প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

২.৬ সর্দারজি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / এ বি এম কামাল উদ্দিন শামীম

সর্দারজি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / এ বি এম কামাল উদ্দিন শামীম

সর্দারজি – খাজা আহমদ আব্বাস।

খোদ দিল্লি আর তার আশপাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমে উঠলে মুসলমানদের রক্তের কোনো মূল্য রইল না। আমি ভাবলাম, কী দুর্ভাগ্য! প্রতিবেশী প্রায় সবাই শিখ। ওদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করব কি নিজের পেটেই কখন ছুরি চেপে বসে সেই ভয়ে সময় কাটতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, শিখদের আমি খুব ভয় পাই, ঘৃণাও করি কিঞ্চিৎ। আমার মনে হয় ওরা এক অদ্ভুত জানোয়ার। এই মনে হওয়া সেই আমার ছোটবেলা থেকেই। তখন আমার বয়স বছর ছয়েক। একদিন এক শিখকে রোদে বসে চুল আঁচড়াতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম, দেখ, দেখ–মেয়েমানুষের মুখে কত লম্বা-লম্বা দাড়ি। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই বোধ কেমন এক ধরনের ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়। এই বোধটির অবশ্য পেছনে রয়েছে ১৮৫৭ সালের তিক্ত স্মৃতির স্মরণ। সে-সময় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার জন্য পাঞ্জাবের শিখরাজ আর তাদের সেনাবাহিনী ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। এই কারণে একটা অস্পষ্ট ভীতি ও এক অদ্ভুত ধরনের ঘৃণা কেবল শিখ নয়, ইংরেজদের প্রতিও পোষণ করতাম। তবে শিখ-ঘৃণাটাই ছিল প্রবল; অন্যদিকে ইংরেজদের ভয় পেলেও তাদের প্রতি কিছুটা প্রতিবোধও ছিল আমার। মনে-প্রাণে আমি ইংরেজদের মতো কোর্ট-প্যান্ট পরতে চাইতাম। চাইতাম ওরা যেমন শ্লীলতাবোধশূন্য কথা-বার্তা চালিয়ে যায় সেভাবে। কথাবার্তা বলতে। তাছাড়া ওরা ছিল শাসক, আমিও চাইতাম ছোটখাটো একজন শাসক হতে। ওদের মতো কাটা-ছুরি-চামচ দিয়ে খাবার খাওয়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল খুব যাতে পৃথিবীর মানুষ আমাকেও কিছুটা সভ্যভব্য ভাবে। কিন্তু শিখদের যে ভয় করতাম সেটা ছিল অনেকটাই অবজ্ঞা-মিশ্রিত। অদ্ভুত সৃষ্টি এই শিখ–যারা পুরুষ হয়েও চুল রাখে মেয়েমানুষের মতো। ইংরেজি ফ্যাশনের অনুকরণে মাথার চুল ছোট অবশ্য আমি পছন্দ করি না–সেটা ভিন্ন কথা। আব্বা বলতেন, প্রতি শুক্রবার যেন মাথার চুল ছাঁট করি; তাহলে মাথায় খুস্কি হতে পারবে না। কিন্তু আমি সে কথা না-শুনে চুল এমন বড় করে রাখতাম যাতে তা হকি ও ফুটবল খেলার সময় ইংরেজ খেলোয়াড়দের মতো বাতাসে ওড়ে। আব্বা বলতেন, একি! তুই যে মেয়েদের মতো চুল লম্বা রেখেছিস! কিন্তু আব্বা তো পুরনো চিন্তাধারার মানুষ, তার কথা কে শোনে। তিনি তো পারলে ছোটবেলাতেই আমাদের মুখে দাড়ি গজিয়ে দেন। ও হ্যাঁ, মনে পড়ল, শিখদের আর একটা অদ্ভুত নিদর্শন হল তাদের দাড়ি। আমার দাদার দাড়ি ছিল কয়েক ফুট লম্বা। তিনি সে দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার করতেন। কিন্তু দাদাজানের ব্যাপার ভিন্নতম। যতকিছুই হোক তিনি আমার দাদাজান, আর শিখরা শিখ।

ম্যাট্রিক পাস করার পর আমাকে পড়ালেখার জন্যে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কলেজে যে-সব পাঞ্জাবি ছেলে পড়ত আমরা অর্থাৎ দিল্লি ইউপির ছেলেরা তাদেরকে নীচ, মূর্খ এবং বখাটে মনে করতাম। ওরা কথা বলার নিয়মও জানত না। পানাহারের মধ্যেও কোনো রুচিজ্ঞান ছিল না। সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। একগুঁয়ে অভদ্রের একশেষ। লাসসির বড়-বড় গ্লাস সাবাড়কারীরা কেওড়াদার ফালুদা ও সিফটন চায়ের স্বাদ কী বুঝবে! তাদের ভাষা নিতান্ত অমার্জিত। কথা বলার সময় মনে হয় যেন ঝগড়া করছে। কথায়-কথায় তুই-তোকারি এই-সেই। আমি সব সময় এসব পাঞ্জাবিদের এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু আমাদের ওয়ার্ডেন সাহেব খোদা তার মঙ্গল করুন–হঠাৎ করেই আমার কামরায় একজন পাঞ্জাবি ছাত্রকে জায়গা। দিলেন। আমি ভাবলাম, কী আর করা, একত্রে যখন থাকতে হবে কিঞ্চিৎ ভাব পাতিয়েই থাকা যাক। এভাবে থাকতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাই গড়ে উঠল। তার নাম গোলাম রসুল। রাওয়ালপিন্ডিতে বাড়ি। বেশ রসিক ছেলে। আমাকে প্রায়ই চুটকি শোনাত।

আপনারা এখন বলবেন, সর্দার সাহেবের কথা শোনাতে গিয়ে আবার এই গোলাম রসুল কোথা থেকে এসে পড়ল। কিন্তু আসলে এ কাহিনীর সঙ্গে গোলাম রসুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কথা হচ্ছে যে, গোলাম রসুল যে-সব চুটকি শোনাত সেগুলো প্রায়ই শিখদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেসব চুটকি শুনে-শুনে শিখদের স্বভাব-চরিত্র রুচি-বৈশিষ্ট্য ও সামগ্রিক চরিত্র সম্পর্কে আমি যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলাম।

যেমন ধরুন গোলাম রসুল বলত, সব শিখই বেকুব এবং বুন্ধু। দুপুর বারোটা বাজলেই তাদের বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। এ-সম্পর্কে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন একজন সর্দারজি সাইকেলে আরোহণ করে দুপুর বারোটায় অমৃতসরের হল বাজার দিয়ে যাচ্ছিল। চৌরাস্তায় একজন শিখ কনস্টেবল তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমার সাইকেলের লাইট কোথায়? সাইকেল আরোহী সর্দারজি বিনয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলল, জমাদার সাহেব, এই একটু আগে নিভে গেছে। বাড়ি থেকে তো জ্বালিয়েই বেরিয়েছিলাম! কনস্টেবলটি তখন সর্দারজিকে থানায় চালান দেয়ার হুমকি দিল।

অন্য একজন পথচারী শুভ্র-শ্মশ্রু শিখ সর্দারের মধ্যস্থতা করে বললেন, যাও ভাই, গোলমাল কর না। লাইট যদি নিভে গিয়ে থাকে এখন জ্বালিয়ে নাও, ব্যস।

এ ধরনের বহু গল্প গোলাম রসুলের জানা ছিল। পাঞ্জাবি ভাষার সংমিশ্রণে সে যখন এসব গল্প শোনাত তখন হাসতে-হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। আসলে পাঞ্জাবি ভাষায়ই সে-সব গল্প শুনে মজা পাওয়া যেত। কারণ, শিখদের অদ্ভুত ও উদ্ভট তৎপরতা বর্ণনা করার জন্যে পাঞ্জাবির মতো উটকো ভাষাই ছিল মানানসই।

সে থাকগে। অন্যের চালচলন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করে লাভ নেই! কিন্তু শিখদের সবচেয়ে বড় দোষ হল ওরা ঔদ্ধত-হঠকারিতা-মারদাঙ্গা করে মুসলমানদের মোকাবেলা করতে সাহস দেখাত। এখন তো পৃথিবী জেনেই গেছে যে, একজন মুসলমান দশজন হিন্দু বা শিখের সমান। কিন্তু মুসলমানদের এ শক্তিমত্তা তারা স্বীকার করত না। তারা কৃপাণ ঝুলিয়ে গোঁফে এমনকি দাড়িতে তা দিয়ে চলত। গোলাম রসুল বলত, ওদেরকে একদিন আমরা এমন শিক্ষা দেব যে, জীবনভর মনে থাকবে।

কলেজ ছাড়ার পর কয়েক বছর কেটে গেল। ছাত্র থেকে ক্লার্ক, ক্লার্ক থেকে হেড ক্লার্ক পদে উন্নীত হলাম। আলিগড় ছাত্রাবাস ছেড়ে নয়াদিল্লিতে একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়েও হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বদলি হয়ে আমার মুখোমুখি কোয়ার্টারে একজন শিখ সর্দার এসে উঠলে বহুদিন পর গোলাম রসুলের কথা আমার মনে পড়ল। গোলাম রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রাওয়ালপিভিতে শিখদের আচ্ছাসে ধোলাই দেয়া হয়েছে। মুজাহিদরা শিখদের নির্মূল অভিযান শুরু করেছিল। শিখরা সেখানে দারুণ দাপট দেখাচ্ছিল, মুসলমানদের সামনে সেসব দাপট টেকেনি। দাড়ি কামিয়ে অনেক শিখকে মুসলমান করা হয়েছে, অনেককে খত্না করিয়ে দেয়া হয়েছে জোর করে। হিন্দুদের সংবাদপত্রে মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে লেখা হচ্ছিল যে, মুসলমানেরা, শিখ নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করেছে। অথচ এটা ইসলামি ঐতিহ্য পরিপন্থী। মুসলিম মুজাহিদরা কখনো নারী ও শিশুদের ওপর হাত তোলেনি। হিন্দুদের সংবাদপত্রে যেসব শিখ নারী ও শিশুর ছবি ছাপা হয়েছে সেগুলো ছিল হয় জাল ছবি অথবা শিখরা মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে নিজেরাই নিজেদের নারী ও শিশুকে হত্যা করে পত্রিকায় ছেপেছিল। রাওয়ালপিন্ডি এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমানদের এ অপবাদও দেয়া হচ্ছিল যে, তারা হিন্দু ও শিখ মেয়েদের অপহরণ করেছে। অথচ ঘটনা এই যে, মুসলমানদের বীরত্ব দেখে শিখ মেয়েরা মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাদের সঙ্গে চলে গেছে। এমতাবস্থায় ওরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যায় তাতে মুসলমানদের দোষটা কোথায়? তারা তো ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবেই সে সব মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে।

সে যাই হোক, শিখদের তথাকথিত বীরত্বের চেহারা এখন পাল্টে গেছে। এখন কৃপাণ বের করে মুসলমানদের হুমকি দেয়া দূরে থাক রাওয়ালপিন্ডি থেকে পালিয়ে আসা সর্দারের দুরবস্থা দেখে ইসলামের গৌরবে বুক ফুলে উঠল আমার।

আমার প্রতিবেশী সর্দারজির বয়স ষাটের কাছাকাছি। দাড়ি সব শাদা হয়ে গেছে। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন। ভদ্রলোক সব সময় দাঁত বের করে হাসতেন। তাঁর এ হাসি দেখেই বুঝেছিলাম লোকটা আসলে বেকুব এবং নির্বোধ। প্রথম দিকে তিনি আমার সঙ্গে মিতালি পাতাতে চেয়েছিলেন। যাওয়া-আসার সময় গায়ে পড়ে আলাপ করা শিখদের এক আজব রীতি। সেদিন তো বাসায় প্রসাদের মিষ্টান্নই পাঠিয়ে দিলেন। (আমার স্ত্রী সে মিষ্টান্ত সঙ্গে-সঙ্গে মেথরানিকে দিয়ে দিয়েছে) আমি আর বন্ধুত্বের ফাঁদে ধরা দিইনি, কখনো কিছু জিজ্ঞেস করলে মামুলিভাবে দু-একটা কথা জবাব দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েছি। আমি জানতাম ভালোভাবে কথা বললে এ লোক আমার পিছু নেবে। আজ ভালোভাবে আলাপ করবে, কালই গালাগালি শুরু করবে। আপনারা তো জানেন। যে, গালাগালি শিখদের ডাল-রুটি। এ-ধরনের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে কে নিজের মুখ খারাপ করবে? একদিন দুপুরে আমি গিন্নিকে শিখদের নির্বুদ্ধিতার কাহিনী শোনাচ্ছিলাম। বাস্তব প্রমাণ দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি ঠিক বারোটায় আমার ভূত্যকে সর্দারজির বাসার ঘড়িতে কটা বাজে জিজ্ঞেস করার জন্যে পাঠালাম। সর্দারজি ভৃত্যকে বললেন, বারোটা দুমিনিট। আমি গিন্নিকে বললাম, দেখলে তো বারোটা বাজার নাম নিতেই ভয় পাচ্ছে। এ-কথা বলে আমি একচোট হাসলাম, গিন্নিও হাসল। আমি মাঝে-মাঝে অপ্রস্তুত করার জন্যে সর্দারজিকে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন সর্দারজি, বারোটা বেজে গেছে? তিনি নির্লজ্জভাবে দাঁত বের করে জবাব দিতেন–জ্বী, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। এ-কথা বলে খুব হাসতেন–যেন বড় একটা রসিকতা করতে পেরেছেন।

শিশুদের ব্যাপারে সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকতাম। একে তো কোনো শিখের ওপরই আস্থা রাখা যায় না। শিশুদের গলায় কখন কৃপাণ চালিয়ে দেবে কে জানে! তাছাড়া এরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছে। মুসলমানদের প্রতি এমনিতেই মনে-মনে নিশ্চয়ই ঘৃণা পোষণ করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওঁত পেতে থেকে সুযোগ খুঁজবে। স্ত্রীকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম শিশুদের যেন সর্দারজির কোয়ার্টারের দিকে যেতে দেয়া না হয়। কিন্তু শিশুরা তো শিশুই। ক’দিন পর দেখি, আমার ছেলে-মেয়েরা সর্দারজির ছোট মেয়ে মোহিনী এবং তার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলা করছে। বড়জোর দশ বছর বয়সের মোহিনী আসলেই ছিল মোহিনী। গৌরবর্ণ চমৎকার চেহারা। হতভাগাদের মেয়েরা দারুণ সুন্দরীও হয়। আমার মনে পড়ল, গোলাম রসুল বলত, পাঞ্জাব থেকে শিখ পুরুষরা চলে গিয়ে যদি মেয়েদের রেখে যেত তাহলে হুর-এর সন্ধান করার প্রয়োজন হত না। আমার সন্তানদের সর্দারজির মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলতে দেখে আমি ওদের টেনে বাসায় নিয়ে এলাম। তারপর খুব মারলাম। এরপর অন্তত আমার চোখের সামনে কখনো ওদের আর ওদিকে যেতে দেখিনি।

খুব অল্প সময়ে শিখদের আসল চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুড়সুড় করে পালিয়ে এসে, পাঞ্জাবের মুসলমানদের সংখ্যায় কম পেয়ে তাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে দিল। শত-শত এমনকি হাজার-হাজার মুসলমানকে তাদের হাতে শহীদ হতে হল। নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হল মুসলমানকে রক্ত। হাজার-হাজার মুসলিম মেয়ে ও মহিলাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে মিছিল বের করল ওরা। এ-সব কারণে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বহুসংখ্যক মুসলমান দিল্লিতে আসতে শুরু করল। তার ঢেউ এই দিল্লিতে আমার এখানে এসে পৌঁছান ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। আমার পাকিস্তান যাওয়ার তখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। এ কারণে বড় ভাইয়ের সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বিমানযোগে করাচি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে খোদা ভরসা করে থেকে গিয়েছিলাম। উড়োজাহাজে বেশি জিনিসপত্র নেয়া যায় না। এ-কারণে আমি একটা পুরো ওয়াগন বুক করেছিলাম। কিন্তু যেদিন জিনিসপত্র ওয়াগনে তুলব সেদিনই শুনলাম পাকিস্তানি গাড়িতে হামলা করা হচ্ছে। ফলে ঘরের জিনিসপত্র রইল ঘরেই।

১৫ আগস্ট স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হল। কিন্তু এ স্বাধীনতার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ছুটি পালন করলাম। সারাদিন শুয়ে-শুয়ে ‘ডন’ আর ‘পাকিস্তান টাইমস’ পড়ে কাটালাম। উভয় পত্রিকায় ভারতের এ তথাকথিত স্বাধীনতার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। প্রমাণ দেয়া হয়েছে কী করে ইংরেজ ও হিন্দুরা যোগসাজশ করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কেবল কায়েদে আজমের বুদ্ধিমত্তার কারণেই আমরা পাকিস্তান অর্জন করেছি। যদিও হিন্দু ও শিখদের চাপের মুখে ইংরেজরা অমৃতসর ভারতকে দিয়ে দিয়েছে তবু দুনিয়ার সবাই জানে যে-অমৃতসর খাঁটি ইসলামি শহর, এখানকার স্বর্ণ-মসজিদ বিশ্ববিখ্যাত। সেখানে কোনো গুরুদোয়ারা নেই যে, তাকে গোল্ডেন টেম্পল বলা যাবে। মসজিদ তো দিল্লিতেও রয়েছে; শুধু স্বর্ণ মসজিদই নয়, জামে মসজিদ, লালকেল্লা, নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজার, হুমায়ুনের সমাধিসৌধ, সফদার জঙ্গ-এর মাদ্রাসা রয়েছে এখানে। মোটকথা দিল্লির আনাচে-কানাচে মুসলিম শাসনামলের নিদর্শনে ভরা। তবুও আজ সেই দিল্লি বরং বলা উচিত শাহজাহানাবাদে আজ হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। আমি আবেগরুদ্ধ হৃদয়ে ভাবলাম, এই দিল্লি ছিল এক সময় মুসলমানদের রাজসিংহাসনের জায়গা, সভ্যতা-সংস্কৃতির পাদপীঠ। এই দিল্লি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর আমাদের পাঠানো হচ্ছে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান প্রভৃতি বিরান, অনুন্নত, অসংস্কৃত অঞ্চলসমূহে জোরপূর্বক। এ-সব এলাকায় মার্জিত উর্দুতে কেউ কথা পর্যন্ত বলতে জানে না। সালোয়ারের মতো হাস্যকর পোশাক পরে সেখানকার মানুষ। হালকা-পাতলা চাপাতির বদলে দু সের ওজনের নানরুটি খায়। এসব ভেবেও নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, কায়েদে আজম এবং পাকিস্তানের জন্যে এ-ত্যাগ স্বীকার আমাদের করতেই হবে। কিন্তু তবুও দিল্লি হাত ছাড়া হওয়ার চিন্তায় মনটা বিষণ্ণ-বিমর্ষ হয়েই রইল। বিকেলে আমি বাইরে বেরোলাম। সর্দারজি দাঁত বের করে বললেন, কেমন বাবুজি, আজ উৎসব পালন করোনি? আমার ইচ্ছে হল তার দাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিই। শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা গৌরবচিত্ত শিখদের মনে রং ধরাল। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা হাজারের অঙ্ক ছেড়ে লাখের ঘরে গিয়ে পৌঁছুল। এসব লোক আসলে পাকিস্তানের দুর্নাম রটানোর জন্যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। এখানে এসে সর্বত্র নিজেদের দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা জোরেশোরে চলছে। কংগ্রেসিরা কৌশল গ্রহণ করেছে যে কংগ্রেসের নাম না-নিয়ে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ এবং শহীদী দিল নাম নিয়ে কাজ করতে হবে। অথচ এটা তো সবাই জানে যে, এই হিন্দুরা কংগ্রেসী মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পৃথিবীর মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্যে তারা প্রয়োজন হলে গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরুকে লোক দেখানো গালি দিতেও দ্বিধা করে না।

একদিন সকালে খবর এল যে, দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। কুরলবাগ এলাকায় মুসলমানদের বহু বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। চাঁদনি চকে মুসলমানদের দোকানপাট লুণ্ঠন করে তাদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা। হল কংগ্রেসের হিন্দু-রাজত্বের নমুনা। যাক সে কথা। আমি ভাবলাম নয়াদিল্লি তো বহুকাল ধরে ইংরেজদের শহর ছিল–লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কমান্ডার-ইন-চিফ এখানে থাকেন। অন্ততপক্ষে তারা মুসলমানদের ওপর এ-ধরনের অত্যাচার হতে দেবেন না। এটা ভেবে আমি নিজের অফিসের পথে পা বাড়ালাম। সেদিন আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের। হিসাব হওয়ার কথা। আসলে এ-কারণেই আমি পাকিস্তানে যেতে দেরি করছিলাম। গোল মার্কেটের কাছে পৌঁছতেই অফিসের একজন হিন্দু বাবু বললেন, এ কী করছ, যাও, যাও বাসায় যাও, বাইরে বেরিয়ো না। কনট প্লেসে দাঙ্গাকারীরা মুসলমানদের মেরেছে। এ-কথা শুনে আমি বাসায় ফিরে এলাম।

বাসার সামনে আসতেই সর্দারজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, শেখজি, চিন্তা করবেন না। আমি যতক্ষণ সহি-সালামতে আছি, কেউ আপনাকে হাত লাগাতে পারবে না। আমি ভাবলাম, শিখের ওই দাড়ির আড়ালে কত শয়তানি লুকিয়ে আছে কে জানে। মনে-মনে খুব খুশি যে, মুসলমানদের পাইকারিভাবে নিধন করা হচ্ছে অথচ মৌখিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করছে। আসলে আমাকে চটানোর জন্যেই এ-ধরনের কথা বলছে। কেননা এই এলাকায় আমিই একমাত্র মুসলমান।

কিন্তু আমি কাফেরদের কোনো অনুগ্রহের প্রত্যাশী নই। এটা ভেবে নিজের ঘরে এলাম। ভাবলাম যদি মরেও যাই দশ-বিশটাকে মেরে মরব। সোজা কামরায় প্রবেশ করে পালঙ্কের নিচে উঁকি দিলাম–সেখানে আমার দোলা শিকারি বন্দুক রয়েছে। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি প্রচুর গুলি ও কার্তুজ সংগ্রহ করে রেখেছি। কিন্তু এ ক! পালঙ্কের নিচে বন্দুক নেই। সব কামরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও বন্দুক পাওয়া গেল না।

হুজুর, আপনি কী খুঁজছেন। আমার অনুগত বিশ্বস্ত ভৃত্য মামদো জিজ্ঞেস করল।

আমার বন্দুক কোথায় গেল?

মামদো কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখভাব বলে দিচ্ছিল, সে জানে বন্দুক কোথায় আছে। হয়তো সে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

বলছিস-না কেন? আমি ধমক দিয়ে বললাম।

ধমক দেয়ায় জানা গেল–মামদো আমার বন্দুক চুরি করে তার বন্ধুদের দিয়েছে। ওরা দরিয়াগঞ্জে মুসলমানদের হেফাজতের উদ্দেশ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করছে।

আমাদের কাছে কয়েকশ’ বন্দুক আছে হুজুর। সাতটি আছে মেশিনগান। দশটি রিভলবার। একটি তোপ। কাফেরদের ভুনা করে ফেলব। ভুনা।

আমি বললাম, দরিয়াগঞ্জে আমার বন্দুক দিয়ে কাফেরদের ভুনা করলে এখানে আমার আত্মরক্ষার উপায় কীভাবে হবে? আমি তো এখানে কাফেরদের দঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। এখানে আমাকে ধুনো দেয়া হলে কে দায়ী হবে?

মামদোকে বললাম, কোনো-না-কোনোভাবে চুপিসারে তুমি দরিয়াগঞ্জে যাও। সেখান থেকে আমার জন্যে একটা বন্দুক এবং শ’ দুয়েক কার্তুজ নিয়ে এস।

মামদো চলে যাওয়ার পর আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, সে আর ফিরে আসবে না।

এখন আমি বাসায় সম্পূর্ণ একাকী। সামনের কার্নিশে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ফটো নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। ভাবলাম তাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা কে জানে।

পরে এটুকু ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম যে, তারা তো অন্তত ভালোয়-ভালোয় পাকিস্তান পৌঁছে গেছে। আমি যদি প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোভ না-করে আগেই চলে যেতাম তাহলে কী ভালোই-না হতো! এখন আর আফসোস করে কী হবে?

সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব!

দূর থেকে কোরাসকণ্ঠের আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল। এরা দাঙ্গাকারী। আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আহত হরিণের মতো আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। সেই আহত হরিণ গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তার পেছনে লেগে আছে শিকারি কুকুর। আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই। কামরার দরজা পাতলা কাঠের তৈরি। ওপরের দিকে গ্রাস ফিট করা। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেও দু’মিনিটের মধ্যেই দাঙ্গাকারীরা দরজা ভেঙে ভেতরে চলে আসবে।

সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব–এ-আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল।

হঠাৎ দরজায় করাঘাত হল। সর্দারজি ভেতরে প্রবেশ করে বললেন, শেখজি, তুমি আমাদের ঘরে চল। তাড়াতাড়ি কর। কিছু চিন্তা-ভাবনা না-করেই সর্দারজিকে অনুসরণ করলাম। পেছনের দিকের বারান্দায় আমাকে লুকিয়ে রাখা হল। মৃত্যুর গুলি শন করে আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কারণ আমি সর্দারজির ঘরে প্রবেশ করার পর-পরই আমাদের বাসার সামনে এসে থামল একটা লরি। সে লরি থেকে দশ-পনেরো জন যুবক নামল। যুবকদের মধ্যে নেতা-গোছের একজনের হাতে টাইপ করা একটা কাগজে নামের তালিকা রয়েছে। ৮নং কোয়ার্টারে শেখ বোরহান উদ্দিন কাগজের উপর তাকিয়ে যুবনেতা উচ্চারণ করল। উচ্ছখল যুবকরা পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার কোয়ার্টারে। আমার চেয়ার, টেবিল, সিন্দুক, বই-পুস্তক ইত্যাদি এমনকি আমার ময়লা জামা-কাপড় সবকিছু লরিতে নিয়ে তোলা হয়।

.

ডাকাত!

লুটেরা!

দস্যু!

ভাবলাম সর্দারজি বাহ্যিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমাকে যে এখানে নিয়ে এলেন তিনিই কি কম লুটেরা? তিনি দাঙ্গাকারীদের বললেন, থামো, থামো, এ-ঘরের ওপর আমার অধিকার বেশি রয়েছে। এ-লুণ্ঠনে অংশ নেয়ার অধিকার আমারও পাওয়া দরকার। এ-কথা বলেই তিনি নিজের ছেলে-মেয়েদের ইঙ্গিত করলেন। তারাও লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হল। কেউ প্যান্ট নিয়ে গেল, কেউ স্যুটকেস, কেউ আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ছবি। এসব গনিমতের মাল সোজা অন্দরমহলে চলে যাচ্ছে।

মনে-মনে ভাবলাম যদি বেঁচে থাকি তবে, ওরে সর্দার, তোর সঙ্গে বোঝাপড়া হবে। কিন্তু এখন তো আমি টু শব্দও করতে পারছি না। সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। যদি তারা জানতে পারে যে আমি এখানে আছি

‘এস, ভেতরে এস।’ হঠাৎ দেখি সর্দারজি নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে বাড়ির ভেতরে ডাকছেন। আমি বৃদ্ধের চেহারার দিকে তাকালাম। লুটপাটে অংশ নেয়ার ছুটোছুটিতে তার চেহারা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তার হাতের চকচক করা কৃপাণ আমাকে মৃত্যুর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

কথা বলার সময় নেই। যদি আমি কিছু বলি এবং দাঙ্গাকারীরা শুনতে পায় তাহলে একটা গুলি আমার বুক ভেদ করে যাবে।

কৃপাণ এবং বন্দুকের মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে। দাঙ্গাবাজ দশটি যুবকের চেয়ে একজন বৃদ্ধের কৃপাণ অনেক ভালো। আমি নীরবে কামরায় প্রবেশ করলাম।

ওখানে নয়, ভেতরে এস।

আমি ভেতরের দিকের একটি কামরায় গেলাম। মনে হচ্ছিল, কসাইখানায় করি প্রবেশ করছে। আমার চোখ কৃপাণের তীক্ষ্ণ ধারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।

এই নাও তোমার জিনিসপত্র। এ-কথা বলে সর্দারজি নিজে এবং তার ছেলেমেয়েরা মিছেমিছি লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি আমার সামনে এনে রাখল।

সর্দার-গিন্নি বললেন, বাবা তোমার কোনো জিনিসই বলতে গেলে রক্ষা করতে পারলাম না।

আমি কোনো কথা বললাম না। হঠাৎ বাইরে ঝনঝন শব্দ শোনা গেলে। সাঙ্গাকারীরা আমার লোহার আলমারি বাইরে বের করে সেটি ভাঙার চেষ্টা করছে।

একজন বলল, এর চাবি পাওয়া গেল সহজে ঝামেলা মিটে যেত। অন্যজন বলল, এর চাবি তো পাকিস্তানে পাওয়া যাবে। ভীরু তো, তাই পালিয়ে গেছে। মুসলমানের বাচ্চা হলে তো মোকাবেলা করত!

ছোট্ট মোহিনী আমার স্ত্রীর কয়েকটি রেশমি কামিজ এবং ঘাঘরা দাঙ্গাকারীদের কবল থেকে কেড়ে নিচ্ছিল। ওদের উক্তি শুনে সে বলল, হু হু! তোমরা বড় বাহাদুর বটে! শেখজি ভীরু হতে যাবেন কেন? তিনি তো পাকিস্তানে যাননি।’

একজন যুবক বলল, যদি না-ও গিয়ে থাকে তবে এখানে কোথাও মুখ কালো করে লুকিয়ে আছে।

মুখ কালো করে লুকোবে কেন, উনি তো আমাদের এখানে।

আমার হৃৎস্পন্দন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। মোহিনী নিজের ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে রইল। কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জন্যে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট।

সর্দারজির মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। তিনি আমাকে ভেতরের অন্য একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে দরজায় হুক লাগিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পুত্রকে কৃপাণ হাতে দরজায় রেখে নিজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে কী হল আমি তখনো ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। তবে চড়-থাপ্পড় এবং পরক্ষণে মোহিনীর কান্না শোনা গেল। তারপর পাঞ্জাবি ভাষায় সর্দারজির মুখ নিঃসৃত অশ্লীল খিস্তি-খেউড়। বুঝতে পারলাম যে, কাকে এবং কেন তিনি গালি দিচ্ছেন। আমি চারদিক থেকে বন্দি ছিলাম, এ কারণে সঠিক কিছু শুনতে পেলাম না।

কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণের আওয়াজ শোনা গেল। সর্দার-গিন্নি তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন।

লরির ঘরঘর আওয়াজ শোনা গেল ক্ষণিক পরেই। সমগ্র বিল্ডিং এলাকায় নৈঃশব্দ ছেয়ে গেল। আমাকে কক্ষবন্দি অবস্থা থেকে বের করার পর দেখি সর্দারজি পালঙ্কের উপরে পড়ে আছেন, তার বুকের কাছাকাছি জায়গায় সাদা কামিজ ভেদ করে রক্তধারা গড়াচ্ছে। তার পুত্র প্রতিবেশীর বাসা থেকে ডাক্তারকে টেলিফোন করতে গেছে।

সর্দারজি! এ তুমি কী করলে? নিজের অজ্ঞাতেই আমার মুখ থেকে এ-কথা বেরিয়ে এল। আমি স্তব্ধ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলাম কেবল। আমার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি লোপ পেয়ে গেছে তখন।

সর্দারজি, এ তুমি কী করলে?

আমার ঋণ পরিশোধ করলাম, খোকা!

ঋণ!

হ্যাঁ খোকা! রাওয়ালপিভিতে তোমার মতোই একজন মুসলমান নিজের জীবন দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের জীবন ও ইজ্জত রক্ষা করেছে।

তার নাম কী ছিল সর্দারজি?

গোলাম রসুল।

গোলাম রসুল? আমার মনে হল ভাগ্য যেন আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দেয়ালের ঘড়িতে বারোটা বাজল। এক দুই তিন চার পাঁচ…।

সর্দারজি হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনি যেন হাসছেন। আমার নিজের দাদার কথা মনে পড়ল। তার মুখে কয়েক ফুট লম্বা দাড়ি ছিল। সর্দারজির চেহারা তার চেহারার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে। ছয় সাত আট নয়…।

সর্দারজি যেন হাসছিলেন। তার শাদা দাড়ি এবং খোলা চুল চেহারার চারদিকে একটি আলোক আভা তৈরি করেছে।

দশ এগারো বারো। মনে হল সর্দারজি যেন বলছেনজ্বী হ্যাঁ, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্দারজির দু’চোখ বুজে গেল।

দূর, বহু দূর থেকে যেন গোলাম রসুলের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল : আমি বলেছি না, বারোটা বাজলেই শিখদের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়? এখন এই সর্দারজিকে দেখ। একজন মুসলমানের জন্যে নিজের জীবন দিলেন।

সর্দারজি সেদিন মারা যাননি, আমিই মরেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *