাদের এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। পুরনো ধর্মের রক্ষকরা, তাদের দিন শেষ এবং তাদের উচিত নতুনের জন্য পথ ছেড়ে দেওয়া, এমন কিছু স্বীকার করতে সবসময়ই অনিচ্ছুক থাকেন। মুহাম্মদ আশা করেছিলেন যে, তিনি মদিনার ইহুদি আর খ্রিস্টধর্মীয়দের প্ররোচিত করতে পারবেন যে, আসলে তিনি তাদের শত্রু নন বরং তিনি তাদের ধর্মের পরিপূর্ণ রূপ, সেই পরিণতি, যার জন্যে তারা অপেক্ষা করছিলেন। কুর’আনে যেমন বলা হয়েছে, তিনি আপনার কাছে সত্যের সেই বইটি পাঠিয়েছেন, ইতিপূর্বে যা ছিল এটি সেটাই নিশ্চিত করেছে, এর আগে তিনি ‘তোরা’ আর ‘গসপেল পাঠিয়েছেন। আর সে-কারণে মুহাম্মদ প্রথমে তার অনুসারীদের জেরুজালেমের দিকে ফিরে উপাসনা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র যখন ইহুদি আর খ্রিস্টানরা তাকে তাদের নবী হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন তিনি এর পরিবর্তে মক্কার দিকে ফিরে প্রার্থনা করতে তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, নবী হিসাবে তাদের এই প্রত্যাখ্যানটি, যদিও দুঃখজনক তবে, তাদের পূর্বের সব আচরণের সাথে সংগতিপূর্ণ। ইহুদিরা সবসময়ই সেই নবীদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ঈশ্বর যাদের প্রেরণ করেছিলেন। তাদের শেষ প্রত্যাখ্যান ছিল নবী যিশু (ইয়েসুস বা ইসা)। তাকে ঈশ্বরে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে এমনকি খিস্টানরাও যিশুকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একজন মাত্র আল্লাহর একত্ববাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী, মুহাম্মদ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, খ্রিস্টানরা শুধুমাত্র ঈশ্বরকে একটি পুত্রই দেয়নি, স্বর্গে ঈশ্বরের পাশে বসানোর জন্যে তারা একই সাথে দুটি অন্য স্বর্গীয় সত্তাকেও সৃষ্টি করেছেন। এর কারণ খ্রিস্টানরা ‘ট্রিনিটি’রূপে ঈশ্বর সম্বন্ধে একটি তত্ত্ব বিবর্তন করেছিলেন, অথবা যেখানে একজন ঈশ্বর তিনটি ভিন্ন উপায়ে প্রকাশিত হয়েছে : মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে সেই সৃষ্টিকর্তা পিতা, পৃথিবীতে তার জীবনে যিশুখ্রিস্টের মধ্যে পুত্র, এবং সেই স্পিরিট বা পবিত্র আত্ম হিসাবে, যা ইতিহাসের মধ্যদিয়ে মানবতাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের শেষ অবধি। এই জটিলভাবে পরিকল্পিত ধর্মতাত্ত্বিক প্রকৌশলের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ গর্জে উঠেছিলেন : ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহু ওয়া-মুহাম্মদ রাসুল আল্লাহ’।

তাদের ধর্মবিশ্বাসের অংশ হিসাবে ইসলামের অনুসারীদের পাঁচটি প্রধান কর্তব্য পালন করতে হবে, কখনো যেগুলোকে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ’ বলা হয়। প্রথম কর্তব্যটি হচ্ছে আন্তরিক সমর্পণের সাথে শাহাদা পাঠ বা আরবি ভাষায় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ঘোষণা, যে-বাক্যটি দিয়ে আমি আগের অনুচ্ছেদটি শেষ করেছি : আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই, আর মুহাম্মদ হচ্ছেন তার নবী। একেশ্বরবাদের এই অভিব্যক্তির উচ্চারণ হচ্ছে একটি রূপ, যার মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস ঘোষণা করেন এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতরা এটি ব্যবহার করে তাদের স্বীকারোক্তি প্রদান করেন।

দ্বিতীয় স্তম্ভটি হচ্ছে, মক্কার দিকে মুখ করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করা, যাকে বলা হয় সালাত (বা নামাজ), আর সালাতের এই প্রার্থনা করা হয় ভোরে, দুপরে, বিকালের মাঝখানে, সূর্যাস্তে এবং সূর্যাস্ত আর মধ্যরাত্রির মধ্যবর্তী একটি সময়ে। পৃথিবীর হৃদয়স্পর্শী শব্দগুলোর একটি হচ্ছে মুয়াজ্জিনের (বা যিনি সবাইকে প্রার্থনা করতে ডাকেন), সেই আহ্বান : আজান। কোনো মসজিদের মিনারের উঁচু ব্যালকনি থেকে যা বিশ্বাসীদের প্রার্থনা করতে আহ্বান জানায়। তিনি পালাক্রমে কম্পাসের চারটি দিকের প্রতিটি দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলেন : ‘আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ হচ্ছেন আল্লাহর নবী। নামাজ পড়তে আসুন, মুক্তি পেতে আসুন। আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ’। বর্তমানে প্রার্থনায় ডাকার এই আহ্বান মূলত আধুনিক শহরের নানা শব্দের মধ্যে অমসৃণভাবে বাজানো আজানের কোনো রেকর্ডিং। কিন্তু কোনো নীরব আফ্রিকার গ্রামে মুয়াজ্জিনের সেই ছড়িয়ে পড়া আহ্বানটি ভোরবেলা শোনা, আকুল আকাঙ্ক্ষার একটি তীরে বিদ্ধ হওয়ার মতো অনুভূত হতে পারে।

ধর্মটির তৃতীয় স্তম্ভটি হচ্ছে জাকাত, অথবা দান করা, যেহেতু সব সম্পদই এসেছে আল্লাহর দয়ায়, ধার্মিক মুসলমানদের জন্যে দান করা মানে আল্লাহর কাছে সেই সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া, তিনি একাই যে সম্পদের একমাত্র মালিক। এটি আরো একটি উপায়, যার মাধ্যমে সেই সম্পদের দ্বারা সমাজের দরিদ্র ও অসহায়রা উপকৃত হতে পারেন, এবং একই সাথে ইসলাম ধর্ম প্রচারেও ব্যবহৃত হতে পারে। ইসলাম একটি মিশনারি বা প্রচারের ধর্ম, যার লক্ষ্য পুরো পৃথিবীকে এর দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর করা, একটি একক সংঘ অথবা উম্মা, যেখানে বিশ্বাস ও জীবন একীভূত হয় পূর্ণাঙ্গ একটি রূপে। উম্মাহতে এমন কোনো বিন্দু থাকবে না যেখানে ধর্ম শেষ হবে আর সমাজের সূচনা হয় অথবা যেখানে সমাজের শেষ হয় আর ধর্মের সূচনা হয়। এটি একই জিনিস হবে।

চতুর্থ স্তম্ভটি হচ্ছে, রমজান (বা রামাদান) মাসে মাসব্যাপী রোজা রাখা, যে মাসটি ইসলামি ক্যালেন্ডারের নবম মাস। ত্রিশ দিন ধরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি এই রোজা পালন করা হয়। এই সময়ে কোনো খাদ্য গ্রহণ অথবা পানীয় পান করা যাবে না। কিন্তু এটি শুধুমাত্র খাদ্য আর পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা নয়। রমজানের শেষের দিকে মসজিদে বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান পালন করা হয়, যেগুলো বিশ্বাসীদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা-সংক্রান্ত জ্ঞান বৃদ্ধি করার জন্যে পরিকল্পিত হয়েছে। এবং রমজানের সাতাশতম দিনটি বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করা হয়, শবে-ই-কদর বা শক্তির রাত, এটি সেই প্রথম রাতটিকে চিহ্নিত করে, যখন মক্কার বাইরে একটি গুহায় মুহাম্মদ প্রথম আল্লাহর নিকট থেকে ঐশী প্রত্যাদেশ বা ওহী পেয়েছিলেন, যা পরৈ কুর’আন হয়েছিল। রমজান শেষ হয় ঈদ-উল-ফিতর উৎসবের মাধ্যমে। রোজা শেষ হবার পর একটি আনন্দোৎসব। ঈদ হচ্ছে আনন্দের একটি সময় যখন পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সাথে দেখা করেন এবং উপহার বিনিময় করেন।

পঞ্চম কর্তব্য আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি, মক্কায় হজ করতে যাওয়া। প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ পড়া আর রমজান মাসে রোজা রাখার চেয়ে মক্কায় হজ করতে যাওয়া বেশ বড় একটি ব্যাপার। সুতরাং মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করা হয় যে, তারা তাদের জীবনে মাত্র একবার এই কাজটি করবেন। হাজিরা আব্রাহামের কাবা প্রদর্শন করেন, যা এখন মক্কার বিশাল মসজিদ, আল-মাসজিদ আল-হারামের মধ্যে অবস্থিত বিশাল কিউব বা ঘণক্ষেত্র আকৃতির একটি ভবন। হাজিরা কাবার চারপাশে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতদিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করেন। তারপর তারা সাফা আর মারওয়া নামের দুটি ছোট পাহাড়ের কাছে যান। সেখানে দুটি পাহাড়ের মধ্যে হয় তারা দৌড়ান অথবা দ্রুত হাঁটেন হাজারের সেই নিদারুণ যন্ত্রণাকে স্মরণ করে, যখন তিনি তার পুত্র ইসমায়েলের জন্যে তপ্ত শুষ্ক মরুভূমিতে পানির জন্যে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করেছিলেন, যে পানির স্রোতধারা ক্ষুব্ধ ইসমায়েলের পায়ের লাথির মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছিল। হজের আরো একটি নাটকীয় উপাদান হচ্ছে তিনটি স্তম্ভের প্রতি লক্ষ করে যখন হাজিরা পাথর নিক্ষেপ করেন, যেগুলো পৃথিবীর অশুভ সবকিছুকেই প্রতিনিধিত্ব করে। মুসলমানদের জন্যে হজের অভিজ্ঞতা এত তীব্র আর জীবনরূপান্তরকারী হতে পারে যে, তারা এই অর্জনটিকে তাদের নামের সাথে একটি পদবী হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। পুরুষদের জন্যে হাজি এবং মহিলাদের জন্যে হাজা।

এই পাঁচটি কর্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এর অনুসারীদের অনুসরণ করার জন্যে ইসলামকে খুব স্পষ্ট আর জটিলতামুক্ত একটি ধর্মে পরিণত করেছিল। কিন্তু এর ব্যবহারিক স্তরে এর দুটি খুবই শক্তিশালী আবেগ-উদ্রেককারী বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে নবী মোহাম্মদের প্রতি ভক্তি, যা প্রায় সত্যিকারের উপাসনার। কাছাকাছি যায়, তবে কখনোই সেই বিন্দুতে পৌঁছায় না। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য ঈশ্বর নেই, আর মুহম্মদ হচ্ছেন আল্লাহর শেষ নবী, মুহম্মদকে উপাসনা করা যাবে না–কারণ তিনি ঈশ্বর নন–কিন্তু তিনি এত বেশি শ্রদ্ধেয় যে, যখনই তার নাম উচ্চারিত হয় প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে তার পরে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সা.) (যার অর্থ হলো তার ও তার পরিবারের ওপর আল্লাহর দয়া-করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক)। আর সে-কারণেই মুসলমানরা খুবই উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, যখন তাদের নবীকে ব্যঙ্গ বা অবিশ্বাসীরা তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন।

কিন্তু আল্লাহর প্রতি মুসলিমদের সমর্পণ আরো অনেকটাই উচ্চস্তরের, তাদের নবীর প্রতি শ্রদ্ধার চেয়েও যা অনেক বেশি। ইসলামের একেশ্বরবাদ খুবই তীব্র এবং আবেগীয়, যা সারাক্ষণই আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় এই ধারণাটির ওপর গুরুত্বারোপ করে। কুর’আন বেশ কাব্যিক হয়ে ওঠে যখন এটি আল্লাহর সৌন্দর্য বর্ণনা করে। কুর’আনের হৃদয়স্পর্শী অধ্যায়গুলোর একটি হচ্ছে ১৩ নং সুরা, যে অধ্যায়টি আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর নিরানব্বইটি নামের ঘোষণা দিয়েছে। নিচে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।

আল্লাহ, যে নামটি’ সব নামের উপরে…
দয়াময়, যারা দয়া প্রদর্শন করে তাদের সবার চেয়ে যিনি দয়ালু…
সহমর্মী, যিনি কোমল এবং সহমর্মিতায় পূর্ণ…
পর্যবেক্ষণকারী, যিনি তার সৃষ্টির ওপর লক্ষ রাখেন…
ক্ষমাশীল, যিনি সবসময়ই ক্ষমা করতে প্রস্তুত …

কুর’আনের ভাষার মাধুর্য আর সান্ত্বনা আছে। কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র সেটাই আমরা পাই না, এমনকি সুরা ১৩য় সেই সতর্কবাণীও আছে, আল্লাহর সাথে পৃথিবীর সম্পর্কে সান্ত্বনা যেমন আছে, তেমন ভয়ের ব্যাপারও আছে আরো দুটি নাম যেমন:

পীড়াদানকারী, যিনি কষ্ট দেন এবং আশীর্বাদও দেন…
প্রতিহিংসক, যিনি পাপীদের ওপর তার প্রতিহিংসার প্রকাশ ঘটান…

কুর’আন আল্লাহর সৌন্দর্যের প্রশস্তিতে পূর্ণ। এছাড়াও এটি পাপী আর অবিশ্বাসীদের প্রতি তার ক্ষোভে বজ্রকণ্ঠের কথাও বলে। সুতরাং আল্লাহর সেই দিকটি এবং বহু মানুষের জন্যে এর পরিণতিটি কী, সেটি অনুসন্ধান করার এখন সময় হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *