২২. শেষ নবী

অধ্যায় ২২. শেষ নবী

তিনটি ধর্ম আব্রাহামকে তাদের পূর্বসূরি পিতা হিসাবে দাবি করে। আর এই দাবিটিকে বোঝার দুটি উপায় আছে। একধরনের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের রূপ হিসাবে এটিকে গ্রহণ করা যেতে পারে। আব্রাহাম তার একেশ্বরবাদের ধারণাটি প্রথমে হস্তান্তর করেছিলেন ইহুদিদের এবং তাদের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের কাছে। তারপর সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম এটিকে পুনরায় দাবি করেছিল, যা এটিকে দেখেছিল এই ধর্মদুটির দ্বারা এর লঘুকরণ হিসাবে। কিন্তু এছাড়াও শারীরিক অর্থে আব্রাহামের উত্তরাধিকারের ধারণাটিকে বোঝা সম্ভব হতে পারে। আব্রাহামের ছেলে আইজাক ছিলেন ইজরায়েলের জনক, যার মধ্যে দিয়ে ইহুদি আর খ্রিস্টানরা তাদের বংশঐতিহ্য খুঁজে পায়। কিন্তু আব্রাহামের আরো একটি ছেলে ছিল। আর সেখানে একই কাহিনির সূচনা।

আব্রাহামের দুইজন স্ত্রী ছিলেন, সারা এবং তার মিশরীয় ভৃত্য হাজার। সারা হাজারকে ঈর্ষা করতেন। তিনি ভয় পেতেন যে আব্রাহাম হাজারের পুত্র ইসমায়েলকে তার উত্তরাধিকার হিসাবে ঘোষণা করবেন। সুতরাং দুজনকে নির্বাসনে পাঠাতে তিনি তার স্বামীকে প্ররোচিত করেছিলেন। হাজার তার শিশুপুত্রকে নিয়ে লোহিত সাগরের নিকটবর্তী মরুভূমিতে দিভ্রান্ত হয়ে ঘুরেছিলেন, সেখানে একটি পাথরের উপর বসে তিনি কাঁদছিলেন, কারণ তিনি নিজেকে খুব অসহায় আর দুঃখী অনুভব। করছিলেন। কিন্তু ইসমায়েল আদৌ বিষণ্ণ ছিলেন না। তিনি ক্ষুব্ধ, খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। ইসলামের ঐতিহ্যমতো তিনি ক্ষুব্ধ অবস্থায় বালির উপর লাথি মারতে শুরু করেছিলেন। তিনি এত জোরে লাথি মেরেছিলেন যে, তিনি একটি ঝর্নার অস্তিত্ব উন্মোচন করেছিলেন, পানির যে ঝর্নাগুলো মরুভূমির সবুজ এলাকায় দেখা যায়, যাদের মরূদ্যান বলে। যখন আব্রাহাম শুনেছিলেন যে ইসমায়েল একটি মরূদ্যান সৃষ্টি করেছেন, তিনি তার পরিত্যক্ত স্ত্রী এবং সন্তানকে দেখতে আসেন, এই ঝর্নার কাছেই একটি উপাসনালয় নির্মাণ করেন, যে ঝর্নাটি তাদের জীবন রক্ষা করেছে। এই মন্দিরে তিনি একটি পবিত্র কালো পাথর স্থাপন করেছিলেন। আর সেই পাথরের সাথে সংশ্লিষ্ট আছে আরো একটি কাহিনি।

জেনেসিস, যে বইটি ইহুদি বাইবেলের প্রথম বই, আমাদের জানাচ্ছে, প্রথম পুরুষ ছিলেন আদম এবং তার স্ত্রীর নাম ছিল ইভ বা হাওয়া। আদম আর হাওয়া একটি বিস্ময়কর সুন্দর বাগানে বাস করতেন, যার নাম ইডেন, যেখানে তাদের কোনোকিছুরই অভাব ছিল না। বাগানের সব ফলের গাছের মধ্যে শুধুমাত্র একটি তাদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল। এটাই ছিল ভালো আর খারাপ বোঝার সেই জ্ঞানবৃক্ষ। আদম এবং হাওয়া অপরিবর্তনশীল শিশুসুলভ একটি জীবন কাটাচ্ছিলেন, তাদের প্রতিটি চাহিদা পূরণ করেছিলেন ঈশ্বর। পিতামাতারা প্রায়শই তাদের সন্তানদের চিরকালই শিশু করেই রাখতে চান। কিন্তু শিশুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বড় হয়ে ওঠার জন্যে, ভালোমন্দের জ্ঞান অর্জন করার জন্যে। এই তাড়নাই আদম আর হাওয়াকে প্ররোচিত করেছিল সেই নিষিদ্ধ ফলটি খেতে। এবং সাথে সাথেই তাদের মন প্লাবিত হয়েছিল সেই জ্ঞানে, জীবন আর আগের মতো সরল নেই।

আর যখন আদম আর হাওয়া তাদের শিশুসুলভ সরলতা হারিয়েছিলেন, ঈশ্বর তাদের এই পৃথিবীতে নির্বাসিত করেছিলেন প্রাপ্তবয়স্কতার সব জটিলতাসহ। কিন্তু ইসলামে বর্ণিত এই কাহিনির বিবরণে, তিনি আদম আর হাওয়াকে সেই বাগান থেকে স্মারক হিসাবে কিছু একটা নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন, যা কিনা চিরকাল তাদের সাথে থাকবে। তারা ইডেন হারিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ঈশ্বরকে হারাননি। তাদের জন্যে স্বর্গের বাগানের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও ঈশ্বর তখনো তাদের সাথে ছিলেন। আর তারা স্বর্গ থেকে যে-জিনিসটি তাদের সাথে নিয়ে এসেছিলেন সেটি হচ্ছে একটি কালো পাথর, যা তাদের সাথে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে এসেছিল। আব্রাহাম সেই পাথরটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন, আর সেটাই তিনি সেই কাবায় স্থাপন করেছিলেন, যা তিনি নির্মাণ করেছিলেন ইসমায়েলের আবিষ্কৃত সেই মরূদ্যানে। এই কাবা ও এর বিখ্যাত পৌরাণিক কালো পাথরটিকে ঘিরেই একটি শহর গড়ে উঠেছিল। সেই শহরটির নাম মক্কা।

মক্কা (যা এখন সৌদি আরবের একটি শহর) আরব উপদ্বীপে লোহিত সাগরের পূর্বতীরে মোটামুটি মাঝামাঝি একটি জায়গায় অবস্থিত। আরব পৃথিবীর অন্যতম একটি রহস্যময় আর আকর্ষণীয় একটি এলাকা। আরব একটি বিশাল উপদ্বীপ, ১২০০ মাইল দীর্ঘ আর ১৩০০ মাইল প্রশস্ত পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে আরব সাগর আর পূর্বে পারস্য উপসাগর এটিকে ঘিরে রেখেছে। এর অভ্যন্তরের বিশাল মরুভূমিতে বাস করত যাযাবরদের নানা গোত্র অথবা বেদুইনরা, যারা খুবই দৃঢ়সংকল্প এবং তীব্রভাবেই স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের দল, জেনেসিস সঠিক বিবরণ দিয়েছিল, যখন এটি ইসমায়েলকে বর্ণনা করেছিল, বন্য গাধার মতে, প্রতিটি মানুষের সাথে তার শত্রুতা, আর তার সাথে শক্রতা প্রতিটি মানুষের’। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী বেদুইন গোত্রগুলো পানির কুয়া আর মরূদ্যানের মালিকানা নিয়ে পরস্পরের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকত, কিন্তু সবাই মক্কা নামের এই পবিত্র শহরটিকে শ্রদ্ধা করতেন, এবং সেখানে তারা তীর্থে যেতেন সেই কালো পাথরটিতে চুমু খেতে, যা আদমের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আব্রাহাম পেয়েছিলেন, এবং তারা সেই কুয়ায় পানি পান করেন, যা ইসমায়েল আবিষ্কার করেছিলেন। তাদের পিতামহ আব্রাহাম ছিলেন একজন আবেগময় একেশ্বরবাদী, কিন্তু তাদের সম্বন্ধে সেটি বলা সম্ভব ছিল না। যদিও তারা সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের ঈশ্বর আল্লাহর উপাসনা করতেন, কিন্তু তারা তাদের মূর্তিগুলোকে ভালোবাসতেন, বছরের প্রতিটি দিনের জন্যে তাদের একটি করে মূর্তি ছিল। এই তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী বেশ ভালোই উপার্জন করতেন, যারা কালো পাথরে চুমু এবং পবিত্র কুয়া থেকে পানি পান করতে আসতেন, তারা তাদের দোকান থেকে মূর্তি কিনতেন, যা কাবার চারপাশ ঘিরে বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল।

আব্রাহাম–যেমন প্রাচীন হিব্রু কাহিনি আমাদের বলেছে– জানতেন কত সহজে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা যায়। তিনি দেখেছিলেন পারিবারিক দোকানে বিক্রয় করতে তার বাবা দোকানে বসেই নানা দেবতাদের মূর্তি গড়তেন। যে মূর্তিগুলোকে তিনি প্রতারণা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, দরিদ্রদের থেকে অর্থ শুষে নেওয়ার ধূর্ত একটি কৌশল। মক্কায় যা হচ্ছিল সেটি দেখে তিনি নিশ্চয়ই আরো বেশি রেগে যেতেন, যেখানে ব্যবসায়ীরা তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনীয়তাগুলো বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, যারা কিনা আধ্যাত্মিক সান্ত্বনার জন্যে সেখানে উপস্থিত হতেন। আর ধর্ম সময় নির্বিশেষে পবিত্র সব শহরেই এমন কিছু ঘটতে দেখা যায়। প্রয়োজন আছে এমন অভাবী মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা বিক্রয় করে খুব দ্রুত আয় করা যায়। যিশু নিজেও এর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন, যখন জেরুজালেমে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে পুরোহিতদের পরিবারগুলো গরিবের অর্থে বিত্তশালী হয়ে উঠেছে। এ কারণে তিনি মন্দিরে মূদ্রা রূপান্তকারীদের টেবিল উল্টে দিয়েছিলেন এবং তাদের বলেছিলেন তারা ঈশ্বরেরে ঘরকে ‘ডাকাতের’ আস্তানায় পরিণত করেছেন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে একজন মানুষ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি যিশুর মতোই আব্রাহামের একেশ্বরবাদকে তার জন্মশহরে হকার, ফেরিওয়ালা আর দোকানি ব্যবসায়ীদের দ্বারা কলুষিত হতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি মুহাম্মদ নামেই পরিচিত ছিলেন।

মুহাম্মদের জীবন আদৌ সহজ কোনো জীবন ছিল না, জন্মের আগেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন, আর ছয় বছর বয়সে তিনি তার মাকেও হারিয়েছিলেন। এতিম এই শিশুটিকে দেখাশুনা করেছিলেন তার দাদা, যতদিন-না তার চাচা, একজন সফল ব্যবসায়ী, আবু তালিব তাকে দত্তক নিয়েছিলেন। তিনি তরুণ মুহাম্মদকে উটচালক হিসাবে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পণ্যবোঝাই উটের ক্যারাভান আরব-অর্থনীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। মরুভূমির মধ্যদিয়ে সেগুলো উত্তরে সিরিয়া, পশ্চিমে মিশর, প্যালেস্টাইন আর পূর্বে পারস্যে যাতায়াত করত। এই ক্যারাভানগুলো সুগন্ধী আর মশলা নিয়ে যেত, আর রেশম আর সুতির কাপড়ের বিনিময়ে সেগুলো বাণিজ্য করত তাদের দীর্ঘ যাত্রাশেষে দেশে ফিরে আসার আগে। নবী ইসাইয়া বর্ণনা করেছিলেন দক্ষিণ আরবের শেবা থেকে অসংখ্য মালবাহী উটের কাফেলা জেরুজালেমে সোনা আর ফাঙ্কিনসেন্স (ধূপ) নিয়ে আসত। আর এই ধরনের বাণিজ্যে মোহাম্মদ শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন।

খুব দ্রুত তিনি শিখতে পারতেন এবং তার যোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং সুনামের কারণে একজন ধনী বিধবা খাদিজা সিরিয়াগামী তার একটি ক্যারাভানের দায়িত্ব তাকে দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ আর খাদিজা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে, তখন তার বয়স ছিল পঁচিশ আর খাদিজার চল্লিশ। তাদের মোট ছয়টি সন্তান হয়েছিল। চারটি মেয়ে এবং দুটি ছেলে, যে ছেলেদুটি শৈশবেই মারা গিয়েছিল। ফাতিমাই তার কন্যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি আলীকে বিয়ে করেছিলেন, এবং হাসান ও হুসেইন, মুহাম্মদের প্রিয় দুই নাতির মা হয়েছিলেন।

মুহাম্মদ খুব সফল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, তার সততা আর নীতিপরায়ণতা তাকে একধরনের সামাজিক নেতা হিসাবে সুপরিচিত করে তুলেছিল, যার কাছে মানুষ নানা সমস্যার সমাধান খুঁজতে, ব্যবসা এবং পারিবারিক কোন্দল মীমাংসা করতে আসতেন। কিন্তু মুহাম্মদের মধ্যে আরো কিছু ছিল। তিনি একটি বিশেষ গ্রুপের সদস্য ছিলেন, যারা সর্বক্ষণই এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের কারণ আর লক্ষ্য খুঁজতে এর সীমায় এবং সীমানার বাইরে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলেন।

তারা মানবসমাজকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা এর কদর্যতার আর অবিচার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। যদিও তারা শ্রদ্ধা করতেন, যেভাবে ধর্ম সংগ্রামরত মানুষকে তাদের সীমানার বাইরে আধ্যাত্মিক একটি বাস্তবতার সংস্পর্শে নিয়ে আসে, কিন্তু তারা জানতেন কত সহজে ক্ষমতাবানরা ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন, তাদের নিজেদের লক্ষ্যপূরণে এবং সেইসব মানুষের কল্যাণের বিরুদ্ধে যাদের এটি সহায়তা করার কথা ছিল।

মক্কার কাবাকে ঘিরে থাকা ব্যবসায়ীদের বাজার দেখে বিরক্ত মুহাম্মদ তার চল্লিশ বছর বয়সে মক্কার বাইরে একটি গুহায় প্রায়শই প্রার্থনা আর ধ্যান করতে চলে যেতেন। আর এখানেই তিনি তার প্রথম দৈবদৃশ্যটি দেখেছিলেন, এবং প্রথমবারের মতো তার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন, যে ঐশী দর্শন আর কণ্ঠ শোনা তার বাকি জীবন জুড়ে অব্যাহত ছিল। তিনি জানতেন, এই কণ্ঠটি সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেনি, এটি এসেছে ফেরশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে। তাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত জিবরাইলের প্রথম শব্দগুলো ছিল : ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। ভ্রণ থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন’। মুহাম্মদ প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি আসলেই কী ঘটছে। তিনি কি কোনো অশুভ আত্মার কথা শুনলেন, যে তাকে প্ররোচিত করতে চাইছে? নাকি তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? যারা কণ্ঠ শোনেন বা কোনো দৃশ্য দেখেন, তাদেরও এই নামেই চিহ্নিত করা হয়? সুতরাং সংশয়ে আচ্ছন্ন মুহাম্মদ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কণ্ঠ অসাধারণ সৌন্দর্যপূর্ণ শব্দসহ তার সাথে কথা বলা অব্যাহত রেখেছিল। এবং তিনি অবশেষে এটির ওপর বিশ্বাসস্থাপন করেছিলেন, এবং অনুধাবন করেছিলেন এই কণ্ঠটি তাকে নবী হবার আহ্বান জানাচ্ছে।

আর নবী হবার ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হচ্ছে, তারা যা কিছু শুনেছেন সেটি তারা নিজেদের মধ্যে চেপে রাখতে পারবেন না। সবাইকে সতর্ক করতে আর ঈশ্বর তাদের যা নির্দেশ দিয়েছেন সেটি অনুসরণ করতে তাদের প্ররোচিত করার দায়িত্ব দিয়েই নবীদের পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। সুতরাং কয়েক বছর ফেরেশতা জিব্রাইলের কাছে ঐশী নির্দেশনা শোনার পর যে নির্দেশনাগুলো তিনি মুখস্থ করেছিলেন–এবং তার স্ত্রী খাদিজার উষ্ণ সহায়তা আর উৎসাহে, ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কাবাসীদের কাছে মুহাম্মদ সেটি প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তার মূল বার্তাগুলোর মধ্যে একেবারে নতুন বা মৌলিক কিছু ছিল না এবং তিনি কখনো সেটি দাবিও করেননি। তারা যা কিছু ভুলে গেছেন এটি সেটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। এটি নবী আব্রাহামের বার্তা : মূর্তিগুলো সব মিথ্যা আর একমাত্র একজন আল্লাহ আছেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই।

মুহাম্মদের এই বার্তাটি বিশেষ করে দরিদ্রদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল, কারণ তাদেরকে ঠকিয়েই ব্যবসায়ীরা, যারা পবিত্র স্থানটি দেখাশুনা করত আর নানা ধরনের মূর্তি বিক্রয় করত, তারাই শুধু লাভবান হয়ে উঠেছিলেন। শীঘ্রই তিনি মক্কায় অনুসারীদের একটি দল পেয়েছিলেন, যারা, নিজেদের আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন। আর এটাই ‘মুসলিম’ শব্দটির অর্থ। সবকিছুই ঠিকমতো চলছিল যতক্ষণ তিনি শুধুমাত্র ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই এবং মুহাম্মদ হচ্ছেন তার শেষ নবী’ –এই বার্তাটি প্রচারের মধ্যেই নিজের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তখন ধর্মের সংখ্যা ছিল অনেক এবং আধ্যাত্মিকতার বাজারে সবসময়ই আরো একটি ধর্মের জায়গা থাকে। তবে বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নেয়, যখন এই নতুন বিশ্বাসটি প্রতিষ্ঠিত স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যবসা আর সেই ব্যবসা থেকে অর্জিত লভ্যাংশ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতো আশঙ্কা সৃষ্টি করে। আর সেখানে সেটাই হয়েছিল। মুহাম্মদ এইসব ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করেছিলেন, যারা কাবার পাশেই মূর্তির বাজারে মূর্তি বিক্রয় এবং পবিত্র কুয়া থেকে পানি পান করতে তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন। এরপর যা ঘটার সেই অনিবার্য ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছিল। সমগ্র মক্কাজুড়ে মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের পর্ব শুরু হয়েছিল।

সৌভাগ্যক্রমে, ইয়াথরিব শহরের একটি কূটনৈতিক দল, যারা মুহাম্মদকে ধর্মপ্রচার করতে শুনেছিলেন, তারা তাকে তার অনুসারীদের নিয়ে ইয়াথরিবে চলে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইয়াথরিব থেকে আসা সেই জনপ্রতিনিধির দলটি জানত যে তাদের শহরে একজন নেতার দরকার, আর তারা ভেবেছিলেন, এই মানুষটি সেই দায়িত্বের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। মক্কা থেকে দুইশো মাইলের চেয়ে খানিকটা বেশি দূরে অবস্থিত ইয়াথরিব শহরে তার অনুসারীদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটি ঘটেছিল খুব গোপনে। মুহাম্মদ, তার চাচাত ভাই আলী এবং বন্ধু আবু বকর সবার শেষে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। রাতের অন্ধকারেই তারা মক্কা ছেড়েছিলেন, ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে, যা এখন ‘হেজিরা’ (হিজরত) (অভিনিষ্ক্রমণ) নামে পরিচিত। এটি ছিল সেই মুহূর্ত যখন থেকে মুসলমানদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জিতে প্রথম বছরটি শুরু হয়েছিল। ইয়াগরিব নামের যে-শহরে তারা পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেটির একটি নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল, মদীনা বা নবীর শহর।

তবে এই হিজরত সব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, কারণ এর পরের দশ বছরে মক্কা আর মদিনার মধ্যে বেশকিছু যুদ্ধ হয়েছিল, অবশেষে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে তার জন্ম-শহরের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর কোনো উপায় নেই অনুধাবন করে, মক্কা আত্মসমর্পণ করেছিল এবং নবী শহরে প্রবেশ করেছিলেন। এর বাসিন্দার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক হামলা করা হয়নি, কিন্তু মুহাম্মদ কাবা থেকে সব মূর্তি অপসারিত করেছিলেন এবং মক্কাবাসীদের মুসলিম হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এরপর তিনি মদীনায় ফিরে যান।

কিন্তু তার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়েছিল। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কায় শেষবারের হজ করতে গিয়েছিলেন এবং তার বিদায়ী ভাষণটি দিয়েছিলেন। কালো পাথরের কাবা আর পবিত্র ঝর্নার শহরে মোহাম্মদের এই শেষ ভ্রমণটি বিশেষভাবে উদযাপিত হয় এবং মক্কায় হজ বা তীর্থযাত্রা করার বিষয়টি পাঁচটি একান্ত কর্তব্যের ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ-একটিতে পরিণত হয়, যা মুসলমানরা তাদের জীবদ্দশায় পূর্ণ করবেন, এমন প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু নবী বিদায় হজের পর আর বেশিদিন বেঁচেছিলেন না। তিনি একটি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি একটি ধর্মবিশ্বাসকে রেখে গিয়েছিলেন যা বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম এবং এখনো ইতিহাসের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে যাচ্ছে। পরের অধ্যায়ে আমরা এর ধর্মতত্ত্বের সমৃদ্ধতা আর এর আচারগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *