০৩. চাকা

অধ্যায় ৩. চাকা

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির একটি জনপ্রিয় মূলভাবনা হচ্ছে, একজন নায়ক সময়ের অতীতে যিনি ফিরে যান, অতীতের কিছু ঘটনা পরিবর্তন করতে, মানব-ইতিহাসের ওপর যে ঘটনাগুলো ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিল। এরকমই একটি গল্পের শুরুতে আমরা দেখি, উন্মত্ত, সন্ত্রাসী একজন বোমাবাজসহ একটি রেলগাড়ি রেললাইন ধরে দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছে। এবং রেলগাড়িটি যখন বিশাল একটি বাঁধের উপর দিয়ে অতিক্রম করছিল, সে বোমা বিস্ফোরণ করে এটিকে উড়িয়ে দেয়, এবং সেই বাঁধটি ভাঙার কারণে পুরো শহরটি নিমজ্জিত করার মতো ভয়াবহ প্লাবনের সৃষ্টি করে। সৌভাগ্যজনকভাবে সরকারের একটি গোপন বিভাগ একটি কৌশল পরিশীলিত করেছিল, তারা চাইলে যে-কোনো একজন ব্যক্তিকে অতীতের কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে পাঠিয়ে দিতে পারে। এই নতুন যন্ত্র ব্যবহার করে এই রেলগাড়িটি স্টেশন ত্যাগ করার আগেই তারা তাদের একজন এজেন্টকে সেই রেলগাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বোমাবাজকে খুঁজে বের করা এবং বোমাটিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য তাকে দুইঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় অতিক্রান্ত হবার কয়েক মুহূর্ত আগে সেই এজেন্টটি তার মিশনটি সফল করতে পেরেছিলেন, শহরটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। আমরা অধিকাংশই এভাবে অতীতে ফিরে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেছি, যেমন, কিছু ঘটার আগে একটি ম্যাসেজ যদি মুছে ফেলতে পারি অথবা কিছু করার তাড়না ঠিক সময়মতো দমন করতে পারি যা অন্যদের কষ্ট দিয়েছে এবং আমাদের জন্যে কেবল দুঃখের কারণ হয়েছে। কিন্তু ‘ল অব কনসিকোয়েন্স’ (পরিণতির সূত্র অথবা একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার পরে ঘটবে এমন একটি শর্ত) পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আর আমরা যা করেছিলাম তার পরিণতিসহ আটকা পড়ে যাই।

হিন্দুধর্মে এটিকে কার্মা অথবা কর্মের সূত্র (ল অব ডিড) বলা হয়। কিন্তু এটির ব্যাপ্তি শুধুমাত্র এই জীবনটি নয় যা আপনি এখন যাপন করছেন। হিন্দুধর্মের শিক্ষানুয়ায়ী, আপনার আত্মা এই মুহূর্তে যে-জীবনটি আপনি কাটাচ্ছেন, সেটিতে আসার আগে, অতীতে আরো বহু জীবন কাটিয়ে এসেছে। আর এই জীবনটি শেষ হবার পরে ভবিষ্যতে আপনি আরো বহু জীবন কাটাবেন। এই জীবনগুলো প্রত্যেকটি নির্ধারিত হয় কীভাবে আপনি এর আগের জীবনটি কাটিয়েছেন তার ওপর, এবং সেটি নির্ভর করবে এরও আগের জীবন এবং সেই জীবনের আগের জীবন কেমন কাটিয়েছিলেন তার ওপর। এভাবে বহুদূর একটি অতীতের অস্পষ্টতায় যা বিস্তৃত হয়ে আছে। ঠিক এখন যেভাবে আপনি আচরণ করছেন সেটি জীবনের চাকার পরবর্তী ঘূর্ণনে আপনি কেমন জীবন পাবেন সেটিকে প্রভাবিত করবে।

যখন ভারতের নবী আর প্রাজ্ঞ সাধুরা দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবং মানুষ যখন মারা যায় তাদের সাথে কী ঘটে সেই বিষয়ে ভেবেছিলেন, তারা একটি আকর্ষণীয় উত্তর পেয়েছিলেন। মানুষ আসলে মরে না, সেই অর্থে যে সম্পূর্ণভাবে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়, অথবা সেই অর্থে যে তারা মৃত্যুর পরে অন্য কোনো একধরনের জীবন কাটানো অব্যাহত রাখেন। না, তারা পৃথিবীতেই আবার ফিরে আসেন অন্য কোনো জীবনের রূপে, যে রূপটি কী হবে তা নির্দেশ করে তাদের অতীত সব জীবনের কার্মা। আর সেই জীবনটি মানুষ হিসাবে নাও হতে পারে। পুরো অস্তিত্বটাই এখানে একটি বিশাল রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহৃত হবার কারখানা, যেখানে জীবনের গুণগতমান, যা ‘মৃত্যু’ চিহ্নিত দরজা দিয়ে অতিক্রম করে, সেটি ‘পুনর্জন্ম’ নামে চিহ্নিত দরজার অন্যদিক থেকে বের হয়ে আসা জীবনের রূপ ও গুণগত মানকে প্রভাবিত করে। আর এই কারখানাটির নাম হচ্ছে ‘সামসারা’ (সংসার, জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের চক্র, মানে এই চক্রের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা), কারণ আত্মাগুলো এর মধ্যদিয়ে বাহিত হয়ে তাদের পরবর্তী এবং তার পরবর্তী (এবং পরবর্তী…) রূপগুলো পায়। ভালো কিংবা খারাপ, প্রতিটি কর্ম যা তারা একটি জীবনে করেছিলেন, সেগুলো তাদের পরবর্তী জীবনগুলোর গুণগত মানটিকে প্রভাবিত করে। আর শুধুমাত্র মানুষ প্রাণীরাই এই সামসারার চক্রে আটকে পড়ে নেই। পুরো পৃথিবীটা নিজেই মৃত্যু আর পুনর্জন্মের একই আইন মেনে চলে। এই অস্তিত্বের বর্তমান চক্রটি শেষে, এটি একটি বিশ্রামপর্বে প্রবেশ করবে, যেখান থেকে সময় হলে আবার এটিকে ডেকে নিয়ে আসা হবে অস্তিত্বের ভিন্ন একটি রূপে। সুতরাং অস্তিত্বের এই চাকাটি বিরতিহীনভাবেই ঘূর্ণায়মান।

কিন্তু এই কার্মাকে (বা কর্ম : কাজ, অভিপ্রায় ও ফল) তারা অতিপ্রাকৃত কোনো আত্মা-পরিদর্শকের পরিকল্পিত শাস্তি হিসাবে মনে করেন না। কার্মা মাধ্যাকর্ষণের সূত্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক একটি আইন, যেখানে কোনো একটি জিনিস আরেক জিনিস থেকে আসে, যেভাবে কোনো ফলাফল কারণ অনুসরণ করে। যেমন, একটির-পর-একটি সাজানো ইটের প্রথমটিকে স্পর্শ করে ধাক্কা দিলে দেখা যায় একটার-পর-একটা সবগুলো ইটই পড়ে যাচ্ছে। ‘সামসারা’র মধ্যে দিয়ে এর যাত্রায় আত্মাকে হয়তো এমনকি আট মিলিয়ন সংখ্যক বার জীবনের রূপে আবির্ভূত হতে হয় অবশেষ-এর মোক্ষ অর্জন করার পূর্বে।

মৃত্যুর পর আমাদের সাথে কী ঘটে, সেটির এই বিবরণটির ধর্মীয় পরিভাষায় নাম হচ্ছে ‘রিইনকারনেশন’ বা পুনর্জন্ম। সারা পৃথিবীজুড়েই বহু সমাজেই এটি বিশ্বাস করে আসা হচ্ছে, তবে ভারতে হিন্দুধর্মের মতো আর কোথাও এটি এত তীব্রতা অর্জন করতে পারেনি। এটিকে ব্যাখ্যা করতে যেসব শব্দ আমি ব্যবহার করেছি, কার্মা, কাজের সূত্র, ‘সামসারা’, ‘মোক্ষ’ বা মুক্তির অনুসন্ধানে জন্ম জন্মান্তরের আত্মার পরিভ্রমণ, সব এসেছে সংস্কৃত নামক একটি প্রাচীন ভাষা থেকে। এই ভাষাটিকে ভারতে নিয়ে এসেছিল উত্তর থেকে আসা একদল বন্য আগ্রাসনকারী। কমন এরা শুরু হবার প্রায় দুই হাজার বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব) ভারতে তাদের আবির্ভাবে সাথে আমরা হিন্দুধর্মের সূচনাপর্বটির সময় নির্ধারণ করতে পারি।

ভারতের উপরে বহু দূর-উত্তরে তৃণভূমির বিস্তৃত একটি ভৌগোলিক এলাকা আছে, যাদের বলা হয় মধ্য-এশীয় স্টেপস। এটি মৃত, রুক্ষ, বৃক্ষহীন, তৃণাবৃত, সুবিস্তীর্ণ সমতল একটি এলাকা, ঘোড়সওয়ার কাউবয়দের জন্যে আদর্শ, যারা তাদের গবাদি পশুর পালের জন্যে সেরা চারণভূমির সন্ধানে চিরব্যস্ত। নিশ্চিত নয় এমন কিছু কারণে কমন এরা শুরু হবার আগের দ্বিতীয় সহস্রাব্দে, আরো উত্তম একটি জীবন খুঁজে পাবার প্রত্যাশায় মানুষ এই স্টেপস থেকে দক্ষিণে অভিযাত্রা করতে শুরু করেছিল। তাদের অনেকেই আরো দক্ষিণে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তারা তাদের নিজেদের স্বদেশবাসী/স্বদেশি বা স্বজাতি বলতেন, তাদের নিজেদের ভাষায়, ‘আর্য’। তারা যুদ্ধপ্রিয় একটি জাতি ছিল, দ্রুতগামী রথ পরিচালনা করতেন; উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে সিন্ধুনদের উপত্যকায় দলবেঁধে ঢেউয়ের মতো তারা প্রবেশ করেছিলেন।

ইতিমধ্যেই সেখানে একটি উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব তখন ছিল, যে সভ্যতাটির অগ্রসর পর্যায়ের শিল্পকলা, স্থাপত্য আর ধর্মের একটি কাঠামো ছিল। আর উন্নত সমাজের মতোই এটিরও যেমন সদগুণাবলি ছিল, তেমন অনাচারও ছিল। আর এরকম একটি দৃশ্যে এই আর্য আগ্রাসনকারীরা তাদের ঘোড়ায় চড়ে হাজির হয়েছিলেন, তাদের সূক্ষ্ম পরিশীলতায় যে ঘাটতি ছিল, শক্তি আর সাহস দিয়ে তারা সেই ঘাটতিটি পুষিয়ে নিয়েছিল। আরেকটি বিষয় যা স্থানীয়দের থেকে আগ্রাসীদের পৃথক করেছিল, সেটি হচ্ছে তার চামড়ার রং ছিল হালকা, আর সেই চামড়ার রঙের পার্থক্যের মধ্য বহু ইঙ্গিত প্রবেশ করেছিল, যা এখনো আমাদের এই সময় অবধি প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছে, যা সেই আর্য শব্দটিকে একটি কুৎসিত অর্থ। দিয়েছে। কিন্তু এই আগ্রাসীরা তাদের হালকা রঙের চামড়া ছাড়াও আরো কিছু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের দেবদেবীদেরও তারা সাথে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়াও এনেছিলেন বিস্ময়কর ব্যাপ্তির একটি ধর্মীয় সাহিত্যকর্মের সূচনা– যার নাম ‘বেদ’।

লিখিত রূপে বেদ রচিত হয়েছিল কমন এরা শুরু হবার ১২০০ থেকে ১০০০ বছর আগে, যখন আর্যরা ভারতে তাদের দৃঢ়ভাবে স্থাপন এবং এখানকার জীবনযাত্রার ওপর তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ‘শ্রুতি’ বা শোনা হিসাবে পরিচিত, বেদকে দুটি পৃথক অথচ সম্পর্কযুক্ত অর্থে বোঝা হতো। তাদের মূল বিষয়গুলো মূলত শুনেছিলেন অতীতের সাধুরা, অস্তিত্বের অর্থ তাদের কাছে পরপার থেকে উন্মোচিত হবার যারা অপেক্ষায় ছিলেন। তারা ছিলেন এর মূল শ্ৰোতা সেই মানুষগুলোর সাথে যেই কণ্ঠগুলো কথা বলেছে। এবং তারা যা শুনেছিলেন, সেটি তাদের কাছ থেকেই শুনেছিলেন তাদের অনুসারীরা, যা তাদের কাছে বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন তাদের শিক্ষকরা। এভাবে বেদের মূল আধেয়টি মুখে-মুখে শতাব্দীর-পর-শতাব্দী হস্তান্তরিত হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র শিখতে চায় এমন কারো সেগুলো উচ্চস্বরে আবৃত্তি করা এখনো পছন্দনীয় একটি উপায়। আপনি কোনো বাইবেল বা কুর’আন পাবেন না হিন্দু মন্দিরে, কিন্তু এর উচ্চারিত সমতূল্য শব্দগুলো সেখানে পালিত হওয়া বিভিন্ন আচারে আপনি শুনতে পারবেন।

বেদ শব্দটির অর্থ ‘জ্ঞান’। শব্দটির মূল ইংরেজি ‘উইট’ বা ‘উইসডোম’ শব্দটির মূলের মতো। মোট চারটি বেদ ছিল : ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেকটি বেদ আবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত : সংহিতা (মন্ত্র ও আশীর্বচন), আরণ্যক (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম, যজ্ঞ ও প্রতীকী যজ্ঞ), ব্রাহ্মণ (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির ওপর টীকা) ও উপনিষদ (ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনা)। এদের সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য এখানে যুক্ত করছিঃ যেমন, ঋগ্বেদ সংহিতা এই চারটি বেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন; এখানে এক হাজারের বেশি স্তোত্র ও মন্ত্র আছে যা দেবতাদের প্রতি স্ত বগাথা। ধর্মে এই আচারটিকে বলা হয় ‘পূজা’ (উপাসনা)। অন্য আরেকটি উপায়ে এটি ভাবা যেতে পারে। এটি সেই ধরনের চাটুকারিতা যা শক্তিশালী শাসকরা সাধারণত উপভোগ করে থাকেন, অনেকটাই সেরকম যেভাবে ব্রিটেইনের রানিকে সম্বোধন করা হয়, ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি’, এবং প্রজারা সবাই মাথা নুইয়ে সম্মান জানাবে এমন প্রত্যাশা করা হয় যখনই তার সাথে দেখা হবে, এখানে যেমন ঋগ্বেদের একটি উদাহরণ :

সবকিছুর স্রষ্টা, অসীম জ্ঞানী, অসীম শক্তিমান, স্রষ্টা, নির্দেশদাতা, সর্বোচ্চ আদর্শ … আপনি একটি ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়ই। খুব স্পষ্ট করেই এটি বলে দিচ্ছে! আর যেমন করে পার্থিব সম্রাটরা উপহার পেতে ভালোবাসেন, এছাড়া প্রশংসায় আপুত হয়ে আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পছন্দ করেন, দেবতারাও সেটাই চান। যদি স্তোত্ৰগীত দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদিত আমাদের চাটুকারিতা হয়ে থাকে, বিসর্জনগুলো হচ্ছে সেই উপহারগুলো, যা সাধারণত এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। এবং সেগুলো সতর্কভাবে পরিকল্পিত অনুষ্ঠান আচারের মাধ্যমে দেবতাদের প্রতি নিবেদন করতে হবে, যার জন্যে দক্ষ পেশাজীবীদের দরকার, যারা পুরো অনুষ্ঠানটি নিয়মমাফিক পরিচালনা করেন। হিন্দু ঐতিহ্যে যে-পুরোহিতরা এই বিসর্জনের বিষয়টি পরিচালনা করেন তাদের বলা হয় ব্রাহ্মণ (বর্ণ), আর এই কাজে তাদের সহায়তা করতে নির্মিত নির্দেশিকাগুলো, যা তারা সংকলিত করেছিলেন, সেটিকে হিন্দুশাস্ত্র বলা হয়।

এই ধরনের নির্দেশিকা অধিকাংশ মানুষের জন্যে ক্লান্তিকর একটি বিষয়। কিন্তু সেগুলো বিশেষ ধরনের ধর্মীয় মনের কাছে প্রায় আচ্ছন্ন করে রাখার মতোই আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে। তারুণ্যে যাজক হবার জন্যে যখন আমি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম, খ্রিস্টীয় বিভিন্ন প্রথার বহু বিচিত্র আচার আর অনুষ্ঠানের নির্দেশিকা আমাকে বিস্মিত করেছিল। বিশাল আকারের একটি বই আছে, যার নাম ‘দ্য সেরেমনিস অফ দ্য রোমান রাইট ডেসক্রাইবড’, এছাড়াও অপেক্ষাকৃত বেশ নিপ্রভ চার্চ অব ইংল্যান্ডেরও এই বইটির একটি সংস্করণ আছে : ‘রিচ্যুয়াল নোটস’। আমি খুব উৎসাহের সাথে সেই বইয়ে ডুবে যেতাম, কল্পনা করতাম বিশপদের বাহিনী ধীরে সুবিশাল ক্যাথিড্রালের মধ্যদিয়ে হেঁটে আসছেন, মিষ্টি ধূপের ধোয়ায় পুরো ক্যাথিড্রাল পূর্ণ। ঐ বইগুলোই ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় ধর্মের জন্য ব্রাহ্মণ। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্মকর্তারাই আনুষ্ঠানিক কাপড় পরেন, বা বিস্তারিত আচার পালন করেন না। বহু গোপনীয় ক্লাব আর শিক্ষার্থীদের ভ্রাতৃত্ব সংগঠনগুলোরও নিজস্ব গোপন আচার-অনুষ্ঠান আছে, যা প্রতীক আর আনুষ্ঠানিক আচারের মানব প্রয়োজনীয়তাটি স্মরণ করিয়ে দেয়।

যদি আমার মতো আপনিও বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে কোনো একটি ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে বেদ এর বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটির আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত। এটি এসেছে উপনিষদে; যা লেখা হয়েছে প্রায় তিন শতাব্দী বিস্তৃত একটি সময়পর্বে এবং এর কাজ শেষ হয়েছে কমন এরা শুরু হবার প্রায় ৩০০ বছর আগে। উপনিষদ বা ‘একজন শিক্ষকের নিকট উপবেশন’ –ধর্মীয় আচার, আনুষ্ঠানিক প্রথা ও উৎসবের দিক থেকে হিন্দুধর্মের আগ্রহের লক্ষ্যটিকে দার্শনিক আর ধর্মতত্ত্বের দিকে পরিচালিত করেছিল। এই উপনিষদেই আমরা প্রথম ‘কার্মা’ আর ‘সামসারা’র মতবাদটি খুঁজে পেয়েছিলাম, যা আমরা এই অধ্যায়ের শুরুতে খানিকটা আলোচনা করেছি।

পরবর্তী অধ্যায়ে এইসব সুনির্দিষ্ট হিন্দুশিক্ষাগুলোর কয়েকটির আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল আর যেভাবে সেগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেটি আমরা অনুসন্ধান করব। কিন্তু আমি ধর্মের আরেকটি বড় প্রশ্নের হিন্দুধর্মীয় উত্তরটি দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই। মৃত্যুর পর আমাদের সাথে কী ঘটে সেই প্রশ্নটির উত্তর এই ধর্মটি কীভাবে দিয়েছে ইতিমধ্যেই সেটি আমরা দেখেছি। উপনিষদের উত্তরটি ছিল পুনর্জন্মবাদের আকর্ষণীয় মতবাদ। আরেকটি যে-প্রশ্ন ধর্ম সবসময়ই জিজ্ঞাসা করে থাকে, সেটি হচ্ছে : যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে এই মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে সেই অসীম অন্ধকারে আসলে কী আছে? অন্য ধর্মগুলো মূলত নবীদের নাম উল্লেখ করেছে, যারা তাদের এই উত্তরগুলো দিয়ে গেছেন, এবং তাদের উত্তরগুলোকে তারা নিজেদের উত্তর হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাদের নামেই তারা নিজেদের ও তাদের ধর্মের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু হিন্দুধর্মের সাথে

এমনটা ঘটেনি। এই ধর্মে এমন কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই, যার কাছ থেকে ধর্মটি। তার নাম নিতে পারে। অতীতেও একক কোনো চরিত্র নেই, যার কাছ থেকে এটি অনুপ্রেরণা পেয়েছে বলে দাবি করতে পারে। ভারতের গভীর অতীতের অজ্ঞাতনামা কিছু স্বাপ্নিকদের কাছ থেকে এটি এসেছিল। কিন্তু যদিও ঐসব প্রাচীন স্বাপ্নিকদের নাম তারা মনে রাখেননি ঠিকই, তবে তাদের যা-কিছু বলা হয়েছিল, সেটি তারা সংরক্ষণ করেছেন।

এবং ঋগ্বেদে এটি ধর্মের সেই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া শুরু করেছিল, আসলেই আমাদের এই মহাবিশ্বের বাইরে কী আছে। আর এটি শুনতে হলে সেই উত্তর ভারতের নক্ষত্রপূর্ণ আকাশের নিচে আগুনের পাশে বসে আছেন এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করতে হবে, যেখানে তাদের অজানা সাধুদের একজন সময়কে ভেদ করে মহাবিশ্বের সেই সূচনা আর সেটিকে ছাড়িয়ে যেতেন। কথা নয়, রাতের অন্ধকারের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে তিনি স্তব পাঠ করতেন :

যখন অনস্তিত্ব কিংবা অস্তিত্ব কিছুই ছিল না: কোনো বায়ুর
জগৎ ছিল না, সেটি ছাড়িয়ে ছিল না কোনো আকাশ;
সেই ‘একটি’ মাত্র জিনিস, কোনো নিশ্বাস ছাড়া,
তার নিজের প্রকৃতি দিয়ে শ্বাস নিয়েছিল :
এটি ছাড়া আর কোনোকিছুই ছিল না।
এই পৃথিবী তৈরি হবার পরেই দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছে।
কে তাহলে জানে।
কীভাবে এটি প্রথম অস্তিত্বশীল হয়ে উঠেছিল?
তিনি, এইসব সৃষ্টির যিনি প্রথম, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছিলেন,
অথবা করেননি।
যার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ আকাশ,
আসলেই তিনি সবকিছুই জানেন,
অথবা হয়তো তিনি সেটি জানেন না।

তিনি যে স্তবটি পাঠ করছেন আর আমরা শুনছি, সেখানে বিস্ময় আছে। আমাদের বলা হয়েছে, দেবতারা আছে, কিন্তু তাদের সৃষ্টি হয়েছে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে। এর মানে হচ্ছে তারাও, আমাদের মতোই সৃষ্ট এবং তারা সময়ের সেই চক্রের ঘূর্ণনে আবদ্ধ। তারাও আমাদের মতোই আসেন এবং চলে যান। কিন্তু সেই স্বাপ্নিক আভাস দিয়েছেন, ঐসব রূপ-পরিবর্তনের পেছনে এমন কিছু আছে যা কখনোই বদলায় না, অপরিবর্তনশীল; সেই একটা জিনিস, যেভাবে তিনি বলেছেন। যেন ইতিহাস আর এর পাত্রপাত্রীরা সব কুয়াশার মতো কিছু, যা বিশাল কোনো পর্বতের উপস্থিতিকেও আচ্ছাদিত আর বিকৃত করে উপস্থাপন করতে পারে : ‘সেই একটি জিনিস’, কিন্তু কী সেটা? আর দেবতারাই বা কে, যারা এর প্রতিনিধিঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *