১২. ভিন্নমতাবলম্বী

অধ্যায় ১২. ভিন্নমতাবলম্বী

যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি পৃথিবীতে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা হ্রাস করতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সেগুলো পৃথিবীকে আরো বেশি বিপজ্জনক একটি স্থানে পরিণত করেছে, তিনি বেশ শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ সমালোচক ছিলেন একজন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি বিশ্বাস করতেন, আমেরিকায় যত বেশি বোমা থাকবে, এটি তত বেশি নিরাপদ হবে। এই বিরোধিতার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করার পর, প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, কোনোকিছু নিয়ে কারো চূড়ান্ত বিশ্বাস, বিশেষ করে যদি সেই মানুষটি একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন, সেটি যে-কোনো খোলামনের মানুষকে নাড়িয়ে দিতে বাধ্য। আর সেটাই তিনি বলেছিলেন, একটি আবদ্ধ মন থাকার বড় সুবিধা।

কারণ আবদ্ধ মনের মানুষদের জন্যে যে একটিমাত্র সগ্রাম বাকি থাকে, সেটি হচ্ছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাকি সবার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। আর কোনোকিছু নিয়ে এই ধরনের নিশ্চয়তা’র কারিগরি নাম হচ্ছে অর্থডক্সি’ (বা প্রচলিত বিশ্বাস); এই শব্দটির উৎস গ্রিক, যার অর্থ ‘সত্য অথবা সঠিক বিশ্বাস। প্রেসিডেন্ট কেনেডির মতো কোনো ব্যক্তি, যিনি পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন একজন ‘হেরেটিক’, আর তাদের মতামতগুলোকে বলা হয় ‘হেরেসি’, আরেকটি গ্রিকশব্দ এর উৎস, যার অর্থ, যারা প্রচলিত ধারণার বিরোধিতা করেন। এই অর্থডক্সি’ আর ‘হেরেসি’ মানবজীবনে সবক্ষেত্রেই দেখা যায়, তবে ধর্মের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে শক্তিশালী। আর এটি কীভাবে কাজ করে সেটি পর্যবেক্ষণ, আমাদের বুঝতে সহায়তা করবে, কেন ধর্মগুলো নিজেদের মধ্যেই সর্বক্ষণ, এবং কখনো কখনো সহিংস ভিন্নমত প্রদর্শন করে থাকে।

অথচ অধিকাংশ ধর্মই প্রচলিত মতামতের বিরুদ্ধে একটি ‘হেরেসি’ বা ভিন্নমত হিসাবে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। একজন নবী তার অভ্যন্তরীণ কণ্ঠস্বরের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছিলেন, যা সমসাময়িক মতামতকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, যেভাবে আব্রাহাম তার বাবার দোকানে বানানো দেবতাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেছিলেন। এর পরে যা সাধারণত ঘটে সেটি হচ্ছে, একটি বিভাজন, যেখানে ভিন্নমত পোষণকারী সেই ব্যক্তি পৃথক হয়ে একটি নতুন ধর্ম শুরু করেন অথবা পুরনো ধর্মের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শাখা সৃষ্টি করেন। কখনো এই ভিন্নমত পোষণকারীরাই তাদের যুক্তিতে বিজয়ী হন এবং তাদের ধারণাগুলো নতুন অর্থডক্সি বা প্রচালিত মতামতে রূপান্তরিত হয়। আবদ্ধ মনগুলো হয় আবদ্ধই থাকে, এবং নতুন ধারণার অনুপ্রেরণাগুলো অন্য কোথাও চলে যায়, অথবা নতুন অন্তদৃষ্টিগুলো সম্পৃক্ত হবার সুযোগ করে দিতে এটি যথেষ্ট পরিমাণ উন্মুক্ত হয়।

অন্য একেশ্বরবাদী ধর্মানুসারীদের তুলনায়, এই প্রক্রিয়ার সাথে বসবাস করতে ইহুদিরাই অপেক্ষাকৃত বেশি অভ্যস্ত ছিলেন। শুরু থেকে বিতর্ক আর ভিন্নমত তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল। অবশ্যই সব ধর্মে বিতর্ক হয়, কিন্তু অধিকাংশ ধর্মই যত দ্রুত সম্ভব সেই বিতর্ক থামিয়ে দেয়, এবং তারা একটি সীমারেখা টেনে দেয়, যা হয় সবাইকে গ্রহণ করতে হবে, নয়তো বের হয়ে যেতে হবে। ধর্মে তর্কের কোনো বিশৃঙ্খলা তারা সহ্য করেন না। ইহুদি ধর্ম কখনোই আসলে তেমন ছিল না। এটি জানত ধর্মের কোনোকিছুই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এটি বিশ্বাস করত, লোহার বাক্সে মনকে বন্দি করে চাবি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার চেয়ে যুক্তিতর্ক অব্যাহত রাখা অনেক উত্তম। ইহুদিবাদের পবিত্র বইয়ের ঠিক কেন্দ্রেই আমরা একজন ‘হেরেটিক’ বা ভিন্নমতাবলম্বীর দেখা পাই, যার নাম ছিল জব, যিনি সেই সময়ের প্রচলিত ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে নিজের মতামত প্রস্তাব করেছিলেন।

জবের এই কাহিনিটি দীর্ঘসময় ধরেই লোককাহিনি হিসাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ব্যাবিলনে নির্বাসনের সময় একজন অজ্ঞাত কবি কাহিনিটি নিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন, এবং এটিকে এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন, যেন এটি দুঃখ আর কষ্ট ভোগ করার সমস্যাটি ব্যাখ্যা করতে পারে। অন্য কোনো জাতি অপেক্ষা ইহুদিদেরই সম্ভবত এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার অধিকতর প্রয়োজন ছিল। বড় সাম্রাজ্যগুলোর আগ্রাসনের পরিণতিতে অন্য বহু জাতি আর জনগোষ্ঠী ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিন্তু অন্ততপক্ষে তাদের সেই দুর্দশা শেষ হয়েছিল। কিন্তু ইহুদিদের জন্যে এই দুর্দশা স্পষ্টতই মনে হয়েছিল যেন চিরন্তন একটি বিষয়। সত্তর খ্রিস্টাব্দের দিকে জাতি হিসাবে ধ্বংস হবার পর, নিজেদের বলে দাবি করার মতো তাদের আর কোনো দেশ ছিল না, যাযাবরের মতো একটি ইতিহাসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল তাদের, এবং তারা যেখানেই গিয়েছিলেন সেখানেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কোথাও তারা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার ব্যাপারে কখনোই নিশ্চিত হতে পারেননি, তারা তাদের বাক্স গুছিয়ে রেখেছিলেন, পরবর্তী মহাঅভিপ্রয়াণ, পরবর্তী নির্বাসনের জন্যে সদাপ্রস্তুত।

তারা তাদের দেশ আর মন্দির হারিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাদের বইটি রক্ষা করেছিলেন, এবং এটি তাদের আধ্যাত্মিক বাসভূমিতে পরিণত হয়েছিল, যা তারা অনায়াসে তাদের মালপত্রের স্যুটকেসের মধ্যে গুঁজে দিতে পারতেন, যখন পরবর্তী বহিষ্কারাদেশ তাদের নিয়তিতে আরোপিত হতো। এমনকি যদি এটি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তারা এটির মূলসার তাদের স্মৃতিতে ধারণ করে রেখেছিলেন, পেন্টাটিউখ থেকে কয়েকটি কবিতা, যা তাদের সবারই কণ্ঠস্থ ছিল। তারা এর নাম দিয়েছিলেন ‘শেমা’, হিব্রু যে-শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘শোনা। ‘শোনো, ও ইসরায়েল : আমাদের প্রভু ঈশ্বর হচ্ছেন একমাত্র প্রভু এবং তুমি তোমার প্রভু ঈশ্বরকে ভালোবাসবে সর্বান্তকরণে, পুরো আত্মা দিয়ে, আর শক্তি দিয়ে। ইহুদি ঐতিহ্যমতে ডানিয়েল সিংহের গুহায় এটি আবৃত্তি করেছিলেন এবং .

অক্ষত অবস্থায় তিনি ফিরে এসেছিলেন। আর ডানিয়েলের কাহিনি সব মহাবিপদের সময়ই ইজরায়েলাইটদের অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু ইহুদিদের এখন কী অনুপ্রাণিত করতে পারে, যখন কিনা শক্তিশালী সিংহের চোয়াল তাদের একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে? ইজরায়েলের জীবনে’ এখন কেন এত দুঃখ?

এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিল ‘বুক অব জব’। বহু শতাব্দী ধরে তার স্বধর্মীয়দের জিজ্ঞাসা করে আসা প্রশ্নটির কোনো বিশ্বাসযোগ্য উত্তর ছিল না জবের কাছে। তবে জব যা করেছিলেন সেটি হচ্ছে, দুঃখ আর দুর্দশাগুলো হচ্ছে পাপের জন্যে ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তি প্রচলিত এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি ধ্বংস করেছিলেন। আর ধর্মের ইতিহাসে এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। আমাদের সামনে এটি সাধারণ একজন মানুষকে উপস্থাপন করেছিল, যিনি কোনো ভুলধারণাকে অনায়াসেই শনাক্ত করতে পারেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম তাকে বলেছিল, এটি ভুল হতে পারে না, কারণ ঈশ্বর বলেছেন এটাই সঠিক। সুতরাং তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন : ঈশ্বর কি কোনো ভুল জিনিসকে সঠিক করতে পারেন শুধুমাত্র সেটি সঠিক’ বলে ঘোষণা দিয়ে? না, ভুল সবসময়ই ভুল, ঈশ্বর যাই বলুক না কেন, অথবা ঈশ্বর বলেছেন, এমন দাবি করে পুরোহিতরা, আমাকে যাই বলুক না কেন। আমি জানি তাদের ব্যাখ্যা ভুল এবং আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও আমি সেটাই বলব। জব ছিলেন একজন হেরেটিক (ভিন্নমতাবলম্বী), যিনি বাইবেলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন এবং এর শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করছেন।

যখন বুক অব জব শুরু হয়, আমাদের বলা হয়েছিল, তিনি একজন সৎ আর নীতিবান ব্যক্তি ছিলেন, যিনি ঘটনাক্রমে অতিমাত্রায় বিত্তশালীও ছিলেন। সাত পুত্র আর তিন প্রিয় কন্যা ছাড়াও তার সাত হাজার ভেড়া, তিন হাজার উট, পাঁচশো জোয়াল টানা ষাঁড়, পাঁচশো স্ত্রী-গাধা, কর্মচারী ভৃত্য আর প্রচুর পরিমাণে ভূসম্পত্তি ছিল। তার সেই সময় আর স্থানের বিবেচনায় তিনি নিঃসন্দেহে অতীব বিত্তশালী ছিলেন।

কিন্তু একটি পর্যায়ে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তার গবাদিপশুর পাল চুরি হয়ে যায়, তার ভৃত্য আর সন্তানদের হত্যা করা হয় এবং তিনি নিজেই খুব বিশ্রী একটি চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাকে আবর্জনার মধ্যে বসে মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরো দিয়ে নিজের গা চুলকাতে দেখা যায়। তার দুর্গতি আর যন্ত্রণা ছিল চরম। তার স্ত্রী তাকে বলেছিলেন, এখন তার উচিত হবে ঈশ্বরকে ঘৃণা করা আর অভিশাপ দেওয়া এবং মৃত্যুবরণ করা। কিন্তু তার সব দুর্দশা বিষয়ে জবের প্রত্যুত্তর ছিল : নগ্ন হয়ে আমি মায়ের জঠর থেকে এসেছি, নগ্ন হয়েই আমি ফিরে যাব। প্রভু দিয়েছিলেন আবার প্রভু সেটি কেড়ে নিয়েছেন, প্রভুর নামেই আশীর্বাদ’।

পরের দৃশ্যে আমরা দেখি জবের সাথে তিনজন বন্ধু দেখা করতে এসেছেন, এবং তারা বলেছিলেন, তারা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে এসেছেন, কিন্তু আসলে তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিলেন। তারা ছিলেন সেই ধরনের বিশ্বাসী, সবকিছুর জন্যে তাদের কাছে প্রস্তুত থাকত উত্তর, এমনকি সেই ক্ষতির সুনামি, যা জবকে নিমজ্জিত করেছিল, তার জন্যেও তাদের একটি উত্তর ছিল। এলিফাজ দ্য টেমানাইট, বিলডাড দ্য শুহাইট আর জোফার দ্য নামাথাইট, তাদের দুর্ভাগা বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাদের জেরা শুরু করেছিলেন। ক্রমশ বাড়তে থাকা বিরক্তিসহ তারা একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু এলিফাজ দ্য টেমানাইটই প্রথম জবের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির একটি আনুষ্ঠনিক ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করেছিলেন।

এলিফাজ বলেছিলেন : ‘নিরপরাধীদের কখনোই ক্ষতির মুখে পড়তে হয় না, যখন কিনা খারাপদের নিয়তিতেই আছে কষ্ট। তুমি যেহেতু এখন কষ্ট পেয়েছ, আমাদের বলল, তুমি কী করেছিলে যে, তোমার ওপর এই দুর্দশা পতিত হয়েছে? জব তাদের এই অভিযোগের যুক্তিটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তার ওপর এই দুর্দশা চাপানোর জন্যে ঈশ্বরের যে কারণই থাকুক না কেন, এটি অবশ্যই জবের পাপের কারণে হতে পারে না, যে পাপ কিনা তার নিজের মাথার ওপর এই শাস্তি নিয়ে এসেছে। জব জানতেন তিনি নীতিবান একজন মানুষ ছিলেন, এবং তিনি কখনোই এমন কিছু করেননি, যার জন্যে এই দুর্ভাগ্যে পতিত হবার মতো কোনো শাস্তি যুক্তিযুক্ত হতে পারে, এটি অবশ্যই তার প্রাপ্য নয়।

জবের বন্ধুরা তাকে খোলামনে প্রশ্ন করতে আসেননি। তাদের কাছে কখনোই মনে হয়নি যে, তাদের প্রচলিত আনুষ্ঠানিক এই তত্ত্বটি ভুল হতে পারে। তারা যদি অন্য কোনো সম্ভাবনার কথা মনে জায়গা দেন, তাহলে তাদের পরিপাটি করে সাজানো ধর্মীয় মহাবিশ্বের সবকিছুরই প্রকৃত স্বরূপ বের হয়ে আসবে। তাই অযথা সন্দেহ করার চেয়ে বরং প্রচলিত চিন্তা আঁকড়ে থাকাই উত্তম। কিন্তু জব তার ব্যাখ্যা থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানান। এই মতবাদটি অবশ্যই ভুল, কারণ তিনি জানেন এমন কিছু তিনি করেননি যে, এই সর্বনাশ তার প্রাপ্য হতে পারে, যা কিনা তার সমস্ত পরিবার আর সৌভাগ্যকে মুছে দিয়েছে।

একজন সাধারণ মানুষ, যাকে অসাধারণ একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার ওপর আরোপিত অভিযোগগুলোর কাছে সমর্পণ করার পরিবর্তে, জব একটি হিংস্র নিষ্ঠুর তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনকি যদি তার পক্ষে তিনি যে নিরপরাধ সেটি প্রমাণ করা অসম্ভব ছিল এই জীবনে–কারণ যা নেই তা প্রমাণ করা সবসময়ই অসম্ভব তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর ঈশ্বর তার সুনাম পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবেন : ‘কারণ আমি জানি আমার ত্রাণকর্তা আছেন এবং পরিশেষে একদিন তিনি এই পৃথিবীর উপর দাঁড়াবেন, আর আমার চামড়া যদি এভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, আমি খালি মাংসের এই শরীর দিয়ে ঈশ্বরকে দেখতে পাব, যাকে আমি আমার পাশেই দেখব, আমার চোখ তাকেই দেখবে আর কাউকে না।

কিন্তু তার সততা প্রমাণ করতে জবকে তার মৃত্যু অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। ঈশ্বর স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন এবং নিন্দা করেছিলেন তাদেরকে, যারা জবকে দোষী অভিযুক্ত করে তাকেই অপমানিত করেছিল। ঈশ্বর এলিফাজ দ্য টেমানাইটকে বলেছিলেন : তোমার আর তোমার এই দুই বন্ধুর আচরণ নিয়ে আমি খুবই অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ হয়ছি, কারণ আমার সম্বন্ধে তোমরা যা বলছিলে তা সঠিক নয়, আমার দাস হিসাবে যে-কাজটি না-করাটাই তোমাদের কর্তব্য ছিল। এখানে একজন প্রচলিত মতামতের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী একজন ‘হেরেটিক’ ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, সেই প্রচলিত ধারণার শিক্ষকরা নয়, যারা দলের মতামত মেনে চলেন।

কিন্তু এই গল্পের প্রচলিত শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করার এমনকি ঈশ্বরেরও অনুমতি ছিল না! পরে একজন লেখক, জবের এই ভিন্নমতের জন্যে ঈশ্বরের সমর্থন দেবার কারণে বিচলিত হয়ে, এই কাহিনিতে একটি সুখকর পরিণতি জুড়ে দিয়েছিলেন মূল পাঠ্যাংশে। ঈশ্বর জবকে তার আগে যা ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এবং এভাবে সেই পুরনো তত্ত্বটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সততা পুরস্কৃত হয় আর অসৎ ব্যক্তিরা তাদের কর্মের জন্যে এই জীবনেই শাস্তি ভোগ করেন। এই গল্পের অসাধারণ বিষয়টি হচ্ছে, এখানে আমরা প্রচলিত মত আর ভিন্নমতকে একসাথে কাজ করতে দেখি এবং এটি আমাদেরকে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবার অনুমতি দেয়।

যখন আমরা এই গল্পটি বিবেচনা করি, ঈশ্বরের দ্বিতীয় নির্দেশের মূর্তি প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করা আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি ঈশ্বরকে ছোট মোড়কে মুড়িয়ে ধর্মীয় বাজারে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তর করার মতো কোনো কাজ করতে ইজরায়েলাইটদের সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সংগঠিত ধর্মগুলো মূলত সেটাই করে থাকে। তাদের প্রচলিত মতামতের মোড়কে এটি ঈশ্বরকে একটি বাক্সের মতো ঢুকিয়ে রাখে এবং ঠিক সেটাই তারা বাকি সবাইকে জোর করে মানতে বাধ্য করে। জবকে সান্ত্বনা দিতে আসা তার বন্ধুরা এটাই করার চেষ্টা করেছিলেন। সহমর্মিতাসহ তার নিয়তিতে আসা সব হতাশা আর কষ্টের ভাগ না-নিয়ে এই বন্ধুরা তাকে বলেছিলেন, ঠিক কীভাবে তার এই পরিস্থিতিতে ঈশ্বরেরই হাত আছে এবং তারা তাকে এই ব্যাখ্যাটি মেনে নিতে। জোর করেছিলেন। অতিবিকশিত ধর্মীয় মূল ভাবনাগুলো সাধারণত এমন কাজ করতে ভালোবাসে। তারা মানুষকে নির্দেশ দেয়, ঠিক কীভাবে ভাবতে হবে, কোনোকিছুর কী অর্থ, সেটির ব্যাখ্যা দেয় এবং কীভাবে এই পরিস্থিতিতে ঈশ্বর ভূমিকা রাখেন সেটি দাবি করেন। কিছু ধর্ম যেভাবে কাজটি করে থাকে, এই ধরনের ব্যাখ্যার মুষলধারার মুখোমুখি হওয়া অনেকটাই আপনার নিজেকে কোনো দীর্ঘ বাস-যাত্রায় আত্মনিয়ন্ত্রণহীন কোনো ব্যক্তির পাশে বসে কাটানোর মতোই, যে কিনা সারারাত ধরে জোর করে তার সব উন্মত্ত ভাবনা আপনাকে শুনতে বাধ্য করে।

এলিফাজ দ্য টেমানাইট, বিলডাড দ্য শুহাইট আর জোফার দ্য নামাইট হচ্ছেন ধ্রুপদী চরিত্রের ধর্মীয় গোঁড়া মৌলবাদী, যারা মনে করেন তাদের কাছে সবকিছুরই ব্যাখ্যা করা আছে, রেকর্ড করা টেপের মতো এবং যাদের সাথেই তাদের দেখা হয়, তাদেরকেই সেই টেপ বাজিয়ে শোনানোর মতো আর কোননা কাজই করতে তারা এতটা ভালোবাসেন না। বুক অব জবের অসাধারণ বিষয়টি হচ্ছে, এটি তাদের কথা শুনতে গিয়ে চূড়ান্তভাবে ক্লান্তিকর হতে ভয় পায়নি, শুধুমাত্র মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে। ঈশ্বর কী কিংবা তিনি কী করতে চাইছেন বা তার পরিকল্পনা আর তার বার্তাটি কী, সেটি কেউ নিশ্চিতভাবে জানেন, এমন কোনো দাবি কারোরই করা উচিত নয়। অন্য বহুধরনের বিশ্বাসীদের তুলনায় ইহুদিরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন এই ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচতে। তারা অন্য মানুষদের ওপর তাদের ঈশ্বরকে চাপিয়ে দেবার কোনো চেষ্টা করেন না। তারা নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করতে সারাক্ষণই ব্যস্ত, সুতরাং তেমন কিছু করার মতো সময়ও তাদের হাতে নেই। এবং তারা এখনো বিতর্ক করে যাচ্ছেন। কিন্তু এখানে তাদেরকে তাদের ঈশ্বর নিয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্কে মগ্ন রেখে এগিয়ে যাব অন্য আরেকটি ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে। জোরোয়াস্ট্রিয়ানিজম বা জরথুস্ত্রীয় ধর্মমত। এটি আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে পারস্যে, কমন এরা (খ্রিস্টপূর্বাব্দে) শুরু হবার ছয়শো বছর আগে বুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে, কিন্তু প্রথমে ভারতে আমাদের একটি যাত্রাবিরতি করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *