০৭. যাযাবর

অধ্যায় ৭. যাযাবর

আর (Ur)। সংক্ষিপ্ত দুটি অক্ষরের একটি শব্দ। এখানে ‘U’ উচ্চারিত হবে আ (যেমন up)। ‘r’ এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে যেমন করে স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা করেন, খানিকটা টেনে, সুতরাং Ur, অথবা Urrr, (আররর)। আর এখানেই কমন এরা শুরু ১৮০০ বছর (খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আগে কোনো একটি সময় ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন–গোত্রপিতা আব্রাহাম। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমান, সবাই তাদের প্রতিষ্ঠাতা-পিতা হিসাবে আব্রাহামকে দাবি করেছে। পানির একটি ক্ষীণ স্রোতধারার কথা ভাবুন, হাজার মাইল দূরে কোনো পর্বত থেকে যা যাত্রা শুরু করেছে, সমতলে সেটি তিনটি বিশাল নদীতে পরিণত হয়েছে, সেই ধারণাটি সহজেই আপনি অনুধাবন করতে পারবেন। মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে ছিল ‘আর’ শহরটির অবস্থান। মেসোপটেমিয়া একটি গ্রিক নাম, যার অর্থ দুটি নদীর মধ্যবর্তী এলাকা এই নদীদুটি হচ্ছে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস। ‘আর’ শহরটি ছিল সেই দেশে যে দেশটির বর্তমান নাম ইরাক।

উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের কাছে আসা কাহিনি অনুযায়ী, আব্রাহাম ছিলেন টেরাহ’র পুত্র। তার দুইটি ভাই ছিল, নাহোর এবং হারান। বাইবেলে বুক অব জেনেসিসে আমরা তাদের কাহিনি খুঁজে পাই। কিন্তু হিব্রু বাইবেলের একটি প্রাচীন সহায়ক-বইয়ে তাদের সম্বন্ধে আমরা আরো কয়েকটি গল্প পাই। এটি আমাদের বলছে, তারা মেষপালক ছিলেন, ইউফ্রেটিসের উপত্যকায় সমৃদ্ধ তৃণভূমিতে তারা তাদের গবাদি পশুদের চারণ করাতেন। আর টেরাহ’র একটি লাভজনক পার্শ্বব্যবসা ছিল, তিনি সেই এলাকায় বসবাসরত মানুষদের উপাসনা করা দেবতাদের মূর্তি নির্মাণ করতেন। মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীদের চারজন প্রধান দেবতা ছিলেন। ‘আনু’ ছিলেন স্বর্গের দেবতা, ‘কি’ ছিলেন পৃথিবীর দেবী, এনলিল’ ছিলেন বাতাসের দেবতা আর ‘একি’ ছিলেন পানির দেবতা। সূর্য আর চাঁদকেও তারা দেবতা হিসাবে উপাসনা করতেন। এখানে লক্ষ করার মতো একটি বিষয় হচ্ছে, কীভাবে প্রাচীন ধর্মগুলোয় প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই স্বর্গীয় বিবেচনা করা হতো।

ভারতবাসীদের মত, মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরাও এমন কিছু চেয়েছিলেন যেদিকে তারা তাকাতে পারবেন, যখন দেবতাদের প্রতি তারা তাদের ভক্তি প্রদর্শন করবেন। টেরাহ বেশ আনন্দের সাথে তাদের চাহিদা পূরণ করতেন তার কারখানা থেকে মূর্তি সরবরাহ করে। একদিন যখন তিনি তার দোকানে অনুপস্থিত ছিলেন, আর ব্যবসা দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন আব্রাহাম, তখন সেখানে মূর্তি কিনতে এসেছিলেন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি। আব্রাহাম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার বয়স কত? বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘সত্তর’। তাহলে বলতেই হবে, আপনি আসলেই একজন নির্বোধ’, আব্রাহাম তাকে বলেছিলেন, ‘সাত দশক আগে আপনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তারপরও আপনি এমন একটি মূর্তিকে পূজা করবেন, যা এই দোকানের পেছনের কারখানাতে কেবল গতকালই বানানো হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটি কিছুক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন, তারপর আর মূর্তি না কিনে তিনি টাকা ফেরত নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে যান।

ঘটনাটি জানতে পেরে তার ভাইরা খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তারা তাদের বাবাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, আব্রাহাম কিন্তু পারিবারিক ব্যবসাটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে তার অনমনীয় মতামতের কারণে। সুতরাং টেরাহ আব্রাহামকে দোকানের সামনের অংশ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পূজার নিবেদনগুলো সংগ্রহ করতে, খদ্দেররা যা নিয়ে আসতেন। দোকানেরই একটি ঘরে সাজানো তাদের প্রিয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে। একদিন এক নারী দেবতাদের একজনের জন্য খাবার উপহার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রচলিত উপায়ে সেটি গ্রহণ না করে, আব্রাহাম তাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন, ‘বেশ, এই দেবতার একটি মুখ আছে বটে, তিনি বলেছিলেন, কিন্তু আপনার তৈরি করা খাবার এ না পারবে খেতে, না পারবে আপনাকে ধন্যবাদ বলতে। এর হাত আছে, কিন্তু তার সামনে এই খাবার রাখলেও হাত দিয়ে এক টুকরো খাবারও সে মুখে তুলতে পারবে না। যদিও এর সুন্দর করে খোদাই করা পা আছে, সেই পা তুলে এটি এক পাও আপনার দিকে এগিয়ে আসতে পারবে না। অন্তত আমার কাছে, যারা এটি বানিয়েছেন আর যারা এটি পূজা করেন তারা এই মূর্তিটার মতোই নির্বোধ আর অকেজো’।

দুটি কারণে সেই সময়ে এই ধরনের কথাবার্তা খুবই বিপজ্জনক একটি বিষয় ছিল। সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করা কখনোই জনপ্রিয় পদক্ষেপ নয়। আর এটি আরো বেশি খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যদি সমালোচনা স্থানীয় অর্থনীতির জন্যে হুমকিস্বরূপ হয়। এটি ছিল এমন একটি সমাজ যেখানে বহু দেবতারই পূজা করা হতো, এবং এইসব পূজনীয় দেবতাদের মূর্তি বানানো বেশ লাভজনক একটি ব্যবসা ছিল। সুতরাং আব্রাহাম নিজেকে ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তার জন্যে তখন একমাত্র নিরাপদ পথ ছিল, সেই শহর ত্যাগ করে চিরকালের জন্যে চলে যাওয়া। এই মুহূর্ত থেকেই তিনি গন্তব্যহীন যাযাবরে পরিণত হন, যিনি তার পরিবার আর পশুর পাল নিয়ে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন। কিন্তু এটি তার একটি আধ্যাত্মিক যাত্রাও ছিল, যা ধর্মীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।

আব্রাহামের গল্পটি সেই মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করে, যখন বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদ বরাবর ধর্মীয় ভাবনাগুলোর দিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, যখন বহু। দেবতার প্রতি শিথিল আনুগত্য আর উপাসনা, একজন ঈশ্বরের প্রতি কঠোর আনুগত্যে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। এই পরিবর্তনটিকে প্ররোচিত করেছিল কি? কেন আব্রাহাম তার বাবার দোকানের এইসব নিরীহ ছোট মূর্তিগুলোর ব্যাপারে এত ক্ষুব্ধ ছিলেন? আব্রাহামের মনের ভিতর প্রবেশ করতে আমাদেরকে কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু সেখানে আসলে কী ঘটেছিল তার অংশবিশেষ অনুধাবন করার বিষয়টি বেশ সহজ। তিনি দেখেছিলেন যে, তার বাবা এই ছোট মূর্তিগুলো খোদাই করছেন। তিনি জানতেন এইসব বানাতে কী ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং তিনি কীভাবে এটিকে মানুষের খেলনা ছাড়া আর অন্যকিছু ভাববেন? বেশ, তাহলে সহজ বিশ্বাসীদের মতো তিনি কেন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিষয়টি উপেক্ষা করেননি এবং নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি? কেন তিনি এত রেগে গিয়েছিলেন?

এর কারণ, তিনি ছিলেন একজন নবী। যিনি তার মাথায় ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন। এবং সেই কণ্ঠ তাকে সতর্ক করেছিল, এইসব দেবতাদের পূজা করা শুধুমাত্র একটা খেলা নয়-যা মানুষকে বিনোদন দেয় অথবা মূর্তি ব্যবসায়ীদের জীবিকা অর্জনে সহায়তা করে। এর ভিত্তি একটি ভয়ংকর আর বিপজ্জনক মিথ্যা। শুধুমাত্র একজনই ঈশ্বর আছেন, তিনি শুধুমাত্র এইসব মূর্তি আর দেবতাদের ছবি দেখেই বিতৃষ্ণাই অনুভব করেননি, এগুলো তিনি তীব্রভাবে ঘৃণা। করতেন, কারণ এগুলো সত্যিকার সৃষ্টিকর্তা পিতার সাথে পরিচয় হওয়া থেকে। তার নিজের সন্তানদের বাধা দেয়। আগন্তুকের দ্বারা অপহৃত হওয়া সন্তানের পিতামাতাদের মতো তিনি তাদের ফেরত চান, আর তাদের যারা অপহরণ করছিল, তাদের শাস্তি চান।

এটি মানবকাহিনির ক্রান্তিকালীন গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত, এবং বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভাবা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। আমাদের ইতিহাস থেকে স্পষ্ট যে, পরস্পরকে ঘৃণা করার ব্যাপারে মানুষ খুবই দক্ষ। সাধারণত যারা আমাদের থেকে কোনো না-কোনোভাবে ভিন্ন, তারাই আমাদের ঘৃণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। বর্ণ, শ্রেণি, রঙ, লিঙ্গ, রাজনীতি, এমনকি চুলের রঙও আমাদের ভেতরে কুৎসিত আচরণ উসকে দিতে পারে। ধর্মও সেটি করতে পারে। বাস্তবিকভাবে, ধর্মীয় ঘৃণা সম্ভবত এই ধরনের মানব অসুস্থতার সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ, কারণ এটি মানুষের ঘৃণাকে ঐশ্বরিক যৌক্তিকতা প্রদান করে। কারো মতামত পছন্দ নয় বলে সেই মানুষগুলোকে ঘৃণা করা এক জিনিস। তবে বিষয়টি পুরোটাই ভিন্ন হয়ে ওঠে, যখন এমন কিছু বলা হয় যে, ঈশ্বরও তাদের ঘৃণা করেন এবং তিনি তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান। সুতরাং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি লক্ষ করা যে, ধর্মীয় বিশ্বাস মানব সম্পর্কগুলোয় একটি বিপজ্জনক উপাদান যুক্ত করে আব্রাহামের কাহিনি থেকে আরেকটি ঘটনা যেমন সেটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

মূর্তিগুলোকে ঘৃণা করার নির্দেশ দেওয়া ছাড়াও, আব্রাহামের মাথার মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠা সেই কণ্ঠ তাকে তার পিতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য একটি দেশে চলে যাবার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিল, যেখানে একটি সময় তিনি একটি মহান জাতির সূচনা করবেন। সুতরাং জেনেসিস আমাদের বলছে যে, আব্রাহাম তার পরিবার এবং গবাদি পশুর পাল নিয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন, এবং তিনি ইউফ্রেতিস অতিক্রম করে পশ্চিমদিকে তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন, যতক্ষণ-না তিনি কানানে এসে পৌঁছান। কানান আজ পরিচিত ইসরায়েল অথবা প্যালেস্টাইন নামে, একটি বিশাল সাগরের পূর্বতীরে যার অবস্থান, যে সাগরটিকে আমরা এখন ভূমধ্যসাগর নামে চিনি। তবে সাগরতীরে নয় বরং আব্রাহাম তার বসতি গড়েছিলেন আরো অভ্যন্তরে, দেশটির মেরুদণ্ডের মতো বিস্তৃত চুনাপাথরের পাহাড়শ্রেণির ধার ঘেঁষে বিস্তৃত সমতলে। এখানেই তার পরিবার আর তার অনুসারী গোত্র-সদস্যরা ক্রমশ আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।

তারপর একদিন আবার সেই কণ্ঠটি আব্রাহামের মাথায় কথা বলে উঠেছিল। এটি তাকে নির্দেশ দিয়েছিল তার ছেলে আইজাককে স্থানীয় পাহাড়ের উপর একটি জায়গায় নিয়ে যেতে, যেখানে তাকে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বিসর্জন দিতে হবে। আব্রাহাম পশুহত্যা এবং তাদের পুড়িয়ে ঈশ্বরের প্রতি বিসর্জন দেওয়ায় অভ্যস্ত। ছিলেন, কিন্তু তিনি কখনোই তার নিজের সন্তানদের কাউকে বিসর্জন দেবার এমন কোনো নির্দেশ পাননি। কিন্তু তিনি সেই নির্দেশকে প্রশ্ন কিংবা অমান্য করার সাহসও পাননি। পরের দিন বেশ সকালেই তিনি ঘুম থেকে উঠে বেশকিছু জ্বালানি কাঠ দড়ি দিয়ে বেঁধে তার গাধার পিঠে দুজন তরুণ আর তার ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। যখন সেই পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছেছিলেন, তিনি সেই তরুণদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার জন্যে সেখানে অপেক্ষা করতে এবং তার গাধাটির পাহারা দিতে। তিনি জ্বালানি কাঠের আঁটিটা পুত্র আইজাকের পিঠে বেঁধে দেন, একটি মশাল জ্বালান এবং ধারালো একটি ছুরি তার কোমরবন্ধে গুঁজে নেন। এবং দুজনেই পর্বতের উপরে উঠতে শুরু করেন। যখন তারা এই পাহাড় বেয়ে উঠছিলেন আইজাক তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিসর্জনের জন্য আপনার কাছে আগুন আর ছুরি প্রস্তুত আছে বাবা? কিন্তু সেই প্রাণী কৈ, যাকে আপনি জবাই করবেন? উত্তরে আব্রাহাম বলেছিলেন, চিন্তা কোরো না পুত্র, আমাদের যা দরকার তা সব ঈশ্বরই জোগাড় করে দেবেন।

যখন তারা পাহাড়ের উপর সেই জায়গায় উপস্থিত হলেন, যেখানে বিসর্জন দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আব্রাহাম পাথর দিয়ে সাজিয়ে একটি সাময়িক পূজার বেদি তৈরি করলেন, এবং এর উপর জ্বালানি কাঠ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি তার আতঙ্কে কম্পমান পুত্রকে ধরে মুখ নিচু করে সেই কাঠের সাথে বেঁধে ফেলেন। এরপর তিনি আইজাকের লম্বাচুল দুই হাতে ধরে মাথাটা টান দিয়ে উপরে তোলেন তার গলাটি উন্মুক্ত করতে। এরপর তিনি তার কোমর থেকে ছুরিটি টেনে বের করেন এবং তার পুত্রের গলা কাটতে উদ্যত হন, ঠিক যখনই এই কাজটি তিনি করবেন, তখনই তার মাথার সেই কণ্ঠস্বর আবার তাকে নির্দেশ দিয়েছিল।

‘আব্রাহাম, তোমার পুত্রকে হত্যা কোরো না, এটি বলেছিল, আমার নির্দেশে তাকে হত্যা করতে তোমার ইচ্ছাটাই প্রমাণ করে, মানবিক আবেগের চেয়ে আমার প্রতি তোমার আনুগত্য আরো বেশি শক্তিশালী। সুতরাং, আমি তোমার পুত্রের জীবন রক্ষা করব। ভয়ানকভাবে কম্পমান আব্রাহাম তার ছুরি নিচে নামিয়ে নেন, তারপরই তিনি কাছেই একটি বড় রামছাগল লক্ষ করেন, একটি কাঁটা ঝোপে যার শিং আটকে গিয়েছিল। উদ্বেগ থেকে মুক্তির উন্মত্ততায় তিনি তার পুত্রের পরিবর্তে দ্রুত সেই প্রাণীর গলা জবাই করেন এবং ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন করেন সেই বেদিতে এই মাউন্ট মরিয়া’র বিষয়ে আমাদের কখনোই বলা হয়নি, আইজাক এই। ভয়ানক অভিজ্ঞতা নিয়ে কী ভেবেছিলেন। কিন্তু সেটি কল্পনা করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

আমরা জানি কিছু আদি ধর্মে মানব বিসর্জনের প্রচলন ছিল। এবং কীভাবে এটি শুরু হয়েছিল সেটি বোঝাও খুব কঠিন নয়। দেবতাদের যদি স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মতো ভাবা হয়, যাদেরকে আপনার পক্ষে রাখতে হবে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, কীভাবে আদিম মন হয়তো এমন কোনো উপসংহারে পৌঁছেছিল : সেরা প্রাণীটি বিসর্জন দেবার পাশাপাশি মাঝে মাঝে মানুষ বলি দিলে হয়তো আসলেই তাদের সমর্থন আর মন জয় করা সম্ভব হতে পারে। আব্রাহাম আর আইজাকের এই বিষণ্ণ গল্পে হয়তো একটি দূরের প্রতিধ্বনি আছে। কিন্তু এটি সেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি প্রথাগত জুডাইজম বা ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামে। যে ধর্মগুলোর জন্যে এটি আবশ্যিক পাঠ্যাংশ। তাদের জন্য এই কাহিনিটি যা সংজ্ঞায়িত করেছে, সেটি হচ্ছে পৃথিবী সব বন্ধন উপেক্ষা করে। ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি চূড়ান্ত নিবেদন আর আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ। যদিও আমরা এখন এমন কোনো পিতাকে অবশ্যই উন্মাদ ভাবব, যিনি কিনা দাবি করেন, তার পুত্রকে হত্যা করতে ঈশ্বরই তাকে নির্দেশ দিয়েছেন–এমনকি যদি সে শেষমুহূর্তে সেটি না করে পিছিয়েও আসেন–এর মানে এই না যে, সব ধর্মই একটি পাগলামি এমন কোনো সিদ্ধান্তে আমাদের খুব দ্রুত পৌঁছাতেই হবে। কিন্তু এর। কিছু দাবির বিপরীতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রাখা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে, সময়ের সাথে যখন এই গল্পটাকে আমরা আরো অনুসরণ করব। যে বিপদটি আমরা এখানে লক্ষ করেছি, সেটি হচ্ছে মানবমনের মধ্যে কথা বলা ঈশ্বরের কণ্ঠকে অতিরিক্ত বেশি কর্তৃত্ব দেবার প্রবণতা। মূর্তির প্রতি আব্রাহামের গভীর ঘৃণা এখানে একটি ভালো নির্দেশিকা।

আমরা তার চিন্তাটিকে অনুসরণ করেছি, যেখানে তিনি মানুষের সৃষ্টি বলে মূর্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেছেন, এদের স্বর্গীয় কোনো শক্তি বলে ভাবা পুরোপুরিভাবেই অদ্ভুত একটি বিষয়। কিন্তু ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের ধারণাগুলো কি মানুষেরই আবিষ্কার নয়? আমরা হয়তো সেগুলো পাথর কিংবা কাঠের টুকরো ব্যবহার করে নিজেদের হাত দিয়ে খোদাই করে তৈরি করিনি। কিন্তু আমরা সেটি করেছি আমাদের মনের গভীরে, শব্দ আর ধারণা দিয়ে। এইসব ধারণাগুলোর নামে করা দাবিগুলোর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে এটি যথেষ্ট একটি কারণ হওয়া উচিত। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি এরকম কিছু দাবি কত বিপজ্জনক হতে পারে। সেই ধারণাটি ঈশ্বর হয়তো চাইতে পারেন আমরা যেন আমাদের সন্তানদের বিসর্জন দিই– প্রদর্শন করে ধর্ম মানবসমাজের জন্যে একটি শক্র হতে পারে। আব্রাহামকে নিয়ে ঈশ্বরের পরীক্ষা আর কিছু না হলেও অন্তত এটি প্রমাণ করে যে, মানুষ তাদের নিজেদেরকে যে-কোনোকিছু করতেই প্ররোচিত করতে পারে, যদি তারা মনে করেন সেই নির্দেশটি এসেছে ‘উপর’ থেকে। কোনো-না-কোনো সময়, প্রায় সবকিছুই ধর্মের নামে করা হয়েছে।

আমি বলেছিলাম যে, আব্রাহামের গল্পটি ধর্মের ইতিহাসের একটি ক্রান্তিকালীন মুহূর্ত। এটি বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদ, একজন ঈশ্বরের ধারণার দিকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এবং এটি প্রদর্শন করেছিল ধর্মগুলো কখনোই স্থির বা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে না। সারাক্ষণই সেগুলো বিবর্তিত আর পরিবর্তিত হচ্ছে। ধর্ম অনেকটাই চলচ্চিত্রের মতো। আর সে-কারণে আব্রাহাম খুবই প্রভাবশালী একটি চরিত্র। তিনি বহুদূরে অজানায় যাত্রা করেছিলেন আর তার দিক পরিবর্তন করেছিলেন, সেটি শুধু পৃথিবীর উপরেই না, তার নিজের মনেও। এই ঘুরে দাঁড়ানো আর দিক পরিবর্তন করার ক্ষমতাই কৌতূহলোদ্দীপক সব মানুষেরই বৈশিষ্ট্যসূচক একটি চিহ্ন। আর ধর্ম বোঝার জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি।

আব্রাহাম গন্তব্যহীন একটি পথের যাত্রী ছিলেন, এবং তার মৃত্যুর পর, যে গোত্রগুলো তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলোর সদস্যরা তাদের যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন, যেমন মানুষ সবসময়ই করেছে আরো উত্তম জীবনের অনুসন্ধানে। কাহিনি বলছে, আব্রাহামের মৃত্যুর কয়েক প্রজন্ম পরে একটি বড় দুর্ভিক্ষ কানান আক্রমণ করেছিল, যা বাধ্য করেছিল তার উত্তরসূরিদের আবার পথে নামতে। এইবার তারা দক্ষিণে আরেকটি বিশাল নদী অতিক্রম করে মিশরে গিয়েছিলেন। যেখানে তাদের ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। যেখানে মোজেসের সাথে আবার আমাদের দেখা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *