১৪. পার্থিব ধর্ম

অধ্যায় ১৪. পার্থিব ধর্ম

ভারতের উত্তর সীমানা ধরে অগ্রসর হয়ে চীনের মধ্যে প্রবেশ করেছিল রেশম পথ, ‘দ্য সিল্ক রোড’ আর কমন এরা শুরু হবার প্রায় ২০৬ বছর আগে এটি তার জীবন শুরু করেছিল, যখন একজন চীনা সম্রাট তার দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি দ্রব্য রেশম ভারতীয়দের কাছে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে কিছু ব্যবসায়ীকে পশ্চিমে পাঠিয়েছিলেন। এবং একটি সময় এই সিল্ক রোড প্রায় চার হাজার মাইল দূরে ইউরোপের সীমানায় ভূমধ্যসাগরের উপকূল অবধি সম্প্রসারিত হয়েছিল। ঘোড়সওয়ারদের ক্যারাভানগুলো এই পথে যাতায়াত করত, পূর্ব থেকে পশ্চিমে নিয়ে যেত রেশম আর অন্য দ্রব্য, কাপড় আর উল নিয়ে সেগুলো পূর্বে ফিরে আসত। কিন্তু এই বিখ্যাত পথ ধরে শুধুমাত্র রেশম আর অন্যান্য পণ্যসামগ্রী বহন করেই পশ্চিমে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ধারণাও হস্তান্তর হয়েছিল, ধর্মও আমদানি হয়েছিল। বৌদ্ধবাদকে ভারত থেকে চীনে নিয়ে এসেছিলেন ব্যবসায়ীরা, যা পরে তিনটি প্রধান চীনাধর্মের একটি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

কিন্তু ধর্ম নিয়ে চীনের অধিবাসীদের নিজস্ব কিছু ভাবনাও ছিল, আর সেটি বর্ণনা করার সবচেয়ে প্রায়োগিক আর ব্যবহারিক শব্দ হচ্ছে ‘প্রাথম্যাটিক’, আরেকটি গ্রিকশব্দ যার সুস্পষ্ট একটি অর্থ আছে। এটি এসেছে সেই শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে কোনো কর্ম বা কাজ, এখান থেকে ইংরেজি ‘প্র্যাকটিকাল’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ প্রায়োগিক আচরণ, তত্ত্ব নয়, এর বিপরীত এটি অনুশীলন, সেই কাজটি করা, সঠিক বিশ্বাস করার চেয়ে এখানে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক কাজ করা।

এমনকি চীনের আদি বহুঈশ্বরবাদও ছিল ব্যবহারিক এবং বাস্তবতাপূর্ণ একটি জীবনাচরণের সূত্র। প্রকৃতির শক্তিগুলো কিংবা আবহাওয়ার খামখেয়ালিগুলো চীনে দেবতাদের প্রতিনিধিত্ব করত। এবং তাদের আচার-অনুষ্ঠানে চীনারা তাদের দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতেন, অনুকূল পরিস্থিতি দিয়ে যেন তারা আশীর্বাদ করেন, এবং যা-কিছু তাদের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো যেন তারা জীবন থেকে নির্মূল করেন। তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা, স্বর্গের দেবতাদের যিনি দেবতা, বৃষ্টি পাঠাতেন, যা শস্যক্ষেতে পানি সরবরাহ করে এবং যা তাদের জীবনধারণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। কিন্তু যখন বৃষ্টি হতো, তখন বন্যাও হয়। বন্যার জন্যে যে দেবতা দায়ী, তিনি ছিলেন ‘গং গং’। আর যেখানে মাঝে মাঝে বন্যা হয় সেখানে অনাবৃষ্টিও হয়। বা ছিলেন এই অনাবৃষ্টির দেবতা। আর মানুষের কাছে খাদ্যের চেয়ে আর কী এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা তাদের বাঁচতে সহায়তা করত? মিলেট বা জওয়ারের দেবতা ‘হু জি’, যা ক্ষেতের শস্যবহনকারী ঘাসের গুরুত্ব ইঙ্গিত করত তাদের জীবনে।

এইসব শক্তিগুলোকে একটি ভারসাম্যে ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি করাই বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহারিক একটি কাজ। ধর্ম কোনো একটি মতবাদের ওপর বিশ্বাস করার বিষয় ছিল না বরং কিছু করার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এইসব শক্তিগুলোকে ব্যবস্থাপনা করার জন্যে এটি যথেষ্ট বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একটি উপায় ছিল, যেন সেই শক্তিগুলো মানবসমাজের জন্য ভালো কিছু দিতে পারে।

প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাদের ব্যবস্থাপনা করা ছাড়াও, চীনারা একগুচ্ছ দুষ্ট আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, যাদের তারা এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতেন : ড্রাগন, দৈত্য, পরী, ভ্যাম্পায়ার, নোম, গবলিন ইত্যাদি। আর এইসব দুষ্ট আত্মাগুলোকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবার জন্যে তারা মূলত আতশবাজি আবিষ্কার করেছিলেন, আজও চীনদেশের মানুষরা চোখ-ধাঁধানো আতশবাজি পোড়ানোর প্রদর্শনী দেখতে ভালোবাসেন।

এইসব অতিপ্রাকৃত শক্তিদের মোকাবেলা করার জন্যে চীনাদের হয়তো তাদের নিজস্ব ব্যবহারিক উপায় ছিল, কিন্তু সেই বহুঈশ্বরবাদে খুব অল্পকিছুই মৌলিক ছিল। তাদের ঈশ্বরগুলো মানবজাতির গভীর ইতিহাসের সাধারণ কল্পনারই অংশ ছিল, সেই মনগুলো যাদের একসময় কল্পনা করেছিল যে, মন অদ্ভুত বিস্ময়ে এই মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়েছিল, যেখানে তারা নিজেদের আবিষ্কার করেছিল। কমন এরা শুরু হবার পরে, পঞ্চম আর ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসে আমরা জীবনের প্রতি চীনাদের এই ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে একটি নতুন স্পষ্টতা আর দিকনির্দেশনা অর্জন করতে দেখি। যে-সময়ে বৌদ্ধ আর জৈনরা ভারতীয় ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করছিলেন এবং ব্যাবিলনে ইহুদি নির্বাসিতরা তাদের ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন, তখন চীনের চিন্তাবিদদের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মেজাজ লক্ষ করতে পারি। বর্তমানের এই পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে চীনের প্রাজ্ঞ এই ঋষিরা তাদের সৃজনশীল মন ব্যবহার করেছিলেন। যে জীবনটি আসছে সেই মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে তারা ভাবেননি। এইসব চিন্তাবিদদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটিকে আমরা এখন কনফুসিয়াস নামে চিনি।

কনফুসিয়াস নামটি হচ্ছে কং ফুজি বা মাস্টার বা দার্শনিক কং নামটির নতুন একটি সংস্করণ। এই কং ফুজি নামটি দেওয়া হয়েছিলে কং কিউ নামের একজন চিন্তাশীল কর্মকর্তাকে, যিনি সেই সময়ে চীনকে বহুবিভক্ত করা রাজ্যগুলোর কোনো একটি রাজ্যে সরকারি চাকরি করতেন। তার জীবন সম্বন্ধে খুব সামান্য কিছু আমাদের জানা আছে। কিন্তু তার লেখায় আমরা একজন প্রাজ্ঞ আর উদারমনা ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাই, মৃত্যুর বহুদিন পরেও যিনি তার সর্বোচ্চ প্রভাব বজায় রেখেছেন। তার জন্ম হয়েছিল চীনের খুব বিশৃঙ্খল একটি সময়ে, কমন এরা শুরু হবার ৫৫১ বছর আগে। যখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোর রাজারা পরস্পরের সাথে বিরতিহীন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ আর রাজনীতিবিদরা যেমন এই সময়ে মানবতাকে সমস্যায় রাখা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সংগ্রাম করেন, তাদের সময়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরাও চীনের সমস্যা থেকে উত্তরণে বেশকিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। আর যে-সমাধানগুলো তারা প্রস্তাব করেছিলেন সেগুলো আমাদের সময়ের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমরা যা শুনি তার থেকে খুব-একটা ভিন্ন। কিছু নয়। সহিংসতার জবার দাও সহিংসতা দিয়ে, আগুনের উত্তর আগুন। শত্রুরা আমাদের যতটা তীব্রভাবে আঘাত করে, তার চেয়ে আরো তীব্রভাবে তাদের প্রতি আক্রমণ করো। আরো বড় বন্দুক আর প্রাণঘাতী বোমা বানাও। এবং কঠোর সাহসী নেতাদের খুঁজে বের করো, যারা খারাপ লোকগুলোকে শায়েস্তা করতে পারেন। পুরো ইতিহাস জুড়েই, রাজনৈতিক কৌশলগুলো সাধারণত পড়তে সাম্প্রতিক সময়ের হলিউড ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতোই মনে হবে।

কনফুসিয়াসের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তিনি যুদ্ধবাজ রাজাদের বলেছিলেন, শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর সেটি অর্জন করতে হলে তাদের সেই ধরনের মন্ত্রীদের নির্বাচন করতে হবে, যারা নৈতিকতায় শিক্ষিত এবং সহিংসতা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই দ্বন্দ্ব নিরসনে দক্ষ। নেতারা তার কথা শুনেছিলেন এবং কনফুসিয়াসের প্রজ্ঞাকে সম্মান করেছিলেন, তার ভাবনাগুলোকে নীরবে সমর্থন করে। কিন্তু কেউই তার ধারণাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কনফুসিয়াসের যেমন প্রজ্ঞা ছিল, তেমনি ছিল ধৈর্য। তিনি তার বাকি জীবনটি তার অনুসারীদের কাছে ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করে ব্যয় করেছিলেন, এবং তিনি আশা করেছিলেন, একজন প্রকৃতভাবে শিক্ষিত শাসক এই সবকিছুই একদিন ব্যবহারিক স্তরে প্রয়োগ করবেন। তিনি ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান। কিন্তু তার অনুসারীরা তার শিক্ষাকে বই হিসাবে সংকলিত করেছিলেন, সুতরাং তার ধারণাগুলো টিকে ছিল। আর সেই ধারণাগুলোর সময়ও একদিন এসেছিল। কমন এরা শুরু হবার ১০০ আগে একজন সম্রাটের আবির্ভাব হয়েছিল, যিনি এই ধারণাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করেছিলেন, এবং সেগুলোই চীনের প্রধান দর্শন ছিল, ১৯১২ সালে সাম্রাজ্যপ্রথার চূড়ান্ত বিলুপ্ত হবার আগ অবধি। এমনকি বর্তমানের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কনফুসিয়াসের মূলনীতিগুলোর শক্তিশালী একটি অবস্থান আছে।

কনফুসিয়াসের মূল ধারণাটি ছিল কর্কশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে অথবা একক স্বার্থপর মানুষগুলোর বিরুদ্ধে, যারা সমাজ ও এর বিধিনিষেধগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কনফুসিয়াস শিখিয়েছিলেন, জন্মের মুহূর্ত থেকেই আমরা বহু সম্পর্কের জালে আটকে থাকি, আর আমরা এই সম্পর্কগুলো ছাড়া বেঁচে থাকতে অক্ষম। সমাজের জন্যে যা ভালো সেটি একক ব্যক্তির জন্যে ভালো। এমনকি কখনো এর অর্থ হচ্ছে, কোনো একক ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে অস্বীকার করা। জীবন সম্বন্ধসূচক, সমাজ হচ্ছে একটি শরীর, আমরা প্রত্যেকেই এর সদস্য-অঙ্গ। একক কোনো অঙ্গ টিকে থাকতে পারে না, যদি শরীর থেকে সেটি পৃথক হয়ে যায়।

এবং সহমর্মিতা হচ্ছে সেই আঠা, যা সবাইকে একসাথে যুক্ত করে রাখে। এই সহমর্মিতা মানে হচ্ছে ‘একত্রে দুঃখভোগ করা’। সহমর্মীরা অন্যদের অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন, তাদের নিজেদের অনুভূতি অনুসরণ এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করে। কনফুসিয়াসের কাছ থেকেই। আমরা সেই অভিব্যক্তিটি, যা পরিচিত ‘গোল্ডেন রুল’ নামে, তার প্রাচীনতম প্রকাশটি পেয়েছিলাম। এটি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দুটি রূপেই আসতে পারে : অন্যদের সাথে ঠিক সেভাবেই আচরণ করুন, আপনি যেমন চান অন্যরা আপনার সাথে করুক; অথবা অন্যদের সাথে এমন কিছু করবেন না যা আপনি চাইবেন না কেউ আপনার সাথে করুক।

অন্যদের প্রতি সহমর্মিতা আর সহানুভূতির সেই প্রাণশক্তির ধারণাটি বোঝাতে কনফুসিয়াস যে-শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেটি ছিল ‘রেন। চীনাদের প্রয়োগবাদী মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তত্ত্ব হিসাবে রেনকে বোঝার চেষ্টা না করে বরং এটি কর্মে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আপনি যদি অন্য কারো জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন দেন, আপনি তাহলে ‘রেন অনুশীলন করছেন। আপনি কোনো ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট কিনতে দোকানে যাচ্ছেন, যা কেনার জন্যে আপনি বহু মাস ধরে সঞ্চয় করেছেন, এবং আপনি সেটি না-কিনে একজন শরণার্থী ব্যক্তিকে তা দান করে দিলেন, তখন আপনি ‘রেন’ অনুশীলন করছেন। ‘রেন’ হচ্ছে সবচেয়ে মহৎ আচরণ, যা কিনা কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হতে পারে। এটি হচ্ছে নিজের আগে অন্যকে গুরুত্ব দেওয়া। এবং এই ‘রেন’ প্রাণশক্তিটি কনফুসিয়াস রাজনীতিবিদ আর নেতাদের মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তারা যেন নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয় বরং জনগণের কল্যাণ কীভাবে হবে সেই বিষয়ের ওপর সর্বাগ্রে মনোযোগ দেন। এবং তিনি আশা করেছিলেন যে, সাধারণ নাগরিকরা সেই একই উদারতার প্রাণশক্তির উদাহরণ অনুসরণ করবেন, যখন তারা কোনো নেতাকে বিচার করবেন, যিনি খুব কঠিন সময়ে রাজ্য শাসন করার জন্যে সংগ্রাম করছেন।

পারস্পরিক ভিন্নমত বা বিতর্ক আর সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনায় কনফুসিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গি শেখায় প্রতিপক্ষকে কীভাবে ধৈর্য আর সহমর্মিতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। একারণে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, এটি একটি সুনির্দিষ্ট শৈলীর শিষ্টাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট। শিষ্টাচার আর ধৈর্য হচ্ছে এমন মনের পরিচয়, যা মানব সম্পর্কগুলোর জটিলতা এবং সেটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সতর্কতা বিষয়ে সচেতন। পাশ্চাত্যের ব্যস্ত মন অপেক্ষা আজও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শিষ্টাচার অনেক বেশি উপস্থিত ধৈর্যশীল কোনো প্রাচ্য মনে।

কিন্তু কনফুসিয়াসের এই শিক্ষাগুলোকে কি একটি ধর্মের চেয়ে বরং একটি দর্শন হিসাবেই বোঝার জন্যে উত্তম ছিল না? এই দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য সংজ্ঞায়িত করলে, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধা হবে। ‘ফিলোসফি’, আরো একটি গ্রিক-শব্দ, এর মানে হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, এর সব সম্ভাব্য রূপে। এবং যে-রূপটি নৈতিক দর্শন হিসাবে জানি, সেটি এই পৃথিবীতে বাস করার সেরা আর প্রাজ্ঞতম উপায় কী হতে পারে সেটি অধ্যয়ন করে। অন্যদিকে ধর্ম মূলত আগ্রহী এই পৃথিবীর ওপারে যে-জগৎ আছে সেই বিষয়ে, এবং আমাদের জন্যে এটি কেমন হবে, যখন আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু এই প্রশ্নগুলো কনফুসিয়াসের মতাদর্শের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটির মূলত ঘনীভূত মানবসমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করে, কীভাবে আমরা এই পৃথিবীতে আমাদের জীবন ব্যবস্থাপনা করতে পারি, অনাগত জীবনের জন্যে পুণ্য সঞ্চয়। কিংবা শাস্তি এড়াতে, পাপ এড়িয়ে বাঁচার উপরে নয়। জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে হবে শুধুমাত্র এই জীবনের খাতিরেই, মরার পরে আমাদের সাথে কী হতে পারে তার একটি ভূমিকা হিসাবে নয়।

তবে কনফুসিয়াসের মতাদর্শটির একটি দিক আছে, যা এটিকে ধর্মীয় জগতের বলয়ে নিয়ে এসেছিল : মৃত্যুর প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি এটির গভীর শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের আচার। কিন্তু এই দিকটিকেও সেই দর্শনের সম্প্রসারিত একটি রূপ হিসাবে বোঝা সম্ভব হতে পারে, যে-দর্শনটি সমাজের পরস্পর সংযুক্ত সদস্য হিসাবে মানুষকে বিবেচনা করে। এমনি মৃত্যুও আমাদের সেই সম্পর্ককে ছিন্ন করতে পারে না। সেকারণে কনফুসীয় সমাজে মৃতদের জন্যে বেশ তীব্রভাবেই শোক অনুভব করা হয় এবং তাদের স্মৃতি নিরন্তরভাবে লালন করা হয়। একটি মৃত্যুর পর শোকপর্বটি এর স্থায়িত্বে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মৃতের সন্তানের জন্যে এটি দুই বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে, যে-সময়ে তারা কোনো কাজ করেন না, যৌনমিলন করেন না, সাধারণতম খাওয়া ছাড়া আর কোনোকিছু খাওয়া, ভালো কোনো কাপড় পরেন না বা সাধারণভাবে জীবনকে উপভোগ করেন না।

কিন্তু কনফুসিয়াস মনে করতেন, পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা আর তাদের। মৃত্যুপরবর্তী শোক প্রকাশ করা ছাড়াও আরো অনেক কিছু করার আছে। মৃতের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। ঠিক তেমন আমরা তাদের সাথে কোনো সংযোগও হারায়নি। তারা হয়তো জীবনের এই দৃশ্য ত্যাগ করেছেন এবং জীবনের অন্যপ্রান্তে কোথাও চলে গেছেন কিন্তু আমাদের জীবনে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি তারা ধরে রাখেন। চোখের আড়ালে তারা আছেন, এর মানে এই না যে, তারা আমাদের মনের আড়ালেও আছেন। আর সে-কারণে একটি জনপ্রিয় কনফুসীয় বসন্তকালীন ছুটি হচ্ছে ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড ব্রাইট ফেস্টিভাল’, যখন পরিবারের জীবিত সদস্যরা তাদের পূর্বসূরিদের সমাধিতে যান তাদের সাথে সংযোগ করতে, পরস্পরের সান্নিধ্য আবার উপভোগ করতে। শিষ্টাচার আর সবার জন্যে শ্রদ্ধা, এমনকি যদি তারা মৃতও হয়ে থাকেন, ছিল কনফুসিয়াসের মতাদর্শটির একটি স্বাতন্ত্র বিধায়ক বৈশিষ্ট্য (কিংমিঙ্গ অথবা চিং মিং ফেস্টিভাল, এছাড়াও এটি পরিচিত ইংরেজিতে টম্ব-সুইপিং ডে বা কবর পরিষ্কার করার দিন, কখনো চাইনিজ মেমোরিয়াল ডে অথবা অ্যানসেস্টর ডে)।

কিন্তু চীনে কখনো এই মতাদর্শটি শুধুমাত্র এককভাবে এর পূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারেনি। এটি জীবনের প্রতি পারস্পরিক প্রতিস্থাপনযোগ্য তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির একটি ছিল। অপর দুটি ছিল, তাওইজম এবং বুদ্ধধর্ম। পরের অধ্যায়ে আমরা তাওবাদ নিয়ে আলোচনা করব এবং বৌদ্ধধর্মের দিকে আবার একবার আমরা নজর দেব জানতে, কী হয়েছিল এই ধর্মটির সাথে, যখন প্রথম শতাব্দীতে এটি অবশেষে চীনে পৌঁছেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *