প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

২.৪ দুই হাত ॥ ইসমত চুগতাই / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

দুই হাত ॥ ইসমত চুগতাই / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

দুই হাত – ইসমত চুগতাই

রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে। বুড়ি মেথরানি চিঠি পড়িয়ে নেয়ার জন্য আব্বা মিঞার কাছে এসেছিল। রামঅওতারের ছুটি হয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তো! তাই তিন বছর বাদে রামঅওতার ফিরে আসছে। কৃতজ্ঞতাবশত সে দৌড়ে-দৌড়ে সকলের চরণ স্পর্শ করছে যেন এইসব চরণের মালিকেরাই তার একমাত্র পুত্রকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জীবিত সুস্থ অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসছে।

বুড়ির বয়স পঞ্চাশ বছর হয়েছে; কিন্তু তাকে সত্তর বছরের মতো দেখায়। দশ-বারোটা ছোট-বড় ছেলে জন্ম দিয়েছিল সে। তাদের মধ্যে কেবল রামঅওতারই অনেক মানত-টানত করার ফলে বেঁচে আছে। বিয়ে দেয়ার এক বছর পুরা না-হতেই, রামঅওতারের ডাক’ এসে গিয়েছিল। মেথরানি অনেক আপত্তি করেছিল; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কিন্তু যখন রামঅওতার উর্দি পরে শেষবারের মতো তার চরণ স্পর্শ করতে এল, তখন ছেলের দাপট দেখে বুড়িরও বুক ফুলে উঠেছিল, যেন তার ছেলে কর্নেলই হয়ে গেছে।

পেছনের মহলে চাকর-বাকররা হাসছিল। রামঅওতার ফিরে আসার পর যে ড্রামা হবার সম্ভাবনা, সবাই তা নিয়ে উৎসুক হয়ে বসে আছে। যদিও রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে কামান-বন্দুক ছুঁড়তে যায়নি, তবু সিপাহিদের পায়খানা সাফ করতে-করতেও তো তার মধ্যে কিছুটা সিপাহিয়ানা দেখা গেয়েছে। ধূসর উর্দি পরে সেই পুরনো রামঅওতার তো আর সেই লোকটি নেই যে সে গোরীর কার্যকলাপ চুপচাপ শুনবে, তার তরতাজা খুন বদনামির ওপর খেপে না-উঠবে।

বিয়ে করে আনার সময় গৌরীর যৌবন কত মচমচে ছিল। রামঅওতার যতদিন ছিল ততদিন তার ঘোমটা ছিল এক ফুট লম্বা। কেউ তার মুখের রূপ দেখতে পায়নি। যখন পতি বিদেশে গেল তখন সে ভেউ-ভেউ কেঁদেছিল–যেন তার সিথির সিঁদুর চিরকালের মতো মুছে যাচ্ছে। কিছুদিন কাঁদো-কাদো চোখে মাথা ঝুঁকিয়ে সে পায়খানার টব বহন করত। তারপর ধীরে-ধীরে তার ঘোমটার দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছিল।

কিছু লোকের ধারণা যে, ঐ সময় মেয়েটার শরীরে বসন্ত ভর করেছিল। আর একধাপ এগিয়ে কেউ-কেউ বলেছিল, গোরী একটা ছিনাল। রামঅওতার চলে যাওয়াতেই আপদ এসে জুটেছিল। বদমাশ মেয়ে সব সময় ‘হি-হি’ করত, সব সময় যেন মদমত্তা হয়ে হাঁটত। কোমরে পায়খানার টব বসিয়ে কাঁসার কাকন ছনছ করে যেদিক দিয়ে সে চলে যেত সেদিকে লোকে বেহুঁশ হয়ে তাকিয়ে থাকত। ধোপার হাত থেকে সাবানের বাটি পিছলে চৌবাচ্চায় পড়ে যেত, তাওয়ার উপর ফুলে-ওঠা রুটি থেকে চলে যেত বাবুর্চির দৃষ্টি। ভিস্তির ডোল ডুবে যেত কুয়াতে। চাপরাশিদের ব্যাজ লাগানো পাগড়ি হেলে গিয়ে কাঁধে ঝুলতে থাকত। আর যখন এই আপদের প্রতিমা ঘোমটার আড়াল থেকে নয়ন-বাণ নিক্ষেপ করে চলে যেত তখন সারা পেছন-মহল এক নিষ্প্রাণ দেহের মতো স্থবির হয়ে পড়ত। আবার হঠাৎই চমকে উঠে একে অপরের দুর্গতি নিয়ে বিদ্রূপ করত তারা। ধোপানি প্রচণ্ড রাগে মাড়ের কড়াই উল্টে দিত। চাপরাশিনি বুকে চেপে-রাখা ছেলেকে ধমকে উঠত অকারণে। বাবুর্চির তৃতীয় পক্ষের বিবির হিস্টিরিয়া হয়ে যেত।

নামেই কেবল গোরী কিন্তু বদমাশ মেয়েটা কালো কুটকুটে–যেন উল্টানো তাওয়ার উপর কোনো নষ্ট মেয়ে পরোটা ভেজে চমকে উঠে রেখে দিয়েছে। চওড়া কুঁকদানির মতো নাক, ছড়ানো ঠোঁট। তার সাত পুরুষে দাঁত মাজার ফ্যাশন ছিল না। চোখে বিস্তর কাজল দেয়ার পরেও ডান চোখের টেরাভাব ঢাকা যেত না তার। ঐ টেরা চোখেই সে আবার এমন করে বিষ-মাখানো তীর ছুড়ত যে তা নিশানা ভেদ করত। মোষের চেয়ে চওড়া পা। যে দিক দিয়ে চলে যায় সে দিকে ছড়িয়ে যায় সর্ষের তেলের পচা গন্ধ। হাঁ, কণ্ঠস্বর ছিল আশ্চর্য রকমের মধুর। উৎসব-অনুষ্ঠানে যখন ভাবে বিভোর হয়ে কাজরি গাইত তখন তার কণ্ঠস্বর চলে যেত সবচেয়ে চড়ায়।

বুড়ি মেথরানি ওরফে তার শাশুড়ি, ছেলে চলে যাওয়ার পর গোরীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। উঠতে-বসতে তাকে রক্ষার জন্য গালি দিত। তার ওপর নজর রাখার জন্য পেছন-পেছন ঘুরত। কিন্তু এখন বুড়ির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। চল্লিশ বছর পায়খানা বহন করার ফলে তার কোমর চিরকালের মতো এক দিকে বেঁকে গিয়ে থেকে। গিয়েছিল ওখানেই। সে আমাদের পুরনো মেথরানি। আমাদের জন্মের পরে সে-ই ফুল-নাড়ি ওই মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। মায়ের প্রসববেদনা উঠলে সে এসে বসত চৌকাঠের উপর। আর কখনো কখনো লেডি-ডাক্তারকেও অনেক দরকারি পরামর্শ দিত। টোটকা চিকিৎসার জন্য মন্ত্রপূত তাবিজও নিয়ে বেঁধে দিত পট্টিতে। মেথরানিদের ঘরে সে ছিল গুরুগম্ভীর বয়স্কের মর্যাদায় আসীন।

এমনি জনপ্রিয় মেথরানির পুত্রবধূ হঠাৎ একদিন লোকের চক্ষুশূল হয়ে গেল। চাপরাশিনি আর বাবুর্চিনির তো আরো অভিযোগ ছিল। আমাদের শান্ত-শিষ্ট বউদিদের মাথা তার ঢং দেখে থমকে যেত। আর যে-কামরায় তাদের স্বামীরা আছে সে-কামরা ঝাঁট দিতে যদি সে যেত, তাহলে তারা পড়িমরি করে বুক থেকে দুধের বাচ্চাদের মুখ সরিয়ে দৌড়ত সেখানে যাতে ঐ ডাইনি তাদের স্বামীদের ওপর টোটকা প্রয়োগ না করতে পারে!

গোরী যেন একটা মারকুটে লম্বা শিংওলা ষড়–যা এখানে-ওখানে দিব্যি ছুটে বেড়াত। মেয়েরা তাকে দেখলে নিজ-নিজ কাঁখের বাসন-গামলা দুই হাতে সামলে চেপে ধরত বুকে। আর যখন সে হাল্কা কোমল চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াত তখন পেছন-মহলের মহিলাদের এক হঠাৎ গড়ে-ওঠা প্রতিনিধি-মণ্ডল এসে হাজির হত। মায়ের দরবারে খুব চেঁচামেচি হত, ভাবী বিপদ আর তার সাংঘাতিক ফলাফল নিয়ে হত তর্কবিতর্ক। পতিরক্ষার জন্য এক কমিটি বানানো হয়েছিল তার কারণে, যাতে সব বউদিরা হৈ-চৈ করে ভোট দিল। মাকে দেয়া হয়েছিল ওই সমিতির সম্মানিত প্রধানের পদ। সব মহিলা নিজ-নিজ পদের মর্যাদা অনুযায়ী পিড়ি আর পালঙ্কের কিনারে বসল। পানের দোনা ভাগ করে দেয়া হল তাদের আর ডেকে পাঠানো হল বুড়িকে। বাচ্চাদের মুখে মাই দিয়ে সভায় নিস্তব্ধতা রক্ষা করা হল। পেশ করা হল মোকদ্দমা। আমাদের মা খুব রোয়াবের কণ্ঠে বলেছিলেন, কী রে চুড়েল! তুই বদমাশ বউকে কী এইজন্যে ছেড়ে রেখেছিস যাতে সে আমাদের বুকের উপরে শিল-নোড়া বাটে? তোর মতলবটা কী? মুখে কালি মাখাবি?’

মেথরানিও রেগে উঠল। ফেটে পড়ে বলল, ‘কী করব, বেগম সাহেবান? হারামখোরকে চার লাথি মেরে ছিলাম। রুটিও খেতে দিইনি; কিন্তু রাড়ি তো আমার কজায় নেই…’

.

‘আরে ওর কি রুটির কিছু কমতি আছে?’ বাবুর্চিনি ঢিল ছুড়ল। সাহারানপুরের খানদানি বাবুর্চি ঘরের মেয়ে সে, আবার তৃতীয় পক্ষের বিবি। আল্লার আশ্রয়, কেমন তেজ আর রাগ তার। অন্যদিকে চাপরাশিনি, মালিনী, ধোপানি–সবাই মোকদ্দমাকে আরো সঙিন করে তুলল। বেচারি মেথরানি বসে বসে সকলের লাথি-ঝাঁটা খেতে-খেতে নিজের চুলকানি-ভরা থলথলে গা চুলকাতে লাগল।

‘বেগম সাহেবান, আপনি যেমন বলবেন তেমন করতে দ্বিধা করব না। কিন্তু করব কী, মাগির গলা টিপে দেব?’

টেটিয়াকে শিক্ষা দেবার তীব্র অভিলাষে ঐ মহিলাদের মনে খুশির ঢেউ উঠছিল। আর সকলেরই মনে বুড়ির প্রতি সীমাহীন দরদ তখন…

মা রায় দিয়েছিলেন–মড়াটাকে ধরে বাপের বাড়িতে ছেড়ে দে।’

এ বেগম সাহেবান, এ কি কখনো হতে পারে?

মেথরানি জানিয়েছিল যে, বউ খালি হাতে আসেনি। সারা জীবনের কামাই পুরো দু’শ’ ফেললে তবে এই দামাল মাগী হাতে আসবে। বরং এই টাকায় দুটো গরু কেনা যাবে। অনায়াসে কলসিভরা দুধ দেবে। তখন এই রাড়িকে দুই লাথি দেয়া যাবে হয়তো। আর যদি গোরীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া যায় তাহলে এর বাপ খুব তাড়াতাড়ি অন্য মেথরের হাতে বেচে দেবে একে। সে তো কেবল ছেলের শয্যা-শোভা নয়। দুই হাতওয়ালা মেয়েমানুষ, যে চারটে পুরুষ মানুষের কাজ করে ফেলে। রামঅওতার। যাওয়ার পর থেকে বুড়ি এত কাজ সামলাতে পারে না। এই বুড়ো বয়সে বউয়ের দুই হাতের সাহায্য নিয়েই চলছে তার।

মহিলারা কেউ অবুঝ নয়। মামলা সামাজিক চালচলন থেকে সরে এসে আর্থিক বাস্তব অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে গেল তখন। সত্যি কথাই, বুড়ির জন্যে বউটা থাকাই দরকার। কার এমন দিল আছে দু’শ’ টাকা ফেলে দেবে। এই দু’শ টাকা ছাড়াও বিয়েতে বেণের কাছ থেকে নিয়ে খরচ করেছে, লোকজন খাইয়েছে। বেরাদরিকে রাজি করিয়েছে। এই সমস্ত খরচ আসবে কোথা থেকে। রামঅওতার যে বেতন পায় তা তো ধার শুধতেই বেরিয়ে যায়। এমন মোটা-তাজা বউ এখন তো চারশ’ টাকার কমে পাওয়া যায় না। পুরো সাফাইয়ের কাজের পর আশপাশের আরো চার কুঠিতে কাজ করে গোরী। মাগী কাজে চৌকস।

মা শেষ সওয়াল দিয়ে দিলেন–যদি ঐ লুচ্চির জলদি-জলদি কোনো ব্যবস্থা না-কর তো কুঠির হাতায় থাকতে দেওয়া হবে না…’

বুড়ি অনেক চেঁচামেচি করল আর ফিরে গিয়ে প্রাণ ভরে অনেক গালি দিল বউকে। চুল ধরে মারলও। বউ তার কেনা-বউ। সে পিটতে থাকল, হড়বড় করে বকতে থাকল তারপর একদিন সে সব চাকরদের ঘর তছনছ করে দিল প্রতিশোধ হিসেবে। বাবুর্চি, ভিশৃতি, ধোপা আর চাপরাশিরা নিজ-নিজ বউদের ধরে-ধরে খুব পিটল। এবারও মেথরানি বউয়ের মামলায় আমার সভ্যা বউদির দল ও সম্ভ্রান্ত ভাইদের মধ্যে খচাখচি হয়ে গেল আর বউদিদের বাপের বাড়িতে তার পাঠানো হতে থাকল। ফলে বউরা প্রতি ঘরে সই-পাখির কাটা হয়ে গেল।

দু-চারদিন পরে বুড়ি মেথরানির দেওরের ছেলে রতীরাম আপন জেঠিমার সঙ্গে দেখা করতে এসে ওখানেই থেকে গেল। দু’-চারটে কুঠিতে কাজ যা বেড়ে গিয়েছিল তা সে সামলে দিল। নিজের গায়ে তো নিষ্কর্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার বউ এখনো নাবালিকা, এ-কারণে দ্বিরাগমন হয়নি।

রতীরাম আসায় মৌসুম উল্টে-পাল্টে একেবারে বদলে গেল; যেমন হাওয়ার দমকের সঙ্গে ঘন মেঘের দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বউকে বলে-বলে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁসার কাকন মূক হয়ে গিয়েছিল। যেমন বেলুন থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেলে সেটা চুপচাপ ঝুলতে থাকে তেমনভাবে বউয়ের ঘোমটা ঝুলতে-ঝুলতে নিচের দিকে বেড়েই চলল। এখন সে নাকে দড়ি-না-বাধা বলদের বদলে একেবারে লজ্জাবতী বধূ। পেছন-মহলের সব মহিলা সান্ত্বনার নিঃশ্বাস ফেলল। স্টাফের পুরুষরা তাকে খোঁচা দিলে সে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে থাকত, আর কেউ বেশি চোখ মারলে সে ঘোমটার মধ্যে থেকে অশ্রু-ভেজা চোখের তেরছা নজরে রতীরামের দিকে দেখত, আর দৌড়ে বাহু চুলকাতে-চুলকাতে রতীরামের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেত।

বুড়ি শান্ত হয়ে দেউড়িতে বসে আধ-খোলা চোখে এই মিলনান্ত নাটক দেখতে দেখতে গুড়গুড়িতে টান দিত। চারদিকেই শীতল শান্তি ছেয়ে গিয়েছিল–যেন সব ফেঁড়া থেকে পুঁজ বেরিয়ে গেছে।

এদিকে বউয়ের বিরুদ্ধে এক নতুন দল তৈরি হল আর তাতে যোগ দিল শার্গিদ-পেশার পুরুষেরা। কথায়-অকথায় যে বাবুর্চি একদিন তার পরোটা ভেজে দিত সে পায়খানার টব সাফ না-করার জন্যে গালি দিতে লাগল। ধোপার অভিযোগ সে মাড় লাগিয়ে কাপড় দড়িতে টাঙিয়ে দেয়, আর এই হারামজাদি ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। যে ভিশৃতি তার হাত ধুইয়ে দেবার জন্য মশক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত আজ তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঙিনায় জল ছিটাবার জন্যে বলে কিন্তু সে শোনে না, ফলে বউ শুকনো জমিতে ঝাড় দিয়ে দিলে চাপরাশি ধুলো ওড়ানোর জন্যে দোষারোপ করে তাকে গালি দিতে থাকে।

সে মাথা ঝুঁকিয়ে সকলের তিরস্কার এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। কে জানে বউ শাশুড়িকে গিয়ে কী বলে দিয়েছিল, ফলে বুড়ি ঠা-া করে সকলের মাথা খেয়ে ফেলত। এখন তার দৃষ্টিতে বউ একেবারে শুদ্ধ আর পুরোপুরি ভালো।

দাড়িওলা দারোগাজি হল সব চাকরদের সর্দার। বাবাকে সে আসল পরামর্শদাতা বলে মানত। সে একদিন বাবার কাছে হাজির হয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ভয়ানক বদমায়েশি আর শয়তানির কান্না কেঁদে বলল যে বউ আর রতীরাম অনুচিত সম্পর্ক সংস্থাপন করে সারা শার্গিদ-পেশাকে নোংরা করে দিয়েছে। বাবা মামলা সেশনে সোপর্দ করে দিলেন অর্থাৎ এতে লাগিয়ে দিলেন মাকে। মহিলাদের সভা ফের বসল আর বুড়িকে ডেকে আনিয়ে গালাগালি করা হল।

‘আরে হারামজাদি, তুই কি জানিস তোর ছিনাল-বউ কী বদমায়েশি করে বেড়াচ্ছে?’

মেথরানি এমনি ঝাপসাভাবে তাকাল যেন সে বুঝতেই পারছে না কার সম্পর্কে কথা হচ্ছে। আর যখন তাকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলা হল যে চোখে-দেখা সাক্ষীদের বক্তব্য এই যে। বউ আর রতীরামের মধ্যে সম্পর্ক অশোভনীয় রকম খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দু’জনকে খুবই যাচ্ছেতাই অবস্থায় ধরা হয়েছে, তখন তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ দেয়াই উচিত ছিল বুড়ির। উল্টে বিগড়ে গেল সে। ভারি ঝামেলা লাগিয়ে দিল। রামঅওতার আজ যদি এখানে থাকত তো যারা তার নিষ্কলঙ্ক বউয়ের ওপর কলঙ্ক লেপন করছে তাদের মজা দেখিয়ে দিত। বউ হারামজাদি তো এখন চুপচাপ, রামঅওতাদের কথা মনে করে চোখের জল ফেলছে। প্রাণ দিয়ে কাজকও করছে। কারুর কোনো অভিযোগ থাকতে পারে না। ঠাট্টা তো কেউ করছে না। লোকে নিছক তার দুশমন বনে গেছে। বুড়ি কাঁদতে শুরু করল। তাকে অনেক বোঝানো হল কিন্তু শোক করতে সে নিজেই এমন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে যেন সারা দুনিয়া তার জান নিতে উদ্যোগী হয়েছে। বুড়ি আর তার নিকলঙ্ক বউ লোকের কী ক্ষতিটা করেছে? সে তো কারোর কোনো-কিছুর মধ্যে নেই। বুড়ি নিজে তো সকলের সব রহস্য জানে কিন্তু আজ পর্যন্ত তো কারোর হাটে হাঁড়ি ভাঙেনি। তার কী দরকার কারোর ছিদ্র অন্বেষণ করার? কুঠিবাড়িগুলোর পেছনে কী-না হয়ে থাকে? মেথরানি কারোর ময়লা লুকিয়ে রাখে না। এই দুই বুড়ো হাতে বড়-বড় লোকের কত পাপ সে মাটিচাপা দিয়েছে। এই দুই হাত ইচ্ছে করলে এখন রানীর সিংহাসন উল্টে দিতে পারে। কিন্তু না। কারোর সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু কেউ যদি তার গলায় ছুরি চালায় তো তাহলে সব-কিছু গড়বড় হয়ে যাবে, যেমন-তেমন কারো-না-কারো চাপা রহস্য আপন বুড়া কজে থেকে বের করে দেবার দরকার বোধ করি হবে না।

তার ভ্রুভঙ্গি দেখে শীঘ্রই ছুরি-চালানেওয়ালিদের হাত ঝুলে পড়ল। সব মহিলাই তার পক্ষ নিতে লাগল। বউ যাই করুক-না কেন তাদের নিজ-নিজ কেল্লা তো সুরক্ষিত আছে। তা হলে অভিযোগটা হয় কী করে? এবার কিছুদিনের জন্যে বউয়ের প্রেমটা কমে গেল। মানুষও ভুলে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু রহস্যভেদকারীরা ধরে নিয়েছিল যে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। বউয়ের ভারিসারি শরীরও বেশিদিন গণ্ডগোল লুকিয়ে রাখতে পারল না। ফলে লোকে বুড়ির কাছে খুব হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল। কিন্তু এই নতুন মামলায় বুড়ি বিলকুল হাবিজাবি বকতে লাগল। একেবারে এমনি হয়ে যেত যেন একদম শুনতেই পাচ্ছে না। এখন সে প্রায়ই খাটের উপর শুয়ে থেকে বউ আর রতীরামের ওপর হুকুম চালায়। কখনো কাশে, হাঁচে, বাইরে রোদে গিয়ে বসে। এখন ওরা দু’জনে বুড়ির এমনই দেখাশোনা করে যেন সে কোন পাটরানি।

ভালো-ভালো বউ-ঝিরা তাকে অনেক বুঝিয়েছে। রতীরামের মুখে কালি মাখাও। আর তারও আগে রামঅওতার ফিরে এসে বউয়ের চিকিৎসা করাক। সে তো নিজেই এই কৌশলে খুব নিপুণ। দু’দিনেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বুড়ি কিছু বুঝতেই চাইল না। এদিকে-ওদিকে সকলের কাছে অভিযোগ করতে লাগল যে, তার হাঁটুতে আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। তার কারণ এইসব কুঠিবাড়িতে লোকে বেশি পরিমাণে নিষিদ্ধ দ্রব্য খেতে শুরু করেছে। কোনো-না-কোনো কুঠিতে পায়খানা লেগেই আছে। এতে টালমাটাল বুঝানোওয়ালারা জ্বলে-পুড়ে খাক হতে থাকে। মেনে নাও যে বউ মেয়েছেলের জাত, অজ্ঞ, বোকা। বড়-বড় সম্ভ্রান্ত মহিলার পদস্খলন হয়ে যায়, কিন্তু ওই বড়-বড় ঘরের ইজ্জতদার শাশুড়িরা তো কানে তেল দিয়ে বসে থাকে না। কিন্তু কে জানে কেন এই ষাট বছরের বুড়ি যে বিপদকে সে খুব সহজেই কুঠিবাড়ির জঞ্জালের নিচে কবর দিয়ে দিতে পারে, সে নিজেই এখন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে।

রামঅওতারের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিল বুড়ি। সব সময়েই ধমক দিত– ‘রামঅওতারকে আসতে দাও। বলে দেব। তোদের হাড়মাস এক করে দেবে।’

আর এখন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে রামঅওতার জীবন্ত ফিরে আসছে। সমস্ত পরিবেশটাই দম বন্ধ করে আছে। এক ভয়ংকর হাঙ্গামার অপেক্ষায় আছে লোকে।

কিন্তু লোকেদের খুব রাগ হল যখন বউ একটি ছেলের জন্ম দিল। কিন্তু তাকে বিষ দেবার বদলে বুড়ি খুব খুশি হয়ে উঠল। রামঅওতার চলে যাওয়ার দু’বছর বাদে ছেলে হবার পর বুড়ি একেবারেই চমকিত হয়নি। ঘরে ঘরে ফাটা-ছেঁড়া পুরনো কাপড় আর অভিনন্দন কুড়োতে লাগল সে। তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরা তাকে হিসাব করে অনেক বুঝিয়েছিল যে, এই ছেলে রামঅওতারের হতেই পারে না, কিন্তু বুড়ি সবকিছু বুঝেও সব কথা নস্যাৎ করে দিল। বলল আষাঢ়ে রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিল–তখন বুড়ি হলুদ কুঠির নয়া ঢঙের ইংরেজি পায়খানার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, এখন চৈত্রমাস শুরু হয়েছে আর জ্যৈষ্ঠ মাসে বুড়িয়ার লু লেগেছিল কিন্তু খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল সে। যখনই তার হাঁটুতে বেদনা বেড়ে যেত, সে বলত–বৈদ্যজি পুরো হারামি। ওষুধের মধ্যে খড়ি মিশিয়ে দেয়। এরপর সে আসল কথা থেকে সরে গিয়ে নষ্ট মেয়েছেলে আর বোকাদের মতো উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করত। কারোর-কারো মাথায় এই কথা ঢুকেছিল যে, ওই চালাক বুড়িকে কিছুই বোঝানো যাবে না, কারণ সে না-বোঝার সিদ্ধান্ত করে বসে আছে।

ছেলেটা হবার পর সে রামঅওতারকে চিঠি লিখিয়েছিল। …রামঅওতার সমীপে, চুম্বন ও স্নেহ-সম্ভাষণের পরে অত্র সব কুশল জানিয়ে আর তোমার কুশল জানাইবে আর ভগবানের নিকট তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করি আর তোমার ঘরে একটি পুত্রের জন্ম হইয়াছে সে-কারণে তুমি এই পত্রকে ‘তার বলিয়া জানিবে আর শীঘ্র আসিবে।’

লোকে ভেবেছিল রামঅওতার কিছুটা নারাজ হবে। কিন্তু সকলের আশায় ছাই পড়ল যখন রামঅওতারের খুশিতে ভরা পত্রে জানাল যে, সে ছেলের জন্য মোজা বেনিয়ান নিয়ে আসছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, এখনই তার আসার কথা। বুড়ি নাতিকে হাঁটুর ওপর শুইয়ে খাটের উপর বসে রাজত্ব করছিল। আচ্ছা, এর চেয়ে সুন্দর বার্ধক্য আর কী হতে পারে! সব কুঠির কাজ হয়ে যাচ্ছে ঝটপট। মহাজনের সুদ সময়মতো কায়দা-মাফিক চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আর তার নাতি শুয়ে আছে হাঁটুর উপর।

শেষ পর্যন্ত লোকে ভেবে নিল, রামঅওতার যখন আসবে, আসল ব্যাপার বুঝতে পারবে, তখন দেখে নেয়া যাবে। এবার রামঅওতার যুদ্ধ জিতে আসছে। শেষতক ও তো সিপাহি বটে। রক্ত কেন গরম না-হবে? লোকের হৃদয় উৎসাহে ভরে উঠল। পেছনে মহলের বাতাবরণ বউয়ের সংকীর্ণ নজরের কারণে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। দু-চারটে খুন হবার আর নাক কাটবার আশায় জেগে উঠেছিল।

যখন রামঅওতার ফিরে এল তখন ছেলেটার বয়স বছরখানেক। পেছন হলে হৈ-চৈ লেগে গেল। বাবুর্চি হাঁড়িতে অনেক জল ঢেলে দিল, যাতে সে নিশ্চিন্ত হয়ে কচুক করে মজা খাকতে পারে। ধোপারা মাড়ের কড়াই নামিয়ে মাটিতে রেখে দিল আর ভিতি তার ডোল ফেলে দিল কুয়ার ধারে।

রামঅওতারকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই বুড়ি তার কোমর ধরে চেঁচাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই দাঁত বের-করা ছেলেটাকে রামঅওতারের কোলে দিয়ে এমনি হাসতে শুরু করে দিল যেন সে কোনোদিন কাঁদেইনি।

রামঅওতার ছেলেটাকে দেখে এমন লজ্জা পেল যেন ছেলেটাই তার বাপ। ঝটপট বাক্স খুলে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করেছিল সে। লোকে ভেবেছিল কুরি বা চাকু বের করছে কিন্তু সে যখন তা থেকে লাল বেনিয়ান আর হলদে মোজা বের করল, তখন সব চাকর-বাকরদের পৌরুষের ওপর যেন একটা জোর ঘা পড়ল।

‘ধেততেরিকে। শালা সিপাহি হয়েছে… আপাদমস্তক হিজড়া…।’ ওদিকে বউ সংকোচে এমনভাবে কুঁকড়ে ছিল যেন সে নববিবাহিতা বধূ। সে কাঁসার থালায় জল ভরে রামঅওতারের দুর্গন্ধভরা ফৌজি বুট খুলে নিয়ে পা ধুয়ে জল খেল।

রামঅওতারকে বুঝিয়েছিল লোকে। জ্রিপ করেছিল। তাকে বোকা-বুন্ধু বলেছিল, কিন্তু সে বোকার মতোই দাঁত বের করে থাকত যেন কিছুই সে বুঝতে পারছে না। রতীরামের দ্বিরাগমন হওয়ার কথা ছিল, সে দেরি না-করে চলে গেল।

রামঅওতারের এই কাজে লোকে যতটা আশ্চর্য হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল ক্রুদ্ধ। আমাদের বাবা, যিনি সাধারণত চাকর-বাকরদের সম্পর্কে কৌতূহল দেখাতেন না, তিনিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। সারা কানুনের জ্ঞান প্রয়োগ করে রামঅওতারকে জব্দ করার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন।

‘কী রে, তুই তিন বছর পরে ফিরলি?’

‘হুজুর ঠিক খেয়াল নেই, কিছু কম-বেশি হতে পারে…’

‘আর তোর ছেলের বয়স বছরখানেক হবে।’

‘এতটাই তো মনে হয় হুজুর, কিন্তু শ্বশুর বড় বদমাশ…’

রামঅওতার লজ্জা পেয়েছিল।

‘আরে, তুই এখন হিসাব কর…’

‘হিসাব? কী হিসাব করব হুজুর?’ রামঅওতার মরা-মরা গলায় বলেছিল।

‘উল্লুকের বাচ্চা, এটা কী করে হল?’

‘আমি তা কেমন করে জানব, হুজুর। ভগবানের দান।‘

ভগবানের দান? তোর মাথা… এই ছেলে তোর হতে পারে না’… বাবা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে জব্দ করতে চাইছিলেন, রামঅওতার ফের মরা-মরা গলায় বেকুবির সঙ্গে বলল–

তা আমি কী করব, হুজুর, হারামজাদিকে আমি খুব মেরেছি…’ ক্রোধভরে ছিটকে গিয়ে সে বলল।

‘আরে, তুই একেবারে উল্লুকের বাচ্চা… বদমায়েশ মাগীটাকে বাইরে বার করে দিসনি কেন?

‘না হুজুর, এ কি কখনো হতে পারে?’ রামঅওতার হে-হে করছিল।

‘কেন রে?’

হুজুর, আড়াইশ’-তিনশ’ টাকা আবার একটা বিয়ের জন্য কোথা থেকে আনব? আর ভাই-বেরাদারিকে খাওয়াতে একশ-দু’শ’ টাকা খরচা হয়ে যাবে…’

‘কেন রে, বেরাদারিকে কেন তোর খাওয়াতে হবে? বউয়ের বদমায়েশির জরিমানা কেন তোকে দিতে হবে?

তা আমি জানি না, হুজুর। আমাদের সমাজে এই রকমই হয়ে থাকে…’

‘কিন্তু ছেলেটা তোর নয়, রামঅওতার … ঐ হারামি রতীরামের।’ বাবা রেগে গিয়ে বোঝালেন।

তাতে কী হয়েছে, হজুর…রতীরাম আমার ভাইয়ের মতো–… অন্য কেউ তো নয়… নিজেরই রক্ত সম্পর্কের…

তুই একেবারে উলুকের বাচ্চা।’ বাবা খচে গিয়েছিল।

হুজুর, ছেলেটা বড় হয়ে আমার কাজ গুছিয়ে নেবে।’

রামঅওতার সবিনয়ে বোঝাল, ‘সে দুহাত লাগাবে, তখন বুড়ো বয়সের ভার কমে যাবে…’

রামঅওতারের মাথা লজ্জায় ঝুঁকে পড়ল। আর কে জানে কেন একদম রামঅওতারের সঙ্গে-সঙ্গে বাবার মাথাও ঝুঁকে গেল–যেন তার কাঠামোর ওপর লাখ-লাখ কোটি-কোটি হাত ছেয়ে গেল…এই হাতগুলো পাপপঙ্কিল নয়, শুদ্ধ। এ তো সেই জয়ী–সংগ্রামী হাত যা দুনিয়ার মুখ থেকে ময়লা ধুয়ে নিচ্ছে। তার বুড়ো বয়সের বোঝা তুলছে।

এই মাটিতে লেগে-থাকা কচি-কচি কালো হাত ধরিত্রীর সিথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *