প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

২.৭ প্রতিশোধ ॥ খাজা আহমদ আব্বাস

প্রতিশোধ ॥ খাজা আহমদ আব্বাস

প্রতিশোধ – খাজা আহমদ আব্বাস

দুটো রঙের বিভীষিকা। ভয়ঙ্করের প্রেতচ্ছায়া অদৃশ্য কায়াহীন পদসঞ্চারে পিছু নিয়েছে। তার দিনরাত্রির।

লাল, টক্টকে লাল; আর ফ্যাকাশে হলুদ, ভয়াবহ বিবর্ণতা।

লাল। মানুষের তাজা খুন যেন।

হলুদ। মড়ার মুখের রক্তশূন্য পাণ্ডুরতা!

লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল, বাতাসের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙ দুটোর বুদ্বুদ।

হলুদ আর লাল, লাল আর হলুদ–প্রেতায়িত সূর্যরশ্মির তীব্রতা তার চোখ ভেদ করে সোজা মগজে খোঁচা মারছে; হাজার হাজার অদৃশ্য সূচের মতো লাল আর হলুদ রশ্মির তীক্ষ্ণতা তার সমস্ত দেহ খুঁচিয়ে বিধছে।

দিনে-রাত্তিরে, কি জাগরণে, কি নিদ্রায়–হয়তো হাঁটছে, হয়তো-বা বসে রয়েছে– সবসময়েই চোখের সামনে বিভীষিকার ভয়ঙ্কর আবৃত রঙ দুটোর শিখা নাচতে থাকে নারকীয় দানবের অজস্র লকলকে জিভের মতো। শয়তানের অগ্নৎসবে কাঠের বদলে পোপাড়ানো হচ্ছে অগুণতি মড়া। হাজার শব জ্বলছে এক চিতায়; আর অসংখ্য অদেহী আত্মা চারদিক ঘিরে নাচছে মৃত্যুতাণ্ডবের অদৃশ্য নাচ। তাদের ভীতিসঞ্চারী গর্জনে ধ্বনিত হচ্ছে :

প্রতিশোধ!

প্রতিশোধ!!

প্রতিশোধ!!!

লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল রঙ দুটোর জ্বলন্ত পাবকশিখার তীক্ষ্ণতা বেঁধে ফেলছে তার দেহমন আত্মার সামগ্রিকতাকে। কি প্রভাতের অরুণিমায়, কি সূর্যাস্তের মৃত্যুগরিমায় রঙ দুটোর শিখা তার চোখের সামনে সবসময়েই জ্বলতে থাকে। শিরার ভেতরে প্রবাহিত হতে থাকে জ্বলন্ত আগুনের তরলতা। রক্ত কোথায়? প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসে অগ্নিদাহের ধোয়ার গন্ধ। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি মানুষী সত্তা হারিয়ে নরকের অদৃশ্য আগুনে প্রেতাত্মায় রূপান্তরিত হয়েছে।

সবাই জানে হরিদাস পাগল হয়ে গেছে। হরিদাসও কথা কয় না কারো সঙ্গে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব–কারো সঙ্গে নয়। এই নির্বাকতাই তার মস্তিষ্কবিকৃতির যথেষ্ট পরিচায়ক। তা নাহলে সে কথা কয় না কেন? রাজ্যের যত মজার মজার মুখরোচক উত্তেজক আলাপ-আলোচনার আসরে তার অমন বোবা ও গোমড়া মুখ কেন? না কারো বিয়ের গল্প, কি সিনেমার গল্প, কি এমনি গালগল্প, কুৎসা, নিন্দা, রাজনীতি, সাহিত্য–না, হরিদাস এইসব কিছুরই চৌহদ্দির বাইরে। এমনকি চোখে-মুখে পর্যন্ত ভাবান্তর নেই, সমাজ-সংসারের বহু ঊর্ধ্বে, একেবারে নির্লিপ্ত। যেন সে পাথর হয়ে গেছে।

কিংবা অন্ধ, বোবা, বধির। কিন্তু একবার শুধু দাঙ্গা আর খুনের গল্প উঠিয়ে দাও, তারপর দেখ–ঘৃণা আর ক্রোধের লেলিহান আগুনের ঝলকে ওর চোখ দুটো উঠেছে জ্বলে। নির্বাক হরিদাসের অগ্নিভয়ঙ্কর চোখজোড়া তখন যেন লড়াইয়ের হাঁক দেয় :

প্রতিশোধ!

প্রতিশোধ!!

প্রতিশোধ!!!

পাঞ্জাব বিভাগের সময় হরিদাস ছিল লায়ালপুরের একজন ডাকসাইটে উকিল। তখন কেবল বিভক্ত পাঞ্জাবের টুকরো দুটোকে নৃশংস ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অগ্নিশ্রাবী কড়াইয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। লায়ালপুরের বাস্তুত্যাগীরা বলেছে, দাঙ্গায় হরিদাসের গোটা পরিবারটাই খুন হয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে লম্বা দশ মাস। কাল নাকি সর্বদুঃখহরা। সেই মারাত্মক স্মৃতিও ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এসেছে। তাছাড়া সঠিক কেউ জানতও না কীভাবে তার স্ত্রী আর কন্যা মারা গেছে। আরও হাজার হাজার জনের মতো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, না গৃহদাহে, না খুনখার ছুরির আঘাতে। হরিদাস কাউকে বলেনি সে-কথা।

হরিদাস পাগল হয়নি; অথচ মাঝে মাঝে পাগল হবার ইচ্ছাই তাকে পেয়ে বসে। তাহলে সবকিছু ভুলে যাওয়া যেত। হৃদয়বিদারী ভয়াবহ স্মৃতির অহর্নিশ নিপীড়ন অসহ্য–কীভাবে বাড়ি লুঠ হল, কীভাবে তার স্ত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরল, কীভাবে প্রতিবেশী-বন্ধুরা নিহত হল–এইসব। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে কন্যা জানকীর স্মৃতি। উঃ, ঘিলুতে কী যেন কামড়াতে থাকে। মনের পর্দায় মর্মান্তিক ছবিগুলো ভেসে ওঠে বিশৃঙ্খলভাবে।

সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি। ভয়ঙ্করও বটে।

জানকী, সতেরো বছরের জানকী। মায়ের বুকের ধন, বাপের চোখের মণি।

গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল গায়ের রঙ। আর চোখ, নার্গিস ফুল কোথায় লাগে! ছিপছিপে লতিয়ে ওঠা দেহবল্লরী। ভয় হয় মৃদুতম স্পর্শেই কুঁকড়ে যেতে পারে। গোটা লায়ালপুরে সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে জানকী।

মুখখানা কী চমৎকার! সারল্যের প্রলেপ রয়েছে তার ওপরে।

পাশাপাশি আরেকটা ছবি ঝিলিক মেরে ওঠে।

কয়েকটি কুৎসিত ভয়াবহ মুখাবয়ব। চোখে পাশব কামনার সর্বধ্বংসী অগ্নিশিখা। ওষ্ঠের কুঞ্চনে শয়তানের নারকীয় হাসি।

সূর্যালোকে চকচক করছে ছুরির শাণিত ধার। বন্দুকের অদৃশ্য কালো কালো চোখ দ্যুতিময়তায় জ্বলছে। সেই ভয়ঙ্কর মুখগুলো এগিয়ে আসে জানকীর দিকে ভয়ঙ্করের পদক্ষেপ ফেলে।

এখনও, দশমাস পরেও, হরিদাস নিজের অনুনয়-ভারাক্রান্ত কাতর ভিক্ষা প্রার্থনার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়।

: মার আমাকে, মেরে ফেল–শুধু–শুধু আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। ফের এগিয়ে আসে ওরা জানকীর দিকে। বিভীষিকার কালো কালো ছায়া-রঙ ওদের মুখে।

: আমি মুসলমান হতে রাজি আছি। আমার মেয়েও হবে। শুধু দয়া কর, দয়া কর– ওকে বাঁচাও।

নৃশংস বিকট মুখগুলোতে কোনোরকম কারুণ্যের ছায়া নেই। কামনা-ভয়ঙ্কর চোখগুলো জানকীর দিকে এগোতে থাকে। গোখরো সাপ যেন এগোচ্ছে সম্মোহিত শিকারের দিকে।

: আমার মেয়ের কচি বয়স ও সুন্দরী। দেখতেই পাচ্ছ। তোমরা যে কেউ ওকে মুসলমান করে বিয়ে কর, কেবল জীবনটা নিয়ে না।

একটা মুখ। এতগুলো ভয়াবহ মুখের ভেতরে সেটা আরও ভয়ঙ্কর। হলদে ময়লা দাঁত, চোখ-ভরা বিকট কামনা। ক্ষুধার বিশ্বগ্রাসী দাবানল। উল্লাসে আর উত্তেজনায় ঘন কালো দাড়ি কাঁপছে তার। তার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই জানকীর ফুলের মতো সৌন্দর্য। পরমুহূর্তে হরিদাসের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। প্রেতায়িত কালো মেঘ যেন চাঁদ ঢেকে ফেলেছে। কিন্তু বর্বরের পাশব আক্রমণে জানকী গুঁড়িয়ে যাবার আগেই হরিদাসের দৃষ্টি আটকে যায়।

জানকীর চোখে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত ভীতি-ব্যাকুলতার ছায়া। ভীতি, ঘৃণা, অসহায়তা, নৈরাশ্য, নিষ্ফল করুণা ভিক্ষা–সবকিছু মিশিয়ে। সামনেই বাপকে বাঁধা হয়েছে একটা গাছের সঙ্গে। মেয়ের ইজ্জতহানি স্বচক্ষে দেখবার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে জিইয়ে। বীভৎস সে দৃশ্য। অসহ্য! হরিদাসের চোখের পাতা মুদে আসে।

স্মৃতির পর্দায় দৃশ্যটা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনিই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। হায়, কান দুটোও যদি একেবারে বধির হয়ে যেত। তাহলে তো ঐ মর্মভেদী বিকট আর্তনাদ শুনতে হত না। শুনতে হত না গায়ের কাপড় নির্দয় হাতে ফড়ফড় করে টেনে ছেঁড়ার শব্দ, শয়তানটার কামার্ত নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ, জানকীর মরণ চিৎকার, গোঙানি, কান্না। এখনও সে-সব কানে বাজে।

এমনকি মনের এতগুলো পাতা ডিঙিয়েও সেই ভয়ানক মুখগুলো একটার পর একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ… পরপর মুখগুলো ভেসে উঠছে যতক্ষণ-না সেই অসহায় কান্নাকে মৃত্যুর স্তব্ধতা শুষে নেয়। এ স্তব্ধতা আরো ভয়ঙ্কর, রক্ত ঘনতায় জমাট বাঁধা আর্তনাদের চেয়েও। তারপর সে চোখ খোলে…

ফুলের মতো জানকীর মুখখানা। ফুলটা যেন মাড়িয়ে নিষ্পিষ্ট করে দেয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে। বিবর্ণ, সৌরভ্যুত, প্রাণহীন ফুল। আলুলায়িত কেশসম্ভারে অত্যাচারের বিশৃঙ্খলা। কপোলতটে নৃশংস দংশনের স্পষ্ট গভীরতা। ক্ষতমুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে।

মৃত পাণ্ডুর মুখে যেন রুজের রক্তিম লালিমা। গারের পাপড়িরাঙা চামড়া কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। নিষ্ঠুর ধারাল দাঁতের আঘাত স্পষ্ট। সমস্ত শরীরের ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। গাল, কান, নাক এমনকি খোলা বুক থেকেও। জন্মের মতো, হ্যাঁ, যতদিন বাঁচবে ততদিনের জন্য হরিদাসের মনের ক্যানভাসে শয়তান রক্তের আখরে এঁকে দিয়েছে এ ছবিখানা। এ ছবি চির-অম্লান। কিছুতেই ভুলবার নয়। অসম্ভব!

নিজের হাতে হরিদাস সাজিয়েছে মেয়ের চিতা। দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জানকী। অগ্নিদেব তার কোমল, সুন্দর দেহ-নৈবেদ্য গ্রহণ করেছেন। পবিত্র নিষ্পাপ দেহনির্মাল্য। আহত, অপমানিত, ধর্ষিত সে দেহ। হরিদাস এখনও সেই চিতার অগ্নিশিখা দেখতে পায়। শিখাগুলো নাচছে তার চোখের সামনে। লাল আর হলুদ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। তার মনে হয়েছিল জানকীর নয়, হিন্দুস্থানের ইজ্জত দাহ করা হচ্ছে। চিতাগ্নিশিখার সঙ্গে মানবতা উবে যাচ্ছে। সৌন্দর্য, দয়াধর্ম আর সহানুভূতি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

চিতার আগুন একসময়ে নিভল। কিন্তু প্রতিহিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল হরিদাসের মনে। এ আগুন নিভবার নয়। না… না… কখনো না… অন্তত… যতদিন-না হরিদাস প্রতিশোধ নিতে পারে একটি মুসলমান মেয়ের নগ্ন বুকে ছুরিকাঘাত করে। তাই হরিদাস বেঁচে রয়েছে এখনো। একবার, শুধু একবার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তার পরমুহূর্তেই মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরবে সে।

প্রতিশোধ!

প্রতিশোধ!!

কোটের নিচে ধারাল ছুরি লুকানো রয়েছে। কিন্তু কোথায় সুন্দরী মুসলমান মেয়ে? জিঘাংসু হরিদাসের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। দিল্লির মুসলমানদের অনেকে দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। যারা এখনও রয়ে গেছে, তারা তো পথে বেরাতেই সাহস করে না। কাপুরুষ কোথাকার, ভীতুর দল!

ভাগ্য হরিদাসের সঙ্গে অদ্ভুত খেলা শুরু করেছে। বাস্তুত্যাগী পুনর্বসতি সাহায্য তহবিল থেকে সে তিনশ’ টাকা পেয়েছে। এত টাকা দিয়ে কী করবে? কেউই তো নেই আর–না গৃহ, না পরিবার। আহার-পরিচ্ছদের দরকার নেই। এমনকি বাঁচবার পর্যন্ত ইচ্ছে নেই। কী করবে হরিদাস অত টাকা দিয়ে! ভাবতে ভাবতে নয়াদিল্লি আর পুরনো দিল্লির পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে।

কনট প্লেস থেকে চাঁদনি চক। চাঁদনি থেকে জামে মসজিদ। মসজিদের সরু সরু মিনার। সাদা গম্বুজের ওপর নজর পড়লে ফের জেগে ওঠে প্রতিহিংসার সঙ্কল্প। মুসলমানদের বিরুদ্ধে, গোটা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে। জামে মসজিদ থেকে দরিয়াগঞ্জ–তারপর রাজঘাট। এমনকি রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিও তার মন থেকে প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা নির্বাপিত করতে পারে না।

গান্ধীজী মহাত্মা ছিলেন। ঋষি। কিন্তু আমি যে সাধারণ লোক। তিনি পারেন শত্রুকে ক্ষমা করতে, আমি পারি না।

সেখান থেকে এডওয়ার্ড পার্ক। পার্কে রাজার পাথরের মূর্তি। ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে।

: বাহ্, হুজুর বাহ্। চলে তো গেলে, এদিকে আমাদের ঠেলে দিলে এক মৃত্যুঘাতী দুর্দশায়।

ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা অচেনা জায়গায় এসে পড়ল। তারই মতো অসংখ্য বাস্তুত্যাগী ঘুমোচ্ছে পাকা রাস্তার ওপর। বাতাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারি তীব্র গন্ধ। সেন্ট, ঘাম, ভ্যাপসা মাটি, প্রস্রাব, ফুল, ফিনাইল, পেট্রোলের গন্ধ। বাঁ ধারে একসার দোকান। মিঠাইয়ের দোকান, দুধের দোকান। হোটেল এখনও খোলা রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। প্রতিটি পথিকের দৃষ্টি একতলার আলোকিত ব্যালকনিতে নিবদ্ধ। আলোয় উজ্জ্বল রশ্মিতে আমন্ত্রণের পত্ররেখা। বায়ুতরঙ্গের ছন্দে সঙ্গীত ঝঙ্কার। জায়গাটা?

: বাবুজি!

আচমকা সম্বোধন। একটা লোক, তার তির্যক দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

: বাবুজি হুকুম করেন তো খাশা চিজ দেখাতে পারি।

কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না-পেরে হরিদাস এগোতে থাকে। কিন্তু লোকটা এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।

: খুশি না-হলে আপনার বখশিসের সব পয়সা হারাম।

কথার আবছা অংশ পরিষ্কার হয়ে গেল তার মুখের ইঙ্গিত থেকে।

: ভাই আমি একজন বাস্তুত্যাগী। হরিদাস বলল।

: আমিও তাই বাবুজি। আমরা তো একই দলের, আসুন-না আমার সাথে, একটা মুসলমান মেয়ে আছে…। পাকিস্তানের খেসারত নেবার এই তো সুযোগ, পাকিস্তানি হুর ভোগ করার সুযোগ।

মুসলমান মেয়ে! পাকিস্তানি হুর!!

প্রতিহিংসার লাল আর হলদে শিখা হরিদাসের চোখের সামনে নাচছে প্রেতায়িত নাচ। যেতে যেতে লোকটা আপনা থেকেই বলতে লাগল, বাবুজি, এমন মেয়ে হাজারেও একটা মেলে না। বয়েস কতই-বা হবে–বড়জোর সতের কি আঠারো।

তারপর এদিক-ওদিক ইতস্তত তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, আমরা ওকে জলন্ধর থেকে নিয়ে এসেছি। মশহুর লোকের মেয়ে। কী বলব বাবুজি-ওকে রাজি করিয়ে ব্যবসায়ে নামাতে পাক্কা দশ মাস সময় লেগেছে।

জানকীরও কি একই বয়েস ছিল না? জানকীও কি নামজাদা লোকের মেয়ে নয়? তবু সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর মুখগুলো একবর্ণ দয়াও দেখায়নি। এক দুই তিন চার পাঁচ…যতক্ষণ পর্যন্ত-না অনাঘ্রাত পবিত্র ফুলটা মাটির সঙ্গে নিষ্পিষ্ট হয়ে গেছে।

: তাহলে আমিই-বা কেন দয়া দেখাতে যাব? হরিদাস ভাবল। তার হাত কোটের ভেতরে রাখা ছুরিটা একবার ছুঁয়ে এল।

বেশ্যাবাড়ির সাধারণ বৈঠকখানা। মেঝেতে ময়লা সাদা চাদর বিছানো। সিলিং থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। দেয়ালে শস্তা তৈলচিত্র টাঙানো। ভগবান কৃষ্ণ, রাজা রামচন্দ্র, সতী সীতা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী আর পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু। দুটো বড় বড় আয়না। ঘরের এককোণে বসে পান তৈরি করছে স্থূলকায়া কুৎসিৎ একটা প্রৌঢ়া। মুখে ব্রণের দাগ। সমস্ত কিছুর ওপরে তার বিচক্ষণ দৃষ্টি। বাজনার যন্ত্র, গায়ক আর বাজনদারদের মাঝখানে রয়েছে সেই পাকিস্তানি হুর। গান গাইছে সে।

হরিদাস হুর দেখেনি কখনো, কিন্তু শুনেছে চেহারার বিবরণ। মেয়েটি হুরই বটে! গায়ের রঙ জানকীর চেয়েও সুন্দর, তবে রক্তহীনতার বিবর্ণতা স্পষ্ট। দেহসৌষ্ঠবে মঞ্জুরিত লতার কৃশতা আর সৌকুমার্য। কালো আয়ত চোখ। তবে এ চোখে সুস্থতার জ্যোতি বা জীবনের ছায়া নেই। যেমনটি জানকীর ছিল। তার বদলে নৈরাশ্যের অন্ধকার প্রকাশমান।

হরিদাস দেখছিল মেয়েটি গাইছে, কিন্তু কানে বিন্দুবিসর্গ গানের বুলিও ঢুকছে না। ঘর বোঝাই শ্রোতা। হরিদাসের চোখ এ জনতার অস্তিত্ব অনুভব করছে। কিন্তু তারা কি ধনী, দরিদ্র, ভদ্রলোক, না বদলোক এ স্তরবিন্যাস বুঝবার মতো দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা চোখে নেই। এক কোণায় ঘুপটি মেরে বসে সে গভীরভাবে তাকিয়ে ছিল পাকিস্তানি হুরটির দিকে। সে দৃষ্টিতে কামনার লাম্পট্য ছিল না। কেবল প্রতিহিংসার লাল আর হলুদ শিখা কাঁপছে।

লোকটা বলেছিল মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন ঘর ফাঁকা হয়ে যাবে। গোটা রাতের জন্যে দর ঠিক হয়েছে দু’শ’ টাকা। মাত্র দু’শ’। বাকি টাকা তাহলে কী করবে! বাকি টাকার দরকার আর নেই। পরের দিন বাঁচবার আর কোনো ইচ্ছেই নেই। তার। আজকেরটাই জীবনের শেষ রাত। কাল থেকে সে মুক্ত। সবকিছু থেকে মুক্ত। টাকা-পয়সা, দৌলত, প্রতিশোধ, জীবন, সবকিছু থেকে। দশ টাকা করে একশ’ টাকাই মেয়েটাকে বখশিস দিয়ে দিল। পায়ের কাছ থেকে দশ টাকার নোট কুড়িয়ে নেবার সময় মেয়েটা প্রতিবার তাকে সালাম করল। যাক, এতেও বিক্ষুব্ধ মন কিছুটা অন্তত সান্ত্বনা পাচ্ছে! একটি মুসলমান মেয়েকে এভাবে অপমান করে হরিদাস অন্তত এটুকু ভাবতে পারছে যে তার অপমানিতা মেয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু এ তো সামান্য মাত্র!

নিষ্পলক স্থির চোখে হরিদাস মেয়েটির প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। সে বুঝতে পেরেছিল মেয়েটি জাত ব্যবসায়ী নয়। ওর সব অঙ্গভঙ্গিই যান্ত্রিক। অনুভূতিহীন। নগ্নবাহু দুলিয়ে গানের সঙ্গে অপাঙ্গদৃষ্টি ছুঁড়ে ব্যবসার কায়দা প্রদর্শন ওর অপটুতাই ধরিয়ে দিচ্ছিল। দম-দেয়া ঘড়ির মতো মেয়েটা। হরিদাসের সারা শরীরে একটা ভৌতিক রহস্যময় অনুভূতি কিলবিল করে বয়ে গেল মুহূর্তে। মনে হল, এ জীবন্ত মানুষ নয়। একটা মড়ার দেহ জাদুকরের মায়ায় কেমন করে যেন সাময়িক জীবন পেয়েছে।

আর-একটা জিনিস নজরে পড়ল। টাকা বখশিস দেয়ার অছিলায় যখনই কেউ ওকে ছুঁতে চেষ্টা করছে তখুনি মেয়েটা ছিটকে প্রসারিত হাত সরিয়ে নিচ্ছে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো! আশ্চর্য, মুখে কিন্তু তার এই অনিচ্ছার কোনো ভাবান্তরই নেই। রোষ কি বিরক্তি কিছুই নয় টাকা-নোট যা কিছুই পাচ্ছিল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিল ঘরের কোণায়। সেখানে বসেছিল স্থূলকায়া প্রৌঢ়াটি। এ অবহেলা প্রৌঢ়ার মুখে দাগ কাটেনি। কিন্তু টাকাগুলো ছুঁড়ে দেবার সময়কার কব্জির ঝাঁকুনিতে অসহ্য ঘৃণার প্রকাশ স্পষ্ট। মেয়েটি যেন বলতে চাইছিল–

: নাও টাকা, নাও, যে টাকার জন্যে এই বাজারে আমায় বিক্রি করছ। এই নাও, তারপর রেহাই দাও আমাকে। নাও…নাও… খুশি হও।

ওর নিপীড়িত নিরীহতা কেমন করে যেন হরিদাসের মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করল। হরিদাসের স্থির বিশ্বাস জন্মাল, মেয়েটির জন্ম ভদ্র, ধনী মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে। পরিষ্কার সুস্পষ্ট সুরজ্ঞান আর উচ্চারণভঙ্গিতে সুশিক্ষার পরিচয় প্রকাশমান। মোটমাট জানকীর ইজ্জতহানির প্রতিশোধ নেয়ার উপযুক্ত পাত্রই বটে।

রাত দুপুর হল। একে একে সবাই চলে গেল। মেয়েটিও চলে গেল শোবার ঘরে। এমনকি একবারও তাকাল না হরিদাসের দিকে, ওর বাকি রাতের একমাত্র খদ্দের। হরিদাস সেই লোকটাকে দু’শ টাকা দিয়ে ওঠাল। লোকটা টাকাগুলো চালান করল কুৎসিৎ চেহারার প্রৌঢ়া বাড়িউলির কাছে। প্রৌঢ়া টাকাগুলো দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলোর নিচে। তারপর খুশি হয়ে দশ টাকার একটা নোট তুলে দিল লোকটার হাতে। লোকটা সালাম করে চলে গেল। ময়লা, পায়োরিয়ায় খাওয়া বিচ্ছিরি দাঁত বের করে প্রৌঢ়া চোখ টিপে হরিদাসকে বলল–

: বাবুজি, এবার যান ভেতরে। তবে একটু সাবধান। মেয়েটা নতুন কি না–আপনি তো জানেন সবকিছু।

পরমুহূর্তে হরিদাস ঢুকে পড়ল ঘরে।

সতর্কতার সঙ্গে ভালো করে দরজার আগল লাগাল সে। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি বসেছিল খাটের উপরে চিন্তাকুলভাবে। হরিদাস এগোল সেদিকে। হরিদাসকে দেখেই মেয়েটি সমসহকারে উঠে পড়ল। দৃষ্টি মেঝেয় নিবদ্ধ। তারপর জুতোর ফিতে খুলে দিতে বসল। হয়তো এই হুকুম ছিল বাড়িউলির।

: ছেড়ে দাও–

কর্কশর হরিদাসের কণ্ঠে। পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসা একটা মুসলমান। মেয়েকে দেখে বেশ তৃপ্তি বোধ করছে সে।

: গায়ের কাপড় সরাও—

কম্পিত হাতে মেয়েটি শাড়ি খুলে ফেলল। কেবল রইল পেটিকোট আর ব্লাউজ।

: এগুলোও–

অসহায় লজ্জায় ও দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। … পেটিকোটটা ঝুপ করে মাটিতে খসে পড়ল। হরিদাসের হাত পকেটের ছুরির ওপর।

: তোমাকে সম্পূর্ণ ন্যাংটো দেখতে চাই। বুঝেছ? … এখানো হয়নি। দু’শ’ টাকা নগদ দিয়েছি তার জন্যে।

মেয়েটি মুখ ফেরাল। চোখে অব্যক্ত ভিক্ষার নিদারুণ কারুণ্য। আশা ঐ মধ্যবয়সী খদ্দেরটার যদি দয়া হয়। হয়তো তার মনে দয়া হতে পারে, ওর সম্পূর্ণ নগ্নতার ওপরে জেদ না-ও করতে পারে।

: জলদি কর হরিদাস গর্জে উঠল নির্দয়ভাবে। আমার সময় নেই।

পকেটের ভেতরে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে তার হাত। মেয়েটি সুইচের দিকে এগোবার চেষ্টা করল।

: না–পথরোধ করে দাঁড়াল হরিদাস।

: অন্ধকার নয়–

জানকীর কী হয়েছিল? খোলা রাস্তার ওপরে দিনের আলোয় কি তার ইজ্জতহানি করা হয়নি?

ব্লাউজ খুলল মেয়েটি। সুগঠিত স্তনযুগলের যৌবন-রেখার স্পষ্টতা ঢাকা রয়েছে। কাঁচুলির তলায়।

: এটাও…

ছুরি প্রস্তুত। আবার মেয়েটি তাকাল তার দিকে। চোখে করুণ ভিক্ষার আবেদন।

এইভাবেই জানকী তাকিয়েছিল হৃদয়হীন পশুগুলোর দিকে। কিন্তু তারা কণামাত্র দয়াও দেখায়নি। না, হরিদাসও দেখাবে না।

হাতের আঁজলা দিয়ে মেয়েটি মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল স্তনের ওপর।

হরিদাসের ডান হাতে ঝকমক করে উঠল ছুরিটা, মৃত্যু আঘাত হানতে উদ্যত। অপর হাতে মেয়েটির হাত দুটো হিঁচড়ে নামাল মুখ থেকে। ও দেখুক হরিদাস কী করতে যাচ্ছে। জানকীও তো দেখেছে। এই মুহূর্তটির জন্যেই তার দীর্ঘ দশ মাসের অধীর প্রতীক্ষা। লাল আর হলুদ শিখা নাচছে উল্লাসভরে।

হরিদাসের এক হাতে উদ্যত ছুরি আর অপর হাত পাশব ভঙিতে বুকের কাঁচুলির দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। করুণ, তীব্র, মরণ আর্তনাদ। চোখে মৃত্যুভীতির গাঢ় ছায়া।

হরিদাস দেখল সে চোখে আরও কিছু আছে-ভীতির সঙ্গে ঘৃণা আছে। করুণা ভিক্ষার আবেদন স্পষ্ট, আর রয়েছে সম্পূর্ণ অসহায়তা। ঠিক জানকীর চোখের দৃষ্টি। কিন্তু তবু সে দৃষ্টি জানকীকে বাঁচাতে পারেনি। বিদ্যুৎচমকের ক্ষিপ্রতায় হরিদাসের বাঁ হাত স্পর্শ করল মেয়েটির কাঁচুলি। এ কি, কাঁচুলি এত ভারি ঠেকছে কেন? তবু হ্যাঁচকা টান মারল কাঁচুলিটায়। আর এর সঙ্গে…

ছুরিটা শূন্যেই উদ্যত হয়ে রইল। লজ্জায় হরিদাস চোখ ফেরাল। মাত্র একটি কথা শব্দ হয়ে ফসকে বেরিয়ে এল তার নিবদ্ধ ঠোঁট দুটোর কাছ থেকে :

‘বেটি!

কাঁচুলির নিচে যেখানে সে ছুরির আঘাত করতে যাচ্ছিল সেখানে দেখল স্তন দুটো নেই। মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সেখানে কিছুই নেই…কিছুই নেই…

[অনুবাদক : অজ্ঞাত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *