১৩. শেষ যুদ্ধ

অধ্যায় ১৩. শেষ যুদ্ধ

ভারতের পশ্চিম উপকূলে মুম্বাই শহরের দক্ষিণে মালাবার পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে চোখে রাখলে, অগণিত গাছের সারির উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো হাস্যময় পাথরের একটি স্তম্ভ নজরে পড়তে পারে পর্যটকদের। সেই পাহাড়ে উঠে স্তম্ভটির নিকটে যাওয়া তাদের নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ, কিন্তু যদি তারা কোনো ড্রোন ব্যবহার করে ছবি তুলতে পারেন, তাহলে দেখবেন এই স্তম্ভটির একটি সমতল ছাদ আছে, যার প্রান্তসীমা ঘিরে রেখেছে অল্প উচ্চতার একটি প্রাচীর। এবং ছাদটি বিভক্ত করা হয়েছে তিনটি এককেন্দ্রিক বৃত্তে। ক্যামেরা হয়তো শবদেহ-খাদক কোনো পাখিকে সেখানে ব্যস্ত থাকতে দেখতে পারে, যারা সেখানে প্রথম বৃত্তে পুরুষ, দ্বিতীয় বৃত্তে নারী এবং তৃতীয় বৃত্তে সাজিয়ে রাখা ছোট মৃতদেহগুলো সব গোগ্রাসে গিলছে।

ড্রোন এখানে যা উন্মোচন করছে, সেটি কিন্তু মৃতদের প্রতি প্রদর্শিত নিস্পৃহ নির্বিকার কোনো আচরণ নয়, বরং এটি হচ্ছে গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ একটি ধর্মীয় আচরণ, পার্সিদের প্রাচীন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আচার, যারা বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। পার্সিরা বিশ্বাস করেন, মৃতদেহ হচ্ছে অপবিত্র, সুতরাং যদি তারা সেটি কবর দেয়, তাহলে সেই শরীরটি পৃথিবীকেও দূষিত করবে, যা এটিকে গ্রহণ করবে, এবং যদি তারা সেটি দাহ করেন, তাহলে সেটি সেই আগুনকে দূষিত করবে, যা এটি দাহন করবে। এছাড়াও তারা মৃতদেহ খেয়ে বেঁচে থাকা প্রাণীদের প্রতি সদয় আচরণ করার ওপর বিশ্বাস রাখেন, যারা কিনা মৃতদেহ খেয়ে পৃথিবীকে পরিষ্কার রাখে; সে-কারণে তারা এইসব টাওয়ার অব সাইলেন্স’ (ডাখমা) নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে তারা তাদের মৃতদেহগুলোকে তীব্র সূর্যের আলোয় কাক আর শকুনের ঠোঁটের কাছে নিবেদন করেন। একবার এই স্তম্ভের উপর মৃতদেহ রাখলে সেগুলো মাংসহীন হাড়ের স্তূপে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না, এরপর শুষ্কতা আর সূর্যের আলোয় এই কংকালগুলো বর্ণহীন আর ক্রমশ ভাঙতে শুরু করে, যতক্ষণ-না সেগুলো স্তম্ভের কেন্দ্রে একটি হাড়ের কক্ষে জমা হয়, যেখানে তারা ধীরে ধীরে ধুলায় পরিণত হয়, মাটি দ্বারা পরিস্রাবিত হয়ে সমুদ্রে ভেসে চলে যায়। সুতরাং মৃত্যুর সময় হারানো দেহটি জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সেই প্রাণীদের জন্যে খাদ্যে পরিণত হয়। সবকিছুই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। কিছুই অপচয় হয় না।

যদিও বহু শতাব্দী ধরেই পার্সিরা, যারা এইসব টাওয়ার অব সাইলেন্স’ নির্মাণ করেছিলেন, ভারতে বসবাস করছেন, কিন্তু তারা মূলত এসেছিলেন পারস্য থেকে, বিষয়টি তাদের নামই ইঙ্গিত করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি ভূখণ্ড, ইরান, এই ইরানকে গ্রিকরা যে নাম দিয়েছিল সেটি হচ্ছে পারসিয়া (বা পারস্য)। পার্সিরা যে ধর্মের অনুসরণ করেন তার নাম জোরায়াস্টিয়ানিজম বা জরথুস্ত্রবাদ, যার উদ্ভব হয়েছিল ইরানে, ইজরায়েলাইটদের ব্যাবিলন নির্বাসনের সমসাময়িক কোনো একটি সময়ে, কমন এরা শুরু হবার ছয় শতাব্দী আগে (খ্রিস্টপূর্ব)। ভারতের পার্সিরা ছাড়া আজ পৃথিবীতে জরথুস্ত্রবাদের খুব বেশি অনুসারী নেই, কিন্তু তাদের ধর্মটি ইহুদিদের ধর্মটি সহ অন্য ধর্মবিশ্বাসগুলোর ওপর গভীর একটি প্রভাব ফেলেছিল। এবং যেহেতু ইহুদিবাদই খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের জন্ম দিয়েছিল, পৃথিবীতে বর্তমানে যা এখন সবচয়ে জনবহুল ধর্ম, সে-কারণে আমরা জরথুস্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠাতা জরথুস্ত্রকে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করতে পারি। যদিও তারিখগুলো সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে যখন তারিখগুলো এমন একটি সময়ের, যখন খুব সামান্য তথ্যই লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো, কিন্তু মনে করা হয় খুব সম্ভবত ৬২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জরথুস্ত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এবং একজন প্রতিদ্বন্দ্বী পুরোহিত তাকে ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হত্যা করেছিলেন।

জরথুস্ত্র যে তার মতোই একজন পুরোহিতের হাতে খুন হয়েছিলেন এই তথ্যটি ধর্মের অন্যতম শক্তিশালী একটি বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় : এর সহিংস মতানৈক্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা। এর কারণ ধর্মের চূড়ান্ত উৎসটি এমন একটি জায়গায়, যা আমরা জরিপ করতে পারি না, বিতর্ক নিরসনে ঠিক যেভাবে কোনো দূরবর্তী দ্বীপ হয়তো আমরা জরিপ করতে পারি। ধর্মের উৎস পৃথিবীর বাইরে এবং এমন একটি বাস্তবতায় যা এই পৃথিবীর বাস্তবতা নয়। এর গোপন তথ্যগুলো আমাদের কাছে প্রকাশ করেন নবীরা, যারা দাবি করেন এর রহস্যময়তায় তারা প্রবেশ করতে পেরেছেন। সেই কণ্ঠস্বরগুলো যা তাদের বলেছে সেটি তারা ঘোষণা করেন এবং একটি নতুন ধর্মের জন্ম হয়। আর প্রতিটি নতুন ধর্মকে যেহেতু পুরনো ধর্মের ওপর একটি প্রতি-আক্রমণ হিসাবে দেখা হয়, তাই বিস্ময়কর নয়, পুরনো ধর্মের পুরোহিতরা সবসময়ই দলবেঁধে নতুন ধর্মের নবীদের উপর আক্রমণ করেছে। আর সে-কারণেই ধর্মীয় ইতিহাসে সেরা চরিত্রগুলো বলেছেন, নবীদের সবসময়ই কষ্টভোগ করতে হয়, এবং তাদের সেই স্বর্গীয় অন্তর্দৃষ্টি পাবার দণ্ড দিতে হয় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। জরথুস্ত্র পুরনো ধর্মের একজন পুরোহিত ছিলেন, যিনি নতুন ধর্মের নবী হয়েছিলেন, সুতরাং তিনি-যে সমস্যায় পড়বেন সেটি নিশ্চিত ছিল।

বোঝার জন্যে সবচেয়ে সহজ ধর্মীয় বিতর্কটি বহুঈশ্বরবাদ আর একেশ্বরবাদের মধ্যে, যারা বিশ্বাস করেন মহাবিশ্ব বহু দেবতায় পূর্ণ আর যারা বিশ্বাস করেন শুধুমাত্র একজনই ঈশ্বর আছেন, তাদের মধ্যে বিতর্ক। আব্রাহাম ছিলেন প্রথম একেশ্বরবাদী। এবং জরথুস্ত্র অবশ্যই তার পাশে দাঁড়াবার অধিকার রাখেন। কিন্তু যা কিছু তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন আর শুনেছিলেন, সেটি আব্রাহামের কাছে যা উন্মোচিত হয়েছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিল। এর কারণ, বহু ধর্মীয় স্বপ্নদ্রষ্টার মতো জরথুস্ত্র একটি বিশেষ সমস্যা নিয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলেন।

একেশ্বরবাদ হয়তো বহু লক্ষ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতাদের বিশৃঙ্খলাটি পরিষ্কার করেছিল, কিন্তু এটি এর নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়েও এসেছিল। যেমন, আমরা দেখছি, ইজরায়েলের সমস্যাটি ছিল তাদের নিরন্তর দুর্দশা এবং কষ্ট, পুরো ইতিহাস জুড়েই যার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের জাতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়া বিষয়টি কেন তাদের বিরতিহীন দুঃখের কারণ হয়েছিল? তবে জরথুস্ত্রের জন্যে সমস্যাটি ছিল আরো গভীর আর বিশ্বজনীন। যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ভালো মানুষের সাথে কেন এই খারাপ জিনিসগুলো ঘটে। জরথুস্ত্র আরো গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, এবং খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ভালো আর খারাপ এই পৃথিবীতে প্রথমে প্রবেশ করেছিল। মানুষের জন্যে জীবনটা বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধটি শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথেই না, স্বজাতির বিরুদ্ধেও তাদের যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়, যাদের অনেকেই খুবই নিষ্ঠুর আর অন্যদের ওপর তাদের আরোপিত দুঃখগুলোর প্রতি যারা উদাসীন। আর এই অশুভ জিনিসটি আসছে কোথা থেকে? আর যারা এটি সহ্য করছেন, তারা কি কোনোদিনও এর জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন, আর যারা এই কাজগুলোর জন্যে দায়ী তারা কি কখনো শাস্তি পাবেন?

এই প্রশ্নগুলোই জরথুস্ত্রকে পারস্যের প্রাচীন বহুঈশ্বরবাদী ধর্মের পুরোহিত হিসাবে তার শান্তিপূর্ণ জীবন থেকে টেনে বের করে এনেছিল। অতীতের বহু আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানকারীর মতো, অশুভের প্রকৃতি নিয়ে ধ্যান করে বেশকিছু বছর কাটাতে এটি তাকে প্ররোচিত করেছিল। তারপর একটি সমাধান তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। ধারাবাহিক কিছু স্বর্গীয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে সত্যটি তার কাছে উন্মোচিত হয়েছিল: ভালো আর খারাপের এই যুদ্ধটি মানব-ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন। এটির সূচনা হয়েছে একেবারে ঈশ্বরের হৃদয়ে। আসলেই একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আছেন, যাকে তিনি ডেকেছিলেন ‘আহুরা মাজদা’ (জ্ঞানী প্রভু বা সর্বজ্ঞানস্বামী) নামে, কিন্তু সেই একজন ঈশ্বরের জীবনেও তিনি জটিলতা আবিষ্কার করেছিলেন। একেবারে শুরুতে আহুরা মাজদা দুটি ভিন্ন যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, এবং তিনি তাদের দুজনকেই তাদের নিজস্ব পথ বেছে নেবার অনুমতি দিয়েছিলেন। একজন ভালোত্বকে আর অন্যজন এর বিপরীত অশুভকে নির্বাচিত করেছিলেন। একজন সত্যকে, আর অন্যজন মিথ্যাকে বেছে নিয়েছিলেন। সুতরাং এই পৃথিবী, এখানে বাস করা প্রতিটি সত্তার অন্তর, ভালো আর খারাপের মধ্যে সেই সংগ্রামের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, যেখানে আহুরা মাজদার পুত্ররা পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, এবং তারা দুজনেই আমাদেরকে স্বপক্ষে টেনে এনে জয়ী হতে চেষ্টা করে। এবং আহুরা মাজদার পুত্রদের মতো আমাদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কাকে সমর্থন করব।

ভালো আর খারাপের এই দ্বন্দ্বটি ঈশ্বরের জীবনের কেন্দ্রে নিয়ে যাবার মাধ্যমে জরথুস্ত্র আসলেই যে-সমস্যাটির উত্তর খুঁজতে এতদিন সংগ্রাম করেছিলেন, সেটি সমাধান করতে পারেননি। পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যার জন্যে দরকার ছিল আহুরা মাজদার একটি বক্তব্য, যেখানে তিনি বলবেন, কী কারণে তিনি আদৌ অশুভ জিনিসটির সৃষ্টি করেছিলেন এবং তার সন্তানদের এর শিকার হবার সুযোগ করে দিয়ে এর দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জরথুস্ত্র যা করেছিলেন সেটি হচ্ছে, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি সেই পরিস্থিতিটির নাটকীয় একটি মাত্রা দিয়েছিলেন, যে-পরিস্থিতিতে আমরা প্রায়শই আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করি। প্রতিভাবান ঔপন্যাসিকের মতে, তিনি মানুষের জীবনকে বর্ণনা করেছিলেন ধারাবাহিকভাবে ঘটমান যুদ্ধের একটি সমষ্টি হিসাবে। এবং আমাদের নৈতিক সংগ্রামটি এখানে যুদ্ধের মাত্রা পেয়েছিল। আমরা আমাদের আসক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, আমরা প্রলোভনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি। এই ব্যাখ্যায় এমনকি আসলেই একটি অশুভ শক্তির ধারণাও সেখানে অর্থবহ হয়ে ওঠে। অনেক ধারণা আছে যা মানুষের মনকে ভাইরাসের মতো সংক্রমণ করতে পারে, এবং ভয়ানক সব কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে যা অনুপ্রাণিত করতে পারে। বর্ণবাদ যেমন সবচেয়ে সুস্পষ্ট একটি উদহারণ, কিন্তু আরো অনেক উদাহরণই আছে।

কিন্তু জরথুস্ত্র একজন নাট্যকারের চেয়ে অনেক বেশিকিছু ছিলেন, যিনি মানব অভিজ্ঞতার সামনে একটি আয়না তুলে ধরেছিলেন। ডানিয়েলের মতো তিনিও একজন ‘অ্যাপোক্যালিপটিক’ বা মহাপ্রলয়ের আগাম বার্তাবাহক ছিলেন, যিনি ইতিহাসের সীমানা ছাড়িয়ে সেই সময়টি দেখেছিলেন, যখন ঈশ্বর এই পৃথিবীর কাহিনিটির উপসংহার টানবেন। ভালো বইগুলোর একটি চূড়ান্ত অধ্যায় থাকা দরকার, যেখানে অমীমাংসিত বিষয়গুলো বোধগম্য করে তোলা হয় এবং একটি সন্তোষজনক পরিণতি অর্জন করা সম্ভব হয়। এই তাগাদা সব ধর্মেই প্রবল, যেগুলো ইতিহাসকে একটি চক্র নয় বরং ধনুক থেকে ছুটে চলা একটি তীর হিসাবে দেখেছে : একটি কাহিনি যার একটি শুরু আছে, একটি মধ্যমপর্ব আর একটি শেষ আছে, কোনো চাকা নয়, যা চিরন্তন আবর্তনশীল।

জরথুস্ত্র বিশ্বাস করতেন, ভালো আর খারাপ চিরকালই চূড়ান্ত একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়া থেকে এড়িয়ে থাকতে পারবে না। একটি শেষ বোঝাপড়া হবেই। আহুরা মাজদার এই ভালো আর খারাপ সৃষ্টি পরিকল্পিত হয়েছে নিজেদের নিয়তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা আর সময় দেবার জন্যে, যেন আমরা সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারি। আর আমরা কী নির্বাচন করি সেটির প্রতি তিনি উদাসীন নন। যারা অশুভ আর খারাপ কোনোকিছুকে নির্বাচন করেন, সেই মানুষগুলোর ট্র্যাজেডি হচ্ছে তারা তাদের কাজের পরিণতি কী হতে পারে সেই বিষয়ে খুব বেশি দূরদৃষ্টির পরিচয় দেন না। প্রতিটি নির্বাচন আর সিদ্ধান্ত তাদের চরিত্রটি গড়তে সহায়তা করে এবং পরিশেষে নিজেদের তারা যে-ধরনের মানুষে পরিণত করেছেন তার ভিত্তিতেই তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। মৃত্যুর পর প্রতি আত্মাকে ‘চিনভাত’ সেতু (বা হিসাব-নিকাশের সেতু) পার হতে হবে সেই নিয়তিতে প্রবেশ করার জন্যে, যা এটি এর নিজের জন্যে তৈরি করেছে। এই সেতুটি ক্ষুরের ধারালো প্রান্তের মতো সংকীর্ণ। এর অপরপ্রান্তে আছে স্বর্গ, কিন্তু এর নিচে আছে নরক। যা ঘটে তা হচ্ছে, হয় আত্মা নিজেকে অশুভ বিষয় দিয়ে এতটাই ভারী করে ফেলবে যে, এর ওজন এটিকে নরকের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, অথবা এতটাই হালকা থাকে শুভশক্তিতে, যা এটি খুব অনায়াসেই সেই সেতু পেরিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করে।

এমনকি এটাও জরথুস্ত্রের সেই শেষ-সংক্রান্ত অন্তদৃষ্টিতে সবচেয়ে নাটকীয় উপাদান ছিল না। অশুভ কোনোকিছুর অস্তিত্বের সমস্যাটিকে সমাধান করতে হবে, সেই অশুভ শক্তি, যা সেতু-অতিক্রমরত কোনো আত্মাকে নরকে টেনে নিয়ে যায়। জরথুস্ত্রের সমাধান এসেছিল সেখানে, যাকে তিনি বলেছেন সৃষ্টির শেষ পর্যায়। যখন আহুরা মাজদা অবশেষে দুষ্ট যমজটিকে ধ্বংস করবেন, অশুভের যে মূল উৎস। পৃথিবী পুর্নবায়িত হবে এবং কল্যাণময়তা আর ন্যায়বিচার অবশেষে রাজত্ব করবে। এবং একজন ত্রাণকর্তা, একজন ‘সাওশয়ন্ত’ অথবা যিনি তাদের জন্যে উপকার নিয়ে আসবেন, আবির্ভূত হবেন। তার মাধ্যমে অশুভ পরিশেষে পরাজিত হবে এবং এর পরেই পৃথিবীর পুনর্নবায়ন ঘটবে।

জীবন্ত এবং ভীতিকর হওয়া ছাড়াও জরথুস্ত্রের শিক্ষা খুবই প্রভাবশালী ছিল। এবং পৃথিবীর ধর্মগুলোয় এটি বেশকিছু নতুন ধারণা যুক্ত করেছিল। এখানেই আমরা একক ব্যক্তির পুনর্জন্মের ধারণা পাই, যা হতে পারে স্বর্গের পরমানন্দে অথবা নরকের অনন্ত নির্যাতনে। এবং এখানেই আমরা প্রথম খুঁজে পাই সেই শেষ মহাযুদ্ধের ধারণাটিকে, সময়ের শেষে যে-যুদ্ধে অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে ন্যায়বিচার আর নৈতিকতার একটি পৃথিবী পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ঈশ্বর একজন ত্রাণকর্তাকে পাঠাবেন। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি কীভাবে ডানিয়েল এইসব একই ধরনের কিছু ধারণা দুর্দশায় আক্রান্ত ইসরায়েলকে সান্ত্বনা দেবার প্রচেষ্টায় ব্যবহার করেছিলেন। যে-ধারণাগুলো হয়তো ইহুদিরা আত্তীকৃত করেছিলেন পারস্যে তাদের নির্বাসনের সময়। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মগুলো পরস্পর থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল না এবং যথেষ্ট পরিমাণ পারস্পরিক নিষিক্তকরণ সেখানে ঘটেছিল।

জরথুস্ত্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন কিন্তু একই সাথে তিনি সমর্থন এবং সফলতাও অর্জন করেছিলেন। তার শিক্ষাগুলো একত্র করে একটি পবিত্র ধর্মশাস্ত্র সংকলিত করা হয়েছিল, সেটির নাম ‘আবেস্তা’। এবং সেই প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ভিন্নমতটি মূলধারার বিশ্বাসে রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল। জরথুস্ত্রের অনুসারীরা সবসময়ই যে- কোনো ধরনের ছবি অবিশ্বাস করে এসেছেন, কিন্তু তাদের প্রভু সর্বজ্ঞানস্বামী বা আহুরা মাজদার জন্যে তাদের নিজস্ব প্রতীক আছে–আগুন। তাদের মন্দিরে তারা এই পবিত্র আগুন সবসময় জ্বালিয়ে রাখেন, আর সে-কারণে ভ্রান্তভাবে তাদের অগ্নি-উপাসক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আগুন অবশ্যই তাদের কাছে পবিত্র, কিন্তু শুধুমাত্র সর্বজ্ঞানস্বামী মাজদার একটি প্রতীক হিসাবে।

যখন তারা বেঁচে আছেন, এর অনুসারীদের ভালো চিন্তা, ভালো শব্দ উচ্চারণ এবং ভালো কর্ম করার উপদেশ দেওয়া হয়, যেন ‘চিনভাত’ সেতুর উপর দিয়ে দ্রুত তাদের আত্মা অতিক্রম করতে পারে, যখন তারা মারা যাবেন এবং তাদের শবদেহ টাওয়ার অব সাইলেন্সের (ডাখমা বা চিলঘর) ছাদের উপর ছড়িয়ে রাখা হবে আকাশের পাখিদের জন্যে একটি উপহার হিসাবে। এখনো এই টাওয়ার অব সাইলেন্সগুলো ইরানে পাহাড়ের উপর দেখা যায়, যা অতীতের স্মারকচিহ্ন হয়ে আছে সেই দেশে, যে-দেশে এটাই একসময় প্রধান ধর্ম ছিল। কিন্তু জরথুস্ত্রের মতবাদ একই নিয়মের শিকার হয়েছিল, যে-নিয়মে এটি একদিন পূর্বতন অন্য একটি ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। এবং সময়ের সাথে এর সমাপ্তিও নিকটবর্তী হয়ে উঠেছিল। বহু শতাব্দী ধরে এটি এর জন্মস্থান ইরানে টিকে ছিল, কিন্তু ১৩০০ বছর আগে এটিকে প্রতিস্থাপিত করে আরো দৃঢ়প্রত্যয়ী একটি নতুন ধর্ম, ইসলাম। এই সময় জরথুস্ত্রীয়রা ভারত-অভিমুখে একটি দীর্ঘ অভিপ্রয়াণ শুরু করেছিলেন, যেখানে পবিত্র আগুন জ্বালানো, টাওয়ার অব সাইলেন্স (ডাখমা) নির্মাণ এবং ভালো চিন্তা, শব্দ আর কর্ম সম্পাদন করার স্বাধীনতা আবার ফিরে পেয়েছিলেন। এবং সেখানে, যদিও সংখ্যায় কম, তারা এখনো বসবাস করছেন।

নতুন একটি অধ্যায় শুরু করার আগে, এতক্ষণ আমরা যা কিছু শিখলাম সেখান থেকে কিছু উপসংহারে পৌঁছানোর আগে, আমি পেছনের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাতে চাই, সেই সময়ের দিকে, যার বিবরণ আমি এতক্ষণ দিয়েছি। হাতি আর অন্ধ মানুষদের নিয়ে সেই জৈনদের নীতিগর্ভ রূপক কাহিনিটি এই আলোচনা শুরু করার একটি আদর্শ জায়গা হবে। এর বার্তাটি ছিল, সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চূড়ান্ত বাস্তবতা সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে মানুষ অক্ষম, সুতরাং তারা যেসব ধর্মীয় দাবিগুলো করে থাকেন সেই বিষয়ে তাদের আরো বি আর সহিষ্ণু হওয়া উচিত।

এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও, ধর্মের নবী ও সাধু ব্যক্তিরা তাদের বিশ্বাস নিয়ে কদাচিৎ সন্দেহ পোষণ করে থাকেন, কারণ মানুষ আর চূড়ান্ত সেই বাস্তবতার মাঝখানে ঝুলে থাকা সেই পর্দার নেপথ্যে কী আছে, তারা সেটি দেখেছেন এবং ‘শুনেছেন বলে তারা দাবি করে থাকেন। আমি সতর্কসূচক কমা দিয়ে ‘দেখেছেন’ আর ‘শুনেছেন’ ক্রিয়াপদগুলো চিহ্নিত করেছি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে, আমাদের নিজেদেরই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কীভাবে সেই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে তাদের প্রস্তাবিত দাবির প্রতি আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাব। কারণ তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জিনিস দেখেছিলেন অথবা একই জিনিস ভিন্নভাবে দেখেছিলেন!

হিন্দু ঋষিরা কার্মার সেই চক্রের ঘূর্ণন এবং পুনর্জন্ম আর সময়ের অনন্ত আবর্তন দেখেছিলেন। এবং এই ধারণাগুলোই ভারতীয় এই ধর্মটির কেন্দ্রীয় মতবাদে রূপান্তরিত হয়েছিল।

ইহুদি নবীরা শুধুমাত্র একজন সত্যিকারের ঈশ্বরকে দেখেছিলেন, যিনি যখন সময় হবে, তার মেসাইয়াকে প্রেরণ করবেন এই পুরো ইতিহাসটির সমাপ্তি করতে, যে-আশা আজো বহু বিশ্বাসী ইহুদিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

জরথুস্ত্র সময়ের শেষে ভালো আর খারাপের মধ্যে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ দেখেছিলেন, যে যুদ্ধ ভালোর জয় হবে।

যদিও প্রত্যেকেই এটি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, এইসব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতারা বর্তমানের এই সময়ে কী ঘটছে তার চেয়ে বরং ইতিহাসের অন্যপ্রান্তে যা কিছু ঘটতে তারা দেখেছিলেন সেই বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন।

কিন্তু আমাদের পরের যাত্রাবিরতিতে যখন আমরা চীনের দিকে তাকাব, আমরা আবিষ্কার করব যে, এই দেশটির সাধুরা মৃত্যুপরবর্তী জীবনের চেয়ে বরং কীভাবে এই জীবনটি আরো ভালো জীবন কাটানো যায়, সেটি নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। সুতরাং এবারে আসুন পূর্বদিকে যাওয়া যাক, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আর দীর্ঘতম বাণিজ্যপথ, দ্য সিল্ক রোড ধরে, আরো বেশিকিছু জানতে। এটি আমাদের নিয়ে যাবে সুদূর চীন অবধি, এবং জীবন সম্বন্ধে কনফুসিয়ানিজম নামে একটি কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *