প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

১.৮ চড়ুইপাখি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / জাফর আলম

চড়ুইপাখি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / জাফর আলম

চড়ুইপাখি – খাজা আহমদ আব্বাস

লোকটির নাম রহিম। রহিম খান। নামের বিপরীত তার কাজ। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি নেই : এ অঞ্চলে। তার ভয়ে গ্রামটাও যেন কাপে। মানুষ বা পশু-কারো প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ নেই তার। একদিন কর্মকারের ছেলেটা রহিম খানের বলদের লেজে কয়েকটা কাঁটাগাছ বেঁধে দিয়েছিল। ছেলেটাকে কী মার! মারের চোটে যখন রক্তারক্তি অবস্থা, রহিম তখন ছেড়ে দিয়েছিল ছোঁড়াটাকে। গাঁসুদ্ধ বলাবলি করে, ‘খোদার একটু ভয়ডর নেই দজ্জালটার। কচি বাচ্চাদের মারে যে, মূক পশুগুলোকে যে পিটুনি দেয়, এমন পাতকের কপালে নির্ঘাত দোজখ-বাস আছে।’

যত বলাবলি সবকিছু রহিম খানের পেছনে–অগোচরে। তারা সামনে কেউ খুলুক তো মুখ! বেচারা বুলু একদিন শুধু বলেছিল, ‘আহা, বাচ্চাদের এমন করে মারতে নেই আব্বা। আর যাবে কোথায়! রহিম ঝাঁপিয়ে পড়ে বুন্দুর ওপর। এমন মার খেল বুন্দু যে, পাড়ার প্রতিটি লোকে চমকে উঠল। পাছে রহিম বিরক্ত হয় তাই বুন্দুর কাছে কেউ সান্ত্বনা দিতেও ঘেষল না। গাঁ-সুদ্ধ সবাই বলাবলি করল ‘ও বেটার মাথা খারাপ হয়েছে; ওকে পাগলা গারদে পাঠাও।’ কিন্তু এ-সব কথাবার্তাও রহিম খানের পেছনে, নিভৃতেসামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

গ্রামের কেউ রহিম খানের সঙ্গে কথা বলে না। না-বলুক, রহিমের তাতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না। কাঁধের উপর লাঙল নিয়ে সকালে সে মাঠে যায়। পথে কারো দেখা পেলে রহিম না-দেয় সালাম, না-করে কুশল জিজ্ঞাসা। দুটো বলদ তার। রহিম ওদের নাথু আর ছিদু বলে ডাকে। মাঠে পৌঁছে সে বলদদুটোর সঙ্গে কথা শুরু করে হাল দিতে-দিতে। হয়তো এক সময় চিৎকার করে ওঠে–

‘এই শালা নাথু, সোজা লাইন ধর, ধর বলছি। তোর বাপ এসে চাষ দিয়ে যাবে রে হারামজাদা? এই ছিদু। তোর আবার কী হল রে হারামি?’

হাতের পাঁচনটা দিয়ে তারপর রহিম দমাদম ছিদু-নাথুকে পেটাতে থাকে। প্রহারে-প্রহারে বলদদুটোর সারা পিঠে শুধু ক্ষতের চিহ্ন।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বউ আর ছেলেদুটোকে নিয়ে রহিম খিস্তি শুরু করে। শাক-সবজি বা ভাজাভুজিতে বউ লবণ দিতে ভুলে গেছে তো আর রক্ষা নেই। কোনো ছেলে কোনো অপকর্ম করল তো রহিম তাকে পা উপরে বেঁধে গরুপেটা লাঠিটা দিয়ে পেটাতে থাকবে। বেহুশ না-হওয়া পর্যন্ত ছেলের নিস্তার নেই। প্রতিদিন এমনি একটা-না-একটা কিছু ঘটবেই ওই বাড়িতে। প্রায় প্রতি রাত্রে বউ-বাচ্চাদের ওপর গাল-খিস্তি মার-ধোর, …যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করতে থাকে। পাড়া-পড়শিরা দেখে-শুনেও কেউ আসে না। এগিয়ে এসে যে রহিমকে থামাবে, সে সাহস হয়ে ওঠে না কারো।

দিন-রাত মার খেয়ে বেচারি বউটা আধমরা হয়ে গেছে। বয়স ওর চল্লিশের কাছাকাছি হলেও বেচারিকে ষাট বছরের বুড়ির মতো লাগে। বাচ্চারা যতদিন ছোট ছিল, আচ্ছা মার খেয়েছে বাপের হাতে। বড় ছেলেটা যখন বাপের কোঠায়, একদিন কী কারণে বাপের হাতে একচোট বিষম মার খেল। মার খেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে পালাল সেদিন, আর ফেরেনি।

কিছু দূরের এক গ্রামে ছেলেটার এক মামা থাকত। মামাই আশ্রয় দিল তাকে। বউ একদিন অনেক সাহস করে রহিমকে বলছিল, ‘হিলামপুর যদি কখনো যাও, পায়ে পড়ি, নুরুকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’ যেই-না বলা, শয়তান যেন তড়াক করে রহিমের ওপর ভর করল, কী বললি, হারামজাদাকে আমি ফিরিয়ে আনতে যাব।’ রাগে কাঁপতে থাকে রহিম খান–’শুনে রাখ, ও ব্যাটা কখনও ফিরে এলে আর আস্ত রাখব না।’

সে যাই হোক, এমন মৃত্যুর খামারে নুরু আর কখনো ফিরে আসেনি; আসার দরকারও বোধ করেনি। দু’বছর পর ছোট ছেলেটাও পালাল। ভাইয়ের কাছে গেল পালিয়ে। রহিমের প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা সহ্য করতে এখন থাকল শুধু বউ। কিন্তু সে-ও একদিন এমন মার খেল যে, বাড়ি ছাড়া ভিন্ন আর কোনো গত্যন্তর রইল না। কতদিনের সংসারের মায়া–সে মায়াও ছিন্ন করতে বেচারি বাধ্য হল। রহিম মাঠে চাষ করতে গেছে, এই সুযোগে ভাইকে গোপনে ডাকিয়ে এনে তার সঙ্গে মা’র কাছে চলে গেল বউ।

সন্ধ্যায় রহিম ঘরে ফিরে এল। পাশের বাড়ির বউ অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে এগিয়ে এসে রহিম খানকে বউয়ের চলে যাবার খবর জানাল। কেন জানি, আজ রহিম ক্ষেপল না। চুপচাপ শুধু শুনে গেল। তারপর বলদদুটোকে রাত্রির জন্য বাঁধতে গেল ঘেরা-উঠানে। সে নিশ্চিত জানে বউ আর কখনো তার কাছে ফিরে আসবে না।

উঠোন থেকে রহিম ঘরে ফিরে এল। নির্জন, নিস্তব্ধ। না, একেবারে শব্দহীন নয়, একটা বিড়াল ম্যাও-মাও করে চলেছে। লেজ ধরে বিড়ালটাকে ছুঁড়ে মারল রহিম। তারপর চুলোর কাছে গেল। ঠাণ্ডা চুলো। রাজ্যের আলসেমি বোধ করতে লাগল সে। চুলো ধরিয়ে নিজ হাতে রান্না করা তার হল না। পেটে কিছু না-দিয়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রহিম। কিছুক্ষণ পর ঘুমে তলিয়ে গেল।

সূর্য ওঠার অল্প পরেই তার ঘুম ভাঙল। আজ কাজে যাওয়ার তাড়াহুড়া নেই। ছাগলগুলোর দুধ দুইয়ে তাই খেল সে। হুঁকোটা সাজিয়ে নিয়ে বসল বিছানায়। সূর্যের আলোয় ততক্ষণ ঘর ভরে গেছে। ঘরের কোণায় রহিম খান কতগুলো মাকড়সার জাল দেখতে পেল। ওগুলো সরানো দরকার। বাঁশের লাঠির আগায় কিছুটা ন্যাকড়া বেঁধে সে জাল ভাঙতে গেল। সিলিং-এ এক চড়ইয়ের বাসা হঠাৎ তার নজরে পড়ল। দুটো চড়ই উড়ে একবার করে বাসায় ঢুকছে আর বেরুচ্ছে।

এ বাসা ভাঙতে হবে প্রথম-প্রথম এমনি চিন্তায় রহিম থেমে গেল। একটা টুল নিয়ে এসে সে চড়ইয়ের বাসায় উঁকি মারল। হৃষ্টপুষ্ট দুটো বাচ্চা ভিতরে কিচিরমিচির করছে আর তাদের বাপ-মা মাথার উপর উড়ে-উড়ে তাদেরকে সম্ভাব্য আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করছে। বাসার দিকে হাত বাড়াতেই মাদি চড়ই তার মাথায় ঝাঁপটা মারল সঙ্গে-সঙ্গে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে রহিম হেসে উঠল, নচ্ছার। আমার চোখদুটো উপড়ে নিতে চাস?’ টুল থেকে নেমে পড়ল রহিম। বাসা ভাঙা হল না আর।

পরের দিন থেকে রহিম আবার মাঠের কাজে মন দিল। গ্রামের কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। সারাটা দিন সে মাঠে হাল দেয়া, পানি সেচ দেয়া বা ফসল কাটায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু সূর্য ডোবার আগেই সে এখন ঘরে ফিরে যায়। হুঁকা ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চড়ইগুলোর লাফ-ঝাঁপ দেখতে থাকে নিবিষ্ট মনে। বাচ্চাদুটো এখন উড়তে শিখেছে। ছেলেদের নামে একটা বাচ্চাকে সে নুরু, আরেকটাকে বুন্দু বলে ডাকে। পৃথিবীতে এখন রহিমের বন্ধু বলতে চারটি চড়ই। গ্রামের সবাই তাকে এড়িয়ে চলে সত্যি, কিন্তু হঠাৎ সবার খেয়ালে আসে, আজকাল রহিম তার বলদদুটোকে মারধর করে না। নাথু আর ছিদুও এখন ছাড়া পেয়ে খুব খুশি। ওদের পিঠের উপরের ক্ষতগুলো প্রায় সেরে গেছে। একদিন সকালেই রহিম খান মাঠ থেকে ফিরছিল। রাস্তায় কতকগুলো ছেলে খেলায় মত্ত। রহিমকে দেখেই ওরা জুতা-টুতা ফেলে ভোঁ-দৌড়। রহিম পেছনে-পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে শোন, শোন। পালাস নে। মারব না তোদের, শোন। কে শোনে জালিমের কথা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। শিগগিরই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাড়ির দিকে রহিম জোরে পা চালাল। বলদদুটোকে উঠোনে বেঁধেছে মাত্র, অমনি শোঁ-শোঁ ঝড় উঠল।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রহিম খান। বাতিটি জ্বালাল প্রতিদিনের মতো। আজো সে কয়েক টুকরো রুটি চড়ইগুলোর কাছাকাছি একটি কুলুঙ্গিতে রেখে ডাকতে লাগল, ‘কই রে নুরু, কই রে বুন্দু।’ আজ নুরু-বুদু বাইরে এল না। ব্যাপার দেখতে রহিম চড়ইয়ের বাসায় উঁকি দিল। দেখল চারটা চড়ুই-ই ডানায় মাথা গুঁজে জড়াজড়ি করে বসে আছে। সিলিং-এর এক ছিদ্র দিয়ে আসা ফোঁটা-ফোঁটা পানি বাসাটা ভিজিয়ে ফেলেছে।

এমনভাবে পানির ফোঁটা পড়তে থাকলে বাসাটা পয়মাল হয়ে যাবে। বেচারাদের তখন মাথা গুঁজবার ঠাই থাকবে না।’ বৃষ্টি-মাথায় রহিম দেয়ালে মই লাগিয়ে চালে উঠল। চালের বৃষ্টি-চোয়ানো ছিদ্রটা বন্ধ করতে বেশ সময় নিল। আর ততক্ষণে সে নিজে ভিজে একাকার। ঠকঠক করে কাঁপছে ঠাণ্ডায়। ঘরে এসে বিছানায় বসতে-না-বসতেই হঠাৎ হাঁচির তোড় শুরু হল। রহিম খান ঘোড়াই তোয়াক্কা করে এই হাঁচির। পরদিন সকালে কিন্তু ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারল না সে। জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তার ওষুধ এনে দেবে।

এমনিভাবে দুদিন কেটে গেল।

দুদিন রহিম খানকে মাঠে যেতে না-দেখে গ্রামবাসীরা কৌতূহল বোধ করল। চৌকিদার কয়েকজন চাষিকে সঙ্গে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকল। বিছানায় শুয়ে রহিম আপন মনে বিড়বিড় করছে, ‘ওরে বুন্দু-নুরু, কোথায় গেলি তোরা? কে তোদের আজ খাবার দেবে? কেউ নাই রে!’ চারটা চড়ই তখন সিলিং-এর কাছে উড়ে ঘুরঘুর করছে।

কালু অর্থপূর্ণ মাথা নেড়ে বলল, ‘লোকটা পাগলই হয়ে গেল শেষে। সাত সকালেই কাল হাসপাতালে খবর পাঠাতে হবে। ওরা এসে মনে হলে না-হয় পাগলাগারদেই নিয়ে যাবে।

পরদিন গায়ের লোক হাসপাতালের এক কর্মচারীকে নিয়ে যখন রহিমের ঘরে ঢুকল, রহিম তখন বেঁচে নেই। ঘরের ভিতর চঞ্চল চারটা চড়ই শুধু ঘুরঘুর করে উড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *