১৫. সবচেয়ে ভালো উপায়

অধ্যায় ১৫. সবচেয়ে ভালো উপায়

কনফুসিয়াসের মতবাদ হয়তো বুঝতে সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু এটি বেশ গুরুতর একটি বিষয় ছিল। খুব একটা আনন্দ করার কিছু সেখানে ছিল না। আরেকটি চীনা মতাদর্শ, তাওইজম বা তাওবাদের (ডাওইজম) ক্ষেত্রে এটি ঠিক এর উল্টো। তাওবাদ বুঝতে আপনাকে বেশ সংগ্রাম করতে হবে কিন্তু একবার যখন আপনি বুঝতে পারবেন, এটি বেশ উপভোগ্য মনে হবে। অন্য ধর্মের ঋষিদের মত, তাও’ মতাদর্শ যারা উদ্ভাবন করেছিলেন, তারা কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিলেন, আর তারা সেটি কোথায় খুঁজে পেয়েছিলেন সেই বিষয়টি তাদের স্বতন্ত্র করেছিল। হিন্দু ঋষিরা দেখেছিলেন, পৃথিবী আর সেখানে আমাদের জীবন হচ্ছে একটি বিভ্রম বা মায়া, আর মুক্তি পেতে সেই মায়াটিকে আমাদের মন থেকে দূর করতে হবে। ইহুদি নবীরা দেখেছিলেন, ঈশ্বর এই পৃথিবীর সবকিছুরই ইতি টানবেন একদিন, এবং এর বাসিন্দাদের পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব থাকাকালীন কৃতকর্মের জন্যে বিচার করবেন। কারণ এই দুটি ধর্মের জন্যে পৃথিবী এবং সেখানে মানুষের অবস্থানটি ছিল একটি সমস্যা, আর সেই সমস্যাটিকে সমাধান করতে হবে। এবং তারা এই পৃথিবীর বাইরে গিয়েছিলেন এর উত্তর খুঁজতে।

তাওবাদীরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছিলেন। আর তারা যা কিছু দেখেছিলেন সেটাই ভালোবেসেছিলেন। এই মহাবিশ্বের সংঘটন, সংহতি আর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, যেভাবে এটি একত্রে সবকিছু ধারণ করে আছে, তাদের আলোড়িত করেছিল। অবশ্যই এর মানব-অংশটি ছাড়া! কারণ শুধুমাত্র মানুষই এই মহাবিশ্বের সাথে একীভূত বা সমকালীন হয়ে নেই, কারণ আত্মসচেতন মন মানুষকে প্রাকৃতিক সব ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আর প্রকৃতির সাথে এই সংহতি এবং এর ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন কাটানোর প্রক্রিয়াটির পুনরুদ্ধার করার মধ্যেই আছে প্রকৃত শান্তি। কিন্তু বিষয়টি তারা যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন, সেটি অনুসরণ করা অনেকের জন্যেই বেশি কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল। মানুষকে মহাবিশ্বের তাও’ অনুসারে বাঁচার জন্যে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই ‘তাও কী, সেটি তারা ব্যাখ্যা করেননি। এটি আরো বেশি জটিল হয়ে উঠেছিল যখন তারা অন্যদের বলেছিলেন, তারা তাও’ শিখতে পারবেন না, যদি-না তারা ইতিমধ্যেই জানেন তাও’ আসলে কী। এবং বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে ওঠে, যখন তারা বলেছিলেন, যারা জানেন তাও’ কী, তারা সেই বিষয়ে কোনোকিছু উচ্চারণ করেন না, এবং যারা এটি নিয়ে কথা বলেন তারা তাও’ কী সেটি আসলেই জানেন না। এটি পড়ে তাও’ আসলে কী, সেটি বুঝতে আপনি সম্ভবত গভীর চিন্তায় পড়ে গেছেন। যে-কোনো যৌক্তিক মানুষের মতো আপনি কোননা বিষয়ের ব্যাখ্যা চান। বিষয়টি সম্বন্ধে আপনি একটি স্বচ্ছ ধারণা পেতে চান। আপনার মন সেটাই দাবি করে। তবে তাওবাদীরা দয়ালু হাসি হেসে এবং কোনোকিছু না বলে শুধুমাত্র আপনার বিরক্তিটাই বাড়িয়ে দেবে!

সুতরাং আপনার জীবনের সেই সময়গুলো স্মরণ করা এখানে মূল্যবান প্রমাণিত হতে পারে, যখন কোনো একটি কাজ কঠোর পরিশ্রমের সাথে করার কারণেই সেই কাজটি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু যখনই সেটি করার চেষ্টায় হাল ছেড়ে দেবেন, এটি তখনই সম্ভব হয়ে ওঠে। একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে, সুইমিংপুলের সেই মুহূর্তটি, যখন প্রথমবারের মতো আপনি সাঁতার কাটতে শুরু করেছিলেন। অথবা কোনো গ্রীষ্মের বিকালে, যখন আপনি ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন, আসলেই আপনি রাস্তা দিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ভারসাম্য হচ্ছে মুখ্য বিষয়। শুধুমাত্র তারাই, যাদের ইতোমধ্যেই এটি আছে, আসলেই জানেন এটি কী। আমরা হয়তো এটিকে বলতে পারি তাও অব সাইক্লিং’। তাওবাদ কামনা করে, যেভাবে আমরা বাঁচি আর সবকিছুর সাথে সম্পর্কিত থাকি, সেখানে যেন আমরা সেই ভারসাম্যটি খুঁজে পাই, আর এটি শুধুমাত্র অন্য মানুষের সাথেই না, পুরো মহাবিশ্বের সাথে।

আর জীবনের প্রতি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের নেপথ্যের ব্যক্তিটি ছিলেন কনফুসিয়াসের চেয়ে বয়সে খানিকটা বড় সমসাময়িক একজন, যার নাম লাওজি অথবা লাওৎ সে। কমন এরা শুরু হবার ৬০০ বছর আগের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আশেপাশে কোনো একটি সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি চীন সম্রাটদের কোনো একজনের লাইব্রেরিতে কাজ করতেন। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিটি কী, সেটি ব্যাখ্যা করতে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি ধর্ম আর দর্শনের ইতিহাসে অন্যতম সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আর শ্রদ্ধেয় বইটি লিখেছিলেন, যার নাম লাওৎ সু (বুক অব দ্য ওয়ে’)।

এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো হচ্ছে ভারসাম্য’ আর ‘সম্পূরকতা। লাওৎ সে দেখেছিলেন প্রকৃতি, সবকিছুরই এর সম্পূরক একটি বিপরীত আছে। তিনি এইসব পরস্পরের বিপরীতদের নাম দিয়েছিলেন, ইয়াং’ এবং ‘ইন’। প্রতিটি ইনের সম্পূরক ইয়াং আছে এবং প্রতি ইয়াং-এর তেমন-এর পরিপূরক ইন আছে। এই পার্থক্যটিকে স্পষ্ট করতে, তাও মতাদর্শের অনুসারীরা একটি বৃত্ত এঁকে সেটিকে সমান দুটি অংশে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন একটি বক্ররেখা এর মধ্যে দিয়ে এঁকে। একটি সাদা, অপরটি কালো। এবং প্রতিটি স্বতন্ত্র অর্ধাংশ একটি বিন্দু ধারণ করে যা এর বিপরীত, কালো বিন্দু সাদা অর্ধাংশে এবং সাদা বিন্দু কালো অর্ধাংশে। এটি অন্যদের মাঝে আমাদের নিজেদের খুঁজে পেতে উপদেশ দেয়, কালোর মধ্যে সাদা আর সাদার মধ্যে কালো, পৌরুষে রমণীয়তা আর রমণীয়তায় পৌরুষ; শত্রুর মধ্যে বন্ধু আর বন্ধুর মধ্যে শক্র, আমার ধর্ম আপনার ধর্মের মধ্যে, আপনার ধর্ম আমার ধর্মের মধ্যে; এটি কনফুসিয়াসের ধারণাগুলোর সাথে খুব একটা ভিন্ন নয়, এটি যখন আমাদেরকে অন্যদের জায়গায় কল্পনা করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু লাওৎ সে এখানে একটি আনন্দপূর্ণ নিজস্ব স্পর্শ রেখে গেছেন। তিনি চাননি যে আমরা শুধুমাত্র বৈচিত্র্য সহ্য করি, তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন এই বৈচিত্র্য উপভোগ করি। এই পৃথিবী হচ্ছে একটি বিশাল অর্কেস্ট্রা, যেখানে শত শত ভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র সম্মিলিতভাবে সুন্দর সংগীত সৃষ্টি করছে। ভারসাম্য, সময় আর ঐক্যতান, এই সবকিছুই তাও-এর চিহ্ন।

লাওৎ সে লক্ষ করেছিলেন, আরেকটি উপায়ে মানুষ তাদের ভারসাম্য হারায় সেটি হচ্ছে, যখন তারা অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন বোধ করে। নিজস্ব ছন্দে বাঁচতে না দিয়ে তারা সারাক্ষণই তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করে। আর এর সবচেয়ে চূড়ান্ত একটি উদাহরণ হচ্ছে সেই মানুষটি, যার কাছে তার নিজের উপায়টি হচ্ছে সবকিছু করার জন্যে একমাত্র শ্রেষ্ঠ উপায়; ডিশওয়াশারে বাসন। ঢোকানোর উপায় থেকে দেশ পরিচালনা অবধি। এই ধরনের মানুষগুলো সারাক্ষণই বিরক্তির মধ্যে থাকেন, কারণ বাস্তবতা সেই বিশেষ নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করে না, যে-নিয়মটি তারা এর ওপর জোর করে আরোপ করতে চান। লাওৎ সে তাদের বলেছিলেন, উদ্বিগ্ন না হয়ে শরীর আর মন শিথিল আর দুশ্চিন্তামুক্ত করতে, এবং একটি গাছের জীবন থেকে কিছু শিখতে। গাছকে কারো বলতে হয় না, কীভাবে কোন কাজ করতে হবে। এটি এর প্রকৃতিকেই অনুসরণ করে। তাহলে মানুষরা কেন সেই একই কাজ করতে পারছে না। এত উৎকণ্ঠিত হওয়া থেকে কেন তারা নিজেদের থামাতে পারছে না, আর সবকিছুকে তাদের নিজস্ব গতিতে চলতে দিচ্ছে না? লাওৎ সে জীবনের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকে বলেছিলেন ‘উ-ওয়ে’, ‘কিছু করা–কোনোকিছু না করে’, সবকিছুকে তাদের মতো থাকতে দিয়ে, সবকিছুকে তাদের নিজস্ব গতিতে ঘটতে দিয়ে। তিনি সব নিয়মকানুন অপছন্দ করতেন এবং যেভাবে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণকামী কোনো সংগঠক সবাইকে জীবন-চক্রে তাদের নিজস্ব বিন্দুতে নিয়ে আসেন, তাদের ভিন্নতাকে উদযাপন করার বদলে।

জীবনের প্রতি এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন এমন কেউ হচ্ছেন একজন অ্যানার্কিস্ট (নৈরাজ্যবাদী), আরেকটি গ্রিকশব্দ যার অর্থ, যে সরকারের বিরুদ্ধে। তাওবাদীদের জন্য এটি চূড়ান্তভাবে সরকারের বিরোধিতা নয়, এটি মূলত সরকারের ভারসাম্য আর ক্ষমতার সমন্বয় দেখতে চায়। সমাজে আইনপ্রণেতাদের প্রাধান্যবিস্তারকারী ভূমিকার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া, এবং তাদের সেই উপায়গুলোকে অপছন্দ করা, যার মাধ্যমে তারা সবাইকে একই ছাঁচে গড়ে তুলতে চান। অ্যানার্কিস্টের বিপরীত হচ্ছে ‘লিগালিস্ট’, এমন কেউ যিনি বিশ্বাস করেন, মানবপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে আইন। কোনোকিছু সমাজের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? বেশ, সেটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। সবসময় লিগালিস্টদের এটাই স্লোগান।

কনফুসিয়াসের ব্যতিক্রম, সার্বিকভাবে সমাজের মঙ্গল কামনায় যিনি মানুষের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, লাওৎ সে সমাজের মধ্যে প্রতিটি মানুষকে যতটা সম্ভব ততটাই স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন। জীবনের প্রতি দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি, আবারও ইন এবং ইয়াং, প্রত্যেকটিরই কিছু আছে এর সমর্থনে বলার জন্যে। কিন্তু যেহেতু তারা ইতিহাসের সেরা সংগঠক আর কদাচিৎ তারা বিশ্রাম নেন, লিগালিস্টরাই সাধারণত ধর্ম আর সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করেন, এবং অন্যদের ওপর তাদের ইচ্ছাগুলো চাপিয়ে দিতে থাকেন। এবং যদি তাদের প্রয়োজন হয় সেটি করার জন্যে তারা এমনকি যুদ্ধ শুরু করতেও প্রস্তুত থাকেন। লাওৎ সে ঘুদ্ধ ঘৃণা করতেন, মানব সংহতি যা ধ্বংস করে। হয়তো যদি মানুষ তার কথা শুনত, তাহলে পৃথিবীতে যুদ্ধ কম হতো আর জীবন আরো উপভোগ্য হতো।

সুস্পষ্টভাবে এর ধর্মীয় ধারণাগুলো গ্রহণ না করেও তাওবাদ থেকে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন, কিন্তু আমাদের ভুল হবে যদি আমরা এর ধর্মীয় ধারণাগুলোর অস্তিত্ব উপেক্ষা করি। ৫২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লাওৎ সে’র মৃত্যুর পরেও তাওবাদের বিকাশ অব্যাহত ছিল। আর তাও শেখানো ছাড়াও তাওবাদে বহু দেবতারা ছিলেন। এর সবচেয়ে প্রধান দেবতারা, যাদের স্বর্গীয় গণ্যমান্য বলা হয়, বিশ্বাস করা হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাদের সৃষ্টি হয়েছিল যখন পৃথিবী অস্তিত্বশীল হয়েছিল। এইসব প্রধান দেবতাদের রাজসভা বসে স্বর্গে, তাদের সাহায্য করার জন্যে আছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমর্যাদার দেবতাদের দিয়ে তৈরি গৃহস্থালী কর্মচারীরা। মহাবিশ্বের সাথে আসা দেবতারা ছাড়াও, মানুষও দেবতা বা ‘অমর’ হতে পারে। অমরত্বের এই মর্যাদা পেতে হলে প্রথমে তাদের ভেতর থেকে সব ত্রুটি বের করে দিতে হবে ধ্যান আর কামনা প্রশমনের নিয়মমাফিক অনুশীলন করে, পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া বুদ্ধের কঠোর অনুশীলনের মতো। পার্থক্যটি হচ্ছে তাওবাদীরা মহাবিশ্বে বিশ্বাস করেন, তাদের জন্যে আত্মার বিজয় মানে নির্বাণের মহাসাগরের উপর এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নয়, বরং দেবতা হিসাবে ব্যক্তিগত অমরত্ব লাভ করা। আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা তাওবাদকে অন্যসব ধর্ম থেকে পৃথক করেছে সেটি হচ্ছে এটি নারীদের অবস্থান দিয়েছে। দেবীসহ, তাওবাদের নারী যাজক এবং বিদ্বান ছিলেন, যারা এর বিবর্তনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এর প্রস্তাবিত দর্শনের প্রতি সততা প্রদর্শন করে তাওবাদ টিকে আছে ‘ইন’-এর রমণীয় এবং ইয়াং’-এর পৌরুষের মূলনীতির দ্বারা।

কনফুসিয়াসের মতাদর্শ আর তাওবাদ দুটোই চীনের স্থানীয়, কিন্তু তৃতীয় ধর্মটি, বৌদ্ধধর্ম, এটি ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল। বুনো অশ্বখগাছের নিচে বুদ্ধের বোধিলাভের সেই মুহূর্ত থেকে তার শিক্ষা প্রচারিত হতে শুরু করেছিল তর বিস্তার লাভ করেছিল ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, কোরিয়া, জাপান ও আরো অনেক দেশে। যখন এর পরিধিতে এটি বিস্তৃত হয়েছিল, একই সাথে এটি বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হতেও শুরু করেছিল বুদ্ধের বাণীর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যাগুলোর সূত্র অনুসরণ করে। থেরাভাদা বৌদ্ধবাদ-এর মূল আন্দোলনের কঠোরতার প্রতি আনুগত্য ধরে রেখেছে এখনো। এই ধারায়, মোক্ষলাভের সবচেয়ে দ্রুততম পথ হচ্ছে সন্ন্যাসী হওয়া। এটি পরিচিত হীনযান বৌদ্ধবাদ নামে। এটি আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিদের বোধিসত্ত্ব লাভের লক্ষ্যে ছোটা রেসিং গাড়ির মতো। মহায়না (মহাযান) বৌদ্ধবাদ হচ্ছে বাসের মতো, সাধারণ মানুষদের জন্যে, বোধিসত্ত্ব অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে যারা তাদের নিজস্ব গতিতে অগ্রসর হন।

আর এই দুটি ধারার মধ্যে দ্রুততাই শুধুমাত্র পার্থক্য নয়। আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছিলাম, ধর্মে একটি মহাবিভাজন হচ্ছে সেই দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে, যারা ছবি বা মূর্তি ভালোবাসেন এবং যারা সেটি ঘৃণা করেন। বুদ্ধ স্বয়ং সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু লোকপ্রিয় ধর্মগুলো ভালোবাসে কোনোকিছুর দিকে শ্রদ্ধা নিয়ে তাকাতে আর বৌদ্ধদের জন্যে স্বয়ং বুদ্ধ ছাড়া আর কী ছবি মূর্তিই বা থাকতে পারে তাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে? বুদ্ধের মূর্তিগুলো, প্রায়শই বিস্ময়করভাবেই সুন্দর, মহায়নাধারার অনুসারীদের মন্দিরে প্রধান মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। আর বৌদ্ধধর্মের এই রূপটিই ‘সিল্ক রোড’ ধরে চীনে প্রবেশ করেছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে। এটি চীনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং চীনা ধর্মগুলোকে পরিবর্তিত করেছিল। এবং সেইসাথে এগুলোর প্রভাবে এটি নিজেও পরিবর্তিত হয়েছিল।

ধর্মের প্রতি চীনারা তাদের ব্যবহারিক প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গিটি অব্যাহত রেখেছিল। ভিন্নধারাগুলোর সেরা অংশগুলোর সংমিশ্রণ নিয়ে তারা কোনো অস্বস্তি বোধ করেনি। এভাবে তারা একটি একক বিশ্বাসের প্রতি কঠোরভাবে আনুগত্য প্রকাশেও কোনো বাড়াবাড়ি করেনি। সুতরাং যখন বৌদ্ধবাদের সাথে তাওবাদের দেখা হয়েছিল, আর সেই সাক্ষাতে উভয়েই পরিবর্তিত হয়েছিল। একটি পরিণতি হচ্ছে ‘জেন বৌদ্ধবাদ, ‘জেন’ শব্দটির উৎস ধ্যান বা মেডিটেশন বোঝাতে ব্যবহৃত চীনা শব্দটি। মনে আছে, তাও বোঝা বা পাওয়া কত কঠিন একটি কাজ? ‘জেন’ এর সেই ঠাট্টাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিটি ঋণ করেছিল।

.

‘কীভাবে আমি শান্তি পেতে পারি, আর এইসব কামনাগুলোকে দমন করতে পারি? আমাকে শেখাও। আমাকে বলল, কীভাবে পবিত্র বইগুলো আমার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে এবং কীভাবে আমি এখান থেকে মুক্তি পেতে পারি?

‘বাহির…ভিতর….বাহির…ভিতর’।

‘কী’?

‘স্থির হয়ে বসুন, খুব স্থির… আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস লক্ষ করুন : শ্বাস বাহিরে ফেলুন, ভেতরে নেন, আবার শ্বাস বাহিরে ফেলুন, আবার ভিতরে নেন…’।

আমি আমার সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি আর আপনি আমাকে শ্বাস নেবার অনুশীলন শেখাচ্ছেন! আমার অন্যকিছু দরকার, যা দিয়ে আমার মনটাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব…

বেশ, ঠিক আছে, এই ডেইজি ফুলটির দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকুন, ভালো করে লক্ষ করুন…।

কী?

.

জৈন বৌদ্ধবাদে তাওবাদের কৌতুকপ্রবণতা আছে, এবং যে সংস্কৃতিগুলোতে যুক্তিবাদের প্রাধান্য খুব বেশি, তারা সেখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে।

বৌদ্ধবাদ থেকে তৃতীয় যে-ধারাটির উদ্ভব হয়েছিল সেটি গভীর একটি প্রভাব ফেলেছিল পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় একটি দেশের ওপর। তান্ত্রিক বৌদ্ধবাদ (বজ্রযান), বোধি অর্জন করার এই ধারাটি ব্যাপকভাবে একজন শিক্ষকের সহায়তা নিবেদন করে এবং এই ধরনের বৌদ্ধবাদ তার শিকড় গেড়েছিল তিব্বতে। হিমালয়ের অন্যপ্রান্তে, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তিব্বত পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম একটি এলাকা। এটিকে বলা হয় পৃথিবীর ছাদ, কারণ দেশটি মূলত সুবিশাল পর্বতমালা আর মালভূমির উপর অবস্থিত। এর এই দুর্গম্য এমন একটি বৌদ্ধবাদকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা এই পুরো দেশটিকে রূপান্তরিত করেছিল একটি বিশাল সন্ন্যাস-আশ্রমে। শিক্ষক সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে, যারা পরিচিত ‘লামা’ নামে, তিব্বত এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল, যার কেন্দ্রে ছিল বৌদ্ধবাদের আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলাগুলো।

এবং তিব্বতের লামারা বৌদ্ধবাদের একটি বিশেষ ধারার স্বতন্ত্র আর বৈশিষ্ট্যসূচক ব্যবহার করেছিলেন। যখন কোনো একজন সন্ন্যাসী বোধি অর্জন করেন, তিনি তার নির্বাণ পাবার সেই সুযোগটি বিনিময় করতে পারেন, এবং অন্যদেরকে তাদের মোক্ষলাভে সহায়তা করতে ‘জীবন্ত বুদ্ধ’ হিসাবে পৃথিবীতে আবার ফিরে আসতে পারেন। তিব্বতের বৌদ্ধধারায় কিছু উচ্চপর্যায়ের লামাদেরকে তাদের নিজেদের পুনর্জন্ম নির্বাচন করার জন্যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই মানুষটি, যাকে তারা তাদের উত্তরসূরি হিসাবে নির্বাচন করবেন, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। লামার মৃত্যুর পর তার বদলি কাউকে খুঁজে পেতে কখনো বেশ কয়েক বছর ব্যয় করতে হয়। যখন শনাক্ত করার পর, তিনি বেশ কিছুসংখ্যক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তাকে লামার পুর্নজন্ম নেওয়া রূপ হিসাবে কোনো একটি সন্ন্যাসাশ্রমে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এই উত্তরাধিকারের ধারার সবচেয়ে পরিচিত বর্তমানের দালাই লামার ঘটনাটি। যার হাসিমুখ পশ্চিমে এখন খুব পরিচিত রূপ পেয়েছে, যিনি পঞ্চাশের দশকে চীনাদের তিব্বত আগ্রাসনের পর সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি প্রথম দালাই লামার তেরোতম পুনর্জন্ম এবং হয়তোবা শেষ। এর মানে এই না যে, তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের অবসান হয়েছে। ধর্মের নানা উপায় আছে, এর নির্যাতনকারীদের চেয়েও বেশিদিন টিকে থাকার। এটি হচ্ছে কামারের নেহাই, যা বহু হাতুড়ির ক্ষয়ের কারণ হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধবাদ থেমে থাকেনি, যখন এটি চীনে প্রবেশ করেছিল। এটি আরো পূর্বদিকে এর যাত্রা অব্যাহত রেখেছে যতক্ষণ-না এটি জাপানে পৌঁছেছিল, যেখানে এটি আমাদের আলোচনার পরবর্তী ধর্মটির সাক্ষাৎ পেয়েছিল, সেই ধর্মটি হচ্ছে ‘শিন্টো’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *