১৮. ধর্মান্তরিত

অধ্যায় ১৮. ধর্মান্তরিত

ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ধর্মের নাটকে আরো একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্যসূচক চরিত্র। ‘কনভারসন’ (ধর্মান্তরিতকরণ) শব্দটির মানে উলটো ঘুরে যাওয়া এবং বিপরীত দিকে তাকানো। অধিকাংশ মানুষই জীবদ্দশায় তাদের মতামত পরিবর্তন করেন, কিন্তু সাধারণত সেটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, ক্রমশ সময়ের সাথে একটি ধারণা থেকে সরে আসা। কিন্তু ধর্মীয় রূপান্তর কদাচিৎ এমন হয়ে থাকে। ধর্মান্তরিত ব্যক্তি চোখের পলকেই রূপান্তরিত হতে পারেন। খুব দ্রুত তারা সম্পূর্ণভাবে বদলে যেতে পারেন। এটি এতই আকস্মিক একটি ব্যাপার যে, তারা বলেন এটি অনেকটাই আবার নতুন করে জন্ম নেওয়ার মতো একটি ব্যাপার।

এই জন্ম নেওয়ার সাদৃশ্য উদাহরণটি যথাযথ, কারণ এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রসব যতই দ্রুত হোক না কেন, একটি শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার উপযোগী হতে সময় লাগে। একই সাথে ধর্মান্তরিত হবার সেই মুহূর্তটি আকস্মিক মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে প্রায়শই এটি দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি, যা আসলেই বহুবছর ধরেই চলমান ছিল। ধর্মান্তরিতের আত্মা বিভাজিত, তারা এমন কিছুর বিরুদ্ধে সগ্রাম করছেন, যার প্রতি তাদের অনুভূত সেই আকর্ষণটি তারা স্বীকার করতে পারেন না। যদি তারা পরাজয় মেনে নেন, এটি তাদের জীবনকে এমন একদিকে নিয়ে যাবে, যা তারা চান না। সুতরাং তারা যুদ্ধ করেন, সেই জিনিসটির বিরুদ্ধে, যে-জিনিসটির কাছে তারা আত্মসমর্পণ করতে কামনা করছেন।

খ্রিস্টধর্মে বহু ধর্মান্তরিতদের মধ্যে যাদের জীবন সম্পূর্ণভাবেই বদলে গিয়েছিল তাদের সাথে যা ঘটেছিল সেই কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন সল নামের একজন ইহুদি ব্যক্তি। সল পরবর্তীতে একজন খ্রিস্টান হয়েছিলেন এবং পল নামে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তার ধর্মান্তরিতকরণের ঘটনাটি এতই বিখ্যাত যে, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছিল সেটি, আকস্মিকভাবে মন পরিবর্তন করা বোঝাতে একটি শব্দ-সংকেত হিসাবে আমাদের ভাষায় প্রবেশ করেছে। আমরা যখন জীবনের এমন কোনো মুহূর্তের বর্ণনা দিতে চাই, যখন এটি সম্পূর্ণ বিপরীতে এর দিক পরিবর্তন করেছিল, তখন একটি ‘দামাস্কাস রোড’ অভিজ্ঞতার কথা বলি, কারণ দামাস্কাসগামী রাস্তার উপরেই সল অবশেষে খ্রিস্টধর্মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, যে-বিশ্বাসটির অনুসারীদের তিনি নিজেই বহুবছর ধরে নিপীড়ন করে আসছিলেন।

আমরা সঠিকভাবে জানি না সল কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ধারণা করা হয় এটি খ্রিস্টযুগ শুরু হবার দ্বিতীয় বছরের শুরুর কোনো একটি সময় ছিল। তার মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের একটি ধারা বলছে ৬২ আর ৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো একটি সময়, তিনি রোমে তার ধর্মবিশ্বাসের জন্যে শহীদ হয়েছিলেন। আমরা জানি তিনি বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে অবস্থিত তৎকালীন রোমান প্রদেশ সাইলিসিয়ার একটি শহর টারসাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল, তিনি ছিলেন ইহুদি এবং তার পিতার কাছ থেকেই তিনি রোমের নাগরিকত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। সম্ভবত তার রোমান নাম ছিল পল। পেশায় তিনি তাঁবু-নির্মাতা ছিলেন, তবে তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং খুব ভালো গ্রিক পড়তে আর লিখতে পারতেন। তিনি যে চার্চগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই চার্চগুলোর উদ্দেশ্যে লেখা তার চিঠিগুলো সবচেয়ে প্রাচীনতম খ্রিস্টীয় ডকুমেন্ট, যা আমাদের কাছে আছে। সম্ভবত জেরুজালেম শহরের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক গামালিয়েলের তত্ত্বাবধানে তিনি তার শিক্ষার একটি অংশ পেয়েছিলেন। এবং তিনি বলেছিলেন তার এই শিক্ষক ছিলেন একজন ‘ফারিসি’।

নিজেদেরকে যতই ঐক্যবদ্ধ দাবি করুক না কেন, সব ধর্মই হচ্ছে বিভিন্ন দল-উপদলের একটি জোট, যারা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে তাদের বিশ্বাসের প্রতি অনুগত। কখনো খুবই ভিন্ন উপায়ে। সলের সময় জুডাইজম বা ইহুদিবাদও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ধর্মের সবচেয়ে সাধারণ বিভাজনটি মূলত রক্ষণশীল আর প্রগতিশীলদের মধ্যে থাকে। তারা যেহেতু জানেন, তাদের ধর্মটি এসেছে সেই নবীদের কাছ থেকে, যারা ঈশ্বরের কণ্ঠ শুনেছেন, এবং তারপর যিনি তার নির্দেশনাগুলো মানুষকে জানিয়েছিলেন, রক্ষণশীলরা তাদের বিশ্বাসকে মূল ঐশী প্রত্যাদেশের প্রথম পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখেন। কিন্তু প্রগতিশীলরা পরবর্তীতে আসা নতুন ব্যাখ্যা, পরিবর্তন আর ধারণাগুলো গ্রহণ করতে চান। প্রথম শতাব্দীতে জুডাইজমে এইসব পরস্পরবিরোধী প্রবণতাগুলো প্রতিনিধিত্ব করতেন সাডুসি বা রক্ষণশীলরা আর ফারিসি বা প্রগতিশীলরা, সে-দলেরই একজন সদস্য ছিলেন সল।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি মূলত ছিল মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের ওপর বিশ্বাস সংক্রান্ত ধারণায়, যে-বিষয়টি ইহুদিবাদের সূচনাপর্বে আলোচনায় আসেনি। আব্রাহামের আবিষ্কার ছিল, শুধুমাত্র একজনই ঈশ্বর আছেন। মোজেসের আবিষ্কার ছিল ঈশ্বরের সেই নির্বাচন আর চুক্তি : ইহুদিরা তার বিশেষভাবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠী এবং তার প্রদত্ত আইনগুলোর সংরক্ষক। এটাই ছিল ইহুদিবাদের মূল সার, যার প্রতি সাডুসি বা রক্ষণশীলরা কঠোরভাবে অনুগত ছিলেন। তারা সেই ধারণাগুলোকে অবিশ্বাস করতেন, ব্যাবিলনের নির্বাসিত থাকার সময় যে-ধারণাগুলো তারা আত্তীকৃত করেছিলেন বলে মনে করা হয়, যেমন, মৃতদের পুনর্জন্ম এবং শেষবিচারের দিনে তাদের মধ্যে শাস্তি অথবা পুরস্কার বিতরণ। ব্যাবিলন থেকে আরেকটি আমদানি রক্ষণশীলরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেটি হচ্ছে ফেরেশতাদের অস্তিত্বের ওপর তাদের বিশ্বাস। দাবি করা হয়, ফেরেশতারা ঈশ্বর আর মানবজাতির মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। পৃথিবীতে তাদের সন্তানদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার জন্যে অশরীরী বুদ্ধিমত্তা অথবা অশরীরী মন হিসাবে বর্ণিত ফেরেশতাদের ঈশ্বর ব্যবহার করেন। সাভুসি বা রক্ষণশীলরা ছিল আরেকটি অপ্রয়োজনীয় আমদানি। তার খবর পৌঁছে দেবার জন্যে ঈশ্বরের কোনো বার্তাবাহকের দরকার নেই। তিনি ইতিমধ্যে সর্বত্র বিরাজমান এবং তাদের নিশ্বাসের চেয়েও যিনি আরো বেশি তাদের নিকটবর্তী।

তবে ফারিসিরা বিষয়টি এভাবে দেখেননি। তারা প্রগতিশীল ছিলেন, ঈশ্বর তার অস্তিত্বের রহস্যময়তা আর তার পৃথিবী-সংক্রান্ত উদ্দেশ্যগুলো নিয়ে তার সন্তানদের শিক্ষা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এমন প্রস্তাবনাটি তারা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কেন? তারা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, কেন তাদের বিশ্বাস করা উচিত হবে, ঈশ্বর তার নির্বাচিত মানুষগুলোকে যা জানাবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, শতবছর আগেই তিনি সেইসব জ্ঞান বিতরণ করার কাজটি শেষ করে ফেলেছেন? তাহলে তিনি কি একজন জীবন্ত ঈশ্বর নন, যিনি এখনও নতুন নবীকে আহ্বান করতে সক্ষম, যাকে তিনি তার মানুষদের জানাতেন নতুন সত্য শিক্ষা দিতে পারেন?নবী ডানিয়েল কি তাদের বলেননি যে, ঈশ্বর ইজরায়েলের সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন ফেরেশতা মাইকেলকে এবং তাদের জন্য অভূতপূর্ব। একটি খারাপ সময়ের পর, তারা মুক্তি পাবেন, এবং মৃতরা তাদের কবর থেকে জেগে উঠবে, কেউ অনন্ত জীবনে আর কেউ অনন্ত লজ্জায়? এবং রোমানদের শাসনের অধীনে যে দুর্দশার অভিজ্ঞতা তাদের হচ্ছে, সেটাই কি ডানিয়েলের বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে না? তারা কি সবাই ডানিয়েলের প্রতিশ্রুত চূড়ান্ত সমাপ্তি আর পৃথিবীতে এইসব ঘটনাগুলো ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী একজন ‘মেসাইয়া’র আগমনের জন্য অপেক্ষা করছেন না?

ইজরায়েলে তখন সময়টি ছিল ধর্মীয় আর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। জেরুজালেম বহু গোষ্ঠীর মানুষ দিয়ে অতিমাত্রায় জনবহুল হয়েছিল, যারা সেই মানুষটিকে খুঁজছিলেন, যিনি সেই মেসাইয়ার যুগটি তাদের পরিত্রাণের উদ্দেশ্য নিয়ে আসবেন। কিন্তু সবার প্রতিশ্রুত মেসাইয়া হিসাবে দাবি করা এমন কারোর জন্য সেখানে একটি ত্রিমুখী বিপদ অপেক্ষা করেছিল। তখন ইসরায়েল শাসন করছিল রোমসাম্রাজ্যের খুবই অধৈর্য একগুচ্ছ কর্মকর্তা, যারা বিদ্রোহের সামান্যতম সম্ভাবনা খুব নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে প্রস্তুত ছিলেন। অন্তত তাদের কাছে এই মেসাইয়া হচ্ছে রোমশাসনের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহীর পোশাকি নাম। এবং তারা জানতেন কীভাবে বিদ্রোহীদের দমন করতে হয়।

আর যে যাজক-পুরোহিতরা মূল মন্দিরটি পরিচালনা করতেন, তারাও এই প্রতিশ্রুত মেসাইয়া দাবি করা এমন কারোর জন্যে ভীতিকর আরেকটি প্রতিপক্ষ ছিলেন। রোমানদের কাছে তিনি হয়তো রাজনৈতিক বিদ্রোহী হতে পারেন, কিন্তু ইহুদি পুরোহিতদের কাছে তারা ছিলেন ঈশ্বরবিরোধী একজন ধর্মদ্রোহী, যিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা কী সেই বিষয়ে তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এবং তারা জানতেন কীভাবে ধর্মদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে হয়।

হেরড রাজপরিবারের সদস্যরা, রোম-কর্তৃপক্ষ ইজরায়েলকে চারটি এলাকায় বিভাজিত করে সেগুলো দেখাশুনা করার জন্যে যাদের দায়িত্ব দিয়েছিল, তারাও এই নিজেকে প্রতিশ্রুত দেবতা হিসাবে দাবি করা এমন মেসাইয়ার জন্য সমানভাবে বিপজ্জনক আরেকটি প্রতিপক্ষ ছিলেন। তাদের ক্ষমতার সামান্য অবশিষ্টাংশ আঁকড়ে বেঁচে থাকা এইসব ছোটখাটো রাজপরিবারের সদস্যদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে এমন কোনো মেসাইয়া অবশ্যই একটি হুমকি ছিল। এবং তাদের জীবনযাত্রার প্রতি হুমকি হতে পারে এমন কাউকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায় তারা সেটি জানতেন।

এক পাসওভারের সময় এমনই একজন মেসাইয়া দাবিকৃত ব্যক্তি যিশুকে, ‘ধর্মদ্রোহী’ হিসাবে দণ্ডিত করা ইহুদি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আর ‘অনাকাঙিক্ষত সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা গ্যালিলির শাসক হেরড অ্যান্টিপাসের সমর্থনে রোম কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু সেই সমস্যাটি যিশুখ্রিস্ট বা মেসাইয়া যিশু নামে পরিচিত এই ব্যক্তিটিকে ক্রুশবিদ্ধ করার পরে শেষ হয়ে যায়নি। আর সেই সময়ে এই কাহিনিতে প্রবেশ করেছিলেন সল।

যিশুর অনুসারীরা তার মৃত্যুর পর তাদের মেসাইয়াকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করেননি। বরং তারা আরো সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। তারা বলেছিলেন তাদের কাছে প্রমাণ আছে যে, ঈশ্বরই এই মেসাইয়াকে পাঠিয়েছিলেন চূড়ান্ত ইতিহাস পরিসমাপ্তি হবার সেই দিনটির জন্যে ইজরায়েলকে প্রস্তুত করতে। তার মৃত্যুর পর, তিনি তাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন এলাকায় ‘আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং তিনি তাদের একতাবদ্ধ থাকতে এবং তার শেষ চূড়ান্ত আগমনের জন্যে অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটি সেই মন্দিরের ইহুদি যাজকদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছিল, তারা ভেবেছিলেন যিশুকে হত্যা করার মাধ্যমে এই বিপজ্জনক সমস্যাটিকে চিরকালের জন্যে তারা উৎপাটন করতে পেরেছেন। সুতরাং মন্দির পুলিশের একটি বিশেষ শাখার নেতৃত্ব দেবার জন্য তারা সল দ্য ফারিসিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন তিনি আরো বড় কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করার আগেই এই তথাকথিত খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের আটক করতে খুঁজে বের করেন। এমন কাজের জন্যে সল মরিয়া হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, এবং তিনি অতি উৎসাহের সাথে খ্রিস্টান-নিপীড়নে নেমে পড়েছিলেন।

এই সময়ে তার একটি বর্ণনা আমাদের কাছে আছে। তিনি আকারে ছোটখাটো ছিলেন, তার মাথায় টাক ছিল, পা দুটি খানিকটা ধনুকের মতো বাঁকা ছিল। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, শারীরিকভাবে তিনি অনাকর্ষণীয় ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ কিছু একটা ছিল। আর তার চোখে সেটি দেখা যেত। তীব্র আবেগময় কোনো অনুসন্ধানীর গভীরতা ছিল তার চাহনিতে। অস্থির প্রাণশক্তিতে তিনি বলীয়ান ছিলেন। এবং তিনি বিতর্ক করতে পারতেন। এই সেই মানুষ যিনি এখন খ্রিস্টান-শিকারির ব্যাজ পরে আছেন। কিন্তু স্মরণ করুন, তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল ফারিসি। যখন কিনা রক্ষণশীল সাডুসিরা বিশ্বাস করতেন না। যে, মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে কারো ফিরে আসা সম্ভব হতে পারে, সুতরাং খ্রিস্টানদের এই দাবি উদ্ভট অবাস্তব বলে তারা আগেই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল খুব স্পষ্ট : কোনো মানুষই মৃত্যুর পর আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না, আর খ্রিস্টানদের এই মেসাইয়া যিশুও মানুষ ছিলেন, যিশুও মৃত্যুর পর জীবিত ফিরে আসেননি।

তবে ফারিসিরা এভাবে বিষয়টি নিয়ে যুক্তি দেবেন না। তারা বিশ্বাস করতেন সত্যিই একদিন ঈশ্বর শেষবিচারের জন্যে মৃতদের জাগিয়ে তুলবেন। তারা শুধু বিশ্বাস করতে পারেননি যে, তিনি ইতিমধ্যে যিশু-নামক এই ব্যক্তিকে মৃত্যু থেকে

জাগিয়ে তুলেছেন। এবং সলও এমন কিছু বিশ্বাস করতেন না। আর সে-কারণেই। তিনি সেইসব ধর্মদ্রোহীদের পেছনে তাড়া করে খুঁজেছিলেন, যারা এমন কিছু বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার মনে কি বিষয়টি নিয়ে খানিকটা সংশয় ছিল? আর সে-কারণেই তিনি এত প্রবলভাবে খ্রিস্টান-বিরোধী ছিলেন? সারা দেশ ঘুরে খ্রিস্টানদের তাড়া করে বেড়ানোর অর্থ কি তাহলে তার নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোরই একটি প্রচেষ্টা ছিল?

এবং আসলেই তিনি দৌড়েছিলেন। তিনি খবর পেয়েছিলেন জেরুজালেম থেকে একশো মাইল উত্তরে দামাস্কাস শহরে যিশুর অনুসারীরা ইতিমধ্যেই অবস্থান করছেন। এরপর তারা কোথায় গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন? দামাস্কাসে এদেরকে খুঁজে বের করতে প্রধান-যাজকের কাছে তিনি অনুমতি নিয়েছিলেন। যখন তিনি দামাস্কাসের পথে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ করে খুব উজ্জ্বল একটি আলো তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল, তিনি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি একটি কণ্ঠ শুনতে পান, যে-কণ্ঠটি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন তুমি আমাকে নির্যাতন করছ?’ আতঙ্কিত পল এর উত্তরে আর্তনাদ করে বলেছিলেন, কে তুমি’? আমি যিশু, যাকে তুমি নির্যাতন করছ’, কণ্ঠটি তাকে বলেছিল। তারপর সেই কণ্ঠটি তাকে উঠে দাঁড়াতে বলেছিল, এবং তাকে দামাস্কাসে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিল, পরবর্তীতে তাকে কী করতে হবে সেটি যথাসময়েই জানানো হবে। যখন সল দাঁড়াতে পেরেছিলেন তখন তিনি তার চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পারছিলেন না। তার এই অন্ধত্বকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিথ্যা বলে এখনই বাতিল করে দেবেন না, স্মরণ করুন মানুষের মন কী করতে পারে। একটি কথা আছে, তাদের মতো এত অন্ধ আর কেউ নেই, যারা ইচ্ছা করেই কিছু দেখেন না। সলের এই অন্ধত্ব ছিল, এখন যে-বিষয়টি সত্য বলেই তিনি জানেন, সেটিকে দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করারই একটি উপসর্গ। তার সহকারীদের সহায়তায় তিনি দামাস্কাসে পৌঁছান, এবং সেখানে তার থাকার জন্যে একটি ঘর ভাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। অন্ধ আর সংশয়গ্রস্ত, সেখানে তিনি তিনদিন ছিলেন, যখন তিনি কিছু খেতে বা পান করতেও পারেননি, এরপরে কী হবে তার জন্যই শুধু অপেক্ষা করছিলেন।

যিশুর একজন স্থানীয় অনুসারী আনানিয়াস, সল যে-ঘরে উঠেছিলেন সেখানে তার দেখাশুনা করার জন্যে এসেছিলেন। তার দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে এসেছিল। এবং সাথে সাথেই তিনি একটি বিপজ্জনক কাজ করেছিলেন, তিনি স্থানীয় একটি সিনাগগে যান এবং উপস্থিত প্রার্থনাকারীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে জানান যে, যিশুই ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র, সেই মেসাইয়া, যার জন্যে তারা অপেক্ষা করছেন। তিনি তাদের জানান, এটি তিনি জানতে পেরেছেন কারণ স্বয়ং যিশু তার সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

কল্পনা করুন যিশুর অনুসারীদের ওপর এই ঘটনাটির প্রভাব কেমন ছিল। তাদের সবচেয়ে বড় একজন নির্যাতনকারী, এখন তাদেরই একজন বলে নিজেকে দাবি করছেন। এটি কি তার চালাকির কোনো কৌশল? সল কি তাদের সংগঠনে প্রবেশ করতে চাইছেন ছদ্ম-বিশ্বাসীর পরিচয়ে, যেন এর সদস্যদের চিহ্নিত করতে তার সুবিধা হয়? তারা স্পষ্টতই এই নতুন ধর্মান্তরিতকে নিয়ে বেশ অস্বস্তি অনুভব করেছিলেন।

এরপর তার করণীয় নিয়ে সল নিজেও খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না। তবে তিনি যে-সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটি তার জন্যে বৈশিষ্ট্যসূচকই ছিল। তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে জানতে ও সদস্য হতে চার্চের নেতাদের মুখাপেক্ষী না হয়ে বরং তিনি একাই আরবের মরুভূমির দিকে চলে গিয়েছিলেন, তার সাথে যা ঘটেছিল সেটি নিয়ে ভাবতে এবং প্রার্থনা করতে। খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসের ওপর তার আর কোনো প্রশিক্ষণের দরকার ছিল না, তিনি ভেবেছিলেন, দামাস্কাস রোডে তার সামনে উপস্থিত হয়ে যিশু তার যা দরকার সবকিছুই তাকে দিয়েছেন। যিশুর এই পুনরুত্থান একটি বার্তা ছিল। সেটি ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন, গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই আপনি বুঝতে পারবেন।

যিশু আন্দোলনের নেতাদের, বা তিনি যেভাবে বলেছিলেন, অন্য নেতাদের সাথে দেখা করতে জেরুজালেমে আসতে সলের আরো তিনবছর সময় লেগেছিল, ততদিনে তিনি পল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনিও নিজেকে যিশুর একজন সহচর হিসাবে দাবি করেছেন, অর্থাৎ তার বার্তা ছড়িয়ে দেবার জন্যে যাকে যিশু ‘প্রেরণ’ করেছেন। এবং বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে দ্বন্দ্ব দ্রুত নিরসন হওয়াই ভালো।

যিশুর ঘনিষ্ঠ অন্য সহচররা ভেবেছিলেন, বিষয়টি বেশ অদ্ভুত নয় কি, এই ভুইফোঁড়, যে কিনা যিশুর সাথে কখনোই সাক্ষাৎ করেননি, এই পৃথিবীতে তার জীবন সম্বন্ধে যিনি কিছুই জানেন না, তারপরও তিনি কিনা যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থানের ঘোষণা প্রচার করছেন? আমরা ঈশ্বরপুত্র যিশুকে চিনতাম, যদিও তিনি আমাদের হতবুদ্ধি করেছিলেন। এভাবে কাউকেই আমরা তার মতো করে এর আগে কখনোই কথা বলতে শুনিনি। তিনি কি সেই মেসাইয়া, আমরা তাঁর কথা শুনে ভেবেছিলাম? সেটি জানতে আমরা তার অনুসারী হয়েছিলাম। কিন্তু আমরা যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম তেমন কিছু ঘটেনি।

বেশ, তাহলে এই যিশু নামের মানুষটি কে ছিলেন? আর আসলেই তার সাথে কী ঘটেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *