২১. চার্চ যখন দায়িত্ব নিয়েছিল

অধ্যায় ২১. চার্চ যখন দায়িত্ব নিয়েছিল

পল পৌঁছাবার আগেই রোমে সম্ভবত খ্রিস্টানরা ছিলেন। সাম্রাজ্যের রাস্তা আর সমুদ্রপথ সৈন্যদের সাথে নানা মতামত আর ধারণার চলাচল সুগম করেছিল, সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, খ্রিস্টানরা ইতিমধ্যেই রোমানজগতের রাজধানীতে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তখন তাদের প্রতি খুব একটা বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। পল বর্ণনা করেছিলেন, প্রথম খ্রিস্টানরা ঘৃণ্য আর অগুরুত্বপূর্ণ। ছিলেন, সেইসব অসহায় মানুষগুলোর মতোই, যারা ইজরায়েলে যিশুকে অনুসরণ করেছিলেন। এবং তাদের মধ্যে বেশকিছু ক্রীতদাসও থাকতে পারেন। ঘোড়া বা যে আস্তাবলে ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে, সেগুলোর মতো ক্রীতদাসরাও কোনো মালিকের। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলেন। দাসপ্রথা সেই জীবনে সর্বজনীন একটি সত্য ছিল। এমনকি বাইবেলও এটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। পানির সিক্ততা আর বালির শুষ্কতার মতো-খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল এটি। রোমে তার আটকাবস্থায় পলের ধর্মান্তরিত করা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন পালিয়ে যাওয়া একজন ক্রীতদাস, ওনেসিমাস, যিনি তার মালিকের কিছু অর্থ ছিনতাই করে শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পল তাকে ভালোবেসেছিলেন কিন্তু তাকে দাসত্ব থেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। তিনি তাকে তার মালিক ফিলেমনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কুড়িয়ে-পাওয়া মানিব্যাগের মতো, এবং তার সাথে দয়াশীল আচরণ করতে ফিলেমনের কাছে অনুনয় করে প্রার্থনা করেছিলেন, এখন যখন সে তার স্বধর্মীয় একজন খ্রিস্টান।

পল কেন দাসপ্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেননি এটিকে খ্রিস্টধর্মের বিশ্বজনীন ভালোবাসার পরিপন্থি দাবি করে? এখন যেহেতু তার দাসকে ফিরে পেয়েছেন মালিক, শুধুমাত্র তার সাথে ভালো আচরণ করার অনুনয় করা ছাড়া, তার ক্রীতদাসকে মুক্তি দিতে তিনি কেন ফিলেমনকে প্ররোচিত করেননি? সম্ভবত এর কারণ হতে পারে, পৃথিবী সেই মুহূর্তে যেমন ছিল সেটি বেশিদিন স্থায়ী হবে এমন প্রত্যাশা তিনি করেননি। যিশু খুব শীঘ্রই ফিরে আসছেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার আর ভালোবাসার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন আর সে-কারণে, কী দরকার এমন একটি পদ্ধতি পরিবর্তন করা, যার কিনা বিলুপ্তি আসন্ন? আপনি যদি কোনো একটি বাড়ি ভাঙতে শুরু করেন, নিশ্চয়ই সেই বাড়ির পয়ঃপ্রণালী কিংবা পানির লাইন ঠিক করে অযথা সময় আর অর্থ নষ্ট করবেন না। এর মানে প্রথম খ্রিস্টানরা এই জগতে পুরোপুরিভাবে আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। খুব দ্রুত এই পৃথিবী সমাপ্তি হতে যাচ্ছে, খ্রিস্টানদের এই প্রত্যাশাটি মূলত তাদের বিরুদ্ধে রোমানদের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল। এই মানসিকতাটি তাদের এমন একটি ধারণা দিয়েছিল যে, খ্রিস্টানধর্মাবলম্বীরা বাকি মানবজাতিকে ঘৃণা করে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আরো একটি বিষয় লক্ষ করার পরেই কেবল রোম-কর্তৃপক্ষ খ্রিস্টানদের তাদের ক্রোধের একটি নিশানা বানাতে শুরু করেছিল।

ধূপ হচ্ছে গাছের নিঃসৃত একধরনের রস বা রেজিন, যার সাথে নানা সুগন্ধী ভেষজ মিশ্রিত করা হয় এবং যখন এটি পোড়ানো হয় তখন বেশ মিষ্টি গন্ধসহ একটি ধোয়া চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। প্রাচীন ধর্মগুলোয়, কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে এই ধূপ জ্বালানো খুব জনপ্রিয় একটি উপাসনাপদ্ধতি ছিল। তারা সম্ভবত একসময় ভাবতেন, যখন এই ধূপদানি থেকে ধোঁয়া উপরে উঠবে, এর সুবাস স্বর্গের দেবতাদের তৃপ্ত করবে এবং তাদের সমর্থন বা আজ্ঞা নিশ্চিত করবে। রোমের নাগরিকদের জন্যে তাদের সম্রাটের ছবির নিচে ধূপদানিতে কিছু ধূপ পোড়ানো একটি আবশ্যিকতা ছিল, ঠিক যেন তারা তাকে একজন দেবতা হিসাবে উপাসনা করছেন। এটি আনুগত্যের একটি পরীক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছিল, অনেকটাই পতাকার প্রতি সম্মানপ্রদর্শন আর জাতীয় সংগীতের সময় উঠে দাঁড়ানোর মতো। তারা তাদের সম্রাটকে আসলেই দেবতা হিসাবে দেখতেন কিনা সেটি নিয়ে সংশয় আছে, তবে এই আচারটি অবশ্যই সেদিকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু খ্রিস্টানদের জন্যে এমন কিছু মেনে নেওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার প্রমাণিত হয়েছিল। তারা প্রতিবাদ করেছিলেন, যদিও তারা সম্রাটের অনুগত প্রজা, তারপরও তারা তাকে কোনো দেবতার মতো ভক্তিপ্রদর্শন করে ধূপ জ্বালাতে পারবেন না।

এটাই কর্তৃপক্ষকে ভীষণ খেপিয়ে তুলেছিল। সেই গুজবটি, খ্রিস্টানরা পৃথিবীর পরিসমাপ্তির জন্যে গোপনে পরিকল্পনা করছেন, সেইসাথে সম্রাটের প্রতি তাদের ধূপ জ্বালাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ, ধারাবাহিকভাবে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ংকর পর্বগুলোর সূচনা করেছিল, যা পরবর্তীতে কদাচিৎ বিরতিসহ কয়েক শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল। এটি শুরু হয়েছিল ৬৪ খ্রিস্টাব্দে যখন নিরো রোম-সম্রাট ছিলেন। একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড রোম শহরকে প্রায় ধ্বংস করেছিল, সেই সময় একটি গুজবও রটেছিল যে, কাজটি স্বয়ং সম্রাট করেছেন তার প্রাসাদ সম্প্রসারণের জন্যে জায়গা পরিষ্কার করতে। এবং বলা হয়েছিল তিনি তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন যখন নিচে পুরো শহরটি আগুনে পুড়ছিল।

বিপদ হতে পারে এমন হুমকির মুখে আতঙ্কিত হয়ে নিরো এই দোষটি পুরোপুরিভাবে খ্রিস্টানদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যেকেই জানতেন, তারা সম্রাটকে ঘৃণা করেন এবং এই পৃথিবীর পরিসমাপ্তি ঘটুক, এটাই তারা আশা করেন। সুতরাং তারাই দোষী। কুৎসিত গণনির্যাতনের একটি পর্ব শুরু হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, নিরো কয়েকজন খ্রিস্টান ব্যক্তির সারা শরীর তেল দিয়ে আবৃত করে তার প্রাসাদের বাগানে মোমবাতির মতো প্রজ্বলিত করেছিলেন। আমরা এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারব না, কিন্তু সম্ভাবনা আছে পলের শিরশ্চেদ করা হয়েছিল চার্চের উপর রোম-কর্তৃপক্ষের প্রথম আনুষ্ঠানিক নিপীড়নপর্বে। একটি বিশ্বাসের ধারা আছে, যেটি দাবি করে এরপর অ্যাপোস্টল পিটার রোমে এসেছিলেন, এবং তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিংবদন্তি বলছে পিটার উল্টো করে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কারণ তিনি তার প্রভু যিশুকে ত্যাগ। করেছিলেন যখন রোমানরা তাকে গ্রেফতার করেছিল।

এই নির্যাতন খ্রিস্টধর্মের সম্প্রসারণকে মন্থর করার জন্যে কিছুই করতে পারেনি। বরং এর বিপরীতটাই একটি সত্য ছিল। আর এমনটা প্রায়শই ঘটে যখন কর্তৃপক্ষ এমন কোনোকিছুকে দমন করে বিলুপ্ত করতে চেষ্টা করেন, যার প্রতি এর সম্মতি নেই। নির্যাতিত খ্রিস্টানরা দাবি করেছিলেন শহীদের রক্তই হবে চার্চের বীজ। এবং এরপরের প্রায় আড়াই শতাব্দীতে পুরো সাম্রাজ্য জুড়েই চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আলোচনা আরো অগ্রসর করার আগে একটি তথ্য জানানো ভালো, ‘চার্চ’ শব্দটির দুটি অর্থ আছে। এটি একটি গ্রিকশব্দকে অনুবাদ করেছিল, যার অর্থ শুধুমাত্র একটি সমাবেশ’ বা ‘এক গোষ্ঠী মানুষ। সুতরাং খ্রিস্টীয় চার্চের অর্থ হচ্ছে সেই মানুষগুলো, যারা খ্রিস্টকে অনুসরণ করেন। অনিবার্যভাবে যে দালানগুলোয় তারা মিলিত হতেন সেটিও পরিচিত হয়ে উঠেছিল চার্চ’ নামে। আর সবচেয়ে ভালো উপায়, যার মাধ্যমে আমরা এই দুটি অর্থকে পৃথক করতে পারি, সেটি হচ্ছে একটি বড়হাতের ‘সি’ ব্যবহার করা, বড় হাতের ‘সি’ সহ চার্চ মানে জনগোষ্ঠী অথবা সমাবেশ –চার্চ (Church), ছোট হাতের ‘সি’ হচ্ছে সেই ভবনটি যেখানে তারা একত্র হয়, চার্চ (church)।

প্রথম খ্রিস্টানরা যখন তাদের নির্যাতনকারীদের কাছে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করতেন না, তখন তারা বহু সময় ব্যয় করেছিলেন তাদের বিশ্বাস নিয়ে পরস্পরের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি চার্চের প্রথম বিতর্কটি ছিল, যারা ইহুদি নয় এমন কেউ যারা ধর্মান্তরিত হবেন, তারা কি ইহুদিদের অনুশাসনগুলো মেনে চলবেন কিনা। পল সেই বিতর্কে জিতেছিলেন, এবং ইহুদি অনুসারীদের বাইরে খ্রিস্টধর্ম আর চার্চের ব্যাপক সম্প্রসারণে তিনি স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এবং এটি ভবিষ্যতে আরো বহু জটিল বিতর্কের একটি সূচনাপর্ব ছিল। এরপরের সবচেয়ে বড় বিতর্কটি ছিল, যিশু কে ছিলেন, সেই বিষয়ে। তারা জানতেন, তিনি একজন মানব-পুরুষ ছিলেন। তারা জানতেন, তিনি নাজারেথ থেকে এসেছিলেন। তারা জানতেন, জেরুজালেমে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এবং তারা জানতেন, ঈশ্বর তাকে তার প্রিয়পুত্র হিসাবে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু কীভাবে তিনি একই সাথে একজন মানব-পুরুষ আর ঈশ্বরপুত্র হতে পারেন? পল এই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন এমন কিছু বলে যে, ঈশ্বর তাকে পালকপুত্র হিসাবে ‘দত্তক’ নিয়েছিলেন। সুতরাং এর অর্থ কি এমন হতে পারে যে, কোনো একটি সময় ছিল যখন তিনি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন না? তারা বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা পছন্দ করেননি। তারা এর বিপরীত একটি ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। তিনি সবসময়ই ঈশ্বরপুত্র ছিলেন। এবং খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪ সালের আশেপাশে কোনো একটি সময় এই পৃথিবীতে ছদ্মবেশে তিনি এসেছিলেন তার সন্তানদের উদ্ধার করতে। পুনরায় ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের আগে, ত্রিশ বছর ধরে তিনি মানব-পুরুষের জীবন কাটিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মানুষ এবং সম্পূর্ণ ঈশ্বর। কিন্তু ঠিক কীভাবে বিষয়টির বোধগম্য একটি ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হতে পারে? তারা বিষয়টি নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে বিতর্ক করেছিলেন, এবং এটি বহু উপদল আর ধারার জন্ম দিয়েছিল।

অবশ্যই যিশুর স্বর্গীয় পরিচয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক ছাড়াও তারা অনেক কিছুই করেছিলেন। তারা দরিদ্র অসহায়দের সেবা করেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যে প্রশাসনিক কাঠামো অনুকরণ করে দক্ষতার সাথে তারা নিজেদের সংগঠিত করেছিলেন। তারা নিজেদের ভৌগোলিক সীমানায় ভাগ করেছিলেন, যে ভৌগোলিক এককগুলোর তারা নাম দিয়েছিলেন ‘ডাইওসিস’, যেখানে প্রশাসক হিসাবে একজন তত্ত্বাবধায়ক অথবা বিশপকে নিয়োগ দেওয়া হতো। বিশপের অধীনে থাকতেন যাজকরা, যারা স্থানীয় খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর দেখাশুনা করতেন। সমাজকল্যাণের জন্যে তৃতীয় একটি স্তর ছিল, সেই কর্মীদের বলা হয় ডিকন, যারা দরিদ্র আর অসহায়দের দেখাশুনা করতেন। খুব কার্যকরী দক্ষ একটি সংগঠন তারা তৈরি করেছিলেন, এবং মসৃণভাবে এটি কাজ করেছিল। খুব শীঘ্রই বড় শহরগুলোর যেমন, রোম, বিশপরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, এমনকি সাম্রাজ্যের কর্তৃপক্ষের কাছেও। নির্যাতন অব্যাহত ছিল খানিকটা মাত্রায়, কিন্তু সেটি চার্চকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এবং শেষ নির্যাতনপর্বটি প্রমাণিত হয়েছিল রাতের শেষ আঁকড়ে ধরার মতো, যার পরেই এসেছিল নতুন আর বিস্ময়কর একটি ভোর।

যখন খ্রিস্টীয় চার্চ নিজেকে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী একীভূত একটি সংগঠন হিসাবে, রোম সাম্রাজ্য ঠিক বিপরীত দিকে অগ্রসরমান ছিল। নিজেকে বহুখণ্ডে খণ্ডিত করার মাধ্যমে ক্রমশ এটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এর সেনারা সাম্রাজ্য রক্ষা করতে দেশের সীমানায় হামলে-পড়া আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বদলে বরং নিজেদের মধ্যেই বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করে কাটাতে শুরু করেছিল। কিন্তু অনিয়মিতভাবে শক্তিশালী কয়েকজন নেতার আবির্ভাব হয়েছিল, যারা সাম্রাজ্যের ধ্বংস ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন ডাইক্লেশিয়ান। ২৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্রাট হয়েছিলেন, সাম্রাজ্যকে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় খ্রিস্টান চার্চের উপর তিনি সর্বশেষ এবং হিংস্রতম নির্যাতনপর্বটি পরিচালনা করেছিলেন। কারণ তিনি তাদেরকে মিত্র না ভেবে বরং তার লক্ষ্য অর্জনে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছিলেন। এই ভয়াবহ নির্যাতনের পর্বটি শুরু হয়েছিল ৩০৩ খ্রিস্টাব্দে এবং যতদিন এটি চলেছিল, পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, কিন্তু এর আগে যত নির্যাতনপর্ব এসেছিল, এটি তার কোনোটির চেয়ে বেশি সফল হতে পারেনি। এর দশ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছিল যখন চার্চ আর সাম্রাজ্য এক হয়ে গিয়েছিল।

৩০৫ খ্রিস্টাব্দে যখন ডাওক্লেশিয়ান অসুস্থ হবার পর সম্রাটের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। খুব দ্রুত নেতৃত্বের ওপর দাবি করা প্রতিদ্বন্দ্বীরা আবার পরস্পরের সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এবং এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন কনস্টান্টিন। ৩১২ খ্রিস্টাব্দে, রোমের উপকণ্ঠে একটি যুদ্ধের আগের রাতে, যে যুদ্ধটি নির্ধারণ করবে, কে রোমের পরবর্তী সম্রাট হবেন, কনস্টান্টিন তার তাঁবুতে ঘুমিয়েছিলেন, তিনি খুব জীবন্ত একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নে তিনি দেখেছিলেন খ্রিস্টীয় চিহ্ন ‘ক্রুশ’ তার সামনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, এবং তিনি একটি কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন, যা তাকে নির্দেশ দিচ্ছে, এই প্রতাঁকের নিচে তুমি জিতবে।

পরের দিন সকালেই তিনি সেই ব্যানার তৈরি করেন, এবং সেটি উজ্জ্বলভাবে ক্রুশের চিহ্ন দিয়ে অলংকৃত করেন, এবং যুদ্ধে যান, এবং তিনি সেদিন তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছিলেন। পরের বছরই তিনি খ্রিস্টানদের নির্যাতন করার ডিক্রিটি বাতিল করে দেন এবং সাম্রাজ্য জুড়েই ধর্মপালনে অসীম স্বাধীনতা প্রদান করেন। ৩১৫ সালে তিনি ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ডের প্রথাও বাতিল করেছিলেন, যা খ্রিস্টানরা তীব্রভাবেই ঘৃণা করে আসছিলেন। এবং ৩২৪ সাল নাগাদ, যদিও অন্য ধর্মগুলোর প্রতি সহিষ্ণু ছিল রোম, তিনি খ্রিস্টান ধর্মকে সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র বিশ বছরের মধ্যে নির্যাতিত অস্পৃশ্য একটি ধর্ম থেকে সম্রাটের প্রিয় ধর্মে রূপান্তরিত হবার ঘটনাটি ছিল আসলেই বিস্ময়কর একটি রূপান্তর।

কিন্তু খুব সরল হবে যদি কনস্টান্টিনের যিশুর ধর্মে ধর্মান্তরের বিষয়টিকে আধ্যাত্মিক হিসাবে দেখা হয়। তিনি খুবই ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিলেন, এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, একমাত্র খ্রিস্টধর্মই তার সাম্রাজ্যকে একীভূত করে রাখার ক্ষেত্রে আঠার মতো কাজ করবে : একটি বিশ্বজনীন চার্চ একটি বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যের উপর মূদ্রিত করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন যখন আবিষ্কার করেছিলেন, মানুষ আর ঈশ্বর হিসাবে যিশুখ্রিস্টের প্রকৃতি সংজ্ঞায়িত করার শ্রেষ্ঠ উপায় নিয়ে চার্চ নিজেই বহু প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। এই বিতর্কের সমাধানের পরিণতি এত ক্ষুদ্র একটি বিষয় ছিল, এটি আসলেই একটি মাত্র অক্ষরের ওপর নির্ভর করে ছিল, সেটি হচ্ছে আইয়োটা, আই (i) অক্ষরটির গ্রিক সংস্করণ। এই বিতর্ক সমাধান করার প্রত্যয়ে, ৩২৫ সালে কনস্টান্টিন বর্তমান তুরস্কের একটি শহর নাইসিয়ায় তার সাম্রাজ্যের সব বিশপ আর ধর্মতাত্ত্বিকদের ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর তিনি তাদের একটি ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন, এবং যতক্ষণ-না তারা এই সমস্যাটির সমাধান করতে পারেন ততক্ষণ তাদের মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ‘আয়োটা’ কি বাদ যাবে, না গ্রহণ করা হবে? (সিজারিয়ার ইউসেবিয়াস যে-শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেটি হচ্ছে homoiousios বা ‘একই ধরনের উপাদানে তৈরি, এটি নাইসিয়ার কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত, যিশু এবং ঈশ্বর পিতা হচ্ছেন homoousios বা একই উপাদানে তৈরি, তার থেকে ভিন্ন ছিল। সেই সময়ের খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতেন যে, তারা একই ধরনের উপাদানে তৈরি, এর মানে হচ্ছে একজন যিশু তিনি পরিত্রাণকারী ঈশ্বর পিতার হুবহু নয়, যা ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর। উপরন্তু, যদি তারা একই ধরনের স্বর্গীয় উপাদানে তৈরি হয়ে থাকেন, তাদের মূল একেশ্বরবাদের মতবাদেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সৃষ্টি হয়। এভাবেই কাউন্সিল অব নাইসিয়া প্রস্তাব করেছিল যে, যিশু ও স্বর্গীয় পিতা একই উপাদানে তৈরি। আর homoiousios আর homoousios শব্দদুটির মধ্যে পার্থক্য ছিল একটি গ্রিক অক্ষর, আইওটা (i), আর এখান থেকেই সেই অভিব্যক্তিটি এসেছে, এক আইওটা পার্থক্য। অবেশেষে তারা আইওটাটি সেই শব্দ থেকে বাদ দিয়েছিলেন যা বিতর্কের মূলে ছিল। এই সমস্যাটির সমাধান হয় এবং পুরোপুরি ঈশ্বর আর পুরোপুরি মানুষ হিসাবে যিশুখ্রিস্টের প্রকৃতিটি অবশেষে চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়েছিল।

কনস্টান্টিন এই ফলাফল নিয়ে এতই তৃপ্ত হয়েছিলেন যে, তিনি সব বিশপদের রাজকীয় একটি ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি তার দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার প্রাসাদের দরজার সামনে তাদের তলোয়ারগুলো রেখে আসতে এবং বিশপরা আড়ম্বরের সাথে তার রাজকীয় কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন, সেখানে তারা রাজকীয় ভোজসভায় অংশ নেন পুরো কক্ষে চমৎকারভাবে সজ্জিত কাউচের উপর শুয়ে। একজন বিশপ এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি এই অনুষ্ঠানটিকে বর্ণনা করেছিলেন যেন পৃথিবীতে অবশেষে খ্রিস্টের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো দৃশ্য অবশ্যই যিশু তার নিজের বলে শনাক্ত করতে পারতেন না। যে শক্তি একদিন তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল সেটি এখন এর নিজের উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে তাকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাটি চার্চের চুড়ান্ত বিজয় হিসাবে দেখেছেন, এর নির্যাতনকারীদের ওপর এবং ইউরোপীয় ইতিহাসে তাদের দীর্ঘ প্রাধান্য বিস্তারকারী পর্বের সূচনা হিসাবে। এটি নিজেকে ক্যাথলিক চার্চ (বিশ্বজনীন) নামে চিহ্নিত করতে শুরু করেছিল। কারণ এটি সারা রোমসাম্রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সাম্রাজ্যের ক্ষমতা যখন পড়তির দিকে, চার্চের ক্ষমতা তখন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যতক্ষণ-না এটি সেই পর্যায়ে যেতে পেরেছিল, যখন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, এবং রাজারাও আতঙ্কিত থাকতেন এর কর্তৃত্বের সামনে। পার্থিব রাজনৈতিক শক্তির সাথে এর অংশীদারিত্ব পরিচিতি পেয়েছিল ক্রিসেনডম বা খ্রিস্টরাজ্য নামে। আর এই খ্রিস্টীয় রাজ্য এতই শক্তিশালী ছিল এর চূড়ান্ত শীর্ষে, গরিমার মেঘে আবৃত থাকা এর এই নতুন রূপের মধ্যদিয়ে তখন গ্যালিলি থেকে আসা সেই কৃষকটির রক্তাক্ত শরীরকে দেখা প্রায় অসম্ভব ছিল, যিনি এই সবকিছুরই সূচনা করেছিলেন। প্রায়, তবে একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ যদিও এখন একটি সত্যিকারের রাজমুকুট তার মাথার উপর শোভা পাচ্ছে এবং সত্যিকারের রাজকীয় বেগুনি চাদরে তিনি আচ্ছাদিত, যখন তারা চার্চে প্রার্থনা করতে আসত, খ্রিস্টানরা নিউ টেস্টামেন্ট থেকে সেই অন্য খ্রিস্টের বর্ণনা শোনা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে তিনি তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর কখনোই ফিরে আসেননি। কিন্তু চার্চে সবসময়ই সেই মানুষগুলো ছিলেন যারা ভেবেছিলেন, এর কারণ হচ্ছে তিনি আসলেই কখনো চলে যাননি।

খ্রিস্টানদের গল্প শেষ হওয়া এখনো অনেক বাকি। এর শ্রেষ্ঠতম বছরগুলো এখনো আসা বাকি। তবে আমরা সেই কাহিনি ছেড়ে যাব পরের কয়েকটি অধ্যায়ে আরেকটি ধর্মের উত্থানের বিষয়টি দেখতে, যে-ধর্মটিও অতীতের আব্রাহামকে তাদের পিতা হিসাবে দেখেছিল : ইসলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *