০৮. নলখাগড়ার বনে

অধ্যায় ৮. নলখাগড়ার বনে

আইজাক, যে ছেলেকে নিজের মাথার মধ্যে শোনা কণ্ঠের নির্দেশে আব্রাহাম প্রায় হত্যা করতে গিয়েছিলেন, তিনি বেঁচেছিলেন এবং নিজেই একসময় সন্তানের পিতা হতে পেরেছিলেন। আর আইজাকের ছেলে ইয়াকব, এর আগে তার পিতামহের মতো তার প্রতি নির্দেশিত ঈশ্বরের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন। কণ্ঠটি বলেছিল, তাকে আর ইয়াকব বলে ডাকা হবে না। এখন থেকে তার নতুন নাম হবে ‘ইজরায়েল’, যার অর্থ ‘ঈশ্বর শাসন করেন’। সুতরাং তার বারোটি ছেলেকে ডাকা হতো চিলড্রেন অব ইসরায়েল (ইজরায়েলের সন্তান) নামে অথবা ‘ইজরায়েলাইটস’। দাদা আব্রাহামের মতোই, ইয়াকব, এখন যার নাম ইজরায়েল, একজন যাযাবর মেষপালক ছিলেন। পানি আর ভালো চারণভূমির সন্ধানে তিনি তার গবাদি পশুর পালকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতেন। ধীরে ধীরে ইজরায়েলাইটসরা একটি গোত্র হিসাবে আকারে বেশ বড় আর সবচেয়ে সমৃদ্ধ পানির কুয়া আর সেরা চারণভূমির জন্যে অন্য গোত্রগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো তারা যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু একসময় ভয়াবহ একটি দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল পুরো কানান এলাকাটি। এর ঘাস আর কুয়ার পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, সুতরাং ইজরায়েলাইটরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, যেভাবে মানুষ সেই সময়ের সূচনা থেকেই করেছে, অন্য কোথাও গিয়ে তাদের ভাগ্যটা যাচাই করে দেখাই বরং তাদের জন্যে উত্তম হবে। এবং তারা আরো দক্ষিণে মিশরে এসে বসতি গড়েছিলেন, যেখানে নীলনদের পলিতে সমৃদ্ধ চারণভূমিতে তাদের গবাদি পশুরা চরে বেড়াত। প্রথমদিকে স্থানীয় মিশরীয়রা সাদরে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, নীলনদের কাছে এবং সাগর থেকে খুব একটা দূরে নয়, গোশেন প্রদেশে তাদের বসতিস্থাপন করতে অনুমতি দিয়েছিল। এখানে ইজরায়েলাইটরা আরো বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন এবং তাদের সংখ্যাও বেড়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন। মূর্তির প্রতি আব্রাহামের তীব্র ঘৃণার কথা স্মরণ করে, স্থানীয় ধর্ম থেকে তারা নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, যা মূলত ছিল একধরনের প্রাণবন্ত বহুঈশ্বরবাদ, যেখানে দেবদেবীরা কুকুর, বিড়াল, কুমির এবং অন্য প্রাণীদের রূপে উপাস্য ছিলেন।

প্রায়শই সেই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়ে থাকে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে মিশতে অস্বীকার করেন, ইজরায়েলাইটরা ক্রমেই মিশরীয়দের অপছন্দের পাত্র হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন। এবং যখন তারা সংখ্যায় বেড়েছিলেন, এবং আরো বেশি সফল হয়ে উঠেছিলেন, যে অপছন্দ তারা স্থানীয়দের মনে উদ্রেক করেছিলেন, সেটি একসময় ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছিল। তারপর এই ঘৃণাই ইজরায়েলাইটদের উপর স্থানীয়দের নির্যাতন আর তাদেরকে বাধ্যতামূলক শ্ৰম-দাসে রূপান্তরিত করার একটি অজুহাতে পরিণত হয়েছিল। এবং যখন এই সংগঠিত নিষ্ঠুরতা তাদের দমন করতে ব্যর্থ হয়েছিল, মিশরীয় কতৃপক্ষ পরিকল্পিত উপায়ে তাদের ধ্বংস করার একটি নীতি গ্রহণ করেছিল। ইজরায়েলাইট নারীদের মিশরীয় পুরুষদের জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে এবং বাকিদের সাধারণ জনসংখ্যার সাথে একীভূত করার উদ্দেশ্যে রাজা সদ্যজাত সব পুরুষ ইজরায়েলাইটদের জন্মের পরপরই হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। একজন মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, চোখের সামনে নিজের সন্তানের হত্যাকাণ্ড দেখার চেয়ে বরং তাকে নিয়তির হাতেই ছেড়ে দেবেন। সুতরাং খুব সতর্কভাবে প্রস্তুত পানিরোধী একটি ঝুড়িতে শিশুটিকে রেখে, সেটি তিনি নীলনদের তীরে নলখাগড়ার বনের মধ্যে রেখে এসেছিলেন, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে তিনি জানতেন ফারাও কন্যা, মিশরের রাজকুমারী, নিয়মিত স্নান করতে আসেন। তার এই কৌশলটি কাজে লেগেছিল। যখন রাজকন্যা নলখাগড়ার ঝোঁপের মধ্যে একটি ঝুড়িতে শিশুটিকে ভাসতে দেখেছিলেন, তার নিজের সন্তান হিসাবে তিনি শিশুটিকে দত্তক নেন এবং তাকে মিশরীয় একটি নাম দিয়েছিলেন, মোজেস।

যদিও তিনি রাজপ্রাসাদে বিলাসী আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যে মিশরীয় নন, বরং একজন ইজরায়েলাইট, সেই বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। ক্রমশ দৃঢ় হতে থাকা একটি অনুভূতি তাকে একটি অনুধাবনে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল, আর সেটি হচ্ছে : তার নিয়তি ঐ ক্রীতদাসদের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের শোষকদের সাথে নয়, যারা তাকে দত্তক নিয়েছিল এবং প্রতিপালন করেছে। সুতরাং তার স্বজাতিরা কেমন আছে সেটি দেখতে তিনি আরো বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। একদিন কৌতূহলই কর্মরত তাদের একটি দলের কাছে যেতে তাকে প্ররোচিত করেছিল। যখন তিনি দেখেছিলেন যে, তাদের মিশরীয় তত্ত্বাবধায়ক নৃশংসভাবে একজন ইজরায়েলাইটকে প্রহার করছেন, তিনি এতই রেগে গিয়েছিলেন, তিনি সেই মিশরীয়কে সেখানেই হত্যা করে মরুভূমির বালির মধ্যে কবর দিয়ে রেখেছিলেন।

আবারো একই কৌতূহল পরের দিন তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তার ক্রোধ উসকে দিয়েছিল পরস্পরের সাথে হাতাহাতি করা দুইজন ইজরায়েলাইট। যখন তিনি এই ঝগড়া থামাতে হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, ঝগড়াটি শুরু করেছিল যে ব্যক্তি, তিনি মোজেসকে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে উঠেছিলেন : ‘ধরে নিচ্ছি এবার আপনি আমাকেও খুন করবেন, ঠিক গতকাল যেভাবে মিশরীয়কে মেরেছিলেন, তারপর একইভাবে আমাকেও বালির মধ্যে কবর দিয়ে রাখবেন’। তিনি আসলে কে, সেটি তারা বুঝতে পেরেছিলেন, আর এই খবর এখন দ্রুত প্রাসাদে পৌঁছে যাবে ও তাকে বিপদে ফেলবে, বিষয়টি অনুধাবন করে, মোজেস মরুভূমির দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে মেষপালকদের একটি পরিবার তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।

এখানেই প্রথম তার সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল এই বইয়ের শুরুতে, একটি মরুভূমির কাঁটা-ঝোঁপের সামনে তখন তিনি নতজানু হয়ে আছেন, যিনি সেই কণ্ঠটি শুনছিলেন, সেটি তাকে এমন কিছু বলছিল যা তিনি শুনতে চাইছিলেন না। তাকে সেই কণ্ঠস্বরটি বিপজ্জনক একটি কর্তব্য পালন করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিল, যে নির্দেশটি পালন করার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না। এটি সেই একই কণ্ঠস্বর, যা একদিন মেসোপোটেমিয়ানদের উপাস্যদেবতাদের প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে আব্রাহামকে তার জীবনের ঝুঁকি নিতে বলেছিল। এটি সেই কণ্ঠস্বর, পুত্র আইজাককে বিসর্জন দেবার জন্যে যা পরে আব্রাহামকে নির্দেশ দিয়েছিল। এবং এটি সেই একই কণ্ঠস্বর, যা ইয়াকবকে তার নাম পরিবর্তন করে ইজরায়েল (যার অর্থ ‘ঈশ্বর শাসন করেন’) রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এটি ছিল দেবতাদের নিয়ে ভাবার একটি নতুন উপায়। একসময় গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, প্রতিটি গোত্রের একটি নিজস্ব দেবতা (বা দেবতারা) থাকবে। কিন্তু এই ধারণাটি, একজন মাত্র দেবতা মানুষের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনকি হয়তো ইতিহাসও যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, সেটি ছিল নতুন এবং ভীতিকর। যখন মোজেস সেই কণ্ঠস্বরটির নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যিনি তার সাথে কথা বলছিলেন, তার উত্তরটিও এমনকি আরো বেশি অস্বস্তিকর ছিল। ‘আমি’, শুধুমাত্র এটাই ছিল তার উত্তর। এই বাক্যটির প্রকৃত অর্থ কী হতে পারে সেটি সমাধান করা বেশ কঠিন একটি ব্যাপার। কিন্তু এটি প্রস্তাব করেছিল যে, এই কণ্ঠস্বরই সব

জীবন আর শক্তির উৎস, এবং যা কিছুর অস্তিত্ব আছে এটি তার নেপথ্য অর্থ। এবং যাদের প্রতি এটি উচ্চারিত হয়েছিল তারা অনুভব করেছিলেন, এর সাথে নিজেদের যুক্ত করলে তাদের নিজেদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

এমন নয় যে, এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে তাদের কিছু বলার সুযোগ আছে। এটি প্রায় শূন্য থেকে হাজির হয়ে তাদের মনে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে, এমন কোনো ধারণার মতো যে ধারণার কাছ থেকে কোনো নিস্তার নেই। এটি তাদের বলেছিল, মাত্র একজন’ ঈশ্বর আছেন, এবং শুধুমাত্র একজন ঈশ্বর হতে পারেন। বাকি সব দেবতারাই মানবসৃষ্ট, হয় মানব কল্পনা তাদের সৃষ্টি করেছে অথবা আক্ষরিকার্থে মানুষের হাতেই তাদের তৈরি করা হয়েছে। এইসব তথাকথিত দেবতারা সব মিথ্যা। এই মিথ্যাই মানুষের প্রাণশক্তিকে নষ্ট করেছে এবং সে-কারণেই এদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে, এবং একজন ও একমাত্র সত্যিকার ঈশ্বর, যিনি ইজরায়েলের সন্তানদের নির্বাচিত করেছেন, এই সত্যটি সারা পৃথিবীতে সবাইকে জানাতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই যাদের কাছে এই বার্তা এসেছিল, তারা আতঙ্কিত হয়েছিলেন। বহুসংখ্যক দেবতা এবং অসংখ্য উৎসাহী পূজারি এবং এই দেবতাদের সেবা দেবার নামে প্রতিষ্ঠিত নানা ব্যবসায় পৃথিবী পূর্ণ। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে অপমান করা এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ একটি কাজ, এবং যেভাবে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে সেটিকে হুমকি দেওয়া এমনকি আরো বিপজ্জনক।

সে-কারণে মোজেস এই কণ্ঠস্বরের দাবিগুলোকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি কেবলই মিশর আর এর শাসকদের কাছ থেকে থেকে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন তার মাথার মধ্যে এই কণ্ঠস্বরটি তাকে আবার মিশরে ফিরে যেতে এবং সেখানে একটি বিপ্লব সংগঠিত করতে নির্দেশ দিচ্ছে। তার দায়িত্ব হচ্ছে ইজরায়েলাইটদের নেতৃত্ব দেয়া –ইতিমধ্যেই তিনি যাদের অকৃতজ্ঞ আর উছুঙ্খল একদল মানুষ হিসাবে জানেন–তিনি যেন তাদের মিশর থেকে বের করে অন্য একটি দেশে নিয়ে যান। যদি ধরে নেই তারা সেখানে পৌঁছাতে পারলেন, কিন্তু কে জানে ঠিক কী ধরনের অভ্যর্থনা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সেই দেশে, যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরটির তীব্রতা কমেনি, এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোজেস সেই নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে আবার তিনি মিশরে ফিরে এসেছিলেন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল, ইজরায়েলাইটদের প্ররোচিত করা যে, আব্রাহাম, আইজাক আর ইয়াকবের ‘ঈশ্বর তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তিনি তাদের মিশর থেকে নতুন একটি দেশের দিকে নিয়ে যান, যেখান থেকে তারা বহু প্রজন্ম আগে মিশরে এসেছিল। অভিযোগ আর অনুযোগ আর প্রতিবাদের পর তারা অবশেষে রাজি হয়েছিলেন তাকে অনুসরণ করতে, শুধুমাত্র যদি তিনি তাদের মুক্তি দিতে ফারাওকে রাজি করাতে পারেন। আর কীভাবে তিনি সেটি করার পরিকল্পনা করছেন?

মোজেসের প্রথম পদক্ষেপ ছিল, মিশরীয়দের কাছ থেকে কয়েকদিনের ছুটি আদায় করা, ইজরায়েলাইটরা যেন গোশেনের উত্তরে মরুভূমিতে তাদের ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারেন। ইজরায়েলাইটদের অহংকারী আর একচেটিয়া স্বতন্ত্র ধর্মের প্রতি ইতিমধ্যেই ঘৃণাপূর্ণ মিশরীয়রা এই হিংসুটে দেবতার পূজা করতে। তাদের ছুটি দিতে অস্বীকার করেছিল। এরপর এই গল্পটি আমাদের বলছে, মোজেস দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়ে তার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে ইজরায়েলাইটদের ঈশ্বর মিশরীয়দের উপর একের-পর-এক দুর্যোগ ঘটিয়ে আক্রমণ করেছিলেন। অবশেষে এটি এর চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল সেই ইজরায়েলাইটদের প্রথম পুত্রদের হত্যা করার মতো ভয়ংকর ঘটনার প্রতিধ্বনি করে, অতীতে যে-গণহত্যাটি একদিন মোজেসের জন্য ফারাও’র নিজের পরিবারে প্রতিপালিত হবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।

মোজেসকে সেই কণ্ঠস্বর নির্দেশ দিয়েছিল, ইজরায়েলাইটরা যেন একটি নির্দিষ্ট রাতে তাদের ঘরের দরজার বাইরে বের না হয় এবং প্রতিটি পরিবার একটি মেষ বিসর্জন দেবে এবং দরজার উপর সেই মেষের রক্ত দিয়ে একটি চিহ্ন এঁকে রাখবে, যা এটিকে মিশরীয়দের বাসা নয় বরং ইজরাইলাইটদের বাসা হিসাবে চিহ্নিত করবে। এবং সেই মধ্যরাতে প্রতিটি মিশরীয় পরিবারের প্রথম সন্তান, এমনকি তাদের গবাদি পশুর প্রথম সন্তানটিকে ঈশ্বর সারা দেশজুড়ে হত্যা করেছিলেন, কিন্তু রক্তদ্বারা চিহ্নিত ঘরগুলো তিনি এড়িয়ে যান তাদের কোনো ক্ষতি না করে। যখন সকাল এসেছিল, ভয়ংকর আর্তনাদে সারাদেশ কেঁপে উঠেছিল, দিনের আকাশ যা হাহাকারে বিদীর্ণ করেছিল। এমন কোনো মিশরীয় বাড়ি ছিল না যেখানে সেই রাতে কেউ মারা যায়নি। সুতরাং ফারাও মোজেসকে। ডেকে পাঠান এবং বলেন, ‘তুমি জিতেছ, তোমার স্বজাতির মানুষগুলোকে তুমি মরুভূমিতে নিয়ে যাও, কিছুদিনের জন্যে তোমাদের ঈশ্বরের উপাসনা করতে, আমাদের ত্যাগ করে যাও, যেন আমরা আমাদের মৃতদের নিয়ে শোক করতে পারি। সুতরাং সেই পালিয়ে যাবার পরিকল্পনাটি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

মোজেস ইজরায়েলাইটস আর তাদের গবাদি পশুদের দীর্ঘ বিশৃঙ্খল একটি দলকে পথ দেখিয়ে ভূমধ্যসাগরের উপকূলের নিকটেই ‘সি অব রিডস’ নামের একটি বিপজ্জনক নদীর মোহনা অতিক্রম করেছিলেন। তখন ভাটার সময় ছিল, এবং তারা নিরাপদে অপরপ্রান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে মিশরীয়রা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের আসলে বোকা বানানো হয়েছে। ইজরায়েলাইটরা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে মরুভূমিতে তাদের ধর্মীয় তীর্থে যায়নি। যদি তারা আসলেই সেই কাজটি করত, তাহলে তো তাদের গবাদি পশুর পাল নিয়ে মরুভূমিতে যাবার কথা ছিল না, সুতরাং তারা পালিয়ে যাবার পরিকল্পনাই করেছিল এবং ইতিমধ্যে বাড়তি একটা দিন পরিমাণ সময় তারা চুরি করে বহুদূর এগিয়ে গেছে। সুতরাং মিশরীয়রা তাদের দ্রুতগামী রথ আর ঘোড়ায় চড়ে তাদের ধরতে পিছু নিয়েছিলেন। ‘সি অব রিডসের মোহনায় এসে যখন তারা হাজির হয়েছিলেন, ঠিক তখনই জোয়ারের পানি সেখানে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল প্রবল বেগে। সেই স্রোতে আটকা পড়ে তারা সবাই পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। ইজরায়েলাইটরা এটি তাদের ঈশ্বরের একটি কাজ বলেই দিনটি উদযাপন করে থাকেন। অবশেষে তারা মিশরের দাসজীবন থেকে বহুদূরে এবং স্বাধীন হতে পেরেছিলেন।

এটি ইহুদি জাতির ইতিহাসে একটি নির্ধারণী মুহূর্ত ছিল, এবং এটি তারা সেই সময় থেকেই যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করে আসছেন। এটিকে বলা হয় ‘ফিস্ট অব পাসওভার। বার্ষিক এই উৎসবের দিনটিতে ইহুদিরা অতীতের সেই রাতটিকে স্মরণ করেন, যখন স্বর্গীয় বিনাশক ঈশ্বর ইজরায়েলের সন্তানদের নিরাপদে পার করে দিয়েছিলেন; এবং মিশরের ক্রীতদাস-জীবন থেকে তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত দেশে পালিয়ে আসার সময় সুরক্ষা করেছিলেন। এই উৎসবের সন্ধ্যায় ইহুদি শিশুরা তাদের পিতামাতার কাছে জানতে চায়, পাসওভারের দিনটির খাওয়া তাদের অন্যসব উৎসবের খাওয়া থেকে এত ভিন্ন কেন।

এই রাতে সাধারণ রুটির পরিবর্তে কেন তারা মাটসো– চ্যাপ্টা আফোলা রুটি খায়? তাদেরকে এর উত্তরে বলা হয়, এটি খাওয়া হয় কারণ মাটসো তাদের মনে করিয়ে দেয়, মিশর থেকে পালিয়ে আসার সেই রাতে রুটি ফুলে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না, তাড়াহুড়া করে চুলা থেকে রুটিগুলো যে-অবস্থায় ছিল সেভাবেই তাদের বের করে নিতে হয়েছিল। যখন তারা প্রশ্ন করে, প্রতিরাতে নানাধরনের শাকসবজির বদলে কেন এই রাতে তাদের অবশ্যই একটি তিতা’ শাক খেতে হয়। তাদের বলা হয়, মিশরে দাস হিসাবে তাদের তিক্ত দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় এটি। সেই তিতা শাকটি একবার লবণ পানি আর একবার মিষ্টি মিশ্রণে ডুবিয়ে তারা স্মরণ করেন, তাদের অশ্রুগুলো আনন্দে এবং তাদের দুঃখ রূপান্তরিত হয়েছিল সুখে। এবং যখন তারা জিজ্ঞাসা করে, কেন এই রাতে তারা টেবিলে শুয়ে পড়তে পারবে। তাদের বলা হয়, মিশরে শুধুমাত্র স্বাধীন যারা তারাই শুয়ে শুয়ে খেতে পারতেন, যখন দাসদর অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন তারা স্বাধীন, সুতরাং তারা এখন সেটি করতে পারবেন।

ইহুদি শিশুরা এই প্রশ্নগুলো প্রতি পাসওভারের রাতে জিজ্ঞাসা করে আসছে গত ৩৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। একই প্রশ্ন করা হয় আর একই উত্তর দেওয়া হয়। তারা এখন স্বাধীন, তাই তারা এখন শুয়ে শুয়ে খেতে পারবেন! এই গল্পের হৃদয়স্পর্শী বিষয়টি হচ্ছে, তাদের ইতিহাসে অসংখ্যবার, যখন ইহুদি শিশুরা এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করেছে এবং সেই একই উত্তর শুনেছে, যা তাদের স্বাধীনতার ঘোষণা বহন করছে, কিন্তু তারা আবারও বন্দি হয়েছিলেন। আর এটাই সেই মেঘ –এই গল্পের উপর যা একটি ছায়া ফেলেছিল, যখন গল্পটি সময়ের সাথে অগ্রসর হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জন করার একটি মহান আর সাহসী উদ্যোগকে এটি উদযাপন করে সেই জাতির জন্যে একটি নির্ধারণী মুহূর্ত হিসাবে, যাদের ইতিহাস মূলত পুরোটাই নির্যাতন আর বন্দিত্বের।

কিন্তু এটি ধর্ম কীভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় গল্পগুলো হয়তো অতীতের দিকে তাকায় ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর আসল অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্যে আশা দেওয়া। এভাবেই ইহুদি জনগোষ্ঠী এই গল্পটিকে ব্যবহার করে এসেছেন। তারা এই মহাঅভিপ্রয়াণটিকে স্মরণ করেন। একটি জাতি হিসাবে তাদের জন্মদিন হিসাবে। কিন্তু যা পরে এসেছিল সেটি আতশবাজি আর বিশেষ ভোজসহ স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন নয়। সেটি ছিল উত্তম একটি ভবিষ্যতের সন্ধানে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ আর দারুণ দুর্বিষহ একটি যাত্রা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *