প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

১.৯ পর্যটক ॥ কুররাতুল আইন হায়দার / মোস্তফা হারুণ

পর্যটক ॥ কুররাতুল আইন হায়দার / মোস্তফা হারুণ

পর্যটক – কুররাতুল আইন হায়দার

গত বছর এক সন্ধ্যায় দরজায় ঘণ্টা বাজল। আমি বাইরে এলাম। এক লম্বা ছিপছিপে ইউরোপীয়ান ছেলে ক্যানভাসের থলে কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ঝোলানো রয়েছে। দ্বিতীয় একটি থলে। পায়ে ধূলিমলিন পেশোয়ারি চপ্পল। আমাকে দেখে বিনীত হয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। তারপর একটা খাম এগিয়ে দিলে বলল,

আপনার মামার চিঠি।

‘ভেতরে এস।’

আসান মামুর চিঠি। তিনি লিখেছেন, আমরা করাচি থেকে হায়দারাবাদ (সিন্ধু) ফিরে যাচ্ছিলাম। থাটের মাকালি হিলের কবরের মাঝে ছেলেটি বসেছিল। আংটি দেখিয়ে পাথেয় চাইলে আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। ছেলেটি বিশ্ব-ভ্রমণে বেরিয়েছে। এখন ইভিয়াতে যাচ্ছে। অটো বড় ভালো ছেলে। আমি তাকে ভারতীয় আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকানা লিখে দিয়েছি–সে তাদের কাছে থাকবে। তুমিও তাকে আতিথ্য দিও।

নোট : ওর কাছে সম্ভবত টাকাকড়ি নেই।

ছেলেটি কামরায় এসে মেঝেতে থলে রাখল। তারপর চোখ রগড়ে দেয়ালের ছবি দেখতে লাগল। এত লম্বা ছেলেটির মুখখানা বাচ্চার মতো ছোট। তার ওপর আবছা সোনালি দাড়ি-গোঁফে বড় আশ্চর্য লাগছে।

এ দেখছি আর এক আপদ। আমি একটু বাঁকা করে ভাবলাম। আসান মামুর মতো ফেরেশতা চরিত্রের লোকটা এর কজাতে পড়ে গেল কী করে? এরা হল বিশ্বপর্যটক। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পথিকদের বন্ধুত্ব পাতানোতে এরা বেশ ওস্তাদ।

‘শাহেদাও আপনাকে সালাম বলেছে।’ সে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল।

‘শাহেদা?’

‘হ্যাঁ, আপনার কাজিন। বেনারসে আমি তাদের ওখানে ছিলাম। আর লক্ষ্ণৌতে আপনার ফুফুর বাড়িতে। চাটগাতে গিয়ে থাকব আপনার আঙ্কলের কাছে। আর যদি দাজিলিং যেতে পারি তো আপনার কাজিন তাহেরার ওখানে উঠব।’

সে পকেট থেকে আরো একটা লম্বা লেফাফা বের করল।

‘বসে যাও অটো, চা খাও।‘ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে পড়ল সেই দুজন ডাচ পর্যটকের কথা, যারা করাচি এসে হামেদ চাচার ওখানে ঘাঁটি করে বসেছিল। তাদেরও পয়সা-কড়িও শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

‘আমি তুরস্ক এবং ইরান হয়ে এসেছি। জার্মানি থেকে এ-পর্যন্ত মোটর এবং লরিতে। লিফট পেয়েছি। এখন যাব লংকা। তারপর থাইল্যান্ড ইত্যাদি। সেখান থেকে কার্গো বোটে চড়ে জাপান, আমেরিকা। তারপর বাড়ি পৌঁছব। এখানে আমি আওরঙ্গাবাদ থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছি।’

‘তোমার এ-সফর বেশ রোমাঞ্চকর দেখছি।’

‘হ্যাঁ, ইস্তাম্বুলে তিনরাত আমি গ্যালাটার পুলের নিচে ছিলাম। আর ইরানে–’

তারপর বিভিন্ন ছোটখাট এডভেঞ্চার শুনিয়ে বলল, ‘আমি কলোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।

‘সেখানে সবাই আমার সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে খুব বেশি রকম আলোচনা করে। অথচ এখানে কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের আলোচনা খুব কম হয়। এখানকার আসল সমস্যা হল–’

বলতে গিয়ে সে ভারতের সমস্যাবলি সম্পর্কে বিরাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। তারপর একটু থেমে শুরু করল–

‘আমি ধনী পর্যটক এবং সাধারণ ইউরোপীয়দের মতো শুধু তাজমহল দেখতে আসিনি। আমি রাতভর দোকানের বারান্দায় শুয়ে থাকি। কৃষকদের ঝুপড়িতে কাটাই, মজুরদের সাথে ভাব করি–যদিও আমি তাদের ভাষা বুঝতে পারি না।

খাওয়ার পর সে বোম্বের মানচিত্র বের করে মেঝেতে রাখল।

‘বেচারি ইংরেজ বোম্বাইয়ের স্থাপত্যরীতিকে ভিকটোরিয়ান গথিক বলে ধরে নিয়েছে। এখানে কী কী দেখবার মতো আছে, বলুন দেখি।’

‘কেন, এলিফ্যান্টা–আপালু বন্দর আর…’

‘এ সব তো গাইড বুকেও আছে।’

সে অধৈর্য হয়ে আমার কথা কাটল এবং ভারতের জীবনব্যবস্থা ও রীতিনীতির ওপর বড় ভারি এবং উদাহরণ সমৃদ্ধ আলোচনা করে শোনাল।

‘অটো, তোমার বয়স কত?’–আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম। ‘একুশ। যখন জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছব তখন হবে বাইশ। তার পরের বছর আমি ডকটরেট পাব। আমি জার্মানির গীতিকাব্যের ওপর গবেষণা করছি। জার্মানিতে শুধু ডকটরেট দেয়, যেমন আপনাদের এখানে বি.এ., এম.এ।’

এরপর বহুক্ষণ সে জার্মানির গীতিকাব্য, বিশ্ব রাজনীতি মায় ভারতের শিল্পকলার আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল। সে নাকি ছবিও আঁকে। কী রকম ডাকসাইটে ছেলে–আমি মনে-মনে বললাম। জার্মানদের মতোই মার্জিত এবং স্বচ্ছ বুদ্ধিসম্পন্ন সে।

‘আমি রাত্রে শোবার আগে আপনার বইগুলো দেখতে পারি?’

‘অবশ্যই।’

রাতভর বসার ঘরে বাতি জ্বলল। সকাল তিনটায় গোসলখানায় পানি ঝরার শব্দে আমি জেগে উঠলাম। সে নেয়ে-ধুয়ে একদম সাফসাফাই, যাতে তার জন্যে বাড়ির কারো অসুবিধা না-হয়। নাস্তার সময় সে রাতভর পড়ে শেষ করা পুস্তকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সম্পর্কে নানা মতামত ব্যক্ত করল। তারপর বোম্বের মানচিত্র বের করে বেরিয়ে পড়ল ভ্রমণে।

কামরা ঠিক করার সময় হঠাৎ তার থলেতে আমি চারটি বই দেখলাম : গ্যেটের ফাউস্ট, হাইনের কাব্য, রিলকে, ব্রেশট এবং পবিত্র ইঞ্জিল।

সন্ধ্যায় সে ভারি ক্লান্ত এবং বিবর্ণ হয়ে ফিরলে আমি বললাম, ‘অটো, কাল রাতে তুমি তো খোদার বিরুদ্ধে ছিলে–অথচ ইঞ্জিল সাথে নিয়ে ঘুরছ।’

একথা শুনে অটো খোদার ধ্যানে আবেগ-অন্ধ মানবিক বাধ্যতার ওপর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ফেলল।

‘অটো, তুমি এলিফ্যান্টা গিয়েছিল? সেখানকার ত্রিমূর্তি আর দেবতা–’

‘আমি কোথাও যাইনি। সারাদিন ভিকটোরিয়া গার্ডেনে বসে ভিড়-জমা মানুষদের দেখেছি। মানুষ–মানুষই সবচে বড় দেবতা।’

‘হ্যাঁ, তা তো বটে। কিন্তু তুমি খেয়েছ কোথায়?’

‘আমি এক ডজন কলা কিনে নিয়েছিলাম।

হঠাৎই আমি খুব লজ্জিত হলাম। যাবার সময় কিছু খাবার দিতে আমার কেন মনে ছিল না ভেবে লজ্জা লাগল। আসান মামুর কথাও মনে পড়ল, সম্ভবত ওর কাছে পয়সা-কড়ি নেই।

খাবার টেবিলে সে বলল, ‘আমি অনেক দিন পর পেটপুরে খাচ্ছি।’

আমি তার সঙ্গে জার্মানির আলোচনা করতে লাগলাম। বার্লিনের প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে জানিয়ে দিল যে, সে পাক্কা এন্টি-কমুনিস্ট।

বাড়িতে আমার মা আমার জন্যে মজার-মজার খাবার তৈরি করে। আপনি মাকে দেখলে খুব খুশি হতেন। মায়ের বয়স এখন বিয়াল্লিশ। নানান বিপদ-আপদ বেচারিকে অকালে বুড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনো মা সুন্দরীদের একজন।

‘তুমি কি তার একমাত্র ছেলে?’

‘হ্যাঁ, আমার পিতা সৈন্যবিভাগের অফিসার ছিলেন। মায়ের বাড়ি প্রসা। মায়ের বয়স যখন সতেরো তখন বাবার সাথে বিয়ে হয় তার; এর কিছুদিন পরই বাবা পোল্যান্ডের যুদ্ধে নিহত হন। তার পরের মাসেই আমার জন্ম। বোমা বিস্ফোরণ থেকে বাঁচবার জন্যে মা আমাকে কাঁধে করে নানা জায়গায় ফিরতেন। আমাকে কোলে নিয়ে, মাথায় রুমালের ফলবুট পরে, সামান্য আসবাবপত্র প্রেম্বুলেটরে এঁটে গ্রামে-গ্রামে ঘুরতেন আর ক্ষেতখামারে লুকিয়ে থাকতেন। মা যখন পোল্যান্ডের এক গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন তখন সৈন্যেরা ঘরে আসে। আমার বয়স তখন বছর চারেক। আমার শৈশবের অবিস্মরণীয় স্মৃতি এই ভীষণ রাতটা। ভয়ে আমি পালঙ্কের নিচে লুকালাম। লোকেরা যখন মাকে টেনে নিয়ে গেল আমি জোরে-জোরে কাঁদতে লাগলাম। মাকে ওরা টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল। এর পর মা ভয়ে ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে বেশ ক’দিন পর ফিরলেন। এদিকে আমি খালি ঘরে একা। বাইরের গোলাগুলির আওয়াজ ঘরের ভেতর ছমছম করে বেড়াত। বাবুর্চিখানা এবং ভাঁড়ারের আলমারি খুলে আমি খাবার তালাশ করতাম। যা কিছু পেতাম তাই ক্ষুধার জ্বালায় খেয়ে ফেলতাম। আলমারিগুলোর তাক ছিল অনেক উঁচুতে। সেখানে অনেক খাবারও ছিল। কিন্তু আমি নাগাল পেতাম না।’

এতটুকু বলে সে চুপসে গেল। খেতে থাকল নীরবে।

‘চালের খাবার খুব ভালো লাগে। কয়েক মিনিট পর সে আস্তে করে বলল, এই জন্যে পারলে আমি যুদ্ধের ধ্বংসকাহিনী পড়ি না। বড়দের কাছ থেকে শোনা এমনি আরো অসংখ্য বীভৎস কাহিনী শুনেছি। আমার সেই ফরাসি মেয়েটির কথা মনে পড়ছে, যে এই অটোরই স্বজাতি জার্মানদের মৃত্যুলীলার কাহিনী শুনিয়েছে। এই পোল্যান্ডেই যেখানে অটো এবং তার মায়ের এই দুরবস্থা হয়েছিল, নাৎসিরাও রাতদিন সেখানে কাজ করছে। সেখানে রোজ হাজারো ইহুদিদেরকে নিষ্ঠুর মৃত্যুযন্ত্রে নিক্ষেপ করা হত। ব্রিটিশের গোলা-বারুদ এ-অঞ্চলকে করে দিয়েছিল একেবারে ধ্বংসস্তূপ। আমার সেই রুশ বালিকার কাহিনীও মনে পড়ল। কে যেন শুনিয়েছিল কাহিনীটি। নিজের গোটা পরিবারকে জার্মানদের নির্মম মেশিনগানের সামনে আহুতি দিতে দেখে ভয়ে-বিভীষিকায় পলকের মধ্যে তার মাথার সব চুল শাদা হয়ে গিয়েছিল।

অথচ এরা সবাই উনিশ শ পঁয়তাল্লিশোত্তর ইউরোপের নবীন বংশধর।

মানবতার সেবক যিশুর অনুসারী পশ্চিম ইউরোপ তার সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী দিয়েছে!

‘তোমার মা এখন কী করেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘তিনি এখন হাউস-কিপার। সামরিক বিধবা হিসেবে পেনশন পান। আমাদের দু কামরার ছোট ঘর। আমি সন্ধের শিফটে এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। আমার মা খুব ভালো। এসট্রলজিতে পূর্ণ বিশ্বাসী, রীতিমতো গির্জায় যান। গত বছর আমি সাইকেলে সারা জার্মানি ভ্রমণ করেছি। জার্মানি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ।

‘সব দেশই তার বাসিন্দাদের কাছে সুন্দর। কিন্তু তুমি নব্য-নাৎসি যেন না-হয়ে ওঠ।’

‘না আমি নাৎসি হব না। ইহুদিদের প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই।’

সে সহজে বলল। আমার হাসি পেল।

‘আমার মাতুলরা এখনো পূর্ব জার্মানিতে রয়েছে। যেমন আপনাদের কিছু লোক এখানে, আর কিছু পাকিস্তানে।’ সে ম্যাপ দেখিয়ে বোঝাল।

দ্বিতীয় দিন সে কথা দিয়েছিল শহরের দর্শনীয় সব কিছু দেখবে। কিন্তু সে দিনও সারাক্ষণ সে রানিবাগে বসে কাটাল।

চতুর্থ দিন ছেলেটা ওয়ার্ডেন রোডে ভুলা ভাই দেশাই ইন্সটিটিউটের বারান্দায় বসে লাওস যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রবন্ধ পড়ে দিনটা কাটিয়ে দিল।

ভেতরে মেয়েরা নাচ শিখছিল আর হলঘরে হুসেনের নতুন চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল।

বোম্বের সব দূরত্ব সে পায়ে হেঁটে পার করত। ওয়ার্ডন রোড থেকে ফ্লোরা ফাউন্টেন অবধি সে পায়ে হেঁটে গেছে। আমার মনে হত, জার্মান জাত নিঃসন্দেহে জীন বা দেও জাত-সম্ভূত।

‘আমি আট আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত রোজ খরচ করি। প্রায়ই কলা খেয়ে থাকি। সবখানেই অতিথিপরায়ণ লোক মিলে যায়। কেমন আশ্চর্য দেখুন, মানুষ এককভাবে কত সাদাসিধে এবং নিষ্পাপ, অথচ সমষ্টির আবর্তে সে পশুর মতো।’

সে মুখ উঁচু করে বসল। সেদিন সে এক ট্রাক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে এসেছে। বাঙ্গালোর অবধি সে ট্রাকে চড়ে যাবে। খুব সকালে সে তার বই-পত্র, কাপড়-চোপড়, তাঁবু আর বিছানা দিয়ে থলে দুটি ভরে কাঁধে তুলে নিল। এবং খোদা হাফেজ বলে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিস ফ্লোরা ফাউন্টেনে যাবার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দিল।

অটো চলে গেছে কয়েক মাস হল। আসান মামুর চিঠি এলে আমি তাকে অভিযোগ করে লিখলাম, অটো এখান থেকে সেই যে গেল আর একটা খবরও দিল না, সে এখন কোথায়-কোথায় ফিরছে। আসান মামুর চিঠি ডাকে দিয়ে ফিরতেই বিকেলের ডাকে অটোর চিঠি এল। খামে লাওসের রাজার ছবি। চিঠিতে লিখেছে–

‘সেই জার্মান ছেলেটি, যে আপনার বাড়িতে দিনকয় ছিল আপনাকে ভুলে যায়নি। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। (মাফ করবেন, আমি ইংরেজিতে দুর্বল) আপনি। আমাকে বড় বোনের মতো স্নেহ দিয়েছেন। আমি ভালোবাসায় আস্থাবান। এর কারণ হয়তো আমি এখনো কমবয়সী। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীতে সে-সব লোকেরাই সুখী, যারা কোনো দিকে না-দেখে, প্রশ্ন না-করে সবকিছু মেনে নেয়। আমরা যতই প্রশ্ন করছি ততই মনে হচ্ছে যে, জীবনটা নিছক অর্থহীন।

লংকায় নিউরেলিয়া থেকে কেনেডি পর্যন্ত এক টুরিস্ট বাসে গিয়েছি। বাসে এক সিংহলি ছাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে খাইয়েছে। নাম তার রাজা। সে আমার জন্যে পথ থেকে কিছু ফুলও কিনেছে। বাসে ক’টা ঢোল ছিল। রাজা সেগুলো বাজিয়ে গান গেয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছে সে গান। এক সময় রাজা আমাকে বলল, চল, স্নান করি। অথচ কয়েক মিনিট পরে সে মরে গেল। হঠাৎ পানিতে ডুবে গিয়েছিল। দু’ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর আমরা তার শব একটা বাকের নিচে পেলাম। এসব কী? আমি ভাবতে লাগলাম, এমন হল কেন? আমাদের কেউই রাজাকে বাঁচাতে পারল না। এটা কি ঘটনাচক্রে ঘটল, না এটাই তার ভাগ্য? রাজা মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তার বোন এবং ভাইও পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে মরেছে। তার বাপ অন্ধ। মা-ও বড় রুগ্ণা, রাজাই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল।

মাদ্রাজের এক যুবক কবি আমাকে জানাল, এই পৃথিবীর কারণে সে খুব দুঃখী। মাদ্রাজে আমি রেডিও ইন্টারভিউ দিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করেছিলাম। সেখান থেকে আমি এসেছি পেনাং। খুব সুন্দর দ্বীপটা। এখানে অনেক চীনা থাকে।

এক মালগাড়ির শেষ ডাব্বায় চড়ে আমি ব্যাংককে পৌঁছেছি। এখানে এক বৌদ্ধ মন্দিরে থাকি। মন্দিরের যাজকদের সঙ্গে আমি খাবার খাই। দ্বিপ্রহরের সময় সুন্দরী মেয়েরা এবং মহিলারা নানা বেশ-ভূষায় তাদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ জানবার জন্যে যাজকের কাছে আসে।

বেশিরভাগ ভিক্ষুই প্রেম-পিয়াসী। দেদার তামাক টানে। কোনো কাজ করে না। ধর্মভীরু বৃদ্ধরা তাদের খাবার এবং পয়সা জোগায়। অনেক ভিক্ষুই মন্দিরে এসেছে পরিশ্রম ভালো লাগে না বলে। লোকগুলো ভারি দুর্বল। তাদের ধর্মে এই হীনতার এক সুস্পষ্ট বৈধতাও বিদ্যমান। এদের অনেকে যথানিয়মে শুচি হয়ে যোগসাধনায়ও বসে। বেশিরভাগ ভিক্ষুই খাওয়া এবং মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বাকি সময় শুয়ে-শুয়ে কাটায়।

নাংকাইতে আমি মেকং নদীতে স্নান করেছি। তারপর চলে এসেছি লাওসে।

দিয়েন ভিয়েন একটা বড় গ্রামের মতো। রৌদ্র বড় কড়া। সড়কগুলো ধুলোয় ধূসর। শুধু রাতগুলো বড় সুন্দর। অন্ধকার সব কদাচার, অত্যাচার, হানাহানি এবং রক্তপাত বুকে লুকিয়ে নেয়। এখানে মশা খুব বেশি।

সুফানা অবধি এক প্লেনে ফ্রি লিফট পেলাম। এখন আমি পাকশাতে আছি। তারপর যাব কম্বোডিয়া। আঙ্কল আহমদের ওখানে মানে চিটাগাংয়ে যেতে পারিনি। বর্মায় প্রবেশ করতে হিমশিম খেয়ে গেছি। আমি লালচীন এবং ভিয়েতনামের ভিসার জন্যে দরখাস্ত করেছি। পিকিং বা হ্যাঁনয়ে গিয়ে জবাব পেয়ে যাব। কাল আমি এখান থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছি।

আপনার চিরকৃতজ্ঞ
‘অটো’

.

উনিশ শ তেষট্টির এক বিদেশি পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ভিয়েতনামের অরণ্যপুরী’ শীর্ষক রঙিন সচিত্র প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাতে রয়েছে গেরিলা সৈন্যদেরকে গুলি করে মারার দৃশ্য। নৌকায় করে গেরিলা কয়েদিদেরকে মেকং নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কৃষাণ মেয়েরা তীরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওপারে পৌঁছলে তাদেরকে গুলি করে মারা হবে। প্রবন্ধের শেষ দিকে দু পৃষ্ঠাব্যাপী রঙিন ছবি। তাতে সজীব ধানক্ষেতের দৃশ্য। ধানের শীষ হাওয়ায় দুলছে। প্রান্তসীমায় গাছের লম্বা পাতা দুলছে। সবুজ সতেজ বনানী আর তার পাশে ছলছল করা নদী। বড় মনোরম দৃশ্য। শিল্পী যা দেখে ছবি আঁকে, কবি কবিতা লেখে, আর গাল্পিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিকায় গল্প লেখে ঠিক তাই। কিন্তু এ-ছবির শেষদিকে বিস্রস্ত বিবর্ণ অর্ধনগ্ন রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে। কিছু দূরে কালো রঙের যুদ্ধবিমান দাঁড়িয়ে আছে ভয়াল দানবের মতো। ছবির নিচে লেখা রয়েছে,

‘মৃত্যুর খামার’

 একজন ভিয়েতকং গেরিলা, যাকে মেকং নদীর ধানক্ষেতে মারা হয়েছে, তার সঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক কোণে। এই রক্তাক্ত খণ্ড-যুদ্ধের সময় এক পর্যটক যুবক মেকং নদী পার হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছিল। হঠাৎ ফসকে যাওয়া এক গুলি তাকে ভেদ করে যায়। এই সুন্দর দেশে ১৯৪৪ সাল থেকে যুদ্ধ চলে আসছে, এবং…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *